শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

13 June, 2021

শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা


 জগদীশ্বরানন্দ

 ভূমিকা

(স্বামী জগদীশ্বরানন্দ)

ভূমিকা-সূচী

1) প্রস্তাবনা
2) গীতার মহিমা
3) গীতার প্রাচীনত্ব
3.1) গীতা ও বৌদ্ধধর্ম
3.2) গীতা ও মহাভারত
3.2.1) কালনির্ণয়ে জ্যোতিষশাস্ত্র
3.3) গীতা ও পতঞ্জলির যোগসূত্র
3.4) গীতা ও ব্রহ্মসূত্র
3.5) গীতা ও উপনিষদ্‌
3.6) গীতা ও শতপথ-ব্রাহ্মণ
4) গীতার ভাষা
5) গীতাসাহিত্য

6) গীতার ঐতিহাসিক সমালোচনা
6.1) গীতা মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত ?
6.2) গীতা মহাভারতের প্রকৃত অংশ
7) গীতার শ্লোকসংখ্যা
7.1) ব্যাসদেবের মত
7.2) শ্রীচৈতন্যদেবের মত
7.3) প্রাচীন হস্তলিখিত পুঁথি
7.4) কাশ্মীরী গীতা
7.5) শঙ্করাচার্যের মত
7.6) শুদ্ধ ধর্মমণ্ডল গীতা
7.7) আলবেরুনির মত
7.8) ফারসী ও আরবী অনুবাদ
8) গীতার বিবিধ ভারতীয় ব্যাখ্যা
8.1) অদ্বৈতবাদ
8.2) বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ
8.3) দ্বৈতবাদ
8.4) দ্বৈতাদ্বৈতবাদ
8.5) অন্যান্য ব্যাখ্যা
8.6) ত্যাগই গীতার বাণী
9) গীতার বৈদেশিক ব্যাখ্যা 
10) গীতার প্রচার
10.1) ইংরেজী অনুবাদ
10.2) অন্যান্য বিদেশী ভাষায় অনুবাদ
10.3) বাংলায় অনুবাদ
10.4) গীতার অন্যান্য প্রচার
11) গীতা ও উপনিষদাবলী
11.1) উপনিষদ্‌ এবং গীতার শ্লোকে সাদৃশ্য
11.2) গীতা এবং ব্রহ্মতত্ত্ব
11.3) যুদ্ধক্ষেত্রে গীতা কিরূপে উপদিষ্ট হইল ?
12) গীতা ও ভাগবত
13) গীতার উদারতা
14) গীতায় আত্মার অমরত্ব
15) গীতায় অবতারবাদ
16) গীতোক্ত কর্মযোগ
17) বৌদ্ধধর্ম ও গীতা
17.1) যোগক্ষেম শব্দের ব্যবহার
18) গীতায় যোগচতুষ্টয়ের সমন্বয়
18.1) নিষ্কাম কর্মযোগ দ্বারা মুক্তি
18.2) জ্ঞানযোগ দ্বারা মুক্তি
18.3) ভক্তিযোগ দ্বারা মুক্তি
18.4) রাজযোগ দ্বারা মুক্তি
19) গীতাকবচ
20) গীতামাহাত্ম্য
 

1) প্রস্তাবনা

গীতা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থ । গীতা যে শুধু হিন্দুধর্মের সকল সম্প্রদায় কর্তৃক সমাদৃত তাহা নহে, অন্যান্য ধর্মাবলম্বী অসংখ্য নরনারী শ্রদ্ধাভরে ইহা পাঠ করেন । জার্মান মনীষী উইলিয়াম ভন হামবোল্‌ট বলিয়াছেন, "গীতার মতো সুললিত, সত্য এবং সুগভীর তত্ত্বপূর্ণ পদ্যগ্রন্থ সম্ভবতঃ পৃথিবীর আর কোন ভাষায় নাই ।" পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ছত্রিশটি ভাষায় আজ পর্যন্ত ইহার পঁচিশ শতাধিক সংস্করণ হইয়াছে । জার্মান, ফরাসী, ইংরেজী প্রভৃতি ইওরোপের প্রধান ভাষাসমূহে গীতার অনুবাদ বিদ্যমান । ১৭৮৫ খ্রীষ্টাব্দে গীতার প্রথম ইংরেজী অনুবাদ লণ্ডনে মুদ্রিত হয় । অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে রুশ ভাষায় গীতার অনুবাদ হইয়াছিল । প্রসিদ্ধ ইংরেজ মনীষী কার্লাইল বিখ্যাত মার্কিন মনীষী এমার্সনের সহিত সাক্ষাৎকালে তাঁহাকে একখানি গীতা উপহার দিয়াছিলেন । গীতার প্রভাব এমার্সনের সারগর্ভ রচনাবলীতে সুস্পষ্ট দেখা যায় । তিলক বলেন, "গীতার মতো অপূর্ব গ্রন্থ সংস্কৃত সাহিত্যে কেন, জগতের সাহিত্যে দুর্লভ ।"


2) গীতার মহিমা

স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, "উপনিষদ্‌ হইতে আধ্যাত্মিক তত্ত্বের কুসুমরাজি চয়ন করিয়া গীতারূপ এই সুদৃশ্য মাল্য গ্রথিত হইয়াছে ।" 

মহাত্মা গান্ধী বলেন, "গীতা মানবের পারমার্থিক জননী । আমার গর্ভধারিণীর স্বর্গগমনের পর গীতা তাঁহার স্থান অধিকার করিয়াছে ।" 

সমগ্র মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠ সূরি তাঁহার গীতাব্যাখ্যার প্রারম্ভে লিখিয়াছেন - 'মহাভারতে সকল বেদের সারার্থ সংগৃহিত । আর সমগ্র মহাভারতের সারতত্ত্ব গীতায় বর্তমান । সেইজন্য গীতা সর্বশাস্ত্রময়ী । সকল শাস্ত্রের সার গীতায় নিহিত ।' 

কেশব কাশ্মীরী সত্যই বলিয়াছেন - "শ্রীভগবান্‌ করুণাপূর্বক ভবসাগর পার হইবার জন্য গীতারূপ নৌকা সৃষ্টি করিয়াছেন । উহার সাহায্যে ভগবদ্ভক্তগণ অনায়াসে সংসার-সমুদ্র অতিক্রম করিতে পারিবেন ।" 

বাংলার ভূতপূর্ব গবর্ণর লর্ড রোনাল্ডসের মতে গীতাতত্ত্বই ভারতীয় চিন্তার পূর্ণ পরিণতি ও সূক্ষ নির্যাস ।

মোগল সম্রাট্‌ শাজাহানের পুত্র দারাশিকো লিখিয়াছেন, "গীতা স্বর্গীয় আনন্দের অফুরন্ত উৎস । সর্বোচ্চ সত্যলাভের সুগম পথ গীতায় প্রদর্শিত । গীতায় পরমপুরুষের কথা বিবৃত ও ব্রহ্মবিদ্যা ব্যাখ্যাত । গীতা ইহলোক ও পরলোকের সুগভীর ও শ্রেষ্ঠ রহস্যের দ্বারোদ্ঘাটন করেন ।"

ইংরেজ মনীষী ডক্টর এল.ডি.বার্নেট বলেন, "লক্ষ লক্ষ লোক গীতা পড়িয়াছেন বা শুনিয়াছেন । সকলেই উহার পাঠে বা শ্রবণে বুঝিতে পারেন যে, ঈশ্বরলাভের দুর্গম পথে উহা শ্রেষ্ঠ সম্পদ ও সহচর । জীবনের প্রত্যেক কর্মকে অনাসক্তির অনলে শুদ্ধ করিয়া উপাসনায় পরিণত করার যে অপূর্ব কৌশল গীতা শিক্ষা দেয়, তাহা মানবের কর্মজীবনের অনন্য অবলম্বন ।"

শোনা যায়, জনৈক ফরাসী তত্ত্বপিপাসু দ্বাদশ বৎসর গীতার স্বাধ্যায় করিয়া বলিয়াছেন, "গীতাকে ধর্মজীবনের চিরসঙ্গী করিলে অন্য কোন ধর্মগ্রন্থপাঠের আবশ্যকতা থাকে না ।"

এক শত ষাট বৎসর পূর্বে ব্রিটিশ ভারতের প্রথম গবর্ণরজেনারেল ওয়ারেন্‌ হেস্টিংস, চার্লস উইলকিন্স-কৃত গীতার ইংরেজী অনুবাদের ভূমিকায় লিখিয়াছেন - "গীতার প্রাচীনত্ব এবং যে পূজা উহা বহু শতাব্দী যাবৎ মনুষ্যজাতির এক বৃহদংশের নিকট হইতে পাইয়া আসিতেছে তাহার দ্বারা গীতা সাহিত্য-জগতে এক অভূতপূর্ব বিস্ময় উৎপাদন করিয়াছে । উহার সাহিত্যিক গুণাবলী জগতে অননুকরণীয় । গীতাপাঠে শুধু ইংরেজগণ কেন, সমগ্র বিশ্ববাসী উপকৃত হইবেন । গীতাধর্মের অনুশীলনে মাননজীবন শান্তিধামে পরিণত হইবে ।

গীতা হিন্দুদের নৈতিক উন্নতি, সাহিত্য-সৃষ্টি ও পৌরাণিক রহস্যভেদের আশ্চর্যজনক প্রামাণিক গ্রন্থের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন । যদিও ইওরোপের সভ্যতা, ধরমাচরণ ও নৈতিক ব্যবহার গীতোক্ত শিক্ষা হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, তথাপি উহা আমাদের ধর্মসাধনে ও নৈতিক কর্তব্যপালনে বিশেষ সহায়ক হইবে । যে সাধনতত্ত্বের বিষয়ে ইওরোপের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতকুল এবং সাধকগণ অজ্ঞ, ভারতের সেই সনাতন সাধনার কথা গীতা বলিয়াছেন । গীতার মৌলিকত্ব, ভাবের গভীরতা ও অভিনবত্ব, দার্শনিক তত্ত্বের উচ্চতা, বলিষ্ঠ যুক্তিতর্ক ও ব্যাখ্যা-কৌশল অপূর্ব ও অসাধারণ । গীতার উপদেশ খ্রীষ্টান ধর্মের মূলসূত্রগুলির প্রকৃত ও সরল ব্যাখ্যা পাওয়া যায় ।"


3) গীতার প্রাচীনত্ব


3.1) গীতা ও বৌদ্ধধর্ম :-

গীতা যে কত প্রাচীন সেই সম্বন্ধে পণ্ডিতগণের মধ্যে বিশেষ মতভেদ আছে । অনেকের মত - গীতা ভগবান্‌ বুদ্ধের পরবর্তী । ডাঃ লরিনসারের মতে গীতা বুদ্ধদেবের জন্মের অনেক পরে; এমন কি যীশুখ্রীষ্টের আবির্ভাবের কয়েক শতাব্দী পরে রচিত । মারাঠী পণ্ডিত টেলাং তাঁহার গীতার উপক্রমণিকায় লিখিয়াছেন যে, উহা খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীরও কিছু পূর্বে লিখিত এবং ডাঃ লরিনসারের অযৌক্তিক উক্তির তীব্র সমালোচনা করিয়াছেন ।

স্যার আর.জি.ভাণ্ডারকর তাঁহার "Vaisnavism and Saivism" (p.13) গ্রন্থে বলেন - "গীতাতে ব্যূহের কোন উল্লেখ নাই । সুতরাং ইহার জন্মতারিখ, শিলালিপি ও নির্দেশ পতঞ্জলির বহু পূর্বে অর্থাৎ গীতার উৎপত্তি খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর প্রারম্ভের পরে কিছুতেই নহে; তবে চতুর্থ শতাব্দীর কত পূর্বে ইহার জন্ম তাহা নিশ্চয় করা সুকঠিন । গীতা যখন রচিত হয়, তখন বাসুদেব ও নারায়ণ অভেদ-জ্ঞানে পূজিত বা বাসুদেব বিষ্ণুর অবতাররূপে গৃহীত হন নাই । গীতাতে [১০|২১] বিষ্ণুকে প্রধান আদিত্য বলা হইয়াছে, পরমপুরুষ বলা হয় নাই এবং দশম অধ্যায়ে বাসুদেবকে সীমান্বিতভাবে বিষ্ণু বলা হইয়াছে; প্রত্যেক শ্রেণী বা জাতির মধ্যে যিনি শ্রেষ্ঠ তিনিই তাঁহার দিব্য বিভূতি, 'তেজোহংশসম্ভবম্‌' । সুতরাং মারাঠী পণ্ডিত ভাণ্ডারকরের মতে গীতার জন্ম অন্ততঃ খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর পূর্বে ।

জার্মান পণ্ডিত গার্বের মতে মূল গীতা খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে এবং গীতার আধুনিক কলেবর খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে উৎপন্ন ।

নবম শতাব্দীতে শঙ্করাচার্য গীতাভাষ্য রচনা করেন । পঞ্চম শতাব্দীতে আবির্ভূত মহাকবি কালিদাস গীতার বিষয় অবগত ছিলেন । কালিদাসের 'রঘুবংশে' [১০|৩১] একটি বাক্য আছে, যাহার সহিত গীতার একটি শ্লোকের [৩|২২] নিকট-সাদৃশ্য আছে । সপ্তম শতাব্দীতে বাণভট্ট তাঁহার গ্রন্থে গীতার উল্লেখ করিয়াছেন । খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে বহু পুরাণ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার অনুকরণে অন্যান্য গীতা সৃষ্টি করিয়াছেন । ভাসের 'কর্ণভার' নাটকে 'হতোহপি লভতে স্বর্গং জিত্বা তু লভতে যশঃ' - এই বাক্যটি গীতার একটি শ্লোকের [২|৩৭] প্রথমার্ধের প্রতিধ্বনি মনে হয় । ভাসের আবির্ভাবকাল কখনও খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে, কখনও বা খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে নির্দিষ্ট হয় । বোধায়নের (সম্ভবতঃ পঞ্চম শতাব্দীর) গৃহসূত্র ও পিতৃমেধসূত্রে গীতার শ্লোক উদ্ধৃত এবং বাসুদেবের উপাসনা বিবৃত আছে ।

ডাঃ সর্বেপল্লী রাধাকৃষ্ণন্‌ বলেন, গীতা খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে রচিত । ডাঃ সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের মতে গীতা বুদ্ধের পূর্ববর্তী কালে উৎপন্ন এবং উহা ভাগবত-ধর্মের প্রাচীনতম গ্রন্থ । ভাগবত-ধর্মের প্রাচীনত্ব তিলকসেনার্ট ও বুহ্‌লার কর্তৃক স্বীকৃত । বুহ্‌লার সাহেব বলেন যে, খ্রীষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে জৈনধর্মের আবির্ভাবের বহু পূর্বে ভাগবত-ধর্মের উৎপত্তি । ডাঃ দাশগুপ্ত আরও বলেন, "গীতাতে বৌদ্ধ মতের কোন প্রকার উল্লেখ নাই এবং উহার ভাষাও পাণিনীয় নহে । সুতরাং গীতা নিশ্চিতই বুদ্ধের পূর্বে রচিত, কিছুতেই বুদ্ধের পরবর্তী যুগের নহে ।"

কেহ কেহ গীতায় নির্বাণ-শব্দটি কয়েকবার উল্লিখিত দেখিয়া মত প্রকাশ করেন যে, গীতা বৌদ্ধযুগে সৃষ্ট; কিন্তু এই প্রকার যুক্তি নিতান্ত অগভীর ও অর্বাচীন । কারণ, নির্বাণ-শব্দটি বৌদ্ধদের নিজস্ব নহে, উহা গীতাতে পাঁচবার ব্যবহৃত হইয়াছে [২|৭২, ৫|২৪,২৫,২৬, ৬|১৫] । কিন্তু এই পাঁচটি শ্লোকে নির্বাণ-শব্দটি ব্রহ্ম-শব্দের সহিত সদা সংযুক্ত দৃষ্ট হয় । গীতায় ব্রহ্মনির্বাণের অর্থ ব্রাহ্মী স্থিতি, বৌদ্ধ নির্বাণের মতো 'শূন্য' নহে । সুতরাং বৌদ্ধগণই যে গীতা হইতে নির্বাণ-শব্দটি গ্রহণ করিয়াছেন - এই মতই অধিকতর সমীচীন মনে হয় । অতএব স্পষ্টই প্রতীত এবং প্রমাণিত হয় যে, গীতা ভগবান্‌ বুদ্ধের পূর্বে রচিত ।



3.2) গীতা ও মহাভারত :-

গীতাকে  মহাভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশরূপে ধরিলে উহার আরও প্রাচীনত্ব প্রমাণিত হয় । রমেশচন্দ্র দত্ত এবং প্র্যাট্‌ সাহেবের মতে মহাভারত খ্রীঃপূঃ ১২শ শতাব্দীতে রচিত । মহাভারতে অগ্নি, ইন্দ্রাদি বৈদিক দেবতার উপাসনা আছে । বৌদ্ধযুগে উক্ত মহাকাব্য প্রসিদ্ধ ছিল । উহাতে বুদ্ধ ও বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে কোন প্রকার উল্লেখ না থাকায় ম্যাক্‌ডোনেল বলেম, "মহাভারতের আদিম আকৃতি অন্ততঃ খ্রীঃপূঃ ৫ম শতাব্দীতে উৎপন্ন ।" আশ্বলায়ন সূত্রে মহাভারতের উল্লেখ আছে । গুপ্তরাজগণের শিলালিপিতে মহাভারতের নাম স্পষ্টভাবে উল্লিখিত । কবি ভাস তাঁহার বহু রচনার ঘটনা মহাভারত হইতে গ্রহণ করিয়াছেন । অশ্বঘোষ তাঁহার 'বুদ্ধচরিত' ও 'সৌন্দরনন্দ' কাব্যে মহাভারতের উল্লেখ করিয়াছেন । বুহ্‌লার ও কির্‌স্টে (Buhler & Kirste) তাঁহাদের 'Contributions to the Study of the Mahabharat' নামক গ্রন্থে বলেন যে, মহাভারতের যে আকার বর্তমানে দৃষ্ট হয়, তাহা খ্রীষ্টীয় তৃতীয় শতকে বিজ্ঞাত এবং ৫ম শতকে প্রায় একই প্রকার ছিল । উহার কিয়দংশ পুরাণের যুগে রচিত । ডাঃ রাধাকৃষ্ণনের মতে মহাভারত অন্ততঃ খ্রীঃপূঃ ৫ম শতাব্দীতে উহার বর্তমান আকার লাভ করিয়াছিল । সম্ভবতঃ উহার মৌলিক আকৃতি খ্রীঃপূঃ ১১শ শতকে উৎপন্ন ।


3.2.1) মহাভারত ও গীতার কালনির্ণয়ে জ্যোতিষশাস্ত্র :-

মহাভারত যত প্রাচীন, গীতাও তত প্রাচীন । ১৯৪৪ খ্রীঃ এপ্রিল মাসে কাশীতে যে নিখিল ভারত প্রাচ্য সম্মেলন হইয়াছিল তাহাতে তিনজন জ্যোতির্বিদ পণ্ডিত গীতার কালনির্ণয়বিষয়ক তিনটি প্রবন্ধ পাঠ করেন । মিঃ কারান্তিকর বলেন খ্রীঃপূঃ ১৯৩১ অব্দে গীতোক্ত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হইয়াছিল । ডাঃ দফ্‌তরীর মতে খ্রীঃপূঃ ১১৬২ এবং অধ্যাপক সেনগুপ্তের মতে খ্রীঃপূঃ ২৫৬৬ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কাল ।

লোকমান্য তিলক 'মাসানাং মার্গশীর্ষোহহম্‌' [১০|৩৫] - গীতার এই শ্লোকাংশ জ্যোতিষশাস্ত্রের দিক হইতে আলোচনা করিয়া এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন যে, খ্রীষ্টজন্মের ১৪০০ বৎসর পূর্বে গীতা রচিত হইয়াছিল ।



3.3) গীতা ও পতঞ্জলির যোগসূত্র :-

'যোগ' শব্দটি  উভয় গ্রন্থে ব্যবহৃত হইলেও পতঞ্জলির যোগশব্দ অপেক্ষা গীতার যোগশব্দ অধিকতর ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত । যোগসূত্রের ৭০টি সূত্রের মধ্যে ১২টি সূত্রের শব্দপ্রয়োগে এবং গীতার শব্দপ্রয়োগে সমতা পরিলক্ষিত হয় । ইহাতে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, গীতা পতঞ্জলিসূত্র অপেক্ষা প্রাচীনতর । পতঞ্জলি পাণিনীয় সূত্রের ভাষ্যকার, সুতরাং পাণিনির পরবর্তী । পতঞ্জলি পাণিনির ১০০ বা ১৫০ বৎসর পরবর্তী । পাণিনির সময় খ্রীঃপূঃ  ৮০০ হইতে খ্রীঃপূঃ ৫০০ বৎসরের মধ্যে ।


3.4) গীতা ও ব্রহ্মসূত্র :-

গীতায় 'ব্রহ্মসূত্র' শব্দটির প্রয়োগ দেখিয়া কোন কোন পণ্ডিত মনে করেন, গীতা ব্রহ্মসূত্রের পরবর্তী । কিন্তু ব্রহ্মসূত্রের মধ্যে বৌদ্ধমতের উল্লেখ থাকায় ব্রহ্মসূত্রের সময়  খ্রীঃপূঃ ২৫০ অব্দ বলা যাইতে পারে । সুতরাং পূর্বোক্ত যুক্তির কোন সারবত্তা নাই ।
 

3.5) গীতা ও উপনিষদ্‌ :-

মিঃ টেলাঙ্গ এবং অন্যান্য পণ্ডিত গীতা এবং মুণ্ডক ও শ্বেতাশ্বতরাদি উপনিষদের ভাবসাদৃশ্য এবং অনেক স্থলে ভাষাসাদৃশ্য লক্ষ্য করিয়া অনুমান করেন যে, গীতা এবং মুণ্ডক ও শ্বেতাশ্বতরাদি উপনিষদ্‌ সমসাময়িক । মুণ্ডক উপনিষদে 'অষ্টাদশোক্তমবরং যেষু কর্ম' [১|২|৭] মন্ত্রাংশে সম্ভবতঃ অষ্টাদশ অধ্যায়াত্মক কোন গ্রন্থকে লক্ষ্য করিয়াছে । গীতা এবং মুণ্ডক উপনিষদে 'অবরং কর্ম' শব্দের প্রয়োগ আছে । ইহা হইতে মনে হয়, গীতা ও মুণ্ডক উপনিষদ্‌ সমসাময়িক । শ্রুতির ও স্মৃতির মধ্যবর্তী যুগে উপনিষৎসমূহ রচিত । 'গীতাসূপনিষৎসু' বাক্যেও গীতা উপনিষদ্‌রূপে অভিহিত ।


3.6) গীতা ও শতপথ-ব্রাহ্মণ :-

পণ্ডিতগণের মতে শতপথ-ব্রাহ্মণ শ্রুতির সময়ের শেষভাগে রচিত । 'কৃত্তিকাঃ প্রাচৈঃ দিশৈঃ ন চ্যবন্তে' এই বাক্য হইতে মিঃ বৈদ্য প্রমাণ করিয়াছেন যে, শতপথ-ব্রাহ্মণ খ্রীষ্টজন্মের অন্ততঃ তিন হাজার বর্ষ পূর্বে রচিত । এইরূপে মিঃ বৈদ্য এবং অধ্যাপক ভি.বি.আঠাওয়ালে বহু অকাট্য যুক্তি দ্বারা প্রমাণ করিয়াছেন, গীতা খ্রীঃপূঃ তিন হাজার বর্ষ পূর্বে রচিত 

4) গীতার ভাষা

গীতার ভাষা প্রাঞ্জল, সহজবোধ্য ও সুখপাঠ্য । গীতার সংস্কৃত সরল ও সাবলীল । তাহাতে অতি প্রাচীন শব্দের প্রয়োগে ব্যাকরণের সূত্র লঙ্ঘিত হইলেও মনে হয়, গীতার সময় সংস্কৃত প্রচলিত ভাষা ছিল, কেবলমাত্র পণ্ডিতগণের ভাষা ছিল না । কবিত্ব ও দার্শনিকতার এমন অপূর্ব সম্মিলন কুত্রাপি দেখা যায় না । সুমিষ্ট ও সরল সংস্কৃতে শ্লোকগুলি রচিত এবং কয়েকবার পাঠেই কণ্ঠস্থ হইয়া যায় । জীবন্ত ভাবটি ভাষার পাতলা আবরণ ভেদ করিয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে । ডাঃ সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের মতে গীতার ভাষা বিস্তরশঃ অপাণিনীয় ও অপ্রচলিত (archaic)  এবং ভাষাভঙ্গীও অত্যন্ত প্রাচীন । গীতায় যে-সকল অপাণিনীয় বা আর্ষপ্রয়োগ আছে, তিনি তাঁহার নিম্নলিখিত তালিকা দিয়াছেন - 

'যুধ্য' স্থলে 'যুধ্যস্ব' [৩|৩০]
'নিবৎস্যসি' স্থলে 'নিবসিষ্যসি' [১২|৮]
'মা শোচীঃ' স্থলে 'মা শুচঃ' [১৬|৫]
'যমঃ সংযচ্ছতাম্‌' স্থলে 'যমঃ সংযমতাম্‌' [১০|২৯]
'প্রিয়ায়া অহর্সি' স্থলে 'প্রিয়ায়ার্হসি' [১১|৪৪]
'সেনান্যাম্‌' স্থলে 'সেনানীনাম্‌' [১০|২৪]

আত্মনেপদী ধাতুর পরস্মৈপদী-রূপে ব্যবহারঃ-

যত্‌ [৬|৩৬, ৭|৩, ৯|১৪, ১৫|১১]রম্‌ [১০|৯]বিজ্‌ [৫|২০]

পরস্মৈপদী ধাতুর আত্মনেপদী-রূপে ব্যবহারঃ-

কাঙ্ক্ষ্‌ [১|৩১]ব্রজ্‌ [২|৫৪]বিশ্‌ [১৮|৫৫]ইঙ্গ্‌ [৬|১৯, ১৪|২৩]

আর্ষ সন্ধি - 'হে সখেতি' [৩|১০]

'শক্লোষি' স্থলে 'শকস্যে' [১১|৮, মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠ]
'ইমং মহিমানং' স্থলে 'ইদং মহিমানং' [১১|৪১, মধুসূদন সরস্বতী]
'নমস্কৃত্য' স্থলে 'নমস্কৃত্বা' [১১|৩৫, মধুসূদন সরস্বতী]
'ইমং ধর্মং' স্থলে 'ধর্মস্যাস্য' [১১|৩৫, মধুসূদন সরস্বতী]

এইরূপ প্রায় ৩২টি আর্ষপ্রয়োগ গীতাতে আছে । ভাণ্ডারকর স্মৃতিগ্রন্থে (Commemoration Volume) প্রকাশিত শ্রী ভি.কে.রাজয়াডে উক্ত প্রকার অশুদ্ধির বহু দৃষ্টান্ত দিয়াছেন । এই প্রকার ভাষাগত অনিয়মের দ্বারা গীতার প্রাচীনত্বই প্রমাণিত হয় । পাণিনীয় ব্যাকরণের সূত্র "বাসুদেবার্জুনাভ্যাম্‌ বুঞ" [৪|৩৯৮] হইতে মনে হয়, পাণিনি মহাভারতীয় আখ্যায়িকার সহিত পরিচিত ছিলেন । সুতরাং গীতা যে পাণিনীয় ব্যাকরণের পূর্ববর্তী ইহা নিঃসন্দেহ এবং উহাতে অপাণিনীয় প্রয়োগ অবশ্যম্ভাবী ।

গীতার [৩|১৯,৩৬] শ্লোকদ্বয়ে পুরুষ শব্দে (দীর্ঘ) ঊকারের ব্যবহার দৃষ্ট হয় । গীতার বোধায়ন ভাষ্যের হস্তলিখিত পুঁথির মতে 'ছন্দের অনুরোধে উক্ত (দীর্ঘ) ঊকার ব্যবহৃত' । আবার 'পুরুষ' শব্দ যে অপাণিনীয় নহে, তাহা পাণিনিকৃত অষ্টাধ্যায়ীর সূত্র [৬|৩|১৩৭] হইতে জানা যায় ।
 

5) গীতাসাহিত্য

গীতার উপর বহু ভাষ্য ও টীকাদি (১৫-১৬টি) লিখিত হইয়াছে । গীতার শঙ্করভাষ্যই প্রাচীনতম প্রাপ্ত ভাষ্য । শঙ্করের পূর্বেও যে গীতার ভাষ্যাদি রচিত হইয়াছিল, তাহার স্পষ্ট উল্লেখ দেখা যায় । গীতার শঙ্করভাষ্যের টীকায় [২|১০] আনন্দজ্ঞান গিরি বলেন, বেদান্তসূত্রের টীকাকার বোধায়ন গীতার উপর একটি বৃত্তি রচনা করিয়াছিলেন; কিন্তু উহা এখন পাওয়া যায় না । বোধায়নকে এইজন্য বৃত্তিকার বলা হয় ।

শঙ্করভাষ্য হিন্দী, মারাঠী, বাংলা, ইংরেজী, জার্মান প্রভৃতি ভাষায় অনূদিত হইয়াছে । শঙ্করভাষ্যের উপর আনন্দগিরি এবং রামানন্দ-কৃত যথাক্রমে 'বিবরণ' ও 'ব্যাখ্যা' নামক টীকাদ্বয় আছে । শঙ্করের পরে গীতার উপর ভাষ্যাদি রচনা কিছুকালের জন্য বন্ধ ছিল, মনে হয় ।

মধ্বাচার্য (আনন্দতীর্থ) ত্রয়োদশ শতাব্দীতে যে গীতাভাষ্য রচনা করিয়াছিলেন, তাহার উপর জয়তীর্থকৃত 'প্রমেয়দীপিকা' নামক টীকা আছে । মধ্বাচার্য-কৃত 'ভগবদ্‌গীতা-তাৎপর্য-নির্ণয়'র উপর জয়তীর্থ 'ন্যায়দীপিকা' নামক টীকা লিখিয়াছেন ।

রামানুজাচার্য (ব্রহ্মসূত্রের 'শ্রীভাষ্য'-রচয়িতা) একাদশ শতাব্দীতে বিশিষ্টাদ্বৈত-মতানুযায়ী যে গীতাভাষ্য রচনা করিয়াছিলেন, তাহার উপর বেঙ্কটনাথের (বেদান্তাচার্যের) 'তাৎপর্য-চন্দ্রিকা' নামক টীকা আছে ।

রামানুজ-গুরু যামুনাচার্য-কৃত ১০ম শতাব্দিতে রচিত 'গীতার্থ-সংগ্রহে'র উপর নিগমান্ত মহাদেশিকের 'গীতার্থ-সংগ্রহ-রক্ষণ' এবং ১৪শ শতাব্দীর বরাবর মুনি-কৃত 'গীতার্থ-সংগ্রহদীপিকা' নামক টীকাদ্বয় বর্তমান । উল্লিখিত দ্বিতীয় টীকাটি কাঞ্জিভরম্‌ সুদর্শন প্রেস হইতে প্রকাশিত ।

যামুনাচার্য নামধারী দুই ব্যাক্তির গীতার উপর গদ্যে ও পদ্যে দুইটি টীকা পাওয়া যায় । গদ্য টীকাকার যামুনাচার্য বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী হইলেও রামানুজের গুরু নহেন । এই গদ্য টীকাটি কাঞ্জিভরম্‌ সুদর্শন প্রেস হইতে প্রকাশিত । উহাতে অন্বয়মুখে সরল পদার্থ দেওয়া আছে ।

বোম্বাই নির্ণয় সাগর প্রেস হইতে অষ্টভাষ্য-টীকা সম্বলিত যে গীতা প্রকাশিত হইয়াছে, তাহাতে শঙ্করভাষ্যের ব্যাখ্যা 'ভাষ্যোৎকর্ষদীপিকা' এবং মধুসূদন সরস্বতীর টীকার ব্যাখ্যা 'গূঢ়ার্থ-দীপিকা-তত্ত্বালোক' (মৈথিলী পণ্ডিত শ্রীধর্মদত্ত শর্মা-কৃত) আছে ।

একমাত্র ভারতীয় ভাষা মারাঠীতে গীতার উপর দুইটি প্রসিদ্ধ টীকা আছে - (i) মহারাষ্ট্রের ধর্মগুরু জ্ঞানেশ্বর-রচিত, (ii) বালগঙ্গাধর তিলক-কৃত 'গীতারহস্য'

তিলকের 'গীতারহস্য' এবং শ্রীঅরবিন্দের 'গীতানিবন্ধনিচয়' বর্তমান যুগের দুইটি শ্রেষ্ঠ ভাষ্য । উভয় ভাষ্যই বাংলা ও হিন্দী প্রভৃতি ভাষায় অনূদিত হইয়াছে ।



বর্ণানুক্রমে টীকাকারগণ :-

অভিনব গুপ্ত ও নৃসিংহ ঠাকুরের 'ভগবদ্‌গীতার্থ-সংগ্রহ'
আনন্দগিরি - 'গীতা-ভাষ্য-বিবেচন', 'গীতাশয়'

কল্যাণভট্ট - 'রসিক-রঞ্জিনী'
কেশবকাশ্মীরী‌ (নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের) - 'গীতা-তত্ত্ব-প্রকাশিকা'
কৈবল্যানন্দ সরস্বতী - 'ভগবদ্‌গীতা-সার'
কৃষ্ণ-ভট্ট বিদ্যাধিরাজ (মধ্বাচার্যের শিষ্য, চতুর্দশ শতাব্দী) - 'গীতা টীকা'

গোকুলচন্দ্র - 'ভগবদ্‌গীতার্থ-সার'
গৌরগোবিন্দ রায় (ব্রাহ্ম সমাজের) - 'গীতা-প্রপূর্তি'

নরহরি - 'ভগবদ্‌গীতা-সার-সংগ্রহ'
নীলকণ্ঠ (গোবিন্দ সূরির পুত্র) - 'ভাবদীপিকা'

প্রত্যক্ষ দেবজটাচার্য - ''ভগবদ্‌গীতার্থ-সংগ্রহ-টীকা'

বলদেব বিদ্যাভূষণ - 'গীতা-ভূষণ-ভাষ্য'
বল্লভাচার্য - 'গীতার্থ-বিবরণ'; তৎপুত্র-কৃত 'গীতাতাৎপর্য'
বাদিরাজ - 'ভগবদ্‌গীতা-লক্ষাভরণ'
বিঠ্‌ঠল দীক্ষিত - 'ভগবদ্‌গীতা-হেতু-নির্ণয়'
বিশ্বনাথ চক্রবর্তী - 'সারার্থবর্ষিণী'

জগদ্ধর - 'ভগবদ্‌গীতা-প্রদীপ'
জয়রাম - 'গীতাসারার্থ-সংগ্রহ'

দত্তাত্রেয় - 'প্রবোধ-চন্দ্রিকা'

মথুরানন্দ -'ভগবদ্‌গীতাপ্রকাশ'
মধুসূদন সরস্বতী - 'গূঢ়ার্থদীপিকা' (শব্দের সরলার্থ সহ)
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী - গুজরাটীতে গান্ধীভাষ্য

রাঘবেন্দ্র স্বামী (সুধীন্দ্র যতির শিষ্য, সপ্তদশ শতাব্দী) - 'গীতা-বিবৃতি', 'গীতা-সংগ্রহ', 'গীতার্থ-বিবরণ'
রাজানক (শৈবমতাবলম্বী) ও রামকণ্ঠ-কৃত 'সর্বতোভদ্র'

শ্রীধরস্বামী - 'সুবোধিনী'
শ্রীমৎ হনুমান্‌-কৃত গীতার 'পৈশাচভাষ্য'
শ্রীপুরুষোত্তম - 'অমৃত-তরঙ্গিণী'

সদানন্দ ব্যাস - 'ভাব-প্রকাশ'
সূর্যপণ্ডিত -'পরমার্থপ্রপা'

এতদ্ব্যতীত নিম্বার্ক, শঙ্করানন্দ, বিজ্ঞানভিক্ষু, কেশব ভট্ট, ব্রহ্মানন্দ গিরি, রামকৃষ্ণ, মুকুন্দদাস, রামনারায়ণ, অর্জুন মিশ্র, জনার্দন ভট্ট, দেববোধ, দেবস্বামী, নন্দকিশোর, নারায়ণ সর্বজ্ঞ, পরমানন্দ ভট্টাচার্য, যজ্ঞনারায়ণ, রত্নগর্ভ, লক্ষণ ভট্ট, শ্রীনিবাসাচার্য, বিমল বোধ, মধ্য মন্দির, বরদরাজ ব্যাসতীর্থ, সত্যাভিনব যতি, কৃষ্ণাচার্য, বিদ্যাধিরাজ, জয়রাম জয়তীর্থ, বৈশম্পায়ন, আজ্ঞেশ্বরপাল প্রমুখ অনেকেই গীতার উপর টীকাদি লিখিয়াছেন ।



6) গীতার ঐতিহাসিক সমালোচনা


6.1) গীতা মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত ?

আধুনিক পণ্ডিতগণ বাইবেলের ন্যায় গীতারও উচ্চতর বা ঐতিহাসিক সমালোচনা (higher or historical criticism) করিয়াছেন । জার্মান পণ্ডিত গার্বে সর্বপ্রথম গীতার ঐতিহাসিক সমালোচনা ও গবেষণা আরম্ভ করেন । ইনিই প্রথম জার্মান ভাষায় গীতার অনুবাদও প্রচার করিয়াছেন । উক্ত সমালোচনার স্থলে টালবয়েজ হুইলার, ডাঃ সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত প্রমুখ পণ্ডিতগণ বলেন যে, গীতা একখানি স্বতন্ত্র গ্রন্থ এবং মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত । গার্বের শিষ্য জার্মান সংস্কৃতজ্ঞ ডাঃ রুডল্‌ফ অটো গীতার উচ্চতর সমালোচনা করিয়া জার্মান ভাষায় যে বৃহৎ গ্রন্থ লিখিয়াছেন তাহার নাম 'The Original Gita'; বইখানি ইংরেজী ভাষায়ও অনুদিত হইয়াছে । অটো সাহেবের মতে গীতায় কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধ-বিষয়ক আখ্যায়িকা-অংশটি মহাভারতের প্রকৃত অংশ । এই আখ্যায়িকা-অংশ ১২৮টি শ্লোকের অনধিক, কিন্তু তিনি বলেন - ভক্তি, যোগ, জ্ঞান, কর্ম প্রভৃতি-সম্বন্ধীয় গীতার উপদেশগুলির পৃথক পৃথক গ্রন্থ এবং শ্রীকৃষ্ণের বাণীরূপে প্রচলিত করিবার উদ্দেশ্যেই মহাভারতের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে । সুতরাং এইগুলি প্রক্ষিপ্ত ।

6.2) গীতা মহাভারতের প্রকৃত অংশ

কিন্তু বালগঙ্গাধর তিলক এবং ডাঃ সর্বেপল্লী রাধাকৃষ্ণন এই বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেন । তাঁহারা বলেন, সমগ্র গীতাই মহাভারতের প্রকৃত অংশ । কারণ, প্রথমতঃ গীতা ও মহাভারতের অন্যান্য অংশের মধ্যে ভাষার নিকট সাদৃশ্য আছে এবং দ্বিতীয়তঃ মহাভারতের অন্যান্য পর্বে গীতার উল্লেখ আছে । ভীষ্মপর্বের ২৫ হইতে ৪২ অধ্যায়ই ভগবদ্‌গীতা । কিন্তু শান্তি ও অশ্বমেধ পর্বে এবং অন্যান্য বহু স্থলে ব্যাসদেব ভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণের মুখ-নিঃসৃত ভগবদ্‌গীতার সুস্পষ্ট উল্লেখ করিয়াছেন । ইহা হইতে নিঃসংশয়ে প্রমাণিত হয় যে, গীতা মহাভারতের প্রকৃত অংশ, প্রক্ষিপ্ত নহে । অটো সাহেবের পক্ষে কোন বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ এপর্যন্ত পাওয়া যায় নাই ।
 

7) গীতার শ্লোকসংখ্যা

গীতার শ্লোকসংখ্যা-সম্বন্ধে বিভিন্ন মত আছে । গীতার শ্লোকসংখ্যা সাত শত বলিয়াই এতকাল পাঠকসাধারণ অবগত আছেন । শঙ্করাচার্য হইতে আরম্ভ করিয়া করিয়া অদ্যাবধি সকল ভাষ্যকার, টীকাকার ও ব্যাখ্যাকারই গীতার উক্ত শ্লোকসংখ্যা নির্বিবাদে গ্রহণ করিয়াছেন । কিন্তু বর্তমান যুগের আধুনিক গবেষণাসমূহের অভিনব আবিষ্কার এই যে, গীতার বর্তমান আকারটি অঙ্গহীন ও অসম্পূর্ণ এবং উহার শ্লোকসংখ্যা ৭৪৫, ৭০০ নহে । ব্যাসদেবের বাক্যই এই মতের প্রথম ও প্রধান সমর্থক :-


7.1) ব্যাসদেবের মত

শ্রীকৃষ্ণকথিত শ্লোক ৬২০ + অর্জুনকথিত শ্লোক ৫৭ + সঞ্জয়কথিত শ্লোক ৬৭ + ধৃতরাষ্ট্রকথিত শ্লোক ১ = ৭৪৫ শ্লোকসংযুক্ত ব্যাসদেব কথিত গীতা  [মহাভারত, ভীষ্মপর্ব, ৪৩|৭]

षट्शतानि सविंशानि श्लोकानां प्राह केशवः । अर्जुनः सप्तपञ्चाशत्सप्तषष्टिं तु सञ्जयः ॥ धृतराष्ट्रः श्लोकमेकं गीताया मानमुच्यते । [Mahabharata, Bhisma Parva, 43|4]


ষট্শতানি সবিংশানি শ্লোকানাং প্রাহ কেশবঃ । অর্জুনঃ সপ্তপঞ্চাশৎসপ্তষষ্টিং তু সঞ্জয়ঃ ॥ ধৃতরাষ্ট্রঃ শ্লোকমেকং গীতায়া মানমুচ্যতে । [মহাভারত, ভীষ্মপর্ব, ৪৩|৪]


শ্রীকৃষ্ণকথিত শ্লোক ৫৭৫ + অর্জুনকথিত শ্লোক ৮৪ + সঞ্জয়কথিত শ্লোক ৪০ + ধৃতরাষ্ট্রকথিত শ্লোক ১ = ৭০০ শ্লোকসংযুক্ত প্রচলিত গীতা


7.2) শ্রীচৈতন্যদেবের মত

শ্রীচৈতন্যদেব তাঁহার প্রিয়শিষ্য গদাধরের লিখিত গীতায় নিজহস্তে শ্লোকসংখ্যার মান লিখিবার সময় মহাভারতের উক্ত শ্লোকটি উদ্ধৃত করিয়াছিলেন । মহাপ্রভুর এই পুঁথি এখনও ভরতপুরে (মুর্শিদাবাদ) গদাধরের শ্রীপাটে রক্ষিত আছে এবং ইহা লইয়া আলোচনাও হইয়াছে ।


7.3) প্রাচীন হস্তলিখিত পুঁথি

কাথিয়াবাড়স্থ গণ্ডাল স্টেটের রাজবৈদ্য জীবরাম কালিদাস শাস্ত্রী সুরাট ও কাশী হইতে দুইটি প্রাচীন ভূর্জপত্রে হস্তলিখিত পুঁথি সংগ্রহ করিয়াছেন যাহা পুস্তকাকারে গণ্ডাল রসশালা ঔষধাশ্রম হইতে প্রকাশিত হইয়াছে । ১১৭৯ খ্রীষ্টাব্দে লিখিত সুরাট থেকে সংগৃহীত গীতা অধিকাংশ স্থলে কাশ্মীরী গীতার অনুরূপ । ইহাতে প্রচলিত গীতা হইতে ২১টি নূতন ও অধিক শ্লোক এবং ২৫০টি পাঠান্তর পরিদৃষ্ট হয় । ১৬০৮ খ্রীষ্টাব্দে লিখিত কাশী থেকে সংগৃহীত গীতায় ৭৪৫টি শ্লোক আছে । এই গীতাদ্বয়ের প্রকাশের পর দেশি, বিদেশি গীতাবিদ্‌গণের মধ্যে গীতার শ্লোকসংখ্যা-সম্বন্ধে গভীর জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হইয়াছে । ৭৪৫টি শ্লোকসংযুক্ত গীতা ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও প্রকাশিত হইয়াছে, যদিও পাঠকসাধারণের ইহা অবিদিত ।


7.4) কাশ্মীরী গীতা

শ্রীনগর হইতে অভিনবগুপ্তাচার্যের টীকা-সম্বলিত যে কাশ্মীরী গীতার সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে তাহাতে ৭৪৫টি শ্লোক আছে । পুণার আনন্দাশ্রম হইতে প্রকাশিত ও রাজনক রামকবি-কৃত গীতার 'সর্বতোভদ্র' নামক টীকা এবং পুণার ভাণ্ডারকর ওরিয়েন্টাল ইন্সটিটিউট হইতে প্রকাশিত গীতাও কাশ্মীরী গীতাকেই অনুসরণ করিয়াছে । কাশ্মীরী গীতা হস্তলখিত পুঁথির আকারে বহু শতাব্দী যাবৎ প্রচলিত ছিল; এমন কি, শঙ্করাচার্যের সময়েও ছিল ।


7.5) শঙ্করাচার্যের মত

কিন্তু দক্ষিণ ভারতে কাশ্মীরী গীতার প্রচার ছিল না বলিয়া সম্ভবতঃ উহা শঙ্করাচার্যের দৃষ্টিগোচর হয় নাই । সেই যুগে এখনকার মতো যাতায়াতের, মুদ্রাযন্ত্রের বা ডাকের কোন সুবিধা না থাকায় এক প্রদেশের হস্তলিখিত পুঁথি অন্য প্রদেশে তেমন যাতায়াত করিতে পারিত না । তাই শঙ্করাচার্য গীতার শ্লোকসংখ্যা সাত শত বলিয়াই গ্রহণ করিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয় । যাহার ফলে তাঁহার পরবর্তী ভাষ্যকার ও টীকারগণও এই শ্লোকসংখ্যার পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করিতে সাহসী হন নাই । কিন্তু তিনিও তাঁহার ভাষ্যে ১|১ শ্লোকের কোন উল্লেখ করেন নাই ও ১৩|১ শ্লোকও অব্যাখ্যাত রাখিয়াছেন । অর্থাৎ তিনিও উক্ত শ্লোকদ্বয় গ্রহণ করেন নাই ।

শঙ্করাচার্যের পূর্বেও ৭৪৫ শ্লোকযুক্ত গীতার উপর বহু টীকা ছিল । কিন্তু মধ্যযুগে ধর্মান্ধ মুসলমানদিগের হাতে সংস্কৃত সাহিত্যের যে দুর্গতি হইয়াছিল তাহার ফলে অধিকাংশ হস্তলখিত পুঁথি বিনষ্ট হইয়াছে ।


7.6) শুদ্ধ ধর্মমণ্ডল গীতা

মাদ্রাজের শুদ্ধ ধর্মমণ্ডল হইতে যে গীতা মুদ্রিত হইয়াছে তাহার শ্লোকসংখ্যাও ৭৪৫ । তবে উক্ত গীতাতে প্রচলিত গীতা হইতে ৩৭টি শ্লোক বাদ দিয়া মহাভারতের উদ্যোগ, অনুশাসন ও শান্তিপর্ব হইতে ৮২টি শ্লোক যথেচ্ছভাবে গ্রহণপূর্বক গীতার শ্লোকসংখ্যাও ৭৪৫ করা হইয়াছে । এতদ্ব্যতীত এই গীতায় ২৬টি অধ্যায় আছে । আদ্য ও অন্ত্য অধ্যায়ের বিশেষ নাম এবং অবশিষ্ট ২৪টি অধ্যায়ের প্রত্যেকটিতে ২৪টি শ্লোক আছে ।


7.7) আলবেরুনির মত

একাদশ শতকে বিখ্যাত মুসলমান ঐতিহাসিক আলবেরুনি তাঁহার আরবী গ্রন্থে গীতার শ্লোকসংখ্যা সাত শতের অধিক ধরিয়াছেন । তিনি নিজেও সংস্কৃতবিদ্‌ ছিলেন এবং তাঁহার গ্রন্থে যে সকল শ্লোক উদ্ধার করিয়াছিলেন তাহা প্রচলিত গীতায় নাই ।


7.8) ফারসী ও আরবী অনুবাদ

সম্রাট্‌ আকবরের মন্ত্রী আবুল ফজল এবং তাঁহার ভ্রাতা ফৈজী গীতার যে দুইটি ফারসী অনুবাদ করিয়াছিলেন তাহার একটিতে স্পষ্ট উল্লিখিত আছে - 'সম্রাটের আদেশে গীতার ৭৪০ শ্লোকের ফারসী অনুবাদ সমাপ্ত হইল ।' গীতার আবুল ফজল-কৃত ফারসী অনুবাদ লণ্ডনস্থিত ইণ্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে অদ্যাপি রক্ষিত আছে । ফৈজীকৃত ফারসী অনুবাদ লাহোর, এলাহাবাদ, জয়পুর ও জলন্ধর প্রভৃতি স্থান হইতে বহুবার মুদ্রিত হইয়াছে । শাহ আলি দাস্তগীর-কৃত গীতার ফারসী অনুবাদের হস্তলিখিত পুঁথি কাশী মহারাজার গ্রন্থাগারে আজও রক্ষিত আছে । মোগল সম্রাটগণের আমলে গীতার একটি আরবী তর্জমা হইয়াছিল । তদুনাযায়ীও গীতার শ্লোকসংখ্যা ৭৪৫ ।


8) গীতার বিবিধ ভারতীয় ব্যাখ্যা

প্রত্যেক ভাষ্যকার ও টীকাকার স্ব স্ব ধর্মমত অনুযায়ী গীতার ব্যাখ্যা করিয়াছেন । বৃত্তিকার বোধায়নের মতে জ্ঞান ও কর্মের সমুচ্চয়ই গীতার প্রতিপাদ্য; পৃথগ্‌ভাবে কোনটাই মোক্ষদায়ক নহে ।

8.1) অদ্বৈতবাদ

শঙ্করাচার্য সমুচ্চয়বাদ খণ্ডনপূর্বক অদ্বৈতবেদান্তানুযায়ী গীতাভাষ্য লিখিয়াছেন । তিনি বলেন, 'গীতার সিদ্ধান্ত এই যে, কেবলমাত্র তত্ত্বজ্ঞানেই মুক্তিলাভ হয়, জ্ঞান ও কর্মের সমুচ্চয়ের ফলে নহে ।' তাঁহার মতে ব্রহ্মাত্মৈক্যদর্শনরূপ জ্ঞান দ্বারা অজ্ঞান বিনাশপূর্বক নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি, ব্রাহ্মীস্থিতি বা ব্রহ্মনির্বাণলাভই গীতার উপদেশ । অজ্ঞানই দ্বৈতভাব-উৎপাদক । এই দ্বৈতভাব হইতেই সকল কর্ম হয় । দ্বৈতভাব-নাশান্তে নিষ্ক্রিয় আত্মায় প্রতিষ্ঠিত হইলেই সর্বকর্মসন্ন্যাস হয় । নিষ্কাম কর্মের দ্বারা চিত্ত শুদ্ধ হইলে মেঘমুক্ত সূর্যের ন্যায় আত্মজ্ঞান প্রকাশিত হয় । আত্মজ্ঞানলাভ হইলে নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি অর্থাৎ কর্মত্যাগ হয় । মধুসূদন সরস্বতী, আনন্দগিরি, শঙ্করানন্দ প্রভৃতি বহু টীকাকার শঙ্করের পদানুবর্তী ।

8.2) বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ

রামানুজাচার্য স্বীয় গুরু যামুনাচার্যের মতই তাঁহার গীতাভাষ্যে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করিয়াছেন । তাঁহার মতে জীব (চিৎ), জগৎ (অচিৎ) ও ব্রহ্ম - এই তিনটি তত্ত্ব স্বতন্ত্র হইলেও ব্রহ্ম জগৎ ও জীববিশিষ্ট । তাঁহার মতে ব্রহ্মের সঙ্গে জীব ও জগতের স্বজাতীয় ও বিজাতীয় ভেদ না থাকিলেও স্বগতভেদ অবশ্য স্বীকার্য । তাঁহার দার্শনিক মত বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ ও তিনি ভক্তিধর্মের প্রচারক । তিনি বলেন, 'বর্ণাশ্রমধর্ম অবশ্য পালনীয় ।' কারণ সকল শাস্ত্র এই বিষয়ে একমত - 'একশাস্ত্রার্থতয়ানুষ্ঠেয়ম্‌' । ফলাকাঙ্ক্ষা বিসর্জন করিয়া ঈশ্বরকে প্রসন্ন করিবার জন্য বর্ণাশ্রমধর্ম অনুষ্ঠিত হইলে 'ভাবসংশুদ্ধি' হয় এবং মানুষ জ্ঞানের অধিকারী হয় ।

8.3) দ্বৈতবাদ

দ্বৈতবাদী ও ভক্তিমার্গের আচার্য মধ্বাচার্য মায়াবাদ খণ্ডনপূর্বক পরব্রহ্মের সহিত জীবসমূহের নিত্য ভেদ প্রতিষ্ঠা করেন । বল্লভাচার্যের মতে ব্রহ্ম ও মুক্ত জীব মূলতঃ অভেদ হইলেও জীব ব্রহ্মের অংশ, মায়া ঈশ্বরের শক্তিমাত্র, জগৎপ্রপঞ্চ মিথ্যা নহে এবং ভগবৎকৃপাই তাঁহাকে লাভ করিবার একমাত্র পন্থা ।

8.4) দ্বৈতাদ্বৈতবাদ

দ্বৈতাদ্বৈতবাদী নিম্বার্কের মতে জীবসমূহ ও জগৎ সূক্ষরূপে ঈশ্বরের বিরাট শরীরে অবস্থিত ।

8.5) অন্যান্য ব্যাখ্যা

জ্ঞানেশ্বর পাতঞ্জল যোগকেই গীতার শিক্ষা বলিয়া ব্যাখ্যা করিয়াছেন ।

অভিনবগুপ্তের মতে গীতা আধ্যাত্মিক অর্থে পরিপূর্ণ । তিনি বলেন, ধর্মক্ষেত্র শব্দের অর্থ নবদ্বারবিশিষ্ট দেহ, মামকাঃ শব্দের অর্থ প্রজ্ঞালব্দ চিন্তা; ধৃতরাষ্ট্র, কৌরবগণ ও পাণ্ডবগণ কাল্পনিক বস্তু, জড়দেহবান ব্যক্তি নহেন ।

মধুসূদন সরস্বতীর 'গূঢ়ার্থদীপিকা' নামক পঞ্চদশ শতাব্দীতে রচিত গীতার টীকা পণ্ডিত ভূতনাথ সপ্ততীর্থ কর্তৃক বাংলায় অনূদিত হইয়াছে । তাঁহার মতে বেদের যেমন কর্ম, উপাসনা ও জ্ঞান - এই কাণ্ডত্রয় আছে, অষ্টাদশাধ্যায়ী গীতা তেমনি কাণ্ডত্রয়াত্মিকা । উহার ১ম ষট্‌কে জীবের স্বরূপ (ত্বং পদার্থ = জীবাত্মা), ২য় ষট্‌কে ব্রহ্মের স্বরূপ (তৎ পদার্থ = পরমাত্মা) ও ৩য় ষট্‌কে জীব(ত্বং) ও ব্রহ্মের(তৎ) অভেদতত্ত্ব (অসি = হও) প্রতিপন্ন হইয়াছে । 


তত্ত্বমসি = ত্বং + তৎ + অসি
(টীকাকারের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি : মধুসূদন শঙ্করপন্থী অদ্বৈতবাদী ও চৈতন্যদেবের সমসাময়িক ছিলেন । ফরিদপুর জেলার কোটালীপাড়া গ্রামে তাঁহার জন্ম হয় । ইনি সন্ন্যাসগ্রহণপূর্বক কাশীধামস্থ গোপাল মঠে বাস করিতেন । 'অদ্বৈতসিদ্ধি' নামক তাঁহার বেদান্তগ্রন্থ ভারত-বিখ্যাত ।)

ভাষ্যকার যামুনাচার্যের মতে গীতার প্রথম ছয় অধ্যায়ে ভক্তিলাভের উপায়স্বরূপ ভাগবত জ্ঞানের স্বরূপ নির্ণীত হইয়াছে; দ্বিতীয় ছয় অধ্যায়ে ভক্তি ও উপাসনা-সহায়ে লব্ধব্য ভাগবত স্বরূপ বর্ণিত এবং বাকি ছয় অধ্যায়ে পূর্বোক্ত বিষয়দ্বয়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যা ।

রামানুজের গুরু যামুন তাঁহার গীতাগ্রন্থে বলেন যে, নারায়ণই পরব্রহ্ম; একমাত্র ভক্তি দ্বারাই সেই নারায়ণকে প্রাপ্ত হওয়া যায়; স্বধর্মানুষ্ঠান, সম্যক শাস্ত্রজ্ঞান এবং তীব্র বৈরাগ্য দ্বারা ঈশ্বরভক্তি লাভ হয় ।

নিগমান্ত মহাদেশিকের মতে নিষ্কাম কর্ম পরোক্ষভাবে জ্ঞানোৎপত্তি দ্বারা এবং সাক্ষাৎভাবে আত্মানুভূতি-প্রদানে সমর্থ ।

শ্রীঅরবিন্দ পুরুষোত্তমবাদী । তাঁহার গীতাব্যাখ্যার মূল রচনা প্রথমে ইংরেজীতে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয় এবং পরে উহা বাংলা, হিন্দী প্রভৃতি ভাষায় অনূদিত হইয়াছে । গীতার পঞ্চদশ অধ্যায়ে যে পুরুষোত্তমযোগ বর্ণিত, তিনি তাহাই অবলম্বনপূর্বক স্বীয় দর্শন ব্যাখ্যা করিয়াছেন । তাঁহার মতে এই জীব ও জগৎ ক্ষর পুরুষ, কূটস্থা প্রকৃতি অক্ষর পুরুষ এবং এই উভয় পুরুষের অতীত যে ঈশ্বর তিনি উত্তম পুরুষ বা পুরুষোত্তম । 'পরমাত্মাই পুরুষোত্তমনামে শাস্ত্রে অভিহিত । সেই পরমাত্মা বিশ্বপ্রপঞ্চে প্রবিষ্ট ও পরিব্যাপ্ত ।' - [গীতা ১৫|১৭]

বালগঙ্গাধর তিলক বলেন - 'নিষ্কাম কর্মই গীতার ধর্ম; যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং পূর্ণ আত্মজ্ঞান সত্ত্বেও নিষ্কাম কর্ম অনুষ্ঠান ও প্রচার করিয়াছেন ।'

শ্রীধরস্বামী তাঁহার গীতার টীকায় জ্ঞানমিশ্রা ভক্তি প্রচার করিলেও জ্ঞান অপেক্ষা ভক্তির প্রাধান্য স্বীকার করিয়াছেন । তাঁহার মতে জ্ঞান ও ভক্তি স্বরূপতঃ এক হইলেও ভক্তিই মুক্তিদাত্রী ।


শ্রীবিশ্বনাথ চক্রবর্তীর মতে গীতাশাস্ত্র সর্ববেদ-তাৎপর্য-পর্যবসিতার্থ রত্ন দ্বারা অলঙ্কৃত; ইহার অষ্টাদশ অধ্যায়ে অষ্টাদশ বিদ্যা-পরিপূরিত । গীতার প্রথম ছয় অধ্যায়ে নিষ্কাম কর্মযোগ, দ্বিতীয় ছয় অধ্যায়ে ভক্তিযোগ এবং শেষ ছয় অধ্যায়ে জ্ঞানযোগ প্রদর্শিত । ভক্তিযোগ অতিশয় গূঢ় এবং কর্ম ও জ্ঞানের মূল কারণস্বরূপ; অতএব অতিশয় শ্রেষ্ঠ ও সর্ব দুর্লভ বলিয়া মধ্যবর্তী ছয় অধ্যায়ে সন্নিবিষ্ট । ভক্তিরহিত কর্ম ও জ্ঞান উভয়ই বৃথা । এইজন্য সাধকগণ কর্ম ও জ্ঞান উভয়কেই ভক্তিমিশ্রিত করিয়া সাধন করিতে বিধি প্রদান করিয়াছেন ।
(টীকাকারের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি : বিশ্বনাথ বৈষ্ণব ধর্মের আচার্য, চৈতন্যপন্থী এবং অচিন্ত্যভেদাভেদবাদী ছিলেন । তাঁহার মতে শ্রীরাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তির ভেদ-অভেদও অচিন্ত্য । ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে উনি নদীয়া জেলার কোন ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করেন । কোঙ্গলের শ্রীবর্ধন নামক স্থানে তৎপ্রতিষ্ঠিত মঠ অদ্যাপি বর্তমান । তিনি বহু সংস্কৃত গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন ।)

বলদেব বিদ্যাভূষণের মতে গীতোপনিষদে ঈশ্বর, জীব, প্রকৃতি, কাল ও কর্ম - এই পঞ্চ বিষয় বর্ণিত । তন্মধ্যে বিভুসংবিৎ ঈশ্বর, অণুসংবিৎ জীব, সত্ত্বাদিগুণত্রয়ের আশ্রয়রূপ দ্রব্য প্রকৃতি এবং ত্রিগুণশূন্য জড় দ্রব্য কাল । পুরুষত্বনিষ্পন্ন অদৃষ্টাদি শব্দবাচ্য কর্ম ইত্যাদি রূপে ঈশ্বরাদির লক্ষণ নিরূপিত হইয়াছে । তন্মধ্যে ঈশ্বরাদি চতুষ্টয় নিত্য বস্তু এবং জীবাদি চতুষ্টয় ঈশ্বর-বশীভূত । কর্ম প্রাগ্‌ভাবের ন্যায় অনাদি ও বিনাশী । সংবিৎস্বরূপ ঈশ্বর ও জীব উভয়েই সংবেত্তা (জ্ঞানাশ্রয়) ও অস্মদাদি-শব্দের প্রতিপাদ্য ।
(টীকাকারের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি : ব্রহ্মসূত্রের গোবিন্দভাষ্যের রচয়িতা বলদেব বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর সুযোগ্য শিষ্য । ইনিও চৈতন্যপন্থী এবং অচিন্ত্যভেদাভেদবাদী ছিলেন ।)
 


8.6) ত্যাগই গীতার বাণী

আত্মজ্ঞানলাভের পর কর্মসন্ন্যাসের প্রকৃষ্ট প্রমাণ শ্রীরামকৃষ্ণদেবের অভূতপূর্ব জীবন । কর্মত্যাগ হইবার পর তিনি 'গলিতহস্ত' হইলেন, আর তর্পণাদি কর্ম করিতে পারিলেন না । পরাভক্তি লাভ হইবার পর তিনি আর বিধিপূর্বক জগন্মাতার পূজা ও উপবীত ধারণ করিতে সম্পূর্ণ অক্ষম হইলেন । শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেন - "কয়েকবার 'গীতা' 'গীতা' উচ্চারণ করিলে যাহা হয় (অর্থাৎ ত্যাগী) তাহাই গীতার শিক্ষা ।" সকল কর্মের ফলাকাঙ্ক্ষা-ত্যাগই গীতার বাণী । 'একমাত্র ত্যাগের দ্বারা অনেকে অমৃতত্ব লাভ করিয়াছিলেন' - উপনিষদের এই মহতী বাণীই গীতায় বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যাত ।

জার্মান মনীষী গেটে বলিতেন, "তোমাকে সকল কর্ম এক সময় ত্যাগ করিতেই হইবে । এই সনাতন সঙ্গীত অনন্তকাল ধরিয়া আমাদের কর্ণে ধ্বনিত হইতেছে । সমগ্র জীবন প্রত্যেক ঘণ্টায় এই সঙ্গীত আমাদের কর্ণে প্রবেশ করিতেছে যদিও উহা আমরা শুনি না ।"

 

9) গীতার বৈদেশিক ব্যাখ্যা

গার্বে এবং হপ্‌কিন্‌স অনুমান করেন যে, অনেক লেখক বিভিন্ন শতাব্দীতে গীতায় স্ব স্ব রচনা সংযোজন করিয়াছেন । গার্বে বলেন, "গীতার মৌলিক আকারটি খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে সাংখ্যযোগের ভিত্তিতে রচিত, কিন্তু খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে পুনরায় উহা উপনিষদুক্ত অদ্বৈতবাদের গ্রন্থরূপে গৃহীত ও পরিবর্তিত হয় ।" গার্বে 'Indian Antiquary'-তে (December 1918)  লিখিয়াছেন, 'গীতায় সগুণ ও নির্গুণ উপাসনাকে সমান স্থান দেওয়া হইয়াছে । উভয় উপাসনার কোনটিকে উচ্চ বা নীচ বলা হয় নাই । স্থানে স্থানে উভয়ের প্রভেদও অস্বীকৃত হইয়াছে । দুইটি মতের এইরূপ অপূর্ব সমন্বয় বা সামঞ্জস্যই গীতার বৈশিষ্ট্য ।' গার্বে আরও বলেন, "গীতোক্ত দার্শনিক তত্ত্বের সম্পূর্ণ ভিত্তি প্রায় সাংখ্যযোগের উপর প্রতিষ্ঠিত । সাংখ্যযোগই গীতায় প্রথম স্থান অধিকার করিয়াছে; দ্বিতীয় স্থান মাত্র বেদান্ত-কর্তৃক অধিকৃত । বেদান্ত শব্দটি 'বেদান্তকৃৎ'-রূপে মাত্র একবার গীতায় উক্ত [১৫|১৫] । কিন্তু সাংখ্য ও যোগের প্রায়শঃই উল্লেখ দৃষ্ট হয় । আর উপর্যুক্ত বেদান্ত শব্দটিও উপনিষদের অর্থে ব্যবহৃত । প্রাচীন ও নবীন দর্শনের অসমঞ্জস সমাবেশ গীতাতে দেখা যায় । বেদান্তের ধারাটি গীতায় আধুনিক, মৌলিক নহে । দার্শনিক বা ধর্মীয় যে দৃষ্টিতেই গীতাকে বিচার করা যায়, উপর্যুক্ত সিদ্ধান্ত সমীচীন মনে হয় ।"

হপ্‌কিন্‌স বলেন, "পরবর্তী কালের কোন বিষ্ণু-উপাসনা-মূলক উপনিষদ্‌কে কৃষ্ণভাবোদ্দীপক গ্রন্থে পরিণত করিয়া গীতা উৎপন্ন হইয়াছে ।" হোল্‌জমানের মতে কোন বেদান্ত-গ্রন্থকে বিষ্ণুভক্তি-প্রচারের উদ্দেশ্যে পরিবর্তিত করিয়া গীতা সৃষ্ট হইয়াছে । বেরিডেল কীথ বলেন, "শ্বেতাশ্বতরের ন্যায় গীতা পূর্বে একখানি উপনিষদ্‌ ছিল । পরে উহা কৃষ্ণোপাসনার গ্রন্থরূপে পরিবর্তিত ।" বার্নেটের ধারণা যে, গীতাকারের যত্নে বিভিন্ন ধর্মমত সুশৃঙ্খলভাবে সমঞ্জস হইয়াছিল । পল ডয়সন বলেন, "উপনিষদুক্ত অদ্বৈতবাদের অধঃপতনের যুগে গীতা এক বিকৃত সৃষ্টি । উক্ত যুগে আস্তিকতা ধীরে ধীরে নাস্তিকতায় পরিবর্তিত হইতেছিল ।" সেনেটের মতে স্বতঃসিদ্ধ বা স্বাভাবিক সমন্বয়সাধনই (spontaneous syncretism) গীতার মুখ্য উদ্দেশ্য । চার্লস জনস্টন বলেন, "ভগবদ্‌গীতা সেই বেদসরোবর, যাহার স্বচ্ছ ও শুদ্ধ সলিল ভারত-ভারতীর দারুণ সংঘর্ষের সঙ্গে যুগে যুগে ভারতেতিহাসরূপ অরণ্যের মধ্য দিয়া বেদরূপ হিমালয়ের অগম্য শৃঙ্গ হইতে প্রবাহিত ও সঞ্চিত ।"

 

10) গীতার প্রচার

ভারতে এবং ভারতেতর বহু দেশে গীতার খুব প্রচার হইয়াছে । বাংলা ভাষায় উহার অনেক অনুবাদ ও সংস্করণ হইয়াছে ও হইতেছে । এতদ্ব্যতীত মারাঠী, গুজরাটী, হিন্দী, উড়িয়া, আসামী, তেলেগু, তামিল, মালয়ালম্‌, কানাড়ী, মেবারী, মারোয়াড়ী, সিন্ধী, গুরুমুখী, উর্দু, খাসিয়া, ফারসী, গাড়োয়ালী, নেপালী প্রভৃতি ভারতের প্রায় সকল ভাষায় গীতার অসংখ্য অনুবাদ ও সংস্করণ হইয়াছে । গোরক্ষপুর গীতা প্রেস হইতে প্রকাশিত হিন্দী গীতার কয়েক লক্ষ খণ্ড বিক্রীত হইয়াছে ।

কলিকাতায় বাঁশতলা গলিস্থিত গীতা লাইব্রেরিতে এপর্যন্ত পৃথিবীর ছত্রিশটি ভাষায় গীতার যে পঁচিশ শতাধিক সংস্করণ হইয়াছে তাহার মধ্যে সাতাশটি ভাষায় প্রায় এগার শত সংস্করণের নমুনা-গীতা সংগৃহীত আছে । গীতা-প্রেমিকের এইগুলি অবশ্য দর্শনীয় ।


10.1) ইংরেজী অনুবাদ

রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী স্বরূপানন্দস্বামী পরমানন্দস্বামী প্রভবানন্দ ও স্বামী নিখিলানন্দ-কৃত গীতার ইংরেজী অনুবাদ দেশে ও বিদেশে বিশেষ খ্যাতিলাভ করিয়াছে । কোন কোন ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বামী স্বরূপানন্দের গীতা পাঠ্যপুস্তকরূপে নির্বাচিত হইয়াছে । স্বামী প্রভবানন্দ ইংরেজ কবি ক্রীস্টোফার ঈশারউডের সহযোগে গদ্যে ও পদ্যে গীতার ইংরেজী অনুবাদ করিয়াছেন । বিখ্যাত ইংরেজ মনীষী অলডাশ হাক্সলী ইহাতে একটি মনোজ্ঞ ভূমিকায় লিখিয়াছেন, 'জগতে যে সনাতন দর্শন আবিষ্কৃত হইয়াছে, উহার প্রাঞ্জলতম ও পূর্ণতম সংক্ষিপ্তসার গীতায় আছে । শুধু ভারতীয়গণের জন্য নহে, সমগ্র মানবজাতির জন্য উহার স্থায়ী মূল্য আছে । সনাতন দর্শনের সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক বিবৃতি ভগবদ্‌গীতা দিয়াছেন ।' মাদ্রাজ রামকৃষ্ণ মঠ হইতে উক্ত গীতার একটি ভারতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে ।

স্যার চার্লস্‌ উইলকিন্স-কৃত গীতার ইংরেজী অনুবাদ ১৭৮৫ খ্রীঃ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক লণ্ডন হইতে প্রকাশিত হয় । ইহাতে ব্রিটিশ ভারতের প্রথম গভর্ণর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস কর্তৃক লিখিত ভূমিকা আছে । ইহাই বিদেশীয় ভাষায় মূদ্রিত ও অনূদিত সর্বপ্রথম ভারতীয় গ্রন্থ ও গীতার প্রথম ইংরেজী অনুবাদ ।

এ্যানি বেসান্ত কর্তৃক অনূদিত ইংরেজী গীতার লক্ষাধিক কপি বিক্রীত হইয়াছে । এ ছাড়া স্যার এডুইন আরনল্‌ড-কৃত গীতার পদ্যানুবাদ; জন ডেভিস্‌, অধ্যাপক ফ্রাঙ্কলিন এডগার্টন, হোলডেন, এডোয়ার্ড সাম্ফশন, উইলিয়াম কিউ. জাজ, চার্লস্‌ জনস্টোন, রেভারেণ্ড আর. ডি. গ্রিফিথ, রাইডার এফ্‌. টী. ব্রুকস্‌, ই. ওয়াশবার্ণ হপ্‌কিন্স প্রভৃতি-কৃত গীতার ইংরেজি গদ্যানুবাদ বিশেষ প্রচলিত ।


10.2) অন্যান্য বিদেশী ভাষায় অনুবাদ

ফরাসী অনুবাদ : আন্না কামেস্কী, এমিল বার্ণফ, এ. এন্ডিউড শুল্‌ফ

জার্মান অনুবাদ : গদ্যে - রিচার্ড গার্বে, পল ডয়সন, লিওপল্‌ড ফন শ্রেডার; পদ্যে - ফ্রাঙ্ক হার্টম্যান ও থিওডর স্প্রিংম্যান

ল্যাটিন অনুবাদ : আগাস্টাস গিলেলমাস শ্লেগেল

ইটালিয়ান অনুবাদ : এন. ডি. ফ্লোরেন্স

সুইডিশ অনুবাদ : নিনো রুনেবার্গ, উইলিয়াম জাজ ও ফ্রাঞ্জ লেক্ষাউ

রাশিয়ান অনুবাদ : ম্যাঞ্জিয়ারলি ও কামেস্কী

ডাচ্‌ অনুবাদ : ল্যাবার্টন ও ডাঃ জে. ডবলিউ. বৈশেডাইন

স্পানিশ অনুবাদ : এ. ত্রিমিশভ ও জে. আর. বোরেল

বোহেমিয়ান অনুবাদ : ডাঃ এ. হটিম্যান

হাঙ্গেরিয়ান অনুবাদ : লেগ্রাডি ন্যম্‌দা কন্যুকিয়াডো

জাপানী অনুবাদ : অধ্যাপক জে. তাকাকুশু

তিব্বতী অনুবাদ : জনৈক লামা


10.3) বাংলায় অনুবাদ

রামদয়াল মজুমদার, দামোদর মুখোপাধ্যায়, দেবেন্দ্রবিজয় বসু, রাজেন্দ্রনাথ ঘোষ, কৃষ্ণানন্দ স্বামী, অবিনাশ শর্ম ও জগদীশচন্দ্র ঘোষ-কৃত গীতার বাংলায় অনুবাদ প্রসিদ্ধ । পণ্ডিত প্রমথনাথ, পণ্ডিত ভূতনাথ সপ্ততীর্থ ও পণ্ডিত পার্বতীচরণ যথাক্রমে গীতার শাঙ্করভাষ্য, গূঢ়ার্থদীপিকা ও সুবোধিনী টীকার বঙ্গানুবাদ করিয়া অমর হইয়াছেন । বাংলায় গীতায় বহু পকেট-সংস্করণ আছে ।


10.4) গীতার অন্যান্য প্রচার

শ্রীশ্রীচণ্ডীর ন্যায় গীতারও অখণ্ড পাঠ হইয়া থাকে । কোথাও কোথাও গীতার নিত্য পাঠ হয় । সুর-তান-লয়-যোগে বহুস্থানে গীতা গীত হয় । ইহার পাঠে মহাশান্তি ও স্বস্ত্যয়ন হয় । বিশ্বষতঃ বিশ্বরূপদর্শন (১১শ) অধ্যায় (যাহা ব্রহ্ম অধ্যায়রূপে বর্ণিত) শুচি, অশুচি, সর্বাবস্থায় পাঠ করা যায় । লাহোর, করাচি প্রভৃতি শহরে 'গীতা-হল্‌' নির্মিত হইয়াছিল । মহারাষ্ট্রে গীতার জ্ঞানেশ্বরী ব্যাখ্যা শুনিবার জন্য সহস্র সহস্র নরনারীর সমাগম হয় । বরোদা ও আমেদাবাদে যে বিশাল 'গীতা মন্দির' প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, তাহাতে গীতাদেবীর মূর্তি নিত্য পূজিত হয় । বাঙ্গালোরে জনৈকা স্ত্রীভক্ত গীতার সকল শ্লোক কাপড়ের উপর রেশমের সেলাই দ্বারা লিখিয়াছেন । উক্ত গ্রন্থখানি দেখিবার সৌভাগ্য আমাদের হইয়াছে । অনেক পণ্ডিত এখনও আছেন যাঁহাদের সমগ্র গীতা কণ্ঠস্থ । কোন কোন কলেজে গীতা পাঠ্যপুস্তকরূপে পঠিত হয় ।


11) গীতা ও উপনিষদাবলী

গীতা একটি উপনিষদ্‌ । প্রত্যেক অধ্যায়ের শেষে বেদ-ব্যাস গীতাকে উপনিষদ্‌ বলিয়াছেন । উপনিষদ্‌-তত্ত্বই গীতায় পত্রপুষ্পে শোভিত ও পরিবর্ধিত । উপনিষদ্‌রূপ গাভীসমূহের দুগ্ধই এই গীতামৃত [গীতার ধ্যান, ৪] । উপনিষদের নিগূঢ় নির্যাস শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের জন্য গীতামৃতরূপে পরিণত করিয়াছেন ।

উপনিষদ্‌সমূহের ন্যায় গীতাও কম্বুকণ্ঠে আত্মতত্ত্ব বা ব্রহ্মতত্ত্ব ঘোষণা করিয়াছেন । ব্রহ্মতত্ত্বের এমন সুললিত ও সহজবোধ্য ব্যাখ্যা অন্য কোন গ্রন্থে দেখা যায় না । শঙ্করাচার্য সেইজন্য তাঁহার উপনিষদ্‌ ও গীতার ভাষ্যে একই তত্ত্ব প্রচার করিয়াছেন । অদ্বৈতনিষ্ঠ প্রস্থানত্রয়ের মধ্যে গীতা অন্যতম ।



11.1) উপনিষদ্‌ এবং গীতার শ্লোকে সাদৃশ্য

উপনিষদের কয়েকটি শ্লোক গীতায় কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত আকারে পাওয়া যায় । উদাহরণস্বরূপ নিম্নে কিছু সমানার্থক শ্লোক উদ্ধৃত করা হইল । আরও সাদৃশ্যযুক্ত শ্লোক উদ্ধৃত করা যাইতে পারে । অতএব গীতাপাঠ করিলেই উপনিষদ্‌পাঠ হয় । গীতা উপনিষদের শ্রেষ্ঠ ভাষ্য ।

কঠোপনিষদের ১|২|১৫ : গীতার ৮|১১
কঠোপনিষদের ২|৭,১৫,১৮-১৯ : গীতার ৮|১১, ২|২০, ২|১৯
ঈশোপনিষদের  : গীতার ১৩|১৬ ও ৬|২৯
মুণ্ডক উপনিষদের ২|১|২ : গীতার ১৩|১৫



11.2) গীতা এবং ব্রহ্মতত্ত্ব

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের অন্তে অর্জুন গীতার উপদেশ বিস্মৃত হওয়ায় পুনর্বার উহা প্রার্থনা করিলে ভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণ বলিয়াছিলেন - "যে ব্রহ্মতত্ত্ব তোমাকে পূর্বে যোগযুক্ত হইয়া বলিয়াছিলাম, তাহা সম্পূর্ণরূপে পুনরায় বলা অসম্ভব ।" [মহাভারত, অশ্বমেধ পর্ব, ১৬শ অধ্যায়]

বেদতুল্য গীতার ভাগবত বাণী নিত্য ও অপৌরুষেয় । গীতা পঞ্চম বেদ । গীতাতত্ত্ব ও বেদবাণী অভেদ । সেইজন্য স্বামী বিবেকানন্দ বলিয়াছেন যে, গীতা বেদের সর্বোত্তম ভাষ্য । গীতা ব্রহ্মযোগ-শাস্ত্র ও অদ্বৈতামৃতবর্ষিণী । ব্রহ্মবিদ্যাই গীতার প্রতিপাদ্য তত্ত্ব । গীতায় ব্রহ্মযোগ বিবৃত । ব্রাহ্মীস্থিতি বা ব্রহ্মনির্বাণ লাভ করা, গুণাতীত যোগারূঢ় বা স্থিতপ্রজ্ঞ হওয়াই গীতার উপদেশ ।



11.3) যুদ্ধক্ষেত্রে গীতা কিরূপে উপদিষ্ট হইল ?

ইহা অসম্ভব নহে । ইতিহাসে দৃষ্টান্ত আছে । রোমান সম্রাট্‌ মার্কাস্‌ অরেলিয়াস যে যুদ্ধে যাইয়া নিহত হন, সেই যুদ্ধে যাইবার পূর্বে তিনি তিন দিবস স্বীয় রাজধানীর বিদ্বদ্‌বর্গকে প্রাসাদে আহ্বানপূর্বক দর্শনালোচনা করিয়াছিলেন ।


12) গীতা ও ভাগবত

গীতা ও ভাগবতে একই তত্ত্ব উপদিষ্ট । উভয় গ্রন্থে একই অবতারের উপদেশ প্রবিবৃত । গীতার বক্তা কুরুক্ষেত্রের শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীমদ্‌ভাগবতে বৃন্দাবনের শ্রীকৃষ্ণের বাণী গ্রথিত । গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে এবং ভাগবতের একাদশ স্কন্ধে জ্ঞানযোগ বর্ণিত । গীতার দ্বাদশ অধ্যায়ে এবং ভাগবতের দশম স্কন্ধে ভক্তিযোগ বিবৃত । উভয় গ্রন্থেই সমানভাবে জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি ও যোগতত্ত্ব স্থান পাইয়াছে । 
"অব্যভিচারিণী ভক্তি দ্বারা ত্রিগুণাতীত হওয়া যায়" [গীতা ১৪|২৬]
"আত্মারাম মুনিগণ অহৈতকী ভক্তি লাভ করেন" [ভাগবত]

আবার গীতার ন্যায় ভাগবতেও আত্মতত্ত্ব উপদিষ্ট । ভাগবতের ১২শ স্কন্ধের শেষে শুকদেব রাজা পরীক্ষিৎকে আত্মজ্ঞানের উপদেশ দিতেছেন । ভাগবতের বেদস্তুতিতে আছে - "আত্মতত্ত্ব প্রকাশের জন্যই ভগবান্‌ মানবরূপে অবতীর্ণ হন ।" গীতার মতে যুগে যুগে অবতার আগমন করেন । ভাগবতেও উক্ত হইয়াছে 'অবতার অসংখ্য' । 

গীতায় শ্রীভগবান্‌ ভক্তকে সর্বধর্ম পরিত্যাগ পূর্বক তাঁহার শরণাগত হইবার জন্য উপদেশ দিয়াছেন [১৮|৬৬] । তদ্রূপ শ্রীমদ্‌ভাগবতেও আছে "সর্বপ্রযত্নে সকল প্রাণীর আত্মস্বরূপ আমার শরণাগত হও । তাহা হইলে আমার দ্বারা অকুতোভয় (সর্বত্র নির্ভয়) হইবে [১১|১২|১৫] ।" শরণাগতি দ্বারাই ভক্ত অভয় লাভ করেন । শ্রীশ্রীচণ্ডীর অন্তে মেধা ঋষিও রাজা সুরথকে ভবভয়নাশের জন্য পরমেশ্বরী ভগবতীর শরণাগত হইতে বলিতেছেন ।

13) গীতার উদারতা

গীতা সার্বজনীন ধর্মগ্রন্থ । গীতা সকল ধর্মের, সকল সম্প্রদায়ের, সকল শ্রেণীর ধর্মগ্রন্থ হইবার যোগ্য । গীতাশাস্ত্রে কোন 'গোড়ামি' বা সংকীর্ণতা স্থান পায় নাই ।

"যে যেভাবে আমায় আরাধনা করে, আমি সেই ভাবে তাহাকে কৃপা করি । সকল ধর্মপিপাসু মৎপথেই বিচরণ করিতেছে ।" [৪|১১] 

"যাহারা ঈশ্বরের যে কোন রূপ শ্রদ্ধাপূর্বক অর্চনা করিতে ইচ্ছা করে, আমি তাহাদিগকে সেই মূর্তিতে ভক্তি ও বিশ্বাস প্রদান করি ।" [৭|২১]

"যাহারা শ্রদ্ধাযুক্ত হইয়া অন্য দেবতা উপাসনা করে, তাহারাও অবিধিপূর্বক আমারই উপাসনা করে ।" [৯|২৩]

এইরূপ সার্বজনীনতা ও উদারতা অন্য ধর্মগ্রন্থে দুষ্প্রাপ্য । ভগবানের অসংখ্য নাম ও অসংখ্য রূপ । তাঁহার যে কোন একটি নামে ও রূপে আমাদের নিষ্ঠা হইলেই মুক্তি করতলগত হইবে । নিষ্ঠাপূর্বক তাঁহার একটি নাম জপ ও একটি রূপ ধ্যান করিলেই মোক্ষলাভ হয় । অপরের ইষ্টকে শ্রদ্ধা করা ইষ্টনিষ্ঠার একটি প্রধান সাধন । অপরের ইষ্টকে অশ্রদ্ধা করা অনুচিত । কর্মযোগ, ভক্তিযোগ, রাজযোগ ও জ্ঞানযোগ প্রত্যেকটি অন্যনিরপেক্ষ স্বতন্ত্র মুক্তি-মার্গ, এই ভাবটি গীতার কয়েকটি শ্লোকে পরিস্ফুট হইয়াছে । স্বামী বিবেকানন্দ গীতার উক্ত বৈশিষ্ট্য মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিয়াছেন । রুচির বৈচিত্রহেতু ঋজু, কুটিল যে পথে মানুষ চলুক না কেন, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা থাকিলে সাধকের ঈশ্বরলাভ হইবেই । ভগবান্‌ শ্রীরামকৃষ্ণ তাই বলিতেন, "যত মত তত পথ" । এক-একটি ধর্মমত যে ঈশ্বরলাভের ভিন্ন ভিন্ন পথ, তাহা তিনি তাঁহার অভূতপূর্ব ও অলৌকিক জীবনে সাধন করিয়া দেখাইয়াছেন ।



14) গীতায় আত্মার অমরত্ব

কুরুক্ষেত্রে অর্জুন আত্মীয়বর্গকে যুদ্ধার্থে উপস্থিত দেখিয়া দুঃখিত হইলেন । তিনি স্বজনগণকে বিনাশপূর্বক রাজ্যলাভের ইচ্ছা ত্যাগ করিলেন । তখন শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের মৃত্যুভয় দূর করিবার জন্য তাঁহাকে আত্মার অমরত্ব শিক্ষা দিলেন । শ্রীভগবান্‌ বলিলেন - "এই নরপতিগণ ও আমরা পূর্বে ছিলাম না, বা পরে থাকিব না - ইহা সত্য নহে ।" অর্থাৎ আমরা ও ইহারা আত্মারূপে জন্মের পূর্বেও ছিলাম এবং মৃত্যুর পরেও থাকিব । আত্মার জন্ম নাই, মৃত্যু নাই; আত্মা অমর । মানুষ দেহমাত্র নহে । মানুষ আত্মাই । দেহের জন্ম বা মৃত্যু হয় । মৃত্যু আত্মাকে স্পর্শ করিতে পারে না । মৃত্যুতে স্থূল দেহের ধ্বংশ হয় মাত্র । "বস্ত্র জীর্ণ হইলে যেমন উহা পরিত্যাগ করিয়া আমরা নূতন বস্ত্র পরিধান করি, তেমনি আত্মা ভগ্ন ও জীর্ণ দেহ ত্যাগ করিয়া নূতন দেহ গ্রহণ করে [২|২২] ।" মৃত্যুর পরে পুনর্জন্ম হয়; পুনর্জন্ম দেহান্তরপ্রাপ্তি মাত্র । কৌমার, যৌবন ও জরার ন্যায় মৃত্যুও দেহের একটি অবস্থামাত্র । "আত্মাকে মৃত্যু বিনাশ করিতে পারে না, অস্ত্র ছেদন করিতে পারে না, অগ্নি দগ্ধ করিতে পারে না, জল সিক্ত করিতে পারে না এবং বায়ু শুষ্ক করিতে পারে না [২|২৩] ।" ইহাই গীতার প্রথম ও প্রধান শিক্ষা ।

আত্মার অমরত্বে বিশ্বাস করিলে অর্জুনের ন্যায় আমাদেরও মৃত্যুভয় বিদুরিত হইবে, শোক অন্তর্হিত হইবে । শ্রীমদ্‌ভাগবতের ১২শ স্কন্ধে শুকদেব রাজা পরীক্ষিৎকে মৃত্যুভয় দূর করিবার জন্য আত্মজ্ঞানের উপদেশ দিবার উদ্দেশ্যে বলিতেছেন, "আত্মা দেহ হইতে পৃথক্‌ । তুমি অমর আত্মা - এই জ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত মৃত্যুভীতি যাইবে না ।"

গ্রীসের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী সক্রেটিস আত্মজ্ঞান লাভ করিয়া মৃত্যুঞ্জয় হইয়াছিলেন । মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হইয়া শেষ জীবনে তিনি যখন কারাগারে আবদ্ধ ছিলেন, তখন তাঁহার জনৈক শিষ্য তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, "মৃত্যুর পর আপনার দেহ কিভাবে সৎকার করিব ?" সক্রেটিস তদুত্তরে বলিয়াছিলেন, "আমার দেহের সৎকার যেভাবে ইচ্ছা করিও, তবে ইহা নিশ্চিত জানিও যে, এই দেহ সক্রেটিস নহে ।"

জন্মের পূর্বে যে আমরা ছিলাম এবং মৃত্যুর পরেও থাকিব, বিনষ্ট হইব না - এই ধারণা আবালবৃদ্ধবনিতা সকলের হৃদয়ে বিদ্যমান । মন একটু অন্তর্মুখীন ও একাগ্র হইলেই উক্ত সত্য প্রতিভাত হয় । ইংলণ্ডের প্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক বার্ট্রাণ্ড রাসেল (Bertrand Russel) তাঁহার নবম বা দশমবর্ষীয় পুত্রকে খ্রীষ্টান ধর্মের একটি তত্ত্ব শিক্ষা দিবার উদ্দেশ্যে বলিলেন, "মিশরের পিরামিড যখন নির্মিত হয়, তখন তোমার অস্তিত্ব ছিল না । জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই তোমার অস্তিত্ব আসিয়াছে ।" (খ্রীষ্টানগণ জন্মান্তরে বিশ্বাসী নহেন ।) পুত্র পিতাকে জিজ্ঞাসা করিল, "সে (পুত্র) তখন কি করিতেছিল ?" পিতা তাহাকে বারবার বলা সত্ত্বেও বালক কিছুতেই তাহার জন্মের পূর্বের অনস্তিত্ব বিশ্বাস করিতে পারিল না । মানুষ দেহাতিরিক্ত আত্মা, সুতরাং কিরূপে এইরূপ বিশ্বাস করা সম্ভব ?

দেহবুদ্ধির প্রাবল্যহেতু আত্মবুদ্ধি সম্প্রতি অন্তর্হিত হইয়াছে । আত্মবুদ্ধি বৃদ্ধির সঙ্গেই ক্ষুধাতৃষ্ণা, জন্মমৃত্যু, জরাব্যাধি প্রভৃতি জড়ধর্মের অধীনতা দূর হয়; সকল দুর্বলতা, দূঃখ ও দৈন্য পলায়ন করে; মানব মৃত্যুঞ্জয় ও মহাবীর হয় ।



15) গীতায় অবতারবাদ

শ্রীমদ্‌ভাগবতের ন্যায় শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাও অবতারবাদ প্রচার করেন । সম্ভবতঃ সর্বপ্রথম গীতাতেই অবতার-তত্ত্ব সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যাত ।  গীতায় [৪|৭-৯] ভগবান্‌ স্বয়ং বলিয়াছেন -
 

"যখনই ধর্মের গ্লানি ও অধর্মের উত্থান হয় তখনই আমি অবতীর্ণ হই । সাধুরক্ষা, দুষ্টবিনাশ ও ধর্মস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে নরদেহ ধারণ করি ।"

অবতারে বিশ্বাস হইলে মুক্তিলাভ হয়, আর পুনর্জন্ম হয় না । শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাই বলিতেন, "অবতারে বিশ্বাস পূর্ণ জ্ঞানের লক্ষণ ।" মূঢ়গণই মনুষ্যতনুধারী ভগবানে বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারে না । অবতারবাদেই ধর্মের নিগূঢ় তত্ত্ব নিহিত ।

অবতার মায়ামনুষ্য । তিনি মায়াধীশ; জীবের ন্যায় মায়াধীন নহেন । তিনি যেন দেহবান্‌ হন, যেন জাত হন । অবতার নরদেহধারী ভগবান্‌ । দেহধারণকালে তিনি তাঁহার ভাগবতস্বরূপ বিস্মৃত হন না । অবতার দেব-মানব, 'নির্গুণ গুণময়', 'নিরঞ্জন নররূপধর' ।

দেবত্ব ও মানবত্বের অপূর্ব মিলন অবতারে দৃষ্ট হয় । ভক্তিতে মানবের অন্তর্নিহিত দেবত্ব প্রস্ফুটিত হয় । ঈশ্বর ও মানবের মিলনভূমি এই অবতার । অবতারকে দর্শন করিলেই ঈশ্বরদর্শন করা হয় । অবতারগণের জন্ম অলৌকিক; কারণ তাঁহারা জীবের ন্যায় কর্মাধীন নহেন । ঈশ্বরের নরলীলাই সর্বোত্তম । অবতারের লীলাস্মরণ, তাঁহার নামজপ ও তাঁহার মূর্তিধ্যানই ধর্মজীবনের প্রধান সাধন । এইজন্য ভগবান্‌ অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখাইলেন ।

নিরাকার, নির্গুণ ব্রহ্ম কিরূপে সাকার ও সগুণ হন, কিরূপে রক্তমাংসের শরীরে আবির্ভূত হন - এই গভীর রহস্য দুর্ভেদ্য । অবতারকে আশ্রয় করিলে ধর্মসাধন সহজ হইয়া যায় । বিশ্বরূপ দর্শনান্তে শ্রীকৃষ্ণে অর্জুনের ভগবদ্বুদ্ধি আসা মাত্র অর্জুনের মোহরাত্রি অতীত হইল । যীশুখ্রীষ্টের অবতারত্বে বিশ্বাস আসিতেই সল পলে পরিণত হইলেন । মানবের দেবত্ব এবং ভগবানের মানবত্ব প্রকটিত হয় অবতারবাদে । অবতারকে চিন্তা করিলেই ঈশ্বরকে চিন্তা করা হয় । বেদে অবতারবাদ ব্যক্ত হয় নাই । পরবর্তী যুগে ভক্তিধর্মের উৎপত্তির সঙ্গে অবতারবাদ উৎপন্ন হয় । পৃথিবীর প্রায় সকল ধর্মে উক্ত মত কোন-না-কোন প্রকারে বিকশিত হইয়াছে ।



16) গীতোক্ত কর্মযোগ

নিষ্কাম কর্মযোগই গীতার শ্রেষ্ঠ বাণী । বর্ণধর্ম ও আশ্রমধর্ম অনাসক্তভাবে পালন করিলে ভগবদ্দর্শন হয় । অনাসক্ত হইয়া কর্তব্য কর্ম করিলে ক্রমে ক্রমে চিত্তশুদ্ধি ও পরে জ্ঞান লাভ হয় ।

মহাভারতে [১২|১৮|৩১] অর্জুন বলিতেছেন - "যে অনাসক্ত বন্ধনহীন পুরুষ শত্রু-মিত্রে সমদর্শী এবং সক্তবৎ ব্যবহারশীল হন, তিনি মুক্ত । হে মহীপতে ইহাই গীতোক্ত মুক্তির আদর্শ ।"

যাজ্ঞবল্ক্য-স্মৃতিতে [৩|২০৪-০৫] সন্ন্যাসীর অবস্থা বর্ণনান্তে কথিত আছে, 'সত্যশীল, জ্ঞাননিষ্ঠ গৃহী সন্ন্যাসগ্রহণ না করিয়াও মুক্তিলাভ করেন ।'

গান্ধীজীর মতে গীতায় অনাসক্তিযোগ কথিত । অনাসক্তি যতই মনে দৃঢ়মূল হইবে, ততই চিত্ত শুদ্ধ হইবে, ততই আধ্যাত্মিক তত্ত্বের আস্বাদ পাওয়া যাইবে ।

গীতা কর্ম ত্যাগ করিতে উপদেশ দেন নাই; কর্মে অনাসক্তি, কর্মফলত্যাগই গীতার মহীয়সী বাণী । জগতের অন্য কোন ধর্মগ্রন্থ এত মুক্তকণ্ঠে এই অদ্ভুত তত্ত্ব প্রচার করেন নাই । সচন্দন পুষ্প ভগবানের চরণে অর্পণ করিলে যেমন পূজা হয়, তেমনি স্ব স্ব কর্ম ঈশ্বরে সমর্পণ করিলেও তাঁহার উপাসনা হয় । নিষ্কাম কর্মও এক প্রকার ঈশ্বরারাধনা ।

স্বামী বিবেকানন্দ বলিতেন, "বুদ্ধদেব ধ্যানের দ্বারা ও যীশুখ্রীষ্ট প্রার্থনার দ্বারা যে আধ্যাত্মিক অবস্থা ও দিব্যভাব লাভ করিয়াছিলেন, অনাসক্ত কর্মী নিষ্কাম কর্মের দ্বারাও সেই উচ্চাবস্থা লাভ করিবেন ।" তাই স্বামীজী কর্মসঙ্কুল বর্তমান যুগে নারায়ণজ্ঞানে জীবসেবা ধর্মের প্রধান অঙ্গরূপে প্রবর্তন করিলেন ।

চৈনিক ঋষি লাউৎজে (Laozi also Lao-Tzu or Lao-Tze) প্রাচীন চীনে wa wei wei বা নিষ্কাম কর্মযোগ শিক্ষা দিয়াছেন । লাউৎজে তাঁহার 'তাও তে-কিং' (Tao Te Ching) নামক জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থে বলেন - "অনাসক্ত মানবই জগতে পূর্ণ স্বাধীনতা ও শান্তি উপভোগ করিতে সমর্থ । তিনি জগতে বাস করিয়াও জগদতীত হন ।"

প্রসিদ্ধ ইংরেজ মনীষী অলডাশ্‌ হাক্সলী (Aldous Huxley) তাঁহার "Ends and Means" নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন যুগে প্রচলিত আদর্শ মানবের বহু সংজ্ঞা সমালোচনাপূর্বক এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন যে, গীতোক্ত অনাসক্ত মানবই আদর্শ পুরুষ । যিনি যত অনাসক্ত তিনি তত উন্নত ।

ফরাসী দেশের ভূতপূর্ব প্রধান মন্ত্রী ক্লেম্যান্সো (Georges Benjamin Clemenceau) বলিয়াছেন - গীতোক্ত কর্ম-কৌশল যদি জানিতাম তাহা হইলে আমার কর্ম-জীবন ধর্ম-জীবনে পরিণত হইত । খ্রীষ্টান সাধক ব্রাদার লরেন্স নিষ্কামভাবে পাচকের কর্ম করিয়াই সর্বত্র ঈশ্বরের অস্তিত্ব উপলব্ধি করিয়াছিলেন ।

ব্যাধগীতাতে আছে যে, ব্যাধ মাংসবিক্রয়রূপ স্বীয় বর্ণধর্ম অনাসক্তভাবে পালন করিয়াই আত্মজ্ঞান-লাভ করিয়াছিলেন । মহাভারতে দেখা যায়, অনাসক্তচিত্তে পতিসেবা দ্বারাই সতীসাধ্বী স্ত্রীর জ্ঞান-চক্ষু উন্মীলিত হইয়াছিল । অনাসক্তভাবে স্বধর্মপালনই শ্রেষ্ঠ সাধনা । সকল সময়ে সকল অবস্থায় অনাসক্তিতে প্রতিষ্ঠিত হইলে মানুষ পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় ।



17) বৌদ্ধধর্ম ও গীতা

ডাঃ রাধাকৃষ্ণনের মতে "গীতার প্রভাব পুরাকালে চীন ও জাপান পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছিল । মহাযান বৌদ্ধধর্মের প্রধান গ্রন্থদ্বয় 'মহাযানশ্রদ্ধোৎপত্তি' এবং 'সদ্ধর্মপুণ্ডরীক' গীতাতত্ত্বের নিকট গভীরভাবে ঋণী ।" হিন্দুধর্মে গীতা যে স্থান অধিকার করিয়াছে, বৌদ্ধধর্মে ধম্মপদও সেই স্থান পাইয়াছে । ধম্মপদ ও গীতার মধ্যে ভাবসাদৃশ পরিলক্ষিত হয় ।

17.1) যোগক্ষেম শব্দের ব্যবহার

যে ভক্ত অনন্যচিত্ত হইয়া নিরন্তর ঈশ্বরের উপাসনা করেন, ঈশ্বর স্বয়ং তাঁহার যোগক্ষেম বহন করেন [গীতা ৯|২২] ।

সেই সকল সতত চেষ্টাশীল এবং নিত্য দৃঢ়পরাক্রম ধ্যানিগণ পরম শান্তি (যোগক্‌খেমং)-রূপ নির্বাণ লাভ করেন [ধম্মপদ, অপ্পমাদো বগ্‌গো, ৩] ।

মন্দবুদ্ধিগণ শ্রেয় (যোগক্ষেমাদ্‌) অপেক্ষা প্রেয়কে বরণ করেন [কঠোপনিষদ, ১|২|২] ।

ব্রহ্মই যোগক্ষেমরূপে প্রাণাপানে অবস্থিত [তৈত্তিরীয় উপনিষদ, ৩|১০|২] ।

যোগক্ষেম শব্দটি গভীর অর্থপূর্ণ । যোগ অপ্রাপ্ত বস্তুর প্রাপ্তি এবং ক্ষেম প্রাপ্ত বস্তুর সংরক্ষণ । শঙ্করমতে যোগক্ষেম আহারাদি সকল প্রয়োজনীয় বস্তু । শ্রীধর শব্দটি 'মুক্তি' অর্থে ব্যাখ্যা করিয়াছেন । ধম্মপদ-মতে যোগক্‌খেমং=যোগক্ষেম=মুক্তি । শ্রীধর ও ধম্মপদ এক অর্থেই যোগক্ষেম শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন । শব্দটি অতি প্রাচীন, সম্ভবতঃ উপনিষৎ ও গীতা হইতে উহা ধম্মপদে গৃহীত ।

 

18) গীতায় যোগচতুষ্টয়ের সমন্বয়

গীতায় যে ধর্ম-সমন্বয় ধ্বনিত হইয়াছে, তাহা ধর্মেতিহাসে অপূর্ব । (নিষ্কাম) কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ ও রাজযোগ - এই চারটি অন্যনিরপেক্ষ মোক্ষমার্গের এরূপ অপূর্ব সমন্বয় অন্য শাস্ত্রে নাই । শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী - "যত মত তত পথ" গীতাতেই ব্যাখ্যাত । পূজ্যপাদ স্বামী জগদানন্দজী যখন আমার গীতাখানি সংশোধন করিতেছিলেন তখন তিনি গীতার এই সমন্বয়-সূত্রটি আমাকে ধরাইয়া দেন ।


18.1) নিষ্কাম কর্মযোগ দ্বারা মুক্তি

শ্রীভগবান অর্জুনকে বলিতেছেন [৩|১৯] - সেই হেতু সদা অনাসক্ত হইয়া কর্তব্য কর্ম অনুষ্ঠান কর । মানুষ অনাসক্ত হইয়া কর্ম করিলে পরম পদ প্রাপ্ত হয় ।


18.2) জ্ঞানযোগ দ্বারা মুক্তি

শ্রীভগবান বলিতেছেন [১২|৩-৪] - যাঁহারা ইন্দ্রিয়সমূহ সংযত করিয়া এবং সর্বত্র সমবুদ্ধি ও সদা সর্বভূতের হিতে রত হইয়া অক্ষর, অনির্দেশ্য, অব্যক্ত, সর্বব্যাপী, অচিন্ত্য, কূটস্থ, অচল, নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসনা করেন, তাঁহারা আমাকেই প্রাপ্ত হন ।


18.3) ভক্তিযোগ দ্বারা মুক্তি

শ্রীভগবান বলিতেছেন [১১|৫৪] - কেবলমাত্র অনন্যা ভক্তি দ্বারাই আমাকে স্বরূপতঃ জানিতে, প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ করিতে এবং আমাতে বিলয়রূপ মোক্ষলাভ করিতে ভক্তগণ সমর্থ হয় ।


18.4) রাজযোগ দ্বারা মুক্তি

শ্রীভগবান বলিতেছেন [৫|২৭,২৮] - বাহ্য বিষয় মন হইতে বাহির করিয়া দৃষ্টি ভ্রূযুগলের মধ্যে স্থির করিয়া নাসিকার মধ্যে বিচরণশীল প্রাণ ও অপান বায়ুর ঊর্ধ্ব ও অধোগতি রোধ করিয়া এবং ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধি সংযমপূর্বক ইচ্ছা, ভয় ও ক্রোধশূন্য হইয়া যে মুনি সর্বদা বিরাজ করেন তিনি জীবন্মুক্ত ।


19) গীতাকবচ

শ্রীশ্রীচণ্ডীর যেমন কবচ আছে, গীতারও তদ্রূপ কবচ আছে । যেমন দেবীকবচ পাঠান্তে চণ্ডীপাঠ বিহিত, সেইরূপ গীতাকবচ পাঠান্তে গীতাপাঠ করিতে হয় । বার্ণেল সাহেবের ক্যাটালগ [১১৪৬নং, ১৮৬ পৃঃ] অনুসারে তাঞ্জোরের মহারাজা সরফৌজির সরস্বতীমহল গ্রন্থাগারে তেলেগু অক্ষরে লিখিত পুঁথিতে একটি গীতাকবচ আছে ['শ্রীভারতী' পত্রিকায় - ২য় বর্ষ, ৭ম সংখ্যা - শ্রীজিতেন্দ্রনাথ বসু কর্তৃক প্রকাশিত] ।

যাহা ধারণ করিলে শত্রু-নিক্ষিপ্ত অস্ত্রশস্ত্রাদি হইতে আত্মরক্ষা করা যায়, তাহাকে কবচ বলে । যিনি গীতাতত্ত্বে প্রবেশ করিতে অগ্রসর হন, তাঁহার বাহ্য ও আভ্যন্তর নানা প্রবল শত্রু থাকে । ইহাদের আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষা করিবার জন্য গীতাকবচ অবশ্য ধারণীয় । গীতাকবচে ষড়ঙ্গ রক্ষা করিবার বিধি ও কৌশল বিশেষভাবে উল্লিখিত আছে । উক্ত কবচের বৈশিষ্ট এই যে, ইহাতে গীতার ছয়টি মূল শ্লোক উল্লিখিত । 


20) গীতামাহাত্ম্য

সাধারণতঃ দুইটি গীতামাহাত্ম্য দেখা যায় । তন্মধ্যে যেটি বৃহত্তর সেটি বৈষ্ণবীয় তন্ত্রসারে উক্ত । ইহাতে ৮৪টি শ্লোক আছে । স্বামী কৃষ্ণানন্দ কর্তৃক সম্পাদিত গীতায় উক্ত মাহাত্ম্য সানুবাদ প্রদত্ত । আর যেটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র এবং ২৩টি শ্লোকে সমাপ্ত, সেটি অনুবাদ সহিত এই গীতায় দেওয়া হইয়াছে । উক্ত মাহাত্ম্যটি কাহারো কাহারো মতে বরাহপুরাণোক্ত । বোম্বাই নির্ণয়সাগর প্রেস হইতে প্রকাশিত এবং বহুটিকাসমন্বিত গীতার মত এইরূপ । কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, উক্ত প্রেস হইতে প্রকাশিত বরাহপুরাণে এই গীতামাহাত্ম্য নাই । মহাভারতে এবং স্কন্দপুরাণে দুইটি গীতামাহাত্ম্য পাওয়া যায় । কিন্তু সেগুলি প্রচলিত নহে । হরি ওঁ । 

গীতার ধ্যান

(স্বামী জগদীশ্বরানন্দ)*

হে জননী ভগবদ্গীতাআপনি স্বয়ং ভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণকর্তৃক অর্জুনকে কথিতাপ্রাচীন মহর্ষি ব্যাসদেবকর্তৃক মহাভারতের মধ্যে ভীষ্মপর্বে [২৫ হইতে ৪২ পর্যন্ত আঠার অধ্যায়ে] গ্রথিতাঅষ্টাদশ-অধ্যায়রূপিণীঅদ্বৈততত্ত্বরূপ-অমৃতবর্ষিণী ও সংসারনাশিনী ভগবতীআমি আপনার ধ্যান করি । ১

হে মহামতি ব্যাসদেবআপনার নয়নযুগল প্রস্ফুটিত-পদ্মপত্রসদৃশ বিশালআপনি মহাভারতরূপ তৈলপূর্ণ জ্ঞানময় প্রদীপ প্রজ্বলিত করিয়াছেনআপনাকে প্রণাম করি । ২

শরণাগতের কল্পবৃক্ষতুল্যআশ্বচালনহেতু এক হস্তে চাবুক ও লাগামধারীগীতারূপ অমৃতদোহনকারী ও জ্ঞানমুদ্রা-যুক্ত ভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণকে প্রণাম করি । ৩

উপনিষদাবলী গাভীসমূহসেই-সকল গাভীর দোগ্ধা শ্রীকৃষ্ণবৎস অর্জুনমহাদুগ্ধ অমৃতময়ী গীতা এবং বিবেকিগণই এই দুগ্ধের পানকর্তা । ৪

কংস ও চানূর নামক দৈত্যদ্বয়-বিনাশীজননী দেবকীর পরমানন্দদায়কবসুদেবপুত্র জগদ্‌গুরু ভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণকে বন্দনা করি । ৫

কুরুক্ষেত্রযুদ্ধরূপ যে নদীতে ভীষ্মদ্রোণরূপ তীরদ্বয়জয়দ্রথরূপ জলগান্ধাররাজরূপ (পিচ্ছিল) নীল প্রস্তরশল্যরূপ কুম্ভীরকৃপরূপ খরস্রোতকর্ণরূপ উত্তাল তরঙ্গঅশ্বত্থামা ও বিকর্ণরূপ ভয়ঙ্কর মকরদ্বয় এবং দুর্যোধনরূপ আবর্ত ছিলভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণ কর্ণধার হওয়ায় পাণ্ডবগণ সেই রণনদী নিশ্চিতরূপে উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন । ৬

পরাশরপুত্র ব্যাসদেবের বাক্যরূপ সরোবরজাতহরিকথা-প্রসঙ্গ দ্বারা প্রস্ফুটিতনানা আখ্যানরূপ কেশরযুক্তযে পদ্মের মধু এই জগতের সজ্জনরূপ ভ্রমরগণ নিত্য পান করেনকলিকলুষনাশকগীতারূপ তীব্রসুগন্ধযুক্ত অমল মহাভারতরূপ সেই পদ্ম আমাদের কল্যাণের কারণ হউক । ৭

যাঁহার কৃপায় বাক্‌শক্তিহীন বাগ্মী হয় এবং পঙ্গু গিরি লঙ্ঘন করেআমি সেই পরমানন্দস্বরূপ মাধবকে বন্দনা করি । ৮

ব্রহ্মাবরুণইন্দ্ররুদ্র ও মরুৎগণ দিব্য স্তব দ্বারা যাঁহার স্তব করেনসামগায়কগণ অঙ্গপদক্রম ও উপনিষৎ সহিত বেদ দ্বারা যাঁহার মহিমা গান করেনযোগিগণ ধ্যানে তদ্গতচিত্ত হইয়া যাঁহাকে দর্শন করেন এবং দেবাসুরগণও যাঁহার চরম তত্ত্ব অবগত নহেনসেই পরম দেবতাকে প্রণাম করি । ৯

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার মঙ্গলধ্যান সমাপ্ত ।

শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা : প্রথম অধ্যায় – অর্জুনবিষাদযোগ 

ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়
ধৃতরাষ্ট্র উবাচ –
ধর্ম্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ।
মামকাঃ পাণ্ডবাশ্চৈব কিমকুর্ব্বত সঞ্জয়।।১

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন -
হে সঞ্জয়, পুণ্যক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে আমার পুত্রগণ এবং পাণ্ডুপুত্রগণ যুদ্ধার্থে সমবেত হইয়া কি করিলেন ? ১
সঞ্জয় উবাচ
দৃষ্ট্বা তু পাণ্ডবানীকং ব্যূঢ়ং দুর্যোধনস্তদা। 
আচার্যমুপসঙ্গম্য রাজা বচনমব্রবীৎ।।২।।
সঞ্জয় কহিলেন -
তৎকালে রাজা দুর্যোধন পাণ্ডব-সৈন্যদিগকে ব্যুহাকারে সজ্জিত দেখিয়া দ্রোণাচার্য সমীপে যাইয়া এই কথা বলিলেন । ২
                          পশ্যৈতাং পান্ডুপুত্রাণামাচার্য মহতীং চমূম্ ।
                     ব্যূঢ়াং দ্রুপদপুত্রেণ তব শিষ্যেণ ধীমতা।।৩।।

গুরুদেব, আপনার ধীমান্ শিষ্য দ্রুপদপুত্র কর্তৃক ব্যুহবদ্ধ পাণ্ডবদিগের এই বিশাল সৈন্যদল দেখুন । ৩

                                              অত্র শূরা মহেষ্বাসা ভীমার্জুনসমা যুধি। 
যুযুধানো বিরাটশ্চ দ্রুপদশ্চ মহারথঃ।।৪।।
ধৃষ্টকেতুশ্চেকিতানঃ কাশিরাজশ্চ বীর্যবান্ ।
পুরুজিৎ কুন্তিভোজশ্চ শৈব্যশ্চ নরপুঙ্গবঃ।।৫।।
যুধামন্যুশ্চ বিক্রান্ত উত্তমৌজাশ্চ বীর্যবান্ ।
সৌভদ্রো দ্রৌপদেয়াশ্চ সর্ব এব মহারথাঃ ।।৬।।

এই সেনার মধ্যে ভীমার্জুনের সমকক্ষ, মহাধনুর্ধারী বহু বীর পুরুষ রহিয়াছেন । সাত্যকি, বিরাট, মহারথ দ্রুপদ, ধৃষ্টকেতু, চেকিতান, বীর্যবান্ কাশীরাজ, কুন্তীভোজ পুরুজিৎ, নরশ্রেষ্ঠ শৈব্য, বিক্রমশালী যুধামন্যু, বীর্যবান্ উত্তমৌজা, সুভদ্রা-পুত্র (অভিমন্যু), দ্রৌপদীর পুত্রগণ (প্রতিবিন্ধ্যাদি) ইহারা সকলেই মহারথী । ৪-৬
অস্মাকন্ত বিশিষ্টা যে তান্নিবোধ দ্বিজোত্তম। 
নায়কা মম সৈন্যস্য সংজ্ঞার্থং তান্ ব্রবীমি তে।।৭।।

দে দ্বিজশ্রেষ্ঠ ! আমার সৈন্যমধ্যেও যে সকল প্রধান সেনানায়ক আছেন তাহাদিগকে অবগত হউন । আপনার সম্যক্ অবগতির জন্য তাহাদিগের নাম বলিতেছি । ৭

ভবান্ ভীষ্মশ্চ কর্ণশ্চ কৃপশ্চ সমিতিঞ্জয়ঃ। 
অশ্বত্থামা বিকর্ণশ্চ সৌমদত্তিস্তথৈব চ।।৮।।

আপনি, ভীষ্ম, কর্ণ, যুদ্ধজয়ী কৃপ, অশ্বত্থামা, বিকর্ণ, সোমদত্তপুত্র এবং জয়দ্রথঃ । ৮
অন্যে চ বহুবঃ শূরা মদর্থে ত্যক্তজীবিতাঃ। 
নানাশস্ত্রপ্রহরণাঃ সর্বে যুদ্ধবিশারদাঃ।।৯।।

আমার জন্য জীবন ত্যাগে প্রস্তুত আরও অনেক নানাশস্ত্রধারী বীরপুরুষ আছেন । তাঁহার সকলেই যুদ্ধ বিশারদ । ৯

অপর্যাপ্তং তদস্মাকং বলং ভীষ্মাভিরক্ষিতম্ । 
পর্যাপ্তং ত্বিদমেতেষাং বলং ভীমাভিরক্ষিতম্ ।।১০।। 


ভীষ্মকর্তৃক সম্যক্ রক্ষিত আমাদের সেনা অপরিমিত । আর ভীমকর্তৃক রক্ষিত পাণ্ডবদের সেনা পরিমিত (অপেক্ষাকৃত অল্প) । ১০

অয়নেষু চ সর্বেষু যথাভাগমস্থিতাঃ।
ভীষ্মমেবাভিরক্ষস্ত ভবন্তঃ সর্ব এব হি।।১১।।

আপনারা সকলেই স্ব স্ব বিভাগানুসারে সমস্ত বূহ্যদ্বারে অবস্থিত থাকিয়া ভীষ্মকেই সকল দিক্ হইতে রক্ষা করিতে থাকুন । ১১

তস্য সঞ্জনয়ন্ হর্ষং কুরুবৃদ্ধঃ পিতামহঃ। 
সিংহনাদং বিনদ্যাচ্চৈঃ শঙ্খং দধ্মৌ প্রতাপবান্ ।।১২।।

তখন প্রতাপশালী কুরুবৃদ্ধ পিতামহ তাঁহার (দুর্যোধনের) আনন্দ জন্মাইয়া উচ্চ সিংহনাদ করিয়া শঙ্খধ্বনি করিলেন । ১২

ততঃ শঙ্খাশ্চ ভের্যশ্চ পণবানকগোমুখাঃ ।
সহসৈবাভ্যহন্যস্ত স শব্দস্তুমুলোহভবৎ।।১৩।।

তখন শঙ্খ, ভেরী, পণব, আনক, গোমুখ প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র সহসা বাদিত হইলে সেই শব্দ তুমুল হইয়া উঠিল । ১৩

ততঃ শ্বেতৈর্হয়ৈর্যুক্তে মহতি স্যন্দনে স্থিতৌ। 
মাধবঃ পান্ডবশ্চৈব দিব্যৌ শঙ্খৌ প্রদ্ধমতুঃ।।১৪।।

অনন্তর শ্বেতাশ্বযুক্ত মহারথে স্থিত শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন দিব্য শঙ্খধ্বনি করিলেন । ১৪

পাঞ্চজন্যং হৃষীকেশো দেবদত্তং ধনঞ্জয়ঃ। 
পৌন্ড্রং দধ্মৌ মহাশঙ্খং ভীমকর্মা বৃকদরঃ।।১৫।।
অনন্তবিজয়ং রাজা কুন্তীপুত্রো যুধিষ্ঠিরঃ। 
নকুলঃ সহদেবশ্চ সুঘোষমণিপুষ্পকৌ।।১৬।।

শ্রীকৃষ্ণ পাঞ্চজন্য নামে শঙ্খ, অর্জুন দেবদত্ত নামক শঙ্খ এবং ভীম পৌণ্ড্র নামক মহাশঙ্খ বাজাইলেন । কুন্তীপুত্র রাজা যুধিষ্ঠির অনন্তবিজয় নামক শঙ্খ, নকুল সুঘোষ নামক শঙ্খ এবং সহদেব মণিপুস্পক নামক শঙ্খ বাজাইলেন । ১৫,১৬

কাশ্যশ্চ পরমেষ্বাসঃ শিখন্ডী চ মহারথঃ। 
ধৃষ্টদ্যুম্নো বিরাটশ্চ সাত্যকিশ্চাপরাজিতঃ।।১৭।। 
দ্রুপদো দ্রৌপদেয়াশ্চ সর্বশঃ পৃথিবীপতে। 
সৌভদ্রশ্চ মহাবাহুঃ শঙ্খান্ দধ্মুঃ পৃথক্ পৃথক্।।১৮।।

হে রাজন্, মহাধনুর্ধর কাশীরাজ, মহারথ শিখণ্ডী, ধৃষ্টদ্যুম্ন, বিরাট রাজা, অজেয় সাত্যকি, দ্রুপদ, দ্রৌপদীর পুত্রগণ, মহাবাহু সুভদ্রা-পুত্র - ইহারা সকলেই পৃথক্ পৃথক্ শঙ্খ বাজাইলেন । ১৭,১৮

স ঘোষো ধার্তরাষ্ট্রাণাং হৃদয়ানি ব্যদারয়ৎ। 
নভশ্চ পৃথিবীং চৈব তুমুলোহভ্যনুনাদয়ন্ ।।১৯।।

সেই তুমুল শব্দ আকাশ ও পৃথিবীতে প্রতিধ্বনিত হইয়া ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণ ও তৎপক্ষীয়গণের হৃদয় বিদীর্ণ করিল । ১৯

অথ ব্যবস্থিতান্ দৃষ্ট্বা ধার্তরাষ্ট্রান্ কপিধ্বজঃ। 
প্রবৃত্তে শস্ত্রসম্পাতে ধনুরুদ্যম্য পান্ডবঃ। 
হৃষীকেশং তদা বাক্যমিদমাহ মহীপতে।।২০।।

হে রাজন্, অনন্তর ধৃতরাষ্ট্রপক্ষীয়দিগকে যুদ্ধোদ্‌যোগে অবস্থিত দেখিয়া শস্ত্রনিক্ষেপে প্রবৃত্ত কপিধ্বজ অর্জুন ধনু উত্তোলন করিয়া শ্রীকৃষ্ণকে এই কথা বলিলেন । ২০

সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে রথং স্থাপয় মেহচ্যুত। 
যাবদেতান্নিরীক্ষেহহং যোদ্ধুকামানবস্থিতান্ ।।২১।। 
কৈর্ময়া সহ যোদ্ধব্যমস্মিন্ রণসমুদ্যমে।।২২।।
যোৎস্যমানানবেক্ষেহহং য এতেহত্র সমাগতাঃ। 
ধার্তরাষ্ট্রস্য দুর্বদ্ধের্যুদ্ধে প্রিয়চিকীর্ষবঃ।।২৩।।
অর্জুন বলিলেন -
হে অচ্যুত, যুদ্ধকামনায় অবস্থিত ইহাদিগকে যাবৎ আমি দর্শন করি, তাবৎ (তুমি) উভয় সেনার মধ্যে আমার রথ স্থাপন কর; এই যুদ্ধব্যাপারে কাহাদিগের সহিত আমার যুদ্ধ করিতে হইবে তাহা আমি দেখি; দুর্বুদ্ধি দুর্যোধনের হিতকামনায় যাহারা এখানে উপস্থিত হইয়াছেন, সেই সকল যুদ্ধার্থিগণকে আমি দেখি । ২১, ২২, ২৩

এবমুক্তো হৃষীকেশো গুড়াকেশেন ভারত। 
সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে স্থাপয়িত্বা রথোত্তমম্।।২৪।।

সঞ্জয় কহিলেন -
হে ভারত ! অর্জুন কর্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া শ্রীকৃষ্ণ উভয় সেনার মধ্যে ভীষ্ম দ্রোণ এবং সমস্ত রাজগণের সম্মুখে উৎকৃষ্ট রথ স্থাপন করিয়া কহিলেন -

ভীষ্মদ্রোণপ্রমুখতঃ সর্বেষাং চ মহীক্ষিতাম্ । 
উবাচ পার্খ পশ্যৈতান্ সমবেতান্ কুরূনিতি।। ২৫।।


শ্রীকৃষ্ণ কহিলেন -
"হে অর্জুন, সমবেত কুরুগণকে দেখ ।'' ২৪,২৫

তত্রাপশ্যৎ স্থিতান্ পার্থঃ পিতৃনথ পিতামহান্। 
আচার্যান্মাতুলান্ ভ্রাতৃন্ পুত্রান্ পৌত্রান্ সখীংস্তথা। 
শ্বশুরান্ সুহৃদশ্চৈব সেনয়োরুভয়োরপি।। ২৬।।


তখন অর্জুন উভয় সেনার মধ্যেই অবস্থিত পিতৃব্যগণ, পিতামহগণ, আচার্য্যগণ, মাতুলগণ, ভ্রাতৃগণ, পুত্রগণ, পৌত্রগণ, মিত্রগণ, শ্বশুরগণ ও সুহৃদ্‌গণকে দেখিলেন । ২৬

তান্ সমীক্ষ্য স কৌন্তেয়ঃ সর্বান্ বন্ধুনবস্থিতান্। 
কৃপয়া পরায়াবিষ্টো বিষীদন্নিদমব্রবীৎ।।২৭।।

সেই কুন্তীপুত্র অর্জুন বন্ধুবান্ধবদিগকে যুদ্ধার্থে অবস্থিত দেখিয়া নিতান্ত করুণার্দ্র হইয়া বিষাদপূর্বক এই কথা কহিলেন । ২৭

অর্জুন উবাচ
দৃষ্ট্বেমং স্বজনং কৃষ্ণ যুযুৎসুং সমুপস্থিতম্। 
সীদন্তি মম গাত্রাণি মুখং চ পরিশুষ্যতি।।২৮।।
অর্জুন কহিলেন - 
হে কৃষ্ণ, যুদ্ধেচ্ছু এই সকল স্বজনদিগকে সম্মুখে অবস্থিত দেখিয়া আমার শরীর অবসন্ন হইতেছে এবং মুখ শুষ্ক হইতেছে । ২৮

বেপথুশ্চ শরীরে মে রোমহর্যশ্চ জায়তে। 
গান্ডীবং স্রংসতে হস্তাৎ ত্বক্ চৈব পরিদহ্যতে।।২৯।।

আমার শরীরে কম্প ও রোমাঞ্চ হইতেছে; হাত হইতে গাণ্ডীব খসিয়া পড়িতেছে এবং চর্ম জ্বালা করিতেছে । ২৯

ন চ শক্নোম্যবস্থাতুং ভ্রুমতীব চ মে মনঃ। 
নিমিত্তানি চ পশ্যামি বিপরীতানি কেশব।।৩০।।

হে কেশব, আমি স্থির থাকিতে পারিতেছি না; আমার মন যেন ঘুরিতেছে, আমি দুর্লক্ষণ সকল দেখিতেছি । ৩০

ন চ শ্রেয়োহনুপশ্যামি হত্বা স্বজনমাহবে। 
ন কাঙ্ক্ষে বিজয়ং কৃষ্ণ ন চ রাজ্যং সুখানি চ।।৩১।।

যুদ্ধে স্বজনদিগকে নিহত করিয়া আমি মঙ্গল দেখিতেছি না । হে কৃষ্ণ, আমি জয়লাভ করিতে চাহি না, রাজ্যও চাহি না, সুখভোগ চাহি না । ৩১

কিং নো রাজ্যেন গোবিন্দ কিং ভোগৈর্জীবিতেন বা। 
যেষামর্থে কাঙ্ক্ষিতং নো রাজ্যং ভোগাঃ সুখানি চ।।৩২।। 
ত ইমেহবস্থিতা যুদ্ধে প্রাণাংস্ত্যক্তা ধনানি চ। 
আচার্যাঃ পিতরঃ পুত্রাস্তথৈব চ পিতামহাঃ।।৩৩।। 
মাতুলাঃ শ্বশুরাঃ পৌত্রাঃ শ্যালাঃ সম্বন্ধিনস্তথা। 
এতান্ন হস্তুমিচ্ছামি ঘ্নতোহপি মধূসূদন।।৩৪।। 

হে গোবিন্দ, যাহাদিগের জন্য রাজ্য, ভোগ, সুখাদি কামনা করা যায় সেই আচার্য্য, পিতৃব্য, পুত্র, পিতামহ, মাতুল, শ্বশুর, পৌত্র, শ্যালক ও কুটুম্বগণ যখন ধনপ্রাণ ত্যাগ স্বীকার করিয়াও যুদ্ধার্থে উপস্থিত, তখন আমাদের রাজ্যেই বা কি কাজ আর সুখভোগ বা জীবনেই বা কি কাজ ? হে মধুসূদন, যদি ইহারা আমাকে মারিয়াও ফেলে তথাপি আমি ইগাদিগকে মারিতে ইচ্ছা করি না । ৩২, ৩৩, ৩৪

অপি ত্রৈলোক্যরাজ্যস্য হেতোঃ কিং নু মহীকৃতে। 
নিহত্য ধার্তরাষ্ট্রন্নঃ কা প্রীতিঃ স্যাজ্জনার্দন।।৩৫।।

হে কৃষ্ণ, পৃথিবীর রাজত্বের কথা দূরে থাক, ত্রৈলোক্যরাজ্যের জন্যই বা দুর্য্যোধনাদিগকে বধ করলে আমাদের কি সুখ হইবে ? ৩৫

পাপমেবাশ্রয়েদস্মান্ হত্বৈতানাততায়িনঃ। 
তস্মান্নার্হা বয়ং হস্তুং ধার্তরাষ্ট্রান্ সবান্ধবান্ । 
স্বজনং হি কথং হত্বা সুখিনঃ স্যাম মাধব।।৩৬।।


যদিও ইহারা আততায়ী (এবং আততায়ী শাস্ত্রমতে বধ্য), তথাপি এই আচার্য্যাদি গুরুজনকে বধ করিলে আমরা পাপভাগীই হইব । অতএব আমরা সবান্ধব ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদিগকে বধ করিতে পারি না; হে মাধব, স্বজন বধ করিয়া আমরা কি প্রকারে সুখী হইব ? ৩৬


যদ্যপ্যেতে ন পশ্যন্তি লোভোপহতচেতসঃ। 
কুলক্ষয়কৃতং দোষং মিত্রদ্রোহে চ পাতকম্।।৩৭।। 
কথং ন জ্ঞেয়মস্মাভিঃ পাপাদস্মান্নিবর্তিতুম্।
কুলক্ষয়কৃতং দোষং প্রপশ্যদ্ভির্জনার্দন।।৩৮।।

যদিও ইহারা লোভে হতজ্ঞান হইয়া কুলক্ষয়জনিত দোষ এবং মিত্রদ্রোহজনিত পাতক দেখিতেছে না, কিন্তু হে জনার্দন, আমরা কূলক্ষয়জনিত দোষ দেখিয়াও সে পাপ হইতে নিবৃত্ত কেন না হইব ? ৩৭,৩৮

কুলক্ষয়ে প্রণশ্যন্তি কুলধর্মাঃ সনাতনাঃ। 
ধর্মে নষ্টে কুলং কৃৎস্নমধর্মোহভিভবত্যুত।।৩৯।।

কূলক্ষয় হইলে সনাতন কূলধর্ম নষ্ট হয় এবং ধর্ম নষ্ট হইলে সমগ্র কূল অধর্মে অভিভূত হয় । ৩৯

অধর্মাভিভবাৎ কৃষ্ণ প্রদুষ্যন্তি কুলুস্ত্রয়ঃ। 
স্ত্রীষু দুষ্টাসু বার্ষ্ণেয় জায়তে বর্ণসঙ্করঃ।।৪০।।

হে কৃষ্ণ, কূল অধর্মে অভিভূত হইলে কূলস্ত্রীগণ ব্যভিচারিণী হয় । হে বার্ষ্ণেয়, কূলনারীগণ ব্যভিচারিণী হইলে বর্ণসঙ্কর জন্মে । ৪০

সঙ্করো নরকায়ৈব কুলঘ্নানাং কুলস্য চ। 
পতন্তি পিতরো হ্যেষাং লুপ্তপিন্ডোদকক্রিয়াঃ।।৪১।।


বর্ণসঙ্কর, কূলনাশকারীদিগের এবং কূলের নরকের কারণ হয় । শ্রাদ্ধ-তর্পণাদি ক্রিয়ার লোপ হওয়াতে ইহাদের পিতৃপুরুষ নরকে পতিত হয় (সদ্গতিপ্রাপ্ত হয় না) । ৪১

দোষৈরেতৈঃ কুলঘ্নানাং বর্ণস্করকৈঃ। 
উৎসাদ্যন্তে জাতিধর্মাঃ কুলধর্মাশ্চ শাশ্বতাঃ।।৪২।।

কূলনাশকারীদগের বর্ণসঙ্করকারক ঐ দোষে সনাতন জাতিধর্ম, কূলধর্ম ও আশ্রমধর্মাদি উৎসন্ন যায় । ৪২

উৎসন্নকুলধর্মাণাং মনষ্যাণাং জনার্দন। 
নরকে নিয়তং বাসো ভবতীত্যনুশুশ্রুম।।৪৩।।

হে জনার্দন, যে মনুষ্যদিগের কূলধর্ম উৎসন্ন যায়, তাহাদের নিয়ত নরকে বাস হয়, ইহা আমরা শুনিয়াছি । ৪৩

অহো বত মহৎ পাপং কর্তুং ব্যবসিতা বয়ম্।
যদ্ রাজ্যসুখলোভেন হস্তুং স্বজনমুদ্যতাঃ।।৪৪।।

হায় ! আমরা রাজ্যসুখলোভে স্বজনগণকে বিনাশ করিতে উদ্যত হইয়া মহাপাপে প্রবৃত্ত হইয়াছি । ৪৪

যদি মামপ্রতীকারমশস্ত্রং শস্ত্রপাণয়ঃ। 
ধার্তরাষ্ট্রা রণে হন্যুস্তন্মে ক্ষেমতরং ভবেৎ।।৪৫।।

আমি শস্ত্রত্যাগ করিয়া প্রতিকারে বিরত হইলে যদি অস্ত্রধারী দুর্য্যোধনাদি আমাকে যুদ্ধে বধ করে তাহাও আমার পক্ষে অধিকতর মঙ্গলকর হইবে । ৪৫
এবমুক্তার্জুনঃ সংখ্যে রথোপস্থ উপাবিশৎ। 
বিসৃজ্য সশরং চাপং শোকসংবিগ্নমানসঃ।।৪৬।।

সঞ্জয় কহিলেন -
শোকাকুলিত অর্জুন এইরূপ বলিয়া যুদ্ধমধ্যে ধনুর্বাণ ত্যাগ করিয়া রথোপরি উপবেশন করিলেন । ৪৬
                                                                সমাপ্ত

১) সঞ্জয়ের দিব্যচক্ষু প্রাপ্তি
যুদ্ধারম্ভের পূর্বে ব্যাসদেব অন্ধরাজকে যুদ্ধদর্শনার্থ দিব্যচক্ষু প্রদান করিতে চাহিলেন । ধৃতরাষ্ট্র তাহাতে অসম্মত হইয়া বলিলেন - আমি জ্ঞাতি-কুটুম্বের নিধন দেখিতে চাই না, আপনার তপঃপ্রভাবে যাহাতে যুদ্ধের সমস্ত বৃত্তান্ত যথাযথ শ্রবণ করিতে পারি, আপনি তাহাই করুন । তখন ব্যাসদেব রাজ-অমাত্য সঞ্জয়কে বর প্রদান করেন । সেই বরপ্রভাবে তিনি দিব্যদৃষ্টি লাভ করিয়া যুদ্ধাদি সন্দর্শন ও উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের বাক্যাদি-শ্রবণ ও মনোভাব সমস্ত পরিজ্ঞাত হইয়া ধৃতরাষ্ট্রের নিকট বর্ণনা করিয়াছিলেন । গীতার সমস্তই সঞ্জয়-বাক্য [মভাঃ|ভীঃ|১|২৪] । 'পরম যোগশক্তির আধার মহামুনি ব্যাস যে এই দিব্য চক্ষু সঞ্জয়কে দিতে সক্ষম ছিলেন, তাহা অবিশ্বাস করিবার কোনো কারণ দেখিতে পাই না' - শ্রীঅরবিন্দ ।

ধর্মক্ষেত্র - যুদ্ধক্ষেত্র কুরুক্ষেত্র
কুরুক্ষেত্র চিরকালই পরম পুণ্যভূমি বলিয়া পরিচিত । জাবাল উপনিষদে ও শতপথব্রাহ্মণে ইহাকে দেবযজন অর্থাৎ দেবতাদের 'যজ্ঞস্থান' বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে । ইহার প্রাচীন নাম সমন্তপঞ্চক । পরশুরাম একুশ বার পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করিয়া এই স্থানে পিতৃ-তর্পণ করিয়াছিলেন । দুর্যোধনাদির পূর্বপুরুষ বিখ্যাত কুরু রাজা এই স্থানে হল-চালনা করিয়া এই বর লাভ করিয়াছিলেন যে, যে-ব্যক্তি এই স্থানে তপস্যা করিবে অথবা যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করিবে, সে স্বর্গে গমন করিবে । তদবধিই ইহার নাম কুরুক্ষেত্র । প্রাচীন গ্রন্থাদীতে সর্বত্রই কুরুক্ষেত্রকে ধর্মক্ষেত্র বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে । বনপর্বের তীর্থযাত্রা পর্বাধ্যায়ে কুরুক্ষেত্রকে তিন লোকের মধ্যে শ্রেষ্ঠ তীর্থস্থান বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে; সুতরাং 'ধর্মক্ষেত্র' এই বিশেষণটি একান্ত সুসঙ্গত ও প্রয়োজনীয় ।

৩) 'আপনার ধীমান শিষ্য' - এ-কথাটি দুর্যোধন শ্লেষাত্মক ভাবেই ব্যবহার করিয়াছেন । আবার 'ধৃষ্টদ্যুম্ন' না বলিয়া 'দ্রুপদপুত্র' বলিয়া দ্রোণাচার্যের পূর্বশত্রুতা স্মরণ করাইয়া দিতেছেন ।

৫) কুন্তিভোজঃ পুরুজিৎ - একই ব্যক্তি, ইনি ভীমসেনাদির মাতুল । কুন্তিভোজ কৌলিক নাম ।

৬) মহারথ = যিনি একাকী দশ-সহস্র ধনুর্ধারীর সহিত যুদ্ধ করেন এবং যিনি শস্ত্রশাস্ত্রে প্রবীণ, তিনিই মহারথ ।

৮) সমিতিঞ্জয়ঃ = সমিতি(সংগ্রামে) জয় লাভ করে যে অর্থাৎ যুদ্ধজয়ী ।
সৌমদত্তিঃ = সোমদত্ত-পুত্র বিখ্যাত ভূরিশ্রবা ।

১০) পর্যাপ্ত = যাহা আয়ত্ত করা যায়, পরিমাণ করা যায় অর্থাৎ পরিমিত, সীমাবদ্ধ । অর্থান্তরে যথেষ্ট, সমর্থ ।
অপর্যাপ্ত = অপরিমিত, অসংখ্য । অর্থান্তরে অপ্রচুর, অসমর্থ ।
এই অনুবাদে প্রথম অর্থই গ্রহণ করে তাৎপর্য এইভাবে ব্যাখ্যা করা হইয়াছে - 'আমাদের সৈন্য অপরিমিত অর্থাৎ বৃহৎ, তাহাতে বীরশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম আমাদের সেনাপতি; আর উহাদের সৈন্য পরিমিত অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র, আর নগন্য ভীম উহাদের সেনাপতি - সুতরাং আমাদের জয় হইবে না কেন ?'

শ্রীধর স্বামীর টীকায় শেষোক্ত ব্যাখ্যাই আছে । এঁনার মতে, পরের শ্লোকে 'সকলে ভীষ্মকে রক্ষা করুন' এ-কথায় বুঝা যায় যে, দুর্যোধনের মনে কিছু ভয়ের উদ্রেক হইয়াছিল এবং তিনি নিজের সৈন্যবল অপ্রচুর বা অসমর্থ মনে করিতেছেন । কিন্তু দুর্যোধনের ভয় পাওয়ার কথা মহাভারতে কোথাও নাই । বরং ঠিক ইহার বিপরীত কথাই আছে [মভাঃ|উঃ|১-৬৯, মভাঃ|ভীঃ|৫১|৬|৯] যাহা হইতে বুঝা যায় যে সকলকে উৎসাহ-দানার্থই এ-সকল কথা বলা হইয়াছিল । এই কারণে লোকমান্য তিলক প্রমুখ অনেকে পূর্বোক্ত প্রথম অর্থই গ্রহণ করিয়াছেন ।

১১) 'সকলে ভীষ্মকে রক্ষা করুন' - দুর্যোধনের এই আশঙ্কার তাৎপর্য
ভীষ্ম সমরে অপরাজেয়, তথাপি তাঁহার জন্য দুর্যোধনের এত আশঙ্কা কেন ? দুর্যোধন পূর্বেই এই আশঙ্কা ব্যক্ত করিয়াছেন - 'ভীষ্ম একাই সসৈন্য পাণ্ডবকে বধ করিতে পারেন, কিন্তু তিনি শিখণ্ডীকে বধ করিবেন না, সুতরাং সকলে সতর্ক হইয়া সর্ব দিক হইতে ভীষ্মকে রক্ষা করিবেন, আমরা যেন জম্বুক-শিখণ্ডী দ্বারা অতর্কিতভাবে ভীষ্মসিংহকে বধ না করাই' [মভাঃ|ভীঃ|১৫|১৪-২০] ।

১৩) পণব = মৃদঙ্গ, আনক = ঢাক, গোমুখ = রণশঙ্খ; সেকালের বিউগ্‌ল্‌ (bugle) ছিল শঙ্খ ।

২৪) ভারত = দুষ্মন্ত-রাজার পুত্র ভরতের বংশধর, এখানে ধৃতরাষ্ট্র ।
গুড়াকেশেন = গুড়াকা (নিদ্রা, আলস্য), তাহার ঈশ, অর্থাৎ নিদ্রালস্যজয়ী, এখানে অর্জুন ।
হৃষীকেশঃ = হৃষীক ইন্দ্রিয়, তাহার ঈশ, অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গণের প্রভু, শ্রীকৃষ্ণ ।

৩৬) আততায়ী (assassin) 
অগ্নিদো গরদশ্চৈব শস্ত্রপাণির্ধনাপহঃ । ক্ষেত্রদারাপহারী চ ষড়েতে আততায়িনঃ ।।
ছয়জন আততায়ী - (i)অগ্নিদ (যে ঘরে আগুন দেয়), (ii)গরদ (যে বিষ দেয়), (iii)বধার্থ অস্ত্রধারী, (iv)ধনাপহারী, (v)ভূমি-অপহারী ও (vi)দারা-হরণকারী ।
দুর্যোধনাদি প্রায় এ-সমস্ত কর্মই করিয়াছেন; সুতরাং তাহারা আততায়ী ।
Six types of assassin (who can be killed as per law) : one who (i)commits arson, (ii)gives poison, (iii)wields weapon to kill, (iv)steals wealth, (v)steals land, (vi)steals wife.

অর্থশাস্ত্রমতে (law) আততায়ী বধ্য [মনু|৮|৩৫০-৫১] । কিন্তু ধর্মশাস্ত্রমতে (morality) "অহিংসা পরমো ধর্মঃ', 'গুরুজনাদিরবধ্যঃ', 'ন পাপে প্রতিপাপঃ স্যাৎ' ইত্যাদি । অর্থশাস্ত্র হইতে ধর্মশাস্ত্র বলবৎ । সুতরাং আততায়ী হইলেও গুরুজনাদি-বধে পাপভাগী হইতে হইবে, ইহাই অর্জুনোক্তির মর্ম ।

৪২) বর্ণধর্ম = ব্রাহ্মণের অধ্যাপনাদি, ক্ষত্রিয়ের প্রজারক্ষাদি, বৈশ্যের কৃষি-বাণিজ্যাদি, শূদ্রের পরিচর্যাদি । (অর্জুন এস্থলে জাতিধর্ম ও বর্ণধর্ম সমার্থক রূপে ব্যবহার করিয়াছেন কিন্তু মানুষের জাতি তার জন্মের সহিত সম্পর্কিত আর শ্রীকৃষ্ণের বর্ণ মানুষের গুণের ও কর্মের সহিত সম্পর্কিত [গীতা|৪|১৩], uploader's comment ।) বর্ণ বনাম জাতি
কুলধর্ম = কৌলিক উপাসনা-পদ্ধতি ও আচার-নিয়মাদি ।
আশ্রমধর্ম = ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ, সন্ন্যাস ।

            শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : দ্বিতীয় অধ্যায় - সাংখ্যযোগ 

সঞ্জয় কহিলেন -
তখন মধুসূদন কৃপাবিষ্ট অশ্রুপূর্ণলোচন বিষন্ন অর্জুনকে এই কথা বলিলেন । ১

শ্রীভগবান্ বলিলেন -
হে অর্জুন ! এই সঙ্কটসময়ে অনার্য-জনোচিত, স্বর্গহানিকর, অকীর্তিকর তোমার এই মোহ কোথা হইতে উপস্থিত হইল ? ২

হে পার্থ, কাতর হইও না । এইরূপ পৌরুষহীনতা তোমাকে শোভা পায় না । হে পরন্তপ ! তুচ্ছ হৃদয়ের দুর্বলতা ত্যাগ করিয়া (যুদ্ধার্থে) উত্থিত হও । ৩

অর্জুন বলিলেন -
হে শত্রুমর্দন মধুসূদন, আমি যুদ্ধকালে পূজনীয় ভীষ্ম ও দ্রোণের সহিত কিরূপে বাণের দ্বারা প্রতিযুদ্ধ করিব ? (অর্থাৎ) তাঁহারা আমার শরীরে বাণ নিক্ষেপ করিলেও আমি গুরুজনের অঙ্গে অস্ত্র নিক্ষেপ করিতে পারিব না । ৪

মহানুভব গুরুজনদিগকে বধ না করিয়া ইহলোকে ভিক্ষান্ন-ভোজন করাও শ্রেয়ঃ । কেননা গুরুজনদিগকে বধ করিয়া ইহলোকে যে অর্থকাম ভোগ করিব তাহা তো (গুরুজনের) রুধির-লিপ্ত । ৫

আমরা জয়ী হই অথবা আমাদিগকে ইহারা জয় করুক, এই উভয়ের মধ্যে কোন্‌টি শ্রেয়স্কর তাহা বুঝিতে পারিতেছি না, - যাহাদিগকে বধ করিয়া বাঁচিয়া থাকিতে চাহি না, সেই ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রগণ সম্মুখে অবস্থিত । ৬

(গুরুজনদিগকে বধ করিয়া কিরূপে প্রাণ ধারণ করিব এইরূপ চিন্তাপ্রযুক্ত) চিত্তের দীনতায় আমি অভিভূত হইয়াছি; প্রকৃত ধর্ম কি এ সন্বন্ধে আমার চিত্ত বিমূঢ় হইয়াছে; যাহা আমার ভাল হয়, আমাকে নিশ্চিত করিয়া তাহা বল, আমি তোমার শিষ্য, তোমার শরণাপন্ন, আমাকে উপদেশ দাও । (আমাকে আর তুমি সখা বলিয়া মনে করিও না, আমি তোমার শিষ্য) । ৭

পৃথিবীতে নিষ্কন্টক সমৃদ্ধ রাজ্য এবং সুরলোকের আধিপত্য পাইলেও যে শোক আমার ইন্দ্রিয়গণকে বিশোষণ করিবে তাহা কিসে যাইবে, আমি দেখিতেছি না । ৮

সঞ্জয় কহিলেন - 
শত্রুতাপন অর্জুন হৃষীকেশ গোবিন্দকে এইরূপ বলিয়া 'আমি যুদ্ধ করিব না' এই কথা কহিয়া তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিলেন (নীরব রহিলেন) । ৯

হে ভারত (ধৃতরাষ্ট্র) ! হৃষীকেশ উভয় সেনার মধ্যে বিষাদপ্রাপ্ত অর্জুনকে হাসিয়া এই কথা বলিলেন । ১০

শ্রীভগবান্ বলিলেন -
যাহাদিগের জন্য শোক করার কোন কারণ নাই, তুমি তাহাদিগের জন্য শোক করিতেছ, আবার পণ্ডিতের ন্যায় কথা বলিতেছ । কিন্তু যাঁহারা প্রকৃত তত্ত্বজ্ঞানী তাঁহারা কি মৃত কি জীবিত, কাহারো জন্য শোক করেন না । ১১

আমি পূর্বে ছিলাম না, বা তুমি ছিলে না বা এই নৃপতিগণ ছিলেন না, এমন নহে (অর্থাৎ সকলেই ছিলাম) । আর, পরে আমরা সকলে থাকিব না তাহাও নহে (অর্থাৎ পরেও সকলে থাকিব) । ১২

জীবের এই দেহে বাল্য, যৌবন ও বার্ধক্য, কালের গতিতে উপস্থিত হয় । তেমনি কালের গতিতে দেহান্তর-প্রাপ্তিও হয় । জ্ঞানিগণ তাহাতে মোহগ্রস্ত হন না । ১৩

হে কৌন্তেয়, ইন্দ্রিয়বৃত্তির সহিত বিষয়াদির সংযোগই শীতোষ্ণাদি সুখদুঃখ প্রদান করে । সেগুলির একবার উৎপত্তি হয়, আবার বিনাশ হয়, সুতরাং ওগুলি অনিত্য । অতএব সে সকল সহ্য কর । ১৪

হে পুরুষশ্রেষ্ঠ, যে স্থিরবুদ্ধি ব্যক্তি এই সকল বিষয়স্পর্শ-জনিত সুখদুঃখ সমভাবে গ্রহণ করেন, উহাতে বিচলিত হন না, তিনি অমৃতত্ব লাভে সমর্থ হন । ১৫

অসৎ বস্তুর ভাব (সত্তা, স্থায়িত্ব) নাই, সৎবস্তুর অভাব (নাশ) নাই; তত্ত্বদর্শিগণ এই সদসৎ উভয়েরই চরম দর্শন করিয়াছেন (স্বরূপ উপলব্ধি করিয়াছেন) । ১৬

যিনি এই সকল (দৃশ্য জগৎ) ব্যাপিয়া আছেন তাঁহাকে অবিনাশী জানিও । কেহই এই অব্যয় স্বরূপের বিনাশ করিতে পারে না । ১৭

দেহাশ্রিত আত্মার এই সকল দেহ নশ্বর বলিয়া উক্ত হইয়াছে । কিন্তু আত্মা নিত্য, অবিনাশী, অপ্রমেয় (স্বপ্রকাশ) । অতএব, হে অর্জুন, যুদ্ধ কর (আত্মার অবিনাশিতা ও দেহাদির নশ্বরত্ব স্মরণ করিয়া কাতরতা ত্যাগ কর । স্বধর্ম পালন কর) । ১৮

যে আত্মাকে হন্তা বলিয়া জানে এবং যে উহাকে হত বলিয়া মনে করে, তাহারা উভয়েই আত্মতত্ত্ব জানে না । ইনি হত্যা করেন না, হতও হন না । ১৯

এই আত্মা কখনো জন্মেন না বা মরেন না । ইনি অন্যান্য জাত বস্তুর ন্যায় জন্মিয়া অস্তিত্ব লাভ করেন না অর্থাৎ ইনি সৎরূপে নিত্য বিদ্যমান । ইনি জন্মরহিত, নিত্য, শাশ্বত এবং পুরাণ; শরীর হত হইলেও ইনি হত হন না । ২০

যিনি আত্মাকে অবিনাশী, নিত্য, অজ, অব্যয় বলিয়া জানেন, হে পার্থ, সে পুরুষ কি প্রকারে কাহাকে হত্যা করেন বা করান ? ২১

যেমন মনুষ্য জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া নূতন বস্ত্র গ্রহণ করে, সেইরূপ আত্মা জীর্ণ শরীর পরিত্যাগ করিয়া অন্য নূতন শরীর পরিগ্রহ করে । ২২

শস্ত্রসকল ইহাকে ছেদন করিতে পারে না, অগ্নিতে দহন করিতে পারে না, জলে ভিজাইতে পারে না, বায়ুতে শুষ্ক করিতে পারে না । ২৩

এই আত্মা অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য, অশোষ্য । ইনি নিত্য, সর্বব্যাপী, স্থির, অচল, সনাতন, অব্যক্ত, অচিন্ত্য, অবিকার্য্য বলিয়া কথিত হন । ২৪

অতএব আত্মাকে এই প্রকার জানিয়া তোমার শোক করে উচিত নয় । ২৫

আর যদি তুমি মনে কর যে, আত্মা সর্বদা দেহের সঙ্গে জন্মে এবং দেহের সঙ্গেই বিনষ্ট হয়, তথাপি, হে মহাবাহো, তোমার শোক করা উচিত নয় । (দেহনাশে আত্মারও নাশ হয় ইহা স্বীকার করিয়া লইলেও শোক করা উচিত নয় । কেননা, জন্মমৃত্যু অবশ্যম্ভাবী ।) ২৬

যে জন্মে তার মরণ নিশ্চিত, যে মরে তার জন্ম নিশ্চিত; সুতরাং অবশ্যম্ভাবী বিষয়ে তোমার শোক করা উচিত নয় । ২৭

হে ভারত (অর্জুন) ! জীবগণ আদিতে অব্যক্ত, মধ্যে ব্যক্ত এবং বিনাশান্তে অব্যক্ত থাকে । তাহাতে শোক বিলাপ কি ? ২৮

কেহ আত্মাকে আশ্চর্য্যবৎ কিছু বলিয়া বোধ করেন, কেহ ইহাকে আশ্চর্য্যবৎ কিছু বলিয়া বর্ণনা করেন, কেহ বা ইনি আশ্চর্য্যবৎ কিছু, এই প্রকার কথাই শুনেন । কিন্তু শুনিয়াও কেহ ইহাকে জানিতে পারেন না । ২৯

হে ভারত, জীবসকলের দেহে আত্মা সর্বদাই অবধ্য, অতএব কোন প্রাণীর জন্যই তোমার শোক করা উচিত নহে । ৩০

স্বধর্মের দিকে দৃষ্টি রাখিয়াও তোমার ভীত-কম্পিত হয়া উচিত নহে । ধর্মযুদ্ধ অপেক্ষা ক্ষত্রিয়ের পক্ষে শ্রেয়ঃ আর কিছু নাই । ৩১

হে পার্থ, এই যুদ্ধ আপনা হইতেই উপস্থিত হইয়াছে, ইহা মুক্ত স্বর্গদ্বার স্বরূপ । ভাগ্যবান্ ক্ষত্রিয়েরাই ঈদৃশ যুদ্ধ লাভ করিয়া থাকেন । ৩২

আর যদি তুমি ধর্মযুদ্ধ না কর তবে স্বধর্ম ও কীর্তি ত্যাগ করিয়া তুমি পাপযুক্ত হইবে । ৩৩

আরও দেখ, সকল লোকে চিরকাল তোমার অকীর্তি ঘোষণা করিবে । সম্মানিত ব্যক্তির পক্ষে অকীর্তি মরণ অপেক্ষা অধিক, অর্থাৎ অকীর্তি অপেক্ষা মরণও শ্রেয়ঃ । ৩৪

মহারথগণ মনে করিবেন, তুমি ভয়বশতঃ যুদ্ধে বিরত হইতেছ, দয়াবশতঃ নহে । সুতরাং যাহারা তোমাকে বহু সম্মান করেন তাহাদিগের নিকট তুমি লঘুতা প্রাপ্ত হইবে । ৩৫

তোমার শত্রুরাও তোমার সামর্থ্যের নিন্দা করিয়া অনেক অবাচ্য কথা বলিবে; তাহা অপেক্ষা অধিক দুঃখকর আর কি আছে ? ৩৬

যুদ্ধে হত হইলে স্বর্গ পাইবে, জয়লাভ করিলে পৃথিবী ভোগ করিবে, সুতরাং হে কৌন্তেয়, যুদ্ধে কৃতনিশ্চয় হইয়া উত্থান কর । ৩৭

অতএব, সুখদুঃখ, লাভ-অলাভ, জয়-পরাজয় তুল্যজ্ঞান করিয়া যুদ্ধার্থ উদ্‌যুক্ত (উদ্যত) হও । এইরূপ করিলে পাপভাগী হইবে না । ৩৮

হে পার্থ, তোমাকে এতক্ষণ সাংখ্য নিষ্ঠা-বিষয়ক জ্ঞান উপদেশ দিলাম, এক্ষণ যোগবিষয়ক জ্ঞান শ্রবণ কর (যাহা এক্ষণ বলিতেছি) এই জ্ঞান লাভ করিলে কর্মবন্ধন ত্যাগ করিতে পারিবে । ৩৯

এষা তেহভিহিতা সাংখ্যে বুদ্ধিয়োগে ত্বিমাং শৃণু।
বুদ্ধ্যা য়ুক্তো য়য়া পার্থ কর্মবন্ধং প্রহাস্যসি।। গীতা - ২।৩৯
পদচ্ছেদঃ এষা। তে। অভিহিতা। সাংখ্যে। বুদ্ধিঃ। য়োগে। তু।
ইমাং। শৃণু। বুদ্ধ্যা। যুক্তঃ । য়য়া। পার্থ। কর্মবন্ধং। প্রহাস্যসি।।
পদার্থঃ (পার্থ) হে পার্থ! (তে) তােমার জন্য (এষা) এই (সাংখ্যে) শঙ্কা=সদসদ্ধি
বিষয়ে (বুদ্ধিঃ) জ্ঞানযােগের উপদেশ করে আর এখন (য়ােগে, তু, ইমাং, শ্রৃণু) ক.
বিষয়ক এই উপদেশকে শ্রবণ করাে (য়য়া, বুদ্ধ্যা) যে বুদ্ধি থেকে (যুক্তঃ) যুক্ত হয়ে তুমি
(কর্মবন্ধং) কর্মবন্ধন থেকে (প্রহাস্যসি) মুক্ত হতে পারবে।।
ভাবার্থঃ হে অর্জুন! তােমার এই বুদ্ধি শঙ্কার বিষয়ে কেন হয়? এখন যােগ-বিষয়ক বুদ্ধিকে
শ্রবণ করাে, যাহা থেকে যুক্ত হয়ে তুমি কর্মের বন্ধনকে নষ্ট করতে পারবে।
এইজন্য "য়োহর্থজ্ঞ ইত্ সকলম্ ভ্রদ্রমশ্লুতে” (নিরুক্ত ১।৬।১৮)
কেননা সেই অর্থজ্ঞানের বল হইতে বিকলের সকলকে বানিয়ে নেয়। কিন্তু এই বেদবাদিদের তব সারা পুণ্য-পাপ যজ্ঞ-ক্রিয়ার মন্ত্রোচ্চারণ তথা ক্রিয়া-প্রক্রিয়া-ক্রমেই রেখে দেয়। এই জন্য ভগবান শ্রী কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছে যে হে অর্জুন! ধর্ম-মার্গ অতি সরল হয়।
মহাে অর্ণঃ সরস্বতী প্র চেতয়তি কেতুনা।
ধিয়ো বিশ্বা বি রাজতি। (ঋগ্বেদ ১।৩।১২)
ভাবার্থঃ জ্ঞানের প্রকাশ করার জন্য এই বিদ্যার দেবী কর্মের মহাসাগরকে জ্ঞানের সামনে খুলে দিতে হয় অর্থাৎ এই বিদ্বার কারণ মনুষ্য, কর্মকে নানা মার্গের জ্ঞাতা হয়ে যায় আর এই প্রকার নিজের বুদ্ধিকে জ্ঞানযুক্ত করে।।
(আর্যমুনি গীতা ভাষ্য)

ইহাতে (এই নিষ্কাম কর্মযোগে) আরব্ধ কর্ম নিষ্ফল হয় না এবং (ত্রুটি-বিচ্যুতি-জনিত) পাপ বা বিঘ্ন হয় না, এই ধর্মের অল্প আচরণও মহাভয় হইতে ত্রাণ করে । ৪০

ইহাতে (এই নিষ্কাম কর্মযোগে) ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি (নিষ্কাম ভাবে কর্ম করিয়াই আমি ত্রাণ পাইব এইরূপ নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি) একই হয় অর্থাৎ একনিষ্ঠই থাকে, নানাদিকে ধাবিত হয় না । কিন্তু অব্যবসায়ীদিগের (অস্থিরচিত্ত সকাম ব্যক্তিগণের) বুদ্ধি বহুশাখাবিশিষ্ট ও অনন্ত (সুতরাং নানাদিকে ধাবিত হয়) । ৪১

হে পার্থ, অল্পবুদ্ধি ব্যক্তিগণ বেদের কর্মকাণ্ডের স্বর্গফলাদি প্রকাশক প্রীতিকর বাক্যে অনুরক্ত, তাহারা বলে বেদোক্ত কাম্যকর্মাত্মক ধর্ম ভিন্ন আর কিছু ধর্ম নাই, তাহাদের চিত্ত কামনা-কলুষিত, স্বর্গই তাহাদের পরম পুরুষার্থ, তাহারা ভোগৈশ্বর্য্য লাভের উপায়স্বরূপ বিবিধ ক্রিয়াকলাপের প্রশংসাসূচক আপাতোমনোরম বেদবাক্য বলিয়া থাকে; এই সকল শ্রবণ-রমণীয় বাক্যদ্বারা অপহৃতচিত্ত, ভোগৈশ্বর্য্যে আসক্ত ব্যক্তিগণের কার্যাকার্য নির্ণায়ক বুদ্ধি এক বিষয়ে স্থির থাকিতে পারে না (ঈশ্বরে একনিষ্ঠ হয় না) । ৪২, ৪৩, ৪৪

হে অর্জুন, বেদসমূহ ত্রৈগুণ্য-বিষয়ক, তুমি নিস্ত্রৈগুণ্য হও - তুমি নির্দ্বন্দ্ব, নিত্যসত্ত্বস্থ, যোগ-ক্ষেমরহিত ও আত্মবান্ হও । ৪৫

বাপী-কূপ-তড়াগাদি ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র জলাশয়ে যে প্রয়োজন সিদ্ধ হয়, এক বিস্তীর্ণ মহাজলাশয়ে সেই সমস্তই সিদ্ধ হয়; সেইরূপ বেদোক্ত কাম্যকর্মসমূহে যে ফল লাভ হয়, ব্রহ্মবেত্তা ব্রহ্মনিষ্ঠ পুরুষের সেই সমস্তই লাভ হয় । ৪৬

কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন ।
মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি।। (গীতা ২/৪৭)

কর্মেই তোমার অধিকার, কর্মফলে কখনও তোমার অধিকার নাই । কর্মফল যেন তোমার কর্মপ্রবৃত্তির হেতু না হয় কর্মত্যাগেও যেন তোমার প্রবৃত্তি না হয় । ৪৭
কর্মফলের চিন্তা না করে কর্ম সম্পাদন করতে হবে । এখানে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন আমরা যেন কর্মফলের আশায় কর্ম না করি । কর্মফলের আশায় কর্ম করলে আমাদের আসক্তি জন্মে আর আমাদের দুঃখের হেতু হয় ৷ এজন্য আমাদের নিষ্কাম কর্মযোগী হতে হবে ।

হে ধনঞ্জয়, যোগস্থঃ হইয়া, ফলাসক্তি বর্জন করিয়া, সিদ্ধি ও অসিদ্ধি তুল্যজ্ঞান করিয়া তুমি কর্ম কর । এইরূপ সমত্ব-বুদ্ধিকেই যোগ কহে । ৪৮

হে ধনঞ্জয়, কেবল বাহ্য কর্ম বুদ্ধিযোগ অপেক্ষা নিতান্তই নিকৃষ্ট; অতএব তুমি সমত্ববুদ্ধির আশ্রয় লও; যাহারা ফলের উদ্দেশে কর্ম করে, তাহার দীন, কৃপার পাত্র । ৪৯

সমত্ববুদ্ধিযুক্ত নিষ্কাম কর্মী ইহলোকেই সুকৃত- (পুণ্যকর্ম) দুষ্কৃত (পাপকর্ম) উভয়ই ত্যাগ করেন । সুতরাং তুমি যোগের অনুষ্ঠান কর; কর্মে কৌশলই যোগ । ৫০

সমত্ববুদ্ধিযুক্ত জ্ঞানিগণ কর্ম করিলেও কর্মজনিত ফলে আবদ্ধ হন না, সুতরাং তাঁহারা জন্মরূপ বন্ধন অর্থাৎ সংসার বন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া সর্বপ্রকার উপদ্রবরহিত বিষ্ণুপদ বা মোক্ষপদ প্রাপ্ত হন । ৫১

যখন তোমার বুদ্ধি মোহরূপ গহনকানন অতিক্রম করিবে, তখন তুমি শ্রুত ও শ্রোতব্য বিষয়ে বৈরাগ্য প্রাপ্ত হইবে । ৫২

লৌকিক ও বৈদিক নানাবিধ ফলকথা শ্রবণে বিক্ষিপ্ত তোমার বুদ্ধি যখন সমাধিতে নিশ্চল হইয়া থাকিবে তখন তুমি (সাম্যবুদ্ধিরূপ) যোগ প্রাপ্ত হইবে । ৫৩

অর্জুন কহিলেন -
হে কেশব, যিনি সমাধিস্থ হইয়া স্থিতপ্রজ্ঞ হইয়াছেন তাঁহার লক্ষণ কি ? স্থিতধী ব্যক্তি কিরূপ কথা বলেন ? কিরূপে অবস্থান করেন ? কিরূপে চলেন ? ৫৪

শ্রীভগবান্ বলিলেন -
হে পার্থ, যখন কেহ সমস্ত মনোগত কামনা বর্জন করিয়া আপনাতেই আপনি তুষ্ট থাকেন, তখন তিনি স্থিতপ্রজ্ঞ বলিয়া কথিত হন । ৫৫

যিনি দুঃখে উদ্বেগশূন্য, সুখে স্পৃহাশূন্য, যাঁহার অনুরাগ, ভয় এবং ক্রোধ নিবৃত্ত হইয়াছে, তাঁহাকে স্থিতপ্রজ্ঞ মুনি বলা যায় । ৫৬

যিনি দেহ-জীবনাদি সকল বিষয়েই শুভ প্রাপ্তিতে সন্তোষ বা অশুভ প্রাপ্তিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেন না, তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ । ৫৭

কচ্ছপ যেমন কর-চরণাদি অঙ্গসকল সঙ্কুচিত করিয়া রাখে, তেমনি যিনি রূপরসাদি ইন্দ্রিয়ের বিষয় হইতে ইন্দ্রিয়সকল সংহরণ করিয়া লন, তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ । ৫৮

ইন্দ্রিয়দ্বারা বিষয়গ্রহণে অপ্রবৃত্ত ব্যক্তির বিষয়োপভোগ নিবৃত্ত হয় বটে, কিন্তু বিষয়-তৃষ্ণা নিবৃত্ত হয় না । কিন্তু সেই পরম পুরুষকে দেখিয়া স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির বিষয়-বাসনাও নিবৃত্ত হয় । ৫৯

হে কৌন্তেয়, প্রমাথী ইন্দ্রিয়গণ সংযমে যত্নশীল, বিবেকী পুরুষেরও চিত্তকে বলপূর্বক হরণ করে (বিষয়াসক্ত করে) । ৬০

যিনি আমার অনন্যভক্ত তিনি সেই সকল ইন্দ্রিয়কে সংযত করিয়া আমাকে চিত্ত সমাহিত করিয়া অবস্থান করেন । তাদৃশ সমাহিতচিত্ত ব্যক্তিরই ইন্দ্রিয়-সকল বশীভূত হয়, তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ । ৬১

বিষয়-চিন্তা করিতে করিতে মনুষ্যের তাহাতে আসক্তি জন্মে, আসক্তি হইতে কামনা অর্থাৎ সেই বিষয় লাভের অভিলাষ জন্মে, সেই কামনা কোন কারণে প্রতিহত বা বাধা প্রাপ্ত হইলে প্রতিবোধকের প্রতি ক্রোধ জন্মে, ক্রোধ হইতে মোহ, মোহ হইতে স্মৃতিভ্রংশ, স্মৃতিভ্রংশ  হইতে বুদ্ধিনাশ, বুদ্ধিনাশ হইতে বিনাশ ঘটে । ৬২-৬৩

কিন্তু যিনি বিধেয়াত্মা অর্থাৎ যাহার মন নিজের বশবর্তী, তিনি অনুরাগ ও বিদ্বেষ হইতে বিমুক্ত, আত্মবশীভূত ইন্দ্রিয়গণদ্বারা বিষয় উপভোগ করিয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করেন । ৬৪

চিত্তপ্রসাদ জন্মিলে এই পুরুষের সমস্ত দুঃখের নিবৃত্তি হয়, যেহেতু প্রসন্নচিত্ত ব্যক্তির বুদ্ধি শীঘ্র উপাস্য বস্তুতে স্থিতি লাভ করে । ৬৫

যিনি অযুক্ত অর্থাৎ যাঁহার চিত্ত অসমাহিত ও ইন্দ্রিয় অবশীকৃত, তাঁহার আত্ম-বিষয়া বুদ্ধিও হয় না, চিন্তাও হয় না । (যাঁহার আত্ম-বিষয়া) চিন্তা নাই, তাঁহার শান্তি নাই, যাঁহার শান্তি নাই, তাঁহার সুখ কোথায় ? ৬৬

মন বিষয়ে প্রবর্তমান ইন্দ্রিয়গণের যেটিকে অনুবর্তন করে, সেই একটি ইন্দ্রিয়ই, যেমন বায়ু জলের উপরিস্থিত নৌকাকে বিচলিত করে, তদ্রূপ উহার প্রজ্ঞা হরণ করে । ৬৭

হে মহাবাহু ! (যখন ইন্দ্রয়াধীন মন এবং মনের অধীন প্রজ্ঞা) সেই হেতু, যাহার ইন্দ্রিয় সর্বপ্রকারে বিষয় হইতে নিবৃত্ত হইয়াছে, তাহারই প্রজ্ঞা স্থির হইয়াছে । ৬৮

সাধারণ প্রাণিগণের পক্ষে যাহা (আত্মনিষ্ঠা) নিশাস্বরূপ, তাহাতে (আত্মনিষ্ঠাতে) সংযমী ব্যক্তি জাগ্রত থাকেন; যাহাতে (বিষয়নিষ্ঠাতে) অজ্ঞ প্রাণিসাধারণ জাগরিত থাকে, আত্মদর্শী মুনিদিগের তাহা (বিষয়নিষ্ঠা) রাত্রিস্বরূপ । ৬৯

যেমন নদ-নদীর জলে পরিপূরিত প্রশান্ত সমুদ্রে অপর জলরাশি আসিয়া প্রবেশ করিয়া বিলীন হইয়া যায়, সেইরূপ যে মহাত্মাতে বিষয় সকল প্রবেশ করিয়াও কোনরূপ চিত্তবিক্ষেপ উৎপন্ন করে না, তিনি শান্তিলাভ করেন; যিনি ভোগ কামনা করেন, তিনি শান্তি পান না । ৭০

যে ব্যক্তি সমস্ত কামনা ত্যাগ করিয়া নিস্পৃহ হইয়া বিচরণ করেন, যিনি মমতাশূন্য ও অহঙ্কারশূন্য, তিনিই শান্তিপ্রাপ্ত হন । ৭১

হে পার্থ, ইহাই ব্রাহ্মীস্থিতি (ব্রহ্মজ্ঞানে অবস্থান) । এই অবস্থা প্রাপ্ত হইলে জীবের আর মোহ হয় না । মৃত্যুকালে এই অবস্থায় থাকিয়া তিনি ব্রহ্মনির্বাণ বা ব্রহ্মে মিলনরূপ মোক্ষ লাভ করেন । ৭২

___________________________


১) দয়া ও কৃপা স্বতন্ত্র ভাব :
দয়া = লোকের দুঃখে দুঃখিত হইয়া দুঃখমোচনের প্রবল প্রবৃত্তি ।
কৃপা = পরের দুঃখচিন্তায় বা দুঃখদর্শনে কাতর হওয়া ।
'কাতরতা দয়া নহে, কৃপা । দয়া বলবানের ধর্ম, কৃপা দুর্বলের ধর্ম ।' - শ্রীঅরবিন্দ ।

৩) 'যে কৃপার বশে (কাতর হইয়া) অস্ত্র পরিত্যাগ করে, ধর্মে পরানঙ্মুখ হয়, কাঁদিতে বসিয়া ভাবে আমার কর্তব্য করিতেছি, আমি পুণ্যবান - সে ক্লীব ।' ... "শ্রীকৃষ্ণ দেখিলেন, অর্জুন কৃপায় আবিষ্ট হইয়াছেন, বিষাদ তাঁহাকে গ্রাস করিয়াছে । এই তামসিক ভাব অপনোদন করিবার জন্য অন্তর্যামী তাঁহার প্রিয়সখাকে ক্ষত্রিয়োচিত তিরস্কার করিলেন, তাহাতে যদি রাজসিক ভাব জাগরিত হইয়া তমঃকে দূর করে ।' - শ্রীঅরবিন্দ ।

৭) পুত্র বা শিষ্যরূপে জিজ্ঞাসু না হইলে গুরু তত্ত্বোপদেশ দেন না, কাজেই তত্ত্বজিজ্ঞাসু-অর্জুন লৌকিক 'সখ্য'-ভাব ত্যাগ করিয়া ভগবানের 'শিষ্যত্ব' স্বীকার করিলেন । একান্ত শ্রদ্ধার বশে সম্পূর্ণভাবে ভগবানের শরণাগত হওয়াই গীতার প্রধান শিক্ষা । ইহাই আত্মসমর্পণ । এই শ্রদ্ধাবলেই অর্জুন গীতোক্ত-শিক্ষার শ্রেষ্ঠপাত্র বলিয়া গৃহীত ।

১১) অর্জুনের মোহ :
এই স্থলেই প্রকৃতপক্ষে গীতা আরম্ভ । গীতোক্ত ধর্ম কি তাহা বুঝিতে হইলে, কি উপলক্ষে এই ধর্মের প্রচার হইয়াছিল তাহা স্মরণ রাখা প্রয়োজন । পাঠক মনে রাখিবেন, অর্জুন পূর্বাপরই যুদ্ধার্থে উদ্যোগী ছিলেন, যুদ্ধের কর্তব্যতা সম্বন্ধে কখনও তাঁহার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ হয় নাই । বরং শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধ অনিবার্য জানিয়াও যুদ্ধ নিবারণার্থ যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছিলেন - এমন কি স্বয়ং দৌত্যকার্য্যে ব্রতী হইয়াছিলেন । সেই যুদ্ধ যখন আসন্ন, শস্ত্র-সম্পাত যখন আরম্ভ হইয়াছে, তখন অর্জুনের বিষম নির্বেদ উপস্থিত, তিনি যত ধর্মশাস্ত্র খুঁজিয়া-খুঁজিয়া যুদ্ধের অকর্তব্যতা প্রতিপাদ্য করিতে উন্মুখ । অর্জুনের মনোরম বাক্যগুলি শুনিয়া আমাদের মনে হয়, কি উচ্চ অন্তঃকরণের কথা । কি উদার নিঃস্বার্থ ভাব ! কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ কি বলিতেছেন ? ভগবান একটু হাসিয়া বলিলেন, এগুলি জ্ঞানীর ভাষায় মূর্খের কথা । তোমার এ-মোহ কোথা হইতে উপস্থিত হইল ?

অর্জুনের এই মোহ দূরীকরণের চেষ্টাতেই গীতাশাস্ত্রের উদ্ভব । অর্জুনের মোহ উপলক্ষ্য করিয়া ভগবান সমগ্র মানব-জাতির অশেষ কল্যাণকর এই অপূর্ব ধর্মতত্ত্ব জগতে প্রচার করিলেন । 

১২) আত্মার অবিনাশিতা : আত্মা নিত্য, উহার নাশ অর্থাৎ মৃত্যু নাই । আত্মার পক্ষে জন্ম অর্থ দেহ-গ্রহণ, মৃত্যু অর্থ দেহত্যাগ বা দেহান্তর-প্রাপ্তি ।

১৩) জন্মান্তরবাদ : খ্রীষ্টীয় বনাম হিন্দু মত
বাল্যাবস্থার পরে যৌবনাবস্থা উপস্থিত হয়, উহা অবস্থান্তরমাত্র । সেইরূপ এক দেহ ত্যাগ করিয়া অন্য দেহ গ্রহণও জীবাত্মার একটি অবস্থান্তর মাত্র । এখানে 'মৃত্যু' না বলিয়া বলা হইয়াছে, 'দেহান্তর-প্রাপ্তি', সুতরাং মানিয়া লওয়া হইল মরিলেই জন্ম হয় । ইহাই জন্মান্তরবাদ । আত্মার অবিনাশিতা ও পুনর্জন্ম হিন্দুধর্মের এই দুইটি প্রধান তত্ত্ব । বৌদ্ধধর্মেরও ইহাই মূলতত্ত্ব । খ্রীষ্টীয় ধর্ম আত্মার অবিনাশিতা স্বীকার করেন, কিন্তু পুনর্জন্ম স্বীকার করেন না । এখন প্রশ্ন এই - আত্মা যদি অবিনাশী, তবে দেহনাশের পরে ইহার কি গতি হয় ?

এ-সম্বন্ধে খ্রীষ্টীয় ধর্মের মত এই যে - পরমেশ্বর বিচার করিয়া জীবের সুকৃতি ও দুষ্কৃতি-অনুসারে দেহান্তে পুণ্যবানকে অনন্ত স্বর্গে ও পাপীকে অনন্ত নরকে প্রেরণ করেন । এই ধর্মমতের অনুকূলে যুক্তি বেশী কিছু নাই । বিশ্বাসই ইহার মূল ভিত্তি । কিন্তু ইহার প্রতিকূলে প্রধান আপত্তি এই যে, ঈশ্বরের এই যে বিচার, ইহা অবিচার বলিয়াই বোধ হয়; কেননা এই সংসারে কেহই কেবল পুণ্য বা কেবল পাপ করে না । সকলে কিছু-না-কিছু পুণ্যকর্মও করে, পাপকর্মও করে । সুতরাং যাহার জন্য অনন্ত স্বর্গবাসের ব্যবস্থা হইল, তাহার পাপের শাস্তি হইল না; পক্ষান্তরে যাহার পক্ষে অনন্ত নরকবাস লখিত হইল, তাহার পুণ্যের পুরস্কার হইল না । বলিতে পার, প্রত্যেক জীবের পাপ-পুণ্যের হিসাব-নিকাশ করিয়া পাপ ও পুণ্যের আধিক্য-অনুসারে অনন্ত নরকবাস বা স্বর্গবাসের ব্যবস্থা হয়, কিন্তু অনন্তকালের তুলনায় মানুষের এই জীবনকাল কতটুকু ? ক্ষণস্থায়ী এই জীবনের পাপাধিক্য বা পুণ্যাধিক্যের জন্য অনন্তকাল ব্যাপিয়া নরকবাস বা স্বর্গবাসের ব্যবস্থা, ইহাতে কি একপক্ষে অতি-নিষ্ঠুরতা, অপর পক্ষে অতি-উদারতা প্রকাশ পায় না ?

এ-সম্বন্ধে হিন্দুমত এই যে - স্বর্গ বা নরকভোগ জীবের চরম গতি নয় । যাহা হইতে জীবের উদ্ভব, সেই পরব্রহ্মে লীন হওয়া বা ভগবানকে প্রাপ্ত হওয়াই জীবের পরম লক্ষ্য ও চরম গতি । যে-পর্যন্ত জীব তাহার উপযোগী না হয়, সে পর্যন্ত তাহাকে কৃতকর্মানুসারে পুনঃপুনঃ দেহ ধারণ করিয়া কর্মফল ভোগ করিতে হয় । ভোগ ভিন্ন প্রারব্ধ কর্মের ক্ষয় হয় না । জীবের এই যে জন্মমৃত্যু-চক্রে পরিভ্রমণ, ইহারই নাম সংসার (সং-সৃ=গমন করা) । এই সংসার ক্ষয় হইয়া কিরূপে জীবের ব্রহ্মনির্বাণ বা ভগবৎ-প্রাপ্তি হইতে পারে, তাহাই সমগ্র হিন্দুদর্শন ও হিন্দুশাস্ত্রের প্রতিপাদ্য বিষয় । অবশ্য হিন্দুশাস্ত্রে, জীবের কৃতকর্মানুসারে স্বর্গাদি-ভোগের ব্যবস্থাও আছে, কিন্তু তাহা অনন্তকালের জন্য নহে । যে-কর্মবিশেষের ফলে স্বর্গাদি লাভ হয়, সেই কর্মের ফলভোগ শেষ হইলে তাহাকে আবার জন্মগ্রহণ করিতে হয় । মোক্ষ বা ভগবৎ-প্রাপ্তি না হওয়া পর্যন্ত জন্মকর্মের নিবৃত্তি নাই ।

১৪) তিতিক্ষা = শীতোষ্ণ, সুখদুঃখ, মান-অপমানাদি দ্বন্দ্ব-সহিষ্ণুতা । ইহা মহাফলপ্রদ, ইহা জীবনকে মধুময় করে, মানবকে অমৃতত্ত্ব প্রদান করে ।

১৫) অমৃতত্ত্ব :
এই স্থূল শরীর লইয়া চিরকাল বর্তমান থাকাকে অমৃতত্ত্ব বা অমরত্ব বলে না; তাহা কেহ থাকিতে পারে না; কারণ ভৌতিক দেহ বিনাশশীল, মৃত্যুর অধীন [গী|২|২৭] । মৃত্যুর পর সূক্ষ্ম শরীরে বিদ্যমান থাকাকেও অমৃতত্ত্ব বলে না, উহা সকলেই থাকে [গী|১৫|৮-৯] এবং পুনরায় দেহ গ্রহণ করে । এই জন্মমৃত্যুর চক্র হইতে নিষ্কৃতি লাভই অমৃতত্ত্ব লাভ, ইহাকেই মোক্ষ বলা হয় ।

দেহাত্মবোধ : দেহটাকেই 'আমি'-বোধ করা । আমরা এই অনিত্য দেহটা লইয়াই 'আমি' 'আমি' করি, কিন্তু দেহের মধ্যে যে দেহী (আত্মা) আছেন, তাঁহার খোঁজ লই না ।

দেহাত্মবিবেক : আত্মা দেহ হইতে পৃথক বস্তু - এই জ্ঞান । এই জ্ঞানলাভের নামই অমৃতত্ত্ব (আত্মানন্দ, নিত্যানন্দ, ব্রহ্মানন্দ, প্রেমানন্দ) লাভ ।

এক তত্ত্বই ব্রহ্মআত্মাভগবান, এই ত্রিবিধ নামে অভিহিত হন এবং সাধকের ভাব-বৈশিষ্ট্যহেতু ত্রিবিধ ভাবে প্রকাশিত হন । সাধক যখন এই দেহচৈতন্যের ঊর্ধ্বে উঠিয়া ব্রহ্মচৈতন্যে [গী|৬|২৮] অথবা আত্মচৈতন্যে [গী|৬|২৯] অথবা ভাগবত-চৈতন্যে [গী|৬|৩০] অবস্থান করেন, তখন তিনিই অমৃতত্ত্ব লাভ করেন ।

এই শ্লোকে বলা হইল, যাঁহার সুখদুঃখে সমভাব, তিনি অমৃতত্ত্ব লাভ করেন । এই সমতা বা সাম্যবুদ্ধির কথা পরেও আমরা পাইব, শ্রীগীতায় ইহাকেই যোগ বলা হইয়াছে [গী|২|৪৮,৫০; ৬|৩৩] । সুখদুঃখে সাম্যভাব সমতাযোগের একটি বিশেষ দৃষ্টান্ত মাত্র ।

ত্যাগ : গীতাশাস্ত্র বলেন ত্যাগ অর্থ আসক্তি ত্যাগ, কামনা-বাসনা ত্যাগ । আসক্তিই সুখদুঃখাদি-চিত্তচাঞ্চল্যের কারণ । সংসার-আসক্তি ত্যাগ করিয়াও সংসার করা যায়, বিষয়-কামনা না করিয়াও বিষয় ভোগ করা যায়, ফল কামনা না করিয়াও কর্ম করা যায় এবং শ্রীগীতার উপদেশ, তাহাই কর্তব্য ।

হৃদয়গ্রন্থি : শাস্ত্রমতে কামনাই হৃদয়গ্রন্থি, যাহা ছিন্ন করিতে পারিলেই মরণশীল মানুষ অমর হইতে পারে । 'জীবিতাবস্থায়ই (ইহ) যখন হৃদয়ের গ্রন্থিসকল (কামনাসমূহ) বিনষ্ট হয়, তখন মরণশীল মানুষ অমর হয়, এইটুকুই সমগ্র বেদান্তশাস্ত্রের সারকথা [কঠোপনিষদ |২|৩|১৫] । একমাত্র শ্রীকৃষ্ণের শরণ লইলে, তাঁহার কৃপায় হৃদয়গ্রন্থি ক্রমে শিথিল হয় ।

পরাভক্তি : ভক্তিশাস্ত্রে ইহাই অমৃতস্বরূপ, উহা পাইলেই সাধক সিদ্ধ হন, অমর হন, তৃপ্ত হন - আর কিছু পাইবার আকাঙ্ক্ষা থাকে না, মোক্ষেরও না । [ভক্তিসূত্র]

১৬) অস্‌ (থাকা) + শতৃ = সৎ, যাহা থাকে, নিত্য তাহাই সৎ । যাহা থাকে না, আসে যায়, তাহা অসৎ, অনিত্য । আত্মাই সৎ; জগৎপ্রপঞ্চ, দেহাদি ও তৎসংসৃষ্ট-সুখদুঃখাদি অসৎ । সুতরাং অর্থ হইল - 'আত্মার বিনাশ নাই, দেহাদি ও সুখদুঃখাদির স্থায়িত্ব বা অস্তিত্ব নাই ।' এখন দেহাদির স্থায়িত্ব নাই, একথা বুঝা গেল, কিন্তু 'দেহাদির অস্তিত্ব নাই', এ-কথার অর্থ কি ?

যাঁহারা মায়াবাদী, তাঁহারা বলেন, এক আত্মাই (ব্রহ্মই) সত্য, জগৎ মিথ্যা - মায়া-বিজৃম্ভিত । ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়, ব্রহ্ম ভিন্ন আর-কিছুর পারমার্থিক সত্তা নাই । কিন্তু জগৎ যে মিথ্যা, এই মতবাদ অনেকেই স্বীকার করেন না এবং গীতাও এ-মত সমর্থন করেন বলিয়া বোধ হয় না । সুতরাং তাঁহারা 'নাসতো বিদ্যতে ভাবো' এই শ্লোকাংশের অন্যরূপ ব্যাখ্যা করিয়াছেন ।

শ্রীমৎ শ্রীধরস্বামী বলেন - এই শ্লোকের সদসৎ-বস্তুর স্বরূপ-বর্ণনায় আত্মার নিত্যতা এবং সুখ-দুঃখাদির অনিত্যতা ও অনাত্মধর্মিতাই লক্ষ্য করা হইয়াছে, ইহাই টীকাকারের অভিপ্রায় ।

সুখদুঃখের অনাত্মধর্মিতা :
সুখদুঃখ আত্মার ধর্ম নহে, উহা অন্তঃকরণের ধর্ম । অন্তঃকরণ = মন + বুদ্ধি + চিত্ত + অহঙ্কার । হিন্দু-দার্শনিকগণ মনস্তত্ত্বের যে সূক্ষ্মানুসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করিয়াছেন তাহার সম্যক আলোচনা এ-স্থলে সম্ভবপর নহে । স্থূলত এইটুকু স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, এ-সকলই প্রকৃতির বিকৃতি বা পরিণাম; পুরুষ বা আত্মার সহিত উহাদের কোনো নিত্য সম্বন্ধ নাই ।

জ্ঞানান্মুক্তি/ত্রিগুণাতীত অবস্থা : প্রকৃতির সংযোগবশত আত্মা সুখদুঃখের ভোক্তা বলিয়া প্রতীয়মান হন । সৃষ্টিকালে পুরুষ ও প্রকৃতি পরস্পর-সংযুক্ত থাকাতে পুরুষের ধর্ম প্রকৃতিতে ও প্রকৃতির ধর্ম পুরুষে উপচরিত হয় । এই কারণেই বস্তুত অচেতন হইলেও প্রকৃতিকে চেতন বলিয়া মনে হয় এবং বস্তুত অকর্তা হইলেও আত্মাকে কর্তা-ভোক্তা বলিয়া বোধ হয় । পুরুষ (আত্মা) ও প্রকৃতির পার্থক্য যখন উপলব্ধি হয়, তখন আর এ-অজ্ঞান থাকে না । এই প্রকৃতি ও পুরুষের পার্থক্য-জ্ঞান'ই সাংখ্যদর্শনের 'জ্ঞানান্মুক্তি' - জ্ঞান হইতে মুক্তি । গীতাতে ইহাই ত্রিগুণাতীত অবস্থা বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে । এই অবস্থায় সুখদুঃখের পরানিবৃত্তি । বিশদ

সৎকার্যবাদ : 'নাসতো বিদ্যতে ভাবো নাভাবো বিদ্যতে সতঃ' - এ-কথায় এই বুঝায় যে, যাহা নাই তাহা হইতে পারে না এবং যাহা আছে তাহার অভাব হয় না অর্থাৎ কোনো পদার্থই নূতন উৎপন্ন হয় না এবং কোনো কিছুই বিনষ্ট হয় না, পরিবর্তন হয় মাত্র । ইহা সাংখ্যদর্শনের একটি প্রধান সিদ্ধান্ত যাহার উপরেই সাংখ্যের প্রকৃতিবাদ ও সৃষ্টিতত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত । ইহাকে বলে সৎকার্যবাদ ।

১৭) অব্যয় = যাহার উপচয় (বৃদ্ধি) ও অপচয় (ক্ষয়) নাই, যাহা সর্বদাই একরূপ ।

মূলতত্ত্ব : সাধন-ভেদে একেরই তিন রূপ বা বিভাব । যে তাঁহাকে যে-ভাবে চিন্তা করে তাহার নিকট তিনি তাহাই । জ্ঞানীর নিকট তিনি জ্যোতির্ময় ব্রহ্ম, যোগীর নিকট তিনি চিদাত্মস্বরূপ পরমাত্মা, ভক্তের নিকট তিনি সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ ভগবান । বিশদ
অদ্বয় জ্ঞান তত্ত্ব কৃষ্ণের স্বরূপ । ব্রহ্ম, আত্মা, ভগবান তিন তাঁর রূপ ।।
জ্ঞান, যোগ, ভক্তি তিন সাধনার বশে । ব্রহ্ম, আত্মা, ভগবান ত্রিবিধ প্রকাশে ।। [শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত]
অদ্বৈতবাদ : ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা । জীবাত্মা ও পরমাত্মা অভিন্ন, যেমন ঘটাকাশ ও মহাকাশ । পাঁচটি শূন্য ঘটে যে-আকাশ আছে, উহা আধারভেদে বিভিন্ন বোধ হইলেও মূলত একই । ঘট পাঁচটি ভাঙিয়া দিলে আর ভেদ থাকে না, তখন সকলেই এক মহাকাশ । এইরূপ বিভিন্ন দেহাধিষ্ঠিত আত্মা দেহভেদে ভিন্ন বোধ হইলেও স্বরূপত অভিন্ন । দেহবন্ধন-বিমুক্ত হইলেই উহার স্ব-স্বরূপ পরমাত্মরূপ প্রতিভাত হয় । এই যে দৃশ্য জগৎ প্রত্যক্ষ হইতেছে, উহা ভ্রমমাত্র; যেমন রজ্জুতে সর্পভ্রম, শুক্তিতে রজতভ্রম, সূর্য-রশ্মিতে মরীচিকাভ্রম । মায়াবাদীর মতে এই ভ্রম হয় ব্রহ্মের 'অঘটন-ঘটন-পটীয়সী' মায়াশক্তির প্রভাবে । তত্ত্বজ্ঞান জন্মিলে এই মায়া কাটিয়া যায়, তখনই 'সোহহম্‌' 'অহং ব্রহ্মাস্মি' এইরূপ আত্মস্বরূপ অধিগত হয় । অদ্বৈতমতে ব্রহ্ম নির্বিশেষ, নির্বিকল্প, নিরুপাধি, নির্গুণ; সুতরাং অজ্ঞেয়, অচিন্ত্য, অমেয় - মনোবুদ্ধির অগোচর ।

বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ : ব্রহ্ম ও জীব স্বতন্ত্র বস্তু । জগৎ মিথ্যা নহে, উহা ব্রহ্মের মায়াশক্তি-প্রসূত । জগৎ ব্রহ্মেরই শরীর । ব্রহ্ম সগুণ, তিনি জগতের কর্তা ও উপাদান । এই মতকে অনেকে দ্বৈতবাদও বলেন ।

শুদ্ধদ্বৈতবাদ : ব্রহ্ম, জীব ও জগৎ তিনই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও পৃথক তত্ত্ব ।

২০) ষড়বিধ বিকার : (i)জন্ম, (ii)অস্তিত্ব, (iii)বৃদ্ধি, (iv)বিপরিণাম, (v)অপক্ষয়, (vi)বিনাশ - লৌকিক বস্তুর বিকার । জন্মের পর যে বিদ্যমানতা তাহার নাম অস্তিত্ব-বিকার ।

পুরাণ = সনাতন ।

অহং অর্থাৎ আত্মা অকর্তা হইলেও অহঙ্কার (আমি করিতেছি এই বুদ্ধি) যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণ কর্মের বন্ধন যায় না । সুতরাং আত্মা অকর্তা বলিয়া যে অর্জুনের হত্যাজনিত পাপ হইবে না তাহা নহে । যদি অর্জুনের এই জ্ঞান জন্মে যে, আমি অকর্তা, আমি কিছুই করিতেছি না, প্রকৃতিই প্রকৃতির কাজ করিতেছে; আমি নিঃসঙ্গ, নির্লিপ্ত, তবেই তাহার ফলভোগ নিবারিত হইবে । এইরূপ জ্ঞানই, এই কর্তৃত্বাভিমান-ত্যাগই গীতায় পুনঃপুনঃ উপদিষ্ট হইয়াছে ।

৩৯) সংখ্যা = বস্তুতত্ত্ব সম্যক প্রকাশিত হয় যাহা দ্বারা অর্থাৎ সম্যক জ্ঞান ।
সাংখ্য = সংখ্যায় প্রকাশমান আত্মতত্ত্ব অর্থাৎ তত্ত্বজ্ঞান ।

'সাংখ্য' ও 'যোগ'-শব্দের বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার :
সনাতন ধর্মে অতি প্রাচীন কাল হইতেই দুইটি সাধনমার্গ বা মোক্ষপথ প্রচলিত আছে - (i)সাংখ্য বা জ্ঞানমার্গ, (ii)কর্মমার্গ । জ্ঞানমার্গ-অবলম্বিগণ প্রায় সকলেই কর্মত্যাগী, কর্ম হইতে নিবৃত্ত, এইজন্য ইহাকে সন্ন্যাসমার্গ বা নিবৃত্তিমার্গও বলে । কর্মমার্গ-অবলম্বীরা জ্ঞানলাভ করিয়াও কর্মের যোগ ছেদন করেন না, কর্মে প্রবৃত্ত থাকেন, এইজন্য ইহাকে প্রবৃত্তিমার্গ বলে ('প্রবৃত্তিলক্ষণো যোগো জ্ঞানং সন্ন্যাসলক্ষণম্‌' - অনুগীতা) ।

কর্ম দ্বিবিধ - (i)সকাম, (ii)নিষ্কাম । বৈদিক কর্মযোগ = যাগযজ্ঞাদি কাম্য কর্ম; বৈদান্তিক কর্মযোগ = নিষ্কাম কর্মযোগ ।

গীতায় জ্ঞানমার্গ বুঝাইতে 'সাংখ্য' শব্দ ও নিষ্কাম কর্মযোগ বুঝাইতে 'যোগ' শব্দ পুনঃপুনঃ ব্যবহৃত হইয়াছে ।

জ্ঞানমার্গেরই একটি বিশিষ্ট প্রাচীন স্বরূপ মহর্ষি কপিলদেব-প্রণীত পুরুষ-প্রকৃতি-বিবেক বা সাংখ্যদর্শনে বিবৃত হইয়াছে । কিন্তু এ-স্থলে সাংখ্য-শব্দে সাংখ্যদর্শন বুঝায় না ।

যোগ বলিতে সাধারণত আসন-প্রাণায়ামাদি, পাতঞ্জল দর্শনোক্ত অষ্টাঙ্গযোগ বা সমাধিযোগ বুঝায় । এ-স্থলে যোগ-শব্দ এই অর্থে ব্যবহৃত হয় নাই । গীতায় সমাধিযোগ ও সাংখ্যদর্শনেরও অনেক তত্ত্ব সন্নিবিষ্ট আছে । সুতরাং 'যোগ' ও 'সাংখ্য'-শব্দ বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়, তাহা স্মর্তব্য ।

কর্মবন্ধ : শত কোটি-কল্পেও ভোগ ভিন্ন কর্মক্ষয় হয় না, কৃতকর্মের শুভাশুভ ফল অবশ্যই ভোগ করিতে হইবে । এই কর্মফল ভোগের জন্য আমাদিগকে পুনঃপুনঃ জন্মমৃত্যু-জরাব্যাধি-সঙ্কুল সংসার-বন্ধনে আবদ্ধ হইতে হয় । ইহাই কর্মবন্ধন । আমরা যদি ফল ত্যাগ করিয়া সিদ্ধি ও অসিদ্ধি সমজ্ঞান করিয়া কর্তৃত্বাভিমান বর্জন করিয়া কর্ম করিতে পারি তবে সেই নিষ্কাম কর্মে বন্ধন হয় না ।

৪১) বুদ্ধি (intelligent will), মন (mind), বাসনা (desire)
গীতার 'বুদ্ধি' শব্দের যথাযথ ইংরেজী অনুবাদ করিতে গেলে বলিতে হয়, 'intelligent will' (Sri Aurobindo) । সাধারণভাবে 'বোধ', 'জ্ঞান' অর্থে বুদ্ধি-শব্দের প্রয়োগ হয় । দার্শনিক পরিভাষায় বুদ্ধিকে বলে ব্যবসায়াত্মিকা বা নিশ্চয়াত্মিকা মনোবৃত্তি বা অন্তরিন্দ্রিয় । বিষয়ের সহিত ইন্দ্রিয়-সংযোগে মনে নানারূপ জ্ঞান বা সংস্কার জন্মে এবং ইহার কোনটি ভাল, কোনটি মন্দ, কোনটি গ্রাহ্য, কোনটি ত্যাজ্য, ইহা এই প্রকার, না ঐ প্রকার, মনে এইরূপ সঙ্কল্প-বিকল্প উপস্থিত হয় । তখন বুদ্ধি, বিচার করিয়া কোনটি গ্রাহ্য বা কর্তব্য তাহা নির্ণয় করিয়া দেয় । এই হেতু মনকে সঙ্কল্প-বিকল্পাত্মক এবং বুদ্ধিকে ব্যবসায়াত্মিকা ইন্দ্রিয় বলে । সংস্কৃতভাষায় এইরূপ কার্যাকার্য-নির্ণয় করার ব্যাপারকেই 'ব্যবসায়' কহে ।

'বুদ্ধি' কিছু স্থির নিশ্চয় করিয়া দিলে মন আবার সেই দিকে ধাবিত হয়, সেই কার্যে আসক্ত হয় । ইহাকেই 'বাসনা' বলে, ইহাকে অনেক সময় 'বাসনাত্মিকা বুদ্ধি' বলা হয় । এই শ্লোকে প্রথম পংক্তিতে ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিরই স্পষ্ট উল্লেখ আছে, কিন্তু দ্বিতীয় পংক্তিতে 'বুদ্ধয়ঃ' শব্দে বুঝায় বাসনাত্মিকা বুদ্ধি বা বাসনাতরঙ্গ । বস্তুত জ্ঞান, বিচার, ব্যবসায় (perceptive choice), বাসনা (will), উদ্দেশ্য (motive) - এই সকলই গীতায় স্থলবিশেষে এক 'বুদ্ধি'-শব্দদ্বারাই প্রকাশিত হয়, ইহা মনে রাখা কর্তব্য ।

৪২-৪৪) বেদের কর্মকাণ্ড :
বেদের চারি ভাগ - (i)সংহিতা, (ii)ব্রাহ্মণ, (iii)আরণ্যক ও (iv)উপনিষদ । সংহিতা ও ব্রাহ্মণ-ভাগ লইয়া কর্মকাণ্ড এবং আরণ্যক ও উপনিষদ-ভাগ লইয়া জ্ঞানকাণ্ড । কর্মকাণ্ডে বিবিধ যাগযজ্ঞাদির ব্যবস্থা আছে এবং বিহিত প্রণালীতে ঐ সমস্ত কর্ম সম্পন্ন হইলে স্বর্গাদি লাভ হয়, এইরূপ ফলশ্রুতিও আছে । সাধারণত 'ধর্মকর্ম' বলিতে লোকে এই সকল কর্মকেই বুঝিয়া থাকে । শ্রীভগবান বলিতেছেন, ঐ সকল কাম্যকর্মে ভোগ-বাসনা বিদূরিত হয় না, বরং আরো বর্ধিত হয় ।
ষড়দর্শনের মধ্যে মীমাংসা-দর্শন (পূর্ব-মীমাংসা) কর্মবাদী, অন্যান্যগুলি জ্ঞানবাদী । মীমাংসা-মতে যজ্ঞাদিই ধর্ম এবং স্বর্গই পরম পুরুষার্থ, তদ্ভিন্ন ঈশ্বরতত্ত্ব বা ব্রহ্মতত্ত্ব বলিয়া কিছু আছে বলিয়া ইঁহারা স্বীকার করেন না । এই শ্লোকে এই কর্মবাদী মীমাংসকদিগকেই লক্ষ্য করা হইয়াছে ।

৪৫) নিস্ত্রৈগুণ্য = নিষ্কাম (শাঙ্কর-ভাষ্য, শ্রীধর স্বামী) ।
নির্দ্বন্দ্ব = শীতোষ্ণ, সুখ-দুঃখাদি পরস্পর-বিরোধী ভাবদ্বয়কে যিনি তুল্য জ্ঞান করেন ।
নিত্যসত্ত্বস্থঃ = নিতসত্ত্বগুণাশ্রিত অথবা নিত্যধৈর্যশীল । তমঃ ও রজোগুণকে দমন করিয়া শুদ্ধ সত্ত্বগুণের উৎকর্ষ দ্বারাই ত্রিগুণাতীতের অবস্থা লাভ হয় । এই অবস্থাই সিদ্ধাবস্থা, ইহার পর আর সাধনার প্রয়োজন হয় না ।
নির্যোগক্ষেম = যোগ-ক্ষেম-রহিত; যোগ = অলব্ধ বস্তুর উপার্জন; ক্ষেম = লব্ধ বস্তুর রক্ষণ । অর্থ এই - তুমি উপার্জন ও রক্ষা এই উভয় বিষয়েই চিন্তা ত্যাগ কর ।

৪৬) লোকমান্য তিলক, বঙ্কিমচন্দ্র-প্রমুখ আধুনিক ব্যাখ্যাকর্তৃগণের অনেকেই এই শ্লোকের নিম্নোক্তরূপ ব্যাখ্যা করেন । -
সকল স্থান জলে প্লাবিত হইলে কূপাদি ক্ষুদ্র জলাশয়ের যে প্রয়োজন, তত্ত্বজ্ঞ ব্রহ্মনিষ্ঠ পুরুষের সমস্ত বেদেও সেই প্রয়োজন । অর্থাৎ সকল স্থান জলে প্লাবিত হইলে যেমন কূপাদি ক্ষুদ্র জলাশয়ে কোনো প্রয়োজন হয় না, তদ্রূপ ব্রহ্মনিষ্ঠ পুরুষের বেদে কোনো প্রয়োজন নাই । কেননা যিনি ব্রহ্মজ্ঞ, যিনি ঈশ্বরকে জানিয়াছেন, তাঁহার আর বেদে কি প্রয়োজন ?

ইহা স্পষ্টই বেদ-নিন্দার মত শুনায় । ব্রহ্মজ্ঞই হউন আর যাহাই হউন বেদে কাহারও প্রয়োজন নাই, এরূপ কথা যাহাতে না বলা হয়, প্রাচীন ব্যাখ্যাকর্তৃগণ কষ্টকল্পনা করিয়া সেরূপ ব্যাখ্যারই অন্বেষণ করিয়াছেন ।

রহস্য - গীতা ও বেদের আপাতবিরোধ
সনাতন ধর্ম = যাহা বেদমূলক তাহাই ধর্ম; কিন্তু বেদের 'জন্মকর্মফলপ্রদ' কাম্যকর্মাত্মক কর্মকাণ্ডের বিরোধী বলেই গীতাশাস্ত্রকে মনে হয় ।

বেদের প্রকৃত তাৎপর্য কি তাহা আমরা বুঝি না । অতি প্রাচীনকালে বেদের গূঢ়ার্থ গুরু-শিষ্য-পরম্পরাক্রমে অধিগত হইত, উহা লিপিবদ্ধ হইত না । উহা বহু পূর্বেই লুপ্ত হইয়া গিয়াছিল । পরে বেদার্থ যিনি যেরূপ বুঝিয়াছেন তিনি সেইরূপ ব্যাখ্যা করিয়াছেন এবং তদনুসারে নানা মতবাদের সৃষ্টি হইয়াছে । দর্শন ও ধর্মশাস্ত্রাদি বেদ শিরোধার্য করিয়াও পরস্পর বিরুদ্ধ-মতাবলম্বী ।

বেদবাদ : দ্বাপরযুগের শেষকালে একটি কাম্যকর্মবাদী ধর্মমত (বা অধর্মমত) বড় প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল । ইহাকেই বেদবাদ বলা হইয়াছে । কাম্যকর্মবাদী বলেন, বেদের কর্মকাণ্ডই সার্থক, যাগযজ্ঞাদিই একমাত্র ধর্ম, স্বর্গই একমাত্র পুরুষার্থ, উহাতেই সমস্ত দুঃখনিবৃত্তি, এতদ্ব্যতীত ঈশ্বরতত্ত্ব বলিয়া আর-কিছুই নাই । এই আপাত-মনোরম কর্মমার্গ, যাহা ইহকালে ধনৈশ্বর্য, পরকালে উর্বশী-পারিজাতাদির আশাপ্রদ, তাহা যে লোকপ্রিয় হইবে তাহা বলাই বাহুল্য । ফলে যাগযজ্ঞাদির ঘটা বাড়িয়া গেল । অশ্বমেধ, গো-মেধ, নরমেধাদি 'মেধে'র মাত্রা বৃদ্ধি পাইল, প্রাণি-বধই ধর্মে পরিণত হইল ।

এইরূপে যখন বিষম ধর্মবিপ্লব উপস্থিত হইল - ধর্মের গ্লানি, অধর্মের অভ্যুত্থান, তখনই ধর্ম-সংস্থাপনার্থ শ্রীভগবানের গীতা-প্রচার । তাই শ্রীভগবান বলিতেছেন - 'এই বেদবাদী, মূঢ়গণের কথায় মুগ্ধ হইও না, ও-পথে যাইও না, উহাতে বুদ্ধি ঈশ্বরে একনিষ্ঠ হয় না । ইহা বেদ-নিন্দা নহে, বেদের অপব্যাখ্যাকারী কাম্যকর্মবাদিগণের নিন্দা ।

তবে ত্রিগুণাত্মক কর্মকাণ্ডের কি প্রয়োজন ?
ব্রহ্মজ্ঞের ইহাতে কোনো প্রয়োজন নাই । কিন্তু জগৎ ত্রিগুণাত্মক, সংসার ত্রিগুণাত্মক, দেহাভিমানী জীব ত্রিগুণে অভিভূত - সে ত্রিগুণ ত্যাগ করিতে না পারিলে, নিবৃত্তি-মার্গ অবলম্বন করিতে না পারিলে - কোন ধর্ম লইয়া থাকিবে ? তাহার উচ্ছৃঙ্খল কামনা বিধিবদ্ধ না করিলে সংসার রক্ষা পাইবে কিরূপে ? কামনা-পূরণার্থ যাগযজ্ঞ ও দেবার্চনাদির ব্যবস্থা, স্বর্গের প্রলোভন, প্রবৃত্তির প্রতিরোধার্থ নরকাদির ভয়, প্রায়শ্চিত্তাদির বিধান, এই সকল না থাকিলে কামনাকুল জীব স্বেচ্ছাচারী হইয়া আত্মঘাতী হইয়া উঠিত । তাই লোকবৎসল বেদ - অজ্ঞ ও নিম্ন অধিকারীর জন্য এই সকল ব্যবস্থা করিয়াছেন এবং উহাতে রুচি জন্মাইবার জন্য স্বর্গফলাদির বর্ণনা করিয়াছেন । উচ্চাধিকারী ব্যক্তি ঐ সকল কর্ম ঈশ্বরার্পণ-বুদ্ধিতে ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করিয়া করিবেন, উহাতেই কর্মবন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া সিদ্ধিলাভ করিবেন ।

৪৭) রহস্য - নিষ্কাম কর্ম কি সম্ভবপর ?
ফলাকাঙ্ক্ষা না থাকিলে কর্ম করিবে কেন ? উদ্দেশ্য (motive) ভিন্ন কর্ম হয় না । কিন্তু ফলাফলে উদাসীনতা ও উদ্দেশ্যহীনতা এক কথা নহে । নিষ্কাম কর্মও উদ্দেশ্যহীন নহে; 'লোক-সংগ্রহ', ভগবানের সৃষ্টিরক্ষাই উহার উদ্দেশ্য; উহা ভগবানের কর্ম । বস্তুত, ইহা ভগবানের অর্চনা । যখন ভাগবত ইচ্ছা ও কর্মীর ইচ্ছা এক হয়, তখনই প্রকৃত নিষ্কাম কর্ম সম্ভবপর; তখন কর্তার ব্যক্তিত্ব থাকে না । এরূপ অবস্থায় ফলাফলে সমত্ব-বুদ্ধি অসম্ভব ব্যাপার তো নহেই, ফলত উহা স্বাভাবিকই হইয়া উঠে ।

প্রশ্ন - এইরূপ যন্ত্রচালিত পুতুলের (mechanical) ন্যায় কর্মের কোনো নৈতিক মূল্য (moral value) কি আছে ?
উত্তর - গীতার অধ্যাত্ম-তত্ত্ব ঐ নৈতিক মূল্যের অনেক উপরে । ঐ নৈতিক মূল্যটিকে অর্থাৎ ঐ কর্মফলের দায়িত্বটা ত্যাগ করাই নিষ্কাম কর্মীর লক্ষ্য । উহাই কর্মবন্ধ । উহার ফল স্বর্গ বা নরক বা পুনর্জন্ম । হিন্দু-সাধক ইহার কোনোটিই চাহেন না । তিনি জানিতে চাহেন তাঁহাকে, যাঁহা হইতে তাঁহার উদ্ভব, যাঁহা হইতে তাঁহার কর্ম-প্রবৃত্তি । সুতরাং তিনি নিজেকে যন্ত্রস্বরূপ মনে করিয়া সেই যন্ত্রীর নিকটই আত্মসমর্পণ করেন ।

৪৯) সমত্ববুদ্ধির যোগ/বুদ্ধিযোগ : সিদ্ধি ও অসিদ্ধিতে যে-সমত্ববুদ্ধি তাহাই যোগ । এই সমত্ববুদ্ধি-রূপ যোগ বা সমত্ববুদ্ধির যোগকেই এখানে বুদ্ধিযোগ বলা হইয়াছে ।

কর্মাকর্মের নৈতিক বিচারে বুদ্ধিই শ্রেষ্ঠ কষ্টিপাথর অর্থাৎ ভাল/মন্দ কর্ম বা শ্রেষ্ঠ/নিকৃষ্ট কর্ম বিচার করিবার সময় কর্মের বাহ্য ফলের দিকে দৃষ্টি না করিয়া, কর্তা কি উদ্দেশে, কিরূপ বুদ্ধিতে কার্য করেন, তাহাই দেখিতে হইবে । 'The moral worth of an action cannot be anywhere but in the principle of the will, without regard in the ends which can be attained by action.' -[Kant's Theory of Ethics quoted by Lokamanya Tilak].

'এক্ষণে বুঝা গেল, বুদ্ধিযোগ বলিতে কি বুঝায়, অভ্রান্ত বুদ্ধির সহিত এবং সেই জন্য অভ্রান্ত ইচ্ছার সহিত, অনন্যচিত্ত হইয়া সর্বভূতে এক আত্মা জানিয়া, আত্মার শান্ত সমতা হইতে কার্য কর, অনন্ত কামনার বশে ইতস্তত ছুটাছুটি না করা, হাই 'বুদ্ধিযোগ' । - [শ্রী অরবিন্দের গীতা, অনিলবরণ]

৫১) স্বর্গ ও মোক্ষ : কর্মমাত্রই বন্ধনের কারণ, সে সুকৃতই হউক আর দুষ্কৃতই হউক, - যেমন স্বর্ণ-শৃঙ্খল আর লৌহ-শৃঙ্খল । পুণ্যফলে স্বর্গাদি-প্রাপ্তি মোক্ষ নহে, উহাও অস্থায়ী ভোগের বিষয়মাত্র । স্বর্গ হইতে পতন অনিবার্য । কিন্তু নিষ্কাম কর্মী মোক্ষপদ প্রাপ্ত হন ।

৫৫) আত্মারাম = 'আপনাতেই আপনি তুষ্ট' - পরমানন্দস্বরূপ আত্মাতেই স্বয়ং পরিতুষ্ট । যিনি সর্ববিধ কামনা বর্জন করিয়াছেন, সুতরাং বাসনা-জনিত চিত্তবিক্ষেপ বিদূরিত হওয়াতে যিনি বিশুদ্ধ আত্মানন্দ উপভোগ করিতেছেন ।

৫৬) রাগ = বিষয়ানুরাগ
ভয় = বিষয়-বিনাশের আশঙ্কা
ক্রোধ = বিষয়-বাসনা প্রতিহত হইলে প্রতিকারোন্মুখ জ্বলনাত্মক চিত্ত-বিকার
বিষয়-বাসনার পূরণে সুখ, অপূরণে দুঃখ । সুতরাং সুখ, দুঃখ, রাগ, ভয়, ক্রোধ - সকলেরই মূল কামনা; কামনা-ত্যাগীই স্তিথধী ।

প্রশ্নঃ কামনার পূরণে অর্থাৎ ভোগেই সুখ । কামনা বর্জন করিয়া ভোগ-সুখ ত্যাগ করিয়া কি তবে জড়পিণ্ডবৎ হইতে হইবে ? এ কি অস্বাভাবিক ধর্ম নয় ? পাশ্চাত্যেরা যাহাকে Ascetism বলে, এ কি তাই নয় ?
উত্তরঃ না, তা নয় । 'ভোগ-দ্বিবিধ, শুদ্ধ ও অশুদ্ধ । শুদ্ধ ভোগে সুখদুঃখ নাই, পুরুষের চিরন্তন স্বভাবসিদ্ধ ধর্ম আনন্দই আছে । অশুদ্ধ ভোগে সুখ ও দুঃখ আছে; হর্ষশোকাদি-দ্বন্দ্ব অশুদ্ধ ভোগীকে বিচলিত ও বিক্ষুব্ধ করে । কামনা অশুদ্ধতার কারণ । কামীমাত্রেই অশুদ্ধ, যে নিষ্কাম সে শুদ্ধ ।' - [শ্রীঅরবিন্দ]
গীতায় এই শুদ্ধ ভোগই বিহিত, অশুদ্ধ ভোগ নিষিদ্ধ । ইন্দ্রিয়-সংযমই বিহিত ইন্দ্রিয়ের ধ্বংস বিহিত নয়, বরং নিষিদ্ধ [২|১৫,৬৪; ৩|৭,৩৩,৩৪; ১৭|৬] ।

৬১) ভগবচ্চিন্তাই ইন্দ্রিয়-সংযমের মহৌষধ । ভগবানকে হৃদয়ে ধারণ করিলে যেরূপ আত্যন্তিক চিত্তশুদ্ধি হয়, দেবতা-উপাসনা, তপ, বায়ুনিরোধ-যোগ, মৈত্রী, তীর্থস্থান, ব্রত, দান, বিদ্যা ও জপের দ্বারা তাহা হয় না ।

৬৩) মোহ = বিপর্যয়বুদ্ধি; চিত্তের যে-অবস্থায় সকল বস্তুই অযথাবৎ প্রতীয়মান হয়, যাহা যা নয়, তাহা তাই বলিয়া জ্ঞান হয় ।

৬৪) নির্লিপ্ত সংসারী :
'তুমি সংসারে থাক তাহাতে দোষ নাই, সংসার তোমাতে না থাকিলেই হয় । জলের উপর নৌকা থাকিতে পারে, কিন্তু নৌকায় জল উঠিলেই ডুবিয়া যায় ।' - শ্রীরামকৃষ্ণ ।

'যেমন গৃহস্তের বাটীর দাসীরা সংসারের যাবতীয় কার্য করিয়া থাকে, সন্তানদিগকে লালন-পালন করে, উহারা মরিয়া গেলে রোদনও করে, কিন্তু মনে জানে যে, ইহারা তাহাদের কেহই নহে ।' - শ্রীরামকৃষ্ণ ।

'বিষয়াসক্ত জীব মুখে নাম জপ করে, কিন্তু মনে বিষয়-চিন্তা করে । উহা উল্টাইয়া লও ।' - রামদয়াল মজুমদার ।

___________________________
Online Source: 
http://geetabangla.blogspot.com/2011/08/blog-post_24.html

*Hard Copy Source:
"Sri Gita" or "Srimadbhagabadgeeta" by Gitashastri Jagadish Chandra Ghosh & Anil Chandra Ghosh. 26th Edition - June 1997 (1st Edition, 1925 from Dhaka now in Bangladesh). Published by Subhadra Dey (Ghosh), Presidency Library, 15 Bankim Chatterjee Street, Kolkata-700073. Printed by Web Impressions Pvt.Ltd., 34/2 Beadon Street, Kolkata-700006.




Disclaimer: This site is not officially related to Presidency LibraryKolkataThis is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : তৃতীয় অধ্যায় - কর্মযোগ
অর্জুন কহিলেন -
হে জনার্দন, যদি তোমার মতে কর্ম হইতে বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ, তবে হে কেশব, আমাকে হিংসাত্মক কর্মে কেন নিযুক্ত করিতেছ ? বিমিশ্র বাক্যদ্বারা কেন আমার মনকে মোহিত করিতেছ; যাহাদ্বারা আমি শ্রেয় লাভ করিতে পারি সেই একটি (পথ) আমাকে নিশ্চিত করিয়া বল । ১,২

শ্রীভগবান কহিলেন -
হে অনঘ, ইহলোকে দ্বিবিধ নিষ্ঠা আছে, ইহা পূর্বে বলিয়াছি ।  সাংখ্যদিগের জন্য জ্ঞানযোগ এবং কর্মীদিগের জন্য কর্মযোগ । ৩

কর্মচেষ্টা না করিলেই পুরুষ নৈষ্কর্ম্যলাভ করিতে পারে না, আর (কামনা ত্যাগ ব্যতীত) কর্মত্যাগ করিলেই সিদ্ধিলাভ হয় না । ৪

কেহই কখনো ক্ষণকাল কর্ম না করিয়া থাকিতে পারে না, কেননা, প্রকৃতির গুণে অবশ হইয়া সকলেই কর্ম করিতে বাধ্য হয় । ৫

যে ভ্রান্তমতি হস্তপদাদি কর্মেন্দ্রিয় সকল সংযত করিয়া অবস্থিতি করে, অথচ মনে মনে ইন্দ্রিয়-বিষয়সকল স্মরণ করে, সে মিথ্যাচারী । ৬

কিন্তু যিনি মনের দ্বারা জ্ঞানেন্দ্রিয়সকল সংযত করিয়া অনাসক্ত হইয়া কর্মেন্দ্রিয়ের দ্বারা কর্মযোগের আরম্ভ করেন, তিনিই শ্রেষ্ঠ । ৭

তুমি নিয়ত কর্ম কর; কর্মশূন্যতা অপেক্ষা কর্ম শ্রেষ্ঠ, কর্ম না করিয়া তোমার দেহযাত্রাও নির্বাহ হইতে পারে না । ৮

যজ্ঞার্থ যে কর্ম তদ্ভিন্ন অন্য কর্ম মনুষ্যের বন্ধনের কারণ । হে কৌন্তেয় তুমি সেই উদ্দেশ্যে (যজ্ঞার্থ) অনাসক্ত হইয়া কর্ম কর । ৯

সৃষ্টির প্রারম্ভে প্রজাপতি যজ্ঞের সহিত প্রজা সৃষ্টি করিয়া বলিয়াছিলেন - তোমরা এই যজ্ঞদ্বারা উত্তরোত্তর বর্ধিত হও; এই যজ্ঞ তোমাদের অভীষ্টপ্রদ হউক । ১০

এই যজ্ঞদ্বারা তোমরা দেবগণকে (ঘৃতাহুতি প্রদানে) সংবর্দ্ধনা কর, সেই দেবগণও (বৃষ্ট্যাদি দ্বারা) তোমাদিগকে সংবর্ধিত করুন; এইরূপে পরস্পরের সংবর্ধনা দ্বারা পরম মঙ্গল লাভ করিবে । ১১

যেহেতু, দেবগণ যজ্ঞাদিদ্বারা সংবর্ধিত হইয়া তোমাদিগকে অভীষ্ট ভোগ্যবস্তু প্রদান করেন, সুতরাং তাঁহাদিগের প্রদত্ত অন্নপানাদি যজ্ঞাদি-দ্বারা তাহাদিগকে প্রদান না করিয়া যে ভোগ করে সে নিশ্চয়ই চোর (দেবস্বাপহারী) । ১২

যে সজ্জনগণ যজ্ঞাবশেষ অন্ন ভোজন করেন অর্থাৎ দেবতা, অতিথি প্রভৃতিকে অন্নাদি প্রদান করিয়া অবশিষ্ট ভোজন করেন তাঁহারা সর্বপাপ হইতে মুক্ত হন । যে পাপাত্মারা কেবল আপন উদরপূরণার্থ অন্ন পাক করে, তাহারা পাপরাশিই ভোজন করে । ১৩

প্রাণিসকল অন্ন হইতে উৎপন্ন হয়, মেঘ হইতে অন্ন জন্মে, যজ্ঞ হইতে মেঘ জন্মে, কর্ম হইতে যজ্ঞের উৎপত্তি, কর্ম বেদ হইতে উৎপন্ন জানিও এবং বেদ পরব্রহ্ম হইতে সমুদ্ভূত; সেই হেতু সর্বব্যাপী পরব্রহ্ম সদা যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত আছেন । এইরূপে প্রবর্তিত জগচ্চক্রের যে অনুবর্তন না করে (অর্থাৎ যে যজ্ঞাদি কর্মদ্বারা এই সংসার-চক্র পরিচালনের সহায়তা না করে) সে ইন্দ্রিয়সুখাসক্ত ও পাপজীবন; হে পার্থ, সে বৃথা জীবন ধারণ করে । ১৪,১৫,১৬

কিন্তু যিনি কেবল আত্মাতেই প্রীত, যিনি আত্মাতেই তৃপ্ত, যিনি কেবল আত্মাতেই সন্তুষ্ট থাকেন, তাঁহার নিজের কোন প্রকার কর্তব্য নাই । ১৭

যিনি আত্মারাম তাঁহার কর্মানুষ্ঠানে কোন প্রয়োজন নাই, কর্ম হইতে বিরত থাকারও কোন প্রয়োজন নাই । সর্বভূতের মধ্যে কাহারও আশ্রয়ে তাঁহার প্রয়োজন নাই (তিনি কাহারও আশ্রয়ে সিদ্ধকাম হইবার আবশ্যকতা রাখেন না) । ১৮

অতএব তুমি আসক্তিশূন্য হইয়া সর্বদা কর্তব্য কর্ম সম্পাদন কর, কারণ অনাসক্ত হইয়া কর্মানুষ্ঠান করিলে পুরুষ পরমপদ (মোক্ষ) প্রাপ্ত হন । ১৯

জনকাদি মহাত্মারা কর্ম দ্বারাই সিদ্ধিলাভ করিয়াছেন । লোকরক্ষার দিকে দৃষ্টি রাখিয়াও তোমার কর্ম করাই কর্তব্য । ২০

শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যাহা যাহা আচরণ করেন, অপর সাধারণেও তাহাই করে । তিনি যাহা প্রামাণ্য বলিয়া বা কর্তব্য বলিয়া গ্রহণ করেন, সাধারণ লোকে তাহারই অনুবর্তন করে । ২১

হে পার্থ, ত্রিলোক মধ্যে আমার করণীয় কিছু নাই, অপ্রাপ্ত বা প্রাপ্তব্য কিছু নাই, তথাপি আমি কর্মানুষ্ঠানেই ব্যাপৃত আছি । ২২

হে পার্থ, যদি অনলস হইয়া কর্মানুষ্ঠান না করি, তবে মানবগণ সর্বপ্রকারে আমারই পথের অনুবর্তী হইবে । (কেহই কর্ম করিবে না) । ২৩

उत्सीदेयुरिमे लोका न कुर्यां कर्म चेदहम् ।
संकरस्य च कर्ता स्यामुपहन्यामिमाः प्रजाः ॥3.24॥

যদি আমি কর্ম না করি তাহা হইলে এই লোক সকল উৎসন্ন যাইবে । আমি বর্ণ*-সঙ্করাদি সামাজিক বিশৃঙ্খলার হেতু হইব এবং ধর্মলোপহেতু প্রজাগণের বিনাশের কারণ হইব । ২৪

হে ভারত, অজ্ঞ ব্যক্তিরা কর্মে আসক্তিবিশিষ্ট হইয়া যেরূপ কর্ম করিয়া থাকে, জ্ঞানী ব্যক্তিরা অনাসক্ত চিত্তে লোকরক্ষার্থে সেইরূপ কর্ম করিবেন । ২৫

জ্ঞানীরা কর্মে আসক্ত অজ্ঞানদিগের বুদ্ধিভেদ জন্মাইবেন না । আপনারা অবহিত হইয়া সকল কর্ম অনুষ্ঠান করিয়া তাহাদিগকে কর্মে নিযুক্ত রাখিবেন । ২৬

প্রকৃতির গুণসমূহদ্বারা সর্বতোভাবে কর্মসকল সম্পন্ন হয় । যে অহঙ্কারে মুগ্ধচিত্ত সে মনে করে আমিই কর্তা । ২৭

কিন্তু হে মহাবাহো ! যিনি সত্ত্বরজস্তমোগুণ ও মন, বুদ্ধি ইন্দ্রিয়াদির বিভাগ ও উহাদের পৃথক্ পৃথক্ কর্ম-বিভাগ তত্ত্ব জানিয়াছেন, তিনি ইন্দ্রিয়াদি ইন্দ্রিয়বিষয়ে প্রবৃত্ত আছে ইহা জানিয়া কর্মে আসক্ত হন না, কর্তৃত্বাভিমান করেন না । ২৮

যাহারা প্রকৃতির গুণে মোহিত তাহারা দেহেন্দ্রিয়াদি কর্মে আসক্তিযুক্ত হয়; সেই সকল অল্পবুদ্ধি মন্দমতিদিগকে জ্ঞানিগণ কর্ম হইতে বিচালিত করিবেন না । ২৯

কর্তা ঈশ্বর, তাঁহারই উদ্দেশ্যে ভৃত্যবৎ কর্ম করিতেছি, এইরূপ বিবেকবুদ্ধি সহকারে সমস্ত কর্ম আমাতে সমর্পণ করিয়া কামনাশূন্য ও মমতাশূন্য হইয়া শোকত্যাগপূর্বক তুমি যুদ্ধ কর । ৩০

যে মানবগণ শ্রদ্ধাবান ও অসূয়াশূন্য হইয়া আমার এই মতের অনুষ্ঠান করে, তাহারাও কর্মবন্ধন হইতে মুক্ত হয় । ৩১

যাহারা অসূয়াপরবশ হইয়া আমার এই মতের অনুষ্ঠান করে না, সেই বিবেকহীন ব্যক্তিগণকে সর্বজ্ঞান-বিমূঢ় ও বিনষ্ট বলিয়া জানিও । ৩২

জ্ঞানবান্ ব্যক্তিও নিজ প্রকৃতির অনুরূপ কর্মই করিয়া থাকেন । প্রাণিগণ প্রকৃতিরই অনুসরণ করে; ইন্দ্রিয়-নিগ্রহে কি করিবে ? ৩৩

সকল ইন্দ্রিয়েরই স্ব স্ব বিষয়ে রাগদ্বেষ অবশ্যম্ভাবী । ঐ রাগদ্বেষের বশীভূত হইও না; উহারা জীবের শত্রু (অথবা, শ্রেয়োমার্গের বিঘ্নকারক) । ৩৪

স্বধর্ম কিঞ্চিদ্দোষবিশিষ্ট হইলেও উহা উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত পরধর্মাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ । স্বধর্মে নিধনও কল্যাণকর, কিন্তু পরধর্ম গ্রহণ করা বিপজ্জনক । ৩৫

অর্জুন কহিলেন -
হে কৃষ্ণ, লোকে কাহাদ্বারা প্রযুক্ত হইয়া অনিচ্ছা-সত্ত্বেও যেন বলপুর্বক নিয়োজিত হইয়াই পাপাচরণ করে । ৩৬

শ্রীভগবান বলিলেন -
ইহা কাম, ইহাই ক্রোধ । ইহা রজোগুণোৎপন্ন, ইহা দুষ্পূরণীয় এবং অতিশয় উগ্র । ইহাকে সংসারে শত্রু বলিয়া জানিবে । ৩৭

যেমন ধূমদ্বারা বহ্নি আবৃত থাকে, মলদ্বারা দর্পণ আবৃত হয়, জরায়ূদ্বারা গর্ভ আবৃত থাকে, সেইরূপ কামের দ্বারা জ্ঞান আবৃত থাকে । ৩৮

হে কৌন্তেয়, জ্ঞানীদিগের নিত্যশত্রু এই দুষ্পূরণীয় অগ্নিতুল্য কামদ্বারা জ্ঞান আচ্ছন্ন থাকে । ৩৯

ইন্দ্রিয়সকল, মন ও বুদ্ধি - ইহারা কামের অধিষ্ঠান বা আশ্রয়স্থান বলিয়া কথিত হয় । কাম ইহাদিগকে অবলম্বন করিয়া জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করিয়া জীবকে মুগ্ধ করে । ৪০

কাম, প্রবল শত্রু । ইন্দ্রিয়াদি উহার অবলম্বন বা আশ্রয়স্বরূপ ।  তুমি প্রথমে কামের অবলম্বন স্বরূপ ইন্দ্রিয়দিগকে জয় কর, তবেই কাম জয় করিতে পারিবে । ৪১

ইন্দ্রিয়সকল শ্রেষ্ঠ বলিয়া কথিত হয়; ইন্দ্রিয়গণ অপেক্ষা মন শ্রেষ্ঠ; মন অপেক্ষা বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ; বুদ্ধি হইতে যিনি শ্রেষ্ঠ তিনিই আত্মা । ৪২

হে মহাবাহো, এইরূপে বুদ্ধির সাহায্যে বুদ্ধিরও উপরে অবস্থিত পরমাত্মা সম্বন্ধে সচেতন হইয়া, আত্মাকে আত্মশক্তির প্রয়োগেই ধীর ও নিশ্চল কর এবং দুর্ণিবার শত্রু কামকে বিনাশ কর [শ্রীঅরবিন্দ] । অথবা, নিজেই নিজেকে সংযত করিয়া কামরূপ দুর্জয় শত্রুকে মারিয়া ফেল [লোকমান্য তিলক]; অথবা, নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধিদ্বারা মনকে নিশ্চল করিয়া কামরূপ দুর্জয় শত্রু (কামকে) বিনাশ কর [শ্রীধরস্বামি] । ৪৩

___________________________


৪) নৈষ্কর্ম্য লাভ : কর্মবন্ধন হইতে মুক্তি বা নিষ্কৃতির অবস্থাকে নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি বা মোক্ষ বলে । শ্রীগীতা বলেন সন্ন্যাসমার্গে মোক্ষ লাভ হয় জ্ঞানের ফলে, কর্মত্যাগের ফলে নয় । কর্ম বন্ধনের কারণ নয়, অহঙ্কার ও কামনাই বন্ধনের কারণ । কামনা ত্যাগেও জ্ঞানের প্রয়োজন এবং সেই হেতুই নিষ্কাম-কর্মও মোক্ষপ্রদ । মোক্ষের জন্য চাই, অহঙ্কার ও ফলাসক্তি ত্যাগ, কর্মত্যাগ প্রয়োজন হয় না । বস্তুত দেহধারী জীব একেবারে কর্মত্যাগ করিতেই পারে না ।

৬-৭) মিথ্যাচারী ও কর্মযোগী : হস্তপদাদি সংযত করিয়া ধ্যানে বসিয়াছি । মন বিষয়ে ভ্রমণ করিতেছে । আমি মিথ্যাচারী। এই অবস্থা উল্টাইয়া লইতে পারিলে আমি কর্মযোগী হইব । অর্থাৎ যখন ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বিষয়-কর্ম করিতেছি, কিন্তু মন ঈশ্বরে নিবিষ্ট আছে, বিষয়-কর্মও তাঁহারই কর্ম মনে করিয়া কর্তব্যবোধে করিতেছি, উহাতে আসক্তি নাই, ফলাকাঙ্ক্ষা নাই । সিদ্ধি-অসিদ্ধিতে হর্ষ-বিষাদ নাই ।

৮) নিয়ত কর্ম : সাধারণত শাস্ত্রবিহিত কর্তব্য-কর্ম (duty), স্বধর্ম - লোকমান্য তিলক । এখানে ইন্দ্রিয়সকল সংযত করিয়া (নিয়ম্য) যে কর্ম তাহাই বুঝায় (controlled action) ।

ধর্মশাস্ত্র : স্বেচ্ছাচারিতা ও উচ্ছৃঙ্খলতা নিবারণপূর্বক ধর্ম ও লোকরক্ষার উদ্দেশ্যে যে সকল বিধি-নিষেধ প্রবর্তিত হইয়াছে । শাস্ত্র সকল সম্প্রদায়ের, সকল সমাজের, সকল জাতিরই আছে । সকলের পক্ষেই শাস্ত্রবিহিত কর্মই কর্তব্য-কর্ম । হিন্দুর কর্মজীবনে ও ধর্মজীবনে পার্থক্য নাই, তাই হিন্দুর সাংসারিক-কর্ম-নিয়ামক শাস্ত্রু ধর্মশাস্ত্র । তিন সহস্র-বৎসর পূর্বে প্রবর্তিত কোনো শাস্ত্রবিধি যদি অবস্থার পরিবর্তনে সমাজরক্ষার প্রতিকূল বোধ হয়, তবে তাহা অবশ্যই ত্যাজ্য । কেননা, যুক্তিহীন, গতানুগতিক ভাবে শাস্ত্র অনুসরণ করিলে ধর্মহানি হয় -
কেবলং শাস্ত্রমাশ্রিত্য ন কর্তব্যো বিনির্ণয়ঃ ।যুক্তিহীনবিচারেণ ধর্মহানিঃ প্রজায়তে ।। - বৃহস্পতি
স্বয়ং ব্রহ্মাও যদি অযৌক্তিক কথা বলেন, তবে তাহা তৃণবৎ পরিত্যাগ করিবে ।
অন্যং তৃণমিব ত্যাজ্যমপ্যুক্তং পদ্মজন্মনা - বশিষ্ঠ
৯) 'যজ্ঞার্থ' কর্ম কি ? বৈদিক যাগযজ্ঞাদি-ক্রিয়াকাণ্ড সমস্তই রূপাত্মক, উহাদের অন্তর্নিহিত গূঢ় অর্থ আছে । 'যজ্ঞের মর্মভাব ত্যাগ, অতএব যজ্ঞার্থে কর্ম করার এরূপ অর্থও অসঙ্গত নহে যে, ত্যাগের ভাবে কর্মানুষ্ঠান করা । এইরূপ কর্মানুষ্ঠান যখন অভ্যাসে পরিণত হয়, তখন মানব-জীবন একটি মহাযজ্ঞের আকার ধারণ করে । সেই যজ্ঞের বেদী জগতের হিত, ত্যাগ, আত্মবলিদান এবং যজ্ঞেশ্বর স্বয়ং ভগবান ।' [গীতায় যজ্ঞতত্ত্ব, বেদান্তরত্ন হীরেন্দ্রনাথ দত্ত]

১৩) পঞ্চমহাযজ্ঞ : মানুষ জীবনরক্ষার্থ অনিচ্ছাসত্ত্বেও প্রাণিহিংসা করিতে বাধ হয় । শাস্ত্রকারগণ গৃহস্তের পাঁচ প্রকার 'সূনা' অর্থাৎ জীবহিংসা-স্থানের উল্লেখ করেন । যথা - (i)উদূখল, (ii)জাঁতা, (iii)চুল্লী, (iv)জলকুম্ভ ও (v)ঝাঁটা । এগুলি গৃহস্তের নিত্য-ব্যবহার্য, অথচ এগুলি দ্বারা কীটপতঙ্গাদি প্রাণিবধও অনিবার্য, সুতরাং তাহাতে পাপও অবশ্যম্ভাবী । এই পাপমোচনার্থ পঞ্চমহাযজ্ঞের ব্যবস্থা । যথা - (i)অধ্যাপনা (এবং সন্ধ্যোপাসনাদি) ব্রহ্মযজ্ঞ/ঋষিযজ্ঞ, (ii)তর্পণাদি পিতৃযজ্ঞ, (iii)হোমাদি দৈবযজ্ঞ, (iv)কাকাদি-জীবজন্তুকে খাদ্যপ্রদান ভৃতযজ্ঞ ও (v)অতিথি-সৎকার নৃযজ্ঞ । সকলের প্রতিই মানুষের কর্তব্য আছে, এই কর্তব্যকেই শাস্ত্রে 'ঋণ' বলে । ত্যাগমূলক পঞ্চযজ্ঞদ্বারা পিতৃঋণ, দেবঋণ ইত্যাদি পরিশোধ করিতে হয় ।

১৪-১৫) গীতায় যজ্ঞবিধি : গীতা সকাম-যজ্ঞেরই বিরোধী, নিষ্কাম-যজ্ঞের নহে । যজ্ঞ, দান ও তপস্যা - এই সকল কর্ম চিত্তশুদ্ধিকর, উহা অবশ্যকর্তব্য; কিন্তু আসক্তি ও ফলকামনা ত্যাগ করিয়া এই সকল কর্ম করিতে হইবে [১৮|৫-৬] । 'গীতার শ্লোকগুলিতে যে-যজ্ঞের বিধান আছে তাহাতে যদি আমরা কেবল আনুষ্ঠানিক যজ্ঞই বুঝি তাহা হইলে আমরা গীতোক্ত কর্ম-তত্ত্ব যথার্থ বুঝিতে পারিব না; বস্তুত, এই শ্লোকগুলির মধ্যে গভীর গূঢ়ার্থ আছে ।' - [শ্রীঅরবিন্দ] । 'যজ্ঞের মর্মভাব ত্যাগ (sacrifice) - [বেদান্তরত্ন হীরেন্দ্রনাথ দত্ত]

রহস্য - যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞাদি
ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরও শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শক্রমেই 'কাম্য কর্ম' রাজসূয়-যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন, কিন্তু নিষ্কামভাবে, কর্তব্যানুরোধে । এই রাজসূয়-যজ্ঞের উদেশ্য প্রধানত জরাসন্ধ, শিশুপাল প্রভৃতি ধর্মদ্বেষী অত্যাচারী 'অসুরগণ'কে নত বা নিহত করিয়া একচ্ছত্র ধর্মরাজ্য সংস্থাপন । কিন্তু ঈদৃশ অশ্বমেধ-যজ্ঞ অপেক্ষাও যে বিশুদ্ধ ত্যাগ-লক্ষণ নৃযজ্ঞাদির শ্রেষ্ঠতা কম নহে, মহাভারতকার সুবর্ণনকুল-উপাখ্যানে তাহাও প্রদর্শন করিয়াছেন ।

সুবর্ণনকুল-উপাখ্যান : এক নকুল যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ-যজ্ঞস্থলে আসিয়া অবিরত লুণ্ঠিত হইতেছিল । দেখা গেল, নকুলটির মুখ ও শরীরের অর্ধাংশ স্বর্ণময় । অদ্ভুত জীবটির অদ্ভুত কর্মের কারণ জিজ্ঞাসা করা হইলে নকুল বলিল - দেখিলাম, কুরুক্ষেত্রে এক উঞ্ছবৃত্তি ব্রাহ্মণ সপরিবারে উপবাসী থাকিয়া অতিথিকে সঞ্চিত সমস্ত যবচূর্ণ প্রদান করিলেন । সেই অতিথির ভোজনপাত্রে যৎকিঞ্চিৎ উচ্ছিষ্ট অবশিষ্ট ছিল, সেই পবিত্র যবকণার সংস্পর্শে আমার মুখ ও দেহার্ধ স্বর্ণময় হইয়াছে । অপরার্ধ স্বর্ণময় করিবার জন্য আমি নানা যজ্ঞস্থলে যাইয়া লুণ্ঠিত হইলাম, কিন্তু দেখিলাম এ-যজ্ঞ অপেক্ষা সেই ব্রাহ্মণের শক্তুযজ্ঞই শ্রেষ্ঠ; কেননা আমার দেহ স্বর্ণময় হইল না ।

১৭-১৯) জ্ঞানীর কর্ম : 'উচ্চতর সত্যের অভিমুখ হইলেই কর্ম ত্যাগ করিতে হইবে না - সেই সত্য লাভ করিবার পূর্বে ও পরে নিষ্কাম কর্মসাধনই গূঢ় রহস্য । মুক্ত পুরুষের কর্মের দ্বারা লাভ করিবার কিছুই নাই, তবে কর্ম হইতে বিরত থাকিয়াও তাঁহার কোনো লাভ নাই এবং কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য তাঁহাকে কর্ম করিতে বা কর্ম ত্যাগ করিতে হয় না, অতএব যে কর্ম করিতে হইবে (জগতের জন্য, লোক-সংগ্রহার্থে [৩|২০]) সর্বদা অনাসক্ত হইয়া তাহা কর ।' - শ্রীঅরবিন্দের গীতা

২০) লোকসংগ্রহম্‌ : লোকরক্ষা, সৃষ্টিরক্ষা । এ-স্থলে 'লোক' শব্দের অর্থ ব্যাপক । শুধু মনুষ্য-লোকের নহে, দেবাদি সমস্ত লোকের ধারণ-পোষণ হইয়া পরস্পরের শ্রেয় সম্পাদন করিবে । জ্ঞানী পুরুষ সমস্ত জগতের চক্ষু, ইঁহারা যদি নিজের কর্ম ত্যাগ করেন, তাহা হইলে অন্ধতমসাচ্ছন্ন হইয়া সমস্ত জগৎ ধ্বংস না হইয়া যায় না । লোকদিগকে জ্ঞানী করিয়া উন্নতির পথে আনয়ন করা জ্ঞানী পুরুষদিগেরই কর্তব্য ।

২৪) সঙ্করস্য : 'সঙ্কর' অর্থ পরস্পর-বিরুদ্ধ পদার্থের মিলন বা মিশ্রণ, উহার ফল সামাজিক বিশৃঙ্খলা । বর্ণসঙ্কর উহার প্রকার বিশেষ । বর্ণসঙ্কর, কর্মসঙ্কর, নানাভাবেই সাঙ্কর্য উপস্থিত হইতে পারে । লোকে স্বধর্মানুসারে কর্তব্য-পালন না করিলেই এইরূপ সাঙ্কর্য উপস্থিত হয় । এ-স্থলে সঙ্কর-শব্দের সাধারণ ব্যাপক অর্থ গ্রহণই কর্তব্য । মূল শ্লোকে "বর্ণের" উল্লেখ নেই [uploader's comment] ।
শ্লোকের তাৎপর্য - আমি কর্ম না করিলে আমার দৃষ্টান্তের অনুসরণে সকলে স্বীয় কর্তব্য-কর্ম ত্যাগ করিয়া স্বেচ্ছাচারী হইয়া উঠিবে । স্বেচ্ছাচারে সাঙ্কর্য ও বিশৃঙ্খলা অবশ্যম্ভাবী । সামাজিক বিশৃঙ্খলায় ধর্মলোপ, সমাজের বিনাশ । সুতরাং লোক-শিক্ষার্থ, লোক-সংগ্রহার্থ আমি কর্ম করি, তুমিও তাহাই কর ।

কৃষ্ণই হিন্দুর জাতীয় আদর্শ : 'আপনি আচরি ধর্ম লোকেরে শিখায়' - শ্রীচৈতন্য-লীলাপ্রসঙ্গ । অবতারগণ মানব-ধর্ম স্বীকার করিয়া মানবী-শক্তির সাহায্যেই কর্ম করিয়া থাকেন, নচেৎ লোকে তাঁহাদের আদর্শ ধরিতে পারে না । এইভাবে দেখিলে, তাঁহারা আদর্শ মনুষ্য । শ্রীচৈতন্য, ভক্তরূপে স্বয়ং আচরণ করিয়া প্রেমভক্তি শিক্ষা দিয়াছেন । বুদ্ধদেব ত্যাগ ও বৈরাগ্যের প্রতিমূর্তি । শ্রীরামচন্দ্রে কর্তব্যনিষ্ঠার চরমোৎকর্ষ । আর শ্রীকৃষ্ণ সর্বতঃপূর্ণ, সর্বকর্মকৃৎ ।

২৫) নিষ্কাম কর্মের উদ্দেশ্য : দুইটি উদ্দেশ্য - (i)ভগবানের অর্চনা, (ii)সৃষ্টি রক্ষা । জ্ঞানী যদি কর্মত্যাগী হন, তবে জ্ঞান প্রচার করিবে কে ? কর্মে নিষ্কামতা শিক্ষা দিবে কে ? সংসার-কীট কর্মীকে ভগবানের দিকে আকর্ষণ করিবে কে ? কর্মী যদি স্বার্থান্বেষী হন, তবে জগতের দুঃখ মোচন করিবে কে ? তাই প্রহ্লাদ দুঃখ করিয়া বলিয়াছিলেন -
'প্রায়ই দেখা যায়, মুনিরা নির্জনে মৌনাবলম্বন করিয়া তপস্যা করেন, তাঁহারা তো লোকের দিকে দৃষ্টি করেন না । তাঁহারা তো পরার্থনিষ্ঠ নন, তাঁহারা নিজের মুক্তির জন্যই ব্যস্ত, সুতরাং স্বার্থপর ।'
অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে যেমন রামকৃষ্ণ মিশন অথবা ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের সন্ন্যাসীবৃন্দ । কিন্তু স্মরণ রাখিতে হইবে যে সেবাধর্মী সন্ন্যাসীবৃন্দের কর্মজীবনের আদর্শ কেবল সমাজ-সেবা বা ভূতহিত নয়, উহা তাঁহাদের শিক্ষার আনুষঙ্গিক ফল এবং উচ্চস্তরে উঠিবার সোপানমাত্র । স্বামী বিবাকানন্দের শিক্ষার মূল কথা ভাগবত-জীবন লাভ, সর্বজীবকে সত্ত্বশুদ্ধ করিয়া ভগবানের দিকে আকৃষ্ট করা । বর্তমান ভারতবাসী তমোগুণাক্রান্ত, রজোগুণের উদ্রেক না হইলে সত্ত্বে যাওয়া যায় না, এই জন্য তিনি কর্মের উপর এত জোর দিয়াছেন ।

'দেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, সমাজসেবা, সমষ্টির সাধনা, এই সমস্ত যে আমাদের ব্যক্তিগত স্বার্থপরতার হস্ত হইতে পরিত্রাণ লাভ করিয়া অপরের জীবনের সহিত নিজের একত্ব উপলব্ধি করিবার প্রকৃষ্ট উপায় তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই । আদিম স্বার্থপরতার পর ইহা দ্বিতীয় অবস্থা । কিন্তু গীতা আরো উচ্চ তৃতীয় অবস্থার কথা বলিয়াছেন । দ্বিতীয় অবস্থাটি সেই তৃতীয় অবস্থায় উঠিবার আংশিক উপায় মাত্র । সেই এক সর্বাতীত সার্বজনীন ভাগবত সত্তা ও চৈতন্যের মধ্যে মানবের সমগ্র ব্যক্তিত্বকে হারাইয়া ক্ষুদ্র আমিকে হারাইয়া, বৃহত্তর আমাকে পাইয়া যে ভাগবত অবস্থা লাভ করা যায়, গীতায় তাহারই নিয়ম বর্ণিত হইয়াছে ।' - শ্রীঅরবিন্দের গীতা (সংক্ষিপ্ত) ।

২৬) সন্ন্যাসবাদে ভারতের দুর্দশা :
প্রাচীন ভারত কর্মদ্বারাই গৌরবলাভ করিয়াছিল, শিক্ষা-সভ্যতায়, শিল্প-সাহিত্যে, শৌর্য-বীর্যে জগতে শীর্ষস্থান অধিকার করিয়াছিল । সেই ভারতবাসী আজ অলস, অকর্মা, বাক্যবাগীশ বলিয়া জগতে উপহাসাস্পদ । এ-দুর্দশা কেন ? ভারতকে কর্ম হইতে বিচ্যুত করিল কে ? ভারতে এ-বুদ্ধিভেদ জন্মিল কিরূপে ?

বুদ্ধদেবের অষ্টাঙ্গ পথ, শঙ্করের মায়াবাদ, পরবর্তী ধর্মাচার্যগণের দ্বৈতবাদ, এ-সকলে জ্ঞান, বৈরাগ্য, প্রেম, ভক্তি সবই আছে, কিন্তু কর্মের প্রেরণা নাই, কর্মপ্রশংসা নাই, কর্মোপদেশ নাই । কুরুক্ষেত্রের সমরাঙ্গনে যে শঙ্খধ্বনি উত্থিত হইয়াছিল, 'কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন', সে ধ্বনির আর কেহ প্রতিধ্বনি করেন নাই, তেমন কথা ভারতবাসী তিন-সহস্র বৎসরের মধ্যে আর শুনে নাই । মধ্যযুগে সে কেবল শুনিয়াছে - 'কর্মে জীবের বন্ধন, জ্ঞানেই মুক্তি', 'সন্ন্যাস গ্রহণ করিলেই মানুষ নারায়ণ হয়' এই সব । ফলে, সংসারে জাতবিতৃষ্ণ, কর্মবিমুখ অদৃষ্টবাদীর সৃষ্টি, দলে-দলে অনধিকারীর সন্ন্যাস গ্রহণ, ধর্মধ্বজী ভিক্ষোপজীবীর সংখ্যাবৃদ্ধি । এইরূপে কালে সমাজ হইতে রজোগুণের সম্পূর্ণ অন্তর্ধান হইল, সত্ত্বগুণাশ্রিত অতি অল্পসংখ্যক ব্যক্তি সমাজ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া জ্ঞানভক্তির চর্চায় নিযুক্ত রহিলেন - তমোগুণাক্রান্ত নিদ্রাভিভূত জনসাধারণ শত্রুর আক্রমণে চমকিত হইয়া 'কপালের লিখন' বলিয়া চিত্তকে প্রবোধ দিল ।

পূর্বে যে-সকল মহাপুরুষের কথা উল্লিখিত হইল ইঁহারা সকলেই যুগাবতার । সনাতন ধর্মের গ্লানি উপস্থিত হইলে, সেই গ্লানি নিবারণ করিয়া উহার বিশুদ্ধি ও সময়োপযোগী পরিবর্তন সাধনের জন্যই যুগধর্মের প্রবর্তন হয় । তত্তৎকালে ঐ সকল ধর্মপ্রবর্তনের প্রয়োজন ছিল বলিয়াই এই যুগাবতারগণের আবির্ভাব । ইঁহারা কখনো অনধিকারীকে সোহহং জ্ঞান বা সন্ন্যসাদি উপদেশ দেন নাই । কিন্তু কালের গতিতে যুগধর্মেরও ব্যভিচার হয়, লোকে উহার প্রকৃত মর্ম গ্রহণ করিতে না পারিয়া নানারূপ উপধর্মের সৃষ্টি করে, উহাতেই কুফল ঘটে ।

২৭-৩০) কর্মী ও কর্মযোগী :
প্রশ্নঃ জ্ঞানীও কর্ম করেন, অজ্ঞানও কর্ম করেন, তবে জ্ঞানী ও অজ্ঞানে পার্থক্য কি ?
উত্তরঃ অজ্ঞান ব্যক্তি মনে করেন, কর্ম করি আমি, জ্ঞানী মনে করেন, কর্ম করেন প্রকৃতি । অজ্ঞান 'আমি'টাকে কর্মের সহিত যোগ করিয়া দেন বলিয়াই ফলাসক্ত হন । সুতরাং অজ্ঞানের কর্ম ভোগ, জ্ঞানীর কর্ম যোগ । কর্মী হইলেই কর্মযোগী হয় না । কর্তৃত্বাভিমান ও ফলাকাঙ্খা বর্জন ব্যতীত কর্ম যোগে পরিণত হয় না ।

'কাঁচা আমি' ও 'পাকা আমি' : "মানুষের ভিতর 'কাঁচা আমি' ও 'পাকা আমি', এই দুই রকম 'আমি' আছে । অহঙ্কারী আমি কাঁচা আমি । এ-আমি মহাশত্রু । ইহাকে সংহার করা চাই । মুক্তি হবে কবে, অহং যাবে যবে । সমাধি হলে তাঁর সঙ্গে এক হওয়া যায়, আর অহং থাকে না । জ্ঞান হবার পর যদি অহং থাকে তবে জেনো সে বিদ্যার আমি, ভক্তির আমি, দাস আমি, সে অবিদ্যার আমি নয় । সে পাকা আমি । প্রহ্লাদ, নারদ, হনুমান, এঁরা সমাধির পর ভক্তি রেখেছিলেন; শঙ্করাচার্য, রামানুজ, এঁরা বিদ্যার আমি রেখেছিলেন ।" - শ্রীরামকৃষ্ণ ।

সমাধি : সমাধি হইলেই যে বাহ্য বিষয়ের জ্ঞান লোপ পাইবে, তাঁহার শরীর ও মনের জ্ঞানও লোপ পাইবে, এমন-কি তাঁহার শরীর দগ্ধ করিলেও জ্ঞান হইবে না, তাহা নহে । সমাধিস্থ ব্যক্তির প্রধান লক্ষণ এই যে, তাঁহার ভিতর হইতে সমস্ত কামনা দূর হয়, সংসারের শুভাশুভ, সুখ-দুঃখ, কর্ম-কোলাহলে মন সম্পূর্ণ অবিচলিত থাকে, তিনি আত্মার আনন্দেই তৃপ্ত থাকেন - যখন সাধারণের চক্ষুতে তাঁহাকে দেখায় যে, তিনি সাংসারিক বাহ্য-ব্যাপারে ব্যস্ত, তখনো সম্পূর্ণভাবে ভগবানের দিকেই তাঁহার লক্ষ্য থাকে ।

৩৩) স্বভাব কাহাকে বলে ?
জীবমাত্রেই একটি বিশেষ প্রকৃতি লইয়া জন্মগ্রহণ করে এবং প্রকৃতির অনুগামী হইয়া সে কর্ম করে । এই প্রকৃতি কি ? শাস্ত্রকারগণ বলেন, পূর্বজন্মার্জিত ধর্মাধর্ম-জ্ঞানেচ্ছাদিজনিত যে-সংস্কার তাহা বর্তমান জন্মে অভিব্যক্ত হয়; এই সংস্কারের নামই প্রকৃতি । পূর্বে বলা হইয়াছে যে, ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতির প্রেরণায়ই জীব কর্ম করে [৩|২৭-২৯] । বস্তুত, এই প্রাক্তন সংস্কারের মূলেও সেই ত্রিগুণ । পূর্বজন্মের ধর্মাধর্ম কর্মফলে গুণবিশেষের প্রাবল্য বা হ্রাস হইয়া স্বভাবের যে অবস্থা দাঁড়ায়, তাহাই প্রাচীন সংস্কার বা অভ্যাস । কাহারো মধ্যে সত্ত্বগুণের, কাহাতে রজোগুণের, কাহাতে তমোগুণের প্রাবল্য । আবার গুণত্রয়ের সংযোগে নানাবিধ মিশ্রগুণেরও উৎপত্তি হয়; যথা - সত্ত্ব-রজঃ, রজ-স্তমঃ ইত্যাদি । যখন যাহার মধ্যে যে গুণ প্রবল হয়, তখন তাহার মধ্যে সেই গুণের কার্য হইয়া থাকে । ইহাকেই স্বভাবজ কর্ম বলে । এ-স্থলে বলা হইতেছে, জীবের প্রবৃত্তি স্বভাবেরই অনুবর্তন করে, স্বভাবই বলবান, ইন্দ্রিয়ের নিগ্রহে বা শাস্ত্রাদির শাসনে কোন ফল হয় না ।

৩৪) তবে কি জীবের স্বাতন্ত্র্য নাই, তাহার আত্মোন্নতির উপায় নাই ?
আছে । ইন্দ্রিয়সমূহকে নিগ্রহ বা পীড়ন না করিয়া তাহাদিগকে বশীভূত করিতে হইবে । স্ব-স্ব বিষয়ে রাগদ্বেষ ইন্দ্রিয়ের স্বাভাবিক, কিন্তু জীবের রাগদ্বেষের বশে যাওয়া উচিত নয় । যিনি রাগদ্বেষ হইতে বিমুক্ত, তিনি ইন্দ্রিয়ের অধীন নন, ইন্দ্রিয়সমূহই তাঁহার অধীন হয় । এইরূপ আত্মবশীভূত ইন্দ্রিয়দ্বারা স্বকর্ম করিতে হইবে, স্বধর্ম পালন করিতে হইবে [২|৬৪] ।

৩৫) যুগধর্ম : সময়োপযোগী পরিবর্তন সাধনের জন্যই যুগধর্মের প্রবর্তন হয় এবং সনাতন ধর্মের বিশুদ্ধি রক্ষিত হয় । বিশদ : স্বধর্ম বলিতে কি বুঝায় ?

৩৭) ষড়রিপু : (i)কাম, (ii)ক্রোধ, (iii)লোভ, (iv)মোহ, (v)মদ, (vi)মাৎসর্য ।
  1. কাম = যে-কোন রূপ ভোগবাসনা ।
  2. ক্রোধ = বাসনা প্রতিহত হইলেই ক্রোধের উদ্রেক হয় ।
  3. লোভ = মিষ্টরসাদি বা ধনাদির দিকে অতিমাত্রায় আকৃষ্ট হওয়া ।
  4. মোহ = বিষয়-বাসনারূপ অজ্ঞান বা মায়া যা আত্মজ্ঞান আচ্ছন্ন করিয়া রাখে, উহার অতীত নিত্যবস্তুকে দেখিতে দেয় না ।
  5. মদ = এই অজ্ঞানতার ফলে 'আমি ধনী', 'আমি জ্ঞানী' এইরূপ অহমিকা ।
  6. মাৎসর্য = পরশ্রীকাতরতা; পরের উন্নতি-দর্শনে নিজের অহমিকার খণ্ডনের ফলে উপস্থিত চিত্তক্ষোভ ।
সুতরাং, ষড়রিপুগুলির ্মূল হইতেছে কাম, কামনা বা বাসনা । এইগুলি এক বস্তুরই বিভিন্ন বিকাশ, এক ভাবেরই বিভিন্ন বিভাব ।

৩৮) বিষয়-বাসনা থাকিতে আত্মজ্ঞানের উদয় হয় না । যেমন ধূম অপসারিত হইলে অগ্নি প্রকাশিত হয়, ধূলিমল অপসারিত হইলে দর্পণের স্বচ্ছতা প্রতিভাত হয়, প্রসবের দ্বারা জরায়ূ প্রসারিত হইলে ভ্রুণের প্রকাশ হয়, সেইরূপ বিষয়-বাসনা বিদূরিত হলে তত্ত্বজ্ঞানের উদয় হয় (সংসারের ক্ষয় হয়) ।

৪৩) আত্মস্বাতন্ত্র্য ও প্রকৃতির বশ্যতা :
জীব যখন 'পাকা আমি'কে জানিতে পারে, তাঁহার প্রেরণা বুঝিতে পারে, তখন তাহার প্রকৃতির বশ্যতা থাকে না । 'পাকা আমি'র জ্ঞানের দ্বারা 'কাঁচা আমি' দূরীভূত হন - ইহাকেই বলা হইতেছে - আত্মার দ্বারা আত্মাকে স্থির করা বা নিজেই নিজেকে স্থির করা । ইহারই নাম আত্ম-স্বাতন্ত্র্য ।
শ্রীভগবান্‌ বলিলেন -
এই অব্যয় যোগ আমি সূর্যকে বলিয়াছিলাম । সূর্য (স্বপুত্র) মনুকে এবং মনু (স্বপুত্র) ইক্ষ্বাকুকে ইহা বলিয়াছিলেন । ১

এইরূপে পুরুষপরম্পরা প্রাপ্ত এই যোগ রাজর্ষিগণ বিদিত ছিলেন । হে পরন্তপ, ইহলোকে সেই যোগ দীর্ঘকালবশে নষ্ট হইয়াছে । ২


তুমি আমার ভক্ত ও সখা, এই জন্য এই সেই পুরাতন যোগ অদ্য তোমাকে বলিলাম; কারণ, ইহা উত্তম গুহ্য তত্ত্ব । ৩

অর্জুন বলিলেন -

আপনার জন্ম পরে, বিবস্বানের জন্ম পূর্বে; সুতরাং আপনি যে পূর্বে ইহা বলিয়াছিলেন, তাহা কিরূপে বুঝিব ? ৪

শ্রীভগবান্‌ বলিলেন -

হে অর্জুন ! আমার এবং তোমার বহু জন্ম অতীত হইয়াছে । আমি সে সকল জানি; হে পরন্তপ ! তুমি জান না । ৫

আমি জন্মরহিত, অবিনশ্বর এবং সর্বভূতের ঈশ্বর হইয়াও স্বীয় প্রকৃতিতে অনুষ্ঠান করিয়া আত্মমায়ায় আবির্ভূত হই । ৬

হে ভারত ! যখনই যখনই ধর্মের গ্লানি এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, আমি সেই সেই সময়ে নিজেকে সৃষ্টি করি (দেহ ধারণপূর্বক অবতীর্ণ হই) । ৭

সাধুগণের পরিত্রাণ, দুষ্টদিগের বিনাশ এবং ধর্মসংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই । ৮

হে অর্জুন, আমার এই দিব্য জন্ম ও কর্ম যিনি তত্ত্বতঃ জানেন, তিনি দেহত্যাগ করিয়া পুনর্বার আর জন্মপ্রাপ্ত হন না - তিনি আমাকেই প্রাপ্ত হন । ৯

বিষয়ানুরাগ, ভয় ও ক্রোধ বর্জন করিয়া, আমাতে একাগ্রচিত্ত ও আমার শরণাপন্ন হইয়া, আমার জন্মকর্মের তত্ত্বালোচনা রূপ জ্ঞানময় তপস্যাদ্বারা পবিত্র হইয়া অনেকে আমার পরমানন্দভাবে চিরস্থিতি লাভ করিয়াছেন । ১০

হে পার্থ ! যে আমাকে যে-ভাবে উপাসনা করে, আমি তাহাকে সেই ভাবেই তুষ্ট করি । মনুষ্যগণ সর্বপ্রকারে আমার পথেরই অনুসরণ করে অর্থাৎ মনুষ্যগণ যে পথই অনুসরণ করুক না কেন, সকল পথেই আমাতে পৌঁছিতে পারে । ১১

ইহলোকে যাহারা কর্মসিদ্ধি কামনা করে তাহারা দেবতা পূজা করে, কেননা মনুষ্যলোকে কর্মজনিত ফললাভ শীঘ্রই পাওয়া যায় । ১২

বর্ণচতুষ্টয় গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে আমি সৃষ্টি করিয়াছি বটে, কিন্তু আমি উহার সৃষ্টিকর্তা হইলেও আমাকে অকর্তা ও বিকাররহিত বলিয়াই জানিও । ১৩

কর্মসকল আমাকে লিপ্ত করিতে পারে না, কর্মফলে আমার স্পৃহাও নাই, এইরূপে যিনি আমাকে জানেন, তিনি কর্মদ্বারা আবদ্ধ হন না । ১৪

এইরূপ জানিয়া (অর্থাৎ আত্মাকে অকর্তা, অভোক্তা মনে করিয়া) পূর্ববর্তী মোক্ষাভিলাষিগণ অর্থাৎ পূর্ববর্তী জনকাদি রাজর্ষিগণ কর্তৃত্বাভিমান বর্জনপূর্বক নির্লিপ্তভাবে স্বীয় কর্তব্য কর্ম সম্পাদন করিয়া গিয়াছেন, তুমিও সেইরূপ নিষ্কামভাবে স্বীয় কর্তব্য পালন কর । ১৫

কর্ম কি, কর্মশূন্যতাই বা কি, এ বিষয়ে পণ্ডিতেরাও মোহ প্রাপ্ত হন অর্থাৎ ইহার প্রকৃত তত্ত্ব বুঝিতে পারেন না, অতএব কর্ম কি, (এবং অকর্ম কি) তাহা তোমাকে বলিতেছি, তাহা জানিলে অশুভ হইতে (সংসারবন্ধন হইতে) মুক্ত হইবে । ১৬

বিহিত কর্মের বুঝিবার বিষয় আছে, বিকর্ম বা অবিহিত কর্মের বুঝিবার বিষয় আছে, অকর্ম বা কর্মত্যাগ সন্বন্ধেও বুঝিবার বিষয় আছে; কেননা কর্মের গতি (তত্ত্ব) দুর্জ্ঞেয় । ১৭

যিনি কর্মে অকর্ম এবং অকর্মে কর্ম দেখেন মনুষ্যের মধ্যে তিনিই বুদ্ধিমান্‌; তিনি যোগী, তিনি সর্বকর্মকারী । ১৮

যাঁহার সমস্ত কর্মচেষ্টা, ফলতৃষ্ণা ও কর্ত্তৃত্বাভিমানবর্জিত, সুতরাং যাঁহার কর্ম জ্ঞানরূপ অগ্নিদ্বারা দগ্ধ হইয়াছে, সেইরূপ ব্যক্তিকেই জ্ঞানিগণ পণ্ডিত বলিয়া থাকেন । ১৯

যিনি কর্মে ও কর্মফলে আসক্তি পরিত্যাগ করিয়াছেন, যিনি সদা আপনাতেই পরিতৃপ্ত, যিনি কোন প্রয়োজনে কাহারও আশ্রয় গ্রহণ করেন না, তিনি কর্মে প্রবৃত্ত হইলেও কিছুই করেন না (অর্থাৎ তাঁহার কর্ম অকর্মে পরিণত হয়) । ২০

যিনি কামনা ত্যাগ করিয়াছে, যাঁহার চিত্ত ও ইন্দ্রিয় সংযত, যিনি সর্বপ্রকার দান-উপহারাদি গ্রহণ বর্জন করিয়াছেন, তাদৃশ ব্যক্তি কেবল শরীরদ্বারা কর্মানুষ্ঠান করিয়াও পাপভোগী হন না (কর্মবন্ধনে আবদ্ধ হন না) । ২১

যিনি প্রার্থনা ও বিশেষ চেষ্টা না করিয়া যাহা প্রাপ্ত হওয়া যায় তাহাতেই সন্তুষ্ট থাকেন, যিনি দ্বন্দ্বসহিষ্ণু, মাৎসর্য্যশূন্য সুতরাং বৈরবিহীন, যিনি সিদ্ধি ও অসিদ্ধি তুল্য জ্ঞান করেন, তিনি কর্ম করিয়াও কর্মফলে আবদ্ধ হয়েন না । ২২

যিনি ফলাকাঙ্ক্ষাবর্জিত, রাগদ্বেষাদিমুক্ত, যাঁহার চিত্ত আত্মবিষয়ক জ্ঞানে নিবিষ্ট বা জ্ঞানস্বরূপ ব্রহ্মে অবস্থিতি, যিনি যজ্ঞার্থ (অর্থাৎ ঈশ্বর-প্রীত্যর্থ যজ্ঞস্বরূপ) কর্ম করেন, তাঁহার কর্মসকল ফলসহ বিনষ্ট হইয়া যায়, ঐ কর্মের কোন সংস্কার থাকে না (অর্থাৎ তাহার কর্ম বন্ধনের কারণ হয় না) । ২৩


অর্পণ (স্রুবাদি-যজ্ঞপাত্র) ব্রহ্ম, ঘৃতাদি ব্রহ্ম, অগ্নি ব্রহ্ম, যিনি হোম করেন তিনিও ব্রহ্ম, এইরূপ জ্ঞানে ব্রহ্মরূপ কর্মে একাগ্রচিত্ত পুরুষ ব্রহ্মই প্রাপ্ত হন । ২৪

অন্য কোন কোন যোগিগণ দৈবযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন, অপর কেহ কেহ ব্রহ্মরূপ অগ্নিতে (পূর্বোক্ত ব্রহ্মার্পণ রূপ) যজ্ঞদ্বারাই যজ্ঞার্পণ করেন (অর্থাৎ সর্বকর্ম ব্রহ্মে অর্পণ করেন) । ২৫

অন্যে সংযমরূপ অগ্নিতে চক্ষুকর্ণাদি ইন্দ্রিয়সমূহকে হোম করেন অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গুলিকে রূপরসাদি বিষয় হইতে প্রত্যাহার করিয়া সংযতেন্দ্রিয় হইয়া অবস্থান করেন, ইহার নাম সংযম-যজ্ঞ বা ব্রহ্মচর্য; অন্যে ইন্দ্রিয়রূপ অগ্নিতে শব্দাদি বিষয়সমূহকে আহুতি দেন - অর্থাৎ ইন্দ্রিয়সমূহ শব্দাদি বিষয় গ্রহণ করিতেছে, কিন্তু তিনি রাগদ্বেষশূন্যচিত্তে অনাসক্তভাবে থাকেন । মুমুক্ষু নির্লিপ্ত সংসারীরা এই যজ্ঞ করেন; ইহাকে বলা যায় ইন্দ্রিয়-যজ্ঞ । ২৬

অন্য কেহ (ধ্যানযোগিগণ) সমস্ত ইন্দ্রিয়-কর্ম ও সমস্ত প্রাণকর্ম ব্রহ্মজ্ঞানে প্রদীপিত আত্মসংযম বা সমাধিরূপ যোগাগ্নিতে হোম করেন অর্থাৎ পঞ্চ জ্ঞানেদ্রিয়, পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় ও পঞ্চ প্রাণ - ইহাদের সমস্ত কর্ম নিরোধ করিয়া আত্মানন্দসুখে মগ্ন থাকেন । ইহার নাম আত্মসংযম বা সমাধি যজ্ঞ । ২৭

কেহ কেহ দ্রব্যদানরূপ যজ্ঞ করেন, কেহ কেহ তপোরূপ যজ্ঞ করেন, কেহ কেহ যোগরূপ যজ্ঞ করেন, কোন কোন দৃঢ়ব্রত যতিগণ বেদাভ্যাসরূপ যজ্ঞ করেন, কেহ কেহ বেদার্থপরিজ্ঞানরূপ যজ্ঞ সম্পাদন করেন । ২৮

আবার অন্য যোগিগণ অপান বায়ুতে 
প্রাণবায়ু এবং প্রাণবায়ুতে অপান বায়ু আহুতি দিয়া প্রাণ ও অপান বায়ুর গতি রোধ করিয়া প্রাণায়াম-পরায়ণ হইয়া থাকেন । ২৯

অপর কোনো-কোনো যোগী মিতাহারী হইয়া (আহার-সংযম-পূর্বক) ইন্দ্রিয়সমূহ প্রাণবায়ুতে আহুতি দেন । এই 
সকল যজ্ঞবিদ্‌গণ যজ্ঞদ্বারা পাপমুক্ত হন । ৩০

যাঁহারা অমৃত-স্বরূপ যজ্ঞাবশিষ্ট অন্ন ভোজন করেন, তাঁহারা সনাতন ব্রহ্মপদ লাভ করেন । হে কুরুশ্রেষ্ঠ! যে কোনরূপ যজ্ঞই করে না, তাহার ইহলোকই নাই, পরলোক তো দূরের কথা (অর্থাৎ ইহলোকেই তাহার কোন সুখ হয় না, পরলোকে আর কি হইবে ?) । ৩১

এইরূপ বহুবিধ যজ্ঞ ব্রহ্মের মুখে বিস্তৃত (বিহিত) আছে, এ সকলই কর্মজ অর্থাৎ কায়িক, বাচিক বা মানসিক এই ত্রিবিধ কর্ম হইতে সমুদ্ভূত বলিয়া জানিও; এইরূপ জানিলে মুক্তিলাভ করিবে । ৩২

হে পরস্তপ, দ্রব্যসাধ্য দৈব্যযজ্ঞাদি হইতে জ্ঞানযজ্ঞ শ্রেষ্ঠ; কেননা, ফল-সহিত সমস্ত কর্ম নিঃশেষে জ্ঞানে পরিসমাপ্ত হয় । ৩৩

গুরুচরণে দণ্ডবৎ প্রণামদ্বারা, নানা বিষয় প্রশ্নদ্বারা এবং গুরুসেবা দ্বারা সেই জ্ঞান লাভ কর । জ্ঞানী, তত্ত্বদর্শী গুরু তোমাকে সেই জ্ঞান উপদেশ করিবেন । ৩৪

হে পাণ্ডব, যাহা জানিলে পুনরায় এরূপ (শোকাদি জনিত) মোহ প্রাপ্ত হইবে না, যে জ্ঞানদ্বারা সমস্ত ভূতগ্রাম স্বীয় আত্মাতে এবং অনন্তর আমাতে দেখিতে পাইবে । ৩৫

যদি তুমি সমুদয় পাপী হইতেও অধিক পাপাচারী হও, তথাপি জ্ঞানরূপ তরণী দ্বারা সমুদয় পাপসমুদ্র ঊত্তীর্ণ হইতে পারিবে । ৩৬

হে অর্জুন, যেমন প্রজ্জ্বলিত অগ্নি কাষ্ঠরাশিকে ভস্মীভূত করে, তেমন জ্ঞানরূপ অগ্নি কর্মরাশিকে ভস্মসাৎ করে । ৩৭

ইহলোকে জ্ঞানের ন্যায় পবিত্র আর কিছু নাই । কর্ম-যোগে সিদ্ধ-পুরুষ সেই জ্ঞান কালসহকারে আপনিই অন্তরে লাভ করে । ৩৮

যিনি শ্রদ্ধাবান্‌, একনিষ্ঠ সাধন-তৎপর এবং জিতেন্দ্রিয়, তিনিই জ্ঞানলাভ করেন । আত্মজ্ঞান লাভ করিয়া অচিরাৎ পরম শান্তি লাভ করেন । ৩৯

অজ্ঞ, শ্রদ্ধাহীন, সংশয়াকুল, ব্যক্তি বিনষ্ট হয়, সংশয়াত্মার ইহলোকও নাই, পরলোকই নাই, সুখও নাই । ৪০

নিষ্কাম কর্মযোগের দ্বারা যাঁহার কর্ম ঈশ্বরে সমর্পিত হইয়াছে, আত্মদর্শনরূপ জ্ঞানের দ্বারা যাঁহার সকল সংশয় ছিন্ন হইয়াছে, এইরূপ অপ্রমাদী আত্মবিদ্‌ পুরুষকে কর্মসকল আবদ্ধ করিতে পারে না অর্থাৎ তিনি কর্ম করিলেও কর্মফলে আবদ্ধ হন না । ৪১


অতএব হে, ভারত, অজ্ঞাতজাত হৃদয়স্থ এই তোমার সংশয়রাশিকে আত্মজ্ঞানরূপ খড়্গদ্বারা ছেদন করিয়া নিষ্কাম কর্মযোগ অবলম্বন কর, উঠ, যুদ্ধ কর । ৪২
___________________________


১) বিবস্বান (সূর্য) হইতেই সূর্যবংশের উৎপত্তি । বিবস্বানের পুত্র মনু, মনুর পুত্র ইক্ষ্বাকু । এই বৈবস্বত মনু হইতে ৫৮তম অধস্তন পুরুষ শ্রীরামচন্দ্র ।

এই শ্লোকে যে যোগধর্মের কথা উল্লেখ করা হইল, ইহাই মহাভারতের শান্তিপর্বে কথিত নারায়ণীয় ধর্ম বা সাত্বত ধর্ম । কল্পে কল্পে এই ধর্ম কিরূপে আবির্ভূত হইয়া প্রচারিত হইয়াছে তথাত তাহার বিস্তারিত পরম্পরা দেওয়া হইয়াছে । এ-স্থলে মাত্র ব্রহ্মার সপ্তম জন্মে অর্থাৎ বর্তমান কল্পে ত্রেতাযুগের প্রথমে এই ধর্ম কিরূপে প্রচারিত হইয়াছিল, সেই পরম্পরা দেওয়া হইয়াছে ।

২) রাজর্ষি = রাজা হইয়াও যিনি ঋষি, যেমন জনকাদি । সুতরাং যাঁহারা জ্ঞানী ও কর্মী, ইহা তাঁহাদেরই অধিগম্য ।

৬) মায়া = পরমেশ্বরের অপূর্ব সৃষ্টি-কৌশল, যোগমায়া, যোগ । শঙ্কর মতে অবস্তু বা ভ্রমাত্মক কোনো কিছু (illusion) ।
পরমেশ্বরের নিজের অব্যক্ত স্বরূপ হইতে সমস্ত জগৎ নির্মাণ করিবার অচিন্ত্য শক্তিকেই গীতাতে 'মায়া' বলা হইয়াছে [তিলক] ।

অবতারতত্ত্ব :
সর্বভূতেশ্বর জন্মমৃত্যু-রহিত, প্রাণিগণের যেরূপ জন্মমৃত্যু হয়, তাঁহার সেরূপে আবির্ভাব হয় না । তিনি তাঁহার ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতিকে বশীভূত করিয়া মায়াবলে আবির্ভূত হন অর্থাৎ মায়া-শরীর ধারণ করেন [শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য] । কিন্তু ভক্তিপন্থী শ্রীধরস্বামী প্রভৃতি বলেন - উহাই তাঁহার নিত্যসিদ্ধ-চিদ্রূপ, উহা জড়রূপ নহে ।

মহাভারতে নারায়ণীয়-পর্বাধ্যায়ে যে দশ অবতারের উল্লেখ আছে তাহাতে বুদ্ধ অবতার নাই, প্রথমে হংস (swan) অবতার । পরবর্তী পুরাণসমূহে বুদ্ধ-অবতার লইয়াই দশ অবতারের গণনা হইয়াছে । ভাগবতে দ্বাবিংশ অবতারের উল্লেখ আছে, এবং এই প্রসিদ্ধ শ্লোকাংশ আছে - 'শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান পরব্রহ্ম; সমস্ত অবতার তাঁহারই অংশ ও কলা' । 

বেদান্তমতে ঈশ্বর কেবল এক নন, তিনি অদ্বিতীয়, একমেবদ্বিতীয়ম্‌, তিনিই সমস্ত, তিনি ছাড়া আর-কিছু নাই, সকলই তাঁহার সত্তায় সত্তাবান, সকলই তাঁহার মধ্যেই আছে, তিনি সকলের মধ্যেই আছেন । সুতরাং অজ আত্মার দেহ-সম্পর্ক গ্রহণ করা অসম্ভব তো নহেই, বরং সেই সম্পর্কেই জগতের অস্তিত্ব । কাজেই হিন্দুর পক্ষে অবতার-বাদ কেবল ভক্তি-বিশ্বাসের বিষয়মাত্র নহে, উহা বেদান্তের দৃঢ় ভিত্তির উপরেই প্রতিষ্ঠিত ।

৮) যুগে যুগে - তত্ত্বদবসরে, তত্তৎ সময়ে (শ্রীধর, বলদেব) যখনই ধর্মের গ্লানি হয়, তখনই অবতার; এক যুগে একাধিক অবতারও হয় । 

৯-১০) লীলা-তত্ত্বের অনুধ্যানই শ্রেষ্ঠ সাধনা
শ্রেষ্ঠ অধ্যাত্মতত্ত্ব : শ্রীভগবান অজ, অব্যয়, অব্যক্ত হইয়াও কিরূপে আত্মমায়ার দ্বারা অবতীর্ণ হন ।
দিব্য কর্মতত্ত্ব : তিনি নিষ্ক্রিয়, অকর্তা হইয়াও নির্লিপ্তভাবে কিরূপে কর্ম করেন ।
ভক্তি-তত্ত্ব : তিনি নির্গুণ হইয়াও সগুণ, অশেষকল্যাণগুণোপেত, অহেতুক কৃপাসিন্ধু; লোকসংগ্রার্থ, লোকশিক্ষার্থ বা ভক্তবাঞ্ছাপূরণার্থ তাঁহার এই লীলা - এই তত্ত্ব ।

'অবতারের আগমনের নিগূঢ় ফল তাহারা ল্ভ করে, যাহারা ইহা হইতে দিব্য জম্ন ও দিব্য কর্মের প্রকৃত মর্ম বুঝিতে পারে, যাহাদের চিত্ত তাঁহার চিন্তাতেই পূর্ণ হয়, যাহারা সর্বতোভাবে তাঁহার আশ্রয় গ্রহণ করে, যাহারা জ্ঞানের দ্বারা শুদ্ধ হইয়া এবং নিম্ন প্রকৃতি হইতে মুক্ত হইয়া দিব্য সত্তা ও দিব্য প্রকৃতি লাভ করে ।' [শ্রীঅরবিন্দের গীতা]

১১) গীতার এই শ্লোকটির তাৎপর্য বুঝিলে প্রকৃতপক্ষে ধর্মগত-পার্থক্য থাকে না, হিন্দুর হৃদয়ে ধর্মবিদ্বেষ থাকিতে পারে না । হিন্দুর নিকট কৃষ্ণ, খ্রীষ্ট, বুদ্ধ সকলেই এক । 

'ইহাই প্রকৃত হিন্দুধর্ম । হিন্দুধর্মের তুল্য উদার ধর্ম আর নাই - আর এই শ্লোকের তুল্য উদার মহাবাক্য আর নাই ।' [বঙ্কিমচন্দ্র]

১৩) অব্যয় - অবিকারী (নীলকন্ঠ) । তিনি নির্গুণ হইয়াও সগুণ, ‘নির্গুণো-গুণী’ । নির্গুণ বিভাবে তিনি নির্বিশেষ নিষ্ক্রিয়; সগুণবিভাবে তিনি সৃষ্টিস্থিতিপ্রলয়কর্তা । তাই তিনি কর্তা হইয়াও অকর্তা, ক্রিয়াশীল হইয়াও অবিকারী । কেহ সকামভাবে রাজসিক বা তামসিক পূজার্চনা করে, কেহ নিষ্কাম ভাবে উপাসনা করে । এরূপ কর্ম-বৈচিত্র্য কেন? তুমিই ত এসব ঘটাও ? - না, প্রকৃতিভেদবশতঃ এইরূপ হয় । প্রকৃতিভেদ অনুসারে বর্ণভেদ বা কর্মভেদ আমি করিয়াছি - কিন্তু আমি উহার কর্তা হইলেও উহাতে লিপ্ত হই না বলিয়া আমি অকর্তা । জীবেরও এই তত্ত্ব জানিয়া নিষ্কামভাবে স্বধর্ম পালন করা উচিত । মুমুক্ষু ব্যক্তিগণ পূর্বে এই ভাবেই কর্ম করিযাছেন ।  

চতুর্বর্ণের উৎপত্তি

১৪) শ্রীভগবান্‌ আদর্শ কর্মযোগী, তাঁহার নির্লিপ্ততা ও নিস্পৃহতা বুঝিতে পারিলে মনুষ্য নিষ্কাম কর্মের মর্ম বুঝিতে পারে, তাহার কর্ম নিষ্কাম হয় । সুতরাং কর্ম করিয়াও সে কর্মবন্ধন হইতে মুক্ত হয় ।

১৬) কর্ম - বিহিত কর্ম; বিকর্ম - অবিহিত কর্ম; অকর্ম - কর্মশূন্যতা; কর্মত্যাগ, কিছু না করিয়া তুষ্ণীম্ভাব অবলম্বন । 

১৮) কর্মতত্ত্বঃ, বিকর্মতত্ত্ব, অকর্মতত্ত্ব :
কর্মতত্ত্বঃ : যিনি কর্মে অকর্ম দর্শন করেন অর্থাৎ যিনি কর্ম করিয়াও মনে করেন যে দেহেন্দ্রিয়াদি কর্ম করিতেছে, আমি কিছুই করি না, তিনিই বুদ্ধিমান্‌, কেন না কর্ম করিয়াও তিনি কর্মের ফলভোগী হন না । অর্থাৎ যিনি কর্তৃত্বাভিমান ত্যাগ করিয়া কর্ম করেন, তাঁহার কর্মও অকর্মস্বরূপ ।

বিকর্মতত্ত্বঃ : কর্ম করিয়াও তাহার ফলভোগী হন না সুতরাং নির্লিপ্ত অনহঙ্কারী কর্মযোগীর পক্ষে বিকর্মও অকর্মস্বরূপ ।

অকর্মতত্ত্বঃ : আর যিনি অকর্মে কর্ম দর্শন করেন, তিনিই বুদ্ধিমান্‌ । অনেকে আলস্যহেতু, দুঃখবুদ্ধিতে কর্তব্যকর্ম ত্যাগ করেন, কিন্তু তাহারা জানেন না এ অবস্থায় প্রকৃতির ক্রিয়া চলিতে থাকে, কর্মবন্ধ হয় না । এই যে কর্মত্যাগ বা অকর্ম ইহা প্রকৃতপক্ষে কর্ম, কেননা ইহা বন্ধনের কারণ । আবার ইহারা কর্ম ত্যাগ করিয়া মনে করেন, আমি কর্ম করি না, আমি বন্ধনমুক্ত । কিন্তু “আমি কর্ম করি” ইহা যেমন অভিমান, “আমি কর্ম করি না” ইহাও সেইরূপ অভিমান, সুতরাং বন্ধনের কারণ । ইহারা বুঝেন না যে কর্ম করে প্রকৃত, ‘আমি’ নহে । বস্তুতঃ ‘আমি’ ত্যাগ না হইলে কেবল কর্মত্যাগে বন্ধন-মুক্ত হওয়া যায় না । সুতরাং এইরূপ অকর্ম বা কর্মত্যাগও বন্ধনহেতু বলিয়া প্রকৃতপক্ষে কর্মই ।

১৯) নিষ্কাম কর্ম দিব্য কর্ম, ভাগবৎ কর্ম ! ‘আমি করিতেছি’ এইরূপ কর্তৃত্বাভিমান যাঁহার নাই, তিনি কর্ম করিয়াও তাহার ফলভাগী হন না । অহং-বুদ্ধিত্যাগই প্রকৃত জ্ঞান । এই জ্ঞানরূপ অগ্নিদ্বারা তাঁহার কর্মের ফল দগ্ধ হইয়াছে, তাঁহার কর্মের ফলভাগিত্ব বিনষ্ট হইয়াছে । এইরূপ ব্যক্তিই কর্মে অকর্ম অর্থাৎ কর্মশূন্যতা দেখেন । 

২৩) যজ্ঞতত্ত্ব :
বৈদিক যজ্ঞাদি লইয়াই হিন্দুধর্মের আরম্ভ । যজ্ঞমাত্রেরই মূল তাৎপর্য হইতেছে ত্যাগ এবং ত্যাগের ফলস্বরূপ ভোগ - দিব্যভোগ ('অমৃতমশ্নুতে') । নৃযজ্ঞ, ভূতযজ্ঞ প্রভৃতি স্মার্ত-যজ্ঞগুলি সকলই ত্যাগমূলক । প্রাচীনকালে যজ্ঞই ঈশ্বর-আরাধনার প্রধান অঙ্গ ছিল । কালক্রমে এই সকল যজ্ঞবিধি অতি জটিল ও বিস্তৃত হইয়া পড়ে ।

বেদের ব্রাহ্মণভাগে বিবিধ যাগযজ্ঞাদির বিস্তৃত বিবরণ আছে । বৈদিক ক্রিয়াকর্ম ও বৈদিক মন্ত্রের দুইটি অঙ্গ ছিল - (i)বাহ্য, আনুষ্ঠানিক; (ii)আভ্যন্তরীণ, আধ্যাত্মিক । বাহ্য অনুষ্ঠানটি প্রকৃতপক্ষে কোনো আধ্যাত্মিক গূঢ়-তত্ত্বেরই রূপক বা প্রতীকরূপে ব্যবহৃত হইত । যেমন সোমরস = অমৃত/অমরত্ব/ভূমানন্দের প্রতীক; ধান = ধনের প্রতীক; দূর্বা = দীর্ঘায়ুর প্রতীক । দূর্বার মৃত্যু নাই, রৌদ্রে পুড়িয়া, বর্ষায় পচিয়া গেলেও আবার গজাইয়া উঠে । উহার আর এক নাম 'অমর' । সুতরাং ধান-দূর্বা মস্তকে দেওয়ার অর্থ - ধনেশ্বর হও, চিরায়ু লাভ কর । বস্তুত, হিন্দুদিগের পূজার্চনা, আচার-অনুষ্ঠান সমস্তই রূপক বা প্রতীক-তান্ত্রিক (symbolic) ।

ক্রমে ব্রহ্মবিদ্যা বা জ্ঞানমার্গের প্রভাবে বৈদিক যাগযজ্ঞাদি গৌণ বলিয়া বিবেচিত হইতে লাগিল এবং জ্ঞানযজ্ঞ/ব্রহ্মযজ্ঞই শ্রেষ্ঠ যজ্ঞ বলে নির্ধারিত হইল । তাহার পর ভাগবত-ধর্ম ও ভক্রিমার্গের প্রচার হইলে পুরাণাদি-শাস্ত্রে জপযজ্ঞ/নামযজ্ঞেরই প্রাধান্য দেওয়া হইয়াছে । শ্রীগীতায়ও ভগবান দ্রব্যযজ্ঞ হইতে জ্ঞানযজ্ঞেরই শ্রেষ্ঠতা দিয়াছেন । বস্তুত ভারতীয় ধর্মচিন্তার ক্রমবিকাশ ও সম্প্রসারণের সঙ্গে-সঙ্গে যজ্ঞশব্দের অর্থ ও তাৎপর্য সম্প্রসারিত হইয়াছে । গীতায় এই সম্প্রসারণের সকল স্তরই স্বীকার করা হইয়াছে এবং যজ্ঞের যে মূলতত্ত্ব ত্যাগ, ঈশ্বরার্পণ, নিষ্কামতা তাহা যুক্ত করিয়া সবগুলিই মোক্ষপ্রদ করিয়া দেওয়া হইয়াছে ।

২৪) যিনি কর্মে ও কর্মের অঙ্গসকলে ব্রহ্মই দেখেন, তিনি ব্রহ্মত্বই প্রাপ্ত হন - ‘ব্রহ্মবিদ ব্রহ্মৈব ভবতি’ । 
জ্ঞানীর কর্ম ব্রহ্মকর্ম :
যিনি যজ্ঞ করিতে বসিয়া স্রুবাদি (হবিঃ-অর্পণ করিবার জন্য হাতা) কিছু দেখিতে পান না, সর্বত্রই ব্রহ্ম দর্শন করেন, ব্রহ্ম ব্যতীত আর-কিছু ভাবনা করিতে পারেন না, ব্রহ্মে একাগ্রচিত্ত সেই যোগী পুরুষ ব্রহ্মই প্রাপ্ত হন । এই স্থলে 'যজ্ঞ'-শব্দ রূপার্থক; বস্তুত জ্ঞানীর কর্মকেই এখানে যজ্ঞরূপে কল্পনা করা হইয়াছে । ইহাই কর্মযোগের শেষ কথা, এই অবস্থায় কর্ম জ্ঞানে পরিসমাপ্ত হয় । এই জন্যই বলা হইয়াছে, 'সাংখ্যগণ যে স্থান লাভ করেন, কর্মযোগীও তাহাই প্রাপ্ত হন' [৫|৫] । যাঁহারা 'সাংখ্যযোগ ও কর্মযোগকে পৃথক বলেন তাঁহারা অজ্ঞ' [৫|৪] । 'সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম' (এ-সমস্তই ব্রহ্ম), 'অহং ব্রহ্মাস্মি' (আমি ব্রহ্ম), ইত্যাদি শ্রুতিবাক্য এই জ্ঞানই প্রচার করিয়াছেন । জীবের অহংবুদ্ধি যখন সম্পূর্ণ বিদূরিত হয়, তখনই এই পূর্ণ একত্বের জ্ঞান আবির্ভূত হয় । তখন জ্ঞাতা-জ্ঞেয়, উপাস্য-উপাসক, কর্তা-কর্ম-করণ এইসকল ভেদবুদ্ধি থাকে না; সর্বত্রই এক তত্ত্ব, এক শক্তিই আবির্ভূত হয় । এইরূপ জ্ঞানে যিনি কর্ম করিতে পারেন, জীবনযাপন করিতে পারেন, তাঁহার কর্ম-বন্ধন কি ? তিনি তো মুক্ত পুরুষ ।

কর্মভক্তিজ্ঞান - এই তিন মার্গেরই শেষ ফল অদ্বয় তত্ত্বোপলব্ধি, পার্থক্য প্রারম্ভে ও সাধনাবস্থায় ।
  1. কর্মীর আরম্ভ লোকরক্ষার্থ বা ঈশ্বরপ্রীত্যর্থ নিষ্কাম কর্মে;
  2. ভক্তের আরম্ভ নিষ্কাম উপাসনায়;
  3. জ্ঞানমার্গী সাধকগণ প্রারম্ভ হইতেই অদ্বৈতভাবে চিন্তা করেন ।
বিশিষ্ট চিন্তা :
প্রকৃত পক্ষে জ্ঞানমার্গী সাধকগণদের কোনো উপাসনা নাই, কেননা সকলই যখন ব্রহ্ম, তখন কে কাহার উপাসনা করিবে ? কেবল ব্রহ্মচিন্তাই তাঁহাদের উপাসনা, তাই এই উপাসনার নাম 'বিশিষ্ট চিন্তা' । ইহা ত্রিবিধ -
  1. অঙ্গাববিদ্ধ উপাসনা = যজ্ঞের অঙ্গবিশেষকে ব্রহ্ম ভাবনা করা ।
  2. প্রতীক উপাসনা = যাহা ব্রহ্ম নয়, তাহাকে ব্রহ্ম-ভাবনা, যেমন মনকে ব্রহ্ম ভাবিয়া উপাসনা করা ।
  3. অহংগ্রহ = আত্মা ব্রহ্ম হইতে অভিন্ন, আমিই ব্রহ্ম ('অহং ব্রহ্মাস্মি') - এইরূপ ভাব-সাধনা ।
২৫-২৭) 'যজ্ঞ' শব্দ রূপকার্থে ব্যবহৃত হইয়াছে । যজ্ঞের লাক্ষণিক অর্থ গ্রহণ করিয়া বিভিন্ন সাধন-প্রণালী বর্ণিত হইয়াছে :-
  1. দৈবযজ্ঞ : ইন্দ্র-বরুণাদি দেবতার উদ্দেশে
  2. ব্রহ্মার্পণ যজ্ঞ বা জ্ঞানযজ্ঞ : ব্রহ্মাগ্নিতে জীবাত্মার আহুতি
  3. সংযমযজ্ঞ : ব্রহ্মচর্য অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গুলিকে রূপরসাদি-বিষয় হইতে প্রত্যাহার
  4. ইন্দ্রিয়যজ্ঞ : ইন্দ্রিয়রূপ অগ্নিতে শব্দাদি-বিষয়সমূহের আহূতি (নির্লিপ্ত সংসারী)
  5. আত্মসংযম বা সমাধি-যজ্ঞ : আত্মাতে চিত্তকে একাগ্র করা (ধ্যানযোগিগণ)
প্রাণকর্মাণি - প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান, সমান - মনুষ্য শরীরে এই পঞ্চপ্রাণ আছে :-
  1. প্রাণবায়ুর কর্ম : বহির্নয়ন
  2. অপান বায়ু্র কর্ম : অধোনয়ন
  3. ব্যান বায়ু্র কর্ম : আকুঞ্চন ও প্রসারণ
  4. উদান বায়ু্র কর্ম : ঊর্দ্ধনয়ন
  5. সমান বায়ুর কর্ম : ভুক্তপদার্থের পরিপাক-করণ
২৮) এই শ্লোকে পাঁচ প্রকার যজ্ঞের কথা বলা হইল :-
  1. দ্রব্যযজ্ঞ : দ্রব্যত্যাগরূপ যজ্ঞ । পূর্বের দৈবযজ্ঞ ও ব্রহ্মার্পণ যজ্ঞও দ্রব্যযজ্ঞ । উহা শ্রৌত কর্ম, আর বাপী-কূপাদি খনন, দেবমন্দির প্রতিষ্ঠা, অন্নসত্র দান ইত্যাদি স্মার্ত-কর্ম । এ-সকল এবং পুষ্পপত্র-নৈবেদ্যাদি দ্বারা পূজার্চনা সমস্তই দ্রব্যযজ্ঞ ।
  2. তপোযজ্ঞ : কৃচ্ছ্র-চান্দ্রায়ণাদি উপবাস ব্রত
  3. যোগযজ্ঞ : অষ্টাঙ্গ যোগ বা রাজযোগ - যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি ।
  4. স্বাধ্যায়-যজ্ঞ : ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করিয়া শ্রদ্ধাপূর্বক যথাবিধি বেদাভ্যাস
  5. বেদজ্ঞান-যজ্ঞ : যুক্তিদ্বারা বেদার্থ নিশ্চয় করা
২৯) প্রাণবায়ু = হৃদয় হইতে যে বায়ু বাহিরে আসে; অপান বায়ু = বাহির হইতে যে বায়ু হৃদয়ে প্রবেশ করে ।
প্রাণায়াম : প্রাণ = প্রাণবায়ু, আয়াম = নিরোধ; অর্থাৎ প্রাণবায়ুর নিরোধ । ইহা তিন প্রকার - (i)পূরক, (ii)রেচক, (iii)কুম্ভক ।

পূরক প্রাণায়াম : প্রশ্বাস দ্বারা অপান বায়ুকে শরীর-ভিতরে প্রবেশ করাইলে প্রাণবায়ুর গতি রোধ হয়, ইহাই অপানে প্রাণের আহুতি; ইহাতে অন্তর বায়ুতে পূর্ণ হয় ।

রেচক প্রাণায়াম : নিঃশ্বাস দ্বারা প্রাণবায়ুকে শরীর থেকে নিঃসারণ করিলে অপান বায়ুর অন্তঃপ্রবেশরূপ গতিরোধ হয়, অর্থাৎ বাহিরের বায়ু ভিতরে প্রবেশ করিতে পারে না, ইহাই প্রাণে অপানের আহুতি; ইহাতে অন্তর বায়ুশূন্য হয় ।

কুম্ভক প্রাণায়াম : প্রাণ ও অপানের গতি রোধ করিয়া অর্থাৎ রেচন-পূরণ পরিত্যাগ-পূর্বক বায়ুকে শরীরের মধ্যে নিরুদ্ধ করিয়া অবস্থিতি করেন । এইরূপ কুম্ভকে শরীর স্থির হইলে ইন্দ্রিয়সমূহ প্রাণবায়ুতে লয় হইয়া যায়, ইহাই প্রাণে ইন্দ্রিয়সমূহের আহুতি ।

৩০) একথার তাৎপর্য এই যে, যজ্ঞই সংসারের নিয়ম । প্রত্যেকের কর্তব্য সম্পাদন দ্বারা, পরস্পরের ত্যাগ স্বীকার দ্বারা, আদান-প্রদান দ্বারাই জগৎ চলিতেছে এবং উহাতেই প্রত্যেকের সুখ-স্বাতন্ত্র্য অব্যাহত আছে । যে এই বিশ্ব-যজ্ঞ ব্যাপারে যোগদান করে না, যজ্ঞস্বরূপে স্বীয় কর্তব্য সম্পাদন করে না, তাহার ইহকাল ও পরকাল উভয়ই বিনষ্ট হয়, তাহার জীবন ব্যর্থ হয় । 

৩১) যজ্ঞাবশিষ্ট দ্রব্যকে অমৃত বলে । এ-স্থলে ইহা রূপকার্থক । যজ্ঞস্বরূপ কৃত নিষ্কাম কর্মদ্বারাই মোক্ষ লাভ হয় ।

৩৪) পরিপ্রশ্নেন - আমি কে ? আমার সংসার-বন্ধন কেন ? কিরূপে বন্ধনমুক্ত হইব ? ইত্যাদি প্রশ্ন দ্বারা ।

৩৭) 'ইহা দ্বারা মোটেই বুঝায় না যে, যখন জ্ঞান সম্পূর্ণ হয় তখন কর্ম বন্ধ হইয়া যায়' - [শ্রী অরবিন্দ]

পারমার্থিক জ্ঞান কি ? যাহা দ্বারা সর্বভূত এবং স্বীয় আত্মা অভিন্ন বোধ হয় এবং তারপর বোধ হয় সেই আত্মা শ্রীভগবানেরই সত্ত্বা, - আমি, সর্বভূত, যাহা কিছু তাঁহার সত্তায়ই সত্তাবান, তাঁহারই আত্ম-অভিব্যক্তি, তিনিই সকলের মূল [গী|৪|৩৫] । শ্রদ্ধা দ্বারাই অতীন্দ্রিয় এই পারমার্থিক জ্ঞানলাভ হয়, ভক্তি-বিশ্বাসই জ্ঞানের ভিত্তি ।

প্রাকৃত/লৌকিক জ্ঞান কি ? চক্ষু-কর্ণাদি ইন্দ্রিয় দ্বারা, বুদ্ধিবিচার দ্বারা নানা বিষয়ে আমরা যে জ্ঞানলাভ করি । ইহাতে শ্রদ্ধার প্রয়োজন হয় না । এই সকল নিম্নস্তরের সত্যের সহিত মিথ্যা মিশ্রিত থাকে, সংশয়বুদ্ধিতে পরীক্ষা করিয়া (scientific method) মিথ্যা হইতে সত্যকে পৃথক করিয়া লইতে হয় ।

৪০) যে অজ্ঞ, অর্থাৎ যাহার শাস্ত্রাদির জ্ঞান নাই, এবং যে সদুপদেশ লাভ করে নাই এবং যে শ্রদ্ধাহীন অর্থাৎ সদুপদেশ পাইয়াও যে তাহা বিশ্বাস করে না এবং তদনুসারে কার্য্য করে না, সুতরাং যে সংশয়াত্মা - অর্থাৎ যাহার সকল বিষয়েই সংশয় - এইটি কি ঠিক, না ঐটি ঠিক, - এইরূপ চিন্তায় যে সন্দেহাকুল তাহার অত্মোন্নতির কোন উপায় নাই । 

৪১) অর্থাৎ - জ্ঞানী কর্ম করিয়াও কর্মে আবদ্ধ হন না, সুতরাং জ্ঞানীরও কর্ম আছে, একথা স্পষ্টই বলা হইল, তবে সে কর্ম অকর্মস্বরূপ ।

রহস্য : কর্ম ও জ্ঞানে সংযোগ কিরূপে সম্ভব ? অদ্বৈত-ব্রহ্মজ্ঞানে কর্মের স্থান কোথায় ?
গতি ও স্থিতি, আলোক ও অন্ধকার যেমন একত্র থাকিতে পারে না, তদ্রূপ কর্ম ও জ্ঞানের সমুচ্চয় অসম্ভব বলিয়াই বোধ হয় । সন্ন্যাসবাদিগণ এইরূপ যুক্তিবলেই জ্ঞান-কর্মের সমুচ্চয় অস্বীকার করেন । নির্গুণ, নিষ্ক্রিয়, নির্বিশেষ ব্রহ্মও আছেন; আবার সগুণ সবিশেষ, ক্রিয়াশীল ব্রহ্মও আছেন - এই দুই বিভাব যাঁহার তিনিই পুরুষোত্তম [১৫|১৮] । 'আমিত্ব' বর্জন করিয়াও 'আমি' রাখা, জ্ঞানলাভ করিয়াও কর্ম করা - এটা অসম্ভব নহে । বস্তুত যোগিগণ সর্বদাই আবশ্যক কর্ম করেন যেমন রাজর্ষি জনকাদি, দেবর্ষি নারদাদি, ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠাদি, মহর্ষি বিশ্বমিত্রাদি, পরমহংস রামকৃষ্ণাদি । সর্বোপরি শ্রীভগবান স্বয়ং নিজ কর্মের আদর্শ দেখাইয়া, জ্ঞানিগণকে বিশ্বকর্মে আহ্বান করিয়া বলিতেছেন - 'লোকরক্ষার্থ জ্ঞানিগণও অনাসক্তচিত্তে কর্ম করিবে' । ইহার উপর আর টীকা-টীপ্পনী চলে না, দার্শনিক মতবাদ যাহাই হউক ।

৪২) তুমি যুদ্ধে অনিচ্ছুক, কারণ তোমার হৃদয়ে নানারূপ সংশয় উপস্থিত হইয়াছে । গুরুজনাদি বধ করিয়া কি পাপভাগী হইব ? আত্মীয়-স্বজনাদির বিনাশে শোক-সন্তপ্ত হইয়া রাজ্যলাভেই বা কি সুখ হইবে ? এইরূপ শোক, মোহ ও সংশয়ে অভিভূত হইয়া তুমি স্বীয় কর্তব্য বিস্মৃত হইয়াছ । তোমার এই সংশয় অজ্ঞান-সম্ভূত । যাঁহার দেহাত্মবোধ বিদূরিত হইয়াছে, সর্বভূতে একাত্মবোধ জন্মিয়াছে - তাঁহার চিত্তে এ সকল সংশয় উদিত হয় না; তিনি শোক-দুঃখে অভিভূত হন না [ঈশোপনিষৎ|৭]; ইহাই প্রকৃত জ্ঞান, তাহা পূর্বে বলিয়াছি । শ্রদ্ধা, আত্মসংযম একনিষ্ঠা - সেই জ্ঞান লাভের যে উপায় তাহাও বলিয়াছি । আমার বাক্যে তোমার শ্রদ্ধা আছে, তোমার আত্মসংযম ও একনিষ্ঠা আছে, সুতরাং তোমাকে আমি জ্ঞানোপদেশ দিতেছি । তুমি আত্মজ্ঞান লাভপূর্বক নিঃসন্দেহ হইয়া নিষ্কাম কর্মযোগ অবলম্বন কর, স্বীয় কর্তব্য পালন কর, যুদ্ধ কর । 
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : পঞ্চম অধ্যায় - সন্ন্যাসযোগ 
অর্জুন বলিলেন -
হে কৃষ্ণ ! তুমি কর্মত্যাগ ও কর্মযোগ উভয়ই বলিতেছ, এই উভয়ের মধ্যে যাহা শ্রেয়স্কর সেই একটি আমাকে নিশ্চয় করিয়া বল । ১

শ্রীভগবান্‌ কহিলেন
 -

সন্ন্যাস ও কর্মযোগ উভয়েই মোক্ষপ্রদ, কিন্তু উভয়ের মধ্যে কর্মসন্ন্যাস অপেক্ষা কর্মযোগই শ্রেষ্ঠ । ২

হে মহাবাহো, যিনি কিছু আকাঙ্ক্ষা করেন না, রাগ-দ্বেষও করেন না, তাঁহাকে নিত্যসন্ন্যাসী জানিও; তাদৃশ রাগ-দ্বেষাদি-দ্বন্দ্বশূন্য শুদ্ধচিত্ত পুরুষ অনায়াসে সংসারবন্ধন হইতে মুক্তি লাভ করেন । ৩

অজ্ঞ ব্যক্তিগণই সন্ন্যাস ও কর্মযোগকে পৃথক্‌ বলিয়া থাকেন, পণ্ডিতগণ এরূপ বলেন না । ইহার একটি সম্যক্‌ অনুষ্ঠিত হইলে উভয়ের ফল (মোক্ষ) লাভ হয় । ৪

সাংখ্যগণ যে স্থান লাভ করেন কর্মযোগিগণও সেই স্থান প্রাপ্ত হন । যিনি সন্ন্যাস ও কর্মযোগকে একরূপ দেখেন তিনিই যথার্থদর্শী । ৫

হে মহাবাহো, কর্মযোগ বিনা সন্ন্যাস কেবল দুঃখের কারণ হয় । কিন্তু কর্মযোগযুক্ত সাধক অচিরেই ব্রহ্ম সাক্ষাৎকার লাভ করেন । ৬

যিনি কর্মযোগে যুক্ত, বিশুদ্ধচিত্ত, সংযতদেহ, জিতেন্দ্রিয় এবং সর্বভূতের আত্মাই যাহার আত্মস্বরূপ, এরূপ সম্যগ্‌দর্শী পুরুষ কর্ম করিয়াও কর্মে আবদ্ধ হন না । ৭

কর্মযোগে যুক্ত তত্ত্বদর্শী পুরুষ দর্শন, শ্রবণ, স্পর্শ, ঘ্রাণ, ভোজন, গমন, নিদ্রা, নিঃশ্বাস গ্রহণ, কথন, ত্যাগ, গ্রহণ, উন্মেষ ও নিমেষ প্রভৃতি কার্য করিয়াও মনে করেন, - ইন্দ্রিয়সকলই ইন্দ্রিয়বিষয়ে প্রবৃত্ত হইতেছে, আমি কিছুই করিনা (ইন্দ্রিয়দ্বারা কর্ম করিলেও কর্তৃত্বাভিমান-বর্জনহেতু তাঁহার কর্মবন্ধন হয় না) । ৮,৯

যিনি ব্রহ্মে সমুদয় কর্ম স্থাপনপূর্বক ফলাসক্তি ও কর্তৃত্বাভিমান ত্যাগ করিয়া কর্ম করেন, তিনি পাপে লিপ্ত হন না, যেমন পদ্মপত্র জলসংসৃষ্ট থাকিয়াও জলদ্বারা লিপ্ত হয় না । ১০

কর্মযোগিগণ ফলকামনা ও কর্তৃত্বাভিনিবেশ পরিত্যাগ করিয়া চিত্তশুদ্ধির নিমিত্ত কেবল শরীর, মন, বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয়াদি দ্বারা কর্ম করিয়া থাকেন । ১১

নিষ্কাম কর্মযোগিগণ কর্মফল ত্যাগ করিয়া সর্বদুঃখ-নিবৃত্তিরূপ স্থিরা শান্তি লাভ করেন । সকাম বহির্মুখ ব্যক্তিগণ কামনাবশতঃ ফলে আসক্ত হইয়া বন্ধনদশা প্রাপ্ত হন । ১২

জিতেন্দ্রিয় পুরুষ (কর্মযোগী) মনে মনে সমস্ত কর্ম ত্যাগ করিয়া নবদ্বারমুক্ত দেহে সুখে বাস করেন, তিনি কিছু করেন না, অন্যকেও কিছু করান না । ১৩
 

প্রভু (আত্মা) লোকের কর্তৃত্ব করেন না, কর্ম সৃষ্টি করেন না, সুখদুঃখরূপ কর্মফলসন্বন্ধও রচনা করেন না, কিন্তু প্রকৃতিই কর্মে প্রবৃত্ত হয় । ১৪

সর্বব্যাপী আত্মা কাহারও পাপ বা পুণ্য গ্রহণ করেন না; অজ্ঞান কর্তৃক জ্ঞান আচ্ছন্ন থাকে বলিয়া জীব মোহপ্রাপ্ত হয় । ১৫

কিন্তু যাহাদের আত্ম-বিষয়ক জ্ঞানদ্বারা সেই অজ্ঞান বিনষ্ট হয় তাহাদিগের সেই আত্মজ্ঞান সূর্যবৎ পরম তত্ত্বকে প্রকাশ করিয়া দেয়, অর্থাৎ সূর্য যেরূপ তমোনাশ করিয়া সমস্ত বস্তু প্রকাশিত করেন, সেইরূপ আত্মজ্ঞান জীবের সমস্ত মোহ দূর করিয়া পরম পুরুষকে প্রকাশ করিয়া দেয় । ১৬

যাঁহাদের নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি সেই পরম পুরুষেই নিবিষ্ট হইয়াছে, তাহাতেই যাঁহাদের আত্মভার, তাহাতেই যাঁহাদের নিষ্ঠা, তিনিই যাঁহাদের পরমগতি এবং অনুরক্তির বিষয়, তাঁহাদের আর পুনরায় দেহধারণ করিতে হয় না, কারণ জ্ঞানের দ্বারা তাঁহাদের সংসার-কারণ অজ্ঞান দূরীভূত হইয়াছে । ১৭

বিদ্যাবিনয়যুক্ত ব্রাহ্মণে, চণ্ডালে, গো, হস্তী ও কুক্কুরে আত্মবিৎ পণ্ডিতগণ সমদর্শী । ১৮

যাহাদিগের মন সাম্যে অবস্থিত অর্থাৎ সর্ববিষয়ে বৈষম্য-রহিত, তাহারা ইহলোকে থাকিয়াই এই জনন-মরণ-রূপ সংসার অতিক্রম করেন; যেহেতু, ব্রহ্ম সম ও নির্দোষ, সুতরাং সেই সমদর্শী পুরুষগণ ব্রহ্মেই অবস্থিতি করেন অর্থাৎ ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হন । ১৯

ঈদৃশ ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তি স্থিরবুদ্ধি, সর্বপ্রকার মোহ-বর্জিত এবং ব্রহ্মেই অবস্থিত অর্থাৎ ব্রহ্মভাবে ভাবিত; সুতরাং তিনি প্রিয়বস্তু লাভেও হৃষ্ট হন না, অপ্রিয় সমাগমেও উদ্বিগ্ন হন না (তিনি শুভাশুভ, প্রিয়াপ্রিয় ইত্যাদি দ্বন্দ্ববর্জিত) । ২০

বাহ্যবিষয়ে অনাসক্ত, ব্রহ্মে সমাহিতচিত্ত পুরুষ আত্মায় যে আনন্দ আছে তাহা লাভ করেন, তিনি অক্ষয় আনন্দ উপভোগ করেন । ২১

বিষয়ভোগজনিত যে সকল সুখ সে সকল নিশ্চয়ই দুঃখের হেতু এবং আদি ও অন্তবিশিষ্ট (ক্ষণস্থায়ী, অনিত্য), বিবেকী ব্যক্তি উহাতে রত হন না । ২২

যিনি দেহত্যাগ করিবার পূর্বে এই সংসারে থাকিয়াই কামক্রোধজাত বেগ প্রতিরোধ করিতে পারেন, তিনিই যোগী, তিনিই সুখী পুরুষ । ২৩

যাঁহার অন্তরে (আত্মাতেই) সুখ, যাঁহার অন্তরে (আত্মাতেই) আরাম ও শান্তি,  যাঁহার অন্তরেই আলোক, সেই যোগী ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হন । ২৪

যাঁহারা নিষ্পাপ, সংশয়শূন্য, সংযতচিত্ত, সর্বভূতহিতে রত, সেইরূপ ঋষিগণ ব্রহ্মনির্বাণ প্রাপ্ত হন । ২৫

কামক্রোধবিমুক্ত, সংযতচিত্ত আত্মদর্শী যতিগণের ব্রহ্মনির্বাণ নিকটেই, চারিদিকেই বর্তমান অর্থাৎ তাঁহারা ব্রহ্মনির্বাণের মধ্যেই বাস করেন । ২৬

বাহ্যবিষয়সমূহ মন হইতে বহিষ্কৃত করিয়া; - চক্ষুর্দ্বয়কে ভ্রূমধ্যে স্থাপন করিয়া, প্রাণ ও অপান বায়ুর ঊর্ধ্ব ও অধো গতি সমান করিয়া, উহাদিগকে নাসামধ্যে রাখিয়া যিনি ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধিকে সংযত করিযাছেন এবং যিনি মোক্ষপরায়ণ, ইচ্ছাভয়ক্রোধবর্জিত ও আত্মমননশীল - তিনি সর্বদাই মুক্ত । ২৭,২৮

মুক্ত যোগিপুরুষ আমাকে যজ্ঞ ও তপস্যাসমূহের ভোক্তা, সর্বলোকের মহেশ্বর এবং সর্বলোকের সুহৃদ্‌ জানিয়া পরম শান্তি লাভ করেন । ২৯
___________________________


৩) নিত্যসন্ন্যাসী = সংসারে থাকিয়া কর্মানুষ্ঠানকালেও সন্ন্যাসী

৬) শ্রীভগবান কর্ম রাখিলেন, যজ্ঞও রাখিলেন বটে, কিন্তু উহার অর্থের সম্প্রাসরণ করিলেন, ফলাকাঙ্ক্ষা বর্জিত করিয়া মীমাংসকের স্বর্গপ্রদ কাম্যকর্মকে মোক্ষপ্রদ বিশুদ্ধ নিষ্কাম কর্মে পরিণত করিলেন, সঙ্গে-সঙ্গে কর্তৃত্বাভিমান-বর্জন ও সমত্ব-বুদ্ধির উপদেশ দিয়া কর্মকে জ্ঞানের সহিত সংযুক্ত করিয়া ব্রহ্মকর্ম বা বিশ্বকর্মে পরিণত করিলেন । জ্ঞান-কর্ম-ভক্তিমিশ্র যোগধর্ম - ইহা সম্পূর্ণই গীতার নিজস্ব ।

১০) ব্রহ্মণি আধায় : ব্রহ্মে কর্ম স্থাপন বা নিক্ষেপ করিয়া । ব্রহ্ম বলিতে অক্ষর নিষ্ক্রিয় পুরুষ বুঝায় । তাঁহাতে কর্মস্থাপন কিরূপ ? দেহ থাকিলে প্রকৃতির কর্ম চলিবেই, কিন্তু সেই কর্মে কোনো সংস্কার থাকিবে না - ইহাই ব্রহ্মজ্ঞানে অবস্থিত মুক্ত পুরুষের কর্ম । অজ্ঞানীর কর্ম স্থাপিত হয় অহং-এর উপর, জ্ঞানীর অহং-অভিমান না থাকাতে তাঁহার কর্ম স্থাপিত হয় ব্রহ্মের উপর ।

পুরুষোত্তম ও ব্রহ্ম ঠিক এক কথা নহে । পুরুষোত্তমে সগুণ-নির্গুণ দুই ভাবই আছে - অক্ষর ব্রহ্ম পুরুষোত্তমের নির্গুণ বিভাব । পুরুষোত্তমে কর্ম অর্পণই কর্মযোগের উদ্দেশ্য । ব্রহ্মে কর্ম স্থাপন, ঈশ্বরে কর্ম-সমর্পণের সহায়ক অনুষঙ্গী অবস্থা, কিন্তু দুইটি ঠিক এক নহে ।
The reposing of the work in the Impersonal (ব্রহ্মণি) is a means of getting rid of the personal egoism (অহংবুদ্ধি) of the doer, but the end is to give up all our actions to that great Lord of all (সর্বভূত-মহেশ্বর) - Essays on the Gita, Sri Aurobindo.

১৩) নবদ্বারে পুরে : দেহ নবদ্বারযুক্ত পুরী সদৃশ - দুই চক্ষু, দুই কর্ণ, দুই নাসারন্ধ্র, মুখ, পায়ু ও উপস্থ ।

মনস্য সংন্যস্য : মনে-মনে ত্যাগ করিয়া - অর্থাৎ কার্যত ত্যাগ নহে । কর্মযোগীর কার্য কিরূপে হয় তাহাই এখানে বলা হইতেছে । তাঁহার দেহাদি কার্য করিতেছে; কিন্তু তিনি ত দেহ নন, তিনি দেহী অর্থাৎ আত্মা । আত্মা নির্লিপ্ত, তিনি কিছু করেন না, তাঁহার কর্মজনিত বিক্ষেপ নাই, তিনি সুখে দেহমধ্যে অবস্থিত আছেন ।

১৫) আত্মতত্ত্ব ও ঈশ্বরতত্ত্ব :
এই অধ্যায়ের ১৩-১৪-১৫ শ্লোকে বর্ণিত তত্ত্বগুলি মূলত সাংখ্যশাস্ত্রের । সাংখ্যদর্শন নিরীশ্বর; উহার মূলে দুইটি তত্ত্ব - নিষ্ক্রিয় পুরুষ আর ক্রিয়াশীল প্রকৃতি । বেদান্তদর্শনের পরিভাষায় সাংখ্যের নিষ্ক্রিয় পুরুষ বা আত্মাই নির্গুণ ব্রহ্ম, আর প্রকৃতি হইতেছেন মায়া বা অজ্ঞান । মায়াতত্ত্ব অনুযায়ী এক ব্রহ্মই সত্য । বেদান্তে ব্রহ্মের নির্গুণ-সগুণ দুই বিভাবেরই বর্ণনা আছে এবং গীতাও তাহাই অনুসরণ করিয়াছেন । শ্রীগীতা অনুযায়ী অজ্ঞান অর্থ জ্ঞানের অভাব বা ভ্রান্ত জ্ঞান । ঈশ্বরই পরতত্ত্ব, পরমাত্মা, পুরুষোত্তম । সাংখ্যের পুরুষ ও প্রকৃতি তাঁরই পরা ও অপরা প্রকৃতি, শক্তি বা বিভাব ।

১৮) আপাততঃ বিষম বস্তুতে সমদর্শন হয় কখন ? যখন আত্মস্বরূপ বা ব্রহ্মস্বরূপ দর্শন হয় । আত্মজ্ঞানের ফলই সমত্ব । আত্মদর্শী পণ্ডিতগণ জগৎকে ব্রহ্ম-দৃষ্টিতে দেখেন । এই ব্রহ্মই নারায়ণ পদবাচ্য । তাঁহাদের দৃষ্টিতে ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল, পাপী, পুণ্যবান, গাভী, হস্তী, কুক্কুর সকলই নারায়ণ ।

২৪, ২৫, ২৯) অভিতঃ : ব্রহ্মনির্বাণ ইঁহাদিগের হস্তস্তিত এই অর্থ । The Nirvana in the Brahman exists all about them (অভিতঃ বর্ততে), for it is the Brahma-consciousness in which they live . - Sri Aurobindo.

ব্রহ্মনির্বাণম্‌ : ব্রহ্মে নিবৃত্তি বা লয় । মায়াধীন জীবচৈতন্যের, উচ্চতর অন্তরাত্মাতে নীচের অহঙ্কার বা 'আমি'র লয় - The extinction of the ego in the higher spiritual inner Self. - Sri Aurobindo.

ব্রহ্মনির্বাণ লাভ করিয়াও ঋষিগণ সর্বভূতহিত-সাধনে নিযুক্ত থাকেন [গী|৫|২৫] । 'এই অধ্যায়ের আরম্ভে কর্মযোগকে শ্রেষ্ঠ স্থির করিয়া আবার ২৫শ শ্লোকে বলা হইয়াছে যে, জ্ঞানী পুরুষ সকল প্রাণীর হিতসাধনে প্রত্যক্ষভাবে মগ্ন থাকেন, ইহা হইতেই প্রকাশ পাইতেছে যে, এই সমস্ত বর্ণনা কর্মযোগী জীবন্মুক্তেরই, সন্ন্যাসীর নহে ।' - লোকমান্য তিলক (গীতারহস্য)

'সংসার ও সংসারের কাজের সহিত নির্বাণের কোনো বিরোধই নাই । কারণ, যে সকল ঋষি এই নির্বাণ লাভ করিয়াছেন তাঁহারা ক্ষরজগতের মধ্যে ভগবানকে দেখিতে পান এবং কর্মের দ্বারা তাঁহার সহিত নিবিড়ভাবে সংযুক্ত থাকেন, তাঁহারা সর্বভূতের হিতসাধনে নিযুক্ত থাকেন । ... ক্ষর পুরুষের লীলাকে তাঁহারা পরিত্যাগ করেন নাই, দিব্যলীলায় পরিণত করিয়াছেন ।' - শ্রীঅরবিন্দের গীতা ।

নির্বাণবাদ : নির্বাণ শব্দটি বৌদ্ধধর্ম-প্রসঙ্গে বিশেষ পরিচিত । এই নির্বাণবাদকে অনেকে শূন্যবাদও বলেন । বেদান্তের নির্বিশেষ ব্রহ্মতত্ত্ব বুঝাইতেও 'শূন্য' শব্দ বহু শাস্ত্রগ্রন্থে (মৈত্রায়ণী উপনিষদ, উত্তরগীতা, তেজবিন্দু উপনিষদ, শিবসংহিতা ইত্যাদি) ব্যবহৃত হইয়াছে ।

নির্গুণ নির্বিশেষ পরতত্ত্ব মনে ধারণা করা যায় না, বাক্যে প্রকাশ করা যায় না । তাহা কথায় ব্যক্ত করিতে হইলে 'শূন্য' কথাটিই উপযোগী হয়; উহা অবস্তু বা অভাবাত্মক কিছু নহে । এই কারণেই বৌদ্ধদর্শনেও ধারণার অতীত অজ্ঞেয় পরতত্ত্বকে 'শূন্য' বলিয়া নির্দেশ করা হইয়াছে । ইহা প্রকৃতপক্ষে নাস্তিক্যবাদ নয় । বৌদ্ধের 'শূন্য', আর গুণশুন্য (নির্গুণ) ব্রহ্ম প্রায় এক কথাই । গীতায় ব্রহ্মনির্বাণ বা ব্রাহ্মীস্থিতিই সাধনার চরম কথা বা মোক্ষ নহে । পুরুষোত্তম স্বয়ং ভগবানের স্বরূপ জ্ঞান এবং তাঁহাতে পরাভক্তিই গীতার শেষ কথা ।

'এই অবস্থা ব্রহ্মভূত হওয়ারও পরের অবস্থা । গীতায় স্থানে-স্থানে ব্রাহ্মীস্থিতি, ব্রহ্মনির্বাণ প্রভৃতির যে উল্লেখ আছে, ইহা সাধনার খুব উচ্চ অবস্থা বটে, কিন্তু সাধকের চরম নহে । গীতা তাহারও পরের অবস্থা বর্ণনা করিয়াছেন । বেদান্তদর্শন জীবকে ব্রহ্মলোক অবধি লইয়া গিয়াছেন - গীতা কিন্তু জীবকে ঈশ্বরের সহিত মিলিত করিয়া দিয়াছেন ।' - 'গীতায় ঈশ্বরবাদ', বেদান্তরত্ন হীরেন্দ্রনাথ দত্ত ।

'But the Gita is going to represent the Iswara, the Purushottama, as higher even than the still and immutable Brahma (সম, শান্ত, অক্ষর ব্রহ্ম) and the loss of the ego in the Impersonal (ব্রহ্মনির্বাণ) comes in the beginning only as a great and initial step towards union with Purushottama. This is the Supreme Divine, God, who possesses both the infinite and the finite and in whom the personal and the Impersonal, the one self and the many existences... are united.' - Essays on the Gita, Sri Aurobindo.

'পূর্ণযোগের দ্বারা পুরুষোত্তমের সহিত জীবাত্মার মিলনই গীতার সম্পূর্ণ শিক্ষা নহে । এই জ্ঞানের পথে কেবল অক্ষর ব্রহ্মের সহিত মিলনের যে সঙ্কীর্ণতম মত, তাহা গীতার শিক্ষা নহে । এই জন্যই গীতা প্রথমে জ্ঞান ও কর্মের সামঞ্জস্য করিয়া পরে দেখাইতে পারিয়াছে যে, জ্ঞান ও কর্ম উভয়ের সহিত সমন্বিত প্রেম ও ভক্তি উত্তম রহস্য পথে চরম অবস্থা । - শ্রীঅরবিন্দের গীতা ।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : ষষ্ঠ অধ্যায় - ধ্যানযোগ 
শ্রীভগবান্‌ বলিলেন -
কর্মফলে আকাঙ্ক্ষা না করিয়া যিনি কর্তব্য-কর্ম করেন, তিনিই সন্ন্যাসী, তিনিই যোগী । যিনি যজ্ঞাদি শ্রৌতকর্ম ত্যাগ করিয়াছেন অথবা সর্ববিধ শারীরকর্ম ত্যাগ করিয়াছেন, তিনি নহেন । ১

হে পাণ্ডব, যাহাকে সন্ন্যাস বলে, তাহাই যোগ বলিয়া জানিও, কেননা, সঙ্কল্পত্যাগ না করিলে কেহই যোগী হইতে পারে না । ২

যোগে আরোহণেচ্ছু মুনির পক্ষে নিষ্কামকর্মই যোগ-সিদ্ধির কারণ, যোগারূঢ় হইলে চিত্তের সমতাই ব্রাহ্মীস্থিতিতে নিশ্চল থাকিবার কারণ । ৩

যখন সাধক সর্বসঙ্কল্প ত্যাগ করায় রূপরসাদি ইন্দ্রিয় ভোগ্যবিষয়ে এবং কর্মে আসক্ত হন না, তখন তিনি যোগারূঢ় বলিয়া উক্ত হন । ৪

আত্মার দ্বারাই আত্মাকে বিষয়কূপ হইতে উদ্ধার করিবে, আত্মাকে অবসর করিবে না (নিম্নদিকে যাইতে দিবে না) । কেননা, আত্মাই আত্মার বন্ধু এবং আত্মাই আত্মার শত্রু । ৫

যে আত্মাদ্বারা আত্মা বশীভূত হইয়াছে, সেই আত্মাই আত্মার বন্ধু । অজিতাত্মার আত্মা শত্রুবৎ অপকারে প্রবৃত্ত হয় । ৬

জিতেন্দ্রিয়, প্রশান্ত অর্থাৎ রাগদ্বেষাদিশূন্য ব্যক্তির পরমাত্মা শীত-গ্রীষ্ম, সুখ-দুঃখ, অথবা মান-অপমান প্রাপ্ত হইলেও সমাহিত থাকে (অর্থাৎ অবিচলিতভাবে আপন সম-শান্ত-স্বরূপে অবস্থান করে) । ৭

যাঁহার চিত্ত শাস্ত্রাদির উপদেশজাত জ্ঞান ও উপদিষ্ট তত্ত্বের প্রত্যক্ষ অনুভূতির দ্বারা পরিতৃপ্ত, যিনি বিষয়-সন্নিধানেও নির্বিকার ও জিতেন্দ্রিয়, মৃৎপিণ্ড পাষাণ ও সুবর্ণখণ্ডে যাঁহারা সমদৃষ্ট, ঈদৃশ যোগীকে যুক্ত (যোগসিদ্ধ) বলে । ৮

সুহৃৎ, মিত্র, শত্রু, উদাসীন, মধ্যস্থ, দ্বেষ্য, বন্ধু, সাধু ও অসাধু - এই সকলের প্রতি যাঁহার সমান বুদ্ধি, তিনিই প্রশংসনীয় অর্থাৎ তিনি সর্ববিষয়ে সকলের প্রতি রাগদ্বেষশূন্য, তিনিই শ্রেষ্ঠ । ৯


যোগী একাকী নির্জন স্থানে থাকিয়া সংযতচিত্ত, সংযতদেহ, আকাঙ্ক্ষাশূন্য ও পরিগ্রহশূন্য হইয়া চিত্তকে সতত সমাধি অভ্যাস করাইবেন । ১০

পবিত্র স্থানে নিজ আসন স্থাপন করিবে; আসন যেন অতি উচ্চ অথবা অতি নিম্ন না হয় । কুশের উপরে ব্যাঘ্রাদির চর্ম এবং তাহার উপর বস্ত্র পাতিয়া আসন প্রস্তুত করিতে হয়; সেই আসনে উপবেশন করিয়া চিত্ত ও ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়া সংযমপূর্বক মনকে একাগ্র করিয়া আত্মশুদ্ধির জন্য যোগ অভ্যাস করিবে । ১১,১২

শরীর (মেরুদণ্ড), মস্তক ও গ্রীবা সরলভাবে ও নিশ্চলভাবে রাখিয়া সুস্থির হইয়া আপনার নাসাগ্রবর্তী আকাশে দৃষ্টি রাখিবে, এদিক্‌ ওদিক্‌ তাকাইবে না; (এইরূপে উপবেশন করিয়া) প্রশান্ত-চিত্ত, ভয়বর্জিত, ব্রহ্মচর্যশীল হইয়া মনঃসংযমপূর্বক মৎপরায়ণ মদ্গতচিত্ত হইয়া সমাধিস্থ হইবে । ১৩,১৪

পূর্বোক্ত প্রকারে নিরন্তর মনঃসমাধান করিতে করিতে মন একাগ্র হইয়া নিশ্চল হয় । এইরূপ স্থিরচিত্ত যোগী নির্বাণরূপ পরম শান্তি লাভ করেন । এই শান্তি আমাতেই স্থিতির ফল । ১৫

হে অর্জুন, কিন্তু যিনি অত্যধিক আহার করেন অথবা যিনি একান্ত অনাহারী, তাঁহার যোগ হয় না; অতিশয় নিদ্রালু বা অতিজাগরণশীলের যোগসমাধি হয় না । ১৬

যিনি পরিমিতরূপ আহার-বিহার করেন, পরিমিতরূপ কর্মচেষ্টা করেন, পরিমিতরূপে নিদ্রিত ও জাগ্রত থাকেন, তাঁহার যোগ দুঃখনিবর্তক হয় । ১৭

যখন চিত্ত বিশেষরূপে নিরুদ্ধ হইয়া আত্মাতেই অবস্থিতি করে, তখন যোগী সর্বকামনাশূন্য হয় । ঈদৃশ যোগী পুরুষই যোগসিদ্ধ বলিয়া কথিত হন । ১৮

নির্বাত-প্রদেশে স্থিত দীপশিখা যেমন চঞ্চল হয় না, আত্মবিষয়ক যোগাভ্যাসকারী সংযতচিত্ত যোগীর অচঞ্চল চিত্তের উহাই দৃষ্টান্ত । ১৯

যে অবস্থায় যোগাভ্যাসদ্বারা নিরুদ্ধ চিত্ত উপরত (সর্ববৃত্তিশূন্য, নিষ্ক্রিয়) হয় এবং যে অবস্থায় আত্মাদ্বারা আত্মাতেই আত্মাকে দেখিয়া পরিতোষ লাভ হয় (তাহাই যোগ শব্দ বাচ্য জানিও) । ২০

যে অবস্থায় ইন্দ্রিয়ের অগোচর, কেবল শুদ্ধ বুদ্ধিগ্রাহ্য যে নিরতিশয় সুখ (আত্মানন্দ) যোগী তাহাই অনুভব করেন এবং যে অবস্থায় স্থিতি লাভ করিয়া আত্মস্বরূপ হইতে বিচলিত হন না, তাহাই যোগশব্দবাচ্য জানিবে । ২১

যে অবস্থা লাভ করিলে যোগী অন্য কোন লাভ ইহার অপেক্ষা অধিক সুখ-কর বলিয়া বোধ করেন না এবং যে অবস্থায় স্থিতি লাভ করিলে মহাদুঃখেও বিচলিত হন না (তাহাই যোগশব্দবাচ্য জানিবে) । ২২

এইরূপ অবস্থায় (চিত্তবৃত্তিনিরোধে) দুঃখসংযোগের বিয়োগ হয়, এই দুঃখ-বিয়োগই যোগশব্দবাচ্য । এই যোগ নির্বেদশূন্য চিত্তে অধ্যবসায় সহকারে অভ্যাস করা কর্তব্য । ২৩

সংকল্পজাত কামনাসমূহকে বিশেষরূপে ত্যাগ করিয়া, মনের দ্বারা (চক্ষুরাদি) ইন্দ্রিয়সমূহকে বিষয় ব্যাপার হইতে নিবৃত্ত করিয়া, ধৈর্য্যযুক্ত বুদ্ধিদ্বারা মন ধীরে ধীরে নিরুদ্ধ করিবে এবং এইরূপ নিরুদ্ধ মনকে আত্মাতে নিহিত করিয়া (আত্মাকারবিশিষ্ট করিয়া) কিছুই ভাবনা করিবে না । ২৪,২৫

মন স্বভাবতঃ চঞ্চল, অতএব অস্থির হইয়া উহা যে যে বিষয়ে ধাবিত হয়, সেই সেই বিষয় হইতে উহাকে প্রত্যাহার করিয়া আত্মাতেই স্থির করিয়া রাখিবে । ২৬

এইরূপ যোগসিদ্ধ পুরুষ চিত্তবিক্ষেপক রজোগুণবিহীন এবং চিত্তলয়ের কারণ তমোগুণ বর্জিত হইয়া ব্রহ্মভাব লাভ করেন, ঈদৃশ প্রশান্তচিত্ত যোগীকে নির্মল সমাধি-সুখ আশ্রয় করে । ২৭

এই রূপে সদা মনকে সমাহিত করিয়া নিষ্পাপ হওয়ায় যোগী ব্রহ্মানুভবরূপ নিরতিশয় সুখ লাভ করেন । ২৮

এইরূপ যোগযুক্ত পুরুষ সর্বত্র সমদর্শী হইয়া আত্মাকে সর্বভূতে এবং সর্বভূতকে আত্মাতে দর্শন করিয়া থাকেন । ২৯

যিনি আমাকে সর্বভূতে অবস্থিত দেখেন এবং আমাতে সর্বভূত অবস্থিত দেখেন, আমি তাহার অদৃশ্য হই না, তিনিও আমার অদৃশ্য হন না । ৩০

যে যোগী সমত্ববুদ্ধি অবলম্বনপূর্বক সর্বভূতে ভেদজ্ঞান পরিত্যাগ করিয়া সর্বভূতস্থিত আমাকে ভজনা করেন, তিনি যে অবস্থায়ই থাকুন না কেন, আমাতেই অবস্থান করেন । ৩১

হে অর্জুন, সুখই হউক, আর দুঃখই হউক, যে ব্যক্তি আত্মসাদৃশ্যে সর্বত্র সমদর্শী সেই যোগী সর্বশ্রেষ্ঠ ইহাই আমার অভিমত । ৩২

অর্জুন বলিলেন -

হে মধুসূদন, তুমি এই যে সমত্বরূপ যোগতত্ত্ব ব্যাখ্যা করিলে, মন যেরূপ চঞ্চল তাহাতে এই সমত্বভাব স্থায়ী হয় বলিয়া আমার বোধ হয় না । ৩৩

হে কৃষ্ণ, মন স্বভাবতঃই চঞ্চল, ইন্দ্রিয়াদির বিক্ষেপজনক মহাশক্তিশালী (বিচারবুদ্ধি বা কোনরূপ মন্ত্রৌষধিরও অজেয়), দৃঢ় (লৌহবৎ কঠিন, অনমনীয়); এই হেতু আমি মনে করি বায়ুকে আবদ্ধ করিয়া রাখা যেরূপ দুঃসাধ্য, মনকে নিরোধ করাও সেইরূপ সুদুষ্কর । ৩৪

শ্রীভবগান্‌ বলিলেন -

হে মহাবাহো ! মন স্বভাবতঃ চঞ্চল, উহাকে নিরোধ করা দুষ্কর, তাহাতে সংশয় নাই । কিন্তু হে কৌন্তেয়, অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা উহাকে বশীভূত করা যায় । ৩৫

অভ্যাস ও বৈরাগ্য দ্বারা যাহার চিত্ত সংযত হয় নাই তাহার পক্ষে যোগ দুষ্প্রাপ্য, ইহা আমারও মত; কিন্তু বিহিত উপায় অবলম্বন করিয়া সতত যত্ন করিলে চিত্ত বশীভূত হয় এবং যোগলাভ হইতে পারে । ৩৬

অর্জুন কহিলেন -

হে কৃষ্ণ, যিনি প্রথমে শ্রদ্ধাসহকারে যোগাভ্যাসে প্রবৃত্ত হন, কিন্তু যত্নের শিথিলতাবশতঃ যোগ হইতে ভ্রষ্টচিত্ত হওয়ায় যোগসিদ্ধি লাভে অসমর্থ হন, তিনি কি প্রকার গতি প্রাপ্ত হন ? ৩৭

হে মহাবাহো, তিনি ব্রহ্মপ্রাপ্তির উপায়ভূত যোগমার্গে অকৃতকার্য হওয়াতে মোক্ষ হইতে বঞ্চিত হন, এবং কাম্য কর্মের ত্যাগহেতু স্বর্গাদি হইতেও বঞ্চিত হন, সুতরাং ভোগ মোক্ষরূপ পুরুষার্থদ্বয় ভ্রষ্ট হইয়া, ছিন্ন মেঘখণ্ডের ন্যায় (মেঘখণ্ড যেমন মূল মেঘরাশি হইতে ছিন্ন হইয়া অপর মেঘরাশি প্রাপ্ত না হইলে মধ্যস্থলে বিলীন হইয়া যায় তদ্রুপ) নষ্ট হন না কি ? ৩৮

হে কৃষ্ণ, তুমি আমার সংশয় নিঃশেষরূপে ছেদন করিয়া দাও, কেননা, তুমি ভিন্ন আমার এই সংশয়ের অপনেতা আর কেহ নাই । ৩৯

শ্রীভগবান্‌ বলিলেন -

হে পার্থ, যোগভ্রষ্ট ব্যক্তির ইহলোকে কি পরলোকে কুত্রাপি বিনাশ নাই । কারণ, হে বৎস, শুভকর্মকারী পুরুষ কখনও দুর্গতি প্রাপ্ত হন না । ৪০

যোগভ্রষ্ট পুরুষ পুণ্যকর্মকারীদিগের প্রাপ্য স্বর্গলোকাদি প্রাপ্ত হইয়া তথায় বহু বৎসর বাস করিয়া পরে সদাচার সম্পন্ন ধনীর গৃহে জন্মগ্রহণ করেন । ৪১

পক্ষান্তরে, যোগভ্রষ্ট পুরুষ জ্ঞানবান্‌ যোগীদিগের কুলে জন্মগ্রহণ করেন । জগতে ঈদৃশ জন্ম অতি দুর্লভ (যেমন ব্যাসতনয় শুকদেবের) । ৪২

হে কুরুনন্দন, যোগভ্রষ্ট পুরুষ সেই জন্মে পূর্বজন্মের অভ্যস্ত মোক্ষবিষয়ক বুদ্ধি লাভ করেন এবং মুক্তিলাভের জন্য পুনর্বার যত্ন করেন । ৪৩

তিনি অবশ হইয়াই পূর্বজন্মের যোগাভ্যাসজনিত শুভ সংস্কারবশতঃ যোগমার্গে আকৃষ্ট হন । যিনি কেবল যোগের স্বরূপ-জিজ্ঞাসু, তিনিই বেদোক্ত কাম্যকর্মাদির ফল অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ফল লাভ করেন (যিনি যোগের স্বরূপ জানিয়া যোগাভ্যাস-পরায়ণ তাঁহার আর কথা কি ?) । ৪৪

সেই যোগী পূর্বাপেক্ষাও অধিকতর যত্ন করেন, ক্রমে যোগাভ্যাসদ্বারা নিষ্পাপ হইয়া বহু জন্মের চেষ্টায় সিদ্ধিলাভ করিয়া পরম গতি লাভ করেন । ৪৫

যোগী তপস্বিগণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, জ্ঞানিগণ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ, কর্মিগণ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ, ইহাই আমার মত; অতএব হে অর্জুন, তুমি যোগী হয় । ৪৬

যিনি শ্রদ্ধাবান্‌ হইয়া মদ্গতচিত্তে আমার ভজনা করেন, সকল যোগীর মধ্যে তিনিই আমার সহিত যোগে সর্বাপেক্ষা অধিক যুক্ত, ইহাই আমার অভিমত অর্থাৎ ভগবানে ঐকান্তিক ভক্তিপরায়ণ যোগীই শ্রেষ্ঠ সাধক । ৪৭
___________________________

১) নিরগ্নি - অগ্নিসাধ্য শ্রৌতকর্মত্যাগী । ধর্মশাস্ত্রে উক্ত আছে যে, সন্ন্যাসাশ্রমীর অগ্নি রক্ষা করিবার প্রয়োজন নাই । তিনি ‘নিরগ্নি’ হইয়া, সর্ব কর্ম ত্যাগ করিয়া ভিক্ষা দ্বারা শরীর রক্ষা করিবেন । অক্রিয় - শারীরকর্মত্যাগী অর্দ্ধমুদিতনেত্র যোগী (বলদেব) ।

২) সন্ন্যাস - কর্মযোগ - ধ্যানযোগ : গীতার মতে সন্ন্যাসের স্থূলকথা ফলসন্ন্যাস, কামনা-ত্যাগ - কেবল কর্মত্যাগ নহে । ধ্যানযোগ বা চিত্তনিরোধ-যোগেরও স্থূলকথা সঙ্কল্পত্যাগ, কামনাত্যাগ; কারণ, সঙ্কল্পই চিত্তবিক্ষেপের হেতু । আবার কর্মযোগেরও মূলকথা - কামনা ত্যাগ । সুতরাং সন্ন্যাস, ধ্যানযোগ, কর্মযোগ - এ তিনই এক, তিনেরই মূলকথা সঙ্কল্পত্যাগ, ইহারই সাধারণ নাম গীতোক্ত যোগ । সুতরাং এখানে যোগ বলিতে ধ্যানযোগ ও কর্মযোগ উভয়ই বুঝায়, বস্তুতঃ গীতার মতে ধ্যানযোগ কর্মযোগের অঙ্গীভূত ।

৩) শম = শান্তি (তিলক, শ্রীঅরবিন্দ); নিষ্কামকর্মীর আত্মসংযম-জনিত চিত্তপ্রসাদ - Calm of Self-mastery and Self-possession gained by works. - Sri Aurobindo.

৬) এখানে রূপকভাবে বলা হইয়াছে যে, আত্মার দ্বারা আত্মাকে উদ্ধার করিবে । কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আত্মা একটিই এবং সে নিজেই । সুতরাং এ কথার অর্থ এই যে, নিজেই নিজেকে প্রকৃতির বন্ধন হইতে উদ্ধার করিবে, নিজেকে অধোগামী করিবে না, জীব নিজেই নিজের শত্রু, নিজেই নিজের মিত্র ।

যোগের উদ্দেশ্য আত্মার উদ্ধার । যে পর্যন্ত মন কূটস্থ-চৈতন্যে বিলীন না হয়, সে পর্যন্ত তাহাকে সংযত করিয়া রাখিবে, ইহাই ধ্যানযোগ - ইহাই সারকথা ।

আত্মশক্তি ও কৃপাবাদ : আমাদের শাস্ত্রে দুই-রকম ধর্মোপদেশ পাওয়া যায় - (i)মায়ামুক্ত না হইলে তাঁহাকে পাওয়া যাইবে না, আবার (ii)তাঁহাকে না পাইলে মায়াও ঘুচিবে না । উভয় কথাই সত্য, উভয়ই গ্রাহ্য কারণ ইহার আগে-পরে নাই । মায়া-মুক্তি ও ঈশ্বর-প্রাপ্তি একই অবস্থা এবং ঠিক একই সময়েই হয় । এই দুই-রকম উপদেশ প্রকৃতপক্ষে দুইটি বিভিন্ন মার্গ বা সাধন-পথের সঙ্কেত ।

  • জ্ঞানমার্গের (আত্মস্বাতন্ত্র্য ও আত্মশক্তি) উপদেশ : মায়া বা অজ্ঞান দূর না হইলে সেই পরতত্ত্ব উপলব্ধ হয় না । আত্মার দ্বারা আত্মার উদ্ধার । সাধনদ্বারা প্রকৃতির রজস্তমোগুণকে দমন করিয়া শুদ্ধ সত্ত্বগুণের উদ্রেক করিয়া প্রকৃতির অতীত হওয়াই নিজেই নিজেকে উদ্ধার করিতে পারা ।
  • ভক্তিমার্গের (আত্মসমর্পণ ও কৃপাবাদ) উপদেশ : সর্বতোভাবে তাঁহার শরণ না লইলে, তাঁহার কৃপা না হইলে, মায়া দূর হইবে না । ঈশ্বরই জীবকে যন্ত্রারূঢ় পুত্তলিকার ন্যায় মায়াদ্বারা চালাইতেছেন, জীব সর্বতোভাবে তাঁহার শরণ লইলে, অনন্যভক্তিযোগে তাঁহার ভজনা করিলে ঈশ্বরই তাহাকে এমন বুদ্ধিযোগ দেন, যাহাদ্বারা সে মায়ামুক্ত হইয়া ভগবানকে পাইতে পারে ।

৯) সর্ববিষয়ে সমচিত্ততাই যোগের শ্রেষ্ঠ ফল । এই সমচিত্ততা লাভ করা অবশ্য সহজ নহে । চঞ্চল মনকে স্থির করিয়া আত্মসংস্থা করার এক বিশিষ্ট উপায় ধ্যানযোগ বা অভ্যাসযোগ ।

১৩,১৪) নাসিকাগ্রং সংপ্রেক্ষ্য - টীকাকারগণ বলেন, ঠিক নাসাগ্রই যে অবলোকন করিতে হইবে এরূপ অর্থ নহে, দৃষ্টি এদিক্‌ ওদিক্‌ না পড়ে এই জন্যই নাসাগ্রবর্তী আকাশে দৃষ্টি রাখিতে হইবে । কেহ কেহ বলেন, ইহার অর্থ ভ্রূমধ্যে দৃষ্টি রাখিয়া, কেননা নিম্নদিক হইতে ধরিলে নাসাগ্র বলিতে ভ্রূমধ্য বুঝায় । মৎপর, মচ্চিত্ত হইয়া - আমিই একমাত্র প্রিয়, বিষয়াদি নয় - এইরূপ ভাবনাদ্বারা আমাতেই চিত্ত নিবিষ্ট করিয়া ।

বিবাহিত জীবনে যোগাভ্যাস : কামোপভোগই বিবাহিত জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হইলে তাহা তো পশুজীবন । কিন্তু মুনিঋষিদের মধ্যেও স্বনামখ্যাত অনেকে বিবাহিত ছিলেন এবং সন্তানের জনকও ছিলেন । শাস্ত্রে আছে, বেদ অধ্যাপনান্তে আচার্য শিষ্যকে এইরূপ উপদেশ দিতেছেন - সত্য বলিবে, ধর্মানুষ্ঠান করিবে, সন্তানধারা অবিচ্ছিন্ন রাখিবে [তৈত্তিরিয় উপনিষদ ১|১১|১] । বংশরক্ষার জন্যই বিবাহ করার এইরূপ উপদেশ সকল ধর্মশাস্ত্রেই আছে । ঐ-উদ্দেশ্য-সাধনের জন্য বিবাহিত জীবনের কতটুকু সময় আবশ্যক ? - অতি সামান্য । বাকী সমস্ত জীবন ব্যাপিয়া সংযমের উপদেশ । এ-অনুশাসন সন্ন্যাসধর্মের চেয়ে বড় কম কঠোর নয়, এবং বিষয়ের মধ্যে থাকিয়া এইরূপ সংযম-সাধনে অধিকতর দৃঢ়তার প্রয়োজন, সন্দেহ নাই । এই হেতুই গৃহস্তের পক্ষে অবিহিত কালে (অর্থাৎ বংশরক্ষার্থ ভিন্ন অন্য সময়ে) স্ত্রী-সম্ভোগে নিবৃত্ত থাকাই ব্রহ্মচর্য [মহাভারত অনুশাসন পর্ব |১৬২; মনু |৩|৪৫, ৫০] । এই হেতু হিন্দুশাস্ত্রে বিবাহের অপর নাম উপযম (সংযম) ।

১৫) মৎসংস্থাম্‌ - আমাতেই যাহার অবস্থিতি বা সমাপ্তি (নীলকণ্ঠ); মদ্‌রূপেণ অবস্থিতাম্‌ (শ্রীধর); that has its foundation in Me (Sri Aurobindo).

২২) আত্মানন্দ পরম সুখকর, এমন কোন সুখ নাই যাহা ইহা অপেক্ষা অধিক সুখকর বলিয়া বোধ হইতে পারে, এবং এমন কোন দুঃখ নাই যাহাতে আত্মজ্ঞানীকে বিচলিত করে পারে - কেননা, তিনি আত্মারাম, বাহ্য সুখদুঃখের অতীত ।

২৩) দুঃখসংয়োগবিয়োগম্‌ - the putting away of the contact with pain, the divorce of the mind's marriage with grief (Sri Aurobindo).
নির্বেদ : এত কাল যোগাভ্যাস করিলাম, সিদ্ধিলাভ হইল না, আত কত কাল কষ্ট করিব - এইরূপ হতাশভাব (মধুসূদন) ।
অনির্বণ্ণচেতসা : নির্বেদশূন্য, শৈথিল্যরহিত চিত্তে যোগাভ্যাস কর্তব্য । 

২৪-২৬) সঙ্কল্প ও কামনা :
গীতায় সঙ্কল্প ও কামনা, উভয়ই ত্যাগ করার কথা আছে । কার্যত ব্যাপার একই, কিন্তু স্বরূপত সঙ্কল্প ও কামনার মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে ।
সঙ্কল্প = শোভনাধ্যাস, যাহা শোভন বা সুন্দর নয় তাহাকে সুন্দর বলিয়া কল্পনা করার নাম । ইহাই অজ্ঞান, ইহা হইতেই বিষয়ে অভিলাষ জন্মে; ইহাই কাম । সুতরাং কামনা সঙ্কল্পজাত ।
ধৃতিগৃহীতয়া বুদ্ধ্যা = ধৈর্যযুক্ত বুদ্ধিদ্বারা [শঙ্কর]
উপরমেৎ = উপরতি অভ্যাস করিবেন, মনের নিরোধ করিবেন - 'cease from mental action'.

সমাধি অভ্যাস :
  1. কামনা ত্যাগ - সর্বপ্রকার কামনা নিঃশেষে ত্যাগ করিতে হয় ।
  2. মনের দ্বারা ইন্দ্রিয়সংযম - মনের দ্বারা ইন্দ্রিয়সমূহকে বিষয় হইতে প্রত্যাহরণ করিতে হইবে । চক্ষু দর্শন করিতেছে, কিন্তু মন তাহাতে যোগ দিতেছে না, সুতরাং দেখিয়াও দেখা হইল না । চক্ষু নষ্ট হইলে বা মুদ্রিত করিয়া থাকিলেই ইন্দ্রিয়সংযম হয় না ।
  3. চিত্তবৃত্তি নিরোধ - সাত্ত্বিকী-বুদ্ধি ভাল-মন্দ নিশ্চয় করিয়া, নিত্যানিত্য বিচার করিয়া মনকে সৎপথে চালিত করে । সাত্ত্বিকী ধৃতিশক্তি মনকে বহির্মুখী হইতে না দিয়া ভিতরে ধারণ করিয়া রাখে । এই ধৃতিসংযুক্ত বুদ্ধিদ্বারা মনকেও অন্তর্মুখী করিয়া ক্রমে-ক্রমে চিত্তবৃত্তি নিরোধ করিতে হইবে । সহসা চিত্তবৃত্তি নিরোধের চেষ্টা করিলে মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যহানির সম্ভাবনা ।
  4. আত্মাতে বিলীন - মন নির্মল হইয়া যখন আত্মাকার প্রাপ্ত হইবে, তখনই আত্মস্বরূপ প্রতিভাত হইবে । এই অবস্থায় কোন চিন্তাই থাকিবে না, আত্মচিন্তাও নয় । কারণ চিন্তা থাকিলে মনের অতীত হওয়া যায় না । এ-অবস্থায় ধ্যাতা, ধ্যান, ধ্যেয় - জ্ঞাতা, জ্ঞান, জ্ঞেয় - সবই এক হইয়া যায় । এক আত্মস্বরূপই থাকে, চিন্তা করিবে কে ? কার ? তাই ভগবান শঙ্করাচার্য বলিয়াছেন - 'চিন্তাশূন্যতাই শ্রেষ্ঠ ধ্যান' ।
ব্রহ্মভাব : যাহা মনের অগোচর (যেমন নির্গুণ ব্রহ্ম), তাঁহার বিষয়ে চিন্তা করা যায় না । আবার যাহা চিন্তা করা যায়, যেমন বিষয়াদি, তাহাও অতত্ত্ব, অবস্তু বলিয়া চিন্তনীয় নয়; সুতরাং মন যখন আত্মচিন্তা এবং বিষয়চিন্তা, ইহার কোনো পক্ষই অবলম্বন করে না, অর্থাৎ সম্পূর্ণ নিরবলম্ব হয়, তখন ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হয় । [ব্রহ্মবিন্দু উপনিষদ |২৬]

রাজযোগ : সমাধিযোগ/নিরোধযোগ/অষ্টাঙ্গ যোগ
যোগ - যে ক্রিয়াকৌশলে মনকে (চিত্তকে) আত্মসংস্থ করিয়া আত্মস্বরূপ বিকশিত করা যায় । চিত্ত অবস্থাভেদে পাঁচ রূপ ধারণ করে - (i)ক্ষিপ্ত - এই অবস্থায় মন কামনাকুলিত হইয়া নানা বিষয়ে ধাবিত হয়; (ii)মূঢ় - এই অবস্থায় মন তমোগুণাক্রান্ত হইয়া মোহে অভিভূত হইয়া থাকে; (iii)বিক্ষিপ্ত - এই অবস্থায় মনের চঞ্চলতা থাকিলেও উহা সময়-সময় অন্তর্মুখী হইতে চেষ্টা করে, ইহা সাধনার প্রথমাবস্থা; (iv)একাগ্র - এই অবস্থায় মন লক্ষ্য বিষয়ে সুস্থির হয়; (v)নিরুদ্ধ - এই অবস্থায় চিত্ত বৃত্তিশূন্য হইয়া থাকার মতো হয়, ইহাই চরম সমাধির অবস্থা ।

যেমন সূর্যকান্তমণিসংযোগে (আতস পাথর - magnifying glass) সূর্যরশ্মিসকল দাহ্যবস্তুতে কেন্দ্রীভূত হইলে উহাকে অগ্নিময় করিয়া তোলে, সেইরূপ ইতস্তত-বিক্ষিপ্ত মন যোগদ্বারা আত্মসংস্থ হইলে উহার স্বস্বরূপ প্রকাশিত করে । রাজযোগের অষ্ট অঙ্গ - (1)যম, (2)নিয়ম, (3)আসন, (4)প্রাণায়াম, (5)প্রত্যাহার, (6)ধারণা, (7)ধ্যান, (8)সমাধি ।

যম : অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য, অপরিগ্রহ ।
অস্তেয় - পরদ্রব্য অপহরণ করিবে না, ওকথা মুখে আনিবে না, এরূপ চিন্তাও মনে স্থান দিবে না ।
অপরিগ্রহ - কোনো অবস্থায় কাহারো নিকট হইতে দান, উপহারাদি গ্রহণ না করা । দান ইত্যাদি গ্রহণে হৃদয় সঙ্কুচিত হয়, চিত্তের স্বাধীনতা বিনষ্ট হয়, মানুষ হীন হইয়া যায় । অপরিগ্রহের মূলে দুইটি গুণ - (i)স্বাবলম্বন (সাংসারিক উন্নতি), (ii)বৈরাগ্য (আধ্যাত্মিক উন্নতি) ।

নিয়ম : শৌচ (বাহ্য ও অন্তঃ), সন্তোষ, তপঃ, স্বাধ্যায়, ঈশ্বরপ্রণিধান ।
স্বাধ্যায় - মন্ত্রজপ, বেদপাঠ বা ধর্মশাস্ত্রাদির অধ্যয়ন । মন্ত্রজপ - (i)বাচিক, (ii)উপাংশু (কেবল ওষ্ঠস্পন্দন হয়, শব্দ শুনা যায় না), (iii)মানস ।
ঈশ্বরপ্রণিধান - স্মরণ-মননাদি ঈশ্বরোপাসনা (স্বামী বিবেকানন্দ), ঈশ্বরে সর্বকর্ম সমর্পণ (ব্যাসভাষ্য) ।

আসন : যাহাতে অনেকক্ষণ স্থিরভাবে স্বচ্ছন্দে বসিয়া থাকা যায় । যেমন সিদ্ধাসন, পদ্মাসন, সিংহাসন ও ভদ্রাসন । স্বস্তিকাসন সর্বাপেক্ষা সহজ । 'বক্ষঃস্থল, গ্রীবা ও মস্তক সমান রাখিয়া শরীরটাকে বেশ স্বচ্ছন্দভাবে রাখিতে হইবে ।' - স্বামী বিবেকানন্দ ।

প্রাণায়াম : (i)রেচক (বাহিরে শ্বাস ত্যাগ), (ii)পূরক (ভিতরে শ্বাস গ্রহণ), (iii)কুম্ভক (বায়ুকে শরীরের মধ্যে অথবা বাহিরে নিরুদ্ধ করিয়া রাখা) । এই সকল প্রক্রিয়া সদগুরু-উপদেশগম্য ।

প্রত্যাহার : বিষয়ে প্রবৃত্ত ইন্দ্রিয়সমূহের বলপূর্বক প্রত্যাকর্ষণের নাম ।

ধারণা : হৃৎপদ্মে, ভ্রূমধ্যে, নাসাগ্রে বা কোনো দিব্য মূর্তিতে চিত্ত আবদ্ধ রাখা । সাধারণত যোগশাস্ত্রে ধারণার ছয়টি স্থান নির্দিষ্ট করা হয় - ষট্‌চক্র ।

ধ্যান : যে বিষয়ে চিত্তকে ধারণা করা যায় সেই বিষয়ে অবিচ্ছিন্ন তৈলধারার ন্যায় চিত্তের একতান-প্রবাহের নাম ।

সমাধি : ধ্যানের পরিপক্ক অবস্থা সমাধি । দুইপ্রকার - (i)সম্প্রজ্ঞাত বা সবীজ (ধ্যেয় বস্তুর সম্যক জ্ঞান থাকে), (ii)সম্প্রজ্ঞাত বা নির্বীজ  বা নিরোধ-সমাধি (চিত্তবৃত্তি একেবারে তিরোহিত হয়, সমুদয় মানসিক ক্রিয়ার বিরাম হয়) । 

অষ্টাঙ্গ যোগ ও গীতোক্ত যোগ : 
ধারণার পরিপক্ক অবস্থা ধ্যান, ধ্যানের পরিপক্ক অবস্থা সমাধি; ধ্যান, ধারণা, সমাধি - এই তিনটি ক্রমে এক বস্তু সম্বন্ধে প্রযুক্ত হইলে তাহাকে 'সংযম' বলে [যো.সূ.|৩|৪] । এই তিনটিই যোগের অন্তরঙ্গ-সাধন, অপরগুলিই বহিরঙ্গ-সাধন [যো.সূ.|৩|৭] । যম ও নিয়ম চিত্তশুদ্ধির উপায়, উহা সকল সাধনার ভিত্তিস্বরূপ । আসন, প্রাণায়াম, মনঃ-সংযমের সহায়ক শারীরিক-প্রক্রিয়া । এই সকলই গীতাতে সাধারণভাবে স্থানে-স্থানে উল্লিখিত হইয়াছে । প্রকৃতপক্ষে, ধ্যান ও সমাধিই যোগের মূল কথা - গীতায় উহাই বিশেষরূপে উপদিষ্ট হইয়াছে । কিন্তু গীতার পূর্ণাঙ্গ যোগে কর্ম, ধ্যান, জ্ঞান, ভক্তি এই চারিটিরই সমন্বয় ।

গান্ধীবাদ ও অহিংসা :
পূর্বোক্ত যম-নিয়মের অভ্যাস নৈতিক চরিত্র-গঠনের শ্রেষ্ঠ উপায় এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির ভিত্তিস্বরূপ । মহাত্মা গান্ধীর প্রতিষ্ঠিত সত্যাগ্রহাশ্রমে বিদ্যার্থীদের এগুলি অভ্যাস করিতে হইত । সত্য-অহিংসাদির অভ্যাসে সম্যক সিদ্ধ হইলে যে যোগবল বা আত্মশক্তি লাভ হয় তাহা দ্বারাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইতে পারে । যেমন যোগশাস্ত্রে আছে 'যিনি অহিংসা সাধনে চরম সিদ্ধিলাভ করিয়াছেন, তাঁহার সম্মুখে সকল প্রাণীই বৈরভাব ত্যাগ করে' [যো.সূ.|২|৩৫] । মহাত্মা গান্ধী তাই বিশ্বাস করতেন অহিংসার প্রভাবে হিংস্র বন্যপশুও যখন হিংসা ত্যাগ করে, তখন অত্যাচারী নরপশু হইলেও অহিংসা ও ত্যাগের প্রভাবে তাহার ভাবান্তর (change of hearts) অনিবার্য । তাই তাঁর আন্দোলনের মূল কথা ছিল আত্মত্যাগ ও আত্মশুদ্ধি (self-sacrifice and self-purification).

২৭) যোগসিদ্ধির ফল নির্মল ব্রহ্মানন্দ ও সর্বত্র সমত্ববুদ্ধি ।

২৯-৩০) 'যাঁহা যাঁহা নেত্র পড়ে, তাঁহা তাঁহা কৃষ্ণ স্ফুরে ।' - [চৈ.চৈ.]
শ্রীভগবান বলিতেছেন - আমার ভক্ত কখনো আমাকে হারান না, আমিও ভক্তকে কখনো হারাই না । আমার ভক্ত সর্বত্র আমাকেই দেখেন এবং আমাতেই সমস্ত দেখেন । তিনি জগতের দিকে তাকাইলে জগৎময় আমার মূর্তিই অনুভব করেন । আবার আমার দিকে তাকাইলে তিনি দেখেন আমিই সব, আমাতেই সব । অপার সমুদ্রে যেমন তরঙ্গমালা, সেইরূপ বিধি, বিষ্ণু, শিব, শক্তি, রবি, চন্দ্র, বরুণ, যমাদি সকলই আমাতে ভাসিতেছে ।

৩১) জীবে প্রেম, স্বার্থ ত্যাগ, ভক্তি ভগবানে :
'আমাকে ভজনা করা' এবং 'সর্বভূতস্থ আমাকে ভজনা করা' - এই দুই-কথার মধ্যে কি পার্থক্য তাহা প্রণিধানযোগ্য । এই কথাটি শ্রীমদ্ভাগবতে নির্গুণভক্তিতত্ত্ব-বর্ণনা প্রসঙ্গে অতি স্পষ্টরূপে উল্লেখ করা হইয়াছে -
'আমি সর্বভূতে ভূতাত্মস্বরূপে অবস্থিত আছি । অথচ সেই আমাকে অবজ্ঞা করিয়া মনুষ্য প্রতিমাদিতে পূজারূপ বিড়ম্বনা করিয়া থাকে । সর্বভূতে অবস্থিত আত্মা ও ঈশ্বর আমাকে উপেক্ষা করিয়া যে প্রতিমাদি ভজনা করে সে ভস্মে ঘৃতাহুতি দেয় । যে প্রাণীগণের অবজ্ঞাকারী, সে বিবিধ দ্রব্য ও বিবিধ ক্রিয়াদ্বারা আমার প্রতিমাতে আমার পূজা করিলেও আমি তাহার প্রতি সন্তুষ্ট হই না । সুতরাং মানুষের কর্তব্য হইল, আমি সর্বভূতে আছি ইহা জানিয়া সকলের প্রতি সমদৃষ্টি, সকলের সহিত মিত্রতা ও দান-মানাদির দ্বারা সকলকে অর্চনা করে ।' - [ভা|৩|২৯|২১-২২, ২৪, ২৭]
সর্বজীবের সেবাই ঈশ্বরের অর্চনা । বিশ্বপ্রেমই ঈশ্বরে ভক্তি । অবশ্য ইষ্টবস্তুর উপাসনা আবশ্যক নয়, নিষিদ্ধও নয় । 'পুরুষ যে-পর্যন্ত সর্বভূতস্থিত আমাকে আপনার হৃদয়ের মধ্যে জানিতে না পারে, সে-পর্যন্ত প্রতিমা-প্রভৃতিতে আমার অর্চনা করিবে [ভা|৩|২৯|২৫] । সুতরাং সর্বদা মনে রাখিতে হইবে প্রতিমাতে কাহার অর্চনা হইতেছে এবং সে-অর্চনার উদ্দেশ্য কি । উহা বিস্মৃত হইয়া যদি প্রতীককেই ঈশ্বর করিয়া তুলি, তবে উহা জড়োপাসনায় পরিণত হয় ।
'হে দৈত্যগণ, এই বিশজগৎ বিষ্ণুর বিস্তারমাত্র । তোমরা সকলকে আপনার সঙ্গে অভেদ দেখিও । এইরূপ সমত্বদর্শনই ঈশ্বর-আরাধনা ।' [প্রহ্লাদ, বিষ্ণু পুরাণ |১|১৭|৮৪|৯০]
ইহাই বেদান্তে ব্রহ্মজ্ঞান । ইহাই যোগীর সমদর্শন, ইহাই কর্মীর নিষ্কাম কর্ম, ইহাই ভক্তের নির্গুণা ভক্তি । এই শ্লোকটিতে জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি ও যোগের অপূর্ব সমন্বয় । ইহাই গীতোক্ত পূর্ণাঙ্গযোগ । তাই শ্রীঅরবিন্দ লিখিয়াছেন, এই শ্লোকটিকে সমগ্র গীতার চরম সিদ্ধান্ত বলিয়া গ্রহণ করা যায় ।
'Whoever loves God in all and whose soul is founded upon the divine oneness, however he lives and acts, lives and acts in God - that may almost be said to sum up the whole final result of the Gita's teaching.' - Sri Aurobindo.
ঈশ্বর-সম্বন্ধে সাধারণ ধারণা এই, তিনি জীব ও জগৎ হইতে স্বতন্ত্র । তিনি জগতের পালনকর্তা, শাসনকর্তা । তিনি প্রার্থনা মঞ্জুর করেন, দণ্ড-পুরস্কার দেন, সকলকে রক্ষা করেন । সুতরাং সমাজরক্ষক পার্থিব রাজাকে যেমন ধন্যবাদ দেওয়া সম্মান করা আমাদের কর্তব্য, সেইরূপ জগৎরক্ষক ঈশ্বরকেও ভক্তি করাও আমাদের কর্তব্য । বস্তুত, সকল ধর্মেই, সকল সমাজেই, ঈশ্বরের ধারণা কতকটা এইরূপ । 'কিন্তু হিন্দুর ঈশ্বর সেরূপ নহেন । তিনি সর্বভূতময়, তিনি সর্বভূতের অন্তরাত্মা । কোনো মনুষ্য তাঁহা ছাড়া নাই । মনুষ্যকে না ভালবাসিলে তাঁহাকে ভালবাসা হইল না । যতক্ষণ না বুঝিতে পারিব যে, সকল জগৎই আমি, সর্বলোক ও আমাতে অভেদ, ততক্ষণ আমার জ্ঞান হয় নাই, ভক্তি হয় নাই, প্রীতি হয় নাই । অতএব জাগতিক প্রীতি হিন্দুধর্মের মূলেই আছে । অচ্ছেদ্য, অভিন্ন, জাগতিক প্রীতি ভিন্ন হিন্দুত্ব নাই । মনুষ্য-প্রীতি ভিন্ন ঈশ্বরভক্তি নাই । ভক্তি ও প্রীতি হিন্দুধর্মে অভিন্ন ।' - বঙ্কিমচন্দ্র ।

৩২) বেদান্ত, বিশ্বপ্রেম ও হিতবাদ :
'আজকাল অনেকের মতে নীতির ভিত্তি হিতবাদ (utility) অর্থাৎ যাহাতে অধিকাংশ লোকের অধিক পরিমাণে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য হইতে পারে তাহাই নীতির ভিত্তি । ইহাদিগকে জিজ্ঞাসা করি, আমরা এই ভিত্তির উপর দণ্ডায়মান হইয়া নীতি পালন করিব, তাহার হেতু কি ? যদি আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়, তাহা হইলে কেননা আমি  অধিকাংশ লোকের অত্যধিক অনিষ্ট সাধন করিব ?
... অবশ্য নিঃস্বার্থপরতা কবিত্বহিসাবে সুন্দর হইতে পারে, কিন্তু কবিত্ব তো যুক্তি নহে, আমাকে যুক্তি দেখাও, কেন আমি নিঃস্বার্থপর হইব । হিতবাদিগণ (utilitarians) ইহার কি উত্তর দিবেন ? তাঁহারা তখন কিছুই উত্তর দিতে পারেন না ।' - স্বামী বিবেকানন্দ ।

বস্তুত ইহার উত্তর হিন্দু ভিন্ন, হিন্দুর বেদান্ত ভিন্ন আর কেহ দিতে পারে না । 'লোকসমূহের প্রতি অনুরাগবশত লোকসমূহ প্রিয় হয় না, আত্মার প্রতি (আপনার প্রতি) অনুরাগবশতই লোকসমূহ প্রিয় হয় । সর্বভূতের প্রতি অনুরাগবশত সর্বভূত প্রিয় হয় না, আত্মার প্রতি (আপনার প্রতি) অনুরাগবশতই সর্বভূত প্রিয় হয় ।' - [বৃহদারণ্যক উপনিষদ |৪|৫|৬]

তুমি অপরকে, তোমার শত্রুকেও ভালবাসিবে কেন ? কারণ তুমি তোমার আত্মাকে অর্থাৎ আপনাকে ভালবাসে বলিয়া । তুমিই সেই - 'তত্ত্বমসি' । এই তত্ত্বই হিন্দু-ধর্মনীতির ভিত্তি । তাই হিন্দুধর্ম কেবল হিন্দুর ধর্ম নহে, উহা বিশ্বমানবের ধর্ম, সনাতন বিশ্বধর্ম ।

'প্রহ্লাদকে যখন হিরণ্যকশিপু জিজ্ঞাসা করিলেন, শত্রুর সঙ্গে রাজার কি রকম ব্যবহার করা কর্তব্য ? প্রহ্লাদ উত্তর করিলেন, শত্রু কে ? সকলই বিষ্ণু-(ঈশ্বর)ময়, শত্রু-মিত্র কি প্রকারে প্রভেদ করা যায় ? প্রীতিতত্ত্বের এইখানে একশেষ হইল; এবং এই এক কথাতেই সকল ধর্মের উপর হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠতা প্রতিপন্ন হইল মনে করি ।' - বঙ্কিমচন্দ্র ।

The highest and purest morality is the immediate consequence of the Vedanta. The Gospels fix correctly as the highest law of morality - 'Love your neighbour as yourself'. But why should I do so, since by the order of nature, I feel pain and pleasure only in myself and not in my neighbour ? The answer is not in the Bible, but it is in the Vedas - in the great formula - 'That thou art' (তৎ ত্বম্‌ অসি), which gives in three words metaphysics and morals together.' - [Dr. Paul Deuseen,1,2]

'The Vedanta gives profoundly-based reasons for charity and brotherliness.' - [Sir John Woodroffe1]

দয়া ও মায়া :
প্রশ্নঃ আত্মজ্ঞ যোগী দ্বন্দ্ববর্জিত পুরুষ । তিনি সুখদুঃখের অতীত । তিনি জীবের সুখদুঃখে অভিভূত হইবেন কিরূপে ? সে তো তাঁহার অধঃপতন, আধ্যাত্মিক অপমৃত্যু । আর জগতের দুঃখের পসরা নিজের মাথায় লইয়া তাঁহার স্বস্তি কোথায় ? সমদর্শনের কি এই ফল ? কেবল দুঃখের মাত্রা বৃদ্ধি ?

উত্তরঃ কথাটা ধরেছ ভাল, কিন্তু তা হলে ঈশ্বরের মতো দুঃখী বোধ হয় আর কেহ নাই । তাঁহাকে 'দয়াময়' বলা হয়, জীবের দুঃখে দুঃখিত না হইলে তিনি দয়াময় হন কিরূপে ? স্মরণ রাখিতে হইবে, এ-স্থলে বদ্ধ জীবের কথা হইতেছে না, এ হইতেছে জীবন্মুক্ত যোগীর কথা যিনি প্রকৃতির মধ্যে থাকিয়াও, সুখদুঃখের মধ্যে থাকিয়াও সেই পরম পুরুষেই অবস্থান করেন । তাঁহার আর পতনের সম্ভাবনা কোথায় ? তাঁহার সংসারে থাকার একমাত্র উদ্দেশ্য জীবের যাহাতে দুঃখমোচন হয়, জীব যাহাতে সুখী হয়, তাহাই করা । তিনি নির্লিপ্তভাবে, নিষ্কামভাবে সেই কর্মই করেন - সময়-সময় সুখদুঃখের অভিনয়ও করেন - কিন্তু সে অভিনয় মাত্র, তিনি অভিভূত হন না । তাঁহার দয়া আছে, তিনি জড়পিণ্ড নহেন, কিন্তু তাঁহার মায়া নাই, অর্থাৎ সুখদুঃখাদি যে প্রকৃতির ধর্ম, তাহাতে তিনি বদ্ধ হন না । অবতারগণ, মহাপুরুষগণ, জনকাদি রাজর্ষিগণ - ইঁহারা সকলেই এইরূপেই জীবের সঙ্গে হাসিয়া-কাঁদিয়া লীলাখেলা করিয়াছেন, জীবের দুঃখমোচনের চেষ্টা করিয়াছেন । নরেন্দ্রাদি অন্তরঙ্গ ভক্তের জন্য শ্রীরামকৃষ্ণের এত ব্যাকুলতা কেন ? সে দয়া, মায়া নহে । জীবের দুঃখে গৌতম গৃহত্যাগী, শ্রীচৈতন্য সন্ন্যাসী । সে-ও দয়া, মায়া নহে ।

৩৫) অভ্যাস ও বৈরাগ্য :
অভ্যাসে দুঃসাধ্য কার্যও সুসাধ্য হয় । স্বভাব অভ্যাসেরই ফল । শারীরিক অভ্যাস অপেক্ষা মানসিক অভ্যাসের ফল আরও অদ্ভুত । আমাদের মনে যে কোনো চিন্তা-প্রবাহ উদিত হয়, তাহাই একটি সংস্কার রাখিয়া যায় । এই সংস্কারগুলির সমষ্টিই আমাদের স্বভাব । আমাদের বর্তমান স্বভাব পূর্ববর্তী অভ্যাসের ফল । আমাদের পরবর্তী স্বভাব হইবে বর্তমান অভ্যাসের ফল । সুতরাং সৎস্বভাব গঠন করিতে হইলে সর্বদা সৎচিন্তা ও সৎকর্মের অভ্যাস কর্তব্য । যোগ কতকগুলি সদভ্যাসের অনুশীলন মাত্র, এই জন্য ইহাকে অভ্যাসযোগ বলে । কিসের অভ্যাস ? প্রধানত বহির্মুখী চঞ্চল মনকে অন্তর্মুখী করিয়া আত্মসংস্থ করিবার অভ্যাস ।

৪০) যোগাভ্যাসের যে কোনরূপ চেষ্টামাত্রই শুভকর্ম । সম্পূর্ণ সিদ্ধি লাভ না হওয়াতে তাহার পুনর্জন্ম নির্ধারিত হয় না বটে, কিন্তু শুভকর্মজনিত অন্যরূপ শুভফল তিনি প্রাপ্ত হন, তাহার সদ্গতিই লাভ হয় ।

৪১) যিনি বিষয়-ভোগে বিরত হইয়া যোগাভ্যাসে রত ছিলেন, তিনি পরজন্মে ধনীর গৃহে যান কেন ? - তাহার সম্পূর্ণ বিষয়বৈরাগ্য জন্মে নাই বলিয়া, মৃত্যুকালে ভোগবাসনা বলবতী ছিল বলিয়া । কিন্তু যাঁহার মৃত্যুকালে তীব্র বৈরাগ্য ও মোক্ষেচ্ছা বর্তমান থাকে, তাঁহার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ গতি হয়, তাহা পরবর্তী শ্লোকে বলিতেছেন ।

৪৬) তপস্বী = 'যাঁহারা কৃচ্ছ্রসাধ্য চান্দ্রায়ণাদি-ব্রতনিষ্ঠ' ।
কর্মী = যাঁহারা স্বর্গাদি-ফলকামনায় যাগযজ্ঞাদি কাম্য-কর্ম করেন ।
পরোক্ষ জ্ঞানী = যাঁহার কেবল শাস্ত্রজ্ঞান আছে, আত্মা, জীব, জগৎ এ-সব কি তাহা শাস্ত্রানুশীলনে বুঝিয়াছেন, কিন্তু আত্মানুভব হয় নাই ।
অপরোক্ষ জ্ঞানী = যাঁহার প্রত্যক্ষ আত্মদর্শন হইয়াছে ।
এ-স্থলে জ্ঞানী অপেক্ষা যোগী শ্রেষ্ঠ বলায় শাস্ত্রজ্ঞানী বা পরোক্ষ জ্ঞানীকেই লক্ষ্য করা হইয়াছে ।
এ-স্থলে 'যোগী' = কর্মযোগী, 'জ্ঞানী' = সাংখ্যজ্ঞানী সন্ন্যাসী [গীতারহস্য, লোকমান্য তিলক]

৪৭) নির্গুণ ব্রহ্মজ্ঞানে কর্ম ও ভক্তির স্থান কিরূপে সম্ভব ?
উঃ অক্ষর ব্রহ্ম সম, শান্ত, নিষ্ক্রিয়, নির্বিকার - তিনি কর্মে লিপ্ত নন, কর্ম করে প্রকৃতি, উহাই মায়া বা অজ্ঞান; সুতরাং কর্ম অজ্ঞান-প্রসূত, উহার সহিত জ্ঞানের সমুচ্চয় হয় না এবং অচিন্ত্য, অব্যক্ত, নির্গুণ ব্রহ্মে ভক্তিও সম্ভব না । গীতা পুরুষোত্তম-তত্ত্ব দ্বারা জ্ঞানবাদিগণের এ-আপত্তি খণ্ডন করিয়াছেন । গীতায় শ্রীভগবান বলিতেছেন - প্রকৃতি কর্ম করে তা ঠিক, কিন্তু প্রকৃতি আমারই প্রকৃতি - আমারই শক্তি । ক্ষর ও অক্ষর দুই-ই আমার বিভাব - আমি পুরুষোত্তম [১৫|১৬-১৮] । অহংশূন্য জীবন্মুক্তের কর্মের সহিত জ্ঞানের বিরোধ নাই, কারণ সে কর্ম তাঁহার নয়, আমারই কর্ম । আর এ-জ্ঞানের সহিত ভক্তিরও কোনো বিরোধ নাই; কেননা এ-জ্ঞান কেবল অচিন্ত্য, অব্যক্ত, অক্ষর ব্রহ্মের জ্ঞান নহে, ইহা অব্যক্ত-ব্যক্ত, নির্গুণ-গুণী 'সমগ্র' পুরুষোত্তমের জ্ঞান । তাই শ্রীভগবান বলিয়াছেন, জ্ঞানীই আমার শ্রেষ্ঠ ভক্ত, 'আমার আত্মস্বরূপ' [৭|১৭-১৮], আমাতে অব্যভিচারিণী ভক্তিই জ্ঞান [১৩|১০-১১] ।

এইরূপে গীতা কর্ম, জ্ঞান, ভক্তির সমন্বয়ে সুন্দর সম্পূর্ণ সাধনতত্ত্ব প্রচার করিয়াছেন । ইহাই গীতার পূর্ণাঙ্গযোগ । গীতোক্ত যোগী একাধারে জ্ঞানী, কর্মী ও ভক্ত । এ-যোগী নিত্যসমাহিত, নিত্যমুক্ত, - যুদ্ধ-কোলাহলে তাঁহার চিত্তবিক্ষেপের ভয় কি ? এ সমাধির অর্থ ভগবৎ-সত্তায় আপন সত্তা মিলাইয়া দেওয়া, তাঁহারই প্রেমানন্দে সর্বকামনা ভুলিয়া তাঁহারই কর্ম বাহিরে দেহেন্দ্রিয়াদি দ্বারা সম্পন্ন করা, আর অন্তরে সতত সর্বাবস্থায় তাঁহাতেই অবস্থান করা ।

এই অধ্যায়ে প্রধানতঃ ধানযোগ বা সমাধি-যোগের প্রক্রিয়া ও ধ্যানযোগীর লক্ষণ বর্ণিত হইয়াছে । এই হেতু ইহাকে ধ্যানযোগ বা অভ্যাসযোগ বলে ।

শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা : সপ্তম অধ্যায় – জ্ঞানবিজ্ঞানযোগ 
 
[ভগবৎতত্ত্ব কি, কিরূপে তদ্‌গত-চিত্ত হওয়া যায় - শ্রীভগবান্‌ স্বয়ং এই অধ্যায়ে তাহা বলিতেছেন ।]

শ্রীভগবান্‌ বলিলেন -
হে পার্থ, ভক্ত সর্বতোভাবে আমার শরণাগত হইয়া (অগ্নিহোত্রাদি যজ্ঞ, দান বা তপস্যাদি কর্মের ফলাশ্রয় না করিয়া) আমাতে মনোনিবেশ-পূর্বক যোগাভ্যাস করিলে বিভূতি, বল, শক্তি ও ঐশ্বর্যাদিসম্পন্ন পুর্ণস্বরূপে (সগুণ ও নির্গুণরূপে) আমাকে নিঃসংশয়ে যেরূপে জানিতে পারিবে, তাহা শ্রবণ কর । ১

অপরোক্ষ অনুভূতির সহিত মদ্‌বিশয়ক এই জ্ঞান নিঃশেষে তোমাকে উপদেশ দিব । স্বানুভূতির সহিত তাহা লাভ করিলে সংসারে আর অন্য কিছু জ্ঞাতব্য অবশিষ্ট থাকে না । ২

সহস্র সহস্র মনুষ্যের মধ্যে কদাচিৎ কেহ আত্মজ্ঞান লাভের জন্য প্রযত্ন করেন; আর প্রযত্নশীল মুমুক্ষুগণের মধ্যেও ক্কচিৎ কেহ আমাকে স্বরূপতঃ (স্বীও আত্মা-রূপে) জানিতে পারেন (কারণ ব্রহ্মজ্ঞানলাভ অতিশয় দুর্লভ) । ৩

ভূমি, জল, বায়ু, অগ্নি, আকাশ, মন, বুদ্ধি এবং অহঙ্কার - এই অষ্ট প্রকারে আমার ঐশ্বরী মায়াশক্তি বিভক্ত । ৪

হে মহাবাহো, ইহা আমার অনর্থকরী বন্ধনাত্মিকা নিকৃষ্টা প্রকৃতি । কিন্তু ইহা হইতে অত্যন্ত স্বতন্ত্র আমার প্রকৃষ্টা প্রকৃতি অবগত হও। জগতের অন্তঃপ্রবিষ্ট সেই জীবভূতা প্রকৃতি এই জগৎপ্রপঞ্চ ধারণ করিয়া আছেন । ৫

আমার এই উভয় প্রকৃতি হইতে জড় ও চেতন সর্বভূত উৎপন্ন হইয়াছে, ইহা ধারণা কর । অতএব আমি সমগ্র জগতের সৃষ্টি ও প্রলয়রূপ অর্থাৎ উক্ত প্রকৃতিদ্বয় দ্বারা আমি জগতের কারণস্বরূপ । ৬

হে ধনঞ্জয়, আমা অপেক্ষা জগতের অন্য শ্রেষ্ঠ কারণ নাই। যেমন সূত্রে মণিসমূহ গ্রথিত হইয়া থাকে, সেইরূপ এই পরিদৃশ্যমান জগৎ আত্মভূত আমাতে অনুস্যূত ও বিধৃত রহিয়াছে । ৭

হে কৌন্তেয়, আমি জলে রস, চন্দ্রে ও সূর্যে জ্যোতিঃ, চারি বেদে ওঁকার, আকাশে শব্দ এবং মনুষ্যমধ্যে পুরুষকাররূপে বিরাজ করি । ৮

আমি পৃথিবীতে পবিত্র গন্ধ, অগ্নিতে দীপ্তি, সর্বপ্রাণীর আয়ু ও তপস্বিগণের মধ্যে তপঃশক্তিরূপে বিরাজ করি । ৯

হে পার্থ, আমাকে স্থাবর ও জঙ্গম সকল ভূতের সনাতন কারণ বলিয়া জানিবে । আমি বিবেকিগণের নিত্যানিত্যবস্তুবিবেকরূপ বুদ্ধি এবং তেজস্বিগণের তেজঃস্বরূপ । ১০

হে ভরতকুলশ্রেষ্ঠ, আমি বলবান্‌গণের কামরাগ-বর্জিত দেহধারণের উপযোগী সামর্থ্য । ধর্মশাস্ত্রের অবিরোধী কামনা-বাসনারূপে আমি প্রাণিগণের মধ্যে বিরাজমান । ১১

প্রাণিগণের যে সকল সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক ভাব স্বকর্মফলে উৎপন্ন হয়, তাহা আমা হইতেই উৎপন্ন জানিবে । যদিও তাহারা আমা হইতে উৎপন্ন, তথাপি জীবের ন্যায় আমি সেই সকল ভাবের অধীন নহি; কিন্তু সেই সকল ভাব আমার অধীন (বশীভূত) । ১২

ত্রিগুণজাত সুখদুঃখমোহাদি ভাব দ্বারা জগতের প্রাণিসমূহ ভ্রান্ত হইয়া এই সকল ভাবের অতীত আমার অব্যয় নিরুপাধিক স্বরূপ জানিতে পারে না । ১৩

কারণ আমার এই ত্রিগুণাত্মিকা অঘটন-ঘটন-পটীয়সী মায়া অতিক্রম করা অতিশয় কষ্টকর । কিন্তু যাঁহারা ধর্মাধর্ম পরিত্যাগপূর্বক আমাকে আশ্রয় করেন এবং অন্য প্রকার সাধনের উপর নির্ভর করেন না, তাঁহারাই কেবল আমার এই দুস্তর মায়া উত্তীর্ণ হইতে পারেন, অর্থাৎ সংসার-বন্ধন হইতে মুক্ত হন । ১৪

কিন্তু যাহারা মনুষ্যগণের মধ্যে নিকৃষ্ট, সেই সকল মোহগ্রস্ত পাপকারিগণের বিবেকজ্ঞান মায়া দ্বারা অপহৃত হওয়ায় তাহারা হিংসা ও মিথ্যা ব্যবহারাদি আসুর স্বভাব আশ্রয় করে । সেইজন্য তাহারা আমার ভজনা করে না । ১৫

হে ভরতকুলগৌরব অর্জুন, আর্তিযুক্ত, তত্ত্বজিজ্ঞাসু, অর্থকামি ও তত্ত্বজ্ঞানী - এই চারি প্রকার পুণ্যকর্মা ব্যাক্তিগণ আমার ভজনা করেন । ১৬

এই চারি প্রকার ভক্তের মধ্যে নিত্যযুক্ত, আমাতে একনিষ্ঠ তত্ত্বজ্ঞানীই শ্রেষ্ঠ । আমি জ্ঞানীর অত্যন্ত প্রিয় এবং জ্ঞানীও আমার অতীব প্রিয়, কারণ তিনি মৎস্বরূপপ্রাপ্ত । ১৭

ইঁহারা সকলেই মহান্‌ এবং সকলেই আমার প্রিয় । কোন ভক্তই আমার অপ্রিয় নহেন; কিন্তু জ্ঞানী আমার অত্যন্ত প্রিয়; কারণ জ্ঞানী আমার আত্মস্বরূপ - ইহা আমার নিশ্চয় । বাসুদেবে সমাহিতচিত্ত জ্ঞানী উৎকৃষ্ট গতিস্বরূপ আমাকেই আশ্রয় করিয়া থাকেন, অর্থাৎ 'আমি ভগবান্‌ বাসুদেব হইতে স্বরূপতঃ অন্য নহি' - এই বুদ্ধি জ্ঞানীর সর্বদা দৃঢ় থাকে । ১৮

জ্ঞানী আমার অত্যন্ত প্রিয় । কারণ বহু জন্মের সাধন-ফলে শেষ জন্মে 'সমুদয় জীবজগৎ বাসুদেবই' (ব্রহ্মই) এইরূপ জানিয়া তিনি আমাকে নিরতিশয় প্রেমাস্পদরূপে ভজনা করেন । সেইরূপ মহাপুরূষ অতিশয় দুর্লভ । ১৯

পুত্র, অর্থ ও স্বর্গাদি লাভের কামনা দ্বারা যাঁহাদের বিবেকবুদ্ধি অভিভূত হইয়াছে, তাঁহারা জপ ও উপবাসাদি নিয়ম পালনপূর্বক স্বীয় স্বভাবানুযায়ী (বাসুদেব ভিন্ন) অন্যান্য দেবতার ভজনা করেন । ২০

যে যে ভক্ত যে যে দেবমূর্তি শ্রদ্ধার সহিত অর্চনা করেন, সেই সেই দেবমূর্তিতে আমি তাঁহাদিগকে অচলা ভক্তি প্রদান করি । ২১

সেই ভক্ত শ্রদ্ধাযুক্ত হইয়া সেই দেবতার আরাধনা করেন এবং সেই দেবতার নিকট হইতে কর্মফলদাতা আমারই দ্বারা বিহিত কাম্যবস্তু অবশ্য লাভ করেন । ২২

অল্পবুদ্ধি ব্যক্তিগণের আরাধনালব্ধ সেই ফল অস্থায়ী । ইন্দ্রাদি দেবতার উপাসকগণ স্ব স্ব দেবতাকে প্রাপ্ত হন, আর আয়াস সমান হইলেও আমার ভক্তগণ আমাকেই লাভ করিয়া মোক্ষরূপ অনন্ত ফলের অধিকারী হইয়া থাকেন । ২৩

অবিবেকিগণ আমার অব্যয় অনুপম উৎকৃষ্ট পরমাত্মস্বরূপ না জানিয়া প্রপঞ্চাতীত আমাকে লীলাবিগ্রহধারণ-অবস্থাতেই পর্যবসিত মনে করে; সেইজন্য আমার শরণাগত না হইয়া অন্য দেবতাকে ভজনা করে । ২৪

কারণ, ত্রিগুণাত্মিকা মায়া দ্বারা আবৃত বলিয়া আমি সকলের নিকট প্রকাশিত হই না; কেবলমাত্র কোন কোন ভক্তের নিকট অভিব্যক্ত হই। সেইজন্য এই মোহান্ধ জগৎ আমার জন্ম-মৃত্যুরহিত অব্যয় স্বরূপ জানিতে পারে না । ২৫

[কিন্তু আমার জ্ঞান মায়ার দ্বারা প্রতিহত নহে । অতএব -] হে অর্জুন, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত - এই তিন কালের সমস্ত ভূতকেই আমি জানি । কিন্তু (আমার শরণাগত ভক্ত ব্যতীত) কেহ আমাকে জানিতে পারে না । ২৬

কারণ হে পরন্তপ অর্জুন, ইচ্ছাদ্বেষাদি অনুকূল ও প্রতিকূল বিষয় হইতে সুখ-দুঃখাদি দ্বন্দ্ব সমুদ্ভূত হয় । এই দ্বন্দ্বজাত মোহ প্রাণীর প্রজ্ঞাকে স্ববশীভূত করিয়া ব্রহ্মজ্ঞানের প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করে । এই মোহ দ্বারা প্রাণীগণ উৎপত্তি কালে অভিভূত হয় । সেইজন্য পরমার্থ (আত্মতত্ত্ব)-বিষয়ে প্রতিবন্ধ জ্ঞান লইয়াই প্রাণীগণ জন্মগ্রহণ করে । ২৭

কিন্তু যে-সকল পুণ্যকর্মা ব্যাক্তিগণের পাপ ক্ষীণ হইয়াছে, তাঁহারা সুখ-দুঃখ ও শীতোষ্ণাদি দ্বন্দ্ব-নিমিত্তক মোহ হইতে মুক্ত হইয়া দৃঢ় নিষ্ঠার সহিত আমার ভজনা করেন । ২৮

এইরূপ যাঁহারা জরা ও মৃত্যু হইতে মুক্তিলাভের জন্য আমাকে আশ্রয় করিয়া সাধন করেন, তাঁহারা সনাতন ব্রহ্ম, সমগ্র অধ্যাত্ম ও অখিল কর্ম অবগত হন । ২৯

এবং এইরূপ যাঁহারা অধিভূত, অধিদৈব ও অধিযজ্ঞের সহিত বিদ্যমান আমার উপাসনা করেন, সেই সকল সমাহিতচিত্ত ব্যক্তি মৃত্যুকালেও আমাকে প্রত্যক্ষ করিতে সমর্থ হন । ৩০

ভগবান্‌ ব্যাসকৃত লক্ষশ্লোকী শ্রীমহাভারতের ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতারূপ উপনিষদে ব্রহ্মবিদ্যাবিষয়ক যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জুনসংবাদে জ্ঞান-বিজ্ঞান-যোগনামক সপ্তম অধ্যায় সমাপ্ত ।
_________________________________________

২) ব্রহ্মজ্ঞানলাভ হইলে সবই জ্ঞাত হয়, একবিজ্ঞানে সর্ববিজ্ঞান । যাঁহাকে জানিলে অশ্রুত শ্রুত, অমত মত ও অবিজ্ঞাত বিজ্ঞাত হয় । - [ছান্দোগ্য উপঃ, ৬|১|৩]
 
৫) প্রকৃতি বা মায়াশক্তি দ্বিবিধা - অবিদ্বা ও বিদ্বা । যেমন অবিদ্বা বন্ধন করেন, তেমনি বিদ্বা মোক্ষ দেন ।
জীবভূতা : প্রাণধারণের নিমিত্তভূত ক্ষেত্র । বিদ্যাশক্তি-অবচ্ছিন্ন চেতন পুরুষকেও এখানে প্রকৃতি বলা হইয়াছে । ভোক্তৃত্ব আছে বলিয়া অপরা প্রকৃতি হইতে ইঁহার শ্রেষ্ঠত্ব । - [আনন্দগিরি] 

৬) অপরা প্রকৃতি অচেতন এবং জীব অল্পজ্ঞ বলিয়া সৃষ্টিকার্যে উভয়েই অসমর্থ ।
৭) ব্রহ্মের সমান বা অধিক কোন সত্তা সমাধিতে দৃষ্ট হয় না । - [শ্বেতাশ্বতর উপঃ, ৬|৮]


১১) কাম = অপ্রাপ্ত বস্তুর প্রাপ্তি-ইচ্ছা
রাগ = প্রাপ্ত বস্তুর নশ্বরতা সত্ত্বেও তাহার চিরস্থায়িত্তে বিশ্বাসপূর্বক তাহাকে ভালবাসা

১২) সাত্ত্বিক ভাব = শমদমাদি; রাজসিক ভাব = হর্ষাদি; তামসিক ভাব = শোক-মোহাদি

১৪) আমার মায়া দ্বারা সাংখোক্ত স্বতন্ত্র প্রকৃতি নিষিদ্ধ হইয়াছে । - [শ্বেতাশ্বতর উপঃ, ৪|১০]
অনুভবসিদ্ধা মায়া; অকস্মাৎ ইহাকে অস্বীকার করা যায় না । আবার জ্ঞানোদয়ে দেখা যায় না । - [আনন্দগিরি]
 
১৫) অসুর = যাহারা ইন্দ্রিয়তৃপ্তিতে সর্বদা ব্যাপৃত

১৬) আর্তি = তস্কর, রোগ ও ব্যাঘ্রাদি দ্বারা নিপীড়ন

অহৈতুকী ভক্তি = অহঙ্কারাদি হৃদয়গ্রন্থিমুক্ত আত্মজ্ঞানী মুনিগণও শ্রীভগবানে অহৈতুকী ভক্তি করিয়া থাকেন । শ্রী হরির ঈদৃশ মহিমা । - [ভাগবত, ১|৭|১০]

১৭) বাসুদেব জ্ঞানীর আত্মা, তাই তিনি জ্ঞানীর প্রিয়; জ্ঞানীও বাসুদেবের আত্মা বলিয়া বাসুদেবের প্রিয় - ভগবান ও ভক্ত আত্মতঃ অর্থাৎ স্বরুপতঃ অভিন্ন । শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন - ভাগবত, ভক্ত ও ভগবান - তিনে এক, একে তিন ।

১৯) যিনি সর্বভূতের অধিষ্ঠান এবং যিনি সকলের অনুগ্রাহকরূপে সর্বভূতে অবস্থিত, আমি সেই বাসুদেবই । 'সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম' অর্থাৎ এই চরাচর জগৎ ব্রহ্মাতিরিক্ত অন্য কিছু নহে । দৃশ্যাদৃশ্য বিশ্বজগৎ ব্রহ্মময় ।

২১) যিনি এক হইয়াও অনেকের কামনা বিধান করেন । - [কঠ উপঃ, ২|২|১৩]
 
২৫) যোগমায়া = অনাদি অনির্বাচ্য অজ্ঞান । - [আনন্দগিরি]
গুণত্রয়ের সংযোগই, সংঘটনই যোগ । যোগই মায়া । - [শঙ্করাচার্য]
অঘটনঘটনপটীয়সী মায়া - [শ্রীধরস্বামী]
আত্মার সঙ্কল্পানুবিধায়িনী মায়া - [মধুসূদন সরস্বতী]

২৭) যে ইচ্ছাদ্বেষকে বশীভূত করিতে পারে না, তাহার বাহ্য বস্তুরও যথার্থ জ্ঞান হয় না; দুর্লভ পরমাত্মজ্ঞান যে তাহার একেবারেই হয় না, ইহা বলা নিষ্প্রয়োজন । 

২৮) নিষ্ঠা : পরমার্থতত্ত্ব এই প্রকার, অন্য প্রকার নহে - এই দৃঢ় নিশ্চয়
 
৩০) কৃষ্ণ ভক্তগণ অনায়াসেই ব্রহ্মজ্ঞানলাভে সমর্থ হন - [শ্রীধরস্বামী]
সগুণ উপাসনা পরিপক্ক হইলে নির্গুণ উপাসনায় পর্যবসিত হয় । সবিকল্প সমাধিলাভের পর সহজেই নির্বিকল্প সমাধিলাভ হয় । এই জন্য প্রবর্তকের পক্ষে নির্গুণ ধ্যান বিহিত নহে । শ্রীকৃষ্ণ ভক্তগণকে শ্রীভগবানের অবতার-মূর্তির পূজা ও ধ্যান দ্বারা ভগবানে চিত্ত স্থির করিতে উপদেশ দিতেছেন । অবতার ও ঈশ্বর অভেদ, সগুণ ব্রহ্ম ও নির্গুণ ব্রহ্ম একই । অবতারে মনোনিবেশ দ্বারা ব্রাহ্মীস্থিতি লাভ সহজসাধ্য ।

শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা : অষ্টম অধ্যায় – অক্ষরব্রহ্মযোগ 

অর্জুন বলিলেন -
হে পুরুষোত্তম, ব্রহ্ম কি, অধ্যাত্ম কি, কর্ম কি, অধিভূত এবং অধিদৈবই বা কাহাকে বলে ? ১

হে মধুসূদন, এই দেহে অধিযজ্ঞ কে এবং কিরূপে অবস্থিত ? মৃত্যুকালে জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিগণ কিরূপে আপনাকে জানিতে পারেন ? ২

উত্তরে শ্রীভগবান্‌ বলিলেন -
অক্ষরকে নিরতিশয় পরব্রহ্ম বলে। স্বভাবকে অর্থাৎ প্রতি দেহে সেই পরব্রহ্মের প্রত্যগাত্মভাবে অবস্থিতিকে অধ্যাত্ম বলে । ভূতবস্তুর উৎপত্তিকর দেবোদ্দেশে দ্রব্যাদি ত্যাগরূপ যজ্ঞকে কর্ম বলে । ৩

হে নরশ্রেষ্ঠ অর্জুন, দেহাদি বিনাশশীল পদার্থই অধিভূত, হিরণ্যগর্ভই অধিদেবতা এবং আমিই এই দেহে অধিযজ্ঞ । ৪

যিনি মৃত্যুকালে আমাকে স্মরণ করিতে করিতে দেহত্যাগ করেন, তিনি আমাকে লাভ করেন, ইহাতে কোন সন্দেহ নাই । ৫

হে কৌন্তেয়, যিনি মৃত্যুকালে যে দেবতা চিন্তা করিতে করিতে দেহত্যাগ করেন, সেই দেবতানিষ্ঠাতে অভ্যস্ত তিনি সেই দেবতাকেই প্রাপ্ত হন । ৬

অতএব, সর্বদা আমাকে স্মরণ কর এবং স্বীয় ক্ষাত্র ধর্ম-পালনহেতু যুদ্ধ কর । আমাতে মন ও বুদ্ধি সমর্পণ করিলে আমাকেই লাভ করিবে । ইহাতে কোন সন্দেহ নাই । ৭

হে পার্থ, অভ্যাস-যোগে যুক্ত হইয়া অনন্যগামী চিত্তে শাস্ত্র ও আচার্যের উপদেশানুসারে জ্যোতির্ময় পরম পুরুষ শ্রীভগবানের ধ্যান করিতে করিতে যোগী তাঁহাকেই প্রাপ্ত হন । ৮

যিনি সর্বজ্ঞ, সনাতন, বিশ্বনিয়ন্তা এবং সূক্ষ হইতেও সূক্ষ; যিনি অচিন্ত্যস্বরূপ, সূর্যবৎ স্বপ্রকাশ ও জ্যোতির্ময় (নিত্য চৈতন্য-প্রকাশ); যিনি মোহান্ধকারের অতীত এবং সকলের কর্মফলদাতা, তাঁহাকে মৃত্যুকালে ভক্তিযুক্ত হৃদয়ে ধ্যানাভ্যাসজনিত চিত্তস্থৈর্য দ্বারা একাগ্রমনে ভ্রূযুগলমধ্যে সম্যগরূপে প্রাণধারণপুর্বক যিনি স্মরণ করেন, তিনি সেই দিব্য পরম পুরুষকে প্রাপ্ত হন । ৯-১০

বেদার্থজ্ঞগণ যাঁহাকে অক্ষর পুরুষ বলিয়া বর্ণনা করেন, নিঃস্পৃহ সন্ন্যাসিগণ যাঁহাকে লাভ করেন, ব্রহ্মচারিগণ যাঁহাকে লাভ করিবার আকাঙ্ক্ষায় ব্রহ্মচর্য পালন করেন, তোমাকে সেই অক্ষর ব্রহ্মের কথা সংক্ষেপে বলিব । ১১

সমস্ত ইন্দ্রিয়দ্বার সংযত এবং মন হৃদয়ে নিরুদ্ধ করিয়া ভ্রূযুগলের মধ্যে নিজের প্রাণ স্থাপনকরতঃ যোগাভ্যাসে প্রবৃত্ত হইয়া একাক্ষর ব্রহ্মনাম ওঁ উচ্চারণপূর্বক তাঁহার অর্থরূপ আমাকে স্মরণ করিতে করিতে যিনি দেহত্যাগ করেন, তিনি মোক্ষ প্রাপ্ত হন । ১২-১৩

ওম্ ইতি একাক্ষরম্ ব্রহ্ম ব্যাহরন্ মাম্ অনুস্মরন্ ।
য়ঃ প্রযাতি ত্যজন্ দেহম্ সঃ যাতি পরামাম্ গতিম্ ।।[গীতা-৮/১৩]
পদার্থঃ (ওম্, একাক্ষরম্, ব্রহ্ম) 'ওঁ' হলো এক অক্ষর ব্রহ্ম অর্থাৎ ব্রহ্মের বোধক যে 'ওঁ' (ও৩ম্) অক্ষর আছে উহাকে (ব্যাহরন্) কথন করে (মাম্, অনুস্মরন্) আমাকে এর অনন্তর স্মরণ করে অর্থাৎ এই পদের উপদেষ্টা হিসেবে জেনে (য়ঃ) যে পুরুষ (দেহম্, ত্যজন্) দেহকে ত্যাগ করে (প্রযাতি) মৃত্যু হয় (সঃ) সে (পরামাম্, গতিম্, যাতি) পরম গতি কে প্রাপ্ত হয়।।
ভাবার্থঃ যে পুরুষ 'ওঁ' নামক ব্রহ্ম অক্ষর কে স্মরণ করতে করতে দেহ ত্যাগ দ্বারা প্রয়াণ করে সে পুরুষ পরম গতি কে প্রাপ্ত হয়।।
ভাষ্যঃ এখানে কথন করে যে 'ওঙ্কার' এর জপ সমাধি লাভে উপযোগী, যেমন 'ঈশ্বরপ্রণিধানাদ্বা' যোগদর্শন ১/২৩ সূত্রে কথন করা হয়েছে যে ঈশ্বরের 'প্রণিধান' ভক্তি বিশেষ দ্বারা সমাধি লাভ হয়।।
এই শ্লোকের ব্যাখ্যাতে অবতারবাদী টীকাকারগণ এই অক্ষর কে কৃষ্ণের সাথে মিলিয়ে দেয় অর্থাৎ কৃষ্ণ কে পরমেশ্বর বলে কথন করে। যদি মহর্ষি ব্যাসজীর এমন তাৎপর্য হতো তাহলে এই অক্ষর এর অনন্তর কৃষ্ণজী 'মাম্ অনুস্মর' কথন কথন করতো না, আমাদের বিচারে কৃষ্ণজী নিজেই নিজেকে ওই অক্ষরের উপদেষ্টা হওয়ার কারণে মহত্ত্ব কথন করে, নিজে অক্ষর ব্রহ্ম হওয়ার অভিমানে নয়, যদি স্বয়ং অক্ষর= ব্রহ্ম হওয়ার অভিমান করতো তাহলে 'তমাহুঃ পরমাম্ গতিম্' গীতা ৮/২১ এই বাক্য দ্বারা ওই অক্ষর কে পরম গতি নিরুপণ করে নিজের ধাম কথন করতো না। 'ধাম' শব্দের অর্থ হলো স্থিতি স্থান অর্থাৎ আমার স্থিতির স্থান হয় সেই অক্ষর, এই কথন করে আবার সামনে গিয়ে ওই অক্ষর প্রাপ্তির অন্যান্য ভক্তি দ্বারা কথন করে।।-[আর্যমুনি ভাষ্য]

যিনি একাগ্র মনে আমাকে যাবজ্জীবন নিরন্তর স্মরণ করেন, সেই সদা স্মরণশীল যোগীর আমি সহজলভ্য । ১৪

মুক্ত মহাত্মারা আমাকে লাভ করিয়া আর দুঃখালয় নশ্বর সংসারে পুনর্জন্ম প্রাপ্ত হন না । ১৫

হে অর্জুন, পৃথিবী হইতে ব্রহ্মলোক (ব্রহ্মভুবন) পর্যন্ত সপ্ত লোকই পুনরাবর্তনশীল (অর্থাৎ ঐ সকল লোক হইতে মানুষ সংসারে পুনরাগমন করে) । কিন্তু হে কৌন্তেয়, আমাকে লাভ করিলে আর পুনর্জন্ম হয় না । ১৬

সহস্রযুগব্যাপী ব্রহ্মার দিন এবং সহস্রযুগব্যাপী তাঁহার রাত্রি যে যোগিগণ অবগত হন, তাঁহারা দিবারাত্রের তত্ত্ববেত্তা (কালের পরিমাণজ্ঞ) । ১৭

ব্রহ্মার দিবাগমে সমস্ত আকৃতিবিশিষ্ট বস্তু অব্যক্ত হইতে অভিব্যক্ত হয় এবং তাঁহার রাত্রিসমাগমে সেই অব্যক্তেই (প্রজাপতির নিদ্রাবস্থা) তাহারা প্রলীন হয় । ১৮

হে পার্থ, সেই ভূতসমূহ পুনঃপুনঃ উৎপন্ন হইয়া ব্রহ্মার রাত্রিসমাগমে লয় হয় এবং তাঁহার দিবাগমে স্বীয় কর্মের অধীন হইয়া পুনরায় জন্মগ্রহণ করে । ১৯

ভূতগ্রামের বীজভূত অবিদ্যারূপ অব্যক্ত হইতে সম্পূর্ণ বিলক্ষণ ও ব্যতিরিক্ত এবং ইন্দ্রিয়ের অগোচর, স্বতন্ত্র যে অক্ষর-নামক পরব্রহ্ম, তিনি ব্রহ্মা হইতে স্থাবর-জঙ্গমাদি সকল ভূত বিনষ্ট হইলেও বিনষ্ট হন না । ২০

ইন্দ্রিয়াতীত অক্ষর ব্রহ্ম বলিয়া যিনি শাস্ত্রে কথিত হইয়াছেন, তিনি জীবের শেষ গতি । সেই অক্ষরবিষয়ক জ্ঞানলাভ হইলে কেহ আর সংসারে প্রত্যাবৃত্ত হয় না; তাহাই আমার (বিষ্ণুর) পরম পদ । ২১

হে পার্থ, সকল জীবজগৎ পরমেশ্বরের মধ্যেই অবস্থিত । ঘটাদি যেমন আকাশ দ্বারা অন্তরে ও বাহিরে ব্যাপ্ত, সেইরূপ এই সমগ্র জগৎ ঈশ্বর কর্তৃক পরিব্যাপ্ত । অনন্যা (জ্ঞানরূপ) ভক্তি দ্বারা সেই পরম পুরুষকে লাভ করা যায় । ২২

হে ভরতশ্রেষ্ঠ, যে কালে মৃত্যু হইলে উপাসকগণ ও কর্মিগণ যথাক্রমে মোক্ষ ও পুনর্জন্ম লাভ করেন, সেই কালের কথা তোমাকে বলিব । ২৩

দেবযান মার্গে সগুণ ব্রহ্মের উপাসকগণ অগ্নি, জ্যোতি, দিবা, শুক্লপক্ষ ও উত্তরায়ণের ছয় মাস অতিক্রমপুর্বক ব্রহ্মলোকে গমন করেন । কিন্তু, সদ্যোমুক্তিভাক্‌ যোগিগণ জীবৎকালেই ব্রহ্মময় হন । তাঁহাদের প্রাণ ব্রহ্মলীন হয়, উৎক্রান্ত হইয়া কোন লোকে যায় না । ২৪

পিতৃযানমার্গে কর্মী ধূম, রাত্রি, কৃষ্ণপক্ষ এবং দক্ষিণায়নের ছয়মাস অতিক্রম করিয়া চন্দ্রলোকে গমনপূর্বক স্ব স্ব কর্মের ফলস্বরূপ সুখভোগান্তে মর্ত্যলোকে প্রত্যাবৃত্ত হন । ২৫

দেবযান ও পিতৃযান - জগতের এই মার্গদ্বয় সনাতন (নিত্য) বলিয়া কথিত হয়। দেবযানে গতি হইলে মুক্তি লাভ হয় এবং পিতৃযানে গমন করিলে পুনরায় দেহধারণ করিতে হয় । ২৬

হে পার্থ, উত্তরমার্গে ক্রমমুক্তি ও দক্ষিণমার্গে সংসারে প্রত্যাবর্তন হয় - এই জ্ঞান থাকিলে কোনও ধ্যানযোগী (উপাসক) মোহগ্রস্ত হন না । অর্থাৎ তিনি দক্ষিণমার্গ-প্রাপক উপাসনাবর্জিত কর্ম কর্তব্য বলিয়া গ্রহণ করেন না । অতএব, হে অর্জুন, তুমি সর্বদা ব্রহ্মধ্যানে সমাহিত হও । ২৭

বেদপাঠ, যজ্ঞানুষ্ঠান, তপশ্চর্যা ও দানকর্মের যে পুণ্যফল কীর্তিত হইয়াছে, এই অধ্যায়োক্ত সপ্ত প্রশ্নের উত্তরে বর্ণিত তত্ত্ব অবধারণ ও আচরণপূর্বক ধ্যাননিষ্ঠ যোগিগণ সেই ফলরাশি অতিক্রম করিয়া পরমকারণ ব্রহ্ম-পদ প্রাপ্ত হন । ২৮

ভগবান্‌ ব্যাসকৃত লক্ষশ্লোকী শ্রীমহাভারতের ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতারূপ উপনিষদে ব্রহ্মবিদ্যাবিষয়ক যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জুনসংবাদে অক্ষরব্রহ্মযোগনামক অষ্টম অধ্যায় সমাপ্ত ।
_________________________________________

১) পুরুষ/পূরূষ : এই বিশ্ব যাঁহার দ্বারা পূর্ণ (ব্যাপ্ত) । পুরে যিনি শয়ন করেন ।
পুরুষোত্তম = ঈশ্বরের অবতার

৩) এই বীজভূত যজ্ঞ হইতে বৃষ্ট্যাদিক্রমে স্থাবরজঙ্গমাত্মক ভূতনিচয় উৎপন্ন হয় ।

৪) অধিভূত = যে সকল দেহাদি নশ্বর পদার্থ প্রাণিমাত্রকে অধিকার করিয়া আছে
অধিদৈবত = অধিষ্ঠাত্রী দেবতা । সূর্যমণ্ডলস্থ যে বিরাট পুরুষ স্বীয় অংশভূত সর্বদেবতার অধিপতি । - [শ্রীধরস্বামী] ।
সর্বপ্রথমে কেবল প্রজাপতি হিরণ্যগর্ভই বিদ্যমান ছিলেন । তিনি জাতমাত্রই সর্বভূতের অধীশ্বর হইলেন । তিনি এই পৃথিবী ও আকাশকে স্বস্থানে স্থাপিত করিলেন । সেই অনির্জ্ঞাতস্বরূপ দেবতার উদ্দেশে আমরা হবন করি । - [ঋগ্বেদ, ১০|১২১|১]
 
অধিযজ্ঞ = এই দেহে অবস্থিত আমিই অধিযজ্ঞ, যজ্ঞের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা, যজ্ঞাদিকর্ম-প্রবর্তক ও তৎফলদাতা । - [শ্রীধরস্বামী]
 
৭) সতত স্মরণের অভ্যাসই অন্তরঙ্গ সাধন । ইষ্টস্মরণ জ্ঞানলাভের উপায় ও ইষ্টভাবপ্রাপ্তি হইবার ফল । - [শ্রীধরস্বামী]

৮) অভ্যাস : বিলক্ষণ (অন্য)-প্রত্যয়রহিত তুল্য প্রত্যয়ের পুনঃপুনঃ আবৃত্তির নাম অভ্যাস । ধ্যানকালে বিজাতীয় প্রত্যয় উদিত হইলে তাহা ছেদনপূর্বক স্বজাতীয় প্রত্যয়ের প্রবাহ প্রবৃদ্ধ করিতে হয় ।

১০) আজ্ঞাচক্র ভ্রূদ্বয়ের মধ্যবর্তী । তথায় মন উঠলে জ্ঞানচক্ষু বা দিব্যদৃষ্টি লাভ হয় । ব্যাসকৃপায় সঞ্জয় ও কৃষ্ণকৃপায় অর্জুন এই জ্ঞানচক্ষুলাভ করিয়া যথাক্রমে কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধ ও বিশ্বরূপ দর্শন করেন ।
 
১৩) ওঁকার ব্রহ্মবাচক, ব্রহ্মের শব্দ-প্রতীক - প্রতিমাদির ন্যায় ব্রহ্মের ধ্যেয় মূর্তি । - [শঙ্করাচার্য]
প্রণব ব্রহ্মোরূপ (ব্রহ্মলাভের ভেলাস্থানীয়) - [শ্বেতাশ্বতর উপঃ, ২|৮]
যে শব্দ উচ্চারণে যাহা স্ফুরিত হয় তাহা সেই শব্দের বাচ্য । সমাহিতচিত্তে ওঁকার উচ্চারণে যে বিষয়-বিবিক্ত সংবেদন (জ্ঞান) স্ফুরিত হয়, তাহা ওঁকারবাচ্য এবং উহাই সত্ত্বপ্রধান মায়াবিচ্ছিন্ন ওঁকারোপাধিক ব্রহ্ম । সেই ব্রহ্ম আমি - এইরূপে ধ্যান করিবে । তাহাতে অসমর্থ হইলে ওঁকারকে ব্রহ্মপ্রতীকরূপে উপাসনা করিবে । অর্থাৎ ওঁ-শব্দে ব্রহ্মদৃষ্টি করিবে । ওঁকারই ব্রহ্ম - এইভাবে চিন্তা করিবে । - [আনন্দগিরি]

ওঁকার-সহায়ে পরব্রহ্মের ধ্যানকারিগণ ক্রমমুক্তিলাভ করেন । - [ব্রঃসূঃ, ১|৩|১৩]

১৬) সপ্তলোক = ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ, মহঃ, জন, তপঃ ও সত্যলোক বা ব্রহ্মলোক
ব্রহ্মলোক = ব্রহ্মার লোক, ব্রহ্মের লোক নাই
 
১৭) চারি সহস্র যুগে ব্রহ্মার একদিন (বার ঘন্টা) হয় । ব্রহ্মার রাত্রিও সমপরিমাণ । এইরূপ গণনায় ব্রহ্মার আয়ু এক শত বৎসর ।
যুগ = সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি
 
১৮) অব্যক্ত-শব্দের অর্থ প্রজাপতির নিদ্রাবস্থা, অব্যাকৃত নহে । ইহা ব্রহ্মার দৈনন্দিন সৃষ্টি ও প্রলয়; আকাশাদির উৎপত্তি ও প্রলয় এইসময়ে হয় না । - [ভাষ্যোৎকর্ষদীপিকা]

১৯) পুর্বকল্পে যে ভূতসমূহ ছিল, তাহারাই পুনর্বার বর্তমানকল্পে সৃষ্ট হয়, আবার কল্পান্তে লয় হয় ।
 
২১) বিষ্ণুর পদ = বিষ্ণুই পদ । যেমন 'রাহুর শির' বলিলে রাহুকেই বুঝায়, কারণ শির ভিন্ন রাহুর অন্য কোনও শরীর নাই । স্বর্গাদি লোকপ্রাপ্তি শ্রেষ্ঠ গতি, আর ব্রহ্মপ্রাপ্তিই শেষ গতি ।

২৩) কাল = মার্গ; কারণ এই গীতোক্ত মার্গদ্বয়ে কালাভিমানিনী দেবতার সংখ্যা অন্য দেবতার অপেক্ষা অধিক ।
 
২৪) দেবযানে জ্ঞানপ্রকাশ থাকায় শুক্ল এবং পিতৃযানে জ্ঞানপ্রকাশ না থাকায় কৃষ্ণ ।
 
দেবযানমার্গে গমন করিলে যোগী যথাক্রমে অর্চিঃ (অগ্নি ও জ্যোতি), অহঃ (দিবা), শুক্লপক্ষ ও উত্তরায়ণ, সংবৎসর, দেবলোক, বায়ু, সূর্য, চন্দ্রমা ও বিদ্যুৎ, বরুণ, ইন্দ্র ও প্রজাপতি প্রাপ্ত হন । অমানব পুরুষ প্রজাপতিলোক হইতে বিদ্যুল্লোকে আসিয়া উপাসককে প্রজাপতিলোকে (ব্রহ্মলোকে) লইয়া যান । সেই উপাসকদের আর পুনর্জন্ম হয় না । - [ব্রহ্ম সূত্র, ৪|৩|১-৪]
 
পিতৃযানমার্গে কর্মী পুরুষ ধূম, রাত্রি, কৃষ্ণপক্ষ, দক্ষিণায়ন ও পিতৃলোক অতিক্রম করিয়া চন্দ্রলোকরূপ স্বর্গলাভ করেন । স্বর্গভোগান্তে তাঁহাদের পুনর্জন্ম হয় । - [বৃহদারণ্যক উপঃ, ৬|২|১৬]

২৭) ক্রমমুক্তি : দেহান্তে ব্রহ্মলোকে গমন ও তথায় ঐ লোকের ঐশ্বর্যসম্ভোগ । পরে তথায়ই জ্ঞানলাভ দ্বারা কল্পান্তে ব্রহ্মরূপে অবস্থান ও অপুনরাবৃত্তি (মোক্ষ)-লাভ ।
 
উপাসনার অঙ্গরূপে উত্তরমার্গ ধ্যান করিতে হয় । যখনই মৃত্যু হউক, উপাসকের দেবযানে এবং কর্মীর পিতৃযানে গতি হয় । দিবাভাগে ও উত্তরায়ণে মৃত্যুতে দেবযানে গতি এবং রাত্রিভাগে ও দক্ষিণায়ণে মৃত্যুতে পিতৃযানে গতি হয় - সাধারণের এই বিশ্বাস ঠিক নহে । - [আনন্দগিরি]

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : নবম অধ্যায় - রাজবিদ্যা-রাজগুহ্য-যোগ

শ্রীভগবানুবাচ –
ইদন্তু তে গুহ্যতমং প্রবক্ষ্যাম্যনূসয়বে।
জ্ঞানং বিজ্ঞানসহিতং যজ্ জ্ঞাত্বা মোক্ষ্যসেহশুভাৎ।।১
তুমি অসূয়াশূন্য, দোষদর্শী নও । তোমাকে এই অতি গুহ্য বিজ্ঞানসহিত ঈশ্বরবিষয়ক জ্ঞান কহিতেছি, ইহা জ্ঞাত হইলে তুমি সংসারদুঃখ হইতে মুক্ত হইবে । ১

শিষ্য শ্রদ্ধাহীন এবং দোষদর্শী হইলে গুরু তাহাকে গুহ্য বিষয় উপদেশ দেন না। কিন্তু অর্জ্জুন সেরূপ নহেন। তিনি গুহ্য বিষয় শ্রবণের অধিকারী, ‘অসূয়াশূন্য’ শব্দে তাহাই প্রকাশ পাইতেছে।

রাজবিদ্যা রাজগুহ্যং পবিত্রমদমুত্তমম্।
প্রত্যক্ষাবগনং ধর্ম্ম্যং সুসুখং কর্ত্তুমব্যয়ম্।।২

ইহা রাজবিদ্যা, রাজগুহ্য অর্থাৎ সকল বিদ্যা ও গুহ্য বিষয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ; ইহা সর্বোৎকৃষ্ট, পবিত্র, সর্বধর্মের ফলস্বরূপ, প্রত্যক্ষ বোধগম্য, সুখসাধ্য এবং অক্ষয় ফলপ্রদ । ২

অশ্রদ্দধানাঃ পুরুষা ধর্ম্মস্যাস্য পরন্তপ।
অপ্রাপ্য মাং নিবর্ত্তন্তে মৃত্যুসংসারবর্ত্মনি।।৩

হে পরন্তপ, এই ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাহীন ব্যক্তিগণ আমাকে পায় না; তাহারা মৃত্যুময় সংসার-পথে পরিভ্রমণ করিয়া থাকে । ৩

ময়া ততমিদং সর্ব্বং জগদব্যক্তমূর্ত্তিনা।
মৎস্থানি সর্ব্বভুতানি ন চাহং তেষ্ববস্থিতঃ।।৪

আমি অব্যক্ত স্বরূপে এই সমস্ত জগৎ ব্যাপিয়া আছি । সমস্ত ভূত আমাতে অবস্থিত, আমি কিন্তু তৎসমুদয়ে অবস্থিত নহি । ৪

ন চ মৎস্থানি ভূতানি পশ্য মে যোগমৈশ্বরম্।
ভূতভৃন্ন চ ভূতস্থো মমাত্মা ভূতভাবনঃ।।৫

তুমি আমার ঐশ্বরিক যোগদর্শন কর । এই ভূতসকলও আমাতে স্থিতি করিতেছে না; আমি ভূতধারক ও ভূতপালক, কিন্তু ভূতগণে অবস্থিত নহি । ৫

যথাকাশস্থিতো নিত্যং বায়ুঃ সর্ব্বত্রগো মহান্।
তথা সর্ব্বাণি ভূতানি মৎস্থানীত্যুপধারয়।।৬

যেমন সর্বত্র গমনশীল মহান্‌ বায়ু আকাশে অবস্থিত, সেইরূপ সমস্ত ভূত আমাতে অবস্থিত ইহা জানিও । ৬

সর্ব্বভুতানি কৌন্তেয় প্রকৃতিং যান্তি মামিকাম্।
কল্পক্ষয়ে পুনস্তানি কল্পাদৌ বিসৃজাম্যহম্।।৭

হে কৌন্তেয়, কল্পের শেষে (প্রলয়ে) সকল ভূত আমার ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতিতে আসিয়া বিলীন হয় এবং কল্পের আরম্ভে ঐ সকল পুনরায় আমি সৃষ্টি করি । ৭

প্রকৃতিং স্বামবষ্টভ্য বিসৃজামি পুনঃ পুনঃ।
ভুতগ্রামমিমং কৃৎস্নমবশং প্রকৃতের্বশাৎ।।৮

আমি স্বীয় প্রকৃতিকে আত্মবশে রাখিয়া স্বীয় স্বীয় প্রাক্তন-কর্ম নিমিত্ত স্বভাববশে জন্মমৃত্যুপরবশ ভূতগণকে পুনঃ পুনঃ সৃষ্ট করি । ৮

ন চ মাং তানি কর্ম্মাণি নিবধ্নন্তি ধনঞ্জয়।
উদাসীনবদাসীনমসক্তং তেষু কর্ম্মসু।।৯

হে ধনঞ্জয়, আমাকে কিন্তু সেই সকল কর্ম আবদ্ধ করিতে পারে না । কারণ, আমি সেই সকল কর্মে অনাসক্ত, উদাসীনবৎ অবস্থিত । ৯
ময়াধ্যক্ষেণ প্রকৃতিঃ সূয়তে সচরাচরম্।
হেতুনানেন কৌন্তেয় জগত্ বিপরিবর্ত্ততে।।১০

হে কৌন্তেয়, আমার অধিষ্ঠানবশতঃই প্রকৃতি এই চরাচর জগৎ প্রসব করে, এই হেতুই জগৎ (নানারূপে) বারংবার উৎপন্ন হইয়া থাকে । ১০

                     অবজানন্তি মাং মুঢ়া মানুষীং তনুমাশ্রিতম্।
                      পরং ভাবমজানন্তো মম ভুতমহেশ্বরম্।।১১

অবিবেকী ব্যক্তিগণ সর্বভূত-মহেশ্বর-স্বরূপ আমার পরম ভাবনা জানিয়া মনুষ্য-দেহধারী বলিয়া আমার অবজ্ঞা করিয়া থাকে । ১১


এই সকল বিবেকহীন ব্যক্তি, বুদ্ধিভ্রংশকারী তামসী ও রাজসী প্রকৃতির বশে, আমাকে অবজ্ঞা করিয়া থাকে । উহাদের আশা ব্যর্থ, কর্ম নিষ্ফল, জ্ঞান নিরর্থক এবং চিত্ত বিক্ষিপ্ত । ১২
             

কিন্তু হে পার্থ, সাত্ত্বিকী প্রকৃতি-প্রাপ্ত মহাত্মগণ অনন্যচিত্ত হইয়া আমাকে সর্বভূতের কারণ এবং অব্যয়স্বরূপ জানিয়া ভজনা করেন । ১৩


তাঁহারা যত্নশীল ও দৃঢ়ব্রত হইয়া ভক্তিপূর্বক সর্বদা আমার কীর্তন এবং বন্দনা করিয়া নিত্য সমাহিত চিত্তে আমার উপাসনা করেন । ১৪


কেহ জ্ঞানরূপ যজ্ঞদ্বারা আমার আরাধনা করেন । কেহ কেহ অভেদ ভাবে (অর্থাৎ উপাস্য-উপাসকের অভেদ/একত্ব চিন্তাদ্বারা), কেহ কেহ পৃথক্‌ ভাবে অর্থাৎ (দাস্যাদি ভাবে), কেহ কেহ সর্বময়, সর্বাত্মা আমাকে নানা ভাবে (অর্থাৎ ব্রহ্মা, রুদ্রাদি নানা দেবতারূপে) উপাসনা করেন । ১৫


আমি ক্রতু, আমি যজ্ঞ, আমি স্বধা, আমি ঔষধ, আমি মন্ত্র, আমিই হোমাদি-সাধন ঘৃত, আমি অগ্নি, আমিই হোম ।  ১৬


আমি এই জগতের পিতা, মাতা, বিধাতা, পিতামহ; যাহা কিছু জ্ঞেয় এবং পবিত্র বস্তু তাহা আমিই । আমি ব্রহ্মবাচক ওঙ্কার, আমি ঋক্‌, সাম ও যজুর্বেদ স্বরূপ । ১৭

আমি গতি, আমি ভর্তা, আমি প্রভু, আমি শুভাশুভ দ্রষ্টা, আমি স্থিতি-স্থান, আমি রক্ষক, আমি সুহৃৎ, আমি স্রষ্টা, আমি সংহর্তা, আমি আধার, আমি লয়স্থান এবং আমিই অবিনাশী বীজস্বরূপ । ১৮

হে অর্জুন, আমি (আদিত্যরূপে) উত্তাপ দান করি, আমি ভূমি হইতে জল আকর্ষণ করি, আমি পুনর্বার জল বর্ষণ করি; আমি জীবের জীবন, আমিই জীবের মৃত্যু; আমি সৎ (অবিনাশী অব্যক্ত আত্মা), আমিই অসৎ (নশ্বর ব্যক্ত জগৎ) । ১৯

ত্রিবেদোক্ত যজ্ঞাদিকর্মপরায়ণ ব্যক্তিগণ যজ্ঞাদি দ্বারা আমার পূজা করিয়া যজ্ঞশেষে সোমরস পানে নিষ্পাপ হন এবং স্বর্গলাভ কামনা করেন, তাঁহারা পবিত্র স্বর্গলোক প্রাপ্ত হইয়া দিব্য দেবভোগসমূহ ভোগ করিয়া থাকেন । ২০

তাঁহারা তাঁহাদের প্রার্থিত বিপুল স্বর্গসুখ উপভোগ করিয়া পুণ্যক্ষয় হইলে পুনরায় মর্ত্যলোকে প্রবেশ করেন । এইরূপে কামনাভোগ-পরবশ এই ব্যক্তিগণ যাগযজ্ঞাদি বেদোক্ত ধর্ম অনুষ্ঠান করিয়া পুনঃ পুনঃ সংসারে যাতায়াত করিয়া থাকেন । ২১

অনন্যচিত্ত হইয়া আমার চিন্তা করিতে করিতে যে ভক্তগণ আমার উপাসনা করেন, আমাতে নিত্যুযুক্ত সেই সমস্ত ভক্তের যোগ ও ক্ষেম আমি বহন করিয়া থাকি (অর্থাৎ তাহাদের প্রয়োজনীয় অলব্ধ বস্তুর সংস্থান এবং লব্ধ বস্তুর রক্ষণ আমি করিয়া থাকি) । ২২

হে কৌন্তেয়, যাহারা অন্য দেবতায় ভক্তিমান্‌ হইয়া শ্রদ্ধাযুক্তচিত্তে তাঁহাদের পূজা করে তাহারাও আমাকেই পূজা করে, কিন্তু অবিধিপূর্বক (অর্থাৎ যাহাতে সংসার নিবর্তক মোক্ষ বা ঈশ্বরপ্রাপ্তি ঘটে তাহা না করিয়া) । ২৩

আমিই সর্ব যজ্ঞের ভোক্তা ও ফলদাতা । কিন্তু তাহারা আমাকে যথার্থরূপে জানে না বলিয়া সংসারে পতিত হয় । ২৪

ইন্দ্রাদি দেবগণের পূজকেরা দেবলোক প্রাপ্ত হন, শ্রাদ্ধাদি দ্বারা যাঁহারা পিতৃগণের পূজা করেন তাঁহারা পিতৃলোক প্রাপ্ত হন, যাঁহারা যক্ষ-রক্ষাদি ভূতগণের পূজা করেন তাঁহারা ভূতলোক প্রাপ্ত হন, এবং যাঁহারা আমাকে পূজা করেন তাঁহারা আমাকেই প্রাপ্ত হন । ২৫

যিনি আমাকে পত্র, পুস্প, ফল, জল, যাহা কিছু ভক্তিপূর্বক দান করেন, আমি সেই শুদ্ধচিত্ত ভক্তের ভক্তিপূর্বক প্রদত্ত উপহার গ্রহণ করিয়া থাকি । ২৬

হে কৌন্তেয়, তুমি যাহা কিছু কর, যাহা কিছু ভোজন কর, যাহা কিছু হোম কর, যাহা কিছু দান কর, যাহা কিছু তপস্যা কর, তৎ সমস্তই আমাকে অর্পণ করিও । ২৭

এইরূপ সর্ব কর্ম আমাতে সমর্পণ করিলে শুভাশুভ কর্ম-বন্ধন হইতে মুক্ত হইবে । আমাতে সর্বকর্ম সমর্পণরূপ যোগে যুক্ত হইয়া কর্মবন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া আমাকেই প্রাপ্ত হইবে । ২৮

আমি সর্বভূতের পক্ষেই সমান । আমার দ্বেষ নাই, প্রিয়ও নাই । কিন্তু যাহারা ভক্তিপূর্বক আমার ভজনা করেন, তাঁহারা আমাতে অবস্থান করেন এবং আমিও সে সকল ভক্তেই অবস্থান করি । ২৯

অতি দুরাচার ব্যক্তি যদি অনন্যচিত্ত (অনন্য ভজনশীল) হইয়া আমার ভজনা করে, তাহাকে সাধু বলিয়া মন করিবে । যেহেতু তাহার অধ্যবসায় উত্তম । ৩০

ঈদৃশ দুরাচার ব্যক্তি শীঘ্র ধর্মাত্মা হয় এবং নিত্য শান্তি লাভ করে; হে কৌন্তেয়, তুমি সর্বসমক্ষে নিশ্চিত প্রতিজ্ঞা করিয়া বলিতে পার যে, আমার ভক্ত কখনই বিনষ্ট হয় না । ৩১

হে পার্থ, স্ত্রীলোক, বৈশ্য ও শূদ্র, অথবা যাহারা পাপযোনিসম্ভূত অন্ত্যজ জাতি তাহারাও আমার আশ্রয় লইলে নিশ্চয়ই পরমগতি প্রাপ্ত হন । ৩২

পুণ্যশীল ব্রাহ্মণ ও রাজর্ষিগণ যে পরম গতি লাভ করিবেন তাহাতে আর কথা কি আছে ? অতএব তুমি (এই রাজর্ষি-দেহ লাভ করিয়া) আমার আরাধনা কর । কারণ এই মর্ত্যলোক অনিত্য এবং সুখশূন্য । ৩৩

তুমি সর্বদা মনকে আমার চিন্তায় নিযুক্ত কর, আমাতে ভক্তিমান্‌ হও, আমার পূজা কর, আমাকেই নমস্কার কর । এইরূপে মৎপরায়ণ হইয়া আমাতে মন সমাহিত করিতে পারিলে আমাকেই প্রাপ্ত হইবে । ৩৪
___________________________


১) শিষ্য শ্রদ্ধাহীন এবং দোষদর্শী হইলে গুরু তাহাকে গুহ্য বিষয় উপদেশ দেন না । কিন্তু অর্জুন সেরূপ নহেন । তিনি গুহ্য বিষয় শ্রবণের অধিকারী, ‘অসূয়াশূন্য’ শব্দে তাহাই প্রকাশ পাইতেছে ।

২) রাজগুহ্য রাজবিদ্যা কি ?
বিদ্যামাত্রই সেকালে গুহ্য থাকিত । কেননা, অধিকারী শিষ্যগণ ব্যতীত অন্য কাহাকেও উহা উপদেশ করা হইত না । এই সকল গুহ্যবিদ্যার মধ্যে গীতোক্ত ভক্তিযোগই শ্রেষ্ঠ, তাই উহাকে রাজগুহ্য বলা হইয়াছে । ব্রহ্মবিদ্যা-সম্বন্ধে এই অধ্যায়ে এমন কিছু বলা হয় নাই, যাহা পূর্বে কথিত হয় নাই এবং যাহাকে গুহ্যতম বলা যাইতে পারে । 'ইহা সুস্পষ্ট যে, অক্ষর অব্যক্ত ব্রহ্মের জ্ঞানকে লক্ষ্য করিয়া এই বর্ণনা করা হয় নাই । কিন্তু রাজবিদ্যা শব্দে এ-স্থলে ভক্তিমার্গই বিবক্ষিত হইয়াছে ।' - [লোকমান্য তিলক]

১২) পাষণ্ডী = ভগবদ্বিমুখ অসুর লোক যেমন কংস, শিশুপাল ।
মোঘাশাঃ : শ্রীকৃষ্ণ অপেক্ষা অন্য দেবতারা শীঘ্র কামনা পূর্ণ করিবে, যাহারা এইরূপ নিষ্ফল আশা করে ।
মোঘকর্মাণঃ : ঈশ্বর-বিমুখ বলিয়া যাহাদের যাগযজ্ঞাদি কর্ম নিষ্ফল হয় ।
মোঘজ্ঞানাঃ : ভগবদ্ভক্তিহীন বলিয়া যাহাদের শাস্ত্রপাণ্ডিত্যাদি সমস্তই নিষ্ফল হয় ।

১৫) মত-পথ :
পরমেশ্বর বিশ্বতোমুখ, এই হেতুই তাঁহার উপাসনা-প্রণালীও বিভিন্ন হয় । জ্ঞান-যজ্ঞের অর্থ পরমেশ্বরের স্বরূপ-জ্ঞানের দ্বারাই বিচার করিয়া উহার দ্বারা সিদ্ধিলাভ করা । কিন্তু পরমেশ্বরের এই জ্ঞানও দ্বৈত-অদ্বৈত প্রভৃতি ভেদে অনেক প্রকারের হইতে পারে । এই কারণে জ্ঞান-যজ্ঞও বিভিন্ন প্রকারের হইতে পারে । ' 'একত্ব', 'পৃথকত্ব' প্রভৃতি পদের দ্বারা বুঝা যায় যে, অদ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত প্রভৃতি সম্প্রদায় যদিও আধুনিক, তথাপি কল্পনাসকল প্রাচীন ।' - [গীতারহস্য|লোকমান্য তিলক]

১৬) ক্রতু, যজ্ঞ - এই দুইটি সদৃশার্থক হইলেও একার্থক নহে । 'যজ্ঞ' শব্দ 'ক্রতু' শব্দ অপেক্ষা অধিক ব্যাপক । শ্রৌত যজ্ঞকে ক্রতু বলে । এস্থলে দুইটি শব্দই ব্যবহৃত হইয়াছে বলিয়া ক্রতু অর্থে অগ্নিষ্টোমাদি শ্রৌত যজ্ঞ এবং যজ্ঞ অর্থে স্মার্ত যজ্ঞাদি বুঝিতে হবে ।

১৮) বিবিধ কর্ম বা সধনায় যে গতি বা ফল পাওয়া যায় তাহা তিনিই । যে যাহা করুক তাহার শেষ গতি তিনিই । শুভাশুভ যে কোন কর্ম লোকে করে তিনি সবই দেখেন, এই জন্য তিনিই সাক্ষী । সর্বভূত তাঁহাতেই বাস করে, তাই তিনি নিবাস । তিনি প্রভব, প্রলয় ও স্থান অর্থাৎ সৃষ্টি, স্থিতি, লয়কর্তা । প্রলয়েও জীবসমূহ বীজ অবস্থায় তাহাতে অবস্থান করে, এই জন্য তিনি নিধান । প্রত্যুপকারের আশা না করিয়া সকলের উপকার করেন, তাই তিনি সুহৃৎ । তিনি আর্তের আর্তিহর, তাই তিনি শরণ ।

১৯) সৎ ও অসৎ : এই শব্দদ্বয় গীতা এবং বেদান্তাদি-শাস্ত্রে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে ।

  1. সৎ = অক্ষর অবিনাশী অব্যক্ত ব্রহ্মবস্তু; অসৎ = নশ্বর ব্যক্ত জগৎ ।
  2. সৎ = অব্যক্ত প্রকৃতি; অসৎ = ব্যক্ত জগৎ ।
  3. সৎ = অস্তি, আছে; অসৎ = নাস্তি, নাই । যে-বস্তুর সৃষ্টি হয় এবং যাহার নাশ হইয়া থাকে সেই বস্তুই সৎ বা অসৎ । যাহা সৃষ্টির পূর্বেও ছিল এবং পরেও থাকিবে, তৎসম্বন্ধে 'আছে' বা 'নাই' এরূপ কিছুই বলা যায় না । তাই ব্রহ্মতত্ত্বের বর্ণনায় কখনো 'ন সৎ ন অসৎ' বলা হয় । কেননা, সেই অতীন্দ্রিয় ব্রহ্মবস্তু সত-অসৎ, আলোক-অন্ধকার, জ্ঞান-অজ্ঞান ইত্যাদি পরস্পর সতত-সাপেক্ষ দ্বৈত-বুদ্ধির অতীত অর্থাৎ সম্পূর্ণ অজ্ঞেয় ।
  4. প্রাচীন উপনিষদাদিতে অনেক স্থলে বিপরীতার্থে এই শব্দদ্বয় ব্যবহার করা হইয়াছে । অর্থাৎ 'সৎ' = দৃশ্য ব্যক্ত জগৎ; 'তৎ' বা 'অসৎ' = অব্যক্ত ব্রহ্মবস্তু ।
২১) বেদোক্ত যাগযজ্ঞাদির অনুষ্ঠানকারী সকাম ব্যক্তিগণ পুণ্যফল-স্বরূপ স্বর্গলোক প্রাপ্ত হন বটে, কিন্তু মোক্ষ প্রাপ্ত হন না । একথা পূর্বে আরও কয়েক বার বলা হইয়াছে (২|৪২-৪৫, ৮|১৬,২৫ ইত্যাদি) । ২০-২৫ এই কয়েকটা শ্লোকে ফলাশায় দেবোপাসনা ও নিষ্কাম ঈশ্বরোপাসনায় পার্থক্য দেখান হইতেছে ।

২২) যোগক্ষেম : ভক্তের ভগবান, ঈশ্বর-চিন্তা ও বিষয়-চিন্তা
ভগবানের কর্ম দ্বিবিধ - (i)গৌণী ভক্তিযোগ (স্মরণ, কীর্তন, পূজার্চনাদি), (ii)নির্গুণা বা পরা ভক্তি সহকারে গীতার নিষ্কাম কর্মযোগ (সর্বভূতে ঈশ্বর আছেন জানিয়া সর্বভূতের হিতসাধন) ।

কিন্তু দিবারাত্র ঈশ্বরচিন্তা করিব বা সর্বভূতের হিতসাধনে দেশের কাজে, দশের কাজে ব্যস্ত থাকিব, তবে সংসার-চিন্তা, দেহের চিন্তা করিব কখন ? দেহরক্ষা না হইলে ঈশ্বরচিন্তাও হয় না, দশের কাজও হয় না - 'নিজে বাঁচিলে তবে ধর্ম' [বিশ্বামিত্র]; 'আত্মানং সততং রক্ষেৎ' [মনু] । ইহার উত্তরে শ্রীভগবান বলিতেছেন, যাহারা নিত্যযুক্ত হইয়া সতত আমারই চিন্তায়, আমারই কর্মে মগ্ন থাকে, তাহাদের যোগক্ষেম আমিই বহন করি অর্থাৎ দেহাদি-রক্ষণের ভার আমিই গ্রহণ করি । অন্যের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থাও ঈশ্বর করেন; তবে তাহাদিগকে চেষ্টা করিতে হয়, নিত্যযুক্ত (পাটোয়ারী বুদ্ধি-সহকারে নহে) ভগবদ্ভক্তের চেষ্টা করিতে হয় না, এই পার্থক্য । 

২৪) অন্য দেবতার পূজাও তোমারই পূজা । তবে তাহাদিগের পূজা করিলে সদ্গতিলাভ হইবে না কেন ? কারণ, অন্যদেবতা-ভক্তেরা আমার প্রকৃত স্বরূপ জানে না; তাহারা মনে করে সেই সেই দেবতাই ঈশ্বর । এই অজ্ঞানতাবশতঃই তাহাদের সদ্গতি হয় না । তাহারা সংসারে পতিত হয় । কেননা, অন্য দেবতারা মোক্ষ দিতে পারেন না ।

একেশ্বরবাদ - বহুদেবোপাসনা - মূর্তিপূজা
হিন্দু বহুদেবোপাসক হইলেও বহু-ঈশ্বরবাদী নহেন, প্রতিমা-পূজক হইলেও পৌত্তলিক (Idolator) নহেন । বেদে কতিপয় দেবতার উল্লেখ আছে, কিন্তু সে সকলই এক, বহুত্ব কল্পনামাত্র ('একং সন্তং বহুধা কল্পয়ন্তি' ঋগ্বেদ ১০|১১৪|৫) । দেবতাদিগেরও পূর্বে সেই অব্যক্ত হইতে ব্যক্ত জগৎ উৎপন্ন হইয়াছে [ঋ|১০|৭২|২] ।

সুতরাং দেবতাগণ ঈশ্বর নহেন, ঈশ্বরের শক্তিবিশেষের বিভিন্ন প্রকাশ বা বিভূতি । ভয়ে, বিস্ময়ে, ভক্তিতে বা স্বার্থবুদ্ধিতে শক্তিমানের পূজা, বীর-পূজা, সকলেই করে; দেবগণের পূজাও তদ্রূপ, উহাতে অন্যবিধ ইষ্টলাভ হইতে পারে, ঈশ্বরলাভ হয় না ।

হিন্দুরা যে দেবদেবীর মূর্তি পূজা করেন, তাহাকে প্রতিমা (holy image বা প্রতীক symbol) বলে, পুত্তলিকা (Idol) বলে না । নাম-রূপ ব্যতীত মনুষ্যমন সেই অনন্তশক্তিমৎ অব্যক্ত বস্তু ধারণা করিতে পারে না; তাই ঈশ্বরের শক্তি-বিশেষের সহিত সাদৃশ্য কল্পনা করিয়া চিন্তার অবলম্বন-স্বরূপ একটা প্রতীক (symbol) গ্রহণ করা হয় মাত্র । মূর্তির প্রাণ-প্রতিষ্ঠা, স্তব-স্তুতি, ধ্যান-প্রণাম ইত্যাদি মন্ত্রাদির প্রতি লক্ষ্য করিলে স্পষ্টই বুঝা যায়, সাধক প্রতীক-অবলম্বনে ঈশ্বরেরই পূজা করিতেছেন, পুতুল পূজা করিতেছেন না । এইজন্যই প্রতিমা-পূজক ও পৌত্তলিক এক কথা নহে । কিন্তু যাঁহারা প্রকৃতির অতীত হইয়া অতীন্দ্রিয় তত্ত্বজ্ঞান লাভ করিয়াছেন, তাঁহাদিগের প্রতিমারও প্রয়োজন হয় না । বস্তুত তাঁহার প্রতিমা (তুলনা) নাই ।

২৬) আমার পূজা অনায়াস-সাধ্য । ইহাতে বহুব্যয়সাধ্য উপকরণের প্রয়োজন নাই । ভক্তিসহ যাহা কিছু আমার ভক্ত আমাকে দান করেন, দরিদ্র ব্রাহ্মণ শ্রীদামের চিপিটকের ন্যায় তাহাই আমি আগ্রহের সহিত গ্রহণ করি । আমি দ্রব্যের কাঙ্গাল  নহি, ভক্তির কাঙ্গাল । এই কথাটা বুঝাইবার জন্য ‘ভক্তিপূর্বক’ শব্দটা দুইবার ব্যবহৃত হইয়াছে ।

সাকারোপাসনা :
'ফল-পুষ্পাদি প্রদান করিতে হইলে তাহা যে প্রতিমায় অর্পণ করিতে হইবে এমন কথা নাই । ঈশ্বর সর্বত্র আছেন, যেখানে দিবে সেখানেই তিনি পাইবেন ।' - [বঙ্কিমচন্দ্র]

মানববুদ্ধি নাম-রূপের অতীত কোনো অতীন্দ্রিয় বস্তুর ধারণা করিতে পারে না, সুতরাং যে-পর্যন্ত না সাধক প্রকৃতির অতীত হইয়া অতীন্দ্রিয় তত্ত্বজ্ঞান লাভ করেন, সে-পর্যন্ত তাঁহাকে সাকারের মধ্য দিয়া, স্থূলের মধ্য দিয়াই সূক্ষ্মে যাইতে হইবে, অন্য গতি নাই ।

'আপনারা মনকে স্থির করিবার অথবা কোনোরূপ চিন্তা করিবার চেষ্টা করিয়া দেখিবেন - আপনারা মনে-মনে মূর্তি গঠন না করিয়া থাকিতে পারিতেছেন না । দুই প্রকার ব্যক্তির মূর্তি-পূজার প্রয়োজন হয় না । এক নরপশু, যে ধর্মের কোনো ধার ধারে না, আর সিদ্ধপুরুষ - যিনি এই সকল সোপান-পরম্পরা অতিক্রম করিয়াছেন । আমরা যতদিন এই দুই অবস্থার মধ্যে অবস্থিত, ততদিন আমাদের ভিতরে-বাহিরে, কোনো-না-কোনো রূপ আদর্শ বা মূর্তির প্রয়োজন হইয়া থাকে ।' - [স্বামী বিবেকানন্দ, ভক্তি-রহস্য]

২৯) নরসিংহ : পুত্রের (প্রহ্লাদের) প্রীতি ও পিতার (হিরণ্যকশিপুর) বিদ্বেষ মূর্তিমান নরসিংহ-রূপ ধারণ করিল । বিদ্বেষ-সিংহ অভক্তকে বিনাশ করিল, ভক্তবৎসল নরদেব ভক্তকে ক্রোড়ে লইলেন । এই ভক্ত-রক্ষক ও অভক্ত-নাশক রূপ ভক্তের প্রীতি- ও অভক্তের বিদ্বেষ-ভাবেরই প্রতিমূর্তি - উহা ভগবানের বৈষম্য-প্রসূত নহে ।

৩১) ভক্তি-স্পর্শমণি :
অতি পাপাসক্ত ব্যক্তিও যদি নিমেষমাত্র অচ্যুতের ধ্যান করেন, তবে তিনি তপস্বী বলিয়া পরিগণিত হন; তিনি যাঁহাদিগের মধ্যে উপবেশন করেন তাঁহারাও পবিত্র বলিয়া পরিগণিত হন ।

নিমেষমাত্রে অসাধু সাধু হইয়া উঠে, এ-কথা অত্যুক্তি নহে । অন্ধকার গৃহে দীপ জ্বালিলে নিমেষমাত্রেই গৃহ আলোকিত হয়, স্পর্শমণির সংস্পর্শে নিমেষমাত্রেই লৌহখণ্ড সুবর্ণ হয়, ভক্তিস্পর্শেও মানুষ নিমেষমাত্রেই পবিত্র হইয়া যায় । ভক্তির এই পতিতপাবনী শক্তি আছে । কৃষ্ণসেবা, সাধুসঙ্গ, গুরুকৃপায় উহা লাভ হয় । মহাপুরুষগণ এই শক্তি সঞ্চারিত করিতে পারেন ।

তাই দেখি, সেই দরিদ্র ব্রাহ্মণ ধনলোভে বৃন্দাবনে দৌড়িলেন, সনাতন গোশ্বামীর নিকট পার্থিব স্পর্শমণি পাইলেন; কিন্তু উহা লইয়া আর গৃহে ফিরিতে পারিলেন না । গোস্বামীর পাদমূলে লুণ্ঠিত হইয়া সেই অপার্থিব স্পর্শমণি যাচ্ঞা করিলেন - 
'যে ধনে হইয়া ধনী,      মণিরে মান না মণি
                    তাহারই খানিক
মাগি আমি নত শিরে' ।  এত বলি নদীনীরে
                    ফেলিল মাণিক !

প্রায়শ্চিত্ত : জীবের পাপের সীমা নাই । শাস্ত্রেও বিধি-নিষেধের অন্ত নাই । সুতরাং প্রায়শ্চিত্তেরও নানা বিধান । গ্রহ-বিপ্রকে স্বর্ণদান হইতে তুষানলে জীবনদান পর্যন্ত কৃচ্ছ্র, অতিকৃচ্ছ্র, মহাকৃচ্ছ্র ইত্যাদি-রূপ প্রায়শ্চিত্তের অসংখ্য বিধি-ব্যবস্থা । কৃচ্ছ্র-সাধনে চিত্ত-শুদ্ধি হয়, সন্দেহ নাই; কিন্তু আন্তরিক অনুশোচনা ও ভগবদ্ভক্তির সহিত সংযুক্ত না হইলে উহা প্রাণহীন অনুষ্ঠান মাত্রে পর্যবসিত হয় । বরং দেশ-কাল-পাত্র-ভেদে সুব্যবস্থিত না হইলে সামাজিক অত্যাচার বলিয়াই গণ্য হয় ।

৩২) পাপযোনয়ঃ : পাপযোনি-সম্ভূত, নীচকুলজাত (অন্ত্যজ) । এই শব্দটি স্ত্রী-শূদ্রাদির বিশেষণ নয় ।

শাস্ত্রজ্ঞানশূন্য স্ত্রী-শূদ্রাদির পক্ষে জ্ঞানযোগের সাহায্যে মুক্তি লাভ সম্ভবপর নহে । কিন্তু ভক্তিযোগ জাতিবর্ণনির্বিশেষে সকলের পক্ষেই সুখসাধ্য; ভাগবত ধর্মের ইহাই বিশেষত্ব । ইহাতে জাতিভেদ-জনিত অধিকারভেদ নাই ।

৩৪) ঐকান্তিক ধর্ম - ভগবৎ-শরণাগতি :
একান্ত ভাবে ভগবানের শরণ লইয়া নিত্যযুক্ত হইয়া তাঁহার ভজনা করা এবং স্বধর্মরূপে ভৃত্যবৎ তাঁহারই কর্ম সম্পাদন করা ।

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : দশম অধ্যায় - বিভূতি-যোগ

শ্রীভগবান্‌ কহিলেন -
হে মহাবাহো, তুমি আমার বাক্য শ্রবণে প্রীতি লাভ করিয়াছ, আমি তোমার হিতার্থ পুনরায় উৎকৃষ্ট কথা বলিতেছি, তাহা শ্রবণ কর । ১

কি দেবগণ, কি মহর্ষিগণ কেহই আমার প্রভাব বা উৎপত্তির বিষয় জ্ঞাত নহেন ।  কেননা আমি দেব ও মনুষ্যগণের সর্বপ্রকারেই আদিকারণ । ২

যিনি জানেন যে আমার আদি নাই, জন্ম নাই, আমি সর্বলোকের মহেশ্বর, মনুষ্য মধ্যে তিনি মোহশূন্য হইয়া সর্বপাপ হইতে মুক্ত হন । ৩

বুদ্ধি, জ্ঞান, কর্তব্য বিষয়ে অব্যাকুলতা, ক্ষমা, সত্য, দম, শম, সুখ, দুঃখ, জন্ম, মৃত্যু, ভয়, অভয়, অহিংসা, রাগদ্বেষাদি বিষয়ে সমচিত্ততা, সন্তোষ, তপঃ, দান এবং যশ ও অযশ - প্রাণিগণের এই সমস্ত ভিন্ন ভিন্ন ভাব (অবস্থা) আমা হইতেই উৎপন্ন হইয়া থাকে । ৪,৫

ভৃগু প্রভৃতি সপ্তমহর্ষি, তাঁহাদের পূর্ববর্তী চারি জন মহর্ষি (অথবা সংকর্ষণাদি চতুর্ব্যুহ) এবং স্বায়ম্ভূবাদি মনুগণ,- ইহারা সকলেই আমার মানসজাত এবং আমার জ্ঞানৈশ্বর্য-শক্তিসম্পন্ন; জগতের সকল প্রজা তাহাদিগ হইতে উৎপন্ন হইয়াছে । ৬

যিনি আমার এই বিভূতি (ভৃগু, মন্বাদি) এবং যোগৈশ্বর্য যথার্থরূপে জানেন, তিনি মৎভক্তিলক্ষণ স্থির যোগ লাভ করেন এবং আমাতেই সমাহিতচিত্ত হন, তাহাতে সংশয় নাই । ৭

আমি সমস্ত জগতের উৎপত্তির কারণ ।  আমা হইতে সমস্ত প্রবর্তিত হয়; বুদ্ধিমান্‌গণ ইহা জানিয়া প্রেমাবিষ্ট হইয়া আমার ভজনা করেন । ৮

যাহাদিগের চিত্তই আমাতেই অর্পিত, যাঁহারদের প্রাণ মদ্গত (আমাকে ভিন্ন যাঁহারা প্রাণ ধারণে অসমর্থ), এইরূপ ভক্তগণ পরস্পরকে আমার কথা বুঝাইয়া এবং সর্বদা আমার কথা কীর্তন করিয়া পরম সন্তোষ লাভ করেন ।  তাঁহাদের আর কোন অভাব থাকে না, সুতরাং তাহারা পরম প্রেমানন্দ উপভোগ করিয়া থাকেন । ৯

যাঁহারা সতত আমাতে চিত্তার্পণ করিয়া প্রীতিপূর্বক আমার ভজনা করেন সেই সকল ভক্তকে আমি ঈদৃশ বুদ্ধিযোগ প্রদান করি, যদ্দারা তাঁহারা আমাকে লাভ করিয়া থাকেন । ১০

আমার সেই ভক্তগণের প্রতি অনুগ্রহার্থই তাঁহাদের অন্তঃকরণে অবস্থিত হইয়া উজ্জ্বল জ্ঞানরূপ দীপদ্বারা তাহাদের অজ্ঞানান্ধকার বিনষ্ট করি । ১১

অর্জুন বলিলেন -

আপনি পরব্রহ্ম, পরম ধাম, পরম পবিত্র, ভৃগু প্রভৃতি ঋষিগণ, দেবর্ষি নারদ ও অসিত, দেবল এবং ব্যাস প্রভৃতি আপনাকে নিত্য-পুরুষ, স্বয়ংপ্রকাশ, আদিদেব, জন্মরহিত ও সর্বব্যাপী বিভু বলেন ।  আপনি স্বয়ং আমাকে তাহাই বলিলেন । (১২,১৩)

হে কেশব ! তুমি যাহা আমাকে বলিতেছ সে সকলই সত্য বলিয়া মানি; কারণ, হে ভগবন্ ‌! কি দেব কি দানব, কেহই তোমার প্রভাব (বা আবির্ভাবতত্ত্ব) জানেন না (আমি ক্ষুদ্র মনুষ্য, উহা কি বুঝিব ?) ১৪

হে পুরুষত্তম, হে ভূতভাবন, দেবদেব, হে জগৎপতে, তুমি আপনি আপন জ্ঞানে আপন স্বরূপ জান ।  (তোমার স্বরূপ আর কেহ জানে না) । ১৫

তুমি যে যে বিভূতি দ্বারা সর্বলোক ব্যাপিয়া রহিয়াছ তাহা তুমিই বলিতে সমর্থ ।  সে সকল বিস্তৃতরূপে আমাকে কৃপাপূর্বক বল । ১৬

হে যোগিন্‌, কি প্রকারে সতত চিন্তা করিলে আমি তোমাকে জানিতে পারি ? হে ভগবন্‌‌, আমি তোমাকে কোন্‌ কোন্‌ পদার্থে কি ভাবে চিন্তা করিব, তাহা বল । ১৭

হে জনার্দন ! তুমি পুনরায় তোমার যোগৈশ্বর্য ও বিভূতি-সকল আমাকে বিস্তৃতরূপে বল ।  যেহেতু তোমার অমৃতোপম বচন শ্রবণ করিয়া আমার তৃপ্তি হইতেছে না । ১৮

শ্রীভগবান্‌ কহিলেন
 -

আচ্ছা, আমার প্রধান প্রধান দিব্য বিভূতিসকল তোমাকে বলিতেছি ।  কারণ আমার বিভূতি-বাহুল্যের অন্ত নাই ।  (সুতরাং সংক্ষেপে বলিতেছি ।) ১৯

হে অর্জুন, সর্বভূতের হৃদয়স্থিত আত্মা (প্রত্যক্‌ চৈতন্য) আমিই । আমিই সর্বভূতের উৎপত্তি, স্থিতি ও সংহার স্বরূপ (অর্থাৎ সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়কর্তা) । ২০

দ্বাদশ আদিত্যের মধ্যে আমি বিষ্ণু নামক আদিত্য ।  জ্যোতিষ্কগণের মধ্যে আমি কিরণমালী সূর্য ।  মরুৎগণের মধ্যে আমি মরীচি এবং নক্ষত্রগণের মধ্যে চন্দ্র । ২১

বেদসমূহের মধ্যে আমি সামবেদ, দেবগণের মধ্যে আমি ইন্দ্র, ইন্দ্রিয়গণের মধ্যে আমি মন এবং ভূতগণের আমি চেতনা (জ্ঞানশক্তি) । ২২

একাদশ রুদ্রের মধ্যে আমি শঙ্কর, যক্ষরক্ষোগণের মধ্যে আমি কুবের, অষ্ট বসুর মধ্যে আমি অগ্নি এবং পর্বতগণের মধ্যে আমি সুমেরু । ২৩

হে পার্থ ! আমাকে পুরোহিতগণের প্রধান বৃহস্পতি জানিও, আমি সেনানায়কগণের মধ্যে দেব সেনাপতি কার্তিকেয় এবং জলাশয় সমূহের মধ্যে আমি সাগর । ২৪

মহর্ষিগণের মধ্যে আমি ভৃগু, শব্দসকলের মধ্যে আমি একাক্ষর ওঁকার, যজ্ঞসকলের মধ্যে আমি জপযজ্ঞ এবং স্থাবর পদার্থের মধ্যে আমি হিমালয় । ২৫

আমি বৃক্ষসকলের মধ্যে অশ্বত্থ, দেবর্ষিগণের মধ্যে নারদ, গন্ধর্বগণের মধ্যে চিত্ররথ এবং সিদ্ধপুরুষগণের মধ্যে কপিলমুনি । ২৬

অশ্বগণের মধ্যে অমৃতার্থ সমুদ্র মন্থনকালে উদ্ভূত উচ্চৈঃশ্রবাঃ বলিয়া আমাকে জানিও; এবং হস্তিগণের মধ্যে ঐরাবত এবং মনুষ্যগণের মধ্যে রাজা বলিয়া আমাকে জানিও । ২৭

আমি অস্ত্রসমুহের মধ্যে বজ্র, ধেনুগণের মধ্যে কামধেনু, আমি প্রাণিগণের উৎপত্তি হেতু কন্দর্প; এবং আমি সর্পগণের মধ্যে বাসুকি । ২৮

নাগগণের মধ্যে আমি অনন্ত, জলচরগণের মধ্যে আমি জলদেবতা বরুণ, পিতৃগণের মধ্যে আমি অর্যমা, এবং ধর্মাধর্ম ফলদানের নিয়ন্তৃগণ মধ্যে আমি যম । ২৯

দৈত্যগণের মধ্যে আমি প্রহ্লাদ, গ্রাসকারীদিগের মধ্যে আমি কাল, পশুগণের মধ্যে আমি সিংহ, পক্ষিগণের মধ্যে আমি গরুড় । ৩০

বেগবান্‌দিগের মধ্যে আমি বায়ু, শস্ত্রধারিগণের মধ্যে আমি দাশরথি রাম, মৎস্যগণের মধ্যে আমি মকর এবং নদীসমুহের মধ্যে আমি গঙ্গা । ৩১

হে অর্জুন, সৃষ্ট পদার্থ মাত্রেই আদি, মধ্য ও অন্ত (উৎপত্তি, স্থিতি ও বিনাশকর্তা) আমি, বিদ্যাসমূহের মধ্যে আমি আত্মবিদ্যা বা ব্রহ্মবিদ্যা; তার্কিকগণের বাদ, জল্প ও বিতণ্ডা নামক তর্কসমূহের মধ্যে আমি বাদ (তত্ত্বনির্ণয়ার্থ বিচার) । ৩২

অক্ষরসমূহের মধ্যে আমি অকার, সমাসসমূহের মধ্যে আমি দ্বন্দ্ব, আমিই অক্ষয় কালস্বরূপ, এবং আমিই সমুদয় কর্মফলের বিধান-কর্তা । ৩৩

সংহর্তাদিগের মধ্যে আমি সর্বসংহারক মৃত্যু, ভবিষ্য প্রাণিগণেরও আমি উদ্ভব স্বরূপ; নারীগণের মধ্যে আমি কীর্তিশ্রীবাক্‌স্মৃতিমেধাধৃতিক্ষমা - এই সকল দেবতাস্বরূপ, অর্থাৎ ঐ সকল আমারই বিভূতি । ৩৪

আমি সামবেদোক্ত মন্ত্রসকলের মধ্যে বৃহৎ সাম, ছন্দোবিশিষ্ট মন্ত্রের মধ্যে গায়ত্রী; আমি বৈশাখাদি দ্বাদশ মাসের মধ্যে অগ্রহায়ণ মাস, এবং ঋতুসকলের মধ্যে বসন্ত ঋতু । ৩৫

আমি বঞ্চনাকারিগণের দ্যূতক্রীড়া (Gambling), আমি তেজস্বিগণের তেজঃ ।  বিজয়ী পুরুষের জয়, উদ্যোগী পুরুষের উদ্যম এবং সাত্ত্বিক পুরুষের সত্ত্বগুণ । ৩৬

আমি বৃষ্ণি-বংশীয়দিগের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণ, পাণ্ডবগণের মধ্যে ধনঞ্জয়, মুনিগণের মধ্যে ব্যাস, কবিগণের মধ্যে শুক্রাচার্য । ৩৭

আমি শাসনকর্তৃগণের দণ্ড, জয়েচ্ছু ব্যক্তিগণের সামাদি-নীতি, গুহ্য বিষয়ের মধ্যে মৌন, এবং জ্ঞানিগণের জ্ঞান । ৩৮

হে অর্জুন, সর্বভূতের যাহা বীজস্বরূপ তাহাই আমি, আমা ব্যতীত উদ্ভূত হইতে পারে চরাচরে এমন পদার্থ নাই । ৩৯

হে পরন্তপ, আমার দিব্য বিভূতিসমূহের অন্ত নাই ।  আমি এই যাহা কিছু বিভূতি বিস্তার বলিলাম, তাহা আমার বিভূতিসকলের সংক্ষেপে বা দিগ্‌দর্শন মাত্র । ৪০

যাহা যাহা কিছু ঐশ্বর্যযুক্ত, শ্রীসম্পন্ন অথবা অতিশয় শক্তিসম্পন্ন তাহাই আমার শক্তির অংশসম্ভূত বলিয়া জানিবে । ৪১

অথবা হে অর্জুন, তোমার এত বহু বিভূতিবিস্তার জানিয়া প্রয়োজন কি? (এক কথায় বলিতেছি) আমি এই সমস্ত জগৎ আমার একাংশ মাত্র দ্বারা ধারণ করিয়া অবস্থিত আছি । ৪২
___________________________


(১) সপ্তম, অষ্টম ও নবম অধ্যায়ে  পরমেশ্বরের স্বরূপ বর্ণনপ্রসঙ্গে তাঁহার নানা ব্যক্ত রূপ বা বিভূতির কথা সংক্ষেপে বলা হইয়াছে ।  উহাই এই অধ্যায়ে সবিস্তারে বলিবেন ।

(২) ঋগ্‌বেদীয় নাসদীয় সূক্তের ঋষি আদি কারণ সন্বন্ধে ঠিক এই কথাই বলিয়াছে - ‘অর্বাগ্‌ দেবা অস্য বিসর্জ্জনেনাথ কো বেদ যত আবভূব’ [ঋক্‌|১০|১|৯|৬], - দেবতারাও এই বিসর্গের (সৃষ্টির) পরে হইল ।  আবার উহা সেখান হইতে নিঃসৃত হইল তাহা কে জানিবে ?

(৪,৫) তিনিই সকল অবস্থা, সকল ভাব, সকল বৃত্তির মূল কারণ ।  তাহাই এই দুইটি শ্লোকে বলা হইয়াছে ।

৬) সপ্ত মহর্ষি : 1)মরীচি, 2)অঙ্গিরস, 3)অত্রি, 4)পুলস্ত্য, 5)পুলহ, 6)ক্রতু, 7)বশিষ্ঠ [মভাঃ|শাঃ|৩৩৫|২৮-২৯, ৩৪০|৪৪-৪৫] । মতান্তরে 1)ভৃগু, 2)মরীচি, 3)অত্রি, 4)অঙ্গিরা, 5)পুলহ, 6)পুলস্ত্য, 7)ক্রতু ।

পূর্বে চত্বারঃ : টীকাকারগণের অনেকেই বলেন, ইঁহারা (i)সনক, (ii)সনন্দ, (iii)সনাতন, (iv)সনৎকুমার, এই চারি মহর্ষি; কিন্তু ইঁহারা সকলেই চিরকুমার, প্রজা সৃষ্টি করেন নাই । সুতরাং লোকমান্য তিলক বলেন, - ইঁহারা (i)বাসুদেব (আত্মা), (ii)সঙ্কর্ষণ (জীব), (iii)প্রদ্যুম্ন (মন), (iv)অনিরুদ্ধ (অহঙ্কার), এই চারি মূর্তি বা 'চতুর্ব্যূহ' । মহাভারতে নারায়ণীয় বা ভাগবত-ধর্ম বর্ণনায় এই চতুর্ব্যূহের উল্লেখ আছে এবং গীতায়ও এই ভাগবত-ধর্মই প্রতিপাদিত হইয়াছে । এখানে বলা হইতেছে যে, এই চারি ব্যূহ এক সর্বতঃপূর্ণ বাসুদেবেরই বিভাব ।

মনবঃ : চতুর্দশ মনু, যথা 1)স্বায়ম্ভূব, 2)স্বারোচিষ, 3)উত্তম, 4)তামস, 5)রৈবত, 6)চাক্ষুষ, 7)বৈবস্বত, 8)সাবর্ণি, 9)দক্ষসাবর্ণি, 10)ব্রহ্মসাবর্ণি, 11)ধর্মসাবর্ণি, 12)রুদ্রসাবর্ণি, 13)দেবসাবর্ণি, 14) ইন্দ্রসাবর্ণি । [বিশদ]

১১) 'পরাভক্তি ও পরা বিদ্যা এক...' [স্বামী বিবেকানন্দ] । যাঁহারা অনন্যভক্তি যোগে তাঁহার ভজনা করেন, তাঁহারা সেই ভক্তিবলেই তত্ত্বজ্ঞান লাভ করিয়া মায়ামোহ-নির্মুক্ত হইয়া তাঁহাকে প্রাপ্ত হন ।

১৭) অবতার, আবেশ, বিভূতি :
অবতার : ভক্তিশাস্ত্রে নানাবিধ অবতারের উল্লেখ আছে - পুরুষ অবতার (সঙ্কর্ষণাদি), লীলাবতার (মৎস্য-কূর্মাদি), যুগাবতার (শ্রীচৈতন্য, শ্রীরামকৃষ্ণ) ।

আবেশ : যখন কোনো মহাপুরুষে ঈশ্বরের শক্তিবিশেষের বিশেষ অভিব্যক্তি হয়, তখন তাহাকে আবেশ বলে; যেমন সনকাদিতে জ্ঞানশক্তি, নারদে ভক্তিশক্তি, অনন্তে ভূধারণশক্তি ইত্যাদি । ইঁহাদিগকে শক্ত্যাবেশ-অবতারও বলা হয় ।

বিভূতি : বিশ্বে সর্বত্রই ঐশী শক্তিরই প্রকাশ, কিন্তু যাহা-কিছু অতিশয় ঐশ্বর্যযুক্ত, শ্রীসম্পন্ন বা শক্তিসম্পন্ন তাহাতেই তাঁহার শক্তির বিশেষ অভিব্যক্তি কল্পনা করা হয় । ইহাকেই বিভূতি বলে । বলা বাহুল্য, বিভূতি ঈশ্বর নহেন ।

'একটি বিড়ালের মধ্যে ঈশ্বর দর্শন - সে তো খুব ভাল কথা - তাহাতে কোনো বিপদাশঙ্কা নাই, বিড়ালের বিড়ালত্ব ভুলিতে পারিলেই আর-কোনো গোল নাই, কারণ তিনিই সব । কিন্তু বিড়ালরূপী ঈশ্বর প্রতীক মাত্র ।' - [স্বামী বিবেকানন্দ]

২১) দ্বাদশ আদিত্য - ধাতা, মিত্র, অর্যমা, রুদ্র, বরুণ, সূর্য, ভগ, বিবস্বান, পূষা, সবিতা, ত্বষ্টা, বিষ্ণু । 

মরুতাম্‌ - ঊনপঞ্চাশ বায়ুর মধ্যে ।

২২) সাধারণতঃ বেদসমূহ মধ্যে ঋগ্বেদকেই প্রধান বলা হয় এবং ৯।১৭ শ্লোকে ‘ঋক্‌সামযজুরেব চ’ এই কথায় উহাকেই অগ্র স্থান দেওয়া হইয়াছে ।  কিন্তু সামবেদ গান-প্রধান বলিয়া উহার আকর্ষণী শক্তি অধিক এবং ভক্তিমার্গে পরমেশ্বরের স্তবস্তুতিমূলক সঙ্গীতেরই প্রাধান্য দেওয়া হয় ।  - ‘মদ্ভক্তা যত্র গায়ন্তি তত্র তিষ্ঠামি নারদ ।’ এই হেতু যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়াকর্মাত্মক বেদ অপেক্ষা গানপ্রধান সামবেদেরেই শ্রেষ্ঠত্ব কথিত হইয়াছে ।

২৫) জপযজ্ঞ - নামমাহাত্ম্য : সর্ববিধ যজ্ঞের (দ্রব্য-, জ্ঞান-, ব্রহ্ম-, তপো-যজ্ঞ) মধ্যে জপযজ্ঞ বা নামযজ্ঞই শ্রেষ্ঠ । সুতরাং উহাই শ্রীভগবানের বিভূতি । কলিতে নাম-সংকীর্তনই শ্রেষ্ঠ সাধন বলিয়া পরিগণিত । শ্রীমাদ্ভাগবত বলেন - কলি অশেষ দোষের আকর হইলেও উহার একটি মহৎ গুণ এই যে, কলিতে কৃষ্ণনাম-কীর্তন দ্বারাই সংসারবন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া পরমগতি প্রাপ্ত হওয়া যায় ।

নামের দার্শনিক তত্ত্ব : নাম ও নামী অভেদ । সমগ্র জগৎ নামরূপাত্মক । ভাব, নাম ও রূপ - একই বস্তু, সূক্ষতর, কিঞ্চিৎ ঘনীভূত ও সম্পূর্ণ ঘনীভূত । সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের অন্তরালে নাম রহিয়াছে, আর সেই নাম হইতেই এক বহির্জগৎ সৃষ্ট বা বহির্গত হইয়াছে ।

সকল ধর্মেই এই নামকে শব্দব্রহ্ম বলিয়া থাকে । হিন্দুদের মতে এই নাম বা শব্দ ওঁ; এই ওঁকার জগতের সমষ্টিভাব বা ঈশ্বরের নাম । ব্যষ্টিভাব তাঁহার অনন্ত নাম । বস্তুত এইরূপ নাম বা পবিত্র শব্দ অনেক আছে । ভক্ত যোগীরা সেই বিভিন্ন নামের সাধন-উপদেশ দিয়া থাকেন । সদ্গুরু-পরম্পরা-ক্রমে আসিলেই নাম শক্তিসম্পন্ন থাকে এবং পুনঃপুনঃ জপে তাহা অনন্তশক্তিসম্পন্ন হয় । ঐ মন্ত্রের বারবার উচ্চারণে ভক্তির উচ্চতম অবস্থা আসে । - [স্বামী বিবেকানন্দ, ভক্তিরহস্য]

২৬) দেবর্ষি - দেবতা হইয়াও যিনি মন্ত্রদ্রষ্টা বলিয়া ঋষিত্ব লাভ করিয়াছেন, যেমন নারদ ।
গন্ধর্বগণ = দেবগায়ক
কপিলমুনি = সাংখ্যদর্শনের প্রণেতা ।

২৮) কন্দর্পঃ = কাম
প্রজনঃ : প্রাণিগণের উৎপত্তি-হেতু কন্দর্প (কাম), এই কথাতে সম্ভোগমাত্র যে কামের পরিণাম তাহা নিকৃষ্ট, ইহাই সূচিত হইয়াছে ।

২৯) অর্যমা - পিতৃগণের অধিপতি । পিতৃগণের নাম এই - অগ্নিষ্বত্বা, সৌম্য, হবিষ্মান, উষ্মপা, সুকাল, বহির্ষদ এবং আজ্যপ । বেদে অর্যমার নাম দৃষ্ট হয় ।

নাগ ও সর্প : ইহারা এ-স্থলে দুই বিভিন্ন জাতি বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে । সর্পগণের রাজা বাসুকি এবং নাগগণের রাজা অনন্ত বা শেষনাগ । অনন্ত অগ্নিবর্ণের এবং বাসুকি হরিদ্রাবর্ণের ।

৩০) কলয়তাম্‌ : সকলকেই বশীভূত করেন বা সকলেরই দিন গণনা করেন কাল, অথবা ঘটনাসমূহের নির্দেশকারিগণের মধ্যে কালই শ্রেষ্ঠ । কিংবা কলয়ৎ-শব্দের অর্থ গ্রাসকারীও হয় [তিলক] ।

৩২) তর্কশাস্ত্রে তিন প্রকার তর্ক আছে - (i)জল্প (জিগীষা-পরতন্ত্র হইয়া যে-প্রকারেই হউক আত্মমত-স্থাপন), (ii)বিতণ্ডা (পরপক্ষদূষণ), (iii)জিগীষু না হইয়া কেবল সত্য নির্ণয়ের জন্য উভয় পক্ষে যে বিচার) ।

পূর্বে ২০ শ্লোকে ‘আমি ভূত সকলের আদি, অন্ত ও মধ্য’ এরূপ বলা হইয়াছে ।  উহা সচেতন সৃষ্টি সন্বন্ধে বলা হইয়াছে এবং এই শ্লোকে চরাচর সমগ্র সৃষ্টি সন্বন্ধেই এই কথা বলা হইল, ইহাই প্রভেদ ।

৩৩) অকার আদি বর্ণ এবং সকল বর্ণের ইচ্চারণে উহাই প্রকাশিত হয়; এই হেতু উহার শ্রেষ্ঠত্ব ।
দ্বন্দ্ব-সমাসে উভয় পদেরই প্রাধান্য থাকে, এই হেতু উহা শ্রেষ্ঠ ।
এখানে কাল বলিতে অবিচ্ছিন্ন প্রবাহস্বরূপ অক্ষয় কাল (eternal time) ।

৩৪) কীর্তিলক্ষ্মীধৃতিসেবাপুষ্টিশ্রদ্ধাক্রিয়াবুদ্ধিলজ্জামতি - দক্ষের এই দশ কন্যার ধর্মের সহিত বিবাহ হয় ।  এইজন্য ইহাদিগকে ধর্মপত্নী বলে ।  উহার তিনটা এখানে উল্লিখিত হইয়াছে ।

৩৫) বৃহৎসাম - এই মন্ত্রদ্বারা ইন্দ্র (ব্রহ্ম) সর্বেশ্বররূপে স্তুত হন । এইহেতু মোক্ষ-প্রতিপাদক বলিয়া উহার শ্রেষ্ঠত্ব ।
মার্গশীর্ষ বা অগ্রহায়ণ মাস হইতেই সে-সময়ে বৎসর গণনা হইত, এই হেতু মার্গশীর্ষকে প্রধান স্থান দেওয়া হয়েছে [মভা|অনু|১০৬,১০৯; বাল্মিকী রামায়ণ|৩|১৬; ভাগবত|১১|১৬|২৭] । মার্গশীর্ষ নক্ষত্রকে অগ্রহায়ণী অর্থাৎ বর্ষারম্ভের নক্ষত্র বলা হইত [গীতারহস্য, লোকমান্য তিলক] ।

৩৬) ভাল-মন্দ সকলই তাঁহা হইতে জাত, সুতরাং বঞ্চনা করিবার শ্রেষ্ঠ উপায় যে দ্যূতক্রীড়া তাহাও তাঁহারই বিভূতি [গী|৭|১২] ।

৩৭) মুনি = বেদার্থমননশীল; কবি = সূক্ষ্মার্থদর্শী; শুক্রাচার্য = অসুরদিগের গুরু

যে শ্রেণীর যাহা প্রধান তাহাতেই ঐশ্বরিক শক্তির সমধিক বিকাশ এবং তাহাই বিভূতি বলিয়া গণ্য ।  এই হেতু বৃষ্ণিগণের প্রধান শ্রীকৃষ্ণ, ভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণের বিভূতি ।  ব্যাসদেব মুনিগণের প্রধান ।  ইনি বেদ বিভাগ করেন এবং মহাভারত, ভাগবত ও অন্যান্য পুরাণ সমস্ত রচনা করেন ।  আবার, ব্রহ্মসূত্র বা বেদান্ত দর্শনের রচয়িতা বলিয়াও ইনি প্রসিদ্ধ ।  অথচ এই সকল গ্রন্থের রচনাকাল শত শত বৎসর ব্যবধান ।  এই হেতু অনেকে বলেন - এক ব্যাসই বহুবার জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন ।  যোগিশ্রেষ্ঠ বশিষ্ঠদেব লিখিয়াছেন যে, এক ব্যাসকেই বহুবার জন্মগ্রহণ করিতে দেখিয়াছেন ।  -“ইমং ব্যাসমুনিং তত্র দ্বাত্রিংশং সংস্মরাম্যহম্‌’’ ।

৩৮) নীতিঃ : শত্রুজয় বা রাজ্যরক্ষার উপায় । রাজনীতি (State-crafts) - সাম, দান, ভেদ, দণ্ড ।

দণ্ড, রাজ্যশাসন বা সমাজশাসনের মুখ্য উপায়, এই হেতু উহা বিভূতি; মৌনাবলম্বন করিলে মনোভাব কিছুতেই ব্যক্ত হয় না, সুতরাং উহাই শ্রেষ্ঠ গোপনহেতু ।

বিশ্বানুগ - বিশ্বাতিগ :
শ্রীভগবান বলিতেছেন, - 'আমি একাংশে এই চরাচর বিশ্ব ব্যাপিয়া আছি, আমি বিশ্বরূপ ।' তবে অপরাংশ কিরূপ, কোথায় ? মানব-বুদ্ধি বিশ্বরূপের ধারণাতেই বিহ্বল হইয়া যায়, বিশ্বের অতীত, নাম-রূপের অতীত যে বস্তু, তাহা সে ধারণাই করিতে পারে না । তাহা অনন্ত, অব্যক্ত, অজ্ঞেয় । তিনি মায়া স্বীকার করিয়া সোপাধিক হইলেও সসীম হন না । তিনি বিশ্বানুগ (Immanent) হইয়াও বিশ্বাতিগ (Transcendental), প্রপঞ্চাভিমানী হইয়াও প্রপঞ্চাতীত । তাঁহার এই প্রপঞ্চাতীত বিশ্বাতিগ নির্গুণ স্বরূপ ধারণার অতীত ।

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : একাদশ অধ্যায়

 - বিশ্বরূপ-দর্শন-যোগ

অর্জুন বলিলেন -
তুমি আমার প্রতি অনুগ্রহ করিয়া যে পরম গুহ্য অধ্যাত্ম-তত্ত্ব বর্ণন করিলে তাহাতে আমার এই মোহ বিদূরিত হইল । ১

হে কমললোচন, ভূতগণের উৎপত্তি ও লয় এবং তোমার অক্ষয় মাহাত্ম্য - এ সকলই তোমার নিকট হইতে সবিস্তারে আমি শুনিলাম । ২

হে পরমেশ্বর, তুমি আপনার বিষয় যাহা বলিলে তাহা এইরূপ বটে; হে পুরুষোত্তম, আমি তোমার সেই ঐশ্বরিক রূপ দেখিতে ইচ্ছা করি । ৩

হে প্রভো ! যদি তুমি মনে কর যে, আমি সেই রূপ দর্শনের যোগ্য, তাহা হইলে হে যোগেশ্বর, আমাকে তোমার সেই অক্ষয় আত্মরূপ প্রদর্শন কর । ৪

শ্রীভগবান্‌ বলিলেন -

হে পার্থ, নানা বর্ণ ও নানা আকৃতিবিশিষ্ট শত শত সহস্র সহস্র বিভিন্ন অবয়ববিশিষ্ট আমার এই অদ্ভূত রূপ দর্শন কর । ৫

হে ভারত (অর্জুন), এই আমার দেহে দ্বাদশ আদিত্য, অষ্ট বসু, একাদশ রুদ্র, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, এবং ঊনপঞ্চাশৎ মরুদ্‌গণ দর্শন কর; পূর্বে যাহা কখনও দেখ নাই, তেমন বহুবিধ আশ্চর্য বস্তু দর্শন কর । ৬

হে নিদ্রাজয়ী অর্জুন, আমার এই দেহে একত্র অবস্থিত চরাচর সমগ্র জগৎ দর্শন কর এবং অপর যাহা কিছু তুমি দেখিতে ইচ্ছা কর, তাহাও এখন দেখিয়া লও । ৭

হে অর্জুন, তুমি তোমার এই চর্মচক্ষুদ্বারা আমার এই রূপ দর্শনে সমর্থ হইবে না । এজন্য তোমাকে দিব্যচক্ষু দিতেছি, তদ্দারা আমার এই ঐশ্বরিক যোগসামর্থ্য দেখ । ৮

সঞ্জয় কহিলেন -

হে রাজন্‌ মহাযোগেশ্বর হরি এইরূপ বলিয়া তৎপর পার্থকে পরম ঐশ্বরিক রূপ দেখাইলেন । ৯

সেই ঐশ্বরিক রূপে অসংখ্য মুখ, অসংখ্য নেত্র, অসংখ্য অদ্ভুত অদ্ভুত দর্শনীয় বস্তু, অসংখ্য দিব্য আভরণ এবং অসংখ্য উদ্যত দিব্যাস্ত্রসকল বিদ্যমান (ছিল) । ১০

সেই বিশ্বরূপ দিব্য মাল্য ও দিব্য বস্ত্রে সুশোভিত, দিব্যগন্ধদ্রব্যে অনুলিপ্ত, সর্বাশ্চর্যময়, দ্যুতিমান্‌ অনন্ত ও সর্বতোমুখ (সর্বত্র মুখবিশিষ্ট) (ছিল) । ১১

আকাশে যদি যুগপৎ সহস্র সূর্যের প্রভা উত্থিত হয়, তাহা হইলে সেই সহস্র সূর্যের প্রভা মহাত্মা বিশ্বরূপের প্রভাব তুল্য হইতে পারে । ১২

তখন অর্জুন সেই দেবদেবের দেহে নানা ভাবে বিভক্ত তদীয় অঙ্গপ্রত্যঙ্গ স্বরূপ একত্রস্থিত সমগ্র জগৎ দেখিয়াছিলেন । ১৩

সেই বিশ্বরূপ দর্শন করিয়া ধনঞ্জয় বিস্ময়ে আপ্লুত হইলেন । তাঁহার সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল । তিনি অবনতমস্তকে সেই দেবদেবকে প্রণাম করিয়া করজোরে বলিতে লাগিলেন । ১৪

অর্জুন বলিলেন -

হে দেব, তোমার দেহে আমি সমস্ত দেবগণ, স্থাবর জঙ্গমাত্মক বিবিধ সৃষ্ট পদার্থ, সৃষ্টিকর্তা কমলাসনস্থ ব্রহ্মা, নারদ-সনকাদি দিব্য কবিগণ এবং অনন্ত্য-তক্ষকাদি সর্পগণকে দেখিতেছি । ১৫

অসংখ্য বাহু, উদর, বদন ও নেত্রবিশিষ্ট অনন্তরূপ তোমাকে সকল দিকেই আমি দেখিতেছি । কিন্তু হে বিশ্বেশ্বর, হে বিশ্বরূপ, আমি তোমার আদি, অন্ত, মধ্য, কোথাও কিছু দেখিতেছি না । ১৬

কিরীট, গদা ও চক্রধারী, সর্বত্র দীপ্তিশালী, তেজঃপুঞ্জস্বরূপ, প্রদীপ্ত অগ্নি ও সূর্যের ন্যায় প্রভাসম্পন্ন, দুর্নিরীক্ষ্য, অপরিমেয় তোমার অদ্ভূত মুর্তি সর্বদিকে সর্বস্থানে আমি দেখিতেছি । ১৭

তুমি অক্ষর পরব্রহ্ম, তুমি একমাত্র জ্ঞাতব্য তত্ত্ব, তুমিই এই বিশ্বের পরম আশ্রয়, তুমিই সনাতন ধর্মের প্রতিপালক, তুমি অব্যয় সনাতন পুরুষ, ইহাতে আমার সংশয় নাই । ১৮

আমি দেখিতেছি, তোমার আদি নাই, মধ্য নাই, অন্ত নাই, তোমার বলৈশ্বর্যের অবধি নাই, অসংখ্য তোমার বাহু, চন্দ্র সূর্য তোমার নেত্রস্বরূপ, তোমার মুখমণ্ডলে প্রদীপ্ত হুতাশন জ্বলিতেছে; তুমি স্বীয় তেজে নিখিল বিশ্বকে সন্তাপিত করিতেছ । ১৯

হে মহাত্মন্‌, একমাত্র তুমিই স্বর্গ ও পৃথিবীর মধ্যস্থল এই অন্তরীক্ষ এবং দিক্‌সকলও ব্যাপিয়া রহিয়াছ । তোমার এই অদ্ভূত উগ্রমূর্তি দর্শন করিয়া ত্রিলোক ব্যথিত হইতেছে । ২০

ঐ দেবতাগণ তোমাতেই প্রবেশ করিতেছেন । কেহ কেহ ভীত হইয়া (জয় জয়, রক্ষ রক্ষ ইত্যাদি বাক্যে) কৃতাঞ্জলিপুটে রক্ষা প্রার্থনা করিতেছেন, মহর্ষি ও সিদ্ধগণ স্বস্তি স্বস্তি বলিয়া উত্তম সারগর্ভ স্তোত্রসমূহদ্বারা তোমার স্তব করিতেছেন । ২১

একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য, অষ্ট বসু, সাধ্যনামক দেবগণ, বিশ্বদেবগণ, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, ঊনপঞ্চাশ মরুৎ, উষ্মপা (পিতৃগণ), গন্ধর্ব, যক্ষ, অসুর ও সিদ্ধগণ সকলেই বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া তোমাকে দর্শন করিতেছেন । ২২

হে মহাবাহো, বহু বহু মুখ, নেত্র, বাহু, ঊরু, পাদ ও উদর বিশিষ্ট এবং বহু বৃহদাকার দন্ত দ্বারা ভয়ঙ্করদর্শন তোমার এই সুবিশাল মূর্তি দেখিয়া লোকসকল ভীত হইয়াছে এবং আমিও ভীত হইয়াছি । ২৩

হে বিষ্ণো, নভঃস্পর্শী, তেজোময়, বিচিত্রবর্ণ, বিস্ফারিতবদন, অত্যুজ্জল বিশালনেত্র-বিশিষ্ট তোমার রূপ দেখিয়া আমার অন্তরাত্মা ব্যথিত হইতেছে, আমার দেহেন্দ্রিয় বিকল হইতেছে, আমি মনকে শান্ত করিতে পারিতেছি না । ২৪

বৃহৎ দন্তসমূহের দ্বারা ভয়ানকদর্শন, প্রলয়াগ্নি সদৃশ তোমার মুখসকল দর্শন করিয়া আমার দৃষ্টিভ্রম ঘটিতেছে (আমি দিশেহারা হইয়াছি), আমি স্বস্তি পাইতেছি না । হে দেবেশ, হে জগন্নিবাস, প্রসন্ন হও (আমার ভয় দূর কর) । ২৫

(জয়দ্রথাদি) রাজন্যবর্গসহ ঐ সকল ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণ এবং ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ এবং আমাদের প্রধান প্রধান যোদ্ধৃগণ তোমার দংষ্ট্রাকরাল ভয়ঙ্করদর্শন মুখগহ্বরে ধাবিত হইয়া প্রবেশ করিতেছে  । কাহারো কাহারো মস্তক চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া গিয়াছে এবং উহা তোমার দন্তসন্ধিতে সংলগ্ন হইয়া রহিয়াছে দেখা যাইতেছে । ২৬,২৭

যেমন নদীসমূহের বিপুল জলপ্রবাহ সমুদ্রাভিমুখ হইয়া সমুদ্রে গিয়া প্রবেশ করে, সেইরূপ এই মনুষ্য লোকের বীরগণ তোমার সর্বতোব্যাপ্ত জ্বলন্ত মুখগহ্বরে প্রবেশ করিতেছে । ২৮

যেমন পতঙ্গগণ অতি বেগে ধাবমান হইয়া মরণের জন্য জ্বলন্ত অগ্নিতে প্রবেশ করে, সেইরূপ এই লোকসকল মরণের নিমিত্তই অতি বেগে তোমার মুখগহ্বরে প্রবেশ করিতেছে । ২৯

তুমি জ্বলন্ত মুখসমূহের দ্বারা লোকসমূহকে গ্রাস করিয়া বারংবার স্বাদগ্রহণ করিতেছ । সমগ্র জগৎ তোমার তীব্র তেজোরাশি-ব্যাপ্ত হইয়া প্রতপ্ত হইয়া উঠিয়াছে । ৩০

উগ্রমূর্তি আপনি কে, আমাকে বলুন । হে দেববর, আপনাকে প্রণাম করি, প্রসন্ন হউন । আদি পুরুষ আপনাকে আমি জানিতে ইচ্ছা করি । আপনি কে, কি কার্যে প্রবৃত্ত, বুঝিতেছি না । ৩১

শ্রীভগবান্‌ কহিলেন -

আমি লোকক্ষয়কারী অতি ভীষণ কাল; এক্ষণে এই লোকদিগকে সংহার করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি; তুমি যুদ্ধ না করিলেও প্রতিপক্ষ সৈন্যদলে যে সকল যোদ্ধা অবস্থান করিতেছে তাহারা কেহই থাকিবে না । ৩২

অতএব, তুমি যুদ্ধার্থ উত্থিত হও; শত্রু জয় করিয়া যশঃ লাভ কর, নিষ্কন্টক রাজ্য ভোগ কর । হে অর্জুন, আমি ইহাদিগকে পূর্বেই নিহত করিয়াছি; তুমি এখন নিমিত্ত-মাত্র হও । ৩৩

দ্রোণ, ভীষ্ম, জয়দ্রথ, কর্ণ এবং অন্যান্য যুদ্ধবীরগণকে আমি পূর্বেই নিহত করিয়া রাখিয়াছি, তুমি সেই হতগণকে নিহত কর; ভয় করিও না । রণে শত্রুগণকে নিশ্চয় নিহত করিতে পারিবে, যুদ্ধ কর । ৩৪

সঞ্জয় বলিলেন -

শ্রীকৃষ্ণের এই বাক্য শ্রবণ করিয়া অর্জুন কম্পিত কলেবরে কৃতাঞ্জলিপুটে কৃষ্ণকে নমস্কার করিলে; আবার অত্যন্ত ভীত হইয়া প্রণামপূর্বক গদ্‌গদ স্বরে বলিতে লাগিলেন । ৩৫

অর্জুন কহিলেন -

হে হৃষীকেশ, তোমার মাহাত্ম্য-কীর্তনে সমস্ত জগৎ যে হৃষ্ট হয় এবং তোমার প্রতি অনুরক্ত হয়, ইহা যুক্তিযুক্ত; রাক্ষসেরা যে তোমার ভয়ে ভীত হইয়া চতুর্দিকে পলায়ন করে, এবং সিদ্ধগণ যে তোমাকে নমস্কার করেন, তাহাও আশ্চর্য নহে । ৩৬

হে মহাত্মন্‌, হে দেবেশ, হে জগন্নিবাস, তুমি ব্রহ্মারও গুরু এবং আদি কর্তা; অতএব সমস্ত জগৎ কেন তোমাকে নমস্কার না করিবে । তুমি সৎ (ব্যক্ত জগৎ), তুমি অসৎ (অব্যক্ত প্রকৃতি) এবং সদসতে অতীত যে অক্ষর ব্রহ্ম তাহাও তুমি । ৩৭

হে অনন্তরূপ, তুমি আদিদেব, তুমি অনাদি পুরুষ, তুমি এই বিশ্বের একমাত্র লয়স্থান, তুমি জ্ঞাতা, তুমিই জ্ঞাতব্য, তুমিই পরমধাম ! তুমি এই বিশ্ব ব্যাপিয়া অবস্থান করিতেছ । ৩৮

বায়ু, যম, অগ্নি, বরুণ, চন্দ্র তুমিই; পিতামহ ব্রহ্মাও তুমি এবং ব্রহ্মার জনকও (প্রপিতামহ) তুমি । তোমাকে সহস্রবার নমস্কার করি, আবার পুনঃ পুনঃ তোমাকে নমস্কার করি । ৩৯

তোমাকে সম্মুখে নমস্কার করি, তোমাকে পশ্চাতে নমস্কার করি; হে সর্বস্বরূপ, সর্বত্রই তুমি - তোমাকে সকল দিকেই নমস্কার করি; অনন্ত তোমার বলবীর্য, অসীম তোমার পরাক্রম । তুমি সমস্ত  ব্যাপিয়া রহিয়াছ, সুতরাং তুমিই সমস্ত । ৪০

তোমার এই বিশ্বরূপ এবং ঐশ্বর্যমহিমা না জানিয়া, তোমাকে সখা ভাবিয়া অজ্ঞানবশতঃ বা প্রণয়বশতঃ, হে কৃষ্ণ, হে মাধব, হে সখা, এইরূপ তোমায় বলিয়াছি; হে অচ্যুত, আহার, বিহার, শয়ন ও উপবেশনকালে একা অথবা বন্ধুজন সমক্ষে পরিহাসচ্ছলে তোমার কত অমর্যাদা করিয়াছি, অচিন্ত্যপ্রভাব তুমি, তোমার নিকট তজ্জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি । ৪১,৪২

হে অমিতপ্রভাব, তুমি এই চরাচর সমস্ত লোকের পিতা; তুমি পূজ্য, গুরু ও গুরু হইতে গুরুতর; ত্রিজগতে তোমার তুল্য কেহই নাই, তোমা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ থাকিবে কি প্রকারে ? ৪৩

হে দেব, পূর্বোক্ত রূপে আমি অপরাধী, সেই হেতু দণ্ডবৎ প্রণামপূর্বক তোমার প্রসাদ প্রার্থনা করিতেছি । সকলের বন্দনীয় ঈশ্বর তুমি; পিতা যেমন পুত্রের, সখা যেমন সখার, প্রিয় যেমন প্রিয়ার অপরাধ ক্ষমা করেন, তুমিও তদ্রুপ আমার অপরাধ ক্ষমা কর । ৪৪

হে দেব, পূর্বে যাহা কখনও দেখি নাই, সেই রূপ দেখিয়া আমার হর্ষ হইয়াছে বটে, কিন্তু ভয়ে মন ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছে; অতএব, তোমার সেই (চির পরিচিত) পূর্বরূপটা আমাকে দেখাও; হে দেবেশ, হে জগন্নিবাস, আমার প্রতি প্রসন্ন হও । ৪৫

কিরীটধারী এবং গদা ও চক্রহস্ত তোমার সেই পূর্বরূপই আমি দেখিতে ইচ্ছা করি । হে সহস্রবাহো, বিশ্বমূর্তে, তুমি চতুর্ভূজ মূর্তি ধারণ কর । ৪৬

শ্রীভগবান্‌ বলিলেন -

আমি প্রসন্ন হইয়া স্বকীয় যোগ প্রভাবেই এই তেজোময়, অনন্ত, আদ্য, বিশ্বাত্মক পরমরূপ তোমাকে দেখাইলাম; আমার এই রূপ তুমি ভিন্ন পূর্বে কেহ দেখে নাই । ৪৭

হে কুরুপ্রবীর, না বেদাধ্যয়ন দ্বারা, না যজ্ঞবিদ্যার অনুশীলন দ্বারা, না দানাদি ক্রিয়াদ্বারা, না উগ্র তপস্যা দ্বারা - মনুষ্যলোকে তুমি ভিন্ন আর কেহ আমার ঈদৃশ রূপ দেখিতে সক্ষম হয় নাই । ৪৮

তুমি আমার এই ঘোর রূপ দেখিয়া ব্যথিত হইও না, বিমূঢ় হইও না, ভয় ত্যাগ করিয়া প্রীত মনে পুনরায় তুমি আমার পূর্বরূপ দর্শন কর । ৪৯

সঞ্জয় বলিলেন -

বাসুদেব অর্জুনকে এই বলিয়া পুনরায় সেই স্বীয় মূর্তি দেখাইলেন; মহাত্মা পুনরায় প্রসন্ন মূর্তি ধারণ করিয়া ভীত অর্জুনকে আশ্বস্ত করিলেন । ৫০

অর্জুন বলিলেন -

হে জনার্দন, তোমার এই সৌম্য মানুষ রূপ দর্শন করিয়া আমি এখন প্রসন্নচিত্ত ও প্রকৃতিস্থ হইলাম । ৫১

শ্রীভগবান্‌ বলিলেন -

তুমি আমার যে রূপ দেখিলে উহার দর্শন লাভ একান্ত কঠিন; দেবগণও সর্বদা এই রূপের দর্শনাকাঙ্ক্ষী । ৫২

আমাকে যেরূপ দেখিলে এই রূপ বেদাধ্যয়ন, তপস্যা, ধ্যান, যজ্ঞ, কোন কিছু দ্বারাই দর্শন করা যায় না । ৫৩

হে পরন্তপ, হে অর্জুন, কেবল অনন্যা ভক্তি দ্বারাই ঈদৃশ আমাকে স্বরূপতা জানিতে পারা যায়, সাক্ষাৎ দেখিতে পারা যায়, এবং আমাতে প্রবেশ করিতে পারা যায় । ৫৪

হে পাণ্ডব, যে ব্যক্তি আমারই কর্মবোধে সমুদয় কর্ম করেন, আমিই যাঁহার একমাত্র গতি, যিনি সর্বপ্রকারে আমাকে ভজনা করেন, যিনি সমস্ত বিষয়ে আসক্তিশূন্য, যাহার কাহারও উপর শত্রুভাব নাই (সর্বভূতে বৈরভাবশূন্য), তিনিই আমাকে প্রাপ্ত হন । ৫৫

___________________________

১) 'সপ্তম অধ্যায়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান আরম্ভ করিয়া সপ্তম ও অষ্টমে পরমেশ্বরের অক্ষর অথবা অব্যক্ত রূপের এবং নবম ও দশমে অনেক ব্যক্ত রূপের যে জ্ঞান বলিয়াছে, তাহাকেই অর্জুন প্রথম শ্লোকে ‘অধ্যাত্ম’ বলিয়াছেন ।' - [গীতারহস্য, লোকমান্য তিলক] । আমার এই মোহ বিনষ্ট হইল অর্থাৎ তোমার প্রকৃত তত্ত্ব জানিয়া, তুমিই সর্বভূতের নিয়ন্তা, সর্ব কর্মের নিয়ামক, ইহা বুঝিতে পারিয়া ‘আমি কর্তা’, ‘আমার কর্ম’ ইত্যাদি রূপে যে আমার মোহ তাহা অপগত হইল, আমি বুঝিতেছি, তুমিই কর্তা, তুমিই যন্ত্রী, আমি যন্ত্রমাত্র ।

৩) তুমি পরমেশ্বর । ‘আমি একাংশে জগৎ ধারণ করিয়া আছি’ ইত্যাদি যাহা তুমি বলিলে তাহা সত্য । আমার বড় ইচ্ছা হইতেছে আমি তোমার সেই বিশ্বরূপ দর্শন করি ।

৭) ‘অপর যাহা কিছু’ এ কথার তাৎপর্য্য এই যে, ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান ত্রিকালের যত কিছু ঘটনা সকলি আমার এই দেহে বিদ্যমান । এই যুদ্ধের জয়-পরাজয়াদি ভবিষ্যৎ ঘটনা যাহা দেখিতে ইচ্ছা কর, তাহাও এই দেহে দেখিতে পাইবে (১১|১৬-৩৩ ইত্যাদি শ্লোক দ্রষ্টব্য) ।

১২) এই শ্লোকে অপূর্ব শব্দবিন্যাসকৌশলে শব্দের ধ্বনি দ্বারাই কিরূপে অর্থ দ্যোতনা হইতেছে, তাহা লক্ষ্য করিবার বিষয় ।

১৯) ‘অনন্ত বাহু’, ‘আদি অন্ত মধ্যহীন’ ইত্যাদি বর্ণনা পূর্বে করা হইয়াছে । কিন্তু হর্ষ-বিস্ময়াদি রসের বর্ণনায় পুনরুক্তি দোষজনক হয় না - “প্রমাদে বিস্ময়ে হর্ষে দ্বিস্ত্রিরুক্তং ন দুষ্যতি ।”

২০) অর্জুন বিশ্বরূপ ব্যতীত আর কিছুই দেখিতেছেন না এবং তিনি এই রূপ দেখিয়া স্বয়ং অত্যন্ত ভীত হইয়াছেন । ‘ত্রিলোক ভীত হইয়াছে’ যে বলিতেছেন উহা তাঁহারই মনের ভাব মাত্র । বস্তুতঃ অর্জুন ব্যতীত আর কেহ বিশ্বরূপ দেখিতে পারে না, দেখেও নাই ।

২২) উষ্মপাঃ = পিতৃগণ; শ্রাদ্ধে পিতৃগণকে যে অন্নাদি দেওয়া হয় তাহা উষ্ণ থাকিলেই তাঁহারা উহার উষ্মভাগ অর্থাৎ তৎতৎ-পদার্থে নিহিত প্রকৃত তেজঃশক্তি গ্রহণ করেন । শাস্ত্রে সাত প্রকার পিতৃগণের উল্লেখ আছে [গী|১০|২৯] ।

২৭) ভগবানের ভূত-ভবিষ্যত নাই, তাঁহার সকলই বর্তমান । তাঁহার দেহে ত্রৈকালিক ঘটনার একত্র সমাবেশ । সুতরাং যুদ্ধ ব্যাপারে যাহা ঘটিবে ভগবান তাঁহার বিরাট দেহে তাহাই দেখাইতেছেন ।

৩১) আমি আপনার বিশ্বরূপ ও বিভূতিসমূহ দেখিতে চাহিয়াছিলাম । কিন্তু আপনার এই সংহারমূর্তি দেখিয়া আমি বুঝিতেছি না, আপনি কে ও কি কার্যে প্রবৃত্ত ।

৩৩) সব্যসাচী = যিনি বাম হস্তে শর-সন্ধান করিতে অভ্যস্ত; অর্জুন

দুর্যোধন যখন সন্ধির সকল প্রস্তাবই অগ্রাহ্য করিলেন, তখন ভীষ্মদেব শ্রীকৃষ্ণকে বলিয়াছিলেন - 'বুঝিতেছি, এই ক্ষত্রিয়েরা কালপক্ক হইয়া উঠিয়াছে ।' - [মহাভারত উদ্যোগপর্ব |১২৭|৩২] । এই কাল কি এবং কালপক্ক কাহাকে বলে, তাহাই শ্রীভগবান বিশ্বরূপে অর্জুনকে প্রত্যক্ষ দেখাইলেন ।

৩৯) প্রজাপতিপ্রপিতামহ : ব্রহ্মা হইতে মরীচি আদি মানস-পুত্রের উৎপত্তি, মরীচি হইতে কশ্যপ এবং কশ্যপ হইতে সমস্ত প্রজার উৎপত্তি । ব্রহ্মা, মরীচি-আদির পিতা, এই জন্য তাঁহাকে পিতামহ বলা হয় এবং ব্রহ্মারও পিতা অর্থাৎ যিনি পরমেশ্বর তিনি প্রপিতামহ । কশ্যপদিকেও প্রজাপতি বলে । কিন্তু এখানে প্রজাপতি শব্দ একবচনান্ত থাকাতে উহার অর্থ ব্রহ্মা বলিয়াই গ্রহণ করা সঙ্গত ।

৪৫-৪৬) ঐশ্বর্য ও মাধুর্য : 
একাদশ অধ্যায়ে বিশ্বরূপের বর্ণনা, ইহা অদ্ভুতরসের বর্ণনা - ইহাতে ভয়, বিস্ময়, বিহ্বলতা আনয়ন করে - ইহাতে মাধুর্য, শান্তি ও প্রীতির ভাব নাই । তাই সৌন্দর্য-রস-পিপাসু ভক্তগণ সেই অনন্তস্বরূপের অনন্ত ঐশ্বর্যের চিন্তা করেন না - তাঁহার শান্ত সৌম্য লীলাবিগ্রহই ধ্যান করেন - উহার অপার সৌন্দর্য উপভোগ করেন । ঐশ্বর্য ও মাধুর্যে এই প্রভেদ । কথাটি রসতত্ত্ব-বিচারে পাশ্চাত্য দার্শনিকগণও বেশ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করিয়াছেন । যেমন -

"The beautiful calms and pacifies us; the sublime brings disorders into our faculties." [Weber's History of Philosophy]

"The sublime is incompatible with charms; and as the mind is not merely attracted by the object but continually in turn repelled, satisfaction in the sublime does not so much contain positive pleasure as admiration and respect." [Kant]

"The beautiful is the infinite represented in the finite form". [Schelling]

৪৭) শ্রীকৃষ্ণের চতুর্ভুজ ও দ্বিভুজ রূপ : এ-স্থলে অর্জুন ভগবানের চতুর্ভুজ বিষ্ণুমূর্তি দেখিতে চাহিতেছেন । কৃষ্ণলীলায় ভগবান দ্বিভুজ; কিন্তু বাসুদেবগৃহে তিনি শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী চতুর্ভুজ-রূপেই আবির্ভূত হইয়াছিলেন । পরে কংসভয়ে ভীত বসুদেবের প্রার্থনায় দুই বাহু সংবরণ করেন । কিন্তু সময়-সময় চতুর্ভুজ মূর্তিও ধারণ করিয়াছেন । [ভাগবত |১০|৮৩|২৮]

৫৪) একমাত্র অনন্যা ভক্তি দ্বারাই পরমেশ্বরের স্বরূপ জ্ঞান হয়, তাঁহার সাক্ষাৎকার হয় এবং পরিশেষে তাঁহার সহিত তাদাত্ম্য লাভ হয় । এই শেষ অবস্থাকে ভক্তিশাস্ত্রে অধিরূঢ়ভাব বলে (১৮|৫৫ দ্রষ্টব্য) ।

৫৫) অহিংস-নীতি ও ধর্ম্যযুদ্ধ :
ব্যবহারিক ধর্মতত্ত্ব বড় সূক্ষ্ম ও জটিল । অহিংসনীতি ও অত্যাচারীর সংহার, সত্যকথন ও দস্যুতাড়িত পলায়নপর আশ্রিতের রক্ষা, ইত্যাদি স্থলে যখন পরস্পর বিরোধ উপস্থিত হয়, তখন কোনটি ধর্ম, কোনটি অধর্ম - তাহা নির্ণয় করা বড় সহজ নহে । এই হেতু মহাভারতে পুনঃপুনঃ বলা হইয়াছে, 'সূক্ষ্মা গতির্হি ধর্মস্য' ।

বিশ্বরূপ ও ভূমাবাদ :
দুইটি শ্রুতিবাক্যকে সনাতন ধর্মের ভিত্তি বলা যায় :-

  1. 'একমেবাদ্বিতীয়ং ব্রহ্ম' - ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়
  2. 'সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম' - এই সমস্তই ব্রহ্ম

কিন্তু এই বাক্য দুইটির ব্যাখ্যায় বৈদান্তিকগণের মধ্যে মর্মান্তিক মতভেদ আছে । এক পক্ষ বলেন, - একমাত্র ব্রহ্মই আছেন, তিনি অখণ্ড অদ্বৈত-তত্ত্ব, তাহার মধ্যে নানাত্ব নাই - তিনি ভূমা । ভ্রমবশত সেই ব্রহ্ম-বস্তুতেই জগতের অধ্যাস হয় - যেমন রজ্জুতে সর্পভ্রম হয়, মরীচিকায় জলভ্রম হয় । এই ভ্রমের কারণ মায়া বা অজ্ঞান; অজ্ঞান বিদূরিত হইলেই ব্রহ্ম উদ্ভাসিত হন ।
অপরপক্ষ বলেন - ব্রহ্ম অদ্বিতীয় তাহা ঠিক, ব্রহ্মই এই সমস্ত হইয়াছেন । তিনিই জগতের নিমিত্ত কারণ ও উপাদান কারণ । তিনি আপনাকে জগৎরূপে পরিণত করিয়াছেন । জগৎ ব্রহ্মের শরীর, বিশ্ব তাঁহার রূপ বা দেহ, এইজন্য তিনি বিশ্বরূপ । তিনিই ভূমা । ইহা ভূমাবাদের অন্য দিক ।

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : দ্বাদশ অধ্যায় - ভক্তিযোগ

অর্জুন বলিলেন –
সতত ত্বদ্‌গতচিত্ত হইয়া যে সকল ভক্ত তোমার উপাসনা করেন এবং যাঁহারা অব্যক্ত অক্ষরের উপাসনা করেন, এই উভয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সাধক কে ? ১

শ্রীভগবান্‌ কহিলেন -

যাঁহারা আমাতে মন নিবিষ্ট করিয়া নিত্যযুক্ত হইয়া পরম শ্রদ্ধা সহকারে আমার উপাসনা করেন, তাঁহারাই আমার মতে যুক্ততম অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ সাধক । ২

কিন্তু যাহারা সর্বত্র সমবুদ্ধিযুক্ত এবং সর্বপ্রাণীর হিতপরায়ণ হইয়া ইন্দ্রিয়সমূহকে বিষয় হইতে প্রত্যাহৃত করিয়া সেই অনির্দেশ্য, অব্যক্ত, সর্বব্যাপী, অচিন্ত্য, কূটস্থ, অচল, ধ্রুব, অক্ষর ব্রহ্মের উপাসনা করেন, তাহারাও আমাকেই প্রাপ্ত হন । ৩,৪

অব্যক্ত নির্গুণব্রহ্মে আসক্তচিত্ত সেই সাধকগণের সিদ্ধি লাভে অধিকতর ক্লেশ হয়; কারণ, দেহধারিগণ অতি কষ্টে নির্গুণ ব্রহ্মবিষয়ক নিষ্ঠা লাভ করিয়া থাকেন । ৫

কিন্তু যাহারা সমস্ত কর্ম আমাতে অর্পণ করিয়া, একমাত্র আমাতেই চিত্ত একাগ্র করিয়া, ধ্যাননিরত হইয়া আমার উপাসনা করেন, হে পার্থ, আমাতে সমর্পিতচিত্ত সেই ভক্তগণকে আমি অচিরাৎ সংসারসাগর হইতে উদ্ধার করিয়া থাকি । ৬,৭

আমাতেই মন স্থাপন কর, আমাতে বুদ্ধি নিবিষ্ট কর, তাহা হইলে দেহান্তে আমাতেই স্থিতি করিবে, ইহাতে সন্দেহ নাই । ৮

হে ধনঞ্জয়, যদি আমাতে চিত্ত স্থির রাখিতে না পার, তাহা হইলে পুনঃপুনঃ অভ্যাসদ্বারা চিত্তকে সমাহিত করিয়া আমাকে পাইতে চেষ্টা কর । ৯

যদি অভ্যাসেও অসমর্থ হও, তবে মৎকর্মপরায়ণ হও (অর্থাৎ শ্রবণ, কীর্তন, পূজাপাঠ ইত্যাদি কর্মের অনুষ্ঠান কর); আমার প্রীতি সাধনার্থ কর্মের অনুষ্ঠান করিলেও তুমি সিদ্ধি লাভ করিবে । ১০

যদি ইহাতেও অশক্ত হও, তাহা হইলে মদ্‌যোগ অর্থাৎ আমাতে কর্মার্পণরূপ যোগ আশ্রয় করিয়া সংযতাত্মা হইয়া সমস্ত কর্মের ফল ত্যাগ কর । ১১

অভ্যাস অপেক্ষা জ্ঞান শ্রেষ্ঠ, জ্ঞান অপেক্ষা ধ্যান শ্রেষ্ঠ । ধ্যান অপেক্ষা কর্মফলত্যাগ শ্রেষ্ঠ । এইরূপ ত্যাগের পরই শান্তি লাভ হইয়া থাকে । ১২

যিনি কাহাকেও দ্বেষ করেন না; যিনি সকলের প্রতি মিত্রভাবাপন্ন ও দয়াবান্‌; যিনি সমত্ববুদ্ধি ও অহঙ্কারবর্জিত, যিনি সুখে দুঃখে সমভাবাপন্ন, সদা সন্তুষ্ট, সমাহিতচিত্ত, সংযত-স্বভাব, দৃঢ়বিশ্বাসী, যাহার মন বুদ্ধি আমাতে অর্পিত, ঈদৃশ মদ্ভক্ত আমার প্রিয় । ১৩,১৪

যাহা হইতে কোন প্রাণী উদ্বেগ প্রাপ্ত হয় না এবং যিনি স্বয়ংও কোন প্রাণি-কর্তৃক উত্যক্ত হন না এবং যিনি হর্ষ, অমর্ষ, ভয় ও উদ্বেগ হইতে মুক্ত, তিনি আমার প্রিয় । ১৫

যিনি সর্ব বিষয়ে নিঃস্পৃহ, শৌচসম্পন্ন, কর্তব্য-কর্মে অনলস, পক্ষপাতশূন্য, যাহাকে কিছুতেই মনঃপীড়া দিতে পারে না এবং ফল কামনা করিয়া যিনি কোন কর্ম আরম্ভ করেন না, এতাদৃশ ভক্ত আমার প্রিয় । ১৬

যিনি ইষ্টলাভে হৃষ্ট হন না, অপ্রাপ্য বস্তুলাভে আকাঙ্ক্ষা করেন না, যিনি কর্মের শুভাশুভ ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করিয়াছেন, ঈদৃশ ভক্তিমান্‌ সাধক আমার প্রিয় । ১৭

যিনি শত্রু-মিত্রে, মান-অপমানে, শীত-উষ্ণে, সুখ-দুঃখে সমত্ববুদ্ধি-সম্পন্ন, যিনি সর্ববিষয়ে আসক্তিবর্জিত, স্তুতি বা নিন্দাতে যাঁহার তুল্য জ্ঞান, যিনি সংযতবাক্‌, যদ্দৃচ্ছালাভে সন্তুষ্ট, গৃহাদিতে মমত্ববুদ্ধি-বর্জিত, এবং স্থিরচিত্ত, ঈদৃশ ভক্তিমান্‌ ব্যক্তি আমার প্রিয় । ১৮,১৯

যাঁহারা শ্রদ্ধাবান্‌ ও মৎপরায়ণ হইয়া পূর্বোক্ত অমৃততুল্য ধর্মের অনুষ্ঠান করেন, সেই সকল ভক্তিমান্‌ আমার অতীব প্রিয় । ২০
___________________________

১) “এবং” – এইরূপে অর্থাৎ দশম অধ্যায়ের শেষ শ্লোকে যে নিষ্কাম কর্মযুক্ত ভক্তির সাধন উক্ত হইয়াছে, তাহাই লক্ষ্য করা হইয়াছে । এইরূপ সগুণ ঈশ্বরের উপাসক এবং নির্গুণ ব্রহ্মোপাসক; ইহাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কে, ইহাই অর্জুনের প্রশ্ন ।

২) এই শ্লোকে স্পষ্টই বলা হইল যে ব্যক্তোপাসনা বা ভক্তিমার্গই শ্রেষ্ঠ । তবে জ্ঞানমার্গে নির্গুণ ব্রহ্মোপাসনা কি নিষ্ফল ? না, তা নয় । জ্ঞানমার্গে ব্রহ্মোপাসনা দ্বারাও তাঁহাকে পাওয়া যায় ।

৪) কূট = মায়া, অজ্ঞান, মিথ্যাভূত জগৎ-প্রপঞ্চ; গিরিশৃঙ্গ
কূটস্থ : নানা অর্থ হয় - (i) যিনি এই মিথ্যাভূত মায়িক জগতের অধিষ্ঠানরূপে অবস্থিত, অথচ নিত্য নির্বিকার, (ii) গিরিশৃঙ্গবৎ নিশ্চলভাবে অবস্থিত, (iii) সকল বস্তুর মূলে অবস্থিত, (iv) অপরিবর্তনীয় ।

৫) দেহধারিগণের পক্ষে নির্গুণ ব্রহ্মবিষয়ক নিষ্ঠা লাভ করা অতি কষ্টকর । কারণ, দেহাত্মবোধ বিদূরিত না হইলে নির্গুণ ভাবে স্থিতিলাভ করা যায় না ।

৬,৭) আমার ভক্তগণ আমার উপাসনা করিলে আমার প্রসাদে অনায়াসে সিদ্ধিলাভ করিতে পারে । সেই উপাসনার দুইটি কথা উল্লেখযোগ্য - (১) সর্বকর্ম আমাতে সমর্পন । (২) অনন্যভক্তি যোগে আমার উপাসনা । সুতরাং ভক্তিমার্গেও কর্মত্যাগের কোন প্রয়োজন নাই । ঈশ্বরে সর্বকর্ম সমর্পণের উপদেশ হইতে বরং ইহাই বুঝা যায় যে ভক্তিমার্গেও নিষ্কাম ভাবে কর্ম করাই কর্তব্য ।

৮) ব্যক্ত ও অব্যক্তের উপাসনা - ভক্তিমার্গের শ্রেষ্ঠতা
পরমেশ্বরের দুই বিভাব - ব্যক্ত ও অব্যক্ত । যিনি সগুণ, সাকার, স্বরূপে লীলাবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, তিনিই আবার বিশ্বাত্মা, অব্যক্ত নির্গুণ-স্বরূপে তিনি অচিন্ত্য, অনির্দেশ্য, নির্বিশেষ পরব্রহ্ম । শ্রীভগবান বলিয়াছেন, ভগবদ্ভক্তই শ্রেষ্ঠ সাধক কিন্তু যাঁহারা কেবল আত্মস্বাতন্ত্র্যবলে মায়া-নির্মুক্ত হইয়া ব্রহ্মসাক্ষাৎকারে যত্ন করেন, তাঁহারাও তাঁহাকেই প্রাপ্ত হন । কিন্তু দেহাভিমানী জীবের পক্ষে দেহাত্মবোধ বিদূরিত করিয়া ব্রহ্মচিন্তা করা অধিকতর ক্লেশকর । ইহাদ্বারা ভক্তিমার্গ অধিকতর সুলভ ও সুখসাধ্য বলিয়া কথিত হইল ।

১০) ভগবৎকর্মপরায়ণ :  যিনি নিম্নে উল্লিখিত ভক্তিশাস্ত্রের নববিধ ভক্তির সাধন করেন :- 
  1. শ্রবণ
  2. কীর্তন
  3. স্মরণ
  4. পদসেবা
  5. অর্চনা
  6. বন্দনা
  7. দাস্য
  8. সখ্য
  9. আত্মনিবেদন
১২) 'বর্তমান সময়ে গীতার ভক্তিযুক্ত-কর্মযোগ সম্প্রদায় লুপ্তপ্রায় হইয়া গিয়াছে । এই সম্প্রদায় পাতঞ্জল-যোগ, জ্ঞান ও ভক্তি এই তিন সম্প্রদায় হইতে পৃথক এবং এই কারণেই ঐ সম্প্রদায়ের কোনো টীকাকার পাওয়া যায় না, অতএব আজকাল গীতার উপর যত টীকা পাওয়া যায় সেগুলিতে কর্মফলত্যাগের শ্রেষ্ঠতা অর্থবাদাত্মক বুঝানো হইয়াছে । কিন্তু আমার মতে উহা ভুল ।' - [গীতারহস্য, লোকমান্য বাল গঙ্গাধর তিলক]

নিষ্কাম কর্মযোগের শ্রেষ্ঠতা :
গীতার মতে কর্মযোগই সর্বাপেক্ষা সহজসাধ্য কারণ ইহা সর্বাঙ্গ সুন্দররূপে সম্পন্ন করিতে না পারিলেও একেবারে নিষ্ফল হয় না । আর সুসাধ্য হইলেই যে নিম্নস্তরের হইবে, এ-কথার কোনো যুক্তি নাই । দ্বিতীয়ত, ইহাতে বিধি-নিষেধের কঠোর গণ্ডীর মধ্যে থাকিতে হয় না, সুতরাং পদে-পদে বাধা-বিঘ্নের আশঙ্কা থাকে না । তৃতীয়ত, ইহাতে ভগবানের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করিতে হয় । সুতরাং সাধকের লাভালাভ, সিদ্ধি-অসিদ্ধি বিষয়ে আর-কোনো ভাবনা-চিন্তা করিতে হয় না, কেননা তাঁহার অভয়বাণীই আছে, একান্তে আমার শরণ লও; সব আমিই করিয়া দিব, ভয় নাই । অন্যান্য সকল সাধনায়ই আত্মস্বাতন্ত্র্যের উপর নির্ভর করিতে হয়, পদস্খলন হইলেই বিপদ । এ-ক্ষেত্রে কিন্তু তিনি সর্বদাই হাত ধরিয়া আছেন, পতনের ভয় কি ?

ব্রহ্মচন্তক জ্ঞানবাদীরা বলেন যে, অর্জুন উচ্চাঙ্গের উপাসনায় অনধিকারী, তাই শ্রীভগবান চিত্তশুদ্ধির জন্য এই সর্বনিম্নস্তরের কর্মযোগ তাঁহাকে উপদেশ দিয়াছেন । কিন্তু স্বয়ং শ্রীভগবান বলিয়াছেন যে, নির্গুণ উপাসনা দেহধারীর পক্ষে দুঃসাধ্য । তবে যিনি বিশ্বরূপ দেখিতে অধিকারী হইয়াছিলেন, তিনি যদি অনধিকারীই হন, তবে সেই অনধিকারীর দলে থাকাটাই আমাদের মতো ক্ষুদ্র জীবের শ্রেয়ঃকল্প ও সকল সাম্প্রদায়িক মত স্বকপোল-কল্পিত ।

১৫) অমর্ষ = অভিলষিত বস্তুর অপ্রাপ্তিতে অসহিষ্ণুতা (শঙ্কর); পরের লাভে অসহিষ্ণুতা, পরশ্রীকাতরতা (শ্রীধর) ।

১৭) শুভাশুভপরিত্যাগী : যিনি স্বর্গাদি-কামনায় অথবা নরকাদির ভয়ে কোনো কর্ম করেন না, যিনি ফলাকাঙ্ক্ষাবর্জিত, সমত্ববুদ্ধিযুক্ত, সুখদুঃখ, পাপপুণ্যাদি দ্বন্দ্ববর্জিত ।

১৮-২০) ধর্মামৃত : কর্মফলত্যাগ অর্থাৎ কামনাত্যাগেই পরম শান্তি । 'এখন বুঝিলে ভক্তি কি ? ঘরে কপাট দিয়া পূজার ভাণ করিয়া বসিলে ভক্ত হয় না, ... 'হা ঈশ্বর ! হা ঈশ্বর !' বলিয়া গোলযোগ করিয়া বেড়াইলে ভক্ত হয় না । যে আত্মজয়ী, যাহার চিত্ত সংযত, যে সমদর্শী, যে পরহিতে রত, সেই ভক্ত । ঈশ্বরকে সর্বদা অন্তরে বিদ্যমান জানিয়া যে আপনার চরিত্র পবিত্র না করিয়াছে, যাহার চরিত্র ঈশ্বরানুরাগী নহে, সে ভক্ত নহে । যাহার সমস্ত চরিত্র ভক্তির দ্বারা শাসিত না হইয়াছে সে ভক্ত নহে । গোতোক্ত স্থূলকথা এই । এরূপ উদার এবং প্রশস্ত ভক্তিবাদ জগতে আর কোথাও নাই । এই জন্য ভগবদ্গীতা জগতের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ।' - [বঙ্কিমচন্দ্র]
ভক্তের লক্ষণ [১২|৬-৭, ১৩-২০] = স্থিতপ্রজ্ঞের লক্ষণ [২|৫৫-৭৫] = জ্ঞানীর লক্ষণ [১৩|৭-১১]
বস্তুত পরাভক্তি ও পরমজ্ঞানে কোনো পার্থক্য নাই । কামনাত্যাগ উভয়েরই মূলকথা এবং ত্যাগজনিত শান্তি ও সমত্ববুদ্ধি উহার সুধাময় ফল ।

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : ত্রয়োদশ অধ্যায় - ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞ বিভাগযোগ

অর্জুন কহিলেন -
হে কেশব, প্রকৃতি ও পুরুষ, ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞ এবং জ্ঞান ও জ্ঞেয় এইগুলি জানিতে আমি ইচ্ছা করি । (প্রক্ষিপ্ত ? শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য ও শ্রীধরস্বামী এই শ্লোকটি গ্রহণ করেন নাই ।)

শ্রীভগবান্‌ কহিলেন -

হে কৌন্তেয়, এই দেহকে ক্ষেত্র বলা হয় এবং যিনি এই ক্ষেত্রকে জানেন (অর্থাৎ ‘আমি’ ‘আমার’ এইরূপ মনে করেন) তিনিই ক্ষেত্রজ্ঞ (জীবাত্মা); ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞবেত্তা পণ্ডিতগণ এইরূপ বলিয়া থাকেন । ১

হে ভারত, সমুদয় ক্ষেত্রে আমাকেই ক্ষেত্রজ্ঞ বলিয়া জানিও; ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের যে জ্ঞান তাহাই প্রকৃত জ্ঞান, ইহাই আমার মত । অথবা ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞের যে জ্ঞান তাহাই আমার (পরমেশ্বরের) জ্ঞান, ইহাই সর্বসম্মত । ২

সেই ক্ষেত্র কি, উহা কি প্রকার, উহা কি প্রকার বিকার-বিশিষ্ট, ইহার মধ্যেও কি হইতে কি হয়, এবং সেই ক্ষেত্রজ্ঞ কে এবং তাহার প্রভাব কিরূপ, এইসকল তত্ত্ব সংক্ষেপে আমার নিকট শ্রবণ কর । ৩

ঋষিগণ কর্তৃক নানা ছন্দে পৃথক্‌ পৃথক্‌ নানা প্রকারে এই ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞ-তত্ত্ব ব্যাখ্যাত হইয়াছে । ব্রহ্মসূত্র-পদসমূহেও যুক্তিযুক্ত বিচারসহ নিঃসন্দিগ্ধরূপে এই বিষয় ব্যাখ্যাত হইয়াছে । ৪
 

ক্ষিতি আদি পঞ্চমহাভূত, অহঙ্কার, বুদ্ধি (মহত্তত্ত্ব), মূল প্রকৃতি, দশ ইন্দ্রিয়, মন এবং রূপরসাদি পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের বিষয় (পঞ্চতন্মাত্র) এবং ইচ্ছা, দ্বেষ, সুখ, দুঃখ, সংঘাত, চেতনা ও ধৃতি এই সমুদয়কে সবিকার ক্ষেত্র বলে । ৫,৬

শ্লাঘা-রাহিত্য, দম্ভ-রাহিত্য, অহিংসা, ক্ষমা, সরলতা, গুরুসেবা, শৌচ, সৎকার্যে একনিষ্ঠা, আত্মসংযম, বিষয়-বৈরাগ্য, নিরহঙ্কারিতা, জন্ম-মৃত্যু-জরাব্যাধিতে দুঃখ দর্শন, বিষয়ে বা কর্মে অনাসক্তি, স্ত্রীপুত্রগৃহাদিতে মমত্ববোধের অভাব, ইষ্টানিষ্টলাভে সমচিত্ততা, আমাতে (ভগবান্‌ বাসুদেবে) অনন্যচিত্তে ঐকান্তিক ভক্তি, পবিত্র নির্জন স্থানে বাস, প্রাকৃত জনসমাজে বিরক্তি, সর্বতা অধ্যাত্মজ্ঞানের অনুশীলন (নিত্য আত্মজ্ঞাননিষ্ঠা), তত্ত্বজ্ঞানের প্রয়োজন আলোচনা - এই সকলকে জ্ঞান বলা হয়; ইহার বিপরীত যাহা তাহা অজ্ঞান । ৭-১১

যাহা জ্ঞাতব্য বস্তু, যাহা জ্ঞাত হইলে অমৃত অর্থাৎ মোক্ষ লাভ করা যায়, তাহা বলিতেছি; তাহা আদ্যন্তহীন, আমার নির্বিশেষ স্বরূপ-ব্রহ্ম; তৎসন্বন্ধে বলা হয় যে, তিনি সৎও নহেন, অসৎও নহেন । ১২

সর্বদিকে তাঁহার হস্তপদ, সর্বদিকে তাঁহার চক্ষু, মস্তক ও মুখ, সর্বদিকে তাহার কর্ণঃ এইরূপে এই লোকে সমস্ত পদার্থ ব্যাপিয়া তিনি অবস্থিত আছেন । ১৩

তিনি চক্ষুরাদি সমুদয় ইন্দ্রিয় বৃত্তিতে প্রকাশমান অথচ সর্বেন্দ্রিয়বিবর্জিত, নিঃসঙ্গ অর্থাৎ সর্বসঙ্গশূন্য অথচ সকলের আধারস্বরূপ, নির্গুণ অথচ সত্ত্বাদি-গুণের ভোক্তা বা পালক । ১৪

সর্বভূতের অন্তরে এবং বাহিরেও তিনি; চল এবং অচলও তিনি; সূক্ষ্মতাবশতঃ তিনি অবিজ্ঞেয়; এবং তিনি দূরে থাকিয়াও নিকটে স্থিত । ১৫

তিনি (তত্ত্বতঃ বা স্বরূপতঃ) অপরিচ্ছিন্ন হইলেও সর্বভূতে ভিন্ন-ভিন্ন বলিয়া প্রতীত হন । তাঁহাকে ভূতসকলের পালনকর্তা, সংহর্তা ও সৃষ্টিকর্তা বলিয়া জানিবে । ১৬

তিনি জ্যোতিসকলেরও (সূর্যাদিরও) জ্যোতিঃ; তিনি তমের অর্থাৎ অবিদ্যারূপ অন্ধকারের অতীত, তিনি বুদ্ধিবৃত্তিতে প্রকাশমান জ্ঞান, তিনি জ্ঞেয় তত্ত্ব, তিনি জ্ঞানের দ্বারা লভ্য, তিনি সর্বভূতের হৃদয়ে অবস্থিত আছেন । ১৭

এই প্রকারে ক্ষেত্র, জ্ঞান এবং জ্ঞেয় কাহাকে বলে সংক্ষেপে কথিত হইল । আমার ভক্ত ইহা জানিয়া আমার ভাব বা স্বরূপ বুঝিতে পারেন, বা আমার দিব্য প্রকৃতি প্রাপ্ত হন । ১৮

প্রকৃতি ও পুরুষ, উভয়কেই অনাদি বলিয়া জানিও । দেহেন্দ্রিয়াদি বিকারসমূহ এবং সুখ, দুঃখ, মোহাদি গুণসমূহ প্রকৃতি হইতেই উৎপন্ন হইয়াছে জানিবে । ১৯


শরীর ও ইন্দ্রিয়গণের কর্তৃত্ব বিষয়ে প্রকৃতিই কারণ, এবং সুখ, দুঃখ ভোগ বিষয়ে পুরুষই (ক্ষেত্রজ্ঞ) কারণ বলিয়া উক্ত হন । ২০

পুরুষ প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিত হইয়া প্রকৃতির গুণসমূহ ভোগ করেন এবং গুণসমূহের সংসর্গই পুরুষের সৎ ও অসৎ যোনিতে জন্মগ্রহণের কারণ হয় । ২১

এই দেহে যে পরম পুরুষ আছেন, তিনি উপদ্রষ্টা, অনুমন্তা, ভর্তা, ভোক্তা, মহেশ্বর ও পরমাত্মা বলিয়া উক্ত হন । ২২
 

যিনি এই প্রকার পুরুষতত্ত্ব এবং বিকারাদি গুণ সহিত প্রকৃতিতত্ত্ব অবগত হন, তিনি যে অবস্থায় থাকুন না কেন, পুনরায় জন্মলাভ করেন না অর্থাৎ মুক্ত হন । ২৩

কেহ কেহ (স্বয়ং) আপনি আপনাতেই ধ্যানের দ্বারা আত্ম দর্শন করেন । কেহ-কেহ সাংখ্যযোগ দ্বারা এবং অন্য কেহ-কেহ কর্মযোগের দ্বারা আত্মাকে দর্শন করেন । ২৪

আবার অন্য কেহ-কেহ এইরূপ আপনা আপনি আত্মাকে না জানিয়া অন্যের নিকট শুনিয়া উপাসনা করেন । শ্রদ্ধাপূর্বক উপদেশ শ্রবণ করিয়া উপাসনা করতঃ তাঁহারাও মৃত্যুকে অতিক্রম করেন । ২৫


হে ভরতর্ষভ, স্থাবর, জঙ্গম যত কিছু পদার্থ উৎপন্ন হয়, তাহা সমস্তই ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের সংযোগ হইতে হইয়া থাকে জানিবে । ২৬
 

যিনি সর্বভূতে সমভাবে অবস্থিত এবং সমস্ত বিনষ্ট হইলেও যিনি বিনষ্ট হন না, সেই পরমেশ্বরকে যিনি সম্যক দর্শন করিয়াছেন, তিনিই যথার্থদর্শী । ২৭

যিনি সর্বভূতে সমান ও সমভাবে অবস্থিত ঈশরকে দর্শন করেন, তিনি আত্মাদ্বারা আত্মাকে হনন করেন না এবং সেই হেতু তিনি পরম গতি প্রাপ্ত হন । ২৮

প্রকৃতিই সমস্ত প্রকারে সমস্ত কর্ম করেন এবং আত্মা অকর্তা, ইহা যিনি দর্শন করেন তিনিই যথার্থদর্শী । ২৯

যখন তত্ত্বদর্শী সাধক ভূতসমূহের পৃথক্‌ পৃথক্‌ ভাব বা নানাত্ব একস্থ অর্থাৎ এক ব্রহ্মবস্তুতেই অবস্থিত এবং সেই ব্রহ্ম হইতেই এই  নানাত্বের বিস্তার দর্শন করেন, তখন তিনি ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হন । ৩০
 

হে কৌন্তেয়, অনাদি ও নির্গুণ বলিয়া এই পরমাত্মা অবিকারী; অতএব দেহে থাকিয়াও তিনি কিছুই করেন না এবং কর্মফলে লিপ্ত হন না । ৩১

যেমন আকাশ সর্ববস্তুতে অবস্থিত থাকিলেও অতি সূক্ষ্মতা হেতু কোন বস্তুতে লিপ্ত হয় না, সেরূপ আত্মা সর্বদেহে অবস্থিত থাকিলেও কিছুতেই লিপ্ত হন না । ৩২

হে ভারত, যেমন এক সূর্য সমস্ত জগৎকে প্রকাশিত করেন, সেরূপ এক ক্ষেত্রজ্ঞ (আত্মা) সমস্ত ক্ষেত্র বা দেহকে প্রকাশিত করেন । ৩৩

যাহারা জ্ঞানচক্ষুদ্বারা ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের প্রভেদ এবং ভূতপ্রকৃতি অর্থাৎ অবিদ্যা হইতে মোক্ষ কি প্রকার তাহা দর্শন করেন (জানিতে পারেন) তাহারা পরমপদ প্রাপ্ত হন । ৩৪
___________________________


২) আমি কেবল ক্ষেত্রজ্ঞ নহি, ক্ষেত্রও আমি । কারণ প্রকৃতির পরিণামই দেহ এবং সেই প্রকৃতি আমার বিভাব ও শক্তি [গী|৪|১০] ।

৪) ব্রহ্মসূত্র :
ব্রহ্মসূত্র বলিতে বেদান্ত দর্শন বুঝায় । বিভিন্ন ঋষিগণ বিভিন্ন উপনিষদে পৃথক্‌ পৃথক্‌ অধ্যাত্মতত্ত্বের আলোচনা করিয়াছেন । যুক্তিযুক্ত বিচার বিতর্ক দ্বারা ঐ সকল বিভিন্ন মতের সমন্বয় ও সামঞ্জস্য বিধান করিয়া বেদান্ত দর্শন রচিত হইয়াছে । এই শ্লোকে তাহাই বলা হইল । ঋষিগণ বিভিন্ন উপনিষদে পৃথক্‌ ভাবে যাহা আলোচনা করিয়াছেন, ব্রহ্মসূত্র তাহাই কার্যকারণহেতু দেখাইয়া নিঃসন্দিগ্ধরূপে ব্যাখ্যা করিয়াছে । এই হেতু উহার অপর নাম উত্তর মীমাংসা এবং উহাতে ক্ষেত্রজ্ঞের বিচার আছে বলিয়া উহাকে শারীরক সূত্রও বলে (শরীর=ক্ষেত্র) । ব্রহ্মসূত্র বা বেদান্তদর্শন গীতার পরে রচিত হইয়াছে মনে করিয়া কেহ কেহ ‘ব্রহ্মসূত্র’ পদে ব্রহ্মপ্রতিপাদক সূত্র অর্থাৎ উপনিষদাদি এইরূপ অর্থ করেন । কিন্তু লোকমান্য তিলক প্রভৃতি আধুনিক পণ্ডিতগণের মত এই যে বর্তমান মহাভারত, গীতা এবং বেদান্তদর্শন বা ব্রহ্মসূত্র এই তিনই বাদরায়ণ ব্যাসদেবেরই প্রণীত । এই হেতু ব্রহ্মসুত্রকে ব্যাসসূত্রও বলে ।

৬) ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞ : আমি সুখী, আমি দুঃখী, 'আমার দেহ', 'আমার গৃহ' - এই আমি কে ?
এই 'আমি' দেহ নহে, হস্তপদাদি-ইন্দ্রিয় নহে, মনও নহে, বুদ্ধিও নহে; 'আমি' এ-সকলের অতীত কোনো বস্তু, যাহার নাম জীব ও জীবাত্মা । কৃষক যেমন ক্ষেত্র হইতে ফল উৎপন্ন করিয়া ভোগ করে, জীবও তদ্রূপ এই দেহ অবলম্বন করিয়া প্রাক্তন-কর্মজনিত সুখ-দুঃখাদি ভোগ করেন, এই জন্য এই দেহের নাম ক্ষেত্র । আবার ক্ষেত্রস্বামী যেমন জানেন যে, ইহা আমার ক্ষেত্র, সুতরাং আমি মালিক, আমিই ভোক্তা, এইরূপ অভিমান করেন, সেইরূপ জীবও এই দেহ আমারই ভোগভূমি বলিয়া জানেন এবং আমার দেহ, আমার মন ইত্যাদি রূপ অভিমান করেন । এই হেতু জীবকে ক্ষেত্রজ্ঞ বলা হয় । সুতরাং বেদান্তমতে দেহ ও আত্মার যে তত্ত্ব বা বিচার তাহারই নাম ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞ বিচার । ইহাই সাংখ্যমতে প্রকৃতি-পুরুষ বিচার । [বিশদ]

সাংখ্যের ২৪ তত্ত্ব ব্যতীত ইচ্ছা, দ্বেষ, সুখ, দুঃখ, সংঘাত, চেতনা, ধৃতি - এই কয়েকটি অতিরিক্ত তত্ত্বের এ-স্থলে উল্লেখ করা হইয়াছে । ইচ্ছা, দ্বেষ, সুখ, দুঃখ - মনেরই গুণ, সুতরাং মনেই উহাদের সমাবেশ হয় ।
চেতনা : জীবদেহে প্রাণের ক্রিয়া বা চেষ্টা-চাঞ্চল্য । চেতনা ও চৈতন্য এক কথা নহে । সুষুপ্তি-অবস্থায় চেতনা অর্থাৎ প্রাণের ক্রিয়া থাকে কিন্তু চৈতন্য বা আমি-জ্ঞান থাকে না । এই চেতনা নামক ক্রিয়া জড় দেহেরই গুণ, আত্মার নহে, এই জন্য ইহাকে ক্ষেত্রের মধ্যেই সমাবেশ করা হয় ।
ধৃতি : মন, প্রান ইত্যাদির ক্রিয়া শরীরের মধ্যে যে শক্তির দ্বারা স্থির থাকে । ইহাও জড়দেহেরই গুণ ।
সংঘাত = সমুচ্চয় বা সংহতি; জ্ঞানেন্দ্রিয়, কর্মেন্দ্রিয়, উভয়েন্দ্রিয়, মন, প্রাণ ইত্যাদি শারীরিক ও মানসিক সমস্ত তত্ত্বের যে  সংহতি বা সমুচ্চয়, দার্শনিক ভাষায় তাহারই নাম সংঘাত বা শরীর । ক্ষেত্রের মধ্যেই উহার সমাবেশ করা হইয়াছে ।

১১) জ্ঞানীর ২০টি লক্ষণ : 'যাহা পিণ্ডে তাহা ব্রহ্মাণ্ডে' অর্থাৎ এই নশ্বর দেহেন্দ্রিয়াদির অতিরিক্ত যে অবিনশ্বর আত্মতত্ত্ব এবং নামরূপাত্মক নশ্বর ব্যক্ত জগতে অভিব্যাপ্ত যে অবিনশ্বর ব্রহ্মতত্ত্ব - এই উভয়ই এক; জীব, প্রকৃতি বা মায়ামুক্ত হইলেই এই একত্ব-জ্ঞান লাভ করে, উহাই প্রকৃত জ্ঞান । ইহাই আত্মজ্ঞান, ব্রহ্মাত্মৈক্যজ্ঞান, দেহাত্মবিবেক, পুরুষ-প্রকৃতি-বিবেক, ব্রাহ্মী-স্থিতি, কৈবল্য মুক্তি ইত্যাদি নানা কথায় ব্যক্ত করা হয় । বেদান্তী ও ব্রহ্মজ্ঞানী এক কথা নহে । যিনি এই জ্ঞান লাভ করেন, তাঁহার সর্বত্র সাম্যবুদ্ধি জন্মে, তাঁহার সর্বসময়ে শুদ্ধ বুদ্ধি, শুদ্ধ বাসনা ও শুদ্ধ আচরণ পরিদৃষ্ট হয় এবং তাঁহার অমানিত্ব, অদম্ভিত্ব প্রভৃতি গুণের উদ্রেক হয় ।

১৫) এই শ্লোকটি সম্পূর্ণ শেতাশ্বেতর উপনিষৎ [৩|১৬] হইতে আসিয়াছে ।

১৯) সাংখ্যমতে পুরুষ ও প্রকৃতি উভয়ই অনাদি এবং স্বতন্ত্র মূলতত্ত্ব; কিন্তু বেদান্তী বলেন, প্রকৃতি স্বতন্ত্র নহে, উহা পরমেশ্বর হইতেই উৎপন্ন, পরমেশ্বরেরই শক্তি এবং এই হেতুই অনাদি । গীতায় ইহাদিগকেই অপরা ও পরা প্রকৃতি বলা হইয়াছে ।

২১) পুরুষের সংসারিত্বের কারণ :
পুরুষ-প্রকৃতির সংসর্গবশত প্রকৃতির গুণ অর্থাৎ সত্ত্ব, রজঃ, তমোগুণের ধর্ম সুখ-দুঃখ-মোহাদিতে আবদ্ধ হইয়া পড়েন এবং আমি সুখী, আমি দুঃখী, আমি কর্তা, আমার কর্ম ইত্যাদি অভিমান করিয়া কর্মপাশে আবদ্ধ হন । এই সকল কর্মের ফলভোগের জন্য তাঁহাকে পুনঃপুনঃ সদসদ্‌-যোনিতে জন্মগ্রহণ করিতে হয় । সত্ত্বগুণের প্রাবল্যে দেব-যোনিতে, রজোগুণের উৎকর্ষে মনুষ্য-যোনিতে এবং তমোগুণের আধিক্যে পশ্বাদি-যোনিতে তাঁহার জন্ম হয় ।

যিনি পুরুষকে প্রকৃতি হইতে পৃথক বলিয়া জানেন, যিনি জানেন যে পুরুষ অকর্তা, উদাসীন, উপদ্রষ্টা মাত্র - তিনিই জ্ঞানী, তিনিই এই জন্মকর্মের বন্ধন হইতে মুক্ত ।

২২) উপদ্রষ্টা = সমীপে থাকিয়া যিনি দেখেন অথচ নিজে ব্যাপৃত হন না;
ভর্তা : ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি প্রভৃতি জড় হইলেও চৈতন্যময় পুরুষের চৈতন্যাভাসে উদ্ভাসিত হইয়া থাকে । ইহাকেই পুরুষের ভরণ বলা হইয়াছে এবং এই হেতুই পুরুষকে ভর্তা বলা হয় ।
ভোক্তা : যিনি স্বরূপত নির্বিকার ও নির্লিপ্ত হইলেও সুখ-দুঃখাদি যেন উপলব্ধি করেন অর্থাৎ নিত্য চৈতন্যময় বলিয়া সুখ-দুঃখাদি বৃত্তিকেও চৈতন্যগ্রস্ত করিয়া প্রকাশ করেন, তাই তিনি ভোক্তা ।

সাংখ্য দর্শন যাহাকে স্বতন্ত্র মূলতত্ত্ব পুরুষ বলেন, তাহাকেই এস্থলে পরমপুরুষ পরমাত্মা বলা হইতেছে । সুতরাং এস্থলে সাংখ্য ও বেদান্তের সমন্বয় হইয়া গেল ।

২৩) প্রকৃতি-পুরুষ বিবেক :
এই জ্ঞেয় বস্তুই ক্ষেত্রজ্ঞ, পরমাত্মা বা পরব্রহ্ম এবং প্রকৃতি-সম্ভূত দেহেন্দ্রিয়াদিই ক্ষেত্র । বেদান্তে যাহা ক্ষেত্র বা ক্ষেত্রজ্ঞ, সাংখ্য-শাস্ত্রের পরিভাষায় তাহাই প্রকৃতি ও পুরুষ এবং ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞ-জ্ঞানই সাংখ্যের পুরুষ-প্রকৃতি-বিবেক । এই প্রকৃতি-পুরুষের বিবেকজ্ঞান অর্থাৎ পার্থক্য-জ্ঞানেই কৈবল্য মুক্তি - যাঁহার এই জ্ঞান হইয়াছে, তাঁহার পক্ষে ধর্ম-কর্ম, বিধি-নিষেধ কিছু নাই; অনাসক্তভাবে কর্ম করিলেও তাঁহার কর্মবন্ধন নাই, কেননা তিনি ত্রিগুণাতীত মুক্তপুরুষ । প্রকৃতিই মায়া, উহাই সংসারের কারণ; সুতরাং তিনি মায়ামুক্ত, তাঁহার সংসারের ক্ষয় হইয়াছে ।

২৪) আত্মকারা : মন যখন নির্বিষয় হয়, তখন আর উহা মন থাকে না, আত্মকারাকারিত হয় । এই অবস্থায় আত্মদর্শন হয়; 'আপনি আপনাতে আত্মদর্শন করেন' [লোকমান্য তিলক] ।

২৫) ধ্যান, জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি - গীতা এই চারটি বিভিন্ন মার্গের উল্লেখ করিয়াছেন এবং ইহার যে কোন মার্গে সাধন আরম্ভ হউক না কেন, শেষে পরমেশ্বর প্রাপ্তি বা মোক্ষ লাভ হয়ই, ইহাই গীতার উদার মত । গীতোক্ত যোগ বলিতে ইহার ঠিক কোন একটা বুঝায় না । গীতা এই চারিটি মার্গের সমন্বয় করিয়া অপূর্ব যোগধর্ম শিক্ষা দিয়াছেন । সেই যোগ কি তাহা পূর্বে নানা স্থানে প্রদর্শিত হইয়াছে । 

২৬) বেদান্ত মতে এ সংযোগকে অধ্যাস, ঈক্ষণ ইত্যাদি বলা হয় । এই অধ্যাসের ফলে ক্ষেত্রজ্ঞের ধর্ম ক্ষেত্রে আরোপিত হয় এবং ক্ষেত্রের ধর্ম ক্ষেত্রজ্ঞে আরোপিত হয় ।

২৭) ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞ বা প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগে সৃষ্টি, একথা পূর্বে বলা হইয়াছে । এই সংযোগের মধ্যে যিনি বিয়োগ দর্শন করেন অর্থাৎ প্রকৃতি হইতে পুরুষের, বা দেহ হইতে আত্মার পার্থক্য দর্শন করেন, এবং সেই এক বস্তুই সর্বত্র সমভাবে বিদ্যমান ইহা অনুভব করেন, তিনিই মুক্ত । এই শ্লোক এবং পরবর্তী কয়েকটি শ্লোকে এই তত্ত্বই বিবৃত হইয়াছে ।

২৮) আত্মঘাতী : এই দুর্লভ মানব-জন্ম লাভ করিয়াও যে আত্মার উদ্ধারের চেষ্টা করে না সে আত্মঘাতী । অথবা যিনি জানেন যে, পরহিংসা ও আত্মহিংসা একই কথা, তিনি 'আত্মার দ্বারা আত্মাকে হনন করেন না' । স্বামী বিবেকানন্দ দ্বিতীয় অর্থই গ্রহণ করিয়াছেন ।

৩০) জগতের নানাত্বের মধ্যে যিনি একমাত্র ব্রহ্মসত্ত্বাই অনুভব করেন, এবং সেই এক ব্রহ্ম হইতেই এই নানাত্বের অভিব্যক্তি ইহা যখন সাধক বুঝিতে পারেন, তখনই তাঁহার ব্রহ্মভাব লাভ হয় । 

৩২) যেমন আকাশ সর্বব্যাপী হইয়াও সুগন্ধ, দুর্গন্ধ, সলিল, পঙ্কাদির দোষ-গুণে লিপ্ত হয় না, সেইরূপ আত্মা সর্বদেহে অবস্থিত থাকিলেও দৈহিক দোষগুণে লিপ্ত হন না । 

৩৩) সূর্যের সহিত উপমার তাৎপর্য এই যে, যেমন এক সূর্য সকলের প্রকাশক অথচ নির্লিপ্ত, আত্মাও সেইরূপ । 

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : চতুর্দশ অধ্যায় - গুণত্রয়-বিভাগযোগ

শ্রীভগবান্‌ বলিলেন -
আমি পুনরায় জ্ঞানসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম জ্ঞান বলিতেছি, যাহা জানিয়া মুনিগণ এই দেহবন্ধন হইতে মোক্ষলাভ করিয়াছেন । ১

এই জ্ঞান আশ্রয় করিয়া যাঁহারা আমার সাধর্ম্য লাভ করেন অর্থাৎ ত্রিগুণাতীত অবস্থা প্রাপ্ত হন, তাঁহারা সৃষ্টিকালেও জন্মগ্রহণ করেন না, প্রলয়কালেও ব্যথিত হন না (
অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যু অতিক্রম করেন) । ২

হে ভারত, প্রকৃতিই আমার গর্ভাধান-স্থান । আমি তাহাতে গর্ভাধান করি, তাহা হইতেই সর্বভূতের উৎপত্তি হয় । ৩

হে কৌন্তেয়, দেব-মনুষ্যাদি বিভিন্ন যোনিতে যে সকল শরীর উৎপন্ন হয়, প্রকৃতি তাহাদের মাতৃস্থানীয়া এবং আমিই গর্ভাধানকর্তা পিতা । ৪

হে মহাবাহো, সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ প্রকৃতিজাত এই তিন গুণ দেহমধ্যে অব্যয় আত্মাকে বন্ধন করিয়া রাখে । ৫

হে অনঘ, এই তিন গুণের মধ্যে সত্ত্বগুণ নির্মল বলিয়া প্রকাশক এবং নির্দোষ; এই সত্ত্বগুণ সুখসঙ্গ ও জ্ঞানসঙ্গদ্বারা আত্মাকে বন্ধন করিয়া রাখে । ৬

হে অর্জুন, রজোগুণ রাগাত্মক, তৃষ্ণা ও আসক্তি উহা হইতে উৎপন্ন হয় । উহা কর্মাসক্তিদ্বারা দেহীকে বন্ধন করে । ৭

হে ভারত, তমোগুণ অজ্ঞানজাত এবং দেহিগণের ভ্রান্তিজনক । ইহা প্রমাদ (অনবধানতা), আলস্য ও নিদ্রা (চিত্তের অবসাদ) দ্বারা জীবকে আবদ্ধ করে । ৮

হে ভারত, সত্ত্বগুণ সুখে এবং রজোগুণ কর্মে জীবকে আসক্ত করে । কিন্তু তমোগুণ জ্ঞানকে আবৃত করিয়া প্রমাদ (কর্তব্যমূঢ়তা বা অনবধানতা) উৎপন্ন করে । ৯

হে ভারত, সত্ত্বগুণ রজঃ ও তমোগুণকে অভিভূত করিয়া প্রবল হয়, রজোগুণ তমঃ ও সত্ত্বগুণকে অভিভূত করিয়া প্রবল হয় এব তমোগুণ রজঃ ও সত্ত্বগুণকে অভিভূত করিয়া প্রবল হয় । ১০

যখনই এই দেহে শ্রোত্রাদি সর্ব ইন্দ্রিয়দ্বারে জ্ঞানাত্মক প্রকাশ অর্থাৎ নির্মল জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তখন জানিবে যে, সত্ত্বগুণ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইয়াছে । ১১

হে ভরতশ্রেষ্ঠ, লোভ, সর্বদা কর্মে প্রবৃত্তি এবং সর্ব কর্মে উদ্যম (সর্বদা ইহা করিব উহা করিব - এইরূপ অস্থিরতা), শান্তি ও তৃপ্তির অভাব, বিষয়স্পৃহা - এইসকল লক্ষণ রজোগুণ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইলে উৎপন্ন হয় । ১২

হে কুরুনন্দন, তমোগুণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইলে বিবেকভ্রংশ, নিরুদ্যমতা, কর্তব্যের বিস্মরণ এবং মোহ বা বুদ্ধি-বিপর্যয় - এইসকল লক্ষণ উৎপন্ন হয় । ১৩

সত্ত্বগুণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইলে যদি জীবের মৃত্যু হয়, তবে তিনি উত্তম তত্ত্ববিদ্‌গণের প্রাপ্য প্রকাশময় দিব্য লোকসকল প্রাপ্ত হন । ১৪

রজোগুণের বৃদ্ধিকালে মৃত্যু হইলে কর্মাসক্ত মনুষ্য-যোনিতে জন্ম হয় এবং তমোগুণের বৃদ্ধিকালে মৃত্যু হইলে পশ্বাদি মূঢ়-যোনিতে জন্ম হয় । ১৫

সাত্ত্বিক পুণ্য কর্মের ফল নির্মল সুখ, রাজসিক কর্মের ফল দুঃখ এবং তামসিক কর্মের ফল অজ্ঞান, তত্ত্বদর্শিগণ এইরূপ বলিয়া থাকেন । ১৬

সত্ত্বগুণ হইতে জ্ঞান উৎপন্ন হয়; রজোগুণ হইতে লোভ এবং তমোগুণ হইতে অজ্ঞান, প্রমাদ ও মোহ উৎপন্ন হইয়া থাকে । ১৭

সত্ত্বগুণপ্রধান ব্যক্তি ঊর্ধ্বলোকে অর্থাৎ স্বর্গাদি লোকে গমন করেন; রজঃপ্রধান ব্যক্তিগণ মধ্যলোকে অর্থাৎ ভূলোকে অবস্থান করেন; এবং প্রমাদ-মোহাদি নিকৃষ্টগুণসম্পন্ন তমঃপ্রধান ব্যক্তিগণ অধোগামী হয় (তমিস্রাদি নরক বা পশ্বাদি যোনি প্রাপ্ত হয়) । ১৮

যখন দ্রষ্টা জীব গুণ ভিন্ন অন্য কাহাকেও কর্তা না দেখেন (অর্থাৎ প্রকৃতিই কর্ম করে, আমি করি না, ইহা বুঝিতে পারেন) এবং তিন গুণের অতীত পরম বস্তুকে অর্থাৎ আত্মাকে জ্ঞাত হন, তখন তিনি আমার ভাব অর্থাৎ ব্রহ্মভাব বা ত্রিগুণাতীত প্রাপ্ত হন । ১৯

জীব দেহোৎপত্তির কারণভূত এই তিন গুণ অতিক্রম করিয়া জন্মমৃত্যু জরাদুঃখ হইতে বিমুক্ত হইয়া অমৃতত্ত্ব অর্থাৎ মোক্ষ লাভ করেন । ২০


অর্জুন কহিলেন -
হে প্রভো, কোন্‌ লক্ষণের দ্বারা জানা যায় যে জীব ত্রিগুণ অতিক্রম করিয়াছেন ? তাঁহার আচার কিরূপ ? এবং কি প্রকারে তিনি ত্রিগুণ অতিক্রম করেন ? ২১

 
শ্রীভগবান্‌ বলিলেন - 
হে পাণ্ডব, সত্ত্বগুণের কার্য প্রকাশ বা জ্ঞান, রজোগুণের ধর্ম কর্ম-প্রবৃত্তি এবং তমোগুণের ধর্ম মোহ, এই সকল গুণধর্ম প্রবৃত্ত হইলেও যিনি সুখবুদ্ধিতে উহা আকাঙ্ক্ষা করেন না, তিনিই গুণাতীত বলিয়া উক্ত হন । ২২

যিনি উদাসীনের ন্যায় সাক্ষিরূপে অবস্থান করেন, সত্ত্বাদিগুণ-কার্য সুখদুঃখাদি কর্তৃক বিচালিত হন না, গুণসকল স্ব স্ব কার্যে বর্তমান আছে, আমার সহিত ইহার কোন সম্পর্ক নাই, ইহা মনে করিয়া যিনি চঞ্চল হন না, তিনি গুণাতীত বলিয়া কথিত হন । ২৩

যাঁহার নিকট সুখদুঃখ সমান, যিনি স্বস্থ অর্থাৎ আত্মরূপেই স্থিত, মৃত্তিকা, প্রস্তর ও সুবর্ণ যাঁহার নিকট সমান, যিনি প্রিয় ও অপ্রিয় এবং আপনার নিন্দা ও প্রশংসা তুল্য মনে করেন, যিনি ধীমান্‌ বা ধৈর্যযুক্ত, তিনিই গুণাতীত বলিয়া অভিহিত হন । ২৪

মানে ও অপমানে, শত্রুপক্ষ ও মিত্রপক্ষে যাঁহার তুল্যজ্ঞান এবং ফলাকাঙ্ক্ষা করিয়া যিনি কর্মোদ্যম করেন না (সর্বারম্ভপরিত্যাগী), এরূপ ব্যক্তি গুণাতীত বলিয়া কথিত হন । ২৫

যিনি ঐকান্তিক ভক্তিযোগ সহকারে আমার সেবা করেন, তিনি এই তিন গুণ অতিক্রম করিয়া ব্রহ্মভাব লাভে সমর্থ হন । ২৬

যেহেতু আমি ব্রহ্মের নিত্য অমৃতের অর্থাৎ মোক্ষের, সনাতন ধর্মের এবং ঐকান্তিক সুখের প্রতিষ্ঠা (অথবা আমি অমৃত ও অব্যয় ব্রহ্মের, শাশ্বত ধর্মের এবং ঐকান্তিক সুখের প্রতিষ্ঠা) । ২৭ 
___________________________

(১) পূর্ব অধ্যায়ে বলা হইয়াছে, সকল কর্ত্রিত্বই প্রকৃতির, পুরুষ অকর্তা । প্রকৃতির গুণসঙ্গবশতঃই জীবের সদসদ্‌ যোনিতে জন্ম ও সুখ-দুঃখ ভোগ অর্থাৎ সংসারিত্ব । এই গুণ কি, উহাদের লক্ষণ কি, উহারা কি ভাবে জীবকে আবদ্ধ করে, কিরূপে প্রকৃতি হইতে বিবিধ সৃষ্টি হয়, ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত কিছুই বলা হয় নাই । সেই হেতু এই প্রকৃতি-তত্ত্ব বা ত্রিগুণ-তত্ত্বই আবার বলিতেছেন ।

(২) সাধর্ম্য = স্বরূপতা অর্থাৎ আমি যেমন ত্রিগুণাতীত এইরূপ ত্রিগুণাতীত অবস্থা ।

(৩,৪) মহদ্‌ব্রহ্ম = প্রকৃতি; 'গর্ভাধান করি' = সর্বভূতের জন্মকারণ স্বরূপ বীজ প্রকৃতিরূপ যোনিতে আধান করি । ভূতগণকে তাহাদের স্বীয় প্রাক্তন কর্মানুসারে ক্ষেত্রের সহিত সংযোজিত করি । অথবা প্রকৃতিতে আমার সঙ্কল্পিত বীজ আধান করি অর্থাৎ আমার সঙ্কল্পানুসারেই প্রকৃতি সৃষ্টি করে । ঈশ্বরের সৃষ্টি-সঙ্কল্পই গর্ভাধানস্বরূপ - প্রকৃতির স্বতন্ত্র সৃষ্টি-সামর্থ্য নাই । বেদান্তে ইহাকেই 'ঈক্ষণ' বলে (জ্ঞান-বিজ্ঞান-যোগে 'সাংখ্যের সৃষ্টিতত্ত্ব - প্রকৃতি ও পুরুষ' দ্রষ্টব্য) ।

(৫) জীবাত্মা অবিকারী হইলেও প্রকৃতির গুণসঙ্গবশতঃ দেহাত্মভাব প্রাপ্ত হওয়ায় সুখ-দুঃখ মোহাদিতে জড়িত হইয়া পড়েন । ত্রিগুণের বন্ধন =  প্রকৃতি-সংযোগে পুরুষের সংসারবন্ধন ।

(৬) সত্ত্বগুণের বন্ধন - সত্ত্বগুণের মুখ্য ধর্ম - সুখ ও জ্ঞান - এই দুইটিও বন্ধনের কারণ বলা হইতেছে । সত্ত্বগুণ দুই প্রকার - (i) মিশ্রসত্ত্ব অর্থাৎ রজস্তমো-মিশ্রিত সত্ত্ব এবং (ii) শুদ্ধসত্ত্ব অর্থাৎ রজস্তমো-বর্জিত সত্ত্ব । রজস্তমোবর্জিত বিশুদ্ধ সত্ত্বগুণের লক্ষণ = নিস্ত্রৈগুণ্য বা ত্রিগুণাতীতের অবস্থা অর্থাৎ নির্দ্বন্দ্বভাব, বিমল সদানন্দ এবং অপরোক্ষ আত্মানুভূতির অবস্থা । গীতায় নিস্ত্রৈগুণ্য বলিতে 'নিত্য শুদ্ধসত্ত্বগুণাশ্রিত' বুঝায় । এই হেতুই ২|৪ শ্লোকে শ্রীভগবান অর্জুনকে 'নিস্ত্রৈগুণ্য' হইতে বলিয়াও 'নিত্যসত্ত্বস্থ' হইতে বলিয়াছেন ।
সত্ত্বগুণ জলের ন্যায় নির্মল হইলেও অপর দুইটির সহিত মিশ্রিত থাকায় উহা বন্ধনের কারণ হয় । "সত্ত্বগুণের খুব প্রাধান্য হইলেও তাহা প্রকৃত স্বাধীনতার অবস্থা নহে কারণ অন্যান্য গুণের ন্যায়ই বাসনা (মহত্তর) ও অহঙ্কারের (শুদ্ধতর) দ্বারাই বন্ধন করে । সাত্ত্বিক অহঙ্কারের উদাহরণ - আমি সাধু, আমি জ্ঞানী । প্রকৃত স্বাধীনতা, চরম স্বরাজ্য তখনই আরম্ভ হইবে যখন প্রাকৃত আত্মার উপরে আমরা পরমাত্মাকে দেখিতে পাইব, ধরিতে পারিব । আমাদের ক্ষুদ্র 'আমি' - আমাদের অহঙ্কার এই পরমাত্মাকে দেখিতে দেয় না । ইহার জন্য আমাদিগকে গুণত্রয়ের বহু ঊর্ধ্বে উঠিতে হইবে, ত্রিগুণাতীত হইতে হইবে, কারণ পরমাত্মা সত্ত্বগুণেরও উপরে ।" ...[abridged from শ্রীঅরবিন্দের গীতা (অনিলবরণ)] ।

(১০-১৩) সত্ত্বগুণ, রজোগুণ ও তমোগুণ কখনও পৃথক্‌ পৃথক্‌ থাকে না, একত্রেই থাকে । কিন্তু জীবের পূর্ব কর্মানুসারে অদৃষ্টবশে কখনও সত্ত্বগুণ অপর দুইটিকে অভিভূত করিয়া প্রবল হয় এবং জীবকে সুখাদিতে আসক্ত করে । এইরূপ কোথাও রজোগুণ প্রবল হইয়া কর্মাসক্তি, বিষয়-স্পৃহা, অস্থিরতা জন্মায় বা তমোগুণ প্রবল হইয়া নিদ্রা, অনুদ্যম, প্রমাদ, কর্তব্যের বিস্মৃতি, বুদ্ধি-বিপর্যয়, আলস্যাদি উৎপন্ন করে । এই হেতুই জীবের সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক এইরূপ বিভিন্ন প্রকৃতি বা স্বভাব দৃষ্ট হয় ।

(১৮) সত্ত্বগুণ-প্রধান ব্যক্তিগণ স্বর্গাদি দিব্যলোক প্রাপ্ত হন । কিন্তু তাহা হইলেও তাহাদের মোক্ষলাভ বা ভগবৎপ্রাপ্তি ঘটে না । ঐ সকল লোক হইতেও পতন আছে । তবে মোক্ষলাভ কিসে হয় ? - পরের দুই শ্লোক ।

(২০) প্রকৃতির গুণসঙ্গবশতঃই জীবের দেহোৎপত্তি ও সংসারিত্ব । এই ত্রিগুণ অতিক্রম করিতে পারিলেই মোক্ষ । তাহার উপায় কি ? সাংখ্যদর্শন বলেন যে, জীব যখন বুঝিতে পারে যে প্রকৃতি পৃথক্‌, আমি পৃথক্‌, তখনই তাহার মুক্তি হয় । কিন্তু বেদান্ত ও গীতা সাংখ্যের এই প্রকৃতি-পুরুষরূপী দ্বৈতকে মূল তত্ত্ব বলিয়া স্বীকার করেন না । সুতরাং এই কথাটিই গীতায় এইরূপ ভাবে বলা হয় যে, প্রকৃতি ও পুরুষের উপরে যে পরমাত্মা বা পুরুষোত্তম আছেন, সেই পরমাত্মাকে যখন জীব জানিতে পারে, তখনই তাহার মোক্ষ বা ব্রহ্মলাভ হয় ।

(২১) ব্রাহ্মীস্থিতি = স্থিতপ্রজ্ঞ অথবা ত্রিগুণাতীতের অবস্থা

(২২,২৩) দেহে প্রকৃতির কার্য চলিতেছে চলুক । আমি উহাতে লিপ্ত নই । আমি অকর্তা, উদাসীন্, সাক্ষিস্বরূপ । এই জ্ঞান যাঁহার হইয়াছে তিনিই ত্রিগুণাতীত ।

(২৫) আরম্ভ = ঐহিক বা পারত্রিক ফল কামনা করিয়া কর্মের উদ্যোগ । সর্বারম্ভপরিত্যাগী = এইরূপ আরম্ভ যিনি করেন না । উদাহরণ ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির ।

(২৭) আমিই ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা - ভগবৎ-তত্ত্ব ও ব্রহ্মতত্ত্ব

সাংখ্যমতে ত্রিগুণাতীত হইয়া বা কৈবল্য লাভের একমাত্র উপায় পঞ্চবিংশতি তত্ত্বের জ্ঞান [সাংখ্যসূত্র ৩|২৩] । পাতঞ্জলমতে ধ্যান-ধারণা ও পরিশেষে নির্বীজ সমাধি; সাংখ্যে যাহাকে প্রকৃতি বলে, অদ্বৈত বেদান্তে তাহাই অজ্ঞান বা মায়া । বেদান্ত মতেও জ্ঞানই ব্রহ্মভাব বা মোক্ষলাভের উপায়, ব্রহ্মসূত্রে কোথাও 'ভক্তি' শব্দ নাই । কিন্তু এস্থলে ভগবান্‌ বলিতেছেন - ত্রিগুণাতীত হইয়া ব্রহ্মভাব লাভের উপায় আমাতে অব্যভিচারিণী ভক্তি; আমাকে একান্ত ভক্তিযোগে সেবা করিলেই ত্রিগুণাতীত হইয়া ব্রহ্মভাব লাভ করা যায়, কারণ আমিই ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা [১৪|২৬,২৭]; ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হইলে আমাতে পরাভক্তি জন্মে [১৮|৫৪] । 'আমি' বলিতে অবশ্য এস্থলে বুঝায় ভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণ । কিন্তু ভগবানে ও ব্রহ্মে কি কোন পার্থক্য আছে ? আছেও; নাইও । স্বরূপতঃ না থাকিলেও সাধকের নিকট যে পার্থক্য আছে তাহা বুঝা যায় দ্বাদশ অধ্যায়ে অর্জুনের প্রশ্নে - 'তোমাকে যাঁহারা ত্বদ্‌গতচিত্ত হইয়া ভজনা করেন, আর যাঁহারা অক্ষর ব্রহ্ম চন্তা করেন, এ উভয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সাধক কে ?' তদুত্তরে শ্রীভগবান্‌ বলিলেন - 'আমার ভক্তই শ্রেষ্ঠ সাধক, তবে অক্ষর ব্রহ্মচিন্তকেরাও আমাকেই পান ।' এই কথার মর্ম - অক্ষর ব্রহ্ম আমিই, ব্রহ্মভাব আমারই বিভাব, নির্গুণভাবে আমি অক্ষর ব্রহ্ম, সগুণভাবে আমি বিশ্বরূপ, লীলাভাবে আমি অবতার - আমি পুরুষোত্তমই পরতত্ত্ব । ব্রহ্ম, আত্মা, বিরাট্‌, বৈশ্বানর, তৈজস, প্রাজ্ঞ, তুরীয় - সকলই আমি, সকল অবস্থাই আমার বিভাব বা বিভিন্ন ভাব । এই সগুণ-নির্গুণ, সৃষ্টিস্থিতি-প্রলয়কর্তা, যজ্ঞ-তপস্যার ভোক্তা, সর্বলোকমহেশ্বর পরমাত্মা পুরুষোত্তমই ভগবৎ-তত্ত্ব; আর উহার যে অনির্দেশ্য, অক্ষর, নির্বিশেষ নির্গুণ বিভাব, তাহাই ব্রহ্মতত্ত্ব । এই অর্থে বলা হইয়াছে, আমিই ব্রহ্মের অথবা শাশ্বত ধর্মের প্রতিষ্ঠা ।

সাধনপথে ভক্তির উপযোগিতা স্বীকার করিলেই ভগবত্তত্তের শ্রেষ্ঠতা স্বতঃই আসিবে, এই হেতু গীতা বেদান্তাদি শাস্ত্রের মূলতত্ত্ব স্বীকার করিলেও উহাতে ঈশ্বর-বাদেরই প্রাধান্য । 'গীতা সাধারণভাবে সেই সেই দর্শনের (সাংখ্য, বেদান্তাদির) মূল প্রতিপাদ্য অঙ্গীকার করিয়া তাহার সহিত ঈশ্বরবাদ সংযুক্ত করিয়া তাহাদিগকে সুসম্পূর্ণ করিয়াছেন । এই ঈশ্বরবাদই গীতার প্রাণ; গীতার আদি, অন্ত, মধ্য - সমস্তই ঈশ্বরবাদে সমুজ্জল ।' - বেদান্তরত্ন হীরেন্দ্রনাথ, গীতায় ঈশ্বরবাদ ।

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : পঞ্চদশ অধ্যায় - পুরুষোত্তমযোগ

শ্রীভগবান্‌ বললেন -
(বেদবিদ্‌গণ) বলিয়া থাকেন যে, (সংসাররূপ) অশ্বত্থের মূল ঊর্দ্ধদিকে এবং শাখাসমূহ অধোগামী; উহা অবিনাশী; বেদসমূহ উহার পত্রস্বরূপ; যিনি এই অশ্বত্থকে জানেন তিনিই বেদবিৎ । ১

সত্ত্বাদিগুণের দ্বারা বিশেষরূপে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত, বিষয়রূপ তরুণপল্লব-বিশিষ্ট উহার শাখাসকল অধোভাগে ও ঊর্ধ্বভাগে বিস্তৃত; উহার (বাসনারূপ) মূলসহ মনুষ্যলোকে অধোভাগে বিস্তৃত রহিয়াছে । ঐ মূলসমূহ ধর্মাধর্মরূপ কর্মের কারণ বা প্রসূতি । ২

এ সংসারে স্থিত জীবগণ সংসার-বৃক্ষের পূর্বোক্ত ঊর্দ্ধমূলাদি রূপ উপলব্ধি করিতে পারে না । সেইরূপ আদি, অন্ত এবং স্থিতিও উপলব্ধি করিতে পারে না । এই সুদৃঢ়মূল অশ্বত্থবৃক্ষকে তীব্র বৈরাগ্যরূপ শস্ত্রদ্বারা ছেদন করিয়া তৎপর যাঁহাকে প্রাপ্ত হইলে আর পুনর্জন্ম হয় না, যাঁহা হইতে এই সংসার-প্রবৃত্তির বিস্তার হইয়াছে, 'আমি সেই আদি পুরুষের শরণ লইতেছি' এই বলিয়া তাঁহার অন্বেষণ করিতে হইবে । ৩,৪

যাঁহাদের অভিমান ও মোহ নাই, যাঁহারা সংসার-আসক্তি জয় করিয়াছেন, যাঁহারা আত্মতত্ত্বে নিষ্ঠাবান্‌, যাঁহাদের কামনা নিবৃত্ত হইয়াছে, যাঁহারা সুখদুঃখ-সংজ্ঞক দ্বন্দ্ব হইতে মুক্ত, তাদৃশ বিবেকী পুরুষগণ সেই অব্যয় পদ প্রাপ্ত হন । ৫

যে পদ প্রাপ্ত হইলে সাধক আর সংসারে প্রত্যাবর্তন করেন না, যে পদ সূর্য, চন্দ্র বা অগ্নি প্রকাশ করিতে পারে না, তাহাই আমার পরম স্বরূপ । ৬

আমারই সনাতন অংশ জীব হইয়া প্রকৃতিতে অবস্থিত মন ও পাঁচ ইন্দ্রিয়কে সংসারে অর্থাৎ কর্মভূমিতে আকর্ষণ করিয়া থাকেন । ৭

যেমন বায়ু, পুষ্পাদি হইতে গন্ধবিশিষ্ট সূক্ষ কণাসমূহ লইয়া যায় তদ্রূপ যখন জীব এক দেহ পরিত্যাগ করিয়া অন্য দেহে প্রবেশ করেন, তখন এই সকলকে (এই পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও মনকে) সঙ্গে করিয়া লইয়া যান । ৮

জীবাত্মা কর্ণ, চক্ষু, ত্বক্‌, রসনা, নাসিকা এবং মনকে আশ্রয় করিয়া শব্দাদি বিষয়সকল ভোগ করিয়া থাকেন । ৯

জীব কিরূপে সত্ত্বাদি গুণসংযুক্ত হইয়া দেহে অবস্থিত থাকিয়া বিষয়সমূহ ভোগ করেন, অথবা কিরূপে দেহ হইতে উৎক্রান্ত হন, তাহা অজ্ঞ ব্যক্তিগণ দেখিতে পান না, কিন্তু জ্ঞানিগণ জ্ঞাননেত্রে দর্শন করিয়া থাকেন । ১০

সাধনে যত্নশীল যোগিগণ আপনাতে অবস্থিত এই আত্মাকে দর্শন করিয়া থাকেন, কিন্তু যাহারা অজিতেন্দ্রিয় ও অবিবেকী তাহারা যত্ন করিলেও ইঁহাকে দেখিতে পায় না । ১১

যে তেজ সূর্যে থাকিয়া সমস্ত জগৎ উদ্ভাসিত করে এবং যে তেজ চন্দ্রমা ও অগ্নিতে আছে, তাহা আমারই তেজ জানিবে । ১২

আমি পৃথিবীতে অনুপ্রবিষ্ট হইয়া স্বকীয় বলের দ্বারা ভূতগণকে ধারণ করিয়া আছি । আমি অমৃতরসযুক্ত চন্দ্ররূপ ধারণ করিয়া ব্রীহি যবাদি ওষধিগণকে পরিপুষ্ট করিয়া থাকি । ১৩

আমি বৈশ্বানর (জঠরাগ্নি) রূপে প্রাণিগণের দেহে অবস্থান করি এবং প্রাণ ও অপান বায়ুর সহিত মিলিয়া চর্ব্য চূষ্যাদি চতুর্বিধ খাদ্য পরিপাক করি । ১৪

আমি অন্তর্যামিরূপে সকল প্রাণীর হৃদয়ে অধিষ্ঠিত আছি, আমা হইতেই প্রাণিগণের স্মৃতি ও জ্ঞান উৎপন্ন হইয়া থাকে এবং আমা হইতেই স্মৃতি ও জ্ঞানের বিলোপও সাধিত হয়; আমিই বেদসমূহের একমাত্র জ্ঞাতব্য, আমিই আচার্যরূপে বেদান্তের অর্থ-প্রকাশক এবং আমিই বুদ্ধিতে অধিষ্ঠিত থাকিয়া বেদার্থ পরিজ্ঞাত হই । ১৫

ক্ষর ও অক্ষর দুই পুরুষ ইহলোকে প্রসিদ্ধ আছে । তন্মধ্যে সর্বভূত ক্ষর পুরুষ এবং কূটস্থ অক্ষর পুরুষ বলিয়া কথিত হন । ১৬

অন্য এক উত্তম পুরুষ পরমাত্মা বলিয়া কথিত হন । তিনি লোকত্রয়ে প্রবিষ্ট হইয়া সকলকে পালন করিতেছেন, তিনি অব্যয়, তিনি ঈশ্বর । ১৭

যেহেতু আমি ক্ষরের অতীত এবং অক্ষর হইতেও উত্তম, সেই হেতু আমি লোক-ব্যবহারে এবং বেদে পুরুষোত্তম বলিয়া খ্যাত । ১৮

হে ভারত, যিনি মোহমুক্ত হইয়া এই ভাবে আমাকে পুরুষোত্তম বলিয়া জানিতে পারেন, তিনি সর্বজ্ঞ হন এবং সর্বতোভাবে আমাকে ভজনা করেন । ১৯

হে নিষ্পাপ, আমি এই অতি গুহ্যকথা তোমাকে কহিলাম । যে কেহ ইহা জানিলে জ্ঞানী ও কৃতকৃত্য হয় । (অতএব তুমিও যে কৃতার্থ হইবে তাহাতে সন্দেহ কি ?) ২০
___________________________

(১) সংসারবৃক্ষ (বৈদিক বর্ণনা) - এস্থলে সংসারকে অশ্বত্থ বৃক্ষের সহিত তুলনা করা হইয়াছে । এই সংসারবৃক্ষ ঊর্ধ্বমূল, কেননা পুরুষোত্তম বা পরমাত্মা হইতেই এই বৃক্ষ উৎপন্ন হইয়াছে । এই হেতু ইহাকে ব্রহ্মবৃক্ষও বলা হয় । [কঠ ৬|১, মভাঃ অশ্ব ৩৫|৪৭] । এই বৃক্ষের শাখাস্থানীয় মহত্তত্ত্ব, অহঙ্কার প্রভৃতি পরিণামগুলি ক্রমশঃ অধোগামী, এই হেতু ইহা অধঃশাখ । পুরুষোত্তম বা পরব্রহ্ম হইতে কিরূপে প্রকৃতির বিস্তার হইয়াছে তাহা জ্ঞান-বিজ্ঞান-যোগে বংশবৃক্ষে দ্রষ্টব্য । এই সংসারবৃক্ষ অব্যয়, কারণ ইহা অনাদি কাল হইতে প্রবৃত্ত । বেদত্রয় এই সংসারবৃক্ষের পত্র, কারণ পত্রসমূহ যেমন বৃক্ষের আচ্ছাদনহেতু রক্ষার কারণ, সেইরূপ বেদত্রয়ও ধর্মাধর্ম প্রতিপাদন দ্বারা ছায়ার ন্যায় সর্বজীবের রক্ষক ও আশ্রয়স্বরূপ । এই সংসারবৃক্ষকে যিনি জানেন তিনি বেদজ্ঞ, কারণ সমূল সংসারবৃক্ষকে জানিলে জীব, জগৎ, ব্রহ্ম এই তিনেরই জ্ঞান হয়, আর জানিবার কিছু অবশিষ্ট থাকে না ।
 
(২) সংসারবৃক্ষ (সাংখ্য-দৃষ্টিতে বর্ণনা) - এই সংসার প্রকৃতিরই বিস্তার । সুতরাং ঐ বৃক্ষের শাখাসকল গুণপ্রবৃদ্ধ, অর্থাৎ সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ, এই তিন গুণের দ্বারা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত । শব্দ-স্পরশাদি বিষয়সমূহ উহার প্রবাল বা তরুণপল্লব-স্থানীয় । এই হেতু উহা বিষয়-প্রবাল । উহার শাখাসমূহ ঊর্ধ্ব ও অধোদিকে বিস্তৃত অর্থাৎ কর্মানুসারে জীবসকল অধোদিকে পশ্বাদি যোনিতে এবং ঊর্ধ্ব দিকে দেবাদি যোনিতে প্রাদুর্ভূত হইয়া থাকে । উহার বাসনারূপ মূলসকল কর্মানুবন্ধী অর্থাৎ ধর্মাধর্মরূপ কর্মের প্রসূতি । এই মূলসকল অধোদিকে মনুষ্য-লোকে বিস্তৃত রহিয়াছে, কারণ মনুষ্যগণেরই কর্মাধিকার ও কর্মফল বিশেষরূপে প্রসিদ্ধ । 

(৬) তিনি স্বপ্রকাশ । তাঁহার প্রকাশেই জগৎ প্রকাশিত । জড় পদার্থ চন্দ্র-সূর্যাদি তাঁহাকে প্রকাশ করিবে কিরূপে ? এই শ্লোকটি প্রায় অক্ষরশঃই শ্বেতাশ্বতর ও কঠোপনিষদে আছে । 

(৭) জীব ও ব্রহ্মে ভেদ ও অভেদ - জীব ও ব্রহ্ম এক, না পৃথক্‌ ?

এ সম্বন্ধে নানারূপ মতভেদ লইয়াই দ্বৈতবাদঅদ্বৈতবাদবিশিষ্টাদ্বৈতবাদদ্বৈতাদ্বৈতবাদ প্রভৃতি মতবাদের সৃষ্টি হইয়াছে । গীতার নানাস্থলেই জীবব্রহ্মৈক্যবাদই স্বীকৃত হইয়াছে বলিয়া বোধ হয় । যেমন শ্রীভগবান্‌ বলিতেছেন - "আমিই সর্বভূতাশয়স্থিত আত্মা" [১০|২০], "আমাকে ক্ষেত্রজ্ঞ বলিয়া জানিও" [১৩|২], "আসুরী প্রকৃতির লোক শরীরস্থ আমাকে কষ্ট দেয়" [১৭|৬] । এই সকল স্থলে স্পষ্ট বলা হইয়াছে যে, ভগবান্‌ই দেহে জীবরূপে অবস্থিত আছেন । 'তত্ত্বমসি', 'সোহহং', 'অহং ব্রহ্মাস্মি', 'অয়মাত্মা ব্রহ্ম' - চারি বেদের এই চারিটি মহাবাক্যও এই সত্যই প্রচার করিতেছে যে, জীবই ব্রহ্ম ।

কিন্তু শ্রীভগবান্‌ এও বলিতেছেন - "জীব আমার সনাতন অংশ" [১৫|৭] । এ অংশ কিরূপ ? অদ্বৈতবাদী বলেন - ব্রহ্ম অখণ্ড, অপরিচ্ছিন্ন, নিরবয়ব, অদ্বয় বস্তু, উহার খণ্ডিত অংশ কল্পনা করা যায় না । এ স্থলে 'অংশ' বলিতে মহাকাশের অংশ ঘটাকাশ (ঘটের মধ্যে যে আকাশ আছে) বুঝিতে হইবে । ঘট ভাঙ্গিলে এক অপরিচ্ছিন্ন আকাশই থাকে । জীবেরও দেহোপাধিপশতঃ ব্রহ্ম হইতে পার্থক্য, দেহোপাধিনাশে এক অপরিচ্ছিন্ন ব্রহ্মসত্তাই অবশিষ্ট থাকে ('ব্রহ্মাদ্বয়ং শিষ্যতে') ।

অচিন্ত্য-ভেদাভেদবাদ - এই গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতে জীব ও ঈশ্বর উভয়েই চিদ্রূপ - চেতন । এই নিমিত্ত অর্থাৎ জীব ও ব্রহ্মের চেতনাংশের সাদৃশ্যেই উভয়ের একত্ব । যেমন তেজোময় সূর্য হইতে অনন্ত রশ্মি বহির্গত হয়, অথবা অগ্নিপিণ্ড হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গসমূহ নির্গত হয়, সেইরূপ ব্রহ্ম হইতে জীবসমূহের উৎপত্তি । অগ্নি ভিন্ন স্ফুলিঙ্গের পৃথক্‌ অস্তিত্ব নাই, ব্রহ্ম ভিন্নও জীবের পৃথক্‌ সত্তা নাই । স্ফুলিঙ্গ অগ্নিই বটে, কিন্তু ঠিক অগ্নিও নয়, অগ্নি-কণা । জীব ও ব্রহ্মেও সেইরূপ অভেদ ও ভেদ আছে, জীব ব্রহ্মকণা । 

(৮-১০) জন্মান্তর-রহস্য - জীবের উৎক্রান্তি - সূক্ষ শরীর

প্রশ্ন#1 - আত্মা অকর্তা, উদাসীন, নিত্যমুক্ত । প্রকৃতি বা দেহ-বন্ধনবশতঃই তিনি বদ্ধ হন । মৃত্যুর পর যখন সেই দেহ-বন্ধন চলিয়া যায়, তখনই ত তিনি মুক্ত হইয়া স্ব-স্বরূপ লাভ করিতে পারেন । তখন আর প্রকৃতি থাকে কোথায় ? 

প্রশ্ন#2 - জীব একদেহে পাপপুণ্যাদি সঞ্চয় করে, জন্মান্তরে অন্য দেহে তাহার ফল ভোগ করে, এই বা কিরূপ ব্যবস্থা ?

উত্তর - সাংখ্যের সৃষ্টিতত্ত্ব অনুসারে শরীর তিনরকম - (1) স্থূলশরীর - পঞ্চ স্থূলভূত (আকাশ, বায়ু, অগ্নি, অপ্‌, পৃথিবী) দ্বারা নির্মিত, চর্মচক্ষে দৃশ্যমান্‌; (2) সূক্ষশরীর বা লিঙ্গ-শরীর - মহত্তত্ত্ব, অহঙ্কার, দশেন্দ্রিয়, মন ও পঞ্চতন্মাত্র (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ) দ্বারা গঠিত (মোট ১৮টি সাংখ্যোক্ত তত্ত্ব); জ্ঞানচক্ষুদ্বারা দৃশ্যমান্‌; (3) কারণ-শরীর - সকলের মূল কারণ প্রকৃতি ।


মৃত্যুকালে পঞ্চভূতাত্মক স্থূল শরীরই বিনষ্ট হয়, সূক্ষ শরীর লইয়া জীব উৎক্রমণ করে এবং পূর্ব কর্মানুযায়ী নূতন স্থূল-দেহ ধারণ করিয়া ঐ সূক্ষ শরীর লইয়াই পাপপুণ্যাদি ফলভোগ করে এবং এই কারণেই উহার মন, বুদ্ধি, ধর্মাধর্মাদি সংস্কার অর্থাৎ স্বভাব পূর্বজন্মানুযায়ীই হয় । তবে জন্মগ্রহণ-কালে পিতামাতার দেহ হইতে লিঙ্গ-শরীর যে দ্রব্য আকর্ষণ করিয়া লয় তাহাতে তাহার দেহ-স্বভাবের ন্যূনাধিক ভাবান্তর ঘটিয়া থাকে । সুতরাং, কেবল স্থূল দেহের সংসর্গ লোপ হইলেই জীবের মুক্তি হয় না, সূক্ষ শরীরও যখন লোপ পায়, তখনই জীবের সত্যস্বরূপ প্রতিভাত হয় ।

এস্থলে পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও মনকেই সূক্ষ শরীর বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে [১৫|৯] । দ্রষ্টব্য এই, 'ইন্দ্রিয়' বলিতে চক্ষু-কর্ণাদি স্থূল ইন্দ্রিয়যন্ত্র বুঝায় না, উহা স্থূল দেহের অন্তর্গত - প্রকৃত ইন্দ্রিয় বা ইন্দ্রিয়-শক্তিই সূক্ষ তত্ত্ব । বেদান্তমতে পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চ প্রাণ এবং বুদ্ধি ও মন (মোট ১৭টি অবয়বে) সূক্ষ শরীর গঠিত । সাংখ্যমতে পঞ্চ প্রাণ একাদশ ইন্দ্রিয়েরই অন্তর্ভূক্ত ।

যোগিগণ সূক্ষদেহ লইয়া স্থূলদেহ হইতে বহির্গত হইয়া অন্য শরীরে প্রবেশ করিতে পারেন (মহাভারতে জনক-সুলভা সংবাদ ইত্যাদি দ্রষ্টব্য) ।

(১৩) শাস্ত্রে এইরূপ বর্ণনা আছে যে, চন্দ্র জলময় ও সর্বরসের আধার এবং চন্দ্রের এই রসাত্মক গুণেই বনস্পতিগণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় । 

(১৪) দেহ যন্ত্রে এক খণ্ড রুটি ফেলিয়া দিলে উহা রক্তে পরিণত হয় । দেহাভ্যন্তরীণ কি কি প্রক্রিয়াদ্বারা এই পরিপাক-ক্রিয়া সাধিত হয়, তাহা জড়বিজ্ঞান বলিতে পারে । কিন্তু কোন, শক্তিবলে এই কার্য সাধিত হয়, তাহা জড়বিজ্ঞান জানে না । উহা ঐশ্বরিক শক্তি । 

(১৫) আত্মচৈতন্য প্রভাবে জীবের স্মৃতি ও জ্ঞানের উদয় হইয়া থাকে এবং যে মোহবশতঃ স্মৃতি ও জ্ঞানের লোপ হয়, সেই মোহও ইহা হইতেই জাত । সমস্ত বেদেই তাঁহাকে জানিতে উপদেশ করেন । বেদব্যাসাদিরূপে তিনিই বেদার্থ-প্রকাশক এবং বেদবেত্তা বা ব্রহ্মবেত্তাও তিনিই, ব্রহ্ম না হইলে ব্রহ্মকে জানা যায় না । 


(১৯) তিনি সর্বজ্ঞ হন - অর্থাৎ আমাকে পুরুষোত্তম বলিয়া জানিলে আর জানিবার কিছু অবশিষ্ট থাকে না, সগুণ-নির্গুণ, সাকার-নিরাকার, দ্বৈতাদ্বৈত ইত্যাদি সংশয় আর তাঁহার উপস্থিত হয় না; তিনি জানেন, আমিই নির্গুণ পরব্রহ্ম, আমিই সগুণ বিশ্বরূপ, আমিই সর্বলোক-মহেশ্বর, আমিই লীলায় অবতার, আমিই হৃদয়ে পরমাত্মা, সুতরাং তিনি সকল ভাবেই আমাকে ভজনা করেন ।

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : ষোড়শ অধ্যায় - দৈবাসুর-সম্পদ্‌-বিভাগযোগ

শ্রীভগবান্‌ বললেন -
নির্ভীকতা, চিত্তসূদ্ধি, আত্মজ্ঞাননিষ্ঠা ও কর্মযোগে তৎপরতা, দান, বাহ্যেন্দ্রিয় সংযম, যজ্ঞ, শাস্ত্র-অধ্যয়ন, তপঃ, সরলতা, অহিংসা, সত্য, অক্রোধ, ত্যাগ, শান্তি, পরনিন্দাবরজন, জীবে দয়া, লোভহীনতা, মৃদুতা (অক্রৌর্য), কু-কর্মে লজ্জা, অচাঞ্চল্য, তেজস্বিতা, ক্ষমা, ধৃতি, শৌচ, দ্রোহ বা হিংসা না করা, অনভিমান, - হে ভারত, এই সকল গুণ দৈবী সম্পদ্‌ অভিমুখে জাত পুরুষের হইয়া থাকে । ১,২,৩ (অর্থাৎ যাঁহারা পূর্বজন্মের কর্মফলে দৈবী সম্পদ্‌ ভোগার্থ জন্মগ্রহণ করেন তাঁহাদেরই এই সকল সাত্ত্বিক গুণ জন্মিয়া থাকে) ।

হে পার্থ, দম্ভ, দর্প, অভিমান, ক্রোধ, নিষ্ঠুরতা এবং অজ্ঞান আসুরী সম্পদ্‌-অভিমুখে জাত ব্যক্তি প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ এই সকল রাজসিক এবং তামসিক প্রকৃতির লোকের ধর্ম । ৪

দৈবী সম্পদ্‌ মোক্ষের হেতু এবং আসুরী সম্পদ্‌ সংসার-বন্ধনের কারণ হয় । হে পাণ্ডব, শোক করিও না; কারণ তুমি দৈবী সম্পদ্‌ অভিমুখে জন্মিয়াছ । ৫

হে পার্থ, এ জগতে দৈব ও আসুর এই দুই প্রকার প্রাণীর সৃষ্টি হয় । দৈবী প্রকৃতির বর্ণনা সবিস্তার করিয়াছি, এক্ষণে আসুরী প্রকৃতির কথা আমার নিকট শ্রবণ কর । ৬

আসুরভাবাপন্ন ব্যক্তিগণ জানে না যে, ধর্মে প্রবৃত্তিই বা কি আর অধর্ম হইতে নিবৃত্তিই বা কি, অর্থাৎ তাহাদের ধর্মাধর্ম, কর্তব্যাকর্তব্য জ্ঞান নাই । অতএব তাহাদের মধ্যে শৌচ, সদাচার বা সত্য কিছুই নাই । ৭

এই আসুর প্রকৃতির লোকেরা বলিয়া থাকে যে, এই জগতে সত্য বলিয়া কোন পদার্থ নাই, সকলই অসত্য; জগতে ধর্মাধর্মেরও কোন ব্যবস্থা নাই এবং ধর্মাধর্মের ব্যবস্থাপক ঈশ্বর বলিয়াও কোন বস্তু নাই । ইহা কেবল স্ত্রী-পুরুষের অন্যোন্যসংযোগে জাত (কামসম্ভূত) । স্ত্রী-পুরুষের কামই ইহার একমাত্র কারণ, ইহার অন্য কারণ নাই । ৮

পূর্বোক্ত দৃষ্টি (নিরীশ্বরবাদীদিগের মত) অবলম্বন করিয়া বিকৃতমতি, অল্পবুদ্ধি ক্রূরকর্মা ব্যক্তিগণ অহিতাচরণে প্রবৃত্ত হয়; তাহারা জগতের বিনাশের জন্যই জন্মগ্রহণ করিয়া থাকে । ৯

যাহা কখনও পূর্ণ হইবার নহে, এইরূপ কামনার বশীভূত হইয়া দম্ভ, অভিমান ও গর্বে মত্ত হইয়া, তন্ত্রমন্ত্রাদি দ্বারা স্ত্রী-রত্নাদি প্রাপ্ত হইব, অবিবেকবশতঃ এইরূপ দুরাশার বশবর্তী হইয়া অশুচিব্রত অবলম্বন করতঃ তাহারা কর্মে (ক্ষুদ্র দেবতাদির উপাসনায়) প্রবৃত্ত হইয়া থাকে । ১০

মৃত্যুকাল পর্যন্ত অপরিমেয় বিষয়-চিন্তা আশ্রয় করিয়া (যাবজ্জীবন নিরন্তর বিষয়চিন্তাপরায়ণ হইয়া) বিষয়ভোগনিরত এই সকল ব্যক্তি নিশ্চয় করে যে, কামোপভোগই পরম পুরুষার্থ, এতদ্ব্যতীত জীবনের অন্য লক্ষ্য নাই, সুতরাং ইহারা শত শত আশাপাশে বদ্ধ এবং কামক্রোধপরায়ণ হইয়া অসৎ মার্গ অবলম্বনপূর্বক অর্থ-সংগ্রহে সচেষ্ট হয় । ১১,১২

অদ্য আমার এই লাভ হইল, পরে এই ইষ্টবস্তু পাইব, এই ধন আমার আছে, এই ধন আমার পরে হইবে, এই শত্রুকে আমি পরাজিত করিয়াছি, অন্যান্যকেও হত করিব; আমি সকলের প্রভু, আমিই সকল ভোগের অধিকারী, আমি কৃতকৃত্য, আমি বলবান্‌, আমি সুখী, আমি ধনবান্‌, আমি কুলীন, আমার তুল্য আর কে আছে ? আমি যজ্ঞ করিব, দান করিব, মজা করিব - এই প্রকার অজ্ঞানে বিমূঢ়, বিবিধ বিষয়-চিন্তায় বিভ্রান্তচিত্ত, মোহজালে জড়িত, বিষয়ভোগে আসক্ত ব্যক্তিগণ অপবিত্র নরকে পতিত হয় । ১৩-১৬

আত্মশ্লাঘাযুক্ত, অবিনয়ী, ধনমানের গর্বে বিমূঢ় সেই আসুর প্রকৃতির ব্যক্তিগণ দম্ভ প্রকাশ করিয়া অবিধিপূর্বক নামমাত্র যজ্ঞ করে । ১৭

সাধুগণের অসূয়াকারী সেই সকল ব্যক্তি অহঙ্কার, বল, দর্প, কাম ও ক্রোধের বশীভূত হইয়া স্বদেহে ও পরদেহে অবস্থিত আত্মরূপী আমাকে দ্বেষ করিয়া থাকে । ১৮

এইরূপ দ্বেষপরবশ, ক্রুরমতি, নরাধম, আসুরপুরুষগণকে আমি সংসারে (ব্যাঘ্র-সর্পাদি) আসুরী যোনিতে পুনঃ পুনঃ নিক্ষেপ করিয়া থাকি । ১৯

হে কৌন্তেয়, এই সকল মূঢ় ব্যক্তি জন্মে জন্মে আসুরী যোনি প্রাপ্ত হয় এবং আমাকে না পাইয়া শেষে আরও অধোগতি (কৃমিকীটাদি যোনি) প্রাপ্ত হয় । ২০

কাম, ক্রোধ এবং লোভ - এই তিনটি নরকের দ্বারস্বরূপ, ইহারা আত্মার বিনাশের মূল (জীবের অধোগতির কারণ) । সুতরাং এই তিনটিকে ত্যাগ করিবে । ২১

হে কৌন্তেয়, নরকের দ্বারস্বরূপ এই তিনটি হইতে মুক্ত হইলে মানুষ আপনার কল্যাণ সাধনপূর্বক পরমগতি প্রাপ্ত হয় । ২২

যে ব্যক্তি শাস্ত্রবিধি ত্যাগ করিয়া স্বেচ্ছাচারী হইয়া কর্মে প্রবৃত্ত হয়, সে সিদ্ধি লাভ করিতে পারে না, তাহার শান্তি-সুখও হয় না, মোক্ষলাভও হয় না । ২৩

অতএব কর্তব্য-অকর্তব্য নির্ধারণে শাস্ত্রই তোমার প্রমাণ, সুতরাং তুমি শাস্ত্রোক্ত ব্যবস্থা জানিয়া (ইহায়) যথাধিকার কর্ম করিতে প্রবৃত্ত হও । ২৪

___________________________

(১-৩) আসুরিক প্রকৃতির লোক তাঁহাকে চিনে না, সুতরাং অবজ্ঞা করে; দৈবী বা সাত্ত্বিক প্রকৃতির লোক তাঁহাকে ভক্তি করে [৯|১১-১৩] । এই উভয় প্রকৃতির বিস্তারিত বর্ণনা এই অধ্যায়ে করা হইতেছে এবং আসুরী প্রকৃতির কিরূপে সংশোধন হয় তাহাও উপদেশ দেওয়া হইয়াছে । 
(৮) অথবা মতান্তরে, জগতের শাস্ত্রোক্ত কোন সৃষ্টি-পরম্পরা নাই । জগতের সকল পদার্থই মনুষ্যের কামনা-বাসনা তৃপ্ত করিবার জন্য । তাহাদের অন্য কোনও উপযোগ নাই । 
(১৭) এই সকল বিবেকহীন ব্যক্তি, বুদ্ধিভ্রংশকারী তামসী ও রাজসী প্রকৃতির বশে, আমাকে অবজ্ঞা করিয়া থাকে । উহাদের আশা ব্যর্থ, কর্ম নিষ্ফল, জ্ঞান নিরর্থক এবং চিত্ত বিক্ষিপ্ত । [৯|১২]

(১৮) আমি অন্তর্যামিরূপে সকলের মধ্যেই আছি, কিন্তু দম্ভবশে আমার অন্তর্যামিত্ব অস্বীকার করিয়া স্বদেহস্থিত আমাকে দ্বেষ করে এবং প্রাণি-হিংসাদি দ্বারা অন্য দেহেও আমাকে দ্বেষ করিয়া থাকে । 
(২৩) সিদ্ধি = পুরুষার্থ প্রাপ্তির যোগ্যতা (শঙ্কর); তত্ত্বজ্ঞান (শ্রীধর) ।

(২৪) শাস্ত্র = শ্রুতি-স্মৃতি-পুরাণাদি । ধর্মশাস্ত্র = কর্তব্যাকর্তব্য নির্ণায়ক শাস্ত্র; আধুনিকগণ ইহাকে নীতিশাস্ত্র বলেন । কিন্তু সংস্কৃত সাহিত্যে নীতিশাস্ত্র বলিতে কেবল রাজনীতিই বুঝায় । উহা ধর্মশাস্ত্রেরই অন্তর্গত ।

(২৪) ইহ = কর্মাধিকারে বর্তমান থাকিয়া (শ্রীধর); এই লোকে (তিলক); এই কর্মাধিকার-ভূমিতে অর্থাৎ ভারতবর্ষে (শঙ্কর) । ভারতবর্ষ কর্মভূমি, মোক্ষ সাধনার শ্রেষ্ঠ স্থান, দেবগণও এস্থানে জন্মগ্রহণ বাঞ্ছা করেন [বৃহন্নারদীয় পুরাণ ৩|৪৯-৫৬, ৬৯-৭৯; অপিচ, ভাগবত ৫|১৯-২৭] ।

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : সপ্তদশ অধ্যায় - শ্রদ্ধাত্রয়‌-বিভাগযোগ

অর্জুন কহিলেন -
হে কৃষ্ণ, যাঁহারা শাস্ত্রবিধি ত্যাগ করিয়া (অথচ) শ্রদ্ধাযুক্ত হইয়া যাগযজ্ঞ পূজাদি করিয়া থাকেন, তাঁহাদিগের নিষ্ঠা কিরূপ ? সাত্ত্বিকী, না রাজসী, না তামসী ? ১

শ্রীভগবান্‌ কহিলেন -
দেহীদিগের সাত্ত্বিকী, রাজসী ও তামসী, এই তিন প্রকারের শ্রদ্ধা আছে, উহা স্বভাবজাত অর্থাৎ পূর্বজন্মের সংস্কার-প্রসূত; তাহা বিস্তারিত বলিতেছি, শ্রবণ কর । ২

হে ভারত, সকলেরই শ্রদ্ধা নিজ নিজ অন্তঃকরণ-প্রবৃত্তি বা স্বভাবের অনুরূপ হইয়া থাকে । মনুষ্য শ্রদ্ধাময়; যে যেইরূপ শ্রদ্ধাযুক্ত, সে সেইরূপই হয় । ৩

সাত্ত্বিক ব্যক্তিগণ দেবগণের পূজা করেন, রাজসিক প্রকৃতির ব্যক্তিগণ যক্ষরক্ষদিগের পূজা করেন এবং তামসিক ব্যক্তিগণ ভূত-প্রেতের পূজা করিয়া থাকে । ৪

দম্ভ, অহঙ্কার, কামনা ও আসক্তিযুক্ত এবং বলগর্বিত হইয়া যে সকল অবিবেকী ব্যক্তি শরীরস্থ ভূতগণকে এবং অন্তর্যামিরূপে দেহমধ্যস্থ আমাকে কৃশ করিয়া (কষ্ট দিয়া) শাস্ত্রবিধিবিরুদ্ধ অত্যুগ্র তপস্যাদি করিয়া থাকে, তাহাদিগকে আসুরবুদ্ধিবিশিষ্ট বলিয়া জানিবে । ৫,৬

(প্রকৃতিভেদে) সকলেরই প্রিয় আহারও ত্রিবিধ হইয়া থাকে; সেইরূপ যজ্ঞ, তপস্যা এবং দানও ত্রিবিধ; উহাদের মধ্যে যেরূপ প্রভেদ তাহা শ্রবণ কর । ৭

যাহা আয়ু, উৎসাহ, বল, আরোগ্য, চিত্ত-প্রসন্নতা ও রুচি - এ সকলের বর্ধনকারী এবং সরস, স্নেহযুক্ত, সারবান্‌ এবং প্রীতিকর - এইরূপ (সাত্ত্বিক) আহার সাত্ত্বিক ব্যক্তিগণের প্রিয় । ৮

অতি কটু, অতি অম্ল, অতি লবণাক্ত, অতি উষ্ণ, তীক্ষ্ণ, বিদাহী এবং দুঃখ, শোক ও রোগ উৎপাদক (রাজসিক) আহার রাজস ব্যক্তিগণের প্রিয় । ৯

যে খাদ্য বহু পূর্বে পক্ক, যাহার রস শুষ্ক হইয়া গিয়াছে, যাহা দুর্গন্ধ, পর্যুষিত (বাসি), উচ্ছিষ্ট ও অপবিত্র, তাহা তামস ব্যক্তিগণের প্রিয় । ১০

ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করিয়া 'যজ্ঞ করিতে হয় তাই করি' এইরূপ অবশ্য-কর্তব্য বোধে শাস্ত্রবিধি অনুসারে শান্তচিত্তে যে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়, তাহা সাত্ত্বিক যজ্ঞ । ১১

কিন্তু হে ভরতশ্রেষ্ঠ, ফল লাভের উদ্দেশ্যে এবং দম্ভার্থে (নিজ ঐশ্বর্য, মহত্ত্ব বা ধার্মিকতা প্রকাশার্থ) যে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয় তাহাকে রাজস-যজ্ঞ বলিয়া জানিবে । ১২

শাস্ত্রোক্ত বিধিশূন্য, অন্নদানহীন, শাস্ত্রোক্ত মন্ত্রহীন, দক্ষিণাহীন, শ্রদ্ধাশূন্য যজ্ঞকে তামস-যজ্ঞ বলে । ১৩

দেব, দ্বিজ, গুরু, বিদ্বান্‌ ব্যক্তির পূজা, শৌচ, সরলতা, ব্রহ্মচর্য, অহিংসা, এই সকলকে শারীর তপস্যা বলে । ১৪

যাহা কাহারও উদ্বেগকর হয় না, যাহা সত্য, প্রিয় ও হিতকর এইরূপ বাক্য এবং যথাবিধি শাস্ত্রাভ্যাস - এই সকলকে বাঙ্‌ময় বা বাচিক তপস্যা বলা হয় । ১৫

চিত্তের প্রসন্নতা, অক্রুরতা, বাক্‌-সংযম, আত্মসংযম বা মনসংযম এবং অন্যের সহিত ব্যবহারে কপটতারাহিত্য, এই সকলকে মানসিক তপস্যা বলে । ১৬

পূর্বোক্ত ত্রিবিধ তপস্যা যদি ফলাকাঙ্ক্ষাশূন্য, ঈশ্বরে একাগ্রচিত্ত ব্যক্তিগণ কর্তৃক পরম শ্রদ্ধা সহকারে অনুষ্ঠিত হয়, তবে তাহাকে সাত্ত্বিক তপস্যা বলে । ১৭

সৎকার, মান ও পূজা লাভ করিবার জন্য দম্ভ সহকারে যে তপস্যা অনুষ্ঠিত হয় এবং ইহলোকে যাহার ফল অনিত্য এবং অনিশ্চিত, তাহাকে রাজসিক তপস্যা বলে । ১৮

মোহাচ্ছন্নবুদ্ধিবশে নিজের শরীরাদিকেও পীড়া দিয়া অথবা জারণ, মারণাদি অভিচার দ্বারা পরের বিনাশার্থ যে তপস্যা অনুষ্ঠিত হয়, তাহাকে তামস তপস্যা বলে । ১৯

"দান করা উচিত, তাই দান করি" এইরূপ কর্তব্য-বুদ্ধিতে উপযুক্ত দেশ, কাল ও পাত্র বিবেচনা করিয়া অনুপকারী ব্যক্তিকে (অর্থাৎ প্রত্যুপকারের আশা না রাখিয়া) যে দান করা হয়, তাহাকে সাত্ত্বিক দান বলে । ২০

পরন্তু প্রত্যুপকারের আশায় অথবা স্বর্গাদি ফল কামনায় অতি কষ্টের সহিত যে দান করা হয়, তাহাকে রাজস দান বলে । ২১

অনুপযুক্ত দেশে, অনুপযুক্ত কালে এবং অনুপযুক্ত পাত্রে যে দান এবং (উপযুক্ত দেশকালপাত্রে প্রদত্ত হইলেও) সৎকারশূন্য এবং অবজ্ঞাসহকারে কৃত যে দান, তাহাকে তামস দান বলে । ২২

(শাস্ত্রে) 'ওঁ তৎ সৎ' এই তিন প্রকারে পরব্রহ্মের নাম নির্দেশ করা হইয়াছে; এই নির্দেশ হইতেই পূর্বকালে বেদবিদ্‌ ব্রাহ্মণ, বেদ ও যজ্ঞ সৃষ্ট হইয়াছে । ২৩

এই হেতু ব্রহ্মবাদিগণের যজ্ঞ, দান ও তপস্যাদি শাস্ত্রোক্ত কর্ম সর্বদা 'ওঁ" উচ্চারণ করিয়া অনুষ্ঠিত হয় । ২৪

যাঁহারা মোক্ষ কামনা করেন, তাঁহারা ফল কামনা ত্যাগ করিয়া 'তৎ' এই শব্দ উচ্চারণপূর্বক বিবিধ যজ্ঞ তপস্যা এবং দানক্রিয়ার অনুষ্ঠান করেন । ২৫

হে পার্থ, সদ্ভাব ও সাধুভাব অর্থাৎ কোন বস্তুর অস্তিত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব নির্দেশার্থ সৎ শব্দ প্রযুক্ত হয়; এবং (বিবাহাদি) মঙ্গল কর্মেও সৎ শব্দ ব্যবহৃত হয় । ২৬

যজ্ঞ, তপস্যা ও দানে স্থিতি অর্থাৎ নিষ্ঠা বা তৎপর হইয়া থাকাকেও সৎ বলে এবং এই সকলের জন্য যে কিছু কর্ম করিতে হয় তাহাও সৎ বলিয়া কথিত হয় । ২৭

হে পার্থ, হোম, দান, তপস্যা বা অন্য কিছু যাহা অশ্রদ্ধাপূর্বক অনুষ্ঠিত হয়, সে সমুদয় অসৎ বলিয়া কথিত হয় । সে সকল না ইহলোকে না পরলোকে ফলদায়ক হয় । ২৮

 ___________________________
(৩) পুরুষঃ = সংসারী জীবঃ (শঙ্কর) 

(৪) কিন্তু সকাম দেবোপসনা মিশ্রসাত্ত্বিক । উহাতে কাম্যবস্তু বা দেব-লোকাদি প্রাপ্তি হয়, ভগবৎ-প্রাপ্তি হয় না । নিষ্কামভাবে একমাত্র ভগবানের আরাধনাই শুদ্ধ সাত্ত্বিকী শ্রদ্ধা, ভাগবতে ইহাকেই নির্গুণা শ্রদ্ধা বলা হইয়াছে [ভাগবত ১১|২৫|২৬] ।
 

ত্রিবিধ শ্রদ্ধা :
শ্রদ্ধাই উপাসনার প্রাণ; যজ্ঞ, দান, ব্রত-নিয়মাদিরও মুখ্য কথা শ্রদ্ধা । প্রেমভক্তি-পথের প্রথম কথাই শ্রদ্ধা, শ্রদ্ধা হইতে ক্রমে রুচি, রাগ, ভাব ও নির্মল প্রেমের বিকাশ । - [ভক্তিরসামৃতসিন্ধু|১|৪|১১, চৈ.চ. মধ্য|২৩|৯|১০]
শ্রদ্ধা মনের ধর্ম, মন স্বভাবতই অন্ধ, শ্রদ্ধাও অন্ধ; বুদ্ধিদ্বারা চালিত না হইলে উহা অযোগ্য বস্তুতেই শ্রদ্ধা জন্মাইয়া জীবকে অধঃপাতিত করে । পক্ষান্তরে, মনে যদি শ্রদ্ধা না থাকে, লোকে যদি কেবল বুদ্ধিদ্বারাই চালিত হয়, তবে কেবল শুষ্ক পাণ্ডিত্য, বিতর্ক ও নাস্তিকতা আনয়ন করে ।
বুদ্ধিও সাত্ত্বিকাদি-ভেদে ত্রিবিধ এবং শ্রদ্ধা এই বুদ্ধিকর্তৃক চালিত হয় বলিয়া উহাও ত্রিবিধ হয় । তামসিকবুদ্ধি-প্রসূত তামসিক শ্রদ্ধা - দস্যুগণের নরবলি দিয়া কালীপূজা করা । রাজসিকবুদ্ধি-প্রসূত রাজসিক শ্রদ্ধা - ছাগমহিষাদি বলিদান করা । সাত্ত্বিকবুদ্ধি-প্রসূত সাত্ত্বিক শ্রদ্ধা - ছাগমহিষাদিকে কামক্রোধাদি পাশব বৃত্তির প্রতীকমাত্র বুঝিয়া ঐ সকল রিপুকে বলিদান করাই মায়ের শ্রেষ্ঠ অর্চনা বলিয়া মনে করা । 

(১০) সাত্ত্বিকাদি-ভেদে তিন প্রকার আহার :-
  1. সাত্ত্বিক আহার : যাহা আয়ু, উৎসাহ, বল, আরোগ্য, চিত্ত-প্রসন্নতা ও রুচি বর্ধনকারী এবং সরস, স্নেহযুক্ত, সারবান এবং প্রীতিকর ।
  2. রাজস আহার : অতি কটু, অতি অম্ল, অতি লবণাক্ত, অতি উষ্ণ, তীক্ষ্ণ, বিদাহী এবং দুঃখ, শোক ও রোগ-উৎপাদক ।
  3. তামস আহার : যে খাদ্য বহু পূর্বে পক্ক, যাহার রস শুষ্ক হইয়া গিয়াছে, যা হা দুর্গন্ধ, পর্যুষিত (বাসি) উচ্ছিষ্ট ও অপবিত্র ।

আহার-শুদ্ধি 
সর্বপ্রকার সাধনপক্ষেই, বিশেষতঃ ভক্তিমার্গে, আহারশুদ্ধির বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হয় । 'আহার শুদ্ধ হইলে চিত্ত শুদ্ধ হয়, চিত্ত শুদ্ধ হইলে সেই শুদ্ধ চিত্তে সর্বদা ঈশ্বরের স্মৃতি অব্যাহত থাকে' [ছান্দোগ্য ৭|২৬] ।
(1) শ্রীমৎ রামানুজাচার্যের মতে আহার = খাদ্য (food) । তাঁহার মতে খাদ্যের ত্রিবিধ দোষ পরিহার করা কর্তব্য । (i) জাতিদোষ অর্থাৎ খাদ্যের প্রকৃতিগত দোষ - যেমন মদ্য, মাংস, রশুন, পেঁয়াজ ইত্যাদি উত্তেজক খাদ্য; (ii) আশ্রয় দোষ - অর্থাৎ যে ব্যক্তির নিকট হইতে খাদ্য গ্রহণ করা যায়, তাহার দোষে খাদ্যে যে দোষ জন্মে - যেমন অশুচি, অতিকৃপণ, আসুর-স্বভাব, কুৎসিত-রোগাক্রান্ত খাদ্যবিক্রেতা, দাতা, পাচক বা পরিবেশনকারী প্রভৃতি; (iii) নিমিত্ত দোষ - অর্থাৎ খাদ্যে ধুলি, ময়লা, কেশ, মুখের লালা ইত্যাদি অপবিত্র দ্রব্যের সংস্পর্শ ।
(2) শ্রীমৎ শঙ্করাচার্যের মতে আহার = ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়জ্ঞান অর্থাৎ যাহা গ্রহণ করা যায় তাহাই আহার । তাঁহার মতে আহারশুদ্ধি অর্থ রাগ, দ্বেষ, মোহ এই ত্রিবিধ দোষবর্জিত হইয়া ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বিষয়গ্রহণ ।
(3) স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন - "এই দুইটি ব্যাখ্যা আপাতবিরোধী বলিয়া বোধ হইলেও উভয়টিই সত্য ও প্রয়োজনীয় । সূক্ষ শরীর বা মনের সংযম, মাংস-পিণ্ডময় স্থূল শরীরের সংযম হইতে উচ্চতর কার্য বটে, কিন্তু সূক্ষের সংযম করিতে হইলে অগ্রে স্থূলের সংযম করা বিশেষ আবশ্যক । সুতরাং ইহা যুক্তিসিদ্ধ বোধ হইতেছে যে, খাদ্যাখাদ্যের বিচার মনের স্থিরতারূপ উচ্চাবস্থা লাভের জন্য বিশেষ আবশ্যক । নতুবা সহজে এই স্থিরিতা লাভ করা যায় না । কিন্তু আজকাল আমাদের অনেক সম্প্রদায়ে এই আহারাদির বিচারের এত বাড়াবাড়ি, এত অর্থহীন নিয়মের বাঁধাবাধি, এই বিষয়ে এত গোঁড়ামি যে, তাঁহারা যেন ধর্মটিকে রান্নাঘরের ভিতর পুরিয়াছেন । এইরূপ ধর্ম এক বিশেষ প্রকার খাঁটি জড়বাদ মাত্র । উহা জ্ঞান নহে, ভক্তিও নহে, কর্মও নহে ।" [ভক্তির সাধন, ভক্তিযোগ, স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, চতুর্থ খণ্ড, পৃঃ ৪০-৪১]


(১১) ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে শ্রীকৃষ্ণ এইরূপ সাত্ত্বিক যজ্ঞ করিতেই উপদেশ দিয়াছিলেন এবং তিনিও কর্তব্যানুরোধে নিষ্কামভাবে উহা সম্পন্ন করিয়াছিলেন । যুধিষ্ঠির বলিয়াছিলেন - "রাজপুত্রি, আমি কর্মফলান্বেষী হইয়া কোন কর্ম করি না; দান করিতে হয় তাই দান করি, যজ্ঞ করিতে হয় তাই যজ্ঞ করি; ধর্মাচরণের বিনিময়ে যে ফল চাহে, সে ধর্মবণিক, ধর্মকে সে পণ্যদ্রব্য করিয়াছে । সে হীন, জঘন্য ।" [মভাঃ বনপর্ব ৩১|২৫] 

(১৫) অপ্রিয় সত্য বলা অনুচিত - মনু ৪|১৩৮ । অপ্রিয় সত্য ও হিত্যবাক্য বলার ও শোনার লোক অতি বিরল - মহাভারতে বিদুরবাক্য । 

(১৮) সৎকার = সাধুকার অর্থাৎ এই ব্যক্তি বড় সাধু, তপস্বী - এইরূপ প্রশংসা-বাক্যাদি । মান = মানন অর্থাৎ প্রত্যুত্থান (আসিতে দেখিয়া উঠিয়া দাঁড়ান), অভিবাদন প্রভৃতি দ্বারা সম্মান প্রদর্শন । পূজা = পাদ প্রক্ষালন, আসনাদি দান, ভোজন করান ইত্যাদি ।
 

(১৮) এইরূপ তপস্যায় আত্মোন্নতি বা পারলৌকিক কোন স্থায়ী ফল হয় না, কেবল ইহলোকে ক্ষণস্থায়ী প্রতিষ্ঠা লাভ হইতে পারে । কিন্তু সেইরূপ প্রতিষ্ঠা লাভও যে হইবে তাহারও নিশ্চয়তা নাই । এই জন্য ইহাকে অনিত্য ও অধ্রুব বলা হইয়াছে । 

(২০) সাত্ত্বিক দান
সাত্ত্বিক দানের তিনটি লক্ষণ - (1) ফলাকাঙ্ক্ষা না করিয়া নিষ্কাম কর্তব্য-বুদ্ধিতে দান, (2) অনুপকারী ব্যক্তিকে দান (যে পূর্বে উপকার করেনি অথবা পরেও প্রত্যুপকার করিবে না তাহাকে দান নচেৎ উহা আদান-প্রদান হইয়া যায়), (3) উপযুক্ত দেশ, কাল ও পাত্র বিবেচনা করিয়া দান ।

(3a) উপযুক্ত দেশের উদাহরণ - যে গ্রামে বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব, তথায়ই পুষ্করিণী প্রতিষ্ঠায় জলদানের ফল হয়, বড় শহরে উহার কোন প্রয়োজন নাই । প্রাচীন টীকাকারগণদের সঙ্কীর্ণ মতে কুরুক্ষেত্রাদি পুণ্যক্ষেত্র ।

(3b) উপযুক্ত কালের উদাহরণ  - কলেরার প্রাদুর্ভাবমাত্রেই ঔষধ দানের ব্যবস্থা করা বিধেয়, পূর্বে বা পরে উহাতে অর্থব্যয় করা নিষ্ফল । প্রাচীন টীকাকারগণদের সঙ্কীর্ণ মতে সংক্রান্তি গ্রহণাদি পুণ্যকাল ।

(3c) উপযুক্ত পাত্রের উদাহরণ  - অভাবগ্রস্থ বিপন্ন ব্যক্তিকেই দান করিতে হয়, অর্থশালীকে দান করা নিষ্ফল । প্রাচীন টীকাকারগণদের সঙ্কীর্ণ মতে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ (শঙ্কর) ।

কিন্তু আধুনিকগণ এইরূপ সঙ্কীর্ণ অর্থ অনুমোদন করেন না । যেমন মনস্বী বঙ্কিমচন্দ্র লিখিয়াছেন - "সর্বনাশ ! আমি যদি স্বদেশে বসিয়া (অর্থাৎ পুণ্যক্ষেত্রাদিতে নয়) ১লা হইতে ২৯শে তারিখের মধ্যে (অর্থাৎ সংক্রান্তিতে নয়) কোন দিনে অতি দীনদুঃখী, পীড়ায় কাতর একজন মুচি বা ডোমকে (অর্থাৎ ব্রাহ্মণকে নয়) কিছু দান করি, তবে সে দান ভগবদভিপ্রেত দান হইল না ! এইরূপে কখন কখন ভাষ্যকারদিগের বিচারে অতি উন্নত, উদার ও সার্বভৈমিক যে ধর্ম তাহা অতি সঙ্কীর্ণ এবং অনুদার উপধর্মে পরিণত হইয়াছে । ইহারা যাহা বলেন তাহা ভগবদ্বাক্যে নাই, স্মৃতিশাস্ত্রে আছে । কিন্তু বিনা বিচারে ঋষিদিগের বাক্যসকল মস্তকের উপর এতকাল বহন করিয়া এই বিশৃঙ্খলা, অধর্ম ও দুর্দশায় আসিয়া পড়িয়াছি । এখন আর বিনা বিচারে বহন কর্তব্য নহে ।" [ধর্ম্মতত্ত্ব (অনুশীলন), বঙ্কিম রচনাসমগ্র]

প্রকৃত পক্ষে এ বিষয়ে ঋষিশাস্ত্রের কোনরূপ অনুদারতা নাই । শাস্ত্রের মর্ম বুঝিবার বা বুঝাইবার ত্রুটিতে আমাদের দুর্দশা । শাস্ত্রে দীনদুঃখী, আর্ত, পীড়িত, অভ্যাগত (visitor), এমন কি পশুপক্ষী, বৃক্ষলতাদির পর্যন্ত ধারণ-পোষণের ব্যবস্থা আছে । সর্বভূতের রক্ষাই গার্হস্থ্য ধর্ম, ইহাই শাস্ত্রের অনুশাসন । তবে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণকে দান সর্বশ্রেষ্ঠ দান বলিয়া উল্লিখিত কারণ তাঁহারা হিন্দু-সমাজের প্রতিষ্ঠা ও বর্ণাশ্রম ধর্মাদির ব্যবস্থা করিয়াও অর্থাগমের যাবতীয় কর্মেই (যেমন রাজত্ব, প্রভুত্ব, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্যাদি) অন্য জাতির অধিকার দিয়াছেন । নিজেরা উঞ্ছবৃত্তি বা অযাচিত দানের (প্রতিগ্রহ) উপর নির্ভর করিয়া সামান্য গ্রাসাচ্ছাদনে সন্তুষ্ট থাকিয়া সমাজে ধর্ম (যজন-যাজন) ও জ্ঞান (অধ্যয়ন, অধ্যাপনা) বিস্তারের ভার লইয়াছেন । ঈদৃশ পরার্থপর ত্যাগী ব্রাহ্মণজাতির রক্ষাকল্পে শাস্ত্রের যে সকল ব্যবস্থা তাহা সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত ও সমাজরক্ষার অনুকূল । আবার, বেদজ্ঞানহীন নিরগ্নি (অর্থাৎ স্বধর্ম পালনে পরাঙ্মুখ) দ্বিজবন্ধুদিগকে দান করিলে নিরয়গামী (condemned to hell) হইতে হয়, শাস্ত্রে এমন কঠোর অনুশাসনও রহিয়াছে । সুতরাং ঋষিশাস্ত্রের অনুদারতা বা পক্ষপাতিতা কোথাও নাই ।

গ্রহণাদি সময়ে বা পুণ্যক্ষেত্রাদিতে লোকের সাত্ত্বিক ভাব বৃদ্ধি হওয়ারই সম্ভাবনা থাকে, এই হেতু সেই কাল বা স্থান-দানাদি কর্মে প্রশস্ত বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকিবে, কেননা দানাদি কর্ম সাত্ত্বিক শ্রদ্ধার সহিত নিষ্পন্ন না হইলে নিষ্ফল হয় [গীতা ১৭|২৮] । কিন্তু কাল পরিবর্তনে ব্রাহ্মণজাতির ব্রাহ্মণত্ব বা তীর্থক্ষেত্রাদির মাহাত্ম্য যদি লোপ পায় এবং তদ্দরুণ লোকের ভক্তিশ্রদ্ধার যদি ব্যত্যয় ঘটে, তবে এই সকল বিধি-ব্যবস্থার কোন মূল্য থাকে না, তাহা বলাই বাহুল্য । সে স্থলে শাস্ত্রের প্রকৃত মর্ম ও উদ্দেশ্য বুঝিইয়া তদনুসারে কর্তব্যাকর্তব্য নির্ণয় করাই শ্রেয়কল্প; সংস্কারবশতঃ প্রাণহীন অনুষ্ঠান লইয়া বসিয়া থাকিলে ক্রমশঃ অধোগতি সুনিশ্চিত ।
 

(২৬) সদ্ভাব = থাকার ভাব বা অস্ত্যর্থে ।

(২৭) ওঁ তৎ সৎ (স্ফোট) - এই তিনটি ব্রহ্মবাচক । তিনটির পৃথক্‌ও ব্যবহার হয়, এক সঙ্গেও ব্রহ্ম নির্দেশার্থ ব্যবহৃত হয় । ওঁ (অ-উ-ম্‌) বা প্রণব বা শব্দব্রহ্ম বা স্ফোটরূপী ওঙ্কার হইতেই জগতের সৃষ্টি । " 'ওঁ' - গূঢ়াক্ষররূপী বৈদিক মন্ত্র; 'তৎ' - তাহা অর্থাৎ দৃশ্য জগতের অতীত দূরবর্তী অনির্বাচ্য তত্ত্ব; 'সৎ' - চক্ষুর সম্মুখস্থ দৃশ্য জগৎ । এই তিন মিলিয়া সমস্তই ব্রহ্ম, ইহাই এই সঙ্কল্পের অর্থ ।" - লোকমান্য তিলক । এ স্থলে বলা হইতেছে যে - 'ওঁ তৎ সৎ' এই ব্রহ্মনির্দেশ হইতে ব্রাহ্মণাদি কর্তা, করণরূপ বেদ এবং কর্মরূপ যজ্ঞ সৃষ্টি হইয়াছে । ইহারই নাম শব্দব্রহ্মবাদ । এই ওঙ্কারই জগতের অভিব্যক্তির আদি কারণ শব্দব্রহ্ম । ইহার নাম স্ফোট । স্ফোট হইতে কিরূপে জগতের সৃষ্টি হইল তাহা শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণিত আছে [ভা | ১২|৬|৩৩-৩৭] :-
১) সমাধিমগ্ন ব্রহ্মার হৃদাকাশ হইতে প্রথমত নাদ উৎপন্ন হইল;
২) নাদ হইতে ত্রিমাত্রা ওঙ্কার উৎপন্ন হইল যাহা সমস্ত বৈদিক মন্ত্রোপনিষদের বীজস্বরূপ;
৩) অব্যক্ত ওঙ্কারের অকার, উকার, মকার এই তিন বর্ণ প্রকাশ পাইল;
৪) এই তিন বর্ণ হইতে ক্রমশ সত্ত্বাদি গুণ, ঋগাদি বেদ, ভূর্ভুবাদি লোক অর্থাৎ জগৎপ্রপঞ্চ সৃষ্ট হইল ।

কর্মে ব্রহ্মনির্দেশ :
পূর্বে বলা হইয়াছে, ব্রহ্মবাচক স্ফোটরূপী ওঙ্কার হইতেই জগতের সৃষ্টি । জগতের ধারণ-পোষণের জন্য যজ্ঞসৃষ্টি । যজ্ঞ-শব্দে ব্যাপক অর্থে চাতুর্বর্ণ্যের আচরণীয় সমস্ত কর্ম বুঝায় । এই যজ্ঞ-কর্মের ব্যবস্থাই বেদে আছে এবং যজ্ঞরক্ষার ভার প্রধানত ব্রাহ্মণের উপর । ব্রাহ্মণ, বেদ ও যজ্ঞ পরব্রহ্ম হইতেই উৎপন্ন হইয়াছে; সুতরাং ব্রহ্মবাচক 'ওঁ তৎ সৎ' এই সঙ্কল্পই সমগ্র সৃষ্টির মূল । যজ্ঞ বা কর্মদ্বারাই সৃষ্টিরক্ষা হয়, সুতরাং 'ওঁ তৎ সৎ' এই সঙ্কল্পদ্বারাই সমস্ত কর্ম করিতে হয় । ইহার স্থূল মর্ম এই যে, সর্বকর্মই পরমাত্মাকে স্মরণ করিয়া ঈশ্বরার্পণ-বুদ্ধিতে করিবে অর্থাৎ কর্মকে ব্রহ্মকর্মে পরিণত করিবে, তাহা ত্যাগ করিবে না ।

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : অষ্টাদশ অধ্যায় - মোক্ষযোগ

অর্জুন কহিলেন -
হে মহাবাহো, হে হৃষিকেষ, হে কেশিনিসূদন, সন্ন্যাস ও ত্যাগের তত্ত্ব কি, তাহা পৃথক্‌ ভাবে জানিতে ইচ্ছা করি । ১

শ্রীভগবান্‌ বলিলেন -
কাম্য কর্মের ত্যাগকেই পণ্ডিতগণ সন্ন্যাস বলিয়া জানেন; এবং সমস্ত কর্মের ফল-ত্যাগকেই সূক্ষ্মদর্শিগণ ত্যাগ বলিয়া থাকেন । ২

কোন কোন (সাংখ্য) পণ্ডিতগণ বলেন যে, কর্মমাত্রই দোষযুক্ত, অতএব ত্যাজ্য; অন্য কেহ কেহ (মীমাংসকগণ) বলেন যে, যজ্ঞ, দান ও তপঃকর্ম ত্যাজ্য নহে । ৩

হে ভরতশ্রেষ্ঠ, ত্যাগ বিষয়ে আমার সিদ্ধান্ত শ্রবণ কর; হে পুরুষশ্রেষ্ঠ, ত্যাগ ত্রিবিধ বলিয়া কথিত হইয়াছে । ৪

যজ্ঞ, দান ও তপস্যারূপ কর্ম ত্যাজ্য নহে, উহা করাই কর্তব্য । যজ্ঞ, দান ও তপস্যা বিদ্বান্‌গণেরও চিত্তশুদ্ধিকর । ৫

হে পার্থ, এই সকল কর্মও কর্তৃত্বাভিমান ও ফল কামনা ত্যাগ করিয়া করা কর্তব্য । ইহাই আমার নিশ্চিত মত এবং ইহাই উত্তম মত । ৬

স্বধর্ম বলিয়া যাহার যে কর্ম নির্দিষ্ট আছে, সেই কর্ম ত্যাগ করা কর্তব্য নহে । মোহবশতঃ সেই কর্ম ত্যাগ করাকে তামসত্যাগ বলে । ৭

কর্মানুষ্ঠান দুঃখকর মনে করিয়া কায়িক ক্লেশের ভয়ে যে কর্মত্যাগ করা হয়, তাহা রাজসত্যাগ । যিনি এই ভাবে কর্মত্যাগ করেন, তিনি প্রকৃত ত্যাগের ফল লাভ করেন না । ৮

হে অর্জুন, কর্তৃত্বাভিমান ও ফলকামনা ত্যাগ করিয়া, কেবল কর্তব্য বলিয়া যে বিহিত কর্ম করা হয়, তাহাই সাত্ত্বিক ত্যাগ বলিয়া কথিত হয় । ৯ (অর্থাৎ কর্তৃত্বাভিমান ও ফলকামনা ত্যাগই সাত্ত্বিক ত্যাগ, কর্মত্যাগ নহে) ।

সত্ত্বগুণবিশিষ্ট, স্থিরবুদ্ধি, সংশয়শূন্য পূর্বোক্ত সাত্ত্বিক ত্যাগী পুরুষ দুঃখকর কর্মেও দ্বেষ করেন না এবং সুখকর কর্মেও আসক্ত হন না । ১০ (অর্থাৎ রাগদ্বেষ হইতে বিমুক্ত থাকিয়া কেবল কর্তব্যবোধে কর্ম করিয়া থাকেন) ।

যে দেহ ধারণ করে তাহার পক্ষে কর্ম সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করা সম্ভবপর নয়; অতএব যিনি (কর্ম করিয়াও) কর্মফল ত্যাগ করেন, তিনিই প্রকৃত ত্যাগী বলিয়া কথিত হন । ১১

যাঁহারা ফল-কামনা ত্যাগ করেন না সেই অত্যাগী পুরুষগণের মৃত্যুর পরে অনিষ্ট, ইষ্ট ও ইষ্টানিষ্ট-মিশ্র, তাঁহাদের কর্মানুসারে এই তিন প্রকার ফল লাভ হয় । কিন্তু সন্ন্যাসীদের অর্থাৎ যাঁহারা কর্মফল ত্যাগ করিয়া কর্ম করেন, তাঁহাদের কখনও ফল লাভ হয় না । ১২ (অর্থাৎ তাঁহারা কর্ম করিলেও কর্মে আবদ্ধ হন না) ।

হে মহাবাহো, যে কোন কর্ম সম্পাদনের পক্ষে পাঁচটি কারণ সাংখ্য-সিদ্ধান্তে বর্ণিত আছে, তাহা আমার নিকট শ্রবণ কর । ১৩

অধিষ্ঠান (স্থান), কর্তা, বিবিধ করণ বা সাধন (যন্ত্র), কর্তার অনেক প্রকার চেষ্টা বা ব্যাপার এবং পঞ্চম কারণ দৈব । ১৪

মনুষ্য শরীর, মন ও বাক্যদ্বারা ন্যায্য বা অন্যায্য যে কোন কর্ম করে, পূর্বোক্ত পাঁচটি তাহার কারণ । ১৫

বাস্তবিক অবস্থা এইরূপ হইলেও (অর্থাৎ  পূর্বোক্ত পাঁচটি কর্মের কারণ হইলেও) নিঃসঙ্গ আত্মাকে যে কর্তা বলিয়া মনে করে, তাহার বুদ্ধি শাস্ত্রাদি জ্ঞানের দ্বারা পরিমার্জিত না হওয়ায় সে প্রকৃত তত্ত্ব দেখিতে পায় না । ১৬

যাঁহার 'আমি কর্তা' এই ভাব নাই, যাঁহার বুদ্ধি কর্মের ফলাফলে আসক্ত হয় না, তিনি সমস্ত লোক হনন করিলেও কিছুই হনন করেন না এবং তাহার ফলে আবদ্ধও হন না । ১৭

জ্ঞান, জ্ঞেয় ও পরিজ্ঞাতা, এই তিনটি কর্মচোদনা অর্থাৎ কর্মপ্রবর্তক বা কর্মপ্রবৃত্তির হেতু । করণ, কর্ম, কর্তা, এই তিনটি কর্মসংগ্রহ বা ক্রিয়ার আশ্রয় । ১৮

কাপিল সাংখ্যশাস্ত্রে জ্ঞান, কর্ম ও কর্তা সত্ত্বাদি গুণভেদে তিন প্রকার কথিত হইয়াছে, সে সকল যথাবৎ কহিতেছি, শ্রবণ কর । ১৯

যে জ্ঞানদ্বারা পরস্পর বিভক্তভাবে প্রতীয়মান সর্বভূতে এক অদ্বয় অব্যয় বস্তু (পরমাত্মতত্ত্ব) পরিদৃষ্ট হয়, সেই জ্ঞান সাত্ত্বিক জানিবে । ২০

যে জ্ঞানের দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন ভূতসমূহে পৃথক্‌ পৃথক্‌ ভাবের অনুভূতি হয় তাহা রাজস জ্ঞান । ২১

যাহা প্রকৃত তত্ত্ব তাহা না বুঝিয়া, ইহাই যাহা কিছু সমস্ত, এইরূপ বুদ্ধিতে কোন একমাত্র বিষয়ে আসক্ত থাকে সেই যুক্তিবিরুদ্ধ, অযথার্থ, তুচ্ছ জ্ঞানকে তামস জ্ঞান কহে । ২২

কর্মকর্তা ফলকামনা পরিত্যাগপূর্বক রাগদ্বেষ-বর্জিত হইয়া অনাসক্তভাবে অবশ্যকর্তব্যরূপে বিহিত যে কর্ম করেন, তাহাকে সাত্ত্বিক কর্ম বলা হয় । ২৩

আর, ফলাকাঙ্ক্ষা করিয়া অথবা অহঙ্কার সহকারে বহু আয়াস স্বীকার করিয়া যে কর্ম অনুষ্ঠিত হয়, তাহা রাজস কর্ম বলিয়া কথিত হয় । ২৪

ভাবিফল কি হইবে, নিজের সামর্থ্য কতটুকু, প্রাণিহিংসাদি হইবে কিনা, পরিণামে কিরূপ হানি হওয়ার সম্ভাবনা - এইসকল বিচার না করিয়া মোহবশতঃ যে কর্ম আরম্ভ করা হয়, তাহা তামস কর্ম বলিয়া কথিত হয় । ২৫

যিনি আসক্তিবর্জিত, যিনি 'আমি', 'আমার' বলেন না অর্থাৎ কর্তৃত্বাভিমান ও মমত্ববর্জিত, যিনি সিদ্ধি ও অসিদ্ধিতে হর্ষবিষাদশূন্য হইয়া নির্বিকার চিত্তে ধৈর্য ও উৎসাহ সহকারে কর্ম করেন, তাঁহাকে সাত্ত্বিক কর্তা বলে । ২৬

বিষয়াসক্ত, কর্মফলাকাঙ্ক্ষী, লোভী, হিংসাপরায়ণ, শৌচাচারহীন, সিদ্ধিলাভে হর্ষান্বিত ও অসিদ্ধিতে শোকান্বিত - এরূপ কর্তাকে রাজস কর্তা বলে । ২৭

যে অস্থিরমতি, অভদ্র, অনম্র, শঠ, পরবৃত্তিনাশক, অলস, সদা অবসন্নচিত্ত ও দীর্ঘসূত্রী, তাহাকে তামস কর্তা বলে । ২৮

হে ধনঞ্জয়, বুদ্ধির ও ধৃতিরও যে গুণানুসারে তিনপ্রকার ভেদ হয় তাহা পৃথক্‌ পৃথক্‌ সুস্পষ্টরূপে বলিতেছি, শ্রবণ কর । ২৯

হে পার্থ, কর্ম করা অথবা কর্ম হইতে নিবৃত্ত থাকা (অর্থাৎ কর্মমার্গ বা সন্ন্যাস), কর্তব্য কি, অকর্তব্য কি, কিসে ভয়, কিসে অভয়, কিসে বন্ধ, কিসে মোক্ষ, এই সকল যে বুদ্ধিদ্বারা যথাযথরূপে বুঝা যায়, তাহাই সাত্ত্বিকী বুদ্ধি । ৩০

হে পার্থ, যে বুদ্ধিদ্বারা ধর্ম ও অধর্ম, কার্য ও অকার্য যথার্থরূপে বুঝা যায় না, তাহা রাজসী বুদ্ধি । ৩১

হে পার্থ, যে বুদ্ধি মোহাচ্ছন্ন থাকাতে অধর্মকে ধর্ম মনে করে এবং সকল বিষয়ই বিপরীত বুঝে, তাহা তামসী বুদ্ধি । ৩২

যে অবিচলিত ধৃতিদ্বারা মন, প্রাণ ও ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়া সমাধি বা সমদর্শনরূপ যোগবলে নিয়মিত হয়, তাহা সাত্ত্বিকী ধৃতি । ৩৩

হে পার্থ, হে অর্জুন, যে ধৃতিদ্বারা মনুষ্য ধর্ম, অর্থ ও কামোপভোগেই লাগিয়া থাকে এবং সেই সেই প্রসঙ্গে ফলাকাঙ্ক্ষী হয়, তাহা রাজসী ধৃতি । ৩৪

হে পার্থ, যে ধৃতিদ্বারা দুর্বুদ্ধি ব্যক্তি নিদ্রা, ভয়, শোক, বিষাদ এবং মদ ছাড়িতে পারে না অর্থাৎ যাহাতে মনুষ্যকে এই সকল বিষয়ে আবদ্ধ করিয়া রাখে, তাহা তামসী ধৃতি । ৩৫

হে ভরতর্ষভ, এক্ষণে আমার নিকট ত্রিবিধ সুখের বিষয় শ্রবণ কর । ৩৬

যে সুখে ক্রমে ক্রমে অভ্যাসবশতঃ আনন্দ লাভ হয় (হঠাৎ নহে), যাহা লাভ হইলে দুঃখের অন্ত হয়, যাহা অগ্রে বিষের ন্যায়, পরিণামে অমৃততুল্য, যাহা আত্মনিষ্ঠ বুদ্ধির প্রসন্নতা হইতে জন্মে, তাহাই সাত্ত্বিক সুখ । ৩৭

রূপরসাদি বিষয়ে ইন্দ্রিয়ের সংযোগবশতঃ যে সুখ উৎপন্ন হয় এবং যাহা অগ্রে অমৃতের ন্যায় কিন্তু পরিণামে বিষতুল্য হয়, সেই সুখকে রাজস সুখ কহে । ৩৮ (ইহারই নাম বৈষয়িক বা আধিভৌতিক সুখ) ।

যে সুখ প্রথমে এবং পরিণামেও আত্মার বা বুদ্ধির মোহজনক এবং যাহা নিদ্রা, আলস্য ও কর্তব্যবিস্মৃতি হইতে উৎপন্ন হয়, তাহাকে তামস সুখ বলে । ৩৯

পৃথিবীতে, স্বর্গে অথবা দেবগণের মধ্যেও এমন প্রাণী বা বস্তু নাই যাহা প্রকৃতিজাত সত্ত্বাদি গুণ হইতে মুক্ত । ৪০

হে পরন্তপ, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদিগের কর্মসকল ভাবজাত গুণানুসারে পৃথক্‌ পৃথক্‌ বিভক্ত হইয়াছে । ৪১

শম, দম, তপঃ, শৌচ, ক্ষমা, সরলতা, জ্ঞান, বিজ্ঞান ও সাত্ত্বিকী শ্রদ্ধা - এই সমস্ত ব্রাহ্মণের স্বভাবজাত কর্ম (লক্ষণ) । ৪২

পরাক্রম, তেজ, ধৈর্য, কার্যকুশলতা, যুদ্ধে অপরাঙ্মুখতা, দানে মুক্তহস্ততা, শাসন-ক্ষমতা, এইগুলি ক্ষত্রিয়ের স্বভাবজাত কর্ম (লক্ষণ) । ৪৩

কৃষি, গোরক্ষা ও বাণিজ্য বৈশ্যদিগের এবং সেবাত্মক কর্ম শূদ্রদিগের স্বভাবজাত । ৪৪

নিজ নিজ কর্মে নিষ্ঠাবান্‌ ব্যক্তি সিদ্ধি লাভ করে; স্বকর্মে তৎপর থাকিলে কিরূপে মনুষ্য সিদ্ধিলাভ করে তাহা শুন । ৪৫

যাঁহা হইতে ভূতসমূহের উৎপত্তি বা জীবের কর্মচেষ্টা, যিনি এই চরাচর ব্রহ্মাণ্ড ব্যাপিয়া আছেন, মানব নিজ কর্মদ্বারা তাঁহার অর্চনা করিয়া সিদ্ধিলাভ করিয়া থাকে । ৪৬

স্বধর্ম দোষ-বিশিষ্ট হইলেও সম্যক্‌ অনুষ্ঠিত পরধর্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ । স্বভাব-নির্দিষ্ট কর্ম করিয়া লোকে পাপভাগী হয় না । ৪৭

হে কৌন্তেয়, স্বভাবজ কর্ম দোষযুক্ত হইলেও তাহা ত্যাগ করিতে নাই । অগ্নি যেমন ধূমদ্বারা আবৃত থাকে, তদ্রূপ কর্মমাত্রই দোষযুক্ত । ৪৮

যিনি সর্ববিষয়ে অনাসক্ত, জিতেন্দ্রিয় ও নিস্পৃহ, তিনি কর্মফল ত্যাগের দ্বারা নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি লাভ করেন অর্থাৎ কর্মবন্ধন হইতে মুক্ত হন । ৪৯

হে কৌন্তেয়, এইরূপে নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি-প্রাপ্ত ব্যক্তি যে প্রকারে ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হন তাহা আমার নিকট শ্রবণ কর; উহাই জ্ঞানের চরম অবস্থা । ৫০

বিশুদ্ধ সাত্ত্বিক বুদ্ধিযুক্ত হইয়া, ধৈর্যসহ আত্মসংযমন করিয়া, শব্দাদি বিষয়সমূহ ত্যাগ করিয়া, রাগদ্বেষ বর্জন করিয়া, নির্জন স্থানে অবস্থিত ও মিতভোজী হইয়া, বাক্য, শরীর ও মনকে সংযত করিয়া, বৈরাগ্য অবলম্বন করিয়া, সর্বদা ধ্যানে নিরত থাকিয়া, অহঙ্কার, বল (পাশবিক শক্তির ব্যবহার), দর্প, কাম, ক্রোধ এবং বাহ্য ভোগ-সাধনার্থ প্রাপ্ত দ্রব্যাদি বর্জন করতঃ মমত্ববুদ্ধিহীন প্রশান্তচিত্ত সাধক ব্রহ্মভাব লাভে সমর্থ হন । ৫১,৫২,৫৩

ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হইলে পর তিনি প্রসন্নচিত্ত হইয়া (নষ্ট বস্তুর জন্য) শোক করেন না, বা (অপ্রাপ্ত বস্তুর জন্য) আকাঙ্ক্ষাও করেন না । তিনি সর্বভূতে সমদর্শী হন এবং আমাতে পরা ভক্তি লাভ করেন । ৫৪

(যিনি) এইরূপ পরাভক্তিদ্বারা আমাকে স্বরূপতঃ জানিতে পারেন, (তিনিই) বুঝিতে পারেন - আমি কে, আমার কত বিভাব, আমার সমগ্র স্বরূপ কি; এবং এইরূপে আমাকে স্বরূপতঃ জানিয়া তদনন্তর (তিনি) আমাতে প্রবেশ করেন । ৫৫

আমাকে আশ্রয় করিয়া সর্বদা সর্বকর্ম করিতে থাকিলেও আমার প্রসাদে শাশ্বত অব্যয় পদ প্রাপ্ত হন । ৫৬

মনে মনে সমস্ত কর্ম আমাতে সমর্পণ করিয়া, মৎপরায়ণ হইয়া, সাম্য-বুদ্ধিরূপ যোগ অবলম্বন করিয়া, সর্বদা আমাতে চিত্ত রাখ (এবং যথাধিকার স্বকর্ম করিতে থাক) । ৫৭

আমাতে চিত্ত রাখিলে তুমি আমার অনুগ্রহে সমস্ত সঙ্কট অর্থাৎ কর্মের শুভাশুভ ফল অতিক্রম করিবে । আর যদি আমার কথা না শুন, তবে বিনাশ-প্রাপ্ত হইবে । ৫৮

তুমি অহঙ্কারবশতঃ এই মনে করিতেছ আমি যুদ্ধ করিব না, তোমার এই সঙ্কল্প মিথ্যা; প্রকৃতিই (তোমার ক্ষত্রিয় স্বভাব) তোমাকে (যুদ্ধকর্মে) প্রবর্তিত করিবে । ৫৯ (৩|২৭ শ্লোক দ্রষ্টব্য)

হে কৌন্তেয়, মোহবশতঃ তুমি যাহা করিতে ইচ্ছা করিতেছ না, স্বভাবজ স্বীয় কর্মে আবদ্ধ থাকায় তোমাকে অবশ হইয়া তাহা করিতে হইবে । ৬০

হে অর্জুন, ঈশ্বর সর্ব জীবের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত থাকিয়া মায়াদ্বারা যন্ত্রারূঢ় পুত্তলিকার ন্যায় তাহাদিগকে ভ্রমণ করাইতেছেন । ৬১

হে ভারত, সর্বতোভাবে তাঁহারই শরণ লও; তাঁহার প্রসাদে পরম শান্তি ও চিরন্তন স্থান প্রাপ্ত হইবে । ৬২

আমি তোমার নিকট এই গুহ্য হইতেও গুহ্য তত্ত্বকথা ব্যাখ্যা করিলাম, তুমি ইহা বিশেষভাবে পর্যালোচনা করিয়া যাহা ইচ্ছা হয় তাহা কর । ৬৩

এখন সর্বাপেক্ষা গুহ্যতম পরমশ্রেয়ঃসাধন আমার কথা শ্রবণ কর; তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয়, এই হেতু তোমাকে এই কল্যাণকর কথা বলিতেছি । ৬৪

তুমি একমাত্র আমাতেই চিত্ত রাখ, আমাকে ভক্তি কর, আমাকে পূজা কর, আমাকে নমস্কার কর । আমি সত্য প্রতিজ্ঞাপূর্বক বলিতেছি, তুমি আমাকেই পাইবে, কেননা তুমি আমার প্রিয় । ৬৫

সকল ধর্ম পরিত্যাগ করিয়া তুমি একমাত্র আমারই শরণ লও; আমি তোমাকে সকল পাপ হইতে মুক্ত করিব, শোক করিও না । ৬৬


যে তপস্যা করে না বা স্বধর্মানুষ্ঠান করে না, যে অভক্ত, যে শুনিবার ইচ্ছা রাখে না এবং যে আমাকে নিন্দা করে, এরূপ ব্যক্তিকে তুমি গীতাশাস্ত্র বলিবে না । ৬৭

যিনি এই পরম গুহ্যশাস্ত্র আমার ভক্তগণের নিকট ব্যাখ্যা করিবেন, তিনি আমাকে পরাভক্তি করায় (অর্থাৎ এই কার্যে আমি ভগবানেরই উপাসনা করিতেছি এইরূপ মনে করায়) আমাকেই প্রাপ্ত হইবেন, ইহাতে সন্দেহ নাই । ৬৮

মনুষ্যমধ্যে গীতা-ব্যাখ্যাতা অপেক্ষা আমার অধিক প্রিয়কারী আর কেহ নাই এবং পৃথিবীতে তাহা অপেক্ষা আমার অধিক প্রিয় আর কেহ হইবেও না । ৬৯

আর যিনি আমাদের এই ধর্মসংবাদ (গীতাশাস্ত্র) অধ্যয়ন করিবেন, তিনি জ্ঞানযজ্ঞদ্বারা আমার অর্চনা করিলেন, ইহাই আমি মনে করিব । ৭০

যিনি শ্রদ্ধাবান্‌ ও অসূয়াশূন্য হইয়া শ্রবণ করেন, তিনিও পাপ হইতে বিমুক্ত হইয়া পুণ্যবান্‌গণের প্রাপ্য শুভ লোকসকল প্রাপ্ত হন । ৭১

হে পার্থ, তুমি একাগ্রমনে ইহা শুনিয়াছ ত ? হে ধনঞ্জয়, তোমার অজ্ঞানজনিত মোহ দূর হইয়াছে ত ? ৭২

অর্জুন বলিলেন -
হে অচ্যুত, তোমার প্রসাদে আমার মোহ নষ্ট হইয়াছে, আমার কর্তব্যাকর্তব্য-জ্ঞান লাভ হইল, আমি স্থির হইয়াছি, আমার আর সংশয় নাই, আমি তোমার উপদেশ মত কার্য (যুদ্ধ) করিব । ৭৩

সঞ্জয় বলিলেন -
এইরূপে মহাত্মা বাসুদেব এবং অর্জুনের এই অদ্ভুত লোমহর্ষকর সংবাদ আমি শ্রবণ করিয়াছি । ৭৪

ব্যাসদেবের প্রসাদে সাক্ষাৎ যোগেশ্বর স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের মুখ হইতেই আমি এই যোগশাস্ত্র শ্রবণ করিয়াছি । ৭৫

হে রাজন্‌, কেশব ও অর্জুনের এই পবিত্র অদ্ভুত সংবাদ বারংবার স্মরণ করিয়া মুহুর্মুহুঃ হর্ষ হইতেছে । ৭৬

হে রাজন্‌, হরির সেই অতি অদ্ভুত বিশ্বরূপ স্মরণ করিয়া আমার অতিশয় বিস্ময় জন্মিতেছে এবং বার বার হর্ষ হইতেছে । ৭৭

যে পক্ষে যোগেশ্বর কৃষ্ণ এবং যেখানে ধনুর্ধর পার্থ, সেখানেই লক্ষী, বিজয়, উত্তরোত্তর ঐশ্বর্যবৃদ্ধি ও অখণ্ডিত রাজনীতি আছে, ইহাই আমার মত । ৭৮ [অতএব আপনি পুত্রগণের জয়লাভের আশা ত্যাগ করুন, পাণ্ডবগণের সঙ্গে সন্ধি করুন ।]

___________________________
১) কেশিনিসূদন = শ্রীকৃষ্ণ ব্রজলীলায় কেশী নামক অসুরকে বধ করিয়াছিলেন

সন্ন্যাস ও ত্যাগের ব্যাখ্যা - সন্ন্যাস ও ত্যাগ এই দুইটির ধাত্বর্থ একই = পরিত্যাগ করা, ছাড়া । কিন্তু 'সন্ন্যাস' শব্দের একটি বিশেষ অর্থ এই যে, সর্বকর্ম ত্যাগ করিয়া চতুর্থ আশ্রম অবলম্বন করা । এই চতুর্থাশ্রম শাস্ত্রবিহিত এবং সন্ন্যাস অবলম্বন ব্যতীত মোক্ষলাভ হয় না, এই মতও সুপ্রচলিত । অর্জুনও মনে করিয়াছিলেন, শ্রীভগবান্‌ অবশ্য এই কথা শেষে বলিবেন । কিন্তু তিনি এ পর্যন্ত কোথাও কর্মত্যাগের উপদেশ দিলেন না । তিনি আরও এই কথা বলিলেন যে, যিনি আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করেন তিনিই নিত্য সন্ন্যাসী । সেই জন্যই অর্জুন প্রশ্ন করিলেন যে, তিনি ত্যাগ ও সন্ন্যাস এই শব্দ দুইটি কি অর্থে ব্যবহার করিতেছেন । ইহাদের মধ্যে অর্থগত কোন পার্থক্য আছে কিনা এবং থাকিলে, তাহা কি ? এই কথার উত্তরেই শ্রীভগবান্‌কর্মযোগ-মার্গের সারার্থ পুনরায় স্পষ্টীকৃত করিয়া গীতাশাস্ত্রের উপসংহার করিয়াছেন ।

২) কাম্য কর্মের ত্যাগই সন্ন্যাস । কিন্তু সূক্ষদর্শী পণ্ডিতগণ বলেন যে, সকল কর্মের ফল-ত্যাগই প্রকৃত ত্যাগ; সুতরাং যিনি ফল ত্যাগ করেন, তিনি কর্ম করিলেও প্রকৃতপক্ষে সন্ন্যাসী ।

৬) পূর্বে বলা হইয়াছে যে, কর্তৃত্বাভিমান ও ফলকামনা বর্জন করিয়া ঈশ্বরার্পণ বুদ্ধিতে সমস্ত কর্ম করা উচিত । শ্রৌত স্মার্ত যজ্ঞদানাদি কর্মও ঠিক সেই ভাবেই করা কর্তব্য । ইহাই নিষ্কাম কর্মযোগ ।

৭) (স্বভাব)নিয়ত কর্ম - স্বধর্মানুসারে যথাধিকার প্রাপ্ত কর্ম । জীবের স্বভাব বা প্রকৃতির গুণভেদবশতঃই বর্ণভেদ ও কর্মভেদ শাস্ত্রে বিহিত হইয়াছে । সুতরাং যথাধিকার শাস্ত্রবিহিত কর্মই নিয়ত কর্ম । ইহাকেই স্বধর্ম, স্বকর্ম, সহজ কর্ম, স্বভাবজ কর্ম ইত্যাদি বলা হইয়াছে ।

৮) ত্যাগের ফল কর্মবন্ধন হইতে মুক্ত হওয়া অর্থাৎ মোক্ষ লাভ করা । কিন্তু কায়ক্লেশভয়ে কর্তব্য কর্ম ত্যাগ করিলে তাহাতে মোক্ষ লাভ হয় না । এইরূপ ত্যাগকে রাজসত্যাগ বলে ।

১৩) সাংখ্যে কৃতান্তে - এস্থলে 'সাংখ্যে' পদটি 'কৃতান্ত' পদের বিশেষণ । সাংখ্য = কাপিল সাংখ্য অথবা বেদান্তশাস্ত্র । কৃতান্ত = সিদ্ধান্ত শাস্ত্র । সুতরা 'সাংখ্যে কৃতান্তে' = কাপিল সাংখ্যশাস্ত্র অথবা
বেদান্তশাস্ত্র ।

১৪) কোন কর্ম হইতে গেলেই কর্তা, করণ বা সাধন (যন্ত্র), অধিকরণ বা স্থান এবং কর্তার নানাবিধ চেষ্টা প্রয়োজন । বেদান্তাদি শাস্ত্রের পরিভাষায় অহঙ্কারই কর্তা, চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয় করণ, দেহই অধিষ্ঠান এবং প্রাণ অপানাদির ব্যাপারই চেষ্টা বলিয়া গৃহীত হয় । এই সকলের সহায়তাই কর্ম সম্পন্ন হয় । এতদ্ব্যতীতও আমাদের প্রযত্নের প্রয়োজক ও অনুকূল এমন কোন ব্যাপার আছে যাহা আমরা জানি না এবং দেখি না - ইহাকেই দৈব বলা হয় ।

১৪,১৫) দৈব কি ? - শাস্ত্রে চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয়ের প্রত্যেকের আনুকূল্যকারী এক একটি অধিষ্টাত্রী দেবতার উল্লেখ আছে । যেমন, শরীরের দেবতা পৃথিবী, চক্ষুর - অর্ক, হস্তের - ইন্দ্র, অহঙ্কারের - রুদ্র, মনের - চন্দ্র, ইত্যাদি । এই দেবগণের সাহায্যে ও শক্তিতেই ইন্দ্রিয়াদির কার্য সম্পন্ন হয় । অনেক টীকাকার ইহাকেই 'দৈব' বলিয়াছেন । কেহ কেহ বলেন 'সর্বপ্রেরক অন্তর্যামী' অথবা 'ধর্মাধর্ম-সংস্কার' । মূল তত্ত্বটি একই । সেইটিই বুঝা প্রয়োজন ।
প্রশ্ন এই - জীব কর্ম করে কেন ? কর্ম-প্রবৃত্তি কোথা হইতে আসিল ? জন্ম, কর্ম, সংসার, সৃষ্টি - ইহার আদি কোথায়, ইহার মূল কারণ কি ? ইহার মূলে ব্রহ্মসঙ্কল্প - 'আমি এক আছি, বহু হইব' - পরব্রহ্মের এই সঙ্কল্প হইতেই ব্রহ্মাদি স্তম্ব পর্যন্ত সর্বভূতের উৎপত্তি ও সকলের স্ব স্ব কার্যে প্রবৃত্তি । বলীবর্দাদি চতুষ্পদ জন্তু যেমন নাসিকায় বদ্ধ হইয়া মনুষ্যের ইচ্ছায় তাহার নিমিত্ত কর্ম করে, আমরা সকলেই সেইরূপ ত্রিগুণে বদ্ধ হইয়া ঈশ্বরের ইচ্ছায় তাঁহার কর্ম করি (শ্রীভাগবতে ব্রহ্মার বাক্য ৫।১।২৪) ।
সুতরাং সৃষ্টিকালে অথবা সৃষ্টির প্রাক্কালে (শ্রীশ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবা) যাহার ললাটে যাহা লিখিত হইয়াছে অর্থাৎ যাহার পক্ষে যাহা নির্দিষ্ট হইয়াছে, সকলেই তদনুসারে কর্ম করিতেছে, ইহার অন্যথা করিবার কাহারও সাধ্য নাই ।
এই ঈশ্বর-সঙ্কল্পকেই মহানিয়তি বা দৈব বলে । হরিহরব্রহ্মাও ইহা লঙ্ঘন করিতে পারেন না, কেননা তাঁহারাও এই সঙ্কল্পের অধীন । সৃষ্টি হইতে প্রলয় পর্যন্ত জগতে যাহা কিছু কর্ম হয় তাহা এই নিয়তিবলেই সম্পন্ন হয় । এই নিয়তিবলেইচন্দ্র-সূর্য, বায়ু-বরুণাদি স্ব স্ব কার্যে ব্যাপৃত আছেন, এই নিয়তিবলেই আদিত্যাদি দেবগণ চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয়ের শক্তি দান করিতেছেন, এই হেতু এই শক্তিকেই 'দৈব' বলা হইয়াছে । এই ঈশ্বর-সঙ্কল্পকেই কেহ কেহ 'সর্বপ্রেরক অন্তর্যামী' বলিয়াছেন । এই নিয়তিই প্রাক্তন বা পূর্বজন্মের 'ধর্মাধর্ম সংস্কার'রূপে প্রকাশিত হয় এবং জন্মে জন্মে জীবের জন্মকর্মের ফলবৈষম্য উৎপন্ন করে, ইহাকেই লোকে অদৃষ্ট বলে ।
অনেকে মনে করেন, দৈবের যখন খণ্ডন নাই, তখন পুরুষকার অবলম্বন করা বৃথা । তাঁহারা বুঝিতে পারেন না যে, দৈব পুরুষকাররূপেই কর্মের নিয়ন্তা হয়, পুরুষকার আশ্রয় করিয়াই দৈব ফল প্রদান করে । শস্য উৎপাদনার্থ বীজ ও ক্ষেত্র উভয়েরই প্রয়োজন; দৈব কর্মের বীজস্বরূপ এবং সুপ্রযুক্ত পুরুষকার কর্ষিত ক্ষেত্রস্বরূপ; এই উভয়ের সংযোগে কর্মফল লাভ হয় ।

১৭) স্থিতপ্রজ্ঞ কর্মযোগী পাপপুণ্যের অতীত । প্রকৃতিই কর্ম করে, আত্মা অকর্তা, নিঃসঙ্গ । দেহ ইন্দ্রিয় অহঙ্কার এবং দৈব বা ঈশ্বর-সঙ্কল্প এই সকলই কর্মঘটনার কারণ, আত্মা বা 'আমি' ইহার কোনটির মধ্যেই নয় । সুতরাং যে মনে করে, আত্মা বা 'আমিই' কর্তা, সে অজ্ঞান, সে প্রকৃত তত্ত্ব জানে না । এই অজ্ঞানতাপ্রসূত কর্তৃত্বাভিমানবশতঃই তাহার কর্মবন্ধন হয় । যাঁহার অহং অভিমান নাই, বুদ্ধি যাঁহার নির্লিপ্ত, তাঁহার কর্মবন্ধন হয় না, সে কর্ম লোকরক্ষাই হউক, লোকহত্যাই হউক, তাহাতে কিছু আসে যায় না । এইরূপ কর্তৃত্বাভিমান ও কামনাবর্জিত আত্মজ্ঞানী পুরুষই স্থিতপ্রজ্ঞ, ব্রহ্মভূত, ত্রিগুণাতীত, জীবন্মুক্ত ইত্যাদি নামে অভিহিত হন । ঈদৃশ শুদ্ধ, বুদ্ধ, মুক্ত-স্বভাব ব্যক্তিগণের ব্যবহার সম্বন্ধে পাপ-পুণ্য, ধর্ম-অধর্ম, নীতি-অনীতি ইত্যাদির বিচার চলে না, কেননা তাঁহারা পাপ-পুণ্যাদি দ্বন্দ্বের অতীত (শঙ্করাচার্য) । কৌষীতকী উপনিষদে ইন্দ্র প্রতর্দনকে বলিতেছেন যে, বৃত্র অর্থাৎ ব্রাহ্মণকে বধ করিলেও আমার পাপ হয় না, একথার মর্মও ইহাই ।

১৮) কর্মচোদনা ও কর্মসংগ্রহ - কোন কর্ম আরম্ভ করিবার পূর্বে একটি প্রেরণা চাই, এই প্রেরণার জন্য জ্ঞান, জ্ঞেয় ও জ্ঞাতা, এই তিনটির প্রয়োজন । স্থুল কথা কর্মচোদনা = কর্মবিষয়ক মানসিক প্রেরণা, কর্মসংগ্রহ = সেই প্রেরণার বাহ্য প্রকাশ ।

২০) সাত্ত্বিক-জ্ঞান - জগতের নানাত্বের মধ্যে যে একত্ব দর্শন তাহাই প্রকৃত জ্ঞান । একমাত্র অদ্বয় অব্যয় সদ্বস্তুই আছেন, যাহা কিছু ছিল, আছে বা থাকিতে পারে, সমস্তই তাঁহাতেই আছে, তিনি 'সব', সমস্তই বাসুদেব; ইহাই অদ্বৈত জ্ঞান । এই জ্ঞান লাভ জীবের পরম নিঃশ্রেয়স্‌, উহাই মুক্তি । আত্মজ্ঞান, ব্রহ্মজ্ঞান, ব্রহ্মাত্ম্যৈক্যজ্ঞান, সর্বত্র সমদর্শন ইত্যাদি নানা কথায় এই জ্ঞানের বর্ণনা পূর্বে করা হইয়াছে । এই সাত্ত্বিক জ্ঞানলাভ করিয়া সাত্ত্বিক কর্তা বা কর্মযোগী সাত্ত্বিক (নিষ্কাম) কর্ম করেন ।

২১) রাজস জ্ঞান - সর্বভূতে ভেদবুদ্ধি, একত্বের মধ্যে নানাত্ব দর্শন, ইহাই বদ্ধ জীবের জ্ঞান বা অজ্ঞান । ইহাতেই বদ্ধ হইয়া জীব জন্মমৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হয় । এই রাজস জ্ঞান বা ভেদজ্ঞান হইতেই সংসার, ইহা হইতেই রাগদ্বেষ দম্ভদর্পাদি সর্ববিধ রাজস প্রবৃত্তি অ কাম্য কর্মের উৎপত্তি ।

২২) তামস জ্ঞান - তুচ্ছ একই বিষয়ে অভিনিবিষ্ট থাকে, উহার বাহিরে যায় না । যেমন মৃত্তিকা, পাথর, বৃক্ষাদিকেই একমাত্র উপাস্য বস্তু মনে করা, উহা ব্যতীত ঈশ্বরের অন্যবিধ স্বরূপ বা সত্তার ধারণা না থাকা । নিজের দেহ বা পরিবারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যেই যে আসক্ত - তাহারও তামসিক জ্ঞান ।

২৪) কামনা ও অহঙ্কার থাকিলেই দুরাকাঙ্ক্ষা ও দুশ্চিন্তা অনিবার্য । অনেক-স্থলে নিজের অত্যধিক স্বার্থচিন্তায় অপরের স্বার্থের প্রতি দৃষ্টি থাকে না, তাহাতে সংঘর্ষ উপস্থিত হয় । আবার দুরাকাঙ্ক্ষাবশতঃ অনেকে কঠোর শারীরিক কষ্ট সহ্য করিয়াও স্বার্থ সাধনে যত্নপর হয়, এই সব কারণেই বলা হইয়াছে যে, সকাম কর্ম বহু আয়াসসাধ্য ।

২৫) ত্রিবিধ কর্ম - নিষ্কাম কর্ম = সাত্ত্বিক কর্ম, সকাম কর্ম = রাজসিক ও তামসিক কর্ম, নিষিদ্ধ কর্ম = সকাম কর্মের কতকগুলিকে শাস্ত্রে নিষিদ্ধ কর্ম বলা হইয়া থাকে । বিশেষ দ্রষ্টব্য - কর্মের এই শ্রেণী-বিভাগ কর্মেরই বাহ্য প্রকৃতি বা পরিণাম বিচার করিয়া করা হয় নাই, কর্তার বুদ্ধি অনুসারেই করা হইয়াছে । গীতার মতে কর্মের কর্তব্যাকর্তব্য-বিচারে কর্মের ফলাফল না দেখিয়া কর্তার বাসনাত্মিকা বুদ্ধিরই বিচার করা হয় । এইরূপ বিচারে হিংসাত্মক যুদ্ধাদি কর্মও সাত্ত্বিক হইতে পারে, আবার অবস্থা-বিশেষে লোকহিতকর দানাদি কর্মও রাজসিক বা তামসিক হইতে পারে । আবার একই কর্ম এক জনের পক্ষে সাত্ত্বিক হইতে পারে, অপরের পক্ষে রাজসিক বা তামসিক হইতে পারে । যেমন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকর্ম - ইহা অর্জুনের পক্ষে সাত্ত্বিক, কেননা তিনি স্বধর্ম বলিয়া নিষ্কামভাবে উহা অনুষ্ঠান করিয়াছেন । কর্ণাদি যোদ্ধৃগণের পক্ষে ইহা রাজসিক, কেননা তাঁহারা ধনমানাদির আশায় উহাতে যোগদান করিয়াছিলেন; দুর্যোধনের পক্ষে উহা তামসিক, কেননা তিনি নিজের সামর্থ্য, শক্তিক্ষয়, ভাবিফল ইত্যাদি বিবেচনা না করিয়া মোহবশতঃ উহাতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন ।

২৮) দীর্ঘসূত্রী = আজ না, কাল করিব এইরূপ ভাবে যে কাল-বিলম্ব করে ।

৩০) সাত্ত্বিকী বুদ্ধি ও সদসদ্বিবেক (Conscience) :
পাশ্চাত্য নীতিশাস্ত্র অনুযায়ী সদসদ্বিবেক (Conscience) হল মানুষের এক স্বাভাবিক স্বতন্ত্র শক্তি যাহাদ্বারা সে বিনা বিচারে (intuitionally) ভাল-মন্দ নির্ণয় করিতে পারে । কিন্তু চোর বা সাধুর conscience পৃথক হয় কেন, তাহার কোন সন্তোষজনক উত্তর পাশ্চাত্য শাস্ত্রের কাছে নাই । ভারতীয় দর্শনে এরূপ কোনো স্বতন্ত্র শক্তির অস্তিত্ব স্বীকৃত হয় নাই । হিন্দু-দর্শনমতে ভাল-মন্দ বা যাহা-কিছু বিচারের শক্তি একমাত্র বুদ্ধির । বুদ্ধি যখন আত্মনিষ্ঠ হইয়া শুদ্ধ হয় তখনই তাহার বিচার যথার্থরূপ হয়, কেননা তখন উহা আত্মার প্রেরণা বা স্বাধর্ম্য লাভ করে, ইহাই সাত্ত্বিকী বুদ্ধি । সাত্ত্বিকী বুদ্ধিই সন্দেহস্থলে প্রমাণস্বরূপ, কিন্তু রাজসী ও তামসী বুদ্ধি লোককে বিপথে চালিত করে । এই হেতুই পাশ্চাত্যগণ যাহাকে conscience বলেন, তাহা সকলের সমান হয় না । কেননা প্রকৃতির গুণভেদে বুদ্ধি বিভিন্ন হয় ।

২৯,৩৩,৩৫) ত্রিবিধ ধৃতি - সেই মানসিক শক্তি যাহাতে মনুষ্য কোন কর্মে দৃঢ়ভাবে লাগিয়া থাকিতে পারে ।
সাত্ত্বিকী ধৃতি = যাহা দ্বারা সাত্ত্বিক বা নিষ্কাম কর্মে লাগিয়া  থাকা যায়;
রাজসী ধৃতি= যাহাতে অর্থকামাদি রাজসিক বিষয়ে লাগিয়া থাকে;
তামসী ধৃতি = যাহা দ্বারা শোক, ভয় ইত্যাদি তামসিক ভাবে লাগিয়া থাকে ।

৩৯) প্রমাদ = কর্তব্যের ভ্রম বা বিস্মৃতি । অনবধানতা ।

কর্মতত্ত্ব বিশ্লেষণ :
যে কোনো কর্ম সম্পাদনের পক্ষে অধিষ্ঠান, কর্তা, করণ, নানাবিধ চেষ্টা এবং দৈব - এই সকল কারণ বিদ্যমান থাকে । সুতরাং যে মনে করে, কেবল 'আমিই' কর্ম করি, সে দুর্মতি প্রকৃত তত্ত্ব বোঝে না । যাহার 'আমি কর্তা' এই ভাব নাই, তিনি কর্মের শুভাশুভ ফলে আবদ্ধ হন না । কর্মপ্রবৃত্তির হেতু = (i)জ্ঞান, (ii)জ্ঞেয়, (iii)জ্ঞাতা । ক্রিয়ার আশ্রয় =  (i)কর্তা, (ii)কর্ম, (iii)করণ । তন্মধ্যে জ্ঞান, কর্তা ও কর্ম গুণভেদে ত্রিবিধ হয় । আবার কর্তার বুদ্ধিধৃতি এবং যে-সুখলাভার্থ কর্ম করা হয় সেই সুখও গুণভেদে ত্রিবিধ । এইরূপ গুণভেদবশতই বিভিন্ন কর্তার, বিভিন্ন কর্মের বিভিন্ন ফল হয় । যেমন সাত্ত্বিক জ্ঞান (সর্বত্র সমদর্শন) হইতে সাত্ত্বিক কর্তা (কর্মযোগী) সাত্ত্বিক কর্ম (নিষ্কাম কর্ম) করেন, তাঁহার সাত্ত্বিকী বুদ্ধি (বন্ধমোক্ষ-নির্ণয়-সমর্থা) এই কর্ম নিশ্চয় করিয়া দেয় । সাত্ত্বিকী ধৃতি তাঁহাকে এই কর্মে স্থির রাখে এবং তিনি এই সাত্ত্বিক কর্মের যে-ফল সাত্ত্বিক সুখ, নির্মল আত্মপ্রসাদ (আত্মানন্দ), তাহা লাভ করেন । রাজসিক ও তামসিক কর্তার কর্ম এবং তাহার ফলও এইরূপ গুণভেদে বিভিন্ন হয় ।

৪২,৪৪) গুণভেদে বর্ণভেদ ও কর্মভেদ; বর্ণভেদ ও জাতিভেদ 

৪৬) স্বধর্ম বা কর্তব্য পালনেই ঈশ্বরের অর্চনা - তাহাতেই সিদ্ধি । কর্ম ভগবানেরই সৃষ্টি এবং তাহা হইতেই জীবের কর্ম-প্রবৃত্তি । ইহাই তাঁহার লীলা । জীব কর্মে বিরত হইলে তৎক্ষণাৎ ভবলীলা শেষ হয় । সুতরাং তাঁহার সৃষ্টি-রক্ষার্থ গীতার ভাষায় লোকসংগ্রহার্থ বা ভক্তিশাস্ত্রের ভাষায় তাঁহার লীলাপুষ্টির জন্য জীবের যথাপ্রাপ্ত কর্ম করিতে হয় । হিন্দুর কর্ম-জীবনে ও ধর্ম-জীবনে পার্থক্য নাই । তাহার সমস্ত কর্মই ধর্মশাস্ত্রনির্দিষ্ট । এই সমস্ত কর্ম, ফলকামনা ত্যাগ করিয়া একমাত্র শ্রীবিষ্ণুপ্রীতিকাম হইয়া, করিতে পারিলেই তাঁহার অর্চনা হয় এবং তাহাতেই সদ্গতি লাভ হয়, ইহা সমস্ত ভক্তিশাস্ত্রের সিদ্ধান্ত ।

৪৮) ক্ষত্রিয়ের যুদ্ধকর্মে বা কৃষকের কৃষিকর্মেও প্রাণিহিংসা অনিবার্য; কিন্তু এইরূপ হিংসাদিযুক্ত হইলেও তাহা ত্যাগ করিয়া অন্য বর্ণের কর্ম গ্রহণ করা কর্তব্য নয় । কেননা কর্মমাত্রই দোষযুক্ত, যেহেতু উহা বন্ধনের কারণ, কর্ম করিলেই তাহার শুভাশুভ ফলভোগার্থ পুন; পুনঃ জন্মগ্রহণ ও সংসার-যাতনা ভোগ অনিবার্য । তবে কর্মত্যাগই ত শ্রেয়ঃকল্প ? না, কর্ম করিয়াও যাহাতে কর্মবন্ধন না হয় তাহার উপায় আছে । (পরের শ্লোক) ।

৪৯) জিতাত্মা = জিতেন্দ্রিয় (শঙ্কর), নিরহঙ্কার (শ্রীধর) ।

৪৯) নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি = কর্মবন্ধন হইতে মুক্তি । সমস্ত অধ্যাত্ম-শাস্ত্রের মূল কথাই হইতেছে, কিরূপে জীব জন্ম-কর্মচক্র হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিতে পারে তাহার উপায় নির্দেশ ।

৫৩) পরিগ্রহম্‌ = শরীরধারণার্থ বা ধর্মানুষ্ঠানার্থ লোকের নিকট হইতে অর্থ বা দ্রব্যাদি গ্রহণ । প্রকৃত যোগযুক্ত সাধু পুরুষ এ সকলও ত্যাগ করেন ।

৫৪-৫৬) নিষ্কাম কর্ম -> নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি -> সাত্ত্বিকী বুদ্ধি -> ব্রহ্মভূত (ব্রহ্মভাব প্রাপ্তি) -> পরাভক্তি -> মোক্ষ (ভগবৎ-প্রাপ্তি)

এস্থলে জ্ঞানবাদী ও ভক্তিবাদীর মধ্যে এক সূক্ষ তর্ক উপস্থিত হয় । জ্ঞানবাদী বলেন, জ্ঞান ব্যতীত মুক্তি নাই এবং এই হেতুই - আমাকে স্বরূপতঃ জানিয়া আমাতে প্রবেশ করেন - এস্থলে এই কথা আছে । ভক্তিবাদী বলেন, ব্রহ্মভাবলাভেই জীবের মুক্তি, ইহাই জ্ঞানমার্গের চরম অবস্থা । কিন্তু এস্থলে শ্রীভগবান্‌ বলিতেছেন, ব্রহ্মভাবলাভ হইলেই আমাতে পরাভক্তি জন্মে এবং ভক্তিদ্বারাই আমার স্বরূপের অবগতি হইলে ভক্ত আমাকে প্রাপ্ত হন । সুতরাং এস্থলে ভক্তিরই প্রাধান্য দেওয়া হইয়াছে; বস্তুত পরম জ্ঞান ও পরাভক্তিতে কোন পার্থক্য নাই, সাধক যে পথেই সাধনা আরম্ভ করুক না কেন, একটি থাকিলে অপরটি আসিবেই, সুতরাং জ্ঞান-ভক্তির প্রাধান্য লইয়া বিবাদ নিরর্থক ।

৫৭) বুদ্ধিযোগ : গীতায় শ্রীভগবান যে যোগ বলিতেছেন, তাহাকে কখনো বুদ্ধিযোগ, কখনো বা কেবল যোগ শব্দদ্বারাই প্রকাশ করিয়াছেন । এ-স্থলে বুদ্ধি অর্থ শুদ্ধ সাম্য-বুদ্ধি, উহাই কর্মযোগের মূল, কর্ম করিবার সময় বুদ্ধিকে স্থির, পবিত্র সম ও শুদ্ধ রাখাই সেই যোগ, 'যুক্তি' বা কৌশল যাহাতে কর্মের বন্ধন হয় না, সে কর্ম যাহাই হউক-না-কেন । এই হেতুই 'কর্ম হইতে বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ' [২|৪৮-৫১] ।

৫৯-৬৩) প্রকৃতি-পারতন্ত্র ও আত্মস্বাতন্ত্র্য - এস্থলে শ্রীভগবান্‌ বলিতেছেন - তুমি ইচ্ছা না করিলেও প্রকৃতি তোমাকে স্বাভাবিক কর্মে প্রবর্তিত করিবে, তোমাকে অবশভাবেই সে কর্ম করিতে হইবে । প্রকৃতির প্রেরণায় কর্ম, কর্মফলে সদসৎ যোনিতে জন্ম, জন্মিয়া আবার কর্ম, কর্মফলে আবার জন্ম । সুতরাং দেখা যায়, জীবকে অবিরত জন্ম-কর্মের ভবচক্রেই ঘুরিতে হয় । এই প্রকৃতি-পারতন্ত্র বা কর্মবিপাক হইতে মুক্তিলাভের উপায় কি ? জ্ঞানলাভার্থ, মোক্ষার্থ জীবের কি কোন স্বাতন্ত্র্য নাই ? অধ্যাত্মশাস্ত্র বলেন, আছে । পরমাত্মা শুদ্ধবুদ্ধমুক্তস্বভাব এবং তিনিই বা তাঁহারই সনাতন অংশ জীবাত্মারূপে দেহে আছেন; তিনি কখনও প্রকৃতির পরতন্ত্র হইতে পারেন না । দেহেন্দ্রিয়াদির বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ায় তাঁহাকে বদ্ধ অ পরাধীনের ন্যায় বোধ হয়; তিনি মায়াধীন হন । কিন্তু তাহা হইলেও স্বতঃই তাঁহার মুক্ত হইবার প্রেরণা আসে । গুরুপদেশ, সাধুসং প্রভৃতি অনুকূল অবস্থায় সেই প্রেরণা মন এবং বুদ্ধির উপর কার্য করে, তাহাতেই মনুষ্যের মনে আত্মোন্নতি বা মোক্ষানুকূল কর্ম করিবার প্রবৃত্তি জন্মে ।

আমাদের মধ্যে দুইটি 'আমি' আছে - (i)কাঁচা আমি, বদ্ধ আমি, অহঙ্কারী আমি, প্রকৃতির দাস আমি (Lower-self, ego-sense); (ii) পাকা আমি, শুদ্ধ, বুদ্ধ, স্বতন্ত্র্য আমি (Higher self, soul) । এই পাকা আমি দ্বারা কাঁচা আমি উদ্ধার করিতে হইবে । এই গেল জ্ঞানমার্গের কথা ।

কৃপাবাদ - কিন্তু ভক্তিমার্গে বলা হয় যে, শ্রীভগবান্‌ই অন্তর্যামীরূপে হৃদয়ে অধিষ্ঠিত থাকিয়া জীবকে যন্ত্রারূঢ় পুত্তলিকার ন্যায় মায়াদ্বারা চালাইতেছেন, সুতরাং সর্বতোভাবে তাঁহার শরণ লইলেই তাঁহার প্রসাদে মুক্তিলাভ হয় । মনে রাখা প্রয়োজন, কৃপাবাদ অর্থ নিশ্চেষ্টতা নয়, আত্মচেষ্টা ব্যতীত ভগবৎকৃপা হয় না ।

ইচ্ছা-স্বাতন্ত্র্য (Freedom of the Will) - পাশ্চাত্য দার্শনিকগণ ইহা সম্বন্ধে অনেক গবেষণা করিয়াছেন, কিন্তু কোন স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারিয়াছেন বলিয়া বোধ হয় না । আর্য ঋষিগণ সাংখ্য-বেদান্তাদি শাস্ত্রে মনস্তত্ত্ব ও আত্মতত্ত্বের যে সূক্ষানুসূক্ষ বিশ্লেষণ করিয়াছেন তাহা পর্যালোচনা করিলে দেখা যায় যে, 'ইচ্ছা-স্বাতন্ত্র্য' শব্দটিই একরূপ অর্থহীন । কারণ, ইচ্ছা মনের ধর্ম; মন বুদ্ধির দ্বারা চালিত হয়, মনবুদ্ধি প্রকৃতিরই পরিণাম এবং প্রকৃতির গুণানুসারেই বিভিন্ন হয়, সুতরাং ইচ্ছাও সর্বদাই প্রকৃতির অধীন - উহার স্বাতন্ত্র্য নাই । উহার স্বাতন্ত্র্য তখনই হয়, যখন জীব ত্রিগুণাতীত বা নিত্যসত্ত্বস্থ হয়, অর্থাৎ জীবের স্বাতন্ত্র্য-ইচ্ছা থাকে না, যখন জীবের ইচ্ছা এবং ঈশ্বরেচ্ছা এক হইয়া যায় - প্রকৃতপক্ষে উহা আত্ম-স্বাতন্ত্র্য, 'ইচ্ছা-স্বাতন্ত্র্য' নহে । এই হেতুই গীতায় মিশ্র-সাত্ত্বিক বুদ্ধিকেও বন্ধনের কারণ বলা হইয়াছে ।

৬৪,৬৬) সর্বধর্মত্যাগ করিয়া আমার শরণ লও (শরণাগতি)

অর্জুনের মোহ অপসারণার্থে শ্রীভগবান্‌ এ পর্যন্ত কর্মজ্ঞান-ভক্তিমিশ্র অপূর্ব যোগধর্মের উপদেশ প্রদান করিলেন । পরিশেষে সর্বগুহ্যতম এই সারকথাটি বলিয়া দিলেন - শ্রুতি, স্মৃতি বা লোকাচারমূলক নানা ধর্মের নানারূপ বিধিনিষেধের দাসত্ব ত্যাগ করিয়া (abandoning all rules of conduct - Aurobindo) তুমি সর্বতোভাবে আমার শরণ লও, আমার কর্মবোধে যথাপ্রাপ্ত কর্তব্য কর্ম করিয়া যাও, তোমাত কোন ভয় নাই, আমিই তোমাকে সর্বপাপ হইতে মুক্ত করিব । ইহাই গীতায় শ্রীভগবানের অভয়বাণী, ইহাই ভক্তমার্গের সারকথা । ইহারই নাম ভগবৎ-শরণাগতি বা আত্মসমর্পণ-যোগ । ভক্তিশাস্ত্রে শরণাগতির ষড়্‌বিধ লক্ষণ বর্ণিত আছে - (i) শ্রীভগবানের প্রীতিজনক কার্যে প্রবৃত্তি, (ii) প্রতিকূল কার্য হইতে নিবৃত্তি, (iii) তিনি রক্ষা করিবেন বলিয়া দৃঢ় বিশ্বাস, (iv) রক্ষাকর্তা বলিয়া তাঁহাকেই বরণ, (v) তাঁহাতে সম্পূর্ণ আত্ম-সমর্পণ, (vi) 'রক্ষা কর' বলিয়া দৈন্য ও আর্তি প্রকাশ ।

৬৭) শুশ্রূষা শব্দের দুই অর্থ - (i) শ্রবণের ইচ্ছা, (ii) পরিচর্যা, সেবা । এস্থলে যে কোন অর্থ গ্রহণ করা যায় ।

৭৮) এস্থলে "যোগেশ্বর ও ধনুর্ধর" এই বিশেষণের সার্থকতা লক্ষ করিবার বিষয় । যুক্তি ও শক্তি মিলিত হইলেই কার্য-সফলতা সম্ভবপর, নচেৎ কেবল বলে বা কেবল বুদ্ধিদ্বারা কৃতকার্য হওয়া যায় না, উদাহরণ জরাসন্ধ-বধ ।

শ্রীশ্রীগীতামাহাত্ম্যম্‌ 

(শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য)

যে ব্যক্তি এই পবিত্র গীতাশাস্ত্র পাঠ করেন, তিনি ভয় ও শোকাদি শূন্য হয়ে বিষ্ণুধাম প্রাপ্ত হন । ১ 

যে ব্যক্তি সর্বদা গীতা অধ্যয়ন করেন এবং প্রাণায়াম ইত্যাদিতে তৎপর থাকেন তাঁর ইহজন্ম এবং পূর্বজন্মের সমস্ত পাপ নিঃসন্দেহে নষ্ট হয়ে যায় । ২

নিত্যস্নানে মানুষের শারীরিক মল নাশ হয় আর গীতাজ্ঞান-রূপ জলে একবারও যদি স্নান করা হয়, তবে তা সংসাররূপ মল নাশ করে দেয় । ৩

যা সাক্ষাৎ পদ্মনাভ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখ(পদ্ম) হইতে নিঃসৃত, সেই গীতাশাস্ত্র ঠিকভাবে পাঠ করা উচিত, অন্য শাস্ত্রাদির বিস্তারিত ব্যাখ্যার কী প্রয়োজন ? ৪

যা অমৃতোপম মহাভারতের সার এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত, সেই গীতারূপ গঙ্গাজল পান করলে এই জগতে পুনর্বার জন্মগ্রহণ করতে হয় না । ৫

উপনিষদ্‌সমূহ গাভীর সমান, গোপালনন্দন শ্রীকৃষ্ণ তার দোহক, অর্জুন গো-বৎস, এই মহৎ গীতামৃত সেই গাভীর দুগ্ধ আর শুদ্ধ-বুদ্ধিসম্পন্ন সুধীজন তার ভোক্তা । ৬

দেবকীনন্দন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কথিত গীতাশাস্ত্রই একমাত্র উত্তম শাস্ত্র, ভগবান দেবকীনন্দনই একমাত্র সর্বোত্তম দেবতা, তাঁর নামই একমাত্র মন্ত্র এবং সেই ভগবানের সেবাই হল একমাত্র কর্তব্য-কর্ম । ৭
_________________________________________
আমার সীমিত সামর্থ্যে অনুসন্ধান করে এ পর্যন্ত ৬টি গীতামাহাত্ম্যের খোঁজ পেয়েছি :-
  1. বৈষ্ণবীয় তন্ত্রসারে উক্ত গীতামাহাত্ম্য (84-85 শ্লোকসংখ্যা) 123
  2. বরাহপুরাণে উক্ত গীতামাহাত্ম্য (23 শ্লোকসংখ্যা) 12
  3. শ্রী আদি শংকরাচার্য্য'এর লেখা গীতামাহাত্ম্য (7 শ্লোকসংখ্যা) 12
  4. পদ্মপুরাণ, উত্তরাখণ্ডে উক্ত গীতামাহাত্ম্য 123456 (English); 78 (Bengali)
  5. স্কন্দপুরাণ, অবন্তীখণ্ডে উক্ত গীতামাহাত্ম্য (15 শ্লোকসংখ্যা) 12
  6. মহাভারতে উক্ত গীতামাহাত্ম্য (4 শ্লোকসংখ্যা) 1
বিভিন্ন গীতা ও মাহাত্ম্য নিয়ে বিদগ্ধ আলোচনা 1

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ভাষ্য (বাংলা) ডাউনলোড করুন:
শ্রী গীতা - জগদীশচন্দ্র ঘোষ।৩৩ মেগাবাইট। https://drive.google.com/.../1qxM-H05IAKwn9p1lg.../view...
যথার্থ গীতা - স্বামী অড়গড়ানন্দ।৪ মেগাবাইট। https://drive.google.com/.../14kSq0AfvVGLdn4CyrTz97X.../view
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।১৩ মেগাবাইট। https://drive.google.com/.../1e7GsxL0F7bYANsmWPFA.../view...
শ্রী অরবিন্দের গীতা (১-২) অনিলবরণ রায়।৩৬ মেগাবাইট https://drive.google.com/.../1tIHT5zLq3yABdaITIYj.../view...
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা - সাধক সঞ্জীবনী।গীতাপ্রেস।৭১ মেগাবাইট। https://drive.google.com/.../1nuy8a3OcGKWv1zkh2aX.../view...
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা - প্রভুপাদ ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী।শ্রীচৈতন্য সারস্বত মঠ।২০ মেগাবাইট। https://drive.google.com/.../1qSJGLNzkMTETBkOBFc21Yc.../view
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা – কৃষ্ণাপ্রসন্ন সেন- আনন্দগিরিকৃত টীকা সহিত শাঙ্কর ভাষ্য সম্বলিতা।৬৫ মেগাবাইট। https://drive.google.com/.../1ISnHP54.../view...
গীতা - শশধর তর্কচূড়ামনি (শঙ্কর ভাষ্য)।১৩ মেগাবাইট। https://drive.google.com/.../1dDJ80MmVYvwYXZkY4Ud.../view...
গীতা - সতেন্দ্রনাথ ঠাকুর।১৪ মেগাবাইট। https://drive.google.com/.../134pTXPU5fzEda.../view...
গীতা - মথুরানাথ তর্করত্ন।৬২ মেগাবাইট। https://drive.google.com/.../1jCoJQ02XokCYFyPiR0X.../view...
গীতা - লক্ষ্মণ শাস্ত্রী। ১১ মেগাবাইট। https://drive.google.com/.../1VefAplLigosDm663F0g.../view...
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা - সুরধূণী দেবী।৬৫মেগাবাইট। https://drive.google.com/.../1UsyZcpBXlxyPuOq918S.../view...
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (বৃহৎ) - দামোদর মুখোপাধ্যায়।১০৩ মেগাবাইট। https://drive.google.com/.../12rhdfVZOVjAEZqZa3Ag.../view...
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ - শ্রীল প্রভুপাদ।ইসকন।৭১ মেগাবাইট। https://drive.google.com/.../1l0uG8p1AoQZrP.../view...
গীতা (শক্তিবাদ ভাষ্য) - সত্যানন্দ সরস্বতী।৩ মেগাবাইট। https://drive.google.com/.../1thqISUw8CGnjKY.../view...
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (গান্ধী ভাষ্য) - সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত।১৯ মেগাবাইট। https://drive.google.com/.../1u6CLu39rbNLQTxeJSZV.../view...
গীতা - (পদ্যানুবাদ) নবীন চন্দ্র সেন।৮ মেগাবাইট। https://drive.google.com/.../1pd64i5fPZYnQI.../view...
গীতা - কেদারনাথ দত্ত।২০ মেগাবাইট। https://drive.google.com/.../1VeNVmxv.../view...

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

ঋগ্বেদ ৭/৪/৭

  পরিষদ্যম্ হ্যরণস্য রেক্ণো নিত্যস্য রায়ঃ পতয়ঃ স্যাম। ন শেষো অগ্নে অন‍্যজাতম্ অস্ত্যচেতনস্য মা পথম্ বিদুক্ষঃ॥ ঋগ্বেদ ভাষ্য (স্বামী দयानন্দ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ