অথর্ববেদ চতুর্দশ কাণ্ড প্রথম সূক্ত - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

01 August, 2025

অথর্ববেদ চতুর্দশ কাণ্ড প্রথম সূক্ত

অথর্ববেদ কাণ্ড ১৪

অথর্ববেদ–সংহিতা — চতুর্দশ কাণ্ড

প্রথম অনুবাক

প্রথম সূক্ত : বিবাহ–প্রকরণম

[ঋষি : সূর্যা সাবিত্রী। দেবতা : আত্মা, সোম, বিবাহ, বধূবাস, সংস্পর্শমোচন, বিবাহমন্ত্ৰাশিষ। ছন্দ : অনুষ্টুপ, পংক্তি, ত্রিষ্টুপ, জগতী, বৃহতী, উষ্ণিক।]

ক্ষেমকরণ ত্রিবেদী ভাষ্য

সত্যেনোত্তভিতা ভূমিঃ সূর্যেপোত্তভিতা দৌঃ। 

ঋতেনাদিত্যাস্তিষ্ঠন্তি দিবি সোমো অধি শ্রিতঃ ॥ ১৷৷ 

পদার্থঃ (সত্যেন) সত্যস্বরূপ পরমেশ্বর দ্বারা (ভূমিঃ) ভূমি (উত্তভিতা) [আকাশে] উত্তমরূপে ধারিত, এবং (সূর্যেণ) সূর্যলোক দ্বারা (দ্যৌঃ) প্রকাশ (উত্তভিতা) উত্তম রীতিতে ধারিত। (ঋতেন) সত্য নিয়ম দ্বারা (আদিত্যাঃ) প্রকাশমান কিরণ-সমূহ [বা অখণ্ড সূক্ষ্মপরমাণু] (তিষ্ঠন্তি) স্থিত হয়, এবং (দিবি) [সূর্যের] প্রকাশে (সোমঃ) চন্দ্র (অধি) যথাবৎ (শ্রিতঃ) আশ্রিত রয়েছে ॥১॥

ভবার্থঃ লোক দুই প্রকারের− একটি প্রকাশক যেমন সূর্য আদি এবং অন্যটি অপ্রকাশমান যেমন পৃথিবী চন্দ্র ইত্যাদি। পরমেশ্বরের নিয়ম দ্বারা প্রকাশক সূর্য আদি লোক প্রকাশ্য পৃথিবী চন্দ্র আদি লোক-সমূহকে নিজের প্রকাশ দ্বারা প্রকাশিত করে ॥১॥১−মন্ত্র ১ তথা ২ মহর্ষিদয়ানন্দকৃত ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকা, প্রকাশ্যপ্রকাশকবিষয় পৃ০ ১৪৩, ১৪৪ এ ব্যাখ্যাত রয়েছে।২−মন্ত্র ১-৩ ঋগ্বেদ এ আছে−১০।৮৫।১-৩। মন্ত্র ৩ আলাদাভাবে রয়েছে ॥

টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

[ভূমিঃ = মাতৃশক্তি "দ্যৌরহং পৃথিবী ত্বম্" (অথর্ব০ ১৪।২।৭১)। বিবাহ সংস্কারে বর বলে- বধূ ! আমি তো দ্যৌ এবং তুমি পৃথিবী। ভূমিঃ- ভবন্তি, উৎপদ্যন্তে, অপত্যানি যস্যাম্। সূর্যেণ =চক্ষুষা “চক্ষোঃ সূর্যো অজায়ত" (যজু০ ৩১।১২) তথা "যস্য সূর্যঃ চক্ষু" (অথর্ব০ ১০।৭।৩৩)। দ্যৌঃ = পিতৃশক্তি (অথর্ব০ ১৪।২।৭১)। দিবি - মস্তিষ্কে, "দিবং যশ্চক্রে মূর্ধানম্" (অথর্ব০ ১০।৭।৩২); তথা "শীর্ষ্ণো দ্যৌঃ সমবর্তত" (যজু০ ৩১।১৩)। সোমঃ- বীর্য; "রেতঃ সোমঃ" (কৌ০ ব্রা০ ১৩।৭; শ০ ব্রা০ ৩।৩।২।১; ৩।৩।৪।২৮; ৩।৪।৩।১১; ১।৯।২।৯; ২।৫।১।৯; ৩।৮।৫।২; তৈ০ ব্রা০ ২।৭।৪।১] ব্যাখ্যা-- সত্যাচার তথা সত্যানুষ্ঠানের সম্বন্ধ মাতৃশক্তির সাথে দর্শানো হয়েছে। মাতা অর্থাৎ মহিলাদের মধ্যে ধর্মভাবনা অধিক জাগরূক থাকে। মাতৃশক্তির মধ্যে যদি সত্যাচার এবং সত্যানুষ্ঠানের অভাব হয় তবে সন্ততির ওপর এর কুপ্রভাব অধিক মাত্রায় পড়ে, এবং নৈতিক দৃষ্টিতে সমাজ সংগঠনও অধিক শিথিল হয়ে যায়। এইজন্য মাতৃশক্তির মধ্যে সত্যাচার তথা সত্যানুষ্ঠানর অত্যন্ত আবশ্যকতা রয়েছে। সূর্য দ্বারা দ্যুলোক ধারিত রয়েছে,-এমন অর্থ যুক্তি বিরুদ্ধ। সূর্যও একটি নক্ষত্র বা তারা। যথা “অগ্নে নক্ষত্রমজরমা সূর্য রোহয়ো দিবি" (ঋ০ ১০।১৫৬।৪)। হে অগ্নি! তুমি অজর-নক্ষত্র সূর্যকে দ্যুলোকে আরূঢ় করেছো। দ্যুলোকে অন্য নক্ষত্র তথা তারা এই সূর্যের থেকেও বড়ো, অতঃ এই সূর্য দ্যুলোককে ধরে রেখেছে, -এই কথন উপপন্ন হতে পারে না। সাথে এটাও জানা আবশ্যক, কাণ্ড ১৪ এর সূক্ত ১ এবং ২ বিবাহপরক। বিবাহ প্রকরণে "সূর্য দ্যুলোককে ধারণ করে রয়েছে"- এমন বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন। এইভাবে মন্ত্রের শেষ ভাগেরও প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যা যুক্তিরহিত। পিতৃশক্তির মধ্যে সত্যাচার তথা সত্যানুষ্ঠানের সাথে সাথে দৃষ্টিশক্তি এবং মস্তিষ্কের শক্তির প্রাধান্য হওয়া উচিত। পিতৃশক্তির মধ্যে এই দুটি গুণ.. প্রায়ঃ প্রধান হয়। দৃষ্টিশক্তির অভিপ্রায় হল দেখার-নিরীক্ষণ করার শক্তি, তথা মস্তিষ্ক শক্তির অভিপ্রায় হল বিচার, নির্ণয় আাদি শক্তি-সমূহ। মাতৃশক্তিতে হৃদয়ের প্রাধান্য হওয়া উচিত এবং পিতৃশক্তির ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের। এইজন্য মন্ত্রে মাতৃশক্তির সাথে সত্যের সম্বন্ধ দর্শানো হয়েছে এবং পিতৃশক্তির সাথে সূর্যের অর্থাৎ জ্ঞান প্রকাশের। মাতৃশক্তির স্থিতি সত্যনিষ্ঠা ওপর নির্ভর এবং পিতৃশক্তির মস্তিষ্কের ওপর। ঋত২ এর অর্থ হল নিয়ম তথা পবিত্রকর্ম আদি। ব্রহ্মচর্যাশ্রমে ঋত অর্থাৎ নিয়ম-সমূহ তথা পবিত্র কর্মের আবশ্যকতা খুবই প্রয়োজন।নিয়ম-সমূহ এবং পবিত্রকর্ম ছাড়া বসু= ব্রহ্মচারী [২৪ বর্ষ পর্যন্ত ব্রহ্মচারী] হওয়া দুষ্কর হয়ে যায়, আদিত্য= ব্রহ্মচারী অর্থাৎ ৪৮ বর্ষের ব্রহ্মচর্য পালন করা তো সুতরাং অতি কঠিন। মন্ত্রে এটা দর্শানো হয়েছে আদিত্য ব্রহ্মচারী হওয়ার জন্য এটা আবশ্যক যে, ব্রহ্মচারী ঋত-মার্গের অবলম্বন করুক, অনৃত-মার্গের নয়। মন্ত্রে সোম শব্দের অর্থ বীর্য। এই বিষয়ে অন্য প্রমাণ:- (অ) সোম শব্দ "সু" ধাতু থেকে সৃষ্ট, যার একটি অর্থ প্রসব। বীর্য হল, প্রসবের কারণ। Seed, Semen শব্দগুলোতেও "সু" ধাতুই প্রতীত হয়। সোম শব্দে "সু" ধাতু এবং "মন্" হল প্রত্যয় (উণা০ ১।১৪০)। অতঃ সোম-এর মৌলিকরূপ হল "সুমন্", যা Semen এর অনুরূপ। Semen এর অর্থ ইংরেজি ভাষায় বীর্য। (আ) যজুর্বেদ ১৯ তথা ২০ অধ্যায়ে সোমকে শুক্র, রেতঃ, এবং ইন্দ্রিয় বলা হয়েছে (১৯।৭২, ৭৬, ৭৯, ২০।৫৫)। শুক্র-এর অর্থ বীর্যও হয়। তথা ইন্দ্রিয়ের অর্থ বল৩ এবং সামর্থ্যও। বীর্য দ্বারা বল এবং সামর্থ্য প্রাপ্ত হয়। (ই) আয়ুর্বেদে অগ্নি ও সোম শব্দের প্রয়োগ রজস্ তথা বীর্যের জন্য হয়েছে। যথা "সৌম্যং শুক্রমার্তবমাগ্নেয়ম্", অর্থাৎ শুক্র হল সোম, তথা ঋতুধর্ম হল অগ্নি। তথা "শুক্রং চ্যুতং যোনিমভিপ্রপদ্যতে সংসৃজ্যতে চার্ত্তবেন। ততোঽগ্নিসোমসংয়োগাৎ সংসৃজ্যমানো, গর্ভাশয়মনু প্রতিপদ্যতে ক্ষেত্রজ্ঞঃ" (সুশ্রুত, শরীর স্থান, অ০ ৩, সূত্র ৪)। অর্থাৎ শুক্র (বীর্য) পুরুষ থেকে চ্যুত হয়ে যোনিতে আসে, এবং ঋতুধর্ম (রজস্) এর সাথে মিলিত হয়। তখন অগ্নি এবং সোমের সংযোগের সাথে মিলে জীবাত্মা গর্ভাশয় প্রাপ্ত হয়। বৈদিক সাহিত্য অনুসারে সংসার তিন লোক-এ বিভক্ত। পৃথিবী-লোক, অন্তরিক্ষ লোক, তথা দ্যুলোক। আধিদৈবিক দৃষ্টিতে এই তিনটি লোক প্রত্যক্ষ দর্শিত হচ্ছে। আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে পা থেকে কটিভাগ পর্যন্ত পৃথিবীলোক, মধ্যভাগ অন্তরিক্ষলোক, তথা জ্ঞানেন্দ্রিয় সমেত মস্তক হল দ্যুলোক। বেদে দ্যুলোক তথা মূর্ধা অর্থাৎ মস্তকে উপমানোপমেয়ভাব দর্শানো হয়েছে। যথা- "দিবং যশ্চক্রে মূর্ধানং তস্মৈ জ্যেষ্ঠায় ব্রহ্মণে নমঃ" (অথর্ব০ ১০।৭।৩৩)। এইজন্য প্রকরণানুসারে মন্ত্রে "দিবি" এর অর্থ হল মস্তিষ্কে। মন্ত্রের উত্তরার্ধে এটা দর্শানো হয়েছে নিয়ম-সমূহ তথা কর্তব্যের পালন করলেই মনুষ্য আদিত্য-ব্রহ্মচারী হয়, এবং এই আদিত্য-ব্রহ্মচারীদের দিব্ অর্থাৎ মস্তিষ্কে সোম অর্থাৎ বীর্য আশ্রিত থাকে, অর্থাৎ বীর্য এঁদের মস্তিষ্ক তথা বিচারশক্তির নির্মাণ এবং পরিপোষণ করে। এমন ব্রহ্মচারীকে "ঊর্ধ্বরেতা" বলা হয়। এইভাবে মন্ত্রে মাতৃশক্তি এবং পিতৃশক্তির মধ্যে ভেদ/পার্থক্য দেখিয়ে, শেষে উচ্চকোটির ব্রহ্মচর্যের বর্ণনা করা হয়েছে, এবং সাথে ব্রহ্মচর্যের সাধন-সমূহেরও বর্ণনা হয়েছে। মন্ত্রের সারমর্ম হল, উচ্চকোটির আদিত্য ব্রহ্মচারীর, তথা সত্য আদি ধার্মিক ভাবনাযুক্ত এবং ভূমির সদৃশ উৎপাদনশক্তি বিশিষ্ট "সূর্যা" নামক ব্রহ্মচারিণীর পরস্পর বিবাহ হল আদর্শ বিবাহ।] [১."চক্ষোঃ সূর্যোঽঅজায়ত" (যজু০ ৩১।১২) এ, সূর্য এবং চক্ষুঃ অর্থাৎ দৃষ্টির পরস্পর সম্বন্ধ দর্শানো হয়েছে। ২. ঋত= Thoper, Right, Fixed or settled rule, law, Gious action, Divine truth (আপ্টে)। ৩. ইন্দ্রিয় = Power, force (আপ্টে)।]

সোমেনাদিত্য বলিনঃ সোমেন পৃথিবী মহী। 

অথথা নক্ষত্রাণামেষামুপস্থে সোম আহিতঃ॥ ২॥ 

পদার্থঃ (সোমেন) চন্দ্রের সাথে (আদিত্যাঃ) সূর্যের কিরণ-সমূহ (বলিনঃ) বলবান্ [হয়] এবং (সোমেন) চন্দ্রের [প্রকাশের] সাথে (পৃথিবী) পৃথিবী (মহী) বলবতী অর্থাৎ পুষ্ট [হয়]।(অথো) এবং (এষাম্) এই (নক্ষত্রাণাম্) গতিশীল তারাগণের  (উপস্থে)  সমীপে  (সোমঃ) চন্দ্র (আহিতঃ) স্থাপিত ॥ 

ভাবর্থঃ চন্দ্র শীতলস্বভাব বিশিষ্ট, সূর্যের কিরণ-সমূহ চন্দ্রের উপর পড়ে শীতল হয়ে যায়, এবং যখন তা চন্দ্র থেকে ঘুরে বায়ুর সাথে মিশে পৃথিবীতে পড়ে, তখন শীতলতার কারণে পৃথিবীর অন্ন আদি পদার্থ-সমূহকে পুষ্ট করে। এইভাবে সূর্য এবং চন্দ্রের প্রভাব নক্ষত্রগুলোর ওপর হয় ॥

টিপ্পণীঃ
[পৃথিবী = স্ত্রী। মন্ত্র ১ এ ভূমি শব্দ দ্বারা স্ত্রী-এর নির্দেশ করা হয়েছে। এর জন্য মন্ত্র ১ পর টিপ্পণী দ্রষ্টব্য। মহী= মহ পূজায়াম্। নক্ষত্রাণাম্ =ন + ক্ষৎ + র। অর্থাৎ অক্ষতবীর্য এবং অক্ষতযোনিবিশিষ্ট পুরুষদের এবং স্ত্রীদের। উপস্থে= জননেন্দ্রিয়ের মধ্যে। সোম শব্দ দ্বারা পুরুষনিষ্ঠ এবং স্ত্রীনিষ্ঠ সন্তানোৎপাদক-তত্ত্ব অর্থাৎ বীর্য এবং রজস্ অভিপ্রেত হয়েছে। ব্যাখ্যা-- আদিত্য ব্রহ্মচারী বীর্য দ্বারা বলবান হয়। ৪৮ বর্ষের ব্রহ্মচারী আদিত্য ব্রহ্মচারী কথিত হয়। স্ত্রী-ব্রহ্মচারিণীও রজস্ শক্তির কারণে পূজনীয়া হয়। স্ত্রী-এর স্থান সেটাই যা ভূমি এবং পৃথিবীর। অনুর্বর পৃথিবী অনুৎপাদিকা হয়। বীজ বপন করলে পৃথিবী যখন সবুজাভ হয় তখন পৃথিবীর শোভা বৃদ্ধি পায়। এইভাবে পুরুষের বীর্যরূপী বীজের কারণে যখন মাতার কোল মানো পরিপূর্ণ হয়, তখন মাতা হয়ে স্ত্রী, পূজা তথা সম্মানীয় হয়ে যায়। যাদের বীর্য বা রজস্ ব্রহ্মচর্যাশ্রমে ক্ষত হয় না তাঁদের উপস্থেন্দ্রিয়/জননেন্দ্রিয়-এর মধ্যে গৃহস্থাশ্রমের সময়ে, বীর্য উপস্থিত হয়, এবং যাদের বীর্য ক্ষত হতে থাকে তাঁরা নির্বীয হয়ে যায়, এবং গৃহস্থ জীবনের উচিত/সঠিক সময়ে তাঁদের উপস্থেন্দ্রিয়ে বীর্যের উপস্থিতি হয় না/থাকে না। তাঁরা সন্তান-কর্মের জন্য নিঃশক্ত হয়ে যায়। পৃথিবী = প্রথ-বিস্তারে। মাতা সন্তানদের দ্বারা সমাজের বিস্তার করে।] [১. সোম শব্দ যদ্যপি বীর্যার্থক। কিন্তু এই মন্ত্রগুলোতে "সন্তানোৎপাদক-তত্ত্ব" অর্থ নেওয়া উচিত, যা সোম শব্দের ধাত্বর্থ। অতঃ সোমশব্দ দ্বারা বীর্য এবং রজস্ উভয় অর্থ অভিপ্রেত হয়েছে।]

সোমং মন্যতে পপিবান্ যৎ সম্পিষন্ত্যোধি। 

সোমং যং ব্রহ্মাণে বিদুন তস্যাশ্নাতি পার্থিবঃ ॥ ৩৷৷ 

পদার্থঃ (সোমম্) চন্দ্রের [অমৃত] (পপিবান্) আমি পান করেছি, [এই কথন মনুষ্য] (মন্যতে) মানে/মান্য করে, (যৎ) যখন (ওষধিম্) ঔষধি [অন্ন, সোমলতা আদিকে] (সম্পিষন্তি) সেই [মনুষ্য] পিষ্ট করে। (যম্) যে (সোমম্) জগৎস্রষ্টা পরমাত্মাকে (ব্রহ্মাণঃ) ব্রহ্মজ্ঞানীরা (বিদুঃ) জানে, (তস্য) উনার [অনুভব] (পার্থিবঃ) পৃথিবীর [বিষয়ে] আসক্ত পুরুষ (ন) না (অশ্নাতি) ভোগ করে/প্রাপ্ত করে ॥৩॥

ভাবার্থঃ চন্দ্র দ্বারা পুষ্ট অন্ন সোমলতা ইত্যাদির সেবন দ্বারা মনুষ্য শরীরপুষ্টি করে, কিন্তু যে মনুষ্য বিদ্বানদের সৎসঙ্গ করে ঈশ্বরজ্ঞান দ্বারা আত্মাকে পুষ্ট করে, তাঁরা শরীরপোষকের অপেক্ষা অধিক আনন্দ প্রাপ্ত করে ॥৩॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ ও পদার্থ বিশ্বানাথ বিদ্যালঙ্কারঃ

পদার্থঃ (যৎ) যখন [ঋত্বিকগণ] (সোমম্, ওষধিম্) সোম ঔষধিকে (সং পিষন্তি) একসাথে বা সম্যকরূপে পিষ্ট করে [তখন যজমান] (মন্যতে) মান্য করে (সোমম্) সোম (পপিবান্) আমি পান করেছি। কিন্তু (ব্রহ্মাণঃ) ব্রহ্মবেত্তা বা বেদবেত্তা (যম) যাকে (সোমম) সোম (বিদুঃ) জানে, (পার্থিবঃ) পৃথিবী ভোগী পুরুষ (তস্য) সেই সোমের (অশ্নাতি, ন) অশন বা সেবন করে না।

টিপ্পণীঃ
[ব্যাখ্যা- মন্ত্রে সোমপানের বর্ণনা আছে। মন্ত্রে বলা হয়েছে সোম ঔষধিকে পিষ্ট করে এবং রস বের করে পান করে যে ব্যক্তি মনে করে আমি সোম পান করে নিয়েছি সে সোমপানের অভিপ্রায় ঠিকভাবে বোঝে না। ব্রহ্মবেত্তাদের বা বেদবেত্তাদের মতে সোমপান আলাদা বস্তু। পার্থিব অর্থাৎ স্ত্রীভোগী পুরুষ, ব্রহ্মবেত্তাদের দ্বারা জ্ঞাত সোমপান করতে পারে না। ব্রহ্মবেত্তাদের সোমপান হল সন্তানোৎপাদকতত্ত্বকে শরীরের মধ্যেই লীন করে দেওয়া, এবং তার দ্বারা মস্তিষ্কশক্তি, শারীরিক শক্তি, এবং আত্মিকশক্তি বৃদ্ধি করা। পার্থিবঃ= মন্ত্র ১,২ এ ভূমি এবং পৃথিবী শব্দ দ্বারা স্ত্রী-এর বর্ণনা হয়েছে। অতঃ পার্থিব শব্দের অর্থ "স্ত্রীভোগী" করা হয়েছে। এমন ভোগগুলোকে পার্থিবভোগ তথা Earthly enjoyments বলা হয়।]

যৎ ত্বা সোম প্রপিবন্তি তত আ প্যায়সে পুনঃ। 

বায়ুঃ সোমস্য রক্ষিতা সমানাং মাস আকৃতিঃ। ৪


পদার্থঃ (সোমঃ) হে চন্দ্র ! (যৎ) যখন (ত্বা) তোমাকে (প্রপিবন্তি) সেই [কিরণ-সমূহ] পান করে, (ততঃ) তখন (পুনঃ) পুনঃ (আ প্যায়সে) তুমি পরিপূর্ণ হয়ে যাও। (বায়ুঃ) পবন (সোমস্য) চন্দ্রের (রক্ষিতা) রক্ষক এবং (মাসঃ) সকলের পরিমাপক [পরমেশ্বর] (সমানাম্) অনুকূল ক্রিয়ার (আকৃতিঃ) নির্মাতা ॥৪॥

ভাবার্থঃ যখন চন্দ্রের রস, সূর্যের কিরণ-সমূহ টেনে নেয়, সেই রস পৃথিবীতে কিরণ-সমূহের দ্বারা আসে এবং পদার্থ-সমূহকে পুষ্ট করে, তৎপশ্চাৎ সেই পার্থিব রস কিরণের মাধ্যমে বায়ু দ্বারা শোষিত হয়ে চন্দ্রে পৌঁছায়। এইভাবে চন্দ্র ঈশ্বরনিয়ম দ্বারা প্রাণীদের জন্য সদা উপকারী হয়॥৪॥ এই মন্ত্র কিছুটা আলাদাভাবে ঋগ্বেদে আছে−১০।৮৫।৫ ॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ ও পদার্থ বিশ্বানাথ বিদ্যালঙ্কারঃ

(সোম) হে বীর্য অর্থাৎ সন্তানোৎপাদক-তত্ত্ব ! (যৎ) যখন (ত্বা) তোমাকে (প্র পিবন্তি) ব্রহ্মচারী প্রকর্ষরূপে পান করে, (ততঃ) তদনন্তর (পুনঃ) পুনঃ অর্থাৎ আরও অধিক (আ প্যায়সে) তুমি বৃদ্ধি পাও/বর্ধিত হও। (বায়ুঃ) প্রাণায়াম (সোমস্য) বীর্য অর্থাৎ সন্তানোৎপাদক-তত্ত্বের (রক্ষিতা) রক্ষা করো, (আকৃতিঃ) তথা উহার নির্মাণ করো, যেমন (মাসঃ) মাস (সমানাম্) বর্ষ/বছরের (আকৃতিঃ) নির্মাণ করে।

[ব্যাখ্যা- বীর্য পান অর্থাৎ বীর্যকে রক্তের মধ্যে অন্তর্লয় করলে বীর্য আরও অধিক বৃদ্ধি পায়। প্রাণায়াম এবং শুদ্ধ বায়ুর সেবন দ্বারা বীর্যের রক্ষা এবং উহার নির্মাণ হয়। শুদ্ধ বায়ু এবং শুদ্ধ বায়ুতে কৃত প্রাণায়াম দ্বারা বীর্যের নির্মাণের ক্ষেত্রে মাস ও বর্ষ/বছরের দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে। মাস এবং বর্ষ/বছরের মধ্যে পরস্পর তাদাত্ম্য সম্বন্ধ আছে। মাসের সমূহই হল বর্ষ। এই দৃষ্টান্ত দ্বারা বেদ দর্শিয়েছে যে, শুদ্ধ বায়ু এবং শুদ্ধবায়ুতে কৃত প্রাণায়াম এবং বীর্যের মধ্যেও তাদাত্ম্য সম্বন্ধ আছে। মানো শুদ্ধ বায়ু এবং প্রাণায়ামই বীর্যরূপে পরিণত হয়ে যায়। এই তাদাত্ম্য সম্বন্ধকে দর্শিয়ে বেদ বীর্যের নির্মাণ তথা বীর্যের রক্ষার সম্বন্ধে প্রাণায়ামের মহত্ত্ব দর্শিয়েছে। "সমানাম্" এ সমা এর অভিপ্রায় হল, চান্দ্রবর্ষ। বেদে চন্দ্রকে মাসের নির্মাতা বলা হয়েছে। যথা "অরুণো মাসকৃদ বৃকঃ" (ঋ০ ১।১০৫।১৮) এর ব্যাখ্যায় নিরক্তকার বলেছেন "অরুণ আরোচনো, মাসকৃন্মাসানাং চার্ধমাসানাং চ কর্তা ভবতি চন্দ্রমা, বৃকঃ বিবৃতজ্যোতিষ্কো বা, বিকৃতজ্যোতিষ্কো বা বিক্রান্ত জ্যোতিষ্কো বা" (৫।৪।২০, ২১)। সম্বৎসর= সৌরবর্ষ। সমাঃ সম্বৎসরান্ মাসান্ ভূতস্য পতয়ে যজে (৩।১০।৯)]

আচ্ছদ্বিধানৈপিতে বাহঁতৈঃ সোম রক্ষিতঃ। 

গ্রামিচ্ছুম্বন্ তিষ্ঠসি ন তে অশ্নাতি পার্থিবঃ ॥ ৫৷৷ 

পদার্থঃ (সোমঃ) হে সর্বোৎপাদক পরমেশ্বর (আচ্ছদ্বিধানৈঃ) আচ্ছাদনকারী বিধান দ্বারা (গুপিতঃ) গুপ্ত [অন্তর্ধান] করা এবং (বার্হতৈঃ) বেদ বাণীর দ্বারা কথিত নিয়ম-সমূহের দ্বারা (রক্ষিতঃ) রক্ষিত, (গ্রাব্ণাম্) বিদ্বানদের [প্রার্থনা] (ইৎ) অবশ্য (শৃণ্বন্) শ্রবণ করে তুমি (তিষ্ঠসি) স্থিত, (পার্থিবঃ) পৃথিবীর [বিষয়-সমূহে] আসক্ত পুরুষ (তে) তোমার [অনুভবকে] (ন) না (অশ্নাতি) ভোগ করে ॥৫॥

ভাবার্থঃ সর্বব্যাপক পরমাত্মা নিজের অনন্ত সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ম দ্বারা সুরক্ষিত থেকে অনেক উপকার করে, ঈশ্বরকে/ঈশ্বরনিয়মকে বিদ্বানই জানে, সামান্য মনুষ্য জানতে পারে না। এইজন্য সব মনুষ্য বিদ্বান্ হয়ে ঈশ্বরজ্ঞান দ্বারা উন্নতি করুক ॥৫॥এই মন্ত্র ঋগ্বেদে আছে−১০।৮৫।৪॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (বার্হতৈঃ) বৃহতী বেদবাণীতে কথিত (আচ্ছদ্বিধানৈঃ) আচ্ছাদনের বিধি-সমূহের দ্বারা (সোম) হে বীর্য ! (গুপিতঃ) তুমি অন্তর্লীন হও, (রক্ষিতঃ) তথা সুরক্ষিত হও। (গ্রাব্ণাম্) বিদ্বানগণের [বাণী-সমূহকে] (ইৎ) ই (শৃণ্বন্) শ্রবণ করে (তিষ্ঠসি) তুমি [শরীরের মধ্যে] স্থিত হও, (পার্থিবঃ) স্ত্রীভোগী বা পার্থিবভোগ-সমূহে আসক্ত পুরুষ (তে) তোমার (অশ্নাতি, ন) অশন্ অর্থাৎ পান করতে পারে না।

ভাবার্থঃ [বার্হত= বৃহতী অর্থাৎ মহতী বেদবাণীতে কথিত। বেদবাণী হল বৃহতী, যতঃ ঈশ্বরীয়, তথা মানুষসৃষ্টির সমকালীন। বৃহতী = বাক্ (শ০ ব্রা০ ১৪।৪।১।২২)। আচ্ছদ্বিধানৈঃ= আচ্ছাদন করার বিধি-সমূহ, সুরক্ষিত রাখার বিধি-সমূহ, যার দ্বারা বীর্য শরীরে অচ্ছাদিত থাকে সেই বিধি-সমূহ। গ্রাব্ণাম্ ="বিদ্বাংসো হি গ্রাবাণঃ" (শ০ ব্রা০ ৩।৯।৩।৪)। তথা "আ বাঁ গ্রাবাণো অশ্বিনা ধীভির্বিপ্রা অচুচ্যুবুঃ" (ঋ০ ৮।৪২।৪) এ গ্রাবাণঃ কে বিপ্রাঃ অর্থাৎ মেধাবী বলা হয়েছে, এবং ধীভিঃ দ্বারা একে বুদ্ধিমান বলা হয়েছে। ব্যাখ্যা- বেদোক্ত আচ্ছাদনের বিধি-সমূহের দ্বারা অর্থাৎ রক্ষার বৈদিক সাধন-সমূহ এবং উপায় দ্বারা, বীর্য শরীরে লীন থাকতে পারে, এবং সুরক্ষিত হতে পারে। শৃঙ্গারোৎপাদক গীত, তাদৃশ কথা তথা বার্তালাপ দ্বারা শরীরে বীর্য স্থিত থাকে না। এর স্থিরতার জন্য বিদ্বানদের দ্বারা বেদবাণীর সতত শ্রবণ আবশ্যক। স্ত্রীভোগী তথা পার্থিবভোগে লিপ্ত পুরুষ বীর্যাশন অর্থাৎ সোমপান করতে পারে না/অক্ষম।

চিত্তিরা উপবহণং চক্ষুরা অভ্যঞ্জন। 

দ্যৌভূমিঃ কোশ আসী যদয়াৎ সূর‍্যা পতি৷৬৷৷

মন্ত্রাঃ ৬-৬৪। বিবাহসংস্কারোপদেশঃ-

পদার্থঃ (চিত্তিঃ) চেতনা [কন্যার] (উপবর্হণম্) ছোটো ওড়না/বস্ত্র [সমান] (আঃ) হোক, (চক্ষুঃ) দর্শনসামর্থ্য (অভ্যঞ্জনম্) উবটন [শরীর মর্দনের দ্রব্যের তুল্য] (আঃ) হোক। (দ্যৌঃ) আকাশ এবং (ভূমিঃ) ভূমি (কোশঃ) নিধিমঞ্জূষা [পেটি ছোট বাক্সের সমান] (আসীৎ) হোক, (যৎ) যখন (সূর্যা) প্রেরক [বা সূর্যের চমকের সমান তেজসম্পন্না] কন্যা (পতিম্) পতিকে (অয়াৎ) প্রাপ্ত হবে ॥৬॥

ভাবার্থঃ যখন কন্যা বাহ্যিক উপকরণের উপেক্ষা করে অভ্যন্তরীণ বিদ্যাবল দ্বারা চেতন্য স্বভাব, এবং পদার্থ-সমূহকে দিব্যদৃষ্টিতে দর্শনকারী, এবং আকাশ ও ভূমি থেকে সুবর্ণ আদি প্রাপ্তকারী, এবং প্রাপ্তিতে সহায়ক হবে, তখন সুযোগ্য পতির সাথে বিবাহ করুক ॥৬॥এই মন্ত্র ঋগ্বেদে আছে−১০।৮৫।৭ ॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (চিত্তিঃ) সম্যক্ জ্ঞান (উপবর্হণম্) উপধান (আঃ) ছিল, (চক্ষুঃ) দৃষ্টি শক্তি (অভ্যঞ্জনম্১) অঞ্জন বা সুরমা (আঃ) ছিল, (দ্যৌঃ, ভূমিঃ) দ্যুলোক এবং ভূলোক (কোশঃ) জ্ঞানের সম্পদ (আসীৎ) ছিল, (যৎ) যখন (সূর্যা) সূর্যা ব্রহ্মচারিণী অর্থাৎ আদিত্য ব্রহ্মচারিণী (পতিম্) পতির কাছে গিয়েছে বা পৌঁছেছে।

ভাবার্থঃ [ব্যাখ্যা- উচ্চকোটির বিবাহ হল আদিত্য ব্রহ্মচারীর আদিত্য ব্রহ্মচারিণীর সাথে। এই মন্ত্রগুলোতে আদিত্য ব্রহ্মচারিণীকে সূর্যা অর্থাৎ সূর্যা ব্রহ্মচারিণী বলা হয়েছে। আদিত্য ব্রহ্মচারী ৪৮ বর্ষের ব্রহ্মচারী হয়, এবং আদিত্য ব্রহ্মচারিণী ৩২ বা ২৪ বর্ষের। আদিত্য ব্রহ্মচারীর জন্য মন্ত্র সংখ্যা ১,২ এ আদিত্য নাম দেওয়া হয়েছে। এই দুজনের আয়ুর সম্বন্ধে মহর্ষি দয়ানন্দ লিখেছেন স্ত্রী-এর আয়ু থেকে বরের আয়ু, কমপক্ষে দেড় গুণ এবং সর্বাধিক দ্বিগুণ হবে" (সংস্কার বিধি, বিবাহ প্রকরণ)। আজকাল রীতি-নীতিতে বধূ যখন পতির ঘরে যায় তখন সে নিজের সাথে পর্যাপ্ত যৌতুক নিয়ে যায়। বৈদিক যৌতুকের সম্বন্ধে দর্শানো হয়েছে যে, সূর্যা যখন পতির ঘরে গিয়েছে তখন সে চিত্তি অর্থাৎ সম্যক্ জ্ঞানের উপধান, সধী/বুদ্ধিযুক্ত-দৃষ্টিশক্তির অঞ্জন অর্থাৎ সুরমা; তথা দ্যুলোক এবং ভূলোকের জ্ঞানরূপী সম্পদকে নিজের সাথে নিয়ে গেছে। অভিপ্রায় হল আদর্শ বিবাহে বাহ্য যৌতুকের কোনো আবশ্যকতা নেই। যখন উচ্চকোটির শিক্ষিত আদিত্য ব্রহ্মচারী এবং সূর্যা ব্রহ্মচারিণীর মধ্যে পরস্পর প্রেমপূর্বক বিবাহ হয় তখন বধূর বাস্তবিক যৌতুক বধূর সদ্গুণ, তথা বধূর বিদ্যা এবং সুশীলতা ইত্যাদি হয়। সম্যক্জ্ঞান মস্তককে পবিত্র করে এবং মস্তকের আশ্রয় হয়। এইজন্য সম্যক্জ্ঞানকে বিদুষীর বালিশ/উপধান বলা হয়েছে। এইভাবে অঞ্জন অর্থাৎ সুর্মার কাজ হল চক্ষুর শক্তি অক্ষুণ্ণ রাখা। সূর্যা ব্রহ্মচারিণীর মধ্যে যে দিব্য এবং বিদ্যাসম্পন্ন দৃষ্টি২ শক্তি থাকে সেটাই মানো ব্রহ্মচারিণীর সুরমা। তথা দ্যুলোক এবং ভূলোকের ব্যাপী জ্ঞানই সূর্যা ব্রহ্মচারিণীর মহত্ত্বশালী সম্পদ, যা পিতার ঘর থেকে প্রাপ্ত করে বধূ পতির ঘরের দিকে প্রস্থান করে।] [১. অভ্যঞ্জনম্ = Applying collyrium (সুরমা) to the eyelashes (আপ্টে)। ২. ইংরেজি ভাষায়ও চক্ষুর বাচক Eye শব্দ ব্যাপক/অনেক অর্থ হয়। Eye এর অর্থ কেবল স্থূল চোখই নয়। এর অর্থ নজর/দৃষ্টিভঙ্গি/বিবেচনা, বিচার ইত্যাদিও হয়। যথা "in my mindh eye"; To see eye to ye I এইভাবে মন্ত্র পঠিত চক্ষু শব্দও ব্যাপক অর্থে প্রযুক্ত হয়েছে। মন্ত্রে সম্যক্ জ্ঞানকে চক্ষুঃ বলা হয়েছে। জ্ঞানচক্ষুঃ, প্রজ্ঞাচক্ষুঃ চারচক্ষুঃ নয়চক্ষুঃ প্রভৃতির ক্ষেত্রেও চক্ষুঃ শব্দের প্রয়োগ, চর্মচক্ষুঃ থেকে ভিন্নার্থে হয়েছে।]

 

রৈভ্যাসীদদেয়ী নারাশংসী নন্যাচনী। 

সূর্যায় ভদ্ৰমিদ বাসো গাথয়ৈতি পরিষ্কৃতা ॥ ৭৷ 

পদার্থঃ (রৈভী) বেদবাণী (সূর্যায়াঃ) প্রেরক [বা সূর্যের চমকের সমান তেজবিশিষ্ট] কন্যার (অনুদেয়ী) সাথী/সখী [সমান] এবং (নারাশংসী) মনুষ্যদের গুণ-সমূহের স্তুতি (ন্যোচনী) নৌচী [লঘুসহচরী সমান] (আসীৎ) হোক। এবং (ভদ্রম্) শুভ কর্ম (ইৎ) ই (বাসঃ) বস্ত্র [সমান] হোক [কেননা সে] (গাথয়া) গান যোগ্য বেদবিদ্যা দ্বারা (পরিষ্কৃতা) সজ্জিত হয়ে (এতি) চলে॥৭॥

ভাবার্থঃ কন্যা বেদ এবং ইতিহাস পাঠ করে, বিচার করে শুভ কর্ম করে, উত্তম বিদ্যা দ্বারা নিজের শোভা বৃদ্ধি করুক॥৭॥এই মন্ত্র কিছুটা আলাদাভাবে ঋগ্বেদে আছে−১০।৮৫।৬ ॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (রৈভী) পরমেশ্বরের স্তোতাদের দ্বারা প্রদত্ত বৈদিক স্তুতিবাণী (অনুদেয়ী) সাথে দেওয়া সম্পত্তি (আসীৎ) ছিল, (নারাশংসী) নর-নারীদের কর্তব্য-সমূহের আশংসন অর্থাৎ কথনকারী বেদবাণী (ন্যোচনী) নিরন্তর একসাথে থাকা সখী ছিল। (ভদ্রম্) সুখদায়ক তথা ভদ্রজনোচিত (ইৎ) ই, (সূর্যায়াঃ) সূর্যা ব্রহ্মচারিণীর (বাসঃ) বস্ত্র ছিল, সে (গাথয়া) বৈদিক গানবিদ্যা দ্বারা (পরিষ্কৃতা) সজ্জিত (এতি) পতিগৃহে আসে।

ভাবার্থঃ [রৈভি; রেভঃ স্তোতৃনাম (নিঘং০ ৩।১৬), রেভতি অর্চর্তি কর্মা (নিঘং০ ৩।১৪) অতঃ রৈভী = পরমেশ্বরের স্তোতাদের দ্বারা প্রাপ্ত বৈদিক স্তুতি বাণী। অনু= একসাথে, যথা "অনুগঙ্গ" বারাণসী। নারাশংসী =নারা শংসাঃ১ মন্ত্রাঃ (নিরু০ ৭।১।৪), অতঃ নারাশংসী = নরাণাং নারীণাং চ কর্তব্যানাং আশংসাঃ কথনানি যস্যাং সা বেদবাণী। ন্যোচনী = নি (নিতরাম্) উচ সমবায়ে, অর্থাৎ সদা সাথে বর্তমান/অবস্থানকারী। বিশেষঃ- অথবা রৈভী এর ব্যুৎপাদন = রৈ (ধন) + ভা (প্রকাশ) + ঈ (স্ত্রিয়াম্ ঙীষ্)। অর্থাৎ ধনবিদ্যার প্রকাশকারী বেদবাণী] ব্যাখ্যা-- গৃহস্থ জীবনকে সাত্ত্বিক করার জন্য পরমেশ্বরের স্তুতি উপাসনার অত্যন্ত আবশ্যকতা রয়েছে। এইজন্য রৈভী-কে অনুদেয়ী বলা হয়েছে। রৈভী এর অর্থ ধনবিদ্যাসম্বন্ধী বেদবাণীও সম্ভব। বর্তমান সময়ে বধূ, যখন পতির ঘরে যায়, তখন সে প্রাকৃতিক যৌতুক সাথে নিয়ে যায় সাথ। সাথে দেওয়া সম্পত্তিকে অনুদেয়ী বলা হয়েছে। সূর্যা ব্রহ্মচারিণীকে পড়ানো মন্ত্র, যার মধ্যে ধনবিদ্যা বা অর্থ শাস্ত্রের বর্ণনা আছে, তা মানো বিবাহে দেওয়া সম্পত্তি। যে অর্থশাস্ত্রের বিদ্যা প্রাপ্ত, সে স্বয়ং ধনোপার্জন করতে পারে। তাঁর পিতৃগৃহ থেকে ধন নিয়ে আসার প্রয়োজন হয় না। মনুস্মৃতিতে এইজন্য বলা হয়েছে— অর্থস্য সঙ্গ্রহে চৈনাং ব্যয়ে চৈব নিয়োজয়েৎ (অধ্যা০ ৯, শ্লো০ ১১) অর্থাৎ পত্নীকে ধন-সঙ্গ্রহ তথা ব্যয়ের কাজে পতি নিযুক্ত করে/করুক। অর্থাৎ ঘরে ধন সঙ্গ্রহ তথা ব্যয়ের অধিকার পত্নীকে দেওয়া উচিত। অর্থবিদ্যা না জেনে অর্থসংগ্রহ এবং অর্থব্যয়ের কার্য সফলতাপূর্বক সম্পন্ন হতে পারে না। অতঃ অর্থবিদ্যার অনুদান হল বস্তুতঃ সম্পত্তিদান। এইভাবে সূর্যা ব্রহ্মচারিণীকে ব্রহ্মচর্যকালে যে নর-নারীর কর্তব্য সম্বন্ধিত মন্ত্র পড়ানো হয়েছে তা নববধূর সাথে সদা বর্তমান সাথী। অনুদেয়ী-সম্পত্তির অপেক্ষা ন্যোচনী-বিদ্যা অধিক মহত্ত্ব রাখে। বিবাহের সময় বর, স্বয়ং বধূর জন্য, বস্ত্র নিয়ে আসে, এবং বর দ্বারা নিয়ে আসা বস্ত্রই বিবাহে বধূকে পরিধান করানো হয়, পিতৃগৃহের বস্ত্র নয়। পিতৃগৃহ থেকে তো বধূ সুখদায়ক তথা ভদ্রজনোচিত বস্ত্র প্রাপ্ত করে, চমকিত-ভড়কীলে। বর দ্বারা প্রদত্ত বস্ত্রের বর্ণনা অথর্ব০ ১৪।১।৪৫ এ হয়েছে। নববধূ বৈদিক গানবিদ্যা দ্বারা পরিষ্কৃতও হওয়া উচিৎ। অর্থাৎ নববধূ গান বিদ্যার সাজসজ্জা দ্বারা সজ্জিত হওয়া উচিৎ। গৃহস্থ জীবনকে মধুর তথা রসবান করার জন্য গানবিদ্যা দ্বারা বধূকে বিভূষিত হওয়া উচিত।] [১. যেন নরাঃ প্রশস্যন্তে স নারাশংসো মন্ত্রঃ (নিরু০ ৯।১।৯)।]

স্তোমা আসন প্রতিষয়ঃ কুরীরং ছন্দ ওপশঃ। 

সূর্যায় অশ্বিনা বরাগ্নিরাসীৎ পুরোগবঃ ॥ ৮

পদার্থঃ (স্তোমাঃ) স্তুতিয়োগ্য গুণ (সূর্যায়াঃ) প্রেরক [বা সূর্যের চমকের সমান তেজসম্পন্ন] কন্যার (প্রতিধয়ঃ) বস্ত্রের আঁচলের [সমান] (আসন্) হোক, (কুরীরম্) কর্তব্যকর্ম এবং (ছন্দঃ) আনন্দপ্রদ বেদ (ওপশঃ) মুকুট [সমান হোক] এবং (অগ্নিঃ) অগ্নি [শারীরিক এবং বাহ্যিক অগ্নি দ্বারা স্বাস্থ্য, শিল্প, যজ্ঞ আদি বিধান] (পুরোগবঃ) অগ্রগামী [পুরোহিত সমান] (আসীৎ) হোক, [যদ্যপি] (অশ্বিনা) বিদ্যা প্রাপ্ত দুই [বধূ বর] (বরা) পরস্পরের কামনাকারী [বা শ্রেষ্ঠ গুণান্বিত] হোক ॥৮॥

যখন কন্যা ব্রহ্মচর্য দ্বারা বিদ্যা প্রাপ্ত করে স্বাস্থ্য আদি বিধানে নিপুণ হয়/হবে এবং যখন তেমনই বর ব্রহ্মচারী বিদ্বান্ হয়/হবে, তখন দুজনে পরস্পর বিবাহের কামনা করুক ॥৮॥মন্ত্র ৮-১৩ কিছুটা আলাদাভাবে ঋগ্বেদে আছে−১০।৮৫।৮-১৩ ॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (স্তোমাঃ) ঋচা-সমূহের গেয়স্বরূপ (আসন্) ছিল (প্রতিধয়ঃ) প্রত্যেক অঙ্গে ধারণ যোগ্য অলংকার, (ছন্দঃ) বৈদিক ছন্দ বা অথর্ববেদের মন্ত্র ছিল (কুরীরম্, ওপশঃ) কুরীর এবং ওপশ নামের অলঙ্কার। (অশ্বিনা) অশ্বের ওপর আরূঢ় বা দ্যৌঃ এবং পৃথিবীর অথবা সূর্য এবং চন্দ্রের গুণবিশিষ্ট মাতা-পিতা (সূর্যায়াঃ) সূর্যা-ব্রহ্মচারিণীর বরণ অর্থাৎ নির্বাচক ছিল, কিন্তু (অগ্নিঃ) সূর্যা সম্বন্ধী অগ্নি অর্থাৎ আগ্নেয়রূপ রজোধর্ম (পুরোগবঃ) নির্বাচনে অগ্রগামী রূপ (আসীৎ) ছিল। প্রচলিত সংস্কৃত ভাষার দৃষ্টিতে “আসীৎ, আসন্" এর ভূতকাল পরক অর্থ করা হয়েছে। "ছন্দসি লুঙ্লঙ্লিটঃ" (অষ্টা০ ৩।৪।৬) দ্বারা লুঙাদি সব কালে প্রযুক্ত হয়। বর্তমান কালেও এর প্রয়োগ হয়।

[প্রতিধয়ঃ = পরিধয়ঃ (পৈপ্পলাদ শাখা)। প্রতিধি= অলঙ্কারকে "পর্যাণদ্ধং বিশ্বরূপং যদস্তি" (১৪।২।১২) এ "পর্যাণদ্ধ" পদ দ্বারা সূচিত করা হয়েছে। প্রতিধি = অলঙ্কার, কুরীর এবং ওপশ থেকে ভিন্ন। কুরীর এবং ওপশ নারীদের শিরোলঙ্কার। যথা “কুরীরমস্য শীর্ষণি কুম্ভং চাধি নি দধ্মসি" (অথর্ব০ ৬।১৩৮।৩); তথা “ক্লীবং কৃধ্যোপশিনমথো কুরীরিণং কৃধি।" (অথর্ব০ ৬।১৩৮।২)। ব্যভিচারী পুরুষকে ক্লীব অর্থাৎ নপুংসক করে তাঁর মাথার ওপর কুরীর এবং ওপশ বাঁধার বিধান মন্ত্রগুলোতে হয়েছে। বিবাহের সময় স্ত্রীকে "কলীরা" বাঁধা হয়, যা কুরীর-এর বিকৃতরূপ প্রতীত হয়। ছন্দঃ = এর দ্বারা অথর্ববেদেরও গ্রহণ হয়েছে। যথা “ছন্দাংসি জজ্ঞিরে তস্মাদ্ যজুস্তস্মাদজায়ত" (যজু০ ৩১।৭) এ ছন্দাংসি-এর অভিপ্রায় হল অথর্ববেদ বা অথর্ববেদের মন্ত্র। প্রতিধয়ঃ১— এর অর্থ রথের চাকার অর করা হয়, যেগুলোকে পরস্পর যুক্ত করে চাকা তৈরি করা হয়। যে অরগুলো পরস্পর মিলিত হয়ে পরিধিরূপ হয়ে যায়। অতঃ প্রতিধয়ঃ = পরিধয়ঃ (পৈপ্পলাদ শাখা) পরিধি কেন্দ্রের চারদিকে থাকে। এই পরিধিতে কেন্দ্র সুরক্ষিত থাকে। স্তোম অর্থাৎ সামগানের জন্য মন্ত্রগুলোর গেয়স্বরূপ, মানো সূর্যারূপী কেন্দ্রের পরিধি ছিল। এই সামগানগুলোর দ্বারা সূর্যা সুরক্ষিত ছিল। সামগানগুলো তথা তম্মন্ত্রনিষ্ঠ সদুপদেশগুলোর দ্বারা সূর্যা, নিজেকে, কুবিচার, দুর্ব্যসন তথা দুঃখ ক্লেশ থেকে সুরক্ষিত রেখেছিল তথা "যত্রেদং ব্রহ্ম ক্রিয়তে পরিধির্জীবনায় কম্" (অথর্ব০ ৮।২।২৫) এ ব্রহ্ম অর্থাৎ মন্ত্র এবং তদুপদিষ্ট পরমেশ্বরকে জীবনের জন্য পরিধিরূপ বলা হয়েছে। স্তোমাঃ— বৈদিক মন্ত্র যখন গান করা হয় তখন মন্ত্রগুলোর অনেক পদ এবং পাদ বার বার পুনরাবৃত্তি করা হয়, কোথাও কোথাও হ্রস্ব স্বরকে দীর্ঘ তথা প্লুত-এ পরিবর্তিত করতে হয়, অনেক বার মাঝখানে-মাঝখানে আলাপও করা হয়। গানে মন্ত্রগুলোর এই সম্পূর্ণ স্বরূপকে গেয়স্বরূপ বা স্তোম বলা হয়, তথা আলাপের উপযোগী নিরর্থক শব্দগুলোকে স্তোম বলা হয়। এইভাবে মন্ত্রগুলোর নিত্যস্বরূপ এবং গেয়স্বরূপ এর মধ্যে পার্থক্য হয়ে যায়। এই গেয়স্বরূপগুলোকে স্তোম বলা হয়। ব্যাখ্যা— অশ্বিনা = অশ্বিনৌ, অর্থাৎ ঘরের মাতা-পিতা। নিরক্ত ১২।১।১ এ বলা হয়েছে "অশ্বিনৌ দ্যাবাপৃথিব্যাদিত্যেকে। সূর্যাচন্দ্রমসাদিত্যেকে। তথা অথর্ব০ ১৪।২।৭১ এ বলা হয়েছে "দ্যৌরহং পৃথিবী ত্বম্। তাবিহ সং ভবাব প্রজামা জনয়াবহৈ"। অর্থাৎ বর বধূকে বলে, আমি দ্যৌঃ, তুমি পৃথিবী। আমরা দুজন একত্রিত হই এবং সন্তানোৎপাদন করি। এর দ্বারা বর দ্যৌঃ এর গুণসম্পন্ন এবং বধূ পৃথিবীর গুণসম্পন্না বলা হয়েছে। এইভাবে মন্ত্র ১৪।১।১ এ পতিকে সূর্য, তথা ১৪।১।২৩,২৪ এ বধূকে চন্দ্র দ্বারা বর্ণিত করা হয়েছে। এর দ্বারাও বর এবং বধূর গুণ-সমূহের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। বরের মাতা-পিতা বধূর নির্বাচনে বরের সহায়ক হয়, কিন্তু অন্তিম সিদ্ধান্ত বর-বধূকে স্বয়ং করতে হবে। আপস্তম্ব গৃহ্যসূত্রেও বলা হয়েছে "সুহৃদঃ সমবেতান্ মন্ত্রবতো বরান্ প্রহিণুয়াৎ" (পটল ২, খণ্ড ৪, সূ০ ১), অর্থাৎ একত্রিত বা পরস্পর এক ধারণাসম্পন্ন তথা বিদ্বান্ মিত্রদের বররূপে অর্থাৎ কন্যার নির্বাচনের জন্য প্রেরণ করুক। এই সূত্রেও, বিবাহেচ্ছু ব্যক্তিকে বরণকর্মে সহায়তা প্রদানকারীকে "বরান্" বলা হয়েছে। অতঃ মন্ত্রে বরা=বরৌ দ্বারা বরের মাতা-পিতারই গ্রহণ বোঝা উচিৎ। বর-বধূর নির্বাচনের ক্ষেত্রে মাতা-পিতার পরামর্শকে আবশ্যক মনে করা হয়েছে। বিবাহার্থ সূর্যা-এর নির্বাচনে, সূর্যা-এর মধ্যে প্রকটিত অগ্নির বর্তমান থাকা অনিবার্য। অভিপ্রায় হল, যুবতির অগ্নিশক্তির মধ্যে যখন বিবাহের উগ্র২ ইচ্ছা উৎপন্ন হবে, তখন সূর্যা-এর মাতা-পিতা সূর্যা-এর জন্য সদৃশ পতির বরণ করুক, উহার পূর্বে নয়। সূর্যা হল ব্রহ্মচারিণী। সে পর্যাপ্ত আয়ু সংযম দ্বারা অতিক্রম করেছে। যদি সে সারাজীবন ব্রহ্মচারিণী থাকতে চায় তবে তাঁকে বিবাহের জন্য বাধিত করা উচিত নয়। যুবতীর মাসিক ধর্মকে মন্ত্রে অগ্নি বলা হয়েছে। মাসিক-ধর্মের বর্ণ লাল হয় যা অগ্নির বর্ণ। মাসিকধর্ম গৃহস্থধর্মের বা গৃহস্থ ভাবনার প্রেরক। যুবতীর অগ্নিতে বিবাহেচ্ছা হল, বিবাহের পুরোগব রূপ, অগ্রগামী রূপ। মাসিকধর্মযুক্ত যুবতীকে রজস্বলা বলা হয়। রজস্ কে ব্যাখ্যেয় মন্ত্রে অগ্নি বলা হয়েছে। রজস্বলাবস্থাতেও রজোগুণের ভাবনা জাগরিত হয়ে যায়। মাসিকধর্ম প্রকট হলেও যতক্ষণ না পর্যন্ত সূর্যা-এর মধ্যে বিবাহেচ্ছা প্রকট না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁর বিবাহ করানো উচিত নয়। আয়ুর্বেদে সোম অর্থাৎ বীর্যকে শুক্র এবং ঋতুধর্মকে আগ্নেয় বলা হয়েছে, (দেখো মন্ত্র ১ এর ব্যাখ্যা)। এইজন্য মন্ত্র ৮ এ অগ্নি দ্বারা ঋতুধর্মের গ্রহণ করা হয়েছে।] [১. প্রতিধয়ঃ= Cress plecess (হ্বিটনী)। ২. "সূর্যা যৎ পত্যে শংসন্তীম্" (অথর্ব০ ১৪।১।৯)।]

সোমমা বধুয়ুরভবদখিনাস্তামুভা বরা। 

সূর্যাং যৎ পত্যে শংসন্তীং মনসা সবিতাদদাৎ ॥ ৯৷৷ 

(সোমঃ) শুভ গুণযুক্ত ব্রহ্মচারী (বধূয়ুঃ) বধূর কামনাকারী (অভবৎ) হোক, (উভা) উভয়েই (অশ্বিনা) বিদ্যা প্রাপ্ত [বধূ বর] (বরা) পরস্পরের কামনাকারী [বা শ্রেষ্ঠ গুণান্বিত] (আস্তাম্) হোক, (যৎ) যখন (পত্যে) পতির জন্য (মনসা) মন থেকে (সংশন্তীম্) গুণকীর্তন করে (সূর্যাম্) প্রেরক [বা সূর্যের চমকের সমান তেজসম্পন্না] কন্যাকে (সবিতা) জগতের উৎপাদক পরমাত্মা (অদদাৎ) প্রদান করবেন ॥৯॥

ব্রহ্মচারী এবং ব্রহ্মচারিণী পূর্ণ বিদ্যা প্রাপ্ত করে পরস্পরের গুণের পরীক্ষা করে গৃহাশ্রমে প্রবেশ করুক এবং পরমেশ্বরকে ধন্যবাদ দেবে যে, বড়ো ভাগ্যক্রমে তুল্যগুণ কর্ম স্বভাবী স্ত্রী-পুরুষের দম্পতি পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়েছে ॥৯॥এই মন্ত্র মহর্ষিদয়ানন্দকৃত সংস্কারবিধি গৃহাশ্রমপ্রকরণে ব্যাখ্যাত আছে ॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (সোমঃ) বীর্য বা বীর্যবান্ ব্রহ্মচারী (বধূয়ুঃ) বধূর কামনাকারী (অভবৎ) হয়েছে (অশ্বিনা = অশ্বিনৌ) তখন তাঁর মাতা-পিতা (উভা= উভৌ) উভয়েই (বরা =বরৌ) কন্যার বরণ, নির্বাচক (আস্তাম্) হয়েছে, (যৎ) যখন (পত্যে) পতির জন্য (শংসন্তীম্) অনুমোদন করে (সূর্যাম্) সূর্যা-ব্রহ্মচারিণীকে, (সবিতা) উৎপাদক পিতা (মনসা) মন থেকে অর্থাৎ মনন করে, বিচারপূর্বক তথা প্রসন্নতাপূর্বক (অদদাৎ) কন্যা প্রদান করেছে।

[সোমঃ = সোম-এর অর্থ বীর্য [মন্ত্র ১]। যেমন মন্ত্র ৮ এ অগ্নি পদ দ্বারা রজস্বলা ব্রহ্মচারিণীর বর্ণনা হয়েছে, তেমনই মন্ত্র ৯ এ সোম পদ দ্বারা বীর্যবান্ বরের বর্ণনা হয়েছে। বধূয়ুঃ = বধূ + ক্যচ্ (ইচ্ছা) + উ (বালা)। বধূর কামনাকারী। শংসন্তীম্ = শংস্ To praise, approve (আপ্টে)। সবিতা = ষু প্রসবে; ষূঙ্ প্রাণিগর্ভবিমোচনে, অর্থাৎ উৎপাদক পিতা। অদদাৎ = ডুদাঞ্ দানে (জুহোত্যাদি)। ব্যাখ্যা- আদিত্য ব্রহ্মচারীর সোমশক্তির মধ্যে যখন বধূর কামনা জাগরিত হবে তখন তাঁর জন্য সদৃশ পত্নীর নির্বাচন করা উচিত, এর পূর্বে নয়। সর্বোত্তম হবে, যদি আদিত্য ব্রহ্মচারীর সোমশক্তি সদা সাত্ত্বিক বর্তমান থাকে, এবং তাঁর মধ্যে বধূর জন্য ইচ্ছা জাগরিত না হয়। এমন সাত্ত্বিক ব্রহ্মচারীদের দ্বারা জগতের কল্যাণ হয়। প্রাণিজগৎ রজস্ এবং বীর্যের অর্থাৎ অগ্নি এবং সোম-এর সংযোগ দ্বারা উৎপন্ন হয়, এইজন্য প্রাণিজগৎ হল "অগ্নীষোমীয়"।]

মনো অস্যা অন আসীদ দৌরাসীদুত চ্ছদিঃ।। 

শুক্রাবনড়াহাবাস্তাং যদয়াৎ সূর‍্যা পতিম্ ॥ ১০ 

পদার্থঃ মনঃ) মন (অস্যাঃ) এই [ব্রহ্মচারিণীর] (অনঃ) রথ [সমান] (আসীৎ) হোক, (উত) এবং (দ্যৌঃ) সূর্যের প্রকাশ (ছদিঃ) আতপত্র/ছত্র [সমান] (আসীৎ) হোক। (শুক্রৌ) দুই বীর্যবান্ [বধূ, বর] (অনড্বাহৌ) রথ বহনকারী দুই বলদের [সমান] (আস্তাম্) হোক, (যৎ) যখন (সূর্যা) প্রেরক [বা সূর্যের চমকের সমান তেজসম্পন্না] কন্যা (পতিম্) পতিকে (অয়াৎ) প্রাপ্ত হবে/হয় ॥১০॥

যখন কন্যা বেদ আদি শাস্ত্র পাঠ করে, মননশীল, তাপ আদি সহ্য করার যোগ্য হবে/হয় এবং যখন তেমনই সুযোগ্য পতি হবে, তখন গৃহাশ্রম চালনা করার ক্ষেত্রে সমর্থ হয়ে বর, বধূ দুজন প্রীতিপূর্বক বিবাহ করুক ॥১০॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (অস্যাঃ) এই সূর্যাব্রহ্মচারিণীর (অনঃ) রথ (মনঃ) মন ছিল (উত) এবং (ছদিঃ) ছত্র (দ্যৌঃ) মস্তক, বিচার শক্তি (আসীদ্) ছিল, (অনড্বাহৌ) মনরূপী রথের বহনকারী দুই বলদ (শুক্রৌ) বলশালী জ্ঞানেন্দ্রিয়বর্গ তথা কর্মেন্দ্রিয়বর্গ (আস্তাস্) ছিল, (যদ্) যখন (সূর্যা) সূর্যা ব্রহ্মচারিণী (পতিম্) পতির দিকে (অয়াৎ) গিয়েছিল।

[ব্যাখ্যা- মন্ত্রে সূর্যা ব্রহ্মচারিণীর গুণ-সমূহের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। সূর্যা যখন পতির দিকে গিয়েছিল তখন তাঁর মন ছিল রথরূপ। মনোবাঞ্ছা ছাড়া কোনো চেতন-এর চলা সম্ভব নয়। সূর্যা নিজ ইচ্ছাপূর্বক পতির দিকে গেল/গিয়েছিল,-এই অভিপ্রায় "মনঃ, অনঃ" দ্বারা প্রকট করা হয়েছে। মনরূপী রথের ছত্র ছিল দ্যৌঃ। বেদে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে শীর্ষ অর্থাৎ মস্তককে দ্যৌঃ বলা হয়েছে। যথা "শীর্ষ্ণো দ্যৌঃ সমবর্তত" (যজু০ ৩১।১৩) অর্থাৎ মস্তক দ্যুলোকের প্রতিনিধি। মস্তক বিচার/ভাবনার কেন্দ্র। মন তো ইচ্ছার দ্যোতক, এবং দ্যৌঃ বা মস্তক বিচারের দ্যোতক। সূর্যার মনরূপী রথে অর্থাৎ তাঁর মনোবাঞ্ছার ওপর দ্যৌঃ অর্থাৎ বিচারের ছত্র ছিল। অভিপ্রায় হল সূর্যার ইচ্ছা, তাঁর বিচার দ্বারা সুরক্ষিত ছিল, প্রেরিত ছিল। সূর্যার ইচ্ছাশক্তির রথে সুবিচারের ছদিঃ অর্থাৎ ছত্র ছিল। ছদিঃ এর কাজ হল রথকে রোদ, শীত এবং বর্ষা ইত্যাদি থেকে রক্ষা করা। ছদ অপবারণে। এইভাবে সুবিচারের ছদিঃ, সূর্যার মনোবাঞ্ছাকে কুমার্গ থেকে রক্ষাকারী হয়েছে। বিচাররহিত অনিয়ন্ত্রিত ইচ্ছা কুমার্গগামিনী হতে পারে। সূর্যার পতির দিকে গমনের ইচ্ছা সুবিচারপূর্বক হয়েছে, এই অভিপ্রায় রয়েছে। অনড্বাহৌ = অনস্ = রথ, বাহৌ= বহনকারী করনেবালে দুই বলদ। মন্ত্র ১৪।১।১১ এ অনড্বাহৌ-এর স্থানে "গাবৌ" পঠিত আছে। বেদে গো শব্দ ইন্দ্রিয় বাচকও হয়। গৌঃ এর অর্থ মহর্ষি দয়ানন্দ "ইন্দ্রিয়" করেছেন (উণা০ ২।৬৮)। এইজন্য ইন্দ্রিয়-সমূহের বিষয়গুলোকে 'গোচর' বলা হয়। অর্থাৎ যার মধ্যে গৌ অর্থাৎ ইন্দ্রিয়-সমূহ, বিচরণ করে। ইন্দ্রিয়সমূহ অর্থাৎ জ্ঞানেন্দ্রিয়-সমূহ এবং কর্মেন্দ্রিয়-সমূহ মনরূপী রথকে বিষয়-সমূহের দিকে আকর্ষণ করে নিয়ে যায়। সূর্যার বিবাহে, সূর্যার ইন্দ্রিয়-সমূহ১, সূর্যার মনরূপী রথের বহনকারী হয়েছিল/হয়েছে] তথা [আধিভৌতিক দৃষ্টিতে মন্ত্র সূর্যার ভৌতিক-রথেরও বর্ণনা করে। বিবাহের পর সূর্যা যখন পতিগৃহের দিকে যায় তখন সূর্যা-এর রথ "মনঃ" অর্থাৎ মননীয় ছিল, মনোরম ছিল। এই রথের ছত্র "ছদিঃ" দ্যুলোকের সদৃশ ছিল, অর্থাৎ দ্যুলোক যেমন নক্ষত্ররাজি দ্বারা সজ্জিত, তেমন রথের ছত্র কৃত্রিম নক্ষত্ররাজি দ্বারা সুসজ্জিত ছিল বা হওয়া উচিত। অথর্ব০ ১৪।১।৬১ এ সূর্যার রথকে "সুকিংশুক" বলা হয়েছে, টেসু অর্থাৎ পলাশ ফুল দিয়ে সজ্জিত বলা হয়েছে। তথা এই ভৌতিক রথের বহনকারী দুই বলদ ছিল, যা বীর্যবান্ অর্থাৎ বলশালী ছিল (শুক্রৌ, অনড্বাহৌ)।] [১. এই ইন্দ্রিয়গুলোকে শুক্রৌ বলা হয়েছে। শুক্র-এর অর্থ হল,—বীর্য। সূর্যার ব্রহ্মচর্যের কারণে সূর্যার ইন্দ্রিয়-সমূহ বীর্যবতী। অর্থাৎ বলবতী ছিল। শুক্র= শুক্র + অচ্ (অর্শআদিভ্যোঽচ; অষ্টা০ ৫।২। ১২৭)। অতঃ শুক্র= শুক্রবান্]

ঋকত্সামাভ্যামভিহিতৌ গবৌ তে সামনাবৈতাম। 

শ্রোত্রে তে চক্রে আস্তাং দিবি পন্থাশ্চরাচরঃ। ১১। 

পদার্থঃ (ঋক্সামাভ্যাম্) পদার্থ-সমূহের স্তুতিবিদ্যা এবং মোক্ষজ্ঞান দ্বারা (অভিহিতৌ) অভিহিত [দুই প্রকারের বোধ] (গাবৌ) দুই বলদ [রথের দুই বলদের সমান] (তে) তোমার (সামনৌ=সমানৌ) অনুকূলে (ঐতাম্) চলুক। (তে) তোমার (শ্রোত্রে) দুই কান (চক্রে) দুই চাকার [সমান] (আস্তাম্) হোক, (দিবি) প্রত্যেক ব্যবহারে (পন্থাঃ) মার্গ (চরাচরঃ) চলাচল [থাকুক] ॥১১॥

কন্যা বেদবিহিত কর্মে প্রবীণ/পারদর্শী হয়ে শ্রবণ মনন দ্বারা সংসারের পদার্থ-সমূহ থেকে গুণ গ্রহণ করে গৃহাশ্রমের ব্যবহার চালানোর ক্ষেত্রে সমর্থ হোক ॥১১॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ হে সূর্যা ব্রহ্মচারিণী! (ঋক্ সামাভ্যাম্) ঋগ্বেদের জ্ঞান এবং সামবেদের উপাসনা দ্বারা (অভিহিতৌ) প্রেরিত (তে) তোমার (গাবৌ) জ্ঞানেন্দ্রিয় বর্গ তথা কর্মেন্দ্রিয় বর্গ (সামনৌ) শান্তিসম্পন্ন হয়ে (ঐতাম্) বিচরণ করছে/করেছে। (তে) তোমার (চক্রে) মনরূপী রথের দুই চাকা (শ্রোত্রে) বেদ প্রতিপাদিত অভ্যুদয় এবং নিঃশ্রেয়স (আস্তাম্) ছিল, (দিবি) দ্যুলোকে (পন্থাঃ) যেমন মার্গ (চরাচরঃ) চালু আছে [যার মধ্যে অসংখ্য তারা নক্ষত্র বিচরণ করছে] তেমন তোমার গৃহস্থ জীবনেরও (পন্থাঃ) মার্গ রয়েছে, যা (চরাচরঃ) অনাদিকাল থেকে চলে এসেছে।

[ব্যাখ্যা- মন্ত্র ১১ এ গাবৌ শব্দ দ্বিবচনান্ত আছে, মন্ত্র ১০ এ অনড্বাহৌ শব্দও দ্বিবচনান্ত। এই দুটি শব্দ একই অর্থে প্রযুক্ত হয়েছে। জ্ঞানেন্দ্রিয়বর্গ এবং কর্মেন্দ্রিয়বর্গ এর দ্বারা অভিপ্রেত হয়েছে। গৌঃ শব্দ ইন্দ্রিয়ার্থকও হয়, এই মন্ত্র ১০ এ দর্শানো হয়েছে। অনড্বাহৌ শব্দও মনরূপীরথের বাহনের নিদর্শক হওয়ায়, "গাবৌ" অর্থের দ্যোতক। সূর্যার জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং কর্মেন্দ্রিয় সাত্ত্বিক ছিল, কেননা সে ঋগ্বেদের জ্ঞান, এবং সামবেদের উপাসনা দ্বারা প্রেরিত হয়েছে। এইজন্য একে "সামনৌ" বলা হয়েছে। সাম সান্ত্বপ্রয়োগে। শ্রোত্র শব্দ বেদবাচক। এইজন্য বেদাধ্যেতাকে শ্রোত্রিয় বলা হয়। যে শ্রোত্র অর্থাৎ বেদের অধ্যয়ন করে, তাঁকে শ্রোত্রিয় বলে। শ্রোত্রিয়ংশ্ছন্দোধীতে (অষ্টা০ ৫।২।৮৪), অর্থাৎ যে ছন্দোময়ী বেদবাণীর অধ্যয়ন করে, সে শ্রোত্রিয়১। শ্রোত্রে পদ দ্বিবচনান্ত পঠিত। বেদ অভ্যুদয়-এবং-নিঃশ্রেয়স এর বর্ণনা করে, এই দৃষ্টিতে শ্রোত্রে পদ দ্বিবচনান্ত পঠিত হয়েছে। এই দুটি সূর্যার মনরূপী রথের দুই চাকা। চাকা রথের সঞ্চালনের কারণ। অভ্যুদয় এবং নিঃশ্রেয়স সূর্যার মনরূপী রথের সঞ্চালক ছিল,—এটা মন্ত্রে সূচিত করা হয়েছে। সাথে মন্ত্রে এটাও দর্শানো হয়েছে গৃহস্থ পথ কোনো হেয় বা খারাপ পথ নয়। এই পথ চরাচর, সদা এটা চলতে থাকে। ঋষিমুনিও এই পথে চলেছেন। সমগ্র প্রাণীজগতের এটাই পথ। অতঃ এই পথে চলা সাংসারিক নিয়ম।] তথা [মন্ত্রের আধিভৌতিক অর্থ হল "সূর্যার রথের দুই বলদ স্তুতি তথা সান্ত্বনাপূর্বক চালিত হয়ে শান্তিপূর্বক চলল/চলেছিল। রথের দুই চাকা শ্রবণীয় অর্থাৎ শ্রবণ২ সুভগ ছিল, এবং রাস্তা দিনে চলে গেল, যার ওপর লোকেরা দিনের বেলায় চলাফেরা করে। অর্থাৎ রাত্রির সময় চরাচরের অভাবে সূর্যার প্রস্থান করা উচিত নয়।] [১. ব্যাকরণের দৃষ্টিতে "ছন্দস্” শব্দকে "শ্রোত্র" ভাব নিপাত প্রযুক্ত হয়েছে, (অষ্টা০ ৫।১।৮৪) এর টিপ্পণী, দ্বারা জ্ঞানেন্দ্র সরস্বতী, কৌমুদী। ছন্দস্ এর অভিপ্রায় ছন্দোময়ী বেদবাণী। ২. অর্থাৎ রথের চাকার ধ্বনি শ্রবণে মধুর ছিল।]

শুচী তে চক্রে যাত্যা ব্যানো অক্ষ আহতঃ। 

অনো মনস্ময়ং সূর্যারোহৎ প্রতী পতিম্ ॥ ১২৷৷ 


পদার্থঃ (যাত্যাঃ তে) তোমার চলনশীল-এর (শুচী) দুই শুদ্ধ [কান, মন্ত্র ১১] (চক্রে) দুই চাকার [সমান হোক] এবং (ব্যানঃ) ব্যান [সর্বশরীর ব্যাপক বায়ু] (অক্ষঃ) ধুরা/অক্ষ [সমান] (আহতঃ) [চাকায়] সংযোজিত হোক। (পতিম্) পতির কাছে (প্রয়তী) গমন করে (সূর্যাঃ) প্রেরক [বা সূর্যের চমকের সমান তেজসম্পন্না] কন্যা (মনস্ময়ম্) মনোময় [বিচাররূপ] (অনঃ) রথে (আ অরোহৎ) আরোহণ করুক ॥১২॥

যখন কন্যা শ্রবণ মনন দ্বারা ব্যান বায়ু অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের বৃত্তি দমন করতে সক্ষম হবে, তখন পতির সমীপে থেকে গৃহাশ্রমের গাড়ি চালাবে ॥১২॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ হে সূর্যা ব্রহ্মচারিণি ! (যাত্যাঃ) পতিগৃহের দিকে গমনশীল/গমনকারী (তে) তোমার (চক্রে) মনরূপী রথের দুই চাকা অর্থাৎ প্রাণ এবং অপান বায়ু (শুচী) তোমাকে পবিত্রকারী এবং তার মধ্যে (ব্যানঃ) ব্যান বায়ু (অক্ষঃ) অক্ষ রূপে (আহতঃ) সংযোজিত ছিল। (পতিম্) পতির দিকে (প্রয়তী) প্রয়াণ/গমনকারী (সূর্যা) সূর্যা ব্রহ্মচারিণী (মনস্ময়ম্) মনোময় (অনঃ) রথের (আরোহৎ) আরোহণ করেছিল।

[ব্যাখ্যা- মন্ত্রে দুই চাকার সম্বন্ধে নতুন কল্পনা করা হয়েছে। ১১ তম মন্ত্রে দুই কানকে দুটি চাকা বলা হয়েছে। মন্ত্র ১২ এ ব্যান বায়ুর বর্ণনার কারণে, তৎসম্বন্ধী প্রাণ-এবং-অপানকে "শুচি" বলা হয়েছে। শুচি-এর অর্থ হল পবিত্রকারী। প্রাণ-এবং-অপান শরীর ও মনকে পবিত্র করে, এইজন্য বৈদিক সাহিত্যে একে "পবিত্রে" বলা হয়েছে। যথা "প্রাণাপানৌ পবিত্রে" (তে০ ব্রা০ ৩।৩।৪।৪; তথা ৩।৩।৬।৭)। প্রাণ ফুসফুসের মাধ্যমে প্রবিষ্ট হয়ে রক্তকে শুদ্ধ করে এবং অশুদ্ধ বায়ুকে শরীর থেকে বাইরে বের করে দেয়, তথা অপান মল-মূত্র বের করে শরীরের শুদ্ধি করে। সূর্যা ব্রহ্মচারিণী গুরুকুলের শুদ্ধ বায়ুতে থেকে, তথা শুদ্ধ বায়ুতে প্রাণায়াম দ্বারা নিজের শরীর এবং মনকে পবিত্র করেছে। প্রাণ-এবং-অপানকে মনোময় রথের দুই চাকা বলা হয়েছে, কেননা মনের গতি প্রাণ-এবং-অপানের ওপর নির্ভরশীল। প্রাণ-এবং-অপান রূপী দুই চাকার মধ্যে পরস্পর সম্বদ্ধ/সংযোগ রাখার জন্য এর মধ্যে ব্যান-এর অক্ষ লাগানো আছে। ব্যান-এর বিষয়ে বাচস্পত্য কোষে বলা হয়েছে "দেহস্থে সর্বশরীরব্যাপকে প্রাণাদিমধ্যে বায়ুভেদে। ব্যানো বিষ্বক্ অননবাম্ বায়ুঃ", অর্থাৎ সব শরীরে ব্যাপ্ত হয়ে শরীরের প্রত্যেক অঙ্গে প্রাণশক্তির সঞ্চারক হল ব্যান। যে ব্যান বায়ু সমগ্র শরীরকে চালনা করছে তা প্রাণ এবং অপান রূপী চাকার মাঝে অক্ষ রূপ হয়ে প্রাণাপানকে সমগতিতে চালনা করছে। ব্যান-এর ক্ষমতার কারণেই প্রাণ এবং অপান পরস্পর সম্পর্কযুক্ত দিন-রাত অক্ষুণ্ণরূপে চলতে থাকে। অভিপ্রায় হল, ব্রহ্মচারিণীর প্রাণাপান এবং ব্যান যখন বলিষ্ঠ হয়ে যাবে এবং প্রাণাপানের শুদ্ধির কারণে যখন সে সুস্থ থাকবে তখন তাঁর বিবাহ হওয়া উচিত। তথা ভৌতিক অর্থ হল "হে সূর্যা ব্রহ্মচারিণী ! তুমি যখন পতির দিকে গিয়েছিলে, তখন তোমার রথের দুই চাকা পরিষ্কার-নির্মল ছিল, চাকার মধ্যে মজবুত অক্ষ সংযোজিত ছিল, এবং রথ মনস্ময় অর্থাৎ বিচারপূর্বক নির্মিত তথা মনোহারী ছিল"। ব্যানঃ = বি + অন (প্রাণনে), অর্থাৎ বিশিষ্ট প্রাণশক্তিযুক্ত = মজবুত।

সূর্যয় বহতুঃ প্ৰাথাৎ সবিতা যমবাসৃজৎ। 

মঘাসু হন্যন্তে গাবঃ ফনীষু বুহ্যতে ॥১৩৷৷ 

পদার্থঃ (সূর্যায়াঃ) প্রেরক [বা সূর্যের চমকের সমান তেজসম্পন্না] কন্যার (বহতুঃ) দায় [যৌতুক, কন্যাকে দেয় পদার্থ] (প্র অগাৎ) সন্মুখে চলুক, (যম্) যে [পদার্থ] (সবিতা) জন্মদাতা পিতা (অব অসৃজৎ) দান করে। (মঘাসু) সৎকার ক্রিয়ার মধ্যে (গাবঃ) বাণী (হন্যন্তে) চলুক, এবং সেই [বধূ] (ফল্গুনীষু) সফল ক্রিয়ার মাঝে (বি উহ্যতে) অভিষিক্ত/অধিষ্ঠিত হবে/হোক॥১৩॥

পিতার উচিত বিবাহের সময় কন্যাকে স্ত্রীধন অর্থাৎ যোগ্য বস্ত্র, অলঙ্কার, ধন দান করা এবং সবাই আশীর্বাদ বচন দিয়ে সেই ক্রিয়া সফল করুক॥১৩॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (সূর্যায়াঃ) সূর্যা ব্রহ্মচারিণীর (বহতুঃ) বিবাহ (প্র, অগাৎ) সমীপে আগত হয়েছে, (যম্) যার (সবিতা) উৎপাদক পিতা (অবাসৃজৎ) স্বীকৃতি১ প্রদান করেছে, বা যার সৃষ্টি করেছে। (মঘাসু) মঘা নক্ষত্রে অর্থাৎ মাঘমাসে (গাবঃ) বিবাহ সম্বন্ধী বচন (হন্যন্তে)২ প্রেষিত করা হয়, এবং (ফল্গুনীষু) ফাল্গুনী নক্ষত্রে অর্থাৎ ফাল্গুনমাসে (ব্যুহ্যতে) সূর্যা বিবাহিত হয়।

[বহতুঃ = বিবাহ। যথা "যাং কল্পয়ন্তি বহতৌ বধূমিব" (অথর্ব০ ১০।১।১) এ "বহতু" এর অর্থ বিবাহ। গাবঃ; গৌঃ বাঙ্নাম (নিঘং০ ১।১১)। হন্যন্তে=হন্ হিংসা এবং গতিঃ। এখানে গতি অর্থে "হন্" এর প্রয়োগ হয়েছে। অর্থাৎ মাঘ-এ বিবাহ সম্বন্ধী বচন প্রেষিত করা হয়। মাঘমাস শীত প্রধান হয়, এইজন্য এই মাসে বাগদান করে দেওয়া, এবং ফাল্গুনমাসে বিবাহ করা শ্রেষ্ঠ মানা হয়েছে। ফাল্গুনমাসে শীত কম হয়ে যায়। বাগদান এবং বিবাহে দীর্ঘ সময়ের অন্তর হওয়া উচিত নয়। আপস্তম্ব গৃহ্যসূত্রে "মঘাভিঃ গাবো গৃহ্যন্তে", "ফল্গুনীভ্যাং ব্যূহ্যতে" পাঠ পাওয়া যায়। আপস্তম্ব-এ হন্যন্তে এর স্থানে গৃহ্যন্তে পদ পঠিত হয়েছে। এর দ্বারা প্রতীত হয় হন্যন্তে এ হন্ এর অর্থ "বধ করা" নয়। মহর্ষি দয়ানন্দের, বাগ্দান তথা বিবাহের সম্বন্ধে, নিম্নলিখিত বিচার রয়েছে। "যখন কন্যা এবং বরের বিবাহের সময় হবে, অর্থাৎ যখন এক বর্ষ বা ছয় মাস ব্রহ্মচর্যাশ্রম এবং বিদ্যাপূর্ণ হতে বাকি থাকবে তখন সেই কন্যাদের এবং কুমারদের প্রতিবিম্ব অর্থাৎ যাকে ফোটোগ্রাফ বলা হয়, অথবা প্রতিকৃতি অঙ্কন করে কন্যাদের অধ্যাপিকাদের কাছে কুমারদের, কুমারদের অধ্যাপকদের কাছে কন্যার প্রতিকৃতি প্রেরণ করুক। যার যার রূপ মিলে যাবে তাঁর তাঁর ইতিহাস অর্থাৎ জন্ম থেকে শুরু করে সেই দিন পর্যন্ত জন্ম চরিতের পুস্তক যা আছে তা অধ্যাপকেরা চেয়ে নিয়ে দেখুক/বিচার করুক। যখন/যদি দুজনের গুণ কর্ম স্বভাব সদৃশ হবে তবে/তখন যার যার সাথে যার যার বিবাহ হওয়া যোগ্য নির্ধারণ করবে সেই সেই পুরুষ এবং কন্যার প্রতিবিম্ব এবং ইতিহাস কন্যা ও বরের হাতে প্রদান করবে এবং বলবে, এক্ষেত্রে যা তোমার তোমার/তোমাদের অভিপ্রায় রয়েছে তা আমাকে বিদিত করে দাও, যখন তাঁদের দুজনের নির্ণয় পরস্পর বিবাহ করার হয়ে যাবে তখন সেখানে, নাহলে কন্যার মাতা-পিতার ঘরে, বিবাহ যোগ্য হবে। যখন তাঁরা পরস্পর সম্মুখীন হবে তখন সেই অধ্যাপকদের বা কন্যার মাতা-পিতা আদি ভদ্র পুরুষদের সামনে তাঁদের দুজনের পরস্পরের মধ্যে কথোপকথন শাস্ত্রার্থ করানো, এবং যা কিছু গুপ্ত ব্যবহার জিজ্ঞেস করবে তাও সভায় লিখে একে অপরের হাতে দিয়ে প্রশ্নোত্তর করে নেবে" (সত্যার্থ প্রকাশ)। মহর্ষি বিবাহ সম্বন্ধে গুরুদের বিশেষ মহত্ত্ব দেওয়া হয়েছে। গুরুকেও "সবিতা" বলা যেতে পারে। গুরু বিদ্যার গর্ভ থেকে জন্ম দিয়ে ব্যক্তিকে দ্বিজন্মা করে জন্মের কারণ হয়। বিশেষঃ–মন্ত্রে "মঘাসু" শব্দ পঠিত আছে। ঋগ্বেদ (১০।৮৫।১৩) এ "অঘাসু" পাঠ আছে। অঘাসু এ "অ+ঘা+সু" দ্বারা "অ" নিষেধার্থক, এবং "ঘা" হন্ ধাতুর রূপ প্রতীত হয়। এর দ্বারা স্পষ্ট হয় যে, "অঘা" নক্ষত্রে প্রাণী গৌ-এর হনন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই দৃষ্টিতে মঘাসু-কে আমরা "ম (মা)+ঘা (হন্)" মান্য করতে পারি। ইহারও অভিপ্রায় হবে মঘা নক্ষত্রে গাভীর বধ নিষিদ্ধ]। [১. অবসৃজ্, অবসর্গ = Allawing one to follow one's Inclination; স্বীকৃতি দেওয়া (আপ্টে)। ২. তথা মাঘ মাসে "গাবঃ" আদিত্যের রশ্মিসমূহ, "হন্যন্তে" মৃতপ্রায় হয়ে যায়, এবং ফাল্গুন মাসে রশ্মিসমূহ "ব্যুহ্যতে" আদিত্য বিশেষরূপে পুনঃ প্রাপ্ত করে নেয়। "সর্বে রশ্ময়ো গাব উচ্যন্তে" (নিরু০ ২।২।৭)। এই অর্থে হন্=বধ। ব্যুহ্যতে = বি + উহ্ (বহ্ প্রাপণে) অভিপ্রায় হল, রশ্মিসমূহের মৃতপ্রায় হয়ে যাওয়ায় শৈত্যাধিকতার জন্য কেবল বাগ্দান হোক, বিবাহ নয়। ফাল্গুনমাসে, ঋতুরাজ বসন্তের কারণে, প্রকৃতি সুন্দর হয়ে যায়, এবং শৈত্যেরও প্রকোপ থাকে না।]

যদশ্বিনা পৃচ্ছমানাব্যতং ত্রিচক্রেণ বহতুং সূর্যায়াঃ। 

কৈকং চক্রং বামাসীৎ ক দোয় তস্থথুঃ ॥১৪৷ 

পদার্থঃ (অশ্বিনা) হে বিদ্যা প্রাপ্ত [দুই স্ত্রী পুরুষ সমূহ !] (যৎ) যখন (সূর্যায়াঃ) প্রেরক [বা সূর্যের চমকের সমান তেজসম্পন্না] কন্যার (বহতুম্) বিবাহকে (পৃচ্ছমানৌ) প্রশ্ন করে [তোমরা দুজন] (ত্রিচক্রেণ) নিজের তিন চক্রবিশিষ্ট [কর্ম, উপাসনা এবং জ্ঞান বিশিষ্ট রথ] দ্বারা (অয়াতম্) পৌঁছাও। (ক্ব) কোথায় (বাম্) তোমাদের দুজনের (একম্) এক [আত্মবোধরূপ] (চক্রম্) চক্র (আসীৎ) থাকে, (ক), কোথায় (দেষ্ট্রায়) উপদেশের জন্য (তস্থথুঃ) তোমরা দুজন স্থিত হও ॥১৪॥

স্ত্রী-পুরুষ বিবাহ উৎসবে একত্র হয়ে পরস্পর আত্মোন্নতি এবং পরস্পর উপকারে স্থিতির বিচার করুক। মন্ত্র ১৬ দেখো ॥১৪॥ এই মন্ত্র ঋগ্বেদে আছে−১০।৮৫।১৪, ১৫ ॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (ত্রিচক্রেণ) তিন চক্র, তিনটি পরিক্রমার দ্বারা (সূর্যায়াঃ) সূর্যা ব্রহ্মচারিণীর (বহতুম্) বিবাহের জন্য, (যৎ) যখন (অশ্বিনা) হে বরের মাতা-পিতা ! তোমরা দুজন (পৃচ্ছমানৌ) কন্যার সদ্গুণ-সমূহ বা বিবাহের সম্বন্ধে পরস্পর জিজ্ঞেস করে, কথোপকথন করে (অয়াতম্) বধূর ঘরে পৌঁছাও, তখন (বাম্) তোমাদের দুজনের তিনটি পরিক্রমা থেকে (একম্, চক্রম্) একটি পরিক্রমা (ক্ব) কিসের মধ্যে বা কোন স্থানে (আসীৎ) হবে, তথা (দেষ্ট্রায়) আদেশ, নির্দেশ উপদেশ, বা দান দেওয়ার সময় (ক্ব) কোন স্থানে (তস্যতুঃ) তোমরা দুজন স্থিত হবে। "ছন্দসি লুঙ্লঙ্লিটঃ" দ্বারা লুঙ্ আদি সর্ব কালে হয়।

[ত্রিচক্রেণ= এর সামান্যতঃ অর্থ করা হয়, "তিনটি চক্রবিশিষ্ট রথ দ্বারা"। দেষ্ট্রায়, দিশ্=To direct; To teach; To grant (আপ্টে)। আসীৎ তথা তস্থতুঃ এর প্রয়োগ ভবিষ্যদর্থে হয়েছে। অশ্বিনা = অশ্বিনৌ= বরের মাতা-পিতা (মন্ত্র ৮,৯)] [ব্যাখ্যা- বরের মাতা-পিতাকে তিন চক্র অর্থাৎ পরিক্রমার বিধি দ্বারা সূর্যাকে বিবাহিত করাতে হবে। বরের মাতা-পিতাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে তোমাদের তিন চক্রের মধ্যে এক চক্র কার মধ্যে আশ্রিত হবে, অর্থাৎ এক পরিক্রমা বর-বধূর মধ্যে কাকে করতে হবে, তথা কোন সময় বা কোন স্থানে করতে হবে ? বাকি দুই চক্রের সম্বন্ধেও প্রশ্ন স্বভাবতঃ বুঝে নেওয়া উচিত। সম্ভবতঃ এই দুটি অর্থাৎ একটি পৃষ্ট এবং অপরটি অপৃষ্ট চক্রের স্পষ্টীকরণ মন্ত্র ১৬ এ করা হয়েছে। দেষ্ট্রায় পদ "দিশ্” ধাতু থেকে ব্যুৎপন্ন। দিশ্ এর অর্থ হল "অতিসর্জন" অর্থাৎ দান। অতঃ দেষ্ট্রায় এর মুখ্যার্থ হল "দানের জন্য"। কন্যাদান তথা গোদানের সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হয়েছে এই দানের সময়, হে বরের মাতা-পিতা ! তোমরা কোথায় অর্থাৎ কোন স্থানে স্থিত হবে।]

যদযাতং শুভশতী বরেয়ং সূর্যামুপ। 

বিশ্বে দেবা অনু তুদ বামজান পুত্রঃ পিতরমবৃণীত পূষা ৷ ১৫৷৷ 

পদার্থঃ (শুভঃ পতী) হে শুভক্রিয়ার পালনকারী [স্ত্রী-পুরুষ সমূহ !] তোমরা দুজন (যৎ) যখন (সূর্যাম্=সূর্যায়াঃ) প্রেরক [বা সূর্যের চমকের সমান তেজসম্পন্না] কন্যার (বরেয়ম্) শ্রেষ্ঠ কর্মে (উপ) আদরপূর্বক (অয়াতম্) পৌঁছাও। (বিশ্বে দেবাঃ) সব বিদ্বানগণ (বাম্) তোমাদের দুজনের (তৎ) সেই [কর্মে] (অনু অজানন্) সম্মতি প্রদান করুক [যে] (পূষা) পোষণকারী (পুত্রঃ) পুত্র (পিতরম্) পিতাকে (অবৃণীত) স্বীকার করে ॥১৫॥

শুভচিন্তক স্ত্রী পুরুষ বিবাহে এসে প্রচেষ্টা করুক যাতে বিদ্বানগণ প্রসন্ন হয়ে আশীর্বাদ প্রদান করুক যে, সেই বধূ-বরের পুত্র পোষণকারী বিদ্বান্ পরাক্রমী হবে/হয় ॥১৫॥এই মন্ত্র ঋগ্বেদে আছে−১০।৮৫।১৪, ১৫ ॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (শুভস্পতী) হে শোভাযুক্ত বরযাত্রার, বা শুভকর্ম-সমূহের স্বামী বরের মাতা-পিতা ! তোমরা দুজন (যৎ) যে (সূর্যাম্, উপ) সূর্যা ব্রহ্মচারিণীর কাছে বা তাঁর বিবাহার্থে (বরেয়ম্) বর দ্বারা গমনীয় বধূগৃহে (অয়াতম্) পৌছেঁছো, এবং যে (বাম্) তোমরা দুজনের (পূষা) পরিপুষ্ট (পুত্রঃ) পুত্র, (পিতরম্) শ্বশুরকে পিতৃরূপে (অবৃণীত) বরণ করেছে, (তৎ) সেই দুই কর্মকে (বিশ্বে দেবাঃ) দুই দিকের আত্মীয় সব বিদ্বানগণ তথা দিব্যগণ (অনু) অনুকূলরূপে (অজানন্) জেনেছে।

[সূর্যাম্, উপ (সমীপ বা উপয়ন্তুম্)। বরেয়ম্ = বর+এয়ম্ (ইণ গতৌ)। অনু, অজানন্=অথবা অনুজ্ঞা দিয়েছে। অয়াতম্= অ+যা (প্রাপণে)। ঋগ্বেদ ১০।৮৫।১৫ এ "পিতরৌ" পাঠ আছে, অর্থাৎ মাতা-পিতা দুজনকে] [ব্যাখ্যা–বরের মাতা-পিতা বরযাত্রাকে শোভাযুক্ত করুক, এবং এটা মনে রাখুক, বিবাহে সব কার্য শুভ হোক, এই সময়ে কোনো অশুভ কাজ হওয়া উচিত নয়। বিবাহের সম্বন্ধ নির্ধারণের ক্ষেত্রে তথা বিবাহ কার্যে, উভয় পক্ষের দিব্যগণ, বয়ঃজেষ্ঠ তথা বিদ্বানদের অনুমতি, স্বীকৃতি, বর তথা তাঁর মাতা-পিতার সাথে হওয়া উচিত। বর পরিপুষ্ট হওয়া উচিত, নির্বল নয়। বর, সূর্যার পিতাকে পিতৃরূপে স্বীকার করুক, এবং সূর্যার মাতাকে মাতা জানুক। এইভাবে সূর্যার অন্য আত্মীয়কেও নিজের আত্মীয় জানুক]

ঘে তে চক্রে সূর্যে ব্রহ্মাণ ঋতুথা বিদুঃ। 

অথৈকং চক্রং যদ গুহা তদদ্ধাতয় ইদ বিদুঃ ॥ ১৬৷৷ 

পদার্থঃ (সূর্যে) হে প্রেরক [বা সূর্যের চমকের সমান তেজসম্পন্না] কন্যা ! (তে) তোমার (দ্বে) দুই [কর্ম এবং উপাসনা রূপ] (চক্রে) চক্রগুলোকে (ব্রহ্মাণঃ) ব্রহ্মজ্ঞানীরা (ঋতুথা) সব ঋতুতে (বিদুঃ) জানে। (অথ) এবং (একম্) এক [জ্ঞানরূপ] (চক্রম্) চক্র (যৎ) যা (গুহা) হৃদয়ে আছে, (তৎ) তা (অদ্ধাতয়ঃ) সত্য জ্ঞানী পুরুষ (ইৎ) ই (বিদুঃ) জানে॥১৬॥

বেদবেত্রী কন্যা এবং বেদবেত্তা বরের কর্ম, উপাসনা, জ্ঞানের যোগ্যতা বিদ্বানগণ বিচার করুক। মন্ত্র ১৪ দেখো ॥১৬॥ এই মন্ত্র ঋগ্বেদে আছে−১০।৮৫।১৬ ॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (তে) সেই প্রসিদ্ধ (দ্বে) দুই (চক্রে) চক্রকে (ব্রহ্মাণঃ) বেদবেত্তা (সূর্যে) সূর্যের মধ্যে, (ঋতুথা) বসন্ত ঋতুর অনুসারে (বিদুঃ) জানে, (অথ) এবং (একম্, চক্রম্) এক চক্র (যদ্) যা (গুহা) ঘরে অজ্ঞাত রূপে থাকে (তদ্) তা (অদ্ধাতয়ঃ, ইৎ) সতত সত্যানুগামী বিদ্বানই (বিদুঃ) জানে।

[তে="তদ্" এর দ্বিতীয়া বিভক্তির দ্বিবচন, নপুংসকলিঙ্গ। সূর্যে="সূর্য" এর সপ্তম্যেক বচন। অদ্ধাতয়ঃ= অদ্ধা সত্যনাম (নিঘং০ ৩।১০)+অৎ (সততগমনে) ব্রহ্মাণঃ, ব্রহ্ম=ঈশ্বরঃ, "বেদঃ" তত্ত্ব, তপো বা (উণা০ ৪।১৪৭) মহর্ষি দয়ানন্দ। অথবা ব্রহ্মবেদ=অথর্ববেদ। মন্ত্র ১৪ এ ত্রিচক্রের বর্ণনা আছে। মন্ত্র ১৬ এ সেই তিনটি চক্রের বিভাগ দর্শানো হয়েছে, দুটি চক্র তো সূর্যের মধ্যে আছে, এবং একটি চক্র গুহায় আছে, অর্থাৎ গুহায় স্থিত অজ্ঞাত বস্তুর সদৃশ অজ্ঞাতরূপ। সূর্যের মধ্যে দুটি চক্র স্পষ্ট দৃষ্টিগোচর হয়। (১) এক দৈনিক গতির চক্র অর্থাৎ পরিক্রমা, পূর্ব থেকে পশ্চিম তথা পশ্চিম থেকে পুনঃ পূর্ব দিকে। যা দিন রাত্রির ঋতুর কা নির্মাণ করতা হৈ। (২) অপর চক্র অর্থাৎ পরিক্রমা হল উত্তরায়ণ সীমান্ত থেকে দক্ষিণায়ন সীমান্ত, এবং দক্ষিণায়ন সীমান্ত থেকে পুনঃ উত্তরায়ণ সীমান্ত। এই দ্বিতীয় চক্র=পরিক্রমা, ঋতু-সমূহের নির্মাণ করে। মন্ত্রে 'ঋতুথা" শব্দ দ্বারা বসন্ত ঋতুর গ্রহণ হয়েছে। সূর্য দক্ষিণায়ন থেকে পুনঃ যখন ভূমধ্য রেখায় আসে তখন বসন্ত ঋতু যৌবন অবস্থায় থাকে। মন্ত্র ১৩ এর অনুসারে বিবাহ ফাল্গুনে হওয়া উচিত, এবং ফাল্গুনের প্রারম্ভে প্রায় বসন্তু-ঋতুর প্রারম্ভ হয়ে যায়। এইজন্য "ঋতুথা" শব্দ দ্বারা সূর্যা-এর ঋতুধর্মের বিষয় মন্ত্রে অভিপ্রেত নয় প্রতীত হয়। বিবাহের এই মন্ত্রগুলোতে দ্যোঃ১ এবং পৃথিবীর বর-এবং-বধূর রূপের মধ্যে সম্বন্ধ দর্শানো হয়েছে। যথা মকর অথর্বঃ [১৪।২।৭১] দ্যৌঃ১ অর্থাৎ সূর্যে স্থিত দুই চক্রের বর্ণনা মন্ত্রের পূর্বার্ধে হয়েছে। উত্তরার্ধে পৃথিবীর এক চক্রের বর্ণনা আছে যাকে গুহা পদ দ্বারা অজ্ঞাত স্বরূপ দর্শানো হয়েছে। পৃথিবী সূর্যের পরিক্রমা করে। ইহা পৃথিবীর চক্র/পরিক্রমা। পৃথিবীস্থ প্রাণীদের পৃথিবীর এই চক্র/পরিক্রমার অনুভূয়মান/অনুভব হয় না। অতঃ এই চক্রের বর্ণনা "যদ্ গুহা" দ্বারা হয়েছে। সূর্যারূপী পৃথিবীর এই এক চক্র বা পরিক্রমা আছে। সূর্য মানো পৃথিবীর ঋতু-সমূহের সম্বন্ধে দুটি পরিক্রমা করে, এবং পৃথিবী সূর্যের এক পরিক্রমা করে। এই বর্ণনা যথাদৃষ্ট তথা যথানুভূত বর্ণনা। বৈদিক সিদ্ধান্তে পৃথিবীই সূর্যের পরিক্রমা করে, সূর্য পৃথিবীর পরিক্রমা করে না। যথাঃ- আয়ং গৌঃ পৃশ্নি॑রক্রমী॒দস॑দন্ মা॒তরং॑ পু॒রঃ। পি॒তরং॑ চ প্র॒য়ন্ত্স্বঃ॑॥৬॥ (যজু০ ৩।৬)।][১. মন্ত্রে দ্যৌঃ দ্বারা সূর্য অভিপ্রেত হয়েছে, না দ্যুলোক সৌরমণ্ডলে সূর্য এবং পৃথিবীর পরস্পর সম্বন্ধ বর-বধূর রূপে প্রকট করা হয়েছে, দ্যুলোক এবং পৃথিবীর নয়। সূর্যকে দ্যৌঃ বলা হয়েছে "দ্যৌতনাৎ"। দ্যোতন-এর কারণে; দ্যৌঃ এর অর্থ অন্তরিক্ষও হয় (উণা০ ২।৬৮) মহর্ষি দয়ানন্দ।] অথবা [(সূর্যে) হে সূর্যা ব্রহ্মচারিণী ! (তে) তোমার (দ্বে) দুই (চক্রে) পরিক্রমা (ব্রহ্মাণঃ) বেদবেত্তা বিদ্বান্ (ঋতুথা) বসন্ত ঋতুর বিবাহানুসারে (বিদুঃ) জানে। (অথ) তথা (একম্) এক (চক্রম্) পরিক্রমা (যদ্) যা (গুহা) অজ্ঞাত হয়, (তৎ) তা (অদ্ধাতয়ঃ) সতত সত্যানুগামী বিদ্বান্ই (বিদুঃ) জানে।] [ব্যাখ্যা— মন্ত্র দ্বারা প্রতীত হয়, সূর্যার বিবাহের সময় সূর্যা দুই পরিক্রমা করে বিবাহমণ্ডপে, যেখানে বিবাহে নিমন্ত্রিত দেব-দেবীরা বসে থাকে। এবং সূর্যা এক পরিক্রমা করে, ঘরের ভেতর। এই পরিক্রমার সাক্ষী সত্যময় জীবনসম্পন্ন বিদ্বান্ই হয়, সর্ব সাধারণ নিমন্ত্রিত ব্যক্তি নয়। ঘরের ভেতরে হওয়া এই পরিক্রমার বিষয়ে "গুহা" শব্দের প্রয়োগ হয়েছে। এমনটাই বৈদিক বিধি মন্ত্র দ্বারা প্রতীত হয়। সূর্যা-এর দুটি মণ্ডপ-পরিক্রমা এবং একটি গুহা-পরিক্রমার সাথে-সাথে বরও পরিক্রমা করে। এই তিনটি পরিক্রমার নির্দেশ "ত্রিচক্রেণ বহতুং সূর্যায়াঃ" দ্বারা হয়েছে (অথর্ব০ ১৪।১।১৪)। অথবা সূর্য অর্থাৎ বরের, বিবাহ মণ্ডপে, দুটি পরিক্রমার সাথে সূর্যাও, তথা সূর্যার এক গুহা পরিক্রমার সাথে বরও পরিক্রমা করে। এই মন্ত্রগুলোর দ্বারা পরিক্রমার স্বরূপ এমনটাই প্রতীত হয়, অনেক পদ্ধতিকারগণ নে এই পরিক্রমার স্বরূপ ভিন্ন প্রকারের বলেছেন। পদ্ধতিকারগণও বিবাহের বিধি দুই প্রকারের বলেছেন। কিছু বিধি তো বধূর ঘরে হয়, এবং কিছু বিবাহমণ্ডপ বা সভামণ্ডপে হয়। ঘরে হওয়া বিধি-সমূহকে গুহা-বিধি বলা যেতে পারে, মন্ত্রনির্দেশানুসারে, সূর্যার এক পরিক্রমাও গুহা-পরিক্রমা]

অর্যমণং যজামহে সুবন্ধুং পতিবেদন। 

উর্বরুকমিব বন্ধনাৎ প্রেতো মুঞ্চামি নামুতঃ ॥ ১৭

পদার্থঃ (সুবন্ধুম্) সুন্দরবন্ধু, (পতিবেদনম্) রক্ষক পতির জ্ঞান প্রদায়ী বা প্রদায়ী (অর্যমণম্) শ্রেষ্ঠদের সম্মান প্রদানকারী পরমাত্মাকে (যজামহে) আমরা পূজা করি। (উর্বারুকম্ ইব) শশাকে যেমন (বন্ধনাৎ) লতা বন্ধন থেকে, [তেমনই দুজন বধূ-বরকে] (ইতঃ) এই [বিয়োগপাশ/বন্ধন] থেকে (প্র মুঞ্চামি) আমি [বিদ্বান্] মুক্ত করি, (অমুতঃ) সেই [প্রেম বন্ধন] থেকে (ন) না [মুক্ত করি] ॥১৭॥

পরমাত্মার মহতী কৃপার স্মরণ করে বিদ্বানগণ বধূ-বরকে বিয়োগের কষ্ট থেকে মুক্ত করে পরস্পর প্রেমাস্পদ করুক ॥১৭॥এই মন্ত্র কিছুটা আলাদাভাবে ঋগ্বেদে আছে−৭।৫৯।১২। এবং যজুর্বেদে−৩।৬ ॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (অর্যমণম্) ন্যায়কারী, (সুবন্ধুম্) সর্বোত্তম বন্ধু, (পতিবেদনম্) পতি প্রাপ্তিতে সহায়ক পরমেশ্বরের (যজামহে) আমরা যজন অর্থাৎ পূজা সঙ্গতি তথা উনার প্রতি আত্মদান করি। (বন্ধনাৎ) বন্ধন থেকে (ইব) যেমন (উর্বারুকম্) খরমুজ স্বভাবতঃ মুক্ত হয়, তেমনই সূর্যা বা কন্যাকে (ইতঃ) এই পিতৃগৃহ থেকে (মুঞ্চামি) আমি মুক্ত করি, (অমুতঃ) সেই পতিগৃহ থেকে (ন) নয়।

[অর্যমা= "সত্যন্যায়কারী মনুষ্যদের মান্য, এবং পাপ তথা পুণ্য অর্জনকারীদের পাপ এবং পুণ্যের ফলের যথাবৎ সত্য-সত্য নিয়মকর্তা, এর মাধ্যমে সেই পরমেশ্বরের নাম অর্যমা", (সত্যার্থ প্রকাশ সমু০ ১)। সুবন্ধুম্="স নো বন্ধুর্জনিতা" (যজু০ ৩২।১০)। যজামহে= যজ্ দেবপূজা সঙ্গতিকরণদানেষু ] [ব্যাখ্যা— কন্যা পক্ষের লোকেরা কন্যাকে পতিগৃহে পাঠানোর পূর্বে, অর্যমা অর্থাৎ ন্যায়কারী পরমেশ্বরকে হৃদয়ের সাক্ষী তথা অন্তর্যামী জেনে যজ্ঞ করে। এই যজ্ঞ বিনা বধূ পত্নী হতে পারে না "পত্যুর্নো যজ্ঞসংযোগে" (অষ্টা০ ৪।১।১৩৩) দ্বারা পতির সাথে পত্নীর সম্বন্ধ যজ্ঞ পূর্বক হয়। অর্যমা-এর বিশেষণ হল, পতিবেদনম্। এই শব্দ দ্বারা বিবাহ সম্বন্ধকে পবিত্র বলা হয়েছে। বেদে পরমাত্মাকেও সদ্গৃহস্থ বলা হয়েছে। তিনি প্রকৃতিরূপী পত্নীর পতি। এই পত্নী দ্বারা তিনি সমগ্র সংসার উৎপন্ন করেন। পরমাত্মা বেদের দ্বারা পতি-পত্নীর সম্বন্ধের/সম্পর্কের ঘোষণা করেছেন। এই সম্পর্ক সংসারকে উত্তম সন্তান প্রদানের জন্য। সংসারে উত্তম সন্তান তখনই উৎপন্ন হবে/হতে পারে যখন মনুষ্য সমাজ শুভ এবং পবিত্র ভাবনার দ্বারা প্রেরিত হয়ে বিবাহ সম্বন্ধ করবে। পতি-পত্নীর সম্পর্ক কাম বাসনার উচ্ছৃঙ্খল রাজ্য হওয়া উচিত। এইজন্য বৈদিক ধর্মে এই সম্পর্ক পরমাত্ম-যজন থেকে প্রারম্ভ হয়। কন্যার পিতা উদ্ঘোষিত করে, আমি নিজের গৃহের প্রেমবন্ধন থেকে একে মুক্ত করি, কিন্তু পতিগৃহের প্রেমবন্ধন থেকে একে মুক্ত করি না। নববিবাহিতাকে পতিগৃহে স্থির করার জন্য মাতা-পিতার সদুপদেশ অধিক প্রভাবশালী হয়। এইজন্য বিবাহ-যজ্ঞের সময় কন্যার পিতা নিজের ধর্মপুত্রকে বিশ্বাস দেয়, আমি সর্বদা প্রচেষ্টা করবো, যাতে কন্যা পতিপক্ষ থেকে নিজের সম্বন্ধ বিচ্ছেদ না করে। বিবাহের পর না পতি সম্বন্ধ ত্যাগ করে পত্নীর, এবং না পত্নী সম্বন্ধ ত্যাগ করে পতির। দুজনেই পারস্পরিক পতিপত্নী সম্পর্কের দৃঢ়-সূত্রে আবদ্ধ থাকুক। মন্ত্রের পিতৃগৃহের ত্যাগ করার ক্ষেত্রে "উর্বারুক" এর দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে। এই ফল যখন পরিপক্ক হয়ে যায় তখন তার নিজের আশ্রয় থেকে সম্বন্ধ স্বয়মেব ছিন্ন হয়ে যায়। এইভাবে পিতৃগৃহ থেকে সম্বন্ধ ত্যাগের ক্ষেত্রেও সেটাই উচিত সময় যখন বধূর আয়ু পরিপক্ব হয় এবং সে বিবাহসম্বন্ধের/সম্পর্কের যোগ্য আয়ুসম্পন্না পূর্ণযুবতী হয়ে যায়। এর দ্বারা জ্ঞাত হয় যে, বৈদিক দৃষ্টিতে অপরিপক্ব আয়ুতে কন্যার বিবাহ হওয়া উচিত নয়।]


প্রেত মুঞ্চামি নামুতঃ সুবদ্ধামমুতস্কর। 

যথেয়মিন্দ্র মীবঃ সুপুত্রা সুভগাসতি। ১৮৷৷ 

পদার্থঃ (ইতঃ) এই [বিয়োগ পাশ/বন্ধন] থেকে [এই বধূকে] (প্র মুঞ্চামি) আমি [বর] উত্তমরূপে মুক্ত করি, (অমুতঃ) সেই [প্রেমপাশ/বন্ধন] থেকে (ন) না [মুক্ত করি], (অমুতঃ) সেই [প্রেমপাশ/বন্ধনে] [সেই বধূকে] (সুবদ্ধাম্) ভালো বন্ধনযুক্ত (করম্) আমি করি। (যথা) যাতে (মীঢ্বঃ) হে সুখের বর্ষণকারী (ইন্দ্র) পরম ঐশ্বর্যবান পরমাত্মন্ ! (ইয়ম্) এই [বধূ] (সুপুত্রা) সুন্দর পুত্রসম্পন্না এবং (সুভগা) বড়ো ঐশ্বর্যসম্পন্না (অসতি) হবে/হয় ॥১৮॥

বধূ-বরের উচিত নিজেদের মধ্যে প্রেমের আচরণ করা, এবং পরমাত্মার উপাসনা করে প্রচেষ্টাপূর্বক ঘরে শ্রেষ্ঠ সন্তান এবং ঐশ্বর্য প্রাপ্ত করে আনন্দিত থাকা ॥১৮॥মন্ত্র১৮, ১৯ ঋগ্বেদে কিছুটা আলাদাভাবে আছে−১০।৮৫।২৫, ২৪ এবং দুটি মন্ত্র মহর্ষিদয়ানন্দকৃত সংস্কারবিধি বিবাহপ্রকরণে উদ্ধৃত আছে এবং বিনিয়োগ এরূপ যে, বর এই দুটি মন্ত্র বলে বধূর বাঁধা কেশ মুক্ত করুক ॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (ইতঃ) এই পিতৃগৃহ থেকে (প্র মুঞ্চামি) আমি এই কন্যাকে মুক্ত করি, (অমুতঃ) সেই পতিগৃহে (সুবদ্ধাম্) সুদৃঢ় বদ্ধ (করম্) করি। (যথা) যাতে (মীঢ্বঃ, ইন্দ্র) হে বীর্যবান্ ইন্দ্র ! অর্থাৎ বীর্যশক্তি এবং আত্মিক শক্তিসম্পন্ন হে ধর্মপুত্র ! (ইয়ম্) এই কন্যা (সুপুত্রা) উত্তম পুত্রসম্পন্না, (সুভগা) সৌভাগ্যবতী (অসতি) হয়।

[মীঢ্ব = মিহ্ সেচনে, বীর্যসেচনে সমর্থ] [ব্যাখ্যা - মন্ত্রে কন্যার পিতা নিজ ধর্মপুত্রকে আশ্বাস দেয় আমি পিতৃগৃহের সাথে সম্বন্ধযুক্ত কন্যার প্রেমবন্ধন শিথিল করে দিই যাতে কন্যা পতিগৃহে স্থির হতে পারে। ইন্দ্র-এর অর্থ আত্মিক শক্তিসম্পন্ন পতি, এবং মীঢ্বঃ এর অর্থ হল "সীঞ্চনকারী" বা বীর্যশক্তিসম্পন্ন। এই দৃষ্টিতে মন্ত্র ১৫ এ বরকে "পূষা" বলা হয়েছে। যদি পতি বীর্যবান্ না হয় তবে গৃহস্থধর্ম সফল হবে না/হতে পারে না, তথা পারস্পরিক পতিপত্নী সম্পর্ক আলগা/শিথিল হতে পারে, এবং পত্নী সুপুত্রা হতে পারে। সুভগা এর অর্থ হল উত্তম ভগসম্পন্ন। ভগ এর ৬ অর্থ হয়, ঐশ্বর্য, ধর্ম, যশ, শ্রী, জ্ঞান এবং বৈরাগ্য। গৃহস্থে মাতার কর্ত্তব্য হওয়া উচিত, এই ৬ ভগ-এর যথাশক্তি উপার্জন করতে থাকা, যাতে সন্তান সুসন্তান হতে পারে।]

প্র ত্বা মুঞ্চামি বরুণস্য পাশাদ যেন ত্বাবাৎ সবিতা সুশেবাঃ। 

ঋতস্য যোনৌ সুকৃতস্য লোকে স্যোনং তে অস্তু সহসম্ভলায়ৈ ৷ ১৯৷৷ 

পদার্থঃ [হে বধূ !] (ত্বা) তোমাকে (বরুণস্য) প্রতিরোধের (পাশাৎ) বন্ধন থেকে (প্র মুঞ্চামি) আমি [বর] উত্তমরূপে মুক্ত করি, (যেন) যার সাথে (ত্বা) তোমাকে (সুশেবাঃ) অত্যন্ত সেবাযোগ্য (সবিতা) জন্মদাতা পিতা (অবধ্নাৎ) বেঁধেছে। (ঋতস্য) সত্য নিয়মের (যোনৌ) ঘরে এবং (সুকৃতস্য) সুকৃত [পুণ্য কর্মের] (লোকে) সমাজে (সহসম্ভলায়ৈ) সখীদের সহিত বর্তমান (তে) তোমার জন্য (স্যোনম্) আনন্দ (অস্তু) হোক ॥১৯॥

যে কন্যাকে পিতা যোগ্য পতি প্রাপ্তির পূর্বাবস্থা পর্যন্ত ধরে রেখেছিল, তাঁকে পিতার ঘর থেকে প্রসন্নতার সহিত নিয়ে বর প্রেমপূর্বক রাখুক এবং ঘরের সব ধর্মাত্মা বিদ্বান্ স্ত্রী-পুরুষ শ্রেষ্ঠ ব্যবহার করে তাঁকে সুখ প্রদান করুক ॥১৯॥মন্ত্র ১৮ এর টিপ্পণী দেখো ॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (বরুণস্য) বরণ যোগ্য শ্রেষ্ঠ পরমেশ্বর সম্বন্ধী (পাশাৎ) প্রেম-বন্ধন থেকে (ত্বা) হে বধু ! তোমাকে (প্র মুঞ্চামি) আমি মুক্ত করি, (যেন) যে প্রেম-বন্ধন দ্বারা (সুশেবাঃ) উত্তম সুখদাতা (সবিতা) জন্মদাতা পিতা (ত্বা) তোমাকে (অবধ্নাৎ) বন্ধন করেছিল। (ঋতস্য) সত্য নিয়মের (যোনৌ) আমার গৃহে, তথা (সুকৃতস্য) সুকর্মীদের (লোকে) সমাজে, (সহসম্ভলায়ৈ, তে) সম্যগ্ভাষী পতির সাথে বর্তমান তোমার জন্য (স্যোনম্) সদা সুখ (অস্তু) হোক।

[সুশেবাঃ=সু + শেবম্ সুখনাম (নিঘং০ ৩।৬)। যোনিঃ গৃহনাম (নিঘং০ ৩।৪) সম্ভল=সম্ (সম্যক্) + ভল (পরিভাষণে), অর্থাৎ সম্যগ্ভাষী, প্রেমপূর্বক ভাষণকারী পতি (মন্ত্র ৩১)। স্যোনম্ সুখনাম (নিঘং০ ৩।৬)। সহসম্ভলায়ৈ= সম্ভলেন সহ বর্ততে ইতি সহসম্ভলা, তস্যৈ] [ব্যাখ্যা–বরুণ অর্থাৎ সংসারের সম্রাট্ পরমেশ্বরের বন্ধন, সংসারকে বেঁধে রেখেছে। মাতা-পিতা এবং সন্তানদের, পতি এবং পত্নীর পারস্পরিক প্রেমবন্ধনও একটি বন্ধন যার রচনা প্রভু সৃষ্টিতে করে রেখেছেন। এই প্রেমবন্ধনের সত্তা পশুদের, পক্ষীর তথা কীট-পতঙ্গের মধ্যেও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে, যার মাধ্যমে প্রাণিসৃষ্টির সৃজন হচ্ছে। বর বলে— হে বধু ! এখনও পর্যন্ত তো এই প্রেমবন্ধন দ্বারা তোমার সুখী মাতা-পিতা তোমাকে বেঁধে রেখেছিল, কিন্তু এখন থেকে আমি তোমাকে নিজের প্রেমবন্ধন দ্বারা আবদ্ধ করি। এইভাবে বর নিজের হার্দিক প্রেমের বিশ্বাস বধূকে দেয়। সাথে বর বলে এই নতুন ঘরে সত্যের রাজ্য আছে। এই ঘরে তুমি সদা সুখপূর্বক থাকবে, এবং আমি সদা সম্যগ্ভাষী হয়ে তোমার জন্য সুখদায়ী হবো।]

ভগস্তৃত নয়তু হস্তগৃহ্যাশ্বিনা ত্বা প্র বহতাং রথেন। 

গৃহা গচ্ছ গৃহপত্নী যথাসো বশিনী ত্বং বিদথমা বদাসি। ২০৷ 

পদার্থঃ [হে বধূ !] (ভগঃ) ঐশ্বর্যবান্ বর (ত্বা) তোমাকে (ইতঃ) এখান থেকে (হস্তগৃহ্য) হাত ধরে (নয়তু) নিয়ে যাক, (অশ্বিনা) বিদ্যা প্রাপ্ত দুজন [স্ত্রী-পুরুষ সমূহ] (ত্বা) তোমাকে (রথেন) রথ দ্বারা (প্র বহতাম্) উত্তমরূপে নিয়ে চলুক। (গৃহান্) ঘরে (গচ্ছ) পৌঁছাও, (যথা) যাতে (গৃহপত্নী) গৃহপত্নী [ঘরের স্বামিনী] (অসঃ) তুমি হও এবং (বশিনী) বশবর্তীকারী (ত্বম্) তুমি (বিদথম্) সভাগৃহে (আ বদাসি) কথোপকথন করো ॥২০॥

প্রতাপশালী বর গুণবতী বধূকে আদরপূর্বক নিয়ে চলুক, বিদ্বান্ স্ত্রী-পুরুষ তাঁকে রথে আরোহণ করাবে। সভ্যা বধূ পতিগৃহে পৌঁছে নিজের বিদ্বত্তা এবং শুভ গুণ-সমূহের কারণে প্রিয় বচন এবং আচরণের মাধ্যমে সকলকে প্রসন্ন করে ॥২০॥মন্ত্র ২০, ২১ আলাদাভাবে ঋগ্বেদে আছে−১০।৮৫।২৬, ২৭ ॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (ভগঃ) ৬ ভগ সম্পন্ন পতি (ত্বা) হে পুত্রী ! তোমাকে (হস্তগৃহ্য) তোমার হাত ধরে (নয়তু) নিয়ে চলুক, (অশ্বিনা) বরের মাতা-পিতা (ত্বা) তোমাকে (রথেন) রথ দ্বারা (প্রবহতাম্) সুখপূর্বক ঘরে নিয়ে চলুক। হে পুত্রী ! (গৃহান্) পতি গৃহবাসীদের দিকে (গচ্ছ) তুমি যাও, (যথা) যাতে (পত্নী) পতিগৃহের স্বামিনী (অসঃ) তুমি হতে পারো, (বশিনী) পুত্রদের এবং ভৃত্য আদিকে বশবর্তীকারী হয়ে (ত্বম্) তুমি (বিদথম্) তাঁদের কর্ত্তব্যজ্ঞানের (আ বদাসি) নিরন্তর কথন করো।

[ভগঃ=মন্ত্র ১৮; সুভগা পদ-এর ব্যাখ্যায়। প্র বহতাম্ = প্র+বহ (প্রাপণে)। গৃহান্ = গৃহাঃ দারাঃ, তথা অন্য গৃহবাসী] [ব্যাখ্যা - পিতা পুত্রীকে বলে— হে পুত্রী ! তোমার এই পতি ভগস্বরূপ বা ভগসম্পন্ন (অর্শ আদ্যচ্) প্রাকৃতিক এবং আধ্যাত্মিক সম্পত্তিতে সম্পন্ন, ধর্মাত্মা তথা যশস্বী, জ্ঞানী তথা বৈরাগ্যবান্। এই কথন দ্বারা পুত্রীকে পিতা পতির সদ্গুণ-সমূহের পরিজ্ঞান দেয়, যাতে পতির ওপর কন্যা ভরসা, বিশ্বাস, তথা শ্রদ্ধা করতে পারে। পত্নীকে পতি, পিতৃগৃহ থেকে, হাত ধরে রথ পর্যন্ত নিয়ে চলুক, তৎপশ্চাৎ পতির মাতা-পিতার সুরক্ষায় পত্নী, পতিগৃহে রথ দ্বারা যাবে। কন্যার পিতা পুত্রীকে এটাও উপদেশ দেয়— তুমি পতির ঘরে গিয়ে নিজের সদ্গুণ-সমূহের কারণে পতিগৃহের স্বামিনী হও। পত্নী গৃহের তথা গৃহবাসীদের স্বামিনী তখনই হতে পারে যখন সে নিজের সেবাভাব তথা কর্ত্তব্যভাবনা দ্বারা সব গৃহবাসীদের মনকে মোহ লে। গৃহপত্নীর একটি আরও অভিপ্রায় আছে। তা হলো, বিবাহের সময়ই পত্নীকে, পতিগৃহের স্বামিনী অর্থাৎ উত্তরাধিকারিণী উদ্ঘোষিত করে দেওয়া হয়েছে। মানো ইহা পত্নীর আইনত অধিকার উদ্ঘোষিত করা হয়েছে।]

ইহ প্রিয়ং প্রজায়ৈ তে সমৃধ্যতামস্মিন্ গৃহে গার্হপত্যায় জাগৃহি। 

এনা পত্যা তন্বং সং স্পৃশস্বাথ জির্বিবিদথমা বদাসি ॥ ২১৷৷ 

পদার্থঃ [হে বধূ !] (ইহ) এই [পতিকূলে] (তে) তোমার (প্রিয়ম্) হিত (প্রজায়ৈ) প্রজা [সন্তান, সেবক প্রমুখের] জন্য (সম্) উত্তমরূপে (ঋধ্যতাম্) বৃদ্ধি হোক, (অস্মিন্ গৃহে) এই ঘরে (গার্হপত্যায়) গৃহপত্নীর কার্যের জন্য (জাগৃহি) তুমি জাগ্রত থাকো [সাবধান থাকো]। (এনা পত্যা) এই পতির সাথে (তন্বম্) শ্রদ্ধা (সং স্পৃশস্ব) সংযুক্ত করো, (অথ) এবং (জির্বিঃ) স্তুতিযোগ্য তুমি (বিদথম্) সভাগৃহে (আ বদাসি) কথোপকথন করো ॥২১॥

বধূর উচিত পতিকূলে পৌঁছে প্রসন্নচিত্ত হয়ে সন্তান, সেবক আদির যথাবৎ পালন করে গৃহকাজে সাবধান থাকা, এবং পতির প্রতি ভক্তি করে সংসারে কীর্তি বৃদ্ধি করা ॥২১॥ এই মন্ত্র কিছুটা আলাদাভাবে মহর্ষিদয়ানন্দকৃত সংস্কারবিধি বিবাহপ্রকরণে উদ্ধৃত আছে−ঘর পৌঁছে বধূকে রথ থেকে নামানো ইত্যাদি কর্ম করে বর এই মন্ত্র বলে বধূকে সভামণ্ডলে নিয়ে যাক/যাবে ॥২১॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (ইহ) এই পতিগৃহে (তে) তোমার জন্য (প্রজায়ৈ) তথা তোমার সন্তানদের জন্য (প্রিয়ম্) প্রিয় বস্তু-সমূহের (সম্, ঋধ্যতাম্) সম্যক্ বৃদ্ধি হোক। (অস্মিন্, গৃহে) এই পতিগৃহে (গার্হপত্যায়) গৃহপতি অর্থাৎ নিজপতির কার্য-সমূহের সম্পাদনের জন্য (জাগৃহি) হে বধু ! তুমি জাগরূক থাকো। (এনা, পত্যা) এই পতির সাথে (তন্বম্) তনূর (সংস্পৃশস্ব) স্পর্শ করো, (অথ) তথা (জির্বিঃ) জীর্ণাবস্থা হয়ে অর্থাৎ বৃদ্ধাবস্থায় (বিদথম্) জ্ঞানবিজ্ঞানের (আ বদাসি) সর্বত্র উপদেশ করো।

[জিবিঃ=যো জীর্যতি। এইভাবে পুরুষের সম্বন্ধে বলা হয়েছে "অথ জির্বির্বিদথমা বদাসি" (অথর্ব০ ৮।১।৬)। জিব্রিঃ =যো জীর্যতি (উণা০ ৫।৪৯) তথা জীর্বি (৪।৫৫) মহর্ষি দয়ানন্দ। "জির্বিঃ" এর রূপান্তর লৌকিক সংস্কৃতে “জিব্রিঃ" তথা জীর্বিঃ প্রতীত হয়। বিদথম্=বিদথা বেদনেন (নিরু০ ৩।২।১২); বিদথে বেদনে (নিরু০ ১।৩।৭); বিদথানি বেদনানি "জ্ঞানানি" (নিরু০ ৬।২।৭)] [ব্যাখ্যা-মন্ত্রে পিতা নিজের পুত্রীকে প্রথমে আশীর্বাদ দেয়, তোমার তথা তোমার সন্তানদের জন্য পতিগৃহে সদা সুখের বৃদ্ধি হোক, এবং তদনন্তর উপদেশ দেয়, পতিগৃহে গৃহস্থ ধর্মের পালন তথা পতির কার্য-সমূহের সম্পাদনের ক্ষেত্রে সদা সাবধান থাকা। তথা পতি ভিন্ন অন্য কোনো পুরুষের সাথে প্রসঙ্গ না করা, এবং বৃদ্ধাবস্থায় জ্ঞান বিজ্ঞানের সর্বত্র প্রচার করা। বৈদিক ধর্মে বয়োবৃদ্ধ তথা জ্ঞানবৃদ্ধ ব্যক্তিদেরই জ্ঞানোপদেশের অধিকার রয়েছে। নারীরাও বৃদ্ধাবস্থায় জ্ঞানোপদেশ দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত নয়। নারীরা গৃহজীবনেই নিজ জীবন যাত্রার সমাপ্তি যেন না মনে করে।]

ইহৈব স্তং মা বি যৌষ্টং বিশ্বমায়ুবত। 

ক্রীড়ন্তৌ পুত্রৈপ্তভিমোদমানৌ স্বস্তকৌ॥ ২২৷ 

পদার্থঃ [হে বধূ-বর !] (ইব এব) এখানে [গৃহাশ্রমের নিয়মেই] (স্তম্) তোমরা দুজন থাকো, (মা বি যৌষ্টম্) কখনো আলাদা হয়োনা, এবং (পুত্রৈঃ) পুত্রদের সাথে তথা (নপ্তৃভিঃ) নাতিদের সাথে (ক্রীডন্তৌ) ক্রীড়া করে, (মোদমানৌ) হর্ষ/আমোদ/আনন্দ করে এবং (স্বস্তকৌ) উত্তম ঘরসম্পন্ন তোমরা দুজন (বিশ্বম্ আয়ুঃ) সম্পূর্ণ আয়ু (বি অশ্নুতম্) প্রাপ্ত হও ॥২২॥

স্ত্রী-পুরুষ দুজনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে প্রসন্নতাপূর্বক পুত্র-পৌত্র আদির সাথে ধর্মাচরণ পূর্বক অবস্থান করে পূর্ণ আয়ু ভোগ করে যশস্বী হোক ॥২২॥ এই মন্ত্র কিছুটা আলাদাভাবে ঋগ্বেদে আছে−১০।৮৫।৪২, এবং মহর্ষিদয়ানন্দকৃত সংস্কারবিধি গৃহাশ্রমপ্রকরণ যথা ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকা বিবাহবিষয় পৃষ্ঠা ২০৮ এ ব্যাখ্যাত আছে ॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (ইহ) এই গৃহস্থজীবনে (এব) ই (স্তম্) থাকো, (মা) না (বিয়ৌষ্টম্) পরস্পর বিয়োগ প্রাপ্ত হও। (পুত্রৈঃ) পুত্রদের সাথে, (নপ্তৃভিঃ) পৌত্র এবং দৌহিত্রদের সাথে (ক্রীডন্তৌ) ক্রীড়া করে, (মোদমানৌ) আনন্দ প্রসন্ন হয়ে, (স্বস্তকৌ) গৃহজীবন উত্তম করে, (বিশ্বম্, আয়ুঃ) পূর্ণ আয়ু (ব্যশ্নুতম্) ভোগ বা প্রাপ্ত করো।

[ব্যাখ্যা - কন্যার পিতা বর-বধূ দুজনকেই আশীর্বাদ দিয়ে বলে (১) তোমরা দুজন গৃহস্থ জীবনে পতি-পত্নী সম্পর্কে থাকো। (২) পরস্পর পতি-পত্নী সম্পর্কের বিচ্ছেদ করিওনা, এবং না একে অপরের থেকে চিরকাল পর্যন্ত আলাদা থাকো। (৩) গৃহস্থ জীবনকে নিয়মপূর্বক রাখো যাতে তোমরা নিজেদের ১০০ বর্ষের পূর্ণ আয়ু ভোগ করো। (৪) পুত্রদের, পৌত্রদের, দৌহিত্রদের সাথে খেলা করো, এবং পরস্পর আনন্দ-প্রসন্ন থাকো। (৫) ঘরকে শিষ্টাচার আদি দ্বারা উত্তম করো তথা ঘরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং রম্য করো।]

পূর্বাপরং চরতো মায়য়ৈতৌ শিশু ক্রীড়ন্তৌ পরি যাতোহর্ণবম। 

বিশ্বান্যো ভুবনা বিচষ্ট ঋতূরনন্যা বিদধজ্জায়সে নবঃ ॥ ২৩ 

পদার্থঃ (এতৌ) এই দুটি [সূর্য, চন্দ্রমা] (পূর্বাপরম্) পূর্বাপর (মায়য়া) বুদ্ধিপূর্বক [ঈশ্বরকৃত নিয়ম দ্বারা] (চরতঃ) বিচরণ করে, (ক্রীডন্তৌ) ক্রীড়ারত (শিশূ) [মাতা-পিতার দুঃখ দূরকারী] দুই বালক [যেমন] (অর্ণবম্) অন্তরিক্ষের (পরি) চারদিকে (যাতঃ) চলছে। (অন্যঃ) এক [সূর্য] (বিশ্বা) সব (ভুবনা) ভুবনকে (বিচষ্টে) দর্শন করে, (অন্যঃ) দ্বিতীয় তুমি [চন্দ্র] (ঋতূন্) ঋতু-সমূহকে [নিজের গতির মাধ্যমে] (বিদধৎ) তৈরি করে [শুক্ল পক্ষে] (নবঃ) নবীনরূপে (জায়সে) প্রকট হও ॥২৩॥

সূর্য এবং চন্দ্র আকাশে পরিভ্রমণ করে। চন্দ্র আদি লোক-সমূহকে সূর্য আলো দেয়। চন্দ্র শুক্লপক্ষে এক-এক কলা বর্ধিত হয় এবং বসন্ত আদি ঋতুসমূহ সৃষ্টি করে। হে স্ত্রী-পুরুষগণ ! যেমন এই সূর্য-চন্দ্র ঈশ্বরনিয়মে চলে সংসারের উপকার করে, তেমনই তোমরা উপকার করো ॥২৩॥মন্ত্র ২৩, ২৪ কিছুটা আলাদাভাবে ঋগ্বেদে আছে−১০।৮৫।১৮, ১৯ এবং আছে-অ০ ৭।৮১।১, ২, তথা মন্ত্র ২৩ এর তিন পদ আছে-অ০ ১৩।২।১১ ॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (এতৌ) এই দুজন পতি এবং পত্নী (মায়যা) প্রজ্ঞাপূর্বক (পূর্বাপরম্) পূর্ব অর্থাৎ ব্রহ্মচর্যাশ্রম থেকে গৃহস্থাশ্রমের দিকে, গৃহস্থাশ্রম থেকে বানপ্রস্থাশ্রমের দিকে, বানপ্রস্থাশ্রম থেকে সন্ন্যাসাশ্রমের দিকে (চরতঃ) বিচরণ করে, এবং (শিশু) শিশুদের সদৃশ (ক্রীডন্তৌ) ক্রীড়া করে (অর্ণবম্) গৃহস্থ সমুদ্র (পরি) পরিত্যাগ করে (যাতঃ) আগামী আশ্রমে চলে যায়। (অন্যঃ) এক অর্থাৎ পতি (বিশ্বা ভুবনা) সকল গৃহস্থ-ভুবনের (বিচষ্টে) দেখাশোনা/নিরীক্ষণ করে, এবং (অন্যঃ) অন্য অর্থাৎ তুমি হে পত্নী ! (ঋতূন্) ঋতুধর্মকে (বিদধৎ) প্রকট করে (নবঃ) নবীন নবীন রূপে (জায়সে) প্রকট হতে থাকো ।

[মায়া প্রজ্ঞানাম (নিঘং০ ৩।৯)। পরি (অর্ণবম্) "অপপরী বর্জনে" (অষ্টা০ ১।৪।৮৮); তথা “পরের্বচনে বা বচনম্" দ্বারা পরি১ অর্ণবম্ যাৎ=অর্ণবং গৃহস্থাশ্রমং পরিত্যজ্য যাতঃ। অর্ণবম্=সমুদ্রম্। মনুস্মৃতিতে গৃহস্থকে সাগর অর্থাৎ সমুদ্র দ্বারা উপমিত করা হয়েছে। যথা নদীনদাঃ সর্বে সাগরে যান্তি সংস্থিতিম্ ।তথৈবাশ্রমিণঃ সর্বে গৃহস্থে যান্তি সংস্থিতিম্ ॥৬/৯০ ব্যাখ্যা — মন্ত্রে পতি এবং পত্নীর বর্ণনা সূর্য ও চন্দ্রের দৃষ্টান্ত দ্বারা করা হয়েছে। সূর্য এবং চন্দ্রের সম্বন্ধে বলা হয়েছে,— সূর্য, চন্দ্র পরমেশ্বরের প্রজ্ঞা দ্বারা অর্ণব অর্থাৎ অন্তরিক্ষে পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত বিচরণ করে। সূর্য এবং চন্দ্র পরমেশ্বর দ্বারা দৃঢ় নিয়মে চলছে, এগুলোর নিয়মবদ্ধ গতির মাধ্যমে এগুলোর এক বুদ্ধিমান্ নিয়ন্তার অনুমান হয়। সেই বুদ্ধিমানের প্রজ্ঞা দ্বারা প্রেরিত হয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমের দিকে নিয়মিত চলছে। এই দুটি মানো পরমেশ্বরীয় মাতার শিশু, যা অন্তরিক্ষের ক্রীড়াভূমিতে খেলা করছে। এর মধ্যে একটি অর্থাৎ সূর্য মানো চলমান হয়ে নিজ সৌর মণ্ডলের ভুবনের নিরীক্ষণ করে নিয়মের মধ্যে চালনা করে, এবং অপর অর্থাৎ চন্দ্র ঋতু অর্থাৎ তিথি, সপ্তাহ, পক্ষ এবং মাসরূপী কালের নির্মাণ করছে। চন্দ্রের ক্রমবর্ধমান এবং ক্রমহ্রাসমান কলা কাল/সময়ের পরিজ্ঞানের ক্ষেত্রে স্পষ্ট সহায়ক। তথা এই চন্দ্র কলার ক্ষয় তথা বৃদ্ধি দ্বারা নবীন নবীন রূপ ধারণ করে মানো প্রতিমাসে পুনঃ পুনঃ সৃষ্টি হয়। পতি সূর্য স্থানাপন্ন এবং পত্নী চন্দ্র স্থানাপন্ন। কারণ হল, সূর্য শক্তি দেয় এবং চন্দ্র শক্তি নেয়। এইভাবে পতি শক্তি প্রদান করে এবং পত্নী শক্তি গ্রহণ করে। পতি এবং পত্নী ব্রহ্মচর্যাশ্রমরূপী পূর্বসমুদ্র থেকে গৃহস্থাশ্রমরূপী অপর সমুদ্রে আসে, এবং প্রজ্ঞা, অর্থাৎ নিজ বুদ্ধিমত্তা দ্বারা গৃহস্থাশ্রমে বিচরণ করে। প্রজ্ঞা এবং বুদ্ধিমত্তা বিনা ব্রহ্মচর্য এবং গৃহস্থে বিচরণ করা দুষ্কর। প্রজ্ঞাবান্ই নিজ প্রজ্ঞা-নৌকার দ্বারা সফলতাপূর্বক এঈ আশ্রম সমুদ্রগুলো থেকে পার হতে পারে। মন্ত্রে ব্রহ্মচর্যাশ্রম থেকে গৃহস্থাশ্রম যাওয়ার বিধান পতি-পত্নীর জন্য করা হয়েছে। এই বিধি আগামী আশ্রমগুলোর সম্বন্ধেও জানা উচিত। গৃহস্থাশ্রমে এসে, শিশু রূপে পরস্পর হাসি-মজা এবং আনন্দিত তথা প্রসন্ন হয়ে, পতি এবং পত্নীকে গৃহস্থ জীবনযাপন করা উচিত। গৃহস্থে বিভিন্ন রকমের কষ্ট এবং আপত্তির সম্মুখীন হতে হয়। হাসিখুশি থাকা পতি-পত্নীই এই সমস্ত কষ্ট তথা আপত্তির সম্মুখীন হতে পারে। পতির গৃহস্থ জীবনে সামান্য নিরীক্ষণ হওয়া উচিত। পত্নী ঋতু-সমূহ অর্থাৎ ঋতুধর্ম প্রকট করে, ঋতুমতী হয়ে, পুত্রদের তথা পুত্রীদের রূপে নবীন নবীন রূপে প্রকট হতে থাকে। সন্তানদের নির্মাণ মাতাই করে। ১০ মাস মাতার পেটে অবস্থান করে বাচ্চা মাতার সংস্কার দ্বারাই প্রভাবিত হতে থাকে। জন্মের পরেও বাল্যাবস্থায় মাতারই প্রভাব সন্তানদের ওপর অধিকতর হয়, মানো মাতাই পুত্রদের তথা পুত্রীদের রূপে বিভিন্ন সময়ে প্রকট হতে থাকে। "আত্মা বৈ পুত্রনামাসি”।] [১. "পরি অর্ণবম্" প্রয়োগে "পরিত্রিগর্ত বৃষ্টো দেবঃ" এর সদৃশ বর্জনার্থক পরি এর যোগ-এ দ্বিতীয়া বিভক্তি রয়েছে। যদ্যপি বর্জনার্থক "পরি" এর যোগ-এ পঞ্চমী বিভক্তিও হয়।]

নবোনবো ভবসি জায়মানোহাং কেতুরুষসামেষ্যগ্র। 

ভাগং দেবেভ্যো বি দধাস্যায় প্র চন্দ্রমস্তিরসে দীর্ঘমায়ুঃ ॥ ২৪৷৷ 

পদার্থঃ (চন্দ্রমঃ) হে চন্দ্র ! তুমি [শুক্ল পক্ষে] (নবোনবঃ) নব-নব (জায়মানঃ) প্রকট হতে (ভবসি) থাকো, এবং (অহ্নাম্) দিনের (কেতুঃ) জ্ঞাতা তুমি (উষসাম্) ঊষা [প্রভাত বেলার] (অগ্রম্) আগে (এষি) চলো এবং (আয়ন্) আগত তুমি (দেবেভ্যঃ) উত্তম পদার্থ-সমূহকে (ভাগম্) সেবনীয় উত্তম গুণ (বি দধাসি) বিবিধ প্রকারে প্রদান করো এবং (দীর্ঘম্) দীর্ঘ (আয়ুঃ) আয়ু (প্র) উত্তমরূপে (তিরসে) পার করো ॥২৪॥

চন্দ্র শুক্লপক্ষে এক-এক কলা বৃদ্ধি করে নতুন-নতুন হয়, এবং দিন অর্থাৎ প্রতিপদা আদি চন্দ্র তিথি সৃষ্টি করে, এবং পৃথিবীর পদার্থ-সমূহের মধ্যে পুষ্টি দিয়ে প্রাণীদের জীবন বৃদ্ধি করে, এইভাবে স্ত্রী-পুরুষ সংসারে উপকার করে নিজেদের জীবন সুফল করুক॥২৪॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (চন্দ্রমঃ) হে চন্দ্র সমান শীতল স্বভাবী পত্নি ! তুমি (নবঃ নবঃ) নবীন নবীন রূপে (জায়মানঃ) প্রকট (ভবসি) হতে থাকো, (অহ্নাম্) তুমি দিনের (কেতুঃ) পতাকা, (উষসাম্) উষা কালের (অগ্রম্) সামনে-সামনে অর্থাৎ তার আগে (এষি) তুমি আগমন করো। (আয়ন্) আগত তুমি (দেবেভ্যঃ) দেবতাদের জন্য (ভাগম্) অংশ/ভাগ-এর (বিদধাসি) বিধান করে, (চন্দ্রমঃ) হে চন্দ্র সদৃশ পত্নী ! তুমি (আয়ুঃ) আয়ু (দীর্ঘম্) দীর্ঘ (প্র তিরসে) করো।

[ব্যাখ্যা - মন্ত্রের চন্দ্রের দৃষ্টিতে জায়মানঃ, আয়ন এ পুংলিঙ্গতা রয়েছে। চন্দ্রের পক্ষে চন্দ্র প্রতি অমাবস্যার পর মানো জন্ম নিয়ে নতুন নতুন রূপে প্রকট হতে থাকে। তা দিন অর্থাৎ তিথির কেতু অর্থাৎ জ্ঞাপক। [কেতুঃ প্রজ্ঞানাম (নিঘং০ ৩।৯); কেতুম্=প্রজ্ঞানাম (নিরু০ ১২।১।৭)], কৃষ্ণপক্ষের অন্তিম দিন থেকে চন্দ্র পূর্ব দিকে ঊষার আগে আগে চলে। অমাবস্যা তথা পূর্ণিমার যজ্ঞে, বায়ু আদি দেবতাদের মানো যজ্ঞের ভাগ প্রদান করে, এবং আয়ু বৃদ্ধি করে। চন্দ্রের কারণে সমুদ্রে জোয়ার-ভাটা হয়, ঔষধি-সমূহের মধ্যে রস সঞ্চার হয়, তথা প্রাণীশরীরে রক্ত সঞ্চার বৃদ্ধি হয়,—এইজন্য চন্দ্র আয়ু বৃদ্ধি করে। বিবাহসূক্তে চন্দ্রের বর্ণনা নিরর্থক যদি চন্দ্রের দৃষ্টান্ত দ্বারা চন্দ্রসমশীতল স্বভাবী সূর্যা-এর বর্ণনা মন্ত্রে অভিপ্রেত না হয়। এই ভাবনার দৃষ্টিতে মন্ত্র ২৩ এ সূর্য-চন্দ্রের দৃষ্টান্ত দ্বারা পতি-পত্নীর বর্ণনা করা হয়েছে। মন্ত্রে পত্নীর নিম্নলিখিত গুণ-সমূহের বর্ণনা হয়েছে। (১) পত্নী চন্দ্রের সদৃশ নবীন-নবীন রূপে প্রকট হতে থাকে। ভিন্ন ভিন্ন গুণ-সমূহ, আকৃতির সন্তান মাতারই ভিন্ন ভিন্ন রূপ। মাতাই মানো এই ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রকট হচ্ছে। যথা "আত্মা বৈ পুত্র নামাসি সং জীব শরদঃ শতম্" (শত০ ব্রা০ ১৪।৯।৮।২৬)। (২) পত্নী দিনের মানো পতাকা/জ্ঞাপক। রাজার মহলে যদি পতাকা থাকে তবে জ্ঞাত হয় যে, মহলে রাজার উপস্থিতি রয়েছে। দিনের শুরুর সাথে-সাথেই নতুন আশা-আকাঙ্খার উদয় হয় যেগুলোর সফলতায় পত্নী সহায়ক হয়। এই পতাকার অভাবে গৃহজীবন শূন্য। (৩) পত্নীকে উষা কালের পূর্বেই জাগ্রত হয়ে গৃহকার্যে ব্যাপৃত হয়ে যাওয়া উচিত। (৪) পত্নী থাকলেই দেবতারা অর্থাৎ মাতৃদেব, পিতৃদেব, তথা অতিথি দেব তাঁদের নিয়ত খাদ্য আদির ভাগ প্রাপ্ত করতে পারে। পঞ্চমহাযজ্ঞের বিধান, যার দ্বারা অতিথি আদি দেবতাদের সৎকার করা হয়, পত্নীরহিত পুরুষের জন্য সম্ভব নয়। এইজন্য পত্নীরূপী চন্দ্রের গৃহের নভোমণ্ডলে প্রবেশ আবশ্যক মানা হয়েছে। (৫) গৃহস্থে পত্নী যদি প্রেমময়ী হয় তবে সে পতির আয়ু বৃদ্ধির জন্য সহায়ক হয়।]

পরা দেহি শামুল্যং ব্রহ্মভ্যো বি ভজা বসূ। 

কৃত্যেষা পদ্বতী ভূত্বা জায়া বিশতে পতিম্ ॥ ২৫৷৷ 

পদার্থঃ [হে বর !] (শামুল্যম্) [হৃদয়ের] মলীনতা (পরা দেহি) দূর করে দাও, (ব্রহ্মভ্যঃ) বিদ্বানদের (বসু) সুন্দরবস্তু (বিভজ) বিতরণ করো। (এষা) এই (কৃত্যা) কর্তব্যকুশল (জায়া) পত্নী (পদ্বতী) ঐশ্বর্যবতী (ভূত্বা) হয়ে (পতিম্) পতির মধ্যে (আ বিশতে) এসে প্রবেশ করে ॥২৫॥

গৃহপতি শুদ্ধ অন্তঃকরণ দ্বারা বিদুষী স্ত্রী এবং বিদ্বানদের যথাবৎ আদর সৎকার করুক, যাদের শিক্ষা আদি প্রচেষ্টা দ্বারা স্ত্রী রত্ন সে প্রাপ্ত করেছে॥২৫॥এই মন্ত্র কিছুটা আলাদাভাবে ঋগ্বেদে আছে−১০।৮৫।২৯ ॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (এষা) এই (জায়া) পত্নী যখন মানো (পদ্বতী) পায়ের সমান (কৃত্যা) কৃতিশক্তি (ভূত্বা) হয়ে (পতিম্) পতির [ঘরে বা হৃদয়ে] (বিশতে) প্রবেশ করে, তখন হে পতি ! তুমি (শামুল্যম্) শান্তিদাহক ব্যবহার (পরাদেহি) ত্যাগ করো, এবং (ব্রহ্মভ্যঃ) বেদ-তথা-ব্রহ্মবেত্তাদের প্রতি (বসু) ধন-এর (বিভজা) বিভাগ করো।

[শামুল্যম্=শম্ (শান্তি) + উল্ (দাহে)। কৃত্যা = Action, Deed (আপ্টে)। ব্যাখ্যা - পত্নীকে গৃহকার্যে কৃতিশক্তিরূপ হওয়া উচিত। গৃহকার্যে নিশ্চেষ্টতা এবং আলস্য হওয়া উচিত নয়। তবেই সে পতির হৃদয়ে প্রবেশ পেতে পারে। পতিগৃহে পত্নীর আগমন হলে পতির উচিত শান্তিদাহক ব্যবহার/আচরণ ত্যাগ করা, যাতে পতি-পত্নীর মধ্যে প্রেম বৃদ্ধি পেতে থাকে। কটুভাষণ, অসহিষ্ণুতাপূর্ণ ব্যবহার, তথা কঠোর শাসন আদি ব্যবহার দ্বারা গৃহস্থ জীবনে শান্তি দগ্ধ হয়ে যায়। এমন ব্যবহারের অধিকতর সম্ভাবনা পতির দিক থেকে হয়ে থাকে। এইজন্য মন্ত্রে এই উপদেশ পতিকে দেওয়া হয়েছে। গৃহস্থ জীবনে পতি, বেদবেত্তাদের তথা ব্রহ্মজ্ঞানীদের সৎকার ধন দ্বারা করুক। এইজন্য পতি, নিজ আয়ের যথোচিত ভাগ, সৎপাত্রদের সেবার জন্য বিভক্ত করে দেবে। ইহা সামাজিক ধর্ম।]

নীললোহিতং ভবতি কৃত্যাসক্তিৰ্যজ্যতে। 

এধন্তে অস্যা জ্ঞাতয়ঃ পতিৰ্বন্ধেযু বধ্যতে৷ ২৬৷৷ 

পদার্থঃ (নীললোহিতম্) নিধি-সমূহের প্রকাশ (ভবতি) হয়, [যখন] (কৃত্যা=কৃত্যায়াঃ) কর্তব্যকুশল [পত্নীর] (আসক্তিঃ) প্রীতি (বি অজ্যতে) প্রসিদ্ধ হয়। (অস্যাঃ) এই [বধূর] (জ্ঞাতয়ঃ) জ্ঞাতিগণ (এধন্তে) বৃদ্ধি পায়, এবং (পতিঃ) পতি (বন্ধেষু) [বধূর সাথে প্রেমের] বন্ধনে (বধ্যতে) আবদ্ধ হয় ॥২৬॥

যে কূলে কর্মকুশল বুদ্ধিমতী স্ত্রী ধন-সম্পদের লাভ ক্ষতি ইত্যাদি বিচার করে কর্তব্য করে, সেখানে ধন সম্পত্তি বৃদ্ধি পায়। ধন-বুদ্ধিমতী স্ত্রী-এর সমৃদ্ধি দ্বারা মাতা-পিতা প্রমুখ এবং সব সগোত্র লোকেরা বৃদ্ধি করে এবং পতি তাঁর প্রতি হার্দিক প্রীতি করে ॥২৬॥এই মন্ত্র ঋগ্বেদে আছে−১০।৮৫।২৮ ॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ যখন (কৃত্যাসক্তিঃ) কৃতিশক্তিরূপ পত্নীর আসক্তি পতির প্রতি (ব্যজ্যতে) অভিব্যক্ত হয়ে যায়, তখন (নীল লোহিতম্) পতি নীলও লাল (ভবতি) হয়ে যায়। তখন (অস্যাঃ) এই পত্নীর (জ্ঞাতয়ঃ) পিতৃগৃহের লোকেরা (এধন্তে) বৃদ্ধি প্রাপ্ত করে, এবং (পতিঃ) পতি (বন্ধেষু) পত্নীর প্রেমবন্ধনে (বধ্যতে) আবদ্ধ হয়।

[ব্যাখ্যা– পত্নী মানো কৃতিশক্তির অবতার হওয়া উচিত। অর্থাৎ কর্মশীলা হওয়া উচিৎ। পতির প্রতি তাঁর নিজের প্রেমাসক্তিও নিজ ব্যবহারের দ্বারা অভিব্যক্ত করা উচিৎ। ইহার মাধ্যমে পতি সদা প্রসন্ন থেকে নির্বলও পরিপুষ্ট হয়ে যায়। দূর্বলতার কারণে শরীরের লালরক্ত নীল হয়ে যায়। মুখের লাল হওয়া স্বাস্থ্যের চিহ্ন। মুখের নীলভাব দূর্বলতা তথা রোগের সূচক। পত্নীর পিতৃগৃহের লোকেরা এই খুশীতে ক্রমবর্ধমান হয় যে— আমাদের কন্যা পতিগৃহে স্থিত হয়েছে, এবং সে পতিকে নিজ-প্রেম-বশবর্তী করে নিয়েছে। পতিও পত্নীর প্রেমবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পত্নীর প্রতি অনুরাগ প্রকট করে।]

অশ্লীলা তনূর্ভবতি রুশতী পাপয়ামুয়া। 

পতির্যদ বব্বো বাসসঃ স্বমঙ্গমভূর্ণতে। ২৭। 

পদার্থঃ (রুশতী) চমকপ্রদ (তনূঃ) রূপ (অমুয়া) সেই (পাপয়া) পাপ ক্রিয়া দ্বারা (অশ্লীলা) অশ্লীল [হতশ্রী] (ভবতি) হয়ে যায়, (যৎ) যখন (পতিঃ) পতি (বধ্বঃ) বধূর (বাসসঃ) বস্ত্র দ্বারা (স্বম্অঙ্গম্) নিজের অঙ্গকে (অভ্যূর্ণুতে) ঢেকে নেয়॥২৭॥

যখন পতি পুরুষার্থ ত্যাগ করে কুকামী হয়ে খারাপ নারীদের সমান কুচেষ্টা করে, তখন সেই দুর্বলেন্দ্রিয়ের রূপ নষ্ট হয়ে যায় এবং সে লজ্জা প্রাপ্ত হয় ॥২৭॥এই মন্ত্র কিছুটা আলাদাভাবে ঋগ্বেদে আছে−১০।৮৫।৩০ ॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (রুশতী) পতির চমকিত (তনূঃ) দেহ, (অমুয়া) সেই (পাপয়া) পাপিন বা ঋতুমতীর সাথে প্রসঙ্গ দ্বারা (অশ্লীলা) শ্রী রহিত (ভবতি) হয়ে যায়, (যদ্) যদ্যপি (পতিঃ) পতি (বধ্বঃ) বধূর (বাসসঃ=বাসসা, ঋ০ ১০।৮৫।৩০) বস্ত্র বা সহবাস দ্বারা (স্বম্) নিজের (অঙ্গম্) অঙ্গ-সমূহকে (অভ্যূর্ণতে) আচ্ছাদিত করে।

[ব্যাখ্যা— মন্ত্র ২৬তম এ পত্নী দ্বারা প্রদর্শিত পতির প্রতি অনুরাগের লাভ দর্শানো হয়েছে। কিন্তু পত্নী যদি পরপুরুষের সাথে সহবাস দ্বারা পাপকর্ম করে, তবে সে পতিধর্ম থেকে চ্যুত বোঝা উচিৎ, এবং তাঁর সাথে গৃহস্থধর্মের পালন করা উচিৎ নয়। তথা পত্নী যখন ঋতুমতী হবে তখনও পত্নী সহবাসের জন্য বর্জিত। এমতাবস্থায় কৃত সহবাস, পতির নীরোগ শরীরকে দূষিত তথা রুগ্ণ করে দেয়। ঋতুমতীকেও পাপা বলা হয়েছে। এই অর্থে পাপা এর অভিপ্রায় পাপিন নয়। অপিতু "পা+অপ" দ্বারা ঋতুমতীর সাথে সহবাস দ্বারা পা (রক্ষা) + অপ (অপগত) হয়ে যায়। এইজন্য হল ঋতুমতী “পাপা”। এমতাবস্থায় সহবাস দ্বারা শরীর রক্ষারহিত হয়ে যায়, তথা ঋত্ববস্থায় পত্নী অসুরক্ষিত১ থাকে। মন্ত্রের আরও একটি অভিপ্রায়ও সম্ভব, "সেই পাপময়ী রীতি দ্বারা পতির সুন্দর তথা চমকিত দেহও শ্রীরহিত হয়ে যায়। পতি স্ত্রী-এর বস্ত্র দ্বারা নিজ দেহ আবৃত করে, সেই বস্ত্র পরিধান করে। পুরুষের পৌরুষপূর্ণ দেহ মানো এক সুন্দর তথা চমকিত দেহ। পৌরুষশক্তি সম্পন্ন পুরুষ যদি স্ত্রী-এর বস্ত্র পরিধান করে তবে এই রীতি পাপময়ী, দূষিত। পুরুষদের জন্য মস্তকে সিঁথি বের করাও স্ত্রী বেশভূষার গ্রহণ করা ["রুশৎ ইতি বর্ণনাম, রোচতে র্জ্বলতিকর্মণঃ (নিরু০ ৬।৩।১৩)]। [১. পাপা =পা+অপ=অপগতা। ঋত্ববস্থায় ঠাণ্ডা আদি লেগে যাওয়া তথা রোগাক্রমণের ভয়ে স্ত্রী, "পা" অর্থাৎ রক্ষা থেকে অপগতা অর্থাৎ অসুরক্ষিত থাকে, অতঃ এমতাবস্থায় সহবাস বর্জিত।]

আশসনং বিশসনমথো অধিৰিকৰ্তনম। 

সূর্যায়াঃ পশ্য রূপাণি তানি ব্রহ্মোত শুম্ভতি। ২৮

পদার্থঃ (সূর্যায়াঃ) প্রেরক [বা সূর্যের চমকের সমান তেজসম্পন্না] কন্যার (আশসনম্) আশংসা [অপ্রাপ্তকে পাওয়ার ইচ্ছা], (বিশসনম্) বিশংসা [প্রাপ্তের শুভ কর্মে ব্যয়] (অথো) এবং (অধিবিকর্তনম্) অধিকারপূর্বক বিঘ্ন-সমূহের ছেদন, (রূপাণি) এই রূপ-সমূহ [সুন্দর লক্ষণগুলোকে] (পশ্য) তুমি দেখো, (তানি) সেই [সুন্দর লক্ষণগুলোকে] (ব্রহ্মা) ব্রহ্মা [বেদবেত্তা পতি] (উত) ই (শুম্ভতি) শোভায়মান করে ॥২৮॥

যখন বধূ-বর পরস্পর শুভ গুণ-সমূহ এবং মর্যাদার সম্মান করে, তখন উত্তম প্রচেষ্টা দ্বারা সেই গৃহাশ্রমের শোভা বৃদ্ধি পায়॥২৮॥এই মন্ত্র কিছুটা আলাদাভাবে ঋগ্বেদে আছে−১০।৮৫।৩৫ ॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (আশসনম্) আশাময় জীবন, (বিশসনম্) বিশেষ প্রশস্ত জীবন, (উত) তথা (অধিবিকর্তনম্) অধিকার পূর্বক বস্ত্রকে বিবিধ প্রকারে কাটার কর্ম; (সূর্যায়াঃ) সূর্যা ব্রহ্মচারিণীর (রূপাণি) এই রূপ-সমূহেক (পশ্য) তুমি দেখো। (তানি) সেই রূপকে (ব্রহ্মা) বেদবেত্তা এবং ব্রহ্মজ্ঞানী (শুম্ভতি) সুশোভিত করে।

[আশসনম্ = আশা। যথা "যদাশসা বদতো মে বিচুক্ষুমে" (অথর্ব০ ৭।৫৭।১); অর্থাৎ আশাপূর্বক কথন করে যা আমার বিক্ষুব্ধ হয়েছে। বিশসনম্=বি (বিশেষ) + শস্ (প্রশস্তি, প্রশস্ত) অর্থাৎ প্রশংসিত জীবন। শস্ত=graised (আপ্টে)। অধি+বিকর্তনম্ যথা "যা অকৃন্তন্নবয়ন্" (অথর্ব০ ১৪।১।৪৫)] [ব্যাখ্যা—মন্ত্রে সূর্যা ব্রহ্মচারিণীর রূপ-সমূহ অর্থাৎ স্বরূপ বা গুণ-সমূহের বর্ণনা হয়েছে। পত্নীকে সদা আশাময় জীবন ব্যতীত করা উচিত। আপত্তি-সমূহ তথা কষ্টের মধ্যেও পত্নীকে নিজের আশাময় জীবন নির্মাণের অভ্যাস করা উচিত। আশাময় জীবনের সাথে-সাথে পত্নীকে নিজের জীবন বিশেষরূপে শস্ত অর্থাৎ প্রশস্ত করা উচিত। নিরাশাতেও প্রশস্ত কর্ম, তথা সদা প্রশস্ত ব্যবহার করা উচিৎ, এই আশায় যে— সব দিন এক সমান থাকে না। অধিকার পূর্বক বস্ত্র কাটা-সেলাই করা, কাটা তথা বুনন পত্নীর গৃহশিল্প হওয়া উচিৎ। কন্যার শিক্ষার ইহা এক বিশেষ অঙ্গ হওয়া উচিত। এই সম্বন্ধে কন্যাকে বিশেষ দক্ষতা প্রাপ্ত করা উচিৎ যাতে সে অধিকার পূর্বক উক্ত কার্য-সমূহ করতে পারে। সূর্যা ব্রহ্মচারিণী ব্রহ্মচর্যকালে বৈদিক শিক্ষা প্রাপ্ত করেছে এবং তদনুসারে নিজ জীবন তৈরি করেছে, এইজন্য এঁর/সূর্যার যোগ্য পতিও বেদজ্ঞ বিদ্বান্ হওয়া আবশ্যক। সেই পতি বিদুষী সূর্যার সদ্গুণ-সমূহের মধ্যে শোভারূপ হতে পারে, এবং সূর্যার সদ্গুণ-সমূহের শোভা বৃদ্ধি করতে পারে। ব্রহ্মা-কোটির বর, তথা সূর্যা-কোটির বধূর, পরস্পর বিবাহ “ব্রাহ্মবিবাহ" কথিত হয়। ব্রাহ্মবিবাহের সম্বন্ধে মনুস্মৃতির শ্লোক নিম্নলিখিত,— আচ্ছাদ্য চার্চয়িত্বা চ শ্রুতিশীলবতে স্বয়ম্। আহূয় দানং কন্যায়া ব্রাহ্মো ধর্মঃ প্রকীর্ত্তিতঃ॥ অর্থাৎ—“কন্যার যোগ্য, সুশীল তথা [বেদের] বিদ্বান্ পুরুষের সৎকার করে, কন্যাকে বস্ত্র আদি দ্বারা অলঙ্কৃত করে, সেই উত্তম পুরুষকে আহ্বান করে, অর্থাৎ যাকে কন্যাও প্রসন্ন [পছন্দ] করেছে, তাঁকে কন্যা দেওয়া, ব্রাহ্মবিবাহ কথিত হয়"। (সংস্কারবিধি, মহর্ষি দয়ানন্দ)।

এয় তৃষ্টমেতৎ কটুকমপাষ্টবদ বিষবন্নৈতদত্তবে। 

সূর্যাং যো ব্রহ্মা বেদ স ইদ বাধূয়মহতি। ২৯ 

পদার্থঃ (এতৎ) এই [পূর্বোক্তশুভ লক্ষণ বধূ-বরের বিরোধে] (তৃষ্টম্) দাহজনক, (কটুকম্) কটু [অপ্রিয়], (অপাষ্ঠবৎ) অপস্থান [অপমান] যুক্ত এবং (বিষবৎ) বিষসমান [হয়], (এতৎ) এই [বিরুদ্ধতা] (অত্তবে) প্রচেষ্টা করার জন্য (ন) না [হয়]। (যঃ) যে (ব্রহ্মা) ব্রহ্মা [বেদবেত্তা পতি] (সূর্যাম্) প্রেরক [বা সূর্যের চমকের সমান তেজসম্পন্না] কন্যাকে (বেদ) জানে, (সঃ ইৎ) সে (বাধূয়ম্) বিবাহ কর্মের (অর্হতি) যোগ্য হয় ॥২৯॥

যেখানে বধূ-বর পরস্পরবিরোধী নির্গুণী হয়, সেখানে গৃহাশ্রমে বিপত্তি থাকে, এবং যখন দুজনেই পূর্ণ বিদ্বান্ এবং যুবক হয়ে পরস্পরের গুণ জেনে বিবাহ করে, তখন তাঁরা গৃহাশ্রমে আনন্দ ভোগ করে ॥২৯॥এই মন্ত্র কিছুটা আলাদাভাবে ঋগ্বেদে আছে−১০।৮৫।৩৪॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (এতৎ) এই [অন্নম্] অন্ন (তৃষ্টম্) তৃষ্ণাজনক, অধিক তথা দাহজনক (কটুকম্) এই অন্ন স্বাদে কটু, (অপাষ্ঠবৎ) এই অন্ন নিঃসার, (বিষবৎ) এই অন্ন বিষাক্ত, (অত্তবে, ন) এই অন্ন ভক্ষণ যোগ্য নয়—এই প্রকারের অন্ন বিজ্ঞানসম্পন্না (সূর্যাম্) সূর্যা ব্রহ্মচারিণীকে, (যঃ) যে (ব্রহ্মা) বেদবিৎ তথাং ব্রহ্মজ্ঞ বিদ্বান্ (বেদ) জানে, অর্থাৎ তাঁর এই গুণ-সমূহের সাথে পরিচিত, (স , ইৎ) সেই (বাধূয়ম্) সূর্যার সাথে বধূকর্ম বা বিবাহের (অর্হতি) যোগ্য হয়।

[তৃষ্টম্ = তৃষা পিপাসায়াম্, তথা দাহজনকম্ (বাচস্পত্য কোষ)। কটুকম্=যো জিহ্বাগ্রং বাধতে, উদ্বেগং জনয়তি, শিরো গৃহ্ণীতে, নাসিকাং স্রাবয়তি সঃ কটুকঃ (সুশ্রুত)। sharp, sungenr, hot, disagreeable, u pleasent (আপ্টে)। অপাষ্ঠবৎ=অপগতা আস্থা যস্মাৎ তদ্বৎ, যার থেকে সার/নির্যাস নিষ্কাশিত হয়েছে এমন অন্ন] [ব্যাখ্যা—সূর্যা ব্রহ্মচারিণীকে আধ্যাত্মিক, মানসিক তথা সদাচারের শিক্ষার সাথে-সাথে বস্ত্র সম্বন্ধিত হস্তশিল্প, অন্নের গুণাবগুণের জ্ঞান, তথা সেগুলোর রন্ধনবিদ্যার শিক্ষাও দেওয়া উচিৎ। বর্তমানে ইহাকে গৃহ বিজ্ঞান (Home-science) বলা হয়। যে ব্রহ্মা সূর্যার এই গুণ-সমূহকে পছন্দ করে সেই ব্রহ্মা সূর্যার সাথে বিবাহের অধিকারী হয়।]

স ইৎ তৎ সস্যানং হরতি ব্রহ্মা বাসঃ সুমঙ্গল। 

প্রায়শ্চিত্তিং যো অধ্যেতি যেন জায়া ন রিষ্যতি ॥ ৩০ 

পদার্থঃ (সঃ) ইৎ) সেই (ব্রহ্মা) ব্রহ্মা [বেদবেত্তা পতি] (তৎ) তখন (স্যোনম্) সুখদায়ক এবং (সুমঙ্গলম্) সুমঙ্গলময় (বাসঃ) বস্ত্র আদি [ঘরে] (হরতি) নিয়ে আসে, (যঃ) যে [পতি] (প্রায়শ্চিত্তিম্) প্রায়শ্চিত ক্রিয়া (অধ্যেতি) জানে, (যেন) যার কারণে (জায়া) পত্নী (ন রিষ্যতি) কষ্ট পায় না ॥৩০॥

যখন মনুষ্য বিদ্বান্ দূরদর্শী হয়ে গৃহাশ্রমে প্রবেশ করে, সেই পরিশ্রম করে বস্ত্র আদি আবশ্যক পদার্থ নিয়ে এসে ঘরে পত্নী সহিত আনন্দ প্রাপ্ত হয়/প্রাপ্তি করে॥৩০॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (সঃ) সেই (ব্রহ্মা) বেদবেত্তা ব্রহ্মজ্ঞ (ইৎ) ই (ত্ত্) সেই (স্যোনম্) সুখকারিণী (সুমঙ্গলম্) তথা উত্তম মঙ্গলময়ী, (বাসঃ) বস্ত্রাচ্ছাদিত বধূকে, (হরতি) নিজ গৃহে নিয়ে যায়, (যঃ) যে (প্রায়শ্চিত্তিম্) প্রায়ঃ, বিজ্ঞানের (অধ্যেতি) অধ্যয়ন করতে থাকে (যেন) যে বিজ্ঞান দ্বারা (জায়া) পত্নী (রিষ্যতি, ন) দুঃখ, কষ্ট এবং বিনাশ প্রাপ্ত হয় না।

[স্যোনম্ সুখনাম (নিঘং০ ৩।৬)। বাসঃ= বাসস্= বস্ত্রাচ্ছাদিত বধূ। প্রায়শ্চিত্তিম্ = প্রায়ঃ+চিত্তিম্ (চিতী সঞ্জ্ঞানে) +ক্তিন্। অধ্যেতি=অধ্যয়নং করোতি। অথবা “বাস"= বস্ত্র। বিবাহানন্তর বধূর বস্ত্র নিয়ে যাওয়ার সাথে-সাথে বধূকেও ব্রহ্মা নিয়ে যায়, এইজন্য বাসঃ শব্দের দ্বারা বধূও অভিপ্রেত হয়েছে, এইজন্য মন্ত্রে জায়া শব্দের প্রয়োগ হয়েছে।] [ব্যাখ্যা—যে পতি, গৃহস্থ জীবনে আগত কষ্ট-সমূহের নিবৃত্তির উপায়-সমূহকে জানে এবং সেগুলোর অধ্যয়ন করতে থাকে, সে স্বয়ং তথা তাঁর পত্নীও সুখী থাকে।]

যুবং ভগং সং ভরতং সমৃদ্ধমৃতং বদন্তাবৃতোদ্যেষু। 

ব্ৰহ্মণস্পতে পতিমস্যৈ নোচয় চারু সম্ভলো বদতু বাচমেতাম্ ॥ ৩১ 

পদার্থঃ [হে বধূ-বর !] (ঋতোদ্যেষু) সত্য বচনের মাঝে (ঋতম্) সত্য (বদন্তৌ) কথন করে (যুবম্) তোমরা দুজন (সমৃদ্ধম্) অধিক সম্পত্তিবিশিষ্ট (ভগম্) ঐশ্বর্যকে (সম্) একসাথে (ভরতম্) ধারণ করো। (ব্রহ্মণঃ পতে) হে বেদের রক্ষক [পরমেশ্বর !] (অস্যৈ) এই [বধূর] জন্য (পতিম্) পতিকে (রোচয়) আনন্দিত করো−(এতাম্ বাচম্) এই বচন (সম্ভলঃ) যথার্থ বক্তা পুরুষ (চারু) মনোহর রীতিতে (বদতু) কথন করুক ॥৩১॥

বিদ্বানগণ পরমেশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে আশীর্বাদ প্রদান করুক যে, এই দুজন স্ত্রী-পুরুষ নিজেদের প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় থেকে সম্পত্তি এবং ঐশ্বর্য প্রাপ্ত করে সদা প্রসন্ন থাকুক॥৩১॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (ঋতোদ্যেষু) সত্যই যেখানে বলা উচিৎ সে ব্যবহারের মধ্যে (ঋতম্) সত্য (বদন্তৌ) বলে (যুবম্) তোমরা দুজন (সমৃদ্ধম্) পুষ্কল (ভগম্) ঐশ্বর্য, ধর্ম, যশ, শ্রী, জ্ঞান এবং বৈরাগ্যের (সং ভরতম্) সম্পোষণ তথা সংগ্রহ করো। (ব্রহ্মণস্পতে) হে বেদের পতি পরমেশ্বর! বা বেদজ্ঞ বিদ্বন্! (অস্যৈ) এই বধূর জন্য (পতিম্) পতিকে (রোচয়) রুচিকর করো, যাতে পতি (সম্ভলঃ) সম্যগ্ভাষী/প্রেমপূর্বক ভাষণকারী হয়ে (চারু) সুচারুরূপে পত্নীর প্রতি (এতাম্, বাচম্) এই বাণী বলে।

[ভগম্=ঐশ্বর্যস্য সমগ্রস্য ধর্মস্য যশসঃ শ্রিয়ঃ। জ্ঞানবৈরাগ্যযোশ্চৈব ষণ্ণা ভগ ইতীরণা"। ভরতম্=ভৃ পোষণে। সম্ভলঃ=সম্(সম্যক্)+ভল পরিভাষণে] [ব্যাখ্যা—(১) পতি এবং পত্নীকে সকল ব্যবহারে সদা সত্যই বলা উচিৎ। (২) গৃহস্থ জীবনে এই দুজন ভগ-সমূহের সম্যক্ সংগ্রহ করুক। (৩) গৃহ জীবনেও বৈরাগ্যের আবশ্যকতা রয়েছে। গৃহজীবনকে কর্ত্তব্যের দৃষ্টিতে পূরণ করুক, রাগে নয়। বৈরাগ্য বিনা গৃহজীবনে লম্পটতার রাজ্য হয়ে যায়। (৪) বেদের বিদ্বান পুরোহিতের কর্ত্তব্য হল, বিভিন্ন সময়ে নব বিবাহিতদের উপদেশ দিতে থাকা যাতে পতি-পত্নীর মধ্যে পারস্পরিক প্রেম বৃদ্ধি পায়, যাতে এঁরা দুজন পরস্পরের প্রতি রুচিকর হয়ে থাকে, এবং সদা পরস্পরের সঙ্গে মধুর তথা প্রিয় বাণী কথন করে। মন্ত্রে পতিকে “সম্ভল" বলা হয়েছে, অর্থাৎ সম্যগ্ভাষী। কটুভাষণের সম্ভাবনা প্রায়ঃ পতির দিক থেকে হয়, পত্নীর দিক থেকে নয়।]

ইহেদসাথ ন পরো গমাথেমং গাবঃ প্ৰজয়া বর্ধয়াথ। 

শুভং যতীরুদ্বিয়াঃ সোমবর্ধমো বিশ্বে দেবাঃ ক্রন্নিহ বো মনাংসি। ৩২। 

পদার্থঃ (গাবঃ) হে গতিশীল [পুরুষার্থী কুটুম্বগণ !] (ইহ ইৎ) এখানেই [আমাদের মধ্যে] (অসাথ) তোমরা থাকো, (পরঃ) দূরে (ন গমাথ) যেও না, এবং (ইমম্) এই [পুরুষকে] (প্রজয়া) প্রজা [পুত্র, পৌত্র, সেবক আদি] দ্বারা (বর্ধয়াথ) বর্ধন করো। (শুভম্) শুভ রীতিতে (যতীঃ) গমন করে (উস্রিয়াঃ) নিবাসী স্ত্রীগণ এবং (সোমবর্চসঃ) ঐশ্বর্যের সাথে প্রতাপশালী (বিশ্বে) সব (দেবাঃ) বিদ্বানগণ [অর্থাৎ ঘরের বিদ্বান্ স্ত্রী-পুরুষ] (বঃ) তোমাদের (মনাংসি) মনকে (ইহ) এখানে [গৃহ কার্যে] (ক্রন্) করুক ॥৩২॥

সব কুটুম্বীগণ পুরুষার্থ করে একসাথে ধৈর্যপূর্বক ঘরে থাকুক এবং সন্তানদের শিক্ষা দান দ্বারা বর্ধন করুক এবং সম্পত্তি এবং ঐশ্বর্য বৃদ্ধি করে গৃহাশ্রম শোভায়মান করুক ॥৩২॥ এই মন্ত্রের প্রথম পাদ আছে-অ০ ৩।৮।৪ ॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (গাবঃ) হে গাভীরা! (ইহ) এই ঘরে (অসাথ, ইৎ) সদা থাকো, (পরঃ) এই ঘর থেকে দূরে (ন, গমাথ) যেওনা। (প্রজয়া) সন্তানদের দ্বারা (ইয়ম্) এই গৃহপতিকে (বর্ধয়াথ) বর্ধিত করতে থাকো। (শুভম্) শোভাযুক্ত গোশালায় (যতীঃ) হে গাভীরা! তোমরা যাও, (উস্রিয়াঃ) সূর্যের কিরণ-সমূহের সদৃশ শুদ্ধ, তথা (সোমবর্চসঃ) দুগ্ধরূপী তেজযুক্ত তোমরা হও। (বিশ্বে দেবাঃ) ঘরের সব দেবতা অর্থাৎ মাতৃদেব, পিতৃদেব আদি (ইহ) এই ঘরে (বঃ) তোমাদের (মনাংসি) মনকে (ক্রন্) প্রসন্ন করুক।

[উস্রিয়াঃ, উস্রঃ=বসতীতি উস্রঃ=রশ্মিঃ (উণা০ ২।১৩, মহর্ষি দয়ানন্দ)। উস্রিয়া ইতি গোনাম (নিরু০ ৪।৩।১৯); তথা “বীতং পাতং পয়ঃ উস্রিয়ায়াঃ" (ঋ০ ১।১৫৩।৪) উস্রা= উস্রাবিণোঽস্যাং ভোগাঃ (নিরু০ ৪।৩।১৯)=উৎ+স্রু গতৌ, যার থেকে দুধ স্রবিত হয়। সোম=দুধ। যথা “অনূপে গোমান্ গোভিরক্ষাঃ সোমো দুগ্ধাভিরক্ষাঃ" (ঋ০ ৯।১০৭।৯) এ, দোহনযোগ্য গাভী থেকে সোম অর্থাৎ দুধ ক্ষরিত হয়, এমনটা বলা হয়েছে] ব্যাখ্যা—গৃহস্থীকে ঘরে গাভী পালন করা উচিৎ। দুধ না দেওয়া গাভীকে অপরের কাছে বিক্রি করা উচিৎ নয়। গাভী নিজ সন্তান অর্থাৎ বাছুরের দ্বারা গৃহপতিকে এবং গৃহপতির সন্তানদের দুধ, ঘৃত দিয়ে বৃদ্ধি করে। গাভীর গোশালা সুন্দর এবং শোভাযুক্ত হওয়া উচিৎ। এর মাধ্যমে গাভী সুস্থ তথা প্রসন্ন থাকে। গাভীদের স্নান আদি দ্বারা শুদ্ধ এবং পরিষ্কার রাখা উচিৎ যেমন সূর্যের কিরণ-সমূহ শুদ্ধ এবং পরিষ্কার হয়। ঘরের গুরুজনদের উচিত, সেবা দ্বারা গাভীদের মন সদা প্রসন্ন রাখা।]

ইমং গাবঃ প্রজয়া সং বিশাথায়ং দেবানাং ন মিনাতি ভাগ। 

অস্মৈ বঃ পূষা মরুতশ্চ সর্বে অম্মৈ বো ধাতা সবিতা সুবাতি ॥ ৩৩। 

পদার্থঃ (গাবঃ) হে গতিশীল [পুরুষার্থী কুটুম্বগণ !] (ইমম্) এই [পুরুষের] মধ্যে (প্রজয়া) প্রজা [সন্তান, সেবকদের] সাথে (সম্) মিলে (বিশাথ) তোমরা প্রবেশ করো, (অয়ম্) এই [পুরুষ] (দেবানাম্) বিদ্বানদের (ভাগম্) ভাগ (ন) না (মিনাতি) নাশ করে। (অস্মৈ) এই [পুরুষের] জন্য (বঃ) তোমাদের (পূষা) পোষক বৈদ্য (চ) এবং (সর্বে) সব (মরুতঃ) বীর পুরুষ, এবং (অস্মৈ) এই [পুরুষের] জন্য (বঃ) তোমাদের (ধাতা) ধারণকারী (সবিতা) প্রেরক আচার্য (সুবাতি) প্রেরণ করে/করুক ॥৩৩॥

কুটুম্বদের উচিত, সব সন্তানদের এবং উপযোগী পুরুষদের সহিত মিলে বিদ্বান্ প্রধান পুরুষের আদর সম্মান করুক ॥৩৩॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (গাবঃ) হে গাভীরা! (ইমম্) এই ঘরে (প্রজয়া) বাছুর সমেত (সং বিশাথ) একসাথে প্রবেশ করো, যাতে (অয়ম্) এই গৃহপতি (দেবানাম্, ভাগম্) দেবতাদের ভাগকে (ন মিনাতি) নষ্ট বা বিলুপ্ত না করে। (পূষা) পরিপুষ্ট গৃহপতি, (সর্বে মরুতঃ) সব মৌসুমী১ বায়ু, বা যজ্ঞশীল গৃহবাসী, (ধাতা) পৃথিবী বা ধারণপোষণকারী গোপাল অর্থাৎ গোয়ালা, তথা (সবিতা) গৃহপত্নীর বা পতির উৎপাদক পিতা (বঃ) হে গাভীরা! তোমাদের (অস্মৈ) এই ঘরের জন্য (সুবাতি) প্রেরিত করে।

[পূষা] পূষা পুত্রঃ, বিবাহিত গৃহপতি (মন্ত্র ১৫)। মরুতঃ=মৌসুমী বায়ু। যথা “অপঃ সমুদ্রাদ্দিবমুদ্বহন্তি দিবস্পৃথিবীমভি যে সৃজন্তি। যে অদ্ভিরীশানা মরুতশ্চরন্তি তে নো মুঞ্চন্ত্বংহসঃ (অথর্ব০ ৪।২৭।৪)। তথা মরুতঃ ত্র ত্বিজঃ (নিঘং০ ৩।১৮) অর্থাৎ প্রত্যেক ঋতুতে যজ্ঞকারী যজ্ঞশীল গৃহবাসী। ধাতা=ধা ধারণ পোষণয়োঃ, যা পৃথিবী২। “ইয়ং (পৃথিবী) বৈ ধাতা (তৈ০ ব্রা০ ৩।৮।২৩।৩)। সবিতা=পত্নীর পিতা (মন্ত্র ৯, ১৯); বা পতির পিতা] ব্যাখ্যা—গাভী এমন ক্রয় করা উচিত যার সাথে বাছুর থাকবে, যাতে গাভী দুধ দিতে পারে। অতঃ প্রজা সমেত গাভীর গৃহপতির ঘরে প্রবেশ করা উচিত। গাভী ঘরে থাকলে গাভীর দুধ, ঘৃত দ্বারা দেবযজ্ঞ করা উচিত, যাতে দেবতারা তাঁদের ভাগ প্রাপ্ত করতে পারে। অগ্নিহোত্র, দর্শপৌর্ণমাস আদি দেবযজ্ঞ রয়েছে। এইভাবে দুধ, দই, ঘৃত আদি দ্বারা অতিথি দেব, মাতৃদেব, পিতৃদেব, আচার্য দেব প্রমুখদের সৎকার করাও দেবযজ্ঞ। মন্ত্র ৯ এ পূষা দ্বারা পরিপুষ্ট বরের বর্ণনা হয়েছে। নিজের পরিপুষ্টি ধরে রাখার জন্য তাঁর উচিৎ, ঘরে সদা গাভী রাখা। সবিতা হল বধূর পিতা। বৈদিক বিবাহ বিধিতে সবিতা, বরকে গোদান করার বিধান রয়েছে, যা এই মন্ত্র দ্বারা অনুমোদিত হয়েছে। প্রকরণানুসারে পতিগৃহে সবিতা হল, পতির পিতা। গোচারণের জন্য গোয়ালা/রাখালেরও আবশ্যকতা রয়েছে। তথা গাভীর খাবারের জন্য কৃষিযোগ্য ভূমিও দরকার। এই দুটির জন্য “ধাতা" শব্দের প্রয়োগ মন্ত্রে হয়েছে। এইভাবে মৌসুমী বায়ু কৃষিকর্মে সহায়ক হয়, যাতে গাভীরা শস্য পায়। গাভী থাকলে গৃহবাসীদের যজ্ঞশীল হওয়া উচিত। এই সম্বন্ধে নিম্নলিখিত মন্ত্র দ্রষ্টব্য, যথা— কিং তে কৃণ্বন্তি কীকটেষু গাবো নাশিরং দুহ্রে ন তপন্তি ঘর্মম্। আ নো ভর প্রমগন্দস্য বেদো নৈচাশাখং মঘবন্রন্ধয়া নঃ॥ ঋ০ ৩।৫৩।১৪॥ হে পরমেশ্বর! কৃপণ লোকেদের মাঝে স্থিত তোমার গাভীরা কোন প্রয়োজন সিদ্ধ করে, যা না তো স্তনপক্ব দুগ্ধ প্রদান করে, এবং না তাদের দুধ দ্বারা তাদের স্বামী যজ্ঞাগ্নিকে তপ্ত করে……। আশিরম্=আ+শ্রীঞ্ পাকে+ক্বিপ্; শ্রী কে শির আদেশ (অষ্টা০ ৬।১।৩৬)। ধর্মঃ যজ্ঞনাম (নিঘং০ ৩।১৭)।][১. মৌসুমী বায়ু জলের অভাব দূর করে, তথা কৃষিকাজের জন্য উপকারী হয়। ২. গাভীর শস্যের জন্য ভূমিরও আবশ্যকতা রয়েছে, যাতে গাভীরা শস্যের অভাব/অপূর্ণতা অনুভব না করতে পারে। গাবঃ এ বহুবচন আছে, যাতে দুগ্ধ-ঘৃত প্রভূত মাত্রায়, তথা বাছুর-বলদ কৃষিকর্মের জন্য প্রাপ্ত হতে পারে।]

অনৃক্ষরা ঋজবঃ সন্তু পন্থানো যেভিঃ সখায়ো যন্তি নো বরেয়ম। 

সং ভগেন সময্যা সং ধাতা সৃজতু বৰ্চসা ॥ ৩৪৷৷ 

পদার্থঃ (অনৃক্ষরাঃ) অকণ্টক/নিষ্কণ্টক (ঋজবঃ) সরল (পন্থানঃ) মার্গ (সন্তু) হোক, (যেভিঃ) যার মধ্য দিয়ে (নঃ) আমাদের (সখায়ঃ) মিত্রগণ (বরেয়ম্=বরেণ্যম্) সুন্দর বিধানে (যন্তি) চলে। (ধাতা) ধারণকারী [পরমেশ্বর] (ভগেন সম্) ঐশ্বর্যের সাথে (অর্যম্ণা সম্) শ্রেষ্ঠদের সম্মানকারী ব্যবহারেরর সাথে এবং (বর্চসা সম্) প্রতাপের সাথে [আমাদের] (সৃজতু) সংযুক্ত করেন/করুক ॥৩৪॥

সব ঘরের লোকেরা পরমেশ্বরের উপাসনার সাথে বিদ্বানদের সমান বিঘ্ন-সমূহ নাশ করে শ্রেষ্ঠদের সন্মান দ্বারা ঐশ্বর্যবান্ এবং প্রতাপশালী হোক ॥৩৪॥ এই মন্ত্রের পূর্বার্ধ কিছুটা আলাদাভাবে ঋগ্বেদে আছে−১০।৮৫।২৩ ॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (অনৃক্ষরাঃ) কণ্টক অর্থাৎ কষ্ট রহিত (ঋজবঃ) তথা সোজা/সরল (পন্থানঃ) মার্গ (সন্তু) হোক, (যেভিঃ) যে মার্গ-সমূহ দ্বারা (সখায়ঃ) আমাদের মিত্র (নঃ) আমাদের (বরেয়ম্) শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের দ্বারা আগমন যোগ্য ঘরে (যন্তি) আসা-যাওয়া করে। (ধাতা) বিধাতা পরমেশ্বর (নঃ) আমাদের (ভগেন) ঐশ্বর্য, ধর্ম, যশ, শ্রী, জ্ঞান এবং বৈরাগ্যের সাথে (সং সৃজতু) সংসর্গ করেন/করুক, (অর্যম্ণা)১ অর্য=স্বামী অর্থাৎ জগতের স্বামীর জ্ঞাতার সাথে (সম্) আমাদের সংসর্গ করেন/করুক, (বর্চসা) তেজসহিত (সম্) আমাদের সংসর্গ করেন/করুক।২

[বরেয়ম্=বর (শ্রেষ্ঠ মনুষ্য)+এয়ম্ (তাঁদের দ্বারা আগমনের যোগ্য)।] [১. অর্য স্বামিনং মিমীতে মন্যতে জানাতি ইতি অর্যমা (উণা০ ১।১৫৯, মহর্ষি দয়ানন্দ)। অর্যঃ=ঈশ্বরঃ (নিরু০ ১৩।১।৪), তথা আর্যঃ=ঈশ্বর পুত্রঃ (নিরু০ ৬।৫।২৬)। নিরুক্ত এবং মহর্ষি দয়ানন্দের দৃষ্টিতে অর্যমা= স্বামী অর্থাৎ ব্রহ্মবেত্তা। ২. অথর্ববেদের ইংরেজি অনুবাদক "William Whitney" এই মন্ত্রের সম্বন্ধে লিখেছেন "Text is a foolish and inconsistent"। অর্থাৎ মন্ত্র রচনা মূর্খতা পূর্বক, এবং অসঙ্গত। অনুবাদক মন্ত্রের অভিপ্রায় বুঝতে অক্ষম হয়েছে।]

যচ্চ বর্চো অক্ষেষু সুরায়াং চ যদাহিত। 

যদ গোম্বশ্বিনা বৰ্চস্তেনেমাং বসাবতম্ ॥ ৩৫৷৷ 

পদার্থঃ (যৎ) যে (বর্চঃ) তেজ (অক্ষেষু) ব্যবহার কুশলদের মধ্যে (চ চ) এবং (যৎ) যে [তেজ] (সুরায়াম্) ঐশ্বর্য [বা লক্ষ্মীর] মধ্যে (আহিতম্) আহিত/স্থাপিত। (যৎ) যে (বর্চঃ) তেজ (গোষু) গতিশীল [পুরুষার্থী] লোকদের মধ্যে রয়েছে, (অশ্বিনা) হে বিদ্যা প্রাপ্ত দুজন [স্ত্রী-পুরুষ যুগল !] (তেন বর্চসা) সেই তেজ দ্বারা (ইমাম্) এই [বধূকে] (অবতম্) শোভায়মান করো॥৩৫॥

সব স্ত্রী-পুরুষ প্রচেষ্টা করে শিক্ষা প্রদান করুক যে, বিদ্বান্ পতি-পত্নী নিজের কর্তব্যকে সকুশলসিদ্ধ করে তেজস্বী হোক ॥৩৫॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (অক্ষেষু) রথের অক্ষে (যৎ) যে (বর্চঃ) তেজ (আহিতম্) নিহিত রয়েছে, (চ) এবং (সুরায়াম্) জলের মধ্যে (যদ্) যে তেজ নিহিত আছে, (চ) এবং (যৎ) যে (বর্চঃ) তেজ, (অশ্বিনা) হে বরের মাতা-পিতা! (গোষু) গাভীদের মধ্যে নিহিত রয়েছে, (তেন) সেই সেই (বর্চসা) তেজ দ্বারা (ইমাম্) এই বধূকে (অবতম্) দীপ্তি সম্পন্ন করো।

[সুরা উদকনাম (নিঘং০ ১।১২) অবতম্=অব গতি, রক্ষণ, কান্তি, দীপ্তি ইত্যাদি। আহিতম্=অথবা “কথিতম্"। যথা “ব্রাহ্মণে ইদমাহিতম্"। অক্ষ=Axis, Axie (আপ্টে)] [ব্যাখ্যা— “অশ্বিনা" দ্বারা বরের মাতা-পিতার নির্দেশ হয়েছে। (মন্ত্র ৮, ১৪, ২০)। বরের মাতা-পিতা বধূর মধ্যে ৩ তেজ স্থাপিত করুক। (১) রথের অক্ষের তেজ। (২) জলের তেজ। (৩) গাভীদের তেজ। রথের দুই চাকায় লেগে থাকা দণ্ডকে অক্ষ [মন্ত্র ১২] অর্থাৎ ধুরা বলা হয়। এই ধুরা-এর ওপর সম্পূর্ণ রথ অবলম্বিত থাকে, ধুরা সম্পূর্ণ রথের আধার হয়। অতঃ ধুরা-এর তেজ হল “আধাররূপী গুণ"। নববধূকে শিক্ষা দেওয়া উচিৎ, তুমিই এই গৃহস্থ-রথের আধার/ভিত্তি। জলের স্বভাব হল শীতলতা। শীতলতা হল জলের তেজ। নববধূকে জলের দৃষ্টান্ত দ্বারা শীতলতা, ক্ষমা, শান্তির উপদেশ দেওয়া উচিৎ। গাভী সাত্ত্বিক দুধ দ্বারা মাতৃবৎ পালন-পোষণ করে। অতঃ গাভীর মধ্যে তেজ হল “মাতৃবৎ পালকতারূপী গুণ। পত্নীও পালন-পোষণের দৃষ্টিতে গোরূপ হওয়া উচিৎ।]

যেন মহানগ্ল্যা জঘনমখিনা যেন বা সুরা। 

যেনাক্ষা অভ্যষিচ্যন্ত তেনেমাং বচসাবতম্ ॥ ৩৬ ৷৷ 

পদার্থঃ (যেন) যে [তেজের] কারণে (মহানঘ্ন্যাঃ) অত্যন্ত নির্দোষ স্ত্রীর (জঘনম্) পৌরুষ, (যেন) যার কারণে (সুরা) ঐশ্বর্য [লক্ষ্মী], (বা) এবং (যেন) যার দ্বারা (অক্ষাঃ) সব ব্যবহার (অভ্যষিচ্যন্ত) সীঞ্চিত হয় [বৃদ্ধি হয়], (অশ্বিনা) হে বিদ্যা প্রাপ্ত দুজন [স্ত্রী-পুরুষ সমূহ/যুগল !] (তেন বর্চসা) সেই তেজ দ্বারা (ইমাম্) এই [বধূকে] (অবতম্) শোভায়মান করো ॥৩৬॥

সব স্ত্রী-পুরুষ একসাথে উপায় করুক, বধূ বড়ো-বড়ো স্ত্রীদের সমান পৌরুষ, ঐশ্বর্য এবং ব্যবহার বৃদ্ধি করে তেজস্বিনী হোক ॥৩৬॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (যেন) যে (বর্চসা) তেজ দ্বারা (মহানঘ্ন্যাঃ) মহা-অবধ্যা গাভীর (জঘনম্) ঊধস্ সীঞ্চন হয়েছে, (বা) তথা (যেন) যে তেজ দ্বারা (সুরা) জল সীঞ্চণ করা হয়েছে, (যেন) যে তেজ দ্বারা (অক্ষাঃ) রথের অক্ষ (অভ্যষিচ্যন্ত) সীঞ্চন করা হয়েছে, (অশ্বিনা) হে বরের মাতা-পিতা! (তেন) সেই তেজ দ্বারা (ইমাম্) এই বধূকে তোমরা (অবতম্) কান্তিমতী করো বা সীঞ্চন করো।

[মহাঘ্ন্যাঃ১=মহা+ন+ঘ্নী (অঘ্নী)। অঘ্ন্যা গোনাম (নিঘং০ ২।১১)। অবতম্=অব্ কান্তৌ। হুইটনি অথর্ববেদের ইংরেজি অর্থে “মহানঘ্ন্যাঃ জঘনম্" এর অর্থ করেছে “Back sides of courteugan" অর্থাৎ ‘বেশ্যার নিতম্ব ভাগ'। খুব ভ্রষ্ট অর্থ। নববধূকে কী বেশ্যা হওয়ার উপদেশ বরের মাতা-পিতা দেবে? জঘনম্ দ্বারা যদি গাভীর উৎপাদক ইন্দ্রিয়ও অভিপ্রেত হয় তবে এর দ্বারা কেবল এই অভিপ্রায় সম্ভব, নববধূ সাত্ত্বিক সন্তানদের জননী, গাভীর মতো। মন্ত্র ৩৫ এর দৃষ্টিতে ‘মহানঘ্নী' দ্বারা গাভীর গ্রহণ বোঝা উচিৎ] [ব্যাখ্যা— বেদে গৌ এর নাম “অঘ্ন্যা"। অঘ্ন্যা-এর অর্থ হল “হনন যোগ্যা নয়"। এর দ্বারা স্পষ্ট— বেদে গাভীর হত্যার নিষেধ হয়েছে। এইভাবে বলদের জন্য “অঘ্ন্যঃ" শব্দ বেদে পঠিত আছে। যথা “গবাং যঃ পতিরঘ্ন্যঃ" (অথর্ব০ ৯।৪।১৭)। এর দ্বারা বলদের হত্যারও নিষেধ করা হয়েছে। মন্ত্রে গাভীর জন্য “মহানঘ্নী" শব্দের প্রয়োগ হয়েছে, এর মাধ্যমে গাভীকে “মহা-অবধ্যা" বলা হয়েছে, কেননা গাভী দুধ আদি দ্বারা মহোপকারিণী। গাভীর ঊধঃ স্থলে দুধরূপী তেজ থাকে, যার দ্বারা গাভী নিজের বাছুরকে তেজস্বী করে তোলে। নববধূ মাতা হয়ে নিজের উত্তম এবং সাত্ত্বিক দুধ দ্বারা নিজের সন্তানদের তেজস্বী করুক,—এই উপদেশ মন্ত্র দ্বারা নববধূকে দেওয়া হয়েছে। সুরা অর্থাৎ জল, এবং অক্ষ অর্থাৎ ধুরা, এর তেজ দ্বারা যে উপদেশ নববধূর নেওয়া উচিত তার বর্ণনা মন্ত্র ৩৫ এ করা হয়েছে।] [১. সম্ভবতঃ বেদে, গাভীর জন্য, নঘ্নী=অঘ্নী এবং অঘ্ন্যা উভয় প্রযুক্ত হয়েছে।]

যো অনিখো দীদয়স্বন্তর্যং বিপ্রাস ঈড়তে অধ্বরেষু। 

অপাং নপান্মধুমতীরপো দা যাভিরিন্দ্রো বাবৃধে বীৰ্য্যবান্ ৷৷ ৩৭৷ 

পদার্থঃ (যঃ) যে [পরমেশ্বর] (অনিধ্মঃ) অপ্রকাশিত হয়ে [অন্তর্যামী] থেকে (অপ্সু অন্তঃ) প্রজাদের ভেতরে (দীদয়ৎ) চমকিত হয়, (যম্) যে [পরমেশ্বরের], (বিপ্রাসঃ) বুদ্ধিমানগণ (অধ্বরেষু) সন্মার্গের কথনকারী ব্যবহারে/আচরণে, (ঈডতে) স্তুতি করে, [সেই তুমি] (অপাম্) প্রজাদের মধ্যে (নপাৎ) নাশরহিত [পরমেশ্বর !] (মধুমতীঃ) মধু বিদ্যা যুক্ত [পূর্ণ বিজ্ঞানবতী] (অপঃ) প্রজাগণ (দাঃ) দান করো, (যাভিঃ) যে [প্রজাদের] দ্বারা (ইন্দ্রঃ) ঐশ্বর্যবান্ মনুষ্য (বীর্যবান্) বীর্যবান্ [ধীর, বীর, শরীর, ইন্দ্রিয়, এবং মনের দিক থেকে অতিশয় শক্তিশালী] হয়ে (বাবৃধে) বর্ধন করে ॥৩৭॥

বধূ-বরের উচিত, বিদ্বানদের সমান সর্বান্তর্যামী সর্বনিয়ন্তা পরমাত্মার উপাসনা করে ব্রহ্মচর্যাদি দ্বারা বিদ্বান্ সন্তান, সেবক আদি প্রাপ্ত করা এবং বেদবিদ্যা দ্বারা বৃদ্ধি করে সদা উন্নতি করতে থাকা ॥৩৭॥এই মন্ত্র কিছুটা আলাদাভাবে ঋগ্বেদে আছে−১০।৩০।৪, এবং নিরুক্ত ১০।১৯ এও ব্যাখ্যাত রয়েছে ॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (যঃ) যে পরমাত্মাগ্নি (অনিধ্মঃ) বিনা ইন্ধনে (অপ্সু অন্তঃ) রক্ত তথা বীর্যরূপী জলের ভেতরে (দীদয়ৎ) প্রদীপ্ত হয়, (যম্) যার (বিপ্রাসঃ) মেধাবীরা (অধ্বরেষু) হিংসারহিত ধ্যান যজ্ঞে (ঈডতে) স্তুতি-উপাসনা করে। (অপাং নপাৎ) হে বীর্যরূপী জলের না পতন হতে দেওয়া পরমেশ্বর! (মধুমতীঃ) মধুসদৃশ (অপঃ) বীর্যরূপী জল (দাঃ) আমাদের প্রদান করো, (যাভিঃ) যে বীর্যরূপী জলের দ্বারা (ইন্দ্রঃ) ইন্দ্র (বীর্যাবান্) বীর্যবান্ হয়ে (বাবৃধে) বর্ধিত হয়।

[অপ্সু= বৈদিক সাহিত্যে আপঃ এর অর্থ রক্ত তথা বীর্যও হয়। বাহ্য জগতের জলের প্রতিনিধি, আধ্যাত্মিক অর্থে, শরীরগত রক্ত। যথা “কো অস্মিন্নাপো ব্যদধাত্বিষূবৃতঃ পুরূবৃতঃ সিন্ধুসৃত্যায় জাতাঃ। তীব্রা অরুণা লোহিনীস্তাম্রধূম্রা ঊর্ধ্বা অবাচীঃ পুরুষে তিরশ্চীঃ ॥" (অথর্ব০ ১০।২।১১)। অথর্ব০ ১৬।১।১-১৩ এ বীর্যেরও বর্ণনা আপঃ শব্দ দ্বারা হয়েছে। দীদয়ৎ= দীদয়তি জ্বলতিকর্মা (নিঘং০ ১।১৬)। অপাংনপাৎ=অপাং+ন+পাৎ (পৎ) বীর্যরূপী জলের যে/যিনি পতন হতে দেয়না। ইন্দ্রঃ=আত্মা, অর্থাৎ আত্মিক শক্তি সম্পন্ন ব্যক্তি। বীর্যাবান্=বীর্য সম্পন্ন ইন্দ্র। এই ভাবনা দ্বারা বলা হয়েছে “বীর্য বা ইন্দ্রঃ" (তৈ০ ব্রা০ ৯।৭।৫।৮); “শিশ্নমিন্দ্রঃ" (শত০ ব্রা০ ১২।৯।১।১৬); “রেত ইন্দ্রঃ" (শত০ ব্রা০ ১২।৯।১।১৭)] [ব্যাখ্যা—বেদে পরমাত্মাকে অগ্নিও বলা হয়েছে “তদেবাগ্নিস্তদাদিত্যঃ” (যজুঃ ৩২।১)। পরমাত্মা হলেন প্রকাশস্বরূপ, অতঃ অগ্নি। তিনি ভক্তদের পাপ ভস্মীভূত করে দেন, অতঃ অগ্নি। পরমাত্মাগ্নি পার্থিব অগ্নির সদৃশ নয় যে/যা ইন্ধন দ্বারা প্রদীপ্ত হয় (অনিধ্মঃ)। পরমাত্মাগ্নি জলে প্রকট হয়। উপনিষদে হৃদয়কে পরমাত্মাগ্নির স্থান বলা হয়েছে। হৃদয়ে রক্তরূপী জলের নিবাস রয়েছে, এবং রক্তে বীর্যের নিবাস রয়েছে। অতঃ মন্ত্রে বলা হয়েছে, পরমাত্মাগ্নি জলে প্রদীপ্ত হয়, এবং বীর্যবান্ ব্যক্তিই অষ্টাঙ্গ যোগের উপায়-সমূহের দ্বারা পরমাত্মার সাক্ষাৎ করতে পারে। যোগদর্শনে বীর্যকে যোগসিদ্ধির কারণ বলা হয়েছে। যথা “শ্রদ্ধাবীর্যস্মৃতিসমাধিপ্রজ্ঞাপূর্বক ইতরেষাম" (যোগ ১।২০)। বৈদিক যজ্ঞ হল অধ্বর, হিংসা রহিত। এমন যজ্ঞে বিপ্র অর্থাৎ মেধাবীরাই পরমাত্মার স্তুতি উপাসনা তথা পূজা করে। পরমাত্মার কৃপা বীর্যরূপী জলের পতন হতে দেয় না। যে পুরুষের মধ্যে পরমাত্মাগ্নির প্রকাশ হয়েছে সে গৃহস্থেও ব্রহ্মচর্য বিধি দ্বারা থাকে। তাঁর বীর্য কামবাসনা দ্বারা প্রেরিত হয়ে পতিত হয় না। “মধু" বর্ণের/বর্ণবিশিষ্ট বীর্যকে উত্তম গণ্য করা হয়েছে। বীর্য দ্বারা মনুষ্য বীর্যবান্ হয়ে দীর্ঘায়ু হয়। গৃহস্থে উত্তম বীর্যের আবশ্যকতা থাকে। এইজন্য মন্ত্রে উত্তম বীর্যের শনাক্তকরণ, বীর্যের রক্ষা, বীর্যের পতন না হতে দেওয়া, এবং বীর্যের লাভের বর্ণনা হয়েছে। বিশেষঃ- আধিদৈবিক দৃষ্টিতে মন্ত্রের অর্থ অন্তরিক্ষস্থ বিদ্যুৎ। কিন্তু গৃহস্থ প্রকরণে বিদ্যুৎ-সম্বন্ধী বর্ণনা অনুপযোগী।]

ইদমহং রুশন্তং গ্রাভং তদূষিমপোহামি। 

যো ভদ্রো রোচনস্তমুদচামি ॥ ৩৮ 

পদার্থঃ (ইদম্) এখন [গৃহস্থ হওয়ায়] (অহম্) আমি [স্ত্রী বা পুরুষ] (রুশন্তম্) হিংসুক/উদ্বিগ্নকারী, (তনূদূষিম্) শরীর দূষক (গ্রাভম্) গ্রাহী [মলবন্ধক রোগ বা দুষ্ট ব্যবহার/আচরণ] (অপঊহামি) দূর করি। (যঃ) যে (ভদ্রঃ) মঙ্গলময়, (রোচনঃ) রোচক/রুচিসম্পন্ন ব্যবহার আছে, (তম্) তা (উৎ) উত্তমতাপূর্বক (অচামি) প্রাপ্ত হই ॥৩৮॥

বধূ-বর পীড়াপ্রদ, রোগকারক কর্ম এবং স্বভাব ত্যাগ করে স্বাস্থ্যবর্ধক ব্যবহার করে গৃহাশ্রমে আনন্দ বৃদ্ধি করুক ॥৩৮॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (ইদম্) এখন বা এখানেই (অহম্) আমি (রুশন্তম্) হিংসাকারী (তনূদূষিম্) এবং শরীরকে দূষিতকারী (গ্রাভম্) কুকামরূপী গ্রাহকে (অপোহামি) ত্যাগ করি, (যঃ) এবং যে (ভদ্রঃ) সুখকারী এবং কল্যাণকারী (রোচনঃ) এবং শরীরের কান্তি বা দীপ্তিমান (গ্রাহঃ) গ্রাহ আছে (তম্) তা (উদ্ অচামি) উৎকৃষ্ট হয়ে প্রাপ্ত হই।

[রুশন্তম্= রুশ হিংসায়াম্। তনূদূষিম্=যথা (অথর্ব০ ১৬।১।৭)। গ্রাভম্=গ্রাহ= দৃঢ়ভাবে আবদ্ধকারী, নক্র, কুমির। হৃগ্রহোর্ভঃ ছন্দসি (বার্তিক ৮।২।৩২) দ্বারা “হ" কী “ভ" হুআ। ভদ্রম্=ভদ্ কল্যাণে সুখে চ] ব্যাখ্যা—কাম১ ভাব সর্বদা ত্যাগ করলে গৃহস্থধর্মের পালন হয় না। কিন্তু কাম-এর উগ্ররূপের দ্বারা গৃহস্থ ধর্ম অধর্মে পরিণত হয়ে যায়। অতঃ গৃহস্থ ধর্মের পালনের জন্য না তো কাম উগ্ররূপ-এ হওয়া উচিত, এবং না ইহার সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ। মন্ত্রে উগ্র-কামকে গ্রাহ বলা হয়েছে। গ্রাহ হল নক্র বা নাকা বা কুমির। যেমন নাকা প্রাণীকে ধরে তার বিনাশ করে দেয়, তেমনই উগ্রকামও বিনাশক, হিংস্র, হিংসাকারী। তথা শরীরকে দূষিত করে দেয়। কিন্তু গৃহস্থধর্মোপযোগী কাম-এর শ্রেয়রূপও আছে। ইহাকে ভদ্র এবং রোচন বলা হয়েছে। সদ্গৃহস্থী এই শ্রেয়রূপী কামকে স্বীকার করে। কিন্তু এই ভদ্র গ্রাহও হল গ্রাহরূপ। এইজন্য সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি ব্রহ্মচর্য থেকেই সন্ন্যাস গ্রহণ করে শ্রেয়রূপ কাম-এরও ত্যাগ করে। শ্রেয়রূপ গ্রাহও শারীরিক এবং মানসিক শক্তির হ্রাসের কারণ হয়। কিন্তু শ্রেয়রূপ কাম-এর স্বীকার করাও ততক্ষন পর্যন্ত সম্ভব নয় যতক্ষণ না মনুষ্য উচ্চ তথা উৎকৃষ্ট ভাবনার অবলম্বন করে। মনের উৎকৃষ্টাবস্থা বিনা কাম-এর শ্রেয়রূপ হওয়া অসম্ভব। এই ভাবকে মন্ত্রে “উদ্-অচামি" দ্বারা প্রকট করা হয়েছে।] [১. কাম আদি অগ্নির জন্য, অথর্ব০ (১৬।১।১-১৩)।]

আস্যৈ ব্রাহ্মণাঃ মপনীৰ্হরবীরপ্পীরুজাপঃ। 

অৰ্মণণা অগ্নিং পযেতু পূষ প্রতীক্ষন্তে শ্বশুরো দেবশ্চ ৷৷ ৩৯। 

পদার্থঃ (অস্যৈ) এই [বধূর] জন্য (ব্রাহ্মণাঃ) ব্রাহ্মণ [বিদ্বানগণ] (স্নপনীঃ) শুদ্ধিকারক সামগ্রী (আ হরন্তু) নিয়ে আসুক, (অবীরঘ্নীঃ) বীরদের হিতকারী (আপঃ) প্রজাগণ (উৎ) উত্তমতাপূর্বক (অজন্তু) প্রাপ্ত হোক। (পূষন্) হে পুষ্টিকারক [বিদ্বান্ !] (অর্যম্ণঃ) শ্রেষ্ঠদের সম্মানকারী [পতির] (অগ্নিম্) অগ্নির [প্রত্যেক পতি-পত্নী] (পরি এতু) পরিক্রমা করুক, (শ্বশুরঃ) শ্বশুর [পতির পিতা] (চ) এবং (দেবরঃ) দেবর/ভাসুর [পতির ছোটো-বড়ো ভ্রাতা] (প্রতি ঈক্ষন্তে) প্রতিক্ষা করুক ॥৩৯॥

বরের ঘরে পৌঁছে বধূ-বর বিদ্বানদের আজ্ঞানুসারে শুদ্ধ জল আদি দ্বারা স্নান করে অগ্নিহোত্রাদি করে যজ্ঞকুণ্ডের পরিক্রমা করুক এবং সব কুটুম্বরা সন্মানপূর্বক স্বাগত করুক ॥৩৯॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (অস্যৈ) এই বধূর জন্য, (ব্রাহ্মণাঃ) বেদের বিদ্বান্ বৈদ্য, (স্নপনীঃ) স্নানের যোগ্য (আপঃ) জল (আহরন্তু) নিয়ে আসুক, (অবীরঘ্নীঃ) এবং বীর পুত্রদের অহননকারী জলকে (উদ্ অজন্তু) উৎকৃষ্ট করে নিয়ে আসুক। (অর্যম্ণঃ) ঈশ্বর জ্ঞাতা পতির (অগ্নিম্) তেজকে, বীর্যকে (পর্যেতু) এই বধূ প্রাপ্ত করে/করুক। (পূষন্) হে পুষ্টপতি! (শ্বশুরঃ, দেবরঃ, চ) বধূর শ্বশুর, দেবর আদি (প্রতীক্ষন্তে) এই প্রতীক্ষা করছে।

[ব্রাহ্মণাঃ=বৈদ্য ব্রাহ্মণবৃত্তির হওয়া উচিত, ধনলোলুপ নয়। যথা “ওষধয়ঃ সমবদন্ত সোমেন সহ রাজ্ঞা । যস্মৈ কৃণোতি ব্রাহ্মণস্তঁ রাজন্পারয়ামসি"॥ (যজু০ ১২।৯৬), অর্থাৎ ঔষধি-সমূহ নিজেদের রাজা সোম-এর সাথে সংবাদে বললো আমাদের যখন ব্রাহ্মণত্বসম্পন্ন উদাসীন ব্যক্তি চিকিৎসার জন্য প্রযুক্ত করে। তখন আমরা রোগীকে কষ্ট থেকে পার করে দিই। অর্যম্ণঃ= অর্য স্বামিনং মিমীতে মন্যতে জানাতীতি অর্যসা (উণা০ ১।১৫৯, মহর্ষি দয়ানন্দ)। স্নপনীঃ= গর্ভাধান-সংস্কারে গর্ভাধানের পূর্বে স্নানের বিধি রয়েছে। পারস্কর গৃহ্যসূত্রে বলা হয়েছে অথ গর্ভাধানং স্ত্রিয়ঃ পুষ্পবত্যাঃ, চতুরহাদূর্ধ্ব স্নাত্বা বিরুজায়াঃ তস্মিন্নেব দিবা,-আদিত্যং গর্ভমিতি"। এর ব্যাখ্যায় মহর্ষি দয়ানন্দ সংস্কার বিধিতে লিখেছেন— “এরপর যখন স্ত্রী রজস্বলা হয়ে চতুর্থ দিনের পর পঞ্চম দিন স্নান করে রজরোগ রহিত হবে সেই দিন “আদিত্যং গর্ভম্" ইত্যাদি মন্ত্রগুলোর দ্বারা আহুতি দেবে"। “তথা এই মন্ত্রগুলোর দ্বারা আহুতি দেওয়ার সময় প্রত্যেক আহুতির স্রুচায় অবশিষ্ট থাকা ঘৃতকে বধূ নিয়ে, স্নানের ঘরে গিয়ে, সেই ঘী পায়ের নখ থেকে শুরু করে মাথা পর্যন্ত সব অঙ্গে মর্দন করে স্নান করবে/করুক" (সংস্কার-বিধি)] [ব্যাখ্যা— ব্রাহ্মণ অর্থাৎ বেদজ্ঞ বৈদ্য, গর্ভাধানের দিন, ঋতুমতী হওয়ার চতুর্থ দিন, বধূর জন্য স্নানযোগ্য জল নিয়ে আসবে। এই জল নানাবিধ ঔষধি দ্বারা উৎকৃষ্ট করে বধূর স্নানের জন্য নিয়ে আসা উচিত। গর্ভাধানের সময় তথা তৎপশ্চাৎও বধূ এমন উৎকৃষ্ট জল দ্বারা স্নান করতে থাকুক। এর দ্বারা গর্ভ স্থাপন হয়ে যায়। তথা গর্ভস্থ শিশুর বিনাশ হয় না। এই স্নান দ্বারা শিশু পুষ্ট এবং সুস্থ থেকে সংসারে আসে। চরক সংহিতা “গর্ভস্থাপনীয় প্রকরণ" এ লেখা আছে “গর্ভবতী স্ত্রী ইন্দ্রায়ণ/রাখাল শসা, ব্রাহ্মী, শ্বেত দূর্বা, সবুজ দূর্বা, পলাশ, গুলঞ্চ, হরিতকি, নীম, খরেটা, শতমূলী এই সব ঔষধির সাথে সিদ্ধ করা দুগ্ধ এবং ঘৃতের পান করে/করুক/করবে। তথা এই ঔষধি-সমূহের সাথে সিদ্ধ করা জল দ্বারা স্নান করে/করুক/করবে" (চরক, শরীর স্থান, অ০ ৮)। স্নানের পর ঈশ্বরজ্ঞ-পতির অগ্নি অর্থাৎ তেজকে, বধূ নিজের গর্ভাশয়ে ধারণ করে। মন্ত্রে পতিকে অর্যমা বলা হয়েছে। গর্ভাধানের সময় পতি পরমেশ্বরটে স্মরণ করে সাত্ত্বিক ভাবনা দ্বারা গর্ভাধান করুক, বৈষয়িক/বিষয়-সমূহের ভাবনা দ্বারা নয়। গর্ভাধানের সময় বিচারের প্রভাব গর্ভস্থ শিশুর ওপর অত্যাধিক প্রভাব ফেলে। এইসময় পতিকে মনে রাখা উচিত পরমেশ্বর যেমন প্রকৃতিতে নিজ কামনা রূপী গর্ভের ধারণ করেন তেমনই আমিও পত্নীর মধ্যে গর্ভাধান করি/করবো। পতির বীর্যকে অগ্নি অর্থাৎ তেজ বলা হয়েছে। অগ্নি অর্থাৎ তেজকে বীর্যও বলা হয়। যথা “স্যাদ্রক্ষণীয়ং যদি মে ন তেজঃ" (রঘুবংশ ১৪।৬৫) এ সীতা কবির উক্তি দ্বারা রামের বীর্যকে তেজঃ বলেছেন। তথা তেজঃ=Semen, Seed, Semen Virile (আপ্টে)। “অর্যম্ণো অগ্নিং পর্যেতু" এর অভিপ্রায় এটাও সম্ভব— গর্ভাধানের জন্য গর্ভাধান-সংস্কার রচনা করে, অর্যমা নামবিশিষ্ট পতি দ্বারা প্রদীপ্ত করা অগ্নির পরিক্রমা, পত্নী করে। মন্ত্রে শ্বশুর এবং দেবর আদি আত্মীয়দের দ্বারা যে প্রতীক্ষার বর্ণনা হয়েছে তা গর্ভাধানের সম্বন্ধে প্রতীত হয়।]

শং তে হিরণ্যং শমু সন্ধাপঃ শং মেথির্ভবতু শং যুগস্য তর্ম। 

শং ত আপঃ শতপবিত্ৰা ভবন্তু শমু পত্যা তন্বং সং স্পৃশস্ব৷ ৪০৷৷ 

পদার্থঃ [হে বধূ !] (তে) তোমার জন্য (হিরণ্যম্) সোনা [দ্রব্য, অলঙ্কার ইত্যাদি] (শম্) সুখদায়ক [হোক], (উ) এবং (আপঃ) প্রজাগণ [সন্তান, সেবক আদি] (শম্) শান্তিদায়ক (সন্তু) হোক, (মেথিঃ) পশু বাঁধার কাষ্ঠদণ্ড (শম্) আনন্দপ্রদ এবং (যুগস্য) জোয়ালের (তর্দ্ম) ছিদ্র (শম্) শান্তিদায়ক (ভবতু) হোক। (তে) তোমার জন্য (শতপবিত্রাঃ) শত প্রকারে শুদ্ধকারী (আপঃ) জল (শম্) শান্তিদায়ক (ভবন্তু) হোক, (শম্) শান্তির জন্য (উ) ই (পত্যা) পতির সাথে (তন্বম্) নিজের শ্রদ্ধা (সং স্পৃশস্ব) সংযুক্ত করো ॥৪০॥

শ্বশুর-শাশুড়ি প্রমুখ স্বাগত করে সুবর্ণ অলংকার ইত্যাদি যা কিছু পদার্থ দেবে, বধূ সেগুলো প্রসন্ন হয়ে স্বীকার করুক এবং ঘরের সন্তান, সেবক পশুদের, অন্ন, জল আদির ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রে প্রবৃত্ত হয়ে আনন্দ প্রাপ্তি করুক এবং পতির প্রতি সদা পূর্ণ প্রীতি রাখুক ॥৪০॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (তে) তোমার জন্য হে বধু! (হিরণ্যম্) গর্ভস্থবীর্য (শম্) সুখপ্রদ হোক, (আপঃ) সপ্ত প্রাণ (উ) নিশ্চিতরূপে (শম্) সুখপ্রদ (সন্তু) হোক, (মেথিঃ) তোমাদের দুজনের প্রজ্ঞা (শম্) সুখপ্রদ হোক, (যুগস্য) তোমাদের দুজনের (তর্দ্ম) পারস্পরিক হিংসা তথা অনাদর ভাব (শম্) শান্ত হয়ে যাক। (তে) তোমার জন্য (শতপবিত্রা আপঃ) শত প্রকারের ঔষধি দ্বারা পবিত্র করা স্নানার্থ জল (শম্) সুখ-শান্তি প্রদ (ভবন্তু) হোক, (উ) তথা (পত্যা) পতির সাথে (শম্) শান্তিপূর্বক (তন্বম্) নিজ শরীরের (সং স্পৃশস্ব) স্পর্শ করো।

[হিরণ্যম্=শুক্রং হিরণ্যম (তৈ০ ব্রা০ ১।৭।৬।৬)। আপঃ=সপ্তঽঋষয়ঃ প্রতিহিতাঃ শরীরে সপ্ত রক্ষন্তি সদমপ্রমাদম্ । সপ্তাপঃ স্বপতো লোকমীয়ুস্তত্র জাগৃতোঽঅস্বপ্নজৌ সত্রসদৌ চ দেবৌ ॥ (যজু০ ৩৪।৫৫) এ “সপ্ত আপঃ" এর জন্য নিরুক্তে বলা হয়েছে “সপ্ত আপনানি ইমানি এব ষডিন্দ্রিয়াণি বিদ্যা সপ্তমী" (নিরু০ ১২।৪।৩৮)। মেথিঃ=প্রজ্ঞা (ভ্বাদি); মিদৃ মেদৃ মেধাহিংসনয়োঃ, থান্তাবিমাবিতি স্বামী (ভট্টজী দীক্ষিত)। উ=অথবা পাদপূর্ণঃ। যথা “কম্ ঈম্ ইৎ, উ,-ইতি পদপূরণাঃ" (নিরু০ ১।৩।১০)। তর্দ্ম=তৃদ্ হিংসানাদরয়োঃ। পারস্পরিক শারীরিক যাতনা, তথা মানসিক কষ্ট দেওয়া হিংসারূপ, কটুভাষণও বাচিক হিংসা,-গৃহস্থ-জীবনে এগুলো শান্ত হয়ে যাওয়া উচিত, এইভাবে পারস্পরিক অনাদরের ভাবনারও পরিত্যাগ করে দেওয়া উচিৎ]

খে রথস্য খেহনসঃ খে যুগস্য শতক্রতো। 

অপালামিন্দ্র ত্রিপূত্বাকৃপণাঃ সূর্যচম্॥ ৪১। 

পদার্থঃ (শতক্রতো) হে শত প্রকারের বুদ্ধি বা কর্মশীল ! (ইন্দ্র) হে বড়ো ঐশ্বর্যবান [পতি !] (রথস্য) রথ [রথরূপ শরীরের] (খে) গমন [চেষ্টায়], (অনসঃ) জীবনের (খে) গমন [উপায়ে] এবং (যুগস্য) যোগ [ধ্যানের] (খে) গমন [চলার] ক্ষেত্রে (অপালাম্=অপারাম্) অপার গুণান্বিত [ব্রহ্মবাদিনী পত্নীকে] (ত্রিঃ) তিন বার [কর্ম, উপাসনা এবং জ্ঞান দ্বারা] (পূত্বা) শোধন করে (সূর্যত্বচম্) সূর্যের সমান তেজস্বিনী (অকৃণোঃ) তুমি করো ॥৪১॥

বুদ্ধিমান্ বিদ্বান্ পতি প্রচেষ্টা করুক যাতে, বিদুষী পত্নী বেদজ্ঞান দ্বারা শুদ্ধ হয়ে শরীরকে উচিত চেষ্টায়/কর্মে/আচরণে, জীবনকে সুন্দর উপায়ে, এবং মনকে ঈশ্বরভক্তিতে নিয়োজিত করে সংসারে কীর্তি পায়॥৪১॥ এই মন্ত্র কিছুটা আলাদাভাবে ঋগ্বেদে আছে− সায়ণভাষ্য ৮—১।৮০।৭ এবং আজমের বৈদিকযন্ত্রালয় পুস্তক ৮।৯১।৭ ॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (শতক্রতো) হে শত বর্ষের আয়ুতে কর্মশীল, যজ্ঞশীল তথা উত্তম সঙ্কল্পবিশিষ্ট! তথা (ইন্দ্র) হে আত্মিক শক্তি সম্পন্ন পতি! তুমি (রথস্য) শরীর-রথের (খে) আনন্দে, (অনসঃ) অন্নের (খে) আনন্দে, (যুগস্য) পতি-পত্নীর যুগলের (খে) আনন্দে, (অপালাম্) তুমি ছাড়া অন্য যার পালক নেই,-এমন পত্নীকে, (ত্রিঃ) এই তিন প্রকারে (পূত্বা) পবিত্র করে, (সূর্যত্বচম্) সূর্যের ত্বক অর্থাৎ কিরণের সদৃশ চমকিত করে দিয়েছো, পবিত্র করে দিয়েছো।

[রথস্য= “আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেব তু" (কঠ, উপ০ ৩।৩)। খে=আনন্দে, Happiness, pleasure (আপ্টে)। অনস্=অন্ন (উ০ ৪।১৯০, মহর্ষি দয়ানন্দ), “অনিতি জীবতি যেনেতি অনঃ, ওদনং পদবান্নং বা"। ক্রতুঃ=কর্ম (নিঘং০ ২।১); প্রজ্ঞা (৩।৯)। প্রজ্ঞা, যজ্ঞ (উণা০ ১।৭৬) মহর্ষি দয়ানন্দ] [ব্যাখ্যা— পতির কর্ত্তব্য হল, পত্নীকে এমন উপদেশ দেওয়া যাতে পত্নী তিন প্রকারের আনন্দে পবিত্র হয়। সেই তিনটি আনন্দ হল শারীরিক আনন্দ, অন্নের আনন্দ, তথা পতি-পত্নী যুগলের আনন্দ। পত্নী নিজের শারীরিক আনন্দকে অপবিত্র যেন না হতে দেয়। দৈনিক স্নান, উদ্যম এবং নিরালসতা, তথা বিষয় বাসনার নিয়ন্ত্রণ হল শারীরিক পবিত্রতা। অন্নকে দোষরহিত, স্বাদু তথা পুষ্টিকারক করা, এবং রাজস তথা তামস অন্নের সেবন না করা অন্ন সম্বন্ধী পবিত্রতা। পতি এবং পত্নী পৃথক্ পৃথক্ হয়ে গেলে, পরস্পর লড়াই এবং মনোমালিন্য দ্বারা, দুজনের সহবাসের আনন্দে তথা পবিত্রতায় পার্থক্য/দূরত্ব সৃষ্টি হয়। পত্নীর পবিত্রতায় সূর্যত্বক অর্থাৎ সূর্যের কিরণ-সমূহের দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে। সূর্যের কিরণ-সমূহ স্বয়ং সদা পবিত্র, তথা অন্য অপবিত্র পদার্থ-সমূহকে তথা স্থলকেও পবিত্র করে দেয়। পত্নীও পবিত্রতায় সূর্যের কিরণ-সমূহের সদৃশ স্বয়ং পবিত্র হওয়া উচিত। তাঁর নিজের পবিত্রতায়, তাঁর সম্পর্ক/সংস্পর্শে অন্য অপবিত্রও পবিত্র হয়ে যায়। পত্নীর মধ্যে এই তিনটি পবিত্রতা স্থাপনকারী পতিকেও স্বয়ং পবিত্র হওয়া উচিত। এইজন্য পতিকে শতক্রতু এবং ইন্দ্র বলা হয়েছে। যে উত্তম কর্মশীল, যজ্ঞশীল, উত্তম সঙ্কল্পসম্পন্ন, তথা আত্মশক্তি সম্পন্ন ,-সে অপবিত্র হতে পারে না। পত্নীকে মন্ত্রে অপালা বলা হয়েছে। বিবাহের পর পত্নী এবং সন্তানদের পালন করা পতির কর্ত্তব্য। পত্নীর কর্ত্তব্য হল গৃহব্যবস্থা তথা সন্তানদের দেখাশোনা করা তথা সুশিক্ষা। পতি এবং পত্নী দুজনেই চাকরিতে নিরন্তর নিয়োজিত থাকলে গৃহব্যবস্থা ঠিক থাকে না, এবং না সন্তানদের দেখাশোনা এবং না সুশিক্ষা হতে পারে।]

আশাসানা সৌমনসং প্রজাং সৌভাগ্যং রয়িম। 

পরনুব্রতা ভূত্বা সং নহ্যস্বামৃতায় কম্ ॥ ৪২৷৷ 

পদার্থঃ [হে বধূ !] (সৌমনসম্) মনের প্রসন্নতা, (প্রজাম্) প্রজা [সন্তান, সেবক আদি], (সৌভাগ্যম্) বড়ো ভাগ্যবান এবং (রয়িম্) ধন-সম্পদের (আশাসমানা) আশাবাদী তুমি (পত্যুঃ) পতির (অনুব্রতা) অনুকূল কর্মশীল (ভূত্বা) হয়ে (অমৃতায়) অমরত্ব [পুরুষার্থ এবং কীর্তির] জন্য (কম্) সুখপূর্বক (সং নহ্যস্ব) সন্নদ্ধ হও [যুদ্ধের জন্য কবচ ধারণ করো] ॥৪২॥

সব কুটুম্ব লোকেরা বধূকে শিক্ষা প্রদান করুক যাতে যে সেই বিদুষী বধূ যোগ্যতার সহিত পতির প্রতি প্রীতি করে প্রসন্নতাপূর্বক গৃহকার্য সিদ্ধ করে ॥৪২॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (সৌমনসম্) মনের প্রসন্নতা, (প্রজাম্) উত্তম সন্তান, (সৌভাগ্যম্) উত্তম ভগ-সমূহের সত্তা/বিদ্যমানতা (রয়িম্) তথা ধন-সম্পদের (আশাসানা) কামনাকারী হে বধূ! তুমি (পত্যুঃ) পতির (অনুব্রতা) অনুকূল ব্রত তথা কর্মকারী (ভূত্বা) হয়ে (অমৃতায়) মোক্ষ বা অনশ্বর পরমেশ্বরের প্রাপ্তির জন্য (সং নহ্যস্ব) সজ্জিত হও, প্রস্তুত হও।

[অনুব্রতা; ব্রতম্ কর্মনাম (নিঘং০ ২।১), অথবা সত্যাচরণাদি ব্রত। আশাসানা=আঙঃ শাসু ইচ্ছায়াম্ (অদাদিঃ)] [ব্যাখ্যা— পরস্পরের প্রসন্নতা এবং খুশীর রাজ্য, গৃহে পত্নীর ওপর অধিক নির্ভর করে। যদি পত্নী কলহ প্রিয়া এবং কটুভাষিণী হয়, তবে গৃহজীবনে সদা দুঃখ এবং ক্লেশ-এর রাজ্য/পরিস্থিতি হবে। অতঃ পত্নী সদা সৌমনস কামনা করুক। পত্নী সদা উত্তম সন্তানের কামনা করুক। জাঃ অপত্যম্ (নিরু০ ৬।২।৯); প্রজাঃ=প্রকৃষ্ট অপত্য। মাতার বিচার-সমূহ, ব্যবহার/আচরণ তথা সংস্কারের প্রভাব সন্তানদের ওপর অধিক হয়। এইজন্য মাতা নিজের মনের মধ্যে সন্তানদের প্রকৃষ্ট করার ভাবনা সদা জাগরিত রাখুক। সন্তান গর্ভে থাকাকালীনও মাতার মনে এই ভাবনা সদা জাগরিত থাকুক। তথা সন্তান জন্মলাভের পরেও মাতার মনে এই ভাবনা জাগরিত থাকা উচিত। পত্নী উত্তম ভগ-সমূহের সদা কামনা করুক। উত্তমঐশ্বর্য, উত্তমধর্ম, উত্তমযশ, উত্তমশ্রী, উত্তমজ্ঞান এবং উত্তমবৈরাগ্য,-এগুলোর প্রাপ্তি সৌভাগ্য। ঐশ্বর্য আদি উত্তমও হয় এবং অনুত্তমও। সুপথ দ্বারা উপার্জিত ঐশ্বর্য আদি উত্তম এবং কুপথ দ্বারা উপার্জিত অনুত্তম। শ্রদ্ধাপূর্বক কৃত ধর্ম উত্তম এবং লোক প্রশংসার জন্য কৃত ধর্ম অনুত্তম। ত্যাগ, তপস্যা, পরোপকার, দান ইত্যাদি দ্বারা প্রাপ্ত যশ উত্তম, এবং পরনিন্দা, বিশ্বাসঘাতকতা দ্বারা প্রাপ্ত অপযশ অনুত্তম। জ্ঞানবৃদ্ধির জন্য প্রাপ্ত জ্ঞান উত্তম, বিবাদের জন্য প্রাপ্ত জ্ঞান অনুত্তম। মোহ-মমতা বিহীন বৈরাগ্য উত্তম, ছদ্মবেশী বৈরাগ্য অনুত্তম। ভদ্রবস্ত্রে শ্রী অর্থাৎ শোভা উত্তম, এবং চিত্তাকর্ষক বেশভূষায় অনুত্তম। পতি এবং পত্নীর ব্রত এবং কর্মের মধ্যে যদি পরস্পর অনুকূলতা হয়/থাকে তবে গৃহজীবন অধিক সুখী হয়। এইজন্য মন্ত্রে “পত্যুরনুব্রতা ভূত্বা" বলা হয়েছে। পত্নী গৃহস্থজীবনে, গৃহস্থের ঐহলৌকিক কৃত্যের সাথে-সাথে মোক্ষকৃত্যের জন্যও প্রসন্নতাপূর্বক প্রচেষ্টা করতে থাকুক। গৃহস্থধর্মে প্রতিপাদিত কর্ত্তব্যের পালন যদি ভক্তি, শ্রদ্ধা এবং নিঃস্পৃহতা তথা ফলত্যাগের ভাবনা দ্বারা করা হয় তবে ইহার দ্বারা পত্নী মোক্ষের দিকে অগ্রসর হয়ে যায়।]

যথা সিন্ধুনদীনাং সাম্রাজ্যং সুষুবে বৃষা। 

এবা ত্বং সম্রাজ্ঞেধি পতুরস্তং পরেত্য। ৪৩৷৷ 

(যথা) যেমন (বৃষা) বলবান্ (সিন্ধুঃ) সমুদ্র (নদীনাম্) নদী-সমূহের (সাম্রাজ্যম্) সাম্রাজ্য [চক্রবর্তী রাজ্য, নিজের জন্য] (সুষুবে) উৎপন্ন করেছে। [হে বধূ !] (এব) তেমনই (ত্বম্) তুমি (পত্যুঃ) পতির (অস্তম্) ঘরে (পরেত্য) পৌঁছে (সম্রাজ্ঞী) রাজরাজেশ্বরী [চক্রবর্তী রানী] (এধি) হও ॥৪৩॥

বড়ো লোকেদের শিক্ষা এবং আশীর্বাদ দ্বারা বধূ সাবধানতার সহিত ঘরের সব কাজ নিজ হাতে নিয়ে মহারানী হয়ে থাকুক ॥৪৩॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (যথা) যেমন (বৃষা) বর্ষণকারী (সিন্ধুঃ) সমুদ্র (নদীনাম্) নদী-সমূহের (সাম্রাজ্যম্) সাম্রাজ্য (সুষুবে) প্রাপ্ত করেছে, (এবা=এবম্) এভাবেই (ত্বম্) হে বধু! তুমি (পত্যুঃ) পতির (অস্তম্) ঘরে (পরেত্য) গিয়ে, (সম্রাজ্ঞী) রাণী (এধি) হও।

[ব্যাখ্যা— সমুদ্রের সাম্রাজ্য নদীগুলোর ওপর হয়। নদী-সমূহ নিজের জল সম্পত্তি সমুদ্রকে উপহার দেয়, কেননা সমুদ্র নদীগুলোর রাজা। এইভাবে গৃহবাসীদের উচিত, নিজেদের সমস্ত উপার্জন এই নববধূর প্রতি দিয়ে দেওয়া। কেননা নববধূ পতিগৃহের সম্রাজ্ঞী,. রাণী। কিন্তু সমুদ্র নদীগুলোর দ্বারা প্রদত্ত দেয়-কে নিজ স্বার্থের জন্য রাখে না। সমুদ্র হল বৃষা, বর্ষার কারণ। নদীগুলোর দ্বারা প্রতিগ্রহ নিয়ে সমুদ্র, বর্ষারূপে সেই প্রতিগ্রহকে পুনঃ নদীগুলোতে তথা পৃথিবীর অন্য পদার্থ-সমূহের প্রতি সমর্পিত করে দেয়। পত্নীর উচিত প্রাপ্ত উপার্জন গৃহবাসীদের সমুন্নতিতে ব্যয় করা। তথা সমুদ্র জলের বর্ষণ করেও সদা পরিপূর্ণ থাকে, এভাবেই পত্নীও ধন-সম্পদের ব্যয় এই বিধিতে করে/করুক/করবে যাতে সে ব্যয় করেও ধন-সম্পত্তিতে সদা পরিপূর্ণ থাকে (দেখো মন্ত্র ৭ এর ব্যাখ্যা)। কিন্তু পত্নীকে সর্বদা মনে রাখতে হবে, গৃহ-সাম্রাজ্যে পত্নী হল সম্রাজ্ঞী, গৃহ-সাম্রাজ্যে পতি সম্রাট্। বাকি গৃহবাসী এই দুজনের দ্বারা পালনীয় তথা রক্ষণীয়। সম্রাজ্ঞী সম্রাটের পরামর্শ দ্বারাই ব্যয় করে/করুক/করবে, অন্যথা নয়। মন্ত্রে রাজা-প্রজার পারস্পরিক লেনদেনের বিষয়েও আলোকপাত করা হয়েছে। রাজা সমুদ্রের সদৃশ, প্রজাদের থেকে নিয়ে, উহার ব্যয় প্রজাদের মঙ্গলের জন্য করে/করুক/করবে, কেবল স্বার্থ সিদ্ধির জন্য নয়।]

সম্রাজ্ঞেধি শ্বশুরেষু সম্রাজ্ঞত দেবৃষু। 

ননান্দুঃ সম্রাজ্ঞেধি সম্রাজ্ঞত শশ্বাঃ ॥ ৪৪৷৷ 

পদার্থঃ [হে বধূ !] তুমি (শ্বশুরেষু) নিজের শ্বশুর আদি [আমার পিতা আদি গুরুজনদের] মাঝে (সম্রাজ্ঞী) রাজরাজেশ্বরী, (উত) এবং (দেবৃষু) নিজের দেবর [আমার বড়ো এবং ছোটো ভাইয়ের] মাঝে (সম্রাজ্ঞী) রাজরাজেশ্বরী (এধি) হও। (ননান্দুঃ) নিজের ননদ [আমার বোনের] (সম্রাজ্ঞী) রাজরাজেশ্বরী, (উত) এবং (শ্বশ্র্বাঃ) নিজের শাশুড়ি [আমার মাতার] (সম্রাজ্ঞী) রাজরাজেশ্বরী (এধি) হও॥৪৪॥

বধূ বিদ্যা এবং বুদ্ধির সহায়তায় নিজের কর্তব্যে এমন চতুর হোক যেন শ্বশুর, শাশুড়ি, দেবর, ননদ প্রমুখ সকল বড়ো-ছোটো জন তাঁর বড়ো প্রতিষ্ঠা করে ॥৪৪॥ এই মন্ত্র কিছুটা আলাদাভাবে ঋগ্বেদে আছে− ১০।৮৫।৪৬। এবং মহর্ষি দয়ানন্দকৃত সংস্কারবিধি বিবাহপ্রকরণে পতির ঘরে পৌঁছে বধূ-বরের হবন করার ক্ষেত্রে ব্যাখ্যাত রয়েছে ॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ হে বধু! (শ্বশুরেষু) নিজের শ্বশুরদের মধ্যে তুমি (সম্রাজ্ঞী) রাজেশ্বরী (এধি) হও, (উত) এবং (দেবৃষু) দেবর-দের মধ্যে (সম্রাজ্ঞী) রাজেশ্বরী হও। (ননান্দু) ননদদের মধ্যে (সম্রাজ্ঞী) রাজেশ্বরী (এধি) হও, (উত) এবং (শ্বশ্র্বাঃ) শাশুড়ির সম্বন্ধে (সম্রাজ্ঞী) রাজেশ্বরী হও।

[ব্যাখ্যা— সম্রাজ্ঞীর অর্থ হল, সম্যক্ রাজ্য শাসনকারী। শ্বশুর, শাশুড়ি, দেবর, ননদ প্রমুখদের তথা অন্য গৃহবাসীদের ওপর সম্রাজ্ঞী, সেবাবৃত্তি দ্বারা রাজ্য করে/করুক/করবে। ইহাই সম্যক্-রাজ্য। শ্বশুরেষু এ বহুবচন পতির পিতা, পিতৃব্য-এর সূচক। বর্তমানে বিবাহের পর প্রায়ঃ নববধূর নিজের পতির আত্মীয়দের সাথে কলহ থাকে। কারণ হল পতির আত্মীয়/স্বজনরা, নববধূকে সেই অধিকার দিতে চায় না, যে অধিকারের কথা এই মন্ত্রে উদ্ধৃত করা হয়েছে। শাশুড়ি এবং ননদ আদি নববধূকে নিজেদের দৃষ্টিতে চালনা করতে চায় যাতে বধূ তাঁদের নিয়ন্ত্রণে থাকে।]

যা অকৃন্তন্নবয় যাশ্চ তত্নিরে যা দেবীরা অভিতোহদদন্ত। 

তাস্থা জরসে সং ব্যয়ায়ুষ্মতীদং পরি ধৎস্ব বাসঃ ॥ ৪৫। 

পদার্থঃ (যাঃ) যে [স্ত্রীগণ] (অকৃন্তন্) বেষ্টিত করেছে, (চ) এবং (যাঃ) যারা (তত্নিরে) তন্তুগুলোকে বিস্তারিত করেছে, এবং (অবয়ন্) বয়ন করেছে, এবং (যাঃ দেবীঃ) যে দেবীরা (অন্তান্) [বস্ত্রের] আঁচল (অভিতঃ) সব প্রকারে (অদদন্ত) দিয়েছে। [হে বধূ !] (তাঃ) সেই সব স্ত্রীগণ (ত্বা) তোমাকে (জরসে) স্তুতির জন্য (সং ব্যযন্তু) বস্ত্র পরিধান করাবে, (আয়ুষ্মতী) আয়ুষ্মতী তুমি (ইদং বাসঃ) এই বস্ত্রকে (পরি ধৎস্ব) ধারণ করো ॥৪৫॥

বড়ো-বড়ো গুণবতী নারীরা আদর করে সুন্দর-সুন্দর বস্ত্র বধূকে দিয়ে পরিধান করাবে এবং আশীর্বাদ দেবে যাতে, বধূ প্রসন্ন থেকে বড়ো যশ প্রাপ্ত করে॥৪৫॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (যাঃ) যে (দেবীঃ) দেবীগণ (অকৃন্তন্) সূতা কেটেছে, (অবয়ন্) এবং তা বুনন করেছে, (যাঃ চ) এবং যে দেবীগণ (অভিতঃ) বস্ত্রের চারিদিকের (অন্তান্) কিনারা/অন্ত (অদদন্ত) দিয়েছে, (তাঃ) সেই দেবীগণ (ত্বা) তোমাকে, হে বধু! (জরসে) জরাবস্থা পর্যন্ত (সম্ব্যযন্তু) হাতের দ্বারা কাটা-বুনন করা বস্ত্রের দ্বারা আবৃত করতে থাকুক। (আয়ুষ্মতী) আয়ুষ্মতী তুমি (ইদম্) এই (বাসঃ) বস্ত্র (পরিধৎস্ব) পরিধান করো।

[ব্যাখ্যা— মন্ত্রে সূতো কাটা, বস্ত্র বুনন, বস্ত্রের কিনারা/অন্ত তৈরি করা,—দেবীদের গৃহ কৌশল দর্শানো হয়েছে। নববধূকে এই উপদেশও দেওয়া হয়েছে তুমি হাত দিয়ে নির্মিত বস্ত্র ধারণ করো, এবং সারাজীবন এমনই বস্ত্র ধারণ করো। গৃহ-উদ্যোগের ইহা একটি দৃষ্টান্ত।]

জীবং রুদন্তি বি নয়ন্ত্যধ্বরং দীর্ঘামনু প্রসিতিং দীধর্নরঃ। 

বামং পিতৃভ্যো য ইদং সমীরিরে ময়ঃ পতিভ্যো জনয়ে পরিজে। ৪৬। 

পদার্থঃ (নরঃ) নর [নেতারা] (জীবম্) [সংসারের] জীবনের জন্য [প্রেমের] (রুদন্তি) অশ্রু বিমোচন করে, (অধ্বরম্) হিংসারহিত ব্যবহারকে (বি) বিবিধ প্রকারে (নয়ন্তি) নিয়ে চলে, এবং (দীর্ঘাম্) দীর্ঘ (প্রসিতিম্ অনু) প্রবন্ধ ক্রিয়ার সাথে (দীধ্যুঃ) প্রকাশমান হয়। (যে) যে [পুরুষার্থীগণ] (পিতৃভ্যঃ) পিতা আদি মান্য লোকেদের জন্য (ইদম্) এই (বামম্) শ্রেষ্ঠ পদার্থ (সমীরিরে) প্রেরিত করেছে, (পতিভ্যঃ) সেই রক্ষক পুরুষদের জন্য [পতির সাথে] (জনয়ে পরিষ্বজে) পত্নীর সংগম (ময়ঃ) সুখদায়ক ॥৪৬॥

করুণাশীল, বীরপুরুষ গৃহাশ্রমে হিংসা ত্যাগ করে দৃঢ় ব্যবস্থা করে যশ প্রাপ্ত করে। যে মনুষ্য এই শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত বিদ্বানদের মধ্যে বিস্তার করে, সেই বিদ্বান্ গৃহাশ্রমী স্ত্রী-পুরুষদের থেকে/দ্বারা বিদ্যাবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সুখ প্রাপ্ত করে ॥৪৬॥ এই মন্ত্র কিছুটা আলাদাভাবে ঋগ্বেদে আছে− ১০।৪০।১০, এবং মহর্ষিদয়ানন্দকৃত সংস্কারবিধি বিবাহপ্রকরণে বধূকে পিতৃ-গৃহ ত্যাগ করার সময় চোখে অশ্রু নিয়ে আসার জন্য বরের উক্তিতে রয়েছে ॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (যে) যে/যারা (ইদম্) এই সিদ্ধান্ত (সমীরিরে) প্রেরিত করেছে যে, (পতিভ্যঃ) পতিদের জন্য তথা (জনয়ে) জননী অর্থাৎ পত্নীদের জন্য (পরিষ্বজে) পরস্পর আলিঙ্গনেই (ময়ঃ) আনন্দ এবং সুখ, (তে) সেই (নরঃ) নর-নারীগণ (জীবম্) যাবজ্জীবন (রুদন্তি) রোদন করে, (অধ্বরম্) এবং হিংসারহিত গৃহস্থ যজ্ঞকে (বি নয়ন্তি) ধর্মবিরুদ্ধ মার্গে নিয়ে যায়, (দীর্ঘাম্) দীর্ঘ (প্রসিতিম্) বিষয়ের (অনু) নিরন্তর (দীধ্যুঃ) ধ্যান অর্থাৎ চিন্তন করতে থাকে, তথা (পিতৃভ্যঃ) পিতৃদের প্রতি (বামম্) বামাচার অর্থাৎ বিরুদ্ধ আচার-ব্যবহার (সমীরিরে) প্রেরিত করে।

[সমীরিরে=সম্=ঈট্ (গতৌ)। প্রসিতিম্=প্র+ষিঞ্ বন্ধনে=প্রবন্ধ] [ব্যাখ্যা—গৃহস্থ জীবনকে ভোগস্থলী মনে করা নিতান্ত ভুল। যে গৃহস্থী এটা মনে করে যে, গৃহস্থ জীবন পরস্পরালিঙ্গনের মাধ্যমে আনন্দের জন্য তাঁদের অবস্থা নিম্নলিখিত হয়ে যায়:— এমন ব্যক্তি প্রথমে ক্ষণিক আনন্দে লীন হয়ে যায়, কিন্তু পরিণামে সারাজীবন কাঁদতে থাকে। তাঁরা গৃহস্থধর্মের যজ্ঞিয়াংশ দূর করে গৃহস্থকে ধর্মবিরুদ্ধ দিশায় নিয়ে যায়, এবং অযজ্ঞময় করে দেয়। তাঁরা দীর্ঘ দীর্ঘ বিষয়ের চিন্তাই করতে থাকে, কিন্তু ধৈর্য এবং সাহসের অভাবের কারণে সফলতা তাঁরা প্রাপ্ত হয় না। তাঁরা মাতা-পিতা এবং অন্য বৃদ্ধদের প্রতি এমন ব্যবহার/আচরণ করতে থাকে যা শিষ্টাচার বিবর্জিত/বহির্ভূত।]

স্যোনং ধ্রুবং প্রজায়ৈ ধারয়মি তেহম্মানং দেব্যাঃ পৃথিব্যা উপস্থে। 

তমা তিষ্ঠানুমাদ্যা সুবৰ্চা দীর্ঘং ত আয়ুঃ সবিতা কৃপোতু ॥ ৪৭ ৷৷ 

পদার্থঃ (স্যোনম্) সুখদায়ক, (ধ্রুবম্) দৃঢ় (অশ্মানম্) পাথরকে (দেব্যাঃ) দিব্য গুণান্বিত (পৃথিব্যাঃ) পৃথিবীর (উপস্থে) কোলে (প্রজায়ৈ) প্রজা [সন্তান, সেবক আদির] জন্য (তে) তোমার জন্য (ধারয়ামি) আমি [পতি] ধারণ করি। (অনুমাদ্যা) নিরন্তর হর্ষ করে এবং (সুবর্চাঃ) বড়ো প্রতাপশালী তুমি (তম্) সেই [পাথরে] (আ তিষ্ঠ) দাঁড়াও/স্থিত হও, (সবিতা) সকলের উৎপন্নকারী পরমেশ্বর (তে) তোমার (আয়ুঃ) আয়ুকে (দীর্ঘম্) দীর্ঘ (কৃণোতু) করে/করুক ॥৪৭॥

যেমন পৃথিবীতে পাথর পাহাড়ে দৃঢ় হয়ে থাকে, তেমনই বধূ-বর দৃঢ় প্রতিজ্ঞার সাথে গৃহাশ্রম সিদ্ধ করে আনন্দ প্রাপ্তি করুক ॥৪৭॥ এই মন্ত্র দ্বারা বধূকে বর শিলার ওপর দাঁড় করাবে। মহর্ষিদয়ানন্দকৃত সংস্কারবিধি বিবাহপ্রকরণে বধূর জন্য শিলার ওপর আরোহণ করানো অন্য মন্ত্রে লেখা আছে ॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ হে বধু! (তে) তোমার (প্রজায়ৈ) ভাবী সন্তানের জন্য [আদর্শরূপে], (পৃথিব্যাঃ) পৃথিবীর (উপস্থে) এই সমীপ-স্থানে (ধ্রুবম্) সুদৃঢ় (অশ্মানম্) পাথর (ধারয়ামি) আমি স্থাপিত করি, যা (দেব্যাঃ) তোমার, দেবীর (উপস্থে) কোলে মানো (স্যোনম্) সুখদায়ক এবং (ধ্রুবম্) সুদৃঢ় [পুত্রের রূপ]। (তৎ) সেই পাথরের ওপর (আ তিষ্ঠ) এসে দাঁড়াও, তথা সেই পুত্রের ওপর তুমি নিজের “আস্থা", অর্থাৎ আশা তথা বিশ্বাস রাখো। (অনুমাদ্যা) তুমি ধর্মানুসারে আমার দ্বারা প্রসন্ন রাখার যোগ্য, (সুবর্চাঃ) তুমি তেজস্বিনী। (সবিতা) জগদুৎপাদক পরমেশ্বর (তে) তোমার (আয়ুঃ) আয়ু (দীর্ঘম্) দীর্ঘ (কৃণোতু) করুক।

[স্যোনম্ সুখনাম (নিঘং০ ৩।৬)। অনুমাদ্যা= বিবাহধর্মানুসারে, বিবাহের পর পত্নীকে সদা প্রসন্ন রাখা,-ইহা বিবাহধর্ম। অনুমাদ্যা=অনু (বিবাহ ধর্মানুসার)+মাদ্যা] [ব্যাখ্যা— বিবাহপদ্ধতির অনুসারে বধূকে শিলারোহণ করানো হয়। শিলারোহণের জন্য বর এই মন্ত্র দ্বারা বধূকে প্রেরিত করে, যাতে বহ পরখ সকে কি শিলা কিতনী দৃঢ় তথা মজবূত হৈ। বর বধূকে অনুভব করায় যে, যেমন পৃথিবী-মাতার কোলে এই শিলা দৃঢ় তথা মজবুত, তেমনই তোমার কোলেও দৃঢ় তথা মজবুত সন্তান হওয়া দরকার। বর বধূকে “দেব্যাঃ” দ্বারা দেবী বলে। দেবী-এর অর্থ হল দিব্যগুণসম্পন্না। মাতা দেবী হলে সন্তানরাও দেব এবং দেবী হতে পারে। বৈদিক সাহিত্যে আদর্শ শরীরকে পাথর দ্বারা উপমিত করা হয়েছে। যথা “অশ্মানং তন্বং কৃধি" (অথর্ব০ ১।২।২), তথা “অশ্মা ভবতু তে তনূঃ" (অথর্ব০ ২।১৩।৪)। অর্থাৎ তুমি শরীরকে পাথর করো, তথা তোমার শরীর পাথর/কঠোর হোক। শরীরের স্থূলতা স্বাস্থ্যের চিহ্ন নয়। অপিতু শরীরের মজবুত তথা কঠোর হওয়া স্বাস্থ্যের চিহ্ন। এমন সন্তানরাই সুখ পেতে পারে (স্যোনম্) তথা মাতা-পিতাকে সুখী করতে পারে। ভাষ্যকারেরা স্যোনম্ পদকে অশ্মানম্ এর বিশেষণ মেনেছেন। কিন্তু এটা বোধগম্য নয় যে, পাথর সুখকারী কিভাবে হতে পারে। যদি অশ্মানম্ পদকে পুত্রের রূপক মানা হয় তবে স্যোনম্ শব্দ রুচিকর হয়, অর্থাৎ অশ্মা সদৃশ সুদৃঢ় হয়ে সুখদায়ক পুত্র। মন্ত্রে “আ তিষ্ঠ" দ্বারা বধূকে বলা হয়েছে যে, তুমি অশ্মা সদৃশ সুদৃঢ় সন্তানের প্রাপ্তিতে আস্থা তথা বিশ্বাস রাখো। বধূর, এই আশা এবং বিশ্বাসের অনূকূলে, জীবনচর্যা হলে সন্তান তদনুরূপ হতে পারে। "সুবর্চাঃ" দ্বারা বধূকে এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, গৃহস্থধর্মের এইভাবে তুমি পালন করো যাতে তোমার শারীরিক তেজ কম না হয়, যাতে তুমি দীর্ঘায়ু হতে পারো।

যেনাগ্নিরস্যা ভূম্যা হস্তং জগ্রাহ দক্ষিণম্। 

তেন গৃহামি তে হস্তং মা ব্যথিষ্ঠা ময়া সহ প্ৰজয়া চ ধনেন চ ৷৷ ৪৮৷ 

পদার্থঃ (যেন) যে [সামর্থ্য] দ্বারা (অগ্নিঃ) তেজস্বী পুরুষ (অস্যাঃ ভূম্যাঃ) এই ভূমি [প্রত্যক্ষ ভূমির সমান ধৈর্যবতী নিজের পত্নীর] (দক্ষিণম্) বড়ো বল/শক্তিসম্পন্ন বা গতিসম্পন্ন [অথবা ডান] (হস্তম্) হাত (জগ্রাহ) ধরেছে। (তেন) সেই [সামর্থ্য] দ্বারা (তে হস্তম্) তোমার হাতকে (গৃহ্ণামি) আমি [পতি] ধরি, (ময়া সহ) আমার সাথে থেকে (প্রজয়া) প্রজা [সন্তান সেবক আদির] সাথে (চ চ) এবং (ধনেন) ধন-সম্পদের সাথে (মা ব্যথিষ্ঠাঃ) ব্যথা প্রাপ্ত হয়োনা ॥৪৮॥

যেমন পূর্বপুরুষেরা জল গ্রহণ করে উপকার করে এসেছে, তেমনই বধূ-বর জলগ্রহণ করে প্রীতির সহিত পরস্পর হিত করে সন্তান আদির পালন এবং ধন-সম্পদের বৃদ্ধি করুক ॥৪৮॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (যেন) যে উদ্দেশ্যে (অগ্নিঃ) অগ্রণী (ভূম্যাঃ) ভূমিসদৃশ উৎপাদক বধূর (দক্ষিণম্) উৎসাহী দক্ষিণ/ডান (হস্তম্, জগ্রাহ) হাত জল গ্রহণ করেছে, (তেন) সেই উদ্দেশ্যে হে বধু ! (তে হস্তং গৃহ্ণামি) তোমার জলগ্রহণ আমি করি। (ময়া সহঃ) আমার সাথে বর্তমান তুমি (প্রজয়া চ, ধনেন চ) প্রজাদের দ্বারা এবং ধন দ্বারা (মা ব্যথিষ্ঠাঃ) ব্যাথা প্রাপ্ত না হও।

[অগ্নিঃ অগ্রণীর্ভবতি (নিরু০ ৭।৪।১৪)। তেন=উদ্দেশ্য হল প্রজা অর্থাৎ উত্তম সন্তান, তথা তাঁদের পালন পোষণার্থ ধন। বর বধূকে বলে, আমার বংশের অগ্রণী পুরুষ যে উদ্দেশ্যে জলগ্রহণ করে এসেছে সেই উদ্দেশ্যে আমি তোমার জলগ্রহণ করি যাতে প্রজা এবং ধন-সম্পদের অভাব দ্বারা তুমি ব্যথা প্রাপ্ত না হও।

দেবস্তে সবিতা হস্তং গৃহ্বাতু সোয়মা রাজা সুপ্রজসং কৃণোতু। 

অগ্নিঃ সুভগাং জাতবেদাঃ পত্যে পত্নীং জরদষ্টিং কৃণোতু ॥ ৪৯। 

পদার্থঃ (দেবঃ) ব্যবহারকুশল/ব্যবহারে চতুর, (সবিতা) সর্বপ্রেরক [পরমেশ্বর] (তে হস্তম্) তোমার হাতকে (গৃহ্ণাতু) ধরুক [সহায়তা করে/করুক], (রাজা) ঐশ্বর্যবান্ (সোমঃ) সর্বোৎপাদক [পরমাত্মা] (সুপ্রজসম্) সুন্দর সন্তানসম্পন্না (কৃণোতু) করে/করুক। (জাতবেদাঃ) ধন প্রাপ্তিতে সহায়ক (অগ্নিঃ) সর্বব্যাপক [জগদীশ্বর] (পত্যে) পতির জন্য (পত্নীম্) পত্নীকে (সুভগাম্) বড়ো ঐশ্বর্যসম্পন্না এবং (জরদষ্টিম্) স্তুতির সহিত প্রবৃত্তিসম্পন্না বা ভোজনসম্পন্না (কৃণোতু) করে/করুক ॥৪৯॥

বধূ-বর সদা পরমেশ্বরের উপাসনা করে পরস্পর সহায়তা করার ক্ষেত্রে, সন্তানকে সুশিক্ষিত বলবান্ করার ক্ষেত্রে, এবং ধন-সম্পদের সঙ্গ্রহ করার ক্ষেত্রে তৎপর থেকে সংসারে কীর্তিমান্ হোক ॥৪৯॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (দেবঃ) দিব্য গুণান্বিত (সবিতা) তোমার প্রেরক প্রেরণা প্রদানকারী বর (তে) তোমার (হস্তং গৃহ্ণাতু) জলগ্রহণ করে, (সোমঃ) বীর্যবান্ (রাজা) তোমার ভাবী গৃহের রাজা এই বর (সু প্রজসম্) তোমাকে উত্তমপ্রজা সম্পন্ন (কৃণোতু) করে/করুক। (অগ্নিঃ) জগদগ্রণী (জাতবেদাঃ) তথা উৎপন্ন জগতে বিদ্যমান পরমেশ্বর (পত্নীম্) তোমাকে, পত্নীকে (পত্যে) পতির জন্য (সুভগাম্) সৌভাগ্যবতী তথা (জরদষ্টিম্) জরাবস্থা পর্যন্ত গমনকারী অর্থাৎ দীর্ঘায়ু (কৃণোতু) করে।

[সবিতা= ষূ (সূ) প্রেরণে, তথা "সবিতা প্রসবিতা" (নিরু০ ১০।৩।৩১)। সোমঃ=বীর্য (অথর্ব০ ১৪।১।২-৫)। মন্ত্র মেং সোম=বীর্যবান্) (অর্শ আদ্যচ্)। অগ্নিঃ= অগ্রণীর্ভবতি (নিরু০ ৭।৪।১৪)। জাতবেদাঃ=জাতে জাতে বিদ্যত ইতি বা (নিরু০ ৭।৫।১৯)। মন্ত্র, পুরোহিত দ্বারা উক্ত]

গৃমি তে সৌভগত্বায় হস্তং ময়া পত্যা জরদষ্টিৰ্যথাসঃ। 

ভগো অর্যমা সবিতা পুরন্ধির্মহং ত্বাদুৰ্গাৰ্হপত্যায় দেবাঃ ॥ ৫০। 

পদার্থঃ [হে বধূ !] (সৌভগত্বায়) সৌভাগ্য [অর্থাৎ গৃহাশ্রমে সুখের] জন্য (তে হস্তম্) তোমার হাতকে (গৃহ্ণামি) আমি [পতি] ধরি/গ্রহণ করি, (যথা) যাতে (ময়া পত্যা) আমার অর্থাৎ পতির সাথে (জরদষ্টিঃ) স্তুতির সহিত প্রবৃত্ত বা ভোজনসম্পন্না (অসঃ) তুমি থাকো। (ভগঃ) সকল ঐশ্বর্যবান, (অর্যমা) শ্রেষ্ঠদের সম্মানকারী, (সবিতা) সকলের প্রেরক, (পুরন্ধিঃ) সব জগতকে ধারণকারী [পরমেশ্বর] এবং (দেবাঃ) সব বিদ্বানগণ (মহ্যম্) আমাকে (ত্বা) তোমাকে (গার্হপত্যায়) গৃহকার্যের জন্য (অদুঃ) দিয়েছে ॥৫০॥

বধূ-বর পরমেশ্বর এবং বিদ্বানদের সাক্ষী করে পরস্পর হাত ধরে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করুক যে, আমরা দুজন নিষ্কপট পরস্পর সহায়ক হয়ে পরমেশ্বর এবং বিদ্বানদের মর্যাদায় চলে গৃহাশ্রমের কর্তব্য সিদ্ধ করবো॥৫০॥ এই মন্ত্র কিছুটা আলাদাভাবে ঋগ্বেদে আছে-১০।৮৫।৩৬, এবং মহর্ষি দয়ানন্দকৃত ঋগ্বেদাদি ভাষ্যভূমিকা বিবাহবিষয় পৃষ্ঠা ২০৮ এ ব্যাখ্যাত রয়েছে॥

টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ হে বধু ! (সৌভগত্বায়) নিজের সৌভাগ্যের জন্য (তে) তোমার (হস্তম্, গৃহ্ণামি) জলগ্রহণ আমি করি, (ময়া, পত্যা) আমার, পতির সাথে (যথা) যাতে (জরদষ্টিঃ) জরাবস্থা পর্যন্ত গমনকারী (অসঃ) তুমি হও। (ভগঃ) আমি ৬ ভগ সম্পন্ন, (অর্যমা) জগতের স্বামীর জ্ঞাতা, শ্রেষ্ঠদের সম্মানকারী, শ্রেষ্ঠ মনসম্পন্ন তথা ন্যায়কারী, (সবিতা) তোমার প্রেরক, (পুরন্ধিঃ) তথা অনেক বুদ্ধিমান্। (দেবাঃ) উপস্থিত দেবতাগণ এবং দেবীগণ (গার্হপত্যায়) গৃহপতির কর্তব্যের পালনের জন্য, (মহ্যম্) আমার জন্য (ত্বা) তোমাকে (অদুঃ) দিয়েছে।

[ভগ ৬ টি (অথর্ব০ ১৪।১।৪২)। পুরন্ধিঃ=বহুধীঃ (নিরু০ ৬।৩।১৩)। মন্ত্র ৫১ এ ভগ-এবং-সবিতাকে জলগ্রহণকারী বলা হয়েছে। তদনুসারে ভগ, অর্যমা১, সবিতা, এবং পুরন্ধি-এর অর্থ পতিপরক করা হয়েছে। দেবাঃ=দেবাশ্চ দেব্যশ্চ, এক শেষ "পুমান্ স্ত্রিয়া" (অষ্টা০ ১।২।৬৭)] [ব্যাখ্যা - বর বধূকে বলে, আমি নিজের সৌভাগ্যের জন্য তোমার জলগ্রহণ করি। পত্নী বিনা পুরুষের সৌভাগ্য হয় না। বর্তমান রীতিনীতিতে পতির কারণে পত্নীকে সৌভাগ্যবতী বলা হয়। মন্ত্রের অনুসারে পত্নী বিনা পতিও সৌভাগ্যবান্ হয় না, পতি উত্তম ভগ-এর নিবাস হয় না। "গার্হপত্যায়" দ্বারা সূচিত করা হয়েছে পত্নী বিনা, পতি গৃহস্থাশ্রমসম্বন্ধী ধর্মকৃত্য-সমূহের অনুষ্ঠানের যোগ্য হয় না। পঞ্চমহাযজ্ঞ, দর্শপৌর্ণমাস আদি কর্ম পতি পত্নীর সহযোগিতা দ্বারাই হয়। শেষে পতি বলে, এই দেবতারা এবং দেবীগণ যারা আমাদের বিবাহের সাক্ষী- আমার প্রতি তোমাকে দিয়েছে।] [১. অর্যমা (অথর্ব০ ১৪।১।৩৯)]

ভগস্তে হস্তমগ্রহীৎ সবিতা হস্তমগ্রহী। 

পত্নী ত্বমসি ধর্মাহং গৃহপতিস্তব ॥ ৫১। 

পদার্থঃ (ভগঃ) ঐশ্বর্যবান্ [পরমাত্মা] (তে) তোমার (হস্তম্) হাত (অগ্রহীৎ) ধরেছেন [সহায়তা করেছেন], (সবিতা) সর্বোৎপাদক জগদীশ্বর (হস্তম্) হাত (অগ্রহীৎ) ধরেছেন। (ধর্মণা) ধর্ম অনুযায়ী, (ত্বম্) তুমি (পত্নী) [আমার] পত্নী [পালনকারী] (অসি) হও, (অহম্) আমি (তব) তোমার (গৃহপতিঃ) গৃহপতি [ঘরের পালনকারী] ॥৫১॥


পতি-পত্নী দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করুক, পরমেশ্বরের অনুগ্রহ দ্বারা আমরা দুজন মিলিত হয়েছি, আমরা দুজন মিলিত হয়ে গৃহাশ্রমে ধর্ম মার্গে চলবো এবং পরস্পর সহায়তা করবো ॥৫১॥

টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

হে বধু ! (ভগঃ) ভগ-সমূহ দ্বারা সম্পন্ন আমি অর্থাৎ বর (তে) তোমার (হস্তম্, অগ্রহীৎ) জলগ্রহণ করেছি, (সবিতা) উৎপাদনশক্তি সম্পন্ন তথা তোমার প্রেরক (হস্তম্, অগ্রহীৎ) তোমার জলগ্রহণ করেছে। (ত্বম্) তুমি (ধর্মণা) বৈদিক ধর্মানুসারে (পত্নী, অসি) আমার পত্নী হয়েছো, এবং (অহম্) আমি (তব) তোমার (গৃহপতিঃ) গৃহরক্ষক পতি হয়েছি।

[সবিতা্=সু, সূ=প্রসবে, প্রেরণে চ। বর নিজেকে গৃহপতি সম্বোধন করে বধূকে বিশ্বাস দেয় যে, আমি তোমার নবগৃহে তোমার রক্ষক হবো। তুমি এবং তোমার সন্তানরা আমার বিদ্যমানতায় অসুরক্ষিত অনুভব করবে না।]

মমেয়মস্তু পোষ্যা মহং হৃদদ বৃহস্পতিঃ। 

ময়া পত্যা প্রজাবতি সং জীব শরদঃ শতম্ ॥ ৫২। 

পদার্থঃ (ইয়ম্) এই [পত্নী]   (মম)  আমার  ( পোষ্যা)  পোষণযোগ্য (অস্তুন)  হোক, (মহ্যম্) আমাকে (ত্বা) তোমাকে (বৃহস্পতিঃ) বড়ো লোক-সমূহের স্বামী [পরমাত্মা] (অদাৎ) দিয়েছেন। (প্রজাবতি) হে শ্রেষ্ঠ প্রজাসম্পন্না ! তুমি (ময়া পত্যা) আমার অর্থাৎ পতির সাথে (সম্) মিলে (শতম্) শত (শরদঃ) বর্ষ পর্যন্ত (জীব) জীবিত থাকো ॥৫২॥

পতির উচিত বস্ত্র, অলঙ্কার আদি পদার্থ দ্বারা পত্নীর সন্মান করতে থাকা, যাতে দম্পতি প্রসন্ন থেকে সন্তান আদির পালন-পোষণ করে পূর্ণ আয়ু ভোগ করুক ॥৫২॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (ইয়ম্) এই বধূ (মম) আমার (পোষ্যা) পোষণীয়া (অস্তু) হোক, হে বধু ! (বৃহস্পতিঃ) বেদের বিদ্বান্ পুরোহিত বা মহাব্রহ্মাণ্ডের পতি পরমেশ্বর (মহ্যম্) আমার প্রতি (ত্বা) তোমাকে (অদাৎ) দিয়েছে। (ময়া পত্যা) আমার, পতি দ্বারা (প্রজাবতি) হে উৎকৃষ্ট ভাবী সন্তানসম্পন্না ! তুমি (সম্) আমার সাথে (শতম্, শরদঃ) শত বর্ষের আয়ু পর্যন্ত (জীব) জীবিত থাকো।

[বৃহস্পতিঃ = বৃহস্পতি র্বৈ দেবানাং পুরোহিতঃ (ঐত০ ব্রা০ ৮।২৬)] [ব্যাখ্যা — মন্ত্রের প্রথমার্ধ দ্বারা বর বিবাহ মণ্ডপে উপস্থিত জনতার প্রতি বলে, এই বধূ আমার দ্বারা পোষ্যা হবে। আমি সদা এই বধূর ভরণ-পোষণ করতে থাকবো। তথা উত্তরার্ধ দ্বারা বধূকে বলে, আমার থেকে ভিন্ন কোনো পরপুরুষ দ্বারা তুমি প্রজাবতী হবে না।]

ত্বষ্টা বাসো ব্যদধাঙ্গুভে কং বৃহম্পতেঃ প্রশিষা কবীনাম। 

তেনেমাং নারীং সবিতা ভগশ্চ সূর্যামিব পরি ধত্তাং প্রজয়া ৷৷ ৫৩৷৷ 

পদার্থঃ (ত্বষ্টা) সূক্ষ্মদর্শী [আচার্য] (বৃহস্পতেঃ) বড়ো বেদবাণীর রক্ষিকা [বৃহস্পতি পদবীসম্পন্না স্ত্রী-এর] (শুভে) শুভ [আনন্দের] জন্য (কবীনাম্) বুদ্ধিমানদের (প্রশিষা) অনুমতিতে (কম্) আনন্দ সহিত (বাসঃ) বস্ত্র (বি) বিশেষ করে (অদধাৎ) দিয়েছে। (তেন) এই কারণে (সূর্যাম্ ইব) সূর্যের চমকের সমান [শোভায়মান] (ইমাম্ নারীম্) এই নারী [নর-এর পত্নীকে] (সবিতা) প্রেরক বিদ্বানদের সমূহ (চ) এবং (ভগঃ) ঐশ্বর্যবান্ পতি, উভয়ই (প্রজয়া) প্রজা [সন্তান সেবক আদির] সাথে (পরি) সবদিক থেকে (ধত্তাম্) ধারণ করুক ॥৫৩॥

যে বিদুষী স্ত্রী বিদ্যা প্রাপ্ত করে বিদ্বানদের সমাজে বৃহস্পতি, স্নাতক আদি পদবী নিয়ে বিদ্যাসূচক বস্ত্র প্রাপ্ত করেছে, বিদ্বানগণ এবং পতি তাঁর সদা প্রতিষ্ঠা করুক, যাতে সে উত্তম প্রজাসম্পন্না হয় ॥৫৩॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (বৃহস্পতেঃ) বেদের বিদ্বান্ পুরোহিতের তথা (কবীনাম্) বিদ্বানদের (প্রশিংষা) প্রশাসন অর্থাৎ আজ্ঞা বা নির্দেশ দ্বারা, (ত্বষ্টা) কারীগর (শুভে) শোভার জন্য (কম্) সুখদায়ক (বাসঃ) বস্ত্র (ব্যদধাৎ) নির্মিত করেছে, (তেন) সেই বস্ত্র দ্বারা (সবিতা) বধূর উৎপাদক পিতা, (চ) এবং (ভগঃ) ভগসম্পন্ন বর; অর্থাৎ এই দুজন, (সূর্যাম্, ইব) সূর্যাকে যেমন, তেমন (ইমাম্, নারীম্) এই বিবাহিত নারীকে (প্রজয়া) সন্তান সমেত (পরি ধত্তাম্) আবৃত করুক।

[ব্যাখ্যা- বধূপক্ষ এবং বরপক্ষের পুরোহিতদের তথা বিদ্বানদের নির্দেশানুসারে বধূর বস্ত্র নির্মাণ করার আজ্ঞা কারীগরদের দেওয়া উচিৎ। বধূর পিতা, তথা বধূর বর, দুজনেই বস্ত্রকে বধূ এবং তাঁর ভাবী সন্তানদের পরিধানের জন্য প্রদান করুক। বস্ত্র শোভাজনক হওয়া উচিত, তথা সুখদায়কও। কেবল শোভা জনক নয়। সূর্যামিব= মন্ত্রগুলোতে আদিত্য-ব্রহ্মচারী তথা সূর্যা-ব্রহ্মচারিণীর বিবাহের বর্ণনা মুখ্যরূপে হয়েছে। ইহা আদর্শ বিবাহ। "সূর্যামিব" দ্বারা তদভিন্ন নীচু ব্রহ্মচারিণীদের তথা নীচু ব্রহ্মচারীদের বিবাহও বেদাভিমত দর্শানো হয়েছে। এই বর-বধূ রুদ্র তথা বসু কোটির।]

ইন্দ্রাগ্নী দ্যাবাপৃথিবী মাতরিশ্বা মিত্রাবরুণা ভগো অশ্বিনোভা। 

বৃহস্পতির্মরুততা ব্ৰহ্ম সোম ইমাং নারীং প্রজয়া বধয়ন্তু ॥ ৫৪

পদার্থঃ (ইন্দ্রাগ্নী) বিদ্যুৎ এবং ভৌতিক অগ্নি, (দ্যাবাপৃথিবী) সূর্য এবং ভূমি, (মিত্রাবরুণা) প্রাণ এবং অপান, (উভা) উভয়ই (অশ্বিনা) দিন এবং রাত্রি, (মাতরিশ্বা) আকাশে প্রবাহিত [সূত্রাত্মা বায়ু], (বৃহস্পতিঃ) বড়ো লোক-সমূহের রক্ষক [আকাশ], (সোমঃ) চন্দ্র, (ভগঃ) সেবনীয় যশ (ব্রহ্ম) অন্ন, এবং (মরুতঃ) বিদ্বানগণ (ইমাম্ নারীম্) এই নারীকে (প্রজয়া) প্রজা [সন্তান, সেবক আদি] দ্বারা (বর্ধয়ন্তু) বর্ধন করুক ॥৫৪॥

বিদুষী স্ত্রী এবং বিদ্বান্ পুরুষের উচিত, সংসারের সব পদার্থকে উপযোগী করে সন্তান আদিকে বৃদ্ধিযুক্ত করা ॥৫৪॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (ইন্দ্রাগ্নী) বিদ্যুৎ এবং অগ্নি, (দ্যাবাপৃথিবী) চমকিত সূর্য তথা বিস্তৃত ভূমি, (মাতরিশ্বা) অন্তরিক্ষীয় বায়ু, (মিত্রাবরুণা) দিন এবং রাত, (ভগঃ) ঐশ্বর্য আদি ছয়টি ভগ, (উভা) উভয় (অশ্বিনা) সূর্য এবং চন্দ্র, (বৃহস্পতিঃ) বেদের বিদ্বান্ পুরোহিত, (মরুতঃ) মৌসুমী বায়ু, (ব্রহ্ম) বেদস্বাধ্যায়, (সোমঃ) বীর্যরক্ষা তথা সোম আদি ঔষধি-সমূহের সেবন, – (ইমাম্, নারীম্) এই নারীকে (প্রজয়া) প্রজাসমেত (বর্ধয়ন্তু) বর্ধিত করুক।

[ইন্দ্রঃ=ইন্দ্রঃ অন্তরিক্ষস্থানঃ (নিরু০ ৭।২।৫), অর্থাৎ ইন্দ্রের স্থান হল অন্তরিক্ষ। অতঃ ইন্দ্র=বিদ্যুৎ। মাতরিশ্বা = বায়ুঃ; "মাতর্যন্তরিক্ষে শ্বসিতি, মাতর্যাশ্বনিতীতি বা" (নিরু০ ৭।৭।২৬)। মিত্রাবরুণা=অহোরাত্রৌ (তাং০ ২৫।১০।১০)। ভগঃ- ঐশ্বর্য, ধর্ম, জ্ঞান, বৈরাগ্য। অশ্বিনা= সূর্যাচন্দ্রমসাবিত্যেকে (নিরু০ ১২।১।১)। মরুতঃ= মৌসুমী বায়ু। যথা "অপঃ সমুদ্রাদ্দিবমুদ্বহন্তি দিবস্পৃথিবীমভি যে সৃজন্তি। যে অদ্ভিরীশানা মরুতশ্চরন্তি তে নো মুঞ্চন্ত্বংহসঃ ॥" (অথর্ব০ ৪।২৭।৪)। ব্রহ্ম= বেদ স্বাধ্যায় (অথর্ব০ ১৪।১।১।৬৪)। সোমঃ = উৎপাদক বীর্য, রজস্ (অথর্ব০ ১৪।১।১।২-৫), তথা সোম ঔষধি] [ব্যাখ্যা - স্বাস্থ্য-বর্ধনের জন্য প্রথম সাধন দর্শানো হয়েছে ইন্দ্র অর্থাৎ বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ দ্বারা চিকিৎসা তথা গৃহ্যপ্রয়োগে ইহার ব্যবহার। অপর সাধন হল অগ্নি। অগ্নিহোত্র এবং ঋতুযজ্ঞের দ্বারা, তথা গার্হপত্যাগ্নি দ্বারা ঘর তথা বাইরের বায়ুমণ্ডলের শুদ্ধি। তৃতীয় সাধন হল দ্যৌঃ, অর্থাৎ কক্ষে প্রকাশের বিদ্যমানতা অর্থাৎ সূর্যের কিরণের প্রবেশ। চতুর্থ সাধন হল পৃথিবী। স্বাস্থ্যবর্ধনের জন্য গৃহের ভূমি বিস্তৃত হওয়া উচিত, তথা ঘর স্বাস্থ্যকারী ভূমিতে তৈরি করা উচিত। পৃথিবী= প্রথ বিস্তারে। পঞ্চম সাধন হল মাতরিশ্বা অর্থাৎ বায়ু। গৃহের এই বিধিতে নির্মাণ করা হোক যাতে গৃহে বায়ুর সঞ্চার হতে পারে। ষষ্ঠ সাধন হল দিন এবং রাতের নিয়মপূর্বক সৃষ্টি। দীর্ঘ দিন তথা দীর্ঘ রাতবিশিষ্ট প্রদেশে স্বাস্থ্য ঠিক থাকতে পারে না। যেমন উত্তরধ্রুব, দক্ষিণধ্রুব তথা এগুলোর সমীপের প্রদেশ। সপ্তম সাধন হল ভগ অর্থাৎ ঐশ্বর্য, ধর্মানুসারে জীবন, স্বাস্থ্য বিধির পরিজ্ঞান, এবং গৃহজীবনেও বৈরাগ্য অর্থাৎ অতিভাগ থেকে বিরাম। সূর্য এবং চন্দ্রের প্রকাশের সেবনও স্বাস্থ্যবর্ধক। এইভাবে পুরোহিত-প্রথার অব্যাহত রাখা অর্থাৎ পুরোহিতদের দ্বারা ঘরে ধার্মিক কৃত্য, যজ্ঞ তথা সংস্কার করাতে থাকা। মৌসুমী বায়ু চিত্তকে প্রসন্ন করে, গ্রীষ্ম ঋতুর উষ্ণতাকে কম করে, কৃষিকর্ম বৃদ্ধি করে, অন্ন এবং ও ঔষধি-সমূহ উৎপন্ন, যেগুলোর সেবনে স্বাস্থ্য বৃদ্ধি হয়। এইভাবে ব্রহ্মোপাসনা, তথা বৈদিক স্বাধ্যায় দ্বারা স্বাস্থ্যবর্ধক সাধনের পরিজ্ঞানে স্বাস্থ্যবৃদ্ধি হয়। সোমশক্তির সংযম পূর্বক-প্রয়োগ তথা সোম আদি ঔষধি-সমূহের সেবনেও স্বাস্থ্যবৃদ্ধি হয়।

বৃহস্পতিঃ প্রথমঃ সূর্যায়ঃ শীর্ষে কেশাঁ অকল্পয়ৎ। 

তেনেমামশ্বিনা নারীং পত্যে সং শোভয়ামসি ॥ ৫৫৷৷ 

পদার্থঃ (প্রথমঃ) প্রথম থেকেই বর্তমান (বৃহস্পতিঃ) বড়ো-বড়ো লোক-সমূহের স্বামী [পরমেশ্বর] (সূর্যায়াঃ) প্রেরক [বা সূর্যের চমকের সমান তেজসম্পন্না] কন্যার (শীর্ষে) মস্তকে (কেশান্) কেশগুলোকে (অকল্পয়ৎ) সৃষ্টি করেছেন। (তেন) এই [কারণে] (অশ্বিনা) হে বিদ্যা প্রাপ্ত দুজন [স্ত্রী-পুরুষের সমাজ !] (ইমাম্ নারীম্) এই নারীকে (পত্যে) পতির জন্য (সম্) ঠিক-ঠিক (শোভয়ামসি) আমরা শোভায়মান করি ॥৫৫॥

পরমেশ্বর মস্তকের কেশ এবং তেমনই শরীরের অঙ্গ-সমূহকে নিজ-নিজ প্রয়োজনের জন্য হৃষ্টপুষ্ট করেছে। গুরুজনদের উচিত বধূ-বরকে সংসারের হিতের জন্য বিদ্যা সুশীলতা আদি দ্বারা সুশিক্ষিত করা যাতে নিজের শরীরের অঙ্গ-সমূহকে হৃষ্টপুষ্ট রাখে ॥৫৫॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (প্রথমঃ) অনাদিকাল থেকে বিদ্যমান (বৃহস্পতিঃ) মহাব্রহ্মাণ্ড তথা মহতী বেদবাণীর পতি পরমেশ্বর, (সূর্যায়াঃ) এই সূর্যা ব্রহ্মচারিণীর (শীর্ষে) মস্তকে/মাথায় (কেশান্) কেশের (অকল্পয়ৎ) নির্মাণ করেছিল। (অশ্বিনা) হে বরের বা বধূর মাতা-পিতা ! (তেন) সেই কেশকলাপ দ্বারা (ইমাম্, নারীম্) এই নারীকে, (পত্যে) পতির জন্য, (সম্, শোভয়ামসি) আমরা সম্যক্ প্রকারে শোভায়মান করি।

[বৃহস্পতিঃ= পরমেশ্বর বৃহতী বেদবাণীর পতি যথা "বৃহস্পতে প্রথমং বাচো অগ্রং যৎপ্রৈরত নামধেয়ং দধানাঃ" (ঋ০ ১০।৭১।১) এ বাণী-সমূহের অগ্রবাণী অর্থাৎ বেদবাণীর সম্পর্ক বৃহস্পতির সাথে দর্শানো হয়েছে। বিবাহের সময় বৃহস্পতি অর্থাৎ পুরোহিতের নির্দেশানুসারে কন্যার সম্বন্ধী কন্যার কেশগুচ্ছকে সজ্জিত করে কন্যার শোভা বৃদ্ধি করুক যাতে পতির অনুরাগ তাঁর ওপর/প্রতি হয়/হতে পারে।]

ইদং তদ্রপং যদবস্ত যোষা জায়াং জিজ্ঞাসে মনসা চরন্তী। 

মন্বর্তিষ্যে সখিভিনবশ্বৈঃ ক ইমান বিদ্বান্ বি চচৰ্ত পাশা৷ ৫৬। 

পদার্থঃ (ইদম্) এই (তৎ) সেই (রূপম্) রূপ [সুন্দরতা এবং স্বভাব], (যৎ) যা (যোষা) সেবনীয় (বধূ) (অবস্ত) ধারণ করেছে, (মনসা) বিজ্ঞানসহিত (চরন্তীম্) চলে/গমন করে (জায়াম্) পত্নীকে (জিজ্ঞাসে) আমি জানতে চাই। (নবগ্বৈঃ) স্তুতিযোগ্য চরিত্রসম্পন্না অথবা নবীন-নবীন বিদ্যা প্রাপ্ত করার এবং করানোর জন্য (সখিভিঃ) মিত্রদের সহিত (তাম্ অনু) সেই [পত্নীর] সাথে-সাথে (অর্তিষ্যে) আমি গমন করবো, (বিদ্বান্) বিদ্বান্ (কঃ) প্রজাপতি [পরমেশ্বর] (ইমান্ পাশান্) এই [অবিদ্যার] পাশ/ফাঁদকে (বিচচর্ত) বিমোচন করে দিয়েছি ॥৫৬॥

বিদ্যা সুশীলতা আদিগুণ দ্বারা সুভূষিত পতি-পত্নী সুযোগ্য ইষ্ট মিত্রদের সহিত শুভ গুণ-সমূহের আদর করে পরস্পরের হিত করুক এবং পরমেশ্বরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করুক যার অনুগ্রহ দ্বারা এমন শুভ সুযোগ প্রাপ্তি হয়েছে ॥৫৬॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (ইদম্) ইহা (তদ্, রূপম) সেই রূপ-সৌন্দর্য (যদ্) যা (যোষা) স্ত্রী জাতি (অবস্ত) বস্ত্র আদি দ্বারা ধারণ করে। (মনসা) মনন শক্তি দ্বারা বিচার-শীলা (জায়াম্) জায়া অর্থাৎ পত্নীর (জিজ্ঞাসে) আমি জিজ্ঞাসু। (নবগ্বৈঃ) প্রশংসনীয় চাল-চলনসম্পন্ন (সখিভিঃ) নিজের মিত্রদের সাথে (তাম্) সেই জায়া-এর (অনু) অনুকূলে (অর্তিষ্যে) আমি চলবো, বা তাঁর অনুবর্তী হবো। (বিদ্বান্) জ্ঞানী (কঃ) প্রজাপতি (ইমান্) এই (পাশান্) প্রেমপাশ/বন্ধনকে (বি চচর্ত) বিশেষরূপে গ্রথিত করেছে, দৃঢ়বদ্ধ করেছে।

[অন্বর্তিষ্যে=অনু + ঋৎ১ (বৃৎ) অনুবর্তিষ্যে। নবগ্বৈঃ=নব (নূ স্তুতৌ) + গু (গতি)। কঃ=কো বৈ নাস প্রজাপতিঃ (ঐ০ ব্রা০ ৩।২১)। বি চচর্ত=চৃতী গ্রন্থনে (তুদাদি)] [ব্যাখ্যা- কেশসম্বারণ তথা শোভাজনক বস্ত্রের দ্বারা উৎপন্ন নারীর রূপসৌন্দর্যের বিষয় স্মরণে রেখে বর বলে, এই সম্পদও এক বাস্তবিক সম্পদ্ যা নারীর মধ্যে থাকা আবশ্যক। কিন্তু কেবল এই এক শারীরিক সম্পৎ দ্বারা গৃহস্থ জীবন সুখময় হতে পারে না। এর জন্য এটা আবশ্যক যে, পত্নীর মধ্যে মানসিক বিচার শক্তিও থাকবে, সে মননশীলা এবং বিচারশীলা হবে, যাতে গৃহ্য তথা সামাজিক কর্ত্তব্য সে বিচারপূর্বক পূরণ করতে পারে। বেদ অনুসারে বর এমনই বধূর জিজ্ঞাসু। বর বলে, এমন বধূর তো আমি অনুবর্তী হয়ে যাবো। কেননা বিচারশীলা বধূ নিজের হার্দিক প্রেম তথা উত্তম বিচারের কারণে পতিকে নিজের অনুকূল করে নেয়। পত্নীকে সামাজিক জীবন থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়। পতির মিত্রদের সাথেও পত্নীর পরিচয় করিয়ে দেওয়া উচিৎ। পতির মিত্র এমন হওয়া উচিত, যে/যারা স্তুত্য আচার-বিচারশীল অর্থাৎ সদাচারী হবে। দুরাচারী মিত্রদের সঙ্গ দ্বারা দুরাচারের পঙ্ক/কাদায় পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে। এবং না দুরাচারী পরিচিতদের পত্নীর পরিচয় করানো উচিত। পরে বর প্রেমবন্ধনগুলোর স্বাভাবিকতার দিকে দৃষ্টিপাত করে, এবং এই প্রেমবন্ধনগুলোর গরিমাকে অনুভব করে বলে, বাস্তবে এই প্রেমবন্ধনগুলোতে বন্ধনকারী হলেন স্বয়ং প্রজাপতি পরমেশ্বর যিনি ষ বিদ্বান্ অর্থাৎ এই রহস্যগুলোর তত্ত্ববেত্তা। বর অনুভব করে যে, প্রজাপতি এই প্রেমবন্ধনগুলোকে নিষ্প্রয়োজনে আবদ্ধ করেননি। এই প্রেমবন্ধনগুলোর ছাড়া গৃহস্থ জীবন তথা সামাজিক জীবন নিঃসার হয়ে যায়, রুক্ষ-শুষ্ক হয়ে যায়।] [১. সম্ভবতঃ গত্যর্থক "ঋৎ" বৈদিক ধাতু।]

অহং বি ষ্যামি ময়ি রূপমস্যা বেদদিৎ পশ্য মনসঃ কুলায়ম্। 

ন স্তেয়মদ্মি মনসোদমুচ্যে স্বয়ং শ্যুনো বরুণস্য পাশা৷ ৫৭৷ 

পদার্থঃ (অস্যাঃ) এই [পত্নীর] (রূপম্) রূপ [স্বভাব বা সৌন্দর্যকে] (মনসঃ) নিজের মনের (কুলায়ম্) আধার (বেদৎ) জেনে এবং (পশ্যন্) অবলোকন করে (ইৎ) ই (অহম্) আমি [বর] (ময়ি) নিজের মধ্যে (বি ষ্যামি) নিশ্চিতরূপে ধারণ করি। (স্তেয়ম্) চুরির পদার্থকে (ন) না (অদ্মি) ভক্ষণ করি, (মনসা) অন্তঃকরণ দ্বারা/বিজ্ঞান দ্বারা (বরুণস্য) আবরণ [অর্থাৎ বিঘ্নের] (পাশান্) পাশ/ফাঁদকে (স্বয়ম্) স্বয়ং [অর্থাৎ পুরুষার্থ দ্বারা] (শ্রথ্নানঃ) আলগা/শিথিল করে (উৎ অমুচ্যে) আমি মুক্ত হয়েছি ॥৫৭॥

বিদ্বান্ পতি-পত্নী পরস্পর উত্তম গুণ স্বভাবকে হৃদয়ে ধারণ করে বিচারপূর্বক বিঘ্ন-সমূহ দূর করে নিষ্কপট হয়ে উন্নতি করুক ॥৫৭॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (অহম্) আমি পতি (অস্যাঃ) এই পত্নীর (রূপম্) স্বরূপকে (ময়ি) নিজের মধ্যে (বিষ্যামি) আবদ্ধ করি, (মনসঃ) নিজের মনরূপী পক্ষীর (কুলায়ম্) নীড় (বেদৎ) এই পত্নীকে জেনে, (পশ্যন্) এবং দেখে। (স্তেয়ম্) পত্নীর থেকে লুকিয়ে (ন অদ্মি) আমি না ভক্ষণ করি। (মনসা) মন থেকে অর্থাৎ স্বেচ্ছাপূর্বক (উদ্ অমুচ্যে) লুকিয়ে খাওয়া আমি ত্যাগ করি, এইভাবে (বরুণস্য) শ্রেষ্ঠ পরমেশ্বরের (পাশান্) প্রেমবন্ধনগুলোকে (স্বয়ম্) স্বয়ং অর্থাৎ স্বেচ্ছাপূর্বক (শ্রথ্নানঃ)১ আমি দৃঢ়বদ্ধ করি।

[বিষ্যামি= বি (বিশেষতয়া) + ষিঞ্, (বন্ধনে)। (শ্রথ্নানঃ=শ্রথন = Tying, Binding (আপ্টে)] [ব্যাখ্যা— পতি বলে, আমি পত্নীর উভয় স্বরূপকে,- শারীরিক তথা মানসিক স্বরূপকে, নিজ হৃদয়ে আবদ্ধ করি। অভিপ্রায় হল, আমি এই স্বরূপগুলো সদা স্মরণে রেখে পত্নীব্রত মার্গ থেকে বিচলিত হবো না। পতি এটাও বলে, আমি নিজের মনরূপী পক্ষীর বাসা এই পত্নীকে জানছি/জেনেছি, এবং সাক্ষাৎ দেখছি। নীড়-এ পক্ষী নিজেকে সুরক্ষিত তথা নিশ্চিন্ত পায়, এইভাবে পতি বলে, বিচারশীলা এবং সৌন্দর্যের প্রতিমারূপ পত্নীকে প্রাপ্ত করে আমার মন বিচলিত হবে না। পতি এটাও প্রণ করে, সে পত্নীর থেকে লুকিয়ে কোনো অন্নভোগ করবে না, অপিতু আমরা দুজন খাদ্য-পানীয়ের সেবন একসাথে করবো। লুকিয়ে খাদ্য-পানীয়ের সেবন মানসিক বিচারকেও ত্যাগ দেওয়ার প্রণ পতি করে। "মনসোদমুচ্যে" - এর এটাই অভিপ্রায়। পরে পতি বলে, এইভাবে স্বয়ং আমি গৃহস্থ জীবনে পরমেশ্বরীয় প্রেমপাশগুলোকে দৃঢ় বদ্ধ করতে থাকবো, যাতে আমাদের মধ্যে পারস্পরিক অনুরাগ বৃদ্ধি হতে থাকে, এবং আমাদের গৃহস্থজীবনে বিরাগ, দ্বেষ তথা পরস্পরোপেক্ষা-এর লেশমাত্রও না থাকে।] [১. ভাষ্যকারেরা শ্রথ্নানঃ এর অর্থ করেছে, শিথিল করে, আলগা করে। এই অর্থ মন্ত্রোক্ত ভাবনার বিপরীত। পত্নীর স্বরূপকে চিত্তে আবদ্ধ করা তাঁকে নিজের মনের বাসা জানা তথা পৃথক্ অন্নগ্রহণের বিচারও ন করা,- ইহার দ্বারা প্রেমপাশ দৃঢ় হয়, শিথিল নয়।]

প্র ত্বা মুঞ্চামি বরুণস্য পাশাদ যেন ত্বাবধাৎ সবিতা সুশেবাঃ। 

উরুং লোকং সুগমত্র পন্থাং কৃপোমি তুভ্যং সহপত্নৈ বধু ৷৷ ৫৮

পদার্থঃ [হে বধূ !] (ত্বা) তোমাকে (বরুণস্য) আবরণ [বিঘ্নের] (পাশাৎ) বন্ধন থেকে (প্র মুঞ্চামি) আমি [বর] উত্তমরূপে মুক্ত করি, (যেন) যার সাথে (ত্বা) তোমাকে (সুশেবাঃ) অত্যন্ত সেবাযোগ্য (সবিতা) জন্মদাতা পিতা (অবধ্নাৎ) বেঁধেছে। (বধু) হে বধূ ! (সহপত্ন্যৈ) পতির সাথে বর্তমান (তুভ্যম্) তোমার জন্য (অত্র) এখানে [গৃহাশ্রমে] (উরুম্) প্রশস্ত (লোকম্) ঘর এবং (সুগম্) সুগম (পন্থাম্) মার্গ (কৃণোমি) আমি [পতি] করি ॥৫৮॥

যে কন্যাকে পিতা যোগ্য পতির প্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত গতি স্তব্ধ করেছিল, সেই কন্যা যোগ্য পতির সাথে সুখপূর্বক সুপ্রবন্ধ করে গৃহাশ্রমের কর্তব্য করুক এবং তেমন পতিও পুরুষার্থ করে পত্নীর সাথে প্রীতিপূর্বক থাকুক ॥৫৮॥ এই মন্ত্রের পূর্বার্দ্ধ মন্ত্র ১৯ এ আছে॥৫৮॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (বধু) হে বধু ! (বরুণস্য) শ্রেষ্ঠ পরমেশ্বরের (পাশাৎ) সেই প্রেমবন্ধন থেকে (ত্বা) তোমাকে (প্র মুঞ্চামি) আমি বর প্রমুক্ত করি, মুক্ত করি, (যেন) যে-পাশ/বন্ধন দ্বারা (সুশেবাঃ) উত্তম-সুখদায়ক (সবিতা) জন্মদাতা তোমার পিতা (ত্বা) তোমাকে (অবঘ্নাৎ) নিজের সাথে বেঁধেছিল। হে বধু ! (সহপত্ন্যৈ) পতির সাথে অবস্থানকারী (তুভ্যম্) তোমার জন্য (উরুম্) বিস্তৃত (লোকম্) তথা দর্শনীয় নিজের ঘরকে এবং (অত্র) এই ঘরে (পন্থাম্) আসা-যাওয়ার মার্গকে (সুগম, কৃণোমি) আমি পতি সুগম অর্থাৎ বাধারহিত করি।

[সুশেবাঃ=সু (উত্তম) + শেবম্ সুখনাম (নিঘং০ ৩।৬)। লোকম্= লোক দর্শনে (স্বাদি)] [ব্যাখ্যা – সন্তানের সাথে মাতা-পিতার প্রেম স্বাভাবিক হয়। এই প্রেম পরমেশ্বর দ্বারা স্বাভাবিক করা হয়েছে। এই প্রেম পরমেশ্বরীয় পাশ, বন্ধন, যার দ্বারা গৃহস্থ ব্যক্তি পরস্পর বাঁধা থাকে। সকল মাতা-পিতা স্বভাবতঃ নিজের সন্তানদের ভালোবাসে। এটাই কারণ যে, সন্তানরাও মাতা-পিতার প্রেমবন্ধনে বাঁধা থাকে। বিবাহের পর কন্যা যখন পতিগৃহে যায় তখন তাঁকে নিজের মাতা-পিতার স্বাভাবিক প্রেমবন্ধন আলগা করতে হয়। এই ক্ষতির পূর্তি, পতি দ্বারা প্রদত্ত প্রেমবন্ধন দ্বারাই হতে পারে। পতি এইজন্য নিজের পত্নীকে বলে, তোমার পিতা তোমাকে নিজের স্বাভাবিক প্রেমবন্ধন দ্বারা নিজের সাথে আবদ্ধ করে রেখেছিল, সেই প্রেমবন্ধন থেকে আমি তোমাকে মুক্ত করি, এবং নিজের প্রেমবন্ধনে তোমাকে আবদ্ধ করি।]

উদ্যচ্ছধ্বমপ রক্ষো হনাথেমাং নারীং সুকৃতে দত। 

ধাতা বিপশ্চিৎ পতিমস্যৈ বিবেদ ভগো রাজা পুর এতু প্রজান ॥ ৫৯। 

পদার্থঃ [হে বীরগণ ! শস্ত্র-সমূহ] (উৎ যচ্ছধ্বম্) ওঠাও/উত্থিত করো, (রক্ষঃ) রাক্ষসকে (অপ হনাথ) মেরে দূর করো, (ইমাং নারীম্) এই নারী [নর-এর পত্নীকে] (সুকৃতে) সুকৃত [পুণ্য কর্মে] (দধাত) ধারণ করো। (বিপশ্চিৎ) বুদ্ধিমান্ (ধাতা) ধারণকারী [পরমেশ্বর] (অস্যৈ) এই [বধূর] জন্য (পতিম্) পতি (বিবেদ) প্রাপ্ত করিয়েছে, (প্রজানন্) প্রথম থেকে জ্ঞাতা (রাজা) প্রকাশমান (ভগঃ) ঐশ্বর্যবান্ [পরমাত্মা] (পুরঃ) অগ্রে (এতু) প্রাপ্ত হোক॥৫৯॥

ধর্মাত্মা বীরগণ প্রচেষ্টা পূর্বক বিঘ্ন থেকে পৃথক্ করে বধূ-বরকে ধর্মে প্রবৃত্ত রাখুক, এবং পরমাত্মার সদা ধ্যান করুক যে, যিনি কৃপা করে বিদ্বান্ পতি-পত্নীকে মিলিত করিয়েছেন, তিনি তাঁদের সদা সহায়তা করুক॥৫৯॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (উদ্ যচ্ছধ্বম্) উদ্যম করো, (রক্ষঃ) রাক্ষসকে (অপ হনাথ) অপগত করো, দূর করো, বা তার হনন করো, (ইমাম্) এই (নারীম্) নারীকে (সুকৃতে) সুকর্মে (দধাত) নিয়োজিত করো। (বিপশ্চিৎ) মেধাবী (ধাতা) বিধাতা (অস্যৈ) এই নারীর জন্য (পতিম্) পতি (বিবেদ) প্রাপ্ত করিয়েছেন, (ভগঃ) ঐশ্বর্যাদি সম্পন্ন (রাজা) এই সম্রাজ্ঞীর সম্রাট্ অর্থাৎ পতি (প্র জানন্) গৃহস্থধর্মের কর্তব্য-সমূহকে জেনে (পুরঃ) কর্তব্যপথে সামনে-সামনে (এতু) এগিয়ে চলুক, আগমন করুক।

[রক্ষঃ= কামগ্রাম (গ্রাহ) রূপী রাক্ষস [অথর্ব০ ১৪।১।৩৮]। হনাথ= হন্ গতৌ। নিঘণ্টুতে হন্ ধাতুর প্রয়োগ "গতি" এর জন্য হয়েছে। যথা হনতি, হন্তাৎ, হন্তি, =গতি কর্মাণঃ (২।১৪)। কিন্তু হন্ এর অর্থ হিংসাও হয়। বিপশ্চিৎ মেধাবিনাম (নিঘং০ ৩।১৫)] [ব্যাখ্যা- গৃহস্থজীবনে মাতা-পিতা আদি গুরুজনদের উদ্যমী হওয়া উচিত, তবেই তাঁদের সন্তানরাও উদ্যমী হবে। গৃহস্থধর্ম পালন করেও কামগ্রাহকে নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিৎ। অনিয়ন্ত্রিত কামগ্রাহ হল রাক্ষস। গৃহস্থের গুরুজনদের কর্তব্য হল, নিজেদের সুকর্মে নিয়োজিত করা, তবেই নবাগত নারীকেও সুকর্মে নিয়োজিত করতে পারবে। অর্থাৎ নিজেদের জীবনের দৃষ্টান্ত দ্বারা তাঁরা নববধূকেও উদ্যমী তথা নিজের রাক্ষসী ভাব এবং রাক্ষসী কর্মের বিনাশকারী করুক। পতি গৃহস্থের কর্ত্তব্যপথ সম্পর্কে জানুক। সেই পথে পতি স্বয়ং প্রথমে গমন করুক। এর দ্বারা পত্নীও কর্ত্তব্যপথে অগ্রসর হবে। গৃহস্থে পতির জীবনের প্রভাব পত্নীর জীবনের ওপর পড়ে। মন্ত্রে পতিকে রাজা বলা হয়েছে। অতঃ পত্নী হল রাজ্ঞী। মন্ত্র ৪৩,৪৪ এ পত্নীকে সম্রাজ্ঞী বলা হয়েছে, এইজন্য পতি হল সম্রাট্। গৃহস্থের রাজ্যে এই দুজন সম্রাট্ তথা সম্রাজ্ঞী। মন্ত্রে এটাও দর্শানো হয়েছে ঈশ্বর পত্নীকে পতি প্রদান করেছেন। বৈদিক বিবাহপদ্ধতিতে পতি এবং পত্নীর হৃদয়ে এই ভাবনা সদা জাগরূক থাকা উচিত যে, পতির পত্নীকে প্রাপ্ত করা, তথা পত্নীর পতিকে প্রাপ্ত করা,– এর মধ্যে পরমেশ্বরীয় ইচ্ছা কাজ করে; অতঃ পতি-পত্নী পরস্পর প্রেম বৃদ্ধি করে গৃহস্থধর্মের পালন করতে থাকুক, একে অপরের থেকে পৃথক্ না হোক তথা পরস্পর সমপর্ক বিচ্ছেদের কথা যেন না ভাবে।]

ভগস্ততক্ষ চতুরঃ পাদা ভগস্ততক্ষ চত্বাযুলানি। 

ত্বষ্টা পিপেশ মধ্যতোহনু বর্ধানৎসা নো অস্তু সুমঙ্গলী ॥ ৬০৷৷ 

পদার্থঃ (ভগঃ) ভগবান্ [ঐশ্বর্যবান্ জগদীশ্বর] (চতুরঃ) চার [ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ রূপ] (পাদান্) প্রাপ্তিযোগ্য পদার্থ (ততক্ষ) রচনা করেছেন, (ভগঃ) ভগবান্ (চত্বারি) চার [ব্রহ্মচর্য, গৃহস্থ, বানপ্রস্থ এবং সন্ন্যাস আশ্রম রূপ] (উষ্পলানি) হিংসা থেকে উদ্ধারকারী কর্ম (ততক্ষ) রচনা করেছেন। (ত্বষ্টা) বিশ্বকর্মা [পরমেশ্বর] (মধ্যতঃ) মাঝে [স্ত্রী-পুরুষের ভেতরে] (বর্ধ্রান্) বৃদ্ধি ব্যবহারের (অনু) অনুকূল (পিপেশ) ব্যবস্থা করেছেন, (সা) সেই [বধূ] (নঃ) আমাদের জন্য (সুমঙ্গলী) সুমঙ্গলী [আনন্দ প্রদায়ী] (অস্তু) হোক ॥৬০॥

পরমেশ্বর বেদ দ্বারা ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ এবং সেগুলোর সাধন ব্রহ্মচর্য আদি আশ্রমের উপদেশ করে সংসারের উপকারের জন্য স্ত্রী-পুরুষদের জ্ঞান এবং বুদ্ধি রূপ বৃদ্ধির সামর্থ্য প্রদান করেছেন ॥৬০॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (ভগঃ) সমগ্র ঐশ্বর্য, ধর্ম, যশ, শ্রী, জ্ঞান, এবং বৈরাগ্য সম্পন্ন পরমেশ্বর (চতুরঃ) পুরুষার্থের চার (পাদান্) পাদ (ততক্ষ) নির্মিত করেছেন, (ভগঃ) সেই পরমেশ্বর (চত্বারি, উষ্পলানি) জীবনের চারটি ক্ষণ/মুহূর্ত (ততক্ষ) নির্মিত করেছেন। (ত্বষ্টা) রূপ সৃষ্টিকারী কারীগর পরমেশ্বর (মধ্যতঃ) মাঝে-মাঝে/মধ্যে-মধ্যে/মাঝখানে-মাঝখানে (অনু) নিরন্তর (বর্ধ্রান্) দৃঢ় বন্ধনকে (পিপেশ) রূপ দিয়েছেন, অর্থাৎ জীবনে সুন্দর সুন্দর বন্ধন লাগিয়েছেন। (সা) সেই পত্নী (নঃ) আমাদের জন্য (সু মঙ্গলী) উত্তম মঙ্গলময়ী (অস্তু) হোক।

[ততক্ষ = ত্বক্ষ তনুকরণে। ত্বক্ষা এর অর্থ হল তক্ষক/কাঠমিস্ত্রি। তক্ষক কাঠ কেটে, তাকে তনূকৃত করে/আকৃতি দিয়ে চেয়ারও অনান্য আসবাবপত্র নির্মাণ করে। মন্ত্রে ততক্ষ শব্দ দ্বারা কেবল নির্মাণ অর্থ অভিপ্রেত হয়েছে। উষ্পলানি = বস্ + ক্বিপ্ + পলানি = উস্ + পলানি (বচিস্বপিয়জাদীনাং কিতি, অষ্টা০ ৬।১।১৫) দ্বারা বস্ (নিবাসে) এর "ব" কে "উ" সম্প্রসারণ হয়েছে। তদনন্তর (শাসিবসিঘসীনাং চ, অষ্টা০ ৮।৩।৬০ দ্বারা "উস্" এর "স্" এর "ষ্" হয়েছে। অতঃ উষ্ (নিবাস)। উষ্পলানি = নিবাস এর মুহুর্ত। ত্বষ্টা = রূপকৃত। যথা “য ইমে দ্যাবাপৃথিবী জনিত্রী রূপৈরপিংশদ্ ভুবনানি বিশ্বা। তমদ্য হোতরিষতো যজীয়ান্ দেবং ত্বষ্টারমিহ যক্ষি বিদ্বান্" (ঋ০ ১০।১১০।৯)। বর্ধ্রান্ = বর্ধ্র Aleather, strap (আপ্টে)। পিপেশ= পিশ্ অবয়বে। পেশ রূপনাম (নিঘং০ ৩।৭)] [ব্যাখ্যা- পূর্বের মন্ত্রগুলোতে ভগ দ্বারা, ছয়টি ঐশ্বর্যাদি গুণসম্পন্ন বর বা পতির গ্রহণ হয়েছে [মন্ত্র ২০, ৫১,৫৯], কিন্তু এই মন্ত্রে ভগ দ্বারা ভগবান পরমেশ্বরের বর্ণনা হয়েছে। পরমেশ্বর পুরুষার্থের চার পাদ নিশ্চিত করেছেন, - ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মোক্ষ। পরমেশ্বর জীবনেরও চারটি ভাগ নিশ্চিত করেছেন, - ব্রহ্মচর্য, গৃহস্থ, বানপ্রস্থ এবং সন্ন্যাস। এই হল চারটি আশ্রম। এর রচয়িতা কারীগর জীবনযাত্রায় সুন্দর সুন্দর বন্ধনগুলোকেও রচনা করে রেখেছেন। যে এই বন্ধনগুলোতে আবদ্ধ হয়েছে, সে জীবনযাত্রার লক্ষ্য থেকে ভ্রষ্ট হয়ে যায়। পত্নী যদি এই যাত্রার জন্য সুমঙ্গলী হয়, গৃহ্য মঙ্গলকার্যের সম্পাদনকারী হয় তবে পতি-পত্নী দুজনেই নিজেদের জীবনযাত্রায় সফল হতে পারে/পারবে। মন্ত্রে জীবনসম্বন্ধী প্রত্যেক আশ্রমকে মুহূর্ত বলা হয়েছে। চার আশ্রম জীবনকে চার মুহূর্ত বলা হয়েছে। যে ব্যক্তি কোনো আশ্রমেও থেকে এটা মনে করে যে, "সময় পর্যাপ্ত"; এবং নিজের কর্তব্যে প্রমাদী হয়ে যায় সে নিজের আশ্রমজীবনে সফলতা থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়। জানা নেই কখন মৃত্যু এসে ঘিরে ফেলবে। তাই বলা হয়েছে ''গৃহীত ইব কেশেষু মৃত্যুনা ধর্মমাচরেৎ"। বস্তুতঃ জীবনকে মুহূর্তে/ক্ষণের সদৃশ ক্ষণিক জেনে নিজ কর্ত্তব্যগুলোকে নিয়তকাল অনুসারে করা উচিত।]

সুকিংশুকং বহতুং বিশ্বরূপং হিরণ্যবৰ্ণং সুবৃতং সুচক্র। 

আ রোহ সূর্যে অমৃতস্য লোকং স্যোনং পতিভ্যো বহতুং কৃণু ত্বম্ ॥ ৬১৷ 

পদার্থঃ (সূর্যে) হে প্রেরক [বা সূর্যের চমকের সমান তেজসম্পন্না] বধূ ! (সুকিংশুকম্) অতিশয় চমকিত [অগ্নি বা বিদ্যুৎসম্পন্ধ] বা অনেক প্রশংসনীয় গতিসম্পন্ন, (বিশ্বরূপম্) নানা রূপবিশিষ্ট [শুক্ল, নীল, পীত, রক্ত আদি বর্ণবিশিষ্ট, অথবা উঁচু-নীচে মধ্যম স্থানে], (হিরণ্যবর্ণম্) সুবর্ণের জন্য আকাঙ্ক্ষা যোগ্য, (সুবৃতম্) সুন্দরভাবে বিচরণশীল [সবদিকে বিচরণশীল] (সুচক্রম্) সুন্দর [দৃঢ়, শীঘ্রগামী] চক্র/চাকা বিশিষ্ট (বহতুম্) রথে [গৃহাশ্রমরূপ গাড়িতে] (ত্বম্) তুমি (আ রোহ) আরোহণ করো, এবং (পতিভ্যঃ) পতিকূলের লোকেদের জন্য (বহতুম্) [নিজের] পৌঁছানো (অমৃতস্য) অমরত্ব [পুরুষার্থের] (স্যোনম্) সুখদায়ক (লোকম্) লোক [সংসারের স্থান] (কৃণু) করো ॥৬১॥

যেমন চতুর মহারথী ধন-ধান্যে পরিপূর্ণ সুদৃঢ় রথে নিজের সাথীদের সহিত আরোহণ করে ইচ্ছানুসারে বিচরণ করে কার্য সিদ্ধি করে, তেমনই বুদ্ধিমান স্ত্রী তথা পুরুষ গৃহাশ্রমে প্রবেশ করে সুপ্রবন্ধ/সুব্যবস্থা দ্বারা নিজের কুটুম্বদের সহিত সুখ ভোগ করুক॥৬১॥এই মন্ত্র কিছুটা আলাদাভাবে ঋগ্বেদে আছে−১০।৮৫।২০, তথা মহর্ষিদয়ানন্দকৃত সংস্কারবিধি বিবাহপ্রকরণে রথে বধূকে বরের আরোহণ করিয়ে নিয়ে যাওয়া বিনিযুক্ত/বর্ণিত হয়েছে, এবং নিরুক্ত ১২।৮ এ ব্যাখ্যাত আছে ॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (সুকিংশুকম্) পলাশ ফুল দ্বারা সুসজ্জিত, বা সুন্দর সুসজ্জিত, প্রকাশমান, (বিশ্বরূপম্) নানাবিধ রূপবিশিষ্ট, (হিরণ্যবর্ণম্) সুবর্ণের নকাশীবিশিষ্ট, (সুবৃতম্) সুন্দর বা উত্তম রীতিতে গমনশীল (সুচক্রম্) উত্তম চক্রবিশিষ্ট (বহতুম্) রথের সদৃশ বর্তমান (বহতুম্) গৃহস্থ-রথে (সূর্যে) হে সূর্যা-ব্রহ্মচারিণী! তুমি (আ রোহ) আরূঢ় হও, এই গৃহস্থ-রথ (অমৃতস্য লোকম্) অমৃতের স্থান, এই গৃহস্থ-রথকে (ত্বম্) তুমি (পতিভ্যঃ) পতি এবং অন্য নিজের রক্ষকদের জন্য (স্যোনম্) সুখকারী (কৃণু) করো।

[সুকিংশুকম্ = সুন্দর কিংশুক অর্থাৎ পলাশ ফুল দ্বারা সুসজ্জিত। পলাশ ফুলকে কিংশুক বলা হয়। আকৃতিতে এই ফুল "শুক" অর্থাৎ তোতার মতো হয়, এগুলিকে দেখে এমন প্রতীত হয় মানো ছোটো-ছোটো তোতা পাখি শাখায় বসে আছে। এই ফুল বসন্ত কালে ফোটে। ঋ০ ১০।৮৫।২০ এ সুকিংশুকম্ এর সাথে শল্মলিম্ পাঠও আছে। শল্মলি এর অর্থ হল শিমুল। শিমুল ফূলও লালবর্ণ এবং সুন্দর হয়, এবং বসন্তকালে প্রস্ফুটিত হয়। অথর্ব০ ১৪।১।১৩ এ "ফল্গুনীষু ব্যূহ্যতে" দ্বারা বিবাহের জন্য আদর্শ কাল ফাল্গুন-মাস মানা হয়েছে, যা বসন্তকাল। এই বসন্তকালের পরিপুষ্টি সুকিংশুকম্, তথা শল্মলিম্ শব্দ করছে। (নিরু০ ১২।১।৮) এ সুকিংশুক এবং শল্মলি এর অর্থ নিম্নলিখিত দেওয়া হয়েছে সুকাশনম্ অর্থাৎ সুন্দর-প্রকাশবিশিষ্ট/যুক্ত, তথা শল্মলিম্ অর্থাৎ শন্নমলম্, নষ্টমল, নির্মল। নিরুক্তে "অপি বোপমার্থে স্যাৎ" দ্বারা "সুকিংশুকমিব শল্মলিমিতি” কে উপমার্থক বলে "কিংশুক" এর বৃক্ষরূপ তথা পুষ্পরূপ হওয়াও স্বীকৃত হয়েছে। এইভাবে "শল্মলিঃ সুশরো ভবতি, শরবান্ বা" দ্বারা শল্মলি এর বৃক্ষরূপ তথা পুষ্পরূপ হওয়াও স্বীকৃত করা হয়েছে। স্যোনম্ সুখনাম (নিঘং০ ৩।৬)] [ব্যাখ্যা - পত্নী যখন পিতৃগৃহ থেকে পতিগৃহের দিকে গমন করবে তখন পত্নী যে রথে আরূঢ় হবে তা পুষ্পমালা দ্বারা সুসজ্জিত হওয়া উচিত, তথা বিবিধ রূপে রূপিত, সুন্দর পরিষ্কার চাকাযুক্ত হওয়া উচিৎ। সূর্যা ব্রহ্মচারিণী বিবাহের পর পতিগৃহের দিকে যাওয়ার/গমনের জন্য যখন রথে আরোহণ করবে, তখন তাঁকে বলা উচিৎ, এখন তুমি এই রথে আরূঢ় হয়ে মানো গৃহস্থ রথে আরূঢ় হয়েছো। এই গৃহস্থরথ অমৃতের স্থান (অথর্ব০ ১৪।১।৪২), ইহাকে নরক ধাম করিওনা। তথা গৃহস্থে এমন আচরণ করবে, যাতে তোমার পতি এই গৃহস্থকে সুখধাম অনুভব করতে পারে। তথা পতিগৃহে অবস্থানকারী তোমার যে অন্য রক্ষক আছে, যথা শাশুড়ি, শ্বশুর, দেবর আদি তাঁদের সাথেও সদ্ব্যবহার দ্বারা তাঁদেরও সুখী রাখবে। বেদানুসারে যতঃ পত্নী গৃহের সম্রাজ্ঞী, এবং গৃহের প্রবন্ধ/ব্যবস্থা পত্নীর হাতেই আছে, এইজন্য সম্ভাবিত হতে পারে, গুরুজনদের সাথে আচরণে কোথাও যেন পত্নী উচ্ছৃঙ্খল না হয়ে যায়, এইজন্য পিতার সদুপদেশ সময়োচিত প্রতীত হয়।]

অভ্রাতৃঘীং বরুণাপশুখ্রীং বৃহম্পতে। 

ইন্দ্ৰাপতিঘ্নীং পুত্রিনীমাম্মুভ্যং সবিতর্বহ৷৷ ৬২৷৷ 

পদার্থঃ (বরুণ) হে শ্রেষ্ঠ ! (বৃহস্পতে) হে বেদবাণীর রক্ষক ! (ইন্দ্র) হে বড়ো ঐশ্বর্যবান ! (সবিতঃ) হে প্রেরক [বর !] (অভ্রাতৃঘ্নীম্) ভ্রাতাদের অনুদ্বিগ্নকারী, (অপশুঘ্নীম্) পশুদের অনুদ্বিগ্নকারী, (অপতিঘ্নীম্) পতিকে না দুঃখপ্রদায়ী এবং (পুত্রিণীম্) শ্রেষ্ঠ পুত্রদের উৎপন্নকারী [বধূকে] (অস্মভ্যম্) আমাদের হিতের জন্য (আবহ) তুমি নিয়ে চলো ॥৬২॥

সব বিদ্বানগণ আশীর্বাদ প্রদান করুক যাতে বিদ্বান্ সমর্থ বর বিদুষী ব্যবহারকুশল বধূকে গৃহাশ্রমের সিদ্ধির জন্য আদরপূর্বক গ্রহণ করে ॥৬২॥ এই মন্ত্র মিলিয়ে নাও-ঋগ্বেদ১০।৮৫।৪৪ ॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (বরুণ) হে শ্রেষ্ঠ তথা পত্নীর বরণকারী ! (বৃহস্পতে) তথা বৃহতী বেদবাণীর বিদ্বান্ ! (ইন্দ্র) হে আত্মিক শক্তিসম্পন্ন ! (সবিতঃ) এবং উৎপাদনশক্তি সম্পন্ন পুত্র ! তুমি (অভ্রাতৃঘ্নীম্) ভাইদের না হননকারী, (অপশুঘ্নীম্) পশুদের না হননকারী, (অপতিঘ্নীম্) পতির না হননকারী, (পুত্রিণীম্) পূত্র-পূত্রিদের উৎপাদনে সমর্থ বধূকে (অস্মভ্যম্) আমাদের জন্য (আ বহ) নিয়ে এসো।

[বরুণঃ=বৃণোতীতি (উণা০ ৩।৫৩) উত্তমঃ; মহর্ষি দয়ানন্দ)] [ব্যাখ্যা– বরণকারী বরকে তাঁর আত্মীয়রা বলে, তুমি এমন বধূ আমাদের জন্য নিয়ে এসো যে -(১) ঘরে এসে ভাই বোনদের কষ্ট দেবে না (অভ্রাতৃঘ্নীম্)। (২) যে পশুহত্যা করে মাংস ভক্ষিকা নয়, তথা গাভী ও অনান্য পশুর পালন করবে (অপশুঘ্নীম্)। (৩) যে পতিঘাতিনী নয়, পতিকে কষ্ট দেবে না (অপতিঘ্নীম্)। (৪) যে বন্ধ্যা নয়, সন্তানোৎপাদনে সক্ষম (পুত্রিণীম্)। এই চারটি গুণ পত্নীর। পতির চারটি গুণ নিম্নলিখিত:- (১) পতি বরুণ হোক/হবে, আচার-বিচারে শ্রেষ্ঠ হোক/হবে (বরুণ), নির্গুণী, দুর্গুণী না হোক/হবে। (২) পতি বৃহস্পতি হোক/হবে, বেদের বিদ্বান্ হোক/হবে (বৃহস্পতে)। যথা - "বেদানধীত্য বেদৌ বা বেদং বাপি যথাক্রমম্। অবিপ্লুতব্রহ্মচর্যো গৃহস্থাশ্রমমাবিশেৎ" (মনু০ ৩।২)। (৩) পতি ইন্দ্র হোক/হবে, অর্থাৎ আত্মিকশক্তিসম্পন্ন হোক/হবে (ইন্দ্রঃ আত্মা, ইন্দ্রিয়াণাং স্বামী), যাতে সে গৃহস্থকে ভোগস্থল না করে দেয়। (৪) সে সন্তানোৎপাদনশক্তি সম্পন্ন হোক/হবে, নির্বীর্য, নপুংসক না হোক/হবে (সবিতঃ) যাতে বংশ পরম্পরা চলতে থাকে।]

মা হিংসিষ্টং কুমাৰ্যং স্কুণে দেবকৃতে পথি। 

শালায়া দেব্যা দ্বারং স্যোনং কৃশ্যে বধূপথ ৷ ৬৩। 

পদার্থঃ (স্থূণে) হে দুজন স্থির স্বভাবী [স্ত্রী-পুরুষের পঙ্ক্তি/শ্রেণী !] (কুমার্যম্) কুমারী [কন্যা অর্থাৎ বধূকে] (দেবকৃতে) বিদ্বানদের সৃষ্ট (পথি) মার্গে (মা হিংসিষ্টম্) কষ্ট পেতে দিওনা। (দেব্যাঃ) ব্যবহারযোগ্য (শালায়াঃ) গৃহের (স্যোনম্) সুখদায়ক (দ্বারম্) দ্বারকে (বধূপথম্) বধূর মার্গ (কৃণ্মঃ) আমরা করি ॥৬৩॥

সব স্ত্রী-পুরুষ প্রচেষ্টা করুক যাতে পিতৃকুল থেকে পৃথক্ হয়ে বধূ প্রসন্ন থাকে এবং যেমন সুন্দর স্বচ্ছগৃহের সুন্দর স্বচ্ছ দ্বার থেকে আসা-যাওয়ার সুখ হয়, তেমনই সুপ্রবন্ধবিশিষ্ট গৃহাশ্রমে বধূ সুখ প্রাপ্ত হোক ॥৬৩॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

(স্থূণে) হে ঘরের দুটি স্তম্ভ ! অর্থাৎ বৃদ্ধ মাতা-পিতা ! (দেবকৃতে) দেবতাদের দ্বারা নিশ্চিত করা (পথি) গৃহস্থমার্গে বা সুপথে বর্তমান (কুমার্যম্) কুমারী নববধূকে (মা হিংসিষ্টম্) তোমরা কষ্ট দিওনা। (দেব্যাঃ শালায়াঃ) দিব্য শালা-এর (স্যোনম্) সুখদায়ক (দ্বারম্) দ্বরকে, (বধূপথম্) বধূর আসা-যাওয়ার মার্গ (কৃণ্মঃ) আমরা অবাধিত করি।

[শালায়াঃ- শালা-এর অভিপ্রায় হল বিশাল গৃহ। দেখো বৈদিক শালা (অথর্ব০ ৯।৩।১-৩১)। এর মধ্যে একটি কক্ষ থাকা আবশ্যক হবিঃ রাখার জন্য (হবির্ধানম্); একটি (অগ্নিশালা) অর্থাৎ যজ্ঞশালা; ঘরে যত পত্নী অর্থাৎ পুত্রদের পত্নীরা থাকবে প্রত্যেকের জন্য পৃথক্-পৃথক্ কক্ষ (পত্নীনাম্ সদনম্); তথা বৈঠক (সদঃ) অতিথি দেবতাদের জন্য পৃথক্ কক্ষ (দেবানাং সদঃ) (অথর্ব০ ৯।৩।৭); গাভী তথা অশ্বদের জন্য গোশালা তথা অশ্বশালা (৯।৩।১৩); যজ্ঞশালা (৯।৩।১৪); শালা-এর মধ্যভাগে শেবধি অর্থাৎ Savings এর নিধিরূপ, দৃঢ়নির্মিত কক্ষ, বিমানম্ উদরং শেবধিভ্যঃ (৯।৩।১৫); খাদ্য-সামগ্রী রাখার কক্ষ (বিশ্বান্তং বিভ্রতী ৯।৩।১৬)। রান্নাঘর তথা জলের কক্ষ (৯।৩।২২)। এই সূক্তে শালা-এর অন্য ভেদও দর্শানো হয়েছে। যথা দ্বিপক্ষা, চতুষ্পক্ষা, ষট্পক্ষা, অষ্টাপক্ষা, দশপক্ষা আদি শালা (৯।৩।২০, ২১)। পক্ষ=Side Room] [ব্যাখ্যা - বর নিজের মাতা-পিতার কাছে প্রার্থনা করে যে, আপনারা দুজন এই ঘরের স্তম্ভ, আধার/ভিত্তি। মাতা-পিতার আশীর্বাদ তথা তাঁদের দেখাশোনার মাধ্যমে নবযুবক পতি-পত্নী গৃহস্থজীবনকে আনন্দময় তথা সমুন্নত করতে পারে। এইজন্য পতি-পত্নীর উচিত, তাঁরা মাতা-পিতাকে নিজের গৃহজীবনের আধার-স্তম্ভ মনে করুক। বর মাতা-পিতার কাছে এটাও প্রার্থনা করে যে, দিব্যগুণী লোকেদের দ্বারা নিশ্চিত করা কর্তব্যপথে গমন করে এই কুমারীকে আপনারা কোনো প্রকারের কোনো কষ্ট দেবেননা। কুমারী দেব নিশ্চিত কর্তব্যপথ থেকে ভ্রষ্ট হয়ে যদি আসুরপথ বা রাক্ষসপথে গমন করে তবে তাঁকে বোঝানোর এবং সুপথে নিয়ে আসার অধিকার গুরুজনদের রয়েছে। তাঁরা বুঝিয়ে, সান্ত্বনা দিয়ে, সামবিধি তথা দণ্ড বিধি দ্বারা তাঁকে দেবমার্গে নিয়ে আসার সদা প্রচেষ্টা করতে থাকুক। পতি নিজের গৃহকে দেবী-শালা অর্থাৎ দেবগৃহ বলে। পতি এই দেবগৃহের সুখদায়ক দ্বার-এ প্রবেশের অবাধিত অধিকার দেবপথে গমনকারী এই পত্নীকে স্বয়ং দেয়, এবং নিজের মাতা-পিতার কাছেও এই অধিকার প্রদানের প্রার্থনা করে।]

ব্রহ্মাপরং যুজ্যতাং ব্রহ্ম পূর্বং ব্রহ্মান্ততে মধ্যতো ব্রহ্ম সর্বতঃ। 

অনাব্যাপাং দেবপুরাং প্রপদ্য শিবা স্যোনা পতিলোকে বি রাজ ॥ ৬৪।

পদার্থঃ (ব্রহ্ম) ব্রহ্ম [পরব্রহ্ম পরমাত্মা] (পূর্বম্) পূর্বে, (ব্রহ্ম) ব্রহ্ম (অপরম্) পরে, (ব্রহ্ম) ব্রহ্ম (অন্ততঃ) অন্তে/শেষে এবং (মধ্যতঃ) মধ্য/মাঝে, এবং (ব্রহ্ম) ব্রহ্মকে (সর্বতঃ) সর্বত্র (যুজ্যতাম্) ধ্যান/স্মরণ করা যাবে। [হে বধূ !] (অনাব্যাধাম্) ছেদনরহিত [অটুট, দৃঢ়] (দেবপুরাম্) দেবতাদের [বিদ্বানদের] গঢ়/দূর্গে (প্রপদ্য) পৌঁছে (শিবা) কল্যাণকারিণী এবং (স্যোনা) সুখদায়িনী তুমি (পতিলোকে) পতিলোক [পতির সমাজে] (বি রাজ) বিরাজমান হও ॥৬৪॥

বধূ তথা বরের উচিত পরমাত্মাকে সব স্থানে এবং সবসময়ে প্রত্যক্ষ জেনে বীরত্ব এবং নির্বিঘ্নতা দ্বারা গৃহাশ্রমে নিজদের কর্তব্যগুলোকে প্রসন্নতাপূর্বক সম্পূর্ণ করা ॥৬৪॥ ইতিপ্রথমোঽনুবাকঃ ॥

পদার্থঃ টিপ্পণীঃ (বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার)

পদার্থঃ (ব্রহ্ম) বেদ (অপরম্) শালা-এর পশ্চিম পক্ষে (যুজ্যতাম্) প্রযুক্ত হোক, (ব্রহ্ম) বেদ (পূর্বম্) শালা-এর পূর্বের পক্ষে, (ব্রহ্ম) বেদ (অন্ততঃ) শালা-এর অন্ত/পেছনের পক্ষে, (ব্রহ্ম) বেদ (মধ্যতঃ) শালা-এর মধ্যবর্তী পক্ষে, (ব্রহ্ম) বেদ (সর্বতঃ) শালা-এর সব পক্ষে প্রযুক্ত হোক। (অনাব্যাধাম্) সব প্রকারের ব্যাধি বা রোগ কৃমির সব প্রকারের আঘাত রহিত (দেবপুরাম্) এই দেবপুরী অর্থাৎ দিব্যশালা (প্র পদ্য) প্রাপ্ত হয়ে, (শিবো) হে বধু ! কল্যাণ রূপা তথা (স্যোনা) সুখদায়িনী, তুমি (পতিলোকে) পতির গৃহে (বিরাজ) বিরাজমান হও, বা রাজ্য করো।

[মন্ত্র ৬৩ এ দিব্যশালার বর্ণনা, এবং অথর্ব০ ৯।৩।২৩ এ শালা-এর পক্ষ অর্থাৎ কক্ষগুলোর বর্ণনা হয়েছে। দেবপুরাম্ = অথবা দেবতাদের নগরীতে প্রবেশ করে পতিগৃহে বিরাজমান]। [ব্যাখ্যা - ঘরের গুরুজন নববধূর প্রতি বলে - হে দেবী ! তোমার বিদ্যমানতায় এই দেবপুরী বা দেবগৃহের পূর্বের, পশ্চিমের, পেছনের, মাঝখানের কক্ষগুলোতে তথা সর্বত্র বেদমন্ত্রের ধ্বনি উত্থিত হোক, তথা বেদমন্ত্রের দ্বারা ব্রহ্মের স্বরূপের জ্ঞান তথা ব্রহ্মের সাথে যোগজ সম্পর্ক অব্যাহত থাকুক। গৃহজীবনের ইহা সর্বোত্তম আদর্শ। বৈদিক ধ্বনি তথা বৈদিক সামগান গৃহবাসীদের শ্রোত্র/কানকে পবিত্র করে, এবং তাঁদের মনে পবিত্র ভাবনার সঞ্চার করে, তাঁদের জীবনকে বৈদিক মর্যাদায় গড়ে তোলে। বর্তমানের রেডিও তথা T. V. এর অশ্লীল তথা উদ্ভট গীত গৃহের পরিবেশ দূষিত করছে। গুরুজন বধূকে এই আশ্বাসনও দেয় যে, এই শালা আধি-ব্যাধি শূন্য। তথা এই শালা দেবপুরী। দেবপুরীর বাসী দিব্যগুণী। তুমিও এই দেবপুরীতে এসে দেবী হও। এবং সকলের কল্যাণকারী বালী তথা সুখের বর্ষণকারী হবে। সূক্তে আদর্শ-বিবাহের বর্ণনা হয়েছে, যার নায়ক আদিত্য ব্রহ্মচারী এবং সূর্যা ব্রহ্মচারিণী, যারা ব্রহ্মচর্যের সুদীর্ঘ সময়ে পবিত্র জীবনযাপন করে দেবতা এবং দেবী হয়েছে। এমন ব্যক্তিদের শালা তো হবেই,—দেবপুরী।]

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

অথর্ব্বেদ ১৪/১/৫

ঋষিঃ - সাবিত্রী সূর্যা ॥ দেবতা - আত্মা; সোমঃ ॥ ছন্দঃ - অনুষ্টুপ্ ॥ আচ্ছর্দ্বিধানৈর্গুপিতো বার্হতৈঃ সোম রক্ষিতঃ। গ্রাব্ণামিচ্ছৃণ্বন্তিতিষ্ঠসি...

Post Top Ad

ধন্যবাদ