ভূমিকা
যখন থেকে মানুষ এই পৃথিবীতে জন্মেছে, তখন থেকেই ঈশ্বর তত্ত্বের বিষয়ে কৌতূহল রেখেছে আর বেশিরভাগ মানুষ ঈশ্বরকে কোনো-না-কোনো প্রকারে মেনেও আসছে। বৈদিক মত, যেটা মহাভারত কাল পর্যন্ত এই পৃথিবীতে একমাত্র সত্য এবং সার্বকালিক ধর্মের রূপে প্রচলিত ছিল, সেটা ঈশ্বর তত্ত্বের সুন্দর ও বৈজ্ঞানিক স্বরূপ প্রস্তুত করতো। মহাভারত যুদ্ধের পশ্চাৎ বৈদিক ধর্মের পতন হতে-হতে ভূমণ্ডলে অনেক মত-মতান্তরের জন্ম হয় আর সেগুলো ঈশ্বর তত্ত্বের সত্য স্বরূপের স্থানে নিজ-নিজ কল্পনা অথবা বেদের কিছু মন্ত্রের সত্যার্থকে না বুঝতে পারার কারণে নানা প্রকারের ঈশ্বরের বিভিন্ন মান্যতার প্রচার করে। নানা কল্পিত ঈশ্বরের মান্যতা এই সংসারের মধ্যে পরস্পর বিরুদ্ধ অনেক কল্পিত মত-সম্প্রদায়ের জন্ম দেয়। এগুলোর মধ্যে অনেক মত অন্য মতের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াবশতঃ উৎপন্ন হতে থাকে।
.সংসারের মধ্যে চার্বাক, বৌদ্ধ ও জৈন আদি নাস্তিক মত কিছু কল্পিত ঈশ্বরবাদী মতের পশুবলী আদি পাপের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াস্বরূপ উৎপন্ন হয়। অন্যদিকে ইসলাম আদি মত বিকৃত বৈদিক ধর্মের ভ্রান্ত ধারণা যেমন - মূর্তিপূজা, বহুদেবতাবাদী আদির প্রতিক্রিয়াবশতঃ উৎপন্ন হয়। শিখ আদি কিছু মত সামাজিক সম্প্রীতি ও মত-মতান্তরের একতার উদ্দ্যেশে চালানো হয়। সারাংশ এই হল যে ভূমণ্ডলের মধ্যে সর্বমান্য একমাত্র সত্য সনাতন বৈদিক মতের স্থানে হাজার-হাজার মত-মতান্তর উৎপন্ন হয়ে যায় আর সম্পূর্ণ মানবতা খণ্ড-খণ্ড হয়ে যায়। নিজ-নিজ অন্ধ আস্থার আধারে নানা ঈশ্বরের পূজা নানা প্রকারে এই সংসারের মধ্যে হচ্ছে, তো কেউ-কেউ ঈশ্বরের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করছে। ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকারকারী চার্বাক, জৈন ও বৌদ্ধ মতের দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে কোনো বিশেষ গুরুত্ব নেই, তবে জৈন মতের কিছু বিদ্বান ও বৈজ্ঞানিক জৈন দর্শনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার খুব চেষ্টা করতে দেখা যায়।.বর্তমান বিকশিত বিজ্ঞানের নিতান্ত ভোগবাদী প্রবাহ ধর্ম ও ঈশ্বরের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছে। এই চ্যালেঞ্জকে স্বীকার করার সামর্থ্য ঈশ্বরবাদী মত যথা পৌরাণিক মত®, ঈসাই, ইসলামী, শিখ, ইহুদী আদি কারও কাছে দেখা যায় না। এটাই হল কারণ যে এইসব মতের দৃঢ় অনুগামীরাও বর্তমান বিজ্ঞানের সাজসজ্জায় প্রভাবিত হয়ে পাশ্চাত্য ভোগবাদী বিচারধারার প্রবাহে তীব্র বেগে বয়ে যাচ্ছে। শাস্ত্রের গম্ভীর অধ্যয়নের অভাবে আর্যসমাজেরও এই দুরবস্থা হয়ে গেছে। সব ঈশ্বরবাদী মত নিজ-নিজ কর্মকাণ্ডের নির্বহন করছে বলে যদিও মনে হয়, কিন্তু ভিতরে-ভিতরে ঈশ্বরের প্রতি অবিশ্বাসে ভরে যাচ্ছে। কিছু কট্টরপন্থী ব্যতীত অধিকাংশ ঈশ্বরবাদী নিজ-নিজ শাস্ত্রের না তো গম্ভীর অধ্যয়ন করে আর না সেগুলোর উপর দৃঢ়তাপূর্বক বিশ্বাস করে।.আমেরিকা বা ইউরোপ আদি দেশ যদিও সারা সংসারে ঈসাই (ক্রিশ্চিয়ান) মিশনারী পাঠিয়ে ঈসাইকরণের ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে, কিন্তু ভিতরে-ভিতরে সেখানকার যুব প্রজন্ম বাইবেলের শিক্ষা থেকে দূরে সরে গিয়ে আধুনিক ভোগবাদীর জলাশয়, যেটা বাইবেলের শিক্ষার পুরোপুরি বিপরীত, তারমধ্যে পূর্ণ রূপে ফেঁসে গেছে। ইসলামী দেশের মধ্যেও এইরকম হাওয়া বইছে। যারা কট্টরবাদী আছে, তারা কুরআনের প্রতি কট্টরবাদী হওয়া সত্ত্বেও আধুনিকতা থেকে বাঁচতে পারছে না। তারা নিজের কল্পনাপ্রসূত জিহাদের আবেশে কুরআনকেও যথাযথ ভাবে বুঝতে পারছে না। তারা কেবল ক্রূরতাপূর্বক হিংসা আর রক্তপাতকেই ঈশ্বরীয় আদেশ মেনে সম্পূর্ণ সংসারকে আতঙ্কিত করতেই নিজেদের জন্নত মনে করছে। তথাকথিত হিন্দু বেদ, শাস্ত্র ঈশ্বরের নামে মূর্তিপূজা, অবতারবাদ, অস্পৃশ্যতা, ঘৃণা, নারী-শোষণ আদি পাপকে শতাব্দী ধরে চালিয়ে বৈদিক সত্য সনাতন ধর্মের নাশ করেছে।.বেদের স্থানে নানা কল্পিত গ্রন্থ, তথাকথিত ধর্মগুরু ও অবতারের ধারণার কারণে বৈদিক ধর্ম ও সংস্কৃতির ভয়ংকর বিকৃত রূপ প্রচলিত হয়ে যায়। হিন্দুদের মধ্যে ঈশ্বরের পরিস্থিতি সর্বাধিক হাস্যাস্পদ, বিকৃত, মূর্খতাপূর্ণ ও ভয়ংকর আছে। এখানে যেকোনো চালাক ব্যক্তি স্বয়ংকে ঈশ্বরের অবতার ঘোষিত করে সাধারণ জনগণকে ঠকাতে পারে। শুধু মানুষই নয়, অপিতু পশু, পক্ষী, সরীসৃপ আদিও এই অভাগা ভারতে ঈশ্বরের অবতার মানা হয়েছে। আজ ঈশ্বর ও ধর্মকে কেবল আস্থা ও বিশ্বাসের বিষয় ধরে নেওয়া হয়েছে, এই কারণে কোটি-কোটি মানুষের আস্থাগুলো সংঘর্ষ করছে, একে-অপরের রক্তপাত করছে। এই সংসারে যত রক্ত ঈশ্বর ও ধর্মের নামে ঝরেছে, ততটা সম্ভবতঃ অন্য কারণে ঝরেনি। অস্তু।___________________® বৈদিক ধর্মের বিকৃত রূপ, যাকে আজ হিন্দু বা সনাতন ধর্ম নাম দেওয়া হয়। ঈশ্বরের অস্তিত্বের বৈজ্ঞানিকতা
এখন
আমরা ঈশ্বর তত্ত্বের উপর নিষ্পক্ষ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি দিয়ে বিচার করবো। আমি সংসারের সকল ঈশ্বরবাদীর কাছে প্রশ্ন করতে চাইবো যে ঈশ্বর নামক কোনো পদার্থ সত্যিই কি এই সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান আছে নাকি নেই? যেমন কোনো অজ্ঞানী ব্যক্তিও সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবী, জল, বায়ু, অগ্নি, নক্ষত্র, আকাশগঙ্গা, বনস্পতি এবং প্রাণীর অস্তিত্বের উপর কোনো শঙ্কা করবে না, তেমনই এইসব বাস্তবিক পদার্থের মূল নির্মাতা ও সঞ্চালক ঈশ্বর তত্ত্বের উপর সকল ঈশ্বরবাদী শঙ্কা বা সন্দেহ হতে রহিত কি? সংসারের বিভিন্ন পদার্থের অস্তিত্ব ও স্বরূপ কি কোনো আস্থা ও বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে? যদি তা না হয়, তাহলে এই পদার্থগুলোর নির্মাতা বলে পরিচিত ঈশ্বর কেন কারও আস্থা ও বিশ্বাসের আশ্রয়ের উপর নির্ভর করবে? আমাদের আস্থা না থাকলে কি ঈশ্বর থাকবে না?
.
আমাদের আস্থা দিয়ে সংসারের ছোট থেকে ছোট পদার্থও না তো তৈরি হতে পারে আর না আস্থা সমাপ্ত হলে কোনো পদার্থের অস্তিত্ব নষ্ট হতে পারে, তাহলে আমাদের আস্থা দিয়ে কেন ঈশ্বর তৈরি হতে পারে আর কেন আমাদের আস্থা সমাপ্ত হলে ঈশ্বর লুপ্ত হতে পারে? আমাদের আস্থা দিয়ে কি সৃষ্টির কোনো পদার্থের স্বরূপ পরিবর্তন হতে পারে? যদি তা না হয়, তাহলে কেন আমরা নিজ-নিজ আস্থার কারণে ঈশ্বরের রূপ পরিবর্তনের কথা বলি? সংসারের সমস্ত ভৌতিক ক্রিয়ার বিষয়ে কোত্থাও কারও বিরোধ নেই, কোথাও আস্থা বা বিশ্বাসের বৈশাখীর আবশ্যকতা নেই, তাহলে ঈশ্বরকে কেন এমন দুর্বল ও অসহায় করা হল, যা আমাদের আস্থায় বিভাজিত হওয়া মানব আর মানবের মাঝে বিরোধ, হিংসা ও দ্বেষকে বাড়িয়ে তুলছে।
.
আমরা সূর্যকে একটা মানতে পারি, পৃথিবী আদি লোক এবং নিজ-নিজ শরীরকে এক সমান মেনে আধুনিক ভৌতিক বিদ্যাকে মিলেমিশে পড়তে ও পড়াতে পারি, তাহলে আমরা ঈশ্বর আর তাঁর নিয়মকে এক সমান মেনে পরস্পর মিলেমিশে কেন থাকতে পারি না? আমরা ঈশ্বরের তৈরি সৃষ্টি এবং তাঁর নিয়মের উপর বিনা কোনো পূর্বাগ্রহে প্রেমপূর্বক বার্তালাপ ও তর্ক-বিতর্ক করি, তাহলে কেন এই সৃষ্টির রচয়িতা ঈশ্বর তত্ত্বের উপর কোনো চর্চা বা তর্ক করতে ভয় পাই? কেন সামান্য মতভেদ হওয়া মাত্র ফতবা জারি করে দেওয়া হয় আর কেন অগ্নিসংযোগ বা হিংসার উপর উতারু হয়ে যায়? সৃষ্টির নির্মাতা ঈশ্বর তত্ত্বের অস্তিত্ব কি কারও শঙ্কা ও তর্ক মাত্র দ্বারাই কেঁপে উঠবে অথবা মুছে যাবে?
.
যদি ঈশ্বর তর্ক, বিজ্ঞান বা বিরোধী পক্ষের আস্থা ও বিশ্বাস তথা নিজের পক্ষের অনাস্থা ও অবিশ্বাস দ্বারা মুখে যায়, তাহলে এমন ঈশ্বরের মূল্য কি হবে? এমন পরজীবী, দুর্বল ও অসহায় ঈশ্বরের পূজা করে কি লাভ হবে? তাঁকে কেন মানা হবে? কেন সেই কল্পিত ঈশ্বর আর তাঁর নামে প্রচলিত কল্পিত ধর্মে ব্যর্থ মাথাঠুকে ধন, সময় ও শ্রমের অপব্যয় করা হবে?
.
ঈশ্বরপ্রসূত ভৌতিকীর নিয়ম
আমার প্রবুদ্ধ পাঠকগণ! একটু ভাবুন, যদি ঈশ্বর নামক কোনো সত্তা বাস্তবে সংসারে বিদ্যমান থাকে, তাহলে সে আমাদের বিশ্বাস ও আস্থার সাহায্যে জীবিত থাকবে না। সেই সত্তা নিরপেক্ষ রূপে যথাযথ বিজ্ঞানের দ্বারা জানার যোগ্যও হবে। তাঁর একটা নিশ্চিত স্বরূপ হবে, তাঁর নিশ্চিত নিয়ম হবে। ঈশ্বরের ভৌতিক নিয়মের বিষয়ে রিচার্ড পি. ফাইনম্যান বলেছেন -
"We can imagine that this complicated array of moving things which constitutes "the world" is something like a great chess game being played by the Gods, and we are observers of the game. We do not know what the rules of the games are, all we are allowed to do is to watch the playing. Of course, if we watch long enough, we may eventually catch on to a few rules. The rules of the game are what we mean by fundamental physics." (Lectures on Physics, Pg.13)
.
এর মানে হল এই সংসার নিশ্চিত নিয়মে তৈরি হয়েছে ও চলছে। সেই নিয়ম ঈশ্বর দ্বারা তৈরি করা হয়েছে আর তিনি সেগুলোকে জারি করে এই সংসারের নির্মাণ করেছেন ও চালাচ্ছেন। বৈজ্ঞানিক সেই অসংখ্য নিয়মের মধ্যে কয়েকটাকে জানতে তো পারবে মাত্র, কিন্তু সেগুলোকে বানাতে বা জারি করতে পারবে না। এখানে ফাইনম্যান একটা ভারী ভুল অবশ্য করেছেন, সেটা হল "গড" (God) -এর স্থানে "গডস্" (Gods) লিখেছেন। যদি নিয়ম নির্মাতা অনেক "গডস্" হয়, তাহলে সেই নিয়মগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য থাকবে না। সব "গডস্" - এর সমন্বিত ও নিয়ন্ত্রণকারী অন্য কোনো "সুপ্রিম গড" -এর অস্তিত্বকে মানতে হবে আর ভৌতিকীর মূলভূত নিয়মের নির্মাতা একটাই "গড" হবে।
.
ধ্যান দিবেন, এই "গড" বাইবেলের "গড" নয়, বরং এমন ঈশ্বর, যাঁর স্বরূপ বেদাদি শাস্ত্রের মধ্যে বর্ণিত আছে। তাঁর নিয়ম সর্বত্র কাজ করছে। সবকিছ নিয়মবদ্ধ ভাবে আছে। ভৌতিকীতে অনেক স্থিরাঙ্ক সর্ববিদিত আছে, এগুলোর স্থিরতাই বলে দেয় যে কেউ সৃষ্টিকে পূর্ণ রূপে নিয়মবদ্ধ বানিয়েছে। সমস্ত কণা আর লোকের দূরত্ব ও গতি, সেগুলোর বল, দ্রব্যমান, আবেশ আদি সব কিছু স্থির আছে। উচ্ছৃঙ্খল ভাবে কখনও স্থিরতা হওয়া সম্ভব নয়। যদি এগুলোর মধ্যে কোনো একটা স্থিরাঙ্ক কিঞ্চিৎ পরিমাণও পরিবর্তিত হয়, তাহলে সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ড তছনছ হয়ে যেতে পারে। এর পরেও যদি কেউ এমন বলে যে সব কিছু উচ্ছৃঙ্খল ভাবে হচ্ছে, তাহলে সেই ব্যক্তি হয় জড় বুদ্ধির হবে অথবা সে কোনো দুষ্ট প্রয়োজনে বশীভূত হয়ে একগুঁয়ে হয়ে আছে।
.
এখন আমরা বিচার করবো যে সেই ঈশ্বরের ভৌতিক নিয়মই মূলভূত ভৌতিকী বিজ্ঞান নামে পরিচিত। এই বিজ্ঞানের উপরই সম্পূর্ণ ভৌতিক বিজ্ঞান, খগোল, রসায়ন, জীব, বনস্পতি, ভূগর্ভ, প্রযুক্তি, মেডিক্যাল সায়েন্স আদি সব শাখা আশ্রিত। মূলভূত ভৌতিকী বিনা সংসারে বিজ্ঞানের অস্তিত্বই সম্ভব নয়। যখন ঈশ্বরের ভৌতিক নিয়ম, যার দ্বারা এই সংসারকে জানা যায়, সারা ব্রহ্মাণ্ডের বুদ্ধিবাদী প্রাণী বা মানুষের জন্য সমান হবে, তাহলে সেই ঈশ্বরকে জানার জন্য আবশ্যক তাঁরই বানানো আধ্যাত্মিক নিয়ম অর্থাৎ অধ্যাত্ম বিজ্ঞান (যাকে প্রায়শঃ ধর্ম বলা হয়) সেটাও তো সব মানুষের জন্য সমানই হবে। আশ্চর্যের বিষয় যে এই সাধারণ তর্ককে বোঝার বুদ্ধিও ঈশ্বরবাদীর মধ্যে আর নেই, তাহলে নিশ্চয়ই এটা তাদের কল্পনাপ্রসূত ঈশ্বরীয় ধারণা ও কল্পিত উপাসনা-পূজা পদ্ধতিরই ফল হবে, যেখানে সত্যকে অনুসন্ধানের বৈজ্ঞানিক মেধা কোথাও পালিয়ে গেছে।
.
ঈশ্বরবাদী বৈজ্ঞানিক কেবল রিচার্ড ফাইনম্যানই নন, বরং অনেক প্রতিভাশালী বৈজ্ঞানিক ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার করেছেন ও করেন। কারণ বর্তমান বিজ্ঞান কেবল পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা ও গণিতীয় ব্যাখ্যার সহায়তায় বেঁচে আছে আর তার স্বরূপ এটাই। এই কারণে ঈশ্বরের ব্যাখ্যা এগুলোর সহায়তায় তো সেটা করতে পারবে না আর না সেটা এর ব্যাখ্যার ইচ্ছা করে। অন্যদিকে স্টিফেন হকিং তো "গ্র্যান্ড ডিজাইন" পুস্তকের মধ্যে যেন সংসারের সকল ঈশ্বরবাদীকে মূর্খ বলে নিরর্থক ব্যঙ্গ করেছেন। বিজ্ঞানের নাম নিয়ে স্বয়ং অবৈজ্ঞানিকতার পরিচয় দিয়েছেন। এই পুস্তকের পূর্বে তারই পুস্তকের মধ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার করেছেন, তারপর যেন অকস্মাৎ ভারী অনুসন্ধান করে সংসারে ঘোষণা করে দেন যে ঈশ্বর নামক কোনো অস্তিত্ব ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে নেই।
.
অন্যদিকে আজ সংসারের মধ্যে এমন ভয়ঙ্কর পাপের প্রবাহ বইছে যে তথাকথিত ঈশ্বরবাদীও এমন ব্যবহার করছে, যেন তাদের উপর ঈশ্বর নামক কোনো সত্তাই নেই, সেই অহংকারী মানব স্বয়ংকেই সর্বোচ্চ সত্তার মতো দেখানোর প্রদর্শন করতে দেখা যায়। এই কারণে আমি সারা সংসারের বৈজ্ঞানিকদের (অনীশ্বরবাদী ও ঈশ্বরবাদী উভয়) আহ্বান করতে চাইবো যে তারা ঈশ্বরের সত্তার উপর খোলা মস্তিষ্কে বিচার করার জন্য উদ্যত হোক। আজ অনেক ঈশ্বরবাদী বিদ্বান ঈশ্বরবাদী বৈজ্ঞানিকদের প্রমাণ দিতে দেখা ও শোনা যায়, কিন্তু আমি ঈশ্বরীয় সত্তার প্রমাণ কোনো বৈজ্ঞানিকের থেকে নেওয়া আবশ্যক বলে মনে করি না।
.
এখন সেই সময় আসবে, যখন বর্তমান বৈজ্ঞানিক আমাদের মতো বৈদিক বৈজ্ঞানিকদের প্রমাণ মানতে প্রারম্ভ করে নতুন বৈজ্ঞানিক যুগের সূত্রপাত করবেন অর্থাৎ আমাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে কাজ করবেন। আমি আজ সারা বিশ্বের সমস্ত প্রবুদ্ধ সমাজের কাছে ঘোষণাপূর্বক বলতে চাইবো যে যদি ঈশ্বর না থাকে, তাহলে সব ঝঞ্ঝাট ছেড়ে দিয়ে নিতান্ত নাস্তিক ও স্বচ্ছন্দ হয়ে যান আর যদি ঈশ্বর সিদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে তাঁর আজ্ঞাতে চলে নিয়মবদ্ধ জীবনযাপন করে সংসারকে সুখী করে তোলার চেষ্টা করুন, কারণ সম্পূর্ণ সংসার সেই ঈশ্বরেরই রচনা আর এই কারণে কেবল সব মানবই নয়, বরং প্রাণীমাত্র পরস্পর গোত্রী ভাই-ভাই না হলেও, তবে ভাবনাত্মক রূপে ভাই-ভাই হবে।
"কেন", "কে" এবং "কার জন্য" প্রশ্ন নয়?
এখন আমরা ঈশ্বরের অস্তিত্বের উপর নতুন করে বিচার করবো -
আমরা এ পর্যন্ত বৈজ্ঞানিকদের যেসব চর্চা সৃষ্টি বিজ্ঞানের উপর করেছি, তারদ্বারা এই বিচার সামনে আসে যে বৈজ্ঞানিক "কেন" প্রশ্নের উত্তর দেন না, কারণ তাদের দৃষ্টিতে এটা বিজ্ঞানের বিষয় না। আমরা সংসারে নানা স্তরে কিছু প্রশ্নবাচক শব্দের সম্মুখীন হই -
১. কেন
২. কে
৩. কার জন্য
৪. কি
৫. কিভাবে
.
এই প্রশ্নগুলোর মধ্যে "কি", "কিভাবে" -এর উত্তরের বিষয়ে বর্তমান বিজ্ঞান বিচার করার চেষ্টা করে বলে মনে হয়। যদিও এই দুটো প্রশ্নেরও পূর্ণ সমাধান বিজ্ঞানের কাছে নেই, কিন্তু চেষ্টা অবশ্য নিষ্ঠাবান হয়ে করা হচ্ছে। "কেন", "কে" এবং "কার জন্য" এই তিনটা প্রশ্নের বিষয়ে বিচার করাও আধুনিক বিজ্ঞানের জন্য কিঞ্চিৎ মাত্র রুচিত বিষয় নয়। এখন আমরা এই প্রশ্নগুলোর অভিপ্রায়ে ক্রমশঃ বিচার করবো -
.
১. কেন - এই প্রশ্ন প্রয়োজনের সন্ধানের জন্য প্রেরিত করে। আমরা নিঃসন্দেহে সারা জীবন নানা প্রকারের কর্ম করি এবং নানা দ্রব্যের সংগ্রহ করি। সেইসবের কোনো-না-কোনো প্রয়োজন অবশ্যই থাকে। যেকোনো বুদ্ধিমান প্রাণী কোনো-না-কোনো প্রয়োজন হেতুই কোনো প্রবৃত্তি রাখে। মূর্খ ব্যক্তি নিষ্প্রয়োজন কর্মে প্রবৃত্তি রাখতে পারে, কিন্তু বুদ্ধিমান তো কখনও এমন করবে না। এখন সংসার নিয়ে ভাবুন যে এটা কেন তৈরি হয়েছে আর কেন সঞ্চালিত হচ্ছে? এর প্রত্যেক গতিবিধির কোনো-না-কোনো প্রয়োজন অবশ্যই আছে। "কেন" প্রশ্নের উপেক্ষাকারী কোনো বৈজ্ঞানিক কি এটা মানেন যে এই সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ড হচ্ছে নিষ্প্রয়োজন একটা রচনা?
.
আমি মনে করি প্রত্যেক মানুষকে সর্বপ্রথম "কেন" প্রশ্নের উত্তরই খুঁজে বের করার চেষ্টা করা উচিত। যেভাবে কোনো কর্ম করার পূর্বে সে সেটার প্রয়োজন সম্বন্ধে জানে, সেইভাবে এই সৃষ্টির উৎপন্ন হওয়া আর কোনো শরীরধারীর জন্ম নেওয়ার প্রয়োজন জানারও চেষ্টা করা উচিত। বর্তমান বিজ্ঞান এই প্রশ্ন থেকে দূরে থাকার কারণেই আজ সেটা অনেক অনুসন্ধান করেও সেগুলোর প্রয়োজন ও দুষ্প্রভাবের উপর বিচার করে না। এই কারণে মানুষকে নিজের বিবিধ ক্রিয়াকলাপ, এমনকি বেঁচে থাকার প্রয়োজনেরও জ্ঞান না থাকার কারণে সে ভোগের অতি তৃষ্ণাতে পথভ্রষ্ট হয়ে অশান্তি ও দুঃখের জালে ফেঁসে যাচ্ছে।
.
২. কে - এই প্রশ্ন "কেন" -এর সঙ্গে জুড়ে আছে। কোনো কাজ কি প্রয়োজনের জন্য হচ্ছে, এর সাথে আরও একটা প্রশ্ন উপস্থিত হয় যে সেই কাজটা কে সম্পন্ন করেছে অথবা কে সম্পন্ন করছে অর্থাৎ তার প্রযোজক কে? এই সৃষ্টির প্রত্যেক ক্রিয়ার একটা নিশ্চিত প্রয়োজন আছে, তারসঙ্গে তার প্রযোজক কোনো চেতন তত্ত্ব আছে। কোনো জড় পদার্থ কোনো ক্রিয়ার প্রযোজক হয় না। জড় পদার্থ প্রয়োজনের সামগ্রী তো হতে পারে, কিন্তু তার কর্তা অর্থাৎ প্রযোজক নয়। চেতন তত্ত্বই জড় তত্ত্বের উপর সাম্রাজ্য ও নিয়ন্ত্রণ করে। চেতন তত্ত্ব স্বতন্ত্র হওয়াতে কর্তাপনের অধিকারী হয়, অথচ জড় পদার্থ স্বতন্ত্র না হওয়ার কারণে কর্ত্তৃত্ব সম্পন্ন হতে পারে না।
.
৩. কার জন্য - এই প্রশ্ন এই কথার বিচার করে যে কোনো কর্তা কোনো কাজ করেছে বা করছে, তো সেই কাজ কি নিজের জন্য করেছে বা করছে নাকি অন্য কোনো চেতন তত্ত্বের জন্য করছে? এখানে কোনো উপভোক্তা হবে আর উপভোক্তা চেতনই হয়। জড় পদার্থ কখনও না তো স্বয়ংয়ের উপভোগ করতে পারে আর না সেটা অন্য জড় পদার্থের উপভোগ করতে পারে। সৃষ্টির সমস্ত জড় পদার্থ কখনও স্বয়ংয়ের জন্য হয় না। সূর্যাদি তারা, গ্রহ, উপগ্রহ, হাওয়া, আকাশ, জল, বনস্পতি সমস্ত পদার্থ অন্য কারও উপভোগ হেতু হয়, স্বয়ংয়ের জন্য নয়। সেগুলো যার জন্য হয়, সেই পদার্থ চেতনই হবে, জড় কখনও হবে না।
.
৪. কি - এই প্রশ্ন পদার্থের স্বরূপকে সম্পূর্ণরূপে ব্যাখ্যা করে। জগৎ কি? এর স্বরূপ কি? মূল কণা কি? ঊর্জা ও দ্রব্য কি? বল কি? এইসব প্রশ্নের সমাধান এই ক্ষেত্রের বিষয় হয়। বর্তমান বিজ্ঞান তথা দর্শন শাস্ত্র দুটোই এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার যথাসম্ভব চেষ্টা করে। এর ক্ষেত্র অনেক ব্যাপক হয়। বর্তমান বিজ্ঞান এই প্রশ্নের সম্পূর্ণ উত্তর দিতে সক্ষম নয়। যেখানে বিজ্ঞান অক্ষম হয়ে যায়, সেখানে বৈদিক বিজ্ঞান কিংবা দর্শন শাস্ত্র এর উত্তর দেয়।
.
৫. কিভাবে - যেকোনো ক্রিয়া কিভাবে সম্পন্ন হয়? জগৎ কিভাবে তৈরি হয়েছে? দ্রব্য ও ঊর্জা কিভাবে ব্যবহার করে? বল কিভাবে কাজ করে? এইসব প্রশ্নের সমাধান এই ক্ষেত্রের বিষয় হয়। বর্তমান বিজ্ঞান এই ক্ষেত্রে কাজ করছে, কিন্তু এরও পূর্ণ সন্তোষপ্রদ উত্তর তার কাছে নেই। অন্য প্রশ্নের উত্তর না জানা পর্যন্ত এর সন্তোষপ্রদ উত্তর প্রাপ্ত করাও সম্ভব নয়।
.
এই পাঁচটা প্রশ্নের অতিরিক্ত অন্য আরও কিছু প্রশ্ন আছে, যার সমায়োজন এই পাঁচ প্রশ্নের মধ্যেই প্রায় হতে পারে।

বিগ-ব্যাং সিদ্ধান্তের প্রসঙ্গে

এখন
আমরা সৃষ্টি উৎপত্তির প্রসঙ্গে "কেন" ও "কে" প্রশ্নের উপর ক্রমশঃ বিচার করবো -
.
বর্তমানে সৃষ্টি উৎপত্তির বিষয়ে সর্বাধিক প্রচলিত বিগ-ব্যাং সিদ্ধান্তের মধ্যে অনেক প্রশ্ন নিম্নানুসারে উপস্থিত হয় -
.
১. অনন্ত সঘন ও অনন্ত তাপযুক্ত শূন্য আয়তনের পদার্থের মধ্যে অকস্মাৎ বিস্ফোরণ কেন হয়েছে তথা এটা কে করেছে?
.
২. যদি স্টিভন ওয়েনবার্গের বিগ-ব্যাংয়ের উপর বিচার করি, তাহলে সেখানেও "কেন" ও "কে" প্রশ্ন উপস্থিত হবে। যদি চেতন নিয়ন্ত্রক সত্তাকে স্বীকার করা হয়, তাহলে তো বলা যেতে পারে যে সে করেছে আর বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ জীবের ব্যবহারের যোগ্য সৃষ্টির নির্মাণের জন্য বিস্ফোরণ করেছে, কিন্তু অনীশ্বরবাদী এর উত্তর কখনও দিতে পারবে না। একজন বৈজ্ঞানিক আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে যদি ঈশ্বরকে মানা হয়, তাহলেও তো এই প্রশ্ন উঠবে যে ঈশ্বর অকস্মাৎ আজ থেকে প্রায় ১৩.৬ আরব বর্ষ পূর্বেই কেন বিস্ফোরণ করেছে? তো এর উত্তরে ঈশ্বরবাদী তো উচিত উত্তর দিতে পারে যে চেতন তত্ত্ব ইচ্ছা ও জ্ঞান শক্তি সম্পন্ন হয়। সে কোনো কাজের সময় ও প্রয়োজন নিজের বুদ্ধি আর বিবেক দিয়ে নিশ্চিত করে করতে পারে। কোনো পাখি গাছ থেকে অমুক সময়ে কেন উড়েছে? আমি অমুক সময়ে অমুক কাজ করতে কেন বসেছি? আমি খিদে পেলে আহার করবো কি করবো না, এটা আমার ইচ্ছা ও বিবেকের বিষয় হবে, এখানে "কেন" প্রশ্ন উচিত হবে না, কিন্তু গাছ থেকে পাতা কেন পড়লো? বৃষ্টি এখনই কেন হচ্ছে? জল কেন নিচের দিকে বইছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর অবশ্য দেওয়ার যোগ্য হবে, কারণ এখানে ইচ্ছা এবং বিবেক নেই। এই কারণে ঈশ্বরবাদী বিগ-ব্যাংয়ের সময় ও প্রয়োজনের ঔচিত্যকে সিদ্ধ করতে পারবে, অনীশ্বরবাদী সেটা কখনও করতে পারবে না। আমার একথা বলার প্রয়োজন এই নয় যে ঈশ্বর দ্বারা বিগ-ব্যাং হওয়া সম্ভব অর্থাৎ যদি বিগ-ব্যাং থিওরিস্ট ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার করে, তাহলে বিগ-ব্যাং সিদ্ধান্ত সত্য হতে পারে? না, ঈশ্বর তত্ত্বও বর্তমান বৈজ্ঞানিকদের বিগ-ব্যাংকে সম্পন্ন করতে পারবে না। বিগ-ব্যাং কিভাবে হয়? এর সমাধান ঈশ্বরবাদ থেকেও পাওয়া সম্ভব নয়। ঈশ্বরও তাঁর নিয়ম অর্থাৎ মূলভূত ভৌতিকীর নিয়মের বিরুদ্ধ কাজ করতে পারবে না। বস্তুতঃ বিগ-ব্যাং মডেলের মধ্যে আধুনিক ভৌতিকীরই অনেক স্থাপিত সিদ্ধান্তের উল্লঙ্ঘন হয়, সেগুলোর চর্চা এখানে সম্ভব নয়। তবে হ্যাঁ, যদি কোনো লোকে বিস্ফোরণ মানা হয়, সেই লোকও অনাদি না মানা হয়, আর তারসঙ্গে ভৌতিকীর স্থাপিত নিয়মের উল্লঙ্ঘন না হয়, তাহলে ঈশ্বর দ্বারা বিস্ফোরণ করা সম্ভব, কিন্তু সেই একটা বিস্ফোরণ দিয়েই সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের নির্মাণ হওয়া সম্ভব নয়। শূন্য থেকে ঈশ্বরও সৃষ্টির রচনা করতে পারবে না। সৃষ্টি রচনার জন্য অনাদি জড় উপাদান কারণের আবশ্যকতা অবশ্যই হবে, কিন্তু জড় পদার্থের মধ্যে স্বয়ং গতি ও ক্রিয়া হয় না, এই কারণে এগুলোকে উৎপন্ন করতে ঈশ্বরের ভূমিকা অবশ্যই আছে। অনন্ত পদার্থ (অনন্ত তাপ, অনন্ত দ্রব্যমান) থেকে সান্ত ঊর্জা ও সান্ত দ্রব্যমান যুক্ত ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি কিভাবে হয়েছে? এর উত্তর অনীশ্বরবাদী দিতে পারবে না, অথচ ঈশ্বরবাদী এর উত্তর দিতে গিয়ে বলতে পারে যে ঈশ্বর নিজের প্রয়োজনানুসারে অনন্ত পদার্থের মধ্যে থেকে কিছু পদার্থকে ব্যবহৃত করে ব্রহ্মাণ্ডের রচনা করতে পারে। যেভাবে সংসারে কোনো ব্যক্তি পদার্থ বিশেষ থেকে কিছু ভাগ নিয়ে নিজের ইচ্ছা বা প্রয়োজনানুসারে কোনো বস্তু বিশেষের নির্মাণ করার জন্য স্বতন্ত্র হয়, তার ইচ্ছা বা প্রয়োজনের উপর অন্য কোনো ব্যক্তি প্রশ্ন উপস্থিত করতে পারে না, সেইভাবে অনন্ত পদার্থ থেকে কিছু পদার্থ নিয়ে পরমাত্মা সান্ত দ্রব্যমান ও ঊর্জা যুক্ত ব্রহ্মাণ্ডের রচনা করেন। আমরা এর উপর এমন প্রশ্ন করতে পারি না যে তিনি অনন্ত পদার্থের অবশিষ্ট ভাগের ব্যবহার কেন করেন নি অথবা অনন্ত দ্রব্যমান বা ঊর্জা যুক্ত ব্রহ্মাণ্ড কেন তৈরি করেন নি? তাছাড়া এই প্রশ্নটাও তো অনুত্তরিত যে ব্রহ্মাণ্ড সান্ত নাকি অনন্ত হয়। আমার মতে ব্রহ্মাণ্ড ঈশ্বরের তুলনায় সান্ত তথা আমাদের তুলনায় অনন্ত হয়। আমরা যে পদার্থকে এমন মনে করি যে সেটা ব্রহ্মাণ্ড নির্মাণে কাজে লাগেনি, সেটা আমাদের অল্পজ্ঞতাই হবে। বস্তুতঃ যে পদার্থ এমন হয়, সেটাও ব্রহ্মাণ্ডের সঞ্চালন আদিতে পরোক্ষ ভূমিকা পালন করে। সেই পদার্থই প্রাণ, মন, ছন্দ ও মূল প্রকৃতির রূপে বিদ্যমান থাকে। দ্বিতীয় কথা হল, প্রারম্ভে দ্রব্যমান, ঊর্জার মতো লক্ষণ বিদ্যমানই হয় না।
.
৩. দূর-দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে যাওয়া পদার্থ কিভাবে ঘনীভূত হওয়া প্রারম্ভ করে? অনীশ্বরবাদী দূরে ছুটে যাওয়া পদার্থের ঘনীভূত হওয়ার যথাযথ কারণ বলতে পারবে না, কিন্তু ঈশ্বরবাদী এর এইভাবে সমাধান করতে পারে যে দূরে ছুটতে থাকা পদার্থকে ঈশ্বর সৃষ্টি সৃজন হেতু তার থেকে সূক্ষ্ম তরঙ্গ রূপ শক্তিশালী পদার্থকে উৎপন্ন করে তার দ্বারা ছড়াতে থাকা পদার্থকে থামিয়ে ঘনীভূত করতে পারে অর্থাৎ সংঘননের প্রক্রিয়া প্রারম্ভ করতে পারে।
.
এইভাবে যদি কেউ বিগ-ব্যাং দ্বারা সৃষ্টি উৎপন্ন হওয়া মানে, তাহলেও এরমধ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে।

অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড (ইটার্নাল ইউনিভার্স)

এই মতের উপর এটা জেনে রাখা অনিবার্য যে কোনো কণা বা কোয়ান্টা, যার মধ্যে যেকোনো প্রকারের বল অথবা ক্রিয়া বিদ্যমান থাকে, সেটা অনাদি হতে পারে না। এর পাশাপাশি এটাও তথ্য যে অন্য কোনো সূক্ষ্মতর পদার্থের সংযোগ দ্বারা যে পদার্থ তৈরি হয়েছে, সেটাও অনাদি হতে পারে না। এর কারণ হল যেকোনো সংযুক্ত বা নির্মিত পদার্থের মধ্যে তার বিভিন্ন অবয়বের মাঝে কর্মরত বল এবং সেগুলোর মাঝে সূক্ষ্ম রশ্মির আদান-প্রদান কখনও অনাদি হতে পারে না। একে পদার্থের স্বাভাবিক অবস্থা কখনও বলা সম্ভব নয়। এই কণাগুলোর সূক্ষ্ম অবয়বের মাঝে না কেবল বল ও গতির অস্তিত্ব আছে, অপিতু এগুলোর মধ্যে একটা নিশ্চিত প্রয়োজনও লুকিয়ে আছে। এখন আমরা সৃষ্টির অনাদিত্বের উপর একটু অন্য পদ্ধতিতে বিচার করবো -
.

গতি কি অনাদি হতে পারে?
"সৃষ্টি" শব্দের অর্থ হল - "নানা পদার্থের বুদ্ধিপূর্বক মিশ্রণ দ্বারা নতুন-নতুন পদার্থের উৎপত্তি হওয়া।" এই মিশ্রণের ক্রিয়াতে বল আর গতি হওয়া অনিবার্য। প্রশ্ন হল জড় পদার্থের মধ্যে কি স্বয়ং বল অথবা গতি হওয়া সম্ভব? এই সৃষ্টির মধ্যে যেসব বল ও গতি দেখা যায়, সেগুলো কি মূলতঃ তার নিজের হয়? এই বিষয়ে মহর্ষি বেদব্যাসের কথন হল -
প্রবৃত্তেশ্চ (অনুপপত্তেঃ) (ব্রহ্মসূত্র ২.২.২)
.
অর্থাৎ জড় পদার্থের মধ্যে স্বতঃ কোনো ক্রিয়া বা গতি আদি হয় না। তার মধ্যে গতি বা ক্রিয়াকে উৎপন্নকারী কোনো চেতন তত্ত্ব অবশ্যই থাকে। আমরা আমাদের চারিদিকে নানা প্রকারের গতি নিরন্তর দেখি, তো কয়েকটা গতির চালক দেখা যায় না। এখন আমরা বিচার করবো যে এমন কোন-কোন পদার্থ আছে যাদের চালক দেখা যায় না আর এমন কোন-কোন পদার্থ আছে যাদের চালক দেখা যায়, কিংবা দেখা যেতে পারে। আমরা বাস, রেলগাড়ি, কার আদি বাহনের চালককে প্রত্যক্ষ দেখি, তাদের ইচ্ছা বা চেষ্টা আদি ক্রিয়াগুলোর অনুভব করি।
.
আমরা বাহনের গতি প্রারম্ভকারী চেতন বাহনচালককে দেখি, কিন্তু বাহনের ইঞ্জিনে হতে চলা ক্রিয়াগুলোকে মাত্র জ্বালানি থেকে উৎপন্ন বলে মনে করি। জ্বালানি বা তারথেকে উৎপন্ন ঊর্জা বাহনকে কিভাবে গতি দেয়? বিদ্যুৎ বড়-বড় যন্ত্রকে কিভাবে চালায়? বিদ্যুৎ চুম্বকীয় বল কিভাবে কাজ করে? ঊর্জা ও বল কি? এই প্রশ্নগুলোর স্পষ্ট জ্ঞান আমাদের নেই। বর্তমান বিজ্ঞানও একথা স্বীকার করে। রিচার্ড পি. ফাইনম্যান লিখেছেন -
"It is important to realize that in physics today, we have no knowledge of what energy is."
(Lectures on Physics, Pg.40)
.
"If you insist upon a precise definition of force, you will never get it." (id.Pg.147)
.
"Why things remains in motion when they are moving or why there is a law of gravitation was, of course not known." (is. Pg.15)
.
এর দ্বারা এটা স্পষ্ট হয় যে আধুনিক ভৌতিক বিজ্ঞান বল এবং ঊর্জাকে সঠিকভাবে বুঝতে পাচ্ছে না। সেগুলো কিভাবে কাজ করে, এখানে অজ্ঞাত আছে। সূক্ষ্ম পরমাণু, অণু অথবা তরঙ্গ কিভাবে ক্রমাগত চলছে? এটা নিয়েও পুরোপুরি অজ্ঞাত। ফাইনম্যানের এই স্পষ্ট স্বীকারোক্তি প্রশংসনীয়। বস্তুতঃ বর্তমান বিজ্ঞানের কার্যশৈলীর একটা সীমা আছে।

বিজ্ঞান কি?

সাইন্স শব্দের অর্থ সম্বন্ধে চেম্বর্গ ডিকশনারিতে লেখা আছে -
"Knowledge ascertained by observation and experiment, critically tested, systematized and brought under general principles, esp in relation to the physical world, a department or a branch of such knowledge or study."
.
"Oxford advance learner dictionary" ইন্ডিয়ান এডিশনে সাইন্সের অর্থ এই ভাবে করেছে -
"Organized knowledge esp when obtained by observation and testing of facts, about the physical world, natural laws."
.
এই দুটো পরিভাষা থেকে স্পষ্ট হয় যে ভৌতিক জগতের যে জ্ঞান পর্যবেক্ষণ, অনুসন্ধান আর বিবিধ পরীক্ষার মাধ্যমে সুপরীক্ষিত এবং ব্যবস্থিত হয়, সেটা আধুনিক বিজ্ঞানের সীমাতে মানা হয়। এর দ্বারা এটাও স্পষ্ট হয় যে আমাদের কাছে পরীক্ষণের যত অধিক সাধন উপলব্ধ হবে, আমাদের বিজ্ঞান ততই অধিক পরীক্ষণ করে সৃষ্টির পদার্থকে জানতে পারবে। নিজের টেকনিকের সাধনের সীমার বাইরে বিদ্যমান যেকোনো পদার্থ সেটা যতই যথার্থ হোক না কেন, তাকে বিজ্ঞান স্বীকার করতে পারবে না।
.
পশ্চিমী দেশের বৈজ্ঞানিকরা আইজেক নিউটনের পূর্বে গুরুত্বাকর্ষণ বলের সম্বন্ধে জানতো না, গ্যালিলিও এবং কোপারনিকাসের পূর্বে পৃথিবীর আকার ও পরিক্রমণের জ্ঞান তাদের ছিল না, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের জন্য গুরুত্বাকর্ষণ বল, পৃথিবীর গোলাকার হওয়া তথা সূর্যের চারিদিকে তার পরিক্রমণ করা আদি বিষয় বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ছিল না অর্থাৎ এইসব তথ্য কল্পনা মাত্র ছিল। কিন্তু যখন এই বৈজ্ঞানিকরা অনুসন্ধান ও পরীক্ষা করে, তখন এই সব তথ্য বৈজ্ঞানিক সত্যের রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। আজ সংসারের মধ্যে যা যা নতুন আবিষ্কার হচ্ছে, সেগুলো আজকের পূর্বে কল্পনার বিষয় ছিল, কিন্তু এখন বিজ্ঞান ও টেকনিক হয়েগেছে। এই কারণে বলা হয় যে বিজ্ঞান হল পরিবর্তনশীল।
.
একে বর্তমান বিজ্ঞানের বিশেষত্ব বলবো নাকি অপূর্ণতা, বৈজ্ঞানিকদের স্বয়ং বিচার করা উচিত। আমি সূর্যকে দেখতে পাবো কি পাবো না, এরদ্বারা সূর্য আর তার বিজ্ঞানের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসবে না, তাহলে আমি একে আমার পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার সীমাতে কঠোরতাপূর্বক বেঁধে রাখার জিদ কেন করবো? স্থূল রূপে জ্ঞানেরও দুটো ক্ষেত্র আছে। একটা হল, যার পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার টেকনিক বর্তমানে উপলব্ধ আছে আর আরেকটা হল, যার পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের টেকনিক মানুষের দ্বারা বিকশিত করার সম্ভাবনা হতে পারে। এর অতিরিক্ত জ্ঞানের একটা ক্ষেত্র এমনও আছে, যার পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণ কোনো টেকনিক দিয়ে সম্ভব নয়, বরং যাকে য়োগ সাধনাজন্য দিব্যদৃষ্টি দিয়েই জানা সম্ভব। এই তিন প্রকারের জ্ঞানের মধ্যে উচিত তর্ক হওয়া অনিবার্য। যে বিষয় সামান্য সুতর্ক তথা ঊহার দৃষ্টি দিয়েই অসম্ভব বলে মনে হবে, সেটা উপরোক্ত তিন প্রকারের জ্ঞানের মধ্যে একটাও জ্ঞানের ক্ষেত্রে আসবে না।
.
এখানে ঊহা ও তর্কের যথার্থ তাৎপর্যও গম্ভীর বিচারকই জানতে পারবে, সামান্য ব্যক্তি নয়। যে-যে ব্যক্তির প্রতিভা ও সাধনা যত-যত অধিক হবে, তার তর্ক ও ঊহা শক্তি ততই অধিক যথার্থ হবে। এই কারণে বর্তমান বিজ্ঞানকে তার ক্ষেত্রের বাইরে গিয়ে সুতর্ক ও ঊহার দৃষ্টি দিয়েও বিচার করা উচিত। যদি কোনো সজ্জন এমন বলে যে সুতর্ক ও ঊহার বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোনো গুরুত্ব নেই, তাহলে আমি সেই সজ্জনকে বলতে চাইবো যে বিজ্ঞানের জন্ম সুতর্ক এবং ঊহা রূপ দর্শন থেকেই হয়েছে আর যেখানে বিজ্ঞানের সামর্থ্য বা ক্ষেত্র সমাপ্ত হয়ে যায়, সেখানে তার সমাপ্তি সুতর্ক ও ঊহা রূপ দর্শনেই হয়, কিংবা বিজ্ঞানের চরম সীমার বাইরে দর্শনের সীমা পুনঃ প্রারম্ভ হয়। আমরা এই বিন্দুকে নিম্ন প্রকারে জানার চেষ্টা করবো -
.

দর্শন ও বৈদিক বিজ্ঞান

যখন নিউটন বৃক্ষ থেকে আপেলকে নিচে পড়তে দেখেছিলেন, সেই সময় তাঁর মনে এই ঊহা ও তর্কের উৎপত্তি হয়েছিল যে আপেল নিচেই কেন পড়েছে? তাঁর এই বিচার থেকে গুরুত্বাকর্ষণের আবিষ্কার আর এতদর্থ করা পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিত্তি রাখা হয়। অনেক ব্যক্তি আপেল পড়তে দেখেছেন বা সেই সময়ও দেখেছিলেন, কিন্তু এই বিচার নিউটনের মস্তিষ্কেই আসে, কারণ তিনি তর্ক ও ঊহা-সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। এই কথা ইউরোপ দেশের প্রসঙ্গেই মানা উচিত, কারণ বৈদিক বাঙ্ময়ের মধ্যে তো গুরুত্বাকর্ষণ বলের উল্লেখ সর্বদা থেকে আছে। দর্শনকে ইংরাজি ভাষাতে ফিলোসফি বলা হয়, যার পরিভাষা করে চেম্বার্গ ডিকশনারির মধ্যে লেখা আছে -
.
"In pursuit of wisdom and knowledge, investigation contemplation of the nature of being knowledge of the causes and laws of all things, the principles underlying any sphere of knowledge, reasoning."
.
"Oxford advance learner dictionary" - মধ্যে এইভাবে পরিভাষিত করা হয়েছে -
.
"Search for knowledge and understanding of the nature and meaning of the universe and human life."
.
অর্থাৎ সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে বিদ্যমান বিভিন্ন বস্তু, সেগুলোর কারণ তথা কাজ করার সিদ্ধান্ত আদিকে তর্ক ও ঊহার আধারে জানার চেষ্টা করাকেই দর্শন বলে।
.
এর দ্বারা স্পষ্ট হয় যে বিজ্ঞান ও দর্শন উভয়ের উদ্দেশ্য হল ব্রহ্মাণ্ডকে জানার চেষ্টা করা। দুটোর প্রক্রিয়াতে কিছু ভেদ অবশ্য আছে, কিন্তু দুটোর উদ্যেশ্য সমান আছে। বিজ্ঞানের ক্ষেত্র মানব টেকনিকের সামর্থ্য পর্যন্ত সীমিত আর দর্শনের ক্ষেত্র চিন্তন, মনন ও ঊহার সীমা পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। কখনও বিজ্ঞান পর্যবেক্ষণাদি কর্মের বিদ্যমানতার মধ্যেও মূল কারণ বা নিয়মাদি বিষয়ে ভ্রমিত হতে পারে, তো দর্শনও দার্শনিকদের (বিশেষ করে পরম সিদ্ধ য়োগীজন ছাড়া) কল্পনার বেগে বাহিত হয়ে ভ্রান্ত হতে পারে। আমাদের উভয় শৈলীকে বিবেক সম্পন্ন ভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করা উচিত।
.
এখন আমি পাঠকদের সম্মুখে বিজ্ঞান ও দর্শনের সীমা আর সামঞ্জস্য দেখিয়ে সৃষ্টির একটা নিয়মের উপর বিচার করবো -
.
যখন আমরা এই কথার উপর বিচার করি যে একটা ধনাত্মক বস্তু অন্য ঋণাত্মক বস্তুকে কেন আকর্ষিত করে? তখন এই জ্ঞানের প্রক্রিয়াতে সর্বপ্রথম আমাদের এই অনুভব হয় যে বিপরীত আবেশ যুক্ত যেকোনো বস্তু একে-অপরকে আকর্ষিত করে। এখানে আকর্ষণ বল আছে, তো তার কারণও হবে, এটা বিচার করা হল দর্শনের ক্ষেত্র। কোনো দুটো বস্তু পরস্পর নিকট আসছে, তাহলে নিশ্চয়ই তাদের মাঝে কোনো আকর্ষণ বল কাজ করছে, এটা জানাও দর্শনের ক্ষেত্র হবে। এখন সেই আকর্ষিত হওয়া বস্তুর উপর বিপরীত বিদ্যুৎ আবেশ আছে, এটা বলা বিজ্ঞানের কাজ। এই আবেশ কিভাবে কাজ করে? এটা বলাও বিজ্ঞানের কাজ। বর্তমান বিজ্ঞান জেনেছে যে যখন দুটো বিপরীত আবেশ যুক্ত কণা নিকট আসে, তখন তাদের মাঝে ভার্চুয়াল ফোটনস্ উৎপন্ন আর সঞ্চারিত হওয়া প্রারম্ভ করে। এই পার্টিকলস্ বা ফোটনগুলোই আকর্ষণ বলের কারণ হয়। এই পার্টিকলস্ বর্তমান বিজ্ঞানের মতে সেই দুই কণার মাঝে বিদ্যমান স্পেসকে সংকুচিত করে সেই কণাগুলোকে পরস্পর নিকটে নিয়ে আসার কাজ করে। এই প্রক্রিয়াকে জানা হল বিজ্ঞানের কাজ। সম্ভবতঃ বর্তমান বিজ্ঞানের সীমা এখানেই সমাপ্ত হয়ে যায়। এরপর দর্শন বা বৈদিক বিজ্ঞানের সীমা প্রারম্ভ হয়।
.
যখন আমি জিজ্ঞাসা করি যে ধন ও ঋণ বিদ্যুৎ আবেশ যুক্ত কণা পরস্পর নিকট আসতেই ভার্চুয়াল পার্টিকলস্ কোথা থেকে আর কেন প্রকট হয়ে যায়? তখন বৈজ্ঞানিক উত্তর দেয় যে এর উত্তর আমরা জানি না। যেখানে বর্তমান বিজ্ঞানের কাছে উত্তর পাওয়া যায় না, সেখানে বৈদিক বিজ্ঞান বা দর্শন উত্তর দিয়ে দেয়। এই উত্তর বৈদিক ঋষিদের বা বেদের মহান্ বিজ্ঞান থেকে পাওয়া যাবে, যার বিস্তৃত বিবেচনা আমি "বেদবিজ্ঞান-আলোকঃ" গ্রন্থের মধ্যে করেছি। এখানে আমি এটা বলতে চাইবো যে বর্তমান বিজ্ঞান কোনো বলের কাজ করার প্রক্রিয়াকে নিয়ে কথা বলে, অথচ বৈদিক বিজ্ঞান কিংবা দর্শন তার পূর্বে গিয়ে এটা বলে দেয় যে সেই বলের প্রক্রিয়া কেন হচ্ছে আর মূল প্রেরক বল কি? সেখানে আমি এটা সিদ্ধ করবো যে সমস্ত জড় বলের মূল প্রেরক বল চেতন পরমাত্ম তত্ত্বের বল হয়। এখানে বর্তমান বিজ্ঞান না তো আমার প্রশ্নের উত্তর দেয় আর না ঈশ্বর তত্ত্বের মূল প্রেরক বলের অস্তিত্বকে স্বীকার করে। এই দুরাগ্রহ কোনো বৈজ্ঞানিকের জন্য উচিত নয়। তাকে হয় সমস্যার সমাধান করা উচিত নয়তো বৈদিক বৈজ্ঞানিকদের কাছে সমাধান জিজ্ঞাসা করা উচিত।
.
আমরা এখানে চর্চা করছিলাম যে ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে আধুনিক বিজ্ঞান দ্বারা মানা মূলকণা অনাদি হতে পারে না আর তাহলে সেগুলোর মধ্যে হতে চলা যেকোনো প্রকারের ক্রিয়া বা গতিও অনাদি হতে পারে না। এখন যদি কেই একগুঁয়ে হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে যে, ধরে নিন মূলকণা প্রাণাদি সূক্ষ্ম পদার্থ বা প্রকৃতি রূপ সূক্ষ্মতম পদার্থ দিয়ে তৈরি হয়েছে, তাহলেও সেই সূক্ষ্ম বা সূক্ষ্মতম কারণ পদার্থের মধ্যে গতি কেন অনাদি হতে পারবে না? এর জন্য চেতন ঈশ্বর তত্ত্বের আবশ্যকতা কেন হবে?
.
এই বিষয়টা নিয়ে আমি এইভাবে বিচার করি -
.
এই সৃষ্টির মধ্যে যেসব গতি এবং বলের অস্তিত্ব আছে, সেটা পদার্থের সূক্ষ্মতম অবস্থা পর্যন্ত কার্যকর হয়। পদার্থের অণুর মধ্যে হতে চলা যেকোনো ক্রিয়া, বল আদির প্রভাব তাতে বিদ্যমান আয়ন্স পর্যন্ত হয়। আয়ন্সের মধ্যে হতে চলা প্রত্যেক গতি ও বল আদির প্রভাব বা সম্বন্ধ ইলেকট্রনস, প্রোটনস, নিউট্রনস বা কোয়ার্কস ও গ্লুওনস পর্যন্ত হয়। আমি বিশ্বাস করি যে বর্তমান বিজ্ঞানও একে মিথ্যা বলবে না। এই সূক্ষ্ম কণাগুলোর অবয়ব ও স্বরূপের বিষয়ে বর্তমান বিজ্ঞান অনভিজ্ঞ আছে, এই কারণে এগুলোতে হতে চলা গতি, ক্রিয়া, বল আদির প্রভাবের ব্যাপকতার বিষয়েও বর্তমান বিজ্ঞান অনভিজ্ঞ আছে। এই প্রভাব প্রাণ, মন ও বাক্ তত্ত্ব পর্যন্ত ব্যাপ্ত হয়, যেটা মূল প্রকৃতি ও ঈশ্বরের মধ্যে সমাপ্ত হয়। বস্তুতঃ ঈশ্বর তত্ত্বের মধ্যে কোনো ক্রিয়া হয় না আর প্রকৃতির মধ্যে ক্রিয়া ঈশ্বরীয় প্রেরণা থেকে হয়, আর তারদ্বারা প্রকৃতির মূল স্বরূপ পরিবর্তিত হয়ে যায়। কিন্তু এইসব জ্ঞান বর্তমান বিজ্ঞান বা টেকনিকের দ্বারা হওয়া সম্ভব নয়।
.
গতি ও বলের ব্যাপ্তির পশ্চাৎ আমরা এটাও বিচার করবো যে এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে হতে চলা প্রত্যেক ক্রিয়া অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ শৈলীতে হচ্ছে। সমস্ত সৃষ্টি স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোনো ক্রিয়ার পরিণাম নয়, বরং প্রত্যেক বল বা ক্রিয়া অত্যন্ত ব্যবস্থিত ও বিশেষ প্রয়োজনানুসারে হচ্ছে। মূলকণা, কোয়ান্টা আদি সূক্ষ্ম পদার্থ কিংবা বিভিন্ন বিশাল লোক-লোকান্তর আদি পদার্থ জড় হওয়াতে না তো বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ ক্রিয়া করতে পারবে আর না সেগুলো নিজের ক্রিয়ার প্রয়োজনকে বুঝতে পারবে।
.
স্টিফেন হকিং যিনি "গ্র্যান্ড ডিজাইন" নামক নিজের পুস্তকের মধ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে নিজের অবৈজ্ঞানিক কুতর্কের দ্বারা অস্বীকার করার অসফল চেষ্টা করেছেন, এমনকি শরীরের মধ্যে জীবাত্মার অস্তিত্বকেও অস্বীকার করার অসফল চেষ্টা করেছেন। তিনি তাঁর পুস্তকে রোবট এবং পরগ্রহী জীবের মধ্যে ভেদও করেছেন, তাসত্ত্বেও পরগ্রহী জীবের মধ্যে স্বতন্ত্র ইচ্ছা ও বুদ্ধিযুক্ত আত্মাকে মানেন না। এই জেদীপনা বর্তমান বিজ্ঞানকে বিনাশকারী ভোগবাদী পথে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি পুনঃ লিখেছেন -
"How can one tell if a being has free will? If one encounters an alien, how can one tell if it is just a robot or it has a mind of its own? The behaviour of a robot would be completely determined, unlike that of a being with free will. Thus one could in principle detect a robot as a being whose actions can be predicted. As we said in Chapter 2, this may be impossibly difficult if the being is large and complex. We can not even solve exactly the equations for three or more particles interacting with each other. Since an alien the size of a human would contain about a thousand trillion trillion particles even if the alien were a robot, it would be impossible to solve the equations and predict what it would do. We would therefore have to say that any complex being has free will not as a fundamental feature, but as an effective theory, an admission of our inability to do the calculations that would enable us to predict its actions." (The Grand Design, Pg. 178)
.
পাঠক এখানে ভাবুন যে যদি থাউজেন্ট ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন পার্টিকলগুলোই বুদ্ধি ও ইচ্ছার উৎপত্তির কারণ হতে পারে, তাহলে রোবটের মধ্যে কি এত কণা নেই? সেটাও তো সেই মূলকণা থেকে তৈরি হয়েছে, যা দিয়ে আমাদের শরীর তৈরি হয়েছে। অণুর স্তরের উপরই যা ভেদ আছে, অন্যথা প্রায় পরমাণুর স্তরে কোনো ভেদ নেই, মূলকণার স্তরে তো নিতান্ত সমতা আছে। তাহলে কেবল মাত্র কণার সংখ্যার কারণে ভেদকে কিভাবে মেনে নিয়েছেন আর জীবের ব্যবহারকে কেবল এই আধারে অজ্ঞেয় বলে দিয়েছেন। আজ একজন মানুষ অনেক স্বচালিত রোবটের নির্মাণ করতে পারে, কিন্তু বিনা মানুষের প্রেরণা ও নিয়ন্ত্রণে অনেক রোবট মিলেও একটা মানুষ কেন, স্বয়ং একটা রোবটের নির্মাণ করতে পারবে কি?
.
এই অবৈজ্ঞানিকতা মূর্খতাপূর্ণ পুস্তকের মধ্যে জন্ম, মরণ, ইচ্ছা আদিকে যেভাবে বোঝানো হয়েছে, সেটা বাস্তবে হকিং সাহেবকে বৈজ্ঞানিকের স্থানে মাত্র এক প্রতিক্রিয়াবাদী বা দুরাগ্রহী নাস্তিক দার্শনিকের রূপে প্রস্তুত করেছে। এটা পড়ে আমার মনে তাঁর প্রতি যে সম্মান ছিল, সেটা প্রায় সমাপ্ত হয়ে গেছে। তাঁর প্রত্যেক তর্কের উত্তর সাধারণ ভাবে দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু এই গ্রন্থের মধ্যে জীবের অস্তিত্বের সিদ্ধি আবশ্যক নয়, তবুও এখানে আমি সংক্ষেপে কিছু বিচার করবো। রোবটের মধ্যে ইচ্ছা, জ্ঞান, চেষ্টা, দ্বেষ, সুখ ও দুঃখ এইসব গুণগুলো নেই। সেটা কোনো মানুষ দ্বারা নির্মিত ও সঞ্চালিত হয়। অপরদিকে কোনো জীবিত প্রাণী অন্য কোনো প্রাণীর দ্বারা সঞ্চালিত হয় না, বরং প্রত্যেক কর্মকে করতে স্বতন্ত্র হয়।
.
আজ হকিং সাহেবের মতো যেসকল বৈজ্ঞানিক ইচ্ছা, জ্ঞান আদি গুণ যুক্ত ব্যবহারের তথাকথিত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করে জীবাত্মার অস্তিত্বকে অস্বীকার করার চেষ্টা করছে, সেটা বস্তুতঃ এই রকম, যেমন কোনো ব্যক্তি কোনো মিষ্টান্নকারী দ্বারা তৈরি করা বিধির ব্যাখ্যাতে আগুন, জল, আটা, চিনি, দুধ, ঘী, কড়াই, হাতা আদি সব কাজের কথা বলছে, এই খাদ্য পদার্থের মধ্যে নানা পরিবর্তনের রাসায়নিক প্রক্রিয়ার কথা বলছে, কিন্তু মিষ্টান্নকারীর চর্চাই করছে না, বরং তার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে দিচ্ছে। এই বিষয়ে আমার এক মিত্র প্রফেসর ভূপসিংহ দারুন রচক তর্ক প্রস্তুত করেছেন। তিনি বলেছেন যে যদি কোনো নাস্তিক বৈজ্ঞানিক স্বয়ংকে একটা রোবট মনে করে, তাহলে আমি তাকে আগুনে ঝাঁপাতে বলবো, কারণ দুটোই তো জড় বস্তু আর এই কারণে এমন করলে সেই বৈজ্ঞানিক মহাশয়েরও কোনো দুঃখ-কষ্ট তো হবে না। এমন তথাকথিত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বাস্তবে অবৈজ্ঞানিক ও দুরাগ্রহপূর্ণই হয়।
.
এইভাবে এইসব বৈজ্ঞানিক এই সৃষ্টির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করার সময় তার নির্মাতা, নিয়ন্ত্রক বা সঞ্চালক অসীম বুদ্ধি ও বলসম্পন্ন চেতন পরমাত্ম তত্ত্বের শুধু উপেক্ষাই করে না, অপিটু কিছু বৈজ্ঞানিক তো তাঁর অস্তিত্বকেই অস্বীকার করতে পা থেকে মাথা পর্যন্ত জোর লাগিয়ে দেয়। এটা নিশ্চিত যে আজ বৈজ্ঞানিক মূল ভৌতিকীর ক্ষেত্রে ক্রমাগত গম্ভীর অনুসন্ধান করছে আর করাও উচিত। আমি নিঃসন্দেহে বৈজ্ঞানিকদের এই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার প্রশংসা করবো, কিন্তু এই সম্পূর্ণ উপক্রমে তারা চেতন নিয়ন্ত্রক ও নিয়ামক তত্ত্বকেই পুরোপুরি অস্বীকার করে দেয়। এটাই হল কারণ যে বিজ্ঞান বর্তমান মূল ভৌতিকীর অনেক সমস্যাকে আজ পর্যন্ত সমাধান করতে পারেনি। এই কারণেই বিজ্ঞানের "হিস্ট্রি অফ টাইম" -এরমধ্যে ভারী ত্রুটি আছে, ঊর্জা-দ্রব্য সংরক্ষণের ভঙ্গ হওয়ার সমস্যা আছে, "কেন" ও "কে" এই রকম প্রশ্নের উত্তর না পাওয়ার সমস্যা আছে, বস্তুতঃ সর্বত্র সমস্যাই সমস্যা আছে।
.
এই সব লেখার অভিপ্রায় এটাই যে সম্পূর্ণ জড় জগতের মধ্যে যেসব বল ও গতি বিদ্যমান আছে, তার পিছনে চেতন ঈশ্বর তত্ত্বেরই মূল ভূমিকা আছে। অন্যদিকে প্রাণীর শরীরে আত্মার ভূমিকা আছে। প্রত্যেক গতির পিছনে কোনো-না-কোনো বলের ভূমিকা আছে। কেবল বলের ভূমিকা দ্বারা গতি এলোমেলো, নিষ্প্রয়োজন এবং অব্যবস্থিত হবে, কিন্তু সৃষ্টি এক সুব্যবস্থিত, বুদ্ধিগম্য ও সপ্রয়োজন রচনা হয়েছে, এই কারণে এর মধ্যে বলের পাশাপাশি ভারী প্রজ্ঞারও ভূমিকা অবশ্যই আছে। বল ও বুদ্ধি কিংবা ইচ্ছা, জ্ঞান আদি কেবল চেতনের মধ্যেই হওয়া সম্ভব। এই চেতন তত্ত্বকেই পরমেশ্বর বলে। এই তত্ত্বের উপর বিচার করা বর্তমান বিজ্ঞানের সামর্থ্যের বিষয় নয়। এই কারণে বর্তমান বৈজ্ঞানিকদের ভৌতিক বিজ্ঞানের সাথে-সাথে দর্শন শাস্ত্র, যেখানে ঈশ্বর, জীব রূপী সূক্ষ্মতম চেতন এবং প্রকৃতি, মন, প্রাণ আদি সূক্ষ্মতর জড় পদার্থের বিচার করা হয়, সেগুলোর উপরও গম্ভীর চিন্তন করা উচিত। এরদ্বারা বর্তমান ভৌতিক বিজ্ঞানের অনেক সমস্যার সমাধান করতে সহায়তা প্রাপ্ত হবে।
.
মহর্ষি গৌতম কোনো সিদ্ধান্ত (থিয়োরি) নিরূপণের উপায়ের পাঁচটা অবয়ব বলেছেন -
.
প্রতিজ্ঞাহেতূদাহরণোপনয়নিগমনান্যবয়বাঃ। (ন্যায়দর্শন ১.১.৩২)
অর্থাৎ এই পাঁচ অবয়ব আর সেগুলোর প্রক্রিয়া এই রকম হয় -
১. প্রতিজ্ঞা - গতি অনিত্য হয়।
২. হেতু - কারণ আমরা একে উৎপন্ন ও নষ্ট হতে দেখি।
৩. উদাহরণ - যেমন সংসারে জড় পদার্থ বা চেতন প্রাণীর দ্বারা নানা প্রকারের গতি উৎপন্ন হতে দেখা যায়, তারসঙ্গে সেই গতিগুলোর বিরামও চেতন দ্বারা হতে দেখা যায়।
৪. উপনয় - সেইভাবে অন্য গতিও অনিত্য হয়।
৫. নিগমন - সমস্ত দৃষ্ট বা অদৃষ্ট গতি অনিত্য হয়।
.
গতির অনিত্যতা সিদ্ধির পশ্চাৎ একইভাবে গতির পিছনে থাকা চেতন কর্তার অস্তিত্বের সিদ্ধি করবো -
.
১. প্রতিজ্ঞা - গতি মূলতঃ চেতনের বল দ্বারা উৎপন্ন ও নিয়ন্ত্রিত হয়।
২. হেতু - আমরা জগতে বিভিন্ন গতি বিভিন্ন চেতন প্রাণীর দ্বারা উৎপন্ন ও নিয়ন্ত্রিত হতে দেখি।
৩. উদাহরণ - যেমন আমরা স্বয়ং বিভিন্ন গতিকে উৎপন্ন ও নিয়ন্ত্রণ করি।
৪. উপনয় - সেই রকম অন্য গতি, যার কোনো প্রেরক ও নিয়ন্ত্রক সাক্ষাৎ দেখা যায় না, সেগুলোও কোনো অদৃষ্ট চেতন তত্ত্ব (ঈশ্বর আদি) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও প্রেরিত হয়।
৫. নিগমন - সব প্রকারের গতিকে উৎপন্ন, প্রেরিত ও নিয়ন্ত্রণকারী কোনো-না-কোনো চেতন তত্ত্ব (ঈশ্বর অথবা জীব) অবশ্য আছে অর্থাৎ বিনা চেতন গতি উৎপন্ন, নিয়ন্ত্রণ ও সঞ্চালিত হওয়া সম্ভব নয়।
.
এইভাবে বলের বিষয়ে বিচার করবো -
.
১. প্রতিজ্ঞা - প্রত্যেক বলের পিছনে চেতন তত্ত্বের ভূমিকা আছে।
২. হেতু - কারণ আমরা চেতন প্রাণীর মধ্যে বল হতে দেখি।
৩. উদাহরণ - যেমন সংসারে আমরা বিভিন্ন ক্রিয়াতে নিজের বলের ব্যবহার করি।
৪. উপনয় - সেই রকম সৃষ্টির মধ্যে যে বিভিন্ন প্রকারের বল দেখা যায়, সেইসব বলের মধ্যে কোনো অদৃষ্ট চেতনের ভূমিকা আছে।
৫. নিগমন - প্রত্যেক বলের পিছনে কোনো-না-কোনো চেতন (ঈশ্বর অথবা জীব) তত্ত্বের মূল ভূমিকা অবশ্যই আছে, কিংবা সেই বল ওই চেতনেরই হয়। জড় পদার্থের মধ্যে নিজের কোনো বল হয় না।
.
এখন বুদ্ধিগম্য কর্মের মধ্যে চেতন তত্ত্বের ভূমিকার উপর বিচার করবো -
১. প্রতিজ্ঞা - প্রত্যেক বুদ্ধিগম্য এবং ব্যবস্থিত রচনার পিছনে চেতন তত্ত্বের ভূমিকা আছে।
২. হেতু - কারণ আমরা চেতন প্রাণীদের বুদ্ধিগম্য কর্ম করতে দেখি।
৩. উদাহরণ - যেমন আমরা নিজের বুদ্ধির দ্বারা বিভিন্ন প্রকারের কর্মকে সিদ্ধ করি।
৪. উপনয় - সেই রকম সৃষ্টির মধ্যে বিভিন্ন বুদ্ধিগম্য রচনার পিছনে ঈশ্বর রূপী অদৃষ্ট চেতনের ভূমিকা আছে।
৫. নিগমন - সব প্রকারের বুদ্ধিগম্য রচনা কিংবা সম্পূর্ণ সৃষ্টির প্রত্যেক ক্রিয়ার পিছনে চেতন তত্ত্বের অনিবার্য ভূমিকা আছে।
.
এইভাবে গতি ও সংযোগজন্য পদার্থের অনাদি ও অনন্ত না হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন গতি, বল ও বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ রচনার পিছনে চেতন তত্ত্বের অনিবার্য ভূমিকা সিদ্ধ হয়। কিছু কর্মের মধ্যে জীব রূপী চেতনের ভূমিকা আছে। এই কারণে মহর্ষি বেদব্যাস লিখেছেন -
.
সা চ প্রশাসনাত্। (ব্রহ্মসূত্র ১.৩.১১)
.
অর্থাৎ এই সম্পূর্ণ সৃষ্টির বিভিন্ন ক্রিয়া সেই ব্রহ্মের প্রশাসনের দ্বারাই সম্পন্ন হয়। জীবের জন্য মহর্ষি কপিল লিখেছেন -
.
বিশেষকার্য়েষ্বপি জীবানাম্। (সাংখ্য দর্শন ১.৬২)
.
এইভাবে পাঠক এটা নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন যে, যেকোনো পদার্থ সূক্ষ্ম কারণ পদার্থের সংযোগ থেকে তৈরি হয় তথা সেটা অন্য কারও থেকে প্রেরিত গতি, বল, ক্রিয়া আদি গুণ যুক্ত হয়, সেই পদার্থ অনাদি হতে পারে না। আবার যে পদার্থ এমন সূক্ষ্মতম রূপে বিদ্যমান হয়, যার অন্য কোনো কারণ বিদ্যমান হয় না, সেটা অনাদি হতে পারে। এরদ্বারা প্রকট হল যে মূল প্রকৃতি রূপ পদার্থ, যেখানে কোনো গতি আদি গুণ বিদ্যমান হয় না, সেটা অনাদি হয়। এমন অনাদি পদার্থ থেকে সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক, নিয়ামক, সর্বশক্তিমান, সর্বব্যাপক ও সর্বজ্ঞ ঈশ্বর তত্ত্ব এই সৃষ্টির রচনা সময়ে-সময়ে করতে থাকে। কখনও সৃষ্টি তো কখনও প্রলয় হতে থাকে। এই সৃষ্টি-প্রলয় চক্রের না তো কোনো আদি আছে আর না কোনো অন্ত। না তো কোনো সৃষ্টি অনাদি ও অনন্ত হতে পারে আর না কোনো প্রলয় অনাদি ও অনন্ত হতে পারে, কিন্তু এদের চক্র অবশ্য অনাদি ও অনন্ত হয়।
.
এইভাবে আমরা বিগ-ব্যাং সিদ্ধান্ত এবং ইটারনাল ইউনিভার্স এই দুই মান্যতা নিয়ে সৃষ্টির রচয়িতা চেতন ঈশ্বর তত্ত্বের অস্তিত্বের অনিবার্যতাকে সিদ্ধ করলাম। স্ট্রিং থিয়োরি এবং এম-থিয়োরি দুটোই বিগ-ব্যাং সিদ্ধান্তকে বিশ্বাস করে, এই কারণে এদের নিয়ে পৃথক ভাবে ঈশ্বর তত্ত্ব সিদ্ধির আবশ্যকতা নেই। প্রবুদ্ধ এবং প্রজ্ঞাবান্ পাঠকদের উচিত যে তারা নিজ-নিজ হঠ, দুরাগ্রহ ও অহংকারকে ত্যাগ করে সত্য বৈজ্ঞানিকতার পরিচয় দিবেন।
সাধারণতঃ ঈশ্বরের অনুভব কেন হয় না? 🍁
এখানে কিছু পাঠক এই প্রশ্ন করতে পারেন যে সৃষ্টির বিভিন্ন ক্রিয়ার কর্তার রূপে আমাদের ঈশ্বরের অনুভব কেন হয় না? চলুন, এর উপর সবিস্তারে বিচার করি -
.
এখানে সর্বপ্রথম আমরা বিচার করবো যে কোনো ক্রিয়ার সঞ্চালক বা কর্তার অনুভব কোন-কোন পরিস্থিতির মধ্যে হয়?
.
১. কর্তা সাকার হলে যে কেউ তার প্রত্যক্ষ করতে পারে।
২. ক্রিয়ার প্রারম্ভ ও সমাপ্তির লক্ষণের অনুভব হলে পরে কর্তার বোধ সহজে হয়।
৩. কর্তার নিজের ভিতরে কোনো নাড়াচাড়া বিশেষ দ্বারাও তার কর্তাপনের অনুভব হয়।
৪. কর্তার অনুভবের জন্য ক্রিয়ার বিবিধ গতিবিধি বা লক্ষণকে জানার জ্ঞান অনিবার্য হবে।
৫. কর্তা নিরাকার হলে পরে সিদ্ধান্ত নিরূপণের উপায়ের পাঁচ অবয়বের সম্যগ্ জ্ঞান অনিবার্য হবে।
.
এখন উপরোক্ত বিন্দুর উপরে ক্রমশঃ বিচার করবো -
.
১. কর্তা সাকার হলে তার প্রত্যক্ষ হওয়া সরল হয়। আমরা সংসারে বিভিন্ন ক্রিয়ার সঞ্চালক, নিয়ন্ত্রক এবং বিভিন্ন বস্তুর নির্মাতাকে প্রত্যক্ষ দেখতে পারি। এতে কোনো সন্দেহ নেই। সৃষ্টির কর্তা ঈশ্বর তত্ত্ব সাকার না হওয়াতে অর্থাৎ নিরাকার হওয়ার জন্য চোখ দিয়ে প্রত্যক্ষ হয় না। একইভাবে সেটা স্বাদ, গন্ধ, স্পর্শ ও শব্দের বিষয় না হওয়াতে রসনা, প্রাণ, ত্বক ও শ্রোত্র দিয়েও প্রত্যক্ষ হয় না। এর পাশাপাশি অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং অনন্ত বিশাল অর্থাৎ সর্বব্যাপক, অত্যন্ত নিকট এবং অত্যন্ত দূরস্থ পদার্থেরও প্রত্যক্ষ হতে পারে না। সেই ঈশ্বর সূক্ষ্মতা ও ব্যাপকতার মধ্যে অনন্ত হওয়াতে তথা আমাদের নিকটতম আর দূরতম বিদ্যমান হওয়াতে প্রত্যক্ষ হতে পারে না।
.
২. আমরা সংসারে হতে চলা অনেক ক্রিয়ার প্রারম্ভ ও সমাপ্তি হতে প্রত্যক্ষ দেখি, এই কারণে সেই ক্রিয়ার প্রারম্ভ ও সমাপনের কর্তার বোধ সহজভাবে হয়ে যায়। সৃষ্টির সেইসব ক্রিয়া, যার প্রারম্ভ হতে অথবা সমাপ্ত হতে আমরা দেখতে পারি না অর্থাৎ যেসব ক্রিয়াকে আমরা আমাদের জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত যেমনটা-তেমনি দেখি ও শুনি, সেইসব ক্রিয়ার প্রারম্ভ ও সমাপ্ত হওয়ার বিচার আমাদের মাথায় আসে না। আকাশের মধ্যে বিভিন্ন লোকের ভ্রমণ, প্রকাশন, অণু বা পরমাণুর গতি আদি আমরা জন্ম থেকে যেমনটা দেখেছি ও শুনেছি, তেমনই এখন পর্যন্ত চলছে আর আমাদের জীবন কালের মধ্যে তেমনই বজায় থাকবে। এই কারণে এগুলোর কর্তা, নিয়ন্ত্রক, সঞ্চালক আদি গুণ যুক্ত কোনো চেতন কর্তার সাধারণতঃ কল্পনাও হয় না। যদি কোনো অত্যল্পায়ু জীব কোনো বাহনকে কেবল চলতেই দেখে, তাকে কখনও বিরাম অবস্থায় না দেখে, তাহলে তার মনে এই বিষয় আসবেই না যে একে কোনো কর্তা চালিয়েছে বা চালাচ্ছে।
.
৩. যদি কোনো সাকার কর্তাও কোনো বাহন আদি যন্ত্রের পাশে বসে থাকে, কিন্তু নিজের শরীরে কোনোরূপ নাড়াচাড়া না করে, তাহলেও প্রত্যক্ষদর্শীর এমন বোধ হবে না যে সেই কর্তা (চালক) ঐ বাহনটাকে চালাচ্ছে, বরং সে এমন মনে করবে যে সেই বাহন স্বয়ংই চলছে।
.
৪. যতক্ষণ পর্যন্ত ক্রিয়ার আদি, মধ্য ও অন্তের মধ্যে প্রতিত হওয়া বিভিন্ন লক্ষণের জ্ঞান কারও থাকবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত তার কর্তার বোধ হবে না। কোনো পশুর এই কথার বোধ হতে পারে না যে কোনো ব্যক্তি বাস, রেল, উড়োজাহাজ আদিকে চালায়। সে সেই বাহনগুলোকে চলতে ও থামতেও দেখতে পারে, সেগুলোতে বসা চালককেও দেখতে পারে, তবুও তার এই বোধ হতে পারে না যে সেই চালকই এই বাহনগুলোকে চালাচ্ছে বা থামাচ্ছে।
.
৫. উপরোক্ত চার বিন্দু সাকার কর্তার সঙ্গে সম্বন্ধ রাখে। যদি কর্তা নিরাকার হয়, তাহলে সেই পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নিরূপণের সব পাঁচ অবয়বকে জেনে রাখার সাথে-সাথে প্রতিভা হওয়াও অনিবার্য হবে, অন্যথা ঈশ্বর তত্ত্বের অস্তিত্বের বোধ হবে না। বর্তমান বিজ্ঞান কেবল পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যেই বিশ্বাস করে, গণিতীয় ব্যাখ্যার উপর বিশ্বাস করে, এই কারণে ঈশ্বরের অস্তিত্বের বোধ তার হয় না। যেখানে তার সীমা সমাপ্ত হয়ে যায়, সেখানে সেটা বলে দেয় যে আমরা জানি না। একথা তো সত্য যে আপনি জানেন না, কিন্তু আপনাকে জানার চেষ্টা করাও কি উচিত নয়? এর পাশাপাশি আপনার কি এমন বলার অধিকার আছে যে যেটা আমরা জানি না, তাকেও আমরা মানবো না? এমন দুরাগ্রহ বিজ্ঞান তো মানা যেতে পারে না। আপনাকে কি এখানে বৈদিক বিজ্ঞান বা দর্শনের আশ্রয় নেওয়া উচিত নয়? আপনি এমন কেন মনে করেন যে যেটা বর্তমান বিজ্ঞান দ্বারা সিদ্ধ হওয়ার যোগ্য, কেবল সেটাই সত্য, বাকি সব অসত্য। এই বিষয়ে রিচার্ড পি. ফাইনম্যান ঠিকই লিখেছেন -
.
"Mathematics is not a science from our point of view, in the sense that it is not a natural science. The test of its validity is not experiment. We must incidentally, make it clear from the beginning that if a thing is not science, it is not necessarily bad. For example, love is not a science. So, if something is said not be a science, it does not mean that there is something wrong with it, it just means that it is not a science." (Lectures on Physics, Pg.27)
.
অর্থাৎ যাকে বর্তমান বিজ্ঞানের সীমাতে মানা যাবে না, সেটা মিথ্যা, এমন মানা উচিত নয়। তাকে কেবল এটাই বলা উচিত যে এটা বিজ্ঞান নয়।
.
বস্তুতঃ ফাইনম্যান মডার্ন সাইন্সের পরিভাষার আধারেই একথা বলেছেন, তবে তিনি বিজ্ঞানের বাইরের বিষয়কে মিথ্যা ও অনাবশ্যক মানেন না। আমি বর্তমান বিজ্ঞান এবং দর্শন উভয়ের পরিভাষাকে স্পষ্ট করেছি। এখন আমরা বৈদিক দৃষ্টিতে বিজ্ঞানের পরিভাষার উপর বিচার করবো। ঋষি দয়ানন্দ সরস্বতী লিখেছেন -
"বিজ্ঞান তাকে বলে যেটা কর্ম, উপাসনা আর জ্ঞান এই তিন দ্বারা যথাযথ ভাবে ব্যবহারে নেওয়া আর পরমেশ্বর থেকে শুরু করে তৃণ পর্যন্ত পদার্থের সাক্ষাৎ বোধ হওয়া, সেগুলো দিয়ে যথাযথ ব্যবহার করা।"
(বেদ বিষয় বিচার - ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকা)
.
এর সংস্কৃত ভাগে "পৃথিবীতৃণমারভ্য প্রকৃতিপর্য়্যন্তানাম্ পদার্থানাম্ জ্ঞানেন য়থাবদুপকারগ্রহণম্..." বলে প্রকৃতি পর্যন্ত অর্থাৎ স্থূলতম থেকে শুরু করে সূক্ষ্মতম পদার্থের যথার্থ জ্ঞানকে বিজ্ঞান বলেছেন। এরমধ্যে ঈশ্বর ও জীবের যথার্থ জ্ঞান সম্মিলিত আছে। এই যথার্থ জ্ঞান কিভাবে প্রাপ্ত হবে, এই বিষয়ে বলেছেন যে জ্ঞান, কর্ম ও উপাসনার মাধ্যমে যথার্থ বিজ্ঞান প্রাপ্ত হয়। এর তাৎপর্য হল যে সত্য শাস্ত্রের গম্ভীর অধ্যয়নের পশ্চাৎ তাকে কর্ম অর্থাৎ পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারা পুষ্ট করা, যাকে আজকের বিজ্ঞানও করে। যে বিষয় পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষার মাধ্যমে সিদ্ধ বা সাক্ষাৎ হওয়া সম্ভব নয়, তার জন্য উপাসনাকে বিশেষ সাধন রূপ বলেছেন।
.
য়োগ সাধন দ্বারা প্রাপ্ত অন্তর্দৃষ্টি হল বৈদিক ঋষিদের সেই বিশিষ্ট দান, যার শক্তিতে সেই ঋষিগণ সৃষ্টির সাথে-সাথে জীব ও ঈশ্বরের মতো নিরাকার চেতন পদার্থের সাক্ষাৎ করে যথার্থ বিজ্ঞানকে প্রাপ্ত করেছিলেন। এই জ্ঞান প্রায়শঃ নির্ভ্রান্ত হয়। এমন অন্তর্দৃষ্টির দ্বারা প্রাপ্ত যথার্থ বিজ্ঞানকে সেই ঋষিগণ কল্প সূত্র, ব্রাহ্মণ গ্রন্থ, মনুস্মৃতি, ষড্দর্শন, উপনিষদ, রামায়ণ ও মহাভারত আদি গ্রন্থের মধ্যে লিপিবদ্ধ করেন। সেই পরম য়োগীজন নিজের উপাসনা=সাধনার দ্বারা বড়-বড় লোক-লোকান্তর থেকে শুরু করে সূক্ষ্ম মূলকণা ও কোয়ান্টা এবং এগুলোর থেকেও সূক্ষ্মতম প্রাণ, ছন্দ ও মরুদ্ আদি পদার্থের মধ্যে নিজের মন বা বুদ্ধিতত্ত্বকে প্রবিষ্ট করিয়ে এগুলোর অনুভব কোনো বাহ্য টেকনিক ছাড়াই করতেন। এরও আগে গিয়ে তাঁরা স্বয়ং নিজের আত্ম স্বরূপ এবং সবথেকে সূক্ষ্ম ও অনন্ত তত্ত্ব ঈশ্বরের সাক্ষাৎ অনুভব করতেন।
.
এইভাবে বৈদিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্র বর্তমান বিজ্ঞানের তুলনায় অধিক ব্যাপক হয়। আমি ঐতরেয় ব্রাহ্মণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা (বেদবিজ্ঞান-আলোকঃ) করার সময় মহর্ষি ঐতরেয় মহীদাসের য়োগদৃষ্টি দিয়ে জানা সৃষ্টির গভীর রহস্যকে স্বয়ং অনুভব করেছি। আশ্চর্য হয়ে যাই যে কিভাবে মহর্ষি ভগবন্ত নিজের অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে সৃষ্টির বিজ্ঞানের সূক্ষ্ম ও গম্ভীর রহস্যের সাক্ষাৎ করতেন। এই অন্তর্দৃষ্টিও ঈশ্বরের কৃপা ছাড়া প্রাপ্ত হয় না। "বেদবিজ্ঞান-আলোকঃ" গ্রন্থের মধ্যে ঈশ্বরীয় অস্তিত্বের সংকেত দেয় এমন অনেক প্রসঙ্গ বিদ্যমান আছে। তবে হ্যাঁ, বর্তমানে যদি কেউ তথাকথিত য়োগীর কাছে এই বিজ্ঞানের আশা করে, তাহলে সে নিরাশই হবে, কারণ আজ এই সংসার থেকে য়োগবিদ্যার বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
(🍁 ঈশ্বরের বৈজ্ঞানিক স্বরূপ 🍁
🌿 সৃষ্টিকর্তা - এই সৃষ্টির রচয়িতা, নিয়ন্ত্রক ও সঞ্চালকের রূপে চেতন তত্ত্ব ঈশ্বরের সিদ্ধির পর আমরা এটা বিচার করবো যে সেই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি দিয়ে সিদ্ধ করা ঈশ্বর স্বয়ং কিরকম? এ পর্যন্ত এটা তো নিশ্চিত হয়েছে যে সম্পূর্ণ সৃষ্টির রচনা, সঞ্চালন ও ধারণ কর্তা আছে, তাঁকেই ঈশ্বর বলে। এটা ভারী আশ্চর্যের বিষয় যে আজ সৃষ্টির রচয়িতাকে ঈশ্বর মেনে কেউ পূজো করে না, বরং বিভিন্ন চমৎকার (জাদু) দেখায় এমনকেই ঈশ্বর মেনে পূজো করা হয়। এর উপরও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি রেখে বিচার করবো -
.
🌿 সৎ স্বরূপ - সর্বপ্রথম সেই ঈশ্বর নিত্য হওয়া উচিত। যদি সেই ঈশ্বর অনিত্য হয়, তাহলে তাকে নির্মাণকারী তার থেকেও কোনো বৃহৎ চেতন সত্তা বিদ্যমান হওয়া উচিত, যেটা কোনো অনিত্য ঈশ্বর নামক পদার্থকে উৎপন্ন করতে পারে। যদি এমনও হয়, তাহলে সেই বৃহৎ চেতন সত্তা অবশ্যই অনাদি ও নিত্য হওয়া উচিত। আর যদি এমন মানা হয়, তাহলে সেই অনাদি চেতন সত্তাকেই ঈশ্বর নাম দেওয়া হবে, অনিত্য সত্তাকে মোটেও অনাদি মানা যাবে না। এই কারণে ঈশ্বর সৎ স্বরূপ সিদ্ধ হয়। ধ্যাতব্য হল, কোনো চেতন সত্তাই কারও দ্বারা তৈরি হয় না আর না স্বয়ং তৈরি হয়, বরং সেটা নিশ্চিত রূপে অনাদি হয়।
.
🌿 চিৎ স্বরূপ - সেই ঈশ্বর সৎ স্বরূপ হওয়ার পাশাপাশি চেতন হওয়া উচিত, কারণ চেতন সত্তাই ইচ্ছা, জ্ঞান ও চেষ্টা এই তিন গুণ যুক্ত হয়ে বিভিন্ন প্রকারের রচনাকে সম্পাদিত করতে পারে। জড় পদার্থের মধ্যে কখনও চেতনের প্রাদুর্ভাব হওয়াই সম্ভব নয়। যারা রাসায়নিক সংযোগ দ্বারা চেতনের উৎপত্তি মানে, তাদের সর্বপ্রথম তো এটুকুই জেনে রাখা উচিত যে যেকোনো ক্রিয়ার প্রারম্ভ মাত্রের জন্যও চেতন তত্ত্বের আবশ্যকতা আছে, আমি এ পর্যন্ত এমন সিদ্ধ করে দিয়েছি। এই কারণে রাসায়নিক ক্রিয়াও চেতন ছাড়া সম্ভব নয়, আর তাই রাসায়নিক ক্রিয়া দ্বারা চেতনের প্রাদুর্ভাবের মান্যতা স্বতঃ নিরস্ত হয়ে যায়।
.
🌿 আনন্দ স্বরূপ - এর সাথে সেই সত্তা আনন্দস্বরূপ হওয়া উচিত। এর কারণ হল সম্পূর্ণ সৃষ্টিকে রচনা করতে তাঁর কিঞ্চিৎ মাত্র ক্লেশ, দুঃখ আদি হওয়া উচিত নয়। যদি সেই সত্তা দুঃখ ও ক্লেশ যুক্ত হওয়ার আশঙ্কা গ্রস্ত হয়, তাহলে সে সৃষ্টি রচনার মতো মহান কর্মকে করতে পারবে না। এইজন্য ঈশ্বর তত্ত্বের পরিভাষাতে মহর্ষি পতঞ্জলি বলেছেন -
ক্লেশকর্মবিপাকাশয়ৈরপরামৃষ্টঃ পুরুষবিশেষ ঈশ্বরঃ (য়োগদর্শন ১.২৪)
.
অর্থাৎ অবিদ্যাদি ক্লেশ, পাপ-পুণ্য আদি কর্ম এবং সেগুলোর ফল, বাসনা থেকে পৃথক পুরুষ অর্থাৎ সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে শয়নকারী=ব্যাপ্তকারী চেতন তত্ত্বকে ঈশ্বর বলে। এই কারণে ঈশ্বর সর্বদা আনন্দস্বরূপই হয়। এইজন্য ঋষি দয়ানন্দ ঈশ্বরকে সচ্চিদানন্দ বলেছেন।
.
ধ্যাতব্য হল, ক্লেশ ও দুঃখ কেবল তারই হবে, কোনো বঞ্ছিত পদার্থ যার অপ্রাপ্য আছে। যদি এমন হয়, তাহলে সেই সত্তা অপূর্ণতা গ্রস্ত হবে। এমন হলে পরে সে সৃষ্টি রচনা, ধারণ, পালন ও সঞ্চালনে সক্ষম কখনও হবে না।
.
🌿 সর্বব্যাপক - আমরা জানি যে আমাদের সৃষ্টিতে বর্তমান বৈজ্ঞানিক সম্ভবতঃ দুই আরব গ্যালাক্সিকে দেখেছে বা অনুভব করেছে। আমাদের গ্যালাক্সিতেই প্রায় দুই আরব নক্ষত্র আছে। এ পর্যন্ত বৈজ্ঞানিকের দেখা ব্রহ্মাণ্ডের ত্রিজ্যা ১০^২৬ মিটার মানা হয়। এটা তো হল আমাদের টেকনিকের দৃষ্টির সীমা। এর বাইরে এই ব্রহ্মাণ্ড কতদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে, সেটা কেউই জানে না আর না জানতে পারবে। দুই গ্যালাক্সির মাঝে কয়েক আরব-খারব কিলোমিটার ক্ষেত্রের মধ্যে কোনো লোক নেই, তবে সম্পূর্ণ রিক্ত স্থানের মধ্যে সূক্ষ্ম হাইড্রোজেন গ্যাস অত্যন্ত বিরল অবস্থায় ভরা থাকে। তার মাঝেও ভ্যাকিউম এনার্জি ভরা থাকে।
.
সারাংশ হল যে এত বড় ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে নিতান্ত রিক্ত স্থান কোত্থাও নেই। এরমধ্যে আমাদের সূর্যের থেকে কোটি-কোটি গুণ বড় নক্ষত্রও বিদ্যমান আছে, তো সূক্ষ্ম ল্যাপটনস্, কোয়ার্কস্ এবং কোয়ান্টাও বিদ্যমান আছে। এর অতিরিক্ত এগুলোর থেকেও সূক্ষ্ম প্রাণ, ছন্দ ও মনস্তত্ত্বাদি পদার্থ বিদ্যমান আছে। এই সমস্ত স্থূল ও সূক্ষ্ম পদার্থের মধ্যে গতি ও বলের বিদ্যমানতা আছে। সবগুলোর মধ্যে সৃজন ও বিনাশের খেলা চলছে। এই কারণে যেখানে-যেখানে এই খেলা চলছে, সেখানে-সেখানে ঈশ্বর তত্ত্বও বিদ্যমান হওয়া উচিত। এর মানে হল ঈশ্বর সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম পদার্থের মধ্যেও বিদ্যমান আছে তথা স্থূল থেকে স্থূলতম পদার্থের মধ্যেও বিদ্যমান আছে। এই কারণে কঠোপনিষদের ঋষি বলেছেন -
.
অণোরণীয়ান্ মহতো মহীয়ান্। (কঠোপনিষদ্ ২.২০)
.
অর্থাৎ সেই পরমাত্মা হল সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম আর মহান থেকে মহান। এই কারণে পরমাত্মা সর্বব্যাপক হয়।
.
য়জুর্বেদে (৪০.১) বলা হয়েছে -
.
ঈশাবাস্যমিদꣳ সর্বম্ য়ৎকিঞ্চ জগত্যাম্ জগৎ।
.
অর্থাৎ সেই ঈশ্বর এই সম্পূর্ণ জগতের মধ্যে ব্যাপ্ত হয়ে তাকে আচ্ছাদিত করে আছে। এইভাবে সেই ঈশ্বর যে সর্বব্যাপক সেটা সিদ্ধ হয়। সে কখনও একদেশী হতে পারেন না। যে একদেশী হবে, সে এতো বিশাল ব্রহ্মাণ্ডের নির্মাণ, ধারণ ও সঞ্চালন করতে কখনও সক্ষম হবে না। যদি কেউ বলে যে যেমন শরীরের মধ্যে জীবাত্মা এক স্থানে থেকেও সারা শরীরের সঞ্চালন করে, সেই রকম ঈশ্বরও একদেশী হয়েও ব্রহ্মাণ্ডের সঞ্চালন করতে পারে, তাহলে এই তর্ক উচিত নয়। জীবাত্মাকে শরীর সঞ্চালনের জন্য ঈশ্বর দ্বারা নির্মিত সূক্ষ্ম শরীররূপী সাধনেরও আবশ্যকতা হয়, সেটা দিয়েই স্থূল শরীরের সঞ্চালন করে। যদি পরমাত্মা একদেশী হয়, তাহলে সে কার তৈরি সাধনের সহায়তায় ব্রহ্মাণ্ডের সঞ্চালন করবে? তাছাড়া একদেশী অনন্ত সামর্থ্যশালীও হতে পারবে না, যে ব্রহ্মাণ্ডের নির্মাণ করবে। দুর্ভাগ্যবশতঃ বর্তমান সংসারের ঈশ্বরবাদী মানব সর্বব্যাপক ঈশ্বরের উপাসনা না করে মন্দির, মসজিদ, চর্চ, ক্ষীরসাগর, কৈলাশ পর্বত, চতুর্থ ও সপ্তম আকাশে থাকা কল্পিত ঈশ্বরের পূজোতে লেগে আছে।
সর্বশক্তিমান - এই সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের নির্মাণ, চালন ও নিয়ন্ত্রণকারী সর্বব্যাপক ঈশ্বর তত্ত্ব সর্বশক্তিমানই হওয়া উচিত। আজকের বিজ্ঞান এই বিষয়ে সচেতন যে সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ড কত বিশাল? সূক্ষ্ম কণা থেকে শুরু করে বিশাল লোকের রচনা করা, সেগুলোকে গতি প্রদান করা আর সব বল ও ঊর্জাকেও বল ও ঊর্জা প্রদান করা, কোনো সামান্য শক্তিশালী তত্ত্বের সামর্থ্য নয়। একটু ভেবে দেখুন যে এই পৃথিবী আর এর সমান কয়েক আরব-খারব লোক, এই লোকের থেকেও কয়েক লক্ষ ও কোটি গুণ ভারী নক্ষত্রকে তৈরি করতে, ধারণ করতে, পরিক্রমণ ও ঘূর্ণন করায় এমন সত্তার শক্তি কত হবে? এই কারণে সেই ঈশ্বর তত্ত্ব সর্বশক্তিমানই হতে পারে। এখানে মনে রাখতে হবে যে "সর্বশক্তিমান" শব্দের অর্থ এই নয় যে ঈশ্বর বিনা কোনো উপাদান পদার্থ নিয়ে শূন্য দিয়ে সৃষ্টি রচনা করতে পারে অথবা সে বিনা কোনো নিয়মে চমৎকারপূর্বক যেকোনো কিছু করতে পারে, আর তাঁর জন্য যেকোনো কার্য করা অসম্ভব নয়, এমন কথন উচিত নয়। কারণ ঈশ্বর স্বয়ং নিয়ামক হয়, সে নিজের নিয়ম অনুসারেই কার্য করে, অন্যথা কার্য করতে পারে না। তাঁর সর্বশক্তিমত্তা তো এই বিষয়ে যে সে এত বড় সৃষ্টিকে বিনা কারও সহায়তা নিয়ে তৈরি করে, চালায় ও সময় এলে তার প্রলয়ও করে।.
নিরাকার - এখন এই বিষয়ের উপর বিচার করুন, যে পদার্থ সর্বশক্তিমান অর্থাৎ অনন্ত ঊর্জা বল যুক্ত এবং সর্বব্যাপক হবে, তাঁর আকার কি হবে? আমি মনে করি এ বিষয়ে কোনো সাধারণ বুদ্ধির ব্যক্তিও এটাই বলবে যে সর্বব্যাপক ও সর্বশক্তিমতী সত্তার কোনো আকার হবে না। বস্তুতঃ ঊর্জা ও বলের মতো গুণ কোনো সাকার পদার্থের মধ্যে হয়ই না। এই সংসারের মধ্যে সাকার পদার্থের মধ্যে যে বল ও ঊর্জা দেখা যায়, সেটা আসলে সেই সাকার পদার্থের ভিতরে বিদ্যমান অন্য নিরাকার পদার্থেরই হয়। বিভিন্ন বিশাল বা লঘু যন্ত্রের মধ্যে বিদ্যুৎ, যা নিরাকার হয়, তো সেই বিদ্যুৎ আদিরই বল বিদ্যমান হয়। প্রাণীর শরীরের মধ্যে চেতন জীবাত্মারই বল কার্য করে। নিরাকার বিদ্যুৎ আদি পদার্থের মধ্যে চেতন পরম তত্ত্ব ঈশ্বরের বল কার্য করে, একথা আমি পূর্বেই লিখে দিয়েছি। যে ঈশ্বর তত্ত্ব প্রত্যেক সূক্ষ্ম ও স্থূল পদার্থের মধ্যে ব্যাপক হয়ে সেগুলোকে বল ও ঊর্জা প্রদান করছে, সে কেবল নিরাকারই হতে পারে, সাকার কখনও নয়।.
প্রশ্ন - ঈশ্বর তো নিরাকারই হয়, কিন্তু দুষ্টকে দণ্ড ও সজ্জনের সংরক্ষণ হেতু কখনও-কখনও শরীর ধারণ করে, একে ঈশ্বরের অবতার নেওয়া বলা হয়।.
উত্তর - এই কথা না কেবল বেদ এবং আর্ষ গ্রন্থের বিরুদ্ধ, অপিতু বিজ্ঞান ও যুক্তিরও সর্বথা বিরুদ্ধ।.অকায়মব্রণমস্নাবিরম্ (য়জুর্বেদ ৪০.৮)দিব্যো হ্যমূর্তঃ পুরুষঃ (মুণ্ডক উপনিষদ্ ২.২).এখানে ঈশ্বরকে অমূর্ত (নিরাকার), কখনও স্নায়ু-অন্ত্রের বন্ধনে আসে না অর্থাৎ অশরীরী বলা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বেদ, উপনিষদাদি গ্রন্থকে মানে এমন পৌরানিক (তথাকথিত সনাতনী) মহানুভাব অবতারবাদের ধারণার সংবাহক হয়ে আছে, এটা ভারী দুঃখের বিষয়। তারা মুখেই বলে যে বেদকে তারা ঈশ্বরীয় জ্ঞান ও পরম প্রমাণ মানে, কিন্তু তারা আসলে তথাকথিত প্রচলিত পুরাণ ব্রহ্মবৈবর্ত, ভাগবত আদির মধ্যেই আস্থা রাখে, অথচ ঐতরেয়, শতপথ আদি আসল পুরাণ থেকে নিতান্ত দূরে ও অনভিজ্ঞ আছে।.এই মিথ্যা ধারণা সনাতন বৈদিক ধর্ম, জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং সনাতন সংস্কৃতির ভারী বিনাশ করেছে, একথা বিগত ২-৩ সহস্র বছরের ভারতীয় ইতিহাস থেকে প্রমাণিত হয়। এই অবতারবাদের মিথ্যা ধারণা থেকে মূর্তিপূজা, বহুদেববাদাদি দোষের জন্ম নেয়, যার প্রতিক্রিয়াতেই বিশ্বের মধ্যে অনেক অবৈদিক সম্প্রদায়ের প্রাদুর্ভাব হয় আর বৈদিক ধর্মের ভারী অপকীর্তি হয় ও নিরন্তর হচ্ছে। আজ অনেক চালাক ও ধূর্ত ব্যক্তি স্বয়ংকে ঈশ্বরের অবতার বা এজেন্ট ঘোষিত করে ধর্মভীরু এবং অবিবেকী জনকে বিভ্রান্ত করে ঠকাচ্ছে।.এখন বেদ, উপনিষদের মতের সঙ্গে-সঙ্গে আমরা বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়েও বিচার করবো। যে মহানুভাব এমন বলে যে বিনা শরীর ধারণ করে ঈশ্বর দুষ্টের সংহার করতে পারবে না, তারা এটা ভাবে না যে এই বিশাল ব্রহ্মাণ্ডের সম্পূর্ণ প্রলয় করতে কিংবা এর সৃষ্টি করার জন্য তো শরীর ধারণ করতে হয় না, তাহলে কোনো মানুষকে মারার জন্য ঈশ্বরকে জন্ম নিতে হয়, এটা নিতান্ত অজ্ঞানতার কথা হবে। সেই ঈশ্বর অশরীরী থেকেও সেই দুষ্ট ও সজ্জনদের জন্ম দিতে পারে, তাহলে কি সেই ঈশ্বর অশরীরী থেকে ঐ দুষ্টদের মেরে সজ্জনদের রক্ষা করতে পারবে না? এই বিষয়ের উপর বিবেচনা করলে পুস্তকের স্তরটাই কম হয়ে যায়, কারণ যে মহানুভাব এই সাধারণ বিষয়টা বোঝে না যে সর্বব্যাপক, একরস ও নিরাকার ঈশ্বর কোনো শরীর বিশেষের মধ্যে কেন্দ্রিত হতে পারে না, সেই মহানুভাব বিজ্ঞানের গম্ভীর রহস্যের ভাণ্ডার বেদ ও আর্ষ গ্রন্থকে কিভাবে বুঝবে? এই কারণে এই সাধারণ বিষয়কে আমি এখানেই বিরাম দিবো।.
সর্বজ্ঞ - ঈশ্বর তত্ত্বের সর্বশক্তিমত্তার পশ্চাৎ তাঁর সর্বজ্ঞতার উপর বিচার করবো। এটা সামান্য বুদ্ধির কথা যে আধুনিক জগতে এক-দুটো যন্ত্রের নির্মাণকারী ইঞ্জিনিয়ার তথা ব্রহ্মাণ্ডের মাত্র কিছু রহস্যের জ্ঞান অর্জনকারী একজন বৈজ্ঞানিক অনেক বুদ্ধিমান মানা হয়। মানব নির্মিত যেকোনো জটিলতম রচনার থেকেও জটিল ও দুর্বোধ্য রচনা একটা গাছের পাতা হয়। শরীরের কোষিকার গঠন ও ক্রিয়াবিজ্ঞানের সামনে মহান থেকে মহান বৈজ্ঞানিকও নতমস্তক হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে যে এই সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডকে রচনা করেছে এবং চালাচ্ছে, সে কত জ্ঞানী হবে? বস্তুতঃ সেই ঈশ্বর সর্বজ্ঞই হয়। সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডকে জানার প্রচেষ্টা এই ভূমিতে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী মানব কোটি-কোটি বছর থেকে করে আসছে আর যতদিন সৃষ্টি থাকবে, এমন প্রচেষ্টা করতেই থাকবে, কিন্তু তাকে কখনও পূর্ণরূপে জানতে পারবে না। এমন সেই ব্রহ্মাণ্ডকে যে বানিয়েছে, যে তাকে চালাচ্ছে, সে নিশ্চয়ই সর্বজ্ঞ অর্থাৎ অনন্ত জ্ঞানী হবে।.
পবিত্র - এমন ধরণের ঈশ্বর কখনও সৃষ্টির উপাদান কারণ রূপ পদার্থের মধ্যে মিশ্রিত হয় না, তাই তাঁকে পবিত্রও বলা হয় অর্থাৎ সে সর্বদাই বিশুদ্ধ রূপে বিদ্যমান থাকে, এই কারণেই ঈশ্বরকে সৃষ্টির নিমিত্ত কারণ মানা হয়, অন্যদিকে প্রকৃতি রূপী মূল পদার্থকে এই সৃষ্টির উপাদান কারণ মানা হয়, এটাই হল বাস্তবতা। এরসঙ্গে এই তথ্যও আছে যে ঈশ্বর কখনও কোনো প্রকারে কিঞ্চিৎ মাত্র দোষাগ্রস্থ হয় না। সে সবকিছুর মধ্যে ব্যাপ্ত হয়েও সবার থেকে সর্বদা পৃথক বিশুদ্ধ রূপেই বিদ্যমান থাকে।.
সর্বাধার - এমন ঈশ্বরই এই ব্রহ্মাণ্ডকে তৈরি ও চালিয়ে তাকে ধারণ করে আছে, এই কারণে তাঁকে সর্বাধার বলা হয়। বর্তমান বিজ্ঞান সৃষ্টির ধারণের মধ্যে গুরুত্বাকর্ষণ বল তথা ডার্ক মেটারের ভূমিকা মানে। এটাও সত্য, কিন্তু এই ধারক পদার্থের ধারক স্বয়ং ঈশ্বর তত্ত্বই হয়। সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ড বিভিন্ন প্রকারের বলের দ্বারা ধারণ করে আছে আর সমস্ত বলের মূল বল ঈশ্বরেরই বল হয়, এটা আমি পূর্বেই সিদ্ধ করেছি। এই কারণে ঈশ্বরই সর্বাধার হয়।.
ন্যায়কারী-দয়ালু - এমন ঈশ্বর তত্ত্ব অবশ্যই সর্বদা সর্বথা পূর্ণ ও তৃপ্ত বা অকাম হওয়া উচিত। তাহলে সে এই সৃষ্টির রচনা নিজের জন্য নয়, বরং অন্য কোনো অপূর্ণ চেতন তত্ত্বের উপভোগ ও মোক্ষ হেতু করে। সেই অপূর্ণ চেতন তত্ত্বকেই জীবাত্মা বলে। এখানে "অপূর্ণ" অর্থ এটাই ধরে নেওয়া উচিত যে সে বল, জ্ঞান ও আয়তন আদির দৃষ্টিতে ঈশ্বরের তুলনায় অত্যন্ত লঘু হয়। কারণ সেই ঈশ্বর নিজের জন্য কিছুই চায় না, বরং জীবের ভালোর জন্যই সৃষ্টির রচনা করে, এই কারণে তাকে দয়ালু বলে। সে সর্বদা জীবদের তাদের কর্মের অনুসারেই ফল দেয়, না তারথেকে অধিক আর না ন্যূন। এই কারণে তাঁকে ন্যায়কারীও বলা হয়। কর্মানুসারে ফল প্রাপ্ত করা চেতন পদার্থ জগতে কারণ-কার্য নিয়মের সমান হয়। জড় জগতে আমরা সর্বত্র কারণ-কার্যের নিয়ম দেখতে পাই। বর্তমান বিজ্ঞানও জড় জগতে কারণ-কার্যের নিয়মকে স্বীকার করে। আর্থর বৈজোর লিখেছেন -"Cause and effects are still related in quantum mechanics, but what they concern needs careful interpretation."(Concepts of Modern Physics, Pg.161)
যখন জড় জগতে কারণ-কার্যের নিয়ম সর্বত্র কাজ করে, আমরা যদিও সেটা পুরোপুরি বুঝতে পারি না, তাহলে সে চেতন জগতে কাজ কেন করবে না? আমার মতে এখানে কর্মফল ব্যবস্থাই কারণ-কার্যের নিয়ম রূপে কাজ করে। আমরা একে পূর্ণরূপে কখনও জানতে পারবো না। ঈশ্বরও এই ব্যবস্থাকে উপেক্ষিত করতে পারবে না। তাঁর প্রার্থনা, উপাসনা আদি করলেও সে কখনও কোনো জীবের কর্মের অনিষ্ট ফল থেকে সেই জীবকে বাঁচাতে পারবে না, এরমধ্যেই তাঁর ন্যায় ও দয়া দুটোই সমাহিত আছে। যদি প্রার্থনা থেকে প্রভাবিত হয়ে সে জীবকে তার পাপের দণ্ড না দেয়, তাহলে তাঁর সম্পূর্ণ কর্ম-ফল এবং ন্যায় ব্যবস্থা তছনছ হয়ে যাবে।
.
কোনো অপরাধীর অপরাধকে ক্ষমা করা বিচারকের ন্যায় নয়, বরং অন্যায়ই হয়। এই ক্ষমার ফলে সেই অপরাধী পাপ করার জন্য আরও প্রোৎসাহিত হবে তথা এরফলে সে অনেক জীবকে আরও অধিক দুঃখ দিতে পারে, যার ফল স্বয়ং বিচারককেও ভুগতে হবে কিংবা সেই পাপের উত্তরদায়ী সে স্বয়ং হবে। এই কারণে সত্য বিচারক কখনও কোনো অপরাধকে ক্ষমা করে না আর ক্ষমা করা উচিতও নয়। যখন কোনো সত্য বিচারক এমন করে না, তাহলে সেই পরমাত্মা রূপী বিচারক কেন কারও অপরাধকে ক্ষমা করে নিজের ন্যায় ব্যবস্থাকে ভঙ্গ করবে?
.
ঈশ্বরীয় ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভাবে ব্যবস্থিত ও স্বাভাবিক হয়, সেখানে কখনও কোনো স্খলন হয় না। এই কারণে যে ঈশ্বরবাদী প্রার্থনা, য়াগ, তৌবা, কনফারেন্স আদির দ্বারা নিজের পাপমোচনের কামনা করে, তারা ঈশ্বর তত্ত্বের বিশুদ্ধ স্বরূপকে জানে না। পাপের ফলের বিষয়ে মহাদেব শিব ভগবতী উমাকে বলেছেন -
দ্বিধা তু ক্রিয়তে পাপম্ সদ্ভিশ্চাসদ্ভিরেব চ।
অভিসম্ধায় বা নিত্যমন্যথা বা য়দৃচ্ছয়া।।
অভিসম্ধিকৃতস্যৈব নৈব নাশোऽস্তি কর্মণঃ।
অশ্বমেধসহস্রৈশ্চ প্রায়শ্চিত্তশতৈরপি।।
অন্যথা য়ত্ কৃতম্ পাপম্ প্রমাদাদ্ বা য়দৃচ্ছয়া।
প্রায়শ্চিত্তাশ্বমেধাভ্যাম্ শ্রেয়সা তৎ প্রণশ্যতি।।
(মহাভারত, অনুগীতাপর্ব, দানধর্মপর্ব, অধ্যায় ১৪৫ - দাক্ষিণাত্য সংস্করণ)
.
এর অর্থ হল যে পাপ প্রমাদ বা অসাবধানীপূর্বক হয়ে যায়, তাকে প্রায়শ্চিত্ত আদি কিছু উপায়ে মুছে ফেলা যেতে পারে, কিন্তু যে পাপ জেনেবুঝে বা প্রতিজ্ঞাপূর্বক করা হয়েছে, সেটা কখনও নাশ প্রাপ্ত হয় না অর্থাৎ তার ফল অবশ্যই ভোগ করতে হবে। এটাই হল ঈশ্বরের সত্য ন্যায় আর আসল দয়া হল এটাই। দণ্ড দেওয়ার পিছনেও ঈশ্বরের প্রয়োজন আছে যে যাতে সেই পাপী প্রাণীর পাপ থেকে অন্য প্রাণীর রক্ষা হতে পারে আর সেই পাপী প্রাণী স্বয়ং যেন ভবিষ্যতে আর পাপ কর্ম করতে প্রবৃত্ত না হয়। সেই ঈশ্বর পাপী জীবকে এই ভাবে দণ্ড দেয়, যেমন যোগ্য মাতা-পিতা নিজের সন্তানকে মন্দ থেকে বাঁচানোর জন্য দয়াপূর্বক তাড়না করে, তারা যেমন ক্রোধবশত এমন করে না। ঈশ্বরও ঠিক সেই রকম সকল জীবের সবথেকে বড় মাতা-পিতার সমান পালক, ন্যায়কারী ও দয়ালু হয়।
.
আজ সংসারে এক সত্য সনাতন বৈদিক ধর্মকে ত্যাগ করে মানব সমাজ বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভাজিত হয়ে বিভিন্ন ঈশ্বরের কল্পনা করছে। প্রায়শঃ সব সম্প্রদায় পাপ থেকে মুক্তির অনেক সরল উপায়ের কথা বলে। প্রায় সবাই ঈশ্বরকে পাপ ক্ষমাকারী মানে। এইজন্য ঈশ্বরকে প্রসন্ন করার জন্য বিভিন্ন প্রকারের পূজাড়ম্বর, নদী স্নান, নাম স্মরণ, কথা স্মরণ, ব্রত, উপবাস, রোজা, প্রার্থনা, নামাজ, বিভিন্ন মূর্তি, গাছ বা পশুর পূজা আদি অনেক সাধন প্রচারিত করে রেখেছে। এইসব থেকে পাপ তো ক্ষমা হয় না, কিন্তু এইসব আড়ম্বরের প্রচারকদের আজীবিকা অবশ্য চলছে। এই আড়ম্বর যত মাত্রায় বাড়ছে, পাপও ততই মাত্রায় নিরন্তর বেড়ে চলেছে। এর ফলে সামান্য প্রবুদ্ধ ব্যক্তির বিশ্বাস না কেবল ঈশ্বর ও তাঁর কর্মফল ব্যবস্থা থেকে উঠে যাচ্ছে, অপিতু নৈতিক মূল্যেরও নিরন্তর ক্ষরণ হচ্ছে। এই কারণে ঈশ্বরের দয়ালু ও ন্যায়কারী উভয় বিশেষণ সম্বন্ধীয় বৈজ্ঞানিক স্বরূপ জেনে রাখা নিতান্ত আবশ্যক।
.
খুবই দুঃখজনক ও আশ্চর্যের বিষয় যে ভগবান্ শিবের উপরোক্ত বচনের উপেক্ষা করে ভগবান্ শিবের পূজার নামে শিবভক্ত বিভিন্ন প্রকারের পাপকে ক্ষমা করানোর কামনায় মন্দিরের মধ্যে প্রতিমাপূজন করতে দেখা যায়। বস্তুতঃ এইসব ভক্ত পাপ ত্যাগের চেষ্টা করে না, পাপ ত্যাগ করার জন্য বুদ্ধি ও শক্তিও ঈশ্বরের কাছে চায় না, বরং ভরপুর মাত্রায় পাপ করেও যেন পাপের ফল কখনও না প্রাপ্ত হয়, এটাই প্রার্থনা করে। এরথেকে বড় নাস্তিকতা আর কি হতে পারে? এমন করে তারা যেন ঈশ্বরকে ঘুষখোর অথবা মূর্খ মনে করে। কোনো ভক্ত কি একে ভালো বলবে? এটা তো ছদ্মবেশী নাস্তিকতা, যা পরিষ্কার নাস্তিকতা অর্থাৎ ঈশ্বরকে না মানার থেকেও অধিক ঘাতক হয়।
.
এখানে আরও জ্ঞাতব্য হল, যারা ঈশ্বরকে ক্ষমাকারীও মানে না আর সন্ধ্যা, যজ্ঞ ও ধ্যানাদি করে, তারাও পাপের মধ্যে লিপ্ত হয় আর এমন করেও স্বয়ংকে আধ্যাত্মিক প্রবক্তা বা আর্য মনে করে। এই ব্যবহারকেও ছদ্মবেশী নাস্তিকতা বলে, যা মূর্তিপূজন আদির থেকেও অধিক দোষপূর্ণ হয়। সত্য তো এটাই যে সৃষ্টিকে না জেনে কোনো ব্যক্তিই সত্য আস্তিক হতে পারবে না।
.
এইভাবে ঈশ্বর তত্ত্বের অনন্ত গুণ, কর্ম ও স্বভাব আছে। আমি এখানে মাত্র কয়েকটা গুণের বর্ণনা করেছি। ঋষি দয়ানন্দ সরস্বতী আর্যসমাজের দ্বিতীয় নিয়মে ঈশ্বর তত্ত্বের স্বরূপের অত্যন্ত সুন্দর বর্ণনা করে লিখেছেন -
"ঈশ্বর সচ্চিদানন্দস্বরূপ, নিরাকার, সর্বশক্তিমান, ন্যায়কারী, দয়ালু, অজন্মা, অনন্ত, নির্বিকার, অনাদি, অনুপম, সর্বাধার, সর্বেশ্বর, সর্বব্যাপক, সর্বান্তর্যামী, অজর, অমর, অভয়, নিত্য, পবিত্র আর সৃষ্টিকর্তা হয়। কেবল তাঁরই উপাসনা করা উচিত।"
.
ঈশ্বরের স্বরূপের এরথেকে সুন্দর আর প্রভাবশালী সূত্ররূপে বর্ণনা কোথাও খুঁজে পাওয়া সম্ভবত অসম্ভব। আজ সংসারে প্রচলিত বিভিন্ন মত-সম্প্রদায়ের মধ্যে ঈশ্বরের মিথ্যা কল্পিত স্বরূপের ভরমার আছে। এমনই ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্টিফেন হকিং তার "দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন" নামক পুস্তকে উপহাসপূর্বক খণ্ডন করেছেন আর এমনটা করাও উচিত। যদি হকিংয়ের সামনে ঈশ্বর তত্ত্বের এই বৈদিক বৈজ্ঞানিক স্বরূপ বিদ্যমান হতো, তাহলে তাকে ঈশ্বর তত্ত্বের মান্যতাকে খণ্ডিত করার আবশ্যকতা হতো না। এটা ভারী আশ্চর্যের বিষয় যে কোনো ঈশ্বরবাদী হকিংয়ের বিচারকে পড়ে ঈশ্বরের সত্য স্বরূপকে জানার জন্য প্রবৃত্ত হতে দেখা যায়নি, বরং ঈশ্বরের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করার উপর জোর দেওয়া হয়। আশা করি আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণ আমার ঈশ্বর বিষয়ক এই প্রকরণ থেকে ঈশ্বরীয় সত্তা ও তাঁর স্বরূপের বোধ অবশ্যই হবে আর তারা হকিংয়ের মতো ভুল করবেন না।
(ক্রমশঃ)
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ