শিবের দৃষ্টিতে ধর্ম - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

10 October, 2025

শিবের দৃষ্টিতে ধর্ম

 

শিবের দৃষ্টিতে ধর্ম

🍁 সম্পাদকীয় 🍁
আজ ভারতে যে মহাপুরুষের সর্বাধিক পূজা করা হয়, তিনি হলেন - ভগবান্ মহাদেব শিব। একদিকে যেমন পৌরাণিক বিদ্বানরা মহাদেব শিবের চরিত্রকে অত্যন্ত অশ্লীল, চমৎকারী আর কাল্পনিক রূপে প্রস্তুত করেছে, তেমনই অন্যদিকে আর্যসমাজিরা তাঁর চরিত্রকে নিকৃষ্ট বলে মনে করে অবহেলা করে দিয়েছে। বস্তুতঃ দুটোই তাঁর যথার্থ স্বরূপকে সমাজের সম্মুখে প্রস্তুত করতে পারেনি। সম্ভবতঃ তারা তাঁকে, তাঁর চরিত্রকে, তাঁর আদর্শ এবং সিদ্ধান্তকে জানেই না। এমন পরিস্থিতিতে পূজ্য আচার্য অগ্নিব্রত নৈষ্ঠিক ভগবান্ মহাদেবের বাস্তবিক স্বরূপের বোধ করার জন্য মহাভারত গ্রন্থের আধারে তাঁর ধর্মবিষয়ক উপদেশকে সংসারের সামনে প্রস্তুত করেছেন। এই বিষয়ে আচার্যশ্রীর প্রবচনের প্রসারণ আমাদের "বৈদিক ফিনিক্স" ইউটিউব চ্যানেলের মধ্যে ষোলোটা ভিডিওর মাধ্যমে করা হয়েছে। এই প্রবচন মহাভারতের অনুশাসন পর্বের অন্তর্গত দানধর্ম পর্বের একটা শ্লোকের উপর আধারিত। এরমধ্যে অহিংসা, সত্য, দয়া, শম আর দানের প্রমাণপূর্বক ও দৃষ্টান্তসহিত ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
.
প্রবচন প্রত্যেক মানুষকে শোনা ও গ্রহণ করা উচিত আর শুনে নিজ ব্যবহারে সেটা ধারণ করা উচিত, বিশেষ করে গৃহস্থিদের। মহাভারতে লেখা আছে -
.
"শ্রূয়তাম্ ধর্মসর্বস্বম্ শ্রুত্বা চৈবাবধার্য়তাম্।"
.
অর্থাৎ ধর্মের স্বরূপ কি? শুনুন আর শুনে তদনুসারে চলুন।
.
ধর্মের অনিবার্যতা নিয়ে মহর্ষি বেদব্যাস মহাভারতের স্বর্গারোহণ পর্বে বলেছেন -
ঊর্ধ্ববাহুর্বিরৌম্যেষ ন চ কশ্চিচ্ছৃণোতি মে।
ধর্মাদর্থশ্চ কামশ্চ সঃ কিমর্থম্ ন সেব্যতে।।
.
অর্থাৎ আমি আমার দুই বাহু উপর তুলে, চিৎকার করে বলছি, কিন্তু আমার কথা কেউই শুনছে না। ধর্মের দ্বারা মোক্ষ তো প্রাপ্ত হয়, অর্থ আর কামও ধর্মের দ্বারাই সিদ্ধ হয়, তা সত্ত্বেও মানুষ তার সেবন কেন করে না? আচার্য চাণক্য ধর্মকে সুখের মূল বলেছেন - "সুখস্য মূলম্ ধর্মঃ"। এইজন্য প্রত্যেক সুখাভিলাষী ব্যক্তিকে ধর্মের আচরণ অবশ্যই করা উচিত।
.
এই পুস্তকের মধ্যে সর্বপ্রথম ধর্মের প্রথম লক্ষণ "অহিংসা"র উপর বিচার করে হয়েছে। হিংসা, কাম, ক্রোধ, লোভ আদির তরঙ্গগুলো সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডকে কিভাবে প্রভাবিত করে? এই বিজ্ঞান পাঠকদের জন্য নবীন হবে। এর পশ্চাৎ "সত্য" নিয়ে চর্চা করা হয়েছে, যার উপর সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ড টিকে আছে। দয়ার দ্বারা কিভাবে ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে? পরে এই বিষয়ে সবিস্তারে বলা হয়েছে। পরবর্তী কিছু অধ্যায়ের মধ্যে মানুষের মন ও ইন্দ্রিয় কিভাবে প্রদূষিত হচ্ছে আর এগুলোকে নিয়ন্ত্রিত করে কিভাবে ব্রহ্মচর্যের পালন করা সম্ভব, তা নিয়ে বলা হয়েছে। অন্তিমে দুটো অধ্যায়ের মধ্যে দান কেন করবেন? আর সর্বশ্রেষ্ঠ দান কি? এইরূপ প্রশ্নের উত্তর পাঠকগণ পড়তে পারবেন। পুস্তকের অন্তিমে পরিশিষ্টের রূপে ভগবান্ শিবের অনুসারে চার বর্ণের ধর্ম, বর্ণ পরিবর্তন আর স্বর্গের অধিকারী কে? এইসব বিষয় বর্ণিত আছে।
.
পাঠকদের সুবিধা আর কিছু সজ্জনদের আগ্রহে আমি এই প্রবচনকে লিপিবদ্ধ করার নির্ণয় লিয়েছি। আচার্যশ্রীর উপদেশকে লিখিত রূপ দেওয়ার কৃতিত্ব প্রিয় য়শপাল আর্যের। মৌখিক আর লিখিত ভাষার মধ্যে পার্থক্য হওয়ার কারণে ভাষাকে পরিষ্কৃত করা অত্যাবশ্যক ছিল। এই কাজ আমার সহধর্মিণী শ্রীমতি মধুলিকা আর্যা, যিনি শ্রীমদ্ দয়ানন্দ কন্যা গুরুকুল, চোটিপুরার সুযোগ্যা স্নাতিকা হন তথা সম্প্রতি পি.এইচ.ডি. পূর্ণ করতে চলেছেন, তিনি দক্ষতার সাথে সম্পাদিত করেছেন, এরজন্য তাকে সহৃদয়ে ধন্যবাদ জানাই।
.
পাঠকদের কাছে বিনম্র নিবেদন যে তারা পুস্তকটা আদ্যোপান্ত পড়বেন, তার পাশাপাশি তারা এই বিষয়গুলোর উপর গম্ভীরতাপূর্বক চিন্তন করবেন আর এই উপদেশগুলোকে নিজের জীবনে ধারণ করার চেষ্টা করবেন, যাতে তাদের জীবন সুখময় আর আদর্শ হয়ে ওঠে।
- বিশাল আর্য
🍁 ভূমিকা 🍁
ভগবান্ মহাদেব শিব একজন ঐতিহাসিক মহাপুরুষ ছিলেন, যিনি দেব বর্গে উৎপন্ন হয়েছিলেন। কৈলাশ ক্ষেত্র তাঁর রাজধানী ছিল। আজ শ্রাবণ মাসের শুরু থেকেই দেশ ও বিদেশের শিবালয়গুলোতে পূজা, কীর্তন, কথাবাচন, শিবলিঙ্গের অশ্লীল পূজা, যেটা শিবপুরাণের মধ্যে বর্ণিত দারুবন কথার উপর আধারিত তথা এই কথাকে কোনো সভ্য ও সুসংস্কৃত মহিলা বা পুরুষ শুনতেই পাবে না, শুরু হয়ে যায়। শিবলিঙ্গের উপর দুধ চড়ানো, যেটা বয়ে নর্দমায় গিয়ে পরিবেশকে দূষিত করে, পূজা করার স্বরূপ কি সত্যিই এমন? আশ্চর্যের বিষয় যে ভগবান্ শিবের এই অভাগা রাষ্ট্রের মধ্যে যেখানে কোটি-কোটি বাচ্চা বা বৃদ্ধ পেট ভরে খাওয়ার জন্য ভুগছে, সেই দেশের মধ্যে এইভাবে দুধ ছড়ানো, এটা সেই ক্ষুধার্ত নর-নারীর সাথে-সাথে স্বয়ং ভগবান্ শিবেরও অপমান নয় কি? কত জন শিবভক্ত আছে যারা ভগবান্ শিবের বিমল ও দিব্য চরিত্র, শৌর্য, ঈশ্বরভক্তি, য়োগসাধনা এবং অদ্ভুত জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত? এটা আপনারা স্বয়ং আত্মনিরীক্ষণ করুন। ভগবান্ শিব কেমন ছিলেন, তাঁর কি প্রতিভা ছিল, তাঁর কি উপদেশ ছিল, এইসব জানা বা বোঝার না তো কারও কাছে সময় আছে আর না বোধ আছে। এই কারণে আমি একটা শৃঙ্খলা রূপে তাঁর গম্ভীর উপদেশ ও জ্ঞান-বিজ্ঞানকে মহাভারত গ্রন্থের আধারে প্রস্তুত করা প্রারম্ভ করবো। এই বর্ণনা ভীষ্ম পিতামহের সেই উপদেশগুলোর মধ্যে পাওয়া যায়, যা তিনি শরশয্যাতে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে দিয়েছিলেন। আজ এটা ভারী সমস্যা যে পৌরাণিক (তথাকথিত সনাতনী) ভাইরা ভগবত্পাদ মহাদেব শিবকে অত্যন্ত অশ্লীল, চমৎকারী ও কাল্পনিক রূপে চিত্রিত করেছে, অপরদিকে আর্যসামাজী বন্ধুরা যেন তাঁকে জঞ্জালের পাত্রে ফেলে দিয়েছে। এমতাবস্থায় তাঁর যথার্থ চিত্রন এই সংসারের সম্মুখে নিতান্ত লুপ্ত হয়েগেছে।
পৌরাণিক বন্ধু ধর্মের নামে প্রচলিত বিভিন্ন মান্যতা ও কথনকে বুদ্ধির চক্ষু বন্ধ করে অক্ষরশঃ সত্য বলে মেনে নেয় আর যদি বা কেউ মিথ্যা কথনের খণ্ডন করে, তাহলে তাকে হিন্দু বিরোধী বলে ঝগড়া করতে উদ্যত হয়। তারা এটাও কিভাবে না যে মিথ্যা কথন আর অন্ধবিশ্বাসের কারণেই এই ভারত আর হিন্দু জাতির এই দুর্গতি হয়েছে, ভারতের ইতিহাস ও জ্ঞান-বিজ্ঞান নষ্ট হয়েছে, ভারত কয়েকশ বছর ধরে বিদেশীদের দাস ছিল। অন্যদিকে আর্যসামাজী বন্ধু বিনা গম্ভীর চিন্তন ও স্বাধ্যায় করে পুরাণের সাথে-সাথে মহাভারত, বাল্মিকী রামায়ণের সব অথবা অধিকাংশ কথাকে কাল্পনিক মনে করে খণ্ডন করার জন্য তৎপর থাকে; মহাদেব, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্রের মতো ভগবানদের ভুলে যাওয়ার পাপ করতে হলেও, তারা খণ্ডন করাকেই আর্যবর্ত বলে মনে করে। তারা এটা ভাবে না যে যদি মিথ্যা কথন আর অন্ধবিশ্বাসের খণ্ডন করতে হয়, তাহলে এই দেবতাদের সত্য ইতিহাসও তো জানা ও জানিয়ে দেওয়া অনিবার্য হবে। আপনাদের কাছে আগ্রহ করবো যে আপনারা এই উপদেশগুলোকে গম্ভীর্তাপূর্বক শুনবেন, বিচার করবেন তথা আচরণে নিয়ে এসে আসল শিবভক্ত হওয়ার চেষ্টা করবেন। ঈশ্বর আমাদের সবাইকে এমন সত্য শিবভক্ত হওয়ার বুদ্ধি ও শক্তি প্রদান করুক, এটাই কামনা করি।
.
ভগবান্ শিবের বিষয়ে প্রায়শই শিবপুরাণের কথার বাচন হয়, অথচ মহর্ষি বেদব্যাস কৃত মহাভারতকে পড়ার পাঠক এখন আর নেই বললেই চলে। উল্লেখনীয় হল যে মহর্ষি বেদব্যাস দ্বারা রচিত আঠারো পুরাণের মান্যতা আসলে তাঁর দ্বারা নয় বরং অন্য আচার্যদের দ্বারা রচিত ছিল আর এই গ্রন্থগুলো কোনো প্রামাণিক গ্রন্থের ধাঁচে আসে না। যদিও মহাভারতেও প্রায় ৯৫ শতাংশ এমন আছে, যা মহর্ষি বেদব্যাসের পশ্চাৎ তাঁর শিষ্য এবং কালান্তরে অনেক অপ্রামাণিক বিদ্বানরা লিখে জুড়ে দিয়েছে। তা সত্ত্বেও বলবো যে মহাভারত হল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা গ্রন্থ। মহর্ষি দয়ানন্দ কৃত "সত্যার্থপ্রকাশ" আর "ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকা"র গম্ভীর অধ্যায়ণ থেকে প্রাপ্ত ও নীর-ক্ষীর বিবেকী প্রজ্ঞার দ্বারা আমি যেকোনো আর্ষ গ্রন্থকে সঠিকভাবে বুঝতে পারি। আমার "বেদবিজ্ঞান-আলোক" গ্রন্থও এই ধরণের তদন্তে পরোক্ষ সহযোগিতা করতে পারে।
এখন আমি মহাদেব শিবের চর্চা করবো -
মহর্ষি দয়ানন্দ তাঁর পুনা প্রবচনে মহাদেব শিবকে অগ্নিষ্বাতের পুত্র বলেছেন। অগ্নিষ্বাত কার পুত্র ছিলেন, এটা খুব স্পষ্ট নয় তবে তিনি মহর্ষি ব্রহ্মার বংশজ অবশ্যই ছিলেন। মহাভারতে মহর্ষি বৈশম্পায়ন বলেছেন -
.
উমাপতির্ভূতপতিঃ শ্রীকণ্ঠো ব্রহ্মণঃ সুতঃ।
উক্তবানিদমব্যগ্রো জ্ঞানম্ পাশুপতম্ শিবঃ।।
শান্তিপর্ব । মোক্ষধর্মপর্ব । অধ্যায় ৩৪৯ । শ্লোক ৬৭ (গীতাপ্রেস)
.
এখানে ভগবতী উমার পতি ভূতপতি, যেটা ভগবান্ শিবেরই নাম, তাঁকে মহর্ষি ব্রহ্মার পুত্র বলেছেন। তাঁর পাশুপত অস্ত্র বিশ্বপ্রসিদ্ধ ছিল। এই অস্ত্রকে নষ্ট করতে পারে এমন কোনো অস্ত্র ভূমণ্ডলে ছিল না।
.
মহাভারতের অনুশীলন করে জানা যায় যে, ভগবান্ শিব অত্যন্ত বিরক্ত পুরুষ, সর্বদা য়োগ-সাধনায় লীন, বিবাহিত হয়েও পূর্ণ জিতেন্দ্রিয়, আকাশগমন আদি অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধি সম্পন্ন, বেদ-বেদাঙ্গের মহান বৈজ্ঞানিক, সুগঠিত, তেজস্বী ও অত্যন্ত বলিষ্ঠ শরীর ও বীরতার অপ্রতিম ধনী দিব্য পুরুষ ছিলেন। তিনি জীবনমুক্ত অবস্থা প্রাপ্ত মহাবিভূতি ছিলেন। তাঁর ইতিহাসের বর্ণনা তো অধিক পাওয়া যায় না কিন্তু তাঁর উপদেশগুলোকে আমরা মহাভারতের মধ্যে পড়তে পারি। এই কারণে আমি এই গ্রন্থের উপরই ধ্যান কেন্দ্রিত করবো।
🌿 ২. ভগবান্ শিবের অনুসারে ধর্মের প্রথম লক্ষণ
ও৩ম্ য়ো ভূতম্ চ ভব্যম্ চ সর্বম্ য়শ্চাধিতিষ্ঠতি।
স্বর্য়স্য চ কেবলম্ তস্মৈ জ্যেষ্ঠায় ব্রহ্মণে নমঃ।।
(অথর্ববেদ ১০.৮.১)
.
এখন আমি মহাভারতের আধারে ভগবান্ শিবের উপদেশের বর্ণনা প্রারম্ভ করবো। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে দানধর্ম পর্বের অন্তর্গত ভগবতী উমা মহাদেব শিবের নিকট প্রশ্ন করেছেন যে -
ধর্মঃ কিম্লক্ষণঃ প্রোক্তঃ কথম্ বা চরিতুম্ নরৈঃ।
শক্যো ধর্মমবিন্দদ্ভির্ধর্মজ্ঞ বদ মে প্রভো।।২৩।।
অর্থাৎ হে প্রভো ধর্মজ্ঞ! ধর্মের লক্ষণ কি? তথা যারা ধর্মকে জানে না, তারা কিভাবে ধর্মের আচরণ করবে?
.
আজ ধর্মের পরিভাষা বাইরের লক্ষণকে দেখে করা হয়। কেউ দাড়ি দেখে, তো কেউ শিখা দেখে, কেউ যজ্ঞোপবীত দেখে, তো কেউ সন্ধ্যা করতে দেখে, কেউ যজ্ঞ করতে, তো কেউ নামাজ পড়তে আর কেউ প্রার্থনা করতে দেখে। এগুলোর মধ্যে একটাও ধর্মের লক্ষণ নয়। সন্ধ্যা করাও ধর্মের লক্ষণ নয়। সন্ধ্যা করলে আমাদের ভিতরে যে গুণগুলো তৈরি হবে, সেগুলো ধর্মের লক্ষণ হবে। সন্ধ্যা করেছি আর আমাদের ভিতরে ধর্মের লক্ষণ আসেনি, তো সন্ধ্যা ধর্ম নয়। সন্ধ্যা হল ধর্ম পথে চলার জন্য একটা সাধন।
এখন মহাদেব শিব ধর্মের লক্ষণ সম্বন্ধে বলেছেন -
অহিম্সা সত্যবচনম্ সর্বভূতানুকম্পনম্।
শমো দানম্ য়থাশক্তি গার্হস্থ্য়ো ধর্ম উত্তমঃ ।। ২৫।।
(মহাভারত অনুশাসন পর্ব, দানধর্ম পর্ব, অধ্যায় ১৪১)
শ্রীমহেশ্বর বললেন - দেবী ! কোনো জীবের উপর হিংসা না করা, সত্য বলা, সব প্রাণীর উপর দয়া করা, মন আর ইন্দ্রিয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ করা তথা নিজের সামর্থ্যানুসারে দান দেওয়া হল গৃহস্থ আশ্রমের উত্তম ধর্ম ।।২৫।।
.
এখানে অহিংসাকে প্রথম ধর্ম বলা হয়েছে আর যদি পাতঞ্জল য়োগদর্শনকে দেখি, তাহলে অষ্টাঙ্গ য়োগের মধ্যে প্রথম ধর্ম য়ম আছে - অহিংসা। ভগবান্ পতঞ্জলি এটাও লিখেছেন যে অহিংসা হল মূল, অহিংসা হল মহাব্রত, অহিংসার থেকে বড় কোনো ব্রত নেই।
.
এখন অহিংসা কি, এর উপর বিচার করবো -
প্রায়শঃ মানুষ এমন মনে করে যে অহিংসার অর্থ হল কারও সাথে শত্রুতা না করা। আমরা গান্ধীর তিন বাঁদরের কথা শুনেছি - কারও মন্দ দেখো না, কারও মন্দ শোনো না আর কাউকে মন্দ বলো না। মন্দটা কি, সেটাও তো জেনে রাখা দরজার। যদি রাজা কারও মন্দ না শোনে, তাহলে অপরাধীকে কিভাবে দণ্ড দিবে? কোনো ব্যক্তি যদি আবেদনকারী হয়ে ন্যায়ের জন্য আবেদন নিয়ে আসে, আর সেখানে রাজা চোখ, মুখ আর কান বন্ধ করে বসে পড়ে, তাহলে কি হবে? অর্থাৎ অহিংসার অর্থ বোঝাই হয়নি। অহিংসার অর্থ প্রাচীন ঋষিদের কালের পশ্চাৎ যদি সবথেকে বেশি কেউ জেনেছেন তো তিনি হলেন ঋষি দয়ানন্দ। তিনি সত্যার্থ প্রকাশের মধ্যে অহিংসার অর্থ সম্বন্ধে লিখেছেন -
"প্রাণীমাত্রের প্রতি দ্রোহ ত্যাগ অর্থাৎ সবার সঙ্গে প্রীতি করা।"
.
এখানে "অর্থাৎ সবার সঙ্গে প্রীতি করা" যদি না লিখতেন, তাহলে অহিংসা বোঝাই যেতো না। পরমাণু বোম কারও হিংসা করে না, কেউ তাকে চালাবে, তখন সেটা হিংসা করবে। বন্দুকের গুলিও স্বয়ং কারও হিংসা করে না, তাহলে কি এটা অহিংসা হবে? কবুতর কারও হিংসা করে না, কেউ মারতে এলে, তাহলে চোখ বন্ধ করে নেয়, এটা কি অহিংসা হবে? পাথরও হিংসা করে না, যদি কেউ সেটা মাথায় মারে, তাহলে সেটা আঘাতকারীর হিংসা হবে। এর ফলে পাথর কি অহিংসক হবে? এইজন্য ঋষি দয়ানন্দ জুড়ে দিয়েছেন - "সবার সঙ্গে প্রীতি করা"। অন্যদিকে মহর্ষি ব্যাস য়োগদর্শনের ভাষ্যতে অহিংসার পরিভাষা করে লিখেছেন -
"সর্বথা সর্বদা সর্বভূতানাম্ অনভিদ্রোহঃ সা অহিংসা"
- য়োগদর্শন
.
(সর্বথা) সব রকম ভাবে (সর্বদা) সব কালে (সর্বভূতানাম্) সব জীবের প্রতি (অনভিদ্রোহঃ) দ্রোহ করা উচিত নয়, (সা অহিংসা) সেটা হল অহিংসা।
.
যখন বিচারক কাউকে দণ্ড দেয়, তো তার মনে কোনো দ্রোহের ভাবনা থাকে না, বরং ন্যায়ের ভাবনা থাকে। বিচারকের মনে এই ভাবনা থাকে যে পীড়িত ব্যক্তি ন্যায় পাবে তথা অপরাধীরও উন্নতি হবে। যদি বিচারক অহিংসার অর্থ এটাই গ্রহণ করে যে কারও সাথে দ্রোহ না করা অর্থাৎ অপরাধীকে দণ্ড না দেওয়া, তাহলে অপরাধ বাড়বে। আর এর জন্য উত্তরদায়ী বিচারকই হবে। এইজন্য অহিংসার অর্থ হবে - কারও সাথে দ্রোহ না করা। ন্যায়ার্থ কাউকে মারা হিংসা নয়, বরং অহিংসা হয়। এর দ্বারা অনেকের প্রাণ বাঁচবে, এইজন্য ডাকাতকে দণ্ড দেওয়া অহিংসার অন্তর্গত আসে, হিংসার অন্তর্গত নয়।
.
এখন দ্বিতীয় কথা হল - সবার সাথে প্রীতি করা। দুষ্টকে দণ্ড দেওয়া কঠিন কাজ বটে। দুষ্ট যদি দুর্বল হয় তাহলে যে কেউ তাকে দণ্ড দিয়ে দিবে, কিন্তু যদি বলবান হয় তাহলে দণ্ড দেওয়ার সাহস কে করবে? ঋষি দয়ানন্দ মানুষের পরিভাষা নিয়ে বলেছেন - "অন্যায়কারী বলবান হলেও তাকে কখনও ভয় করবে না।" মানুষের লক্ষণ প্রথমে বলে দিয়েছেন - মানুষ অহিংসা থেকে তৈরি হয় আর যে ব্যক্তি মানুষ হয়, সেই ব্যক্তিই য়োগী হয়। মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী য়োগী হতে পারে না। এইজন্য মানবতার প্রথম পরিভাষাও অহিংসাই হয়। ধর্মের পরিভাষা হল অহিংসা আর যে ব্যক্তি ধর্মকে ধারণ করে, সেই ব্যক্তিই মানুষ হয়। "অন্যায়কারী বলবান হলেও তাকে কখনও ভয় করবে না" এটা কোনো সহজ কাজ নয়। যদি রাজা অন্যায়কারী হয়, তাহলে তাকেও ভয় না পাওয়া। এর বিপরীত ন্যায়কারী, ধর্মাচরণকারী, আধ্যাত্মিক ব্যক্তি, খুব দুর্বল, যার কাছে কিছুই নেই, তবুও তাকে ভয় করে চলবে। কিন্তু ব্যবহারে এমন হয় না। আজ সত্য কথা বলা ও সত্যের উপর চলা ব্যক্তিদের কেউ কিছু মনেই করে না, যারা ক্ষমতা এবং বলসম্পন্ন আছে, সবাই তাদের তোষামোদ করে, এমন করা হিংসা হয়। যদি দুষ্ট ব্যক্তির তোষামোদ করা হয়, তাহলে সেই দুষ্ট আরও অধিক দুষ্ট কর্ম করবে। এইভাবে তার দোষও আমাদের উপরই আসবে। এইজন্য ঋষি লিখেছেন যে "অন্যায়কারী বলবান হলেও তাকে কখনও ভয় করবে না, সর্বদা তার নাশের চেষ্টা করতে থাকবে", তার নাশ করাও অহিংসার কোটিতে আসবে। একজন রাজা যদি দুষ্ট হয়, তাহলে তাকে দণ্ড দিলে সম্পূর্ণ রাজ্য সুখী হয়ে উঠবে, এইজন্য তাকে দণ্ড দেওয়া অহিংসার কোটিতে আসবে। ভগবান্ কৃষ্ণ, ভগবান্ রাম, ভগবান্ মহাদেব আদি এমনই তো করেছেন, সবার হাতে অস্ত্র আছে, এটা হিংসার জন্য নয়, বরং অহিংসার রক্ষার জন্য। তাঁদের অস্ত্রের ব্যবহারও অহিংসার কোটিতে আসে। যেমন - বিচারকের ন্যায়পূর্বক ফাঁসির শাস্তি দেওয়াও অহিংসার কোটিতে আসে। যদি অন্যায়পূর্বক দণ্ড দেয়, তাহলে সেটা হিংসার কোটিতে আসবে।
.
এরপরের কথায় আসবো, "ধর্মাত্মা নির্বল হলেও সর্বদা তাকে ভয় করে চলবে, তার সর্বদা প্রিয়াচরণ করবে" অর্থাৎ তার সঙ্গে প্রীতি রাখবে। মহর্ষি দয়ানন্দ এটাও বলে দিয়েছেন যে কার সাথে প্রীতি আর কার সাথে শত্রুতা করবেন - "অন্যায়কারীর সাথে শত্রুতা আর সজ্জনদের সাথে প্রীতি করবে।" সবার সাথে প্রীতি করে, এটা মুখে বলা অনেক সহজ, কিন্তু এক নিজের ভাই আছে আর এক শত্রুর ভাই আছে। শত্রু যতই দুষ্ট হোক না কেন, কিন্তু তার ভাই যদি সজ্জন হয়, তাহলে কতজন মানুষ আছে যে তার সাথে প্রীতি করবে? নিজের আর অপরের ভেদ মুছে ফেলে ব্যবহার করা, এটাই হল বাস্তবে প্রীতি করা আর এটাই হল অহিংসা। সবার সাথে প্রীতি করা অর্থাৎ সবার সুখ নিয়ে চিন্তাভাবনা করা। মন্দিরে স্লোগান দেওয়া হয় - ধর্মের জয় হোক, অধর্মের নাশ হোক, সবাই সুখী হোক, সব প্রাণীর মধ্যে সদ্ভাবনা হোক, সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ। এইসব এমন ভাবে বলা হয়, যেভাবে টেপ রেকর্ডার বলে। টেপ রেকর্ডের মধ্যে কোনো ভাবনা থাকে না, কেবল শব্দ থাকে আর যখন আমরা কথাবলি, তখন ভাবও থাকে। এইভাবে যেসব স্লোগান দেওয়া হয়, সেগুলোতেও কোনো ভাব থাকে না। যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয় যে সব প্রাণীর মধ্যে সদ্ভাবনা এবং তাদের কল্যাণের জন্য আপনি কি করছেন? যেমন কোনো ডাক্তার স্লোগান দেয় যে সব রোগী ঠিক হোক, সব রোগী নিরোগ হোক, সব রোগী সুস্থ্য হোক আর ওষুধ কাউকে না দেয়, তাহলে কি তার স্লোগানে সব রোগী ঠিক হয়ে যাবে? কখনও না। ঠিক সেইরকম ভাবে আমরা স্লোগান দিচ্ছি - ধর্মের জয় হোক, অধর্মের নাশ হোক, সবাই সুখী হোক, সব প্রাণীর মধ্যে সদ্ভাবনা হোক। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা অহিংসক হয়ে উঠবো না আর আমাদের মনের মধ্যে সবার প্রতি প্রীতির ভাবনা উৎপন্ন হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত এইসব স্লোগান দিয়েও কোনো লাভ হবে না।
.
দিনের ২৪ ঘন্টার মধ্যে এমন কি কোনো সময় আছে যখন আমরা সবার ভালোর জন্য চিন্তা ভাবনা করি? সব সময় আমার দোকান, আমার বাড়ি, আমার ব্যবসা, আমার চাকরি, আমার ছেলে, আমার মেয়ে, আমার স্ত্রী, আমার মা-বাবা, এমন বলতে থাকি। কেবল মাত্র নিজের বিষয়েই ভাবি, নিজের বিষয়ে ভাবা মোটেও মন্দ নয়, অবশ্যই ভাবা উচিৎ, এটা ভালো কথা। নিজের সম্বন্ধে যদি না ভাবেন তাহলে অন্যের ভালো কিভাবে করবেন? কিন্তু এইসব করার পরেও কি এমন কোনো সময় আসে যে আমরা দেশের সম্বন্ধে ভাবি, মানবতার সম্বন্ধে ভাবি, ধর্মের সম্বন্ধে ভাবি? মন্দিরে গিয়ে ঘন্টা বাজিয়ে দিবো আর তিন-চারটা স্লোগান দিয়ে ফিরে চলে আসবো। যখন আমার স্লোগান দিবো আর সেই সময় কোনো দুঃখী ব্যক্তি এসে পরে, তাহলে কি আমরা তার কথা শোনার জন্য প্রস্তুত হবো? আমরা তাকে বলবো যে আমাদের পূজা করতে দাও। যদি আমরা ধ্যানে বসি আর কোনো দুঃখীর আওয়াজ আসে, তাহলে আমাদের কি কর্তব্য করা উচিত? আমরা কি ধ্যানে বসে থাকবো নাকি সেখানে গিয়ে তার সহায়তা করবো? উত্তর হল সেখানে গিয়ে তার সহায়তা করা। পরমাত্মাকে ধ্যানের কোনো আবশ্যকতা নেই। আমি চার ঘন্টা ধ্যান করি, তো এর থেকে সে কি পাবে? আমরা ধ্যান নিজের স্বার্থের জন্য করি, যাতে আমাদের আত্মা এবং বুদ্ধি পবিত্র হয়, যার দ্বারা আমরা ভালো কাজ করবো আর ভালো ফল পাবো। এইজন্য অবশ্যই ধ্যান করা উচিত, কারণ যদি এগুলো পবিত্র না হয় তাহলে সারা জীবন অব্যবস্থিত হয়ে যাবে। এইভাবে অহিংসা অর্থ হল - কারও সাথে দ্রোহ না করা, কাউকে অন্যায় ও দ্বেষ দৃষ্টিতে না দেখা, বরং প্রেম আর স্নেহের দৃষ্টিতে দেখা। এইজন্য য়জুর্বেদের মধ্যে বলা হয়েছে -
"মিত্রস্য চক্ষুষা সমীক্ষামহে।।" (য়জুর্বেদ ৩৬.১৮)
অর্থাৎ আমরা সব প্রাণীকে মিত্রের দৃষ্টিতে দেখবো।
.
এই সংসারের মধ্যে লক্ষ-লক্ষ কোটি-কোটি প্রকারের প্রাণ আছে। সেগুলোর মধ্যে আমরাও হলাম একটা প্রজাতি। অহিংসা বলে - সব প্রাণীর প্রতি প্রীতিভাব। আমরা তো মানবের সাথেও প্রীতি করতে পারিনি, তো অন্য প্রাণীদের সাথে কিবা করতে পারি। স্বয়ংকে ছেড়ে দিয়ে বাকি সবাইকে তো আমরা নিজের ভোজন বানিয়ে ফেলেছি। যাকেই খাওয়া যেতে পারে, মানুষ তাকেই খাওয়ার চেষ্টা করছে। যেখানে অহিংসা বলছে যে সবার সাথে প্রীতি করো, সেখানে আমরা সব প্রাণীকে খাওয়াই নিজের ধর্ম বানিয়েছি। আমরা এমন বলি যে - আমরা কি খাবো কি খাবো না এটা আমরা নির্ণয় করবো, অন্যরা কেন তার নির্ণয় নিবে? এটাই তো আমাদের স্বতন্ত্রতা। এর জন্য অধিকারের আওয়াজ ওঠে যে আমাদের খাওয়ার অধিকার আছে। আমি গরু খাবো নাকি কি খাবো, এটা আমার অধিকার, গোহত্যা বন্ধ করলে কি হবে? এই কারণেই গোহত্যা আজ পর্যন্ত বন্ধ হয়নি। এখন বাকি রইলো মানুষ, তাদের মধ্যেও একে-অপরকে খাওয়ার কথা করছে। সারা বিশ্বের মধ্যে ৭-৮ আরব মানুষ আছে, সেগুলোর মধ্যে আমরা কতজনের ভালো চাই? মহাদেব শিবের পরিভাষা তো এটাও ছিল যে কেউই আমাদের কারণে যেন দুঃখী না হয়, কিন্তু দুষ্টকে দণ্ড দেওয়ার ও আত্মরক্ষার অধিকার সবার আছে। হিংসা জেআরএম অনেক প্রকারের হয়, তেমনই অহিংসাও অনেক প্রকারের হয়। এরপর আমরা এই বিষয়ে চর্চা করবো।

(ক্রমশঃ)

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

শিবের দৃষ্টিতে ধর্ম

  সম্পাদকীয় আজ ভারতে যে মহাপুরুষের সর্বাধিক পূজা করা হয়, তিনি হলেন - ভগবান্ মহাদেব শিব। একদিকে যেমন পৌরাণিক বিদ্বানরা মহাদেব শিবের চরিত্র...

Post Top Ad

ধন্যবাদ