প্রাণায়াম - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

19 March, 2024

প্রাণায়াম

 << পূর্ববর্ত্তী পঞ্চমভাগ

ব্রহ্মচর্য

প্রাণায়াম (ষষ্ঠ ভাগ)
ভূমিকা
"প্রাণায়াম হচ্ছে ব্রহ্মচারীর প্রাণ" এটা সোলো আনা সত্য। প্রাণায়ামের সাধনা শ্রদ্ধাপূর্বক নিরন্তর দীর্ঘকাল অভ্যাস না করা পর্যন্ত পূর্ণরূপে সিদ্ধ হয় না আর বিনা ব্রহ্মচর্য পালন করে এর সিদ্ধির সফলতা প্রাপ্ত হয় না। যদি কেউ প্রাণায়ামের সাধনা না করে ব্রহ্মচর্য পালনে সফলতা প্রাপ্ত করতে চায় তাহলে সেটা এমন দুঃসাহস হবে যে যেমন কেউ বিন্দুকে ধরে আকাশে চড়তে চায়। অতঃ "প্রাণায়ামঃ পরমম্ তপঃ" অর্থাৎ প্রাণায়াম হল সর্বশ্রেষ্ঠ তপ, এমন রহস্যপূর্ণ বাক্য লিখে মনু জী আমাদের চক্ষু খুলে দিয়েছেন, কারণ তপ হচ্ছে ব্রহ্মচারীর ভূষণ। এইজন্য মহর্ষি দেব দয়ানন্দ জী দয়া করে আমাদের এই ভাবে সাবধান করে দিয়েছেন যে "কেউ রাজকুমার অথবা রাজকুমারী হোক অথবা কোনো দরিদ্রের সন্তান হোক, সবাইকে তপস্বী হওয়া উচিত।"
এইজন্য প্রত্যেক বালককে নিজের কল্যাণার্থ অনিবার্য রূপে ব্রহ্মচর্যের সাধনার জন্য তপ করতেই হবে। এটা ছাড়া অখণ্ড ব্রহ্মচর্যের পালন করা একদমই অসম্ভব, আর শরীর শুকনো করা বা খিদাতে মরার নাম তপ নয় কিন্তু ধর্মের কাজ করতে গিয়ে যেসব কষ্ট আসবে তাকে সহ্য করে নিরন্তর ধর্মাচরণ করাই হল তপ। এই তপ তো সাধারণত প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য আচরণে নিয়ে আসার তপ হয় কিন্তু যে ব্যক্তি সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হতে চাইবে তাকে সর্বশ্রেষ্ঠ তপ প্রাণায়ামের সাধনা করতেই হবে। এইজন্য সকল আশ্রমবাসীকে প্রাণায়ামের অভ্যাস করার জন্য ঋষিরা আদেশ দিয়েছেন কিন্তু সর্ব আশ্রমের আধার ব্রহ্মচর্যাশ্রমের মধ্যে সফলতা প্রাপ্ত করার জন্য প্রাণায়াম রূপী তপের আগুনে না তাপা পর্যন্ত কল্যাণ অথবা সফলতা নেই।

প্রাণ আর ব্রহ্মচারীর পরস্পর একটা গুরুত্বপূর্ণ সম্বন্ধ আছে, এর উপর ছান্দোগ্য উপনিষদের আধারে মহর্ষি দয়ানন্দ জী সত্যার্থ-প্রকাশ গ্রন্থের মধ্যে প্রকাশ ফেলেছেন, তিনি লিখেছেন - ব্রহ্মচর্য তিন প্রকারের হয়, কনিষ্ঠ, মধ্যম আর উত্তম। কনিষ্ঠ ব্রহ্মচারীর জন্য এটা সত্কর্ত্তব্য যে ২৪ বছর পর্যন্ত জিতেন্দ্রিয় অর্থাৎ ব্রহ্মচারী থেকে বেদাদি বিদ্যা আর সুশিক্ষা গ্রহণ করবে আর বিবাহ করার পরও লম্পট হবে না, তাহলে তার শরীরে প্রাণ বলবান হয়ে সব শুভ গুণের বাস হবে আর ব্রহ্মচারীর শরীর তথা আত্মা আরোগ্য আর বলবান হবে।"

এর ফল এমন লেখা আছে যে - "বসু ব্রহ্মচারীর আয়ু ৭০ বা ৮০ বছর পর্যন্ত হবে। মধ্যম ব্রহ্মচর্য হল যারা ৪৪ বছর পর্যন্ত ব্রহ্মচারী থেকে বেদাভ্যাস করে, তাদের প্রাণ ইন্দ্রিয়, অন্তঃকরণ আর আত্মা বলবান হয়ে দুষ্টদের রোদন করায় আর শ্রেষ্ঠদের পালনকারী হয়। যেসব ব্রহ্মচারী প্রথম বয়ের মধ্যে তপশ্চর্যা করে তার এই রুদ্র রূপ প্রাণযুক্ত হয়ে এটা মধ্যম ব্রহ্মচর্য সিদ্ধ হবে। উত্তম ব্রহ্মচর্য ৪৮ বছর পর্যন্ত হয়। উত্তম ব্রহ্মচারীর প্রাণ অনুকূল হয়ে সর্বপ্রকার বিদ্যা গ্রহণ করে। যে আচার্য আর মাতা-পিতা নিজের সন্তানকে প্রথমে বিদ্যা ও গুণ গ্রহণের জন্য তপস্বী বানিয়ে সেই বিষয়েরই উপদেশ করেন, সেইসব সন্তান নিজেরাই তৃতীয় উত্তম অখণ্ডিত ব্রহ্মচর্যকে পূর্ণ করে, তাদের আয়ু পূর্ণ অর্থাৎ ৪০০ বছর পর্যন্ত প্রাপ্ত হয় আর যারা এই ব্রহ্মচর্যকে প্রাপ্ত করে সেটা নষ্ট করে না তারা সব ধরণের রোগ হতে রহিত হয়ে ধর্ম, অর্থ, কাম আর মোক্ষকে প্রাপ্ত করে।"
উপরোক্ত লেখাতে আদর্শ ব্রহ্মচারী মহর্ষি দয়ানন্দ জী ব্রহ্মচারীকে তপস্যা করার জন্য আদেশ করেছেন আর তিন প্রকারের ব্রহ্মচারীদের ব্রহ্মচর্য দ্বারা যেসব ফল প্রাপ্তি হয় তারও উল্লেখ করেছেন। এরমধ্যে একটা কথা ধ্যান দেওয়া উচিত যে "প্রথম বসু ব্রহ্মচারীর শরীরে প্রাণ বলবান হয়ে সব শুভ গুণ বাস করে আর তার শরীর ও আত্মা নিরোগ তথা বলবান হয় অর্থাৎ সত্যিকারের বৈশ্য হয়। দ্বিতীয় রুদ্র ব্রহ্মচারীর প্রাণ, ইন্দ্রিয়, অন্তঃকরণ আর আত্মা বলবান হয় আর সেই রুদ্ররূপ প্রাণ দ্বারা যুক্ত হয়ে দুষ্টদের রোদন করাতে আর শ্রেষ্ঠদের পালন করার শক্তি প্রাপ্ত করে অর্থাৎ সত্যিকারের ক্ষত্রিয় হয়। তৃতীয় উত্তম ব্রহ্মচারী ৪৮ বছর পর্যন্ত অখণ্ডিত ব্রহ্মচর্যের পালন করে। তার প্রাণ তার অনুকূল হয় আর সে সর্বপ্রকার বিদ্যার ভাণ্ডার হয়ে যায়।

তার আয়ু পূর্ণ অর্থাৎ ৪০০ বছর পর্যন্ত প্রাপ্ত হয়। এই রকম অখণ্ড ব্রহ্মচারী যদি ব্রহ্মচর্যের ক্ষয় না করে তাহলে সে নিজের জীবনের অন্তিম লক্ষ্যকে অর্থাৎ পুরুষার্থ চতুষ্টয় ধর্ম, অর্থ, কাম আর মোক্ষ, জীবনের এই চারটা ফলকে সে প্রাপ্ত করে। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ অখণ্ডিত ব্রহ্মচর্যের পালন করে পূর্ণ বিদ্বান হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত তার প্রাণ অনুকূল হবে না, আর প্রাণ অনুকূল না হওয়া পর্যন্ত পূর্ণ আয়ু যার অবধি ৪০০ বছর বলা হয়েছে, প্রাপ্ত হবে না আর এই রকম দেব পুরুষই মৃত্যুকে জিতে মোক্ষ প্রাপ্ত করে। "ব্রহ্মচর্য়েণ তপসা দেবা মৃত্যুমপাঘ্নত। ইন্দ্রো হ ব্রহ্মচর্য়েণ দেবেভ্যঃ স্বরাভরত্", দেবতারা ব্রহ্মচর্য আর তপ না করে মৃত্যুকে জিততে পারবে না আর এই ইন্দ্র অর্থাৎ আত্মা নিজের ইন্দ্রিয়কে নিশ্চিত ভাবে ইহলৌকিক সুখ আর পরলৌকিক মোক্ষ আনন্দ তখনই প্রদান করতে পারবে যখন সে নিশ্চিত ভাবে সর্বোত্তম ব্রহ্মচর্যের পালন করবে। "দেবা অমৃতমানশানাঃ" দেবতারা অমৃতের ভোগ অর্থাৎ অমরপদের প্রাপ্তি করে। বেদের এই শিক্ষা এটাই সিদ্ধ করে যে দেবলোকে যাওয়ার জন্য দেব না হওয়া পর্যন্ত নির্বাহ হবে না। সেখানে দেবতারাই প্রবেশ করতে পারে আর দেবতা হওয়ার পূর্বে তো সর্বোত্তম ব্রহ্মচর্যের পালন করে ঋষি পদের প্রাপ্তি করতে হবে। "চতুর্বেদাদৃষিঃ, অত ঊর্ধ্বম্ দেবঃ" ব্রহ্মচর্য পালন করার সাথে চারটা বেদ সাঙ্গোপাঙ্গ পড়ার পর ঋষি পদের প্রাপ্তি হবে। দেবতাদের স্থান ঋষিদেরও উপরে আর এক-একটা বেদ পড়ার জন্য ১২-১২ বছর পর্যন্ত ব্রহ্মচর্য পালন করা অত্যন্ত আবশ্যক, তারপর ঋষিপদ পাওয়া যায় আর দেবপদ তো তার থেকেও উঁচুতে, অর্থাৎ সারা জীবন যে অখণ্ড ব্রহ্মচর্য পালন করার জন্য প্রচণ্ড তপশ্চর্যা করবে, সে-ই দেব হয়ে মৃত্যুকে জিতে মোক্ষকে প্রাপ্ত করবে। এই রকম আপ্ত পুরুষ দেব দয়ানন্দ ছিলেন। এইজন্য প্রাণের বসুরূপ, রুদ্ররূপ আর আদিত্যরূপকে প্রাপ্ত করার জন্য তিন প্রকারের ব্রহ্মচর্যের উপদেশ করা হয়েছে।
ঋষি দয়ানন্দ পুরুষের বিবাহের সর্বোত্তম সময় ৪৮ বছর বলেছেন, কারণ এই আয়ুতে সব সাঙ্গোপাঙ্গ বেদ তথা শরীরস্থ সব ধাতু পুষ্ট হয়ে পূর্ণত্বকে প্রাপ্ত করে। "পুরুষের যেমন সর্বোত্তম বিবাহের সময় ৪৮ বছর, তেমনই স্ত্রীদের ২৪ বছর। এমনও লেখা আছে যে এই সময়ের পশ্চাৎ যে ধাতুবৃদ্ধি হয় সেটা শরীরে থাকে না কিন্তু স্বপ্ন, ঘর্মাদি দ্বারা বাইরে বেরিয়ে যায়। অতঃ ৪৮ বছরের পর পুরুষ আর ২৪ বছরের পর স্ত্রীকে ব্রহ্মচর্য থাকা উচিত নয়", এই স্থানটা পড়ে অনেকবার ব্রহ্মচারী-প্রেমীদের সন্দেহ হয় যে - ২৪ বছর পর স্ত্রী আর ৪৮ বছর পর পুরুষের শরীরে যে বীর্যাদি ধাতু বাড়ে সেটা যখন শরীরের মধ্যে থাকবেই না আর স্বপ্ন, প্রস্বেদাদি দ্বারা বাইরে বেরিয়ে যাবে তাহলে ব্রহ্মচারী হয়ে কি লাভ? এই বিষয়ে অনেকবার ব্রহ্মচারী-প্রেমীরা সাক্ষাৎ করে তথা পত্র দ্বারা শঙ্কা করেছে, তারা মহর্ষি দয়ানন্দের যথার্থ তাৎপর্যকে না বুঝতে পেরে ভ্রমে পড়ে যায়। আসলে, উপরোক্ত কথাটা সামান্য ব্যক্তিদের বিষয়ে লেখা হয়েছে কিন্তু যারা সারা জীবন ব্রহ্মচারী থাকতে চায়, এই নিয়মটা তাদের জন্য নয়। এই নিয়ম তো বিবাহ করবে এমন পুরুষ আর স্ত্রীদের জন্য, "কিন্তু যারা বিবাহ করতেই নিচ্ছুক নয়, তারা আমরণ ব্রহ্মচারী থাকতে পারলে থাকুক - ভালো কথা।

কিন্তু এই কাজ পূর্ণ বিদ্বান, জিতেন্দ্রিয় আর নির্দোষ য়োগী স্ত্রী-পুরুষের জন্য। কারণ কামবেগকে দমন করে ইন্দ্রিয় সমূহকে আত্মবশে রাখা খুবই কঠিন কাজ।" মহর্ষি দয়ানন্দ জীর অনেক ইচ্ছে ছিল যে তার সমান এইরকম সারাজীবন ব্রহ্মচারী হয়ে থাকা স্ত্রী আর পুরুষ সহস্র হোক। তিনি পুনাতে একটা বক্তৃতা দেওয়ার সময় সেই ইচ্ছাকে এইভাবে প্রকট করেছিলেন - "আর্য ধর্মের উন্নতির জন্য আমার মতো অনেক উপদেষক আপনার দেশে হওয়া উচিত। এইরকম কাজ একা কেউ ঠিকভাবে করতে পারবে না তবুও এটা দৃঢ় নিশ্চয় করে নিয়েছি যে নিজের বুদ্ধি আর শক্তির অনুসারে যা কিছু দীক্ষা নিয়েছি তা চালিয়ে যাবো।"
দেব দয়ানন্দের কত দৃঢ় ধারণা ছিল, তিনি তাঁর এই ইচ্ছাকে পুনরায় সত্যার্থ প্রকাশের মধ্যে এই বাক্যে প্রকট করেন - "যে পুরুষ বা স্ত্রী বিদ্যা, ধর্ম বৃদ্ধি আর সারা সংসারের উপকার করতেই ইচ্ছুক, তারা বিবাহ করবে না, যেমন পঞ্চশিখাদি পুরুষ আর গার্গী আদি স্ত্রী হয়েছিলেন।" উপরোক্ত প্রমাণ দ্বারা এটা সিদ্ধ হয় যে দেব দয়ানন্দ নিজের সমান দেশোপকারের জন্য সহস্র নৈষ্ঠিক অর্থাৎ আজীবন ব্রহ্মচারী আর ব্রহ্মচারিণি বানাতে চেয়েছিলেন, এইরকম অবস্থায় যদি ৪৮ বছরের পশ্চাৎ শরীরে বীর্যাদি ধাতুকে সুরক্ষিত না রাখা যেতে পারে তাহলে তিনি স্বয়ং কেন ব্রহ্মচারী হতেন আর নিজের সমান "ব্রহ্মচর্য়েণ তপসা রাজা রাষ্ট্র বিরক্ষতি। আচার্য়ো ব্রহ্মচর্য়েণ ব্রহ্মচারিণমিচ্ছতে" এই বেদ মন্ত্রের অনুসারে ব্রহ্মচারীদের কামনা কেন করতেন। আসল কথা হল এই কাজটা সর্বশ্রেষ্ঠ কিন্তু খুবই কঠিন, তাই ঋষিবর লিখেছেন যে এই কাজ পূর্ণ বিদ্বান আর পূর্ণ য়োগীদের।
য়োগের আটটা অঙ্গ আছে আর সেই আটটার মধ্যে একটা অঙ্গ হল প্রাণায়াম, যাকে পরম তপ বলা হয়েছে আর প্রাণায়ামাদির সাধনা ছাড়া পূর্ণ য়োগী কেন সাধারণ ব্রহ্মচারীও হতে পারবে না। এইজন্য প্রাণায়াম হচ্ছে ব্রহ্মচারীর প্রাণ। সত্যার্থ প্রকাশের মধ্যে একটা শঙ্কা আছে যে "যারা ব্রহ্মচর্য থেকে সন্ন্যাস নিবে তাদের নির্বাহ কষ্টকর হবে, কামকে থামিয়ে রাখাও অতি কঠিন হবে, এইজন্য গৃহাশ্রম, বানপ্রস্থ হয়ে যখন বৃদ্ধ হয়ে যাবে তখনই সন্ন্যাস নেওয়া উচিত।" ঋষিবর এর উত্তর দিয়েছেন - "যারা নির্বাহ করতে পারবে না, ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে না তারা ব্রহ্মচর্য থেকে সন্ন্যাস নিবে না কিন্তু যারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে তারা কেন নিবে না? যে পুরুষ বিষয়ের ফলে দোষ আর বীর্য সংরক্ষণের গুণ জেনে গেছে, সে কখনো বিষয়াসক্ত হবে না, তার বীর্য বিচারাগ্নির ঈন্ধনবত্ হবে অর্থাৎ তার মধ্যেই ব্যয় হয়ে যাবে।"

এই বাক্যটা পূর্বোক্ত শঙ্কার পূর্ণ সমাধান করে দিয়েছে। যে ব্যক্তি প্রাণায়ামাদির সাধনা করে তার বীর্য স্বপ্ন আর প্রস্বেদাদির দ্বারা বাইরে বেরিয়ে আসে না, সে ঊর্ধ্বরেতা হয় অর্থাৎ তার বীর্য প্রাণায়ামের দ্বারা তার মস্তিষ্কের মধ্যে পৌঁছে যায় আর সেখানে বিচারাগ্নির জ্বালানি হয়ে তারমধ্যে ব্যয় হয় আর ব্রহ্মচারীর মস্তিষ্কের মধ্যে জ্ঞানের জ্যোতি প্রকাশিত হয়। বীর্যের একটা অণুও তার শরীর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে না। যেমন প্রদীপের তেল বাতির দ্বারা উপরে চড়তে থাকে আর সবকিছু প্রকাশিত করে, তেমনই আদিত্য ব্রহ্মচারী প্রাণায়ামের দ্বারা এই বীর্যকে মস্তিষ্কের মধ্যে পৌঁছে দিয়ে, সব বিদ্যার মাধ্যমে পরিপূর্ণ হয়ে সূর্যের সমান সংসারকে দেদীপ্যমান করে তোলে। যেভাবে এই পবিত্র আর্যাবর্তের মধ্যে "অষ্টাশীতি সহস্রাণি ঋষীণামূর্ধ্বরেতসাম্ বভূবুঃ" ৮৮ হাজার ঊর্দ্ধরেতা অখণ্ড ব্রহ্মচারী ঋষি হয়েছিল যারা এই এই ব্রহ্মচর্যের প্রতাপ দ্বারাই সারা বিশ্বের মধ্যে বেদের পবিত্র জ্ঞানের প্রকাশ করেছে আর প্রাণায়ামাদি অষ্টাঙ্গ য়োগ দ্বারা পূর্ণ য়োগী হয়ে ঊর্দ্ধরেতা পদবীকে প্রাপ্ত করেছে।
এইজন্য ব্রহ্মচারীর প্রাণ প্রাণায়ামকে গ্রহণ করে আমাদের দেশের বালক-বালিকারা সত্যিকারের ব্রহ্মচারী হতে সফল হোক, এই ভাবনার সঙ্গে ব্রহ্মচারীর প্রাণ "প্রাণায়াম" এই ছোট্ট পুস্তকটা পাঠকদের ভেট করছি।

- ওমানন্দ সরস্বতী
গুরুকুল ঝজ্জর
শিবরাত্রি ২০৩২ (বিক্রম সম্বত্)

প্রাণায়াম (ষষ্ঠ ভাগ)
প্রাণায়ামের গুরূত্ব
আজ মানুষের জীবন নিতান্ত নীরস আর ক্লেশপূর্ণ হয়ে গেছে। চতুর্দিকে ভয় আর আশঙ্কার মেঘে আকাশ মেঘলা হয়ে উঠেছে। মানুষের জীবনে সুখ শান্তির কোনো লক্ষণই দৃষ্টিগোচর হয় না। সারা বিশ্ব একটা ভয়ংকর অশান্তির আগুনে ধুধু করে জ্বলছে। জীবাত্মাকে সব লৌকিক সুখ প্রাপ্তি করার সাধন আর মোক্ষ পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার সুন্দর বাহন রূপী এই শরীর বিভিন্ন ব্যাধির দ্বারা জর্জরিত হয়ে যাচ্ছে। "শরীরম্ ব্যাধিমন্দিরম্" এই উক্তি স্পষ্ট রূপে চরিতার্থ হচ্ছে। আর্য সন্তান রাজযক্ষ্মা, (তপেদিক) শ্বাস-দমা, প্রমেহ, অর্শ, হৃদয়-রোগ, যকৃৎ-রোগ, উদর-রোগ তথা ভয়ংকর বাতের রোগে পীড়িত হয়ে গোঙাচ্ছে। রোগীদের চিৎকারে বায়ুমণ্ডল পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। বৈদ্য আর ডাক্তার ছায়ার মতো মানুষদের পিছু পিছু ছুটছে, কিন্তু এতসব চেষ্টার পরেও দেশের স্বাস্থ্য উন্নতির স্থানে দিন প্রতিদিন অবনতিই হচ্ছে। শরীরের সমান মনেরও অবস্থা হয়েগেছে, সবাই মানসিক রোগে পীড়িত আর কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, ঈর্ষা, মদ, মৎসর আদি ভয়ংকর শত্রু আজ খুব বেড়ে গেছে।
কামের অগ্নি মানুষকে ভস্মসাত করছে, তবুও মানুষ অন্ধ হয়ে পতঙ্গের সমান এই বিষয়ের অগ্নিতে ঝাঁপ দিচ্ছে। শৃঙ্গারপূর্ণ জীবন, দূষিত শিক্ষা তথা অশ্লীল চলচ্চিত্র এই অগ্নিতে বায়ুর সমান কাজ করছে। ক্রোধও তার প্রচণ্ড অবস্থাতে আছে, আর ক্রোধ রূপী বিষে সিক্ত বচন অন্য মানুষের হৃদয়ে নিজের সমানই প্রতিক্রিয়া উৎপন্ন করে বাতাবরণকে বিক্ষুব্ধ করছে, আর তাই দ্বেষ, ঈর্ষা, বিবাদ তথা কলহের বাজার ভয়ংকর গরম হয়ে আছে। ধনের তাপ তো মানুষের জীবনের ধারাকেই পরিবর্তন করে দিয়েছে, যে মানুষের জন্ম আত্ম-জ্ঞানের জন্য হয়েছিল, আজ তারাই এই ভৌতিক পার্থিব নুড়ি-পাথর সংগ্রহতে ব্যর্থ নষ্ট করে দিচ্ছে, জীবনের মাপদণ্ড কেবলমাত্র টাকা রোজগার করাই হয়ে গেছে। চরিত্র, সংযম, ব্রহ্মচর্য, য়োগাভ্যাসের তো কোথাও নামও শোনা যায় না। এইভাবে আজ মানসিক রোগকে অমৃত মনে করে স্নেহের সঙ্গে তাকে বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
হে মানব জাতি! তুমি কি জানো আমাদের এই দয়নীয় দশা কেন হয়েছে? জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সুখ আমাদের জন্য মৃগ মরীচিকা মাত্র হয়ে গেছে? জীবনে এত বিষমতা-অশান্তি আর নিরাশা কোথা থেকে এসেছে? সব প্রকারের দিব্য শক্তি থেকে আমাদের সম্বন্ধ কেন বিচ্ছেদ হয়ে গেছে? আজ আমরা কেন পশুদের থেকেও নিকৃষ্ট, দীন-হীন, দুঃখী আর নিরাশ্রয় হয়ে গেছি? এইসব প্রশ্নের যদি আপনি একটাই উত্তর জানতে চান তাহলে আমি বলবো যে আমরা বেদের মধ্যে পরমেশ্বরের দ্বারা উপদিষ্ট প্রাণ বিদ্যাকে ভুলে গেছি। এই জীবনদায়িনী প্রাণবিদ্যাকে আদি সৃষ্টিতে বেদ দ্বারা ঋষি-মুনিরা প্রাপ্ত করে সকল মানুষের নিকট এর ক্রিয়াত্মক প্রচার করেছিলেন। এই প্রাণবিদ্যারই স্বরূপ হচ্ছে প্রাণায়াম, যার দ্বারা "ন হ অস্য প্রজা হীয়তে"র অনুসারে আমাদের দেশে আয়ু মধ্যম শত বর্ষ ছিল আর মানুষ চারশো বছর পর্যন্তও নিরোগ জীবন ধারণ করতো আর মৃত্যুঞ্জয় পদবী দ্বারা বিভূষিত হতো। পিতার সামনে পুত্রের মৃত্যু হতো না, বিশাল ললাট, বলবান আর প্রসারিত হওয়া বক্ষঃস্থল, প্রচণ্ড ভুজদণ্ড তথা কান্তিযুক্ত ৬ ফিট লম্বা সুদৃঢ় সুন্দর শরীরকে দেখে রোগ দূরেই থাকতো। প্রাণায়ামের প্রভাবে শরীর আর মন পবিত্র হওয়ার কারণে কোনো প্রকারের নির্বলতা, নিরাশা, নিষ্কর্মণ্যতার কোনো স্থান ছিল না। এই প্রাণ বিদ্যা ভারতবর্ষের প্রত্যেক নর-নারী নিকট পর্যন্ত পৌঁছে ছিল, এর প্রভাবেই সকলে চরিত্রের ধনী হতো আর এই কারণেই মনু মহারাজ বিশ্বের সম্মুখে ঘোষণা করেছিলেন -
এতদ্দেশপ্রসূতস্য সকাশাদগ্রজন্মনঃ।
স্বম্ স্বম্ চরিত্রম্ শিক্ষেরন্পৃথিব্যাম্ সর্বমানবাঃ।।
(মনুঃ ১/৭৪)
অর্থাৎ সারা বিশ্বের মানব ভারতবর্ষের ব্যক্তিদের থেকে চরিত্রের শিক্ষা গ্রহণ করে নিজের জীবনকে বিশুদ্ধ করবে। এই প্রাণায়াম বিদ্যার কারণেই দেশের মধ্যে সবদিক থেকে সুখ শান্তি ছিল।

🍁 প্রাণায়ামের আদিস্রোত হল বেদ 🍁

মহর্ষি দয়ানন্দ জী দ্বারা প্রণীত আর্যসমাজের তৃতীয় নিয়মানুসারে "বেদ হল সব সত্য বিদ্যার পুস্তক।" সব বিদ্যার সমান এই প্রাণ বিদ্যারও আদিমূল হল বেদ। বেদের মধ্যে প্রাণায়ামের মৌলিক সিদ্ধান্তের বর্ণনা স্পষ্ট ভাবে আছে। সুবিজ্ঞ পাঠকদের জ্ঞানের জন্য এখানে কিছু মন্ত্র উদ্ধৃত করে দিচ্ছি -

দ্বাবিমৌ বাতৌ বাত আ সিন্ধোরা পরাবতঃ।
দক্ষম্ তে অন্য আ বাতু পরান্যো বাতু য়দ্রুপঃ।।
(ঋঃ ১০/১৩৭/২)

এই মন্ত্রের ভাষ্য আর্য বিদ্বান এইভাবে করেছেন -
(ইমৌ দ্বৌ) এই দুই প্রকারের (বাতৌ) বায়ু (বাতঃ) বাহিত হয়, একটা বায়ু (আসিন্ধোঃ) হৃদয় পর্যন্ত যায় আর আরেকটা (আপরাবতঃ) বাইরের বায়ুমণ্ডল পর্যন্ত যায়। (অন্যঃ) তারমধ্যে একটা (তে) তোমার জন্য(দক্ষম্) বল (আবাতু) ভিতরে নিয়ে আসবে আর (অন্যঃ) আরেকটা (য়দ্রপঃ) যে দোষ মন্দ আছে তাকে (পরাবাতু) বাইরে নিয়ে যাবে।

অর্থাৎ - হে মনুষ্য! তোমার মধ্যে দুটো বায়ু চলছে। তোমার মধ্যে শ্বাস আর প্রশ্বাস রূপে প্রাণের দুই রকমের গতি হয়। শ্বাস দ্বারা বাইরের শুদ্ধ বায়ু তোমার ভিতরের সিন্ধু স্যন্দনশীল হৃদয় পর্যন্ত আসে আর প্রশ্বাস দ্বারা ভিতরের দূষিত বায়ু বাইরে "পরাবত" পর্যন্ত যায়।

আমাদের ভিতরে হৃদয় হল সেই "সিন্ধু" স্থান যেখানে সহস্র রুধিরবাহিনী নাড়ীরূপ নদী এসে একত্রিত হয় আর বাইরের "পরাবত" হল সেই বায়ুমণ্ডল নামক স্থান যা হচ্ছে বায়ুর অপার অটুট ভাণ্ডার। আর এই যে পরাবত থেকে সিন্ধু পর্যন্ত আর সিন্ধু থেকে পরাবত পর্যন্ত দুটো বায়ু আমাদের মধ্যে নিরন্তর চলছে, এটাই হল আমাদের জীবনের আধার। কারণ এরমধ্যে প্রথম বায়ু শ্বাস, আমাদের সিন্ধুতে বাইরে থেকে প্রাণ আর নবজীবনকে নিয়ে আসে আর আমাদের রক্তের এক-একটা কণাকে নব-বল সংযুক্ত করে আর আরেকটা বায়ু, আমাদের রক্ত থেকে তথা সারা শরীর থেকে সমস্ত মল-দোষ-বিকারকে বয়ে নিয়ে যায় আর বাইরে পরাবতের মধ্যে ফেলে দেয় আর আমাদের জীবনকে বাড়িয়ে দেয়, এইভাবে আমাদের জীবনের বৃদ্ধি হয়। আমরা নিত্য অধিক-অধিক বলবান আর নিরোগ হই। তবে হে মনুষ্য! এই দ্বিবিধ প্রাণক্রিয়া কেবল তোমার ভৌতিক জীবনের সিদ্ধান্ত নয় বরং তোমার মানসিক আর আত্মিক জীবনের রহস্যও এরমধ্যে আছে। তুমি জানো না যে, সব মহাপুরুষ নিজের শ্বাস দ্বারা কেবল শারীরিক শক্তিকে নয় বরং উৎসাহ, ধৈর্য, বল, সত্য, প্রেম আদি সব মানসিক আর আত্মিক সৎ ভাবনাকে ভিতরে নিয়েছে, তথা প্রশ্বাস দ্বারা সব প্রতিবন্ধকতা, কাপুরুষতা, অশক্তি, মিথ্যা, ঘৃণা আদি সব অসৎ ভাবনাকে বাইরে বের করে দিয়েছে, এইজন্য তারা মহান হয়েছে। প্রাণের সঙ্গে মন এমন ভাবে জুড়ে আছে যে তুমি শ্বাস দ্বারা যেটা ভাববে সেটাই তোমার মধ্যে এসে বাস করবে আর যাকে প্রশ্বাস দ্বারা ধ্যান করবে সেটা বাইরে বেরিয়ে যাবে। নিজের প্রার্থনাতে তুমি এই সিদ্ধান্তকে একটু ব্যবহার করে দেখো। যাকে বাস করাতে চাইবে তাকে শ্বাস দ্বারা চিত্রিত করে দেখো আর যেসব অশুভ বিচার যেতেই চায় না, সেগুলো আসলে বার-বার প্রশ্বাসের দ্বারা বাইরে বের করে দেখো তাহলে তুমি নিঃসন্দেহে অদ্ভুত সফলতা প্রাপ্ত করবে। আর নিজের ব্যায়াম প্রাণায়াম আর প্রার্থনার মধ্যে তুমি সদা এই জগৎ ব্যাপক জীবন সিদ্ধান্তের ব্যবহার করো। তুমি দেখবে যে নিজের এই দ্বিবিধ প্রাণক্রিয়া দ্বারা অনন্ত শক্তির ভাণ্ডার দিয়ে জুড়ে আছো আর এই ভাণ্ডার থেকে নিজের প্রত্যেক শ্বাস দ্বারা প্রয়োজন অনুযায়ী বল প্রাপ্ত করতে পারবে আর নিজের শ্বাস দ্বারা সেই পবিত্রকারক মহাপারাবারের মধ্যে নিজের তুচ্ছ মলিনতাকে ফেলে দিয়ে সদা পবিত্র থাকতে পারবে। অতঃ হে মনুষ্য! তুমি ওঠো আর এখন নিজের প্রত্যেক শ্বাস আর প্রশ্বাস দ্বারা নিত্য উন্নত আর নবজীবন সম্পন্ন হও। 

এইভাবে বেদের আজ্ঞা আছে। এইরকমই আরেকটা মন্ত্র প্রাণায়ামের স্বরূপকে স্পষ্ট চিত্রণ করে -

আ বাত বাহি ভেষজম্ বি বাত বাহি য়দ্রপঃ।
ত্বম্ হি বিশ্বভেষজো দেবানাম্ দূত ঈয়সে।।
(ঋঃ ১০/১৩৭/৩)

অর্থাৎ - (বাত) হে প্রাণ! (ভেষজম্ আবাহি) স্বাস্থ্যপ্রদ ঔষধীগুণ আমার মধ্যে নিয়ে আসো আর (বাত) হে প্রাণ! (য়দ্রপঃ) আমার মধ্যে যে দুঃখ রোগ আছে তাকে (বি বাহি) আমার থেকে বাইরে নিয়ে যাও। (ত্বম্) তুমি (হি) নিশ্চিত রূপে (বিশ্বভেষজঃ) সর্ব ঔষধীরূপ, (দেবানাম্ দূত ঈয়সে) তুমি দিব্যগুণের দূতের মতো গতি করো। 

মন্ত্রের মধ্যে প্রাণের একটা দিব্য দেব রূপ সুন্দর আলঙ্কারিক বর্ণনা করা হয়েছে, যথা - হে বায়ু! হে প্রাণ! তুমি সর্ব ঔষধীরূপ, তোমার মধ্যে সমস্ত ঔষধ বিদ্যমান আছে, আমরা তো না জেনে বাইরের এই বিভিন্ন প্রকারের ঔষধ খাওয়ার চক্করে পড়ে আছি। যদি আমরা সঠিক ভাবে তোমার সেবন করি, তোমার শক্তি ব্যবহার করি তাহলে আমাদের কখনও কোনো ওষুধের আবশ্যকতা হবে না। সংসারের ৯০ শতাংশ রোগী এইজন্য রোগগ্রস্থ কারণ তারা সঠিক ভাবে শ্বাস নেওয়া জানে না তথা সর্বৌষধময় তোমার থেকে লাভ নিতে জানে না। যদি আমরা ঠিক ভাবে শ্বাস নিই তাহলে ভিতরে আসতে থাকা শ্বাসই আমাদের দিব্য ঔষধপান হবে আর বাইরে যেতে থাকা প্রশ্বাস আমাদের সব রোগ-মল বের করে দিবে। এমনটা যে বলা হয় দেবতাদের বৈদ্য হল অশ্বিনীকুমার, সেটা আর কিছু না, সেটা নাসত্যৌ (নাক থেকে জন্মা) অশ্বিনৌ অর্থাৎ এই শ্বাস-প্রশ্বাস বা প্রাণাপানই হল সেটা, যাকে ইড়া, পিঙ্কলা, চন্দ্রপ্রাণ, সূর্যপ্রাণ আদি অন্য রূপেও দেখা যায়। এই প্রাণাপানের নিয়ম দ্বারাই সংসারের সব রোগের দিব্য আর অমোঘ চিকিৎসা হয়ে যায়। অবিদ্যার কারণে আমরা বাইরের বৈদ্যকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, অথচ সব ঔষধ আমাদের ভিতরেই বিদ্যমান আছে।

আর হে প্রাণ! তুমি তো দেবদূত, আমাদের ভিতরে দেবদূত হয়ে গমন করছো, আমাদের ভিতরে সব দেবতাদের বার্তা নিয়ে এসে শুনিয়ে দিয়ে যাও। যারা প্রাণোপাসনা হতে রহিত, তোমার এই সূক্ষ্ম দেব-বার্তাকে শোনে না, তারা তোমার এই দিব্য চিকিৎসা হতে বঞ্চিত থাকে, কিন্তু যারা তোমার উপাসক হয় তারা তো নিজের প্রাণের মধ্যে সূক্ষ্ম রূপে চলতে থাকা সব পৃথ্বী, অপ, তেজ আদি দেবগুলোর বার্তাকে শুনে নেয়। শরীরের সব কার্যকলাপ আর চেষ্টার প্রেরক তথা নিয়ামক হে বাত! হে প্রাণ! শরীরের মধ্যে দোষ উৎপন্ন হতেই তুমি আমাদের মধ্যে দিব্য প্রেরণা করো, শরীরকে বিশেষ ভাবে  নাড়া-চারা বা চেষ্টা করার প্রেরণা তথা বিশেষ প্রকারের ভোজন, পান, আচ্ছাদনের প্রেরণা উৎপন্ন করো। আমরা যদি সেগুলো শুনি আর তদনুসারে আচরণ করি তাহলে আমাদের সব রোগের চিকিৎসা হয়ে যাবে অথবা বেশির ভাগ অবস্থায় তো আমরা রোগ উৎপন্ন হওয়ার থেকেই বেঁচে যাবো। কিন্তু আমরা সেগুলো শুনি না, অন্যদিকে যারা শোনে তারা নিজের নাসিকার মধ্যে চলতে থাকা তোমার "স্বর"কেও শুনে নেয়, তাকে আধিদৈবিক সংসারের স্বরের সঙ্গে মিলিয়ে রাখে, এরফলে তাদের জীবন এমন সংগীতময় হয়ে যায় যে তারা সর্বদা সুস্থ আর নিরোগ থাকে। হে প্রাণ!  আমরা তোমার দিব্যদূত বার্তা শুনি অথবা না শুনি তবে এটা সত্য যে আমাদের নিকট আসা দিব্য চিকিৎসক হচ্ছ তুমি আর তুমি সর্বৌষধ রূপ। হে আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য সম্পূর্ণ দেবের দূত হয়ে আমাদের মধ্যে চলমান প্রাণ! তুমি সত্যিই সর্বৌষধ রূপ।

এইভাবে বেদের মধ্যে প্রাণায়ামের গুরুত্বের বিশদ বর্ণনা আছে। শারীরিক মানসিক সব বিকারকে দূর করে তারমধ্যে শক্তির সঞ্চার করা হল প্রাণায়ামের মুখ্য কাজ। জীবন পূর্ণতঃ শ্বাসক্রিয়ার উপরই অবলম্বিত। প্রাণায়াম দ্বারা দেহের মধ্যে সঞ্জীবন শক্তির সঞ্চার হয়, মনের প্রসুপ্ত শক্তি জাগ্রত হয়ে ওঠে, শরীর শুদ্ধ, পবিত্র, বলবান, তেজস্বী তথা কান্তিমান হয়, শরীরের সব মাংসপেশী সম্পুষ্ট হয়, শরীরের মধ্যে পরিভ্রমণ করতে থাকা রক্ত শুদ্ধ আর বিকাররহিত হয়। এইভাবে প্রাণায়াম সব ধাতুর মলকে দূর করে বীর্যকে শুদ্ধ পবিত্র করে ওজ-রূপে পরিণত করে জীবনকে সুখময় করে তোলে। এইজন্য বেদের মধ্যে প্রাণকে পিতা, ভ্রাতা, মিত্র আদি রূপে বর্ণিত করা হয়েছে। সামবেদের উত্তরার্চিকে এই বিষয়ের মন্ত্র আছে -

উত বাত পিতাসি ন উত ভ্রাতোত নঃ সখা।
স নো জীবাতবে কৃধি।। (সামবেদ ১৮৪১)

মন্ত্রের ভাবনা স্পষ্ট যে প্রাণই হচ্ছে আমাদের পিতা, ভ্রাতা আর মিত্র। অতঃ প্রাণ আমাদের দীর্ঘজীবনের জন্য সক্ষম। সামবেদের মধ্যে এর পূর্বের মন্ত্রটা সব রোগ দূর কারক প্রাণায়ামকে কল্যাণকারী বলা হয়েছে -
বাত আ বাতু ভেষজম্ শম্ভু ময়োভু নো হৃদে।
প্র ন আয়ূম্ষি তারিষত্।। (সামবেদ ১৮৪০)
অর্থাৎ - (বাত) হে বায়ু (নঃ) আমাদের (হৃদয়ে) (শম্ভু) কল্যাণ আর শান্তিকারক (ময়োভু) সুখকারক (ভেষজম্) আধি ব্যাধিকে শান্তিদায়ক ঔষধীকে (আবাতু) প্রাপ্ত করাও আর (নঃ) আমাদের (আয়ূম্ষি) আয়ুর বর্ষকে (প্রতারিষত্) বাড়াও।

প্রাণ হল শরীরের প্রধান শক্তি, প্রাণের উপর বশিত্ব প্রাপ্ত করলে মন সহিত জ্ঞানেন্দ্রিয়, কর্মেন্দ্রিয়ও মানুষের বশে এসে যায়। অথর্ববেদের মধ্যে প্রাণবিদ্যার বিশদ বর্ণনা আছে। অথর্ববেদের প্রাণসূক্তের একটা মন্ত্র প্রাণের প্রাধান্যকে স্পষ্ট রূপে বর্ণনা করে -

প্রাণায় নমো য়স্য সর্বমিদম্ বশে।
য়ো ভূতঃ সর্বস্যেশ্বরো য়স্মিন্ত্সর্বম্ প্রতিষ্ঠিতম্।।
(অথর্বঃ ১১/৪/১)

এই মন্ত্রটার ভাষ্য মহর্ষি দয়ানন্দ জী সত্যার্থ প্রকাশের প্রথম সমুল্লাসে এইভাবে করেছেন -
"যেমন সারা শরীর আর ইন্দ্রিয় প্রাণের অধীন হয়, তেমনই সারা জগৎ হল পরমেশ্বরের অধীন।" এই মন্ত্রের মধ্যে পরমেশ্বরের স্বামিত্ব বলার জন্য প্রাণের উপমা দেওয়া হয়েছে, যারদ্বারা প্রাণের গুরুত্ব স্পষ্ট সিদ্ধ হয়।
.
যেভাবে অথর্ববেদের মধ্যে প্রাণের গুরুত্বের বর্ণনা আছে সেইভাবে য়জুর্বেদের মধ্যেও প্রাণের বিশদ বর্ণনা আছে।  প্রাণকে পুষ্ট আর দীর্ঘ করার জন্য লেখা আছে -
প্রাণস্ত আপ্যায়তাম্।। (য়জুঃ ৬/১৫) অর্থাৎ তোমার প্রাণ সম্বন্ধিত হোক। প্রাণের পুষ্টি দ্বারাই সারা শরীরের অঙ্গের পুষ্টি হয়, এই বর্ণনা নিম্ন মন্ত্রের মধ্যে করা হয়েছে -

ঐন্দ্রঃ প্রাণোऽঅঙ্গেऽঅঙ্গে নিদীধ্যদৈন্দ্রऽউদানোऽঅঙ্গেऽঅঙ্গে নিধীতঃ। (য়জুঃ ৬/২০) 

অর্থাৎ - আত্মার শক্তি দ্বারা প্রেরিত হয়ে প্রাণ প্রত্যেক অঙ্গের মধ্যে গিয়ে পৌঁছায়। আত্মার শক্তি দ্বারা প্রেরিত হয়ে উদান প্রত্যেক অঙ্গের মধ্যে পৌঁছায়। সুতরাং সবাইকে প্রাণের রক্ষা করা উচিত, এই সংকেত বেদের মধ্যে স্পষ্ট রূপে করা হয়েছে।

প্রাণম্মে পাহ্যপানম্মে পাহি ব্যানম্মে পাহি চক্ষুর্মऽউর্ব্যা বিভাহি শ্রোত্রম্মে শ্লোকয়। (য়জুঃ ১৪/৮)

অর্থাৎ - আমার প্রাণ-অপান-ব্যানের সংরক্ষণ করো। প্রাণের রক্ষণ হলে প্রাণ সারা শরীরের রক্ষা করে। এইভাবে "প্রাণম্ তে শুন্ধামি" (য়জুঃ ৬/১৪), "প্রাণম্ মে তর্পয়ত" (য়জুঃ ৬/৩১) আদি বেদের বচনও উপরোক্ত ভাবকে ব্যক্ত করে। য়জুর্বেদের মধ্যে প্রাণকে শরীরের রাজা বলা হয়েছে যথা "রাজা মে প্রাণঃ" (য়জুঃ ২০/৫) অর্থাৎ প্রাণ হল আমাদের রাজা। যেরূপ সংসারের মধ্যে রাজা শ্রেষ্ঠ হওয়ার কারণে সব ব্যবস্থা সঠিকভাবে চলে, সেইরূপ প্রাণ সবল হলে মনেন্দ্রিয় আদি শরীরের অবয়ব সঠিকভাবে কাজ করে। উপরোক্ত উদাহরণ দ্বারা স্পষ্ট সিদ্ধ হয়ে গেল যে প্রাণ-বিদ্যার আদি স্রোত হল বেদ।

🍁 উপনিষদের মধ্যে প্রাণের গুরুত্ব 🍁

উপনিষদ হল আধ্যাত্মিক গ্রন্থ তথা প্রাণও অধ্যাত্ম ক্ষেত্রের তত্ত্ব, এই কারণে উপনিষদের মধ্যে প্রাণের গুরুত্ব বিশেষরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। উপনিষদের মধ্যে প্রাণকে কোথাও ব্রহ্মা, কোথাও দেব, কোথাও বসু, রুদ্র, আদিত্য, পিতা, মাতা, স্বসা, আচার্য আদি বিশেষণ দ্বারা বিভূষিত করা হয়েছে, যারদ্বারা প্রাণের সর্বশ্রেষ্ঠতা সিদ্ধ হয়। এই বিষয়ে নিম্ন স্থল  বিশেষ দ্রষ্টব্য -
প্রাণো ব্রহ্মেতি ব্যজানাত্। প্রাণাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে। প্রাণেন জাতানি জীবন্তি। প্রাণম্ প্রয়ন্ত্যভিসম্বিশন্তীতি। 
(তৈত্তিরীয়োপনিষদ, ভৃগুবল্লী, তৃতীয়োऽনুবাক) 

এই প্রকরণের অভিপ্রায় স্পষ্ট যে - প্রাণই হল ব্রহ্ম, কারণ প্রাণ থেকে সব ভূত উৎপন্ন হয়, প্রাণ দ্বারা জীবিত থাকে আর অন্তিমে প্রাণের মধ্যেই গিয়ে লীন হয়। 

এইভাবে উপনিষদের স্থানে-স্থানে প্রাণকে জ্যেষ্ঠ আর শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে, সেগুলো দেখুন -

১. কতম একো দেব ইতি প্রাণ ইতি... (বৃহ.উ. ৩/৯/৯)
২. প্রাণো বৈ জ্যেষ্ঠশ্চ শ্রেষ্ঠশ্চ... বৃহ. ৬/১/১)
৩. প্রাণো বৈ বলম্ তৎপ্রাণে প্রতিষ্ঠিতম্..(বৃহ.উ. ৫/১৪/৪)
৪. প্রাণো বা অমৃতম্... (বৃহ. ১/৬/৩)
৫. প্রাণা বৈ সত্যম্... (বৃহ. ২/১/২০)
৬. প্রাণা বৈ য়শো বীর্য়্যম্... (বৃহ. ১/২/৬)

প্রাণের সর্বশ্রেষ্ঠতা বলার জন্য প্রশ্নোপনিষদের মধ্যে একটা অতিরোচক উপাখ্যান আছে। একবার শরীরের মধ্যে ইন্দ্রিয়ের মধ্যে পরস্পর ঝগড়া বাধে, মন-শ্রোত্র-চক্ষু-ত্বচা-রসনা আদি ইন্দ্রিয়গুলো স্বয়ংকে বড় আর অন্যদের ছোটো বলতে থাকে। এই রকম অবস্থা দেখে প্রাণ সবাইকে বলে -

তান্ বরিষ্ঠঃ প্রাণ উবাচ মামোহ মাপদ্যথাऽহমেব তৎপঞ্চধাऽऽত্মানম্ প্রবিভজ্যৈতদ্বাণমবষ্টভ্য বিধারয়ামীতি।।১৯
তেऽশ্রদ্দধানা বভূবুঃ সোऽভিমানাদূর্ধ্বমুৎক্রমত ইব তস্মিন্নুৎক্রামত্যথেতরে সর্ব এবোৎক্রামন্তে তস্মিম্শ্চ প্রতিষ্ঠমানে সর্ব এব প্রতিষ্ঠন্তে তদ্যথা মক্ষিকা মধুকররাজানমুৎক্রামন্তম্ সর্বা এবোৎক্রামন্তে তস্মিম্শ্চ প্রতিষ্ঠমানে সর্বা এব প্রতিষ্ঠন্তে এবম্ বাঙ্মনশ্চক্ষুঃশ্রোত্রঞ্চ  তে প্রীতাঃ প্রাণম্ স্তুন্বন্তি।।২০

সেই বিবাদকারীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণ বললো যে তোমরা মোহ অজ্ঞানীর মতো করো না। আমিই স্বয়ং নিজেকে পাঁচ ভাগে ভাগ করে এই শরীরকে ধারণ করে আছি। কিন্তু এই বচন তারা বিশ্বাস করলো না। এতে অভিমান করে প্রাণ শরীরের বাইরে চলে যেতে থাকে, যখন সে বাইরে যেতে থাকে তখন মন আদি ইন্দ্রিয়গুলোও তার সঙ্গে বের হতে থাকে আর তার স্থির হওয়াতে তারাও স্থির হয়। তখন তারা সন্তুষ্ট হয়ে প্রাণকে শ্রেষ্ঠ মেনে নেয় আর তার স্তুতি করতে থাকে। এই সব উপাখ্যানের তাৎপর্যই ছিল প্রাণের সর্বশ্রেষ্ঠতা সিদ্ধ করা।

বৃহদারণ্যকোপনিষদের মধ্যে প্রাণকে শরীরের অঙ্গের রস রূপে স্বীকার করা হয়েছে, এতে তার প্রাধান্য নিশ্চিত হয়। যথা -

সোऽয়াস্য আঙ্গিরসোऽঅঙ্গানাম্ হি রসঃ প্রাণো বা অঙ্গানাম্ রসঃ প্রাণো হি বা অঙ্গানাম্ রসস্তস্মাদ্যস্মাত্ কস্মাচ্চাঙ্গাৎপ্রাণ উৎক্রামতি তদেব তচ্ছুষ্যত্যেষ হি বা অঙ্গানাম্ রসঃ।। (বৃহ. ১/৩/১৯)

অর্থাৎ প্রাণই হচ্ছে অঙ্গের রস, যে অঙ্গ থেকে প্রাণ চলে যায় সেই অঙ্গ শুকিয়ে যায়।

বসু রুদ্র আদিত্য রূপে প্রাণের বর্ণনা -
প্রাণা বাব বসব এতে হীদঁ সর্বম্-বাসয়ন্তি।। ১
প্রাণা বাব রুদ্রা এতে হীদঁ সর্বঁ রোদয়ন্তি।। ৩
প্রাণা বাবাऽऽদিত্যা এতে হীদঁ সর্ব মাদদতে।। ৫ 
(ছান্দোগ্যোপনিষদ ৩/১৬)

প্রাণ হল বসু কারণ এটা সবাইকে বাস করায়, জীবন প্রদান করায়। প্রাণ হল রুদ্র কারণ এটা বেরিয়ে গেলে মৃত্যু হয়, সবাই কান্না করে। প্রাণ হল আদিত্য কারণ এটা সব বিদ্যাকে গ্রহণ করে।

আমি এটা পূর্বেই লিখেছি যে বেদের মধ্যে প্রাণকে মাতা-পিতা-ভ্রাতা রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। উপনিষদের মধ্যেও প্রাণের সেইরকম স্তুতি আছে -

প্রাণো হ পিতা প্রাণো মাতা প্রাণো ভ্রাতা প্রাণঃ স্বসা প্রাণ আচার্য্যঃ প্রাণো ব্রাহ্মণঃ।। (ছান্দোগ্যোপনিষদ ৭/১৫/১)

অর্থাৎ প্রাণ হল মাতা (মান্য হিতকারী), প্রাণ হল পিতা (পালক-সংরক্ষক), প্রাণ হল ভ্রাতা (ভরণ পোষণ করার যোগ্য), প্রাণ হল স্বসা (উত্তম রূপে রক্ষক), প্রাণ হল আচার্য (আত্মিক গুরু), প্রাণ হল ব্রাহ্মণ (ব্রহ্মের নিকট নিয়ে যায়)। এইভাবে অন্য উপনিষদের মধ্যেও অনেক স্থানে প্রাণের স্তুতি আছে।
🍁আয়ুর্বেদের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ চরকের মধ্যে প্রাণের গুরত্ব🍁 

তিস্র এষণাঃ পর্য়েষ্টব্যা ভবন্তি, তদ্যথা প্রাণৌষণা, ধনৈষণা পরলোকৈষণেতি। আসাম্ তু খল্বেষণানাম্ প্রাণৌষণাম্ তাবতৎপূর্বতরমাপদ্যেত। কস্মাতৎ প্রাণপরিত্যাগে হী সর্বত্যাগঃ।

অর্থাৎ মানুষের তিনটা ইচ্ছা করা উচিত, প্রথম হল - প্রাণের কামনা, দ্বিতীয় হল - ধনের কামনা আর তৃতীয় হল - মোক্ষের কামনা। এই তিনটা কামনার মধ্যে প্রাণের সুরক্ষণাদির কামনা হল মুখ্য, কারণ প্রাণ নাশের ফলে সর্বনাশ হয়, অর্থাৎ ধনৈষণা আর পরলোকৈষণা দুটো জীবিত অবস্থাতেই হতে পারে, মারা গেলে নয়। সুতরাং প্রাণৌষণা হচ্ছে মুখ্য, তাই প্রাণরক্ষার জন্য মানুষকে প্রাণায়ামের অভ্যাস করা উচিত। আর নিয়মিত প্রাণায়ামের অভ্যাস করার ফলে মানুষ দীর্ঘায়ু হয়।

🍁 প্রাণায়ামের ফলে বুদ্ধির বিকাশ 🍁

প্রাণায়াম যেমন শরীরের শক্তি বাড়ায় তেমনই মলের নাশও করে। মানুষের বুদ্ধি ত্রিগুণাত্মক হয়, তমোগুণের প্রভাবে বুদ্ধির মধ্যে মলিনতা-প্রমাদ-আলস্য-তন্দ্রার বাহুল্য থাকে, আর সর্বদা নিষ্কর্মণ্যতার সাম্রাজ্য মনের মধ্যে রাজত্ব করে। এইভাবে যখন বুদ্ধির মধ্যে রজোগুণের প্রভাব হয় তখন মনের মধ্যে চঞ্চলতা-রাগ-দ্বেষ-ঈর্ষা আদির প্রাধান্য হয়, আর সাংসারিক ঐশ্বর্য ইন্দ্রিয়ের বিষয়ে আসক্তি তথা আডম্বর প্রধান জীবন হয়। প্রাণায়াম করার ফলে বুদ্ধিতে তমোগুণ আদি মল দূর হয়ে সত্ত্বগুণের প্রাধান্য হয়। য়োগদর্শনের মধ্যে মহর্ষি পতঞ্জলি জী লিখেছেন -

"ততঃ ক্ষীয়তে প্রকাশাবরণম্" (য়োগদর্শন ২/৫২)

অর্থাৎ - প্রাণায়াম করার ফলে আমাদের মনে প্রকাশের আবরণ স্বরূপ যে মল আছে সেটা ক্ষীণ হয়ে যায়। যার ফলে আমাদের অবিদ্যা-অজ্ঞান-দুর্বলতা আদি সব মানসিক অক্ষমতা দূর হয়ে মন, আত্মা সব শক্তির ভাণ্ডার হয়। এই কারণে একজন অনুভবী বিদ্বান লিখেছেন -

প্রাণায়ামাত্ পুষ্টির্গাত্রস্য বুদ্ধিস্তেজো য়শো বলম্।
প্রবর্ধন্তে মনুষ্যস্য তস্মাৎপ্রাণায়ামমাচরেৎ।।

অর্থাৎ - প্রাণায়াম করার ফলে মানুষের শরীর হৃষ্ট-পুষ্ট হয়, বুদ্ধি সূক্ষ্মগ্রাহিণী এবং কুশাগ্র হয়, শরীরের মধ্যে তেজ, যশ আর বলের নিরন্তর বৃদ্ধি হয়। সুতরাং প্রতিদিন অবশ্যই প্রাণায়াম করা উচিত।

এই যুগের সর্বমূর্ধন্য য়োগিরাজ মহর্ষি দয়ানন্দ জী এই বিষয়ে য়োগদর্শনের একটা সূত্রের ভাষ্যতে লিখেছেন -

য়োগাঙ্গানুষ্ঠানাদশুদ্ধিক্ষয়ে জ্ঞানদীপ্তিরাবিবেকখ্যাতেঃ।
(য়োগদর্শন ২/২৮)

অর্থাৎ যখন মানুষ প্রাণায়াম করে তখন প্রতিক্ষণ উত্তরোত্তর কালে অশুদ্ধির নাশ আর জ্ঞানের প্রকাশ হতে থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত মুক্তি হয় না ততক্ষণ পর্যন্ত তার আত্মার জ্ঞান নিরন্তর বাড়তে থাকে। (সত্যার্থপ্রকাশ তৃতীয় সমুল্লাস)

মহর্ষি দয়ানন্দ জী আরও লিখেছেন যে -
এইভাবে প্রাণায়াম করলে দুই প্রাণায়ামের গতি রুদ্ধ হওয়াতে প্রাণ নিজ বশে আসলে মন তথা ইন্দ্রিয় স্বাধীন হয়। বল পুরুষার্থ বৃদ্ধি হয়ে বুদ্ধি তীব্র আর সূক্ষ্ম হয়, যার ফলে অত্যন্ত কঠিন আর সূক্ষ্ম বিষয়কে অতি শীঘ্র গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। এতে মানুষের শরীরে বীর্যবৃদ্ধির ফলে স্থৈর্য, বল, পরাক্রম, জিতেন্দ্রিয়তা আর অল্পকালের মধ্যেই সকল শাস্ত্র বুঝে আয়ত্ত করার সামর্থ জন্মায়। (সত্যার্থপ্রকাশ তৃতীয় সমুল্লাস)

এইভাবে মনুস্মৃতির প্রমাণও উদ্ধৃত করে মহর্ষি জী প্রাণায়ামের গুরুত্ব বর্ণনা করেছেন -

প্রাণায়ামা ব্রাহ্মণস্য ত্রয়োऽপি বিধিবৎকৃতাঃ।
ব্যাহৃতিপ্রণবৈর্য়ুক্তা বিজ্ঞেয়ম্ পরমম্ তপঃ।।
দহ্যন্তে ধ্মায়মানানাম্ ধাতূনাম্ হি য়থা মলাঃ।
তথেন্দ্রিয়াণাম্ দহ্যন্তে দোষাঃ প্রাণস্য নিগ্রহাত্।।
প্রাণায়ামৈর্দহেদ্দোষান্ ধারণাভিশ্চ কিল্বিষম্।
প্রত্যাহারেণ সম্সর্গান্ ধ্যানেনানীশ্বরান্গুণান্।।
(মনুঃ ৬/৭০-৭২)

এইভাবে ব্রাহ্মণ অর্থাৎ ব্রহ্মবিৎ সন্ন্যাসীর কর্তব্য হল, ওঙ্কার সহিত সপ্তব্যাহৃতি দ্বারা বিধিপূর্বক যথাশক্তি প্রাণায়াম করবে। কিন্তু কখনও তিনটার কম প্রাণায়াম করা উচিত নয়, এটাই সন্ন্যাসীর পরম তপস্যা। কারণ যেভাবে অগ্নিতে ধাতু উত্তপ্ত অথবা দ্রবীভূত করলে তার মল নষ্ট হয়ে যায়, সেইরূপ প্রাণের নিগ্রহ দ্বারা মন প্রভৃতি ইন্দ্রিয় সমূহের দোষ ভস্মীভূত হয়। এইজন্য সন্ন্যাসীগণ নিত্য প্রতি প্রাণায়াম দ্বারা আত্মা, অন্তঃকরণ আর ইন্দ্রিয় সমূহের দোষ, ধারণার দ্বারা পাপ, প্রত্যাহার দ্বারা সঙ্গদোষ আর ধ্যান দ্বারা অনীশ্বার গুণ অর্থাৎ হর্ষ, শোক এবং অবিদ্যাদি জীবের দোষ ভস্মীভূত করবে। (সত্যার্থপ্রকাশ পঞ্চম সমুল্লাস)

🍁 প্রাণায়াম দ্বারা মনের একাগ্রতা 🍁

আমাদের মনের মধ্যে অনেক দিব্য শক্তি বিদ্যমান আছে, কিন্তু মনের চঞ্চলতার কারণে আমরা সেগুলোর ব্যবহার করতে সক্ষম হই না। সংসারে সবথেকে কঠিন কাজ হল মনকে বশ করা। গুরু দ্রোণাচার্যের পরীক্ষাতে পাখির চোখে তীর মেরে উত্তীর্ণ হওয়া, মাছের চোখকে তীর দিয়ে বিন্ধ করে দ্রৌপদী স্বয়ম্বরের বিজয়ী তথা নিদ্রাকে বশ করে গুডাকেশের পদবী দ্বারা বিভূষিত বিশ্বপ্রসিদ্ধ যোদ্ধা অর্জুনও এই মনের চঞ্চলতাকে অনুভব করে য়োগীরাজ শ্রীকৃষ্ণ জীকে সম্বোধিত করে বলেছিলেন -

চঞ্চলম্ হি মনঃ কৃষ্ণ প্রমাথি বলবদ্ দৃঢম্।
তস্যাহম্ নিগ্রহম্ মন্যে বায়োরিব সুদুষ্করম্।(গীতা ৬/৩৪)

অর্থাৎ - হে কৃষ্ণ! এই মন অতি বলবান, দৃঢ়, প্রমাথি তথা অতি চঞ্চল। একে একাগ্র করা আমি বায়ুকে নিরোধের সমান অতি দুষ্কর মনে করি।

যদি আমাদের অধিকার মনের উপর হয় তাহলে নিশ্চিতরূপে আমরা আমাদের অন্তিম লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো। এর চঞ্চলতাকে নষ্ট করে একাগ্র করার জন্য মুখ্য সাধন হল প্রাণায়াম। মন আর প্রাণের মধ্যে অতি নিকট সম্বন্ধ আছে, মনের নিরোধ হলে প্রাণের নিরোধ তথা প্রাণের নিরোধ হলে মনের নিরোধ হওয়াটা অবশ্যম্ভাবী। এইজন্য কোনো এক সাধক বিদ্বান লিখেছেন -

চলে বাতে চলম্ চিত্তম্ নিশ্চলে নিশ্চলম্ ভবেত্।
য়োগী স্থাণুত্বমাপ্নোতি ততো বায়ুম্ নিরোধয়েত্।। 

অর্থাৎ - প্রাণ চঞ্চল হলে মন চঞ্চল তথা প্রাণ নিরোধ হলে মনও নিরোধ হয়। প্রাণায়াম দ্বারা য়োগী স্থিরভাব প্রাপ্ত করে, সুতরাং প্রাণের অবরোধ করা উচিত।
.
এইভাবে য়োগদর্শনের মধ্যে মহর্ষি পতঞ্জলি জী মন নিরোধের সাধনের বর্ণনা সম্বন্ধে লিখেছেন -

প্রচ্ছর্দনবিধারণাভ্যাম্ বা প্রাণস্য। (য়োগদর্শন ১/৩৪)

প্রাণকে নাসিকা দিয়ে বাইরে নিক্ষেপ করে আর তাকে বিশেষরূপে নিরুদ্ধ করলে মন স্থির হয়। অর্থাৎ রেচক আর পূরক প্রাণায়াম দ্বারা মন চঞ্চলতা ছেড়ে একাগ্র হয়।

প্রাণের ফল নির্দেশ করে য়োগদর্শনকার পুনঃ লিখেছেন -
ধারণাসু চ য়োগ্যতা মনসঃ। (য়োগদর্শন ২/৫৩) 

অর্থাৎ - প্রাণায়াম দ্বারা মন একাগ্র হয়ে ধারণার জন্য সক্ষম হয়।

সাংখ্যদর্শনের নির্মাতা মহর্ষি কপিল জীও প্রাণায়াম দ্বারা মনের একাগ্রতাকে স্বীকার করে নিজের দর্শনের মধ্যে লিখেছেন -

নিরোধশ্ছর্দিবিধারণাভ্যাম্। (সাংখ্যদর্শন ৩/৩৩)

অর্থাৎ - রেচক পূরক প্রাণায়াম দ্বারা মনের বৃত্তির নিরোধ হয়।

এইভাবে সব ঋষি-মহর্ষি এই বিষয়ে এক মত, অতএব সাধক মহানুভব স্বয়ং অনুভব করে লাভ নিবেন।

🍁 প্রাণ-অপানের স্বরূপ 🍁

আজ শিক্ষিত সমাজের মধ্যে প্রাণ-অপানের বিষয়ে নিতান্ত ভ্রম ছড়িয়ে আছে। মানুষ মনে করে, যে বায়ুকে আমরা বাইরে থেকে ভিতরে শরীরের মধ্যে গ্রহণ করি সেটা প্রাণ তথা যে বায়ু ভিতর থেকে বাইরে যায় সেটা অপান। এই ভ্রম প্রাণ অপানকে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমার্থক শব্দ মনে করেই হয়েছে। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের মধ্যে প্রাণ অপানের স্বরূপ এর একদম ভিন্ন আছে। মহর্ষি দয়ানন্দ জীও তাঁর গ্রন্থের মধ্যে প্রাচীন মান্যতাকে প্রামাণিক মেনে যে শ্বাস বাইরে বের হয় তার সংজ্ঞা "প্রাণ" তথা যে বায়ু বাইরে থেকে ভিতরে নেওয়া হয় তার নাম "অপান" বলেছেন।

অনেক পুস্তক প্রকাশক মহানুভব মহর্ষি জীর মন্তব্যকে না বুঝতে পেরে বর্তমান কালের মিথ্যা ধারণার অনুসারে সত্যার্থপ্রকাশ আদি ঋষি গ্রন্থের মধ্যে পরিবর্তন করার অক্ষম্য অপরাধ করে বসেছেন। প্রাণ অপানের বিষয়ে মহর্ষির মন্তব্য জানার জন্য ওনার গ্রন্থের উদাহরণ এখানে দেওয়া উপযুক্ত হবে।

সত্যার্থপ্রকাশের মধ্যে মহর্ষি জী বৈশেষিকদর্শনের (২/৪) সূত্রের ভাষ্য করে লিখেছেন - "(প্রাণ) ভিতর থেকে বায়ুকে বাইরে নিক্ষেপ করা, (অপান) বাইরে থেকে বায়ুকে ভিতরে আনা।" (সত্যার্থপ্রকাশ, তৃতীয় সমুল্লাস) 

এইভাবে "প্রাণময় কোষ" এর বিবেচনা করে মহর্ষি জী অন্য স্থানে লিখেছেন - "প্রাণময়" যারমধ্যে "প্রাণ" অর্থাৎ যে বায়ু ভিতর থেকে বাইরে যায়, "অপান" যে বায়ু বাইরে থেকে ভিতরে আসে...। (সত্যার্থপ্রকাশ, নবম সমুল্লাস)

প্রাণ অপানের স্বরূপ সম্বন্ধে মহর্ষি জী য়জুর্বেদের নিম্ন মন্ত্রের ভাষ্য করে লিখেছেন -

প্রাণায় স্বাহাऽপানায় স্বাহা ব্যানায় স্বাহা চক্ষুষে স্বাহা শ্রোত্রায় স্বাহা বাচে স্বাহা মনসে স্বাহা। (য়জুঃ ২২/২৩)

পদার্থ - (প্রাণায়) য় আভ্যান্তরাদ্ বহির্নিঃসরতি (অপানায়) য়ো বহির্দেশাদাভ্যন্তরম্ গচ্ছতি...।

আর্যভাষা - (প্রাণায়) যে পবন ভিতর থেকে বাইরে যায়...(অপানায়) যেটা বাইরে থেকে ভিতরে আসে...।

এইভাবে ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকার মধ্যে অথর্ববেদের মন্ত্র উদ্ধৃত করে লিখেছেন -

আয়ুশ্চ রূপম্ চ নাম চ কীর্তিশ্চ।
প্রাণশ্চাপানশ্চ চক্ষুশ্চ শ্রোত্রম্ চ।।

(প্রাণশ্চাপানশ্চ) যে বায়ু ভিতর থেকে বাইরে যায় তাকে "প্রাণ" আর যে বায়ু বাইরে থেকে ভিতরে আসে তাকে "অপান" বলে। (ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকা, বেদোক্তধর্মবিষয়)

প্রাণায়ামের বিষয়ে অন্য ঋষি-মহর্ষিদেরও মন্তব্য এটাই, তথা মহর্ষি পাণিনি জী তাঁর বর্ণোচ্চারণ শিক্ষা গ্রন্থের মধ্যে লিখেছেন - "নাভিপ্রদেশাত্ প্রয়ত্নপ্রেরিতঃ প্রাণো নাম বায়ুরূর্ধ্বমাক্রামন্নুর আদীনাম্ স্থানানামন্যতমস্মিন্ স্থানে প্রয়ৎনেন বিচার্য়তে।" 

মহর্ষি দয়ানন্দ জী এই প্রসঙ্গের অর্থ আর্যভাষাতে এইভাবে করেছেন - যে শ্বাস উপরে বের হয় তাকে প্রাণ বলে, সেটা আত্মার উচ্চারণের ইচ্ছা দ্বারা বিচারপূর্বক নাভিদেশ থেকে প্রেরণা পেয়ে প্রাণবাযু উপরে উঠে কন্ঠ আদি স্থানের মধ্যে কোনো এক স্থানে উত্তম প্রচেষ্টা দ্বারা বিচার করা হয়।

প্রাণাপানের বর্ণনা বাচস্পত্য কোষের মধ্যেও এইভাবে লেখা আছে - য়দ্বৈ পুরুষঃ প্রাণিতি মুখনাসিকাভ্যাম্ বাযুম্ বহির্নিস্সারয়তি স প্রাণাখ্যো বায়ুর্বায়ুবৃত্তিবিশেষঃ। য়দপানিত্যপশ্যমিতি তাভ্যামেব মুখনাসিকাভ্যাম্ অন্তরাকর্ষতি সোऽপানাখ্যো বৃত্তিরিতি।

এইভাবে অন্যত্র অনেক স্থানেও প্রাণাপানের স্বরূপের বর্ণনা এইরকম আছে। 

🍁 প্রাণায়ামের স্বরূপ 🍁
এই উপস্থিত অধ্যায়ের মধ্যে প্রাণায়ামের স্বরূপ আর শরীরের উন্নতিতে প্রাণায়াম কিরকম সহায়ক হয় তার বিবেচনা করা হবে। প্রাণায়াম হচ্ছে য়োগাঙ্গের চতুর্থ অঙ্গ। য়োগদর্শনের মধ্যে একে সমাধির সিদ্ধিতে বহিরাঙ্গ সাধন মানা হয়েছে। প্রাণায়ামের স্বরূপ প্রকট করতে গিয়ে মহর্ষি পতঞ্জলি য়োগদর্শনের মধ্যে লিখেছেন -
তস্মিন্ সতি শ্বাসপ্রশ্বাসয়োর্গতিবিচ্ছেদঃ প্রাণায়ামঃ। (য়োগ ২/৪৯)
(তস্মিন্ সতি) আসনের সিদ্ধি হয়ে গেলে (শ্বাস-প্রশ্বাসয়োঃ) শ্বাস আর প্রশ্বাসের (গতি-বিচ্ছেদঃ) গতিকে যথাশক্তি থামিয়ে দেওয়া (প্রাণায়ামঃ) "প্রাণায়াম" বলে।
যে বায়ু আমরা বাইরে থেকে ভিতরে গ্রহণ করি তাকে শ্বাস তথা যাকে ভিতর থেকে বাইরে ছেড়ে দিই তাকে প্রশ্বাস বলে। আসনকে সম্যক্ ভাবে অভ্যাস করার পশ্চাৎ এই শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিকে রীতি বিশেষ অনুসারে থামিয়ে রাখাকে প্রাণায়াম বলে।
এখানে শ্বাস প্রশ্বাসের গতি বিচ্ছেদের তাৎপর্য হল শ্বাসকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে ভিতরেই যথাশক্তি থামিয়ে রাখা তথা প্রশ্বাসকে বাইরেই যথাশক্তি থামানোর চেষ্টা করা। প্রাণায়াম শব্দ (প্রাণানামায়ামঃ) প্রাণ+আয়াম এই দুটো শব্দের সংযোগ দ্বারা হয়েছে, প্রাণের অর্থ শ্বাস-প্রশ্বাসের তথা আয়ামের অর্থ হল ছড়িয়ে দেওয়া বা বিস্তার করা। অর্থাৎ শনৈঃ শনৈঃ অভ্যাস দ্বারা শ্বাস প্রশ্বাসকে নিগ্রহ করে তার নিরোধের অবধি বাড়িয়ে দেওয়াই হল প্রাণায়াম।
🍁 শারীরিকোন্নতির সাধন প্রাণায়াম 🍁
"প্রাণো বৈ বলম্" এর অনুসারে শরীরের বল বাড়াতে প্রাণ হচ্ছে মুখ্য সাধন। প্রাণায়ামের অভ্যাস দ্বারা একজন দুর্বল আর নির্বীর্য মানুষও সশক্ত তথা তেজস্বী হতে পারে। ইতিহাসের মধ্যে এর অনেক প্রমাণ আছে, রাবণের সভাতে অঙ্গদ দ্বারা ভূমিতে পা জমিয়ে সব রাক্ষসদের লজ্জিত করতে এই প্রাণায়ামই কারণ ছিল। মহর্ষি দয়ানন্দ জীও প্রাণায়ামের অভ্যাস দ্বারাই অতুল শারীরিক বল সংগ্রহ করেছিলেন। ওনার জীবনে অনেক আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটেছিল, যেমন কয়েক মনের বোঝাই করা গাড়ি কাদায় আটকে যাওয়া দুটো ষাঁড় দিয়েও বের করা যাচ্ছিল না এমন গাড়িকে সহজেই কাদা থেকে বাইরে বের করা প্রাণায়াম দ্বারাই সম্ভব ছিল, তারপর পরস্পর সংঘর্ষ করতে থাকা ভয়ংকর দুটো ষাঁড়ের শিং ধরে সরিয়ে দেওয়া, ছুটতে থাকা ঘোড়া বগ্গীকে পিছন থেকে ধরে থামিয়ে দেওয়া আর কয়েকশ বরিষ্ঠ কুস্তিগীরের সভাতে হাত উঁচু করে শক্তি পরীক্ষার জন্য সতর্ক করা, কর্ণ সিংহকে হাত ধরে মূর্চ্ছিত করে দেওয়া, নিজের ভেজা কৌপিন থেকে চিপে জল বের করে কুস্তিগীরদের পরীক্ষা করা আর এইরকম অন্য অনেক পরিস্থিতিতে নিজের শারীরিক বল দ্বারা মানুষকে আশ্চর্যচকিত করে দেওয়া আদি সব প্রাণায়ামেরই প্রতাপ ছিল। তিনি নিত্য প্রতি খুব প্রাতঃকালে উঠে ৩-৪ ঘন্টা পর্যন্ত প্রাণায়াম করতেন। প্রাণায়ামের কারণে ওনার শরীর বজ্রসদৃশ হয়ে যায়। বড়-বড় কুস্তিগীর ওনার পা দাবানোর সময় পায়ের স্পর্শ করে আর এইরকম ওনার শরীরের অদ্ভুত কঠোরতা দেখে খুব অবাক হয়ে যেত।
.
প্রফেসর রামমূর্তির লোকপ্রসিদ্ধ বলের রহস্য এই প্রাণায়ামই ছিল। এই বিষয়ে তিনি স্বয়ং লিখেছেন যে "বাল্যাবস্থায় শরীরে তপেদিকের লক্ষণ দেখা দেয় কিন্তু ব্রহ্মচর্য, ব্যায়াম আর প্রাণায়ামের বিশেষ অভ্যাসের কারণে আমি শারীরিক বলে বিশ্ববিজেতা হতে পেরেছি।" এই প্রাণায়াম দ্বারা প্রফেসর রামমূর্তির একটা ঘুষিতেই বিদেশি কুস্তিগীরের মৃত্যু হয়েছিল। মোটা-মোটা শিকলকে সুতোর মতো তিনি অনায়াসে ছিঁড়ে ফেলতেন, কয়েকশ মনের পাথরকে বুকে রেখে ভেঙে দেওয়া তথা হাতিকে নিজের বুকের উপরে চড়িয়ে দেওয়া, দু-দুটো মোটরকে একসাথে থামিয়ে তিনি প্রাণায়ামের আধিপত্য দেশ-বিদেশের সব স্থানে ছড়িয়ে ছিলেন। আজ দেশের স্বাস্থ্য পতনোন্মুখ হয়ে আছে যদি আমরা চাই যে আমাদের দেশে পুনরায় বলিষ্ঠ স্ত্রী-পুরুষ হোক তাহলে আমাদের নিজের দিনচর্যাতে প্রাণায়ামকে স্থান দিতে হবে। প্রাণায়াম বিনা আমরা আরোগ্য আর বল প্রাপ্তির দিশাতে এক পাও আগে যেতে পারবো না। প্রাণায়াম দ্বারা কিভাবে শারীরিক উন্নতি হয় সেটা জানার জন্য এক দৃষ্টি শরীরের ভিতরে হতে চলা অনিচ্ছিত কাজের মধ্যে হৃদয় আর ফুসফুসের কাজের উপর ফেলা উচিত।
🍁 হৃদয় 🍁
রক্তপরিচালক যন্ত্রের নাম হল হৃদয়। এই অঙ্গ অনৈচ্ছিক মাংস দ্বারা নির্মিত আর দুই ফুসফুসের মাঝে বক্ষের ভিতরে থাকে। যুবক মানুষের হৃদয় প্রায় ৪ ইঞ্চি লম্বা ৬ ইঞ্চি চওড়া আর ২ ইঞ্চি মোটা আর তার ভার প্রায় ৩০০ গ্রাম হয়। কোনো মানুষের হৃদয়, আকার, পরিমাণাদিতে তার বন্ধ মুঠি থেকে অনেক কিছু পাওয়া যায়। হৃদয়ের অধিকাংশ মধ্যরেখার বাদিকে অবস্থিত আর তার ডানদিকে ডান তথা বাদিকে বাম ফুসফুস থাকে। হৃদয় হচ্ছে মাংস দ্বারা নির্মিত একটা কোষ্ঠ যার ভিতরে রক্ত ভরা থাকে। এর ভিতরে চারটা ভিন্ন-ভিন্ন ঘর আছে, যথা (১) ডান গ্রাহক কোষ্ঠ, (২) ডান ক্ষেপক কোষ্ঠ, (৩) বাম গ্রাহক কোষ্ঠ আর (৪) বাম ক্ষেপক কোষ্ঠ।
.
হৃদয় কখনও একইরকম থাকে না, সেটা কখনও সংকুচিত হয় আবার কখনও প্রসারিত হয়। হৃদয়ের সঙ্গে দুই প্রকারের স্নায়ুর সম্বন্ধ থাকে, যেসব স্নায়ুতন্ত্র শরীর থেকে দূষিত রক্তকে হৃদয়ের মধ্যে ফিরিয়ে নিয়ে আসে তাদের শিরা বলে তথা যেগুলোর মধ্যে শুদ্ধ রক্ত শরীরের পোষণের জন্য হৃদয়ের মধ্যে আসে, তাদের ধমনি বলে। শরীর থেকে শিরা দ্বারা আসা অশুদ্ধ রক্তকে শুদ্ধ হওয়ার জন্য ফুসফুসের মধ্যে পাঠিয়ে দেওয়া তথা ফুসফুস থেকে আসা শুদ্ধ রক্তকে শরীরের মধ্যে পাঠিয়ে দেওয়াই হল হৃদয়ের কাজ। হৃদয় নিরন্তর নিজের কাজের মধ্যে লেগে থাকে। মানুষের শরীরের সব রক্তের ভার শরীরের ভারের প্রায় বিশ শতাংশ হয়। যে ব্যক্তির ভার ১ মন ২০ সের, তার শরীরে প্রায় ৩ সের রক্ত আছে। হৃদয় সংকুচিত হওয়াকে আঙ্কুচন বা সঙ্কোচ বলে আর ছড়িয়ে পূর্বদশাকে প্রাপ্ত হওয়াকে প্রসার বলে। হৃদয় এই সঙ্কোচ আর প্রসার দ্বারা রক্তকে গ্রহণ করে আর সামনের দিকে ধাক্কা দেয়। হৃদয় এই সঙ্কোচ আর প্রসারের ক্রিয়া এক মিনিটে ৭২ বার করে। এইভাবে ২৪ ঘন্টায় ২৫২ মন রক্ত হৃদয় থেকে শুদ্ধ হওয়ার জন্য ফুসফুসের মধ্যে যায় আর ততটাই ফুসফুস থেকে শুদ্ধ হয়ে হৃদয়ে পুনরায় ফিরে আসে। যখন হৃদয় সঙ্কোচ করে তখন সেটা রক্তকে খুব বেগে ধমনির মধ্যে ধাক্কা দেয়া আর প্রসার দিয়ে শিরা দ্বারা রক্তকে গ্রহণ করে। এই সঙ্কোচ-প্রসারের কারণে এক ধরণের শব্দ উৎপন্ন হয় যা শুনতে লুব-ডপ লুব-ডপ লুব-ডপ এইরকম হয়।
🍁 ফুসফুস বা শ্বাসযন্ত্র 🍁
ফুসফুস দুটো আছে, বক্ষের মধ্যে হৃদয়ের ডান আর বামদিকে থাকে। ডানদিকের ফুসফুস বামদিকের ফুসফুসের তুলনায় অধিক চওড়া আর ভারী হয়। মানুষের ফুসফুসের ভার প্রায় এক সের হয়, তবে স্ত্রীদের এর থেকে একটু কম হয়। ফুসফুসের মধ্যে শ্বাস নাসিকার দ্বারা শ্বাসপ্রণালীর মধ্যে হয়ে পৌঁছায়। ফুসফুসের মধ্যে অনেক ছোট-ছোট অংশ আছে যা পরস্পর সৌত্রিক তন্তুর দ্বারা বাঁধা থাকে, যাকে বায়ু মন্দির বলে। ফুসফুসের কাজ হল শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়ার সম্পাদন করা, এটা শ্বাস নিলে প্রসারিত হয় আর প্রশ্বাস অর্থাৎ বায়ু বাইরে বেরিয়ে গেলে নিজের পূর্ব অবস্থায় ফিরে আসে। প্রশ্বাসের পশ্চাৎও ফুসফুসের মধ্যে বায়ু ভরা থাকে। সাধারণতঃ সুস্থ মানুষ এক মিনিটে ১৬ থেকে ২০ পর্যন্ত শ্বাস নেয়, বাল্যকালে এই সংখ্যা অধিক হয়। রোগ হলে শ্বাসের সংখ্যা হ্রাস পায়। ফুসফুস নিরন্তর শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়ার দ্বারা রক্তের শুদ্ধি করে। এটা আমি পূর্বেই লিখেছি যে ফুসফুস হচ্ছে স্পঞ্জের মতো অসংখ্য ছোট-ছোট বায়ু মন্দিরের সমুদায়। দৈর্ঘ্য-প্রস্থে ছড়িয়ে দিলে শ্বাসযন্ত্র ১৪০০০ বর্গ ফিট স্থান নেয়। এই বায়ু মন্দির বক্ষোদর, মধ্যস্থ পেশীর চালে খোলা আর বন্ধ হতে থাকে। যখন এই বায়ু মন্দির ধাক্কা দেয় তখন একদিকে তো হৃদয় থেকে অশুদ্ধ রক্ত আর অন্যদিক থেকে শ্বাস দ্বারা নেওয়া বায়ু তাকে ভরে দেয়। রক্ত আর বায়ুর মাঝে এক অতি পাতলা ঝিল্লি থাকে। প্রকৃতির একটা বিলক্ষণ নিয়ম তাতে কাজ করে, সেই নিয়মের বশীভূত হওয়ায় যারমধ্যে যে বায়ু হয় না সেটা অন্যের থেকে টেনে নেয়। শুদ্ধ বায়ু থেকে জীবনীয় তত্ত্ব (অক্সিজেন) রক্তের মধ্যে মিলে যায় আর রক্তের মধ্যে সঞ্চিত দূষিত তত্ত্ব বায়ুর মধ্যে মিলে যায়, এইভাবে শুদ্ধ হওয়া রক্ত ধমনির দ্বারা সারা শরীরের মধ্যে পৌঁছে যায় আর অশুদ্ধ হওয়া বায়ু প্রশ্বাস দ্বারা শরীরের বাইরে বেরিয়ে যায়। এই কাজ প্রতিক্ষণ হতে থাকে।
🍁শ্বাসযন্ত্রের মধ্যে শুদ্ধ বায়ু না পৌঁছানোর পরিণাম 🍁
এখন চিন্তার বিষয় হল যদি হৃদয় থেকে রক্ত শুদ্ধ হওয়ার জন্য শ্বাসযন্ত্রের মধ্যে যাবে কিন্তু শ্বাস দ্বারা পর্যাপ্ত বায়ু শ্বাসযন্ত্রের মধ্যে না পৌঁছায় অথবা সব বায়ু মন্দিরের মধ্যে যেখানে রক্ত পৌঁছে গেছে কিন্তু শুদ্ধ বায়ু না পৌঁছায় তাহলে তার পরিণাম কি হবে?
শ্বাসযন্ত্রের প্রধানত তিনটা ভাগ আছে, (১) উর্দ্ধ ভাগ যা প্রায় গলা পর্যন্ত, (২) মধ্যভাগ যা দুইদিকে হৃদয়ের এদিক-সেদিক এবং (৩) নিম্ন ভাগ যা বক্ষোদয় মধ্যস্থ পেশীর উপরে দুইদিকে। সাধারণ ভাবে যে শ্বাস নেওয়া হয় সেটা পূর্ণ শ্বাস হয় না এইজন্য শ্বাসযন্ত্রের সব ভাগে অথবা সব ভাগের সমস্ত বায়ু মন্দিরের মধ্যে পৌঁছায় না, ফলে শ্বাসযন্ত্রের উর্দ্ধ ভাগ রোগী হওয়া শুরু করে।
.
ঠিক এইভাবে শ্বাসযন্ত্রের মধ্য আর নিম্ন ভাগ রোগী হয়ে গেলে কাশি-শ্বাস-নিমোনিয়া আর জীর্ণ জ্বরাদি অনেক রোগ যা শ্বাসযন্ত্রের সঙ্গে সম্বন্ধিত, সেগুলো হতে থাকে। এইভাবে পর্যাপ্ত বায়ু শ্বাসযন্ত্রের মধ্যে না পৌঁছানোর কারণে যেমন একদিকে শ্বাসযন্ত্র বা ফুসফুস সম্বন্ধিত রোগ উৎপন্ন হয়, তেমনই অন্যদিকে রক্ত শুদ্ধ হতে পারে না আর এই বিনা শুদ্ধ হওয়া অশুদ্ধ রক্তই হৃদয়ের মধ্যে ফিরে গিয়ে সেখান থেকে সারা শরীরের মধ্যে ধমনির দ্বারা ছড়িয়ে যায়। বারংবার এইভাবে দূষিত রক্ত শরীরের মধ্যে ছড়িয়ে যাওয়ার কারণে সাধারণ চুলকানি থেকে ভয়ংকর কুষ্ঠ রোগ পর্যন্ত হয়। শরীরের মধ্যে উৎসাহ-কান্তি-স্ফূর্তির নিতান্ত অভাব হয়, শরীর-মন-মস্তিষ্কের সমস্ত শক্তি নিস্তেজ হয়ে যায় আর মানুষ ভয়ংকর রোগে পীড়িত হয়ে সাক্ষাৎ নরকের অনুভব করে।

🍁 প্রাণায়ামের গুরুত্ব 🍁
এতক্ষণ আমরা হৃদয় ফুসফুস আদি শরীরের অঙ্গের বর্ণনা এইজন্য করলাম যাতে আমরা শ্বাস সংস্থানের কাজ আর তার গুরুত্বকে বুঝতে পারি। আমাদের জ্ঞানেন্দ্রিয়া, কর্মেন্দ্রিয়া, মন, বুদ্ধি আদি সব অধ্যাত্ম জগতের তত্ত্বের নির্মাণ রক্তের দ্বারাই হয়। রক্তের দ্বারাই মাংস, চর্বি, অস্থি, মজ্জা, শুক্র যাবৎ ধাতু তৈরি হয়। রক্ত যত শুদ্ধ পবিত্র হবে শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নির্মাণ ততই ঠিক ভাবে হবে। রক্তকে শুদ্ধ তথা জীবনীয় তত্ত্ব দ্বারা পরিপূর্ণ করার কাজ ফুসফুসের যাকে সে শ্বাস-প্রশ্বাস দ্বারা সম্পাদিত করে। এইরকম অবস্থায় প্রাণায়ামের গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে যায়। আমরা পূরক প্রাণায়াম দ্বারা বিশুদ্ধ বায়ু অধিক পরিমাণে ফুসফুসের মধ্যে পৌঁছে দিতে পারি আর সেটা তার চাপ দ্বারা ফুসফুসের মধ্যে উপস্থিত সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম বায়ু মন্দিরের মধ্যে পৌঁছে রক্তকে শুদ্ধ করতে পারে, তথা অভ্যন্তর কুম্ভক দ্বারা শ্বাসযন্ত্রের ধারণশক্তিকে অধিকাধিক বাড়িয়ে তাকে সবল বানাতে পারে আর বেগপূর্বক রেচক প্রাণায়াম করে ফুসফুসের মধ্যে উপস্থিত সম্পূর্ণ দূষিত বায়ুকে বাইরে ফেলে দিতে পারে। এইভাবে রেচক আর পূরক ক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা পূর্ণ স্বাস্থ্য লাভ করে সুখী হতে পারি।
.
আমি এটা প্রাণায়ামের স্থূল কাজের বর্ণনা করেছি যাকে আধুনিক শরীরশাস্ত্রজ্ঞও স্বীকার করে। এছাড়াও প্রাণায়ামের আরও অনেক অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। যে বায়ু আমরা নাসিকা দ্বারা ভিতরে নিই বা বাইরে বের করি, কেবল তারই নাম প্রাণ নয়। প্রাণবাহক স্নায়ুতন্ত্র শরীরের প্রত্যেক অঙ্গের মধ্যে এমনকি ত্বকেরও প্রত্যেক অণুর মধ্যে ছড়িয়ে আছে। এইসব স্নায়ুতন্ত্রের মধ্যে প্রতিক্ষণ প্রাণদেব পরিক্রমা করতে থাকে। প্রাণবাহক স্নায়ুতন্ত্র রক্তবাহক স্নায়ুতন্ত্রের সমান সচ্ছিদ্র নয় বরং দৃঢ় হয়। এর অভ্যন্তর তথা বাইরের অবয়ব থেকে হয়ে প্রাণ এমন ভাবে গতি করে যেমন "শোষক কাগজে" জল। একেই প্রাণসূত্র বলে। গতি আর জ্ঞান এই দুই প্রকার কাজের সম্পাদন প্রাণ আর দৈব মন এই সূত্রের দ্বারা করে। প্রাণায়াম করার ফলে এইসব প্রাণসূত্র বিশেষ বল প্রাপ্ত করে, যার ফলে সম্পূর্ণ শরীরের মধ্যে স্ফূর্তি আর উৎসাহের সঞ্চার হয়।
প্রাণায়াম করার সময় "মূলধারের সঙ্কোচ" নামক ক্রিয়া বিশেষ ধ্যান দিয়ে করতে হয়, যার বর্ণনা আমরা পরবর্তী অধ্যায়ের মধ্যে করবো। মূলধারের সঙ্কোচ দ্বারা প্রাণ উর্দ্ধগতি হয়ে মস্তিষ্কের মধ্যে স্থির হয়ে যায়, যার ফলে মন অনায়াসে একাগ্র হয়ে সাধককে আনন্দিত করে তোলে। এইভাবে প্রাণায়াম করলে অনেক অপূর্ব লাভ হয়।
🍁 দীর্ঘায়ুর সাধন প্রাণায়াম 🍁
প্রাণীদের আয়ুকে শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যে বিভক্ত তো মানা যায় না তবে যারা ব্রহ্মচর্যের পালন করে নিয়মপূর্বক প্রাণায়াম করে তারা তেমন শরীর মন আদি হতে নিরোগ থাকে তেমনই তারা আয়ুতেও বৃদ্ধি প্রাপ্ত করে। প্রাণায়ামের অভ্যাস দ্বারা মানুষের ফুসফুস বলবান হয়, শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি গম্ভীর হওয়াতে আয়ু ক্ষীণ হয় না আর তাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের সংখ্যা অনেক কমে যায়। এই কারণে ঋষি, মহর্ষি তথা সংযমী মানুষ দীর্ঘায়ু হয় আর তাদের অপেক্ষায় চরিত্রহীন সংযম-রহিত জীবনযাপনকারী ব্যক্তি অতি অল্পায়ু হয়। যেসময় আমাদের দেশে এই প্রাণায়াম বিদ্যার প্রচার ছিল তখন মানুষের সাধারণ আয়ু শত বর্ষ ছিল, রোগ প্রায় হতোই না, মৃত্যুও বিনা ইচ্ছায় আসতো না। মহাভারতে ভীষ্ম পিতামহ কয়েক মাস যাবৎ মৃত্যুর সঙ্গে সংঘর্ষ করতে থাকেন আর তারপর নিজের ইচ্ছানুসারে প্রাণ বিসর্জন করেন। শ্বাসের সঙ্গে আয়ুর ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে, সেটা নিম্ন বিবরণ তালিকার দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যায় -
🌱 শ্বাসের উপর প্রাণীদের আয়ু -
(প্রাণী) --(প্রতি মিনিট শ্বাস) -- (আয়ু)
খরগোশ -------- ৩৮ ------------ ৮ বছর
পায়রা ----------- ৩৬ ------------ ৮ বছর
বাঁদর ------------- ৩২ ---------- ২১ বছর
কুকুর ------------ ২৯ ----------- ১৪ বছর
ছাগল ----------- ২৪ ----------- ১৩ বছর
নেউল ----------- ২৫ ----------- ১৩ বছর
ঘোড়া ------------ ১৯ ----------- ৫০ বছর
মানুষ ------------ ১৫ --------- ১০০ বছর
হাতি -------------- ১২ --------- ১০০ বছর
সাপ ---------------- ৮ ---------- ১২০ বছর
কচ্ছপ ------------- ৫ ---------- ১৫০ বছর
দ্রষ্টব্য - এই শ্বাস সংখ্যা সুস্থ প্রাণীদের দেওয়া হয়েছে, রোগী আর দূর্ব্যসনিদের নয়।
🍁 শ্বাস সর্বদা নাক দিয়েই নিবেন 🍁
পরমপিতা পরমাত্মার কৃপায় মানুষ এমন সুবিধা প্রাপ্ত করেছে যে সে নাক আর মুখ দুটো দিয়েই শ্বাস নিতে পারে কিন্তু একটু গম্ভীর ভাবে দেখলে এই পরিণাম আসে যে - শ্বাস নেওয়ার জন্য প্রকৃতি নাসিকারই নির্মাণ করেছে। আজ অনেক ব্যক্তি আর বিশেষ করে কথিত সভ্য বলা হয় এমন মানুষের মধ্যে মুখ দিয়ে শ্বাস নেওয়ার দূর্ব্যসন দেখা যায়, যার পরিণাম খুবই হানিকারক। তার কারণ হল মুখের মধ্যে এমন কোনো সাধন নেই যেটা বায়ুকে সংশোধন করে ফুসফুসের যোগ্য করতে পারে, এই কারণে দূষিত পরমাণু সহিত বায়ু শ্বাসযন্ত্রের মধ্যে পৌঁছে অনেক সংক্রামক রোগকে উৎপন্ন করে। মুখ দিয়ে শ্বাস নেওয়ার মার্গ ছোট হওয়ার কারণেও বায়ু অতি শীত অথবা অতি উষ্ণ রূপেই শ্বাসযন্ত্রের মধ্যে পৌঁছে যায়, যার ফলে সর্দি, জ্বর, কাশি আদি অনেক রোগ উৎপন্ন হয়। এর বিপরীত নাসিকা দিয়ে শ্বাস নেওয়া অতি উপযোগী হয়। পরমাত্মা নাসিকার মধ্যে এমন ভাবে সাধন সংযুক্ত করেছেন যা ফুসফুসকে হানি করে এমন জীবাণুকে মাঝখানেই থামিয়ে দেয়, আর শ্বাসযন্ত্র পর্যন্ত বায়ু এসে পৌঁছাতে-পৌঁছাতে বায়ু উপযুক্ত শীতোষ্ণ হয়ে যায়। যেসব ব্যক্তি প্রাণায়াম মার্গে আগে যেতে চায় তাদের সর্বপ্রথম নাক দিয়ে শ্বাস নেওয়ার স্বভাব করা উচিত। এটা শুনতে খুবই সামান্য কথা বলে মনে হয় কিন্তু স্বাস্থ্যের দৃষ্টিতে এর বিশেষ গুরুত্ব আছে।
🍁 প্রাণায়ামের প্রস্তুতি 🍁
প্রাণায়াম করার পূর্বে তার প্রস্তুতি নেওয়াটা পরমাবশ্যক, অর্থাৎ নিজেকে প্রাণায়ামের যোগ্য করে তোলা।
যেসব সাধক নিজেকে প্রাণায়ামের অধিকারী করে না তারা অনুভবী গুরুর সানিধ্যে থাকা সত্ত্বেও যথেষ্ট উন্নতি হতে বঞ্চিতই থাকে। সুতরাং প্রাণায়ামের পথিককে নিম্ন বিষয়গুলোর উপর গভীর ভাবে ধ্যান দেওয়া উচিত -
🌿 প্রাণায়ামের প্রতি আস্থা 🌿
যারা প্রাণায়ামে সফল হতে চায় তাদের সর্বপ্রথম কর্তব্য হল তারা তাদের মনকে প্রাণায়ামের গুণের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দিবে, যাতে প্রাণায়ামের বিচার আসতেই তার মধুর পরিণামের বিচার করে মন লাফিয়ে ওঠে। প্রাণায়াম করার পূর্বে আমাদের মনের মধ্যে এই বিচার দৃঢ় হওয়া উচিত যে এখন আমরা জীবনদায়িনী ক্রিয়াকে করতে চলেছি, যার দ্বারা অনেক দিব্য শক্তি প্রাপ্ত হবে। শরীরের সব ধাতুর মল ভস্মীভূত হয়ে যাবে। নিরাশা-দুর্বলতা-নিষ্কর্মণ্যতা নামেরও শেষ থাকবে না, সব প্রকারের রোগের ইতিশ্রী হয়ে যাবে। জীবনে উৎসাহ-পৌরুষ-সাহস-শৌর্য- পুরুষার্থ আদি শুভ গুণের উদয় হবে। ইন্দ্রিয়ের মলিনতা এবং চঞ্চলতা নষ্ট হয়ে পরমপুরুষার্থের সহযোগিনী হয়ে উঠবে। বুদ্ধি কুশাগ্র হওয়াতে জ্ঞানের অথাহ সাগরের মধ্যে ইচ্ছানুসারে বিচরণ করতে পারবে। সব ধরণের ঋদ্ধিসিদ্ধি চরণ চুম্বন করবে, বীর্যের ঊর্ধ্বগতি হওয়ার কারণে আত্মা বাস্তবিক রূপে শরীরের রাজা হয়ে যাবে। সংকীর্ণতা দূর হয়ে "বসুধৈব কুটুম্বকম্" এর দিব্য সংবাদ মনের মধ্যে স্ফুরিত হয়ে উঠবে। অন্তঃকরণের মল বিক্ষেপ আবরণ আদি সব দোষ দূর হয়ে জীবন পবিত্র আর সফল হয়ে যাবে। এই ভাবে অনেক শুভ গুণের ধ্যান করে অতি উৎসাহ-নিষ্ঠা আর শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রাণায়াম করতে বসবেন। মনের ভিতরে সংশয় অথবা বিকল্পের একটুও অবকাশ দিবেন না, এইভাবে করলে খুব শীঘ্রই যথেষ্ট উন্নতি হওয়া সম্ভব।
🌿 প্রাণায়ামে আসনের উপযোগিতা 🌿
প্রাণায়াম তথা আসনের পরস্পর ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে। আসনের সিদ্ধির পশ্চাৎই সাধক প্রাণায়ামে পূর্ণ সফলতা প্রাপ্ত করতে পারে এইজন্য য়োগদর্শনের মধ্যে মহর্ষি পতঞ্জলি জী প্রাণায়ামের সম্বন্ধে করে লিখেছেন -
তস্মিন্সতি শ্বাসপ্রশ্বাসয়োর্গতিবিচ্ছেদঃ প্রাণায়ামঃ। (য়োগ ২/৪৯)
অর্থাৎ - আসন সিদ্ধ হলে শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিকে রোধ করা হল প্রাণায়াম। সূত্রের মধ্যে "তস্মিন্ সতি" পদ বিশেষ ধ্যান দেওয়ার যোগ্য, আচার্য এই পদের দ্বারা প্রাণায়ামের জন্য আসনের বিশেষ উপযোগিতা সিদ্ধ করতে চাইছেন, এই কারণে প্রাণায়ামের পূর্বে এই আসনের বিধান করেছেন। আসনের স্থিরতার সবথেকে বড় লাভ হল - সাধককে উপাসনার বিঘ্ন শীত-উষ্ণ- খিদে-তৃষ্ণা আদি দ্বন্দ্ব দুঃখ দেয় না। এইজন্য য়োগসূত্রকার লিখেছেন -
ততো দ্বন্দ্বানভিঘাতঃ।। (য়োগ ২/৪৭)
অর্থাৎ - যখন আসন স্থির হয়ে যায় তখন উপাসককে কোনো পরিশ্রম করতে হয় না আর শীত-উষ্ণ অধিক পীড়া দেয় না।
গীতার মধ্যে আসনের বিষয়ে লেখা আছে -
য়োগী য়ুঞ্জীত সততমাত্মানম্ রহসি স্থিতঃ।
একাকী য়তচিত্তাত্মা নিরাশীরপরিগ্রহঃ।। ১০
শুচৌ দেশে প্রতিষ্ঠাপ্য স্থিরমাসনমাত্মনঃ।
নাত্যুচ্ছ্রিতম্ নাতিনীচম্ চৈলাজিনকুশোত্তরম্।। ১১
তত্রৈকাগ্রম্ মনঃ কৃত্বা য়তচিত্তেন্দ্রিয়ক্রিয়ঃ।
উপবিশ্যাসনে য়ুঞ্জ্যাদ্যোগমাত্মবিশুদ্ধয়ে।। ১২
সমম্ কায়শিরোগ্রীবম্ ধারয়ন্নচলম্ স্থিরঃ।
সম্প্রেক্ষ্য নাসিকাগ্রম্ স্বম্ দিশশ্চানবলোকয়ন্।। ১৩
(গীতা ৬/১০-১৩)
য়োগী একান্ত দেশে বসে মন একাগ্র করবে। পরমেশ্বরের চিন্তনের অতিরিক্ত অন্য বিষয়বাসনার চিন্তন করবে না। নিরন্তর একরস মমতারহিত হয়ে মনকে পরমেশ্বরের মধ্যে লাগাবে।। ১০
এমন স্থানে করবে সেখানকার ভূমি, জল, বায়ু শুদ্ধ হবে আর সেটা না তো অধিক উঁচু আর না অধিক নিচু হবে, সেখানে নিচে কুচের আসন তার উপর মৃগছালা বিছিয়ে তার উপর একাগ্র মনে চিত্ত আর ইন্দ্রিয়ের বৃত্তিকে নিরোধ করে নিশ্চল দৃঢ় আসনপূর্বক স্বয়ং বসে নিজের আত্মার শুদ্ধির জন্য ধ্যান য়োগের মাধ্যমে পরমাত্মার চিন্তনে তৎপর হবে।। ১১-১২
কাধ, মেরুদন্ড, মাথা আর গলাকে অচল আর সোজা ধারণ করে নিজের নাসিকার অগ্রভাগে ধ্যান রেখে স্থির হয়ে বসবে আর এদিক-সেদিক কোনো দিশাতে দৃষ্টি ফেলবে না।। ১৩
প্রাণায়াম করার জন্য উপযুক্ত আসনের জিজ্ঞাসাতে আমি বলবো, যে আসনে সুখপূর্বক অধিক সময় পর্যন্ত বসা যেতে পারে সেই আসনটাই উচিত হবে। য়োগদর্শনের মধ্যেও সেটা বলা হয়েছে -
"স্থিরসুখমাসনম্" (য়োগ ২/৪৬)।
প্রাণায়ামের অভ্যাস করার জন্য সিদ্ধাসন হল সর্ব শ্রেষ্ঠাসন। সিদ্ধাসনের অভ্যাস দ্বারা অন্য অনেক ধাতু সম্বন্ধীয় বিকার নষ্ট হয়ে যায়। বিধিটা এইরকম -
.
সমতল ভূমিতে বসে বাঁ পায়ের গোড়ালি অণ্ডকোষ আর গুদা ইন্দ্রিয়ের মাঝখানে যে স্থান আছে, সেখানে লাগাবে। এটা হচ্ছে সেই স্থান যেখান থেকে বীর্যবাহক স্নায়ুতন্ত্র গমন করে। ডান পায়ের গোড়ালি মূত্র ইন্দ্রিয়ের উপরে যেখানে কেশ গজায়, সেখানে লাগাবে। দুই পায়ের গোড়ালি মিলে থাকবে। দুই হাঁটু ভূমিতে স্পর্শ করবে। মাথা-গলা-মেরুদণ্ড সমরেখাতে (সোজা) রাখতে হবে। দুই হাত সোজা করে দুই হাঁটুর উপরে রাখবে। শরীর টানটান হওয়া উচিত। বুক প্রসারিত আর সামনের দিকে উদিত হয়ে থাকবে। দৃষ্টি নাসিকার অগ্রভাগ অথবা ভ্রুকুটিতে স্থির করবে। প্রাণায়ামের অভ্যাস করার পূর্বে এক বা দুই ঘন্টা পর্যন্ত এই আসনে বসার অভ্যাস করা উচিত।
.
এই আসন করলে পাচনশক্তি বাড়ে, ডায়রিয়া, শ্বাস, কাশী, বহুমূত্র আদি রোগ দূর হয়, হৃদয় বলবান হয়, স্বপ্নদোষ, প্রমেহ আদি ধাতু সম্বন্ধীয় সব দোষ নষ্ট হয়ে যায়, মন একাগ্র এবং শান্ত হয়ে নিয়ন্ত্রণে আসে, বিষয় লালসা কম হয়, বীর্যের ঊর্দ্ধগতি হয়। ব্রহ্মচারীকে ব্রহ্মচর্যের সিদ্ধির জন্য এর বিশেষ অভ্যাস করা উচিত। এর অতিরিক্ত শির্ষাসন, পদ্মাসন, সর্বাঙ্গাসন, হলাসন, ময়ুরাসন, পশ্চিমোত্তানাসনও প্রাণায়ামের অভ্যাসের জন্য বিশেষ লাভদায়ক হয়। এইসব আসন করলে স্নায়ুতন্ত্রের শুদ্ধি হয়ে প্রাণায়ামে সফলতা প্রাপ্ত হয় আর অভ্যাসকারীর স্বাস্থ্য ঠিক থাকে।
🍁 প্রাণায়াম আর বন্ধ জ্ঞান 🍁

প্রাণায়াম অভ্যাসীদের জন্য বন্ধের জ্ঞান হওয়াটা অতি আবশ্যক। বন্ধ হল তিনটা, যথা (১) মূলবন্ধ, (২) উড্ডিয়ানবন্ধ আর (৩) জালন্ধরবন্ধ (কণ্ঠবন্ধ)। এই তিনটা একসঙ্গে বন্ধত্রয় বলে। তিনটা বন্ধই প্রাণায়াম মার্গে অতি লাভপ্রদ আর পরমোপয়োগী হয়। তিনটার বিধি এখানে পৃথক-পৃথক ভাবে দেওয়া হল -

🌿 মূলবন্ধ 🌿

পদ্মাসন বা সিদ্ধাসনে বসে নাভি থেকে নিচে উদরের ভাগকে পিছন দিকে সঙ্কুচিত করে তথা গুদা ইন্দ্রিয় এবং মূত্র ইন্দ্রিয়কে উপরের দিকে সঙ্কোচ করবেন। আপনি এটা অন্য ভাবেও ঠিক বুঝতে পারবেন, যখন লঘুশঙ্কা (প্রস্রাব) করতে যাবেন আর মূত্রত্যাগ করার সময় মাঝখানেই নাভির নিচের ভাগকে উপরের দিকে টান দিবেন তো এর উপরে সঙ্কোচের কারণে গুদা ইন্দ্রিয় আর মূত্রেন্দ্রিয়ও একসঙ্গে টানবে তথা মূত্র বের হওয়া একদম বন্ধ হয়ে যাবে আর যতক্ষণ এই মূলাধারকে ঢিলা করবেন না ততক্ষণ পর্যন্ত এক ফোঁটা মূত্র আসবে না, এই ক্রিয়াকেই মূলবন্ধ বলে। সব প্রকারের প্রাণায়ামে এই বন্ধ জারি থাকা অত্যাবশ্যক। এই মূলাধার সঙ্কোচকে তো ব্রহ্মচারীর প্রাণই বলা উচিত, কারণ এর নিরন্তর অভ্যাস দ্বারা সব প্রকারের বীর্য সম্বন্ধীয় বিকার দূর হয়ে যায় তথা বীর্যের ঊর্ধ্বগতি হয়। যেসব ব্যক্তির কুসঙ্গ আদির কারণে স্বপ্নদোষ আদি রোগ হয়েছে, তাদের জন্য এটা খুবই উত্তম প্রয়োগ। আপনি যখন কয়েক মাস প্রাণায়াম করার অভ্যাস করবেন তথা মূলবন্ধকে লাগানোর ঠিক অভ্যাস হয়ে যাবে তখন আপনি দেখবেন যে স্বপ্নদোষ আর স্বপ্নদোষের সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকবে। ধীরে-ধীরে আপনি স্বপ্নদোষ থেকে মুক্ত হয়ে যাবেন আর আপনার বিজয় হবে।

এর অতিরিক্ত মূলাধার সঙ্কোচের কারণে কুণ্ডলিনী জাগ্রত হয়ে যায় তথা সুষুম্নার মুখ খুলে যায়, যার ফলে কুণ্ডলিনী এরমধ্যে প্রবেশ করে, এই ক্রিয়ার ফলে সাধকের প্রাণের ঊর্দ্ধগতি হয়ে সুষুম্নার দ্বারা মস্তিষ্কের মধ্যে চলে যায় আর সেখানে স্থির হওয়ার কারণে সাধক পরমাত্মার দিব্য আনন্দের প্রাপ্তি করে। এই বিষয়ে স্বামী আত্মানন্দ জী মহারাজ তাঁর "সন্ধ্যা অষ্টাঙ্গ য়োগ" পুস্তকের মধ্যে লিখেছেন -

কুণ্ডলিনী পেটের কোন অঙ্গ আর এটা জাগলে সুষুম্নার মুখ খুলে যাওয়ার সঙ্গে এর কি তাৎপর্য, এতে মতভেদ আছে। তবে হ্যাঁ, একথা অবশ্যই আছে যে "কুণ্ডলিনী জাগরণ" নামক ক্রিয়ার পরে সুষুম্না মার্গে প্রাণ বিনা কোনো বাধায় তীব্রতার সঙ্গে মস্তিষ্কের দিকে চলে যায় আর এর পূর্বে এমনটা হতো না, খুব সম্ভবত সুষুম্নার নিচের ভাগ শ্লেষ্মা আদি মলের দ্বারা আক্রান্ত থাকে আর সেটাই প্রাণের উর্দ্ধগতির প্রতিবন্ধক থাকে। (মূলবন্ধাদি) বিশেষ ক্রিয়া দ্বারা সংশোধন হয়ে যাওয়ার পর প্রাণের বন্ধ সরে যায়...। কুণ্ডলিনীর স্বরূপ যাইহোক না কেন তবে এটা নিশ্চিত যে মূলাধার সঙ্কোচের ফলে প্রাণের ঊর্দ্ধগতি হয়ে আধ্যাত্ম আনন্দের প্রাপ্তি হয়।

🌿 উড্ডিয়ানবন্ধ 🌿

পদ্মাসন বা সিদ্ধাসন লাগিয়ে বসবেন তথা সম্পূর্ণ শ্বাসকে একসঙ্গে বের করে দিবেন, পেটকে পিছনের দিকে টানবেন, এমনটা করলে অন্ত্র শরীরের পিছনের ভাগে লেগে যাবে তখন পেটের সব অবয়বের মধ্যে সঙ্কোচ উৎপন্ন হবে, একেই উড্ডিয়ানবন্ধ বলে। উড্ডিয়ানের অর্থ উড়ন-ও হয়, কারণ যখন এর অভ্যাস করা হয় তখন প্রাণ সুষুম্নানাড়ি থেকে উপরে উড়ে যায়, এইজন্য এই বন্ধের নাম হল উড্ডিয়ান।

এর অভ্যাস বাহ্যকুম্ভকের সময় করা হয়। প্রাণায়ামের সময় এই বন্ধকে বসে তথা ব্যায়ামের সময় দাঁড়িয়ে করা যেতে পারে। এই বন্ধকে ৬ থেকে ৮ মিনিট পর্যন্ত করা উচিত। নৌলি ক্রিয়ার প্রারম্ভিক ক্রিয়া উড্ডিয়ান বন্ধই হয়। নৌলি ক্রিয়া বিশেষ ভাবে দাঁড়িয়ে করা হয়। ব্রহ্মচর্য রক্ষাতে এর দ্বারা খুব সহায়তা পাওয়া যায়। নিয়মিত এর অভ্যাস করলে স্বাস্থ্য, শক্তি, তেজ আর স্ফূর্তি প্রাপ্ত হয়। এর অভ্যাস নৌলি ক্রিয়ার সঙ্গে করা হয়। এই অভ্যাস আমাশয়-অন্ত্র আদির দোষের জন্য রামবাণ আর পেটের সব রোগ থেকে বাঁচার জন্য উড্ডিয়ান বন্ধ হল অমূলক ঔষধ। এই ক্রিয়ার মাধ্যমে উদরের সব অবয়বের যথাযত ব্যায়াম হয়ে যায়, এর জন্য এর থেকে ভালো আর কোনো ক্রিয়া নেই। সব প্রকারের ব্যায়ামের মধ্যে এই ক্রিয়া অনুপম তথা সবথেকে অধিক লাভকারী। পেট আর অন্ত্রের কঠিন রোগে যেখানে ঔষধ ব্যর্থ হয়ে যায় সেখানে এই ক্রিয়া অতি শীঘ্র সফলতা প্রাপ্ত করে। উদরের চর্বিকে কম করতে আর বায়ুর নিবৃত্তি করতে এই ক্রিয়া অদ্বিতীয়।

🌿 জালন্ধরবন্ধ 🌿

পদ্মাসন অথবা সিদ্ধাসন লাগিয়ে বসে অভ্যন্তর প্রাণায়াম করবেন অর্থাৎ নাক দিয়ে বায়ুকে ভিতরে শ্বাসযন্ত্রের মধ্যে ভরে নিবেন আর সেখানেই নিরোধ করবেন, তারপর গলাকে সঙ্কুচিত করে থুতনিকে বুকের মধ্যে লাগাবেন, একেই জালন্ধরবন্ধ বলে। যখন কুম্ভকের অবধি পুরো হয়ে যাবে তখন মাথা উপরে ওঠাবেন আর তারপর মাথা, গলা আর সারা শরীর সোজা করে শ্বাস বাইরে বের করে দিবেন। অভ্যন্তর কুম্ভক করার সময় বায়ু উপরে মস্তিষ্কের মধ্যে চলে যায়, যার ফলে মাথায় উষ্ণতা, মাথা ব্যথা, ভারীতা আদি অনেক বিকার হয় কিন্তু জালন্ধর বন্ধ সঠিক ভাবে করলে প্রাণ উপরে যায় না আর কোনো ধরণের বিকারের সম্ভাবনা থাকে না। 

উপরে মূলবন্ধ, জালন্ধরবন্ধ তথা উড্ডিয়ানবন্ধ নিয়ে পৃথক-পৃথক ভাবে আলোচনা করা হয়েছে। সিদ্ধসনে বসে প্রাণায়াম করার সময় এগুলোর অভ্যাস করা উচিত। এরই সঙ্গে প্রাণায়াম করলে বিশেষ লাভ হয় সুতরাং এর প্রয়োগ মন দিয়ে করা উচিত।

🍁 ব্রহ্মচর্য আর প্রাণায়াম 🍁

যারা প্রাণায়াম থেকে পূর্ণ লাভ প্রাপ্ত করতে চায় তাদের সর্বপ্রথম ব্রহ্মচর্য প্রলনের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হওয়া উচিত। সংযম বিনা কোনো সাধকই এই পথে এক পাও আগে যেতে পারবে না। পুস্তক তথা ব্যাখ্যাতে প্রাণায়ামের দিব্য আকর্ষক গুণের স্মরণ করে অনেক ব্যক্তি ব্রহ্মচর্যের উপেক্ষা করে প্রাণায়ামের মধ্যেই পরিশ্রম করে। এতে তারা লাভের স্থানে অনেক ভয়ংকর রোগ নিয়ে বসে। আসলে প্রাণায়াম আর ব্রহ্মচর্যের মধ্যে অবিনাভাব সম্বন্ধ আছে। যেভাবে ব্রহ্মচর্য বিনা প্রাণায়ামে সফলতা পাওয়া যায় না, তেমনই প্রাণায়ামের অভাবে ব্রহ্মচর্য পথ প্রশস্ত হওয়া সম্ভব নয়।

প্রাণায়াম করার ফলে শরীরের মধ্যে এক ধরণের উষ্ণতা উৎপন্ন হয়, যার ফলে জঠরাগ্নি প্রদীপ্ত হয়ে উদরস্থ সব বিকার নষ্ট হয়ে তথা শরীরের রস, রক্ত, মাংস, মেদাদি বীর্য পর্যন্ত সব ধাতুর মল ক্ষীণ হয়ে শরীর শুদ্ধ পবিত্র হয়ে যায়। আর এর বিপরীত যে অসংযমী ব্যক্তি ভোগ বিলাস দ্বারা নিজেকে নির্বীর্য বানিয়ে ফেলেছে, সে যদি প্রাণায়াম করে তাহলে তার ভিতরে উষ্ণতা অধিক বেড়ে শরীরের ধাতুকে শুকিয়ে দিবে, যার ফলে তার শরীর দূর্বল, রুক্ষ আর নিস্তেজ হয়ে হবে।

প্রাণায়ামের অভ্যাসীকে ব্রহ্মচর্য পালনের কতটা আবশ্যকতা আছে তার একটা প্রমাণ মহর্ষি দয়ানন্দ জীর জীবনচরিত্র থেকে পাওয়া যায় - একদিন এক ঠাকুরপ্রসাদ সুনার দানাপুর স্বামী জীর নিকট নিবেদন করে যে আপনি আমাকে য়োগ (প্রাণায়াম) এর বিধি বলুন। স্বামী জী উত্তর দেন - "আরও একটা বিয়ে করে নাও তোমার য়োগ (প্রাণায়াম) পূর্ণ হয়ে যাবে।" কিছুদিন পূর্বে ঠাকুরপ্রসাদ প্রথম স্ত্রী থাকতে দ্বিতীয় বিবাহ করেছিল। অতঃ মহর্ষি তাকে এইভাবে উপহাসাত্মক উত্তর দেন, যার দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যায় যে প্রাণায়ামের অভ্যাসীকে ব্রহ্মচর্যের দৃঢ়ব্রতী হওয়া উচিত।

তাছাড়া প্রত্যেক কাজের শুরুতে অনভ্যাসের কারণে কষ্টকর অনুভব হয় তবে প্রাণায়ামের প্রারম্ভিক অভ্যাস কালে সাধকের উপর আলস্য-প্রমাদের তীব্র আক্রমণ হয়, সেখান থেকে পার হওয়া ব্রহ্মচর্যের দ্বারাই সম্ভব। এইজন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জী গীতাতে ঠিকই বলেছেন -

অসম্য়তাত্মনা য়োগো দুষ্প্রাপ ইতি মে মতিঃ।
বশ্যাত্মনা তু য়ততা শক্যোऽবাপ্তুমুপায়তঃ।। 
(গীতা ৬/৩৬)

অর্থাৎ - যার মন নিজের অধীনে নেই তার সমাধিরূপ য়োগ অনেক দুঃখের সঙ্গে প্রাপ্ত হয়, এটা আমি মনে করি আর যে নিজের মনকে বশ করেছে আর স্বয়ং যত্নশীল, সে চেষ্টা করলে প্রাপ্ত করতে পারবে। অতঃ যে সজ্জন প্রাণায়ামের মার্গে যেতে চাইবে তাকে বিশেষ নিষ্ঠা পূর্বক ব্রহ্মচর্যের পালন করা উচিত।

🍁 প্রাণায়াম আর ভোজন 🍁

আমাদের জীবনের মূল আধার হল ভোজন। ভোজনের সাত্ত্বিক মীমাংসার বিনা আমরা কোনো ক্ষেত্রেই উন্নতি করতে পারবো না, কারণ আমাদের শরীর-মন-মস্তিষ্ক তথা অন্য সব সাধনভূত শরীর অবয়ব ভোজন দ্বারাই নির্মিত আর বিকশিত হয়। সাত্ত্বিক-রাজসিক আর তামসিক ভেদ দ্বারা ভোজন তিন ভাগে বিভক্ত, প্রাণায়ামের অভ্যাসীকে শুদ্ধ সাত্ত্বিক-পৌষ্টিক তথা স্নিগ্ধ আহারই সর্বদা সেবন করা উচিত আর সেটাও পরিমিত মাত্রায়, নিশ্চিত সময়, দেশ কাল আর শরীরের বলাবলের বিচার করে, তবেই লাভপ্রদ হয়।

আজ আমাদের ভোজন প্রায় দূষিত হয়ে গেছে। প্রথমত আমরা এটাই জানি না যে ভোজন স্বাদের জন্য হয় না বরং শরীর রক্ষার নিমিত্তের জন্য হয়, এই কারণে আমরা ভোজনের নির্ধারণ করার সময় লাভ-হানির উপেক্ষা করে কেবল জিহ্বার লোলুপতাকে অধিক গুরুত্ব দিই। প্রাণায়াম অভ্যাসীদের জন্য অনুভবী সাধক বিদ্বান ভোজনের চর্চা করে লিখেছেন -

পুষ্টম্ সুমধুরম্ স্নিগ্ধম্ ধাতুপ্রপোষণাম্।
মনোऽভিলষিতম্ য়োগ্যম্ য়োগী ভোজনমাচরেত্।।

অর্থাৎ - প্রাণায়ামের সাধক য়োগীকে শরীরপোষক, মধুর, স্নিগ্ধ, শরীরের সব ধাতুকে পুষ্ট করে এমন রুচিকারক, প্রকৃতির অনুকূল ভোজন করা উচিত।

ঠিক এইরকম সাত্ত্বিক ভোজনের বিধান শ্রীকৃষ্ণ জী গীতার মধ্যে বলেছেন -

আয়ুঃ সত্ত্ববলারোগ্যসুখপ্রীতিবিবর্ধনাঃ।
রস্যাঃ স্নিগ্ধাঃ স্থিরা হৃদ্যা আহারাঃ সাত্ত্বিকপ্রিয়াঃ।।
(গীতা ১৭/৮)

অর্থাৎ - আয়ু, উৎসাহ, বল, আরোগ্য, সুখ আর প্রীতি বৃদ্ধিকারী ভোজন সত্ত্বগুণী মানুষদের প্রিয় হয়। অর্থাৎ যে ভোজনের সেবন দ্বারা আয়ু, বল, বীর্য, আরোগ্য আদি শুভ গুণের বৃদ্ধি হয়, যা সরস হালকা - ঘৃতাদিযুক্ত চিরস্থায়ী আর হৃদয়ের জন্য হিতকর হয় সেইসব ভোজন সাত্ত্বিক হয়। কিছু সাত্ত্বিক পদার্থ নিচে দেওয়া হল -

🌿 সাত্ত্বিক পদার্থ -

দেশী গরুর ঘী আর দুধ, গম, যব, চাল, মুগ ডাল, তাজা ফল, শাক, ঝিঙ্গে, লাউ আদি মধুর শীতল, স্নিগ্ধ, সরস, শুদ্ধ, পবিত্র আর শীঘ্র হজমকারী তথা ওজ আর কান্তিপ্রদ পদার্থ, এগুলো সব সাত্ত্বিক।

আজকাল মানুষের ভোজনে সাত্ত্বিকের অভাব তথা রাজসিক আর তামসিক অংশের প্রাধান্য আছে। সবাই টক, নোনতা, অত্যুষ্ণ, তীক্ষ্ণ, রুক্ষ, দাহক, লবণাক্ত, ঝাল তথা মসলা যুক্ত ভোজন করে, যার ফলে রজোগুণের বৃদ্ধি হয়ে প্রতিক্ষণ তৃষ্ণা আর চিন্তার জ্বালাতে মানুষ অশান্ত হয়ে আছে। এই ধরণের মানুষ প্রাণায়ামে কখনো সফল হবে না, সুতরাং প্রাণায়ামের অভ্যাসীকে সাত্ত্বিক ভোজনের মাত্রাও ধ্যানে রাখা আবশ্যক, অধিক মাত্রায় খাওয়া সাত্ত্বিক ভোজনও দুঃখদায়ক। গরিষ্ঠ আর মলবদ্ধকারী আহার থেকে সাধককে দূরেই থাকা উচিত।

🍁 প্রাণায়াম আর নিয়মিত দিনচর্যা 🍁

প্রাণায়ামে সফলতার জন্য নিয়মিত দিনচর্যা হওয়াটা পরম আবশ্যক। সাধকের প্রত্যেক ক্ষণ নিশ্চিত কার্যক্রমানুসারে বিভক্ত হওয়া উচিত। প্রাতঃকাল জাগরণ থেকে শুরু করে রাতের শয়ন পর্যন্ত নিয়মিত রূপে দিনচর্যা অবাধ রূপে চলা উচিত। এইভাবে একটানা লম্বা সময় পর্যন্ত অভ্যাস করলে মন তথা শরীরের অন্য অবয়ব সময়ানুসারে কাজ করার অভ্যাস হয়ে যায়, ফলে মন সব বিকল্প থেকে রহিত অতিশান্ত থাকবে। সায়ংকালে নিশ্চিত সময়ে শয়ন করার ফলে প্রাতঃ ঠিক সময় নিদ্রা পূরণ হবে আর একটু সময়ের মধ্যেই শরীরের সব ক্লান্তি দূর হবে। শৌচ আদি মল বিসর্জনের সময় নিশ্চিত হওয়াতে আমাদের অনৈচ্ছিক মাংস সঠিক সময়ে মল ত্যাগ করবে। এর ফলে কব্জ বা কোষ্ঠকাঠিন্য আদি রোগ থেকে সহজেই মুক্তি পাওয়া যাবে। ভোজনের সময় নিশ্চিত হওয়াতে খিদে ঠিকভাবে পাবে আর ভোজনের পরিপাকও উচিত রীতিতে হবে। শরীরের সব অঙ্গের ব্যবস্থা ঠিক থাকার জন্য প্রাণায়াম করে প্রতিদিন মন উৎসাহিত থাকবে, আর মন স্বতঃ প্রাণায়ামের মধ্যে লেগে যাবে। এইভাবে নিয়মিত দিনচর্যা করলে খুব শীঘ্রই উন্নতি হবে।

প্রাণায়ামের অভ্যাসীদের জন্য কিছু বিষয় উপরে লেখা হয়েছে। এর অতিরিক্ত আজকাল অনেক ব্যক্তি হঠ য়োগের আডম্বরকে প্রধান মেনে অনেক প্রকারের মুদ্রা-বস্তি-ধৌতি-ত্রাটক আদি ক্রিয়ার বিধান করে। কিন্তু এইসব ক্রিয়া প্রাণায়ামের মার্গে সাধক হওয়ার স্থানে বাধকই হয়। আমার জানা এমন অনেক মানুষ আছে যারা মুদ্রা আর বস্তি আদি ক্রিয়ার ফলে নিজেকে সারা জীবনের জন্য রোগী বানিয়েছে। যে সাধক ব্রহ্মচর্যের পালন করার সঙ্গে শুদ্ধ সাত্ত্বিক আহার করে তার এইসব অস্বাভাবিক সাধনের কোনো আবশ্যকতাই নেই কারণ প্রাণায়াম করলে সব মলের নিরাকরণ হয়ে যায়। অতঃ এইসব হট্টগোল থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়স্কর।
.
এই বিষয়ে দিব্য য়োগী মহর্ষি দয়ানন্দ জী তাঁর পুনার একাদশতম বক্তৃতাতে এইভাবে বিধান করেছেন -
"এখন হঠ য়োগের বিধান নিয়ে বর্ণনা করবো। হঠ য়োগের মধ্যে বস্তি তাকে বলে যেটা গুদার পথ দিয়ে জল চড়িয়ে পরিষ্কার করা হয়। টকটকি লাগিয়ে এমনভাবে দেখা যেখানে চোখের পলকও বন্ধ হবে না, তাকে ত্রাটক বলে। নাকের মধ্যে সুতো ঢুকিয়ে মুখ দিয়ে বের করাকে নেতি বলে। মখমলের চার আঙ্গুল চওড়া আর ১৬ থেকে ৮০ হাত পর্যন্ত লম্বা কাপড় মুখের রাস্তা দিয়ে পেটে নিয়ে পুনঃ বাইরে বের করাকে ধৌতি বলে। এইসব হচ্ছে যাদুকরের খেলা, এইসব থেকে কবে নিবৃত্তি পেয়ে য়োগ প্রাপ্ত করতে পারবে, এটা হঠ য়োগই জানে! এইসব করার ফলে রোগ উৎপন্ন হয়।"

মহর্ষি দয়ানন্দ জীর উপরোক্ত উদাহরণ থেকে স্পষ্ট সিদ্ধ হয় যে বস্তি আদি হঠয়োগ ক্রিয়ার সঙ্গে য়োগ আর প্রাণায়ামের কোনো সম্বন্ধ নেই, এইসব করলে সাধক য়োগী না হয়ে রোগী তো অবশ্যই হয়ে যাবে। সুতরাং এইসব থেকে দূরে থাকা উচিত।

🍁 প্রাণায়াম বিধি এবং ভেদ 🍁
প্রাচীনকালে ভারতবর্ষ ভৌতিক ঐশ্বর্যের সঙ্গে-সঙ্গে আধ্যাত্ম বিদ্যাতেও উন্নতির শিখরে বিরাজমান ছিল। প্রাণায়াম বিদ্যা এখানে প্রত্যেক মানুষ জানতো। ব্রহ্মনিষ্ঠ শ্রোত্রিয় গুরুদের পরম্পরা অবিচ্ছিন্ন রূপে চলতো। প্রাণায়ামের মর্ম জানা মনীষী বিদ্বানদের গুরুকুলাদি আশ্রম স্থানে-স্থানে বিদ্যমান ছিল, যেখানে সহস্র সংখ্যক ব্রহ্মচারী, বানপ্রস্থী প্রাণায়ামাদি য়োগাঙ্গের ক্রিয়াত্মক অভ্যাস করতো। সন্ন্যাসী মহাত্মারা গ্রামে-গ্রামে ভ্রমণ করে প্রাণায়ামের গম্ভীর রহস্যের বিবেচনা নিষ্কাম ভাবে মানুষ মাত্রের হিতার্থে করতেন। সেই সময় ভারত সারা বিশ্বের গুরু ছিল। প্রাণায়াম বিদ্যার কারণে সব ক্ষেত্রে তেজস্বিতার একছত্র সাম্রাজ্য ছিল। এই কারণে পবিত্র আর্যাবর্তে সব স্ত্রী-পুরুষ শ্রদ্ধা পূর্বক প্রাণায়াম নিত্যপ্রতি করতেন।
ধীরে-ধীরে প্রমাদ আলস্যের প্রভাবে তথা সৎকর্মের হ্রাসের কারণে বৈদিক জ্ঞানের ভানু অস্তাচলে পৌঁছে যায়। যার পরিণাম স্বরূপ তত্ত্ববেত্তাদের সন্তান আজ প্রাণবিদ্যা হতে নিতান্ত শূন্য। শুধু সামান্য জনতাই নয় বরং বড় বড় পণ্ডিতও প্রাণায়াম বিদ্যা সম্বন্ধে অন্ধ, এইজন্য সর্বত্র অন্ধপরম্পরা চলছে। মানুষ প্রাণায়ামের নামে ভয় পায় আর সেটা কেবল য়োগীদের ব্যবহারের বস্তু বলে মনে করে। এমন অনেক পাখণ্ডী আছে যারা য়োগের নামে আডম্বর করে মানুষের কাছ থেকে ধন হরণ করে মহাপাতকী হচ্ছে। চেলা-চেলিদের বাড়িয়ে সম্প্রদায়ের রূপ দিয়ে অতি নিন্দিত কর্ম করছে। এইরকম অবস্থা দেখে ঋষিদের সন্দেশকে সকল মানুষের কাছে পৌঁছানোর ভাবনা নিয়ে এখানে শাস্ত্রোক্ত প্রাণায়ামের বিধি লেখা হল।
মহর্ষি দয়ানন্দ জী এই যুগের সর্বমান্য য়োগীরাজ আর আপ্ত পুরুষ হন। মহাভারত কাল থেকে আজ পর্যন্ত এই ৫ হাজার বছরে তাঁর সমান কোনো য়োগী হয়নি। আজকালকার য়োগী আর মহাত্মা বলা হয় এমন জন তো তাঁর পায়ের ধুলোও হবে না। তিনি নিজের জীবনে পূর্ণরূপে য়োগতত্ত্বের সাক্ষাৎকার করেছিলেন। তাঁর দ্বারা উপদিষ্ট বিধি সর্বথা বেদাদি শাস্ত্রোক্ত হওয়ার কারণে পাঠকদের কল্যাণার্থ এখানে উদ্ধৃত করা হল -
প্রচ্ছর্দনবিধারণাভ্যাম্ বা প্রাণস্য। (য়োগ ১/৩৪)
অত্যন্ত বেগে বমন করলে যেমন অন্নজল বাইরে বেরিয়ে যায় তেমনই প্রাণকে বলপূর্বক বহির্নিক্ষেপ করে যথাশক্তি বাইরেই নিরুদ্ধ করবে। যখন বের করতে ইচ্ছা হবে তখন মূলেন্দ্রিয়কে উর্দ্ধদিকে আকর্ষণ করে বায়ুকে বাইরে নিক্ষেপ করবে। যতক্ষণ মূলেন্দ্রিয়কে উর্দ্ধদিকে আকর্ষণ করে রাখবে ততক্ষণ পর্যন্ত প্রাণ বাইরে থাকবে। এইভাবে প্রাণ অধিক সময় বাইরে থাকতে সক্ষম হবে। যখন অস্থিরতা বোধ হবে তখন ধীরে-ধীরে বায়ুকে ভিতরে নিয়ে এসে পুনরায় সামর্থ্য আর ইচ্ছানুসারে সেইরূপ করতে থাকবে আর মনে-মনে "ও৩ম্" জপ করতে থাকবে। এইভাবে করলে আত্মা আর মনের পবিত্রতা আর স্থিরতা হয়। প্রথম, "বাহ্যবিষয়" অর্থাৎ প্রাণকে বহুক্ষণ বাইরে নিরোধ করা। দ্বিতীয়, "অভ্যন্তর" অর্থাৎ প্রাণকে ভিতরে যতক্ষণ নিরোধ করা যায় ততক্ষণ নিরোধ করা। তৃতীয়, "স্তম্ভবৃত্তি" অর্থাৎ একই সঙ্গে যে স্থানের প্রাণ সেই স্থানে যথাশক্তি রোধ করা। চতুর্থ, "বাহ্যাভ্যন্তর" ক্ষেপী" অর্থাৎ প্রাণ যখন ভিতর থেকে বাইরে বহির্গত হতে থাকবে তখন তার বিরুদ্ধে তাকে বাইরে বের হতে না দিয়ে বাইরে থেকে ভিতরে আনবে। যখন প্রাণ বাইরে থেকে ভিতরে আসতে আরম্ভ করবে তখন তাকে ভিতর থেকে বাইরের দিকে ধাক্কা দিয়ে রোধ করে রাখবে। এইভাবে একের বিরুদ্ধে অন্যের ক্রিয়া করলে উভয়ের গতি রুদ্ধ হওয়াতে প্রাণ নিজের বশে এলে মন তথা ইন্দ্রিয়ও স্বাধীন হয়। বল আর পুরুষত্ব বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়ে বুদ্ধি তীব্র আর সূক্ষ্মরূপ হয়, যার ফলে অত্যন্ত কঠিন তথা সূক্ষ্ম বিষয় শীঘ্র গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। এতে মানব শরীরে বীর্য বৃদ্ধির ফলে ধৈর্য্য, বল, পরাক্রম, জিতেন্দ্রিয়তা আর অল্পকালের মধ্যেই সব শাস্ত্র বুঝে আয়ত্ত করার সামর্থ্য জন্মাবে। স্ত্রীরাও এইরূপ য়োগাভ্যাস করবে। (সত্যার্থপ্রকাশ, তৃতীয় সমুল্লাস)
মুখ্য রূপে প্রাণায়ামের চারটা ভেদ আছে। মহর্ষি দয়ানন্দ জী উপরে প্রাণায়ামের পূর্ণ বিধি লিখে দিয়েছেন। এর আধার হল য়োগদর্শনের "বাহ্যাভ্যন্তরস্তম্ভবৃত্তির্দেশকালসম্খ্যাভিঃ পরিদৃষ্টো দীর্ঘসূক্ষ্মঃ" তথা "বাহ্যাভ্যন্তরবিষয়াক্ষেপী চতুর্থঃ" (য়োগ ২/৫০-৫১) এই দুটো সূত্র। এই দুই সূত্রের ভাষ্য ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকার উপাসনাবিষয়ে সংস্কৃত তথা আর্য উভয় ভাষাতে মহর্ষি জী এইভাবে করেছেন -
"য়ত্র প্রশ্বাসপূর্বকো গত্যভাবঃ স বাহ্যঃ। য়ত্র শ্বাসপূর্বকো গত্যভাবঃ স আভ্যন্তরঃ। তৃতীয়ঃ স্তম্ভবৃত্তির্য়ত্রোভয়াভাবঃ সকৃৎপ্রয়ত্নাদ্ভবতি। য়থা তপ্তে ন্যাস্তমুপলে জলম্ সর্বতঃ সঙ্কোচমাপদ্যতে তথা দ্বয়োর্য়ুগপদ্ গত্যভাব ইতি।
.
বালবুদ্ধিভিরঙ্গুল্যঙ্গুষ্ঠাভ্যাম্ নাসিকাছিদ্রমবরুধ্য য়ঃ প্রাণায়ামঃ ক্রিয়তে স খলু শিষ্টেস্ত্যাজ্য এবাস্তি। কিন্ত্বত্র বাহ্যাভ্যন্তরাঙ্গেষু শান্তিশৈথিল্যে সম্পাদ্য সর্বঙ্গেষু য়থাবৎ স্থিতেষু সৎসু বাহ্যদেশম্ গতম্ প্রাণম্ তত্রৈব য়থাশক্তি সম্ রুধ্য প্রথমো বাহ্যাখ্যঃ প্রাণায়ামঃ কর্ত্তব্যঃ। তথোপাসকৈর্য়ো বাহ্যাদ্দেশাদন্তঃ প্রবিশতি তস্যাভ্যন্তর এব য়থাশক্তি নিরোধঃ ক্রিয়তে, স আভ্যন্তরো দ্বিতীয়ঃ সেবনীয়ঃ। এবম্ বাহ্যাভ্যন্তরাভ্যামনুষ্ঠিতাভ্যাম্ দ্বাভ্যাম্ কদাচিদুভয়োর্য়ুগপত্সম্রোধো য়ঃ ক্রিয়তে স স্তম্ভবৃত্তিস্তৃতীয়ঃ প্রাণায়ামোऽভ্যসনীয়ঃ। (য়োগ ২/৫০)
.
এইভাবে পরবর্তী সূত্রের ভাষ্য মহর্ষি জী করেছেন -
"য়ঃ প্রাণায়াম উভয়াক্ষেপী স চতুর্থো গদ্যতে। তদ্যথা য়দোদরাদ্ বাহ্যদেশম্ প্রতিগন্তুম্ প্রথমক্ষণে প্রবর্ত্ততে তম্ সম্লক্ষ্য পুনঃ বাহ্যদেশম্ প্রত্যেব প্রাণাঃ প্রক্ষেপ্তব্যাঃ। পুনশ্চ য়দা বাহ্যাদ্দেশাদাভ্যন্তরম্ প্রথমমাগচ্ছেত্তমাভ্যন্তর এব পুনঃ পুনঃ য়থাশক্তি গৃহীত্বা তত্রৈব স্তম্ভয়েত্স দ্বিতীয়ঃ। এবম্ দ্বয়োরেতয়োঃ ক্রমেণাভ্যাসেন গত্যভাবঃ ক্রিয়তে স চতুর্থঃ প্রাণায়ামঃ। য়স্তু খলু তৃতীয়োऽস্তি স নৈব বাহ্যাভ্যন্তরাভ্যাসস্যাপেক্ষাম্ করোতি কিন্তু য়ত্র য়ত্র দেশে প্রাণো বর্ত্ততে তত্র তত্রৈব সকৃৎস্তম্ভনীয়ঃ। য়থা কিমপ্য দ্ভুতম্ দৃষ্ট্বা মনুষ্যশ্চকিতো ভবতি তথৈব কার্য়্যমিত্যর্থঃ। (য়োগ ২/৫১)
তারপর মহর্ষি আর্যভাষাতে লিখেছেন -
"এই প্রাণায়াম চার প্রকারের হয়, যথা - (১) বাহ্য বিষয়ক, (২) আভ্যন্তর বিষয়ক, (৩) স্তম্ভবৃত্তি আর (৪) বাহ্য আর আভ্যন্তর বিষয়ক। এই চার প্রাণায়াম এইভাবে সম্পন্ন করতে হয় যথা - যখন ভিতর থেকে বাইরে শ্বাস প্রবাহিত হয় তখন সেই বায়ুকে বাইরেই যথাশক্তি থামিয়ে রাখবে, এটাই হল প্রথম প্রাণায়াম। যখন বাইরে থেকে শ্বাস ভিতরে গমন করে তখন ভিতরে যথাশক্তি সেই প্রবেশ করা বায়ুকে থামিয়ে রাখবে, এটা হল দ্বিতীয় প্রাণায়াম। তৃতীয় স্তম্ভবৃত্তি অর্থাৎ বায়ুকে যথাস্থানে একদম সুখ সহিত যতক্ষণ থামিয়ে রাখা যায় ততক্ষণ পর্যন্ত থামিয়ে রাখাকে স্তম্ভবৃত্তি বলে, অর্থাৎ বাইরের বায়ু ভিতরে প্রবেশ না করিয়ে অথবা ভিতরের বায়ুকে বাইরে নিঃসরণ না করিয়ে, যেখানে সেই বায়ু আছে তাকে সেখানেই আর সেই অবস্থাতেই যথাশক্তি সুখ পূর্বক অবরোধ করাকে স্তম্ভবৃত্তি বলে। এইভাবে যখন শ্বাস ভিতর থেকে বাইরে নিঃসরণ হবে তখন বাইরেই অল্প-অল্প করে থামাবে আবার যখন বাইরে থেকে বায়ু ভিতরে আসবে, তখন তাকে ভিতরেই অল্প-অল্প করে থামাতে থাকবে, একে বাহ্যাভ্যন্তরাক্ষেপী বলে। এই চার প্রকার প্রাণায়ামের অনুষ্ঠান করলে চিত্ত নির্মল হয়ে উপাসনায় স্থির হয়। (ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকা উপাসনাবিষয়)
এর অতিরিক্ত মহর্ষি জী সংস্কারবিধি, পঞ্চমহাযজ্ঞবিধি আদি গ্রন্থের মধ্যেও প্রাণায়াম বিধির সংকেত করেছেন তবে বিশেষ ভাবে সত্যার্থ প্রকাশ আর ভাষ্যভূমিকাতে প্রাণায়ামের নির্দেশ আছে। সাধক মহানুভবদের সুবিধার জন্য উপরোক্ত চার প্রকারের প্রাণায়ামকে নিচে একটু বিস্তার ভাবে লিখে দিচ্ছি -
(১) বাহ্যবিষয় বা বাহ্যকুম্ভক প্রাণায়াম -
সবার আগে সিদ্ধাসন বা পদ্মাসনে বসবেন। সিদ্ধাসনের প্রকার আমি পূর্বেই লিখে দিয়েছি। প্রাণায়াম করার পূর্বে বাম স্বর যদি চলে তাহলে ঠিক আছে। যেদিকে বায়ু আসবে সেদিকে মুখ করবেন। যেরূপ অত্যন্ত বেগে বমন হয় আর অন্ন-জল বাইরে বেরিয়ে যায়, ঠিক সেইরূপ প্রাণ (শ্বাস) -কে যথাশক্তি বাইরে বের করবেন। একবার নিরন্তর এক শ্বাসে সব বায়ু বাইরে বেরিয়ে যেতে হবে, ঝটকা দিয়ে-দিয়ে নয়। প্রাণায়াম করার পূর্বে মূলবন্ধ ঠিকভাবে লাগিয়ে নিবেন আর যতক্ষণ প্রাণায়াম করবেন ততক্ষণ পর্যন্ত নিরন্তর মূলবন্ধ লাগিয়ে রাখবেন, মাঝখানে যেন কিঞ্চিৎ ঢিলা না হয়। প্রথমে হৃদয়ের বায়ু বল পূর্বক বের করবেন তারপর উপরের ফুসফুসের শ্বাস বের করে খালি করা উচিত, তারপর উদরকে খালি করবেন। শ্বাস এই বিধিপূর্বক বের করলে স্বয়ং হৃদয় ফুসফুস আর পেটের বায়ু ক্রমশঃ একবারেই বেরিয়ে যায়। কিন্তু এটা ধ্যানে রাখবেন সব শ্বাস যেন একদম বাইরে বেরিয়ে যায়, থেমে-থেমে কখনও বের করবেন না। শ্বাসকে লম্বা করে নিরন্তর গতি দিয়ে একবারেই বাইরে বের করে দিবেন। শ্বাস বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার পর উড্ডিয়ানবন্ধও করে দিবেন। শ্বাসকে যথাশক্তি বাইরে থামিয়ে রাখার চেষ্টা করবেন। যখন উৎকণ্ঠা হবে তখন উড্ডিয়ান বন্ধ সরিয়ে ধীরে-ধীরে বায়ুকে ভিতরে নিবেন কিন্তু ভিতরে থামিয়ে রাখবেন না। মূলবন্ধ পূর্বের সমানই জারি থাকবে, এই হল একটা প্রাণায়াম। তারপর এইভাবে এই প্রাণায়ামের দ্বিতীয় আবৃত্তি (পুনরায়) করবেন। কম করে হলেও অন্তত ৩ টা প্রাণায়াম অবশ্যই করবেন। এই প্রাণায়ামের অভ্যাস কালে ভিতরে শ্বাস থামিয়ে রাখবেন না। প্রথমে এই বাহ্যবিষয়ের অভ্যাস অন্তত এক বছর পর্যন্ত করা উচিত। এই হচ্ছে প্রথম প্রাণায়াম আর এটা সিদ্ধ হওয়ার পরই অন্য প্রাণায়াম করা উচিত হবে। সাধারণতঃ মানুষ বাইরে তথা ভিতরে থামিকে রাখা, দুটো একসঙ্গে আরম্ভ করে দেয়, এইজন্য বিশেষ লাভ তথা উন্নতি হয় না। এক মাস পর্যন্ত তিনটা করেই প্রাণায়াম করবেন, তারপর ধীরে-ধীরে প্রতি মাসে সংখ্যা বাড়াতে থাকবেন। যদি গোদুগ্ধ ঘৃত বা অন্য পৌষ্টিক ভোজন পর্যাপ্ত মাত্রায় খেতে পান তাহলে দুই সময় অভ্যাস করা উচিত। এই প্রাণায়ামের সংখ্যা ২১ পর্যন্ত বাড়াতে পারেন। প্রাণায়াম করার সময় হাত দিয়ে নাক ধরে শ্বাস থামানো উচিত নয়। মূলাধারের সঙ্কোচ নিরন্তর রাখা উচিত। একটা প্রাণায়াম করার পর তিন থেকে চার সাধারণ শ্বাস নিয়ে পুনরায় দ্বিতীয় প্রাণায়াম করা উচিত। এইভাবে প্রত্যেক প্রাণায়ামের আবৃত্তিতে এই ক্রমই থাকবে। প্রাণায়ামের সময় অর্থ সহিত ও৩ম্ জপ করতে থাকবেন।
🌿লাভ - এই প্রাণায়াম বিশেষ লাভপ্রদ আর নিরন্তর এর অভ্যাস করার ফলে সবাই উর্দ্ধরেতা হয়ে ব্রহ্মচর্যের দিব্য আনন্দের উপভোগ করতে পারবেন। শরীর তথা নাড়ির শুদ্ধি এই প্রাণায়াম দ্বারা অতি শীঘ্র হয়ে যায়। শরীর তথা ইন্দ্রিয়ের সমস্ত বিকার নষ্ট হয়ে তেজস্বিতা তথা স্থিরতা আসে। এটা ব্রহ্মচারীদের জন্য অমোঘ প্রয়োগ।
২. আভ্যন্তরকুম্ভক বা আভ্যন্তরবিষয় প্রাণায়াম -
এই প্রাণায়াম বাহ্যপ্রাণায়াম সিদ্ধ হওয়ার পর করা উচিত। পূর্ব প্রাণায়ামের সমান সিদ্ধসন অথবা পদ্মাসনে বসে মূলবন্ধ করবেন। তারপর নাক দিয়ে শীঘ্র শ্বাস ভিতরে ভরে নিবেন। একটা শ্বাসেই বায়ু পুরো ভরে যাওয়া উচিত। শ্বাস ভরে যাওয়ার পর জালন্ধর বন্ধ লাগিয়ে দিন আর যথাশক্তি শ্বাসকে ভিতরেই থামিয়ে রাখুন। যখন উৎকণ্ঠা হবে (আর ধরে রাখতে পারবেন না বলে মনে হবে) তখন জালবন্ধ সরিয়ে শ্বাসকে শীঘ্র বাইরে বের করে দিবেন। এই হল একটা প্রাণায়াম। এরপর দুই থেকে চার সামান্য শ্বাস নিয়ে পুনরায় সেইভাবে পূরক করে কুম্ভক করবেন। প্রথম প্রাণায়ামের সমান ধীরে-ধীরে ভোজন আর শক্তি অনুসারে এই প্রাণায়ামেরও সংখ্যা বাড়ানো উচিত। মূলবন্ধ নিরন্তর সাবধানী পূর্বক লাগিয়ে রাখতে হবে। মনকে নাভীর নিচে, হৃদয় অথবা ভ্রুকুটি আদি স্থানে একাগ্র করবেন তারসঙ্গে ও৩ম্ এর জপ নিরন্তর করতে থাকবেন। ধ্যানের দ্বারা প্রাণের চাপ ফুসফুসের প্রত্যেক অবয়বের উপর দেওয়ার চেষ্টা করবেন। এটাই হল দ্বিতীয় প্রাণায়াম আর একে পূরক কুম্ভকও বলে।
🌿 লাভ - এই প্রাণায়ামের ফলে শরীরের শক্তি অত্যধিক বাড়ে, শরীর সুন্দর-সুডৌল হয়। ফুসফুস আর বক্ষঃস্থল বজ্রের সমান দৃঢ় হয়, শীত থেকে রক্ষা করতেও এটা অতি সহযোগী হয়, তাছাড়া ধাতুর বিকারও এই প্রাণায়াম দ্বারা নষ্ট হয়ে যায়। এর অভ্যাসের সঙ্গে প্রথম রেচক প্রাণায়ামও করা যেতে পারে।
৩. স্তম্ভবৃত্তি প্রাণায়াম -
এই হল তৃতীয় প্রাণায়াম। এরমধ্যে পূর্ববৎ আসনে বসে মূলবন্ধ লাগিয়ে না তো শ্বাসকে বাইরে বের করার আবশ্যকতা হয় আর না বাইরে থেকে ভিতরে নেওয়ার। যে অবস্থায় শ্বাস বিদ্যমান আছে সেই অবস্থায় তাকে থামিয়ে দেওয়া হয় আর থামানোর পরে জালবন্ধ লাগিয়ে দেওয়া হয়। যখন আর থামিয়ে রাখা যায় না তখন সাধারণ রীতিতে শ্বাস নিয়ে অথবা বের করে পুনরায় তাকে সেই অবস্থায় থামিয়ে দেওয়া হয়। বাকী সব প্রক্রিয়া পূর্বোক্তই হয়। এই প্রাণায়ামে শ্বাস আর প্রশ্বাস উভয়ের নিরোধ হয়। এরজন্য মহর্ষি ব্যাস জী বড় অনুকূল দৃষ্টান্ত দিয়েছেন, তিনি লিখেছেন - যেরূপ উত্তপ্ত পাথরের উপর ঢেলে দেওয়া জল চারিদিক থেকে সরে গিয়ে এক স্থানে সঞ্চিত হয়ে যায়, সেইরূপ এই প্রাণায়ামে শ্বাস আর প্রশ্বাস উভয়ের একইসঙ্গে নিরোধ হয়। য়োগ দর্শনের ২/৫০ সূত্রের মধ্যে উপরোক্ত তিন প্রকারের প্রাণায়ামের পরীক্ষণের জন্য লিখেছেন - "বাহ্যাভ্যন্তরস্তম্ভবৃত্তির্দেশকালসম্খ্যাভিঃ পরিদৃষ্টো দীর্ঘসূক্ষ্মঃ।" অর্থাৎ বাহ্য, আভ্যন্তর, স্তম্ভবৃত্তি এই তিন নিরোধের দেশ, কাল আর সংখ্যার পরিমাপ করা উচিত।এদের পরিমাপের বিধি হল এইরকম - বায়ু নিরোধের সময় প্রাণ শরীরের মধ্যে কতদূর পর্যন্ত ছড়িয়েছে এর নিরীক্ষণ হল দেশের পরিমাপ। প্রাণ যত দূর পর্যন্ত ছড়ায় শরীরের ততটা ভাগের মধ্যে পিঁপড়ের হেঁটে চলার মতো মনে হয়। এটাই প্রাণের দেশের তুলনা দ্বারা পরিচয়। প্রাণ নিরোধের সময় মনের মধ্যে এটা প্রবল ভাবনা হওয়া উচিত যে প্রাণ আমার সম্পূর্ণ শরীরের মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছে। যতক্ষণ যাবৎ শ্বাসকে আমরা ভিতরে স্তম্ভিত করেছি এটা তার কালের দৃষ্টিতে পরিমাপ আর সেই প্রাণায়ামের আমরা কতবার আবৃত্তি করেছি অর্থাৎ কতবার প্রাণায়াম করেছি এটা সংখ্যার দৃষ্টিতে প্রাণায়ামের মাপ হবে।
এর অতিরিক্ত নিরোধের দীর্ঘতা আর সূক্ষ্মতার নিরীক্ষণও আবশ্যক। দীর্ঘতার অভিপ্রায় হল পূর্বের তুলনায় দেশ, কাল, সংখ্যার দৃষ্টিতে প্রাণায়ামের মধ্যে কতটা বৃদ্ধি হয়েছে। দেশ-কাল-সংখ্যার দ্বারা পরিদৃষ্ট নিরোধ প্রাণায়ামকে পরের দিনই দেশ-কাল-সংখ্যাকে বাড়ানোর চেষ্টা করা উচিত নয়। তাকে সেই অবস্থাতেই অভ্যস্থ করার জন্য কিছুদিন অবশ্যই লাগিয়ে রাখা উচিত। তারপর ধীরে-ধীরে সেই প্রাণায়ামের এত অভ্যাস হয়ে যাওয়া উচিত যে অভ্যাসী জানবেই না যে আমি প্রাণায়াম করছি। কোনো প্রকারের শ্রমের অনুভব প্রাণায়াম করার সময় হবে না আর শ্বাস নেওয়া তথা বের করার গতি অতি সূক্ষ্ম হয়ে যাবে, একেই সূক্ষ্মতা বলে। যে রকম আমি আভ্যন্তর প্রাণায়ামের দেশ-কাল-সংখ্যার দীর্ঘতা আর সূক্ষ্মতার পরীক্ষণের বিধি উপরে বলেছি, সেই রকম বাহ্য প্রাণায়ামেরও পরীক্ষণ করা যেতে পারে। বাহ্য প্রাণায়াম কাল আর সংখ্যার পরীক্ষণ তো পূর্ববৎই হবে কিন্তু দেশের পরীক্ষণ শরীরের ভিতরে না করে শরীরের বাইরে করা হয়, অর্থাৎ নাক থেকে বের হতে থাকা প্রশ্বাসের প্রভাব বাইরের প্রদেশে কতদূর পর্যন্ত পড়ে তার পরীক্ষা আমরা নাকের সম্মুখে তুলো আদির হালকা টুকরো রেখে করতে পারি। এই পরীক্ষা এইজন্য করা হয় যে প্রাণ যত ধীরে-ধীরে আর সূক্ষ্ম করে বের করা যাবে ততই তার প্রভাব নিকট দেশ পর্যন্ত থাকবে আর প্রভাব যত নিকট দেশ পর্যন্ত থাকবে ততই লাভপ্রদ হবে। এটা আমি প্রথম আর দ্বিতীয় প্রাণায়ামের দেশ-কাল-সংখ্যা দ্বারা দীর্ঘতা আর সূক্ষ্মতার পরিমাপের প্রকার বর্ণনা করলাম। স্তম্ভবৃত্তি প্রাণায়ামের মধ্যে শ্বাস প্রশ্বাসের দেশ কাল আর সংখ্যার দ্বারা সমালোচনা না করে তাকে যেখানে আছে সেখানেই যেমনটা-তেমন থামিয়ে দেওয়া হয়। এইভাবে এটা তৃতীয় প্রাণায়াম হল।
৩. বাহ্যাভ্যন্তরবিষয়াক্ষেপী প্রাণায়াম -
এটা হল অন্তিম তথা পূর্ণ প্রাণায়াম। এতক্ষণ যাবৎ প্রাণায়ামের এক-একটা অবয়বের অভ্যাস চলছিল, এই নিরন্তর অভ্যাসের প্রভাবে সাধকের মধ্যে এই অন্তিম প্রাণায়াম করার যোগ্যতা আসতে পারে। যদিও স্তম্ভবৃত্তি প্রাণায়ামে শ্বাস-প্রশ্বাস উভয়েরই নিরোধ করতে হয় কিন্তু এরমধ্যে আর চতুর্থ প্রাণায়ামের মধ্যে অনেক বড় পার্থক্য আছে। স্তম্ভবৃত্তির মধ্যে শ্বাস আর প্রশ্বাসের বিষয়ের ধ্যান না রেখেই তাকে থামিয়ে দেওয়া হয়, কিন্তু এখানে শ্বাস আর প্রশ্বাসের বিষয় দেশ কাল আর সংখ্যার আলোচনা করার সঙ্গে সেই দুটোকে একসঙ্গে নয় ক্রমে-ক্রমে থামাতে হয়। এই প্রাণায়ামের বিধিটা হল এই রকম -
সর্বপ্রথম পূর্বে লেখা বিধি অনুসারে বাহ্য প্রাণায়াম করবেন আর উড্ডিয়ান বন্ধ আর জালবন্ধ লাগিয়ে দিবেন, মূলবন্ধ তো সব প্রাণায়ামের মধ্যে অবশ্যই জারি থাকবে। কিছু সময় কুম্ভকের পশ্চাৎ যখন বাইরের বায়ু ভিতরে আসতে থাকবে তখন শ্বাসকে ভিতরে না নিয়ে জালবন্ধকে ঢিলা করে ভিতর থেকে ধাক্কা দিয়ে বাযুকে বাইরেই বের করে দিবে আর তারপর জালবন্ধ লাগিয়ে দিবেন। এমনটা করলে নাভীর নিচের সূক্ষ্ম প্রাণ খুব বেগে উপরে উঠবে আর হৃদয়স্থ প্রাণের মধ্যে এসে মিলে যাবে। বাইরে থেকে শ্বাস ভিতরে নেওয়ার বারংবার তীব্র প্রেরণা হবে কিন্তু আপনি মানসিক ইচ্ছা দ্বারা বায়ুকে ধাক্কা দিয়ে বাইরেই বের করতে থাকবেন। এমনটা করার সময় খুব বেগে হিচকীর মতো শব্দ হবে, শরীর থেকে ঘাম বের হতে থাকবে, যখন অধিক উৎকণ্ঠা হবে তখন জালবন্ধ ছেড়ে দিয়ে শ্বাস ভিতরে নিয়ে নিবেন, এটা অর্ধেক প্রাণায়াম হল, তারপর দুই থেকে চার সামান্য শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে আভ্যন্তর প্রাণায়াম করুন, জালবন্ধ লাগিয়ে দিন, মূলবন্ধ তো আগে থেকেই জারি থাকবে। কিছুক্ষণ কুম্ভক করার পর যখন শ্বাস ভিতর থেকে বাইরে বের হতে থাকবে তখন মনের ইচ্ছা শক্তির প্রভাব দ্বারা শ্বাসকে নিচে ডাবিয়ে দিবেন তথা জালবন্ধকে ঢিলা করে নাক দিয়ে আরও শ্বাস ভরে তারপর জালবন্ধ করে দিবেন। এমনটা করলে কিছু সময় পর্যন্ত শ্বাস আরও ভিতরেই থাকবে। ইচ্ছে শক্তির চাপ নিরন্তর রাখবেন। পুনঃ শ্বাস উপরে উঠে বাইরে বের হওয়ার চেষ্টা করবে কিন্তু জালবন্ধ লাগিয়ে রাখার কারণে নাক দিয়ে না তো বের হতে পারবে কিন্তু কিছু প্রাণ শ্বাস প্রণালী দিয়ে অন্ন প্রণালীতে চলে যাবে। প্রাণ যখন ধাক্কা দিয়ে উপরে ওঠে আর অন্ন প্রণালীতে যায় তখন সেই সময় একটা শব্দ উৎপন্ন হয় সেটা অভ্যাসী ব্যক্তিরা স্পষ্ট অনুভব করে। এই ধ্বনি কিছুটা ডভ-ডভ এর সমান হয়। এইভাবে সাধক বারবার প্রাণকে নিচে চাপ আরও শ্বাস নিতে থাকে আর একটু-একটু শ্বাস অন্ন প্রণালী দ্বারা উদরের মধ্যে যেতে থাকে এবং সেখানে পৌঁছে মলবদ্ধতা বা কোষ্ঠকাঠিন্যকে সমূলে নষ্ট করে দেয়। এই প্রাণায়ামের মধ্যে বিশেষ পরিশ্রম করতে হয়, প্রত্যেক স্নায়ু-নাড়ি প্রাণের চাপে ঝাপটানি দিয়ে ওঠে। সারা শরীর ঘামে ভিজে যায়। যখন বিশেষ উদ্বেগ অনুভব হয় তখন জালবন্ধকে সরিয়ে শ্বাস বাইরে বের করে দিবেন। এই প্রাণায়াম সম্বন্ধে য়োগিরাজ স্বামী আত্মানন্দ জী মহারাজও তাঁর গ্রন্থের মধ্যে এইভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এইভাবে এটা একটা প্রাণায়াম হল, আপনি যথাশক্তি এর সংখ্যা বাড়াতে থাকবেন। এর অভ্যাস কোনো অনুভবী গুরুর সান্নিধ্যে করা উচিত, নয়তো হানি হওয়ার আশঙ্কা থাকে আর যথেষ্ট উন্নতিও হয় না। এইভাবে এই চারটা প্রাণায়ামের বিধি পূরণ হল।
🌿 লাভ - এই প্রাণায়ামের অভ্যাস দ্বারা প্রথম অধ্যায়ে বর্ণিত সব গুণের বাস সাধকের মধ্যে হয়ে যায়। ধাতুর সব মল আর অন্তঃকরণের পাপ ভস্মীভূত হয়ে সাধক কৃতকৃত্য হয়ে যায়। এরপর সমাধিকে নিকটই ধরা উচিত।

🍁 প্রাণাপানের পরস্পর আহুতি 🍁

প্রাণায়ামের ক্ষেত্রে এই রহস্যের খুবই চর্চা হয়ে থাকে যে প্রাণায়ামের মধ্যে পূর্ণ সিদ্ধি তখনই পাওয়া যায় যখন প্রাণের মধ্যে অপানের তথা অপানের মধ্যে প্রাণের আহুতি পড়ে। এই ভাবনাকে ব্যক্ত করে গীতার মধ্যে শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র জী বলেছেন - 

অপানে জুহ্বতি প্রাণম্ প্রাণেऽপানম্ তথাপরে।
প্রাণাপানগতী রুদ্ধ্বা প্রাণায়ামপরায়ণাঃ।।
অপরে নিয়তাহারাঃ প্রাণান্প্রাণেষু জুহ্বতি।
সর্বেऽপ্যেতে য়জ্ঞবিদো য়জ্ঞক্ষপিতকল্মষাঃ।। 
(গীতা ৪/২৯,৩০)

কিছু মানুষ প্রাণায়ামে তৎপর প্রাণ অপানের গতিকে থামিয়ে অপান বায়ুতে প্রাণের আর সেইরূপ প্রাণ বায়ুতে অপানের আহুতি দেয়, অন্য নিয়মিত ভোজনকারী প্রাণের মধ্যে প্রাণের আহুতি দেয়। এরা সবাই যজ্ঞকে জানে তথা যজ্ঞের মাধ্যমে পাপ দূর করে। এই দুই শ্লোকে অপানের মধ্যে প্রাণের তথা প্রাণের মধ্যে অপানের আর প্রাণের মধ্যে প্রাণের আহুতি দেওয়ার সংকেত আছে। এইরকম করা সাধক প্রাণায়ামে দক্ষ হয়। এই আহুতির ফল নির্দেশ করে যে, সব পাপ রহিত হয়ে যায়। এই আহুতির স্বরূপ নিচে দেওয়া হল -

🍁 প্রাণের মধ্যে অপানের আহুতি 🍁

নাভির নিচের ভাগে স্থিত বায়ুর নাম হল অপান তথা উদর থেকে উপর হৃদয় প্রদেশে স্থিত বায়ুর নাম হল প্রাণ। চতুর্থ প্রাণায়ামে যেমনটা আমি উপরে লিখেছি যে যখন বাহ্যকুম্ভক করে মূলবন্ধপূর্বক উড্ডিয়ান বন্ধ লাগানো হয় তখন নিচের প্রাণের ঊর্দ্ধগতি হতে থাকে। বারবার মানসিক শক্তি দিয়ে যখন ভিতর থেকে শ্বাস বাইরে ধাক্কা দেওয়া হয় তখন নিচের প্রাণ অতি তীব্রতার সঙ্গে হৃদয়স্থ প্রাণের মধ্যে এসে মিলে যায়। জালবন্ধ লাগিয়ে রাখার কারণে দুটো প্রাণ হৃদয় প্রদেশের মধ্যে স্থিত হয়ে যায়, এটাই হচ্ছে প্রাণের মধ্যে অপানের আহুতি।

🍁 অপানের মধ্যে প্রাণের আহুতি 🍁

অপানের মধ্যে প্রাণের আহুতিও চতুর্থ প্রাণায়ামে আভ্যন্তর বিষয়ে আলোচনা করে দেওয়া হয়। যে সময় আভ্যন্তর কুম্ভক শক্তিপূর্বক অনেক সময় ধরে করা হয় তখন প্রাণ উপরের দিকে উঠতে থাকে। জালন্ধর বন্ধ লাগিয়ে রাখার কারণে এই উপরে ওঠা প্রাণ নাসিকা দিয়ে বাইরে না বের হয়ে শ্বাস প্রণালী হয়ে অন্ন প্রণালীর মধ্যে চলে যায় আর অন্ত্রের মধ্যে গিয়ে অপানের মধ্যে মিলে যায়। তারপর মানসিক শক্তি দিয়ে প্রাণকে বুকের নিচে চাপ দিয়ে জালন্ধর বন্ধকে ঢিলা করে পুনঃ ফুসফুসের মধ্যে আরও শ্বাস ভরে নেওয়া হয়, আর কিছু সময় পশ্চাৎ পুনরায় প্রাণ উপরে উঠে অন্ন প্রণালীতে চলে যায়। এই ক্রিয়া বারংবার হতে থাকে আর অপানের মধ্যে প্রাণের আহুতি হতে থাকে। উদরের মধ্যে যাওয়া এই প্রাণ উদরের সব রোগকে নষ্ট করে দেয়।

🍁 প্রাণের মধ্যে প্রাণের আহুতি 🍁

এই আহুতি তৃতীয় স্তম্ভবৃত্তি প্রাণায়ামের মধ্যে দেওয়া হয়। এই প্রাণায়ামের মধ্যে না অপানের মধ্যে প্রাণের আর না প্রাণের মধ্যে অপানের আহুতি দেওয়া হয়, কিন্তু প্রাণ যে অবস্থায় আছে তাকে থামিয়ে দেওয়া হয়। এইজন্য এটা প্রাণের মধ্যেই প্রাণের হয়। এর অতিরিক্ত ধ্যান দ্বারাও সূক্ষ্ম প্রাণ আর অপানের পরস্পর আহুতি দেওয়া হয়। এটা পূর্বেই লেখা হয়েছে যে মন আর প্রাণের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে, যে স্থানে মন একাগ্র হবে প্রাণও সেখানে গিয়ে স্থির হয়। যখন মনের সব বৃত্তিকে থামিয়ে ভ্রুকুটি, ব্রহ্মরন্ধ্র আদি মস্তিষ্ক স্থানের মধ্যে মন একাগ্র করা হয় তখন হৃদয়ের নিচের সূক্ষ্ম প্রাণ যাকে অপান বলে, সেটা উপরে উঠে হৃদয়ের প্রাণের মধ্যে গিয়ে মিলে যায়। এটা হল প্রাণ অপানের পরস্পর একে অপরের মধ্যে আহুতি আর যখন হৃদয়স্থ প্রাণ মস্তিষ্কগত প্রাণের মধ্যে গিয়ে মিলিত হয় তখন একেই প্রাণের মধ্যে আহুতি বলা হয়।

উপরোক্ত চারটা প্রাণায়ামই হচ্ছে মুখ্য প্রাণায়াম তবে এইসব প্রাণায়ামের মধ্যে একটু-একটু ভিন্নতা করে উপভেদ রূপে প্রাণায়ামের অভ্যাসীরা আরও অন্য প্রাণায়ামের রূপে নামকরণ করে রেখেছে। কোনো না কোনো অবস্থায় সেইসব প্রাণায়ামও সাধকের উন্নতিতে সহায়ক হবে। তাই তার উপযোগিতার কথা মাথায় রেখে  সেগুলোর সংগ্রহ পাঠক যেন জানে তার জন্য সেগুলো নিয়েও আলোচনা করবো। এইসব প্রাণায়ামের উপযোগিতা বিশেষ অবস্থাতেই হয়, তাই এগুলোর অভ্যাস দৈনিক করার আবশ্যকতা নেই।

(১) ভস্রিকা প্রাণায়াম
সংস্কৃতে কামারের ধৌঁকনীকে ভস্রিকা বলে। কামার বা স্বর্ণকার এক গতিতে যেভাবে তাদের ধৌঁকনী চালায় ঠিক সেইভাবে শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়া করা উচিত। জোরে-জোরে শ্বাস নেওয়া আর বের করা হল ভস্রিকা প্রাণায়ামের বিশেষত্ব।

পদ্মাসন অথবা সিদ্ধাসনে বসে শরীর-গলা-মাথাকে একদম সোজা রাখবেন। দুই হাতের তালু হাঁটুর উপরে থাকবে। তারপর ২১ বার কামারের ধৌঁকনীর সমান শ্বাস নিন আর বের করে দিন, তারসঙ্গে বুককে ফুলিয়ে আর সংকুচিত করতে থাকবেন। শ্বাস ভিতরে ভরার সময় উদর বাইরে তথা শ্বাস বের করার সময় উদর ভিতরে সংকুচিত করে নিবেন। একের পর এক শ্বাস না থামিয়ে নিরন্তর নিতে থাকবেন। নয় বার থেকে যথাশক্তি ২১ বার এইভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া করে একবার লম্বা শ্বাস নিবেন, তাকে যথাশক্তি ভিতরে থামিয়ে রেখে নাসিকা দ্বারা বাইরে বের করে দিবেন। এইভাবে একটা প্রাণায়াম হল। সায়ং প্রাতঃ প্রাণায়ামের শুরুতে তথা অভ্যাসের পশ্চাৎ ১ থেকে ৩ বার পর্যন্ত করা উচিত। কিছু মানুষ একে এতটা বাড়িয়ে দেয় যে তারা ক্লান্ত হওয়া পর্যন্ত করতে থাকেন। এতে অনেক ঘাম বের হবে, আর ব্যায়ামটা কঠিন। এটা করার সময় যদি মাথা ঘোরে তাহলে থামিয়ে বিশ্রাম নিবেন। প্রত্যেক প্রাণায়ামের পর দুই মিনিট বিশ্রাম করা উচিত।

🌿 লাভ - ভস্রিকা প্রাণায়ামের ফলে গলার পীড়া দূর হয়, জঠরাগ্নি প্রদীপ্ত হয়, কফের বিকার নষ্ট হয়, নাক আর বুকের ব্যাথা দূর হয়, হাঁপানি ক্ষয় আদি রোগ দূর হয়, কুণ্ডলিনী জাগৃত হয়, শরীরে উষ্ণতা আসে, স্নায়ুতন্ত্র শুদ্ধ হয়। সব ধরণের কুম্ভকের মধ্যে এটা উত্তম, এর অভ্যাস অবশ্যই করা উচিত আর ভস্রিকা প্রাণায়ামের আবৃত্তি নিজের শক্তি অনুসারে করা উচিত, তবে অভ্যাস বিনা অত্যধিক করা উচিত নয়।

(২) প্লাবনী প্রাণায়াম
এই প্রাণায়ামে উদরের মধ্যে শ্বাস ভরার অভ্যাস করা হয়, পেটের মধ্যে বায়ু ভরে বেলুনের সমান ফুলিয়ে দেওয়া হয়। অনেক বায়ু ভরে গেলে পেটের মধ্যে এক ধরণের শব্দ হতে থাকে, কিন্তু এতে ধ্যান রাখা উচিত যে যেসময় উদরের মধ্যে বায়ু ভরা হবে তখন যেন শরীরের অন্য অঙ্গে বায়ু না থাকে তবেই প্লাবনী সিদ্ধ হবে।

🌿 লাভ - এই প্রাণায়ামে প্রাণের উপর তো সাধকের অধিকার হয়েই যায়, তারসঙ্গে উদরের সব রোগের নাশ হয়ে পেট রেশমের সমান কোমল হয়ে আরোগ্যতার বিকাশ করে। কোষ্ঠকাঠিন্য তো সমূলে নষ্ট হয়ে যায়, যাকে সব রোগের জননী বলা হয়। অপান বায়ুর শুদ্ধি, মলমূত্র নির্বিঘ্নে ত্যাগ হওয়া, পাচনশক্তি বৃদ্ধি, বীর্য এবং রক্তের শুদ্ধি আদি অনেক লাভ হয়। প্লাবনী প্রাণায়াম করে ইচ্ছানুসারে জলের উপর থাকা যেতে পারে। তারপর উড্ডিয়ান বন্ধ করে বায়ু ধীরে-ধীরে বাইরে বের করে দিন। এই প্রাণায়াম কোনো অনুভবীর কাছে শিখে নেওয়া উচিত। যেসব মানুষ এর অভ্যাসী হয়ে যায় তারা কিছু দিন পর্যন্ত বিনা আহার করেও থাকতে পারে, এর রকম বর্ণনা আছে।

(৩) শীতলী প্রাণায়াম
জীভকে লম্বা করে নলের মতো ভাঁজ করবেন, তারপর সশব্দে মুখ দিয়ে শ্বাস নিবেন আর আরামে যতক্ষণ পর্যন্ত পারবেন বায়ুকে থামিয়ে রাখবেন তারপর নাসিকা দিয়ে বায়ুকে বাইরে বের করে দিবেন। এই প্রাণায়াম বসে-বসে, দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে অথবা হাঁটতে-হাঁটতেও ১০ থেকে১৫ মিনিট পর্যন্ত করতে পারবেন।

🌿 লাভ - এই প্রাণায়ামের অভ্যাস করলে রক্ত শুদ্ধ হয়, খিদে-তৃষ্ণা কমে যায়, আমাশয়ে শীতলতা প্রাপ্ত হয়। গুল্ম-প্লীহা, সংক্রামক রোগ, জ্বর, ক্ষয়, অপচ, অর্শ আদি রোগ দূর হয়। তৃষ্ণা পেলে এর অভ্যাস দ্বারা তৃষ্ণা শান্ত হয়ে যায়।

(৪) শীতকরী প্রাণায়াম
জীভকে এমন ভাবে ভাঁজ করবেন যে তার সিরা তালুর সঙ্গে লেগে থাকবে আর মুখ দিয়ে সশব্দে শ্বাস নিবেন অথবা দাঁতের পঙক্তিকে একে অপরের সঙ্গে মিলিয়ে দিন আর জীভকে দাঁতের সঙ্গে লাগিয়ে সিঁটির মতো আওয়াজ করে মুখ দিয়ে ধীরে-ধীরে শ্বাস ভিতরে ভরবেন। তারপর যথাশক্তি ভিতরে থামিয়ে রেখে নাসিকা দিয়ে বাইরে বের করে দিবেন। এই প্রাণায়ামও বসে-বসে, দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে অথবা হাঁটতে-হাঁটতে করা যেতে পারে। এটা ১০ বার পর্যন্ত করা উচিত।

🌿 লাভ - এই প্রাণায়ামের অভ্যাস করলে শক্তি তথা সৌন্দর্য প্রাপ্তি হয়, খিদে-তৃষ্ণা-আলস্য-নিদ্রা কম হয়, পিত্তের বিকার শান্ত হয়।

(৫) উজ্জায়ী প্রাণায়াম
পদ্মাসন বা সিদ্ধাসনে বসে মুখ বন্ধ করবেন, তারপর ধীরে-ধীরে আর একবার শ্বাসেই যতটা পারবেন ফুসফুসের মধ্যে বায়ুকে ভরে নিবেন, তারপর জালন্ধর বন্ধ লাগিয়ে দিবেন। যথাশক্তি বায়ুকে থামিয়ে রেখে বাম নাসারন্ধ্র দিয়ে ধীরে-ধীরে বাইরে বের করবেন। বিরেচন যত ধীরে-ধীরে হয় প্রাণায়ামের ততই অধিক হয়, একথা সব প্রাণায়ামের মধ্যে ধ্যানে রাখা উচিত। কিছু মানুষ এমনটা মানে যে শ্বাস নেওয়ার পশ্চাৎ বাযু ফুসফুস থেকে সরিয়ে মুখের মধ্যে ভরে নিবে আর তারপর মুখ দিয়ে তাকে বাইরে বের করে। 

🌿 লাভ - এর অভ্যাসের ফলে মাথার উষ্ণতা দূর হয়, শরীরে সৌন্দর্য বাড়ে আর জঠরাগ্নি প্রদীপ্ত হয়। হাঁপানি, ক্ষয়, ফুসফুস সম্বন্ধীয় রোগ দূর হয়। সায়ং প্রাতঃ ৪ বার এর অভ্যাস করা যেতে পারে।

(৬) সূর্যভেদ প্রাণায়াম
এই প্রাণায়ামের বিশেষত্ব হল কেবল সূর্য নাড়ী অর্থাৎ ডান নাসারন্ধ্র দিয়েই শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়া করা হয়। সিদ্ধাসন বা পদ্মাসনে নিশ্চিন্ত মনে বসবেন, তারপর ধীরে-ধীরে ডান নাসারন্ধ্র দিয়ে শ্বাস এতটা ভিতরে টেনে নিবেন যেন যথাসম্ভব বায়ু ভিতরে চলে যায়, তারপর জালন্ধর বন্ধ লাগিয়ে দিবেন। ঘাম আসা পর্যন্ত বায়ুকে ভিতরেই ধরে রাখবেন। যখন মনে উদ্বেগ হবে তখন জালন্ধর বন্ধ সরিয়ে ডান নাসারন্ধ্র দিয়ে প্রশ্বাস ক্রিয়া করবেন। শ্বাস-প্রশ্বাসের এই ক্রিয়া খুবই ধীরে-ধীরে হওয়া উচিত। একবারে সব বায়ু জোরে বের করা উচিত নয়।

🌿 লাভ - সূর্যভেদ প্রাণায়ামের অভ্যাস করলে পেট আর অন্ত্রের রোগ দূর হয়। বাত রোগ, নাক সম্বন্ধীয় রোগ, জ্বর আদি নষ্ট হয় আর অভ্যাসী দীর্ঘায়ু আর শক্তি প্রাপ্ত করে তথা কুণ্ডলিনী শক্তি জাগ্রত হয়।

(৭) সুখদ প্রাণায়াম
পদ্মাসন বা সিদ্ধাসনে বসে ধীরে-ধীরে বায়ুকে ভিতরে নিবেন, প্রথমে ফুসফুসের নিচের ভাগকে ভরবেন। মনের মধ্যে প্রবল ইচ্ছা রাখবেন যে ফুসফুসের অধোভাগ বায়ু দিয় ভরে যাচ্ছে। এতে পেট একটু ফুলবে, এরপর এই শ্বাস দিয়ে ফুসফুসের মধ্য ভাগে বায়ুকে পৌঁছে দিবেন। প্রত্যেক ক্রিয়ার সঙ্গে মানসিক শক্তির সম্বন্ধ বজায় রাখতে হবে। এমনটা করলে পেট কিছুটা সংকুচিত হবে আর বুক কিছু প্রসারিত হবে। এরপর শ্বাসের তৃতীয় আর অন্তিম ভাগ দিয়ে ফুসফুসের উপরের ভাগকে ভরবেন, এই ক্রিয়ার পূর্বে দুই কাঁধকে উপরে উঠাবেন, এই তিন ক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পূর্ণ কুম্ভক করবেন। প্রায় এক মিনিট পর্যন্ত বায়ু ভরা থাকবে। তারপর সিঁটি বাজানোর সমান মুখাকৃতি করে দ্রুত তিনের বেশী বারে একটু-একটু করে শ্বাস বাইরে বের করবেন। একবার বের করে একটু থেমে এইভাবে একটু থেমে-থেমে আর বলপূর্বক শ্বাসকে বাইরে বের করবেন। এটা একটা প্রাণায়াম হল।

🌿 লাভ - এই প্রাণায়ামের ফলে শরীরের ক্লান্তি দূর হয়, শরীর বলবান স্বস্থ সুন্দর হয়, রজোগুণ ও তমোগুণ দূর হয়ে মন একাগ্র হয়। এর অভ্যাস প্রত্যেক প্রকারের ব্যায়াম প্রাণায়ামের পশ্চাৎ করা উচিত।

(৮) ভ্রামরী প্রাণায়াম
ইচ্ছানুসারে আসন লাগিয়ে দুই নাসারন্ধ্র দিয়ে ভিমরুলের মতো ভঁও ভঁও ভঁও শব্দ করার সঙ্গে পূরক করুন। তারপর যথাশক্তি কুম্ভক করে, সেইভাবে ভিমরুলের সমান শব্দ করে-করে দুই নাসিকা ছিদ্র দিয়ে শ্বাস বের করে দিন। এতে ভ্রমরের সমান ধ্বনি হওয়ার জন্য এই প্রাণায়ামের নাম ভ্রামরী প্রাণায়াম।
🌿 লাভ - এই প্রাণায়াম করলে মনের চঞ্চলতা দূর হয়ে শান্ত হয় আর মনে অনেক আনন্দের অনুভব হয়।

(৯) সমবৃত্তি প্রাণায়াম
এই প্রাণায়াম শরীরের দুর্বলতাকে দূর করার জন্য অমোঘ প্রয়োগ। এর নাম সমবৃত্তি হওয়ার কারণ হল এতে পূরক-কুম্ভক রেচক সমান বৃত্তিতে হয়, অর্থাৎ পূরক রেচক প্রাণায়াম এত সূক্ষ্মতার সঙ্গে করা হয় যে সাধক একটুও শ্রম তথা শব্দের অনুভব করে না।
এই প্রাণায়ামের বিধি হল সাধারণত যেকোনো সুখদ আসনে বসে অতি ধীরে-ধীরে সূক্ষ্ম ভাবে শ্বাসকে উদর আর ফুসফুসের সব ভাগে ঠিক ভাবে ভরে নেওয়া। বিনা বিশেষ শক্তি লাগিয়ে কেবল মানসিক প্রভাবের কারণে শ্বাসকে কিছু সময় পর্যন্ত ভিতরেই থামিয়ে রাখার অভ্যাস করবেন। তারপর ধীরে-ধীরে বিনা শব্দ আর শ্রম করে বাইরে বের করে দিবেন, তথা কিছু সময় পর্যন্ত প্রাণকে বাইরেই স্তম্ভিত করবেন। এই প্রাণায়াম স্বাভাবিক রূপে প্রসন্নতাপূর্বক করবেন। উদর তথা ফুসফুসের উপর চাপ দিবেন না। এইভাবে শক্তি অনুসারে প্রতিদিন এই প্রাণায়ামের অভ্যাস করলে অশক্ত মানুষও সশক্ত হয়ে যায়।

🌿 লাভ - এই প্রাণায়ামের অভ্যাস ধৈর্যপূর্বক দীর্ঘকাল পর্যন্ত করার ফলে রোগের নাশ হয়ে হারিয়ে যাওয়া শক্তি পুনঃ প্রাপ্ত হয়। নিয়মিত রূপে এটা করার ফলে ক্ষয় (যক্ষ্মা) আদি ভয়ংকর রোগেরও সমূল উচ্ছেদ করার সামর্থ্য এই প্রাণায়ামের মধ্যে আছে। সব ধরণের নির্বলতা, নিরাশা দূর হয়ে সাধক আনন্দ-বিভোর হয়ে ওঠে। এই প্রাণায়ামের মধ্যে একটা বিশেষ ধ্যান দেওয়ার বিষয় হল এটা করার সময় যেন শ্বাসের শব্দ নিজের কানেও শোনা যায় না আর  না ফুসফুসের উপর কোনো ধরণের শ্রম হয়, তবেই এতে পূর্বোক্ত লাভ হবে, অন্যথা দুর্বল অবস্থায় ফুসফুসের মধ্যে বায়ুর চাপে হানি হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে।

(১০) অগ্নি প্রদীপ্ত প্রাণায়াম
একবার অমৃতসর নিবাসী চৌধুরী জয়কিশন জী মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী জীর কাছে সৎসঙ্গের জন্য আসেন, তো তিনি দেখেন যে স্বামী জী প্রাণায়াম করছেন আর ওনার শরীর থেকে খুব বেগে ঘাম বইছে আর সম্পূর্ণ শরীর রক্তবর্ণ হয়ে যাচ্ছে, মুখমণ্ডল তেজে প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছে। দৃষ্টি স্বামী জীর দিকে জমছিল না, এমন অবস্থা দেখে তিনি আশ্চর্য চকিত হন। যখন স্বামী জী প্রাণায়াম সমাপ্ত করে সৎসঙ্গে বসেন তখন তিনি প্রশ্ন করেন - মহারাজ জী! আপনি কৃপা করে বলবেন যে আপনি কোন প্রাণায়াম করেন আর তার নাম কি? এর উত্তরে মহর্ষি বলেন - একে অগ্নি প্রদীপ্ত প্রাণায়াম বলে। এর বিধিটা এইরকম - সুখাসনে বসে প্রাণকে ধীরে-ধীরে পূরক দ্বারা মূলাধার পর্যন্ত ভরে দিবেন তারপর বলপূর্বক কুম্ভক করবেন যেন বুক আর মুখ লাল বর্ণ হয়ে যায়। শুরুতে অধিক কুম্ভক করবেন না, এটা ধীরে-ধীরে বাড়াবেন, মাথার দিকে যেন প্রাণের বেগ না যেতে পারে, তা নাহলে অচেতন হওয়ার ভয় থাকে। মনে উদ্বেগ হলে রেচক অর্থাৎ প্রাণকে বাইরে বের করে দিবেন। এই প্রাণায়ামের গুণের বর্ণনা সম্বন্ধে মহর্ষি জী বলেছেন যে এই প্রাণায়ামের ফলে শীতের নিবারণ হয়। য়োগী, তপস্বীরা হিমগিরিতে বসে এই প্রাণায়ামের অভ্যাস করে। এছাড়া এই প্রাণায়াম করার ফলে জঠরাগ্নি প্রদীপ্ত হয়ে শরীর হাল্কা হয়। উৎসাহ, স্বরে মধুরতা, বল, তেজ, ওজ, ধৈর্য আর সৌন্দর্যের বৃদ্ধি হয়ে সব রোগ নষ্ট হয়। এই প্রাণায়ামের আধারে মহর্ষি ঘোর শীতকালেও অনেক বার সহসা ঘাম বের করে দিতেন, যা দেখে ভক্তজন অতি শ্রদ্ধান্বিত হয়ে নতমস্তক হয়ে যেত।

(১১) খিদা তৃষ্ণা নিবারক প্রাণায়াম
পদ্মাসনে বসে হাতের তালুকে দুই হাঁটুর উপর স্থির করে কণ্ঠ আর মুখ বন্ধ করে ও৩ম্ শব্দ করতে-করতে মুখে বায়ু উৎপন্ন করবেন তথা জল গিলে নেওয়ার মতো বায়ুকে গিলে উদর ভরতে থাকবেন। প্রথমদিন পাঁচ বার এইভাবে বায়ুপান করবেন, তারপর প্রতিদিন পাঁচবার বাড়াতে থাকবেন। তারপর কিছু দিনের অভ্যাসে উদর বায়ুতে পূর্ণ হওয়া শুরু করবে। ৩০ মিনিটের অভ্যাস হয়ে গেলে বায়ুতে ভরা উদর ফুলে জলপূর্ণ বেলুনের সমান ভারী হয়ে যাবে। তারপর পূর্ব অবস্থাতে আসার জন্য কয়েক মিনিট পর্যন্ত কয়েক বার ময়ূরাসন করে শীর্ষাসন করতে হয়, অথবা ময়ূরাসন আর সর্বঙ্গাসন করা উচিত। এমনটা করলে এই বায়ু অপানবায়ুর রূপে গুদা দিয়ে বেরিয়ে যায়। এইভাবে এক ঘন্টা সময় লেগে যায় পূর্ব অবস্থাতে আসতে। এই প্রাণায়ামের ফলে এই লাভ হয় যে খিদে-তৃষ্ণার অভাব হয়ে অনেক দিন পর্যন্ত নিরাহার থেকেও কোনো য়োগী নিশ্চিন্ত সমাধির অনুষ্ঠান করতে পারে। এই প্রাণায়ামকে বায়ুপান প্রাণায়ামও বলে।

🍁 প্রাণায়াম দ্বারা রোগ নিবারণ 🍁
আমি প্রথমাধ্যায়ে ঋগ্বেদের মন্ত্র দিয়ে এটা সিদ্ধ করেছিলাম যে প্রাণ হচ্ছে একটা সর্বশ্রেষ্ঠ ঔষধ। শরীরের প্রত্যেক অবয়বের উপর এর বিশেষ প্রভাব পড়ে। নিত্য প্রতি প্রাণায়াম করা মানুষের শরীরের সব দোষ ক্ষীণ হয়ে স্বাস্থ্য অতি উত্তম হয়। প্রাণায়ামের ভিতরে একটা এমন বিশেষ গুণ আছে যে এটা যেমন ব্যর্থ চর্বিকে শুকিয়ে সাম্যাবস্থায় নিয়ে আসে তেমনই কৃশকায় ব্যক্তির শরীরে ধাতুর বৃদ্ধি করে পরিপুষ্টও করে দেয়। আয়ুর্বেদ অনুসারে অধিক মোটা মেদস্বী মানুষকে সুস্থ না মেনে একটা ভিন্ন লক্ষণ বলেছে। যথা -
সমদোষঃ সমাগ্নিশ্চ সমধাতুমলক্রিয়ঃ।
প্রসন্নাত্মেন্দ্রিয়ঃ স্বস্থ ইত্যভিধীয়তে।।
অর্থাৎ - যে মানুষের বাত-পিত্ত-কফ তিন দোষ, জঠরাগ্নি-রস-রক্ত-মাংস-মেদ-অস্তি-মজ্জা-শুক্র আদি ধাতু সাম্যাবস্থাতে আছে, পুরীষ মূত্র আদি মলের বিসর্জন উচিত পরিমাণে সঠিক সময়ে হয়, আত্মা আর ইন্দ্রিয় প্রসন্ন উৎসাহযুক্ত, সেই ব্যক্তি সুস্থ।
প্রাণায়াম করা ব্যক্তির উপরোক্ত লক্ষণ অনায়াসেই সিদ্ধ হয়। সব রোগের উদ্গমস্থান হচ্ছে উদর। মিথ্যা আহার বিহার করার ফলে সর্বপ্রথম বাত-পিত্ত-কফ আদি দোষ উদরের মধ্যেই কুপিত হয় আর তারপর ভিন্ন-ভিন্ন স্থানে গিয়ে ভিন্ন-ভিন্ন রোগের উৎপাদক হয়। উদরকেই সব রোগের উৎপত্তিস্থান মেনে আজ প্রাকৃতিক চিকিৎসাকে মানা বিদ্বান সব রোগের চিকিৎসাতে উদরের চিকিৎসাকে প্রাধান্য রাখে তথা এই বিষয়ে তাদের পর্যাপ্ত সফলও হতে দেখা যায়। আয়ুর্বেদ অনুসারেও প্রধানরূপে সব রোগের জনক হচ্ছে উদর। যদি আমরা আমাদের উদরকে সুস্থ আর সক্রিয় রাখতে পারি তাহলে নিশ্চয়ই রোগ থেকে মুক্তি প্রাপ্ত করতে সফল হবো। রোগ থেকে উৎপত্তির পশ্চাৎ বিবিধ ওষুধের দ্বারা তাকে নষ্ট করার তুলনায় যদি রোগের জন্মই না হয় তাহলে এটা সর্বশ্রেষ্ঠ প্রচেষ্টা হবে। প্রাণায়াম হচ্ছে এক এমন সফল ক্রিয়া যার দ্বারা শরীরের মধ্যে মল সঞ্চিত হতে পারে না, শরীরের মধ্যে যেখানেই মল হবে, প্রাণ সেখানেই পৌঁছে টক্কর দিবে তথা সেই বিকারকে শরীর থেকে বাইরে বের করেই ছাড়বে।
বাত-পিত্ত-কফ এগুলো হচ্ছে শরীরের ধাতু দোষ আর এগুলো মল রূপে কাজ করে। এই তিনটা যখন সাম্যাবস্থাতে শুদ্ধ রূপে থাকে তখন শরীরকে ধারণ করার জন্য ধাতু বলে, আর যখন দূষিত হয়ে হানি করে তখন এর সংজ্ঞা দোষ হয়ে যায় তথা যখন এই বাত-পিত্ত-কফই অতি দূষিত হয়ে শরীরের মধ্যে শমনের অযোগ্য হয় তখন এদের মল বলা হয়। পিত্ত আর কফ দুটোই নিজরূপে পঙ্গু হয়, বায়ুই এদেরই এদিক-সেদিক শরীরের বিভিন্ন ভাগে নিয়ে যায়, এই জন্য বায়ুই প্রাধান্য, যদি বায়ু ঠিক হয় তাহলে কফ-পিত্তও ঠিক ভাবে কাজ করে। শরীরের মধ্যে বায়ু নিজেকে দশ ভাগে বিভক্ত করে কাজ করে। কর্ম ভেদের কারণে বায়ুর দশটা নাম খুবই প্রসিদ্ধ, যথা - (১) প্রাণবায়ু, (২) অপানবায়ু, (৩) ব্যানবায়ু, (৪) সমানবায়ু, (৫) উদানবায়ু, (৬) দেবদত্তবায়ু, (৭) কৃকলবায়ু, (৮) ধনঞ্জয়বায়ু, (৯) নাগবায়ু, আর (১০) কূর্মবায়ু।
প্রাণায়াম করার ফলে এই দশ প্রকারের বায়ু শুদ্ধ আর পরিপুষ্ট হয়ে নিজের কাজকে ঠিক ভাবে করে। যার ফলে সম্পূর্ণ বিকার ক্ষীণ হয়ে শরীর নির্মল তথা রোগরহিত হয়। এইভাবে প্রাণায়াম রোগের মূলকে সমাপ্ত করে মানুষকে নিশ্চিন্ত করে দেয়। উপরে আমি সুস্থ মানুষের জন্য প্রাণায়ামের উপযোগিতার উপর বিচার করেছি, এখন আমি এটা তুলে ধরার চেষ্টা করবো যে উৎপন্ন হওয়া রোগকে প্রাণায়ামের মাধ্যমে নষ্ট করে শারীরিক শক্তির বিকাশ কিভাবে করা যেতে পারে!
🍁 সর্বব্যাধিনিবারক প্রাণায়াম 🍁
শরীরের যেকোনো অঙ্গে যেকোনো ধরণের ব্যাধি হোক না কেন, তাকে দূর করার জন্য নিম্ন ক্রিয়া করা উচিত - সর্বপ্রথম শরীরকে একটু শিথিল করে গভীর শ্বাস নিবেন তারপর যে স্থানে পীড়া বা ব্যাধি আছে তার উপর হাত রাখবেন। তারপর নিজের চিত্তের বৃত্তিকে ব্যাধির স্থানে স্থির করুন।
ধরে নিন আপনার বুকে ব্যথা আছে, তো সেই সময় শরীরের অন্য কোনো অবয়বের দিকে ধ্যান না দিয়ে কেবল বুকের দিকে মন লাগাবেন। এমন মনে করবেন যেন বুক ছাড়া শরীরের আর কোনো অবয়বই নেই। এইভাবে সেই অঙ্গ আপনার চিত্ত-বৃত্তির অঙ্গ হয়ে যাবে। মনের বৃত্তির অনুসারে সূক্ষ্ম প্রাণের গতি পীড়া স্থলের দিকে হয়ে যাবে। যেভাবে সামান্য কাঁচের মধ্যে সূর্যের কিরণকে সংগ্রহীত করার শক্তি না থাকার কারণে অগ্নি উৎপন্ন হতে পারে না, কিন্তু সূর্যকান্ত কাঁচের দ্বারা ধূপে একটু সময়ের মধ্যেই অগ্নি উৎপন্ন হয়ে যায়, ঠিক এইভাবে সারা শরীরে ছড়িয়ে থাকা প্রাণ রোগ নিবারণে অসক্ষম ছিল, এখন ধ্যান দ্বারা একটা স্থানে কেন্দ্রীভূত করার ফলে অদ্ভুত পরিণাম দেখা যাবে। যে স্থানে ব্যাধি আছে সেখানে মনের বৃত্তি কেন্দ্রীভূত করে এমন দৃঢ় ধারণা করবেন যে রোগ আমার শরীর থেকে বেরিয়ে প্রশ্বাস দ্বারা দূর হয়ে যাচ্ছে তথা যে শ্বাস আমি গ্রহণ করছি তার দ্বারা শক্তি প্রাপ্ত করছি। এইভাবে আপনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তীব্র আজ্ঞা দিবেন যে সম্পূর্ণ ব্যাধি আমার শরীর থেকে বেরিয়ে যাক। তারপর বিনা কোনো সঙ্কোচে এমন অনুভব করবেন যে ব্যাধি শরীর থেকে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। এইভাবে ক্রিয়া করলে আপনার মানসিক শক্তি বেড়ে যাবে, প্রাণ মনের বৃত্তি অনুসারে পীড়া স্থলে নিজের কাজ করা শুরু করে দিবে আর আপনি স্বাস্থ্য লাভ করবেন। এইভাবে আপনি প্রত্যেক রোগের উপর এই ক্রিয়ার প্রয়োগ করতে পারবেন। ইচ্ছাশক্তি যত বলবান হবে তার দ্বারা প্রাণও নিজের কাজ করবে তথা শীঘ্রই লাভ অনুভব হওয়া শুরু করবে। কদাচিৎ শীঘ্র লাভ না হলেও এই ক্রিয়াকে শীঘ্র ছেড়ে দিবেন না, কারণ ফল প্রাপ্তিতে বলম্ব হওয়ার কারণ ক্রিয়ার শিথিলতাই হয়। ক্রিয়াকে দীর্ঘকাল পর্যন্ত শ্রদ্ধাপূর্বক করলে সফলতা অবশ্যই প্রাপ্ত হয়। এই রীতির দ্বারা প্রত্যেক ব্যাধিকে দূর করা যেতে পারে।
🍁 বুদ্ধিবর্ধক প্রাণায়াম 🍁
ব্রহ্মচর্য পালন না করলে, নিরন্তর অত্যধিক বৌদ্ধিক পরিশ্রম করলে, চিন্তা-শোক-ভয়-ক্রোধ-লোভ-মোহ আদি মানসিক বিকার দ্বারা অভিভূত হলে, মনকে এক বিষয়ে কেন্দ্রীভূত না করলে, উদরের শুদ্ধি সঠিক ভাবে না হলে, খিদে না লাগলে, শরীর অতিকৃশ হলে, মদ্য-মাংস-তামাক আদি মাদক দ্রব্যের সেবন করলে, কোনো ভয়ঙ্কর চোটের আঘাতে তথা এইরূপ বিপরীত আহারের কারণে মানুষের বাত পিত্ত দোষ কুপিত হয়ে মস্তিষ্কের জ্ঞানতন্তুকে শিথিল করে দেয়, যার ফলে মাথা ভারী, মানসিক আর শারীরিক ক্লান্তি, স্মরণশক্তির হ্রাস, দেখা-শোনা বস্তুকে ভুলে যাওয়া, বৌদ্ধিক কর্মে মন না লাগা আদি লক্ষণ প্রকট হয়। যার ফলে মানুষ সর্বদা চিন্তিত আর নিরাশ থাকে। এই রকম ব্যক্তিকে নিম্ন প্রকারের প্রাণায়াম করা উচিত -

এই বিষয়ে মহর্ষি দয়ানন্দ জী সত্যার্থ প্রকাশের তৃতীয় সমুল্লাসে বিদ্যার্থীদের জন্য প্রাণায়ামের বিধান করে লিখেছেন - "চতুর্থ বাহ্যাভ্যন্তরাক্ষেপী অর্থাৎ যখন প্রাণ ভিতর থেকে বাইরে বের হবে তখন তার বিরুদ্ধে না বের করার জন্য বাইরে থেকে শ্বাস ভিতরে নিবে, আবার যখন বাইরে থেকে ভিতরে আসবে তখন ভিতর থেকে বাইরের দিকে প্রাণকে ধাক্কা দিয়ে থামাতে থাকবে। এইরূপ একে অপরের বিরুদ্ধে করবে তাহলে দুটোর গতি থেমে গিয়ে প্রাণ নিজের বশে হওয়াতে মন আর ইন্দ্রিয়ও স্বাধীন হবে। বল তথা পুরুষার্থ বেড়ে বুদ্ধি এমন তীব্র সূক্ষ্ম হয়ে যাবে যে খুব কঠিন আর সূক্ষ্ম বিষয়কেও শীঘ্র গ্রহণ করে নিবে। এতে মানুষের শরীরে বীর্য বৃদ্ধি প্রাপ্ত করে স্থির বল পরাক্রম, জিতেন্দ্রিয়তা, সব শাস্ত্রকে কিছু কালের মধ্যেই জেনে যাবে। স্ত্রীরাও এইভাবে য়োগাভ্যাস করবে।"

এখানে মহর্ষি জী প্রাণায়াম দ্বারা বুদ্ধি বৃদ্ধির স্পষ্ট নির্দেশ করেছেন, যা অনুভূত তথা প্রামাণিক। এই প্রাণায়াম সম্বন্ধে আমরা পূর্বেই চর্চা করেছি। এর অতিরিক্ত প্রাতঃকাল জলনেতি, উজ্জায়ী প্রাণায়াম, শীর্ষাসন, বৃক্ষাসন, সর্বঙ্গাসন, মৎসাসন, হলাসন, চক্রাসন আদিও অত্যুপয়োগী। মস্তিষ্কের হানি করে এমন সব আহার বিহার বন্ধ করে দেওয়া উচিত। মনের মধ্যে এইরকম দৃঢ় বিশ্বাস রাখা উচিত যে আমার বুদ্ধি কারও থেকে কম নয় তথা ধীরে-ধীরে বাড়ছে। কাম-ক্রোধ-চিন্তা আদি মানসিক আবেশ হতে পৃথক হয়ে সর্বদা প্রসন্নচিত্ত থাকার অভ্যাস করবেন।
ভোজন পৌষ্টিক সাত্ত্বিক আর স্নিগ্ধ করবেন। ব্রহ্মচর্য পালনে বিশেষ নিষ্ঠা রূপে প্রবৃত্ত হবেন।
🍁 ঊর্ধ্বরেতা প্রাণায়াম 🍁
ঊর্ধ্বরেতা হওয়ার বিধির পূর্বে বীর্যের বিষয়ে কিছু তথ্য প্রাপ্ত করাটা আবশ্যক। বীর্য হল প্রাণীমাত্রের জীবন তত্ত্ব আর এই বীর্যরূপী বীজ ছাড়া সংসারের কোনো পদার্থের উৎপত্তি, রক্ষা আর জীবন হবে না, একে শাস্ত্রের মধ্যে বীজত্ব, বীরত্ব, ওজস্, বল, তেজ, শুক্র, পবিত্রতা, রেতস্, কান্তি, বিন্দু, ভর্গ আদি নাম দেওয়া হয়েছে। উপরোক্ত সব নাম মানব জীবনের দিব্য অলৌকিক শক্তির সূচক। এই দিব্যশক্তি হল আমাদের ভোজনের সারতত্ত্ব। এই বীর্যের ঊর্দ্ধ আর অধঃ নামক দুটো গতি আছে। দূষিত আহার বিহার আর কুসংস্কারের ফলে যেমন বীর্য অধোগতি প্রাপ্ত করে, তেমনই প্রয়ত্নবিশেষ করার ফলে বীর্যের ঊর্দ্ধগতি হয়।
ঊর্ধ্বরেতা হল একটা বিশেষ বিদ্যা, যার দ্বারা বীর্যের গতি সর্বদার জন্য ঊর্দ্ধ হয়ে যায়, সেই বিদ্যার ঝলক আর রূপরেখা আদর্শ ব্রহ্মচারী মহর্ষি দয়ানন্দের গ্রন্থে পাওয়া যায়। অনেক বছর ধরে এর অনুসন্ধান তথা অনুভব আমিও করেছি, তাছাড়া এর অনুভব আমার অনেক ব্রহ্মচর্যপ্রেমী মিত্র করেছে এবং করিয়েছে। যারা এর অনুভব করেছে তারাও মুক্তকণ্ঠে এর প্রশংসা করেছে। যারা দীর্ঘকাল যাবৎ এর শ্রদ্ধাপূর্বক আর নিরন্তর সেবন করে তারা অবশ্যই ঊর্দ্ধরেতা হয়ে যায়। তার ইচ্ছা বিনা বীর্যের এক বিন্দুও তার শরীর থেকে বাইরে বের হয় না।এই বিধির কিছু ভাগ ব্রহ্মচর্য প্রেমীদের লাভের জন্য নিচে দিয়ে দিচ্ছি।
এটা হচ্ছে একটা প্রাণায়ামের বিধি, এটা কেবল পড়ে নেওয়া মাত্রই কাজে লাগবে না, ব্রহ্মচর্যের অন্য সব নিয়ম পালনের সঙ্গে-সঙ্গে প্রতিদিন প্রাণায়ামের অভ্যাস করতে হবে। আজকাল "মাতৃমান্ পিতৃমান্ আচার্য়বান্ পুরুষো বেদ" অনুসারে সন্তানের নির্মাণ হয় না। মাতা-পিতা সন্তানের জন্ম দেওয়াকেই নিজের কর্তব্যের ইতিশ্রী মনে করে বসে আছে। ব্রহ্মচর্যবিহীন মাতা-পিতার দ্বারা উৎপন্ন হওয়া সন্তান দুর্বল, রোগী আর অল্পায়ু হয়। বীজের মধ্যেই দোষ থাকার কারণে প্রায়শঃ সন্তানদের প্রবৃত্তি সংযম, চরিত্র, ব্রহ্মচর্য পালনের দিকে না গিয়ে স্বভাবানুসারে বিষয়-বাসনার দিকে যায়, তথা দুর্ভাগ্যবশতঃ তাদের চরিত্র-পূর্ণ গুরুকুলের বাতাবরণ উপলব্ধ না হয়ে শিক্ষার নামে সহ-শিক্ষার তীব্র চুল্লি দিয়ে গমন করে। যার পরিণাম স্বরূপ ১৫, ১৬ বছরের আয়ুতে পৌঁছাতে-পৌঁছাতে প্রত্যেক বালকের শরীর কামাগ্নিতে জ্বলতে থাকে, শরীরের ভিতরে জমে থাকা বীর্য গলতে থাকে। যেরূপ শীতে জমা ঘী আগুনে রাখলে গলে গিয়ে পাতলা হয়ে যায় তথা ছিদ্রযুক্ত পাত্র থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে, সেইরূপ ছোটো-ছোটো বালকের মধ্যেও দুষ্টবিচার আর কুচেষ্টার কারণে বীর্য পাতলা হয়ে প্রবাহিত হতে থাকে আর নাভির নীচে মূত্রাশয়ের নিকট যে বীর্যের কোষ আছে সেখান জমা হতে থাকে আর বীর্য দিয়ে বীর্যকোষ ভরে যায়। এই বীর্য পুনরায় উপরে ফিরে যায় না আর স্বপ্নদোষাদির দ্বারা বাইরে বেরিয়ে আসে। এইভাবে বীর্যের কোষ বারবার ভর্তি আর খালি হতে থাকে। এই বীর্যই হচ্ছে শরীরের রাজা, যার কাজ শরীরের অঙ্গকে বানানো। সেটা ২৫ বছর আয়ুর পূর্বে কখনও বা সারাজীবন শরীর থেকে বাইরে বের হতে পারতো না তথা সেটা ঊর্দ্ধগতি হয়ে শরীর আর মস্তিষ্কের শক্তির রূপ ধারণ করতো, কিন্তু আজ ইচ্ছার বিরুদ্ধ আর শরীরের সার অমৃতরূপী বীর্য মূত্রের সমান ফোঁটা-ফোঁটা বেরিয়ে যাচ্ছে, এমন অবস্থায় বালক আর যুবক কান্না আর চিৎকার ছাড়া আর কোনো দিশা খুঁজে পায় না।
তাদের অশ্রু মুছে দেওয়ার জন্য এই ঊর্দ্ধরেতা হওয়ার গুপ্তরহস্য কর্তব্য মনে করে লিখে দিচ্ছি। এতে শুক্রাশয়ে পড়ে থাকা বীর্য পুনরায় উপরে যেতে থাকবে, যেমন প্রদীপের তেল যায়। এটা হচ্ছে ঋষিদের গুপ্তবিদ্যা যা আজ লক্ষ টাকা খরচ করেও পাওয়া যায় না। ব্রহ্মচর্যপ্রেমীরা এর রক্ষা করতে দিনরাত এক করে দেয়, ভয়ংকর থেকে ভয়ংকর পর্বতের গুফাতে আর গভীর অরণ্যের ভিতরে সন্ধান করে তারপর এর ভেদ প্রাপ্ত করে। এইজন্য এটা পড়ে ব্যর্থ মনে করবেন না বরং এর শ্রদ্ধাপূর্বক অভ্যাস করবেন। এতে স্বপ্নদোষাদি রোগ থেকে অবশ্যই পিণ্ড ছুটে যাবে আর বীর্য রক্ষাতে সফলতা প্রাপ্ত করবেন। বিধিটা এইরকম -
সর্বপ্রথম সিদ্ধাসনে বসবেন, যার বিধি পূর্বে লিখে দিয়েছি। যদি কেবলমাত্র এই সিদ্ধাসনেরই অভ্যাস করা যায় তাহলে এটাও বীর্যরক্ষাতে তথা স্বপ্নদোষকে দূর করতে অত্যন্ত হিতকর হবে। তারপর বাহ্যবিষয় বা বাহ্যকুম্ভক প্রাণায়াম করবেন, যার উল্লেখ আমরা পূর্বে করেছি। ঊর্দ্ধরেতা হওয়ার জন্য এই প্রাণায়ামের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটা বিশেষ ক্রিয়ার উপর ধ্যান রাখতে হয় আর তার সঙ্গে-সঙ্গে অভ্যাসও করতে হয়।

শ্বাস বের করার পূর্বে নাভির নিচে যে মূলাধারকে টেনে ছিলেন, তাকে নিরন্তর টেনে রাখতে হবে, ঢিলে করা যাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত অথবা যতগুলো প্রাণায়াম করবেন, মূলাধারকে টেনেই রাখবেন। শুরু-শুরুতে একটু কঠিন মনে হবে কিন্তু কিছু দিনের অভ্যাসে এটা সহজেই করতে পারবেন। তারপর মূলাধারকে টানাতে তথা গুদা টান-টান থাকবে আর বীর্য কোষ যেখানে থাকে সেটাও উপরের দিকে টানা থাকবে। মূলাধার টানার সময় নাভির নীচে ধ্যান করবেন যে আমি বীর্যকে উপরের দিকে টানছি। কিছু সময় অভ্যাসের পর বীর্য উপরের দিকে যথাযত ভাবে যেতে থাকবে আর পরবর্তীতে আপনি পূর্ণরূপেণ ঊর্দ্ধরেতা হয়ে যাবেন। এই অভ্যাসের ফলে বীর্য উপরের দিকে বইতে থাকবে, বীর্যকোষে বীর্য আসাই বন্ধ হয়ে যাবে। তারপর আপনার ইচ্ছা বিনা এক বিন্দু বীর্যও বাইরে বের হবে না। স্বপ্নদোষ-প্রমেহ আদি রোগ তো হবেই না। এমন অবস্থাও আসবে যে যদি কখনও স্বপ্নদোষ হওয়ার সুযোগ আসে তাহলে আপনি অর্ধনিদ্রাতে মূলাধারকে টেনে নিবেন, চক্ষু খুলে যাবে আর স্বপ্নদোষ থেকে বেঁচে যাবেন, আপনার বিজয় হবে। আপনার বিজয় আর পরাজয় আপনার অভ্যাসের উপর নির্ভর করবে। এক বছর পর্যন্ত এই বাহ্য (রেচক) প্রাণায়ামের অভ্যাস করবেন। এরপর দ্বিতীয় আভ্যন্তর প্রাণায়াম করবেন আর এইভাবে ক্রমে-ক্রমে তৃতীয় স্তম্ভবৃত্তি তথা চতুর্থ ব্যাহ্যাভ্যান্তরবিষয়াক্ষেপী প্রাণায়াম করবেন। সব প্রাণায়ামের অভ্যাস করার পর আপনি নিশ্চিত রূপে ঊর্দ্ধরেতা হয়ে যাবেন। এই প্রাণায়ামের যত প্রশংসা করা যায় কমই হবে। সব ঋষি আর বিশেষ করে পূজ্যপাদ মহর্ষি দয়ানন্দের কৃপায় এই নিপতিত হয়ে যাওয়া সংসার এই বিদ্যা পুনঃ প্রাপ্ত করেছে। এই প্রাণায়ামের প্রভাবে যেমন স্বপ্নদোষাদি রোগ দূর হবে তেমনই শরীরের মধ্যে বীর্যের বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়ে স্থির বল পরাক্রম আর জিতেন্দ্রিতা প্রাপ্ত হবে। এর অভ্যাস সকল যুবক-যুবতী বিদ্যার্থী তথা ব্রহ্মচর্যপ্রেমী স্ত্রী-পুরুষকে করা উচিত। এটা বীর্যরক্ষার সর্বোত্তম সাধন আর পরম ঔষধ। এছাড়া পদ্মাসন, সিদ্ধাসন, সর্বাঙ্গাসন, ঊর্ধ্ব পদ্মাসন, হলাসন, শীর্ষাসন, য়োগমুদ্রা আদি আসন তথা উজ্জায়ী, ভস্রিকা আদি প্রাণায়ামও অতি হিতকারী হয়। যদি বীর্য বিকারের কারণে শরীরে জ্বলন হয় তাহলে ভস্রিকের স্থানে শীতলী প্রাণায়াম করা লাভদায়ক হবে। বিচার শুদ্ধ তথা পবিত্র রাখবেন, লাললঙ্কা, গুড়, চিনি, পিঁয়াজ, রসুন আদি উত্তেজক পদার্থের সেবন করবেন না। প্রাণায়ামে বিশেষ সফলতা পেতে হলে লবণের সেবনও ছেড়ে দিবেন।

🍁 মলবদ্ধতানাশক প্রাণায়াম 🍁

ভোজনে অতি জলপান করলে, নিতান্ত শুষ্ক ভোজন করলে, অতি পরিশ্রম করলে, বিষ্টম্ভী আর গরিষ্ঠ ভোজন করলে, শৌচ আদির বেগকে থামালে তথা ভোজন করার নিয়ম পালন না করার ফলে উদরস্থ বায়ু কুপিত হয়ে উদরের মধ্যে মলকে শুকিয়ে দেয়। যার ফলে শৌচ পরিষ্কার ভাবে বের হয় না অথবা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর একটু শুকনো মল বের হয়। বিদ্বান ব্যক্তিরা একেই কব্জ বা মলবদ্ধতা (কোষ্ঠকাঠিন্য) বলেছেন। আমাদের অন্ত্রের ভিতরে ছোটো-ছোটো গ্রাহক অঙ্কুর লেগে থাকে, যাদের কাজ হল ভোজন থেকে রসকে টেনে যকৃৎতে পৌঁছে দেওয়া। সেখানে গিয়ে এই রস রঞ্জক পিত্ত থেকে রঙিন হয়ে রক্তের রূপে পরিবর্তিত হয়। যখন এই গ্রাহক অঙ্কুর ভোজন থেকে রস গ্রহণ করে তখন অপানবায়ুর দ্বারা মলভাগ মলাশয়ে চলে যায় আর সেখান থেকে গুদা মার্গ দ্বারা বাইরে বেরিয়ে যায়। যে ব্যক্তির মলবদ্ধ (কোষ্ঠকাঠিন্য) রোগ হয় তার অন্ত্র মলকে ছেড়ে দেয় না আর মল তারমধ্যেই আটকে থাকে, গ্রাহক অঙ্কুর নিজের কাজ করতে থাকে যারফলে দূষিত আর দুর্গন্ধযুক্ত রসও চুষে যকৃৎতের মধ্যে পাঠিয়ে দেয়। পুনঃ পরবর্তী রক্ত আদি সব ধাতু দূষিত হয়ে যায়। এর ফলে মানুষ নিতান্ত নিস্তেজ, উৎসাহহীন, দুর্বল হয়, বাস্তবিক খিদে বন্ধ হয়ে যায়। ভোজনের পূর্বে একটু খিদের অনুভূতি হয় কিন্তু ভোজনে রুচি আর স্বাদ থাকে না। আয়ুর্বেদ অনুসারে কব্জ অনেক রোগের জননী হয়। আজ ভারতে কোটি-কোটি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত, কোটি-কোটি টাকা কব্জনাশক ওষুধের উপর ব্যয় হয়। কব্জের রোগী তো ব্রহ্মচর্য পালনে সফল হবে না তবে প্রত্যেকটা প্রাণায়াম কব্জকে সমূল নষ্ট করে ফেলার সামর্থ্য রাখে। কব্জকে দূর করার জন্য এখানে একটা বিশেষ প্রাণায়াম লিখে দিচ্ছি, বিধিটা এইরকম -
.
সুখ পূর্বক স্বস্তিক আদি যেকোনো আসনে বসে দুই হাতকে হাঁটুর উপরে রাখবেন। সর্বপ্রথম পূরক প্রাণায়াম করবেন তথা বায়ু বুকের মধ্যে ভরে উদরের মধ্যে নিয়ে যাবেন। উদরকে বায়ু দিয়ে অধিকাধিক ফুলিয়ে নিবেন, তারপর রেচক করবেন। রেচক করার সময় পেটকে একদম সংকুচিত করে পিঠের সঙ্গে মিলিয়ে দিবেন। মূলবন্ধ আর উড্ডিয়ান বন্ধ সঠিক ভাবে লাগিয়ে রাখবেন, তারপর পুনরায় পূরক করবেন আর বায়ু দিয়ে উদরকে ফুলিয়ে দিবেন তথা এইভাবে পুনঃ রেচক করে মূলাধার সংকোচ করবেন। এই প্রাণায়াম ২৫ থেকে ১০০ বার পর্যন্ত করা যেতে পারে, এর অভ্যাস করলে কিছু দিনের মধ্যেই অন্ত্রের মধ্যে শক্তি আসার কারণে যত পুরোনো কব্জই হোক না কেন সব দূর হয়ে যাবে। এর অতিরিক্ত কব্জকে দূর করার জন্য উত্তানপাদাসন, পবনমুক্তাসন, পশ্চিমোত্তানাসন, পাদাঙ্গুষ্ঠাসন, ধনুরাসন, হলাসন, সর্বাঙ্গাসন, ন্যৌলী, শীর্ষাসন আদি আসনের অভ্যাসও অতি লাভপ্রদ হয়।

🍁 প্রতিশায়নাশক প্রাণায়াম 🍁

মলমূত্র আদির বেগ থামালে, অজীর্ণ (অপচন) হলে, অধিক কথা বললে, ক্রোধ করলে, ঋতুর বিপরীততার কারণে, মাথায় রোদ আদি গরমের কারণে, অধিক জাগলে, অধিক ঘুমালে, বর্ষার জলে ভেজার কারণে, শীত লাগাতে, কুয়াশাতে থাকা বা ভ্রমণের কারণে, ব্রহ্মচর্য নাশের কারণে, ভাপ-ধুয়া আর ধুলাদি থেকে সঞ্চিত কফ দূষিত হয়ে প্রতিশ্যায় (জ্বর) উৎপন্ন হয়। যার ফলে মানুষের হাঁচছি আসে, মাথা ভারী লাগে, শরীরে নিবিড়তা, অঙ্গে ব্যথা, নাক দিয়ে জল আসা অথবা নিতান্ত থেমে যাওয়া আদি লক্ষণ প্রকট হয়। এই রোগ উদরবিকারের সঙ্গে সম্বন্ধ রাখে। যখন মানুষের প্রথম ধাতু রস দূষিত হয়ে শ্লেষ্মা (কফ) রূপ ধারণ করে তখন মাথায় গিয়ে স্নায়ুর অবরোধ করে, একে প্রতিশ্যায় (জ্বর) বলে। তাছাড়া মুখ ঢেকে, দরজা-জানালা বন্ধ করে  ঘুমালে, অশুদ্ধ বায়ু ফুসফুসে যাওয়ার কারণেও জ্বর হয়। প্রাণায়ামের অভ্যাসীর তো প্রথমত জ্বর হয়ই না আর যদি বা প্রতিশ্যায় হয়েও যায় তাহলে অতি শীঘ্রই সেটা সমাপ্ত হয়ে যায়। এই রোগের পরম ওষুধ হল ভস্রিকা প্রাণায়াম। একটা শুদ্ধ বস্ত্র দিয়ে নাক পরিষ্কার করতে থাকবেন। প্রাণায়ামের উষ্ণতায় সম্পূর্ণ সঞ্চিত কফ গলে বাইরে বেরিয়ে যাবে, উদর অগ্নি প্রদীপ্ত হওয়ার কারণে কফ হওয়া বন্ধ হয়ে রক্ত হওয়া শুরু করবে। এইভাবে এক দিনের মধ্যেই প্রতিশ্যায় (জ্বর) সমাপ্ত হয়ে যাবে। জ্বরের মধ্যে ভোজন বিষ তুল্য হয়, সুতরাং উপবাস, জলনেতি, উত্তানপাদাসন, পশ্চিমোত্তানাসন, হস্তপাদাঙ্গুষ্ঠাসন, পবনমুক্তাসন বিশেষ লাভদায়ক সিদ্ধ হয়।

🍁 মাথাব্যথার উপশমকারী প্রাণায়াম 🍁

মাথা ব্যথা খুবই কষ্টদায়ক রোগ আর এর উৎপত্তির কারণ দুটো, প্রথমত উদরের বিকৃতি হওয়া, অর্থাৎ যখন উদরে ভোজন পরিপাক সঠিকভাবে হয় না তখন সেই দূষিত হওয়া রস কফ রূপে পরিবর্তিত হয়ে বায়ু দ্বারা প্রেরিত করা মাথার মধ্যে গিয়ে সূক্ষ্ম শিরা-স্নায়ুকে অবরোধ করে দেয়, যার ফলে মাথা ভারী, চোখে জল, অধিক ব্যথা হওয়া আদি লক্ষণ দেখা যায়। মাথা ব্যথার আরেকটা কারণ হল অতিশ্রম-চিন্তা-ক্রোধ-ব্রহ্মচর্য নাশ, অতি জাগরণ আদি বিপরীত আচরণ। অতিশ্রম আদির কারণে বাত কুপিত হয়ে মাথায় অতি পীড়া উৎপন্ন করে। মাথা ব্যথার চিকিৎসার জন্য সর্বপ্রথম রোগের কারণকে দূর করা উচিত। যদি উদর বিকারের কারণে মাথা ব্যথা হয় তাহলে জ্বরের চিকিৎসাতে লেখা আসন আর প্রাণায়াম করা উচিত তথা অতিশ্রম আদির কারণে হলে জলনেতি, প্রাতঃ নাসিকা দিয়ে জলপান আর শীতলী প্রাণায়াম লাভদায়ক হয়।

🍁 হাঁপানি 🍁

হাঁপানি উদরের বিকৃতির কারণেই হয়। যখন ভোজন সঠিকভাবে হজম হয় না তখন উদরের উষ্ণতার কারণে উপরে উঠে আসে, যা শ্বাস প্রণালীতে সঞ্চিত হয়ে শ্বাসমার্গকে থামিয়ে দেয় যারফলে হৃদয়ে পীড়া, উদরে শূল, পেট ফুলে যাওয়া, মুখের ফ্যাকাশে ভাব আদি লক্ষণ প্রকট হয়, আয়ুর্বেদে একে মহাব্যাধি বলা হয়েছে। এটা খুবই ভয়ংকর রোগ। এই রোগে রেচক-পূরক আর সমবৃত্তি প্রাণায়াম বিশেষ লাভপ্রদ হয়। প্রাণায়াম করার সময় অধিক শক্তি না লাগিয়ে একটু-একটু নিরন্তর অভ্যাস করা উচিত। এই রোগের জন্য প্রাণায়ামই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ ওষুধ। বৈদ্য ডাক্তার আদিও যখন রোগীকে অন্তিম অবস্থায় দেখে তথা সব ওষুধপত্র ব্যর্থ হয়ে যায় তখন গভীর আর লম্বা শ্বাস নেওয়ারই পরামর্শ দেয় যা এক প্রকারের প্রাণায়ামই হয়। উদরকে ঠিক করার জন্য যে আসন আমি পূর্বে লিখে দিয়েছি সেটা এই রোগেও লাভপ্রদ হয়।

🍁 নিদ্রা না আসার চিকিৎসা 🍁

পেটে কব্জ বা কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য, জ্বরাদির জন্য, অধিক মানসিক শ্রম বা চিন্তার জন্য, চা কফি আদি নেশা জাতীয় বস্তুর সেবনের জন্য মানুষের নিদ্রা আসে না। যার ফলে মাথা ভারী, মাথা ব্যথা, মাথা চক্কর দেয়, অঙ্গ ভঙ্গ, চোখে জ্বলন, আলস্য আদি বিকার উপস্থিত হয়। অনিদ্রা দূর করার জন্য উদরের শুদ্ধি আবশ্যক। উদরকে ঠিক
করে এমন আসন উপযোগী হয়। শোয়ার সময় পূরক আর রেচক করে সারা শরীরকে শিথিল করে দিবেন। মনকে ভ্রুকুটির মাঝখানে স্থির করে অন্ধকারে বিলীন করে দিবেন। এইভাবে এই রোগ দূর হওয়া সম্ভব।
.
এছাড়া ক্ষয় (যক্ষ্মা), কাশি, ডায়রিয়া, অচেতনতা, রক্তবিকার, বাতবিকার, নেত্রের দুর্বলতা, অজীর্ণ, পেটব্যথা, অর্শ, মৃগী, পাগলামো, কফরোগ, কণ্ঠরোগ আদির চিকিৎসা প্রাণায়াম আর আসন দ্বারা সফলতাপূর্বক করা যেতে পারে, যাকে বুদ্ধিমান সাধক প্রাণায়ামের তত্ত্বকে জেনে স্বয়ং করতে সক্ষম হবে।

🍁 প্রাণায়ামপূর্বক ব্যায়াম 🍁

প্রাণায়াম হচ্ছে স্বয়ংই পূর্ণ ব্যায়াম, এর দ্বারা শরীরের প্রত্যেক অবয়বের শ্রম হয় তাছাড়া অন্য প্রত্যেক ব্যায়ামের সঙ্গেও প্রাণায়ামের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে। প্রাণায়ামের অভাবে ব্যায়াম কেবল অপূর্ণই নয় বরং হানিপ্রদও হয়, এইজন্য ব্যায়ামের প্রসিদ্ধ আচার্য প্রফেসর রামমূর্তি এই বিষয়ে লিখেছেন - "ব্যায়াম প্রাণায়ামের সঙ্গে করবেন, অর্থাৎ শ্বাস মুখ দিয়ে না নিয়ে নাক দিয়ে নিবেন আর পূরক-কুম্ভক-রেচক করতে-করতে করবেন।"

মানুষ মনে করে প্রাণায়াম তো য়োগেরই একটা অঙ্গ, তাই ব্যায়ামের সঙ্গে এর কোনো সম্বন্ধ নেই। এই ভুলের কারণে মানুষ ব্যায়াম হতে পূর্ণ লাভ প্রাপ্ত করে না। প্রাণায়াম হচ্ছে ব্যায়ামের প্রাণ আর এর সঙ্গে আমাদের শরীরের সরাসরি সম্বন্ধ আছে, সেটা জেনে রাখা আবশ্যক। এইজন্য একটু খুলে লিখে দিচ্ছি -

যখন কেউ ব্যায়াম আরম্ভ করে তখন তার মাংসপেশীতে পীড়া হয়। এর অধিক অনুভব সেই ব্যক্তি করে যে প্রতিদিন ব্যায়াম করে না কিন্তু একদিন দেখাদেখি বা কারও দ্বারা উৎসাহিত করার কারণে পঞ্চাশ-ষাট বৈঠক একবারে দিয়ে দেয় অথবা একাধ মিল দৌড় দেয়। এর ফলে তার হাঁটু আর উরু টানটান হয়ে যায় আর ভারী-ভারী মনে হয়। উঠতে বসতে খুব কষ্ট হয়, কারণ যে মাংসপেশী দিয়ে কখনও কোনো কাজ করা হয়নি, এমন আরামে থাকা মাংসপেশীর ছোট-ছোট ভাগ ব্যায়াম করার ফলে ভেঙে যায় আর এগুলো ভেঙে শরীরের মধ্যে একত্রিত হয় আর এর ফলে ফুলে গিয়ে কষ্ট হয়। কিন্তু প্রতিদিন ব্যায়াম বা পরিশ্রমের অভ্যাসের কারণে সেই ভাগই সুদৃঢ় হয় আর ভাঙে না বা খুব কম ভাঙে। কারণ আমাদের রক্তে যে প্রাণবায়ু আছে সেটা এই ভেঙে যাওয়া ভাগকে জীবনশক্তি (অক্সিজেন) শ্বাস দ্বারা বাইরের শুদ্ধ বায়ু আমাদের ভিতরে আসতে থাকে আর প্রশ্বাস দ্বারা ভেঙে যাওয়া ব্যর্থ ভাগ বা রক্তের মল আদির সঙ্গে মিশে বিষাক্ত বায়ু (কার্বন) বাইরে বেরিয়ে যায়। ব্যায়াম করার সময় শ্বাস চরে যাওয়ার কারণই হল এটা আর শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যায়, কারণ সাধারণ অবস্থায় কম ভাঙা-ভাঙি হয়, তাই সাধারণ শ্বাস-প্রশ্বাস দিয়েই কাজ চলে যায়। কিন্তু ব্যায়াম করার সময় যখন ভাঙা-ভাঙি অধিক হয় তখন তাকে ঠিক করার জন্য অধিক প্রাণবায়ুর দরকার হয় আর অধিক প্রাণবায়ুর জন্য অধিক শ্বাস আর প্রশ্বাসের আবশ্যকতা হয়, এইজন্য ব্যায়াম করার সময় অধিক শ্বাস চরে যায়। যখন ব্যায়ামের সময় অধিক শ্বাস চরে যায় আর প্রাণবায়ু আমাদের ফুসফুসের মধ্যে যায় আর রক্তের সঙ্গে মিশে শরীরের কোণায়-কোণায় ব্যাপ্ত হয়, তখন সেই সময় এটা শরীরের উষ্ণতাকে ঘাম দ্বারা বাইরে বের করে। এইজন্য ব্যায়াম করার সময় ঘাম আসে। যে সময় আমরা কোনো কঠিন ব্যায়াম করি তখন শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বাড়ে, ফলে শরীরের উষ্ণতাও বাড়ে। যদি প্রাণ আর অপানের টক্কর বা সংঘর্ষে উৎপন্ন হওয়া উষ্ণতাকে কম না করা হয় তাহলে জ্বর হবে, কারণ শরীরের উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ার নামই হল জ্বর। এই অধিক বেড়ে যাওয়া উষ্ণতাকে আমাদের প্রাণবায়ু শ্বাস-প্রশ্বাস তথা ঘামের দ্বারা আমাদের শরীর থেকে বাইরে বের করে দেয়। ঊষ্ণকালে আমরা জলকে ঠান্ডা রাখার জন্য তাকে মাটির কোনো পাত্রে ভরে রাখি, এমনটা করাতে পাত্রের বাহ্যভাগে যে জল আসে সেটা উষ্ণবায়ুর সঙ্গে স্পর্শ করে বাষ্প হয়ে যায়। বাষ্প হওয়ার জন্য যে উষ্ণতার আবশ্যকতা হয় তাকে পাত্রের জল থেকে নিয়ে নেয়। ঠিক এইভাবে যখন ব্যায়ামাদির কারণে আমাদের শরীরে উষ্ণতা বেড়ে যায় তখন মাটির পাত্রের মতো আমাদের শরীরও ঘামতে থাকে আর ঘাম দ্বারা শরীরে বাড়তে থাকা উষ্ণতা বাইরে বেরিয়ে যায় আর ঘামের সঙ্গে অনেক ধরণের বিজাতীয় মল (বিষ) যা অনেক ধরণের রোগ উৎপন্নের কারণ হতে পারে, সেগুলোও শরীর থেকে বাইরে বেরিয়ে যায়।

এইজন্য বেদ ভগবান্ ব্যায়ামকে পরম আরোগ্যের মুখ্য সাধন বলেছেন -

বিষ্কন্ধম্ সর্বা রক্ষাম্সি ব্যায়ামে সহামহে। (অথর্ব ৭২/৪/৪)

নির্বল করে এমন শোষক রোগকে আর সব রাক্ষস অর্থাৎ সব রোগকৃমিকে আমরা ব্যায়ামের মাধ্যমে নষ্ট করে দিই।

পাঠক! এতটুকু পড়ে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে ক্লান্তিকে দূর করার জন্য, ভেঙে যাওয়া মাংসপেশীকে জোড়া লাগানোর জন্য অথবা তাতে নবজীবন নিয়ে আসার জন্য আর ব্যায়াম থেকে উৎপন্ন হওয়া বিষকে দূর করার জন্য প্রাণবায়ুকে প্রবেশ করানো উচিত। প্রাণবায়ুর অধিক প্রবেশ শীঘ্র-শীঘ্র শ্বাস নিয়ে অথবা গভীর শ্বাস নিয়েও করা যেতে পারে। যেরূপ নদীর মার্গ সংকীর্ণ হলে তার গতির বেগ বেড়ে যায় সেইরূপ আমাদেরও ব্যায়ামের সময় শীঘ্র শ্বাস নিতে হয় আর আমাদের শ্বাস ফুলে যায়। যদি আমরা চাই যে আমাদের শ্বাস যেন না ফুলে তাহলে আমাদের গভীর শ্বাস নেওয়ার স্বভাব করা উচিত। গভীর শ্বাস সম্পূর্ণ ফুসফুসের মধ্যে যায়। বেশিরভাগ মানুষ শ্বাস নিতে জানে না, তাদের একটুখানি শ্বাস একটু ফুসফুসে গিয়ে উল্টো ফিরে আসে। গভীর শ্বাস নেওয়ার অভ্যাস করা উচিত যাতে আমাদের ফুসফুস সুস্থ আর নমনীয় থাকে। ব্যায়ামের মধ্যে গভীর শ্বাসের নামই প্রাণায়াম। গভীর শ্বাস নেওয়ার সময় আমাদের মনের শক্তি দ্বারা ফুসফুসের প্রত্যেক ভাগে বায়ু পৌঁছানোর চেষ্টা করা উচিত। ব্যায়াম করার সময় আমাদের নাসিকার দুই ছিদ্র খোলা হতে হবে। আসন, দণ্ড-বৈঠক যেকোনো ব্যায়াম আপনি করবেন তো সর্বদা প্রাণায়ামের সঙ্গেই করবেন, এটাই আমাদের প্রাচীন শৈলী। প্রাণায়াম বা গভীর শ্বাস নেওয়ার গুরুত্বকে এখন ইউরোপ আদি পাশ্চাত্য দেশের মানুষও জেনেছে আর এই প্রাণায়ামের বিধি Deep breathing নামে প্রসিদ্ধ হয়েছে।
.
ইংল্যান্ডের ডাক্তার উস্টেস মাইলজ তার পুস্তকে শ্বাস নেওয়ার বিধির বিষয়ে লিখেছেন - "পূর্ণ শ্বাস নেওয়ার বিধি প্রাচীন আর্য গ্রন্থের মধ্যে লেখা আছে। শ্বাস সাবধানে নিবেন অর্থাৎ যদি আপনি প্রাকৃতিক রূপে সঠিক ভাবে শ্বাস নিতে না জানেন তাহলে অভ্যাস করুন। শ্বাস গভীর ভাবে নেওয়া উচিত যাতে সম্পূর্ণ ফুসফুস ভরে যায় আর তারপর সম্পূর্ণ শ্বাস বাইরেও বের করা উচিত। উত্তমরূপে শ্বাস নেওয়ার অভ্যাস খুবই গুণকারী হয় আর এটা এক এমন শৈলী যা মানুষকে প্রতিক্ষণ পূর্ণ করতে হয়, বৃদ্ধ্বাবস্থাতে গিয়েও এটা ছাড়া উচিত নয়, এটা মৃত্যু কাল পর্যন্ত করা উচিত তথা তার লাভ নেওয়া উচিত। এমন সহস্র মানুষ আছে যারা শ্বাস নেওয়ার বিধি সঠিক জানে না। উত্তমবিধিতে এক-দুই বছর শ্বাস নেওয়ার অনুভব করুন তারপর আপনি স্বয়ং জেনে যাবেন যে ফুসফুসের বায়ুর মাত্রা দ্বিগুণ হয়ে গেছে।"
.
এরপর তিনি আরও লিখেছেন - "উত্তমবিধিতে শ্বাস নেওয়া শারীরিক স্বাস্থ্য আর স্বাস্থ্য রক্ষার নিয়মের জন্য হয়। এর দ্বারা স্বাস্থ্য বাড়ে, উত্তমরূপে শ্বাস নিলে রূপ-রং ঠিক হয় আর মানুষের জীবন সুখ-ভোগার যোগ্য হয় তারসঙ্গে মানসিক বিচার উত্তম হয়। উত্তমরূপে শ্বাস নেওয়াতে ধন আর শক্তি ব্যর্থ নষ্ট হয় না। এতে মানুষ নিজের শরীর আর মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে।"
.
যদিও যেকোনো ব্যায়ামের সঙ্গে ফুসফুসের ব্যায়ামও হয়ে যায়, কারণ সব ব্যায়ামের মধ্যে শ্বাস শীঘ্র-শীঘ্র যাওয়া-আসা করে, এতে ফুসফুস খুব প্রসারিত আর সংকুচিত হয়। ভালো শুদ্ধ বায়ু রক্তকে শুদ্ধ করে, রক্তের ভ্রমণ বাড়ে আর শরীরের মল বাইরে বের হয়। কিছু মল তো ঘাম দ্বারা বেরিয়ে যায়, কিছু ব্যায়ামের উষ্ণতায় জ্বলে যায়, কিছু রক্তের সঙ্গে মিশে ফুসফুসের মধ্যে এসে শুদ্ধ হয়, কিছু শ্বাস মার্গ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়, কিছু মল-মূত্রের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে যায়, এইসব লাভ ব্যায়াম থেকে হয়। কিন্তু প্রাণায়াম বা গভীর শ্বাসের অভ্যাস দ্বারা রক্ত আর শরীরের শুদ্ধি আর ফুসফুসের ব্যায়াম অন্য সব ব্যায়ামের তুলনায় হাজার গুণ বেশি লাভদায়ক হয়। এইজন্য অন্য ধার্মিক নিত্য কর্মের সঙ্গে-সঙ্গে দৈনিক প্রাণায়াম করার আজ্ঞা প্রাচীন শাস্ত্রের মধ্যে দেওয়া আছে। গভীর শ্বাসের নামই হল প্রাণায়াম এটা পূর্বেই বলা হয়েছে, সুতরাং সর্বদা গভীর শ্বাস নিবেন।

🍁 গভীর শ্বাস নেওয়ার বিধির অভ্যাস 🍁

এমন কোনো শান্ত আর একান্ত স্থানে যেখানকার বায়ু শুদ্ধ আর শীতল হবে, যেখানে ধুলো বা ধুঁয়া আদি হানিকারক বস্তু থাকবে না, সেখানে সিদ্ধাসন বা যেকোনো সুখপূর্বক আসন করে বসবেন, এমনভাবে বসবেন যেন আপনার বুক, গলা আর মাথা তিনটাই সোজা থাকবে তথা মেরুদণ্ডও সোজা রাখবেন। এরপর ধীরে-ধীরে নাক দিয়ে শ্বাসকে বাইরে বের করবেন, যতক্ষণ পর্যন্ত বুক, পেট রিক্ত না হবে শ্বাস নিরন্তর বের করতে থাকবেন অর্থাৎ সম্পূর্ণ বায়ু বের করে দিতে হবে। শ্বাসের এইভাবে বাইরে বের করার ক্রিয়াকে রেচক বলে। তারপর এইভাবে ধীরে-ধীরে শ্বাসকে ভিতরে নিবেন আর যতক্ষণ পর্যন্ত বুক আর পেট ঠিকঠাক ভাবে ভরে না যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত শ্বাস নিতে থাকবেন, শ্বাস ভরার এই ক্রিয়াকে পূরক বলে। এইভাবে শুরু-শুরুতে রেচক আর পূরকের অভ্যাস অনেক বার করবেন। যখন এক-দুই মাস অভ্যাস করার পর শ্বাস বের করা আর ভরা ঠিকঠাক ভাবে করতে পারবেন তখনই বাইরের বা ভিতরের শ্বাসকে থামানোর অভ্যাস করা উচিত।

শ্বাসকে বাইরে বা ভিতরে থামানোর অভ্যাসের নাম হল কুম্ভক। যদি কারো ইচ্ছা শুরুতেই শ্বাসকে থামানোর হয় তাহলে কিছুক্ষণ থামানো উচিত আর থামানোর সময়টা ধীরে-ধীরে বাড়ানো উচিত, বলপূর্বক থামালে হানি হয়। অভ্যাস দ্বারা বাইরে আর ভিতরে উভয় দিকের শ্বাসকে থামানোর অবধি বা কুম্ভকের সময় স্বয়মেব বেড়ে যায়। রেচক বা কুম্ভকের অভ্যাস সোজা দাঁড়িয়ে, শুয়ে-শুয়ে, চলতে-চলতে অথবা পশ্চিমাত্তানাসনেও করা যেতে পারে। ব্যায়াম করার পূর্বে এক-দুইবার ভস্রিকা প্রাণায়াম করলে খুব লাভ হয়, তার বিধি আমি পূর্বে লিখে দিয়েছি। এইভাবে ভস্রিকা তথা গভীর শ্বাসের করা এই অভ্যাস ফুসফুসকে সুস্থ আর নমনীয় করে দেয়। নমনীয় ফুসফুসে শ্বাস বা প্রাণের মাত্রা অধিক হয়। যখন আমরা একবারে অধিক প্রাণ ভিতরে ভরে নিবো তখন শীঘ্রই দ্বিতীয় শ্বাস নেওয়ার আবশ্যকতা হবে না, একেই গভীর বা উত্তম শ্বাস বলে।

প্রাণায়ামপূর্বক ব্যায়াম করার বিশদ বর্ণনা "ব্রহ্মচর্যের সাধনা" চতুর্থ ভাগের পৃষ্ঠা ১১৬ থেকে ১২৯ পর্যন্ত করা হয়েছে। প্রফেসর রামমূর্তির দণ্ড, সপাট বৈঠক আদির সচিত্র বর্ণনা সেখানে করা হয়েছে। দণ্ড, বৈঠক, কাবাডি, আসন আদি সব প্রকারের ব্যায়াম রেচক-পূরক-কুম্ভক পূর্বক করা উচিত। এইভাবে ব্যায়াম করলে অত্যধিক সফলতা প্রাপ্ত হবে, শরীর যেমন পরিপুষ্ট, সুন্দর, তেজস্বী হবে তেমনই বুদ্ধি, মন, মস্তিষ্ক, অন্তঃকরণ, ইন্দ্রিয় আদি সব আন্তরিক অবয়বও শুদ্ধ-পবিত্র আর পরিপুষ্ট হয়ে যাবে, যার ফলে পূর্ণ আদর্শ ব্রহ্মচারী হওয়ার সফলতা প্রাপ্ত হবে। সুতরাং সবাইকে প্রাণায়ামপূর্বক ব্যায়ামই করা উচিত।

(ষষ্ঠ ভাগ সমাপ্ত)
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

সপ্তম ও অষ্টম ভাগ


🍁সৎসঙ্গের অর্থ 🍁

সৎসঙ্গ শব্দের মধ্যে ষষ্ঠী বা তৃতীয় তৎপুরুষ সমাস আছে, সতাম্ সগঃ "সৎসঙ্গঃ" "সদ্ভির্বা সঙ্গঃ" সজ্জন ব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গ বা মেলামেশা করা, সজ্জন ধার্মিক বিদ্বানদের মনোহর উপদেশ শোনা আর তার উপর আচরণ করা, ব্রহ্মচর্যাদি উত্তম ব্রতের পালন করা, বেদাদি সত্যশাস্ত্রের স্বাধ্যায় করা, সত্য বলা, ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস, ঈশ্বর ভক্তি, সদাচার আদি জীবনোত্থানের উত্তমোত্তম সাধনকেও সৎসঙ্গের মধ্যে ধরা উচিত আর কুসঙ্গের শব্দার্থ এর বিপরীত ধরা উচিত।

🍁সৎসঙ্গের মহিমা🍁

আমাদের শাস্ত্র সৎসঙ্গের মহিমায় পরিপূর্ণ, সবগুলো সৎসঙ্গকে মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করেছে। আসলে সৎসঙ্গ বিষয়টা এইরূপ যে প্রশংসা করতে-করতে বিরামের ইচ্ছা হয় না। কোনো এক কবি খুব সুন্দর বলেছেন -
চন্দনম্ শীতলম্ লোকে চন্দনাদপি চন্দ্রমাঃ।
চন্দ্রচন্দনয়োর্মধ্যে শীতলা সাধুসঙ্গতিঃ।।
সংসারে চন্দনকে শীতল মানা হয়, চন্দ্রমার সৌম্য কিরণ তো তার থেকেও অধিক শীতলতর, কিন্তু চন্দন আর চন্দ্রমা থেকেও অধিক শীতলতম হল সাধু-সঙ্গতি অর্থাৎ সাধু-মহাত্মাদের সৎসঙ্গ।
সৎসঙ্গঃ পরমম্ তীর্থম্ সৎসঙ্গঃ পরমম্ পদম্।
তস্মাৎসর্বম্ পরিত্যজ্য সৎসঙ্গম্ সততম্ কুরু।।
সৎসঙ্গই পরম পবিত্র তীর্থ, সৎসঙ্গই পরম পদ মোক্ষের সাধন, এইজন্য সব দুর্ব্যেসন ছেড়ে সদা সৎসঙ্গ করা উচিৎ।
শ্রীমদ্শঙ্করাচার্য জী লিখেছেন -
সৎসঙ্গগত্বে নিঃসঙ্গত্বম্ নিঃসঙ্গত্বে নির্মোহত্বম্।
নির্মোহত্বে নিশ্চলত্বম্ নিশ্চলত্বে জীবন্মুক্তঃ।।
সৎসঙ্গ দ্বারা বিবেক জ্ঞান প্রাপ্ত হলে মানুষ সাংসারিক পদার্থে না ফেঁসে নিঃসঙ্গ হয় আর সংসারের মধ্যে না ফাঁসার কারণে মোহ স্বয়ংই দূর হয়ে যায় তথা মনে স্থিরতা আসে, আর যখন মন ঈশ্বরের ভক্তিতে স্থির হয় তখন মানুষ সংসার সাগর পার হয়ে যায়।
মলয়াচলগন্ধেন ত্বিন্ধনম্ চন্দনায়তে।
তথা সজ্জনসঙ্গেন দুর্জনঃ সজ্জনায়তে।।
যেমন মলয়াচল চন্দনের পর্বতে নিকটবর্তী ইন্ধনও চন্দন হয়ে যায়, তার মধ্যেও চন্দনের মতো সুগন্ধ আসতে থাকে, ঠিক সেইরূপ সজ্জনদের সঙ্গতির ফলে দুর্জনও সজ্জন হয়ে যায়। কারণ -
মহাজনস্য সঙ্গসর্গঃ কস্য নোন্নতিকারকঃ।
পদ্মপত্রস্থিতম্ বারি ধত্তে মুক্তাফলশ্রিয়ম্।।
মহাপুরুষদের সঙ্গে সঙ্গসর্গের ফলে এক তুচ্ছ ব্যক্তিও উন্নতি করে অত্যুত্তম হয়, যেমন বর্ষার এক ছোট্ট বিন্দু কমল পত্রের সঙ্গসর্গে মুক্তোর মতো দেখতে হয়। এই জল বিন্দু সমুদ্রের ঝিনুকে পড়ে সত্যিকারের মোতি হয়ে যায়। কিন্তু উত্তপ্ত লোহার উপর পড়লে তার চিহ্নমাত্র থাকে না, নষ্ট হয়ে যায়। ঠিক এই অবস্থা সৎসঙ্গ আর কুসঙ্গের বিষয়ে জেনে রাখা উচিত।
আপনি যদি কোনো সুগন্ধিত তেল ইতর আদি বিক্রি করে এমন দোকানে যান তাহলে সবকিছুতে সুগন্ধ পাবেন আর পুনঃ একটা কর্মকারের দোকানে গিয়ে বসুন, সেখানে তপ্ত লোহার অগ্নিকণা বস্ত্র আর শরীরকে জ্বালিয়ে দিবে। সৎসঙ্গ আর কুসঙ্গের মধ্যে ভেদ এইরকম। সৎসঙ্গ উন্নতির শিখরে চড়িয়ে দেয় আর কুসঙ্গ অবনতির গর্তে ফেলে দেয়।
এক তুচ্ছ কীটও ফুলের সৎসঙ্গের কারণে বড় বড় রাজা মহারাজার মাথায় গিয়ে পৌঁছায়, কাঁচও স্বর্ণের সৎসঙ্গের কারণে সূর্যের মতো চকচক করে। মুর্খ ব্যক্তিও পণ্ডিতের সৎসঙ্গে থাকার দরুন অতি চতুর হয়ে যায়, নিস্তেজও তেজস্বীর সৎসঙ্গের কারণে তেজসম্পন্ন হয়ে যায়, সূর্যের সম্পর্কে এসে কাঁচের মধ্যেও জ্বালানোর শক্তি উৎপন্ন হয় আর সেটা বস্ত্র আদিকে জ্বালিয়ে দেয়। এইজন্য নীতিকারেরা বলেছেন - "সতাম্ হি সঙ্গঃ সকলম্ প্রসূতে" অর্থাৎ সজ্জন পুরুষদের সঙ্গতি করলে সবকিছু প্রাপ্ত হয়।
এক কবি বলেছেন -
য়দি সৎসঙ্গনিরতো ভবিষ্যসি-ভবিষ্যসি।
অথ দুর্জনসম্সর্গে পতিষ্যসি-পতিষ্যসি।।
যদি সৎসঙ্গী হও তাহলে সৎ হয়ে যাবে আর যদি কুসঙ্গে পড়ো তাহলে পতিত হবে।
🍁 কুসঙ্গ দোষ 🍁
অহো দুর্জনসঙ্গসর্গান্মানহানিঃ পদে পদে।
পাবকো লোহসঙ্গেন মুদ্গরৈ রভিহন্যতে।।
দুর্জনের সঙ্গে থাকলে পদে-পদে মানহানি-অপমান সহ্য করতে হয়, শুদ্ধ পবিত্র অগ্নিকেও লোহার সঙ্গে হাঁতুড়ি দিয়ে পেটানো হয়। ছোলার সাথে ঘুনকেও পিষে ফেলা হয়। একটা লোকোক্তি আছে যে - "নীচাশ্রয়ো হি মহতামপমান-হেতুঃ" নীচের আশ্রয় নিলে অথবা তার নিকট থাকলে মহাপুরুষেরও অপমান হয়।
.
অর্থাৎ সম্পূর্ণ দুরাচার আর বিনাশের মূল কারণ হল কুসঙ্গতি, সুতরাং নিজের কল্যাণ করতে ইচ্ছুককে বিশেষ ভাবে ব্রহ্মচারীদের কুসঙ্গ থেকে দূরে থাকা উচিত, অর্থাৎ অষ্ট-মৈথুন সর্বথা ত্যাগ করে দেওয়া উচিত, যথা চোখ দিয়ে কখনও নোংরা বস্তু সিনেমা, নৃত্য, নাটক তথা আশ্লীল চিত্রাদি না দেখা, কান দিয়ে কখনও অশ্লীল গান, সিনেমা রাগিণী আদি না শোনা, নাসিকা দ্বারা কোনো গন্ধের উপর মোহিত না হওয়া, পা দিয়ে কুসঙ্গতিতে না যাওয়া, হাত দিয়ে কোনো খারাপ বস্তুকে না স্পর্শ করা আর মন দিয়ে উপরোক্ত বিষয়গুলোকে ভুলেও চিন্তন না করা। তাৎপর্য হল পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পাঁচ কর্মেন্দ্রিয় আর মন এগুলোর উপর আমাদের আধিপত্য হওয়া উচিত, তবেই আমরা কুসঙ্গ থেকে বাঁচতে পারবো।
একবার ভগবান্ বিষ্ণু রাজা বলিকে জিজ্ঞেস করেন যে - আপনি সজ্জনদের সঙ্গে নরকে যেতে পছন্দ করবেন নাকি দুর্জনদের সঙ্গে স্বর্গে? রাজা বলি উত্তর দেন যে - আমি সজ্জনদের সঙ্গে নরকে যাওয়াটা উত্তম মনে করি, কারণ যেখানে সজ্জন যাবে সেখানে নরকও স্বর্গ হয়ে যাবে আর দুর্জন স্বর্গকেও নরক বানিয়ে দিবে। কারণ -
অণুরপ্যসতাম্ সঙ্গঃ সদ্গুণম্ হন্তি বিস্তৃতম্।
গুণরূপান্তরম্ য়াতি তক্রয়োগাদ্ য়থা পয়ঃ।।
দুর্জনের একটুখানি কুসঙ্গও বিস্তৃত গুণরাশিকে নষ্ট করে দেয়, যেমন একটুখানি টকের সংস্পর্শে এসে হাজার হাজার গুণ অধিক দুধের গুণ আর রূপ সর্বথা ভিন্ন হয়ে যায়। এক ফোঁটা বিষের কারণে সম্পূর্ণ ভোজন সামগ্রী বিষাক্ত হয়ে যায়। আর যেখানে কেবল দুর্জন আর দুর্জন আছে সেখানে স্বর্গের কামনা করা মানে খপুষ্প তথা বন্ধ্যাপুত্রের তুল্যই হবে। য়োগরসায়নের মধ্যে বলা হয়েছে -
অসৎসঙ্গাদ্গুণজ্ঞোऽপি বিষয়াসক্তমানসঃ।
অকস্মাৎপ্রলয়ম্ য়াতি গীতরক্তো য়থা মৃগঃ।।
কুসঙ্গ দ্বারা যখন মন বিষয়ের বিষের সঙ্গে যুক্ত হয় তখন গুণবান আর বিদ্বান ব্যক্তিও সহসা মৃত্যুর গ্রাস হয়, যেমন বীণার সুমধুর অনুরাগে বশীভূত হওয়া মৃগ মারা যায়।
গোস্বামী তুলসীদাস জী ঠিকই বলেছেন -
বরু ভল বাস নরক কর তাতা। ন দুষ্ট সঙ্গ জনি দেই বিধাতা।।
অর্থাৎ - ঘোর নরকে থাকা ভালো কিন্তু পরমাত্মা কাউকে যেন দুষ্টের সঙ্গতি না দেন। কারণ মানুষ ভয়ংকর থেকে ভয়ংকর বিপদ থেকেও পার পেতে পারে কিন্তু দুষ্টের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসা অসম্ভব না হলেও কঠিন অবশ্যই।
সংসারে এমন কোন নীচ কর্ম আছে যাকে মানুষ কুসঙ্গের সঙ্গে থেকে শেখে না? দুর্জন স্বয়ং তো নষ্ট-ভ্রষ্ট হয়েই যায় কিন্তু তার সঙ্গে-সঙ্গে অনেক ভালো-ভালো বাচ্চাদের নিয়েও ডুবে যায়।
পণ্ডিত বিষ্ণু শর্মা পঞ্চতন্ত্রের মধ্যে লিখেছেন -
"বরম্ প্রাণত্যাগো ন পুনরধমানামুপগমঃ"
প্রাণ ত্যাগ করা ভালো কিন্তু নীচের সঙ্গতি ভালো নয়। কারণ প্রাণ ত্যাগ করলে কর্মানুসারে আরেকটা উত্তম শরীর পাওয়া যাবে কিন্তু কুসঙ্গের মধ্যে তো লোক-পরলোক দুটোই নষ্ট হয়ে যাবে, এই লোক তো প্রত্যক্ষরূপে নষ্ট-ভ্রষ্ট হচ্ছেই আর পাপ কর্ম করার ফলে পরবর্তী জন্মও উত্তম প্রাপ্ত হবে না।
.
"জেইসা সাঙ্গ ওয়াইসা রাঙ্গ" এর অনুসারে সৎসঙ্গ করার ফলে মানুষ শ্রেষ্ঠ হয় আর কুসঙ্গে পড়ে অধম হয়। সঙ্গের রঙ চড়ে অবশ্যই, একটা স্বচ্ছ ভবন ধুয়োতে কালো হয়ে যায় আবার কালা কয়লাও অগ্নির সংযোগে জ্বলতে শুরু করে, লতা বা ঘাসের মধ্যে থাকা কীটপতঙ্গও তৎসদৃশ রঙের হয়ে যায়। তাই বলাও হয়েছে -
অসতাম্ সঙ্গদোষেণ সাধবো য়ান্তি বিক্রিয়াম্।
দুর্য়োধনপ্রসঙ্গেন ভীষ্মো গোহরণে গতঃ।।
দুর্জনের সঙ্গতিতে থাকলে সজ্জনও দুর্জন হয়, তার বৃত্তিও বিকৃত হয়ে যায়। মহাভারত কালে দুষ্ট দুর্যোধনের সঙ্গে থাকার কারণে ভীষ্ম পিতামহ রাজা বিরাটের গরু চুরি করতে গিয়েছিলেন।
এইজন্য বিচারশীল সৎপুরুষেরা বলেছেন -
"ভুজঙ্গবদ্বর্জ্যো বুধৈর্দুর্জনঃ" বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের সর্বদা সাপের থেকে দূরে থাকার মতো দুর্জনদের থেকেও দূরে থাকা উচিত। এদের সঙ্গতি করা তো দূরের কথা এই রকম দুষ্ট পাপীদের পাশে বাস করাও হানিপ্রদ। শুধু তাই নয়, রাজর্ষি চাণক্য জী তো দুর্জনকে সাপের থেকেও ভয়ংকর বলেছেন -
সর্পশ্চ দুর্জনশ্চৈব বরম্ সর্পো ন দুর্জনঃ।
সর্পো দশতি কালে দুর্জনস্তু পদে পদে।। (চাণক্য নীতি)
সাপ আর দুর্জনের মধ্যে সাপ ভালো, কারণ সাপ তো যখন কাল এসে উপস্থিত হবে তখন কামড়াবে কিন্তু দুর্জন তো পদে-পদে প্রহার করবে। সাপ, বিচ্ছু আদি কোনো অবয়ব বিশেষে প্রহার করে কিন্তু দুর্জনের তো এক-একটা অঙ্গ বিষে ভরা থাকে।
তক্ষকস্য বিষম্ দন্তে মক্ষিকায়াশ্চ মস্তকে।
বৃশ্চিকস্য বিষম্ পুচ্ছে সর্বাঙ্গে দুর্জনস্য তৎ।।
সাপের দাঁতে, মাছির মাথায় আর বিচ্ছুর লেজে বিষ থাকে কিন্তু দুর্জনের সারা অঙ্গ বিষাক্ত হয়।
.
এইজন্য বিষ্ণু শর্মা পঞ্চতন্ত্রের মধ্যে বলেছেন -
আরম্ভগুর্বী ক্ষয়িণী ক্রমেণ, লঘ্বী পুরা বৃদ্ধিমতী চ পশ্চাৎ।
দিনস্য পূর্বার্দ্ধপরার্দ্ধভিন্না, ছায়েব মৈত্রী খলসজ্জনা নাম্।।
অর্থাৎ - দুর্জনের মিত্রতা শুরুতে খুব বড় হয় অর্থাৎ অতি সুন্দর বলে মনে হয় কিন্তু উত্তরোত্তর হ্রাস পেতে থাকে, যেমন প্রাতঃকালে ছায়া খুব বড় হয় কিন্তু দুপুর হতে-হতে কমে ন্যূনতম হয়ে যায় আর সজ্জনদের মিত্রতা শুরুতে নামমাত্রই হয় কিন্তু সেটা প্রতিদিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। যেভাবে দুপুরের পশ্চাৎ ছায়া উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে।
এইজন্য দুর্জনদের সঙ্গতিকে শুরুতে বৃদ্ধি দেখে তার ফাঁদে পড়া উচিত নয়, বরং আগামী দিনে তার দুষ্পরিণামের কথা ভেবে সর্বথা পৃথকই থাকা উচিত, এতেই কল্যাণ হবে। কারণ কুসঙ্গ পাপকে বাড়ায়, বুদ্ধিকে মলিন করে, কীর্তিকে নষ্ট করে, ধর্মকে ধ্বংস করে বিপদের পাহাড় দাঁড় করে দেয় আর ধন সম্পত্তি ন্যায় আদির লোভ হয়। স্বভাব খিটখিটে আর ক্রোধী হয়ে যায়, এমন কোনো দুষ্কর্ম নেই যা এই লোক তথা পরলোকের নাশ কুসঙ্গতির দ্বারা হয় না।
কুসঙ্গে পড়লে ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ, পুরুষার্থ চতুষ্টয় আর লোক-পরলোক সব মাটি হয়ে যায়, মানুষ জন্ম প্রাপ্ত করেও পশু-পক্ষীর থেকেও নীচ গতি হয়। এইজন্য বলা হয়েছে -
ন স্থাতব্যম্ ন গন্তব্যম্ ক্ষণমপ্যধমৈঃ সহ।
পয়োऽপি শৌণ্ডিকীহস্তে মদিরাম্ মন্যতে জনঃ।।
অধম পুরুষের নিকট এক ক্ষণের জন্যও থাকা উচিত নয়, যদি কোনো সজ্জন পুরুষ অকস্মাৎ কোনো নিন্দনীয় স্থানে চলে যায় তাহলে মানুষ তাকেও সেইরূপ মনে করতে শুরু করে, যেমন মদ তৈরি করে বিক্রি করে এমন কলালের হাতে শুদ্ধ পবিত্র গোদুগ্ধ থাকলেও মানুষ তাকে মদই মনে করে।
কুসঙ্গের দুটো ভেদ আছে, যথা - শারীরিক আর মানসিক। শারীরিক কুসঙ্গ থেকে পৃথক থাকা সহজ, কারণ এরজন্য কিছু বাধা প্রত্যক্ষ রূপে হয়, নিজের কুলের, মাতা-পিতার মান সম্মানের ভয়ের বা মাতা-পিতা অথবা গুরুজনদের ভয়ে অথবা লজ্জার কারণে মানুষ প্রত্যক্ষ রূপে কিছু অংশে কুসঙ্গ থেকে বেঁচে যায়, লুকিয়ে-লুকিয়ে তখনই করে যখন সুযোগ পায়, কিন্তু মানসিক কুসঙ্গ থেকে বাঁচা খুবই কঠিন। মানুষ প্রতিক্ষণ উঠতে-বসতে খেতে-হাঁটতে এমনকি শয়ন কালেও স্বপ্নের দ্বারা নিজের বিচারকে দূষিত করতে থাকে। নোংরা অশ্লীল পুস্তক পড়াও মানসিক কুসঙ্গ হয়।
.
কিছু সরল সাধারণ ব্যক্তি এমন মনে করে যে আমরা শরীর দিয়ে তো কিছু করি না, নোংরা পুস্তক পড়লে অথবা অশ্লীল ভাবনা ভাবলে খারাপের কি আছে? কিন্তু এমন ভাবা ব্যক্তি ভয়ংকর ভুল করে। মন দ্বারা অথবা কর্ম দ্বারা আমরা যেমন শুভাশুভ বিচার বা কর্ম করবো, তার সেইরূপ অমিত ছাপ চিত্তের উপর পড়ে আর পরবর্তীতে সেটা বাসনার রূপ ধারণ করে কষ্ট দেয়। ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ জী গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলেছেন -
ধ্যায়তো বিষয়ান্ পুম্সঃ সঙ্গস্তেষুপজায়তে।
সঙ্গাতৎ সঙ্গজায়তে কামঃ কামাৎ ক্রোধোऽভিজায়তে।।
ক্রোধাদ্ভবতি সম্মোহঃ সম্মোহাৎস্মৃতিবিভ্রমঃ।
স্মৃতিভ্রম্শাদ্বুদ্ধিনাশো বুদ্ধিনাশাৎপ্রণশ্যতি।।
কুসঙ্গতে প্রথমে মনের মধ্যে মন্দ বিচার উৎপন্ন হয় আর তারপর তারসঙ্গে মানুষের সঙ্গ হয়ে যায় অর্থাৎ সেইরূপ স্থান বা ব্যক্তির নিকট পৌঁছে যায়। সঙ্গ দ্বারা কাম উৎপন্ন হয়, "কামিনাম্ কামিনীনাঞ্চ সঙ্গাৎ কামী ভবেৎপুমান্", কামুক স্ত্রী-পুরুষের সঙ্গ দ্বারা মানুষ স্বয়ং কামী হয়ে যায়। আর যখন সেই কামনার পূর্তি হয় না তখন ক্রোধ এসে উপস্থিত হয় আর কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেয়, স্মরণ শক্তি হ্রাস পেতে থাকে, স্মরণ শক্তি বিকৃতির কারণে বুদ্ধি ভ্রষ্ট হয়ে যায়, যারফলে সর্বনাশ হয়, কারণ সারা সংসারটাই হচ্ছে বুদ্ধির খেলা। "বুদ্ধির্য়স্য বলম্ তস্য" সেই ব্যক্তিই বলবান যার বুদ্ধি সুস্থিত আছে। বুদ্ধি চলে যাওয়া মানেই সব চলে গেছে। এইজন্য কুসঙ্গ থেকে মনসা-বাচা-কর্মণা পৃথক থাকা উচিত।

শিক্ষা আর কুসঙ্গ 🍁
আজ লেখাপড়া করেনি এমন মানুষের তুলনায় লেখাপড়া জানা শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মানুষ অধিক কুসঙ্গের চক্রে ফেঁসে আছে, এর কারণ হল আমাদের প্রচলিত শিক্ষা প্রণালী। অশিক্ষিত ব্যক্তি অজ্ঞানতার কারণে অথবা কুসঙ্গের কারণে মন্দের মধ্যে ফেঁসে যায় কিন্তু এই শিক্ষার প্রণালীতেই তো মন্দ শেখানো হয়। এইজন্য আমাদের শিক্ষিত বর্গের আচরণের স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।
প্রাচীনকালে আর্ষপাঠবিধির অনুসারে বালক-বালিকা গুরুকুলে মাতা-পিতা আর সাংসারিক বাতাবরণ হতে পৃথক হয়ে ব্রহ্মচর্যপূর্বক বিদ্যোপার্জন করতো। সাত-আট বছরের বালক-বালিকাকে গুরুজনের নিকটতম সম্পর্কে ছেড়ে দেওয়া হতো। গুরু বা আচার্যের প্রধান কর্ম ছিল যে তিনি দিনরাত (২৪ ঘন্টা) তাদের আচার-বিচারের উপর ধ্যান রাখতেন আর বিদ্যাও এমন পড়ানো হতো যারদ্বারা লোক-পরলোক দুটোই সুধরে যেতো, ব্রহ্মচারী (বিদ্যার্থী) পতিত হওয়ার সুযোগই পেতো না। এইজন্য এখানে কপিল, কণাদ, জৈমিনি, পতঞ্জলি আর শ্রীরাম, শ্রীকৃষ্ণ তথা দয়ানন্দ উৎপন্ন হয়েছিলেন।
বর্তমানের অনার্ষ শিক্ষা প্রণালী হল এর ঠিক উল্টো। এরদ্বারা মানবের স্থানে দানব তৈরি করা হয়। আসলে এই শিক্ষার ভিত্তিটাই লর্ড ম্যাকালের দূষিত ভাবনার উপর করা হয়েছিল। যে ভবনের ভিত্তিটাই দূষিত তার থেকে কল্যাণের কিবা আশা করা যেতে পারে!
২৪ ঘণ্টার মধ্যে কেবল পাঁচ ঘন্টা পাঠ্য পুস্তকের পাঠ পড়িয়ে অধ্যাপক নিজের কর্তব্য পূরণ হয়ে গেছে বলে মনে করে, আর মাতা-পিতাকে তো কোনো চিন্তা করার আবশ্যকতাই প্রতিত হয় না কারণ তারা তাদের সন্তানকে স্কুলে পড়ার জন্য ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি চিন্তামুক্ত হয়ে যায়। বিদ্যার্থীর জীবনের ধ্যান কারও নেই (সম্ভবতঃ এটা আমাদের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে)।
এই পাঠবিধির মধ্যে বিদ্যার্থীদের চরিত্র নির্মাণের জন্য কোনো স্থান নেই, আচার-বিচারকে ভ্রষ্ট করার সাধনের ভরমার আছে। কামুকতাকে উৎপন্ন করে এমন অশ্লীল অনার্ষ দূষিত গ্রন্থ পাঠ্যক্রমের মধ্যে রাখা হয়েছে, সেগুলো পড়ে ব্রহ্মচারী থাকা খুবই কঠিন। প্রথমত ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যেকার অবস্থাটাই এইরূপ হয় যে সেখানে না প্রকাশ থাকে আর না অন্ধকার। যদি এই অবস্থায় বিদ্যার্থীকে সৎপথ না দেখানো হয় তাহলে পতিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। পতিত হওয়ার দ্বিতীয় সাধন হল দুশ্চরিত্র অধ্যাপক আর বিদ্যার্থীদের কুসঙ্গ তথা বিচারকে নোংরা করে এমন অশ্লীল অনার্ষ গ্রন্থের অধ্যয়ন। যদি বা কোনো ন্যূনতা রয়ে যায় তাহলে তাকেও সহশিক্ষা (নবযুবক আর নবযুবতীদের একসঙ্গে মিলিত হয়ে পড়া) তথা সিনেমা, নাচ, গান, ইন্টারনেট, মোবাইল আদি পূরণ করে দেয়, যারফলে একজন বিদ্যার্থীর পক্ষে সদাচারী হয়ে থাকা অসম্ভব হয়ে যায়। এর পরিণামস্বরূপ মাধ্যমিক আসতে-না-আসতেই প্রায় সব বিদ্যার্থীর আচার ভ্রষ্ট হয়ে যায়। এরপর কলেজে তো এক শতাংশও এমন বিদ্যার্থী পাওয়া যায় না যার ব্রহ্মচর্য নষ্ট হয়নি।
.
যখন বিদ্যার্থী সব হারিয়ে বি.এর. উপাধি নিয়ে ঘরে ফিরে আসে তখন তার অবস্থা ঠিক সেই রস বের করা আখ বা লেবুর মতো হয়। এই সম্পূর্ণ দুষ্পরিণামের কারণ হল শারীরিক আর মানসিক কুসঙ্গ।
.
প্রাচীনকালে আচার্য শিষ্যকে ব্রহ্মচর্যের শিক্ষা দিতেন। "তম্ রাত্রীস্তিস্র উদরে বিভর্তি" (অথর্বঃ ১১/৫/৩) বেদের আদেশানুসারে শিষ্যের রক্ষা সেইরূপ করতেন যেভাবে মাতা গর্ভাবস্থায় শিশুর রক্ষা করে।
🔹রামকে কে বানিয়েছিল? গুরুবর বশিষ্ঠ।
🔹কৃষ্ণকে কে বানিয়েছিল? ঋষি ঘোর আঙ্গিরস। 🔹অর্জুনকে বানিয়েছিল? আচার্য দ্রোণ।
🔹দয়ানন্দকে কে বানিয়েছিল? গুরুবর বিরজানন্দ।
কিন্তু আজকের শিক্ষা প্রণালীতে গুরুরা এই ভার নিজের কাঁধ থেকে সরিয়ে দর্জির উপর ছেড়ে দিয়েছে। এইজন্য যে যেমনটা চায় সেইরূপ দুই-তিন ঘন্টার মধ্যেই দর্জির ঘরে গিয়ে হয়ে যায়।
এইরকম মানুষকে বেদ "ততনুষ্টি", "তনুশুভ্র" আর "কবাসখ" বলেছে - "অপাপ শক্রস্ততনুষ্টিমূহতি তনুশুভ্রম্ মঘবা য়ঃ কবাসখঃ।" (ঋগ্বেদ ৫/৩৪/৩)
যারা ঈশ্বরের ভক্তি করে, উত্তম মার্গে চলে, ঈশ্বর তার উন্নতি করেন, শক্তি প্রদান করেন, কিন্তু যারা "ততনুষ্টি" হয়, দিনরাত বিষয়ের মধ্যেই ফেঁসে থাকে, "তনুশুভ্র" অর্থাৎ শরীরের সাজ-সজ্জাতে লেগে থাকে আর "কবাসখ" অর্থাৎ যে কুৎসিত সঙ্গতির মধ্যে থাকে, যার মিত্র তথা সাথী কুৎসিত আচরণের হয়, তাকে সর্বশক্তিমান ঐশ্বর্যশালী পরমাত্মা (অপ অপ ঊহতি) নিচে ফেলে দেন অর্থাৎ নাশ করেন।
বর্তমান শিক্ষা প্রণালীর ভয়ংকর দুষ্পরিণাম দেখে এতে কোনো ভারতীয়ই সন্তুষ্ট নয়, রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে ছোট কর্মচারি পর্যন্ত সবাই এর কটু-আলোচনা করে। সময়ে-সময়ে আমাদের সব নেতা বলে যে বর্তমান শিক্ষা প্রণালীর পরিবর্তন হওয়া উচিত, কিন্তু জানি না সেই শুভদিন কবে আসবে যখন দুরাচারের জননী এই শিক্ষা-প্রণালী সমাপ্ত হবে আর এটা অতীত-শিক্ষা-প্রণালীর রূপে পরিণত হবে। পরমাত্মার কৃপায় খুব শীঘ্র এই দুরাচারের আড্ডা তথা আচরণহীন ক্লার্ক তৈরির কারখানা বন্ধ হোক আর পুনরায় সেই রামায়ণ-মহাভারতকালীন আর্ষ শিক্ষা-প্রণালী প্রচলিত হোক, যাতে আমরাও বাল্মীকি তথা ব্যাসের সুরে সুর মিলিয়ে বলতে পারি - "সর্বে বেদবিদঃ শূরাঃ সর্বে শস্ত্র বিশারদাঃ"।
তথা আমাদের রাষ্ট্রপতিও রাজা অশ্বপতির মতো নিঃসঙ্কোচে বলতে পারেন -
ন মে স্তেনো জনপদে ন কদর্য়ো ন মদ্যপঃ।
নানাহিতাগ্নির্নাবিদ্বান্ ন স্বৈরী স্বৈরিণী কুতঃ।।
(ছান্দোগ্যোপনিষদ)
🍁 সৎসঙ্গের লাভ 🍁
সৎসঙ্গের লাভ অপার, মানুষ মায়া-মোহ থেকে সরে যায় আর তার ভিতরে বিবেক জ্ঞানের উদয় হয় যারফলে সে সত্যাসত্যের নির্ণয় করতে পারে। সৎপথে চলার শক্তি অর্জন করে, যদি আলস্যবশ কিছু শিথিলতা আসে তাহলে সে সৎসঙ্গ থেকে দূর সরে যায়। পড়ে যাওয়া ব্যক্তিও সৎসঙ্গ পেয়ে উঠে দাঁড়ায়, বড়-বড় ডাকুও সজ্জনের শরণে এসে সুধরে যায়।
সৎসঙ্গের লাভের বর্ণনাতে সংস্কৃতের এক কবি খুব সুন্দর লিখেছেন -
জাড্যম্ ধিয়ো হরতি সিঞ্চতি বাচি সত্যম্,
মানোন্নতিম্ দিশতি পাপমপাকরোতি।
চেতঃ প্রসাদয়তি দিক্ষু তনোতি কীর্তি,
সৎসঙ্গতিঃ কথয় কিম্ ন করোতি পুম্সাম্।।
সৎসঙ্গের ফলে বুদ্ধির মলিনতা, মূঢ়তা দূর হয়, বাণীতে সত্যের সিঞ্চন হয় অর্থাৎ মানুষ মিথ্যাকে ছেড়ে দেয় আর সত্যকে গ্রহণ করতে শুরু করে, যারফলে তার সব পাপ কর্ম সরে যায়, চিত্ত প্রসন্ন থাকে আর সংসারে তার কীর্তি ছড়িয়ে পড়ে। এইজন্য সৎসঙ্গের ফলে সব শুভ গুণ মানুষের মধ্যে চলে আসে।
সৎসঙ্গ পেয়ে সহস্র পথভ্রষ্ট মানুষ পুনরায় সৎপথকে গ্রহণ করেছে। আপনি এমন মহাপুরুষের অনেক উদাহরণ পাবেন যারা কেবল একটুখানি সৎসঙ্গ পেয়েই পুরো কায়া পাল্টে দিয়েছে।
মহর্ষি দয়ানন্দ জী পেশাবরে সিপাহী লেখরামকে ২৫ বছর পর্যন্ত ব্রহ্মচর্য পালনের উপদেশ দিয়েছিলেন, মহর্ষির ব্রহ্মচার্যের প্রভাব তার উপর এমন পড়ে যে সে পঁচিশের স্থানে ৩৬ বছর পর্যন্ত ব্রহ্মচার্য পালন করে আর পরবর্তীতে সেই লেখরাম ধর্মবীরদের পংক্তিতে নিজের নাম অঙ্কিত করে যায়।
নাস্তিক মুন্শীরাম উকিল বারেলীতে মহর্ষি দয়ানন্দ জীর সৎসঙ্গে সম্মিলিত হয়েছিল, সেই সময় সব ধর্মের প্রতি তার পরাঙ্গমুখ হয়ে গিয়েছিল কিন্তু মহর্ষির উপদেশের প্রভাব তার উপর এত গভীর পড়ে যে সেই নাস্তিক মুন্শীরাম ঈশ্বরের শ্রদ্ধালু ভক্ত বীর সেনানী শ্রদ্ধানন্দ হয়ে যায়।
সম্বৎ ১৯৪০ যখন মহর্ষি দয়ানন্দ জী মৃত্যুর শয্যাতে বিরাজমান ছিলেন তখন ওনার কাছে পণ্ডিত গুরুদত্ত বিদ্যার্থী এম. এ. আসে। আগে সেও ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস করতো না কিন্তু মহর্ষির প্রভাব দেখে সারা জীবনের জন্য ঈশ্বরের সত্য ভক্ত হয়ে যায়।
একবার মহর্ষি দয়ানন্দ জীকে অমীচন্দ একটা গান শুনিয়েছিল। তার গান শুনে ঋষি অত্যন্ত প্রসন্ন হন আর বলেন যে - "অমীচন্দ তুমি তো রত্ন কিন্তু তুমি কাদাতে পড়ে আছো।" এইটুকু বলেছিলেন আর তাতেই মাতাল মাংসাহারী আর বেশ্যাগামী অমীচন্দ সব পাপ ছেড়ে দিয়ে সত্য আর্য হয়ে যায় আর নিজের সম্পূর্ণ জীবন আর্যসমাজের প্রচারের কাজে লাগিয়ে দেয়।
.
🍁 কার সঙ্গ করা উচিত? 🍁
যে যেরূপ হয় সে সেইরূপের সঙ্গে মিত্রতা করে এমনটা সংসারে দেখা যায়, তাদের সঙ্গে ওঠে-বসে আর আহার-বিহার আদি করে। মহারাজ ভর্তৃহরি জী লিখেছেন -
মৃগা মৃগৈঃ সঙ্গমনুব্রজন্তি, গাবশ্চ গভিস্তুরগাস্তুরঙ্গৈঃ।
মূর্খাশ্চ মূর্খৈঃ সুধিয়ঃ সুধীভিঃ সমানশীলব্যসনেষু সখ্যম্।।
মৃগ মৃগের সঙ্গে চলে, গরু গরুর সঙ্গে আর ঘোড়া ঘোড়ার সঙ্গে, মূর্খ মূর্খের সঙ্গে আর পণ্ডিত পণ্ডিতদের সঙ্গে থাকতে পছন্দ করে, কারণ মিত্রতা তাদেরই হয় যাদের আচার-বিচার তথা ব্যবহারে মিল আছে।
এইজন্য মানুষকে পরীক্ষার জন্য বিদ্বানরা এমন বিধি বানিয়েছেন যে যদি আপনি জানতে চান যে দেবদত্ত কিরকম, তাহলে তার সঙ্গীদের, তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখে এমন বন্ধু-বান্ধবকে দেখেনিন যে তারা কিরকম, যেমন তার সঙ্গী ভালো কিংবা মন্দ হবে, দেবদত্তও তেমন হবে।
এটা তো হল স্বাভাবিক প্রবৃত্তির বিষয়, কিন্তু চেষ্টা করলে এর থেকে বিপরীত করতে পারে। একজন ভালো মানুষও দুর্জনদের মধ্যে বসে দুর্জন হয়ে যেতে পারে, সেইরূপ দুর্জনও সজ্জনদের শরণে এসে সজ্জন হতে পারে কারণ -
হীয়তে মতিস্তাত হীনৈঃ সহ সমাগমাত্।
সমৈশ্চ সমতামেতি বিশিষ্টৈশ্চ বিশিষ্টতাম্।।
নিজের থেকে হীন ব্যক্তির সঙ্গে থেকে কোনো লাভ নেই অপিতু স্বয়ংও হীন-নীচ হয়ে যায়, নিজের সমান ব্যক্তির সঙ্গে থেকেও কোনো বিশেষ লাভ নেই, নিজের থেকে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের সঙ্গে থাকলে লাভ আছে, কারণ স্বয়ংও সেইরকম হতে পারবে। এইজন্য নিজের থেকে অধিক গুণবান্ শ্রেষ্ঠ পুরুষ তথা সাধু মহাত্মাদের সঙ্গে থাকা উচিত।
সবথেকে উত্তম সর্বশক্তিমান হলেন পরমপিতা পরমাত্মা, তাঁর সৎসঙ্গ - স্তুতি, প্রার্থনা, উপাসনা নিত্যপ্রতি অবশ্যই করা উচিত। ঈশ্বরের ভক্তির ফল মহর্ষি দয়ানন্দ জী লিখেছেন - "যেমন শীতে আতুর ব্যক্তি অগ্নির নিকটে গেলে তার শীতের নিবৃত্তি হয়, সেইরকম পরমেশ্বরের নিকটতা প্রাপ্ত হলে সব দোষ দুঃখ সরে গিয়ে পরমেশ্বরের গুণ, কর্ম, স্বভাব সদৃশ জীবাত্মার গুণ, কর্ম, স্বভাব পবিত্র হয়ে যায়। এইজন্য পরমেশ্বরের স্তুতি, প্রার্থনা আর উপাদনা করা উচিত।
যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ ঈশ্বরকে সর্বব্যাপক আর সর্বশক্তিমান জেনে তাঁর ভক্তি করবে না, ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস করবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত পাপ করা থামাতে পারবে না। পাপ কর্ম সর্বদা লুকিয়ে-লুকিয়েই করা হয় আর মানুষ সবাইকে ঠকিয়ে একান্তে পাপ করে বসে। কিন্তু সেই সর্বশক্তিমান সর্বব্যাপক প্রভুর কাছে কোনো কিছুই লুকাতে পারবে না, কারণ তিনি তো আগে থেকেই সর্বত্র বিদ্যমান আছেন। কুকর্ম করার সময় যখন ভয়, লজ্জা আদি হয় তখন মানুষ এদিক-সেদিক চারিদিকে দৃষ্টি ফেলে দেখে নেয় যে কেউ কোথাও দেখছে না তো। যখন কোথাও কেউ দৃষ্টিগোচর হয় না তখন নিঃসঙ্কোচে পাপে প্রবৃত্ত হয়ে যায়। কিন্তু সেই মূর্খ এটা জানে না যে - "দ্বৌ সম্নিষদ্য য়ম্মন্ত্রয়েতে রাজা তদ্বদে বরুণস্মৃতীয়ঃ" (অথবঃ ৪/১৬/২)। দুই ব্যক্তি মিলে যখন কোনো ভালো বা মন্দ গুপ্ত মন্ত্রণা করে তখন তৃতীয় সকল ব্রহ্মাণ্ডের স্বামী শ্রেষ্ঠ বরুণ পরমাত্মাও সেটা জানেন। এইজন্য কখনও এমন ভুল করা উচিত নয়। যে ব্যক্তি অন্যকে ঠকায়, প্রতারণা করে, বরুণ পরমাত্মা তৎক্ষণাৎ তাকে ধরে বন্দী বানিয়ে নেন আর মূর্খ পাপী সেটা জানতেও পারে না।
.
ঈশ্বরের পশ্চাৎ তৎকৃত বেদ তথা বেদানুকূল শাস্ত্র স্মৃত্যাদির স্বাধ্যায় দ্বারা সৎসঙ্গ করা উচিত তথা যে ঋষি, মুনি, সাধু, মহাত্মা আর আপ্ত পুরুষ আছেন তাদের সঙ্গতির লাভ নেওয়া উচিত।
আমি অনেক স্থানে সাধু-সন্তের সঙ্গে সৎসঙ্গ করার জন্য নির্দেশ করেছি। সাধু-সন্ত বলতে আমার বলার অভিপ্রায় হল যারা স্বার্থ-ছল-কপটাদি হতে রহিত, বীতরাগ, নিষ্কামী তথা যারা সর্বদা লোক-কল্যাণে লেগে থাকে। আজকাল এমন ভোজন-ভট্টও অনেক আছে যারা কেবল নিজের উল্লু সোজা করার জন্যই সন্ন্যাসীর বস্ত্রাদি ধারণ করে পবিত্র সন্ন্যাস আশ্রমকে কলঙ্কিত করছে। কেবল লিঙ্গ বা চিহ্ন বিশেষ যে ধর্মের কারণ হয় না তা ভগবান্ মনু মহারাজ স্পষ্ট বলে দিয়েছেন - "ন লিঙ্গম্ ধর্মকারণম্।"
.
সুতরাং ধূর্ত পাখণ্ডীদের চক্র থেকে দূরে থাকা উচিত, এরা হল সেই ছদ্মবেশী অধম পুরুষ যাদের বিষয়ে চাণক্য জী বলেছেন - "বরম্ প্রাণত্যাগো ন পুনরধমানামুপগমঃ।" অর্থাৎ প্রাণ ত্যাগ করা উত্তম হবে কিন্তু এমন ধূর্ত পাখণ্ডী পুরুষাধমের সঙ্গতি করা উচিত নয়।
বাস্তবে যারা আসল সাধু হয় তাদের আদর, সৎকার তথা সৎসঙ্গ অবশ্যই করা উচিত। কারণ -
সাধুসঙ্গতয়ো লোকে সন্মার্গস্য চ দীপকাঃ।
হার্দান্ধকারহারিণ্যো ভাসো জ্ঞানবিবস্বতঃ।।
সাধু-সন্তের সৎসঙ্গ এই সংসারে সৎপথ দেখানোর জন্য প্রকাশ স্তম্ভের কাজ করে, কারণ সাধু মহাত্মাদের সৎসঙ্গ হৃদয়রূপী গুহা থেকে অজ্ঞানান্ধকারকে নষ্ট করার জন্য জ্ঞান-সূর্য স্বরূপ হয়।
মহর্ষি দয়ানন্দ জী লিখেছেন - "পরমেশ্বর মানুষকে আজ্ঞা দিয়েছেন যে যজ্ঞের অনুষ্ঠান, ভালো ভালো গুণের জ্ঞান, বিদ্বানদের সেবা, দুষ্ট ব্যক্তি ও দুষ্ট দোষের ত্যাগ আর ঈশ্বরের উপাসনা তথা বিদ্বানদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার করে আর সব বিদ্যা প্রাপ্ত করে সবার জন্য সুখ উৎপন্ন করে এমন উন্নতি সদা করা উচিত।" (য়জুর্বেদ ভাষ্য ১/১৬)
সৎসঙ্গের বিষয়ে এই বাক্যটা সদা স্মরণে রাখা উচিত -
"ক্ষণমিহ সজ্জনসঙ্গতিরেকা, ভবতি ভবার্ণবতরণে নৌকা।" অর্থাৎ সৎসঙ্গ রূপী নৌকো অল্প-ক্ষণের মধ্যে সংসার সাগর থেকে পার করিয়ে দিতে সহায়ক হয়।
🍁 কুসঙ্গের আধুনিক স্রোত 🍁
সিনেমা, টিভি সিরিয়াল, রসকস, প্রহসন, মোবাইল, ইন্টারনেট, নাচ-গান আদি। আজকের যুগে দূষিত বিচারধারার সবথেকে অধিক প্রচারকারী হল সিনেমা (চলচিত্র)। আমাদের আচার-পরম্পরা, সভ্যতা আর সংস্কৃতির উপর কুঠারাঘাত করে কামবাসনা, বিলাসিতা তথা স্পষ্ট রূপে দুরাচারের দিগ্দর্শণ করে সম্পূর্ণ বাতাবরণকে বিষয়ের বিষে ভরে দিয়েছে। এই দুষ্ট পিশাচের চক্রে ফেঁসে লক্ষ-লক্ষ কোটি-কোটি বালক-বালিকা আর নবযুবক তথা নবযুবতী নিজের চরিত্রকে ভ্রষ্ট করেছে আর দিন প্রতিদিন করে যাচ্ছে। এই সিনেমার পরিণাম স্বরূপ সহস্র নর-নারী নিজের অমূল্য নিধি যৌবনকে বিষয়াগ্নির জ্বালানী বানিয়েছে, লক্ষ-লক্ষ পরিবার ধ্বংস হয়েছে, কিন্তু দুঃখের বিষয় যে আজও এই পতনের ভয়ংকর সাধন সিনেমাকে কলাবিদ্যার আবরণে ঢাকা হচ্ছে। বাস্তবে বলতে গেলে কলাবিদ্যার নাম করে দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হচ্ছে। অনেক শতাব্দী ধরে বিদেশী শাসকরাও আমাদের চরিত্রের যে হানি করতে পারেনি তাকে এই কলাবিদ্যা কিছু বছরের মধ্যেই করে ফেলেছে। যদি এই কলাবিদ্যার স্বাগত এইভাবে চলতে থাকে তাহলে আগামী প্রজন্মে নবযুবকদের আচারহীনতা পরাকাষ্ঠাতে পৌঁছে যাবে আর সভ্যতা এবং সংস্কৃতি মুখ লুকানোর স্থান খুঁজে পাবে না।
ভারতে প্রায় দুই কোটির অধিক ব্যক্তি প্রতিদিন সিনেমা দেখে। একদিকে এমন মানুষ আছে যারা পেট ভরে রুটি পর্যন্ত খেতে পায় না আর অন্যদিকে দেশের কোটি-কোটি অর্থ ব্যভিচারের প্রচারে ব্যয় করা হচ্ছে। আমাদের এত বড় ধনরাশি আমাদেরই বিনাশের জন্য লাগানো হয়েছে আর আমরা বসে-বসে সেই তামাশা দেখছি।
ব্রহ্মচর্যকে নষ্ট করার জন্য সিনেমা হচ্ছে সবথেকে বড় কুসঙ্গতি, অথবা বলতে পারেন সিনেমা হল ব্রহ্মচর্যের সবথেকে বড় শত্রু।* যারা সিনেমা দেখে তারা সাত জন্মেও বীর্যরক্ষা করতে পারবে না। কারণ এগুলো কামুকতা, শৃঙ্গার, অসভ্য-পরিহাস, চুম্বন, আলিঙ্গন, তর্জন, উত্তেজন, নগ্ন-নৃত্য আদিতে ভরা থাকে। বেশিরভাগ ফিল্ম নবযুবকদের এই পাঠই পড়ায় যে কিভাবে কোনো ভালো ঘরের মেয়েকে ভ্রষ্ট করা যায়।
.
যখন কোনো সিনেমা দেখে এমন ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করা হয় যে আপনি সিনেমা কেন দেখেন? তখন সে উত্তরে বলে যে - "সিনেমা হচ্ছে এই যুগের সর্বোত্তম কলা (art), যখন কাজ করতে-করতে মন একঘেয়েমি হয়ে যায় তো মনকে প্রসন্ন করার জন্য সিনেমা হল ভালো সাধন, অনেক ফিল্ম শিক্ষাপ্রদ হয় যারদ্বারা উত্তমোত্তম শিক্ষা পাওয়া যায়, তাই সিনেমা দেখলে হানির কি আছে? মানুষ অকারণে এর বিরোধ করে" ইত্যাদি অনর্গল প্রলাপ আরম্ভ করে দেয়।
.
উপরোক্ত সব হেতু আমার হিসেবে হেত্বাভাস। সর্বনাশের সাধনকে কলাবিদ্যা বলা বা মেনে নেওয়াই সবথেকে বড় ভুল হবে। যদি দুর্জনতোষ ন্যায় দ্বারা একে কলাবিদ্যাও মানা হয়, তাহলে কি সিনেমা ঘর কলাবিদ্যা শেখানোর বিদ্যালয়? সেখানে কি চিত্র দেখিয়ে সম্ভাষণ আর হাব-ভাবের মাধ্যমে কোনো কল্পিত বা ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা করা হয়? সেখানে না তো কলাবিদ্যার দৃষ্টিতে সিনেমার কর্মচারী সিনেমা দেখায় আর না দর্শক তেমনটা দেখে। বরং অশ্লীল গান শুনে শৃঙ্গার-রসে পরিপূর্ণ হাব-ভাবে মনের মধ্যে কামবাসনা অবশ্যই অঙ্কুরিত হয় আর সেটা ব্রহ্মচারীর পতনের কারণ।
মনোরঞ্জনের সাধন ভেবে সিনেমা দেখা, সেটাও অজ্ঞানতা হবে। একে মানসিক পতনের সাধন বলা যেতে পারে অবশ্য তবে মনোরঞ্জনের সাধন নয়। সিনেমা দেখলে মনের ক্লান্তি দূর হয় না বরং মন আরও নির্বল হয়ে যায়। শৃঙ্গার-রসে পরিপূর্ণ সিনেমার বাতাবরণে সদাচারের ভিত্তি কখনও জমে না। স্বামী আত্মানন্দ জী "মনোবিজ্ঞান তথা শিবসংকল্প" পুস্তকের মধ্যে লিখেছেন - "সরলতা হল সদাচারের জননী আর শৃঙ্গার হল ব্যভিচারের দূত।"
মনোবলের সাধন হল সদাচার, সদাচারের অভাবে সিনেমা দেখলে মনোরঞ্জন হয় না তবে মদের নেশার মতো প্রতীত হয়। পরবর্তীতে মানসিক শক্তির হ্রাস আর নির্বলতা জানতে পারা যায়।
এর অতিরিক্ত চলচ্চিত্র দেখার কারণে নেত্র-জ্যোতি নষ্ট হয়ে যায়, এরই পরিণাম-স্বরূপ ছোটছোট বাচ্চাদের চোখে চশমা পরতে দেখা যায়। সিনেমা দেখার সময় সহস্র ব্যক্তি বন্ধ ভবনের ভিতরে ঢুকে বসে পড়ে, যেখানে না আছে সূর্যের প্রকাশ আর না আছে শুদ্ধ বায়ুর সঞ্চার, এমন অবস্থায় স্বাস্থ্যও খারাপ হয়।
মানুষ রাত্রি বারোটা পর্যন্ত সিনেমা দেখে আর প্রাতঃকাল আটটা-নয়টা পর্যন্ত বিছানায় শুয়ে থাকে, এমন মানুষ স্বাস্থ্য আর ব্রহ্মচর্য পালন কিভাবে করবে! নিজের জীবন নির্বাহও পরাশ্রিত হয়ে করে।
ফিল্মকে শিক্ষাপ্রদও বলাও উচিত নয়, কারণ যতই ভালো ফিল্ম হোকনা কেন তারমধ্যে সাধারণ জনতার বাসনা-তৃপ্তির জন্য কিছু-না-কিছু সামগ্রী অবশ্যই পাওয়া যায়। যদি বা কোনো ফিল্মকে শিক্ষাপ্রদ মানা হয়, তাহলে সিনেমা দেখার স্বভাব অবশ্যই হয়ে যাবে আর সে পুনঃ সিনেমা দেখার জন্য বাধিত হবে। ফিল্ম সর্বদা শিক্ষাপ্রদ দেখানো হয় না, ফলে বাধ্য হয়ে অশ্লীল নোংরা ফিল্ম দেখতে হবে আর তার দুষ্পরিণাম হবে আচার ভ্রষ্টতা।
এইজন্য তন, মন, ধন আর আত্মা সবকিছুকে নষ্ট করে এমন ভয়ংকর কুসঙ্গ থেকে বিদ্যার্থী, ব্রহ্মচারী তথা নিজের অমূল্য মানব জীবনের সঙ্গে যারা প্রীতি রাখে এমন ব্যক্তিদের সর্বদা দূরে থাকা উচিত।
তৎসদৃশ সার্কাস, রাসলীলা, রামলীলা, প্রহসন, ড্রামা, নাটক, নাচ-গান, মোবাইল, টিভি আদি ব্রহ্মচর্যকে দূষিত করার কারণে এগুলো সর্বথা ত্যাজ্য। মহর্ষি দয়ানন্দ জীও সত্যার্থপ্রকাশের মধ্যে "রামলীলা"কে "রাণ্ডলীলা" লিখেছেন আর তার সঙ্গে নাচ-গানাদিকেও নিষেধ করেছেন। কারণ এগুলো ব্রহ্মচর্য পালন আর বিদ্যোপার্জনের বাধক। কুসঙ্গ হল ব্রহ্মচর্যপালন তথা বিদ্যাপ্রাপ্তির সবথেকে বড় বিঘ্ন। মহর্ষি দয়ানন্দ জী ব্রহ্মচারীর জন্য সত্যার্থপ্রকাশের মধ্যে লিখেছেন - "বিদ্যা পড়তে-পড়াতে যেগুলো বিঘ্ন হবে, যেমন কুসঙ্গ অর্থাৎ দুষ্ট বিষয়ী জনের সঙ্গ, দুষ্ট ব্যসন যেমন মদ্যাদি° সেবন আর বেশ্যাগমনাদি, বাল্যাবস্থাতেই বিবাহ অর্থাৎ পঁচিশ বর্ষের পূর্বে পুরুষ আর ষোলো বর্ষের পূর্বে স্ত্রীর বিবাহ হওয়া..." ইত্যাদি।
সত্যার্থ প্রকাশ দ্বিতীয় সমুল্লাসে মহর্ষি দয়ানন্দ জী লিখেছেন - "বীর্যের রক্ষা করলে আনন্দ আর নাশ করলে দুঃখের প্রাপ্তি হয় সেটাও জানিয়ে দেওয়া উচিত। যেমন দেখুন যার শরীরে বীর্য সুরক্ষিত থাকে তার তখন আরোগ্য, বুদ্ধি, বল, পরাক্রমের বৃদ্ধি হয়ে খুব সুখের প্রাপ্তি হয়। এর রক্ষণের নিয়ম হল এটাই যে বিষয়ের কথা, বিষয়ী ব্যক্তির সঙ্গ, বিষয়ের ধ্যান, স্ত্রীর দর্শন, একান্ত সেবন, সম্ভাষণ আর স্পর্শাদি কর্ম হতে ব্রহ্মচারীরা পৃথক থেকে উত্তম শিক্ষা পূর্ণবিদ্যাকে প্রাপ্ত করবে। যার শরীরে বীর্য নেই সে নপুংসক মহাকুলক্ষিণী আর যার প্রমেহ রোগ আছে সে দুর্বল, নিস্তেজ, নির্বুদ্ধি, উৎসাহ-সাহস-ধৈর্য্য-বল-পরাক্রমাদি গুণ হতে রহিত হয়ে নষ্ট হয়ে যায়। যদি তুমি সুশিক্ষা, বিদ্যা গ্রহণ আর বীর্যরক্ষা করতে এই সময়টা হারিয়ে ফেলো তাহলে এই জন্মে তুমি আর এই অমূল্য সময় পুনরায় ফিরে পাবে না।"
এইভাবে পঠন-পাঠন বিধির মধ্যে মহর্ষি দয়ানন্দ জী লিখেছেন - "মুখ্যরূপে সামবেদের গান বাদিত্র বাদন পূর্বক শিখবে আর নারদ সংহিতা আদি যা যা আর্ষগ্রন্থ আছে সেগুলো পড়বে, কিন্তু লম্পট, বেশ্যা, বৈরাগীদিগের বিষয়াসক্তি উৎপন্নকারী গর্দভ শব্দবৎ ব্যর্থ সংগীতালাপ কখনও করবে না।" (সত্যার্থপ্রকাশ সমুল্লাস ৩)
পাঠকবৃন্দ! মহর্ষি দয়ানন্দ জী জীবনকে উত্তম বানানোর জন্য তথা ব্রহ্মচর্যপালন, বিদ্যোপার্জনাদির বিষয়ের কত স্পষ্ট লিখেছেন। সব মাদক দ্রব্য বা নেশা, সব বিষয় এবং সব প্রকারের কুসঙ্গ হতে পৃথক থেকে সর্বদা পবিত্র তপস্বী জীবন বানিয়েই ব্রহ্মচর্য পালন আর বিদ্যাধ্যয়ন করা সম্ভব আর কুসঙ্গে ফেঁসে নেশা তথা বিষয়ের সেবন করলে জীবন সর্বথা নষ্ট হয়ে যায়, এটা মহর্ষির এই উপদেশ থেকে পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে গেছে। সুতরাং এগুলো সর্বদার জন্য ত্যাগ করে দেওয়া উচিত।
____________________________________________
* বর্তমানে সিনেমার স্থানে আপনি "মোবাইল" বসিয়ে দিতে পারেন কারণ এই স্থানটা এখন মোবাইল নিয়েছে।
° এখানে "আদি" শব্দ দ্বারা তামাক, আফিম, গাঁজা, চরস, তাড়ি, বিড়ি, সিগারেট, নস্যি, জর্দা, খৈনি, গুটখা, সুলফাদি সব মাদক দ্রব্যের নিষেধ ধরা হয়েছে।
(সপ্তম ভাগ সমাপ্ত)

অষ্টম ভাগ

🍁 স্বাধ্যায় 🍁
স্বাধ্যায়ের আবশ্যকতা -
"বেদ হল সব সত্য বিদ্যার পুস্তক। বেদ পড়া-পড়ানো এবং শোনা-শোনানো সকল আর্যের পরম ধর্ম।" - মহর্ষি দয়ানন্দ
আমরা হলাম আর্য আর বেদ পড়া এবং পড়ানো আমাদের পরম ধর্ম, এই পরম ধর্মের পালন করার জন্য আমাদের প্রতিদিন বেদের স্বাধ্যায় করা উচিত। যদি আমরা প্রতিদিন স্বাধ্যায় না করি তাহলে আমরা নিজের ধর্ম থেকে সরে যাবো, পশু হয়ে যাবো, শুধু তাই নয় সর্বথা নষ্ট হয়ে যাবো। কারণ এটা নিয়ম যে যখন কেউ ধর্মকে ছেড়ে দেয় তখন সেও নষ্ট হয়ে যায়। উদাহরণার্থ অগ্নিকে ধরে নিন, উষ্ণতা হল অগ্নির ধর্ম, যতক্ষণ তারমধ্যে উষ্ণতা আছে ততক্ষণ পর্যন্ত সেটা অগ্নি, কিন্তু উষ্ণতা ধর্ম নষ্ট হয়ে গেলে তাকে কেউ অগ্নি বলে না, সেটা ছাই রূপে পরিণত হয়। ঠিক সেইরূপ অবস্থা হল আমাদের, যতক্ষণ আমরা আমাদের ধর্ম পালন করবো, প্রতিদিন বেদের স্বাধ্যায় করবো, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা জীবিত থাকবো, উন্নতির পথে (মোক্ষের পথে) অগ্রসর হবো। আমাদের ভিতরে আর্যত্ব (শ্রেষ্ঠত্ব) স্থিত আছে, অন্যথা আমাদের আত্মা পতিত হলে, আর্যত্বও নষ্ট হয়ে যাবে। ভগবান্ মনু জী লিখেছেন - "বেদসম্ন্যাসতঃ শূদ্রস্তস্মাদ্বেদম্ ন সম্ন্যসেৎ" অর্থাৎ বেদ ত্যাগ অর্থাৎ বেদের স্বাধ্যায় না করলে মানুষ শূদ্র হয়ে যায়। এইজন্য বেদের স্বাধ্যায় ত্যাগ করা উচিত নয়।
অনভ্যাসেন বেদানামাচারস্য চ বর্চনাৎ।
আলস্যাদন্নদোষাচ্চ মৃত্যুর্বিপ্রান্ জিঘাম্সতি।।
বেদের স্বাধ্যায় না করলে, আচারহীন হলে তথা আলস্য-প্রমাদাদি ঘিরে ধরলে মৃত্যু এসে উপস্থিত হয়। এর বিপরীত বেদাদি শাস্ত্রের স্বাধ্যায় করলে, সদাচারী আর আলস্য-প্রমাদাদি ছেড়ে দিলে মৃত্যুকেও মারা যেতে পারে অর্থাৎ মানুষ তার ভয় থেকে মুক্ত হতে পারে। বেদের মধ্যে লেখা আছে - "ব্রহ্মচর্য়েণ তপসা দেবা মৃত্যুমপাঘ্নত" (অথর্বঃ ১১/৫/১৯) ব্রহ্মচর্য অর্থাৎ বেদাধ্যয়ন, ঈশ্বরচিন্তন আর বীর্যরক্ষা রূপী তপের দ্বারা বিদ্বানগণ মৃত্যুকেও মেরে ফেলতেন আর এই স্বাধ্যায়-যজ্ঞটাও এমন যে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আজীবন করা উচিত। মানব জীবনের চার আশ্রমের মধ্যে কোনো আশ্রমে একটা, কোনোটাতে দুটো আর কোনোটাতে পাঁচটা যজ্ঞের বিধান আমাদের শাস্ত্রকারগণ করেছেন কিন্তু স্বাধ্যায়-যজ্ঞ সব আশ্রমের মধ্যে অনিবার্য।
.
ব্রহ্মচর্য প্রধানত বেদাদি অধ্যয়নের জন্যই হয়, সবকটা না হলেও অন্তত একটা বেদ তো অবশ্যই পড়া উচিত, তবেই গৃহস্থাশ্রমে প্রবেশ করার বিধান আছে -
বেদানধীত্য বেদৌ বা বেদম্ বাপি য়থাক্রমম্।
অবিপ্লুতব্রহ্মচর্য়ো গৃহাশ্রমমাবিশেৎ।। (মনুঃ ৩/২)
চার বেদ অথবা দুটো বেদ অন্যথা অন্তত একটা বেদের যথাযথ অর্থাৎ শিক্ষা-কল্প-ব্যাকরণ-নিরুক্ত-ছন্দ জ্যোতিষাদি বেদাঙ্গের অধ্যয়ন পূর্বক পড়ে, "গুরুণানুমতঃ" অর্থাৎ গুরু বা আচার্যের আজ্ঞা নিয়ে ব্রহ্মচারীকে গৃহস্থ আশ্রমে প্রবেশ করা উচিত।
.
গৃহস্থে গিয়েও স্বাধ্যায়যজ্ঞ প্রতিদিন করা আবশ্যক। সমাবর্তনের সময় আচার্য অন্তেবাসীকে সাবধান করে দেন যে - "স্বাধ্যায়ান্মা প্রমদঃ স্বাধ্যায়প্রবচনাভ্যাম্ ন প্রমদিতব্যম্" (তৈত্তিরীয়ারণ্যক শিক্ষাবল্লী ৭/১১) অর্থাৎ হে শিষ্য! তুমি স্বাধ্যায়ে কখনও প্রমাদ করো না, স্বাধ্যায় আর প্রবচন প্রতিদিন করতে থাকবে।
এইভাবে তৃতীয় বানপ্রস্থাশ্রমেও তপ আর স্বাধ্যায়াদির জন্য বিধান আছে। মহর্ষি মনু বলেছেন -
স্বাধ্যায়ে নিত্যয়ুক্তঃ স্যাদ্দান্তো মৈত্রঃ সমাহিতঃ।
দাতা নিত্যমনাদাতা সর্বভূতানুকম্পকঃ।। (মনুঃ ৬/৭)
অর্থাৎ বানপ্রস্থীর উচিত যে সে জিতেন্দ্রিয় হয়ে সর্বদা স্বাধ্যায়ে রত থাকবে, সাংসারিক বিষয় হতে ইন্দ্রিয়ের দমন করে, সবার উপর কৃপা দৃষ্টি রেখে বিদ্যাদির দান করতে থাকবে কিন্তু প্রত্যুপকারে কারও কাছ থেকে কোনোকিছু নিবে না, এইরূপ ব্যবহার করবে।
.
চতুর্থাশ্রম সন্ন্যাসে সকল সাংসারিক সাধনের নিষেধ করে স্বাধ্যায়ের আবশ্যকতা বলা হয়েছে - "সন্ন্যসেত্সর্বকর্মাণি বেদমেকম্ ন সন্ন্যসেত্।" অর্থাৎ সন্ন্যাসী সব সাংসারিক কর্ম থেকে বিরত থাকবে কিন্তু বেদের স্বাধ্যায়কে কখনও ছেড়ে দিবে না, এটা সন্ন্যাসীদের জন্যও অনিবার্য।
এইভাবে ব্রহ্মচর্য, গৃহস্থ, বানপ্রস্থ আর সন্ন্যাস সব আশ্রমের মধ্যে স্বাধ্যায়-যজ্ঞকে শাস্ত্রকারগণ অত্যন্ত আবশ্যক বলেছেন। অন্য সাংসারিক কর্মের মধ্যে অবকাশ (ছুটির) বিধান আছে তবে স্বাধ্যায়ের আবশ্যকতা ততটাই যতটা শ্বাস প্রশ্বাসের। শ্বাস-প্রশ্বাস যেমন সারাজীবন নিরন্তর চলতেই থাকে, ঠিক সেইরূপ স্বাধ্যায়-যজ্ঞটাও নিত্যপ্রতি অখণ্ডিত রূপে চালিয়ে রাখা উচিত।
বেদোপকরণে চৈব স্বাধ্যায়ে চৈব নৈত্যিকে।
নানুরোধোऽস্ত্যনধ্যায়ে হোমমন্ত্রেষু চৈব হি।। (মনুঃ ২/৯৩)
নৈত্যিকে নাস্ত্যনধ্যায়ো ব্রহ্মসত্রম্ হি তৎ স্মৃতম্।
বেদাদি পড়তে স্বাধ্যায়াদি নিত্যকর্ম করতে কখনও অনধ্যায় হয় না, সর্বদা অধ্যায়ই হয়, কারণ স্বাধ্যায়াদি কর্মকেই ব্রহ্মযজ্ঞ বলে, সব আশ্রম আর সব বর্ণের মধ্যে সর্বদা এই ব্রহ্মযজ্ঞের অনুষ্ঠান প্রতিদিন করা উচিত।
.
যদি কোনো কর্ম (চাকরি আদি) বিশেষের কারণে স্বাধ্যায়ে বাধা পড়ে তাহলে সেই কর্মকে পর্যন্ত ত্যাগ করার বিধান আছে, কিন্তু স্বাধ্যায় এতই আবশ্যক যে তাকে কখনও ছাড়া উচিত নয়।
"সর্বান্ সন্ত্যজেদর্থান্ স্বাধ্যায়স্য বিরোধিনঃ" অর্থাৎ এইজন্য নিজের জীবন যাত্রাকে চালানোর জন্য অন্য কর্ম করার সাথে-সাথে স্বাধ্যায়ও নিত্যপ্রতি অবশ্যই করা উচিৎ। এর সর্বোত্তম বিধি হল নিজের সব কাজের জন্য সময় বিভক্ত করা অর্থাৎ নিজের দিনচর্যা স্বয়ং সুবিধানুসারে বানিয়ে তদনুসারে চলা, সেখানে স্বাধ্যায়ের জন্যও কোনো নিশ্চিত সময় নির্ধারিত করা উচিত।
.
স্বাধ্যায়ের জন্য উত্তম সময় হল প্রাতঃকাল, মহর্ষি মনু জীও এই নির্দেশ করেছেন -
ব্রাহ্মে মুহূর্তে বুধ্যেত ধর্মার্থো চানুচিন্তয়েৎ।
কায়ক্লেশাম্শ্চ তন্মূলান্ বেদতত্ত্বার্থমেব চ।। (মনুঃ ৪/৬৮)
প্রাতঃকাল ব্রাহ্ম মুহূর্তে উঠে ধর্ম, অর্থ, শারীরিক ক্লেশ তথা তার কারণ আর বেদের তত্ত্বের চিন্তন করা উচিত। এইজন্য প্রত্যেক নর-নারীকে বিশেষরূপে ব্রহ্মচারীকে প্রাতঃকাল ব্রাহ্ম-মুহূর্তে উঠে নিত্যকর্ম হতে নিবৃত্ত হয়ে শান্তচিত্তে বেদাদি সত্য শাস্ত্রের স্বাধ্যায় অবশ্যই করা উচিত।
আজকাল মানুষের মধ্যে স্বাধ্যায়ের প্রতি অরুচি হয়ে গেছে। আধুনিক ঢঙের ব্যক্তি স্বাধ্যায়ের কোনো আবশ্যকতাই বোঝে না, তাই দিন-প্রতিদিন স্বাধ্যায়ের যেন অভাব হয়ে যাচ্ছে আর মানব সমাজ থেকে মানবতা মুখ লুকিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে তথা দানবের সাম্রাজ্য বেড়ে চলেছে। এই বেড়ে চলা দানবতাকে অর্থাৎ দুরাচার বা ব্যভিচারকে থামাতে স্বাধ্যায় করা পরমাবশ্যক। স্বাধ্যায়ের অভাবে আমাদের এই ভয়ংকর পতন হয়েছে সুতরাং পুনরুত্থান স্বাধ্যায়ের দ্বারাই হবে। এইজন্য সবাইকে স্বাধ্যায় করার ব্রত নেওয়া উচিত আর নিয়মিত রূপে তার পালন করা উচিত। শরীরের জন্য যেমন ভোজন আবশ্যক তেমনই আত্মার জন্য স্বাধ্যায় অত্যন্ত আবশ্যক।
.
স্বাধ্যায় করার বিষয়ে বেশিরভাগ ব্যক্তি এটাই অজুহাত করে যে স্বাধ্যায়ের জন্য আমার সময় নেই। কিন্তু এটা একদম মিথ্যে কথা, মানুষের অধিকারে সময় আছে, দিনরাত ২৪ ঘন্টার মধ্যে অন্তত এক ঘন্টা স্বাধ্যায়ার্থ অতি সহজ ভাবে বের করা যেতে পারে। সেই এক ঘন্টা সময়ের মধ্যে যদি প্রতিদিন ২০ পৃষ্ঠাও কোনো পুস্তকের স্বাধ্যায় করা যায় তাহলে বছরের ৩৬৫ দিনে ৭৩০০ পৃষ্ঠা পড়া যেতে পারে, জীবনের এত লম্বা সময়ের মধ্যে ভাবুন কত সহস্র গ্রন্থের স্বাধ্যায় করা যেতে পারে।
কিন্তু আমরা আমাদের জীবনের অমূল্য সময়কে শরীরের সাজসজ্জা, খেলাধুলা আর আড্ডাবাজীতে ব্যর্থ হারিয়ে ফেলি অথবা আলস্য আর প্রমাদে পড়ে থেকে জীবনকে বৃথা হারিয়ে ফেলি। কিন্তু এটা সদা স্মরণে রাখবেন - যে ব্যক্তি নিজের সময়কে ব্যর্থ নষ্ট করে, সে তার জীবনকেও নষ্ট করে, জীবন ক্ষণে-ক্ষণে পরিণত হয় আর নষ্ট হয়। বুদ্ধিমান তারাই যারা নিজের সময়ের সদুপয়োগ করে।

স্বাধ্যায়ের অর্থ 🍁

সু য়া স্ব উপপদ হওয়াতে আঙ্ অধিপূর্বক অধ্যয়নার্থক "ইঙ্" ধাতু দ্বারা "ইঙ্শ্চ" ৩/৩/২১ এই পাণিনীয় সূত্র দিয়ে ঘঞ্ প্রত্যয় করলে "স্বাধ্যায়" শব্দ সিদ্ধ হয়। "সুষ্ঠু আবৃত্য অধ্যয়নম্ স্বাধ্যায়ঃ", "স্বমধ্যয়নম্ স্বাধ্যায়ঃ" অর্থাৎ বারংবার আবৃত্তি পূর্বক অধ্যয়ন করা বা নিজের জন্য স্বয়ং অধ্যয়ন করা। স্ব শব্দের আত্মা, আত্মীয় আদি অনেক অর্থ হওয়ার কারণে স্বাধ্যায় শব্দেরও বিবিধ অর্থ হয়।

য়োগদর্শনের ব্যাসভাষ্যতে স্বাধ্যায় শব্দের অর্থ মহর্ষি ব্যাস জী এইরকম করেছেন - "স্বাধ্যায়ঃ প্রণবাদিপবিত্রাণাম্ জপো মোক্ষশাস্ত্রাধ্যায়নম্ বা" (২/১ তথা ২/৩২ সূত্রভাষ্যে) প্রণব অর্থাৎ ওম্ গায়ত্রাদির জপ করা বা মোক্ষশাস্ত্র যথা আধ্যাত্মিক গ্রন্থ বেদ, দর্শন, উপনিষদাদি পড়াকে স্বাধ্যায় বলে।

সকল কোষকারগণ স্বাধ্যায় শব্দকে বেদাধ্যয়ন শব্দের সমার্থক বা সমানার্থক মেনেছেন -

স্বাধ্যায়ঃ। বেদে। স্বাভিমতপ্রণবাদিমন্ত্রজপে। ব্রহ্ম য়জ্ঞে বেদাধ্যয়নে। ফলবদর্থাববোধপর্য়ন্তাধ্যয়নে। উপনিষদ্গ্রন্থাবৃত্তৌ। মোক্ষশাস্ত্রাণামধ্যয়নে। সু অতীব আবৃত্য অধ্যয়নম্। স্বার্থমধ্যয়নম্ বা। (শব্দার্থচিন্তামণিঃ)
.
স্বাধ্যায়ঃ। সুষ্ঠু আবৃত্য অধ্যায়ো বেদাধ্যয়নমিতি। (শব্দকল্পদ্রুমবৃহদভিধানম্)

স্বাধ্যায়ঃ স্যাজ্জপঃ। দ্বে বেদাধ্যয়নস্যেতি তট্টীকা। (অমরকোষঃ)

স্বাধ্যায়ো জপ ইত্যুক্তো বেদাধ্যয়নকর্মণি। (শব্দরত্নাবলী)
.
দ্বে আবৃত্য বেদাধ্যয়নে। সু সুকৃতায় আবৃত্য অধ্যায়োऽধিতিঃ স্বাধ্যায়ঃ। (ভরতঃ)

"সম্যক্ রূপে শাস্ত্রমাত্রের অধ্যয়নকেই স্বাধ্যায় বলে।" (হিন্দি বিশ্বকোষ)

এইভাবে সকল কোষকারগণ স্বাধ্যায় শব্দের অর্থ বেদ, দর্শন, উপনিষদাদি শাস্ত্রের অধ্যয়ন করা, আত্মকল্যাণার্থ অধ্যয়ন করা, আত্মচিন্তন, ঈশ্বরভক্তি, প্রণবাদি জপ করা ইত্যাদি অর্থ করেছেন। সেইরূপ "স্বাধ্যায়ী আর স্বাধ্যায়বান্" শব্দও বিশিষ্ট বেদাধ্যায়ীর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যথা -

স তূর্ধ্বরেতাস্তপসি প্রসক্তঃ, স্বাধ্যায়বান্ বীতভয়ঃ কৃতাত্মা। চচার সর্বাম্ পৃথিবী মহাত্মা, ন চাপি দারান্ মনসা প্য কাঙ্ক্ষত।। (মহাভারত ১/৪০/১০)
.
মহাত্মা জরক্তারু জী স্বাধ্যায়, ব্রহ্মচর্যপালন আদি তপে লেগে পড়েন, ভয় শোকাদি হতে রহিত, ঊর্ধ্বরেতা আর জিতেন্দ্রিয় হয়ে সম্পূর্ণ ভূমণ্ডলে ভ্রমণ করেন, তিনি মনের মধ্যে কখনও স্ত্রী আদির ইচ্ছা করেন নি।
.
এইভাবে অশ্লীল, অনার্ষ, নোংরা, উত্তেজক নাটক-উপন্যাস, কাহিনী, সিনেমা, রাগিণী, রামলীলা, রাসলীলা আদি সম্বন্ধিত কোনো পুস্তক পড়াকে স্বাধ্যায় বলা যায় না, যারা এমনটা মনে তারা ভূল করছে। স্বাধ্যায় হল আত্মোন্নতির সর্বোত্তম সাধন, কিন্তু এইসব নাটকাদির অধ্যয়ন দ্বারা উন্নতির স্থানে অবনতিই হবে।
.
কিছু সজ্জন ব্যক্তি সংবাদপত্র পড়েই সন্তুষ্ট হয়ে যান, তাদের দৃষ্টিতে এটাই স্বাধ্যায় কিন্তু সংবাদপত্রকে স্বাধ্যায় ভাবাটা অজ্ঞান হবে। স্বাধ্যায় শব্দের অর্থ আমি সপ্রমাণ উপরে লিখে দিয়েছি আর পরবর্তীতে স্বাধ্যায় করার যোগ্য গ্রন্থের নামোল্লেখও করা হবে, সেই গ্রন্থগুলোর অধ্যয়ন করাকেই স্বাধ্যায় বলে। নাটক, উপন্যাস, গল্প-কাহিনী আর সংবাদপত্র আদি পড়া মোটেও স্বাধ্যায় নয়।

🍁 স্বাধ্যায়ের মহিমা 🍁

আমাদের শাস্ত্রের মধ্যে স্বাধ্যায়ের মহিমা অনেক করেছে। বেদ, স্মৃতি, উপনিষদ, দর্শন আর ব্রাহ্মণগ্রন্থের মধ্যে স্বাধ্যায়ের গুরুত্বের উপর খুব প্রকাশ ফেলা হয়েছে। স্বাধ্যায়ের গুরুত্বকে লক্ষ্যে রেখেই আমাদের পূর্বজ ঋষি-মহর্ষিগণ আমাদের দিনচর্যাতে স্বাধ্যায়কে সবথেকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। যেমন দেখুন, পঞ্চমহাযজ্ঞের মধ্যে স্বাধ্যায় হচ্ছে একটা যজ্ঞ°, য়োগের আট অঙ্গের মধ্যে স্বাধ্যায় হচ্ছে উপাঙ্গ^, মনু মহারাজ* স্বাধ্যায়কে সর্বোত্তম তপ বলেছেন আর ধর্মের সপ্তম লক্ষণ "ধী" অর্থাৎ বিমল বুদ্ধি প্রাপ্তিরও সাধন হল স্বাধ্যায়। য়োগদর্শনের ভাষ্যকার মহর্ষি ব্যাস জী লিখেছেন -

স্বাধ্যায়াদ্ য়োগমাসীত য়োগাৎস্বাধ্যায়মামনেৎ।
স্বাধ্যায়য়াগসম্পত্ত্যা পরমাত্মা প্রকাশতে।।

স্বাধ্যায়ের মাধ্যমে য়োগের দিকে প্রবৃত্ত হয়ে য়োগ দ্বারা স্বাধ্যায়ের চিন্তন করা উচিত, স্বাধ্যায় তথা য়োগাভ্যাসের দ্বারা ঈশ্বরের প্রাপ্তি হয়।

ছান্দোগ্যোপনিষদের অন্তিমেও লেখা আছে -
"আচার্য়কুলাদ্বেদমধীত্য য়থাবিধানম্ গুরোঃ কর্মাতিশেষেণাভিসমাবৃত্য কুটুম্বে শুচৌ দেশে স্বাধ্যায়মধীয়ানো ধার্মিকান্ বিদধদাত্মনি সর্বেন্দ্রিয়াণি সম্প্রতিষ্ঠাপ্যাহিম্সন্ সর্বভূতান্যন্যত্র তীর্থেভ্যঃ স খল্বেবম্ বর্তয়ন্ য়াবদায়ুষম্ ব্রহ্মলোকভিসম্পদ্যতে। ন চ পুনরাবর্ততে। (৮/১৫/১)

ব্রহ্মচারী আচার্য-কুল থেকে বিধিপূর্বক বেদ পড়ে গুরুর সেবা শুশ্রুষা আদি সম্পূর্ণভাবে করে সমাবর্তন করে কুটুম্ব-গৃহাশ্রমে থেকে, পবিত্র স্থানে বেদাদি শাস্ত্রের স্বাধ্যায় করে, নিজের পরিবার তথা সমাজের জনগণকে ধার্মিক বানিয়ে, আত্মার মধ্যে সব ইন্দ্রিয়কে স্থাপিত করে, তীর্থ স্থান হতে অন্যত্রও প্রাণীর হিংসা না করে, মরণ পর্যন্ত এইভাবে ব্যবহার করে মোক্ষকে প্রাপ্ত করে তথা আবাগমনের চক্র (জন্ম-মৃত্যু) থেকে মুক্ত হয়ে যায়।
.
শতপথ (১১/৫/৬/১-২) ব্রাহ্মণের মধ্যে স্বাধ্যায়ের মহিমা এইভাবে করা হয়েছে - স্বাধ্যায় আর প্রবচন হল অত্যন্ত প্রিয় বিষয়, শান্তচিত্তে স্বাধ্যায় করা ব্যক্তি স্বতন্ত্রভাবে নিজের কর্ম সিদ্ধ করতে পারে, আনন্দে থাকে, নিজের হিতাহিতের ধ্যান রাখে, সংযমী, বুদ্ধিমান আর যশস্বী হয়, বুদ্ধি নির্মলতার কারণে স্বাধ্যায়শীল ব্যক্তি ধর্ম-অর্থ-কাম আর মোক্ষ প্রাপ্ত করে, সত্য ব্রাহ্মণত্ব প্রাপ্ত করে, যথাযথ আচার-ব্যবহারবান্ আর সমাজের মধ্যে বিশ্বাসের পাত্র হয়, সবার থেকে যথেষ্ট সম্মান, ধনাদি প্রাপ্ত করে। সংসারের মধ্যে যত কর্ম আছে, স্বাধ্যায় হল সেগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ, কঠিন কর্ম, এমনটা জেনে যারা স্বাধ্যায় করে তারা তত্ত্বকে জেনে যায়। এইজন্য স্বাধ্যায় করা উচিত।
.
ঋগ্বেদের (১০/৭১/৬) জ্ঞান সূক্তের মধ্যে স্বাধ্যায়ের মহিমা এইভাবে বলা হয়েছে -

য়স্তিত্যাজ সচিবিদম্ সখায়ম্ ন তস্য বাচ্যপি ভাগো অস্তি। য়দীম্ শৃণোত্যলকম্ শৃণোতি ন হি প্রবেদ সুকৃতস্য পন্থাম্।।

(য়) যে ব্যক্তি (সচিবিদম্) পরমেশ্বরকে প্রাপ্ত করায় বা তাঁর জ্ঞান করায় এমন (সখায়ম্) বেদের স্বাধ্যায় রূপী মিত্রকে (তিত্যাজ) ছেড়ে দেয়, (তস্য) সেই ব্যক্তির (বাচি অপি) বাণীর মধ্যেও (ন ভাগো অস্তি) কোনো সেবনীয় তত্ত্ব নেই। (য়ৎ ইম্ শৃণোতি) সে যা কিছু শোনে (অলকম্ শৃণোতি) সব মিথ্যাই শোনে আর (ন হি প্রবেদ সুকৃতস্য পন্থাম্) সে সুকৃতের, পূণ্যের, মোক্ষের মার্গকে জানতে পারে না। এইজন্য পরমসুখ মোক্ষ প্রাপ্তির জন্য বেদের স্বাধ্যায় অবশ্যই করা উচিত।

🍁 স্বাধ্যায়ের ফল 🍁

য়ঃ স্বাধ্যায়মধীতেऽব্দম্ বিধিনা নিয়তঃ শুচিঃ।
তস্য নিত্যম্ ক্ষরত্যেষ পয়ো দধি ঘৃতম্ মধু।।

যে ব্যক্তি বিধিপূর্বক এক বর্ষ পর্যন্ত শুদ্ধ একাগ্রচিত্ত হয়ে স্বাধ্যায় করে সে ঋগ্বেদ, য়জুর্বেদ সামবেদাদির জ্ঞান অর্থাৎ জ্ঞান কর্ম উপাসনাদির ফল প্রাপ্ত করে। শতপথ ব্রাহ্মণের মধ্যে মধু তথা পয়ের অর্থ ঋচা আর ঘৃতের অর্থ সাম করা আছে™।

ঋগ্বেদ আর সামবেদের মধ্যে স্বাধ্যায়ের ফল বর্ণনা করে এমন ছয়টা মন্ত্র আছে, তাতে স্বাধ্যায়ের বিভিন্ন লাভের বিস্তৃত বর্ণনা আছে, তারমধ্যে কেবল তিনটা মন্ত্র এখানে উদ্ধৃত করছি -

য়ঃ পাবমানীরধ্যেত্যৃষিভিঃ সম্ভৃতম্ রসম্।
সর্বম্ স পূতমশ্নাতি স্বদিতম্ মারিশ্বনা।। (ঋগ্বেদ ৯/৬৭/৩১)
পাবমানী অর্থাৎ সবকিছুকে পবিত্রকারী ঈশ্বর প্রদত্ত এবং ঋষি দ্বারা সঞ্চিত ঋচার যে অধ্যয়ন করে, সে পবিত্র আনন্দ রসের আস্বাদন করে।

পাবমানীর্দধন্তু ন ইমম্ লোকমথো অমুম্।
কামান্ত্সমর্ধয়ন্তু নো দেবীর্দেবৈঃ সমাহৃতাঃ।। (সামবেদ উত্তরার্চিক ১৩০১)
পাবমানী ঋচা এইলোক আর পরলোক উভয়কে ধারণ করতে আমাদের সহায়ক হোক, দেব অর্থাৎ উত্তম বিদ্বান বা শ্রেষ্ঠ ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রাপ্ত করা এই ঋচা আমাদের শুভকামনাকে পূর্ণ করুক।

পাবমানীঃ স্বস্ত্যয়নীস্তাভির্গুচ্ছন্তি নান্দনম্।
পুণ্যাঁশ্চ ভক্ষান্ ভক্ষয়ত্যমৃতত্বম্ চ গচ্ছতি।। (সামবেদ উত্তরার্চিক ১৩০৩)
এই পাবমানী ঋচাগুলো কল্যাণকারী, এরদ্বারা মানুষ আনন্দ প্রাপ্ত করে, এই ঋচার অর্থাৎ বেদের স্বাধ্যায়কারী এইলোকে উত্তম ভোগের উপভোগ করে মোক্ষের অধিকারী হয়।

মহর্ষি পতঞ্জলি স্বাধ্যায়ের ফল সম্বন্ধে লিখেছেন -
"স্বাধ্যায়াদিষ্টদেবতাসম্প্রয়োগঃ" (য়োগদর্শন ২/৪৪)
বেদাদি মোক্ষ শাস্ত্রের পঠন-পাঠন, প্রণব তথা গায়ত্রী আদি মন্ত্রের অর্থ সহিত জপ দ্বারা ঈশ্বর, বৈদিক বিদ্বান, য়োগী আদি মহাপুরুষের সঙ্গে সম্বন্ধ হয় তথা তারদ্বারা বিভিন্ন উত্তম কর্মে সহায়তা প্রাপ্ত হয়।
.
স্বাধ্যায়ের মাধ্যমে মানুষ ইষ্টদেবতা তথা উত্তম শুভ গুণ প্রাপ্ত করতে পারে, এখন কোনো মহাপুরুষ এই সংসারে নেই কিন্তু তাদের গ্রন্থের স্বাধ্যায় করে আমরা সেখান থেকে তাদের বিচারের সঙ্গে সঙ্গতি করে যথেষ্ট লাভ নিতে পারি। অতএব এই সূত্রের ভাষ্য করে মহর্ষি ব্যাস জী লিখেছেন - "দেবা ঋষয়ঃ সিদ্ধাশ্চ স্বাধ্যায়শীলস্য দর্শনম্ গুচ্ছন্তি কার্য়ে চাস্য বর্তন্ত ইতি।" অর্থাৎ বিদ্বান, বেদমন্ত্রার্থের দ্রষ্টা, য়োগসিদ্ধ স্বাধ্যায়শীলকে প্রাপ্ত করে তার কর্মকে সিদ্ধ করতে পারে অর্থাৎ তাদের গ্রন্থের স্বাধ্যায় করে স্বাধ্যায়বান্ ব্যক্তি নিজের কর্মকে সিদ্ধ করে নেয়।
.
মহর্ষি য়াজ্ঞবল্ক্য জী লিখেছেন -

"য়দ্য়দ্ধ বায়ম্ ছন্দস্যঃ স্বাধ্যায়মধীয়তে তেন তেন হৈবাস্য য়জ্ঞক্রতুনেষ্টম্ভবতি, য় এবম্ বিদ্বান্স্বাধ্যায়মধীতে, তস্মাৎস্বাধ্যায়োऽধ্যেতব্যঃ" (শতপথঃ ১১/৫/৭/১)

"স্বাধ্যায়শীল ব্যক্তি যে-যে বেদের স্বাধ্যায় করে সে সেই-সেই বেদের সেই ফল প্রাপ্ত করে যা সেই বেদ দ্বারা যজ্ঞ করলে হয়, সুতরাং স্বাধ্যায় অবশ্যই করা উচিত।"
.
জন্ম থেকে কেউ ব্রাহ্মণাদি হয় না কিন্তু সব নিজের-নিজের গুণ কর্মানুসারেই হয়। শূদ্রকুলে উৎপন্ন ব্যক্তি ব্রাহ্মণ হয়ে যায় আর ব্রাহ্মণকুলোৎপন্ন ব্যক্তি শূদ্র হয়ে যায়।© মনু মহারাজ বলেছেন -

স্বাধ্যায়েন ব্রতৈর্হোমৈস্ত্রৈবিদ্যেনেজ্যয়া সুতৈঃ।
মহায়জ্ঞৈশ্চ য়জ্ঞৈশ্চ ব্রাহ্মীয়ম্ ক্রিয়তে তনুঃ।। (মনুঃ ২/২৮)

এই শ্লোকের অর্থ মহর্ষি দয়ানন্দ জী সত্যার্থপ্রকাশের মধ্যে এইভাবে লিখেছেন - (স্বাধ্যায়) সকল বিদ্যার পঠন-পাঠন; (ব্রত) ব্রহ্মচর্য এবং সত্যভাষণাদি নিয়ম পালন; (হোম) অগ্নিহোত্রাদি হোম, সত্যগ্রহণ, অসত্য বর্জন এবং সত্যবিদ্যা দান; (ত্রৈবিদ্যেন) বেদস্থ কর্ম, উপাসনা, জ্ঞান, বিদ্যাগ্রহণ; (ইজ্যায়া) পক্ষেষ্টি যজ্ঞ প্রভৃতি কর্ম; (সুতৈঃ) সুসন্তানোৎপত্তি; (মহায়জ্ঞৈ) ব্রহ্ম, দেব, পিতৃ, বৈশ্বদেব এবং অতিথিদের সেবারূপ পঞ্চমহাযজ্ঞ আর (য়জ্ঞৈঃ) অগ্নিষ্টোমাদি, শিল্পবিদ্যা ও বিজ্ঞানাদি যজ্ঞানুষ্ঠান দ্বারা এই শরীরকে ব্রাহ্মী অর্থাৎ বেদ ও পরমেশ্বরের ভক্তির আধার স্বরূপ ব্রাহ্মণ-শরীর করা যায়। এইসব সাধন ব্যতীত ব্রাহ্মণ-শরীর হয় না।
.
ব্রাহ্মণ অর্থাৎ সর্বোত্তম পুরুষ হওয়ার জন্যও সর্বপ্রথম স্বাধ্যায়ের আবশ্যকতা হয়। যখন আমরা আমাদের থেকে অধিক বিদ্বান, অনুভবী, বেদ-শাস্ত্রবেত্তা ঋষি-মহর্ষি আর বিদ্বানদের গ্রন্থের স্বাধ্যায় করি, নিজের মনে তাদের বিচার গ্রহণ করি, তখন আমাদের মানসিক শক্তি বৃদ্ধি পায়, তদনুকূল আচরণ করলে আমরাও সেইরূপ বিদ্বান ধার্মিক পুরুষ হতে পারি। স্বাধ্যায়ের যে কত লাভ তা কতদূর বর্ণনা করবো, কেবল স্বাধ্যায়ের শক্তিতেই একজন সাধারণ ব্যক্তি উচ্চকোটির বিদ্বান হতে পারে, এমন সহস্র উদাহরণের সাক্ষী ইতিহাস হয়ে আছে -

বরমৌন্ট আমেরিকার এক মৌচি চার্লস সী ফাস্ট তার আজীবিকার (চাকরি) মধ্যে প্রতিদিন এক ঘন্টা বের করে ১০ বছর পর্যন্ত এক ঘন্টা গণিতের অধ্যয়ন করেন। কেবল সেই এক ঘন্টার স্বাধ্যায়ের আধারে উচ্চকোটির বিদ্বান হয়ে যান।

পণ্ডিত গুরুদত্ত এম. এ. এর উপাধি নেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে বৈদিক গ্রন্থের স্বাধ্যায়ও করেন আর সেই গুরুদত্ত এম. এ. মহর্ষি দয়ানন্দ জীর দেহাবসানের পশ্চাৎ সকল পাশ্চাত্যের বেদ সম্বন্ধিত আক্ষেপের তিনি যথাযথ জবাব দেন যারফলে তারা অবাক হয়ে যায়। পণ্ডিত গুরুদত্ত জী গুরুমুখ থেকে বেদবেদাঙ্গের বিধিপূর্বক অধ্যয়ন করেন নি অথচ স্বাধ্যায়ের কারণেই তিনি এত উচ্চকোটির বিদ্বান হন।

এইভাবে স্বামী দয়ানন্দ জী, পণ্ডিত চমূপতি জী এম. এ, পণ্ডিত লেখরাম জী তথা মহাত্মা নারায়ণ স্বামী জী আদি সকল মহাপুরুষের জীবনচরিত্র পড়ে দেখুন, এইসব মহাপুরুষ স্বাধ্যায়ের শক্তিতেই এত উচ্চকোটির বিদ্বান লেখক, বক্তা শাস্ত্রার্থমহারথী আদি হয়েছিলেন আর এখনও এমন অনেক বিদ্বান আছেন যারা স্বাধ্যায়ের দ্বারাই সবকিছু প্রাপ্ত করেছেন। কিন্তু বিস্তার ভয়ের কারণ এখানে অধিক লেখাটা উচিত হবে না। সুতরাং স্বাধ্যায়ের লাভগুলো ধ্যানে রেখে প্রত্যেক ব্যক্তিকে স্বাধ্যায়শীল হওয়া উচিত।
_____________________________________________
° স্বাধ্যায়ো ব্রহ্ময়জ্ঞঃ (শতপথঃ ১১/৫/৬/৩)
^ শৌচসন্তোষতপঃস্বাধ্যায়েশ্বরপ্রণিধানানি নিয়মাঃ।। (য়োগ ২/৩২)
* বেদাভ্যাসো হি বিপ্রাণাম্ পরমম্ তপ উচ্যতে।
ব্রহ্ময়জ্ঞঃ স বিজ্ঞেয়ঃ ষডঙ্গসহিতস্তু য়ঃ।। (মনুস্মৃতি)
™ মধু হ বা ঋচঃ (১১/৫/৭/৫)
পয় আহুতয়ো হ বা এতা দেবানাম্ য় দৃচঃ (১১/৫/৬/৪)
ঘৃতম্ হ সামানি (১১/৫/৭/৫)
© শূদ্রো ব্রাহ্মণতামেতি ব্রাহ্মণশ্চৈতি শূদ্রতাম্।
ক্ষত্রিয়াজ্জাতমেবন্তু বিদ্যাদ্বৈশ্যাত্তথৈব চ।। (মনুঃ ১০/৬৫)
(ক্রমশঃ)





No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

रामभद्राचार्य और आर्य समाज

 स्वामी भद्राचार्य जी का अनर्गल प्रलाप   स्वामी  रामभद्राचार्य  जी का एक वीडियो प्रचारित हो रहा हैं।  भद्राचार्य जी ने स्वामी दयानन्द जी पर ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ