সূর্য সিদ্ধান্ত - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

10 October, 2025

সূর্য সিদ্ধান্ত

॥ শ্রীঃ ॥

ভূমিকা

উচ্চারণ (বাংলা বর্ণে):
শ্রীভাস্কারো নিখিলসৃষ্টি-সমগ্রহেতুঃ কালাত্মকোऽপি তৎ-কালনিয়ামকো যঃ।
তেনোপদিষ্ট-সদুপাসিত-গূঢ়সূর্য-সিদ্ধান্তমেষ বিবৃণোমি জনেষু হিন্দ্যম্।।

বাংলা অনুবাদ:
শ্রী ভাস্কর (সূর্যদেব) সমগ্র সৃষ্টি-ব্রহ্মাণ্ডের মূল কারণ, তিনি কালরূপ হলেও স্বয়ং সেই কালের নিয়ন্তা। তাঁরই উপদেশে, যেটি মহাজ্ঞানীরা গূঢ়ভাবে উপাসনা করেছেন সেই সূর্যসিদ্ধান্ত—আমি এখন মানুষের মধ্যে ব্যাখ্যা করছি ও প্রসারিত করছি।

জ্যোতিষশাস্ত্রের বিশাল সাহিত্যে, যেন মেরুপর্বতের ন্যায় অটলভাবে বিরাজমান ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ তার প্রাচীনতা ও প্রামাণিকতার জন্য যেমন সুপরিচিত, তেমনি তার সরলতা (সহজবোধ্যতার) জন্যও জনপ্রিয়। সূর্যসিদ্ধান্তের উপদেশক স্বয়ং ভগবান সূর্য, তাই এই গ্রন্থের রচনাকাল নির্ধারণ সর্বদাই বিতর্কিত ছিল। সূর্যসিদ্ধান্তের উপদেশ বিভিন্ন যুগে ঋষিদের প্রদান করা হয়েছে, যার মধ্যে সর্বশেষ উপদেশ সূর্যের অংশাবতার ‘ময়’ কে দেওয়া হয়েছিল। এই ঘটনাই সূর্যসিদ্ধান্তের এক দীর্ঘ ধারার ইঙ্গিত বহন করে।

সূর্যসিদ্ধান্তে যেভাবে বিভিন্ন কালভেদ বা যুগান্তরের উল্লেখ আছে, তা এই শাস্ত্রের প্রামাণিকতা ও সূক্ষ্ম সচেতনতার প্রমাণ দেয়। সূর্যসিদ্ধান্তের ঐতিহাসিক দিক নিয়ে গবেষণা করা পণ্ডিতগণ বর্তমান সূর্যসিদ্ধান্তকে ‘ময়’-উপদিষ্ট সূর্যসিদ্ধান্ত থেকে ভিন্ন বলে মনে করেন। কিছু পণ্ডিত আবার ‘পঞ্চসিদ্ধান্তিকা’-তে বর্ণিত সূর্যসিদ্ধান্তকেই মূল গ্রন্থ হিসেবে মেনে নিয়েছেন।

এই প্রসঙ্গে শ্রী বালকৃষ্ণ দীক্ষিত তাঁর “ভারতীয় জ্যোতিষ” গ্রন্থে লিখেছেন—
“বর্তমান সূর্যসিদ্ধান্তের ভগণাদি ও বর্ষমান ‘পঞ্চসিদ্ধান্তিকা’-য় উল্লিখিত সূর্যসিদ্ধান্তের ভগণাদি ও বর্ষমানের সঙ্গে মেলে না। পঞ্চসিদ্ধান্তিকায় উল্লিখিত সূর্যসিদ্ধান্ত এবং বর্তমানে প্রচলিত সূর্যসিদ্ধান্ত—বর্ষমান ও ভগণাদি মূল উপাদানের দিক থেকে একে অপরের থেকে ভিন্ন বলে প্রতীয়মান হয়। দ্বিতীয়টি প্রথমটির তুলনায় নবীন, কারণ বরাহমিহির তাঁর ‘পঞ্চসিদ্ধান্তিকা’-য় কেবল প্রথমটিকেই অন্তর্ভুক্ত করেছেন।”

“পৌলশতি বিস্ফুটোऽসৌ তস্যাসনস্তু রোমকঃ প্রক্তঃ।

স্পষ্টতরঃ সাৱিত্রঃ পরিশেষো দূরবিভ্রষ্টী।।

আচার্য বরাহমিহির তাঁর পঞ্চসিদ্ধান্তিকা গ্রন্থে পাঁচটি প্রাচীনতম জ্যোতির্বিদ্যা-সিদ্ধান্তকে একত্র করে পঞ্চসিদ্ধান্তিকা নামে সংকলন করেছিলেন। এই পাঁচটি সিদ্ধান্তের নাম— পৌলিশ, রোমক, বসিষ্ঠ, সৌর (সূর্য) এবং পৈতামহ

গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে তিনি উল্লেখ করেছেন—
“পৌলিশ সিদ্ধান্ত শুরুতে সবচেয়ে শুদ্ধ ছিল, তার কাছাকাছি ছিল রোমক সিদ্ধান্ত। এদের তুলনায় সূর্যসিদ্ধান্ত আরও স্পষ্ট ও নির্ভুল। অপর দুটি—বসিষ্ঠ ও পৈতামহ সিদ্ধান্তে কালের সঙ্গে সঙ্গে অনেক অমিল দেখা দিয়েছে।”

এই পাঁচটি সিদ্ধান্ত অত্যন্ত প্রাচীন। কিন্তু নির্ভরযোগ্য প্রমাণের অভাবে এদের সঠিক রচনাকাল আজও নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। বর্তমান সময়েও “সিদ্ধান্তপঞ্চক” নামে এক সমষ্টি আলোচনায় আছে, কিন্তু এই পাঁচটি বর্তমানের পঞ্চসিদ্ধান্তিকা-উল্লিখিত পাঁচটির থেকে ভিন্ন। তাই এগুলিকে বর্তমান সিদ্ধান্তপঞ্চক বলা হয়। তাদের নাম নিম্নরূপ—

১. সূর্যসিদ্ধান্ত
২. সোমসিদ্ধান্ত
৩. বসিষ্ঠসিদ্ধান্ত
৪. রোমশসিদ্ধান্ত
৫. বাহ্যসিদ্ধান্ত (শাকল্য সংহিতায় উল্লিখিত)

এই পাঁচটি সিদ্ধান্ত অপুরুষেয় (অর্থাৎ মানবসৃষ্ট নয়, ঐশ্বরিকভাবে প্রকাশিত) বলে মানা হয়।

আচার্য শঙ্কর বালকৃষ্ণ দীক্ষিত স্পষ্ট লিখেছেন—
“পঞ্চসিদ্ধান্তিকায় উল্লিখিত পাঁচটি সিদ্ধান্তের মধ্যে কয়েকটি বা সবকটি, এবং বিষ্ণুধর্মোত্তরে বর্ণিত সিদ্ধান্ত ছাড়া বর্তমানে আর কোনও সিদ্ধান্ত অপুরুষেয় হিসেবে স্বীকৃত নয়।”

ঐতিহাসিক প্রমাণের ভিত্তিতে পাওয়া ও স্বীকৃত সকল জ্যোতির্বিদ্যা-সিদ্ধান্তের মধ্যে আর্যসিদ্ধান্ত-কেই সবচেয়ে প্রাচীন বলে মনে করা হয়। উপরোক্ত পাঁচটি সিদ্ধান্ত আর্যসিদ্ধান্তেরও পূর্ববর্তী হতে পারে—এই মত আমার।

পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরাও এই সিদ্ধান্তগুলির রচনাকাল নিয়ে গভীরভাবে গবেষণা করেছেন। হিটনেবেন্টলি গ্রহগণনার ভিত্তিতে বর্তমান সূর্যসিদ্ধান্তের সময় নির্ধারণের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাদের নির্ধারিত সময়ে যথেষ্ট অমিল পাওয়া যায়।

তাই পঞ্চসিদ্ধান্তিকা-য় বর্ণিত এই সিদ্ধান্তগুলির সুনির্দিষ্ট কাল বলা কঠিন। তবে একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, এরা শক বর্ষ ৪২১ (প্রায় খ্রিস্টীয় ৪৯৯ সালের পূর্বে) প্রচলিত ছিল।

বর্তমান সূর্যসিদ্ধান্ত, পঞ্চসিদ্ধান্তিকায় উল্লিখিত সূর্যসিদ্ধান্তের তুলনায় অনেক বেশি পরিশুদ্ধ ও স্পষ্ট। তাই কিছু পণ্ডিতের মত, এই বর্তমান সূর্যসিদ্ধান্ত আর্ষগ্রন্থ (ঐশ্বরিক উৎসের গ্রন্থ) নয়। তবে সূর্যসিদ্ধান্তে বর্ণিত ‘ময়’ ও ‘সূর্য’-এর সংলাপ থেকে এর আর্ষত্ব বোঝা যায়। তবু ইতিহাসবিদেরা কিছু সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, যেমন—

১. আধুনিক সূর্যসিদ্ধান্তের রচয়িতা ছিলেন লাটদেব
২. আধুনিক সূর্যসিদ্ধান্ত লাটদেব রচিত হলেও এর সমস্ত অংশ তাঁর নিজস্ব নয়; কিছু অংশ পঞ্চসিদ্ধান্তিকায় বর্ণিত সূর্যসিদ্ধান্ত থেকে নেওয়া হয়েছে।
৩. পঞ্চসিদ্ধান্তিকা রচনার কিছু সময় পরে, কেউ হয়তো বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিশেষ অংশ একত্র করে নতুন সিদ্ধান্ত রচনা করেছিলেন। রচয়িতার নাম অজানা থাকায় সেটিকেই পরে আর্ষগ্রন্থ বলে মানা হয়েছে।

এই বিষয়ে আচার্য ব্রহ্মগুপ্ত লিখেছেন যে— রোমকবসিষ্ঠ সিদ্ধান্তের গ্রহগণনার অংশ আর্যভটীয় গ্রন্থের সঙ্গে মেলে, কিন্তু সূর্যসিদ্ধান্ত ও রোমক সিদ্ধান্তের ‘পরিধ্যংশ’ অংশ আর্যভটীয়-এর সঙ্গে নয়, বরং মূল সূর্যসিদ্ধান্ত-এর সঙ্গে মেলে।
এ থেকেই বোঝা যায়, মূল সূর্যসিদ্ধান্তকেই কোনও আচার্য পরিশোধন ও সংশোধন করে বর্তমান সূর্যসিদ্ধান্তের রূপে প্রকাশ করেছেন।

বর্তমান সূর্যসিদ্ধান্তে মোট ১৪টি অধ্যায় (অধিকার) রয়েছে, যথা—
১. মধ্যমাধিকর (গ্রহের মধ্যগতি),
২. স্পষ্টাধিকর (গ্রহের সুনির্দিষ্ট অবস্থান),
৩. ত্রিপ্রশ্নাধিকর,
৪. চন্দ্রগ্রহণাধিকর,
৫. সূর্যগ্রহণাধিকর,
৬. ছেদ্যকাধিকর,
৭. গ্রহযুত্যাধিকর,
৮. ভগ্রহযুত্যাধিকর,
৯. উদয়াস্তাধিকর,
১০. চন্দ্রশৃঙ্গোত্রত্যাধিকর,
১১. পাতাধিকর,
১২. ভূগোলাধ্যায়াধিকর,
১৩. জ্যোতিষোপনিষদাধ্যায়,
১৪. মানাধ্যায়।
প্রত্যেক অধ্যায়েই প্রায় ৫০০টি শ্লোক রয়েছে।

সূর্যসিদ্ধান্তের রচনাকাল বিষয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে ঐকমত্য নেই। গ্রন্থের নিজস্ব বিবরণ অনুযায়ী, এর রচনা কৃতযুগের শেষের দিকে হয়েছিল—অর্থাৎ শক বর্ষ ১৯২০ (খ্রিস্টাব্দ প্রায় ১৯৯৮)-এর প্রায় ২১,৬৫০৯৯ বছর পূর্বে। তবে এই সময়কাল ইতিহাসবিদেরা গ্রহণ করেননি। তাঁদের যুক্তি, যদি সূর্যসিদ্ধান্ত এত প্রাচীন হতো, তবে মহাভারতে বর্ষ ও বার গণনার বিষয়ে কোনও বিভ্রান্তি থাকত না, এবং স্পষ্ট বার গণনা-র উল্লেখ পাওয়া যেত। কিন্তু মহাভারত-এ কোথাও বার গণনার উল্লেখ নেই, তাই সূর্যসিদ্ধান্ত পরবর্তী রচনা।

এছাড়া আর্যভট্ট-ও তাঁর গ্রন্থে সূর্যসিদ্ধান্তের কোনও উল্লেখ করেননি, যা থেকে অনুমান করা যায়— সূর্যসিদ্ধান্তের রচনাকাল সম্ভবত তাঁর সময়, অর্থাৎ খ্রিস্টাব্দ ৪৭৬-এর আশেপাশে। তবে কিছু পণ্ডিত মনে করেন যে সূর্যসিদ্ধান্তের মূল রূপ পঞ্চসিদ্ধান্তিকা-তেই ছিল, এবং পরে কিছু আচার্য তা সংশোধন করে আজকের বর্তমান সূর্যসিদ্ধান্ত-এর রূপ দিয়েছেন।

“তস্মাত্ ত্বং স্বাং পুরীং গচ্ছ তত্র জ্ঞানং দদামি তে।
রোমকে নগরে ব্রহ্মশাপান্ ম্লেচ্ছাবতারধৃক্।।

পাশ্চাত্য পণ্ডিতরাও সূর্যসিদ্ধান্তের রচনাকাল নির্ধারণে বহু চেষ্টা করেছেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাঁদের সিদ্ধান্তগুলিতেও একমত হওয়া যায়নি। বেন্টলি গ্রহের পর্যবেক্ষণ ও সূর্যসিদ্ধান্তে বর্ণিত সূর্য-চন্দ্রের গতির তুলনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে সূর্যসিদ্ধান্তের রচনাকাল খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীর শেষ পর্যায়ে

এই সিদ্ধান্তের উপর মন্তব্য করতে গিয়ে ভর্জেন্স লিখেছিলেন—
“বেন্টলি অন্যান্য গ্রহের জন্য যে ‘শূন্য অশুদ্ধি’ (অর্থাৎ পর্যবেক্ষণ ও গণনার মধ্যে ত্রুটিহীন সময়) নির্ধারণ করেছেন, তা আমার দ্বারা ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে নির্ধারিত সময়ের সঙ্গে মিলে যায়। তবে বিশ্লেষণে দেখা যায়, বেন্টলি যে শূন্য অশুদ্ধি নির্ধারণ করেছিলেন, তা গ্রহগুলির তুলনায় নয়, বরং সূর্য ও চন্দ্রের তুলনায় নির্ধারিত ছিল। আমার হিসাব অনুযায়ীও খ্রিস্টাব্দ ২৫০ সালে সূর্যের শূন্য অশুদ্ধি ঘটে।”

ভর্জেন্স আরও বলেন— সূর্যের অবস্থান নির্ধারণে যদি মাত্র এক ডিগ্রির ভুল ঘটে, তবে শূন্য অশুদ্ধি সময়ে প্রায় ৪২৫ বছরের পার্থক্য দেখা দেয়। আর যদি কৃত্তিকা নক্ষত্রসহ ছয়টি নক্ষত্রের ধ্রুবাঙ্কে এক ডিগ্রি পরিবর্তন ধরা হয়, এবং প্রতি ডিগ্রির জন্য সর্বোচ্চ সময় ৭২ বছর ধরা হয়, তবে এই হিসেবে সূর্যসিদ্ধান্তের রচনাকাল দাঁড়ায় খ্রিস্টাব্দ ৩৮৪, অর্থাৎ আনুমানিক ৪০০ খ্রিস্টাব্দের আশেপাশে
তাই পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের মতে, সূর্যসিদ্ধান্তের রচনাকাল খ্রিস্টাব্দ ৪০০ থেকে ১১০০-এর মধ্যে ধরা যায়।

গ্রন্থ অনুসারে, সূর্য থেকে ‘ময়’ নামক এক ঋষি সূর্যসিদ্ধান্তের জ্ঞান লাভ করেছিলেন। সূর্যসিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, বিভিন্ন যুগে সূর্য দেব ঋষিদের জ্ঞানদান করতেন, কিন্তু বর্তমান সূর্যসিদ্ধান্তের উপদেশ বিশেষভাবে ময়কে দেওয়া হয়েছিল।

কিছু গবেষক ‘ময়’-কে বিদেশী, অর্থাৎ মিশরের বাসিন্দা বলে মনে করেন। বেভার লিখেছিলেন— মিশরের রাজা তালময়স নামটি ভারতীয় গ্রন্থে তুরুময় নামে পরিচিত, এবং সেই তুরুময়ই আসলে ময়। এমনও অনুমান করা হয়েছে যে, ‘আলমাজেস্তা’-র লেখক টলেমি-ই সম্ভবত এই ‘ময়’।

সূর্যসিদ্ধান্তের কিছু প্রাচীন পাণ্ডুলিপিতে এই শ্লোকটি সংযোজিত আছে—

“তস্মাৎ ত্বং স্বাং পুরীং গচ্ছ তত্র জ্ঞানং দদামি তে।
রোমকে নগরে ব্রহ্মশাপান্ ম্লেচ্ছাবতারধৃক্।।’’

ইত্যুক্ত্বা অন্তর্দধে দেবঃ

এই কথার ভিত্তিতে ‘ময়’-কে রোমের অধিবাসী বলা হয়েছে। কিন্তু তৎকালীন ভারতীয় আচার্যদের সাক্ষ্যের উপর ভিত্তি করে এটা প্রমাণিত হয় যে ময় ছিলেন ভারতীয়। কারণ, ব্রহ্মগুপ্ত সূর্যসিদ্ধান্তকে কোনো বিদেশি গ্রন্থ হিসেবে গণ্য করেননি; তিনি কেবল রোমকসিদ্ধান্তকেই বিদেশি বলেছেন।

‘পঞ্চসিদ্ধান্তিকা’-য় উল্লিখিত বিভিন্ন জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের পটভূমি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মহামहोপাধ্যায় পণ্ডিত সুধাকর দ্বিবেদী লিখেছেন—

গর্গাদি ঋষিদের থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানকে যিনি বিশ্লেষণ করেছিলেন, সেই পুলিশ মহর্ষি-র ব্যাখ্যা হলো পৌলিশসিদ্ধান্ত। ব্রহ্মার অভিশাপের ফলে সূর্য রোম নগরের যবনদের যে জ্ঞান দিয়েছিলেন, সেটিই রোমকসিদ্ধান্ত। বসিষ্ঠ ঋষি তাঁর পুত্র পরাশরকে যে জ্ঞান দিয়েছিলেন, সেটি বসিষ্ঠসিদ্ধান্ত
ব্রহ্মা তাঁর পুত্র বসিষ্ঠকে যে জ্ঞান দিয়েছিলেন, সেটিই পৈতামহ বা ব্রাহ্মসিদ্ধান্ত
এবং সূর্য ময়কে যে উপদেশ দিয়েছিলেন, সেটিই সূর্যসিদ্ধান্ত নামে পরিচিত।

এই সূত্রে দেখা যায়, কেবল রোমকসিদ্ধান্ত বিদেশি, বাকি সবগুলোই ভারতীয় তত্ত্ব।
এ থেকেই স্পষ্ট যে ময়ও ভারতীয় ছিলেন এবং তাঁর রচিত সূর্যসিদ্ধান্তই আজ আমাদের হাতে আছে, যদিও তা মূল আকারে নয়, বরং সংস্কারিত (পরিষ্কৃত) রূপে।


অর্থ: শক ১৫২৫ সালে রঙ্গনাথ সূর্যসিদ্ধান্ত–এর উপর গূঢ়ার্থ প্রকাশিকা নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ টীকা (ব্যাখ্যা) রচনা করেন।

এর প্রকাশনা হয়েছিল কাশী ও কলকাতা থেকে।
আরেকটি ব্যাখ্যা নৃসিংহ দৈবজ্ঞ শক ১৫৪২ সালে লিখেছিলেন, যার নাম সৌরভাষ্য

সূ সি বিজ্ঞান ভাষ্য পৃষ্ঠ ৯
(এটি একটি টীকা বা গ্রন্থের পৃষ্ঠাসূচক উল্লেখ। অর্থ: “সূর্যসিদ্ধান্ত বিজ্ঞান ভাষ্য, পৃষ্ঠা ৯।”)

বিশ্বনাথ দৈবজ্ঞ নে ভি শক পঞ্চদশ শত পঞ্চাশে এক সোদাহরণ টীকা লিখি...
অর্থ: বিশ্বনাথ দৈবজ্ঞও শক ১৫৫০ সালে একটি উদাহরণ-সমৃদ্ধ টীকা রচনা করেন।

এর পাশাপাশি, শক ১৬৪১ সালে দাদাভাই কিরণাবলী নামে একটি টীকা লিখেছিলেন।
এসবের মধ্যে রঙ্গনাথের গূঢ়ার্থ প্রকাশিকাই সবচেয়ে বিশদ ও যুক্তিনিষ্ঠ রচনা হিসেবে গণ্য।

পণ্ডিত বাপুদেব শাস্ত্রী নে সন আঠারো শত ষাট মে সূর্যসিদ্ধান্ত কা অ্যাংলেজি অনবাদ কিয়া था।

অর্থ: পণ্ডিত বাপুদেব শাস্ত্রী ১৮৬০ সালে সূর্যসিদ্ধান্ত-এর ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন। বিদেশি পণ্ডিতদের মধ্যে রেভারেন্ড বর্জেসও সূর্যসিদ্ধান্ত-এর ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন, যার প্রকাশ ১৮৬০ সালে আমেরিকান ওরিয়েন্টাল সোসাইটি কর্তৃক হয়েছিল।

প্রোফেসর হুইটনে নে ভি সূর্যসিদ্ধান্ত পর বিস্তৃত টীকা লিখি হ্যায়।
অর্থ: অধ্যাপক হুইটনেও সূর্যসিদ্ধান্ত-এর উপর একটি বিশদ মন্তব্য রচনা করেছেন।

তিনি লিখেছিলেন যে ভারতীয়রা জ্যোতির্বিদ্যা গ্রীক পণ্ডিতদের থেকে শিখেছে, কিন্তু বর্জেসের মতে, গ্রীকরা বরং ভারত থেকে এই জ্ঞান অর্জন করেছে।

পরবর্তী ব্যাখ্যাগুলির মধ্যে মহামहोপাধ্যায় পণ্ডিত সুধাকর দ্বিবেদীর সুধাবর্ষিণী টীকা এবং আধুনিক টীকাগুলির মধ্যে পণ্ডিত কপিলেশ্বর শাস্ত্রীর সুস্পষ্ট টীকা (কাশী থেকে ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

রঙ্গনাথ আচার্য রঙ্গনাথ কা জন্ম শক পঞ্চদশ শত শূন্য মে বিদর্ভ দেশে পয়োষ্ণী কে তট পর দচিগ্রাম মে হুয়া था।

অর্থ: আচার্য রঙ্গনাথের জন্ম শক ১৫০০ সালে বিদর্ভ দেশে, পয়োষ্ণী নদীর তীরে দাচিগ্রামে হয়েছিল।

তাঁর পিতার নাম ছিল বল্লাল এবং মাতার নাম গণি। তাঁদের পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে রাম, কৃষ্ণ, গোবিন্দ, রঙ্গনাথ ও মহাদেব — এই পাঁচজনের নাম উল্লেখযোগ্য।

রঙ্গনাথ সূর্যসিদ্ধান্ত-এর উপর গূঢ়ার্থ প্রকাশিকা নামে একটি বিশদ ব্যাখ্যা লিখেছিলেন, যেখানে তিনি যুক্তিসহ ব্যাখ্যা (উপপত্তি) দিয়েছিলেন। তাঁর টীকা পাণ্ডিত্যে পরিপূর্ণ, এবং তাঁর গভীর জ্যোতির্বিজ্ঞানের জ্ঞান এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়।
এই গূঢ়ার্থ প্রকাশিকা কাশীতেই রচিত হয়েছিল। তিনি একজন বিশিষ্ট শিক্ষক হিসেবেও খ্যাত ছিলেন এবং গোল-যন্ত্র প্রভৃতি নির্মাণ করে ছাত্রদের পাঠদান করতেন। আচার্য ভাস্করের তত্ত্বগুলিতে তাঁর বিশেষ দক্ষতা ছিল।

শকে তত্ত্ব তিথ্যুন্মিতে চৈত্র মাসে সিতে শম্ভু তিথ্যাং বুধে অং কোদয়ান মে।
দলাঢ দ্বিনারাচ নাডীষু জাতি মুনীশার্কসিদ্ধান্ত গূঢ়প্রকাশৌ।।

অর্থ:
“শক ১৫২৫ সালের চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের চতুর্দশী তিথি, বুধবার, সূর্যোদয়ের পর ৫২ ঘটি ৩০ পল সময় আমার পুত্র মুনীশ্বর ও আমার গ্রন্থ গূঢ়ার্থ প্রকাশিকা— এই দুটিরই জন্ম হয়।”

পরবর্তীকালে, পরিবর্তিত সময় ও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সূর্যসিদ্ধান্ত-এর একটি হিন্দি ব্যাখ্যার প্রয়োজন অনুভূত হয়। কয়েক বছর আগে এই কাজ শুরু করার চিন্তা হয়েছিল, কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে তা সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি।
অবশেষে ১৯৯৮ সালে ভগবান ভাস্করের কৃপায় এই কাজ সফলভাবে সম্পন্ন হয়।

শুধু হিন্দি ব্যাখ্যা দিয়েই গ্রন্থের সব প্রয়োজন মেটে না, তাই পাঠকদের পূর্ণ সহায়তার জন্য যথাসম্ভব যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যাও (উপপত্তি) সংযোজিত হয়েছে। যেহেতু সূর্যসিদ্ধান্ত একটি পাঠ্যগ্রন্থও, তাই উপপত্তিগুলি সংস্কৃতে দেওয়া হয়েছে, যাতে ছাত্রদের পাঠক্রমেও তা কাজে লাগে।

গ্রন্থের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য এবং একটি প্রামাণিক সংস্কৃত টীকা সংযোজনের উদ্দেশ্যে, আচার্য রঙ্গনাথ রচিত গূঢ়ার্থ প্রকাশিকাও একত্রে সম্পাদিত হয়েছে।

হিন্দি ও সংস্কৃত— দুই টীকাসহ এই গ্রন্থ এখন ছাত্র ও পণ্ডিত উভয়ের জন্যই অত্যন্ত উপযোগী হয়ে উঠেছে। এই দুই দিকের সন্তুষ্টিই প্রকাশনার সার্থকতা প্রমাণ করবে।

তুষ্যন্তু সুজনা বুদ্ধ্বা বিশেষান্ মদুদীরিতান্,
অবোধেন হাসন্তো মাং তোষমেষ্যন্তি দুর্জনাঃ।

অর্থ:
“সৎজনেরা আমার বলা বিশেষ তত্ত্বগুলি বুঝে তুষ্ট হোন, আর মূর্খরা যদি আমায় দেখে হাসেও, তবু তাতে তাদেরও তৃপ্তি আসুক।”


দীপমালিকা
সংवत ২০৫৬ (অর্থাৎ খ্রিষ্টাব্দ ১৯৯৯-২০০০ এর সময়কাল)
বারাণসী – রামচন্দ্র পান্ডেয়

॥ শ্রী ॥

মধ্যমাধিকারঃ – ১

মঙ্গলাচরণম্

অচিন্ত্যাব্যক্তরূপায় নির্গুণায় গুণাত্মনে।
সমস্তজগদাধারমূর্তয়ে ব্রহ্মণে নমঃ॥

অর্থ: অচিন্তনীয় ও অব্যক্ত রূপধারী, নির্গুণ অথচ সকল গুণের অধিষ্ঠান যিনি,
সেই ব্রহ্ম— যিনি সমগ্র জগতের আশ্রয়রূপ— তাঁকে প্রণাম।

যৎ স্মৃত্যা অভীষ্ট কার্যস্য নির্বিঘ্নাং সিদ্ধিম্ এষ্যতি।

নরঃ তং বুদ্ধিদং বন্দে বক্রতুণ্ডং শিবোদ্ভবম্॥

অর্থ:
যাঁর স্মরণে মনুষ্য তার কাঙ্ক্ষিত কর্মে বিঘ্নহীন সিদ্ধিলাভ করে,
বুদ্ধিদাতা, বক্রতুণ্ড, শিবজাতা শ্রীগণেশকে আমি প্রণাম জানাই।

পিতরৌ গণি-বল্লালৌ জয়তোऽম্বা-শিব-আত্মকৌ।
যাভ্যাং পঞ্চসুতাঃ জাতাঃ জ্যোতিঃ সংসার হেতবঃ॥

অর্থ: আমার পিতা বল্লাল ও মাতা গণি — যাঁরা শিব ও অম্বিকার রূপে শুভাত্মা, তাঁদের গর্ভে জন্মেছেন পাঁচ পুত্র, যারা জ্যোতির্বিজ্ঞানে সংসারপথের আলোকপ্রদ।

সার্বভৌম জহাঙ্গীর বিশ্বাস আস্পদ ভাষণম্।
যস্য তং ভ্রাতরং কৃষ্ণং বুধং বন্দে জগদ্‌গুরুম্॥

অর্থ:
যার বুদ্ধিদীপ্ত বাক্য সার্বভৌম সম্রাট জাহাঙ্গীরেরও বিশ্বাসভাজন হয়েছিল,
সেই আমার ভাই কৃষ্ণ—জগৎগুরু সদৃশ সেই প্রাজ্ঞ ব্যক্তিকে আমি প্রণাম করি।

নানা গ্রন্থান্ সমালোচ্য সূর্যসিদ্ধান্ত টিপ্পণম্।
করোমি রঙ্গনায়োऽহং নদ্‌ গূঢ়ার্থ প্রকাশকম্॥

অর্থ:
বহু প্রাচীন গ্রন্থ বিচার করে আমি, রঙ্গনাথ, সূর্যসিদ্ধান্তের গূঢ়ার্থপ্রকাশিকা নামে এই ব্যাখ্যা রচনা করছি।

অথ গ্রহাদি চরিত জিজ্ঞাসূন্ মুনীন্ তৎ প্রশ্ন কারকান্ প্রতি স্ববিদিতং যথার্থ তত্ত্বং সূর্যাংশ পুরুষ ময়াসুর সংবাদং বক্তুকামঃ কশ্চিদ্ ঋষিঃ প্রথম আরম্ভণীয় তৎকথন নির্বিঘ্ন সম্পাত্যর্থং কৃতং ব্রহ্ম প্রণাম মঙ্গলং শিষ্য শিক্ষায়ৈ নিবধ্নাতি।

অর্থ:
যেসব ঋষি গ্রহাদি চরিত (আচরণ) জানার ইচ্ছা রাখতেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে একজন ঋষি সূর্যদেব ও ময়াসুরের সংলাপকে ভিত্তি করে জ্যোতির্বিদ্যার সত্যতত্ত্ব প্রকাশ করতে উদ্যত হন।
প্রথমেই সেই বর্ণনার নির্বিঘ্ন সমাপ্তির জন্য ও শিষ্যদের শিক্ষার্থে তিনি ব্রহ্মাকে প্রণাম করে মঙ্গলাচরণ স্থাপন করেন।

এরপর দীর্ঘ ভাষ্যাংশে রঙ্গনাথ ব্যাখ্যা করেছেন—

ব্রহ্মণে বৃতত্বাদ অপরিচ্ছিন্নত্বাৎ জগত্ ব্যাপকায় ঈশ্বরায় তস্মাৎ... ইত্যর্থঃ।

ব্রহ্ম— যিনি অসীম, অখণ্ড ও সর্বব্যাপী;
যাঁর থেকে এই বিশ্বের সৃষ্টি (“तस्मादात्मन आकाशः सम्भूतः” ইত্যাদি শ্ৰুতি অনুসারে)—
তাঁকেই প্রণাম।

এখানে “সমস্ত জগতের ভিত্তি বা আশ্রয় যিনি—ব্রহ্ম, বিষ্ণু, শিবরূপ সেই ঈশ্বরকে প্রণাম” এই ভাব প্রকাশ করা হয়েছে।

রঙ্গনাথ বোঝাচ্ছেন—
যেহেতু আকাশ কেবল সর্বব্যাপী হলেও জগতের আশ্রয় নয়, তাই ব্রহ্ম-বিষ্ণু-শিব—এই ত্রিরূপ ঈশ্বরই প্রকৃত “সমস্তজগদাধারমূর্তি”।

“অচিন্ত্য” মানে যিনি চিন্তার অতীত,

“অব্যক্তরূপ” মানে যাঁর নির্দিষ্ট রূপ কল্পনা করা যায় না।
তাঁর ধ্যান করা অসম্ভব, তাই তাঁকে নমস্কারই উপযুক্ত।

“নির্গুণ” মানে যিনি সত্ত্ব, রজ, তম—এই তিন গুণের অতীত।

এই গুণহীনতা থেকেই তাঁর “অব্যক্তরূপতা” নির্ণীত হয়।

অর্থাৎ যাঁর অন্তরে নিত্যজ্ঞান, আনন্দ, সত্য ইত্যাদি আত্মগুণ বিদ্যমান।

তাই “নির্গুণ” হলেও তিনি গুণাত্মা
যিনি জ্ঞানের, আনন্দের, চিরসত্তার রূপ স্বরূপ।

শেষে রঙ্গনাথ উপসংহার টানেন—
“নির্গুণ ব্রহ্মই সর্বগুণের উৎস, তাঁর মধ্য দিয়েই জগতের সৃষ্টি সম্ভব;
অতএব তিনিই জগত্কর্তা।”

এইভাবে এই মঙ্গলাচরণে ঈশ্বরের দ্বৈত বৈশিষ্ট্য—
নির্গুণ তত্ত্ব (অচিন্ত্য, অব্যক্ত)
সগুণ তত্ত্ব (জ্ঞানে, আনন্দে পূর্ণ)
উভয়কেই একত্রে প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রকৃতিং স্বাম্-অবষ্টভ্য বিসৃজামি পুনঃ পুনঃ। ভূতগ্রামমিমং কৃত্স্নমবশঃ প্রকৃতের্-বাসাৎ॥ ইতি ভাগবদুক্তের্-ইত্যন্যে॥ ১॥

সিন্দূরারুণ কারুণান্তরলসদ্ ভক্তেষু মন্দ্রধ্বনত্ কণ্ঠানু-শ্রুত-ভাম-দক্ষিণ-চলচ্ছুণ্ডার ফূত্কারিতম্। যাতাং ধ্যান-সমস্ত-কার্য-করন-আভাব-প্রতিযোগি যদ্ ভালে-ইন্দু-প্রসরৎ-তমোऽপহননং চিন্তাম্যহং তন্মহঃ॥ ১॥

নূনং কিন্চিত্ শাস্ত্র-তত্ত্বং সমাপি টীকাকুদ্ভিঃ শাস্ত্রম্-আটীকি সদ্ভিঃ।

হিন্দী-টীকা-সংস্কৃতেন-উপপত্তির্ নূলৈব-আসাং মুক্ত-পদ্-঵ৈন্দ্-঵ী঵॥ ২॥

ভালং শ্রিত্বা রঙ্গনাধ-অনুনাথাং ব্যাখ্যাং গূঢ়ার্থ-প্রকাশা-অভিরামা। গ্রন্থং কুর্যাত্ সূর্যসিদ্ধান্তমেনং শম্ভু লোকালোক-ভাসি-প্রকাশম্॥ ৩॥

অচিন্ত্য, অনির্বচনীয় (কল্পনা সে পরে) এবং অব্যক্ত (নিরাকার) স্বরূপে বালে, সত্ত্ব, রজ, তম, গুণত্রয়ে সে রহিত, (প্রকৃতি) স্বরূপ (সগুণ), সমস্ত সৃষ্টিকে আধারভূত সৃষ্টিস্থিতি বিনাশরূপ মূর্তি-ত্রয়-আত্মক অস্ পরব্রহ্ম কো নমস্কার হ্যায়॥ ১॥

ময়াসুর তপো বর্ণনম্ অল্পাবশিষ্টে তু কৃতে ময়ো নাম মহাসুরঃ। রহস্যং পরমং পুন্যং জিজ্ঞাসুর্ জ্ঞানম্ উত্তমম্॥ ২॥

বেদাঙ্গম্-অগ্যম্-অখিলং জ্যোতিষাং গতিকারণম্। আরাধয়ান্ বিবস্বন্তং তপস্তেপে সুদুশ্চরম্॥ ৩॥

অথ স্বোক্তস্য স্বকল্পিতত্ব-শঙ্কা-আবরণায় তৎ-সংবাদ-উপক্রমং বিবক্ষুঃ...

নিজের উক্তিটি কল্পিত নয়—এই আশঙ্কা দূর করার জন্য, বক্তা ময়াসুর ও সূর্যের সংলাপের সূচনা করতে চান। তাই তিনি প্রথমে উল্লেখ করছেন যে “ময়াসুর কঠোর তপস্যা করেছিলেন”—এ কথাটি প্রমাণ করতে নিচের দুটি শ্লোক বলেছেন।

ময়” নামের যে মহান অসুর ছিলেন, তিনি তপস্যা করেছিলেন। তপস্যা বলতে বোঝায় — ইষ্টদেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য জপ, হোম, ধ্যান ইত্যাদির মাধ্যমে নিজের দেহকে কষ্ট দেওয়া ও নিয়মপালন করা। পুরাণে অসুরদের তপস্যার কথা বারবার এসেছে।

কিন্তু প্রশ্ন ওঠে — অসুররা তো নির্দিষ্ট কোনও দেবতাকে উদ্দেশ্য করে তপস্যা করতেন, তাহলে এখানে ময় কাকে উদ্দেশ্য করে তপস্যা করলেন?
এর উত্তরে বলা হচ্ছে — “আরাধয়ন্নিতি” অর্থাৎ তিনি সূর্যদেবকে (বিবস্বান, সবিতৃমণ্ডলের অধিষ্ঠাতা নারায়ণকে) উপাসনা করছিলেন।

তবুও প্রশ্ন হতে পারে — সূর্য তো অসুরদের শত্রু, তিনি কেন এক শত্রুর তপস্যায় সন্তুষ্ট হলেন?
তার উত্তর — কারণ সেই তপস্যা ছিল “সুদুশ্চরম্” অর্থাৎ অত্যন্ত কঠিন ও যন্ত্রণাপূর্ণ। আর ভক্তির শক্তিতে, ভগবান এমনকি অসুরেরও ইচ্ছা পূর্ণ করেন — পুরাণে তার অনেক উদাহরণ আছে। তাই বোঝা যায়, ময়াসুরের তপস্যা বাস্তব ছিল এবং প্রমাণসিদ্ধ।

অল্পাবশিষ্ট ইতি”—এই অংশে বোঝানো হচ্ছে, কৃতযুগের শেষ ভাগে, অর্থাৎ যুগান্তের সন্ধিক্ষণে, ময়াসুর সেই তপস্যা করেন। সুতরাং এটি কোনও মনগড়া কাহিনি নয়, বরং প্রত্যক্ষ প্রমাণসমর্থিত ঐতিহাসিক ঘটনা।

এখন প্রশ্ন — তিনি তপস্যা কেন করলেন? কারণ তিনি “জিজ্ঞাসু”, অর্থাৎ জানার ইচ্ছাপ্রবণ ছিলেন।

তিনি এমন এক জ্ঞান অর্জন করতে চেয়েছিলেন যা “জ্যোতিষাম্”—অর্থাৎ গ্রহ, নক্ষত্র ও গতির কারণ সম্পর্কিত জ্ঞান, মানে জ্যোতির্বিদ্যা।

তবে আবার সন্দেহ ওঠে — জ্যোতির্বিদ্যা তো মুনি-ঋষিদের জানা বিষয়, একজন অসুরের পক্ষে তা লাভ করা কি সম্ভব?

এর উত্তরে বলা হচ্ছে — “অখিলম্”, অর্থাৎ ময় শুধু অল্প নয়, সমগ্র জ্যোতিষশাস্ত্র জানার বাসনা করেছিলেন।

অসুর-বুদ্ধি দিয়ে তিনি ভাবলেন, “মানুষের মতো সীমিত ঋষির কাছ থেকে আমি সম্পূর্ণ জ্যোতিষতত্ত্ব পাব না; তাই সর্বজ্ঞ ভগবানকেই উপাসনা করব।”

এবং তিনি ভাবলেন — জ্যোতিষ যেহেতু বেদাঙ্গ, অর্থাৎ বেদের অঙ্গ, তাই এর সাধনা মোক্ষফল দিতে সক্ষম; অতএব এই সাধনা পুণ্যময় এবং যুক্তিসঙ্গত।

তাই তিনি এই “পরম পবিত্র” বিদ্যা অর্জনের জন্য সূর্যদেবের তপস্যা করলেন।

কালো’য়ং ভগবান্ বিষ্ণুর্ অনন্তঃ পরমেশ্বরঃ।

তদ্বত্তা পূজ্যতে সম্যক্ পূজ্যঃ কো’ন্যস্ততো মতঃ॥

এভাবে ব্যাখ্যা অনুযায়ী—

ময়াসুর সূর্যদেব (বিবস্বান) বা নারায়ণরূপ পরমেশ্বরের উপাসনা করে সেই “সূর্যসিদ্ধান্ত” তত্ত্ব লাভ করেছিলেন, যা পরবর্তীকালে জ্যোতিষশাস্ত্রের মূল ভিত্তি হয়।

এত্যুক্তেঃ কালপ্রতিপাদকত্বেনোত্কৃষ্টমতো বেদাঙ্গম্। এতে দ্বারা পুরাণাদি প্রমাণগুলির নাস করা হয়েছে — এই অর্থ। কিন্তু ব্যাকরণাদি ছয়টি বেদাঙ্গের মধ্যেই প্রবৃত্তি থাকায়, এখানে এর প্রয়োগ কীভাবে সম্ভব — এই প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে — অগ্রমিতি। অর্থাৎ ছয়টি বেদাঙ্গের মধ্যে এটি শ্রেষ্ঠ। কুত ইত্যত্র আহ — উত্তমমিতি। অর্থাৎ প্রধান অঙ্গ, যেমন নয়ন প্রধান অঙ্গ। এবং নয়নবিহীন ব্যক্তির কিছুই করণীয় না থাকার মতো, তেমনি এই জ্যোতিষশাস্ত্রই বেদাঙ্গগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ — এই অর্থ। কিন্তু এত কিছুর পরেও এর জ্ঞানলাভের জন্য এত আয়াস যুক্তিযুক্ত নয় — এই আপত্তির উত্তরে বলা হয়েছে — রহস্যমিতি।

বিদ্যা হ বৈ ব্রাহ্মণমাজগাম গোপায়মাশेवধিষ্ঠে’হমস্মি। অসূয়কায়ানৃজবে যতায় ন মাং ব্রূয়াদবীর্যবতী তথা স্যাম্।।

এই শ্রুতিবাক্য দ্বারা বোঝানো হয়েছে — ‘গোপ্যম্’ অর্থাৎ গোপনীয়। এবং এই শাস্ত্রটি প্রদানে নিষিদ্ধ ও গোপনীয় বলে নির্ধারিত, তাই এর প্রাপ্তির জন্যই এত কষ্ট করা হয়েছে — এই অর্থ। ॥২–৩॥

সত্যযুগের অল্প সময় অবশিষ্ট থাকাকালীন (অর্থাৎ সত্যযুগের অন্তে) ‘ময়’ নামক এক মহান অসুর সমস্ত বেদাঙ্গের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, গ্রহদের গতির কারণভূত, পরম পবিত্র ও গূঢ় জ্যোতিষশাস্ত্রের উত্তম জ্ঞানলাভের আকাঙ্ক্ষা করে, ভগবান সূর্যের আরাধনা করতে করতে কঠোর তপস্যা করেছিল। ॥২–৩॥

তোষিতস্তপসা তেন প্রীতস্তস্মৈ বরার্থিন। গ্রহাণাং চরিতং প্রাদান্ মযায় সবিতা স্বয়ম্॥৪॥

এরপর তার তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে, জ্যোতিষশাস্ত্রের জ্ঞানরূপ বর কামনা করা ময় অসুরকে ভগবান সূর্য নিজে, অতি আনন্দ সহকারে গ্রহদের চরিত্র (জ্যোতিষশাস্ত্রের জ্ঞান) দান করলেন। ॥৪॥

ময়ং প্রতি সূর্যোপদেশঃ

শ্রীসূর্য উবাচ — বিদিতস্তে ময়া ভাবস্তোষিতস্তপসা হ্যহম্। দদ্যাং কালাশ্রয়ং জ্ঞানং গ্রহাণাং চরিতং মহৎ॥৫॥

এখন প্রশ্ন — সূর্যদেব কীভাবে নিজের শত্রু অসুরের প্রতি এইরূপ বাণী বললেন? সেই প্রশ্নের উত্তরে, ময়কে উদ্দেশ্য করে সূর্যের বলা কথার ভূমিকা ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।

“শ্রীসূর্য উবাচ” — অর্থাৎ তেজের সমূহ দ্বারা দীপ্তিমান সূর্য, ময় অসুরকে উদ্দেশ্য করে বললেন। অন্যথায় চতুর্থ ও পঞ্চম শ্লোকের সংগতিই স্থাপিত হতো না। কী বললেন — তা নিচে বলা হচ্ছে।

হে ময় অসুর! তোমার ভাব, অর্থাৎ তোমার মনোবাঞ্ছা—জ্যোতিষশাস্ত্রজ্ঞানলাভের আকাঙ্ক্ষা—আমি সূর্য নিজে, তোমার মুখে না বললেও, নিজের দ্বারা জেনে নিয়েছি। তারপরও তুমি ভাবছ, হয়তো আমার থেকে সেই সিদ্ধি হবে না—তাই আমি বলছি—

“অহম্” অর্থাৎ আমি সূর্য, তোমাকে দিচ্ছি—“কালাশ্রয়ং জ্ঞানং”—যে জ্ঞান কালের আশ্রয়যুক্ত, অর্থাৎ কালপ্রধান। “গ্রহাণাং চরিতং মহৎ”—গ্রহদের, প্রবহবায়ুতে অবস্থিত নক্ষত্রাদি গ্রহসমূহের মহান ও অপরিমেয় চরিত্ররূপ জ্ঞান।

অর্থাৎ গ্রহদের স্থিতি, গতি ইত্যাদি যাকে বলা হয়—সেই জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রকৃত জ্ঞান আমি তোমাকে প্রদান করছি।

আমি সূর্যমণ্ডলে অবস্থিত হয়ে সেটি দিচ্ছি। কিন্তু তুমি তো অসুর; তাহলে আমার এই বাণী কি তোমাকে প্রতারণার উদ্দেশ্যে নয়?—এই সন্দেহ দূর করার জন্য সূর্য নিজেকে বিশেষণসহ, প্রতারণাহীনভাবে এই কথা বললেন—

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

ঋগ্বেদ ৭/৪/৭

  পরিষদ্যম্ হ্যরণস্য রেক্ণো নিত্যস্য রায়ঃ পতয়ঃ স্যাম। ন শেষো অগ্নে অন‍্যজাতম্ অস্ত্যচেতনস্য মা পথম্ বিদুক্ষঃ॥ ঋগ্বেদ ভাষ্য (স্বামী দयानন্দ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ