তং য়জ্ঞমিত্যস্য নারায়ণ ঋষিঃ । পুরুষো দেবতা । নিচৃদনুষ্টুপ্ ছন্দঃ । গান্ধারঃ স্বরঃ ॥
তং য়॒জ্ঞং ব॒র্হিষি॒ প্রৌক্ষ॒ন্ পুরুষং জা॒তম॑গ্র॒তঃ ।
তেন॑ দে॒বাऽঅ॑য়জন্ত সা॒ধ্যাऽঋষ॑য়শ্চ॒ য়ে ॥ ঌ ॥১. (তম্) = সেই (যজ্ঞম্) = উপাসনীয় [পূজ্য], সংগতিকরণযোগ্য অথবা সমর্পণীয় [দানীয়] প্রভুকে (বর্হিষি) = সেই হৃদয়ে, যেখান থেকে বাসনারূপ ঘাস-ফুস সম্পূর্ণরূপে উৎখাত করা হয়েছে, (প্রৌক্ষন্) = সিঞ্চিত করেন। হৃদয় যেন এক ক্ষেত্র, আর সেই ক্ষেত্রকে এঁরা প্রভুচিন্তনরূপ জল দিয়ে সেচন করেন। এই ক্ষেত্র থেকে তাঁরা বাসনাগুলিকে উপড়ে ফেলেন এবং এই বাসনাগুলির উৎখাতের ফলেই এই ক্ষেত্রের নাম এখানে ‘বর্হিঃ’ বলা হয়েছে। তাঁরা প্রভুকেই যজ্ঞরূপে মানেন। সেই প্রভু পূজনীয়, সংগমনীয়। আমাদের উচিত নিজেদের সেই প্রভুর প্রতি সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করে দেওয়া। এই ‘দিয়ে দেওয়াই’ হল সমর্পণ।
২. কোন প্রভুর সেচন করা হয়? (পুরুষঃ) = সেই প্রভুর, যিনি শরীররূপ পুরীতে বাস করেন [পুরি বসতি, পুরি শেতে বা]। সেই প্রভু, যিনি (অগ্রতঃ) = পূর্ব থেকেই (জাতম্) = বিদ্যমান। প্রভু আমাদের হৃদয়ে আগে থেকেই বিরাজমান। আমাদের কেবল হৃদয়ের শোধন করে, তাকে বর্হিরূপে রূপান্তরিত করে, সেই প্রভুর জ্যোতিকে দর্শন করার চেষ্টা করতে হবে।
৩. (তেন) = সেই প্রভুর দ্বারা (অযজন্ত) = মিলিত হন [সংগতিকরণ করেন]। কারা?
[ক] (দেবাঃ) = যাঁরা নিজেদের হৃদয় থেকে আসুরিক প্রবৃত্তির উৎখাত করে সেই হৃদয়কে দৈবী প্রবৃত্তিতে পূর্ণ করেন। দৈবী প্রবৃত্তি গ্রহণ করেই এঁরা সেই মহাদেবের সঙ্গে মিলনের যোগ্য হন।
[খ] (সাধ্যাঃ) = [সাধ্নুবন্তি পরকার্যাণি] যাঁরা সর্বদা পরার্থের কার্য সিদ্ধ করতে নিয়োজিত থাকেন, যাঁদের হস্ত সর্বদা যজ্ঞকার্যে ব্যাপৃত থাকে। ‘দেব’ শব্দ উপাসনাকাণ্ডের নির্দেশক, আর ‘সাধ্য’ শব্দ কর্মকাণ্ডের নির্দেশ করে।
[গ] (য়ে চ ঋষয়ঃ) = এবং যাঁরা তত্ত্বদর্শী জ্ঞানী। ‘ঋষি’ শব্দ জ্ঞানকাণ্ডের প্রতীক। প্রভুর সঙ্গে মিলন তাঁদেরই হয়, যাঁরা নিজেদের জীবনে উপাসনা, কর্ম ও জ্ঞান—এই তিনটির সুন্দর সমন্বয় সাধন করেন।
টীকাঃ (ব্রহ্মমুনি পরিব্রাজক)
“অন্নং হি পৃথদাজ্যম্” (শত० ৬।৮।৪।৮)
“রস আজ্যম্” (শত० ৩।৭।১।১৩)
“যদিদং কিংচর্বো যজূঁষি সামানি চ্ছন্দাংসি” (বৃহ० ১।২।৫)
বিশেষ
(ঋগ্বেদ মং ১০ সূক্ত ৬০) ঋষি:– নারায়ণঃ ১–১৬ । উত্তরনারায়ণঃ ১৭–২২ (নারাঃ—আপঃ জল হ্যায়, আপঃ নর যস্য সূনুঃ—সন্তান হ্যায়, ঐসে ভে মানব উৎপত্তি কে হেতুভূত, অয়ন—জ্ঞান কা আশ্রয় হ্যায় যস্য বহ, ঐসা জীবজন্মবিদ্যা কা জ্ঞাতা তথা জনকরূপ পরমাত্মা কো মাননে ওয়ালা আস্তিক মহাবিদ্বান্) দেবতা—পুরুষঃ ১, ৩, ৪, ৬, ৮–১৬। ঈশানঃ ২। স্রষ্টা ৫। স্রষ্টেশ্বরঃ ৭। আদিত্যঃ ১৭–১৯, ২২। সূর্য ২০।বিশ্বে দেবাঃ ২১। (পুরুষ—সমষ্টি মে পূর্ণ পরমাত্মা)
সতু সমন্বযাৎ অর্থাৎ ‘সত্যের একত্ব দ্বারা সমন্বয়’। এই ব্রহ্মসূত্র লিখে বাদারায়ণ সমন্বয়-প্রক্রিয়ার শাস্ত্রীয় উপায় নির্ধারণ করেছিলেন। শ্রীশঙ্করাচার্য-এর শারীরিক ভাষ্য-চতুষ্টায়ী-র মধ্যে এটিই চতুর্থ, ফলশ্রুতি সূত্র হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু শঙ্করাচার্যের আগে সমন্বয়-প্রক্রিয়ার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে যাজ্ঞবল্ক্যের নাম গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রমাণের ভেদ, অংশের ভেদ স্বীকার করেও, ভিন্নতায় থাকা একত্ব প্রকাশ করাই সমন্বয়-প্রক্রিয়ার লক্ষণ। বৃহদারণ্যক (অধ্যায় ৪)-এ যে ছয় আধ্যাত্মিক উপ-পদ্ধতি জনক নির্দেশ করেছিলেন, সেটি যাজ্ঞবল্ক্য সমন্বয় সিদ্ধ করেছেন। এর মাধ্যমে তাদের অদ্বিতীয় সমন্বয়ক প্রতিভার ধারণা পাওয়া যায়।
প্রশ্নোপনিষদেও পিপ্পলাদ মহর্ষি ছয় মানসিক দৃষ্টিকোণের সমন্বয় প্রদর্শন করেছেন। পিপ্পলাদ ছিলেন যাজ্ঞবল্ক্যের ভগ্নী, পুত্র এবং প্রিয় শিষ্য। যাজ্ঞবল্ক্য প্রতিষ্ঠিত এই সমন্বয়-প্রক্রিয়াটি পরে আদ্য শ্রী শঙ্করাচার্য অত্যন্ত সফলভাবে এবং জ্যোতির্ময়ভাবে প্রয়োগ করেছেন। প্রিয়ত্ব-প্রাপ্ত এবং জ্যোতির্ময় আত্মতত্ত্বের আদ্য দর্শক হিসেবে শ্রী যাজ্ঞবল্ক্য বিশ্ব তত্ত্ববিদ্যার ইতিহাসে অমর। সমন্বয়-প্রক্রিয়ার প্রতিষ্ঠা তাদের মহৎ কর্ম, যা দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে অত্যন্ত সহায়ক হয়েছে, তার সাক্ষ্য শ্রীশঙ্করাচার্যের শারীরিক ভাষ্যেই পাওয়া যায়। অতএব, এই উদ্বোধক গ্রন্থ লিখে শ্রী কোলাঙ্গড়ে উচ্চ সাহিত্যিক মানে মৌলিক সংযোজন করেছেন, এজন্য আমরা তাদের আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।
যোগীশ্বর যাজ্ঞবল্ক্য
সেই দিনটি ফাল্গুন মাসের শুক্ল পঞ্চমী। সেই দিনে ব্রহ্ম-রাতার বাড়ি আনন্দ আর উৎসবের ফুলে ভরে উঠেছিল। সেখানে এক দিব্য তারা সদ্য জ্বলতে শুরু করেছিল। কত আনন্দ আর কত ভাগ্যবান দিন—it was a moment of immense joy। পুত্র দর্শন ভেদে, বৈদিক আর্যদের জন্য এটি একটি মহা আনন্দের যোগ। ব্রহ্মরাতা আনন্দে ভাসছিলেন এবং মহর্ষির পুত্র দর্শন হলো, আর বৈদিক ভাস্করের জন্মদাত্রী মাতৃ-মাউলী সতী সুনন্দা দেবী ধন্য হলেন। सनাতन ধর্মের শ্রেষ্ঠ বক্তা জন্মগ্রহণ করলেন এবং বৈদিক ধর্মের দিব্য দীপ চিরন্তন হল। এই অনমোল দিব্য রত্ন—অর্থাৎ বর্তমান গ্রন্থের চরিত্র নায়ক—যাজ্ঞবল্ক্য।
ব্রহ্মরাতার কিছু পূর্ব ইতিহাস বলা প্রয়োজন।
ব্রহ্মরাতার পরিবার পরিচিত, বিশুদ্ধ, সমৃদ্ধ এবং অত্যন্ত বিদ্যাসম্পন্ন ছিল। নিজেই ব্রহ্মরাতা ছিলেন মহান তপস্বী এবং বৈদিক বিদ্যায় অত্যন্ত পরিচিত। তাদের দেবরাতও বলা হতো। বিশিষ্ট বৈশম্পায়ণ তাঁদের শ্বশুর এবং রাজা তাঁদের প্রতি উদার আশ্রয় প্রদান করতেন। আচরণে তাঁরা অত্যন্ত বিশুদ্ধ এবং সরল, মননে পাপভীত এবং উদার। খাদ্যদান করতে সদা অগ্রণী হওয়ায় তাঁরা “বাজসনি”—অর্থাৎ অন্নদাতা—উপনামও পেয়েছিলেন।
পরমেশ্বরের লীলা এতই গভীর এবং অদ্ভুত যে, রাজা হোক বা দরিদ্র, প্রত্যেকের কাছে কিছু না কিছু অভাব বা অল্প সমস্যা রেখে দেন। প্রপঞ্চে এমন কোনো মানুষ নেই যিনি সব দিক থেকে সম্পূর্ণ এবং সর্বত্র সুখী। “জগতে সর্বসুখী কে?”—এই উক্তি সত্যি।
ব্রহ্মরাতার বিষয়টি দেখলে, তাঁদের গৃহস্থ জীবন সব দিক থেকে সমৃদ্ধ ছিল। সবকিছু অনুকূল ছিল এবং যোগক্ষেম সুন্দরভাবে চলছিল। তবু সেই সোনার মতো সুন্দর সংসারে এক জিনিসের—একমাত্র জিনিসের—মহান অভাব ছিল। বাড়িতে কোনো কুলদীপক, অর্থাৎ পুত্ররত্নের সম্পূর্ণ অভাব ছিল। তাই ব্রহ্মরাতা কিছুটা দুঃখিত ছিলেন।
“পুত্র না হওয়ায় কি হয়েছে? এতটা দুঃখিত হওয়ার কি কারণ আছে?”—এমন প্রশ্ন আধুনিক পাঠক করতে পারেন। কিন্তু এর যথাযথ উত্তর পেতে হলে প্রাচীন বৈদিক আর্যদের মনোভাব একটু বোঝা প্রয়োজন। পাঠকের জন্য তা বোঝা অপরিহার্য। তা ছাড়া পাঠকের সেই বাস্তব ধারণা আসবে না।
প্রথমে বলতে হবে, যে ব্যক্তি বৈদিক ধর্মে জন্মায়, তার জন্মগতভাবে তিনটি ঋণ থাকে—একটি দেবঋণ, দ্বিতীয় ঋষিঋণ, এবং তৃতীয় পিতৃঋণ। এর মধ্যে পিতৃঋণ থেকে মুক্তির পথ হলো শাস্ত্রানুযায়ী বিবাহ করে স্ত্রীর কাছে পুত্রসন্তান উৎপন্ন করা। এটি না করলে বলা যায় যে মানুষ পিতৃঋণ থেকে মুক্ত হয়নি। এবং এই তিনটি ঋণ থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তার মানবজন্ম সম্পূর্ণ হয়েছে বলে ধরা যায় না। অর্থাৎ, যে ব্যক্তি দেব-ঋষি-পিতৃঋণ থেকে মুক্ত নয়, তার সদগতি নেই—অর্থাৎ স্বর্গলাভ নেই, এমনই বৈদিক ধর্মের সংক্ষিপ্ত বিবেচনা।
এতটুকুই নয়, নিপুাত্রিকার (পুত্রহীন নারীর) বাড়ির খাদ্যও অভিজাত আর্যদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। এজন্য বৈদিক আর্যরা অগ্নিকে প্রার্থনা করতেন ‘মা শূনে অগ্নে নিষদাম নৃণাম্’ অর্থাৎ অগ্নে, নিপুাত্রিকার বাড়িতে থাকার প্রয়োজন আমাদের জন্য যেন না আসে। (ঋ. ৭-১-১১)। আবার এক জায়গায় তাঁরা প্রার্থনা করেছেন ‘মা অ্ভীরতায় রীরিধঃ’ অর্থাৎ অগ্নিদেব, আমাদের নিপুাত্রিকার কাছে অধিকারী করে দেবো না। (ঋ. ৩-১৬-৫)।
এ থেকে বোঝা যায়, নিপুাত্রিকা হওয়া বৈদিক আর্যদের কাছে বড় লজ্জাজনক, মানসিকভাবে অস্বস্তিকর এবং কলঙ্কজনক ছিল। অতিরিক্ত ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
সারাংশ, অর্থাৎ বলতে গেলে, পুত্রসন্তান না থাকায় ব্রহ্মরাতা, এবং তাঁর স্ত্রী সুনন্দা দুজনেই মন থেকে খুবই অশান্ত ছিলেন।
দ্বিতীয় বিষয়টি যা অত্যাবশ্যক তা হলো—বৈদিক আর্যরা স্বভাবগতভাবে আক্রমণাত্মক ছিলেন এবং সেই সঙ্গে…তাঁরা বিস্তারশীল স্বভাবের ছিলেন। তাই তাঁদের কাছে বংশবৃদ্ধি এবং বংশ-বিস্তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে হতো। এটি স্বাভাবিকই ছিল। এছাড়া সমাজের বিস্তারশীল হওয়া সাধারণত সম্ভব নয়।
এটি তাঁরা সম্পূর্ণরূপে বুঝেছিলেন—ঋগ্বেদকালেই। তাই তারা আমাদের জন্য বীরপুত্র প্রদানের জন্য প্রার্থনা করেছেন, যা পদে পদে ঋগ্বেদে প্রতিফলিত হয়েছে। প্রতিটি পরিবারে অন্তত দশটি সন্তান হওয়া উচিত—এমন শক্তিশালী অনুমান পাওয়া যায় ‘দশাস্যां पुत्रমাধেহি’ এই বিবাহের সময় উচ্চারিত মন্ত্র থেকে। অথবা অন্তত আটটি সন্তান হওয়া উচিত—এমন অনুমান পাওয়া যায় ‘অষ্টপুত্রা সৌভাগ্যবতী ভব’ এই মন্ত্র থেকে, যা শুভবাসিনীকে পিতৃপরিবারের দ্বারা দেওয়া আশীর্বাদে বলা হয়।
তাদের বংশপ্রেম কতটা দৃঢ় ছিল, তা পরবর্তী যজুর্বেদের মন্ত্র থেকে সহজেই বোঝা যায়। সেই মন্ত্র হলো—
‘কাণ্ডাত্কাণ্ডাৎ প্ররোহন্তি পারুষঃ পারুষস্পরিঃ। এভানো দুর্বে প্রতনু সহস্রণ শতেন চ।।’ (শুক্ল য. ১৩-২০)
যেমন দুর্বা ঘাস প্রতিটি কাণ্ড ও বীজ থেকে অঙ্কুরিত হয়ে বিস্তার পায়, তেমনি আমাদের বংশও হাজার গুণ বৃদ্ধি হোক। প্রায় একই অর্থের ভাবনা ঋগ্বেদেও দেখা যায় ‘প্রজাবানঃ পশুমান আস্তু যাতুঃ’—হে দেব! আমাদের বাড়ি শিশু এবং গরু-ঘোড়ায় পূর্ণ হোক।
এ থেকে স্পষ্ট হয় যে, বৈদিক আর্য কতটা বংশ-বিস্তারপ্রেমী ছিলেন।
এখানে সব এটি বলার উদ্দেশ্য এতটুকুই যে, পুত্রহীন হওয়া ধর্মদৃষ্টিকোণ থেকে বা সমাজদৃষ্টিকোণ থেকে এক বড় পারিবারিক সমস্যা হিসেবে ধরা হতো। সমাজে এমন ব্যক্তিকে…
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ