অগ্নিহোত্র থেকে শুরু করে অশ্বমেধ পর্যন্ত শ্রোত্যশাস্ত্রের সংক্ষিপ্ত পরিচয়
যজ্ঞ শব্দের মূল অর্থ— “যজ্ঞ” শব্দটি ব্যাকরণজ্ঞ ও প্রাচীন শাস্ত্রাচার্যদের মতে দেবপূজা ও সংগতিকরণের কাজ সম্পর্কিত। এটি ‘যজ’ ধাতু থেকে উৎপন্ন হয়েছে। সেই অনুযায়ী, যেই কর্মে দেব, ঋষি ইত্যাদি প্রাকৃতিক তত্ত্বের পূজা, যথাযোগ্য গুণ-সংবর্ধন এবং প্রত্যক্ষভাবে দেব বা বিদ্বান ব্যক্তিদের সন্মান ও সংযোজন করা হয়, যেখানে ঘি, সুগন্ধি পদার্থ, অন্ন, জল, বায়ু ইত্যাদি প্রাকৃতিক উপাদান শুদ্ধকরণ বা গুণবর্ধনের জন্য ব্যবহার হয় এবং যা মানুষের কল্যাণ বা উৎকর্ষ সাধনের উদ্দেশ্যে করা হয়—এসব কর্মকে যজ্ঞ বলা হয়।
ঋষি দয়ানন্দ এই অর্থের ব্যাখ্যা করেছেন যজুর্বেদ ভ্র. ১-এর দ্বিতীয় মন্ত্রের ভাষ্যে।
এই মূল অর্থের ভিত্তিতে লোকমুখে “যজ্ঞ” শব্দের বহুবিধ ব্যবহার দেখা যায়। ভগবদ্গীতা ৪.২৬-এ উল্লেখ আছে— দ্রব্যযজ্ঞ, তপযজ্ঞ, যোগযজ্ঞ, স্বাধ্যায়যজ্ঞ, জ্ঞানযজ্ঞ।
যেসব যজ্ঞের আমরা এখানে সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেব, সেগুলো দ্রব্যযজ্ঞ নামে পরিচিত। এর কারণ—এ ধরনের যজ্ঞে দেবতাকে উদ্দেশ্য করে ঘি, অন্ন ইত্যাদি পদার্থ অাহুতির মাধ্যমে উৎসর্গ করা হয়। (কাত্যায়ন ভীঃ ১।২।২)
দ্রব্যযজ্ঞ শাস্ত্রে বহুপ্রকার।
যেসব যজ্ঞের উল্লেখ সাক্ষাৎ ঋগ্বেদ বা ব্রাহ্মণগ্রন্থে পাওয়া যায়, সেগুলোকে ভৌতিকযজ্ঞ (ভৌত্যজ্ঞ) বলা হয়।
যেসব যজ্ঞ ঋষিগণ স্মৃতিতে উল্লেখ করেছেন, সেগুলোকে স্মৃতযজ্ঞ বলা হয়।
গৃহ্যসূত্র অনুযায়ী যজ্ঞও স্মার্ত যজ্ঞের অন্তর্ভুক্ত।
এই দুই প্রকার যজ্ঞের মধ্যে তিনটি নিমিত্তিক ভেদ আছে—
নেত্যিক: যেগুলো যথাসময়ে পালন করতে হয়। যেমন:
১. “যযয়াচযতবিচ্ছপ্রচ্ছরক্ষো নং” (ভ্র. ৩।৩।৬০)—যজ্ঞঃ কসমাৎ? প্রখ্যাত যজতিকর্ম।ঘাত্বার্থ: যজ্ঞ তিন প্রকার—
১) বিদ্যা-জ্ঞান-ধর্মানুষ্ঠান: দেব ও বিদ্বানদের উদ্দেশ্য করে ঐহিক ও পারমার্থিক সুখ, সম্পদ অর্জনের জন্য।
২) পদার্থ-সংমেলন: শিল্পকলা, বিদ্যা, দান-ধর্ম ইত্যাদি বাস্তবায়নের জন্য।
৩) দায়করণ: বিদ্যা, সুখ, ধর্ম ইত্যাদি শুভগুণান্বিত জিনিসের জন্য নিয়মিত দান।
যজুর্বেদ (অ. ১, মন্ত্র ২) এ এই তিন প্রকারের উল্লেখ আছে।
৩. যজ্ঞ প্রায়শই অগ্নিতে করা হয়, তবে কোথাও কোথাও জলাদিতে অাহুতি দেওয়ার বিধান আছে।
উদাহরণ: মপ্সু যুহোতি (কাত্যায়ন শ্রোত্র ১০, ৬২৬)
সপ্তমে পদে যুহোতি (তৈত্তিরীয সংহিতা ৬৩১৪৫)
অগ্নিহোত্র থেকে অশ্বমেধ পর্যন্ত শ্রোত্যযজ্ঞের সংক্ষিপ্ত পরিচয়
যজ্ঞ শব্দের মূল অর্থ— “যজ্ঞ” শব্দটি ব্যাকরণজ্ঞ ও প্রাচীন শাস্ত্রাচার্যদের মতে দেবপূজা ও সংযোজনকর্ম সম্পর্কিত। এটি ‘যজ’ ধাতু থেকে উদ্ভূত। সেই অনুযায়ী, যে কর্মে দেব, ঋষি বা অন্যান্য প্রাকৃতিক তত্ত্বের পূজা, যথাযোগ্য গুণবর্ধন, এবং বিদ্বান বা মহৎ ব্যক্তিদের সম্মান ও সংযোগ সাধন করা হয়; যেখানে ঘি, সুগন্ধি পদার্থ, অন্ন, জল, বায়ু ইত্যাদি প্রাকৃতিক উপাদান শুদ্ধকরণ বা গুণবর্ধনের জন্য ব্যবহার হয় এবং মানুষের কল্যাণ বা উৎকর্ষ সাধনের উদ্দেশ্যে করা হয়—এসব কর্মকে যজ্ঞ বলা হয়।
ঋষি দয়ানন্দ এই অর্থ ব্যাখ্যা করেছেন যজুর্বেদ ভ্র. ১-এর দ্বিতীয় মন্ত্রের ভাষ্যতে।
এই মূল অর্থের ভিত্তিতে লোকমুখে “যজ্ঞ” শব্দের বহুবিধ ব্যবহার দেখা যায়। ভগবদ্গীতা ৪.২৬-এ উল্লেখ আছে— দ্রব্যযজ্ঞ, তপযজ্ঞ, যোগযজ্ঞ, স্বাধ্যায়যজ্ঞ, জ্ঞানযজ্ঞ।
যেসব যজ্ঞের সংক্ষিপ্ত পরিচয় আমরা এখানে দেব, সেগুলো দ্রব্যযজ্ঞ নামে পরিচিত। কারণ—এই যজ্ঞে দেবতাকে উদ্দেশ্য করে ঘি, অন্ন ইত্যাদি পদার্থ অাহুতি হিসেবে উৎসর্গ করা হয়। (কাত্যায়ন ভীঃ ১।২।২)
দ্রব্যযজ্ঞ শাস্ত্রে বহুপ্রকার।
যেসব যজ্ঞের উল্লেখ সাক্ষাৎ ঋগ্বেদ বা ব্রাহ্মণগ্রন্থে পাওয়া যায়, সেগুলোকে ভৌতিকযজ্ঞ বলা হয়।
যেসব যজ্ঞ ঋষিগণ স্মৃতিতে উল্লেখ করেছেন, সেগুলোকে স্মৃতযজ্ঞ বলা হয়।
গৃহ্যসূত্র অনুযায়ী যজ্ঞও স্মার্ত যজ্ঞের অন্তর্ভুক্ত।
এই দুই প্রকার যজ্ঞের মধ্যে তিনটি নিমিত্তিক ভেদ রয়েছে—
নৈমিত্তিক: যেগুলো প্রাকৃতিক সংযোগ বা ঘটনায় উদ্ভূত হয়, যেমন—ধনলাভ বা ধ্বংস ইত্যাদি।
কাম্য: যেগুলো কোনো ব্যক্তির ইচ্ছাপূরণের জন্য করা হয়, যেমন—উত্তম পুত্রলাভ।
নেত্যিক: যেগুলো সময়মতো পালন করতে হয়।
শ্রোত্যযজ্ঞ প্রায় অল্পকালীন বা দীর্ঘকালীন বিভিন্ন কর্মের সংমিশ্রণ। ব্রাহ্মণগ্রন্থ এবং শ্ৰোত্র সূত্রে এ ধরনের যজ্ঞের উল্লেখ পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ—গোপথ ব্রাহ্মণ ১।১।১২-এ ২১ প্রকারের অগ্নিযজ্ঞের বর্ণনা আছে, যা ৩৫৭-২১ প্রকারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত—৭টি পাকযজ্ঞ, ৭টি হাভিযজ্ঞ এবং ৭টি সোমযজ্ঞ।
ঋষি দয়ানন্দ প্রপঞ্চে, সত্যার্থপ্রকাশ, ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকায় উল্লেখ করেছেন—অগ্নিহোত্র থেকে অশ্বমেধ পর্যন্ত যেসব যজ্ঞের উল্লেখ আছে, সেগুলো শ্রোত্যযজ্ঞ।
ব্রাহ্মণ ও শ্ৰোত্র সূত্রে যেসব যজ্ঞের উল্লেখ পাওয়া যায়, তার সংক্ষিপ্ত তালিকা—
গোময়ন (৯০/১৩)
প্রজ্ঞনঘান (ভ্র. ৪)
দশপর্ণমাস (শ্রো. ২-৩-৪)
দাক্ষায়ণ যজ্ঞ (শ্রো. ৪)
প্রাগ্রয়ণেষ্টি (অ. ৪)
দ্বিহোম, ক্রীড়িনীষ্টি, গ্রাদিস্যৈষ্টি
চাতুর্মাস্য (ঝো. ৫)
নিরূঠপশুবন্ধ (ঘ. ৬)
সোমযজ্ঞ (প্র. ৭-১১)
একাহ (গ্র. ১২, ২২)
দ্বাদশাহ (ঝো. ১২)
দ্বাদশাহ সত্ররূপ (ঘ. ১২)
পুরুষমেধ (প্র. ২১)
রাজসুয় (প্র. ১৫)
ভ্রর্ণিচয়ন (১৬-৬৮)
সত্রামণি (ভ্র. ১৯)
প্রাইভসেঘ (প্র. ২০)
প্রহীন অতিরাত্র (গ্র. ২৩)
সত্র [দ্বাদশাহ থেকে সহস্রবৎসর] (প্র. ২৪)
প্রায়শ্চিত্ত (প্র. ২৫)
প্রবায় (৯০/২৬)
কাত্যায়ন প্রাদি ধৃত সূত্রে উল্লিখিত এই যজ্ঞগুলোর মধ্যে কিছুতে পশুযজ্ঞের উল্লেখ আছে।
পশুযজ্ঞের ইতিহাস—প্রাচীন কালে যজ্ঞে পশুহত্যা করা হতো না। পরে মানুষের সমাজে মদ্য ও মাংসের প্রচার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পশুযজ্ঞ শুরু হয়। প্রকৃতপক্ষে, পশুযজ্ঞে পশুকে যূপের কাছে বেঁধে সংষ্কারের পরে মুক্ত করা হতো। অন্য যজ্ঞকর্মগুলি যেমন—ঘি, অন্ন ইত্যাদির অাহুতি যথাযথভাবে করা হতো।
ঋষি দয়ানন্দ ব্রাহ্মণ ও শ্ৰোত্র সূত্রে যথাযথ ব্যবহারকে প্রমাণ মনে করেছেন এবং যেসব ব্যবহার যুক্তি-বিরোধী, বেদ-বিরোধী বা অনুচিত, সেগুলো ত্যাজ্য বলে মনে করেছেন। (দ্রঃ সংস্কারবিধি, ভ্র. শ. শতাব্দী, পৃ. ১৩১, রামলাল কাপুর ট্রাস্ট)
দ্রব্যযজ্ঞের আরম্ভ—ঋষিরা যজ্ঞের কর্ম দেখতে পেয়েছিলেন, সেই কর্ম ত্রেতায়ুগে বিস্তৃত হয়। মুণ্ডক উপনিষদ ১।২।১-এ উল্লেখ আছে—
“তদেতৎ সত্যং মন্ত্রেষু কর্মাণি কবয়ো ইয়ান্যপশ্যংস তানি ত্রেতায়া বহু ঘা সনাতানি।”
মহাভারত ও পুরাণেও ত্রেতায়ুগের প্রারম্ভে যজ্ঞের প্রতিষ্ঠার উল্লেখ আছে। উদাহরণস্বরূপ—ত্রেতায়ুগে যজ্ঞ প্রবর্তন।
যজ্ঞের প্রবর্তনা—প্রাথমিকভাবে কেবল এক অগ্নির একবেদের অগ্নিহোত্র শুরু হয়। পরে ঋগ, যজুর, সাম ও দুই যজ্ঞবেদীদের সঙ্গে সোমযজ্ঞ সম্প্রসারিত হয়। শতপয় ব্রাহ্মণ ৪।৬।৭।১৩-এ উল্লেখ আছে—
“যজুষা হ্যৈ দেবা শ্রগণে যজ্ঞ বিতেনি… যজুষা এও আগ্রে যজ্ঞ।”
পুরাণ-ঋষি ও ভ্রর্ণাচার্যদের মাধ্যমে প্রবর্তিত যজ্ঞের সূচনাও পাওয়া যায়।
সর্বশেষে—কিছু যজ্ঞে প্রথমে ঋষিরা পশুযজ্ঞকে মান্য করতেন না, পরে তা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়। উদাহরণস্বরূপ—মহাভারত শান্তি. ৩১৭, অর্নু ৬।৩৪; ১১৬।৫৬-৫৮ এবং বায়ুপুরাণ ১৭।৯১-১২৫।
যজ্ঞের মূল পরিকল্পনা—প্রারম্ভিক দ্রব্যযজ্ঞ থেকে শুরু করে প্রাধিদেবিক জগতের দেবযজ্ঞ পর্যন্ত, যা ঋষিরা প্রাচীন রহস্যের জ্ঞান প্রচারের জন্য বাস্তবায়ন করেছেন। উদাহরণস্বরূপ—পৃথিবীর স্থানাবলী চিত্রায়ন, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও নাট্যরূপে প্রাচীন ঘটনা প্রদর্শন ইত্যাদি।
যজ্ঞের প্রবর্তনা কখন এবং কেন হয়েছে, তার বিস্তারিত আলোচনা ‘ধৌত-যজ্ঞ-মীমাংশা নিবন্ধ’ (পৃ. ৬৪-১১২)-এ দেওয়া হয়েছে। এখানে শুধুমাত্র সংক্ষিপ্ত সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করা হলো।
অগ্ন্যাধান-নিরূপণ
নিত্য, কাম্য ও নৈমিত্তিক সমস্ত শ্রৌতযজ্ঞ গ্রহণযোগ্য। এগুলো দক্ষিণাগ্নি, শ্রোত্র, গাহুপ্ত্যসংজ্ঞক এই তিন প্রকারে সম্পাদিত হয়। যজ্ঞ শুরু করার আগে এই শ্রোত্রগুলোর পূর্ণ শ্রাধান প্রয়োজন। এটিকে ‘প্রাঘান’ বলা হয়।
অগ্ন্যাধানের কর্তৃপক্ষ—প্রগ্ন্যাধানের গ্রধিকারী হলেন বিবাহিত পুরুষ। কারণ, শ্রোত্রকর্মে যজমান ও তার স্ত্রী উভয়কেই নির্দেশ অনুযায়ী কার্য সম্পাদনের সুযোগ থাকে। পূর্ব মীমাংশার ব্যাখ্যাগ্রন্থে এই বিষয়ে উল্লেখ আছে:
“जातपुत्रः कुणकेशोऽग्नीनादধীত” (গ্রনুপলব্ধমূল)
অর্থাৎ—যার পুত্র জন্মেছে এবং যজমানের চুলে কেশের কাল চিহ্নিত, সে প্রগ্ন্যাধান সম্পাদন করবে। এটি সাধারণকাল নির্দেশ করে।
ভ্রগ্ন্যাধানের সময়কাল—
ব্রাহ্মণের জন্য বসন্ত ঋতু
ক্ষত্রিয়দের জন্য গ্রীষ্ম
বৈশ্যদের জন্য শরৎ
(তেও. ব্রা. ১।১।২।৬)
কাত্যায়ন শ্রৌত ৪।৭।৭-এ বৈদ্যের জন্য বর্ষা ঋতুর নির্দেশ পাওয়া যায়। এই অগ্ন্যাধান উক্ত ঋতুগুলোর যে কোনো শর্মবার্য বা পূর্ণিমার দিনে সম্পাদিত হয়।
রথকারের জন্য বর্ষা ঋতু নির্ধারিত “বর্ষাসু রথকারস্য” (শ্বাপ. ৫।৩।১৮)
শ্রাধানকর্মের তিন প্রকার—কর্ম সম্পাদনের দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রাধানকর্ম তিন প্রকার:
হোমপূর্ব
ইষ্টিপূর্ব
সোমপূর্ব
হোমপূর্ব শ্রাধান—যজ্ঞের পূর্বে প্রগ্ন্যহোত্র শুরু করার আগে যা সম্পাদিত হয়, তাকে ‘হোমপূর্ব শ্রাধান’ বলা হয়। যজমান প্রার্থনা করে পূর্ণিমা রাতে স্ত্রীদের সাথে শ্রাধান সম্পন্ন করে, এবং সেখান থেকে প্রগ্ন্যহোত্র শুরু হয়। সুতরাং সন্ধ্যা ও প্রাতঃকালের প্রগ্ন্যহোত্র একক কর্ম হিসেবে গণ্য হয়।
যজুর্বেদ গ্র. ৩।সং. ৯-১০-এ সন্ধ্যাবেলা, প্রাতঃকালে এবং পরবর্তীতে প্রাতঃকালিক মন্ত্রের পাঠের উল্লেখ আছে।
ইষ্টিপূর্ব শ্রাধান—দর্শপূর্ণ মাসে শ্রাধি বা ইষ্টি সম্পন্ন করার আগে যা সম্পাদিত হয়।
রথকার শব্দের ব্যাখ্যা—শ্রৌতসূত্রের ব্যাখ্যাতাদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। আপাস্তম্ভ শ্রৌত ৫।৩।১৯-এ বলা হয়েছে, ব্রাহ্মণ প্রজাতি নিজেদের অনুযায়ী রথ তৈরি করে। কাত্যায়ন শ্রৌত ১।১১১৮-১১ অনুযায়ী, ‘রথকার’ শব্দটি ভিন্ন এবং মিশ্রজাতের জন্য আলাদা।
মাহিষ্য থেকে করণী পর্যন্ত ‘রথকার’ বলতে বোঝানো হয়েছে:
মাহিষ্য—ক্ষত্রিয় জাতের পুরুষ
করণী—শূদ্র জাতের নারী
(দ্রঃ হক্তাহ্মত. কোট. ৬।৬ পর টীকা)
গ্রাঘান-নিরূপণ
যদি গ্রমাবাস্য বা পূর্ণিমার দিনে প্রাঘান সম্পন্ন করা হয়, তবে তার পরবর্তী পূর্ণিমার দিনই পরবর্তী পূর্ণমাসেষ্ঠি বা দর্শেষ্ঠি অনুষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ দশপুণ্যমাস বা তার শুরুর প্রতিটি গ্রমাবাস্য পূর্ণিমার দিন থেকে পূর্ণমাসেষ্ঠি পর্যন্ত গণ্য হয়। পূর্ণিমাসেষ্ঠি ও শ্রোত্রদুষ্ট মিলিয়ে একক কর্ম হিসেবে ধরা হয়। যদিও যজুর্বেদে সমস্ত শাখাগ্রন্থে প্রথমে পূর্ণিমার মন্ত্র পাঠ হয়, তবু কর্মের বাস্তব সূচনা পূর্ণিমাসেষ্ঠি থেকে গণ্য হয়।
ইষ্টিপূর্ব আধান—দর্শপূর্ণ মাসে ইষ্টি বা শ্রাধি করার আগে যা সম্পন্ন হয়। এই ক্ষেত্রে গ্রমাবাস্য রাত থেকে শ্রোত্রহোত্র সম্পন্ন করা হয়।
সোমপূর্ব আধান—প্রথম সোমযজ্ঞের জন্য পূর্বে যে শ্রাধান করা হয়, তাকে ‘সোমপূর্ব প্রাধান’ বলা হয়। সোমযজ্ঞের সময়কাল বসন্ত ঋতু। সোমপূর্ব শ্রাধানকারী গ্রমাবাস্যকে পূর্বনির্ধারিত ঋতু বা সময়মাপক অনুসরণ করতে হয় না। সোমযজ্ঞের পর একই দিনে সন্ধ্যায় প্রগ্ন্যহোত্র সম্পন্ন করা হয় এবং পূর্ণিমা থেকে পূর্ণমাসেষ্ঠির কার্যক্রম শুরু হয়।
গ্রাঘান সম্পন্ন করার স্বাধীনতা—তিন ধরনের অনুষ্ঠানে যজমান তার ইচ্ছা অনুযায়ী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে। এইসবের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব বা ভিন্নতা নেই।
গ্রাঘান পূর্ববর্তী ক্রিয়াকলাপ—প্রগ্রাঘান পূর্ণিমা বা গ্রমাবাস্য দিনে করা হয়। “যদি চন্দ্রদশা না হয়, সেই দিনে উপবাস পালন করা উচিত”—এই বিধি অনুযায়ী গ্রমাবাস্য দিনের উপবাস সম্পন্ন হয়। পূর্ণিমার দিনে চতুদশী অনুযায়ী উপবাস পালন করা হয়। এখানে উপবাস মানে বিশেষ ধরনের আহার, ব্রাহ্মণ-চয় ও সত্যবাদিতার নিয়ম অনুসরণ।
উপবাসের নিয়মাবলী—
যজমান স্ত্রীসহ উপবাস পালন করে
শিখা (চুলের টিপ বা দণ্ড) ও নখ ছেঁড়া হয়
স্নান শেষে দুই রেশমী পোশাক পরা হয়
স্ত্রী শুধুমাত্র নখ ছেঁড়ে পোশাক পরিধান করে
ব্রাহ্মণচয় অনুযায়ী সত্যব্রত গ্রহণ করা হয়
উপবাসের দিনে আহার—
ব্রাহ্মণ: দুধ
ক্ষত্রিয়: যবাগু (পাক করা চাউল)
বৈশ্য: গ্রামজাতীয় খাদ্য
উপবাসের বিশেষ খাদ্য—
সোলোগুণ পানি দিয়ে সিদ্ধ করা চাউল, যা জল মিশে একাকার হয়েছে, তাকে ‘যবাগু’ বলা হয়।
উবলন্ত দুধে দই মিশিয়ে যে ঘন অংশ তৈরি হয়, তাকে ‘প্রামিক্ষা’ বলা হয়। লোকমুখে এটি পনীর বা ছানা নামে পরিচিত। বাকি জলকে ‘বাজিন’ বলা হয়।
যেটি বলা হয়েছে, তা হলো প্রশ্নন বা ভক্ষণ সম্পর্কিত বিধি ও প্রক্রিয়া।
প্রশ্নন (ভক্ষণ) কার্য
প্রভাব অনুসারে, ব্রাহ্মণ গ্রন্থের বিধি অনুযায়ী, যদি কোনো শ্রোত্রহোত্রে দেবতাদের হবি দেওয়া না হয়, তার প্রশ্নন করা উচিত। বিধি অনুযায়ী নির্ধারিত দ্রব্যের পরিমাণও যথেষ্ট হওয়া উচিত, যাতে খাওয়ার পরও শ্রোত্রহোত্রের সমান অবস্থা থাকে। পৌরাণিক যাজ্ঞিক, সংহিতা, ব্রাহ্মণ ও শ্রৌতসূত্রে উল্লিখিত শ্রাম্যুদয়িক শ্রাধ্যও এভাবে সম্পন্ন হয়।
প্রাধান (প্রারম্ভ) করার জন্য যজমানকে সংकल्प করে ঋত্বিজদের নির্বাচন করতে হয়। গ্রাধ্বয শমি (ছোঁকর বা খেজড়) বৃক্ষের গহ্বরে উৎপন্ন গ্রইভতি (=পোপল) বা সাধারণ ব্রহ্মশক্তির বৃক্ষের শুকনো, ফোড়ানো না হওয়া শাখা থেকে উত্তর শ্রাণি গ্রাধ্ব্য অরণ্যের সম্পাদন করতে হয়। পূর্বে সম্পন্ন শ্রাধানিক কার্য একত্রিত করে গ্রাঘান-স্থানতে আনা হয়।
বেদি ও কুন্ড নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য:
জল
বরাহবিহিত মাটি (সূত্র অনুযায়ী খোদাই করা)
ভল্মোক (=দোমক) বা বাঁশি মাটির মিশ্রণ
ঊষ (=উষার ভূমি) মাটি বা রেং
সিক্তা (=বাস্তব)
শক্রা (=ছোট ছোট কংকর বা রোডি)
হিরণ্য (=সোনা)
এই সমস্ত দ্রব্য আলাদা আলাদা পাত্রে রাখা হয়, যাতে প্রতিটির পৃথক জ্ঞান থাকে। এই দ্রব্যগুলোকে যাজ্ঞিক প্রয়োজনীয়তায় “সম্ভার” বলা হয়।
বানস্পতি সম্ভার:
গ্রইভতি
উদুম্বর (=গুলার)
পলাশ
শমো
বিকঙ্কত
ব্রশনি (+বিজলোর অংশ) থেকে দগ্ধ কাঠ
পদ্মপত্র
এগুলোও একত্রে পৃথকভাবে সংরক্ষিত হয়।
বেদির অবস্থান:
পশ্চিমে: গাহুপতী শ্রাগ্নির জন্য
পূর্বে: ব্রাহ্মণীয় শ্রাগ্নির জন্য
দক্ষিণে: দক্ষিণাগ্নির জন্য
ব্রাহ্মণ গ্রন্থ ও শ্রৌতসূত্র অনুযায়ী, প্রতিটি জন্য আলাদা ঘর নির্মাণের বিধি রয়েছে। তবে বর্তমানে যাজ্ঞিক সুবিধার জন্য চারটি ঘর একটি ছাদের নীচে স্থাপন করা হয়। এই চারটি শ্রাগ্নির স্থাপনায় গ্রতিষট সস্য শ্রাগ্নি উপযুক্তভাবে স্থাপন করা হয়।
যেখানে সম্যাগ্নি বসে শিষ্যকে পাঠ করায়, সেখানে গুরু শিষ্যের স্থাপন করেন। শ্রাবসত্য প্রাগ্নিতে গৃহ্যসূত্র অনুযায়ী সংস্কার সম্পন্ন হয়। শ্রাপ (শ্রৌত ৫।৪।৭-৮) অনুযায়ী, সম্যাগ্নি প্রাহবানীয়াগ্নির পূর্বে সম্পন্ন করা হয়।
উল্লেখযোগ্য নির্দেশাবলী:
ব্রাহ্মণদের জন্য পায়ো (দুধ), ক্ষত্রিয়দের জন্য যবাগু, বৈশ্যদের জন্য প্রামিক্ষা বা যেসব খাবার প্রয়োজন।
যাজ্ঞিক কার্য সম্পাদনীর পূর্বে উপবাস পালন।
যাদের দেবতারা হবি গ্রহণ করে না, তাদের জন্য শ্রাদ্ধ সম্পন্ন করা।
অশিষ্ট বা অশুদ্ধ হবি থাকলে তা গ্রহণ করা উচিত নয়।
মাঙ্গলিক কর্মের জন্য যে শ্রাধ্য করা হয়, তাকে গ্রাম্যুদয়িক বলা হয়।
যজমান নির্দেশ দিলে তার স্ত্রীও সমন্বয় থাকতে হবে।
উভয় শ্রাধ্য পদার্থের পরিমাণ ও প্রাকারের চিত্র সংস্কারবিধিতে দেখা যায় (পৃষ্ঠা ২৬, গ্রন্থ শতাব্দী সংস্করণ, রামলাল কপুর মুদ্রিত)।
দ্রব্যসম্ভার (১-৬): জল, হিরণ্য, ঊষ, শ্রাখুকীরিশ (=চুहे খোদাই করা মাটি), মোর শর্করা—এই পাঁচটি দ্রব্য। বিভিন্ন শাখায় দ্রব্যসম্ভারের পরিমাণে কিছু পার্থক্য দেখা যায়।
এরপর ক্ষোম বস্ত্র ধারণ করা যজমানকে শ্রাধ্য ত্রয়ী উভয় শ্রাগ্রনিতে দেওয়া হয়। প্রধ্বয় প্রপালহ আর্ণিয় থেকে মন্ত্রন করে, শ্রেয়ব ওয়েইকুল, প্রযব মহানস, শ্রেয়ব চাষ্ঠু (ভাড়িভূজে ভাড়া), প্রযব ঝোপাসন (প্র্রাবসথ্য) থেকে প্রগ্নি নিয়ে গাহুপতিতে স্থাপন করা হয়, জ্বালিয়ে তার উপর ব্রহ্মোদনের পাক করা হয়। এই চার শারাবে (সকোরে) প্রয়োজনীয় চালের পরিমাণ, প্রযব চারজন মানুষের খাওয়ার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে স্থালিতে (বটলোই বা পাতোলে) রান্না করা হয়। ব্রাহ্মণ ঋত্বিজদের জন্য রান্না করা চালে ‘ব্রহ্মোদন’ বলা হয়।
ব্রহ্মোদন পাক হয়ে গেলে প্রগ্নি থেকে নামিয়ে, মধ্যভাগে গম করে তাতে ঘি ঢালা হয়। সেই ঘিতে পোপলকে তিন সমিঘায় ভিজিয়ে সমিবারিত করে, সুশমিদ্ধায় প্রৌর তা স্থাপন করে। তিন ঋচাশ্রয় থেকে এক এক সমিধা প্রগ্নিতে ফেলা হয় এবং চতুর্থ মন্ত্রের জপ করা হয়।
এরপর ব্রহ্মোদন চার ভাগে ভাগ করে চার ঋত্বিক তা ভক্ষণ করেন। যজমান ঋত্বিজদের জন্য বর প্রেরণ করেন—গো প্রভৃতি দ্রব্য। ব্রহ্মোদনের পাক রাতের সময় করা হয়।
এইভাবে প্রাঘানের পূর্বে ছুটি সম্পন্ন করে, এক বছর বা বারো দিন পর পুনরায় কার্য সম্পন্ন করা হয়। যারা সরাসরি কার্য সম্পন্ন করতে চায়, তারা পরের দিন অবশিষ্ট কার্য সম্পন্ন করে। এই ক্ষেত্রে পূর্ব রাতের সময় যজমান ব্রত গ্রহণ (নিয়ম স্বীকৃতি) করে বীণা ইত্যাদি বাদ্যের আওয়াজে জাগরণ করে, শ্রৌর আগুনকে প্রক্ষেপের মাধ্যমে অব্যাহতভাবে জ্বালিয়ে রাখে।
প্রাতঃকাল একই প্রগ্নিতে প্ররণি তাপ দেওয়া হয় এবং পূর্বোক্ত প্রগ্নি জ্ঞান করে যজমানের হাতে প্ররণি দেওয়া হয়। এরপর প্রধ্বয়ু গাহুপ্তি স্থানের খনন, জল সিঞ্চন প্রভৃতি করে পূর্বে স্থাপিত বরাহবিহিত মৃত দ্রব্যকে দুই সমান ভাগে ভাগ করে, এক ভাগকে পুনরায় দুই ভাগে ভাগ করে। তারপর প্রাঘানের অংশকে গ্রাষী বরাহবিহিত মৃত, বল্মীক মৃত, ঊষ, সিক্তা, শক্রা ক্রমান্বয়ে গার্হপস্পায়নত স্থাপন করা হয়। এর উপরে হিরণ্য রাখা হয়। এইভাবে প্রবিষ্টকে পশ্চিমাগ্নির প্রান্তে রাখা হয়। প্রবিষ্ট শ্রাঘা অংশ (সমস্ত দ্রব্যের শ্রাধা) প্রাহবানীয় প্রান্তে স্থাপন করা হয়। একইভাবে তিন স্থানে পূর্বোক্ত সাতটি বনস্পতি কাঠ ক্রমান্বয়ে রাখা হয়।
গাহুপত্যাধান:
তিনটি গ্রাগ্নির স্থানে পূর্বোক্ত সম্ভারগুলো ক্রমান্বয়ে রাখা হয়।
যজুর্বেদের ভ্র ৩-এর ১-৪ পর্যন্ত ক্রমশঃ সমিধাগ্নিম, সুশমিদ্ধায়, তন্ত্বা সমিধিবৃদ্ধ প্রণয়িত চার মন্ত্র পাঠিত হয়। প্রথম তিনটি মন্ত্র থেকে সশিতের আধান হয়, চতুর্থ মন্ত্রের জপ করা হয়—“তিল্লঃ সমিঘো ঘৃতাওতা প্রাদধাতি সমিধাগ্নি” ইত্যাদি প্রতিউত্তর হয়। (কাত্যায়ন শ্রোত ৪।৮।৩৪)
পক্ষান্তরে দ্বিতীয় বা (কাঃ থোত ৪৮৫) থেকে দ্বিতীয় সুশমিদ্ধায় ঋচা জপ, এবং প্রথম তৃতীয় চতুর্থ মন্ত্র থেকে—
গার্হপত্যাগ্নির প্রধানের জন্য পূর্বের বৃভাই আগুনের শহরকে দৃঢ়ভাবে স্থাপন করুন এবং তার ওপর প্রজ্বালনের জন্য পর্যাপ্ত সমিধি রাখুন। একই স্থানে একটি সাদা প্রশ্ন (দণ্ড) বেঁধে রাখুন। এরপর অধ্যায় চরণ মান্থন করুন। সन्धন (ঘর্ষণ) থেকে আগুন উৎপন্ন হলে তা শুকনো কাণ্ডে নিয়ে ফুঁক দিয়ে প্রজ্জ্বলিত করুন। এটি বেদি পশ্চিমাংশের গার্হপত্য কুন্ডে স্থাপন করুন। আগুন উৎপন্ন হলে যজমানকে অম্ব্যু (পানি) প্রদান করতে হবে। গার্হপত্য কুন্ডে প্রাপ্তি স্থাপন করার পর ব্রহ্মা, রসস্তর, সামের গান করা হয়, তবে প্রথমে নয়।
আহবনীয়াধান গ্রাহবনীয়ের প্রাধান গ্রুপ ০ ধীত ৫১১৩ অনুযায়ী সূর্যোদয়ের সময়ে বলা হয়েছে। সাহবনীয় প্রাপ্তির প্রধানের জন্য পালাশ প্রভৃতি বৃক্ষের এক হাত সমপরিমাণ ১৮ বা ২১ সমি বেয়ে “ইষ্ম” তৈরি করা হয় এবং কুশ দিয়ে বাঁধা হয় (কার্য ০ মৃত্যু ১১৩১ ১৪-১৮)। এই ইষ্মগুলোকে গার্হপত্যাগ্নি থেকে প্রজ্জ্বলিত করে সাহবনীয় শক্তির উদ্ধৃতি করা হয়। এই সময় ব্রহ্মা, বামদেবী ও সাম গান করে।
গার্হপত্যের পাশে রাখা প্রশ্নকে গাড়্যনীয়ের কাছে এবং সাহবনীয়ের উত্তরে প্রাঙ্গ মুখের দক্ষিণপাদ থেকে বহ্যস্থ স্থানে হিরণ্যাদি সম্ভারগুলি প্রতিকামী (লংঘন) করে পূর্বদিকে নিয়ে যায় এবং দক্ষিণ ছোর থেকে ঘুরিয়ে পশ্চিমমুখীভাবে দাঁড় করায়। এই সময় ব্রহ্মা বৃহৎসামের মান গ্রহণ করেন। প্রধান অবস্থানে দক্ষিণের পাশে থাকা শ্রাহমনীবতী সম্ভারের উপরে পেরের চিহ্নকে দুইবার ইষ্মস্থ প্রগ্নি দিয়ে স্পর্শ করানো হয় এবং তৃতীয়বার স্পর্শের সঙ্গে ভূর্ভুবঃস্বঃ মন্ত্রের জপ করে ধাম্ম স্থাপন করা হয়।
যজমান সাহবনীয়ের পূর্ব থেকে এসে পশ্চিমমুখে বসে স্থাপন করা হয় এবং দৃষ্ট্যের পূর্বার্থে হাতে সমিধি ধান করা হয়। দ্বিতীয় ঋচা জপও গ্রস্তে হয়, মধ্যমে নয়। এটি ব্যাখ্যাকারদের মত।
সংস্কারবিধিতে সমিধাগ্নিম্ ইত্যাদি তিনটি পরিচয় থেকে পূর্বে ইষ্ম আত্মা মন্ত্রও সমিধি ধানে ব্যবহার হয়। পর্ণাতেও তিনটি সচিগায়ে ধৌর নারের মন্ত্র নির্দেশিত আছে। এই প্রক্রিয়ার ভাষা অনুযায়ী, রিশি দयानন্দ সমিধারিণ মন্ত্রের জপকে মান্য করেন। এই পক্ষের ক্ষেত্রে যখন ‘সমিধাগ্নি’ মন্ত্র থেকে সমিধির আধান হয় না, তখন ‘স্বাহা’ এবং ‘ইভমগ্ন্যয়ে ইভ ন সম’ পাঠও ব্যর্থ হয়, তাই উচ্চারণ করা উচিত নয়। প্রকৃতিতে তিনটি সমিধি পার্থিব, মাস্তরীক্ষ ও চুষ্ট প্রগ্নিকে উদ্দেশ্য করে দেওয়া হয়। সুতরাং, যজ্ঞকর্ম ও যজুর্বেদের মন্ত্রক্রম অনুসারে সমিধাগ্নিম্ সুশমিদ্ধায়, মোর বা সমিদ্ধ এই তিন মন্ত্র থেকে হয়।
পার্থিব আগুন, পরন্তু ক্ষত্রিয়, জাত্যবেদা প্রগ্নি এবং চ্য সোলকল্প প্রাজ্ঞির আগুনের জন্য সমিতি-প্রক্ষেপ ব্যবহৃত হয়। আঃ শ্রোতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের জন্য গায়ত্রি, ত্রিষ্টুপ ও জগতি উন্ডস্ক—প্রত্যেকে তিনটি ঋচা দিয়ে সমিধি ধান করা হয় (গ্র. প্রাপ. ৫১৬।২)।
১. ‘যজতত্ত্বপ্রকাশ’ অনুযায়ী মাহবনীয় স্থানের পূর্বদিকে পশ্চিমমুখী অবস্থানে থাকা অশ্ব থেকে প্রায়নীয় স্থানের নির্দেশ করা হয়। অর্থাৎ ব্রহ্মনীয়কে লংঘন করে পশ্চিমে পৌঁছানো, এমন ব্যবস্থা করা হয়।
২. পাপ০ শ্রৌত ১৪১৩৭৫ অনুযায়ী সাহবনীয় স্থানের দক্ষিণ বিদ্যায় থাকা ব্রহ্মা রথের চক্র তিনবার ঘোরানো হয়।
দ্যৌরিভ ভূম্না মন্ত্র পাঠ করে এবং আয়, গো প্রভৃতি সাপরাজী ঋচা দ্বারা ধ্রাগ্নির উপস্থান করুন।
দক্ষিণাগ্নির আধান—দক্ষিণামের প্রধানে বিকশিত হয়। এটি হয়—মাহপর্যাগ্নি থেকে অসুস্থ স্বাদের কার্ড দ্বারা ধ্রাগ্নি উদ্ধৃত করে, অথবা অন্য বাণ্ড্যাবি কুর থেকে প্রাপ্তি গ্রহণ করে, অথবা আগ্নির মঞ্চন করে দক্ষিণাগ্নির খণ্ডে পূর্বে স্থাপিত অংশের উপরে আগ্নি স্থাপন করে। দক্ষিণাগ্নির যোনি (ধানমনস্থান) বিকল্প হলে এটি অনিত্যও বলা হয়।
সভ্যাগ্নির আধান—সধ্যাস্তির প্রধান সারণী থেকে প্রাপ্তি বা লোকফিক আগ্নি দ্বারা করা হয়। কাত্যায়নের মত অনুযায়ী (শ্রোত ৪৯৩১৮) ভরণি-মান্থন থেকেই সম্যাগ্নির আধান বলা হয়। যেখানে শিক্ষার্থীদের পাঠ করানো হয়, সেখানে সভা শাস্ত্রার্থ-ভিচার করা হয়, সেটিই ‘সভা’। সভায় হওয়া আগ্নি সভ্যাগ্নি বহন করে। (যজ্ঞতত্ত্বপ্রকাশ, পৃ. ৬) সাধনাচার্য ব্রাহ্ম ২০১১১০ ভাষ্য অনুযায়ী—‘যেখানে জुवा খেলা হয়, সেই সভায় ধ্রাগ্নি সম্যাগ্নি বলা হয়।’
আবাসধ্যাগ্নির আধান—আয়াবাসধ্যাধান দারকাল, দায়াদ্যকালে বা (পার। গৃহ্য ১।২।১-২) কথন অনুযায়ী বিবাহের সময় আয়াবাসধ্যাধান করা হয় বা দায় ভাগের বণ্টনের পর। যদি এই সময়েও আধান না করা হয়, তবে শতাগগীর আয়ামকালে করা হয়। এটি বৈশ্যকৃত প্রাপ্তি দ্বারা সাকার করা হয়।
[বাধানে ‘আপঃ’ থেকে ‘হিরণ্য’ পর্যন্ত সম্ভার এবং বিভিন্ন বনস্পতি কাঠের স্থাপন, ঘরণি থেকে প্রশ্নের মধ্যন, প্রশ্নের জ্ঞানধন ও সুরের সম্ভার চিহ্নিত করার উদ্দেশ্য রয়েছে। এর ব্যাখ্যা সাধারণ কর্মের প্রসঙ্গে দেওয়া হবে।]
পূর্ণাহুতি—ধর্ম্মীদের সঙ্গে ১২ সার ঘৃৎ ব্যবহার করে যুগ্মভাবে পূর্ণাহুতি সম্পন্ন করতে হয়, সপ্ত আগ্নি সমিঘসহ সপ্ত জিহঃ মন্ত্র দ্বারা পূর্ণাহুতি করা হয় (৮০ শাপ০, শ্রীত শ্র' ৮ ১)। কাত্যায়ন শ্রৌতে পূর্ণাহুতি মন্ত্র নির্দিষ্ট নয়, তবে যজমান দ্বারা অন্বারণ্য আধ্যায়ে পূর্ণাহুতি দেওয়ার বিধান আছে (ব্রাহ্মণ-ফাত্যা০, ভৌত ৪.৪১৫)। এই পূর্ণাহুতি দ্বারা ঘরধান কর্ম সমাপ্ত হয়।
পবমান ইষ্টি—সমস্ত ধরীর সমান অনুসারে তিনটি পবমান ইষ্টি হয়, এগুলিকে তনুহুভিয়ানও বলা হয়। প্রথমের ইষ্টির আগ্নি দেবতা, দ্বিতীয়ের ধ্রাগ্নি পবক, এবং তৃতীয়ের প্রাপ্তি শুচি। এগুলির প্রাসঙ্গিক পুরোদাক্ষ দ্রব্য নির্দিষ্ট। এগুলো প্রধানের দিনে একসঙ্গে করা হয়। কাত্যায়ন ভৌত ৪১১০১৫-৬ অনুযায়ী পবমান ইষ্টি দুটি—প্রথম: প্রাপ্তি মচমান দেবতাবালি, দ্বিতীয়: আগ্নিয়াবক ও আগ্নিশুচি দুটি দেবতা পালি। পবমান ইষ্টির পরে প্রাদিত্যেষ्टि হয়। এতে অবস্থান দেবতা এবং চর দ্রব্য নির্ধারিত।
১. ‘যজ্ঞতত্ত্বপ্রকাশ’ অনুযায়ী দক্ষিণারিতের সমাধান গার্হপত্যের পরে সর্ধীদিত সূর্যকালে নির্ধারিত। লেখন বা মুদ্রণ ত্রুটির কারণে বাহবনীয় ও দক্ষিণারিতের সঙ্গে বিভ্রান্তি হয়েছে।
২. পবমান ইষ্টিতে প্রথম দর্শনের দেবতাই প্রধান, তবুও সবকেই পবমান ইষ্টি নামে বাশিক সম্প্রদায়ে গ্রহণ করে।
পবমান দর্শন এবং আদিত্যেষ্ঠির প্রকৃতি দর্শপূর্ণমাস। এই কারণে সূত্রকাররা প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী, প্রাকৃতিক বর্ষের পূর্ণিমা থেকে এই ইষ্টিগুলিতে সমস্ত বম প্রাপ্ত হবে বলে ধরে এই দর্শনের সাধারণ নির্দেশনা দিয়েছেন।
আধান এবং পবমান ইষ্টিগুলির প্রঙ্গাঙ্গিভাব পদমানে ইষ্টিগুলি প্রধান কর্মের অংশ, এমন মত ভট্টকুমারিত। যদাহবনীয়ে জুহুতি—এই স্বাধীন পদ্ধতিতে পবমান ইষ্টিগুলির প্রান্যংগত্ব বিধান অনুযায়ী আধানের সমান, তাই পবমান ইষ্টিগুলিও আগ্নিকে সম্পাদক, এমন মত শবরস্বামী।
ভট্টকুমারিতের মতে, সাংগকর্মেরই ফলজনক হওয়ায়, পবমান ইষ্টির অনুষ্টানের পরে গার্হপত্য আগ্নির সিধি হয়। সুতরাং, পদমানে ইষ্টির পরে প্রাগ্নিহোত্রের প্রারম্ভ হয়। মীমাংসাভাষ্যকারের মতে, আধান এবং পদমানে ইষ্টির প্রঙ্গাজ্ঞভাব নেই, বরং পবমান ইষ্টিগুলিও আধানের সমতুল্য এবং শাহবনীয় ইষ্টিগুলির সম্পাদক। তাই দুইটির সমষ্টি হয়। এই দিক থেকেও পবমান ইষ্টি না হলে সাহবনীয় অবিত্ব সম্পন্ন হয় না, তাই পবমান ইষ্টির পরে প্রাগ্নিহোত্র শুরু হয়।
আপস্তম্ভ কোটসূত্রে প্রধান এবং পবমান ইষ্টির জন্য পৃথক দক্ষিণা উল্লেখ আছে।
দক্ষিণা—আপস্তম্ভ শ্রৌতে, প্রত্যাধানের জন্য বস্ত্র, রথ, গো প্রভৃতি পৃথক দক্ষিণার বিধান আছে এবং পবমান ইষ্টির জন্য ১০০ গুঞ্জা (রতি) সোনার দক্ষিণা নির্ধারিত। প্রথম দুই দর্শনের ৩০+৩০ গুঞ্জা এবং তৃতীয়ের ৪০ গুঞ্জা হিসেবে বিভাজন করা হয়েছে, মোট ১০০ গুঞ্জা। কাত্যায়ন খোতে দুই পদমানে ইষ্টির জন্য ১+৩-৬, বা ৬+৬-১২, বা ১২+১২=২৪ গাওয়ের দক্ষিণা লেখা আছে। বেশি হলে অতিরিক্ত দেওয়ার বিধান আছে। এটি ন্যূনতম এবং সর্বাধিক একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা ধরা হয়েছে।
আদিত্যেষ্ঠির জন্য এক গরু (যা সব সময় দুধ দেয়) দক্ষিণা।
দক্ষিণা সম্পর্কিত ঋষি দয়ানন্দের মত—দয়ানন্দ কাত্যায়ন ধীত গ্রহণ করেছেন। ফাত্যায়ন শ্রৌতে ৬, ১২, ২৪ সংখ্যাকে বিভাজ্য হিসাবে, অর্থাৎ দুই ইষ্টির সম্মিলিত গরুর সংখ্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। দয়ানন্দ স্বামী আদিত্যেষ্ঠির দক্ষিণা সম্পর্কে বলেন—
“অগ্ন্যাধেয় দক্ষিণার্থে চতুর্বিশপক্ষে ৫৯ গরু, দ্বাদশপক্ষে ৫৫, ষট্পক্ষে ১৩। সব ক্ষেত্রে আদিত্যেষ্ঠির ধেনু।” (সংস্কারবিধি, পৃ. ২৪, প্রা. স. ৩০ সং., রালাফটু)
এখানে দয়ানন্দ রিষি কাত্যায়নের ৬, ১২, ২৪ সংখ্যাকে এক-এক দর্শনের দক্ষিণা ধরে দুই দর্শনের ১২, ২৪, ৪৮ গরুর দক্ষিণা স্বীকার করেছেন। এই ১২, ২৪, ৪৮-এ ভূপসি বিধিত গরুকে শরীর গণনা করে তিনি ২৪-পক্ষে ৪১, ১২-পক্ষে ২৫ এবং ৬-পক্ষে ১৩ গরু দক্ষিণা লিখেছেন। আদিত্যেষ্ঠির ধেনু।
১. যশতত্ত্বপ্রকাশ, পৃ. ৭, টি. খ।
২. কাত্যায়ন শ্রৌতে দুটি পবমান ইষ্টি মেনে নেওয়া হয়েছে।
৩. অজমের মুদ্রিত পাঠে “আদিত্যেऽটি ধেনু” লেখা আছে, যা ভুল পাঠ। সংস্কারবিধির দুই হস্তলিখনে আদিত্যেষ্ঠির ধেনু পাওয়া যায়। লেখকপ্রমাদে ‘৫’ চিহ্ন লেখা হয়েছে, যার কারণে পাঠে বিভ্রান্তি।
একবচনান্ত “ধেনু” ব্যবহারের কারণে আদিত্যেষ্ঠিতে একটি ধেনুর দক্ষিণা গ্রহণ করা হয়েছে। কাত্যায়নেরও একই মত।
সংস্কারবিধির প্রধান প্রকরণ—সংস্কারবিধি গ্রন্থ মূলত গৃহ্যকর্ম সংক্রান্ত সংস্কারগুলির জন্য রচিত। পুনরায়, এই গ্রন্থের সাধারণ প্রकरण শ্রীতযজ্ঞকে লক্ষ্য করে সংকলিত। এটি বছরের পূর্ণিমা মাসের पात्रের চিহ্ন বা চিত্র এবং প্রধান প্রক্রণর দক্ষিণা নির্দেশ থেকে সুস্পষ্ট। তাই সংস্কারবিধির প্রধান প্রক্রণ সম্পর্কে এই দৃষ্টিতে চিন্তা করা উচিত। আমাদের মতে, সংস্কারবিধির প্রধান প্রক্রণ হলো শ্রৌত ও গৃহ্যসূত্রযুক্ত অরণ্যাধানের সংক্ষিপ্ত এবং সম্মিলিত রূপ।
ধীতসূত্র অনুসারে তিনটি পবমান ইষ্টিতে ভিন্ন ভিন্ন দেবতা আছেন। এখানে তিনটির জন্য একটি আগ্নি পবমান দেবতা। প্রাধিরবেশ্ঠির স্থানে প্রজাপত্যাহুতি। চারটি ঘৃতাহুতি এবং ‘ত্বন্নোঅন্নে’ ইত্যাদি আটটি আহুতি গৃহ্যাধান অনুযায়ী। সংস্কারকর্মের দৃষ্টিতে এখানে একটি কুন্ডই নির্ধারিত।
দ্রব্যময় যজ্ঞের আধিদৈবিক সৃষ্টি-যজ্ঞের সঙ্গে তুলনা—
‘বৈদিক-সিদ্ধান্ত-মীমাংসা’ এবং মীমাংসা-শবরভাষ্য-ব্যাস্যের প্রথম ভাগে উল্লেখ করা হয়েছে যে, অধ্যাধান থেকে সহল-সংবৎসরসাধ্য পর্যন্ত যেসব যজ্ঞ হয়, যা এই ব্রহ্মাণ্ডে পৃথিবীর রচনা থেকে শুরু করে দেব বা আসুর যজ্ঞ পর্যন্ত, সেগুলি মুনিদের কল্পনায় সৃষ্টি। ওদের দ্বারা সরাসরি বোঝার জন্য রচিত।
বেদে উল্লিখিত যজ্ঞগুলো আধিদৈবিক। দ্রব্য-যজ্ঞের সরাসরি বিধান বেদে নেই। আধিদৈবিক যজ্ঞের জ্ঞান প্রদানের জন্য, মুনিদের কল্পনা অনুযায়ী উদ্যমযজ্ঞে সাম্য থাকার কারণে সেই বিধানমন্ত্রগুলোর ব্যবহার দ্রব্য-যজ্ঞে যথাযথভাবে করা হয়েছে।
এই তত্ত্ব বোঝানোর জন্য পার্যায়ানর্মেবিনির্মাণ এবং ভ্রমণ্যাপন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পৃথিবী-নির্মাণ এবং তার তলে আগ্নির প্রথম উৎপত্তি সঙ্গে তুলনা দেখানো হয়েছে। এটি আমাদের কল্পনা নয়, বরং বৈদিক গ্রন্থে প্রদত্ত সাম্য।
বেদি নির্মাণ সংক্ষিপ্ত বিবরণ:
প্রথমে, যজ্ঞের জন্য ভূমি পরিদর্শন।
মাটি খুঁড়ে অপদ্রব্য, ঘাস বা ফোঁসের মূল অপসারণ।
এরপর ক্রমশ নিম্নলিখিত কাজ:
১. জল সিঞ্চন।
২. বরাহ-হস্তচালিত মাটি বिछানো।
মুদ্রণকালে “ধেনু” একবচনান্তকে ভুলক্রমে বহুবচনান্তে রূপান্তর করা হয়েছে। “অষ্টো” ভেঙে বাক্যটি অর্থহীন হয়ে গেছে।
৩. দিমকের বাঁবুর মাটি বিছানো হয়। এরপর—
৪. উষর ভূমির মাটি (পাঞ্জাবি: রেহ) বিছানো হয়। এরপর—
৫. সিকতা (বালি) বিছানো হয়। এরপর—
৬. শক্রা (ছোট ছোট কঙ্কর বা রোড়ি) বিছানো হয়। এরপর—
৭. ছয়টি টোকা (সাম্ভার) বিছানো হয়। এরপর—
৮. সোনা রাখা হয়। এরপর—
৯. সমিধা (অগ্নিসামগ্রী) রাখা হয়। এরপর—
১০. অশ্বত্থ (পিপল) গাছের দুই কাঠের শরণি তৈরি করে ঘষে আগুন উদ্ভূত করে সমিধার উপর স্থাপন করা হয়।
পৃথিবী সৃজন প্রক্রিয়া ও বেদি-নির্মাণের সাম্য:
অগ্ন্যাধানে বেদি নির্মাণের প্রক্রিয়ায় যে ধাপগুলো অনুসৃত হয়, সেগুলো হিরণ্যগর্ভক্য মহাদণ্ড থেকে পৃথক হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন অবস্থার মাধ্যমে আগ্নির প্রথম উৎপত্তি পর্যন্ত পৃথিবীর পরিবর্তিত অবস্থার প্রতিফলন ঘটায়। বেদই স্পষ্টভাবে এই সাম্য দেখায় “इयं वेदिः परो ग्रन्तः पृथिव्याः' (यजु० २३।६६ )।
শতপথ ব্রাহ্মণ এই সময়কে ৬ ভাগে বিভক্ত করে নয় প্রকারের সৃষ্টি বর্ণনা করেছে, যেমন—
“স শ্রান্তস্তেপানঃ ফেনমসৃজন … স শ্রান্তস্তেপানি মৃদ শুষ্কাপমূপং সিক্ত শর্করা প্রাশ্মানঃ শ্যোহিরণ্যং ঔষধি-বানস্পত্যসৃজন। তেনমাং পৃথিভী প্রাচ্ছায়েদত।” शत० ६।१।१।१३॥
নয় প্রকারের সৃষ্টির মধ্যে ফেনকে প্রধান ধরে বেদি-নির্মাণ প্রক্রিয়ায় তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
বেদি-নির্মাণ ও পৃথিবীর বিভিন্ন অবস্থা:
১. প্রাথমিকভাবে পৃথিবী ছিল জলময় “আপো হ বা ইটমেংগ্র সলিলমেওয়াস” (ইতপয় ১১।৬।১।২)। এই অবস্থার জন্য বেদিতে জলসিঞ্চন করা হয়।
২. বেদি সংযোগে জলতে ফেনা উৎপন্ন হয়, যেমন দুধ গরম করলে ফেনা তৈরি হয়। এই ফেনা বায়ুর সংযোগে ঘনত্ব পায় এবং মৃদুভাব (দৃঢ়তা) তৈরি হয়। যেমন দুধের উপর মাখন জমে।
৩. মৃদের উৎপত্তিতে সূর্যের আলোর বিশেষ ভূমিকা আছে। সূর্যের প্রাঞ্জিরস নামক রশ্মি, যা বরাহও বলা হয়, এই প্রক্রিয়ায় কাজ করে। সেই সময় পৃথিবীর আকার বরাহের মুখের সদৃশ ছোট আকৃতির হয়।
ব্রত ও বেদি-নির্মাণ:
১. হিরণ্য ব্যবহার করা হয়। কাত্যায়ন সূত্র ৪৮।১৫ অনুযায়ী “সম্ভারাণামুপরি হিরণ্যনিধানমিচ্ছন্ত্যেক প্রচার্যঃ।”
২. পুরাণে বলা হয়েছে, বিষ্ণু বরাহ রূপ ধারণ করে জল থেকে পৃথিবী উত্তোলন করেছিলেন।
বরাহ (=শূকর) দ্বারা খোঁড়া সূক্ষ্ম মাটি বিছানো হয়। এজন্য মৈত্রায়ণী-সংহিতা ১৮৬৩৩-এ বলা হয়েছে—
‘যাবদ্ বৈ বরাহস্য চবালং তাবতীয়মগ্র আসীত্। যদ্ বরাহবিহতমুপাস্যাগ্নিমাধত্তে’।
অর্থাৎ শুরুতে পৃথিবী ততটুকুই ছিল, যতটা বরাহের মুখের অগ্রভাগ। ‘বরাহস্য চবালম্’ পৃথিবীর অংশের অল্পতার উপলক্ষণ।
৩. যখন সেই মৃত্তিকা সূর্যের কিরণে শুকিয়ে যায়, তখন তাকে শুষ্কাপ (=যার জল শুকিয়ে গেছে) বলা হয়। তার নীচে জল থাকে। এই শুকিয়ে যাওয়া পাপড়িরূপ মৃত্তিকা মর্দন করলে ভুরভুরে হয়ে যায়। এই শুষ্কাপরূপ অবস্থার বোধ করানোর জন্যই দেওয়া হয় উইপোকার ঢিবির মাটি। উইপোকা পৃথিবীর ভিতর থেকে গোলাকার মাটি তোলে। এবং তা হাওয়া ও রোদের দ্বারা শুকিয়ে গেলে মর্দন করলে ভুরভুরে হয়ে যায়। এজন্য মৈত্রায়ণী সংহিতা ১১৬১৩-এ বলা হয়েছে—
‘যদ্ বাল্মীকবপামুত্কীর্যাগ্নিমাধত্তে’।
৪. সেই শুষ্কাপ সূর্যের কিরণে উত্তপ্ত হয়ে উপ্ (=দাহকারী ক্ষারত্ব) ভাব প্রাপ্ত হয়। এজন্যই বেদিতে ঊসর ভূমি অর্থাৎ ‘রেহ’ বিছানো হয়। মৈত্রায়ণী সংহিতা ১৮৬৭৩-এ বলা হয়েছে—
‘যদূষানুপকীর্যাগ্নিমাধত্তে’।
৫. সেই উপ্-ক্ষার মাটি পুনরায় সূর্যকিরণ ও পৃথিবীর গর্ভস্থিত অগ্নির দ্বারা উত্তপ্ত হয়ে সিকতা (=বালু) রূপ ধারণ করে। এজন্যই বেদিতেও সিকতা বিছানো হয়—
‘যৎসিকতামুপকীর্যাগ্নিমাধত্তে’ (মৈ০ সং০ ১৯৬১৩)।
এই অবস্থায় পর্যন্ত পৃথিবী ছিল শিথিল = ঢিলা, পিলপিলি। শুক্ল যজুঃ ২০।১।২-এ বলা হয়েছে—
‘অবিরাসীত্ পিলিপ্পিলা’।
৬. সেই অন্তঃস্থিত সিকতা ভূগর্ভস্থ তাপে উত্তপ্ত হয়ে শর্করা (=রোড়ি) হয়ে যায়। পৃথিবীর এই অন্তঃপরিবর্তনের বোধ করানোর জন্য বেদিতে শর্করা (=রোড়ি) বিছানো হয়। এজন্য মৈ০ সং০ ১১।৬।৭।৩-এ বলা হয়েছে—
‘যচ্ছকরাঃ উপকীর্যাগ্নিমাধত্তে’।
পৃথিবীর গর্ভে শর্করার উৎপত্তির ফলে ভূমিতে দৃঢ়তা আসে। এই তত্ত্ব বৈদিক গ্রন্থে এভাবে দেখানো হয়েছে—
‘শিথিরা বৈ ইয়মগ্র আসীত্। তাং প্রজাপতিঃ শর্করাভিরদৃঢ়ত্’ (মৈ০ সং০ ১৬।৬।৭।৩)।
পৌরাণিক অবতার বিষ্ণুর অংশ। বেদে বিষ্ণু সূর্যের নাম, তার অরঙ্গিরস নামক কিরণসমূহই বরাহ—
‘অরঙ্গিসোডবি বরাহা উচ্চন্তে’ (নিরুক্ত ৫।৪)।
এগুলিকে জাতিরূপে একবচনে ‘এমূষ বরাহ’ও বলা হয়। শতপথ ১৪।১।২০।১১-এ বলা হয়েছে—
‘তমেমূষ ইতি বরাহ উজ্জঘান’।
এমূষ বরাহের বর্ণনা ঋগ্বেদের ‘বরাহমিন্দ্র এমূষম্’ (৮।৭৩।১০) মন্ত্রেও পাওয়া যায়। এমূষ শব্দের অর্থ— প্রা = সর্বদিক থেকে, ঈম্ = জলসমূহকে (ঈম্ উদকুনাম্, নিঘণ্টু ১।১২), ঊষ = তাপনকারী।
১. উইপোকার ঢিবির নীচে অবশ্যই জল থাকে। এজন্য রাজস্থানে জলঅন্বেষকেরা উইপোকার ঢিবির স্থানে কুয়ো খনন করতে বলেন।
২. সিকতা পৃথিবীর উপরে যেমন রাজস্থানে পাওয়া যায়, তেমনি পৃথিবীর ভিতরেও সৃষ্টি হয়। আজও কাঁচা পাহাড়ে পাওয়া কাঁচা পাথর মর্দন করলে বালুর কণা পৃথক-পৃথক হয়ে যায়।
৩. ছোট-ছোট পাথর = কঙ্কর।
এই অগ্নিরূপ প্রজাপতির কর্মের বর্ণনা ঋগ্বেদ ১০।১৯।২২।১১-এ করা হয়েছে—
‘যেন দ্যৌরুগ্রা পৃথিবী চ দৃঢ়া’।
৭. সেই শর্করা অন্তর্গত তাপে উত্তপ্ত হয়ে পাষাণরূপ ধারণ করে। এজন্য অগ্নিচয়ন-সংজ্ঞক যাগে বেদিতে পাষাণের স্থানে প্রতিনিধিরূপে ইট বিছানো হয়। তাইত্তিরীয় সংহিতা ২।২।৮-এ বলা হয়েছে—
‘ইষ্টকা উপদধাতি’।
৮. সেই পাষাণ ভূগর্ভস্থিত অগ্নিতে উত্তপ্ত হয়ে লোহা থেকে সুবর্ণ পর্যন্ত ধাতুরূপে পরিণত হয়। ধাতু-উৎপত্তিকালীন পূর্ববর্তী অবস্থার বর্ণনা প্রদর্শনের জন্য অগ্নিচয়ন-সংজ্ঞক কর্মে বলা হয়েছে—
‘হিরণ্য নিধায় চেতব্যম্’ (৩০—মীমাংসাভাষ্য ১।২।১৮); এবং
‘রুক্মমুপদধাতি’ (মৈ০ সং০ ৩।২।৬।৬)।
৯. পৃথিবীর গর্ভে লোহা থেকে সুবর্ণ পর্যন্ত ধাতু-নির্মাণ সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত পৃথিবী কূর্ম-পৃষ্ঠের ন্যায় লোমরহিত ছিল। তার পরেই পৃথিবীতে ঔষধি ও বনস্পতির উৎপত্তি হয়। পৃথিবীর এই অবস্থার বর্ণনা ব্রাহ্মণ-গ্রন্থে এভাবে করা হয়েছে—
‘ইয়ং বা অলোমিকৈবাগ্র আসীত্’ (ঐ০ ব্রা০ ২৪।২২)।
‘ঔষধিবনস্পতয়ো বা লোমানি’ (জৈ০ ব্রা০ ২।৭।৫।৪)।
‘ইয়ং তরহি যুক্তা’সীদ্ অলোমিকা। তেজোবন্ তস্মৈ কামায়ালভামহৈ, যথাস্যামোষধয়ো বনস্পতয়শ্চ জায়ন্ত ইতি’ (মৈ০ সং০ ২।১৫।২)।
এই কারণেই বেদিতে হিরণ্য স্থাপন করে তার উপর সমিধা অথবা তার স্থলাভিষিক্ত আরণ্য উপলা (=কাণ্ড) রাখা হয়। বনস্পতিরূপ বৃহৎ বৃক্ষসমূহ উৎপন্ন হওয়ার পর বায়ুর বেগে বৃক্ষশাখার ঘর্ষণের ফলে পৃথিবীতে সর্বপ্রথম অগ্নির উৎপত্তি হয়। তাই বেদে বলা হয়েছে—
‘তস্যা॑স্তে পৃথিবি দেবয়জনি পৃ॒ষ্ঠে᳕ऽগ্নিম॑ন্না॒দম॒ন্নাদ্যা॒য়াऽऽ দ॑ধে ॥ (যজুঃ ৩।৫)।
পৃথিবীর পৃষ্ঠে প্রথম অগ্নির আবির্ভাবের বোধ করানোর জন্য বেদিতে যে অগ্নির আধান করা হয়, তা অশ্বত্থ (পিপল) কাষ্ঠ দ্বারা নির্মিত দুইটি অরণি ঘর্ষণ করেই উৎপন্ন করা হয়।
আপস্তম্বাদি শ্রৌতসূত্রানুসারে প্রধান যাগের বানস্পত্য সম্ভারসমূহের মধ্যে পদ্মপত্রেরও নির্দেশ পাওয়া যায়।
১. ব্রহ্মাণ্ডে এই ‘ক’ অগ্নিরূপ প্রজাপতি। শরীরে এই ‘ক’ অগ্নিরূপ জীবাত্মা প্রজাপতি।
২. নির্দিষ্ট অগ্নিচয়ন-কর্মে ব্যাঘ্রাকৃতির বেদিতে বিভিন্ন আকারের ইট বিছানো হয়। বিভিন্ন ইষ্ট আকারে পাথর স্থাপন করা কষ্টসাধ্য, তাই এখানে প্রতিনিধিরূপে ইট ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
৩. ‘লৌহসমুদ্ভূতং’— মহাভারত, উদ্যোগপর্ব; রসার্ণবতন্ত্র ৫।১৬।৬-এ লৌহসংকরজাত সুবর্ণের বর্ণনা পাওয়া যায়।
৪. মহাবনে বৃক্ষশাখার ঘর্ষণ থেকে প্রায়ই দাবানলের উৎপত্তি হতে দেখা যায়।
চয়নযাগেও ‘তস্মিন্ পুষ্করপর্ণম্ অপাং পৃষ্ঠে’ (কা॰ ধৌত॰ ১।৩।২।২৫) এই নির্দেশ অনুসারে বেদিতে পুষ্করপর্ণ স্থাপনের বিধান পাওয়া যায়। উপরে ৩ নম্বরে যে শুষ্কাপরূপ পার্থিব অবস্থার বর্ণনা করা হয়েছে, সেই সময় পৃথিবী বায়ুর বেগে পুষ্করপর্ণ (পদ্মপাতা)-এর ন্যায় এদিক–ওদিক দুলছিল। ব্রাহ্মণগ্রন্থে বলা হয়েছে—
‘ইয়ং পৃথিবী লেলায়তি যথা পুষ্করপর্ণম্’ (শত॰ ২।১।১।৮)।
এই বিষয়েরই বর্ণনা বায়ুরূপ ইন্দ্রের কর্মের প্রসঙ্গে করা হয়েছে—
‘হন্তাহং পৃথিবীমিমাং নিদধানীহ্ নু বৈ?’ (ঋ০ ১০।১১।৬)।
অর্থাৎ, গর্বভরে ইন্দ্র বলছেন— আমি এতটাই শক্তিশালী যে যেখানে ইচ্ছা এই পৃথিবীকে স্থাপন করতে পারি।
পৃথিবীর এই পুষ্করপর্ণসদৃশ অবস্থারই নিদর্শন প্রদান করা হয় অগ্ন্যাধান বা চয়নযাগে পুষ্করপর্ণ স্থাপন করার মাধ্যমে। মৈত্স্যপুরাণে (১৮৬।১৬ ‘মোর’ সংস্করণ) এই বিষয়ে লেখা আছে—
“এতস্মাৎ কারণাৎ তজ্জ্ঞৈঃ পুরাণৈঃ পরমর্ষিভিঃ ।
যজ্ঞীয়ে বেদদৃষ্টান্তর্যজ্ঞে পদ্মবিধিঃ স্মৃতঃ ॥”
অর্থাৎ— এই কারণেই প্রাচীন ঋষিগণ বেদে নির্দেশিত দৃষ্টান্ত অনুসারে যজ্ঞে পদ্মবিধি, অর্থাৎ পুষ্করপর্ণ স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন।
আহবনীয়ের আধানে অশ্বের উপস্থিতি
আমরা আহবনীয় অগ্নির আধান-প্রকরণে পূর্বেই লিখেছি যে আহবনীয় কুণ্ডের নিকটে প্রথমে পূর্বাভিমুখ একটি অশ্ব স্থাপন করা হয়। তার দক্ষিণ পাদ দ্বারা কুণ্ডের সম্ভারসমূহ স্পর্শ করানো হয়। পরে সেই অশ্বকে ঘুরিয়ে আহবনীয় কুণ্ডের পূর্ব দিকে পশ্চিমাভিমুখ করে দাঁড় করিয়ে তার ডান পা কুণ্ডের মধ্যে স্থাপিত সম্ভারের উপর এমনভাবে রাখা হয়, যাতে অশ্বপদের চিহ্ন সেখানে পড়ে। এরপর কুণ্ডে সেই অশ্বপদচিহ্ন স্পর্শ করিয়ে তার উপর অরণি স্থাপন করা হয়। আপস্তম্ব প্রভৃতি কয়েকটি শ্রৌতসূত্রে এই সময় ব্রহ্মার দ্বারা রথচক্র ঘোরানোরও নির্দেশ পাওয়া যায়।
বেদিতে স্থাপিত যে তিনটি অগ্নি রয়েছে, তাদের মধ্যে গার্হপত্যাগ্নি পার্থিব অগ্নির প্রতীক, আহবনীয় সৌর অগ্নির এবং দক্ষিণাগ্নি অন্তরীক্ষস্থিত বিদ্যুতের প্রতীক। সূর্য বা আদিত্যকে বেদে বহুবার ‘অশ্ব’ নামে নির্দেশ করা হয়েছে—
‘একো অশ্বো বহতি সপ্তনামান্’ (ঋ০ ১।১৬৪।২)।
সূর্যের এই গতিশীলতার কথা মাথায় রেখেই তাকে রথচক্ররূপে বেদে বহুস্থানে বর্ণনা করা হয়েছে—
‘ত্রিনাভি চক্রমজরমনর্বম্’ (ঋ০ ১।১৬৪।২);
‘সনেমি চক্রমজরং বিবাবৃত’ (ঋ০ ১।১৬৪।২৪)।
এই কারণেই সূর্যস্থানীয় আহবনীয় অগ্নির স্থাপনের সময় প্রতীকার্থে অশ্বকে উপস্থিত করা হয়।
অধ্যাত্মবিজ্ঞান ও অগ্ন্যাধান
যেমন যজ্ঞীয় অগ্ন্যাধানের প্রক্রিয়ার সঙ্গে আধিদৈবিক জগতের সৃষ্টির সম্পর্ক আছে, তেমনই ‘যদ্ ব্রহ্মাণ্ডে তৎ পিণ্ডে’ নিয়ম অনুসারে এর সম্পর্ক অধ্যাত্মজগতের সঙ্গেও রয়েছে। শরীরবিজ্ঞানের জ্ঞানীরা বলেন যে মাতৃগর্ভে বীজ ও রক্তের সংযোগের পর শরীরনির্মাণের প্রক্রিয়াও তরলাবস্থা থেকে শরীরগঠনের দিকে প্রায় সেই একই অবস্থাক্রম অনুসরণ করে, যা পৃথিবী-নির্মাণের ক্ষেত্রে বর্ণিত হয়েছে। এই নির্মাণের পূর্ণতা ঘটে স্ত্রী–পুরুষের জননেন্দ্রিয় অঞ্চলে লোমোৎপত্তির মাধ্যমে।
এই শরীরের মধ্যেও তিনটি অগ্নির স্থাপনা ঘটে। শরীরে গার্হপত্য অগ্নি শরীরের স্থূল রূপে প্রতিষ্ঠিত। আহবনীয় অগ্নি হল— শরীরের ঊর্ধ্বভাগে অবস্থিত সেই সূক্ষ্ম শক্তি, যা ক্রমে ঊর্ধ্বগামী হয়ে সূক্ষ্মতম রূপ ধারণ করে প্রোজরূপে পরিণত হয় এবং শেষে ব্রহ্মরন্ধ্রে ক্ষরিত হয়— সেই পীতাভ ব্রহ্মবিন্দু বা ব্রহ্মবারি। যেমন সূর্যের তেজে সমগ্র সৌরমণ্ডল আলোকিত হয়, তেমনি এই প্রোজরূপ অগ্নি থেকেই শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ উজ্জ্বলতা ও শক্তি লাভ করে। দক্ষিণাগ্নি শরীরে জাঠরাগ্নির রূপে বিদ্যমান।
যেমন আধিদৈবিক জগতে বেদিস্থানীয় পৃথিবীর উপর লোমসদৃশ ওষধি ও উদ্ভিদের উৎপত্তির পরে বৃক্ষশাখার ঘর্ষণে পৃথিবীপৃষ্ঠে অগ্ন্যাধান ঘটে, তেমনি অধ্যাত্মক্ষেত্রে পৃথিবীস্থানীয় হল স্ত্রীদেহ। স্ত্রীর যোনিপ্রদেশে লোমের উৎপত্তির পরেই পুরুষের দ্বারা বীর্যরূপ অগ্নির আধান ঘটে। স্ত্রীযোনি অধরারণিস্বরূপ এবং পুরুষের উপস্থেন্দ্রিয় উত্তরারণিস্বরূপ— এই দুইয়ের ঘর্ষণেই পুরুষদেহ থেকে বীর্যস্রাব হয়ে তা স্ত্রীর যোনিতে স্থাপিত হয়।
দক্ষিণাগ্নি সম্পর্কে বিশেষ আলোচনা
যজ্ঞীয় প্রক্রিয়া অনুযায়ী অগ্ন্যাধানের পরে গার্হপত্য, আহবনীয় ও দক্ষিণাগ্নি— এই তিন অগ্নিকেই সর্বদা প্রজ্বলিত রাখতে হয়। যদি কোনও অগ্নি নিভে যায়, তবে পুনরায় আধান করতে হয়— একে বলা হয় ‘পুনরাধান’। যদিও অগ্নিগুলি সর্বদা প্রজ্বলিত থাকে, তবু আহবনীয় ও দক্ষিণাগ্নিকে যজ্ঞকর্ম, যেমন অগ্নিহোত্রের সময়, পুনরায় ‘প্রণয়ন’ (অর্থাৎ নতুন করে আনা) করা হয়। কারণ যাজ্ঞিক নিয়ম অনুসারে— ‘প্রবৃত্তে কর্মণি লৌকিকঃ সম্পদ্যতে’, অর্থাৎ আহবনীয় ও দক্ষিণাগ্নিতে কর্ম সম্পন্ন হলে তা লৌকিক অগ্নির ন্যায় হয়ে যায়। তাই প্রতিটি যজ্ঞকর্মের সময় প্রণয়নের মাধ্যমে তাদের পুনঃসংস্কার করা আবশ্যক।
আহবনীয় অগ্নির জন্য প্রণয়ন সর্বদা গার্হপত্য অগ্নি থেকেই হয়। কিন্তু দক্ষিণাগ্নির ক্ষেত্রে দুইটি মত রয়েছে— এক, গার্হপত্য অগ্নি থেকে; আর দুই, বৈশ্যকুল প্রভৃতি উৎস থেকে। এই কারণেই দক্ষিণাগ্নিকে সর্বদা প্রজ্বলিত থাকলেও অনিত্য বলা হয়েছে। পাণিনীয় অষ্টাধ্যায়ীতে একটি সূত্র আছে— ‘আনায়্যোऽনিত্যে’ (৩।১।১২৭)। যে দক্ষিণাগ্নি আহবনীয়ের ন্যায় গার্হপত্য অগ্নি থেকেই প্রণীত হয়, তাকে ‘আনায়্য’ বলা হয়। আর যে দক্ষিণাগ্নি বৈশ্যকুল প্রভৃতি স্থান থেকে প্রণীত হয়, তাকে ‘আনেয়’ বলা হয়। দক্ষিণাগ্নির প্রণয়নে এই বিকল্প থাকার কারণে আধানকালে যজমানকে সংকল্প করতে হয়— তিনি দক্ষিণাগ্নির জন্য গার্হপত্য থেকে অগ্নি গ্রহণ করবেন, না অন্য উৎস থেকে; এবং সেই সংকল্প শেষ পর্যন্ত পালন করতে হয়।
প্রশ্ন ওঠে— যজ্ঞকর্মে দক্ষিণাগ্নির প্রণয়নের জন্য কেন এই দুই প্রকার যোনির কথা বলা হয়েছে? অগ্ন্যাধানকর্মের সম্পর্ক আধিদৈবিক অগ্নিসমূহের সঙ্গে। দ্যুলোকস্থিত অগ্নির নিরবচ্ছিন্ন প্রজ্বলন পৃথিবীস্থানীয় জলতত্ত্বের উপর নির্ভরশীল। পার্থিব জল, পার্থিব অগ্নি, সৌর অগ্নি ও বায়ুর সংযোগে ক্রমে সূক্ষ্ম হয়ে সূর্যের সুষুম্না-কিরণের মাধ্যমে উত্তरोত্তর আরও সূক্ষ্মতর হয়ে সূর্যলোকে পৌঁছায়। এই শক্তিতেই সূর্য প্রজ্বলিত থাকে। একে বৈদিক ভাষায় ‘পবমান সোম’ বলা হয়। ঋগ্বেদের নবম মণ্ডল এই পবমান সোমেরই বর্ণনা প্রদান করে।
শরীরের মধ্যেও বীর্যরূপ অমৃততত্ত্ব সুষুম্না নাড়ির মাধ্যমে ক্রমশ সূক্ষ্ম হয়ে মস্তিষ্কের ব্রহ্মগুহায় ক্ষরিত হয়। আয়ুর্বেদজ্ঞরা একে ‘প্রোজ’ নামে অভিহিত করেন। যোগীপুরুষগণ এটিকে ব্রহ্মবিন্দু, ব্রহ্মরস প্রভৃতি নামে নির্দেশ করে থাকেন। পবমান সোম, অথবা ব্রহ্মরস, অথবা প্রোজস্তত্ত্বের দ্বারাই জীবাগ্নি সদা কর্মশীল থাকে। এই রসের পানে দেহস্থিত ইন্দ্রিয়সমূহ ও দেবশক্তিগুলি বলবান হয়। প্রোজশক্তি থেকে বঞ্চিত ব্যক্তি নিষ্প্রভ ও আলস্যগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
শরীরস্থিত দক্ষিণাগ্নি অর্থাৎ উদরস্থিত পাচকাগ্নির দুইটি যোনি আছে। এই দুই উৎস থেকেই তার প্রজ্বলন ঘটে। জঠরাগ্নিকে যথাযথভাবে প্রজ্বলিত রাখার জন্য শরীরস্থিত বীর্যাগ্নি এবং বাহ্য খাদ্য থেকে প্রাপ্ত তাপ— এই দুইই সমানভাবে সহায়ক। যে পুরুষ বীর্যহীন হয়ে যায় বা অতিরিক্ত বীর্যনাশ করে, তার জঠরাগ্নি মন্দ হয়ে যায়। আবার যতই বীর্যবান হোক না কেন, যদি কেউ কয়েকদিন খাদ্যগ্রহণ না করে অর্থাৎ উপবাস করে, তবে তার জঠরাগ্নিও নিঃশেষ হয়ে যায়। (আধিদৈবিক জগতে অন্তরীক্ষস্থিত দক্ষিণাগ্নির দুই যোনির যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গেই এর সাদৃশ্য রয়েছে।) এই কারণেই যজ্ঞকর্মে দক্ষিণাগ্নির ক্ষেত্রে বিকল্পবিধান নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
আধিদৈবিক জগতে তিনটি অগ্নিই প্রকৃতির নিয়মে অথবা সর্বনিয়ন্তা ব্রহ্মার বিধানে সৃষ্টির আদিকাল থেকে প্রলয়ান্ত পর্যন্ত সদা প্রজ্বলিত থাকে। কিন্তু শরীরস্থিত তিন অগ্নি মানুষের অজ্ঞতা, অসংযম ও ভ্রান্ত আচরণের ফলে শান্ত বা নিস্তেজ হয়ে যায়। যেমন চিকিৎসার দ্বারা সেগুলিকে পুনরায় প্রজ্বলিত করা হয়, তেমনি যজমানের অসাবধানতায় যদি কোনও অগ্নি নিস্তেজ হয়ে পড়ে, তবে পুনরাধেয় কর্মের মাধ্যমে পুনরায় অগ্নিসমূহের আধান করতে হয়।
অগ্নিহোত্র
পূর্বে বর্ণিত রীতিতে আমাদের আধিদৈবিক জগতে, পৃথিবীর উপর সৃষ্টির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যখন মানুষের আবির্ভাব ঘটে, তখন সর্বপ্রথম যে পরিবর্তনরূপ অবস্থা তার অভিজ্ঞতায় আসে, তা হলো দিন ও রাতের পার্থক্য। আধিদৈবিক জগতের দৃষ্টিতে এটি আকারে ক্ষুদ্র হলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। একইভাবে অধ্যাত্ম জগতেও এই দিন–রাত্রির ভাব জাগ্রত ও সুষুপ্তি— অর্থাৎ জাগা ও ঘুমের রূপে প্রকাশিত হয়। এই উভয় অবস্থাই (আধিদৈবিক ও অধ্যাত্মিক) জগতের স্বাভাবিক পরিণতি। এই তত্ত্বেরই ব্যাখ্যা ঋষিগণ অগ্নিহোত্র রূপে প্রদান করেছেন।
পূর্বোক্ত নিয়মে যে পত্নীসহ যজমান অগ্নিসমূহের আধান সম্পন্ন করেছেন, সেই আহিতাগ্নি দম্পতি সকল শ্রৌতকর্ম সম্পাদনের অধিকার লাভ করেন। যেমন আধিদৈবিক জগতে অহোরাত্রির কালবিভাগ আকারে ক্ষুদ্র, তেমনি শ্রৌতকর্মসমূহের মধ্যে তার প্রতিনিধিরূপ অগ্নিহোত্র কর্মও সর্বাপেক্ষা ক্ষুদ্র। আবার যেমন মানুষ সারাজীবন দিন–রাত্রির অভিজ্ঞতা লাভ করে, তেমনি অগ্নিহোত্রের অনুষ্ঠানও আজীবন পালনীয়।
ভট্ট শবরস্বামী কোনও লুপ্ত ঋগ্বেদীয় ব্রাহ্মণের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন—
“যাবজ্জীবন অগ্নিহোত্র জুহোতি”—
অর্থাৎ জীবনভর অগ্নিহোত্র হোম করা কর্তব্য।
এই অংশটি বাংলায় অনুবাদ করে দিচ্ছি—স্বাভাবিক মানবিক ভাষায়:
“হোম করা উচিত”—এই বাক্যটি মীমাংসা ২/৭/৪/১১–এর ভাষ্যে উদ্ধৃত হয়েছে। শতপথ ব্রাহ্মণ (প্রা. ১২।৪।১।১)–এ অগ্নিহোত্রকে ‘জরাময় সত্র’ বলা হয়েছে। এই কর্মের মাধ্যমে যজমান তখনই মুক্তি লাভ করে, যখন সে অত্যন্ত জীর্ণ হয়ে যায় (দেহ একেবারে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়) অথবা তার মৃত্যু ঘটে। সেখানে বলা হয়েছে—
“এই অগ্নিহোত্রই জরাময় সত্র; এর থেকে মানুষ বার্ধক্যের মাধ্যমে অথবা মৃত্যুর মাধ্যমেই মুক্ত হয়।”
এই কারণেই অগ্নিহোত্রকে নিত্যকর্ম বলা হয়েছে।
অগ্নিহোত্র দিনে দু’বার—রাত্রে ও দিনে—সম্পন্ন করা হয়। এই দুই সময় মিলেই একটি অগ্নিহোত্র কর্ম সম্পূর্ণ হয়।
অগ্নিহোত্রের আরম্ভ
অগ্নিহোত্রের পূর্বপ্রস্তুতি ‘ভাবন কর্ম’ থেকে শুরু হয়ে ‘লোষ্টর’ পর্যন্ত সমাপ্ত হয়। এর পরে অগ্নিহোত্র করার নির্দিষ্ট সময় আসে সন্ধ্যাকাল। তাই অগ্নিহোত্র কর্মের আরম্ভ সন্ধ্যাকাল থেকেই হয়। তার পরে প্রাতঃকাল উপস্থিত হলে প্রাতঃকালীন অগ্নিহোত্র সম্পন্ন করা হয়। যজুর্বেদের তৃতীয় অধ্যায়ে প্রথমে সন্ধ্যাকালীন অগ্নিহোত্রের মন্ত্রগুলি, তারপর প্রাতঃকালীন অগ্নিহোত্রের মন্ত্রগুলি বর্ণিত হয়েছে।
সন্ধ্যা থেকে আরম্ভ করার কারণ
অগ্নিহোত্র সন্ধ্যা থেকে কেন শুরু হয়—এর একটি কারণ আগেই বলা হয়েছে। দ্বিতীয় কারণ হল, যেমন দিনের আগে রাত আসে, তেমনি এই সৃষ্টিরূপ ব্রহ্মার দিনের আগে রাত্রিরূপ প্রলয়কাল থাকে। বর্তমান কাল সর্বদা অতীতের সঙ্গে যুক্ত। তাই সৃষ্টির ব্যাখ্যার আগে প্রলয়ের ব্যাখ্যা প্রয়োজন, নচেৎ সৃষ্টির উৎপত্তি বোঝা যায় না।
ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ১২৬তম সূক্তে, যাকে ‘ভাববৃত্ত সূক্ত’ (সৃষ্টির আবর্তন) বলা হয়, তার প্রথম মন্ত্রেই প্রলয়াবস্থার বর্ণনা আছে। আমাদের মানবধর্মশাস্ত্র, যার উদ্দেশ্য মানবজাতিকে তাদের কর্তব্য বোঝানো, তার সূচনাও হয়েছে—
“আসীদিদং তমোভূতম্”
অর্থাৎ ‘এই জগৎ প্রথমে অন্ধকারময় ছিল’। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই যজুর্বেদেও অগ্নিহোত্রের আরম্ভ সন্ধ্যাকালীন অগ্নিহোত্র দিয়ে করা হয়েছে।
‘অগ্নিহোত্র’ নামের কারণ
‘অগ্নিহোত্র’ শব্দের অর্থ—
“অগ্নির জন্য যে হোম করা হয়, সেই কর্মই অগ্নিহোত্র।”
যদিও অগ্নিহোত্র কর্মের দুই দেবতা—সন্ধ্যাকালীন কর্মের দেবতা অগ্নি এবং প্রাতঃকালীন কর্মের দেবতা সূর্য—তবুও এই হোমকর্ম সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়, কারণ রাত্রির দেবতা অগ্নি। মানুষ রাত্রিকালে অগ্নির সহায়তায়ই কাজ করতে সক্ষম হয়। এই জন্য উভয় কালের কর্মের নাম রাখা হয়েছে ‘অগ্নিহোত্র’।
অগ্নিহোত্রের কাল
মানবধর্মশাস্ত্রে প্রাতঃকালীন অগ্নিহোত্রের তিনটি সময় বলা হয়েছে—
উদিত, অনুদিত ও সময়াধ্যুষিত।
যেমন বলা হয়েছে—
“উদিত, অনুদিত এবং সময়াধ্যুষিত—এই সব অবস্থাতেই যজ্ঞ সম্পন্ন হয়; এটাই বৈদিক শ্রুতি।” (মনুস্মৃতি ২।১৫)
উদিত কাল—যখন সূর্যের উদয় দৃশ্যমান হয়।
অনুদিত কাল—সূর্যোদয়ের আগে, যতক্ষণ পর্যন্ত নক্ষত্র দেখা যায়।
সময়াধ্যুষিত কাল—যখন নক্ষত্র আর দেখা যায় না, অথচ সূর্যের উদয়ও হয়নি।
যেমন বলা হয়েছে—
“প্রভাতকালে যখন নক্ষত্রমণ্ডল লুপ্ত হয়ে যায়, কিন্তু সূর্য এখনও দৃশ্যমান নয় সেই সময়ই সময়াধ্যুষিত কাল।”
উপলব্ধ ব্রাহ্মণ গ্রন্থসমূহে উদিত ও অনুদিত এই দুই কালেই অগ্নিহোত্র সম্পাদনের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই কালবিভাগ অনুসারে ঋগ্বেদী, শুক্ল যজুর্বেদী ও সামবেদী শাখাগুলি অনুদিত কালের অন্তর্গত; আর কৃষ্ণ যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় ও মৈত্রায়ণীয় শাখাগুলিও অনুদিত বলে গণ্য হয়। কিন্তু ন্যায়দর্শন ২।১।৫৭–এর বাত্স্যায়ন ভাষ্যে ‘উদিতে হোতব্যম্, অনুদিতে হোতব্যম্, সময়াধ্যুষিতে হোতব্যম্’ এই তিন কালে অগ্নিহোত্র করার বিধিবাক্য এবং যথা-সময়ে অগ্নিহোত্র না করলে নিন্দাসূচক বাক্য উদ্ধৃত হয়েছে। এর দ্বারা স্পষ্ট হয় যে, যেসব শাখা ও ব্রাহ্মণে সময়াধ্যুষিত কালে অগ্নিহোত্রের বিধান ছিল, সেগুলি বর্তমানে লুপ্ত হয়ে গেছে।
প্রাতঃকালীন অগ্নিহোত্রের তিনটি কালের বিধান থাকলেও, সায়ংকালীন অগ্নিহোত্র সূর্যাস্তের পরেই করা হয়।
অগ্নিহোত্রের কাল-সংক্রান্ত সংকল্প
প্রাতঃকালীন অগ্নিহোত্রের জন্য তিনটি কালের বিধান থাকায়, অগ্নিহোত্র আরম্ভের পূর্বে যজমানকে সংকল্প করতে হয়—সে ‘সূর্যোদয়ের পূর্বে’, অথবা ‘সূর্যোদয়ের পরে’, অথবা ‘সময়াধ্যুষিত কালে’ অগ্নিহোত্র করবে। একবার সংকল্প গ্রহণ করার পর আজীবন সেই সংকল্পিত কালেই অগ্নিহোত্র করতে হয়। অন্যথা কালের লঙ্ঘন হলে সে প্রায়শ্চিত্তের অধিকারী হয়। এই কারণেই ন্যায়বশেন ২।১।২৮–এ ‘অভ্যুপেত্য কালভেদে দোষবচনাত্’ সূত্রের নির্দেশ আছে—অর্থাৎ কোনো একটি কাল গ্রহণ করে পরে তার লঙ্ঘন করলে দোষ বলা হয়।
বাত্স্যায়ন ভাষ্য ২।১।৫৬–এ কালভেদে দোষসূচক নিন্দাবাক্যগুলি এইভাবে উদ্ধৃত হয়েছে—
‘শ্যাবোऽস্যাহুতিমভ্যবহরতি য উদিতে জুহোতি’—যে ব্যক্তি অনুদিত বা সময়াধ্যুষিত কালের সংকল্প করে সূর্যোদয়ের পরে অগ্নিহোত্র করে, তার আহুতি কালো রঙের কুকুর খেয়ে ফেলে।
‘শ্ববলোऽস্যাহুতিমভ্যবহরতি যো অনুদিতে জুহোতি’—যে ব্যক্তি উদিত বা সময়াধ্যুষিত কালের সংকল্প করে অনুদিত কালে হোম করে, তার আহুতি সাদা রঙের কুকুর খেয়ে ফেলে।
‘শ্যাবশ্ববলাবস্যাহুতিমভ্যবহরতঃ যঃ সময়াধ্যুষিতে জুহোতি’—যে ব্যক্তি উদিত বা অনুদিত কালের সংকল্প করে সময়াধ্যুষিত কালে হোম করে, তার আহুতি কালো ও সাদা রঙের কুকুরেরা খেয়ে ফেলে।
এই নিন্দাবাক্যগুলির তাৎপর্য হলো—সংকল্পিত সময়েই অগ্নিহোত্র করার প্রশংসা করা।
মীমাংসকদের একটি নীতি হলো ‘নহি নিন্দা নিন্দিতু প্রবর্ততে, অপিতু বিধেয়ং স্তোতুম্’ (শবরভাষ্য ১।৪।২৬)। অর্থাৎ নিন্দাবাক্য নিন্দা করার উদ্দেশ্যে প্রবর্তিত হয় না; বরং বিধেয় কর্মের প্রশংসাই তার উদ্দেশ্য।
সকল পক্ষেই অগ্নির প্রণয়ন
অগ্নির প্রণয়ন গার্হপত্য অগ্নি থেকে অঙ্গার নিয়ে উপবেশ্য সন্তক পাত্রে করা হয়।
১. যদিও উপরিউক্ত তিনটি বাক্যে শ্যাব, শ্ববল প্রভৃতি রঙবাচক শব্দই পাঠিত হয়েছে, ‘কুকুর’ শব্দের প্রত্যক্ষ উল্লেখ নেই; তথাপি যেমন ‘লোহিত’ বা ‘শোণ’ বললে লাল রঙের গরু বা অশ্বের বোধ হয়, তেমনই এখানে বোঝা উচিত। মহাভাষ্য (১।২।১৭১)–এ বলা হয়েছে—
“সমানে রক্তে বর্ণে গৌঃ লোহিত ইতি ভবতি, অশ্বঃ শোণ ইতি। সমানে চ কালে বর্ণে গৌঃ কৃষ্ণ ইতি ভবতি, অশ্বঃ হেম ইতি। সমানে চ শ্বেতে বর্ণে গৌঃ শ্বেত ইতি ভবতি, অশ্বঃ শ্বেত ইতি।”
দক্ষিণাগ্নি অথবা ব্রাহ্মতীয়ে স্থাপন করার এই কর্ম সকল পক্ষেই সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের পূর্বে সম্পন্ন করা হয়। তদনন্তর তাকে প্রজ্বালিত করে যথাকালে অগ্নিহোত্র করা হয়।
প্রতিশাখা কর্মভেদ
প্রতিশাখাভেদে অগ্নিহোত্র কর্মে কিছু কিছু পার্থক্য রয়েছে। এখানে প্রথমে কাত্যায়ন শ্রৌত ও আপস্তম্ব শ্রৌতসূত্র অনুসারে সাধারণ কর্মের নির্দেশ করা হচ্ছে। অগ্ন্যাধান কর্ম প্রায় মধ্যাহ্ন পর্যন্ত সমাপ্ত হয়। অতএব তার পরেই অগ্নিহোত্রের প্রথম প্রাপ্তি সায়ংকালে হয়, এবং তদনন্তর পরদিন প্রাতঃকালীন অগ্নিহোত্র সম্পন্ন হয়। এইভাবে সায়ংকালীন ও প্রাতঃকালীন অগ্নিহোত্র মিলিয়ে এক অগ্নিহোত্র কর্ম হয়।
সায়ংকালীন অগ্নিহোত্রের দেবতা অগ্নি। ‘ছত্রিন্যায়’ অনুসারে উভয় কালের হোমের সংজ্ঞাই অগ্নিহোত্র। অগ্নিহোত্রের জন্য বহু হব্যদ্রব্যের উল্লেখ পাওয়া যায় (এগুলির বিবরণ পরে করা হবে)। তার মধ্যে পয়ঃ (দুধ) প্রধান ও সর্বসাধারণ দ্রব্যরূপে গণ্য।
অনুষ্ঠানের প্রকার
সায়ংকালীন অগ্নিহোত্রের জন্য ‘সায়ংকালিকমগ্নিহোত্রমহং করিষ্যে’—এইরূপ সংকল্প করে যজমান সূর্যাস্তের পূর্বে উপবেদ-সঞ্জ্ঞক পাত্রে গার্হপত্য অগ্নি থেকে জ্বলন্ত অঙ্গার নিয়ে তা দক্ষিণাগ্নির কুণ্ডে স্থাপন করে। তদনন্তর পুনরায় গার্হপত্য অগ্নি থেকে জ্বলন্ত অঙ্গার নিয়ে আহবনীয়ে স্থাপন করে।
দক্ষিণাগ্নিতে অঙ্গার স্থাপন মন্ত্রবিহীন হয়। আহবনীয়ে ‘অগ্নিপতয়েऽগ্নয়ে’ থেকে ‘তং ত্বয়া নিদধানি’ পর্যন্ত মন্ত্রসমূহ (শ্রৌত ৬/১।১৭, ৬/২।১) উচ্চারণ করতে করতে অঙ্গার স্থাপন করা হয়।
তদনন্তর যজমান সমিধাসমূহ তিন অগ্নিতে নির্দিষ্ট ক্রমে—গার্হপত্য, আহবনীয় ও দক্ষিণাগ্নিতে—প্রক্ষেপ করে। আহবনীয়ে এতটুকু সমিধা রাখে, যাতে প্রদত্ত আহুতি অগ্নির নিচে না পৌঁছে (আপস্তম্ব শ্রৌত ৬।২।৪,৬)। তদনন্তর অগ্নিকুণ্ড চারিদিক থেকে মার্জন করে পরিষ্কার করা হয়। সুগন্ধি দ্রব্য, পুষ্প প্রভৃতির দ্বারাও অগ্নিকে অলঙ্কৃত করা হয় (এটি ঐচ্ছিক বিধি)।
কুণ্ডের চারদিকে ‘উদগগ্র’ অথবা ‘প্রাগগ্র’ কুশ বিছিয়ে যজমান যে অগ্নিহোত্রী গাভী (যার দুধ দ্বারা যজমান অগ্নিহোত্র করে) তাকে যজ্ঞীয় স্থানের দক্ষিণ দিকে এনে বাঁধে। তদনন্তর সূর্য অস্ত গেলে সেই গাভীকে দোহন করে দুধ মাটির পাত্রে (হাঁড়িতে) রাখে। গার্হপত্য অগ্নি থেকে অঙ্গার পৃথক করে কুণ্ডের বাইরে বায়ব্য কোণে স্থাপন করে তার উপর দুধের পাত্র রেখে দুধ গরম করে।
যে পাত্রে দুধ দোহন করা হয়েছে, তাতে অল্প জল দিয়ে পাত্র ধুয়ে সেই জল দুধে মেশায় অথবা সরাসরি জল যোগ করে। তদনন্তর সামান্য কুশ জ্বালিয়ে দুধ—
টীকা
১. কোনো সম্প্রদায়ে এক ব্যক্তির হাতে ছাতা থাকলে সমগ্র সম্প্রদায়কে সেই ব্যক্তি দ্বারা বিশেষিত করে ‘ছত্রিণো যান্তি’—এই লোকব্যবহারকে ছত্রিন্যায় বলা হয়। এখানে সায়ংকালের হোমের দেবতা অগ্নি এবং প্রাতঃকালের হোমের দেবতা সূর্য। উভয় দেবতাযুক্ত কর্মকে অগ্নির দ্বারা বিশেষিত করে ‘অগ্নিহোত্র’ নামকরণ করা হয়েছে।
২. দ্রষ্টব্য—আপস্তম্ব শ্রৌতসূত্র, মুদ্রিত অংশ ২, পৃষ্ঠা ৭, টীকা ৫।
৩. কুশার অগ্রভাগ উত্তর বা পূর্বদিকে রেখে বিছানো হয়। উদগগ্র পক্ষেতে উত্তর থেকে দক্ষিণদিকে এবং প্রাগগ্র পক্ষেতে পূর্ব থেকে পশ্চিমদিকে কুশ বিছানো হয়।
৪. এই জলপ্রক্ষেপ দুধ গরম হওয়ার সময় তা কমে যাওয়া রোধ করার জন্য করা হয়। (রাজস্থান)
দুধের পাত্রটির চারদিকে তিনবার ঘোরানো হয়। একে পর্যগ্নিকরণ বলা হয়। কাত্যায়ন শ্রৌত (৪।১৪।৫) অনুসারে কুশাগ্রগুলি অল্প অল্প বিরতিতে তিনবার জ্বালিয়ে উত্তর দিকে নিক্ষেপ করা হয়। এই তৃণদহন দুধ পাকেছে কি না তা পরীক্ষার জন্য করা হয়। এই কারণেই অন্যান্য হোমে এই কর্মের অভাব দেখা যায়। দুধ পেকে গেলে পাত্রটি নামিয়ে সেই অঙ্গারগুলি পুনরায় গার্হপত্যাগ্নিতে নিক্ষেপ করা হয়।
তৎপশ্চাৎ স্রুক্ ও অগ্নিহোত্রহবণী পাত্র হাতে নিয়ে আহবনীয় অগ্নিতে তপ্ত করে মুছে, স্রুকের সাহায্যে একে একে চারবার অগ্নিহোত্রহবণীতে দুধ ঢালা হয়। (একে হবিরুত্তারণ কর্ম বলা হয়)। সেই অগ্নিহোত্রহবণীতে গৃহীত দুধ গার্হপত্যকুণ্ডের পশ্চিম অংশে রেখে হাত তপ্ত করে তা দ্বারা দুধ স্পর্শ করা হয়।
তদনন্তর এক প্রাদেশ (নয় চাঁক গুল পরিমাণ) মাপে এক, দুই অথবা তিনটি সমিধা দুধপূর্ণ অগ্নিহোত্রহবণীর উপর ধারণ করে গার্হপত্যের উপর দিয়ে বহির্বাহনীর নিকট এনে রাখা হয়। জল স্পর্শ করে আনা সমিধাগুলি অগ্নিতে নিক্ষেপ করে অগ্নিহোত্রহবণীর দুধ দ্বারা
অগ্নির্জ্যোতিজ্যোতিরগ্নিঃ স্বাহা
মন্ত্রে হোম করা হয়।
এর পর অগ্নিহোত্রহবণীর অগ্রভাগে লেগে থাকা দুধ হাতে নিয়ে ভূমিতে ফেলে, পূর্ববৎ পদ্ধতিতে একে একে চারবার দুধ অগ্নিহোত্রহবণীতে নিয়ে
প্রজাপতয়ে স্বাহা
মন্ত্রে দ্বিতীয় আহুতি প্রদান করা হয়।
এইভাবেই প্রাতঃকালে
সূর্যো জ্যোতিজ্যোতিঃ সূর্যঃ স্বাহা
দ্বারা প্রথম এবং
প্রজাপতয়ে স্বাহা
দ্বারা দ্বিতীয় আহুতি প্রদান করা হয়।
এই চারটি আহুতিই সায়ং ও প্রাতঃকালের অগ্নিহোত্র। যজুর্বেদে এই প্রক্রিয়ায় সায়ংকালের চারটি মন্ত্র পাঠ করা হয়েছে এবং প্রাতঃকালের চারটি। কাত্যায়ন শ্রৌতসূত্রে মন্ত্রগুলির বিকল্পও বলা হয়েছে।
হোমকালে অগ্নিহোত্রহবণীতে অবস্থিত সমস্ত দুধের হোম করা উচিত নয়, বরং ভক্ষণের জন্য কিছু অবশিষ্ট রাখা উচিত।
অগ্নিহোত্র-নামক প্রধান আহুতি সম্বন্ধে মতভেদ
তৈত্তিরীয় এবং শुक্ল যজুর্বেদীরা উপরোক্ত চারটি আহুতিকেই অগ্নিহোত্র সংজ্ঞা গ্রহণ করেন। ঋগ্বেদীরা পরে উল্লেখিত সায়ংকালে গার্হপত্য-সম্পর্কিত চারটি এবং দক্ষিণাগ্নি-সম্পর্কিত চারটি—এইভাবে প্রাতঃকালে আরও আটটি আহুতি প্রদান করেন। এই ষোলো আহুতির সঙ্গে উপরোক্ত চারটি আহুতি মিলিয়ে মোট বিশটি আহুতিকে অগ্নিহোত্র সংজ্ঞা প্রদান করেন (প্রায়শ্চিত্তালংকার শ্রৌত ২২)।
উভয়ের মধ্যে পার্থক্য এই যে, তৈত্তিরীয়রা অগ্নিহোত্রে কেবল উপরোক্ত চারটি আহুতিকেই প্রধান মানেন, অবশিষ্ট ষোলোটি গৌণরূপ। ঋগ্বেদীদের মতে বিশটি আহুতিই প্রধান।
এই মতভেদের ফল এই যে, নির্ব্যকর্মে কারণবশত সাঙ্গ কর্মের অসম্ভবতা হলে কেবল প্রধান কর্ম সম্পাদন করলেই যজমান কৃতকার্য হন। এই দৃষ্টিতে তৈত্তিরীয় ও শুক্ল যজুর্বেদীদের মতে কেবল চারটি আহুতিতেই কর্ম সম্পন্ন হয়, কিন্তু ঋগ্বেদীদের মতে বিশটি আহুতি আবশ্যক।
অবশিষ্ট আহুতি
সায়ং ও প্রাতঃকালে উপরোক্ত চারটি আহুতি প্রদান করে অগ্নিহোত্রহবণীকে ভূমিতে নামিয়ে রাখা হয়। রাজস্থানে প্রসিদ্ধ যে, দুধে জল না মিশিয়ে গরম করলে গাভীর স্তন দগ্ধ হয়। এই জন্য সেখানে বিশুদ্ধ দুধ বিক্রেতারাও সামান্য জল মিশিয়ে নেন। এটিকে তারা দুধে জল মেশানো বলে মনে করেন না।
১। যে পাত্র দ্বারা অগ্নিহোত্র করা হয়, তাকে অগ্নিহোত্রহবণী বলা হয়।
রেখে দিয়ে স্ন্ ও স্রুকের সাহায্যে গার্হপত্য অগ্নিতে চারটি এবং দক্ষিণাগ্নিতে চারটি আহুতি প্রদান করা হয়। এর মধ্যে গার্হপত্যাগ্নি-সম্পর্কিত দুইটি আহুতির দেবতা হলেন অগ্নি গৃহপতি। এইগুলির হোমমন্ত্র হলো—
অগ্নে গৃহপতে পরিসদ্য জুষস্ব স্বাহা।
অন্য মতে গৃহপতি, রয়িপতি, পুষ্টিপতি, কাম ও অন্নাদ্য—এই বিশেষণযুক্ত অগ্নিই দেবতা হন। এই মতে হোমমন্ত্র হলো—
অগ্নয়ে গৃহপতয়ে রয়িপতয়ে পুষ্টিপতয়ে কামায়ান্নাদ্যায় স্বাহা।
এইভাবেই দক্ষিণাগ্নিতে প্রদত্ত চারটি আহুতির মধ্যে প্রথম, তৃতীয় ও চতুর্থটির মন্ত্র হলো—
অগ্নেন্দাভ্য পরিসদ্য জুষস্ব স্বাহা।
দ্বিতীয় আহুতির মন্ত্র হলো—
অন্নপতে অন্নস্য নো ধেহি।
এই মন্ত্রগুলি আপস্তম্ব শ্রৌতসূত্র অনুসারে। অন্যান্য শ্রৌতসূত্রে মন্ত্রের ভিন্নতা দেখা যায়। এখানে আমাদের উদ্দেশ্য অগ্নিহোত্র কর্মের একটি সাধারণ পরিচয় প্রদান করা, শ্রৌতসূত্রকারদের প্রক্রিয়াগত ভিন্নতা প্রদর্শন করা নয়। অতএব যে কোনো শ্রৌতসূত্র অনুসারে এই সাধারণ পরিচয় গ্রহণ করা যেতে পারে। পরে দশপূর্ণমাস প্রভৃতির আলোচনায়ও এইভাবেই করা হবে।
অবশিষ্ট কর্ম
হোম সম্পন্ন করে অগ্নির চারদিকে জল সিঞ্চন করে আহবনীয়ের দক্ষিণভাগে বসে অগ্নিদের উপস্থান করা হয়। তদনন্তর বেদির মধ্যস্থলে অগ্নিহোত্রহবণী স্থাপন করে তাতে লেগে থাকা ও হোমে অবশিষ্ট দুধ ভক্ষণ করে আচমন করা হয়। হাত ধুয়ে অগ্নিহোত্রহবণীকে জল দিয়ে পূর্ণ করে পুনরায় আচমন করা হয়। এরপর দর্মা দ্বারা ঘষে পরিষ্কার করা হয়। তারপর যজমান বেদির উপর হাত মেলে জল ঢেলে সেই জল শিরে ছিটিয়ে নেন। এটাই অগ্নিহোত্র কর্মের সংক্ষিপ্ত পরিচয়।
ক্রিয়া সম্পাদনকারী
অগ্নিহোত্রে আহুতি প্রভৃতি কর্ম কে করবেন—যজমান না অধ্বর্যু—এই বিষয়ে বিকল্প আছে। অধ্বর্যু যদি ঋত্বিক্ রূপে বরণ করা হয়ে থাকে তবে তিনিই কর্ম করেন, নতুবা কেবল যজমান করেন। প্রথম পক্ষেও যজমান ও তাঁর পত্নীর উপস্থিতি আবশ্যক। দ্বিতীয় পক্ষেও পত্নী সঙ্গে থাকেন।
দেশান্তর গমনে
যদি যজমান পরিবারসহ দেশান্তরে যান, তবে গার্হপত্য প্রভৃতি অগ্নিকে অরণিতে আরোপ করে নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে অরণিমন্থনের মাধ্যমে অগ্নি উৎপন্ন করে পূর্ববৎ কর্ম করবেন। যদি একা যান, তবে তাঁর অনুপস্থিতিতে যজমানের পত্নী, অধ্বর্যু অথবা শিষ্য অগ্নিহোত্র সম্পাদন করবেন। যদি অধ্বর্যু বা শিষ্য কর্মকারী হন, তবে যজমানের পত্নী ‘ইদং ন মম’ বলে হোমত্যাগ করবেন।
অগ্নিহোত্রের দ্রব্য
শ্রৌতসূত্রে নিত্য (নিষ্কাম) অগ্নিহোত্রে সাধারণত দুধকেই হবি হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে কামনাপূর্বক কাম্য অগ্নিহোত্রে ঘৃত, দধি, যাবাগু, তণ্ডুল (চাল) প্রভৃতি ব্যবহারের বিধান পাওয়া যায়। যেমন—
যাবাগু দ্বারা গ্রামলাভের কামনা,
তণ্ডুল দ্বারা ক্ষেত্রলাভের কামনা,
দধি দ্বারা ইন্দ্রিয়বল কামনা,
ঘৃত দ্বারা তেজলাভের কামনা
(কাত্যায়ন শ্রৌত ১৫।১৪।২১–২৫)।
এছাড়া স্মার্ত হোমে তিল, দধি, পয়ঃ, সোম, যাবাগু, ওদন, ঘৃত, তণ্ডুল, ফল ও অপ্ (জল)—এই দশটি দ্রব্য গণনা করা হয়েছে (দ্র০ স্মার্তোল্লাস)।
নিত্যকর্মের অপরিহার্যতা ও আপৎকালবিষয়ক বিচার
অগ্নিহোত্রকে নিত্যকর্মসমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম গণ্য করা হয়েছে। জীবনে বহু এমন অবস্থা উপস্থিত হয়, যখন বিধিসম্মত সাঙ্গ কর্ম সম্পাদনে মানুষ অসমর্থ হয়ে পড়ে। এই অসমর্থতা দেহজনিত অথবা দ্রব্যজনিত নানা প্রকারের হতে পারে। অতএব অগ্নিহোত্র বিষয়ে শতপথ ব্রাহ্মণ (১১।৩।১)-এ যাজ্ঞবল্ক্য ও জনকের মধ্যে একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় সংলাপ পাওয়া যায়।
হে! জ্ঞানি, সম্রাট! সেটা কী?—দুধই তো।
যদি দুধ না পাওয়া যায়, তবে কী দিয়ে হোম করবে?—যব ও ধান দিয়ে।
যদি যব ও ধানও না পাওয়া যায়, তবে কী দিয়ে হোম করবে?—যে অন্যান্য ঔষধি (= অন্ন) আছে, সেগুলি দিয়ে।
যদি অন্য অন্নও না মেলে, তবে কী দিয়ে হোম করবে?—যে বনজ অন্ন (কোদো, সাওয়া প্রভৃতি) আছে, সেগুলি দিয়ে।
যদি অন্য বনজ অন্নও না পাওয়া যায়, তবে কী দিয়ে হোম করবে?—বনস্পতির (= ফলধারী বৃক্ষের ফল) দ্বারা হোম করবে।
যদি বনস্পতিজ ফলও না পাওয়া যায়, তবে আবার কী দিয়ে হোম করবে?—জল দিয়ে হোম করবে।
যদি জলও না পাওয়া যায়, তবে কী দিয়ে হোম করবে?
তখন যাজ্ঞবল্ক্য বললেন—এখানে যখন কিছুই পাওয়া যায় না, তখন সত্য ও শ্রদ্ধার মধ্যেই হোম কর।
জনক বললেন—হে যাজ্ঞবল্ক্য! তুমি অগ্নিহোত্র জানো, আমি তোমাকে এক হাজার গরু দান করছি।
এই প্রসঙ্গের শেষে বলা হয়েছে—প্রাণই অগ্নিহোত্র। সম্ভবত এই দৃষ্টিকোণ থেকেই ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে—
অপরে নিয়তাহারাঃ প্রাণান্ প্রাণেষু জুহ্বতি। (গীতা ৪।৩০)
অপানে জুহ্বতি প্রাণং প্রাণেऽপানং তথাপরে॥ (গীতা ৪।২৬)
এই প্রসঙ্গ থেকে স্পষ্ট হয় যে শাস্ত্রকারগণ যজ্ঞের বিধান করতে গিয়ে এবং তার নিত্যতার উপর জোর দিতে গিয়েও কর্মকেই প্রধান রূপে গ্রহণ করেছেন এবং দ্রব্যাদি সাধনকে গৌণ হিসেবে মেনেছেন। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে সব সাধন সহজলভ্য থাকা সত্ত্বেও বিধিসিদ্ধ দ্রব্য ত্যাগ করে ইচ্ছামতো অগ্নিহোত্র প্রভৃতি করা যাবে। সাধনের গৌণতা আপৎকালের বিষয়। আপৎকালে যাতে কর্মের লোপ না ঘটে—এই দৃষ্টিতেই কোনোভাবে হলেও তা সম্পন্ন করার বিধান শাস্ত্রকারদের অভিপ্রায়।
কর্ম ও সাধনের এই প্রধানতা ও গৌণতাকে মনে রেখে ঋষি দयानন্দও সন্ধ্যার প্রসঙ্গে আচমন বিষয়ে লিখেছেন—“নো চেৎ।” অর্থাৎ সন্ধ্যার সময় হয়ে গেছে এবং সেই সময় কোনো কারণে জল উপলব্ধ না থাকলে, জলের আচমন ত্যাগ করে সন্ধ্যা সম্পন্ন করবে। শাস্ত্রকারদের সাধনের গৌণতার বিষয়ে এই সঠিক নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও, আর্যসমাজে বহু ব্যক্তি আছেন, যারা ঘরে থাকলেও সন্ধ্যায় আচমন করেন না। এটি শাস্ত্রকারের “নো চেৎ”-এর অপব্যবহার, অথবা সাঙ্গ কর্মের প্রতি আমাদের অনাসক্তির পরিচায়ক।
আধিদৈবিক অগ্নিহোত্র
এই সৃষ্টিতে দিন ও রাতই অগ্নিহোত্রের রূপ। দিনের দেবতা সূর্য এবং রাত্রির দেবতা অগ্নি। এদের আশ্রয়েই চরাচর জগৎ দিন ও রাতে কার্য সম্পাদন করে।
আধ্যাত্মিক অগ্নিহোত্র
প্রাণ ও অপান—এই দু’টিই অধ্যাত্ম অর্থে শরীরের দেবতা। জীবনধারণের আরম্ভ থেকে শেষ পর্যন্ত এরা অগ্নিহোত্র সম্পাদন করে থাকে। এই আধ্যাত্মিক অগ্নিহোত্রে যারা দক্ষ, তারা গীতার ভাষায় প্রণায়ামের গতি নিজের বশে এনে, প্রানে অপান ও অপানে প্রাণের হোম করে—
অর্থাৎ প্রণায়ামপরায়ণ হয়ে সমস্ত ইন্দ্রিয়জাত দোষ দগ্ধ করে ব্রহ্মপ্রাপ্তির পথে অগ্রসর হয়।
ইত্যগ্নিহোত্রঃ পরিচয়ঃ সমাপ্তঃ।
১।
যথা—
দহ্যন্তে ধ্মায়মানানাং ধাতূনাং হি যথা মলাঃ।
তথেন্দ্রিয়াণাং দহ্যন্তে দোষাঃ প্রাণস্য নিগ্রহাত্॥
(মনু ৩।৭২)
দর্শ–পূর্ণমাস
আধিদৈবিক জগতে প্রতিদিন দিন ও রাত্রির রূপে যে পরিবর্তনশীল দৃশ্য সমস্ত প্রাণীর দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে গৃহীত হয়, তার পর প্রাণীমাত্রের দ্বারা যে বিশেষ পরিবর্তনটি অনুভূত হয়, তা হলো রাত্রিতে আলো ও অন্ধকারের রূপে উপস্থিত দৃশ্য। এই পরিবর্তন প্রতিদিন ঘটলেও পনেরো–পনেরো দিনের দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পূর্ণতা লাভ করে বলে পরিচিত। লোকব্যবহারে এগুলি শুক্ল পক্ষ ও কৃষ্ণ পক্ষ নামে পরিচিত।
শুক্ল পক্ষে অমাবস্যার সম্পূর্ণ অন্ধকার রাত্রির পর সূর্যাস্তের পর থেকে ক্রমান্বয়ে আলোর পরিমাণ ও সময় বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং পূর্ণিমার রাত্রিতে পূর্ণচন্দ্রের আলোয় সারা রাত আলোকিত থাকে। একইভাবে কৃষ্ণ পক্ষে পূর্ণিমার পর চন্দ্রোদয় ক্রমে দুই–দুই ঘটি (৪৫ মিনিট) দেরিতে হতে থাকে এবং তার আলোককলা ধীরে ধীরে লুপ্ত হতে থাকায় অন্ধকারের পরিমাণ বাড়তে বাড়তে অমাবস্যার রাত্রিতে সম্পূর্ণ অন্ধকার হয়ে যায়। সেই দিনে চন্দ্রোদয় সূর্যোদয়ের সঙ্গেই হয়। এই কারণেই—
অমা = সহ বসতঃ সূর্যচন্দ্র যস্যাং সা অমাবাস্যা
(কাশিকা বৃত্তি, অষ্টা॰ ২।১।১২২)।
এই আধিদৈবিক ঘটনাচক্রের পরিজ্ঞাপনের জন্য শাস্ত্রকারগণ দর্শপূর্ণমাস নামে পরিচিত কর্মের বর্ণনা করেছেন।
অগ্নিহোত্রের মতো সন্ধ্যা ও প্রাতঃ—এই দুই কাল মিলিয়ে যেমন একটি কর্ম হয়, তেমনি দর্শেষ্টি ও পৌর্ণমাসেষ্টি একত্রে একটি কর্ম নয়; তথাপি উভয়ের অপূর্ব থেকে একটি অপূর্ব উৎপন্ন হয়ে সেখান থেকেই ফল লাভ হয়। এই কারণেই—
দর্শপূর্ণমাসাভ্যাং স্বর্গকামো যজেত
এই বিধিবচনে “দর্শপূর্ণমাসাভ্যাম্” দ্বিবচন দ্বারা নির্দেশ করা হয়েছে।
পূর্ণিমা ও অমাবস্যা চন্দ্রকলার বৃদ্ধি ও হ্রাসের সীমারূপ। বাকি চৌদ্দ রাত্রিতে বৃদ্ধি–হ্রাস প্রত্যক্ষভাবে অনুভূত হয়। এই জন্য দর্শপূর্ণমাসে তেরো–চৌদ্দটি আহুতি প্রধান। উভয় যাগে তিন–তিনটি প্রধান আহুতি থাকে, বাকি এগারোটি অঙ্গরূপ আহুতি (এগুলির বিশেষ বিবরণ পরে করা হবে)।
পৌর্ণমাসেষ্ঠিতে প্রধান হবি হলো—আগ্নেয় অষ্টাকপাল পুরোডাশ (অগ্নীষোম দেবতাক), এবং অগ্নীষোমীয় একাদশকপাল পুরোডাশ। দর্শেষ্ঠিতে আগ্নেয় অষ্টাকপাল পুরোডাশ এবং ইন্দ্রদেবতাক দধি ও ইন্দ্রদেবতাক পয়ঃ (দুধ) হয়। যেহেতু দধি ও দুধ—উভয় হবির দেবতা এক, তাই উভয়কে একত্র করে একবারই উভয়ের আহুতি দেওয়া হয়। এইভাবে স্থূল দৃষ্টিতে দর্শেষ্ঠিতে তেরোটি আহুতি হয়।
এই নির্দেশ ভগবান জৈমিনি সংক্ষ কাণ্ড ২৩।২।৩০ (পূর্ব-মীমাংসা ১।৮।২।৩০) এ করেছেন—
চতুর্দশ পৌর্ণমাস্যামাহুতয়ো হূয়ন্তে, ত্রয়োদশ অমাবাস্যায়াম্ ইতি।
দর্শপূর্ণমাসকে সমস্ত যাগের প্রকৃতি বলা হয়েছে। সংহিতা, ব্রাহ্মণ ও শ্রৌতসূত্র অনুসারে দর্শপূর্ণমাসই সকল যাগের প্রকৃতি। অতএব যাগসমূহে সাধারণভাবে যে সমস্ত কর্ম হয়, সেগুলির পূর্ণ বিন্যাস দর্শপূর্ণমাসে করা হয়েছে। উত্তর যাগগুলিতে যেখানে যে ভিন্নতা বা অতিরিক্ততা থাকে, কেবল সেই অংশেরই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অবশিষ্ট সমস্ত অবিশিষ্ট বিধি প্রকৃতিবদ্ বিকৃতিঃ কর্তব্যাঃ—এই প্রতিদেশ অনুযায়ী চাতুর্মাস্যাদি উত্তর যাগে প্রযোজ্য হয়ে যায়।
এই কারণেই এখানে আমরা দর্শপূর্ণমাস কর্মের পরিচয় কিছুটা বিস্তৃতভাবে প্রদান করছি।
দর্শপূর্ণমাসের আরম্ভে বিকল্প
আমরা আধান প্রকরণে প্রধানপূর্বাধান, সোমপূর্বাধান এবং দৃষ্টিপূর্বাধান—এই ভিন্নতা পূর্বেই লিখেছি (দ্রষ্টব্য—পূর্ব পৃষ্ঠা ১০–১১)। এইরূপে এক পক্ষ মতে আধান করার পর প্রথমে সোমযাগ করে তারপর দর্শপূর্ণমাস সম্পন্ন করা হয়। অপর পক্ষ মতে আধানের পরই দর্শপূর্ণমাস আরম্ভ করা হয় এবং পরে যখন যজমানের সোমযাগ করার ইচ্ছা বা সামর্থ্য হয়, তখন সোমযাগ করা হয়। এই দুই পক্ষের মধ্যে দর্শেষ্ঠির হবিদ্রব্যে পার্থক্য দেখা যায়।
সোমযাজীর দর্শেষ্ঠির হবি—উভয় পক্ষেই আগ্নেয় পুরোডাশ সমান, কিন্তু বাকি দুই হবিদ্রব্যে পার্থক্য রয়েছে। সোমযাজী অর্থাৎ যিনি পূর্বে সোমযাগ করেছেন, তাঁর হবি হয় ঐন্দ্র দধি ও ঐন্দ্র পয়ঃ। দর্শপূর্ণমাসের পরে যজমান যখন সোমযাগ করেন, তার পূর্ব পর্যন্ত দধি ও দুধ—এই দুই হবি ব্যবহৃত হয়। দুধ ও দধি রূপ যে হবি, তার শাস্ত্রীয় নাম সান্নায়্য। এই কারণেই কাত্যায়ন শ্রৌত ৪।২৩।২৫-এ বলা হয়েছে—
সোমযাজী সান্নয়েত।
তৈত্তিরীয় সংহিতা ২।৫।৭-এ প্রোনবাজদের জন্য সান্নায়্য হবির স্পষ্ট বিধান আছে—
নাসোমযাজী সান্নয়েত।
সান্নায়্য শব্দের অর্থ—ভগবান পাণিনি হবি-বিশেষের অর্থে “সান্নায়্য” শব্দটি নিপাতন করেছেন—
সান্নায়্য-নিকাশ্বধায়া মানহবিনিবাসসামিধেনোয়ু
(অষ্টাধ্যায়ী ৩।১।১২৬)।
এই শব্দে “সম্” উপসর্গসহ “নী” ধাতু থেকে ণ্যৎ প্রত্যয় হয়েছে। এর অর্থ—যে হবি ভালোভাবে একত্র করে দেওয়া হয়, তাই সান্নায়্য। ঐন্দ্র দধি ও ঐন্দ্র পয়ঃ—এই দুই দ্রব্যের দেবতা এক হওয়ায় উভয়কে মিলিয়ে ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে আহুতি দেওয়া হয়। এই কারণেই এই হবি সান্নায়্য নামে পরিচিত।
অসোমযাজীর দর্শেষ্ঠির হবি—যিনি আধানের পর সোমযাগ না করেই দর্শপূর্ণমাস আরম্ভ করেন, তাঁর ক্ষেত্রে আগ্নেয় পুরোডাশের অতিরিক্ত ঐন্দ্রাগ্ন অষ্টকপাল পুরোডাশ এবং কিছু শাখা ও উপশাখার মতে বৈষ্ণব অথবা অগ্নীষোমীয় উপাংশুপানও হয়। মীমাংসা ১০।১৮।৫৮-এ দর্শেষ্ঠিতে উপাংশুপানের প্রতিষেধ বলা হয়েছে।
দর্শ শব্দের অর্থ—এর ব্যুৎপত্তি এই যে, “দৃশ্যতে চন্দ্রোऽত্র”—অর্থাৎ কখনো কখনো (যখন চতুর্দশী ক্ষীণ হয়ে অমাবস্যা আরম্ভ হয়) প্রভাতে সূর্যোদয়ের পূর্বে পূর্ব দিগন্তে চাঁদের সূক্ষ্ম রেখা দেখা যায়।
কর্মের আরম্ভ—আধান প্রकरणে পূর্বেই বলা হয়েছে যে আধান অমাবস্যা বা পূর্ণিমায় করা হয়। অতএব যদি অমাবস্যায় আধান করা হয়, তবে পরবর্তী পূর্ণিমায় পৌর্ণমাসেষ্ঠি করা হয়, তার পর দর্শেষ্ঠি। কিন্তু যদি পূর্ণিমায় আধান করা হয়, তবে পরবর্তী অমাবস্যায় দর্শেষ্ঠি না করে পরের পূর্ণিমা থেকে কর্ম আরম্ভ করা হয়। অর্থাৎ দর্শপূর্ণমাসে প্রথমে পৌর্ণমাসেষ্ঠি এবং পরে দর্শেষ্ঠি হয়। এই নিয়মের কারণ সম্ভবত দেশাচার। উত্তর ভারতে প্রথমে কৃষ্ণ পক্ষ গণনা করা হয় এবং দ্বিতীয় শুক্ল পক্ষ অর্থাৎ পূর্ণিমায় মাসের সমাপ্তি ধরা হয়। কিন্তু গুজরাট প্রভৃতি অঞ্চলে প্রথমে শুক্ল পক্ষ…‘পক্ষ’ হয়, এবং শেষে কৃষ্ণ পক্ষ অর্থাৎ অমাবস্যায় মাস পূর্ণ হয়। উত্তর ভারতের পঞ্জিকা হোক বা দক্ষিণাত্য—উভয় ক্ষেত্রেই পূর্ণিমাকে ২৫ সংখ্যায় এবং অমাবস্যাকে ২০ সংখ্যায় নির্দেশ করা হয়। এই নির্দেশও এই কথার প্রমাণ যে প্রাচীনকালে প্রথম পক্ষ ছিল শুক্ল পক্ষ এবং দ্বিতীয় পক্ষ কৃষ্ণ পক্ষ। সেই কারণেই এই কর্মের সূচনা পৌর্ণমাসেষ্ঠি দিয়েই করা হয়।
একটি চিন্তনীয় প্রশ্ন—শুক্ল যজুর্বেদ ও কৃষ্ণ যজুর্বেদের উপলব্ধ সকল শাখায় যেখানে দর্শ–পূর্ণমাসের মন্ত্রপাঠ আছে, সেখানে প্রথমে দর্শেষ্ঠির মন্ত্র এবং পরে পৌর্ণমাসেষ্ঠির মন্ত্র পাওয়া যায়। কিন্তু শতপথ ব্রাহ্মণে যজুর্বেদের প্রথম অধ্যায়ের ব্যাখ্যা মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য দর্শেষ্ঠির মন্ত্র বাদ দিয়ে আরম্ভ করেছেন এবং সেগুলির ব্যাখ্যা শেষে করেছেন। তাহলে সংহিতা বা শাখাগুলিতে কেন দর্শেষ্ঠির মন্ত্র প্রথমে পাঠ করা হয়েছে? শুধু তাই নয়, তৈত্তিরীয় সংহিতা ৩।৫।১১-এ স্পষ্ট বলা হয়েছে—
“দর্শো वा এতयोঃ পূর্বঃ পূর্ণমাস উত্তরঃ।”
এই প্রশ্নের উত্তর এখনও আমাদের বোধগম্য হয়নি। সম্ভবত কোনো এক প্রাচীন কালে (অত্যন্ত প্রাচীন যুগে) দর্শপূর্ণমাসের সূচনা দর্শ থেকেই হতো কি না?
দর্শপূর্ণমাসে কিছু অংশ যাগ এবং কিছু অংশ হোম। যাগ ও হোমের লক্ষণ শাস্ত্রকারেরা এইভাবে নির্ধারণ করেছেন—
যাগের লক্ষণ—
যেখানে দাঁড়িয়ে ‘বষট্’ শব্দসহ আহুতি দেওয়া হয়, যেখানে পুরোডনুবাক্যা ও যাজ্যা মন্ত্র থাকে—তাকে যাগ বলা হয়। এর জন্য ‘যজেত্’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। যেমন—
“দর্শপূর্ণমাসাভ্যাং স্বর্গকামো যজেত্” (দ্রষ্টব্য—আপস্তম্ব শ্রৌত ৩।১৪।১৮)।
হোমের লক্ষণ—
যেখানে বসে ‘স্বাহা’ শব্দসহ আহুতি দেওয়া হয়, তাকে হোম বলা হয়। এর জন্য ‘জুহোতি’, ‘জুহুয়াত্’ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হয়। যেমন—
“অগ্নিহোত্রং জুহোতি” (তৈত্তিরীয় সংহিতা ১।৬।৫।১৯)।
পুরোডনুবাক্যা ও যাজ্যা—
যাগে যে দেবতার উদ্দেশ্যে আহুতি দেওয়া হয়, সেই দেবতাসংক্রান্ত দুইটি ঋকের মধ্যে প্রথমটিকে পুরোডনুবাক্যা (অর্থাৎ আগে উচ্চারিত ঋক) বলা হয় এবং যার দ্বারা আহুতি দেওয়া হয় তাকে যাজ্যা বলা হয়। যাজ্যার শেষে ‘বৌষট্’ শব্দ যুক্ত করে আহুতি প্রদান করা হয়।
দর্শপূর্ণমাসের দ্বৈবিধ্য—
দর্শপূর্ণমাস নিত্য এবং কাম্য (কামনার জন্য) —এই দুই প্রকার। ভিন্ন ভিন্ন কামনার জন্য নিত্যবিধানকৃত কর্মেই সামান্য পরিবর্তন করা হয়।
দর্শপূর্ণমাস যাগের সময়সীমা—
নিত্য দর্শপূর্ণমাস যাগ আজীবন করতে হয়। কিন্তু অতিশয় বার্ধক্যে কর্ম পালনে অক্ষম হলে তার পরিসমাপ্তি করা যেতে পারে। এই অর্থবোধক বৃত্তি মীমাংসাভাষ্যকার শবরস্বামী (মীমাংসা ২।৪।১৪)-এ এইভাবে উদ্ধৃত করেছেন—
“জরাময় वा এতত্ সত্রং যদগ্নিহোত্রং দর্শপূর্ণমাসী চ। জরয়া হ বা এতস্মান্মুচ্যতে মৃত্যুনা বা।”
অর্থাৎ অগ্নিহোত্র এবং দর্শপূর্ণমাস—এই দুইই জরা-মরণ সত্র, অর্থাৎ নিরবচ্ছিন্নভাবে চলমান কর্ম। এগুলি থেকে বার্ধক্য দ্বারা অথবা মৃত্যুর দ্বারা মুক্তি লাভ হয়।
‘মৃত্যুর দ্বারা’। এই কর্মটি ত্রিশ বছর নিরন্তর পালন করার পর পরিত্যাগও স্বীকৃত হয়েছে—
“ত্রিশৎ বর্ষাণি দর্শপূর্ণমাসাভ্যাং যজেত” (শতপথ ১১।১।২।১৩)।
যে যজমান দর্শপূর্ণমাসের সঙ্গে দাক্ষায়ণ যাগও করেন, তিনি পনেরো বছর পর পরিত্যাগ করতে পারেন—
“যদ্য দাক্ষায়ণপাজী স্বাদ্বোऽপি পঞ্চদশৈব বর্ষাণি যজেত। তত্রৈব সা সম্পৎ সংচ্যতে।” (শতপথ ১১।১।২।১৩)।
দাক্ষায়ণ যজ্ঞ কোনো স্বতন্ত্র কর্ম নয়। দর্শপূর্ণমাসের সঙ্গেই, একই দিনে, সামান্য ভিন্ন প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হওয়া কর্ম। (দ্রষ্টব্য—মীমাংসা প্র. ২, পাদ ৩, অধি. ৪, সূত্র ৫–১১)। এই কারণেই বলা হয়েছে—
“হে হি পৌর্ণমাস্যোং যজেত দ্বে প্রভাবাস্যে” (শতপথ ১১।১।২।১৩),
অর্থাৎ দাক্ষায়ণ যজ্ঞসহ করলে দুইটি পূর্ণিমা ও দুইটি অমাবস্যার যজ্ঞ সম্পন্ন হয়। এইভাবে ৩০ বছরের পরিবর্তে ১৫ বছরেই ততগুলি দর্শপূর্ণমাস সম্পন্ন হয়, যতগুলি ৩০ বছরে হতো।
যাগের অনुष্ঠানকাল—দর্শ ও পৌর্ণমাস কর্মের প্রধান কাল অমাবস্যা বা পূর্ণিমা এবং প্রতিপদের সন্ধিকাল। কিন্তু যদি এই সন্ধিকাল মধ্যাহ্নোত্তর বা রাত্রিকালে পড়ে, তবে মধ্যাহ্নোত্তর বা রাত্রিতে কর্ম নিষিদ্ধ হওয়ায় পরদিন (প্রতিপদায়) প্রাতে অনুষ্ঠান করা হয়।
দর্শেষ্ঠিতে দধিরূপ হব্যের জন্য প্রথম দিন গোদোহনাদি কর্ম করা আবশ্যক। তাই সাধারণত উভয় কর্মের ব্রতগ্রহণ প্রভৃতি প্রথম দিন (অমাবস্যা) ও পূর্ণিমার দিনে প্রাতে করা হয় এবং প্রধান কর্ম প্রতিপদার দিনে প্রাতে হয়। কিছু শাস্ত্রকারের মতে, পৌর্ণমাসেষ্ঠির সকল কর্মই প্রতিপদার দিন করা যেতে পারে—
“সদ্যো বা প্রাতঃ” (কাত্যায়ন শ্রৌত ২।১।১৬)।
সাধারণ নিয়ম—যেখানে হব্যদ্রব্য বা দেবতার বিকল্প থাকে, যেমন—
“ব্রীহিভির্যজেত যবৈর্বা” (ধান দিয়ে যাগ করুক বা যব দিয়ে),
এবং
“বিষ্ণুরুপাংশু যষ্টব্যোऽগ্নীষোমৌ বা”
(দর্শেষ্ঠিতে বিষ্ণুদেবতার উপাংশু যাগ করুক অথবা অগ্নীষোম দেবতার—বাজসনেয়ী ও শাংখায়ন শাখার মতে)।
এ ধরনের বিকল্পের ক্ষেত্রে প্রথম যাগের সময়ই একটিমাত্র দ্রব্য বা দেবতার সংকল্প গ্রহণ করতে হয় এবং পরবর্তীতে আজীবন সেই অনুসারেই কর্ম করতে হয়।
মন্ত্রপাঠের প্রকার—যজ্ঞে পাঠিত মন্ত্রসমূহ সম্পর্কে সাধারণ নিয়ম এই যে, জপ-মন্ত্র, নিউখ ও সামমন্ত্র স্বরে পাঠ করা হয়, আর অন্যান্য মন্ত্র একশ্রুতিতে।
“যজ্ঞকর্মণ্যজপনিউখসামসু” (অষ্টাধ্যায়ী ১।২।৩৪) ;
“একশ্রুতি দূরাত্সম্বুদ্ধি যজ্ঞকর্মণি, সুব্রহ্মণ্যা সামজপনিউখযাজমানবর্জম্” (কাত্যায়ন শ্রৌত ১।৮।১৬)।
অর্থাৎ যজ্ঞকর্মে একশ্রুতি পাঠ হয়; সুব্রহ্মণ্যা, সাম, জপ, নিউখ ও যজমান-সম্পর্কিত মন্ত্র ব্যতীত।
তৈত্তিরীয় অধ্বর্যু দ্বারা পাঠিত মন্ত্র চতুঃস্বরে (উদাত্ত, অনুদাত্ত, স্বরিত ও একশ্রুতি) পাঠ করা হয়। হোতা দ্বারা পাঠিত—
১. এই শ্রুতির তাৎপর্য দর্শপূর্ণমাসের প্রশস্তি প্রকাশে। সন্ন্যাস আশ্রম কেবল ব্রাহ্মণের জন্য বিধিবদ্ধ; ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের জন্য বানপ্রস্থই শেষ আশ্রম। বানপ্রস্থে যজ্ঞের বিধান আছে। অতএব তিনি অতি বার্ধক্য বা মৃত্যুপার্যন্ত দর্শপূর্ণমাস করতে পারেন। সন্ন্যাস গ্রহণকারী যখন ইচ্ছা কর্মত্যাগ করতে পারেন। ত্রিশ বছরের বিধান সকল অবস্থায় কর্মপরিত্যাগের বিধায়ক।
২. নিউখসংজ্ঞক ১৬টি ভোঙকার আছে; তার মধ্যে কিছু উদাত্ত, কিছু অনুদাত্ত (দ্রষ্টব্য—আশ্বলায়ন শ্রৌত ৭।১১)।
যে মন্ত্রগুলি পাঠ করা হয়, সেগুলি একশ্রুতিতে পড়া হয়। বাকিটা পূর্বের মতোই। জন নাম সেই সব মন্ত্রের, যেগুলির দ্বারা কোনো কার্য সম্পাদন করা হয় না, কেবলমাত্র পাঠ করা হয়। সুব্রহ্মণ্যা নামে একটি নিগদ (মন্ত্রসমষ্টি) আছে; এটি সোমযাগে ব্যবহৃত হয়।
এইভাবে হোতা দ্বারা উচ্চারিত ঋদ্ধ মন্ত্রগুলি ‘ওঁ’ ধ্বনিসহ উচ্চ স্বরে বলা হয়। উদ্গাতা দ্বারা গীত সামমন্ত্রগুলিও উচ্চ স্বরেই উচ্চারিত হয়। অধ্বর্যু দ্বারা পাঠিত যজুঃ মন্ত্রগুলি উপাংশু রীতিতে বলা হয়—অর্থাৎ এত ক্ষীণ স্বরে, যাতে নিকটস্থ ব্যক্তিও স্পষ্টভাবে শুনতে না পারে। শাস্ত্রে বলা হয়েছে—
“উচ্চৈশ্চ ক্রিয়তে উচ্চৈঃ সাম্না উপাংশু যজুঃ” (মন্ত্র সংহিতা ৩।৬।৬।১৫)।
মধ্যম অধ্বর্যু দ্বারা পাঠিত প্রেষ মন্ত্রগুলি উচ্চ স্বরে পাঠ করা হয়, কারণ প্রেষ মন্ত্রের কাজই হলো কোনো কর্ম করতে পাঠানো বা অনুমতি দেওয়া। যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি প্রেষ শুনতেই না পায়, তবে সে কর্ম কীভাবে করবে? আবার যাজ্যা মন্ত্রের শেষে উচ্চারিত ‘বৌষট্’ শব্দটি যাজ্যা মন্ত্রের থেকেও অধিক উচ্চ স্বরে বলা হয়—
“উচ্চস্তরাং বা বষট্কারঃ” (ভাষ্য ১।২।৩৫)।
দর্শপূর্ণমাসের ঋত্বিক
দর্শপূর্ণমাস যাগে ব্রহ্মা ও অধ্বর্যু প্রধান হন এবং মোট চারজন ঋত্বিক থাকেন—
“দর্শপূর্ণমাসয়োর্যজ্ঞকোশ্চত্বার ঋত্বিজঃ” (তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ২।৩।৬২)।
ঋত্বিকদের কার্য
যজ্ঞে যত আহুতি প্রদান করা হয়, তা হোতা প্রত্যক্ষ করেন “জুহোতি ইতি হোতা”। হোতার সম্পর্ক ঋগ্বেদের সঙ্গে, তাই ঋগ্বেদকে হোত্রবেদও বলা হয়। প্রেষসহ যাবতীয় যজ্ঞীয় কর্ম অধ্বর্যু সম্পন্ন করেন। অধ্বর্যুর সম্পর্ক যজুর্বেদের সঙ্গে, তাই তিনি আধ্বর্যবেদীয় নামে পরিচিত। অগ্নীত্ নামক ঋত্বিক অধ্বর্যুর সহায়ক।
ব্রহ্মা সমগ্র যজ্ঞকর্মের পর্যবেক্ষক। কর্মে কোনো ভুল-ত্রুটি হলে তার সংশোধন করেন—
“যজ্ঞস্থ ভিষগ্ যদ্ ব্রহ্মা” (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৫।১৩।৪),
অর্থাৎ ব্রহ্মা যজ্ঞের চিকিৎসকস্বরূপ, যিনি ভুল-ত্রুটি নিরসন করেন। এই কারণে ব্রহ্মাকে ঋগ্, যজুঃ ও সাম—তিন বেদেই পারদর্শী হতে হয়—
“প্রথ কেণ ব্রহ্মত্বং ক্রিয়তে ইতি? ত্রয়া বিদ্যয়েতি” (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৫।৩৩; শতপথ ব্রাহ্মণ ১১।২।৬।৭)।
দর্শপূর্ণমাসে ব্যবহৃত পাত্র ও দ্রব্য
দর্শপূর্ণমাস যাগে যে সব পাত্র ও দ্রব্য সাধারণত প্রয়োজন হয়, সেগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় এখানে দেওয়া হচ্ছে। প্রথমে সেই সব পাত্র ও দ্রব্যের উল্লেখ করা হচ্ছে, যেগুলির বর্ণনা ঋষি দয়ানন্দ সরকারবিধির সাধারণ প্রकरणে দিয়েছেন এবং যেগুলির চিত্রও সেখানে আছে। সেই অনুসারেই এখানে পাত্রগুলির পরিমাপ ও বর্ণনা দেওয়া হলো। বিভিন্ন শাখা বা শ্রৌতসূত্রে এদের আকার-পরিমাপে সামান্য ভিন্নতা দেখা যায়। এখানে কেবল সাধারণ পরিচয় দেওয়াই উদ্দেশ্য।
১. জুহূ—
এটি পালাশ বৃক্ষের কাঠে নির্মিত। এর অগ্রভাগ হাতের তালুর সমান চওড়া, ছয় অঙ্গুল গভীর খোদাই করা, হাঁসের ঠোঁটের মতো আকৃতিযুক্ত মুখ থাকে এবং পশ্চাৎভাগ দণ্ডাকৃতি। সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য বাহুমাত্র। দণ্ডের শেষ প্রান্তের কিছু আগে নিচের দিকে একটি ভর থাকে, যাতে জুহূ সোজা রাখা যায় এবং তাতে ঢালা ঘৃত পড়ে না যায়। জুহূ পাত্রের মাধ্যমেই আহুতি প্রদান করা হয়—
“হূয়তেऽনয়ে ইতি জুহূঃ”।
২. উপভৃত্ — এটি অশ্বত্থ (পিপল) বৃক্ষের কাঠে তৈরি হয়। এর আকার ও পরিমাপ জুহূ পাত্রের মতোই।
৩. ধ্রুবা — এটি বিকদ্রুত বৃক্ষের কাঠে নির্মিত। অন্যান্য দিক থেকে জুহূ পাত্রের মতোই বুঝতে হবে।
৪. অগ্নিহোত্রহ্বণী — এটিও বিকদ্রুত বৃক্ষের কাঠের হয়। বাকি সব দিক থেকে জুহূর অনুরূপ। এর দ্বারাই অগ্নিহোত্র করা হয়—
“অগ্নিহোত্রং হূয়তেऽনয়ে ইতি।”
এই চারটি পাত্রকে সাধারণভাবে ‘রুচ্’ বলা হয়। এদের আকার একই, কেবল কাঠের প্রকারভেদ আছে। চারটির মধ্যে পার্থক্য বোঝানোর জন্য আলাদা আলাদা চিহ্ন করা হয়।
৫. স্রুব — এটি খাদির (খৈর) বৃক্ষের কাঠে তৈরি। এর খাঁজটি বৃদ্ধাঙ্গুলির গাঁটের মতো আকৃতির হয় এবং এটি প্রায় ২২ অঙ্গুল লম্বা, গোল দণ্ডবিশিষ্ট। সংস্কারবিধিতে দেওয়া স্রুবের চিত্রটি সঠিক নয়; সেখানে যে চিত্র দেওয়া হয়েছে, তা আসলে দ্বি (কড়চি)-র।
৬. কূর্চ — এটি বরণ বৃক্ষের কাঠের হয়। দৈর্ঘ্যে বাহুমাত্র। এটি অগ্নিহোত্রহ্বণীর নীচে রাখা হয়।
৭. বচ্চ-স্পা — এটি সদির বৃক্ষের কাঠের। এর আকৃতি লাঙ্গল বা কৃপাণের মতো, সরল এবং নির্দিষ্ট পরিমাপের।
৮. উলূখল (উখল) — এটি বরণ বৃক্ষের বা অন্য কোনো দৃঢ় বৃক্ষের কাঠে তৈরি হয়। কারও মতে পালাশ বৃক্ষেরও হতে পারে। বসা অবস্থায় মানুষের নাভি পর্যন্ত এর উচ্চতা হয়।
৯. মুসল (মূসল) — এটিও বরণ বৃক্ষের বা অন্য কোনো শক্ত বৃক্ষের কাঠে হয়। কারও মতে খৈর কাঠের। বসা অবস্থায় মানুষের মাথা পর্যন্ত এর উচ্চতা হয়।
বিশেষ কথা — উখল ও মূসল দৃঢ় কাঠের হওয়া উচিত, যাতে ধান বা যব কুটতে গিয়ে ফেটে না যায়। বর্তমানে যজ্ঞের সময় নির্ধারিত ধান বা যব সরাসরি কুটে বা পিষে নেওয়া হয় না। আগে থেকেই ভাঙা চাল বা যব উখলে দিয়ে মূসল দিয়ে খোসা ছাড়ানো হয়, তারপর সূপে ঝাড়া হয়, শিলায় রেখে গুঁড়ো করা হয়। এই কারণে আজকাল যজ্ঞোপকরণের মালিকেরা পালাশের মতো তুলনামূলক নরম কাঠের, আকারে ছোট খেলনার মতো উখল-মূসলও বানান।
উপরে উল্লেখিত কাঠের যেসব পাত্র আছে, সেগুলি সাধারণত বরণ বৃক্ষের কাঠে তৈরি।
“বরণান্যহোমসংযুক্তানি”—যে পাত্রগুলির হোম বা আহুতির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক নেই, সেগুলি বরণ বৃক্ষের কাঠের হয়।
১০. পূর্ব (সূপ) — এটি বাঁশের পাতলা চেরা কাঠি দিয়ে বা শূরপর্ণ (ঝুড়ি-জাতীয়) দিয়ে তৈরি হয়। এতে দড়ি বা সুতো ব্যবহার নিষিদ্ধ।
১১. কৃষ্ণাজিন — এটি কালো হরিণের অখণ্ড চর্ম হওয়া উচিত। অখণ্ড বলতে বোঝায়—গুলি বা তীর দিয়ে মারা হরিণের চামড়া নয়। (বর্তমান কালে এর পরিবর্তে বস্ত্র ব্যবহার করাই যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়)। এটি উখলের নীচে পেতে রাখা হয়, যাতে ধান বা যব কুটবার সময় ছিটকে পড়া দানা মাটিতে না পড়ে।
১২. দৃষদ্ ও উপল (শিলা ও লোড়ি) — এগুলি শক্ত পাথরের হওয়া উচিত, যাতে ধান বা যব পেষণ করার সময় পাথর ক্ষয়ে না যায়। দৃষদ্ (শিলা)-র পরিমাপ প্রায় ১২ অঙ্গুল চওড়া ও ১৮ অঙ্গুল লম্বা। উপল বা লোড়ির পরিমাপ প্রায় ৬ অঙ্গুল।
১৩. ইডাপাত্রী — এটি বরণ বৃক্ষের কাঠে তৈরি হয়। দৈর্ঘ্যে এক হাত (প্রায় ২৪ অঙ্গুল) অথবা এক অরত্নি (প্রায় ২২ অঙ্গুল), উচ্চতায় ৪ অঙ্গুল। মাঝখানে সামান্য বাঁকানো ও খোদাই করা থাকে। ধরার জন্য এতে ৪ অঙ্গুল লম্বা একটি দণ্ড থাকে।
১৪. আসন — ব্রহ্মা, অধ্বর্যু, হোতা, যজমান ও যজমান-পত্নীর বসার জন্য ২২ অঙ্গুল লম্বা ও চওড়া কুশের বা কাঠের আসন ব্যবহৃত হয়। সব্বড়ী পালনের স্থানে পশমের আসন সুবিধাজনক। ছবিতে একে ‘পাটলা’ নামে দেখানো হয়েছে এবং পায়ার উপর উঁচু করে দেখানো হয়েছে, কিন্তু তা সঠিক নয়। যজমান প্রভৃতির আসন ভূমির সঙ্গে সংলগ্ন হওয়া উচিত, অগ্নিস্থানের চেয়ে উঁচু নয়।
১৫. যোক্ত্র — এটি মুঞ্জ ঘাসের তিনটি পাকানো দড়ি দিয়ে তৈরি, দৈর্ঘ্যে প্রায় চার হাত। যজ্ঞকর্মে যজমান ও তাঁর স্ত্রীর কোমরে বাঁধার জন্য ব্যবহৃত হয়।
১৬. পুরোডাশ-পাত্র (দুটি) — দৈর্ঘ্যে প্রাদেশ (প্রায় ৬ অঙ্গুল), চওড়ায় ৫ অঙ্গুল, সাধারণত চৌকো। মাঝখানে ৬ অঙ্গুল গভীর খোদাই থাকে। দর্শপূর্ণমাসে দুটি পুরোডাশ থাকে, তাই পৃথকভাবে রাখার জন্য দুটি পাত্র প্রয়োজন। ধরার জন্য এতে ৪ অঙ্গুলের দণ্ড থাকে।
১৭. শৃতাবদান — দৈর্ঘ্যে প্রাদেশ (প্রায় ৬ অঙ্গুল), চওড়ায় ২ অঙ্গুল। অগ্রভাগ থালার মতো প্রশস্ত। পাকা পুরোডাশ প্রভৃতিকে ভাগ করার কাজে ব্যবহৃত হয়।
১৮. প্রাশিত্র-হরণ (দুটি) — এগুলি কখনো চৌকো, কখনো গোল, আবার কখনো গরুর কানের মতো আকৃতির হয়। মাঝখানে গহ্বর খোদাই করা থাকে। ধরার জন্য ৪ অঙ্গুলের দণ্ড থাকে।
১৯. পড্বত — ছয় অঙ্গুল লম্বা, কটু (ছোট ডাবর বা খুন্তির মতো) আকৃতির, দু’পাশে খোদাই করা থাকে।
২০. অন্তর্ধান কাট — এটি অর্ধচন্দ্রাকৃতি, দৈর্ঘ্যে ১২ অঙ্গুল ও উচ্চতায় প্রায় ৮ অঙ্গুল।
২১. উপবেশ-প্রশ্ন — দৈর্ঘ্যে ২২ অঙ্গুল। এক প্রান্ত হাতের তালুর মতো প্রশস্ত, অন্য প্রান্তে আঙুল বা গাঁটের মতো গঠন থাকে।
২২. রজ্জু (দড়ি) — এটি মুঞ্জ ঘাসের তৈরি। সমিধা ইত্যাদি বাঁধার কাজে ব্যবহৃত হয়।
২৩. শঙ্কু — খাদির (খৈর) কাঠের তৈরি। দৈর্ঘ্যে ১২ অঙ্গুল, মোটা দিকে ৪ অঙ্গুল চওড়া। অগ্রভাগ সূচালো। বেদি নির্মাণের সময় স্থান মাপার কাজে ব্যবহৃত হয়। প্রয়োজন অনুসারে এর সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়।
২৪. পূর্ণপাত্র (দুটি) — যজমান ও তাঁর স্ত্রীর জন্য ব্যবহৃত হয়। দৈর্ঘ্যে ১২ অঙ্গুল, চওড়ায় ৪ অঙ্গুল, গভীরতায় ৪ অঙ্গুল খোদাই করা থাকে।
২৫. প্রণীতা পাত্র — এটি জল রাখার পাত্র। দৈর্ঘ্যে ১২ অঙ্গুল, চওড়ায় ৪ অঙ্গুল, গভীরতায় ৪ অঙ্গুল। ধরার জন্য ৪ অঙ্গুলের দণ্ড থাকে।
২৬. প্রাজ্য-স্থালি — ঘৃত (ঘি) রাখার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি গোলাকার, প্রস্থে প্রায় ১২ অঙ্গুল এবং উচ্চতায় প্রাদেশ (প্রায় ৬ অঙ্গুল)।
২৭. চরু-স্থালি — চরু (মাড় না ছাড়া চাল) রান্নার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি প্রায় ১২ অঙ্গুল চওড়া ও ২ অঙ্গুল উঁচু।
২৮. প্রত্যাহার-পাত্র (স্থালি) — চারজন মানুষের আহারের উপযোগী পরিমাণ ভাত রান্নার জন্য ব্যবহৃত পাত্র।
বিশেষ মন্তব্য — ২৫, ২৬ ও ২৭ নম্বর পাত্রগুলি পিতল বা কাঁসার হওয়া উচিত। কোথাও কোথাও তামার পাত্রের নির্দেশও পাওয়া যায়। তবে তামার হলে ভিতরে অবশ্যই কলাই করা থাকতে হবে, কারণ গরম খাদ্য তামার পাত্রে দূষিত হয়ে যায়। সেই জন্য তামার পাত্র মূলত কেবল জল রাখার কাজেই ব্যবহার করা উচিত।
সংস্কারবিধি গ্রন্থে উপরোক্ত পাত্রগুলির অতিরিক্ত আরও কিছু পাত্র ও দ্রব্যের চিত্র ও বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। সেগুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিচে দেওয়া হল—
২৯. প্রত্রি — এটি প্রায় ২৪ অঙ্গুল লম্বা, উপরের দিকে চওড়া এবং অগ্রভাগে সূচালো, কোদালের মতো আকৃতির।
৩০. অরণি — এর দুই প্রকার: উত্তরারণি ও অধরারণি। সাধারণত শমী (খেজড়া) গাছের কাঠ অথবা সাধারণ পিপলের কাঠ থেকে তৈরি হয়। সংস্কারবিধিতে এদের বিশদ লক্ষণ নেই, শুধু চিত্র দেওয়া আছে। চিত্রে উত্তরারণির দৈর্ঘ্য ১৮ অঙ্গুল দেখানো হয়েছে, যা যথার্থ নয়। অধরারণি সাধারণত প্রায় ৬ অঙ্গুল পুরু ও চওড়া এবং প্রায় ১২ অঙ্গুল লম্বা হয়। এর মাঝখানে উত্তরারণির নিচের মোটা অংশের সমান গর্ত করা থাকে। এই দুটি এবং পরবর্তী একটি উপকরণ অগ্নিমন্থনের (ঘর্ষণের মাধ্যমে আগুন উৎপন্ন করা) কাজে ব্যবহৃত হয়।
৩১. চাত্র — সংস্কারবিধিতে এর কোনো লক্ষণ দেওয়া নেই, কেবল চিত্র মুদ্রিত আছে। চিত্রে ১২ অঙ্গুল মাপ লেখা আছে, কিন্তু এই নামে কোনো স্বতন্ত্র পাত্রের উল্লেখ গ্রন্থে পাওয়া যায় না। সম্ভবত চিত্রটি সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে এখানে যে ‘চাত্র’-এর চিত্র দেওয়া হয়েছে, তা আসলে প্রমন্থ দণ্ডেরই রূপ বলে মনে হয়। প্রমন্থ দণ্ড সাধারণত ১২ অঙ্গুল লম্বা হয়। এর নিচের অংশে উত্তরারণির টুকরো বসানো থাকে এবং উপরের অংশটি অপেক্ষাকৃত সরু হয়, যাতে ঘর্ষণের সময় সহজে ধরা যায়।
৩২. প্রোক্ষিণী — এটি জল ছিটানো বা আচার্য-পাত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
৩৩. পিষ্টপায়ী — এই পাত্রটির স্পষ্ট লক্ষণ সংস্কারবিধিতে দেওয়া নেই, কেবল একটি চিত্র রয়েছে। সেটিও যথার্থ নয়। প্রকৃতপক্ষে এটি দুটি পৃথক পাত্র হওয়া উচিত (৪২–৪৩ নম্বর দ্রষ্টব্য), কিন্তু চিত্রে দুটিকে একত্রে দেখানো হয়েছে।
অতিরিক্ত টীকা —
১) মুসলমান সমাজে চাল ইত্যাদি রান্নার জন্য ‘বেগ’ (বড় পাত্র) ও ‘দেগচি’ (ছোট পাত্র) সাধারণত তামার তৈরি হলেও সেগুলির ভেতরে কলাই করা থাকে। তামার পাত্র আগুনে তুলনামূলক কম জ্বলে এবং পিতল প্রভৃতির তুলনায় টেকসই হয়।
২) কাঁসা হলো পিতল ও তামার সংমিশ্রণে তৈরি ধাতু। আগে কাঁসার বাটলোই ও অন্যান্য রান্নার পাত্র প্রচলিত ছিল, বর্তমানে তার ব্যবহার অনেকটাই কমে গেছে।
৩৪. শম্যা — এর লক্ষণ সংস্কারবিধিতে বর্ণিত নয়, কেবল চিত্র দেওয়া আছে। শম্যা মূলত একটি প্রদেশ (প্রায় ৬ অঙ্গুল) মাপের কাঠের খুঁটির মতো, যা মাটিতে গাঁথা হয়।
৩৫. ভোভলী — অগ্নিমন্থনের সময় উত্তরারণির উপর এটি রেখে চাপ দেওয়া হয়। যেমন কাঠমিস্ত্রি কাঠে ছিদ্র করার সময় উপরের দিক থেকে চাপ দিয়ে দড়ি দিয়ে ঘর্ষণ করে, তেমনই দধিমন্থনের দড়ির মতো পদ্ধতিতে আগুন উৎপন্ন করার সময় এটি ব্যবহৃত হয়। এর মাঝখানেও অরণির উপরের অংশ বসানোর জন্য গর্ত থাকে।
৩৬. নেত্রী (নেতু/নেতো) — এটি চার হাত লম্বা, গরুর লোম দিয়ে তৈরি তিন স্তরের দড়ি। এটিকে উত্তরারণিতে পেঁচিয়ে দুই হাতে টেনে দধিমন্থনের মতোভাবে অগ্নিমন্থন করা হয়।
বিশেষ মন্তব্য — ২৬, ৩০ ও ৩১ নম্বরের উপকরণগুলি পারস্পরিক অসামঞ্জস্য দূর করার কাজে সহায়ক। এগুলির সঙ্গে দর্শপূর্ণমাস যজ্ঞের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই।
৩৭. ইষ্ম — পলাশ কাঠের ১৮টি সমিধা, প্রতিটি এক হাত লম্বা। এগুলি আগুন প্রজ্বালনের কাজে ব্যবহৃত হয়।
৩৮. পরিধি — পলাশ কাঠের সমিধা, বাহুমাত্র লম্বা। এগুলি গার্হপত্য অগ্নিকুণ্ডের তিন দিকে (পূর্ব দিক বাদ দিয়ে) স্থাপন করা হয়।
৩৯. সামিধেনী-সমিতি — পলাশ কাঠের ১৫টি সমিধা, প্রতিটি প্রায় এক প্রাবেশনাত্র (প্রায় ৮০ অঙ্গুল) মাপের।
৪০. সমীক্ষণ — এটি পাঁচ স্তরের দর্ভ ঘাস দিয়ে তৈরি দড়ি। কোথাও কোথাও তিন স্তরের দড়ির বিধানও আছে। এটি সমিধা বাঁধার কাজে ব্যবহৃত হয়।
এখন সেই সব পাত্র ও উপকরণের বিবরণ দেওয়া হচ্ছে, যেগুলির উল্লেখ সংস্কারবিধিতে নেই, কিন্তু দর্শপূর্ণমাস যজ্ঞের জন্য প্রয়োজনীয়—
৪১. মহন্তীপাত্র — ‘মহন্তী’ বলতে গরম জল বোঝায়। চাল বা যব পিষে যে ময়ান প্রস্তুত করা হয়, তা মেশানোর জন্য গরম জলের প্রয়োজন হয়। সেই গরম জল রাখার জন্য এই পাত্র ব্যবহৃত হয়।
৪২. মেক্ষণ — এটি বরণ গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি, অরণিপ্রমাণ (প্রায় ২২ অঙ্গুল) লম্বা। চাল বা যবের ময়ান গরম জলের সঙ্গে মেশাতে এটি ব্যবহৃত হয়। এটি পূর্বে উল্লিখিত ১৭ নম্বর শৃতাবদান পাত্রেরই সদৃশ বলে মনে হয়।
৪৩. পিষ্টলেপ-পাত্র — ময়ান মেশানোর সময় পাত্রের গায়ে যে লেপ লেগে থাকে, তা ধুয়ে রাখার জন্য এই পাত্র ব্যবহৃত হয়।
৪৪. ফলীকরণ-পাত্র — উখল-মূসল দিয়ে কুটে নেওয়া ধান বা যব থেকে চালুনি দিয়ে আলাদা করা তুষ এই পাত্রে রাখা হয়। এটি বরণ কাঠের তৈরি, প্রায় প্রদেশমাত্র (প্রায় ৬ অঙ্গুল)।
৪৫. শকট (গাড়ি) — দর্শপূর্ণমাস প্রভৃতি যজ্ঞে ব্যবহারের জন্য হব্যদ্রব্য আনার কাজে এই গাড়ি ব্যবহৃত হয়। যজ্ঞশালার কাছে এই গাড়িতে ধান বা যব রেখে আনা হয়। বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রে যজ্ঞকার্য সম্পাদনকারীরা কেবল প্রদর্শনের জন্য কাঠের ছোট গাড়ি বানান এবং তাতে আগে থেকে পিষে রাখা শস্য সামান্য স্পর্শ করান। প্রাচীন কালে মানুষ কলসি, ঝুড়ি বা চামড়ার থলি ব্যবহার করেই যজ্ঞোপযোগী দ্রব্য সংগ্রহ করত (শতপথ ব্রাহ্মণ ২।১।২।১৭)।
৪৬. কপাল — এগুলি মাটির তৈরি ছোট, পাতলা, আগুনে পোড়ানো ভাঙা হাঁড়ির খণ্ডের মতো। এর উপর পুরোডাশ রেখে তা পাকানো হয়। দর্শপূর্ণমাস যজ্ঞে মোট ১৮টি কপালের প্রয়োজন হয়।
৪৭. কুশা — বেদিতে বিছানোর জন্য এবং ঘৃত প্রভৃতির উৎপবন (ছাঁকন/শুদ্ধিকরণ) ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত হয়।
৪৮. ধান বা যব — পুরোডাশ প্রভৃতি প্রস্তুত করার জন্য ব্যবহৃত হয়।
৪৯. আজ্য (ঘৃত) — গাভীর ঘি। গাভীর ঘি না পেলে মহিষ বা ছাগলের ঘি ব্যবহার করা যায়। যদি এতে ভেজাল থাকার সন্দেহ হয়, তবে ঘির প্রতিনিধিরূপে শুদ্ধ নারকেল তেল ব্যবহার করা যেতে পারে—এটি লেখকের নিজস্ব মত। কারণ ঘি ও নারকেল তেলের মধ্যে বহু সাদৃশ্য আছে।
উপরোক্ত সব পাত্র ও দ্রব্য পূর্ণমাস ও অমাবস্যা—উভয় পক্ষেই (সান্নায়্য হবি ব্যতীত) প্রয়োজন হয়।
সান্নায়্য হবি প্রস্তুতের জন্য নিম্নলিখিত পাত্র ও দ্রব্যের প্রয়োজন—
১. গাভী — দুধের জন্য।
২. দোহনপাত্র — যে পাত্রে দুধ দোহন করা হয়। এটি কাঠের হয়। এর পরিমাপ দুধের পরিমাণের উপর নির্ভর করে।
৩. কুম্ভ — মাটির পোড়া হাঁড়ি, যাতে দুধ গরম করা হয়। গ্রামে আজও দুধ গরম করার জন্য এটি ব্যবহৃত হয়। এর পরিমাপও দুধের পরিমাণের উপর নির্ভরশীল।
৪. অভিধানী — গরুর গলায় বাঁধার দড়ি।
৫. নিদান — দোহনের সময় গরুর পা বাঁধার দড়ি।
৬. বিধান-পাত্র — গরম করা দুধ ঢেকে রাখার জন্য মাটির বা ধাতুর পাত্র।
৭. শিশ্য (ছিঁকা) — দুধের পাত্র সুরক্ষার জন্য ঝুলিয়ে রাখার উপকরণ। এটি মূলত মুঞ্জ ঘাস ইত্যাদি দিয়ে তৈরি।
৮. যজমান-পাত্র (২টি) — যজমানের ভোজনের জন্য এবং দুধ ও দই রাখার জন্য ব্যবহৃত হয়। এগুলি যজ্ঞীয় বৃক্ষের কাঠ দিয়ে নির্মিত দুটি পাত্র।
৯. পলাশ-শাখা অথবা শমী-শাখা — গাভী দোহনের পর বাছুর বা বাছুরীকে সরিয়ে রাখার জন্য ব্যবহৃত হয়।
এই সমস্ত পাত্র ও দ্রব্যের ব্যবহার দর্শপূর্ণমাস যজ্ঞের বিধান বর্ণনার সময় যথাস্থানে ব্যাখ্যা করা হবে।
এখন আমরা সংস্কারবিধিতে প্রদত্ত যজ্ঞপাত্রগুলির চিত্র উপস্থাপন করব। সেগুলি সেখানে ক্রমানুসারে মুদ্রিত নয়; তাই আমরা—
পূর্ণমাস ইষ্টি
দর্শ–পূর্ণমাস যজ্ঞে প্রথম করণীয় ইষ্টি। পূর্বের ৩১ পৃষ্ঠায় ইতিপূর্বে লেখা হয়েছে যে দর্শ–পূর্ণমাস ইষ্টিগুলির মধ্যে প্রথমে পূর্ণমাস ইষ্টিই সম্পন্ন করা হয়। অথর্ববেদ ৭।১৮।১৪-তেও বলা হয়েছে—
“পৌর্ণমাসী প্রথমা যজ্ঞিয়া আসীত্”
অর্থাৎ পূর্ণিমাই প্রথম যজ্ঞীয় কর্ম। অতএব প্রথমে পূর্ণমাস ইষ্টির প্রক্রিয়া বর্ণনা করা হল।
পূর্ণিমা দিনের করণীয়
পূর্ণিমার দিনে যজমান প্রাতঃকালে নিত্যকর্ম সম্পন্ন করে প্রাতঃকালীন অগ্নিহোত্র করেন। এরপর গার্হপত্য অগ্নি থেকে আহ্বনীয় ও দক্ষিণাগ্নিতে অগ্নি প্রণয়নের জন্য অগ্নির উত্তোলন করে তা আহ্বনীয় ও দক্ষিণাগ্নিতে স্থাপন করা হয়। তিনটি অগ্নিতে অগ্নি প্রজ্বলনের জন্য দুইটি করে মোট ছয়টি সমিধা অর্পণ করা হয়। এর মধ্যে প্রথমটি “মমাগ্নে বর্চঃ” মন্ত্রসহ দেওয়া হয় এবং দ্বিতীয়টি মন্ত্রবিহীনভাবে দেওয়া হয়।
পাঁচ ভূসংস্কার
দেবযাজিক প্রভৃতি পদ্ধতিকারদের মতে, উপরোক্ত ভূসংস্কার সম্পন্ন করেই অগ্নি স্থাপন করা উচিত। এই পাঁচটি সংস্কার হল—
১. কুণ্ডের পরিসমূহন — তিনটি দর্ভ দ্বারা অগ্নিকুণ্ডের অপবিত্রতা দূর করা।
২. কুণ্ডের উপলেপন — গোবর ও জল দিয়ে কুণ্ড লেপন করা।
৩. তিনবার উল্লিখন — হাতের মাপ অনুযায়ী পূর্ব থেকে উত্তর দিকে অগ্নিকুণ্ডের সমান্তরালে তিনটি রেখা অঙ্কন করা।
৪. পাংশু উত্তোলন — পূর্বে অঙ্কিত রেখার মাটি অনামিকা ও বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা তুলে পৃথক করা।
৫. জল দ্বারা অভ্যুক্ষণ — জল ছিটিয়ে অগ্নিকুণ্ড শুদ্ধ করা।
এই পাঁচটি কর্ম পারস্কর গৃহ্যসূত্রে নির্দেশিত হয়েছে। ব্যাখ্যাকারদের মতে, এই পাঁচ ভূসংস্কার অগ্নিকুণ্ডে অগ্নি স্থাপনের জন্য, যজ্ঞীয় ভূমির সাধারণ সংস্কারের জন্য নয়।
মাংস ও মৈথুন বর্জন এবং সত্যবচনের ব্রত
যজমান যজ্ঞকর্মের উভয় দিন মাংস ও মৈথুন ত্যাগ করবেন এবং নির্দিষ্ট মন্ত্র দ্বারা অমৃত ত্যাগপূর্বক সত্যবচনের ব্রত গ্রহণ করবেন।
কেশ ও নখ ছেদন
যজমান, গুরু-শিক্ষা ব্যতীত, কেশ ও শ্মশ্রু মুণ্ডন এবং নখ ছেদন করাবেন। যজমান-পত্নী কেবল নখ ছেদনই করবেন।
কুশ আহরণ
মুণ্ডনের পর স্নান করে যজমান পূর্ব অথবা উত্তর দিকে গমন করে, আসন্ন যজ্ঞকর্মের জন্য কুশ আহরণ করবেন।
(পাদটীকা অংশের সারার্থ)
— গার্হপত্য অগ্নি থেকে আহ্বনীয় ও দক্ষিণাগ্নিতে অগ্নি প্রণয়নই মূলত অগ্নি-প্রণয়ন কর্ম।
— এ বিষয়ে শ্রৌতসূত্রে বিভিন্ন মত উল্লেখ আছে; এটি কখনও মধ্যাহ্নেও সম্পন্ন হতে পারে।
— মাংস ও মৈথুন ত্যাগ এবং অসত্য বর্জন ধর্মশাস্ত্রে সাধারণভাবেই নিষিদ্ধ; এখানে এগুলি কর্মাঙ্গরূপে গ্রহণীয়। এদের লঙ্ঘনে যজমানকে শ্রৌত প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়।
কুশা বা দর্ভ বহির্দেবসদনে দামী মন্ত্রোচ্চারণপূর্বক দর্ভ কেটে গৃহে এনে আহ্বনীয় স্থানের উপরে খোঁক (সংরক্ষণ-পাত্র) প্রভৃতিতে রেখে দেবে, যাতে কর্মের সময় সহজে গ্রহণ করা যায়। কুশা তিন, পাঁচ, সাত ইত্যাদি অযুগ্ম সংখ্যায় মুষ্টিপরিমাণে আনতে হয়। এর মধ্যে প্রথম কাটা কুশমুষ্টিকে ‘প্রস্তর’ বলা হয়।
ইষ্মাহরণ—কুশ আহরণের সময়েই পলাশ বৃক্ষের ২১টি ইধ্মসংজ্ঞক কাঠ, ভেজা বা শুকনো, ছালসহ আনতে হয়। এই ২১টি কাঠের মধ্যে ১৫টি সামিধেনীর জন্য, ৩টি পরিধির জন্য, ২টি আধার সমিধ এবং ১টি অনুয়াজের জন্য নির্ধারিত হয় (যজ্ঞতত্ত্ব-প্রকাশ)। সংস্কারবিধি অনুসারে ১৫টি সামিধেনী সমিধ প্রাদেশমাত্র (১১ অঙ্গুল) এবং পরিধির জন্য ৩টি ইধ্ম বাহুমাত্র হয়।
ব্রতোপায়ন—অপরাহ্নে দম্পতি যে অন্নের আহুতি দেওয়া হবে না, সেই হব্যদ্রব্যের ভোজন করবে। ভক্ষণীয় অন্ন ঘৃত দ্বারা উপসিক্ত, অর্থাৎ স্নিগ্ধ হবে, শুষ্ক হবে না। এবং এমন পরিমাণে ভক্ষণ করবে, যাতে খাওয়া অন্নও না-খাওয়া অন্নের সমান মনে হয়—“যদশিতমনশিতং স্যাত্ তদশ্নীয়াত্” (শতপথ ২।১।১)।
রাত্রিতে শয়ন—পূর্ণিমার দিনে সায়ংকালে অগ্নিহোত্র সম্পন্ন করে যজমান গার্হপত্য অথবা সাহ্নীয় অগ্নির নিকটে ভূমিতে মৃগচর্ম বা উলের বস্ত্র বিছিয়ে শয়ন করবে, অথবা সমগ্র রাত্রি জাগরণ করবে।
পক্ষান্তর—পূর্ণমাসেষ্টিতে একটি পক্ষ এই যে, পূর্বদিনে যে কর্ম করা হয়েছে, তার পরের দিন অর্থাৎ প্রতিপদে পূর্ণমাসেষ্টি সম্পন্ন করা হয়।
প্রতিপদ দিনের কর্ম—অতঃপর প্রতিপদের দিনে যজমান প্রাতঃকালে উঠে নিত্যকর্ম ও অগ্নিহোত্র সম্পন্ন করে পূর্ণমাসেষ্টি কর্মের আরম্ভ করবে।
ছয় আসন—সর্বপ্রথম গার্হপত্যের উত্তরে ব্রহ্মা ও যজমানের জন্য দুটি আসন, সাহ্নীয়ের দক্ষিণে ব্রহ্মার আসন, তার পশ্চিমদিকে যজমানের আসন, গার্হপত্যের উত্তরে অধ্বর্যুর বসার জন্য একটি আসন, এবং প্রণীতার প্রণয়নের জন্য সাহ্নীয়ের উত্তরে অগ্ন্যু-এর দ্বিতীয় আসন—এইভাবে মোট ছয়টি আসন স্থাপন করতে হয়। এই আসনগুলি মৃগচর্ম, কুশা, উন অথবা কাঠের হতে পারে।
ব্রহ্মার বরণ ও প্রার্থনা—গার্হপত্যের উত্তরে উত্তরমুখে বসে যজমান বাম হাতে স্রুক ধারণ করে, দক্ষিণ দিকে পূর্বাভিমুখে বসা ব্রহ্মার ডান হাঁটু ধরে বলে—“আমি অমুক গোত্রের অমুক নামের ব্যক্তি পূর্ণমাসেষ্টি যজ্ঞ সম্পাদন করব। সেই যজ্ঞে আপনাকে ব্রহ্মা হিসেবে গ্রহণ করছি।” এইভাবে ব্রহ্মার বরণ করবে। বরণকৃত ব্রহ্মা “গর্ভ ভূপাতিরহং” প্রভৃতি মন্ত্র জপ করবেন। এরপর যজমান ব্রহ্মার নিকট “বাচস্পতেযজ্ঞং গোপায়”—হে বেদের অধিপতি, আমার যজ্ঞ রক্ষা করুন—এইভাবে প্রার্থনা করবে। তার উত্তরে ব্রহ্মা বলবেন—“গোপায়ামি”—আমি রক্ষা করছি।
স্ব-আসনে ব্রহ্মার বসা—বরণ সম্পন্ন হলে বরণস্থল থেকে উঠে ব্রহ্মা সাহ্নীয়ের পশ্চিম অথবা পূর্ব দিক দিয়ে গিয়ে নিজের আসনে বসবেন।
বিশেষ নিয়ম—নিজ আসনে বসে ব্রহ্মা অনুয়াজ কর্ম অথবা ভাগ-পরিহরণ পর্যন্ত মৌন পালন করবেন। প্রয়োজন হলে অল্পাক্ষর সংস্কৃত বাক্যে কথা বলতে পারবেন।
প্রণীতা-প্রণয়ন—অধ্বর্যু ডান হাতে জলে পূর্ণ পাত্র নিয়ে, তা থেকে বাম হাতে ধারণ করে প্রণীতা প্রণয়ন করবে।
বৃক্ষনির্মিত চক্রাকৃতি প্রণীতাপাত্রে জল ঢেলে ডান হাতে সেই পাত্রটি গার্হপত্য অগ্নির উত্তরে স্থাপন করে। তারপর মন্ত্রোচ্চারণপূর্বক প্রণীতাপাত্রস্থিত জল স্পর্শ করে অধ্বর্যু ব্রহ্মাকে জিজ্ঞাসা করে—
“হে মহান্! আমি এই জলের প্রণয়ন করব”—এই বলে ব্রহ্মার অনুমতি প্রার্থনা করে। একই সঙ্গে যজমানকে বলে—“বাচং বচ্ছ” (মৌন ধারণ করো)।
এরপর ব্রহ্মা “ওঁ প্রণয়” বলে অধ্বর্যুকে প্রণীতার প্রণয়নের অনুমতি দেন। ব্রহ্মার অনুমতি প্রাপ্ত হলে অধ্বর্যু উভয় হাতে প্রণীতাপাত্র ধরে আহ্বনীয় অগ্নির উত্তরে কুণ্ডের পাশে বিছানো দর্ভের উপর স্থাপন করে এবং উপরে থেকেও দর্ভ দিয়ে ঢেকে দেয়।
গার্হপত্য প্রভৃতি অগ্নির পরিস্তরণ—পূর্বে কেটে আনা প্রাগগ্র বা উদগ্র দর্ভতৃণ দ্বারা আহ্বনীয়, গার্হপত্য এবং দক্ষিণাগ্নির ক্রমানুসারে পরিস্তরণ করা হয়। এর বিধি এইরূপ—
প্রথমে পূর্ব দিকে উত্তরাভিমুখী অগ্রভাগযুক্ত দর্ভ দ্বারা,
দক্ষিণে পূর্বাভিমুখী অগ্রভাগযুক্ত দর্ভ দ্বারা,
পশ্চিমে উত্তরাভিমুখী অগ্রভাগযুক্ত দর্ভ দ্বারা,
এবং উত্তরে পূর্বাভিমুখী অগ্রভাগযুক্ত দর্ভ দ্বারা—প্রতিটি অগ্নির পরিস্তরণ করা হয়।
পাত্রাসাদন—এরপর অধ্বর্যু অথবা যজমান আহ্বনীয় অগ্নির পশ্চিমে অথবা উত্তরে দুই-দুটি করে পাত্র স্থাপন করবে। যদি আহ্বনীয়ের পশ্চিমে রাখা হয়, তবে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে পাত্রগুলির অগ্রভাগ পূর্বদিকে রেখে সাজাতে হবে। যদি গার্হপত্যের উত্তরে রাখা হয়, তবে দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে পাত্রগুলির অগ্রভাগ পূর্বদিকে রেখে স্থাপন করতে হবে। এখানে ‘পাত্র’ শব্দ দ্বারা যজ্ঞসাধনসমূহ বোঝানো হয়েছে; পানীয় গ্রহণের পাত্র বোঝানো হয়নি। এই অর্থে শূর্প প্রভৃতিও ‘পাত্র’ নামে অভিহিত হয়।
দুই-দুই পাত্রের জোড়া—
(১) শূর্প ও অগ্নিহোত্ৰগ্রহণী,
(২) রূপ্য শূর্প ও কপাল,
(৩) দম্যা ও কৃষ্ণাজিন (কৃষ্ণমৃগের চর্ম),
(৪) উখল ও মুষল,
(৫) দৃষদ্ ও উপল (শিলা ও লোটি),
(৬) দ্রাফ্ট সঞ্চয়পাত্র ও ব্রীহি বা যব,
(৭) পবিত্রছেদন তিনটি ও দুইটি পবিত্র,
(৮) উপবেশ ও সংভবন উদকপাত্র,
(৯) আজ্যস্থালি ও আজ্য,
(১০) বেদের জন্য কুশসৃষ্টি ও দক্ষিণায় অন্বাহার্য তণ্ডুল,
(১১) বেদিতৃণ ও ঘোর অত্রি,
(১২) ইধ্ম ও বহি,
(১৩) স্রুক ও জুহূ,
(১৪) উপভৃত ও প্রগা,
(১৫) দুইটি প্রাশিত্র-হরণ,
(১৬) ঘৃতাবদান ও পুরোডাশপাত্র,
(১৭) মোচন ও উন-কুশা,
(১৮) পরিধি ও কুশাস্তীর্ণ হেতুপদন,
(১৯) ইডাপাত্র ও বদ্বত,
(২০) অন্তর্ধান কাট ও পূর্ণপাত্র
(ভীমসেনবিরচিত দর্শপূর্ণমাস পদ্ধতি)।
এই পাত্রসমূহের বিন্যাসে বিভিন্ন পদ্ধতিকারদের মধ্যে কিছু ভেদ দেখা যায়।
পতনস্বক্কাস (কৃত্যবিন্যাস) অনুসারে আহ্বনীয় অগ্নির উত্তরে কুশা বিছিয়ে, তার উপর উল্টো করে (মুখ নিচে) যেসব পাত্র রাখা হয়, সেগুলি হল—
স্রুক, জুহূ, উপভৃত, ধ্রুবা, বেদ, পাত্র, আজ্যস্থালি, প্রাশিত্রহরণ, ইডাপাত্র, প্রণীতাপ্রণয়ন—এগুলো বদ্ধ পাত্র।
অনুরূপভাবে গার্হপত্য অগ্নির উত্তরে দর্ভ বিছিয়ে তার উপর উল্টো করে রাখা হয়—
স্থালি, ২১টি কপাল, অগ্নিহোত্রগ্রহণী, শূর্প, কৃষ্ণাজিন, কন্যা, উখল, মুষল, দৃষদ্, উপল—এগুলো অবদ্ধ পাত্র।
এই পাত্রগুলির উত্তরে রাখা হয়—
যোগত্র, মদন্তী, মেক্ষণ, বেদাগ, অন্বাহার্য-স্থালি, ইধ্মা, উপবেদ, পিষ্টলেপপাত্র, ফলীকারণপাত্র।
টীকা—
যজমান-পত্নীর কোমরে বাঁধার জন্য মুঞ্জনির্মিত রজ্জুকে যোগত্র বলা হয়। ‘মদন্তী’ শব্দ দ্বারা উষ্ণ জলের অর্থ বোঝায়। পেষিত ব্রীহি বা যবকে জলের সঙ্গে মেশানোর জন্য কাঠনির্মিত যে পাত্র, তাকে মেক্ষণ বলা হয়।
হবিনির্বাপ (হবি-নির্বাপ)—
হবি-নির্বাপের অর্থ হল—যজ্ঞের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণে হব্য (হবি) গ্রহণ করা। এই হবি গ্রহণ করা হয় হব্য অন্নে ভরা গাড়ি (শকট) থেকে।
ইষ্টিকে গার্হপত্য অগ্নির পশ্চিমে প্রাগগ্র বা উদগ্র অবস্থায় স্থাপন করে, অধ্বর্যু শূর্প ও অগ্নিহোত্রহবণী গ্রহণ করে সেগুলিকে গার্হপত্য অগ্নিতে উত্তপ্ত করে “অন্তরিক্ষমন্বেমি” মন্ত্র উচ্চারণ করে শকটের পশ্চিম দিকে যায় এবং তার দক্ষিণ ও উত্তর দিকের ঘূঃ স্পর্শ করে।
গাড়ির যে দণ্ড বা কাঠ দু’টি পিছনের দিকে প্রসারিত থাকে, সেগুলিকে ঈষা বলা হয়। সেই ঈষার অগ্রভাগ যাতে ভূমি স্পর্শ না করে, তার জন্য যে অবলম্বন দেওয়া হয় তাকে উত্তম্ভন (উঁচু করে ধরে রাখার ব্যবস্থা) বলা হয়। অধ্বর্যু “দেবানামসি” মন্ত্র দ্বারা উত্তম্ভনের পিছনে ঈষা স্পর্শ করে।
এরপর চাকার উপর দাঁড়িয়ে হবিষ্য অন্ন পর্যবেক্ষণ করে। যদি অন্নের মধ্যে তৃণ, কাঁকর বা পাথর থাকে, তবে তা সরিয়ে দিয়ে অন্ন স্পর্শ করে। তারপর “দেবস্য ত্বা” মন্ত্র দ্বারা অগ্নিদেবতার জন্য চার মুঠো হবি শূর্পে রাখা অগ্নিহোত্রহবণীতে নির্বাপ (প্রক্ষেপ) করে। এই চার মুঠোর মধ্যে প্রথম তিন মুঠো প্রত্যেকটি মন্ত্রসহ নির্বাপ করা হয় এবং চতুর্থ মুঠোটি মন্ত্র ব্যতীত নির্বাপ করা হয়। একইভাবে অগ্নীষোম দেবতার জন্যও চার মুঠো হবি নির্বাপ করা হয়।
এরপর অবশিষ্ট হবি স্পর্শ করে, অগ্নিহোত্রহবণী থেকে পৃথক পৃথকভাবে হবি পূর্বদিকে স্থাপন করা হয়। তারপর সেটিকে গার্হপত্য বা আহ্বনীয় অগ্নির পশ্চিমে রাখা হয়।
বিশেষ—
শকটের পরিবর্তে ইডাপাত্রে অন্ন ভরে সেখান থেকেও হবি-নির্বাপ করার পক্ষান্তর বিধান আছে। শতপথ ব্রাহ্মণ (১।১।২।৭)-এ বলা হয়েছে যে প্রাচীন ঋষিরা চর্ম বা বস্ত্রের থলি থেকেই হবি নির্বাপ করতেন। তাদের ক্ষেত্রে ধান্য-সম্পর্কিত মন্ত্রগুলি সেই থলির সঙ্গেই যুক্ত ছিল। আট মুঠো হবি গ্রহণের জন্য গাড়িভর্তি অন্ন গার্হপত্যের কাছে আনার প্রথা মূলত প্রদর্শনমূলক।
বর্তমান কালে অনেক যাজিক এক বা দেড় সের পরিমাণ অন্নের ছোট গাড়ি বানিয়ে কেবল হবি স্পর্শমাত্র করান। শুধু তাই নয়, তারা কোথাও থেকে আনা ব্রীহি ভাঙা, খোসা ছাড়ানো, কুটে নেওয়া প্রভৃতি কর্মও করেন না। পেষিত চাল বা যবের আটা ব্যবহার করেন। তবে কল্পিত ‘অদৃষ্ট’ সৃষ্টির জন্য সেই পেষিত আটা উখলে দিয়ে, সূপে ছিটিয়ে, শিলায় রেখে পিষে দেখান। উখল ও মুষলও অদৃষ্ট সৃষ্টির জন্য ছোট আকারে তৈরি করেন। বাস্তবে এসব কর্ম শাস্ত্রবিরুদ্ধ। হয় সম্পূর্ণ শাস্ত্রানুগ বিধি পালন করা উচিত, নতুবা দেশ-কাল-পরিস্থিতি অনুযায়ী তার সংক্ষিপ্ত রূপ গ্রহণ করা উচিত। ঋষি দয়ানন্দ দ্বিতীয় পথটি গ্রহণ করে সংস্কারবিধিতে সরাসরি চালের নির্বাপ নির্দেশ করেছেন এবং তা ধুয়ে চরু প্রস্তুত করার কথা বলেছেন।
হবির প্রোক্ষণ—
এরপর অধ্বর্যু হবির প্রোক্ষণ (জল ছিটিয়ে সিক্ত করা) করার জন্য জল নিয়ে ব্রহ্মার কাছে অনুমতি প্রার্থনা করে—
“ব্রহ্মন্! হবিঃ প্রোক্ষিষ্যামি।”
ব্রহ্মার অনুমতি প্রাপ্ত হলে অধ্বর্যু হবির প্রোক্ষণ সম্পন্ন করে।
পরিভাষা ব্যাখ্যা—
অগ্নির সম্মুখে বসা বৎসের হাঁটুর আকৃতির যে দর্ভতৃণ, তাকে বেদ বলা হয়। বেদের কাটা অগ্রভাগগুলিকে বেদাগ্র বলে। ঋত্বিজদের দক্ষিণা হিসেবে দেওয়া চাল রান্না করার পাত্রকে অন্বাহার্য স্থালি বলা হয়। পেষিত ব্রীহি বা যবের আটা জল দিয়ে মাখার সময় পাত্রে যে লেপ লেগে থাকে, তাকে পিষ্টলেপ বলা হয় এবং তা রাখার পাত্রকে পিষ্টলেপপাত্র বলে। দ্বিতীয়বার ব্রীহি কুটলে চালের উপর যে সূক্ষ্ম ত্বক বের হয়, তাকে ফলীকারণ বলা হয় এবং তা রাখার পাত্রকে ফলীকারণপাত্র বলে।
টীকা—
বলদের কাঁধে যে জোয়াল স্থাপন করা হয়, তার উভয় প্রান্তের অংশকে ঘূঃ বলা হয়।
স্বর এবং প্রশ্নোষমভ্যো স্বা মন্ত্র দ্বারা ক্রমশ উভয় হউবির প্রোক্ষণ কর। এই প্রোক্ষণ করা হয় ব্রীহি এবং যবের তুষকে ভিজিয়ে নরম করার জন্য, যাতে পরে কুটতে সহজে তুষ আলাদা হয়ে যায়।
হৃদি অবহনন—এরপর অধ্ব্যু কৃষ্ণাজিনকে হাতে ধরে পাত্র থেকে দূরে সরিয়ে ঝাঁড়। এরপর গার্হপত্যের উত্তর বা উত্তরের নিকটে প্রাপ্ত কৃষ্ণাজিন বিছিয়ে তার ওপর উলত রাখে।
সূর্যে পৃথক রক্ষা দিয়ে দুই হউবিকে ডান হাত দিয়ে মিলিয়ে বাম হাতে উললে ডেলে। মুষলকে উপলে রেখে হৃবিশ্কৃদেহ মন্ত্র দ্বারা তিনবার হবি কুটতে যজমানের স্ত্রী বা অমনোৎকে ডাক। এতে মনোযোগ দিয়ে হৃদি ফেটে যাবে।
বিশেষ—শতপথ ব্রাহ্মণ ১।১।৪।১২-এ লেখা আছে—ব্রাহ্মণ যজমানের জন্য হৃবিশ্কৃদেহ নিবার্ধ। বৈশ্য এবং ক্ষত্রিয় যজমানের জন্য ফ্রমযাঃ হৃবিশ্কৃদাগহি এবং হৃবিশ্কৃদাদ্রব, শূদ্র যজমানের জন্য হরবি-একৃদাধাভ। একই নির্দেশ তন্তীর ব্রাহ্মণেও পাওয়া যায়। এটি প্রমাণ করে প্রাচীন কালে শুদ্ধ ব্রাহ্মণও যজ্ঞ-ফর্ম করার অধিকার রাখত।
হৃদি পেষণ—হৃদি ফাটতে গেলে অগনিৎ শিলা সম্যায় দুইবার এবং লোড়ি একবার ফাটে। এরপর অম্ব্যু হাতে সূপ নিয়ে ফুটে যাওয়া হৃদি উখল থেকে বের করে সূপে রাখে, তারপর সূপ থেকে তুষ দূরে সরায়। এরপর তুষ থেকে মুক্ত চাউলকে পুষ্ট করে তুষযুক্ত চাউল পুনরায় উখলে ঢেলে কুতে এবং শূর্প দিয়ে তুষ আলাদা করে। তারপর তুষকে উত্তরের স্থানে ঢেলে দেয়।
এরপর সমস্ত চাউল শিলায় রেখে পিষে, এ সময় অগনিৎ কাপালের উপধান সম্পন্ন হয়।
কাপালের উপধান—গ্রধ্য্যু হৃদি প্রোক্ষণ করে প্রমিত কাপালগুলির উপয়ান করে। এর প্রক্রিয়া হলো—
অম্বীত গার্হপত্যের গদ্দারদের হাতাকৃতি উপবেদ পাত্রে কুণ্ডের পূর্ব অংশে একত্রিত করা। ব্রাঙগারের নিচের তপ্ত মাটিতে ফপাল রাখে। প্রথমে উপবেদ দ্বারা পূর্বে একত্রিত অঙ্গার থেকে একটি অঙ্গার গার্হপত্যের পশ্চিম অংশে ডান দিকে রাখার স্থানীয় পুরোড়াশে রাখে। এরপর ধ্রুবমসি মন্ত্র দ্বারা মধ্যম ফপাল স্থাপন। বরুণমসি মন্ত্র দ্বারা মধ্যম ফপাল পশ্চিমে দ্বিতীয় ফপাল স্থাপন। ঘর্ত্রমসি মন্ত্র দ্বারা মধ্যম কাপাল পূর্বে তৃতীয় কাপাল রাখে। বিশ্বাভ্যঃ মন্ত্র পড়ে মধ্যম কাপালের দক্ষিণে চতুর্থ কাপাল রাখে। চিতস্থঃ মন্ত্র বা তৃষ্ণী দ্বারা অবশিষ্ট চার কাপাল সমানভাবে (যো যো) দক্ষিণ ও উত্তরে রাখে। এভাবে সাগ্নেয় পুরোড়াদা কুটতে চাথ কাপাল রাখার ব্যবস্থা বলা হয়েছে।
১. বেদের উত্তরে একটি গর্ত খোওয়া হয়। এটিকে উৎকর বলা হয়। এতে আবর্জনা ফেলা হয়।
২. এজন্য ঋ. দয়ানন্দ- সংস্কারবিধিতে লিখেছেন সম্পূর্ণ অপাঠ শূদ্রের ক্ষেত্রেও যজ্ঞ সম্পন্ন করার বিধান আছে।
৩. পার্যা কাঠ দিয়ে তৈরি হয়। এর সাহায্যে শিলা ও লোঠী টাঁকা সম্ভব নয়। শীলার ও লোঠীর টাঁকা থাকা প্রয়োজন। তাই টঁচি টঁচাই শিলা ও যুটিকে যশফালে সঠিকভাবে টাঁকানোর জন্য ক্রিয়াগুলি সম্পন্ন করা হয়।
প্রশ্নোভোমীয় একাদশ কপাল স্থাপনের প্রক্রিয়া নিম্নরূপ—প্রথমে মধ্যম কপাল স্থাপন। এরপর মধ্যমের পশ্চিমে দ্বিতীয়, মধ্যমের পূর্বে তৃতীয়, মধ্যমের দক্ষিণে চতুর্থ কপাল রাখে। চতুর্থ ফপালের পূর্বে একটি কপালের স্থান রেখে পঞ্চম, চতুর্থ ও পঞ্চমের মধ্যভাগে পাঠ, চতুর্থের পশ্চিমে সপ্তম, তার পেছনে অষ্টম এবং সর্বোত্তরে নবম কপাল স্থাপন করা হয়।
এটাই কপালের উপধান, কাত্যায়ন শ্রুত অনুসারী। অন্যান্য শ্রোতসূত্রে কপালের উপধানে কিছু পার্থক্য আছে।
কপালকে তপানো—ভূগুণামঙ্গিরসাম মন্ত্র দ্বারা গার্হপত্যের প্রজ্বলিত প্রাঙ্গার থেকে সমস্ত কপাল ঢেকে দেয়।
তণ্ডুলের পেষণ—কৃষ্ণাজিনের ওপর শিলা রেখে তার পশ্চিম অংশে উদগ্র সধ্যা রাখে। এতে শিলা পথটি নীচে থাকে। এরপর শিলার ওপর উদগয় লোটি রেখে শিলার ওপর তণ্ডুল স্থাপন। এরপর প্রাণাথ ত্বা পিনষ্ম ইত্যাদি মন্ত্র দ্বারা তণ্ডুল পেষণ করা হয়।
বেদের নির্মাণ—এক মুঠো বর্ষকে ডানদিকে লেপে দ্বিগুণ করে এক প্রাদেশমাত্র পরিমানে বসা বাছড়ের ঘোঁটুর সমতুল্য বেদো'সি মন্ত্র দ্বারা বেদ তৈরি। এটি বেদি বিভাজনের কাজে ব্যবহৃত হয়। “বেড” শব্দের অর্থ অন্তর্ভূত। অনাদি যা রুদ্ধ করে, তা ওয়েব শব্দ দ্বারা বোঝানো। স্বরবেদের তিন ভাগে বিভক্ত হয়, এবং এটি তার সরাসরি উদাহরণ।
পিষে তণ্ডুলকে পানি দিয়ে গুঁথা (মাণ্ডনা)—অর্চ্যু পাত্রিতে পবিত্র দুই ফুল রেখে কৃষ্ণাজিন থেকে পিষে চাউল পাত্রিতে ঢেলে দেয়। প্রগনিত স্পারকে বাম হাতে নিয়ে ঘাটা মিশানোর জন্য অধ্বর্য-এর ডানদিক থেকে উপসর্জনী নামফ জল ধীরে ধীরে সমাপ শ্রবধীভিঃ মন্ত্রে ঢেলে, মধ্যম ঘাটা গুঁথে। গুঁথে আটা দুই সমান পিণ্ডে বিভক্ত করে ইদ্ভাগ্নেঃ, ইদমগ্নীষোময়ঃ বলার সঙ্গে স্পর্শ করে।
পুরোদাশের পকানো—অধ্বয়ু তাপে থাকা এক কপালের ওপর আগ্নেয় পুরোদাশ এবং ১১ কপালে গ্রগনী-ভোময় পুরিডাশের পিণ্ড স্থাপন। এরপর উরু প্রয়স্ব মন্ত্র দ্বারা এতটুকু ছড়িয়ে দেয় যে সম্পূর্ণ কপালে কভার হয়। এরপর প্রাঙ্গারমিশ্রিত তপ্ত ভস্ম দিয়ে ঢেকে দেয় (যেমনভাবে ওড়্ডি পাকা হয়, তেমন প্রক্রিয়া)।
অন্বাহার্য পাক—চার রিত্বিজের তৃপ্তির জন্য যথাযথ পরিমাণ চাউল নিয়ে সন্বাহায় স্থালি-তে ঢেলে দক্ষিণাগ্নিতে পাকানো হয়। এটি অম্বাহায় পোদন রিত্বিজদের দর্শপর্ণমাসের জন্য দক্ষিণের ব্যবহারের নির্দেশ।
বেদি নির্মাণ—এরপর গ্রাহ্যনীয় কুণ্ডের পশ্চিম অংশে দক্ষিণ ও উত্তর শ্রীণি পর্যন্ত তিন রত্ন (৬৬ বাহুল্য গুল) এবং গার্হপত্যের পূর্বে দক্ষিণ অণি থেকে উত্তর নি পর্যন্ত গৃহস্তি (২৮ অঙ্গুল) পরিমাণ থাকা উচিত। দুই আগ্নির মধ্যবর্তী অংশের বেদির দৈর্ঘ্য ছয় হাত বা প্রয়োজনমতো কম-বেশি হতে পারে। বেদি মধ্যভাগে সংকুচিত, পূর্ব বা উত্তরে ঢালু।
বেদি লিঙ্গ—বেদি শব্দটি স্ত্রীলিঙ্গ।
১. ভাপস্তম্ভ—শ্রুত অনুসারে কূর্ম (কচ্ছপ)-আকৃতিতে বিস্তৃত এবং মুখের আকারও আপস্তম্ভানুবায়ী তৈরি করা হয়। মুখাকৃতি তৈরির সরাসরি বিধান আপস্তম্ভ সূত্রে নেই।
বেদি নির্মাণ নারীর মধ্যভাগে সদ্দা (কেন্দ্র) অনুযায়ী করা হয়। ব্রাহ্মণীয় নীরোনাগ অনুযায়ী, তার নীচের দুটি সন্তানের বিস্তৃত অংশ পূর্বের দক্ষিণ শ্রীণি ও উত্তর শ্রীণি। নারীর নিয়মপ্র অংশ স্থূল হওয়ায় বেদির পশ্চিম দিকে দক্ষিণ-উত্তর শ্রীণি অংশ পূর্বের তুলনায় বিস্তৃত রাখা হয় এবং মধ্যভাগ নারীর কোমরের মতো সংকুচিত করা হয়। গার্হপত্য ও ব্রাহ্মণীয়ের মধ্যবর্তী উত্তর-পূর্ব ভারতের তৃণাবি বসানোর জন্য উৎকর নামের স্থান তৈরি করা হয়।
বেদির পরিগ্রহণ—বেদির চার শ্রোর অঞ্চলে স্পপ দিয়ে রেখা করা পরিগ্রহণ নামে পরিচিত। অধ্য্যু পূর্ব পরিগ্রহণ করতে বালা থেকে জিজ্ঞেস করে—“গৃহাণ! পূর্ব পরিগ্রহণ পরিগৃহোপ্যামি।” ব্রহ্মার অনুমতি পাওয়ার পর দক্ষিণ দিকে বেদির নেতৃ কোণ থেকে সাগ্নেয় কোণ পর্যন্ত পূর্ব পরিগ্রহণ (স্পপ দিয়ে রেখা) করা হয়। একইভাবে, পশ্চিমে দক্ষিণ শ্রীণি থেকে উত্তর অণি পর্যন্ত দ্বিতীয় পরিগ্রহণ, উত্তর দিকে ওয়ায়ব্য কোণ থেকে ঈজ্ঞান কোণ পর্যন্ত তৃতীয় পরিগ্রহণ করা হয়।
স্ত্রীদের সংস্থান—গ্রগনীত সব কুণ্ড গার্হপত্যে তাপে জল স্পর্শের মাধ্যমে আগ্নির কাছে পূর্ব দিকে গিয়ে বেদের আগ্রভাগের কাটানো অংশ (বেদাপ্র) প্রথমে আঙুলের পরিমাণ অনুযায়ী সংযুক্ত করা হয়, এরপর মূল অংশের আগ্রভাগ পরিষ্কার করে আগ্নির ওপর তাপে অধ্য্যু কাছে দেওয়া হয়। তারপর প্রগতিত জুহু তাপে পরিষ্কার করে অধ্য্যু কাছে, উপভৃত সৌর প্র.ভা নামক স্ত্রচগুলোও তাপে পরিষ্কার করে নিজে কাছে দেন।
পরবর্তীতে প্রাশিভহরণ, শুতাবদান, পুরোদাশপাত্রী প্রতিটি তাপে পরিষ্কার করে অধ্য্যু কাছে দেয়। এরপর বেদের অপর অংশের তুম জিন যেগুলো সংযুক্ত করা হয়েছিল, তা উৎফর (ফেলে) দেয়া হয়।
যুক্তি-বদ্ধন—মধ্যম পূর্বে তিন বা পাঁচ লর করে তৈরি দর্বের রশি স্ত্রী-এর কোমর অঞ্চলে কাপড়ের ওপর বেঁধে দেওয়া হয়। বাঁধার সময় কোন গোথা (গাঁঠি) হয় না। দুই প্রান্ত লস দেখা উচিত।
আজ্য গ্রহণ—আরাধ্যকে তাপে স্থাপন করতে গার্হপত্যে আরাজ্যস্থালি রাখা হয়। সেখান থেকে অম্ব্যু তা তুলে পুরোদাশের পূর্বে স্ত্রী-এর সামনে স্থাপন করে, স্ত্রীকে রাজ্যের শ্রবেক্ষণের (ঘি দেখার) জন্য বলেন।
জুহু ইত্যাদিতে ঘৃত গ্রহণ—অধ্য্যু বাঁধা হাতে জুহু, চৌর, বেদ ধরে, ডান হাতে লুদা দিয়ে পরুড় করে, যাভ্যস্থালি থেকে পাত্র নিয়ে ধাম নাপালি মধ্য দিয়ে জুহুতে ঘৃত ঢেলে। প্রথমে একবার মন্ত্র দিয়ে ধ্রুব্র, তিনবার তৃষ্ণী; এরপর উপভূতে একবার মন্ত্র, সাতবার তৃষ্ণী; অর্থাৎ মোট আটবার খুভা থেকে ঘৃত ঢেলে। এরপর ধ্রুব্রে একবার মন্ত্র, তিনবার তৃষ্ণী দিয়ে ঘৃত গ্রহণ করা হয়।
ইষ্ম ও বাহিঁ-এর প্রোক্ষণ এবং প্রস্তর গ্রহণ—অধ্যয়ন ও ধম্ম প্রোক্ষণের জন্য ব্রহ্মা।
বিশেষ দ্রষ্টব্য—পরিগ্রহণের ক্ষেত্রে “পরিগ্রাহ” শব্দেরও ব্যবহার আছে। পাণিনি ৩৩৩১৪৭-এ “যজ্ঞীয় ম্পরিগ্রাহ” শব্দের নির্দেশ দেন।
ইধ্মের প্রোক্ষণী পাত্রে জল দিয়ে প্রোক্ষণ সম্পন্ন করুন। এরপর পূর্ব দিকের বাহি প্রোক্ষণ করুন। এরপর বাহি বাঁধন খুলে, বাহি-এর পূর্ব অংশ থেকে “প্রস্তর” নামে পরিচিত কিছু কুশা হাত নিয়ে ব্রহ্মার কাছে দিন।
বেদির স্তরন—বাহি-এর বাপন খুলে যতটুকু আছে, তার তৃতীয় অংশ নিয়ে ব্রাহ্মণীয়-এর পশ্চিম অংশে দক্ষিণ অঙ্গ থেকে উত্তর অঙ্গের দিকে পুশা বিছান। এতে কুশার অগ্রভাগ পূর্বদিকে থাকবে এবং কাটানো মূল অংশ পশ্চিমদিকে থাকবে। এরপর বাহি-এর দ্বিতীয় অংশ থেকে পূর্ব দিকে স্তরন করুন। এইভাবে, পূর্বে বিছানো দর্বের মূল অংশের ওপর দ্বিতীয়বার স্তরিত দর্ব রাখুন, যাতে মূল ঢেকে যায়। একইভাবে তৃতীয় অংশ দিয়ে তৃতীয়বার স্তরন করুন। এটি ত্রিতৃত স্তরন নামে পরিচিত।
দর্বের স্তরন সম্পূর্ণ হলে বেদি পুরোপুরি ঢেকে যাবে। যদি দর্বের তৃণ ছোট হয়, তবে পাঁচবার বা সাতবারও স্তরন করা যেতে পারে। এই স্তরন প্রক্রিয়াকে পশ্চাদপবর্গ (পশ্চিমে নিবৃতি) বলা হয়। পক্ষান্তরে প্রাগ্-অপবর্গও বেদির স্তরন হিসেবে ধরা হয়, যেখানে পশ্চিম দিক থেকে শুরু করে পূর্বে শেষ হয়।
পরিধি-পরিধান—গন্ধর্বসস্না মন্ত্র দ্বারা গ্রাহ্যণীয় কুণ্ডের পশ্চিমে উত্তর দিকে অগ্রভাগ করে পরিধি নামে পরিচিত কাষ্ঠ স্থাপন করুন (পরিধির পরিমাপ পূর্বে উল্লেখিত)। একইভাবে ইন্দ্রায় “বাহারসি” মন্ত্র দ্বারা ব্রাহ্মণীয়-এর দক্ষিণ অংশে পূর্বের দিকে অগ্রভাগ করে দ্বিতীয় পরিধি স্থাপন করুন। তদ্রূপ, মিত্রাবরুণ মন্ত্র দ্বারা সাহবনীয়-এর উত্তর অংশে তৃতীয় পরিধি স্থাপন করুন।
বিবৃতির রাখা ও প্রস্তরের স্তরন—দর্ব থেকে দুটি তৃণ নিন, যেগুলির চপ্রভাগ ভাঙা নয় এবং দৈর্ঘ্য প্রায় ২২ চঙ্গুল। এগুলো নিয়ে শাহবনীয়-এর পশ্চিম দিকে বেদির মধ্যের পূর্ব দিকে অবস্থিত পূর্বে রাখা বাহির ওপর উত্তর দিকে অপ্রভাগ স্থাপন করুন। এই দুটি তৃণের মধ্যে কিছু ফাঁক রাখুন। এই দুটি তৃণের ওপর পূর্বে পৃথক প্রস্তর স্তরন করা হয়। পূর্বে বেদিতে যে স্তরন করা হয়েছে, তা প্রাগগ্র বর্ষ থেকে করা হয়। বিধৃতি নামে পরিচিত হয়, কারণ প্রস্তরকে বিশেষভাবে ধরে রাখা হয় বা পার্থক্য বোঝানোর জন্য।
প্রস্তরের ওপর জুহু ইত্যাদির স্থাপন—মধ্যযু বাম হাত প্রস্তরের ওপর রেখে, আগ্নীত থেকে প্রদত্ত জুহু ডান হাতে নিয়ে “ঘৃতাচ্যাসি জুহূর্নাম্না” মন্ত্রে প্রাগপ্র প্রস্তরের ওপর স্থাপন করুন। এরপর বাম হাতে বেদি ধরে, আগ্নীত থেকে প্রদত্ত দুটি উপভৃত ডান হাতে নিয়ে “ঘৃতাচ্যস্যু-প্রভুনাস্না” মন্ত্রে জুহু উত্তর দিকে প্রাগগ্র স্থাপন করুন। তারপর ধ্রুব্রকে “ঘৃতাচ্যাসি ধ্ বা নাস্তা” মন্ত্রে বিধৃতির অগ্রভাগে প্রাগপ্র রাখুন। এই তিনটি প্রস্তরের ওপর এভাবে স্থাপন করুন যাতে এগুলো পরস্পরের সঙ্গে স্পর্শ না করে এবং জুহু উপমৃত্ত কিছু নিচে, তার নিচে ধ্রুব্র থাকে।
পুরোড়াশ-এর পুরোড়াশপাত্রে স্থাপন—বাচ্চাদের স্থাপন শেষে অধ্য্যু ডান হাত দিয়ে ভাগ্যস্থানি ও রুয় ধরে এবং বাম হাতে পুরোড়াশপাত্র ও বেদি নিয়ে প্রদক্ষিণ করে গার্হপত্য-এর পিছনে বসে, গার্হপত্য-এর উত্তরে মরাজ্যস্থালির উত্তরে পুরোড়াশপাত্র স্থাপন করেন।
সংস্থান (উত্তর-দক্ষিণে লম্বায়) স্থাপন করে, বেদি থেকে দুইটি পুরোড়াশের ভস্ম-রাজকে ফাটিয়ে ভাগ্যস্বালী থেকে ঘি গ্রহণ করে রুবে দিয়ে দুইটি পুরোড়াশের মौन প্রতিধারণ করুন (যেমন সাধারণভাবে গরম ছাইয়ে চাপা থাকা বাদি বের করে মুছে তার ওপর ঘি দেয়া হয়)। একই পুরোড়াশপাত্রে দুটি সামনে এবং ভ্রমণীয় পুরোড়াশকে ক্রমানুসারে উত্তর-দক্ষিণে রাখুন।
কাপাল অঞ্জন ও উদবসন—এরপর, যে ক্রমে ফপালগুলি প্রাঙ্গারে রাখা হয়েছিল, সেই ক্রমে কাপালগুলি ধরা হয়। প্রতিটি কাপালে পরঞ্জন করা হয়—ঘি কাপালের ওপর লাগিয়ে মন্ত্র পাঠ করা হয়। মন্ত্রের শেষে বলা হয় “প্রথমমুদ্বাসয়ামি” (প্রথম কাপাল প্রাঙ্গার থেকে তুলে নিচ্ছি), “দ্বিতীয়মুদ্বাসয়ামি” ইত্যাদি বলে কাপালগুলো প্রাঙ্গার থেকে তুলে নেওয়া হয়।
হবির স্পর্শ—এরপর সমস্ত হবি বেদির কাছে নিয়ে যান। বেদি হাতে নিয়ে “প্রিয়েণ ধাম্না” মন্ত্র দিয়ে ঘি বা সংজ্ঞক স্বচ্ থেকে উত্তর কুশায় আড়াজ্যস্থালি স্থাপন করুন। এরপর স্পধকে হাতে নিয়ে পাঠ্যস্থালির উত্তরে পূর্বমন্ত্র দিয়ে উত্তর-দক্ষিণ দুই পুরোড়াশকে স্থাপন করুন। তারপর ধ্রুব্রাসদন মন্ত্রে প্রাজ্যস্থানের ঘি, গৃহ উপভৃত ধ্রুব্রাসু.চ. এর পূত এবং দুই পুরোড়াশের স্পর্শ করুন। এবং “সব্যয়ূঃ পাহী মা যজ্ঞন্যম্মন্ত্রী” দ্বারা নিজের হৃদয়ের স্পর্শ করুন।
সামিধেনী মন্ত্রের পাঠ—এরপর, ব্রধ্বয়ু চেদি-এর উত্তর যোনির উত্তরে চারণ আভি ফাষ্ঠ তৈরি করা ঘাসান স্থাপন করুন এবং "এহি হতঃ" মন্ত্র দ্বারা গ্রামান্তরিত করুন। হোতা থাচমন থেকে এক সমিয়া হাতে নিয়ে বলে, “ধনগ্নয়ে সামিধ্যমানায়ানুব্রূহি” (প্রজ্বলিত প্রগ্নির জন্য মন্ত্র পাঠ করুন)। হোতা ব্রহ্মা থেকে সামিধেনী মন্ত্রের পাঠের জন্য অনুমতি চায় “ব্রহ্মান! সামিধেনী মন্ত্র পাঠ করব”। ব্রহ্মার “হ্যাঁ, সামিধেনী মন্ত্র বলো” অনুমোদনের পর, হোতা হাত একত্র করে হৃদয়ের নিকটে রেখে আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে (উপর নয়, নিচ নয়) সামিধেনী মন্ত্রের পাঠ সম্পন্ন করেন।
সামিধেনী মন্ত্র—মোট ১১টি। প্রথম এবং শেষ মন্ত্র তিনবার তিনবার উচ্চারণ করা হয় “ত্রিঃ প্রথমমান্বাহ ত্রিরুতমান”। এইভাবে সংখ্যা বাড়িয়ে পূর্ণমাসে ১৫টি সামিধেনী মন্ত্র হয়।
উচ্চারণ প্রক্রিয়া—মন্ত্রগুলো একে অপরের সাথে মিলিয়ে উচ্চারণ করা হয়। প্রতিটি মন্ত্রের শেষে “প্রণয়” (ও৩ম্) প্রয়োগ করা হয় “টি” অংশে বা মন্ত্রের শেষে স্বর/ব্যঞ্জনের যথাযথ স্থানে। যেমন:
“ভূর্ভুবঃ স্বরোঃম্। প্রভো বাজা অভিযবঃ হবিশ্মন্তঃ ঘৃতাচ্য। দেবাঞ্জিগাতি সুম্ন্যো৩ম্ ত্রগ্ন তা ইয়াহি বীতোয় গুণা্নো হব্যদাতয়ে। নিহোতা সত্সি বর্ধিপো৩ম্ তত্ত্বা ...”
পাণিনি নে প্রণবশ্টে (৮।২।৮৬) নির্দেশ করেছেন, যে “হী” সংশক অংশে প্রণয় (যো৩ম্) প্রয়োগ করা হয়, সেটি ঠিক সেই স্থানে যেখানে মন্ত্রের শেষে স্বাহা দিয়ে আহুতি দেওয়া হয়নি। আর্যসমাজে, বেশকিছু শাস্ত্র জ্ঞানহীনরা এই সূত্র দেখে মন্ত্র এবং স্বাহার মাঝে ও৩ম্ প্রয়োগ করেন। এটি শাস্ত্রবিরুদ্ধ।
সামিধেনী মন্ত্র দ্বারা সমিধার প্রক্ষেপ—
মধ্যয়ু প্রতিটি সামিধেনী মন্ত্রের শেষে ঘোষ্ম উচ্চারণের সঙ্গে এক একটি সমিধা অগ্নিতে নিক্ষেপ করে। কিন্তু সমিদ্ধোऽগ্নি—এই দ্বাদশ মন্ত্রের পূর্বে একাদশতম মন্ত্রের শেষে “শ্রো৩ম্” উচ্চারণের সঙ্গে একটিমাত্র সমিধা রেখে বাকি সমস্ত সমিধা অগ্নিতে প্রক্ষেপ করে দেয়। যে সমিধাটি রেখে দেওয়া হয়, তা অনুয়াজে ব্যবহৃত হবে।
ইধ্ম অর্থাৎ সমিধা মোট ১৮টি—এ কথা পূর্বে পৃষ্ঠা ৩৮, সংখ্যা ৩৭-এ বলা হয়েছে। এর মধ্যে দুইটি সমিধা বীতিহোত্রম্ ও সমিদসি মন্ত্র দ্বারা (কাত্যায়ন ২।১৮।২–৩) গ্রাহ্যবণীয়ে পরিধি স্থাপনের সময় প্রক্ষেপ করা হয়। অবশিষ্ট থাকে ১৬টি সমিধা। এর মধ্যে সামিধেনীর ১০টি মন্ত্র দ্বারা ১০টি সমিধা প্রক্ষেপিত হয়। একাদশ মন্ত্র দ্বারা ৫টি সমিধা প্রক্ষেপিত হয়। ১টি সমিধা অনুয়াজের জন্য অবশিষ্ট থাকে। এইভাবে—
১৮ − ২ = ১৬;
১০ + ৫ + ১ = ১৬।
আধার আহুতি দুইটি—
সামিধেনী মন্ত্র পাঠের পর আধার নামে দুইটি ঘৃত আহুতি দেওয়া হয়। এগুলিকে পূর্বাধার ও উত্তরাধার বলা হয়। পূর্বাধার আহুতি প্রজাপতয়ে স্বাহা মন্ত্রে দেওয়া হয় এবং যজমান ইদং প্রজাপতয়ে ন মম বলে স্বত্বত্যাগ করে। উত্তরাধার আহুতি ইত ইন্দ্রো বীয়ম্ করোৎ মন্ত্রে দেওয়া হয় এবং যজমান ইদমিন্দ্রায় ন মম বলে।
প্রাধার আহুতি দেওয়ার প্রকার—
প্রাধার আহুতিগুলি সোজা, দীর্ঘ (স্থূল) এবং অবিচ্ছিন্নভাবে দেওয়া হয়। অর্থাৎ পূর্ব প্রাধার আহুতি উত্তর দিকে পশ্চিম থেকে পূর্ব অভিমুখে সোজা, দীর্ঘ, স্থূল ও মধ্যখানে না ভেঙে দেওয়া হয়। একে বলা হয়—ঋজুমাধারয়তি, দীর্ঘমাধারয়তি, সন্ততমাধারয়তি। দ্বিতীয় প্রাধার আহুতি দক্ষিণ দিকে পশ্চিম থেকে পূর্ব অভিমুখে দেওয়া হয়। এ বিষয়ে পক্ষান্তরও আছে, তার বিবরণ এখানে দেওয়া হয়নি।
সংস্কারবিধিতে ভুল—
প্রাধার ও আজ্যভাগ আহুতির মন্ত্রগুলির ক্রম লেখকের অসাবধানতায় উলটাপালটা হয়ে গেছে। সেখানে পাঠ দেওয়া হয়েছে—
“সোমাগ্নয়ে স্বাহা। ইদমগ্নয়ে—ইদং ন মম।” এই মন্ত্র দ্বারা বেদির উত্তরভাগে প্রগতি স্থানে,
“ওম্ সোমায় স্বাহা। ইদং সোমায় ইদং ন মম।” এই মন্ত্র দ্বারা বেদির দক্ষিণভাগে প্রজ্বলিত সমিধায় আহুতি দিতে হবে।
তারপর—
“ওম্ প্রজাপতয়ে স্বাহা। ইদং প্রজাপতয়ে—ইদং ন মম।”
“ওম্ ইন্দ্রায় স্বাহা। ইদমিন্দ্রায় ইদং ন মম।”
এই দুই মন্ত্র দ্বারা বেদির মধ্যভাগে দুইটি আহুতি দিতে হবে।
এখানে প্রাধার আহুতির মন্ত্রের স্থলে আজ্যভাগ আহুতির মন্ত্র মুদ্রিত হয়েছে। হিন্দি অংশ ঠিক আছে। একইভাবে আজ্যভাগ আহুতির মন্ত্রের স্থলে প্রাধার আহুতির মন্ত্র মুদ্রিত হয়েছে। হিন্দি অংশ এখানেও ঠিক আছে। কেবল মন্ত্রগুলির পাঠ উপরে-নিচে হয়ে গেছে।
প্রবরাশ্রাবণ অথবা প্রবরবরজ—
প্রাধার আহুতির পর যজমান নিজের প্রবর ঘোষণা করে—
অগ্নির্দেবো দৈব্যা হোতা দেবান্ যক্ষদ্ বিদ্বাংশ্চিকিত্বান্ মনুষ্যদ্ ভরতবৎ—এই মন্ত্রের শেষে নিজের প্রবরগুলির উচ্চারণ করে। যেমন, কোনো যজমানের কশ্যপ গোত্র হলে তিনি পর্যায়ক্রমে পৌত্র, পুত্র ও পিতার নাম উচ্চারণ করে বলেন—কশ্যপবৎ, অবৎসারবৎ, নৈধ্রুববৎ। অর্থাৎ যেমন কশ্যপ অবৎসার ও নৈধ্রুবকে … (এখানে পাঠ যেমন আছে তেমনই অনুসৃত)।
মৈধ্রুব যজ্ঞ করেছিলেন, সেইরূপেই আমি যজ্ঞ করি। যদি ভরদ্বাজ গোত্র হয়, তবে ভরদ্বাজবৎ, বৃহস্পতিবৎ, তারঙ্গিরস্বৎ বলা হয়। ভরদ্বাজ গোত্রের মূল পুরুষ হলেন ভরত; তাঁর পিতা বৃহস্পতি এবং পিতামহ অঙ্গিরা—এই প্রবরগুলির বরণ করা হয়।
প্রবর শব্দের অর্থ বিশেষভাবে শ্রেষ্ঠ। প্রবর নাম তারা, যারা গোত্রের মূল পুরুষের বংশপরম্পরায় ক্রমান্বয়ে মন্ত্রকৃত্ বা মন্ত্রদ্রষ্টা পুত্র, পিতা ও পিতামহ হন। প্রবরগুলির ধারাবাহিকতার দ্বারা গোত্রের প্রাচীন পুরুষদের পরিচয় সংরক্ষিত থাকে। কোন গোত্রের কোন প্রবর—তার বিবরণ শ্রৌতসূত্রসমূহের প্রবরাধ্যায়ে পাওয়া যায়।
হোতৃবরণ—
প্রবরবরণের পর হোতার বরণ করা হয়। এখান থেকেই দর্শপূর্ণমাস যজ্ঞে হোতার কর্ম আরম্ভ হয়।
প্রয়াজ সংজ্ঞক পাঁচ যাগ—
‘প্র’ উপসর্গযুক্ত ‘যাজ’ ধাতু থেকে প্রয়াজ শব্দের উৎপত্তি। যে যজ্ঞ প্রধান যাগ, তার পূর্বে যে যাগগুলি করা হয়, সেগুলিকে প্রয়াজ বলা হয়। দর্শপূর্ণমাসে প্রধান প্রয়াজ পাঁচটি; অন্য যজ্ঞে সংখ্যা কমবেশি হতে পারে। প্রয়াজানুবাজী যজ্ঞাঙ্গ (অষ্টা. ৭।১৩।৬৬২) সূত্রানুসারে ‘যজ্’ ধাতুর জকার নকারে রূপান্তরিত হয় না। এই প্রয়াজগুলি প্রধান যাগের অঙ্গরূপ। এই পাঁচ যজ্ঞের দেবতা হল—
১. সমিধা,
২. তনূনপাত অথবা নরাশংস,
৩. ইডা,
৪. বহি,
৫. স্বাহা।
নরাশংস দেবতা ভরতক, বিলোম, প্রপত, বশিষ্ঠ, শুণক, পরাশর, বধ্রশ্ব, অরণ্য কশ্যপ প্রভৃতি সংস্কৃত প্রবরবিশিষ্ট যজমানদের জন্য নির্দিষ্ট। এদের থেকে ভিন্ন প্রবরবিশিষ্ট যজমানদের ক্ষেত্রে তনূনপাত দেবতাই দ্বিতীয় প্রয়াজের দেবতা হন।
শ্রৌত যাগে যাগের প্রকার—
মধ্যয়ু জুহূ ও উপভৃত গ্রহণ করে পূর্বে স্থাপিত হবিগুলির উত্তর পার্শ্ব দিয়ে, পরিধিগুলির পশ্চিম দিক থেকে বাম পা দিয়ে বেদির দক্ষিণে গিয়ে ঈশান দিকের দিকে মুখ করে, যে দেবতার উদ্দেশ্যে যাগ করা হবে তাঁকে মনে ধারণ করে—
অধ্বর্যু বলে—“ও৩ ধ্রবা।”
উত্তরে অগ্নীত্ বলে—“প্রস্তু শ্রৌষট্।”
তারপর ঐ দেবতার উদ্দেশ্যে পুরোডাশানুবাদ্যা পাঠের জন্য—
অধ্বর্যু হোতাকে বলে—“[অগ্নয়ে] অনুন্যূহি।”
এর পর হোতা ঐ দেবতার উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট পুরোডাশানুবাদ্যা—যেমন অগ্নিমূর্ধা দিবঃ—পাঠ করে।
তারপর দেবতাকে লক্ষ্য করে—
মধ্যয়ু বলে—“[অগ্নিম্] যজ।”
এর পর হোতা ঐ দেবতার যাজ্যা ঋচা পাঠ করে, যার পূর্বে যে যজামহে যোগ হয়—যেমন যে যজামহে অগ্নি ভুবো যজ্ঞস্য—এই মন্ত্র পাঠ করে শেষে বৌষট্ উচ্চারণ করে। বৌষট্ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে মধ্যয়ু আহুতি প্রদান করে।
এটাই এক যাগে এক আহুতির সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া। প্রতি যাগেই এইভাবেই ক্রিয়া সম্পন্ন হয়। উপরোক্ত উদাহরণে অগ্নয়ে, অগ্নিমূর্ধা দিবঃ, অগ্নি ভুবো যজ্ঞস্য—এই মন্ত্রাংশগুলি কেবল যাগের প্রকার বোঝানোর জন্য উদ্ধৃত হয়েছে। যে কোনো দেবতার উদ্দেশ্যে যাগ হোক না কেন, সর্বত্র এই একই প্রক্রিয়া অনুসৃত হয়। তাই ব্রাহ্মণ গ্রন্থে বলা হয়েছে—
“‘ও শ্রাবয়’—এই চার অক্ষর,
‘প্রস্তু শ্রৌষট্’—এই চার অক্ষর,
‘যে যজামহে’—এই পাঁচ অক্ষর,
‘যজ’—এই দুই অক্ষর,
এবং এক অক্ষরের ‘বৌষট্’।
এই সাত অক্ষরই ছন্দস্বরূপ প্রজাপতির যজ্ঞের অনুবিধান।”
(মহা০ভাষ্য ৪।১৪।১৪০ থেকে উদ্ধৃত)
অর্থাৎ— ‘ও শ্রাবয়’ এই চার অক্ষর, ‘প্রস্তু শ্রৌষট্’ এই চার অক্ষর, ‘যে যজামহে’ এই পাঁচ অক্ষর, ‘যজ’ এই দুই অক্ষর এবং ‘বৌষট্’ এই দুই অক্ষর—এই সমস্ত মিলিয়ে মোট ১৭ অক্ষরবিশিষ্ট রূপে বেদে প্রতিষ্ঠিত প্রজাপতি-যজ্ঞে বিধিবদ্ধ আছে।
পুরোऽনুবাক্যা ও যাজ্যা—
যে মন্ত্র দ্বারা যাগের (অর্থাৎ আহুতি প্রদানের) পূর্বে দেবতাকে স্মরণ করা হয় (পুরাণকারদের মতে ‘দেবতার আহ্বান’ করা হয়), সেই ঋচাকে পুরোऽনুবাক্যা (পূর্বে পাঠযোগ্য ঋচা) বলা হয়। আর যে মন্ত্র উচ্চারণ করে দেবতার উদ্দেশ্যে আহুতি প্রদান করা হয়, তাকে যাজ্যা ঋচা বলা হয়। প্রতিটি যাগের জন্য নির্দিষ্ট পুরোऽনুবাক্যা ও যাজ্যা থাকে। মৈত্রায়ণী সংহিতার শেষে যাজ্যা-পুরোऽনুবাক্যা-কাণ্ডে এগুলি ক্রমানুসারে পাঠিত অবস্থায় পাওয়া যায়।
এই যাগক্রমকে লক্ষ্য রেখেই পাণিনি নিম্নলিখিত সূত্রগুলি প্রণয়ন করেছেন—
১. যে যজ্ঞকর্মণি (অষ্টা. ৮।৮।৮)—যজ্ঞকর্মে ‘যে যজামহে’ পদে ‘যে’ শব্দটি প্লুত হয়; যেমন— যে৩ যজামহে অগ্নি ভুবো যজ্ঞস্য।
২. প্রণবষ্টেḥ (৮।৩।২।১৮৬)—যজ্ঞকর্মে ঋচার ‘টি’ সংজ্ঞক অংশে প্লুত প্রণব প্রবেশ করে; যেমন— অগ্নিমূর্ধা… রেতাংসি জিন্বতো৩ম্। (এই বিষয়ে পূর্ব পৃষ্ঠা ৪৬-এ যা লেখা হয়েছে, তা দ্রষ্টব্য।)
৩. যাজ্যান্তঃ (৮।২।২০)—যজ্ঞকর্মে যাজ্যা মন্ত্রের অন্তস্থিত ‘টি’ সংজ্ঞক অংশে প্লুত হয়; যেমন— যে৩ যজামহে অগ্নি ভুবো যজ্ঞস্য… চক্রিষে হব্যবাহো৩ বৌ৩ষট্।
৪. ব্রূহি প্রেষ্য শ্রৌষড্ বীয় ডাবহানাম্ আদেঃ (৮।১।২৬১)—যজ্ঞকর্মে ব্রূহি, প্রেষ্য, শ্রৌষট্, বৌষট্, আবহ প্রভৃতি পদের আদিতে প্লুত হয়; যেমন— অগ্নয়ে অনুব্রূ৩হি, প্রস্তু শ্রৌ৩ষট্, চক্রিষে হব্যবাহো৩ বৌ৩ষট্, অগ্নিমা৩বহ।
৫. প্রণীতপ্রপণে পরস্য চ (৮।৩।২।১৬২)—যজ্ঞকর্মে প্রণীত জল প্রেরণের আদেশে ব্যবহৃত বাক্যের প্রথম অক্ষর এবং তার পরবর্তী বর্তমান অক্ষর প্লুত হয়; যেমন— ও৩ শ্রা৩বয়।
আজ্যভাগাহুতি—
প্রয়াজ সংজ্ঞক যাগগুলির পরে অগ্নি ও সোম দেবতার উদ্দেশ্যে ঘৃতের দুইটি আহুতি প্রদান করা হয়। এগুলিকে আজ্যভাগাহুতি বলা হয়। এর মধ্যে অগ্নেয় আহুতি উত্তর-পূর্বার্ধে এবং সোম আহুতি দক্ষিণ-পূর্বার্ধে প্রদান করা হয়।
প্রধান যাগ—
পূর্ণমাসেষ্ঠিতে তিনটি প্রধান যাগ রয়েছে—
১. অগ্নি দেবতার জন্য আট কপালে সংস্কৃত পুরোডাশ,
২. অগ্নীষোম দেবতার জন্য বাধ্য হবি,
৩. অগ্নীষোম দেবতার জন্য একাদশ কপালে সংস্কৃত পুরোডাশ।
অবদান-এর প্রকার—
আহুতি প্রদানের জন্য যজ্ঞীয় দ্রব্য গ্রহণের নিয়ম এইরূপ—আহুতি দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রস্তুত পুরোডাশ প্রভৃতি হব্য দ্রব্য থেকে প্রতিটি আহুতির জন্য চার অবদান (দুই অবখণ্ডে বিভক্ত চার অংশ) গ্রহণ করা হয়। ‘চতুরবতং জুহোতি’—এটাই সাধারণ নিয়ম। জামদগ্ন্য গোত্রভুক্তদের ক্ষেত্রে ‘পঞ্চাবতং জুহোতি’, অর্থাৎ পাঁচ অংশ গ্রহণের বিধান রয়েছে। এখানে চার অবদানের প্রকার বর্ণিত হচ্ছে।
ঘৃত দ্বারা আহুতি প্রদানের জন্য—
যজ্ঞীয় ঘৃত আজ্যস্থালীতে সংরক্ষিত থাকে। সেখান থেকে চার সুবা পরিমাণ ঘৃত পূরণ করে ধ্রুবা …
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ