নববর্ষষ্টি - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

16 December, 2025

নববর্ষষ্টি

নববর্ষষ্টি


সমীক্ষা 

সুপ্রসিদ্ধ, প্রাজ্ঞ বিদ্বান শ্রী পণ্ডিত উদয়নাচার্য রচিত বৈদিক-পর্ব-পদ্ধতি নববর্ষেষ্টি গ্রন্থটি বিভিন্ন শিরোনামে বিভক্ত এক অমূল্য কৃতি। উপস্থাপিত এই গ্রন্থের সূচনালগ্নে ‘পর্ব-মীমাংসা’ (বেদকালীন পর্বপদ্ধতি) প্রসঙ্গে পর্বশব্দ, পর্ব-যজ্ঞ এবং পর্ব-পদ্ধতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বৈদিক মন্ত্রগুলির পারস্পরিক সামঞ্জস্য সহ বিস্তৃত ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে। 

লেখকের অভিমত এই যে, ভারতদেশের গৌরবের মূল কারণ হলো বেদ ও বৈদিক পরম্পরা। যোগদর্শন ২.১৮-এর প্রমাণ উপস্থাপন করে তিনি বলেন, পরমাত্মা ভোগ ও অপবর্গ (মোক্ষ) — এই দুই উদ্দেশ্যেই সৃষ্টির রচনা করেছেন। এই উদ্দেশ্যের পরিপূর্ণতা কেবল বেদজ্ঞানের মাধ্যমেই সম্ভব। বেদ ও বৈদিক সাহিত্য ভোগ এবং মোক্ষের এক সমন্বিত পথ প্রদর্শন করে। ভারতীয় সমাজের সাধারণ জীবনযাপন বৈদিক সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত, এবং বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে যে আনন্দোৎসবের সঙ্গে আয়োজন করা হয়, সেগুলিকেই ‘পর্ব’ বলা হয়। কোষকারগণ ‘পর্ব’ শব্দের বারোটি অর্থ উল্লেখ করেছেন।

এই গ্রন্থে বেদ, ব্রাহ্মণগ্রন্থ, নিরুক্ত, নিঘণ্টু, মহাভাষ্য, ন্যায়দর্শন, কাত্যায়ন শ্রৌতসূত্র, শাঙ্খায়ন শ্রৌতসূত্র, আশ্বলায়ন শ্রৌতসূত্র, তৈত্তিরীয় সংহিতা, মৈত্রায়ণী সংহিতা, জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ, মনুস্মৃতি প্রভৃতি গ্রন্থের প্রমাণের ভিত্তিতে পর্ব এবং পর্ব-যজ্ঞের অনুষ্ঠান বিষয়ক আলোচনা করা হয়েছে। পরবর্তীতে ব্রত ও উপবাস শব্দের প্রকৃত অর্থ এবং তাদের যথার্থতা নিয়েও বিচার করা হয়েছে। যেমন—

উপ সমীপে যো বাসো জীবাত্মা-পরমাত্মনোঃ ।
উপবাসঃ স বিজ্ঞেয়ো ন তু কায়স্য শোষণম্ ॥ (বরাহোপ ০২.৩৯)

সমাজে প্রচলিত শুভ–অশুভ ধারণা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করতে গিয়ে লেখক বলেন— ‘পর্বের দিনগুলোকে প্রায় সকলেই শুভদিন (সুদিন) বলেই মনে করেন। কিন্তু বার, তিথি, মুহূর্ত, নক্ষত্র, গ্রহ, রাশি ইত্যাদির মধ্যে কিছুকে শুভ এবং কিছুকে অশুভ বলে মানা হয়, এবং এদের কারণেই শুভ–অশুভ বা সুখ–দুঃখ লাভ হয়— এমন বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে। এই ধারণা মূলত পৌরাণিক যুগে রচিত ফলিত জ্যোতিষের গ্রন্থসমূহের কুপ্রভাব, যা সম্পূর্ণরূপে কল্পিত, ভিত্তিহীন ও অবিবেচনাপূর্ণ। লেখক প্রমাণসহ স্পষ্ট করেছেন যে বেদ ও আর্ষগ্রন্থসমূহের দৃষ্টিভঙ্গি এর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, এবং তা ত্রিকালিক সত্য। বেদের সিদ্ধান্ত হলো— শুভ–অশুভ, ভাগ্য ইত্যাদি সবই মানুষের নিজের হাতে, অর্থাৎ তার কর্মের অধীন—
“কৃতং মে দক্ষিণে হস্তে জयो মে সব্য আহিতঃ” (অথর্ববেদ ৭.৫০.৮)।

এরপর বৈদিক মন্ত্রের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে কীভাবে জীবনের প্রতিটি দিনকে পর্বময় করে তোলা যায়। প্রমাণবিশেষজ্ঞ লেখক শতপথ ব্রাহ্মণের প্রামাণ্য বিদ্বান, তাঁর বেদগুরু স্বামী সমর্পণানন্দ সরস্বতী (পণ্ডিত বুদ্ধদেব বিদ্যলঙ্কার)-এর বক্তব্য অবিকল উদ্ধৃত করে বোঝিয়েছেন যে শাস্ত্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সমগ্র বছরের সকল পর্ব কীভাবে ব্যক্তিগত জীবনে পালন বা আত্মস্থ করা যায়। অধ্যায়ের শেষে পর্বের তাৎপর্য উপলব্ধি করানোর জন্য একটি মন্ত্র উদ্ধৃত করে লেখক তাঁর বক্তব্যের উপসংহার টেনেছেন—

“যদেষামন্যো অন্যস্য বাচং শাক্তস্যেব বদতি শিক্ষমাণঃ।
সর্বং তদেষাং সমৃদ্ধেব পর্ব যৎসুবাচো বদথনাধ্যপ্সু॥” (ঋগ্বেদ ৯.১০৩.৫)

অর্থাৎ— বেদজ্ঞানের প্রচার ও প্রসার করাই প্রতিটি মানুষের পর্ব, অর্থাৎ পালনীয় কর্তব্য।

‘নববর্ষেষ্টি’ শিরোনামের অধীনে চৈত্র শুক্ল প্রতিপদায় নবসংবৎসরোৎসব (নতুন সংবৎসরের সূচনার পর্ব) পালনের জন্য বিশেষ মন্ত্রসহ আহুতির বিধান নির্দেশ করা হয়েছে।

মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী সকল মানুষের জন্য যে বেদোক্ত ঋতুচর্যার নির্দেশ দিয়েছেন, তা এই গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে। পাশাপাশি বসন্ত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ ও হেমন্ত— এই পাঁচ ঋতুতে জীবনযাপন কেমন হওয়া উচিত, তা বেদানুসারে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। দৈনন্দিন আচরণের অন্তর্গত জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো উপস্থাপন করে, জীবনের সাফল্যের মূলমন্ত্রও বেদানুসারে নির্ধারণ করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য যে, ঋষি দয়ানন্দ প্রণীত ‘সংস্কারবিধি’-র নামকরণ সংস্কারের শেষে নির্দিষ্ট আশীর্বচনেও এই কামনাই করা হয়েছে— দিন ও রাত, পক্ষ, মাস, ঋতু ও সংবৎসর যেন বার্ধক্য পর্যন্ত সুখসহকারে বৃদ্ধি লাভ করে—
“ওঁ স ত্বাহ্নে পরিদদাত্বহস্ত্বা রাত্র্যে পরিদদাতু রাত্রিস্ত্বা
অহোরাত্রাভ্যাং পরিদদাত্বহোরাত্রী ত্বার্ধমাসেভ্যঃ পরিদত্তামর্ধমাসাস্ত্বা
মাসেভ্যঃ পরিদদাতু মাসাস্ত্বা ঋতুভ্যঃ পরিদদাত্বৃতবস্ত্বা
সংবৎসরায় পরিদদাতু সংবৎসরস্ত্বায়ুষে জরায়ে পরিদদাতু, অসৌ॥”

‘নববর্ষের হর্ষ— কখন, কীভাবে এবং কেন’ শিরোনামে বহুশ্রুত লেখক পাশ্চাত্য নববর্ষ (১ জানুয়ারি) মানার অসংগততা প্রমাণ করতে ইউরোপীয় ধারণাগুলির বিস্তৃত পরিচয় দিয়েছেন। এর বিপরীতে প্রকৃত নতুন সংবৎসর সম্পর্কে যুক্তিসংগত আলোচনা করে স্পষ্ট করা হয়েছে যে নববর্ষের অর্থ হলো সৃষ্টির জন্মদিন; সেই দিন থেকেই নববর্ষের সূচনা হয়। এই সৃষ্টি উৎপন্ন হওয়ার পর থেকে এখনও পর্যন্ত (বিক্রম সংবৎ ২০৭১, মার্চ ২০১৪ পর্যন্ত) ১,৯৭,২৯,৪৯,১১৫ (একশ সাতানব্বই কোটি ঊনত্রিশ লক্ষ ঊনচল্লিশ হাজার একশ পনেরো) বছর অতিবাহিত হয়েছে।

বেদাদি গ্রন্থ অনুসারে বসন্ত ঋতুর সূচনাকেই সংবৎসর বা কালগণনার আরম্ভ বলা হয়েছে—
“মধুশ্চ মাধবশ্চ বাসন্তিকাবৃতূ, শুক্রশ্চ শুচিশ্চ গ্রৈষ্মাবৃতূ,
নভশ্চ नभস্যশ্চ বার্ষিকাবৃতূ, ইষশ্চ ঊর্জশ্চ শারদাবৃতূ,
সহশ্চ সহস্যশ্চ হেমন্তিকাবৃতূ, তপশ্চ তপস্যশ্চ।”

শৈশির ঋতু (তৈত্তিরীয় সংহিতা ৪.৪.১১.১; ১.৪.১৪; আরও দ্রষ্টব্য যজুর্বেদ ১৩.২৫; ১৪.৬, ১৫, ১৬, ২৭; ১৫.৫৭)।
এখানে স্পষ্টভাবে বসন্ত প্রভৃতি ছয়টি ঋতুর বর্ণনা পাওয়া যায় এবং প্রতিটি ঋতু দুইটি করে মাসে বিভক্ত। এতে পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয় যে বর্ষের সূচনা বসন্ত ঋতু থেকেই, অর্থাৎ মধুমাস থেকে। এখানে এটিও বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে সৃষ্টির আদিতে প্রকাশিত বেদেই বারোটি মাস ও ছয়টি ঋতুর উল্লেখ রয়েছে।

এইভাবে এক বছরে (১২ মাস × ৩০ দিন) মোট ৩৬০ দিন হয়— এ কথার বর্ণনাও বৈদিক মন্ত্রে পাওয়া যায়। যেমন—

“য়ে ত্রিষপ্তাঃ পরিযন্তি বিশ্বা রূপাণি বিশ্রতঃ …”
(অথর্ববেদ ১.১.১)

এখানে ‘ত্রিষপ্তাঃ’ শব্দের অর্থ এইভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে—

১. তিন থেকে সাত পর্যন্ত বিজোড় সংখ্যার যোগফল: ৩ + ৫ + ৭ = ১৫
২. তিনের সাত গুণ: ৩ × ৭ = ২১
৩. তিন ও সাতের যোগফল: ৩ + ৭ = ১০

এই তিনটির যোগফল— ১৫ + ২১ + ১০ = ৩৬

অর্থাৎ ৩৬০।
এইভাবে সৃষ্টির আদিতেই বেদ নির্দেশ করেছেন যে এক বছরে ৩৬০ দিন থাকে। এ প্রসঙ্গে আর একটি মন্ত্র দ্রষ্টব্য—

“দ্বাদশ প্রধয়শ্চক্রমেকং ত্রীণি নাভ্যানি ক উ তচ্চিকেত।
তস্মিন্ত্সাকং ত্রিশতা ন শঙ্কবোऽর্পিতাঃ ষষ্টিঃ চলাচলাসঃ॥”
(ঋগ্বেদ ১.১৬৪.৪৮)

এর তাৎপর্য এই যে— সংবৎসররূপী কালচক্রে বারোটি মাসরূপ পরিধি, তিনটি প্রধান ঋতুরূপ নাভি (গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শরৎ) এবং ৩৬০টি দিনরূপ অর (স্পোক) বিদ্যমান, যা অত্যন্ত গতিশীল।

একইভাবে ব্রাহ্মণগ্রন্থসমূহেও সংবৎসরে ৩৬০ দিন থাকার সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে—
“ত্রীণি চ হ বৈ শতানি ষষ্টিশ্চ সংবৎসরস্যাহোরাত্রাণি।”
(গোপথ ব্রাহ্মণ ১.১.৫.৫)

অর্থাৎ, সংবৎসরে ৩৬০ দিন-রাত্রি থাকে। গ্রন্থের শেষে ৬০টি সংবৎসরের নামও শ্লোকাকারে উল্লেখ করা হয়েছে।

এইভাবে প্রমাণসহ প্রতিপাদিত এই গ্রন্থটি বিদ্বজ্জনসমাজ ও সাধারণ মানুষের জ্ঞানবৃদ্ধিতে নিঃসন্দেহে অত্যন্ত উপযোগী ও ব্যবহারিক বলে প্রমাণিত হবে। এই গ্রন্থটি সদা স্বাধ্যায়রত ও নিরবচ্ছিন্ন সাধনাশীল পণ্ডিত শ্রী উদয়নাচার্যের বৈদিক জ্ঞান ও তাতে গভীর অবগাহনের এক উজ্জ্বল প্রমাণ। এটি তাঁর গভীর অধ্যয়নের পরিচায়ক। এই উদ্যোগে তাঁর সাফল্যের জন্য আমি আন্তরিক প্রশংসা জানাই এবং ভবিষ্যতে এমনই আরও আর্ষ গ্রন্থরত্ন রচনা ও প্রকাশের কামনা করি।

ড. বিজয়বীর বিদ্যলঙ্কার
প্রাক্তন অধ্যক্ষ, পণ্ডিত নরেন্দ্র প্রাচ্য মহাবিদ্যালয়
প্রাক্তন অধিষ্ঠাতা, প্রাচ্য ভাষা বিভাগ
উসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, হায়দরাবাদ


পর্ব-মীমাংসা (বেদকালীন পর্বপদ্ধতি)

ভূমিকা

“গায়ন্তি দেবাঃ কিল গীতকানি, ধন্যাস্তু তে ভারতভূমিভাগে।
স্বর্গাপবর্গাস্পদহেতুভূতে ভবন্তি ভূয়ঃ পুরুষাঃ সুরত্বাৎ॥”

বিদ্বানগণ ভারতের প্রশংসা করে বলেন যে, এই ভারতভূমিতে জন্মগ্রহণকারী মানুষগণ ধন্য; কারণ এই দেশ ইহলোক ও পরলোক— অর্থাৎ মোক্ষের সুখ ও আনন্দ প্রদানকারী। এই দিব্যতার কারণেই ভাগ্যবান পুরুষেরা বারবার এই দেশেই জন্ম নিতে আকাঙ্ক্ষা করেন।

মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীও বলেন—
“এই আর্যাবর্ত দেশ এমন এক দেশ, যার সমতুল্য ভূগোলবিশিষ্ট আর কোনো দেশ নেই। সেই কারণেই এই ভূমির নাম স্বর্ণভূমি।”
(সত্যার্থপ্রকাশ, প্রথম সমুল্লাস)

ভারতদেশের এই মহিমার মূল কারণ হলো বেদ ও বৈদিক পরম্পরা। পরমাত্মা ভোগ ও অপবর্গ (মোক্ষ)-এর উদ্দেশ্যেই এই সৃষ্টির রচনা করেছিলেন (দ্রষ্টব্য: যোগদর্শন ২.১৮)। এই উদ্দেশ্যের সিদ্ধি ঘটে বেদজ্ঞানের মাধ্যমে। বেদ ও বৈদিক সাহিত্য ভোগ ও মোক্ষের এক সমন্বিত পথ প্রদর্শন করে, যা সৃষ্টির আদিকাল থেকে এই দেশে অনুসৃত হয়ে আসছে এবং আজও অনুসৃত হচ্ছে। এই উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যই মানবজীবনের পদ্ধতি, নিয়ম, আচার, ব্যবহার ও কর্তব্য নির্ধারিত হয়েছিল। এই নির্ধারণই ধর্ম ও সংস্কৃতির অন্তর্গত, যা বিশ্বের সকল মানুষের জন্য সর্বদাই সমান। এ কথাও বলা হয়েছে—
“সা প্রথমা সংস্কৃতির্বিশ্ববারা” (যজুর্বেদ ৯.১৪)।

এই বৈদিক সংস্কৃতি সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রাথমিকভাবে গ্রহণযোগ্য ও অনুসরণীয়, কারণ তা মানবসমাজের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। অতএব এই সংস্কৃতিতে সংস্কৃত মানবসমাজের সকল কার্যকলাপ বেদ ও বৈদিক পরম্পরায় ওতপ্রোতভাবে যুক্ত থাকে। এমনকি নিত্য ও নৈমিত্তিক কর্ম— যেমন জাগা, ঘুমানো, আহার, স্নান, সন্ধ্যা-যজ্ঞ ইত্যাদিও বৈদিক মন্ত্রসহই সম্পাদিত হয়। এই দেশে কোনো কার্য— তা সাধারণ হোক বা বিশেষ— বেদমন্ত্র ও ঈশ্বরস্মরণ ব্যতীত সম্পন্ন করা হতো না। অর্থাৎ প্রত্যেক ভারতীয়ের জীবনপদ্ধতি— ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা সামাজিক যাই হোক না কেন— সর্বদাই মানবজীবনের লক্ষ্যসাধনার সঙ্গে যুক্ত ছিল। এটাই বৈদিক সংস্কৃতি ও পরম্পরার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। অতএব প্রসঙ্গানুসারে আমরা অগ্রসর হই।

ভারতীয় মানবসমাজের সাধারণ জীবনধারাও বৈদিক সংস্কৃতির সঙ্গে অবিচ্ছিন্নভাবে যুক্ত। পাশাপাশি কিছু বিশেষ প্রসঙ্গ ও নির্দিষ্ট দিনে বিশেষ আয়োজন ও হর্ষোল্লাসের সঙ্গে যে উদ্‌যাপন করা হয়, তাকেই ‘পর্ব’ বলা হয়। এই পর্ব সম্পর্কে আমাদের সর্বাঙ্গীনভাবে জানা প্রয়োজন— প্রকৃতপক্ষে পর্ব কাকে বলে, এর স্বরূপ কী, কীভাবে এটি পালন করা উচিত, এর উদ্দেশ্য কী, ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে মানবের কী উপকার সাধিত হয়, এটি পালন করা কি অপরিহার্য— ইত্যাদি বিষয়।

এই সমস্ত বিষয় জানার পূর্বে ‘পর্ব’ শব্দের অর্থ জানা অত্যাবশ্যক, কারণ এটি একটি সংস্কৃত শব্দ। সংস্কৃত ভাষার বিশেষত্ব হলো— এর প্রতিটি শব্দের মধ্যে গভীর তাৎপর্য ও ভাব নিহিত থাকে, যা শব্দবিশ্লেষণের মাধ্যমেই উপলব্ধি করা যায়। সাধারণত কোষকারদের মতে ‘পর্ব’ শব্দের অর্থসমূহ হলো—
১) তিথিবিশেষ (যেমন— অমাবস্যা, পূর্ণিমা, প্রতিপদ, চতুর্দশী, অষ্টমী ইত্যাদি),
২) সন্ধিকাল (যেমন— সন্ধ্যাকাল …)

অমাবস্যা ও পূর্ণিমার সংযোগস্থল অর্থাৎ প্রতিপদ, উত্তরায়ণের সংযোগ—সংক্রান্তি প্রভৃতি;
৩) তিথিবিশেষ ও সন্ধিকালে সম্পাদিত যজ্ঞ;
৪) সন্ধি, গাঁট, যোগ (যেমন— বাঁশের গাঁট, অস্থিসন্ধি, পর্বতের সংযোগ— “পর্বাণি সন্তি যস্য সঃ পর্বতঃ”, অর্থাৎ যাদের গাঁট আছে তাই পর্বত— পর্বতমালা);
৫) গ্রন্থের অংশ (যেমন— আদিপর্ব, সভাপর্ব প্রভৃতি);
৬) অবয়ব, অঙ্গ;
৭) অংশ, ভাগ, খণ্ড;
৮) জীবনের সিঁড়ি বা ধাপ;
৯) উৎসব, ত্যোহার, আনন্দের উপলক্ষ;
১০) বিষুবত্ (বর্ষারম্ভ);
১১) লক্ষণভেদ এবং
১২) প্রস্তাব।

বেদ, ব্রাহ্মণগ্রন্থ প্রভৃতি বৈদিক সাহিত্য্যে ‘পর্ব’ শব্দটি প্রধানত তিথিবিশেষ, সন্ধিকাল এবং সেই সময়ে অনুষ্ঠিত যজ্ঞ, এমনকি অস্থিসন্ধির অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে। প্রাচীন আচার্যদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেদের সমস্ত শব্দই যৌগিক, রূঢ় বা যোগরূঢ় নয়। অতএব ‘পর্ব’ শব্দের যৌগিক অর্থও বিবেচনা করা আবশ্যক, যা এইরূপ—

“১) পর্ব পুনঃ পৃণাতেঃ প্রীণাতের্বা, ২) অর্ধমাসপর্ব— দেবান্ অস্মিন্ প্রীণন্তীতি, ৩) তত্রকৃতিতরৎ সন্ধিসামান্যাৎ”(নিরুক্ত ১.২০)

মহর্ষি যাস্ক এখানে ‘পর্ব’ শব্দের তিন প্রকার নির্বচন উপস্থাপন করেছেন। প্রথম নির্বচন থেকে জানা যায় যে ‘পর্ব’ শব্দটি “পৃ পালনপূরণয়োঃ” (ক্রয়াদি ১৮) এবং “প্রীজ্ তর্পণে কান্তৌ চ” (ক্রয়াদি ২) ধাতু থেকে উৎপন্ন। মহর্ষি দয়ানন্দ বলেছেন—“পিপর্তীতি পর্ব, পগ্রন্থির্বা” (উণাদি ৪.১১৪)।

তথ্যঃ

১) “পর্ববান্ পর্বতঃ” (নিরুক্ত ১.২০)।

২) “তস্য (সংবৎসরস্য) এতানি পর্বাণি— অহোরাত্রয়োঃ সন্ধী, পৌর্ণমাসী, অমাবাস্যা চ, (বসন্তাদি) ঋতুমুখানি।”
(শতপথ ব্রাহ্মণ ১.৬.৩.৩৫; তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ উপনিষদ ১.১.১)
অর্ধমাসসমূহও পর্বরূপে গণ্য—
(তৈত্তিরীয় সংহিতা ৭.৫.২৫.১; আরও দ্রষ্টব্য ঋগ্বেদ ১.৯৪.৪; যজুর্বেদ ২৩.৪৩; কাত্যায়ন শ্রৌতসূত্র ২৪.৬.৪; শাঙ্খায়ন শ্রৌতসূত্র ৩.২.১; মনুস্মৃতি ৬.৯ প্রভৃতি)।

৩) “গাত্রাণি পর্বশঃ— অঙ্গানি সন্ধিতঃ”
(দয়ানন্দ, যজুর্বেদ ২৩.৪২)।

উপরোক্ত ধাতুগুলির ভিত্তিতে “পৃ পালনপূরণয়োঃ” (জুহোত্যাদি ৪) ধাতু থেকে ‘পর্ব’ শব্দের নিষ্পত্তি দেখিয়ে বলা হয়েছে— এই ধাতুসমূহ থেকে উৎপন্ন ‘পর্ব’ শব্দের অর্থ দাঁড়ায় এমন একটি উপলক্ষ বা সময়, যার মাধ্যমে অথবা যার মধ্যে কর্তব্যকর্মের পালন করা হয়, কিংবা কারও পালন-পোষণ সম্পন্ন হয় এবং নিজের মধ্যে বিদ্যমান শুভগুণের ঘাটতি পূরণ করে অধিকতর শুভগুণের ধারণ করা হয়— তাকেই পর্ব বলা হয়। আবার যে উপলক্ষে বা যে সময়ে সকল মানুষ পরস্পর একে অপরকে তৃপ্ত করে, সন্তুষ্ট করে, একে অপরের সঙ্গে মিলিত হতে চায় এবং পারস্পরিক শুভকামনা প্রকাশ করে, সেটিও পর্ব নামে অভিহিত। যেমন বেদে বন্ধুত্বের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে—
“পর্বাণি সখ্যায় বিব্য়ে” (ঋগ্বেদ ৪.২২.২)।
অর্থাৎ পর্ব পালন করা হয় পারস্পরিক মৈত্রীর জন্য এবং ঈশ্বরের সঙ্গে সখ্যভাব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে।

নিঘণ্টু (৩.২০)-এ ‘পৃণাতি’ (পৃ) ধাতুকে দানার্থে পাঠ করা হয়েছে। এই ধাতুর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আচার্য স্কন্দস্বামী বলেন—
“দীয়তে হি তত্র পিতৃদেবমনুষ্যেভ্যঃ” (নিরুক্ত ১.২০)।
অর্থাৎ যে উপলক্ষে মাতা-পিতা, দাদা-দাদি, নানা-নানি প্রভৃতি জীবিত পিতৃপুরুষদের প্রীতিকর আহার, বস্ত্র, ঔষধ প্রভৃতি প্রয়োজনীয় দ্রব্য প্রদান করে সেবার মাধ্যমে সন্তুষ্ট করা হয়; বিদ্বান প্রভৃতি দেবতুল্য ব্যক্তিদের অন্ন, বস্ত্র এবং দান-দক্ষিণার মাধ্যমে সম্মান জানানো হয়; আবার নিজের কর্মচারী, ভৃত্য, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদেরও যথাযোগ্য দান দেওয়া হয়— সেই উপলক্ষকেই পর্ব বলা হয়।

এবার যাস্কের দ্বিতীয় প্রকার নির্বচনের আলোচনা করা যাক— “অর্ধমাসপর্ব”। মাসের অর্ধাংশ অর্থাৎ অমাবস্যা ও পূর্ণিমাকে ‘পর্ব’ বলা হয়, কারণ এই দুটি হলো শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষের সন্ধিকাল। এই সন্ধিক্ষণে পরিবেশে বিশেষ পরিবর্তন ঘটে, যার প্রভাব শুধু মানুষের উপরই নয়, পশু-পাখি, উদ্ভিদ, বনস্পতি, ঔষধ, নদী, সমুদ্র প্রভৃতি সকল প্রাকৃতিক উপাদানের উপরও পড়ে। এই সময়ে দৈনন্দিন অগ্নিহোত্রের অতিরিক্ত কিছু বিশেষ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করা হয়। অমাবস্যায় অনুষ্ঠিত যজ্ঞকে ‘দর্শেষ্টি’ এবং পূর্ণিমায় অনুষ্ঠিত যজ্ঞকে ‘পূর্ণমাসেষ্টি’ বলা হয়। সহচর্যনীতির নিয়মে এই যজ্ঞগুলিকেও ‘পর্ব’ বলা হয়। নিয়মটি হলো—
“তৎসাহচার্যাৎ তাচ্ছব্দ্যম্”
(দ্রষ্টব্য: মহাভাষ্য ৪.১.৪৮; ন্যায়দর্শন ২.২.৬১)।

যেমন— কেউ যদি বলে, “যষ্টিকাং ভোজয়েতি” (লাঠিকে খাওয়াও), তবে এখানে ‘যষ্টিকা’ শব্দের দ্বারা লাঠিকে নয়, বরং লাঠি বহনকারী ব্যক্তিকেই বোঝানো হয় এবং তাকেই আহার করানো হয়। ঠিক তেমনি বর্তমান প্রসঙ্গে অমাবস্যা ও পূর্ণিমা পর্বে যে যজ্ঞগুলি অবশ্যই সম্পন্ন হয়, সেই ইষ্টিগুলিকেও ‘পর্ব’ বলা হয়।

চাতুর্মাস্য যজ্ঞসমূহের ক্ষেত্রেও (যেমন— বৈশ্বদেব, বরুণপ্রঘাস, সাকমেধ, শুনাসীরীয় ইষ্টি) ‘পর্ব’ শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়
(দ্রষ্টব্য: কাত্যায়ন শ্রৌতসূত্র ৫.২.১৩; ২২.৭.১; শাঙ্খায়ন শ্রৌতসূত্র ১৪.৫.৬; আশ্বলায়ন শ্রৌতসূত্র ৯.২.২ প্রভৃতি)।
এই যজ্ঞগুলিকে ‘পর্ব’ বলা হয় কারণ এই পর্বযজ্ঞগুলিতে আহুতি বা হবির মাধ্যমে দেবতাদের তৃপ্ত করা হয়—
“দেবান্ অস্মিন্ প্রীণন্তীতি [পর্ব]” (নিরুক্ত)।

তৈত্তিরীয় সংহিতাতেও বলা হয়েছে—
“অর্ধমাসে দেবা ইজ্যন্তে” (তৈত্তিরীয় সংহিতা ২.৫.৬.৬),
অর্থাৎ মাসের অর্ধাংশে— অমাবস্যা ও পূর্ণিমার পর্বে— দেবতাদের তৃপ্তির জন্য যজ্ঞ সম্পাদিত হয়। দেবতাদের এই তৃপ্তি যজ্ঞে নিবেদিত আহুতি বা হবির মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়।

এর পরবর্তী ধারাটিও এইরূপ—
“আহুতিভিরেব দেবান্ হুতাদঃ প্রীণাতি” (মৈত্রায়ণী সংহিতা ১.৪.৬)।

এখানে ‘দেব’ বলতে বায়ু, অগ্নি, সূর্য, জল, পৃথিবী, আকাশ প্রভৃতি প্রাকৃতিক তত্ত্বকেই বোঝানো হয়েছে। যজ্ঞের মাধ্যমে এই ভৌতিক দেবতাগুলির দূষণ ও দোষ নষ্ট হয়ে তারা শুদ্ধ হয়— এটিই তাদের সন্তুষ্টি। যেমন, ঈর্ষা, দ্বেষ প্রভৃতি মানসিক দোষ থেকে মুক্ত না হলে মানুষ নিজে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না এবং অন্যকেও সন্তুষ্ট করতে পারে না। ঠিক তেমনই এই দেবতাগুলির সন্তুষ্টি বা নির্মলতার ফলে যথাসময়ে উপযুক্ত বৃষ্টি হয় এবং সকল প্রাণীই তার দ্বারা মহৎ উপকার লাভ করে।

এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে—
“ইতঃ প্রদানাদ্ধি দেবা জীবন্ত্যমুতঃ প্রদানাত্ মনুষ্যাঃ।
নেত ঊর্ধ্বা আহুতয়ো গচ্ছন্তি, নামুতোऽর্বাচী বৃষ্টিঃ প্রাদীয়ত”
(জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ ৩.২১৬)

এর অর্থ— এই পৃথিবী থেকে যজ্ঞের মাধ্যমে হবিগুলি অন্তরিক্ষলোকে পৌঁছালে দেবতারা জীবিত ও নির্মল থাকেন, এবং অন্তরিক্ষলোক থেকে দেবতাদের দ্বারা বৃষ্টি হলে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীরা জীবিত থাকে। যদি যজ্ঞের অনুষ্ঠান না হয়, তবে বৃষ্টিও হবে না। এটাই দেবতাদের সন্তুষ্টির মূল তাৎপর্য।

একদিকে দেবতাদের সন্তুষ্টি, অন্যদিকে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর পরিতৃপ্তি— এটাই প্রাচীন পর্বের প্রকৃত স্বরূপ, অর্থাৎ সত্যিকারের পর্ব (দেবতাদের তৃপ্ত করা এবং মানুষের দ্বারা বৃষ্টির কামনা করা— “প্রীজ্ তर्पণে কান্তৌ চ”)। এই বৈদিক পর্বপদ্ধতি কতই না বিস্ময়কর, আনন্দদায়ক ও হর্ষউৎপাদক— তা বিচক্ষণ পাঠক নিজেই ভেবে দেখবেন।

এই সকল যজ্ঞের মাধ্যমে (বৈদিক পর্বপদ্ধতির দ্বারা) ভৌতিক দেবতাগণ এবং—

১. অগ্নি দেবতা, বায়ু দেবতা, সূর্য দেবতা, চন্দ্র দেবতা, বসুগণ দেবতা, রুদ্রগণ দেবতা, আদিত্যগণ দেবতা, মরুতগণ দেবতা, বিশ্বদেবগণ দেবতা, বৃহস্পতি দেবতা, ইন্দ্র দেবতা, বরুণ দেবতা—
(যজুর্বেদ ১৪.২০)।

মানুষসহ সকল প্রাণীই এতে সন্তুষ্ট হয়। শুধু তাই নয়, এই যজ্ঞগুলির মাধ্যমে অন্য এক প্রকার দেবতাও— অর্থাৎ চেতন দেবতারা— প্রসন্ন হয়ে ওঠেন; এরা হলেন মনুষ্যদেব। যেমন শাস্ত্রে বলা হয়েছে—

“আহুতিভিরেব দেবান্ প্রীণাতি, দক্ষিণাভির্‌ মনুষ্যদেবান্‌ ব্রাহ্মণান্‌ শুশ্রূষুষোऽনূচানান্‌”
(শতপথ ব্রাহ্মণ ২.২.২.৬)

অর্থাৎ যজ্ঞকারী ব্যক্তি আহুতির দ্বারা ভৌতিক দেবতাদের সন্তুষ্ট করেন এবং দক্ষিণা প্রভৃতির মাধ্যমে শুদ্ধাচারী, বেদাধ্যয়নকারী, তত্ত্বজ্ঞ ব্রাহ্মণরূপ মনুষ্যদেবদেরও প্রসন্ন করেন। এইরূপ পর্বযজ্ঞের দ্বারা জড় জগৎ ও চেতন জগৎ— উভয় ক্ষেত্রেই সর্বত্র পর্বই পর্ব, অর্থাৎ আনন্দই আনন্দের পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

এইভাবে যে ব্যক্তি পর্ব পালন করে— অর্থাৎ জড় ও চেতন উভয় জগতে সর্বত্র প্রসন্নতা, প্রীতি ও তৃপ্তি বিস্তার করে— সেই যাজ্ঞিক ব্যক্তি নিজেও অবশ্যম্ভাবীভাবে দেবত্ব লাভ করে, দিব্যতা অর্জন করে এবং এক অলৌকিক আনন্দের অভিজ্ঞতা লাভ করে। যেমন বলা হয়েছে—

“যঃ [এবং] পৃণাতি স হ দেবেষু গচ্ছতি”
(ঋগ্বেদ ১.১২৫.৫)

অতএব মহর্ষি মনু এই পর্বযজ্ঞগুলি অবশ্য পালনীয় বলে নির্দেশ দিয়েছেন—

“বৈতানিকং চ জুহুয়াদগ্নিহোত্রং যথাবিধি।
দর্শমস্কন্দয়ন্ পর্ব পৌর্ণমাসং চ যোগতঃ॥”
(মনুস্মৃতি ৬.৯)

অর্থাৎ পূর্বোক্ত বিধান অনুসারে দৈনিক যজ্ঞ, পঞ্চমহাযজ্ঞ এবং অমাবস্যা, পূর্ণিমা প্রভৃতি পর্বে অনুষ্ঠিত বিশেষ পর্বযজ্ঞ— কোনওটিই পরিত্যাগ না করে সমস্ত যজ্ঞ নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা উচিত।

দিনের পর্বে (প্রাতঃ ও সায়ংকালের সন্ধিক্ষণে), মাসের পর্বে এবং ঋতুজনিত পর্বে অবশ্যই যজ্ঞের অনুষ্ঠান করে যজ্ঞময় জীবন যাপন করতে হবে। এই যজ্ঞগুলির মাধ্যমে দিব্যতা লাভের উদ্দেশ্যে কিছু বিশেষ নিয়মও নির্ধারিত হয়েছে, যেগুলিকে ব্রত বলা হয়। যেমন— মৌন পালন করা ইত্যাদি।

১. এর অর্থ— দিব্যত্ব লাভ করা।

অথবা নিয়মিতভাবে কথা বলা, স্বাধ্যায় করা, ব্রহ্মচর্যের পালন করা, ওঙ্কারের জপ করা এবং উপবাস পালন করা বা কেবল নিয়মিত ও সংযত আহার গ্রহণ করা (যেমন— পয়োব্রত, দধিব্রত, আমিক্ষাব্রত, যবাগূব্রত প্রভৃতি), ভোগবিলাসের প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে ভূমিতে শয়ন করা, শৃঙ্গার প্রভৃতি পরিত্যাগ করা— এইরূপ নানা ব্রতের বিধান শাস্ত্রে নির্ধারিত হয়েছে। এই সকল ব্রতই পার্বণিক যজ্ঞসমূহে অবশ্য পালনীয় ছিল।

মনুস্মৃতিতে বলা হয়েছে—
“ঋতুকালাভিগামী স্যাৎ স্বদারনিরতঃ সদা।
পর্ববর্জ্য ব্রজেচ্চৈনাং তদ্ব্রতো রতিকাম্যয়া॥”
(মনুস্মৃতি ৩.৪৫)

অর্থাৎ, ঋতুকালে (স্ত্রী–পুরুষের সমাগমের সময়ে) স্বীয় পত্নীর সঙ্গেই গমন করবে; কিন্তু সেই ঋতুকালের ষোলো দিনের মধ্যে যদি পূর্ণিমা, অমাবস্যা, চতুর্দশী বা অষ্টমী প্রভৃতি পর্ব পড়ে, তবে সেই দিনগুলিকে বর্জন করতে হবে। এই পর্বদিনগুলিতে স্ত্রী–পুরুষের মধ্যে রতিক্রিয়া কখনোই করা উচিত নয় (স্বামী দয়ানন্দ, সংস্কারবিধি— গর্ভাধান প্রসঙ্গ)। এই নিষেধের তাৎপর্য হলো— পর্বদিনগুলিতে কেবল যজ্ঞেরই অনুষ্ঠান হওয়া উচিত; অন্য কোনো ভৌতিক সুখভোগের কামনা করা উচিত নয়।

এতদ্ব্যতীত ধর্মশাস্ত্রে এই পর্বদিনগুলিকে বেদাদি শাস্ত্র অধ্যয়ন বা অধ্যাপনার জন্য ‘অনধ্যয়ন’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এরও অভিপ্রায় একই— বেদ অধ্যয়নকারী ও অধ্যাপকগণ যেন এই পর্বদিনগুলিতে প্রতিদিনের মতো সাধারণ কর্মে লিপ্ত না থেকে, পার্বণ যজ্ঞসমূহ অবশ্যই সম্পাদন করেন। এই অনিবার্যতার ফলে গুরু ও শিষ্যদের পাঠ-পাঠন সাময়িকভাবে স্থগিত রেখে যজ্ঞের প্রস্তুতি ও যজ্ঞকর্মেই নিয়োজিত থাকতে হতো।

এখানে স্মরণীয় যে ‘অনধ্যয়ন’-এর অর্থ অবকাশ, ছুটি বা সমস্ত কাজ থেকে মুক্ত হয়ে নিছক বিশ্রাম নেওয়া নয়। এ তো অলস ও কর্মবিমুখ লোকদের লক্ষণ। প্রাচীনকালে অনধ্যয়ন ছিল উদ্দেশ্যমূলক। কিন্তু আজকাল রবিবারকে অবকাশের দিন ঘোষণা করে একে বিশ্রামের দিন বানানো হয়েছে। রবিবারের এই অবকাশ খ্রিস্টানদের কাছে উদ্দেশ্যপূর্ণ; তারাই মূলত এই দিনটি পালন করে এসেছে। কারণ তারা ওই দিনে নিজেদের সমস্ত ব্যক্তিগত কাজ বন্ধ রেখে যিশুখ্রিস্টের উপাসনার জন্য গির্জায় যায়। কোনো খ্রিস্টান যেন সেই দিনে গির্জায় না গিয়ে ব্যবসা বা ব্যক্তিগত কাজে নিযুক্ত না থাকে— এই উদ্দেশ্যেই রবিবারকে অবকাশের দিন ঘোষণা করা হয়েছে। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী ঈশা ছয় দিন কাজ করে সপ্তম দিনে (রবিবারে) বিশ্রাম করেছিলেন এবং সেই দিনেই তিনি আশীর্বাদ দান করেন (দ্রষ্টব্য: বিভিন্ন খ্রিস্টীয় সূত্র)।

অতএব তাদের কাছে রবিবারের অবকাশ উদ্দেশ্যপূর্ণ। কিন্তু আমরা বৈদিক (ভারতীয়) মানুষরা আমাদের নিজস্ব পর্বদিনগুলির— অর্থাৎ অনধ্যয়ন দিনের কর্তব্য— কথা ভুলে গিয়ে শুধু তাই নয়, বরং খ্রিস্টানদের অন্ধ অনুকরণ করে চলেছি; এটি সত্যিই নিন্দনীয়। এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় বিষয় হলো— সাত দিনের সপ্তাহবিভাগ অশাস্ত্রীয় ও নিরাধার। সমগ্র বৈদিক সাহিত্যে এর কোনো উল্লেখ নেই। সর্বত্র সংবৎসরের বিভাগ হিসেবে অয়ন, ঋতু, মাস, পক্ষ ও তিথি (দিন)-এরই বর্ণনা পাওয়া যায়।

অতএব প্রসঙ্গানুসারে আমরা অগ্রসর হই। শাস্ত্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা জেনেছি যে পর্বদিনগুলিতে বিশেষ যজ্ঞের অনুষ্ঠান হতো এবং নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম ও ব্রতের পালন করা আবশ্যক ছিল; সেই কারণে ভৌতিক কর্ম পরিত্যাগ করা হতো। পর্বদিনে ব্রতাচরণ অনিবার্য হওয়ায়, কালক্রমে সাহচর্যনীতির ফলে ‘পর্ব’ ও ‘ব্রত’ শব্দ দুটি সমার্থক হয়ে ওঠে।

দুর্ভাগ্যবশত, যখন বৈদিক পরম্পরা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে পৌরাণিক ধারা প্রবল হয়ে উঠল, তখন অসংখ্য অবৈদিক ও অশাস্ত্রীয় ব্রত ও পর্বের প্রচলন ঘটে। আজকাল যে সকল পর্ব (উৎসব) পালিত হয়, তার অধিকাংশই এই পরবর্তী যুগের সৃষ্টি। বৈদিক বা—ঋষিযুগে (আর্ষযুগে) এই সকল ব্রত ও উৎসবের কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি লক্ষ্য করা যায় না। পুরাণ, সিদ্ধান্তসিন্ধু, হেমাদ্রি, কৃত্যরত্নাকর প্রভৃতি অসংখ্য অবৈদিক গ্রন্থে যে সব ব্রত ও পর্ব (উৎসব)-এর বর্ণনা পাওয়া যায়, তাদের তালিকাই এত দীর্ঘ যে তা এক প্রকার পৃথক গ্রন্থের রূপ ধারণ করেছে (দ্রষ্টব্য— ধর্মশাস্ত্রের ইতিহাস, ড. পি. ভি. কাণে, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৯৬–২৩৭)।

প্রকৃতপক্ষে ব্রত ও পর্বের মূল উদ্দেশ্য হলো— ব্যক্তি যেন নিজের আত্মিক উন্নতি সাধন করে মোক্ষলাভ করতে পারে। এই সাধনা বা পদ্ধতিকে অষ্টাঙ্গযোগের রূপে যোগদর্শনে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সেখানে যম— (অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য, অপরিগ্রহ) এবং নিয়ম— (শৌচ, সন্তোষ, তপ, স্বাধ্যায়, ঈশ্বরপ্রণিধান)— জাতি, দেশ, কাল ও সময়ের ভেদাভেদহীনভাবে পালন করাকেই মহাব্রত বলা হয়েছে—

“জাতিদেশকালসময়ানবচ্ছিন্নাঃ সার্বভৌমা মহাব্রতম্”
(যোগসূত্র ২.৩১)

অজ্ঞতা, অলসতা ও প্রমাদের কারণে মানুষের মধ্যে স্বার্থপরতা, ঈর্ষা, দ্বেষ, মোহ প্রভৃতি দোষ জন্ম নেয়। সুতরাং এসব থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে আধ্যাত্মিকতার দিকে আকৃষ্ট করাই পর্ব বা উৎসবের প্রধান লক্ষ্য। এই প্রসঙ্গে উপবাস (ব্রত)-এর বৈদিক বা প্রকৃত স্বরূপ কী— তা বলা অপ্রাসঙ্গিক নয়।

“উপ সমীপে যো বাসো জীবাত্মপরমাত্মনোঃ।
উপবাসঃ স বিজ্ঞেয়ো ন তু কায়স্য শোষণম্॥”
(বরাহোপনিষদ ২.৩৯)

অর্থাৎ— জীবাত্মার পরমাত্মার নিকটে অবস্থান করা বা সেই লক্ষ্যে সাধনা করাকেই উপবাস (মহাব্রত) বলা হয়; কেবল আহার বর্জন করে দেহকে কষ্ট দেওয়াকে উপবাস বলা যায় না। সেটি উপবাস শব্দের প্রকৃত অর্থই নয়। আজকাল উপবাস শব্দটি প্রায় উপহাসের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে— উপবাসের নামে অনেক সময় দ্বিগুণ আহারই করা হয়!

পর্বের বিশেষ দিনে অবৈদিক, অর্থাৎ পৌরাণিক ব্রত পালনের ফলে বৈদিক পরম্পরা নষ্ট হয়ে যায়। এটি এক অক্ষম্য অপরাধ, একপ্রকার পাপ। তাই বেদ আমাদের নির্দেশ দেয়—

“স পর্বভিরক্রতুশঃ কল্পমানো গাঁ মা হিংসীরদিতিং বিরাজম্”
(যজুর্বেদ ১৩.৪৩)

এর অর্থ— যে জিজ্ঞাসু ও মুমুক্ষু ব্যক্তি পূর্ণিমা, অমাবস্যা প্রভৃতি পর্বে অনুষ্ঠিত যজ্ঞের দ্বারা এবং প্রত্যেক ঋতুতে সম্পাদিত যজ্ঞ বা ঋতুচর্যার মাধ্যমে নিজেকে শক্তিশালী করে, সে যেন বেদবাণীর অবিচ্ছিন্ন পরম্পরার বিঘ্ন না ঘটায় এবং যজ্ঞে গাভী প্রভৃতি পশুবলি না দেয়। সারকথা— আমাদের বেদবিরুদ্ধ পথে চলা উচিত নয়।

তবে প্রশ্ন আসে— পর্বের দিনে আমাদের কী করা উচিত? পর্ব কীভাবে পালন করা উচিত? এ বিষয়েও বেদ আমাদের পথ দেখায়—

স পর্ব॑ভির্ঋতু॒শঃ কল্প॑মানো॒ গাং মা হি॑ꣳসী॒রদি॑তিং বি॒রাজ॑ম্ ॥
(ঋগ্বেদ ১.৯৪.৪)

হে ঈশ্বর! আমরা আপনার প্রাপ্তির জন্য আমাদের অন্তরাত্মায় জ্ঞানরূপী ইধ্ম (সমিধা) ধারণ ও প্রজ্বালিত করব। এই উদ্দেশ্যে আমরা প্রত্যেক পর্বে আপনার স্মরণে, আপনার উপাসনায় (উপবাস ব্রতরূপে) হবি অর্পণ করব— অর্থাৎ যজ্ঞ ও যাগ সম্পাদন করব। এটাই পর্ব পালনের প্রাচীনতম বৈদিক পদ্ধতি।

বেদ অন্যত্র বলে—

“সমানৃধে পর্বভির্বরবিধানাঃ”
(ঋগ্বেদ ১০.৭৯.৭)

অর্থাৎ উপাসক জীব নিজের মধ্যে সদ্গুণসমূহ পূর্ণ করে ক্রমশ উন্নতির পথে অগ্রসর হয়ে নিজের জীবনকে পরিপূর্ণ ও সার্থক করে তোলে। এটাই মানবধর্ম। যেমন বলা হয়েছে—

“ত্রয়ো ধর্মস্কন্ধাঃ— যজ্ঞোऽধ্যয়নং দানমিতি”
(ছান্দোগ্য উপনিষদ ২.২৩.১)

অর্থাৎ ধর্মের তিনটি ভিত্তি—
১. যজ্ঞ,
২. বেদস্বাধ্যায় এবং
৩. দান।

এই তিনটিই সেই সব পর্ব (উৎসব), যেগুলি পালন করা হতো।

“যতঃ অভ্যুদয় নিঃশ্রেয়সসিদ্ধিঃ স ধর্মঃ” (বৈশেষিক দর্শন ১.১.২)—
যার দ্বারা ইহলোকের সুখ ও নিঃশ্রেয়স অর্থাৎ মোক্ষ লাভ হয়, তাকেই ধর্ম বলা হয়। এইভাবে প্রাচীন বৈদিক পর্বসমূহ সম্পূর্ণরূপে ধর্মময় ছিল।

এবার আমরা নিরুক্তে প্রদত্ত তৃতীয় ব্যাখ্যার দিকে অগ্রসর হই।
“তত্রকৃতীতরত্ (অপি পর্ব), সন্ধিসামান্যাত্”— অর্থাৎ যেমন মাস ইত্যাদির সন্ধিকে ‘পর্ব’ বলা হয়, তেমনই অন্যান্য বস্তুর সন্ধিকেও ‘পর্ব’ বলা হয়। যেমন— অস্থিসন্ধি (জোড়), বাঁশের গাঁট, পর্বতের সংযোগস্থল ইত্যাদি। এই অর্থটি মহর্ষি দয়ানন্দও প্রকাশ করেছেন—
“পিপর্তীতি পর্ব, গ্রন্থির্বা” (উণাদি ৪.১১৪)।

আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই অর্থের বৈদিক প্রয়োগও এখানে দেখা যায়—
“নির্মজ্ঞানং ন পর্বণো জভার” (ঋগ্বেদ ১০.৬৮.৯)— জ্ঞানের গ্রন্থি (গাঁট)রূপ বন্ধনে আবদ্ধ জীবকে ঈশ্বর মুক্ত করুন।
“প্র পর্বাণি জাতবেদঃ শৃণীহি” (ঋগ্বেদ ১০.৮৭.৫; অথর্ববেদ ৮.৩.৪)— জ্ঞানী ব্যক্তি নিজের অজ্ঞতার গ্রন্থিগুলি নষ্ট করুন।

এই অজ্ঞানরূপ পর্বত ভাঙার পদ্ধতি ও বিধান দ্বিতীয় ব্যাখ্যার আলোচনায় ইতিপূর্বে দেখানো হয়েছে এবং এই ভূমিকার পরবর্তী অংশে বৈদিক মন্ত্রসমূহ ও নববর্ষেষ্ঠিতে ব্যবহৃত মন্ত্রগুলির মাধ্যমেও তা প্রদর্শিত হবে। মহর্ষি যাস্ক তাঁর ‘পর্ব’ শব্দের ব্যাখ্যার মাধ্যমে আমাদের বোঝাতে চেয়েছেন— প্রকৃতপক্ষে পর্ব কী, কীভাবে পর্ব পালন করা উচিত, তার স্বরূপ কী এবং তার উদ্দেশ্য কী।

পরবর্তী অংশে আরও কিছু বৈদিক মন্ত্রের সাহায্যে আমরা পর্ব ও তার পালনের বৈদিক পদ্ধতি আরও স্পষ্টভাবে বোঝার চেষ্টা করব। তার আগে সমাজে প্রচলিত শুভ–অশুভ ধারণা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। সাধারণত মানুষ পর্বদিনগুলিকে শুভদিন হিসেবেই গণ্য করে। কিন্তু বার, তিথি, মুহূর্ত, নক্ষত্র, গ্রহ, রাশি ইত্যাদির মধ্যে কিছু শুভ ও কিছু অশুভ— এই বিশ্বাস করে এবং এগুলির কারণেই সুখ–দুঃখ বা শুভ–অশুভ ফল লাভ হয় বলে মনে করে। এটি পুরাণযুগে রচিত ফলিত জ্যোতিষ গ্রন্থগুলির কুপ্রভাব, যা সম্পূর্ণ কল্পিত, ভিত্তিহীন ও অবিবেচনাপূর্ণ।

প্রারম্ভেই বলা হয়েছে— ঈশ্বর এই সৃষ্টি করেছেন জীবের ভোগ ও অপবর্গ (মোক্ষ) তথা মানবকল্যাণের জন্য। সুতরাং সৃষ্টির প্রতিটি বস্তুই মানুষের জন্য কল্যাণকর ও শুভ হওয়ার কথা। শুভ–অশুভ, হিত–অহিত আসলে মানুষের বিবেক ও কর্মের উপর নির্ভরশীল। যদি কেউ গ্রহ, বার বা তিথিকে অশুভ বলে মনে করে, তবে সেই দোষ গ্রহের নয়, ঈশ্বরের উপরই বর্তায়— কারণ সেগুলির স্রষ্টা ঈশ্বর। ফলিত জ্যোতিষে বিশ্বাসীরা এটি উপলব্ধি করতে পারে না যে তাদের এই বিশ্বাস ঈশ্বরের কর্মব্যবস্থার উপর প্রশ্নচিহ্ন তোলে।

মদ ও মাংসের ব্যবসায়ীরাও নিজেদের দোকানে ইষ্টদেবতার ছবি রেখে প্রতিদিন পূজা করে। তারা প্রতিটি কাজ শুভ–অশুভ বিচার করে, পণ্ডিতদের জিজ্ঞাসা করে, বাড়ি ও দোকানও তথাকথিত বাস্তুবিদদের পরামর্শে নির্মাণ করে। এমনকি মাংসের ব্যবসা শুরু করার ক্ষেত্রেও তথাকথিত শুভ মুহূর্ত নির্ধারণ করে। তাহলে কি এতেই তাদের কল্যাণ হয়? এই সব মুহূর্ত নির্ধারণকারী পণ্ডিত ও গ্রন্থ কি সত্যিই শুভ বা প্রামাণিক? স্পষ্টতই এটি ঈশ্বরের প্রতি অনাস্থা ও অজ্ঞানতারই প্রকাশ।

কোনও কবি এই মর্মকে বড়ই সরল ও দার্শনিক শব্দে বলেছেন—

“পুণ্যস্য ফলমিচ্ছন্তি পুণ্যং নেচ্ছন্তি মানবাঃ।
ফলং পাপস্য নেচ্ছন্তি পাপ কুর্বন্তি মানবাঃ॥”

অর্থাৎ— মানুষ পুণ্যকর্মের ফসল (সুখ) চায়, কিন্তু পুণ্যকর্ম করতে উৎসুক নয়। পাপকর্মের ফসল (দুঃখ) কেউ চায় না, কিন্তু পাপকর্ম করতে সদা প্রস্তুত থাকে। এই পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা অজ্ঞানতা, পাখণ্ড, পৌরাণিকতা, ফলিত জ্যোতিষ ইত্যাদির মূল কারণও এটাই।

বেদ এবং উপশাস্ত্রের দৃষ্টিকোণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। যা সার্বকালীন সত্য। বেদের তত্ত্ব হলো— শুভ-অশুভ, ভাগ্য ইত্যাদি সবই মানুষের হাতেই, অর্থাৎ তার কর্মের অধীনে।
“কৃতং মে দক্ষিণে হস্তে জযো মে সব্য আহিতঃ” (অর্থর্ব ৭.৫০.৮)


মানুষ কিভাবে তার প্রতিটি দিনকে শুভ দিন ও সুদিন বানাবে, তার জীবনকে সুখ-শান্তি ও পরিপূর্ণ অর্থাৎ প্রতিটি দিনকে পর্বময় (পৃ-পরিপালনপূর্ণয়ঃ) করবে, তা বেদমন্ত্রের মাধ্যমে জানা যায়—

“যতো যায়তে সুদিনত্বে আহ্লাঁ সমর্য আ বিদথে বর্ধমানঃ।
পুনন্তি ধীরাঃ আপসো মণীষা দেবয়া বিপ্র উদিয়র্তি ভাষম্॥”
(ঋগ্বেদ ৩.৮.৫০)

অর্থাৎ— বেদজ্ঞ জ্ঞানপ্রাপ্ত দ্বিজ (যাঁরা বেদ জ্ঞান অর্জন করেছেন) তার পরিবার, সমাজ, দেশ ও ধর্মের সুদিনত্ব তথা সমৃদ্ধির জন্য সক্ষম হন। তিনি তার ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকেন, জ্ঞান অর্জন এবং প্রচারে অগ্রসর থাকেন, বা বিদ্বানদের সমাগমে প্রশংসিত হন। এছাড়াও তিনি (বিপ্রঃ দেবয়াঃ: ভাষম্ উদিয়র্তিঃ) জ্ঞানী হিসেবে ঈশ্বরের আজ্ঞা অনুযায়ী বেদবাণী প্রচার করেন।

এইভাবে, তিনি (ধীরাঃ আপসঃ মণীষা পুনন্তি) একজন মেধাবী, পরিশ্রমী ব্যক্তি হয়ে তার বুদ্ধি ও প্রতিভার মাধ্যমে সমস্ত মানুষকে পবিত্র করেন।

“সেইদিনই সত্যিকারের শুভদিন হয়, যখন কেউ বিদ্যা ও উৎকৃষ্ট শিক্ষার সংরক্ষণ করে জ্ঞানী হয়। যেমন শুরদর্পী পুরুষেরা দুষ্টদের পরাজয় করে ধন-সম্পদ ও বৈভবসহ সকলদিকে এগিয়ে যায়, তেমনি বিদ্যা দ্বারা জ্ঞানী মানুষ অজ্ঞাতকে বিনাশ করে জ্ঞান, খ্যাতি ইত্যাদিসহ সকলদিকে এগিয়ে যায়।” (মহর্ষি দয়ানন্দ – ঋগ্বেদ ৩.৮.৫)

নিত্বা দধে বর আ পৃথিব্যা ইকায়াস্পদে সুদিনত্বে অহ্বাম্।
হষদ্বত্যা মানুষআপয়ায়া সরস্বত্যা রেবদগ্রে দিদীহ। (ঋ ৩.২৩.৪)

প্রভু বলেন, “হে প্রাণী! আমি তোমাকে এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্থান, অর্থাৎ উৎকৃষ্ট শরীরে প্রতিষ্ঠিত করেছি। গৌরবময় এবং বৈদিক জ্ঞান অর্জনের উপযোগী শরীরে তোমাকে স্থাপন করেছি। এছাড়া তোমার জীবনের প্রতিটি দিনে মা-বাবা, আচার্য, গুরু ও বিদ্বানদের সঙ্গসহ শুভদিন, অর্থাৎ শুভ সুযোগ প্রদান করেছি। হে উন্নতিশীল প্রাণী! তুমি এই শক্তিশালী শরীরে অবস্থান করো, প্রভুর সাধনার মাধ্যমে এবং বৈদিক জ্ঞানের দীপ্তিতে স্থির থাকো, তবেই তুমি ঐশ্বর্যশালী হয়ে আলোকিত হবে।”

উপ নো বাজা অধ্বরমৃভক্ষা দেবা যাত পথি ভিরদ্দেবযনাঃ।
যথা যজ্ঞ মানুষো বিক্ষ্বা সু দধিধ্বে রণ্বাঃ সুদিনেষ্বলনাম্। (ঋ ৪.৩৭.১)

হে বিদ্বানরা, আপনারা আমাদের যজ্ঞে উপস্থিত হন। (অলৌকিক আনন্দের পথ দ্বারা) আমাদের জীবনযাত্রাকে সুপ্রসন্ন করুন। সাধারণ দিনে বা বিশেষ যজ্ঞ-পর্বে উপস্থিত হয়ে, এই প্রজাগণকে সত্যিকারের যজ্ঞ শিক্ষা দিন—যা হিংসা, বিদ্বেষ ইত্যাদি থেকে মুক্ত, পরস্পরের মধ্যে দান, সঙ্গতি ও প্রীতি প্রচলিত করে। অর্থাৎ, এই পবিত্র কাজের মাধ্যমে দিনই শুভদিন হয়, অন্যথায় নয়।

ইন্দ্র শ্রেষ্ঠানি দ্রবিণানি ধেহি চিত্তিং দক্ষস্য সুভগত্বমাস্মে।
পোষং রযীনাম্, অরিষ্টিং তনুনাম্, স্বাদ্যানং বাচঃ সুদিনত্বম্মাম্। (ঋ ২.২১.৬)

হে প্রভু! আমাদের জন্য শুদ্ধ ও পবিত্র ধন-সম্পদ প্রদান করুন। আমাদের দীক্ষিত ও সক্ষম ব্যক্তিদের জ্ঞান ও ক্ষমতা দিন। আমাদের দেহ সুস্থ, ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পায় এবং আমাদের ভাষা মধুর হোক। শুদ্ধ, সাত্বিক ও সুস্বাদু আহার দ্বারা আমাদের প্রতিটি দিনকে শুভ দিন করে তুলুন।

জীবনের পূর্ণতা, অর্থাৎ প্রতিটি দিনকে শুভ ও সার্থক করার জন্য পবিত্র ধন-সম্পদ, সৎকর্মে দক্ষতা, প্রীতি, পরোপকার, দান ও যজ্ঞের মতো পবিত্র কাজ, শরীরের সুস্থতা এবং মধুর, শুদ্ধ সাত্বিক আহার থাকা অপরিহার্য। কেবল তখনই আমাদের দিন সত্যিকারের শুভ দিন বা উৎসব হিসেবে গণ্য হবে।

“বসিষ্ঠকে বরুণ যেনো নৌকায় স্থাপন করেন, যা নবদীক্ষিত ব্রাহ্মচারী শিষ্যকে জন্ম-মৃত্যুর সাগর পার করবার জন্য ব্যবহৃত হয়; সেই নৌকা হলো বৈদিক জ্ঞানের নৌকা। তিনি নিজেই—শ্রেষ্ঠ গুণাবলীর অধিকারী, সদাচারী ও মহৎ কর্মশীল—শিষ্যকে মন্ত্রার্থের দর্শনে সক্ষম জ্ঞানী মানুষ বানান। (বিদ্বান শিক্ষক) শুভদিনে শিষ্যকে দিনে ও রাতে জ্ঞানার্জনে আরও উন্নত করে তোলেন। অর্থাৎ, কেবল জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে মানুষের দিন আলোকিত ও শুভ হতে পারে, অন্যথায় নয়।” (ঋগ্বেদ ৭.৮৮.৪)

“হে অগ্নি! এই দীক্ষার প্রদীপরূপ জ্ঞানকে প্রেম ও ভক্তি সহকারে গ্রহণ কর; নিজের অন্তঃকরণে বিরাজমান মায়া-অজ্ঞতা দূর কর। হে প্রজ্ঞাবান ও কর্মশীল প্রাণী! তুমি এই পৃথিবীতে নিজ জীবনের দিনগুলোকে শুভ ও দিভ্য করার জন্য দেবযজ্ঞ, ব্রত-তপসা ও কঠোর সাধনার মাধ্যমে সজাগ হও। অজ্ঞানে বা নিদ্রায় থাকা দ্বারা দিন কখনো শুভ হতে পারে না।” (ঋগ্বেদ ১০.৭৭০.১)

“হে সুশিক্ষিত, জ্ঞানী স্ত্রী ও পুরুষগণ! যেই দিভ্য রথে—যে রথ তিন ধরনের গুণসম্পন্ন বিদ্বানদের দ্বারা পরিচালিত হয়:
১) সত্যজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি,
২) বহুভাবপূর্ণ হৃদয় ও মস্তিষ্কসম্পন্ন ব্যক্তি,
৩) সম্পূর্ণ শক্তিশালী দেহবিশিষ্ট ব্যক্তি—
সে রথে তোমরা মন-শক্তি দ্বারা চলমান হয়ে মোক্ষলাভের উদ্দেশ্যে যোগ কর। যখন এই রথে তত্ত্বজ্ঞান উদ্ভূত হয়, তখন প্রতিটি দিন—রাত-দিন, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত—তোমাদের জন্য শুভ ও সুখ, শান্তি ও আনন্দবহুল হয়।” (ঋ ১০.৩৯.১২)

“হে প্রভু! যিনি মননশীল, নিয়মিত যজ্ঞকারী মানুষকে নিজের দূত হিসেবে পাঠান, সেই মানুষ যিনি অন্তঃকরণে নির্মল এবং দেবতার সাথে মিলিত হন, তার জন্য প্রতিটি দিন শুভ ও আহ্নাদায়ক হয়।” (ঋ ৭.১১.২)

সারসংক্ষেপে, প্রতিটি দিনকে সত্যিকারের শুভ ও পূর্ণাঙ্গ করার জন্য শিষ্যদের জন্য শিক্ষক, জ্ঞানার্জন, ব্রত, যজ্ঞ ও সৎকর্ম অপরিহার্য। জ্ঞান, সততা, ধ্যান ও শুভ কর্ম ছাড়া দিন কখনোই শুভ হতে পারে না।

“দিনই হয়। সে (জ্ঞানী) জানে উত্তম মতি সহ যিনি ব্রহ্মকে প্রাপ্তি করার পথ উপদেশ করেন। সেইজন্য তার জন্য সমস্ত দিনই শুভদিন হয়; এবং তাকে সমস্ত প্রকার ধন-সম্পদ, যশ বা জ্ঞানের প্রতিভা প্রাপ্ত হয়; ইন্দ্রিয়ের স্বামী হয়ে সমস্ত ইন্দ্রিয়দ্বারকে বিশেষভাবে দীপ্ত করে। (ঋ ৪.৪.৬)

সেটগ্রে হোক শুভগ ধনুন্ন্যস্ত্র, তুমি নিত্য যজ্ঞের হাভিস দ্বারা প্রিয় করো। নিজের জীবনে তা প্রয়োগ করে; এমন ব্যক্তি সুখী ও উত্তম দানশীল হয়; তারই সমস্ত দিন সুখকর ও শুভদিন হয়; তারই যজ্ঞ সফল হয়। (ঋ ৪.৪.৭)

অজ্যেষ্ঠাসো অকনিষ্ঠাস এতা সং ভ্রাতারঃ সৌভাগ্যায়। যুব পিতা স্বপা রুদ্র এষা সুদ্রধা পৃশ্ছি মরুদ্ভ্যঃ। (ঋ ৫.৬০.৫০)

এরা মানুষ পরস্পর ছোট-বড়, উচ্চ-নিচ ইত্যাদি ভেদভবনহীনভাবে ভাইয়ের মতো একে অপরকে সহায়তা করে, সৌভাগ্য বা উৎকৃষ্ট ঐশ্বর্য প্রাপ্তির জন্য একত্রিত হয়ে এগিয়ে যান। এজন্য প্রত্যেক ব্যক্তি (পিতা) অবশ্যই কর্তব্যপরায়ণ, (যুবা) সুস্থ ও বলশালী, (স্বপা) উত্তম কর্মে নিবেদিত, পরিবারের রক্ষা করে, (রুদ্রঃ) বাহ্য ও অন্তর্নিহিত সকল অসুরি ভাব ধ্বংসকারী, (মরুদ্ভ্যঃ) বায়ুর মতো শক্তিশালী এবং (পৃশ্ছি সুদুঘা) সূর্য, আকাশ, পৃথিবী ও পুষ্টিকর দুধাদির যোগকারী হন। (এষাং সুদিনা) এই জাতীয় ব্যক্তিদের দিনই শুভদিন হয়। অর্থাৎ, এমন কর্তব্যনিষ্ঠ ব্যক্তি ছাড়া কেউ উৎসব উদযাপন করার যোগ্য নয়।

এ পর্যন্ত আমরা বেদমন্ত্রের মাধ্যমে জানেছি যে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক স্তরে মানসিক ও আত্মিক সুখ-শান্তি অর্জনের সাধনা বা পদ্ধতিই ‘পর্ব’ (শুভদিন) বলার যোগ্য। শুধু কিছু মিষ্টি বা খাবার তৈরি করে খাওয়া বা আনন্দ করা কোনো উৎসব নয়; তেমনি, এটি ‘পর্ব’ শব্দের সঠিক অর্থ নয়। সাংসারিক জীবনে স্বার্থ ইত্যাদি প্রবাহ সৃষ্টি করলে মানুষ কেবল ভৌততায় প্রবাহিত হয়, যা মধ্যমধ্যেই উদযাপিত পর্বগুলো আধ্যাত্মিকতায় রূপান্তরিত করে। এটাই পর্বের মূল উদ্দেশ্য, যা মানব সমাজকে জানতে অতি প্রয়োজনীয়।

সংশ্লিষ্ট ঋতু-সংক্রান্ত পর্ব উদযাপন করে আমরা জীবনকে সেই ঋতুগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য করতে শিখি। নববর্ষে নির্ধারিত মন্ত্রের মাধ্যমে এটি প্রদর্শিত হয়েছে। এখানে আমরা শাস্ত্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রী স্বামী সমর্পণানন্দ (পণ্ডিত বুদ্ধদেব বিদ্যালঙ্কার)-এর কিছু মত উপস্থাপন করছি, যাতে পাঠকরা হৃদয়গম্যভাবে বুঝতে পারেন যে বছরব্যাপী সকল পর্ব আমরা ব্যক্তিগত জীবনে কিভাবে পালন ও উপলব্ধি করব।

“এটি ষষ্ঠ অধ্যায়ের তৃতীয় ব্রাহ্মণ শুরু। এই ব্রাহ্মণটিতে অগ্নি-সোম সম্পর্কিত আজ্যভাগ, উপাংশুযাজ এবং পুরোদাশের আঘাতি বর্ণনা করা হয়েছে। এই তিনটি আঘাতি অগ্নি ও সোম দেবতার নামে প্রদত্ত। সুতরাং এখানে অগ্নি ও সোমের মহিমা বলা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে কিভাবে ইন্দ্র বা সমাজের প্রতিনিধি রাজা ব্যক্তি, দেবতাদের সহায়তায় নিজের জন্য তা কার্যকর করতে পারে। অগ্নি ও সোমের তিনটি যুগল (পর্ব) এখানে বর্ণিত হয়েছে—সূর্য-চন্দ্র, দিন-রাত, শুক্লপক্ষ-কাশীণপক্ষ। এর অর্থ হলো: সূর্য ও চন্দ্র মানে বিজ্ঞান ও কলা, দিন-রাত অর্থ নারী-পুরুষ, শুক্ল ও কৃষ্ণপক্ষ অর্থ গর্ভধারণ থেকে প্রসূতি পর্যন্ত শুক্লপক্ষ এবং প্রসূতি থেকে পুনরায় গর্ভধারণ পর্যন্ত কৃষ্ণপক্ষ। এই তিনটি যুগল রাজাকে সমাজসেবায় মানুষকে প্রেরণা দেওয়ার উপায়। এখন এটি কিভাবে হয়, তা ষষ্ঠ কণ্ডিকা থেকে পুরো প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা করা হয়েছে।”

পূর্ণমাসীর দিনে উপবাস করা উচিত, কারণ উপবাস হলো অন্যের অধীনে থেকে শিক্ষালাভের একটি চিহ্ন। এই শিক্ষা দেওয়া হয় বৃত্রাসুরের অবধ্বংস এবং পূর্ণমাসীর চন্দ্রোদয়ের জন্য। পূর্ণমাসীর চাঁদ উদয় হবার আগে উপবাস করার অর্থ হলো—মানুষকে সরল, অভিজ্ঞতাহীন রাখা, যেন তার বৃত্রাসুর অন্য কেউ হত্যা করে, সে কখনো নিজে স্বনির্ভর না হয়, সর্বদা অন্যের অনুসারী এবং পরমুখাপেক্ষী থাকে। অতএব, উপবাস পূর্ণ চন্দ্রোদয় অর্থাৎ মস্তিষ্কের পরিপক্কতার আগে করা উচিত। তাই পূর্ণমাসীর দিনই উপবাস করুন।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, এই বিশেষ যজ্ঞ কখন করা হয়? উত্তর হলো সন্ধিকাল বা বিশেষ পর্বে। উদাহরণস্বরূপ—শিশু যুবক হয়ে গৃহস্থাশ্রমে প্রবেশ করলে এটি একটি আশ্রম থেকে অন্য আশ্রমে সংক্রমণ বা সन्धিকাল। এটি বিশেষ সংস্কারের প্রত্যাশা করে। স্ত্রী-পুরুষ পরস্পর মিলিত হয়ে গর্ভধারণ করলে এটি সन्धিকাল এবং সংস্কারের প্রত্যাশা রাখে। ছাত্র পিতৃকুল থেকে গুরুকুলে প্রবেশ করলে এটি গুরু-শিষ্য সन्धিকাল। মানুষের সমগ্র জীবন সन्धির ওপর ভিত্তি করে। স্ত্রী-পুরুষের বিবাহও আহোরাত্রিক সन्धির মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়। শিশুর প্রসূতির পর তার সংক্রমণ এবং অন্য গর্ভধারণ—এগুলি কৃষ্ণপক্ষ ও শুক্লপক্ষের সन्धি। এরপর এক আশ্রম থেকে অন্য আশ্রমে যাত্রা চাতুর্মাস্য সन्धি। শিশু বয়সের সংরক্ষণকালের কারণে শরৎ বলা হয়েছে; যৌবন হলো বসন্ত, বনপ্রস্থ হলো তপঃপ্রধান গ্রীষ্ম। এরপর জ্ঞান-বর্ষা শুরু হয়।

সন্ধিকালে যে ক্রিয়ার উদ্দেশ্য তা সমাপ্তির পরে তার অভিনয় সৌন্দর্য দেয় না। পূর্ণমাসীর চাঁদ হলো স্নাতকের প্রতিরূপ। এখানে ব্রতোপায়ন তাকে গৃহস্থাশ্রমেও প্রাচীন ব্রহ্মচার্যকাল স্মরণ করিয়ে দিতে। তাই ব্রতোপায়ন পূর্ণমাসীর চাঁদের আগে হওয়া উচিত। এই বিষয়গুলো পরবর্তী কণ্ডিকাগুলোতে বলা হয়েছে।

পরবর্তী কণ্ডিকাগুলোর অর্থ বোঝার আগে একটি শব্দের অর্থ জানাই—সংবৎসরসংবৎসর শব্দের অর্থ হলো ‘ছাতা’ বা ‘শামিয়ানা’, যার নিচে মানুষ মিলিত হয়ে বসবাস করে। যারা বড় ও সুন্দর শামিয়ানা দেখেছেন, তারা জানেন, এতে অনেক টুকরা একত্র করে একটি ছাতা তৈরি করা হয়। মণ্ডল বা ছাতাতেও সন্নিধি বা সংযোগ থাকে। ঠিক তেমনি, মানুষের জীবনও একটি সংবৎসর। এতে আছে আহোরাত্রি, অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর সন্ধি, যা বছরের ছাতার মতো শরত, গ্রীষ্ম, বর্ষা ইত্যাদির সন্ধির সমতুল্য।

কণ্ডিকাগুলোর অর্থ হলো—জীবনের সংবৎসর বা ছাতা কেমন হওয়া উচিত তা বোঝাতে, পরমপিতা পরমাত্মা আমাদের মাথার ওপর সংবৎসর-রূপ ছাতা টান দিয়েছেন। এক বছর যত ভিন্ন রূপ ধারণ করে তা হলো ছাতার বিভিন্ন রঙের ঘণ্টা, যেখানে জীবনের সন্ধি গুলি রয়েছে। যেমন সংবৎসর দিন-রাত দ্বারা গঠিত, তেমনি গৃহস্থ-জীবন স্ত্রী-পুরুষের যুগল দ্বারা গঠিত। যেমন রাতের কোলে চাঁদ আসে, তেমনি স্ত্রীর কোলে শিশু আসে, কখনও কখনও পিতার কোলে। পুত্র চাঁদ কখনও দিনে প্রকাশ পায়, কিন্তু মূল স্থান মা-এর কোলে। যেমন দিনের রশ্মি চাঁদকে আলোকিত করে, তেমনি গৃহপতির বীর্যরূপ সূর্য শিশুকে জন্ম দেয়।

শিশুর গর্ভধারণ শুক্লপক্ষ শুরু, প্রসূতি অষ্টমীর চাঁদ, শিক্ষা প্রাপ্ত হয়ে স্নাতক হওয়া পূর্ণমাসী। প্রসূতির পর কৃষ্ণপক্ষ শুরু। শিশুটি দুধ খাওয়া বন্ধ না করা পর্যন্ত এবং নতুন গর্ভধারণ না হওয়া পর্যন্ত কৃষ্ণপক্ষ চলমান। সমগ্র জীবন পর্যবেক্ষণে, ব্রহ্মচার্যকাল হলো সংগ্রহকাল বা শরৎকাল। স্নাতক হওয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম, যা হেমন্তকাল। এরপর বসন্তকাল হলো গৃহস্থাশ্রম। বনপ্রস্থ তপঃপ্রধান গ্রীষ্ম। এরপর বর্ষা হলো সন্ন্যাসকাল, যখন পুরুষ জীবনভর সংরক্ষিত জ্ঞান মেঘের মতো দেশের মধ্যে বিতরণ করে।

এই সन्धিকালগুলিতে বিশেষ শিক্ষা দেওয়ার জন্য যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষ জীবনের কাজের মধ্যে ব্যস্ত মানুষকে সময়-সময় স্মরণ না করালে শিথিলতা আসে। এটি ৩৫তম কণ্ডিকায় বলা হয়েছে। প্রজাপতি যখন প্রজার সৃষ্টি করতে ব্যস্ত ছিলেন, তখন তার পর্বগুলো আলগা হয়ে গিয়েছিল। তাই প্রজাপতি হলো সংবৎসর; তার সন্ধি হলো দিন-রাত, পূর্ণিমা-মাস এবং ঋতুসন্ধি।

আলগা সন্ধি সঠিকভাবে সংযোজন করতে পূর্ণিমা সহ যজ্ঞ করা হলো—অগ্রিহোত্র দ্বারা দিনরাতের সংযোজন, পূর্ণিমা প্রদর্শন দ্বারা পক্ষের সংযোজন, চাতুর্মাস্য দ্বারা ঋতুর সংযোজন। যখন সन्धি সংযুক্ত হলো, প্রজাপতি এই সম্পত্তির অধিপতি হয়ে উঠলেন।” (শতব্রাহ্মণ ০১.৬.৩.১, ৩৪-৩৭—স্বামী সমর্পণানন্দের ভাষ্য)

সংবৎসর শব্দের মধ্যেই যাজ্ঞিক ও আধ্যাত্মিক অর্থ নিহিত। সংবৎসরের শব্দ “সর্ব+ত্সর” শব্দ থেকে গঠিত। ত্সর হলো গোপনভাবে চলা (ছদ্মগতী) (भ्वा०३७३)।

১. স সৰ্বত্সরো ভবত্‌, সৰ্বত্সরোঃ হ্যৈ ন্যাম ঐতদ্ যৎ সংবৎসর ইতি (শতপথ ১১.১.৬.১২)।

 ধাতুর অর্থ হলো—গোপনভাবে চুপচাপ যাওয়া, পৌঁছানো, প্রাপ্তি। যা অজ্ঞাতভাবে সর্বত্র ও সকলের মধ্যে প্রবেশ করে, সেটিই সংবৎসর নামে পরিচিত। সমপূর্ণভাবে বস-নিবাসে (भ्वা०৭৩१) ধাতু থেকে উনাদিকোষ 'সরন্' (চিত) প্রত্যয় প্রয়োগ করেও সংবৎসর শব্দ গঠিত হয়।

যেখানে সমস্ত ঋতু নির্দিষ্ট ক্রমে একত্রিত হয়ে বাস করে, সেটিই সংবৎসর। সংবৎসর বসন্ত ঋতু থেকে শুরু হয়, যা আগে থেকেই প্রমাণিত। বেদে বলা হয়েছেব॒স॒ন্তো᳖ऽস্যাসী॒দাজ্যং॑ গ্রী॒ষ্মऽই॒ধ্মঃ শ॒রদ্ধ॒বিঃ (ঋ. ১০.৯০.৬, যজু. ০৩১.১৪, অথর্ব. ১৯.৬.১০)।

আজ্য হলো একটি মধুর ও স্নিগ্ধ (স্নেহযুক্ত) পদার্থ। বসন্ত ঋতুতেও সর্বত্র সবুজরূপী স্নেহ প্রতিভাত হয়। গ্রীষ্ম ঋতুর মতো কোথাও শুষ্কতা দেখা যায় না। একইভাবে, মানুষে যদি মধুরতা, প্রেম ও খ্রেহরূপ আজ্য বিরাজিত হয়, সেটিই মানবিক বসন্ত ঋতু, অর্থাৎ মানবিক সংবৎসরের শুরু।

এই দিভ্য গুণ দ্বারা মানুষ গোপনভাবে সকলের হৃদয়ে প্রবেশ করে এবং সেখানে বাস করে। এই স্নিগ্ধ আজ্য দ্বারা দেবতারা, অর্থাৎ দিভ্যগুণযুক্ত স্রোহী মহাপুরুষ, সমস্ত কামনা অর্জন করেছেন এবং অমরত্ব লাভ করেছেন।

ইধ্ম (সমিধা) হলো অগ্নিপ্রধান, তাই এটি গ্রীষ্ম ঋতুর প্রতীক। শরৎ ঋতুতে অন্ন পাকানো হয়। সেই পাকা নতুন অন্ন দিয়ে যজ্ঞে হাভি (আহতী) প্রদান করা হয়; তাই শরৎ ঋতু হলো হাভির প্রতিনিধি।

পরোপকারের ভাবনা, সমস্ত প্রাণীর প্রতি বন্ধুভাব রাখা, অর্থাৎ নহ রূপী আজ্য দ্বারা সকলকে প্রসন্ন করা ও আনন্দিত করা—এটাই ব্যক্তিগত সংবৎসর।

১. आज्येन वै देवाः सर्वान् कामान् अजयनू, सर्वममृतत्वम् (কৌষীতকী ব্রা. ১৪.১)।

এটাই বসন্ত ঋতু। নিজের মধ্যে ও সমাজে ব্যাপ্ত সমস্ত দোষ, আসুরী ভাবকে ইধ্ম (সমিধা)-র মতো ভস্ম করে দেওয়াই গ্রীষ্ম ঋতু। এটি এক মহান তপস্যা। সেই তপস্যায় দগ্ধ ও পরিশুদ্ধ হয়ে ব্যক্তির পরিপক্বতা লাভই, জীবনের সার্থকতাই শরৎ ঋতু। এটিই প্রকৃত সাংবৎসরিক যজ্ঞ, পার্বণ যজ্ঞ

আমরা বৈদিক পর্বগুলোর স্বরূপ, পদ্ধতি ও উদ্দেশ্য ইতিমধ্যেই জেনেছি। বর্তমান সমাজে প্রচলিত পর্বগুলোর মধ্যে যেগুলি বৈদিক পরম্পরার অনুকূল এবং পর্বের প্রকৃত উদ্দেশ্য পূরণে সক্ষম, সেসব পর্বের বৈদিক বিধি ও তার ব্যাখ্যা এখানে উপস্থাপন করা হচ্ছে। সমসাময়িক সমাজে প্রচলিত পর্ব ও উৎসবগুলোকে আমরা এইভাবে ভাগ করতে পারি—
১. বৈদিক—যেমন দর্শেষ্টি, পূর্ণমাসেষ্টি, চাতুর্মাস্য ইত্যাদি।
২. প্রাকৃতিক—যেমন নববর্ষেষ্টি, মকরসংক্রান্তি ইত্যাদি।
৩. আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক—যেমন শ্রাবণী উপাকর্ম ইত্যাদি।
৪. ঐতিহাসিক—যেমন শ্রীराम, শ্রীকৃষ্ণ, মহর্ষি দयानন্দ প্রভৃতি মহাপুরুষদের জন্মতিথি বা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
৫. সামাজিক—যেমন ২৬ জানুয়ারি, ১৫ আগস্ট, আর্যসমাজ প্রতিষ্ঠা দিবস ইত্যাদি।
৬. ব্যক্তিগত—যেমন জন্মদিন, বৈবাহিক বার্ষিকী ইত্যাদি।

এই সব পর্ব ও উৎসবের বিশেষত্ব বা উদ্দেশ্য সংশ্লিষ্ট পর্বের ব্যাখ্যার সময় জানানো হবে। পর্বগুলোর বিভাগের মূল উদ্দেশ্য ও প্রয়োজন বিশেষভাবে জানতে চাইলে “আর্য পর্বপদ্ধতি”-র যশস্বী লেখক শ্রী পণ্ডিত ভবানীপ্রসাদজীর ভূমিকা (পৃষ্ঠা ১৮–৩২) দ্রষ্টব্য।

সমস্ত ভারতবাসীর কাছে আমাদের বিনীত আবেদন—বেদ ও বৈদিক পরম্পরার বিরোধী পর্ব পালন করবেন না এবং মানবিকতার হানি ঘটায় এমন পর্বও পালন করবেন না, অন্যদেরও করতে দেবেন না। যেমন—বিশেষ উপলক্ষে পশু-পাখি হত্যা করে বলি দেওয়া ও তাদের মাংস ভক্ষণ, মদ্যপান করে আনন্দ উদ্‌যাপন। এমন পর্বও পালন করবেন না, যেগুলো থেকে কোনো কল্যাণসাধন হয় না, বরং কেবল ক্ষতিই সম্ভব। যেমন—দীপাবলিতে পটকা ফোটানো, হোলিতে রাসায়নিক রং ও নোংরা কাদা নিয়ে খেলা ইত্যাদি।

পটকা ফোটানোর (আতশবাজি) ফলে যেমন অর্থের চরম অপব্যবহার হয়, তেমনি পরিবেশ দূষণ, প্রাণহানি, দুর্ঘটনা, রোগব্যাধির বিস্তার, ঘরবাড়ি পুড়ে যাওয়া—এমন বহু ক্ষতি অজানা নয়। কেউ যদি বলেন, মাংস-মদ্যপান, আতশবাজি, হোলিতে রং খেলা ইত্যাদি মনোরঞ্জনের উপায়—তবে বলতে হয়, মনোরঞ্জন অবশ্যই সুস্থ সমাজের লক্ষণ। কিন্তু মনোরঞ্জনের উপায় কী হবে, কেমন হবে—এ বিষয়ে ভাবা জরুরি।

মনোরঞ্জনের উপায় থেকেই ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়, তার মানসিক প্রবৃত্তির পরিচয় মেলে। যেমন—শিশুদের খেলাধুলা তাদের শৈশবের পরিচায়ক; সেই উপায়গুলো যুবক বা বৃদ্ধদের জন্য মনোরঞ্জক হতে পারে না। তেমনি যুবকদের মনোরঞ্জনের উপায় শিশু বা বৃদ্ধদের আনন্দ দিতে পারে না। এই প্রবৃত্তির কথাই প্রকাশ করে একজন কবি যথার্থই বলেছেন—

কাব্যশাস্ত্রবিনোদেন কালো গচ্ছতি ধীমতাম্‌ ।
ব্যসনেন চ মূর্খাণাং নিদ্রয়া কলহেন বা ॥

অর্থাৎ—বিদ্বান ও বুদ্ধিমানদের সময় শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার মধ্যেই অতিবাহিত হয়; সেটাই তাদের মনোরঞ্জন। আর মূর্খ ও অজ্ঞদের সময় কু-অভ্যাস, ঝগড়া, নিদ্রা, আলস্য ও প্রমাদেই কেটে যায়—সেগুলিই তাদের মনোরঞ্জনের উপায়।

আমরা আমাদের মানসিক ও বৌদ্ধিক প্রবৃত্তি পরিবর্তন করতে পারি—এটাই পর্ব পালনের মূল উদ্দেশ্য। প্রবৃত্তি পরিবর্তিত হলে মনোরঞ্জনের উপায়ও পরিবর্তিত হবে। তখন মানুষ তামসিকতা থেকে সাত্ত্বিকতার দিকে অগ্রসর হবে। নিজের ধন ও সময়ের অপব্যবহার বন্ধ করে তা পরহিত ও পরোপকারে ব্যয় করবে। এটাই মানবতা, এটাই ধর্ম।

এই কারণেই পর্বগুলোর বিশেষ উপলক্ষে যজ্ঞের আয়োজন করে সর্বপ্রাণীর কল্যাণ করা হয়; সঙ্গে ধন, ধান্য, হিরণ্য, গাভী প্রভৃতি পশুর দানও করা হয়। যে ধন ধর্মে বিনিয়োগ হয়, সেই ধনই প্রকৃত ধন; ভোগ-বিলাসে ব্যয়িত ধনকে ধন বলা যায় না। অতএব মানবতার রক্ষা ও ভারতের গৌরবের জন্য আমাদের প্রাচীন বৈদিক পরম্পরা গ্রহণ করতেই হবে—এটাই আমাদের পরম কর্তব্য।

শেষে, পর্বের করণীয়তা ও সার্থকতা বোঝাতে যে মন্ত্রটি আছে, তা উদ্ধৃত করে বক্তব্যের ইতি টানি—

যদেষামন्यो অন্যস্য বাচং শাক্তস্যেব বদতি শিক্ষমাণঃ ।
সর্বং তদেষাং সমৃধেব পর্ব যৎ সুৱাচো বদথনাধ্যপ্সু ॥
(ঋগ্বেদ ৭.১০৩.৫)

গুরুজনের সান্নিধ্যে থেকে ব্রহ্মচারী (ব্রহ্মে বিচরণকারী শিষ্য) পূর্ণ বিদ্বান, জ্ঞানী ও বিবেকী হয়ে প্রজাদের মধ্যে এবং নিজের শিষ্যদের মধ্যে গুরুজনদের নিকট থেকে প্রাপ্ত বৈদিক জ্ঞান ও পালনীয় ব্রহ্মচর্যাদি ব্রতসমূহ প্রচার ও প্রসার করবে—অর্থাৎ বৈদিক জ্ঞান প্রচার করাই প্রতিটি মানুষের পর্ব, পালনীয় কর্তব্য।

নববর্ষেষ্টি

নবসংবৎসরোৎসব (সংবৎসরারম্ভের পর্ব)
(চৈত্র শুক্ল প্রতিপদা)

প্রাতে সূর্যোদয়ের পূর্বেই উঠে গৃহশুদ্ধি করতে হবে, গোবরাদি দ্বারা লেপন করে, পুষ্পাদি দ্বারা অলংকরণ করে উচ্চতর স্থানে ওমধ্বজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নতুন স্বদেশি বস্ত্র পরিধান করে সপরিবারে সংকল্পপূর্বক সাধারণ যজ্ঞ সম্পন্ন করতে হবে। তদনন্তর “নববর্ষেষ্টি”-সম্পর্কিত নীচে নির্দেশিত বিশেষ মন্ত্রসমূহ দ্বারা আহুতি প্রদান করতে হবে।

বিশেষ আহুতির মন্ত্র

ও৩ম্ সং॒ব॒ৎস॒রো᳖ऽসি পরিবৎস॒রো᳖ऽসীদাবৎস॒রো᳖ऽসীদ্বৎস॒রো᳖ऽসি বৎস॒রো᳖ऽসি । উ॒ষস॑স্তে কল্পন্তামহোরা॒ত্রাস্তে॑ কল্পন্তামর্দ্ধমা॒সাস্তে॑ কল্পন্তাং॒ মাসা॑স্তে কল্পন্তামৃ॒তব॑স্তে কল্পন্তাᳬসংবৎস॒রস্তে॑ কল্পতাম্ । প্রেত্যা॒ऽএত্যৈ॒ সং চাঞ্চ॒ প্র চ॑ সারয় । সু॒প॒র্ণ॒চিদ॑সি॒ তয়া॑ দে॒বত॑য়াऽঙ্গির॒স্বদ্ ধ্রু॒বঃ সী॑দ ॥ স্বাহা॥
(যজুর্বেদ ২৭।৪৫)

পদার্থঃ– হে বিদ্বন্ বা জিজ্ঞাসু পুরুষ! যদ্দ্বারা তুমি (সংবৎসরঃ) সংবৎসরের তুল্য নিয়ম দ্বারা বর্ত্তমান (অসি) আছো । (পরিবৎসরঃ) ত্যাজা বর্ষের সমান দুরাচরণের ত্যাগী (অসি) আছো । (ইদাবৎসরঃ) নিশ্চয়পূর্বক উত্তম প্রকার বর্ত্তমান বর্ষের তুল্য (অসি) আছো (ইদ্বৎসরঃ) নিশ্চিত সংবৎসরের সদৃশ (অসি) আছো । (বৎসরঃ) বর্ষের সমান (অসি) আছো । ইহা দ্বারা (তে) তোমার জন্য (উষসঃ) কল্যাণকারিণী উষা প্রভাতবেলা (কল্পন্তাম্) সমর্থ হউক (তে) তোমার জন্য (অহোরাত্রাঃ) দিন-রাত মঙ্গলদায়ক (কল্পন্তাম্) সমর্থ হউক (তে) তোমার জন্য (অর্দ্ধমাসাঃ) শুক্ল কৃষ্ণ পক্ষ (কল্পন্তাম্) সমর্থ হউক (তে) তোমার জন্য (মাসাঃ) চৈত্রাদি মাস (কল্পন্তাম্) সমর্থ হউক (তে) তোমার জন্য (ঋতবঃ) বসন্তাদি ঋতু (কল্পন্তাম্) সমর্থ হউক (তে) তোমার জন্য (সংবৎসরঃ) বর্ষ (কল্পন্তাম্) সমর্থ হউক, এবং তুমি (প্রেত্যৈ) উত্তম প্রাপ্তি হেতু (সম্, অঞ্চ) সম্যক্ প্রাপ্ত হউক (চ) এবং তুমি (এত্যৈ) উত্তম প্রকার গমন হেতু (প্র, সারয়) স্বীয় প্রভাবের বিস্তার কর যে কারণে তুমি (সুপর্ণচিৎ) সুন্দর রক্ষার সাধনের সঞ্চয়কর্ত্তা (অসি) আছো ইহা দ্বারা (তয়া) সেই উত্তম গুণযুক্ত সময় রূপ দেবতা সহ (অঙ্গিরস্বৎ) সূত্রাত্মা প্রাণবায়ুর সমান (ধ্রুবঃ) দৃঢ় নিশ্চল (সীদ) স্থির হউক ॥

ভাবার্থ
যে যোগ্য মানুষ অকারণে সময় নষ্ট করে না, সুন্দর নিয়মে জীবনযাপন করে কর্তব্য কর্ম সম্পাদন করে এবং ত্যাগযোগ্য বিষয় ত্যাগ করে—তাদের প্রভাতকাল, দিন-রাত্রি, পক্ষ, মাস ও ঋতুসমূহ সুন্দরভাবে অতিবাহিত হয়। অতএব উত্তম গতি লাভের জন্য প্রচেষ্টা করে শুভ পথে চলা উচিত, শুভ গুণ ও সুখের বিস্তার করা উচিত। শুভ লক্ষণযুক্ত বাক্য বা স্ত্রীর সহিত ধর্ম গ্রহণে এবং অধর্ম ত্যাগে দৃঢ় উৎসাহী হওয়া উচিত।

ও৩ম্ য়॒মায়॑ য়ম॒সূমথ॑র্ব॒ভ্যোऽব॑তোকাᳬসংবৎস॒রায়॑ পর্য়্যা॒য়িণীং॑ পরিবৎস॒রায়াবি॑জাতা- মিদাবৎস॒রায়া॒তীত্ব॑রীমিদ্বৎস॒রায়া॑তি॒ষ্কদ্ব॑রীং বৎস॒রায়॒ বিজ॑র্জরাᳬসংবৎস॒রায়॒ পলি॑ক্নীমৃ॒ভুভ্যো॑ऽ জিনস॒ন্ধꣳ সা॒ধ্যেভ্য॒শ্চর্ম॒ম্নম্ ॥স্বাহা ॥ (যজুর্বেদ ৩০.১৫)

পদার্থঃ–হে জগদীশ্বর বা রাজন! আপনি (য়মায়) নিয়মকর্ত্তার জন্য (য়মসূম্) নিয়ন্তাসকলকে উৎপন্নকারিণীকে (অথর্বভ্য) অহিংসকদের জন্য (অবতোকাম্) যাহার সন্তান বাহির হইয়া গিয়াছে সেই স্ত্রীকে (সংবৎসরায়) প্রথম সংবৎসরের জন্য (পর্য়ায়িণীম্) সব দিক দিয়া কালের ক্রম জ্ঞাত্রীকে (পরিবৎসরায়) দ্বিতীয় বর্ষের নির্ণয়ের জন্য (অবিজাতাম্) ব্রহ্মচারিণী কুমারীকে (ইদাবৎসরায়) তৃতীয় ইদাবৎসরে কার্য্য সাধনের জন্য (অতোত্বরীম্) অত্যন্ত গমনশীলকে (ইদ্বৎসরায়) পঞ্চম ইদ্বৎসরায় জ্ঞানের জন্য (অতীষ্কদ্বরীম্) অতিশয় করিয়া জানে যে তাহাকে (বৎসরায়) সাধারণ সংবৎসরায়ের জন্য (বিজর্জরাম) বৃদ্ধা স্ত্রীকে (সংবৎসরায়) চতুর্থ অনুবৎসরের জন্য (পলিক্লীম্) শ্বেত কেশ বিশিষ্টকে (ঋভুভ্যঃ) বুদ্ধিমানদের জন্য (অজিনসন্ধম্) জিতিতে অযোগ্য পুরুষদের সহিত মেলামেশা রক্ষাকারীকে (সাধ্যেভ্যঃ) এবং সাধ্য কার্য্যগুলির জন্য (চর্মম্নম্) বিজ্ঞান শাস্ত্রের অভ্যাসকারী পুরুষকে উৎপন্ন করুন ॥

ভাবার্থ
প্রভৃতি ষাটটি সংবৎসর পাঁচ-পাঁচ করে বারোটি যুগে বিভক্ত। প্রত্যেক যুগে ক্রমানুসারে সংবৎসর, পরিবৎসর, ইদাবৎসর, অনুবৎসর ও ইদাবৎসর—এই পাঁচটি সংজ্ঞা আছে। সময়ের এই সকল অংশের মূল সংবৎসরকে যাঁরা যথাযথভাবে জেনে সময় অপচয় করেন না, তাঁরা সকল উদ্দেশ্যের সিদ্ধি লাভ করেন।

ভাবার্থঃ–প্রভবাদি ৬০ সংবৎসরের মধ্যে পাঁচ পাঁচ করিয়া ১২ যুগ হয় । তাহাদের প্রত্যেক যুগে ক্রমপূর্বক সংবৎসর, পরিবৎসর, ইদাবৎসর, অনুবৎসর ও ইদ্বৎসর এই পাঁচটি সংজ্ঞা । সেই সব কালের অবয়বের মূল সংবৎসরকে বিশেষ করিয়া যে সমস্ত স্ত্রীগণ যথাবৎ জানিয়া ব্যর্থ সময় নষ্ট করে না তাহার সকল প্রয়োজনের সিদ্ধি প্রাপ্ত হয় ॥ মহর্ষি দয়ানন্দকৃত ভাষ্যের বাংলা অনুবাদ॥

ও৩ম্‌ দ্বাদশ প্রধয়ঃ চক্রমেকং ত্রীণি নাভ্যানি ক উ তদ্বিদাম্‌।
তস্মিন্সাকং ত্রিশতা ন শশট্ডবাঃ ষষ্টিঃ চলাচলাসঃ ॥ স্বাহা ॥ 
(ঋগ্বেদ ১.১৬৪.৪৮)

পদার্থঃ হে মনুষ্যগণ! যে রথে (ত্রিশতা) তিনশো (শঙ্কবঃ) বাঁধনকারী পেরেকের ন্যায় (ন) সমতুল্য, (সাকম্) একসাথে (অর্পিতাঃ) সংযোজিত অবস্থায় (ষষ্টিঃ) ষাটটি পেরেকের ন্যায় পেরেক আছে—যেগুলি (চলাচলাসঃ) চলমান ও অচল, অর্থাৎ কিছু চলমান আবার কিছু স্থির; এবং (তস্মিন্) সেই রথে (একম্) একটি (চক্রম্) চাকার ন্যায় গোল চক্র আছে; (দ্বাদশ) বারোটি (প্রধয়ঃ) চাকার পরিধি বা ফেলো যুক্ত চাকা রয়েছে; আর (ত্রীণি) তিনটি (নাভ্যানি) চাকার মধ্যবর্তী নাভিতে উত্তমভাবে স্থিত অক্ষ বা ধুরি স্থাপিত আছে— (তৎ) সেই রথকে (কঃ) কে (উ) যুক্তি-তর্কের দ্বারা (চিকেত) সত্যভাবে জানতে পারে॥

ভাবার্থ
সংবৎসররূপী এক কালচক্রে বারোটি মাসরূপী পরিধি, তিনটি প্রধান ঋতুরূপী নাভি (গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ) এবং ৩৬০টি দিনরূপী আরা আছে, যা অত্যন্ত গতিশীল। এই কালচক্রকে কে সত্যভাবে জানতে পারে? অর্থাৎ এমন জ্ঞানী খুবই বিরল। যেমন এই কালচক্র নিরন্তর গতিময় হয়ে অবিকারভাবে অগ্রসর হয়, তেমনি আমাদেরও অবিরাম কর্মমুখর হয়ে সুখ-দুঃখে সমভাবে স্থিত থেকে উন্নতির পথে অগ্রসর হওয়া উচিত।

ওশম্‌ সপ্ত যুয়ন্তি রথমেকচক্রমেকো অশ্নো বহতি সপ্তনামা।
ত্রিনাভিং চক্রমজরং অনর্বং যত্রেমা বিশ্বা ভুবনাধি তস্থুঃ ॥ স্বাহা ॥
(ঋগ্বেদ ১.১৬৪.২)

পদার্থঃ (যত্র) যেখানে (একচক্রম্) একটিমাত্র চক্রবিশিষ্ট—যার মধ্যে সমস্ত কলার আবর্তনের জন্য চক্র রয়েছে—সেই (রথম্) বিমান প্রভৃতি যানকে (সপ্তনামা) সাত নামে অভিহিত (একঃ) এক (অশ্বঃ) দ্রুতগামী বায়ু বা অগ্নি (বহতি) বহন করে নিয়ে যায়; অথবা যেখানে (সপ্ত) সাত (কলানাম্) কলার আবাসসমূহ (যুঞ্জন্তি) যুক্ত থাকে; অথবা যেখানে (ইমা) এই (বিশ্বা) সমস্ত (ভুবনা) লোক ও লোকান্তর (অধি তস্থুঃ) অধিষ্ঠিত হয়ে অবস্থান করে সেখানে (অনর্বম্) সাধারণভাবে পরিচিত ঘোড়াবিহীন, (অজরম্) জরা ও ক্ষয়হীন, (ত্রিনাভি) তিনটি বন্ধনযুক্ত (তৎ চক্রম্) সেই এক চক্রকে শিল্পীজন প্রতিষ্ঠা করুন।

টিপ্পণীঃ [সূর্য হলো চক্রাকার। ইহা একচক্ররূপ রথ। এর মধ্যে ৭ অশ্ব যুক্ত আছে। ইহা হলো রশ্মিসপ্তক, যা বর্ষাঋতুতে রামধনুর রূপে দৃষ্টিগোচর হয়। বস্তুতঃ এই এক চক্ররথের এক বহন এক অশ্বই করে, যা শুক্লরশ্মি সমূহ। এই শুক্লরশ্মি ৭ রশ্মি-সমূহে পরিণত হয়ে যায়। তিনটি নাভি হলো গ্রীষ্ম, বর্ষা, তথা শরৎ ঋতু। অনেকে "এক চক্র রথ" দ্বারা "বর্ষ চক্র" এর কথন করে।]

ভাবার্থ—আদিত্যমণ্ডলরূপ গতিশীল রথের একটিমাত্র চক্র সূর্য। সেই রথে সাত রঙের কিরণরূপী সাতটি অশ্ব যুক্ত রয়েছে, যারা সূর্যকে সর্বত্র নিয়ে যায়। সূর্যের এই কালরূপী রথ গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শরৎ ঋতুরূপ নাভিবিশিষ্ট, যা সর্বদাই বিনা বিরামে চলমান। এই কালের অন্তর্গতেই সমস্ত লোক অবস্থান করে, এই কালের প্রভাব থেকে কেউই মুক্ত নয়।

ও৩ম্ দ্বাদশারং নহি তজরায় বর্বর্তি চক্র পরি দ্যামৃতস্য।
আ পুত্রা অগ্রে মিথুনাসো অত্র সপ্ত শতানি বিংশতিশ্চ তস্থুঃ ॥স্বাহা॥
(ঋগ্বেদ ১.১৬৪.১১)

ভাবার্থ—এই সূর্যের বারো মাসবিশিষ্ট চক্র এই সমগ্র বিশ্বকে চারদিক থেকে নিরন্তর আবর্তিত করে, তবুও এটি কখনো ভাঙে না বা শিথিল হয় না। বারো মাসের এই চক্র মহান অন্তরিক্ষে সর্বদাই নিয়মিতভাবে চলমান। অগ্নিরূপ সূর্যের দিন-রাত্রিরূপ ৭২০ যুগল পুত্র, অর্থাৎ ৩৬০ দিন ও ৩৬০ রাত, সদা কার্যরত থাকে।

ও৩ম্ পঞ্চপাদং পিতরং দ্বাদশাকৃতিং দিব আহুঃ পরे অর্ধে পুরীষিণম্।
অথেমে অন্য উপরে বিচক্ষণং সপ্তচক্রে ষড়র আহুররপিতম্ ॥স্বাহা॥
(ঋগ্বেদ ১.১৬৪.১২)

ভাবার্থ—অয়ন, ক্রতু, মাস, পক্ষ ও দিনরূপ পাঁচ পায়ে স্থিত এবং বারো মাসরূপ বারো আকৃতিবিশিষ্ট, জল বর্ষণকারী সূর্য দিবলোকের অর্ধাংশে অর্থাৎ পৃথিবী থেকে দূরে পরিভ্রমণ করছে। এই সূর্য ছয় ঋতুরূপ আরবিশিষ্ট এবং অয়ন, ঋতু, মাস, পক্ষ, দিন, রাত্রি ও মুহূর্তরূপ সাত চক্রবিশিষ্ট সংবৎসররূপ রথে আরোহণ করেছে।

ও৩ম্ পঞ্চারে চক্রে পরিবর্তমানে তস্মিন্না তংস্থুর্ভুবনানি বিশ্বা।
তস্য নাক্ষস্তপ্যতে ভুরিংভারঃ সনাদেব ন শীর্যতে সনাভিঃ ॥স্বাহা॥
(ঋগ্বেদ ১.১৬৪.১৩)

ভাবার্থ—অয়নাদি পাঁচ আরবিশিষ্ট রথরূপ সংবৎসর অর্থাৎ কালের মধ্যেই সমস্ত লোক অবস্থিত। এই কালের বাইরে বা এর অতীত কোনো লোক নেই। এত লোকের ভার বহন করেও এই রথের অক্ষ উত্তপ্ত হয় না, ক্ষয়প্রাপ্তও হয় না। এই কালচক্র অনাদি কাল থেকে চলমান এবং অনন্ত কাল পর্যন্ত চলতেই থাকবে, তবুও এটি ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না।

ও৩ম্ সনেমি চক্রমজরং বি বাবৃত উত্তানায়াং দর্শ যুক্তা বহন্তি।
সূর্যস্য চক্ষূ রজসৈত্যাবৃতং তস্মিন্নার্ষিতা ভুবনানি বিশ্বা ॥স্বাহা॥
(ঋগ্বেদ ১.১৬৪.১৪)

ভাবার্থ
এই জগতরূপ চক্র নিরন্তর চলমান হলেও কখনো ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না। উৎপন্ন এই বিশাল প্রকৃতিকে পাঁচ তন্মাত্রা ও পাঁচ মহাভূত বহন করে চলেছে। সূর্যের আলো অন্তরিক্ষস্থিত জল প্রভৃতি দ্বারা আবৃত হয়ে পৃথিবী প্রভৃতিতে বিস্তৃত হয়। সেই সূর্যের আশ্রয়েই সমস্ত লোক স্থিত।

ও৩ম্ সংবৎসরস্য প্রতিমাং যাং ত্বাং রাত্র্যুপাস্মহে।
সা ন আয়ুষ্মতীং প্রজাং রায়স্পোষেণ সং সৃজ ॥স্বাহা॥
(অথর্ববেদ ৩.১০.৩)

ভাবার্থ
অনন্ত পরমেশ্বরী প্রকৃতির সূক্ষ্ম ও স্থূল রূপের জ্ঞান থেকে উপকার গ্রহণ করে আমরা আমাদের সন্তানসহ ধনবান, সুস্থ ও দীর্ঘজীবী হয়ে থাকি।

ওশम्‌ যস্মান্‌ মাসা নির্মিতাস্ত্রিশদরা: সংবৎসরো যস্মান্নির্মিতো দ্বাদশারঃ। অহোরাত্রা যং পরিযন্তো নাপুস্তেনৌদনেনাতিং তরাণি মৃত্যুম্‌ ॥স্বাহা॥ (অথর্ব০৪.৩৫.৪)

ভাবার্থ- পরমাত্মা ত্রিশ দিনসম্বলিত মাসসমূহ এবং বারো মাসসম্বলিত সংবৎসর নির্মাণ করেছেন। দিন ও রাত নিরন্তর গতিশীল হলেও পরমাত্মাকে লাভ করতে পারেনি। কিন্তু আমি (জীবাত্মা) বেদজ্ঞানরূপ আত্মোদন দ্বারা পরমাত্মাকে লাভ করে মৃত্যুকে অতিক্রম করব। অতএব আমাদের প্রতিদিন নিয়মপূর্বক বেদের স্বাধ্যায় করা উচিত।

ও৩ম্ মধবে স্বাহা মাধবায় স্বাহা শুক্রায় স্বাহা শুচয়ে স্বাহা নভসে স্বাহা নভস্যায় স্বাহা ইষায় স্বাহা ঊর্জায় স্বাহা সহসে স্বাহা সহস্যায় স্বাহা তপসে স্বাহা তপস্যায় স্বাহা অহস্পতয়ে ॥স্বাহাঁ॥ (যজু০২২.৩১)

মধ॑বে॒ স্বাহা॒ মাধ॑বায়॒ স্বাহা॑ শু॒ক্রায়॒ স্বাহা॒ শুচ॑য়ে॒ স্বাহা॒ নভ॑সে॒ স্বাহা॑ নভ॒স্যা᳖য়॒ স্বাহে॒ষায়॒ স্বাহো॒র্জায়॒ স্বাহা॒ সহ॑সে॒ স্বাহা॑ সহ॒স্যা᳖য়॒ স্বাহা॒ তপ॑সে॒ স্বাহা॑ তপ॒স্যা᳖য়॒ স্বাহা॑ᳬহসস্প॒তয়ে॒ স্বাহা॑ ॥ 

পদার্থঃ- হে মনুষ্যগণ ! (মধবে) মিষ্টত্বাদিকে উৎপন্ন কারী চৈত্রের জন্য (স্বাহা) যজ্ঞক্রিয়া (মাধবায়) মধুরত্বে উত্তম বৈশাখের জন্য (স্বাহা) যজ্ঞক্রিয়া (শুক্রায়) জলাদি পবন বেগ দ্বারা নির্মলকারী জ্যেষ্ঠর জন্য (স্বাহা) যজ্ঞক্রিয়া (শুচয়ে) বর্ষা যোগে ভূমি আদির পবিত্রকারী আষাঢ়ের জন্য (স্বাহা) যজ্ঞক্রিয়া (নভসে) ভালমত সঘন বাদলের ঘনঘোর শ্রাবণকারী শ্রাবণের জন্য (স্বাহা) যজ্ঞক্রিয়া (নভস্যায়) আকাশে বর্ষা দ্বারা প্রসিদ্ধ হওয়া ভাদ্রের জন্য (স্বাহা) যজ্ঞক্রিয়া (ইষায়) যজ্ঞকে উৎপন্নকারী অশ্বিনের জন্য (স্বাহা) যজ্ঞক্রিয়া (ঊর্জায়) বল ও অন্নকে উৎপন্নকারী বা বলযুক্ত অন্ন অর্থাৎ আশ্বিনে পক্ব বাজরাদি অন্নকে পুষ্টিকারী কার্ত্তিকের জন্য (স্বাহা) যজ্ঞক্রিয়া (সহসে) বলদাতা অগ্রহায়ণের জন্য (স্বাহা) যজ্ঞক্রিয়া (সহস্যায়) বলপ্রদানে উত্তম পৌষের জন্য (স্বাহা) যজ্ঞক্রিয়া (তপসে) ঋতু পরিবর্তনের ফলে ধীরে ধীরে শীতের নিবৃত্তি এবং জীবের শরীরে গরমের প্রবৃত্তি কারী মাঘের জন্য (স্বাহা) যজ্ঞক্রিয়া (তপস্যায়) জীবদিগের শরীরে উষ্ণতা প্রবৃত্তিকারী মাঘের জন্য (স্বাহা) যজ্ঞক্রিয়া (তপস্যায়) জীবদিগের শরীরে উষ্ণতা প্রবৃত্তিকারী উত্তম ফাল্গুণের জন্য (স্বাহা) যজ্ঞক্রিয়া এবং (অংহসঃ) মাসগুলিতে মিশ্রিত মলমাসের জন্য (পতয়ে) পালকের জন্য (স্বাহা) তোমরা যজ্ঞক্রিয়ার অনুষ্ঠান কর ॥ 

ভাবার্থ- মধু, মাধব, শুক্র, শুচি, নভস্‌, নভস্য, ইষ, ঊর্জ, সহস্‌, সহস্য, তপস্‌, তপস্য—এই মাসসমূহে এবং অতিরিক্ত মাসে (মলমাসেও), অর্থাৎ সমগ্র সংবৎসর জুড়ে আমরা নিয়মপূর্বক যজ্ঞের অনুষ্ঠান করতে থাকি।

ও৩ম্ মধুশ্চ মাধবশ্চ বসন্তিকাবৃতূ শুক্রশ্চ শুচিশ্চ গ্রৈষ্মাবৃতূ।
নভশ্চ নভস্যশ্চ বার্ষিকাবৃতূ ইষশ্চ ঊর্জশ্চ শারদাবৃতূ।
সহশ্চ সহস্যশ্চ হৈমন্তিকাবৃতূ তপশ্চ তপস্যশ্চ শৈশিরাবৃতূ ॥স্বাহা॥
(তৈত্তিরীয় সংহিতা ৪.৪.১১.১)

ভাবার্থ- মধু (চৈত্র) ও মাধব (বৈশাখ) মাস বসন্ত ঋতুর সঙ্গে সম্পর্কিত। শুক্র (জ্যৈষ্ঠ) ও শুচি (আষাঢ়) মাস গ্রীষ্ম ঋতুর। নভস্‌ (শ্রাবণ) ও নভস্য (ভাদ্রপদ) মাস বর্ষা ঋতুর। ইষ (আশ্বিন) ও ঊর্জ (কার্তিক) মাস শরৎ ঋতুর। সহস্‌ (মার্গশীর্ষ) ও সহস্য (পৌষ) মাস হেমন্ত ঋতুর। তপস্‌ (মাঘ) ও তপস্য (ফাল্গুন) মাস শিশির ঋতুর।

ও৩ম্ গ্রীষ্মো হেমন্তঃ শিশিরো বসন্তঃ শরদ্বর্ষা স্বিতে নো দধাত।
আ নো গোষু ভজতা প্রজায়াঁ নিবাত ইদ্বঃ শরণে স্যাম ॥স্বাহা॥
(অথর্ব০৬.৫৫.২)

ভাবার্থ- গ্রীষ্ম প্রভৃতি ঋতুগণ আমাদের উত্তম ধন-ঐশ্বর্য ও উত্তম আচরণে স্থাপন করুন; অর্থাৎ আমরা ঋতুচর্যার অনুকূলেই আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন গ্রহণ করি। হে ঋতুগণ! আমাদের গৃহে উত্তম গাভী থাকুক এবং আমরা উত্তম সন্তানের অধিকারী হই। আমরা তোমাদের বায়ু প্রভৃতি উপদ্রবহীন গৃহেই বাস করি।

ও৩ম্ বসন্ত ইচ্ছু রন্ত্যো গ্রীষ্ম ইচ্ছু রন্ত্যঃ।
বর্ষাণ্যনু শরদো হেমন্তঃ শিশিরঃ ইচ্ছু রন্ত্যঃ ॥স্বাহা॥
(সাম০৬১৬)

ভাবার্থ- “যেমন মন, তেমন চিন্তা”—এই উক্তি অনুসারে বিষণ্ণ ও ব্যাকুল মনের মানুষের কাছে সংসারও নিরস ও দুঃখময় বলে প্রতীয়মান হয়। তদ্রূপ গ্রীষ্ম, শীত ও বর্ষা ঋতুর কারণে যারা নানাভাবে কষ্ট পায়, তারা সেই ঋতুগুলোকেই দোষারোপ করে। কিন্তু ভগবৎচিন্তনে রত এক ভক্তের বাক্য দেখুন—বসন্ত ঋতু নিঃসন্দেহে রমণীয়, সর্বত্র সবুজ ও পুষ্পিত বৃক্ষ দেখা যায়। গ্রীষ্ম ঋতুও নিশ্চিতভাবেই রমণীয়, কারণ তা সমস্ত প্রকার মলিনতাকে দগ্ধ করে এবং ঘামের মাধ্যমে শরীরকেও শোধন করে। বর্ষা ঋতুও অত্যন্ত আহ্লাদকর, যা দগ্ধ মলিনতাকে প্রবাহিত করে নগর প্রভৃতিকে শুদ্ধ করে। তার পরবর্তী শরৎ ঋতু অত্যন্ত আকর্ষণীয়, যা বর্ষায় সীমাহীনভাবে বৃদ্ধি পাওয়া জলকে নিয়ন্ত্রিত করে এবং উদ্ভিদের অতিরিক্ত উৎপাদনকেও সীমায় আনে, এভাবে সকলকে সংযত করে তোলে। এরপর আগত হেমন্ত ঋতুও অত্যন্ত সুন্দর ও লাভপ্রদ। ঈশ্বরনির্মিত জগৎ সম্পূর্ণরূপে সুন্দর, রমণীয়, হিতকর ও শুভ; এই জগতে অশুভ, অমঙ্গল বা অহিতকর কিছুই নেই।

ও৩ম্ বসন্তেন ঋতুনাং দেবা বসবস্ত্রিবৃতাং স্তুতাঃ।
রথন্তরেণ তেজসা হবিদিন্দ্রে বর্যো দধুঃ ॥স্বাহা॥
(যজু০২১.২৩)

পদার্থঃ- হে মনুষ্যগণ ! যাহারা (বসবঃ) পৃথিবী আদি অষ্ট বসু অথবা প্রথম শ্রেণিভুক্ত বিদ্বান্গণ (দেবাঃ) দিব্য গুণযুক্ত (স্তুতাঃ) স্তুতিপ্রাপ্ত (ত্রিবৃতা) তিন কালে বিদ্যমান (বসন্তেন) যন্মধ্যে সুখে নিবাস করে, সেই প্রাপ্তি হওয়ার যোগ্য বসন্ত (ঋতুনা) ঋতুসহ বর্ত্তমান (রথন্তরেন) যেখানে রথ দ্বারা উত্তীর্ণ হয় সেই (তেজসা) তীক্ষ্ম স্বরূপ দ্বারা (ইন্দ্রে) সূর্য্যের প্রকাশে (হবিঃ) দেওয়ার যোগ্য (বয়ঃ) আয়ু বৃদ্ধিকারী বস্তুকে (দধুঃ) ধারণ করিবে, তাহাদেরকে স্বরূপ দ্বারা জানিয়া সঙ্গতি কর ॥ 

ভাবার্থ- যারা বসন্ত ঋতুর ন্যায় নিজেদের জীবনে জ্ঞান-বিজ্ঞানের পুষ্প বিকশিত করে, সদা নবীনতা ও সদ্‌গুণ ধারণ করে দিব্যতাকে লাভ করে এবং নিজের অন্তরাত্মার চিন্তনে বাস করে—অর্থাৎ নিজের জীবনে বসন্ত ঋতু প্রতিষ্ঠা করে—এমন বসু ব্রহ্মচারী ও প্রথম স্তরের বিদ্বানগণ ত্রিকালেই প্রশংসিত হন। তারা নিজেদের পরাক্রম ও তেজ দ্বারা জীবাত্মায় জ্ঞানরূপ হবি ও উৎকৃষ্ট জীবন ধারণ করেন।

ও৩ম্ গ্রীষ্মেণ ঋতুনাং দেবা রুদ্রাঃ পঞ্চদশে স্তুতাঃ।
বৃহতা যশসা বলেন হবিদিন্দ্রে ব্যো দধুঃ ॥স্বাহা॥
(যজু০২১.২৪)

ভাবার্থ- যারা গ্রীষ্ম ঋতুর সূর্যের ন্যায় নিজেদের প্রখর জ্ঞানের প্রতাপে অন্তরের মলিনতাকে দগ্ধ করে দেয় এবং জ্ঞান, শান্তি ও আনন্দরূপ রস গ্রহণ করে—অর্থাৎ নিজের জীবনে গ্রীষ্ম ঋতু স্থাপন করে—এমন দিব্যতালাভকারী রুদ্রগণ, অর্থাৎ নিজেদের আসুরী ভাবনাকে দগ্ধকারী রুদ্র ব্রহ্মচারী ও মধ্যম স্তরের বিদ্বানগণ পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় ও পঞ্চ প্রাণকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হন এবং মহান যশ, বল ও জীবনরূপ হবি নিজেদের মধ্যে ধারণ করেন।

ও৩ম্ বর্ষাভিঋতুনাং আদিত্যা স্তোমে সপ্তদশে স্তুতাঃ।
বৈরূপেণ বিশৌজসা হবিদিন্দ্রে ব্যোং দধুঃ ॥স্বাহা॥
(যজু০২১.২৫)

ভাবার্থ- যারা বর্ষা ঋতুর ন্যায় সুক্ষ্ম জ্ঞান সকল মানুষের মধ্যে বর্ষণ করেন এবং তাদের অজ্ঞান ও দুঃখ দূর করে আনন্দিত করেন—অর্থাৎ যারা নিজের জীবনে বর্ষা ঋতুকে ধারণ করেন—এমন আদিত্য দেবগণ, অর্থাৎ আদিত্য ব্রহ্মচারী ও উৎকৃষ্ট বিদ্বজ্জনগণ স্তবযোগ্য হন। তারা সূক্ষ্ম শরীরের মধ্যে (৫ জ্ঞানেন্দ্রিয় + ৫ কর্মেন্দ্রিয় + ৫ প্রাণ + মন + বুদ্ধি) প্রশংসনীয় হন এবং নানা রূপ ও স্বভাববিশিষ্ট প্রজা ও ওজঃশক্তির দ্বারা নিজেদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জীবন ধারণ করেন।

ও৩ম্ শারদেন ঋতুনাং দেবা একবিংশ ঋভবঃ স্তুতাঃ।
বৈরাজেন শ্রিয়া শ্রিয়ং হবিদিন্দ্রে বর্যো দধুঃ ॥স্বাহা॥
(যজু০২১.২৬)

ভাবার্থ- যেমন শরৎ ঋতু বর্ষা ঋতুর মেঘসমূহকে বিচ্ছিন্ন করে আকাশ প্রভৃতিকে নির্মল করে, জলকে শুদ্ধ করে এবং অন্ন ও ফলের বৃদ্ধি সাধন করে—তেমনি ঋভব দেবগণ, অর্থাৎ জ্ঞানজ্যোতিতে প্রদীপ্ত অন্তঃকরণবিশিষ্ট (ঋতেন ভান্তি, ঋতেন ভবন্তীতি বা—নিরুক্ত ১১.১৬) মেধাবী জন অথবা ঋতেই রমণকারী বিদ্বানগণ ২১ তত্ত্ব (সংবৎসরের ১৩ মাস, ৬ ঋতু ও ৩ লোক—দ্রষ্টব্য ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ১.৩০, শতপথ ব্রাহ্মণ ১.৩.৫.১১) জেনে মানুষের মধ্যে বিস্তৃত মেঘরূপ আসুরী ভাবনাকে বিনষ্ট করে তাদের মধ্যে জ্ঞানজ্যোতি প্রজ্বলিত করেন, অন্তঃকরণকে পবিত্র করেন এবং সুখ-শান্তিতে পরিপূর্ণ করে দেন। এইভাবে যারা নিজের জীবনে শরৎ ঋতুকে ধারণ করেন, সেই বিদ্বানগণ সমাজে অত্যন্ত প্রশংসিত হন এবং বিশেষভাবে প্রকাশিত ঐশ্বর্য ও গ্রহণযোগ্য দীর্ঘ জীবন লাভ করেন।

ও৩ম্ হে॒ম॒ন্তেন॑ऽঋ॒তুনা॑ দে॒বাস্ত্রি॑ণ॒বে ম॒রুত॑ স্তু॒তাঃ ।
বলে॑ন॒ শক্ব॑রীঃ॒ সহো॑ হ॒বিরিন্দ্রে॒ বয়ো॑ দধুঃ ॥ স্বাহা॥
(যজু০২১.২৭)

পদার্থঃ- হে মনুষ্যগণ ! যাহা (ত্রিণবে) সাতাইশতম ব্যবহারে (হেমন্তেন) যন্মধ্যে জীবদিগের দেহ বৃদ্ধি পাইতে থাকে সেই (ঋতুনা) প্রাপ্ত হওয়ার যোগ্য হেমন্ত ঋতু সহ আচরণ করিয়া (স্তুতাঃ) প্রশংসার যোগ্য (দেবাঃ) দিব্যগুণযুক্ত (মরুতঃ) মনুষ্য (বলেন) মেঘ দ্বারা (শক্বরীঃ) শক্তির নিমিত্ত গাভিসকলের (সহঃ) বল তথা (হবিঃ) আদান-প্রদানের যোগ্য (বয়ঃ) বাঞ্ছিত সুখকে (ইন্দ্রে) জীবাত্মায় (দধুঃ) ধারণ করিবে, তাহাদের তুমি সেবন কর ॥

ভাবার্থ- হেমন্ত ঋতু যেমন তীব্র শীতের দ্বারা প্রাণীদের কষ্ট দেয় এবং জলপ্রবাহকে সংকুচিত করে, তেমনি মরুদ্‌ দেবগণ—অর্থাৎ ঋত্বিকগণ ও যাজ্ঞিকেরা (মরুত্‌ ইতি ঋত্বিড্‌নাম—নিরুক্ত ২.১৯) নিজেদের এবং যজমানদের দুর্ভাবনার প্রতি অত্যন্ত কঠোরতা প্রদর্শন করেন এবং নিজেদের ও যজমানদের মানসিক প্রবাহ ও চঞ্চলতাকে সংযত ও নিয়ন্ত্রিত করেন। অর্থাৎ তারা নিজেদের জীবনে হেমন্ত ঋতুকে প্রকাশ করেন। এইভাবে তারা (ত্রিণব) ধর্ম, অর্থ ও কামে উত্তম গতিসম্পন্ন হয়ে অথবা জ্ঞান, কর্ম ও উপাসনায় স্তবযোগ্য হয়ে সমাজে খ্যাতি লাভ করেন। ফলত তারা গ্রহণযোগ্য বল, শক্তি, সামর্থ্য ও সহনশীলতা ধারণ করে জীবনকে সার্থক করেন।

ও৩ম্ শৈশিরেণ কৃতুনা দেবাস্ত্রয়স্ত্রিংশে অমৃতাঃ স্তুতাঃ।
সত্যেন রেবতীঃ ক্ষত্রং হবিদিন্দ্রে বয়ং দধুঃ ॥স্বাহা॥
(যজু০২১.২৮)

ভাবার্থ- যেমন শিশির ঋতু বৃক্ষের পাতা ঝরিয়ে নতুন পাতা গজানোর জন্য বৃক্ষে নতুন রস সঞ্চার করে, তেমনি অমৃত দেবগণ—অর্থাৎ বিষয়-বাসনার পশ্চাতে মরণবরণ না করা বিদ্বানগণ অথবা রোগাক্রান্ত না হওয়া মনীষীরাও—নিজেদের সকল বন্ধন শিথিল করে অমরত্ব লাভে সক্ষম রস ও শক্তির সঞ্চার করে নিজেদের জীবনে শিশির ঋতুকে ধারণ করেন। এইভাবে তারা মস্তিষ্করূপ স্বর্গলোক, হৃদয়রূপ অন্তরীক্ষলোক এবং অবশিষ্ট শরীররূপ পৃথিবীলোকে এগারো-এগারো দেবতা (দিব্যগুণ) ধারণ করে নিজেদের দেহকে তেত্রিশ দেবতার আবাসরূপ দেবপুরীতে পরিণত করেন, ফলে তারা অত্যন্ত স্তবযোগ্য হয়ে ওঠেন। তারা সত্যের পথেই ধন-ঐশ্বর্য লাভ করেন এবং আত্মিক বল, অন্ন ও উৎকৃষ্ট জীবনও অর্জন করেন।

ও৩ম্ ঋতবস্ত ঋতুথা পর্ব শমিতারোং বিউশাসতু।
সংবৎসরস্য তেজংসা শমীভিঃ শম্যন্তু ত্বা ॥স্বাহা॥
(যজু০২৩.৪০)

ভাবার্থ- পূর্ববর্তী মন্ত্রসমূহে বর্ণিত ঋতুসমূহের অনুকূল আচার, চিন্তা ও ব্যবহার করলে সেই ঋতুগুলি এবং ঋতুর পর্বসমূহ (সন্ধিকাল) দিব্যতা ও স্বাস্থ্য কামনাকারীদের জন্য শান্তিদায়ক হয়ে পথপ্রদর্শক রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। অভীষ্ট কামনা পূরণে সক্ষম সংবৎসরের তেজস্বিতার দ্বারা এবং ঋতু-অনুকূল কর্মের দ্বারা (শমী কর্মাণি—নিঘ০২.১, নিরুক্ত ১১.১৬) তুমি সুখ ও শান্তি লাভ করো।

ও৩ম্ অর্ধমাসাঃ পরূংষি তে মাসা আচ্ছয়ন্তু শম্যন্তঃ।
অহোরাত্রাণ মরুতো বিলিষ্টং সূদয়ন্তু তে ॥স্বাহা॥ (যজু০২৩.৪১)

ভাবার্থ- শুক্লপক্ষ, কৃষ্ণপক্ষ এবং তাদের পর্বসমূহ (সন্ধি) ও মাসসমূহ তোমাকে শান্তি প্রদান করে আত্মিক, মানসিক ও শারীরিক দোষ দূর করুক। দিন ও রাত্রি—অর্থাৎ সর্বদাই—এই সকল প্রকার প্রাণ ঋতু-অনুকূলভাবে চলনকারী ব্যক্তির সমস্ত ঘাটতি ও দুর্বলতাকে বিনষ্ট করুক।

ও৩ম্ ইদাবৎসরার্য পরিবৎসরায় সংবৎসরায় কৃণুতা বৃহন্নমঃ।
তেষাং বয়ং সুমতৌ যজ্ঞিয়ানামপি ভদ্রে সৌমনসে স্যোম ॥স্বাহা॥ (অথর্ব০৬.৫৫.৩)

ভাবার্থ- প্রভব প্রভৃতি ষাটটি সংবৎসরের মধ্যে বারোটি যুগ বিদ্যমান। প্রত্যেক যুগে সংবৎসর, পরিবৎসর, ইদাবৎসর, অনুবৎসর ও ইদ্ধৎসর—এই পাঁচটি করে বর্ষ থাকে। এই বর্ষসমূহের যথাযথ জ্ঞান লাভ করে আমরা তাতে প্রাচুর্যের সঙ্গে অন্নাদি উৎপন্ন করি এবং সেই নবীন শস্য দ্বারা ঋতু-অনুকূল যজ্ঞযাগ সম্পাদন করে আনন্দিত হই। এই মন্ত্রসমূহ দ্বারা আহুতি প্রদান করে পূর্ণাহুতি ও শান্তিপাঠের মাধ্যমে অগ্নিহোত্র সমাপ্ত করো। তৎপর উপস্থিত সকলেই পরস্পরের প্রতি প্রীতিসহকারে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করুক। বিদ্বানদের নিকট থেকে উপদেশ গ্রহণ করে বিদ্বান, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের যথোচিতভাবে ভোজনাদির দ্বারা সম্মান প্রদর্শন করো।

১. অতঃ খলু অয়নে একসঙ্গে দুইটি সংবৎসর হয়, সেগুলিই পাঁচ যুগ—এই নামে অভিহিত হয়
(সুশ্রুত্‌ সূত্র ০৬.৯), সংবৎসরাঃ পঞ্চ যুগম্‌ (মহা০ সভা০ ১১.৩৮)।

২. নমঃ অন্ননাম— (নিঘণ্টু ২.৭)।

ঋতুচর্যা — মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী

মানুষের উচিত ঋতু-ঋতুতে শুদ্ধ দ্রব্য দিয়ে হোম করা, যাতে সেই দ্রব্য সূক্ষ্ম হয়ে ক্রমান্বয়ে অগ্নি, সূর্য ও মেঘে পৌঁছে বর্ষণের মাধ্যমে সকলের উপকার করে। (যজু० ২৯.৩৫)

যে মানুষ সকল ঋতুতে সময় অনুযায়ী আহার-বিহার গ্রহণ করে, বিদ্যা, যোগাভ্যাস ও সৎসঙ্গ যথাযথভাবে অনুশীলন করে, তারা সব ঋতুতেই সুখ ভোগ করে এবং চোর প্রভৃতি (রোগ) কেউই তাদের কষ্ট দিতে পারে না। (যজু० ১০.১৪)

মানুষের উচিত ধর্মাত্মাদের পথে চলতে চলতে শারীরিক, বাচিক ও মানসিক—এই তিন প্রকার সুখ লাভ করা এবং কামনা পূর্ণ হয় এমন প্রচেষ্টা করা। যেমন বসন্ত প্রভৃতি ঋতু নিজ নিজ ক্রমে চলতে চলতে তাদের নিজস্ব লক্ষণ প্রকাশ করে, তেমনই ঋতুর অনুকূল আচরণ করে আনন্দ লাভ করা উচিত।
(যজু० ১৩.৩১)

যে মানুষ সংযমী আহার-বিহারকারী ও জিতেন্দ্রিয়, তারা সব ঋতুতেই পাঁচ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা সুখ লাভ করে।
(ঋ০ ২.১৩.১০)

মানুষের কর্তব্য যে ঋতুর অনুকূল কর্মের দ্বারা অগ্নি, জল ও অন্নের সেবন করে রাজ্য ও পৃথিবীর সর্বদা রক্ষা করা, যাতে সকল প্রকার সুখ লাভ হয়। (যজু० ১৩.৪৩)

এই সংসারে মানবজন্ম লাভ করে যে নারী ও পুরুষ বিদ্বান হয়ে ব্রহ্মচর্যসেবন, বিদ্যা ও উত্তম শিক্ষাগ্রহণ প্রভৃতি শুভ গুণ-কর্মে নিজে প্রবৃত্ত হয় এবং অন্যদেরও প্রবৃত্ত করে, তারা সেই পথে চলতে চলতে পরমেশ্বর থেকে পৃথিবী পর্যন্ত পদার্থসমূহের যথার্থ বিজ্ঞান দ্বারা উপকার গ্রহণ করে সকল ঋতুতেই নিজেরা সুখী থাকে এবং অন্যদেরও সুখী করে। (যজু० ১৪.৭)

বসন্ত ঋতু

যখন বসন্ত ঋতু আসে, তখন পাখিরাও কোমল মধুর-মধুর শব্দে কথা বলে এবং অন্যান্য সকল প্রাণী আনন্দিত হয়। (যজু० ১৩.২৮)

যখন বসন্ত ঋতু আসে, তখন পুষ্প প্রভৃতির সুগন্ধে যুক্ত বায়ু ও অন্যান্য পদার্থ বিদ্যমান থাকে। সেই ঋতুতে ভ্রমণ ও চলাফেরা পাথ্য—এ কথা নিশ্চিতভাবে জানা উচিত। (যজু० ১৩.২৭)

হে মনুষ্যগণ! তোমরা বসন্ত ঋতু প্রাপ্ত হয়ে যে প্রকার দ্রব্যের হোমে উদ্ভিদাদি কোমল ও গুণযুক্ত হয়, সেইরূপ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করো এবং এভাবে বসন্ত ঋতুর সুখ তোমরা সকলেই লাভ করো।
(যজু० ১৩.২৯)

যে সকল মানুষ বাসের উদ্দেশ্যে বসন্তকালে দিব্য পৃথিবী প্রভৃতি লোক বা বিদ্বানদের সঙ্গ গ্রহণ করে, তারা বসন্ত-সম্পর্কিত সুখ লাভ করে।
(যজু० ২১.২৩)

রাজা প্রভৃতি মনুষ্যদের উচিত যে বসন্ত ঋতুতে প্রথমে অশ্বদের শিক্ষা দান করে এবং রথীদের রথে নিয়োগ করে শত্রু জয়ের উদ্দেশ্যে অভিযান পরিচালনা করে।
(যজু० ১৩.৩৬)

গ্রীষ্ম ঋতু

মানুষ বসন্ত ও গ্রীষ্ম ঋতুর মধ্যবর্তী কালে জলাশয়ে অবস্থিত শীতল স্থান গ্রহণ করবে, যাতে তাপের কারণে কষ্ট না হয় এবং যে যজ্ঞের দ্বারা যথাযথ বৃষ্টি হয় ও প্রজাগণ আনন্দিত হয়, তার অনুসরণ করবে।
(যজু० ১৩.৩০)

হে মনুষ্যগণ! তোমরা পৃথিবী প্রভৃতি পঞ্চভূতের শরীর-সম্পর্কিত বা মানসিক অগ্নিকে—যাদের ব্যতীত গ্রীষ্ম ঋতু সম্ভব নয়—জেনে ও ব্যবহারে এনে সকল প্রাণীকে সুখ প্রদান করো। (যজু० ১৪.৬)

বর্ষা ঋতু

হোম এবং সূর্যরূপ অগ্নির তাপের দ্বারা সর্বগুণসম্পন্ন অন্নাদির সাহায্যে জগতের স্থিতিকারী বৃষ্টি হয়। সেই বৃষ্টির দ্বারা পৃথিবী উত্তম ঔষধি প্রভৃতি পদার্থে সমৃদ্ধ হয় এবং সূর্যরূপ অগ্নির কারণেই প্রাণীদের বিশ্রামের জন্য রাত্রি হয়। (যজু० ২৩.১২)

সকল মানুষের উচিত যে বিদ্বানদের ন্যায় বর্ষা ঋতুতে এমন উপকরণ গ্রহণ করে, যার দ্বারা সর্বপ্রকার সুখ লাভ হয়। (যজু० ১৪.১৫)

শরৎ ঋতু

হে মনুষ্যগণ! শরৎ ঋতুতে যে পদার্থসমূহ উপযোগী, সেগুলি যথাযথভাবে শুদ্ধ করে গ্রহণ করো।
(যজু० ১৪.১৬)

যে সকল মানুষ উত্তম পাথ্য গ্রহণ করে শরৎ ঋতুতে রোগমুক্ত থাকে, তারা লক্ষ্মী অর্থাৎ ঐশ্বর্য লাভ করে। (যজু० ২১.২৬)

হেমন্ত ঋতু

বিদ্বানদের উচিত যে যথাযথ সুখের জন্য হেমন্ত ঋতুতে পদার্থসমূহ গ্রহণ করে এবং তদ্রূপ অন্যদেরও গ্রহণ করায়। (যজু० ১৪.২৭)

যে সকল মানুষ সর্বরস পরিপক্বকারী হেমন্ত ঋতুতে যথাযথ আচরণ করে, তারা অত্যন্ত বলবান হয়।
(যজু० ২১.২৭)

দিনচর্যা

প্রভাতকালে শয়নরত অবস্থায় আমাদের আয়ু ধীরে ধীরে—অর্থাৎ দিন দিন—ক্ষয় হচ্ছে, একথা জেনে ও অলসতা পরিত্যাগ করে আমাদের রাত্রির চতুর্থ প্রহরে জেগে বিদ্যা, ধর্ম ও পরোপকার প্রভৃতি কার্য্যে নিত্য যথোচিত আচরণ করা উচিত। (ঋ० ১.৯২.১০)

যে মানুষ রাত্রির চতুর্থ প্রহরে জেগে শয়ন পর্যন্ত সময়কে বৃথা নষ্ট করে না, সে সুখী হয়; অন্যেরা নয়।
(ঋ० ১.১১৩.৫)

যে মানুষ ঊষার পূর্বে শয়ন ত্যাগ করে প্রয়োজনীয় কর্ম সম্পাদন করে পরমেশ্বরের ধ্যান করে, তারা বুদ্ধিমান ও ধার্মিক হয়। (ঋ० ১.১১৩.১১)

হে নারী-পুরুষগণ! তোমরা রাত্রির চতুর্থ প্রহরে উঠে প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করে যানবাহনে বা পদব্রজে সূর্যোদয়ের পূর্বে শুদ্ধ বায়ুযুক্ত স্থানে ভ্রমণ করলে তোমাদের কখনও রোগ প্রাপ্ত হবে না।
(ঋ० ৪.১৪.৪)

দিন ও রাত্রির সন্ধিক্ষণে—অর্থাৎ সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময়—পরমেশ্বরের ধ্যান ও অগ্নিহোত্র অবশ্যই করা উচিত। (সত্যার্থসমু-৪)

জীবনের সাফল্য

হে মনুষ্যগণ! তোমাদের উচিত এই জগতে মানবদেহ ধারণ করে বিদ্যা, উত্তম শিক্ষা, সদাচার, ধর্ম, যোগাভ্যাস ও বিজ্ঞানকে যথাযথভাবে গ্রহণ করে মুক্তি-সুখের জন্য প্রচেষ্টা করা। একেই মানবজীবনের সাফল্য বলে জেনো। (যজু० ৩৫.২২)

নববর্ষের আনন্দ কবে, কীভাবে এবং কেন?

জানুয়ারি–১ আগমন করলেই ছোট-বড়, প্রাজ্ঞ-সাধারণ, নারী-পুরুষ সকলেই আনন্দ-উল্লাসের সঙ্গে নতুন বছরের অভ্যর্থনার প্রস্তুতিতে মেতে ওঠে। নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানানোর জন্য চারিদিকে ব্যানার, বোর্ড ইত্যাদি লাগানো হয়। রঙ্গোলি, রঙিন আলো, ফুল-মালা প্রভৃতির দ্বারা সাজসজ্জা করা হয়। সারা রাত জেগে পুরনো বছরের শেষ মুহূর্ত অতিক্রান্ত হয়ে নতুন বছরের প্রথম মুহূর্ত উপস্থিত হলেই আবাল-বৃদ্ধ সকলেই নাচ-গান, আতশবাজি, ব্যান্ড-বাজনার শব্দে চারদিক মুখরিত করে নতুন বছরকে মহাসমারোহে স্বাগত জানায় এবং অপরিসীম আনন্দ অনুভব করে।

হে ভারতমাতার মানস বীর সপুতগণ! এ কি জানুয়ারি–১ নতুন বছরের সূচনা? সত্যিই কি এই দিনেই নতুন বছরের আরম্ভ হয়? একবার গভীরভাবে নিজের অন্তরাত্মায় চিন্তা করে দেখুন। বর্তমানে প্রচলিত ক্যালেন্ডার (ক্যালেন্ডার-ক্যালেন্ডার) কালান্তরে ঈসার সঙ্গে সম্পর্কিত—এ কথা সর্ববিদিত। তবে কি ঈসার পূর্বে আমাদের ভারতদেশের কোনো চরিত্র, পরম্পরা ও সংস্কৃতি ছিল না? যদি ছিল, তবে ঈসার পূর্ববর্তী মানুষ কোন দিন নতুন বছর পালন করত? এ বিষয়ে ভাবতে হবে, আত্মমন্থন করতে হবে। এখানে আমরা কেবল প্রধান বিষয়গুলির সঙ্গে দিকনির্দেশনা দিচ্ছি। বিদগ্ধ পাঠকবৃন্দ নিজেরাই চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিন এবং সত্যকে সকলের সামনে উপস্থাপন করুন।

ইউরোপীয় দেশগুলিতে প্রথমে অলিম্পিয়ান সংবৎসর প্রচলিত ছিল। সেই সংবৎসরই ঈসার ৭৫৩ বছর পূর্বে রোমানদের রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর রোমানদের প্রথম রাজা রোমুলুসের সময়ে রোমান সংবৎসর রূপে পরিবর্তিত হয়। তখন সেই সংবৎসরে কেবল দশটি মাস (মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত) এবং মোট ৩০৪ দিন ছিল। সেই মাসগুলির নাম রোমান দেবতা ও সম্রাটদের নামে রাখা হয়েছিল। যেমন—রোমান যুদ্ধদেবতা ‘মার্স’-এর নামে মার্চ মাস, অ্যাটলাস দেবতার কন্যা ‘মাইয়া’ ও ‘জুনো’-র নাম অনুসারে যথাক্রমে ‘মে’ ও ‘জুন’ মাসের নামকরণ হয়। রোমান সম্রাট ‘জুলিয়াস সিজার’ ও তাঁর পৌত্র ‘আগস্টাস সিজার’-এর নাম অনুসারে ‘জুলাই’ ও ‘আগস্ট’ মাস প্রচলিত হয়। এইভাবে প্রথম মাস মার্চ থেকে ষষ্ঠ মাস আগস্ট পর্যন্ত মাসগুলির নামকরণ সম্পন্ন হয়। এর পরবর্তী মাসগুলি ক্রমবোধক শব্দ দ্বারা পরিচিত হয়। যেমন—সপ্তম (সাত নম্বর) মাসের নাম ‘সেপ্টেম্বর’, অষ্টম (আট নম্বর) মাসের নাম ‘অক্টোবর’, নবম (নয় নম্বর) মাসের নাম ‘নভেম্বর’ এবং দশম (দশ নম্বর) মাসের নাম ‘ডিসেম্বর’ রাখা হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে ‘সেপ্টেম্বর’ প্রভৃতি শব্দ সংস্কৃত ‘সপ্তম’ ইত্যাদি শব্দের বিকৃত রূপ। ‘সপ্তম অম্বর’ (সাত নম্বর আকাশ) থেকে সেপ্টেম্বর, তেমনি ‘অষ্টম অম্বর’ থেকে অক্টোবর, ‘নবম অম্বর’ থেকে নভেম্বর এবং ‘দশম অম্বর’ থেকে ডিসেম্বর (দশেম্বর) শব্দের উৎপত্তি। ‘সপ্তমাম্বর’ প্রভৃতি শব্দ আকাশস্থ নক্ষত্রসমূহের বিশেষ অবস্থার নির্দেশক।

এই মার্চ প্রভৃতি দশটি মাসই ৫৩ বছর পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। ঈসার প্রায় ৭০০ বছর পূর্বে রোমানদের দ্বিতীয় রাজা ‘নূমা পম্পিলিয়াস’ ‘জানুস’ নামক রোমান দেবতার নামে জানুয়ারি মাসের সূচনা করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ফেব্রুয়ারি মাসও সংযোজন করেন, যার অর্থ ‘প্রায়শ্চিত্তের মাস’। পঞ্চম রোমান সম্রাট ‘এত্রুস্কান তার্কিনিয়াস প্রিস্কিয়াস’ (৬১৬–৫৭৯ খ্রিষ্টপূর্ব) রোমান রিপাবলিকান ক্যালেন্ডার মুদ্রিত করেন, যাতে জানুয়ারিকে প্রথম স্থান দেওয়া হয়। এই দুই মাসকে যদি দশম মাস ডিসেম্বরের পরে সংযোজন করা হতো, তবে তা অধিক যুক্তিসঙ্গত হতো। কিন্তু এগুলিকে শুরুতে সংযোজন করার ফলে সপ্তম মাস সেপ্টেম্বর নবম মাসে পরিণত হয়, তদ্রূপ অষ্টম মাসও তার স্বাভাবিক ক্রম হারায়।

অক্টোবর মাস দশম, নভেম্বর মাস একাদশ এবং ডিসেম্বর মাস দ্বাদশ মাসে পরিণত হয়ে গেল। এর ফলে সেপ্টেম্বর (সপ্তম অম্বর—সপ্তম আকাশ) প্রভৃতি শব্দগুলির অর্থই অর্থহীন প্রমাণিত হলো। ইংরেজিতে ‘মার্চ’ শব্দের অর্থ হলো— “গমন–আগমন”, অর্থাৎ পুরোনো সংবৎসর অতিবাহিত হয়ে নতুন সংবৎসরের আগমন ঘটেছে। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসকে শুরুতে যুক্ত করার ফলে এই অর্থটিও অর্থহীন হয়ে গেল। এটি অজ্ঞতা ও অবিবেচনার এক জ্বলন্ত উদাহরণ।

এর সঙ্গে আরও একটি বিষয় বিবেচনা করা প্রয়োজন—ফেব্রুয়ারি মাসে কেন ২৮ বা ২৯ দিন থাকে? কালগণনায় যদি কোথাও কম-বেশি হয়ে যায়, যদি কোনো ঘাটতি থেকে যায়, তবে তার পূরণ শেষের দিকে করা উচিত। ফেব্রুয়ারি মাস যদি শেষ মাস হতো, তবে সংবৎসর জুড়ে যে ঘাটতি হয়, তা পূরণ করার জন্য ২৮ বা ২৯ দিন রাখা হয়েছে—এ কথা বোধগম্য হতো এবং ফেব্রুয়ারির অর্থ (প্রায়শ্চিত্ত)ও অর্থবহ হতো। কিন্তু সংবৎসরের মাঝখানে, অর্থাৎ দ্বিতীয় মাসেই ঘাটতির পূরণ করা—এ কেমন বুদ্ধিমত্তা? এর দ্বারা স্পষ্ট হয় যে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি—এই দুই মাসই ডিসেম্বরের পরে যুক্ত হওয়ার যোগ্য, মার্চের আগে নয়।

ভারতীয় প্রাচীন পরম্পরা অনুযায়ী নতুন সংবৎসর চৈত্র শুক্ল প্রতিপদায় আরম্ভ হয়, যা মার্চের শেষ দিকে বা এপ্রিলের শুরুতে পড়ে। এর দ্বারা জানা যায় যে মার্চ ২৫ থেকে বছর আরম্ভ করার রোমান পরম্পরা ও ভারতীয় পরম্পরার মধ্যে গভীর সাদৃশ্য রয়েছে। মার্চ থেকে সংবৎসর শুরু করা ভারতীয় সংস্কৃতিরই অনুসরণ। অতএব নিজের খ্রিষ্টীয় সম্প্রদায়কে বৈদিক সংস্কৃতি থেকে পৃথক করার দুরভিসন্ধিতে রোমান সম্রাট নূমা পম্পিলিয়াস জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসকে মার্চের আগে যুক্ত করেন—এ ছাড়া অন্য কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। এর ফলে রোমান সংবৎসর ৩০৪ দিনের পরিবর্তে (৩০৪ + ৩১ + ২৮/২৯) মোট ৩৬৩ দিনে রূপান্তরিত হয়। এতে কোনো মাস ৩০ দিন, কোনো মাস ৩১ দিন এবং ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ বা ২৯ দিনের রূপে বিভক্ত হয়। জুলিয়াস সিজার এবং আগস্ট…

সিজারের নামানুসারে জুলাই ও আগস্ট—এই দুই মাসকে ক্রমানুসারে ৩১–৩১ দিনের রূপে বিভক্ত করা হয়। এইভাবে এখানে স্পষ্ট হয়ে যায় যে সংবৎসরের আদ্য দিন, মাসগুলির বিভাগ, পরিমাণ, নাম ও ক্রম—এই সবই স্বার্থবশত বা অন্য কোনো দুরভিসন্ধির কারণে নিজস্ব মতান্ধতা থেকে সমাজের ওপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।

রোমান ক্যালেন্ডারের বারো মাসের নাম ও পরিমাণ এইরূপ ছিল—

ল্যাটিন নামবাংলা উচ্চারণদিন
Januariusজানুয়ারিয়ুস৩১
Februariusফেব্রুয়ারিয়ুস২৮ / ২৯
Martiusমার্তিয়ুস৩১
Aprilisআপ্রিলিস৩০
Maiusমাইয়ুস৩১
Juniusজুনিয়ুস৩০
Quintilisকুইন্তিলিস৩১
Sextilisসেক্সটিলিস৩০
Septemberসেপ্টেম্বার৩০
Octoberঅক্টোবের৩১
Novemberনভেম্বার৩০
Decemberডিসেম্বার৩০

খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ সালে জুলিয়াস সিজারের সম্মানে কুইনটিলিস মাসের নাম পরিবর্তন করে ‘জুলাই’ রাখা হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৮ সালে সম্রাট অগাস্টাস সিজার নিজ নামানুসারে সেক্সটিলিস মাসের নাম পরিবর্তন করে ‘আগস্ট’ প্রচলিত করেন। পূর্বে সেক্সটিলিস মাসে মাত্র ৩০ দিন ছিল; কিন্তু নিজের নামাঙ্কিত মাসটিকে জুলিয়াস সিজারের নামাঙ্কিত মাস জুলাইয়ের সমান করার উদ্দেশ্যে ৩০ দিনের পরিবর্তে ৩১ দিনের করা হয়। এই এক দিনের অতিরিক্ততা ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এক দিন কমিয়ে ২৯ দিনের পরিবর্তে ২৮ দিন করে সমন্বয় করা হয়।

এই ক্যালেন্ডারের কিছু ত্রুটি দূর করার জন্য ‘পোপ গ্রেগরি’ একটি নতুন ক্যালেন্ডার প্রকাশ করেন। এই ক্যালেন্ডারই ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দ থেকে কয়েকটি প্রধান দেশে গ্রহণ করা হয়। এই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার কোন কোন দেশে কখন কখন গৃহীত হয়েছিল—তার বিবরণ নিম্নরূপ।

সংবৎসর (ইস্‌ভী সন) গ্রহণকারী দেশসমূহ

১৫৮২ — ফ্রান্স, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, পর্তুগাল, স্পেন।

১৫৮৩–১৮১২ — সুইজারল্যান্ড।

১৫৮৪ — জার্মানির (রোমান ক্যাথলিক), বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডসের কিছু প্রদেশে।

১৫৮৭ — হাঙ্গেরি।

১৬৯৯–১৭০০ — ডেনমার্ক, ডাচ অঞ্চল, জার্মান প্রোটেস্ট্যান্ট অঞ্চল।

১৭৭৬ — জার্মানি।

১৭০২ — ব্রিটেন, আমেরিকা।

১৭০৩ — সুইডেন।

১৮৭৩, ১৮৭৫ — জাপান, মিশর।

১৯১২–১৯১৭ — আলবেনিয়া, বুলগেরিয়া, চীন, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, রোমানিয়া, তুরস্ক, যুগোস্লাভিয়া।

১৯১৮, ১৯২৩ — সোভিয়েত রাশিয়া, গ্রিস।

ভূগোল ও খগোলবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, প্রাকৃতিক ঘটনাবলি থেকে, সূর্য-চন্দ্র-গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থানের সঙ্গে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের মাসগুলোর কোনো বাস্তব সম্পর্ক দেখা যায় না। তাই জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাস মার্চের আগে যুক্ত করা হলেও জানুয়ারি-১ তারিখকে সংবৎসরের আদ্যদিন হিসেবে মানুষ গ্রহণ করেনি। বরং মার্চ-২৫ তারিখকেই সংবৎসরাদির অর্থাৎ নতুন বছরের সূচনা হিসেবে মান্য করে আসছে। ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দ থেকে জানুয়ারি-১ নতুন বছরেরূপে ব্যবহৃত হতে শুরু করে, তার আগে নয়।

জানুয়ারি-১ তারিখে নতুন বছর উদ্‌যাপনের প্রথা ইংরেজরা ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে ভারতে চালু করে। ভারতীয় পরম্পরা নষ্ট করার জন্য বহু ষড়যন্ত্র করা হলেও আর্থিক সংবৎসর এবং শিক্ষাবর্ষ আজও এপ্রিল-১ থেকেই শুরু হয়। এগুলো পরিবর্তন করা যায়নি। এই দুই সংবৎসরই ভারতীয় নবসংবৎসরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু এপ্রিল-১ তারিখকে ‘মূর্খ দিবস’ হিসেবে প্রচলন করা হয়েছে। এর কারণ এই যে— ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের দশম রাজা চার্লস তাঁর দেশে জানুয়ারি-১ কে সংবৎসরাদিরূপে ঘোষণা করেন। কিন্তু দেশের জনগণ রাজাদেশ মানতে অস্বীকার করে এপ্রিল-১ তারিখেই নতুন বছর উদ্‌যাপন করতে থাকে। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে চার্লস রাজাদেশ অমান্যকারীদের মূর্খ ঘোষণা করেন। পরে ধীরে ধীরে জনগণকে জানুয়ারি-১ কেই নতুন বছরেরূপে মানতে বাধ্য করা হয়। এই সাফল্য দেখে ভবিষ্যতে কেউ যাতে এপ্রিল-১ কে নতুন বছর না মানে, সেই উদ্দেশ্যে চার্লস এপ্রিল-১ কে মূর্খ দিবস হিসেবে ঘোষণা করান।

আমরা ভারতীয়রা এই সত্য না জেনে জন্মান্ধের মতো ভেড়াচাল অনুসরণ করে চলেছি এবং কোনো রাজাদেশ ছাড়াই আনন্দের সঙ্গে একে অপরকে এপ্রিল-ফুল অর্থাৎ মূর্খ বানিয়ে চলেছি। পৃথিবীর আর কোথাও এমন দৃষ্টান্ত নেই। প্রত্যেক মানুষ ও সমাজ নিজেকে বুদ্ধিমান, মেধাবী ও মহান মনে করে, মূর্খ বা হীন নয়। পারস্পরিক জ্ঞান আদান-প্রদানই উত্তম সমাজের লক্ষণ; কিন্তু পরস্পরকে মূর্খ বলা বুদ্ধিমানদের আচরণ নয়। অতএব এই ধরনের বুদ্ধিহীন আচরণ ত্যাগ করে এপ্রিল-১ এর পরিবর্তে জানুয়ারি-১ কে মূর্খ দিবস হিসেবে পালন করে নিজেদের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেওয়া উচিত।

জানুয়ারি-১ এর মধ্যরাতে শীত চরম সীমায় থাকে। সর্বত্র তারই প্রভাব দেখা যায়। গাছ-পালা, বৃক্ষ, উদ্ভিদ, লতা-গুল্ম সবই রসহীন হয়ে ঝিমিয়ে পড়ে। কোথাও ফুলের বিকাশ দেখা যায় না। পশু-পাখিদের কাছে শীত প্রায় মৃত্যুর সমান হয়ে ওঠে। এমন বিষণ্ন ও দুঃখময় সময়ে নতুন বছর উদ্‌যাপন করা কি যুক্তিসঙ্গত?
—সুধী পাঠক ভেবে দেখুন 

দিনের সূচনা মধ্যরাতে নয়, বরং সূর্যোদয়ের প্রায় তিন ঘণ্টা আগে (ব্রাহ্মমুহূর্তে) হয়। সেই সময় পশু-পাখি জেগে উঠে নিজেদের মধুর ধ্বনিতে চারদিক মনোরম ও শ্রুতিমধুর করে তোলে। সেই দৃশ্য ভাষায় বর্ণনাতীত। ঠিক সেই সময় ঋষি, মুনি, যোগীরা জেগে ধ্যানে নিমগ্ন হন, ব্রহ্মে লীন হন। এই কারণেই সেই সময়কে ব্রাহ্মমুহূর্ত বলা হয়। কৃষকরাও তখনই নিদ্রা ত্যাগ করে কৃষিকাজে লিপ্ত হন। সেই সময়েই সমগ্র জগতে কর্মচাঞ্চল্য ও সক্রিয়তা দেখা যায়। রাত্রে মলিন হয়ে যাওয়া পাতা ও ফুলেও তখনই নতুন বিকাশ শুরু হয়। প্রাণীদের দেহেও তখন এক বিশেষ চৈতন্যের সঞ্চার ঘটে। মানুষের শরীরেও তখন সক্রিয়তা বাড়ে, রক্তসঞ্চালন ত্বরান্বিত হয়, হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পায়। সেই কারণেই হৃদরোগীদের অনেক সময় এই মুহূর্তেই হৃদ্‌রোগ আঘাত হানে। আমরা শুনে আসছি এবং আয়ুর্বেদ প্রভৃতি শাস্ত্রও বলে—সব মানুষেরই ব্রাহ্মমুহূর্তে জাগা উচিত। কারণ এই দিব্য মুহূর্তে যে ঘুমিয়ে থাকে, তার আয়ু, শক্তি ও বুদ্ধি ক্ষীণ হয়ে যায় এবং আলস্য বৃদ্ধি পায়।

এইভাবে জড় জগত, পশু-পাখি, মানুষের অভিজ্ঞতা ও শাস্ত্র—সবই প্রকাশ করছে যে দিনের সূচনা ব্রাহ্মমুহূর্ত থেকেই হয়। এর বিপরীতে মধ্যরাতে দিন বা সংবৎসরের সূচনা ধরা কি অজ্ঞতার পরিচয় নয়? মেধাসম্পন্ন ভারতীয়দের পক্ষে পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্ধ অনুকরণ করে পশু-পাখির চেয়েও নীচু অজ্ঞের মতো আচরণ করা শোভন নয়। আমাদের সংস্কৃতি হলো—আগুন ও প্রদীপ জ্বালিয়ে আলোর মধ্যে আনন্দ ও অলৌকিক অনুভূতি লাভ করা। আর পাশ্চাত্যদের সংস্কৃতি হলো—প্রদীপ নিভিয়ে অন্ধকারে প্রীতি করা। ঘন অন্ধকারে আচ্ছন্ন মধ্যরাতে শুধু মানুষই নয়, পশু-পাখিরাও গভীর নিদ্রায় থাকে। কোথাও চেতনা বা কর্মপ্রবাহ দেখা যায় না। এমন সময়ে বছর বা দিনের সূচনা ধরা অজ্ঞানতা ও অবিবেকের পরিচায়ক, এবং বিজ্ঞানেরও বিরোধী। এক সূর্যোদয় (ব্রাহ্মমুহূর্ত) থেকে পরবর্তী সূর্যোদয় পর্যন্ত সময়কে জ্যোতিষশাস্ত্রে ‘সাবন দিন’ বলা হয়। মধ্যরাত্রি থেকে দিন শুরু হয়—এমন বর্ণনা কোনো শাস্ত্রেই নেই। অতএব, হে ভারতমাতার বীর সন্তানগণ! জাগো, সচেতন হও, ভাবো।

যথার্থ নূতন সংবৎসর

এতক্ষণে স্পষ্ট করা হয়েছে যে—জানুয়ারি ১ কোনো অবস্থাতেই সংবৎসরের প্রথম দিন হতে পারে না। তাহলে নতুন বছর কবে শুরু হয়? এই প্রশ্নের উত্তর জানার আগে আরও কিছু বিষয়ে চিন্তা করা দরকার।

দিন বা সূর্যোদয় সবসময়ই নতুন-নতুন হয়, কখনোই পুরোনো হয় না। গতকালের সূর্যোদয় আজকের সূর্যোদয়ের মতো ছিল না, আর আজকের সূর্যোদয় ভবিষ্যতে আর কখনো ফিরে আসবে না। প্রতিটি সূর্যোদয় অতীত ও ভবিষ্যৎ থেকে ভিন্ন—সম্পূর্ণ নতুনভাবেই উদিত হয়। যখন প্রতিদিন বা প্রতিটি সূর্যোদয়ই নতুন, তখন ‘নতুন বছর’ কথাটির অর্থ কী? এমন তো হতে পারে না যে বছরে মাত্র একদিনই নতুন, আর বাকি সব দিন পুরোনো। সংবৎসরের প্রতিটি দিন বা সূর্যোদয়কে পুরোনো মনে করা ব্যক্তি কীভাবে একটি দিন বা সূর্যোদয়কে নতুন বলে মানবে? এ ধরনের প্রশ্ন তোলার লোকের অভাব নেই।

এমন প্রশ্নকারীদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়—আপনার জন্মদিন কোন দিন?—তাহলে তিনি বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনকেই নিজের জন্মদিন বলে জানান। অর্থাৎ সেই দিন থেকেই তাঁর নতুন বছর শুরু হয়, সেদিন তিনি জীবনের এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেন, তাঁর বয়সে এক নতুন সংখ্যা যুক্ত হয়। ঠিক তেমনই, নতুন বছরের অর্থ হলো—সৃষ্টির জন্মদিন; সেই দিন থেকেই নতুন বছর আরম্ভ হয়।

যখন সমগ্র জগৎ সৃষ্টি হয়েছিল, তখন চারদিকে সবুজে ভরা ও পুষ্পিত বৃক্ষ-লতা-উদ্ভিদ, নানা পাখির মনোরম কলরব এবং … প্রকাশমান সূর্যাদি নক্ষত্রের দীপ্তিতে উদ্ভাসিত আকাশ প্রভৃতি, আকর্ষণীয় ও আহ্লাদজনক বিচিত্র অবস্থায় পরিপূর্ণ ছিল। সেই সময়ে উৎপন্ন মানুষ কী ধরনের আনন্দানুভূতি লাভ করেছিল—একবার কল্পনা করে দেখুন। সেইরূপ মানব ও সৃষ্টির জন্মদিনের স্মরণ করাই হলো নূতন সংবৎসর। সেই দিন থেকেই সৃষ্টির নূতন দিনের সূচনা হয়।

এই সৃষ্টি উৎপন্ন হয়ে আজ পর্যন্ত (২০৮২ বিক্রম সংবৎ, ডিসসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত) ১,৯৭,২৯,৪৯,১২৬ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এই দীর্ঘকালীন গণনা নিয়ে কারও কারও মনে সন্দেহ জাগে—এত সুদীর্ঘ সময়ের হিসাব মানুষ কীভাবে স্মরণে রেখেছে? এর সমাধান অত্যন্ত সহজ। প্রত্যেক ব্যক্তি যেমন নিজের জন্মদিন ও বয়স বারবার স্মরণ করে এবং অন্যদের জানায়, তেমনই সৃষ্টির কালও স্মরণে রাখা হয়েছে। বৈদিক সংস্কৃতি ও ভারতীয় পরম্পরায় আমাদের প্রাচীন ঋষি-মুনিগণ সমাজে কিছু বিস্ময়কর প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন। যেমন—কোনো ব্যক্তি গুরু, বিদ্বান বা অন্য কোনো পূজনীয় ব্যক্তিকে প্রণাম করার সময় নিজের গোত্র, বংশ, পিতা প্রভৃতির নাম উচ্চারণ করে নিজের বিদ্যাপরম্পরা অর্থাৎ নিজের বেদ, শাখা, সূত্র ইত্যাদি প্রকাশ করত। এই পরম্পরা আজও ব্রাহ্মণসমাজে প্রচলিত। এর ফলে গোত্রাদি বিস্মৃত হয় না। যারা এই পরম্পরা গ্রহণ করেনি, তারা নিজেদের গোত্র ভুলে পাহাড়, নদী, নগর, বৃক্ষ প্রভৃতির নাম অথবা নিরর্থক শব্দকে গোত্ররূপে ব্যবহার করছে। বর্তমানে আধুনিক প্রভাবের ফলে ব্রাহ্মণরাও এই পরম্পরা ত্যাগ করে চলেছে—যা দুঃখজনক।

ঠিক একইভাবে, সৃষ্টিকাল যেন বিস্মৃত না হয়—এই উদ্দেশ্যে আমাদের ঋষি-মুনিরা প্রতিদিনের সন্ধ্যা, যজ্ঞ, পার্বযজ্ঞ ইত্যাদি শুরু করার আগে সংকল্পপাঠের প্রথা চালু করেছিলেন। এই সংকল্পে যজমান বা পুরোহিত সৃষ্টির সূচনা থেকে যজ্ঞের সময় পর্যন্ত সম্পূর্ণ কালের গণনা সংস্কৃত ভাষায় উচ্চারণ করেন। সঙ্গে সঙ্গে ব্রহ্মাণ্ড থেকে শুরু করে যজ্ঞস্থল পর্যন্ত—অর্থাৎ ব্রহ্মাণ্ড, ভূলোক, দ্বীপ, দেশ, প্রদেশ, পর্বত বা নদীপ্রধান অঞ্চল, নগর, গ্রাম, গৃহ, স্থান প্রভৃতির নামও উল্লেখ করেন। তারপর নিজের অন্তর্গত শুভকামনাগুলি প্রকাশ করেন—এটাই সংকল্প। এই পরম্পরা আজও ধর্মীয় কার্যকলাপে অক্ষুণ্ণভাবে প্রচলিত। ভারতবর্ষ ছাড়া অন্য কোথাও এমন পরম্পরা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এই পরম্পরার মাধ্যমে প্রাপ্ত ও সংরক্ষিত সৃষ্টিকালকে আধুনিক বিজ্ঞানীরাও স্বীকার করছেন।

এই নববর্ষে (চৈত্র শুক্ল প্রতিপদা) পর্যন্ত সৃষ্টির সর্বত্রই আমরা নূতনত্ব দেখতে পাই। বৃক্ষ ও উদ্ভিদে পুরোনো পাতা ঝরে পড়ে নতুন নতুন পাতা, ফুল ও ফলের বিকাশ ঘটে এবং চারদিকে সবুজে ভরা মনোরম দৃশ্য দেখা যায়। এমন পরিবেশে ময়ূরও বিস্তৃত পাখা মেলে নৃত্য করতে শুরু করে। বসন্ত ঋতুতে, অর্থাৎ চৈত্র–বৈশাখ মাসে, মৌমাছিরাও মৌচাকে মধু সঞ্চয় করে। এই কারণেই বৈদিক যুগে এই মাসগুলির নাম ‘মধু’ ও ‘মাধব’ প্রসিদ্ধ ছিল। এই বসন্ত ঋতুর সূচনা হতেই কোকিলও নিজের মধুর স্বরে মানুষকে আকর্ষণ করে এবং নববর্ষকে স্বাগত জানায়। কোকিলের এই মনোরম ধ্বনিকে লক্ষ্য করে এক কবি বলেছেন—

কাকঃ কৃষ্ণঃ পিকঃ কৃষ্ণঃ কো ভেদঃ পিককাকয়োঃ।
বসন্তকালে সম্প্রাপ্তে কাকঃ কাকঃ পিকঃ পিকঃ ॥

দেখতে কাক ও কোকিল—উভয়ই কালো, বাহ্যিকভাবে কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু বসন্ত ঋতুর আগমনে তাদের নিজ নিজ স্বরে কাক কাকরূপে এবং কোকিল কোকিলরূপেই পরিচিত হয়।

বসন্ত ঋতু প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে সকল প্রাণীর মধ্যেও নতুন শক্তির সঞ্চার ঘটে। বর্ষাকাল ও শীতকালের মধ্যবর্তী সময়ে শরৎ ঋতু আসে—এটি একটি সন্ধিকাল। এই ঋতুসন্ধিতে, অর্থাৎ ভাদ্রপদ ও আশ্বিন মাসে, মানুষের নানাবিধ ব্যাধি ও রোগের সংক্রমণ ঘটে। বিশেষ করে দুর্বল ব্যক্তিদের উপর এর অধিক প্রভাব পড়ে। এই ঋতুসন্ধিতেই অধিকাংশ মানুষ …মৃত্যুর শিকার হয়। তাই যারা শরৎ ঋতু পার করে কোনও রোগ ছাড়াই, তারা নিজেদেরকে অতি ভাগ্যবান মনে করে এবং মৃত্যুকে জয় করার মতো আনন্দিত হয়। এজন্য সমস্ত মানুষ বেদমন্ত্রের মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে—“হে ঈশ্বর! আমরা শরৎ ঋতুতে সম্পূর্ণ সুস্থ থাকি—পশ্যেম শরদঃ শতম্‌, জীবেম শরদঃ শতম্‌, শ্রুয়্যাম শরদঃ শতম্‌” (যজুঃ ০৩৬.২৪)। এই মন্ত্রের অর্থ, আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয় ও দেহ শত শরৎ ঋতু পর্যন্ত সুস্থ, শক্তিশালী, সুখী এবং আমরা শতাধিক শরৎ ঋতু পর্যন্ত বাঁচি।

মহর্ষি দয়ানন্দজীও লিখেছেন—“হে মানুষেরা! যারা শরৎ ঋতুতে উপকারী পদার্থ ব্যবহার করে, সেগুলো যথাযথভাবে পরিশুদ্ধ করে গ্রহণ কর” (যজুঃ ০১৪.১৬)। “যারা শরৎ ঋতুতে সঠিক আহার-ব্যবস্থা পালন করে, তারা রোগমুক্ত থাকে এবং ঐশ্বর্য (লক্ষ্মী) প্রাপ্তি হয়” (যজুঃ ০২১.২৬)।

কঠোপনিষদেও দেখা যায়—যখন নচিকেতা মৃত্যুর রহস্য জানতে চায়, তখন যমাচার্য বহু প্রলোভন দেখিয়ে বলেন—“স্বয়ং চ জীব শরদো যাওদিচ্ছসি… নচিকেত! মরণং মানুপ্রাক্ষী” (কঠো ০১.১.২৩,২৫)। অর্থাৎ, নচিকেত! তুমি যতটা শরৎ ঋতু পর্যন্ত বাঁচতে চাও, ততদিন বেঁচে থাকার জন্য দীর্ঘায়ু প্রার্থনা কর, তবে মৃত্যুর রহস্য জানতে চাও না।

এইভাবে বেদীয় সাহিত্যেও শরৎ ঋতু প্রায়ই ভয়ঙ্কর হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। কিন্তু বসন্তের প্রারম্ভে—ফাল্গুন-চৈত্র মাসের সংধিবেলা—মৃত্যুর বা অসুস্থতার ভয় দেখা যায় না। বরং বসন্তের শুরুতেই সকলের দেহে নতুন চেতনায় আনন্দ দেখা যায়।

বসন্তকালে পরিবেশ, আকাশ ইত্যাদি অত্যন্ত নির্মল হয় এবং অপরিমিত উষ্ণতা থাকে। এই সময় সূর্য ভুমধ্য রেখায় পৌঁছায়। ফলে পরিবেশে সমান ঠাণ্ডা-গরম থাকে, সব মানুষ সূর্য দর্শন পায়। দিন-রাত সমান হয়। প্রকৃতির এই নতুনত্বকে অনুসরণ করে প্রাচীনকাল থেকে মানুষ এই দিনটিকে বছরের প্রথম দিন বা উৎসব হিসেবে উদযাপন করত। এটি আন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলঙ্গণায় ‘যুগাদি’, জম্মু-কাশ্মীরে ‘নাভরেহ’, মহারাষ্ট্রে ‘গুড়িপড়া’, আসামে ‘রঙলী’, কেরলে ‘বিশুদিন’ নামে উদযাপিত হয়।

এছাড়াও ইরান ও ইরাকে ‘নোরোজ’ (নতুন দিন, বছরের প্রথম দিন) নামে নববর্ষ উদযাপন করা হয়। তাই বসন্ত ঋতুর শুরুতে—চৈত্র শুক্লা প্রতিপদায়—নতুন বছর উদযাপন প্রাকৃতিক, বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিসঙ্গত।

বেদেও বসন্ত ঋতু থেকেই বছরের (কালগণনা) শুরু করার উপদেশ আছে—“মধুশ্ব, মাধবশ্চ, বসন্তিকাবৃতূ, শুক্রশ্ব, শুচিশ্র, গ্রৈষ্মাবৃতূ, নভশ্চ, ন্ভস্যশ্ব, বার্ষিকাবৃতূ, ইষশ্রোর্জশ্চ, শারাদাবৃতূ, সহদ্য সহস্যশ্যা, হেমন্তিকাবৃতূ, তপশথ্চ, তপস্যথ্য, শৈশিরাবৃতূ…” (তিত্তিরীয় সংহিতা ৪.৪.১১.১, ১.৪.১৪; দ্র.যজুঃ ৯৩.২৫; ১৪.৬,১৫,১৬,২৭; ১৫.৫৭)। এখানে স্পষ্টভাবে বসন্তসহ ছয় ঋতুর বর্ণনা আছে, এবং প্রতিটি ঋতু দুটি মাসে বিভক্ত। স্পষ্ট যে বছর বসন্ত ঋতু ও মধুমাস থেকে শুরু হয়। প্রাচীনকালে বেদের মধ্যে ইতিমধ্যেই বারো মাস ও ছয় ঋতুর উল্লেখ ছিল। পশ্চিমা ধারার মতো দশ মাস থেকে বারো মাসের বিকাশ পরে হয়েছে।

বৈদিক কালের মধু, মাধব ইত্যাদি মাসের নাম পরে নক্ষত্রের নাম অনুযায়ী পরিচিতি পেয়েছে। মহর্ষি পাণিনি তাঁর অষ্টাধ্যায়ীতে এই নক্ষত্রিক নামের উল্লেখ করেছেন।

“सास्मिन् पौर्णमासीति” (४.२.२०) অনুযায়ী পূর্ণিমার দিনে চন্দ্রযে নক্ষত্রে অবস্থান করবে, মাসের নাম সেই নক্ষত্রের নাম অনুসারে হবে। উদাহরণস্বরূপ—চিত্রা নক্ষত্রে পূর্ণিমা হলে মাসের নাম চৈত্র, বিশাখা নক্ষত্রে পূর্ণিমা হলে বৈশাখ মাস। অনুরূপভাবে—জ্যেষ্ঠ নক্ষত্রে জ্যৈষ্ঠ মাস, আষাঢ় নক্ষত্রে আষাঢ় মাস, শ্রবণ নক্ষত্রে শ্রাবণ মাস, ভাদ্রপদ নক্ষত্রে ভাদ্রপদ মাস, অশ্বিনী নক্ষত্রে আশ্বিন মাস, কৃত্তিকা নক্ষত্রে কার্তিক মাস, মৃগশিরা নক্ষত্রে মার্গশীর্ষ মাস, পুন্য নক্ষত্রে পৌষ মাস, মঘা নক্ষত্রে মাঘ মাস, ফাল্গুন নক্ষত্রে ফাল্গুন মাস। এইভাবে মাসের নাম থেকেই আকাশস্থ গ্রহ ও নক্ষত্রের অবস্থান বোঝা যায়, যা প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রমাণ।

মাসের বৈদিক নাম, নক্ষত্রিক নাম ও ঋতুর সঙ্গে সম্পর্ক নিম্নরূপ:

বৈদিক নামনক্ষত্রিক নামঋতুঅয়ন
মধু, মাধবচৈত্র, বৈশাখবসন্তউত্তরায়ণ
শুক্র, শুচিজ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়গ্রীষ্মউত্তরায়ণ
ন্ভসু, ন্ভস্যশ্রাবণ, ভাদ্রপদবর্ষাদক্ষিণায়ণ
ইষ, ঊর্জআশ্বিন, কার্তিকশরৎদক্ষিণায়ণ
সহসু, সহস্যমার্গশীর্ষ, পৌষহেমন্তদক্ষিণায়ণ
তপসু, তপস্যমাঘ, ফাল্গুনশিশিরউত্তরায়ণ

এইভাবে বছরের মাস ও ঋতুগুলি ভাগ করা হয়—“দ্বে রূপে সংবৎসরের মাসা, অন্যদ্ ঋতবঃ” (কাঠক সংহিতা ০৩৪.৭)। বেদমতে ঋতুগুলির ক্রম বসন্ত থেকে শুরু হয়, যেমন তিত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ১.১.২.৬-৭-এ উল্লেখ আছে—“মুখং বা এতদূতূনাং যদ্ বসন্তঃ”। অর্থাৎ বসন্তই ঋতুর মুখ বা প্রথম ঋতু।

হ্যাঁ! অতএব বসন্ত ক্রাতুর শুরু থেকে অর্থাৎ চৈত্র শুক্লা প্রতিপদা থেকে নতুন বছর গণনা করা বৈদিক শাস্ত্র এবং ভারতীয় পরম্পরা দ্বারা অনুমোদিত। আমরা সবাই ইংরেজি ক্যালেন্ডারের অভ্যস্ত বা নির্ভরশীল হলেও, বিবাহ, জন্মদিন, অক্ষরাভ্যাস, গৃহপ্রবেশ, ব্যবসা ইত্যাদি শুভ কাজ শুরু করার সময় ভারতীয় পঞ্চাঙ্গেরই আশ্রয় নিই, ইংরেজি ক্যালেন্ডারের নয়। এটাই ভারতীয় সংস্কৃতির অমরত্ব। সূর্য এবং পৃথিবীর মধ্যে যখন চন্দ্র আসে, তখন এরা তিনজনই একই রেখায় থাকে। এই অবস্থাকে অমাবস্যা বলা হয়। চন্দ্রের গতি বেশি হওয়ায় এটি সূর্যের তুলনায় এগিয়ে যায়। এইভাবে সূর্য-চন্দ্রের মধ্যে ১২ অঙ্গুল (ডিগ্রি) দূরত্বের পার্থক্য তৈরি হয়। এটাই একটি তিথি (দিন) বলা হয়। এইভাবে তাদের মধ্যবর্তী দূরত্ব ১২°, ২৪°, ৩৬°… বাড়তে-বাড়তে পুনরায় একই রেখায় আসার জন্য অর্থাৎ তাদের একটি চক্র পূর্ণ করার জন্য (৩৬০° ÷ ১২°) ৩০ তিথি (দিন) হয়, অর্থাৎ একটি মাস পূর্ণ হয়। এইভাবে এক অমাবস্যা থেকে পরবর্তী অমাবস্যা পর্যন্ত একটি মাস (৩০ দিন) সম্পন্ন হয়। বৈদমন্ত্রের মাধ্যমে এটি বর্ণিত হয়েছে যে একটি বছরে বারো মাস থাকে। অর্থাৎ এক বছরে (১২ মাস × ৩০ দিন) ৩৬০ দিন হয়। এটি বৈদমন্ত্রে ও বর্ণিত হয়েছে। যেমন— “ये त्रिषप्ता: परियन्ति विश्वा रूपाणि बिश्रतः...” (অথর্ব ০১.১.১)। এখানে "त्रिषप्ता:" শব্দের অর্থ এই রূপে বোঝা যায়। অন্যত্র দেখার স্থান— তাণ্ড্যমহা ব্রা ০৫, ৯.১১; কোষীতকী ব্রা ০৫.১; শাঙ্কায়ন ব্রা ১৯.৩ ইত্যাদি।

এটি মাসের অমান্ত পক্ষে বর্ণনা, তেমনি পূর্ণিমান্ত পক্ষও বোঝা যেতে পারে। ষষ্টিমাসস্যাহো রাত্রাণি (শততপথ ০৬.২.২.৩৫) অনুযায়ী একটি মাসে ষাট দিন-রাত্রি থাকে, অর্থাৎ ত্রিশ দিন হয়।

১. তিন থেকে সাত পর্যন্ত বিজোড় সংখ্যার যোগ: ৩+৫+৭=১৫
২. তিনবার সাত: ৩×৭=২১
৩. তিন এবং সাতের যোগ: ৩+৭=১০

এইভাবে সৃষ্টিতে বৈদিক মন্ত্রেই বলা হয়েছে যে এক বছরে ৩৬০ দিন থাকে। এবং একটি মন্ত্রকে দেখা যায়— “দ্বাদশ প্রধযশ্চক্র এক ত্রীণি নভ্যানি ক উ তচিকেত। তস্মিন্তসাক ত্রীশতা ন শঙ্কভোদর্পিতাঃ ষষ্টিন চলাচলাসঃ।” (ঋ ০১.১৬৪.৪৮)

সংवत্সর রূপী কালচক্রে বারো মাস রূপী পরিধি, তিনটি প্রধান (গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ) ঋতুরূপী নাভি এবং ৩৬০ দিন রূপী আরে থাকে, যা অত্যন্ত চলমান। তেমনি ব্রাহ্মণ গ্রন্থেও সংবৎসরে ৩৬০ দিনের স্পষ্ট বর্ণনা আছে— “ত্রিণি চ হ বৈ শতানি ষষ্টিশ্ব সংবৎসরস্যাহোরাত্রাণি” (গোপথ ব্রা ০১.১.৫.৫)। শাস্ত্রে কালের গণনা মানবীয় এবং ব্রাহ্ম বছরের ভিত্তিতে করা হয়।

ব্রাহ্মবর্ষ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ এখানে দেওয়া হলো। এই সৃষ্টির অবস্থা এবং প্রলয়ের কাল মিলিয়ে একটি ব্রাহ্মদিবস বলা হয়। এর পরিমাণ মানবীয় গণনায় ৪,৩২,০০,০০,০০০ বছর থাকে। এই ত্রিশ দিনের একটি ব্রাহ্মমাস হয়। বারো ব্রাহ্মমাস মিলিয়ে একটি ব্রাহ্মবছর হয়। এমন একশো ব্রাহ্মবছরকে মিলিয়ে তাকে পরান্তকাল বলা হয়। একটি ব্রাহ্মবছরে (১২৫৭৩০ ÷ ৩৬০) তিনশত ষাট ব্রাহ্মদিন থাকে। পরান্তকালে (৩৬০.০১০০ ÷ ৩৬,০০০) ছত্রিশ হাজার ব্রাহ্মদিন থাকে। এটিকেই মহর্ষি দয়ানন্দ মোক্ষকাল হিসেবে গণ্য করেছেন। মুক্তআত্মা পরান্তকাল পর্যন্ত।

পূর্ণ পাঠ:
১. তিন থেকে সাত পর্যন্ত বিজোড় সংখ্যার যোগ: ৩+৫+৭=১৫
২. তিনবার সাত: ৩×৭=২১
৩. তিন এবং সাতের যোগ: ৩+৭=১০

এইভাবে সৃষ্টিতে বৈদিক মন্ত্রে বলা হয়েছে যে এক বছরে ৩৬০ দিন থাকে। এবং একটি মন্ত্রে দেখা যায়— “দ্বাদশ প্রধযশ্চক্র এক ত্রীণি নভ্যানি ক উ তচিকেত। তস্মিন্তসাক ত্রীশতা ন শঙ্কভোদর্পিতাঃ ষষ্টিন চলাচলাসঃ।” (ঋ ০১.১৬৪.৪৮)

সংবৎসর রূপী কালচক্রে বারো মাস রূপী পরিধি, তিনটি প্রধান ঋতুরূপী নাভি এবং ৩৬০ দিন রূপী আরে থাকে, যা অত্যন্ত চলমান। তেমনি ব্রাহ্মণ গ্রন্থেও সংবৎসরে ৩৬০ দিনের স্পষ্ট বর্ণনা আছে— “ত্রিণি চ হ বৈ শতানি ষষ্টিশ্ব সংবৎসরস্যাহোরাত্রাণি” (গোপথ ব্রা ০১.১.৫.৫)। শাস্ত্রে কালের গণনা মানবীয় এবং ব্রাহ্ম বছরের ভিত্তিতে করা হয়।

ব্রাহ্মবছর সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ এখানে দেওয়া হলো। এই সৃষ্টির অবস্থা এবং প্রলয়ের কাল মিলিয়ে একটি ব্রাহ্মদিবস বলা হয়। এর পরিমাণ মানবীয় গণনায় ৪,৩২,০০,০০,০০০ বছর থাকে। এই ত্রিশ দিনের একটি ব্রাহ্মমাস হয়। বারো ব্রাহ্মমাস মিলিয়ে একটি ব্রাহ্মবছর হয়। এমন একশো ব্রাহ্মবছরকে মিলিয়ে তাকে পরান্তকাল বলা হয়। একটি ব্রাহ্মবছরে (১২৫৭৩০ ÷ ৩৬০) তিনশত ষাট ব্রাহ্মদিন থাকে। পরান্তকালে (৩৬০.০১০০ ÷ ৩৬,০০০) ছত্রিশ হাজার ব্রাহ্মদিন থাকে। এটিকেই মহর্ষি দয়ানন্দ মোক্ষকাল হিসেবে গণ্য করেছেন।

এখন পর্যন্ত আমরা প্রমাণ ও যুক্তির মাধ্যমে জানলাম যে চৈত্র শুক্ল প্রতিপদা থেকে নতুন বছর উদযাপন করা সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত। এবার এই বছরের বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো বর্ণিত হলো—

৯. চৈত্রে মাসি জগৎ ব্রহ্ম সসর্জ প্রথমেহনি।
শুক্লপক্ষে সমগ্রে তু সদা সূর্যোদয়ে সতি।

চৈত্র শুক্ল প্রতিপদার প্রথম সূর্যোদয়ের সময় পর্যন্ত পরমেশ্বর সমগ্র সৃষ্টির সৃষ্টি সম্পন্ন করে মানুষদের উৎপন্ন করেছিলেন। অতএব এটিকে সৃষ্টি সংবৎসর এবং মানব সংবৎসর বলা হয়।

২. এই দিন মানুষের কল্যাণের জন্য পরমাত্মা আগ্নি, বায়ু, আদিত্য, অঙ্গিরা নামে চার রিষির অন্তঃকর্ণে বেদজ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন। এজন্য এটিকে বেদসংবৎসরও বলা হয়।

৩. এই দিনই কলিয়ুগ সংবৎসর শুরু হয়।

৪. এই দিনই পাণ্ডুপুরুষ যুধিষ্ঠিরের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল। এজন্য যুধিষ্ঠির সংবৎসরও এই দিন থেকে শুরু হয়।

৫. অত্যন্ত পরাক্রমী, ধর্মাত্মা এবং ন্যায়প্রিয় বিক্রমাদিত্য নামে প্রসিদ্ধ সংবৎসরও এই দিন থেকেই শুরু হয়।

৬. শালিভাহন হুনদের পরাজিত করে দক্ষিণ ভারত জুড়ে একটি সুস্থ ধর্মীয় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তখন থেকে শালিভাহন শক সংবৎসরও এই দিন থেকে শুরু হয়।

৭. মহর্ষি দয়ানন্দ বৈদিক ধর্ম ও প্রাচীন সংস্কৃতির সংরক্ষণ এবং মানব সমাজের উন্নতির জন্য এই দিনেই আয়র্য সমাজের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

৮. এই নতুন বছরের কাছাকাছি, অর্থাৎ চৈত্র শুক্ল নবমীতে, মর্যাদাপুরুষোত্তম শ্রীরামের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল।

নতুন বছরের দিব্য বার্তা—

এই নতুন বছরের দিভ্য বার্তা গ্রহণ করে এবং তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা এই উৎসব মহাদয়ানন্দের সাথে উদযাপন করার জন্য নিম্নরূপ চেষ্টা করি—

১. এটি সৃষ্টির উৎপত্তির দিন। উৎপত্তির সময় যেমন এটি অত্যন্ত নির্মল, শুদ্ধ-পবিত্র, সকল প্রাণীর জন্য স্বাস্থ্যকর ও মনোহর ছিল, তেমনই এটিকে বজায় রাখা, নিরাপদ রাখা আমাদের কর্তব্য। পরিবেশের দূষণ নির্মূল করতে বৃক্ষাদি রক্ষা করে তাদের বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে এবং প্রতিদিন যজ্ঞ-যাগের আয়োজন করতে হবে।

২. এটি মানব সংবৎসর। সকল মানুষ এক ঈশ্বরের সন্তান। তাই আমাদের জাতি, মত, দেশ, লিঙ্গ ইত্যাদি পার্থক্য ভুলে দিয়ে এবং ঈর্ষা, দ্বেষ, অসূয়াদির মতো দোষ ত্যাগ করে পরস্পরের প্রতি অত্যন্ত প্রীতি, প্রেম, অনুরাগ প্রকাশ করতে হবে এবং মানবতাকে প্রদর্শন করতে হবে। “বসুধৈব কুটুম্বকম্‌”—সমগ্র জগতই একটি পরিবার, এই পবিত্র ভাবনা থেকে চলতে হবে।

৩. এটি বেদোদ্ভব সংবৎসর। যতোদিন ভেদিক ধর্ম ও সংস্কৃতি পৃথিবীতে বিস্তৃত ছিল, তখন সকল মানুষ সুখ-শান্তিতে পরিপূর্ণ ও তৃপ্ত ছিলেন। অতএব আজও বিভিন্ন সময়ে স্বার্থসিদ্ধ ও প্রচলিত সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও মতভেদের প্রতি নয়, বরং ঈশ্বর প্রদত্ত দিভ্য বেদজ্ঞানের অনুসরণ করে, রিষি-মুনিদের মতো এবং শ্রীরাম, শ্রীকৃষ্ণের মতো মহাপুরুষদের মতো সুখ-শান্তি অর্জন করতে পারি। এভাবে একটি দিভ্যমানবসমাজ গঠিত হবে।

৪. এটি শ্রীরাম, যুধিষ্ঠির, বিক্রমাদিত্য, শালিভাহন প্রভৃতি ধর্মনিষ্ঠ মহারাজদের ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার দিন। অতএব আমাদের সকলকে অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, দুরাচার, দুর্নীতি ও অবিনীতির মতো কু-প্রবৃত্তি ত্যাগ করে ধর্ম ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

নিচু ভাবনায় উদ্দীপ্ত রাজনীতি কে ধ্বংস করে, ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য এগিয়ে চলুন এবং দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করুন।
“ধর্মো রক্ষতি রক্ষিতঃ” — যদি আমরা ধর্মের রক্ষা করি, ধর্ম আমাদের রক্ষা করে।
“যতো ধর্মস্ততো জয়ঃ” — যেখানে ধর্ম আছে, সেখানে বিজয় এবং সুখ-শান্তি বিদ্যমান।

৫. এটি আর্যসমাজের প্রতিষ্ঠার দিন। আর্য অর্থ শ্রেষ্ঠ, সমাজ অর্থ মানবতা সমৃদ্ধ মানুষের সম্প্রদায়।
আর্যসমাজ অর্থ হলো উৎকৃষ্ট ও শ্রেষ্ঠ মানুষের সমাজ।
“কৃণ্বন্তো বিশ্বমার্যঃ” (ঋ ০৯.৬৩.৫) — এই বিশ্বে বিদ্যমান অজ্ঞতা, অন্ধকার এবং দুষ্ট শক্তি ধ্বংস করে পুরো বিশ্বকে আর্য করে তুলুন, একটি দিভ্যমানব সমাজ গঠন করুন।
স্বার্থ, অজ্ঞতা, ভূত-প্রেত, যন্ত্র-তন্ত্র, অন্ধবিশ্বাস ইত্যাদি সমূলভাবে বিলোপ করে সকল মানুষকে জ্ঞানী ও বিবেকশীল করুন।

সংবৎসরের নামসমূহ

প্রভবঃ বিভবঃ শুক্লঃ প্রমোদঃ প্রজাপতিঃ
অঙ্গিরাঃ শ্রীমুখো ভাবো যুবা ধাতেশ্বরস্তথা।।
বহুধান্যঃ প্রমাথী চ বিক্রমঃ বৃ্ষস্তথা।
চিত্রভানুঃ সুবানুঃ চ তারণঃ পার্থিবো ব্যয়ঃ॥
সর্বজিত্সর্বধারী চ বিরোধী বিকৃতিঃ খরঃ।
নন্দনো জয়শ্বেভ জয়ো মনমথ-দুর্মুখী॥
হেমলম্ভী বিলম্ভী চ বিকারী শার্বরীপ্লবঃ।
শুভকৃচ্ছোবনঃ ক্রোধী বিশ্বাবসুপরাভবী॥।
প্লবঙ্গঃ কীলকঃ সৌম্যঃ সাধারণবিরোধকৃত্।
পরিধাভী প্রমাথী চ আনন্দো রাক্ষসো উন্মলঃ॥।
পিড়লঃ কালাযুক্তশ্ব সিদ্ধার্থো রৌদ্র-দুর্মতী।
দুন্দুভী রুধিরোদ্গারী রক্তাক্ষী ক্রোধনঃ ক্ষয়ঃ॥

এই অংশে সংবৎসরের বিভিন্ন নাম এবং তাদের বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে, যেমন— বিজয়ী, সৌম্য, রৌদ্র, আনন্দময় ইত্যাদি, যা প্রতিটি সংবৎসরের চরিত্র ও প্রভাবকে নির্দেশ করে।

ক্রমহিন্দি নামবাংলা উচ্চারণ
प्रभवপ্রভব
विभवবিভব
शुभশুভ
प्रमादপ্রমাদ
प्रजापतिপ্রজাপতিঃ
अंगिराঅঙ্গিরাঃ
श्रीमुखশ্রীমুখ
भावভাব
युवযুব
১০धाताধাতা
১১ঈश्वरঈশ্বর
১২बहुधान्यবহুধান্য
১৩प्रमाथीপ্রমাথী
১৪विक्रमবিক্রম
১৫ध्रुवধ্রুব
১৬चिन्मयচিন্ময়
১৭मुकुम्भমুকুম্ভ
১৮तारणতারণ
১৯पार्थिवপার্থিব
২০व्ययব্যয়
২১सर्वजितসর্বজিত
২২सर्वधारीসর্বধারী
২৩विरोधीবিরোধী
২৪विकृतिবিকৃতি
২৫खरখর
২৬नन्दनনন্দন
২৭विजयবিজয়
২৮जिश्रজিশ্র
২৯मनमयমনময়
৩০दुर्मुखদুর্মুখ
৩১हेमलम्बीহেমলম্ভী
৩২विलम्बीবিলম্ভী
৩৩निकरीনিকরী
৩৪शान्तिশান্তি
৩৫प्लवপ্লব
৩৬प्रमुक्कপ্রমুক্ক
৩৭शोभनশোভন
৩৮ज्रोहीজ্রোহী
৩৯विभवायবিভবায়
৪০परमभवপরমভব
৪১प्लवंगপ্লবঙ্গ
৪২कीलकকীলক
৪৩सीघ्रসীঘ্র
৪৪साधारणসাধারন
৪৫विरोधकृतবিরোধকৃত
৪৬पार्थिवপার্থিব
৪৭प्रभाध्यপ্রভাধ্য
৪৮आनन्दআনন্দ
৪৯राक्षसরাক্ষস
৫০अनल (नल)অনল (নল)
৫১पिंगलপিংগল
৫২कालसर्पকালসাপ
৫৩सिद्धार्थসিদ্ধার্থ
৫৪रौद्रরৌদ্র
৫৫दुमितिদুমিতি
৫৬दुरितम्দুরিতম
৫৭फरियाद्रिফরিয়াদি
৫৮रक्ताभिরক্তাভি
৫৯क्रोधক্রোধ
৬০क्षयক্ষয়

 ভারতীয়/স্থানীয় সংবৎসমূহ

সংবৎবাংলা নামসংখ্যা / বছর
সৃষ্টিসংবৎ
শ্রীরাম সংবৎ
শ্রীকৃষ্ণ সংবৎ
যুধিষ্ঠির/কলিয়ুগ সংবৎ
বৌদ্ধ সংবৎ –
মহাবীর (জৈন) সংবৎ
শ্রীশঙ্করাচার্য সংবৎ
বিক্রম সংবৎ
শালিবাহন (শক) সংবৎ
১০কালচুরি সংবৎ
১১বলভী সংবৎ
১২ফসলি সংবৎ
১৩বঙ্গলা সংবৎ
১৪হৃষব সংবৎ
১৫দয়ানন্দ সংবৎ

বিদেশী সংবৎসমূহ

সংবৎবাংলা নামসংখ্যা / বছর
চীনা সংবৎ
খাতাই সংবৎ
পারসি সংবৎ
মিসরী সংবৎ
তুর্কী সংবৎ
আদম সংবৎ
ইরানি সংবৎ
ইহুদি সংবৎ
ইব্রাহিম সংবৎ
১০মূসা সংবৎ
১১ইউনানি সংবৎ
১২রোমান সংবৎ
১৩ব্রহ্ম সংবৎ
১৪মালয়কেতু সংবৎ
১৫পার্থিয়ান সংবৎ
১৬ঈসা (ইসা) সংবৎ
১৭জাভা সংবৎ
১৮হিজরি সংবৎ

রাশি ও ঋতুর সময়কাল

রাশিঋতুসময়কাল
মেষ-বৃষশীত (শিশির)ডিসেম্বর–জানুয়ারি
মিথুন-কর্কবসন্ত (বসন্তকাল)ফেব্রুয়ারি–মার্চ
সিংহ-কন্যাগ্রীষ্ম (গ্রীষ্মকাল)জুন–জুলাই
তুলা-বৃশ্চিকবর্ষা (বর্ষাকাল)আগস্ট–সেপ্টেম্বর
ধনু-মকরহেমন্ত (শরৎ)অক্টোবর–নভেম্বর
কুম্ভ-মীনশীত (শিশির)ডিসেম্বর–জানুয়ারি

রাশি এবং নক্ষত্র

রাশিনক্ষত্র সংখ্যানক্ষত্রের নামরাশিনক্ষত্র সংখ্যানক্ষত্রের নাম
মেষঅশ্বিনীতুলা১৫চিত্রা (১/২)
মেষভরণীতুলা১৬স্বাতী (১/২)
মেষক্রিতিকাবিশাখা (১/২)
বৃষরোহিণীবৃশ্চিক১৭অ্যানুরাধা (১/২)
বৃষমৃগশিরাবৃশ্চিক১৮জ্যেষ্ঠা (১/২)
মিথুনআড়্ধাধনু১৯মূল (১/২)
মিথুনপূর্ণিমাধনু২০পূর্বাষা (১/২)
কর্কপূর্ণমকর২১উত্তরাষা (১/২)
কর্কআষাঢ়ীমকর২২শ্রবণ (১/২)
সিংহ১০মাঘাকুম্ভ২৩ধনিষ্ঠা (১/২)
সিংহ১১পূর্ব ফাল্গুনীকুম্ভ২৪শাতভিষা (১/২)
কন্যা১২উত্তর ফাল্গুনীমীন২৫পূর্বভাদ্রপদ (১/২)
কন্যা১৩হস্তমীন২৬উত্তরভাদ্রপদ (১/২)
কন্যা১৪চিত্রা২৭রেভতী (১/২)

সংখ্যাবাচক শব্দ

সংখ্যাসংস্কৃতবাংলাইংরেজি
একএকOne
১০दशদশTen
১০०शतশতHundred
१०००सहस्रহাজারThousand
१००००अयुतদশ হাজারTen Thousand
१००০০०लक्ष्मলাখHundred Thousand
१००००००प्रत्यम्/नियुतम्দশ লাখMillion
१०^7कोटिকোটিTen Million
१०^८अर्बुदम्দশ কোটিHundred Million
१०^९बुध/अर्बअरबBillion
१०^१०खर्वःদশ अरबTen Billion
१०^११निरध्वःশত অর্বHundred Billion
१०^१२महापदम्ট্রিলিয়নTrillion
१०^१३अंकःদশ ট্রিলিয়নTen Trillion
१०^१४जिलधि/समुप्रःদশ নীলHundred Trillion
१०^१५अभ्यम्পঞ্চQuadrillion
१०^१६मध्यम्দশ পঞ্চTen Quadrillion
१०^१७प्रतियुतশতHundred Quadrillion
१०^१८धुनम्/शंखम्দশ শঙ্খQuintillion

১. ব্রাহ্ম কালগণনা (মানবীয় সংবৎসমূহে)

সময়কালবাংলা অর্থবছর
ব্রাহ্মদিন (সৃষ্টিকাল)১,০০০ চতুর্যুগ৪,৩২,০০,০০,০০০
ব্রাহ্মরাত্রি (প্রলয়কাল)১,০০০ চতুর্যুগ৪,৩২,০০,০০,০০০
ব্রাহ্ম অহোরাত্র (পূর্ণ দিন)দিন + রাত৮,৬৪,০০,০০,০০০
ব্রাহ্ম মাস (১ অহোরাত্রের ১/৩০)২,৫৯,২০,০০,০০,০০০
ব্রাহ্ম সংবৎ (ব্রাহ্ম মাস × ১২)৩১,৩১০,৪০,০০,০০,০০০
ব্রাহ্ম শত সংবৎ (ব্রাহ্ম সংবৎ × ১০০)২১,১০,৪০,০০,০০,০০,০০,০০০

এই সৃষ্টি চক্রের ৩৬,০০০ বার উৎপত্তি ও বিনাশকে পরান্তকাল বলা হয়।

২. মুক্তাত্মার পরান্তকাল

মুক্ত আত্মা পরান্তকালে প্রায় ৩১,১০,৪০,০০,০০,০০,০০০ বছর (৩১ নীল, ১০ খরব, ৪০ কোটি) ব্রহ্মের আনন্দ অনুভব করে। তারপরে পুনরায় জন্ম নেয়।

৩. ব্রাহ্ম অহোরাত্রের বিভাজন

বিভাজনসংখ্যাবাংলা অর্থ
প্রহর৪ প্রহর দিন + ৪ প্রহর রাত
প্রহরের সময়কাল১ প্রহরদিন + রাতের মোট ৮ প্রহরের মধ্যে একটি প্রহর
পূর্বাহ্ন২ প্রহরদিনের প্রথম দুই প্রহর
অপরাহ্ন২ প্রহরদিনের শেষ দুই প্রহর

৪. বর্তমান সৃষ্টিসংবৎ

সংজ্ঞাবছর
বর্তমান সৃষ্টিসংবৎ (সন্ধিসহ)১,৯৭,২৯,৪৯,১১৬
বর্তমান সৃষ্টিসংবৎ (সন্ধিহীন)১,৯৬,০৮,৫৩,১১৬
সন্ধির পার্থক্য (৭ সন্ধি)১,২০,৯৬,০০০

৫. অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাল

ঘটনাবছর
অর্ধদিনকাল১,০৮,০০,০০,০০০
পূর্ণদিনকাল২,১৬,০০,০০,০০০
অন্যান্য সংখ্যা২,১৬,০০,০০,০০০

ব্রাহ্মদিনের প্রথম প্রহরের কাল – ১,০৮,০০,০০,০০০ বছর
ব্রাহ্মদিনের দ্বিতীয় প্রহরের অর্ধাংশ – ৭৪,০০,০০,০০০ বছর

ব্রাহ্মদিনের দেড় প্রহরের কাল – ১,৬২,০০,০০,০০০ বছর

এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে – বর্তমান সৃষ্টিবৎসর, তা সংধিসহ হোক বা সংধিহীন, উভয়ই ব্রাহ্মদিনের আদ্য দুই প্রহরের কালের চেয়ে কম এবং দেড় প্রহরের কালের চেয়ে বেশি। এটি স্পষ্ট যে, সৃষ্টির উদ্ভব হয়ে এখনও পর্যন্ত ব্রাহ্মদিনের আদ্য দেড় প্রহর সম্পূর্ণভাবে অতিবাহিত হয়েছে এবং দ্বিতীয় প্রহরের উত্তরার্ধ চলছে।

আজকাল সংকল্পপাঠ এভাবে প্রচলিত –

“ওষম্‌ তৎসদ্‌ আদ্য ব্রহ্মণো দ্বিতীয়প্রহরার্থে শ্লেতবরাহকাল্পে সপ্তমে বৈবস্বতে মন্বন্তরে...” অথবা “ওষম্‌ তৎসত্‌ শ্রী ব্রহ্মণো দ্বিতীয় প্রহরার্থে বৈবস্বতে মন্বন্তরে...”!

এ ধরনের পাঠে কিছু বিবেচ্য এবং সংশোধনীয় বিষয় রয়েছে, সেগুলি এখানে উপস্থাপন করা হলো –

১. প্রথম পাঠে 'আদ্য' (আজ) শব্দের পাঠ অপ্রাসঙ্গিক এবং অর্থহীন। সংস্কার পদ্ধতিতে মহর্ষি দয়ানন্দ সৃষ্টিকালের নির্দেশ না করে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত সংকল্পের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি এটি এভাবে বলেছেন – “অহম্যদ্য উক্তকর্মকরণায় ভবন্তং বৃতনে।” মহর্ষি এখানে সৃষ্টিকালের স্থানে তার সাংকেতিক এবং উপলক্ষ্য ‘আদ্য’ (আজ) পদটি ব্যবহার করেছেন। অতএব এটি অর্থপূর্ণ। তবে 'আদ্য' উচ্চারণের পর পুনরায় সৃষ্টিকালের বর্ণনা দেওয়া অপ্রাসঙ্গিক। হ্যাঁ, প্রথমে সৃষ্টিকালের বর্ণনা দিয়ে পরে 'আদ্য অমুক মাসে, অমুক তিথি' ইত্যাদি পাঠ করা যেতে পারে, কিন্তু পূর্বে কখনও নয়।

২. “ব্রহ্মণো দ্বিতীয়প্রহরার্থ” এর অর্থ হলো ব্রহ্ম সম্পর্কিত দ্বিতীয় প্রহরের অর্ধে। এই দ্বিতীয় প্রহর কি দিনের, নাকি রাতের, তা এখানে স্পষ্ট হয় না। অতএব এই পাঠে দিনের নির্দেশক শব্দের ব্যবহার থাকা উচিত। পূর্বে বলা হয়েছে যে এই সময় ব্রহ্মমাসের প্রথম দিবস “শ্রেতবরাহকাল্প” চলছে। অতএব ব্যাখ্যার জন্য সংক্ষেপের পাঠ হওয়া উচিত – “ব্রহ্মণঃ শ্রেতবরাহকাল্পনামকে প্রথমদিবসে তহিনে।” যদিও ব্রহ্মরাত্রি (প্রলয়কাল)–এ সংক্ষেপের পাঠ অসম্ভব, তথাপি কালবিভাগের ব্যাখ্যা প্রয়োজন।

৩. “দ্বিতীয়প্রহরার্ধে” এই পাঠে ‘অর্ধ’ শব্দের অর্থ যদি ‘মধ্যকাল’ ধরা হয়, তবে সেই কাল অর্থাৎ দ্বিতীয় প্রহরের অর্ধাংশ (১,৬২,০০,০০,০০০ বছর) অনেক আগে শেষ হয়ে গেছে। অতীতকালের বর্ণনা বর্তমান হিসেবে দেওয়া অজ্ঞতার প্রতীক। যদি ‘অর্ধ’ শব্দের অর্থ মধ্যভাগ না নিয়ে শুধুমাত্র অংশ হিসেবে ধরা হয়, তবে নতুন সন্দেহ জন্মায় যে এটি কি দ্বিতীয় প্রহরের পূর্বার্ধ, নাকি উত্তরার্ধ? অতএব নিশ্চিততার জন্য পাঠ হওয়া উচিত – “দ্বিতীয়প্রহরউত্তরার্ধে” অথবা “দ্বিতীয়প্রহরে তদউত্তরার্ধে”।

৪. “দ্বিতীয়প্রহরার্ধে শ্রেতবরাহকাল্পে” এই পাঠে আরও একটি ত্রুটি আছে – এই বাক্য থেকে অর্থ দাঁড়ায় যে দ্বিতীয় প্রহরের মধ্যে শ্রেতবরাহকাল্পে। কিন্তু দিনের মধ্যে প্রহর থাকে, প্রহরের মধ্যে দিন নয়। অতএব সঠিক পাঠ হওয়া উচিত – “শ্রেতবরাহকাল্পে দ্বিতীয়প্রহরউত্তরার্ধে।”

এবার সংক্ষেপের প্রথম খণ্ডের শুদ্ধ পাঠ হলো –

“ও৩ শ্রীত্রহ্মণঃ শ্রেতবরাহকাল্পনামকে প্রথমদিবসে তহিনে তদউত্তরার্ধে।”

এর অর্থ – সেই পরম সত্তার সম্পর্কিত শ্রেতবরাহকাল্প নামে প্রথম দিবসের দিনে, দ্বিতীয় প্রহরের উত্তরার্ধে।

এরপরের পাঠ “সপ্তমে বৈবস্বতে মন্বন্তরে”–এর বিস্তারিত নিম্নরূপ:

যুগ এবং মন্বন্তুর বিভাজন

চারটি যুগ রয়েছে, তাদের নাম ও কালপরিমাণ নিম্নরূপ –

  • কৃতযুগ (সত্যযুগ) – ১৭,২৮,০০০ বছর = কলিযুগের ৪ গুণ

  • ত্রেতায়ুগ – ১২,৯৬,০০০ বছর = কলিযুগের ৩ গুণ

  • দ্বাপরযুগ – ৮,৬৪,০০০ বছর = কলিযুগের ২ গুণ

  • কলিযুগ – ৪,৩২,০০০ বছর = কলিযুগের ১ গুণ

একটি চতুর্যুগের মোটকাল – ৪৩,২০,০০০ বছর = কলিযুগের ১০ গুণ।

ব্রাহ্মদিন (সৃষ্টিকাল) – ৪,৩২,০০,০০,০০,০০০ বছর = কলিযুগের ১০,০০০ গুণ।

৭৯টি চতুর্যুগকে মিলিয়ে একটি মন্বন্তর বলা হয়। অতএব, একটি মন্বন্তরের কাল হয় – ৭৯ × ৪৩,২০,০০০ = ৩৪,১২,৮,০০,০০,০০০ বছর।

মোট ১৪টি মন্বন্তর থাকে। তাদের মধ্যে প্রথম সাতটি মন্বন্তর ব্রাহ্মদিনের পূর্বাহ্নে থাকে এবং বাকি সাতটি অপরাহ্নে। তাদের নামগুলো হলো –

ব্রাহ্মদিনের পূর্বাকর্ষ্থ মন্বন্তর:
১. স্বয়ম্ভুব
২. স্বারোচিষ
৩. ঔত্তম
৪. তামস
৫. রৈবত
৬. চাক্ষুষ
৭. বৈবস্বত

ব্রাহ্মদিনের অপরাহ্নস্থ মন্বন্তর:
৮. সাওর্ণি / সূর্য সাওর্ণি
৯. দাক্ষ সাওর্ণি
১০. ব্রহ্ম / বৃহৎসাওর্ণি
১১. ধর্ম সাওর্ণি
১২. রুদ্র সাওর্ণি / রুদ্রপুত্র
১৩. দেবসাওর্ণি / রৌচ্য
১৪. ইন্দ্রসাওর্ণি / ভৌত্য / ভৌতব্যক

প্রতিটি দুই মন্বন্তরের মধ্যে একটি সন্ধি বা সন্ধ্যাকাল থাকে। তার পরিমাণ একটি সত্যযুগের সমান, অর্থাৎ ১৭,২৮,০০০ বছর হয়।

উল্লেখযোগ্য সূত্রসমূহ:

ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ – ২.৩৬.২–৪, ৪.৪.১.১–১১৬

মৎস্য পুরাণ – ৯.১–৩৯

বিষ্ণু পুরাণ – ৩.১.৩–৩.২.৪৫

হরিবংশ পুরাণ – ১.৭.১-১.৭.৬০–৯০

স্কন্দ পুরাণ, প্রভাস খণ্ড – ১.১০৫.৩৯,৪০

স্বয়ম্ভুব (প্রথম) মন্বন্তরের আগে ও একটি সন্ধিকাল থাকে। এভাবে মোট ১৫টি সন্ধিকাল হয়। ব্রাহ্মদিনের পূর্বাহ্নে, অর্থাৎ প্রথম সাতটি মন্বন্তরে সাড়ে সাতটি সন্ধি থাকে। সপ্তম ও অষ্টম মন্বন্তরের মধ্যবর্তী সন্ধিকালই ব্রাহ্মদিনের মধ্যাহ্ন। এই সন্ধিকালগুলিতে জলপ্লবন ইত্যাদি আংশিক প্রলয় ঘটে।

এভাবে ১৪টি মন্বন্তর ও ১৫টি সন্ধিকাল মিলে একটি ব্রাহ্মদিন (৪,৩২,০০,০০,০০০ বছর বা ১০০০ চতুর্যুগ) পূর্ণ হয়।

সমষ্টিগত কাল:

  • ১৪টি মন্বন্তরের কাল – ১৪ × ৩০,৬৭,২০,০০০ = ৪২,৯৪,০৮,০০,০০০ বছর

  • ১৫টি সন্ধির কাল – ১৫ × ১৭,২৮,০০০ = ২,৫৯,২০,০০০ বছর

  • ব্রাহ্মদিন (সৃষ্টি) – ৪,৩২,০০,০০,০০০ বছর

চতুর্যুগে হিসাব করলে –

  • ১৪ মন্বন্তর = ১৪০৭১ চতুর্যুগ ≈ ৯৯৪ চতুর্যুগ

  • ১৫টি সন্ধি = ১৫:০১ সত্যযুগ ≈ ৬ চতুর্যুগ

  • ব্রাহ্মদিন (সৃষ্টি) = ১০০০ চতুর্যুগ

এখান থেকে স্পষ্ট হয় যে, ১৫টি সন্ধির কালকে স্বীকার না করে কেবল ১৪টি মন্বন্তরের কাল নিয়ে সৃষ্টিকাল (৪,৩২,০০,০০,০০০ বছর বা ১০০০ চতুর্যুগ) পূর্ণ করা সম্ভব নয়। তাই, সন্ধিহীন সৃষ্টিকাল (১,৯৬,০৮,৫৩,১১৬ বছর) গ্রহণ করা অসাংবিধানিক এবং অজ্ঞাত বৈজ্ঞানিক।

বর্তমানে ব্রাহ্ম প্রথম দিনের সপ্তম বৈবস্বত মন্বন্তর চলছে। অতএব, পূর্বে প্রদর্শিত সংক্ষেপের পাঠে “সপ্তমে বৈবস্বতে মন্বন্তরে” অংশটি যোগ করলে সংক্ষেপের পাঠ হবে –

“ও৩ শ্রীত্রহ্মণঃ শ্রেতবরাহকাল্পনামকে প্রথমদিবসে তহিনে তদউত্তরার্ধে সপ্তমে বৈবস্বতে মন্বন্তরে।”

এরপরের পাঠ “অষ্টাবিংশতিমে কলিউগে”–এর অর্থ নিম্নরূপ:

সৃষ্টি আদি থেকে এখন পর্যন্ত অতিবাহিত কালের হিসাব

এখন পর্যন্ত ৬টি মন্বন্তরের কাল সম্পূর্ণভাবে অতিবাহিত হয়েছে, যার কাল –

৬ মন্বন্তর × ৭১ চতুর্যুগ ≈ ৪২৬ চতুর্যুগ

যা বছর হিসেবে – ৪২৬ × ২৪,৩২০,০০০ = ১০,৩৬,৩২,০০,০০০ বছর (৬টি মন্বন্তরের পূর্ণকাল)

এর সঙ্গে ৭টি সন্ধির কাল – ৭ × ১৭,২৮,০০০ = ১,২০,৯৬,০০০ বছর (৭টি সন্ধি)

এই সময়ে অষ্টাবিংশতিম (২৮তম) কলিউগ চলছে। অর্থাৎ ২৭ কলিউগ বা ২৭ চতুর্যুগ অতিবাহিত হয়েছে। অতিবাহিত কালের হিসাব –

২৭ × ৪,৩২,০০,০০০ = ১,১৬,৬৪,০০,০০০ বছর

২৮তম কলিউগে অতিবাহিত কাল –

  • সত্যযুগ – ১৭,২৮,০০০ বছর

  • ত্রেতায়ুগ – ১২,৯৬,০০০ বছর

  • দ্বাপরযুগ – ৮,৬৪,০০০ বছর

  • বর্তমান কলিযুগ – ৫,১১৫ বছর (৩০ মার্চ ২০১৪ পর্যন্ত, ২০৭১ বঙ্গাব্দ)

ডিসেম্বর ২০২৫-এ কলিয়ুগ প্রায় ৫,১২৭তম বছরে প্রবেশ করছে।

মোট সৃষ্টিকালের হিসাব – ৫,১,৯৭,২৯,৪৯,১১৫ বছর

আমরা পূর্বে বলেছি যে একটি কলিউগের মোটকাল ৪,৩২,০০০ বছর। তাকে ৪ ভাগে ভাগ করলে কলিউগের একটি “চরণ” ও “পাদ” বোঝা যায় –

৪,৩২,০০০ ÷ ৪ = ১,০৮,০০০ বছর

অতএব, এখনও কলিযুগের প্রথম চরণ চলছে। তাই “অষ্টাবিংশতিমে কলিযুগে” পাঠের পরে “কলিপ্রথমচরণে” পাঠ করা হয়।

এখন পর্যন্ত কলিউগের ৫,১১৫ বছর অতিবাহিত হয়েছে এবং বর্তমানে ৫,১১৬তম বছর চলছে। অতএব, “কলিপ্রথমচরণে” পাঠের পরে “পশ্চসহস্ত্রষোডশউত্তর-শততমে কলিযুগাব্দে” পাঠ করা উচিত।

সৃষ্টির উৎপত্তি থেকে বর্তমান সংবৎ পর্যন্ত অতিবাহিত কালের প্রকাশ করা হয়েছে নাম্বার-শব্দে। এখন সেটি সংখ্যাত্মকভাবে প্রকাশ করা হলো –

“একো বৃন্দঃ সপ্তনবতিকোটিঃ একোনত্রিঞ্চত্লক্ষাণি একোনপশ্চাশৎ সহস্রাণি ষোড়শোত্তর-শততমে সৃষ্টিসংবৎসরে।”

এর অর্থ – ১৯৭ কোটি ২৯ লক্ষ ৪৯ হাজার ১১৬তম সৃষ্টিসংবৎ।

এরপর ভারতীয় প্রচলিত সংবৎগুলোও পাঠ করার প্রথা চালু আছে। যেমন –

“দ্বিসপ্ততি-উত্তর-দ্বিসহরুতমে বিক্রমাব্দে, একনবতি-উত্তর শততমে দয়ানন্দাব্দে।”

অর্থাৎ, বর্তমানে ২০৭২তম বিক্রম সংবৎ এবং ১৯১তম দয়ানন্দ সংবৎ চলছে।

এরপর পাঠযোগ্য সংক্ষেপের সংক্ষেপের মূল অংশের অর্থ ও তাৎপর্য নিম্নরূপ জানানো হয়েছে।

সম্পূর্ণ সংক্ষেপের পাঠ হলো –

সংক্ষেপ

যজমান:
“ও৩ম্ আ বসোহঃ সদনে সীদ।”

ঋত্বিক:
“ও৩ম্ সীদামি।”

যজমান:
“ও৩ম্ তৎসত্ শ্রীব্রহ্মণঃ শ্রেতবরাহকাল্পনামকে প্রথম দিবসে তহিনে দ্বিতীয় প্রহরে তদউত্তরার্ধে সপ্তমে বৈবস্বতে মন্বন্তরে অষ্টাবিংশতিমে কলিউগে কলিপ্রথমচরণে পশ্চসহস্ত্রষোডশউত্তর-শততমে কলিউগাব্দে একোভুন্দঃ সপ্তনবতিকোটিঃ একোনত্রিঞ্চত্লক্ষাণি একোনপশ্চাশৎ সহস্রাণি ষোড়শোত্তরশততমে সৃষ্টিসংবৎসরে, দ্বিসপ্ততি-উত্তর-দ্বিসহস্রত্মে বিক্রমাব্দে, একনবতি-উত্তর-শততমে দয়ানন্দাব্দে … নামক সংবৎসরে, … অয়নে, … পা ঋতি, … মাসে, পক্ষে, তিথি, … নক্ষত্রে, প্রাতঃকালে/সায়ঙ্কালে, ভূলকে জম্বূদীপে, ভারতখণ্ডে, আর্যাবর্তে … প্রদেশে, … নগরে, … গ্রামে, স্বশোভনগৃহে, যজ্ঞমণ্ডপে …, গোত্রোত্তন্নঃ, শ্রীমতাম্‌ … মহোদয়ানাং পৌত্রঃ, শ্রীমতাম্‌ … মহোদয়ানাং পুত্রঃ, … নাম আহং শ্রীমত্যা … নামন্যা ধর্মপতল্যা সহিতঃ ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ-চতুর্বিধ ফল-পুরুষার্থ-অ্যাপ্ত্যর্থ, সর্বভূতানাং সুখ-শান্তি-আয়ুঃ-আরোগ্য-ঐশ্বর্যঅভিবৃদ্ধ্যর্থম্‌, বৈদিকধর্ম-প্রাচুর্যার্থ চ ইমং … বृहদ্যজ্ঞং/সংস্কারং কারয়িতু ভবন্তং/ভবন্তী বৃণ।”

ঋত্বিক:
“ওম্ বৃতোউসমি / বৃতাইস্মি”

বৈদিক পরম্পরার রক্ষক

নিগম-নিডম্‌ (বেদগুরুকুল)

ভূতানাং প্রাণিনঃ শ্রেষ্ঠাঃ প্রাণিষু বুদ্ধিজীবিনঃ। বুদ্ধিমৎসু নরাঃ শ্রেষ্ঠা নরেষু ব্রাহ্মণাঃ স্মৃতাঃ॥ (মনু ০১.৯৬)

চরাচর জগতে জীবধারী (প্রাণী) শ্রেষ্ঠ। প্রাণীদের মধ্যে বুদ্ধিজীবী শ্রেষ্ঠ। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে মানুষ শ্রেষ্ঠ, আর মানুষের মধ্যে যারা বেদজ্ঞ, ব্রহ্মবিদ্‌ তারা সর্বোত্তম।

এই জগতে মানুষ সর্বোত্তম প্রাণী হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছে। কিন্তু এর জ্ঞান স্বাভাবিক নয়, এটি নৈমিত্তিক অর্থাৎ এটি মানুষকে মা, বাবা, গুরু ইত্যাদির মাধ্যমে অর্জন করতে হয়, অন্যথায় সে পশু-পক্ষীর থেকেও অধম প্রাণী হিসেবে প্রমাণিত হয়। অতএব মানুষের জন্য জ্ঞান, বিদ্যা, কলা ইত্যাদির অত্যন্ত প্রয়োজন। মানুষকে মানুষের শ্রেণীতে প্রতিষ্ঠিত করার প্রধান উপায় হল বিদ্যা ও জ্ঞান।

মহর্ষি দয়ানন্দও বলেছেন, “যা থেকে বিদ্যা, সভ্যতা, ধর্মমনা, জিতেন্দ্রিয়তা ইত্যাদি বৃদ্ধি পায় এবং অজ্ঞানতা ইত্যাদি দূর হয়, তাকে শিক্ষা বলে।” (“স্বমন্তব্যা”)। “যা থেকে ঈশ্বর থেকে শুরু করে পৃথিবী পর্যন্ত সমস্ত পদার্থের সত্য বিজ্ঞান হয়ে তা থেকে যথাযথ উপকার নেওয়া যায়, সেটিই ‘বিদ্যা’।” (“আইয়ং দিশ্য”)।

কিন্তু বর্তমানে প্রচলিত বিদ্যাবিধান থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত ফলাফল দেখা যাচ্ছে। আধুনিক বিদ্যায় সহানুভূতিহীন মানুষ-রূপ যন্ত্র তৈরির ক্ষমতা থাকলেও, এটি মানবীয় সংস্কারযুক্ত মানুষ তৈরিতে সম্পূর্ণ অক্ষম প্রমাণিত হয়েছে। ব্যক্তিগত জীবন থেকে দেশের ও বিশ্বব্যাপী অঞ্চলে সর্বত্র স্বার্থপরতা, অনাচার, অত্যাচার, অধর্ম, অন্যায়, কর্মহীনতা, বিষয়লিপ্সা, দুরাচার, দুর্নীতি, জাতিবাদ ইত্যাদি থেকে ভয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। মা-বাবা, শিক্ষক ও ছাত্র সবাই আধুনিক বিদ্যায় কেবল ধনের আশা করে। এজন্য সবাই তাদের মনোশক্তি চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়।

কিন্তু আজকের মানুষ বুঝতে পারছে না যে ধন, ঐশ্বর্য ইত্যাদি নিজের লক্ষ্য নয়, এবং এগুলো চিরস্থায়ী সম্পদও নয়। আদর্শ ও সংস্কারবিহীন আধুনিক শিক্ষা মানুষকে পথভ্রষ্ট করে, নরপিশাচে পরিণত করছে। ফলস্বরূপ, রক্ষকই ভক্ষক, প্রাণদাতা (ডাক্তার) প্রাণান্তক, উপকারক অপকারক, নির্মাতা নাশক হিসেবে পরিণত হচ্ছে।

আক্রমণাত্মক ইংরেজদের কুটিল নীতির কারণে, বেদ, ঋষি, মুনি ও অন্যান্য মহাপুরুষদের দ্বারা সমৃদ্ধ ও সর্বসুখ-শান্তিতে পরিপূর্ণ বিশ্বগুরু ভারত আজ ভয়ঙ্কর ও বিপজ্জনক অবস্থার সম্মুখীন। ফলাফল সম্পর্কে বিবেচনা না করে যে কাজ করা হয়েছে তা সম্পূর্ণভাবে ফলহীন ও ক্ষতিকর হয়েছে। এজন্য এটি একটি বড় উদাহরণ। এখনও ভারতীয়রা সচেতন হয়ে ধর্ম, মানবতা, বিশ্বভ্রাতৃত্ব, সংস্কৃতি, সভ্যতা ইত্যাদিকে বিনষ্ট করা থেকে রক্ষা করতে, এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি মূলে নির্মূল করতে, বেদের দিকে ফিরে আসা উচিত এবং অনন্তকালীন বৈদিক সংস্কৃতি ও প্রাচীন ঋষিপরম্পরার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বিদ্যাবিধি গ্রহণ করতে হবে, যাতে দেশের পূর্ব বৈভব পুনরায় দেখা যায়।

এই অপরিহার্যতা উপলব্ধি করে মহর্ষি দেব দয়ানন্দ সরস্বতী ভারতদেশের প্রাচীন বৈভব পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য বেদের প্রচারের জন্য তার সম্পূর্ণ জীবন উৎসর্গ করেছেন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করেছেন। তাদের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে তিনি চারটি গুরুকুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এরপর তার অনুসারী স্বামী শ্রদ্ধানন্দ এবং অন্যান্য তপঃসন্নিপাত বিদ্বানরা সেই গুরুকুল পরম্পরাকে নিঃস্বার্থভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে তা ফুলে-ফলে উন্নত শিখরে পৌঁছে দেন। কিন্তু দক্ষিণ ভারতের জন্য সেই ধরনের প্রচেষ্টা সম্ভব হয়নি। ফলে ভারতের দক্ষিণাংশে বৈদিক বিদ্বান, পণ্ডিত, সন্ন্যাসী, বনপ্রস্থী, ব্রহ্মচারী, প্রচারক, পুরোহিত ইত্যাদির অভাব থেকে ধর্মবিরোধী কার্যক্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এই অভাব পূরণের জন্য এবং মহর্ষি দেব দয়ানন্দের সংকল্পকে বাস্তবায়ন করার, ঋষিপরম্পরাকে দক্ষিণ প্রান্তে পুরোপুরি প্রসারিত করার মহাবিশিষ্ট উদ্দেশ্যে, অবিভক্ত আন্দ্রপ্রদেশের মেদক জেলা, গজওয়েল মণ্ডল, পিডিচেদ গ্রামের নিকটে স্বচ্ছ, নির্মল, একান্ত ও শান্ত পরিবেশযুক্ত চার একর জমিতে ৩ এপ্রিল, ২০০৫ সালে এই বেদগুরুকুল প্রতিষ্ঠিত হয়।

সীমিত সম্পদ থেকে শুরু হওয়া এই গুরুকুল ঈশ্বরের অনুগ্রহ এবং ধর্মপরায়ণ ব্যক্তিদের সহযোগিতায় স্বল্প সময়ে লক্ষ্য অর্জনে সম্পূর্ণ সফল হয়েছে। এই গুরুকুলে বেদ, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদ, উপবেদ, কোষ, বেদলক্ষণ, বেদার্ধ, দর্শন, স্মৃতি, সাহিত্য, ইতিহাস, গবেষণাগ্রন্থ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের সংস্কৃত, হিন্দি, তেলুগু ও ইংরেজি ভাষার সম্পূর্ণ সাহিত্য আধুনিক পদ্ধতিতে সজ্জিত বিশাল গ্রন্থাগার রয়েছে। এখানে প্রায় পাঁচ লাখ টাকার বেশি মূল্যমানের ছয় হাজারের বেশি গ্রন্থ উপলব্ধ। একটি ভव्य ও সুন্দর যজ্ঞশালা, ধ্যানমন্দির, ছাত্রাবাস, অতিথি গৃহ, অফিস, রান্নাঘর, আহারশালা, স্নানাগার সহ সকল সুবিধা রয়েছে। ছাত্রদের পুষ্টিকর বিশুদ্ধ সাত্বিক আহার প্রদান করা হয়।

বর্তমানে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা (৩০) ছাত্র প্রাত্যহিক নিয়মিত সময়সূচির সঙ্গে প্রায় ১০ ঘণ্টা অধ্যয়নে নিয়োজিত। তারা প্রাতঃ ৪টা থেকে রাত ৯.৩০টা পর্যন্ত অধ্যয়ন, ব্রহ্মযজ্ঞ, দেবযজ্ঞ, ধ্যান, জপ, প্রণায়াম, ব্যায়াম, আসন, লাঠি-তলোয়ারবাজি ও অন্যান্য ক্রীড়া প্রাত্যহিকভাবে সম্পন্ন করে। ছাত্রদের শাস্ত্রীয় অধ্যয়নের পাশাপাশি ধর্মীয়, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়ও অন্তর্দৃষ্টি করানো হয়।

শুধু তাই নয়, দেশপ্রেম, মহাপুরুষদের আদর্শ জীবনচরিত্র, ভারতীয় বিশুদ্ধ ইতিহাস ইত্যাদিও পড়ানো হয়। অধ্যয়নের পাশাপাশি শিক্ষাদান, লেখা, বক্তৃতা ইত্যাদির অনুশীলনও করানো হয়। কম্পিউটার প্রশিক্ষণও সম্পূর্ণভাবে প্রদান করা হয়। গুরুকুলে একটি গৌশালাও রয়েছে। ছাত্ররা গোসেবা ও গোঁসংরক্ষণ পদ্ধতিতে পরিচিত হয়। বিভিন্ন বিষয়ের প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয় এবং বিজয়ীদের পুরস্কৃত করা হয়, যা তাদের যোগ্যতা বৃদ্ধি ও উৎসাহ প্রদান করে।

এই গুরুকুলে জাতিভেদ থেকে উত্তীর্ণ হয়ে, সমস্ত আগ্রহীকে শুধু সংস্কৃত ভাষাই নয়, সশব্দ বেদপাঠ এবং সম্পূর্ণ বৈদিক সাহিত্যও পড়ানো হয়।

গুরুকুলের উদ্দেশ্য

১. সম্পূর্ণ বৈদিক সাহিত্য ও বিদ্যার অধ্যয়ন, শিক্ষাদান এবং গবেষণা।
২. বৈদিক বিদ্বান তৈরী করা।
৩. বৈদিক ধর্মের প্রচারক এবং পুরোহিত তৈরি করা।
৪. বৈদিক সংস্কৃতি ও সভ্যতার সংরক্ষণ।
৫. বৈদিক সাহিত্য এবং বেদানুকূল গ্রন্থের প্রকাশনা।
৬. বৈদিক আশ্রম-ধর্ম রক্ষার জন্য বনপ্রস্থ ও সন্ন্যাস আশ্রম প্রতিষ্ঠা করা।
৭. দেবীভাষা সংস্কৃত এবং রাষ্ট্রভাষা হিন্দির প্রচার ও প্রসার করা।
৮. অনাথ ও দরিদ্র শিশুদের আশ্রয় দিয়ে শিক্ষিত করা এবং সম্ভব হলে সহযোগিতা করা।
৯. গ্রামীণ অঞ্চলে নিঃশুল্ক চিকিৎসালয় স্থাপন।
১০. গো-মাতার সুরক্ষার জন্য গোঁশালা প্রতিষ্ঠা।
১১. প্রধান শহর ও গ্রামে বৈদিক গ্রন্থাগার স্থাপন।

প্রবেশ করতে ইচ্ছুক ছাত্র ও সহযোগিতার আগ্রহীদের গুরুকুলের আচার্য সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।

বিশেষ তথ্য:
এই গুরুকুলে প্রদত্ত দান আয়কর আইন অনুযায়ী করমুক্ত। দানের চেক বা ড্রাফট “নিগম-নিডম্‌” নামে পাঠানো যায়। অনলাইন দানের ক্ষেত্রে ফোনে জানিয়ে গুরুকুলের অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দিতে হবে।

ঠিকানা ও যোগাযোগ:
উদয়নাচার্য (অধীক্ষক),
নিগম-নিডম্‌ (বেদগুরুকুল),
মহর্ষি দয়ানন্দ মার্ক, পিডিচেদ, মেদক জেলা (তেলঙ্গানা)- ৫০২ ২৭৮
ফোন: ০৯৪৪০৭২৯৫৮, ০৭৬৬০০৬০৭৪৯

রচয়িতার অন্যান্য গ্রন্থ:
১. শিক্ষাশাস্ত্র (সংস্কৃত, হিন্দি) – ১৫০.০০
২. পাণিনীয় শিক্ষা (সংস্কৃত, হিন্দি) – ৩০.০০
৩. হিতোপদেশঃ (সংস্কৃত, হিন্দি) – ৭০.০০
৪. গোদানবিধিঃ (সংস্কৃত, হিন্দি) – ৭০.০০
৫. গোদানবিধিঃ (সংস্কৃত, তেলুগু) – ২০.০০
৬. বৈদিক পર્વপদ্ধতি-নববর্ষেষ্ঠি (হিন্দি) – ৭৫.০০
৭. বৈদিক পর্বপদ্ধতি-যুগাদি (তেলুগু) – ৭৫.০০
৮. পাণিনীয় অষ্টাধ্যায়ী সূত্রপাঠ (তেলুগু) – ৯৫.০০
৯. নতুন বছর কখন? – ১৫.০০
১০. নুতন সংবৎসর কখন? – ১৫.০০
১১. দিৱ্যবাণী – ১০.০০
১২. অষ্টাইযোগ (তেলুগু অনুবাদ) – …



No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

জন্মকুণ্ডলী ও ভবিষ্যৎবাণী

 বলা হয়, পাঞ্জাবে এক সময় ঝল্লু নামে এক জাট ছিল। তার একমাত্র পুত্র গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন তার মনে এই চিন্তা জাগল—এখন ডাক্তারদের ডাকব ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ