এটি আমরা পূর্বে লিখে এসেছি যে দেবতা কোনো মন্ত্রের মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে থাকে। এই কারণেই এই মন্ত্রের মুখ্য প্রতিপাদ্য ‘ওম্’ ছন্দরশ্মি, মনস্তত্ত্ব, প্রাণতত্ত্ব এবং সকল ছন্দরশ্মি। এই ঋচার উৎপত্তি বিশ্বামিত্র ঋষি [বাগ্ বৈ বিশ্বামিত্রঃ (কৌ. ব্রা. ১০।৫), বিশ্বামিত্রঃ সর্বমিত্রঃ (নিরুক্ত ২।২৪)] অর্থাৎ সকলকে আকর্ষণ করতে সক্ষম ‘ওম্’ ছন্দরশ্মি থেকে হয়েছে।
আধিদৈবিক ভাষ্য— (ভূঃ) ‘ভূঃ’ নামক ছন্দরশ্মি কিংবা অপ্রকাশিত কণ বা লোক, (ভুবঃ) ‘ভুবঃ’ নামক রশ্মি কিংবা আকাশতত্ত্ব, (স্বঃ) ‘সুবঃ’ নামক রশ্মি কিংবা প্রকাশিত কণ, ফোটন বা সূর্যাদি তারার মধ্যে ব্যাপ্ত, (তৎ, সবিতুঃ) সেই অগোচর বা দূরস্থিত সবিতা অর্থাৎ মন, ‘ওম্’ রশ্মি, সকল ছন্দরশ্মি, বিদ্যুৎ ও সূর্যাদি পদার্থকে (বরেণ্যম্, ভর্গঃ, দেবস্য) সর্বত্র আচ্ছাদনকারী ব্যাপক [ভর্গঃ=অগ্নির্বৈ ভর্গঃ (শত. ব্রা. ১২।৩।৪।৮), আদিত্ত্যো বৈ ভর্গঃ (জৈ. উ. ৪।১২।২।২), বীর্যং বৈ ভর্গোऽস্য বিষ্ণুর্যজ্ঞঃ (শত. ব্রা. ৫।৪।৫।১), অয়ং বৈ (পৃথিবী) লোকো ভর্গঃ (শত. ব্রা. ১২।৩।৪।৭)] আগ্নেয় তেজ, যা সমগ্র পদার্থকে ব্যাপ্ত করে বহু সংযোজক ও সংবেদক বল দ্বারা যুক্ত হয়ে প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত লোকসমূহের নির্মাণে প্রেরণা দিতে সক্ষম হয়, (ধীমহি) প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ সে সমগ্র পদার্থে সেই আগ্নেয় তেজ, বল ইত্যাদিকে ব্যাপকভাবে ধারণ করে। (ধিয়ঃ, যঃ, নঃ, প্রচোদয়াত্) যখন সেই উপযুক্ত আগ্নেয় তেজ ঐ পদার্থকে ব্যাপ্ত করে নেয়, তখন বিশ্বামিত্র ঋষি-সংজ্ঞক মন ও ‘ওম্’ রশ্মিরূপ পদার্থ [ধীঃ = কর্মনাম (নিঘ. ২।১), প্রজ্ঞানাম (নিঘ. ৩।৯), বাগ্ বৈ ধীঃ (ঐ. আ. ১।১।৪)] বিভিন্ন প্রকারের বাক্রশ্মিকে নানাবিধ দৃষ্টিভঙ্গি ও ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করে উত্তমভাবে প্রেরিত ও নিয়ন্ত্রিত করতে শুরু করে।
ভাবার্থ— মন এবং ‘ওম্’ রশ্মিগুলি ব্যাহৃতি রশ্মির সঙ্গে যুক্ত হয়ে ক্রমান্বয়ে সকল মরুদ্, ছন্দাদি রশ্মিকে অনুকূলভাবে সক্রিয় করতে করতে সকল কণ, কোয়ান্টা এবং আকাশতত্ত্বকে উপযুক্ত বল ও নিয়ন্ত্রণে যুক্ত করে। এর ফলে সকল লোক তথা অন্তরিক্ষে বিদ্যমান পদার্থ নিয়ন্ত্রিত শক্তিতে যুক্ত হয়ে নিজেদের নিজ নিজ ক্রিয়াগুলি যথাযথভাবে সম্পাদন করতে সক্ষম হয়। এর দ্বারা বিদ্যুৎবলও যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রিত থাকে।
সৃষ্টিতে এই ঋচার প্রভাব— এই ঋচার উৎপত্তির পূর্বে বিশ্বামিত্র ঋষি অর্থাৎ ‘ওম্’ ছন্দরশ্মিগুলি বিশেষভাবে সক্রিয় হয়। এর ছন্দ দৈবী বৃহতী + নিছৃদ্ গায়ত্রী হওয়ার কারণে এর ছান্দস প্রভাব থেকে বিভিন্ন প্রকাশিত কণ বা রশ্মি ইত্যাদি পদার্থ তীক্ষ্ণ তেজ ও বল লাভ করে সংবেদিত হতে থাকে। এর দৈবত প্রভাব থেকে মনস্তত্ত্ব এবং ‘ওম্’ ছন্দরশ্মিরূপ সূক্ষ্মতম পদার্থ থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রাণ, মরুদ্, ছন্দরশ্মি, বিদ্যুৎ-এর সঙ্গে সঙ্গে সকল দৃশ্য কণ বা কোয়ান্টাও প্রভাবিত অর্থাৎ সক্রিয় হতে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় ‘ভূঃ’, ‘ভুবঃ’ এবং ‘সুবঃ’ নামক সূক্ষ্ম ছন্দরশ্মিগুলি ‘ওম্’ ছন্দরশ্মির দ্বারা বিশেষভাবে সংগঠিত ও প্রেরিত হয়ে কণ, কোয়ান্টা, আকাশতত্ত্ব পর্যন্ত প্রভাবিত করে। এর ফলে এ সকলের মধ্যে বল ও শক্তির বৃদ্ধি হয়ে সকল পদার্থ বিশেষ সক্রিয়তা লাভ করে।
এই সময় সংঘটিত সকল ক্রিয়ায় যে যে ছন্দরশ্মিগুলি নিজ নিজ ভূমিকা পালন করে, সেগুলি সকলই বিশেষভাবে উদ্দীপ্ত হয়ে নানাবিধ কর্মকে সমৃদ্ধ করে। বিভিন্ন লোক হোক তারা সূর্যাদি প্রকাশিত লোক অথবা পৃথিব্যাদি গ্রহ বা উপগ্রহাদি অপ্রকাশিত লোক সকলেরই রচনার সময় এই ছন্দরশ্মি নিজ ভূমিকা পালন করে। এর প্রভাবে সমগ্র পদার্থে বিদ্যুৎ ও উষ্মার বৃদ্ধি ঘটে, কিন্তু এই অবস্থাতেও এই ছন্দরশ্মি বিভিন্ন কণ বা কোয়ান্টাকে সক্রিয়তা প্রদান করলেও অনুকূলভাবে নিয়ন্ত্রিত রাখতে সহায়ক হয়। হ্যাঁ, সেখানে ব্যাহৃতিগুলির অবিদ্যমানতা অবশ্যই রয়েছে। এর ষড়জ স্বরের প্রভাবে এই রশ্মিগুলি অন্যান্য রশ্মিকে আশ্রয় দেওয়া, নিয়ন্ত্রণ করা, দমন করা এবং বহন করতে সহায়ক হয়। ব্যাহৃতিগুলির মধ্যম স্বর এগুলিকে বিভিন্ন পদার্থের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে নিজ ভূমিকা পালন করার ইঙ্গিত দেয়।
আধ্যাত্মিক ভাষ্য— (ভূঃ) প্রাণসমূহের থেকেও প্রিয় এবং সকলের প্রাণের আধার, ভূলোকে অর্থাৎ সকল অপ্রকাশিত লোকের স্বামী এবং সৎ স্বরূপ পরমাত্মন্! (ভুবঃ) অপানস্বরূপ অর্থাৎ সকল দুর্গুণ ও দুঃখ দূরকারী চেতনাস্বরূপ পরমেশ্বর! (স্বঃ) ব্যানস্বরূপ অর্থাৎ সমগ্র জগতকে বিভিন্ন প্রকারে ক্রিয়াশীল করানো সকল প্রকাশিত লোকের স্বামী, আনন্দস্বরূপ এবং সকলকে আনন্দ প্রদানকারী জগদীশ্বর! (সবিতুঃ) সমগ্র জগতের উৎপত্তিকারী, সকলকে শুভ কর্মের প্রেরণা দানকারী, সকল লোকের ধারক পরমাত্মার (দেবস্য) সকল দিব্য গুণে যুক্ত, সকল প্রকাশিত লোককেও প্রকাশিতকারী, সকল মানুষকে বেদজ্ঞান প্রদানকারী, সমগ্র সৃষ্টির নিয়ন্তা, সকলের কামনা পূরণে যোগ্য, প্রলয়কালে সকলকে সুপ্ত করানো দেবস্বরূপ পরমাত্মার (তৎ, বরেণ্যম্) সেই বরণীয় সর্বশ্রেষ্ঠ (ভর্গঃ) পাপনাশক তেজকে (ধীমহি) আমরা আমাদের অন্তঃকরণ বা আত্মায় ধারণ করি। (যঃ, নঃ, ধিয়ঃ) যে অর্থাৎ সেই তেজ [ধীঃ=প্রজ্ঞানাম (নিঘ০ ৩।৯), কর্মনাম (নিঘ০ ২।১)] আমাদের বুদ্ধি ও কর্মকে (প্রচোদয়াত্) উত্তমভাবে প্রেরিত করে, অর্থাৎ সেই ঈশ্বর আমাদের সন্মার্গে চলার জন্য প্রেরণা দেন এবং আমরা সেই প্রেরণার অনুসরণ করতে করতে সন্মার্গে চলার সামর্থ্যও লাভ করি এবং সেই মার্গে সদা চলতে থাকি।
এই মন্ত্রটিকে উপাসনার জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বলা হয়েছে, কারণ এতে পরমেশ্বরের স্তুতি, প্রার্থনা ও উপাসনা—এই তিনটিরই সমন্বয় রয়েছে। ‘ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ, সবিতুঃ, দেবস্য, বরেণ্যম্, ভর্গঃ’ এই পদগুলি পরমেশ্বরের গুণাবলির প্রতিপাদন করে; এই কারণেই এগুলি স্তুতিপরক। এই গুণসমূহের কীর্তনের ফলে সাধকের মধ্যে ঈশ্বরের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা ও ভক্তিভাবের উদ্ভব হয়। সকল ব্যাহৃতির চিন্তনের মাধ্যমে সে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডে ঈশ্বরকেই অনুভব করতে শুরু করে। তিনি তাঁকে দুঃখনাশক ও সুখপ্রদাতা বলে জেনে সংসারিক দুঃখ ভুলে আনন্দের অনুভূতি লাভ করেন।
তিনি ঈশ্বরকে সমগ্র সৃষ্টির উৎপাদক ও নিয়ন্তা বলে মান্য করে স্বত্ববোধজনিত অহংকার থেকে মুক্ত হতে শুরু করেন। সেই ঈশ্বরকেই সর্বশ্রেষ্ঠ জেনে তাঁরই সাক্ষাৎকারের কামনা করেন। তাঁর পাপনাশক স্বরূপ স্মরণ করে নিজের অন্তঃকরণের মলিনতা দূর হচ্ছে এমন অনুভব লাভ করেন। এখানে ‘ধীমহি’ পদটি তাঁর উপাসনার দিকেই ইঙ্গিত করে। এই পদের উপর চিন্তনকালে সাধক সেই পরমাত্মার তেজকে নিজের হৃদয়ে অনুভব করেন এবং ‘ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াত্’ এই প্রার্থনামূলক পদের জপের মাধ্যমে তিনি শুদ্ধ বুদ্ধি দান ও তদনুযায়ী কর্ম করার সামর্থ্য প্রার্থনা করেন। এই প্রার্থনার ফলে তিনি ঈশ্বরের প্রতি সম্পূর্ণ সমর্পিত হয়ে সর্বতোভাবে অহংকারশূন্য হওয়ার প্রয়াসে প্রবৃত্ত হন।
আধিভৌতিক ভাষ্য—
এখন আমরা এই মন্ত্রের আধিভৌতিক অর্থের উপর চিন্তা করি—
ভাবার্থ— এখানে ‘ভূঃ’ দ্বারা কর্মবিদ্যা, ‘ভুবঃ’ দ্বারা উপাসনাবিদ্যা এবং ‘স্বঃ’ দ্বারা জ্ঞানবিদ্যা বোঝানো হয়েছে। এই তিন প্রকার বিদ্যার দ্বারা যিনি সম্পূর্ণ, সেই ‘সবিতা’ অর্থাৎ যোগপদার্থের জ্ঞানকে প্রসবিত ও বিকশিতকারী। তিনি দেবগুণে বিভূষিত রাজা, অথবা মাতা–পিতা, উপদেশক, আচার্য কিংবা যোগীপুরুষ যাঁরা গ্রহণযোগ্য ও শ্রেষ্ঠ, এবং যাঁদের তেজ পাপাদি দোষকে নাশ করে। সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বে যজ্ঞ অর্থাৎ সংগঠন, ত্যাগ ও বলিদানের ভাব সমৃদ্ধ করে এমন যে উপদেশ বা বিধান, তাকেই আমরা সকল মানুষ হৃদয়ে ধারণ করি। এইরূপ রাজা, যোগী, আচার্য বা মাতা–পিতা এবং তাঁদের বিধান ও উপদেশ আমাদের কর্ম ও বুদ্ধিকে ব্যক্তিগত, আধ্যাত্মিক, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক উন্নতির পথে সঠিকভাবে প্রেরণা দেয়।
সারকথা এই যে, উত্তম যোগী ও জ্ঞানী মাতা–পিতা, আচার্য এবং রাজা তাঁদের সন্তান, শিষ্য বা প্রজাকে শ্রেষ্ঠ উপদেশ ও সর্বহিতকারী বিধানের মাধ্যমে সকল প্রকার দুঃখ ও পাপ থেকে মুক্ত করে উত্তম পথে পরিচালিত করেন। এইরূপ মাতা–পিতা, আচার্য ও রাজাদের প্রতি সন্তান, শিষ্য ও প্রজারা গভীর শ্রদ্ধাভাব পোষণ করে; যার ফলে সমগ্র পরিবার, রাষ্ট্র এবং বিশ্ব সর্বতোভাবে সুখী হতে পারে।
ধ্যাতব্য— গায়ত্রী-মন্ত্রের সাধনা করেন এবং সন্ধ্যা করেন এমন সাধকের জন্য যোগ্যতা এই যে, তিনি যেন কেবল নিজের বুদ্ধি ও কর্মকে পবিত্র করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকেন; বরং এর সঙ্গে সঙ্গে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে তামসিক প্রবৃত্তিগুলিকে দূর করার জন্যও নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাঁর সর্বদা বুদ্ধিবর্ধক ও সাত্ত্বিক আহার গ্রহণ করা উচিত।
এই গ্রন্থে কেবল মন্ত্রের দেবতার ব্যাখ্যার প্রসঙ্গেই আমরা নয়টি প্রমাণ প্রদান করেছি এবং প্রতিটি প্রমাণের পৃথক-পৃথক অর্থও বাংলায় স্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে। ঋষি-তত্ত্বকে বোঝানোর জন্যও দুটি প্রমাণ দেওয়া হয়েছে এবং সেগুলির অর্থও পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ভাষ্য রচনার ক্ষেত্রেও বহু প্রমাণ ব্যবহার করা হয়েছে এবং সেসবের অর্থ ব্যাখ্যা করা হয়েছে; অথচ মহর্ষি দয়ানন্দ জি এই মন্ত্রের ভাষ্যে কোনো প্রমাণই দেননি।
তবুও কেউ প্রশ্ন করতে পারেন এত প্রমাণ দেওয়ার পরও কি অর্থ স্পষ্ট হয়নি? এর উত্তরে বলা যায়, শুরুতে প্রমাণগুলিকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করার পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে সেই প্রক্রিয়াকে ন্যূনতম করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর কারণ ছিল এই যে, গ্রন্থটি পড়তে পড়তে পাঠক নিজেই ধীরে ধীরে বিষয় বোঝার যোগ্য হয়ে ওঠেন এবং তখন আর নতুন পাঠকের মতো করে সব কিছু আলাদা করে বুঝিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন থাকে না। উপরন্তু, সময়সীমার বিষয়টিও সামনে ছিল।
এখন আমি আপনাদের কাছে একটি প্রশ্ন রাখতে চাই যদি আপনারা আমার স্থানে থাকতেন, তাহলে কী করতেন? আশা করি, আপনারা নিজেদের প্রশ্নের উত্তর নিজেরাই পেয়ে গেছেন।
প্রশ্ন— আপনার এই নিরুক্ত-ভাষ্যের ফলে কি বর্তমানে প্রচলিত গুরুুকুল-পরম্পরা ধ্বংস হয়ে যাবে না? যদি এমন হয়, তবে তার সম্পূর্ণ দায়ভার কি আপনারই হবে?
উত্তর— আপনার এই আশঙ্কা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। গুরুুকুলগুলিকে বেদ ও আর্ষ গ্রন্থসমূহের রক্ষার জন্যই সর্বদা সচেষ্ট থাকা উচিত। আমার এই নিরুক্ত অথবা ঐতরেয় ব্রাহ্মণের ভাষ্যের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে ব্যাকরণবেদ, ছন্দশাস্ত্রের পাদ এবং নিরুক্ত শাস্ত্রই প্রতিষ্ঠিত হবে। যখন গুরুুকুলের আচার্যরা এমন অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন, তখন এই গ্রন্থগুলির প্রতি তাঁদের বর্তমানের তুলনায় অনেক বেশি শ্রদ্ধা জন্মাবে। তাঁদের আত্মবল বৃদ্ধি পাবে।
ভেবে দেখুন, আমি নিরুক্ত-ভাষ্যে কী করেছি। আমি বেদমন্ত্র এবং মহর্ষি যাস্কের বচনগুলির সঙ্গে কোনো রকম ছেঁড়াছেঁড়া করিনি। একটি শব্দেরও কোথাও কোনো ভেদ করিনি। আমি কেবল সেই শব্দগুলিরই আমার নিজস্ব ভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করেছি। আমি অন্যান্য সব ভাষ্যকারদের ভাষ্যও দেখেছি, তাতে নানা প্রকার পাপের বিদ্যমানতাও অনুভব করেছি। এই কারণেই শাস্ত্রগুলির প্রতি সর্বদিক থেকে যে নিন্দা হয়ে আসছে, তার অভিজ্ঞতাও আমি পেয়েছি।
এই কারণেই আমি মধ্যযুগীয় ও বর্তমান ভাষ্যকারদের অনার্ষ পরম্পরাকেই দোষী জেনে তাকে ধ্বংস করার দায়িত্ব অবশ্যই গ্রহণ করেছি। শাস্ত্রের অপমান দেখে আপনার মতো নীরব থাকতে আমি পারি না, কারণ তা করা অপরাধ হবে। তখন আমার সামনে কেবল দুটি পথই ছিল... প্রথমত, আমি আপনার মতোই মধ্যযুগীয় ও আধুনিক ভাষ্যকারদের পাণ্ডিত্যের সামনে নতমস্তক হয়ে সমস্ত পাপের দায় ঋষিদের গ্রন্থ ও বেদসমূহের ওপর চাপিয়ে দিই। এরপর হয় আপনার মতো নীরব থাকি, অথবা এমন করার পর নিজেও তাঁদের সঙ্গে গিয়ে মিশি, যারা দিনরাত বেদাদি শাস্ত্রগুলির ওপর এ রকম ঘৃণিত অভিযোগ আরোপ করে চলেছে এবং যারা দেশ ও ধর্মের জন্য গভীর চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।
শৈশবকাল থেকেই কেবল সত্যের ওপর দৃঢ় থাকার স্বভাবের কারণে আমি যদি এই শাস্ত্রগুলিকে বহু পাপের পোষক মনে করে তাদের সর্ববৃহৎ বিরোধী হয়ে যেতাম, তবে আপনাদের সবার জন্যই আমি সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা হয়ে উঠতাম। যখন আপনারা খ্রিস্টান, মুসলমান, ইহুদি, বৌদ্ধ এবং বামপন্থীদের অভিযোগেরই উত্তর দিতে পারছেন না, তখন আমার সঙ্গে আপনারা মোকাবিলা করতেন কীভাবে?
সৌভাগ্যবশত আমি ঋষি দয়ানন্দকে খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলাম। বেদ ও ঋষিদের বিষয় সম্পর্কে তাঁর গভীর উপলব্ধিও আমি স্পষ্টভাবে বুঝেছিলাম। এই কারণেই এই শাস্ত্রগুলির ওপর কোনো প্রকার দোষারোপ আমি গ্রহণ করতে পারিনি। তাই এই শাস্ত্রগুলির ভাষ্যকাররা—তাঁরা আমার কাছে যতই পূজনীয় হোন না কেন—তাঁদের উপেক্ষা করে, প্রভুপ্রদত্ত জন্মজাত বুদ্ধি ও সত্যপালনের শক্তির ওপর ভরসা করে নিজস্ব পথ নিজেই নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তারই ফল এই যে, আমি এই দুই গ্রন্থ মানবকল্যাণের জন্য উপস্থাপন করতে পেরেছি। এটিই আমার দ্বিতীয় বিকল্প।
এই বিকল্প গ্রহণ করার জন্য আপনার তো আনন্দিত হওয়াই উচিত ছিল যে আমি আপনাকে বিরোধীদের মতো চ্যালেঞ্জ জানানো ব্যক্তি হয়ে উঠিনি। যদি বেদ ও আর্ষ গ্রন্থসমূহকে নিষ্কলুষ ও মহান বিজ্ঞানসমৃদ্ধ বলে প্রতিষ্ঠা করার বিষয়েও আপনার আপত্তি থাকে, তবে তা আপনারই সমস্যা।
কোনো বেদবিরোধী যদি এই কাজের বিরোধিতা করে, তবে তা বোঝা যায়। কিন্তু যে নিজেকে বেদভক্ত ও ঋষিভক্ত বলে পরিচয় দেয়, সে যদি এমন করে তবে তা অত্যন্ত দুঃখজনক ও বিস্ময়কর ব্যাপার।
দুর্ভাগ্যবশত আজ আমাদের মধ্যে প্রত্যেকে নিজ নিজ গোষ্ঠীর বিদ্বানদের মান-সম্মান নিয়েই কেবল চিন্তিত। নিজের পদ, প্রতিষ্ঠা ও ধনের চিন্তাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। যদি ঋষি বা বেদের মান-সম্মান আপনার দৃষ্টিতে সামান্যও গুরুত্ব পেত, তবে বেদাদি শাস্ত্রগুলির ওপর আরোপিত ঘৃণিত অভিযোগ দেখে আপনি গান্ধীর তিন বানরের মতো নীরব থাকতেন না।
আমি আপনাদের সকলকে বলতে চাই আমার গ্রন্থগুলিতে যদি এই ধরনের কোনো অভিযোগের সত্যতা প্রতীয়মান হয়, তবে শুধু তার সমাধানই নয়, আমার খণ্ডনও করুন এর জন্য আমি আপনাকে ধন্যবাদই জানাব। কিন্তু ভিত্তিহীন নিন্দার প্রতি আমি উদাসীনই থাকব।
সবশেষে আপনাদের সকলের কাছে এই করজোড় নিবেদন করছি নিজ নিজ সাথী বা গুরুর মান-প্রতিষ্ঠার চিন্তা পরিত্যাগ করে কেবল ঋষি ও বেদের সম্মান ও প্রতিষ্ঠার কথাই ভাবুন। কারণ তাঁদের প্রতিষ্ঠাই সত্যের প্রতিষ্ঠা, মানবতার প্রতিষ্ঠা; আর সত্য ছাড়া ধর্ম নেই।
এবার আমরা গুরুকুলগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করছি। যখন গুরুকুলে এই ধরনের ভাষ্য পাঠ করানো হবে এবং সেখানে প্রতিভাবান ছাত্ররা আসবে, তখন আমাদের গুরুকুলগুলো এক–দু’জন বেদবিরোধী ব্যক্তির আপত্তির জবাব দেওয়াতেই শুধু সক্ষম হবে না, বরং তাদের কাছে বেদ ও ঋষিদের গৌরবও স্পষ্টভাবে বোঝাতে পারবে। সেই সময় গুরুকুলগুলো বিজ্ঞানীদের কাছেও তীর্থস্থান হয়ে উঠবে, যেমন প্রাচীন কালে হয়ে থাকত।
গুরুকুলের ব্রহ্মচারীরা তারা কেবল বেদপাঠী হোক বা শাস্ত্রসমূহের নিয়মিত অধ্যয়নকারীই হোক সবার মধ্যেই এক ধরনের বৈজ্ঞানিক প্রতিভার জাগরণ ঘটবে এবং তাদের মধ্যে দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের জন্ম হবে। তারা বড় বড় বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যবস্থাপনা সংস্থার মতোই সকলের কাছে আদরণীয় হয়ে উঠবে। এই কারণে আমার কাজের ফলে গুরুকুলের পরম্পরা ধ্বংস হবে না; বরং সেই পরম্পরা বিশ্বজুড়ে সম্মানিত ও প্রতিষ্ঠিত হবে।
-আচার্য অগ্নিব্রত নৈষ্ঠিক জীর লেখা হতে বঙ্গানুবাদ (বেদার্থ বিজ্ঞানম্)
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ