বৈদিক রশ্মি বিজ্ঞানম্ - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

28 June, 2025

বৈদিক রশ্মি বিজ্ঞানম্


বৈদিক রশ্মি বিজ্ঞানম্ভূমিকা
বেদ হল সংসারের সবথেকে প্রাচীন গ্রন্থ, এটা তো সর্ববিদিত, কিন্তু বেদের পরিচয় কেবল এটুকুই নয়। যে গ্রন্থ সবথেকে পুরোনো হবে, সেটাই যে সবথেকে প্রামাণিক হবে, এটাও অনিবার্য নয়। বেদের বিষয়ে সংসারের মধ্যে ভিন্ন-ভিন্ন মত প্রচলিত আছে। কিছু মহানুভাব বেদকে কেবল হিন্দুদের গ্রন্থ মনে করে। একইসাথে তারা এই গ্রন্থকে হিন্দুদের পূর্বজ ঋষিদের দ্বারা ভিন্ন-ভিন্ন কালে লেখা মানে। এই গ্রন্থের মধ্যে তারা অথর্ববেদকে সবথেকে নবীন বেদ মানে। এই সব মহানুভাব এমনও মানে যে বেদের মধ্যে ইন্দ্র, বরুণ আর অগ্নি আদি কল্পিত দেবতাদের স্তুতির বাহুল্য আছে। বেদের মধ্যে কিছু রাজা, ঋষি-মহর্ষির ইতিহাস আছে আর অথর্ববেদের মধ্যে যাদু-টোনা, ভূত-প্রেত, শকুন-অপশকুনের বর্ণনা আছে। বেদের মধ্যেও ভিন্ন-ভিন্ন দেশ, নদী আর পর্বতের বর্ণনা আছে আর এইসব নদী, পর্বত বা ব্যক্তি প্রাচীন ভারতের সঙ্গে সম্বন্ধিত। এইভাবে তাদের দৃষ্টিতে বেদ হল একটা অতি সাধারণ গ্রন্থ, যেটা হল ভারতীয়, বিশেষ করে হিন্দুদের জন্য।
.
অন্যদিকে হিন্দু সমাজ বেদকে ঈশ্বরীয় গ্রন্থ মানে, কিন্তু অনেকত্র কিছু বিদ্বান একে বিভিন্ন ঋষিদের দ্বারা লেখা গ্রন্থ মানে। এদের দৃষ্টিতে বেদের মধ্যে নানা প্রকারের স্তুতি আছে আর এগুলোর ব্যবহার নানা প্রকারের কর্মকাণ্ডের জন্য করা হয়, এইজন্য এই বিদ্বানদের বেদমন্ত্রে নানা প্রকারের কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ করতে দেখা যায় আর সেই কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে স্বর্গ প্রাপ্তির অভিলাষা রাখে। কিছু ব্যক্তি এই কর্মকাণ্ডের মধ্যে পশুবলি, এমনকি নরবলি এবং মাংস-মদের সেবন করাকেও বেদোক্ত মানে। এই ধরণের মান্যতাই সংসারের মধ্যে বামমার্গকে উৎপন্ন করে, যেখানে পঞ্চ মকারকেই (মাংস, মদ, মৈথুন, মুদ্রা, মৎস) পূজা মানা হতো।
.
যখন কিছু বিজ্ঞ জন বেদের এমন বীভৎস রূপ দেখে আর এমন বেদকে অপৌরুষেয় মানতে দেখে, তখন তারা বলে যে বেদ হল ভাণ্ড, ধূর্ত ও নিশাচরদের লেখা। এই কারণে তারা না কেবল বৈদিক কর্মকাণ্ডের আলোচনা করে, বরং ঈশ্বর, আত্মা, জন্ম আর কর্মফল আদি মান্যতাকেও পুরোপুরি অস্বীকার করে দেয় আর বলে -
য়াবজ্জীবেত্ সুখম্ জীবেত্ ঋণম্ কৃত্বা ঘৃতম্ পিবেত্।
ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনম্ কুতঃ।।
(সত্যার্থপ্রকাশ্য দ্বাদশ সমুল্লাস থেকে উদ্ধৃত)
.
এইভাবে বামমার্গীরা বেদকে মানতো, কিন্তু বেদজ্ঞান হতে শূন্য হওয়ার কারণে সংসারের মধ্যে অনেক প্রকার পাপ ছড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে অনীশ্বরবাদী এবং বেদবিরোধী নাস্তিক মত চার্বাক নাম প্রসিদ্ধ তো ছিলই। এইভাবে এই মানব সমাজ দুটো বর্গে বিভাজিত হয়ে যায়। একটা বর্গ শিখা, সূত্র ও শাস্ত্রধারী হয়ে ভয়ঙ্কর পাপ করছিল, যজ্ঞের মধ্যে মাংস-মদিরা আর চর্বির দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল, অন্যদিকে চার্বাক মত মানুষকে স্বেচ্ছাচারী বিষয়ভোগী বানাচ্ছিল। সেই পরিস্থিতিতে কোনো পবিত্রাত্মা, যিনি বেদের যথার্থ স্বরূপ সম্বন্ধে জানেন না, তার কিংকর্তব্যবিমূঢ় হওয়াটা স্বাভাবিক ছিল। এই কারণে মহাত্মা বুদ্ধ আর মহাবীর স্বামীর মতো মহাপুরুষ একদিকে তো বেদকে দূরে সরিয়ে দেন অথবা বেদের প্রতি উদাসীন হন, তো অন্যদিকে নাস্তিক চার্বাক মতকেও অস্বীকার করে দেন। তাঁরা দুইজনই অহিংসা আর সত্যকে আধার বানিয়ে নবীন মার্গে গমণ করেন।
.
ঋষি দয়ানন্দের অনুসারে প্রতিমাপূজনের প্রথা এদের অনুয়ায়ীদের থেকে শুরু হয়েছিল। এমন শোনা যায় যে এঁদের দিবঙ্গত হওয়ার পশ্চাৎ এঁদের অনুয়ায়ীরা বেদকে হিংসার পোষক গ্রন্থ বলে আর বৈদিক সাহিত্যকে জ্বালানো শুরু করে দেয়, একথা কতদূর সত্য, তা আমি জানি না। এইভাবে বেদ বিজ্ঞানের অস্ত হওয়ার পশ্চাৎ ছড়িয়ে যাওয়া অজ্ঞানের অন্ধকারে চারটা মত পৃথক-পৃথক ভাবে অগ্রসর হতে থাকে। বৈদিক বিদ্যা তো প্রায় সমাপ্তই হয়ে গিয়েছিল, তারসঙ্গে বৈদিক সাহিত্যও বিনাশ প্রাপ্ত হচ্ছিল। এমন পরিস্থিতিতে দক্ষিণ ভারতে আদি শঙ্করাচার্যের মতো মহাপুরুষের জন্ম হয়। শোনা যায় যে তিনি আট বছর বয়সে সন্ন্যাসী হয়েছিলেন আর তিনি বেদ এবং ভারতবর্ষের অধোগতি দেখেন, তো তিনি ধর্ম স্থাপনার বিচার করেন। ঋষি দয়ানন্দ সত্যার্থপ্রকাশের ১১ সমুল্লাসে আদি শঙ্করাচার্যকে অনেক সম্মান সহিত বর্ণিত করেন। ঋষি দয়ানন্দ লিখেছেন - "এরপর ২২০০ বৎসর পূর্বে দ্রবিড় দেশোৎপন্ন "শঙ্করাচার্য" নামক এক ব্রাহ্মণ ব্রহ্মচর্য দ্বারা সব শাস্ত্রের অধ্যয়ন করে ভাবতে লাগলেন, হায়! সত্য আস্তিক বেদমত বিলুপ্ত আর নাস্তিক জৈনমত প্রচলিত হওয়ায় বিশেষ অনিষ্ট হচ্ছে। যেকোনো প্রকার হোক এই মতের অপসারণ আবশ্যক। শঙ্করাচার্য শাস্ত্রধ্যয়ন তো করে ছিলেন, তার পাশাপাশি জৈনগ্রন্থসমূহও অধ্যয়ন করেছিলেন। তাঁর যুক্তিও ছিল প্রবল।"
.
এমন মহান বিদ্বান শঙ্করাচার্য ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক একতার জন্য চার মঠের স্থাপনা করেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ ৩২ বছরের অল্পায়ুতেই বিশ্বাসঘাত করে বিষ দিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয় আর তিনি তাঁর বিচারকে স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেওয়ার সুযোগ পান নি। তাঁর পশ্চাৎ তাঁর অনুয়ায়ীরা ব্রহ্মসূত্রের সহায়তা নিয়ে ব্রহ্মসূত্রেরই বিরুদ্ধ "ব্রহ্ম সত্যম্ জগন্মিথ্যা"র মতো মিথ্যা এবং অবৈদিক ঘোষণা প্রারম্ভ করে দেয়। তাঁর গ্রন্থের মধ্যে নারী আর শূদ্রের প্রতি হেয় ভাবের দুর্ভাগ্যপূর্ণ প্রকরণ আমরা দেখতে পাই আর সম্ভবতঃ এইসব প্রকরণকে দেখেই মনুস্মৃতি, রামায়ণ এবং মহাভারত আদি গ্রন্থের মধ্যে এইরূপ পাপপূর্ণ প্রক্ষেপ করা হয়েছে। হতে পারে এর আগে থেকেই শাস্ত্রের মিথ্যা অর্থ আর প্রক্ষেপের দুর্ভাগ্যপূর্ণ পরম্পরা প্রারম্ভ হয়ে গিয়েছিল।
.
আমার নিজের মত হল, বাল্যাবস্থাতেই যে যুবক বৈরাগ্যবান্ হয়েছে, সারা ভারতবর্ষের মধ্যে যে নিজের বিদ্বতার ডঙ্কা বাজিয়েছে, যাঁর মনে বৈদিক সনাতন ধর্ম এবং ভারত দেশকে বাঁচানোর প্রবল উৎকণ্ঠা আছে, সম্পূর্ণ ভারতবর্ষে যে একাই বিজয় যাত্রার জন্য পা বাড়িয়েছে, এমন তেজস্বী, অপ্রতিম আত্মবলসম্পন্ন আর প্রজ্ঞাবান্ পুরুষ পূর্ণ য়োগীই হতে পারে। যেকোনো য়োগীর জন্য এমন সম্ভব বলে মনে হয় না যে তিনি মানব মাত্রের মধ্যে ভেদভাব করবেন। য়োগীর প্রারম্ভই হয় অহিংসা থেকে আর অস্পৃশ্যতা (ছুয়াছুত) তো এক প্রকারের হিংসাই হবে, য়োগ যার সর্বদা বিরোধ করে, এইজন্য এমনই মনে হয় যে কিছু ব্যক্তি নিজের পাপকে প্রমাণিত সিদ্ধ করার জন্য শঙ্করাচার্যের গ্রন্থের মধ্যে প্রক্ষেপ করেছে। যদি দুর্জন-তোষ ন্যায় দ্বারা এটা তাঁর নিজস্ব মত মানা হয়, তাহলেও বেদবিরুদ্ধ হওয়ার কারণে এটা কাউকে স্বীকার করা উচিত নয়।
.
এইভাবে এরপর ভারতবর্ষের মধ্যে পাঁচটা মুখ্য ধারা প্রচলিত হয় - বামমার্গ, চার্বাক, বৌদ্ধমত, জৈনমত আর তথাকথিত অদ্বৈতবাদ। বৌদ্ধমত ভারতীয়কে অহিংসার নামে ভীতু করে দিচ্ছিল, তো অপরদিকে অদ্বৈত মত "অহম্ ব্রহ্মাऽস্মি" এবং "ব্রহ্ম সত্যম্ জগন্মিথ্যা" র মতো ভ্রামক কথন করে-করে ভারতীয়দের পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় হিত থেকে বিরক্ত করে দিচ্ছিল। বামমার্গ আর চার্বাক তো ছিলই অধর্মের দুটো নাম। এমন পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ ভারতবর্ষ বেদবিদ্যা থেকে নিরন্তর দূর থেকে দূরতর হয়ে যাচ্ছিল। অনেক আচার্য নিজ-নিজ মতের প্রবর্তন করে যাচ্ছিলেন, কিন্তু কোনো মতের মধ্যেই বেদবিদ্যার যথার্থ প্রকাশ না হওয়ার কারণে রাষ্ট্রীয়তা এবং সামাজিক অবধারণাই সমাপ্ত হয়ে যায়। কোনো আচার্যই রাষ্ট্র আর সমাজের প্রতি কর্তব্যকে বলার ছিল না। অধিকাংশ জনসংখ্যার জন্য বেদের পঠন-পাঠন নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় আর যারা পঠন-পাঠন করছিল, তারাও বেদপাঠ আর কর্মকাণ্ড পর্যন্তই সীমিত হয়ে গিয়েছিল। তবে হ্যাঁ, এটুকু অবশ্যই ছিল যে বেদার্থ হতে সর্বথা শূন্য বেদপাঠিগণ বেদকে সস্বর কণ্ঠস্থ করে প্রত্যেক পরিস্থিতিতে তাকে বাঁচিয়ে রাখে আর এই কারণে তারমধ্যে প্রায় কোনো প্রক্ষেপ হয়নি। বীভৎস কর্মকাণ্ডিগণও ব্রাহ্মণ গ্রন্থ এবং শ্রৌত্র সূত্র আদি গ্রন্থকে বাঁচিয়ে রাখে। এই কারণে সংসার এই ব্রাহ্মণদের অবশ্যই ঋণী থাকবে।
.
এমন পরিস্থিতিতে মৃতপ্রায় ভারত বিদেশী আক্রমণকারীদের আক্রমণে আহত হতে থাকে। এইভাবে এই ভারত দেশ ধার্মিক, দার্শনিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও আর্থিক সবদিক থেকে ছিন্ন-ভিন্ন আর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। অনেক মত-পন্থ জন্ম নিচ্ছিল, দেশ বিদেশিদের কাছে পদাক্রান্ত হচ্ছিল। এমন কোনো রাজা-মহারাজা বা ধর্মাচার্য দেখা যাচ্ছিল না, যিনি এই সম্পূর্ণ পরিস্থিতির মূল্যাঙ্কন করে প্রত্যেক ক্ষেত্রে দেশ আর বিশ্বকে উচিত দিশা দিতে পারেন। এই দেশে অনেক মহাপুরুষও জন্মে ছিলেন, যাঁদের মধ্যে আচার্য চাণক্য, সন্ত কবীর, গুরু নানকদেব, সন্ত রবিদাস, গোস্বামী তুলসীদাস, মীরা বাই, সন্ত জ্ঞানেশ্বর আদি প্রমুখ। এখানে আমি বীর ক্ষত্রিয়দের চর্চা করা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি না, কারণ ধর্মাচার্য আর দার্শনিকগণই দেশকে দিশা দেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ এইসব মহাপুরুষদের মধ্যে কেউই বেদবিদ্যার বিশেষ জ্ঞাতা ছিলেন না, তাসত্ত্বেও তাঁরা নিজের সামর্থ্য আর পরিস্থিতি অনুসারে নিষ্কাম পুরুষার্থ করেন।
.
এমন বিষম পরিস্থিতিতে গুজরাটের টাঙ্কারা নামক গ্রামে এক মহাপুরুষ জন্ম নেন আর সেই মহাপুরুষ স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী নামে বিশ্ববিখ্যাত হন। সৌভাগ্যক্রমে তিনি মহান প্রজ্ঞাবান্ স্বামী বিরজানন্দ সরস্বতীর মতো গুরুকে পান। দণ্ডী স্বামী বিরজানন্দ সরস্বতী নেত্রহীন হওয়া সত্ত্বেও নিজের মহতী প্রজ্ঞা এবং য়োগারূঢ় আত্মার বলে ভারতবর্ষের অধোগতিকে সূক্ষ্মতা সহিত দেখতে পাচ্ছিলেন, সেই সময় সেই দৃশ্য দেখতে ভারতবর্ষের কোনো আচার্য কিংবা রাজা-মহারাজা সক্ষম ছিলেন না। এমন মহান গুরু স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীকে এক বিরাট ব্যক্তিত্বের বানিয়ে দেন। তিনি নিজের গুরুর ভাবনার অনুরূপ, যেটা প্রাচীন আর্ষ পরম্পরার অনুসারেই ছিল, শাস্ত্রের সঙ্গে-সঙ্গে দেশ আর সমাজ উদ্ধারের সংকল্প নেন। তিনি এক সুদক্ষ বৈদ্যের মতো এটা যথাযথ ভাবে জানতে পারেন যে প্রাচী আর্যাবর্ত (ভারত) দেশেরও উৎকৃষ্ট রূপ ছিল, বেদবিদ্যার প্রকাশই ছিল তার কারণ আর ভারতের যে বিনাশ হয়েছে, সেটা বেদবিদ্যার পতনের কারণেই হয়েছে।
.
যদিও তিনি সত্যার্থপ্রকাশ আদি গ্রন্থের মধ্যে বিবিধ ক্ষেত্রের মধ্যে দেশ আর বিশ্বকে একটা নতুন দিশা দেওয়ার চেষ্টা করেন আর দেশকে স্বতন্ত্র করার আহ্বান তিনিই প্রথম করেন, কিন্তু তাঁর সবথেকে প্রমুখ কাজ ছিল - বিভিন্ন প্রকারের কর্মকাণ্ডের শিকলে জড়িয়ে থাকা বেদের যথার্থ স্বরূপকে সংসারের সম্মুখে প্রস্তুত করার চেষ্টা করা। তিনি বেদকে সনাতন আর্ষ পরম্পরার অনুকূল দেখার চেষ্টা করেন আর তিনি আশা ব্যক্ত করেন যে যেদিন তাঁর বেদভাষ্য পূর্ণ হবে, সেইদিন ভূমণ্ডলে সূর্যের মতো প্রকাশ হবে, যাকে নষ্ট কিংবা ঢেকে ফেলার সামর্থ্য কারও হবে না। তাঁর দৃষ্টি আর্ষ ছিল, মহান য়োগবল ছিল আর তাঁর হৃদয়ে বৈদিক ধর্ম ধ্বংস হওয়ার প্রবল সন্তাপ ছিল। শরীরে অদ্ভুত বল আর মস্তিষ্ক প্রবল প্রতিভাসম্পন্ন ছিল। এইজন্য তিনি আর্যাবর্ত দেশ আর সনাতন বৈদিক ধর্মের দুরবস্থার মূল কারণকে জানতে পেরে ছিলেন। এমন ব্যক্তি হাজার-হাজার বছর পশ্চাৎ তিনি প্রথম মহাপুরুষ ছিলেন। তিনি অনুভব করেন যে যখন থেকে ভারতবর্ষ অথবা বিশ্বের মধ্যে বেদের যথার্থ স্বরূপ লুপ্ত হয়েছে, তখন থেকেই এই পতন শুরু হয়েছে।
.
এই কারণে তিনি পরম্পরাগত শৈলী থেকে আলাদা হয়ে বেদভাষ্য করা শুরু করেন। তিনি ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকার মধ্যেই বেদের যথার্থ বিজ্ঞানের এক অতি সংক্ষিপ্ত ঝলক প্রস্তুত করেন। ঋগ্বেদের প্রারম্ভিক মন্ত্রের কিছু বিস্তার ভাবে দুই-দুই প্রকারের ভাষ্য করেন আর ক্রমে-ক্রমে তাঁর ভাষ্য সংক্ষিপ্ত থেকে সংক্ষিপ্ততর হতে থাকে আর ঋগ্বেদ ভাষ্যের পশ্চাৎ তিনি য়জুর্বেদ ভাষ্যও সংক্ষিপ্ত রূপেই করেন। আর্য বিদ্বান আচার্য বিশ্বশ্রবা ব্যাসের অনুসারে "ঋষি দয়ানন্দ বলতেন যে চারটা বেদের ভাষ্য করতে তাঁকে চারশ বছরের আয়ু লাগবে", কিন্তু তিনি বেদভাষ্য করার জন্য মাত্র ৭-৮ বছর পেয়েছিলেন, তারমধ্যেও তিনি একটা স্থানে নিশ্চিন্তভাবে বসে ভাষ্য করতে পারেন নি।
.
বর্তমানে ঋগ্বেদের সপ্তম মণ্ডলের ৬১তম সূক্তের দুটো মন্ত্র পর্যন্তই তাঁর করা ভাষ্য আমরা পাই, কিন্তু তাঁর য়জুর্বেদ ভাষ্যের শুরুতে যে লেখা আছে, তাতে স্পষ্ট হয় যে তিনি ঋগ্বেদের ভাষ্য পূর্ণ করেছিলেন, কিন্তু কারও প্রমাদবশ ঋগ্বেদের শেষ ভাষ্যের পাণ্ডুলিপি সম্ভবতঃ কোথাও হারিয়ে গেছে। কেউ তার সন্ধান করার চেষ্টা করেছে কিনা, তা আমার জানা নেই। তাঁর উপলব্ধ ভাষ্যও সাংকেতিক মাত্রই আছে, কারণ কোথাও-কোথাও তো তিনি অনেক পদের ভাষ্য না করেই ছেড়ে দিয়েছেন। ভাষ্যের হিন্দি অনুবাদও তাঁর নয়, বরং তাঁর লেখন কার্য করা পণ্ডিতদের। তারা হিন্দি-অনুবাদে অনেকত্র ঋষি দয়ানন্দের মন্তব্যের বিপরীত অনুবাদ করেছে, যা কোথাও-কোথাও হাস্যাস্পদ হয়ে গেছে। সাধারণ জন হিন্দি অনুবাদই পড়ে, এই কারণে বেদের স্বাধ্যায় করেও আর্যজন বিশেষ কিছু লাভ নিতে পারে নি। ঋষি দয়ানন্দের সংস্কৃত ভাষ্যও বিস্তৃত ব্যাখ্যার আবশ্যকতা রাখে।
.
সম্ভবতঃ ঋষির এমন অনুভব হয়ে গিয়েছিল যে তাঁর জীবন অধিক দিন যাবে না আর তাঁর কাছে কাজের অধিকতাও ছিল। এইজন্য তিনি সাংকেতিক ভাষ্যই করতে পান। যে সকল আর্যজন হঠপূর্বক এই ভাষ্যকে পূর্ণ মানে, তারা আজ পর্যন্ত সেখানে থেকে কিছু প্রকাশ না স্বয়ং আর না স্বয়ংয়ের পরিবারে করতে পেরেছেন, অথচ তাদের এই প্রকাশ সারা ভূমণ্ডলে করার ছিল। কেউই এই বিচার করার জন্য উদ্যত নন যে আমরা কেন বেদভাষ্য থাকা স্বত্ত্বেও পাশ্চাত্য কুশিক্ষা আর কুসভ্যতার দাস হয়ে গেছি? কেন আমরা নিজের পরিবারের মধ্যে বেদের শ্রেষ্ঠতা স্থাপিত করতে পারিনি? আমাদের আত্মনিরীক্ষণ করা উচিত যে উপলব্ধ বেদভাষ্য পড়ে এমন নিশ্চয় হয় কি যে বেদভাষ্যের মধ্যে যা কিছু আছে, মানুষ তা লিখতে পারবে না? আমাদের কি এমন মনে হয় যে বেদের মধ্যে সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের চর্চা করা হয়েছে আর সেই চর্চাও এমন গম্ভীর যে তাকে বর্তমান বিজ্ঞান পূর্ণ রূপে কখনও জানতে পারবে না? আমাদের কি এমন মনে হয় না যে বেদভাষ্য সাংকেতিক আছে আর তাকে আধার করে আমরা সংসারে বেদকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবো না?
.
এইসব লেখার মানে এই নয় যে আমি ঋষি দয়ানন্দের অবমাননা করছি, বরং আমার উদ্দেশ্য হল ঋষি দয়ানন্দের সময়ের পরিস্থিতি আর তাঁর বিবশতাকেও অনুভব করার চেষ্টা করা হোক। কেউ যতই প্রতিভাশালী ব্যক্তি হোক না কেন, সে ঋষি দয়ানন্দের সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এত বড় কাজ করতে পারবে না, এটাই তাঁর গৌরব। ঋষি দয়ানন্দের পশ্চাৎ তাঁর থেকে প্রেরিত পণ্ডিত গুরুদত্ত বিদ্যার্থী বেদাদি শাস্ত্রকে কিছু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করেন। তাঁর লেখা ইউরোপীয় বৈদিক বিদ্বানদের মধ্যে ধূম মেছে যায়, কিন্তু ইউরোপের পদার্থ বিজ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ দিতে অথবা নতুন দিশা দেওয়ার কাজ তিনি করতে পারেন নি। আর্য সমাজ আর ডি.এ.বি. কলেজের প্রচার করতে অতি ব্যস্ত থাকার কারণে আর অল্প বয়সে সংসার ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণে তিনি বিশেষ প্রতিভার ধনী হওয়া সত্ত্বেও বেদের উপর কাজ করতে পারেন নি।
.
ঋষি হতে প্রেরিত অন্য মহানুভাব মহাত্মা মুন্সীরাম (স্বামী শ্রদ্ধানন্দ), লেখরাম, পণ্ডিত কৃপারাম (স্বামী দর্শনানন্দ), প্রফেসর শ্যামকৃষ্ণ বর্মা, লালা লাজপতরায় এবং মহাত্মা হংসরাজ প্রমুখ হন, যাঁরা রাষ্ট্র ও সমাজকে জাগাতে আর স্বাধীনতা আন্দোলনকে দাঁড় করাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের পশ্চাৎও অনেক বিদ্বান আর দেশভক্ত আর্যসমাজের মধ্যে হয়, যারা নিজের সারা জীবন দেশ আর সমাজের জন্য আহুতি করে দেন, কিন্তু বেদের যথার্থ স্বরূপকে জানতে ইচ্ছুক এমন কোনো বিদ্বান হননি, যিনি বেদের অপৌরুষেয়তা এবং সর্ববিজ্ঞানময়তাকে সিদ্ধ করতে সক্ষম হবেন। এই কারণে আমাদের গুরুকুল বিদেশী শিক্ষার ঝড়কে থামাতে সক্ষম তো হয়নি, বরং গুরুকুল স্বয়ং ম্যাকালের শিক্ষার প্রবাহে ভেসে যাচ্ছে। যদি আমরা আধুনিক শিক্ষার কোনো বিকল্প প্রস্তুত করতে পেতাম, বৈদিক বিজ্ঞান আর প্রৌদ্যোগিকীর কিছু বিকাশ করতে পেতাম আর সম্পূর্ণ হিন্দু সমাজ আর্যসমাজের বিদ্বানদের পাশে দাঁড়াতো, তাহলে আজ দেশের মধ্যে নিজের স্বদেশী শিক্ষা আর চিকিৎসার সাম্রাজ্য হতো।
.
আমি প্রায় ৩০ বছর পূর্বেই এটা অনুভব করা শুরু করে ছিলাম যে আমরা আর্যসমাজের প্রথম আর তৃতীয় নিয়মের উপর যতই ভাষণ-প্রবচন করি না কেন, তবে বৈজ্ঞানিক জগতে একে সিদ্ধ করতে পারা অতি দুষ্কর। এই জন্য আমি বেদের উপর এমন দৃষ্টিতে বিচার করার ব্রত নিয়েছি যাতে বেদ ঈশ্বরীয়ও হয়ে যায় আর তারসঙ্গে সর্ববিজ্ঞানময়ও হয়। আর্য বিদ্বানদের মধ্যে এমন কাউকে দেখিনি, যিনি এই দিশাতে মার্গদর্শন বা পরামর্শ দিতে পারেন। এই কারণে স্বয়ংই আর্ষ গ্রন্থ পড়ার সিদ্ধান্ত নিই। এই ক্রমে পড়তে-পড়তে ব্রাহ্মণ গ্রন্থের বারি আসে। সর্বপ্রথম ঐতরেয় ব্রাহ্মণ গ্রন্থের সায়ণ ভাষ্য তথা ডাক্তার সুধাকর মালবীয় দ্বারা করা হিন্দি অনুবাদ দেখি। একই সঙ্গে আর্য বিদ্বান আচার্য বীরেন্দ্র শাস্ত্রীর হিন্দি অনুবাদ এবং পণ্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ উপাধ্যায় দ্বারা করা শতপথ ব্রাহ্মণের হিন্দি অনুবাদ দেখি। এইসব দেখে খুব ভয় হয় যে যদি ব্রাহ্মণ গ্রন্থ এমন হয়, তাহলে বেদকে অপৌরুষেয় আর সর্ববিজ্ঞানময় বলা নিতান্ত মূর্খতার কথা হবে। এরদ্বারা আর্য সমাজের মূল বিচারধারার ভবনই ভেঙে পড়বে।
.
ঋষি দয়ানন্দের কথনের উপর আমার পূর্ণ বিশ্বাস ছিল আর সকল প্রাচীন ঋষিদের উপরেও অটুট শ্রদ্ধা ছিল। এর থেকে প্রেরিত হয়ে আমি এই সিদ্ধান্তে আসি যে ব্রাহ্মণ গ্রন্থের কোনো ভাষ্য বা অনুবাদই ঠিক নয়। আর তাই স্বয়ং এর ভাষ্য করা উচিত। এই ক্রমেই আমি "বেদবিজ্ঞান-আলোকঃ" নামে ঐতরেয় ব্রাহ্মণের বৈজ্ঞানিক ভাষ্য করি। এরমধ্যে প্রায় ১২৫ টা গ্রন্থকে উদ্ধৃত করেছি। যার দ্বারা সিদ্ধ হয়েছে যে আমার করা ভাষ্য ঋষিদের বিচারের অনুরূপই হয়েছে। কোথাও কোনো কথা কল্পনা করে লেখা হয়নি। এইরূপ স্থিতি এই গ্রন্থের মধ্যেও আছে। বেদ মন্ত্রকে রশ্মির রূপে মানতে তথা বেদের ঋষিদেরও রশ্মিরূপে অন্তরীক্ষে বিদ্যমান হওয়ার সংকেত পণ্ডিত ভগবদ্দত্ত রিসার্চ স্কোলারের নিরুক্ত-ভাষ্য থেকে প্রাপ্ত হয়। একইসঙ্গে ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকার বেদনিত্যত্ব বিষয় নামক অধ্যায়ে উল্লিখিত এই বচন থেকেও হয় - "কিন্তু আকাশে শব্দের প্রাপ্তির কারণে শব্দ তো অখণ্ড একরস সর্বত্র ভরে আছে। শব্দ হল নিত্য। বেদের শব্দ সবদিক থেকে নিত্য বজায় থাকে।" এছাড়াও অনেক ব্রাহ্মণ গ্রন্থ, উপনিষদ এবং আরণ্যক তথা বেদের কিছু শাখার বচন থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে সম্পূর্ণ সৃষ্টি বৈদিক ছন্দ রশ্মি দিয়ে তৈরি আর সেগুলোর দ্বারাই সঞ্চালিত হচ্ছে। আর এই সবেরও মূল সঞ্চালক হল পরব্রহ্ম পরমাত্মা।
.
এইভাবে আমি সৃষ্টিকে জানার জন্য বৈদিক রশ্মি সিদ্ধান্তের আবিষ্কার করি, যা বাস্তবে আমার সিদ্ধান্ত নয়, বরং প্রাচীন ঋষি আর বেদের সিদ্ধান্ত, যাকে আমরা হাজার-হাজার বছর ধরে ভুলে গিয়েছিলাম। এই সিদ্ধান্তের আধারেই সম্পূর্ণ সৃষ্টির এমন ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, যা বর্তমান বিজ্ঞানের যেকোনো সিদ্ধান্তের থেকে অধিক সূক্ষ্ম, গম্ভীর আর ব্যাপক হবে। বৈদিক রশ্মি বিজ্ঞানের দ্বারাই বেদকে অপৌরুষেয় এবং সর্ববিজ্ঞানময় সিদ্ধ করা যেতে পারে, এছাড়া অন্য কোনো মার্গ নেই। এই সিদ্ধান্তের দ্বারাই প্রাচীন ইতিহাসের অন্বেষণ করতে যেকোনো ঘটনার সম্ভব বা অসম্ভব হওয়ার পরিচয়ও করা যেতে পারে। এর আধারে বেদাদি শাস্ত্রের ব্যাখ্যা করে সেগুলো পূর্ণ নির্দোষ আর সর্বহিতকারী রূপে সংসারে প্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে। এইভাবে এই বিজ্ঞানের বিকাশ করে সুদূর ভবিষ্যতে এমনও বৈদিক শিক্ষা প্রণালীর বিকাশ করা যেতে পারে, যা আধুনিক শিক্ষা প্রণালীর থেকে অধিক শ্রেষ্ঠ আর হিতকারী হবে, কিন্তু এইসব করতে হলে আমাদের কাছে পর্যাপ্ত আর্থিক সংশোধনের আবশ্যকতা হবে।
.
এর জন্য সেই সব মহানুভাবকে গম্ভীরতা পূর্বক বিচার করা উচিত, যারা বেদকে সংসারে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চান।যাদের মধ্যে ভারতবর্ষকে বৌদ্ধিক দাসত্ব থেকে মুক্তি করার প্রচণ্ড ইচ্ছা আছে আর যাদের মধ্যে ঋষি-মুনি আর দেব তথা অন্য প্রাচীন মহাপুরুষদের প্রতি গভীর সম্মানের ভাব বিদ্যমান আছে। আজ আসুরী কুশিক্ষা ও কুসংস্কারকে প্রচারিত আর প্রসারিত করার জন্য বিশ্বের সব সংস্থান লেগে পরে আছে, অথচ বেদ আর দেবতাদের কথা বলে এমন মহানুভাবের কাছে না কোনো পরিকল্পনা আছে আর না আছে কোনো দিশা। পৌরাণিক তথাকথিত সনাতনী মহানুভাব মন্দিরের উপর ধন ব্যয় করা আর নানা কর্মকাণ্ড করা-করানোর মধ্যেই ব্যস্ত আছে আর আর্যসমাজী মাত্র যজ্ঞ, কথিত য়োগ, প্রবচন আদি করেই স্বয়ংকে বেদভক্ত মেনে বসে আছে। বস্তুতঃ বেদ কোথাও দেখা যাচ্ছে না। আশা করি সকল দেশভক্ত বৈদিক সনাতন ধর্মপ্রেমী সজ্জন এর উপর অবশ্যই বিচার করবেন।
(ক্রমশঃ)




No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

বৈদিক রশ্মি বিজ্ঞানম্

ভূমিকা বেদ হল সংসারের সবথেকে প্রাচীন গ্রন্থ, এটা তো সর্ববিদিত, কিন্তু বেদের পরিচয় কেবল এটুকুই নয়। যে গ্রন্থ সবথেকে পুরোনো হবে, সেটাই যে সব...

Post Top Ad

ধন্যবাদ