আপনি এটা জিজ্ঞেস করতে পারেন যে, সৃষ্টির বিভিন্ন ক্রিয়াগুলোর কর্তার রূপে আমরা ঈশ্বরের অনুভব কেন করতে পারি না? আসুন এই প্রশ্নটির উপর বিস্তারভাবে বিচার করি -
এখানে আমরা সর্বপ্রথম বিচার করবো যে, কোনো ক্রিয়ার সঞ্চালক বা কর্তার অনুভব কোন-কোন
পরিস্থিতিতে হয়?
(১) কর্তা সাকার হলে পরে যে কেউ তার প্রত্যক্ষ করতে পারে।
(২) ক্রিয়ার প্রারম্ভ ও সমাপ্তি লক্ষণের অনুভব হলেই কর্তার বোধ সহজ হয়।
(৩) কর্তা নিজের মধ্যে ক্রিয়া বিশেষ দ্বারাও তার কর্তাপনের অনুভব হয়।
(৪) কর্তার অনুভবের জন্য ক্রিয়ার বিবিধ গতিবিধি বা লক্ষণকে জানবার জ্ঞান অনিবার্য।
(৫) কর্তা নিরাকার হলে সিদ্ধান্ত নিরূপণের পাঁচ অবয়বের সম্যগ্ জ্ঞান অনিবার্য।
এখন উপর্যুক্ত বিন্দুগুলোর উপর ক্রমশঃ বিচার করা যাক -
(১) কর্তা সাকার হলে তার প্রত্যক্ষ হওয়া সরল। আমরা সংসারে বিভিন্ন ক্রিয়ার সঞ্চালক, নিয়ন্ত্রক এবং বিভিন্ন বস্তুর নির্মাতাকে প্রত্যক্ষ দেখে থাকি। এতে কোনো সংশয় নেই। সৃষ্টির কর্তা ঈশ্বর তত্ব সাকার না হওয়ায় নেত্র দ্বারা প্রত্যক্ষ হয় না। এইভাবে সেটি স্বাদ, গন্ধ, স্পর্শ ও শব্দের বিষয় না হওয়ায় রসনা, প্রাণ, ত্বচা ও শ্রোত দ্বারাও প্রত্যক্ষ হয় না।
(২) সংসারে হতে চলা অনেক ক্রিয়ার প্রারম্ভ ও সমাপ্ত হতে আমরা প্রত্যক্ষ দেখে থাকি, এই কারণে সেই ক্রিয়াগুলোর প্রারম্ভ ও সমাপন কর্তার বোধ সহজভাবেই হয়ে যায়। সৃষ্টির সেই ক্রিয়া, যার প্রারম্ভ হতে অথবা সমাপ্ত হতে, আমরা দেখতে পারি না অর্থাৎ যেসব ক্রিয়াকে আমরা নিজের জন্ম হতে মরণ পর্যন্ত যথাযথ দেখে ও শুনে থাকি, সেসব ক্রিয়ার প্রারম্ভ ও সমাপ্ত হওয়ার বিচার আমাদের মাথায় আসেই না। আকাশের মধ্যে বিভিন্ন লোকের ভ্রমণ, প্রকাশন, অণু বা পরমাণুর গতি আদি আমরা জন্ম থেকেই যেমনটা দেখেছি ও শুনেছি, তেমনটাই এখন পর্যন্ত চলছে আর আমাদের জীবনের অন্তেও সেরকমই হয়ে থাকবে। এই কারণে এটির কর্তা, নিয়ন্ত্রক, সঞ্চালক আদি গুণযুক্ত কোনো চেতন কর্তার সাধারণতঃ কল্পনাও হয় না। যদি কোনো অত্যল্পায়ু জীব কোনো বাহনকে কেবল চলন্তই দেখে, তাকে কখনও বিরাম অবস্থায় না দেখে, তখন তার মনে এই বিষয়ই আসবে না যে, এটিকে কোনো কর্তা চালিয়েছে বা চালাচ্ছে।
(৩) যখন কোনো সাকার কর্তাও যদি কোনো বাহন আদি যন্ত্রের পাশে বসে থাকে কিন্তু নিজের শরীরে কোনো রূপ ক্রিয়াও না করে, তবুও কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর এরকম বোধ হবে না যে সেই কর্তাটি (চালকটি) সেই বাহনটিকে চালাচ্ছে, বরং তাতে তার এরূপ মনে হবে যে বাহনটি স্বতঃই চলছে।
(৪) যতক্ষণ পর্যন্ত কাউকে ক্রিয়ার আদি, অন্ত ও মধ্যতে প্রতিত কারক নানা লক্ষণের জ্ঞান না হবে, ততক্ষণ তার কর্তার বোধ হবে না। কোনো পশুর এটা বোধ হয় না যে, কোনো ব্যক্তি বাস, রেল, উড়োজাহাজ আদি চালায়। সে এই বাহনগুলোকে চলতে ও থামতেও দেখে থাকে, তাতে বসে থাকা চালকটিকেও দেখতে পারে, তারপরও তার এই বোধ হয় না যে সেই চালকটিই এই বাহনটিকে চালাচ্ছে বা থামাচ্ছে।
(৫) উপর্যুক্ত চার বিন্দু সাকার কর্ম দ্বারাই সম্বন্ধিত। যদি কর্তা নিরাকার হয়, তখন সেই স্থিতিতে সিদ্ধান্ত নিরূপণের সকল পাঁচ অবয়বগুলোকে বোঝার হেতু প্রতিভার হওয়াও অনিবার্য হবে, অন্যথা ঈশ্বর তত্বের অস্তিত্বের বোধ হবে না। বর্তমান বিজ্ঞান কেবল প্রয়োগ, প্রেক্ষণ ও পরীক্ষণের মধ্যেই বিশ্বাসী, গণিতীয় ব্যাখ্যাতে বিশ্বাস করে, এই কারণে তাদের ঈশ্বর অস্তিত্বের বোধ হয় না। যেখানে তাদের সীমা সমাপ্ত হয়ে যায়, সেখানে তারা বলে দেয় যে, আমরা জানি না। এই কথাটি তো সত্য যে, আপনারা জানেন না কিন্তু আপনাদের কি জানবার চেষ্টাও করা উচিত নয়? আপনাদের এখানে বৈদিক বিজ্ঞান বা দর্শনের আশ্রয় নেওয়াও কি উচিত নয়? আপনারা এটা কেন মনে করেন যে, যেটি বর্তমান বিজ্ঞান দ্বারা সিদ্ধ হওয়ার যোগ্য, সেটাই সত্য, অন্য সবই মিথ্যা। এই বিষয়ে Richard P. Feynman ঠিকই লিখেছেন -
"Mathematics is not a science from our point of view, in the sense that it is not a natural science. The test of its validity is not experiment. We must incidentally, make it clear from the beginning that if a thing is not science it is not necessarily bad. For example, love is not a science. So, if something is said not to be a science, it does not mean that there is something wrong with it, it just means that it is not a science." (Lectures on Physics - P. 27)
অর্থাৎ যাকে বর্তমান বিজ্ঞানের সীমায় মানা যায় না, সেটা মিথ্যা, এমনটা মানা উচিত নয়। তাকে কেবল এটা বলা উচিত যে এটা বিজ্ঞান নয়।
বস্তুতঃ Feynman মডার্ন সায়েন্সের পরিভাষার আধারেই এটা বলেছেন, তবুও তিনি বিজ্ঞানের বাইরের বিষয়কে মিথ্যা ও অনাবশ্যক মানেন না। আমি বর্তমান বিজ্ঞান এবং দর্শন উভয়ের পরিভাষাকেই স্পষ্ট করেছি। এখন আমরা বৈদিক দৃষ্টি দ্বারা বিজ্ঞানের পরিভাষার উপর বিচার করবো। মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী জী লিখেছেন -
"বিজ্ঞান তাকে বলে যা কর্ম, উপাসনা আর জ্ঞান এই তিনটি দ্বারা যথাযথ উপয়োগে নেওয়া আর পরমেশ্বর হতে তৃণ পর্যন্ত পদার্থের সাক্ষাৎ বোধ হওয়া, তার থেকে যথাযত উপয়োগ করা।" (বেদ বিষয় বিচার - ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকা)
এটি সংস্কৃত ভাষ্যতে "পৃথিবীতৃণমারম্য প্রকৃতিরপর্য়ন্তানাম্ পদার্থানাম্ জানেন য়থাবদুপকাগ্রহণ..." বলে প্রকৃতি পর্যন্ত অর্থাৎ স্থূলতম থেকে সূক্ষ্মতম পদার্থের যথাযত জ্ঞানকে বিজ্ঞান বলেছেন। এটির মধ্যে ঈশ্বর ও জীবেরও যথার্থ জ্ঞান সম্মিলিত রয়েছে। এই যথার্থ জ্ঞান কিভাবে প্রাপ্ত করা যাবে, এই বিষয়ে বলেছেন যে, জ্ঞান, কর্ম ও উপাসনা দ্বারা যথার্থ বিজ্ঞান প্রাপ্ত হয়। এর তাৎপর্য হল সত্যশাস্ত্রের গম্ভীর অধ্যয়নের পশ্চাৎ তাকে কর্ম অর্থাৎ প্রয়োগ, প্রেক্ষণ ও পরীক্ষণ দ্বারা পুষ্ট করা, যাকে আজকের বিজ্ঞানও স্বীকার করে। যে বিষয় প্রয়োগ বা প্রেক্ষণ দ্বারা সিদ্ধ বা সাক্ষাৎ হয় না, তার জন্য উপাসনাকে বিশেষ সাধন রূপ বলা হয়েছে। য়োগ সাধনা দ্বারা প্রাপ্ত অন্তর্দৃষ্টি বৈদিক ঋষিগণের বিশিষ্ট দান, যার বলের উপর সেই ঋষিগণ সৃষ্টির সঙ্গে-সঙ্গে জীব ও ঈশ্বরের মতো নিরাকার চেতন পদার্থের সাক্ষাৎ করে যথার্থ বিজ্ঞানকে প্রাপ্ত করেছিলেন। এই জ্ঞান প্রায়শই নির্ভুল হয়। এই অন্তর্দৃষ্টি দ্বারাই প্রাপ্ত যথার্থ বিজ্ঞানকে সেই ঋষিগণ কল্প সূত্র, ব্রাহ্মণ গ্রন্থ, মনুস্মৃতি, ষঙ্দর্শন, উপনিষদ, রামায়ণ ও মহাভারত আদি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। সেই য়োগীজন তাদের নিজের উপাসনা=সমাধির দ্বারা সুবিশাল-লোক লোকান্তর থেকে সূক্ষ্ম মূলকণা ও ক্বাণ্টাজ্ এবং এটির থেকেও সূক্ষ্ম প্রাণছন্দ ও মরুদ্ আদি পদার্থের মধ্যে নিজের মন বা বুদ্ধিতত্বকে প্রবিষ্ট করিয়ে তার অনুভব বিনা কোনো বাহ্য টেকনিকে করতেন। এরও আগে তাঁরা স্বয়ং নিজের আত্ম স্বরূপ এবং সর্বসূক্ষ্ম ও অনন্ত তত্ব ঈশ্বরের সাক্ষাৎ অনুভব করতেন। এইভাবে বৈদিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্র বর্তমান বিজ্ঞানের অপেক্ষায় অনেক ব্যাপক। আমি ঐতরেয় ব্রাহ্মণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যান করার সময় মহর্ষি ঐতরেয় মহীদাসের য়োগদৃষ্টি দ্বারা জেনে যাওয়া সৃষ্টির গূঢ় রহস্যগুলোকে স্বয়ং অনুভব করেছি। আশ্চর্য হয় যে, কিভাবে মহর্ষি ভগবন্ত তাঁর নিজের অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা সৃষ্টি বিজ্ঞানের সূক্ষ্ম ও গম্ভীর রহস্যগুলোকে সাক্ষাৎ করতেন। এই অন্তর্দৃষ্টিও বিনা ঈশ্বরের কৃপায় পাওয়া যায় না। এই সম্পূর্ণ গ্রন্থে ঈশ্বরীয় সত্তার সংকেত দেওয়ার মতো অনেক প্রসঙ্গ এরপরে তুলে ধরা হবে।
• সৃষ্টিকর্তা - এই সৃষ্টির রচয়িতা, নিয়ন্ত্রক ও সঞ্চালকের রূপে চেতন তত্ব ঈশ্বর সিদ্ধির উপরান্ত আমরা এটা বিচার করবো যে, সেটি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে সিদ্ধ করা ঈশ্বরটি স্বয়ং কিরকম? এর উপর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে বিচার করা যাক -
• সত্ স্বরূপ - সর্বপ্রথম সেই ঈশ্বরটি নিত্য হতে হবে। যদি সেই ঈশ্বর অনিত্য হয়ে যায়, তখন তাকে নির্মাণকারী কেউ তাঁর থেকেও মহতী চেতন সত্তা বিদ্যামান হতে হবে, যেটি কোনো অনিত্য ঈশ্বর নামক পদার্থকে উৎপন্ন করতে পারে। যদি এরকমটাও হয়, তাহলে সেই মহতী চেতন সত্তা অবশ্যই অনাদি, নিত্য হতে হবে। যদি এরকমটা না মানা হয়, তবে সেই অনাদি চেতন সত্তাটিকেই ঈশ্বর নাম দেওয়া হবে, নাকি অনিত্য সত্তাটিকে অনাদি মানা হবে। এই কারণে ঈশ্বর সত্ স্বরূপ সিদ্ধ হয়ে থাকে। ধ্যাতব্য হল যে, যেকোনো চেতন সত্তা কখনও কারও দ্বারাই নির্মাণ সম্ভব নয় আর না স্বয়ং নির্মিত হয়, বরং সেটি নিশ্চিত রূপে অনাদিই হয়ে থাকে।
• চিত্ স্বরূপ - সেই ঈশ্বর সত্ স্বরূপ হওয়ার সাথে চেতনও হতে হবে, কারণ কেবল চেতন সত্তাই ইচ্ছা, জ্ঞান ও প্রয়ত্ন এই তিনটি গুণে যুক্ত হয়ে নানা প্রকারের রচনাকে সম্পাদিত করতে পারে।
• আনন্দ স্বরূপ - এর সঙ্গে সেই সত্তাটি আনন্দ স্বরূপও হতে হবে। এর কারণটি হল যে, সম্পূর্ণ সৃষ্টিকে নির্মাণে তাঁর কিঞ্চিৎও ক্লেশ, দুঃখ আদি যেন না হয়। যদি সেই সত্তাটি দুঃখ ও ক্লেশে যুক্ত হওয়ার আশঙ্কায় গ্রস্ত হয়ে যায়, তাহলে সেটি সৃষ্টি রচনার মতো মহান্ কর্মকে করতে পারবে না। এইজন্য ঈশ্বর তত্বের পরিভাষা করে মহর্ষি পতঞ্জলি জী বলেছেন -
"ক্লেশকর্মবিপাকাশয়ৈপরামৃষ্টঃ পুরুষবিশেষ ঈশ্বরঃ"
(য়োগ দর্শন ১|২৪)
অর্থাৎ - অবিদ্যাদি ক্লেশ, পাপ-পুণ্য আদি কর্ম এবং তার ফল, বাসনা হতে পৃথক্ পুরুষ অর্থাৎ সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডে শয়নকারী অর্থাৎ ব্যাপ্ত বিরাজমান চেতন তত্বটিকে ঈশ্বর বলে। এইকারণেই তিনি হলেন সর্বদা আনন্দ স্বরূপ। এইজন্য মহর্ষি দয়ানন্দ ঈশ্বরকে সচ্চিদানন্দ বলেছেন।
• সর্বব্যাপক - আমরা জানি যে আমাদের সৃষ্টিতে বর্তমান বৈজ্ঞানিক প্রায় দুই অরব গ্যালাক্সিকে দেখেছে বা অনুভব করেছে। আমাদের গ্যালাক্সিতেই প্রায় দুই অরব তারা রয়েছে। বৈজ্ঞানিক এখন পর্যন্ত দেখা ব্রহ্মাণ্ডের ত্রিজ্যা 10^26m -কে মানছে। দুই গ্যালাক্সির মাঝে কয়েক অরব-খরব কিলোমিটার ক্ষেত্রের মধ্যে কোনো লোক হয় না, তবুও সম্পূর্ণ রিক্ত স্থানের মধ্যে সূক্ষ্ম হাইড্রোজেন গ্যাস অত্যন্ত বিরল অবস্থাতে ভরা থাকে। তারমধ্যেও Vaccum Energy ভরা থাকে। সারাংশ হল এটা যে, এত বড় ব্রহ্মাণ্ডে নিতান্ত রিক্ত স্থান কোথাও নেই। এরমধ্যে আমাদের সূর্যের থেকে কয়েক কোটি গুণ বড় তারাও বিদ্যমান রয়েছে, তাই সূক্ষ্ম লেপ্টন, ক্বার্ক এবং ক্বাণ্টাজ্ও বিদ্যমান রয়েছে। এর অতিরিক্ত এরথেকেও সূক্ষ্ম প্রাণ, ছন্দ ও মনতত্বাদি পদার্থ বিদ্যমান রয়েছে। এরথেকেও স্থূল ও সূক্ষ্ম পদার্থের মধ্যে গতি ও বলের বিদ্যামানতা রয়েছে। সবার মধ্যে সৃজন ও বিনাশের খেলা হচ্ছে। এর কারণ যেখানে-যেখানে এই খেলা চলছে, সেখানে-সেখানে ঈশ্বর তত্বটিও বিদ্যমান হতে হবে। এটির আশয় হল যে, ঈশ্বর সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম পদার্থের মধ্যেও বিদ্যমান রয়েছে তথা স্থূল থেকে স্থূলতম পদার্থের মধ্যেও বিদ্যমান রয়েছে। এই কারণে কঠ উপনিষদের ঋষি বলেছেন -
"অণোরণীয়ান্ মহতো মহীয়ান্"
(কঠ০ উপ০ ২|২০)
অর্থাৎ - সেই পরমাত্মা হল সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম আর মহান থেকে মহান্। এই কারণে তিনি হলেন সর্বব্যাপক।
য়জুর্বেদ বলছে -
ইশাবাস্যমিদ্ঁ সর্বম্ য়ত্কিঞ্চ জগত্যাম্ জগত্"
(য়জু০ ৪০|১)
অর্থাৎ - সেই ঈশ্বর এই সম্পূর্ণ জগতে ব্যাপ্ত হয়ে তাকে আচ্ছাদিত করে আছে। এই প্রকারে সেই ঈশ্বর সর্বব্যাপক সিদ্ধ হচ্ছে। সেটি একদেশী কখনও হতে পারে না।
• সর্বশক্তিমান্ - এই সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডকে বানাতে, চালাতে ও নিয়ন্ত্রিতকারী সর্বব্যাপক ঈশ্বর তত্ব সর্বশক্তিমানই হতে হবে। আজকের বিজ্ঞান এই বিষয়ে অবগত যে সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডটি কত বড়? সূক্ষ্ম কণা হতে বিশাল লোকের রচনা করা, তাতে গতি প্রদান করা, সকল বল ও ঊর্জাকেও বল ও ঊর্জা প্রদান করা, কোনো সামান্য শক্তিশালী তত্বের সামর্থ্য নয়, এই কারণে সেই ঈশ্বর তত্বটি সর্বশক্তিমানই হতে পারে। এখানে ধ্যাতব্য হল যে, "সর্বশক্তিমান" এর অর্থ এটা নয় যে ঈশ্বর বিনা কোনো উপাদান পদার্থে শূন্য হতে সৃষ্টি রচনা করতে পারে অথবা সে বিনা কোনো নিয়মে চমৎকার পূর্বক যা ইচ্ছে তাই করতে পারে, তার কাছে যেকোনো কাজ করা অসম্ভব নয়, এরকম কথন উচিত নয়। ঈশ্বর হলেন স্বয়ং নিয়ামক, যিনি নিজেরই নিয়মের অনুসারে কাজ করতে পারেন, অন্যথা কাজ করতে পারেন না। তাঁর সর্বশক্তিমত্তা তো এই বিষয়ে যে তিনি এত বড় সৃষ্টিকে বিনা কারও সহায়তায় রচনা করেন, চালনা করেন ও সঠিক সময়ে তার প্রলয়ও করেন।
• নিরাকার - এখন এই বিষয়টির উপর বিচার করা যাক যে, যেই পদার্থটি সর্বশক্তিমান্ অর্থাৎ অনন্ত ঊর্জা ও বল দ্বারা যুক্ত এবং সর্বব্যাপক হবে, তার আকারটি কেমন হবে? আমি মনে করি যে, এই বিষয়টিতে সামান্য বুদ্ধিমান ব্যক্তিও এটাই বলবে যে সর্বব্যাপক ও সর্বশক্তিমান সত্তাটির কোনো আকারই হবে না। বস্তুতঃ ঊর্জা ও বলের মতো গুণ কোনো সাকার পদার্থে হয়ই না। এই সংসারে সাকার পদার্থের মধ্যে যেসব বল বা ঊর্জা দেখা যায়, তা বস্তুতঃ সেই সাকার পদার্থটির ভিতর বিদ্যমান অন্য নিরাকার পদার্থেরই হয়ে থাকে। বিভিন্ন বিশাল বা লঘু যন্ত্রতে বিদ্যুৎ, যেটি নিরাকারই হয়, আদির বল বিদ্যমান থাকে। প্রাণীর শরীরের মধ্যে চেতন জীবাত্মারও বল কাজ করে। নিরাকার বিদ্যুৎ আদি পদার্থের মধ্যে চেতন পরম তত্ব ঈশ্বরের বল কাজ করে, এটি আমি পূর্বেই বলেছি। যে ঈশ্বর তত্বটি প্রত্যেক সূক্ষ্ম ও স্থূল পদার্থের মধ্যে ব্যাপ্ত হয়ে তাতে বল ও ঊর্জা প্রদান করছে, সেটি কেবল নিরাকারই হতে পারে, সাকার কখনও নয়।
• সর্বজ্ঞ - ঈশ্বর তত্বের সর্বশক্তিমত্তার পশ্চাৎ তাঁর সর্বজ্ঞতার উপর বিচার করা যাক। এটি সামান্য বুদ্ধির বিষয় যে, আধুনিক জগতে এক একটি যন্ত্র নির্মাণকারী ইঞ্জিনিয়ার তথা ব্রহ্মাণ্ডের কিছু রহস্যের জ্ঞানী একজন বৈজ্ঞানিককে অনেক বুদ্ধিমান মানা হয়। এরকম পরিস্থিতিতে যে সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডকে রচনা আর চালনা করে, সে কত জ্ঞানী হবে? বস্তুতঃ সেই ঈশ্বরই হলেন সর্বজ্ঞ। সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ড যাকে জানার চেষ্টা, এই ভূমির সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী মানব কোটি-কোটি বর্ষ থেকে করে আসছে আর যতদিন সৃষ্টি থাকবে, তারা এরকম চেষ্টা করতেই থাকবে কিন্তু তাঁকে কখনও পূর্ণতঃ জানতে পারবে না। যে এরকম ব্রহ্মাণ্ড নির্মাণ করেছে, যে এটিকে চালাচ্ছে, সেটি নিশ্চয়ই সর্বজ্ঞ অর্থাৎ অনন্ত জ্ঞানী হবে।
• পবিত্র - এরকম ঈশ্বর কখনও সৃষ্টির উপাদান কারণ রূপ পদার্থে মিশ্রিত হয় না, এইজন্য তাঁকে পবিত্রও বলা হয় অর্থাৎ সেটি সর্বদা বিশুদ্ধ রূপে বিদ্যমান থাকে, এই কারণে ঈশ্বরকে সৃষ্টির নিমিত্ত কারণ মানা হয়, অন্যদিকে প্রকৃতি রূপী মূল পদার্থ এই সৃষ্টির উপাদান কারণ মানা হয়, এটাই বাস্তবতা। এরসঙ্গে তথ্য এটাও যে, ঈশ্বর কখনও কোনো প্রকারে দোষ দ্বারা কিঞ্চিৎমাত্রও গ্রস্ত হতে পারে না।
• সর্বাধার - এরকম সেই ঈশ্বরটিই ব্রহ্মাণ্ডকে নির্মাণ, চালনা করে তাকে ধারণও করে আছেন, এই কারণে তাঁকে সর্বধার বলা হয়। বর্তমান বিজ্ঞান এটির ধারণাকে গুরুত্বাকর্ষণ বল এবং ডার্ক ম্যাটারের ভূমিকাকে মানে। এটা সত্যিই কিন্তু এই ধারক পদার্থের ধারক তত্বটিই হল স্বয়ং ঈশ্বর।
• ন্যায়কারী-দয়ালু - এরকম সেই ঈশ্বর তত্বটি সর্বদা সর্বথা নিশ্চই পূর্ণ ও তৃপ্ত বা অকাম হতে হবে। তখন তিনি এই সৃষ্টির রচনা স্বয়ংয়ের জন্য নয় বরং অন্য কারও অপূর্ণকাম চেতন তত্বের উপভোগ ও মোক্ষ হেতু করেন। সেই অপূর্ণকাম চেতন তত্বটিকেই জীবাত্মা বলে। এখানে "অপূর্ণ" অর্থে এটা বোঝা উচিত যে সেটি বল, জ্ঞান ও আয়তন আদির দৃষ্টিতে ঈশ্বরের অপেক্ষায় অত্যন্ত লঘু। কারণ সেই ঈশ্বর নিজের জন্য কিছুই চান না, বরং জীবের ভালোর জন্যই সৃষ্টির রচনা করেন, এই কারণে তাঁকে দয়ালু বলে। তিনি সর্বদা জীবদের তাদের কর্মের অনুসারে ফল দেন, না তার অধিক আর না ন্যূন, এই কারণে তাঁকে ন্যায়কারীও বলে। কর্মানুসার ফল পাওয়া চেতন পদার্থ জগতে কারণ কার্যের নিয়মের সমান। জড় জগতে আমরা সর্বত্র কারণ কার্যের নিয়ম দেখে থাকি। বর্তমান বিজ্ঞানও জড় জগতে কারণ কার্যের নিয়মকে স্বীকার করে। Arthur Beiser লিখেছেন -
"cause and effects are still related in quantum mechanics, but what they concern needs careful interpretation" (Concepts of Modern Physics - P.161)
যখন জড় জগতে কারণ-কার্যের নিয়ম সর্বত্র কাজ করে, যদিওবা তাকে আমরা পূর্ণতঃ বুঝতে না পারি, তাহলে সেটি চেতন জগতে কেন কাজ করবে না? আমার মত হল এই যে, এখানে কর্মফল ব্যবস্থাই কারণ কার্যের নিয়মের রূপে কাজ করে। আমরা এটিকে পূর্ণতঃ কখনও জানতে পারবো না। ঈশ্বরও এই ব্যবস্থাকে উপেক্ষিত করতে পারবেন না। তাঁর প্রার্থনা, উপাসনা আদি করলেও তিনি কোনো জীবের কর্মের অনিষ্ট ফল থেকে সেই জীবকে বাঁচাতে পারবেন না, এখানেই তাঁর ন্যায় ও দয়া উভয়ই সমাহিত রয়েছে। যদি প্রার্থনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি জীবদের তাদের পাপের দণ্ড না দেন, তবে তাঁর সম্পূর্ণ কর্মন্যায় ব্যবস্থা ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাবে। কোনো অপরাধীর অপরাধকে ক্ষমা করে দেওয়াটা ন্যায়াধীশের (বিচারকের) ন্যায় নয় বরং অন্যায়ই হবে। এই ক্ষমার দ্বারা সেই অপরাধী পাপ করার হেতু আরও প্রোত্সাহিত হবে তথা এরফলে সে অনেক জীবের আরও অধিক দুঃখ দিতে পারে, যারফল স্বয়ং ন্যায়াধীশকেও (বিচারককেও) ভুগতে হবে কিংবা তিনিও সেই পাপের উত্তরদায়ী হবে। এই কারণে সত্য বিচারক কখনও কোনো অপরাধীকে ক্ষমা করেন না আর এটা করা উচিতও নয়। যখন কোনো সত্য বিচারক এরকমটা করেন না, তাহলে সেই পরমাত্মা রূপ বিচারক কেন কারও অপরাধকে ক্ষমা করে নিজের ন্যায় ব্যবস্থাকে ভঙ্গ করবেন? ঈশ্বরীয় ব্যবস্থা হল প্রণত ব্যবস্থিত ও স্বাভাবিক, তাতে কখনও কোনো স্খলন হয় না। এই কারণে যারা ঈশ্বরবাদী প্রার্থনা, য়াগ, তৌবা, confession আদি দ্বারা নিজেদের পাপমোচনের কামনা করেন, তারা ঈশ্বর তত্বের বিশুদ্ধ স্বরূপকে বোঝেন না। পাপের ফলের বিষয়ে মহাদেব শিব ভগবতী উমাকে বলেছেন -
"দ্বিধা তু ক্রিয়তে পাপম্ সনিশ্চাসদ্বি চ।
অভিসম্ধায় বা নিত্যমন্যথা বা য়দৃচ্ছয়া।।
অভিসম্ধিকৃতস্পৈব নৈব নাশোকস্তি কর্মণঃ।
অশ্বমেধসহগ্রেশ্চ প্রায়শ্চিত্তশতৈরপি।।
অন্যথা য়ত্ কৃতম্ পাপ প্রমাদা বা য়দৃচ্ছয়া।
প্রায়শ্চিত্তাশ্বমেধাভ্যাম্ শ্রেয়সা তত্ প্রণস্যতি।"
(মহাভারত অনুশাসন দানধর্ম পর্ব |
অধ্যায় ১৪৫ দক্ষিণাত্য সংস্করণ)
এটার মানে হল এই যে, যেসব পাপ প্রমাদ বা অসাবধানী পূর্বক হয়ে যায়, সেসব প্রায়শ্চিত্ত আদি কিছু উপায়ের দ্বারা মুছে ফেলা যেতে পারে, কিন্তু যেসব পাপ জেনেশুনে বা প্রতিজ্ঞাপূর্বক করা হয়েছে, সেসব কখনও নাশ প্রাপ্ত হয় না অর্থাৎ তার ফল অবশ্যই ভোগ করতে হয়। এটাই ঈশ্বরের সত্য ন্যায় ও এটাই হল তাঁর সত্য দয়া। দণ্ড দেওয়ার পিছনেও ঈশ্বরের প্রয়োজন থাকে যেন সেই পাপী প্রাণীর পাপের থেকে অন্য প্রাণীদের রক্ষা করা যেতে পারে আর সেই পাপী প্রাণী স্বয়ংও ভবিষ্যতে পাপ কর্মে প্রবৃত্ত না হয়। সেই ঈশ্বর পাপী জীবকে এইভাবে দণ্ড দেন, যেমনটা যোগ্য মাতা-পিতা নিজের সন্তানকে খারাপ থেকে বাঁচানোর হেতু দয়াপূর্বক তাড়ন করেন, নাকি তিনি ক্রোধবশ এরকম করেন। এইভাবে সেই ঈশ্বর হলেন সকল জীবের সবথেকে বড় মাতা-পিতার সমান পালক, ন্যায়কারী ও দয়ালু।
আজ সংসারে এক সত্য সনাতন বৈদিক ধর্মকে ত্যাগ করে মনুষ্য সমাজ নানা সম্প্রদায়গুলোতে বিভাজিত হয়ে বিভিন্ন ঈশ্বরের কল্পনা করছে। প্রায়শঃই সকল সম্প্রদায় পাপ থেকে মুক্তির কোনো সরল উপায় বলে দেয়। সকলে প্রায়ঃ ঈশ্বরকে পাপ ক্ষমাকারী বলে মনে করে। এতদর্থ ঈশ্বরকে প্রসন্ন করার হেতু বিভিন্ন প্রকারের পূজাডম্বর, নদী স্নান, নাম স্মরণ, কথা স্মরণ, ব্রত, উপবাস, রোজা, প্রার্থনা, নামাজ, নানা মূর্তির, বৃক্ষ পত্র বা পশু আদির পূজা আদি অনেক ধরনের সাধন প্রচারিত করে রেখেছে। এতে পাপ তো ক্ষমা হয় না কিন্তু এই আড়ম্বরের প্রচারকদের আজীবিকা অবশ্য চলছে। এই আড়ম্বর যত মাত্রায় বেড়ে চলেছে, পাপও ততমাত্রাতেই বেড়ে চলেছে। এরফলে সামান্য প্রবুদ্ধ ব্যক্তির বিশ্বাস না কেবল ঈশ্বর ও তাঁর কর্ম ফলের ব্যবস্থা থেকে উঠে যাচ্ছে, বরং নৈতিক মূল্যেরও নিরন্তর ক্ষরণ হতে চলেছে। এই কারণে ঈশ্বরের দয়ালু ও ন্যায়কারী উভয়ই বিশেষণের সমন্বিত বৈজ্ঞানিক স্বরূপ বুঝে নেওয়াটা নিতান্ত আবশ্যক।
এইপ্রকার ঈশ্বর তত্বটির অনন্ত গুণ, কর্ম, স্বভাব রয়েছে। আমি এখানে কিছু গুণের বিবেচনা করেছি। মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী আর্য সমাজের দ্বিতীয় নিয়মে ঈশ্বর তত্বের স্বরূপের অত্যন্ত সুন্দর বিবেচনা করে গাগরে সাগর ভরে দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন -
"ঈশ্বর হলেন সচ্চিদানন্দস্বরূপ, নিরাকার, সর্বশক্তিমান, ন্যায়কারী, দয়ালু, অজন্মা, অনন্ত, নির্বিকার, অনাদি, অনুপম, সর্বাধার, সর্বেশ্বর, সর্বব্যাপক, সর্বান্তর্য়ামী, অজড়, অমর, অভয়, নিত্য, পবিত্র আর সৃষ্টিকর্তা। তাঁরই উপাসনা করা উচিত।"
ঈশ্বরের স্বরূপের এরথেকে সুন্দর বিবেচনা সম্ভবতঃ আর কোথাও নেই। আজ সারা বিশ্বে প্রচলিত বিভিন্ন মত সম্প্রদায়গুলোতে ঈশ্বরের মিথ্যা কল্পিত রূপের এরকমই ঈশ্বরের অস্তিত্বের ভরমার রয়েছে। Stephen Hawking তার The Grand Design নামক পুস্তকটিতে উপহাসপূর্বক ঈশ্বর তত্বকে খণ্ডন করেছেন আর করাও উচিত। যদি Hawking এর সম্মুখ ঈশ্বর তত্বের এই বৈদিক বিজ্ঞান স্বরূপটি বিদ্যমান হতো, তাহলে তাকে ঈশ্বর তত্বের মান্যতাকে খণ্ডিত করার আবশ্যকতা হতো না। এটা খুবই আশ্চর্য যে, কোনো ঈশ্বরবাদীই Hawking এর বিচারকে পড়ে ঈশ্বরের সত্য স্বরূপকে জানার হেতু প্রবৃত্ত হতে দেখা যায়নি, বরং ঈশ্বরের সত্তাটিকেই অস্বীকারের উপর জোড় দেওয়া হয়। আশা করি যে, আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণ আমার ঈশ্বর বিষয়ক এই প্রকরণটি থেকে ঈশ্বরীয় সত্তা ও স্বরূপের অবশ্যই বোধ হবে আর তারা Hawking এর মতো ভুল পুনরাবৃত্তি করবেন না।
ঈশ্বরীয় সত্তাটির অস্তিত্ব ও স্বরূপের বৈজ্ঞানিকতা আলোচনার পর আমরা এই বিষয়ের উপর বিচার করবো যে, ঈশ্বর এই সৃষ্টির রচনা, সঞ্চালন, ধারণ ও প্রলয় আদি প্রক্রিয়াগুলোতে নিজের কি ও কিরকম ভুমিকা পালন করেন অর্থাৎ তাঁর কার্যপ্রণালী - ক্রিয়াবিজ্ঞানটি ঠিক কিরকম? সারা বিশ্বের ঈশ্বরবাদী নানা প্রকার দ্বারা ঈশ্বরের আলোচনার তো করে কিন্তু এই বিষয়ের উপর বিচারও করে না যে সেই ঈশ্বরটি তাঁর নিজের কার্যকে কিভাবে সম্পন্ন করেন? আমরা জানি যে এই সৃষ্টিতে যেসব ক্রিয়াই হচ্ছে, তার পিছনে চেতন তত্ব ঈশ্বরের ভূমিকা রয়েছে। এছাড়া প্রাণীদের শরীরে জীবাত্মা রূপী চেতন তত্বেরও ভূমিকা রয়েছে। আমরা এখানে ঈশ্বর তত্ব ভূমিকার চর্চা করবো। ঈশ্বর কি সূক্ষ্ম-সূক্ষ্ম কণা, ক্বাণ্টা আদি থেকে শুরু করে বড়-বড় লোক লোকান্তরের ঘূর্ণন ও পরিক্রমণ, তাদের ধারণ, আকর্ষণ, প্রতিকর্ষণ বলের প্রত্যক্ষ কারণ? না, ঈশ্বর সূর্যাদি লোকগুলোকে ও ইলেকট্রন্স আদি কণাগুলোকে ধরে ঘোড়ান না বা চালান না, বরং এইসব পদার্থ সেই বিভিন্ন বল, যাকে বর্তমান বিজ্ঞান জানে বা জানার চেষ্টা করছে, এরদ্বারা নিজ-নিজ কার্য করছে। হ্যাঁ, এইসব বলের উৎপত্তি যেসব প্রাণ ও ছন্দাদি পদার্থ দ্বারা হয়েছে, তাকে বর্তমান বিজ্ঞান এতটুকুও জানে না। এই কারণে বর্তমান বিজ্ঞান দ্বারা মান্যতা প্রাপ্ত মূলবলের উৎপত্তি এবং ক্রিয়াবিধির সমুচিত ব্যাখ্যা করতে এই বিজ্ঞান অক্ষম। এই মূলবলের উৎপত্তি এবং নিয়ন্ত্রণ এই বিবিধ প্রকারেরই প্রাণ ও ছন্দাদি রশ্মির দ্বারা হয়ে থাকে। বিষয়টি এখানেই সমাপ্ত নয়, এই প্রাণ ও ছন্দাদি রশ্মিও মন এবং সূক্ষ্ম বাক্ তত্বের মিথুন দ্বারা উৎপন্ন ও নিয়ন্ত্রিত হয়। এই কারণে মন এবং সূক্ষ্ম বাক্ তত্ত্বটির স্বরূপ ও ব্যবহারকে না জেনে প্রাণ ও ছন্দাদি রশ্মির এবং তারথেকে উৎপন্ন বিভিন্ন কথিত মূলবলগুলো (গুরুত্ব, বিদ্যুৎ চুম্বকীয়, নাভিকীয় বল এবং দুর্বল বল) এর স্বরূপ ও ক্রিয়াবিজ্ঞানের যথাযত বোধ হওয়া সম্ভব নয়।
ধ্যাতব্য হল যে, মন ও বাক্ তত্বটিও জড় হওয়ার কারণে স্বয়ং কোনো কার্যতে প্রবৃত্ত হওয়ার সামর্থ্য রাখে না। এটিকে প্রবৃত্ত করতে সকলের মূলতত্বটি হল চেতন ঈশ্বর। তিনিই এই মন এবং সূক্ষ্ম বাক্ তত্বটিকে প্রেরিত করেন। এটির মাঝে এক কালতত্বও রয়েছে কিন্তু সেটিও জড় হওয়ায় ঈশ্বর তত্বটি দ্বারা প্রেরিত হয়ে কার্য করে। এইভাবে কার্য করার কিংবা প্রেরক এবং প্রেরিত পদার্থ, নিয়ামক ও নিয়ম্য তত্বের শৃঙ্খলা এই প্রকারে হয় -
চেতন ঈশ্বর তত্বটি কাল তত্বকে প্রেরিত করে। কাল তত্বটি মন-বাক্ তত্বকে প্রেরিত করে, পুনঃ মন এবং বাক্ তত্ব প্রাণ ও ছন্দাদি রশ্মিগুলোকে প্রেরিত করে। তারপর সেই প্রাণ ও ছন্দাদি রশ্মি আধুনিক কথিত চার প্রকারের মূলবলগুলোকে উৎপন্ন ও প্রেরিত করে, তার পশ্চাৎ সেই চারটি বল (বস্তুতঃ বলের সংখ্যা অনেক অধিক রয়েছে, যা সকল প্রাণাদি রশ্মির কারণেই উৎপন্ন হয়ে থাকে) সমস্ত সৃষ্টিকে উৎপন্ন ও সঞ্চালিত করতে সহায়ক হয়।
এইভাবে ঈশ্বর তত্ব প্রত্যেক ক্রিয়ার সময় কেবল কাল বা ওম্ ছন্দ রশ্মিকেই প্রেরিত করে, সেটি অগ্রিম প্রক্রিয়াকে আগে বাড়াতে থাকে। এই তত্বটি এতই সূক্ষ্ম যে মনুষ্য কখনও এটিকে কোনোরূপ প্রয়োগ প্রেক্ষণ দ্বারা জানতে পারবে না। কেবলমাত্র উচ্চ কোটির য়োগীই এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াকে জানতে ও বুঝতে পারবেন। এই গ্রন্থে মহায়োগী মহর্ষি ঐতরেয় মহীদাস এরকম সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াকে নিজের মহান্ য়োগ বল দ্বারা বুঝে নিয়ে এই মহান্ রহস্যপূর্ণ গ্রন্থটিতে বর্ণিত করেছেন। পরমাত্মার অসীম দয়ায় আমি এই গ্রন্থটিকে বুঝতে সফল হয়েছি। এতে স্থানে-স্থানে ঈশ্বর তত্বের ভূমিকার বর্ণনা কিংবা তাঁর ক্রিয়াবিজ্ঞানের সাংকেতিক বর্ণনা রয়েছে, যাকে পাঠক গ্রন্থের অধ্যয়ন করেই জানতে পারবেন। সারাংশতঃ ঈশ্বর কাল, ওম্ রশ্মি ও প্রকৃতিকে প্রেরিত করে সৃষ্টি প্রক্রিয়াকে প্রারম্ভ ও সম্পাদিত করেন। তিনি কোনো ক্রিয়াতে জীবাত্মার মতো এরকম অংশীদার হন না যে তাঁকে নিজের কর্মের ফল ভুগতে হবে। তিনি হলেন সর্বদা অকাম। কেবলমাত্র জীবদের জন্যই সবকিছু করেন, এই কারণে তিনিই কর্তা আর তিনিই অকর্তা। তিনি হলেন সৃষ্টির নিমিত্ত কারণ। ঈশ্বর কিভাবে প্রেরিত করেন? সেই প্রেরণা বা জাগরণের ক্রিয়াবিজ্ঞানটি কি? এসব বিষয় আমি পরবর্তী কালতত্ব প্রকরণের মধ্যে সংক্ষিপ্ত রূপে বোঝাবো, পাঠক সেখানেই দেখতে পারবেন (এই বিষয়টি আপনি বেদ বিজ্ঞান আলোক গ্রন্থে পড়তে পারেন বা Vaidic Physics youtube channel এ ভিডিও উপলব্ধ রয়েছে, সেটিও দেখতে পারেন)।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ