ব্রহ্মচর্যের সাধনা - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

24 October, 2023

ব্রহ্মচর্যের সাধনা

 

brahmacharya

প্রাতঃ জাগরণ

ব্রহ্মচারী হোক অথবা গৃহস্থ, যারা জীবনে উন্নতি করতে চায় তাদের সবার আগে প্রাতঃ ঘুম থেকে ওঠারই অভ্যাস করা উচিত।

মনু মহারাজ প্রাতঃকাল ব্রাহ্মমুহূর্তে উঠে আবশ্যক কর্তব্য কর্ম করার বিধান এইভাবে করেছেন -
ব্রাহ্মে মুহূর্ত্তে বুধ্যেত ধর্মার্থৌ চানু চিন্তয়েত্।
কায়ক্লেশাম্শ্চ তন্মূলান্ বেদতত্ত্বার্থমেব চ।। (মনুঃ ৪/৯২)

ব্রাহ্মমুহূর্তে উঠে ধর্ম আর অর্থের চিন্তন করা উচিৎ। নিজের শরীরের ক্লেশ আর তার কারণের উপর বিচার করা উচিৎ আর বেদের তত্ত্বের অধ্যয়ন করা উচিৎ।
অন্য একটা স্থানেও এইরকম লেখা আছে -

ব্রাহ্মে মুহূর্ত্তে উত্তিষ্ঠেত্স্বস্থো রক্ষার্থ মায়ুষঃ।
শরীরচিন্তাম্ নির্বর্ত্য কৃতশৌচবিধিস্ততঃ।।
আয়ু রক্ষার জন্য ব্রাহ্মমুহূর্তে উঠে আর শরীরের চিন্তাকে ছেড়ে, শৌচ স্নানাদি করে স্বস্থচিত্ত হয়ে ঈশ্বরের ধ্যান আদি নিত্য কর্মকে করবে। প্রাতঃকালে ওঠার ফলে মানুষ সুস্থ থাকে, তার রোগ হয় না, অতঃ নিরোগ শরীর অধিক বছর পর্যন্ত কর্ম করতে পারে। প্রাতঃকালে ওঠার অসংখ্য লাভ শাস্ত্রকারীরা বলেছেন।
গোভিল গৃহ্যসূত্রের মধ্যেও এইভাবে বিধান আছে -
"প্রতিদিনম্ রাত্রেঃ পশ্চিমে য়ামে চোত্থায়াবশ্যকম্ কৃত্বা০"
প্রতিদিন রাত্রির চতুর্থ প্রহরে জাগবে। এই বিষয়ে মহর্ষি দয়ানন্দ জীও সংস্কার বিধিতে লিখেছেন -

স্ত্রী-পুরুষ সদা দশটার মধ্যে শয়ন করবে আর রাত্রির শেষ প্রহর বা ৪টার মধ্যে উঠে প্রথমে হৃদয়ে পরমেশ্বরের চিন্তন করবে তারপর ধর্ম আর অর্থের বিচার করবে আর ধর্ম-অর্থের অনুষ্ঠান বা উদ্যোগ করতে গিয়ে যদি অভাব বা কষ্টও হয় তবুও ধর্মযুক্ত কর্ম কখনও ত্যাগ করবে না, বরং সদা নিরন্তর উদ্যোগ করে ব্যবহারিক আর পারমার্থিক কর্তব্য কর্মের সিদ্ধির জন্য ঈশ্বরের স্তুতি-প্রার্থনা-উপাসনা করতে থাকবে যাতে পরমেশ্বরের কৃপা দৃষ্টি আর সহায়তায় মহাকঠিন কাজও সুগমতার সঙ্গে সিদ্ধ হতে পারে। (সংস্কার বিধি গৃহাশ্রমপ্রকরণম)
এইজন্য প্রাতঃকাল উঠে সর্বপ্রথম নিম্ন মন্ত্রের দ্বারা ঈশ্বরের প্রার্থনা করা উচিত -
(ও৩ম্) প্রাতরগ্নিম্ প্রাতরিন্দ্রম্ হবামহে প্রাতর্মিত্রাবরুণা প্রাতরশ্বিনা।
প্রাতর্ভগম্ পূষণম্ ব্রহ্মণস্পতিম্ প্রাতঃ সোমমুত রুদ্রম্ হুবেম।।
(ও৩ম্) প্রাতর্জিতম্ ভগমুগ্রম্ হুবেম বয়ম্ পুত্রমদিতের্য়ো বিধর্ত্তা।
আধ্রশ্চিদ্যম্ মন্যমানস্তুরশ্চিদ্রাজা চিদ্যম্ ভগম্ ভক্ষীত্যাহ।।
(ও৩ম্) ভগ প্রণেতর্ভগ সত্যরাধো ভগেমাম্ ধিয়মুদবা দদন্নঃ।
ভগ প্র নো জনয় গোভিরশ্বৈর্ভগ প্র নৃভির্নৃবন্তঃ স্যাম।।
(ও৩ম্) উতেদানীম্ ভগবন্তঃ স্যামোত প্রপিত্বऽউত মধ্যেऽঅহ্নাম্।
উতোদিতা মঘবন্ত্সূর্য়স্য বয়ম্ দেবানাম্ সুমতৌ স্যাম।।
(ও৩ম্) ভগऽএব ভগবাঁ২ऽঅস্তু দেবাস্তেন বয়ম্ ভগবন্তঃ স্যাম।
তম্ ত্বা ভগ সর্বऽইজ্জোহবীতি স নো ভগ পুরऽএতা ভবেহ।। (য়জুঃ ৩৪/৩৪-৩৮)
এই মন্ত্রের অর্থ বিচারপূর্বক জপ করলে অধিক লাভ হয়।

এর অর্থ মহর্ষি দয়ানন্দ কৃত সংস্কার বিধির গৃহাশ্রম প্রকরণে দেখে নিবেন। অনেক প্রাচীন কাল থেকে অথবা আদি সৃষ্টি থেকে প্রাতঃকাল ব্রাহ্মমুহূর্তে ওঠার বিধান আছে। বাল্মীকি রামায়ণে তার প্রমাণ -
একয়ামাবশিষ্টায়াম্ রাত্র্যাম্ প্রতিবুধ্য সঃ।
অলঙ্কারবিধিম্ কৃৎস্নম্ কারয়ামাস বেশ্মনঃ।।৫।।
(বাল্মীকি রামায়ণ অযোধ্যা কাণ্ড ষষ্ঠ সর্গ)
(রাম আর সীতা) রাত্রি প্রহর শেষ থাকতে ওনারা ওঠেন আর ভৃত্যদের সারা ভবন পরিষ্কার করে সাজানোর আজ্ঞা দিলেন।
রাত্রির পশ্চিময়াম বা চতুর্থ পহরের নাম ব্রাহ্মমুহূর্ত। শাস্ত্রকারীরা এই সময়কে অমৃতবেলা বা দেববেলা বলেছেন। এই ব্রহ্মের অর্থ হল "দেবম্ দেবত্রা" দেবের দেব মহাদেব যাঁর মুখ্য নাম "ও৩ম্", তাঁকে স্মরণ করার সর্বশ্রেষ্ঠ সময়। দেব, বিদ্বান ব্যক্তিরা এই সময়ে ব্রহ্মের ভক্তি আর ভজনে রত থাকেন আর সেইসময় প্রেমময় প্রভু তাঁর সত্য শ্রদ্ধালু ভক্তের উপর আনন্দ অমৃতের বর্ষণ করেন।

সব মানুষ পর্যাপ্ত সময় সুষুপ্তি অর্থাৎ গভীর নিদ্রায় সব সাংসারিক বাসনা থেকে দূরে থাকে। চিত্তের সব বৃত্তিগুলো সেইসময় বিরুদ্ধ অবস্থায় থাকে। এই কারণে আমাদের আত্মা নিজের স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হলে সর্বথা শান্ত হয়ে যায়। প্রকৃতিও সর্বথা শান্ত থাকে, অথবা বলা যেতে পারে সেইসময় সর্বত্র সুন্দর্যতা, মৃদুতা, প্রসন্নতা আর শান্তির সাম্রাজ্য থাকে। এমন মনে হয় যেন দেবপূজা অর্থাৎ ঈশ্বর স্তুতি, প্রার্থনা, উপাসনা আদি শুভ কর্মের জন্যই ঈশ্বর এই উত্তম সময়ের রচনা করেছেন। এই সময় স্বভাবে পাপীর থেকে পাপী মানুষেরও ঈশ ভক্তি আদি শুভ কর্মের মধ্যে মন লাগে। অসুরদের মধ্যেও এই সময় আসুরী বৃত্তি নিম্ন হয়। রাক্ষসদের মধ্যেও দেবতা হওয়ার প্রবৃত্তি জাগৃত হয়ে ওঠে। এইজন্য পশু-পক্ষী আদি সব প্রাণী স্বভাবে প্রাতঃকালেই জেগে ওঠে। নবজাতক শিশুও স্বয়মেব প্রাতঃ উঠে আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে প্রভুর এই পবিত্র সময় প্রমাদে পড়ে শুয়ে থাকার নয়। আমরা এটাও দেখি না যে পাখিরা গাছের ডালে তাদের ডানা মেলে প্রতিদিন তাদের প্রিয়তম প্রভুর প্রেমে গদগদ হয়ে কত মধুর স্বরে গান গায়। এরদ্বারা আমরা এই শিক্ষা পাই যে রাতদিনের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে কেবল একবার আসা এই প্রাতঃকালের সর্বোত্তম সময় ব্রহ্মবন্দনার জন্যই আসে। দেব (বিদ্বান) ব্যক্তিরা একাগ্রচিত্ত হয়ে এইসময় প্রভুর আনন্দ অমৃতের পান করে।
পূর্বাম্ সন্ধ্যাম্ সনক্ষত্রামুপাসীত য়থাবিধি।
গায়ত্রীমভ্যসেত্তাবদ্যাবদাদিত্যদর্শনম্।।
প্রাতঃকালের সন্ধ্যা যতক্ষণ পর্যন্ত আকাশে নক্ষত্র থাকবে বিধিপূর্বক করবে আর যতক্ষণ পর্যন্ত সূর্যের দর্শন হবে না ততক্ষণ গায়ত্রী মন্ত্রের জপ করতে থাকবে। "পুরা সূর্য়স্যোদেতোরাধেয়ঃ" সূর্য উদয়ের পূর্বে ঈশ্বরের ধ্যান করা উচিত, মহাভাষ্য ২/৩/৬৯ এর "ন লোকাব্যয়০" সূত্রতে থাকা বাক্যও উপর্যুক্ত কথনের পুষ্টি করে। সব শাস্ত্রের মধ্যে ঋষি-মহর্ষিরাও এতে একমত যে ব্রাহ্মমুহূর্ত্তের থেকে ভালো ঈশ্বরভক্তির জন্য অন্য পবিত্র সময় নেই। এইজন্য মনু মহারাজও লিখেছেন যে -
পূর্বাম্ সন্ধ্যাম্ জপম্স্তিষ্ঠেত্সাবিত্রীমর্ক দর্শনাত্।
পশ্চিমাম্ তু সমাসীনঃ সম্যগৃক্ষবিভাবনাত্।।
(মনুঃ ২/৭৬)

অর্থাৎ - প্রাতঃকালীন সন্ধ্যা সূর্যের দর্শন হওয়া পর্যন্ত গায়ত্রী মন্ত্রের জপ অর্থসহিত স্থির হয়ে বসে উপাসনা করবে আর সায়ংকালীন সন্ধ্যা নক্ষত্রের দর্শন পর্যন্ত বসে শুদ্ধভাবে গায়ত্রী মন্ত্রের জপ দ্বারা পরমাত্মার উপাসনা করবে।
এইজন্য প্রাচীনকালে সকল ভারতবাসী এই পবিত্র ব্রাহ্ম মুহূর্তে ঈশ্বরচিন্তন, ব্রহ্মার্চনা, য়োগাভ্যাস করতো। এই অমৃত বেলার সদুপয়োগ করার কারণেই প্রাচীন ঋষি-মহর্ষিগণ অমরপদ মোক্ষের প্রাপ্তি করতেন। তাই আজ পর্যন্ত ওনাদের যশ আর কীর্তির গীত গাওয়া হয়। যারা প্রতিদিন খুব প্রাতঃ উঠে শ্রদ্ধাপূর্বক ঈশ্বরের ধ্যান করবে তারা দেবমার্গের পথিক হয়ে মোক্ষপদ পাবে। কারণ ব্রাহ্মমুহূর্তের সময় এত সুন্দর হয় যে এই সময় য়ম-নিয়মের স্বয়ং সিদ্ধি হয়। পরস্পরের ব্যবহার না হওয়ার কারণে হিংসা করার বা অসত্য বলার সুযোগই আসে না, স্বভাবে অহিংসা আর সত্যের প্রসার থাকে। চোরও তার চুরি হতে নিবৃত্ত হয়ে এর পূর্বেই নিজের স্থানে চলে যায়। কামী পুরুষও রাতে অনেকক্ষণ ধরে শুয়ে থাকার কারণে এই সময় আলস্য প্রমাদে পড়ে শুয়ে থাকে বা মশা-মাছি মারতে থাকে। অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য আদি য়ম-নিয়মের স্বয়ং বাতাবরণ হওয়ার কারণে এই সময়টা য়োগাভ্যাস, ঈশ্বরভক্তির সর্বোত্তম সময়।
আমাদের প্রাচীন পুরুষ প্রাতঃ ওঠার সময়কে পূর্ণ ভাবে জানতো আর সবাই ব্রাহ্মমুহূর্তে ওঠার পুরো অভ্যাসী ছিল। তারা মনু জীর আদেশানুসারে এই সময়ে শৌচ, দন্তধাবন, স্নান, ব্যায়াম আর বায়ুসেবন আদি নিত্য কর্মের দ্বারা শরীরকে এত সুন্দর, সুদৃঢ় আর সুস্থ বানিয়ে নিতো যে কায়ার ক্লেশ অর্থাৎ শারীরিক রোগ আর তার কারণ স্বয়ং সমূল নষ্ট হয়ে যেত। সারা জীবন রোগ তাদের স্পর্শ পর্যন্ত করতো না। এর অতিরিক্ত বেদের তত্ত্বের অধ্যয়ন, প্রাণায়াম, য়োগাভ্যাস আর ঈশ্বরচিন্তনের দ্বারা মানসিক আর আত্মিক কাম, ক্রোধ আদি শত্রুকে ভস্মসাত্ করে দিতো। আজ আমরা আমাদের ঋষি-মহর্ষিদের মার্গকে ছেড়ে দিয়ে সর্বথা উল্টো পথে চলছি। আমাদের সব দুঃখের কারণ হল এটাই। এটা জানা সত্ত্বেও যে যারা শুয়ে পড়ে থাকে তারা আলসী, রোগী, অল্পায়ু, একগুঁয়ে, দরিদ্র, দুরাচারী, বিষয়ী তথা অনেক দুর্গুণের ভাণ্ডার হয়। তারা তো স্বাস্থ্য আর সদাচারে নিঃস্ব হয়ে যায়। প্রাতঃকালের এই পবিত্র সময় যার বায়ু অত্যন্ত শুদ্ধ আর সঞ্জীবনী শক্তি দিয়ে ভরা থাকে, আমরা তার কোনো লাভ না নিয়ে খাটের উপর পড়ে থেকে-থেকে এমনি করে হারিয়ে ফেলি আর নিজের পুরুষত্বকে জ্বালিয়ে দিই। কারণ প্রাতঃকালে ওঠা স্ত্রী-পুরুষ সম্পূর্ণ ভাবে সুস্থ ভাগ্যবান আর বুদ্ধিমান হয়। যেমন ইংরেজিতে একটা কথন আছে -
"Early to bed and early to rise makes a man healthy wealthy and wise."
কিন্তু আজকের ইংরেজি শিক্ষিত বাবু আর স্কুল, কলেজের বিদ্যার্থীরা একদম এর উল্টোটা করে। দেরি করে শোয়া আর দেরি করে ওঠাকে এরা নিজের ধর্ম বলে মনে করে। অনেক রাত পর্যন্ত ব্যর্থ আড্ডা মারে আর সিনেমা, নাচ আদি দেখতে থাকে আর পরীক্ষার দিনে পড়ার জন্য অনেক রাত পর্যন্ত জাগে আর তারপর সূর্যোদয়ের অনেক পরে পর্যন্ত শুয়ে পড়ে থাকে। তাই দেরি করে ঘুমানো আর দেরি করে ওঠা ব্যক্তি কখনও বুদ্ধিমান, সুস্থ, ব্রহ্মচারী আর ভাগ্যবান হবে না। বেদ ভগবান কত সুন্দর বলেছেন যে -

উদ্যন্ত্সূর্য় ইব সুপ্তানাম্ দ্বিষতাম্ বর্চ আ দদে।। (অথর্বঃ ৭/১৩/২)

যারা সূর্য উদয়ের পশ্চাৎ অথবা দিনের বেলায় ঘুমায়, তাদের তেজকে উদয় হওয়া সূর্য হরণ করে নেয়, যেমন এক তেজস্বী পুরুষ তার শত্রুর তেজকে নষ্ট করে দেয়।
তেজ বা বর্চস্ সেই শক্তি বা গুণের নাম যার জন্য মানুষ সব ধরনের উন্নতি করে। তেজ তত্ত্বের স্বভাবই হল এগিয়ে যাওয়া। আমরা একটু আলস্যের কারণে কেবল প্রাতঃকাল না উঠে উন্নতির মূল তত্ত্বকে হারিয়ে সর্বথা তেজহীন হয়ে যাচ্ছি। কত দুঃখ আর মূর্খতার কথা যে প্রাতঃকালের সময় হল দিনের মূল বা বাল্যবস্থার। যেমন বাল্যকালে ভালো বা মন্দ যেমনই সংস্কার ঢেলে দেওয়া হয় তার প্রভাব মরণ পর্যন্ত থাকে। সংস্কারের ছাপ অটল আর অমিত হয়, যারা প্রাতঃকালের অমূল্য অমৃত-বেলাকে নষ্ট করে দেয় তাদের সম্পূর্ণ দিনই নষ্ট হয়ে যায়। যেমন প্রাতঃকাল যাবে তেমনই সম্পূর্ণ দিনের গতি হবে। ইংরেজি ভাষার লোকোক্তি আছে যে -
"Well begun is half done,"
প্রাতঃকালের পিছিয়ে পড়া মানুষ সায়ংকাল পর্যন্ত পিছিয়েই থাকে। তার দিনচর্যা সব খারাপ হয়ে যায়, তার কোনো কাজই সময় মতো হয় না। সে নিজের উন্নতির জন্য প্রতিদিন আসা এক নতুন শুভ সুযোগকে হারিয়ে ফেলে। প্রাতঃকালে ওঠার জন্য বেদমন্ত্র আমাদের আশ্চর্যযুক্ত সতর্ক বার্তা দেয় যে -
উদীর্ধ্বম্ জীবো অসুর্ন আগাদপ প্রাগাত্তম আ জ্যোতিরেতি।
আরৈক্পন্থাম্ য়াতবে সূর্য়ায়াগন্ম য়ত্র প্রতিরন্ত আয়ুঃ।।
(ঋঃ ১/১১৩/১৬)

শব্দাংশ - হে মনুষ্য! (উদীর্ধ্বম্) ওঠো জাগো (নঃ) আমাদের জন্য (জীবঃ) জীবন (অসুঃ) প্রাণশক্তি (আগাত্) এসে গেছে, উদয় হয়ে গেছে। (তমঃ) অন্ধকার (অপ প্রাগাত্) সরে গেছে, পালিয়ে গেছে (জ্যোতিঃ) ঊষার জ্যোতি (আ ইতি) আছে (সূর্য়ায়) সূর্যের (পন্থাম্) মার্গকে (য়াতবে) চলার বা পৌঁছানোর জন্য (আরৈক্) খুলে দিয়েছে (য়ত্র) এখানে জীবনশক্তি (আয়ুঃ প্রতিরন্তঃ) জীবনকে বাড়িয়ে দেয় সেই অবস্থায় আমরা (আ অগন্ম) পৌঁছে গেছি।
ভাবার্থ - প্রাতঃকালে ওঠার জন্য ঊষার জ্যোতি হচ্ছে মানুষের জন্য অন্তিম সতর্কতা, সেটা মানুষকে সাবধান করে দেয় যে - হে মনুষ্য! ওঠো এটা জীবনশক্তি সঞ্চয়ের সময়। প্রাণায়াম দ্বারা প্রাণের উদয় (সঞ্চার) এই সময়ই করা হয়। এই সময় পলায়মান অন্ধকার আমাদের ভিতরের অন্ধকারকে নষ্ট করার জন্য সচেতন করছে। এটা প্রভাতের প্রকাশ সূর্যের আগমনের সূচনা দিচ্ছে আর আমাদের বার-বার বলছে, হে মনুষ্য! ওঠো এটা শুয়ে থাকার সময় নয়। যারা এই সময় শুয়ে থাকে তারা নিজের সর্বস্য হারিয়ে ফেলে। এটাই তো সময় জেগে ওঠা মানুষের ভিতরে ঊষার প্রকাশ আর উদয় হওয়া সূর্যের শক্তি নব প্রাণের সঞ্চার করে দিব্য-জ্যোতির উদয় করে আর শুয়ে থাকা ব্যক্তির আরোগ্য স্বাস্থ্য, বল, বুদ্ধি, তেজকে হরণ করে নির্বল, দরিদ্র, নির্বুদ্ধি আর অল্পাযু বানিয়ে দেয়। "ব্রাহ্মে মুহূর্তে য়া নিদ্রা সা পুণ্যক্ষয়কারিণী" ব্রাহ্মমুহূর্তে ঘুমানো সব পুণ্য অর্থাৎ শুভ কর্মের নাশ কারী হয়।
ঐতরেয় ব্রাহ্মণের মধ্যে একটা প্রশ্ন আছে - "কিম্ পুণ্যম্? ব্রহ্মচর্য়ম্।"
অর্থাৎ সংসারের মধ্যে সব পুণ্যের পুণ্য হচ্ছে ব্রহ্মচর্য। ব্রহ্মচর্য প্রেমীর যদি আপনি পরীক্ষা করতে চান তাহলে আপনি প্রাতঃকালে গিয়ে দেখবেন তাদের চারটার পরে কখনও শুয়ে থাকতে দেখবেন না। প্রাতঃকাল চারটার পড়ে শুয়ে থাকা মানুষ কখনও ব্রহ্মচারী হতে পারবে না। কারণ স্বপ্নদোষাদি রোগ এই সময় শুয়ে থাকাতে যে মল-মূত্র দ্বারা মলাশয় আর মূত্রাশয় ভরে থাকে, বীর্যকোষের উপর তার চাপ পড়ে আর সেইজন্যই বীর্য নষ্ট হয়ে যায় আর খারাপ স্বপ্নও চারটার পরেই আসে, যা স্বপ্নদোষের কারণ হয়। কিন্তু প্রাতঃকাল চারটার পূর্বে মানুষ তখনই উঠতে পারবে যখন সায়ংকাল দশটার পূর্বে শুয়ে পড়বে। এইজন্য ব্রহ্মচারী অথবা ব্রহ্মচারী প্রেমীদের ১০টা মধ্যে শুয়ে পড়া আর ৪টা পূর্বে ওঠার অভ্যাস করা উচিত।
প্রাচীন কালে এই পবিত্র দেশে যত পূজ্য ঋষি-মহর্ষি হয়েছে তারা সবাই প্রাতঃকালেই উঠতো, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আধুনিক কালেও সংসারে যত মহাপুরুষ হয়েছে, যারা দেশ, জাতি, ধর্মের জন্য কোনো বড় সেবার কর্ম করেছে তারা সবাই প্রাতঃকালে ওঠার অভ্যাসী ছিল। মহর্ষি দয়ানন্দ সর্বদা খুব প্রাতঃ উঠতেন। নেপোলিয়ন আদি মহাপুরুষ যারা পাশ্চাত্য দেশের হয়েছে তারা সবাই প্রাতঃকালে ওঠার অভ্যাসী ছিল। প্রাতঃ ওঠা মহাপুরুষদের নামের সূচী কিছুদিন পূর্বে ইংরেজি ভাষার প্রসিদ্ধ পত্রিকা Modern Review তে ছেপে ছিল।
প্রাতঃ ওঠার কথা খুবই সামান্য আর ছোট কথা বলে মনে হয়, কিন্তু এর মহত্ব আর ফল খুবই ভারী হয়, এর অভ্যাস পর্যাপ্ত পরিশ্রমের পরেই দৃঢ় হয়। সর্বদা নিরন্তর নিয়ম করে প্রাতঃ ওঠা ব্যক্তি খুবই কম সংখ্যায় দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এইরকমই ব্যক্তি মহাপুরুষ হয়। যেমন বৃক্ষ আর গৃহের মূল আর ভিত্তি ভূমির ভিতরে লুকিয়ে থাকে, সাধারণত এটা দেখে এর কোনো মহত্ব প্রতীত হয় না, কিন্তু মূলের অভাবে বৃক্ষ আর ভিত্তির অভাবে গৃহ টিকতে পারবে না। সেইরকম প্রাতঃ ওঠার গুণ দেখতে ছোট্ট বলে মনে হয় কিন্তু এটা তার ধারণ কারীর জীবনকে উচ্চ, পবিত্র আর মহান বানিয়ে তোলে।
এতকিছুর পরও যদি এমন ভারী লাভপ্রদ গুণকে কেউ ধারণ না করে তাহলে তার থেকে বড় অভাগা আর কে হতে পারে? এই মহত্বকে প্রকট করে এমন মহর্ষি দয়ানন্দ জীর জীবনের একটা ঘটনা আছে। ঘটনাটা এইরকম যে - একদিন এক পাদরী আর এক মিশনারী মহিলা মহর্ষি জীর সঙ্গে দেখা করতে আসে। মহর্ষি তাদের বলেন - ধনের অধিকতা জাতির অবনতির কারণ হয়, যেমন সেটা আর্য জাতির অধঃপতনের কারণ হয়েছিল আর উদাহরণ রূপে বলেন যে, এই কারণে ইংরেজদের দিনচর্যা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আগে যখন আমরা সূর্যোদয়ের পূর্বে ভ্রমণ করতে যেতাম তখন অনেক ইংরেজ স্ত্রী-পুরুষদের বায়ুসেবন করতে দেখতাম, কিন্তু এখন তারা অনেক দেরি করে ওঠে। এইজন্য এখন এদের রাজত্ব থাকবে না।
প্রাতঃকালে না ওঠা ব্যক্তি স্বাস্থ্য, আয়ু, বল, ব্রহ্মচর্য, আদি মহত্বপূর্ণ কার্য সবকিছু হারিয়ে ফেলে। অতঃ প্রত্যেক ব্রহ্মচর্য প্রেমী তথা উন্নতির উচ্ছুক এমন স্ত্রী-পুরুষকে প্রাতঃকাল ব্রাহ্মমুহূর্তে অবশ্যই ওঠা উচিত।

☘️ চক্ষুঃস্নান, উষঃপান আর শৌচ আদি 🍀

(১) চক্ষুঃস্নান -

প্রাতঃকালে উঠে ঈশ্বর চিন্তনের পশ্চাৎ চক্ষুঃস্নান করা উচিত। যার বিধি নিম্ন প্রকারে হবে -

শুদ্ধ জল যা স্বচ্ছ আর বস্ত্র দিয়ে ছেকে নেওয়া, সেই জল দিয়ে মুখকে এমন ভাবে ভরে নিবে যেন সেখানে আর জলের জন্য স্থান বাকি না থাকে অর্থাৎ পুরোপুরি ভাবে ভরে নিবে। এই জলকে মুখের মধ্যে ধরে রাখতে হবে, তারসঙ্গে অন্য শুদ্ধ জল দিয়ে দুই চোখের মধ্যে বার-বার ছিটিয়ে ছিটিয়ে দিবে যাতে রাতে শয়ন কালে যে মল অথবা উষ্ণতা চোখের মধ্যে এসেছে সেটা সর্বথা দূর হয়ে যায়। এইভাবে এই ক্রিয়ার ফলে ভিতরে আর বাইরে দুই দিক থেকে চক্ষু ইন্দ্রিয় শীতলতা প্রাপ্ত করে। নিরর্থক মল আর উষ্ণতা দূর হয়ে দৃষ্টি বেড়ে যায়। এই ক্রিয়াকে প্রতিদিন করা উচিত।
এই ক্রিয়া চোখের জ্যোতির জন্য অত্যন্ত লাভদায়ক। এটা প্রতিদিন শ্রদ্ধাপূর্বক করলে চোখের সব রোগ দূর হয়ে বৃদ্ধাবস্থা পর্যন্ত চোখের জ্যোতি স্থির থাকে।
(২) উষঃপান -

এরপর উষঃপান করবে। প্রাতঃকাল ৪টার পশ্চাৎ যে জল শৌচ বা মল-মূত্র ত্যাগের পূর্বে পান করা হয় তাকে উষঃপান বলে।
উষঃপানের পূর্বে ভালো করে কুলি/গার্গল করে মুখ নাসিকা আদিকে পরিষ্কার করা আবশ্যক। আগে দাঁতকে আঙ্গুল দিয়ে ভালো করে ঘষে-ঘষে দুই-তিনবার কুলি করবে, তারপর আঙ্গুল দিয়ে ঘষে জিভ তথা গলাতে নিচে উপরে তথা ডান-বাঁদিকে লেগে থাকা কফ আদি মলকে ভালো ভাবে পরিষ্কার করে নিবে। নাকের দুই ছিদ্রকেও জল দিয়ে শুদ্ধ করবে। যদি নাক আর মুখকে ঠিক মতো শুদ্ধ না করে উষ-পান (জলপান) করা হয় তাহলে রাতের শয়ন কালে আমাদের উদর থেকে যে মল মুখ দ্বারা বাইরে বেরিয়ে আসার জন্য আসে সেটা জলের সঙ্গে পুনঃ পেটের মধ্যে পৌঁছে গণ্ডগোল করবে।
🔹 উষঃপানের প্রকার -

উষঃপান দুই প্রকারে করা হয়। প্রথম নাসিকা দ্বারা আর দ্বিতীয় মুখ দ্বারা। লাভ দুটো থেকেই হয়। প্রথমে মুখ দ্বারাই জল পান করার অভ্যাস করা উচিত। মাঝে মধ্যে নাসিকার দ্বারাও জল পান করার অভ্যাস করা উচিত। তবে যদি নাসিকা দিয়ে জলপান করতে হয় তাহলে বাম নাসিকার ছিদ্র দিয়ে ধীরে-ধীরে একটু-একটু করে জল যেতে দিবে। এই জলকে মুখ থেকে থুতু মেরে ফেলে দিবে, এইভাবে নাসিকা শুদ্ধ করে নাসিকা দিয়ে জলপান করা উচিত।
🔹 নাসিকা দ্বারা জলপানের বিধি এইরকম হয় -

গ্লাস বা কোনো জলপাত্র যার কিনারা পাতলা হবে তাতে জল ভরে সুবিধা পূর্বক বসে গ্লাসের কিনারা নাকের বাম ছিদ্রের সঙ্গে লাগিয়ে ধীরে-ধীরে জল ভিতরে যেতে দিবে। কণ্ঠের দ্বারা চুমুক দিয়ে টানতে থাকবে জল স্বয়ংই ভিতরে যেতে শুরু করবে, শ্বাসের সাহায্য নিয়ে জলকে টানবে না। বলপূর্বক এই ক্রিয়া করলে পড়ে জলের মার লাগতে পারে। শুরুতে কিছুটা কষ্ট হয়, কারও-কারও তো চোখে জল এসে যায়। কিছু অস্থিরতার মতো উৎপন্ন হয় বা একটু জ্বর-জ্বরের মতো মনে হয়, কিন্তু এতে ভয় পাওয়া উচিত নয়। প্রথম দিন ১ থেকে ২ তোলা জলপান করবে, তারপর ধীরে-ধীরে বাড়াতে থাকবে। ভাবপ্রকাশে ২০ তোলা অর্থাৎ প্রায় ২৮০ মিলিলিটার জলপান করা লেখা আছে কিন্তু প্রত্যেক মানুষ তার প্রকৃতির অনুসারে কম বা বেশি করতে পারে। কারও-কারও বায়ুর জন্য অনেক ঢেক আসে, কারণ জলের সঙ্গে বায়ুও ভিতরে যায়, কিন্তু এতে ভয় পাওয়া উচিত নয়। ডান নাসিকার ছিদ্র দিয়ে জলপান করলেও কোনো হানি হয় না। বাম নসিকার ছিদ্র চন্দ্রস্বর হওয়ার জন্য শীতলতা আর শান্ত থাকে। নাসিকা দিয়ে জলপান করলে কারও যদি কষ্ট হয় তাহলে সে মুখ দিয়েই জলপান করবে।
জল পান করে মূত্রত্যাগ (লঘুশঙ্কা) করবে। এটা সর্বদা ধ্যানে রাখবে যে প্রত্যেক অবস্থাতে মল-মূত্র ত্যাগ করার পূর্বে উষঃপান করা আবশ্যক। জল মিষ্টি আর শুদ্ধ হওয়া উচিত, কুয়োর স্বচ্ছ জল সর্বদা ভালো হয়। উষ্ণকালে সায়ংকালের রাখা বাসি শুদ্ধ জলও ভালো থাকে। অনেক ঠান্ডা আর অনেক গরম জল হানি করবে, যাদের কব্জ আছে তারা সায়ংকালে তামার পাত্রে জল রেখে দিবে আর প্রাতঃ সেই জল পান করবে।
🔹উষঃপানের লাভ -

উষঃপানের অনেক লাভ আয়ুর্বেদ গ্রন্থের মধ্যে লেখা আছে। ধন্বন্তরি সংহিতার মধ্যে লেখা আছে -
সবিতুঃ সমুদয়কালে প্রসৃতিঃ সলিলস্য পিবেদষ্টটৌ।
রোগজরাপরিমুক্তো জীবেদ্বত্সরশতম্ সাগ্রম্।।
যে ব্যক্তি সূর্যোদয়ের কিছু পূর্বে আট অঞ্জলি জল পান করে, রোগ আর বৃদ্ধাবস্থা তার সামনে আসে না। সে সর্বদা সুস্থ আর যুবক থাকে। তার আয়ু একশ বছরেরও অধিক হয়।
ভাবপ্রকাশের মধ্যে লেখা আছে -
অর্শঃশোথগ্রহণ্যো জ্বরজঠরজরাকোষ্ঠমেদোবিকারাঃ।
মূত্রাঘাতাস্রপিত্তশ্রবণগলশিরঃ শ্রোণিশূলাক্ষিরোগাঃ।।
য়ে চান্যে বাতপিত্তক্ষতজকৃতা ব্যাধয়ঃ সন্তি জন্তোঃ।
তাম্স্তানভ্যাসয়োগাদপহরতি পয়ঃ পীতমন্তে নিশায়াঃ।।

অর্শ, চুলকানি, সংগ্রহণী জ্বর, পেটের অন্য রোগ, বার্ধক্য, কুষ্ঠ, মেদরোগ অর্থাৎ অধিক মোটা হওয়া, প্রসাব থেমে যাওয়া, রক্ত-পিত্ত, চোখ, কান, নাসিকা, মাথা, কোমর, গলা ইত্যাদির সব পীড়া তথা বাত, পিত্ত, কফ আর ব্রণ (ফোঁড়া) ইত্যাদি হওয়া আর তার সঙ্গে অন্য সব রোগ উষঃপান দ্বারা দূর হয়ে যায়।
এইরকম ভাবে অন্য আরেকটা স্থানে লেখা আছে -
পাতব্যম্ নাসয়া নীরম্ প্রসৃতিত্রয়মাত্রয়া।
ব্যঙ্গবলিপলিতঘ্নম্ পীনসবৈস্বর্য়কাসশোথহরম্।
রজনীক্ষয়েऽম্বুনস্যম্ রসায়নম্ দৃষ্টিসঞ্জনম্।।
নাসিকা দিয়ে প্রতিদিন শুদ্ধ জলের তিন অঞ্জলি প্রাতঃকাল ব্রহ্মমুহূর্তে পান করা উচিত। কারণ এতে বিকলাঙ্গ, ত্বকে ভাঁজ পড়া, বার্ধক্য, কেশ সাদা হওয়া, পিনস নাকের পচে যাওয়া বা নাসিকাতে পোকা হওয়া আদি নাসিকা রোগ, জ্বরে গলা খারাপ হওয়া, দুর্বলতা, সর্দিকাশি, চুলকানি আদি রোগ নষ্ট হয় আর বার্ধক্য দূর হয়ে পুনঃ যুবকাবস্থা প্রাপ্ত হয়। আয়ুর বৃদ্ধি অর্থাৎ দীর্ঘায়ু প্রাপ্ত হয়। চক্ষু সম্বন্ধীয় সব রোগ দূর হয় আর নেত্রজ্যোতি, এইভাবে জল-নেতি করার ফলে খুব বেড়ে যায়। অতঃ ব্রহ্মচর্য তথা প্রত্যেক স্ত্রী-পুরুষকে প্রতিদিন মুখ বা নাসিকার দ্বারা উষঃপানের অমৃত পান করে অমূল্য লাভ নেওয়া উচিত।
(৩) শৌচ -
জল পান করে লঘুশঙ্কা (মূত্র) ত্যাগ করবে। তৎপশ্চাৎ খোলা জঙ্গলে গিয়ে মল ত্যাগ (শৌচ) করবে। শৌচের জন্য গ্রাম থেকে যত দূরে যাওয়া যাবে তত ভালো।
এরমধ্যে মনু মহারাজের প্রমাণ আছে -
দূরাদাবসথান্মূত্রম্ দূরাত্পাদাবসেচনম্।
উচ্ছিষ্টান্ননিষেকম্ চ দূরাদেব সমাচরেত্।
(মনুঃ ৪/১৫১)

মল-মূত্রের ত্যাগ, পা ধোয়া বা এঁটো ফেলে দেওয়া আদি কর্ম ঘর বা নিবাসস্থান থেকে দূরে করা উচিত। মনু জীর আজ্ঞানুসারে প্রাতঃকাল উত্তর দিকে আর সায়ংকালে দক্ষিণ দিকে মুখ করে শৌচের জন্য বসবে। তারপর যেমন লেখা আছে - মুখ তথা দাঁত বন্ধ রাখবে। বাঁ পায়ের উপর চাপ রেখে বসা ভালো, এর ফলে শৌচ খুলে আসে। শৌচের সময় বল দেওয়া বা কথা বলা খুবই হানিকারক। বল দেওয়ার ফলে বীর্য নষ্ট হয়ে যায়। যে মল স্বয়ং আসবে সেটাই ঠিক।
🔹 মল-মূত্র থামিয়ে রাখার ফলে ক্ষতি -

মল-মূত্র ত্যাগের উপর ব্রহ্মচারীকে ভালো করে ধ্যান রাখা উচিত। সর্বদা সব কাজ ছেড়ে উচিত সময়ে শৌচে যাওয়া অত্যন্ত আবশ্যক। যদি কখনও নিশ্চিত সময়ে শৌচে যাওয়ার ইচ্ছা প্রতিত না হয় তবুও শৌচের জন্য অবশ্যই যাওয়া উচিত। মল বিসর্জন না হলেও যাওয়া উচিত, এরফলে মলের উষ্ণতা কম হয়ে যায় আর হানি করে না। কিন্তু যারা এই আশায় বসে থাকে যে যখন শৌচে যাওয়ার ইচ্ছা হবে তখন যাবে, তাদের স্বভাব বিগড়ে যায়। মলের উষ্ণতার কারণে নেত্রের জ্যোতি হ্রাস পেতে থাকে, বল-বীর্যও ক্ষীণ হতে থাকে। অর্থাৎ ব্রহ্মচর্য নষ্ট হয়ে যায়। মাথায় পীড়া হয় একইভাবে অন্য আরও অনেক রোগের উৎপত্তি হয়ে মানুষ সর্বদা রোগী হয়ে থাকে।
মহর্ষি ধন্বন্তরি সুশ্রুতসংহিতার মধ্যে লিখেছেন -
আয়ুষ্যমুষসি প্রোক্তম্ মলাদীনাম্ বিসর্জনম্।
তদম্ত্রকূজনাধ্মানোদরগৌরববারণম্।।
(সুশ্রুতসংহিতা, চিকিৎসা স্থান, অধ্যায় ২৪)

প্রাতঃকালে (উষঃকাল) মল-মূত্র ত্যাগের ফলে আয়ু বাড়ে আর পেট গুড়গুড় করা, পেট ফুলে যাওয়া আর মোটা আদি রোগ দূর হয়। যারা প্রাতঃকাল শৌচ করতে না গিয়ে দেরি করে মল-মূত্র ত্যাগ করে, তাদের পেটে মল ভিতরে-ভিতরে পচে গিয়ে অত্যন্ত দুর্গন্ধযুক্ত আর বিষাক্ত হয়। মলদ্বারে কেঁচি দিয়ে কাটার সমান পীড়া হতে থাকে। অপান বায়ু বিগড়ে গিয়ে তার ঊর্ধ্বগতি হয়, যার ফলে মল উপরের দিকে চড়তে থাকে আর সেটা পুনঃ জঠরাগ্নিতে গিয়ে পচতে থাকে। তারফলে সম্পূর্ণ শরীরের রক্ত দূষিত হয় আর শৌচও ঠিক মতো খুলে হয় না। পেটের মধ্যে অনেক প্রকারের রোগ উৎপন্ন হয়ে ভয়ংকর পীড়া হয়। এইরকম ভাবে বায়ুর অনেক রোগ উৎপন্ন হয়। এইজন্যই লেখা হয়েছে যে "সর্বেষামেব রোগাণাম্ নিদানম্ কুপিতা মলাঃ।" অর্থাৎ সংসারের মধ্যে যত রোগ আছে সেইসবের উৎপত্তি মল কুপিত হওয়ার কারণেই হয়। যে মল বাইরে বেরিয়ে এলে এত ভয়ংকর দুর্গন্ধ হয় যে সবাই সেটা থেকে দূরে পালায় তাহলে সেটা ভিতরে পড়ে থেকে কি সুগন্ধ দিবে? মল-মূত্রকে থামিয়ে রাখা ব্যক্তি কিভাবে সুখী আর সুস্থ থাকতে পারবে, এটা ভাববার বিষয়। এইজন্য ব্রহ্মচারীকে কোনো কাজে ফেঁসে গিয়ে, মোহ লজ্জা বা ভয়ের কারণে, শীতে ঠান্ডার কারণে অথবা আলস্যের কারণে মল-মূত্রাদির বেগকে থামিয়ে রাখা উচিত নয়। যতই আবশ্যক কাজ হোক না কেন সেটা ছেড়ে দ্রুত মল-মূত্রের ত্যাগ করা উচিত। এই কাজকে সবথেকে আবশ্যক মনে রাখবে।
যে ব্রহ্মচারী উপর্যুক্ত কথার ধ্যান না রেখে মল মূত্রের ত্যাগে আলস্য আর প্রমাদ করবে তাহলে সে নিজের ব্রহ্মচর্যকে হারিয়ে ফেলবে। কারণ মল মূত্রের উষ্ণতার ফলে সারা শরীরে উষ্ণতা আর বিষ ছড়িয়ে যায়, ইন্দ্রিয় ক্ষুব্ধ আর চঞ্চল হয়ে ওঠে। ইন্দ্রিয়ের মধ্যে অস্বাভাবিক ক্ষুব্ধতা আর উত্তেজনার কারণে মানুষ রোগী আর কামী হয়ে যায়, যারফলে বীর্য দূষিত হয়ে বিপর্যয় আর রোগের সম্মুখীন হয়। সঠিক সময়ে মল মূত্র ত্যাগ আর শৌচ পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার ফলে দিনের পর দিন স্ফূর্তি, উৎসাহ, প্রসন্নতা, তেজ, পরাক্রম, স্মৃতি, বুদ্ধি আদি সদ্ গুণের বৃদ্ধি হয় আর বীর্য অত্যন্ত শুদ্ধ আর বিকার রহিত হয়, যারফলে ব্রহ্মচর্যতে কোনো বাঁধা আসে না।
আগেই লেখা হয়েছে যে মল মূত্রের উষ্ণতার ফলে বীর্যের নাশ হয়। বীর্য নাশ মানে নিচের স্বাস্থ্যের উপর প্রহার করা।
"ধাতুক্ষয়াত্ রক্তে মন্দঃ সম্জায়তেऽনলঃ।"
বীর্য নাশের ফলে রক্ত আদি ধাতুও নির্বল, দূষিত আর নষ্ট হয়ে যায় আর "বীর্য়ম্ বৈ বলম্" বীর্যের অভাবে, যেটা বলের ভাণ্ডার হয়, জঠরাগ্নিও নিস্তেজ হয়ে তার কাজ করা ছেড়ে দেয়। কারণ বীর্য তথা রক্ত আদি ধাতুর সঞ্চার দ্বারাই সারা শরীরের অবয়বের মধ্যে কাজ করার শক্তি থাকে, তাই এর অভাবে সব কাজ নষ্ট হয়ে যায়। যেভাবে বিদ্যুতের ধারা বন্ধ হয়ে গেলে সম্পূর্ণ কারখানা বন্ধ হয়ে যায়, সেইরকম বীর্যের নাশের ফলে শরীরের সব কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পুনঃ জঠরাগ্নি নিস্তেজ হয়ে যাওয়া আর তারফলে অন্ত্র দুর্বল হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক আর যখন অন্ত্র আর জঠরাগ্নি নিজের কাজ সঠিক ভাবে করে না তখন মলাবরোধ বা মলবদ্ধতার (কব্জ) রোগ স্থিত রূপে প্রকট হয় আর এটাই বীর্য নাশের মুখ্য হেতু; স্বপ্নদোষ, প্রমেহ আদি ভয়ংকর রোগের জন্মদাতা। যাদের পেটে মল পড়ে থাকে, স্বপ্নদোষ তো এমনই ব্যক্তিদের সঙ্গে মিত্রতা করে। এইজন্য মল, মূত্র, অপান-বায়ু আদির বেগকে থামানোর ফলে হানি হয়, লাভ কিছুই হয় না।
মূত্রের বেগকে থামানোর ফলেও মূত্রেন্দ্রিয় আর পেটের মধ্যে পীড়া হয়। মূত্রতে জ্বলন, মাথা ব্যথা এমনকি বীর্যনাশও হয়। মূত্রের বেগকে থামানোর ফলে মূত্রের মধ্যে প্রথম ধাতু রস যার রং সাদা হয় সেটা বেরিয়ে আসে। রসের দ্বারা যে রক্ত আদি অন্য সব ধাতু উৎপন্ন হয় তাদের উৎপত্তি বন্ধ হয়ে যায়। যখন শরীরের মধ্যে শক্তিশালী, স্বাস্থ্যকর আর ধারণকারক ধাতুই থাকে না তখন শরীরের হ্রাস (নাশ) তো অবশ্যম্ভাবী। এইরকম ভাবে রাতে শোয়ার সময় শীত বা আলস্যের কারণে যারা মূত্রের বেগকে থামিয়ে রাখে, মূত্রের উষ্ণতার ফলে তার স্বপ্নদোষ বা বীর্য নাশ হয়।
একইভাবে মলকে থামিয়ে রাখার ফলে যেসব রোগের উৎপত্তি হয় প্রায় সেই রোগ অপান-বায়ুকে থামিয়ে রাখার ফলেও উৎপন্ন হয়। "ন বেগান্ ধারয়েত্-ধীমান্ জাতান্ মূত্রপুরীষয়োঃ।" (চড়ক, সূত্র স্থান ৭/২) মল, মূত্র, অপান- বায়ু (পাদ), হাঁচি, ঢেকুর, হাই তোলা আদির বেগকে কোনো অবস্থাতেই ব্রহ্মচারী অথবা কোনো মানুষকে থামানো উচিত নয়।। থামানোর জন্য তো কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, শোক, ভয়, চিন্তা, অহংকার আদি মনের বেগ অনেক আছে, এদের থামানোর চেষ্টা করা উচিত। মহর্ষি পতঞ্জলি জীও চরক শাস্ত্রের মধ্যে এইভাবে লিখেছেন -
লোভশোকভয়ক্রোধমানবেগান্ বিধারয়েত্।।২৭।।
দেহপ্রবৃত্তির্য়া কাচিদ্বর্ততে পরপীডয়া।
স্ত্রীভোগস্তেয়হিম্সাদ্যা তস্যা বেগান্ বিধারয়েত্।।২৮।।
(চরক সংহিতা সূত্র অধ্যায় ৭)
লোভ, শোক, ভয়, ক্রোধ, অভিমান, অহংকার, নির্লজ্জতা, ঈর্ষা, অতিরাগ আর পরধনের ইচ্ছা আদির বেগকে থামানো উচিত। আর যেসব শারীরিক বেগ অন্যকে পীড়া দেয় তাকেও থামানো উচিত, কারণ এগুলো থামিয়ে রাখলেই লাভ হয়। কিন্তু মল, মূত্র আদি শারীরিক বেগকে থামানো মহামূর্খতা তথা ব্রহ্মচর্যের জন্য অত্যন্ত ঘাতক। অতঃ ব্রহ্মচর্য তথা স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য প্রাতঃ আর সায়ং দুই কালে নিশ্চিত সময়ে মল-মূত্রের ত্যাগ করা কেবল ব্রহ্মচারীই নয় বরং সবার জন্য পরম কর্তব্য। শৌচ না আসলে পড়েও দুই সময়ে শৌচের জন্য যাওয়া উচিত। যদি কোনো সময়ে শৌচ না আসে তাহলেও খুব চিন্তা করা উচিত নয় আর বল দিয়ে (কিছু-কিছু করে) মল বের করার চেষ্টা করা উচিত নয়, এই পদ্ধতিটা ভালো নয়। কারণ এরফলে নির্বল ধাতু (বীর্য) উষ্ণতা পেয়ে মূত্রেন্দ্রিয়ের দ্বারা বেরিয়ে যায়, যারফলে অন্ত্র নির্বল হয়ে শৌচ পরিষ্কার হওয়ার স্থানে উল্টা মলবদ্ধতা (কব্জ) আরও অধিক হয়ে যায়।
🔹 যদি শৌচ না আসে তাহলে -
যদি শৌচ ঠিকমত না আসে আর স্থাই মলবদ্ধের (কব্জ) রোগ থাকে তাহলে জল পান করে শৌচে যাওয়ার পূর্বে পেটের পশ্চিমোত্তান আসন, ময়ূর আসন আদি আসন তথা অন্য হালকা ব্যায়াম করবে। পেটকে খুব নাড়াবে তারপর শৌচ করতে যাবে। মার্গে যাওয়ার সময় মনে এটা দৃঢ় নিশ্চয় করবে যে আমার খুব শীঘ্র শৌচ এসেছে আর যদি আমি তীব্র গতিতে না চলি তাহলে মার্গেই মল বেরিয়ে বস্ত্র খারাপ হয়ে যাবে। মল ত্যাগের জন্য বসে পড়ার পরেও এইভাবে ধ্যান করবে যে, সব মল মলদ্বার দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসছে, এমনটা করলে মলবদ্ধ হবে না। এমন দৃঢ় নিশ্চয় আর ধ্যানের প্রভাব আমাদের শরীরের উপর খুব পড়ে। একে হাস্যকর মনে করে উড়িয়ে দিবে না, আসলে আমরা শরীরের স্বামী না হয়ে দাস হয়ে বসে আছি, এইজন্য অনেক কষ্ট বহন করতে হয়।
🔹 মলদ্বারের শুদ্ধি -
শৌচে যাওয়ার সময় পর্যাপ্ত পরিমাণের বড় জলপাত্রে শুদ্ধ জল ভরে অবশ্যই সঙ্গে নিয়ে যাবে। পর্যাপ্ত জলে ভরা জলপাত্র না নিয়ে যাওয়া মহামূর্খতা হবে। যারা জলপাত্র সঙ্গে নিয়ে যায় না তারা ইতস্ততঃ পড়ে থাকা নোংরা জল দিয়ে মলদ্বারকে শুদ্ধ করে, যার ফলে অর্শ আদি অনেক রোগ হয়। কেই-কেই এমন পাক্কা বাবু জী হয় যে তারা জল দিয়ে শুদ্ধ করে ফেলার কষ্টই করে না, কেবল কাগজ বা কাপড় দিয়ে মুছে ফেলে দেয় যা অত্যন্ত হানিকারক। শৌচ বা মল ত্যাগ করার পর জল দিয়ে মলদ্বারকে ধোয়ার রীতি সারা ভারতবর্ষে প্রচলিত কিন্তু খুব অল্প সংখ্যক ব্যক্তি আছে যারা সেইভাবে মলদ্বারের শুদ্ধি করতে চায়। প্রায়শঃ শৌচের সময় অধিক হতে অধিক এক সের জলের প্রয়োগ করে, কেউ-কেউ তো এক পাব জল দিয়েই কাজ চালিয়ে দেয়। কত আশ্চর্যের কথা! যে এক পাব জল দিয়ে কিভাবে মলদ্বার শুদ্ধ হতে পারে, অথচ কোনো বিশেষ অবস্থায় তো এক ঘড়া দিয়েও কাজ হয় না। এটা যদিও সাধারণ কাজ বলে মনে হয়, কিন্তু খুব কম ব্যক্তি আছে যারা মলদ্বারের যথার্থ শুদ্ধির বিধি বা প্রকারকে জানে।
এইজন্য এই লোকোক্তিটা প্রসিদ্ধ -
"বুদ্ধিমান হয়ে ঘুরে বেড়ায়, হেগে (শৌচ করে) হাতও ধুতে জানে না।"
পাঠক! ক্ষমা করবেন। যারা অধিক শিক্ষিত হয় তারাই এই বিষয়ে অধিক মূর্খ হয়। যদি এই মূর্খতার সাক্ষাৎ দর্শন করতে চাও তাহলে শহরের সমস্ত পরিবার তথা কলেজের ছাত্রাবাসের মধ্যে প্রতিদিন হতে পারে। শহরে একটা গৃহস্থের পরিবার সবকিছু একটা নোংরা তামলোট দিয়ে (যাকে না কখনও ধোয় আর না মাটি দিয়ে মাজে) বছরের পর বছর ধরে কাজ চালিয়ে যায়। একইভাবে কলেজের ছাত্র এই ধোয়া-মাজার কষ্ট থেকে বাঁচার জন্য কাঁচের বোতলের ব্যবহার করে। কিন্তু এই ধরনের ছোটো-ছোটো ভুলের জন্য তাদের আরও অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়। প্রমাদ বা অজ্ঞানই হচ্ছে এর মূল কারণ।
মানুষ এটা জানে না যে মলদ্বার হচ্ছে মল বের করার মার্গ, সেটা থাকার স্থান নয়। সাধারণ মানুষের এই বিষয়ে জ্ঞান নেই যে শৌচের পরেও মলদ্বারের ভিতরে মল রয়ে যায়, যা মলদ্বারে একটুখানি জল দিয়ে কেবল বাইরে ধুলেই দূর হয়ে যায় না, এই মলই ভিতরে পড়ে থেকে-থেকে পচতে থাকে। এইভাবে অনেক সময় পর্যন্ত প্রমাদ বা অজ্ঞানের কারণে শুদ্ধি না হওয়ার জন্য অর্শ, ক্যানকার ঘা আর মলদ্বারে ফোঁড়া আদি ভয়ংকর রোগ উৎপন্ন হয়, যারমধ্যে আজ সংসার ফেঁসে আছে। এইজন্য মহর্ষি পতঞ্জলি জী চরক সংহিতার মধ্যে লিখেছেন -
মেধ্যম্ পবিত্রমায়ুষ্যমলক্ষ্মী-কলিনাশনম্।
পাদয়োর্মলমার্গাণাম্ শৌচাধানমভীক্ষ্ণশঃ।।
(চরকসংহিতা, সূত্রস্থান, অধ্যায় ৫/৯৫)

পাদ (পা) মল মার্গ (নাক, কান, মলদ্বার, উপস্থেন্দ্রিয়) আদিকে প্রতিদিন বারংবার মল রহিত বা শুদ্ধ করলে বা ধুয়ে নিলে বুদ্ধি, পবিত্রতা তথা আয়ুর বৃদ্ধি হয়। দরিদ্রতা, পাপ তথা রোগের নাশ হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত পাশ্চাত্য সভ্যতা ভারতে পা ফেলেনি সেই সময় পর্যন্ত চরকের এই শ্লোকের মহিমা সম্বন্ধে এখানকার মানুষের পূর্ণ জ্ঞান ছিল। তখনকার মানুষ ভূমিতে মল ত্যাগ করতো, মাটি দিয়ে হাত মাজতো, তারা ছিল প্রাচীন সভ্যতার ভক্ত। তারা যদিও কোট, বুট, পতলুন (প্যান্ট) আদি অপ্রাকৃতিক বস্তু সম্বন্ধে অপরিচিত ছিল কিন্তু তারা ছিল স্বাস্থ্য আর চরিত্ররূপী ধনের ধনী তথা বল বা শক্তির ভাণ্ডার। আজও যারা প্রাচীন শৈলীর প্রাকৃতিক জীবন ব্যতীত করে, সৌভাগ্যক্রমে যাদের মাথায় পাশ্চাত্য সভ্যতার ভূত চড়ে নি, তারা আজও এই শ্লোকের গুরুত্বকে ভালো ভাবে বোঝে আর এর অনুসারে শ্রদ্ধাপূর্বক আচরণ করে পূর্ণ লাভ তুলে নেয়। মল-মূত্রের মার্গের শুদ্ধির এতটুকুই আবশ্যকতা যে যতটুকু ভোজনের পশ্চাৎ মুখ আর দাঁতের তথা চোখ, নাক, কান আদি শরীরের অন্য অঙ্গের শুদ্ধির আবশ্যকতা হয়, কারণ এটাও তো শরীরের আবশ্যক অঙ্গ। যেভাবে মুখ, নাসিকা আদির নোংরা রয়ে গিয়ে অনেক রোগের উৎপত্তি হয়, সেইভাবে মল-মূত্রের মার্গের যথাযথ শুদ্ধির অভাবে অনেক ভয়ংকর রোগের জন্ম হয়। এইজন্য মহর্ষি চরক জীর আজ্ঞানুসারে শৌচের পশ্চাৎ মলদ্বারের ভিতরে আর বাইরে ভালো করে জল আদি দিয়ে শুদ্ধি করা অনিবার্য।

🔹 মলদ্বার শুদ্ধির প্রকার -
মলদ্বারের ভিতরে বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের পাশের যেকোনো আঙ্গুল কিছুটা প্রবেশ করিয়ে আঙ্গুলকে চতুর্দিকে ঘুরিয়ে যেসব মল মলদ্বারের ভিতরের চক্রে লেগে আছে তা ডানহাত দিয়ে জল দিতে-দিতে ভালো করে শুদ্ধ করে নিবে। তৎপশ্চাৎ মাটি লাগিয়ে অনেকবার জল দিয়ে ধুয়ে নিবে। পুনঃ নিজ স্থানে গিয়ে বারংবার মাটি লাগিয়ে দুই হাত তথা তারপর জলপাত্রকেও মাটি আর জল দিয়ে এমন ভাবে মাজবে বা ধুবে যাতে মল-মূত্রের কিঞ্চিৎমাত্রও দুর্গন্ধ না থাকে। এইভাবে মলদ্বার শুদ্ধির ফলে অনেক লাভ হয়।
🔹 মলদ্বার শুদ্ধির লাভ -
উপরিউক্ত ক্রিয়াকে হঠয়োগীরা প্রতিদিন করে, তাদের পরিভাষায় এর নাম হল "গণেশ ক্রিয়া"। এটা প্রতিদিন করলে মলবদ্ধতা (কব্জ) কখনও হবে না অর্থাৎ মল বিসর্জনের ক্রিয়া ঠিক থাকবে। যাদের মলবদ্ধতা (কব্জ) আছে তাদেরও শৌচ ভালো করে হবে। শরীর আর মন দুটোই নির্মল হয়ে চিত্ত প্রসন্ন আর শান্ত হবে। নোংরা পরমাণু মস্তিষ্কের দিকে আসতে পারবে না, তাই মস্তিষ্ক ঠান্ডা আর মন একাগ্র হবে, আলস্য বিন্দুমাত্র থাকবে না, সর্বদা স্ফূর্তি আর উৎসাহ বজায় থাকবে। মলদ্বারের শুদ্ধির ফলে সবথেকে বড় লাভ এই হয় যে এরফলে বীর্যের মধ্যে শীতলতা আসে, কারণ বীর্য-বাহক নাড়িগুলো মলদ্বার থেকে হয়েই বাইরে আসে। এইজন্য ব্রহ্মচর্য রক্ষা করতে এটা বড় সহায়ক হয় আর মূত্রাশয় তথা অর্শ, মলদ্বারে ফোঁড়া আদি মলদ্বারের রোগগুলো এর থেকে অনেক দূরে থাকে।
শুদ্ধির বিষয়ে মনু মহারাজ লিখেছেন -
বিণ্মূত্রোত্সর্গশুদ্ধ্যর্থম্ মৃদ্বার্য়াদেয়মর্থবত্।
দৈহিকানাম্ মলানাম্ চ শুদ্ধিষু দ্বাদশস্বপি।।
(মনুঃ ৫/১৩৪)
মল-মূত্র ত্যাগ আর শরীরের বাইরের মলের শুদ্ধির জন্য ততটুকু মাটি আর জল নিবে যতটুকু দিয়ে দুর্গন্ধাদি দূর হতে পারে।
🔹 বাইরের মল হল -
বসাশুক্রমসৃঙ্গমজ্জামূত্রবিঙ্ঘ্রাণকর্ণবিট্।
শ্লেষ্মাশ্রু দূষিকাস্বেদো দ্বাদশৈতে নৄণাম্ মলাঃ।।
একা লিঙ্গে গুদে তিস্রস্তথৈকত্র করে দশা।
উভয়োঃ সপ্ত দাতব্যা মৃদঃ শুদ্ধিমভীপ্সতা।।
(মনুঃ ৫/১৩৫-১৩৬)
চর্বি, বীর্য, রক্ত, মলদ্বার, মল, মূত্র, নাকের নোংরা, কানের নোংরা, কফ, চোখের জল - মল আর ঘাম - এই হল মানুষের বাইরের মল। শুদ্ধি করতে ইচ্ছুক মানুষ মূত্রের স্থানে একবার, মলদ্বারে তিনবার, বাঁ হাতে দশবার তথা দুই হাতে সাতবার মাটি লাগাবে।
🔹 মূত্রেন্দ্রিয়ের শুদ্ধি -
মহর্ষি চরকের আজ্ঞানুসারে সমস্ত মল মার্গের শুদ্ধি করা অত্যন্ত আবশ্যক। শৌচের সময় প্রতিদিন মূত্রেন্দ্রিয়ের শুদ্ধি করা উচিত, এতে প্রমাদ করবে না। জল হচ্ছে স্বয়ং স্বাভাবিক রূপে মল শুদ্ধকারী বস্তু। মূত্রেন্দ্রিয়ের আন্তরিক ভাগকে তো মূত্রই জলের কিছু পরিবর্তিত রূপে প্রতিদিন এসে পরিষ্কার করে দেয় আর স্বয়ংও বাইরে বেরিয়ে আসে। কিন্তু মূত্রেন্দ্রিয়ের পরের ভাগটাকে ত্বক ঢেকে রাখে। এর নিচে এক প্রকারের সাদা বস্তু, যে মল হয়, সেটা উৎপন্ন হতে থাকে আর ত্বকের নিচে এদিক-সেদিক জমে যায়। যদি এটা সরিয়ে শুদ্ধ না করা হয় তাহলে এই বস্তু ভিতরে একত্রিত হয়ে চুলকানি উৎপন্ন করবে আর একে স্বাভাবিক রূপে বালক চুলকাবে আর এখান থেকেই দোষ উৎপন্ন হয়। এই ক্রিয়া অনেক ভয়ংকর দোষ আর সর্বনাশের কারণ হয়। তাই শৌচের সময় অথবা মূত্র ত্যাগের সময় মূত্রেন্দ্রিয়ের অগ্রভাগের ত্বচাকে পিছনে সরিয়ে এই নোংরা মলকে প্রতিদিন জল দিয়ে সর্বথা ধুয়ে নিবে, একে কখনও একত্রিত হতে দিবে না। মূত্রেন্দ্রিয় ধোয়ার সময় ব্রহ্মচারীরা কখনও অধিক ঘর্ষণ করবে না, কারণ ঘর্ষণের ফলে ইন্দ্রিয়তে উত্তেজনা উৎপন্ন হয়ে বীর্যনাশের সম্ভাবনা থাকে।
🔹 মূত্রেন্দ্রিয়ের স্নান -
মূত্রেন্দ্রিয়ের অগ্রভাগের ভিতরে যে ছিদ্র আছে যেখান থেকে প্রসাব বের হয়, ঠিক এই ছিদ্রের উপর শীতল জলের ধারা অনেক হালকা করে প্রতিদিন অনেকবার দেওয়া উচিত, দুই-তিন মিনিট পর্যন্ত এইভাবে জল নিরন্তর দিলে পরে অত্যধিক লাভ হয়। মূত্রেন্দ্রিয়ের সব শিরা একত্রিত হয়ে যায়, তাকে শরীরের সব জ্ঞান তন্তুর কেন্দ্র বা মূল বলা যেতে পারে। যেভাবে বৃক্ষের মূলে জল দিলে সেটা শক্তি পায় আর সম্পূর্ণ বৃক্ষ সবুজ হয়ে ওঠে, ঠিক সেইভাবে শীতল জলের ধারা দেওয়ার ফলে মূত্রেন্দ্রিয় ঠান্ডা হওয়াতে সম্পূর্ণ শরীরে শীতলতা আসে আর একটা বিশেষ শান্তি পাওয়া যায়। এর বিপরীত দুষ্ট বিচার বা কুচেষ্টার কারণে যদি মূত্রেন্দ্রিয়তে উত্তেজনা বা উষ্ণতা আসে তাহলে সারা শরীরে উষ্ণতা উৎপন্ন হয় আর সেটাই বীর্য নাশের কারণ হয়। তাই যখন-যখন মল আর মূত্র ত্যাগ করবে মূত্রেন্দ্রিয়কে ঠান্ডা জল দিয়ে ধুয়ে নিবে। এইভাবে দিনে অনেকবার মূত্রেন্দ্রিয় স্নান করার ফলে অনেক লাভ হয়।
এইজন্য মলমূত্র ত্যাগ করতে যাওয়ার সময় সঙ্গে জলপাত্র নিয়ে যাওয়ার কথা ঋষিরা লিখেছেন। এই নিয়মের মধ্যে বীর্য রক্ষার অনেক বড় রহস্য লুকিয়ে আছে। ইন্দ্রিয় স্নানের সময় ঠান্ডা জলের ধারা দেওয়ার পর সম্পূর্ণ মূত্রেন্দ্রিয় আর অণ্ডকোষকে ভালো ভাবে ঠান্ডা জল দিয়ে শুদ্ধ আর শীতল করে দেওয়া উচিত। শৌচ তথা মূত্রেন্দ্রিয় স্নানের জন্য কক্ষনো উষ্ণ (গরম) জলের ব্যবহার ভুলেও করা উচিত নয়। মূত্রেন্দ্রিয়ের শুদ্ধি আর স্নানের ফলে স্বপ্নদোষ, প্রমেহ (শৌচ বা মূত্র ত্যাগের সময় বীর্য বেরিয়ে আসা) আদি রোগের থেকে নিবৃত্তি হয়, আর এইসব হওয়ার সম্ভাবনাই থাকে না। অনেক স্বপ্নদোষের রোগীকে কেবল এই ক্রিয়ার দ্বারাই সুস্থ হতে দেখা গেছে, পঞ্চাশ শতাংশ লাভ প্রায় সব রোগী পেয়ে যায়। এই একটুখানি ক্রিয়ার ফলে মূত্রেন্দ্রিয়ের ব্যর্থ উত্তেজনা সমাপ্ত হয়ে বীর্যের মধ্যে স্তম্ভন শক্তি আর গাঢ়ত্ব আসে, মনের চঞ্চলতা শান্ত হয়। জ্বলন্ত কামাগ্নিও শান্ত হয়ে যায়। কিন্তু একটা কথা সদা ধ্যানে রাখবে যে, বিনা কোনো কারণে কখনও ভুলেও মূত্রেন্দ্রিয় স্পর্শ করবে না। মূত্রেন্দ্রিয় শুদ্ধি অথবা মূত্র ত্যাগের সময় যখনই একে স্পর্শ করবে সেই সময় "ও৩ম্" জপ আরম্ভ করে দিবে।
ভাব পবিত্র আর উঁচু রাখবে। মূত্রেন্দ্রিয় হচ্ছে কালো নাগের সমান আর পবিত্র বিচারের সঙ্গে ও৩ম্ -এর জপ হল নাগদমনের ওষুধ। অতঃ যখনই মূত্রেন্দ্রিয় স্পর্শ করার আবশ্যকতা হবে তো তখনই ও৩ম্ -এর জপও সঙ্গে-সঙ্গে আরম্ভ করে দিবে। একে অকারণে স্পর্শ করা মানেই মৃত্যুকে আহ্বান জানানো, এটা সর্বদা মনে রাখবে। একে অকারণে স্পর্শ বা মর্দন করা বিনাশেরই কারণ হয়। এইজন্য মহর্ষি দয়ানন্দ জী লিখেছেন যে - "উপস্থেন্দ্রিয়ের স্পর্শ আর মর্দনের ফলে বীর্যের ক্ষীণতা, নপুংসকতা হয় আর হাতে দুর্গন্ধও হয়, তাই এর স্পর্শ করবে না।" অতঃ মহর্ষি দয়ানন্দ জী এই বাক্য লিখে আমাদের আগে থেকেই সাবধান করে দিয়েছেন। আজ মূত্রেন্দ্রিয় রূপী বিষাক্ত নাগকে অকারণে উত্যক্ত করে সংসারের কত হানি আর বিনাশ হয়েছে সেটা ভাবামাত্রই কান্না আসে। অতঃ মূত্রেন্দ্রিয়ের শুদ্ধি বা স্নান আর মল ত্যাগের সময় কেবল আবশ্যকতা হলেই মূত্রেন্দ্রিয়কে স্পর্শ করবে কিন্তু সেই সময়ও শুদ্ধ বিচার আর পবিত্র ভাবনা রাখবে নয়তো লাভের স্থানে হানি হতে পারে। মূত্রেন্দ্রিয়ের স্নান বা শুদ্ধি শুধু ব্রহ্মচারীই নয় বরং প্রত্যেক ব্রহ্মচর্য প্রেমীকে প্রতিদিন করা উচিত। মূত্রেন্দ্রিয়ের বাহ্য ভাগকে মাটি লাগিয়ে জল দিয়ে প্রতিদিন শুদ্ধ করা উচিত, এইভাবে প্রতিদিন করলে অনেক ধরণের বীর্য সম্বন্ধীয় রোগ থেকে ব্রহ্মচারী বেঁচে থাকবে। অতঃ একে ব্যর্থ আর সাধারণ কথা ভেবে এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয় বরং একে নিজের দিনচর্যার অঙ্গ ভেবে প্রতিদিন শ্রদ্ধাপূর্বক করা উচিত।
🔹 সাবানের ব্যবহার -
শুদ্ধির জন্য জল আর মাটি হচ্ছে সর্বোত্তম কিন্তু আজকের সংসার অনন্য, সেটা নিজের শৈলীর অনুসারেই চলে। এইজন্য ব্রিটিশ ফ্যাশনের ব্যক্তিরা বেশির ভাগ শৌচের পশ্চাৎ হাত শুদ্ধ করার জন্য সাবানের ব্যবহার করে। সাবানের ব্যবহার করে সাধারণ শুদ্ধি তো হয়ে যায় কিন্তু এরফলে রুক্ষতা খুব বেড়ে যায় আর ধনও অধিক ব্যয় হয়। যারা সাবানের ব্যবহার করে তারা ভালো ভাবেই জানে যে সাবান দিয়ে ধুলে বা স্নানের পশ্চাৎ হাত আদি শরীরের অঙ্গ কত রুক্ষ হয় আর মাটি মেখে হাত ধুলে যে শুদ্ধি হয় সেটা সাবান দিয়ে কখনও হবে না। কারণ মাটির স্বাভাবিক গুণই হচ্ছে গন্ধ, তাই দুর্গন্ধ দূর করতে যতটা শক্তি মাটির মধ্যে আছে ততটা অন্য কোনো পদার্থের মধ্যে নেই। আর যেভাবে বিনা কোনো সংকোচে আমরা অধিক মাটি উদারতার সঙ্গে ব্যবহার করতে পারি, সেইভাবে সাবানের ব্যবহার করতে তা সে যতই ধনাঢ্য হোক না কেন সংকোচই করবে, কারণ এতে ধনের অধিক ব্যয় হয়। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশের মধ্যে যতই সাবানের ব্যবহার বেড়ে চলেছে, ততই চর্ম রোগের বৃদ্ধি বেড়ে চলেছে। লাহৌরসোর, লোকলসোর, মুগলীফোঁড়া, চম্বল আদি বিচিত্র সব রোগ যাদের কখনও নামও শোনা যেত না আজ সেগুলো এই সাবানের কৃপায় শুধু নগরেই নয় তারসঙ্গে ছোটো-ছোটো গ্রামের মধ্যেও পৌঁছে গেছে আর বিশেষ করে দিল্লি, কলকাতা, মুম্বাই, অমৃতসর আদি বড়-বড় নগরের মধ্যে যেখানে নকল জেন্টালম্যান খুব পা ছড়িয়ে বসেছে আর জনতার মাথায় ফ্যাশনের ভূত ভয়ংকর ভাবে মাথায় চড়ে আছে, সেখানকার জনতা সারাদিন এমনি করেই নিষ্কারণ সাবানের ব্যবহার করতে থাকে। সেখানে দাদ, চুলকানি, চম্বল, লোকলসোর আদি চর্ম রোগের রাজত্ব চলছে। ব্রিটিশ পদ্ধতির সাবানের মধ্যে প্রায়শঃ পশুর চর্বি থাকে আর সোডা কাস্টিক যা দিয়ে সাবান তৈরি হয়, এটা অত্যন্ত তীক্ষ্ণ হয় যা ত্বকের জন্য অত্যন্ত হানিকারক, এমনকি শরীরের ত্বককে পর্যন্ত জ্বালিয়ে দেয়। এইজন্য স্বাস্থ্যপ্রিয় মানুষকে ফ্যাশনের জন্য স্নান তথা হাত আদি ধোয়ার জন্য সাবান ব্যবহারের মূর্খতা করা উচিত নয়, এতে কেবল হানিই আছে লাভের কিছুই নেই। কিভাবে ভালোভাবে শরীর শুদ্ধি বিনা সাবান ব্যবহার করে হতে পারে তার জন্য এই পুস্তকের স্নান সম্বন্ধীয় ভাগ পড়ে নিবে।
🔹 শৌচ সম্বন্ধীয় আবশ্যক বিষয় -
মল-মূত্র ত্যাগের বিষয়ে মনু জীর আদেশ -
ন মূত্রম্ পথি কুর্বীত ন ভস্মনি ন গোব্রজে।
ন ফালকাষ্ঠে ন জলে ন চিত্যা ন চ পর্বতে।।৪৫।।
ন জীর্ণদেবায়তনে ন বল্মীকে কদাচন।।৪৬।।
(মনুঃ অধ্যায় ৪)
মার্গ (পথ), ছাই, গোশালা বা গোচর ভূমিতে মূত্র ত্যাগ (প্রসাব) করবে না। চাষ করা খেতে, জলে, চিতাতে, উঁচু ঢিপি, যজ্ঞশালা বা মন্দিরে, পঁচা নোংরা আদি কীটপতঙ্গের আস্থানায় কখনও মলমূত্র ত্যাগ করবে না।
মুনিবর চাণক্য কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রের মধ্যে লিখেছেন -
"নাপ্সু মূত্রম্ কুর্য়াত্" (সূত্র ৪০৬) অর্থাৎ জলের মধ্যে মূত্র ত্যাগ করবে না।
এখনকার মানুষ ঋষিদের এই পবিত্র শিক্ষার উপর ধ্যান দেয় না আর নির্লজ্জ হয়ে উঁচু ঢিপি আর পথের উপরই মলমূত্র ত্যাগ করতে দেখা যায়। যজ্ঞশালা মন্দিরাদি পবিত্র ধার্মিক স্থানের মধ্যে এদের শ্রদ্ধাই নেই। গোশালা বা গোচর ভূমিতে মল ত্যাগ না করার গুরুত্বকে এরা কি বুঝবে! এমন মানুষদের কৃপাতেই তো গৌ আদি পবিত্র পশু মল ভক্ষণ করছে। উপরিউক্ত নিষিদ্ধ স্থানে মলমূত্র ত্যাগ করার ফলে পবিত্র ধার্মিক স্থানের পবিত্রতা নষ্ট হয়। গাভীর চারা, অন্ন, জল আদি দূষিত হয়ে স্বাস্থ্য খারাপ হয় আর জলবায়ু দূষিত হয়ে অন্য সব প্রাণীর হানি হয়। পোকা-মাকড়ের আবাসভূমিতে মলমূত্র ত্যাগের মূর্খতা করার জন্য সর্পাদি বিষাক্ত প্রাণীর দ্বারা কামড় খাওয়া মূর্খদের দর্শন আমি করেছি। অতঃ এইরকম নিষিদ্ধ স্থানে মলমূত্র ত্যাগ করার ফলে হানির অতিরিক্ত লাভের কিছুই নেই। শুধু অশিক্ষিতই নয়, শিক্ষিত বাবুরাও নির্লজ্জ হয়ে জানা সত্ত্বেও জেনেশুনে উঁচু-উঁচু স্থানে, পথ চলা মার্গের উপর বা অত্যন্ত নিকটে মাথা নিচু করে মল ত্যাগ করার জন্য বসে যায়। মানুষ যখন নির্লজ্জ হয় তখন নিষিদ্ধ স্থানে মলমূত্র ত্যাগ তো অতি সাধারণ বিষয়, সে না জানি কি কি অপকর্ম করে ফেলে। আমার স্পষ্ট মনে আছে এমনি এক নীচ মানুষ যজ্ঞ বেদীতে মল ত্যাগ করে নিজের মুখ কালো করে গিয়েছিল। এইভাবে মলমূত্র ত্যাগের বিষয়ে মনু জী মহারাজ আরও আদেশ দিয়েছেন -
ন সসত্বেষু গর্তেষু ন গচ্ছন্নাপি চ স্থিতঃ।
ন নদীতীরমাসাদ্য ন চ পর্বতমস্তকে।।
বায়্বগ্নিবিপ্রমাদিত্যমপঃ পশ্যম্স্তথৈব গাঃ।
ন কদাচন কুর্বীত বিণ্মূত্রস্য বিসর্জনম্।।
(মনুঃ ৪/৪৭-৪৮)
যেখানে জীব বাস করে এমন গর্তে, চলতে-চলতে তথা দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে, নদী আদি জলাশয়ের তীরে আর পর্বত শিখরে মল-মূত্র ত্যাগ করবে না। বায়ু, অগ্নি, বিপ্র (বিদ্বান বা মেধাবী পুরুষ), সূর্য, জল আর গাভীকে দেখে কখনও মলমূত্র ত্যাগ করবে না।
যেসব গর্তে জীব থাকে তাতে মলমূত্র ত্যাগ করলে যেমন সেই প্রাণীদের হানি আর কষ্ট হয় তেমনই হানি সেই ব্যক্তিরও হতে পারে যেমনটা আমি পূর্বে লিখেছি।
দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে বা চলতে-চলতে মলমূত্র ত্যাগ করা সভ্যতা আর স্বাস্থ্যের বিরুদ্ধ আর এইরকম ভাবে মলমূত্র ত্যাগ সঠিক ভাবে হয়ও না। কিন্তু ঋষিদের শিক্ষার বিরুদ্ধে চলার স্বভাব এখনকার ইংরেজি জানা বাবুদেরই বেশি দেখা যায়। এইভাবে নদীর তীরে আর পর্বতের শিখরে মল মূত্র ত্যাগ করার ফলে পবিত্র জল আর দিব্য বনৌষধি দূষিত হয়ে আরোগ্য প্রদান করার স্থানে হানিকারক হয়। উপকারের স্থানে হানি করা মানুষের ধর্ম নয়।
অগ্নি, বায়ু, জল আর সূর্যকে দেখে মলমূত্র ত্যাগ করার ফলে সীপ আদি অনেক চরম রোগের ফলে মানুষ কষ্ট পায়।
বিপ্র, বিদ্বান, মেধাবী পুরুষ আর গৌমাতা আদি যাদের মানুষ পূজ্য মনে করে, তাদের দিকে দেখে মলমূত্র ত্যাগ করার ফলে, যে শ্রদ্ধা আর আদরের ভাবনা তাদের প্রতি আছে সেটা আর থাকে না, এরফলে মানুষ নির্লজ্জ হয়ে আরও অনেক ধরনের কুকৃত্য করে। ভয় আর লজ্জার কারণেও মানুষ অনেক ধরণের পাপ থেকে বাঁচে। অতঃ উপরিউক্ত নিষিদ্ধ স্থানে কখনও মলমূত্র ত্যাগ করা উচিত নয় আর যারা এমন করে তাদের মানুষ নয় বরং তাদের পশুর বড় ভাই মানা উচিত।
তিরস্কৃত্যোচ্চরেত্কাষ্ঠলোষ্টপত্রতৃণাদিনা।
নিয়ম্য প্রয়তো বাচম্ সম্বীতাঙ্গোऽবগুণ্ঠিতঃ।।
(মনুঃ ৪/৪৯)
কাষ্ঠ, মাটি তথা তৃণ (গুল্ম) বৃক্ষাদির আড়ালে বসে বস্ত্র দিয়ে গুপ্তাঙ্গকে ঢেকে তথা মাথা বেঁধে প্রতিদিন নিয়ম করে মৌন হয়ে মলমূত্র ত্যাগ করা উচিত।
মূত্রোচ্চারসমুত্সর্গম্ দিবা কুর্য়াদুদঙ্মুখঃ।
দক্ষিণাভিমুখো রাত্রৌ সম্ধ্যয়োশ্চ য়থা দিবা।।
(মনুঃ অধ্যায় ৪/৫০)
দিনের বেলা উত্তর দিকে মুখ করে, রাতে দক্ষিণ দিকে আর সায়ং-প্রাতঃকালেও উত্তর দিকে মুখ করে মলমূত্র ত্যাগ করবে।
মনু জী মহারাজ কিভাবে কোথায় কোন বস্তুর আড়ালে বা পিছনে মলমূত্র ত্যাগ করা উচিত সেটাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন। প্রাতঃ, সায়ং, দিন আর রাতে কোন দিকে মুখ করা উচিত এটাও স্পষ্টভাবে লিখে দিয়েছেন। এই বিষয়ে কেউ-কেউ বলে যে, যেদিকে বায়ু চলে সেইদিকে মুখ করা উচিত।
বিশেষ অবস্থাতে মলমূত্র ত্যাগ করার বিষয়ে মনু জী নিম্নলিখিত বিধান করেছেন -
ছায়ায়ামন্ধকারে বা রাত্রাবহনি বা দ্বিজঃ।
য়থাসুখমুখঃ কুর্য়াত্প্রাণবাধাভয়েষু চ।।
(মনুঃ ৪/৫১)
ভিত্তি বা মেঘের ছায়াতে, রাত, ঝর তথা মেঘাদি দ্বারা হওয়া বিশেষ অন্ধকারে, শারীরিক ক্লেশ অথবা কোনো ধরণের আপত্তি আসার ভয় হলে, এইরকম অবস্থাতে রাত বা দিনের দিশার জ্ঞান না থাকলে দ্বিজ যেদিকে ইচ্ছা সেইদিকে মুখ করে মলমূত্র ত্যাগ করতে পারবে।
প্রত্যগ্নিম্ প্রতি সূর্য়ম্ চ প্রতিসোমোদকদ্বিজান্।
প্রতিগাম্ প্রতিবাতম্ চ প্রজ্ঞা নশ্যতি মেহতঃ।।
(মনুঃ ৪/৫২)
অগ্নি, সূর্য, চন্দ্র, জল, দ্বিজ, গৌ আর বায়ুর সম্মুখে মূত্র ত্যাগকারী পুরুষের নির্মল বুদ্ধি নোংরা আর নষ্ট হয়ে যায়। এই বিষয়ে পূর্বেও লিখেছি যে মনু জীর এই আজ্ঞার বিরুদ্ধে আচরণ করলে মানুষের অনেক রোগ হয়। রোগী মানুষের বুদ্ধি তো খারাপই হয়, তার উপর যদি বুদ্ধিই না থাকে তাহলে এর থেকে বড় আর কি হানি হতে পারে।
"বুদ্ধির্য়স্য বলম্ তস্য, নির্বুদ্ধেস্তু কুতো বলম্"
বুদ্ধির বল হচ্ছে সবথেকে বড় বল। এটা হারিয়ে ফেললে মানুষের কাছে থাকবেই বা কি! অতঃ সবাইকে মনু জী মহারাজের আজ্ঞার পালন করা উচিত।
নাপ্সু মূত্রম্ পুরীষম্ বা ষ্ঠীবনম্ বা সমুত্সৃজেত্।
অমেধ্যলিপ্তমন্যদ্বা লোহিতম্ বা বিষাণি বা।।
(মনুঃ ৪/৫৬)
মলমূত্র, থুতু, কফ, মলমূত্র যুক্ত বস্তু, রক্ত আর বিষ বা বিষাক্ত পদার্থ জলের মধ্যে ফেলবে না।
জলের মতো পবিত্র পদার্থে যারজন্য "জলম্ বৈ জীবনম্" অর্থাৎ জল হচ্ছে প্রাণীমাত্রের জন্য জীবনের আধার বলা হয়েছে, তারমধ্যে মলমূত্র আদি নোংরা পদার্থ, তেমনই রক্তাদি অভক্ষ্য আর বিষাক্ত পদার্থ ফেলা মূর্খতা ছাড়া আর কি হবে! ভগবান যে জলকে শিবতম রস বলে জলের শ্রেষ্ঠতা আর গুণের ব্যাখ্যা করেছে, তার মধ্যে দূষিত পদার্থ ফেলে তাকে নোংরা করা কোনো বিচারশীল ব্যক্তির মাথায় কিভাবে আসতে পারে? জল তো পরম ঔষধ আর মাতার সমান রক্ষাকারী অমৃত, এর সদুপয়োগ করে মানুষ কিভাবে কত পরম লাভ নিতে পারে, সেটা স্নানের প্রকরণে দেখে নিবে।
দূরাদাবস্থান্মূত্রম্ দূরাত্পাদাবসেচনম্।
উচ্ছিষ্টান্ননিষেকম্ চ দূরাদেব সমাচরেত্।।
(মনুঃ ৪/১৫১)
মলমূত্র ত্যাগ, পা ধোয়া বা এঁটো ফেলা আদি কাজ গৃহ বা নিবাস স্থান থেকে দূরে করবে।
যেসব বস্তু নোংরা তথা দুর্গন্ধযুক্ত সেইসব নিবাস স্থান থেকে দূরে ফেলে দেওয়াই মানুষের জন্য হিতকর। এটা তো সবাই জানে যে দুর্গন্ধের কারণেই রোগ ছড়ায় আর রোগের কারণেই মানুষের বল, বুদ্ধি, আয়ু, সৌন্দর্যতা আদি সব শ্রেষ্ঠ গুণ আর শক্তির নাশ তথা হ্রাস হয়। অতঃ যত দূরে এগুলো ফেলে দেওয়া বা ত্যাগ করা হবে ততই হিতকর হবে। এইজন্য আমাদের প্রাচীন পুরুষরা নিবাস স্থান থেকে এক-দুই মিল দূরে গিয়ে শৌচ বা মূত্র ত্যাগ করতো তাই তারা স্বাস্থ্য, বল, শক্তি আদিতে সবদিক থেকে আমাদের তুলনায় অত্যধিক উন্নত ছিল। আমাদেরও ঋষিদের উপরিউক্ত আজ্ঞাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করা উচিত। মলমূত্র ত্যাগ সম্বন্ধীয় উপরিউক্ত নিয়ম শুধু ব্রহ্মচারী নয় বরং সব স্বাস্থ্য প্রেমী সজ্জনদের জন্য সমান। আমাদের পরম পাবন ঋষি-মহর্ষিদের আজ্ঞা হচ্ছে শ্রেষ্ঠ আর মহান, সেই অনুসারে চললেই আমাদের কল্যাণ হবে। আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধির এমন কি অনুভব আর জ্ঞান আছে! যেকোনো বিষয়ে দেখুন আমাদের প্রাচীন পুরুষরা কত গম্ভীর অনুসন্ধান আর অনুভব করেছে।
প্রিয় পাঠকগণ! প্রাচীন ঋষিদের শরণে আসুন, তাদের জ্ঞান আর অনুভব থেকে অপরিমিত লাভ নিন আর জন্ম জন্মান্তর পর্যন্ত আনন্দের সঙ্গে তাদের গুণ গান করুন।


☘️ দন্ত (দাঁত) রক্ষা ☘️
শুধু ব্রহ্মচারী কেন প্রত্যেক মানুষকে প্রাতঃকাল উঠে, চক্ষু-স্নান, উষঃপান আর শৌচ অর্থাৎ শরীরের অধোভাগের শুদ্ধির পশ্চাৎ উর্দ্ধভাগকে শুদ্ধ করা উচিত। রাতে শুয়ে যখন মানুষ প্রাতঃ ঘুম থেকে ওঠে, তখন মুখের ভিতরে জমে থাকা মল দেখা যায়, যারজন্য মুখ আর দাঁত থেকে দুর্গন্ধ আসতে থাকে। দুর্গন্ধ দূর করা আর দাঁত শুদ্ধি করা অত্যন্ত আবশ্যক। এই বিষয়ে বেদ ভগবান সবাইকে আজ্ঞা দিয়েছে যে "অশোণা দন্তাঃ" (অথর্বঃ ১৯/৬০/১) অর্থাৎ তোমাদের দাঁত নির্মল হোক। এইজন্য আমাদের ঋষিরা প্রতিদিন দন্তধাবন (দাতুন) করার নিয়ম বানিয়েছেন।
আয়ুর্বেদের প্রসিদ্ধ আর প্রাচীন শাস্ত্র চরকের মধ্যে লেখা আছে যে -
আপোথিতাগ্রম্ দ্বৌ কালৌ কষায়কটুতিক্তকম্।
ভক্ষয়েত্ দন্তপবনম্ দন্তমাম্সান্যবাধয়ন্।।
(চরক সূত্রস্থান ৫/৬৮)
প্রতিদিন দুই বেলা কষা তথা তিক্ত রস প্রধান বৃক্ষের ডালের অগ্রভাগকে চিবিয়ে কুঁচি অর্থাৎ ব্রাশের সমান করে দন্তমাংস অর্থাৎ দাঁতের মাড়িতে যেন আঘাত না লাগে এমন ভাবে দাতুন করবে।
একইভাবে মহর্ষি ধন্বন্তরি সুশ্রুতের মধ্যে লিখেছেন -
চূর্ণেন তেজোবত্যাশ্চ দন্তান্নিত্যম্ বিশোধয়েত্।
একৈকম্ ঘর্ষয়েদ্দন্তম্ মৃদুনা কূর্চ কেন চ।।
দন্তশোধনচূর্ণেন দন্তমাম্সান্যবাধয়ন্।।
(চিকিৎসা স্থান ২৪/৮-৯)
তেজবল আদি চুর্ণের সঙ্গে দাতুন দিয়ে দাঁতকে প্রতিদিন মাজবে। দাতুনের অগ্রভাগকে চিবিয়ে কুঁচি (ব্রাশ) বানাবে আর এক-একটা দাঁতের উপর দাতুনের কুঁচিকে ঘোষবে।
এখানে দাতুনের সঙ্গে তেজবল আদি মঞ্জনের ব্যবহারও লেখা আছে যা দাঁতের জন্য অত্যন্ত হিতকর। মনু জী মহারাজও প্রাতঃকালে দাতুন করার বিধান করেছেন - "দন্তধাবনম্ পূর্বাহ্ল এব কুর্বীত" (৪/১৫২) অর্থাৎ দন্তধাবন প্রাতঃকালে (প্রথম প্রহরে) করবে।
🌱 দাতুন করার লাভ -
নিহন্তি গন্ধবৈরস্যম্ জিহ্বাদন্তাস্যজম্ মলম্।
নিষ্কৃষ্য রুচিমাধত্তে সদ্যো দন্তবিশোধনম্।।
(চরক সূত্রস্থান ৫/৬৬)
প্রতিদিন দাতুন করার ফলে জিহ্বা, দাঁত আর মুখের ভিতরের মল বেরিয়ে যায়, দুর্গন্ধ তথা বিরসতা (অরুচি) নষ্ট হয় আর খাবারে রুচি বাড়ে। উপরিউক্ত গুণ দাতুনের দ্বারা ততকালই প্রাপ্ত হয়।
সুশ্রুতের মধ্যে দাতুনের গুণ এইভাবে দর্শানো হয়েছে -
তদ্দৌর্গন্ধ্যোপদেহৌ তু শ্লেষ্মাণম্ চাপকর্ষতি।
বৈশদ্যমন্নাভিরুচিম্ সৌমনস্যম্ করোতি চ।।
(চিকিৎসা স্থান ২৪/৯-১০)
দাতুন মুখের দুর্গন্ধ আর দূষিত কফকে বাইরে বের করে দেয়। মল আদির তৈলাক্তকরকে দূর করে তথা অন্নে রুচি আর মনে প্রসন্নতা উৎপন্ন করে।
এইসব প্রমাণ দ্বারা সিদ্ধ হয় যে মুখ আর দাঁতের শুদ্ধি বিজ্ঞানের উপর প্রাচীন ঋষিরা অনেক বড় অনুসন্ধান করেছিলেন আর প্রতিদিন দাতুন করার উপর বল দিয়েছেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কারণ মুখ হচ্ছে শরীরের সেই অবয়ব যার দ্বারা আমাদের পেটে যে ভোজন পৌঁছায় আর এতে দাঁত আদি অবয়বও যুক্ত আছে যা ভোজনকে উদর পর্যন্ত পৌঁছাতে সহায়তা করে। দাঁত ভোজনকে চিবিয়ে হজমের যোগ্য বানিয়ে তোলে। যখন দাঁত ভোজনকে চাবায় তখন জিভ ভোজনকে ওলটপালট করতে সহায়তা করে আর স্বাদও তৈরি করে। কথা বলা, শব্দ করা আদি কাজও মুখ করে। শরীরের মধ্যে মুখ যেমন একটা আবশ্যক অঙ্গ সেই মুখের ভিতরে থাকা দাঁতও অতি গুরুত্বপূর্ণ। দাঁতের দ্বারাই আয়ুর জ্ঞান তথা স্বাস্থ্যের অবস্থা জানা যেতে পারে। যতক্ষণ দাঁত আছে ততক্ষণই ভোজনের স্বাদ পাওয়া যায়, দাঁতের জন্যই মুখ দেখতে সুন্দর হয় কারণ দাঁত থাকার জন্যই মুখ ভরা-ভরা দেখায়। দাঁতের অভাবে মুখ চিপকে যায় আর গাল ভিতরে ঢুকে যায়, মানুষের আকৃতি বিকৃত হয়ে কুরূপ হয়ে যায়, শব্দের উচ্চারণও শুদ্ধ তথা স্পষ্ট হয় না। দাঁতের অনেক রকম নাম আছে যেমন আক্কেল, পেষণ, অগ্রপেষণ, ছেদন দাঁত আদি। আমাদের দাঁত মুখের যে ভাগে গাড়া থাকে তাকে মাড়ি বলে। দাঁত দুইবার বের হয়, একটা তো বাল্যকালের দুধের দাঁত যেটা আট-দশ বছরের আয়ুতেই পড়ে যায়, পুনঃ অন্য নতুন দাঁত উৎপন্ন হয়, যাকে সাবধানে রাখলে পড়ে অন্ত পর্যন্ত কাজ করে। যে ব্যক্তি একশ বছরের অধিক আয়ু ভোগ করে, তাদের তৃতীয়বারও দাঁত হতে দেখা গেছে কিন্তু এই দাঁত নির্বল আর অনেক ছোট হয়।
দাঁত আর স্বাস্থ্যের মধ্যে অনেক বড় সম্বন্ধ আছে। দাঁত সুস্থ থাকলে শরীরও সুস্থ থাকে আর দাঁত খারাপ হলে স্বাস্থ্যও খারাপ হয়। দাঁতের আরোগ্য, আয়ু আর দৃঢ়তা তার শুদ্ধির উপর নির্ভর করে। কিছু মানুষ তো একে শুদ্ধ করার কষ্টই করে না, যদিও বা কয়েক জন করে তো তাদের মধ্যে অধিকাংশই সঠিক ভাবে দাঁত শুদ্ধ করতে জানে না। কেউ-কেউ আঙ্গুল দিয়ে ঘোষাকেই শুদ্ধি মনে করে। কয়েকজন কয়লা, ইটের টুকরো, মাটি, বালু, ছাই দিয়ে ঘোষে দাতুন করে। আবার কেউ-কেউ তো তামাক, ছিলিমের গুল আদি নিকৃষ্ট পদার্থের ব্যবহার করে নিজের দাঁতের সর্বনাশ করে বসে। ইংরেজি পড়া বাবু তো টুথপাউডার আর ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজে আর দাঁত মাজতে-মাজতে খারাপ করে ফেলে। এমনই কিছু সরল মানুষ সুপারির ছাই, বাদামের খোসার ছাই আর বাজারের মাজন দিয়ে নিজের দাঁতের মূল কেটে ফেলে আর লাভের স্থানে হানি করে বসে। খুব কম সংখ্যকই এমন বিচারশীল ব্যক্তি আছে যারা নিজের প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের আজ্ঞার উপর ঋষিদের আদেসানুসারে বিধিপূর্বক বৃক্ষের শাখা দিয়ে ভালো কোমল কুঁচি বানিয়ে প্রতিদিন দাতুন করে। আমাদের শাস্ত্র আর ঋষিদের গুণ আর কত দূর গাইবো, ওনারা প্রত্যেক জীবনোপযোগী বিষয়কে কত বিস্তার ভাবে স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
🌱 দাতুনের পরিমাপ -
দাতুন কত মোটা তথা লম্বা হওয়া উচিত, এই বিষয়ে মহর্ষি ধন্বন্তরি সুশ্রুতের মধ্যে লিখেছেন যে -
তত্রাদৌ দন্তপবনম্ দ্বাদশাম্গুলমায়তম্।
কনিষ্ঠিকা পরীণাহমৃজ্বগ্রন্থিতমব্রণম্।।
অয়ুগ্মগ্রন্থি য়চ্চাপি মৃদ্বগ্রম্ শস্তভূমিজম্।।
(চিকিৎসা স্থান ২৪/৪-৫)
অর্থাৎ দাতুন বারো আঙ্গুল লম্বা আর কনিষ্ঠিকা বা সবথেকে ছোটো আঙুলের সমান মোটা আর সোজা হওয়া উচিত। সেটা যেন গ্রন্থিত গাঁঠওয়ালা আর বেঁকা না হয়, সেখানে কোনো ছিদ্র অর্থাৎ কোনো ধরণের পোকামাকড় আদির ছিদ্র যেন না থাকে আর বিকার রহিত হয়। যেখানে দুটো শাখা আছে এমন গাঁঠওয়ালা হলে হবে না। দাতুনের অগ্রভাগ মৃদু হওয়া উচিত যা দিয়ে ভালো কুঁচি (ব্রাশ) বানানো যেতে পারে আর যে বৃক্ষের দাতুন হবে সেটা যেন শুদ্ধ ভূমিতে উৎপন্ন হয়ে থাকে। ইচ্ছে হল, যেকোনো বৃক্ষের ডাল দাতুনের জন্য ভেঙে নিলাম আর দাতুন করলাম, এইরকম করার ফলে ভুলে কোনো বিষ বৃক্ষ বা হানিকর বৃক্ষের দ্বারা দাতুন হয়ে যেতে পারে।
এইজন্য দাতুনের একটা স্থানে "বিজ্ঞাতবৃক্ষম্" এমন বিশেষণ দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ যে বৃক্ষের দাতুন প্রকৃতির অনুকূল আর লাভদায়ক হবে, তার দাতুন করা উচিত। অজ্ঞাত বৃক্ষের দাতুন কখনও করবে না। আয়ুর্বেদ গ্রন্থের মধ্যে অনেক বৃক্ষের দাতুনের বিধান আছে। চরকের মধ্যে লেখা আছে -
করঞ্জকরবীরার্কমালতীককুভাসনাঃ।
শস্যন্তে দন্তপবনে য়ে চাপ্যেবম্বিধা দ্রুমাঃ।।
(সূত্র স্থান ৫/৭০)
অর্থাৎ করঞ্জ, করবী, আকন্দ, মালতীলতা, অর্জুন তথা অসন (বিজয়সার) আদি বৃক্ষ তথা এর সমান গুণযুক্ত অন্য বৃক্ষেরও দাতুন করা যেতে পারে।
এইভাবে মহর্ষি ধন্বন্তরিও সুশ্রুতের মধ্যে লিখেছেন -
নিম্বশ্চ তিক্তকে শ্রেষ্ঠঃ কষায়ে খদিরস্তথা।
মধুকো মধুরে শ্রেষ্ঠঃ করঞ্জঃ কটুকে তথা।।
(চিকিৎসা স্থান ২৪/৬)
তিক্ত বৃক্ষের মধ্যে নিম, কষা বৃক্ষের মধ্যে খয়ের, মধুর মধ্যে মহুয়া আর ঝাঁজযুক্ত বৃক্ষের মধ্যে করঞ্জের দাতুন শ্রেষ্ঠ।
আরও একটা স্থানে লেখা আছে যে -
অর্কন্যগ্রোধখদিরকরঞ্জককুভাদিকম্।
প্রতর্ভুক্ত্বা চ মৃদ্বগ্রম্ কষায়কটুতিক্তকম্।।
ভক্ষয়েকদ্দন্তধাবনম্ দন্তমাম্সান্যবাধয়ন্।।
আকন্দ, বট, খয়ের, করঞ্জ আর অর্জুন আদি সেইরকম কষা, ঝাঁজ আর তিক্ত রসযুক্ত অন্য বৃক্ষের দাতুন নিবে আর তার অগ্রভাগকে চিবিয়ে এমন মৃদু কুঁচি বানাবে যাতে সেটা দাঁতে ঘোষার সময় মাড়িতে আঘাত না লাগে। এইভাবে অনেক গ্রন্থের মধ্যে ইরিমেদ, অপামার্গ, কদম, আম, বেণুপৃষ্ঠ (বাঁশ), বিল্ব আর উদুম্বর আদি বৃক্ষের দাতুনেরও বিধান আছে।
একটা স্মৃতির মধ্যে তো এমন লেখা আছে যে -
"সর্বে কণ্টকিনঃ পুণ্যাঃ ক্ষীরিণশ্চ য়শস্বিনঃ"
অর্থাৎ সব কাটাযুক্ত বৃক্ষ আর দুধওয়ালা বৃক্ষের প্রয়োগ যশ আর পুণ্য প্রদান করে অর্থাৎ সেগুলোর দাতুনও লাভদায়ক হয়।
🌱 দাতুন কোন বৃক্ষের হবে?

আমাদের সামনে সমস্যা এটাই যে এত বৃক্ষের মধ্যে কোন-কোন বৃক্ষের দাতুন করবো? আমাদের লাভের জন্য তো পরমেশ্বর সব বৃক্ষ বানিয়েছে, কিন্তু এর থেকে লাভ বা হানি তুলে নেওয়া আমাদের বুদ্ধি অথবা এর উচিত অনুচিত প্রয়োগের উপর নির্ভর করে। দাতুন সর্বদা নিজের প্রকৃতির অনুকূল কোনো যোগ্য বৈদ্যের কাছ থেকে সম্মতি নিয়ে করা উচিত। এই বৃক্ষের মধ্যে যে বৃক্ষের দাতুন করার সম্মতি বৈদ্য দিবে, সেটা দিয়েই করবে। এমনি ভাবে বিনা বিচারে চোখবুজে এগুলোর মধ্যে দাতুন করা শুরু করবে না, যারফলে লাভের স্থানে হানি হতে পারে। পাঠকদের লাভের দৃষ্টি রেখে এই বিষয়টাকে আরও স্পষ্ট করে দিচ্ছি। চার প্রকারের রসযুক্ত দাতুনের বিধান সবাই করেছে, যেমন সুশ্রুতে "কষায়ম্ মধুরম্ তিক্তম্ কটুকম্ প্রাত রুত্থিতঃ" ইত্যাদি লেখা আছে। এই চার প্রকারের রসযুক্ত বৃক্ষ আছে, এগুলোর মধ্যে যেকোনো একটা রসযুক্ত বৃক্ষের দাতুন প্রাতঃ উঠে করা উচিত। এগুলোর মধ্যে যেটা শ্রেষ্ঠ সেটা আমি পূর্বেই লিখেছি। যেমন তিক্ত বৃক্ষের মধ্যে নিমের দাতুন হল সর্বশ্রেষ্ঠ। নিম হচ্ছে এক এমন প্রসিদ্ধ বৃক্ষ যা প্রায় সব সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত, এই বিষয়ে বিস্তার ভাবে লেখার আবশ্যকতা নেই।
(১) নিম বৃক্ষের দাতুন -
নিঘণ্টুর মধ্যে নিমের বিষয়ে লেখা আছে - নিম তিক্ত, শীতল, সূজন আর বায়ুর শমন করে, চোখের জন্য হিতকারী, কৃমি পিত্ত আর বিষনাশক তথা অত্যন্ত রক্তশোধক। এই ধরণের আরও অনেক গুণ নিম সম্বন্ধে লেখা আছে, তাই নিমের দাতুন মাড়ি আর দাঁতের সব রোগের জন্য লাভদায়ক। এটা কৃমিকে দূর করে। য়ুনানী চিকিৎসার পুস্তক ইলাজুলগুরবাতে লেখা আছে - "যে ব্যক্তি নিমের দাতুন করে তার কোনো রোগ হয় না আর না তার দাঁতে কোনো পীড়া হয়। " রক্তের সব দোষকে দূর করে সর্বথা শুদ্ধ করে দেয়, জ্বরের রোগীর জন্য হিতকারক হয়, ভোজন রুচি উৎপন্ন করে, ব্রণ তথা ফোঁড়া আদি থেকে সুরক্ষিত রাখে, গরম থেকে বাঁচায় আর কুপিত কফের শমন করে। বমন আসাকে থামায়, প্রমেহ আদি বীর্য রোগের জন্য লাভপ্রদ হয়। নেত্র জ্যোতিকে বাড়ায় আর রক্ষা করে। রক্ত দোষের রোগীর জন্য প্রতিদিন নিমের দাতুনের ব্যবহার অনেক ভালো আর সাধারণ মানুষের জন্য বসন্ত ঋতুতে অর্থাৎ ফাল্গুন বা চৈত্রের দিনে নিমের দাতুন করা খুব ভালো। এরফলে রক্ত সম্বন্ধীয় বিকার হয় না।
মহানিমের (বকায়ন) দাতুনেরও প্রায় তেমনই লাভ আছে যেমনটা নিমের দাতুনের বর্ণনাতে আছে।
(২) খয়ের বৃক্ষের দাতুন -
কষা বৃক্ষের মধ্যে খয়েরের দাতুন শ্রেষ্ঠ মানা হয়েছে। সংস্কৃতে এর নাম দন্তধাবন। ভাবপ্রকাশ নিঘণ্টুর মধ্যে খয়ের দাতুন শীতল, দাঁতের হিতকারী, তিক্ত, কষা আর চুলকানি, কাশি, অরুচি, মেদ (চর্বি), কৃমি, প্রমেহ, জ্বর, ব্রণ, শ্বেত, সূজন, আম, পিত্ত, রক্তবিকার, পাণ্ডু রোগ, কফ তথা কোঢ় (কুষ্ঠ) নষ্ট করে। এইজন্য যার কুষ্ঠ বা মেদ (মোটা হওয়া) রোগ আছে আর এই ধরণের রক্তদোষের রোগী আর চর্ম রোগীদের খয়ের বৃক্ষের দাতুন করা উচিত। খয়েরের দাতুন মুখের ছাল আর মাড়ির পুঁচকে দূর করে। কফ প্রকৃতির মোটা (ফুলে যাওয়া) ব্যক্তির জন্য খয়েরের দাতুন লাভদায়ক। কিন্তু এর বৃক্ষ সব স্থানে হয় না এইজন্য সর্বসাধারণ এর থেকে লাভ নিতে পারে না।
(৩) বাবলা বৃক্ষের দাতুন -
কষা রসযুক্ত বৃক্ষের মধ্যে বাবলার বৃক্ষ ভারতবর্ষের সব স্থানে পাওয়া যায়। এর দাতুন প্রায় সবাই করে। একে ববুল বা বুবুরও বলা হয়। এর গুণের উপর দৃষ্টি দিলে জানা যায় যে এটা এক এমন বৃক্ষ যার দাতুন বিনা কোনো বৈষম্যে প্রত্যেক মানুষ করতে পারবে, কারণ এটা সবার জন্য হিতকারী। ভাবপ্রকাশ নিঘণ্টুর মধ্যে লেখা আছে যে -
বব্বূলঃ কফনুদ্ গ্রাহী কুষ্ঠকৃমিবিষাপহঃ।
অর্থাৎ - বাবলা হল গ্রাহী আর কফ, কুষ্ঠ, কৃমি তথা বিষনাশক। নিঘণ্টুরত্নাকরের মধ্যে লেখা আছে -
বাবলা তিক্ত, কষা, মধুর, মসৃণ, ঠান্ডা, তীক্ষ্ণ, গ্রাহী, আমাতিসার (বদহজম) আর রক্তাতিসারকে (আমাশয়) বন্ধ করে। কফ, কাশি, উষ্ণতা, দাহ, বায়ু আর প্রমেহকে দূর করে। অর্শের জন্য হিতকর হয়। বাবলার বৃক্ষ সর্বত্র পাওয়া যায় আর সব প্রকৃতির জন্য অনুকূল হয়। দাতুনের জন্য যেসব গুণ হওয়া উচিত সেইসব গুণ এরমধ্যে আছে। তাই এর দাতুনের প্রচার ভারতবর্ষের মধ্যে প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে। আজও ভারতে শিক্ষিত বা অশিক্ষিত আর সব মতের অনুগামীরা এর দাতুন করে। আসলে বাবলার দাতুনে সব গুণ ভরপুর আছে। দাঁতের জন্য হিতকারী, তিক্ত, কষা, মধুর আর কটু প্রায় চারটা রসই এরমধ্যে পাওয়া যায়। বাবলার দাতুন যেমন দাঁতকে অত্যন্ত শুদ্ধ করে তেমনই এর ব্যবহার পাচনশক্তিকে বাড়িয়ে তোলে। রক্তকে শুদ্ধ করে, মুখের ভিতরে ছাল পড়ে না, কফ আর কাশিকে দূর করে, প্রমেহ নষ্ট করে, মস্তিষ্ক তথা চোখে শীতলতা আনে, দাঁত আর মাড়িকে কৃমি আদির রোগ থেকে সুরক্ষিত রাখে। আমার মতে প্রত্যেক মানুষকে সর্বদা বাবলার দাতুনেরই ব্যবহার করা উচিত।
(৪) মহুয়া বৃক্ষের দাতুন -
মধুর বৃক্ষের মধ্যে মহুয়ার দাতুন শ্রেষ্ঠ মানা হয়েছে। এটা মুখকে শুদ্ধ করে আর মুখের ছাল, মাড়ির উষ্ণতা আর ফুলে যাওয়াকে দূর করে।
(৫) করঞ্জ বৃক্ষের দাতুন -
ঝাঁজযুক্ত রসের বৃক্ষের মধ্যে করঞ্জের দাতুন হচ্ছে শ্রেষ্ঠ। এটা অর্শ, রক্তদোষ আর কফকে নষ্ট করে। বর্ষা ঋতুর পশ্চাৎ যখন বিষমজ্বর (মেলেরিয়া) ছড়ায়, তখন করঞ্জের দাতুন করার ফলে মানুষ বিষমজ্বর থেকে রক্ষা পায়।
(৬) রক্তকাঞ্চন বৃক্ষের দাতুন -
রক্তকাঞ্চনের দাতুন কফের রোগ আর কণ্ঠরোগের জন্য বিশেষ করে গণ্ডমালা রোগের জন্য অত্যন্ত লাভদায়ক হয়।
(৭) অর্জুন বৃক্ষের দাতুন -
অর্জুনের দাতুন হৃদয় রোগীদের জন্য অত্যন্ত লাভদায়ক। এটা দাঁত তথা মাড়িকে শুদ্ধ করে আর দাঁতকে সুদৃঢ় বানায়।
(৮) তেজবল বৃক্ষের দাতুন -
এটা হচ্ছে এক প্রসিদ্ধ পর্বতীয় বৃক্ষ। এর দাতুন বসন্ত ঋতুতে করা উচিত। এটা ব্যবহার করলে কফের রোগ থাকে না। এর দাতুন কাশি আর শ্বাসের রোগীদের জন্য খুব লাভদায়ক। এটা মুখের দুর্গন্ধ দূর করে, পাচনশক্তিকে বাড়িয়ে তোলে, অর্শ আর কণ্ঠ রোগনাশক হয়। আরও অনেক লাভ আছে কিন্তু এটা সব স্থানে পাওয়া যায় না তাই সবাই এর লাভ নিতে পারে না।
(৯) আকন্দ বৃক্ষের দাতুন -
আকন্দের দাতুন কখনও বিনা কোনো বৈদ্যের সম্মতিতে স্বয়ং ভুলেও করা উচিত নয় কারণ আকন্দ বিষাক্ত হয়। এর দাতুন খুবই বৃদ্ধ, নেশাগ্রস্থ মানুষ তথা শ্বাস, কাশি আদি কফের রোগীদের জন্য লাভদায়ক হয়।
(১০) অশ্বত্থ বৃক্ষের দাতুন -
অশ্বত্থ (ডুমুর) বৃক্ষ ভারতের সব স্থানে পাওয়া যায়। এটা মধুর, কষা, শীতল, রুক্ষ, ভারী, রক্তদোষ, জ্বলন, উষ্ণতা, কফ আর ফোঁড়া তথা ব্রণ দূর করে। রঙকে সুন্দর করে, স্ত্রীয়োনিকে শুদ্ধ করে। শরীর শুকিয়ে যাওয়া, যক্ষ্মা আর পিত্তজ্বরের জন্য অত্যন্ত লাভদায়ক।
পালাজ্বরে অশ্বত্থের দাতুন অনেক লাভদায়ক হয়। যেদিন পালাজ্বর আসার দিন হবে, রোগী এক গজের লম্বা দাতুন নিয়ে নিরন্তর চাবাতে থাকলে জ্বর থেমে যায়। এর দাতুনের ফলে দাঁত তথা মাড়ি সুদৃঢ় হয়। পুরোনো জ্বর আর টিবি রোগীদের অশ্বত্থের দাতুন করা উচিত। অশ্বত্থের দাতুনের ফলে মন শান্ত আর আয়ুর বৃদ্ধি হয়, দাঁত তথা মাড়ির পীড়া সর্বদা দূর হয়ে যায়।
লাক্ষাদি তৈল হচ্ছে আয়ুর্বেদের প্রসিদ্ধ হার্বল তেল, সেটা দিয়ে শরীর মালিশ করলে যক্ষ্মা জ্বরের জ্বলন, রুক্ষতা আর শরীর শুকিয়ে যাওয়া তথা ফুসফুসের পীড়া দূর হয়। এই তেলের মুখ্য ভাগই হচ্ছে অশ্বত্থ বৃক্ষের গঁদ (রস)।
তাছাড়া দাঁতের যে পীড়া রোগীকে ঘুমাতে দেয় না আর কোনো ওষুধ খেলেও কাজ করে না, সেটা লাক্ষাদি তেল দিয়ে কিছুক্ষণ কুলিকুচি করলে দূর হয়ে যায়। এটা অনেক বৈদ্যের অনুভব।
(১১) বট বৃক্ষের দাতুন -
অশ্বত্থের মতো বট বৃক্ষের দাতুনেরও অনেক লাভ আছে। কিন্তু এর দাতুন প্রমেহ রোগের রোগীদের জন্য অমৃতের সমান। যদি প্রমেহ রোগী নিরন্তর শ্রদ্ধাপূর্বক দীর্ঘকাল পর্যন্ত বট বৃক্ষের দাতুন করে তাহলে এটা তার জন্য অত্যন্ত লাভদায়ক হবে।
(১২) বকুল বৃক্ষের দাতুন -
বকুলকে সংস্কৃতে বজ্রদন্তী বলে। সংস্কৃতে হীরার নাম হল বজ্র। হীরার সুদৃঢ়তা আর কান্তি সংসারে প্রসিদ্ধ। বকুলের দাতুন দাঁতকে হীরার মতো কান্তিকারী আর সুদৃঢ় বানিয়ে দেয়, এইজন্য এর নাম বজ্রদন্তী। সংস্কৃত ভাষার মধ্যে বিশেষ গুণ এটাই আছে যে নামের ভিতরেই গুণ নিহিত করা থাকে। এইভাবে বজ্রদন্তীও "য়থা নাম তথা গুণ" লোকোক্তিকে পূর্ণকারী বৃক্ষ। দাঁতের যেকোনো রোগ হোক না কেন সেটা বকুলের দাতুন দ্বারা নষ্ট হয়ে যায়। তাই বকুলের দাতুনই সবথেকে অধিক লাভদায়ক কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হল এই বৃক্ষ সর্বত্র পাওয়া যায় না। এইরকম অবস্থায় বাবলা বৃক্ষেরই দাতুন অথবা নিম আদি অন্য বৃক্ষের দাতুন করবে। অথবা যেটা অধিক পাওয়া যায় আর যেটা চাবালে ভালো কুঁচি (ব্রাশ) হয় আর সেটা স্বাস্থ্যের জন্যও হানিপ্রদ নয়, এমন কোনো বৃক্ষের দাতুন করা যেতে পারে।

☘️ দাতুন করার বিধি ☘️
একটা কথা মনে রাখতে হবে যে দাতুন বিধিপূর্বক না করলে সেই দাতুন বকুল আদি যতই ভালো বৃক্ষের হোক না কেন যথাযথ লাভ হয় না। যত লম্বা আর মোটা দাতুন আমি লিখেছি, সেই রকম দাতুন নিয়ে দুই পাশকে দাঁত দিয়ে আসতে-আসতে চিবিয়ে নরম কুঁচি বানাবে। দাতুন ছাল সহিত করবে, তার ছার কখনও তুলবে না। কেউ-কেউ পাথর আদি দিয়ে থেতলে কুঁচি বানায়, এটা উচিত নয়। দাঁত দিয়ে চিবিয়ে কুঁচি বানালে মুখ তথা দাঁতের ব্যায়াম হয় আর দাঁতের গোড়া সুদৃঢ় হয়ে এটা বৃদ্ধাবস্থা পর্যন্ত কাজ করে। কুঁচিকে শুদ্ধ করে সব দাঁতের ভিতরে আর বাইরে আসতে-আসতে ভালো করে প্রত্যেক দাঁতকে নিচে থেকে উপরে আর উপর থেকে নিচে ঘোষে-ঘোষে শুদ্ধ করবে। এইভাবে দাঁতকে উপর থেকে নিচে আর নিচে থেকে উপরে ঘোষার ফলে শীঘ্র শুদ্ধ হয়। "দন্তান্ পূর্বমধো ঘর্ষয়েত্" থেকে জ্ঞাত হয় যে পার্শ্বোতে দাতুন করা উচিত নয়। অর্থাৎ দক্ষিণ থেকে বাম আর বাম থেকে দক্ষিণে দাতুন করবে না। দাতুন করার মাঝে দাতুনকে শুদ্ধ জল দিয়ে ধুতে থাকবে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিনা ধুয়ে নোংরা দাতুন ব্যবহার করলে হানিও হতে পারে। যদি মুখের মধ্যে কোনো রোগী দাঁত থাকে তাহলে তার মলের কারণে অন্য দাঁতও রোগী হতে পারে। তাই দাতুন ধোয়ার জন্য সর্বদা জল সঙ্গে নিয়ে বসবে, জল ছাড়া কখনও দাতুন করবে না।

দাঁতের মাড়ির উপরও দাতুনকে ঘোষা উচিত, কিন্তু এমন ভাবে ঘোষবে যাতে দাতুন মাড়িকে ফুটো বা ছিলে না দেয়। দাতুন করার সময় মুখের মধ্যে যে লালা থুতু আদি আসতে থাকবে তাকে নিচে ফেলতে থাকবে। যাতে বায়ু আদির সব দূষিত মল বেরিয়ে যায়। দাতুন করার মূল উদ্দশ্য হল মুখ আর দাঁতের শুদ্ধি ভালোভাবে করা, তাই দাতুন করার সময় দাতুনের উপরই ধ্যান রাখা উচিত। কেউ-কেউ দাতুন করতে ঘন্টার পর ঘন্টা লাগিয়ে দেয়, মুখের মধ্যে দাতুন নিয়ে এদিক-সেদিক ঘুরতে থাকে, তারসঙ্গে গল্পগুজবও করে, ইতস্ততঃ থুতু ফেলে স্থানকে নোংরা করে আর রোগ ছড়ানোর কারণ বানায়। লালা বা থুতু হচ্ছে অমূল্য বস্তু, দাতুন মুখে রেখে এমনি করে থুতু ফেলতে থাকা বড় মূর্খতার কাজ হবে। কারণ এই থুতু পেটে গিয়ে ভোজনের সঙ্গে মিলিত হয়ে তাকে দ্রুত হজমের যোগ্য বানিয়ে তোলে, যদি তারা এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা জানতো তাহলে এমনটা করতো না। যদি বিধিপূর্বক মন লাগিয়ে দশ মিনিট দাতুন করা যায় তাহলেই যথেষ্ট, তবে ভোজনের পশ্চাৎ জল দিয়ে ভালো ভাবে কুলিকুচি করে দাঁত পরিষ্কার করা হলে কিছুক্ষণ দাতুন করলেই কাজ হয়ে যায়। কারণ আমাদের ভোজনের যে কিছু অংশ দাঁতের মধ্যে আটকে থাকে, সেটাই দাঁতে বা তার গোড়াতে একত্রিত হয়। কুলিকুচি আর দাতুন এই মলকে দূর করার জন্যই করা হয়। যদি এটা কুলিকুচি আর দাতুন দিয়ে শুদ্ধ না করা হয় তাহলে দাঁত আর দাঁতের মাঝখানে পড়ে থেকে পচতে থাকবে। দাঁতকে নোংরা আর রোগী করবে আর এইরকম মানুষের মুখ থেকেই দুর্গন্ধ আসে। মল আর দুর্গন্ধ থাকার জন্য দাঁতের গোড়া আর দাঁতের মাঝখানের স্থান ছাড়া মুখের মধ্যে আর কোথাও স্থান নেই। এই দুর্গন্ধ স্বাস্থ্যকেও হানি করে। যার মুখ থেকে দুর্গন্ধ আসছে, জেনে নিবে এর দাঁত ঠিক নেই। যাদের দাঁত শুদ্ধ হয় না তাদের দাঁত থেকে দূষিত তত্ত্ব আর দুর্গন্ধের কণা ভোজন করার সময় থুতুর সঙ্গে মিশে পেটে পৌঁছাবে আর যে ভোজন হজমের জন্য পেটে গেছে তাকেও দূষিত করবে। কারণ আমাদের মুখের ভিতরে থুতু (লালা) উৎপন্নকারী গ্রন্থি আছে, সেগুলো থেকে সর্বদা থুতু (রস) বের হতে থাকে, যা মুখকে আর্দ্র রাখে। এই থুতু গ্রন্থি থেকে বেরিয়ে দাঁতের মধ্যে হয়ে ভোজনের সঙ্গে পেটে যায় আর পাচনক্রিয়াতে সহায়ক হয়। দাঁত শুদ্ধ না থাকার কারণে থুতুর সঙ্গে দূষিত মল এক ধরণের বিষ হয়ে যায় আর সেটা পেটে গিয়ে ভোজনকে দূষিত বা বিষাক্ত করে, যারফলে শরীরের রস, রক্ত আদি সব ধাতু দূষিত হয়ে মানুষের স্বাস্থ্য খারাপ হয় আর "শরীরম্ ব্যাধিমন্দিরম্" শরীর রোগের ঘর হয়ে যায়। ঋষিদের দেশ এই ভারতের এমন দুর্দশা যে একশ জনের মধ্যে একজনও নিজের দাঁতের শুদ্ধি দিকে ঠিকভাবে ধ্যান দেয় না। তাই যেদিকে দেখো শুধু হলদে-হলদে নোংরা পচা দাঁতওয়ালা মানুষদের দেখে হৃদয় উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। গ্লানি আর ঘৃণা উৎপন্ন হয়, কারও-কারও মুখ থেকে তো অসম্ভব দুর্গন্ধ আসে।

দক্ষিণ ভারতে আমি স্বয়ং দেখেছি যে প্রাতঃকাল থেকে সায়ংকাল পর্যন্ত তম্বাকু দিয়ে-দিয়ে ছাগলের মতো পান চাবাতে থাকে। তারা একসঙ্গে পাঁচ-সাতটা পানের বান্ডিল বলপূর্বক মুখের মধ্যে ঠুসে রাখে আর তার সঙ্গে সিগারেট বিড়িরও ভরমার চলতে থাকে। তাদের দাঁত এত কালো আর নোংরা হয় যে সেটা দেখে যেকোনো মানুষের বমি আসবে। তাদের মুখের দুর্গন্ধের কথা আর কি বলবো! সেটা বর্ণনা করা আমার শক্তির বাইরে। তাহলে এইরকম মানুষের স্বাস্থ্য কি স্বপ্নেরও কখনও ঠিক হতে পারে? আশ্চর্যের বিষয় যে শুধু দক্ষিণ ভারত কেন, মধ্য ভারত, মালবা আর বাংলারও এমনই দুর্দশা। সেখানে দাতুন করে এমন মানুষ খুবই কম, তাই এইসব প্রান্তের স্বাস্থ্য অন্য প্রান্তের অপেক্ষায় অধিক নিম্ন। মুনিবর চাণক্যের লোকোক্তির অনুসারে -
"দন্তমলোপধারিণম্...বিমুঞ্চতি শ্রীর্য়দি চক্রপাণিঃ।"
অর্থাৎ - যার দাঁতে নোংরা আছে বা যার দাঁত শুদ্ধ নয় তাকে শ্রী অর্থাৎ লক্ষ্মী, শোভা, সৌন্দর্য, কান্তি, মন, বুদ্ধি, বিদ্যা, ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষরূপ সম্পত্তি আদি সম্পূর্ণ ঐশ্বর্য ছেড়ে চলে যায়। এইজন্য স্বাস্থ্য তো চলে গেছে, দরিদ্রতা মহারানীও সেখানে শিবির স্থাপন করেছে। যেসব প্রান্তে দাতুন করার ভালো প্রচার আছে যথা পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট আদি, উপরোক্ত প্রান্তের থেকে ভালো অবস্থায় আছে। অতঃ দেশের শারীরিক উন্নতি আর স্বাস্থ্য উন্নতির জন্য সর্বত্র জনগণের মধ্যে দাতুন করার প্রচার করা উচিত আর এই ধরণের প্রতিজ্ঞা যেমন "আমি দাতুন না করে ভোজন করবো না" স্বয়ং করা তথা অন্যদেরও করানো উচিত।

🌱 দাতুন দ্বারা জিহ্বা শুদ্ধি -
যখন দাতুন দিয়ে দাঁত ভালো করে পরিষ্কার করবে তখন দাতুনকে ধুয়ে সেটাকে মাঝখান থেকে চির করে দুই ভাগ করে নিবে। একটা ভাগকে মাঝখান থেকে ভাজ করে তার দুই মাথাকে দুই হাত দিয়ে ধরে চির করা চেপ্টা ভাগটা দিয়ে ধীরে-ধীরে জিভকে ঘোষে জমে থাকা সাদা মলকে ছাড়িয়ে নিবে আর দাতুনের চির করা অন্য সোজা ভাগটা দিয়ে জিভের কণ্ঠ পর্যন্ত শুদ্ধ করবে। পুনঃ দাতুনকে ধুয়ে ফেলে দিবে। ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমা আঙ্গুলকে মুখের মধ্যে দূর পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে কণ্ঠের কফ আদিকে বাইরে বের করবে। তারপর একটা আঙ্গুলকে জিহ্বার নিচের ভাগকে ধীরে-ধীরে ঘোষে শুদ্ধ করে নিবে। হাতের আঙ্গুল দিয়ে উপরের দিকে তালুকে ঘোষে শুদ্ধ করবে। পুনঃ মুখের ভিতরে জল ভরে খুব কুলিকুচি করবে। এইভাবে করলে মুখের সব মল দূর হয়ে দুর্গন্ধ রহিত হবে। এতে যেমন শুদ্ধি হয় তেমনই তারসঙ্গে ভালো ব্যায়ামও হয়।

🌱 দন্ত মর্দন -
দাঁত, দাঁতের গোড়া আর মাড়িকে ভিতরে আর বাইরে দান হাতের তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে প্রতিদিন কিছুক্ষণ ভালোভাবে মর্দন (মালিশ) করবে। এই মালিশের ফলে দাঁতের অনেক লাভ হয়, দাঁত আর দাঁতের গোড়া সুদৃঢ় হয়, পায়রিয়া (দাঁত থেকে রক্ত বা পুঁজ বের হওয়া) আদি রোগ হয় না, তথা দাঁতের আয়ু বাড়ে। দাতুনের পশ্চাৎ  প্রতিদিন এইরকম করলে খুবই লাভদায়ক হয়।
একটা কথা সব সময় মনে রাখবে, দাতুনের সময়, কুলিকুচি করার সময় সর্বদা শীতল জলের ব্যবহার করবে। যারা নিত্য প্রতিদিন দাতুন করে তাদের দাঁত তথা শরীর সর্বদা নিরোগ আর সুস্থ থাকে, আর তাছাড়া দাতুন করার ফলে চোখের মল আর বিষ প্রতিদিন বের হতে থাকে, যারফলে চোখ শুদ্ধ আর নির্মল হয়। নেত্র জ্যোতি বাড়ে আর চক্ষু সম্বন্ধীয় কোনো রোগ হয় না। এমনকি চোখের ব্যথাও হয় না আর মুখের শুদ্ধি ভালো ভাবে হওয়ার ফলে মুখ সম্বন্ধীয় কোনো রোগও হয় না। দাঁত আর চোখের মধ্যে কত নিকটতম সম্বন্ধ আছে এটা খুব কম মানুষই জানে। দাঁত দূষিত হওয়ার কারণে চোখেও অনেক দোষ আর রোগ উৎপন্ন হয়, এমনকি মানুষ অন্ধ পর্যন্ত হয়ে যায়। এর একটা উদাহরণ স্যার হেরি বাল্ডবিন তার দাঁত বিষয়ক বক্তৃতায় দিয়েছিলেন -
"কেথরিন ব্রাউন নামে এক স্ত্রী ছিল। বাল্যকাল থেকে সে দন্তরোগে পীড়িত ছিল। ধীরে-ধীরে তার চোখের দৃষ্টি কমতে থাকে আর যুবতী হতে-হতে তো সে একদম অন্ধ হয়ে যায়। তার চোখের উন্নতির জন্য অনেক চেষ্টা করা হয় কিন্তু সফলতা পাওয়া যায়নি। যখন সে তার দাঁত তুলে ফেলে তখন সে তার হারিয়ে যাওয়া স্বাস্থ্য পুনঃ প্রাপ্ত করে।"

এইরকমই এক সজ্জন আমার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। চিকিৎসার্থ শ্রী বৈদ্য কর্মবীর জীর কাছে "নরেলা"তে আসেন। না জানি কত বৈদ্য আর ডাক্তারের কাছে ঘুরেফিরে পর্যাপ্ত ধন হারিয়েছেন। ওনার পাচনশক্তি একদম খারাপ হয়ে যায়, খিদেই পেতো না। যকৃৎ দূষিত হওয়ার ফলে রক্ত আদি ধাতু হতো না। প্রত্যেক সময় উদর আর মাথা ব্যথা থাকতো। কাশি আর হালকা জ্বর সবসময় সঙ্গে থাকতো। এইরকম অনেক রোগ তথা দুর্বলতা আদি শরীরে ঘর করেছিল, তাই তিনি জীবনে অত্যন্ত নিরাশ আর দুঃখী ছিলেন, কোনো ওষুধ খেয়েও লাভ হয়নি। আসল বিষয়টা এই ছিল যে ওনার দাঁত একদম দূষিত আর রোগী ছিল, সেইদিকে কোনো বৈদ্যের ধ্যানই যায়নি। যখন ওনার দাঁতের চিকিৎসা করা হয় তখন দাঁতের রোগের সঙ্গে-সঙ্গে সব রোগ ঠিক হয়ে যায় আর সেই সজ্জন একদম সুস্থ হয়ে যান।

🌱 জাদুর কাঠি -
প্রত্যেক ব্যক্তিকে উপরোক্ত উদাহরণ থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত আর প্রতিদিন নিয়ম পূর্বক দাতুন করে নিজের দাঁতকে শুদ্ধ, পবিত্র, সুস্থ আর সুদৃঢ় করা উচিত, কারণ দাঁতের আরোগ্য আর সুদৃঢ়তা শুদ্ধির উপর নির্ভর করে আর শুদ্ধি করার জন্য দাতুনই হচ্ছে জাদুর কাঠি। তাই স্বাস্থ্য আর ব্রহ্মচর্য প্রেমী ব্যক্তিকে দাতুন করা নিজের দিনচর্যার আবশ্যক অঙ্গ ভাবা উচিত। কারণ অসুস্থ মানুষ কখনও ব্রহ্মচর্য রক্ষাতে সফল হবে না।

দাঁত আর স্বাস্থ্যের মধ্যে কত ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে এটা ভালোভাবে সিদ্ধ করা হয়েছে, আর আমরা এই পরিণামে পৌঁছেছি যে কেবল ব্রহ্মচারী নয় বরং প্রত্যেক মানুষকে প্রতিদিন দাতুন দিয়ে দাঁতের শুদ্ধি করা একটা পরমাবশ্যক কর্তব্য। দাঁতকে সুস্থ, শুদ্ধ আর সুদৃঢ় করার জন্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিম্নলিখিত বিষয়কে ধ্যানে রাখা উচিত।

আবশ্যক বিষয় -
(১) ভোজন সর্বদা তাজা আর ঠাণ্ডা করে খাবে। উষ্ণ (গরম) ভোজন চাবানোর ফলে দাঁতের গোড়া নির্বল হয়।

(২) একইভাবে বরফ মিশ্রিত ঠাণ্ডা জল দাঁতের গোড়াকে নির্বল করে।

(৩) গরম বস্তু খাওয়ার পর তার উপর ঠাণ্ডা বা বরফের জলপান করা, সব দন্তরোগ উৎপত্তির কারণ হয়।

(৪) সর্বদা কোমল, মিষ্ট আর মসলা যুক্ত আহারকারীর দাঁতে অনেক রোগ হয়। ভাজা বার্লি (যব), ভুট্টা আদি চাবানোর ফলে দাঁতের শক্তি বজায় থাকে, কারণ এতে দাঁতের ব্যায়াম হয়।

(৫) ভোজন সর্বদা ভালো করে চিবিয়ে-চিবিয়ে খাওয়া উচিত, এরফলে ভোজন শীঘ্র হজম হয় আর দাঁতের ব্যায়াম হওয়ার কারণে দাঁত সুস্থ তথা সুদৃঢ় থাকে। যারা দাঁত দিয়ে কাজ চালায় না তাদের দাঁত আর চোখ দুটোই খারাপ হয়। স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ার মুখ্য কারণই হচ্ছে এটা।

(৬) যাদের দাঁত লম্বা হয় প্রায়শঃ তাদের দাঁতে তথা দাঁতের গোড়াতে এক ধরণের মল (সাদা পদার্থের মতো) জমে থাকে। দুই-চার মাসে নিজে আয়না দেখে ছুরির অগ্রভাগ বা সুই আদি দিয়ে ধীরে-ধীরে সেই মল বের করা উচিত। অথবা এই কাজ কোনো বৈদ্য, ডাক্তার বা নিজের যোগ্য মিত্রের দ্বারা করাবে।

(৭) ভোজনের পশ্চাৎ জল দিয়ে বার-বার কুলিকুচি করে মুখ আর দাঁতকে শুদ্ধ করে নেওয়া উচিত যাতে ভোজনের অংশ দাঁতের গোড়া আর মাঝখানে পড়ে থেকে-থেকে দাঁত খারাপ না হয়।

(৮) ভোজনের পর ততকালই, জ্বর থাকা কালীন শীতপিত্ত (এলার্জি) হলে দাতুন করা উচিত নয়।

(৯) টক, মিষ্টি একসাথে মিলিয়ে খেলে অথবা অধিক খেলেও দাঁত খারাপ হয়।

(১০) দাঁতকে রোগী (দূষিত) করতে মিষ্টি জাতীয় বস্তু, মিষ্টি বিষের কাজ করে। অধিক মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়া ব্যক্তির দাঁত সর্বদা দূষিত আর রোগী থাকে আর শীঘ্র ভেঙে যায়। এইরকম ব্যক্তির দাঁতে অসহ্য পীড়া থাকে।

(১১) চা হচ্ছে স্বাস্থ্য তথা দাঁতের জন্য অত্যন্ত হানিকারক। চা পান কারী ব্যক্তিরা এটা খুব গরম-গরম পান করে। কিছু ব্যক্তি তো এত গরম পান করে যদি কোনো সাধারণ মানুষ সেটা পান করে তাহলে মুখ, জিহ্বা, যকৃৎ আদি সব জ্বলে যাবে। এইজন্য প্রথমত চা পান করাই হানিকারক আর দ্বিতীয়ত এটা গরম-গরম পান করা "করলা আর নিম চরানো" র মতো বিষয় সিদ্ধ হয়। এটা দাঁতের সর্বনাশ করে ফেলে।

চা আর মাংস সেবনের কারণে প্রায়শঃ সব ইউরোপীয় মানুষদের সঙ্গে পায়রিয়া খুব প্রেম করে। তাই তারা যুবকাবস্থাতেই দাঁত হারিয়ে ফেলে আর অপ্রাকৃতিক (নকল) দাঁতই তাদের মুখের শোভা বাড়ায়। চা আর মাংসের ভক্ত ভারতীয়দেরও এমন দুর্দশা।

(১২) এইরকমই তম্বাকু, বিড়ি, সিগারেট আদির সেবন দাঁতের জন্য অত্যন্ত ঘাতক। তম্বাকু খাওয়া আর পান করা দুটোই দাঁতের হানি করে। কেবল ব্রহ্মচারী নয় বরং সব বিচারশীল মানুষকে এই সমস্ত বিষাক্ত পদার্থ থেকে সর্বদা দূরে থাকা উচিত।

আট-দশ দিনে একবার করে দাতুনের কুঁচিকে কোনো উত্তম মঞ্জনে ভরে দাঁত পরিষ্কার করা উচিত। দন্তমঞ্জন না পাওয়া গেলে হলুদ আর লবণ দুটোকে সমভাগ নিয়ে ঠিকভাবে পিষে সেটা দিয়ে দাঁত শুদ্ধ করা উচিত। তিল অথবা সর্ষের তেল দাতুনে দিয়ে ঘোষলে দাঁত তথা তার গোড়া শুদ্ধ আর দৃঢ় হয়। সর্ষের তেলে সূক্ষ্মভাবে পিষানো সৈন্ধব লবণ মিলিয়ে আঙ্গুল দিয়ে দাঁত আর মাড়িকে ভিতরে আর বাইরে সব দিকে ভালো করে মালিশ করা উচিত, তারপর কুলিকুচি করবে, এরফলে দাঁত শুদ্ধ আর দৃঢ় হয়।

🌱 মঞ্জন -
যদি দাতুন না পাওয়া যায় তাহলে কোনো বিশেষ অবস্থায় দাঁতকে শুদ্ধ করার জন্য কিছু লাভদায়ক য়োগ পাঠকদের লাভার্থ লিখে দিচ্ছি। এগুলো দাতুনের সমানই লাভের হয়।

(১) মঞ্জনের সরল য়োগ -
সাধারণ অবস্থায় দাতুনের স্থানে এই মঞ্জনের প্রয়োগ করা যেতে পারে। এটা সর্বত্র বিনা মূল্যে প্রাপ্ত হতে পারে। য়োগটা খুবই ভালো। গাভীর গোবরের ঘুটের ছাই কাপড় দিয়ে ছাঁকনি করে নিবে। যদি জংলী আরনের* ছাই উপলব্ধ হয় তাহলে কি আর বলবো, সেটাই হচ্ছে মঞ্জন। মঞ্জনের আবশ্যকতা হলে এটা দাঁত আর মাড়ির উপর মঞ্জনের মতো মালিশ করে শুদ্ধ জল দিয়ে কুলিকুচি করবে। বিনা পয়সার এই মঞ্জন দাঁতকে এত শুদ্ধ কান্তিময় (চকচকে) বানিয়ে দেয় যে তার সামনে অনেক মূল্যবান মঞ্জনও হার মেনে যাবে। সবথেকে বড় কথা হল এর ব্যবহারে দাঁতের কৃমি (পোকা) দূর হয়। সব ধরণের মল থেকে শুদ্ধ আর পবিত্র হয়ে দাঁত আর মাড়ি সর্বদা রোগ থেকে সুরক্ষিত থাকে। এটা দাঁতের ব্যথা আর রোগ দূর করার রামবাণ।

বড়-বড় রসায়নশালা (ফার্মেসী) আর ঔষধালয়ের স্বামী তথা বড়-বড় বৈদ্যরাও এর প্রয়োগ করে। দাঁতের ব্যথা দূর করার জন্য এটা জাদুর মতো কাজ করে।

(২) মঞ্জনের দ্বিতীয় য়োগ -
এই মঞ্জনও দাতুনের পরিবর্তে প্রতিদিন প্রয়োগ করতে পারবে। এটাও সরল, সস্তা আর সুগম। যেকোনো কাঠ খড়ির কয়লা এক ভাগ, ফিটকিরি (alum) সাদা দগ্ধ করা এক ভাগ, সৈন্ধব লবণ চার ভাগ অত্যন্ত সূক্ষ্ম ভাবে পিষে বস্ত্র দিয়ে ছেঁকে নিবে, এটাই মঞ্জন।  সময় মতো ব্যবহার করবে। এটা দাঁতকে মুক্তার মতো কান্তিময় বানায় আর সব রোগ থেকে সুরক্ষিত রাখে।

(৩) মঞ্জনের প্রসিদ্ধ য়োগ -
মঞ্জনের এই য়োগ খুবই প্রসিদ্ধ আর লাভদায়ক। দাঁতের প্রায় সব রোগের জন্য এটা খুবই ভালো ওষুধ। ভারতের সাধারণ মানুষও একে জানে, কিন্তু দুঃখের বিষয় যে এর প্রয়োগ কেউ করে না। আমি এর মঞ্জন পর্যাপ্ত মাত্রায় বানিয়ে অনেক রোগীর উপর প্রয়োগ করেছি। এটা মাজলেই দাঁত আর দাঁতের ব্যথা পালিয়ে যায়। মাড়ির সব দোষও দূর হয়। দাঁত অত্যন্ত শুদ্ধ বজ্রের সমান সুদৃঢ়, রোগ রহিত আর মুক্তার সমান কান্তিময় হয়ে ওঠে। এই প্রসিদ্ধ য়োগ হচ্ছে - বড় হরিতকীর খোসা, আমলকীর খোসা, বহেড়া খোসা এই সব শুষ্ক হবে। আদা, অশ্বত্থের ফল, গোলমরিচ, তুঁতে বা কপার সালফেট (Copper(II) sulfate) দগ্ধ করে, পাঁচ লবণ, কাষ্ঠ আর মাজুফল (Gall oak) এইসব ঔষধিকে সমপরিমাণ নিয়ে অত্যন্ত সূক্ষ্ম চূর্ণ করবে আর বস্ত্র দিয়ে ছেঁকে ভালো করে রাখবে। কেউ-কেউ এরমধ্যে তৈলস্ফটিক (alabaster) -ও মিশ্রিত করে।∆
ইরিমেদের ছাল ৫ সের চূর্ণ করে ১৬ সের জলে দিয়ে আগুনে চড়িয়ে দিবে। পাত্র কুঁড়ি হতে হবে। যখন জল ৪ সের হয়ে যাবে, সেটা নামিয়ে তার মল ছেঁকে তাতে তিলের তেল ২ সের দিবে আর নিম্ন লিখিত ওষুধকে চূর্ণ তথা ছেঁকে ছোটো ছোটো লাড্ডু বানিয়ে তারমধ্যেই দিয়ে ধীরে-ধীরে আগুন জ্বালাতে থাকবে।

🌱 ওষুধ -
কালো খয়েরের ছাল, লং, গম, পদ্মাখ, মঞ্জিষ্ঠা, লোধ্র, যষ্টিমধু, লাখ, নাগরমোথা, বটের ছাল, দালচিনি, জায়ফল, কর্পূর, কাবাবচিনি, খয়েরের ছাল, ধাতকির ফুল, ছোট এলাচ, নাগকেশর, কায়ফল প্রত্যেকটা এক-এক তোলা। যখন কেবল তেল রয়ে যাবে, নামিয়ে তেলকে নিষ্কাশন করে ঠাণ্ডা হয়ে গেলে শিশির মধ্যে ভরে নিবে। এই তেল গুরুকুল ঝাজ্জরে পাওয়া যায়। এটাই হচ্ছে আয়ুর্বেদের প্রসিদ্ধ য়োগ ইরিমেদাদি তেল। এই তেলের এক ফোঁটা দাঁতের ভয়ংকর ব্যথাকে দূর করে দেয়। প্রতিদিন এই তেল ব্যবহার করলে দাঁত নড়ে না আর যার নড়ে সেটা পুষ্ট হয়ে যায়। দাঁত দিয়ে ঠাণ্ডা বস্তু চাবানো যাচ্ছে না, জল আর ঠাণ্ডা বায়ুও সহ্য হচ্ছে না, দাঁত থেকে রক্ত আসা (পায়রিয়া) পুঁজ আসা, দাঁত নির্বল হওয়া, দাঁত থেকে দুর্গন্ধ আসা, মাড়ি ফুলে যাওয়া, দাঁতের মধ্যে পোকা (কৃমি) হওয়া, ইত্যাদি দাঁত আর মাড়ির সব রোগের রামবাণ হচ্ছে এই ওষুধ। এটা জিহ্বা, তালু, ঠোঁটের রোগকেও দূর করে। এই তেলকে আঙ্গুল দিয়ে দাঁত আর মাড়ির উপর ভিতরে বাইরে ঘোষা উচিত। এর প্রয়োগে কালো, হলদে, নোংরা দাঁতও শুদ্ধ চকচকে হয়ে যায়। দাঁতের রোগের অদ্ভুত ঔষধ ঋষিদের কৃপায় পাওয়া গেছে, প্রয়োগ করো আর লাভ নাও।

পাচনক্রিয়াকে শুদ্ধ রাখার জন্য দাঁতের শুদ্ধি অত্যন্ত আবশ্যক। যদি পাচন শক্তি সঠিক ভাবে কাজ না করে তাহলে ব্রহ্মচর্য পালন করা অথবা সুস্থ থাকা অসম্ভব। অতঃ প্রত্যেক স্বাস্থ্য প্রেমীকে দাঁতের শুদ্ধি আর রক্ষার্থ এই পুস্তক থেকে লাভ নেওয়া উচিত।

* গাভী প্রায়শই জঙ্গলের মধ্যে চরে বেড়ায় আর সেখানেই গোবর করে দেয়। এই গোবরই যখন পড়ে থাকতে-থাকতে শুকিয়ে যায় তখন আরনের নাম ধারণ করে।
∆ এই মঞ্জন ইরায়া গুরুকুল ঝজ্জরেও পাওয়া যায়।
_______________________________________________________________________________________


💠 ব্যায়াম সন্দেশ 💠

🌱 বিষয় প্রবেশ
শৌচ, দন্তধাবন আর মুখ আদি অঙ্গের শুদ্ধির পশ্চাৎ আর স্নানের পূর্বে প্রতিদিন প্রত্যেক ব্যক্তি বিশেষতঃ ব্রহ্মচারীকে নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করা উচিত। সাধারণত স্ত্রী হোক বা পুরুষ যারা যত ভোজন করে, তাদের ততই ব্যায়ামের আবশ্যকতা আছে। এর কারণ স্পষ্ট যে, শরীরের মধ্যে ব্যায়ামরূপী অগ্নি না হওয়ার জন্য ভোজন সঠিক ভাবে হজম হয় না আর সেটা শরীরের অঙ্গ না হয়ে উল্টো হানিই করে। কারণ যেসব খাদ্য-পদার্থের দ্বারা রক্ত আদি ধাতুর নির্মাণ হয়ে বল আর শক্তির সঞ্চয় হয়, সেইসব ঠিক ভাবে হজম না হওয়ার জন্য সেগুলো পচতে থাকে আর শরীরের মধ্যে দুর্গন্ধ উৎপন্ন করে। যেখানে অনেক রোগের উৎপত্তির কারণ হয় সেখানে মানুষের মনের মধ্যে অনেক প্রকারের দুষ্ট বিচারও জন্ম নেয়, যারফলে মানুষের বুদ্ধি ভ্রষ্ট হয়ে স্মরণশক্তিও নির্বল হয়ে যায় আর তার নিজের কর্তব্য-কর্মের জ্ঞানও থাকে না। পরিণামস্বরূপ সে দুঃখদায়ী বিষয়ভোগের মধ্যে ফেঁসে যায় আর এই বিষয়-বাসনার অগ্নি মানুষের স্বাস্থ্য, শক্তি, সৌন্দর্য, স্ফূর্তি আর সাহস আদি সদ্ গুণকে জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করে ফেলে। এমনকি মানুষের সবথেকে প্রিয় বস্তু যুবকাবস্থাকেও এটা খেয়ে ফেলে। দুঃখদায়ী বৃদ্ধাবস্থা চলে আসে, মানুষের শরীর আলস্য, নির্বলতা আর রোগের ঘর হয়ে যায়, যারফলে লোক আর পরলোক দুটোই নষ্ট হয়ে যায়।

🌱 স্বাস্থ্যের গুরুত্ব -
"ধর্মার্থকামমোক্ষাণামারোগ্যম্ মূল মুত্তমম্।" মানুষের জীবনকে সফল করে তোলে এমন "পুরুষার্থ চতুষ্টয়" অর্থাৎ ধর্ম, অর্থ, কাম আর মোক্ষের আধার বা মূল সাধনই হচ্ছে আরোগ্য। কারণ, রোগী মানুষ সাংসারিক সুখ প্রাপ্তির জন্য না তো কৃষি আদি ব্যবসা করতে পারবে আর না সন্ধ্যা, ঈশ্বরোপাসনা, ব্রহ্মচর্য-পালন আদি ধর্ম-কর্ম যা মোক্ষ প্রাপ্তির সাধন হয়, সেগুলোর অনুষ্ঠান করতে সক্ষম হবে। এইজন্য সংসারের সর্বোত্তম আর সর্বপ্রিয় বস্তু হচ্ছে স্বাস্থ্য। সংসারিক ধনৈশ্বর্য তথা ভোগবিলাসের সব সাধন বিদ্যমান থাকার পরও রোগী ব্যক্তি সেগুলো থেকে কিছুই লাভ নিতে পারে না, উল্টো সেগুলো দেখে-দেখে আরও দুঃখী হতে থাকে। রোগী মল-মূত্র ত্যাগ আদি আবশ্যক কাজকেও অন্য মানুষের সহায়তা ছাড়া করতে পারে না। সবসময় তার অন্যের সাহায্যের প্রয়োজন হয় আর এই প্রতিটা মুহূর্ত পরাধীনতার কারণে রোগীর জীবন শুষ্ক, নীরস আর অত্যন্ত দুঃখময় হয়। রোগী হওয়া মানেই সাক্ষাৎ নরকের দর্শন করা। কারণ "সর্বম্ পরবশম্ দুঃখম্"।

স্বর্গ আর নরক অন্যত্র কোথাও হয় না। সুস্থ মানুষের জন্য এই সংসারই স্বর্গের সমান। রোগী মানুষ তা সে যতই ধনী-মানী হোক না কেন, সে সর্বথা পরাধীন হওয়ার ফলে অত্যন্ত হীন আর দুঃখী থাকে। তার অবস্থা একটা দরিদ্র, ভিখারীর থেকেও অধিক খারাপ হয়। কারণ তাকে নিজের ভুলের কারণে গুরুতর নরক (দুঃখ) ভোগ করতে হয়। বিষয়টা যথাযথ ভাবে এটাই যে - কোনো মানুষ যতই দরিদ্র হোক না কেন, যদি সে পূর্ণ সুস্থ থাকে তাহলে সে ধনের অভাব হলেও ধনবান্ হয়। কারণ স্বাস্থ্য-ধনের অধিক কোনো ধন নেই। সুস্থ মানুষই স্বর্গের সব সুখ উপভোগ করে। তাই আমাদের পূর্বজ ঋষি-মহর্ষিরা সাংসারিক সুখ-অভ্যুদয় আর পারলৌকিক সুখ-নিঃশ্রেয়স্ অর্থাৎ মোক্ষ প্রাপ্তির সাধন আরোগ্য বা স্বাস্থ্যকেই মেনেছেন। এইজন্য স্বাস্থ্যই আমাদের সর্বস্ব আর এর রক্ষা করা আমাদের পরম কর্তব্য।

🌱 স্বাস্থ্য আর ব্যায়াম -
ব্যায়াম বিনা স্বাস্থ্যের রক্ষা অসম্ভব। পরমপিতা পরমাত্মা আমাদের রোগী আর দুঃখী হওয়ার জন্য বানায় নি, দুঃখ আর রোগকে তো আমরা নিজেরাই ডেকে আনি আর পুনঃ কান্না আর অনুতাপ করি। আমরা স্বাস্থ্যের মূলাধার ব্যায়ামকে যখন থেকে ছেড়ে দিয়েছি তখন থেকে আমাদের ভয়ংকর দুর্গতি হয়েছে, সেটা লিখতে গেলেও লজ্জা আসে। আজ শুধু বালক, যুবকই নয়, সবাই রোগী। কারণ আমরা ঋষিদের সুন্দর শিক্ষা ব্রহ্মচর্য আর এর মুখ্য সাধন ব্যায়ামকে ছেড়ে দিয়েছি আর তার স্থানে বিষয়ী, ভোগবিলাসপ্রিয় আর কামবাসনার দাস হয়েগেছি। আজকের যুবক আর যুবতীরা ব্যায়ামকে ভালোবাসে না, আখাড়া (কুস্তির ময়দান) আর ব্যায়ামশালাতে যেতে তাদের ভালো লাগে না, তাদের তো সিনেমা, থিয়েটার আর নাচঘর ভালো লাগে। নগরে সিনেমা ঘরের সামনে ভারী ভিড় লেগে যায় আর আখাড়া খালি পড়ে থাকে। দুই-একটা সৌভাগ্যশালী ব্যক্তি ঐদিকে মুখ করে। এরপরও স্বাস্থ্য আর বলের আশা করা যেতে পারে! আমাদের যুবকরা আখাড়াতে গিয়ে করবেই বা কি? কারণ এরা তো দণ্ড, বৈঠক আর কুস্তি এইজন্য ঘৃণা করে যেন এদের কোমল শরীরে আখাড়ার ধুলো বা মাটি না লেগে যায় আর এদের সুন্দর বস্ত্র বা শরীর যেন না খারাপ হয়। এইরকমই ব্যায়ামভীরু নপুংসকদের দিয়ে এই দেশটা ভরা।

সাধারণ যুবকদের এইটুকুও জ্ঞান নেই যে যদি একটা মেশিনকে সারা বছর ধরে না চালানো হয় তাহলে তার অবস্থা কিরকম খারাপ হয়। তাকে পুনঃ চালু করার জন্য নতুন মেশিনের মূল্যেরও অধিক ধনব্যয় করতে হয়, ঠিক সেইরকম আমাদের শরীরও ব্যায়াম বা কাজ না করার ফলে সর্বথা নির্বল, বিকৃত আর রোগের ঘর হয়ে যায়। পুনঃ প্রচেষ্টার পরেও ঠিক হয়ে ওঠে না। সবাই জানে যে পুকুরের জল স্থির হওয়ার কারণে পচে যায় আর নদী ঝর্নার জল নিত্য চলার কারণেই নির্মল আর কাঁচের সদৃশ চকচক করে। সেইরকম ব্যায়াম না করার ফলে শরীর রক্ত সঞ্জারও ভালোভাবে হয় না, তাই অনেক ধরণের মল শরীরের মধ্যে আবদ্ধ বা একত্রিত হওয়ার ফলে রক্ত নোংরা আর খারাপ হয়ে অনেক রোগের উৎপত্তির কারণ হয়। নিত্য ব্যায়াম করার ফলে রক্তের সঞ্চার আর শুদ্ধি হয়, সব অঙ্গের মধ্যে বল, স্ফূর্তি আর শক্তি আসে। ব্যায়াম নমনীয়তা, বৃদ্ধি, সৌন্দর্য, কান্তি আর বলকে উৎপন্ন করে, সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে পূর্ণ আর পুষ্ট করে। আসলে ব্যায়াম হচ্ছে শরীরের জন্য সবথেকে বড় পুষ্টিদায়ক আর স্বাস্থ্যপ্রদ সাধন। উচিত ব্যায়াম করার ফলে প্রায়শঃ সব ধরণের রোগ থেমে যায়। আজ পর্যন্ত সংসারের মধ্যে এমন কোনো মানুষ হয়নি, যে বিনা ব্যায়াম করে পরমারোগ্য আর স্বাস্থ্য প্রাপ্ত করেছে। ব্যায়ামের অভাব বা আলস্যই হচ্ছে রোগের স্রোত। ব্যায়ামই হচ্ছে পূর্ণ সুখ আর স্বাস্থ্য প্রাপ্তির একমাত্র সাধন।

🌱 ব্যায়াম থেকে লাভ -
আমি পূর্বেই বলেছি যে স্বাস্থ্য প্রাপ্তির মুখ্য সাধন হচ্ছে ব্যায়াম। এখন আমি এর পুষ্টিতে ঋষি-মহর্ষি আর অন্য অভিজ্ঞ ব্যায়াম আচার্যদের মত প্রস্তুত করছি। পরম বৈদ্য মহর্ষি ধন্বন্তরির মত হল -
শরীরোপচয়ঃ কান্তির্গাত্রাণাম্ সুবিভক্ততা।
দীপ্তাগ্নিত্বমনালস্যম্ স্থিরত্বম্ লাঘবম্ মৃজা।।
শ্রমক্লমপিপাসোষ্ণশীতাদীনা সহিষ্ণুতা।
আরোগ্যম্ চাপি পরমম্ ব্যায়ামাদুপজায়তে।।
(সুশ্রুত সংহিতা চিকিৎসা০ ২৪/৩৯-৪০)
অর্থাৎ - ব্যায়াম করার ফলে শরীর বাড়ে, শরীরের কান্তি আর সৌন্দর্য বাড়ে, শরীরের সব অঙ্গ সুগঠিত হয়, পাচনশক্তি বাড়ে, আলস্য থাকে না, শরীর দৃঢ় আর হালকা হয়ে স্ফূর্তি আসে তথা তিন দোষের মৃজা (শুদ্ধি) হয়।

শ্রম (ক্লান্ত), ক্লম (দুঃখ), তৃষ্ণা, শীত, গরম আদি সহ্য করার শক্তি নিত্য ব্যায়াম দ্বারাই প্রাপ্ত হয় আর পরম আরোগ্য অর্থাৎ আদর্শ স্বাস্থ্য প্রাপ্তিও ব্যায়াম দ্বারাই হয়।

এই বিষয়ে মহর্ষি পতঞ্জলি জী চরক সংহিতার মধ্যে লিখেছেন যে -
লাঘবম্ কর্মসামর্থ্যম্ স্থৈর্য়ম্ ক্লেশসহিষ্ণুতা।
দোষক্ষয়োऽগ্নিবৃদ্ধিশ্চ ব্যায়ামাদুপজায়তে।।
(চরক সংহিতা সূত্রস্থান ৭/৩১)
ব্যায়াম করার ফলে শরীরে লঘুতা (স্ফূর্তি, হালকা, তৎপরতা), কাজ করার শক্তি, স্থিরতা, ক্লেশ তথা দুঃখকে সহ্য করা, দোষের (কুপিত - বাত, পিত্ত, কফ) নাশ আর হজমশক্তি বৃদ্ধি করে।

আমাদের পূর্বজ ঋষিরা এইসব শ্লোকের মধ্য দিয়ে ব্যায়াম করার লাভের বর্ণনা সুন্দর ভাবে করেছেন। আমরা যেসব ভোজন প্রতিদিন করি সেটা প্রথমে আমাদের পেটের পাকস্থলীর মধ্যে যায় আর সেখানে পেটের অগ্নি যাকে জঠরাগ্নি বলা হয়, সেটা খাওয়া ভোজনকে রন্ধন করে। ভোজন হজম হলে আমাশয় থেকেই বাকি অঙ্গের মধ্যে পৌঁছায় তথা সারা শরীরকে শক্তি আর আরোগ্যতা প্রদান করে। যাদের জঠরাগ্নি ঠিক ভাবে কাজ করে, তাদের খাওয়া পৌষ্টিক ভোজন ব্যর্থ যায় না আর সেগুলো হজম হয়ে রস হয়ে যায়। পৌষ্টিক সারভাগকে তীব্র জঠরাগ্নি মল ভাগের মধ্যে যেতে দেয় না। যার পাচনশক্তি বা জঠরাগ্নি ভালো তথা তীব্র হয় তার ভোজন অধিক মাত্রায় শীঘ্র হজম হয়ে রস আদি ধাতু হতে থাকে আর এই রস, রক্ত, বীর্য আদি সাত ধাতু শরীরকে হৃষ্ট-পুষ্ট বানায় আর ধারণ করে। এইজন্য এগুলোকে ধাতু বলে আর এই ধাতু থেকেই শরীরের নির্মাণ, বৃদ্ধি বা উপচয় হয় আর এর নিম্নতা বা হ্রাসের কারণেই শরীরের নাশ হয়। তাই মহর্ষি ধন্বন্তরি জী মহারাজ "আষোডশাদবৃদ্ধিঃ" সোলো বছর থেকে পঁচিশ বছরের আয়ু পর্যন্ত বৃদ্ধি অবস্থা বলেছেন। এই আয়ুতে বীর্যাদি সব ধাতুর বৃদ্ধি হয়। বৃদ্ধি অবস্থায় অনেক কারণে জঠরাগ্নি খুব তীব্র হয়, আর যা কিছু খাওয়া-পান করা হয় সেটা দ্রুত হজম হয়ে রসাদি ধাতু হয়ে শরীরের অঙ্গ হয়ে যায় আর তাকে দৃঢ় আর পুষ্ট বানায়। যাদের জঠরাগ্নি খারাপ থাকে তারা বৃদ্ধি অবস্থাতেও নির্বল তথা যুবকাবস্থাতে বুড়োই থাকে।

সারাংশ এই হল যে, আমাদের পেটের মধ্যে এক ধরণের উষ্ণতা (অগ্নি) আছে যা ভোজনকে হজম করে, পৌষ্টিক ভাগকে গ্রহণ করে, মল-ভাগকে বাইরে নিষ্কাশিত করে আর রসাদি ধাতুর দ্বারা শরীরের নির্মাণ বা বৃদ্ধি করে। এই উষ্ণতার আবশ্যকতা সবার আছে আর ব্যায়াম করার ফলে সারা শরীরের মধ্যে এই উষ্ণতা এসে যায়। সেটা বিভিন্ন শিরার দ্বারা ভোজন থেকে রসকে এমন ভাবে টানতে থাকে যেভাবে তুলো ঘী বা তেলকে টেনে নেয়। এই উষ্ণতাই শরীরের মধ্যে রক্তাদি ধাতুর নির্মাণ আর সঞ্চার করে। যেভাবে বিদ্যুৎ প্রবাহ দ্বারা বিদ্যুতের তারে উত্তেজনা (গরম) সঞ্চার হয়, সেইভাবে ব্যায়াম দ্বারা সারা শরীরের মধ্যে রক্ত উত্তেজিত হয়ে বিভিন্ন শিরার মাধ্যমে অত্যন্ত তীব্রগতিতে ছুটতে থাকে, শিরাগুলো উত্তেজিত তথা কার্যশীল হয়, সম্পূর্ণ শরীরে রক্ত সঞ্চার ঠিক ভাবে হয় আর যথাযোগ্য সব অঙ্গকে শক্তি প্রদান করে। বিনা বিদ্যুৎ ধারার বিদ্যুৎ সর্বথা শক্তিহীন হয়, সেইরকম রক্ত-সঞ্চারিণী সব শিরা রক্ত-সঞ্চার বিনা ব্যর্থ হয়। রক্ত সঞ্চার বিনা রক্ত হবে কিভাবে?

ক্ত তৈরি হয় রস থেকে আর রস তৈরি হয় ভোজন সঠিক ভাবে হজম হলে পরে; ভোজন হজম হয় উষ্ণতার দ্বারা আর উষ্ণতার জননী হল ব্যায়াম। এই উষ্ণতার দ্বারা রস আর রসের দ্বারা রক্তাদি তৈরি হয়। এই রক্ত শিরার দ্বারা নিয়মিত সারা শরীরে পরিভ্রমণ করতে-করতে শক্তির সঞ্চার করে। ব্যায়াম দ্বারা প্রদীপ্ত হওয়া জঠরাগ্নি ভোজন থেকে কেবল পোষক দ্রব্যকেই গ্রহণ করে না অপিতু এরমধ্যে এমনও শক্তি আছে যে এটা শরীর থেকে বিজাতীয় (বর্জনীয়) মল-মূত্রাদি দ্রব্যকেও বাইরে বের করে ফেলে দেয় আর শরীরকে শুদ্ধ-পবিত্র করে। যেভাবে ঝাড়ু ঘর পরিস্কারের কাজ করে, সেইভাবে এটা শরীরের অনেক মার্গ দ্বারা মল-মূত্রাদিকে বাইরে বের করে দেয় আর ব্যায়াম করার ফলে এই উষ্ণতা শরীরের মধ্যে এতই অধিক হয় যে এটা স্থূল থেকে স্থূল, সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম আটকে থাকা মল আর দোষকেও মলদ্বার, মূত্রেন্দ্রিয়, নেত্র, কর্ণ, নাসিকা আর রোমকূপাদি দ্বারা মল, মূত্র, শ্লেষ্ম, কফ, থুতু, লার, পিত্ত আর ঘাম আদির রূপে শরীর থেকে বাইরে বের করেই ছাড়ে। এমনকি ব্যায়াম করার ফলে ঘামের দ্বারা অনেক ধরণের বিষও শরীর থেকে বাইরে বেরিয়ে যায়।

🌱 প্রো০ রামমূর্তির জীবনের ঘটনা -
এই বিষয়ে প্রফেসর রামমূর্তির জীবনের একটা ঘটনা উল্লেখ করছি আর সেটা এইরকম, ইউরোপে ওনাকে হীনতা দেখানোর জন্য কয়েকজন পাপী ওনার ভোজনে বিষ দিয়ে দেয়। যখন তিনি সেটা বুঝতে পারেন তখন একসঙ্গে দশ-পনেরো হাজার দণ্ড (বুকডন) দিয়ে বের করে ফেলেন। ঘামের দ্বারা সব বিষ বাইরে বেরিয়ে যায় আর তিনি বেঁচে যান।

ব্যায়াম করা ব্যক্তির শরীর অত্যন্ত শুদ্ধ, নির্মল আর রোগ রহিত হয়। মল-মূত্রাদি ঠিকভাবে বেরিয়ে যায়, কখনও মল-বন্ধ (কব্জ) হয় না। তার এমন চিন্তা করতে হয় না যে শৌচ আসবে কি আসবে না, শৌচ দুই সময় খুলে আসে। আমাশয় বা জঠরাগ্নিকে বল দেওয়ার সবথেকে সস্তা আর সর্বোত্তম পদ্ধতিই হচ্ছে ব্যায়াম। ব্যায়ামী ব্যক্তির কখনও মন্দাগ্নি রোগ হয় না, সে যেটাই পেটের মধ্যে দেয় সেটাই শীঘ্র হজম হয়ে শরীরের অঙ্গ হয়ে যায়। তার আহার-পান করা ঘী, দুধ আদি পৌষ্টিক ভোজন তার শরীরের মধ্যেই লেগে যায়, শৌচ দ্বারা বেরিয়ে যায় না। অতঃ তার বল-শক্তি দিনের-পর-দিন বাড়তেই থাকে। তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বৃদ্ধি যথাযোগ্য হয়। শরীরের অঙ্গকে সুঠাম, সঘন, পুষ্ট আর সুন্দর বানানোই হল ব্যায়ামের প্রথম কাজ। যদি কোনো মানুষ কেবল একটা বছর নিরন্তর নিয়ম পূর্বক যেকোনো ব্যায়াম করে তাহলে তার শরীর সুন্দর আর সুদৃঢ় হতে থাকে আর যে সর্বদা শ্রদ্ধাপূর্বক দুই সময় যথাবিধি ব্যায়াম করে, তার তো কি আর বলবো! তার শরীরের সব মাংসপেশী লোহার মতো শক্ত আর সুদৃঢ় হয়ে যায় আর সমস্ত শিরা, সম্পূর্ণ স্নায়ু মণ্ডল আর শরীরের প্রত্যেক অঙ্গ বজ্রের সমান কঠোর আর সুদৃঢ় হয়ে যায়। পদ্ধতি অনুযায়ী ব্যায়াম করার ফলে শরীরের প্রত্যেক অঙ্গ সঠিক ভাবে বৃদ্ধি প্রাপ্ত করে অত্যন্ত সুন্দর, সুদৃঢ় আর সঘন হয়। শরীরে ব্যর্থ মাংস বা চর্বি হয়ে তাকে আলগা করতে পারে না, পেট শরীরের সঙ্গে লেগে থাকে, বাড়তে পারে না।

🌱 ব্যায়ামের প্রশংসাতে ঋষি-মহর্ষিদের মত -
মহর্ষি ধন্বন্তরি জী সুশ্রুতের মধ্যে লিখেছেন -
ন চাস্তি সদৃশম্ তেন কিঞ্চিৎস্থৌল্যাপকর্ষণম্।
ন চ ব্যায়ামিনম্ মর্ত্যম্ মর্দয়ন্ত্যরয়ো ভয়াত্।।
(সুশ্রুতসংহিতা চিকিৎসাস্থান ২৪/৪১)
অর্থাৎ - অধিক স্থূলতাকে (মোটা) দূর করার জন্য ব্যায়াম থেকে ভালো আর কোনো ওষুধ নেই, ব্যায়ামীর থেকে তার শত্রু সর্বদা ভয় করে আর তাকে দুঃখ দেয় না।

ন চৈনম্ সহসাক্রম্য জরা সমধিরোহতি।
স্থিরীভবতি মাম্সম্ চ ব্যায়ামাভিরতস্য চ।।
(সুশ্রুতসংহিতা চিকিৎসাস্থান ২৪/৪২)
অর্থাৎ - ব্যায়ামী মানুষের উপর বার্ধক্য সহসা আক্রমণ করে না। ব্যায়ামী পুরুষের শরীর, হাড়, মাংস সব স্থির হয়।

ব্যায়ামক্ষুণ্ণগাত্রস্য পদূভ্যামুদ্বর্ত্তিতস্য চ।
ব্যাধয়ো নোপসর্পন্তি সিম্হম্ ক্ষুদ্রমৃগা ইব।।
(সুশ্রুতসংহিতা চিকিৎসাস্থান ২৪/৪৩)
অর্থাৎ - ব্যায়াম করে ক্লান্ত হলে যার শরীরে ঘাম আসে আর পায়ের তৈলাদির দ্বারা পর্যাপ্ত মর্দন করে অথবা শরীরে তেল মালিশ আদি দ্বারা নির্মল করে, তার নিকট রোগ এইভাবে আসে না যেভাবে সিংহের ভয়ে নির্বল হরিণ সামনে আসে না।

এইরকমই একটা শ্লোক ব্যাকরণের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ কাশিকার মধ্যেও আছে -
ব্যায়ামক্ষুণ্ণগাত্রস্য পদূভ্যামুদ্বর্তিতস্য চ।
ব্যাধয়ো নোপসর্পন্তি বৈনতেয়মিবোরগঃ।।
(কাশিকা অধ্যায় ৬, পাদ ১, সূত্র ৬৩)
অর্থাৎ - ব্যায়াম করে ক্লান্ত হলে যার শরীরে ঘাম আসে আর পায়ের তৈলাদির দ্বারা পর্যাপ্ত মর্দন করে অথবা শরীরে তেল মালিশ আদি দ্বারা নির্মল করে, তার নিকট রোগ এইভাবে আসে না যেভাবে গরুড়ের ভয়ে সাপ সামনে আসে না।

বয়োরূপগুণৈর্হীনমপি কুর্য়াত্সুদর্শনম্।
ব্যায়ামম্ কুর্বতো নিত্যম্ বিরুদ্ধমপি ভোজনম্।।
বিদগ্ধমবিদগ্ধম্ বা নির্দোষম্ পরিপচ্যতে।।
(সুশ্রুতসংহিতা চিকিৎসাস্থান ২৪/৪৪-৪৫)
অর্থাৎ - যে ব্যক্তি যুবকাবস্থা, সৌন্দর্য আর বীরতা আদি গুণ রহিত হয়, তাকেও ব্যায়াম সুন্দর বানিয়ে তোলে। ব্যায়ামী মানুষ গরিষ্ঠ, জ্বলে যাওয়া অথবা কাঁচা, যেকোনো ধরণের ভোজন হোক না কেন, সেটা প্রকৃতিরও বিরুদ্ধ হোক না কেন, সবকিছুকে সম্পূর্ণ ভাবে হজম করে নেয় আর তার কোনো হানিও হয় না।
ব্যায়ামী মানুষকে কখনও এমন বলতে শুনবে না যে আমার খাবার হজম হচ্ছে না বা মল পরিষ্কার ভাবে হচ্ছে না অথবা বদহজম হয়েছে। এই দুর্গতি তো ব্যায়াম না করা মানুষেরই হয়। তাদের কখনও পরিষ্কার ভাবে শৌচ হয় না, তাই দুইবার শৌচ করতেও যায় না। বদহজম হওয়ার জন্য কখনও ঠিক ভাবে আসল খিদে পায় না। ব্যায়াম না করা ব্যক্তিদের শরীর প্রায়শঃ রোগের ঘর হয়। তাদের সারা জীবনের আয় (কামাই) বৈদ্য, ডাক্তারদেরই ভেট চরে, কিন্তু স্বাস্থ্য আর আসল সুখের দর্শন তাদের জীবনে কখনও ভুলেও হয় না। স্বাস্থ্য বিনা কেমন সুখ আর আনন্দ! কারণ "আরোগ্যম্ চাপি পরমম্ ব্যায়ামাদুপজায়তে।" আদর্শ স্বাস্থ্য অথবা পরম আরোগ্যতার প্রাপ্তি ব্যায়াম দ্বারাই সম্ভব, সেটাই আনন্দ আর সুখের উদ্গম। ব্যায়ামী ব্যক্তির শরীর কেবল সুস্থই নয় অপিতু অত্যন্ত সুন্দর আর দর্শনীয় হয়। ব্যায়ামের দ্বারা শরীর খুব হৃষ্ট-পুষ্ট আর সুন্দর হয়, তাতে শিথিলতা আর দুর্বলতার নাম মাত্রও থাকে না। ব্যায়ামের ফলে শরীরের রং উজ্জ্বল হয়, শুধু মুখ কেন সারা শরীরে লালতা, অদ্ভুত কান্তি আর তেজ চকচক করে, বার্ধক্য তার সামনে আসতে ভয় পায়, ব্যায়ামী ব্যক্তিকে তার শত্রুও ভয় করে। রোগ, বার্ধক্য আর মোটা কেউই সামনে আসে না। ব্যায়ামী পুরুষ মৃত্যুকেও ঠেলে সরিয়ে দেয়, সে হয় গুণের ভাণ্ডার আর তার শরীর হয় সৌন্দর্যের প্রতীক। যদি এইরকম যুবক লঙ্গো়ট বেঁধে দাঁড়িয়ে পরে তাহলে দর্শকের এমনই ইচ্ছে হবে যে এর সুন্দর শরীরকে দেখতেই থাকি। তার আদর্শ স্বাস্থ্য আর মনোহর মানব দেহের কমনীয়কান্তি তাদের মনকে মোহ করে দেয়। কেনই বা মোহ হবে না, যেসব পৌষ্টিক ভোজন সে খেয়েছে সেটা সম্পূর্ণ ভাবে হজম হয়েছে আর তার যে সার তত্ত্ব বীর্য হয়েছে সেটাও ব্যায়ামের দ্বারা হজম হয়ে রক্তে মিলে গেছে আর শরীরের রং হয়ে গেছে।

"বীর্য়ম্ বৈ বলম্" বীর্য হচ্ছে শক্তি আর বলের ভাণ্ডার। ব্যায়ামের দ্বারা এর ঊর্ধ্বগতি হয় আর এটা ওজ -এর রূপে চকচক করতে থাকে, বীর্যের অধোগতি হয় না আর বীর্যের নাশ বা পতনের সম্ভাবনাও থাকে না। শরীরে বীর্যের খুব বৃদ্ধি হয়ে স্থিরতা আসে। এইজন্য মহাপুরুষরা ব্যায়ামকে বীর্য রক্ষার সর্বোত্তম সাধন বলেছেন। ব্যায়ামী পুরুষের জাগৃত বা স্বপ্নাবস্থাতেও কোনো রূপ বীর্যনাশের ভয় থাকে না। তাহলে এমন বীর্যবান মানুষের শরীর কেন সুন্দর আর সুঠাম হবে না, তার পবিত্র আর পরিপুষ্ট দেহের উপর কেন মনোহর কান্তি আর সুন্দর ছবি ফুটে উঠবে না!

🌱 ব্যায়াম আর দুষ্ট বিচার -
ব্যায়াম প্রেমীদের বিচার সর্বদা শুদ্ধ আর পবিত্র হয়। তারা কুসঙ্গ, কুৎসিত আর কামুকতার দুষ্ট বিচারগুলো থেকে সর্বদা দূরে থাকে। যদি কারও কুসংস্কার বশত দুষ্ট বিচার বিরক্ত করে আর কোনো ভাবেই বশে না আসে তাহলে তখনই দ্রুত দৌড়ানো শুরু করে দাও অথবা অন্য যেকোনো ব্যায়াম করা শুরু করে দাও, তারপর দেখবে দুষ্ট বিচার কিভাবে লেজ গুটিয়ে পালায়। আদর্শ ব্যায়ামী পুরুষের সামনে দুষ্ট বিচারের দুষ্টতা চলে না।
কামবাসনার বেগ যতই প্রবল হোক না কেন ততকাল ডুবে যাবে। ব্যায়ামের স্বাদ ব্যভিচারের ভাবনাকে সর্বথা সমূল নষ্ট করে দিবে। অধম থেকে অধম মানুষও যদি নিয়মপূর্বক ব্যায়াম করা শুরু করে দেয় তাহলে সে স্বয়ংই অধমতাকে ঘৃণা করবে। নিয়মিত ব্যায়াম করার ফলে আচারহীন ব্যভিচারীও সদাচারী আর ব্রহ্মচারী হয়ে যায়। ব্যায়ামের দ্বারা মনোবিকারের অন্ত্যেষ্টি হয়ে যায়। মনের চঞ্চলতা নষ্ট হয়ে সেটা নিয়ন্ত্রণে আসে। মন হচ্ছে সব ইন্দ্রিয়ের রাজা, যখন মন শুদ্ধ, পবিত্র হয়ে নিয়ন্ত্রণে আসে তখন শরীর আর ইন্দ্রিয়ের সব দোষ দূর হয়ে সেগুলো স্বয়ং শান্ত আর পবিত্র হয়। আত্মা শম আর দামের শক্তি প্রাপ্ত করে, ব্যায়ামের দ্বারা ভিতর আর বাইরের শুদ্ধি তথা পরিষ্কার হয়। এমন অবস্থায় ব্যায়ামীর জন্য বীর্য-রক্ষা বা ব্রহ্মচর্য পালন খুবই সহজ হয়ে যায় আর ব্রহ্মচর্য পালনে সফল হওয়া মানেই মানুষের সৌভাগ্যের উদয় হওয়া। কারণ য়োগিরাজ মহর্ষি পতঞ্জলির কথনানুসারে "ব্রহ্মচর্য় প্রতিষ্ঠায়াম্ বীর্য়লাভঃ" ব্রহ্মচর্য পালন দ্বারা অপূর্ব বল তথা শক্তি প্রাপ্ত হয় আর নির্বলতা, আলস্য, প্রমাদ আদি দুর্গুণ সব দূরে পালিয়ে যায়।

ব্রহ্মচর্য হল সব শক্তি আর সদ্ গুণের ভাণ্ডার, এইজন্য ব্রহ্মচারী যখন ব্রহ্মচর্য পালনের মুখ্য সাধন ব্যায়ামকে গ্রহণ করে তখন সেখান থেকে সে যেমন ব্রহ্মচর্য পালনে পূর্ণ সফলতা প্রাপ্ত করে তেমনই তার নিরন্তর ব্যায়াম করার ফলে তার পরিশ্রম করার স্বভাবও তৈরি হয়ে যায়। সে কঠিন থেকে কঠিন কাজ হাসতে হাসতে করে ফেলে। তারমধ্যে কাজ করার অদম্য শক্তি, অপূর্ব উৎসাহ আর স্ফূর্তি আসে। নিত্য ব্যায়ামের কারণে শরীর হালকা আর কর্মতৎপর হয়। ব্যায়ামের মধ্যে এমন একটা বিচিত্রতা আছে যে অধিক স্থূল (মোটা) মানুষকে পাতলা আর পাতলা মানুষকে হৃষ্ট-পুষ্ট বানিয়ে তোলে। নির্বলতা যা মানুষকে অধিক কামী আর বিলাসী বানায়, তার পরম শত্রুই হচ্ছে ব্যায়াম। নির্বলতা তাকে দেখে পালায়। ব্যায়ামী ক্লান্ত হওয়া বা ক্লান্ত হয়ে হাপাতে থাকা কি জিনিস, সেটা জানেই না, সে পর্বতের সমান স্থির আর দৃঢ় থাকে। তার জন্য দুঃখ নামের কোনো বস্তুই নেই। সে মৃত্যুর সঙ্গেও হাস্য করে। পুনঃ তার জন্য শীত-উষ্ণ, ক্ষুদা-তৃষ্ণা, সুখ-দুঃখ, হানি-লাভ, মান-অপমান, হর্ষ-শোক, জয়-পরাজয়, জীবন-মরণ আদি পরস্পর বিরোধী দ্বন্দ্ব সুখপূর্বক সহ্য করা সাধারণ বিষয় হয়ে যায়।

উদাহরণ স্বরূপ আমাদের প্রাচীন যোদ্ধা-পুরুষোত্তম রাম, য়োগেশ্বর কৃষ্ণ, বীর হনুমান, ব্রহ্মচারী ভীষ্ম আদি তথা আধুনিক মহাপুরুষ মহর্ষি দয়ানন্দ, স্বামী শ্রদ্ধানন্দ, ধর্মবীর পণ্ডিত লেখরাম, ব্রহ্মচারী রামপ্রসাদ বিস্মিল আর কলিযুগী ভীম প্রো০ রামমূর্তি তথা ব্রহ্মচারী প্রো০ মানিকরাও জী আদি ব্যায়ামশীল ব্যক্তিদের জীবনী পড়লে জানা যায় যে আমাদের এই পুরুষরা সংসারের মধ্যে সেইসব আশ্চর্যজনক কাজ করেছেন যা আজও পড়ে-পড়ে পাঠক রোমাঞ্চিত হয়।

সংসারের সব মহাপুরুষ, বিদ্বান, বৈদ্য আর ডাক্তারের এই একটাই মত যে মানুষের শরীরকে সুন্দর, সুদৃঢ় বানাতে আর সুস্থ রাখতে হলে ব্যায়ামের থেকে ভালো আর কোনো সাধন নেই। স্বাস্থ্যপ্রাপ্তির সব ওষুধের থেকেও পরমৌষধ হচ্ছে ব্যায়াম। যারা এই পরমৌষধের আশ্রয় ছেড়ে বৈদ্য, ডাক্তারের পিছনে ঘুরে বেড়ায় তারা তাদের ধন, যৌবন আর স্বাস্থ্য সবকিছু হারিয়ে ফেলে।

☘️ মহাপুরুষ, প্রসিদ্ধ বৈদ্য আর ডাক্তারের মতামত ☘️

পাঠকদের লাভার্থের জন্য ব্যায়ামের পক্ষে কিছু মহাপুরুষ, বৈদ্য আর ডাক্তারের মতামত এখানে দেওয়া হল -
মহর্ষি দয়ানন্দ যিনি এই যুগের আয়ুর্বেদের প্রকাণ্ড পণ্ডিত, আদর্শ ব্রহ্মচারী আর আদর্শ সুধারক ছিলেন আর সর্বদা দণ্ড (বুকডন), মুগুর আদি নিত্য নিয়মিত রূপে ব্যায়াম করার পরেই ভোজন করতেন। তিনি রাজার দিনচর্যার বিষয়ে সত্যার্থ প্রকাশে এইরকম লিখেছেন -
"প্রাতঃকাল উঠে শৌচাদির পর সন্ধ্যা আর অগ্নিহোত্র করে আর করিয়ে মন্ত্রীদের সঙ্গে মন্ত্রণা করবে। অনন্তর কর্মচারী আর সেনাধ্যক্ষের সঙ্গে মিলিত হবে। নানা প্রকারের ব্যূহ শিক্ষা দিবে তথা স্বয়ং অভ্যাস করবে। তারপর যাবতীয় অশ্বশালা, রাজকোষ, অস্ত্রাগার আদি দেখে নিত্য প্রতি ব্যায়ামশালাতে গিয়ে ব্যায়াম করে মধ্যাহ্ন সময় ভোজনের জন্য অন্তঃপুর অর্থাৎ পত্নী আদির নিবাস স্থানে প্রবেশ করবে।" (সত্যার্থ প্রকাশ ষষ্ঠ সমুল্লাস)

🌱 ডাক্তার হালর সাহেব একটা স্থানে লিখেছেন -
"বীর্য হচ্ছে অমূল্য রত্ন আর সেটাই বলের ভাণ্ডার। সেটা রক্তের মধ্যে পুনঃ মিলিত হয় আর শরীরের মধ্যে অদ্ভুত পরিবর্তন উৎপন্ন করে। ব্যায়ামী পুরুষ তার এই বীর্যের শক্তিকে অন্যদের তুলনায় অধিক রক্ষা করতে পারে।"

🌱 জার্মানের প্রফেসর লিখেছেন -
"ভালো হবে যদি সেই যুবক মরে যায় যে ব্যায়াম করে নিজের শরীরের শক্তিকে পুষ্ট করে না।"

🌱 জার্মান দেশের উদ্ধারক হিটলার "আমার সংঘর্ষ" নামক পুস্তকের মধ্যে লিখেছেন -
"নিজের শিক্ষা পদ্ধতিতে সর্বপ্রথম স্থান জ্ঞানোপার্জন অথবা অক্ষর-অভ্যাসকে নয়, ব্যায়াম শিক্ষা তথা স্বাস্থ্য শরীর-নির্মাণকে দিতে হবে। কারণ সর্বমান্য নিয়ম হল এটাই যে স্বাস্থ্য আর বলবান আত্মা স্বাস্থ্য আর বলবান শরীরের মধ্যেই পাওয়া যায়।"

🌱 ডাক্তার সিলবস্টর গ্রাহম লিখেছেন -
"ব্যায়ামের দ্বারা সব অঙ্গের মধ্যে বল, স্ফূর্তি আসে। সব অঙ্গের মধ্যে পূর্ণতা, নমনীয়তা, বৃদ্ধি, সৌন্দর্য, কান্তি আর বল উৎপন্ন হয়। আসলে ব্যায়াম হচ্ছে শরীরের জন্য সবথেকে বড় পুষ্টিদায়ক ওষুধ।"

🌱 বিদেশী প্রসিদ্ধ কুস্তিগীর মিস্টার সৈণ্ডো -
তিনি বাল্যকালে রোগী ছিলেন, তাকে কোনো ভালো ডাক্তারই সুস্থ করতে পারেনি। শেষে তিনি পরমৌষধ ব্যায়ামের সহায়তা নেন আর এর কৃপাতেই কুস্তিগীরের সংসারে ওনার শঙ্খনাদ হয়। তিনি বলেছেন - "সম্পূর্ণ রোগের চিকিৎসা ব্যায়াম দ্বারা করা যেতে পারে।" শেষ পর্যন্ত সব রোগের চিকিৎসা ব্যায়ামের দ্বারাই করতে থাকেন।

🌱 কলিযুগী ভীম প্রো০ রামমূর্তি জী যিনি হাতিকে নিজের বুকের উপর উঠাতেন, তিনি সব শক্তির স্রোত ব্রহ্মচর্য আর ব্যায়ামকেই বলেছেন। তিনি একটা স্থানে লিখেছেন - "ব্যায়াম না করে অধিক কাল পর্যন্ত ব্রহ্মচারী থাকা অসম্ভব।"

🌱 য়ুনানের প্রসিদ্ধ বৈদ্য আফলাতুন লিখেছেন -
"মল একত্রিত হওয়া থামানোর জন্য ব্যায়ামের থেকে উত্তম কোনো বস্তু নেই।"

🌱 ভারতের প্রসিদ্ধ বৈদ্য পণ্ডিত ঠাকুর দত্ত জী শর্মা "অমৃতধারা" লিখেছেন -
"আর্যদের মধ্যে যখন ব্যায়ামের প্রথা ছিল তখন এখান থেকেই বড়-বড় যোদ্ধা হয়েছিল। ভীমের মতো মানুষ হওয়া এখানেই সম্ভব ছিল, যারা হাতিকে তুলে ফেলে দিতো।" তিনি আরেকটা স্থানে লিখেছেন যে - "ব্যায়ামের মধ্যে অনেক লাভ আছে, আমাদের অঙ্গের ভিতরে এর খুব প্রভাব পড়ে আর আমাদের শরীরকে দৃঢ় করে তোলে। যাদের বীর্য বাইরে বেরিয়ে যেত সেটা শরীরের মধ্যেই থাকে। এরথেকেও বড় লাভ হল যেসব বীর্য হবে সেটা ব্যায়ামের দ্বারা পুনঃ শরীরের মধ্যে শোষণ হয়ে শরীর আর হাড়কে দৃঢ় করবে, সেটা ব্যর্থ বেরিয়ে যাবে না বরং ব্যায়ামের দ্বারা শরীরের আহার হয়ে যাবে। অতঃ ব্যায়ামকে কখনও ছাড়া উচিত নয় অপিতু নিত্য করা উচিত।"

☘️ পাশ্চাত্য দেশ আর আমরা ☘️
পশ্চিমী সব দেশের মধ্যে ব্যায়ামের খুব প্রচার আছে। সেখানে সর্বত্র ব্যায়াম শিক্ষার অঙ্গ হয়ে গেছে। সেখানকার সুধারক ব্যায়ামের গুরুত্বকে ভালোভাবে জেনে গেছে, তাই সেখানে কোনো সমস্যা নেই। সেখানকার জনতা ব্যায়ামকে নিজের অঙ্গ বানিয়েছে, তাই সেখানকার মানুষের স্বাস্থ্য আমাদের থেকে অনেক ভালো। কি এমন কারণ আছে যে এই অভাগা ভারতের যুবকরা ব্যায়াম করে না আর এই জীবনপয়োগী বস্তু বীর্যকে নিজের জীবনের অঙ্গ বানায় না? এর মুখ্য কারণ হচ্ছে কুশিক্ষার প্রভাব অথবা শিক্ষার অভাব। ভারতের মাতা-পিতা সন্তানকে তো উৎপন্ন করে কিন্তু তারা তাদের শারীরিক তথা মানসিক উন্নতির কোনো ধ্যান রাখে না যেটা তাদের মুখ্য কর্তব্য-কর্ম। যদি তারা নিজের সম্মুখ সন্তানকে নিত্য প্রতি ব্যায়াম করায় তথা নিজের সন্তানকে বাল্যকাল থেকেই ব্যায়াম করার অভ্যাসী বানিয়ে দেয়, তারসঙ্গে তাদের ব্যায়ামের গুরুত্বও বুঝিয়ে দেয় তাহলে তারা বড় হয়ে কখনও ব্যায়াম করা ছাড়বে না। প্রথমত বাল্যাবস্থায় ব্যায়ামের অভ্যাস করায় না, এইজন্য যুবকাবস্থায় ব্যায়াম ভারী দেখায়, বুড়ো বয়সের তো কি আর বলবো! সেইসময় তো ওঠা-বসাটাও ভারী হয়ে যায়। এরমধ্যে ব্যায়ামের জন্য কোনো স্থান নেই। আমাদের স্কুলের শিক্ষা এত ব্যর্থ, অরোচক, নিকৃষ্ট আর অসম্পূর্ণ যে এরদ্বারা কোনো ধরণের লাভ নেই। ব্যায়ামের নামে স্কুল, কলেজের মধ্যে ভলিবল ফুটবল আদি ব্রিটিশ শৈলীর খেলা খেলানো হয়। তারমধ্যে গুনেগুনে কয়েকজনই ভাগ নেয় বা নিতে পারে, বাকিরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। এইসব খেলার দ্বারাও বিশেষ কোনো লাভ নেই, এগুলোতে সময় আর ধনের নাশ হয়। খেলা খেলাই হয় আর ব্যায়াম ব্যায়ামই হয়। হতে পারে এক-দুটো বিদ্যার্থী কখনও ভুলে ব্যায়াম করতে পারে, নয়তো প্রায় অধিক বিদ্যার্থী আর শিক্ষকরা এমন যে তারা মনে করে ব্যায়াম করা হল অশিক্ষিত মূর্খ আর নিচ ব্যক্তিদের কাজ। এইজন্য বিদ্যার্থী তথা শিক্ষিত সমাজে স্বাস্থ্যের অত্যন্ত দুর্দশা হয়েছে। অজীর্ণতা বা কোষ্টবদ্ধতার রোগ প্রায় সবার হয়ে থাকে, এর অতিরিক্ত তারা অন্য অনেক ধরণের রোগ যথা প্রতিশ্যায় (জ্বর), কাশি, হৃদয়ের কম্পন, বুক ব্যথা, স্বপ্নদোষ, প্রমেহ আদির দ্বারা পীড়িত হয়। এদের স্বাস্থ্য সর্বদা গণ্ডগোলই থাকে। বিদ্যার্থীদের এইরকম দীন-হীন শারীরিক নির্বল অবস্থাকে দেখে কান্না আসে। ১৬ আর ২০ বছরের বৃদ্ধি অবস্থায় যাদের মুখমণ্ডল সর্বদা হীরের মতো উজ্জ্বল হওয়ার ছিল, আজ তারা নিস্তেজ, বলহীন, মনমলিন, আর অসহায়ের মতো দেখায়। পশ্চিমের মিথ্যা সভ্যতার প্রবাহ আমাদের বিদ্যার্থী সমাজকে অলস, শৃঙ্গার-প্রিয়, ভোগী, রোগী বানিয়ে এদের স্বাস্থ্যের একদম সর্বনাশই করে দিয়েছে। কারণ আমাশয়, পেট আর ফুসফুসের অবনতি হলেই সব রোগ হয় আর এর থেকে সুস্থ থাকার একমাত্র উপায় হল ব্যায়াম।

যদি ব্রহ্মচারী প্রো০ মানিকরাও জীর সমান, অন্য সুধারকও ব্যায়ামের ক্রিয়াত্মক প্রচার করে তাহলে শীঘ্রই দেশের সুদিন ফিরে আসতে পারে। মহারাষ্ট্র বা দক্ষিণে গেলে দেখা যায় শ্রদ্ধেয় প্রফেসর জীর কৃপায় প্রায় সব নগরের মধ্যে ব্যায়ামশালা হয়েছে। শিক্ষিত ব্যক্তিদেরও ব্যায়ামের প্রতি আগ্রহ হচ্ছে। তাদেরই পুরুষার্থে আজ বড়ৌদাতে ৪-৫ লক্ষ অর্থের ব্যায়ামশালা আর শস্ত্রাগার বানানো হয়েছে। এইরকম ভাবে সারা দেশে ব্যায়ামের প্রচারের আবশ্যকতা আছে। সুধার তো তখন হবে যখন আমাদের সরকার এমন রাজ্য নিয়ম বানিয়ে দিবে যাতে সবাইকে অনিবার্য রূপে ব্যায়াম করতেই হবে। যারা ব্যায়াম করবে না তাদের সরকার দণ্ড দিবে আর সারা সমাজ তাদের ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখবে।

আমাদের শিক্ষণ সংস্থাগুলোতে ব্যায়ামের যথাযথ ব্যবস্থা হোক। অন্য বিষয়ের মতো এরও পরীক্ষা নেওয়া হোক, এতে যে উত্তীর্ণ হবে তাকেই উত্তীর্ণ ধরা হবে। এরফলে পুনঃ ব্যায়ামের প্রচার তথা আমাদের স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে। প্রত্যেকটা নগর, গ্রাম আর দেশের প্রত্যেক স্থানে ব্যায়ামশালা তথা আখাড়া চলবে। স্বাস্থ্য আর বলিষ্ঠ ব্যক্তিদের পারিতোষিক আর সম্মান দেওয়া হবে। যারা নির্বল আর রোগী হবে তাদের বিবাহ  করা আর সন্তান উৎপন্ন করার অনুমতি দেওয়া হবে না। বিবাহ আর সন্তানোৎপত্তির অধিকারী কেবল সুস্থ আর বলিষ্ঠ যুব স্ত্রী-পুরুষই হবে। যাদের সন্তান অধিক সুন্দর, সুস্থ আর বলবান হবে, তাদের অনেক প্রকারের পারিতোষিক বা মাসিক বৃত্তি দিয়ে সরকার উৎসাহিত করবে। নির্বল, রোগী সন্তান উৎপন্নকারীকে যথাযথ দণ্ড দিবে। তাহলে হয়তো এই পতিত ভারতের ভাগ্যোদয় হতে পারে, পুনঃ হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন গৌরব-মর্যাদাকে প্রাপ্ত করতে পারবে। কারণ ব্যায়াম তথা শারীরিক শ্রমকে ঘৃণা করে কখনও কোনো দেশ উঠে দাঁড়াতে পারবে না। এইজন্য প্রত্যেক ব্রহ্মচর্য, স্বাস্থ্য তথা দেশপ্রেমীকে প্রতিদিন ব্যায়াম করার ব্রত নেওয়া উচিত।

☘️ ব্যায়ামের লক্ষণ ☘️
এখন পর্যন্ত আমরা ব্যায়াম শব্দের ব্যবহার করে এসেছি, প্রত্যেক ব্যক্তি এর কম-বেশি অর্থও জানে, কিন্তু এর বাস্তবিক অর্থ কি সেটা জানা আবশ্যক। কারণ একটা বস্তুর বাস্তবিক লক্ষণ জেনেই আমরা সেটা থেকে পূর্ণ লাভ নিতে পারবো।

চরক সংহিতার মধ্যে এর লক্ষণ এইভাবে দেওয়া হয়েছে -
শরীরচেষ্টা য়া চেষ্টা স্থৈর্য়ার্থা বলবর্ধিনী।
দেহব্যায়ামসম্খ্যাতা মাত্রয়া তাম্ সমাচরেত্।।
(চরকসংহিতা সূত্রস্থান ৭/৩০)
অর্থাৎ - শরীরের যে চেষ্টা বল বাড়ানোর জন্য আর স্থিরতার (দৃঢ়তা) জন্য করা হয়, সেই চেষ্টার নাম শারীরিক ব্যায়াম। এই ব্যায়ামকে মাত্রাপূর্বক নিত্য প্রতি সেবন করা উচিত।

ব্যাখ্যা - শরীরকে বলিষ্ঠ, কার্যশ্রম, সুদৃঢ়, সুস্থ, সুন্দর, স্থিত তথা দীর্ঘায়ু বানানোর জন্য যেটাই শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দ্বারা প্রতিদিন নিয়মপূর্বক চেষ্টা, পরিশ্রম বা উপায় করা হয়, সেগুলোকে ব্যায়াম বলে।

মহর্ষি ধন্বন্তরি জী সুশ্রুতের মধ্যে লিখেছেন যে -
শরীরায়াসজননম্ কর্ম ব্যায়ামসম্জ্ঞিতম্।
তত্কৃত্বা তু সুখম্ দেহম্ বিমৃদূনীয়াত্সমন্ততঃ।।
(সুশ্রুত চিকিৎসাস্থান ২৪/৩৮)
অর্থাৎ - এমন কর্ম বা ক্রিয়া যার দ্বারা শরীরের পরিশ্রম হয় অথবা শরীরের বৃদ্ধি বা বিকাশের জন্য ক্রিয়াবিশেষ বা প্রচেষ্টা করা হয় তাকে ব্যায়াম বলে। ব্যায়াম করার পশ্চাৎ শরীরকে সুখ দেওয়া উচিত অর্থাৎ বিশ্রাম দেওয়া উচিত আর ভালো করে শরীরের সব অঙ্গ বা মাংস-পেশীকে ধীরে-ধীরে মালিশ করা উচিত। যারফলে শরীরে যে শ্রান্তি বা ক্লান্তি আসে সেটা দূর হয় আর শরীর শীতল হয়ে তার পূর্ব অবস্থায় ফিরে আসে। কারণ ব্যায়াম করলে মাংস-পেশীর উপর বল পড়ে সেগুলো ভেঙে পর্যন্ত যেতে পারে। মালিশ করার ফলে তার ক্লান্তি দূর হয়ে পুনঃ ঠিক হয়ে যায়।

"আয়ামো বিবিধোऽঙ্গানা ব্যায়াম ইতি কীর্তিতঃ।।" (ধনুর্বেদ)
অর্থাৎ - শরীরের বিবিধ অঙ্গের আয়াম অর্থাৎ প্রসার, বিকাশ অথবা বৃদ্ধির জন্য যে শ্রম বা চেষ্টা করা হয়, তাকে ব্যায়াম বলে।

সাধারণ ব্যায়ামী ব্যক্তিরা কেবল এই বিষয়ের ধ্যান রাখে যে তাদের বাহু আর মাংস-পেশী তৈরি হোক আর বুক বেরিয়ে আসুক আর বিশাল হোক, এটাই তাদের উদ্দেশ্য হয়। এইজন্য তারা দণ্ড, বৈঠক আদি কঠিন-কঠিন ব্যায়াম করে। তাদের ইচ্ছানুসারে তাদের শরীরও তৈরী হয় আর শরীরও সুন্দর আর দর্শনীয় হয়। কিন্তু এত ব্যায়াম করার পরও তাদের স্বাস্থ্য ভালো হয় না। এইজন্য ব্যায়াম তো সেটাই ঠিক হবে যেটা করলে পড়ে শরীর সুন্দর, সুগঠিত, সুদৃঢ় আর বলবান তো হবে আর তারসঙ্গে স্বাস্থ্যও ঠিক থাকবে আর মস্তিষ্কও (মানসিক) ঠিক কাজ করবে। তাতে আলস্য, নিদ্রা আর তমগুণের প্রাধান্য হবে না। শরীর, মন আদি সর্বদা উৎসাহে ভরা থাকবে।

☘️ ব্যায়াম মাত্রানুসারেই করা উচিত ☘️
চরক শাস্ত্রের মধ্যে মাত্রা অনুসারে ব্যায়াম করার উপর অনেক বল দেওয়া হয়েছে, অতি মাত্রায় ব্যায়াম করলে অনেক হানি হতে পারে। নিজের শক্তি, বলের অনুসারে তথা নিজের শারীরিক অবস্থাকে বিচার করে ব্যায়াম করা উচিত। ব্যায়াম ততটুকুই করা উচিত যার দ্বারা শরীর অত্যাধিক শ্রান্ত (ক্লান্ত) না হতে পারে। অজ্ঞানের কারণে বা সমষ্টিগত স্পর্ধার (হার-জিত) প্রতিযোগিতা, দৌড়, ফুটবল আদি খেলার মধ্যে শক্তির বাইরে ব্যায়াম হওয়ার সম্ভাবনা সর্বদা থাকে। ব্যক্তিগত বিচারপূর্বক ব্যায়াম করলে পড়ে অত্যাধিক ব্যায়াম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। কেউ-কেউ তো ব্যায়ামের পুস্তক পড়ে বা বক্তৃতা শুনে প্রথম দিনেই অধিক ব্যায়াম করে ফেলে অথবা নিজের থেকে অত্যাধিক বলবান ব্যক্তির সঙ্গে মল্লযুদ্ধ (কুস্তি) করে অথবা কারও সঙ্গে অধিক ব্যায়াম করার প্রতিযোগিতায় অত্যাধিক ব্যায়াম করে ফেলে, যারফলে কখনও খুব ভয়ংকর হানি হয়ে যায়।

ব্যায়ামের মাত্রার বিষয়ে মহর্ষি ধন্বন্তরি সুশ্রুতের মধ্যে লিখেছেন -
সর্বেষ্বৃতুষ্বহরহঃ পুম্ভিরাত্মহিতৈষিভিঃ। 
বলস্যার্ধেন কর্ত্তব্যো ব্যায়ামো হন্ত্যতোऽন্যথা।।
(সুশ্রুত চিকিৎসাস্থান ২৪/৪৬)
অর্থাৎ - নিজের কল্যাণের ইচ্ছুক মানুষকে প্রতিদিন সব ঋতুতে নিজের বলের অর্ধেক ব্যায়াম করা উচিত। অন্যথা অধিক করা ব্যায়াম হানি করে। এমনকি মৃত্যুরও সম্ভাবনা থাকে।

☘️ অত্যাধিক ব্যায়ামের কারণে হানি ☘️
শ্রমঃ ক্লমঃ ক্ষয়স্তৃষ্ণা রক্তপিত্তম্ প্রতামকঃ।
অতিব্যায়ামতঃ কাসো জ্বরশ্ছর্দিশ্চ জায়তে।।
(চরকসংহিতা সূত্রস্থান ৭/৩২)
অর্থাৎ - অত্যাধিক ব্যায়াম করার ফলে শরীর বিনা পরিশ্রম করেই ক্লান্ত থাকে। তাতে পীড়া হয়, মন আর ইন্দ্রিয়ের মধ্যে গ্লানি থাকে। রস, রক্ত আদি ধাতুর ক্ষয় অর্থাৎ নাশ হয়ে মানুষ নির্বল হয়, এমনকি ক্ষয়-রোগও হয়। তৃষ্ণা-রোগ, রক্তপিত্ত (নাক, মুখ বা অন্য কোনো অঙ্গ থেকে) রক্ত বেরিয়ে আসা, প্রতামক-শ্বাস (হাঁপানি), কাশি, জ্বর আর বমন আদি রোগ হয়। 

অতিব্যায়ামতো রোগা মানবানাম্ ভবন্তি হি" 
(চরক সংহিতা)
অর্থাৎ - অত্যাধিক ব্যায়াম করা মানুষ অনেক রোগের মধ্যে ফেঁসে যায়। যারা "অধিকস্যাধিকম্ ফলম্" এর অনুসারে এমনটা মনে করে যে অধিক ব্যায়াম করলে অধিক বল বাড়ে তাই মাত্রাতিরিক্ত ব্যায়াম করে ফেলে, তারা খুবই ভয়ংকর ভুল করে আর এইজন্য অনেক ধরণের হানি বহন করে। চিন্তাভাবনা না করে নির্বিচারে ব্যায়ামের পরিণাম সর্বদা হানিকারকই হয়। অত্যাধিক মাত্রায় ব্যায়ামের ফলে শরীর দুর্বল, রোগী, আনাড়ি আর কুরূপ হয়, বুদ্ধি আর স্মরণশক্তি হ্রাস পায়, মস্তিষ্কের বড় হানি হয়। অনিয়মিত আর অধিক মাত্রায় ভালো বস্তুর উপয়োগও হানিকারক হয়। এইজন্য "অতি সর্বত্র বর্জয়েত্" অতি সর্বত্র নিষেধ। এই বিষয়ে একটা সত্য ঘটনা শোনাচ্ছি -
হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় যখন আখাড়াতে যাওয়া আর ব্যায়াম করার প্রচার বাড়ে, তখন নিজের মাতা-পিতার উৎসাহে এক যুবক আখাড়াতে যাওয়া শুরু করে। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে কয়েকশ দণ্ড-বৈঠক দিতে থাকে। একটু-একটু মল্লযুদ্ধও করে। সেইদিন থেকে তার বুকে সাধারণ পীড়া হওয়া শুরু করে। সে সেইদিকে কোনো ধ্যান দেয় নি আর পূর্বের মতো আখাড়াতে যেতে থাকে। পুষ্টিকারক ভোজন আর নিত্য ব্যায়াম করার পরও তার শরীর নির্বল হতে থাকে। ভোজনের পশ্চাৎ দুপুরের সময় শরীর উষ্ণ হয়ে যেত আর হাত-পায়ের তলা সবসময় জ্বলতে থাকে, কাশিও হয়, তবুও আখাড়াতে যাওয়ার নিয়ম ছাড়ে নি। যখন শরীর অত্যন্ত নির্বল হয়ে যায় আর বুকের ব্যথা তথা কাশি অনেক পীড়া দিতে থাকে আর সবসময় জ্বর হয়, তখন বৈদ্য ডাক্তারের দ্বারে যায়।  অনেক ধরণের চিকিৎসা করা হয় কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। সবসময় মুখ থেকে রক্ত বের হতে থাকে। জ্বর আর বুক ব্যথার জন্য না তো রাতে ঘুমোতে পারতো আর না দিনে একটু সময়ের জন্য আরাম করতে পারতো। শেষে এই প্রতিশ্রুতিশীল যুবক ব্যায়ামের নিয়ম সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ হওয়ার কারণে অনেক ধরণের কষ্ট সহ্য করে বিকরাল কালের গ্রাস হয়ে যায়। আশা করি এই দুর্ঘটনার দ্বারা অত্যাধিক মাত্রার ব্যায়ামী ব্যক্তিরা শিক্ষা গ্রহণ করবেন।

এইজন্য মহর্ষি পতঞ্জলি জী চরক শাস্ত্রের মধ্যে লিখেছেন -
ব্যায়ামহাস্যভাষ্যাধ্বগ্রাম্যধর্মপ্রজাগরান্।
নোচিতানপি সেবেত বুদ্ধিমানতিমাত্রয়া।।
(চরকসংহিতা সূত্রস্থান ৭/৩৩)
অর্থাৎ - ব্যায়াম, হাস্য (হাসি), ভাষ্য (কথা বলা), পথ চলা, মৈথুন তথা রাত্রি জাগরণ এইসবের যতই অভ্যাস হোক না কেন, বুদ্ধিমান মানুষের উচিত তারা যেন এইসব অধিক মাত্রায় সেবন না করে।

এতানেবম্বিধাম্শ্চান্যান্ য়োऽতিমাত্রম্ নিষেবতে।
গজঃ সিম্হমিবাকর্ষন্ সহসা স বিনশ্যতি।।
(চরকসংহিতা সূত্রস্থান ৭/৩৪) 
এগুলো তথা এই ধরণের অন্য কাজ যারা অতিমাত্রায় সেবন করে তারা শীঘ্রই রোগ আর মৃত্যুর গ্রাস হয়। যেমন সিংহ হাতিকে মেরে তাকে টেনে অন্য স্থানে নিয়ে যেতে চায় অর্থাৎ অতিমাত্রায় তাকে টানতে শক্তি লাগিয়ে দেয়, তো তার পরিণাম এই হয় যে সেও মরে যায়।

☘️ ব্যায়ামের মাত্রা ☘️
নিজের বল বা শক্তির থেকে অর্ধেক ব্যায়াম করা উচিত। মহর্ষি ধন্বন্তরি জী সুশ্রুতের মধ্যে বলার্ধের এই লক্ষণ লিখেছেন -
হৃদিস্থানস্থিতো বায়ুর্য়দা বক্ত্রম্ প্রপদ্দতে।
ব্যায়ামম্ কুর্বতো জন্তোস্তদূবলার্ধম্ বিনির্দিশেত্।।
(সুশ্রুতসংহিতা চিকিৎসাস্থান ২৪/৪৭)
হৃদয় স্থানে থেমে থাকা বায়ু যখন ব্যায়ামী মানুষের কণ্ঠ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে বা মুখের মধ্যে আসতে থাকবে অর্থাৎ ফুসফুসের অন্তিম শিখর পর্যন্ত ছোট-ছোট কোষ্ঠকের মধ্যেও যখন ব্যায়াম করার সময় শ্বাস-প্রশ্বাস হতে থাকবে, তাকে বলার্ধ বলে জানা উচিত।

ব্যায়ামের অত্যাধিকতা থেকে বাঁচার জন্য আর উচিত মাত্রা জানার জন্য মহর্ষি ধন্বন্তরি জী খুবই উত্তম বিধি বলেছেন। যাইহোক একটা মানুষ অন্যের চেয়ে অনেক বেশি ব্যায়াম করতে পারে, তাই সবার বলার্ধ পৃথক-পৃথক হয়। বলার্ধের মাত্রাকে সঠিক ভাবে বোঝার জন্য এই বিষয়কে আরও অধিক স্পষ্ট করে দিচ্ছি -
ব্যায়াম করার সময় মুখ বন্ধ রাখা উচিত আর শ্বাস সর্বদা নাক দিয়েই নেওয়া উচিত। ব্যায়াম করতে-করতে যখন শ্বাস চরে যাবে আর মুখ খোলার জন্য বাধ্য হবে তখন বুঝে নেওয়া উচিত যে পর্যাপ্ত ব্যায়াম হয়ে গেছে। স্বাস্থ্যের দশাতে এটা সর্বদা ঠিক কিন্তু নাসা রোগ বা কফ রোগের কারণে নাক বন্ধ হলে এই পরীক্ষা ঠিক নয়। তাই তখন দ্বিতীয় বিধির আশ্রয় নেওয়া উচিত। মহর্ষি ধন্বন্তরি জী দ্বিতীয় বিধিও লিখেছেন -
কক্ষাললাটনাসাসু হস্তপাদাদিসন্ধিষু। 
প্রস্বেদান্মুখশোষাচ্চ বলার্ধম্ তদ্বিনির্দিশেত্।।
(সুশ্রুতসংহিতা চিকিৎসাস্থান ২৪/৪৮)
অর্থাৎ - যখন কক্ষা (বগল), মস্তক, নাসিকা তথা হাত-পা আদির সন্ধিতে ঘাম আসবে আর মুখ শুকিয়ে যাবে তখন বলার্ধ হয়েছে জেনে ব্যায়াম বন্ধ করে দেওয়া উচিত।

বলার্ধের মানে হচ্ছে এটাই যে - কোনো ব্যক্তির ১০০ টা বুকডন দেওয়ার শক্তি আছে, সে ৫০ টা বুকডন দিবে। একে বলার্ধ বলে জানা উচিত।

অত্যাধিক ব্যায়াম থেকে বাঁচার জন্য একটা কথা সর্বদা ধ্যানে রাখবে, ব্যায়াম করার সময় নিজের মুখ যেন বিকৃত না হয়। নিজের শক্তির অধিক ব্যায়াম করলে মুখের আকৃতি খারাপ হয়ে যায়। তাই নিজের বলের অধিক ব্যায়াম করার থেকে বাঁচার এটা একটা ভালো পদ্ধতি।

উপরোক্ত বিষয়কে পড়ে সজ্জন যেন উল্টো শিক্ষা গ্রহণ না করে আর ব্যায়ামের মাত্রা সর্বথা যেন না নিম্ন করে দেয়, তাই বলবো - অধিক ব্যায়াম করলে যেমন হানি হয় তেমনই অল্প ব্যায়াম করার ফলে কিছুই লাভ হয় না। যেমন শহরের মানুষ খেলার জন্য ক্লাব বানায়, সেখানে গিয়ে বাবুলোকরা একটু-আধটু খেলে আসে আর সেটাকেই তারা ব্যায়াম মনে করে। এইরকম ব্যায়ামের ফলে কোনো লাভ হয় না। যেভাবে অধিক ভোজনের ফলে হানি আর রোগ উৎপন্ন হয়, ঠিক সেইভাবে খুব কম ভোজনের কারণে মানুষ নির্বল হয়ে যায় আর তার শরীর কখনও হৃষ্ট-পুষ্ট হয় না। উচিত মাত্রায় করা ভোজন যেমন শরীরকে সুস্থ আর বলবান বানায়, তেমনই উচিত মাত্রায় করা ব্যায়াম আমাদের শরীরকে সুদৃঢ়, সুস্থ আর বলবান বানায়।

শুরুতেই অধিক ব্যায়াম করা উচিত নয়। শুরুতে অল্প ব্যায়াম করবে, পুনঃ ধীরে-ধীরে অভ্যাস বাড়াবে, যেমন - কেউ যদি প্রথমদিনে ১০ টা বুকডন দেয় তাহলে তাকে পরেরদিন একটা বুকডন বাড়ানো উচিত, অথবা সপ্তাহে ১ টা বুকডন বাড়ানোর নিয়মে সে সারা বছরে ৬০ টা আর  দুই বছরে ১১০ টা বুকডন প্রতিদিন করার অভ্যাস করতে পারবে। এইরকম ভাবে নিজের শক্তিকে বিচার করে তথা ভোজনের অনুসারেই ব্যায়ামকে ধীরে-ধীরে বাড়ানো উচিত। অনেকবার ব্যায়ামের নতুন প্রেমী নবযুবক এই বিষয়টাতে খুব শীঘ্রতা করে। প্রথমত, প্রথমদিনই সে নিজের শক্তির অধিক বুকডন আদি ব্যায়াম করে, তারপর উৎসাহে ৫-৫ বা ১০-১০ টা বুকডন প্রতিদিন বাড়ানোর চেষ্টা করে। তার এই খেলা ২-৪ দিন তো চলে, কিন্তু এর পশ্চাৎ যখন তার এই বাড়ানোর নিয়ম ভেঙে যায় আর মন ভরে যায়, তখন পূর্বের মতো উৎসাহ আর রুচি থাকে না আর অবশেষে সে ব্যায়াম ছেড়ে দেয়। এইজন্য একটু ব্যায়ামের সঙ্গে আরম্ভ করে ধীরে-ধীরে সেটা বাড়ানোই হিতকর। একথা সদা ধ্যান রাখবে যে বুকডন, বৈঠক আদি যে ব্যায়ামই করো না কেন, একবারে ততটাই করবে যতটা সুখপূর্বক করতে পারবে, শ্বাস যেন ফুলে না যায়। শ্বাস ফুললে অথবা নাসিকার মূল শুকিয়ে যাওয়ার পশ্চাৎও ব্যায়াম করতে থাকলে শরীরের সঙ্গে খুব অন্যায় হয় আর অনেক ধরণের হানি হয়, সেটা পূর্বেই বলেছি।

🌱 ব্যায়ামের মাত্রার বিষয়ে বিদেশের প্রসিদ্ধ কুস্তিগীর (wrestler) মিস্টার সৈণ্ডো লিখেছেন -
"ব্যায়ামের দ্বারা যদি বল প্রাপ্ত করতে চাও তাহলে অল্প আর নিজের বলানুসারে করো, কিন্তু নিয়মানুসারে করো। এমন নয় যে একদিন তো ১০০ টা বুকডন দিলে আর পরেরদিন একটাও না।"

🌱 শেখ বু আলী সীনার কথন হল -
"যদি ব্যায়াম সমতাপূর্বক ইচ্ছামত আর যথোচিত সময়ে করা হয় তাহলে সবথেকে ভালো লাভদায়ক হতে পারে, কিন্তু যে ব্যায়ামকে সমতাপূর্বক করা হবে না সেটা দূর্বলতা তথা শক্তিহীনতার কারণ হবে।"

🌱 এই বিষয়ে প্রফেসর রামমূর্তি জী বলেছেন -
"ব্যায়ামের অভ্যাস ক্রমশঃ করা উচিত, একদম বাড়িয়ে দেওয়া উচিত নয়। যে ব্যায়ামটা করা হবে, সেটা ধীরে-ধীরে অঙ্গের উপর পুরো জোর দিয়ে করা উচিত।"

ব্যায়াম করলে মাংসপেশীর মধ্যে পীড়া উৎপন্ন হয়। তাতে ব্যথার সঙ্গে-সঙ্গে এক ধরণের অস্থিরতা হয়। অনেক ব্যক্তি এই পীড়া আদির কারণ না বুঝে ব্যায়াম করা বন্ধ করে দেয়। আসলে এই ভাবে ব্যায়ামের দ্বারা উৎপন্ন হওয়া মাংসপেশীর পীড়া পেশীগুলোতে বল প্রাপ্ত করার ইচ্ছা বা খিদে প্রকট করে। অতঃ এই ব্যথার ভয়ে ব্যায়াম ছেড়ে দেওয়া ভারী মূর্খতা হবে। নিরন্তর এক-দুই সপ্তাহ ব্যায়াম করতে থাকলে এই পীড়া স্বয়ংই শান্ত হয়ে যায়। এটা ব্যায়ামের দ্বারাই হয়েছে আর ব্যায়ামের দ্বারাই চলে যায়। অতঃ এর চিন্তা ছেড়ে দিয়ে নিত্য ব্যায়াম করতে থাকা উচিত।

💠 নিয়মিত ব্যায়াম 💠
যেসব ব্যায়াম নিয়মকে ধ্যানে রেখে করা হয়, তাকে নিয়মিত ব্যায়াম বলে। প্রতিদিন যে ব্যায়াম নিজের শক্তি, মাত্রা, ভোজন, আয়ু আদিকে ধ্যানে রেখে নির্দিষ্ট সময় আর উচিত স্থানে শ্রদ্ধাপূর্বক করা হয়, তারদ্বারাই সম্পূর্ণ লাভ হয়। কেউ যদি একদিন ব্যায়াম করে দুইদিন ব্যায়াম না করে অথবা দুই সপ্তাহ করে পুনঃ এক সপ্তাহের জন্য ছেড়ে দেয় আর কোনো দিন অধিক আর কোনো দিন কম ব্যায়াম করে, তাহলে এইভাবে ব্যায়াম করার ফলে যথেষ্ট লাভ হয় না, কিন্তু লাভের স্থানে হানিই হয়।
মিস্টার সৈণ্ডো কুস্তিগীর লিখেছেন - "রাস্তা খোদাইওয়ালা সারাদিন রাস্তা খোদাই করে, ধরে নিন ব্যায়ামই করতে থাকে। কিন্তু তারা অন্যদের তুলনায় এমন হৃষ্ট-পুষ্ট হয় না, যেমনটা হওয়া উচিত। কারণ হল তাদের রাস্তা খোদাই করা এই অভিপ্রায়ে হয় না যে তারা বল আর স্বাস্থ্য প্রাপ্ত করছে। কিন্তু তারা তো উদর পূর্তির জন্য চেষ্টা করছে। তারা এতেও অব্যায়ামীদের তুলনায় সুস্থ আর বলবান হয়। কারণ ব্যায়াম (পরিশ্রম) নিজের গুণ তো অবশ্যই কাজ করে। যদি এরসঙ্গে মনের শক্তিও হতো তাহলে ব্যস খেলা জমে উঠতো।"
কামারও রাস্তা খোদাইওয়ালার সমান সারাদিন ধরে হাতুর চালিয়ে পরিশ্রম করে, কিন্তু তার বাহু আর মাংসপেশী নিয়মিত ব্যায়ামী কুস্তিগীরদের সমান সুদৃঢ় আর পুষ্ট হয় না আর না তাদের শরীর সেইরকম সুস্থ আর বলযুক্ত হয়। অলস মানুষের তুলনায় তো কামার আদির শরীর সুস্থ আর দৃঢ়ই হয়, কারণ পরিশ্রম বা কাজের ফল তো সে প্রাপ্ত করে। কিন্তু ব্যায়ামী কুস্তিগীর নিয়মানুসারে প্রতিদিন সায়ং-প্রাতঃ কিছু সময় ধরে ব্যায়াম করে আর এই নিয়মিত ব্যায়ামই তার শরীরকে সুগঠিত, সুন্দর, সুস্থ, বলযুক্ত করে তোলে। কারণ ব্যায়াম-ব্যায়ামই হয় আর কাজ-কাজই হয়। কামার বা রাস্তা খোদাইওয়ালার কাজকে অনিয়মিত ব্যায়াম বলা যেতে পারে, কারণ সেটা বল আর স্বাস্থ্য বৃদ্ধির জন্য করা হয় না আর না তাতে স্বাস্থ্যের কোনো নিয়ম ধ্যানে রাখা হয়।
☘️ ব্যায়াম আর ইচ্ছা শক্তি ☘️
ব্যায়াম থেকে সম্পূর্ণ লাভ প্রাপ্ত করার জন্য সঠিক ভাবে মন লাগিয়ে ব্যায়াম করা উচিত। ব্যায়াম করার সময় নিজের ইচ্ছাকে সম্পূর্ণভাবে শরীরের অঙ্গের উপর লাগানো উচিত। যে মাংসপেশী বা শরীরের অঙ্গকে যতটা দৃঢ় আর সুস্থ করতে চাইবে সেই অঙ্গ বা পেশীতে ব্যায়াম করার সময় ততই ইচ্ছাকে প্রবিষ্ট করবে। ইচ্ছারহিত ব্যায়াম যেটা ভার মনে করে করা হয়, তাতে কোনো লাভ হয় না। ব্যায়াম করার নামে ভয় পাওয়া উচিত নয়, একে মন লাগিয়ে আর আনন্দের সঙ্গে করা উচিত।
প্রফেসর রামমূর্তি লিখেছেন - ব্যায়াম করার সময় মনকে স্থির রাখা উচিত আর শরীরের প্রত্যেক ভাগে ব্যায়ামের লাভের চিন্তন করতে থাকবে।"
এই বিষয়ে মিস্টার সৈণ্ডো কুস্তিগীর লিখেছেন - "একটা মানুষ যখন সহৃদয়ে ব্যায়াম করে, তার একটুখানি ব্যায়ামই তাকে অধিক সুস্থ আর সুদৃঢ় বানিয়ে তোলে, সেই ব্যক্তির তুলনায় যে ব্যায়াম তো অনেক করে কিন্তু মন লাগিয়ে করে না। যে অঙ্গের ব্যায়াম করবে, তারসঙ্গে মনে-মনে এই অনুভব করা উচিত যে আমার অমুক অঙ্গ বল প্রাপ্ত করছে।"
এইভাবে ব্যায়াম করার ফলে মনের দৃঢ়তা প্রবল ভাবনার কারণে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খুব শীঘ্রই সুন্দর, সুদৃঢ়, সুস্থ আর সুগঠিত হয়। অতঃ ব্যায়াম করার সময় বিশেষ ভাবে ব্রহ্মচারীকে একাগ্রচিত্ত হয়ে এমন দৃঢ় ভাবনা রাখা উচিত যে আমার প্রত্যেক শিরা আর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে বল, তেজ, বীর্য, বীরতা, আরোগ্য, স্বাস্থ্য, সৌন্দর্য, স্থিরতা আর পরাক্রম আদি শক্তি সব সদ্ গুণ প্রবেশ করছে। আমার শরীর উন্নত, হৃষ্ট-পুষ্ট আর বলিষ্ঠ হচ্ছে। এই সংকল্পের অসাধারণ প্রভাব শরীরে পড়ে, যাকে মানুষ অনুভব দ্বারাই জানতে পারবে। যারা খুব শীঘ্রতা আর দ্রুতগতিতে ব্যায়াম করে আর ব্যায়ামের মধ্যে মনের শক্তির ব্যবহার করে না, তারা খুবই কম লাভ নিতে পারে। অতঃ ব্যর্থ ভার মনে করে ব্যায়াম করা কেবল মূর্খতাই হয়। এইজন্য ধীরে-ধীরে সাবধানে বিধিপূর্বক মন লাগিয়ে ব্যায়াম করা উচিত।
☘️ ব্যায়ামের সময় ☘️
প্রত্যেক ব্যক্তিকে সন্ধ্যার সমান প্রাতঃ আর সায়ং দুই সময় ব্যায়াম করা উচিত। দুটো সময়ই ভালো তবে অপেক্ষাকৃত প্রাতঃকালের সময় বেশি ভালো হয় আর ব্রহ্মচর্যের সাধনার জন্য ভালো উদ্যোগী ব্রহ্মচারী রাতে ঘুমানোর সময়ও ক্লান্ত করে দেয় এমন কঠোর ব্যায়াম করে ঘুমিয়ে পড়ে। এরফলে স্বপ্নরহিত গভীর নিদ্রা আসে আর স্বপ্নদোষ আদির দ্বারা বীর্য নাশ হয় না। সায়ংকাল বা শোয়ার সময় যখনই ব্যায়াম করবে, সর্বদা এটা অবশ্যই ধ্যানে রাখবে যে ভোজন করা খাবার হজম হয়ে গেছে আর পেট হালকা হয়েছে অর্থাৎ মল-মূত্র ত্যাগ করার পশ্চাৎই ব্যায়াম করা উচিত। গ্রীষ্ম কালে তো প্রাতঃকাল সূর্যোদয়ের পূর্বেই ব্যায়াম সেরে ফেলা উচিত। গরমের ঋতুতে সূর্যোদয়ের পশ্চাৎ তথা সায়ংকালে কঠোর তথা খুব অধিক ব্যায়াম করা উচিত নয়। প্রাতঃকাল তো সর্বদা স্ফূর্তি, উৎসাহ উৎপন্নকারী হালকা ব্যায়াম দৌড়, আসন আদি করা উচিত। কারণ প্রাতঃকাল খুব বেশি আর কঠোর ব্যায়াম করার ফলে শ্রমের (ক্লান্তি) কারণে অলস বা নিদ্রা বিরক্ত করবে, যারফলে দিনের কাজে বাঁধা আসবে। ব্যায়াম সর্বদা স্নানের পূর্বে করা ভালো কিন্তু ব্যায়াম করার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে শরীর ঠাণ্ডা করে স্নান করা উচিত। ব্যায়াম করার কারণে শরীর যখন উষ্ণ হবে আর ঘাম আসতে থাকবে তো তখনই স্নান করলে হানির সম্ভাবনা থাকে। কোনো বিশেষ অবস্থায় বা শীতকালে স্নান করার পরে ব্যায়াম করা যেতে পারে। যদি স্নান করার পরে ব্যায়াম করতেই হয় তাহলে সন্ধ্যার পরেই করা উচিত। তাছাড়া স্নান করার পশ্চাৎ ব্যায়াম করতে আলস্য থাকে আর ব্যায়ামের পশ্চাৎ স্নান করলে শরীরে স্ফূর্তি, স্বচ্ছতা আর সৌন্দর্যতা আসে তথা ব্যায়ামের ক্লান্তিও দূর হয় আর ব্যায়ামের দ্বারা যেসব দূষিত মল শরীরের রোমকূপ দিয়ে বের হয়, সেগুলো স্নানে ধুয়ে শরীর শুদ্ধ আর পবিত্র হয়, এইজন্য স্নানের পূর্বে ব্যায়াম করা হিতকর। শীতকাল বা বসন্ত ঋতুতে সাধারণ মানুষের জন্য আর ভালো পুষ্টিকারক ভোজনকারীর জন্য ব্যায়াম সর্বদাই লাভদায়ক হয়।
মহর্ষি ধন্বন্তরি জী লিখেছেন -
ব্যায়ামো হি সদা পথ্যো বলিনাম্ স্নিগ্ধভোজিনাম্।
স চ শীতে বসন্তে চ তেষাম্ পথ্যতমঃ স্মৃতঃ।।
(সুশ্রুতসংহিতা চিকিৎসাস্থান ২৪/৪৫)
যারা বলবান আর যারা ঘী, দুধ, বাদাম আদি স্নিগ্ধ, পুষ্টিকারক পদার্থ পর্যাপ্ত মাত্রায় খেতে পায়, এইরকম মানুষের জন্য তো ব্যায়াম সর্বদাই লাভদায়ক হয়। কিন্তু ব্যায়াম করার বিশেষ ঋতু হল বসন্ত আর শীত, এই ঋতুতে ব্যায়াম করা অত্যন্ত লাভদায়ক বলা হয়েছে।
ঋষিদের এই আজ্ঞার অনুসারে ব্যায়ামের পশ্চাৎ স্নিগ্ধ বলবর্ধক পদার্থ অবশ্যই খাওয়া উচিত। যারা ব্যায়াম করার পর পুষ্টিকারক ভোজন খেতে পায় না, তাদের উচিত অধিক ব্যায়াম না করে অল্প ব্যায়াম করা; নয়তো শরীর ক্ষীণ হতে থাকবে। আসনের ব্যায়ামে পৌষ্টিক ভোজন ততটা খাওয়ার আবশ্যকতা নেই, যতটা অন্য পদ্ধতির কঠোর ব্যায়ামে হয়।
☘️ ব্যায়ামীর ভোজন ☘️
গোদুগ্ধ অথবা দুধ থেকে তৈরি দই আদি পদার্থ, বাদাম ইত্যাদি বা অন্য কোনো সাত্বিক পদার্থ প্রাতঃকাল ব্যায়ামের পশ্চাৎ খাওয়া উচিত। কারণ ব্যায়ামের পর খিদে পাবে আর খালি পেট থাকা ভালো নয়, ক্ষুধার্থ থাকলে হানি হয়।
ব্রহ্মচারী রামপ্রসাদ বিস্মিল নিজের আত্মকথাতে লিখেছেন - "বিদ্যার্থী প্রাতঃকাল শৌচাদি থেকে নিবৃত্তি হয়ে ব্যায়াম করবে আর সর্বদা কুয়োর শুদ্ধ জল দিয়ে স্নান করবে। স্নান থেকে নিবৃত্তি হয়ে পরমাত্মার ধ্যানাদি করবে। ঈশ্বরের উপাসনার পশ্চাৎ একটু জলপান (প্রাতরাশ) করবে। কোনো ফল, শুষ্ক ফল, দুগ্ধ অথবা সবথেকে উত্তম হল গমের সুজি রেঁধে যথারীতি গুড় বা সৈন্ধব লবণ দিয়ে (বা কোনো কিছু না দিয়েই) খাবে। তারপর অধ্যয়ন করবে।"
কিন্তু এটা ধ্যানে রাখবে যে ব্যায়ামের উষ্ণতা দূর যাওয়ার পর যখন শরীর সর্বথা ঠাণ্ডা হবে তখনই একটু খাওয়া উচিত, সেইসময় পেট ভরে ভোজন করাও ঠিক নয়। ব্যায়ামের পশ্চাৎ ততকাল ভোজন করলে খুব হানি হয়, তাই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তারপর ভোজন করা উচিত। ব্যায়ামী মানুষের ভোজন সর্বদা নির্দিষ্ট সময়ে সাত্বিক, সরল (সাধারণ), পৌষ্টিক, শীঘ্র হজম করে এমন হালকা আর অল্পমাত্রার হওয়া উচিত। এইরকম মনে করে কখনোই ভোজন করা উচিত নয় যে ব্যায়ামের কারণে আমার জঠরাগ্নি তীব্র আর প্রদীপ্ত হয়েছে, তাই আমি অধিক ভোজন হজম করতে পারি; ব্যায়ামী মানুষকে অধিক ভোজন করা উচিত নয় আর মাংসাদি অভক্ষ্য, গাঁজা, ভাং, মদ আদি মাদক দ্রব্য, ঝাল-টক আদি চটপটা হানিকারক পদার্থের সেবন করা উচিত নয়। কেউ-কেউ তো দুধ, ঘী আদি পুষ্টিকারক পদার্থ খেয়েই সঙ্গে-সঙ্গে ব্যায়াম করতে লেগে যায়। কেউ আবার ব্যায়াম করতে-করতে তারসঙ্গে খেতেও থাকে, এইরকম ব্যক্তিদের মত হল খেয়েদেয়ে অথবা খেতে-খেতে ব্যায়াম করলে পড়ে সব খাবার হজম হয়ে যায় আর শক্তি বাড়ে। এটা এদের বড় ভয়ংকর ভুল, এইরকম করলে অনেক বড় হানি হয়। এইরকম ব্যক্তিরা স্বাস্থ্যের নিয়ম হতে অপরিচিত আর মহামূর্খ হয়। ব্রহ্মচারী অথবা কোনো স্বাস্থ্য প্রেমীকে এইরকম মূর্খদের অন্ধানুসরণ করা উচিত নয়।
ব্যায়াম করে তৎক্ষণাৎ বসা, শোয়া বা দাঁড়িয়ে পড়া হানিকারক হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত শরীর আর শ্বাস তার পূর্বের স্বাভাবিক অবস্থায় না আসবে আর শরীরের উষ্ণতা ন্যুন না হচ্ছে, ততক্ষণ শরীরের অঙ্গের উপর হাত দিতে-দিতে ধীরে-ধীরে হালকা হাঁটা উচিত আর ব্যায়ামের দ্বারা যে ঘাম আসবে সেটা ততকাল মুছে ফেলা উচিত। যতক্ষণ ঘাম শুকিয়ে না যাচ্ছে আর শরীর ঠাণ্ডা না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত দ্রুত চলা বাতাস থেকেও শরীরকে বাঁচানো উচিত। ব্যায়াম করে ততকাল লঘুশঙ্কা (মূত্রত্যাগ) করা লাভদায়ক আর আবশ্যক, এরফলে শরীরের ব্যর্থ উষ্ণতা বেরিয়ে যায়, মূত্রাশয়ের রোগ হয় না, শরীর আর মন শান্ত থাকে।
শুরু-শুরুতে ব্যায়ামের পশ্চাৎ তৃষ্ণা লেগে থাকে, যা ব্যায়ামের দ্বারা হওয়া লাভকে প্রকট করে। কোনো-কোনো মূর্খ এই তৃষ্ণাকে মেটানোর জন্য ততকালই জল, শরবত আদি কোনো পদার্থ পান করে, যা খুবই হানিকারক। কারণ ব্যায়ামের দ্বারা যে লাভ হয়, এইরকম ব্যক্তিরা সেটা সমাপ্ত করে দেয়। ব্যায়ামের পশ্চাৎ জল, শরবত আদি কোনো পদার্থ পান করা উচিত নয় আর যদি পান করতেই হয় তাহলে গাভীর গরম দুধ অথবা বাদাম আদি ঘষে পান করা উচিত। কিন্তু এটাও শরীর শীতল হওয়ার পরেই করা উচিত। এইসব পান করলে যেমন তৃষ্ণা আর খিদে দুটোই শান্ত হবে তেমনই শরীরকে বল আর শক্তিও দিবে।
ভোজন করার পশ্চাৎ অন্ততঃ ৪ ঘন্টা পর ব্যায়াম করা উচিত ব্যায়াম করার ১ ঘন্টা পরে ভোজন করা উচিত।
☘️ ব্যায়াম করা উচিত নয় কাদের? ☘️
চরক শাস্ত্রের মধ্যে লেখা আছে -
ক্রোধশোকভয়ায়াসৈঃ ক্লান্তা য়ে চাপি মানবাঃ।
তে বর্জয়েয়ুর্ব্যেয়ামম্ ক্ষুধিতাস্তৃষিতাশ্চ য়ে।।
(চরক সূত্রস্থান অধ্যায় ৭)
অর্থাৎ - জ্বর আদি রোগ, ক্রোধ, শোক, ভয়ের অবস্থাতে আর খুব খিদে আর তৃষ্ণা লাগলে ব্যায়াম করা উচিত নয়।
এইরকম যখন পেট খুব ভরা থাকবে অথবা খুব খিদে হবে, সেই সময়ও ব্যায়াম করা উচিত নয়।
☘️ ব্যায়ামের সময়ের বস্ত্র ☘️
ব্যায়ামের সময় সবথেকে ভালো বস্ত্র (পোশাক) হচ্ছে ল্যাঙ্গোট। এমনিতে তো ব্যায়াম করার সময় মানুষ ল্যাঙ্গোটের অতিরিক্ত রুমাল, কাচ্ছা, জাঙ্গিয়া, ধুতি, পায়জামা, পাতলুন (প্যান্ট) তথা আরও অন্য ব্রিটিশ শৈলীর বস্ত্র পরে। কিন্তু বানিয়ান, ধুতি, পায়জামা, পাতলুন আদি পরে ব্যায়াম করা তো ব্যায়ামের সঙ্গে হাস্যই করা হবে। যদি এইরকম ব্যক্তি চাদর মুড়ে বিছানাতেই পড়ে থাকে তাহলে ব্যায়ামের দুর্গতি হবে না। ব্যায়াম করার সময় শরীর খোলা অবস্থায় থাকা উচিত আর ব্যায়ামের বস্ত্র শরীরে বাঁধা আর লেগে থাকবে, কিন্তু অধিক টান-টান অর্থাৎ রক্তের মধ্যে যেন কোনো প্রকারের বাধা উৎপন্ন না করে। যেমন কুস্তিগীর জাঙ্গিয়া মল্লযুদ্ধ (কুস্তি) করার জন্য তো ঠিক আছে কিন্তু এটা পরে ব্যায়াম করলে কঠিন আর কষ্ট হয়। এইরকম আলগা-ঢিলা কাচ্ছাও ব্যায়ামের জন্য উপযুক্ত না, এইসব পরলে ব্যায়ামের সময় উচিত স্ফূর্তি আর উৎসাহ হয় না। ল্যাঙ্গোটকেও বেশি টেনে বাঁধা উচিত নয়। ল্যাঙ্গোটকে কোমরে শক্ত করে বাঁধলে অনেক হানি হয়, কারণ ব্যায়াম করার সময় সারা শরীরে মাথা থেকে পা পর্যন্ত রক্ত শীঘ্রতাপূর্বক ছুটতে থাকে। যদি সেইসময় কোমরে ল্যাঙ্গোট খুব শক্ত করে বাঁধা থাকে তাহলে সেটা রক্তের তীব্র গতিকে থামিয়ে দেয় আর রক্তের গতিতে বাঁধা পড়ার কারণে স্বাস্থ্য খারাপ তথা আয়ু কমে যায়। ল্যাঙ্গোট বা অন্য যেকোনো বস্ত্র যেটা খুব শক্ত করে বাঁধা হবে, ব্যায়াম করার সময় হানি করবে। তাই ল্যাঙ্গোট না অধিক ঢিলা আর না শক্ত করে বাঁধা উচিত আর ব্যায়ামের পশ্চাৎ ততকাল ল্যাঙ্গোট খুলে ফেলা উচিত নয়। ব্রহ্মচারীকে তো ল্যাঙ্গোট বিনা থাকাই উচিত নয়। একটা বিশেষ বিষয় হল, প্রায়শঃ ভারতে ব্যায়ামীদের বস্ত্র খুবই মলিন (নোংরা) থাকে, তাদের বস্ত্র থেকে দুর্গন্ধ আসতে থাকে, যা খুবই হানিকারক। এরফলে অনেক ধরণের রোগ উৎপন্ন হয়, তাই বস্ত্রকে ধুয়ে শুদ্ধ করে ফেলা উচিত আর সর্বদা শুদ্ধ রাখা উচিত।
☘️ ব্যায়ামের স্থান ☘️
ব্যায়াম করার স্থান পরিষ্কার, পবিত্র, স্বাস্থ্যপ্রদ আর খোলা হওয়া উচিত। বায়ু যেন ঠিক ভাবে চলা চলে করতে পারে। বায়ু শুদ্ধ আর ঠাণ্ডা হবে, সেই স্থানে অথবা এদিক-সেদিক নিকটে কোথাও পচা-গলা বস্তু পড়ে থাকবে না, কোনো ধরণের দুর্গন্ধ আসবে না, সেখানকার শুদ্ধি (পরিষ্কার) ঠিক ভাবে রাখতে হবে, দুর্গন্ধযুক্ত স্থানে ভুলেও কখনও ব্যায়াম করা উচিত নয়। গ্রাম বা নগরের বাইরে জঙ্গল আর উদ্যান বাটিকার বায়ু আর স্থান অধিক পরিষ্কার আর পবিত্র হয়। কোনো বড় নদী, জলাশয় আর হ্রদের তীর অধিক স্বাস্থ্যপ্রদ হওয়ার জন্য ব্যায়াম তথা আসনের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান। এইরকম আরও অনেক ব্যায়াম ব্যক্তিগত আর দলবদ্ধ প্রচলিত আছে। অন্য পাশ্চাত্য শৈলীর বিদেশি ব্যায়াম বা খেলা ফুটবল, ভলিবল, ক্রিকেট, হকি, ব্যাটমিন্টন, সিঙ্গলবার, ডবলবার, বক্সিং আর প্রফেসর সৈণ্ডোর বিশেষ ব্যায়াম ডম্বল আর ভার তোলা (weight lifting) ইত্যাদি অনেক ধরণের ব্যায়াম প্রচলিত আছে।
☘️ কোন ব্যায়ামটা করবে? ☘️
যারা ব্যায়াম করবে তাদের সামনে একটা সমস্যা এসে দাঁড়ায় যে নিজের জন্য তারা কোন ব্যায়ামটা করবে? মহর্ষি ধন্বন্তরি জী এর উত্তর দিয়েছেন -
বয়োবলশরীরাণি দেশকালাশনানিম্ চ।
সমীক্ষ্য কুর্য়াদ্ ব্যায়ামমন্যথা রোগমাপ্নুয়াত্।।
(সুশ্রুতসংহিতা চিকিৎসা স্থান ২৪/৪৮)
প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত যে সে নিজের আয়ু, বল বা শক্তি, শরীর, প্রকৃতি, দেশ বা স্থান, কাল বা ঋতু আর ভোজনের অনুসারে ভালো ভাবে বিচার করে উচিত ব্যায়াম করবে। যারা উপরোক্ত বিষয় না ভেবে ব্যায়াম করে, তারা অনেক ধরণের রোগে ফেঁসে যায়।
কারণ ব্যায়ামের উদ্দ্যেশ্য হল মানুষের শরীর, মন আর আত্মাকে সুন্দর, সুস্থ, সুগঠিত, বলবান, পবিত্র আর শক্তিশালী করে তোলা। অতঃ যে ব্যায়ামের দ্বারা মানুষের শারীরিক, মানসিক আর আত্মিক সব প্রকারের উন্নতি হবে, বাস্তবে তাকেই ব্যায়াম বলা যেতে পারে আর ভারতীয় দেশী শৈলীর ব্যায়ামই হচ্ছে সর্বগুণ সম্পন্ন ব্যায়াম যা আমাদের প্রাচীন পুরুষদের দীর্ঘকালের অনুভবের পশ্চাৎ প্রচলিত হয়েছে আর সেটা আমরা পরম্পরাগত প্রাপ্ত করেছি।
মহর্ষি ধন্বন্তরি জী আয়ু, অবস্থা আদিকে বিচার করে ব্যায়াম করার আদেশ দিয়েছেন। এইজন্য সর্বপ্রথম নিজের শরীরের পরীক্ষা করে এটা দেখা উচিত যে আমার কোন অঙ্গটা নির্বল (দুর্বল), যেমন - কারও আমাশয় বা পেট খারাপ আছে, ভোজন ঠিক ভাবে হজম হয় না আর পাচনশক্তি ঠিক নেই, তাহলে তাকে অন্য অঙ্গের ব্যায়ামের সঙ্গে পেটের ব্যায়ামের উপর বিশেষ ধ্যান দেওয়া উচিত। এইভাবে নিয়মিত ব্যায়াম করলে তার পেট কোনো ওষুধ ছাড়াই ঠিক হয়ে যাবে। যারা ব্যায়ামশীল হয়েও বৈদ্য আর ডাক্তারের কাছে যায়, তাদের ব্যায়াম করাই ব্যর্থ, কারণ ব্যায়ামীর রোগ হতেই পারে না। যদি বা ভুলে হয়ে যায় তাহলে সেটা ব্যায়াম দ্বারাই তাড়িয়ে দেওয়া উচিত। প্রত্যেক অঙ্গকে সুদৃঢ় আর নিরোগ করে এমন প্রাচীন তথা ভারতীয় শৈলীর ব্যায়াম আসন আদির দ্বারাই সম্ভব। এর গুরুত্ব আজ ইউরোপ আদি পাশ্চাত্য দেশের মানুষরাও ভালো করে বুঝে গেছে, তাই এর প্রচার আমেরিকা আদি দেশের মধ্যে খুব বেড়ে গেছে।
কলিযুগের ভীম প্রফেসর রামমূর্তি এই বিষয়ে নিজের অনুভব লিখেছেন - "পাঁচ বছরের আয়ুতে আমার মধ্যে হাঁপানির লক্ষণ দেখা যায়। পিতা জীর আজ্ঞানুসারে আমি ব্যায়াম করা শুরু করি আর সেই কারণে আমার রোগ দূর হয়ে যায়। আমার সামনে ভীমসেন, হনুমানের মতো বীরদের মূর্তি আর চিত্র সর্বদা থাকতো। আমি নিরন্তর এটাই ভাবতাম যে এদের সমান তো হতে পারবো না কিন্তু নিজের শরীরকে তো অবশ্যই বলবান বানাতে পারবো। দশ বছর বয়সে স্থানীয় কলিজিয়েট স্কুলের আখাড়াতে ভর্তি হয়ে যাই। সেইসময় কুস্তিগীরদের কুস্তির সংবাদ শুনে আমার মনের মধ্যে উৎসাহ উৎপন্ন হয় আর আমি কুস্তিগীর হওয়ার ইচ্ছায় ব্যায়াম করতে থাকি। যেমন-যেমন ভাবে রুচি বাড়তে থাকে তেমন-তেমন ভাবে নিজের ব্যায়ামের অভ্যাসও বাড়িয়ে দিতে থাকি। আমি অনেক উৎসাহে সৈণ্ডোর ডম্বল ঘোরানো শুরু করি, কিন্তু দুই বছর পরেই হতাশ হয়ে সেটা ছেড়ে দিই, এর মুখ্য কারণ হল এরদ্বারা আমার বিশেষ কোনো লাভ প্রাপ্ত হয়নি। শুরুতে আমি হারীজেন্টলবার, প্যারেললবার, রিং আদি বিদেশি শৈলীর ব্যায়াম করেছি, কিছুদিন পর সেগুলোও ছেড়ে দিই আর দেশী ব্যায়াম করা শুরু করি। যত দেশীয় প্রসিদ্ধ কুস্তিগীরদের সঙ্গে দেখা হতো, তাদের সবার থেকে আমি শারীরিক শক্তি বাড়ানোর জন্য ভারতীয় প্রথা আর উপায় জিজ্ঞেস করেছি, কিন্তু কেউই সন্তোষজনক বিধি বলতে পারেনি। এইসময় পর্যন্ত আমি ইন্ট্রেন্স ক্লাস পর্যন্ত ইংরেজি আর একটু সংস্কৃত পড়েছিলাম। সংস্কৃত পঠন-পাঠনে আমার বিশেষ আনন্দ আসে। শারীরিক উন্নতির সঙ্গে-সঙ্গে নিজের আর্য ধর্মের শাস্ত্র মূল সংস্কৃত ভাষায় পড়েছি, গীতার সঙ্গে-সঙ্গে সুশ্রুত আদি আয়ুর্বেদিক গ্রন্থও দেখেছি। নিজের শাস্ত্রের অধ্যয়নে আমি শারীরিক উন্নতির সর্বোত্তম উপায় খুঁজে পাই। অতঃ সমস্ত বিদেশি শৈলী ছেড়ে দিয়ে আমি এটাই গ্রহণ করি আর ঘোষণা করে দিই যে ভীম, দ্রোণ, হনুমান, অর্জুন আদি পূর্বজদের গৌরবকে বাড়ানোর এটাই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যায়ামের প্রণালী। এই দেশী ব্যায়ামের মধ্যে কোনো বস্তু আর যন্ত্রের আবশ্যকতা নেই, ধন লাগে না, শুধু অভ্যাসই সবকিছু, যার দ্বারা শরীরের মাংসপেশী দৃঢ় হয়। পেশীর দৃঢ়তার জন্য প্রাণায়ামের আবশ্যকতা আছে। আমি প্রতিদিন ৩ টা থেকে ৬ টা পর্যন্ত প্রাণায়াম করতাম আর কোনো বিশ্রাম না নিয়ে ১২ মিল পথ হাঁটতাম। এর অতিরিক্ত প্রতিদিন ১ঘন্টা জলের মধ্যে সাঁতার কাটতাম।"
তিনি অন্য একটা স্থানে লিখেছেন - "শুরু-শুরুতে ব্যায়াম করলে শরীরে টান আসতো, অনেক বার আমি অর্ধেক ব্যায়াম করেই ছেড়ে দিতাম। আখাড়াতে আসা কঠিন জ্ঞাত হতো, কিন্তু তখনই আমার মনে দেবতা জেগে উঠতো, নিজের আদর্শকে সিদ্ধ করার জন্য আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যদি এমন না করতে পারি তাহলে এরথেকে মৃত্যুই ভালো। শেষে দুর্বলতার উপর আমি বিজয় প্রাপ্ত করি। ধীরে-ধীরে ব্যায়াম বাড়তে থাকে, সেইসময় আমার ব্যায়ামের ক্রম এইরকম ছিল - ভোরে উঠেই ঘর থেকে ৩ কোস পর্যন্ত দৌঁড়াতাম, একটা ফৌজি দাঁড়িয়ে থাকতো সেখানে গিয়ে খুব মল্লযুদ্ধ করতাম, মল্লযুদ্ধ করে আবার ৩ কোস পথ দৌঁড়ে ঘরে ফিরে আসতাম, তারপর এখানে আমার শিষ্যদের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করতাম। সেইসময় আখাড়াতে দেড়শ যুবক ছিল। তাদের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করে সাঁতার কাটতে চলে যেতাম। তারপর সায়ংকালে ১৫০০ থেকে ৩০০০ পর্যন্ত বুকডন আর ৫০০০ থেকে ১০০০০ পর্যন্ত বৈঠক করতাম, এটাই আমার দৈনিক ব্যায়াম ছিল। এরফলে আমার এত শক্তি হয় যে ১৬ বছরের আয়ুতে আমি নারকেল গাছে জোরে ধাক্কা দিতাম তো ২-৩ টা নারকেল ধুপ-ধুপ করে মাটিতে পড়তো। এই ব্যায়ামের কারণেই আজ আমার বুক ৪৫ ইঞ্চি চওড়া আর ফোলালে ৫৭ ইঞ্চি, শরীর ৫ ফুট সাড়ে ছয় ইঞ্চি আর ওজন আড়াই মন।"
রামমূর্তির বলের বিষয়ে সেইসময়ের এক লেখক লিখেছেন - "আজ ভারতের ঘরে-ঘরে রামমূর্তির নাম ছড়িয়েছে। সে হচ্ছে কলিযুগের ভীম। হাতিকে নিজের বুকের উপর তুলে নেয়, ২৫ ঘোড়ার শক্তির দুই-দুইটা মোটরকে থামিয়ে দেয়। বুকের উপর বড় পাথর রেখে তার উপর পাথরকে টুকরো-টুকরো করে দেয়। অর্ধেক ইঞ্চি মোটা লোহার শিকল পদ্মের কাণ্ডের মতো খুব সহজেই ভেঙে ছিঁড়ে ফেলে। ৫০ মানুষকে বহন করা গাড়িকে শরীরের উপর দিয়ে চড়িয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, ৭৫ মিলের দ্রুত ছুটা হাওয়া গাড়ি তার শরীরের উপর দিয়ে পার হয়ে যায়। এ এক অলৌকিক বল, দৈবী শক্তি, শুনলেই আশ্চর্য লাগে, দেখে দাঁতে আঙ্গুলে চাপ দিতে হয়। কিন্তু এইসব বিষয় দেখতে অসাধ্য মনে হলেও অসম্ভব নয়। যদি চেষ্টা করা হয় তাহলে প্রত্যেক মানুষ রামমূর্তির সমান হতে পারবে। চেষ্টা আর ভালো মনোযোগ হতে হবে।"
এটা পূর্বেই লিখেছি যে রামমূর্তি বাল্যকালে শ্বাসরোগের রোগী ছিলেন। তিনি নিজের এই দুর্বলতার উপর খুবই দুখী ছিলেন। ভীম, লক্ষ্মণ, হনুমান আদি বীর যোদ্ধাদের কথা শুনে-শুনে ওনার মনের মধ্যে সত্য ইচ্ছা উৎপন্ন হয়। ব্যায়ামকে তিনি নিজের জীবনের অঙ্গ বানিয়ে নেন। তিনি ব্রহ্মচর্যের দৃঢ় পক্ষপাতী ছিলেন, শারীরিক আর মানসিক পবিত্রতাকে ব্রহ্মচর্যের মূল মনে করতেন। ব্রহ্মচর্যের জন্যই তিনি ৪৪-৪৫ বছরের আয়ু পর্যন্ত বিবাহ করেন নি। ভারতের বালক আর যুবকদের জন্য তিনি ব্রহ্মচর্য আর প্রাণায়ামের ক্রিয়াত্মক প্রচার করেছেন। ওনার স্বভাব খুবই হাসিমুখ ছিল, তিনি হাসিকে স্বাস্থ্যের জন্য বড় উপযোগী মনে করতেন।
তিনি সর্বদা বলতেন - "মন, বচন আর শরীর দ্বারা পবিত্র থাকবে, সহজ সাধারণ ভোজন করবে, জীবনকে সরল রাখবে, প্রতিদিন ব্যায়াম করবে, এটাই হল সংসারে সুখী থাকার মূলমন্ত্র।"
তিনি সর্বদা নবযুবকদের এইভাবে উৎসাহিত করতেন - "অসফলতা! অসফলতা! অসফলতা!! এটা কি? আমি জানি না। একবার, দুইবার, তিনবার, পাঁচবার, দশবার চেষ্টা চালিয়ে যাও, সফলতা অবশ্যই প্রাপ্ত করবে। "Do or die - করো নয়তো মরো" "কার্য়ম্ বা সাধয়েয়ম্ দেহম্ বা পাতয়েয়ম্" "করবো নয়তো মরবো" এটাই হচ্ছে আমার মূল-মন্ত্র।"
তিনি ভারত মাতার প্রতিশ্রুতিশীল যুবকদের দুর্দশা দেখে তাদের উদ্ধারের জন্য ব্যাকুল হয়ে বলতেন - "ভারতের বালক আর যুবকদের উদ্ধার - এটাই আমার জীবনের মূলসূত্র। তারা কৃষ্ণ, লক্ষ্মণ, ভীম, ভীষ্ম বা হনুমানের সমান হোক বা না হোক, কিন্তু দেশের মধ্যে যুবকদের একটা অজেয় সেনা তৈরি হোক, এটাই আমার মনোকামনা। দেশের প্রত্যেক স্থানে ঘুরে আমি যুবকদের প্রোৎসাহন দিয়েছি। মন, বচন, তন আর ধন দিয়ে আমি ভারতের নবযুবকদের সেবক হয়েছি। একদিন আমি এই সংসার ছেড়ে চলে যাবো, কিন্তু তার আগে আমি এই আশ্বাসন চাই যে আমার সেবা ভারত মাতার চরণে স্বীকৃত হয়েছে।"
ফাঁসির মঞ্চে হাসতে-হাসতে ঝুলে পড়া ব্রহ্মচারী রামপ্রসাদ জী ব্যায়ামের বিষয়ে লিখেছেন - "সব ব্যায়ামের মধ্যে দণ্ড (বুকডন) আর বৈঠক সর্বোত্তম। যেখানে ইচ্ছে হবে ব্যায়াম করে নিবে। যদি সম্ভব হয় তো প্রফেসর রামমূর্তির বিধি অনুসারে দণ্ড তথা বৈঠক করবে। প্রফেসর জীর রীতি বিদ্যার্থীদের (ব্রহ্মচারী) জন্য খুবই লাভদায়ক। অল্প একটু সময়ের মধ্যেই পর্যাপ্ত পরিশ্রম হয়ে যায়। দণ্ড-বৈঠকের অতিরিক্ত শীর্ষাসন আর পদ্মাসনেরও অভ্যাস করা উচিত আর নিজের নিবাস স্থানে বীর, মহাত্মাদের চিত্র রাখা উচিত।"
ব্রহ্মচারী রামপ্রসাদ জী প্রফেসর রামমূর্তির পদ্ধতিতে প্রতিদিন নিয়মপূর্বক ব্যায়াম করতেন। এতে ওনার কত আশ্চর্যজনক লাভ হয়েছে, সেই বিষয়ে তিনি নিজের আত্মকথাতে লিখেছেন - "ব্যায়াম আদি করার কারণে আমার শরীর খুব সুগঠিত হয়ে যায় আর রং উজ্জ্বল হয়ে আসে। আমার স্বাস্থ্য দর্শনীয় হয়, সবাই আমার স্বাস্থ্যকে আশ্চর্যের দৃষ্টিতে দেখতো।"
ব্রহ্মচারী রামপ্রসাদ জীর বিষয়ে একটা স্থানে লেখা আছে - "ওনার মধ্যে অসাধারণ শারীরিক বল ছিল। তিনি সাঁতার আদিতে বড় পণ্ডিত ছিলেন। ক্লান্তি কাকে বলে, তিনি সেটা জানতেনই না। তিনি ব্যায়াম আর প্রাণায়াম এত করতেন যে যারা দেখতো আশ্চর্যচকিত হতো।"

💠 ব্যায়াম আর প্রাণায়াম 💠
প্রফেসর রামমূর্তির পদ্ধতি আসলে ওনার নিজের বানানো পদ্ধতি নয়, সেটা তো আমাদের প্রাচীন ঋষি-মুনিদেরই পদ্ধতি। প্রফেসর রামমূর্তি জী বিশেষ ভাবে ব্যায়ামের জন্য যে নিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন সেটা হল প্রাণায়াম। তিনি স্বয়ং এই বিষয়ে লিখেছেন যে - "ব্যায়াম সর্বদা প্রাণায়ামের সঙ্গে করবে অর্থাৎ শ্বাস মুখ দিয়ে না নিয়ে নাক দিয়ে নিবে আর পূরক, কুম্ভ আর রেচক করার সঙ্গে-সঙ্গে করবে।"
মানুষ মনে করে যে প্রাণায়াম তো হচ্ছে কেবল য়োগের একটা অঙ্গ আর এর সঙ্গে ব্যায়ামের কোনো সম্বন্ধ নেই। এইরকম ভুলের কারণে মানুষ ব্যায়াম থেকে পূর্ণ লাভ নিতে পারে না। প্রাণায়াম হচ্ছে ব্যায়ামের প্রাণ আর আমাদের শরীরের সঙ্গে এর সরাসরি সম্বন্ধ আছে, এটা জেনে রাখা আবশ্যক। এইজন্য একটু খুলে লিখে দিচ্ছি -
কেউ যখন ব্যায়াম আরম্ভ করে তো তার মাংসপেশীতে পীড়া হয়। এর অধিক অনুভব সেই ব্যক্তির হয় যে ব্যক্তি প্রতিদিন ব্যায়াম করে না। কিন্তু দেখাদেখি একদিন বা কারও উৎসাহে পঞ্চাশ-ষাটটা বৈঠক একসঙ্গে করে ফেলে অথবা এক-আধ মিল দৌড় লাগিয়ে দেয়। এরফলে তার পা আর উরুতে টান পড়ে আর ভারী-ভারী মনে হয়, উঠতে-বসতে খুব কষ্ট হয়। কারণ যে মাংসপেশী দিয়ে কখনও কাজ করায় নি এমন আরামে থাকা মাংসপেশীর ছোটো-ছোটো ভাগ (রেশ) ব্যায়াম করার ফলে ভেঙে যায় আর এগুলো ভেঙে শরীরের মধ্যে একত্রিত হয় আর এরফলে ফুলে গিয়ে কষ্ট হয়। কিন্তু প্রতিদিন ব্যায়াম বা পরিশ্রমের অভ্যাসের কারণে সেই ভাগই সুদৃঢ় হয়, আর ভাঙে না বা কম ভাঙে। কারণ আমাদের রক্তের মধ্যে যে প্রাণবায়ু আছে, সেটা এই ভাঙতে থাকা ভাগকে জীবনশক্তি (অক্সিজেন) শ্বাস দ্বারা বাইরের শুদ্ধ বায়ু থেকে আমাদের ভিতরে আসতে থাকে আর প্রশ্বাস দ্বারা ভাঙা ব্যর্থ ভাগ বা রক্তের মল আদির সঙ্গে মিশ্রিত হওয়া বিষাক্ত বায়ু (কার্বন) বাইরে বেরিয়ে যায়। এই কারণেই ব্যায়াম করার সময় শ্বাস-প্রশ্বাস বৃদ্ধি পায় আর তার গতি বেড়ে যায়। কারণ সাধারণ অবস্থায় ভাঙাভাঙি কম হয়, তাই সাধারণ শ্বাস-প্রশ্বাস দ্বারা কাজ চলে যায়। কিন্তু ব্যায়াম করার ফলে যখন ভাঙাভাঙি অধিক বেড়ে যায় তখন তাকে ঠিক করার জন্য অধিক প্রাণবায়ুর দরকার হয় আর অধিক প্রাণবায়ুর জন্য অধিক শ্বাস-প্রশ্বাসের আবশ্যকতা হয়। এইজন্য ব্যায়াম করার সময় শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি অধিক হয় আর যখন প্রাণবায়ু আমাদের শ্বাসযন্ত্রের মধ্যে আসে আর রক্তের সঙ্গে মিলিত হয়ে শরীরের কোণায়-কোণায় ব্যাপ্ত হয়ে যায় তখন সেইসময় এটা শরীরের উষ্ণতাকে ঘামের দ্বারা বাইরে বেরিয়ে আসে। এইজন্য ব্যায়াম করার সময় আমাদের ঘাম আসে। যখন আমরা কোনো কঠিন ব্যায়াম করি তখন শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যায়, কার্বন অক্সিজেনের সঙ্গে মিলে যাওয়ার ফলে যে রাসায়নিক ক্রিয়া হয়, তারফলে শরীরের উষ্ণতাও বেড়ে যায়। যদি প্রাণ আর অপানের সংঘর্ষ দ্বারা উৎপন্ন হওয়া উষ্ণতাকে কমিয়ে না দেওয়া হয় তাহলেই জ্বর হবে। কারণ শরীরের উষ্ণতা বেড়ে হওয়ার নামই হচ্ছে জ্বর। এই অধিক বেড়ে যাওয়া উষ্ণতাকে আমাদের প্রাণবায়ু শ্বাস-প্রশ্বাস তথা ঘামের দ্বারা শরীরের বাইরে বের করে দেয়। উষ্ণকালে আমরা জলকে ঠাণ্ডা রাখার জন্য তাকে মাটির ভাড়ে রেখে দিই, এইরকম করার ফলে ভাড়ের বাহ্য ভাগে যে জল আসে আর সেটা উষ্ণবায়ুর সংস্পর্শে এসে বাষ্প হয়ে যায়। বাষ্প হওয়া জন্য যে উষ্ণতার আবশ্যকতা হয়, সেটা ভাড়ের জল থেকে নিয়ে নেয়। ঠিক সেইভাবে যখন ব্যায়াম আদির কারণে আমাদের শরীরে উষ্ণতা বাড়ে তখন ভাড়ের সমান আমাদের শরীরও ঘামতে থাকে আর ঘামের দ্বারা শরীরে বৃদ্ধি পাওয়া উষ্ণতা বাইরে বেরিয়ে যায় আর ঘামের সঙ্গে-সঙ্গে অনেক ধরণের বিজাতীয় মল (বিষ) যা অনেক ধরণের রোগ উৎপত্তির কারণ হয়, সহজ ভাবে শরীর থেকে বাইরে বেরিয়ে যায়।
এইজন্য বেদ ভগবানও ব্যায়ামকে পরম আরোগ্যের মুখ্য সাধন বলেছে -

বিষ্কন্ধম্ সর্বা রক্ষাম্সি ব্যায়ামে সহামহে।। (অথর্বঃ ২/৪/৪)

নির্বলকারী শোষক রোগকে আর সব রাক্ষস অর্থাৎ সব রোগ-কৃমিকে আমরা ব্যায়াম দ্বারা নষ্ট করি।
পাঠক! এইটুকু লেখার দ্বারা নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন যে শ্রমকে দূর করার জন্য, ভেঙে থাকা মাংসপেশীকে জোড়া লাগানোর জন্য অথবা তাতে নবজীবন নিয়ে আসার জন্য আর ব্যায়ামের দ্বারা উৎপন্ন হওয়া বিষকে দূর করার জন্য প্রাণবায়ুর বড় ভারী আবশ্যকতা আছে।
এইজন্য আমাদের শরীরের ভিতরে যতটা সম্ভব প্রাণবায়ুকে প্রবেশ করানো উচিত। প্রাণবায়ুর অধিক প্রবেশ শীঘ্র-শীঘ্র শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে অথবা গভীর শ্বাস নিয়েই করা যেতে পারে। যেমন অধিক জল হওয়ার ফলে নদীর ধার আর গতির বেগ বেড়ে যায়, সেইরকম আমাদেরও ব্যায়াম করার সময় শীঘ্র শ্বাস নিতে হয় আর আমাদের শ্বাস ফুলে যায়। যদি আমরা চাই যে আমাদের শ্বাস যেন না ফুলে তাহলে আমাদের গভীর শ্বাস নেওয়ার স্বভাব বানাতে হবে। গভীর শ্বাস সম্পূর্ণ শ্বাসযন্ত্রের মধ্যে যায়। বেশিরভাগ মানুষ শ্বাস নিতে জানে না, তাদের একটুখানি শ্বাস একটু শ্বাসযন্ত্রের মধ্যে গিয়ে উল্টো ফিরে আসে। গভীর শ্বাস নেওয়ার স্বভাব অভ্যাসের দ্বারাই সম্ভব। অনেক রোগ, পৈতৃক দোষ আর শোয়া-বসার বিধি না জানার কারণে মানুষ ছোটো-ছোটো শ্বাস নেয়, আর এইজন্য শ্বাসযন্ত্র অনেক রোগে গ্রস্ত থাকে। তাই ব্যায়ামের সময় আমাদের গভীর শ্বাস নেওয়ার অভ্যাস করা উচিত, যাতে আমাদের শ্বাসযন্ত্র সুস্থ আর নমনীয় হয়। ব্যায়ামের মধ্যে গভীর শ্বাসের নামই হল প্রাণায়াম। গভীর শ্বাস নেওয়ার সময় আমাদের মনের শক্তি দ্বারা শ্বাসযন্ত্রের প্রত্যেক ভাগে বায়ু পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা উচিত। ব্যায়াম করার সময় আমাদের নাকের দুই ছিদ্র শুদ্ধ আর খোলা থাকা উচিত। আসন, বুকডন, বৈঠক যেকোনো ব্যায়াম সর্বদা প্রাণায়ামের সঙ্গে করবে, এটাই হল আমাদের প্রাচীন শৈলী। প্রাণায়াম বা গভীর শ্বাস নেওয়ার গুরুত্বকে এখন ইউরোপ আদি পাশ্চাত্য দেশের মানুষও বুঝতে শুরু করেছে আর প্রাণায়ামের এই বিধিটাই সেখানে Deep breathing নামে প্রসিদ্ধ।
ইংল্যান্ডের ডাক্তার উস্টেস মাইল্জ ওনার এক পুস্তকে শ্বাস নেওয়ার বিধির বিষয়ে লিখেছেন - "পূর্ণ শ্বাস নেওয়ার বিধি প্রাচীন আর্যগ্রন্থের মধ্যে লেখা আছে। শ্বাস সাবধানে নিবেন অর্থাৎ যদি আপনি প্রাকৃতিক রূপে ভালোভাবে শ্বাস নিতে জানেন না তাহলে অভ্যাস করবেন। শ্বাস গভীর ভাবে নেওয়া উচিত যাতে সম্পূর্ণ ফুসফুস বায়ুতে ভরে যায় আর তারপর সম্পূর্ণ শ্বাস বাইরে বের করে দিবেন। উত্তম রূপে শ্বাস নেওয়ার অভ্যাস অনেক গুণকারী হয় আর এটা এক এমন কৌশল যাকে মানুষ প্রতিক্ষণ পূর্ণ করতে পারবে, বৃদ্ধাবস্থাতেও এটা ছাড়া উচিত নয়, এটা মৃত্যু পর্যন্ত সম্পূর্ণ লাভ দিতে থাকবে। এমন সহস্র মানুষ আছে যারা শ্বাস নেওয়ার সঠিক বিধিকে জানে না। উত্তম প্রকারে এক-দুই বছর শ্বাস নেওয়ার অনুভব করবেন, তারপর আপনি স্বয়ং জানতে পারবেন যে ফুসফুসে বায়ুর মাত্রা দ্বিগুণ হয়ে গেছে।"
তিনি এরপর লিখেছেন - "উত্তম বিধিতে শ্বাস নেওয়া শারীরিক স্বাস্থ্য আর স্বাস্থ্য রক্ষার নিয়মের জন্য, এরদ্বারা স্বাস্থ্য বাড়ে। উত্তম রূপে শ্বাস নেওয়ার ফলে রং-রূপ ভালো হয় আর মানুষের জীবন সুখ ভোগার যোগ্য হয় আর হৃদয় বা মানসিক বিচার উত্তম হয়। উত্তম রূপে শ্বাস নিলে ধন আর শক্তি ব্যর্থ নষ্ট হয় না। এরদ্বারা মানুষ তার শরীর আর মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।"
এমনিতে তো যেকোনো ব্যায়ামই করা হোক না কেন তারসঙ্গে ফুসফুসের ব্যায়ামটাও হয়ে যায়। কারণ সব ব্যায়ামের মধ্যে শ্বাস শীঘ্র-শীঘ্র যায়-আসে, এরফলে ফুসফুস খুব বড় আর সংকুচিত হয়, ভালো বায়ু রক্তকে শুদ্ধ করে দেয়, রক্তের ভ্রমণ বাড়ে আর শরীরের মল (নোংরা) বাইরে বেরিয়ে যায়। কিছু মল তো ঘাম দ্বারা বেরিয়ে আসে আর কিছু ব্যায়ামের উষ্ণতার দ্বারা জ্বলে যায়, কিছু রক্তের সঙ্গে মিশে ফুসফুসে গিয়ে শুদ্ধ হয়ে যায়, কিছু শ্বাস মার্গ দিয়ে বাইরে চলে যায়, কিছু মল-মূত্রের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে যায়, এইসব লাভ ব্যায়াম দ্বারা হয়। কিন্তু প্রাণায়াম বা গভীর শ্বাসের অভ্যাসের দ্বারা রক্ত আর শরীরের শুদ্ধি আর ফুসফুসের ব্যায়াম অন্য সব ব্যায়ামের তুলনায় কয়েকশ গুণ বেশি লাভদায়ক হয়। এইজন্য অন্য ধার্মিক নিত্য কর্মের সঙ্গে-সঙ্গে দৈনিক প্রাণায়াম করার আজ্ঞা প্রাচীন শাস্ত্রগুলোতে দেওয়া হয়েছে। গভীর শ্বাসের অভ্যাসের নামই হচ্ছে প্রাণায়াম এটা পূর্বেই বলেছি, অতঃ সর্বদা গভীর শ্বাস নিবে।

গভীর শ্বাস নেওয়া বিধির অভ্যাস 

শান্ত আর একান্ত এমন কোনো স্থানে যেখানকার বায়ু শুদ্ধ আর শীতল হবে, যেখানে ধুলো বা ধুঁয়া আদি হানিকারক বস্তু নেই, যেখানে সিদ্ধাসন বা অন্য যেকোনো আসনে বসতে পারবে, সেখানে এমনভাবে বসবে যেন বুক, গলা আর মস্তক তিনটাই একদম সোজা থাকবে, মেরুদণ্ডও সোজা রাখতে হবে। ধীরে-ধীরে নাক দিয়ে শ্বাসকে বাইরে বের করবে, যতক্ষণ পর্যন্ত বুক, পেট খালি না হচ্ছে, শ্বাসকে নিরন্তর বের করতে থাকবে অর্থাৎ সম্পূর্ণ বায়ু বের করে দেওয়া উচিত। শ্বাস এইভাবে বাইরে বের হওয়ার ক্রিয়াকে রেচক বলে। তারপর এইভাবে ধীরে-ধীরে শ্বাসকে ভিতরে নিবে আর যতক্ষণ পর্যন্ত বুক আর পেট ঠিকভাবে ভরে না যাচ্ছে, শ্বাস নিতেই থাকবে, শ্বাসের এই ভরার ক্রিয়াকে পূরক বলে। এইভাবে শুরু-শুরুতে রেচক আর পূরক অনেকবার অভ্যাস করবে। যখন এক-দুই মাস অভ্যাসের পশ্চাৎ শ্বাস বের হওয়া আর ভরা সঠিক ভাবে করতে পারবে তখন বাইরের আর ভিতরের শ্বাসকে থামিয়ে রাখার অভ্যাস করবে।
শ্বাসকে বাইরে বা ভিতরে থামানোর অভ্যাসকে কুম্ভক বলে। যদি শুরুতেই কারও ইচ্ছে হয় যে শ্বাসকে থামিয়ে রাখবে তাহলে অল্প কিছুক্ষণ থামিয়ে রাখবে আর থামিয়ে রাখার সময়টা ধীরে-ধীরে বাড়ানো উচিত, তবে বলপূর্বক থামালে হানি হয়। অভ্যাসের দ্বারা বাইরে আর ভিতরে দুই দিকের শ্বাসকে থামানোর অবধি বা কুম্ভকের সময়টা আপনা-আপনি বেড়ে যায়। রেচক বা পূরকের অভ্যাস সোজা দাঁড়িয়ে, শুয়ে, চলতে-চলতে অথবা পশ্চিমোত্তান আসনেও করা যেতে পারে। ব্যায়াম করার আগে এক-দুইবার ভস্রিকা প্রাণায়াম করার ফলে খুব লাভ হয়, তার বিধি আমার প্রাণায়াম পুস্তকের মধ্যে দেখে নিবে। এইভাবে ভস্রিকা তথা গভীর শ্বাস দ্বারা করা এই অভ্যাস ফুসফুসকে সুস্থ আর নমনীয় (flexible) বানিয়ে দেয়। নমনীয় ফুসফুসের মধ্যে শ্বাস বা প্রাণের মাত্রা অধিক হয়। যখন আমরা একবারে অধিক প্রাণ ভিতরে ভরে নিবো তো শীঘ্রই আরেকটা শ্বাস নেওয়ার আবশ্যকতা হবে না, একেই গভীর তথা উত্তম শ্বাস বলে। এইভাবে ব্যায়াম সম্বন্ধীয় প্রাণায়ামের অভ্যাস করার পশ্চাৎ অভ্যাসীর রাত-দিন গভীর শ্বাস নেওয়ার অভ্যাস হয়ে যায়। সে ব্যায়াম বা অন্য কোনো ধরণের পরিশ্রম করেও ক্লান্ত হয় না আর তার শরীর শুদ্ধ, সুস্থ, সুন্দর, সুদৃঢ়, নির্মল আর দীর্ঘায়ু হয়। কারণ ব্যায়ামের প্রত্যেক শ্বাসের সোজা সম্বন্ধ আমাদের স্বাস্থ্য, বল আর আয়ুর সঙ্গে আছে, এইজন্য ব্যায়াম করার সময় ব্রহ্মচারী তথা সবাইকে ফুসফুস আর গভীর শ্বাস নেওয়ার উপর পুরো ধ্যান রাখা উচিত। ব্যায়াম করার সময় যখন শরীরের কোনো অঙ্গকে বল দিতে হবে বা বিশেষ পরিশ্রম করতে হবে, সেইসময় শ্বাস ভিতরে ভরে রাখা উচিত আর শ্বাসকে ভিতরেই থামানো উচিত অর্থাৎ আভ্যন্তর কুম্ভক করবে। ব্যায়ামের মধ্যে কখন রেচক, পূরক বা কুম্ভক করা উচিত এটা বুকডন-বৈঠক আদির বিধি দ্বারা বুঝে যাবে।
প্রফেসর রামমূর্তির ব্যায়ামে শ্বাস ক্রিয়ার উপর খুব ধ্যান রাখা হয়েছে, তাই তিনি যে বুকডন-বৈঠকের প্রচার করতেন তথা নবযুবক আর বিদ্যার্থীদের জন্য অধিক উপযোগী মনে করে সেগুলো সর্বদা করার অনুরোধ করতেন। তিনি বলেছেন যে - "ব্যায়াম তো সব কুস্তিগীররাই করে কিন্তু তারা ব্যায়ামের সঙ্গে শ্বাসের নিয়মের উপর ধ্যান রাখে না, তাই তাদের শক্তিতে হানি হওয়াটা স্বাভাবিক।"
প্রফেসর রামমূর্তি প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের অধ্যয়ন করেছিলেন, তাই তিনি এই ত্রুটিকে দূর করার প্রচেষ্টা করেন আর এতে তিনি সফলতাও প্রাপ্ত করেন। এইজন্য প্রো০ রামমূর্তির ব্যায়াম দেশী হওয়া সত্ত্বেও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তিনি প্রাচীন প্রণালীর অনুসরণ করেছেন আর শ্বাস-প্রশ্বাসের নিয়মকে ব্যায়ামের মধ্যে বিশেষ ধ্যান রেখেছেন আর এইজন্য ওনার ব্যায়াম শরীরের অন্য অঙ্গের মতো মানসিক শক্তির জন্যও লাভদায়ক হয়।
বুকডন-বৈঠকও এক ধরণের আসন, তাই বুকডনকে দণ্ডাসন বলে। প্রো০ রামমূর্তি দেশী ব্যায়ামের মধ্যে বুকডন আর বৈঠকের খুব প্রশংসা করেছেন। ওনার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে শরীরকে বানাতে এরদ্বারা খুব ভালো সহায়তা প্রাপ্ত হয়। ওনার বুকডন-বৈঠক করার বিধি নিচে দেওয়া হল।
বুকডন অনেক প্রকারের আছে, যেমন - সাধারণ দুই হাতের বুকডন, এক হাতের (বগল) বুকডন, এক পায়ের বুকডন, সব আঙুলের বুকডন, বুড়ো আঙুলের বুকডন, এক পা তুলে বুকডন, ভার তুলে বুকডন, কুর্সি বুকডন আর প্রো০ রামমূর্তির বুকডন ইত্যাদি। এখানে কেবল প্রো০ রামমূর্তির বুকডনের বিধি যা সবার জন্য তথা বিশেষভাবে ব্রহ্মচারীদের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ, সেটা নিয়ে আলোচনা করা হবে।
☘️ বুকডনের বিধি 🍀
দুই হাতের তালু ভূমিতে রেখে আর দুই পাকে পিছনে ছড়িয়ে বুকডন করার জন্য প্রস্তুত হবে। পায়ের গোড়ালী উপরে থাকবে আর পায়ের ভার পায়ের আঙ্গুলের উপরে থাকবে, দুই হাত আর দুই পায়ের মাঝখানটা বুকের প্রস্থের সমান ফাঁকা থাকতে হবে, সাধারণতঃ দুই বিঘতের মাপ ঠিক হবে।
বুকডনের প্রস্তুতিতে বুকডন দেওয়ার পূর্বে পিঠ আর কোমরকে উপরে তুলবে, কোমরকে যতটা পারবে পিছনে টেনে রাখবে, গলা বুকের দিকে ঝুঁকে থাকবে, এমনকি থুতনি বক্ষঃস্থলকে (বুক) স্পর্শ করবে আর চোখের দৃষ্টি পেটের নাভির দিকে থাকবে। পা আর হাত ভূমিতে নিজের স্থানে স্থির থাকবে অর্থাৎ স্থান থেকে সরবে না। সামনে গিয়ে হাত একদম সোজা হবে। এখন কোমর আর বুককে নিচে নিয়ে যাবে, হাতের কনুইয়ের উপর দিয়ে নামাতে থাকবে, নিচে যাওয়ার সময় বুকডন দেওয়ার পূর্বে লম্বা শ্বাস নিবে আর যতটা প্রাণ ভিতরে নিতে পারবে নিয়ে নিবে। কনুইয়ের উপরের ভাগ বুকের পাশে বগলকে স্পর্শ করবে তথা মাথা আর গলা সোজা থাকবে, পায়ের হাঁটু যেন না মুড়ে যায়। বুককে যতটা পারবে নিচে নিয়ে যাবে কিন্তু ভূমিতে স্পর্শ করবে না। কোমরের নিচের অংশ আর মাথা ও বুক শূন্যে থাকবে। বুকডনের এই স্থিতিতে এসে নিজের মনকে ব্যায়ামের এই ক্রিয়ার উপর একাগ্র করবে। এরপর মাথা আর বুককে উপরে তুলে দুই হাতকে সোজা দাঁড় করাবে, এরফলে এখন কোমর নিচু হয়ে যাবে আর মাথা তথা বুক উঁচু হবে। ওঠার সময় কাঁধকে সামনের দিকে টেনে কোমরকে জোরে পিছনের দিকে টানবে। এই অবস্থাতেও শ্বাসকে আটকে রাখবে। এরপর মাথাকে নিচে নামিয়ে আর থুতনি দিয়ে বুককে স্পর্শ করে যখন নিজের পূর্বের স্থিতিতে আসবে তখন ধীরে-ধীরে শ্বাস ছাড়বে। আর শ্বাস ছাড়তে-ছাড়তে সেই পর্যন্ত ভিতরের বায়ুকে বের করবে যতটা বের করা সম্ভব, কিন্তু কষ্টের সঙ্গে নয়, সুখপূর্বক করবে। তারপর ধীরে-ধীরে শ্বাস নিয়ে যত বায়ু নিতে পারবে নিবে, আর বুকডনের এই ক্রিয়াকে পুনঃ আরেকবার করবে।
এইভাবে নিজের শক্তি তথা অভ্যাস আদির অনুসারে বুকডনের ব্যায়াম করবে। যতটা বুকডন করলে শ্বাস ফুলে যাবে না ততটা বুকডন একবারে করা উচিত। আর এক-একটা বুকডনে কম করে হলেও অন্তত ৪-৫ সেকেণ্ডের সময় অবশ্যই লাগানো উচিত। শ্বাস ফুলে গেলে বা নাকের মূল শুকিয়ে যাওয়ার পরেও বুকডন আদি ব্যায়াম করতে থাকলে হানি হয়। একবার বুকডন দেওয়ার পরে কিছু গভীর শ্বাস নেওয়া উচিত। ক্লান্ত হয়ে যাওয়া মাংসপেশীর উপর হাত দিয়ে মালিশ করা উচিত আর ক্লান্তি দূর হলে যদি অধিক করতে ইচ্ছে হয় আর শক্তি থাকে তথা পৌষ্টিক ভোজনের ব্যবস্থা থাকে তাহলে দ্বিতীয়বার বা তার অধিক বুকডন করা উচিত। বুকডন করার সময় শ্বাসের রেচক আর পূরকের উপর আমাদের সম্পূর্ণ অধিকার থাকতে হবে আর কুম্ভক ধ্যানপূর্বক করতে হবে। শ্বাসের প্রক্রিয়া সঠিকভাবে হওয়ার কারণে মানুষ শীঘ্র ক্লান্ত হয় না, শ্বাস ফুলে যায় না বা দম ফুরিয়ে যায় না আর উষ্ণতাও মনে হয় না। বুকডন দেওয়ার সময় যখন নিজের হাতের তালু আর পায়ের আঙ্গুলের উপরে সম্পূর্ণ শরীরের ভার ওঠানো আর নামানো হবে তখন আটকে রাখা অবস্থাতে শ্বাসকে নিচে আসতে আর উপরে টানতে খুব পরিশ্রম করতে হয়। স্নায়ু টান-টান হয়ে যায়, মুখে তেজ আর কান্তি চকচক করে, চোখ প্রশস্ত হয়, নাসারন্ধ্র ফুলতে থাকে, শরীরের জোড় আর গিঁট বেজে ওঠে। বুক, বাহু, স্কন্ধ, উরু আর গলা ধীরে-ধীরে ফুলতে থাকে। বুকডন দেওয়ার সময় শরীর সোজা আর প্রসারিত থাকবে তারসঙ্গে শ্বাসের গতিও সোজা থাকবে। বুকডন দেওয়ার সময় দৃঢ়তার সঙ্গে জমে থাকা বাহু বলের উপর যখন ধীরে-ধীরে নিচে নামাবে আর উপরে উঠাবে সেইসময় একদম সোজা প্রসারিত রাখতে হবে। মাংসপেশীকে দৃঢ় করতে হবে, পা যেন একটুও সরে না যায় আর অঙ্গকে গতি দেওয়ার সময় শ্বাসের গতি পুরোপুরি নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
সাধারণতঃ সবার মত হল বুকডন করার ফলে শরীরের উপরের অর্ধেক ভাগের ব্যায়াম হয় আর কোমরের নিচের ব্যায়াম বৈঠক করার ফলে হয়। যেভাবে বুকডন করার অনেক প্রকার প্রচলিত আছে, ঠিক সেইভাবে বৈঠকেরও অনেক প্রকার আছে। কিন্তু প্রো০ রামমূর্তির বৈঠক ঠিক কিরকম ছিল সেটা নিচে দেওয়া হল -
দুই পা সোজা করে দাঁড়াবে, দুই পায়ের মধ্যে প্রায় ৬ ইঞ্চি দূরত্ব থাকবে। দুই হাত ঝুলিয়ে নিজ-নিজ উরুর উপর স্পর্শ করবে, এরপর পায়ের গোড়ালীকে তুলবে তথা শরীরের ভার পায়ের আঙ্গুলের উপর রাখবে। বুক সোজা অর্থাৎ সামনের দিকে উদিত হয়ে থাকবে। শরীর সোজা সমরেখাতে হবে। তারপর ধীরে-ধীরে শ্বাস ভরে কুম্ভক করবে আর সামনে ৬ ইঞ্চি দূরত্বে ঝাঁপ দিয়ে হাত মুঠি করে ধীরে-ধীরে বসাতে শুরু করবে। হাতকেও ধীরে-ধীরে আগে বাড়াবে আর দুই হাতকে কাঁধ বরাবর সোজা করবে। হাতের মুঠি বন্ধই থাকবে, পায়ের গোড়ালি ভূমিতে স্পর্শ করবে না, সম্পূর্ণভাবে বসার পরেও হাঁটু আর উরু একে-অপরকে যেন স্পর্শ না করে, দুটোর মধ্যে অর্ধেক ইঞ্চির দূরত্ব রাখতে হবে। বসার পরে দুই হাতের কনুই মুড়ে ধীরে-ধীরে কাঁধের দিকে নিয়ে আসবে। হাতের মুঠি কাঁধের সঙ্গে স্পর্শ করবে না, তার মধ্যেও অর্ধেক ইঞ্চির দূরত্ব রাখবে। এরপর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ধীরে-ধীরে উঠবে। সম্পূর্ণ ভাবে ওঠার পরে পিছনে ঝাঁপিয়ে নিজের পূর্বের স্থানে ফিরে আসবে আর দুই হাতকে পূর্বের স্থানে নিয়ে আসবে আর শ্বাসকে রেচক করে বের করে দিবে। এটা সর্বদা ধ্যানে রাখবে যে ধীরে-ধীরে উঠতে হবে আর ধীরে-ধীরে বসতে হবে, বৈঠক করার পূর্বে কুম্ভক করবে, বৈঠক সমাপ্ত হলে রেচক করবে, মাঝখানে শ্বাস নিবে না, তাই শ্বাস নাক দিয়ে পুরো ভরে নিবে। এমন যেন না হয় যে মাঝখানে পুনঃ শ্বাস নিতে হয়। ওঠা-বসার প্রত্যেক অবস্থাতে শরীর সোজা থাকবে, কোমর থেকে বুক পর্যন্ত ভাগ টান-টান থাকবে, ঢিলা যেন না থাকে, বুক আঁটসাঁট আর সামনে বেরিয়ে থাকবে। হাতের মুঠি এত শক্ত করে ধরবে যেন হাত কাঁপতে থাকে।
বৈঠক করার সময় মনকে উরু আর হাঁটুর উপর একাগ্র করে এমন ধ্যান করবে যে আমার সম্পূর্ণ পায়ের মধ্যে বল, শক্তি, দৃঢ়তা আর ওজের সঞ্চার হচ্ছে। আর "ঊর্বোর্মে ওজোऽস্তু" (পারস্কর গৃহ০ ১/৩/২৫) এই অনুসারে আমার উরুতে ওজ স্থির হচ্ছে, চলার শক্তি বাড়ছে আর দুর্বলতা, অক্ষমতা দূর হচ্ছে। একবার বৈঠক ক্রিয়া করতে অন্তত ১-২ মিনিট সময় লাগানো উচিত। শক্তি অনুসারে এই সময়কে বাড়ানোও যেতে পারে। কয়েকশ বৈঠক করার পরিবর্তে যদি এই বৈঠক ১০ বারও করা হয় তাহলেই যথেষ্ট আর এর লাভ অধিক হবে। বৈঠক দ্বারা উরু, হাঁটু আদি পায়ের সব অঙ্গের আর তারসঙ্গে হাতেরও ব্যায়াম হয়ে যায়, হাত আর পায়ের মাংসপেশী দৃঢ় হয়। শুরু-শুরুতে এই বৈঠক ৪-৫ টাই করা উচিত আর তারপর শক্তি অনুসারে বাড়ানো যেতে পারে। যদি এই বৈঠককে একই স্থানে দাঁড়িয়ে করা হয়, সামনে-পিছনে ঝাঁপ না দেওয়া হয় তাহলে একে সাধারণ বৈঠক বলা হবে। ঝাঁপানোর কারণেই এর নাম "সপাট" হয়েছে। এটা দুই ভাবেই করতে পারবে, যেটা ইচ্ছে হবে সেটা করবে কিন্তু সপাট বৈঠকে অধিক লাভ হয়।
☘️ একটা ভ্রম আর তার সমাধান ☘️
মানুষের মধ্যে এই ভ্রমটা খুব ছড়িয়ে আছে যে ব্রহ্মচারী বা বিদ্যার্থীদের জন্য বৈঠকের ব্যায়াম ভালো নয়। এটা একদম নির্মূল, বৈঠকের দ্বারা ব্রহ্মচর্যের মধ্যে কোনো হানি হয় না। তবে এটুকু অবশ্যই ধ্যান রাখতে হবে যে ব্রহ্মচারী বা বিদ্যার্থী অথবা অন্য কেউ যারাই মস্তিষ্ক দিয়ে কর্মকারী হবে, তাদের বৈঠকের তুলনায় বুকডন আদি বুক আর মস্তিষ্কের ব্যায়াম অধিক করা উচিত। সাধারণ নিয়ম হল বৈঠকের ব্যায়াম বুকডনের অর্ধেক হওয়া উচিত।
এখনকার আখাড়াতে কুস্তিগীররা বুকডনের তুলনায় বৈঠক অধিক করে, কারণ কুস্তিগীরদের মোটা-মোটা দীর্ঘ সুন্দর উরু ভালো লাগে আর তারা মল্লযুদ্ধে পা দিয়েই অধিক কাজ করে, কিন্তু বড়-বড় কুস্তিগীরদের দেখবে, তাদের শরীর যতই সুন্দর, সুদৃঢ় বা সুগঠিত হোক না কেন, তাদের মুখখানা নিস্তেজ, কান্তিহীন আর কুরূপ দেখতে হয়।
এখনকার আখাড়াতে যেসব ব্যায়ামের পদ্ধতি প্রচলিত আছে, তারমধ্যে অনেক ভারী সুধারের আবশ্যকতা আছে। বুকডন-বৈঠক করার সময় মল্ল ব্যক্তিরা এত শীঘ্রতা করে যে মেশিনের অবয়ব তাদের সমতা করতে পারবে না, এইজন্য শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়া অত্যন্ত বেগে আর শীঘ্র হতে থাকে। গ্রীষ্মকালে কুকুরের সমান হাপাতে থাকে, কেউ-কেউ তো খুঁটি, দড়ি, গাছ বা দেয়াল আদিকে ধরে বৈঠক করতে থাকে আর কোমরকে তেমন সোজাই করে না। এইসব বৈঠকের দ্বারা অনেক হানি হয়। এইভাবে শীঘ্রতা আর অনিয়মিত রূপে বুকডন-বৈঠক আদি ব্যায়াম করলে কোনো লাভ হয় না।
সাধারণ বৈঠক আর সপাট বৈঠকই সবথেকে ভালো, এর অতিরিক্ত হনুমান বৈঠক, বীর বৈঠক, মুখ ঘোরানো বৈঠক, এক পা-পসার বৈঠক, অঙ্গমরোড় বৈঠক আর হাঁটু-ঘোরানো বৈঠক আদি অনেক প্রকারের বৈঠক আছে, যা নিয়মিত অভ্যাস দ্বারা লাভ হয়। বৈঠকের সমান দৌড়, সাঁতার আদি পায়ের অনেক ব্যায়াম আছে, কিন্তু শরীর যতটা বুকডন আর বৈঠক করলে পড়ে হয় ততটা দৌড় আদি অন্য ব্যায়ামের দ্বারা হয় না।






দৌড়


প্রকট রূপে দৌড়ালে তো পায়েরই অধিক ব্যায়াম হয়, কিন্তু দৌড়ানোর ব্যায়াম সারা শরীরের জন্য উপযোগী। এরদ্বারা পায়ের অতিরিক্ত বুক, ফুসফুস আর পেট আদিরও ব্যায়াম হয়। ফুসফুসের জন্য তো দৌড়ানো অত্যন্ত লাভদায়ক, কারণ দৌড়ানোর সময় ভস্রিকা প্রাণায়াম খুব ভালো ভাবে হয়, যারফলে ফুসফুস বজ্রের সমান সুদৃঢ় আর রক্ত সঞ্চালনের জন্যও খুব ভালো হয়। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে দৌড়ানোর ফলে পায়ের বল বাড়ে, তবে ফুসফুস বা শ্বাসযন্ত্রকে শুদ্ধ আর পুষ্ট করতে, হৃদয়ের গতিশীলতা বজায় রাখতে আর সুদৃঢ় তথা রক্তকে শুদ্ধ করার জন্য দৌড়ের ব্যায়াম অনেক উত্তম। দৌড়ানোর ফলে মানুষের মধ্যে স্ফূর্তি তথা কর্মণ্যতা আসে। ফুসফুস বলবান হওয়ার কারণে কাশি, জ্বর আদি রোগ বিরক্ত করে না। বালক, যুবক, বৃদ্ধ, স্ত্রী, পুরুষ সবার জন্য দৌড়ের ব্যায়াম উত্তম। প্রাতঃকাল সূর্যোদয়ের পূর্বে দৌড়ানো ব্রহ্মচারী আর বিদ্যার্থীদের জন্য অত্যন্ত হিতকর।
খালি পায়ে দৌড়ালে অধিক লাভ হয়। বাল্যাবস্থা তথা বৃদ্ধি অবস্থায় যদি জুতা আদি পরে দৌড়ানো হয় তাহলে পায়ের স্বাভাবিক বিকাশ আর বৃদ্ধি হয় না, এইজন্য পায়ের বিকাশের কথা ধ্যানে রেখেই ঋষিরা "উপানচ্ছত্রধারণম্ বর্জয়" জুতা আর ছাতা ধারণ নিষেধ করেছেন। দৌড়ানোর সময় পা তুলে-তুলে আঙ্গুলের উপর ভার দিয়েই দৌড়ানো উচিত অর্থাৎ পায়ের অগ্রভাগই ভূমির উপর থাকবে, গোড়ালী ভূমিতে থাকবে না। বুক সামনের দিকে উদিত আর টান-টান থাকবে তথা কাঁধ পিঠের দিকে ঝুঁকে থাকবে, হাত মুঠো করে দুই হাতকে বুক বরাবর রাখবে, চোখের দৃষ্টি সামনে থাকবে আর দৌড়ানোর সময় পায়ের দুই উরুকে এত উপরে নিয়ে যাবে যে দুই উরু প্রায় পেটের সামনে যাবে। যত লম্বা পা দৌড়ানোর সময় রাখতে পারবে তত ভালো। যখন দৌড়ানো আরম্ভ করবে তখন শুরুতেই দ্রুত দৌড়াবে না, ধীরে-ধীরে বেগকে বাড়াতে থাকবে। দৌড়ানোর জন্য শরীরের পুরো শক্তি লাগিয়ে দেওয়া উচিত, হঠাৎ করে দৌড়ানো থামিয়ে দেওয়া উচিত নয়, দৌড়ানোর পশ্চাৎ সঙ্গে-সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়া, বসে পড়া বা শুয়ে পড়া আদি খুবই হানিকারক। অতঃ দৌড়ানোর পশ্চাৎ যতক্ষণ শ্বাস দ্রুত চলতে থাকবে ততক্ষণ ভ্রমণ করা বা হালকা হাঁটাই লাভপ্রদ। দৌড়ানোর পশ্চাৎ শরীর যতক্ষণ পর্যন্ত সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত জল পান, জল দিয়ে হাত, মুখ, পা ধোয়া, স্নান আর আহার করা আদি কখনোই উচিত নয়। দৌড়ানোর জন্য স্থান খোলামেলা আর শুদ্ধ বায়ুর পরিবেশ হওয়া উচিত, সেখানকার ভূমি সম হবে আর কাঁটা-নুড়ি রহিত হবে, বিষাক্ত সাপ, পোকামাকড় আদির কোনো ভয় থাকবে না। দৌড়ানোর সময় নাক দিয়ে লম্বা আর গভীর শ্বাস টেনে আর কিছু আটকে রেখে ধীরে-ধীরে ছাড়ার অভ্যাস করা উচিত। লম্বা গভীর শ্বাস নেওয়া আর ছাড়ার ফলে ব্যাকুলতা আর শ্রান্তি অনেক কম হয়। অত্যন্ত বেগে শ্বাস চললেও নাক দিয়েই শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়া করা উচিত।
মুখ খুলে তথা মুখ দ্বারা শ্বাসোচ্ছ্বাস করতে-করতে দৌড়ানো খুবই হানিকারক। দৌড়ানোর সময় অঙ্গকে শিথিল রাখবে না, প্রত্যেকবার হাতকে পিছনের দিকে ভালো ভাবে টানতে থাকবে।
শুরু-শুরুতে একশ মিটারের অধিক দৌড়ানো উচিত নয়। প্রতিদিন একটু-একটু করে বাড়িয়ে এক বা দুই মাইল বা তারও বেশির অভ্যাস নিজের সমর্থ্যানুসারে করা উচিত। ১০-১৫ মাইল পর্যন্ত দৌড়ানোর অভ্যাস করা যেতে পারে কিন্তু মুখ্য বিষয় তো সামর্থ্য আর পুষ্টিকারক ভোজনের হবে, পুষ্টিকারক ভোজনের অভাবে তথা শক্তির তুলনায় অধিক দৌড়ানোর ফলে শরীরের হানি হবে। শুরুতে কিছু দূর দৌড়ালে শ্বাস ফুলে যায় আর দৌড়বাজ ভয় পেয়ে যায়, কিন্তু সাহস বেঁধে দৌড়াতে থাকলে ব্যাকুলতা পালিয়ে যাবে আর সাহসও বেড়ে যাবে। গভীর শ্বাস দৌড়ানোর মধ্যে অত্যন্ত সহায়ক। আমাদের কাবাডি আদি এমন অনেক খেলা আছে যারমধ্যে পর্যাপ্ত মাত্রায় দৌড় হয়ে যায়। এটা সর্বদা ধ্যানে রাখবে যে দৌড়াতে-দৌড়াতে যখন উষ্ণতা বেড়ে যাবে আর শ্বাস খুব শীঘ্র-শীঘ্র বা বেগে আসতে থাকবে আর ফুসফুসের মধ্যে আটবে না তখন দৌড়ানো থামিয়ে দেওয়া উচিত। দৌড় আদি পায়ের ব্যায়াম দ্বারা হাতির শুঁড়ের সমান উরু পুষ্ট হয়।
যারা রাতদিন বসে থাকে আর দৌড়, ভ্রমণ আদি পায়ের ব্যায়াম করে না, তাদের পা নির্বল হয়, উরুর মাংস শুকিয়ে যায় অথবা চর্বি বেড়ে উরুর মাংস ঢিলে আর ঝুলে থাকে আর সেগুলো কুরূপ আর অত্যন্ত স্থূল হয়। উরু একদম পাতলা অথবা অত্যন্ত মোটা আর ঢিলা হওয়া উচিত নয়। যে উরুতে আঙ্গুল টিপলে আঙ্গুল ডেবে যায় না এমন কঠোর উরুকে সুস্থ আর সবল মানা হয়। কিন্তু দৌড় আর বৈঠক বিনা এমন উরু কিভাবে হওয়া সম্ভব! দৌড় আদি ব্যায়ামই উরু আর হাঁটুকে সুন্দর, পুষ্ট আর সবল করে তোলে।
দৌড়ানোর সময়ও মনকে পায়ের হাঁটু আর উরু আদি ভাগের উপর একাগ্র করা উচিত আর এমন ধ্যান করা উচিত যে আমার এই অঙ্গের নির্বলতা দূর হয়ে যাচ্ছে আর বেদের আজ্ঞানুসারে "জঙ্ঘয়োর্জবঃ" উরুতে বেগ, স্ফূর্তি আর বল ইত্যাদি আর "পাদয়োঃ প্রবিষ্ঠা" (অথর্বঃ ১৯/৬০/২) পায়ের হাঁটুতে স্থিরতা, সুদৃঢ়তা তথা সৌন্দর্য আদি গুণের সঞ্চার হচ্ছে। এইভাবে দৃঢ় ভাবনা নিয়ে বেদের এই পবিত্র আজ্ঞার অনুসারে দৌড়ালে অত্যন্ত লাভ হয়। পায়ের উরু, হাঁটু আদি ভাগের মধ্যে স্ফুর্তি, বেগ, বল, শক্তি, সৌন্দর্য, স্থিরতা আর সুদৃঢ়তা আদি গুণের অনুভব অভ্যাসী কিছু দিনের মধ্যেই করতে থাকে। তার উরু আর হাঁটু খুব শীঘ্র পুষ্ট আর বলবান হয়ে যায়।

🍀 সাঁতার 🍀

সাধারণ ব্যায়ামের মধ্যে সাঁতার হল আমাদের শরীর তথা স্বাস্থ্যের জন্য এক বড় উপযোগী ব্যায়াম। সাঁতার দ্বারা শরীরের খুব ভালো ব্যায়াম হয়। বালক, যুবক, বৃদ্ধ, স্ত্রী আর পুরুষ সবার জন্য সাঁতারের ব্যায়াম লাভপ্রদ। যদি বিচারপূর্বক এই ব্যায়াম করা হয় তাহলে কোনো অবস্থাতেই হানি হয় না আর ব্রহ্মচারীর জন্য তো সাঁতারের ব্যায়াম অত্যন্ত লাভদায়ক। এরদ্বারা ব্রহ্মচর্যের সাধনাতে বীর্যরক্ষার জন্য অনেক সহায়তা পাওয়া যায়। ব্রহ্মচারী আর ব্রহ্মচর্য প্রেমী যদি প্রতিদিন এক ঘন্টা সাঁতারের ব্যায়াম করে তাহলে স্বপ্নদোষাদির দ্বারা বীর্যনাশের ভয় বা আশঙ্কা থাকে না। প্রমেহ, স্বপ্নদোষ আদি বীর্যভ্রষ্টতার রোগ বা দোষ খুব শীঘ্র দূর হয়ে যায়, কারণ এটা হচ্ছে বীর্য সম্বন্ধীয় রোগকে দূর করার জন্য সর্বোত্তম ঔষধ। যেসব ব্রহ্মচারী অন্য সাধনের সঙ্গে সাঁতারের ব্যায়াম করে তাদের স্বপ্নদোষ আদি রোগ বিরক্ত করে না আর তারা স্থিরবীর্য বা ঊর্ধ্বরেতা হয়। এইজন্য বেদ ভগবান জলের মহিমার গান করেছে -
অপ্স্বন্তরমৃতমপ্সু ভেষজম্।। (অথর্বঃ ১/৪/৪)
অর্থাৎ - জলের মধ্যে অমৃত আর ঔষধি আছে।
জলের গুরুত্বকে আমাদের প্রাচীন পুরুষ ঋষি-মহর্ষিরা সঠিক ভাবে জানতেন, এইজন্য জলাশয় আর নদীর তীরে আশ্রম বানিয়ে নিবাস করতেন। আর এই কারণে ওনারা সবাই অমোঘবীর্য বা ঊর্ধ্বরেতা হতেন।
ব্যাকরণের অতি প্রাচীন আর প্রামাণিক গ্রন্থ মহাভাষ্যতে মহর্ষি পতঞ্জলি জী লিখেছেন -
অষ্টাশীতিসহস্রাণ্যূর্ধ্বরেতসামৃষীণাম্ বভূবুস্তত্রাগস্যাষ্টমৈর্ঋষিভিঃ প্রজনোऽভ্যুপগতঃ।।
(অ০ ৪ পা০ ১ সূ০ ৭৮)
৮৮ হাজার ঊর্ধ্বরেতা ঋষি হয়েছেন, ওনাদের মধ্যে অগস্ত্য প্রভৃতি আটজন ঋষি সন্ততি উৎপন্ন করেন।
আজও এমন কিছু বিচারশীল ব্যক্তি আছেন যারা এই বিষয়ের উপর অনুভব করেছেন যে যুবকদের স্বপ্নদোষ আদি বীর্য সম্বন্ধীয় রোগ কেবল প্রতিদিন এক ঘন্টা শুদ্ধ জলে সাঁতার কাটলে দূর হয়ে যায়। এইসব রোগের মধ্যে যখন ওষুধের দ্বারা লাভ হয় না তখন জলের মধ্যে সাঁতারের অভ্যাস অমূলক ওষুধের কাজ করে দেয়। এইজন্য ব্রহ্মচারীকে ব্রহ্মচর্যের সাধনা বা বীর্যরক্ষার জন্য আর স্বপ্নদোষ আদি বীর্য সম্বন্ধীয় রোগগ্রস্ত ব্যক্তিদের এই রোগ থেকে বাঁচার জন্য প্রতিদিন নদী আদিতে সাঁতারের অভ্যাস করা উচিত। যারদ্বারা তারা ঊর্ধ্বরেতা, অমোঘবীর্য বা স্থিরবীর্যকারী হতে পারবে। সাঁতারের মধ্যে একটা বিশেষ বিষয় হল এরদ্বারা ব্যায়াম আর স্নান দুটোই একসঙ্গে হয়ে যায়, এইজন্য খুব সহজেই ব্যায়াম আর স্নান দুটোর লাভ একই সঙ্গে হয়। সাঁতারের ব্যায়াম দ্বারা শরীরের অতিরিক্ত জলের স্পর্শে উষ্ণতা দূর হয় আর রোমকূপ স্বচ্ছ হয়ে শরীর শুদ্ধ, নির্মল আর পবিত্র হয়। আসলে স্নান করার জন্য নদী, সরোবর আদি জলাশয়ই হচ্ছে উপযুক্ত স্থান, যেখানে সাঁতার বা স্নান করার সময় ছোটাছুটি করা অথবা এই ধরণের অন্য জলক্রিয়া করার ফলে শরীর আর মন দুটোতেই স্বচ্ছতা, স্ফূর্তি আর উৎসাহ আদি সদ্ গুণের উৎপত্তি আর বৃদ্ধি হয়। সাঁতারের দ্বারা শরীরের সব স্নায়ু আর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের স্বয়ংই পর্যাপ্ত ব্যায়াম হয়ে যায়। নদীর প্রবাহিত জল ধারার পরস্পর সংঘর্ষে এক ধরণের বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় যা সাধারণ শারীরিক রোগকে শীঘ্র দূর করে আমাদের স্বাস্থ্যের উপর খুব ভালো প্রভাব ফেলে। সাঁতারের দ্বারা এমনিতে তো সব অবয়বের ব্যায়াম হয়ে যায় কিন্তু বুক আর ফুসফুসের বিশেষ লাভ হয়। সাঁতারের দ্বারা বুক চওড়া আর সম্পূর্ণ বক্ষঃস্থল পরিপুষ্ট বিস্তীর্ণ হয়, ফুসফুস অত্যন্ত শুদ্ধ আর বলবান হয়। সাঁতারুর সম্পূর্ণ শরীর নিরোগ, সুস্থ, সুন্দর, সুগঠিত, শক্তিশালী, স্ফূর্তিমান আর উৎসাহপূর্ণ হয়ে ওঠে। গভীর জলে প্রবেশ করে প্রাণায়ামপূর্বক ধীরে-ধীরে বল আর আয়ু বৃদ্ধির প্রবল ভাবনা মনের মধ্যে রেখে সাঁতার কাটলে বিশেষ লাভ হয়। জলের মধ্যে ডুব দেওয়ার ফলেও খুব ভালো ব্যায়াম হয়।
সাঁতার কাটাও হচ্ছে এক ধরণের বিদ্যা, তাই এটা প্রত্যেক মানুষকে শিখে নেওয়া উচিত। নিজের বা অন্যের প্রাণরক্ষার জন্য জীবনে এর আবশ্যকতা পড়ে। ডুবে যাওয়ার সময় আমাদের পুস্তক কাজে লাগে না। সাঁতার তেমন কোনো কঠিন কাজ নয়, একটুখানি চেষ্টা করলে ছোটো-ছোটো বালকও একে শিখে নেয়। যেসব গ্রাম বা নগরের নিকট নদী, সরোবর আদি জলাশয় আছে সেখানকার ছোটো-ছোটো বালকও সাঁতারে অত্যন্ত নিপুণ আর নিষ্ণাত হয়, তারা পরস্পরের দেখাদেখিতে না শিখিয়েই সাঁতার শিখে যায়।
তবে হ্যাঁ, সাঁতারুকেও সাবধান থাকা উচিত, নিজের শক্তির অতিরিক্ত সাঁতারের ব্যায়াম করার ফলে মানুষ অধিক ক্লান্ত হয়ে গভীর জলাশয় নদীতে ডুবে যেতে পারে, যারফলে প্রাণহানি হতে পারে। অত্যধিক মাত্রায় সাঁতার করার কারণে মানুষ উন্মাদ, অজ্ঞান, মৃগী আর পাগলামি হয়। আমাদের ঋষিরা "অত্যন্তম্ স্নানম্ বর্জয়" অতি মাত্রায় স্নানাদিকে নিষেধ করেছেন, তাই এক-দেড় ঘন্টার বেশি সাঁতারের ব্যায়ামও ভালো নয়। যখন সাঁতারের ভালো অভ্যাস হয়ে যাবে আর কোনো ধরণের কোনো সন্দেহ থাকবে না তখনই গভীর জলাশয়ে প্রবেশ করা উচিত। সাঁতারের ভালো অভ্যাস বিনা গভীর জলে প্রবেশ করলে প্রাণহানি হওয়ার ভয় থাকে।
পাশ্চাত্য দেশের মানুষও সাঁতারের গুরুত্বকে ভালো ভাবে জানে, সেখানে সাঁতারের জন্য ভারী উৎসাহ দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে ভালো সাঁতারু যুবক-যুবতীদের বড়-বড় উৎসবে পারিতোষিক দিয়ে সাঁতারের জন্য উৎসাহ বাড়ানো হয়। সেখানকার ডাক্তার আর শরীর-শাস্ত্রের বিদ্বানরাও নিম্ন প্রকারের সম্মতির দ্বারা সাঁতারের প্রচার করে -
"সাঁতারের দ্বারা মানুষের মধ্যে অদ্ভুত শক্তি উৎপন্ন হয়, জীবনের সঞ্চার হয়। শরীরের অঙ্গ আর প্রত্যঙ্গের মধ্যে নবীন জীবন প্রাপ্ত হয়। বল বাড়ে আর মানুষ অদ্ভুত স্বাস্থ্যের সঞ্চয় করে।"
এই ধরণের প্রচার দ্বারা সেইসব দেশের মধ্যে সাঁতারের গুরুত্ব বেড়ে গেছে আর সেখানকার স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে সাঁতারের প্রতি অনেক প্রেম হয়েছে। আমাদের দেশের মধ্যেও এইভাবে প্রচার করা উচিত, যাতে সাঁতারের ব্যায়াম দ্বারা আমাদের দেশবাসী বীর্যসম্বন্ধীয় রোগ থেকে নিবৃত্ত তথা ব্রহ্মচর্য রক্ষাতে সফলতা পেয়ে জীবনের আনন্দ নিতে পারে।
সাঁতারের সময় সবাইকে পবিত্রতার ধ্যান রাখা উচিত। নোংরা, দুর্গন্ধযুক্ত তথা বর্ষাকালের নবীন জলে স্নান করার ফলে মাথা ব্যথা তথা অনেক ধরণের দাদ আদি চর্মরোগ হয়। অতএব শুদ্ধ, পবিত্র, স্বচ্ছ নির্মল জলের জলাশয়ের মধ্যেই সাঁতারের ব্যায়াম করা উচিত। এই ধরণের শুদ্ধ জলের মধ্যে সাঁতার কাটলেই বিশেষ লাভ হতে পারে অন্যথা হানি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। অন্য ব্যায়ামের সমান সাঁতারের সময়ও ল্যাঙ্গোটের অতিরিক্ত অন্য বস্ত্র ধারণ করা উচিত নয়।

💠 ভ্রমণ বা বায়ুসেবন 💠

রোগী, নির্বল আর বৃদ্ধ মানুষের জন্য ভ্রমণ বা হাঁটাকেও ব্যায়াম বলা যেতে পারে। যে ব্যক্তি অলস, রোগাদির কারণে কোনো ব্যায়ামই করে না, ভ্রমণ দ্বারা তার কিছু না কিছু ব্যায়াম তো হয়েই যায়। কোমল প্রকৃতির বাবু, রোগী বা বড়-বড় পেটধারীরা ভ্রমণকে ব্যায়ামের স্থান দিতে পারে কিন্তু যদি কোনো ব্রহ্মচর্যের পথিক বা ব্রহ্মচারী ভ্রমণকেই ব্যায়াম মনে করে আর এরদ্বারাই ব্রহ্মচর্যের সাধনা করতে চায় তাহলে এটা তার বড় ভারী ভুল হবে। ভ্রমণের দ্বারা কেউ সাত জন্মেও ব্রহ্মচর্য পালনে সফলতা প্রাপ্ত করতে পারবে না। ব্রহ্মচর্য সাধনার জন্য তো শরীর আর মনকে ক্লান্ত করে এমন কঠোর ব্যায়ামের অত্যন্ত আবশ্যকতা হয়। তাছাড়া ভ্রমণ রোগী আদির জন্য উত্তম। ভ্রমণকারীকে নগর বা গ্রামের বাইরে এমন স্থানে ভ্রমণ করা উচিত যেখানকার বায়ু শুদ্ধ, শীতল আর স্বাস্থ্যপ্রদ হবে। ভ্রমণ বা বায়ুসেবনের জন্য সূর্যোদয়ের পূর্বে প্রাতঃকালের সময়ই উত্তম। শৌচ আদি হতে নিবৃত্ত হয়ে প্রতিদিন কিছু মাইল নিয়মিত ভ্রমণ করলে বা হাঁটলে স্বাস্থ্যের লাভ অবশ্যই হবে। ভ্রমণ করার সময় নাক দিয়ে লম্বা আর গভীর শ্বাস নিলে অধিক লাভ হয়।
🌱 মল্লখম্ভের ব্যায়াম 🌱
মল্লখম্ভের ব্যায়ামের প্রচার দক্ষিণ ভারতে অধিক হয়। মল্লখম্ভের ব্যায়াম দ্বারা শরীর খুব শীঘ্রই সুস্থ আর উন্নত হয়, শরীরে ব্যর্থ মেদ (চর্বি) বাড়ে না, শরীরের সব ছোটো-বড় জোড় বা অবয়ব সুদৃঢ় হয়। এরদ্বারা পেটের শিরাও খুব ভালো লাভ প্রাপ্ত করে, হাতের স্নায়ু সুদৃঢ় হয়, সারা শরীরের মধ্যে এক বিশেষ শক্তি আর স্ফূর্তি আসে, শরীর খুব সুন্দর, সুস্থ আর সুগঠিত হয়। মল্লখম্ভের উপর যে ব্যায়াম করা হয় তা এক প্রকারের আসনই হয়, এরদ্বারা আসনের সমানই শরীরের মধ্যে স্ফূর্তি, হালকা-ভাব আর আরোগ্যের বৃদ্ধি হয়। যারা মল্লখম্ভের ব্যায়াম করে তারা নিজের শরীরকে এত নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে যে তারা মল্লযুদ্ধে (কুস্তি) খুবই কম পরাজিত হয়। কারণ এই ব্যায়াম করার ফলে তারা মল্লবিদ্যাতে বড় নিপুণ হয়। এই ব্যায়ামের দ্বারা খুব শীঘ্র আর সঠিক ভাবে নিজের শরীর নিয়ন্ত্রণে আসে আর যার শরীর নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে সে মল্লখম্ভবিদ্যাতে দক্ষ হয়। মল্লখম্ভের ব্যায়াম কোনো শিক্ষকের কাছ থেকেই শিখে নেওয়া উচিত। বালকরা এটা খুব শীঘ্র শিখতে পারবে, বড় আয়ু বা বৃদ্ধাবস্থায় এটা শেখা খুবই কঠিন।
মল্লখম্ভ শিশুগাছের সরু আর দৃঢ় কাণ্ডের হওয়া উচিত। কোমরের সমান সেটা মোটা হতে হবে। মল্লখম্ভ মাটিতে গাড়ার পর সেটা ভূমি থেকে ৬-৭ ফুট উঁচু হতে হবে। মল্লখম্ভকে কোনো বৃক্ষ বা ঘরের ছায়াতেই গাড়া উচিত যাতে জল আর রোদ্দুরে তার কাঠের হানি না হয়। মল্লখম্ভের চতুর্দিকের মাটি ভালো হওয়া উচিত আর মল্লখম্ভকে কখনও-কখনও তেল লাগিয়ে তার কাঠকে মসৃণ করা উচিত। ১২ বছর আয়ুর বেশি যে কেউ এই ব্যায়াম করতে পারবে, সব অবস্থাতে এটা লাভদায়ক, তবে বৃদ্ধি অবস্থার যুবক ব্রহ্মচারী আর ব্রহ্মচারিণীদের জন্য এটা অত্যন্ত লাভদায়ক।
🌱 মগ্দরের ব্যায়াম 🌱
মগ্দরের ব্যায়াম খুবই প্রাচীন কাল থেকে অথবা বলা যেতে পারে আদি সৃষ্টি থেকেই চলে আসছে। এটা খুবই প্রাচীন ব্যায়াম, আমাদের সাহিত্যে এর অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়, এরদ্বারা এটাই প্রতিত হয় যে প্রাচীনকালে মগ্দরের ব্যায়াম অনেক উন্নত ছিল। কিন্তু আমরা নিজেদের অনেক বিদ্যা তথা কলার সমান ব্যায়াম সম্বন্ধীয় অনেক ধরণের আবশ্যক বিষয়কে ভুলে গেছি। তা সত্ত্বেও দেশের মধ্যে মগ্দরের ব্যায়াম সম্বন্ধীয় পর্যাপ্ত জ্ঞান আর আদরের ভাবনা দেখতে পাওয়া যায়। আখাড়াতে কুস্তিগীর প্রায় সবাই মগ্দরের ব্যায়াম করে, কিছু স্কুল কলেজের মধ্যেও এর কম-বেশি প্রচার দেখতে পাওয়া যায়। মগ্দরকে জোড়ীও বলে। মগ্দরে হাতের অনেক নিয়ম আছে, এটা যারা মগ্দর দিয়ে হাত ঘোরায় তাদের কাছ থেকে শিখে নেওয়া উচিত। একে লেখার দ্বারা শেখানো বা বোঝানো অসম্ভব না হলেও অত্যন্ত কঠিন অবশ্য।
মগ্দরের জোড়া না অধিক হালকা আর না অধিক ভারী হওয়া উচিত। শুরুতে তো অধিক ভারী মগ্দর হওয়া খুবই হানিকারক, নিজের শক্তির অনুসারেই ভার হওয়া উচিত। যখন পূর্ণ অভ্যাস হয়ে যাবে তখন ভারী ঘোরানো উচিত, কিন্তু সেটাও নিজের শক্তির অনুসারে। লম্বা মানুষের জন্য লম্বা আর ছোটো মানুষের জন্য ছোটো মগ্দর ভালো, এতে বিপরীত দিশাতে করলে আঘাত লাগার ভয় থাকে না। মগ্দরকে শক্ত করে ধরা উচিত, ধরার সময় হাতের আঙ্গুল তথা বাহু বাইরের দিকে রাখা উচিত। প্রথমে একটা মগ্দরকেই ডান আর বাম দুই হাত দিয়ে ঘোরানোর অভ্যাস করা উচিত। যখন ভালো ব্যায়াম হয়ে যাবে তখন এক সঙ্গে পৃথক-পৃথক মগ্দর দুই হাত দিয়ে ঘোরানো উচিত। মগ্দর ঘোরানোর সময় বুক ভিতরের দিকে থাকবে না, সম্মুখে উদিত আর বাইরে বেরিয়ে থাকবে। এমনিতে তো মগ্দর ব্যায়ামের দ্বারা শরীরের প্রত্যেক অঙ্গের ব্যায়াম হয়ে যায় আর সব অঙ্গে বল বাড়ে কিন্তু হাতের আঙ্গুল, পাঞ্জা, কনুই, কব্জির নিচের ভাগ, কাঁধ তথা পিঠের পিছনের মাংসপেশীর উপর অধিক বল পড়ে আর এগুলোর খুব ভালো ব্যায়াম হয় আর এইসব অঙ্গ সুদৃঢ় আর বলবান হয়। কনুই, ভুজদণ্ড আর হাতের মাংসপেশীকে সুদৃঢ়, সুন্দর আর সুগঠিত করে এমন মগ্দরের অতিরিক্ত অন্য কোনো ব্যায়াম নেই। কেবল মনোরঞ্জনের জন্যই নয়, শারীরিক উন্নতির জন্য মগ্দরের ব্যায়াম হল এক সুন্দর আর শ্রেষ্ঠ ব্যায়াম।
ডম্বলের ব্যায়ামকে মানুষ হাতের জন্য উত্তম মনে করে আর আজকাল মগ্দরের ব্যায়ামকে প্রায় ছেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু মগ্দরের সামনে ডম্বলের ব্যায়াম তো কিছুই না। তাছাড়া মগ্দর দ্বারা হাতের ব্যায়াম তো হয়েই যায়, কিন্তু আমার অনেক বছরের অনুভব যে একসঙ্গে ভুজদণ্ড আদি হাতের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে তথা বুক, ফুসফুস, মাথা, মেরুদন্ড আদি অন্য সব অঙ্গকে খুব শীঘ্রই সুস্থ, সুদৃঢ় আর সুগঠিত করে এমন মগ্দরের সমান দেশী আর বিদেশি ব্যায়ামের মধ্যে কোনো ব্যায়ামই নেই। ১৬ বছরের অধিক আয়ুর ব্রহ্মচারীকে মগ্দরের ব্যায়াম সায়ংকালে অন্য কঠিন ব্যায়ামের সমান প্রতিদিন করা উচিত।
🌱 লাফানো 🌱
লাফানোর ব্যায়ামও খুব ভালো। লাফানোর সময় হাত-পা ঢিলে রাখলে অনেক কম লাভ হয় তাই হাত-পা টানটান আর শক্ত রাখা উচিত। লাফানোর সময় প্রাণায়াম করলে অত্যন্ত লাভ হয়, এমনিতে তো লাফানোর ফলে সমস্ত অঙ্গের ব্যায়াম হয়ে যায় কিন্তু মুখ্য ভাবে পেট আর পা বিশেষ বল প্রাপ্ত করে। লাফানোর ফলে স্ফূর্তি আসে, আলস্য পালিয়ে যায় আর শরীরের প্রত্যেক অবয়বে রক্তের সঞ্চার হতে থাকে। দৌড়, লাফানো আদি ব্যায়ামের দ্বারা বড় আয়ুদের তো লাভ হয় তবে ১৪ বছরের আয়ু পর্যন্ত বালকের জন্য দৌড়ানো, লাফানো, খেলা আদি খুবই লাভদায়ক। ছোট বালকদের এমন ধরণের ব্যায়াম করানো উচিত যারমধ্যে দৌড়, লাফ অধিক আছে। ১২ বছরের ছোট আয়ুর বালকদের দিয়ে বুকডন, বৈঠক, মুগ্দর আর মল্লযুদ্ধ আদি কঠিন ব্যায়াম করানো উচিত নয়।
🌱 আসন 🌱
আসনের ব্যায়ামও স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এমনিতে তো আসন অনেক আছে তবে পাঁচ-সাতটা আসন যা ব্রহ্মচর্য তথা স্বাস্থ্য প্রেমীকে নিত্য-প্রতি করা উচিত, সেগুলোর বিষয়ে অতি সংক্ষেপে লিখে দিচ্ছি।
(১) শীর্ষাসন
এটা করার বিধি এই রকম - সবার আগে ভূমিতে আসন বিছিয়ে তার উপর কাপড়ের গোল বালিশ বানিয়ে রাখবে আর তার উপর মাথা রেখে দুই হাতের আঙ্গুলকে পরস্পর মিলিয়ে মাথাকে দুই দিক থেকে দৃঢ়তার সঙ্গে রাখবে। দুই পা মুড়ে মাথার সামনে নিয়ে আসবে, তারপর শরীরকে ধীরে-ধীরে উপরে উঠিয়ে মাথার উপর বল দিয়ে দাঁড়াবে। শরীর একদম সোজা থাকবে, পায়ের আঙ্গুল উপরের দিকে টানটান থাকবে আর চোখ খোলা থাকবে। হাঁটু ভাঁজ করা যাবে না, শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়া পূর্ববত্ চলতে থাকবে।
শীর্ষাসন করার পর কিছু সময় সোজা দাঁড়িয়ে থাকা উচিত। কিছু আসন অভ্যাসীদের মত হল যতক্ষণ পর্যন্ত শীর্ষাসন করবে ততক্ষণ পর্যন্ত সোজা দাঁড়িয়ে থাকলে বিশেষ লাভ হয়। সময়াভাবে অধিক বিলম্ব পর্যন্ত দাঁড়িয়ে না থাকতে পারলে অন্য দাঁড়িয়ে করার আসন করা উচিত।
শীর্ষাসন এক-দুই সেকেন্ড থেকে শুরু করা উচিত আর ধীরে-ধীরে নিজের শক্তি তথা ভোজনের অনুসারে এর সময় বাড়ানো উচিত। পনেরো-বিশ মিনিটের অভ্যাস হলে বীর্য সম্বন্ধীয় স্বপ্নদোষ, ধাতুক্ষয়, প্রমেহাদি বিকার দূর হয়ে বীর্যের ঊর্ধ্বগতি হয়, স্বাস্থ্য সুন্দর তথা মুখ লাল হয়, বুদ্ধি তথা নেত্রজ্যোতি বাড়ে, জঠরাগ্নি তীব্র হয়, বড় হওয়া প্লীহা আর যকৃৎ ঠিক হয়ে যায়, অর্শ, গুল্ম, উদাবর্ত, আধ্মান, অজীর্ণ, কোষ্ঠবদ্ধতা, বহুমূত্র প্রভৃতি উদররোগ তথা ব্রণ-ফোঁড়া, কুষ্ঠ, চুলকানি, পামা, পীনস আদি চর্মরোগেও লাভদায়ক হয়।
(২) হস্তপাদাঙ্গুষ্ঠাসন
দুই হাত কোমরে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াবে, এক পা ধীরে-ধীরে উপরে উঠাবে, পায়ের হাঁটু মুড়ে থাকবে না, যখন পা সম্মুখে আসবে তখন যেদিকের পা হবে সেইদিকের হাত দিয়ে পায়ের আঙ্গুলকে ধরবে, শ্বাস ভিতরে থাকবে। এইভাবে অন্য হাত তথা পা দিয়েও করবে। এই আসনকে চিত হয়ে শুয়েও করা যেতে পারে।
এই আসন করলে গ্রীবা, কোমর আর উদরের বিকার নষ্ট হয়, পায়ের গোলা, উরু আদির জন্য এটা লাভদায়ক।
(৩) সিদ্ধাসন
সমতল স্থানে বসে বাঁ পায়ের গোড়ালি গুদা আর অণ্ডকোষের মাঝখানের স্থানে রাখবে আর ডান পায়ের গোড়ালি মূত্রেন্দ্রিয়ের উপরে তথা আঙ্গুল বাঁ পায়ের উরুর উপর রাখবে। দুই পায়ের তলা মিলিয়ে থাকবে, থুতনি কিছু নিচের দিকে অথবা কণ্ঠমূলে লাগাবে, হাত হাঁটুর উপরে থাকবে, দৃষ্টি নাসিকার অগ্রভাগে স্থিত থাকবে, মেরুদণ্ড গ্রীবা আদি সব সমান রেখাতে সোজা রাখতে হবে।
এই আসন য়োগাভ্যাস ধ্যান আদির জন্য সর্বোত্তম, ব্রহ্মচর্য রক্ষাতেও পরম সহায়ক, সুতরাং এর অভ্যাস কম করে হলেও অন্ততঃ এক-দুই ঘন্টা তো অবশ্যই করা উচিত। এই আসনকে যেকোনো সময় যথা লেখাপড়া, ভোজন আদিতে করতে পারবে।
এই আসনের অভ্যাসের ফলে মন স্থির, জঠরাগ্নি দীপ্ত আর হৃদয় বলবান হয়, শ্বাস, কাশি, ডায়রিয়া, বহুমূত্র, স্বপ্নদোষ, প্রমেহাদি রোগ নষ্ট হয়, বিষয়বাসনা শান্ত হয়ে বীর্যের ঊর্দ্ধগতি হয়। এর সিদ্ধির দ্বারা ব্রহ্মচর্যেরও সিদ্ধি হয়, সুতরাং ব্রহ্মচারীকে ব্রহ্মচর্যের সিদ্ধি তথা বীর্যরক্ষার জন্য এর বিশেষ ভাবে অভ্যাস করা উচিত।
(৪) পশ্চিমোত্তানাসন
ভূমিতে বসে দুই পাকে সোজা করবে, সামনের দিকে একটু ঝুঁকে দুই হাত দিয়ে দুই পায়ের আঙ্গুলকে ধরবে আর তারসঙ্গে শ্বাসকে বাইরে বের করে পেটকে ভিতরের দিকে টানবে তথা মাথা হাঁটুর উপর রাখবে, সম্ভব হলে পায়ের মাঝখানে ভূমিতে রাখার চেষ্টা করবে। পা হাঁটু মুড়ে থাকবে না।
পেটের জন্য এই আসন সর্বোত্তম, এরদ্বারা জঠরাগ্নি প্রদীপ্ত হয়, পেট হালকা তথা কোমল হয়, পেটের নাড়ি মল রহিত হয়, চর্বি কমে পেট ছোট হয়, অজীর্ণতা, মন্দাগ্নি, মলাবরোধ, পেটব্যথা প্রভৃতি উদরবিকার সমূল নষ্ট হয়, যকৃৎ আর প্লীহা নির্দোষ হয়, কুঁজোভাব দূর হয়, কাঁধ আর আয়ুর বৃদ্ধি হয়।
(৫) সর্বাঙ্গাসন
সমভূমির উপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়বে আর তারপর দুই পা ধীরে-ধীরে উপরে তুলবে আর হাতকে কোমরে লাগিয়ে সাহারা নিয়ে এত সোজা করবে যেন কেবল কাঁধের ভাগই ভূমিতে থাকে। সম্পূর্ণ শরীর টানটান থাকবে আর শ্বাস ভিতরে থাকবে, থুতনি কণ্ঠমূলে লাগবে তথা দৃষ্টি পায়ের আঙ্গুলের উপর থাকবে।
এই আসন করলে যকৃৎ, প্লীহা, অগ্ন্যাশয়, অন্ত্র শুদ্ধ হয়ে জঠরাগ্নি তীব্র হয়, কোষ্ঠবদ্ধতা দূর হয়, কণ্ঠ রোগের জন্য লাভদায়ক হয়, মৃগী, আর্থ্রাইটিস তথা বীর্যরক্ষার জন্য উত্তম।
(৬) হলাসন
সর্বাঙ্গাসনের স্থিতিতেই দুই পা ধীরে-ধীরে মাথার পিছনে রাখবে, পা সোজা থাকবে আর হাতকে ভূমির উপর সোজা ছড়িয়ে দিবে তথা শ্বাসকে বাইরে বের করে দিবে।
এর লাভও সর্বাঙ্গাসনের সমান হয়। এটা করলে বিশেষভাবে অন্ত্র শক্তি প্রাপ্ত করে, কাঁধ বাড়ে আর এটা সায়াটিকা (sciatica) -র জন্য উত্তম।
(৭) ময়ূরাসন
এই আসন করতে হলে হাতের তালু পায়ের দিকে করে দৃঢ়তার সঙ্গে ভূমির উপর রাখবে, দুই হাতের তালুর মধ্যে এক ফুটের অধিক দূরত্ব রাখবে না। কনুইকে মিলিয়ে নাভিতে লাগিয়ে দুই পা উপরে তুলবে, দুই পা মিলিত তথা টানটান রাখতে হবে, মাথা উপরের দিকে উঠে থাকবে। ময়ূরের মতো সম্পূর্ণ শরীরের ভার পাঞ্জার উপর সুষম রাখতে হবে।
এই আসন করলে জঠরাগ্নি তীব্র হওয়ার কারণে পেটের রোগ হয় না, হাত দৃঢ় হয়, পেটের চর্বি কমে, সংগ্রহণী, ডায়রিয়া আদি অন্ত্র রোগের জন্য লাভদায়ক।
ইতি চতুর্থ ভাগ সমাপ্ত

🍁 (পঞ্চম ভাগ) 🍁

🌼 স্নান 🌼
মুখ তথা মুখ সম্বন্ধীয় অবয়বের শুদ্ধির পশ্চাৎ সম্পূর্ণ শরীরকে শুদ্ধ করার জন্য স্নান করা অত্যন্ত আবশ্যক। মানুষের শরীরের নাক, কান, চক্ষু আদি ইন্দ্রিয় তথা মল-মূত্র আদির দ্বারগুলো থেকে মল বের হয়। কারণ শরীরের ভিতরে প্রতিমুহূর্ত কার্য হতেই থাকে যারফলে মলও উৎপন্ন হতে থাকে আর শরীর স্বাভাবিক ভাবে ভিতরের মলকে সর্বদা বাইরে বের করতে থাকে। গুদা আদি মলদ্বার তথা চক্ষু আদি ইন্দ্রিয়ের অতিরিক্ত শরীরের অসংখ্য ত্বক-ছিদ্রের দ্বার থেকে প্রতিমুহূর্ত ঘাম আদি রূপে মল বের হতে থাকে। এই মল ঘামের সঙ্গে মিশ্রিত থাকে। ঘামের জল তো বাষ্প হয়ে উড়ে যায় কিন্তু মল ভাগ ত্বকের ছিদ্রে একত্রিত হয় আর ছিদ্রের মুখ বন্ধ করে দেয়। এর সবথেকে বড় প্রমাণ হল শরীরের সঙ্গে স্পর্শ করা বস্ত্র খুব শীঘ্র নোংরা হয়ে যায় আর সেটা থেকে দুর্গন্ধ আসতে থাকে। রক্তের বিকারের কারণে শরীর থেকে ঘাম সর্বদা বের হয়, যা বাষ্প হয়ে মানুষের শরীর থেকে সর্বদা প্রত্যেক ঋতুতেই বের হয়। গ্রীষ্ম তথা কঠিন শারীরিক পরিশ্রম করলে তো এত অধিক বের হয় যে এটা সবাই স্পষ্ট দেখতে পায় কিন্তু শীতকাল তথা সাধারণ অবস্থাতে এটা বাষ্পের রূপে বের হয় যা স্পষ্ট দেখা যায় না। আর যদি একে ঠিক ভাবে ধুয়ে ফেলা না হয় তাহলে কিছু সময়ের মধ্যেই ত্বকের উপর এর স্তর জমে একটা পাতলা ঝিল্লি হয়ে যায় আর লোমের ছিদ্র বা রোমকূপকে বন্ধ বন্ধ করে দেয়, রোমকূপ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে শরীরের ভিতরের নতুন মল বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে না আর সেটা ভিতরেই একত্রিত হয়ে অনেক রোগের উৎপত্তির কারণ হয়। এর অতিরিক্ত বাইরের ধুলো উড়ে এসে শরীরের ত্বকের উপরে পড়ে আর জমতে থাকে। অতঃ এই জমে থাকা মলকে দূর করতে তথা শরীরকে শুদ্ধ রাখার জন্য প্রত্যেক মানুষের জন্য স্নান করা অত্যন্ত অত্যাবশ্যক। স্নান করার ফলে শরীরের সব ছিদ্র খুলে যায় আর ছিদ্র দিয়ে মল বিসর্জনের ক্রিয়া ঠিক ভাবে হতে থাকে আর এটা স্বাস্থ্যের জন্য কতটা আবশ্যক তা পূর্বেই লেখা হয়েছে। এগুলো শুদ্ধ থাকাতে মানুষ এরফলে পর্যাপ্ত মাত্রায় বায়ু আর প্রকাশ গ্রহণ করে। শ্বাস কেবল নাসিকা দিয়েই নয়, বরং শরীরের অসংখ্য রোমকূপের মাধ্যমেও মানুষ শ্বাস নিয়ে থাকে। এইসব কাজ মল জমে যাওয়ার কারণে বন্ধ হয়ে যায় আর এইসব ছিদ্র বন্ধ হলে আমাদের নাক, মুখ খোলা থাকলেও আমাদের বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।
🌿 উদাহরণ
একবার এক বিজ্ঞাপনদাতা কোম্পানি তার প্রচারের জন্য একটা মানুষের সারা শরীরে ভালোভাবে বিজ্ঞাপন লাগিয়ে দেয় আর তাকে প্রাতঃকাল থেকে সায়ংকাল পর্যন্ত সারা শহরে ভ্রমণ করায়। সায়ংকালে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। চিকিৎসার্থ এক বৈদ্যকে ডেকে আনা হয়, সে খুব চতুর ছিল, সে দ্রুত সমস্ত বিজ্ঞাপন সরিয়ে দিয়ে তাকে ভালো করে স্নান করিয়ে তারপর উত্তম ভাবে তেল দিয়ে মালিশ করে। তখন তার চেতনা ফিরে আসে। এর মূর্ছিত হওয়ার কারণ ছিল কেবলমাত্র বিজ্ঞাপন সাঁটিয়ে দেওয়ার ফলে ত্বকছিদ্র বন্ধ হয়ে যাওয়া। যদি স্নান আদির দ্বারা তার বন্ধ হয়ে থাকা ত্বকছিদ্র না খোলা হতো তাহলে সে কিছু সময়ের মধ্যে মরে যেত। এই সত্যতাকে প্রকট করে এমন অনেক সত্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।
.
এইজন্য প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে প্রতিদিন স্নান করার নিয়ম চলে আসছে। আমাদের পূর্বজরা ভালো করেই জানতেন যে স্বাস্থ্য আর শরীর শুদ্ধির জন্য স্নান কতটা আবশ্যক। এইজন্য ঋষি-মহর্ষিগণ প্রত্যেক মানুষের দিনচর্যাতে একে আবশ্যক অঙ্গ বলেছেন। পৌরাণিক কালে তো স্নানকে স্বর্গপ্রাপ্তির সাধন বলে ধর্মের অঙ্গ বানিয়ে দেওয়া হয়। সেই অন্ধবিশ্বাসের কারণে আজও পুরোনো শৈলীতে হিন্দু স্ত্রী-পুরুষরা এই স্বর্গপ্রাপ্তির লোভে প্রতিবছর সম্পূর্ণ কার্তিক মাসে প্রায়শঃ খুব ঠাণ্ডা জল দিয়ে শ্রদ্ধাপূর্বক স্নান করে। তাদের কল্পিত স্বর্গের তো কোনো অস্তিত্ব নেই কিন্তু এর পিছনে এক মাস স্নান করার ফলে যে লাভ হয় সেটা তারা পেয়ে যায়, এইভাবে ভারতবর্ষের সব প্রান্তে প্রাতঃকালে স্নান করার চলন এখনও কম-বেশি দেখতে পাওয়া যায়। ইউরোপ, আমেরিকা আদি অন্য মহাদ্বীপ বা দেশে ভারতবর্ষের মতো করে মানুষ স্নান করে না। সেইসব দেশে এমন খুব অল্প ব্যক্তিই আছে যারা প্রতিদিন স্নান করার অভ্যাসী হয়। ভারতে যে এখনও এই ধরণের বিশেষত্ব পাওয়া যায়, তার কারণ হল ঋষিদের কৃপা। এই কারণেই ভারতীয় সভ্যতার ভক্তরা স্নানকে নিজের ধার্মিক কর্তব্য মনে করে প্রতিদিন শ্রদ্ধাপূর্বক করে। কোনো কারণে কোনো দিন স্নান করতে না পারলে নিজেকে পাপী মনে করে। প্রতিদিন স্নান করে নিজেকে যশ আর পুণ্যের ভাগী মনে করে। এই বিষয়ের উপর চিন্তন করলে এটা তো সত্য যে স্নান করলে পুণ্য তথা ধর্ম হয়, কিন্তু সেটা হয় কেবল পবিত্রতার। শরীরের শুদ্ধি আর পবিত্রতা শুধুমাত্র শুদ্ধ জল দিয়ে স্নানের দ্বারাই হয়। এইজন্য মনু জী মহারাজ লিখেছেন - "অদ্ভির্গাত্রাণি শুদ্ধ্যন্তি" (মনুঃ ৫/১০৯) অর্থাৎ জল দিয়ে শরীরের বাইরের সব অবয়ব শুদ্ধ আর পবিত্র হয়। মহর্ষি দয়ানন্দ জী মহারাজও সন্ধ্যা, উপাসনাদি নিত্য কর্মের মধ্যে স্নানকে প্রথম স্থান দিয়েছেন, তিনি তাঁর অমরগ্রন্থ সত্যার্থ প্রকাশের মধ্যে লিখেছেন -
"গায়ত্রী মন্ত্রের উপদেশ প্রদান করে স্নান, অচমন এবং প্রাণায়াম আদি সন্ধ্যোপাসনার ক্রিয়ার শিক্ষা দিবে। প্রথমে স্নান এইজন্য যে, যারদ্বারা শরীরের বাহ্য অবয়বের শুদ্ধি তথা আরোগ্যতা আদির লাভ হয়।" (সত্যার্থ প্রকাশ তৃতীয় সমুল্লাস)
.
মহর্ষি পতঞ্জলি জী মহারাজ তাঁর আয়ুর্বেদের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ চরক শাস্ত্রের মধ্যে লিখেছেন -

পবিত্রম্ বৃষ্যমায়ুষ্যম্ শ্রমস্বেদমলাপহম্।

শরীরবলসন্ধানম্ স্নানমোজস্করম্ পরম্।।

(চরক সংহিতা, সূত্রস্থান ৫/৯১)
অর্থাৎ স্নানের দ্বারা শরীর পবিত্র হয়। বীর্য আর আয়ু বৃদ্ধি হয়। স্নানের ফলে ক্লান্তি, ঘাম তথা মল দূর হয়। শারীরিক বল বৃদ্ধি তথা ওজের অত্যন্ত বৃদ্ধি হয়।
.
এইভাবে সুশ্রুতের মধ্যেও মহর্ষি ধন্বন্তরি জী লিখেছেন -

নিদ্রাদাহশ্রমহরম্ স্বেদকণ্ডূতৃষাপহম্।

হৃদ্যম্ মলহরম্ শ্রেষ্ঠম্ সর্বেন্দ্রিয়বিশোধনম্।।

তন্দ্রাপাপোশমনম্ তুষ্টিদম্ পুম্স্ত্ববর্দ্ধনম্।

রক্তপ্রসাদনম্ চাপি স্নানমগ্নেশ্চ দীপনম্।।

(সুশ্রুত চিকিৎসা ২৪/৫৭-৫৮)
নিদ্রা, জ্বলন, ক্লান্তি, ঘাম, খোসপাঁচড়া আর তৃষ্ণাকে স্নান নষ্ট করে। হৃদয়ের জন্য হিতকারী, মল দূর করে এমন সাধনের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। সব ইন্দ্রিয়ের শোধন (শুদ্ধি), ক্লান্তি দূর করে, স্নানের ফলে চিত্ত প্রসন্ন হয়। পুংসত্বশক্তির বৃদ্ধি অর্থাৎ পুরুষার্থ বাড়ে, রক্ত শুদ্ধ হয় আর জঠরাগ্নি প্রদীপ্ত হয়। অন্য অনেক গ্রন্থের মধ্যেও এইরকম ধরণের লাভ লেখা আছে। এক গ্রন্থকার উপরোক্ত লাভ লেখার সঙ্গে এমনও লিখেছেন যে -
প্রাতঃস্নানম্ দুঃস্বপ্নবিধ্বম্সনম্ রূপদ্যোতকরম্ শরীরসুখদম্।।
অর্থাৎ প্রাতঃ স্নান দুষ্টস্বপ্নের (স্বপ্নদোষ) সর্বনাশকারী হয়। সৌন্দর্য, কান্তি, তেজ দেয় আর শরীরের জন্য সুখদায়ক হয়।
এটা পূর্বেই সিদ্ধ করা হয়েছে যে মলিনতা যা হল রোগের ঘর, তাকে দূর করার জন্য স্নান হল সর্বোত্তম সাধন। বাহ্য শারীরিক মলিনতা যখন স্নান দ্বারা দূর হয়ে যায় তখন শরীর শুদ্ধ আর পবিত্র হয় যারফলে শরীরের সব রোমকূপ খুলে যায় আর শরীর থেকে প্রতিমুহূর্তে বেরিয়ে আসা দূষিত মল ঠিকভাবে ঘামের মাধ্যমে বিনা কোনো বাধায় নিষ্কাশিত হতে থাকে। এরফলে শরীর আর রক্ত অত্যন্ত শুদ্ধ হয় আর বাইরের শুদ্ধ বায়ু ছিদ্রের মাধ্যমে ভিতরের যেতে থাকে। এইভাবে শরীরের মল বা বিষ ঠিকভাবে নিষ্কাশিত হওয়ার ফলে তথা পর্যাপ্ত মাত্রায় শুদ্ধ বায়ু প্রাপ্তির কারণে রক্ত অত্যন্ত শুদ্ধ, বিকাররহিত আর শরীর নির্মল, পবিত্র, নিরোগ সুস্থ তথা সুন্দর হয়। প্রতিদিন স্নান না করার কারণে শরীর মলিন হয় আর ছিদ্র বন্ধ তথা বায়ুর নির্বাধ আবাগমন থেমে যায়, যারফলে চুলকানি, দাদ, ফোঁড়া, ফুঁসি আদি রক্ত বিকার আর এই ধরণের অনেক রোগগ্রস্থ হয়ে মানুষের অসংখ্য হানি হয় আর কষ্ট বহন করে। জানি না কেন মানুষ এত অলস আর মূর্খ হয় যে একটা পয়সাও ব্যয় হয় না যে স্নানের উপর অথচ সেই স্নানে অসংখ্য পরিমাণ লাভ আছে, তবুও এত লাভদায়ক কর্তব্যকে (কর্ম) নিত্য প্রতি করতে কষ্ট মনে করে আর অলসতা করে।
কেবলমাত্র স্নানের দ্বারাই বিশ প্রকারের রোগ থেকে মানুষের শরীর সুরক্ষিত থাকে আর মানুষ পূর্ণ সুস্থও হয়ে যায়। প্রাচীন ঋষিদের এই গুরুত্বপূর্ণ কথায় প্রভাবিত হয়ে জার্মানের প্রসিদ্ধ ডাক্তার লুই কোহনী স্নানের মাধ্যমে চিকিৎসা (bath system) নামক একটা পদ্ধতি চালিয়ে দেন আর এই বিষয়ের উপর একটা বেশ বড় গ্রন্থও লেখেন। যারমধ্যে প্রত্যেক রোগের চিকিৎসা ভিন্ন-ভিন্ন প্রকারের স্নানের মাধ্যমে করা লেখা আছে। আজ ইউরোপ আদি দেশের মধ্যে এর প্রচারও খুব হয়েছে। যেমন-যেমন ভাবে সময় যেতে থাকবে স্নানের গুরুত্বকে সংসার বুঝতে থাকবে আর বিজ্ঞানের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধীয় স্বাস্থ্য প্রদানকারী ঋষিদের এই বৈদিক পবিত্র স্নানের ক্রিয়াকে অবশ্যই গ্রহণ করবে, তখনই সব রোগ থেকে মানুষ মুক্ত হবে আর পূর্ণ সুস্থ আর সুখী হয়ে জীবনের আনন্দ পাবে। কারণ আমাদের পূর্বজ সাক্ষাৎকৃতধর্মা ঋষি-মহর্ষি পরমপিতা পরমাত্মার পরম পবিত্র কল্যাণকারী বেদজ্ঞানের মাধ্যমে সর্বদা পরিচিত ছিলেন। এইজন্য ওনারা কেবল নিজের উন্নতিতেই সন্তুষ্ট না থেকে প্রাণীমাত্রের উন্নতির জন্য বেদজ্ঞানের প্রচার দেশ-দেশান্তর আর দ্বীপ দ্বীপান্তরে করতেন। সংসারের উপকার করাই ওনাদের জীবনের ধ্যেয় বা মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল।
জলের সদুপয়োগ মানুষের জন্য কত কল্যাণকারী এই বিষয়ে স্নানের সময় পাঠ করা কিছু বেদমন্ত্রের দ্বারাই সেটা স্পষ্ট প্রকট হয়ে যায় -
🍁 বেদের মধ্যে শুদ্ধ জল বা স্নানের মহিমা 🍁

ও৩ম্ আপো হি ষ্ঠা ময়োভুবস্তা ন ঊর্জে দধাতন।

মহে রণায় চক্ষসে।। (ঋঃ ১০/৯/১)

(আপঃ) জল (হি) সত্য (ময়োভুব) সুখদায়ী (ষ্ঠা) হয়। (তাঃ) সেই জল (নঃ) আমাদের (ঊর্জে) জীবন বলের জন্য (মহে) মহান্ (রণায়-চক্ষসে) রমণীয় দর্শনের জন্য (দধাতন) ধারণ করুক।
অর্থাৎ - জলের সদুপয়োগ দ্বারা আমাদের সুখ, বল, ওজ, গুরুত্ব, কথাবলার শক্তি উৎপন্ন হয়।

ও৩ম্ য়ো বঃ শিবতমো রসস্তস্য ভাজয়তেহ নঃ।

উশতীরিব মাতরঃ।। (ঋঃ ১০/৯/২)

(বঃ) তোমার (য়ঃ) যে (শিবতমঃ) অত্যন্ত কল্যাণসাধক (রসঃ) রস আছে বা স্বাদ আছে (উশতীঃ মাতরঃ ইব) সন্তানের প্রতি স্নেহকারী মাতার সমান (ইহ) এই সময় বা এই লোকে (নঃ) আমাদের (তস্য) তার (ভাজয়ত) ভাগী করুন।
ভাবার্থ - জল হল পরমাত্মার অত্যন্ত কল্যাণকারী রস যা আমাদের স্নেহময়ী মাতার সমান প্রাণীমাত্রের পালন পোষণ তথা রক্ষা করে।
ঋগ্বেদের একটা মন্ত্রে "অপ্সু বিশ্বানি ভেষজা অগ্নিম্ চ বিশ্বশম্ভুবম্" লেখা আছে। যার অর্থ হল জলের মধ্যে ঔষধী আছে আর সংসারের কল্যাণকারক অগ্নি আছে।
.

ও৩ম্ আপঃ পৃণীত ভেষজম্ বরূথম্ তন্বে৩ মম।

জ্যোক্ চ সূর্য়ম্ দৃশে।। (ঋঃ ১/২৩/২১)

(আপঃ) জল (মম তন্বে) আমার শরীরের জন্য, বিস্তারের জন্য (চ) আর (জ্যোক্) আজীবন (সূর্য় দৃশে) সূর্য দর্শনের জন্য (বরূথম্+ভেষজম্) শ্রেষ্ঠ ঔষধ (পৃণীত) প্রভুর কৃপায় প্রাপ্ত হোক।
এই মন্ত্রের মধ্যে জলকে বিস্তার প্রদানকারী, দীর্ঘায়ু আর চিরকাল পর্যন্ত দেখার জন্য নেত্রজ্যোতি প্রদানকারক শ্রেষ্ঠ ঔষধ বলা হয়েছে।
🍁 স্নান (জল) হল পাপের বিনাশক 🍁

ও৩ম্ ইদমাপঃ প্র বহত য়ক্তিম্ চ দুরিতম্ ময়ি।

য়দ্বাহমভিদুদ্রোহ য়দ্বা শেপ উতানৃতম্।। (ঋঃ ১০/৯/৮)

(ময়ি) আমার মধ্যে (য়ত্ কিম্ চ) যা কিছু (দুরিতম্) দোষ (পাপ) আছে, (বা) অথবা (য়ত্) যা (অহম) আমি (অভি দুদ্রোহ) সৃষ্টি নিয়মের উলঙ্ঘন করেছি (বা) অথবা (য়ত্) যা (শেপে) অপশব্দ করেছি (উত) আর (অনৃতম্) মিথ্যা বলেছি (আপঃ) জলে শীতলতার আধানকারী ভগবান্ আমার (ইদম্) এইসমস্ত দুরিত বা দোষকে (প্রবহত) উত্তম প্রকারে ভাসিয়ে দিন।
ভাবার্থ - জল অনৃত ভাষণ, সৃষ্টি নিয়মের উলঙ্ঘন তথা এইরকম অন্য অনেক দোষকে (নিজের শীতলতা গুণের কারণে) দূরকারী হল।
এইভাবে বেদ ভগবান জলের মহিমার গীত গেয়েছে। অথর্ববেদের (১/৪/৪) মধ্যে "অপ্স্ব১ন্তরমৃতমপ্সু ভেষজম্" অর্থাৎ জলের মধ্যে অমৃত আর ঔষধ আছে, এমন বলা হয়েছে।
এইসব প্রমাণ দ্বারা এটাই সিদ্ধ হয় যে পরমপিতা পরমাত্মা জলের মধ্যে এক অদ্ভুত শক্তি পূর্ণ ভাবে ভরে দিয়েছেন যা প্রাণীদের তৃষ্ণা মেটায়, যারদ্বারা শরীরের মল ধুয়ে যায় আর যদি যুক্তিপূর্বক জলের সেবন (স্নানাদির দ্বারা) করা হয় তাহলে কোনো রোগ নিকটে আসে না। যদি ভুলবশতঃ কেউ নিয়ম বিরুদ্ধ আচরণ করে আর দুর্ভাগ্যবশতঃ রোগের রূপে প্রকৃতি আমাদের দণ্ড দেয় তাহলে এর থেকে বাঁচার উপায় হল জল। যারমধ্যে সব ওষুধ আছে। জল হল সুখের ভাণ্ডার, বল, ওজ, শীতলতা (শান্তি), শক্তি, পুষ্টি, মহত্তা, বক্তৃত্বশক্তি, নেত্রজ্যোতি আদির প্রদানকারী তথা সব রোগের একমাত্র ওষুধ। বেদের মধ্যে জলকে সংসারের সর্বশ্রেষ্ঠ কল্যাণকারী রস বলা হয়েছে আর মাতার সমান এর উপমা দেওয়া হয়েছে। "সন্তান মাতার নিকট হতে যেরূপ উপদেশ আর উপকার লাভ করে, অন্য কারও নিকট সেইরূপ লাভ করে না। মাতা সন্তানকে যেমন স্নেহ করে আর তার হিত কামনা করে, সেইরূপ অন্য কেউই করে না।" (সত্যার্থ প্রকাশ, দ্বিতীয় সমুল্লাস)
মহর্ষি দয়ানন্দ মাতার প্রশংসাতে উপরোক্ত শব্দ বলেছেন। এরদ্বারা এটাই সিদ্ধ হয় যে যেভাবে মাতা তার প্রাণের আহুতি দিয়ে নিজের সন্তানের রক্ষা আর হিত কামনা করে, সেইরূপ পরমাত্মার সর্বশ্রেষ্ট জলও তাঁর প্রিয় সন্তানদের (সব প্রাণী) রক্ষা আর হিতের জন্য পূর্ণ আহুতি দিয়ে দেয়। প্রাণীদের প্রাণ যেভাবে বায়ু হয়, সেইরূপ জলও বনস্পতি তথা সকল প্রাণীর জীবনের আধার হয়। জলের আবশ্যকতা হলে যদি জল না পাওয়া যায় সেইসময় তার মূল্যের পরিমাণ বোঝা যায়। জলের অভাবে খেত শুকিয়ে যায়। বন-জঙ্গল সারা সংসারই ব্যাকুল হয়ে ওঠে, সেই সময় স্মরণ হয় -
"য়ো বঃ শিবতমো রস উশতীরিব মাতরঃ", প্রভু আপনার এই রস (জল) সত্যিই কল্যাণকারী, যা আমাদের মাতার সমান রক্ষা করে।
সংস্কৃতে জলের নাম জীবন হওয়াটা জলের গুরুত্বকে প্রকট করে। জল বিনা জীবন অসম্ভব, এটা সিদ্ধ করার আবশ্যকতা নেই। মানুষের শরীরে প্রায় ৩/৪ ভাগ জল আছে। এইজন্য যেখানে জল আছে সেখানেই সর্বদা মানুষ বসবাস করে আসছে। এই সত্যকে প্রকট করার জন্য বেদ শাস্ত্রগুলো জলের মহিমার এত বর্ণনা করেছে।
.
জগদম্বা নিজের প্রিয় সন্তানদের (জীবাত্মা) কল্যাণের জন্য জলের মত শীতল, শান্তিদায়ক অমৃতরূপী পদার্থের রচনা করেছেন। কিন্তু আমরা হলাম তাঁর অভাগা কুপুত্র যারা এই অমৃত থেকেও দূরে পালিয়ে যাই। স্নানের কথা তো দূরে থাক আমাদের জলপানও ঠিক ভাবে হয় না। পর্যাপ্ত মাত্রায় জল না পাওয়াতে পাচন ক্রিয়া ঠিক হয় না। জলের সহায়তার কারণেই শরীরের মল ঘাম আর মূত্রের দ্বারা বাইরে বেরিয়ে আসে আর শরীর থেকে বেরিয়ে আসা আমাদের দেহ-মল জল দিয়ে স্নানের মাধ্যমে ধুয়ে শরীর আর মনকে শান্ত, পবিত্র আর নির্মল করে দেয়। মানুষের বল, শক্তি, তেজ, ক্রান্তি, রূপ আর সৌন্দর্য আদি গুণ শরীর শুদ্ধির দ্বারাই প্রাপ্ত হয়। শরীর শুদ্ধ হওয়ার ফলে আরোগ্য আর স্বাস্থ্যের বৃদ্ধি হয়, কারণ মলিনতাই হচ্ছে রোগের জননী। আর সুস্থ মানুষই যে দীর্ঘজীবী হয় এই প্রত্যক্ষকে সিদ্ধ করার জন্য প্রমাণের আবশ্যকতা নেই। শরীরের মলিনতার কারণে মনও মলিন হয়।
"নোংরা মন হল ব্রহ্মচর্যের পরম শত্রু। কাম রিপু মলিন মনের মধ্যে এসেই বাসা বাঁধে আর জেগে ওঠা কামবাসনা ব্রহ্মচর্যরূপী ভবনের মূলকে খোখলা করে দেয়।"
কামবাসনাকে শান্ত করার জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ সাধন হল শীতল জল দিয়ে স্নান। এই অনুভব সিদ্ধ আর এটা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত। কেবল জাগ্রত অবস্থা়ই নয় স্বপ্ন অবস্থাতেও বিরক্তকারী দুঃস্বপ্ন বা কাম বিকারকেও শীতল জল দিয়ে স্নান শমন করে দেয়।
য়োগী য়াজ্ঞবল্ক্য জী এই সত্যকে এইভাবে প্রকট করেছেন -
গুণাঃ সদা স্নানপরস্য সাধোঃ,
রূপম্চ তেজস্ব বলঞ্চ শৌচম্।।
আয়ুষ্যমারোগ্যমলোলুপত্বম্,
দুঃস্বপ্ননাশঞ্চ য়শশ্চ মেধাম্।।
হে সজ্জনগণ! নিত্য স্নান করা ব্যক্তি রূপ, তেজ, বল, পবিত্রতা, আয়ুষ্য, আরোগ্যতা, অলোলুপতা, দুঃস্বপ্ন না আসা, যশ আর মেধাদি গুণ প্রাপ্ত করে।
উপরে লেখা প্রমাণ দ্বারা সিদ্ধ হয় যে স্নান সবার জন্য অত্যন্ত লাভদায়ক তাই এটা প্রতিদিন করা আবশ্যক।
ব্রহ্মচর্যের জন্য বিধিপূর্বক স্নান করা অমৃত পানের সমান। বেদের কোষ নিঘণ্টুতে উদক (জল) -এরজন্য একশ নাম আছে। এরমধ্যে "রেতঃ শুক্রম্" যা সব ধাতুর সার বীর্যেরই নাম লেখা আছে, এটা নিঘণ্টুতে পড়েছি। এটাও জলের নাম। এইরূপ জলের নাম অমৃতও লেখা আছে। এরদ্বারা এটাই সিদ্ধ হয় যে - "যদি ব্রহ্মচারী স্নানাদির দ্বারা জলের উচিত প্রয়োগ করে তাহলে জল বীর্যরক্ষাতে অমৃতের সমান সহায়ক হয় আর এটা ব্রহ্মচারীকে শুক্র (বীর্য) দ্বারা পুরিত করে ঊর্ধ্বরেতা, ওজস্বী, তেজস্বী বানিয়ে দেয়।"
জলের বিশেষত্ব প্রকট করে এমন আরও অনেক নাম যেমন "সর্পিঃ, ঘৃতম্ ক্ষীরম্, অন্নম্ ভেষজম্, পবিত্রম্, শুভম্, মহায়শঃ, স্বঃ" আদি নামও সেখানে লেখা আছে। যারদ্বারা বোঝা যায় যে জলের সদুপয়োগ দুধ, ঘীয়ের সমান হৃষ্ট-পুষ্টকারী হয়, অন্নের সমান জীবনের আধার তথা (অন্নের উপাদানে মুখ্য হেতু) সর্বরোগ নাশক ওষুধ হয়। এইজন্য একে আরোগ্য আর স্বাস্থ্য প্রদান করে শুদ্ধ, পবিত্রকারী বলা হয়েছে। এটা মানুষকে কল্যাণ মার্গের পথিক বানিয়ে মহান্ আর যশস্বী বানিয়ে তোলে। তবেই মানুষ অন্তিমে স্বঃ = স্বর্গলোকের প্রাপ্ত করে আর মোক্ষ পদ পায়। এইজন্য ব্রহ্মচারীকে জলকে তুচ্ছ বস্তু ভেবে এর উপেক্ষা করা উচিত নয়। ব্রহ্মচর্য পালনে যে বিঘ্ন আর বাঁধা আসে, স্নান সেইসবকে বধ (সর্বনাশ) করে বীর্যরক্ষাতে উত্তম মিত্রের সমান সহায়তা করে। কিন্তু এই লাভ কেবল শাস্ত্রীয় বিধি অনুসারে স্নান করার ফলেই হয়।

স্নানের শাস্ত্রীয় বিধি 

মানুষ প্রায়শঃ স্নান করার সময় খুব শীঘ্রতা করে। স্নানের সময় ঠাণ্ডা, গরম, নোংরা বা স্বচ্ছ যেমন জল পায়, সেটাই ঝটপট শরীরের উপর দুই-চার মগ ঢেলে দেয়। সারা শরীর ভিজেছে নাকি শুকিয়ে আছে সেদিকেও ধ্যান রাখে না। স্নানের সময় শরীর ঘষার জন্য হাত লাগাতেও এদের কষ্ট হয়। মূর্খরা এমন সব লোকোক্তিও বানিয়ে রেখেছে যে - "স্ত্রীদের স্নান আর পুরুষদের খাবার খুব শীঘ্র হওয়া উচিত।"
তাছাড়া এইরূপ স্নান করেও কি কোনো লাভ হতে পারে? এটা তো কেবল নামেরই স্নান হবে আর এতে লাভের স্থানে হানিই হবে। সারা শরীরই যদি না ভিজে তাহলে শরীরের নোংরা কিভাবে দূর হবে বরং একটুখানি জল ঢালার ফলে শরীরের ভিতরে যে ঊষ্ণতা আছে সেটা উপরে চলে আসবে আর সেটা শান্ত না হওয়ার কারণে হানি আর কষ্ট হবে। এইজন্য যতক্ষণ পর্যন্ত স্নানের দ্বারা শরীর শীতল আর শান্ত না হবে আর তাতে লেগে থাকা মল তথা বিষ পুরোপুরি ভাবে ধুয়ে না যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত সেটার নাম স্নান রাখলে সেটা স্নানের তিরস্কারই করা হবে। এইজন্য সব ঋতুতে পর্যাপ্ত পরিমাণ শুদ্ধ শীতল জল দিয়ে পর্যাপ্ত সময় পর্যন্ত ব্রহ্মচারীকে প্রতিদিন ঘষে-ঘষে অর্থাৎ ঘর্ষণ স্নান করা উচিত। তবেই শরীরের সব মল দূর হয়ে শুদ্ধ শীতল আর শান্ত হবে। শীত ঋতুর তুলনায় উষ্ণ ঋতুতে অধিক সময় পর্যন্ত স্নান করা উচিত। উষ্ণকালে তো প্রত্যেক স্ত্রী-পুরুষের জন্য দুই সময়ের স্নান অত্যন্ত আবশ্যক আর খুবই লাভদায়ক কিন্তু ব্রহ্মচারীকে তো সব ঋতুতে দুই সময় স্নান করা ভোজনের থেকেও অধিক আবশ্যক জেনে রাখা উচিত। অনেক ব্রহ্মচর্য প্রেমী তো রাতে শুতে যাওয়ার পূর্বেও স্নান করে। এরফলে তাদের খুবই বড় লাভ হয় যে নিদ্রাকালে ব্রহ্মচর্যের পরম শত্রু স্বপ্নদোষ বিরক্ত করে না।
"স্বপ্নদোষের রোগী তা সে গৃহস্থী হোক বা ব্রহ্মচারী সায়ংকালে অবশ্যই স্নান করা উচিত।"
যার স্বপ্নদোষ আছে তার জন্য দুই সময় স্নান অথবা তৃতীয়বার স্নানও খুব লাভদায়ক হয়। এরফলে স্বপ্নদোষের সংখ্যা অবশ্যই কমে যাবে আর কারও-কারও এই রোগ বা ব্যাধি স্নানের দ্বারাই সেরে যায়। যে সৌভাগ্যশালী স্ত্রী ও পুরুষের এই মহারোগ নেই তারাও ভবিষ্যতে দুই সময়ের স্নানের কারণে সর্বদা নিশ্চিন্ত আর সুরক্ষিত থাকে।
"সায়ং আর প্রাতঃ কালের স্নান হল স্বপ্নদোষের অস্ত্রের প্রহারকে থামানোর একটা ঢাল।"
সব ঋতুতে কেবল ব্রহ্মচারীই নয় বরং শিশু থেকে বৃদ্ধ সব নর-নারীকে গৃহস্থ, বানপ্রস্থ বা সন্ন্যাসী সব বর্ণাশ্রমীকে সর্বদা শীতল জল দিয়ে স্নান করা উচিত। উষ্ণ জলের প্রয়োগ তো ব্রহ্মচারীদের জন্য অত্যন্ত হানিকারক। উষ্ণ জল ব্রহ্মচর্য আর স্বাস্থ্যের সর্বনাশ করে। এটা পড়ে আমার খুবই দুঃখ আর আশ্চর্য হয় যে কিছু ব্রহ্মচর্যের পুস্তকের লেখকরা শীতকালে উষ্ণজল দিয়ে স্নান করার বিকল্প করে দিয়েছে। কেউ-কেউ তো খোলা আজ্ঞা দিয়েছে। আমার মতে তারা ভারী পাপ করেছে।
"উষ্ণ জল দিয়ে স্নান করা মানেই বীর্যনাশের নিমন্ত্রণ দেওয়া।"
ব্রহ্মচারী বা ব্রহ্মচর্য প্রেমীকে কখনও ভুলেও উষ্ণ জল দিয়ে স্নান করা উচিত নয়। শীতল জল দিয়ে স্নান যেমন ব্রহ্মচর্যের জন্য পীয়ূষপান হয় তেমনই সকলের জন্য তথা সবদিক থেকে স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত লাভদায়ক হয়। শীতল জল দিয়ে স্নান করলে যেমন শরীরের ভিতরে থাকা ব্যর্থ উষ্ণতা বাইরে বেরিয়ে আসে আর শরীর শান্ত হয়ে যায়, তেমনই বাইরের উষ্ণতা চাপে পড়ে ভিতরে চলে যায়। এই কারণে মানুষের জঠরাগ্নি প্রদীপ্ত আর প্রবল হয়। এটা সবার অনুভবের কথা যে খিদে যতই কম হোক না কেন তবে স্নানের পশ্চাৎ সেটা অবশ্যই বেড়ে যায়।
আমাদের এখনকার লোকোক্তিটাও প্রসিদ্ধ। "ব্রাহ্মণ নাহায়া অউর গজব আয়া!" ব্রাহ্মণ অধ্যয়ন অধ্যাপন, য়জন য়াজন তথা উপদেশ আদির কাজ বসে-বসেই করে, এইসব কাজ মস্তিষ্কেরই হয়। এইজন্য ব্রাহ্মণকে অন্য বর্ণের তুলনায় শারীরিক শ্রম অনেক কম করতে হয়, আর তাই তার খিদেও কম পায়। কিন্তু শীতল জল দিয়ে স্নানের কারণে সেও খিদের কষ্টের অনুভব করে। এই লোকোক্তির অভিপ্রায় হল এটাই। এইজন্য মহর্ষি ধন্বন্তরি জী "স্নানমগ্নেশ্চ দীপনম্" এমনটা বলেছেন। অর্থাৎ অন্য লাভের অতিরিক্ত স্নান জঠরাগ্নিকে দীপ্ত করে, অর্থাৎ খিদেকে জাগিয়ে তোলে। ভারতবর্ষের মতো উষ্ণ দেশবাসীর জন্য তো শীতল জল দিয়ে স্নান লাভদায়ক হয়ই কিন্তু শীতপ্রধান পাশ্চাত্য দেশের জন্যও শীতল জল দিয়ে স্নান লাভদায়ক হয়। সেখানকার ব্যক্তিরাও এর উপযোগিতা বুঝতে শুরু করেছে।
ইউরোপের এক ডাক্তার নিকোল্স লিখেছেন - শীতল জলের জন্য ভয় করা উচিত নয়। আমি শীতল বায়ু লাগার কারণে মানুষকে রোগী হতে দেখেছি কিন্তু শীতল জল দিয়ে স্নান করার কারণে কাউকে রোগী হতে দেখিনি। আমি চল্লিশ বছর ধরে নিরন্তর শীতল জল দিয়ে স্নান করে আসছি। যখন বায়ুর শীতলতা থার্মমিটারে শূন্য ডিগ্রীর থেকেও ১০ ডিগ্রী নিচে হয়েছিল আর জলের এক-একটা ফোঁটা মেজের উপর পড়ামাত্র জমে বরফ হয়ে যেত, সেই সময়ও আমি শীতল জল দিয়ে স্নান করেছি। শীতল জল থেকে আমি তো সর্বদা বল আর আরোগ্যতাই প্রাপ্ত করেছি।"
ইউরোপ আর আমেরিকার মতো শীতপ্রধান দেশের নিবাসী যখন শীতল জলের স্নানকে এত লাভদায়ক আর গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে, তখন ভারতের মতো উষ্ণ জলবায়ুর দেশে শীতল জল দিয়ে স্নান করার লাভ আর গুরুত্বকে সবাই খুব সহজেই বুঝতে পারে।
শীতল জল দিয়ে স্নানের ফলে মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক পবিত্রতা আর উচ্চ বিচারের জাগৃতি হয়। কুৎসিত বা নোংরা বিচারের সর্বনাশ হয়। কারণ শীতল জলের স্নান শুধু শরীরকেই নয়, মনকেও শুদ্ধ, পবিত্র আর শান্ত করে, যার প্রভাব অন্তঃকরণ চতুষ্টয় আর আত্মার উপরও পড়ে। এইভাবে স্নান বাহ্য আর অভ্যন্তর উভয় প্রকারের শুদ্ধি করে, যা ব্রহ্মচর্যের জন্য অত্যন্ত আবশ্যক। এইজন্য মহর্ষি ধন্বন্তরি জী - "পাপোপশমনম্ স্নানম্", অর্থাৎ শীতল জলের স্নান পাপের উপশমন (সর্বনাশ) করে এমন লিখেছেন। যখন কামবিকার কোনো যুবককে খুব বিরক্ত করে আর কোনো ভাবেই সেটা শান্ত হয় না তো এমন সময় শীতল জল দিয়ে স্নান রামবাণের সমান কাজ করে। মাথায় শীতল জল পর্যাপ্ত মাত্রায় দেওয়া উচিত যাতে মাথাও একদম শীতল হয়ে যায়। এরফলে মস্তিষ্কের উষ্ণতা দূর হয়ে মন আর শরীরও শুদ্ধ, পবিত্র আর শান্ত হয় আর কামাগ্নি বা পাপের ভাবনা পালিয়ে যায়। কারণ মলিন শরীরে মলিন মন আর মলিন মনে কামবিকার (পাপ) নিবাস করে। এই কথা স্নান করার সময় সবাইকে সর্বদা ধ্যানে রাখা উচিত যে যখন স্নান করতে বসবে তো সর্বপ্রথম মাথার উপরই জল ঢালবে আর সেটা ভিজিয়ে খুব ঠাণ্ডা করে নিবে। কখনও ভুলেও আগে পায়ে বা শরীরের নিচের ভাগে স্নান করার সময় জল ঢালবে না, নয়তো নিচের সব উষ্ণতা মাথায় চড়ে মস্তিষ্ক, স্মরণশক্তি আর নেত্রজ্যোতির খুব হানি করবে আর এতে কাম-বিকার জাগৃত হয়ে প্রবল হবে তথা মন আর স্বাস্থ দুটোর উপরই দুষ্প্রভাব পড়বে। এইজন্য স্নান করার সময় সর্বপ্রথম মাথাকে ভিজিয়ে নিবে আর উত্তম ভাবে ধুয়ে নিবে। এই ছোট্ট ভুলের কারণে অজ্ঞানবশত মানুষ অনেক প্রকারের হানি বহন করে আর করছে। তাছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যেও একথা প্রচলিত যে মাথা সর্বদা শীতল (ঠাণ্ডা) আর পা উষ্ণ রাখা উচিত কিন্তু স্নান করার সময় এই স্বাস্থ্যের রহস্যকে সবাই ভুলে যায়। ব্রিটিশ ভাষাতেও এই লোকোক্তিটা এইভাবে আছে -
"Keep the head cool and the feet warm"
অর্থাৎ মাথা ঠান্ডা আর পা গরম রাখবে। যদি পা আর শরীরের নিচের অঙ্গকে স্নানের সময় আগে ভেজানো হয় বা ধোয়া হয় আর তারপর মাথা আর উপরের অঙ্গকে ভেজানো তথা ধোয়া হয় তাহলে স্নানের যে উদ্দ্যেশ্য ছিল শরীর শুদ্ধির সেটাও সঠিকভাবে হবে না। কারণ মাথা অন্য অঙ্গকে নোংরা করে দেয়, যারফলে পুনঃ ধুয়ে নিতে হয়, এইজন্য মাথা ভিজিয়ে মুখ আদি নিচের অঙ্গকে ক্রমশঃ ভিজাবে আর ডলে-ডলে ঠিকভাবে ধুয়ে নিবে। শরীরের প্রত্যেক অঙ্গকে হাত দিয়ে খুব ডলে-ডলে শুদ্ধ করবে, তারসঙ্গে শরীরে ইচ্ছানুসারে জলও ঢালতে থাকবে, কারণ বিনা ডলে বা ঘষে শরীরের উপর জল ঢাললে নোংরা দূর হয় না। তবে চোখ, মূত্রেন্দ্রিয় আদি কোমল অঙ্গকে সাবধানে শুদ্ধ করা উচিত, তা না হলে হানির সম্ভাবনা থাকে। স্নান করার সময় হাত দিয়ে ডলার ফলে শরীরের মধ্যে যে উষ্ণতা বা বিদ্যুতের মতো উৎপন্ন হয় তার ফলে শরীরের মধ্যে উৎসাহ, স্ফূর্তি, সাহস, বল, তেজ আর কান্তির বৃদ্ধি হয় আর সমস্ত শারীরিক রোগের নিবৃত্তি হয়। এইজন্য শরীরের প্রত্যেক অবয়বকে ভালো করে ডলা বা ঘষা উচিত। এরফলে স্নানের সঙ্গে ব্যায়ামও হয়ে যায়। আর যে অঙ্গ বা স্থানে ঘষা হয় না সেটা নির্বল আর রোগী হয়। স্নানের সময় পেটে খুব ঘর্ষণ করা উচিত যারফলে প্রায় সব উদর বিকার সমাপ্ত হয়ে যায়। অপানবাযু বেরিয়ে যাওয়ার কারণে পেট অত্যন্ত কোমল হয়, শৌচও সঠিকভাবে খুলে আসে আর মানুষের সারা শরীর সুন্দর, সুস্থ আর তেজস্বী হয়। এইভাবে ঘর্ষণ স্নানে অর্থাৎ ডলে-ডলে স্নানের কারণে মানুষ সারাদিন প্রসন্ন আর আনন্দে মগ্ন থাকে। যারা স্নান করে না অথবা বিনা ঘষে স্নান করে তারা স্নানের পুরো লাভ পায় না, আর এমন লোকই সদা মলিন, অলস, বিষয়ী, রোগী, দুঃখী, নিরুৎসাহী তথা নিস্তেজ হয়। ব্রহ্মচর্য পালনে এরা সফলতা প্রাপ্ত করে না তাই অল্পায়ুতেই মৃত্যুর গ্রাস হয়ে যায়। দীর্ঘ-জীবন আর আনন্দের প্রাপ্তি এদের ভাগ্যে জোটে না। ব্রহ্মচারীকে স্নান করার সময় আরও একটা কথা ধ্যানে রাখা উচিত যে যখন মাথাকে শীতল জল দিয়ে ধুয়ে শুদ্ধ করবে, তারপর নাভির নিচে পর্যাপ্ত শীতল জলের ধারা দিয়ে মূত্রেন্দ্রিয় তথা তার আশেপাশের স্থানকে শুদ্ধ করে নিবে, মূত্রেন্দ্রিয়কে হাত দিয়ে ঘষবে না, এরফলে হানি হতে পারে। এই স্থানের শুদ্ধি আবশ্যক, স্নান করার সময় আমরা অন্য সব অঙ্গকে তো শুদ্ধ করি কিন্তু মূত্রেন্দ্রিয়কে লজ্জা বা প্রমাদের কারণে ছেড়ে দিই। এটা খুবই কোমল অঙ্গ, এর শুদ্ধির বিশেষ ধ্যান রাখা উচিত। একে তথা অণ্ডকোষকে তথা আশেপাশের স্থানকে প্রতিদিন স্নানের সময় শুদ্ধ করা আবশ্যক। এগুলো শুদ্ধি না করার কারণে দাদ, চুলকানি, স্বপ্নদোষ আদি রোগ উৎপন্ন হয়। কিন্তু নাভির নিচে জল ঢাললে তথা মূত্রেন্দ্রিয়ের শুদ্ধি স্নানের কারণে ব্রহ্মচর্য পালনে খুব সহায়তা পাওয়া যায়। স্নানের সময় যদি মূত্রেন্দ্রিয়ের স্নানেরও সুবিধা হয় তো প্রতিদিন অবশ্যই করা উচিত। যার বিধি আর লাভ পূর্বে লিখে দেওয়া হয়েছে। এরফলে কাম-বিকার শান্ত হয় আর কেবল মাত্র এই ক্রিয়া করাতেই অনেক রোগীর স্বপ্নদোষ আর ধাতু প্রমেহ দূর হয়ে যায়। ১৬ বছরের আয়ুতে মূত্রেন্দ্রিয়ের আশেপাশে কেশ উৎপন্ন হয়, সেগুলোকেও মাসে দুইবার কেঁচি দিয়ে কেটে ফেলা উচিত তা নাহলে হানির সম্ভাবনা থাকে। এই স্থানের শুদ্ধিতে এটা বাধক। আজকাল ফ্যাশনের পাগলামীতে মানুষ বড়-বড় চুল রাখে। এরফলে মাথায় ধুলো আদি নোংরা জমে যায় আর মাথার স্নান সঠিকভাবে হয় না। এমন লোকের মাথায় নোংরা জমা হয়েই থাকে। মাথাই যদি শুদ্ধ না হয় তাহলে সেটা কেমন স্নান হবে? এইজন্য বলা হয়েছে - "ন চ স্নায়াদ্ বিনা শিরঃ" অর্থাৎ বিনা মাথার স্নান বা মাথা না ভিজিয়ে স্নান করা কখনও উচিত নয়।"
এইজন্য মাথার স্নান সর্বপ্রথম আর অবশ্যই করা উচিত। আর কেশ হচ্ছে এই স্থানের বাধক। ভারতের মতো উষ্ণপ্রদেশ আর বিশেষ করে উষ্ণকালে কেশ অত্যন্ত হানিকারক হয়, এর কারণে মস্তিষ্কের বুদ্ধি তথা চোখ খারাপ হয়ে যায়। এইজন্য মাথার কেশ সর্বদা কেটে রাখবে যাতে স্নানের লাভ শরীর তথা নেত্র পূর্ণ ভাবে প্রাপ্ত করতে পারে। কিছু ব্যক্তি কেশ তথা শরীরকে শুদ্ধ করার জন্য সাবান মেখে উষ্ণ জল দিয়ে স্নান করে। পূর্বে লিখে দেওয়া হয়েছে যে উষ্ণ জল ব্রহ্মচর্যের দৃষ্টিতে অত্যন্ত হানিকারক, এর অতিরিক্ত উষ্ণ জল দিয়ে স্নান তো আরও অধিক হানিকারক হয়। মাথায় উষ্ণ জল ঢালার বিষয়ে সুশ্রুতে মহর্ষি ধন্বন্তরি জী লিখেছেন -

"উষ্ণেন শিরসঃ স্নানমহিতম্ চক্ষুষঃ সদা।"

অর্থাৎ উষ্ণ জল মাথায় ঢেলে স্নান করা চোখের জন্য খুবই হানিকারক। আর শীতল জলের বিষয়ে তিনি লিখেছেন -
"শীতেন শিরসঃ স্নানম্ চক্ষুষ্যমিতি নির্দিশে"
অর্থাৎ শীতল জল মাথায় ঢেলে স্নান করলে সেটা চোখের জন্য লাভদায়ক।
এক বৈদ্য একটা স্থানে লিখেছেন - "শীতল জল দিয়ে স্নান উষ্ণবাত, সোজাক, মৃগী, উন্মাদ, রক্তপিত্ত, স্বপ্নদোষ, প্রমেহ আর অচেতনতা আদি রোগের জন্য খুব উপকারী হয়।"
আজকাল যেহেতু ধাতুক্ষীণতার কারণে ৯০ শতাংশ মানুষের প্রকৃতি বা স্বভাব উষ্ণ থাকে, এই দৃষ্টিতেও সবাইকে শীতল জল দিয়ে স্নান লাভদায়ক হবে। সন্দেহ হয় যে রোগীরাও কি উষ্ণ জল দিয়ে স্নান করবে না? প্রথম তো ব্রহ্মচারী রোগী হয় না। যদি ভুল বশতঃ হয়েও যায় আর স্নান করার ইচ্ছা হয় তাহলে তাকে শীতল জল দিয়েই স্নান করা উচিত। রুগ্ন অবস্থায় যারা ভোজন করতে ভয় করে না, জানি না তারা স্নানের নাম শুনে কেন ভয় পায়? আর রোগী তো দীন দয়ার পাত্রই হয়, এইজন্য মনু জী মহারাজ লিখেছেন "নাতুরঃ স্নানমাচরেত্ (মনুঃ ৪/১২৯) রোগী স্নান করবে না। এই আজ্ঞা দিয়ে রোগীর উপর দয়া দৃষ্টি করেছেন। দুর্ভাগ্যবশত যদি রুগ্ন অবস্থাতে কাউকে উষ্ণ জল দিয়ে স্নান করতই হয় তাহলে মাথা, মূত্রেন্দ্রিয়ের উপরে তো শীতল জলই ঢালা উচিত। এই দুই স্থানে কখনও ভুলেও উষ্ণ জলের প্রয়োগ করা উচিত নয়। এর হানিগুলো পূর্বেই বলে দেওয়া হয়েছে।

স্নানের স্থান 

স্নান করার জন্য সর্বোত্তম স্নান নদীকে মানা হয়েছে। হ্রদ, পুকুর বা কুয়োতেও স্নান করা যাবে। যেখানেই স্নান করা হোক না কেন জল শুদ্ধ হতে হবে। নোংরা পঁচা জলে, সেটা নদী, পুকুর, হ্রদ যাই হোক না কেন, তাতে স্নান করলে রোগ হবে। এইজন্য বর্ষাকালে নোংরা জল হওয়ার কারণেই নদীতে স্নান নিষেধ করা হয়েছে। চরক সংহিতা সূত্রস্থান অধ্যায় ২৭ শ্লোক ২১০ লেখা আছে -
বসুধাকীটসর্পাখুমলসম্দূষিতোদকাঃ।
বর্ষাজলবহা নদ্যঃ সর্বদোষসমীরণাঃ।।
অর্থাৎ মাটি, কীট, সাপ, ইদুর আদি তথা অন্য মল দ্বারা দূষিত জল বর্ষাকালে নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে প্রবাহিত হয়। এইজন্য নদীর জল দূষিত হয়ে সব (তিন) দোষের বৃদ্ধিকারী হয়।
এইভাবে সুশ্রুত সংহিতা সূত্রস্থান অধ্যায় ৪৫ এরমধ্যে লেখা আছে -

কীটমূত্রপুরীষাণ্ডশবকোথপ্রদূষিতম্।

তৃণপর্ণোত্করয়ুতম্ কলুষম্ বিষসম্য়ুতম্।।৯।।

য়োবগাহেত বর্ষাসু পিবেদ্বাপি নবম্ জলম্।

স বাহ্যাভ্যন্তরান্ রোগান্ প্রাপ্নুয়াত্ ক্ষিপ্রমেব তু।।১০।।

অর্থাৎ কীট, মূত্র, বিষ্ঠা, ডিম্ব, শব (মৃতদেহ), কোথ (দুর্গন্ধযুক্ত পদার্থ), তৃণ হতে ঘাস পাত, নুড়িপাথর বর্ষার জলে মিশ্রিত হয়, তাই বর্ষার নবীন জল মলিন আর বিষযুক্ত হয়। যারা সেই জলে স্নান করে বা সেই নবীন জল পান করে, তাদের শরীরে বাইরে ফোঁড়া-ব্রণ, গিনি ওয়ার্ম আদি ত্বকের রোগ হয় তথা শরীরের ভিতরে উদর বিকার, অজীর্ণ, জ্বর আদি রোগ ততকাল হয়।
কিন্তু ঋষিদের এই হিতকারী কথার উপরও পৌরাণিক অন্ধবিশ্বাসে ফেঁসে থাকা মানুষ ধ্যান দেয় না আর গঙ্গা যমুনাকে পবিত্র পাপনাশিনী আর মোক্ষদায়িনী ভেবে বর্ষাকালে এমন নোংরা আর পঁচা জলের মধ্যেই ডুব দিতে থাকে আর এইজন্য দাদ, চুলকানি আদি চর্মরোগ দ্বারা তাদের পঁচতে দেখা যায়। এইভাবে দিল্লি, কলকাতা আদি নগরের নিকটে সারা নগরের মল-মূত্র প্রবাহিত হয়ে প্রতিদিন গঙ্গা আর যমুনাতে মিশ্রিত হতে থাকে, সেখানেও মানুষ তারমধ্যে স্নান করে নিজেকে পুণ্য আর যশের ভাগী মনে করে। কিন্তু নোংরা জল পান করলে যেমন রোগ হয় তেমনই মলিন জল দিয়ে স্নান করলে অনেক রোগের উৎপত্তির কারণ হয়। অতঃ বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের উচিত যে নদী, পুকুর বা হ্রদ যেখানে স্নান করবেন, শুদ্ধ শীতল জল দিয়েই স্নান করবেন। তাছাড়া যে নদী বা হ্রদের জল শুদ্ধ হয় সেখানে স্নান করা ব্রহ্মচারীদের জন্য খুবই লাভ হয়। স্নানের স্নান আর ব্যায়ামের ব্যায়ামও হয়ে যায়, কারণ সাঁতার কাটার ফলে শরীরের সব অঙ্গের ব্যায়াম হয়, এরফলে ফুসফুস শুদ্ধ আর বলবান্ হয়, বুক প্রসারিত তথা সারা শরীর হৃষ্ট-পুষ্ট, সুন্দর, সুদৃঢ়, নিরোগ, সুস্থ আর তেজের বৃদ্ধি হয়। নিয়মপূর্বক সাঁতার কাটলে চক্ষু আর বীর্য সম্বন্ধীয় সব রোগ দূর হয়ে যায়। ব্রহ্মচর্য তথা স্বাস্থ্য রক্ষার দৃষ্টিতে সাঁতার তো হিতকারী হয়ই এমনকি প্রয়োজন হলে অন্যের প্রাণ রক্ষার জন্যও সেটা খুব কাজে লাগে। এইজন্য ব্রহ্মচারীকে অবশ্যই সাঁতার শেখা উচিত। এটা চক্ষুঃস্নান আর মূত্রেন্দ্রিয় স্নানের জন্যও খুব সুবিধার হয় আর এই দুটোই ব্রহ্মচারীদের জন্য অত্যন্ত আবশ্যক আর হিতকর। যদি নদী আর হ্রদ সুলভ না হয় তাহলে কুয়োর পর্যাপ্ত শুদ্ধ, শীতল জল দিয়ে ভালো করে ডলে-ডলে ঘর্ষণ স্নান করা উচিত। কুয়ো থেকে জল বের করার সময় আলস্য করবে না, কারণ এরদ্বারাও ব্যায়াম হয়। স্নানের সময় বা স্নানের পশ্চাৎ শরীরকে সুতির শুকনো বস্ত্র দিয়ে ডলে-ডলে ঘষে নেওয়া উচিত। স্নানের সময় তো ভিজে গামছা দিয়ে ঘষবে, কিন্তু স্নান হয়ে গেলে শুকনো গামছাই উত্তম হবে।
এই ক্রিয়াকে চরকের মধ্যে পরিমার্জন নামে লেখা আছে আর এর অনেক লাভ বলা হয়েছে -

দৌর্গন্ধ্যম্ গৌরবম্ তন্দ্রাম্ কুণ্ডূম্ মলমরোচকম্।

স্বেদবীভত্সতাম্ হন্তি শরীরপরিমার্জনম্।।

(সূত্রস্থান অধ্যায় ৫ শ্লোক ৯০)
স্নানাদির সময় শরীরকে পরিমার্জন বস্ত্র আদির দ্বারা ঘষে-ঘষে নোংরা পরিস্কার করার ক্রিয়া করলে দুর্গন্ধ, ভারীতা, তন্দ্রা (আলস্য), কুণ্ডূ (চুলকানি), মল (সব প্রকারের মলিনতা), অরুচি (ভোজনে রুচি না হওয়া), স্বেদ (ঘাম) দ্বারা বিভৎসতা (কুরূপতা) নষ্ট হয়ে যায়।
.
যারা স্নানের পশ্চাৎ ভিজে শরীরকে শুকনো গামছা দিয়ে ভালো করে ঘষে মোছে না তাদের উপরোক্ত দাদ, চুলকানি আদি দোষ বা রোগ হয়। শরীরকে গামছা দিয়ে না মুছলে স্নানের বিশেষ লাভ হয় না। শুকনো আর মোটা গামছা দিয়ে শরীরকে মুছলে স্নানের কারণে বেরিয়ে আসা শরীরের নোংরা খুব সহজেই সরে যায় আর ত্বক অত্যন্ত শুদ্ধ হয়ে এর উপর এক বিশেষ কান্তি আর তেজ আসে। শরীরকে এইভাবে মোটা শুকনো গামছা দিয়ে মুছলে শরীরের সমস্ত অবয়বের ব্যায়ামও হয়ে যায়। যত শুদ্ধি আর লাভ এইভাবে বস্ত্র দিয়ে মুছে ফেলার কারণে হয় ততটা অন্য কোনো প্রকারে হয় না। এখনকার লেখাপড়া জানা বাবুরা তো স্নানের সময় সাবানের ব্যবহার করে ঘর থেকে ব্যর্থ ধন খরচ করে তারসঙ্গে অনেক হানিও বহন করে।
🍁 স্নানের বিষয়ে কিছু আবশ্যক কথা 🍁
স্নানের সময় শরীরের সব অঙ্গকে (মূত্রেন্দ্রিয় বাদে) ডলে ডলে ঘর্ষণ স্নান করা ব্রহ্মচারীর জন্য তো আবশ্যক কিন্তু পায়ের সব আঙ্গুলের মাঝখানের ভাগগুলোকে হাতের আঙ্গুল দিয়ে এক-দুই মিনিট পর্যন্ত ঘষলে ব্রহ্মচর্যের জন্য অত্যন্ত লাভদায়ক হয়, কারণ আমাদের পায়ের আঙ্গুলের মোটা শিরার সম্বন্ধ মূত্রেন্দ্রিয়ের সঙ্গে আছে। এই শিরাগুলোকে চাপ দিলে বা মালিশ করলে মূত্রেন্দ্রিয়তে অনাবশ্যক উত্তেজনা হয় না। এই লাভকে ধ্যানে রেখেই ব্রহ্মচারী প্রেমী সজ্জনরা দণ্ডযুক্ত খড়মের ব্যবহার করে।
.
স্নান সর্বদা ভোজনের পূর্বেই করা উচিত। কারণ এটা পূর্বেই লেখা হয়েছে যে স্নানের পশ্চাৎ খুব খিদে পায়, কিন্তু ভোজনের পশ্চাৎ সঙ্গে-সঙ্গে স্নান করলে পিত্ত আদি দূষিত হয় আর পাচনক্রিয়ার উপর খারাপ প্রভাব পড়ে।
.
"সৌ কাম ছোড়কর খা, হাজার কাম ছোড়কর নহা" - এই লোকোক্তির দ্বারা এটাই সিদ্ধ হয় যে ভোজন থেকে দশগুণ আবশ্যক হল স্নান। এইজন্য ভোজনের পূর্বে স্নান করা উচিত। সংস্কৃতের এক কবি একে এইভাবে সুন্দর প্রকট করেছেন -

"শতম্ বিহায় ভোক্তব্যম্ সহস্রম্ স্নানমাচরেত্।"

অর্থাৎ শত কাজ ছেড়ে ভোজন করো, হাজার কাজ ছেড়ে স্নান করো। মানুষ খেয়েই অনুতাপ করে, স্নান করে অনুতাপ করে না। স্নান করলে তো দ্রুত উৎসাহ, স্ফূর্তি, পবিত্রতা আদি গুণের প্রাপ্তি হয় আর সাত্ত্বিক বৃত্তির উদয় হয়। ভোজনের পশ্চাৎ মানুষকে আলস্য আর তন্দ্রা চেপে ধরে। এইভাবে কিছু অংশ তমোগুণ ছেয়ে যায়।

"ন স্নানমাচরেদ্ ভুক্ত্বা" (মনুঃ ৪/১২৯)

অর্থাৎ ভোজন করে স্নান করবে না। মনু জী মহারাজের আজ্ঞার বিরুদ্ধে ভোজন করার পশ্চাৎ স্নান করলে অনেক উদরবিকার হয়। যদি কোনো বিশেষ কারণে ভোজনের পশ্চাৎ স্নান করতেই হয় তাহলে ভোজনের কয়েক ঘন্টা পশ্চাৎ করা উচিত। মহর্ষি দয়ানন্দ জীও লিখেছেন যে "ভোজনের পূর্বে স্নান অবশ্যই করবে।" (সত্যার্থ প্রকাশ, ৩ সমুল্লাস)

ন বাসোভিঃ সহ স্নানমাচরেত্। (মনুঃ ৪/১২৯)

অর্থাৎ বস্ত্র পরে স্নান করবে না। মনু জীর এই আজ্ঞানুসারে বিনা বস্ত্রে স্নান করা উচিত। কারণ বস্ত্র পরে স্নান সঠিকভাবে হয় না আর সর্বদা বস্ত্র পরে থাকলে মানুষের শরীর নির্বল হয়ে যায়। অতঃ প্রাতঃকালের বায়ু যখন খোলা শরীরের উপর স্পর্শ করে সেটা সঞ্জীবনী বুঁটির সমান শক্তি প্রদান করে আর খোলা শরীরে স্নান করলে শরীরের সহনশক্তি বাড়ে। সেইজন্য শীত আর উষ্ণতার প্রভাবে শরীরের কোনো হানি হয় না বরং লাভই হয়। কেবল একটা লঙ্গট পরে স্নান করাই হল ভারতীয় সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাচীন রীতি। এতে সারা শরীরে ঘর্ষণ করার পুরো সুবিধা থাকে। পাশ্চাত্য সভ্যতার রঙে রাঙা ব্যক্তিরা সর্বদা নগ্ন হয়ে স্নান করে কিন্তু এটা হল অসভ্যতা আর জংলীপনা, যা ভারতীয় সভ্যতার একদম বিরুদ্ধ। মনুস্মৃতির মধ্যে লেখা আছে -

"ন নগ্নঃ স্নানমাচরেত্" (মনুঃ ৪/৪৪)

অর্থাৎ নগ্ন হয়ে স্নান করবে না।
কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রের (সূত্র ৪০৭) মধ্যে মুনিবর চাণক্য লিখেছেন -

"ন নগ্নো জলম্ প্রবিশেত্" অর্থাৎ নগ্ন হয়ে জলে স্নান করবে না।

এইজন্য আমাদের ঋষিগণ এর সর্বদা নিষেধ করেছেন।
.
অজ্ঞাত আর গভীর জলে প্রবেশ করবে না। কারণ নদী, হ্রদ আদির স্নান তো ভালো কিন্তু "জলজন্তু বা অন্য কোনো পদার্থ দ্বারা দুঃখ হতে পারে বা সাঁতার না জানা থাকলে ডুবে যাওয়াও সম্ভব।" (সত্যার্থ প্রকাশ, দ্বিতীয় সমমুল্লাস)
মনু জী মহারাজও এইরকম উপদেশ দিয়েছেন -

"নাবিজ্ঞাতে জলাশয়ে" (মনুঃ ৪/১২৯)।

অর্থাৎ অবিজ্ঞাত জলাশয়ে (পুকুর আদিতে) প্রবেশ করে স্নানাদি করবে না। অন্যথা হানি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
.
প্রাচীন ঋষিগণ শুদ্ধ জলপান আর সেইসঙ্গে স্নান করার উপর খুব বল দিয়েছেন। সাধারণ মানুষ কোন জলটা শুদ্ধ, পবিত্র আর গুণকারক, তার সঠিক জ্ঞান রাখে না।
.
চরক সংহিতার সূত্রস্থান ২৭ তম অধ্যায়ে লেখা আছে -

জলমেকবিধম্ সর্বম্ পতত্যৈন্দ্রম্ নভস্তলাত্।

য়ত্পতত্পতিতম্ চৈব দেশকালাবপেক্ষতে।।১৯৩।।

অর্থাৎ আকাশ থেকে মেঘের জল একই সমান বর্ষণ হয়, কিন্তু সেটা বর্ষণে তথা নিচে পড়ে দেশ আর কালের কারণে ভিন্ন হয়ে যায়। অন্তরিক্ষ থেকে যে জল বর্ষণ হয় সেটা অত্যন্ত স্বচ্ছ হয় তবে মার্গে ধুলো গ্যাস আদি মল অতিশীত আর উষ্ণতা আদির সংসর্গ হওয়াতে রূপ-রস আদি গুণ তথা হিত-অহিতের মধ্যে ভিন্নতা আসে। আর এইভাবে পৃথিবীর উপর পড়ার পর সেখানকার মাটি তথা মাটিতে থাকা ধাতু, ক্ষার আদির সংসর্গ দ্বারা তাতে ভিন্নতা চলে আসে।
এই বিষয়ে সুশ্রুতসংহিতার সূত্রস্থান ৪৫ তম অধ্যায়ে খুব স্পষ্ট ভাবে লেখা হয়েছে -
যে অন্তরিক্ষ জল ধুলো আদি রহিত হয় আর শুদ্ধরূপে নিচে বর্ষণ হয় তাকে ভালো পাত্রে বন্ধ করে রেখে দিলে অনেক বছর ধরে থাকলেও সেটা গঙ্গাজলের সমান না পঁচবে আর না খারাপ হবে। এইজন্য সুশ্রুত এই সর্বোত্তম জলের নাম "গঙ্গা" রেখেছে। আর যে জলে ধুলো আদি মল তথা অন্য হানিকারক গ্যাসের মিশ্রণ পাওয়া যাবে, সেটা সমুদ্রের সমান অত্যন্ত অশুদ্ধ হওয়ার জন্য সুশ্রুত তাকে "সমুদ্র" নাম দিয়েছে।
.
চরক সংহিতার মধ্যে শুদ্ধ জলকে ছয়টা গুণ দেওয়া হয়েছে -

শীতম্ শুচি শিবম্ মৃষ্টম্ বিমলম্ লঘু ষঙ্গুণম্।

প্রকৃত্যা দিব্যমুদকম্ ভ্রষ্টম্ পাত্রমপেক্ষতে।।

(সূত্রস্থান অধ্যায় ২৭ শ্লোক ১৯৫)
অর্থাৎ অন্তরিক্ষ জলের স্বাভাবিক গুণ ছয়টা আছে যথা - (১) শীতল (২) পবিত্র (৩) কল্যাণকারক (৪) ধুলো আদি হতে রহিত বা আস্বাদে প্রিয় (৫) নির্মল (৬) লঘু (হালকা)। বর্ষণ হওয়ার পর পাত্রের কারণে এটা ভিন্ন-ভিন্ন দোষকে ধারণ করে আর যে স্থানের উপর পড়ে সেইরূপ গুণ এরমধ্যে চলে আসে। এইজন্য স্নানের সময় যদি বর্ষণ হয় তাহলে ব্রহ্মচারীকে বর্ষাতে স্নান করে খুব আনন্দ নেওয়া উচিত। অন্তরিক্ষ থেকে বর্ষণের সময় বর্ষার জলকে যে পরিষ্কার পাত্রে একত্রিত করে রাখা হয়, ধীর মেধাবী ব্যক্তিরা তাকে "ঐন্দ্র" অর্থাৎ ইন্দ্রের জল বলে আর শ্রেষ্ঠপুরুষ বা রাজারা সেই জল পান করে। এটা আশ্বিন মাসে গ্রহণ করা হয়। চরক আর সুশ্রুত সংহিতাতে বর্ষাজলের সেবনের বিধান সুকুমার অর্থাৎ ব্রহ্মচারীর জন্য বিশেষ করেছে। শরৎ ঋতুর বর্ষাজল সর্বশ্রেষ্ঠ হয়।
এই বিষয়ে লেখা আছে -

রাজভিঃ রাজমাত্রৈশ্চ সুকুমারৈশ্চ মানবৈঃ।

সম্গৃহীতাঃ শরদ্যাপঃ প্রয়োক্তব্যাঃ বিশেষতঃ।।

(চরক সংহিতা, সূত্রস্থান, অধ্যায় ২৭/২০৫)
অর্থাৎ রাজা, ধনী, মান্য রাজপুরুষ আর সুকুমার অর্থাৎ ব্রহ্মচারীদের শরৎ ঋতুতে বিধিপূর্বক একত্রিত করা জলের বিশেষভাবে প্রয়োগ করা উচিত।
চরক সংহিতার মধ্যে শরৎ ঋতুর জলের বিষয়ে লেখা আছে -

তনু লঘ্বনভিষ্যন্দি প্রায়ঃ শরদি বর্ষতি।

তত্তু য়ে সুকুমারাঃ স্যুঃ স্নিগ্ধভূয়িষ্ঠভোজনাঃ।

তেষাম্ ভক্ষ্যে চ ভোজ্যে চ লেহ্যে পেয়ে চ শস্যতে।।

(চরক সংহিতা, সূত্রস্থান, অধ্যায় ২৭, শ্লোক ২০০-২০১)
অর্থাৎ শরৎ ঋতুতে যে বর্ষণ হয় তার জল হালকা হয়। সেটা অভিষ্যন্দ বা ক্লেশকারী হয় না। সেই জল সুকুমার অর্থাৎ ব্রহ্মচারীদের জন্য তথা অত্যধিক স্নিগ্ধ (ঘী আদি) ভোজনকারী পুরুষদের ভক্ষ্য, ভোজ্য, লেহ্য তথা পেয়, চার প্রকারের আহারে প্রশস্ত হয় অর্থাৎ এর প্রয়োগ স্নান, পান-আহার আদি সব আবশ্যক কাজে শ্রেষ্ঠ মানা হয়েছে। এইজন্য ব্রহ্মচর্য প্রেমীদের বর্ষা জলের সদুপয়োগ দ্বারা পুরোপুরি লাভ নেওয়া উচিত।

🍁 সন্ধ্যা আর ব্রহ্মচর্য 🍁

ব্রহ্মচারীর নিত্য কর্মে সন্ধ্যা বা ঈশ্বরভক্তির বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এইজন্য মহর্ষি দয়ানন্দ জী লিখেছেন - "প্রথমে শরীর শুদ্ধি অর্থাৎ স্নান আদি কর্ম করে সন্ধ্যোপাসনা আরম্ভ করবে।" সব বেদ-শাস্ত্রের আজ্ঞা এটাই। তাছাড়া কেবল ব্রহ্মচারী কেন প্রত্যেক মানুষের কর্তব্য হল স্নানের পশ্চাৎ অন্তত এক ঘন্টা প্রতিদিন সন্ধ্যোপাসনাতে লাগাবে। কত দুঃখের বিষয় যে সাংসারিক সুখ-সম্পত্তি প্রাপ্তির জন্য তো মানুষ দিন-রাত এক করে দেয় কিন্তু পরমাত্মার চিন্তন করার সময়, সময় না পাওয়ার অজুহাত করে। এই লোক আর পরলোক দুটোতে সুখ আর শান্তির ইচ্ছুক মানুষকে জীবনের এই সর্বপ্রথম কর্তব্যের অর্থাৎ সন্ধ্যার দিকে অবশ্যই ধ্যান দেওয়া উচিত আর প্রাতঃ সায়ং দুই সময় খুব শ্রদ্ধাপূর্বক সন্ধ্যোপাসনা করা উচিত। ব্রহ্মচারী আর সন্ধ্যার সম্বন্ধ তো এইরকম হয় যেমন প্রাণ আর শরীরের হয়। ব্রহ্মচারী কে? বেদ ভগবান এর উত্তর দিয়েছেন - "ব্রহ্মচারীষ্ণম্শ্চরিত রোদসী উভে" (অথর্বঃ ১১/৫/১) ব্রহ্মের সঙ্গে সাক্ষাৎকার করতে ইচ্ছুক হয়ে যে বারংবার তাঁর সন্ধান করে উভয় লোকে বিচরণ করে সে হল ব্রহ্মচারী, কারণ ব্রহ্মচারী নিরন্তর ব্রহ্মের সন্ধানে বন, পর্বত, এই লোক, পরলোক, দ্যাবা, পৃথিবী, স্থূল, সূক্ষ্ম, আকাশ, পাতাল, সর্বত্র সারা সংসারে বিচরণ করে। এইজন্য "ব্রহ্ম ইষ্ণন্ চরতীতি ব্রহ্মচারী" ব্রহ্মের সন্ধান বা প্রাপ্তির জন্য নিজের সর্বস্ব দিয়ে দেয়।

কোনো সত্য ব্রহ্মচারী গুরুর শিক্ষা, সৎসঙ্গ, পথপ্রদর্শন আর নিরন্তর নিরীক্ষণ বিনা ব্রহ্মচর্য পালনে সফল হওয়া সম্ভব নয়। কারণ অনুভবী সত্য ব্রহ্মচারীই কাউকে ব্রহ্মচারী বানাতে পারে। এইজন্য বেদ "আচার্য়ো ব্রহ্মচারী" অর্থাৎ কেবল ব্রহ্মচারীই আচার্য হতে পারে, এই সত্যকে প্রকট করেছে। আচার্যের ব্রহ্মচর্য রূপী অগ্নির দ্বারাই ব্রহ্মচারীর মধ্যে সেইরূপ ব্রহ্মচর্যের অগ্নি প্রদীপ্ত হয়ে ওঠে। যেমন "দীপাদ্দীপমিবান্তরম্" প্রজ্বলিত দীপক দিয়ে অন্য দীপক জ্বালানো হয়। নিভে যাওয়া দীপক দিয়ে অন্য দীপককে জ্বালানো সম্ভব না। এইজন্য তেত্তিরীয় উপনিষদের শিক্ষাবল্লীতে বলা হয়েছে যে - আচার্য়ঃ পূর্বরূপমন্তেবাসী উত্তররূপম্" অর্থাৎ আচার্য হল পূর্বরূপ আর ব্রহ্মচারী হল তার উত্তররূপ। নিষ্কর্ষ এই হল যে আচার্য যেমন হয় ব্রহ্মচারীও তেমনই হয়। যেন আচার্য স্বয়ং ব্রহ্মচারীর ভিতরে ঢুকে নিজের রূপ প্রকট করে।
.
সব গুরুর গুরু আর আচার্যের আচার্য হল সেই পরম ব্রহ্মচারী পরমেশ্বর। এতে য়োগদর্শনের প্রমাণ (সমাধি সূত্র ২৬) আছে - "পূর্বেষামপি গুরুঃ কালেনানবচ্ছেদাত্।" অর্থাৎ সেই ঈশ্বর হলেন পূর্ব (আদি) গুরুদেরও গুরু, কালের সীমা তাঁর জন্য হয় না। তিনি যেমন এই সর্গেরও আদিগুরু তেমনই অতীত আর অনাগত সর্গের আদিগুরু অর্থাৎ গুরুদেরও গুরু। "তস্য বাচকঃ  প্রণবঃ" (য়োগ.সমাধি.সূত্র.২৭) সেই আদি গুরু পরমাত্মার নাম হল "ও৩ম্"। এই নামের সঙ্গে প্রভুর নিত্য সম্বন্ধ আছে অর্থাৎ সব সর্গের মধ্যে তাঁর এই নাম বিদ্যমান থাকে। এইজন্য সেই পরম ব্রহ্মচারী "ও৩ম্" এর শরণে না এসে আর তাঁর নিরন্তর সৎসঙ্গ না করে কিভাবে ব্রহ্মচারী হওয়া সম্ভব? বিষয়ভোগের চক্র বড় প্রবল, এর কাদায় না ফেঁসে বেরিয়ে আসা খুবই কঠিন। বিষয় থেকে সর্বদা দূরে থাকা সত্য ব্রহ্মচারী গুরুর সহায়তায় ব্রহ্মচারী এই দুর্গম পথকে অতিক্রম করতে পারে আর এইরূপ সত্য ত্যাগী আর পরম বৈরাগী গুরু তো হল কেবলমাত্র "ও৩ম্" যিনি পরম ঐশ্বর্যের স্বামী হয়েও ত্রিকালেও বিষয় ভোগের স্পর্শ পর্যন্ত করেন না। তিনি সর্বদা নিষ্কাম হয়ে থাকেন। এই পরব্রহ্মের ব্রহ্মচর্যের সহায়তায় এই ক্ষণভঙ্গুর সংসারটা টিকে আসে, তা নাহলে কবে নষ্ট হয়ে যেত। এইজন্য ব্রহ্মচারীদের এই পরম সহায়কের সহায়তা আর আশ্রয়ের আবশ্যকতা আছে। যেমন বালক তার মাতার কোলে বসে সর্বদা নিশ্চিন্ত আর আনন্দমগ্ন হয়ে যায় সেইরকম এই জগৎজননীর সংরক্ষণ ব্রহ্মচারীকে সব বিঘ্ন বাধা থেকে বাঁচিয়ে দেয়।

"পরমেশ্বরের কৃপাদৃষ্টি আর সহায়তায় মহাকঠিন কাজও সুগমতার সঙ্গে সিদ্ধ হয়ে যায়। জিতেন্দ্রি (ব্রহ্মচারী) হওয়ার অভিলাষীকে দিনরাত প্রণব (ও৩ম্) এর জপ করা উচিত। শীতে আতুর ব্যক্তি যেমন অগ্নির নিকট আসলে তার শীতনিবৃত্তি হয় সেইরূপ পরমেশ্বরের নিকটতা প্রাপ্ত হওয়াতে সব দোষ দুঃখের নিবৃত্তি হয়ে পরমেশ্বরের গুণ, কর্ম, স্বভাবের সদৃশ জীবাত্মার গুণ, কর্ম, স্বভাব পবিত্র হয়। এইজন্য প্রতিদিন পরমেশ্বরের স্তুতি , প্রার্থনা আর উপাসনা করা উচিত।"

মহর্ষি দয়ানন্দ জীর এই বাক্য থেকে এটা সিদ্ধ হয় যে ব্রহ্মচারীকে ব্রহ্মচর্য পালনের মতো মহাকঠিন কর্ম সিদ্ধির জন্য ঈশ্বরোপাসনা বা সন্ধ্যার কত আবশ্যকতা আছে। কারণ সন্ধ্যা বা ঈশ্বরোপাসনার মাধ্যমেই ব্রহ্মচারীর সম্বন্ধ সরাসরি পরম-ব্রহ্মচারী পরমাত্মার সঙ্গে জুড়ে যায় আর যখন ব্রহ্মচারী ব্রহ্মচর্যের সাধনার জন্য প্রচণ্ড তপস্যা করে তখন এইরূপ পুরুষার্থী ব্রহ্মচারীর সহায়তা পরমেশ্বরও করেন। করবে নাই বা কেন? কারণ ব্রহ্মচারীই তো প্রভুর সবথেকে অধিক প্রিয় পুত্র বা শিষ্য হয়।

তেষামেবৈষ ব্রহ্মলোকো য়েষাম্ তপো ব্রহ্মচর্য়ম্ য়েষু সত্যম্ প্রতিষ্ঠিতম্। (প্রশ্নোপনিষদ্ ১/১৫)

এটা প্রশ্নোপনিষদের বাক্য, এখানে বলা হয়েছে - যে ব্রহ্মচর্যরূপী তপের চুল্লিতে নিজেকে তাপায়, ব্রহ্মলোকে তারই অধিকার হয়। পূর্ণ ব্রহ্মচর্যই হল ব্রহ্মপ্রাপ্তির একমাত্র সাধন। বিষয়ী লম্পট ব্যক্তিরা কখনও ঈশ্বরকে প্রাপ্ত করতে পারবে না। ব্রহ্মপ্রাপ্তি তো দূরের কথা, ব্রহ্মচর্য বিনা ঈশ্বরভক্তিও পূর্ণ হবে না আর ঈশ্বরভক্তি বিনা ব্রহ্মচর্য সিদ্ধ হবে না। সাধারণ মানুষ ঈশ্বরভক্তি আর ব্রহ্মচর্যকে পৃথক-পৃথক দেখে কিন্তু আসলে সেটা একই।

এইজন্য বেদ "ব্রহ্মচারীষ্ণন্ চরতি" ব্রহ্মের সন্ধানকারীকেই ব্রহ্মচারী বলেছে আর এইজন্য পঞ্চমহাযজ্ঞের মধ্যে ব্রহ্মযজ্ঞতে পড়া-পড়ানো, সন্ধ্যোপাসনা করা, ঈশ্বরের স্তুতি, প্রার্থনা, উপাসনা করা আর দ্বিতীয় দেবযজ্ঞের মধ্যে কেবল অগ্নিহোত্র করাকেই ব্রহ্মচারীর জন্য ঋষিগণ আবশ্যক নিত্য-কর্ম বলেছেন। এইজন্য সংস্কারবিধির বেদারম্ভ সংস্কারে ব্রহ্মচারীকে নিত্যকর্মের বিষয়ে এই আদেশ করা হয়েছে যে - 

"প্রতিদিনম্ রাত্রেঃ পশ্চিমে য়ামে চোত্ত্থায়াবশ্যকম্ কৃত্বা দন্তধাবনস্নানসন্ধ্যোপাসনেশ্বরস্তুতিপ্রার্থনোপাসনায়োগা-ভ্যাসান্নিত্যমাচর। (গোভিল গৃহ্যসূত্র)

অর্থাৎ রাতের চতুর্থ প্রহরে জেগে আবশ্যক শৌচাদি, দন্তধাবন, স্নান, সন্ধ্যোপাসনা, ঈশ্বরের স্তুতি, প্রার্থনা আর উপাসনা, য়োগাভ্যাসের আচরণ নিত্য করবে।
.
এইজন্য স্নানের পশ্চাৎ ব্রহ্মচারীকে সন্ধ্যোপাসনা করা উচিত। সন্ধ্যার অর্থ পঞ্চমহাযজ্ঞবিধির মধ্যে এইভাবে লেখা আছে -

🌿 সন্ধ্যা শব্দের অর্থ 🌿
সন্ধ্যায়ন্তি সন্ধ্যায়তে বা পরব্রহ্ম য়স্যাম্ সা সন্ধ্যা।
অর্থাৎ যেখানে পরব্রহ্ম পরমাত্মার উত্তমভাবে ধ্যান করা হয়, তাকে সন্ধ্যা বলে।

🌿 সন্ধ্যার সময় 🌿
তত্র রাত্রিন্দিবয়োঃ সন্ধিবেলায়ামুভয়োস্সন্ধ্যয়োঃ সর্বৈর্মনুষ্যৈরবশ্যম্ পরমেশ্বরস্যৈব স্তুতিপ্রার্থনোপাসনাঃ কার্য়াঃ।
অর্থাৎ রাত আর দিনের সংযোগ সময়ে উভয় সন্ধ্যাতে সব মানুষকে পরমেশ্বরের স্তুতি, প্রার্থনা, উপাসনা করা উচিত।

মহর্ষি দয়ানন্দ জী এই বিষয়ে সত্যার্থ প্রকাশের মধ্যে লিখেছেন - "সন্ধ্যা আর অগ্নিহোত্র সায়ং-প্রাতঃ দুই বেলা করবে। রাত-দিনের দুটোই সন্ধি বেলা হয়, এর অধিক নয়।"

"রাগ-দ্বেষ পরিত্যাগ করে ভিতরে আর জলাদি দ্বারা বাইরে পবিত্র করা আবশ্যক। শরীর শুদ্ধির সঙ্গে অন্তঃকরণ শুদ্ধি অবশ্যই করবে, কারণ সেটাই হল সর্বোত্তম আর পরমেশ্বর প্রাপ্তির একমাত্র সাধন। যখন উপাসনা করতে চাইবে তখন একান্ত শুদ্ধ নির্জন স্থানে গিয়ে আসন পেতে বসে প্রাণায়াম দ্বারা ইন্দ্রিয় সমূহকে বাহ্য বিষয় হতে নিরুদ্ধ করবে। মনকে নাভি প্রদেশ, হৃদয়, কন্ঠ, নেত্র, শিখা অথবা মেরুদণ্ডের মধ্যস্থিত অস্থির কোথাও স্থির করে নিজের আত্মা আর পরমাত্মা সম্বন্ধে বিবেচনা করে পরমাত্মাতে মগ্ন হয়ে সংযমী হবে। 
.
এইসব সাধন অবলম্বন করলে আত্মা আর অন্তঃকরণ পবিত্র হয়ে সত্য দ্বারা পূর্ণ হয়। নিত্য প্রতি জ্ঞান-বিজ্ঞান বৃদ্ধি করলে মুক্তি পর্যন্ত প্রাপ্ত হয়। ঈশ্বরভক্তির এই ফল তো পৃথক হবে কিন্তু আত্মার বল এত বেড়ে যাবে যে পর্বতের সমান দুঃখ উপস্থিত হলেও সে ব্যাকুল হবে না এবং সমস্ত কষ্ট সহ্য করতে সক্ষম হবে। এটা কি তুচ্ছ কথা?" এইজন্য "যেভাবে সমাধিস্থ হয়ে য়োগীজন পরমাত্মার ধ্যান করতেন সেইরূপ সন্ধ্যোপাসনা করবে। কম করে হলেও এক ঘণ্টা ধ্যান করবে।" যদি অধিক সময় হয় তাহলে গায়ত্রী মন্ত্র বা "ও৩ম্" এই এক পরমাত্মার নামের অর্থ বিচার করে নিত্য প্রতি জপ করবে। নিজের আত্মাকে পরমেশ্বরের আজ্ঞানুকূল সমর্পণ করে দিবে। এই বিষয়ে মনু জীর আদেশ হল -

অপাম্ সমীপে নিয়তো নৈত্যকম্ বিধিমাস্থিতঃ।

সাবিত্রীমপ্যধীয়ীত গত্বারণ্যম্ সমাহিতঃ।। (মনুঃ ২/৭৯)


মহর্ষি দয়ানন্দ জী এর অর্থ এইভাবে করেছেন - 

অরণ্য বা নির্জন স্থানে গিয়ে সাবধানে জলাশয়ের নিকট উপবেশন পূর্বক নিত্য কর্মে ব্রত থেকে সাবিত্রী অর্থাৎ গায়ত্রী মন্ত্রের উচ্চারণ, অর্থজ্ঞান আর তদনুসার আচরণ করবে। কিন্তু এই জপ মনে-মনে করাই উত্তম।

মহর্ষি পতঞ্জলি জী য়োগদর্শনে ঈশ্বরভক্তির উপর খুব বল দিয়েছেন - "ঈশ্বরপ্রণিধানাদ্বা" (সমাধিপাদ সূত্র ২৩) ঈশ্বরের প্রণিধান (ভক্তি) দ্বারা (নিকটতম) সমাধি হয়। অর্থাৎ যখন মানুষ অনন্যচিত্ত হয়ে ঈশ্বরের সন্ধোপাসনাতে তৎপর হয় তখন ঈশ্বর নিজের ভক্তের এই ভক্তিতে প্রসন্ন হয়ে কৃপাদৃষ্টি করেন, যারফলে ভক্ত য়োগীর সমাধি সিদ্ধ হয়। 


🍁 সন্ধ্যাতে কিভাবে মন লাগবে? 🍁
সন্ধ্যার সাধকরা প্রায়শঃ সবাই এটাই শঙ্কা করে যে সন্ধ্যার সময় সন্ধ্যাতে মন লাগে না। এর মুখ্য কারণ তো হল এটাই যে তারা সন্ধ্যার মন্ত্রের অর্থ মনে রাখে না। মহর্ষি পতঞ্জলি জীর এই আদেশকে তারা ভুলে যায় -
"তজ্জপস্তদর্থভাবনম্।" (য়োগদর্শন সমাধিপাদ সূত্র ২৮)
ও৩ম্ এর জপ আর তার অর্থের চিন্তন করাই হল ঈশ্বর প্রণিধান অর্থাৎ ঈশ্বরের ভক্তি। যারা ও৩ম্ এর জপ তার অর্থের সঙ্গে চিন্তন করে তাদের চিত্ত একাগ্র হয়।
.
আদিত্য ব্রহ্মচারী মহর্ষি দয়ানন্দ জী এইভাবে জপ করার জন্য খুব বল দিয়েছেন। তিনি একটা স্থানে বলেছেন - "সেই নামের জপ অর্থাৎ স্মরণ আর তারই অর্থ সর্বদা চিন্তন করা উচিত।"
.
তিনি ব্রহ্মচারীদের জন্য রাতদিন প্রণবের জপ করা ব্রহ্মচর্য পালনের মুখ্য সাধন বলেছেন। "রাতে যদি জপ করতে গিয়ে খুব আলস্য বেড়ে যায় তাহলে দুই ঘণ্টার নিদ্রা নিয়ে উঠে বসবে আর পূর্ববত্ পবিত্র প্রণবের জপ আরম্ভ করে দিবে।"
ওনার নিজের জীবনও এর প্রত্যক্ষ উদাহরণ। ৪৯ বর্ষের আয়ু পর্যন্ত ঋষিবরের সারা জীবন য়োগাভ্যাস, ঈশ্বর ভজন আর তপশ্চর্যাতেই কেটেছে। তিনি রাতদিন ঈশ্বরের ধ্যানেই মগ্ন থাকতেন আর এই ঈশভক্তির কারণেই প্রভু ওনার আত্মার মধ্যে এক এমন অদ্ভুত শক্তি আর বলের সঞ্চার করে দেন যারদ্বারা দশ বছর সময়ের মধ্যে কুমার্গে চলতে থাকা সংসারটাকেই উল্টে দেন আর সারা সংসারকে মন্ত্র-মুগ্ধ করে দেন। তিনি বক্তৃতাতে বারংবার এই বাক্যগুলো বলতেন - "যখন কেউ নিজের সত্য মন, নিজের আত্মা, নিজের প্রাণ আর সারা সামর্থ্য দিয়ে পরমেশ্বরের ভজন করে তখন সেই কৃপাময় পরমাত্মা তাকে নিজের আনন্দে নিমগ্ন করে দেন। যেমন ছোট বালক নিজের মাতা-পিতার কাছে যেতে চায় তো তার মাতা-পিতা এই ভয়ে যে আমাদের পুত্র এদিক-সেদিক পড়ে গিয়ে যেন কষ্ট না পায়, নিজের সহস্র কাজ ছেড়ে দৌড়ে গিয়ে তাকে কোলে তুলে নেয়, সেইরূপ পরম কৃপানিধি পরমাত্মার দিকে যদি কেউ সত্য আত্মভাব নিয়ে চলে তাহলে পরমাত্মাও তাঁর অনন্ত শক্তি দ্বারা সেই জীবকে তুলে নিয়ে কোলে রেখে দেন, তারপর সেই জীবের আর কোনো কষ্ট থাকে না, সে সর্বদা আনন্দেই থাকে। পরমাত্মা মাতা-পিতার সমান নিজের ভক্তকে সর্বদা সুখ-সম্পন্ন করার কৃপা করেন।"
সন্ধ্যার বিষয়ে মনু জী বলেছেন -
ঋষয়ো দীর্ঘসন্ধ্যত্বাদ্দীর্ঘমায়ুরবাপ্নুয়ুঃ।
প্রজ্ঞাম্ য়শশ্চ কীর্তিম্ চ ব্রহ্মবর্চমেব।। (মনুঃ ৪.৯৪)
অর্থাৎ মন্ত্রার্থদ্রষ্টা ঋষিগণ দীর্ঘ সময় ধরে সন্ধ্যোপাসনা করার কারণে দীর্ঘায়ু, প্রজ্ঞা, যশ, সুকীর্তি আর ব্রহ্মতেজ প্রাপ্ত করেছেন।
এইজন্য যারা উক্ত কর্মকে বিধিপূর্বক করে তারাও দীর্ঘায়ু আদি প্রাপ্ত করে।
আমাদের প্রাচীন পুর্বজরা সন্ধ্যার গুরুত্বকে ভালোভাবে জানতেন, এইজন্য সব নিত্য কর্মে ওনারা সন্ধ্যাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন। ওনারা অত্যন্ত আবশ্যক কাজকেও ছেড়ে সন্ধ্যাবন্দন আদি করতেন। বাল্মীকি রামায়ণ আর মহাভারতে এর অনেক প্রমাণ পাওয়া যায় -
গতে পুরোহিতে রামঃ স্নাতো নিয়তমানসঃ।
সহ পত্ন্যা বিশালাক্ষ্যা নারায়ণমুপাগমত্।।১।।
(বাল্মীকি রামায়ণ, অযোধ্যাকাণ্ড, ষষ্ঠ সর্গ)
অর্থাৎ পুরোহিত (বশিষ্ঠ জী) চলে যাওয়ার পশ্চাৎ রামচন্দ্র জী তাঁর ধর্মপত্নী বিশালাক্ষী সীতার সঙ্গে স্নান করেন আর (দুইজনে স্নান করে) শুদ্ধ মনে নারায়ণের সন্ধ্যোপাসনা করেন।
তত্র শৃণ্বন্ সুখা বাচঃ সূতমাগধবন্দিনাম্।
পূর্বাম্ সন্ধ্যামুপাসীনো জজাপ য়তমানসঃ।।৩।।
বাল্মীকি রামায়ণ, অযোধ্যাকাণ্ড, ষষ্ঠ সর্গ)
অর্থাৎ (রাম আর সীতা) সূত মাগধ আর বন্দীজনের সুখদায়ক বাণী শুনে প্রাতঃ সন্ধ্যোপাসনা করে একাগ্রচিত্ত হয়ে গায়ত্রীর জপ করতে থাকেন।
সন্ধ্যাকালমনা শ্যামা ধ্রুবমেষ্যতি জানকী।
নদীম্ চেমাম্ শুভজলাম্ সন্ধ্যার্থে বরবর্ণিনী।।৫০।।
য়দি জীবতি সা দেবী তারাধিপনিভাননা।
আগমিষ্যতি সাবশ্যমিমাম্ শীতলজলাম্ নদীম্।।৫১।।
(বাল্মীকি রামায়ণ, সুন্দরকাণ্ড, ১৪ সর্গ)
অর্থাৎ সন্ধ্যাকালের ইচ্ছুক শ্যামবর্ণী বরবর্ণিনী সীতা এই শুভ (সুন্দর) জলের নদীতে অবশ্যই আসবেন।
.
যদি সেই চন্দ্রমুখী দেবী জীবিত থাকেন তাহলে তিনি অবশ্যই এই শীতল জলের নদীতে আসবেন।
.
মহাভারতে বাল-ব্রহ্মচারী ভীষ্ম পিতামহ ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে দীর্ঘায়ু প্রাপ্তির সাধন সম্বন্ধে বলেছেন -
ঋষয়ো নিত্যসন্ধ্যত্বাদ্দীর্ঘমায়ুরবাপ্নুবন্।
তস্মাত্তিষ্ঠেত্সদা পূর্বাম্ পশ্চিমাম্ চৈব বাগ্যতঃ।।
(মহাভারত, অনুশাসনপর্ব, অধ্যায় ১০৪, শ্লোক ১৮)
অর্থাৎ নিত্য প্রতি সন্ধ্যা করার কারণে ঋষিগণ দীর্ঘ আয়ু প্রাপ্ত করেছেন। এইজন্য প্রাতঃকাল আর সায়ংকালে বাগ্যত (মৌন) হয়ে সন্ধ্যা করা উচিত।
অকৃত্বা দেবপূজাম্ চ নাচরেদ্ দন্তধাবনম্।
অকৃত্বা দেবপূজাম্ চ নাভিগচ্ছেত্কদাচন।।
(মহাভারত, অনুশাসনপর্ব, অধ্যায় ১০৪, শ্লোক ৪৫)
দাতুন না করে দেবপূজা অর্থাৎ সন্ধ্যা করবে না আর সন্ধ্যা না করে এদিক-সেদিক কর্ম করতে যাবে না।
সন্ধ্যা পাপকে সরিয়ে মানুষকে ধর্মের দিকে নিয়ে যায়। এর উপর ওনার অটল শ্রদ্ধা ছিল। এই বিষয়ে মনু জী মহারাজ বলেছেন -
পূর্বাম্ সন্ধ্যাম্ জপম্স্তিষ্ঠন্নৈশমেনো ব্যপোহতি।
পশ্চিমাম্ তু সমাসীনো মলম্ হন্তি দিবাকৃতম্।।
(মনুঃ ২/১০২)
অর্থাৎ প্রাতঃকালের সন্ধ্যা বা গায়ত্রীর জপ করে মানুষ সারারাতের পাপের নাশ করে আর সায়ংকালের সন্ধ্যা বা জপ করে দিনের মলিন সংস্কার বা পাপকে নাশ করে অর্থাৎ পাপ করার ইচ্ছা নষ্ট হয়ে যায়।
যেভাবে নিবাস স্থানের শুদ্ধি প্রতিদিন সায়ং-প্রাতঃ ঝাড়ু লাগিয়ে অথবা জল দিয়ে ধুয়ে করা হয় সেইভাবে মানুষের হৃদয়-মন্দিরকেও শুদ্ধ করা আবশ্যক, তা নাহলে কুসংস্কার দূষিত করতে থাকবে। এই মলিন সংস্কারের নুড়িপাথরকে প্রাতঃ আর সায়ংকালের সন্ধ্যারূপী ঝাড়ু বা জল দিয়ে ধুয়ে শুদ্ধ করা আবশ্যক। যেভাবে মলিন বস্ত্রকে ধুয়ে শুদ্ধ করা হয় সেইভাবে অন্তঃকরণ রূপী বস্ত্রতে জমে থাকা কাম, ক্রোধ, রাগ, দ্বেষ রূপী মলকে দূর করার জন্য সন্ধ্যার দ্বারা শুদ্ধি আবশ্যক। যেভাবে প্রাতঃকালের করা ভোজন আমাদের সায়ংকাল পর্যন্ত কাজ করার শক্তি দেয় আর সায়ংকালের ভোজন সারা রাতের জন্য শক্তি প্রদান করে, সেইভাবে প্রাতঃকালের করা সন্ধ্যা-ভজন বা ঈশ্বর-চিন্তন সায়ংকাল পর্যন্ত মন্দ বিচার তথা পাপ থেকে বাঁচিয়ে রাখে তথা সায়ংকালে করা ঈশ্বরোপাসনা সারারাত পাপ আর নোংরা বিচার তথা স্বপ্ন থেকে বাঁচিয়ে রাখে। যেভাবে আমরা আমাদের মাতা-পিতা বা গুরুর সম্মুখে ভয় বা লজ্জার কারণে চুরি আর ব্যভিচারাদি পাপ কর্ম করি না, সেইভাবে পিতার পিতা, মাতার মাতা আর গুরুর গুরু সর্ব দ্রষ্টা হলেন "ও৩ম্", যাঁকে লুকিয়ে আমরা কোনো কিছুই করতে পারবো না, যিনি আমাদের কর্মের ফল সুখ-দুঃখের রূপে দেন। যদি তাঁর ধ্যান আমাদের হয় তাহলে কিভাবে আমরা পাপ করতে পারি? আমরা তাঁকে ভুলে যাই তাই পাপের ফাঁদে ফেঁসে যাই, কিন্তু তিনি আমাদের ভুলেন না। যদিও আমরা তাঁকে দেখতে পাই না কিন্তু তিনি ভিতরে বসে-বসে আমাদের বারংবার সত্ পথে চলার জন্য সচেতন করতে থাকেন। শুধু তাই নয়, যখন কোনো পাপ করার প্রবৃত্তি আমাদের মনে আসে তখন তিনি আমাদের ভিতর থেকে বারংবার বাধা দেন আর থামান আর আমরা সেটা অনুভবও করি, কিন্তু প্রভুর সতর্কতাকে উপেক্ষা করে দিই। যখন আমরা ভালো কর্ম করি সেইসময় তিনি আমাদের সেই ভালো কর্ম করার জন্য উৎসাহীতও করেন।
এই বিষয়ে মহর্ষি দয়ানন্দ জী লিখেছেন -
যখন আত্মা মনকে আর মন ইন্দ্রিয় সমূহকে কোনো বিষয়ে নিযুক্ত করে বা যখন চুরি আদি কুকর্ম অথবা পরোপকার আদি সৎকর্ম করতে আরম্ভ করে, তখন জীবের ইচ্ছা, জ্ঞানাদি সেই ইচ্ছিত বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়। সেই মুহূর্তে আত্মার ভিতর থেকে কুকর্ম কাজ করলে ভয়, শঙ্কা আর লজ্জা তথা সৎকর্ম করলে অভয়, নিঃশঙ্কতা, আনন্দ আর উৎসাহ জাগ্রত হয়। এটা জীবাত্মার দিক থেকে নয় বরং পরমাত্মার দিক থেকে হয়।" (সত্যার্থ প্রকাশ, সপ্তম সমুল্লাস)
কিন্তু আমরা আমাদের এই সত্য রক্ষককে উপেক্ষা করি আর পাপ বা কুমার্গের দিকে চলতে থাকি, তখন তাঁরও রক্ষার হাত আমাদের মাথার উপর থেকে সরে যায় কারণ তিনি পাপীর রক্ষক বা সঙ্গী হন না। "ইন্দ্রঃ ইচ্চরতঃ সখা" ঐশ্বর্যশালী ভগবান্ ইন্দ্র পুরুষার্থীদেরই সঙ্গী হন, "মা মর্ত্যস্য মায়িনঃ" তিনি প্রতারক, দুষ্ট আদির সঙ্গী হন না। তিনি অনাথেরও নাথ হন, নিরাশাদেরও আশা হন। মানুষকে কোনো অবস্থাতেই তাঁকে ভুলে যাওয়া উচিত নয়। যারা ভুলে যায় তাদের নিজেদেরই হানি হয়। নিজের কল্যাণ আর স্বার্থের জন্যও প্রাতঃ-সায়ং যদি মানুষ শ্রদ্ধাপূর্বক তাঁর স্মরণ করে তাহলে কিসের জন্য দুঃখ আর ক্লেশ ভোগ করবে।
.
ঈশ উপাসনা বিনা মানুষ সুখীও হয় না আর সে কৃতঘ্ন আর পাপীও হয়।
মহর্ষি দয়ানন্দ জী এই বিষয়ে লিখেছেন -
"যে ব্যক্তি পরমেশ্বরের স্তুতি, প্রার্থনা আর উপাসনা করে না, সে কৃতঘ্ন আর মহামুর্খ হয়। কারণ যে পরমাত্মা জীবদের সুখের জন্য এই জগতে সমস্ত পদার্থ দান করেছেন তাঁর গুণ ভুলে যাওয়া, ঈশ্বরকেই না মানা কৃতঘ্নতা আর মুর্খতা হবে।" (সত্যার্থ প্রকাশ, সপ্তম সমুল্লাস)
🍁 সন্ধ্যা না করলে দণ্ড 🍁
ন তিষ্ঠতি তু য়ঃ পূর্বাম্ নোপাস্তে য়শ্চ পশ্চিমাম্।
স শূদ্রবদ্ বহিষ্কার্য়ঃ সর্বস্মাদ্ দ্বিজকর্মণঃ।। (মনুঃ ২/১০৩)
যে দ্বিজ (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় তথা বৈশ্য) প্রাতঃ-সায়ংকালে সন্ধ্যোপাসনা করে না তাকে সব দ্বিজকর্ম থেকে শূদ্রের তুল্য বের করে দেওয়া উচিত অর্থাৎ দ্বিজের যজ্ঞাদি কর্মে যেমন শূদ্রের অধিকার নেই সেইরূপ সেও শূদ্রবত্ হওয়াতে শুভ কর্মে সম্মিলিত হওয়ার পাত্র নয়।
এইজন্য ঋষিগণ "নৈত্যিকে নাস্ত্যনধ্যায়ঃ" নিত্য কর্মতে অনধ্যায় (ছুটি) হয় না অর্থাৎ সন্ধ্যা আর অগ্নিহোত্র (হবন) আদি নিত্য কর্ম ব্রহ্মচারীকে অনিবার্য রূপে করতে হয়।
এই বিষয়ে মহর্ষি দয়ানন্দ জীর কথন হল - "দুটো যজ্ঞের মধ্যে (প্রথমটা) অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, সন্ধ্যোপাসনা, ঈশ্বরের স্তুতি, প্রার্থনা এবং উপাসনা - "ব্রহ্মযজ্ঞ"। (দ্বিতীয়) অগ্নিহোত্র থেকে অশ্বমেধ পর্যন্ত যজ্ঞ আর বিদ্বান ব্যক্তিদের সেবা আর সংসর্গ লাভ করা - "দেবযজ্ঞ"। কিন্তু ব্রহ্মচর্যে কেবল ব্রহ্মযজ্ঞ আর অগ্নিহোত্রই করতে হবে।" (সত্যার্থ প্রকাশ, তৃতীয় সমুল্লাস)

🍁 ব্রহ্মচারীর ঈশ্বর ভক্তির প্রয়োজন কেন? 🍁
সন্ধ্যার অতিরিক্ত যদি কোনো ব্রহ্মচারী জপের মধ্যে অধিক সময় লাগাতে চায় তাহলে গায়ত্রী মন্ত্র বা প্রণব অর্থাৎ ও৩ম্ এর জপ করা উচিত, এটাই সর্বমান্য প্রাচীন শাস্ত্রীয় পদ্ধতি, যাকে ব্রহ্মা থেকে দয়ানন্দ পর্যন্ত সব ঋষি-মহর্ষি মেনেছেন।
শ্রী পরমহংস পরিব্রাজকাচার্য পরমবিদ্বান শ্রী স্বামী বিরজানন্দ জী মহারাজ আদর্শ ব্রহ্মচারী তথা সেই সময়ে অদ্বিতীয় পণ্ডিত ছিলেন। তাঁকে ব্যাকরণের সূর্য বলা হতো, তাঁরই কৃপায় তাঁর শিষ্য প্রাতঃ স্মরণীয় স্বামী দয়ানন্দ পূর্ণ বিদ্বান, পূর্ণ য়োগী তথা পূর্ণ ব্রহ্মচারী হন। যিনি পরবর্তীতে পতিত ভারতের ভাগ্য-বিধাতা আর বিশ্বের সুধারকদের শিরোমণি হন। সেই মহাপুরুষ স্বামী বিরজানন্দ জীর সম্বন্ধে স্বাধ্যায়শীল ব্যক্তিরা জানেন যে বিরজানন্দ জী বাল্যকাল থেকে অন্ধ ছিলেন। তাঁর পাঁচ বছর আয়ুতে দুই চোখের রত্ন চলে যায়। তারপরও তিনি এত উঁচু মহাত্মা আর বিদ্বান কিভাবে হলেন? তিনি চোদ্দ বছরের আয়ুতে গৃহত্যাগ করে পথে অনেক কষ্ট সহ্য করে ঋষিকেশে এসে পৌঁছান। এই স্থানকে অনেক কাল থেকেই পুণ্যপ্রদ পবিত্র স্থান মানা হয়। তাঁকে উপনয়ন (যজ্ঞোপবীত) সংস্কারের সময় গায়ত্রীর দীক্ষা দেওয়া হয়। তিনি এটা শুনে ছিলেন যে "পবিত্র গায়ত্রী মন্ত্রের সিদ্ধির বল দ্বারা মানুষ ঈশ্বর পর্যন্ত সাক্ষাৎ দর্শন করতে পারে।" বালকের সরল হৃদয়ে এই অমিত ছাপ লেগে যায় আর এর উপর তাঁর দৃঢ় নিশ্চয় হয়। এই কারণে ঋষিকেশে এসে তিনি একমাত্র গায়ত্রীর অবলম্বন (আশ্রয়) করেন আর অনন্যচিত্ত হয়ে তিনি শ্রদ্ধাপূর্বক গায়ত্রীর জপ করতে থাকেন। প্রাতঃকাল, সায়ংকাল, এমনকি কখনও-কখনও মধ্য রাত্রিতেও তিনি গায়ত্রীর সিদ্ধিতে লেগে থাকতেন। এর অতিরিক্ত প্রাতঃকালের স্নানের পশ্চাৎ গঙ্গার নির্মল জলে কণ্ঠ পর্যন্ত নিমজ্জিত হয়ে অনেক সময় ধরে তিনি গায়ত্রীর জপ করতেন। ব্রহ্মচারী বিরজানন্দের জপে এমন দৃঢ়তা দেখে ঋষিকেশের মানুষ আশ্চর্য হয়ে যেত।
.
তখনকার ঋষিকেশ এখনকার ঋষিকেশের সমান নিরাপদ ছিল না। সময়-সময়ে বনের পশুদের উপদ্রবের কারণে সেখানকার নিবাসিদের কষ্ট হতো। কখনও-কখনও এমনও হতো যে জঙ্গলী পশু রাতে এসে বিরজানন্দের ছোট্ট কুটির-ঘরকে ভেঙে যেত। ঋষিকেশ নিবাসী বিরজানন্দ প্রায়শঃ ফল-মূল খেয়েই দিন কাটাতেন। কখনও-কখনও মন্দির বা ক্ষেত্রে গিয়ে ভোজন করে আসতেন। কিন্তু এই ধরণের বিঘ্ন আর বাধা থাকা সত্ত্বেও বিরজানন্দ এক দিনের জন্যও নিজের লক্ষ্য থেকে ভ্রষ্ট হন নি, তিনি নিজের সংকল্পের উপর দৃঢ় আর নিরন্তর সাধনার উপর অবিচলিত থেকে অনেক দিন কাল-যাপন করতে থাকেন। এরপর তিনি ঋষিকেশ ছেড়ে কনখল চলে আসেন, সেখানকার পূর্ণাশ্রম জী বিদ্যা তথা বৈরাগ্যে পূর্ণ ছিলেন, ওনার কাছ থেকে সন্ন্যাস নেন, কিছুদিন ওনার কাছে অধ্যয়নও করেন। অন্যত্রও এইভাবে অধ্যয়ন করতে থাকেন, তার সঙ্গে-সঙ্গে পড়ানোরও কাজ করতে থাকেন।
পাঠক! আশ্চর্য হবেন যে তিনি চক্ষুহীন হওয়া সত্ত্বেও কিভাবে পড়েছেন। বিরজানন্দ জী ব্রহ্মচারী ছিলেন, ব্রহ্মচর্যের প্রভাব আর গায়ত্রীর সিদ্ধি দ্বারা তাঁর স্মৃতিশক্তি, ধারণাশক্তি উজ্জ্বলতর হয়ে গিয়েছিল। বাহ্য চক্ষু নাই বা থাকলো কিন্তু ভিতরের প্রজ্ঞাচক্ষু খুলে গিয়েছিল, এইজন্য তাঁকে প্রজ্ঞাচক্ষু বলা হতো। বিশেষ করে গায়ত্রী মন্ত্রের সিদ্ধির কারণে তিনি ধারণাবতী মেধাবুদ্ধির ধনী হয়ে যান।
গায়ত্রী মন্ত্র জপের বিশেষ ফলই হল স্মরণশক্তির তীব্রতা আর বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা। এরই ফলস্বরূপ প্রিয়তম প্রভু এই দুটো শক্তি নিজের প্রিয়পুত্র বিরজানন্দকে প্রদান করেন। আর এই শক্তির দ্বারাই বিরজানন্দ অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও সংসারের অবিদ্যান্ধকারকে ছিন্ন-ভিন্ন করে দেন। এইসব গুরুমন্ত্রের গুণগান আর জপেরই ফল বোঝা উচিত।
এই মন্ত্র পুস্তকের শুরুতে অর্থ সহিত পাঠকদের সুবিধার জন্য দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে কন্ঠস্থ করে শ্রদ্ধাপূর্বক প্রতিদিন জপ করে লাভ তুলে নিবেন। এই মন্ত্রের ছন্দ হল গায়ত্রী, এইজন্য এর নাম গায়ত্রী হয়েছে। এই মন্ত্রের দেবতা (বিষয়) হল সবিতা, এইজন্য একে সবিতাও বলে। শিশুকে বেদ অধিকার দেওয়ার জন্য আচার্য বা গুরু সর্বপ্রথম এই মন্ত্রের উপদেশ দিতেন, এইজন্য এই মন্ত্র গুরুমন্ত্রের নামে প্রসিদ্ধ হয়ে যায়। এই মন্ত্রকে বেদের সব মন্ত্রের শিরোমণি মানা হয়েছে। যারা এই বিষয়ে অধিক জানতে ইচ্ছুক তারা মহর্ষি দয়ানন্দ কৃত সত্যার্থ প্রকাশ আদি গ্রন্থ তথা স্বামী বেদানন্দ জী কৃত সাবিত্রী প্রকাশ পড়ে লাভ নিবেন।
এইভাবে প্রণব (ও৩ম্) এর জপেরও গুরুত্ব আছে, তাছাড়া পরমাত্মার অনন্ত গুণ আর কর্মের কারণে নামও অনন্ত আছে। এমন অনেক নাম আছে যা পরমাত্মারও হয় আবার অন্য পদার্থেরও হয়। যেমন ন্যায়কারী আর দয়ালু হল পরমাত্মার নাম কিন্তু ন্যায় আর দয়া করে এমন মানুষকেও ন্যায়কারী আর দয়ালু বলা হয়। ও৩ম্ হল এক এমন নাম যা পরমাত্মাকে ছাড়া আর কারও নাম হয় নয়।
"তস্য বাচকঃ প্রণবঃ" দ্বারা এটা সিদ্ধ করা হয়েছে যে জপ করার জন্য তো কেবল "ও৩ম্" নামেরই ব্যবহার করা উচিত, বেদাদি শাস্ত্রের মধ্যে পরমাত্মার মুখ্য নাম "ও৩ম্" -কেই বলা হয়েছে। আমাদের প্রাচীন পুরুষরা ঋষি-মহর্ষি সবাই জপের জন্য "ও৩ম্" নামেরই অনুষ্ঠান আর এরই ব্যবহার আর প্রচার করতেন।
পৌরাণিক যুগে ধর্মের ঠেকেদাররা অবতারবাদ সিদ্ধ করার জন্য আর প্রচার করার জন্য রাম, কৃষ্ণ আদি যা আমাদের মহাপুরুষদের নাম ছিল, সেগুলোকেই পরমাত্মা নাম বানিয়ে দেয় আর সেগুলোর খুব প্রচার করে আর সেই নামের দ্বারা দীক্ষাও নেওয়া শুরু করে। সেই ভ্রমে পড়ে থাকা সাম্প্রদায়িক মানুষ আজও রাম নাম আদির কীর্তন আর জপ করে। এর প্রভাব গান্ধী আদি আধুনিক নেতাদের উপরেও পড়ে আর এই কারণে রাম নাম আদির জপ তারা করতেন।
পাঠক যেন ভ্রমে না পড়ে যায়, এইজন্য আমি তাদের ঈশ্বরভক্তি সম্বন্ধীয় যে উদাহরণে ও৩ম্ বা ঈশ্বরের নামের ব্যবহার বার-বার করেছি সেটা তাদের আশয়ের অনুকূলই।
ও৩ম্ নামের মধ্যে সবথেকে বড় একটা বিশেষত্ব আছে। যেমন একটা মানুষ জন্ম থেকে মূক (বোবা) হলে সেই হীন মানুষটা হাজার চেষ্টা করলেও গড, আল্লাহ, রাম, কৃষ্ণ, ঈশ্বর আদি নামের দ্বারা পরমাত্মার ভজন করতে পারবে না। কারণ সে সেগুলোর উচ্চারণই করতে পারবে না। তাহলে কি সে ইচ্ছুক হওয়া সত্ত্বেও ঈশ্বরের ভজন থেকে বঞ্চিত থাকবে? না, কক্ষনো না! পরমাত্মার "ও৩ম্" নাম হল এমন একটা নাম যাকে কোনো বোবা ব্যক্তিও বলতে পারে। এইজন্য পরমাত্মার নিজ নাম হল "ও৩ম্" আর সেটা সিদ্ধ করতে এটা হচ্ছে প্রবল আর অকাট্য যুক্তি।
.
"ও৩ম্" এর অনেক অর্থ আছে, যেমন - সর্বব্যাপক, রক্ষক, সর্বজ্ঞ, পাপনাশক, সর্বশক্তিমান আদি। এইরূপ সুন্দর মধুর আর সংক্ষিপ্ত অনেক অর্থের গম্ভীর পরমেশ্বরের নাম আর অন্য কোনো ভাষাতে নেই। বেদের মধ্যেও "ও৩ম্" এর জপ করার আজ্ঞা দেওয়া হয়েছে - "ওম্ ক্রতো স্মর, ক্লিবে স্মর" ইত্যাদি। অর্থাৎ হে কর্মশীল জীব! তুমি নিজের কল্যাণের জন্য ও৩ম্ এর স্মরণ করো। ঋষি-মুনিরাও এইজন্য ও৩ম্ এর জপের উপর খুব বল দিয়েছেন। আমি পূর্বেই লিখেছি যে মহর্ষি পতঞ্জলি জী য়োগদর্শনের মধ্যে ও৩ম্ এর জপকে ব্রহ্মদর্শনের একটা সাধন বলেছেন।
গোপথ ব্রাহ্মণের মধ্যেও লেখা আছে যে "অমৃতম্ বৈ প্রণবঃ" অমৃত অর্থাৎ জীবন "অমৃতেনৈব তন্মৃত্যুম্ তরতি" অমৃত অর্থাৎ জীবনের দ্বারা মনুষ্য মৃত্যুকে পার করে।
.
এর মানে হল - জন্ম-মরণের চক্র থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ও৩ম্ হল একটা প্রবল সহায়ক। ব্রহ্মচর্য পালনের জন্য ও৩ম্ এর মতো পরম সহায়ককে ত্যাগ করে একজন সত্য ব্রহ্মচারী কিভাবে এদিক-সেদিক হারিয়ে যেতে পারে। এইজন্য প্রত্যেক ব্রহ্মচারীপ্রেমী বা ব্রহ্মচারীকে সর্বদা এই ব্রহ্মচারী ও৩ম্ এর শরণে নিবাস করা উচিত, যারদ্বারা কোনো ধরণের বিঘ্ন বাধার ভয় বা আশঙ্কাই না থাকে আর ব্রহ্মচর্যের এই কঠোর তপস্যাময় অসিধারা ব্রত সরল আর অত্যন্ত সুগম হয়। এইসব হওয়া সম্ভব তবে সত্য প্রচেষ্টা আর শ্রদ্ধা হতে হবে। সত্য প্রচেষ্টার শ্রদ্ধালু ব্রহ্মচারীর সামনে সেই পরম দয়ালু ও৩ম্ এর কৃপায় কোনো বিঘ্ন বাধাই আসে না। যদি কোনো পুরোনো সংস্কারের কারণে কামবাসনার অঙ্কুর মুখ দেখায় তাহলে সহস্র হাত দিয়ে রক্ষাকারী পরম দয়ালু ও৩ম্ তৎক্ষণাৎ সেই কাম রূপী অঙ্কুরের গ্রীবাকে ভেঙেচুরে ইতিশ্রী করে দেয়।
পর্বতে একটা বিচ্ছুর সমান কাটাদার ভয়ংকর পীড়া দেয় এমন বনস্পতি হয়। কিন্তু সেই বনস্পতির মূলেই আরেকটা অন্য বনস্পতি হয় আর তাকে স্পর্শ করলে সেই পীড়া দ্রুত দূর হয়ে যায়। সেখানকার নিবাসীরা একে ভালো করে জানে। ঠিক এইরকম যে দূষিত মনের মধ্যে দুষ্ট-বিচার বা কাম-বিকারের উদ্ভব বা উৎপত্তি হয় সেখানেও এই পাপ বিনাশক ও৩ম্ এর নিবাস আছে। কারণ আমাদের শুধু শরীর, মন আর আত্মাই কেন, এই সারা সংসারটাই সর্বব্যাপক ও৩ম্ দ্বারা পরিপূর্ণ।
তদেজতি তন্নৈজতি তদ্ দূরে তদ্বন্তিকে।
তদন্তরস্য সর্বস্য তদু সর্বস্যাস্য বাহ্যতঃ।। (য়জুঃ ৪০/৫)
এই সংসারের প্রত্যেক পদার্থের ভিতরে-বাইরে পরমেশ্বর বিদ্যমান আছেন। এমন কোনো স্থান নেই যেখানে তিনি নেই। এইজন্য বিদ্বান য়োগীজন তাঁকে বাইরে সন্ধান করা ছেড়ে দিয়ে সমাধির দ্বারা তার নিজের ভিতরেই দর্শন করেন। এইভাবে এমন বিকট সময় এলে ব্রহ্মচারীকে ঈশ্বরচিন্তনে লেগে পড়া উচিত আর প্রাণায়াম করতে-করতে ও৩ম্ এর জপ করা উচিত। কামরিপুর বধ করার জন্য এটা অমোঘ অস্ত্র আর কামরিপুরকে সর্বদা দমন করার জন্যই প্রাতঃ-সায়ং সন্ধ্যা-বন্দন আদি নিত্য কর্ম করা শুধু ব্রহ্মচারী কেন সকল আশ্রমবাসীদের জন্য অনিবার্য করা হয়েছে।
একটা শ্লোক যাকে আর্যসমাজের বিদ্বান উপদেশক পণ্ডিত সুরেন্দ্র শর্মা জী গৌর নিজের বক্তৃতাতে প্রায়শঃ শোনাতেন। তার কৃপায় আমি এটা প্রাপ্ত করেছি -
শতম্ বিহায় ভোক্তব্যম্, সহস্রম্ স্নানমাত্তরেত্।
লক্ষম্ বিহায় দাতব্যম্, কোটীম্ ত্যক্ত্বা হরিম্ ভজেত্।।
ভোজনের থেকে স্নান আবশ্যক আর এই দুটোর থেকে দান আবশ্যক আর দানের থেকেও ঈশ্বরের ধ্যান আবশ্যক। কোনো বিশেষ অবস্থায় অন্ন বা জল না প্রাপ্ত হলে অথবা রোগের কারণে স্নান আর ভোজন ত্যাগ করা যেতে পারে, কিন্তু এইরকম অবস্থাতেও পাত্রকে দান দেওয়ার ভাবনা আর পরোপকারের প্রবৃত্তিকে বজায় রাখা বিচারশীল ব্যক্তিদের আবশ্যক কর্তব্য। দুর্ভাগ্যবস্থায় দরিদ্রতে ধন-ধান্যের অভাবে মানুষ কাউকে দান দ্বারা সহায়তা করতে পারে না কিন্তু উপরোক্ত বাধা ঈশ্বর-চিন্তনে বাধক নয়। ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত, দরিদ্র, রোগী সবাই কোনো না কোনো রূপে ঈশ্বরের ভজন করতেই পারে, কেবল শ্রদ্ধা আর প্রভুপ্রেম দরকার, যা করতে একটা পয়সাও ব্যয় হয় না। এক কোটি কাজ একটা সময়ে কারও হয় না। এদের ছাড়ার অর্থ হল এটাই যে ঈশ্বর ভজন থেকে বড় কোনো আবশ্যক কাজ নেই এই সংসারে। এইজন্য কেবল ব্রহ্মচারী কেন প্রত্যেক কল্যাণের ইচ্ছুক ব্যক্তিকে সর্বদা শ্রদ্ধাপূর্বক সন্ধ্যোপাসনা করা উচিত।
কিন্তু সন্ধ্যোপাসনা বিধিপূর্বক করলে তবেই লাভ হয়। এই বিধি বিস্তারপূর্বক মহর্ষি দয়ানন্দ কৃত পঞ্চমহাযজ্ঞ বিধি, সংস্কারবিধি আদি গ্রন্থের মধ্যে দেওয়া আছে, সেখানে পড়ে পূর্ণ লাভ নিবে। এটা অবশ্যই ধ্যানে রাখবে যে বিনা প্রাণায়ামের সন্ধ্যা অসম্পূর্ণ হয়। প্রাণায়াম করার ফলে মানুষের মন আদি ইন্দ্রিয়ের মলিনতা আর চঞ্চলতা দূর হয়ে নির্মলতা আর একাগ্রতা প্রাপ্ত হয়। যারদ্বারা সন্ধ্যাতে ভালো করে মন লাগে আর আনন্দ আসে। এইজন্য সন্ধ্যার পূর্বে প্রাণায়াম অবশ্যই করবে।

🍁 প্রাণায়ামের বিধি 🍁
প্রাণায়ামের সামান্য বিধি হল - শুদ্ধ দেশ আর পবিত্র আসনে যেদিকের বায়ু হবে সেইদিকে মুখ করে সিদ্ধাসন লাগিয়ে বসবে। নাভির নিচে থেকে মূত্রেন্দ্রিয়কে উপরে সংকোচ (আকর্ষণ) করে হৃদয় বা ভিতরের বায়ুকে বল পূর্বক বাইরে নিক্ষেপ করে যথাশক্তি বাইরেই থামিয়ে রাখবে। পশ্চাৎ ধীরে ধীরে বায়ুকে ভিতরে নিয়ে সেখানেও কিছুক্ষণ থামিয়ে রাখবে। এটা একটা প্রাণায়াম হল। এইভাবে অন্তত তিনটা প্রাণায়াম করবে অথবা যত সামর্থ্য হবে তত করবে। নাসিকাকে হাত দিয়ে ধরবে না। যখন অস্থিরতা বোধ হবে তখন ধীরে-ধীরে বায়ুকে বাইরে বের করবে। আর যখন বাইরে বের করতে চাইবে তখন মূত্রেন্দ্রিয়কে (নাভির নিচের ভাগ) উপরে আকর্ষণ রাখবে। এইভাবে প্রাণ বাইরে অধিক সময় পর্যন্ত থাকতে পারে আর এই ক্রিয়া স্বপ্নদোষ আদিকে দূর করতে তথা ব্রহ্মচর্যরক্ষার জন্য অত্যন্ত সহায়ক। প্রাণায়াম করার সময় মনে-মনে ও৩ম্ এর জপ করবে অথবা প্রাণায়াম মন্ত্রের মানসিক জপ করবে। এইভাবে করলে আত্মা আর মনের পবিত্রতা আর স্থিরতা হয়।
.
এটা সর্বদা ধ্যানে রাখবে যে নিজের শক্তির অনুসারে সুখপূর্বক ভিতরে আর বাইরে প্রাণকে থামানো উচিত, বলপূর্বক অধিক সময় পর্যন্ত থামিয়ে রাখলে হানি হয়।
.
এটাই প্রাণায়ামের ক্রিয়া যেটা সন্ধ্যাতে প্রাণায়াম মন্ত্রের মধ্যে আছে, তার জপ করে করা উচিত। প্রাণায়ামের যে রীতি দেওয়া হয়েছে এইভাবে অন্তত তিন আর অধিক হতে অধিক একুশ প্রাণায়াম সন্ধ্যার সঙ্গে করা উচিত। এখানে বিধিপূর্বক সন্ধ্যা করার জন্য একটু লিখে দিয়েছি। ব্রহ্মচর্য পালনের দৃষ্টিতে প্রাণায়ামের বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এইজন্য এর পৃথক একটা ভাগ করে দেওয়া হয়েছে, সেটা স্বাধ্যায় করে লাভ নিবে।
যে ব্যক্তি নিজের আচরণের সুধার করে না আর দেখানোর জন্য সন্ধ্যা করে সে দম্ভী হয়। এই বিষয়ে মহর্ষি দয়ানন্দ লিখেছেন "পরমেশ্বরের যেমন গুণ সেই রকম গুণ কর্ম স্বভাব নিজেরও করবে। তিনি যেমন ন্যায়কারী তো নিজেও সেইরূপ ন্যায়কারী হবে আর যে কেবল ভাণ্ডের সমান পরমেশ্বরের গুণকীর্তন করতে থাকে আর নিজের চরিত্র সুধরায় না, তার স্তুতি করা ব্যর্থ।"
.
এইজন্য ব্রহ্মচারীর কর্তব্য হল সে "জগদীশ্বরকে সর্বব্যাপক, ন্যায়কারী, সর্বত্র, সর্বদা সব জীবের কর্মের দ্রষ্টাকে নিশ্চিত মেনে পাপের দিকে নিজের আত্মা আর মনকে কখনো যেতে দিবে না, কিন্তু সর্বদা ধর্মযুক্ত কর্মের মধ্যে বর্তমান রাখবে।"
আদর্শ ব্রহ্মচারী মহর্ষি দয়ানন্দ জীর এই আজ্ঞার অনুসারে চললে ব্রহ্মচারীকে ব্রহ্মচর্য নাশের কোনো ভয় থাকবে না আর সে অখণ্ডিত ব্রহ্মচর্য পালনে সহজেই সক্ষম আর সফল হবে। ব্রহ্মচারীর ব্রহ্মচর্যের শুভ আর পবিত্র প্রতিজ্ঞাকে পরমাত্মা তাঁর কৃপায় পূর্ণ করেন আর তারফলে সে পূর্ণ বিদ্বান, বলবান আর আয়ুষ্মান হয়ে সম্পূর্ণ আনন্দের প্রাপ্তি করে।
🍁 হবন 🍁
যেভাবে সায়ং-প্রাতঃ উভয় সন্ধিবেলাতে সন্ধ্যোপাসনা করা আবশ্যক সেইভাবে সবাইকে দুই সময় নিত্য অগ্নিহোত্র (হবন) করাও উচিত। এর বিধিও মহর্ষি দয়ানন্দ জী কৃত পঞ্চমহাযজ্ঞ বিধি আর সংস্কারবিধি আদি গ্রন্থের মধ্যে লেখা আছে। সেই অনুসারে নিয়মপূর্বক অগ্নিহোত্র করে লাভ নিবে।
এটা সবাই জানে যে আমাদের শরীর থেকে মল-মূত্র আদি রূপে দূষিত আর দুর্গন্ধযুক্ত পদার্থ নিষ্কাশিত হতে থাকে যা জল-বায়ুকে দুর্গন্ধযুক্ত আর দূষিত করে। জল-বায়ু খারাপ হওয়াতে রোগের উৎপত্তি আর রোগের কারণে প্রাণীদের দুঃখ হয়। এইভাবে চন্দন, ঘৃত আদি সুগন্ধিত আর পৌষ্টিক দ্রব্য যা হবনের সময় অগ্নিতে দেওয়া হয় সেই পদার্থ সূক্ষ্ম হয়ে ছড়িয়ে বায়ুর সঙ্গে দূর দেশে গিয়ে দুর্গন্ধের নিবৃত্তি করে আর জল-বায়ু সুগন্ধিত হওয়াতে আরোগ্যের বৃদ্ধি আর রোগের নাশ করে, যারফলে সব রোগের নাশ হয়। অগ্নিতে দেওয়া পদার্থ নষ্ট হয় না। কারণ যেখানে হবন হয় সেখান থেকে দূর দেশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষও (নাসিকা দ্বারা) সুগন্ধের গ্রহণ করে। পদার্থ বিদ্যার জ্ঞানী ব্যক্তিরা এটা ভালো ভাবে জানে যে অগ্নিতে ভেদক শক্তি আছে। যখন হোম করা হয় তখন সেটা ঘরে থাকা বায়ু আর দুর্গন্ধযুক্ত পদার্থকে ছিন্ন-ভিন্ন আর হালকা করে ঘরের বাইরে বের করে দেয় আর তার স্থানে পবিত্র বায়ুর প্রবেশ করিয়ে রোগের নাশ আর সুখের বৃদ্ধির করে। ঘরে রাখা কেসর কস্তুরী বা সুগন্ধিত পুষ্পের সুগন্ধের তেমন সামর্থ্য নেই যে গৃহস্থ বায়ুকে বাইরে বের করে শুদ্ধ বায়ুকে প্রবেশ করাতে পারে। কারণ এরমধ্যে অগ্নির সমান ভেদক শক্তি নেই। যে ব্যক্তি হোম করে না সে পাপের সমান ভাগী হয়। এই বিষয়ে সত্যার্থ প্রকাশের মধ্যে লেখা আছে - "কেননা, মানুষের শরীর হতে যে পরিমাণ দুর্গন্ধ উৎপন্ন হয়ে জল-বায়ুকে দূষণ করে এবং রোগোৎপত্তির কারণ হয়ে প্রাণীদের পক্ষে দুঃখকর হয়, সেই মানুষের সেই পরিমাণ পাপও হয়। এইজন্য সেই পাপ নিবারণার্থ সেই পরিমাণ অথবা তদপেক্ষা অধিক সুগন্ধ বায়ু ও জলের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া আবশ্যক। পানাহারের দ্বারা কেবল ব্যক্তি বিশেষের সুখ হয়। কিন্তু একজন ব্যক্তি যে পরিমাণ ঘৃত আর সুগন্ধ পদার্থাদি ভোজন করে, সেই পরিমাণ দ্রব্যের হবন দ্বারা লক্ষ-লক্ষ মানুষের উপকার হয়। তবে মানুষ যদি উত্তম ঘৃতাদি, উত্তম বস্তু ভোজন না করে তাহলে তার শারীরিক আর আত্মিক বলবৃদ্ধি হবে না। অতএব উত্তম ভোজ্য আর পানীয় গ্রহণ করানও আবশ্যক। কিন্তু তদপেক্ষা অধিক পরিমাণে হোম করা উচিত। অতএব হোম করা অত্যাবশ্যক। (সত্যার্থ প্রকাশ, তৃতীয় সমুল্লাস)
.
আমাদের পূর্বজরা সবাই প্রাচীন কাল থেকে সন্ধ্যার সমান হবনও প্রতিদিন করতেন। বাল্মীকি রামায়ণে লেখা আছে -
দ্রষ্টুমশক্যময়োধ্যায়াম্ নাবিদ্বান্ন চ নাস্তিকঃ।
নানাহিতাগ্নির্নায়জ্বা ন ক্ষুদ্রো বা ন তস্করঃ।।
(বাল্মীকি রামায়ণ, বালকাণ্ড, সপ্তম সর্গ)
অযোধ্যাতে অশিক্ষিত, নাস্তিক, প্রতিদিন যজ্ঞ করে না এমন ব্যক্তি, নীচ আর চোর আদি খুঁজেও পাওয়া যাবে না, সেখানে এদের দর্শন অসম্ভব অর্থাৎ সবাই ঈশ্বরের ভক্ত, আস্তিক, বিদ্বান, ধর্মাত্মা আর প্রতিদিনের যজ্ঞকারী ছিল।
অশ্বপতি মহারাজের রাজ্যও এইরকম ছিল। কেবল এই দুটো কেন, সৃষ্টি থেকে মহাভারতের কিছু কাল পূর্ব পর্যন্ত সারা ভারতবর্ষেই এইরকম অবস্থা ছিল।
সত্যার্থ প্রকাশে মহর্ষি দয়ানন্দ জী লিখেছেন - "প্রত্যেক মানুষ ষোলো আহুতি দিবে আর প্রত্যেক আহুতির পরিমাণ ন্যূনকল্পে ছয় মাষা ঘৃতাদি হওয়া উচিত। আর যদি অধিক হয় তাহলে অতি উত্তম। এইজন্য আর্যবর শিরোমণি মহাশয, ঋষি, মহর্ষি, রাজা, মহারাজারা অনেক হোম করতেন আর করাতেন। যতদিন এই হোম দেশে প্রচলিত ছিল ততদিন পর্যন্ত আর্যবর্ত দেশ নিরোগ আর সুখপূর্ণ ছিল। এখনও যদি পুনঃ হোমের প্রচার করা হয় তাহলে সেইরূপ হয়ে যাবে।" (সত্যার্থ প্রকাশ, তৃতীয় সমুল্লাস)
এইজন্য ব্রহ্মচারীকে সন্ধ্যার সমান হোমও প্রতিদিন করা উচিত কারণ হোমের জন্য শাস্ত্রের মধ্যে অনধ্যায় (ছুটি) করার অনুমতি নেই।
(পঞ্চম ভাগ সমাপ্ত)

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

ছান্দোগ্য উপনিষদ

  সামবেদ-তাণ্ড্য শাখার- ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণের অন্তর্গত শঙ্কর ভাষ্য ও বৈদিক ভাষ্য সহঃ পরিচয় ছান্দোগ্য উপনিষৎ সামবেদোক্ত ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণের অ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ