মনুস্মৃতির মৌলিক মান্যতাসমূহ - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

20 September, 2025

মনুস্মৃতির মৌলিক মান্যতাসমূহ

 এই বিবরণটি সেই সময়ের কথা যখন মানবজাতির উদ্ভবের পর এই সৃষ্টির “আদিযুগ” চলছিল। মানুষ তখন ইতিমধ্যেই বেদের শিক্ষামূলক জ্ঞান অর্জন করেছিল এবং “বৈদিক সংস্কৃত” নামের একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও ব্যাকরণসম্মত ভাষা ব্যবহারে প্রচলিত ছিল।

আদিকালে জনসংখ্যা ছিল অত্যন্ত কম। প্রকৃতির প্রতিটি বস্তু প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে পাওয়া যেত, তাই মানুষের মধ্যে ব্যক্তিগত অধিকারের (স্বত্বাধিকার) প্রবণতা জন্মায়নি। ভূমি, বন, খাদ্যদ্রব্য, জল, পশু বা মানুষ—কোনোটির উপরই কারও মালিকানা ছিল না। পৃথিবী তখন “অকৃষ্টপচ্যা” — অর্থাৎ না জুতেও ইচ্ছামতো অন্ন ও ফল ফলাত। তাই কৃষিকাজ হতো না, খাদ্য সংগ্রহেরও প্রয়োজন ছিল না। যাকে যখন যা দরকার হতো, তখনই তা সহজে পেয়ে যেত।

প্রয়োজন, জীবিকা বা পেশার চিন্তা থেকে মুক্ত মানুষরা বিদ্যাধ্যয়ন, ধর্মচর্চা, তপস্যা ও ঈশ্বরচিন্তায় নিমগ্ন থেকে আধ্যাত্মিক জীবনযাপন করত। তারা নিজ বিবেক অনুযায়ী আত্মনিয়ন্ত্রণে থেকে নিয়ম-শৃঙ্খলা ও মর্যাদার পথ অনুসরণ করত এবং আত্মউন্নতির জন্য সময় ব্যয় করত। তখন সবাই ব্রাহ্মণ বর্ণের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কেউ কারও প্রতি অন্যায় বা অত্যাচার করত না। লোভ, মোহ, ঈর্ষা ও দ্বেষ ইত্যাদির কোনো সুযোগই ছিল না।

মনুস্মৃতির মৌলিক মান্যতাসমূহ

ড. সুরেন্দ্র কুমার (মনুস্মৃতি ভাষ্যকার ও সমালোচক)

ভারতীয় রাজনীতি আজ এমনভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, যেন কোনো দিকনির্দেশহীন বর্ষার নদী—যার স্রোত কখন কোন দিকে মোড় নেবে, তা বলা যায় না। নির্বাচন জেতার জন্য তাদের কেবল একটা “ইস্যু” নামক ব্রহ্মাস্ত্র দরকার — তা দেশ ও সমাজের জন্য যতই বিভাজনমূলক বা ধ্বংসাত্মক হোক না কেন। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য কিছু রাজনৈতিক দল প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের সেই যুগের দিকে ফিরে গিয়ে, মানবসৃষ্টির সূচনাকালে জন্ম নেওয়া মহর্ষি মনুকে “মনুবাদ” নামে একটি মিথ্যা রাজনৈতিক ইস্যু বানিয়ে তুলেছে।

‘মনুবাদ’ শব্দটি প্রচারে আনা হয়েছে, কিন্তু এর প্রকৃত অর্থ কেউ স্পষ্ট করে বলেনি। শব্দটির ব্যবহারও ততটাই অস্পষ্ট ও ইচ্ছেমতো, যতটা রাজনীতির অন্যান্য শব্দের। তবে যেসব প্রেক্ষিতে এটি ব্যবহার হচ্ছে, তা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়—মনু ও মনুবাদ সম্পর্কে ভুল ধারণা সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, যেন লোককথার মতো।

যদি আমরা মনুস্মৃতির উপসংহার অনুযায়ী মনুবাদের অর্থ করি, তবে সেটি হবে—
“গুণ, কর্ম ও যোগ্যতার শ্রেষ্ঠ মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে গঠিত এক চিন্তাধারা।”
এর বিপরীতে, যে চিন্তাধারা “অগুণ, অকর্ম ও অযোগ্যতার অশ্রেষ্ঠ মূল্যবোধে” প্রতিষ্ঠিত, সেটি হবে “অমনুবাদ”।
অতএব যারা মনুবাদ শব্দটিকে উল্টো অর্থে ব্যবহার করেন, তারা নিজেরাও বিভ্রান্ত এবং অন্যকেও বিভ্রান্ত করছেন।

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, যারা মনু ও মনুস্মৃতির বিরোধিতা করেন, তাদের অনেকেই বইটি কখনও পড়েননি— এমনকি দেখেওনি। সাধারণ লোক তো বটেই, ড. আম্বেদকর-এর মতো বিশদ পাঠকও মনু-বিরোধী স্রোতে এমনভাবে ভেসে গিয়েছিলেন যে, তাঁর কাছে প্রতিটি শূদ্র-বিরোধী উক্তিই মনুর নামে যুক্ত হয়ে যায়। এমনকি শংকরাচার্যের রচনায় থাকা কিছু শূদ্রবিরোধী বাক্যও তিনি মনুস্মৃতি-উদ্ভূত বলে মনুর ঘাড়ে চাপিয়ে দেন।

মনুস্মৃতির সমালোচকদের মধ্যে কয়েকটি সাধারণ ভুল ধারনা বারবার দেখা যায়—

  1. তারা সেই শ্লোকগুলো উদ্ধৃত করেন না, যেগুলোতে কর্ম ও গুণের ভিত্তিতে বর্ণবিভাগের সঠিক ব্যাখ্যা আছে এবং যেখানে নারী ও শূদ্রদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে। বরং তারা কেবল সেই শ্লোকগুলো তুলে ধরেন, যেগুলো পরবর্তীকালে সংযোজিত বা বিকৃত (প্রক্ষিপ্ত) হয়েছে বলে প্রমাণিত।

  2. তারা এ প্রশ্নের উত্তর দেন না যে, একই বইতে, একই প্রসঙ্গে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য কেন রয়েছে? কেন তারা কেবল একটি বক্তব্যকে গ্রহণ করে, অপরটি উপেক্ষা করে? যদি তারা এই প্রশ্ন নিয়ে গভীরভাবে ভাবতেন, তবে নিজেদের আপত্তির উত্তর নিজেরাই পেয়ে যেতেন, এবং মনু সম্পর্কে প্রচলিত বহু ভ্রান্ত ধারণা থেকেও মুক্ত থাকতেন।

মনু-সম্পর্কিত প্রধান তিনটি ভ্রান্ত ধারণা

(ক) মনু জন্মভিত্তিক জাতিভেদব্যবস্থা সৃষ্টি করেছিলেন।
(খ) তিনি শূদ্র বা বর্তমানের “দলিত”দের জন্য অন্যায় ও অমানবিক বিধান করেছিলেন এবং সবর্ণদের, বিশেষত ব্রাহ্মণদের, বিশেষাধিকার দিয়েছিলেন।
(গ) মনু নারী-বিরোধী ছিলেন এবং নারীদের পুরুষদের সমান অধিকার দেননি।

এই তিনটি ভুল ধারণার সমাধানের জন্য বাইরের মতামতের চেয়ে মনুস্মৃতির ভিতরের প্রমাণই বেশি প্রামাণ্য।

মনু বর্ণব্যবস্থার প্রবর্তক, কিন্তু জাতিব্যবস্থার প্রবর্তক নন।
তিনি এমন এক আদিযুগের মানুষ, যখন জাতি বা “জন্মভিত্তিক বিভাজন” ধারণাটিই অস্তিত্বে আসেনি।
মনুস্মৃতিতে জন্মের ভিত্তিতে নয়, বরং গুণ, কর্ম ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সমাজবিন্যাস বর্ণিত হয়েছে, যা সম্পূর্ণ বৈদিক দর্শনের ওপর প্রতিষ্ঠিত।

বৈদিক যুগের তিনটি বেদ—ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ ও অথর্ববেদ—এই ব্যবস্থার মূল উৎস। রাজর্ষি মনু সেই বৈদিক নীতিকে নিজের রাজত্বে বাস্তবায়ন করেন এবং নিজের ধর্মশাস্ত্রের মাধ্যমে তা সমাজে প্রচার করেন।

বর্ণ ও জাতির মৌলিক পার্থক্য

  • বর্ণব্যবস্থায় গুণ, কর্ম ও যোগ্যতার ভিত্তিতে মানুষ নিজের পেশা বা কর্তব্য বেছে নিতে পারত।

  • জাতিব্যবস্থায় জন্মের পর থেকেই ব্যক্তির অবস্থান নির্ধারিত হয়ে যায়।

  • বর্ণ পরিবর্তন করা সম্ভব ছিল; কিন্তু জাতি জন্মগত হওয়ায় মৃত্যু পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকে।

যতদিন সমাজে মানুষ গুণ ও কর্মের ভিত্তিতে বর্ণ নির্বাচন করেছিল, ততদিন পর্যন্ত সেটি বর্ণব্যবস্থা ছিল।
যখন জন্মের ভিত্তিতে মানুষ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বা শূদ্র হিসেবে স্থায়ীভাবে ভাগ হয়ে গেল, তখনই তা জাতিব্যবস্থায় রূপ নিল।

“বর্ণ” শব্দটি এসেছে ‘বৃজ্‌’ ধাতু থেকে, যার অর্থ “বেছে নেওয়া” — অর্থাৎ এটি নির্বাচিত, জন্মগত নয়।
ভারতীয় সমাজে জন্মভিত্তিক জাতিভেদের ধারণা বৌদ্ধযুগের কয়েক শতাব্দী আগে থেকেই আস্তে আস্তে তৈরি হতে শুরু করে।

মনুস্মৃতির প্রথম অধ্যায়ে মনু কেবল চারটি বর্ণের কথা বলেছেন— কিন্তু কোনো জাতি বা গোত্রের নাম উল্লেখ করেননি।
এটি প্রমাণ করে যে তাঁর সময়ে জাতি বা গোত্রভিত্তিক বিভাজন ছিল না।
মনু জন্মের ভিত্তিতে “মহত্ত্ব” বা শ্রেষ্ঠত্বকে গুরুত্ব দেননি; বরং বিদ্যা, সদ্‌কর্ম ও চরিত্রকেই আসল মানদণ্ড বলেছেন।

যদি মনু জন্মনা-ভিত্তিক বিভাজনেই বিশ্বাস করতেন, তবে তাঁর সমগ্র ধর্মশাস্ত্রের উদ্দেশ্যই অর্থহীন হয়ে যেত। কারণ জন্মেই যদি মানুষ ব্রাহ্মণ বা শূদ্র হয়, তবে তাঁর জন্য আলাদা করে কোনো কর্মবিধান রাখার দরকার থাকত না।

বর্ণব্যবস্থার স্বাধীনতা

বর্ণব্যবস্থায় মানুষ নিজের যোগ্যতা ও আগ্রহ অনুযায়ী বর্ণ পরিবর্তন করতে পারত।
মনুস্মৃতিতে এমন অনেক শ্লোক রয়েছে যা এই স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়— এবং প্রমাণ করে যে মনু কখনো জন্মভিত্তিক সামাজিক অন্যায়ের পক্ষে ছিলেন না, বরং ন্যায়, গুণ ও কর্মের ভিত্তিতেই সমাজগঠন চেয়েছিলেন।

শ্লোক:
“শূদ্রো ব্রাহ্মণতামেতি, ব্রাহ্মণোচ্ছৈতি শূদ্রতাম্‌।
ক্ষত্রিয়াত্‌ জাতমেবং তু বিদ্যাদ্‌ বৈশ্যাত্‌ তথৈব চ॥”

অর্থ:
গুণ, কর্ম ও যোগ্যতার ভিত্তিতে এক ব্রাহ্মণ শূদ্র হয়ে যেতে পারে এবং শূদ্রও ব্রাহ্মণ হতে পারে। একইভাবে ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য বংশে জন্মানো ব্যক্তিও তার কর্ম ও চরিত্র অনুসারে বর্ণ পরিবর্তন করতে পারে।

মনুস্মৃতিতে এমন বহু শ্লোক পাওয়া যায়, যেখানে বলা হয়েছে—যদি কেউ নিজের নির্ধারিত কর্ম ত্যাগ করে বা নিকৃষ্ট কাজ করে, তবে দ্বিজ (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য) শূদ্রবর্গে গণ্য হবে (দেখুন ২/৩৭, ২/৪০, ২/৬৮; ৪/২৪৫ ইত্যাদি)। অপরদিকে, যদি কোনো শূদ্র শ্রেষ্ঠ কর্ম সম্পাদন করে, তবে সে উচ্চবর্ণে উন্নীত হতে পারে (৯/৩৩৫)।

ঋগ্বেদ থেকে মহাভারত (গীতা) পর্যন্ত এই কর্মনির্ভর বর্ণব্যবস্থা চলমান ছিল। গীতায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে—
“চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।” (৪/১৩)
অর্থাৎ, “চারটি বর্ণ আমি গুণ ও কর্মের ভিত্তিতে সৃষ্টি করেছি”, জন্মের ভিত্তিতে নয়।

ইতিহাসে কর্মনির্ভর বর্ণব্যবস্থার উদাহরণ

ভারতীয় ইতিহাসে শত শত উদাহরণ পাওয়া যায় যা প্রমাণ করে যে বর্ণব্যবস্থা কখনোই জন্মের ভিত্তিতে ছিল না—

  1. দাসীর পুত্র কবষ এলূষশূদ্রপুত্র বাত্স — উভয়েই মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি হিসেবে স্বীকৃত (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ২/৯)।

  2. ক্ষত্রিয় বংশে জন্মানো রাজা বিশ্বামিত্র ব্রহ্মর্ষি হয়েছিলেন (মহাভারত, অনুশাসন পর্ব; রামায়ণ, বালকাণ্ড)।

  3. অজ্ঞাত বংশের সত্যকাম জাবাল ব্রহ্মবাদী ঋষি হন (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৪/৪)।

  4. চণ্ডাল ঘরে জন্মানো মাতঙ্গ ঋষি হিসেবে খ্যাত হন (মহাভারত, অনুশাসন পর্ব ৩)।

  5. নিম্ন বংশে জন্মানো বাল্মীকি (কিছু কাহিনিতে) মহর্ষি বাল্মীকি রূপে প্রতিষ্ঠিত হন (স্কন্দ পুরাণ)।

  6. দাসীপুত্র বিদুর রাজা ধৃতরাষ্ট্রের প্রধান মন্ত্রী ও মহাত্মা হন (মহাভারত, আদিপর্ব)।

অন্যদিকে, খারাপ কর্মের কারণে—

  1. ঋষি পুলস্ত্যের বংশধর রাবণ “রাক্ষস” নামে পরিচিত হন (রামায়ণ, উত্তরকাণ্ড)।

  2. রাজা রঘুর পুত্র প্রবৃদ্ধ, নীচ কাজের কারণে ক্ষত্রিয় সমাজ থেকে বহিষ্কৃত হয়ে রাক্ষস হন।

  3. রাজা ত্রিশঙ্কু চণ্ডাল অবস্থায় পতিত হন।

  4. বিশ্বামিত্রের কয়েক পুত্র শূদ্র হন, আবার কয়েকজন পরে ব্রাহ্মণ হন।

এমনকি গোটা সমাজ বা জাতিও কর্মের ভিত্তিতে বর্ণ পরিবর্তন করেছে। মনুস্মৃতি (১০/৪৩–৪৪) ও মহাভারত অনুযায়ী, বহু প্রাচীন ক্ষত্রিয় জাতি—যেমন পৌণ্ডুক, অড়, দ্রাবিড়, কাঁবোজ, যবন, শক, পারদ, পাল্লব, চীন, কিরাত, দরদ, খশ—নিজেদের ক্ষত্রিয় কর্তব্য ত্যাগ করার ও প্রায়শ্চিত্ত না করার কারণে শূদ্রবর্গে গণ্য হয়েছিল।

পরে মহাভারতে আরও জাতির নাম উল্লেখ আছে—মেকল, লাট, কাণ্বশিরা, শৌণ্ডিক, দার্ব, চৌর, শবর, বর্বর প্রভৃতি।

ইতিহাসের পরবর্তী যুগেও বর্ণ পরিবর্তনের উদাহরণ দেখা যায়। যেমন—রাজপুতানা, সিন্ধ ও গুজরাটের পুষ্করনা বা পুষ্করণ ব্রাহ্মণরা এবং উত্তরপ্রদেশের উনাও জেলার আমতাড়া পাঠক ও মহাবর রাজপুতরা নিচু জাতি থেকে উচ্চ বর্ণে উন্নীত হন (হিন্দি বিশ্বকোষ, খণ্ড ৪, “বর্ণ” শব্দে)।

ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও দলিত সকলের মধ্যে একই গোত্র পাওয়া যায়—এটি প্রমাণ করে যে তারা মূলত একই পূর্বপুরুষের বংশধর, কেবল কালক্রমে পেশা ও জন্মের ভিত্তিতে জাতি স্থায়ী হয়ে গেছে।

মনুস্মৃতির বর্ণব্যবস্থার মূল তত্ত্ব

মনুস্মৃতি অনুযায়ী বর্ণব্যবস্থার মূল ভিত্তি তিনটি—গুণ, কর্ম ও যোগ্যতা
মনু কোনো ব্যক্তিকে তার বর্ণের জন্য নয়, বরং তার গুণ ও কর্মের জন্য সম্মান দেন।
যার মধ্যে যত গুণ ও যোগ্যতা, তার মর্যাদা তত বেশি।

এই নীতিগুলো আজও পৃথিবীর কোনো সভ্য সমাজ অস্বীকার করতে পারেনি। এমনকি সমতা দাবি করা সাম্যবাদী সমাজেও গুণ, কর্ম ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পদ ও মর্যাদার ভেদাভেদ রয়েছে—বেতন, সুবিধা ও সম্মানও তেমনই ভিন্ন।

আমাদের বর্তমান প্রশাসনিক ব্যবস্থার দিকে তাকালেই মনুর বক্তব্য সহজে বোঝা যায়। যেমন—

  1. প্রথম শ্রেণির রাজপত্রিত অফিসার,

  2. দ্বিতীয় শ্রেণির অফিসার,

  3. তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী—

এই বিভাজনও গুণ, কর্ম ও যোগ্যতার ভিত্তিতেই। আগে যেমন শিক্ষাগুরু (গুরুকুল, আশ্রম, আচার্য) যোগ্যতা যাচাই করতেন, এখন তা বিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয় করে। যার শিক্ষার প্রমাণপত্র নেই, সে স্বাভাবিকভাবেই শ্রমভিত্তিক কাজ করে এবং নিম্নশ্রেণির কর্মচারী হয়—যেমন আগে ‘শূদ্র’।

‘শূদ্র’ শব্দের অর্থ—“নিম্ন অবস্থায় থাকা”, “আদেশ মান্যকারী”, “পরিচারক”।
এটির ব্যুৎপত্তি হলো—“শু দ্রবতি ইতি শূদ্রঃ”, অর্থাৎ “যে প্রভুর আদেশে এদিক-ওদিক যাতায়াত করে।”
অন্য একটি অর্থ—“শোচ্যা স্থিতিমাপন্নঃ”, অর্থাৎ “যে নিজের নিম্ন অবস্থায় উদ্বিগ্ন থাকে, কেন আমি পিছিয়ে পড়েছি।”

এই অর্থগুলির মধ্যে কোনো ঘৃণা বা অবজ্ঞা নেই—বরং এটি সমাজের কর্মভিত্তিক ভূমিকার একটি বাস্তব চিত্র।

মনুস্মৃতিতে শূদ্রের সম্মান

মনুস্মৃতির অন্তর্সাক্ষ্যগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শূদ্র সম্পর্কে মনুর ভাবনা অত্যন্ত মানবিক ও সহৃদয় ছিল। মনু শূদ্রদের কখনোই ‘অস্পৃশ্য’, ‘অধম’ বা ‘ঘৃণিত’ বলে দেখেননি। তাঁর দৃষ্টিতে শূদ্র সমাজের অপরিহার্য, সম্মানযোগ্য ও সৎ সদস্য ছিলেন।

আজ যাদের ‘দলিত’, ‘পিছিয়ে পড়া’ বা ‘জনজাতি’ বলা হয়—মনুস্মৃতিতে তাদের কোথাও ‘শূদ্র’ বলা হয়নি। মনুর দেওয়া শূদ্রের সংজ্ঞা একেবারেই আলাদা। মনু বলেন—যাদের দ্বিতীয় জন্ম (ব্রহ্মজন্ম বা বিদ্যাজন্ম) হয়, তারা ‘দ্বিজাতি’, অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য। আর যারা কোনো কারণে সেই ব্রহ্মজন্ম লাভ করতে পারে না—অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ে গুরুর নিকট গিয়ে শিক্ষা ও উপনয়ন-সংস্কার সম্পন্ন করে না—তারা ‘একজাতি’ বা এক জন্মপ্রাপ্ত, অর্থাৎ ‘শূদ্র’।

অর্থাৎ, যে ব্যক্তি শিক্ষা ও সংস্কার থেকে বঞ্চিত, সে-ই ‘শূদ্র’—তার জন্ম যে কোনো পরিবারেই হোক না কেন। এমনকি যে কেউ একবার দ্বিজাতি হয়েও নিজের কর্তব্য ত্যাগ করে, তাকেও মনু ‘শূদ্র’ বলেছেন (মনুস্মৃতি ২/২৬, ৪৬৮, ৭০, ৭২; ৪/২৪৫; ১০/৪ ইত্যাদি)।

মনু বলেন—

“ব্রাহ্মণঃ ক্ষত্রিয়ো বৈশ্যঃ ত্রয়ো বর্ণা দ্বিজাতয়ঃ।
চতুর্থ একজাতিস্তু শূদ্রঃ নাস্তি তু পঞ্চমঃ॥”
(মনু ১০/৪)

অর্থ: আর্য সমাজে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য—এই তিন বর্ণকে ‘দ্বিজাতি’ বলা হয়, কারণ তাদের দ্বিতীয় (বিদ্যা) জন্ম হয়। চতুর্থ বর্ণ একজাতি, অর্থাৎ কেবল মাতাপিতার গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণকারী—সে শূদ্র। এর বাইরে আর কোনো পঞ্চম বর্ণ নেই।

এই শ্লোক থেকে বোঝা যায়—মনু শূদ্রসহ চার বর্ণকেই ‘স্বর্ণ’ ও ‘আর্য’ গণ্য করেছেন। কিন্তু পরবর্তী সমাজ মনুর বিপরীতে গিয়ে শূদ্রকে ‘অস্বর্ণ’ বলে অভিহিত করতে শুরু করে।

মনু যেসব কর্ম যেমন—শিল্প, কারিগরি, ব্যবসা—এসবকে বৈশ্যদের কাজ বলেছেন (৩/৬৪; ৯/৩২৯; ১০/৯৯; ১০/২০), পরে সমাজ সেগুলো করা মানুষদের শূদ্র হিসেবে গণ্য করে। আবার কৃষি ও পশুপালন মনু বৈশ্যদের কাজ বললেও (১০/৯০), পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রাও তা করেছেন—তাদের কেউ ‘বৈশ্য’ বলা হয়নি। তাই এই পরিবর্তন সমাজের নিজস্ব সৃষ্টি, মনুর নয়।

বহু শ্লোক থেকে জানা যায়, মনুর শূদ্রদের প্রতি ছিল গভীর মানবিক সহানুভূতি। তিনি শূদ্রদের জন্য “উত্তম”, “উত্কৃষ্ট”, “শুচি”—এইরকম সম্মানসূচক শব্দ ব্যবহার করেছেন (৯/৩৩৫)। এমন বিশেষণ কোনো ঘৃণিত বা ‘অস্পৃশ্য’ ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না।

মনু নির্দেশ দেন—শূদ্ররা দ্বিজাতিদের গৃহে রান্না, পরিষেবা ইত্যাদি শ্রমকর্ম করবে (৯/৩৩৩–৩৩৫)। যদি কোনো শূদ্র অতিথিরূপে কোনো দ্বিজের গৃহে আসে, তবে তাকে আহার করানো বাধ্যতামূলক (৩/১১২)। দ্বিজদের আদেশ দেওয়া হয়েছে যে, তারা তাদের ভৃত্যদের—যারা সাধারণত শূদ্র হতেন—প্রথমে আহার করাবে, তারপর নিজেরা খাবে (৩/১১৬)। আজকের তথাকথিত ‘সভ্য’ সমাজে কি এমন মানবিক আচরণ দেখা যায়?

অর্থাৎ, মনুর দৃষ্টিতে শূদ্ররা ছিল সমাজের সম্মানিত অংশ, ঘৃণিত নয়।

বৈদিক যুগে ব্রহ্মা বা পরমাত্মার দেহের অংশ হিসেবে ব্রাহ্মণ (মুখ), ক্ষত্রিয় (বাহু), বৈশ্য (জঙ্ঘা) ও শূদ্র (পদ) এর আলংকারিক উৎপত্তি বলা হয়েছে (ঋগ্বেদ ১০/৯০)। এর তিনটি শিক্ষা—
১. চার বর্ণই পরমাত্মার সন্তান,
২. সমান সন্তানের মধ্যে কেউ ঘৃণিত নয়,
৩. এক দেহের পা যেমন অশুচি নয়, তেমনি শূদ্রও অশুচি নয়।

ভারতীয় সংস্কৃতিতে তো পাদপ্রণাম (চরণ স্পর্শ) সম্মানের নিদর্শন, ঘৃণার নয়। তাই মনু বা বৈদিক ধর্মে শূদ্রকে ‘অস্পৃশ্য’ বলা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা।

মনু শূদ্রদের প্রতি বিশেষ সম্মান বিধানও করেছেন। প্রথম তিন বর্ণে সম্মান জ্ঞানের ও গুণের ভিত্তিতে দেওয়া হলেও (২/১৩৪, ২/১৩৭, ২/১৩৮), শূদ্রদের ক্ষেত্রে বিশেষ মানবিক বিধান রয়েছে—
মনু বলেন,

“মান্যঃ শূদ্রোऽপি দশবর্ষী গতো বয়ঃ।” (মনু ২/১৩৭)

অর্থাৎ—“নব্বই বছর বয়সের শূদ্রকে সকল দ্বিজ আগে সম্মান দেবে। বাকি তিন বর্ণে যার গুণ বেশি, সে আগে সম্মান পাবে।” একইভাবে—“ন ধর্মাত্‌ প্রতিষেধনম্‌” (১০/২৬) অর্থাৎ—“শূদ্রদের ধর্মীয় কাজ করতে নিষেধ নেই”—এই বলে মনু শূদ্রদের ধর্মপালনের স্বাধীনতা দিয়েছেন। এই সত্য সেই শ্লোক থেকেও জানা যায় যেখানে মনু বলেছেন—“শূদ্রের কাছ থেকেও উত্তম ধর্ম গ্রহণ করা উচিত।” (২/২৩) [* বেদে শূদ্রদের স্পষ্টভাবে যজ্ঞাদি করা এবং বেদশাস্ত্র অধ্যয়নের অধিকার দেওয়া হয়েছে (যজুর্বেদ ২৬/২; ঋগ্বেদ ১০/৫৩/৪; নিরুক্ত ৩/৮ ইত্যাদি)।] মনুর প্রতিজ্ঞা যে তাঁর মনুস্মৃতি বেদানুসারী, অতএব বেদনির্ভর হওয়ার কারণে মনুরও একই মত। এই কারণেই উপনয়ন প্রসঙ্গে কোথাও শূদ্রের উপনয়নের নিষেধ নেই; কারণ উপনয়ন না করালে তবেই কেউ শূদ্র হয়। একইভাবে শূদ্রকে দাসত্ব করানো বা জীবিকা না দেওয়া মনুর নির্দেশের বিরুদ্ধে। মনু রাজাকে আদেশ দিয়েছেন যে, সে ভৃত্য-পরিচারকদের বেতন স্থান ও পদ অনুযায়ী নির্ধারণ করবে এবং নিশ্চিত করবে যে তাদের বেতন অপ্রয়োজনীয়ভাবে কাটা না হয়। (৭/১২৫–১২৬; ৮/২৪৬)

মনুর যথাযোগ্য ও মনস্তাত্ত্বিক দণ্ডব্যবস্থা—এই বলা সম্পূর্ণ অনুচিত যে, মনু শূদ্রদের জন্য কঠোর দণ্ডের বিধান করেছেন এবং ব্রাহ্মণদের বিশেষাধিকার বা সুবিধা দিয়েছেন। মনুর দণ্ডব্যবস্থার মানদণ্ড হলো—গুণ ও দোষ; এবং এর ভিত্তি—বৌদ্ধিক স্তর, সামাজিক স্তর, পদ, অপরাধের প্রকৃতি ও তার প্রভাব। মনুর দণ্ডব্যবস্থা যথাযোগ্য, যা গণতান্ত্রিক ও মনস্তাত্ত্বিক। যদি মনু গুণ, কর্ম ও যোগ্যতার ভিত্তিতে ব্রাহ্মণ প্রভৃতি উচ্চবর্ণকে বেশি সম্মান ও সামাজিক মর্যাদা দেন, তবে অপরাধ করলে তাঁদের ততটাই বেশি দণ্ডও দেন। এইভাবে মনুর যথাযথ দণ্ডব্যবস্থায় শূদ্রকে সর্বনিম্ন দণ্ড, ব্রাহ্মণকে সর্বাধিক; রাজাকে তারও বেশি দণ্ড দেওয়া হয়েছে।

মনুর এই সর্বসাধারণ দণ্ডব্যবস্থার মানদণ্ড সবক্ষেত্রেই প্রযোজ্য—
“অষ্টাপাদ্যং তু শূদ্রস্থ স্তেয় ভবতি কিল্বিষম্‌।
ষোড়শৈব তু বৈশ্যস্য দ্বাত্রিংশৎ ক্ষত্রিয়স্থ চ॥
ব্রাহ্মণস্য চতুঃষষ্টিঃ পূর্ণম্‌ ৱা উপি শতং ভবেত্‌।
দ্বিগুণা ৱা চতুঃষষ্টিঃ তদদোষগুণবিত্‌ দ্রিশঃ॥”
(৮/৩৩৭–৩৩৮)

অর্থাৎ— ‘কোনও চুরি প্রভৃতি অপরাধে শূদ্রকে যদি আট রূপি দণ্ড দেওয়া হয়, তবে বৈশ্যকে ষোলো গুণ, ক্ষত্রিয়কে বত্রিশ গুণ, ব্রাহ্মণকে চৌষট্টি গুণ, এমনকি তাকে একশো গুণ অথবা একশো আটাশ গুণ দণ্ড করা উচিত, কারণ তারা উর্দ্ধক্রমে বর্ণের গুণদোষ ও তাদের ফল, প্রভাব ইত্যাদি ভালোভাবে বুঝে থাকেন।’ এর সঙ্গে মনু রাজসভাকে আদেশ দিয়েছেন যে, উক্ত দণ্ড থেকে কাউকে ছাড় দেওয়া যাবে না, সে রাজা, আচার্য, পুরোহিত কিংবা রাজামাতাপিতা যেই হোন না কেন; বরং রাজাকে এক হাজার গুণ দণ্ড দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। রাজা দণ্ড না দিয়ে বন্ধুকেও না ছাড়ে, এবং কোনও সমৃদ্ধ ব্যক্তি যদি শারীরিক অপরাধের দণ্ডের পরিবর্তে বিপুল অর্থ দিয়ে মুক্তি পেতে চায়, তবে তাকেও না ছাড়ে। (৮/৩৩৫, ৩৪৭)

দেখুন, মনুর দণ্ডব্যবস্থা কতটা যথাযথ, মনোবৈজ্ঞানিক, ন্যায়পূর্ণ, বাস্তবসম্মত এবং প্রভাবশালী। এর তুলনা আজকের দণ্ডব্যবস্থার সঙ্গে করে দেখুন, পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যাবে। আজকের দণ্ডব্যবস্থার নারা হল— ‘আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান।’ প্রথম বিরোধ এখানেই যে, পদস্তর ও বৌদ্ধিক স্তরের ভিত্তিতে সম্মানব্যবস্থা পৃথক, অথচ দণ্ড এক। দ্বিতীয় বিরোধ এই যে, আজকের দণ্ড যথাযথ নয়। এটা এভাবে বোঝা যায় যে, মাঠ খেয়ে ফেললে মেমনেকে যেমন একটা লাঠি মারা হবে, তেমনই মহিষ, হাতিকেও। এর প্রভাব কী হবে? বেচারা মেমনা লাঠির আঘাতে মেমিয়াবে, মহিষে কিছু হেলচেল হবে, হাতি তেমন কিছু অনুভব করবে না, সিংহ উল্টো খেতে ছুটবে। এটা কি সত্যিই সমান দণ্ড হলো? সমান দণ্ড তো সেটাই, যা লোকাচারে প্রচলিত— মেমনেকে লাঠি দিয়ে, মহিষকে গদা দিয়ে, হাতিকে অঙ্কুশ দিয়ে এবং সিংহকে হুইপ দিয়ে বশ করা হয়।

আরেকটা উদাহরণ নিন—একজন অত্যন্ত দরিদ্র ব্যক্তি হাজার রূপির দণ্ড ঋণ নিয়ে পরিশোধ করবে, মধ্যবিত্ত কিছু কষ্ট সহ্য করে, আর ধনবান ব্যক্তি জুতোর নোকায় রাখবে। এই অমনোবৈজ্ঞানিক দণ্ডব্যবস্থার ফলেই আজ দণ্ডের পাতলা দড়িতে গরিবরা জড়িয়ে পড়ে, ধন-পদ-ক্ষমতাসম্পন্ন লোকেরা সেই দড়ি ছিঁড়ে বেরিয়ে যায়। হিসেব করে দেখুন, স্বাধীনতার পরে কত গরিব মানুষ শাস্তি পেয়েছে, আর কত ধনী, পদবিসম্পন্ন, ক্ষমতাধর লোক পেয়েছে। অর্থনৈতিক অপরাধে ধনীরা জরিমানা দিয়ে যায়, অপরাধ করে যায়। মনুর যথাযথ দণ্ডব্যবস্থায় এই অসামঞ্জস্য নেই। মনুর দণ্ডব্যবস্থা অপরাধের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে। গুরুতর অপরাধে যদি কঠোর দণ্ডের বিধান থাকে, তবে চার বর্ণের জন্যই, এবং সাধারণ অপরাধে সাধারণ দণ্ডের বিধানও চার বর্ণের জন্যই। শূদ্রদের জন্য যে কঠোর দণ্ডবিধান দেখা যায়, তা জন্মনির্ভর জাতিবাদীদের দ্বারা সংযোজিত শ্লোক। উপসংহার এই যে, উপরে উল্লিখিত দণ্ডনীতি-বিরোধী শ্লোকগুলি মনুরচিত নয়।

মনুস্মৃতিতে নারীসম্মান ও পুত্র-কন্যার সমান অধিকার—মনুস্মৃতির অন্তঃসাক্ষ্য বলে যে, মনুর যে নারী-বিরোধী ভাবমূর্তি প্রচার করা হয়েছে, তা ভিত্তিহীন ও তথ্যবিরোধী। রাজর্ষি মনু মনুস্মৃতিতে নারীদের সম্পর্কিত যে বিধান দিয়েছেন, তা সম্মান, নিরাপত্তা, সমতা, সৌহার্দ্য ও ন্যায়বোধ দ্বারা প্রণোদিত। কিছু প্রমাণ—

মহর্ষি মনু সেই প্রথম রাজা ও মহাপুরুষ, যিনি নারীর বিষয়ে সর্বপ্রথম এমন এক শ্রেষ্ঠ আদর্শ ঘোষণা করেছেন, যা নারীর মর্যাদা, মহিমা ও সম্মানকে অসাধারণ উচ্চতা দেয়। শ্লোকে বর্ণিত সম্মানভাবনার চেয়ে বড় নারীর প্রতি সম্মান আর কী হতে পারে?—

যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ।

যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্বাঃ তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ॥ (৩/৫৬)

এর সঠিক অর্থ হলো— ‘যে পরিবারে নারীদের আদর-সম্মান করা হয়, সেখানে দেবতা—দিব্য গুণ, কর্ম, স্বভাবযুক্ত সন্তান ও ঐশ্বরিক ফল প্রাপ্ত হয়; আর যেখানে নারীদের আদর করা হয় না, সেখানে পরিবারে সকল কাজে ও জীবনে ব্যর্থতা আসে।’ এটা এক মনোবৈজ্ঞানিক সত্য যে, যেখানে নারীদের সম্মান করা হয়, সেই ঘরের সন্তানরা উত্তম ও সভ্য হয়; যেখানে মারধর ও কলহ হয়, সেখানে সন্তানও বিগড়ে যায়, ফলত দুঃখ আসে।

নারীদের প্রতি ব্যবহৃত সম্মানজনক ও সুন্দর বিশেষণগুলির চেয়ে বড় প্রমাণ আর কিছু নেই, যা মনুর নারীদের প্রতি অনুভূতি প্রকাশ করে। তিনি বলেন, নারীরা গৃহের ভাগ্যোন্নতি করারিণী, আদরযোগ্য, গৃহের জ্যোতি, গৃহশোভা, গৃহলক্ষ্মী, গৃহপরিচালিকা ও গৃহস্বামিনী, গৃহের স্বর্গ, সংসারযাত্রার ভিত্তি (৯/২৬, ২৮; ৫/৫০)। কল্যাণ কামনাকারী পরিবারের সদস্যদের উচিত নারীদের সম্মান করা; অবমাননায় দুঃখিত নারীদের কারণে পরিবার ও বংশ নষ্ট হয়ে যায়। নারীর প্রসন্নতায়ই বংশের প্রকৃত সুখ নিহিত (৩/৫৫-৬২)। তাই তিনি গৃহস্থদের উপদেশ দেন যে, পরস্পর সন্তুষ্ট থাকো, একে অপরের বিরুদ্ধাচরণ কোরো না, এবং এমন কিছু কোরো না যাতে একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয় (৯/১০২)। মনুর অনুভূতি প্রকাশ করতে একটি শ্লোকই যথেষ্ট—

প্রজনার্থ মহাভাগাঃ পূজার্হাঃ গৃহদীপ্তয়ঃ।
স্ত্রিয়ঃ শ্রিয়শ্চ গেহেষু ন বিশেষোऽস্তি কশ্চন॥ (মনু ২/২৬)

অর্থাৎ— ‘সন্তান উৎপাদন করে গৃহের ভাগ্যোন্নতি করা, আদরযোগ্য, গৃহজ্যোতি হয় নারীরা। শ্রী বা লক্ষ্মী ও নারী—এই দুইয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই; তারা গৃহের প্রত্যক্ষ শোভা।’ লক্ষ্য করুন— ‘নারীরা লক্ষ্মীর রূপ’ এই উক্তিটি মনুর এই মত থেকেই প্রচলিত হয়েছে।

মনুর মত সম্পর্কে অনভিজ্ঞ পাঠক জেনে আনন্দ পাবেন যে, মনুই প্রথম সেই সংবিধান-প্রণেতা যিনি পুত্র-কন্যার সমতা ঘোষণা করে তাকে বৈধতা দিয়েছেন। দেখুন স্পষ্ট ঘোষণা— ‘পুত্রেণ দুহিতা সমা’ (মনু ৯/৩০) অর্থাৎ “কন্যা পুত্রের সমান।”

একই সঙ্গে মনু পিতৃসম্পত্তিতে পুত্র-কন্যাকে সমান অধিকার দিয়েছেন। তাঁর এই মত মনুস্মৃতির ৯/৩০, ১৯২-এ বর্ণিত আছে। এটি নিরুক্তশাস্ত্রে এভাবে উদ্ধৃত হয়েছে—

অবিশেষেণ পুত্রাণাং দায়ো ভবতি ধর্মতঃ।
মিথুনানাং বিসর্গাদৌ মনুঃ স্বায়ম্ভুভ উব্রবীত্॥ (৩৩/৭/৪২)

যে পরিবারে নারীদের আদর-সম্মান করা হয়, সেখানে দেবতারা — অর্থাৎ দিভ্য গুণ, কর্ম, স্বভাবসম্পন্ন সন্তান এবং দিভ্য ফলাদি লাভ হয়; আর যেখানে তাদের সম্মান করা হয় না, সেখানে পরিবারে সকল কাজে ও জীবনে ব্যর্থতা আসে। এটা এক মনস্তাত্ত্বিক সত্য যে যেখানে নারীদের সম্মান করা হয়, সেখানে সন্তানরা শ্রেষ্ঠ ও সভ্য হয়; আর যেখানে মারপিট ও কলহ হয়, সেখানে সন্তানরাও বিপথে যায় এবং ফলত দুঃখ আসে।

নারীদের প্রতি ব্যবহৃত সম্মানজনক ও সুন্দর বিশেষণগুলির চেয়ে নারীর প্রতি মনুর ভাবনা বোঝাতে আরও প্রমাণ প্রয়োজন হয় না। তিনি বলেছেন, নারীরা গৃহের ভাগ্যোন্নতি ঘটান, তারা সম্মানের যোগ্য, গৃহের জ্যোতি, গৃহশোভা, গৃহলক্ষ্মী, গৃহপরিচালিকা ও গৃহস্বামিনী, গৃহের স্বর্গ এবং সংসারযাত্রার ভিত্তি (৯/, ২৬, ২৮; ৫/৫০)। কল্যাণ কামনাকারী পরিবারের লোকদের উচিত নারীদের সম্মান করা; কারণ নারীদের অবমাননা থেকে শোকে নিমগ্ন পরিবার ধ্বংস হয়। নারীর প্রফুল্লতাতেই পরিবারের প্রকৃত সুখ নিহিত (৩/৫৫–৬২)। তাই তিনি গৃহস্থদের উপদেশ দেন যেন তারা পরস্পর সন্তুষ্ট থাকে, একে অপরের বিরুদ্ধ আচরণ না করে এবং এমন কিছু না করে যাতে বিচ্ছেদের অবস্থা আসে (৯/০–০২)।

প্রজনার্থ মহাভাগাঃ পূজার্হাঃ গৃহদীপ্তয়ঃ।
স্ত্রিয়ো হি গৃহকর্মেষু ন বিশেষোऽস্তি কশ্চন॥ (মনু ২/২৬)

অর্থাৎ — সন্তান জন্ম দিয়ে গৃহের ভাগ্যবৃদ্ধিকারিণী, সম্মানযোগ্য ও গৃহের জ্যোতি হলেন নারীরা। শোভা-লক্ষ্মী ও নারী মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই; তারা গৃহের প্রত্যক্ষ শোভা। “নারীরা লক্ষ্মীর রূপ” — এই উক্তি মনুর এই বাণী থেকেই প্রচলিত।

মনুমতের সঙ্গে অপরিচিত পাঠকেরা জেনে আনন্দ পাবেন যে মনুই প্রথম সংবিধানপ্রণেতা যিনি পুত্র ও কন্যার সমতা ঘোষণা করে তাকে আইনি স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। স্পষ্ট ঘোষণা দেখুন — “পুত্রেণা দুহিতা সমা” (মনু ৯/৩০) অর্থাৎ “কন্যা পুত্রের সমান।”

একই সঙ্গে মনু পৈতৃক সম্পত্তিতে পুত্র-কন্যাকে সমান অধিকারী বলেছেন। তার এই মত মনুস্মৃতি ৯/৩০, ১৯২-এ বর্ণিত। নিরুক্ত শাস্ত্রে এভাবে উদ্ধৃত হয়েছে —

অবিশেষেণ পুত্রাণাং দায়ো ভবতি ধর্মতঃ।
মিথুনানাং বিসর্গাদৌ মনুঃ স্বায়ম্ভুভোऽব্রবীত্॥ (৩৩/৭/৪২)

অর্থাৎ — সৃষ্টির আদিতে স্বায়ম্ভুভ মনু এই বিধান দিয়েছিলেন যে পৈতৃক সম্পত্তিতে পুত্র-কন্যা উভয়ের সমান অধিকার থাকবে। মাতৃসম্পত্তিতে কেবল কন্যাদের অধিকার নির্ধারণ করে মনু পরিবারে কন্যাদের গুরুত্ব বাড়িয়েছেন (৯/৩৪)। নারীদের সম্পত্তির উপর আত্মীয়স্বজন যদি অন্যায়ভাবে দখল করে, তবে তাদের চোরের মতো শাস্তি দিতে হবে (৯/২২, ৩/৫২; ৮/২; ৮/২৯)। নারীর সুরক্ষার জন্য তাদের হত্যা বা অপহরণের অপরাধে মৃত্যুদণ্ড এবং ধর্ষণকারীদের জন্য যন্ত্রণামূলক শাস্তি বা দেশনিষ্কাসনের আদেশ মনু দিয়েছেন (৮/৩২৩; ৯/২৩২; ৮/৩৫২)।

নারীর জীবনে আসা প্রতিটি সমস্যার প্রতিকার মনু স্পষ্টভাবে নির্দেশ করেছেন। পুরুষদের আদেশ দিয়েছেন যেন তারা মাতা, স্ত্রী ও কন্যার সঙ্গে ঝগড়া না করে (৪/৮০)। তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনা, নির্দোষ হয়েও ত্যাগ করা বা বৈবাহিক কর্তব্য পালন না করার জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে (৮/২৭৫, ৩৮৯, ৯/৪)।

বিবাহ সম্পর্কে মনুর আদর্শ মত হলো — শিক্ষাপ্রাপ্ত কন্যাদের উপযুক্ত বর নিজে বেছে নেওয়ার অধিকার ও স্বাধীনতা রয়েছে (‘স্বয়ংবর’ ব্যবস্থা) (৯/৯০–৯৪)। বিধবাদের পুনর্বিবাহের অধিকারও দিয়েছেন, সন্তানপ্রাপ্তির জন্য নিয়োগেরও অনুমতি রয়েছে (৯/৭৬, ৯/৫৬–৬৩)। মনু বিবাহকে কন্যার প্রতি আদর ও স্নেহের প্রতীক বলেছেন, তাই লেনদেন বা পণপ্রথাকে অনুচিত বলে নিষিদ্ধ করেছেন (৩/৫–৫৪)। নারীর সুখী জীবনের কামনায় তিনি বলেছেন — আজীবন অবিবাহিতা থাকা শ্রেয়, তবে দুষ্ট বা গুণহীন পুরুষের সঙ্গে বিবাহ করা উচিত নয় (৯/৮৯)।

বিশ্বের সকল ধর্মের মধ্যে কেবল বৈদিক ধর্মে এবং সকল দেশে কেবল ভারতবর্ষে নারীরা পুরুষের ধর্মীয়, সামাজিক ও পারিবারিক কর্মকাণ্ডে সমান অংশীদার। কোনো ধর্মীয় বা পারিবারিক অনুষ্ঠান নারীর অংশগ্রহণ ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না — এটাই মনুর নীতি। তাই ধর্মানুষ্ঠানের দায়িত্ব নারীর হাতে দিয়ে বলেছেন যে প্রতিটি অনুষ্ঠান নারীর সহযোগিতায়ই সম্পন্ন হবে (৯/, ২৮, ৯৬)। বৈদিক যুগে নারীদের বেদ অধ্যয়ন, উপনয়ন, যজ্ঞ ইত্যাদির অধিকার ছিল; তারা ব্রহ্মার আসন অলংকৃত করতেন, ঋষিকা হতেন। বেদকে ধর্মে সর্বোচ্চ প্রমাণ মানা মনু নারীদের এই ধর্মীয় অধিকার ও শিক্ষার প্রবল সমর্থক। তাই তিনি বলেছেন, নারীরা মন্ত্রপূর্বক অনुष্ঠান করবেন এবং ধর্মকার্য তাদের অধীনে হবে (২/৪; ৩/২৮)।

“লেডিস ফার্স্ট” সভ্যতার প্রশংসকদের আরও আনন্দিত হওয়া উচিত, কারণ মনু নির্দেশ দিয়েছেন — “নারীদের আগে পথ ছেড়ে দাও।” নববিবাহিতা, কুমারী, রুগ্ণা, গর্ভবতী, বৃদ্ধা — এদের আগে আহার করিয়ে তারপর স্বামী-স্ত্রী আহার করবে (২/৩৮; ৩/৪, ৬)। মনুর এসব বিধান নারীর প্রতি সম্মান ও স্নেহের প্রতীক এবং উচ্চ সভ্যতার নিদর্শন।

মনু গুণীদের প্রশংসক ও দোষীদের নিন্দুক। তিনি গুণবতী নারীদের যথাযোগ্য সম্মান দিয়েছেন, কিন্তু কর্তব্যহীন বা অধঃপতিত নারীদের সমালোচনা ও শাস্তির বিধানও রেখেছেন। তবে তিনি নারীর অসংযমী বা অনিরাপদ স্বাধীনতার পক্ষে নন। তাই সতর্ক করে বলেছেন — নারী যেন পিতা, স্বামী, পুত্রের সুরক্ষা থেকে পৃথক না হয়, কারণ একাকীত্বে দুই বংশের নিন্দা হতে পারে (৫/৪৯; ৯/৫–৬)। এর অর্থ নারীর স্বাধীনতার বিরোধিতা নয়; বরং এর নিহিতার্থ হলো নারীর প্রথম প্রয়োজন “নিরাপত্তা”।

উপরের বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট হয় — মনুস্মৃতির বিধান নারী বা শূদ্রবিরোধী নয়; তা ন্যায়সংগত ও পক্ষপাতহীন। মনু এমন কিছু বলেননি যা নিন্দার যোগ্য।

মনু মহর্ষি “সবার জন্য শিক্ষা” এবং “সবার জন্য বাধ্যতামূলক শিক্ষা”-র সমর্থক ছিলেন। মনুস্মৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রমাণই এটি প্রতিষ্ঠা করে—

এতদ্দেশপ্রসূতস্য সাক্ষাদগ্রজন্মনঃ।
স্বং স্বং চরিত্রং শিক্ষেরন্ন্‌ পৃথিব্যাং সর্বমানবাঃ॥ (২/২০)

অর্থাৎ — “পৃথিবীতে বসবাসকারী সকল মানুষ! এসো, এই দেশের মহাজ্ঞানী ও সদাচারী ব্রাহ্মণদের কাছ থেকে নিজ নিজ কর্তব্য, আচরণ ও অভীষ্ট বিষয়ের শিক্ষা গ্রহণ করো; জ্ঞানী ও শিক্ষিত নাগরিক হও।”

মহর্ষি মনুর কত মহান আহ্বান! এতে না ব্রাহ্মণ, শূদ্র ইত্যাদি বর্ণের ভেদ আছে, না আর্য-অনার্যর ভেদ আছে, না স্বদেশী-বিদেশীর পার্থক্য এবং না নারী-পুরুষের ভেদভাব আছে। তিনি মানবমাত্রকে সমানভাবে আহ্বান করছেন। কারণ তিনি শিক্ষার গুরুত্ব বোঝেন যে শিক্ষাবিহীন মানুষ, মানুষ হতে পারে না, সে উন্নতি করতে পারে না, পরিবার-সমাজের কল্যাণ হতে পারে না, জাতি অগ্রগতি করতে পারে না, তাই মনুর মতে শিক্ষার সর্বোচ্চ গুরুত্ব ছিল এবং সবার জন্য শিক্ষা অপরিহার্য ছিল। শিক্ষালাভের জন্য তার তরফ থেকে কোনো বাধা নেই, শুধু শিক্ষালাভের ইচ্ছা থাকা উচিত, সে পৃথিবীর যেকোনো অংশের বাসিন্দা হোক, এবং যে-ই হোক। শিক্ষার প্রতি এত উদার ভাব রাখেন যিনি, সেই রাজর্ষির কাছ থেকে কি এটা আশা করা যায় যে তিনি কাউকে শিক্ষার থেকে বঞ্চিত করবেন? কখনোই না। যদি বর্তমান মনুস্মৃতিতে এমন কোনো উক্তি পাওয়া যায় যা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করার বা বাধা দেওয়ার কথা বলে, তবে তা সেই আহ্বানকারী স্বায়ম্ভুভ মনুর হতে পারে না। কারণ ঋষি বা বিদ্বানদের কথায় পরস্পর বিরোধ থাকে না। হ্যাঁ, সেগুলো কোনো পরবর্তী স্বার্থপর ও পক্ষপাতদুষ্ট জাতিভেদবাদীর উক্তি হতে পারে, যা স্বার্থসিদ্ধির জন্য প্রক্ষিপ্ত করা হয়েছে।

মহর্ষি মনু শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতেন এবং বর্ণব্যবস্থায় একে অপরিহার্য মনে করতেন। এর একটি শক্ত প্রমাণ সেখানে আছে যেখানে শিক্ষা না গ্রহণকারীদের বিষয়ে মনু কঠোর বিধান দিয়েছেন। মনু বলেন যে সর্বাধিক নির্ধারিত বয়সসীমা পর্যন্তও যে বালক বা যুবক শিক্ষালাভার্থ উপনয়ন সংস্কার করবে না, সে আর্য বর্ণব্যবস্থা থেকে বহিষ্কৃত হবে। তার বৈধ অধিকার থাকবে না (মনু ২/৩৮–৪০)। এটি সবার জন্য বাধ্যতামূলক শিক্ষার আদেশ। এমন উদার মহর্ষি কারো শিক্ষাবঞ্চনার চিন্তাও করতে পারেন না।

উপরে কিছু মতবাদ মনুস্মৃতির শ্লোকের ভিত্তিতেই দিগ্দর্শন করানো হয়েছে। একইভাবে আরও বহু মতবাদ আছে, যার মৌলিক রূপ মনুস্মৃতিতে পাওয়া যায়। এগুলো পূর্বাপর প্রসঙ্গের সঙ্গে সম্পর্কিত মতবাদ। এর বিপরীতে পূর্বাপর প্রসঙ্গের সঙ্গে সম্পর্কহীন যে মতবাদগুলো আছে, সেগুলো মনুর মৌলিক নয়। সময়ে সময়ে পরিবর্তিত সামাজিক ব্যবস্থা ও ধারণা অনুযায়ী সেগুলো তৎকালীন লোকেরা মনুস্মৃতিতে সংযোজন করেছে, অতএব সেগুলোকে মনুর মৌলিক মতবাদ বলা যায় না। সেগুলোর কারণে মনুস্মৃতি ও মনুস্মৃতি-যুগের সভ্যতা-সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ব্যবস্থার রূপ বিকৃত ও পরিবর্তিত হয়েছে, তাই সেগুলো মহর্ষি মনুর নামে গ্রহণযোগ্য নয়।

মনুস্মৃতিতে প্রক্ষেপ : প্রমাণ ও দুষ্পরিণাম
ডঃ সুরেন্দ্রকুমার (মনুস্মৃতি ভাষ্যকার ও সমালোচক)

‘প্রক্ষেপ’, ‘ক্ষেপক’ অথবা ‘প্রক্ষিপ্ত’ শব্দের অর্থ হলো—মিশ্রণ বা সংযোজন। কোনো ব্যক্তির অনুমতি বা সম্মতি ব্যতিরেকে তার গ্রন্থে অন্য কারো দ্বারা যোগ করা চিন্তাভাবনাকে ‘প্রক্ষেপ’ বলা হয়। এটি আবশ্যক নয় যে ‘প্রক্ষেপ’ বিরোধী মতামতযুক্তই হবে, তা সমর্থনমূলকও হতে পারে। কিছু লোকের মত হলো যে মনুস্মৃতিতে কোনো প্রক্ষেপ নেই; এরা হয় পূর্বধারণা থেকে বা গভীর অধ্যয়নের অভাবে এমন কথা বলে, কারণ মনুস্মৃতিতে পরস্পরবিরোধী ও প্রসঙ্গবিরোধী ভাবের ভরপুর উপস্থিতি দেখা যায়। এই ত্রুটিগুলো কোনো এক ব্যক্তির, বিশেষত ঋষি-স্তরের লেখকের রচনায় থাকতে পারে না। এদের বাইরে আরও বহু প্রমাণ আছে যা প্রক্ষেপের অস্তিত্বকে প্রমাণ করে।

প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে প্রক্ষেপ প্রবণতার ইতিহাস

প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে এটি এক প্রমাণিত ঐতিহাসিক সত্য যে সময়ে সময়ে তাতে প্রক্ষেপ সংঘটিত হয়েছে। এ বিষয়ে পাণ্ডুলিপিগত ও লিখিত প্রমাণ যেমন পাওয়া যায়, তেমনই অন্তঃসাক্ষ্যও পাওয়া যায়। অতএব এটি এখন আর বিতর্কের বিষয় নয়। মনুস্মৃতির প্রক্ষেপগুলো নিয়ে আলোচনা করার আগে অন্য প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের প্রক্ষেপ-সম্পর্কিত ইতিহাসের দিকে এক নজর দেওয়া যাক, যাতে পাঠকগণ প্রক্ষিপ্ততার নিরবচ্ছিন্ন সত্যতা সম্পর্কে জানতে পারেন। ঠিক একই অবস্থা মনুস্মৃতির ক্ষেত্রেও দেখা গেছে।

(ক) বাল্মীকি রামায়ণ — পাঠভেদের কারণে বাল্মীকি রামায়ণের আজ তিনটি সংস্করণ পাওয়া যায়—১. দক্ষিণাত্য, ২. পাশ্চাত্যোত্তরীয়, ৩. গৌড়ীয় বা পূর্বীয়। এই তিন সংস্করণের বহু সর্গ ও শ্লোকে পার্থক্য রয়েছে। গীতা প্রেস, গোরখপুর থেকে প্রকাশিত দক্ষিণাত্য সংস্করণে এখনও বহু এমন সর্গ অন্তর্ভুক্ত আছে যা মূল পাঠের সঙ্গে মিশে যায়নি, তাই সেগুলোর ওপর এখনো “প্রক্ষিপ্তঃ সর্গঃ” লেখা পাওয়া যায় (উদাহরণ: উত্তরকাণ্ডের ৫৯ সর্গের পরে দুই সর্গ)।

নেপালের রাজধানী কাঠমাণ্ডুর জাতীয় আর্কাইভে নোয়াড়ি লিপিতে বাল্মীকি রামায়ণের একটি প্রায় এক হাজার বছর পুরোনো পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে। তাতে বর্তমান সংস্করণের তুলনায় শত শত শ্লোক কম রয়েছে। স্পষ্টতই গত এক হাজার বছরে সেগুলো সংযোজিত হয়েছে। সমালোচকদের মতে, বর্তমান রামায়ণের বালকাণ্ড ও উত্তরকাণ্ডের অধিকাংশ অংশ প্রক্ষিপ্ত। আজও রামায়ণের শুরুতে তিনটি অনুক্রমণিকা পাওয়া যায়, যা সময়ে সময়ে সংযোজিত প্রসঙ্গের সমর্থক। এর মধ্যে একটিতে স্পষ্টত বলা হয়েছে—“ষট্কাণ্ডানি” (৪/২)। অবতার বিষয়ক শ্লোকগুলো অবতার তত্ত্বের বিকাশের পর সংযোজিত হয়েছে।

একটি বৌদ্ধ গ্রন্থের প্রমাণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বৌদ্ধ সাহিত্যে একটি ‘অভিধর্ম মহাবিভাষা’ নামক গ্রন্থ পাওয়া যায়। এর তৃতীয় শতাব্দীর চীনা অনুবাদ পাওয়া গেছে। তাতে এক স্থানে উল্লেখ আছে যে “রামায়ণে বারো হাজার শ্লোক রয়েছে” (ড. ফাদার কামিল বুলকে, ‘রামকথা : উৎপত্তি ও বিকাশ’, পৃ. ৯৪)। অথচ আজ এতে পঁচিশ হাজার শ্লোক রয়েছে। এটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা, যা দেখায় যে প্রাচীন গ্রন্থগুলোতে কীভাবে প্রক্ষেপ ঘটে এসেছে।

(খ) মহাভারত — মহাভারতের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ উদ্ধৃত করা হচ্ছে। এটি জানায় যে প্রায় দুই হাজার বছর আগে মহাভারতে ঘটতে থাকা প্রক্ষেপের বিরুদ্ধে তৎকালীন সাহিত্যে প্রতিবাদ উঠেছিল। এটি প্রমাণ করে যে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে প্রক্ষেপ অনেক আগে থেকেই চলছিল। ‘গরুড় পুরাণ’ (তৃতীয় শতাব্দী) এর নিম্নলিখিত শ্লোকটি অমূল্য প্রমাণ, যা জানায় যে অন্য সংস্কৃতির লোকেরা বৈদিক সংস্কৃতিতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ভারতীয় গ্রন্থে প্রক্ষেপ করেছিল। আশ্চর্যের বিষয় হলো যে এই কথাটি একটি পুরাণ বলছে, যেগুলো নিজেরাই প্রক্ষেপে ভরা বা মহর্ষি ব্যাসের নামে প্রক্ষিপ্ত রূপে বিদ্যমান—

“দৈত্যাঃ সর্বে বিপ্রকুলেষু ভূত্বা, কলৌ যুগে ভারতেঃ ষট্সহস্ত্র্যাম্‌। নিষ্কাস্য কাংশ্চিত্‌ নवनির্মিতানাম্‌ নিবেশনং তত্র কুর্বন্তি নিত্যম্‌॥” (ব্রহ্মকাণ্ড ৭:৫৯)

অর্থাৎ—"এই কলিযুগে মহাভারতে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হচ্ছে। দানব বংশের লোকেরা নিজেদের ব্রাহ্মণ বলে পরিচয় দিয়ে কিছু শ্লোক বাদ দিচ্ছে এবং নতুন নতুন শ্লোক রচনা করে সেখানে সংযোজন করছে।”

এমনই তথ্য মহাভারতেও দেওয়া আছে যে স্বার্থপর লোকেরা বৈদিক ঐতিহ্য বিকৃত করেছে এবং তার জন্য তারা গ্রন্থগুলো বিকৃত করেছে। মহাভারতকারের বেদনা দেখুন—

“সুরা মৎস্যাঃ পশোর্মাসমূ, আসवं কৃশরৌদনম্‌। ধূর্তেঃ প্রবর্তিতং যজ্ঞে নৈতদ্‌ বেদেষু বিদ্যতে॥
অব্যবস্থিত ময়দিঃ বিমূঢ়ের্নাস্তিকঃ নরৈঃ। সংশয়াত্মমিরব্যক্তৈঃ হিংসা সমনুবর্ণিতা॥” (শান্তি পর্ব ২৬৫/৯, ৪)

অর্থাৎ—মদ্যপান, মাছভোজন, পশুমাংস, আসব, লবণভোজনের আহুতি—এসবের বিধান বেদে (বৈদিক সংস্কৃতিতে) নেই। এসব ধূর্ত লোকেরা প্রচলিত করেছে। সীমাহীন, মদ-মাংসাসক্ত, নাস্তিক, আত্মা-পরমাত্মা সম্পর্কে সন্দেহপ্রবণ লোকেরা গোপনে বৈদিক গ্রন্থে হিংসা-সংক্রান্ত বর্ণনা যোগ করেছে।

মহাভারত মহাকাব্যের কায়া-বৃদ্ধির ইতিহাস বর্তমান মহাভারতে নিজেই বর্ণিত হয়েছে। মহাভারত যুদ্ধের পর মহর্ষি ব্যাস যে কাব্য লিখেছিলেন, তার নাম ছিল ‘জয় কাব্য’—

“জয়ো নাম ঐতিহাসোऽযম্‌।” (মহাভারত, আদিপর্ব ১/২, ৬২/২০)

এবং তাতে ছয় বা আট হাজার শ্লোক ছিল। 

অষ্টো এলোকসসহস্ত্রাণি অষ্টৌ এলোকশতানি চ। (আদিপর্ব ২/৩৭, ২৬৯)। ব্যাসশিষ্য বৈশাম্পায়ন এটি বাড়িয়ে ২৪,০০০ শ্লোকের কাব্য রচনা করেছেন এবং এর নাম “ভারত সংহিতা” রেখেছেন—চতুর্বিশতি সাহস্ত্রী চক্র ভারত সংহীতাম্‌ (আদিপর্ব ২/০২)। সৌতি এতে আরও সংযোজন করে এক লক্ষ শ্লোকের কাব্য তৈরি করেছেন এবং এর নাম “মহাভারত” রেখেছেন—শত সাহস্ত্রমিদং কাব্যং ময়োক্তং শ্রূয়তাং হি ৱঃ। (আদি ০৮)। এভাবেই “জয়” কাব্যকে “মহাভারত” রূপে পরিণত করা হয়েছে। মানুষ তাদের স্বতন্ত্র কাব্য তৈরি করার বদলে এতে সংযোজন করেছে। এর ফলে মহাভারতের প্রামাণ্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ঐতিহাসিকতা নষ্ট হয়েছে।

গীতা—গীতা মহাভারতেরই অংশ। এর বর্তমান বিস্তার ব্যবহারিক নয়। যুদ্ধক্ষেত্রে কয়েক মিনিটের মধ্যে দেওয়া উপদেশ এত বড় হতে পারে না এবং সময়োপযোগীও নয়। যদি এটিকে সংক্ষিপ্ততার সম্প্রসারণ বলা হয়, তবে তা কৃষ্ণপ্রকৃত মৌলিক উপদেশ রূপে অবশিষ্ট থাকে না। প্রতিটি দিক থেকে এটি সংযোজিত রূপ। এটি ব্যাসকৃতও নয়; পরবর্তীতে সংযোজন হয়েছে।

নিরুক্ত—আচার্য ইয়াস্ককৃত নিরুক্তের ৩-১৪ অধ্যায় সম্পর্কে সমালোচকদের মত হলো, এগুলো অভাব পূরণের জন্য পরে যোগ করা হয়েছে। এসমেত “পরিবর্ধিত সংস্করণ” হলো শিষ্য-পরম্পরা দ্বারা রচিত।

চরক সংহিতা—মহর্ষি অগ্নিবেশ প্রণীত চরক সংহিতাতেও শিষ্যরা শেষ অধ্যায়ের কিছু অংশ অভাব পূরণের জন্য সংযোজন করেছে। তবে এখানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে এই অংশ অমুক ব্যক্তির দ্বারা রচিত। এতে সংযোজনের প্রবণতা ও ইতিহাসের তথ্য পাওয়া যায়।

মনুস্মৃতি—একইভাবে মনুস্মৃতিতেও সময়ে সময়ে প্রক্ষেপ হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, মনুস্মৃতিতে আরও প্রক্ষেপ হয়েছে কারণ এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল এবং এটি জীবন ও সমাজের বিধি-গ্রন্থ ছিল। তাই এতে পরিবর্তনও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল। যেমন, ভারতের সংবিধানে ছিয়াশি প্রায় সংশোধন আজ পর্যন্ত অর্ধশতাব্দীতে হয়েছে। তেমনি মনুস্মৃতিতে নিম্নলিখিত প্রধান কারণে পরিবর্তন-সংযোজন হয়েছে—

১. অভাব পূরণের জন্য, ২. স্বার্থ পূরণের জন্য, ৩. গৌরব বৃদ্ধির জন্য, ৪. বিকৃতি সৃষ্টির জন্য।

এই প্রক্ষেপ (পরিবর্তন বা সংযোজন) অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্পষ্ট দেখা যায়। মহর্ষি মনুর সদৃশ ধর্মজ্ঞ এবং বিধি প্রদাতার রচনায় ত্রুটি থাকতে পারে না, কিন্তু প্রক্ষিপ্তদের কারণে ত্রুটি এসেছে। এগুলো কখনও বিষয়বিরোধী, কখনও প্রসঙ্গবিরোধী, কখনও পরস্পরবিরোধী, কখনও শৈলীবিরোধী রূপে দেখা যায়।

আর্ষ সাহিত্য প্রচার ট্রাস্ট, খারী বাওয়ালি, দিল্লি-৬ থেকে প্রকাশিত আমার গবেষণা ও ভাষ্যযুক্ত সংস্করণে আমি তাদের শনাক্ত করেছি সাতটি সাহিত্যিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে। সেগুলি হলো—

১. বিষয়বিরোধ, ২. প্রসঙ্গবিরোধ, ৩. পরস্পরবিরোধ, ৪. অবান্তরবিরোধ, ৫. পুনরুক্তি, ৬. শৈলীবিরোধ, ৭. বেদবিরোধ।

প্রক্ষেপ অনুসন্ধানের এই তটস্থ সাহিত্যিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে মনুস্মৃতির প্রাপ্ত ২৬৮৫ শ্লোকের মধ্যে ৪৭৭টি প্রক্ষিপ্ত এবং ১২৪টি মৌলিক। বিস্তারিত পর্যালোচনার জন্য মনুস্মৃতির উক্ত সংস্করণ পাঠযোগ্য। এতে প্রতিটি প্রক্ষিপ্ত শ্লোকের পর তার পর্যালোচনায় প্রক্ষেপের কারণ মানদণ্ড হিসেবে প্রদর্শিত হয়েছে। পাঠক নিজে সেই মানদণ্ড প্রয়োগ করে দেখতে পারেন।

মনুস্মৃতিতে প্রক্ষেপের উপস্থিতি নিম্নলিখিত লিখিত প্রমাণও নিশ্চিত করে। এবং প্রায় সকল শ্রেণীর বিদ্বানও এ বিষয়ে একমত। পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণও পাওয়া যায়—

(ক) মনুস্মৃতি—ভাষ্যকার মেধাতিথি (৯ম শতাব্দী) এর তুলনায় কুল্লুক ভট্ট (১২ম শতাব্দী) এর সংস্করণে ১৭০টি অতিরিক্ত শ্লোক রয়েছে। সেগুলো তখন মূল পাঠের সঙ্গে মিশে যায়নি, তাই কুল্লুক ভট্টের সংস্করণে বৃহৎ কোষ্ঠকে চিহ্নিত করা হয়েছে। অন্যান্য প্রাচীন টীকা-তে ও কিছু শ্লোক এবং পাঠের পার্থক্য দেখা যায়।

(খ) মেধাতিথির ভাষ্যের শেষে একটি শ্লোক আছে, যা জানায় যে মনুস্মৃতি এবং মেধাতিথির ভাষ্য লুপ্তপ্রায় ছিল। বিভিন্ন সংস্করণের সাহায্যে সহারণ রাজা মদন পুনরায় সংকলন করেছিলেন। সেই অবস্থায় শ্লোকের ক্রমবিরোধ বা স্বল্পাধিক্য স্বাভাবিক।

উপদ্বাঘাত মেধাতিথি ভাষ্য, গঙ্গানাথ ঝু, খণ্ড ৩৩, পৃ. ৭২
অর্থাৎ—“সমাজে মান্য কোনো মনুস্মৃতি ছিল, তার উপর মেধাতিথির ভাষ্যও ছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্করণ সংগ্রহ করে রাজা মদন তা পুনঃসংকলন করেছেন এবং বিভিন্ন বই মিলিয়ে ভাষ্য তৈরি করেছেন।”

মনুস্মৃতির রূপে পরিবর্তনের এটি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ। আর্য সমাজের প্রবর্তক মহর্ষি দয়ানন্দ গত শতাব্দীতে প্রথমবার স্পষ্ট ঘোষণা করেছিলেন যে মনুস্মৃতিতে বহু প্রক্ষেপ হয়েছে, যেমন গ্বালে দুধে পানি মেশানোর মতো। তিনি কিছু প্রক্ষিপ্ত শ্লোকের কারণও প্রদর্শন করেছিলেন এবং ঘোষণা করেছিলেন যে আমি প্রক্ষেপপুষ্ট মনুস্মৃতিকেই প্রমাণ হিসেবে মানি (ঋগ্বেদাদিভাষ্য ভূমিকা, গ্রন্থ প্রামাণ্য বিষয়)।

(ঘ) সমগ্র প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে প্রক্ষেপের সত্যতা স্বনামধন্য সনাতনী আচার্য স্বামী আনন্দতীর্থ ‘মহাভারত তাত্পর্যার্থ সিদ্ধান্ত’-এ স্বীকার করেছেন—

“কোচিদ্‌ গ্রন্থান্‌ প্রক্ষিপন্তি কোচিদ্‌ অন্তরিতানাপি,
কুর্যুঃ কোচিচ্চ ব্যত্যান্সং প্রমাদাত্‌ কোচিদন্যথা।
অনুত্সন্নাঃ আপি গ্রন্থাঃ ব্যাকুলাঃ সন্তি সর্বশঃ,
উৎসননঃ প্রায়শঃ সর্বে, কোট্যংশোদপি ন বর্ততে।” (অ০ ২২)

অর্থাৎ—কোথাও গ্রন্থে প্রক্ষেপ করা হচ্ছে, কোথাও মূল বচন বদলানো হচ্ছে, কোথাও এগিয়ে-পেছনে করা হচ্ছে, কোথাও অসতর্কতার কারণে অশুদ্ধ লেখা হচ্ছে। যা গ্রন্থ বাঁচিয়ে রেখেছে তা কেটে-ছাঁটের কষ্টে ব্যাকুল। অধিকাংশ গ্রন্থ ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন সাহিত্যর কোটি অংশও বাঁচেনি। একই অবস্থা মনুস্মৃতিরও হয়েছে।

চীন প্রাপ্ত পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ—বিদেশি প্রমাণের মধ্যে মনুস্মৃতির কাল ও শ্লোকসংখ্যার তথ্য চীনা ভাষার হস্তলিখনে পাওয়া যায়। ১৯৩২ সালে জাপান চীনের ঐতিহাসিক প্রাচীর ধ্বংস করার সময় একটি লোহার ট্রাঙ্কে চীনা প্রাচীন পাণ্ডুলিপি উদ্ধার হয়। সে হস্তলিখন সার অগুটস ফ্রিত্স জর্জের হাতে যায় এবং লন্ডনে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত হয়।

হস্তলিখনগুলো অধ্যয়ন করে জানা যায়, চীনের রাজা চিন-ইজ-ওয়াং তার শাসনকালে সব প্রাচীন বই ধ্বংসের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তখন একজন বিদ্যাপ্রেমী বইগুলো ট্রাঙ্কে লুকিয়েছিলেন এবং প্রাচীর নির্মাণের সময় তা রাখিয়েছিলেন। দুর্ঘটনাক্রমে বোমা বিস্ফোরণে তা বের হয়। চীনা ভাষার হস্তলিখনের একটি অংশে লেখা আছে—“মনুর ধর্মশাস্ত্র ভারতবর্ষে সর্বাধিক মান্য যা বৈদিক সংস্কৃতিতে রচিত এবং দশ হাজার বছরেরও বেশি পুরনো।” এটি মটওয়ানি’র বই ‘মনু ধর্মশাস্ত্র: এ সোশিওলজিক্যাল অ্যান্ড হিস্টোরিক্যাল স্টাডি’ (পৃ. ২৩২-২৩৩) তে উল্লেখ আছে।

চীনা প্রমাণ মনুস্মৃতির প্রকৃত কাল নির্ধারণ না করলেও নির্দেশ দেয় যে মনুর ধর্মশাস্ত্র প্রাচীন। পাশ্চাত্য লেখকদের কাল নির্ধারণের অনুমান এটি অস্বীকার করছে এবং জানাচ্ছে যে কখনো মনুস্মৃতিতে ৬৮০ শ্লোক ছিল।

(চ) পাশ্চাত্য গবেষকরা—উলর, জে. জৌলি, কিথ, ম্যাকড্যানেল প্রভৃতি মনুস্মৃতি সহ প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে প্রক্ষেপ থাকার কথা স্বীকার করেছেন। জে. জৌলি কিছু প্রক্ষেপও দেখিয়েছেন।

(ছ) মনুস্মৃতির অন্যান্য ভাষ্যকার ও সমালোচকরা প্রক্ষেপের সংখ্যা নিম্নরূপ মনে করেছেন—

  • বিশ্বনাথ নারায়ণ মান্ডলিক ১৪৮

  • হরগোবিন্দ শাস্ত্রী ১৫৩

  • জগন্নাথ রঘুনাথ ধায়েপুরে ১০০

  • জয়ন্তকৃষ্ণ হরিকৃষ্ণদেব ৫৯

মনুস্মৃতির প্রথম পাশ্চাত্য সমালোচক বিচারপতি স্যার উইলিয়াম জোন্স প্রাপ্ত ২৬৮৫ শ্লোকের মধ্যে ২০০৫ শ্লোককে প্রক্ষিপ্ত ঘোষণা করেছেন। তার মতে, ৬৮০ শ্লোকই মূল মনুস্মৃতি।

মহাত্মা গান্ধী তাঁর ‘বর্ণব্যবস্থা’ নামক বইয়ে স্বীকার করেছেন যে বর্তমান মনুস্মৃতিতে যে আপত্তিকর বিষয় পাওয়া যায়, তা পরে সংযোজন করা হয়েছে।

(জ) ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও দার্শনিক বিদ্বান—ডঃ রাধাকৃষ্ণন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রভৃতি মনুস্মৃতিতে প্রক্ষেপের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন।

ডঃ ভীমরাও আম্বেডকর এবং মনুস্মৃতির প্রক্ষেপ:

ডঃ আম্বেডকর তাঁর গ্রন্থে মনুস্মৃতির শ্লোকসমূহকে প্রমাণ হিসেবে উদ্ধৃত করেছেন, যার মধ্যে অনেক শ্লোক পরস্পরবিরোধী বিধানযুক্ত। আশ্চর্যজনক হলেও তিনি মনুস্মৃতিতে পরস্পরবিরোধী শ্লোক নেই মনে করেছেন। যদি তিনি পরস্পরবিরোধী শ্লোক মেনে নিতেন, তবে তাকে দুটির মধ্যে যেকোন একটি শ্লোক প্রক্ষিপ্ত হিসেবে গ্রহণ করতে হতো এবং প্রক্ষেপের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হতো। প্রক্ষেপের অস্তিত্ব স্বীকার করলে মনুস্মৃতির বিশুদ্ধ প্রাচীন মান্যতাগুলো স্পষ্ট হয়ে যেত। তখন তার দ্বারা কোনো তীব্র বিরোধের সুযোগ থাকত না।

তবু ডঃ আম্বেডকর জেনে-শুনে প্রক্ষেপের অস্তিত্বের আলোচনা করেননি। প্রশ্ন উঠেছে, কি কারণে তিনি প্রক্ষেপ স্বীকার করেননি?

এটি বিশ্বাসযোগ্য নয় যে তিনি পরস্পরবিরোধী প্রক্ষেপের ব্যাপারে অজ্ঞান ছিলেন, কারণ তিনি প্রায় সকল প্রাচীন গ্রন্থ—বেদ থেকে পুরাণ পর্যন্ত—প্রক্ষেপের উপস্থিতি স্বীকার করেছেন এবং স্পষ্টভাবে আলোচনা করেছেন। যেমন—

(ক) বেদে প্রক্ষেপ:
“পুরুষ সূক্তের বিশ্লেষণ থেকে কি নিস্কর্ষ আসে? পুরুষ সূক্ত ঋগ্বেদে একটি ক্ষেপক।” (আম্বেডকর সাহিত্য, খণ্ড ৪৩, পৃ. ২)
“দুটি মন্ত্র (পুরুষ সূক্তের ১ ও ২) পরে সূক্তের মধ্যে যোগ করা হয়েছে। শুধুমাত্র পুরুষ সূক্ত নয়, এতে সময়ে সময়ে আরও মন্ত্র সংযোজিত হয়েছে। কিছু পণ্ডিতের মত, পুরুষ সূক্তই ক্ষেপক, যার কিছু মন্ত্র পরে যুক্ত হয়েছে।” (ওই, খণ্ড ৪৩, পৃ. ৪)

বেদের প্রক্ষেপ স্বীকার করার ধারণা ভুল কারণ প্রাচীনকাল থেকেই বেদব্যাখ্যা গ্রন্থে প্রতিটি সূক্ত, অনুবাক, পদ ও অক্ষরের গণনা লিপিবদ্ধ ছিল। কোনো পরিবর্তন হলে তা সহজেই শনাক্ত হতো।

(খ) বাল্মীকি রামায়ণে ক্ষেপক:
“মহাভারতের মতো রামায়ণের কাহিনীও সময়ের সঙ্গে ক্ষেপক দ্বারা পূর্ণ হয়েছে।” (আম্বেডকর সাহিত্য, খণ্ড ৭, পৃ. ২০ ও ৪৩০)

(গ) মহাভারতে ক্ষেপক:
“ব্যাসের ‘জয়’ নামক লঘু কাব্যে ৮৮০০ শ্লোক ছিল। বৈশাম্পায়নের ‘ভারত’-এ এটি ২৪,০০০ হলো। সৌতিতে আরও বৃদ্ধি পেয়ে মহাভারতের শ্লোক সংখ্যা ৯৬,৮৩৬ হলো।” (ওই, খণ্ড ৭, পৃ. ২৭)

(ঘ) গীতায় ক্ষেপক:
“মূল ভগবদগীতার প্রথম ক্ষেপক হলো সেই অংশ যেখানে কৃষ্ণকে ঈশ্বর বলা হয়েছে। দ্বিতীয় ক্ষেপক হলো সেই অংশ যেখানে পূর্ব মীমাংশার নীতিগুলি নিশ্চিত করতে সাংখ্য ও বেদান্ত দর্শনের বর্ণনা এসেছে। তৃতীয় ক্ষেপকে কৃষ্ণকে ঈশ্বরের স্তর থেকে পরমেশ্বরের স্তরে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।” (ওই, খণ্ড ৭, পৃ. ২৭৫)

(ঙ) পুরাণে ক্ষেপক:
“ব্রাহ্মণরা পরম্পরায় প্রাপ্ত পুরাণে নতুন অধ্যায় সংযোজন করেছেন, পুরনো অধ্যায় পরিবর্তন করে নতুন অধ্যায় রচনা করেছেন এবং পুরনো নাম ব্যবহার করেছেন। ফলে কিছু পুরাণের মূল বিষয়বস্তু অক্ষুণ্ণ রয়ে গেছে, কিছু লোপ পেয়েছে, কিছুতে নতুন সংযোজন হয়েছে এবং কিছু সম্পূর্ণ নতুন রচনায় রূপান্তরিত হয়েছে।” (ওই, খণ্ড ৭, পৃ. ৩৩)

এই উদাহরণগুলি স্পষ্ট করে যে ডঃ আম্বেডকর প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যতে প্রক্ষেপের অবস্থাকে বোঝেন। এটি বোঝায় যে তিনি স্বীকার করেননি মনুস্মৃতিতে প্রক্ষেপ, কারণ তা করলে তার “বিরোধের জন্য বিরোধ” আন্দোলন শেষ হয়ে যেত। তিনি দলিতদের সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। মনু ও মনুস্মৃতি-বিরোধ ছিল তাদের জন্য কার্যকর হাতিয়ার।

ডঃ আম্বেডকর হিন্দু ধর্মের প্রতি গভীর ঘৃণা পোষণ করতেন এবং হিন্দু ধর্ম ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ফলে হিন্দুদলিত সৌহার্দ্য বজায় রাখার চিন্তা তিনি করেননি।

লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি মনুস্মৃতির সাহিত্যিক অবস্থা, যুক্তি, প্রমাণ, পরম্পরা, এবং সত্য অনুসন্ধানের দাবি ত্যাগ করেছেন। সমালোচনার কোনো উত্তর দেওয়ার দায়িত্ব তিনি এড়িয়েছেন। তার অনুয়ায়ীরা তা অনুসরণ করেছেন। আজও তার সমর্থকরা মনু ও মনুস্মৃতির বিরোধ করেন, কিন্তু যুক্তি ও প্রমাণে কোনো উত্তর দেন না।

নিষ্কর্ষ:

মনুস্মৃতির মৌলিক এবং প্রক্ষিপ্ত শ্লোকের সনাক্তকরণের সহজ উপায়—

১. মনুর সমাজব্যবস্থা গুণ-কর্ম-যোগ্যতায় ভিত্তি করে (ডঃ আম্বেডকর স্বীকার করেছেন), তাই গুণ-কর্ম-যোগ্যতার নীতি অনুযায়ী শ্লোক মৌলিক। জন্মনিষ্ঠ, পক্ষপাতমূলক শ্লোক প্রক্ষিপ্ত। বৌদ্ধকালের কিছু শতাব্দীর পরে সমাজে জাতিবাদের সময় এই প্রক্ষেপ সৃষ্টি হয়েছে।

২. ‘মনুস্মৃতি-এর মৌলিক মান্যতা’ শীর্ষক লেখায় উল্লেখিত দণ্ডব্যবস্থা, উচ্চ-উচ্চ বর্ণের জন্য দণ্ড ব্যবস্থা মৌলিক; পক্ষপাতমূলক কঠোর শ্লোক প্রক্ষিপ্ত।

৩. শূদ্র সংক্রান্ত শ্লোক, তাদের প্রতি সদ্ভাব, ধর্ম পালন মৌলিক; জন্মনিষ্ঠ, শূদ্রনির্ধারক শ্লোক প্রক্ষিপ্ত।

৪. নারীদের সম্মান, স্বাধীনতা, শিক্ষা সংক্রান্ত শ্লোক মৌলিক; বিপরীত শ্লোক প্রক্ষিপ্ত।

এই ভিত্তিতে বলা যায় মনুর মান্যতা আপত্তিহীন।

অতএব মনু ও মনুস্মৃতি মৌলিকভাবে পড়া ও বোঝা প্রয়োজন; প্রক্ষিপ্ত শ্লোকের ভিত্তিতে করা বিরোধ পরিত্যাগ করা উচিত। আদি-ধি দাতা রাজর্ষি মনু ও আদিসংবিধান মনুস্মৃতি গর্বের এবং নিন্দার নয়। প্রাচীন সাহিত্যকে স্বার্থনিমগ্ন রাজনীতিতে আকৃষ্ট না করে সম্মান দেওয়া উচিত।

মনুস্মৃতিতে প্রক্ষেপের দুষ্পরিণাম:

১. রচনাকালে বিভ্রান্তি সৃষ্টি,
২. নব্বর্তী বর্ণনের কারণে মনুস্মৃতি নতুন শাস্ত্র মনে হওয়া,
৩. মৌলিকতা ও প্রামাণ্যতায় সন্দেহ,
৪. পক্ষপাতমূলক বর্ণনের কারণে মনুর ব্যক্তিত্ব ও মনুস্মৃতির খ্যাতি ক্ষতিগ্রস্ত,
৫. বৈদিক যুগের ইতিহাস ও সংস্কৃতির বিকৃত চিত্র,
৬. প্রাচীন ভারতের গৌরবপূর্ণ আদিসংবিধান ও আদিশাস্ত্রের অবমূল্যন।

এই কারণগুলো বিবেচনা করে মনুস্মৃতির প্রক্ষেপ চিহ্নিত করে সেগুলো অপসারণ করা প্রয়োজন। এ উদ্দেশ্যেই লেখক ‘মনুস্মৃতি’-এর প্রক্ষেপ অনুসন্ধানের কাজ করেছেন।

মনুস্মৃতি : একটি অধ্যয়ন

স্ব. পং. গঙ্গাপ্রসাদ উপাধ্যায় (মনুস্মৃতি ভাষ্যকার)

বেদঃ স্মৃতি: সদাচারঃ স্বस्य চর প্রিয়মাত্মনঃ। এতচ্চতুর্বিধং প্রাহু: সাক্ষাদ্ধর্মস্থ লক্ষণম্‌॥

মানব সমাজের প্রকৃত সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধির মূল হলো ধর্মাচরণ। আজ পৃথিবী অসন্তুষ্ট ও ব্যাকুল। সমগ্র পৃথিবী বেদনায় কাঁপছে। ধর্মাচরণের পীযুষবৃষ্টি থেকেই এই দাহাগ্নি শান্ত হতে পারে।

প্রশ্ন হলো, ধর্মাচরণ কী? কি শত-শত মতবিরোধ ও সম্প্রদায় অনুসরণ করা ধর্মাচরণের নাম? উত্তর হলো—‘না’। এই বিভিন্ন সম্প্রদায়ই বৃহৎ মানবতাকে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে। সুতরাং ধর্মাচরণের অর্থ হলো সর্বভৌম ধর্ম—মানব-ধর্মের আচরণ।

ধর্মের লক্ষণ

সর্বভৌম মানব-ধর্মের চারটি লক্ষণ এখানে উল্লেখ করা হলো—

(১) বেদ—ঈশ্বরীয় জ্ঞান, ঈশ্বরীয় আইন বা ঈশ্বরের আদেশ। এটি শ্রৌত ধর্ম। সর্বভৌম শাশ্বত সত্যই ঈশ্বরীয় নিয়ম। এই সত্য-সিদ্ধান্ত দেশ ও কাল নির্বিশেষে সমান। এই নিয়ম জানাও এবং সঠিকভাবে মান্য করে আচরণ করা হলো ধর্মাচরণের প্রথম অঙ্গ।

বিবেচনার জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে, বিশ্ব নিয়ম এবং মানুষের জীবনের চরম সিদ্ধির জন্য ঈশ্বরীয় জ্ঞানের প্রয়োজন। এটি চারটি বেদ সংহিতা আকারে প্রাপ্ত। বেদ কোনো দেশের সম্পদ নয়, না কোনো জাতির ইতিহাস। বেদ সর্বসত্য জ্ঞানের গ্রন্থ। বেদের শিক্ষা সর্বজনীন, সর্বকালীন।

উদাহরণস্বরূপ—

"উদ্যন্ত ইভ সূর্য সুপ্তানাং দ্বিষতাঁ বর্চ আদদে।"

অর্থাৎ, উদীয়মান সূর্যের রশ্মি কোনো ঘুমন্ত মানুষের উপর পড়লে তার জ্যোতি ও শক্তি হ্রাস পায়। দিন কাজের জন্য, রাত্রি বিশ্রামের জন্য। এটি একটি সর্বভৌম সত্য। যদি এর বিপরীত আচরণ করা হয়, রাতের কাজ ও দিনের ঘুম, তবে তা ঈশ্বরীয় নিয়মের বিপরীত। এর দুষ্পরিণাম ভোগ করতে হবে। দেশ ও কাল থেকে উপরে উঠে এটি সর্বজনীন ও সর্বকালীন সত্য।

একইভাবে, প্রতিটি মানুষ মাতৃগর্ভ থেকে নির্দিষ্ট ক্রমে জন্ম নেয়। এটি সকল দেশ ও কালেই সমান। কোনো ব্যক্তি যদি বলেন, কুমারীর গর্ভ থেকে ঈশা জন্ম নিল, বা কুন্তী মাতার কানের মাধ্যমে কর্ণ জন্ম নিল, তবে তা সর্বজনীন বেদের সত্যের বিপরীতে। এই চমৎকারকথা মেনে নেওয়া অন্ধকার ও অজ্ঞানকে আমন্ত্রণ জানানো, যার ফল শোক ও অশান্তি।

(২) স্মৃতি—বেদ বিশ্ব-ধর্ম, স্মৃতি জাতি-ধর্ম। বেদ পরমেশ্বরের আইন, স্মৃতি রাষ্ট্রের আইন। স্মৃতি অবশ্যই বেদের মূল ভাবনায় প্রেরিত হওয়া উচিত। যদিও শ্রৌত ধর্ম সকল কাল ও দেশের জন্য সমান, স্মার্ত ধর্মে দেশকাল অনুযায়ী পার্থক্য হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আরব মরুভূমিতে পানির অভাব, সেখানকার মানুষ নিত্য স্নান করতে পারে না, তখন “ওযু” করা যায়। তবে ভারতের পবিত্র নদী গঙ্গা-যমুনায় যদি কেউ শুধু “ওযু” করে কাজ চালায়, তবে তা স্মার্ত ধর্মের মূল বক্তব্যের বিরোধিতা ও একদেশীয় মানুষের আচরণে বৈষম্য সৃষ্টি। স্মৃতি-শাস্ত্র দেশকাল ও পরিস্থিতি অনুযায়ী লোকাচারের নিয়ম প্রদান করে।

(৩) সদাচার—অর্থ হলো “মহাপুরুষদের দ্বারা অনুশীলিত সমাজধর্ম”। সমাজের উন্নতির জন্য সদাচারী ধর্মী ব্যক্তির নিয়ম ও শিষ্টাচারের মানদণ্ড প্রয়োজন। অবশ্য বুদ্ধি ব্যবহার করে নিশ্চিত করতে হবে যে, কোনো সামাজিক প্রথা মূল ধর্মের (বেদের সত্য) বিরোধী না হয় এবং সমাজ বা রাষ্ট্রের উন্নয়নে বাধা না সৃষ্টি করে। সামাজিক আচরণ সদাচার, বেদ ও স্মৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া উচিত।

(৪) আত্মার অনুকূলতা—ধর্মাচরণের শেষ ও প্রধানতম মানদণ্ড। “আত্মবর্ত সবভূতেশু” এবং “আত্মনঃ প্রতিকূলানি পরেশাং ন সমাচরেত” এই আদর্শ চিরস্মরণীয়। কোনো আচরণ এমন হওয়া উচিত না, যা যদি অন্যের দ্বারা আমাদের সাথে করা হয়, আমরা কষ্ট পাই। কাজ আত্মার কণ্ঠ অনুযায়ী, আত্মবিশ্বাস ও চিন্তাশীলভাবে করা উচিত।

নিষ্কর্ষ—প্রত্যেক আচরণ যদি—
১. বেদের সঙ্গত বিশ্বধর্ম অনুযায়ী,
২. স্মৃতি অনুযায়ী রাষ্ট্রধর্ম বা রাষ্ট্রের সংবিধানের সঙ্গত,
৩. সামাজিক সদাচার বা শিষ্টাচারের সঙ্গত,
৪. আত্মার অনুকূলে, সকল প্রাণীকে আত্মরূপে ধরে করা হয়,
তবে তা ধর্মাচরণ। এর মাধ্যমে ব্যক্তিগত ও সামাজিক উন্নতি, জাতীয় সমৃদ্ধি এবং বিশ্বকল্যাণ সম্ভব।

মনুস্মৃতির মাহাত্ম্য—শ্রুতি (বেদ) অনুসরণ করে স্মৃতির প্রমাণ গুরুত্বপূর্ণ। স্মৃতিগুলি বেদের অনুসারী হওয়া উচিত। এই মানদণ্ডে শুধু মনুস্মৃতি বেদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং সর্বাধিক প্রামাণিক। যদিও এটি মূলত আর্যাবর্তীয়দের জন্য, আদ্য-স্মৃতি হওয়ায় সমগ্র মানবজাতির জন্যও সমানভাবে উপযোগী। এজন্য মনীতিঃ এটিকে ‘মানবধর্মশাস্ত্র’ বলেছে।

স্বামী দয়ানন্দ, আর্স-অংশে প্রক্ষেপ বাদ দিয়ে, মনুস্মৃতির আর্ষ্য অংশকে প্রমাণযোগ্য মানেছেন। তার গ্রন্থে সর্বাধিক প্রমাণও মনুরই। ‘সত্যার্থপ্রকাশ’-এ প্রায় ৪০০, ‘সংস্কারবিধি’-এ ৪৭৫ এবং ‘ঋগ্বেদাদি ভাষ্য ভূমিকা’-এ প্রায় ২০ প্রমাণ দেওয়া হয়েছে।

বেদের সাহিত্য ও প্রাচীন শাস্ত্রে মনুস্মৃতির গুরুত্ব একমতভাবে স্বীকার করা হয়েছে। ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণে লেখা আছে—“যা কিছু মনু বলেছেন তা ঔষধের মতোই উপকারী।” এছাড়া মনুস্মৃতি বেদের সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ বলে বিবেচিত।

মহাভারতে বলা হয়েছে—“পুরাণ, মানবধর্মশাস্ত্র, সঙ্গবেদ—এগুলিকে কোনো কারণে ক্ষতি করা যায় না।” মনুস্মৃতির অন্তর্দৃষ্টিও এ কথাকে প্রমাণ করে।

মনু যা বলেছেন, তা সব বেদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এ ভিত্তিতে রাজা রামমোহনরায় লিখেছেন—“মনুর বিধি (বেদের সার) বিপরীত যে নিয়ম, তা বেদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।” আর্যদের জন্য শ্রুতি ও স্মৃতি প্রধান প্রমাণ। শ্রুতি স্বতঃপ্রমাণ, স্মৃতি পরতঃপ্রমাণ। কালিদাসের রঘুবংশেও বলা হয়েছে—“স্মৃতি শ্রুতি অনুসরণ করে।” মেধাতিথি মনুভাষ্য প্রারম্ভে লিখেছেন—

ঋচো যজুঁষি সামানী মন্ত্রা আথর্বণশ্চয়ে। মহর্ষিবিস্তু ততূ্‌ প্রোক্তং স্মার্তস্তু মনুরব্রবীত॥

অর্থাৎ—“ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ এবং অথর্ববেদের উপদেশ রিষিদের দ্বারা দেওয়া হয়েছিল, তবে স্মার্ত ধর্ম (স্মৃতি) উপদেশ দিয়েছেন ‘মনু’।

মহাভারত শান্তি-পর্বে লেখা আছে—

“ঋষীনুয়াচ্যতানু সার্বানদৃশ্যঃ পুরুষোত্তমঃ। কৃতং শত-সহস্রং হি শ্লোকানামিদমুত্তমম্॥”

অর্থাৎ—‘নিরাকার পরমেশ্বর সেই রিষিদেরকে শত সহস্র শ্লোকের উৎকৃষ্ট জ্ঞান প্রদান করেছেন, যার উপর সমগ্র বিশ্বের ধর্ম প্রতিষ্ঠিত। স্বয়ম্ভূ মনু নিজেই এই ধর্মের উপদেশ প্রদান করেছেন। মনুর সেই উপদেশের ভিত্তিতে ব্রহস্পতি ও উশনস তাদের নিজস্ব স্মৃতিগুলি তৈরি করেছেন।’

মনুস্মৃতির প্রাচীনতা

বর্তমানে যা স্মৃতিগুলি পাওয়া যায়, তার মধ্যে ‘মনুস্মৃতি’ সবচেয়ে প্রাচীন। বিশ্বরূপ যাজ্ঞবলক্য-স্মৃতিতে প্রায় ২০০ শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন, যা বর্তমান মনুস্মৃতিতেও রয়েছে। শ্রী শংকরাচার্য তার বেদান্তভাষ্যে মনুস্মৃতির অনেক শ্লোক উল্লেখ করেছেন। বেদান্ত 3॥4 ‘স্মরন্তি চ’ সূত্রের ব্যাখ্যায় তিনি লিখেছেন—

“মনুব্যাসপ্রভূতয়ঃ শিষ্টাঃ”

অর্থাৎ—মনু ও ব্যাস প্রভৃতি শিষ্ট পুরুষদের বচন স্মৃতির অন্তর্ভুক্ত।

কুমারিলের “তন্ত্রবার্তিক” মনুর উপর ভিত্তি করে রচিত। কুমারিল মনুস্মৃতিকে কেবল অন্যান্য স্মৃতি নয়, বরং গৌতম সূত্র থেকেও অধিক প্রামাণিক ও মর্যাদাপূর্ণ মনে করেছেন।

অপরর্ক যাজ্ঞবলক্য-স্মৃতি 2।24 এর ব্যাখ্যায়ও প্রথম শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন। অশ্বঘোষের বজসুচিতে ‘মানব-ধর্ম’ থেকে অনেক শ্লোক নেওয়া হয়েছে, যা বর্তমান মনুস্মৃতিরই। কিছু শ্লোক সেখানে নেই।

वाल्मीকী রামায়ণ, কিষ্কিন্ধাকাণ্ড 8।30, 32-এ মনুস্মৃতির নিম্নলিখিত দুটি শ্লোক উল্লেখ করা হয়েছে, যা ৮ম অধ্যায়ের ৩৯ ও ৩৭ নম্বর শ্লোকের সমান—

“রাজভিঃ কৃতদঠণ্ডাস্তু কৃত্বা পাপানি মানবাঃ। নির্মলাঃ স্বর্গমায়ান্তি সন্তঃ সুকৃতিনো যথা॥”
“শাসনাদ্বা বিমোক্ষাদ্বা স্তেনঃ স্তেনাদ্বিমুচ্যতে। অশাসিত্বা তু তম রাজা স্তেনস্থাপ্নোতি কিল্বিষম্‌॥”

ভারতের বাইরে মনুর প্রভাব

পি. ভি. কানে তার বইতে লিখেছেন যে, 

"The influence of the Manusmiriti spread eve be-yond the confines of India. In A. Bergigne's Inscrip-tions Sanscrites de campa et du Cambodge [p.423] we have an inscription in which occur verses one of which is identical with Manu (ii, 136) and the other is a summary of Mau [iii 77-80]. The Burmese are gov-erned in modern times by the dhamma that, which are based on Manu. Vide Dr. Ferchhammer's Essay on Sources ad Development of Burmese Law (1885, Rangoon) Dr. E.C.G. Jonker (Leyden 1885) wrote a disseration on an old Javanese lawbook compared with Indian sources of law like the Manusmriti (which is still used as a lawbook in the island of Bali)."

ব্রহ্মদেশ ও বালি দ্বীপের ধর্মশাস্ত্রে মনুস্মৃতির অনুরূপতা লক্ষ্য করা যায়। একটি প্রস্তর-লেখায় দুটি শ্লোক দেওয়া হয়েছে—একটি মনুস্মৃতির মূল, অন্যটি মনুর শ্লোকের সারমাত্রা।

উদাহরণ শ্লোক—

“আচার্যবদ্গৃহস্থোদষপি মাননীয় বহু-শ্রুতঃ। 

অভ্যাগতগুণানাং চ পরাবিদ্যেতি মনবম্॥ 3।27-80”

“অিতাং মান্যস্থানানি গরীপুর্য যদুত্তরম্॥ 2/736”

ব্রহ্মদেশ ও ভারতের নিকটবর্তী দ্বীপগুলোতে ভারতীয় সভ্যতা প্রচলিত ছিল, সুতরাং এই স্থানগুলোর গ্রন্থে মনুস্মৃতির সাদৃশ্য স্বাভাবিক। তবে এটি প্রমাণ করে যে, মনুস্মৃতি তখনও গুরুত্বপূর্ণ ছিল যখন এই দ্বীপগুলির ভারতবর্ষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।

মনু ও মনুস্মৃতি

মানব-ধর্মশাস্ত্রের মধ্যে মনু বিশেষভাবে গৌরবময়। আর্য জাতির সভ্যতা মানব-ধর্মশাস্ত্রের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। আমরা মনু বা মনুস্মৃতি সম্পর্কিত অনেক প্রশ্নের পূর্ণ সমাধান না করলেও মান্য করতে হবে যে, মনু অবশ্যই একজন মহাপুরুষ ছিলেন, যার উপদেশ আর্য সভ্যতার নির্মাণ ও জীবনাবস্থার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

মনু কে ছিলেন?

মনু কে ছিলেন তা বলা কঠিন। উপনিষদকার ও দর্শনকারের মতো মনু সম্পর্কেও কম তথ্য জানা। তিনি রাজা ছিলেন নাকি ঋষি, তপস্বী নাকি গৃহস্থ—এই বিষয়ে তথ্য নেই। কোথাও মনু কেবল ধর্মশাস্ত্রের রচয়িতা বলা হয়েছে, কোথাও সমগ্র সৃষ্টির উৎপত্তি মনুর সঙ্গে যুক্ত বলা হয়েছে।

শতপথ ব্রাহ্মণ (3।4।3।3)-এ লেখা আছে—

“মনুর্বেভস্বতো রাজেত্যাহ তস্য মনুষ্যা বিশঃ।”

অর্থাৎ—‘মনু বৈবস্বত রাজা ছিলেন এবং মানুষ তার প্রজা।’ তাই বোঝা যায় যে, মনু বৈবস্বত সম্ভবত রাজা ছিলেন।

যে ব্যক্তি বিশেষ গুণের কারণে মনুভাইস্বত বলা হয়েছে। মেধাতিথি তার ভাষ্যের শুরুতে মনু সম্পর্কে লিখেছেন—‘মনু নাম কশ্চিত্‌ পুরুষবিশেষঃ নেকবেদশাখাধ্যয়নবিজ্ঞানানুষ্ঠানসম্পন্নঃ স্মৃতিপরম্পরা প্রখ্যাতঃ’। অর্থাৎ—‘মনু একজন বিশেষ পুরুষ ছিলেন, যিনি বহু শাখার বেদ অধ্যয়ন ও ধর্মকর্ম এবং স্মৃতি-পরম্পরার জন্য প্রসিদ্ধ হয়েছিলেন।’ এটি একটি ক্ষতিহীন বক্তব্য এবং এটিকে স্বীকার করতে কারও কোনো দ্বিধা হওয়া উচিত নয়, কারণ যে মনু এত প্রসিদ্ধ, তিনি অবশ্যই একজন বিদ্বান্‌ পুরুষ ছিলেন এবং বেদাচার ও লোকাচার সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন।

প্রচলিত ‘মনুস্মৃতি’-এর রচয়িতা: মনু সম্পর্কে এটুকুই বলা হল, এবার “মনুস্মৃতি”-তে আসা উচিত। প্রশ্ন হলো, যিনি এত প্রসিদ্ধ, কি তিনি প্রচলিত ‘মনুস্মৃতি’-ও রচনা করেছেন? যদি না করে থাকেন, তাহলে মনু সম্পর্কে এত প্রশংসা করার অর্থ কী? আমাদের মতামত হলো, বর্তমান ‘মনুস্মৃতি’-তে মনুর ভাব আছে, মনুর শব্দ নয়। সবাই এটি স্বীকারও করেন। যাকে মানুষ ‘মনুস্মৃতি’ বলে, তার আসল নাম ‘ভৃগুসংহিতা’। বলা হয়, এটি ভৃগু ও তার শিষ্যরা শ্লোক আকারে রচনা করেছেন। ‘মনুস্মৃতি’-তেও লেখা আছে—‘এতদ্বোয়ং ভৃগুঃ শাস্ত্র শ্রাবয়িষ্যত্যশেষতঃ। এতদরিদ্বি মত্তোদ্ধিজগে সর্বমেষোখন মনিঃ। ততস্তথা সতেনোক্তো মহর্ষিঃ মনুনা ভৃগুঃ। তানব্রভিডূষীন্‌ সর্বান্‌ প্রীতাত্মা শ্রূযতামিতি।’ এই শ্লোকগুলোর সামনে-পিছনের শ্লোক মিলিয়ে নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন যে এই সংহিতা ভৃগুরই রচনা। কিন্তু একটি বিষয় নিশ্চিত, অর্থাৎ ‘মনুস্মৃতি’ আজকাল যেই রূপে পাওয়া যায় এবং যাকে ভৃগুসংহিতা বলা হয়, এটি কোনো নতুন গ্রন্থ নয়।

ভৃগুসংহিতার রচয়িতা কে? এটি ভৃগুরই রচনা নাকি অন্য কেউ—এ বিষয়ে বিদ্বানদের মধ্যে বিতর্ক আছে। মনু নিজে রচনা করতে পারেননি। এটি ‘মনুস্মৃতি’-এর প্রথম শ্লোক থেকেই স্পষ্ট—‘মনুমেকাগ্রমাসীনমভিগম্য মহর্ষয়ঃ। প্রতিপূজ্য যথা ন্যায়মিদং বচনমন্ত্রুবন।’ অর্থাৎ—‘যখন মনু মহারাজ একান্তে বসে ছিলেন, তখন মহর্ষিরা শ্রদ্ধাসহ উপদেশের জন্য তাঁর কাছে গিয়েছিলেন।’ যদি মনু নিজেই রচয়িতা হতেন, তাহলে এইভাবে শুরু হতো না। অন্য স্মৃতিও এইভাবে শুরু হয়েছে। যেমন—‘যোগেশ্বরং যাজ্ঞবল্ক্যং সম্পূজ্য মুনয়ৌবুবন। বর্ণাশ্রমেততান্‌ নো বরা ধর্মানশেষতঃ।’ (যাজ্ঞবল্ক্যপ্রতি) ‘হৎঅগ্নিহোত্রমাসীনমত্রিং বেদবিদান্বরং। সর্বশাস্ত্রবিধিজ্ঞং তমর্ষিবিশ্চ নমস্কৃতম্‌। নমস্কৃত্য চ তে সর্ব ইদং বচনমন্ত্রুবন। হিতার্থ সর্বলোকানাং ভগবন্‌ কাথয়স্ব নঃ।’ (অগ্রিস্মৃতি) ‘বিষ্ণুমেকাগ্রমাসীন শ্রুতিস্মৃতিভিশারদম্‌। প্রপঞ্চুমুনয়ঃ সর্ব কলাপগ্রামবাসিনঃ।’ (বিষ্যুস্পতি) ‘ইষ্ট্বা ক্রতুশতং রাজা সম্পাতং বর দক্ষিণম্‌। ভগবতং গুরু শ্রেষ্ঠ পরিবপ্র্ছদ বৃহস্পতিম্‌।’ (কহস্পতিস্মৃতি)

আমাদের ধারণা, যাজ্ঞবল্ক্য প্রভৃতি ঋষিদের নামে যে স্মৃতিগুলো পরে রচনা হয়েছে, সেগুলো শুধুই মনুস্মৃতি-এর অনুকরণ। ভারতীয় সাহিত্যে এমন একটি যুগ এসেছে যখন মানুষ নিজের রচনা প্রাচীন আচার্য ও ঋষিদের নামে প্রচলিত করতো যাতে সাধারণ মানুষের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয়। ভারতে যখন বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি অবৈদিক মত প্রচলিত হয় এবং বেদ পুনরুদ্ধারের জন্য পৌরাণিক মত জোর পায়, তখন এই প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পায়।

‘মনুস্মৃতি’-এর মূল রূপ কি মনুর উপদেশ থেকেই এসেছে? ভিন্ন মত রয়েছে। কিছু মানুষের মতে, এটি আগে সূত্ররূপে ছিল, পরে শ্লোক আকারে রূপান্তরিত হয়েছে এবং এই রূপ দেওয়ার কাজ ভৃগু ঋষির।

আমাদের ধারনা হলো—
১. মনুর উপদেশ আগে কোনো গাথা-রূপে ছিল।
২. তারপর মানব-ধর্মসূত্র আকারে এসেছে।
৩. পরে বর্তমান ‘মনুস্মৃতি’ আকারে রূপান্তরিত হয়েছে।
৪. বর্তমান ‘মনুস্মৃতি’ও খুব প্রাচীন।
৫. পরে এতে অনেক সংযোজন হয়েছে।

‘মনুস্মৃতি’-তে প্রক্ষেপণাংশ—এটি একটি সত্য যে রামায়ণ, মহাভারত, গীতা এবং অন্যান্য মহান গ্রন্থের মতোই ‘বাম মার্গ কাল’ এবং ‘পৌরাণিক কাল’-এ মানবজাতির শত্রুদের দ্বারা স্বার্থ বা অজ্ঞানবশতঃ যথেষ্ট প্রক্ষেপণ হয়েছে।

যখন মহাত্মা বুদ্ধের কিছু আগে বিশুদ্ধ বৈদিক ধর্মে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় এবং কিছু পরে বৌদ্ধ এবং বৈদিক-পৌরাণিক মতের মধ্যে সংঘর্ষ হয়, তখন বিভিন্ন উদ্দেশ্যপূর্ণ সম্প্রদায়িক বিদ্বান মনমতী কসরত চালিয়েছেন। যা চেয়েছিলেন তা যোগ করেছেন, যা চেয়েছিলেন তা বাদ দিয়েছেন। এতে বৈদিক তত্ত্বে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে।

সময়ের প্রভাব প্রতিটি বস্তুতে পড়ে। একটি ঘর যতই শক্তিশালী হোক না কেন, বায়ু, রোদ ও জল তার উপর কিছু প্রভাব ফেলে। প্রতিটি দেয়ালের আকার দেখে বোঝা যায় সময় কত পরিবর্তন এনেছে। প্রথমে পানি দেয়ালে দাগ ফেলে। পরে মালিক পুতাই করে। পরে বৃষ্টি আসে এবং কিছু অংশ ধুয়ে যায়। পরে চুনের পাতলা স্তর দেওয়া হয়। এভাবে প্রতিটি দেয়ালে স্তর সৃষ্টি হয়। কখনও কখনও দেয়াল খুুচে নতুন করে পুতাই করা হয়। তবে তখনও এটিকে মৌলিক দেয়াল বলা যায় না। এ সবই প্রক্ষেপণ।

এইভাবে বইয়ের ক্ষেত্রেও। সাধারণ বিনোদনের জন্য বইয়ে মানুষ খুব কম হস্তক্ষেপ করে, এবং তাও অবচেতনভাবে। তাদের সংযোজন এমন হয় যে কখনও লেখকের ভুলে শব্দ পড়ে যায় বা কোনো পংক্তি বাদ যায়, কখনও কখনও উপরের অর্ধেক পংক্তির সঙ্গে মিশে যায়। কখনও শব্দ বাদ গেলে পরবর্তীরা সংশোধনের জন্য কিছু শব্দ যোগ করে। এইভাবে পরিবর্তন ঘটে। এই সব সংযোজন ক্ষুদ্র, কিন্তু ধর্মগ্রন্থের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক। ধর্মীয় বিপ্লব হলে প্রথমেই ধর্মগ্রন্থের উপর আক্রমণ হয়।

‘মনুস্মৃতি’-এর শ্লোকের মধ্যে পরস্পর-বিরোধিতা স্পষ্ট—
১. সবর্ণাগ্রে দ্বিজাতীনাṁ প্রশস্তা দারকর্মণি। কামতত্তু প্রবৃত্তানামিমা: স্যুঃ ক্রমশো বরাঃ॥
২. শূদ্রেব ভার্যা শূদ্রস্থ সা চ সয়া চ বিশ্বঃ স্মৃতেঃ। তেচ সয়া চৈব রাজ্ষেচ তাইচ সয়া চ আগ্রজন্মনঃ॥

প্রথমে ব্রাহ্মণকে শূদ্র স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহের অধিকার দেওয়া হয়েছে, পরবর্তী শ্লোকে তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে—‘ন ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়যোরাপদ্যপি হি তিষ্ঠতোঃ। কসমিচ্চিদপি বৃত্তান্তে শূদ্রা ভায়্যোপদিশ্যতে।’

মনু (৩/২)–এ আট ধরনের বিবাহের উল্লেখ—‘ব্রাহ্মণো, দৈব, আর্ষ, প্রাজাপত্য, আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস, পৈশাচ’। পরে ৩/২৭–৩/৩৪–এ তাদের বৈশিষ্ট্য দেওয়া হয়েছে। তারপর ৩/৩৯–৩/৪২–এ বলা হয়েছে, প্রথম চারটি—‘ব্রাহ্ম, দৈব, আর্ষ, প্রাজাপত্য’—শ্রেষ্ঠ এবং ‘শিষ্টসম্মত’, বাকি চারটি—‘আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস, পৈশাচ’—কুত্সিত। সুতরাং অমন্দ চার ধরনের বিবাহই করা উচিত। বাকি চারটি বিবাহ ‘নিন্দ্য’, তাই করা উচিত নয়। আমাদের মতে, মনু মহারাজের মূল মতামত এই।

কিন্তু নিচের শ্লোক সম্পূর্ণভাবে এর বিরোধিতা করে—‘ঘডানুপূর্ব্যা বিপ্রস্য, ক্ষত্রস্থ চতুরোবরান্‌। বিদশূদ্রযোস্তু তানেভ বিদ্যাদ্‌ ধর্ম্যানরাক্ষসান্‌॥’ (৩/২৩)

এখানে প্রথম ছয়টি—‘ব্রাহ্মণ, দৈব, আর্ষ, প্রাজাপত্য, আসুর, গান্ধর্ব’—ব্রাহ্মণদের জন্য ধর্মানুকূল বলা হয়েছে। শেষ চারটি—‘আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস, পৈশাচ’—ক্ষত্রিয়দের জন্য ‘ধর্ম’ হিসেবে বলা হয়েছে। বৈশ্য এবং শূদ্রদের জন্য রাক্ষস-বিবাহ ছাড়া আসুর, গান্ধর্ব এবং পৈশাচকে ধর্ম বলা হয়েছে। এটি কেবল ৩/৪ থেকে বিরোধপূর্ণই নয়, বিস্ময়করও। ক্ষত্রিয়দের জন্য প্রথম চারটি বিবাহের অনুমতি কেন নেই? তাদের জন্য কেবল বাকি চারটি কেন? পৈশাচ বিবাহে কী বৈশিষ্ট্য আছে যে এটি ক্ষত্রিয়দের জন্য ভালো এবং বৈশ্য ও শূদ্রদের জন্য খারাপ? কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তি পৈশাচ বিবাহকে কারোর জন্যও ভালো বলতে পারবে না। ক্ষত্রিয় রাজাদের উপর কী করুণা এসেছে যে তাদের বিবাহের জন্য কোনো নিয়মই রাখা হয়নি, সবই বিধিত বলা হয়েছে? এটির সংযোজন সন্দেহাতীত। রাজাদের অশ্লীল আচরণকে ‘ধর্ম’ বলার জন্যই কি এই কৃতকর্ম? গান্ধর্ব বিবাহও ব্যভিচার কম নয়, তবু এটি ব্রাহ্মণদের ছাড়া সকলের জন্য অনুমোদিত। রাজা দুশ্যন্ত যখন শকুন্তলার প্রতি আকৃষ্ট হয়, তখন তিনি মনুস্মৃতির প্রমাণ দেখিয়ে একান্তে সম্পর্ক করতে বাধ্য করেন। রাজারা ‘মনুস্মৃতি’-এর এই অস্ত্র পেয়ে কী না করতে পারে?

এখানি শেষ নয়, পরবর্তী শ্লোকও এর বিরোধী—

‘চতুরো ব্রাহ্মণস্যাদ্যান্‌ প্রশস্তান্‌ কবয়ো বিদুঃ। রাক্ষসং ক্ষত্রিয়স্যৈকমাসুরং বৈশ্যশূদ্রযোঃ॥’ (৩/২৪)

‘বিদ্বানরা বলেন, প্রথম চারটি বিবাহ ব্রাহ্মণের জন্য প্রশংসনীয়। ক্ষত্রিয়দের জন্য এক রাক্ষস-বিবাহ। বৈশ্য ও শূদ্রদের জন্য এক আসুর-বিবাহ।’ এগুলো কি ঠিক হতে পারে? রাক্ষস-বিবাহে কী বৈশিষ্ট্য যে এটি একমাত্র ক্ষত্রিয়দের জন্য প্রশংসনীয় বলা হয়েছে? পরবর্তী দুই শ্লোকও দেখুন—

‘পঞ্চানাং তু ত্রয়ো ধর্ম্যা দ্বাবধর্ম্যো স্মৃতাবিহ। পৈশাচশ্চাসুরশ্চৈব ন কर्तব্যৌ কদাচন॥’ (৩/২৫)

‘পৃথক পৃথক বা মিশ্র বিবাহ পূর্বচোদিত। গান্ধর্ব রাক্ষসশ্চৈব ধর্ম্যো ক্ষত্রস্থ তৌ স্মৃতঃ॥’ (৩/২৬)

কখনও কিছু, কখনও কিছু। কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তি এমন অসংগঠিত কথা বলবে না। সামান্য মনোযোগ দিলে বোঝা যায় ৩/২৩ থেকে ৩/২৬ পর্যন্ত চারটি শ্লোক মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। এভাবে ৩/৩৬, ৩৭, ৩৮-এও অনেক বেত্রিক সংযোজন আছে, যেখানে একে একে একবিংশ-বিংশ প্রজন্মের বিষয় লেখা হয়েছে। এই সংযোজন এতই চোখে পড়ে যে তা সহজেই বোঝা যায়।

(৩) অধ্যায় ৯, ৫৯–৬৩ পর্যন্ত চার শ্লোকে ‘নিয়োগ’-এর নির্দেশনা আছে এবং ৬৩-তম শ্লোকে বলা হয়েছে, ‘নিয়োগ বিধি’ ত্যাগ করলে যারা অন্যথায় আচরণ করে, তারা পতিত হয়। কিন্তু ৬৫–৬৮ পর্যন্ত নিয়োগ নিষিদ্ধ। ৫৯–৬৯ পর্যন্ত এগারো শ্লোক পড়লে স্পষ্ট হয় যে কিছু মিল নেই।

(৪) অধ্যায় ৫-এ মাংস-ভক্ষণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ—

‘না ক্রূত্বা প্রাণিনাং হিংসা মাংশমুত্পদ্যতে ক্বচিত্‌। নচ প্রাণিবধঃ স্বর্গ্যস্তসমান্‌ মাংশং বিবর্জয়েত্‌॥’ (৫/৪৮)
‘সমুত্পত্তি চর মাংশস্য বধবन्धৌ চ দেহিনাম্‌। প্রসমীক্ষ্য নিবর্তেত্‌ সর্বমাংশস্থ ভক্ষণাত্‌॥’ (৫/৪৯)

এখানে শুধু মাংস নিষিদ্ধ নয়, যুক্তিও দেওয়া হয়েছে—প্রাণী হত্যা না করে মাংস পাওয়া যায় না এবং প্রাণীর হত্যা স্বর্গের পথ নয়, তাই মাংস বর্জনীয়। এই যুক্তি অনুযায়ী শুধুমাত্র সাধারণ মাংস-ভক্ষণ নয়, ইয়জ্ঞে মাংস দান বা খাওয়াও নিন্দিত। পরবর্তীতে মাংস নিষিদ্ধ—

‘অনুমন্তা বিশ্বাসিতা নিহন্তা ক্রয়বিক্রয়ী। সংস্কর্তা চ উপহর্তা চ খাদকশ্চেতি ঘাতকাঃ॥’ (৫৫৭)

অর্থাৎ, শুধু মাংস খাওয়ার জন্য নয়, হত্যা, বিক্রি, ক্রয়, রান্না করা সবাই গুণাহীন। তারপরও পরবর্তী শ্লোকগুলোতে মাংসের বিধি আছে—

‘ইয়জ্ঞায় জঘ্দির্‌ মাসস্থেষ দৈবঃ বিধিঃ স্মৃতঃ। অতোন্ন্যথা প্রবৃত্তি তু রাক্ষসো বিধি রুচ্যতে॥’ (৫/৩৭)

অর্থাৎ, ইয়জ্ঞে মাংস দান ‘দৈব বিধি’, এবং ইয়জ্ঞ ছাড়া মাংসের প্রবৃত্তি ‘রাক্ষস বিধি’। কি ইয়জ্ঞে প্রাণীহত্যা ছাড়া মাংস রাখা সম্ভব? যদি না, তবে ‘দৈব বিধি’ ও ‘রাক্ষস বিধি’-তে পার্থক্য কী? একইভাবে ৫/৩২–৫/৪২ পর্যন্ত অসঙ্গত কথা বলা হয়েছে। ৫/৪০-এ উল্লেখ আছে—

‘ইয়জ্ঞার্থ নিহিত প্রাণীরা উত্তম পুনর্জন্ম পায়।’

এভাবে শ্রাদ্ধেও বিভিন্ন প্রাণীর বধের উল্লেখ আছে।

এই সব ক্ষেত্রে পরস্পর-বিরোধের কারণে একটি মৌলিক এবং একটি সংযোজন ধরা প্রয়োজন, কারণ দুটি বিরোধী কথা একই রচয়িতা বলতে পারে না।

বেদ-বিরোধিতা—পাঠকরা প্রশ্ন করতে পারেন, মিলানোর কী মানদণ্ড আছে? সংক্ষেপে বললে ‘মনুস্মৃতি’ কোনো স্বতন্ত্র বই নয়। এটি বৈদিক সাহিত্য এবং বৈদিক ধর্মের প্রচারই এর লক্ষ্য। বেদই এর মূল ভিত্তি। নিচের শ্লোক সাক্ষী—
(১) ‘বেদোদখিলো ধর্মমূলম্‌।’ (২/৬)
(২) ‘বেদঃ স্মৃতি: সদাচারঃ স্বস্য চ প্রিয়মাত্মনঃ’ (২/৭২২)
(৩) ‘প্রমাণং পরমং শ্রুতি:।’ (২/৭৩)
(৪) ‘বেদাস্ত্যাগাচ’ (২/৭৯)
(৫) ‘বেদমেব সদাভ্যস্থেত্‌ তপস্তপস্যন্‌ দ্বিজোত্তমঃ। বেদাভ্যাসো হি বিপ্রস্থ তপঃ পরমিহোচ্যতে।’ (২/৭৬)
(৬) ‘বেদ যজ্জৈরহীনানাং প্রশস্তানাং স্বকর্মসু। ব্রহ্মচার্যাহারেদ্ভেক্ষ গৃহেব্যঃ প্রচেষ্টন্‌।’ (২/৭৮)
(৭) ‘বেদানধীত্য বেদৌ বা বেদং ব্যব যাথাক্রমম্‌।’ (৩/২)
(৮) ‘বেদাভ্যাসো অন্বহং শক্ত্য মহাযজ্ঞক্রিয়া ক্ষমা। নাশয়ন্ত্যাশু পাপানি মহাপাতকজান্যপি।’ (৭৭/২৪৫)
(৯) ‘আর্ষ ধর্মোপদেশং চর বেদশাস্ত্রাউ বিরোধিনা। স্থর্কেনানুসন্ধত্তে স ধর্ম বেদ নেতরঃ।’ (৭২/৭০৬২)

হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে বৈদিক ধর্মে বিপ্লব ঘটেছে এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে বৈদিক গ্রন্থে। তবে প্রাচীন বৈদিক ধর্মের তত্ত্ব এমন এক মানদণ্ড, যার মাধ্যমে বেশিরভাগ মিল-সংযোজন পরীক্ষা করা যায়।

আমরা ‘মনুস্মৃতি’-এর বেদ-বিরোধী সংযোজনকে চার ভাগে ভাগ করি—

(১) মাংস-ভক্ষণ সম্পর্কিত সংযোজন—উপর বলা হয়েছে, মনুস্মৃতি-এর মূল নীতি অহিংসা। বেদে অহিংসার বিশেষ গুরুত্ব।

যজুর্বেদ বলে—
মিত্রস্য চক্ষুষা সর্বাণি ভূতানি সমীক্ষন্তাম্‌।’ (যজুর্বেদ)

অর্থাৎ প্রতিটি প্রাণীকে বন্ধুর মতো দেখা উচিত। কেবল বৈদিক নয়, সকল ধর্মের মূল অহিংসা। যদি মানুষ অন্যকে কষ্ট দিতে দ্বিধা না করে, তাহলে সদাচারের কোনো অংশ পালন সম্ভব নয়। ‘মনুস্মৃতি’ এটি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে, তাই যেখানেই পশু-হত্যার বিধি আছে, তা সব সংযোজন।

কিছু লোক মনে করে যে য়জ্ঞে প্রাণী-বলি বিধি আছে। কিন্তু “মনুস্মৃতি”-এর মূল নীতি এটি সমর্থন করে না। দেখুন—

‘পঞ্চ সূনা গৃহস্থস্য চুল্লি পেষণ্যুপস্করঃ। কন্ডনী চোদকুম্ভেচ বধ্যতে যাস্তু বাহয়ন্‌॥’ (৩/৬৮)

এখানে গৃহস্থের পাঁচটি পাপের উল্লেখ আছে, যা প্রতিটি গৃহস্থকে অনিচ্ছায় করতে হয়—চুল্লি, চাকি, ঝাড়ু, ওখলি এবং জলের ঘড়া। এ ব্যবহারে ছোট ছোট কীটও মারা যায়। গৃহস্থরা চাইয়ে না চাইয়েই এই হিংসা করে। তারা কাউকে কষ্ট দিতে চায় না, কিন্তু তা ঘটে যায়। এমন ধর্মে যেখানে অজান্তে পিপঁড়ের মৃত্যু হলেও মানুষ দোষী হয়, সেখানে জেনে-জেনে কাউকে মারা কত বড় পাপ হবে? এই সূনা-পাপ মিটানোর জন্য দৈনিক প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে মহায়জ্ঞের বিধান আছে—

‘তাসাঁ ক্রমেণ সর্বাসাঁ নিষ্কৃত্যার্থ মহর্ষিভিঃ। পঞ্চ ক্লূপ্তা মহায়জ্ঞাঃ প্রত্যহ গৃহমেধিনাম্‌॥’ (৩/৬৯)

এই পাঁচ মহায়জ্ঞ হল—অধ্যাপন, ব্রহ্মযজ্ঞ, পিতৃযজ্ঞ বা তರ್ಪণ, দেবযজ্ঞ, বলৈশ্বযজ্ঞ এবং নরযজ্ঞ। লোকেরা মনে করে যে ইয়জ্ঞ এবং প্রাণী-হত্যার বিশেষ সম্পর্ক আছে। ইয়জ্ঞ মানে অনেকেই হত্যা বোঝে এবং ‘বলি’ শব্দের অর্থও তাই মনে করে। দুর্ভাগ্য যে এই দুই শব্দ তাদের মূলত থেকে বিপথগামী হয়েছে। ‘ইয়জ্ঞ’ শব্দ ‘যজ্‌’ ধাতু থেকে এসেছে, যার অর্থ—দেব-প্রার্থনা, সমবায় এবং দান; এগুলোর সঙ্গে হত্যা কী সম্পর্ক? কিছু লোক মনে করে নরযজ্ঞ হলো যেখানে মানুষকে মেরে তার মাংস দান করা হয়। এই মানুষের কাছে প্রশ্ন করুন, ব্রহ্মযজ্ঞে ব্রহ্মকে এবং পিতৃযজ্ঞে পিতামাতাকে মারা হবে কি? অর্থবোধহীনতার জন্য কি বলা যায়! নরযজ্ঞের সমার্থক হলো অতিথি-সেবা। তবুও যদি কেউ ইয়জ্ঞকে হিংসাপূর্ণ মনে করে, শব্দের দোষ কি? তদ্রূপ, ‘বলি’ অর্থ হলো ‘ভূতযজ্ঞ’, অর্থাৎ পিপঁড়ে, কাক ইত্যাদিকে খাবার দেওয়া। তাই পিতৃযজ্ঞে প্রাণী-হত্যার বিধান স্পষ্টভাবে পরে যোগ হয়েছে।

যখন মহাত্মা বুদ্ধ ধর্ম প্রচার করেছিলেন, তখন ইয়জ্ঞে প্রাণীকে মারার রেওয়াজ সাধারণ ছিল। এই অত্যাচার দেখে বুদ্ধ বৈদিক ইয়জ্ঞের নিষেধ করেছিলেন, কারণ প্রকৃতপক্ষে সেগুলি বৈদিক ইয়জ্ঞ থাকেনি। এটি ছিল বাম-পথ, বিপথগামী প্রচার। মনে হয় ওই সময় বা তার পরে ‘মনুস্মৃতি’-তে এই সংযোজন হয়েছিল।

(২) শ্রাদ্ধ-সম্পর্কিত সংযোজন—মৃত পিতার শ্রাদ্ধ, তর্পণ ইত্যাদি—দ্বিতীয় সংযোজন। উপরের মতো বলা হয়েছে—

‘পিতৃযজ্ঞস্তু তর্পণম্‌।’ (মনু ৩/৭০)

পিতৃযজ্ঞকে তর্পণ বলা হয়েছে। সাধারণ হিন্দু মনে করে তর্পণ মানে মৃত পিতাকে পানি দেওয়া। মনুর শ্লোক থেকে ‘মৃত পিতার’ গন্ধও পাওয়া যায় না। এই শ্লোকের ভাষ্য করে কুল্লুক ভট্ট লিখেছেন—

‘অন্নাদ্যেন উদকেন বা ইতি তর্পণ বক্ষ্যতি স পিতৃযজ্ঞঃ।’

অর্থাৎ, তর্পণে অন্ন এবং পানি দেওয়ার বিধি আগের শ্লোকগুলোতে বলা হবে, এটিই ‘পিতৃযজ্ঞ’। যেটি বিষয়ে ‘বক্ষ্যতি’ (আগে বলব) লেখা, সেই শ্লোক হলো—

‘কুর্যাধরঃ শ্রাদ্ধমন্নাহেনোদকেন বা। পয়োমূলফলৈর্বাপি পিতৃভ্যঃ প্রীতিমাভহন্‌॥’ (৩/৮২৯)

অর্থাৎ, পিতাদের প্রীতিপূর্বক ডেকে খাওয়া, পানি, দুধ, মূল ফল দিয়ে প্রতিদিন শ্রাদ্ধ করা। এই শ্লোক থাকার পর কেউ বলতে পারবে কি এখানে মৃত পিতাদের প্রতিদিন ডাকার বিধান আছে? এই দুই শ্লোক এবং কুল্লুকের মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, তর্পণ মানে শ্রাদ্ধই। একটি শ্লোকে তর্পণ, অন্যটিতে শ্রাদ্ধ। মূল কথা হলো—মাতাপিতাকে প্রীতিপূর্বক ডেকে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা। ‘অন্নাদ্যেন উদকেন’ মানে ‘খাওয়া ও পানি’। ‘অন্নাদ্য’ বৈদিক গ্রন্থের পরিচিত শব্দ, যা এই অর্থে ব্যবহৃত হয়। মৃত পিতাদের প্রীতিপূর্বক ডাকা কোনো অর্থহীন, তারা তো আসতেই পারে না। বৈদিক তত্ত্ব অনুযায়ী তাদের পুনর্জন্ম হয়, যারা পুনর্জন্ম বিশ্বাস করেন না, তারাও মৃত আত্মার কিছু না কিছু অবস্থান মেনে নেন। তাদের মতে মৃতকে ডাকা অসম্ভব।

মৃতকে পিণ্ডদান প্রথার সূচনা বিদেশ থেকে—মৃতকে খাওয়া-দাওয়া দেওয়ার প্রথা কোথা থেকে শুরু, বলা কঠিন। সাধারণভাবে প্রথা অনেক পুরনো মনে হয়। দুই সহস্র বছর আগেরও। তাই সমসাময়িক সাহিত্যেই এর উদাহরণ আছে। প্রাণীর মৃত্যু পরবর্তী আত্মার গতিবিধি নিয়ে প্রাচীন মিশর ইত্যাদি দেশে ভিন্ন মত। আত্মার সঙ্গে প্রেম করতে করতে মানুষ শরীরকেও ভালোবাসে। এই শরীরের প্রেমের কারণে মৃতদেহকে সম্মান প্রদানের প্রথা গড়ে ওঠে। বৈদিক তত্ত্ব ছিল—

‘ভসমান্ত শরীরম্‌।’ (যজুর্বেদ ৪০/৫২)

অর্থাৎ, মরার পর লাশকে দাহ করা উচিত। মনু ২/৬-এও একই কথা পাওয়া যায়। এটি সর্বোত্তম উপায়, কারণ পাঁচ-ভৌত শরীরকে পচে-গলে না ছাড়াই ধ্বংস করার অন্য কোনো পদ্ধতি নেই। তবে যারা মৃতদেহ সংরক্ষণ করতে চেয়েছিল, যেমন বান্দর মৃত শিশুকে আলিঙ্গন করে রাখত, মৃতদেহ সংরক্ষণের নানা রীতি প্রচলিত হয়। মিশরে লাশের ভিতরে মসলার ব্যবহার করে শরীরের উপরের অংশ রক্ষা করা হত। কেউ মনে করত, মৃতের আত্মার জন্য পরলোক-যাত্রায় খাবার-দাবার রাখা প্রয়োজন। যেমন যাত্রায় মানুষের সঙ্গে খাবার নেয়া হয়, তেমনি লাশের সঙ্গে খাবার বা পিণ্ড রাখা শুরু হয়।

‘পিণ্ড’ শব্দের মূল অর্থ—‘পিণ্ড’ শব্দের মূল অর্থ (জীবিতের জন্য) হলো খাদ্য। যেমন নিচের উদাহরণে দেখা যায়—

১. ‘তথেতি গামুক্তবতে দিলিপঃ সদ্য প্রতিষ্টম্ভবিমুক্তবাহুঃ। স न्यস্তশস্ত্রো হরয়ে স্বদেহমুপানয়ত্‌ পিণ্ডামিভামিষস্থ॥’ (রঘুবংশ ২/৫৯)

২. ‘ন শোচ্যস্তত্র ভবান্‌ সফলাকৃতভার্তূং পিণ্ডঃ।’ (মালবিকারিমিত্র অঙ্ক-পঁচ)

৩. ‘লাডূলচালনমধশ্চরণাওপাৎ ভূমৌ নিপত্য, পদর্শন চ। ইভা পিণ্ডদস্য কুরুতে গজপুড্গবস্তু ধীরং বিলোকয়তি চাটুশৈঃ।’ (ভার্তহীরি নীবিশবক ৩৭)

যখন লাশের সঙ্গে পিণ্ড রাখা হতো, তখন তারা যাচাই করত না যে আত্মা যদি যাত্রায় চলে যায়, তবু লাশের সঙ্গে থাকবে কি না। লাশের সঙ্গে খাবার রাখার অর্থ কী? মৃত্যু পরবর্তী আত্মা যেখানে যায়, কমপক্ষে এটুকু স্বীকার করতে হয় যে তার শরীরের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন। জীবন ও মৃত্যুতে পার্থক্য কী? যতক্ষণ জীবিত, শরীরের সঙ্গে আছে, জীবন। ছাড়লেই মৃত্যু। এইভাবে মৃতদেহের সঙ্গে খাবার বা পিণ্ড রাখা অর্থহীন। তবে মানুষের মোহ থাকে। অজ্ঞতার কারণে মৃত্যু ব্যর্থ মনে হয়, মৃতদেহকে ভালোবাসা শুরু হয়। কবরের ওপর ফাতিহা পাঠের প্রথাও এই অজ্ঞতার প্রতীক। কবরের ওপর চাদর দেওয়া আত্মা সেখানে লেগে আছে ভেবে মানুষ মনে করে। পিণ্ডের এই মূল অর্থ পরে পরিবর্তিত হয়ে মৃতকের নামে আটা-পিণ্ডের অর্থে ব্যবহৃত হয়।

সাধারণভাবে তিন প্রজন্ম পর্যন্ত শ্রাদ্ধ করা হয়। এটাও দেখায় যে জীবিত পিতামহ ইত্যাদির শ্রাদ্ধ-তর্পণই বিকৃত হয়ে এই রূপ পেয়েছে। লিঙ্গ-শরীরকে এই তিন প্রজন্ম পর্যন্তই উপকারে ধরা হয় এবং পুনর্জন্মের জন্য এই সময় ধরে রাখা হয়—এটি একটি সমস্যা যা মৃতক-শ্রাদ্ধের ছলকে এগোতে দেয় না।

পুত্র কীভাবে নরক থেকে রক্ষা করে?—কিছু লোক ‘পুত্র’ শব্দের ব্যুৎপত্তি মৃতক শ্রাদ্ধের পক্ষে নিয়েছে। ‘পুত্র’ অর্থ ‘পুত্‌’, যা নরক থেকে উদ্ধার করে। এ নিয়ে বলা হয়, পুত্র যখন শ্রাদ্ধ করবে, তখনই পিতা নরক থেকে মুক্তি পাবে। যদি কারো পুত্র শ্রাদ্ধ না করে, তবে তার নরক থেকে রক্ষা সম্ভব নয়। কিন্তু এই ধারণা করা লোকেরা কর্মের নীতি বোঝে না। মনিয়ের উইলিয়ামস এই বিষয়ে একটি প্রখর মন্তব্য দিয়েছেন—

“এটি হিন্দু ধর্মের নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত যে শ্রাদ্ধের মাধ্যমে মানুষ নিজ কর্মের ফসল থেকে বাঁচতে পারে, কারণ মনু ৪/১৭৩-এ লিখেছেন যে একবার করা পাপ বীজের মতো ফল আনা থেকে থেমে থাকে না। তবে হিন্দু ধর্ম এই ধরনের পরস্পরবিরোধে ভরা।”

বাস্তবত, এটি ঠিক। যখন মানুষ নিজের কর্ম অনুযায়ী অন্য যোনি পায়, তখন তার পুনর্জন্মকে সন্তানের কর্মের অধীনে রাখা কোথায় ন্যায়সঙ্গত?

পাঠকরা হয়তো বলবেন, তাহলে পুত্রকে নরক থেকে রক্ষাকারী কেন বলা হয়েছে? ইয়াস্কের নৃপকোষে ‘পুত্র’-এর এই ব্যুৎপত্তি কি নেই? আমাদের উত্তর—ব্যুৎপত্তি ঠিক আছে, কেবল বোঝার ভুল আছে। প্রথমে, ধারণা বিভ্রান্তিকর যে ‘পুত্র’ কেবল ছেলেকে বোঝায়, ‘মেয়েকে’ নয়।

ইয়াস্কের নিরুক্ত কোষে এই শ্লোক আছে—

‘অবিশেষেণ পুত্রাণাং দায়ো ভবতি ধর্মতঃ। 

মিথুনানাং বিসর্গাদৌ মনুঃ স্বায়ম্ভুভোদব্রবীত্॥’ (৩৫৫)

অর্থাৎ, ধর্ম অনুযায়ী ছেলে-মেয়ে উভয়ই সমানভাবে অংশ পায়। এ কথা স্বায়ম্ভু মনু বলেছেন। দ্বিতীয়ত, সন্তানের নরক রক্ষার অর্থ—সন্তান উৎপত্তি করে এবং তার যথোচিত পালন করে মানুষ পিতৃ-ঋণ থেকে মুক্তি পায়। ঋণ মেটানো ছাড়া মুক্তি অর্জন কঠিন। সন্তানকে ধর্মনিষ্ঠ ও শিক্ষিত রেখে যাওয়া মৃতের আত্মার জন্যও লাভজনক। কারণ পিতা মারা গেলে জন্ম নেবে সেই বাড়িতেই, যেমনটি ছেড়ে গেছে। যদি সন্তান অধর্মী ও অশিক্ষিত হয়, তবে সমাজের অবস্থা খারাপ হবে, আর নতুন জন্মগ্রহণকারী আত্মাকে এই খারাপ সমাজ-নরক রূপী পরিবেশে পড়তে হবে, যা তার পরবর্তী উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করবে। তাই বলা যায়, সন্তান মানুষকে নরক থেকে রক্ষা করে; তবে মৃতকে পিণ্ড দিয়ে নয়, বরং উত্তম সন্তানরূপী মহাযজ্ঞের মাধ্যমে সামাজিক পরিবেশ শুদ্ধ করার দ্বারা। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে মনিয়ের উইলিয়ামস হিন্দু ধর্মে এত বিরোধ দেখতেন না। তবে যখন হিন্দুরা নিজেরাই তাদের নীতি বিকৃত করে ফেলেছে, তখন বিদেশীদের কী দোষ?

ভারতে এই প্রথা কখন থেকে?—ভারতে এই প্রথার সময়কাল সন্দেহজনক। ভারতবাসীরাও পুনর্জন্ম বিশ্বাস করত এবং এখনো করে। বৌদ্ধ ও জৈন মতের লোকেরা বৈদিক ধর্ম মেনে চলা ত্যাগ করেছিল, তবে পুনর্জন্মে তারা একইভাবে বিশ্বাস রাখত। অন্য দেশগুলোর প্রাচীন ইতিহাসও পুনর্জন্মের সাক্ষ্য দেয়, তবে পরবর্তী লোকেরা পুনর্জন্মের নীতি ত্যাগ করে মৃত আত্মার বিভিন্নভাবে পূজা করতে শুরু করে। এ কথা প্রমাণিত পূর্ব ও পশ্চিম দেশগুলোর ইতিহাস থেকে।

বৌদ্ধধর্ম যখন চীন, জাপান, বার্মা ইত্যাদি দেশে প্রচার পেল, তখন বৌদ্ধরাও মৃত প্রাণীর আত্মার উপাসক হল। মহাত্মা বুদ্ধের মৃত্যুর পর তাদের উপাসক তাকে পূজা করতে লাগল। এই পূজা মানে মৃতের আত্মার উপাসনা। এইভাবে ভারতের এই প্রথার প্রচলন মূলত বৌদ্ধধর্মের অবদান। এর একটি চিহ্ন—ভারতের বিভিন্ন তীর্থস্থান, যা বিভিন্ন কারণে প্রখ্যাত, বিশেষত গয়া, মৃতক-শ্রাদ্ধ ও তর্পণের জন্য। গয়া তীর্থের উল্লেখ বুদ্ধের আগে পাওয়া যায় না।

‘মনুস্মৃতি’-তে গয়ার উল্লেখ নেই। ‘যাজ্ঞবল্ক্য-স্মৃতি’-তে শ্রাদ্ধ-তর্পণ সম্পর্কিত গয়ার উল্লেখ আছে—

‘যদ্‌ দদাতি গয়াস্থচ হ সার্বমান্ত্যমশ্নুতে। তথাষত্রায়তদশ্যাং মদ্যাসু চ বিশেষতঃ।’ (যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি ৭/২৬৭৯২)

“যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি” স্পষ্টত বুদ্ধের অনেক পরে রচিত। আমাদের ধারণা, ‘গয়া’-এর খ্যাতি বুদ্ধই দিয়েছেন। যখন বৌদ্ধ ও পৌরাণিকদের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়, বৌদ্ধ পরাজিত ও পৌরাণিক বিজয়ী, তখন বৌদ্ধদের মন্দির তাদের হাতে চলে যায় এবং এখনও একইভাবে চলে আসছে। পৌরাণিক ধর্মের নতুন বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, প্রাচীন বৈদিক ধর্মের বিকৃত রূপে বৌদ্ধ ও জৈন মতের সংযোজন হলে ফল হয় পৌরাণিক মত। পৌরাণিক ও বৌদ্ধ, জৈন গ্রন্থে এই বাহ্যিক রূপে অনেক সাদৃশ্য আছে—দেব-দেবী, অবতার, মূর্তিগুলো, মন্দির, পূজ্য ব্যক্তির জন্ম ও আয়ু সংক্রান্ত কাহিনী সব মিলিত। এই যুগে বৈদিক গ্রন্থেও অনেক সংযোজন হয়েছে। আমাদের ধারণা, শ্রাদ্ধ ও তর্পণ মৃতদের জন্যের বিধান এই সংযোজনের ফল।

কিছু লোক বলেন, যদি সংযোজন হয়, তাহলে এর প্রমাণ এত বেশি দেখা যেত না। তারা দুটি বিষয় বিবেচনা করে না। প্রথম, বৌদ্ধ মতের প্রভাবে ভারতীয় জীবনের সব ক্ষেত্র জড়িত ছিল। দ্বিতীয়, এই যুগ প্রায় দুই সহস্রাব্দ ধরে। এত সময়ে জাতিগুলি নানা স্থানে পৌঁছে যায়। যদি গত কয়েক বছরের শুধুমাত্র হিন্দি সাহিত্য সমালোচনামূলকভাবে অধ্যয়ন করা হয়, ৫০ বছর আগে ও এখন নীতির মধ্যে বড় পার্থক্য দেখা যাবে। ইউরোপীয় সাহিত্যেও ১০০ বছর আগে বিবর্তনের চিহ্ন ছিল না। ডারউইনের পরে বিবর্তনবাদ সভ্য দেশের সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। তাই আশ্চর্য নয়, পিতৃযজ্ঞকে জীবিত পিতার পরিবর্তে মৃত পিতার জন্য নেওয়া হয়েছে।

মনুস্মৃতি-র শ্লোকটি লক্ষ্যণীয়—

‘একমপ্যাশয়েদ্‌ বিপ্রং পিত্রার্থ পাঞ্চযজ্ঞিকে। ন চেইভাত্রাশয়েত্‌ কঞ্চিদ্‌ বৈশ্বদেবং প্রতি দ্বিজম্‌॥’

অর্থাৎ—‘পঞ্চ-যজ্ঞ-সম্পর্কিত পিতৃযজ্ঞে একজন ব্রাহ্মণকেই খাদ্য দেওয়া যথেষ্ট, কিন্তু বৈশ্বদেবের ক্ষেত্রে কোনো ব্রাহ্মণকে খাবার দেওয়া উচিত নয়।’

এই শ্লোক এবং পরবর্তী অনেক শ্লোক মৃতক-শ্রাদ্ধের গৌরবের উদ্দেশ্যে যুক্ত করা হয়েছে এবং এই অধ্যায়ের শেষে এমন ঘৃণ্য পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়েছে, যা আজকের পৌরাণিকদেরও হতবাক করে এবং বলতে হয় যে ‘মনুস্মৃতি’ কালি যুগের জন্য নয়।

(৩) বর্ণ-সম্পর্কিত ব্যত্যয়—তৃতীয় সংযোজন বর্ণকে জন্ম অনুসারে নির্দিষ্ট করার সম্পর্কিত।

আজকাল হিন্দু জাতি বহু উপজাতিতে বিভক্ত। সবই জন্মের উপর নির্ভরশীল, অর্থাৎ ব্রাহ্মণের ছেলে ব্রাহ্মণ হয়, কন্যাকুব্জ ব্রাহ্মণের ছেলে কন্যাকুব্জ হয়, ক্ষত্রিয়ের ছেলে ক্ষত্রিয় হয়। অনুরূপভাবে নায়ের ছেলে নায়, কাহারের ছেলে কাহার। বৈদিক গ্রন্থে এই উপজাতির নাম নেই। হ্যাঁ, চারটি বর্ণের উল্লেখ আছে—ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র। হিন্দুদের মধ্যে জনশ্রুতি প্রচলিত যে ব্রাহ্মণ ঈশ্বরের মুখ থেকে জন্মেছে, ক্ষত্রিয় বাহু থেকে, বৈশ্য উরু থেকে এবং শূদ্র পা থেকে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো শিক্ষিত মানুষ ভাবেনি, এর অর্থ কী? ঈশ্বরের মুখ কী এবং সেখানে থেকে ব্রাহ্মণ কীভাবে জন্মালো? ঈশ্বরের পা কী এবং শূদ্র কীভাবে জন্মালো? এটি অলংকারিক ভাষা নাকি বাস্তব? যদি অলংকারিক, তবে অর্থ কী? যদি বাস্তব, তবে কীভাবে সম্ভব? কেউ বললে যে আকাশের মুখ থেকে হাতি জন্মেছে, তাহলে প্রশ্ন করতে হবে—আকাশের মুখ মানে কী এবং হাতি কীভাবে?

প্রাচীনকাল থেকে বলা হয়—ব্রাহ্মণ ঈশ্বরের মুখ থেকে, শূদ্র পা থেকে, কিন্তু কেউ জিজ্ঞাসা করেনি। মানুষ বলে, ‘বৈদিক গ্রন্থে লেখা আছে।’ যেই মন্ত্রের উদ্ধৃত প্রমাণ দেওয়া হয় তা বলছে—

‘ব্রাহ্মণোSস্য মুখমাসীত্‌ বাহূ রাজন্যঃ কৃতঃ।
উরূ তদস্য যৎ বৈশ্যঃ পদভ্যাঁ শূদ্রোজজায়ত।’ (যজু. ৩৭/৭)

শব্দার্থ—
(১) ব্রাহ্মণপঃ এর মুখ ছিল ব্রাহ্মণ।
(২) বাহূ রাজন্যঃ কৃতঃ—ক্ষত্রিয় বাহু তৈরি।
(৩) উরূ তদস্য যৎ বৈশ্যঃ—যে বৈশ্য সে উরু।
এতে লেখা নেই, ব্রাহ্মণ মুখ থেকে জন্মেছে, ক্ষত্রিয় বাহু থেকে এবং বৈশ্য উরু থেকে।

অর্থ খুঁজে বের করার দুটি উপায়—বা শব্দের সরাসরি অর্থ বা অলংকারিক অর্থ। যেকোনো শব্দকে অলংকারিকভাবে নেওয়া উচিত নয় যদি সরাসরি অর্থ প্রাসঙ্গিক হয়। এখানে ‘মুখ’ মানে মুখাত্‌ নয়, ‘আসীত্‌’ মানে জন্ম নেওয়া নয়। ‘উরূ তদস্য যৎ বৈশ্যঃ’—বৈশ্য উরু, এই ধাঁচে বলা হয়েছে।

এটি স্পষ্ট করে যে মুখ, বাহু, উরু বা পা থেকে মানুষ জন্মানো সম্ভব নয়। অতএব, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্রের বর্ণনা কেবল উপমা। উভাট ও মহীধরের ব্যাখ্যা অনুযায়ী—প্রশ্নোত্তর রূপে ব্রাহ্মণাদির সৃষ্টির কথন বলা হয়েছে।

অর্থাৎ—এই পুরুষ-সংঘ বা মানবজাতির মধ্যে ব্রাহ্মণ মানে জ্ঞানী ও সর্বোত্তম নেতা, ক্ষত্রিয় মানে শক্তিশালী রক্ষাকারী, বৈশ্য অর্থ ও সম্পদের সঞ্চয়কারী, শূদ্র নিম্নশ্রেণীর ব্যক্তি। ‘মনুস্মৃতি’-র শ্লোকও এটাই নির্দেশ করে—

‘বিপ্রাণাং জ্ঞানতো-জ্যৈষ্ঠ্যং ক্ষত্রিয়াণাং তু বীর্যতঃ।
বৈশ্যানাং ধান্যধনতঃ শূদ্রাণামেভ জন্মতঃ।’ (২/৫৫২)

অর্থাৎ—জ্ঞান, শক্তি, ধন এবং জন্ম অনুযায়ী শ্রেণিবিন্যাস। নীচের শ্লোকগুলোতে ব্রাহ্মণদের কর্তব্য—অধ্যাপন, অধ্যয়ন, যজন, যাজন, দান, প্রতিগ্রহ। ক্ষত্রিয়—প্রাণীর রক্ষা, দান, অধ্যয়ন। বৈশ্য—বাণিজ্য, কৃষি। শূদ্র—নিজের কর্ম।

‘মনুস্মৃতি’-র এই শ্লোক থেকে দেখা যায়—জাতি-পান্তির বর্তমান অবস্থার জন্য মনুকে দোষ দেওয়া ঠিক নয়। বর্তমান অবস্থা যারা সৃষ্টি করেছে, তাদের দোষ।

হ্যাঁ, যে রিয়ায়েত শুধুমাত্র উচ্চশ্রেণীর ব্রাহ্মণদের জন্য ছিল, তা সাধারণ ব্যক্তির উপর প্রয়োগ করা হয়েছিল এবং বর্ণের সত্যতা নষ্ট হয়েছিল। কিছু ব্রাহ্মণও ব্রাহ্মণসামান্যতাবাদে নিজের সুবিধার জন্য ঘৃণ্য নিয়ম তৈরি করেছিল। তবে এর সঙ্গে ‘মনুস্মৃতি’-র কোনো সম্পর্ক নেই।

(৪) দণ্ডবিধি সম্পর্কিত ব্যত্যয়—চতুর্থ বিষয় দণ্ডবিধি। মনুর দণ্ডবিধি সরল, সমতায়ুক্ত ও স্বাভাবিক। অপরাধীকে কঠোর শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্য—সমাজে অন্যায় না ছড়ানো। পরবর্তী সংস্কারকরা বা অতিমাত্রায় কঠোর বা অন্যায়পূর্ণ নিয়ম প্রয়োগ করেছে। শূদ্রদের জন্য অযথা কঠোর শাস্তি, এবং কোথাও কোথাও শ্লোকসহ ভ্রান্ত ব্যাখ্যা। ‘মনুস্মৃতি’-র এই কলঙ্ক দূর করতে এ ধরনের অবৈদিক স্থলকে ছাঁটাই করতে হবে।

মনু ও নারী—বৈদিক সভ্যতার বিরোধীরা বৈদিক সভ্যতার প্রতিটি গুণকে তুচ্ছ করতে চেয়েছে। এক আক্রমণ নারীর অধিকারকে নিয়ে। বলা হয়, মনু নারীর পদ অত্যন্ত নিম্ন। কিন্তু প্রকৃতভাবে—ঋত অনুযায়ী, মা ও বাবা সমান। রথের দুটি চাকার উপমা। ঋগ্বেদ মন্ত্র—

‘মাতা পিতরমৃত আভভাজ।’ (ঋ. ৭/৭৬৪/৮)

অর্থাৎ নারী ও পুরুষ সমানভাবে সৃষ্টি। মনু নারীর সুরক্ষার দায় তাঁর সম্পর্কীদের ওপর অর্পণ করেছেন। কোনো দোষ নেই। পিতা, স্বামী বা পুত্র দায় না নিলে অপরাধী। উদাহরণ—

‘কালেদদাতা পিতা বাচ্যো, বাচ্যশ্চানুপয়ন পতি:।
মৃতে ভর্তার্তু পুত্রস্তু বাচ্যো মাতৃক্ষিতা।’ (৯/৪)

অর্থাৎ—যে পিতা সময়মতো কন্যার বিবাহ না করল, যে স্বামী স্ত্রীকে রতি-সুখ না দিল, যে পুত্র পিতার মৃত্যুর পরে মাতাকে রক্ষা করল না, সে দোষী। এটি প্রমাণ করে না যে নারীকে পূর্ণ স্বাধীনতা না দেওয়া হয়েছে। সুরক্ষার জন্য দায় অর্পণ করা তার অধিকার। যদি নারী সম্পূর্ণ স্বাধীন হতো, সামাজিক বিপদ হতো।

অর্থাৎ—“মহিলাদের রক্ষা করার অর্থ এটি নয় যে তাদের বেঁধে রাখা হবে। এটি ঠিকই বলা হয়েছে। মনু এই বিপরীত নিয়মও করে দিয়েছিলেন যাতে রক্ষকরা এই ‘অতি’ করতে না পারেন। মনুস্মৃতি নিজেই বলে—

“ন কশ্চিদ্‌ যোশিতঃঃ শকতঃ প্রসহ্য পরিরক্ষিতুম্‌।” (9/70)

অর্থাৎ, কেউ জবরদস্তি করে মহিলাকে বেঁধে রাখার মাধ্যমে রক্ষা করতে পারবে না।

মনু শুধু মহিলাদের রক্ষা না করার জন্য পিতা, স্বামী ও পুত্রকে দোষী মনে করেননি, বরং বিভিন্ন অবস্থায় এক ব্যক্তির রক্ষার দায়িত্ব অন্যের উপরও দিয়েছেন, যেমন বিদ্বানের ক্ষুধার্ত মৃত্যুর জন্য রাজাকে দোষী মনে করা হয়। এর অর্থ এই নয় যে বিদ্বানকে রাজার অধীনে রাখা হয়েছে। আজকাল যেসব মহিলারা স্বচ্ছন্দতার আকাঙ্ক্ষী হচ্ছেন, তা শীঘ্রই তাদের চোখ খুলে দেবে, কারণ এটি তাদের জন্য ভয়ঙ্কর। শত শত মেয়েরা এই স্বচ্ছন্দতার কারণে সভ্য দেশগুলিতে অকথনীয় কষ্ট ভোগ করছে। প্রথমে তারা মিথ্যা স্বচ্ছন্দতার লোভে খুশি হয়, কিন্তু শীঘ্রই তাদের ভুল বোঝা পরিষ্কার হয়ে যায়।

দায়ভাগের প্রশ্ন— এখন দায়ভাগের প্রশ্ন। মানুষ অভিযোগ করে যে হিন্দু ধর্মে মহিলাদের নিজের পৈতৃক সম্পত্তি পাওয়া যায় না। এটি একটি মৌলিক প্রশ্ন এবং এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে চিন্তা করা উচিত।

মনুস্মৃতি বৈদিকমূলক, তাই প্রথমে দেখি এই বিষয়ে বেদ কি বলে—

ছেলে এবং মেয়ে দুজনই দায়ভাগের অধিকারী। এটি একটি ঋচা এবং একটি শ্লোকের মাধ্যমে স্পষ্ট করা হয়েছে—

“অড্ভরাদড্রাত্‌উ্‌ সম্ভাবসি হৃদযাদধিজায়সে। আত্মা ব্য পুত্রনামাসি স জীভ শরদঃ শতাম্‌॥”

অর্থাৎ, অঙ্গ-অঙ্গ থেকে উৎপন্ন হয় এবং হৃদয় থেকে প্রকাশ পায়। তাই হে পুত্র, তুমি আত্মা। একশো বছর পর্যন্ত বাঁচো। এখানে ‘পুত্র’ দ্বারা ছেলে এবং মেয়া দুজনকেই বোঝানো হয়েছে, কারণ দুজনই অঙ্গ-অঙ্গ থেকে উৎপন্ন হয়। মেয়ের উৎপত্তি এবং ছেলের উৎপত্তিতে কোনো পার্থক্য নেই।

শ্লোক থেকে খুব স্পষ্ট হয়—

“অবিশেষেণ পুত্রাণাং দায়ো ভবতি থর্মতঃ। মিথুনানাং বিসর্গাদাউ মনুঃ স্বায়ম্ভুভোউব্রভীত্‌॥” (নিরুক্ত 3/42)

অর্থাৎ, কোনো বিশেষতা ছাড়া ছেলে এবং মেয়ে (পুত্রাণাং মিথুনানাং) দায়ভাগের অধিকারী। সৃষ্টি শুরুর সময় স্বায়ম্ভুভ মনু এটি বলেছেন।

এ থেকে বোঝা যায় যে ইয়াস্কের সময় মনুস্মৃতি বা মনুর কোনো শিক্ষার ভিত্তিতে ‘পুত্র’ দ্বারা ছেলে এবং মেয়ে উভয়কেই বোঝানো হয়েছিল এবং দুজনেই দায়ভাগের অধিকারী ছিলেন। সংস্কৃতিতে লিঙ্গ শব্দের মাধ্যমে নয়, অর্থের মাধ্যমে নির্ধারিত। সম্ভবত পরে এই প্রসঙ্গে ‘পুত্র’ শব্দটি কেবল ছেলের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে এবং মেয়েরা দায়ভাগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

কিছু মানুষের ধারণা অনুযায়ী, সম্পত্তির ঝগড়া এড়াতে সব সম্পত্তি ধ্বংস করে দিলে দায়ভাগের ঝগড়া শেষ হবে। যত সম্পত্তি থাকবে, সেটা জাতি অনুযায়ী প্রয়োজন অনুযায়ী বিতরণ করবে। এই নীতি সুন্দর ও আকর্ষণীয়। কিন্তু সংস্কৃত প্রবাদ আছে—“দূরাদ্‌ হি पर्वতা রম্যা”— পর্বত দূর থেকে সুন্দর লাগে। যে বিষয়টি বাস্তবে প্রয়োগ করা যায় না, তার মীমাংশা থেকে কি লাভ? যারা বিভ্রান্তি পছন্দ করে, তারা তা অব্যাহত রাখুক। আমরা কারওকে মূর্খ স্বর্গের কামনা করতে পরামর্শ দিতে পারি না।

সম্পত্তি হল এমন একটি বস্তু, যার স্থাপন করার জন্য মানুষ তার বুদ্ধি, ক্ষমতা এবং শুভ গুণাবলীর উন্নয়ন করে। যদি এই কামনা না থাকে, তবে কয়েকজন সংযমী ব্যতীত বাকিরা উদাসীন, অলস, প্রমাদী ও বিষয়ে ভরা হয়ে যাবে। সম্পত্তি থাকায় যে অসুবিধা তৈরি হচ্ছে, তা বহু গুণের মাধ্যমে সমাধান হয়। চোখ ফেটে গেলে কখনও কখনও ব্যথা কমে, কিন্তু চোখ ফেটে দেওয়া ব্যথার চিকিৎসা নয়।

মনু সম্পত্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থা করেছেন—

(১) সম্পত্তি শুধুমাত্র ছেলেদের পাওয়া।
(২) মেয়েদের স্ত্রী-ধন দেওয়া। এতে সাধারণভাবে জাতির ক্ষতি হয় না, কারণ মেয়ে তার স্বামীর ঘরে গেলে সে তার স্বামীর সম্পত্তির মালিক হয়। একইভাবে তার পিতার সম্পত্তি যা তার ভাই পেয়েছে, তার স্বামীর পরিবারের মালিকানায় চলে যায়। এতে সম্পত্তির টুকরো ভাগ হয় না, পরিবারে একক বিয়ে বাধ্যতামূলক হয় না, এবং মেয়েরা তাদের স্বত্ব থেকে বঞ্চিত হয় না। যেখানে বড় বড় সম্পত্তি আছে, যেমন রাজ্য, সেখানে আলাদা নিয়ম প্রয়োগ করা হয়।

পুত্র না থাকলে ‘পুত্রিকা’ নিয়ম প্রয়োগ করা হয়। ইয়াস্ক বলেন—

“অভ্রাতৃমতী ভাষ ইত্যপরম্‌।”

অর্থাৎ, যার ভাই নেই তার জন্য আলাদা নিয়ম আছে। মনুস্মৃতিতে লেখা আছে—

“অপুত্রৌনেন বিধিনা সুতাং করবীত পুত্রিকাম্‌। যদাপত্যং ভবেদাস্যাং তন্মম স্যাৎ স্বধাকারম্‌॥” (9/727)

অর্থাৎ, যার পুত্র নেই এবং সম্পত্তি আছে, সে তার মেয়েকে পুত্রিকা বানাবে। পুত্রিকা হল সেই মেয়ে, যিনি বিবাহের পর স্বামীর ঘরে যায় না, বরং স্বামী তার কাছে থাকে, এবং তার সন্তানরা দাদার সম্পত্তির অংশীদার হয়।

“যথে আত্মা এবং পুত্রঃ পুত্রেṇa দুহিতা সমা। তস্যামাত্মনি তিষ্ঠন্ত্যাং কতমন্যো ধন হরেৎ॥” (9/7302)

অর্থাৎ, যেমন স্বাভাবিকভাবে পুত্র। পুত্রের সমান পুত্রিকা। তার উপস্থিতিতে অন্য কেউ ধন নিতে পারবে না।

শ্রুতিগুলি প্রমাণ করে যে স্মৃতির দিক থেকে মহিলাদের কোনো অধিকার রাখা হয়নি এমন ধারণা ভুল। মনুস্মৃতি দায়ভাগের ক্ষেত্রে প্রথম শ্লোক—

“ঊর্ধ্ব পিতুৱেচ মাতুৱেচ সমেত্য ভ্রাতরঃ সমম্‌। ভজেরন্‌ পৈতৃক রিখথমনীশাস্তে হি জীভতোঃ॥” (9/704)

অর্থাৎ, পিতা ও মাতা দুজন মারা গেলে ভাইদের পৈতৃক সম্পত্তি সমান ভাগে বণ্টন করতে হবে। জীবিত অবস্থায় পুত্রদের কোনো অধিকার নেই। ‘মাতুশ্চ’ শব্দে প্রকাশ পায় যে মায়ের জীবদ্দশায় মেয়ে অধিকর্তা। ‘অনীশাস্তে হি জীভতোঃ’ দ্বিবচনে এসেছে, অর্থাৎ মায়ের জীবদ্দশায় ছেলেদের কোনো অধিকার নেই।

এবং—

“অনপত্যস্য পুত্রস মাতা দায়ম্‌ অবাপ्नुয়াত্‌। মাতারপি চ বৃত্তায় পিতুর ধন মতা হরেৎ ধনম্‌॥” (9/727)

অর্থাৎ, যদি পুত্রহীন ব্যক্তি মারা যায়, তার সম্পত্তি মায়ের হবে। মা না থাকলে দাদি নেবে।

“জনন্যাং সংস্থিতায় তু সমম্‌ সর্বে সহোদরাঃ। ভজেরন্‌ মাতৃক রিখং ভাগিন্যাচ্‌ সনাভয়ঃ॥” (9/7922)

অর্থাৎ, মায়ের মৃত্যুর পর সব ভাইবোনরা মায়ের সম্পত্তি ভাগ করে নেবে।

এছাড়াও, নাতি-নাতনীদের কিছু অংশ প্রীতিপূর্বক দেওয়া উচিত—

“যাস্তাসাং স্যুর্দুহিতরস্তাসমপি যথাহীতঃ।” (9/795)

অর্থাৎ, মেয়েদের যদি মেয়েরা থাকে, তাদেরও দাদীর সম্পত্তির কিছু অংশ দেওয়া উচিত।

মহিলাদের জন্য পৃথক ধন প্রয়োগ করা হয়েছে এবং এটি পিতার বা ভাইয়ের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল নয়। স্বেচ্ছায় দেওয়া হয়—

“স্বেব্যস্তু কান্যাভ্যঃ প্রদদ্যুর রাতারঃ পৃথক। স্বাত্‌ স্বাদংশ চতুর্ভাগং পতিতাঃ স্যুরদৎসবঃ।” (9/778)

অর্থাৎ, মনু মহিলাদের জন্য স্বতন্ত্র ধন নির্ধারণ করেছেন।

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

ঋগ্বেদ ১০/১৯১/১

সংসমিদ্যুভসে বৃষন্নগ্নে বিশ্বান্যর্য আ।  ইळস্পদে সমিধ্যসে স নো বসূন্যা ভর॥ ঋগ্বেদ ১০।১৯১।১ স্বামী ব্রহ্মমুনি পরিব্রাজকৃত পদার্থ ভাষ্যঃ (বৃষণ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ