পরিষদ্যম্ হ্যরণস্য রেক্ণো নিত্যস্য রায়ঃ পতয়ঃ স্যাম।
ন শেষো অগ্নে অন্যজাতম্ অস্ত্যচেতনস্য মা পথম্ বিদুক্ষঃ॥
ঋগ্বেদ ভাষ্য (স্বামী দयानন্দ সরস্বতীর সংস্কৃত ভাষ্যের ভিত্তিতে)
বিষয়: আপন ধন কোনটি এবং পরধন কোনটি—এই বিষয়টিকে পরের মন্ত্রে বলা হয়েছে॥
পদার্থ
হে (অগ্নে) বিদ্বান্! আপনি (অচেতনস্য) চেতনাহীন মূর্খের (পথঃ) পথগুলোকে (মা) যেন না (বিদুক্ষঃ) কলুষিত করেন। (পরিষদ্যম্) সভায় যে (অন্যজাতম্) অন্য থেকে উৎপন্ন, সেই (হি) সেই (রেক্ণঃ) ধনকে এইরূপ জানুন যে এর (শেষঃ) বিশেষতা বা নিজের আত্মার দৃষ্টিতে শুদ্ধ বিবেচনার কিছুই (ন, অস্তি) নেই এমনি জানুন। আপনার সঙ্গ বা সাহায্যে আমরা (অরণস্য) সংঘর্ষহীন, (নিত্যস্য) স্থির, (রায়ঃ) ধনের (পতয়ঃ) স্বামী (স্যাম) হই॥৭॥
ভাবার্থ
হে মানুষ! ধর্মসঙ্গত পুরুষার্থে যে ধন লাভ হয়, তাকেই নিজের ধন বলে মানো; কিন্তু অন্যায়ে উপার্জিত ধনকে নিজের বলে গণ্য করো না। জ্ঞানীদের পথকে পাখণ্ডের উপদেশে কলুষিত কোরো না। যেমন ধর্মযুক্ত পুরুষার্থে ধন অর্জিত হয়, তেমনি চেষ্টা করো॥৭॥
ঋগ্বেদ ভাষ্য (হরিশরণ সিদ্ধান্তালঙ্কার)
বিষয়: ঋণগ্রস্ত হওয়ার দোষ
পদার্থ: [১] (অরণস্য) [অপার্ণস্য নি°] = ঋণমুক্ত ব্যক্তির (রেক্ণঃ) = ধন (হি) = নিশ্চয়ই (পরিষদ্যম্) = যথেষ্ট হয়। [‘পরিষদ্যং–পর্যাপ্তং’ সা°] অর্থাৎ সংসারী ধন এতটাই হওয়া উচিত যাতে আমরা ঋণগ্রস্ত না হই। প্রয়োজনগুলো পূর্ণ হতে থাকে এইরূপ ধনই আমাদের প্রাপ্ত হওয়া উচিত। আমরা সেই (রায়ঃ) = ধনের (পতয়ঃ স্যাম) = অধিপতি হই, যা (নিত্যস্য) নিত্য, অর্থাৎ ঋণ নিয়ে প্রাপ্ত নয়। ঋণ নিয়ে অর্জিত ধন তো আবার ফিরিয়ে দিতেই হবে।
[২] হে (অগ্নে) = প্রভু! আমরা যেন এইভাবে বুঝে চলি যে (অন্যজাতং শেষঃ ন অস্তি) = অন্যের থেকে জন্মানো অর্থাৎ নেওয়া ঋণে মৃত্যু থেকে মুক্তি নেই; অর্থাৎ মানুষ ঋণ নিয়ে নিজ জীবনকে অকালেই ঋণের ভারে মৃত্যুগ্রস্ত করে ফেলে। হে মানুষ! তুমি (অচেতনস্য) = তোমার পরবর্তী অজ্ঞ সন্তানদের (পথঃ) = পথগুলোকে (মা বিদুঃক্ষঃ) = কলুষিত কোরো না। তারা যেন জন্মাবস্থাতেই ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে জীবন শুরু না করে। পিতার ঋণ সন্তানদের দুর্দশার কারণ হয়ে না ওঠে।
ভাবার্থ
ধনাভাব সংসারযাত্রার সবচেয়ে বড় বাধা, আর অতিরিক্ত ধন ভোগ-বিলাসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রভু এমন ধন দিন যাতে আমরা ঋণগ্রস্ত না হই। ঋণকে মৃত্যুসম বিপদ জ্ঞান করো। তোমার সন্তানদের জন্য ঋণের ভার রেখে যেও না॥
এই মন্ত্রের ঋষি হলেন বসিষ্ঠ। এর অর্থ— “বশিষ্ঠঃ– প্রাণো বৈ বশিষ্ঠঃ” অর্থাৎ এই ছন্দরশ্মির উদ্ভব প্রাণ নামক মৌলিক জীবনীশক্তি থেকে ঘটে। এর দেবতা অগ্নি এবং ছন্দ ভুরিক্ পঙ্ক্তি হওয়ায় এর দৈবিক ও ছান্দসিক প্রভাবে অগ্নিতত্ত্বের বিস্তার ঘটে এবং আকর্ষণ-অনাকর্ষণ শক্তির বৃদ্ধি হয়।
আধিদেবিক ভাষ্য—
(পরিষদ্যম্ হি) “পরিহর্তব্যং হি নোপসর্তব্যম্” অর্থাৎ যে বস্তু ত্যাজ্য বা দূরে রাখার যোগ্য।
(অরণস্য, রেক্ণঃ) — [রণঃ = সংগ্রামের নাম; রেক্ণঃ = যে ব্যয় সৃষ্টি করে]
কোন বস্তু ত্যাজ্য ও দূরে রাখার যোগ্য এর উত্তর হিসেবে বলা হয়েছে
“অরণস্য রেক্ণঃ অরণোঅপার্ণো ভবতি রেক্ণ ইতি ধননাম রিচ্যতে প্রযতঃ”
অর্থাৎ যেসব পদার্থে সংঘাত বা সংযোগের প্রক্রিয়া আর ঘটে না, যাদের শক্তি ক্ষয়প্রাপ্ত এমন নিকটবর্তী বা দূরবর্তী পদার্থ সৃষ্টি-প্রক্রিয়ায় ত্যাজ্য। সংযোগ-বিচ্ছেদে অংশ নিতে গিয়ে এদের শক্তি ক্ষীণ হয়ে যায়, কিছু শক্তি নিঃসৃত হয়, এবং এরা সূক্ষ্ম কণারূপে মহাকাশে ছড়িয়ে থাকে।
এবার বলা হচ্ছে.. কোন পদার্থ সৃষ্টি-প্রক্রিয়ায় কার্যকর?
(নিত্যস্য, রায়ঃ, পতয়ঃ, স্যম্) “নিত্যস্য রায়ঃ পতয়ঃ স্যম্ পিত্র্যস্যেব ধনস্য”
[রায়ঃ = পশু বা শক্তিসমূহ; নিত্যঃ = নিয়মিত বা নিয়ন্ত্রিত]
সৃষ্টি-প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারে কেবল সেই কণা বা পদার্থ, যা নিয়মিত ও নিয়ন্ত্রিত মরুৎ বা ছন্দ-রশ্মি দ্বারা পালন ও রক্ষিত। যখন এই রশ্মিগুলো অনিয়ন্ত্রিত বা ক্ষণস্থায়ী হয়, তখন তারা সংযোগের যোগ্য থাকে না।
[পিতরঃ = যাঁদের মধ্যে উষ্ণতার অংশ আছে] গ্রন্থকার বলেন:- যেসব পদার্থ উষ্ণতায় পরিপূর্ণ, তারাই সংযোগ-যোগ্য; উষ্ণতাহীন কণা কখনোই সৃষ্টি-প্রক্রিয়ার অংশ হতে পারে না।
(ন, শেষঃ, অগ্নে, অন্যান্যতম্, অস্তি) “ন শেষো অগ্নে অন্যান্যতম্ অস্তি শেষ ইত্যপত্যনাম শিষ্যতে प्रयतः (প্রযতঃ)” [অন্য = ভিন্ন; সপত্ন = পাপ বা প্রতিকূল শক্তি] অর্থাৎ দূরবর্তী, অনিয়ন্ত্রিত বা অসুর-প্রভাবিত পদার্থ দ্বারা আক্রান্ত অগ্নিতত্ত্ব শেষ অর্থাৎ কার্যরূপে নতুন অণু গঠনে অসমর্থ হয়। অর্থ এই যে অত্যধিক উত্তপ্ত পদার্থ যদি চরমভাবে অস্থির, অনিয়ন্ত্রিত, অতিদূরস্থিত কিংবা অসুর-তরঙ্গ দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়, তবে তা পরবর্তী ধাপের পদার্থ সৃষ্টি করতে পারে না। এখানে কার্যরূপ পদার্থকে “অপত্য” ও “শেষ” উভয়ই বলা হয়েছে।অর্থাৎ অগ্নি যখন সুপরিকল্পিতভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, তখনই সে কার্যরূপ পদার্থ উৎপাদনে সক্ষম হয়; তখন অগ্নি নিজেই কার্যরূপ পদার্থে রূপান্তরিত হয় অথবা সেই পদার্থের রূপে অবশিষ্ট থাকে। উদাহরণ সৃষ্টি-প্রক্রিয়ায় বায়ু বা অগ্নিতত্ত্ব পরবর্তী ধাপ সম্পন্ন করে যথাক্রমে অগ্নি ও জলতত্ত্বে অবস্থান করে; তাই এরা পূর্ববর্তী তত্ত্বের শেষ।
(অচেতনস্য, মা, পথঃ, বিদুক্ষঃ)
“অচেতযমানস্য তত্প্ৰমত্তস্য ভবতি মা নঃ পথম্ বিদৃদুষ ইতি”
অর্থাৎ যেসব পদার্থ দীপ্তিহীন বা জাগ্রত নয়, তারা বিভিন্ন ক্রিয়ায় বিচ্যুত হয় সৃষ্টি-প্রক্রিয়ার অংশ হতে পারে না। অগ্নিতত্ত্ব এসব প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন পদার্থের পথকে বিকৃত হতে দেয় না; অর্থাৎ উপযুক্ত উষ্ণতা ও শক্তির মাধ্যমেই সূক্ষ্ম কণা ও পদার্থ নিজেদের নির্দিষ্ট পথে সক্রিয়ভাবে গমন করতে পারে এবং বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করতে সক্ষম হয়।
ভাবার্থঃ ক্ষীণ শক্তিযুক্ত কণারা সৃষ্টির যজন-প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং তারা মহাবিশ্বে ইদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়। যে কণারা নিয়ন্ত্রিত মরুদ্ বা ছন্দাদি রশ্মি দ্বারা যুক্ত থাকে, তারা যজন-প্রক্রিয়ায় সক্রিয় থাকে। যখন মরুদাদি রশ্মি অনিয়ন্ত্রিত হয়, তখন তারা সংযোজনে সক্ষম থাকে না। উষ্ণতাযুক্ত কণা সংযোজ্য, উষ্ণতাহীন কণা নয়। দূরবর্তী অনিয়ন্ত্রিত বা অসুর-পদার্থ দ্বারা আক্রান্ত কণাও কোনো নতুন পদার্থ সৃষ্টি করতে পারে না। দীপ্তিযুক্ত পদার্থই পরবর্তী ধাপের পদার্থ তৈরি করতে সক্ষম হয়, দীপ্তিহীন নয়। আরও স্পষ্টতার জন্য পরবর্তী ঋচাটি পরবর্তী খণ্ডে উদ্ধৃত করা হয়েছে।
“নহি গ্রভায়া অরণঃ সুশেভো’ন্যো দর্যো মনসা মন্তভা উ।
অধা চিদ্ অকঃ পুনরিত্স এত্যা নো বাজিক্ অভীষাল এতু নব্যঃ ॥ ঋগ্বেদ ৭।৪।৮॥
এই মন্ত্রের ঋষি ও দেবতা পূর্বোক্ত মন্ত্রের মতোই, এবং এর ছন্দ পঙ্ক্তি। তাই দেবতা ও ছান্দসিক প্রভাবও মোটামুটি একই। কেবল একটি পার্থক্য এ মন্ত্রের প্রভাবে পূর্বোক্ত আকর্ষণ-প্রতিকর্ষণ শক্তির বৃদ্ধি ঘটে না, কিন্তু অগ্নিতত্ত্বের বিস্তার পূর্বের মতোই বজায় থাকে।
“ন হি গ্রহীতব্যোऽরণঃ” অর্থাৎ ক্ষণিক বলযুক্ত কণা পরস্পরের সংযোগ-বিয়োগ প্রক্রিয়ার জন্য গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ যদি তাদের সংযোগ ঘটে যায়, তা অস্থির হয়, যার ফলে পরবর্তী উৎপাদের সৃষ্টি সম্ভব হয় না।
“সুশুখতমোऽপ্যন্যোদরর্যো” দূরবর্তী উখা অর্থাৎ সুদূর আকাশে অবস্থিত সপ্তদশ স্তোম নামে পরিচিত সতেরোটি গায়ত্রী রশ্মিতে যাদের সম্বন্ধে বেদবিজ্ঞান-আলোক ৩.৪২.২-এ পাঠযোগ্য বর্তমান কোনো সূক্ষ্ম পদার্থ যদিও নিজের স্থানে সৃজন-প্রক্রিয়ার জন্য সুখকর অর্থাৎ অনুকূল হয়;
“মনসাপি ন মন্তব্যঃ ময়ং পুত্র ইতি” তবুও মনত্ব দ্বারা তা অপ্রকাশিতই থাকে, অর্থাৎ সৃজন-প্রক্রিয়ার উপযোগী হয় না। কারণ এই যে, দূরস্থিত বা অসুর-পদার্থে আবৃত সেই সংযোজ্য পদার্থ নিজের স্থানে সৃষ্টিকর্ম সম্পন্ন করতে পারে, কিন্তু দূরে অবস্থিত কোনো পদার্থের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে না।
[“পুত্রঃ”তস্মাদাহুঃ কর্তুরিব পুত্র ইতি (কাঠ.সং. ১৩.৩), বরো হি পুত্রঃ (কাঠ.সং. ৯.১৪)]
এই কারণে সেই দূরবর্তী পদার্থকে এখানে অবস্থিত পদার্থ নিজের উৎপাদ বা উৎপাদক বলে মানতে পারে না। এখানে ‘পুত্র’ শব্দের অর্থ শ্রেষ্ঠ নির্মাতা এবং নিজের কর্মরূপ পদার্থ (উৎপাদ) উভয়ই গ্রহণ করতে হবে।
“অথ স অকঃ পুনরেব তদেতি যৎ আগতো ভবতি অক ইতি নিবাসনামোচ্যতে” অর্থাৎ এরপরও সে চলে যায় সেই স্থানে, যেখান থেকে এসেছে। এর তাৎপর্য এই যে, দূরবর্তী পদার্থ যদি কোনো আকর্ষণবলে আকৃষ্ট হয়ও, তা কিছুদূর এসে আবার পূর্ববর্তী স্থানে ফিরে যায়। অনুরূপভাবে কোনো অণু যদি দৃঢ় বলযুক্ত হয় এবং কোনোভাবে ভাঙে এবং তার কিছু আয়ন অন্য কোনো আয়নের সঙ্গে যুক্ত হয়, কিন্তু তাদের মধ্যবর্তী বন্ধনবল দুর্বল হয়, তবে সেই আয়ন ভেঙে পূর্ব-অণুর রূপ গ্রহণ করে। এখানে উদ্দেশ্য এই যে, আয়নদের মিলন দ্বারা অণু-গঠনের একটি নিয়মযুক্ত প্রক্রিয়া আছে।
“এতু নো বাজী বেজনবান্ অভিঋষমানঃ সপত্নান্ নবজাতঃ স এব পুত্র ইতি” এখানে ‘নঃ’ সর্বনামটি সেই কণাদের জন্য ব্যবহৃত, যারা সংযোগের ইচ্ছুক। ফলে এই পাদের অর্থ এই কণারা এমন নূতন উৎপন্ন কণার কামনা করে, যাদের উপযুক্ত বেগ ও শক্তি আছে এবং যারা বাধক অসুর-প্রভৃতি পদার্থকে কম্পিত ও দমনে সক্ষম। এখানে ইঙ্গিত এই যে, কোনো ক্ষেত্রে যেসব কণা সংযোজনে উপযুক্ত, সেই ধরনের কণাই ঐ ক্ষেত্রে উৎপন্ন হতে থাকে। তারা পূর্ব-উৎপন্ন কণাদের অপত্য অর্থাৎ কর্মরূপ। পাশাপাশি তারা সংযোগাদি ক্রিয়ায়ও শ্রেষ্ঠ, তাই তাদের ‘পুত্র’ বলা হয়েছে।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ