
বেদের প্রাদুর্ভাব
বৃহস্পতে প্রথমম্ বাচো অগ্রম্ য়ৎপ্রৈরত নামধেয়ম্ দধানাঃ।
য়দেষাম্ শ্রেষ্ঠম্ য়দরিপ্রমাসীৎপ্রেণা তদেষাম্ নিহিতম্ গুহাবিঃ।। (ঋগ্বেদ ১০.৭১.১)
.
এখানে এই ঋচার প্রথম পদ "বৃহস্পতে" কে "বৃহস্পতেঃ" মানলে এই সংকেতও পাওয়া যায় যে সেই অন্তরীক্ষে ব্যাপ্ত বেদবাণী হল সম্পূর্ণ বাণী এবং সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের পালক ও স্বামী পরমাত্মারই বাণী অর্থাৎ তাঁর থেকেই উৎপন্ন হয়েছে।
.
ভাবার্থ - সৃষ্টি উৎপন্ন হলে সম্পূর্ণ সৃষ্টির মধ্যে বেদের ঋচা প্রাপ্ত হয়। এই ঋচা পরা ও পশ্যন্তী রূপে সম্পূর্ণ অন্তরীক্ষে ভরে থাকে। প্রথম প্রজন্মে উৎপন্ন সর্বাধিক পবিত্রাত্মা চার ঋষি সমাধিস্থ হয়ে ঈশ্বরের প্রেরণায় এইসব ঋচাকে গ্রহণ করেন। এর পূর্বে মানুষের কোথাও কোনো ভাষাই ছিল না, বরং ভাষার উৎপত্তি এইসব ঋচা উৎপত্তির পশ্চাৎ এরই অপভ্রষ্ট হওয়াতে হয়েছে। এই বাণী থেকে শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে অন্য কোনো ভাষা হওয়া সম্ভব নয়। যখন সেই ঋষি জন বাণীকে সমাহিত চিত্ত দ্বারা অন্তরীক্ষ থেকে গ্রহণ করেন, সেই সময় সেই বাণী শুদ্ধ ও পূর্ণ রূপে তাঁদের অন্তঃকরণে প্রবিষ্ট হয়। কোনো ঋচা ও ঋচার অংশের একটা পদও এই প্রক্রিয়াতে স্রাবিত হয় না অর্থাৎ অন্তরীক্ষে সেই ঋচাগুলো যেরূপ ব্যাপ্ত থাকে, সেগুলোকে সেইরূপে গ্রহণ করা হয়। সেই বাণী অর্থাৎ বেদমন্ত্র সেই ঋষিদের অন্তঃকরণে অত্যন্ত শীঘ্রতাপূর্বক সহজে প্রবিষ্ট হয়ে যায়, যেভাবে কেউ মন্ত্রকে কণ্ঠস্থ করে সেইরূপ নয়। সেই মন্ত্রগুলো অন্তরীক্ষ থেকে সেই ঋষিদের অন্তঃকরণে প্রবেশ করে, এর অর্থ হল সেইসব মন্ত্র ঋষিদের স্মৃতিস্তরে সদ্যঃ অঙ্কিত হয়ে যায়।
বিদ্বানরা বাণীর চারটা রূপ বলেছেন -
চত্বারি বাক্পরিমিতা পদানি তানি বিদুর্ব্রাহ্মণা য়ে মনীষিণঃ। গুহা ত্রীণি নিহিতা নেঙ্গয়ন্তি তুরীয়ম্ বাচো মনুষ্যা বদন্তি।। (ঋগ্বেদ ১.১৬৪.৪৫)
.
উপরোক্ত মন্ত্রের ভাষ্যে ঋষি দয়ানন্দ বৈয়াকরণের দৃষ্টিতে চার প্রকারের বাণী যথা - নাম, আখ্যাত, উপসর্গ এবং নিপাত রূপে বর্গীকৃত করেছেন। আচার্য সায়ণ এই ভাষ্যে বাণীর বর্গীকরণ বৈয়াকরণের দৃষ্টির অতিরিক্ত নৈরুক্ত আদির দৃষ্টিকে নিয়েও করেছেন। এরমধ্যে একটা বর্গীকরণ হল - পরা, পশ্যন্তী, মধ্যমা এবং বৈখরী। এরমধ্যে কেবল বৈখরী বাণী মানুষের ব্যবহারে আসে, বাকি তিন প্রকারের বাণীকে কেবল য়োগী পুরুষই দেখতে বা জানতে পারেন।
.
মহর্ষি প্রবর য়াস্ক নিরুক্ত ১৩.৯ এরমধ্যে এই মন্ত্রের ব্যাখ্যাতে বাণীর বর্গীকরণ নিম্ন প্রকারে করেছেন -
"চত্বারি বাচঃ পরিমিতানি পদানি তানি বিদুর্ব্রাহ্মণা য়ে মেধাবিনঃ গুহায়াম্ ত্রীণি নিহিতানি নার্থম্ বেদয়ন্তে গুহা গূহতেঃ তুরীয়ম্ ত্বরতেঃ কতমানি তানি চত্বারি পদানি ওঙ্কারো মহাব্যাহৃতয়শ্চেত্যার্ষম্ নামাখ্যাতে চোপসর্গনিপাতাশ্চেতি বৈয়াকরণাঃ মন্ত্রঃ কল্পো ব্রাহ্মণম্ চতুর্থী ব্যাবহারিকীতি য়াজ্ঞিকাঃ ঋচো য়জূম্ষি সামানি চতুর্থী ব্যাবহারিকীতি নৈরুক্তাঃ সর্পাণাম্ বাগ্বয়সাম্ ক্ষুদ্রস্য সরীসৃপস্য চতুর্থী ব্যাবহারিকীত্যেকে পশুষু তূণবেষু মৃগেষ্বাত্মনি চেত্যাত্মপ্রবাদাঃ অথাপি ব্রাহ্মণম্ ভবতি।"
.
এখানে বর্গীকরণ নিম্নানুসারে -
১. আর্ষমত - ওঙ্কার আর ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ মহাব্যাহৃতি।
ভগবান্ মনু মহারাজও বলেছেন -
অকারম্ চাপ্যুকারম্ চ মকারম্ চ প্রজাপতিঃ।
বেদত্রয়ান্নিরদুহদ্ ভূর্ভুবঃ স্বরিতীতি চ।। (মনুস্মৃতি ২.৭৬)
অর্থাৎ বেদ থেকে এই চার পদকে প্রজাপতি দোহন করেন - ওম্, ভূঃ, ভুবঃ এবং স্বঃ। বেদের সার হল এটাই।
২. বৈয়াকরণ মত - নাম, আখ্যাত, উপসর্গ এবং নিপাত।
৩. য়াজ্ঞিক মত - মন্ত্র, কল্প, ব্রাহ্মণ এবং ব্যাবহারিকী অর্থাৎ লোকভাষা।
৪. নৈরুক্ত মত - ঋক্, য়জুঃ, সাম এবং ব্যাবহারিকী অর্থাৎ লোকভাষা।
৫. অন্য মত - সর্পের বাক্, পক্ষীর বাক্, ক্ষুদ্র সরীসৃপের বাক্ তথা ব্যাবহারিকী (মানব - লোকভাষা)।
৬. আত্মবাদী মত - পশু, বাদ্যযন্ত্র, সিংহ আদির মধ্যে এবং আত্মার মধ্যে অর্থাৎ মানুষের ব্যাবহারিকী বাণী।
.
এর অতিরিক্ত নিরুক্তকার (১৩.৯) বাণীর অন্য শ্রেণী সম্বন্ধে মৈত্রায়াণী সংহিতাকে উদ্ধৃত করে বলেছেন -
"অথাপি ব্রাহ্মণম্ ভবতি - সা বৈ বাক্ সৃষ্টা চতুর্থা ব্যভবৎ এষু লোকেষু ত্রীণি তুরীয়াণি পশুষু তুরীয়ম্য়া পৃথিব্যাম্ সাগ্নৌ সা রথন্তরে য়ান্তরিক্ষে সা বাতে সা বামদেব্যে য়া দিবি সা বৃহতী সা স্তনয়িত্নৌ অথ পশুষু ততো য়া বাগত্যরিচ্যত তাম্ ব্রাহ্মণে ন্বদধু, স্তস্মাদ্ ব্রাহ্মণ উভয়ীম্ বাচম্ বদতি য়শ্চ দেব য়শ্চ ন..."
.
অর্থাৎ সেই উৎপন্ন হওয়া বাণী চার প্রকারের হয়। ভূঃ, ভুবঃ এবং স্বঃ এই তিন লোক বা সূক্ষ্ম ছন্দ রশ্মিরূপে তিন প্রকারে তথা পশু অর্থাৎ বিভিন্ন মরুত্ ও ছন্দ রশ্মি রূপে [পশবো বৈ মরুতঃ] চতুর্থ প্রকারে। যে বাণী পৃথিবীর মধ্যে আছে, সেটাই অগ্নি তথা রথন্তর সামের মধ্যে আছে। এর তাৎপর্য হল যে বাণী অপ্রকাশিত পরমাণুর মধ্যে আছে, সেটা ঊষ্মা ও বিদ্যুৎ যুক্ত কণার মধ্যেও আছে তথা সেই বাণী রথন্তর সাম অর্থাৎ এমন তীব্র বিকিরণ, যা রমণীয় হয়েও তীক্ষ্ণ ভেদক তথা বিভিন্ন কণাকে অতিক্রমকারী হয়, তাতেও বিদ্যমান আছে। যে বাণী অন্তরীক্ষে আছে, সেই বাণী বায়ুর (সূক্ষ্ম ও স্থূল) মধ্যেও বিদ্যমান আছে। এখানে সূক্ষ্ম বায়ুর তাৎপর্য বিভিন্ন প্রকারের প্রাণের সঙ্গে হবে। সেই বাণী বামদেব্য অর্থাৎ বিভিন্ন সৃজন-প্রজনন কর্মে অংশগ্রহণ কারী প্রশস্য ও প্রকাশমান প্রাণ তত্ত্বের মধ্যেও বিদ্যমান আছে। যে বাণী দ্যুলোক অর্থাৎ সূর্যাদি তারার মধ্যে আছে, সেটাই সেগুলোর কিরণের মধ্যে তথা সেইরূপ বাণী স্তনয়িন্তু অর্থাৎ শব্দ করতে থাকা বিদ্যুতের মধ্যেও আছে। এছাড়া অন্য বাণী পশু অর্থাৎ মানুষের ব্যাবহারিকীর (লোক ভাষা) হয়। এর অতিরিক্ত যেসব বাণী আছে, পরমাত্মা সেগুলো ব্রাহ্মণের মধ্যে ধারণ করেন। এখানে ব্রাহ্মণের অর্থ হল - অত্যুচ্চ স্তরের য়োগী পুরুষ, যিনি পরমব্রহ্ম পরমাত্মার সঙ্গে সর্বদা রমণ করেন। এমন ব্রহ্মবেত্তা মহাপুরুষ দুই প্রকারের (মোট চার প্রকারের) বাণী, সেগুলো বিভিন্ন দেবের (লোক আদি) মধ্যে বিদ্যমান হলেও অথবা মানুষের কথা বলার বাণী হলেও, তাঁরা জানেন। এমন ব্রাহ্মণের অক্ষর স্তুতি হয়।
.
এখানে নিরুক্তকার স্বমত তথা মৈত্রায়ণী সংহিতার মত থেকে বাক্-তত্ত্বের গম্ভীর ও ব্যাপক স্বরূপের উপর প্রকাশ ফেলেছেন।
.
বর্তমান বৈজ্ঞানিকও অনেক প্রকারের ধ্বনিকে জানে। সুপারনোবার বিস্ফোরণ থেকে উৎপন্ন অতি শক্তিশালী তরঙ্গকে বৈজ্ঞানিক শক-ওয়েবস বলে। ইউ.এস.এ. খগোল ভৌতিকশাস্ত্রী জন গ্রিবিন ডার্ক ম্যাটার তথা কোস্মিক কিরণের মধ্যেও সূক্ষ্ম ধ্বনি তরঙ্গের উপস্থিতি মানেন। একথা তিনি তাঁর পুস্তক "দ্য অরিজিন্স অফ দ্য ফিউচার - টেন কোশ্চেনস ফর দ্য নেক্সট টেন ইয়ার" পৃষ্ঠা ১৩০ ও ১৩৪ এরমধ্যে লিখেছেন। সৃষ্টি উৎপত্তির মহা বিস্ফোরণে (বিগ ব্যাং) যে ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশনের তাপমাত্রা ২.৭ কেলভিন মানা হয়, সেই অত্যন্ত শীতল রেডিয়েশনের মধ্যেও অত্যন্ত সূক্ষ্ম স্পন্দন (ফ্লাকচুয়েশন) হওয়াকে বৈজ্ঞানিক মানে আর এই উত্থান-পতন ধ্বনি তরঙ্গের রূপে হয়। "দ্য ট্রবল উইথ ফিজিক্স" নামক পুস্তকের ২০৫ পৃষ্ঠাতে লি স্মোলিন লিখেছেন -
"Over the last decades, the temperature fluctuations of the microwave background have been mapped by satellites, balloon borne detectors, and ground based detectors, one way to understand what these experiments measure is to think of the fluctuations as if they were sound waves in the early universe."
এখানে স্পষ্টভাবে সূক্ষ্ম ধ্বনি তরঙ্গের চর্চা করা হয়েছে। সূর্যতে হওয়া বিস্ফোরণ তথা সামান্য অবস্থাতেও পৃথিবীর ভিতরে বিভিন্ন গতিবিধি এবং অন্তরীক্ষে কোস্মিক রেজের সংঘর্ষ থেকেও ধ্বনি তরঙ্গের উৎপত্তিকে বৈজ্ঞানিক মানে ও জানে। যে কথা বৈজ্ঞানিক আজ জানেছে, তার থেকেও সূক্ষ্ম বিজ্ঞানকে মহর্ষি য়াস্ক ও মৈত্রায়ণী সংহিতাকার সহস্র বছর পূর্বে জানতেন। বৈদিক সাহিত্যের মধ্যে বাক্ সম্বন্ধীয় বিজ্ঞান হল খুবই বিস্তৃত ও গম্ভীর। এই ধ্বনি আসলে কি, একে বৈজ্ঞানিক এখন পর্যন্ত পুরোপুরি ভাবে জানতে পারেনি।
.
ধ্বনির বিষয়ে বৈজ্ঞানিকদের কথন হল -
"Sound is an alteration in pressure, stress, particle displacement or particle velocity, which is propogated in an elastic material, or the superposition of such propogated vibrations." (Definition recommended by American Standard Association) - "Acoustics" By Joseph L. Hunter
.
এখানে নিশ্চিত ভাবে ধ্বনির স্পষ্ট ও উত্তম স্বরূপ বলা হয়নি, বরং কোনো পদার্থে উৎপন্ন চাপের রূপেই ধ্বনি তরঙ্গকে গ্রহণ করা হয়েছে। এটা অতি সাধারণ কথা। সেই চাপ কেন ও কিভাবে উৎপন্ন হয়, একথা বর্তমান বিজ্ঞান কিছুই স্পষ্ট করে বলতে পারে না।
.
বর্তমান বৈজ্ঞানিক প্রকাশাদি বিকিরণের মতো ধ্বনির কণাকেও কল্পনা করে। "কিউ ইজ ফর কোয়ান্টাম পার্টিকল ফিজিক্স ফ্রম এ টু জেড" নামক পুস্তকের ২৮১ পৃষ্ঠাতে জোন গ্রীবিন ধ্বনি কণা ফোননের বিষয়ে লিখেছেন -
"Phonon - A particle of sound travelling through a crystal lattice. The idea of a sound wave can be replaced by the idea of phonons in an analogous way to the description of light in terms of photons."
.
এখানে ধ্বনির কণার ধারণা স্পষ্ট আছে। বৈদিক বিচার ধারার মধ্যেও শব্দ তন্মাত্রার মান্যতা সনাতন থেকে চলে আসছে।
.
এই পর্যন্ত বাণীর বিভিন্ন রূপের চর্চা করার পর এখন আমরা পরা, পশ্যন্তী, মধ্যমা তথা বৈখরী এই চার রূপের উপর বিশেষ চর্চা করবো। বাণীর এই বিভাগ যেটা আচার্য সায়ণ করেছেন, তার প্রামাণিকতার উপর কিছু আর্য বিদ্বান প্রশ্ন তুলতে পারেন। যদিও বৈদিক গ্রন্থকে বুঝতে হলে আচার্য সায়ণের শৈলী খুবই দোষপূর্ণ কিংবা মূর্খতাপূর্ণ। যে ঐতরেয় ব্রাহ্মণের আমি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করেছি, তাতে সায়ণ ভাষ্যের প্রায় উপেক্ষাই করেছি, কারণ তাঁর ভাষ্য সর্বথা দোষপূর্ণ, কোথাও-কোথাও বীভৎস, অশ্লীল, মূর্খতাপূর্ণ তথা বৈদিক দৃষ্টির একদম বিপরীত আছে। এতকিছুর পরও সায়ণাচার্যের কোনো উচিত কথাকেও অস্বীকার করা হোক, সেটা আমি স্বীকার করি না। এই বিষয়ে প্রসিদ্ধ আর্য বিদ্বান পণ্ডিত ভগবৎদত্ত রিসার্চ স্কলার তাঁর নিরুক্ত ১৩.৯ ভাষ্যের মধ্যে লিখেছেন -
.
"পরাবাক্ সিদ্ধান্ত নতুন নয়। দেবকী পুত্র ভগবান্ কৃষ্ণ এর বর্ণনা সাম্ব পঞ্চাশিকার তৃতীয় শ্লোকে করেছেন।"
.
এইভাবে মহৎ বেদবিজ্ঞানী য়োগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের মত আমি সর্বথা স্বীকার করি। যে বিদ্বান এর উপরও শঙ্কা করেন, তাদের কোনো উপায় নেই।
.
পরা, পশ্যন্তী আদি বাণীর চার রূপের চর্চা ব্যাকরণ মহাভাষ্যের ভাষ্য প্রদীপে আচার্য কৈয়ট তথা নাগেশ ভোট্টও করেছেন। ইনি "বাক্যপদীয়মে"র অনেক শ্লোককেও উদ্ধৃত করেছেন। (achrya agnivrat)
চত্বারি বাক্পরিমিতা পদানি তানি বিদুর্ব্রাহ্মণা য়ে মনীষিণঃ। গুহা ত্রীণি নিহিতা নেঙ্গয়ন্তি তুরীয়ম্ বাচো মনুষ্যা বদন্তি।। (ঋগ্বেদ ১.১৬৪.৪৫)
.
উপরোক্ত মন্ত্রের ভাষ্যে ঋষি দয়ানন্দ বৈয়াকরণের দৃষ্টিতে চার প্রকারের বাণী যথা - নাম, আখ্যাত, উপসর্গ এবং নিপাত রূপে বর্গীকৃত করেছেন। আচার্য সায়ণ এই ভাষ্যে বাণীর বর্গীকরণ বৈয়াকরণের দৃষ্টির অতিরিক্ত নৈরুক্ত আদির দৃষ্টিকে নিয়েও করেছেন। এরমধ্যে একটা বর্গীকরণ হল - পরা, পশ্যন্তী, মধ্যমা এবং বৈখরী। এরমধ্যে কেবল বৈখরী বাণী মানুষের ব্যবহারে আসে, বাকি তিন প্রকারের বাণীকে কেবল য়োগী পুরুষই দেখতে বা জানতে পারেন।
.
মহর্ষি প্রবর য়াস্ক নিরুক্ত ১৩.৯ এরমধ্যে এই মন্ত্রের ব্যাখ্যাতে বাণীর বর্গীকরণ নিম্ন প্রকারে করেছেন -
"চত্বারি বাচঃ পরিমিতানি পদানি তানি বিদুর্ব্রাহ্মণা য়ে মেধাবিনঃ গুহায়াম্ ত্রীণি নিহিতানি নার্থম্ বেদয়ন্তে গুহা গূহতেঃ তুরীয়ম্ ত্বরতেঃ কতমানি তানি চত্বারি পদানি ওঙ্কারো মহাব্যাহৃতয়শ্চেত্যার্ষম্ নামাখ্যাতে চোপসর্গনিপাতাশ্চেতি বৈয়াকরণাঃ মন্ত্রঃ কল্পো ব্রাহ্মণম্ চতুর্থী ব্যাবহারিকীতি য়াজ্ঞিকাঃ ঋচো য়জূম্ষি সামানি চতুর্থী ব্যাবহারিকীতি নৈরুক্তাঃ সর্পাণাম্ বাগ্বয়সাম্ ক্ষুদ্রস্য সরীসৃপস্য চতুর্থী ব্যাবহারিকীত্যেকে পশুষু তূণবেষু মৃগেষ্বাত্মনি চেত্যাত্মপ্রবাদাঃ অথাপি ব্রাহ্মণম্ ভবতি।"
.
এখানে বর্গীকরণ নিম্নানুসারে -
১. আর্ষমত - ওঙ্কার আর ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ মহাব্যাহৃতি।
ভগবান্ মনু মহারাজও বলেছেন -
অকারম্ চাপ্যুকারম্ চ মকারম্ চ প্রজাপতিঃ।
বেদত্রয়ান্নিরদুহদ্ ভূর্ভুবঃ স্বরিতীতি চ।। (মনুস্মৃতি ২.৭৬)
অর্থাৎ বেদ থেকে এই চার পদকে প্রজাপতি দোহন করেন - ওম্, ভূঃ, ভুবঃ এবং স্বঃ। বেদের সার হল এটাই।
২. বৈয়াকরণ মত - নাম, আখ্যাত, উপসর্গ এবং নিপাত।
৩. য়াজ্ঞিক মত - মন্ত্র, কল্প, ব্রাহ্মণ এবং ব্যাবহারিকী অর্থাৎ লোকভাষা।
৪. নৈরুক্ত মত - ঋক্, য়জুঃ, সাম এবং ব্যাবহারিকী অর্থাৎ লোকভাষা।
৫. অন্য মত - সর্পের বাক্, পক্ষীর বাক্, ক্ষুদ্র সরীসৃপের বাক্ তথা ব্যাবহারিকী (মানব - লোকভাষা)।
৬. আত্মবাদী মত - পশু, বাদ্যযন্ত্র, সিংহ আদির মধ্যে এবং আত্মার মধ্যে অর্থাৎ মানুষের ব্যাবহারিকী বাণী।
.
এর অতিরিক্ত নিরুক্তকার (১৩.৯) বাণীর অন্য শ্রেণী সম্বন্ধে মৈত্রায়াণী সংহিতাকে উদ্ধৃত করে বলেছেন -
"অথাপি ব্রাহ্মণম্ ভবতি - সা বৈ বাক্ সৃষ্টা চতুর্থা ব্যভবৎ এষু লোকেষু ত্রীণি তুরীয়াণি পশুষু তুরীয়ম্য়া পৃথিব্যাম্ সাগ্নৌ সা রথন্তরে য়ান্তরিক্ষে সা বাতে সা বামদেব্যে য়া দিবি সা বৃহতী সা স্তনয়িত্নৌ অথ পশুষু ততো য়া বাগত্যরিচ্যত তাম্ ব্রাহ্মণে ন্বদধু, স্তস্মাদ্ ব্রাহ্মণ উভয়ীম্ বাচম্ বদতি য়শ্চ দেব য়শ্চ ন..."
.
অর্থাৎ সেই উৎপন্ন হওয়া বাণী চার প্রকারের হয়। ভূঃ, ভুবঃ এবং স্বঃ এই তিন লোক বা সূক্ষ্ম ছন্দ রশ্মিরূপে তিন প্রকারে তথা পশু অর্থাৎ বিভিন্ন মরুত্ ও ছন্দ রশ্মি রূপে [পশবো বৈ মরুতঃ] চতুর্থ প্রকারে। যে বাণী পৃথিবীর মধ্যে আছে, সেটাই অগ্নি তথা রথন্তর সামের মধ্যে আছে। এর তাৎপর্য হল যে বাণী অপ্রকাশিত পরমাণুর মধ্যে আছে, সেটা ঊষ্মা ও বিদ্যুৎ যুক্ত কণার মধ্যেও আছে তথা সেই বাণী রথন্তর সাম অর্থাৎ এমন তীব্র বিকিরণ, যা রমণীয় হয়েও তীক্ষ্ণ ভেদক তথা বিভিন্ন কণাকে অতিক্রমকারী হয়, তাতেও বিদ্যমান আছে। যে বাণী অন্তরীক্ষে আছে, সেই বাণী বায়ুর (সূক্ষ্ম ও স্থূল) মধ্যেও বিদ্যমান আছে। এখানে সূক্ষ্ম বায়ুর তাৎপর্য বিভিন্ন প্রকারের প্রাণের সঙ্গে হবে। সেই বাণী বামদেব্য অর্থাৎ বিভিন্ন সৃজন-প্রজনন কর্মে অংশগ্রহণ কারী প্রশস্য ও প্রকাশমান প্রাণ তত্ত্বের মধ্যেও বিদ্যমান আছে। যে বাণী দ্যুলোক অর্থাৎ সূর্যাদি তারার মধ্যে আছে, সেটাই সেগুলোর কিরণের মধ্যে তথা সেইরূপ বাণী স্তনয়িন্তু অর্থাৎ শব্দ করতে থাকা বিদ্যুতের মধ্যেও আছে। এছাড়া অন্য বাণী পশু অর্থাৎ মানুষের ব্যাবহারিকীর (লোক ভাষা) হয়। এর অতিরিক্ত যেসব বাণী আছে, পরমাত্মা সেগুলো ব্রাহ্মণের মধ্যে ধারণ করেন। এখানে ব্রাহ্মণের অর্থ হল - অত্যুচ্চ স্তরের য়োগী পুরুষ, যিনি পরমব্রহ্ম পরমাত্মার সঙ্গে সর্বদা রমণ করেন। এমন ব্রহ্মবেত্তা মহাপুরুষ দুই প্রকারের (মোট চার প্রকারের) বাণী, সেগুলো বিভিন্ন দেবের (লোক আদি) মধ্যে বিদ্যমান হলেও অথবা মানুষের কথা বলার বাণী হলেও, তাঁরা জানেন। এমন ব্রাহ্মণের অক্ষর স্তুতি হয়।
.
এখানে নিরুক্তকার স্বমত তথা মৈত্রায়ণী সংহিতার মত থেকে বাক্-তত্ত্বের গম্ভীর ও ব্যাপক স্বরূপের উপর প্রকাশ ফেলেছেন।
.
বর্তমান বৈজ্ঞানিকও অনেক প্রকারের ধ্বনিকে জানে। সুপারনোবার বিস্ফোরণ থেকে উৎপন্ন অতি শক্তিশালী তরঙ্গকে বৈজ্ঞানিক শক-ওয়েবস বলে। ইউ.এস.এ. খগোল ভৌতিকশাস্ত্রী জন গ্রিবিন ডার্ক ম্যাটার তথা কোস্মিক কিরণের মধ্যেও সূক্ষ্ম ধ্বনি তরঙ্গের উপস্থিতি মানেন। একথা তিনি তাঁর পুস্তক "দ্য অরিজিন্স অফ দ্য ফিউচার - টেন কোশ্চেনস ফর দ্য নেক্সট টেন ইয়ার" পৃষ্ঠা ১৩০ ও ১৩৪ এরমধ্যে লিখেছেন। সৃষ্টি উৎপত্তির মহা বিস্ফোরণে (বিগ ব্যাং) যে ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশনের তাপমাত্রা ২.৭ কেলভিন মানা হয়, সেই অত্যন্ত শীতল রেডিয়েশনের মধ্যেও অত্যন্ত সূক্ষ্ম স্পন্দন (ফ্লাকচুয়েশন) হওয়াকে বৈজ্ঞানিক মানে আর এই উত্থান-পতন ধ্বনি তরঙ্গের রূপে হয়। "দ্য ট্রবল উইথ ফিজিক্স" নামক পুস্তকের ২০৫ পৃষ্ঠাতে লি স্মোলিন লিখেছেন -
"Over the last decades, the temperature fluctuations of the microwave background have been mapped by satellites, balloon borne detectors, and ground based detectors, one way to understand what these experiments measure is to think of the fluctuations as if they were sound waves in the early universe."
এখানে স্পষ্টভাবে সূক্ষ্ম ধ্বনি তরঙ্গের চর্চা করা হয়েছে। সূর্যতে হওয়া বিস্ফোরণ তথা সামান্য অবস্থাতেও পৃথিবীর ভিতরে বিভিন্ন গতিবিধি এবং অন্তরীক্ষে কোস্মিক রেজের সংঘর্ষ থেকেও ধ্বনি তরঙ্গের উৎপত্তিকে বৈজ্ঞানিক মানে ও জানে। যে কথা বৈজ্ঞানিক আজ জানেছে, তার থেকেও সূক্ষ্ম বিজ্ঞানকে মহর্ষি য়াস্ক ও মৈত্রায়ণী সংহিতাকার সহস্র বছর পূর্বে জানতেন। বৈদিক সাহিত্যের মধ্যে বাক্ সম্বন্ধীয় বিজ্ঞান হল খুবই বিস্তৃত ও গম্ভীর। এই ধ্বনি আসলে কি, একে বৈজ্ঞানিক এখন পর্যন্ত পুরোপুরি ভাবে জানতে পারেনি।
.
ধ্বনির বিষয়ে বৈজ্ঞানিকদের কথন হল -
"Sound is an alteration in pressure, stress, particle displacement or particle velocity, which is propogated in an elastic material, or the superposition of such propogated vibrations." (Definition recommended by American Standard Association) - "Acoustics" By Joseph L. Hunter
.
এখানে নিশ্চিত ভাবে ধ্বনির স্পষ্ট ও উত্তম স্বরূপ বলা হয়নি, বরং কোনো পদার্থে উৎপন্ন চাপের রূপেই ধ্বনি তরঙ্গকে গ্রহণ করা হয়েছে। এটা অতি সাধারণ কথা। সেই চাপ কেন ও কিভাবে উৎপন্ন হয়, একথা বর্তমান বিজ্ঞান কিছুই স্পষ্ট করে বলতে পারে না।
.
বর্তমান বৈজ্ঞানিক প্রকাশাদি বিকিরণের মতো ধ্বনির কণাকেও কল্পনা করে। "কিউ ইজ ফর কোয়ান্টাম পার্টিকল ফিজিক্স ফ্রম এ টু জেড" নামক পুস্তকের ২৮১ পৃষ্ঠাতে জোন গ্রীবিন ধ্বনি কণা ফোননের বিষয়ে লিখেছেন -
"Phonon - A particle of sound travelling through a crystal lattice. The idea of a sound wave can be replaced by the idea of phonons in an analogous way to the description of light in terms of photons."
.
এখানে ধ্বনির কণার ধারণা স্পষ্ট আছে। বৈদিক বিচার ধারার মধ্যেও শব্দ তন্মাত্রার মান্যতা সনাতন থেকে চলে আসছে।
.
এই পর্যন্ত বাণীর বিভিন্ন রূপের চর্চা করার পর এখন আমরা পরা, পশ্যন্তী, মধ্যমা তথা বৈখরী এই চার রূপের উপর বিশেষ চর্চা করবো। বাণীর এই বিভাগ যেটা আচার্য সায়ণ করেছেন, তার প্রামাণিকতার উপর কিছু আর্য বিদ্বান প্রশ্ন তুলতে পারেন। যদিও বৈদিক গ্রন্থকে বুঝতে হলে আচার্য সায়ণের শৈলী খুবই দোষপূর্ণ কিংবা মূর্খতাপূর্ণ। যে ঐতরেয় ব্রাহ্মণের আমি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করেছি, তাতে সায়ণ ভাষ্যের প্রায় উপেক্ষাই করেছি, কারণ তাঁর ভাষ্য সর্বথা দোষপূর্ণ, কোথাও-কোথাও বীভৎস, অশ্লীল, মূর্খতাপূর্ণ তথা বৈদিক দৃষ্টির একদম বিপরীত আছে। এতকিছুর পরও সায়ণাচার্যের কোনো উচিত কথাকেও অস্বীকার করা হোক, সেটা আমি স্বীকার করি না। এই বিষয়ে প্রসিদ্ধ আর্য বিদ্বান পণ্ডিত ভগবৎদত্ত রিসার্চ স্কলার তাঁর নিরুক্ত ১৩.৯ ভাষ্যের মধ্যে লিখেছেন -
.
"পরাবাক্ সিদ্ধান্ত নতুন নয়। দেবকী পুত্র ভগবান্ কৃষ্ণ এর বর্ণনা সাম্ব পঞ্চাশিকার তৃতীয় শ্লোকে করেছেন।"
.
এইভাবে মহৎ বেদবিজ্ঞানী য়োগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের মত আমি সর্বথা স্বীকার করি। যে বিদ্বান এর উপরও শঙ্কা করেন, তাদের কোনো উপায় নেই।
.
পরা, পশ্যন্তী আদি বাণীর চার রূপের চর্চা ব্যাকরণ মহাভাষ্যের ভাষ্য প্রদীপে আচার্য কৈয়ট তথা নাগেশ ভোট্টও করেছেন। ইনি "বাক্যপদীয়মে"র অনেক শ্লোককেও উদ্ধৃত করেছেন। (achrya agnivrat)
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ