বেদ হল সংসারের সবথেকে প্রাচীন গ্রন্থ, এটা তো সর্ববিদিত, কিন্তু বেদের পরিচয় কেবল এটুকুই নয়। যে গ্রন্থ সবথেকে পুরোনো হবে, সেটাই যে সবথেকে প্রামাণিক হবে, এটাও অনিবার্য নয়। বেদের বিষয়ে সংসারের মধ্যে ভিন্ন-ভিন্ন মত প্রচলিত আছে। কিছু মহানুভাব বেদকে কেবল হিন্দুদের গ্রন্থ মনে করে। একইসাথে তারা এই গ্রন্থকে হিন্দুদের পূর্বজ ঋষিদের দ্বারা ভিন্ন-ভিন্ন কালে লেখা মানে। এই গ্রন্থের মধ্যে তারা অথর্ববেদকে সবথেকে নবীন বেদ মানে। এই সব মহানুভাব এমনও মানে যে বেদের মধ্যে ইন্দ্র, বরুণ আর অগ্নি আদি কল্পিত দেবতাদের স্তুতির বাহুল্য আছে। বেদের মধ্যে কিছু রাজা, ঋষি-মহর্ষির ইতিহাস আছে আর অথর্ববেদের মধ্যে যাদু-টোনা, ভূত-প্রেত, শকুন-অপশকুনের বর্ণনা আছে। বেদের মধ্যেও ভিন্ন-ভিন্ন দেশ, নদী আর পর্বতের বর্ণনা আছে আর এইসব নদী, পর্বত বা ব্যক্তি প্রাচীন ভারতের সঙ্গে সম্বন্ধিত। এইভাবে তাদের দৃষ্টিতে বেদ হল একটা অতি সাধারণ গ্রন্থ, যেটা হল ভারতীয়, বিশেষ করে হিন্দুদের জন্য।
.
অন্যদিকে হিন্দু সমাজ বেদকে ঈশ্বরীয় গ্রন্থ মানে, কিন্তু অনেকত্র কিছু বিদ্বান একে বিভিন্ন ঋষিদের দ্বারা লেখা গ্রন্থ মানে। এদের দৃষ্টিতে বেদের মধ্যে নানা প্রকারের স্তুতি আছে আর এগুলোর ব্যবহার নানা প্রকারের কর্মকাণ্ডের জন্য করা হয়, এইজন্য এই বিদ্বানদের বেদমন্ত্রে নানা প্রকারের কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ করতে দেখা যায় আর সেই কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে স্বর্গ প্রাপ্তির অভিলাষা রাখে। কিছু ব্যক্তি এই কর্মকাণ্ডের মধ্যে পশুবলি, এমনকি নরবলি এবং মাংস-মদের সেবন করাকেও বেদোক্ত মানে। এই ধরণের মান্যতাই সংসারের মধ্যে বামমার্গকে উৎপন্ন করে, যেখানে পঞ্চ মকারকেই (মাংস, মদ, মৈথুন, মুদ্রা, মৎস) পূজা মানা হতো।
.
যখন কিছু বিজ্ঞ জন বেদের এমন বীভৎস রূপ দেখে আর এমন বেদকে অপৌরুষেয় মানতে দেখে, তখন তারা বলে যে বেদ হল ভাণ্ড, ধূর্ত ও নিশাচরদের লেখা। এই কারণে তারা না কেবল বৈদিক কর্মকাণ্ডের আলোচনা করে, বরং ঈশ্বর, আত্মা, জন্ম আর কর্মফল আদি মান্যতাকেও পুরোপুরি অস্বীকার করে দেয় আর বলে -
য়াবজ্জীবেত্ সুখম্ জীবেত্ ঋণম্ কৃত্বা ঘৃতম্ পিবেত্।
ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনম্ কুতঃ।।
(সত্যার্থপ্রকাশ্য দ্বাদশ সমুল্লাস থেকে উদ্ধৃত)
.
এইভাবে বামমার্গীরা বেদকে মানতো, কিন্তু বেদজ্ঞান হতে শূন্য হওয়ার কারণে সংসারের মধ্যে অনেক প্রকার পাপ ছড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে অনীশ্বরবাদী এবং বেদবিরোধী নাস্তিক মত চার্বাক নাম প্রসিদ্ধ তো ছিলই। এইভাবে এই মানব সমাজ দুটো বর্গে বিভাজিত হয়ে যায়। একটা বর্গ শিখা, সূত্র ও শাস্ত্রধারী হয়ে ভয়ঙ্কর পাপ করছিল, যজ্ঞের মধ্যে মাংস-মদিরা আর চর্বির দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল, অন্যদিকে চার্বাক মত মানুষকে স্বেচ্ছাচারী বিষয়ভোগী বানাচ্ছিল। সেই পরিস্থিতিতে কোনো পবিত্রাত্মা, যিনি বেদের যথার্থ স্বরূপ সম্বন্ধে জানেন না, তার কিংকর্তব্যবিমূঢ় হওয়াটা স্বাভাবিক ছিল। এই কারণে মহাত্মা বুদ্ধ আর মহাবীর স্বামীর মতো মহাপুরুষ একদিকে তো বেদকে দূরে সরিয়ে দেন অথবা বেদের প্রতি উদাসীন হন, তো অন্যদিকে নাস্তিক চার্বাক মতকেও অস্বীকার করে দেন। তাঁরা দুইজনই অহিংসা আর সত্যকে আধার বানিয়ে নবীন মার্গে গমণ করেন।
.
ঋষি দয়ানন্দের অনুসারে প্রতিমাপূজনের প্রথা এদের অনুয়ায়ীদের থেকে শুরু হয়েছিল। এমন শোনা যায় যে এঁদের দিবঙ্গত হওয়ার পশ্চাৎ এঁদের অনুয়ায়ীরা বেদকে হিংসার পোষক গ্রন্থ বলে আর বৈদিক সাহিত্যকে জ্বালানো শুরু করে দেয়, একথা কতদূর সত্য, তা আমি জানি না। এইভাবে বেদ বিজ্ঞানের অস্ত হওয়ার পশ্চাৎ ছড়িয়ে যাওয়া অজ্ঞানের অন্ধকারে চারটা মত পৃথক-পৃথক ভাবে অগ্রসর হতে থাকে। বৈদিক বিদ্যা তো প্রায় সমাপ্তই হয়ে গিয়েছিল, তারসঙ্গে বৈদিক সাহিত্যও বিনাশ প্রাপ্ত হচ্ছিল। এমন পরিস্থিতিতে দক্ষিণ ভারতে আদি শঙ্করাচার্যের মতো মহাপুরুষের জন্ম হয়। শোনা যায় যে তিনি আট বছর বয়সে সন্ন্যাসী হয়েছিলেন আর তিনি বেদ এবং ভারতবর্ষের অধোগতি দেখেন, তো তিনি ধর্ম স্থাপনার বিচার করেন। ঋষি দয়ানন্দ সত্যার্থপ্রকাশের ১১ সমুল্লাসে আদি শঙ্করাচার্যকে অনেক সম্মান সহিত বর্ণিত করেন। ঋষি দয়ানন্দ লিখেছেন - "এরপর ২২০০ বৎসর পূর্বে দ্রবিড় দেশোৎপন্ন "শঙ্করাচার্য" নামক এক ব্রাহ্মণ ব্রহ্মচর্য দ্বারা সব শাস্ত্রের অধ্যয়ন করে ভাবতে লাগলেন, হায়! সত্য আস্তিক বেদমত বিলুপ্ত আর নাস্তিক জৈনমত প্রচলিত হওয়ায় বিশেষ অনিষ্ট হচ্ছে। যেকোনো প্রকার হোক এই মতের অপসারণ আবশ্যক। শঙ্করাচার্য শাস্ত্রধ্যয়ন তো করে ছিলেন, তার পাশাপাশি জৈনগ্রন্থসমূহও অধ্যয়ন করেছিলেন। তাঁর যুক্তিও ছিল প্রবল।"
.
এমন মহান বিদ্বান শঙ্করাচার্য ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক একতার জন্য চার মঠের স্থাপনা করেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ ৩২ বছরের অল্পায়ুতেই বিশ্বাসঘাত করে বিষ দিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয় আর তিনি তাঁর বিচারকে স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেওয়ার সুযোগ পান নি। তাঁর পশ্চাৎ তাঁর অনুয়ায়ীরা ব্রহ্মসূত্রের সহায়তা নিয়ে ব্রহ্মসূত্রেরই বিরুদ্ধ "ব্রহ্ম সত্যম্ জগন্মিথ্যা"র মতো মিথ্যা এবং অবৈদিক ঘোষণা প্রারম্ভ করে দেয়। তাঁর গ্রন্থের মধ্যে নারী আর শূদ্রের প্রতি হেয় ভাবের দুর্ভাগ্যপূর্ণ প্রকরণ আমরা দেখতে পাই আর সম্ভবতঃ এইসব প্রকরণকে দেখেই মনুস্মৃতি, রামায়ণ এবং মহাভারত আদি গ্রন্থের মধ্যে এইরূপ পাপপূর্ণ প্রক্ষেপ করা হয়েছে। হতে পারে এর আগে থেকেই শাস্ত্রের মিথ্যা অর্থ আর প্রক্ষেপের দুর্ভাগ্যপূর্ণ পরম্পরা প্রারম্ভ হয়ে গিয়েছিল।
.
আমার নিজের মত হল, বাল্যাবস্থাতেই যে যুবক বৈরাগ্যবান্ হয়েছে, সারা ভারতবর্ষের মধ্যে যে নিজের বিদ্বতার ডঙ্কা বাজিয়েছে, যাঁর মনে বৈদিক সনাতন ধর্ম এবং ভারত দেশকে বাঁচানোর প্রবল উৎকণ্ঠা আছে, সম্পূর্ণ ভারতবর্ষে যে একাই বিজয় যাত্রার জন্য পা বাড়িয়েছে, এমন তেজস্বী, অপ্রতিম আত্মবলসম্পন্ন আর প্রজ্ঞাবান্ পুরুষ পূর্ণ য়োগীই হতে পারে। যেকোনো য়োগীর জন্য এমন সম্ভব বলে মনে হয় না যে তিনি মানব মাত্রের মধ্যে ভেদভাব করবেন। য়োগীর প্রারম্ভই হয় অহিংসা থেকে আর অস্পৃশ্যতা (ছুয়াছুত) তো এক প্রকারের হিংসাই হবে, য়োগ যার সর্বদা বিরোধ করে, এইজন্য এমনই মনে হয় যে কিছু ব্যক্তি নিজের পাপকে প্রমাণিত সিদ্ধ করার জন্য শঙ্করাচার্যের গ্রন্থের মধ্যে প্রক্ষেপ করেছে। যদি দুর্জন-তোষ ন্যায় দ্বারা এটা তাঁর নিজস্ব মত মানা হয়, তাহলেও বেদবিরুদ্ধ হওয়ার কারণে এটা কাউকে স্বীকার করা উচিত নয়।
.
এইভাবে এরপর ভারতবর্ষের মধ্যে পাঁচটা মুখ্য ধারা প্রচলিত হয় - বামমার্গ, চার্বাক, বৌদ্ধমত, জৈনমত আর তথাকথিত অদ্বৈতবাদ। বৌদ্ধমত ভারতীয়কে অহিংসার নামে ভীতু করে দিচ্ছিল, তো অপরদিকে অদ্বৈত মত "অহম্ ব্রহ্মাऽস্মি" এবং "ব্রহ্ম সত্যম্ জগন্মিথ্যা" র মতো ভ্রামক কথন করে-করে ভারতীয়দের পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় হিত থেকে বিরক্ত করে দিচ্ছিল। বামমার্গ আর চার্বাক তো ছিলই অধর্মের দুটো নাম। এমন পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ ভারতবর্ষ বেদবিদ্যা থেকে নিরন্তর দূর থেকে দূরতর হয়ে যাচ্ছিল। অনেক আচার্য নিজ-নিজ মতের প্রবর্তন করে যাচ্ছিলেন, কিন্তু কোনো মতের মধ্যেই বেদবিদ্যার যথার্থ প্রকাশ না হওয়ার কারণে রাষ্ট্রীয়তা এবং সামাজিক অবধারণাই সমাপ্ত হয়ে যায়। কোনো আচার্যই রাষ্ট্র আর সমাজের প্রতি কর্তব্যকে বলার ছিল না। অধিকাংশ জনসংখ্যার জন্য বেদের পঠন-পাঠন নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় আর যারা পঠন-পাঠন করছিল, তারাও বেদপাঠ আর কর্মকাণ্ড পর্যন্তই সীমিত হয়ে গিয়েছিল। তবে হ্যাঁ, এটুকু অবশ্যই ছিল যে বেদার্থ হতে সর্বথা শূন্য বেদপাঠিগণ বেদকে সস্বর কণ্ঠস্থ করে প্রত্যেক পরিস্থিতিতে তাকে বাঁচিয়ে রাখে আর এই কারণে তারমধ্যে প্রায় কোনো প্রক্ষেপ হয়নি। বীভৎস কর্মকাণ্ডিগণও ব্রাহ্মণ গ্রন্থ এবং শ্রৌত্র সূত্র আদি গ্রন্থকে বাঁচিয়ে রাখে। এই কারণে সংসার এই ব্রাহ্মণদের অবশ্যই ঋণী থাকবে।
.
এমন পরিস্থিতিতে মৃতপ্রায় ভারত বিদেশী আক্রমণকারীদের আক্রমণে আহত হতে থাকে। এইভাবে এই ভারত দেশ ধার্মিক, দার্শনিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও আর্থিক সবদিক থেকে ছিন্ন-ভিন্ন আর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। অনেক মত-পন্থ জন্ম নিচ্ছিল, দেশ বিদেশিদের কাছে পদাক্রান্ত হচ্ছিল। এমন কোনো রাজা-মহারাজা বা ধর্মাচার্য দেখা যাচ্ছিল না, যিনি এই সম্পূর্ণ পরিস্থিতির মূল্যাঙ্কন করে প্রত্যেক ক্ষেত্রে দেশ আর বিশ্বকে উচিত দিশা দিতে পারেন। এই দেশে অনেক মহাপুরুষও জন্মে ছিলেন, যাঁদের মধ্যে আচার্য চাণক্য, সন্ত কবীর, গুরু নানকদেব, সন্ত রবিদাস, গোস্বামী তুলসীদাস, মীরা বাই, সন্ত জ্ঞানেশ্বর আদি প্রমুখ। এখানে আমি বীর ক্ষত্রিয়দের চর্চা করা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি না, কারণ ধর্মাচার্য আর দার্শনিকগণই দেশকে দিশা দেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ এইসব মহাপুরুষদের মধ্যে কেউই বেদবিদ্যার বিশেষ জ্ঞাতা ছিলেন না, তাসত্ত্বেও তাঁরা নিজের সামর্থ্য আর পরিস্থিতি অনুসারে নিষ্কাম পুরুষার্থ করেন।
.
এমন বিষম পরিস্থিতিতে গুজরাটের টাঙ্কারা নামক গ্রামে এক মহাপুরুষ জন্ম নেন আর সেই মহাপুরুষ স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী নামে বিশ্ববিখ্যাত হন। সৌভাগ্যক্রমে তিনি মহান প্রজ্ঞাবান্ স্বামী বিরজানন্দ সরস্বতীর মতো গুরুকে পান। দণ্ডী স্বামী বিরজানন্দ সরস্বতী নেত্রহীন হওয়া সত্ত্বেও নিজের মহতী প্রজ্ঞা এবং য়োগারূঢ় আত্মার বলে ভারতবর্ষের অধোগতিকে সূক্ষ্মতা সহিত দেখতে পাচ্ছিলেন, সেই সময় সেই দৃশ্য দেখতে ভারতবর্ষের কোনো আচার্য কিংবা রাজা-মহারাজা সক্ষম ছিলেন না। এমন মহান গুরু স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীকে এক বিরাট ব্যক্তিত্বের বানিয়ে দেন। তিনি নিজের গুরুর ভাবনার অনুরূপ, যেটা প্রাচীন আর্ষ পরম্পরার অনুসারেই ছিল, শাস্ত্রের সঙ্গে-সঙ্গে দেশ আর সমাজ উদ্ধারের সংকল্প নেন। তিনি এক সুদক্ষ বৈদ্যের মতো এটা যথাযথ ভাবে জানতে পারেন যে প্রাচী আর্যাবর্ত (ভারত) দেশেরও উৎকৃষ্ট রূপ ছিল, বেদবিদ্যার প্রকাশই ছিল তার কারণ আর ভারতের যে বিনাশ হয়েছে, সেটা বেদবিদ্যার পতনের কারণেই হয়েছে।
.
যদিও তিনি সত্যার্থপ্রকাশ আদি গ্রন্থের মধ্যে বিবিধ ক্ষেত্রের মধ্যে দেশ আর বিশ্বকে একটা নতুন দিশা দেওয়ার চেষ্টা করেন আর দেশকে স্বতন্ত্র করার আহ্বান তিনিই প্রথম করেন, কিন্তু তাঁর সবথেকে প্রমুখ কাজ ছিল - বিভিন্ন প্রকারের কর্মকাণ্ডের শিকলে জড়িয়ে থাকা বেদের যথার্থ স্বরূপকে সংসারের সম্মুখে প্রস্তুত করার চেষ্টা করা। তিনি বেদকে সনাতন আর্ষ পরম্পরার অনুকূল দেখার চেষ্টা করেন আর তিনি আশা ব্যক্ত করেন যে যেদিন তাঁর বেদভাষ্য পূর্ণ হবে, সেইদিন ভূমণ্ডলে সূর্যের মতো প্রকাশ হবে, যাকে নষ্ট কিংবা ঢেকে ফেলার সামর্থ্য কারও হবে না। তাঁর দৃষ্টি আর্ষ ছিল, মহান য়োগবল ছিল আর তাঁর হৃদয়ে বৈদিক ধর্ম ধ্বংস হওয়ার প্রবল সন্তাপ ছিল। শরীরে অদ্ভুত বল আর মস্তিষ্ক প্রবল প্রতিভাসম্পন্ন ছিল। এইজন্য তিনি আর্যাবর্ত দেশ আর সনাতন বৈদিক ধর্মের দুরবস্থার মূল কারণকে জানতে পেরে ছিলেন। এমন ব্যক্তি হাজার-হাজার বছর পশ্চাৎ তিনি প্রথম মহাপুরুষ ছিলেন। তিনি অনুভব করেন যে যখন থেকে ভারতবর্ষ অথবা বিশ্বের মধ্যে বেদের যথার্থ স্বরূপ লুপ্ত হয়েছে, তখন থেকেই এই পতন শুরু হয়েছে।
.
এই কারণে তিনি পরম্পরাগত শৈলী থেকে আলাদা হয়ে বেদভাষ্য করা শুরু করেন। তিনি ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকার মধ্যেই বেদের যথার্থ বিজ্ঞানের এক অতি সংক্ষিপ্ত ঝলক প্রস্তুত করেন। ঋগ্বেদের প্রারম্ভিক মন্ত্রের কিছু বিস্তার ভাবে দুই-দুই প্রকারের ভাষ্য করেন আর ক্রমে-ক্রমে তাঁর ভাষ্য সংক্ষিপ্ত থেকে সংক্ষিপ্ততর হতে থাকে আর ঋগ্বেদ ভাষ্যের পশ্চাৎ তিনি য়জুর্বেদ ভাষ্যও সংক্ষিপ্ত রূপেই করেন। আর্য বিদ্বান আচার্য বিশ্বশ্রবা ব্যাসের অনুসারে "ঋষি দয়ানন্দ বলতেন যে চারটা বেদের ভাষ্য করতে তাঁকে চারশ বছরের আয়ু লাগবে", কিন্তু তিনি বেদভাষ্য করার জন্য মাত্র ৭-৮ বছর পেয়েছিলেন, তারমধ্যেও তিনি একটা স্থানে নিশ্চিন্তভাবে বসে ভাষ্য করতে পারেন নি।
.
বর্তমানে ঋগ্বেদের সপ্তম মণ্ডলের ৬১তম সূক্তের দুটো মন্ত্র পর্যন্তই তাঁর করা ভাষ্য আমরা পাই, কিন্তু তাঁর য়জুর্বেদ ভাষ্যের শুরুতে যে লেখা আছে, তাতে স্পষ্ট হয় যে তিনি ঋগ্বেদের ভাষ্য পূর্ণ করেছিলেন, কিন্তু কারও প্রমাদবশ ঋগ্বেদের শেষ ভাষ্যের পাণ্ডুলিপি সম্ভবতঃ কোথাও হারিয়ে গেছে। কেউ তার সন্ধান করার চেষ্টা করেছে কিনা, তা আমার জানা নেই। তাঁর উপলব্ধ ভাষ্যও সাংকেতিক মাত্রই আছে, কারণ কোথাও-কোথাও তো তিনি অনেক পদের ভাষ্য না করেই ছেড়ে দিয়েছেন। ভাষ্যের হিন্দি অনুবাদও তাঁর নয়, বরং তাঁর লেখন কার্য করা পণ্ডিতদের। তারা হিন্দি-অনুবাদে অনেকত্র ঋষি দয়ানন্দের মন্তব্যের বিপরীত অনুবাদ করেছে, যা কোথাও-কোথাও হাস্যাস্পদ হয়ে গেছে। সাধারণ জন হিন্দি অনুবাদই পড়ে, এই কারণে বেদের স্বাধ্যায় করেও আর্যজন বিশেষ কিছু লাভ নিতে পারে নি। ঋষি দয়ানন্দের সংস্কৃত ভাষ্যও বিস্তৃত ব্যাখ্যার আবশ্যকতা রাখে।
.
সম্ভবতঃ ঋষির এমন অনুভব হয়ে গিয়েছিল যে তাঁর জীবন অধিক দিন যাবে না আর তাঁর কাছে কাজের অধিকতাও ছিল। এইজন্য তিনি সাংকেতিক ভাষ্যই করতে পান। যে সকল আর্যজন হঠপূর্বক এই ভাষ্যকে পূর্ণ মানে, তারা আজ পর্যন্ত সেখানে থেকে কিছু প্রকাশ না স্বয়ং আর না স্বয়ংয়ের পরিবারে করতে পেরেছেন, অথচ তাদের এই প্রকাশ সারা ভূমণ্ডলে করার ছিল। কেউই এই বিচার করার জন্য উদ্যত নন যে আমরা কেন বেদভাষ্য থাকা স্বত্ত্বেও পাশ্চাত্য কুশিক্ষা আর কুসভ্যতার দাস হয়ে গেছি? কেন আমরা নিজের পরিবারের মধ্যে বেদের শ্রেষ্ঠতা স্থাপিত করতে পারিনি? আমাদের আত্মনিরীক্ষণ করা উচিত যে উপলব্ধ বেদভাষ্য পড়ে এমন নিশ্চয় হয় কি যে বেদভাষ্যের মধ্যে যা কিছু আছে, মানুষ তা লিখতে পারবে না? আমাদের কি এমন মনে হয় যে বেদের মধ্যে সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের চর্চা করা হয়েছে আর সেই চর্চাও এমন গম্ভীর যে তাকে বর্তমান বিজ্ঞান পূর্ণ রূপে কখনও জানতে পারবে না? আমাদের কি এমন মনে হয় না যে বেদভাষ্য সাংকেতিক আছে আর তাকে আধার করে আমরা সংসারে বেদকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবো না?
.
এইসব লেখার মানে এই নয় যে আমি ঋষি দয়ানন্দের অবমাননা করছি, বরং আমার উদ্দেশ্য হল ঋষি দয়ানন্দের সময়ের পরিস্থিতি আর তাঁর বিবশতাকেও অনুভব করার চেষ্টা করা হোক। কেউ যতই প্রতিভাশালী ব্যক্তি হোক না কেন, সে ঋষি দয়ানন্দের সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এত বড় কাজ করতে পারবে না, এটাই তাঁর গৌরব। ঋষি দয়ানন্দের পশ্চাৎ তাঁর থেকে প্রেরিত পণ্ডিত গুরুদত্ত বিদ্যার্থী বেদাদি শাস্ত্রকে কিছু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করেন। তাঁর লেখা ইউরোপীয় বৈদিক বিদ্বানদের মধ্যে ধূম মেছে যায়, কিন্তু ইউরোপের পদার্থ বিজ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ দিতে অথবা নতুন দিশা দেওয়ার কাজ তিনি করতে পারেন নি। আর্য সমাজ আর ডি.এ.বি. কলেজের প্রচার করতে অতি ব্যস্ত থাকার কারণে আর অল্প বয়সে সংসার ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণে তিনি বিশেষ প্রতিভার ধনী হওয়া সত্ত্বেও বেদের উপর কাজ করতে পারেন নি।
.
ঋষি হতে প্রেরিত অন্য মহানুভাব মহাত্মা মুন্সীরাম (স্বামী শ্রদ্ধানন্দ), লেখরাম, পণ্ডিত কৃপারাম (স্বামী দর্শনানন্দ), প্রফেসর শ্যামকৃষ্ণ বর্মা, লালা লাজপতরায় এবং মহাত্মা হংসরাজ প্রমুখ হন, যাঁরা রাষ্ট্র ও সমাজকে জাগাতে আর স্বাধীনতা আন্দোলনকে দাঁড় করাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের পশ্চাৎও অনেক বিদ্বান আর দেশভক্ত আর্যসমাজের মধ্যে হয়, যারা নিজের সারা জীবন দেশ আর সমাজের জন্য আহুতি করে দেন, কিন্তু বেদের যথার্থ স্বরূপকে জানতে ইচ্ছুক এমন কোনো বিদ্বান হননি, যিনি বেদের অপৌরুষেয়তা এবং সর্ববিজ্ঞানময়তাকে সিদ্ধ করতে সক্ষম হবেন। এই কারণে আমাদের গুরুকুল বিদেশী শিক্ষার ঝড়কে থামাতে সক্ষম তো হয়নি, বরং গুরুকুল স্বয়ং ম্যাকালের শিক্ষার প্রবাহে ভেসে যাচ্ছে। যদি আমরা আধুনিক শিক্ষার কোনো বিকল্প প্রস্তুত করতে পেতাম, বৈদিক বিজ্ঞান আর প্রৌদ্যোগিকীর কিছু বিকাশ করতে পেতাম আর সম্পূর্ণ হিন্দু সমাজ আর্যসমাজের বিদ্বানদের পাশে দাঁড়াতো, তাহলে আজ দেশের মধ্যে নিজের স্বদেশী শিক্ষা আর চিকিৎসার সাম্রাজ্য হতো।
.
আমি প্রায় ৩০ বছর পূর্বেই এটা অনুভব করা শুরু করে ছিলাম যে আমরা আর্যসমাজের প্রথম আর তৃতীয় নিয়মের উপর যতই ভাষণ-প্রবচন করি না কেন, তবে বৈজ্ঞানিক জগতে একে সিদ্ধ করতে পারা অতি দুষ্কর। এই জন্য আমি বেদের উপর এমন দৃষ্টিতে বিচার করার ব্রত নিয়েছি যাতে বেদ ঈশ্বরীয়ও হয়ে যায় আর তারসঙ্গে সর্ববিজ্ঞানময়ও হয়। আর্য বিদ্বানদের মধ্যে এমন কাউকে দেখিনি, যিনি এই দিশাতে মার্গদর্শন বা পরামর্শ দিতে পারেন। এই কারণে স্বয়ংই আর্ষ গ্রন্থ পড়ার সিদ্ধান্ত নিই। এই ক্রমে পড়তে-পড়তে ব্রাহ্মণ গ্রন্থের বারি আসে। সর্বপ্রথম ঐতরেয় ব্রাহ্মণ গ্রন্থের সায়ণ ভাষ্য তথা ডাক্তার সুধাকর মালবীয় দ্বারা করা হিন্দি অনুবাদ দেখি। একই সঙ্গে আর্য বিদ্বান আচার্য বীরেন্দ্র শাস্ত্রীর হিন্দি অনুবাদ এবং পণ্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ উপাধ্যায় দ্বারা করা শতপথ ব্রাহ্মণের হিন্দি অনুবাদ দেখি। এইসব দেখে খুব ভয় হয় যে যদি ব্রাহ্মণ গ্রন্থ এমন হয়, তাহলে বেদকে অপৌরুষেয় আর সর্ববিজ্ঞানময় বলা নিতান্ত মূর্খতার কথা হবে। এরদ্বারা আর্য সমাজের মূল বিচারধারার ভবনই ভেঙে পড়বে।
.
ঋষি দয়ানন্দের কথনের উপর আমার পূর্ণ বিশ্বাস ছিল আর সকল প্রাচীন ঋষিদের উপরেও অটুট শ্রদ্ধা ছিল। এর থেকে প্রেরিত হয়ে আমি এই সিদ্ধান্তে আসি যে ব্রাহ্মণ গ্রন্থের কোনো ভাষ্য বা অনুবাদই ঠিক নয়। আর তাই স্বয়ং এর ভাষ্য করা উচিত। এই ক্রমেই আমি "বেদবিজ্ঞান-আলোকঃ" নামে ঐতরেয় ব্রাহ্মণের বৈজ্ঞানিক ভাষ্য করি। এরমধ্যে প্রায় ১২৫ টা গ্রন্থকে উদ্ধৃত করেছি। যার দ্বারা সিদ্ধ হয়েছে যে আমার করা ভাষ্য ঋষিদের বিচারের অনুরূপই হয়েছে। কোথাও কোনো কথা কল্পনা করে লেখা হয়নি। এইরূপ স্থিতি এই গ্রন্থের মধ্যেও আছে। বেদ মন্ত্রকে রশ্মির রূপে মানতে তথা বেদের ঋষিদেরও রশ্মিরূপে অন্তরীক্ষে বিদ্যমান হওয়ার সংকেত পণ্ডিত ভগবদ্দত্ত রিসার্চ স্কোলারের নিরুক্ত-ভাষ্য থেকে প্রাপ্ত হয়। একইসঙ্গে ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকার বেদনিত্যত্ব বিষয় নামক অধ্যায়ে উল্লিখিত এই বচন থেকেও হয় - "কিন্তু আকাশে শব্দের প্রাপ্তির কারণে শব্দ তো অখণ্ড একরস সর্বত্র ভরে আছে। শব্দ হল নিত্য। বেদের শব্দ সবদিক থেকে নিত্য বজায় থাকে।" এছাড়াও অনেক ব্রাহ্মণ গ্রন্থ, উপনিষদ এবং আরণ্যক তথা বেদের কিছু শাখার বচন থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে সম্পূর্ণ সৃষ্টি বৈদিক ছন্দ রশ্মি দিয়ে তৈরি আর সেগুলোর দ্বারাই সঞ্চালিত হচ্ছে। আর এই সবেরও মূল সঞ্চালক হল পরব্রহ্ম পরমাত্মা।
.
এইভাবে আমি সৃষ্টিকে জানার জন্য বৈদিক রশ্মি সিদ্ধান্তের আবিষ্কার করি, যা বাস্তবে আমার সিদ্ধান্ত নয়, বরং প্রাচীন ঋষি আর বেদের সিদ্ধান্ত, যাকে আমরা হাজার-হাজার বছর ধরে ভুলে গিয়েছিলাম। এই সিদ্ধান্তের আধারেই সম্পূর্ণ সৃষ্টির এমন ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, যা বর্তমান বিজ্ঞানের যেকোনো সিদ্ধান্তের থেকে অধিক সূক্ষ্ম, গম্ভীর আর ব্যাপক হবে। বৈদিক রশ্মি বিজ্ঞানের দ্বারাই বেদকে অপৌরুষেয় এবং সর্ববিজ্ঞানময় সিদ্ধ করা যেতে পারে, এছাড়া অন্য কোনো মার্গ নেই। এই সিদ্ধান্তের দ্বারাই প্রাচীন ইতিহাসের অন্বেষণ করতে যেকোনো ঘটনার সম্ভব বা অসম্ভব হওয়ার পরিচয়ও করা যেতে পারে। এর আধারে বেদাদি শাস্ত্রের ব্যাখ্যা করে সেগুলো পূর্ণ নির্দোষ আর সর্বহিতকারী রূপে সংসারে প্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে। এইভাবে এই বিজ্ঞানের বিকাশ করে সুদূর ভবিষ্যতে এমনও বৈদিক শিক্ষা প্রণালীর বিকাশ করা যেতে পারে, যা আধুনিক শিক্ষা প্রণালীর থেকে অধিক শ্রেষ্ঠ আর হিতকারী হবে, কিন্তু এইসব করতে হলে আমাদের কাছে পর্যাপ্ত আর্থিক সংশোধনের আবশ্যকতা হবে।
.
এর জন্য সেই সব মহানুভাবকে গম্ভীরতা পূর্বক বিচার করা উচিত, যারা বেদকে সংসারে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চান।যাদের মধ্যে ভারতবর্ষকে বৌদ্ধিক দাসত্ব থেকে মুক্তি করার প্রচণ্ড ইচ্ছা আছে আর যাদের মধ্যে ঋষি-মুনি আর দেব তথা অন্য প্রাচীন মহাপুরুষদের প্রতি গভীর সম্মানের ভাব বিদ্যমান আছে। আজ আসুরী কুশিক্ষা ও কুসংস্কারকে প্রচারিত আর প্রসারিত করার জন্য বিশ্বের সব সংস্থান লেগে পরে আছে, অথচ বেদ আর দেবতাদের কথা বলে এমন মহানুভাবের কাছে না কোনো পরিকল্পনা আছে আর না আছে কোনো দিশা। পৌরাণিক তথাকথিত সনাতনী মহানুভাব মন্দিরের উপর ধন ব্যয় করা আর নানা কর্মকাণ্ড করা-করানোর মধ্যেই ব্যস্ত আছে আর আর্যসমাজী মাত্র যজ্ঞ, কথিত য়োগ, প্রবচন আদি করেই স্বয়ংকে বেদভক্ত মেনে বসে আছে। বস্তুতঃ বেদ কোথাও দেখা যাচ্ছে না। আশা করি সকল দেশভক্ত বৈদিক সনাতন ধর্মপ্রেমী সজ্জন এর উপর অবশ্যই বিচার করবেন।
প্রশ্ন - আপনার এই কথন যে সৃষ্টির শুরুতে অগ্নি আদি চারজন ঋষি বেদজ্ঞান প্রাপ্ত করেন, এটা উচিত নয়। কারণ ভারতীয় পরম্পরা মহর্ষি ব্রহ্মাকে সর্বপ্রথম বেদের জ্ঞান প্রাপ্তকারী মানে।
.
উত্তর - এখানে আমি সর্বপ্রথম তো এটা বলতে চাইবো যে এটা আমার মত নয় বরং সংসারের সর্বোচ্চ ও সর্বপ্রথম রাজর্ষি ভগবান্ মনুর মত হল এটা, যাঁর বিষয়ে প্রাচীন ঋষিদের কথন আছে - "য়দ্বৈ কিঞ্চ মনুরবদত্ তদ্ ভেষজম্" (তৈত্তেরীয় সংহিতা ২.২.১০.৩) অর্থাৎ মনু মহারাজের কথন ওষুধের সমান হিতকারী হয়। এই কারণে ভারতীয় কোনো পরম্পরা তাঁর বিরুদ্ধে হওয়া সম্ভব নয়। এখন আমি অন্য আর্ষ গ্রন্থকেও উদ্ধৃত করবো - "ততো ব্রহ্মৈব প্রথমমসৃজ্যত (প্রজাপতিঃ) ত্রয়্যেব বিদ্যা তস্মাদাহুর্ব্রহ্মাস্য সর্বস্য প্রথমজামিতি" (শতপথ ব্রাহ্মণ ৬.১.১.১০)।"
.
এই কথন থেকে এই সংকেত পাওয়া যায় যে পরমাত্মা মহর্ষি ব্রহ্মাকে ত্রয়ী বিদ্যা অর্থাৎ চতুর্বেদের (শৈলী অনুসারে তিন) জ্ঞান দেন। এই কথন হল মহর্ষি য়াজ্ঞবল্ক্যের। যদিও মহর্ষি য়াজ্ঞবল্ক্যের তুলনায় ভগবান্ মনুর স্থান অত্যন্ত উচ্চ, তবুও মহর্ষি য়াজ্ঞবল্ক্যও আপ্ত পুরুষ ছিলেন তাই তাঁর কথনও মিথ্যা হতে পারে না। তাহলে আমাদের কোনো একটা পক্ষকে দেখা উচিত নয়, বরং উভয়ের সামঞ্জস্য নির্ধারিত করা উচিত। এর জন্য ভগবান্ মনু প্রোক্ত শ্লোক "অগ্নিবায়ুরবিভ্যঃ" এরমধ্যে পঞ্চমী বিভক্তি মানতে হবে। এইভাবে শতপথের উপরোক্ত বচনের প্রকাশে মনু প্রোক্ত শ্লোকের অর্থ এই দাঁড়াবে -
.
মহর্ষি ব্রহ্মা যজ্ঞ অর্থাৎ লোককল্যাণার্থ অগ্নি, বায়ু আদি ঋষিদের থেকে ঋক্, য়জুঃ এবং সাম লক্ষণ যুক্ত বেদ প্রাপ্ত করেন। এর মানে হল পরমাত্মা এই সৃষ্টিতে সব জীবের কল্যাণের জন্য অগ্নি, বায়ু আদি ঋষিদের মাধ্যমে মহর্ষি ব্রহ্মাকে সম্পূর্ণ বেদের জ্ঞান প্রাপ্ত করিয়ে দেন। এইভাবে মহর্ষি ব্রহ্মাই এই পৃথিবীর প্রথম পুরুষ ছিলেন, যিনি সম্পূর্ণ ত্রয়ীবিদ্যার জ্ঞান প্রাপ্ত করেন। অগ্নি, বায়ু আদি ঋষিগণ এক-একটা বেদের জ্ঞান প্রাপ্ত করেছিলেন। এইভাবে এক-একটা বেদ প্রাপ্তকারী অগ্নি, বায়ু আদি চার ঋষি ছিলেন, কিন্তু চার বেদের জ্ঞান প্রাপ্তকারী মহর্ষি ব্রহ্মাই প্রথম ব্যক্তি ছিলেন। তাই ভগবান্ মনু এবং মহর্ষি য়াজ্ঞবল্ক্য উভয়ের কথনই সত্য।
.
প্রশ্ন - আপনি বার-বার বেদমন্ত্রকে রশ্মি নাম দিয়েছেন, কখনও কোনো ঋষি তো এমন বলে নি। এটা আপনার মনের মিথ্যা কল্পনা নয় কি? যখন আপনি এই রশ্মিজাল থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে বেদের চিন্তন করবেন, তখন আপনি বেদের অর্থ বুঝবেন।
.
উত্তর - এই প্রশ্নের উত্তর বুঝতে হলে আপনাকে আগে বুঝতে হবে যে বেদ আসলে কি? বেদ হচ্ছে ছন্দরূপ, এই বিষয়ে কোনো প্রকারের তর্ক-বিতর্ক করার আবশ্যকতা নেই। ছন্দের বিষয়ে মহর্ষি য়াস্ক বলেছেন - ছন্দাম্সি চ্ছাদনাত্ (নিরুক্ত ৭.১২)। এই বিষয়ে দৈবত ব্রাহ্মণে (৩.১৯) বলা হয়েছে - "ছন্দাম্সি ছন্দয়ন্তীতি বা"। এখানে প্রশ্ন দাঁড়াবে যে এই ছন্দ কোন পদার্থের নাম, যা অন্য কোনো পদার্থকে আচ্ছাদিত করে। আচ্ছাদন শব্দ এটাই বলে যে ছন্দ হচ্ছে কোনো দ্রব্য, যা অন্য কোনো দ্রব্যকে আচ্ছাদিত করে। "ছন্দঃ" পদের অনেক অর্থ ঋষি দয়ানন্দ তাঁর বেদভাষ্যে করেছেন -
প্রকাশকর্ম (মহর্ষি দয়ানন্দ য়জুর্বেদ ভাষ্য ১৫.৪)
ঊর্জনম্ (মহর্ষি দয়ানন্দ য়জুর্বেদ ভাষ্য ১৫.৪)
বলকারী (মহর্ষি দয়ানন্দ য়জুর্বেদ ভাষ্য ১৪.১৮)
প্রকাশ (মহর্ষি দয়ানন্দ য়জুর্বেদ ভাষ্য ১৪.১৮)
এইসব অর্থ দ্বারা এটাই সিদ্ধ হয় যে ছন্দ হচ্ছে কোনো দ্রব্য। এর অর্থ এই হল যে বেদ মন্ত্র হল দ্রব্যরূপ। অন্যদিকে আরও এক ঋষির কথন হল - "প্রাণাঃ বৈ ছন্দাম্সি" (কৌষীতকি ব্রাহ্মণ ৭.৯.১৭.২)। এর অর্থ হল ছন্দ হল প্রাণ রূপ অর্থাৎ বেদমন্ত্র হল প্রাণরূপ। প্রাণ হল নিরন্তর কম্পনকারী পদার্থ। এর জন্য মহর্ষি য়াজ্ঞবল্ক্য বলেছেন - "অধ্রুবম্ বৈ তদ্যত্প্রাণঃ" (শতপথ ব্রাহ্মণ ১০.২.৬.১৯)। অপরদিকে মহর্ষি ব্যাস জীর কথন হল - "প্রাণঃ কম্পনাত্" (ব্রহ্মসূত্র ১.৩.৩৯)। এর অর্থ এই দাঁড়ালো যে বেদমন্ত্র রূপী পদার্থ এই সৃষ্টিতে সর্বদা কম্পন করতে থাকে। রশ্মিও সর্বদা কম্পন করতে থাকে, এইজন্য মহর্ষি তিত্তির বলেছেন - "প্রাণা রশ্ময়ঃ" (তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ৩.২.৫.২)। আপনি প্রশ্ন করেছিলেন যে রশ্মি শব্দের ব্যবহার কেউ করে নি, এটা আপনার স্বাধ্যায়ের ন্যুনতাকেই দর্শায়।
.
রশ্মি শব্দের ব্যবহার অন্যত্র অনেক স্থানে পাওয়া যায়। উদাহরণার্থ -
মাসা রশ্ময়ঃ (জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ ১.১৩৭)
রশ্ময়ঃ ঋতবঃ (মৈত্রায়ণী সংহিতা ৪.৮.৮, কপিষ্ঠল সংহিতা ৪৩.১)
রশ্ময়ো মরুতঃ (জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ ১.১৩৭)
.
এর উপর আপনি প্রশ্ন করতে পারেন যে রশ্মি তো হল মরুত্, কিন্তু ছন্দকে কোথায় রশ্মি বলা হয়েছে? যদিও প্রাণকে রশ্মি বলা আর ছন্দকে প্রাণ বললে স্বতঃই ছন্দ রশ্মিরূপ সিদ্ধ হয়ে যায়, তবুও আপনার সন্তোষের জন্য আমি আরও একটা প্রমাণ প্রস্তুত করছি - "এষ য়ানি ক্ষুদ্রাণি ছন্দাম্সি তানি মরুতাম্" (তাণ্ড্য মহাব্রাহ্মণ ১৭.১.৩) অর্থাৎ যেসব ন্যুন অক্ষরকারী ছন্দ আছে, সেগুলোই মরুতের রূপ হয়। অথর্ববেদের (১৯.৫৩.১) মধ্যে কালকে সপ্তরশ্মি বলা হয়েছে। এখানে সপ্তরশ্মির অর্থ সাত প্রকারের প্রাণ হবে। সম্পূর্ণ সৃষ্টি এই সব বৈদিক রশ্মি দিয়েই তৈরি হয়েছে, এইজন্য ঋষিগণ বলেছেন -
.
এতে বৈ বিশ্বেদেবা রশ্ময়ঃ (শতপথ ব্রাহ্মণ ২.৩.১.৭)
অন্নম্ রশ্মিঃ (শতপথ ব্রাহ্মণ ৮.৫.৩.৩)
এতে বৈ রশ্ময়ো বিশ্বেদেবাঃ (শতপথ ব্রাহ্মণ ১২.৪.৪.৬)
.
এই সব প্রমাণ থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে সম্পূর্ণ সৃষ্টিটাই হল রশ্মিরূপ অর্থাৎ রশ্মি দিয়ে মিশ্রিত হয়েই তৈরী হয়েছে। এই সৃষ্টিতে এক বিশেষ প্রকারের বিভাগের দৃষ্টিতে সব পদার্থ অন্ন এবং প্রাণ এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা যেতে পারে আর উভয় প্রকারের পদার্থ রশ্মিরূপই হবে। অন্যদিকে য়জুর্বেদে সব পদার্থকে ছন্দরূপ বলা হয়েছে -
.
পৃথিবী ছন্দোऽন্তরিক্ষম্ ছন্দো দ্যৌশ্ছন্দঃ সমাস্ছন্দো নক্ষত্রাণি ছন্দো মনশ্ছন্দঃ কৃষিছন্দো হরিণ্যম্ ছন্দো গৌশ্ছন্দোऽজা চ্ছন্দোऽশ্বছন্দঃ।। (য়জুর্বেদ ১৪.১৯)
.
শৈলীর দৃষ্টিতে বেদ (ছন্দ) তিন প্রকারের হয় -
{১} ঋক্ - এর বিষয়ে বলা হয়েছে -
ঋগ্ভ্যো জাতাম্ সর্বশো মূর্তিমাহুঃ (তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ৩.১২.৯.১১)
ঋক্ বা অয়ম্ পৃথিবীলোকঃ (জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ ২.৩৮০)
.
অর্থাৎ এই সৃষ্টির মধ্যে যেসব পদার্থ বিদ্যমান আছে, সেগুলোতে ঋক্ ছন্দ রশ্মির প্রাধান্য আছে।
.
{২} য়জুঃ - এর বিষয়ে বলা হয়েছে -
সর্বা গতির্য়াজুষী হৈব শশ্বত্ (তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ৩.১২.৯.১)
অন্তরিক্ষম্ বৈ য়জুষামায়তনম্ (গোপথ ব্রাহ্মণ পূর্বভাগ ২.২৪)
অন্তরিক্ষলোকো য়জুর্বেদঃ (ষড্বিংশ ব্রাহ্মণ ১.৫)
এইসব প্রমাণের অর্থ হল এই সৃষ্টির মধ্যে যেসব পদার্থ গতি করছে, সেগুলো য়জুঃ ছন্দ রশ্মি দিয়ে তৈরি আকাশের মধ্যেই গমন করছে। এই ছন্দ রশ্মির বিস্তারকেই আকাশ মহাভূত বলে।
{৩} সাম - এর বিষয়ে বলা হয়েছে -
সর্বম্ তেজঃ সামরূপ্যম্ হ শশ্বত্ (তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ৩.১২.৯.২)
সাম বা অসৌ দ্যুলোকঃ (তাণ্ড্য মহাব্রাহ্মণ ৪.৩.৫)
অর্চিঃ আদিত্যস্য সামানি (শতপথ ব্রাহ্মণ ১০.৫.১.৫)
এইসব প্রমাণ দ্বারা এটা সিদ্ধ হয় যে প্রকাশিত কিরণ এবং প্রকাশিত লোকের মধ্যে সাম নামক ছন্দ রশ্মির প্রাধান্য আছে।
বিস্তার ভয়ের কারণে আমি আর অধিক প্রমাণ দিচ্ছি না আর এইরূপ করা আবশ্যক। এইসব প্রমাণ থাকতে কোনো ব্যক্তিই এমন বলতে পারবে না যে বেদমন্ত্র দিয়ে সৃষ্টির নির্মাণ হয়নি আর বেদমন্ত্র রশ্মি রূপ নয়, এমনও কেউ বলতে পারবে না।
প্রশ্ন - বেদমন্ত্র ক্রিয়ারূপ নাকি দ্রব্যরূপ? আপনি ছন্দকে মনস্তত্ত্বের মধ্যে উৎপন্ন ঢেউয়ের সমান মানেন, এই মান্যতা দ্বারা তো বেদ ক্রিয়ারূপই হতে পারে, দ্রব্যরূপ নয় আর ক্রিয়ারূপ পদার্থ নিমিত্ত কারণ তো হতে পারবে, কিন্তু উপাদান কারণ নয়। অথচ আপনি উপরোক্ত প্রমাণের মাধ্যমে বেদকে উপাদান কারণ সিদ্ধ করেছেন, এটা কি আপনার বিচারের পরস্পর বিরোধ দেখাচ্ছে না?
উত্তর - আমার বিচারের মধ্যে এমন কোনো বিরোধ নেই, বরং আপনার মতিবিভ্রম আছে। যেরূপ জলের মধ্যে ঢেউ উৎপন্ন হয়, সেইরূপ মনের মধ্যে উৎপন্ন ঢেউকে ছন্দ রশ্মি বলে। জলের থেকে পৃথক অস্তিত্ব ঢেউয়ের নেই, বরং ক্রিয়াশীল অর্থাৎ কম্পন করতে থাকা জলকেই ঢেউ বলে, সেইরূপ কম্পন করতে থাকা মনস্তত্ত্বকেই ছন্দ রশ্মি অর্থাৎ বেদমন্ত্র বলে। বিনা কম্পন অর্থাৎ ক্রিয়া না করে কোনো পদার্থই বিকার প্রাপ্ত হয়ে অন্য কোনো পদার্থকে উৎপন্ন করতে পারবে না। এইজন্য মনস্তত্ত্ব মন্ত্রের রূপে কম্পিত না হয়ে সৃষ্টির রচনা করতে অর্থাৎ পদার্থান্তরে পরিবর্তিত হতে সক্ষম হবে না। এইভাবে যেকোনো মন্ত্র অর্থাৎ মনস্তত্ত্বের মধ্যে উৎপন্ন হওয়া কম্পন যেকোনো পদার্থের নিমিত্ত কারণ হবে আর কম্পন করা মনস্তত্ত্ব, যেটা বাক্ রূপ হয়, সেটা হল এই সৃষ্টির উপাদান কারণ। এইজন্য ঋষিগণ বাক্ আর মনের পারস্পরিক সম্বন্ধ নিয়ে লিখেছেন -
বাক্ চ বৈ মনশ্চ দেবানাম্ মিথুনম্ (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৫.২৩), বাগিতি মনঃ (জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ ৩.৪.২২.১১)
.
এখন রশ্মির বিষয়ে মহর্ষি য়াস্কের কথন হল - রশ্মির্য়মনাত্ (নিরুক্ত ২.১৫) অর্থাৎ রশ্মি হল সেই পদার্থ যা নিজের থেকে স্থূল পদার্থকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই প্রমাণ থেকে আপনি এমন বলতে পারেন যে এখানে তো রশ্মি দড়ির জন্য বলা হয়েছে, কারণ দড়ি দিয়ে ঘোড়া আদিকে নিয়ন্ত্রিত করা হয়। তাহলে এই বিষয়ে আমি এটাই বলবো যে শাস্ত্রের নির্বাচনের স্বরূপের বোধ আপনার নেই। বস্তুতঃ শাস্ত্রের নির্বাচন গণিতের সূত্রের মতো ব্যাপকতার সঙ্গে কাজ করে, প্রসঙ্গ থেকেই যার অর্থ জানা যেতে পারে। যদি আমরা প্রসঙ্গের ধ্যান না রাখি, তাহলে বেদের সব পদ রূঢ় হয়ে যাবে আর তখন সেগুলোর অনুবাদ হাস্যাস্পদই হবে, যৌগিক ব্যাখ্যা কখনও হবে না।
উত্তর - যেকোনো বিদ্যা যত সংক্ষেপে বলা হবে, সেটা ততটাই সাংকেতিক ও জটিল ভাষাতে হবে। যখন কোনো বিদ্যাকে অধিকাধিক সরল রূপ দেওয়া হয়, তখন তার গ্রন্থের আকার ততটাই অধিক বেড়ে যায়। সৃষ্টির জ্ঞান হল অনন্ত, তো সেই অনন্ত জ্ঞানকে সীমিত শব্দের মধ্যে আবদ্ধ করা খুবই দুষ্কর। এর পশ্চাৎ বেদের ব্যাখ্যান গ্রন্থ ব্রাহ্মণগ্রন্থ বা নিরুক্তাদি শাস্ত্র বেদসংহিতার তুলনায় সরল আর বিস্তৃত, কিন্তু সেগুলোও সেখানে বর্ণিত জ্ঞানের তুলনায় সংক্ষিপ্ত আর জটিল আছে। তার কারণ হল ঋষি ভগবন্ত কম শব্দের মধ্যে অধিকাধিক জ্ঞান দান করতেন, যাতে তাদের কণ্ঠস্থ করতে সহজ হয়। এই গ্রন্থ সেই সময়কার মানুষের জন্য তো কঠিন ছিল না, কিন্তু আর্ষ পরম্পরা সমাপ্ত হওয়ার হাজার-হাজার বছর পশ্চাৎ আজ সেই গ্রন্থ সবার জন্য দুরূহ হয়ে গেছে, তবে তার দুরূহতা বেদের ঋচার তুলনায় কম আছে। তখন কে জানতো যে ঋষি আর দেবতাদের এই ভূমি আর্যাবর্তে (ভারতবর্ষ) প্রজ্ঞার এমন পতন হবে যে সংস্কৃত ভাষার বড়-বড় বিদ্বান বেদ ও আর্ষ গ্রন্থের এমন ঘৃণিত ও মূর্খতাপূর্ণ ভাষ্য করবেন আর সেই ভাষ্যের আধারেই সারা বিশ্বের মধ্যে বৈদিক সত্য সনাতন ধর্ম এমন অধোগতি প্রাপ্ত করবে।
.
আমি এই গ্রন্থের ভাষ্য করে এর সেই স্থান দেওয়ার চেষ্টা করেছি, যা বাস্তবে হওয়া উচিত। আমি সেই মূল গ্রন্থকে যথাপরিস্থিতি আর যথাশক্তি সরল করার চেষ্টা করেছি, তাসত্ত্বেও সংসাধন আর সময়ের ন্যুনতার কারণে আমি এর আরও অধিক সরল রূপ দিতে অসফল হয়েছি। এরপরও আমি এটাই বলবো যে বেদ হল সম্পূর্ণ সত্য বিদ্যার গ্রন্থ অর্থাৎ তারমধ্যে সম্পূর্ণ নিত্য জ্ঞান অর্থাৎ বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত আছে, তা সেটা পদার্থ বিজ্ঞান হোক বা আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান। যখন গুরুকুল অথবা আধুনিক শিক্ষণ সংস্থানের মধ্যে বিজ্ঞান থেকে ইতর বিষয়ের বিদ্যার্থী ঈশ্বরের সৃষ্টির বিষয় সম্বন্ধে সাধারণ জ্ঞানটুকু রাখে না, তখন তারা এই বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ কিভাবে বুঝবে? য়ম-নিয়ম পালন যখন দুর্লভ হয়ে গেছে, তখন এই গ্রন্থ তাদের আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানের প্রকাশ কিভাবে দিতে পারবে? কোনো ইংরেজি ভাষার খুব ভালো বিদ্বান ইংরেজি ভাষাতে লেখা বিজ্ঞানের গ্রন্থকে বুঝতে পারবেন কি? তিনি তার ভাষা আর ব্যাকরণ জ্ঞানের আধারে কখনও বৈজ্ঞানিককে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে কি? কক্ষনো পারবেন না কারণ তার বিষয়টা আলাদা, সেইরূপ সংস্কৃত ভাষা, সাহিত্য আর ব্যাকরণের জ্ঞাতা প্রবল পবিত্র তর্ক আর ঊহা ছাড়া আর বৈজ্ঞানিক পৃষ্ঠভূমিকে ছাড়া বৈদিক বিজ্ঞানের মহান গ্রন্থকে কিভাবে বুঝতে সক্ষম হবেন?
.
এমন পরিস্থিতিতে বেদ কেন সমস্ত আর্ষ গ্রন্থও ভাষা আর ব্যাকরণের পণ্ডিতদের কাছে এতই দুরূহ হয়ে গেছে যে সেগুলোর ব্যাখ্যাতে লেখা গ্রন্থও তাদের কাছে দুরূহ মনে হচ্ছে। যদি নিজের অন্তরে বৈজ্ঞানিক ভাবনার বিকাশ করা যায় আর আধুনিক পদ্ধতি দিয়ে হলেও, যদি বর্তমান বিজ্ঞানেরও কিছু অধ্যয়ন করা যায় আর নিজের আত্মা ও অন্তঃকরণকে পবিত্র বানিয়ে ঈর্ষা আর অহংকারকে দূরে সরিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে সতত অভ্যাসে আমার গ্রন্থও ধীরে-ধীরে বোঝা যাবে। প্রণালীটা নতুন, তাই বুঝতে কঠিন মনে হওয়া স্বাভাবিক। বেদের মধ্যে গূঢ় বিদ্যা আছে, তাকে আমি কথাবাচকদের স্তর পর্যন্ত গিয়ে বোঝাতে পারবো না। আজ দেশের মধ্যে কথা আর প্রবচন খুব হচ্ছে, কোথাও ভাগবত কথা, শ্রীরাম কথা, বেদকথা, উপনিষদ কথা, কোথাও গীতার প্রবচন, কোথাও বেদের প্রবচন। এই সবের স্তরকে দেখলে তো কোনো ভাবেই এমন মনে হয় না যে আমাদের বেদাদি শাস্ত্র অপার বিজ্ঞানের ভাণ্ডার।
.
যদি আপনাকে এই কথাই সরল লাগে, কেবল দক্ষিণার উদ্দেশ্যে করা নানা প্রকারের কর্মকাণ্ড তথা কেবল স্বাস্থ্য আর ধনের লোভে য়োগের চাদর জড়িয়ে ব্যায়াম আর প্রাণায়ামই যদি সরল লাগে, এইভাবে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করেই সমাধি প্রাপ্ত হয়ে যাওয়ার মতো মিথ্যা কথাই মোক্ষ প্রাপ্তকারী মনে হয়, তাহলে তো আমার গ্রন্থ জানা কখনও সম্ভব হবে না আর না তাকে জানার জন্য বেদাদি শাস্ত্র আছে। যদি এইসব কাজ করেই দেশ আর ধর্মের উদ্ধার হতে পারে, তাহলে এই দেশ ও ধর্মের পতন কখনও হতো না, কারণ এইসব কাজে কখনও বিশেষ অবরোধ আসে নি। যদি অবরোধ এসে থাকে তো কেবল শাস্ত্রের বিজ্ঞানকে জানার প্রণালীতে আর যখন থেকে এতে অবরোধ এসেছে, তখন থেকে দেশ আর ধর্ম দুটোরই পতন হয়েছে। আমাদের সবাইকে মিলিত হয়ে এই পতনকে থামাতে হবে।
.
এখানে আমি এটাও বলবো যে এমন নয় যে আমার গ্রন্থকে কেউই বুঝতে পাচ্ছে না। অনেক পাঠক আর শ্রোতা বেদবিজ্ঞান-আলোক গ্রন্থের কিছু অংশ জেনেছে আর ভরপুর আনন্দও নিচ্ছে। এটা জেনেই আমার মানস সন্তান (প্রিয় বিশাল আর্য এবং ডাক্তার মধুলিকা আর্যা) উচ্চ শিক্ষা প্রাপ্ত করা সত্ত্বেও এখানে বিজ্ঞানের গভীরত্বকে জানার জন্য নিজের জীবন সমর্পণ করে বসেছে আর উজ্জ্বল ভৌতিক ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে ত্যাগ করে দিয়েছে। ভৌতিক বিজ্ঞানের অনেক বিদ্বান আছেন যারা আমার সঙ্গে মিলে কাজ করতে ইচ্ছুক, আবার কিছু বিদেশ থেকে এসে আমার সঙ্গে কাজ করতে চাইছে। অনেক উচ্চ শিক্ষিত যুবক তাদের জীবনকে পূর্ণ রূপে বদলে দিয়েছে। বিজ্ঞানের কত ব্যক্তি সংস্কৃত অধ্যয়ন শিখছে আর সংস্কৃতের কত ব্যক্তি বিজ্ঞান অধ্যয়ন করতে চাইছে, তাহলে কিভাবে বলবো যে আমার বিজ্ঞানকে কেউ বুঝতে পাচ্ছে না?
.
যেরূপ কোনো মুমুক্ষু ব্যক্তি মুক্তির কামনায় য়োগের তপ করেন কিন্তু কামনার সঙ্গে যোগ্যতা না থাকলে তাতে অসফল হন, তবে সেই ব্যক্তি কিছুটা হলেও আনন্দ প্রাপ্ত করেন অবশ্যই। সেইরূপ যারা বাস্তবে শাস্ত্রের বিজ্ঞানের আনন্দ নিতে ইচ্ছুক, তারা অবশ্যই "বৈদিক রশ্মিবিজ্ঞানম্"কে পড়বেন। এদের মধ্যে যারা বিশেষ মেধাবী হবেন, তারা বিশেষ আনন্দ প্রাপ্ত করতে পারবেন আর যাদের মধ্যে পর্যাপ্ত মেধা নেই, তারাও বিশ্বাস তো করতেই পারবেন যে আমাদের বেদাদি শাস্ত্র কত মহান বিজ্ঞানের অসাধারণ গ্রন্থ। আজ যদি জনসাধারণের মধ্যে এতটুকুও বিশ্বাস হয়ে যায়, তাহলেও রাষ্ট্র আর ধর্মের অনেক কল্যাণ হতে পারে।
.
প্রশ্ন - যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার সিদ্ধান্ত প্রয়োগ, পরীক্ষণ, প্রেক্ষণ, পরীক্ষণ ও গণিতের মধ্যে কোনো একটাতে পুষ্টি না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনার বৈদিক রশ্মি সিদ্ধান্তের উপর কিভাবে বিশ্বাস করবো?
উত্তর - আপনাকে কোনো সিদ্ধান্তের পুষ্টির জন্য প্রয়োগ, প্রেক্ষণ বা গণিতের আবশ্যকতা মনে হচ্ছে আর আপনি আপনার এইসব আদর্শ পাশ্চাত্য শিক্ষা পরম্পরা থেকে শিখেছেন। আমি এর গুরুত্বকে অস্বীকার করছি না, তবে পশ্চিমী বৈজ্ঞানিক স্বয়ং তাদের আবশ্যকতার বিষয়ে কি বলেছেন, সেটা আপনার জানার জন্য আমি এখানে উদ্ধৃত করছি -
প্রসিদ্ধ ব্রিটিশ ভৌতিকশাস্ত্রী স্টিফেন হকিংয়ের কথন হল - "Any physical theory is always provisional in the sense that it is only a hypothesis, you can never prove it. No matter how many times the result of experiments agree with some theory. You can never be sure that the next time a result will not contradict the theory, on the other hand you can disprove a theory by finding even a single observation that disagree with the predictions."
(A Briefer History of Time, Pg.14)
এর মানে হল যেকোনো ভৌতিক সিদ্ধান্ত অস্থায়ী হয়। বস্তুতঃ একটা পরিকল্পনাই হয়। আপনি সেটা সিদ্ধ করতে পারবেন না, যদিও আপনি সেটা কয়েকবার প্রয়োগ করে পরীক্ষণ করেছেন। আপনি এটা সুনিশ্চিত করতে পারবেন না যে পরবর্তী কোনো প্রয়োগে বিপরীত নিষ্কর্ষ প্রাপ্ত হবে না। আপনার যেকোনো একটা বিপরীত নিষ্কর্ষ আপনার অনেক ভবিষ্যবাণীকে অসিদ্ধ করতে পারে।
.
এই ধরণের বিচার বিশ্বপ্রসিদ্ধ ভৌতিকশাস্ত্রী স্যার আলবার্ট আইনস্টাইন ব্যক্ত করেছেন - "No amount of experimentation can ever prove me right, a single experiment can prove me wrong."
(Meeting the standards in primary science, Lymn D. Newton, Pg.21)
এই পুস্তকের লেখক পৃষ্ঠ সংখ্যা ২১ অস্ট্রিয়ার দার্শনিক কার্ল পোপারকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন - "...you can never prove or verify a theory, you can only ever disprove it. So investigations and experiments serve the purpose of testing the idea but not to prove it to be true."
এখানেও বর্তমান বিজ্ঞানের অসন্দিগ্ধতার উপর প্রশ্ন চিহ্ন লাগানো হয়েছে। স্টিফেন হকিংয়েরই মিত্র রোজোর পেনরোজেরও মত এটাই, তিনি লিখেছেন - "One might have thought that there is no real danger here because if the direction is wrong the experiment would disprove it, so that some new direction would be forced upon us. This is the traditional picture of how science progresses. But I fear that this is too stringent a criterion and definitely too idealistic a view of science in this modern world of 'Big Science'."
(The Road To Reality, Pg.1020)
এর মানে হল কোনো বৈজ্ঞানিক এমন ভাবতে পারেন যে বিজ্ঞানের মধ্যে কোনো ধরণের কোনো সংকট নেই অর্থাৎ তার সমস্ত নিষ্কর্ষ সত্যই হয়। তিনি মনে করতে পারেন যে যদি নিষ্কর্ষ ভুল হয়, তাহলে সেটা প্রয়োগ ও পরীক্ষণই অসিদ্ধ করে দিবে আর আরেকটা পৃথক নিষ্কর্ষযুক্ত দিশা প্রাপ্ত হয়ে যাবে। এর উপর লেখক লিখেছেন যে আধুনিক বিজ্ঞানের এমন বিচার খুবই কট্টর আর আদর্শবাদী হয়।
.
বিজ্ঞানের আবশ্যকতার বিষয়ে এই দুই বৈজ্ঞানিকের কথনের পশ্চাৎ এর গণিতীয় আধারের উপরেও প্রখ্যাত আমেরিকান বৈজ্ঞানিক রিচার্ড পি. ফাইনমেনের বিচারকে আমি উদ্ধৃত করছি - "But mathematical definitions can never work in the real world. A mathematical definition will be good for mathematics, in which all the logic can be followed out completely, but the physical world is complex." (Lectures on Physics, Pg.148)
অর্থাৎ গণিতীয় ব্যাখ্যা কখনও বাস্তবিক সংসারে কাজ করে না। এই ব্যাখ্যা গণিতের জন্য তো ঠিক আছে, সেখানে এই ব্যাখ্যা সম্পূর্ণরূপে তর্কের অনুসরণ করে, কিন্তু ভৌতিক সংসার হল খুবই জটিল। এই তিন বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে একমত হয়ে আরও একজন বৈজ্ঞানিক জেমস্ ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল বলেছেন - "The true logic of the world is in the calcululs of probabilities." (Lectures on Physics, Pg.64)
এর মানে হল সংসার হচ্ছে বাস্তবে সম্ভাবনার গণিত। ফাইনমেন খুবই স্পষ্ট শব্দে স্বীকার করেছেন যে - "We do not yet known all basic laws. There is an expanding frontier of ignorance."
(Lectures on Physics, Pg.1)
অর্থাৎ এখনও পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক বিজ্ঞানের মূল সিদ্ধান্তকে জানতে পারে নি। এখন বর্তমান বিজ্ঞানের একটা বিচিত্র লক্ষণ দেখুন। স্টিফেন হকিং তাঁর ওয়েবসাইটের একটা স্থানে লিখেছেন - "One can not ask whether the model represents reality, only whether it works. A model is a good model if first it interprets a wide range of observation, in terms of a simple and elegant model. And second, if the model makes definite predictions that can be tested and possibly falsified by observation."
এখানে হকিংয় স্বয়ং বর্তমান বিজ্ঞানের অপূর্ণতা কিংবা অনেকত্র মিথ্যাকে না কেবল স্বীকার করছেন, অপিতু প্রেক্ষণ দ্বারা মিথ্যা সিদ্ধ হওয়াকে বিজ্ঞানের একটা লক্ষণ বা বিশেষত্বও ঘোষণা করছেন। এমন মিথ্যা সিদ্ধ হওয়া বিজ্ঞান কিভাবে কোনো সত্যপিপাসু বা সত্যব্রতীর জন্য প্রমাণ হতে পারে? আমার মতো বৈদিক বৈজ্ঞানিককে এমন বিজ্ঞানের কাছ থেকে সত্যতার প্রমাণপত্র নেওয়ার আবশ্যকতা হবে কি?
.
এতকিছুর পরেও আমি বলবো যে আমাদের বৈদিক রশ্মি সিদ্ধান্ত সেই সূক্ষ্ম তত্ত্বের কথা বলে, যাকে বর্তমানের কোনো টেকনোলজি দিয়ে গ্রহণ করতে পারা একদমই সম্ভব নয়। বর্তমান টেকনোলজি ফোটোন ও ইলেক্ট্রনের দ্বারাই কোনো কণার অনুভব করতে পারে, এই কারণে স্বয়ং এই দুই কণাকে জানার কোনো বিধিও বর্তমান ভৌতিকীর কাছে নেই। অথচ আমি এই কণার থেকেও সাত চরণ পূর্বের যে প্রকৃতির (যা সর্বদা অব্যাক্ত) কথা বলেছি তার কথা তো ছেড়ে দিন, এমনকি মনস্তত্ত্ব, প্রাণ, আকাশতত্ত্ব এবং ছন্দ রশ্মিকেও এরদ্বারা গ্রহণ করা সর্বথা অসম্ভব। এর সাথে কিছু প্রয়োগ হতে পারে, তবে তারজন্য অত্যুচ্চস্তরীয় প্রয়োগশালার দরকার হবে। কণার স্তরের অনুসন্ধানের জন্য যখন সর্নের (সি.ই.আই.এন.) মতো বিশ্বের সবথেকে বড় পরীক্ষাগারের আবশ্যকতা হতে পারে, তাহলে এরথেকে সূক্ষ্ম স্তরের জন্য পরীক্ষা কোথায় আর কিভাবে সম্ভব হবে? তবুও উচ্চস্তরীয় প্রয়োগশালার মধ্যে কিছু স্থূল প্রয়োগ হতে পারে, কিন্তু সংসাধন ছাড়া এটা এখন সম্ভব নয়। সংসাধনের উপলব্ধতার আধারে পরবর্তী কালে পরীক্ষা করা সম্ভব হবে।
.
এখন আসছি একথার উপর যে কিভাবে বিশ্বাস করবেন? এই বিষয়ে আমি বলবো যে যদি এমন কোনো ব্যক্তি যিনি গণিতের খুব কম জ্ঞান রাখেন আর তাকে ত্রিকোণমিতির সূত্র পড়ানো হয়, তাহলে তিনি এটাই ভাববেন যে এইসব সূত্র দিয়ে কি হবে? এই সূত্রের সত্যতা কি আছে? কিন্তু যখন সেই সূত্রের মাধ্যমে আমরা কোনো উড়ন্ত বিমান, বৃক্ষ বা পর্বত শিখরের উচ্চতা বলবো, তখন সেই ব্যক্তি ত্রিকোণমিতি সূত্রের সত্যতার উপর বিশ্বাস করবেন। ঠিক সেইরূপ বীজগণিত, নির্দেশাংক জ্যামিতি আদির বিষয়েও ধরে নিবেন।
এইভাবেই বর্তমান ভৌতিকীর এমন কিছু জটিল সমস্যা, যেগুলোর সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না আর সমাধান করার প্রচেষ্টাতে কয়েক আরব ডলার ব্যয় হয়ে যাচ্ছে, তবুও সংসারের বৈজ্ঞানিক অসফল হচ্ছেন। যদি আমি আমার বৈদিক রশ্মি সিদ্ধান্ত দিয়ে এমন অসফল হওয়া সমস্যার সমাধান রূপে কোনো মডেল প্রস্তুত করি আর সেই মডেল ওই সমস্যাকে চরণবদ্ধ এবং তার্কিক পদ্ধতিতে সমাধান করে, তখন তো বিশ্বাস হবে। এইভাবে বর্তমান ভৌতিকীর কিছু স্থাপিত সিদ্ধান্ত, যেগুলো সত্য হওয়া সত্ত্বেও তর্কসঙ্গত পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করতে পাচ্ছে না, তার ব্যাখ্যা যদি আমি তর্কসঙ্গত পদ্ধতিতে করি, তবেই বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের বিশ্বাস হয়ে যাবে। তবে হ্যাঁ, হঠধর্মী আর অজ্ঞানীর অবশ্যই বিশ্বাস হবে না আর এমন ব্যক্তির বিশ্বাসের কোনো গুরুত্বও হয় না।
.
প্রশ্ন - যদি বৈদিক বিজ্ঞানের উপর আপনার এতই বিশ্বাস থাকে, তাহলে আপনি বিজ্ঞানের রাষ্ট্রীয় ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় পত্রিকাগুলোতে প্রকাশনার্থ শোধ লিখন কেন লেখেন না? যদি কিছু শোধ পত্র উচ্চস্তরীয় পত্রিকার মধ্যে প্রকাশিত হয়ে যায়, তাহলে আপনার বিজ্ঞান শিক্ষিত জগতে মান্য হয়ে যাবে।
উত্তর - শোধপত্র লেখার হঠ করা হল পশ্চিমী দেশের দাসত্বের পরিচায়ক। আমাদের ভারতীয় বা বৈদিক পরম্পরা কখনও এমন ছিল না। শোধপত্রও লিখতে হবে আর সেটা তাদের মানদণ্ডের অনুসারেই লিখতে হবে, আমার এমন দাসত্ব করার কোনো আবশ্যকতা নেই। আমাদের পরম্পরা শাস্ত্রার্থ-সংবাদ করার ছিল, তার জন্য আমি সদা প্রস্তুত আছি, কিন্তু সেই ব্যক্তির সঙ্গে যার বিষয় বৈদিক বিজ্ঞান অথবা বর্তমান বিজ্ঞান হবে। আমাদের আরেকটা পরম্পরা হল - গ্রন্থ লেখার, সেগুলো আমি লিখে দিয়েছি। "বেদবিজ্ঞান-আলোকঃ", "বেদার্থবিজ্ঞানম্" আর এই গ্রন্থটা আপনাদের সকলের সম্মুখে আছে। আমি ৫-১০ পৃষ্ঠার শোধপত্র লেখিনি, বরং কয়েকশ ও হাজার-হাজার পৃষ্ঠার বিশাল গ্রন্থ লিখে দিয়েছি। যাদের মাথায় আসবে তারা পড়ার চেষ্টা করবেন। এই গ্রন্থের এক-একটা পৃষ্ঠাই তো শোধপত্র, এটা আপনি পড়তে পারেন।
.
আমি শোধপত্রের প্রকাশিত হওয়ার কথাকে ভালো করে জানি। পশ্চিমী শৈলী অনুসারে লিখতে হবে, তারাই সেগুলোর পরীক্ষা করবে আর কোনো কারণ না জানিয়ে সেগুলোকে নিরস্ত করারও অধিকারী হবে সেই পশ্চিমী শৈলীর মহানুভাবই। এটা তো সরাসরি আত্মসমর্পণ হল। সেই আধুনিক বৈজ্ঞানিকদেরও এমন লেখা, যেটা কোনো প্রচলিত মান্যতার বিরুদ্ধে লেখা হয়েছে, এমন প্রকাশনেও অনেক বাধা আসে, তাহলে সেই ব্যক্তির শোধপত্র, যা বর্তমান বিজ্ঞানের ভিত্তিকেই কাঁপাবে তথা প্রাচীন ভারতীয় বা বৈদিক পরম্পরার আধারে লেখা হয়েছে, তাকে কে প্রকাশিত করবে? আছে এমন কোনো বর্তমান বৈজ্ঞানিক যিনি আমাদের সম্পূর্ণ বৈদিক বিজ্ঞান- পরম্পরার মূল্যাঙ্কন করার অধিকারী হবেন, যিনি বিজ্ঞানের বর্ণমালা পর্যন্ত তারা জানেন না? একথাকে কোনো বৌদ্ধিক দাস বা মূর্খই স্বীকার করতে পারবে। বর্তমান পাশ্চাত্য পরম্পরাতে নিষ্ঠাবান শোধকর্তাদেরও কত কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হচ্ছে, তার একটা জ্বলন্ত উদাহরণ আমি এখানে প্রস্তুত করছি, সেটা নিচে চিত্রের মধ্যে দেওয়া হলো
বিদ্যা
সংসারের সকল প্রাণীর মধ্যে মানুষ হল সবথেকে বুদ্ধিমান প্রাণী। অন্য সব প্রাণী যদিও একদমই বুদ্ধিহীন হয় না, তবে তাদের মধ্যে বৌদ্ধিক ক্ষমতার বিকাশ অনেক চেষ্টা করার পরেও অনেক কমই হতে পারে। এটাও এক সত্য যে মানুষ বাদে সকল প্রাণী স্বয়মেব নিজের বৌদ্ধিক বিকাশ করতে প্রায়শঃ সক্ষম হয় না। অন্য কারও দ্বারা তাদের বৌদ্ধিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও তারা খুব অধিক বিকশিত হতে পারে না। হাতি, ঘোড়া, কুকুর, বাঁদর আদি বিভিন্ন প্রজাতির কিছু প্রাণীকে প্রশিক্ষণ দিলে কিছু বৌদ্ধিক বিকাশ হবে অবশ্য, তবে এদের মধ্যে কোনো প্রাণী মানুষের সমান বুদ্ধির বিকাশ করতে পারে না। এই কারণে সারা সংসারের বিভিন্ন বিদ্যার বিস্তার আর সেগুলোর ব্যবহার মানব জাতির দ্বারাই হয় এবং হচ্ছে।
.
বিদ্যার পরিভাষা
বিদ্যাই হল এক এমন গুণ, যা এই মানব জাতিকে অন্য সকল জীবধারিদের থেকে আলাদা এক বিশিষ্ট পরিচয় প্রদান করে। বিদ্যাই হল সেই গুণ, যা সংসারের সমস্ত জড় আর চেতন পদার্থের যথার্থ স্বরূপ বিদিত করায়। একথাও বিশেষ ভাবে বুঝতে হবে যে কোনো মানুষই সৃষ্টির বিভিন্ন পদার্থের যথার্থ স্বরূপ আর সেগুলোর পরস্পর বাস্তবিক সম্বন্ধকে ঠিক-ঠিক না জেনে সেগুলো থেকে যথাযোগ্য উপকার নিতে পারবে না। এইজন্য ঋষি দয়ানন্দ সরস্বতী লিখেছেন - "যার দ্বারা পদার্থের স্বরূপ যথাযথ জেনে তার থেকে উপকার নিয়ে নিজের আর অন্যের জন্য সব সুখকে সিদ্ধ করা যেতে পারে, তাকে বিদ্যা বলে।" (ব্যবহারভানু)
.
বিদ্যা ছাড়া মানবের পরস্পর ন্যায়যুক্ত ব্যবহার হওয়াও সম্ভব নয়, এই কারণে ঋষি দয়ানন্দ লিখেছেন - "যার দ্বারা পদার্থ যথাযথ জেনে ন্যায়যুক্ত কর্ম করা হবে, তাকে বিদ্যা বলে।" (ব্যবহারভানু)
.
ঋষি দয়ানন্দের দৃষ্টিতে বিদ্যার ক্ষেত্র খুবই ব্যাপক, যারমধ্যে বর্তমান জগতে পড়ানো হয় এমন অনেক বিদ্যা যথা - ভৌতিক বিজ্ঞান এবং এর শাখা, যেমন - খগোল ভৌতিকী, খগোল বিজ্ঞান, পরমাণু ভৌতিকী, নাভিকীয় ভৌতিকী, কণা ভৌতিকী, ভূ-ভৌতিকী, সূর্য বিজ্ঞান, জৈব ভৌতিকী আদি। রসায়ন বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা, যেমন - কার্বনিক রসায়ন, অকার্বনিক রসায়ন, ভৌতিক রসায়ন, জৈব রসায়ন আদি, প্রাণী বিজ্ঞান, বনস্পতি বিজ্ঞান, টেকনোলজির বিভিন্ন ক্ষেত্র, অত্যন্ত বিকশিত চিকিৎসা বিজ্ঞান, শরীর রচনা এবং ক্রিয়া বিজ্ঞান, পশু-পক্ষী বিজ্ঞান, পরিবেশ এবং আবহাওয়া বিজ্ঞান, ভূগোল, অর্থশাস্ত্র, রাজনীতি এবং সমাজশাস্ত্র, ভাষা-বিজ্ঞান, সূচনা টেকনিক, উদ্যোগ-ব্যাপার প্রবন্ধ, যুদ্ধ বিজ্ঞান, সমুদ্র বিজ্ঞান, সঙ্গীত আদি বিভিন্ন উপযোগী কলা মহর্ষির বিদ্যার অন্তর্গত হয়। একথাও মনে রাখতে হবে, এই সব বিদ্যা কেবল জড় পদার্থের সঙ্গেই বিশেষ সম্বন্ধ রাখে, অথচ আমরা জানি যে এই সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড কেবল জড় পদার্থেরই সংঘাত অর্থাৎ জড়মাত্র নয় আর না এই সমস্ত জড় পদার্থ স্বয়ংয়ের জন্য হয়। না তো এই ব্রহ্মাণ্ডের নির্মাতা জড় হতে পারে আর না এর উপভোক্তা জড় হতে পারে। তাছাড়া এই বিষয় নিয়ে বিস্তার ভাবে আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে জানবো।
.
ঋষি দয়ানন্দের দৃষ্টিতে উপরোক্ত যত বিদ্যা বর্তমানে প্রচলিত আছে, সেগুলো হল বিদ্যার কেবল অর্ধেক ভাগ, অথচ বিদ্যার আরেকটা ভাগ, যার সম্বন্ধ চেতন পদার্থের সঙ্গে সম্বন্ধিত, তারসঙ্গে যেটা ভৌতিক জগতের সূক্ষ্মতম বিজ্ঞান (কণা ভৌতিকী, তরঙ্গ ভৌতিকী, কোয়ান্টাম ফিল্ড থিয়োরি এবং স্ট্রিং থিয়োরি) থেকেও সূক্ষ্ম এবং বিশালতম সৃষ্টি বিজ্ঞান থেকেও ব্যাপক হয়, এই দুটো মিলিত হয়ে বিদ্যার স্বরূপ পূর্ণ হয়। এইজন্য ঋষি বিদ্যার পরিভাষা সম্বন্ধে লিখেছেন - "যার দ্বারা ঈশ্বর থেকে শুরু করে পৃথিবী পর্যন্ত পদার্থের সত্য বিজ্ঞান হয়ে সেগুলো থেকে যথাযোগ্য উপকার নেওয়া যায়, তার নাম হল বিদ্যা।" (আর্য়োদ্দেশ্যরত্নমালা)
বিদ্যা বনাম অবিদ্যা
এই সব বিদ্যার কেবল শব্দ অর্থাৎ সৈদ্ধান্তিক জ্ঞানমাত্রকে মহর্ষি বিদ্যা মানতেন না, বরং এগুলোর উচিত ব্যবহার দ্বারা প্রাণীমাত্রের হিত সিদ্ধ হওয়ার পরেই তাকে বিদ্যার শ্রেণীতে রাখতেন। এরদ্বারা সিদ্ধ হল যে সর্বপ্রথম সমস্ত জগতের শাব্দিক এবং সৈদ্ধান্তিক জ্ঞান হবে, তারপর সেই জ্ঞানের সত্যতা পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রয়োগ, পরীক্ষা এবং প্রেক্ষণ হবে। তারপর সত্য সিদ্ধ হওয়া সেই জ্ঞান-বিজ্ঞান সর্বহিতের জন্য অনুকূল কিনা, এর সঠিকভাবে পরীক্ষা হবে, তখন সেই জ্ঞান-বিজ্ঞানকে সংসারের বিদ্যার শ্রেণীতে প্রতিষ্ঠিত করা হবে। তবেই সেই বিদ্যা সকল জগতের জন্য সুখ আর শান্তিদায়ক হতে পারবে। দুর্ভাগ্যবশতঃ বর্তমান সংসার এই যথার্থ বিদ্যা থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। আজকের প্রচলিত বিদ্যা স্বয়ং পরস্পর বিরোধী হয়ে সংসারে দুঃখ আর অশান্তি উৎপন্ন করছে। একে আমরা এই ভাবে বলতে পারি -
.
সরকারের বিভিন্ন দেশ আর সমাজের মধ্যে আহার-বিহারের বিভিন্ন শ্রেণী এবং সেগুলোকে উৎপন্ন করার জন্য বিভিন্ন প্রকারের জ্ঞান আর টেকনিকের বিকাশ হচ্ছে। সেই খাদ্য পদার্থের গুণবত্তা এবং সরসতার বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণ করা হচ্ছে। সেগুলোর প্রসংস্করণ এবং সংরক্ষণের জন্য নানা প্রকারের টেকনিকের অনুসন্ধান হচ্ছে। এতকিছু হওয়ার পরেও খাদ্য পদার্থ মানব আদির শরীর, মস্তিষ্ক এবং মনের মধ্যে প্রতিকূল প্রভাব উৎপন্ন করছে। যে খাদ্যকে কোনো এক রোগ বিশেষের দৃষ্টিতে উপযোগী ঘোষণা করা হয়, তো সেই খাদ্য পদার্থই কিছু দিনের অনুসন্ধানের পশ্চাৎ অন্য কোনো রোগকে উৎপন্নকারী সিদ্ধ হয়ে যায়। এইভাবে আগে কোনো পদার্থকে কোনো বিশেষ রোগ বা অঙ্গের দৃষ্টিতে উপযোগী সিদ্ধ করতে যেমন সময়, ধন এবং টেকনিকের ব্যয় করা হচ্ছে, তারপর কিছু বছর পর তেমনই ব্যয় তার দুষ্পরিণামকে খোঁজার জন্য করা হচ্ছে আর পরিণাম শূন্য প্রাপ্ত হচ্ছে।
.
আমরা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে উল্ল্যেখযোগ্য প্রগতি করেছি, মানুষের গড় আয়ুতে বৃদ্ধিও হয়েছে, অনেক মহামারীর উপর বিজয় প্রাপ্ত করেছি, কিন্তু এটাও দুর্ভাগ্যপূর্ণ সত্য যে পুঁজিপতিদের ক্রীতদাস হওয়া বৈজ্ঞানিক ও অদূরদর্শী শোধগুলো বিভিন্ন মহামারীকে জন্মও দিয়েছে আর এমন আশঙ্কা প্রবল যে ভবিষ্যতে অধিকাধিক রোগকে জন্ম দেওয়া হবে। জেনেশুনে নপুংসকতা ও বন্ধ্যাত্বের রোগ উৎপন্ন করা হচ্ছে। এছাড়া মানব শারীরিক আর মানসিক বল, প্রসন্নতা, স্মৃতি, মেধা, শান্তি এবং পূর্ণ আরোগ্যতা প্রাপ্ত করেছে কি? সারা সংসারে হতে চলা মাছ-মাংস-ডিমের আহার, মদিরা আদি অভক্ষ্য পানীয়ের ব্যবহার এবং বিষয়-লম্পটতা আদি দোষের কারণে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক, সামাজিক স্তর তথা পরিবেশ তন্ত্র ক্ষত-বিক্ষত হয়নি কি? বিভিন্ন কৃষি টেকনিক খাদ্যান্নতে বৃদ্ধি তো করা হয়েছে, কিন্তু এতে সেই খাদ্যের গুণবত্তার ক্ষরণ হয়নি কি?
.
এই গুণবত্তার বৃদ্ধি আদির জন্য উচ্চ জৈব টেকনিকের বিভিন্ন আবিষ্কার কি অনেক প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে সমস্যা উৎপন্ন করছে না? বিলাসিতা আদির সংসাধনের উপর হওয়া আবিষ্কার এবং তথাকথিত বিকাশের নামে হওয়া শিল্পায়ন থেকে কুপিত হওয়া পরিবেশ কি বন্যা, খড়া, জল সংকট, ভূমিকম্প, সুনামী, অতি হিমপাত, ওলাবৃষ্টি, অতি উষ্ণতা এবং ভীষণ দাবানলের সমস্যা উৎপন্ন করছে না? মনোরঞ্জনের নামে হওয়া বিবিধ আবিষ্কার এই মানব সমাজের মধ্যে হিংসা, কামুকতা, অশান্তি, অকর্মণ্যতা আদি দোষ উৎপন্ন করে নৈতিকতা, সদাচার, অহিংসা এবং শান্তির মতো সৎ গুণকে কি নষ্ট-ভ্রষ্ট করছে না? বাড়তে থাকা সূচনা টেকনিক অনেক সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি অনেক মনোরোগ, অপরাধ, আতংবাদ এবং বিকিরণ প্রদূষণের মতো গম্ভীর সমস্যাকে কি উৎপন্ন করেনি? সূচনা টেকনিকের নেশায় পাগল হাইটেক মানব বিকিরণ প্রদূষণকে গম্ভীরভাবে নিচ্ছে না। আমি মনে করি এই প্রদূষণ সমস্ত ভৌতিক প্রদূষণের থেকে ভয়ানক তথা দীর্ঘকাল পর্যন্ত হানি করে প্রাণীমাত্রের একদিন ভারী সন্ত্রাস করবে। এর থেকেও ভয়ংকর বৈচারিক প্রদূষণ সর্বত্র গভীর দুঃখের সামগ্রী একত্রিত করছে। হিংসা, ক্রূরতা, কামুকতা, ঈর্ষা, শোক, দ্বেষ আদি থেকে উৎপন্ন সূক্ষ্ম তরঙ্গ সম্পূর্ণ প্রাণী জগতের জন্য একদিন অত্যন্ত ঘাতক সিদ্ধ হবে।
.
আজকের পদার্থ বিজ্ঞান যতই প্রগতি করছে, ততই তার টেকনিকের দুষ্প্রভাব অনুভবে আসছে। সেটা সুবিধার মৃগতৃষ্ণাতে অনেক দুবিধাকে আমন্ত্রিত করছে। দুবিধার বোধ তার তখন হয়, যখন সেটা বিলাসী মানুষকে সুবিধার আসক্ত ও অভ্যস্ত বানিয়ে দেয়। এমন পরিস্থিতিতে বিষয়ভোগী মানব দুবিধা ভোগার জন্য বাধ্য হয়, কারণ সে সুবিধার আসক্তি বা মোহ থেকে স্বয়ংকে মুক্ত করতে পারে না। বর্তমান বিজ্ঞান আসলে সেই চঞ্চল বালকের সমান, যে বালক নিজের কোনো কাজ অল্পজ্ঞানের আধারে কৌতূহলবশতঃ কিংবা কোনো লোভ বা আসক্তিবশতঃ শুরু তো করে দেয়, কিন্তু যখন তার কিছু জ্ঞান হয় যে তার কাজের পরিণাম তো তার জন্য হানিকারক হবে, তখন সেই বালক চাইলেও সেই কাজকে ছাড়তে পারে না। এইরূপ বর্তমান বিজ্ঞানও নিজের অপূর্ণ জ্ঞান এবং সুখ-সুবিধার অসীমিত আসক্তিবশতঃ নিরন্তর নিজেরই বিনাশের জাল বুনে চলেছে।
.
আমি সংসারের সকল আধুনিক বিজ্ঞানবাদীকে সাবধান করে দিচ্ছি যে তারা তাদের দিশা পরিবর্তন করুক, অন্যথা পশ্চাতাপ ছাড়া হাতে কিছুই আসবে না। আজ আমার একথা বিজ্ঞান বুঝবে না, কিন্তু আমি নিশ্চিত যে ভবিষ্যতে অবশ্যই আমার এই সাবধান বাণী এই বিজ্ঞানও বুঝবে। সম্পূর্ণ সংসারকে নিজের হাতের মুঠোয় রাখার চেষ্টা করতে ইচ্ছুক মানব নিজের পরিবার এবং স্বয়ং নিজের আত্মা থেকেও দূর হয়ে যায়নি কি? সংসার কি কখনও এটা বিচার করবে যে এমন কেন হচ্ছে? এত কিছু হওয়ার পরেও আমার এইসব লেখার প্রয়োজন এই নয় যে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের উপরোক্ত বিভিন্ন আবিষ্কার বন্ধ করে দেওয়া হোক। এইভাবে সংসারের আর্থিক আর রাজ ব্যবস্থার কারণে যে অশান্তি, দরিদ্রতা, শোষণ, বর্গ-সংঘর্ষ আদি সমস্যা উৎপন্ন হচ্ছে, তার কারণ হলেও আমি এইসব ব্যবস্থাকেই উপড়ে ছুঁড়ে ফেলার আহ্বান করবো না।
.
আমি জার্মান বিদ্বান এডোল্ফ জাস্টের শব্দে বিজ্ঞানকে বেদম এবং হানিকারক বলে পশু-পাখিকে নিজের গুরু বানিয়ে ঘাস-পাতা বা ভূমিতে শোয়ার কথা বলবো না আর না ফ্রান্সিসি সুধারক রুসোর মতো রাজ-ব্যবস্থাকে সব দুঃখের মূল বলবো, কিন্তু আমি এটুকু অবশ্যই বলবো যে বর্তমান জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরম্পরাতে একটা খুব বড় ভুল হচ্ছে। বর্তমান জগৎ চেতন তত্ত্বের নিতান্ত উপেক্ষা করে অথবা তাকে পুরোপুরি অস্বীকার করে উপভোক্তাবাদী, অপূর্ণ এবং বিকৃত সভ্যতার বিস্তার করছে। বিদ্যার বিভিন্ন শাখাতে কোনো সমন্বয় আর নিয়মন দেখা যাচ্ছে না। জগতে বেঁচে থাকার প্রয়োজন কেন তা নিয়ে কারও মাথায় কিছুই আসছে না। এর মুখ্য কারণ হল একটাই আর সেটা হল আমাদের সম্পূর্ণ জ্ঞান-বিজ্ঞান চেতন তত্ত্বের বিজ্ঞানকে ছাড়া নিতান্ত অপূর্ণ। একই সঙ্গে আমার এটাও দৃঢ় বিশ্বাস যে বর্তমান বিকশিত বিজ্ঞানেরও সৃষ্টির সব জড় পদার্থের পূর্ণ আর নির্ভ্রান্ত জ্ঞান নেই।
.
এখনও সৈদ্ধান্তিক ভৌতিকীকে (থিওরেটিকাল ফিজিক্স) গম্ভীর ও সূক্ষ্মভাবে জানার হেতু যথার্থ প্রচেষ্টা করা হচ্ছে না। মূলকণার উপর অনুসন্ধানের যাত্রা সমাপ্ত হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। য়োগসাধনাজন্য অন্তর্দৃষ্টির না কেবল সর্বথা অভাব আছে, বরং তার উপর কিঞ্চিৎমাত্র বিশ্বাসও নেই। আহার-বিহার, আচার-বিচারের সাত্ত্বিকতার অভাবে সূক্ষ্মগ্রাহী বুদ্ধির উজ্জ্বল প্রকাশ বৈজ্ঞানিকদের কাছে একটুকুও নেই। তারা প্রত্যেক কথায় প্রয়োগ ও প্রেক্ষণ কিংবা গণিতীয় ব্যাখ্যার আধারেই জানতে চায়। বৈজ্ঞানিক প্রয়োগ ও প্রেক্ষণ টেকনিকের সীমার বাইরে অসহায় হয়ে যায়। বিশ্বের মধ্যে একটা বড় সংখ্যার বৈজ্ঞানিক মাছ, মাংস, ডিম, মদ, ধূমপান আদি অভক্ষ্য ও ভ্রষ্ট পদার্থের সেবন করে, এতে তাদের বুদ্ধি কিভাবে সাত্ত্বিক হতে পারে? বুদ্ধিই যদি সাত্ত্বিক না হয়, তাহলে তারা জড় ও চেতনের মতো সূক্ষ্ম পদার্থের গম্ভীর ও বিস্তৃত বিবেচনা কিভাবে করতে পারবে? এই কারণে তাদের বিজ্ঞান শুধু চেতন তত্ত্ব কেন, জড় পদার্থ যেমন - মন, প্রাণ, ছন্দ আদি সূক্ষ্ম তত্ত্ব, যেগুলো মূল কণা, ঊর্জা আদিরও মূল কারণ, তার বিষয়ে এতটুকুও বিচার করতে পাচ্ছে না, পরিণামস্বরূপ তাদের সৃষ্টি বিজ্ঞান অপূর্ণ আছে। ঈশ্বর ও জীবাত্মার অস্তিত্বের তো তাদের বিশ্বাসই নেই।
.
এটা স্বাভাবিক কথা যে যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা কোনো পদার্থের যথার্থ বিজ্ঞান প্রাপ্ত করতে পারবো না, ততক্ষণ পর্যন্ত সেই পদার্থের উচিত ব্যবহার কিভাবে করতে পারবো? এইভাবে এটাও সত্য যে যতক্ষণ পর্যন্ত উপভোক্তা মানব স্বয়ং নিজের চেতন স্বরূপের যথার্থ বোধ করবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত উপভোগ্য বস্তুর ভোগ তথা জীবন যাপনের প্রয়োজন কিভাবে বুঝবে? সেইরূপ সৃষ্টি বিজ্ঞানকে জানার সময় যতক্ষণ পর্যন্ত মূল নিমিত্ত তত্ত্ব, যা হল সৃষ্টির স্রষ্টা ও নিয়ামক, সেই চেতন পরমাত্মাতত্ত্বের অস্তিত্বের আবশ্যকতা এবং তাঁর যথার্থ স্বরূপের উপর বিচার করা হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত জগৎ রচনার প্রয়োজন এবং বিভিন্ন জীবধারীর পরস্পর সম্বন্ধ এবং উচিত ব্যবহারের যথার্থ বোধ কিভাবে হতে পারে?
.
প্রশ্ন - ঈশ্বর আর জীবাত্মার মতো রূঢ়িবাদী নষ্টপ্রায় মান্যতার সাথে কোনো যথার্থ জ্ঞান-বিজ্ঞান পরম্পরার কি এমন সম্বন্ধ হতে পারে? আপনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা বলছেন অথচ এই একুশ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক যুগে রূঢ়িবাদী অন্ধ পরম্পরাকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের মিথ্যা চাদর জড়িয়ে এই দেশ আর সংসারকে সেই আদিম আর পাষাণ যুগে নিয়ে যেতে চাইছেন। আপনি কি জানেন না যে এই ভারত আর বিশ্বের মধ্যে ঈশ্বর, জীব এবং ধর্ম আদি অন্ধ পরম্পরার নামে কত রক্ত বয়েছে, মানুষ-মানুষের মধ্যে প্রাচীর দাঁড় করানো হয়েছে, বিকাশের পথে অবরোধ করা হয়েছে? বিদ্যার বাস্তবিক আর সমগ্র দৃষ্টি কি এটাই?
.
উত্তর - আপনার এই প্রশ্ন অত্যন্ত স্বাভাবিক আর সাময়িক। এই ধরণের প্রশ্নের জন্য আমি আপনার মতো মহানুভাবকে দোষী মনে করি না, বরং আমি সেই মহানুভাবদের দোষী মনে করি, যারা ঈশ্বর, ধর্ম, পুনর্জন্ম আর জীবাত্মার মতো বিষয় নিয়ে ব্যাখ্যা-লেখন তো খুব করেন, উপাসনা, ভক্তি, পূজা আদি ভিন্ন-ভিন্ন বিধি প্রচলিত করেন, কিন্তু সেই মহানুভাব না কেবল সৃষ্টি বিদ্যার বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞান আদি শাখাকে পূর্ণতঃ ভুলে গেছেন, অপিতু যে ধর্ম, ঈশ্বর, জীব আদির কথা বলেন এবং এতদ্ বিষয়ক অনেক গ্রন্থ লিখেছেন ও পড়েছেন, সেগুলোর যথার্থ স্বরূপ থেকেও অতি দূরে চলে গেছেন। এটা স্মরণীয় তথ্য যে বিদ্যা মানুষ মাত্রের প্রত্যেক সমস্যার সমাধান হয়, যেকোনো রোগের ওষুধ আছে, কিন্তু যেরূপ অপূর্ণ অথবা বিপরীত ওষুধ রোগীর প্রাণ নিতে পারে, সেইরূপ অপূর্ণ বিদ্যা অথবা বিপরীত জ্ঞান সংসারের মধ্যে সমস্যাই উৎপন্ন করে। সুতরাং যেরূপ একাকী বর্তমান বিজ্ঞান বিশ্বের মধ্যে উপরোক্ত বর্ণিত সমস্যাকে উৎপন্ন করেছে, সেইরূপ কিছু হাজার বছর পূর্ব থেকে ভারত এবং বাকি বিশ্বের মধ্যে ধর্ম, ঈশ্বর, জীবাত্মা এবং পুনর্জন্মের মতো গম্ভীর বিষয় নিয়ে যথার্থ সঠিক জ্ঞানের স্থানে কল্পনা আর অন্ধবিশ্বাস এই মানব জাতিকে অনেকবিধ দুঃখসাগরে ডুবানোর কাজ করেছে।
.
বর্তমানে প্রচলিত ভাষাতে জড় পদার্থের জ্ঞানকে বিজ্ঞান (সাইন্স) এবং চেতন তত্ত্বের বিজ্ঞানকে ধর্ম বলা হয়। বস্তুতঃ এই দুটো একে-অপরের পূরক। এই জন্য দয়ানন্দের বিদ্যার পরিভাষাতে এই দুটোরই সুন্দর সমাবেশ আছে। মহান আধুনিক বৈজ্ঞানিক আলবার্ট আইনস্টাইনও বলেছেন -
"Science without religion is lame, religion without Science is blind."
অর্থাৎ ধর্ম হীন বিজ্ঞান পঙ্গু হয় আর বিজ্ঞান হীন ধর্ম অন্ধ হয়।
"I am of the opinion that all the finer speculations in the realm of science spring from a deep religious feeling."
(মদ্রচিত "সৃষ্টির মূল উপাদান কারণ" পুস্তকের প্রস্তাবনাতে প্রফেসর আভাস কুমার মিত্রা দ্বারা উদ্ধৃত বচন।)
.
অর্থাৎ আমার মতে বিজ্ঞানের সমাজ্যের সুন্দর বিচার গম্ভীর আধ্যাত্মিক ভাবনার সঙ্গে যুক্ত থাকে অথবা সেগুলো থেকেই উৎপন্ন হয়।
.
এখানে একথা মনে রাখতে হবে যে ইংরেজি ভাষার "রিলিজিয়ন" শব্দ "ধর্ম" শব্দের সমান নয়। এই শব্দ সম্প্রদায়কেই ব্যক্ত করে। "ধর্ম" শব্দের সমানার্থক ইংরাজি ভাষাতে কোনো শব্দ নেই। এই জন্য একে ধর্মই বলা উচিত, সেটা যে ভাষাতেই হোক বা কেন।
.
ঋষি দয়ানন্দ বিদ্যা (বিজ্ঞান) এবং ধর্মের আবশ্যক সম্বন্ধকে দর্শানোর জন্য লিখেছেন - "অবিদ্বান ব্যক্তি অপরকে ধর্মের মধ্যে নিশ্চিত করাতে পারে না আর বিদ্বান ব্যক্তি ধার্মিক হয়ে অনেক মানুষকেও ধার্মিক করতে পারে আর কোনো ধূর্ত মানুষ অবিদ্বানকে ফুসলিয়ে অধর্মে প্রবৃত্ত করতে পারে, কিন্তু বিদ্বানকে অধর্ম পথে কখনও চালাতে পারে না, কারণ যে ব্যক্তি চোখে দেখে সে কখনও কুয়োতে পরে না, কিন্তু অন্ধ ব্যক্তির তো পরে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাছাড়া বিদ্বান ব্যক্তি সত্যাসত্যকে জেনে তাতে নিশ্চিত থাকতে পারে আর অবিদ্বান ব্যক্তি ঠিক-ঠিকভাবে স্থির থাকতে পারে না।" (ব্যবহারভানু)
.
"ধর্মের রক্ষক বিদ্যাই হয়, কারণ বিদ্যার দ্বারাই ধর্ম আর অধর্মের বোধ হয়। সেখান থেকে হিতাহিতের বোধ হয়, অন্যথা নয়।" (ঋষি দয়ানন্দের পত্র আর বিজ্ঞাপন - দয়ানন্দ-বিচার-কোষ, ভাগ ১, পৃষ্ঠা ৩ থেকে উদ্ধৃত)
প্রাচীন আর্যাবর্তে (ভারত) বিদ্যা-বিজ্ঞানের ব্যাপকতা
"ঋগ্বেদম্ ভগবোऽধ্যেমি য়জুর্বেদম্ সামবেদমাথর্বণম্ চতুর্থমিতিহাসপুরাণম্ পঞ্চমম্ বেদানাম্ বেদম্ পিত্র্যঁ রাশিম্ দৈবম্ নিধিম্ বাকোবাক্যমেকায়নম্ দেববিদ্যাম্ ব্রহ্মবিদ্যাম্ ভূতবিদ্যাম্ ক্ষত্রবিদ্যাম্ নক্ষত্রবিদ্যাঁ সর্পদেবজনবিদ্যামেতদ্ভগবোऽধ্যেমি।।"
(ছান্দোগ্য উপনিষদ ৭.১.২, ডাক্তার সত্যব্রত সিদ্ধান্তলঙ্কার ভাষ্য)
.
অর্থাৎ [নারদ] বললেন (ঋগ্বেদম্) ঋগ্বেদ (ভগবঃ) হে ভগবন্ (অধ্যেমি) অধ্যয়ন করি বা করেছি (য়জুর্বেদম্) য়জুর্বেদ (সামবেদম্) সামবেদ (আথর্বণম্) অথর্ববেদ (চতুর্থম্) চতুর্থ (ইতিহাসপুরাণম্) ইতিহাস-পুরাণ (পঞ্চমম্) পঞ্চম (বেদানাম্) বেদের (বেদম্) বেদ [জ্ঞান কারক জ্ঞাপক অর্থাৎ ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ, শিক্ষা, কল্প আদি] (পিত্র্যম্) পিতৃ কর্ম [পিতৃ-শুশ্রূষা শাস্ত্র অর্থাৎ গৃহ বিজ্ঞান, আয়ুর্বেদ, কৃষি বিজ্ঞান আদি] (রাশিম্) গণিত শাস্ত্র (দৈবম্) আবহাওয়া বিজ্ঞান, বিভিন্ন প্রাকৃতিক প্রকোপ আদি সম্বন্ধীয় বিজ্ঞান এবং কর্মফল ব্যবস্থা (নিধিম্) অর্থশাস্ত্র (বাকোবাক্যম্) তর্কশাস্ত্র এবং বিধিশাস্ত্র (একায়নম্) নীতিশাস্ত্র (দেববিদ্যাম্) সমস্ত প্রকাশিত সূক্ষ্ম পদার্থের বিজ্ঞান এবং বেদমন্ত্রের বিভিন্ন দেবতার বিজ্ঞান (ব্রহ্মবিদ্যাম্) বিদ্যুৎ বিদ্যা, মন-বাক্ তত্ত্ব আদির বিজ্ঞান এবং পরমাত্মতত্ত্ব বিজ্ঞান (ভূতবিদ্যাম্) ভৌতিকী, রসায়ন বিজ্ঞান, প্রাণী বিজ্ঞান, বনস্পতি বিজ্ঞান, ভূগর্ভশাস্ত্র আদি (ক্ষত্রবিদ্যাম্) যুদ্ধ এবং অস্ত্র-শস্ত্র বিদ্যা (নক্ষত্রবিদ্যাম্) খগোল ভৌতিকী, খগোল বিজ্ঞান, সূর্য এবং নক্ষত্রের বিজ্ঞান (সর্পদেবজনবিদ্যাম্) পৃথিবীর সরীসৃপ সব প্রাণী এবং বন্য প্রাণীর বিজ্ঞান, শিল্পশাস্ত্র অর্থাৎ টেকনোলজি এবং গণিত আদি ললিত বিদ্যা আদি (এতদ্) এই সবের (ভগবঃ) হে ভগবন্ (অধ্যেমি) অধ্যয়ন করছি (অধ্যয়ন করেছি)।
.
কিন্তু -
.
সোऽহম্ ভগবো মন্ত্রবিদেবাস্মি নাত্মবিচ্ছ্রুতঁ হ্যেব মে ভগবদ্দৃশেভ্যস্তরতি শোকমাত্মবিদিতি। সোऽহম্ ভগবঃ শোচামি তম্ মা ভগবাচ্ছোকস্য পারম্ তারয়ত্বিতি। তঁ হোবাচ য়দ্বৈ কিম্চৈতদধ্যগীষ্ঠা নামৈবৈতৎ।।৩।।
(ছান্দোগ্য উপনিষদ ৭.১.৩)
.
অর্থাৎ (সঃ অহম্) সেই আমি অর্থাৎ বেদাদি শাস্ত্রের জ্ঞাতা হয়েও (ভগবঃ) হে ভগবন্! (মন্ত্রবিত্+এব) কেবল মন্ত্রবেত্তাই (অস্মি) আছি অর্থাৎ পাঠকমাত্র আছি (আত্মবিত্ ন) ব্রহ্মবিত্ নই (হি) কারণ (ভগবদ্দৃশ্যেভ্যঃ) আপনার সমান তত্ত্ববেত্তাদের থেকে (মে) আমি (শ্রুতমেব) শুনেছি যে (আত্মবিত্) ব্রহ্মবিত্ (শোকম্ তরতি) শোককে পার করে যান অর্থাৎ শোক করেন না, (ইতি) কিন্তু (ভগবঃ) হে ভগবন্! (সোऽহম্) আমি তো (শোচামি) শোক করছি, সুতরাং আমি আত্মবিত্ নই (তম্) শোকগ্রস্থ (মা) আমাকে (ভগবান্) আপনি (শোকস্য পারম্) শোককে পার (তারয়তু) করে দিন (ইতি) এটাই আমার প্রার্থনা। (তম্ হ উবাচ) তখন প্রসিদ্ধ সনৎকুমার সেই নারদকে বললেন যে (য়ৎকিঞ্চ) যাকিছু (এতত্) পূর্বোক্ত বিজ্ঞানের (বৈ) নিশ্চয় (অধ্যগীষ্ঠাঃ) আপনি অধ্যয়ন করেছেন (এতত্ নামৈব) সেগুলো কেবল নামমাত্র।
(ভাষ্য - পণ্ডিত শিবশঙ্কর শর্মা "কাব্যতীর্থ")
.
পাঠকগণ এখানে ভাবুন যে দেবর্ষি নারদের অধ্যয়ন কত বিশাল ছিল। একা কোনো ব্যক্তি এতগুলো বিষয়ের বিশেষজ্ঞ হতে পারে, এইরূপ কল্পনা করাও অতি কঠিন হবে। দুর্ভাগ্যবশতঃ আর্যাবর্ত (ভারতবর্ষ) অথবা বিশ্ব ভগবান্ নারদ আদি মহাপুরুষদের যথার্থ চরিত্রকে বিস্মৃত করে ফেলেছে। এখন একটু এই পক্ষের উপর বিচার করে দেখুন যে সম্পূর্ণ জড় আর চেতন জগতের বিস্তৃত জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও দেবর্ষি নারদ কেন শোকমগ্ন ছিলেন? তিনি কোন জ্ঞান-পিপাসার জন্য মহর্ষি সনৎকুমারের শ্রী চরণে উপস্থিত হয়েছিলেন?
.
একথার উত্তর তিনি স্বয়ং দিয়েছেন যে আমি হলাম মন্ত্রবিত্, আত্মবিত্ নই অর্থাৎ উপরোক্ত সব বিদ্যার বিস্তৃত সৈদ্ধান্তিক জ্ঞান তো তাঁর ছিল। শিল্প শাস্ত্র অর্থাৎ টেকনিকের বিশেষজ্ঞ হওয়ার কারণে তিনি সম্পূর্ণ পদার্থ বিদ্যার প্রয়োগাত্মক জ্ঞানীও ছিলেন। জ্ঞাতব্য হল, তিনি অনেক বড় বৈজ্ঞানিক ছিলেন, যিনি বিভিন্ন লোকের যাত্রা করতেন। তিনি অনেক তারার যাত্রাও করতেন। ঈশ্বর আর জীব উভয় চেতন তত্ত্বের গভীর মনন-চিন্তনও করেছিলেন, কিন্তু এই চেতন তত্ত্বের সাক্ষাৎকার করে তিনি সেই সময় পর্যন্ত জীবনমুক্ত অবস্থাকে প্রাপ্ত করতে পারেন নি আর এটাই একমাত্র তাঁর শোকের কারণ ছিল।এই বিষয়ে দুটো কথা গম্ভীর রূপে বিচারণীয় -
১. সমস্ত সৃষ্টির জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং ঈশ্বর জীবের পূর্ণ সৈদ্ধান্তিক জ্ঞান ছাড়া চেতন তত্ত্বের সাক্ষাৎকার সম্ভব নয়। এই কারণে ভগবান্ নারদ সংসারের বিবিধ বিদ্যার অধ্যয়ন আগে করে ছিলেন আর তাঁর গুরুজনও এইটুকু বিদ্যার অধ্যয়ন তাঁকে করিয়েছিলেন। যদি ঈশ্বর এবং আত্মা সাক্ষাৎকারের জন্য এইসব বিদ্যা অনাবশ্যক হতো, তাহলে সেই মহান বৈদিক কালে এবং সেই মহান দেব সমাজের মহান ঋষি মহানুভাব নারদের মতো মহান ব্যক্তিকে এতগুলো বিদ্যা পড়ানোর পুরুষার্থ করতেন না। এই বিষয়ে সেইসব মহানুভাবকে গম্ভীরতাপূর্বক বিচার করা উচিত, যারা পদার্থ বিজ্ঞান এবং লোকব্যবহারের বিদ্যাকে নিতান্ত উপেক্ষা করে কেবল ঈশ্বর আর মুক্তির কথা বলে। তো কোনো-কোনো মহানুভাব মুহূর্তের মধ্যে সমাধি প্রাপ্ত করানোর দাবি করে। বস্তুতঃ এমন মহানুভাব হল বৈদিক আর্ষ পরম্পরা এবং এর এক অঙ্গ পাতঞ্জল য়োগশাস্ত্র সম্বন্ধে নিতান্ত অনভিজ্ঞ।
.
প্রশ্ন - আপনার অনুসারে ঈশ্বর প্রাপ্তির জন্য যদি এত জ্ঞান-বিজ্ঞান আবশ্যক হয় তথা এর পশ্চাৎই ঈশ্বর সাক্ষাৎকারের উপায় করা হয়, তাহলে তো কোনো মানুষ ঈশ্বরের উপাসনা করতেই পারবে না, কারণ না তো মহর্ষি নারদের মতো জ্ঞান হবে আর না কেউ আত্ম সাক্ষাৎকারের চেষ্টা করবে।
.
উত্তর - আমার উপরোক্ত কথনের তাৎপর্য এই নয় যে উপরোক্ত পদার্থ বিদ্যা অথবা চেতন বিদ্যার অধ্যয়ন করার সময় ঈশ্বরের উপাসনা না করা হোক। আমাদের বৈদিক সংস্কৃতির মধ্যে তো বাচ্চা জন্ম হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে শিশুর পিতা স্বর্ণ শলাকা দিয়ে মধুর সঙ্গে শিশুর জিহ্বাতে "ওম্" লিখে দেয়। তার প্রয়োজন হল এটাই যে শিশু জীবনে মধুরত্ত্বের জন্য সংসারে তার মধুর ব্যবহার দ্বারা মধুরত্ত্ব ভরে দিবে তথা মধু উত্তম স্বাস্থ্যবর্ধক হওয়ার কারণে সেই শিশু আয়ুর্বিজ্ঞান, আহার শাস্ত্র এবং শরীরোপয়োগী বিভিন্ন বিদ্যার জ্ঞাতা হয়ে উত্তম বল, বুদ্ধি, পরাক্রম, প্রজ্ঞা আর দীর্ঘায়ু যুক্ত হয়ে সারা সংসারকে নিজের সমানই গুণ দিয়ে পূর্ণ করার চেষ্টা করবে এবং সুবর্ণ আদি রত্ন দিয়ে সমৃদ্ধ হয়ে বিভিন্ন লোকোপয়োগী বিদ্যার দ্বারা সংসারকে সুখী-সমৃদ্ধ করার চেষ্টা সর্বদা করবে।
.
একথা বিশেষ বিচারণীয় যে এমন ব্যাপক উদার ভাবনা কোনো ব্যক্তির মধ্যে তখনই আসবে, যখন সে সম্পূর্ণ সংসারকে নিজেরই পরিবার মনে করবে আর নিজের পরিবার তখনই হবে, যখন তাকে উৎপন্ন কারী পিতা একটাই হবে। এইজন্য সেই শিশুর জিহ্বাতে "ওম্" শব্দ লেখা হয়। এটা একথার সংকেত করে যে হে বালক! এই পরমাত্মাই হল এই সম্পূর্ণ জগতের মাতা এবং পিতা অথবা চেতন পরমাত্মাই হল সবার পিতা আর জড় প্রকৃতি হল সবার মাতা। এই কারণে সংসারের সব প্রাণী হল এক পরিবারের সদস্য। এখানে একথা উল্লেখনীয় যে প্রকৃতিকে মাতা তো বলা হয়েছে, কিন্তু পিতা কোথাও বলা হয়নি। অথচ পরমাত্মাকে মাতা এবং পিতা উভয় নামে সম্বোধন করা হয়েছে, যেমন -
ত্বম্ হি নঃ পিতা বসো ত্বম্ মাতা শতক্রতো বভূবিথ।
অথা তে সুম্নমীমহে।। ১১।। (ঋগ্বেদ ৮.৯৮.১১, সামবেদ ১১৭০, অথর্ববেদ ২০.১০৮.২)
.
এইজন্য তিনিই হলেন সর্বোপরী উপাস্য দেব এবং তাঁরই মুখ্য ও নিজ নাম হল "ওম্"। এই কারণে শিশুকে না কেবল এমন শিক্ষা দেওয়া হয় যে সংসার হল পরমাত্মার পরিবার, অপিতু সেই পরমাত্মাই হল আমাদের পরমধাম, এই সংকেতও করা হয়।
.
এইজন্য পাতঞ্জল য়োগের বিভিন্ন অঙ্গের সাধনা করার পাশাপাশি বাল্যাবস্থা থেকেই ঈশ্বর উপাসনা প্রত্যেকটা শিশুর সর্বোপরি ধর্ম হওয়া উচিত। ঈশ্বর উপাসনা এবং ব্রহ্মচর্য-প্রাণায়াম আদি তপের দ্বারা বিদ্যার্থী মহতী প্রজ্ঞাকে প্রাপ্ত করে বিভিন্ন পদার্থ বিদ্যার গম্ভীর রহস্য এবং আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানকেও জানতে অপেক্ষাকৃত সক্ষম হবে আর এমনি করেই দেবর্ষি নারদ উপরিবর্ণিত বিদ্যার মহান বিশেষজ্ঞ হয়ে গিয়েছিলেন। এইজন্য যেকোনো অধ্যাত্মবেত্তার জন্য পদার্থ বিদ্যার উপেক্ষা ও নিন্দা মোটেও উচিত মানা সম্ভব নয়, বরং পদার্থ বিদ্যা হল প্রত্যেক অধ্যাত্মবেত্তার জন্য অনিবার্য বিষয়। এটা খুবই সাধারণ কথা যে কার্যকে না দেখে কোনো কর্তার অনুমান কিভাবে সম্ভব হবে আর যদি তাঁর অস্তিত্বের অনুমানও না হয়, তাহলে তাঁর স্বরূপের যথার্থ জ্ঞান আর তাঁর প্রাপ্তির তো কল্পনা করাও সম্ভব নয়।
.
২. সমস্ত সৃষ্টিকে জানার পশ্চাৎ তথা ঈশ্বর-জীবাত্মা বিষয়ক বিভিন্ন বেদাদি শাস্ত্রকে গম্ভীরভাবে পড়ার পরও ঈশ্বর-আত্মার সাক্ষাৎকার না করে কিংবা জীবনমুক্ত অবস্থাকে প্রাপ্ত না করে পূর্ণ বিশোক অবস্থাকে প্রাপ্ত করা সম্ভব নয়, এই অবস্থাকে মুক্তিও বলে। আমার দৃষ্টিতে দেবর্ষি নারদ মহর্ষি সনৎকুমারের কাছে আসার পূর্বে আত্মা অথবা ঈশ্বরের সাক্ষাৎকার করেন নি, এমন মোটেও সম্ভব বলে মনে হয় না। মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি না হয়ে এত বিশাল আর গভীর অধ্যয়ন করা যেকোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় আর মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি তিনিই হবেন, যিনি ঈশ্বরের সাক্ষাৎকার করেছেন। বর্তমানে কোনো আধ্যাত্মিক আর প্রতিভাশালী বিদ্বান দ্বারা বেদার্থ করা আলাদা বিষয় হবে আর সেই মহান যুগে দেবর্ষি নারদ দ্বারা স্বয়ংকে মন্ত্রবিত্ বলাটা অনেক উচ্চ বিষয় হবে। আমার দৃষ্টিতে "মন্ত্রবিত্" এর অর্থ কেবল পাঠকমাত্র নয়, বরং মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষির স্তর প্রাপ্ত করে নেওয়া হবে। আমি বিভিন্ন বিদ্বান দ্বারা মন্ত্রবিত্ শব্দের অর্থ "পাঠক মাত্র" বলার পক্ষে সহমত নই।
.
যদি মন্ত্রবিতের অর্থ ঋষি হয়, তবে কি ঋষিও শোকাকুল এবং অপূর্ণবিদ্য হন, তাহলে তো তাদের আর সামান্য মানুষের মধ্যে ভেদ কি রইলো?
.
উত্তর - সংসারে সর্বথা পূর্ণপুরুষ তো কেবল পরমাত্মাই হতে পারবে আর জীবাত্মার স্তরে পূর্ণ শোকরহিত এবং সমস্ত জ্ঞেয়ের জ্ঞাতা কেবল মুক্তাত্মা এবং জীবনমুক্ত পুরুষই হতে পারবে। অন্য স্তরে একটু-আধটু অল্পমাত্রায় হলেও শোক-দুঃখ আসবেই আর এমন অবস্থাই সেই সময় দেবর্ষি নারদের ছিল। এটাও মনে রাখতে হবে যে এই স্তরের মহাপুরুষ এবং অন্য স্তরের মানুষের সুখ-দুঃখ ও শোক-আনন্দের মধ্যে অনেক ভেদ আছে।
.
দেবর্ষি নারদ সেই সময় যে আত্মবিত্ না হওয়ার কথা বলেছেন, তার মানে এই যে তিনি মুক্তির কামনা হেতু জীবনমুক্ত অবস্থাকে প্রাপ্ত করার জন্য ঈশ্বরের সাক্ষাৎকারকে সুদৃঢ় করতে তথা নিজের সব সংস্কারকে দগ্ধবীজ করার অভ্যাসের জন্য জীবনমুক্ত অবস্থাকে প্রাপ্ত করা সদ্গুরু মহর্ষি সনৎকুমারের শরণে এসেছিলেন। এইভাবে এতে এই নিষ্কর্ষ বের হয় যে সম্পূর্ণ পদার্থ বিদ্যার জ্ঞাতা বৈজ্ঞানিক ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ সুখ প্রাপ্ত করতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা চেতন তত্ত্বের সাক্ষাৎকার করে তার যথার্থ বিজ্ঞান প্রাপ্ত না করছেন। সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান হল একটা সুন্দর মালার সমান। সংসারের সব পদার্থ বিদ্যা সেই মালার সুন্দর মোতির সমান আর সেই মোতিকে পরস্পর জুড়ে রাখার সুতো হল চেতনতত্ত্ব বিজ্ঞান। যতক্ষণ পর্যন্ত এই সুতো হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত মোতি পরস্পর জুড়ে সৌন্দর্য প্রাপ্ত করতে পারবে না। এইভাবে আধ্যাত্ম বিজ্ঞান ছাড়া পদার্থ বিজ্ঞান এবং ব্যবহারিক বিদ্যার বিভিন্ন শাখা মানব সমাজ অথবা প্রাণীমাত্রকে কক্ষনো সুখ-শান্তি দিতে পারবে না। তারমধ্যে সংঘর্ষ এবং বিরোধ ভাব হবেই, যার ফলে সুখ-সুবিধার বিভিন্ন বিস্তার থাকা সত্ত্বেও মানব সমাজ সুখী আর আনন্দিত হতে পারবে না, আর তখন প্রাণীমাত্রের কথা তো কি বলবো? দুর্ভাগ্যবশতঃ আজ সংসারে এই সবকিছু হচ্ছে। সুখ-সুবিধার সংসাধনের ভীড়ে সুখ, শান্তি, প্রেম, মৈত্রী, করুণার মতো মানবীয় গুণ কোথাও হারিয়ে গেছে। কোনো মালার সুতো না কেবল সেই মোতির আধার প্রদান করে, বরং তাকে ব্যবস্থিত ক্রম প্রদান করে সুন্দর আর উপযোগীও করে তোলে।
.
এইভাবে যথার্থ আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান বিভিন্ন বিদ্যাকে পরস্পর একে-অপরের সঙ্গে জুড়ে আর সেগুলোকে পরস্পর পূরক বানিয়ে প্রাণীমাত্রের জন্য উপযোগীও করে দেয়। তখন যেমন নিরাপদ এবং আবশ্যক টেকনিকের বিকাশ হয়ে পরিকেশও সুন্দর আর সুরক্ষিত হয়, তেমনি মানুষের মধ্যে গলাকাট প্রতিস্পর্ধা না হয়ে পরস্পর প্রীতি আর শান্তিও বজায় থাকে। তিন প্রকারের দুঃখ অর্থাৎ শারীরিক আর মানসিক দুঃখ, প্রাকৃতিক প্রকোপ আদি থেকে উৎপন্ন দুঃখ এবং প্রাণীদের পারস্পরিক সংঘর্ষজন্য দুঃখ কাউকেই পীড়িত করে না। আবার অন্যদিকে বিভিন্ন পদার্থ বিদ্যা এবং ব্যবহারিক জ্ঞানকে পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে কেবল আধ্যাত্মিক কথা বলে এমন মহানুভাব কোনো সুন্দর মালা রূপ সামাজিক ব্যবস্থার কল্পনার থেকেও অতি দূর এক সুতোর সমান এমনি নীরস ব্যবস্থাকে উৎপন্নকারী হয়, সেখানে তাদের পরমাত্মা অথবা মুক্তির প্রাপ্তি তো কি আর হতে পারে, বরং তারা নিজেদের উদরপোষণেও সক্ষম না হয়ে নিতান্ত দুঃখী আর অভিশপ্ত জীবন যাপন করে। এইজন্য য়জুর্বেদের মধ্যে বলা হয়েছে -
অন্ধন্তমঃ প্রবিশন্তি য়েऽবিদ্যামুপাসতে।
ততো ভূয়ऽইব তে তমো য়ऽউ বিদ্যায়াঁ রতাঃ।। (য়জুর্বেদ ৪০.১২)
অর্থাৎ যে সকল মানুষ কেবল পদার্থ বিজ্ঞানের মধ্যে রত থাকেন, তারা দুঃখসাগর রূপ অন্ধকারে ডুবে যান আর যে সকল মানুষ পদার্থ বিদ্যার নিতান্ত উপেক্ষা করে কেবল অধ্যাত্ম বিজ্ঞানের মধ্যেই রত থাকতে চান, তারা আরও অধিক গভীর অন্ধকারে ডুবে যান। এর কারণ পাঠক উপরে নিশ্চয়ই জেনে গেছেন। তাহলে মানুষ পূর্ণ সুখী কিভাবে হতে পারবে? এর উত্তরে বেদ পুনরায় বলেছে -
.
বিদ্যাম্ চাবিদ্যাম্ চ য়স্তদ্বেদোভয়ঁ সহ।
অবিদ্যয়া মৃত্যুম্ তীর্ত্বা বিদ্যয়াऽমৃতমশ্নুতে।।
(য়জুর্বেদ ৪০.১৪)
অর্থাৎ যে সকল মানুষ পদার্থ এবং আধ্যাত্মিক উভয় বিদ্যাকে জানেন, তারা পদার্থ বিদ্যার সমুচিত আর সর্বহিতকারী উপয়োগ দ্বারা তথা শরীর আর জগতের নশ্বর হওয়ার জ্ঞান দ্বারা মৃত্যু-ভয় এবং অন্য সমস্ত দুঃখকে অতিক্রম করে যথার্থ আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানের দ্বারা জীবনমুক্ত কিংবা মুক্তিরূপ পরমানন্দকে প্রাপ্ত করবেন।
.
এইভাবে সংসারে বিদ্যার বিভিন্নতা, ব্যাপকতা আর সেগুলোর সমন্বিত, সুষম আর উপযুক্ত ব্যবহার দ্বারা মানব স্বয়ং সর্ববিধ দুঃখকে সাঁতরে পার করে অন্য সকল প্রাণীদের সুখ দিতে সক্ষম হয়। বিদ্যার উপযোগিতা হল এটাই।
.
পূর্ব অধ্যায়ে আমরা যে বিভিন্ন বিদ্যার চর্চা করেছি, সেগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে -
১.যে পদার্থ এই সৃষ্টির উপাদান কারণ হয় অর্থাৎ যার মিশ্রণের কারণে এই সকল সৃষ্টি তৈরি হয়েছে।
২. যে পদার্থ এই সৃষ্টির উপাদান কারণ না হয়ে নিমিত্ত কারণ মাত্র হয়।
.
এগুলোর মধ্যে প্রথম প্রকারের পদার্থ জড় হয় তথা দ্বিতীয় প্রকারের পদার্থ কিছুটা জড় তথা কিছুটা চেতন হয়। ঋষি দয়ানন্দ সরস্বতী "আর্য়োদ্দেশ্যরত্নমালা" পুস্তকে সৃষ্টির পরিভাষা নিয়ে লিখেছেন - "যা কর্তার রচনা করে কারণ দ্রব্য কোনো সংযোগ বিশেষ দ্বারা অনেক প্রকার কার্যরূপ হয়ে বর্তমানে ব্যবহার করার যোগ্য হয়, তাকে সৃষ্টি বলে।"
.
"স্বমন্তব্যামন্তব্যপ্রকাশ" এরমধ্যে পুনরায় ঋষি দয়ানন্দ লিখেছেন - "সৃষ্টি তাকে বলে যা পৃথক দ্রব্যের জ্ঞান যুক্তিপূর্বক মিলিত হয়ে বিভিন্নরূপ হয়।"
.
এই দুই পরিভাষার উপর বিচার করলে নিম্ন লিখিত নিষ্কর্ষ প্রাপ্ত হয় -
১. সৃষ্টির পদার্থকে মানুষ ব্যবহার করতে পারবে। তার যথার্থ জ্ঞান প্রাপ্ত করতে পারবে। যথার্থ বিজ্ঞান ছাড়া কোনো পদার্থকে উচিত ব্যবহারে নিয়ে আসা সম্ভব নয়, এইজন্য সৃষ্টি বিজ্ঞানের যথার্থতা মানব জাতির জন্য অনিবার্য। সৃষ্টি নিকৃষ্ট নয়, বরং ব্যবহারে নিয়ে এসে সকলের উপকারের জন্যই হয়। সৃষ্টির সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম ও স্থূল থেকে স্থূল পদার্থ অর্থাৎ সূক্ষ্মতম কণা আর তার থেকেও সূক্ষ্ম প্রাণাদি পদার্থ থেকে শুরু করে বিশাল লোক-লোকান্ত পর্যন্ত সবকিছুর যথার্থ বিজ্ঞানের সাক্ষাৎ করে তাকে সর্বহিতার্থ ব্যবহার করা উচিত। সৃষ্টির প্রয়োজন হল এটাই।
২. সৃষ্টি কোনো কারণ পদার্থ থেকে তৈরি হয়েছে। সেই কারণ পদার্থ হল অনাদি ও অনন্ত। সেই কারণ পদার্থ না কখনও তৈরি হয় আর না কখনও নষ্ট হয়। সেই পদার্থের ভাব সর্বদা থাকে, সেটা শূন্য অর্থাৎ অবস্তু নয়, যেমনটা মহান তত্ত্ববেত্তা মহর্ষি কপিল বলেছেন -
"নাবস্তুনো বস্তুসিদ্ধিঃ" (সাংখ্য দর্শন ১.৭৮)
অর্থাৎ অভাব থেকে ভাবের উৎপত্তি হওয়া সম্ভব নয়।
এটাই য়োগেশ্বর মহান বেদবিজ্ঞানী শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন -
নাসতো বিদ্যতে ভাবো নাভাবো বিদ্যতে সতঃ। (গীতা ২.১৬)
অর্থাৎ অসৎ বস্তুর কখনও ভাব হয় না, সৎ বস্তুর কখনও বিনাশ হয় না। এর মানে হল শূন্য (নথিং) থেকে কখনও কোনো বস্তুর উৎপত্তি হতে পারে না তথা যে বস্তু বিদ্যমান আছে, তার কখনও পূর্ণ বিনাশ হয় না। সংসারে সত্তাবান কোনো কিছুর বিনাশ তথা কোনো কারণ দ্রব্যের কোনো বস্তুর উৎপত্তি দেখা বা শোনা যায়, তার যথার্থ হল -
নাশঃ কারণলয়ঃ (সাংখ্য দর্শন ১.১২১)
অর্থাৎ স্থূল পদার্থ তার কারণভূত সূক্ষ্ম পদার্থের মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে যাওয়াকেই বিনাশ বলে। এইভাবে বস্তুর বিনাশ আসলে হয় না, বরং তার রূপ এত সূক্ষ্ম হয়ে যায় যে আমরা তা অনুধাবন করতে পারি না, একেই বিনাশ বা প্রলয় বলে। এর বিপরীত যখন সেই অদৃশ্য, অস্পৃশ্য ও অবিজ্ঞেয় কারণ পদার্থ স্থূল রূপে পরিবর্তিত হয়ে কোনো বস্তুর নির্মাণ হতে দেখা যায়, তখন তাকেই কোনো বস্তুর উৎপন্ন হওয়া মানা হয়। বস্তুতঃ সৃষ্টি ও প্রলয় হল পদার্থের দুই প্রকারের অবস্থার নাম। এটাও মনে রাখতে হবে যে এই সৃষ্টি-প্রলয় বা কার্য-কারণ অবস্থাও সাপেক্ষ হয়ে থাকে। এক পদার্থ অন্য কোনো পদার্থের উপাদান কারণ হতে পারে, আবার সেই পদার্থ অন্য কোনো সূক্ষ্ম পদার্থের কার্যরূপও হতে পারে।
.
এই সৃষ্টি পৃথক-পৃথক সূক্ষ্ম পদার্থের সংযোগ বিশেষ দ্বারা তৈরী হয়েছে। এখানে "বিশেষ" শব্দ এই বলছে যে সৃষ্টির বিভিন্ন পদার্থের (সূক্ষ্ম বা স্থূল) নির্মাণ এলোমেলো কিংবা যেমন-তেমন (randomly combination) ভাবে নয়, বরং জ্ঞান ও যুক্তিপূর্বক সম্যক্ সংযোগ দ্বারাই হয়। সংসারে যে অব্যবস্থা আমরা এলোমেলো দেখতে পাই, সেটা আমাদের অল্প জ্ঞানের কারণেই এমন মনে হয়, অথচ সেই অব্যবস্থার ভিতরেও এক সুন্দর সোদ্দেশ্য ব্যবস্থা থাকে, যাকে আমরা আমাদের অল্প জ্ঞানের কারণে জানতে পারি না। সমস্ত সৃষ্টি পূর্ণ ব্যবস্থিত, জ্ঞানপূর্বক তৈরী করা হয়েছে, জ্ঞানপূর্বক ও সোদ্দেশ্য সঞ্চালিত হচ্ছে।
.
এখন যেহেতু সমস্ত সৃষ্টি সোদ্দেশ্য ও জ্ঞানপূর্বক তৈরী করা হয়েছে, এইজন্য এটা অনিবার্য যে তার নির্মাতা কোনো মহান সামর্থ্যশালী, মহান জ্ঞানী-বিজ্ঞানী, অনাদি ও অনন্ত কর্ত্তা অদৃষ্টরূপেণ সর্বত্র বিদ্যমান আছে। এই পূর্ণ জ্ঞানী কর্ত্তা তত্ত্বের সঙ্গে-সঙ্গে চেতন ভোক্তা তত্ত্বের অস্তিত্বের আবশ্যকতা এবং যথার্থ স্বরূপের চর্চা এই গ্রন্থের উদ্দেশ্য নয়। বিজ্ঞ পাঠক সৃষ্টিতে ঈশ্বর তত্ত্বের অস্তিত্বের বৈজ্ঞানিকতার উপর বিচার করে স্বয়ংই ভোক্তারূপ চেতন জীবতত্ত্বের অস্তিত্বের বৈজ্ঞানিকতার অনুভব করতে পারবেন।
.
এইভাবে আমরা "সৃষ্টি" শব্দের পরিভাষার চর্চা করলাম। এখন এই সৃষ্টির সমার্থক দুটো শব্দ "জগৎ" ও "সংসার" এর উপরও চর্চা করবো। এই দুটো শব্দের অর্থ হল যা নিরন্তর গতিশীল অর্থাৎ পরিবর্তনশীল, তাকে জগৎ বা সংসার বলে। এই সৃষ্টির মধ্যে কোনো কিছুই স্থির বা স্থায়ী হয় না, আর যেটা স্থির, নির্বিকার বা স্থায়ী হয়, সেটা এই সৃষ্টির উপাদান তত্ত্ব অথবা এর অঙ্গভূত তত্ত্ব নয়। সমস্ত জগতের সূক্ষ্মতম থেকে স্থূলতম পদার্থ নিরন্তর গতি করছে, এই নিরন্তর গতির কারণে সেগুলো নিজের স্বরূপকেও ক্রমাগত পরিবর্তিত করছে। এই পরিবর্তন সর্বত্র ও সর্বদা হতে চলা সংযোগ ও বিয়োগের কারণেই হয় আর এই সংযোগ-বিয়োগের কারণ হল গতি। এই সংযোগ-বিয়োগও জ্ঞানপূর্বকই হয়। এই সমস্ত সংযোগ-বিয়োগ রূপী সৃষ্টির সমস্ত ব্যবহার ও গুণের ব্যবস্থিত ও বিশিষ্ট জ্ঞানকেই সৃষ্টি বিজ্ঞান বলে।
.
আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানের পাশাপাশি সংসারের অন্য সব বিজ্ঞান হল সৃষ্টি-বিজ্ঞানেরই বিভিন্ন শাখা। একে এইভাবেও বলা যেতে পারে যে সম্পূর্ণ পদার্থ বিজ্ঞান সৃষ্টি বিজ্ঞানের অন্তর্গত, কিন্তু সংসারে বিভিন্ন লোক-লোকান্তরের রচনার বিজ্ঞানকেই সৃষ্টি বিজ্ঞান বলে। একে ইংরাজি ভাষায় কসমোলজি বলে। বর্তমান বৈজ্ঞানিক এটুকু অবশ্য মানে ও জানে যে এই কসমোলজির সঙ্গে সৌর ভৌতিকী (সোলার ফিজিক্স), প্লাজমা, ফিজিক্স, খগোল ভৌতিকী, খগোল বিজ্ঞান, কোয়ান্টাম ফিল্ড থিয়োরি এবং স্ট্রিং থিয়োরি আদির না কেবল অতি নিকট সম্বন্ধ আছে, অপিতু সেগুলো সবই হল সৃষ্টি বিজ্ঞানের শাখা। এছাড়া কণা-পরমাণু- নাভিকীয় ভৌতিকী ছাড়া কসমোলজির কল্পনাও সম্ভব নয়। ঊষ্মা, প্রকাশ, বিদ্যুৎ, চুম্বক আদির বিজ্ঞানও কসমোলজিকে বোঝাতে আবশ্যক হয়। এইভাবে এই সব বিজ্ঞানের শাখা হল সৃষ্টি বিজ্ঞানেরই ভাগ। যদিও এইসবের জন্য ভৌতিক বিজ্ঞান শব্দই অনেক সার্থক। বিজ্ঞানের অন্য শাখা রসায়ন, ভূগর্ভ বিজ্ঞান, প্রাণী বিজ্ঞান, বনস্পতি বিজ্ঞান আদি সব ভৌতিক বিজ্ঞান ছাড়া অপূর্ণ হয় কিংবা ভৌতিক বিজ্ঞান রসায়ন আদি অনেক শাখা বা বিধির মূল হয়। এইভাবে বর্তমান বিজ্ঞানের প্রায় সব শাখাই হল সৃষ্টি বিজ্ঞানের অঙ্গ। বাস্তবিকতা তো এই হল যে আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান ছাড়া সম্পূর্ণ সৃষ্টি বিজ্ঞান অপূর্ণই হবে।
সৃষ্টি বিজ্ঞানের উপযোগিতা
আজ অনেক অধ্যাত্মবাদী বিজ্ঞান ও টেকনিকের নিন্দা করেন, অথচ তাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা স্বয়ং উচ্চ টেকনিকের প্রচুর ব্যবহার করেন। আমি এমন মহানুভাবদের বলতে চাইবো যে পদার্থ বিজ্ঞান অর্থাৎ সমগ্র সৃষ্টি বিজ্ঞান না কেবল সংসারে বসবাসরত প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য আবশ্যক, অপিতু মুমুক্ষু ও বিরক্তজনদের মোক্ষের জন্যও সমস্ত সৃষ্টির জ্ঞান আবশ্যক, কারণ সৃষ্টি জ্ঞান ছাড়া এর স্রষ্টা পরমাত্মার জ্ঞান হবে না। যখন তাঁর জ্ঞান বা অনুমানই হবে না, তখন তাঁকে প্রাপ্তির জন্য উৎকট ইচ্ছা ও ধ্যানাদি সাধনের প্রাপ্তি হওয়া মোটেও সম্ভব নয়। এইজন্য ঋষি দয়ানন্দ তাঁর বেদভাষ্যতে সৃষ্টি বিদ্যার উপর খুব বল দিয়েছেন। বিদ্যার পরিভাষাতে তিনি দুই প্রকারের বিদ্যার (আধ্যাত্মিক এবং পদার্থ বিদ্যা) সম্মিলিত রূপকেই বিদ্যা বলেছেন। এখানে আমি ঋষির বেদভাষ্যের কিছু বিচার উদ্ধৃত করবো -
.
১. ন হি কশ্চিদপি সৃষ্টিপদার্থানাম্ গুণবিজ্ঞানেন বিনোপকারান্ গ্রহীতুম্ শক্নোতি তস্মাদ্বিদুষাম্ সম্গেন পৃথিবীমারভ্য পরমেশ্বরপর্য়্যন্তান্ পদার্থান্ জ্ঞাত্বা মনুষ্যৈঃ ক্রিয়াসিদ্ধিঃ সদৈব কার্য়া।। (ভাবার্থ ঋগ্বেদ ১.৯১.১৯)
.
অর্থাৎ সৃষ্টির পদার্থের গুণকে না জেনে কেউই সেগুলো থেকে উপকার নিতে পারবে না, এইজন্য মানুষের উচিত বিদ্বানদের সঙ্গ নিয়ে পৃথিবী থেকে ঈশ্বর পর্যন্ত যথাযোগ্য সব পদার্থকে জেনে ক্রিয়াসিদ্ধি সর্বদা করা।
.
২. অস্মিন্ জগতি য়স্য সৃষ্টিপদার্থবিজ্ঞান য়াদৃশম্ স্যাত্তাদৃশম্ সদ্যোऽন্যান্ গ্রায়েত্।
য়দি ন গ্রাহয়েত্ তর্হি তন্নষ্টম্ সদন্যৈঃ প্রাপ্তুমশক্যম্ স্যাত্।। (ভাবার্থ য়জুর্বেদ ১২.৪৮)
.
অর্থাৎ এই জগতে সৃষ্টির পদার্থের বিজ্ঞান যার যেমন হবে, তৎক্ষণাৎ সেটা অন্যকে জানাবে। যদি অন্যকে বলা না হয়, তাহলে সেই নষ্ট হওয়া জ্ঞান কেউই প্রাপ্ত করতে পারবে না।
.
এই বিষয়ে ঋষি দয়ানন্দ সরস্বতীর য়োগবিদ্যার শিষ্য শ্রী লক্ষ্মণানন্দ তাঁর ধ্যান-য়োগ-প্রকাশ নামক গ্রন্থে লিখেছেন - "যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের রুচি আর পরীক্ষা বিদ্বানদের সঙ্গতে তথা ঈশ্বর ও তাঁর রচনার উপর হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের বিজ্ঞান কখনও বাড়বে না, বরং সদা ভ্রমজালে পড়ে থাকবে।"
.
প্রশ্ন - এই সৃষ্টি বিজ্ঞান আদি বিষয় কেবল প্রেয়মার্গী সাংসারিক জনের জন্য তো ঠিক আছে, কিন্তু শ্রেয়মার্গী মুমুক্ষু জনকে পদার্থ বিজ্ঞান নিজের মুখ্য লক্ষ্য থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবে। এইজন্য তাদের এর উপেক্ষা করাই উচিত।
.
উত্তর - এই বিষয়ে কিছু সংকেত আমি পূর্বেই করেছি। এখন আমরা ঋষি দয়ানন্দ সরস্বতী, যিনি এই যুগের একজন প্রসিদ্ধ য়োগী ছিলেন, তাঁর বিচার জানার চেষ্টা করবো। তিনি সত্যার্থ প্রকাশের মুক্তি বিষয়ক নবম সমুল্লাসে মুক্তির সাধনের মধ্যে সর্বপ্রথম বিবেকের বিষয়ে বর্ণনা করে শরীরের পঞ্চকোষ তথা চার প্রকারের শরীরের বর্ণনা করেছেন। এই বর্ণনা কি সৃষ্টি বিজ্ঞানের অন্তর্গত নয়? প্রাণ, সূক্ষ্মভূত, ইন্দ্রিয়, মন আদির জ্ঞান সৃষ্টি বিজ্ঞানের একটা ভাগ নয় কি? এমন বিজ্ঞান, যাকে ঋষি বিবেক বলেছেন, তাকে ছাড়া বৈরাগ্য হওয়া কি সম্ভব? তারপর তিনি বৈরাগ্যের অর্থ নিয়ে সত্যার্থ প্রকাশে সেই সমুল্লাসের মধ্যে বলেছেন - "বিবেক দ্বারা যে সত্যাসত্য জানা গেছে, তাতে সত্যাচরণের গ্রহণ আর অসত্যাচরণের ত্যাগ করাই হল বৈরাগ্য।"
.
এখন বিবেকের বিষয়ে বলেছেন - "পৃথিবী থেকে শুরু করে পরমেশ্বর পর্যন্ত পদার্থের গুণ, কর্ম, স্বভাব সম্বন্ধে জেনে তাঁর আজ্ঞাপালন আর উপাসনাতে তৎপর হওয়া, তাঁর বিরুদ্ধে না চলা, সৃষ্টি থেকে উপকার নেওয়াকে বিবেক বলে।"
.
এই বৈরাগ্য সৃষ্টি বিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত নয় কি? ঋষির য়োগবিদ্যার শিষ্য স্বামী লক্ষ্মণানন্দ ধ্যান-য়োগ-প্রকাশ নামক গ্রন্থের ১৩২ পৃষ্ঠাতে লিখেছেন - "নিজের স্বরূপের জ্ঞান প্রাপ্ত করার যোগ্যতা হওয়ার জন্য জীবের উচিত প্রকৃতিজন্য স্থূল আর সূক্ষ্ম পদার্থকে ক্রমশঃ ধ্যানপূর্বক জানা।"
.
ঋষি দয়ানন্দ তাঁর বেদভাষ্যতে য়োগী হওয়ার জন্য সৃষ্টি বিজ্ঞানের আবশ্যকতা নিয়ে বলেছেন -
.
"ত এব জনা য়োগিনস্সিদ্ধাশ্চ ভবিতুম্ শক্নুবন্তি য়ে য়োগবিদ্যাভ্যাসম্ কৃত্বেশ্বরমারভ্য ভূমিপর্য়্যন্তান্ পদার্থান্ সাক্ষাৎকর্তুম্ প্রয়তন্তে য়মাদিসাধনান্বিতাশ্চ য়োগে রমন্তে য়ে চৈতান্সেবন্তে তেऽপ্যেতৎসর্বম্ প্রাপ্নুবন্তি নেতরে।" (য়জুর্বেদ ভাবার্থ ৭.৮)
.
অর্থাৎ তারাই পূর্ণ য়োগী আর সিদ্ধ হতে পারবেন, যারা য়োগবিদ্যাভ্যাস করে ঈশ্বর থেকে শুরু করে পৃথিবী পর্যন্ত পদার্থকে সাক্ষাৎ করার চেষ্টা করেন আর য়ম-নিয়ম সাধন যুক্ত য়োগের মধ্যে রত থাকেন আর যারা এই সিদ্ধের সেবন করেন, তারাই এই য়োগসিদ্ধিকে প্রাপ্ত করেন, অন্য কেউ নয়।
.
তিনি অন্যত্র লিখেছেন - "য়ে য়থাবৎসৃষ্টিক্রমম্ জানন্তি তে বিদ্বাম্সঃ সর্বতঃ পূজ্যন্তে য়ে চৈতম্ ন জানন্তি তে সর্বতস্তিরস্কৃতা ভবন্তি। (ভাবার্থ ঋগ্বেদ ১.১৬৪.৩৬) অর্থাৎ যারা সঠিকভাবে সৃষ্টিক্রমকে জানেন, সেই বিদ্বানদের সর্বত্র পূজো করা হয় আর যারা একে জানেন না, তারা সবদিকে তিরস্কৃত হন। ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকার "বেদবিষয়বিচার" নামক অধ্যায়ে ঋষি দয়ানন্দ বলেছেন অপরা বিদ্যা অর্থাৎ সৃষ্টি বিদ্যা অর্থাৎ সম্পূর্ণ পদার্থ বিজ্ঞান, পরাবিদ্যা অর্থাৎ অধ্যাত্ম বিদ্যার মূল হয় আর পরাবিদ্যা সেই অপরার ফল হয়। একথা এটাই স্পষ্ট করে যে পদার্থ বিজ্ঞান ছাড়া অধ্যাত্ম জ্ঞান, য়োগ আর মুক্তি হওয়া একদমই সম্ভব নয়।
.
এইভাবে আমরা এখানে দেখতে পেলাম যে ঋষি দয়ানন্দ সরস্বতী সমস্ত পদার্থ বিজ্ঞানকে মানবমাত্রের জন্য উপযোগী ও আবশ্যক মানতেন। বস্তুতঃ যে মানব এই সংসারে বাঁচতে চাইবে, তাকে বিজ্ঞান জানতেই হবে। বিজ্ঞান ছাড়া তার জন্য লোকব্যবহার, আহার, বিহার, আরোগ্যতা প্রাপ্ত করা, যেখানে-সেখানে গমনাগমন ব্যবহার করা আদি কোনো কিছুই সম্ভব হবে না। যদি মানুষ এইসব করতে সক্ষম না হয়, তাহলে সে কিভাবে সুখী হবে? ভগবৎপাদ পতঞ্জলি তাঁর য়োগশাস্ত্রে (২.১৮) এই সম্পূর্ণ সৃষ্টির প্রয়োজন সমস্ত সুখের উপভোগ এবং মোক্ষ প্রাপ্তিকেই বলেছেন। যদি কোনো মানুষ এই সৃষ্টির যথার্থ বিজ্ঞানকে না জানেন, তাহলে তিনি তার যথার্থ ব্যবহার কিভাবে করবেন? আর যদি ব্যবহার করতে না পারেন, তাহলে এই সৃষ্টি যে প্রয়োজনের জন্য তৈরী হয়েছে, সেই প্রয়োজন (সমস্ত সুখ এবং অন্তিম পরম প্রয়োজন মুক্তি) কিভাবে সিদ্ধ হবে?
.
এইজন্য সংসারের মধ্যে প্রত্যেক মানুষের উচিত যে তার নিজের জীবন সার্থক করার জন্য সংসারের সব পদার্থের যথার্থ বিজ্ঞান প্রাপ্ত করে সেগুলো থেকে নিজের ও অন্যের যথাযোগ্য উপকার করার চেষ্টা করতে থাকা। এইরূপ করেই মানুষ অন্তিমে যথার্থ আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান অর্থাৎ আত্মা ও পরমাত্মার যথার্থ বিজ্ঞান প্রাপ্ত করে মুক্তিকেও প্রাপ্ত করতে সক্ষম হবে।
মানব জিজ্ঞাসা এবং সৃষ্টি বিজ্ঞান
সৃষ্টির এমন প্রয়োজনকে জেনে এই মানব প্রাণী যখন থেকে এই পৃথিবীতে এসেছে, তখন থেকেই সৃষ্টির রহস্যকে জানার চেষ্টা করছে। বেদ, মনুস্মৃতি, বিভিন্ন ব্রাহ্মণ গ্রন্থ, মহাভারত, সূত্র-গ্রন্থ, দর্শন, উপনিষদ আদি সম্পূর্ণ প্রাচীন বৈদিক বাঙ্গময়ের মধ্যে সৃষ্টির যথার্থ বিজ্ঞানের উপর বিস্তার ভাবে গম্ভীর বিচার করা হয়েছে। যখন এইসব গ্রন্থের রচনা হয়, সেই সময় এই ভূ-তলে অন্য কোনো সম্প্রদায়ের আবির্ভাবও হয়নি। মহাভারত যুদ্ধের পশ্চাৎ এই সংসারে বিভিন্ন মত-মতান্তর প্রচলিত হয় আর সেগুলোতে নিজ-নিজ শৈলী রূপে সৃষ্টি-উৎপত্তি বিষয়ের উপর বিচার করা হয়। আমি মনে করি যত বিস্তৃত ও সূক্ষ্ম সৃষ্টিবিজ্ঞান বৈদিক বাঙ্গময়ের মধ্যে আছে, ততটা সারা সংসারের কোনো সম্প্রদায় বা দর্শনের মধ্যে হবে না। সংসারের বিভিন্ন সম্প্রদায় বৈদিক বাঙ্গময় থেকেই কিছু-কিছু বিচারকে গ্রহণ করে নিজের-নিজের পৃথক দর্শন তৈরী করেছে। পারসি, বৌদ্ধমত, জৈনমত, ইহুদী, ঈসাই, ইসলাম আদি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের দর্শনের মধ্যে বৈদিক মান্যতা থেকেই কিছু-কিছু প্রেরণা নেওয়া হয়েছে। কুরআন এবং বাইবেলের মধ্যে সৃষ্টি উৎপত্তির বিষয়ে অনেক বিচার বৈদিক ব্রাহ্মণ গ্রন্থ থেকে রূঢ়ার্থে নেওয়া হয়েছে।
.
এইসব সম্প্রদায়ের প্রবর্তক এইসব গ্রন্থের বিচারের যৌগিক অর্থ (যথার্থ) জানতে পারেনি, বরং সেই সময় সংসারে প্রচলিত বৈদিক কথনের রূঢ়ার্থে প্রচলিত ধারণার সংকেতকে গ্রহণ করে তার উপরই নিজের-নিজের সৃষ্টি বিজ্ঞানের ভবন দাঁড় করানোর চেষ্টা করে। ভারতীয় অর্বাচীন ভাগবতাদি পুরাণও এইভাবে বৈদিক কথনকে রূঢ়ার্থেই গ্রহণ করে নিজ-নিজ মতের প্রবর্তন করে দেয়। বৌদ্ধ ও জৈন মত বৈদিক দর্শনের রূঢ়ার্থকে নিয়ে প্রচলিত হওয়া বীভৎস কর্মকাণ্ডের প্রতিক্রিয়াতে উদিত হয়, এই কারণে তারা অনীশ্বরবাদের দিকে প্রবৃত্ত হয়, যদিও অন্য দেশী ও বিদেশী মত ঈশ্বরবাদীই থাকে, তাতে তাদের ঈশ্বর যেমনই হোক না কেন। বস্তুতঃ বৈদিক সনাতন মতের যথার্থকে না জেনে সৃষ্টি বিজ্ঞানের বিষয়ে যেসব মান্যতা প্রচলিত হয়, সেগুলোর মধ্যে অধিকাংশ কল্পনাপ্রসূত ভাগ আছে আর বাস্তবিকতা কম। তবে বৌদ্ধ ও জৈন মতের মধ্যে সৃষ্টিবিদ্যার উপর কিছু গম্ভীর বিচারও করা হয়েছে, তবুও তারা বাস্তবিকতার থেকে অনেক দূরে চলে যায়।
.
আধুনিক পুরাণ গ্রন্থের মধ্যে বায়ু, মৎস্য, ব্রহ্মাণ্ড, বিষ্ণু আদি পুরাণে যেসব সৃষ্টি বিদ্যা আছে, সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ তথা প্রাচীন বৈদিক বাঙ্গময়ই হল এর মূল স্রোত। অন্য শিবপুরাণাদির মধ্যে কিছু গম্ভীর তো কিছু কাল্পনিক বিচারের সমাবেশ আছে। তবে বাইবেল ও কুরআনের মধ্যে এমন বিস্তৃত বিচার নেই আর না সেখানে কোনো ক্রমবদ্ধতা ও যুক্তিসঙ্গতা প্রতীত হয়। বর্তমানে হিন্দি ভাষাতে এগুলোর যেসব অনুবাদ উপলব্ধ আছে, সেগুলোর মধ্যে চমৎকারী ঈশ্বর কথনমাত্র সৃষ্টির রচনা করে দিয়েছে, এমন বলা হয়েছে। বস্তুতঃ এই দুই গ্রন্থের মধ্যে ব্রাহ্মণ গ্রন্থের কিছু প্রচলিত কথনের রূঢ় পরম্পরার কিছু প্রভাব তো আছে, কিন্তু তারা সেইসব কথনের যথার্থ বুঝতে পারে নি আর রূঢ়ার্থকেই গ্রহণ করে বসে। একথা বর্তমানে প্রচলিত পুরাণের বিষয়েও উচিত মানা যেতে পারে। আধুনিক পুরাণের মধ্যেও না কেবল সৃষ্টি বিজ্ঞানকে কোথাও-কোথাও চমৎকারী ঈশ্বরের জাদুগিরি রূপে বিচিত্র করেছে, অপিতু সেই চমৎকারী ঈশ্বরকেও বিভিন্ন য়োনিতে জন্ম নিয়ে ভিন্ন-ভিন্ন চমৎকার করে বিভিন্ন চিত্র-বিচিত্র রূপে বর্ণনা করে একটা জাদুকরের মতো প্রচারিত করে দেয়।
.
এইসব মান্যতার মাঝে বিগত কিছু শতাব্দীর মধ্যে আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম হয় আর এটা সৃষ্টিকে জানতে অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা শুরু করে দেয়। যদিও আধুনিক বিজ্ঞানের উদয় হওয়ার পূর্বে পশ্চিমী দেশের মধ্যে ঈশাই, ইসলাম আদি সাম্প্রদায়িক সৃষ্টি বিদ্যা বিষয়ক বিচার ছাড়াও অরস্তু, প্লেটো আদি বিচারকদের সৃষ্টিবিদ্যা সম্বন্ধীয় বিভিন্ন বিচারের প্রাদুর্ভাব হয়ে গিয়েছিল। যাকে আমরা আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুগের উদয় বলতে পারি, সেটা কোপারনিকাস এবং গ্যালিলিও থেকে শুরু হয়েছে। এরপর সেই সময়ের মহান ব্রিটিশ বৈজ্ঞানিক আইজেক নিউটন থেকে আধুনিক সৃষ্টি বিজ্ঞানের মহান যুগ শুরু হয়। তারপর মহান বৈজ্ঞানিক আলবার্ট আইনস্টাইন পর্যন্ত বর্তমান বিজ্ঞান অনেক ক্রান্তিকারী অনুসন্ধান করে। সৃষ্টির অনেক গভীর রহস্যকে জানতে ও বুঝতে পারে।
.
এই কালে আধুনিক বিজ্ঞান অত্যুচ্চ টেকনিকের এমন বিকাশ করে যে তার সহায়তায় এই ব্রহ্মাণ্ডের অনেক রহস্য থেকে পর্দা উঠতে থাকে। আইনস্টাইনের পশ্চাৎ আজ পর্যন্ত ব্রহ্মাণ্ডকে জানতে অনেক টেকনিক বিকশিত হয়েছে। অনেক বিচার যা কখনও নতুন ও ক্রান্তিকারী মানা হতো, তাকে পুরোনো ও অবিকশিত ভেবে ত্যাগ বা সংশোধিত করা হচ্ছে। সারা সংসারের বৈজ্ঞানিক ও ইঞ্জিনিয়ার এই ব্রহ্মাণ্ডকে জানতে একসাথে যৌথ প্রচেষ্টা করছে। এইদিকে বিভিন্ন সম্প্রদায় যেন এই বিষয়ে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে। তো কোথাও-কোথাও তারাও আধুনিক বিজ্ঞানের বিবেকহীন বা কোথাও-কোথাও বিচারপূর্বক অনুকরণের চেষ্টা করতে দেখা যায়। একদা যে বেদবিদ্যাকে এই ব্রহ্মাণ্ডের বিজ্ঞান বিষয়ের এক অনুপম ও পূর্ণ বিদ্যার রূপে মানা হতো, মধ্যকালীন অবিদ্যার দুষ্প্রভাবে সেটাও নিজেকে বাঁচাতে পারেনি, আমি এমন মনে করি।
.
যদিও ফাল্গুন কৃষ্ণ দশমী বিক্রম সম্বত ১৮৮১ তদনুসারে ১২ ফেব্রুয়ারি ১৮২৫ সালে ভারতবর্ষে জন্মা ঋষি দয়ানন্দ সরস্বতী সনাতন বৈদিক বিদ্যাকে পুনর্জীবিত করার মহান প্রচেষ্টা করেন, কিন্তু কুটিল কালের গতি তাঁকে না তো পূর্ণ আয়ুপর্যন্ত বাঁচতে দেয় আর না তাঁকে তাঁর অল্পায়ু কালেও পূর্ণ মনোযোগ সহকারে বেদোদ্ধারের কাজ করতে দেয়। এইজন্য বৈদিক সৃষ্টি বিদ্যার অপেক্ষিত ও যথার্থ স্বরূপ প্রকাশিত হতে পারেনি আর যা কিছু হয়েছে, সেটাও সাংকেতিকই রয়ে গেছে, যাকে পূর্ণরূপে বুঝতে পারা প্রত্যেক বিদ্বানের সামর্থ্য নয়।
.
আমি মনে করি সৃষ্টি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে দুটোই পক্ষ আছে, যার উপর এখানে বিচার করা আবশ্যক আর সেগুলো হল - ১. আধুনিক বিজ্ঞানের মান্যতা এবং ২. বৈদিক মান্যতার যথার্থ স্বরূপ। এরমধ্যে এখানে আমরা বৈদিক মান্যতার উপরই এরপর বিচার করার চেষ্টা করবো।
.
সংসারের সব প্রাণীর মধ্যে মানুষ হল সর্বশ্রেষ্ঠ এবং বিশিষ্ট প্রাণী। অন্য সব প্রাণী জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নিজের ভাষা, আহার-বিহার আদির জ্ঞান কখনও বাইরে থেকে শেখে না, বরং তাদের ভিতরে এটা স্বভাবতঃ উৎপন্ন হয়ে যায়। তবে হ্যাঁ, তাদের বাচ্চাকে তাদের মা কিছু-কিছু শিখিয়ে দেয়। তাছাড়া যদি না শিখায়, তাহলেও বিভিন্ন পশু-পক্ষীর বাচ্চা একাকী থেকেও কথা বলা, হাঁটাচলা, ভোজন করা, শিকার করা, সন্তানোৎপত্তি করা, নিজের ঘর-ঘোসলা-বাসা বানানো, বলবানের সামনে ভয় পাওয়া ও নির্বলকে ভয় দেখানো আদি স্বয়ং শিখে নেয়। জীবনযাপন শেখার জন্য তাদেরকে প্রশিক্ষণ, বিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবশ্যকতা হয় না। তাদের জ্ঞান ও ভাষার মধ্যে শিশুকাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কোনো বিশেষ বিকাশ দেখা যায় না। তবে কিছু-কিছু পরিবর্তন দেখা যায়, যেমন বয়স্ক হাতি, শিম্পাঞ্জি, বাঁদর, বাঘ আদি তাদের বাচ্চাদের থেকে একটু অধিক জ্ঞানী ও অনুভবী হয়, তবুও তারা যতই জ্ঞানী হোক না কেন, অতিমূঢ় মানুষের সমানও কখনও হতে পারবে না। তাহলে এখন প্রশ্ন হল, মানব জাতির ভাষা ও জ্ঞানের উৎপত্তি বা বিকাশ কি ক্রমশঃ হয়েছে?
.
সংসারে হাজার-হাজার ভাষায় কথা বলা হয় তথা সারা সংসারে প্রায় আট আরব মানুষ নিজের জ্ঞান-বিজ্ঞানের আশ্চর্যজনক বিকাশ করেছে। আশ্চর্যের কথা হল সারা সংসারের বিভিন্ন জাতির পশু-পক্ষী নিজ-নিজ জাতির অনুসারে প্রায় একইরকম জ্ঞান ও ভাষাকে জানে। তাদের মধ্যে পৃথক-পৃথক স্তর হয় না। একই জাতির বাঁদর বা যেকোনো পশু-পক্ষী স্থান বা কাল ভেদের কারণে পৃথক-পৃথক ভাষায় কথা বলে বা তাদের জ্ঞান ও ব্যবহারের মধ্যে ভিন্নতা হয়, এমন আমরা দেখতে পাই না, অথচ মানব জাতির মধ্যে এমন হয়। ভাই-ভাইয়ের মধ্যেও জ্ঞানের অনেক ভেদ দেখা যায়। যদি মানব শিশুকে কোথাও একাকী রেখে দেওয়া হয়, তাহলে সে কোনো মানবীয় ব্যবহারই জানতে পারবে না। এইসব কেন আর কিভাবে হয়েছে? এই বিষয়ে বর্তমান বিদ্বান প্রায়শঃ বর্তমান বিজ্ঞানের বিকাশবাদী সিদ্ধান্তেরই আশ্রয় নিতে দেখা যায়।
(ক্রমশঃ)