![]() |
| জগদীশ্বরানন্দ |
ভূমিকা
(স্বামী জগদীশ্বরানন্দ)
ভূমিকা-সূচী
2) গীতার মহিমা
3) গীতার প্রাচীনত্ব
3.1) গীতা ও বৌদ্ধধর্ম4) গীতার ভাষা
3.2) গীতা ও মহাভারত3.2.1) কালনির্ণয়ে জ্যোতিষশাস্ত্র3.3) গীতা ও পতঞ্জলির যোগসূত্র
3.4) গীতা ও ব্রহ্মসূত্র
3.5) গীতা ও উপনিষদ্
3.6) গীতা ও শতপথ-ব্রাহ্মণ
5) গীতাসাহিত্য
6) গীতার ঐতিহাসিক সমালোচনা
6.1) গীতা মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত ?7) গীতার শ্লোকসংখ্যা
6.2) গীতা মহাভারতের প্রকৃত অংশ
7.1) ব্যাসদেবের মত8) গীতার বিবিধ ভারতীয় ব্যাখ্যা
7.2) শ্রীচৈতন্যদেবের মত
7.3) প্রাচীন হস্তলিখিত পুঁথি
7.4) কাশ্মীরী গীতা
7.5) শঙ্করাচার্যের মত
7.6) শুদ্ধ ধর্মমণ্ডল গীতা
7.7) আলবেরুনির মত
7.8) ফারসী ও আরবী অনুবাদ
8.1) অদ্বৈতবাদ9) গীতার বৈদেশিক ব্যাখ্যা
8.2) বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ
8.3) দ্বৈতবাদ
8.4) দ্বৈতাদ্বৈতবাদ
8.5) অন্যান্য ব্যাখ্যা
8.6) ত্যাগই গীতার বাণী
10) গীতার প্রচার
10.1) ইংরেজী অনুবাদ11) গীতা ও উপনিষদাবলী
10.2) অন্যান্য বিদেশী ভাষায় অনুবাদ
10.3) বাংলায় অনুবাদ
10.4) গীতার অন্যান্য প্রচার
11.1) উপনিষদ্ এবং গীতার শ্লোকে সাদৃশ্য12) গীতা ও ভাগবত
11.2) গীতা এবং ব্রহ্মতত্ত্ব
11.3) যুদ্ধক্ষেত্রে গীতা কিরূপে উপদিষ্ট হইল ?
13) গীতার উদারতা
14) গীতায় আত্মার অমরত্ব
15) গীতায় অবতারবাদ
16) গীতোক্ত কর্মযোগ
17) বৌদ্ধধর্ম ও গীতা
17.1) যোগক্ষেম শব্দের ব্যবহার18) গীতায় যোগচতুষ্টয়ের সমন্বয়
18.1) নিষ্কাম কর্মযোগ দ্বারা মুক্তি19) গীতাকবচ
18.2) জ্ঞানযোগ দ্বারা মুক্তি
18.3) ভক্তিযোগ দ্বারা মুক্তি
18.4) রাজযোগ দ্বারা মুক্তি
20) গীতামাহাত্ম্য
1) প্রস্তাবনা
গীতা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থ । গীতা যে শুধু হিন্দুধর্মের সকল সম্প্রদায় কর্তৃক সমাদৃত তাহা নহে, অন্যান্য ধর্মাবলম্বী অসংখ্য নরনারী শ্রদ্ধাভরে ইহা পাঠ করেন । জার্মান মনীষী উইলিয়াম ভন হামবোল্ট বলিয়াছেন, "গীতার মতো সুললিত, সত্য এবং সুগভীর তত্ত্বপূর্ণ পদ্যগ্রন্থ সম্ভবতঃ পৃথিবীর আর কোন ভাষায় নাই ।" পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ছত্রিশটি ভাষায় আজ পর্যন্ত ইহার পঁচিশ শতাধিক সংস্করণ হইয়াছে । জার্মান, ফরাসী, ইংরেজী প্রভৃতি ইওরোপের প্রধান ভাষাসমূহে গীতার অনুবাদ বিদ্যমান । ১৭৮৫ খ্রীষ্টাব্দে গীতার প্রথম ইংরেজী অনুবাদ লণ্ডনে মুদ্রিত হয় । অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে রুশ ভাষায় গীতার অনুবাদ হইয়াছিল । প্রসিদ্ধ ইংরেজ মনীষী কার্লাইল বিখ্যাত মার্কিন মনীষী এমার্সনের সহিত সাক্ষাৎকালে তাঁহাকে একখানি গীতা উপহার দিয়াছিলেন । গীতার প্রভাব এমার্সনের সারগর্ভ রচনাবলীতে সুস্পষ্ট দেখা যায় । তিলক বলেন, "গীতার মতো অপূর্ব গ্রন্থ সংস্কৃত সাহিত্যে কেন, জগতের সাহিত্যে দুর্লভ ।"
2) গীতার মহিমা
স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, "উপনিষদ্ হইতে আধ্যাত্মিক তত্ত্বের কুসুমরাজি চয়ন করিয়া গীতারূপ এই সুদৃশ্য মাল্য গ্রথিত হইয়াছে ।"
মহাত্মা গান্ধী বলেন, "গীতা মানবের পারমার্থিক জননী । আমার গর্ভধারিণীর স্বর্গগমনের পর গীতা তাঁহার স্থান অধিকার করিয়াছে ।"
সমগ্র মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠ সূরি তাঁহার গীতাব্যাখ্যার প্রারম্ভে লিখিয়াছেন - 'মহাভারতে সকল বেদের সারার্থ সংগৃহিত । আর সমগ্র মহাভারতের সারতত্ত্ব গীতায় বর্তমান । সেইজন্য গীতা সর্বশাস্ত্রময়ী । সকল শাস্ত্রের সার গীতায় নিহিত ।'
কেশব কাশ্মীরী সত্যই বলিয়াছেন - "শ্রীভগবান্ করুণাপূর্বক ভবসাগর পার হইবার জন্য গীতারূপ নৌকা সৃষ্টি করিয়াছেন । উহার সাহায্যে ভগবদ্ভক্তগণ অনায়াসে সংসার-সমুদ্র অতিক্রম করিতে পারিবেন ।"
বাংলার ভূতপূর্ব গবর্ণর লর্ড রোনাল্ডসের মতে গীতাতত্ত্বই ভারতীয় চিন্তার পূর্ণ পরিণতি ও সূক্ষ নির্যাস ।
মোগল সম্রাট্ শাজাহানের পুত্র দারাশিকো লিখিয়াছেন, "গীতা স্বর্গীয় আনন্দের অফুরন্ত উৎস । সর্বোচ্চ সত্যলাভের সুগম পথ গীতায় প্রদর্শিত । গীতায় পরমপুরুষের কথা বিবৃত ও ব্রহ্মবিদ্যা ব্যাখ্যাত । গীতা ইহলোক ও পরলোকের সুগভীর ও শ্রেষ্ঠ রহস্যের দ্বারোদ্ঘাটন করেন ।"
ইংরেজ মনীষী ডক্টর এল.ডি.বার্নেট বলেন, "লক্ষ লক্ষ লোক গীতা পড়িয়াছেন বা শুনিয়াছেন । সকলেই উহার পাঠে বা শ্রবণে বুঝিতে পারেন যে, ঈশ্বরলাভের দুর্গম পথে উহা শ্রেষ্ঠ সম্পদ ও সহচর । জীবনের প্রত্যেক কর্মকে অনাসক্তির অনলে শুদ্ধ করিয়া উপাসনায় পরিণত করার যে অপূর্ব কৌশল গীতা শিক্ষা দেয়, তাহা মানবের কর্মজীবনের অনন্য অবলম্বন ।"
শোনা যায়, জনৈক ফরাসী তত্ত্বপিপাসু দ্বাদশ বৎসর গীতার স্বাধ্যায় করিয়া বলিয়াছেন, "গীতাকে ধর্মজীবনের চিরসঙ্গী করিলে অন্য কোন ধর্মগ্রন্থপাঠের আবশ্যকতা থাকে না ।"
এক শত ষাট বৎসর পূর্বে ব্রিটিশ ভারতের প্রথম গবর্ণরজেনারেল ওয়ারেন্ হেস্টিংস, চার্লস উইলকিন্স-কৃত গীতার ইংরেজী অনুবাদের ভূমিকায় লিখিয়াছেন - "গীতার প্রাচীনত্ব এবং যে পূজা উহা বহু শতাব্দী যাবৎ মনুষ্যজাতির এক বৃহদংশের নিকট হইতে পাইয়া আসিতেছে তাহার দ্বারা গীতা সাহিত্য-জগতে এক অভূতপূর্ব বিস্ময় উৎপাদন করিয়াছে । উহার সাহিত্যিক গুণাবলী জগতে অননুকরণীয় । গীতাপাঠে শুধু ইংরেজগণ কেন, সমগ্র বিশ্ববাসী উপকৃত হইবেন । গীতাধর্মের অনুশীলনে মাননজীবন শান্তিধামে পরিণত হইবে ।
গীতা হিন্দুদের নৈতিক উন্নতি, সাহিত্য-সৃষ্টি ও পৌরাণিক রহস্যভেদের আশ্চর্যজনক প্রামাণিক গ্রন্থের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন । যদিও ইওরোপের সভ্যতা, ধরমাচরণ ও নৈতিক ব্যবহার গীতোক্ত শিক্ষা হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, তথাপি উহা আমাদের ধর্মসাধনে ও নৈতিক কর্তব্যপালনে বিশেষ সহায়ক হইবে । যে সাধনতত্ত্বের বিষয়ে ইওরোপের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতকুল এবং সাধকগণ অজ্ঞ, ভারতের সেই সনাতন সাধনার কথা গীতা বলিয়াছেন । গীতার মৌলিকত্ব, ভাবের গভীরতা ও অভিনবত্ব, দার্শনিক তত্ত্বের উচ্চতা, বলিষ্ঠ যুক্তিতর্ক ও ব্যাখ্যা-কৌশল অপূর্ব ও অসাধারণ । গীতার উপদেশ খ্রীষ্টান ধর্মের মূলসূত্রগুলির প্রকৃত ও সরল ব্যাখ্যা পাওয়া যায় ।"
3) গীতার প্রাচীনত্ব
3.1) গীতা ও বৌদ্ধধর্ম :-
গীতা যে কত প্রাচীন সেই সম্বন্ধে পণ্ডিতগণের মধ্যে বিশেষ মতভেদ আছে । অনেকের মত - গীতা ভগবান্ বুদ্ধের পরবর্তী । ডাঃ লরিনসারের মতে গীতা বুদ্ধদেবের জন্মের অনেক পরে; এমন কি যীশুখ্রীষ্টের আবির্ভাবের কয়েক শতাব্দী পরে রচিত । মারাঠী পণ্ডিত টেলাং তাঁহার গীতার উপক্রমণিকায় লিখিয়াছেন যে, উহা খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীরও কিছু পূর্বে লিখিত এবং ডাঃ লরিনসারের অযৌক্তিক উক্তির তীব্র সমালোচনা করিয়াছেন ।
স্যার আর.জি.ভাণ্ডারকর তাঁহার "Vaisnavism and Saivism" (p.13) গ্রন্থে বলেন - "গীতাতে ব্যূহের কোন উল্লেখ নাই । সুতরাং ইহার জন্মতারিখ, শিলালিপি ও নির্দেশ পতঞ্জলির বহু পূর্বে অর্থাৎ গীতার উৎপত্তি খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর প্রারম্ভের পরে কিছুতেই নহে; তবে চতুর্থ শতাব্দীর কত পূর্বে ইহার জন্ম তাহা নিশ্চয় করা সুকঠিন । গীতা যখন রচিত হয়, তখন বাসুদেব ও নারায়ণ অভেদ-জ্ঞানে পূজিত বা বাসুদেব বিষ্ণুর অবতাররূপে গৃহীত হন নাই । গীতাতে [১০|২১] বিষ্ণুকে প্রধান আদিত্য বলা হইয়াছে, পরমপুরুষ বলা হয় নাই এবং দশম অধ্যায়ে বাসুদেবকে সীমান্বিতভাবে বিষ্ণু বলা হইয়াছে; প্রত্যেক শ্রেণী বা জাতির মধ্যে যিনি শ্রেষ্ঠ তিনিই তাঁহার দিব্য বিভূতি, 'তেজোহংশসম্ভবম্' । সুতরাং মারাঠী পণ্ডিত ভাণ্ডারকরের মতে গীতার জন্ম অন্ততঃ খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর পূর্বে ।
জার্মান পণ্ডিত গার্বের মতে মূল গীতা খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে এবং গীতার আধুনিক কলেবর খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে উৎপন্ন ।
নবম শতাব্দীতে শঙ্করাচার্য গীতাভাষ্য রচনা করেন । পঞ্চম শতাব্দীতে আবির্ভূত মহাকবি কালিদাস গীতার বিষয় অবগত ছিলেন । কালিদাসের 'রঘুবংশে' [১০|৩১] একটি বাক্য আছে, যাহার সহিত গীতার একটি শ্লোকের [৩|২২] নিকট-সাদৃশ্য আছে । সপ্তম শতাব্দীতে বাণভট্ট তাঁহার গ্রন্থে গীতার উল্লেখ করিয়াছেন । খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে বহু পুরাণ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার অনুকরণে অন্যান্য গীতা সৃষ্টি করিয়াছেন । ভাসের 'কর্ণভার' নাটকে 'হতোহপি লভতে স্বর্গং জিত্বা তু লভতে যশঃ' - এই বাক্যটি গীতার একটি শ্লোকের [২|৩৭] প্রথমার্ধের প্রতিধ্বনি মনে হয় । ভাসের আবির্ভাবকাল কখনও খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে, কখনও বা খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে নির্দিষ্ট হয় । বোধায়নের (সম্ভবতঃ পঞ্চম শতাব্দীর) গৃহসূত্র ও পিতৃমেধসূত্রে গীতার শ্লোক উদ্ধৃত এবং বাসুদেবের উপাসনা বিবৃত আছে ।
ডাঃ সর্বেপল্লী রাধাকৃষ্ণন্ বলেন, গীতা খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে রচিত । ডাঃ সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের মতে গীতা বুদ্ধের পূর্ববর্তী কালে উৎপন্ন এবং উহা ভাগবত-ধর্মের প্রাচীনতম গ্রন্থ । ভাগবত-ধর্মের প্রাচীনত্ব তিলক, সেনার্ট ও বুহ্লার কর্তৃক স্বীকৃত । বুহ্লার সাহেব বলেন যে, খ্রীষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে জৈনধর্মের আবির্ভাবের বহু পূর্বে ভাগবত-ধর্মের উৎপত্তি । ডাঃ দাশগুপ্ত আরও বলেন, "গীতাতে বৌদ্ধ মতের কোন প্রকার উল্লেখ নাই এবং উহার ভাষাও পাণিনীয় নহে । সুতরাং গীতা নিশ্চিতই বুদ্ধের পূর্বে রচিত, কিছুতেই বুদ্ধের পরবর্তী যুগের নহে ।"
কেহ কেহ গীতায় নির্বাণ-শব্দটি কয়েকবার উল্লিখিত দেখিয়া মত প্রকাশ করেন যে, গীতা বৌদ্ধযুগে সৃষ্ট; কিন্তু এই প্রকার যুক্তি নিতান্ত অগভীর ও অর্বাচীন । কারণ, নির্বাণ-শব্দটি বৌদ্ধদের নিজস্ব নহে, উহা গীতাতে পাঁচবার ব্যবহৃত হইয়াছে [২|৭২, ৫|২৪,২৫,২৬, ৬|১৫] । কিন্তু এই পাঁচটি শ্লোকে নির্বাণ-শব্দটি ব্রহ্ম-শব্দের সহিত সদা সংযুক্ত দৃষ্ট হয় । গীতায় ব্রহ্মনির্বাণের অর্থ ব্রাহ্মী স্থিতি, বৌদ্ধ নির্বাণের মতো 'শূন্য' নহে । সুতরাং বৌদ্ধগণই যে গীতা হইতে নির্বাণ-শব্দটি গ্রহণ করিয়াছেন - এই মতই অধিকতর সমীচীন মনে হয় । অতএব স্পষ্টই প্রতীত এবং প্রমাণিত হয় যে, গীতা ভগবান্ বুদ্ধের পূর্বে রচিত ।
3.2) গীতা ও মহাভারত :-
গীতাকে মহাভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশরূপে ধরিলে উহার আরও প্রাচীনত্ব প্রমাণিত হয় । রমেশচন্দ্র দত্ত এবং প্র্যাট্ সাহেবের মতে মহাভারত খ্রীঃপূঃ ১২শ শতাব্দীতে রচিত । মহাভারতে অগ্নি, ইন্দ্রাদি বৈদিক দেবতার উপাসনা আছে । বৌদ্ধযুগে উক্ত মহাকাব্য প্রসিদ্ধ ছিল । উহাতে বুদ্ধ ও বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে কোন প্রকার উল্লেখ না থাকায় ম্যাক্ডোনেল বলেম, "মহাভারতের আদিম আকৃতি অন্ততঃ খ্রীঃপূঃ ৫ম শতাব্দীতে উৎপন্ন ।" আশ্বলায়ন সূত্রে মহাভারতের উল্লেখ আছে । গুপ্তরাজগণের শিলালিপিতে মহাভারতের নাম স্পষ্টভাবে উল্লিখিত । কবি ভাস তাঁহার বহু রচনার ঘটনা মহাভারত হইতে গ্রহণ করিয়াছেন । অশ্বঘোষ তাঁহার 'বুদ্ধচরিত' ও 'সৌন্দরনন্দ' কাব্যে মহাভারতের উল্লেখ করিয়াছেন । বুহ্লার ও কির্স্টে (Buhler & Kirste) তাঁহাদের 'Contributions to the Study of the Mahabharat' নামক গ্রন্থে বলেন যে, মহাভারতের যে আকার বর্তমানে দৃষ্ট হয়, তাহা খ্রীষ্টীয় তৃতীয় শতকে বিজ্ঞাত এবং ৫ম শতকে প্রায় একই প্রকার ছিল । উহার কিয়দংশ পুরাণের যুগে রচিত । ডাঃ রাধাকৃষ্ণনের মতে মহাভারত অন্ততঃ খ্রীঃপূঃ ৫ম শতাব্দীতে উহার বর্তমান আকার লাভ করিয়াছিল । সম্ভবতঃ উহার মৌলিক আকৃতি খ্রীঃপূঃ ১১শ শতকে উৎপন্ন ।
3.2.1) মহাভারত ও গীতার কালনির্ণয়ে জ্যোতিষশাস্ত্র :-
মহাভারত যত প্রাচীন, গীতাও তত প্রাচীন । ১৯৪৪ খ্রীঃ এপ্রিল মাসে কাশীতে যে নিখিল ভারত প্রাচ্য সম্মেলন হইয়াছিল তাহাতে তিনজন জ্যোতির্বিদ পণ্ডিত গীতার কালনির্ণয়বিষয়ক তিনটি প্রবন্ধ পাঠ করেন । মিঃ কারান্তিকর বলেন খ্রীঃপূঃ ১৯৩১ অব্দে গীতোক্ত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হইয়াছিল । ডাঃ দফ্তরীর মতে খ্রীঃপূঃ ১১৬২ এবং অধ্যাপক সেনগুপ্তের মতে খ্রীঃপূঃ ২৫৬৬ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কাল ।
লোকমান্য তিলক 'মাসানাং মার্গশীর্ষোহহম্' [১০|৩৫] - গীতার এই শ্লোকাংশ জ্যোতিষশাস্ত্রের দিক হইতে আলোচনা করিয়া এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন যে, খ্রীষ্টজন্মের ১৪০০ বৎসর পূর্বে গীতা রচিত হইয়াছিল ।
3.3) গীতা ও পতঞ্জলির যোগসূত্র :-
'যোগ' শব্দটি উভয় গ্রন্থে ব্যবহৃত হইলেও পতঞ্জলির যোগশব্দ অপেক্ষা গীতার যোগশব্দ অধিকতর ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত । যোগসূত্রের ৭০টি সূত্রের মধ্যে ১২টি সূত্রের শব্দপ্রয়োগে এবং গীতার শব্দপ্রয়োগে সমতা পরিলক্ষিত হয় । ইহাতে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, গীতা পতঞ্জলিসূত্র অপেক্ষা প্রাচীনতর । পতঞ্জলি পাণিনীয় সূত্রের ভাষ্যকার, সুতরাং পাণিনির পরবর্তী । পতঞ্জলি পাণিনির ১০০ বা ১৫০ বৎসর পরবর্তী । পাণিনির সময় খ্রীঃপূঃ ৮০০ হইতে খ্রীঃপূঃ ৫০০ বৎসরের মধ্যে ।
3.4) গীতা ও ব্রহ্মসূত্র :-
গীতায় 'ব্রহ্মসূত্র' শব্দটির প্রয়োগ দেখিয়া কোন কোন পণ্ডিত মনে করেন, গীতা ব্রহ্মসূত্রের পরবর্তী । কিন্তু ব্রহ্মসূত্রের মধ্যে বৌদ্ধমতের উল্লেখ থাকায় ব্রহ্মসূত্রের সময় খ্রীঃপূঃ ২৫০ অব্দ বলা যাইতে পারে । সুতরাং পূর্বোক্ত যুক্তির কোন সারবত্তা নাই ।
3.5) গীতা ও উপনিষদ্ :-
মিঃ টেলাঙ্গ এবং অন্যান্য পণ্ডিত গীতা এবং মুণ্ডক ও শ্বেতাশ্বতরাদি উপনিষদের ভাবসাদৃশ্য এবং অনেক স্থলে ভাষাসাদৃশ্য লক্ষ্য করিয়া অনুমান করেন যে, গীতা এবং মুণ্ডক ও শ্বেতাশ্বতরাদি উপনিষদ্ সমসাময়িক । মুণ্ডক উপনিষদে 'অষ্টাদশোক্তমবরং যেষু কর্ম' [১|২|৭] মন্ত্রাংশে সম্ভবতঃ অষ্টাদশ অধ্যায়াত্মক কোন গ্রন্থকে লক্ষ্য করিয়াছে । গীতা এবং মুণ্ডক উপনিষদে 'অবরং কর্ম' শব্দের প্রয়োগ আছে । ইহা হইতে মনে হয়, গীতা ও মুণ্ডক উপনিষদ্ সমসাময়িক । শ্রুতির ও স্মৃতির মধ্যবর্তী যুগে উপনিষৎসমূহ রচিত । 'গীতাসূপনিষৎসু' বাক্যেও গীতা উপনিষদ্রূপে অভিহিত ।
3.6) গীতা ও শতপথ-ব্রাহ্মণ :-
পণ্ডিতগণের মতে শতপথ-ব্রাহ্মণ শ্রুতির সময়ের শেষভাগে রচিত । 'কৃত্তিকাঃ প্রাচৈঃ দিশৈঃ ন চ্যবন্তে' এই বাক্য হইতে মিঃ বৈদ্য প্রমাণ করিয়াছেন যে, শতপথ-ব্রাহ্মণ খ্রীষ্টজন্মের অন্ততঃ তিন হাজার বর্ষ পূর্বে রচিত । এইরূপে মিঃ বৈদ্য এবং অধ্যাপক ভি.বি.আঠাওয়ালে বহু অকাট্য যুক্তি দ্বারা প্রমাণ করিয়াছেন, গীতা খ্রীঃপূঃ তিন হাজার বর্ষ পূর্বে রচিত ।
4) গীতার ভাষা
গীতার ভাষা প্রাঞ্জল, সহজবোধ্য ও সুখপাঠ্য । গীতার সংস্কৃত সরল ও সাবলীল । তাহাতে অতি প্রাচীন শব্দের প্রয়োগে ব্যাকরণের সূত্র লঙ্ঘিত হইলেও মনে হয়, গীতার সময় সংস্কৃত প্রচলিত ভাষা ছিল, কেবলমাত্র পণ্ডিতগণের ভাষা ছিল না । কবিত্ব ও দার্শনিকতার এমন অপূর্ব সম্মিলন কুত্রাপি দেখা যায় না । সুমিষ্ট ও সরল সংস্কৃতে শ্লোকগুলি রচিত এবং কয়েকবার পাঠেই কণ্ঠস্থ হইয়া যায় । জীবন্ত ভাবটি ভাষার পাতলা আবরণ ভেদ করিয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে । ডাঃ সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের মতে গীতার ভাষা বিস্তরশঃ অপাণিনীয় ও অপ্রচলিত (archaic) এবং ভাষাভঙ্গীও অত্যন্ত প্রাচীন । গীতায় যে-সকল অপাণিনীয় বা আর্ষপ্রয়োগ আছে, তিনি তাঁহার নিম্নলিখিত তালিকা দিয়াছেন -
'যুধ্য' স্থলে 'যুধ্যস্ব' [৩|৩০]
'নিবৎস্যসি' স্থলে 'নিবসিষ্যসি' [১২|৮]
'মা শোচীঃ' স্থলে 'মা শুচঃ' [১৬|৫]
'যমঃ সংযচ্ছতাম্' স্থলে 'যমঃ সংযমতাম্' [১০|২৯]
'প্রিয়ায়া অহর্সি' স্থলে 'প্রিয়ায়ার্হসি' [১১|৪৪]
'সেনান্যাম্' স্থলে 'সেনানীনাম্' [১০|২৪]
আত্মনেপদী ধাতুর পরস্মৈপদী-রূপে ব্যবহারঃ-
যত্ [৬|৩৬, ৭|৩, ৯|১৪, ১৫|১১]রম্ [১০|৯]বিজ্ [৫|২০]
পরস্মৈপদী ধাতুর আত্মনেপদী-রূপে ব্যবহারঃ-
কাঙ্ক্ষ্ [১|৩১]ব্রজ্ [২|৫৪]বিশ্ [১৮|৫৫]ইঙ্গ্ [৬|১৯, ১৪|২৩]
আর্ষ সন্ধি - 'হে সখেতি' [৩|১০]
'শক্লোষি' স্থলে 'শকস্যে' [১১|৮, মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠ]
'ইমং মহিমানং' স্থলে 'ইদং মহিমানং' [১১|৪১, মধুসূদন সরস্বতী]
'নমস্কৃত্য' স্থলে 'নমস্কৃত্বা' [১১|৩৫, মধুসূদন সরস্বতী]
'ইমং ধর্মং' স্থলে 'ধর্মস্যাস্য' [১১|৩৫, মধুসূদন সরস্বতী]
এইরূপ প্রায় ৩২টি আর্ষপ্রয়োগ গীতাতে আছে । ভাণ্ডারকর স্মৃতিগ্রন্থে (Commemoration Volume) প্রকাশিত শ্রী ভি.কে.রাজয়াডে উক্ত প্রকার অশুদ্ধির বহু দৃষ্টান্ত দিয়াছেন । এই প্রকার ভাষাগত অনিয়মের দ্বারা গীতার প্রাচীনত্বই প্রমাণিত হয় । পাণিনীয় ব্যাকরণের সূত্র "বাসুদেবার্জুনাভ্যাম্ বুঞ" [৪|৩৯৮] হইতে মনে হয়, পাণিনি মহাভারতীয় আখ্যায়িকার সহিত পরিচিত ছিলেন । সুতরাং গীতা যে পাণিনীয় ব্যাকরণের পূর্ববর্তী ইহা নিঃসন্দেহ এবং উহাতে অপাণিনীয় প্রয়োগ অবশ্যম্ভাবী ।
গীতার [৩|১৯,৩৬] শ্লোকদ্বয়ে পুরুষ শব্দে (দীর্ঘ) ঊকারের ব্যবহার দৃষ্ট হয় । গীতার বোধায়ন ভাষ্যের হস্তলিখিত পুঁথির মতে 'ছন্দের অনুরোধে উক্ত (দীর্ঘ) ঊকার ব্যবহৃত' । আবার 'পুরুষ' শব্দ যে অপাণিনীয় নহে, তাহা পাণিনিকৃত অষ্টাধ্যায়ীর সূত্র [৬|৩|১৩৭] হইতে জানা যায় ।
5) গীতাসাহিত্য
গীতার উপর বহু ভাষ্য ও টীকাদি (১৫-১৬টি) লিখিত হইয়াছে । গীতার শঙ্করভাষ্যই প্রাচীনতম প্রাপ্ত ভাষ্য । শঙ্করের পূর্বেও যে গীতার ভাষ্যাদি রচিত হইয়াছিল, তাহার স্পষ্ট উল্লেখ দেখা যায় । গীতার শঙ্করভাষ্যের টীকায় [২|১০] আনন্দজ্ঞান গিরি বলেন, বেদান্তসূত্রের টীকাকার বোধায়ন গীতার উপর একটি বৃত্তি রচনা করিয়াছিলেন; কিন্তু উহা এখন পাওয়া যায় না । বোধায়নকে এইজন্য বৃত্তিকার বলা হয় ।
শঙ্করভাষ্য হিন্দী, মারাঠী, বাংলা, ইংরেজী, জার্মান প্রভৃতি ভাষায় অনূদিত হইয়াছে । শঙ্করভাষ্যের উপর আনন্দগিরি এবং রামানন্দ-কৃত যথাক্রমে 'বিবরণ' ও 'ব্যাখ্যা' নামক টীকাদ্বয় আছে । শঙ্করের পরে গীতার উপর ভাষ্যাদি রচনা কিছুকালের জন্য বন্ধ ছিল, মনে হয় ।
মধ্বাচার্য (আনন্দতীর্থ) ত্রয়োদশ শতাব্দীতে যে গীতাভাষ্য রচনা করিয়াছিলেন, তাহার উপর জয়তীর্থকৃত 'প্রমেয়দীপিকা' নামক টীকা আছে । মধ্বাচার্য-কৃত 'ভগবদ্গীতা-তাৎপর্য-নির্ণয়'র উপর জয়তীর্থ 'ন্যায়দীপিকা' নামক টীকা লিখিয়াছেন ।
রামানুজাচার্য (ব্রহ্মসূত্রের 'শ্রীভাষ্য'-রচয়িতা) একাদশ শতাব্দীতে বিশিষ্টাদ্বৈত-মতানুযায়ী যে গীতাভাষ্য রচনা করিয়াছিলেন, তাহার উপর বেঙ্কটনাথের (বেদান্তাচার্যের) 'তাৎপর্য-চন্দ্রিকা' নামক টীকা আছে ।
রামানুজ-গুরু যামুনাচার্য-কৃত ১০ম শতাব্দিতে রচিত 'গীতার্থ-সংগ্রহে'র উপর নিগমান্ত মহাদেশিকের 'গীতার্থ-সংগ্রহ-রক্ষণ' এবং ১৪শ শতাব্দীর বরাবর মুনি-কৃত 'গীতার্থ-সংগ্রহদীপিকা' নামক টীকাদ্বয় বর্তমান । উল্লিখিত দ্বিতীয় টীকাটি কাঞ্জিভরম্ সুদর্শন প্রেস হইতে প্রকাশিত ।
যামুনাচার্য নামধারী দুই ব্যাক্তির গীতার উপর গদ্যে ও পদ্যে দুইটি টীকা পাওয়া যায় । গদ্য টীকাকার যামুনাচার্য বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী হইলেও রামানুজের গুরু নহেন । এই গদ্য টীকাটি কাঞ্জিভরম্ সুদর্শন প্রেস হইতে প্রকাশিত । উহাতে অন্বয়মুখে সরল পদার্থ দেওয়া আছে ।
বোম্বাই নির্ণয় সাগর প্রেস হইতে অষ্টভাষ্য-টীকা সম্বলিত যে গীতা প্রকাশিত হইয়াছে, তাহাতে শঙ্করভাষ্যের ব্যাখ্যা 'ভাষ্যোৎকর্ষদীপিকা' এবং মধুসূদন সরস্বতীর টীকার ব্যাখ্যা 'গূঢ়ার্থ-দীপিকা-তত্ত্বালোক' (মৈথিলী পণ্ডিত শ্রীধর্মদত্ত শর্মা-কৃত) আছে ।
একমাত্র ভারতীয় ভাষা মারাঠীতে গীতার উপর দুইটি প্রসিদ্ধ টীকা আছে - (i) মহারাষ্ট্রের ধর্মগুরু জ্ঞানেশ্বর-রচিত, (ii) বালগঙ্গাধর তিলক-কৃত 'গীতারহস্য'
তিলকের 'গীতারহস্য' এবং শ্রীঅরবিন্দের 'গীতানিবন্ধনিচয়' বর্তমান যুগের দুইটি শ্রেষ্ঠ ভাষ্য । উভয় ভাষ্যই বাংলা ও হিন্দী প্রভৃতি ভাষায় অনূদিত হইয়াছে ।
বর্ণানুক্রমে টীকাকারগণ :-
অভিনব গুপ্ত ও নৃসিংহ ঠাকুরের 'ভগবদ্গীতার্থ-সংগ্রহ'
আনন্দগিরি - 'গীতা-ভাষ্য-বিবেচন', 'গীতাশয়'
কল্যাণভট্ট - 'রসিক-রঞ্জিনী'
কেশবকাশ্মীরী (নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের) - 'গীতা-তত্ত্ব-প্রকাশিকা'
কৈবল্যানন্দ সরস্বতী - 'ভগবদ্গীতা-সার'
কৃষ্ণ-ভট্ট বিদ্যাধিরাজ (মধ্বাচার্যের শিষ্য, চতুর্দশ শতাব্দী) - 'গীতা টীকা'
গোকুলচন্দ্র - 'ভগবদ্গীতার্থ-সার'
গৌরগোবিন্দ রায় (ব্রাহ্ম সমাজের) - 'গীতা-প্রপূর্তি'
নরহরি - 'ভগবদ্গীতা-সার-সংগ্রহ'
নীলকণ্ঠ (গোবিন্দ সূরির পুত্র) - 'ভাবদীপিকা'
প্রত্যক্ষ দেবজটাচার্য - ''ভগবদ্গীতার্থ-সংগ্রহ-টীকা'
বলদেব বিদ্যাভূষণ - 'গীতা-ভূষণ-ভাষ্য'
বল্লভাচার্য - 'গীতার্থ-বিবরণ'; তৎপুত্র-কৃত 'গীতাতাৎপর্য'
বাদিরাজ - 'ভগবদ্গীতা-লক্ষাভরণ'
বিঠ্ঠল দীক্ষিত - 'ভগবদ্গীতা-হেতু-নির্ণয়'
বিশ্বনাথ চক্রবর্তী - 'সারার্থবর্ষিণী'
জগদ্ধর - 'ভগবদ্গীতা-প্রদীপ'
জয়রাম - 'গীতাসারার্থ-সংগ্রহ'
দত্তাত্রেয় - 'প্রবোধ-চন্দ্রিকা'
মথুরানন্দ -'ভগবদ্গীতাপ্রকাশ'
মধুসূদন সরস্বতী - 'গূঢ়ার্থদীপিকা' (শব্দের সরলার্থ সহ)
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী - গুজরাটীতে গান্ধীভাষ্য
রাঘবেন্দ্র স্বামী (সুধীন্দ্র যতির শিষ্য, সপ্তদশ শতাব্দী) - 'গীতা-বিবৃতি', 'গীতা-সংগ্রহ', 'গীতার্থ-বিবরণ'
রাজানক (শৈবমতাবলম্বী) ও রামকণ্ঠ-কৃত 'সর্বতোভদ্র'
শ্রীধরস্বামী - 'সুবোধিনী'
শ্রীমৎ হনুমান্-কৃত গীতার 'পৈশাচভাষ্য'
শ্রীপুরুষোত্তম - 'অমৃত-তরঙ্গিণী'
সদানন্দ ব্যাস - 'ভাব-প্রকাশ'
সূর্যপণ্ডিত -'পরমার্থপ্রপা'
এতদ্ব্যতীত নিম্বার্ক, শঙ্করানন্দ, বিজ্ঞানভিক্ষু, কেশব ভট্ট, ব্রহ্মানন্দ গিরি, রামকৃষ্ণ, মুকুন্দদাস, রামনারায়ণ, অর্জুন মিশ্র, জনার্দন ভট্ট, দেববোধ, দেবস্বামী, নন্দকিশোর, নারায়ণ সর্বজ্ঞ, পরমানন্দ ভট্টাচার্য, যজ্ঞনারায়ণ, রত্নগর্ভ, লক্ষণ ভট্ট, শ্রীনিবাসাচার্য, বিমল বোধ, মধ্য মন্দির, বরদরাজ ব্যাসতীর্থ, সত্যাভিনব যতি, কৃষ্ণাচার্য, বিদ্যাধিরাজ, জয়রাম জয়তীর্থ, বৈশম্পায়ন, আজ্ঞেশ্বরপাল প্রমুখ অনেকেই গীতার উপর টীকাদি লিখিয়াছেন ।
6) গীতার ঐতিহাসিক সমালোচনা
6.1) গীতা মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত ?
আধুনিক পণ্ডিতগণ বাইবেলের ন্যায় গীতারও উচ্চতর বা ঐতিহাসিক সমালোচনা (higher or historical criticism) করিয়াছেন । জার্মান পণ্ডিত গার্বে সর্বপ্রথম গীতার ঐতিহাসিক সমালোচনা ও গবেষণা আরম্ভ করেন । ইনিই প্রথম জার্মান ভাষায় গীতার অনুবাদও প্রচার করিয়াছেন । উক্ত সমালোচনার স্থলে টালবয়েজ হুইলার, ডাঃ সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত প্রমুখ পণ্ডিতগণ বলেন যে, গীতা একখানি স্বতন্ত্র গ্রন্থ এবং মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত । গার্বের শিষ্য জার্মান সংস্কৃতজ্ঞ ডাঃ রুডল্ফ অটো গীতার উচ্চতর সমালোচনা করিয়া জার্মান ভাষায় যে বৃহৎ গ্রন্থ লিখিয়াছেন তাহার নাম 'The Original Gita'; বইখানি ইংরেজী ভাষায়ও অনুদিত হইয়াছে । অটো সাহেবের মতে গীতায় কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধ-বিষয়ক আখ্যায়িকা-অংশটি মহাভারতের প্রকৃত অংশ । এই আখ্যায়িকা-অংশ ১২৮টি শ্লোকের অনধিক, কিন্তু তিনি বলেন - ভক্তি, যোগ, জ্ঞান, কর্ম প্রভৃতি-সম্বন্ধীয় গীতার উপদেশগুলির পৃথক পৃথক গ্রন্থ এবং শ্রীকৃষ্ণের বাণীরূপে প্রচলিত করিবার উদ্দেশ্যেই মহাভারতের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে । সুতরাং এইগুলি প্রক্ষিপ্ত ।
6.2) গীতা মহাভারতের প্রকৃত অংশ
কিন্তু বালগঙ্গাধর তিলক এবং ডাঃ সর্বেপল্লী রাধাকৃষ্ণন এই বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেন । তাঁহারা বলেন, সমগ্র গীতাই মহাভারতের প্রকৃত অংশ । কারণ, প্রথমতঃ গীতা ও মহাভারতের অন্যান্য অংশের মধ্যে ভাষার নিকট সাদৃশ্য আছে এবং দ্বিতীয়তঃ মহাভারতের অন্যান্য পর্বে গীতার উল্লেখ আছে । ভীষ্মপর্বের ২৫ হইতে ৪২ অধ্যায়ই ভগবদ্গীতা । কিন্তু শান্তি ও অশ্বমেধ পর্বে এবং অন্যান্য বহু স্থলে ব্যাসদেব ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণের মুখ-নিঃসৃত ভগবদ্গীতার সুস্পষ্ট উল্লেখ করিয়াছেন । ইহা হইতে নিঃসংশয়ে প্রমাণিত হয় যে, গীতা মহাভারতের প্রকৃত অংশ, প্রক্ষিপ্ত নহে । অটো সাহেবের পক্ষে কোন বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ এপর্যন্ত পাওয়া যায় নাই ।
7) গীতার শ্লোকসংখ্যা
গীতার শ্লোকসংখ্যা-সম্বন্ধে বিভিন্ন মত আছে । গীতার শ্লোকসংখ্যা সাত শত বলিয়াই এতকাল পাঠকসাধারণ অবগত আছেন । শঙ্করাচার্য হইতে আরম্ভ করিয়া করিয়া অদ্যাবধি সকল ভাষ্যকার, টীকাকার ও ব্যাখ্যাকারই গীতার উক্ত শ্লোকসংখ্যা নির্বিবাদে গ্রহণ করিয়াছেন । কিন্তু বর্তমান যুগের আধুনিক গবেষণাসমূহের অভিনব আবিষ্কার এই যে, গীতার বর্তমান আকারটি অঙ্গহীন ও অসম্পূর্ণ এবং উহার শ্লোকসংখ্যা ৭৪৫, ৭০০ নহে । ব্যাসদেবের বাক্যই এই মতের প্রথম ও প্রধান সমর্থক :-
7.1) ব্যাসদেবের মত
শ্রীকৃষ্ণকথিত শ্লোক ৬২০ + অর্জুনকথিত শ্লোক ৫৭ + সঞ্জয়কথিত শ্লোক ৬৭ + ধৃতরাষ্ট্রকথিত শ্লোক ১ = ৭৪৫ শ্লোকসংযুক্ত ব্যাসদেব কথিত গীতা [মহাভারত, ভীষ্মপর্ব, ৪৩|৭]
षट्शतानि सविंशानि श्लोकानां प्राह केशवः । अर्जुनः सप्तपञ्चाशत्सप्तषष्टिं तु सञ्जयः ॥ धृतराष्ट्रः श्लोकमेकं गीताया मानमुच्यते । [Mahabharata, Bhisma Parva, 43|4]
ষট্শতানি সবিংশানি শ্লোকানাং প্রাহ কেশবঃ । অর্জুনঃ সপ্তপঞ্চাশৎসপ্তষষ্টিং তু সঞ্জয়ঃ ॥ ধৃতরাষ্ট্রঃ শ্লোকমেকং গীতায়া মানমুচ্যতে । [মহাভারত, ভীষ্মপর্ব, ৪৩|৪]
শ্রীকৃষ্ণকথিত শ্লোক ৫৭৫ + অর্জুনকথিত শ্লোক ৮৪ + সঞ্জয়কথিত শ্লোক ৪০ + ধৃতরাষ্ট্রকথিত শ্লোক ১ = ৭০০ শ্লোকসংযুক্ত প্রচলিত গীতা
7.2) শ্রীচৈতন্যদেবের মত
শ্রীচৈতন্যদেব তাঁহার প্রিয়শিষ্য গদাধরের লিখিত গীতায় নিজহস্তে শ্লোকসংখ্যার মান লিখিবার সময় মহাভারতের উক্ত শ্লোকটি উদ্ধৃত করিয়াছিলেন । মহাপ্রভুর এই পুঁথি এখনও ভরতপুরে (মুর্শিদাবাদ) গদাধরের শ্রীপাটে রক্ষিত আছে এবং ইহা লইয়া আলোচনাও হইয়াছে ।
7.3) প্রাচীন হস্তলিখিত পুঁথি
কাথিয়াবাড়স্থ গণ্ডাল স্টেটের রাজবৈদ্য জীবরাম কালিদাস শাস্ত্রী সুরাট ও কাশী হইতে দুইটি প্রাচীন ভূর্জপত্রে হস্তলিখিত পুঁথি সংগ্রহ করিয়াছেন যাহা পুস্তকাকারে গণ্ডাল রসশালা ঔষধাশ্রম হইতে প্রকাশিত হইয়াছে । ১১৭৯ খ্রীষ্টাব্দে লিখিত সুরাট থেকে সংগৃহীত গীতা অধিকাংশ স্থলে কাশ্মীরী গীতার অনুরূপ । ইহাতে প্রচলিত গীতা হইতে ২১টি নূতন ও অধিক শ্লোক এবং ২৫০টি পাঠান্তর পরিদৃষ্ট হয় । ১৬০৮ খ্রীষ্টাব্দে লিখিত কাশী থেকে সংগৃহীত গীতায় ৭৪৫টি শ্লোক আছে । এই গীতাদ্বয়ের প্রকাশের পর দেশি, বিদেশি গীতাবিদ্গণের মধ্যে গীতার শ্লোকসংখ্যা-সম্বন্ধে গভীর জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হইয়াছে । ৭৪৫টি শ্লোকসংযুক্ত গীতা ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও প্রকাশিত হইয়াছে, যদিও পাঠকসাধারণের ইহা অবিদিত ।
7.4) কাশ্মীরী গীতা
শ্রীনগর হইতে অভিনবগুপ্তাচার্যের টীকা-সম্বলিত যে কাশ্মীরী গীতার সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে তাহাতে ৭৪৫টি শ্লোক আছে । পুণার আনন্দাশ্রম হইতে প্রকাশিত ও রাজনক রামকবি-কৃত গীতার 'সর্বতোভদ্র' নামক টীকা এবং পুণার ভাণ্ডারকর ওরিয়েন্টাল ইন্সটিটিউট হইতে প্রকাশিত গীতাও কাশ্মীরী গীতাকেই অনুসরণ করিয়াছে । কাশ্মীরী গীতা হস্তলখিত পুঁথির আকারে বহু শতাব্দী যাবৎ প্রচলিত ছিল; এমন কি, শঙ্করাচার্যের সময়েও ছিল ।
7.5) শঙ্করাচার্যের মত
কিন্তু দক্ষিণ ভারতে কাশ্মীরী গীতার প্রচার ছিল না বলিয়া সম্ভবতঃ উহা শঙ্করাচার্যের দৃষ্টিগোচর হয় নাই । সেই যুগে এখনকার মতো যাতায়াতের, মুদ্রাযন্ত্রের বা ডাকের কোন সুবিধা না থাকায় এক প্রদেশের হস্তলিখিত পুঁথি অন্য প্রদেশে তেমন যাতায়াত করিতে পারিত না । তাই শঙ্করাচার্য গীতার শ্লোকসংখ্যা সাত শত বলিয়াই গ্রহণ করিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয় । যাহার ফলে তাঁহার পরবর্তী ভাষ্যকার ও টীকারগণও এই শ্লোকসংখ্যার পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করিতে সাহসী হন নাই । কিন্তু তিনিও তাঁহার ভাষ্যে ১|১ শ্লোকের কোন উল্লেখ করেন নাই ও ১৩|১ শ্লোকও অব্যাখ্যাত রাখিয়াছেন । অর্থাৎ তিনিও উক্ত শ্লোকদ্বয় গ্রহণ করেন নাই ।
শঙ্করাচার্যের পূর্বেও ৭৪৫ শ্লোকযুক্ত গীতার উপর বহু টীকা ছিল । কিন্তু মধ্যযুগে ধর্মান্ধ মুসলমানদিগের হাতে সংস্কৃত সাহিত্যের যে দুর্গতি হইয়াছিল তাহার ফলে অধিকাংশ হস্তলখিত পুঁথি বিনষ্ট হইয়াছে ।
7.6) শুদ্ধ ধর্মমণ্ডল গীতা
মাদ্রাজের শুদ্ধ ধর্মমণ্ডল হইতে যে গীতা মুদ্রিত হইয়াছে তাহার শ্লোকসংখ্যাও ৭৪৫ । তবে উক্ত গীতাতে প্রচলিত গীতা হইতে ৩৭টি শ্লোক বাদ দিয়া মহাভারতের উদ্যোগ, অনুশাসন ও শান্তিপর্ব হইতে ৮২টি শ্লোক যথেচ্ছভাবে গ্রহণপূর্বক গীতার শ্লোকসংখ্যাও ৭৪৫ করা হইয়াছে । এতদ্ব্যতীত এই গীতায় ২৬টি অধ্যায় আছে । আদ্য ও অন্ত্য অধ্যায়ের বিশেষ নাম এবং অবশিষ্ট ২৪টি অধ্যায়ের প্রত্যেকটিতে ২৪টি শ্লোক আছে ।
7.7) আলবেরুনির মত
একাদশ শতকে বিখ্যাত মুসলমান ঐতিহাসিক আলবেরুনি তাঁহার আরবী গ্রন্থে গীতার শ্লোকসংখ্যা সাত শতের অধিক ধরিয়াছেন । তিনি নিজেও সংস্কৃতবিদ্ ছিলেন এবং তাঁহার গ্রন্থে যে সকল শ্লোক উদ্ধার করিয়াছিলেন তাহা প্রচলিত গীতায় নাই ।
7.8) ফারসী ও আরবী অনুবাদ
সম্রাট্ আকবরের মন্ত্রী আবুল ফজল এবং তাঁহার ভ্রাতা ফৈজী গীতার যে দুইটি ফারসী অনুবাদ করিয়াছিলেন তাহার একটিতে স্পষ্ট উল্লিখিত আছে - 'সম্রাটের আদেশে গীতার ৭৪০ শ্লোকের ফারসী অনুবাদ সমাপ্ত হইল ।' গীতার আবুল ফজল-কৃত ফারসী অনুবাদ লণ্ডনস্থিত ইণ্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে অদ্যাপি রক্ষিত আছে । ফৈজীকৃত ফারসী অনুবাদ লাহোর, এলাহাবাদ, জয়পুর ও জলন্ধর প্রভৃতি স্থান হইতে বহুবার মুদ্রিত হইয়াছে । শাহ আলি দাস্তগীর-কৃত গীতার ফারসী অনুবাদের হস্তলিখিত পুঁথি কাশী মহারাজার গ্রন্থাগারে আজও রক্ষিত আছে । মোগল সম্রাটগণের আমলে গীতার একটি আরবী তর্জমা হইয়াছিল । তদুনাযায়ীও গীতার শ্লোকসংখ্যা ৭৪৫ ।
8) গীতার বিবিধ ভারতীয় ব্যাখ্যা
প্রত্যেক ভাষ্যকার ও টীকাকার স্ব স্ব ধর্মমত অনুযায়ী গীতার ব্যাখ্যা করিয়াছেন । বৃত্তিকার বোধায়নের মতে জ্ঞান ও কর্মের সমুচ্চয়ই গীতার প্রতিপাদ্য; পৃথগ্ভাবে কোনটাই মোক্ষদায়ক নহে ।
8.1) অদ্বৈতবাদ
শঙ্করাচার্য সমুচ্চয়বাদ খণ্ডনপূর্বক অদ্বৈতবেদান্তানুযায়ী গীতাভাষ্য লিখিয়াছেন । তিনি বলেন, 'গীতার সিদ্ধান্ত এই যে, কেবলমাত্র তত্ত্বজ্ঞানেই মুক্তিলাভ হয়, জ্ঞান ও কর্মের সমুচ্চয়ের ফলে নহে ।' তাঁহার মতে ব্রহ্মাত্মৈক্যদর্শনরূপ জ্ঞান দ্বারা অজ্ঞান বিনাশপূর্বক নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি, ব্রাহ্মীস্থিতি বা ব্রহ্মনির্বাণলাভই গীতার উপদেশ । অজ্ঞানই দ্বৈতভাব-উৎপাদক । এই দ্বৈতভাব হইতেই সকল কর্ম হয় । দ্বৈতভাব-নাশান্তে নিষ্ক্রিয় আত্মায় প্রতিষ্ঠিত হইলেই সর্বকর্মসন্ন্যাস হয় । নিষ্কাম কর্মের দ্বারা চিত্ত শুদ্ধ হইলে মেঘমুক্ত সূর্যের ন্যায় আত্মজ্ঞান প্রকাশিত হয় । আত্মজ্ঞানলাভ হইলে নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি অর্থাৎ কর্মত্যাগ হয় । মধুসূদন সরস্বতী, আনন্দগিরি, শঙ্করানন্দ প্রভৃতি বহু টীকাকার শঙ্করের পদানুবর্তী ।
8.2) বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ
রামানুজাচার্য স্বীয় গুরু যামুনাচার্যের মতই তাঁহার গীতাভাষ্যে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করিয়াছেন । তাঁহার মতে জীব (চিৎ), জগৎ (অচিৎ) ও ব্রহ্ম - এই তিনটি তত্ত্ব স্বতন্ত্র হইলেও ব্রহ্ম জগৎ ও জীববিশিষ্ট । তাঁহার মতে ব্রহ্মের সঙ্গে জীব ও জগতের স্বজাতীয় ও বিজাতীয় ভেদ না থাকিলেও স্বগতভেদ অবশ্য স্বীকার্য । তাঁহার দার্শনিক মত বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ ও তিনি ভক্তিধর্মের প্রচারক । তিনি বলেন, 'বর্ণাশ্রমধর্ম অবশ্য পালনীয় ।' কারণ সকল শাস্ত্র এই বিষয়ে একমত - 'একশাস্ত্রার্থতয়ানুষ্ঠেয়ম্' । ফলাকাঙ্ক্ষা বিসর্জন করিয়া ঈশ্বরকে প্রসন্ন করিবার জন্য বর্ণাশ্রমধর্ম অনুষ্ঠিত হইলে 'ভাবসংশুদ্ধি' হয় এবং মানুষ জ্ঞানের অধিকারী হয় ।
8.3) দ্বৈতবাদ
দ্বৈতবাদী ও ভক্তিমার্গের আচার্য মধ্বাচার্য মায়াবাদ খণ্ডনপূর্বক পরব্রহ্মের সহিত জীবসমূহের নিত্য ভেদ প্রতিষ্ঠা করেন । বল্লভাচার্যের মতে ব্রহ্ম ও মুক্ত জীব মূলতঃ অভেদ হইলেও জীব ব্রহ্মের অংশ, মায়া ঈশ্বরের শক্তিমাত্র, জগৎপ্রপঞ্চ মিথ্যা নহে এবং ভগবৎকৃপাই তাঁহাকে লাভ করিবার একমাত্র পন্থা ।
8.4) দ্বৈতাদ্বৈতবাদ
দ্বৈতাদ্বৈতবাদী নিম্বার্কের মতে জীবসমূহ ও জগৎ সূক্ষরূপে ঈশ্বরের বিরাট শরীরে অবস্থিত ।
8.5) অন্যান্য ব্যাখ্যা
জ্ঞানেশ্বর পাতঞ্জল যোগকেই গীতার শিক্ষা বলিয়া ব্যাখ্যা করিয়াছেন ।
অভিনবগুপ্তের মতে গীতা আধ্যাত্মিক অর্থে পরিপূর্ণ । তিনি বলেন, ধর্মক্ষেত্র শব্দের অর্থ নবদ্বারবিশিষ্ট দেহ, মামকাঃ শব্দের অর্থ প্রজ্ঞালব্দ চিন্তা; ধৃতরাষ্ট্র, কৌরবগণ ও পাণ্ডবগণ কাল্পনিক বস্তু, জড়দেহবান ব্যক্তি নহেন ।
মধুসূদন সরস্বতীর 'গূঢ়ার্থদীপিকা' নামক পঞ্চদশ শতাব্দীতে রচিত গীতার টীকা পণ্ডিত ভূতনাথ সপ্ততীর্থ কর্তৃক বাংলায় অনূদিত হইয়াছে । তাঁহার মতে বেদের যেমন কর্ম, উপাসনা ও জ্ঞান - এই কাণ্ডত্রয় আছে, অষ্টাদশাধ্যায়ী গীতা তেমনি কাণ্ডত্রয়াত্মিকা । উহার ১ম ষট্কে জীবের স্বরূপ (ত্বং পদার্থ = জীবাত্মা), ২য় ষট্কে ব্রহ্মের স্বরূপ (তৎ পদার্থ = পরমাত্মা) ও ৩য় ষট্কে জীব(ত্বং) ও ব্রহ্মের(তৎ) অভেদতত্ত্ব (অসি = হও) প্রতিপন্ন হইয়াছে ।
তত্ত্বমসি = ত্বং + তৎ + অসি
(টীকাকারের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি : মধুসূদন শঙ্করপন্থী অদ্বৈতবাদী ও চৈতন্যদেবের সমসাময়িক ছিলেন । ফরিদপুর জেলার কোটালীপাড়া গ্রামে তাঁহার জন্ম হয় । ইনি সন্ন্যাসগ্রহণপূর্বক কাশীধামস্থ গোপাল মঠে বাস করিতেন । 'অদ্বৈতসিদ্ধি' নামক তাঁহার বেদান্তগ্রন্থ ভারত-বিখ্যাত ।)
ভাষ্যকার যামুনাচার্যের মতে গীতার প্রথম ছয় অধ্যায়ে ভক্তিলাভের উপায়স্বরূপ ভাগবত জ্ঞানের স্বরূপ নির্ণীত হইয়াছে; দ্বিতীয় ছয় অধ্যায়ে ভক্তি ও উপাসনা-সহায়ে লব্ধব্য ভাগবত স্বরূপ বর্ণিত এবং বাকি ছয় অধ্যায়ে পূর্বোক্ত বিষয়দ্বয়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যা ।
রামানুজের গুরু যামুন তাঁহার গীতাগ্রন্থে বলেন যে, নারায়ণই পরব্রহ্ম; একমাত্র ভক্তি দ্বারাই সেই নারায়ণকে প্রাপ্ত হওয়া যায়; স্বধর্মানুষ্ঠান, সম্যক শাস্ত্রজ্ঞান এবং তীব্র বৈরাগ্য দ্বারা ঈশ্বরভক্তি লাভ হয় ।
নিগমান্ত মহাদেশিকের মতে নিষ্কাম কর্ম পরোক্ষভাবে জ্ঞানোৎপত্তি দ্বারা এবং সাক্ষাৎভাবে আত্মানুভূতি-প্রদানে সমর্থ ।
শ্রীঅরবিন্দ পুরুষোত্তমবাদী । তাঁহার গীতাব্যাখ্যার মূল রচনা প্রথমে ইংরেজীতে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয় এবং পরে উহা বাংলা, হিন্দী প্রভৃতি ভাষায় অনূদিত হইয়াছে । গীতার পঞ্চদশ অধ্যায়ে যে পুরুষোত্তমযোগ বর্ণিত, তিনি তাহাই অবলম্বনপূর্বক স্বীয় দর্শন ব্যাখ্যা করিয়াছেন । তাঁহার মতে এই জীব ও জগৎ ক্ষর পুরুষ, কূটস্থা প্রকৃতি অক্ষর পুরুষ এবং এই উভয় পুরুষের অতীত যে ঈশ্বর তিনি উত্তম পুরুষ বা পুরুষোত্তম । 'পরমাত্মাই পুরুষোত্তমনামে শাস্ত্রে অভিহিত । সেই পরমাত্মা বিশ্বপ্রপঞ্চে প্রবিষ্ট ও পরিব্যাপ্ত ।' - [গীতা ১৫|১৭]
বালগঙ্গাধর তিলক বলেন - 'নিষ্কাম কর্মই গীতার ধর্ম; যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং পূর্ণ আত্মজ্ঞান সত্ত্বেও নিষ্কাম কর্ম অনুষ্ঠান ও প্রচার করিয়াছেন ।'
শ্রীধরস্বামী তাঁহার গীতার টীকায় জ্ঞানমিশ্রা ভক্তি প্রচার করিলেও জ্ঞান অপেক্ষা ভক্তির প্রাধান্য স্বীকার করিয়াছেন । তাঁহার মতে জ্ঞান ও ভক্তি স্বরূপতঃ এক হইলেও ভক্তিই মুক্তিদাত্রী ।
শ্রীবিশ্বনাথ চক্রবর্তীর মতে গীতাশাস্ত্র সর্ববেদ-তাৎপর্য-পর্যবসিতার্থ রত্ন দ্বারা অলঙ্কৃত; ইহার অষ্টাদশ অধ্যায়ে অষ্টাদশ বিদ্যা-পরিপূরিত । গীতার প্রথম ছয় অধ্যায়ে নিষ্কাম কর্মযোগ, দ্বিতীয় ছয় অধ্যায়ে ভক্তিযোগ এবং শেষ ছয় অধ্যায়ে জ্ঞানযোগ প্রদর্শিত । ভক্তিযোগ অতিশয় গূঢ় এবং কর্ম ও জ্ঞানের মূল কারণস্বরূপ; অতএব অতিশয় শ্রেষ্ঠ ও সর্ব দুর্লভ বলিয়া মধ্যবর্তী ছয় অধ্যায়ে সন্নিবিষ্ট । ভক্তিরহিত কর্ম ও জ্ঞান উভয়ই বৃথা । এইজন্য সাধকগণ কর্ম ও জ্ঞান উভয়কেই ভক্তিমিশ্রিত করিয়া সাধন করিতে বিধি প্রদান করিয়াছেন ।
(টীকাকারের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি : বিশ্বনাথ বৈষ্ণব ধর্মের আচার্য, চৈতন্যপন্থী এবং অচিন্ত্যভেদাভেদবাদী ছিলেন । তাঁহার মতে শ্রীরাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তির ভেদ-অভেদও অচিন্ত্য । ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে উনি নদীয়া জেলার কোন ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করেন । কোঙ্গলের শ্রীবর্ধন নামক স্থানে তৎপ্রতিষ্ঠিত মঠ অদ্যাপি বর্তমান । তিনি বহু সংস্কৃত গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন ।)
বলদেব বিদ্যাভূষণের মতে গীতোপনিষদে ঈশ্বর, জীব, প্রকৃতি, কাল ও কর্ম - এই পঞ্চ বিষয় বর্ণিত । তন্মধ্যে বিভুসংবিৎ ঈশ্বর, অণুসংবিৎ জীব, সত্ত্বাদিগুণত্রয়ের আশ্রয়রূপ দ্রব্য প্রকৃতি এবং ত্রিগুণশূন্য জড় দ্রব্য কাল । পুরুষত্বনিষ্পন্ন অদৃষ্টাদি শব্দবাচ্য কর্ম ইত্যাদি রূপে ঈশ্বরাদির লক্ষণ নিরূপিত হইয়াছে । তন্মধ্যে ঈশ্বরাদি চতুষ্টয় নিত্য বস্তু এবং জীবাদি চতুষ্টয় ঈশ্বর-বশীভূত । কর্ম প্রাগ্ভাবের ন্যায় অনাদি ও বিনাশী । সংবিৎস্বরূপ ঈশ্বর ও জীব উভয়েই সংবেত্তা (জ্ঞানাশ্রয়) ও অস্মদাদি-শব্দের প্রতিপাদ্য ।
(টীকাকারের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি : ব্রহ্মসূত্রের গোবিন্দভাষ্যের রচয়িতা বলদেব বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর সুযোগ্য শিষ্য । ইনিও চৈতন্যপন্থী এবং অচিন্ত্যভেদাভেদবাদী ছিলেন ।)
8.6) ত্যাগই গীতার বাণী
আত্মজ্ঞানলাভের পর কর্মসন্ন্যাসের প্রকৃষ্ট প্রমাণ শ্রীরামকৃষ্ণদেবের অভূতপূর্ব জীবন । কর্মত্যাগ হইবার পর তিনি 'গলিতহস্ত' হইলেন, আর তর্পণাদি কর্ম করিতে পারিলেন না । পরাভক্তি লাভ হইবার পর তিনি আর বিধিপূর্বক জগন্মাতার পূজা ও উপবীত ধারণ করিতে সম্পূর্ণ অক্ষম হইলেন । শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেন - "কয়েকবার 'গীতা' 'গীতা' উচ্চারণ করিলে যাহা হয় (অর্থাৎ ত্যাগী) তাহাই গীতার শিক্ষা ।" সকল কর্মের ফলাকাঙ্ক্ষা-ত্যাগই গীতার বাণী । 'একমাত্র ত্যাগের দ্বারা অনেকে অমৃতত্ব লাভ করিয়াছিলেন' - উপনিষদের এই মহতী বাণীই গীতায় বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যাত ।
জার্মান মনীষী গেটে বলিতেন, "তোমাকে সকল কর্ম এক সময় ত্যাগ করিতেই হইবে । এই সনাতন সঙ্গীত অনন্তকাল ধরিয়া আমাদের কর্ণে ধ্বনিত হইতেছে । সমগ্র জীবন প্রত্যেক ঘণ্টায় এই সঙ্গীত আমাদের কর্ণে প্রবেশ করিতেছে যদিও উহা আমরা শুনি না ।"
9) গীতার বৈদেশিক ব্যাখ্যা
গার্বে এবং হপ্কিন্স অনুমান করেন যে, অনেক লেখক বিভিন্ন শতাব্দীতে গীতায় স্ব স্ব রচনা সংযোজন করিয়াছেন । গার্বে বলেন, "গীতার মৌলিক আকারটি খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে সাংখ্যযোগের ভিত্তিতে রচিত, কিন্তু খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে পুনরায় উহা উপনিষদুক্ত অদ্বৈতবাদের গ্রন্থরূপে গৃহীত ও পরিবর্তিত হয় ।" গার্বে 'Indian Antiquary'-তে (December 1918) লিখিয়াছেন, 'গীতায় সগুণ ও নির্গুণ উপাসনাকে সমান স্থান দেওয়া হইয়াছে । উভয় উপাসনার কোনটিকে উচ্চ বা নীচ বলা হয় নাই । স্থানে স্থানে উভয়ের প্রভেদও অস্বীকৃত হইয়াছে । দুইটি মতের এইরূপ অপূর্ব সমন্বয় বা সামঞ্জস্যই গীতার বৈশিষ্ট্য ।' গার্বে আরও বলেন, "গীতোক্ত দার্শনিক তত্ত্বের সম্পূর্ণ ভিত্তি প্রায় সাংখ্যযোগের উপর প্রতিষ্ঠিত । সাংখ্যযোগই গীতায় প্রথম স্থান অধিকার করিয়াছে; দ্বিতীয় স্থান মাত্র বেদান্ত-কর্তৃক অধিকৃত । বেদান্ত শব্দটি 'বেদান্তকৃৎ'-রূপে মাত্র একবার গীতায় উক্ত [১৫|১৫] । কিন্তু সাংখ্য ও যোগের প্রায়শঃই উল্লেখ দৃষ্ট হয় । আর উপর্যুক্ত বেদান্ত শব্দটিও উপনিষদের অর্থে ব্যবহৃত । প্রাচীন ও নবীন দর্শনের অসমঞ্জস সমাবেশ গীতাতে দেখা যায় । বেদান্তের ধারাটি গীতায় আধুনিক, মৌলিক নহে । দার্শনিক বা ধর্মীয় যে দৃষ্টিতেই গীতাকে বিচার করা যায়, উপর্যুক্ত সিদ্ধান্ত সমীচীন মনে হয় ।"
হপ্কিন্স বলেন, "পরবর্তী কালের কোন বিষ্ণু-উপাসনা-মূলক উপনিষদ্কে কৃষ্ণভাবোদ্দীপক গ্রন্থে পরিণত করিয়া গীতা উৎপন্ন হইয়াছে ।" হোল্জমানের মতে কোন বেদান্ত-গ্রন্থকে বিষ্ণুভক্তি-প্রচারের উদ্দেশ্যে পরিবর্তিত করিয়া গীতা সৃষ্ট হইয়াছে । বেরিডেল কীথ বলেন, "শ্বেতাশ্বতরের ন্যায় গীতা পূর্বে একখানি উপনিষদ্ ছিল । পরে উহা কৃষ্ণোপাসনার গ্রন্থরূপে পরিবর্তিত ।" বার্নেটের ধারণা যে, গীতাকারের যত্নে বিভিন্ন ধর্মমত সুশৃঙ্খলভাবে সমঞ্জস হইয়াছিল । পল ডয়সন বলেন, "উপনিষদুক্ত অদ্বৈতবাদের অধঃপতনের যুগে গীতা এক বিকৃত সৃষ্টি । উক্ত যুগে আস্তিকতা ধীরে ধীরে নাস্তিকতায় পরিবর্তিত হইতেছিল ।" সেনেটের মতে স্বতঃসিদ্ধ বা স্বাভাবিক সমন্বয়সাধনই (spontaneous syncretism) গীতার মুখ্য উদ্দেশ্য । চার্লস জনস্টন বলেন, "ভগবদ্গীতা সেই বেদসরোবর, যাহার স্বচ্ছ ও শুদ্ধ সলিল ভারত-ভারতীর দারুণ সংঘর্ষের সঙ্গে যুগে যুগে ভারতেতিহাসরূপ অরণ্যের মধ্য দিয়া বেদরূপ হিমালয়ের অগম্য শৃঙ্গ হইতে প্রবাহিত ও সঞ্চিত ।"
10) গীতার প্রচার
ভারতে এবং ভারতেতর বহু দেশে গীতার খুব প্রচার হইয়াছে । বাংলা ভাষায় উহার অনেক অনুবাদ ও সংস্করণ হইয়াছে ও হইতেছে । এতদ্ব্যতীত মারাঠী, গুজরাটী, হিন্দী, উড়িয়া, আসামী, তেলেগু, তামিল, মালয়ালম্, কানাড়ী, মেবারী, মারোয়াড়ী, সিন্ধী, গুরুমুখী, উর্দু, খাসিয়া, ফারসী, গাড়োয়ালী, নেপালী প্রভৃতি ভারতের প্রায় সকল ভাষায় গীতার অসংখ্য অনুবাদ ও সংস্করণ হইয়াছে । গোরক্ষপুর গীতা প্রেস হইতে প্রকাশিত হিন্দী গীতার কয়েক লক্ষ খণ্ড বিক্রীত হইয়াছে ।
কলিকাতায় বাঁশতলা গলিস্থিত গীতা লাইব্রেরিতে এপর্যন্ত পৃথিবীর ছত্রিশটি ভাষায় গীতার যে পঁচিশ শতাধিক সংস্করণ হইয়াছে তাহার মধ্যে সাতাশটি ভাষায় প্রায় এগার শত সংস্করণের নমুনা-গীতা সংগৃহীত আছে । গীতা-প্রেমিকের এইগুলি অবশ্য দর্শনীয় ।
10.1) ইংরেজী অনুবাদ
রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী স্বরূপানন্দ, স্বামী পরমানন্দ, স্বামী প্রভবানন্দ ও স্বামী নিখিলানন্দ-কৃত গীতার ইংরেজী অনুবাদ দেশে ও বিদেশে বিশেষ খ্যাতিলাভ করিয়াছে । কোন কোন ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বামী স্বরূপানন্দের গীতা পাঠ্যপুস্তকরূপে নির্বাচিত হইয়াছে । স্বামী প্রভবানন্দ ইংরেজ কবি ক্রীস্টোফার ঈশারউডের সহযোগে গদ্যে ও পদ্যে গীতার ইংরেজী অনুবাদ করিয়াছেন । বিখ্যাত ইংরেজ মনীষী অলডাশ হাক্সলী ইহাতে একটি মনোজ্ঞ ভূমিকায় লিখিয়াছেন, 'জগতে যে সনাতন দর্শন আবিষ্কৃত হইয়াছে, উহার প্রাঞ্জলতম ও পূর্ণতম সংক্ষিপ্তসার গীতায় আছে । শুধু ভারতীয়গণের জন্য নহে, সমগ্র মানবজাতির জন্য উহার স্থায়ী মূল্য আছে । সনাতন দর্শনের সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক বিবৃতি ভগবদ্গীতা দিয়াছেন ।' মাদ্রাজ রামকৃষ্ণ মঠ হইতে উক্ত গীতার একটি ভারতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে ।
স্যার চার্লস্ উইলকিন্স-কৃত গীতার ইংরেজী অনুবাদ ১৭৮৫ খ্রীঃ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক লণ্ডন হইতে প্রকাশিত হয় । ইহাতে ব্রিটিশ ভারতের প্রথম গভর্ণর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস কর্তৃক লিখিত ভূমিকা আছে । ইহাই বিদেশীয় ভাষায় মূদ্রিত ও অনূদিত সর্বপ্রথম ভারতীয় গ্রন্থ ও গীতার প্রথম ইংরেজী অনুবাদ ।
এ্যানি বেসান্ত কর্তৃক অনূদিত ইংরেজী গীতার লক্ষাধিক কপি বিক্রীত হইয়াছে । এ ছাড়া স্যার এডুইন আরনল্ড-কৃত গীতার পদ্যানুবাদ; জন ডেভিস্, অধ্যাপক ফ্রাঙ্কলিন এডগার্টন, হোলডেন, এডোয়ার্ড সাম্ফশন, উইলিয়াম কিউ. জাজ, চার্লস্ জনস্টোন, রেভারেণ্ড আর. ডি. গ্রিফিথ, রাইডার এফ্. টী. ব্রুকস্, ই. ওয়াশবার্ণ হপ্কিন্স প্রভৃতি-কৃত গীতার ইংরেজি গদ্যানুবাদ বিশেষ প্রচলিত ।
10.2) অন্যান্য বিদেশী ভাষায় অনুবাদ
ফরাসী অনুবাদ : আন্না কামেস্কী, এমিল বার্ণফ, এ. এন্ডিউড শুল্ফ
জার্মান অনুবাদ : গদ্যে - রিচার্ড গার্বে, পল ডয়সন, লিওপল্ড ফন শ্রেডার; পদ্যে - ফ্রাঙ্ক হার্টম্যান ও থিওডর স্প্রিংম্যান
ল্যাটিন অনুবাদ : আগাস্টাস গিলেলমাস শ্লেগেল
ইটালিয়ান অনুবাদ : এন. ডি. ফ্লোরেন্স
সুইডিশ অনুবাদ : নিনো রুনেবার্গ, উইলিয়াম জাজ ও ফ্রাঞ্জ লেক্ষাউ
রাশিয়ান অনুবাদ : ম্যাঞ্জিয়ারলি ও কামেস্কী
ডাচ্ অনুবাদ : ল্যাবার্টন ও ডাঃ জে. ডবলিউ. বৈশেডাইন
স্পানিশ অনুবাদ : এ. ত্রিমিশভ ও জে. আর. বোরেল
বোহেমিয়ান অনুবাদ : ডাঃ এ. হটিম্যান
হাঙ্গেরিয়ান অনুবাদ : লেগ্রাডি ন্যম্দা কন্যুকিয়াডো
জাপানী অনুবাদ : অধ্যাপক জে. তাকাকুশু
তিব্বতী অনুবাদ : জনৈক লামা
10.3) বাংলায় অনুবাদ
রামদয়াল মজুমদার, দামোদর মুখোপাধ্যায়, দেবেন্দ্রবিজয় বসু, রাজেন্দ্রনাথ ঘোষ, কৃষ্ণানন্দ স্বামী, অবিনাশ শর্ম ও জগদীশচন্দ্র ঘোষ-কৃত গীতার বাংলায় অনুবাদ প্রসিদ্ধ । পণ্ডিত প্রমথনাথ, পণ্ডিত ভূতনাথ সপ্ততীর্থ ও পণ্ডিত পার্বতীচরণ যথাক্রমে গীতার শাঙ্করভাষ্য, গূঢ়ার্থদীপিকা ও সুবোধিনী টীকার বঙ্গানুবাদ করিয়া অমর হইয়াছেন । বাংলায় গীতায় বহু পকেট-সংস্করণ আছে ।
10.4) গীতার অন্যান্য প্রচার
শ্রীশ্রীচণ্ডীর ন্যায় গীতারও অখণ্ড পাঠ হইয়া থাকে । কোথাও কোথাও গীতার নিত্য পাঠ হয় । সুর-তান-লয়-যোগে বহুস্থানে গীতা গীত হয় । ইহার পাঠে মহাশান্তি ও স্বস্ত্যয়ন হয় । বিশ্বষতঃ বিশ্বরূপদর্শন (১১শ) অধ্যায় (যাহা ব্রহ্ম অধ্যায়রূপে বর্ণিত) শুচি, অশুচি, সর্বাবস্থায় পাঠ করা যায় । লাহোর, করাচি প্রভৃতি শহরে 'গীতা-হল্' নির্মিত হইয়াছিল । মহারাষ্ট্রে গীতার জ্ঞানেশ্বরী ব্যাখ্যা শুনিবার জন্য সহস্র সহস্র নরনারীর সমাগম হয় । বরোদা ও আমেদাবাদে যে বিশাল 'গীতা মন্দির' প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, তাহাতে গীতাদেবীর মূর্তি নিত্য পূজিত হয় । বাঙ্গালোরে জনৈকা স্ত্রীভক্ত গীতার সকল শ্লোক কাপড়ের উপর রেশমের সেলাই দ্বারা লিখিয়াছেন । উক্ত গ্রন্থখানি দেখিবার সৌভাগ্য আমাদের হইয়াছে । অনেক পণ্ডিত এখনও আছেন যাঁহাদের সমগ্র গীতা কণ্ঠস্থ । কোন কোন কলেজে গীতা পাঠ্যপুস্তকরূপে পঠিত হয় ।
11) গীতা ও উপনিষদাবলী
গীতা একটি উপনিষদ্ । প্রত্যেক অধ্যায়ের শেষে বেদ-ব্যাস গীতাকে উপনিষদ্ বলিয়াছেন । উপনিষদ্-তত্ত্বই গীতায় পত্রপুষ্পে শোভিত ও পরিবর্ধিত । উপনিষদ্রূপ গাভীসমূহের দুগ্ধই এই গীতামৃত [গীতার ধ্যান, ৪] । উপনিষদের নিগূঢ় নির্যাস শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের জন্য গীতামৃতরূপে পরিণত করিয়াছেন ।
উপনিষদ্সমূহের ন্যায় গীতাও কম্বুকণ্ঠে আত্মতত্ত্ব বা ব্রহ্মতত্ত্ব ঘোষণা করিয়াছেন । ব্রহ্মতত্ত্বের এমন সুললিত ও সহজবোধ্য ব্যাখ্যা অন্য কোন গ্রন্থে দেখা যায় না । শঙ্করাচার্য সেইজন্য তাঁহার উপনিষদ্ ও গীতার ভাষ্যে একই তত্ত্ব প্রচার করিয়াছেন । অদ্বৈতনিষ্ঠ প্রস্থানত্রয়ের মধ্যে গীতা অন্যতম ।
11.1) উপনিষদ্ এবং গীতার শ্লোকে সাদৃশ্য
উপনিষদের কয়েকটি শ্লোক গীতায় কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত আকারে পাওয়া যায় । উদাহরণস্বরূপ নিম্নে কিছু সমানার্থক শ্লোক উদ্ধৃত করা হইল । আরও সাদৃশ্যযুক্ত শ্লোক উদ্ধৃত করা যাইতে পারে । অতএব গীতাপাঠ করিলেই উপনিষদ্পাঠ হয় । গীতা উপনিষদের শ্রেষ্ঠ ভাষ্য ।
কঠোপনিষদের ১|২|১৫ : গীতার ৮|১১
কঠোপনিষদের ২|৭,১৫,১৮-১৯ : গীতার ৮|১১, ২|২০, ২|১৯
ঈশোপনিষদের ৫ : গীতার ১৩|১৬ ও ৬|২৯
মুণ্ডক উপনিষদের ২|১|২ : গীতার ১৩|১৫
11.2) গীতা এবং ব্রহ্মতত্ত্ব
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের অন্তে অর্জুন গীতার উপদেশ বিস্মৃত হওয়ায় পুনর্বার উহা প্রার্থনা করিলে ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ বলিয়াছিলেন - "যে ব্রহ্মতত্ত্ব তোমাকে পূর্বে যোগযুক্ত হইয়া বলিয়াছিলাম, তাহা সম্পূর্ণরূপে পুনরায় বলা অসম্ভব ।" [মহাভারত, অশ্বমেধ পর্ব, ১৬শ অধ্যায়]
বেদতুল্য গীতার ভাগবত বাণী নিত্য ও অপৌরুষেয় । গীতা পঞ্চম বেদ । গীতাতত্ত্ব ও বেদবাণী অভেদ । সেইজন্য স্বামী বিবেকানন্দ বলিয়াছেন যে, গীতা বেদের সর্বোত্তম ভাষ্য । গীতা ব্রহ্মযোগ-শাস্ত্র ও অদ্বৈতামৃতবর্ষিণী । ব্রহ্মবিদ্যাই গীতার প্রতিপাদ্য তত্ত্ব । গীতায় ব্রহ্মযোগ বিবৃত । ব্রাহ্মীস্থিতি বা ব্রহ্মনির্বাণ লাভ করা, গুণাতীত যোগারূঢ় বা স্থিতপ্রজ্ঞ হওয়াই গীতার উপদেশ ।
11.3) যুদ্ধক্ষেত্রে গীতা কিরূপে উপদিষ্ট হইল ?
ইহা অসম্ভব নহে । ইতিহাসে দৃষ্টান্ত আছে । রোমান সম্রাট্ মার্কাস্ অরেলিয়াস যে যুদ্ধে যাইয়া নিহত হন, সেই যুদ্ধে যাইবার পূর্বে তিনি তিন দিবস স্বীয় রাজধানীর বিদ্বদ্বর্গকে প্রাসাদে আহ্বানপূর্বক দর্শনালোচনা করিয়াছিলেন ।
12) গীতা ও ভাগবত
গীতা ও ভাগবতে একই তত্ত্ব উপদিষ্ট । উভয় গ্রন্থে একই অবতারের উপদেশ প্রবিবৃত । গীতার বক্তা কুরুক্ষেত্রের শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীমদ্ভাগবতে বৃন্দাবনের শ্রীকৃষ্ণের বাণী গ্রথিত । গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে এবং ভাগবতের একাদশ স্কন্ধে জ্ঞানযোগ বর্ণিত । গীতার দ্বাদশ অধ্যায়ে এবং ভাগবতের দশম স্কন্ধে ভক্তিযোগ বিবৃত । উভয় গ্রন্থেই সমানভাবে জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি ও যোগতত্ত্ব স্থান পাইয়াছে ।
"অব্যভিচারিণী ভক্তি দ্বারা ত্রিগুণাতীত হওয়া যায়" [গীতা ১৪|২৬]
"আত্মারাম মুনিগণ অহৈতকী ভক্তি লাভ করেন" [ভাগবত]
আবার গীতার ন্যায় ভাগবতেও আত্মতত্ত্ব উপদিষ্ট । ভাগবতের ১২শ স্কন্ধের শেষে শুকদেব রাজা পরীক্ষিৎকে আত্মজ্ঞানের উপদেশ দিতেছেন । ভাগবতের বেদস্তুতিতে আছে - "আত্মতত্ত্ব প্রকাশের জন্যই ভগবান্ মানবরূপে অবতীর্ণ হন ।" গীতার মতে যুগে যুগে অবতার আগমন করেন । ভাগবতেও উক্ত হইয়াছে 'অবতার অসংখ্য' ।
গীতায় শ্রীভগবান্ ভক্তকে সর্বধর্ম পরিত্যাগ পূর্বক তাঁহার শরণাগত হইবার জন্য উপদেশ দিয়াছেন [১৮|৬৬] । তদ্রূপ শ্রীমদ্ভাগবতেও আছে "সর্বপ্রযত্নে সকল প্রাণীর আত্মস্বরূপ আমার শরণাগত হও । তাহা হইলে আমার দ্বারা অকুতোভয় (সর্বত্র নির্ভয়) হইবে [১১|১২|১৫] ।" শরণাগতি দ্বারাই ভক্ত অভয় লাভ করেন । শ্রীশ্রীচণ্ডীর অন্তে মেধা ঋষিও রাজা সুরথকে ভবভয়নাশের জন্য পরমেশ্বরী ভগবতীর শরণাগত হইতে বলিতেছেন ।
13) গীতার উদারতা
গীতা সার্বজনীন ধর্মগ্রন্থ । গীতা সকল ধর্মের, সকল সম্প্রদায়ের, সকল শ্রেণীর ধর্মগ্রন্থ হইবার যোগ্য । গীতাশাস্ত্রে কোন 'গোড়ামি' বা সংকীর্ণতা স্থান পায় নাই ।
"যে যেভাবে আমায় আরাধনা করে, আমি সেই ভাবে তাহাকে কৃপা করি । সকল ধর্মপিপাসু মৎপথেই বিচরণ করিতেছে ।" [৪|১১]
"যাহারা ঈশ্বরের যে কোন রূপ শ্রদ্ধাপূর্বক অর্চনা করিতে ইচ্ছা করে, আমি তাহাদিগকে সেই মূর্তিতে ভক্তি ও বিশ্বাস প্রদান করি ।" [৭|২১]
"যাহারা শ্রদ্ধাযুক্ত হইয়া অন্য দেবতা উপাসনা করে, তাহারাও অবিধিপূর্বক আমারই উপাসনা করে ।" [৯|২৩]
এইরূপ সার্বজনীনতা ও উদারতা অন্য ধর্মগ্রন্থে দুষ্প্রাপ্য । ভগবানের অসংখ্য নাম ও অসংখ্য রূপ । তাঁহার যে কোন একটি নামে ও রূপে আমাদের নিষ্ঠা হইলেই মুক্তি করতলগত হইবে । নিষ্ঠাপূর্বক তাঁহার একটি নাম জপ ও একটি রূপ ধ্যান করিলেই মোক্ষলাভ হয় । অপরের ইষ্টকে শ্রদ্ধা করা ইষ্টনিষ্ঠার একটি প্রধান সাধন । অপরের ইষ্টকে অশ্রদ্ধা করা অনুচিত । কর্মযোগ, ভক্তিযোগ, রাজযোগ ও জ্ঞানযোগ প্রত্যেকটি অন্যনিরপেক্ষ স্বতন্ত্র মুক্তি-মার্গ, এই ভাবটি গীতার কয়েকটি শ্লোকে পরিস্ফুট হইয়াছে । স্বামী বিবেকানন্দ গীতার উক্ত বৈশিষ্ট্য মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিয়াছেন । রুচির বৈচিত্রহেতু ঋজু, কুটিল যে পথে মানুষ চলুক না কেন, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা থাকিলে সাধকের ঈশ্বরলাভ হইবেই । ভগবান্ শ্রীরামকৃষ্ণ তাই বলিতেন, "যত মত তত পথ" । এক-একটি ধর্মমত যে ঈশ্বরলাভের ভিন্ন ভিন্ন পথ, তাহা তিনি তাঁহার অভূতপূর্ব ও অলৌকিক জীবনে সাধন করিয়া দেখাইয়াছেন ।
14) গীতায় আত্মার অমরত্ব
কুরুক্ষেত্রে অর্জুন আত্মীয়বর্গকে যুদ্ধার্থে উপস্থিত দেখিয়া দুঃখিত হইলেন । তিনি স্বজনগণকে বিনাশপূর্বক রাজ্যলাভের ইচ্ছা ত্যাগ করিলেন । তখন শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের মৃত্যুভয় দূর করিবার জন্য তাঁহাকে আত্মার অমরত্ব শিক্ষা দিলেন । শ্রীভগবান্ বলিলেন - "এই নরপতিগণ ও আমরা পূর্বে ছিলাম না, বা পরে থাকিব না - ইহা সত্য নহে ।" অর্থাৎ আমরা ও ইহারা আত্মারূপে জন্মের পূর্বেও ছিলাম এবং মৃত্যুর পরেও থাকিব । আত্মার জন্ম নাই, মৃত্যু নাই; আত্মা অমর । মানুষ দেহমাত্র নহে । মানুষ আত্মাই । দেহের জন্ম বা মৃত্যু হয় । মৃত্যু আত্মাকে স্পর্শ করিতে পারে না । মৃত্যুতে স্থূল দেহের ধ্বংশ হয় মাত্র । "বস্ত্র জীর্ণ হইলে যেমন উহা পরিত্যাগ করিয়া আমরা নূতন বস্ত্র পরিধান করি, তেমনি আত্মা ভগ্ন ও জীর্ণ দেহ ত্যাগ করিয়া নূতন দেহ গ্রহণ করে [২|২২] ।" মৃত্যুর পরে পুনর্জন্ম হয়; পুনর্জন্ম দেহান্তরপ্রাপ্তি মাত্র । কৌমার, যৌবন ও জরার ন্যায় মৃত্যুও দেহের একটি অবস্থামাত্র । "আত্মাকে মৃত্যু বিনাশ করিতে পারে না, অস্ত্র ছেদন করিতে পারে না, অগ্নি দগ্ধ করিতে পারে না, জল সিক্ত করিতে পারে না এবং বায়ু শুষ্ক করিতে পারে না [২|২৩] ।" ইহাই গীতার প্রথম ও প্রধান শিক্ষা ।
আত্মার অমরত্বে বিশ্বাস করিলে অর্জুনের ন্যায় আমাদেরও মৃত্যুভয় বিদুরিত হইবে, শোক অন্তর্হিত হইবে । শ্রীমদ্ভাগবতের ১২শ স্কন্ধে শুকদেব রাজা পরীক্ষিৎকে মৃত্যুভয় দূর করিবার জন্য আত্মজ্ঞানের উপদেশ দিবার উদ্দেশ্যে বলিতেছেন, "আত্মা দেহ হইতে পৃথক্ । তুমি অমর আত্মা - এই জ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত মৃত্যুভীতি যাইবে না ।"
গ্রীসের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী সক্রেটিস আত্মজ্ঞান লাভ করিয়া মৃত্যুঞ্জয় হইয়াছিলেন । মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হইয়া শেষ জীবনে তিনি যখন কারাগারে আবদ্ধ ছিলেন, তখন তাঁহার জনৈক শিষ্য তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, "মৃত্যুর পর আপনার দেহ কিভাবে সৎকার করিব ?" সক্রেটিস তদুত্তরে বলিয়াছিলেন, "আমার দেহের সৎকার যেভাবে ইচ্ছা করিও, তবে ইহা নিশ্চিত জানিও যে, এই দেহ সক্রেটিস নহে ।"
জন্মের পূর্বে যে আমরা ছিলাম এবং মৃত্যুর পরেও থাকিব, বিনষ্ট হইব না - এই ধারণা আবালবৃদ্ধবনিতা সকলের হৃদয়ে বিদ্যমান । মন একটু অন্তর্মুখীন ও একাগ্র হইলেই উক্ত সত্য প্রতিভাত হয় । ইংলণ্ডের প্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক বার্ট্রাণ্ড রাসেল (Bertrand Russel) তাঁহার নবম বা দশমবর্ষীয় পুত্রকে খ্রীষ্টান ধর্মের একটি তত্ত্ব শিক্ষা দিবার উদ্দেশ্যে বলিলেন, "মিশরের পিরামিড যখন নির্মিত হয়, তখন তোমার অস্তিত্ব ছিল না । জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই তোমার অস্তিত্ব আসিয়াছে ।" (খ্রীষ্টানগণ জন্মান্তরে বিশ্বাসী নহেন ।) পুত্র পিতাকে জিজ্ঞাসা করিল, "সে (পুত্র) তখন কি করিতেছিল ?" পিতা তাহাকে বারবার বলা সত্ত্বেও বালক কিছুতেই তাহার জন্মের পূর্বের অনস্তিত্ব বিশ্বাস করিতে পারিল না । মানুষ দেহাতিরিক্ত আত্মা, সুতরাং কিরূপে এইরূপ বিশ্বাস করা সম্ভব ?
দেহবুদ্ধির প্রাবল্যহেতু আত্মবুদ্ধি সম্প্রতি অন্তর্হিত হইয়াছে । আত্মবুদ্ধি বৃদ্ধির সঙ্গেই ক্ষুধাতৃষ্ণা, জন্মমৃত্যু, জরাব্যাধি প্রভৃতি জড়ধর্মের অধীনতা দূর হয়; সকল দুর্বলতা, দূঃখ ও দৈন্য পলায়ন করে; মানব মৃত্যুঞ্জয় ও মহাবীর হয় ।
15) গীতায় অবতারবাদ
শ্রীমদ্ভাগবতের ন্যায় শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাও অবতারবাদ প্রচার করেন । সম্ভবতঃ সর্বপ্রথম গীতাতেই অবতার-তত্ত্ব সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যাত । গীতায় [৪|৭-৯] ভগবান্ স্বয়ং বলিয়াছেন -
"যখনই ধর্মের গ্লানি ও অধর্মের উত্থান হয় তখনই আমি অবতীর্ণ হই । সাধুরক্ষা, দুষ্টবিনাশ ও ধর্মস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে নরদেহ ধারণ করি ।"
অবতারে বিশ্বাস হইলে মুক্তিলাভ হয়, আর পুনর্জন্ম হয় না । শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাই বলিতেন, "অবতারে বিশ্বাস পূর্ণ জ্ঞানের লক্ষণ ।" মূঢ়গণই মনুষ্যতনুধারী ভগবানে বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারে না । অবতারবাদেই ধর্মের নিগূঢ় তত্ত্ব নিহিত ।
অবতার মায়ামনুষ্য । তিনি মায়াধীশ; জীবের ন্যায় মায়াধীন নহেন । তিনি যেন দেহবান্ হন, যেন জাত হন । অবতার নরদেহধারী ভগবান্ । দেহধারণকালে তিনি তাঁহার ভাগবতস্বরূপ বিস্মৃত হন না । অবতার দেব-মানব, 'নির্গুণ গুণময়', 'নিরঞ্জন নররূপধর' ।
দেবত্ব ও মানবত্বের অপূর্ব মিলন অবতারে দৃষ্ট হয় । ভক্তিতে মানবের অন্তর্নিহিত দেবত্ব প্রস্ফুটিত হয় । ঈশ্বর ও মানবের মিলনভূমি এই অবতার । অবতারকে দর্শন করিলেই ঈশ্বরদর্শন করা হয় । অবতারগণের জন্ম অলৌকিক; কারণ তাঁহারা জীবের ন্যায় কর্মাধীন নহেন । ঈশ্বরের নরলীলাই সর্বোত্তম । অবতারের লীলাস্মরণ, তাঁহার নামজপ ও তাঁহার মূর্তিধ্যানই ধর্মজীবনের প্রধান সাধন । এইজন্য ভগবান্ অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখাইলেন ।
নিরাকার, নির্গুণ ব্রহ্ম কিরূপে সাকার ও সগুণ হন, কিরূপে রক্তমাংসের শরীরে আবির্ভূত হন - এই গভীর রহস্য দুর্ভেদ্য । অবতারকে আশ্রয় করিলে ধর্মসাধন সহজ হইয়া যায় । বিশ্বরূপ দর্শনান্তে শ্রীকৃষ্ণে অর্জুনের ভগবদ্বুদ্ধি আসা মাত্র অর্জুনের মোহরাত্রি অতীত হইল । যীশুখ্রীষ্টের অবতারত্বে বিশ্বাস আসিতেই সল পলে পরিণত হইলেন । মানবের দেবত্ব এবং ভগবানের মানবত্ব প্রকটিত হয় অবতারবাদে । অবতারকে চিন্তা করিলেই ঈশ্বরকে চিন্তা করা হয় । বেদে অবতারবাদ ব্যক্ত হয় নাই । পরবর্তী যুগে ভক্তিধর্মের উৎপত্তির সঙ্গে অবতারবাদ উৎপন্ন হয় । পৃথিবীর প্রায় সকল ধর্মে উক্ত মত কোন-না-কোন প্রকারে বিকশিত হইয়াছে ।
16) গীতোক্ত কর্মযোগ
নিষ্কাম কর্মযোগই গীতার শ্রেষ্ঠ বাণী । বর্ণধর্ম ও আশ্রমধর্ম অনাসক্তভাবে পালন করিলে ভগবদ্দর্শন হয় । অনাসক্ত হইয়া কর্তব্য কর্ম করিলে ক্রমে ক্রমে চিত্তশুদ্ধি ও পরে জ্ঞান লাভ হয় ।
মহাভারতে [১২|১৮|৩১] অর্জুন বলিতেছেন - "যে অনাসক্ত বন্ধনহীন পুরুষ শত্রু-মিত্রে সমদর্শী এবং সক্তবৎ ব্যবহারশীল হন, তিনি মুক্ত । হে মহীপতে ইহাই গীতোক্ত মুক্তির আদর্শ ।"
যাজ্ঞবল্ক্য-স্মৃতিতে [৩|২০৪-০৫] সন্ন্যাসীর অবস্থা বর্ণনান্তে কথিত আছে, 'সত্যশীল, জ্ঞাননিষ্ঠ গৃহী সন্ন্যাসগ্রহণ না করিয়াও মুক্তিলাভ করেন ।'
গান্ধীজীর মতে গীতায় অনাসক্তিযোগ কথিত । অনাসক্তি যতই মনে দৃঢ়মূল হইবে, ততই চিত্ত শুদ্ধ হইবে, ততই আধ্যাত্মিক তত্ত্বের আস্বাদ পাওয়া যাইবে ।
গীতা কর্ম ত্যাগ করিতে উপদেশ দেন নাই; কর্মে অনাসক্তি, কর্মফলত্যাগই গীতার মহীয়সী বাণী । জগতের অন্য কোন ধর্মগ্রন্থ এত মুক্তকণ্ঠে এই অদ্ভুত তত্ত্ব প্রচার করেন নাই । সচন্দন পুষ্প ভগবানের চরণে অর্পণ করিলে যেমন পূজা হয়, তেমনি স্ব স্ব কর্ম ঈশ্বরে সমর্পণ করিলেও তাঁহার উপাসনা হয় । নিষ্কাম কর্মও এক প্রকার ঈশ্বরারাধনা ।
স্বামী বিবেকানন্দ বলিতেন, "বুদ্ধদেব ধ্যানের দ্বারা ও যীশুখ্রীষ্ট প্রার্থনার দ্বারা যে আধ্যাত্মিক অবস্থা ও দিব্যভাব লাভ করিয়াছিলেন, অনাসক্ত কর্মী নিষ্কাম কর্মের দ্বারাও সেই উচ্চাবস্থা লাভ করিবেন ।" তাই স্বামীজী কর্মসঙ্কুল বর্তমান যুগে নারায়ণজ্ঞানে জীবসেবা ধর্মের প্রধান অঙ্গরূপে প্রবর্তন করিলেন ।
চৈনিক ঋষি লাউৎজে (Laozi also Lao-Tzu or Lao-Tze) প্রাচীন চীনে wa wei wei বা নিষ্কাম কর্মযোগ শিক্ষা দিয়াছেন । লাউৎজে তাঁহার 'তাও তে-কিং' (Tao Te Ching) নামক জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থে বলেন - "অনাসক্ত মানবই জগতে পূর্ণ স্বাধীনতা ও শান্তি উপভোগ করিতে সমর্থ । তিনি জগতে বাস করিয়াও জগদতীত হন ।"
প্রসিদ্ধ ইংরেজ মনীষী অলডাশ্ হাক্সলী (Aldous Huxley) তাঁহার "Ends and Means" নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন যুগে প্রচলিত আদর্শ মানবের বহু সংজ্ঞা সমালোচনাপূর্বক এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন যে, গীতোক্ত অনাসক্ত মানবই আদর্শ পুরুষ । যিনি যত অনাসক্ত তিনি তত উন্নত ।
ফরাসী দেশের ভূতপূর্ব প্রধান মন্ত্রী ক্লেম্যান্সো (Georges Benjamin Clemenceau) বলিয়াছেন - গীতোক্ত কর্ম-কৌশল যদি জানিতাম তাহা হইলে আমার কর্ম-জীবন ধর্ম-জীবনে পরিণত হইত । খ্রীষ্টান সাধক ব্রাদার লরেন্স নিষ্কামভাবে পাচকের কর্ম করিয়াই সর্বত্র ঈশ্বরের অস্তিত্ব উপলব্ধি করিয়াছিলেন ।
ব্যাধগীতাতে আছে যে, ব্যাধ মাংসবিক্রয়রূপ স্বীয় বর্ণধর্ম অনাসক্তভাবে পালন করিয়াই আত্মজ্ঞান-লাভ করিয়াছিলেন । মহাভারতে দেখা যায়, অনাসক্তচিত্তে পতিসেবা দ্বারাই সতীসাধ্বী স্ত্রীর জ্ঞান-চক্ষু উন্মীলিত হইয়াছিল । অনাসক্তভাবে স্বধর্মপালনই শ্রেষ্ঠ সাধনা । সকল সময়ে সকল অবস্থায় অনাসক্তিতে প্রতিষ্ঠিত হইলে মানুষ পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় ।
17) বৌদ্ধধর্ম ও গীতা
ডাঃ রাধাকৃষ্ণনের মতে "গীতার প্রভাব পুরাকালে চীন ও জাপান পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছিল । মহাযান বৌদ্ধধর্মের প্রধান গ্রন্থদ্বয় 'মহাযানশ্রদ্ধোৎপত্তি' এবং 'সদ্ধর্মপুণ্ডরীক' গীতাতত্ত্বের নিকট গভীরভাবে ঋণী ।" হিন্দুধর্মে গীতা যে স্থান অধিকার করিয়াছে, বৌদ্ধধর্মে ধম্মপদও সেই স্থান পাইয়াছে । ধম্মপদ ও গীতার মধ্যে ভাবসাদৃশ পরিলক্ষিত হয় ।
17.1) যোগক্ষেম শব্দের ব্যবহার
যে ভক্ত অনন্যচিত্ত হইয়া নিরন্তর ঈশ্বরের উপাসনা করেন, ঈশ্বর স্বয়ং তাঁহার যোগক্ষেম বহন করেন [গীতা ৯|২২] ।
সেই সকল সতত চেষ্টাশীল এবং নিত্য দৃঢ়পরাক্রম ধ্যানিগণ পরম শান্তি (যোগক্খেমং)-রূপ নির্বাণ লাভ করেন [ধম্মপদ, অপ্পমাদো বগ্গো, ৩] ।
মন্দবুদ্ধিগণ শ্রেয় (যোগক্ষেমাদ্) অপেক্ষা প্রেয়কে বরণ করেন [কঠোপনিষদ, ১|২|২] ।
ব্রহ্মই যোগক্ষেমরূপে প্রাণাপানে অবস্থিত [তৈত্তিরীয় উপনিষদ, ৩|১০|২] ।
যোগক্ষেম শব্দটি গভীর অর্থপূর্ণ । যোগ অপ্রাপ্ত বস্তুর প্রাপ্তি এবং ক্ষেম প্রাপ্ত বস্তুর সংরক্ষণ । শঙ্করমতে যোগক্ষেম আহারাদি সকল প্রয়োজনীয় বস্তু । শ্রীধর শব্দটি 'মুক্তি' অর্থে ব্যাখ্যা করিয়াছেন । ধম্মপদ-মতে যোগক্খেমং=যোগক্ষেম=মুক্তি । শ্রীধর ও ধম্মপদ এক অর্থেই যোগক্ষেম শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন । শব্দটি অতি প্রাচীন, সম্ভবতঃ উপনিষৎ ও গীতা হইতে উহা ধম্মপদে গৃহীত ।
18) গীতায় যোগচতুষ্টয়ের সমন্বয়
গীতায় যে ধর্ম-সমন্বয় ধ্বনিত হইয়াছে, তাহা ধর্মেতিহাসে অপূর্ব । (নিষ্কাম) কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ ও রাজযোগ - এই চারটি অন্যনিরপেক্ষ মোক্ষমার্গের এরূপ অপূর্ব সমন্বয় অন্য শাস্ত্রে নাই । শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী - "যত মত তত পথ" গীতাতেই ব্যাখ্যাত । পূজ্যপাদ স্বামী জগদানন্দজী যখন আমার গীতাখানি সংশোধন করিতেছিলেন তখন তিনি গীতার এই সমন্বয়-সূত্রটি আমাকে ধরাইয়া দেন ।
18.1) নিষ্কাম কর্মযোগ দ্বারা মুক্তি
শ্রীভগবান অর্জুনকে বলিতেছেন [৩|১৯] - সেই হেতু সদা অনাসক্ত হইয়া কর্তব্য কর্ম অনুষ্ঠান কর । মানুষ অনাসক্ত হইয়া কর্ম করিলে পরম পদ প্রাপ্ত হয় ।
18.2) জ্ঞানযোগ দ্বারা মুক্তি
শ্রীভগবান বলিতেছেন [১২|৩-৪] - যাঁহারা ইন্দ্রিয়সমূহ সংযত করিয়া এবং সর্বত্র সমবুদ্ধি ও সদা সর্বভূতের হিতে রত হইয়া অক্ষর, অনির্দেশ্য, অব্যক্ত, সর্বব্যাপী, অচিন্ত্য, কূটস্থ, অচল, নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসনা করেন, তাঁহারা আমাকেই প্রাপ্ত হন ।
18.3) ভক্তিযোগ দ্বারা মুক্তি
শ্রীভগবান বলিতেছেন [১১|৫৪] - কেবলমাত্র অনন্যা ভক্তি দ্বারাই আমাকে স্বরূপতঃ জানিতে, প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ করিতে এবং আমাতে বিলয়রূপ মোক্ষলাভ করিতে ভক্তগণ সমর্থ হয় ।
18.4) রাজযোগ দ্বারা মুক্তি
শ্রীভগবান বলিতেছেন [৫|২৭,২৮] - বাহ্য বিষয় মন হইতে বাহির করিয়া দৃষ্টি ভ্রূযুগলের মধ্যে স্থির করিয়া নাসিকার মধ্যে বিচরণশীল প্রাণ ও অপান বায়ুর ঊর্ধ্ব ও অধোগতি রোধ করিয়া এবং ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধি সংযমপূর্বক ইচ্ছা, ভয় ও ক্রোধশূন্য হইয়া যে মুনি সর্বদা বিরাজ করেন তিনি জীবন্মুক্ত ।
19) গীতাকবচ
শ্রীশ্রীচণ্ডীর যেমন কবচ আছে, গীতারও তদ্রূপ কবচ আছে । যেমন দেবীকবচ পাঠান্তে চণ্ডীপাঠ বিহিত, সেইরূপ গীতাকবচ পাঠান্তে গীতাপাঠ করিতে হয় । বার্ণেল সাহেবের ক্যাটালগ [১১৪৬নং, ১৮৬ পৃঃ] অনুসারে তাঞ্জোরের মহারাজা সরফৌজির সরস্বতীমহল গ্রন্থাগারে তেলেগু অক্ষরে লিখিত পুঁথিতে একটি গীতাকবচ আছে ['শ্রীভারতী' পত্রিকায় - ২য় বর্ষ, ৭ম সংখ্যা - শ্রীজিতেন্দ্রনাথ বসু কর্তৃক প্রকাশিত] ।
যাহা ধারণ করিলে শত্রু-নিক্ষিপ্ত অস্ত্রশস্ত্রাদি হইতে আত্মরক্ষা করা যায়, তাহাকে কবচ বলে । যিনি গীতাতত্ত্বে প্রবেশ করিতে অগ্রসর হন, তাঁহার বাহ্য ও আভ্যন্তর নানা প্রবল শত্রু থাকে । ইহাদের আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষা করিবার জন্য গীতাকবচ অবশ্য ধারণীয় । গীতাকবচে ষড়ঙ্গ রক্ষা করিবার বিধি ও কৌশল বিশেষভাবে উল্লিখিত আছে । উক্ত কবচের বৈশিষ্ট এই যে, ইহাতে গীতার ছয়টি মূল শ্লোক উল্লিখিত ।
20) গীতামাহাত্ম্য
সাধারণতঃ দুইটি গীতামাহাত্ম্য দেখা যায় । তন্মধ্যে যেটি বৃহত্তর সেটি বৈষ্ণবীয় তন্ত্রসারে উক্ত । ইহাতে ৮৪টি শ্লোক আছে । স্বামী কৃষ্ণানন্দ কর্তৃক সম্পাদিত গীতায় উক্ত মাহাত্ম্য সানুবাদ প্রদত্ত । আর যেটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র এবং ২৩টি শ্লোকে সমাপ্ত, সেটি অনুবাদ সহিত এই গীতায় দেওয়া হইয়াছে । উক্ত মাহাত্ম্যটি কাহারো কাহারো মতে বরাহপুরাণোক্ত । বোম্বাই নির্ণয়সাগর প্রেস হইতে প্রকাশিত এবং বহুটিকাসমন্বিত গীতার মত এইরূপ । কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, উক্ত প্রেস হইতে প্রকাশিত বরাহপুরাণে এই গীতামাহাত্ম্য নাই । মহাভারতে এবং স্কন্দপুরাণে দুইটি গীতামাহাত্ম্য পাওয়া যায় । কিন্তু সেগুলি প্রচলিত নহে । হরি ওঁ ।
গীতার ধ্যান
হে জননী ভগবদ্গীতা, আপনি স্বয়ং ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণকর্তৃক অর্জুনকে কথিতা, প্রাচীন মহর্ষি ব্যাসদেবকর্তৃক মহাভারতের মধ্যে ভীষ্মপর্বে [২৫ হইতে ৪২ পর্যন্ত আঠার অধ্যায়ে] গ্রথিতা, অষ্টাদশ-অধ্যায়রূপিণী, অদ্বৈততত্ত্বরূপ-অমৃতবর্ষিণী ও সংসারনাশিনী ভগবতী, আমি আপনার ধ্যান করি । ১
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : প্রথম অধ্যায় – অর্জুনবিষাদযোগ
মামকাঃ পাণ্ডবাশ্চৈব কিমকুর্ব্বত সঞ্জয়।।১
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন -
আচার্যমুপসঙ্গম্য রাজা বচনমব্রবীৎ।।২।।
পশ্যৈতাং পান্ডুপুত্রাণামাচার্য মহতীং চমূম্ ।
ব্যূঢ়াং দ্রুপদপুত্রেণ তব শিষ্যেণ ধীমতা।।৩।।
গুরুদেব, আপনার ধীমান্ শিষ্য দ্রুপদপুত্র কর্তৃক ব্যুহবদ্ধ পাণ্ডবদিগের এই বিশাল সৈন্যদল দেখুন । ৩
নায়কা মম সৈন্যস্য সংজ্ঞার্থং তান্ ব্রবীমি তে।।৭।।
দে দ্বিজশ্রেষ্ঠ ! আমার সৈন্যমধ্যেও যে সকল প্রধান সেনানায়ক আছেন তাহাদিগকে অবগত হউন । আপনার সম্যক্ অবগতির জন্য তাহাদিগের নাম বলিতেছি । ৭
অশ্বত্থামা বিকর্ণশ্চ সৌমদত্তিস্তথৈব চ।।৮।।
নানাশস্ত্রপ্রহরণাঃ সর্বে যুদ্ধবিশারদাঃ।।৯।।
আমার জন্য জীবন ত্যাগে প্রস্তুত আরও অনেক নানাশস্ত্রধারী বীরপুরুষ আছেন । তাঁহার সকলেই যুদ্ধ বিশারদ । ৯
অপর্যাপ্তং তদস্মাকং বলং ভীষ্মাভিরক্ষিতম্ ।
পর্যাপ্তং ত্বিদমেতেষাং বলং ভীমাভিরক্ষিতম্ ।।১০।।
ভীষ্মকর্তৃক সম্যক্ রক্ষিত আমাদের সেনা অপরিমিত । আর ভীমকর্তৃক রক্ষিত পাণ্ডবদের সেনা পরিমিত (অপেক্ষাকৃত অল্প) । ১০
অয়নেষু চ সর্বেষু যথাভাগমস্থিতাঃ।
ভীষ্মমেবাভিরক্ষস্ত ভবন্তঃ সর্ব এব হি।।১১।।
তস্য সঞ্জনয়ন্ হর্ষং কুরুবৃদ্ধঃ পিতামহঃ।
সিংহনাদং বিনদ্যাচ্চৈঃ শঙ্খং দধ্মৌ প্রতাপবান্ ।।১২।।
ততঃ শঙ্খাশ্চ ভের্যশ্চ পণবানকগোমুখাঃ ।
সহসৈবাভ্যহন্যস্ত স শব্দস্তুমুলোহভবৎ।।১৩।।
ততঃ শ্বেতৈর্হয়ৈর্যুক্তে মহতি স্যন্দনে স্থিতৌ।
মাধবঃ পান্ডবশ্চৈব দিব্যৌ শঙ্খৌ প্রদ্ধমতুঃ।।১৪।।
পৌন্ড্রং দধ্মৌ মহাশঙ্খং ভীমকর্মা বৃকদরঃ।।১৫।।
নকুলঃ সহদেবশ্চ সুঘোষমণিপুষ্পকৌ।।১৬।।
শ্রীকৃষ্ণ পাঞ্চজন্য নামে শঙ্খ, অর্জুন দেবদত্ত নামক শঙ্খ এবং ভীম পৌণ্ড্র নামক মহাশঙ্খ বাজাইলেন । কুন্তীপুত্র রাজা যুধিষ্ঠির অনন্তবিজয় নামক শঙ্খ, নকুল সুঘোষ নামক শঙ্খ এবং সহদেব মণিপুস্পক নামক শঙ্খ বাজাইলেন । ১৫,১৬
কাশ্যশ্চ পরমেষ্বাসঃ শিখন্ডী চ মহারথঃ।
ধৃষ্টদ্যুম্নো বিরাটশ্চ সাত্যকিশ্চাপরাজিতঃ।।১৭।।
দ্রুপদো দ্রৌপদেয়াশ্চ সর্বশঃ পৃথিবীপতে।
সৌভদ্রশ্চ মহাবাহুঃ শঙ্খান্ দধ্মুঃ পৃথক্ পৃথক্।।১৮।।
স ঘোষো ধার্তরাষ্ট্রাণাং হৃদয়ানি ব্যদারয়ৎ।
নভশ্চ পৃথিবীং চৈব তুমুলোহভ্যনুনাদয়ন্ ।।১৯।।
অথ ব্যবস্থিতান্ দৃষ্ট্বা ধার্তরাষ্ট্রান্ কপিধ্বজঃ।
প্রবৃত্তে শস্ত্রসম্পাতে ধনুরুদ্যম্য পান্ডবঃ।
হৃষীকেশং তদা বাক্যমিদমাহ মহীপতে।।২০।।
সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে রথং স্থাপয় মেহচ্যুত।
যাবদেতান্নিরীক্ষেহহং যোদ্ধুকামানবস্থিতান্ ।।২১।।
কৈর্ময়া সহ যোদ্ধব্যমস্মিন্ রণসমুদ্যমে।।২২।।
ধার্তরাষ্ট্রস্য দুর্বদ্ধের্যুদ্ধে প্রিয়চিকীর্ষবঃ।।২৩।।
এবমুক্তো হৃষীকেশো গুড়াকেশেন ভারত।
সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে স্থাপয়িত্বা রথোত্তমম্।।২৪।।
উবাচ পার্খ পশ্যৈতান্ সমবেতান্ কুরূনিতি।। ২৫।।
শ্রীকৃষ্ণ কহিলেন -
"হে অর্জুন, সমবেত কুরুগণকে দেখ ।'' ২৪,২৫
আচার্যান্মাতুলান্ ভ্রাতৃন্ পুত্রান্ পৌত্রান্ সখীংস্তথা।
শ্বশুরান্ সুহৃদশ্চৈব সেনয়োরুভয়োরপি।। ২৬।।
তখন অর্জুন উভয় সেনার মধ্যেই অবস্থিত পিতৃব্যগণ, পিতামহগণ, আচার্য্যগণ, মাতুলগণ, ভ্রাতৃগণ, পুত্রগণ, পৌত্রগণ, মিত্রগণ, শ্বশুরগণ ও সুহৃদ্গণকে দেখিলেন । ২৬
তান্ সমীক্ষ্য স কৌন্তেয়ঃ সর্বান্ বন্ধুনবস্থিতান্।
কৃপয়া পরায়াবিষ্টো বিষীদন্নিদমব্রবীৎ।।২৭।।
সীদন্তি মম গাত্রাণি মুখং চ পরিশুষ্যতি।।২৮।।
বেপথুশ্চ শরীরে মে রোমহর্যশ্চ জায়তে।
গান্ডীবং স্রংসতে হস্তাৎ ত্বক্ চৈব পরিদহ্যতে।।২৯।।
ন চ শক্নোম্যবস্থাতুং ভ্রুমতীব চ মে মনঃ।
নিমিত্তানি চ পশ্যামি বিপরীতানি কেশব।।৩০।।
ন চ শ্রেয়োহনুপশ্যামি হত্বা স্বজনমাহবে।
ন কাঙ্ক্ষে বিজয়ং কৃষ্ণ ন চ রাজ্যং সুখানি চ।।৩১।।
কিং নো রাজ্যেন গোবিন্দ কিং ভোগৈর্জীবিতেন বা।
যেষামর্থে কাঙ্ক্ষিতং নো রাজ্যং ভোগাঃ সুখানি চ।।৩২।।
ত ইমেহবস্থিতা যুদ্ধে প্রাণাংস্ত্যক্তা ধনানি চ।
আচার্যাঃ পিতরঃ পুত্রাস্তথৈব চ পিতামহাঃ।।৩৩।।
মাতুলাঃ শ্বশুরাঃ পৌত্রাঃ শ্যালাঃ সম্বন্ধিনস্তথা।
এতান্ন হস্তুমিচ্ছামি ঘ্নতোহপি মধূসূদন।।৩৪।।
অপি ত্রৈলোক্যরাজ্যস্য হেতোঃ কিং নু মহীকৃতে।
নিহত্য ধার্তরাষ্ট্রন্নঃ কা প্রীতিঃ স্যাজ্জনার্দন।।৩৫।।
তস্মান্নার্হা বয়ং হস্তুং ধার্তরাষ্ট্রান্ সবান্ধবান্ ।
স্বজনং হি কথং হত্বা সুখিনঃ স্যাম মাধব।।৩৬।।
যদিও ইহারা আততায়ী (এবং আততায়ী শাস্ত্রমতে বধ্য), তথাপি এই আচার্য্যাদি গুরুজনকে বধ করিলে আমরা পাপভাগীই হইব । অতএব আমরা সবান্ধব ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদিগকে বধ করিতে পারি না; হে মাধব, স্বজন বধ করিয়া আমরা কি প্রকারে সুখী হইব ? ৩৬
যদ্যপ্যেতে ন পশ্যন্তি লোভোপহতচেতসঃ।
কুলক্ষয়কৃতং দোষং মিত্রদ্রোহে চ পাতকম্।।৩৭।।
কথং ন জ্ঞেয়মস্মাভিঃ পাপাদস্মান্নিবর্তিতুম্।
কুলক্ষয়কৃতং দোষং প্রপশ্যদ্ভির্জনার্দন।।৩৮।।
কুলক্ষয়ে প্রণশ্যন্তি কুলধর্মাঃ সনাতনাঃ।
ধর্মে নষ্টে কুলং কৃৎস্নমধর্মোহভিভবত্যুত।।৩৯।।
অধর্মাভিভবাৎ কৃষ্ণ প্রদুষ্যন্তি কুলুস্ত্রয়ঃ।
স্ত্রীষু দুষ্টাসু বার্ষ্ণেয় জায়তে বর্ণসঙ্করঃ।।৪০।।
পতন্তি পিতরো হ্যেষাং লুপ্তপিন্ডোদকক্রিয়াঃ।।৪১।।
বর্ণসঙ্কর, কূলনাশকারীদিগের এবং কূলের নরকের কারণ হয় । শ্রাদ্ধ-তর্পণাদি ক্রিয়ার লোপ হওয়াতে ইহাদের পিতৃপুরুষ নরকে পতিত হয় (সদ্গতিপ্রাপ্ত হয় না) । ৪১
দোষৈরেতৈঃ কুলঘ্নানাং বর্ণস্করকৈঃ।
উৎসাদ্যন্তে জাতিধর্মাঃ কুলধর্মাশ্চ শাশ্বতাঃ।।৪২।।
উৎসন্নকুলধর্মাণাং মনষ্যাণাং জনার্দন।
নরকে নিয়তং বাসো ভবতীত্যনুশুশ্রুম।।৪৩।।
অহো বত মহৎ পাপং কর্তুং ব্যবসিতা বয়ম্।
যদ্ রাজ্যসুখলোভেন হস্তুং স্বজনমুদ্যতাঃ।।৪৪।।
যদি মামপ্রতীকারমশস্ত্রং শস্ত্রপাণয়ঃ।
ধার্তরাষ্ট্রা রণে হন্যুস্তন্মে ক্ষেমতরং ভবেৎ।।৪৫।।
এবমুক্তার্জুনঃ সংখ্যে রথোপস্থ উপাবিশৎ।
বিসৃজ্য সশরং চাপং শোকসংবিগ্নমানসঃ।।৪৬।।
১) সঞ্জয়ের দিব্যচক্ষু প্রাপ্তি
যুদ্ধারম্ভের পূর্বে ব্যাসদেব অন্ধরাজকে যুদ্ধদর্শনার্থ দিব্যচক্ষু প্রদান করিতে চাহিলেন । ধৃতরাষ্ট্র তাহাতে অসম্মত হইয়া বলিলেন - আমি জ্ঞাতি-কুটুম্বের নিধন দেখিতে চাই না, আপনার তপঃপ্রভাবে যাহাতে যুদ্ধের সমস্ত বৃত্তান্ত যথাযথ শ্রবণ করিতে পারি, আপনি তাহাই করুন । তখন ব্যাসদেব রাজ-অমাত্য সঞ্জয়কে বর প্রদান করেন । সেই বরপ্রভাবে তিনি দিব্যদৃষ্টি লাভ করিয়া যুদ্ধাদি সন্দর্শন ও উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের বাক্যাদি-শ্রবণ ও মনোভাব সমস্ত পরিজ্ঞাত হইয়া ধৃতরাষ্ট্রের নিকট বর্ণনা করিয়াছিলেন । গীতার সমস্তই সঞ্জয়-বাক্য [মভাঃ|ভীঃ|১|২৪] । 'পরম যোগশক্তির আধার মহামুনি ব্যাস যে এই দিব্য চক্ষু সঞ্জয়কে দিতে সক্ষম ছিলেন, তাহা অবিশ্বাস করিবার কোনো কারণ দেখিতে পাই না' - শ্রীঅরবিন্দ ।
ধর্মক্ষেত্র - যুদ্ধক্ষেত্র কুরুক্ষেত্র
কুরুক্ষেত্র চিরকালই পরম পুণ্যভূমি বলিয়া পরিচিত । জাবাল উপনিষদে ও শতপথব্রাহ্মণে ইহাকে দেবযজন অর্থাৎ দেবতাদের 'যজ্ঞস্থান' বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে । ইহার প্রাচীন নাম সমন্তপঞ্চক । পরশুরাম একুশ বার পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করিয়া এই স্থানে পিতৃ-তর্পণ করিয়াছিলেন । দুর্যোধনাদির পূর্বপুরুষ বিখ্যাত কুরু রাজা এই স্থানে হল-চালনা করিয়া এই বর লাভ করিয়াছিলেন যে, যে-ব্যক্তি এই স্থানে তপস্যা করিবে অথবা যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করিবে, সে স্বর্গে গমন করিবে । তদবধিই ইহার নাম কুরুক্ষেত্র । প্রাচীন গ্রন্থাদীতে সর্বত্রই কুরুক্ষেত্রকে ধর্মক্ষেত্র বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে । বনপর্বের তীর্থযাত্রা পর্বাধ্যায়ে কুরুক্ষেত্রকে তিন লোকের মধ্যে শ্রেষ্ঠ তীর্থস্থান বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে; সুতরাং 'ধর্মক্ষেত্র' এই বিশেষণটি একান্ত সুসঙ্গত ও প্রয়োজনীয় ।
৩) 'আপনার ধীমান শিষ্য' - এ-কথাটি দুর্যোধন শ্লেষাত্মক ভাবেই ব্যবহার করিয়াছেন । আবার 'ধৃষ্টদ্যুম্ন' না বলিয়া 'দ্রুপদপুত্র' বলিয়া দ্রোণাচার্যের পূর্বশত্রুতা স্মরণ করাইয়া দিতেছেন ।
৫) কুন্তিভোজঃ পুরুজিৎ - একই ব্যক্তি, ইনি ভীমসেনাদির মাতুল । কুন্তিভোজ কৌলিক নাম ।
৬) মহারথ = যিনি একাকী দশ-সহস্র ধনুর্ধারীর সহিত যুদ্ধ করেন এবং যিনি শস্ত্রশাস্ত্রে প্রবীণ, তিনিই মহারথ ।
৮) সমিতিঞ্জয়ঃ = সমিতি(সংগ্রামে) জয় লাভ করে যে অর্থাৎ যুদ্ধজয়ী ।
সৌমদত্তিঃ = সোমদত্ত-পুত্র বিখ্যাত ভূরিশ্রবা ।
১০) পর্যাপ্ত = যাহা আয়ত্ত করা যায়, পরিমাণ করা যায় অর্থাৎ পরিমিত, সীমাবদ্ধ । অর্থান্তরে যথেষ্ট, সমর্থ ।
অপর্যাপ্ত = অপরিমিত, অসংখ্য । অর্থান্তরে অপ্রচুর, অসমর্থ ।
এই অনুবাদে প্রথম অর্থই গ্রহণ করে তাৎপর্য এইভাবে ব্যাখ্যা করা হইয়াছে - 'আমাদের সৈন্য অপরিমিত অর্থাৎ বৃহৎ, তাহাতে বীরশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম আমাদের সেনাপতি; আর উহাদের সৈন্য পরিমিত অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র, আর নগন্য ভীম উহাদের সেনাপতি - সুতরাং আমাদের জয় হইবে না কেন ?'
শ্রীধর স্বামীর টীকায় শেষোক্ত ব্যাখ্যাই আছে । এঁনার মতে, পরের শ্লোকে 'সকলে ভীষ্মকে রক্ষা করুন' এ-কথায় বুঝা যায় যে, দুর্যোধনের মনে কিছু ভয়ের উদ্রেক হইয়াছিল এবং তিনি নিজের সৈন্যবল অপ্রচুর বা অসমর্থ মনে করিতেছেন । কিন্তু দুর্যোধনের ভয় পাওয়ার কথা মহাভারতে কোথাও নাই । বরং ঠিক ইহার বিপরীত কথাই আছে [মভাঃ|উঃ|১-৬৯, মভাঃ|ভীঃ|৫১|৬|৯] যাহা হইতে বুঝা যায় যে সকলকে উৎসাহ-দানার্থই এ-সকল কথা বলা হইয়াছিল । এই কারণে লোকমান্য তিলক প্রমুখ অনেকে পূর্বোক্ত প্রথম অর্থই গ্রহণ করিয়াছেন ।
১১) 'সকলে ভীষ্মকে রক্ষা করুন' - দুর্যোধনের এই আশঙ্কার তাৎপর্য
ভীষ্ম সমরে অপরাজেয়, তথাপি তাঁহার জন্য দুর্যোধনের এত আশঙ্কা কেন ? দুর্যোধন পূর্বেই এই আশঙ্কা ব্যক্ত করিয়াছেন - 'ভীষ্ম একাই সসৈন্য পাণ্ডবকে বধ করিতে পারেন, কিন্তু তিনি শিখণ্ডীকে বধ করিবেন না, সুতরাং সকলে সতর্ক হইয়া সর্ব দিক হইতে ভীষ্মকে রক্ষা করিবেন, আমরা যেন জম্বুক-শিখণ্ডী দ্বারা অতর্কিতভাবে ভীষ্মসিংহকে বধ না করাই' [মভাঃ|ভীঃ|১৫|১৪-২০] ।
১৩) পণব = মৃদঙ্গ, আনক = ঢাক, গোমুখ = রণশঙ্খ; সেকালের বিউগ্ল্ (bugle) ছিল শঙ্খ ।
২৪) ভারত = দুষ্মন্ত-রাজার পুত্র ভরতের বংশধর, এখানে ধৃতরাষ্ট্র ।
গুড়াকেশেন = গুড়াকা (নিদ্রা, আলস্য), তাহার ঈশ, অর্থাৎ নিদ্রালস্যজয়ী, এখানে অর্জুন ।
হৃষীকেশঃ = হৃষীক ইন্দ্রিয়, তাহার ঈশ, অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গণের প্রভু, শ্রীকৃষ্ণ ।
৩৬) আততায়ী (assassin)
অগ্নিদো গরদশ্চৈব শস্ত্রপাণির্ধনাপহঃ । ক্ষেত্রদারাপহারী চ ষড়েতে আততায়িনঃ ।।
ছয়জন আততায়ী - (i)অগ্নিদ (যে ঘরে আগুন দেয়), (ii)গরদ (যে বিষ দেয়), (iii)বধার্থ অস্ত্রধারী, (iv)ধনাপহারী, (v)ভূমি-অপহারী ও (vi)দারা-হরণকারী ।
দুর্যোধনাদি প্রায় এ-সমস্ত কর্মই করিয়াছেন; সুতরাং তাহারা আততায়ী ।
Six types of assassin (who can be killed as per law) : one who (i)commits arson, (ii)gives poison, (iii)wields weapon to kill, (iv)steals wealth, (v)steals land, (vi)steals wife.
অর্থশাস্ত্রমতে (law) আততায়ী বধ্য [মনু|৮|৩৫০-৫১] । কিন্তু ধর্মশাস্ত্রমতে (morality) "অহিংসা পরমো ধর্মঃ', 'গুরুজনাদিরবধ্যঃ', 'ন পাপে প্রতিপাপঃ স্যাৎ' ইত্যাদি । অর্থশাস্ত্র হইতে ধর্মশাস্ত্র বলবৎ । সুতরাং আততায়ী হইলেও গুরুজনাদি-বধে পাপভাগী হইতে হইবে, ইহাই অর্জুনোক্তির মর্ম ।
৪২) বর্ণধর্ম = ব্রাহ্মণের অধ্যাপনাদি, ক্ষত্রিয়ের প্রজারক্ষাদি, বৈশ্যের কৃষি-বাণিজ্যাদি, শূদ্রের পরিচর্যাদি । (অর্জুন এস্থলে জাতিধর্ম ও বর্ণধর্ম সমার্থক রূপে ব্যবহার করিয়াছেন কিন্তু মানুষের জাতি তার জন্মের সহিত সম্পর্কিত আর শ্রীকৃষ্ণের বর্ণ মানুষের গুণের ও কর্মের সহিত সম্পর্কিত [গীতা|৪|১৩], uploader's comment ।) বর্ণ বনাম জাতি
কুলধর্ম = কৌলিক উপাসনা-পদ্ধতি ও আচার-নিয়মাদি ।
আশ্রমধর্ম = ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ, সন্ন্যাস ।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : দ্বিতীয় অধ্যায় - সাংখ্যযোগ
শ্রীভগবান্ বলিলেন -
হে পার্থ, কাতর হইও না । এইরূপ পৌরুষহীনতা তোমাকে শোভা পায় না । হে পরন্তপ ! তুচ্ছ হৃদয়ের দুর্বলতা ত্যাগ করিয়া (যুদ্ধার্থে) উত্থিত হও । ৩
অর্জুন বলিলেন -
মহানুভব গুরুজনদিগকে বধ না করিয়া ইহলোকে ভিক্ষান্ন-ভোজন করাও শ্রেয়ঃ । কেননা গুরুজনদিগকে বধ করিয়া ইহলোকে যে অর্থকাম ভোগ করিব তাহা তো (গুরুজনের) রুধির-লিপ্ত । ৫
আমরা জয়ী হই অথবা আমাদিগকে ইহারা জয় করুক, এই উভয়ের মধ্যে কোন্টি শ্রেয়স্কর তাহা বুঝিতে পারিতেছি না, - যাহাদিগকে বধ করিয়া বাঁচিয়া থাকিতে চাহি না, সেই ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রগণ সম্মুখে অবস্থিত । ৬
(গুরুজনদিগকে বধ করিয়া কিরূপে প্রাণ ধারণ করিব এইরূপ চিন্তাপ্রযুক্ত) চিত্তের দীনতায় আমি অভিভূত হইয়াছি; প্রকৃত ধর্ম কি এ সন্বন্ধে আমার চিত্ত বিমূঢ় হইয়াছে; যাহা আমার ভাল হয়, আমাকে নিশ্চিত করিয়া তাহা বল, আমি তোমার শিষ্য, তোমার শরণাপন্ন, আমাকে উপদেশ দাও । (আমাকে আর তুমি সখা বলিয়া মনে করিও না, আমি তোমার শিষ্য) । ৭
পৃথিবীতে নিষ্কন্টক সমৃদ্ধ রাজ্য এবং সুরলোকের আধিপত্য পাইলেও যে শোক আমার ইন্দ্রিয়গণকে বিশোষণ করিবে তাহা কিসে যাইবে, আমি দেখিতেছি না । ৮
সঞ্জয় কহিলেন -
হে ভারত (ধৃতরাষ্ট্র) ! হৃষীকেশ উভয় সেনার মধ্যে বিষাদপ্রাপ্ত অর্জুনকে হাসিয়া এই কথা বলিলেন । ১০
শ্রীভগবান্ বলিলেন -
আমি পূর্বে ছিলাম না, বা তুমি ছিলে না বা এই নৃপতিগণ ছিলেন না, এমন নহে (অর্থাৎ সকলেই ছিলাম) । আর, পরে আমরা সকলে থাকিব না তাহাও নহে (অর্থাৎ পরেও সকলে থাকিব) । ১২
জীবের এই দেহে বাল্য, যৌবন ও বার্ধক্য, কালের গতিতে উপস্থিত হয় । তেমনি কালের গতিতে দেহান্তর-প্রাপ্তিও হয় । জ্ঞানিগণ তাহাতে মোহগ্রস্ত হন না । ১৩
হে কৌন্তেয়, ইন্দ্রিয়বৃত্তির সহিত বিষয়াদির সংযোগই শীতোষ্ণাদি সুখদুঃখ প্রদান করে । সেগুলির একবার উৎপত্তি হয়, আবার বিনাশ হয়, সুতরাং ওগুলি অনিত্য । অতএব সে সকল সহ্য কর । ১৪
হে পুরুষশ্রেষ্ঠ, যে স্থিরবুদ্ধি ব্যক্তি এই সকল বিষয়স্পর্শ-জনিত সুখদুঃখ সমভাবে গ্রহণ করেন, উহাতে বিচলিত হন না, তিনি অমৃতত্ব লাভে সমর্থ হন । ১৫
অসৎ বস্তুর ভাব (সত্তা, স্থায়িত্ব) নাই, সৎবস্তুর অভাব (নাশ) নাই; তত্ত্বদর্শিগণ এই সদসৎ উভয়েরই চরম দর্শন করিয়াছেন (স্বরূপ উপলব্ধি করিয়াছেন) । ১৬
যিনি এই সকল (দৃশ্য জগৎ) ব্যাপিয়া আছেন তাঁহাকে অবিনাশী জানিও । কেহই এই অব্যয় স্বরূপের বিনাশ করিতে পারে না । ১৭
দেহাশ্রিত আত্মার এই সকল দেহ নশ্বর বলিয়া উক্ত হইয়াছে । কিন্তু আত্মা নিত্য, অবিনাশী, অপ্রমেয় (স্বপ্রকাশ) । অতএব, হে অর্জুন, যুদ্ধ কর (আত্মার অবিনাশিতা ও দেহাদির নশ্বরত্ব স্মরণ করিয়া কাতরতা ত্যাগ কর । স্বধর্ম পালন কর) । ১৮
যে আত্মাকে হন্তা বলিয়া জানে এবং যে উহাকে হত বলিয়া মনে করে, তাহারা উভয়েই আত্মতত্ত্ব জানে না । ইনি হত্যা করেন না, হতও হন না । ১৯
এই আত্মা কখনো জন্মেন না বা মরেন না । ইনি অন্যান্য জাত বস্তুর ন্যায় জন্মিয়া অস্তিত্ব লাভ করেন না অর্থাৎ ইনি সৎরূপে নিত্য বিদ্যমান । ইনি জন্মরহিত, নিত্য, শাশ্বত এবং পুরাণ; শরীর হত হইলেও ইনি হত হন না । ২০
যিনি আত্মাকে অবিনাশী, নিত্য, অজ, অব্যয় বলিয়া জানেন, হে পার্থ, সে পুরুষ কি প্রকারে কাহাকে হত্যা করেন বা করান ? ২১
যেমন মনুষ্য জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া নূতন বস্ত্র গ্রহণ করে, সেইরূপ আত্মা জীর্ণ শরীর পরিত্যাগ করিয়া অন্য নূতন শরীর পরিগ্রহ করে । ২২
শস্ত্রসকল ইহাকে ছেদন করিতে পারে না, অগ্নিতে দহন করিতে পারে না, জলে ভিজাইতে পারে না, বায়ুতে শুষ্ক করিতে পারে না । ২৩
এই আত্মা অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য, অশোষ্য । ইনি নিত্য, সর্বব্যাপী, স্থির, অচল, সনাতন, অব্যক্ত, অচিন্ত্য, অবিকার্য্য বলিয়া কথিত হন । ২৪
অতএব আত্মাকে এই প্রকার জানিয়া তোমার শোক করে উচিত নয় । ২৫
আর যদি তুমি মনে কর যে, আত্মা সর্বদা দেহের সঙ্গে জন্মে এবং দেহের সঙ্গেই বিনষ্ট হয়, তথাপি, হে মহাবাহো, তোমার শোক করা উচিত নয় । (দেহনাশে আত্মারও নাশ হয় ইহা স্বীকার করিয়া লইলেও শোক করা উচিত নয় । কেননা, জন্মমৃত্যু অবশ্যম্ভাবী ।) ২৬
যে জন্মে তার মরণ নিশ্চিত, যে মরে তার জন্ম নিশ্চিত; সুতরাং অবশ্যম্ভাবী বিষয়ে তোমার শোক করা উচিত নয় । ২৭
হে ভারত (অর্জুন) ! জীবগণ আদিতে অব্যক্ত, মধ্যে ব্যক্ত এবং বিনাশান্তে অব্যক্ত থাকে । তাহাতে শোক বিলাপ কি ? ২৮
কেহ আত্মাকে আশ্চর্য্যবৎ কিছু বলিয়া বোধ করেন, কেহ ইহাকে আশ্চর্য্যবৎ কিছু বলিয়া বর্ণনা করেন, কেহ বা ইনি আশ্চর্য্যবৎ কিছু, এই প্রকার কথাই শুনেন । কিন্তু শুনিয়াও কেহ ইহাকে জানিতে পারেন না । ২৯
হে ভারত, জীবসকলের দেহে আত্মা সর্বদাই অবধ্য, অতএব কোন প্রাণীর জন্যই তোমার শোক করা উচিত নহে । ৩০
স্বধর্মের দিকে দৃষ্টি রাখিয়াও তোমার ভীত-কম্পিত হয়া উচিত নহে । ধর্মযুদ্ধ অপেক্ষা ক্ষত্রিয়ের পক্ষে শ্রেয়ঃ আর কিছু নাই । ৩১
হে পার্থ, এই যুদ্ধ আপনা হইতেই উপস্থিত হইয়াছে, ইহা মুক্ত স্বর্গদ্বার স্বরূপ । ভাগ্যবান্ ক্ষত্রিয়েরাই ঈদৃশ যুদ্ধ লাভ করিয়া থাকেন । ৩২
আর যদি তুমি ধর্মযুদ্ধ না কর তবে স্বধর্ম ও কীর্তি ত্যাগ করিয়া তুমি পাপযুক্ত হইবে । ৩৩
আরও দেখ, সকল লোকে চিরকাল তোমার অকীর্তি ঘোষণা করিবে । সম্মানিত ব্যক্তির পক্ষে অকীর্তি মরণ অপেক্ষা অধিক, অর্থাৎ অকীর্তি অপেক্ষা মরণও শ্রেয়ঃ । ৩৪
মহারথগণ মনে করিবেন, তুমি ভয়বশতঃ যুদ্ধে বিরত হইতেছ, দয়াবশতঃ নহে । সুতরাং যাহারা তোমাকে বহু সম্মান করেন তাহাদিগের নিকট তুমি লঘুতা প্রাপ্ত হইবে । ৩৫
তোমার শত্রুরাও তোমার সামর্থ্যের নিন্দা করিয়া অনেক অবাচ্য কথা বলিবে; তাহা অপেক্ষা অধিক দুঃখকর আর কি আছে ? ৩৬
যুদ্ধে হত হইলে স্বর্গ পাইবে, জয়লাভ করিলে পৃথিবী ভোগ করিবে, সুতরাং হে কৌন্তেয়, যুদ্ধে কৃতনিশ্চয় হইয়া উত্থান কর । ৩৭
অতএব, সুখদুঃখ, লাভ-অলাভ, জয়-পরাজয় তুল্যজ্ঞান করিয়া যুদ্ধার্থ উদ্যুক্ত (উদ্যত) হও । এইরূপ করিলে পাপভাগী হইবে না । ৩৮
হে পার্থ, তোমাকে এতক্ষণ সাংখ্য নিষ্ঠা-বিষয়ক জ্ঞান উপদেশ দিলাম, এক্ষণ যোগবিষয়ক জ্ঞান শ্রবণ কর (যাহা এক্ষণ বলিতেছি) এই জ্ঞান লাভ করিলে কর্মবন্ধন ত্যাগ করিতে পারিবে । ৩৯
ইহাতে (এই নিষ্কাম কর্মযোগে) আরব্ধ কর্ম নিষ্ফল হয় না এবং (ত্রুটি-বিচ্যুতি-জনিত) পাপ বা বিঘ্ন হয় না, এই ধর্মের অল্প আচরণও মহাভয় হইতে ত্রাণ করে । ৪০
ইহাতে (এই নিষ্কাম কর্মযোগে) ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি (নিষ্কাম ভাবে কর্ম করিয়াই আমি ত্রাণ পাইব এইরূপ নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি) একই হয় অর্থাৎ একনিষ্ঠই থাকে, নানাদিকে ধাবিত হয় না । কিন্তু অব্যবসায়ীদিগের (অস্থিরচিত্ত সকাম ব্যক্তিগণের) বুদ্ধি বহুশাখাবিশিষ্ট ও অনন্ত (সুতরাং নানাদিকে ধাবিত হয়) । ৪১
হে পার্থ, অল্পবুদ্ধি ব্যক্তিগণ বেদের কর্মকাণ্ডের স্বর্গফলাদি প্রকাশক প্রীতিকর বাক্যে অনুরক্ত, তাহারা বলে বেদোক্ত কাম্যকর্মাত্মক ধর্ম ভিন্ন আর কিছু ধর্ম নাই, তাহাদের চিত্ত কামনা-কলুষিত, স্বর্গই তাহাদের পরম পুরুষার্থ, তাহারা ভোগৈশ্বর্য্য লাভের উপায়স্বরূপ বিবিধ ক্রিয়াকলাপের প্রশংসাসূচক আপাতোমনোরম বেদবাক্য বলিয়া থাকে; এই সকল শ্রবণ-রমণীয় বাক্যদ্বারা অপহৃতচিত্ত, ভোগৈশ্বর্য্যে আসক্ত ব্যক্তিগণের কার্যাকার্য নির্ণায়ক বুদ্ধি এক বিষয়ে স্থির থাকিতে পারে না (ঈশ্বরে একনিষ্ঠ হয় না) । ৪২, ৪৩, ৪৪
হে অর্জুন, বেদসমূহ ত্রৈগুণ্য-বিষয়ক, তুমি নিস্ত্রৈগুণ্য হও - তুমি নির্দ্বন্দ্ব, নিত্যসত্ত্বস্থ, যোগ-ক্ষেমরহিত ও আত্মবান্ হও । ৪৫
বাপী-কূপ-তড়াগাদি ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র জলাশয়ে যে প্রয়োজন সিদ্ধ হয়, এক বিস্তীর্ণ মহাজলাশয়ে সেই সমস্তই সিদ্ধ হয়; সেইরূপ বেদোক্ত কাম্যকর্মসমূহে যে ফল লাভ হয়, ব্রহ্মবেত্তা ব্রহ্মনিষ্ঠ পুরুষের সেই সমস্তই লাভ হয় । ৪৬
কর্মেই তোমার অধিকার, কর্মফলে কখনও তোমার অধিকার নাই । কর্মফল যেন তোমার কর্মপ্রবৃত্তির হেতু না হয় কর্মত্যাগেও যেন তোমার প্রবৃত্তি না হয় । ৪৭
হে ধনঞ্জয়, যোগস্থঃ হইয়া, ফলাসক্তি বর্জন করিয়া, সিদ্ধি ও অসিদ্ধি তুল্যজ্ঞান করিয়া তুমি কর্ম কর । এইরূপ সমত্ব-বুদ্ধিকেই যোগ কহে । ৪৮
হে ধনঞ্জয়, কেবল বাহ্য কর্ম বুদ্ধিযোগ অপেক্ষা নিতান্তই নিকৃষ্ট; অতএব তুমি সমত্ববুদ্ধির আশ্রয় লও; যাহারা ফলের উদ্দেশে কর্ম করে, তাহার দীন, কৃপার পাত্র । ৪৯
সমত্ববুদ্ধিযুক্ত নিষ্কাম কর্মী ইহলোকেই সুকৃত- (পুণ্যকর্ম) দুষ্কৃত (পাপকর্ম) উভয়ই ত্যাগ করেন । সুতরাং তুমি যোগের অনুষ্ঠান কর; কর্মে কৌশলই যোগ । ৫০
সমত্ববুদ্ধিযুক্ত জ্ঞানিগণ কর্ম করিলেও কর্মজনিত ফলে আবদ্ধ হন না, সুতরাং তাঁহারা জন্মরূপ বন্ধন অর্থাৎ সংসার বন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া সর্বপ্রকার উপদ্রবরহিত বিষ্ণুপদ বা মোক্ষপদ প্রাপ্ত হন । ৫১
যখন তোমার বুদ্ধি মোহরূপ গহনকানন অতিক্রম করিবে, তখন তুমি শ্রুত ও শ্রোতব্য বিষয়ে বৈরাগ্য প্রাপ্ত হইবে । ৫২
লৌকিক ও বৈদিক নানাবিধ ফলকথা শ্রবণে বিক্ষিপ্ত তোমার বুদ্ধি যখন সমাধিতে নিশ্চল হইয়া থাকিবে তখন তুমি (সাম্যবুদ্ধিরূপ) যোগ প্রাপ্ত হইবে । ৫৩
অর্জুন কহিলেন -
হে কেশব, যিনি সমাধিস্থ হইয়া স্থিতপ্রজ্ঞ হইয়াছেন তাঁহার লক্ষণ কি ? স্থিতধী ব্যক্তি কিরূপ কথা বলেন ? কিরূপে অবস্থান করেন ? কিরূপে চলেন ? ৫৪
শ্রীভগবান্ বলিলেন -
হে পার্থ, যখন কেহ সমস্ত মনোগত কামনা বর্জন করিয়া আপনাতেই আপনি তুষ্ট থাকেন, তখন তিনি স্থিতপ্রজ্ঞ বলিয়া কথিত হন । ৫৫
যিনি দুঃখে উদ্বেগশূন্য, সুখে স্পৃহাশূন্য, যাঁহার অনুরাগ, ভয় এবং ক্রোধ নিবৃত্ত হইয়াছে, তাঁহাকে স্থিতপ্রজ্ঞ মুনি বলা যায় । ৫৬
যিনি দেহ-জীবনাদি সকল বিষয়েই শুভ প্রাপ্তিতে সন্তোষ বা অশুভ প্রাপ্তিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেন না, তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ । ৫৭
কচ্ছপ যেমন কর-চরণাদি অঙ্গসকল সঙ্কুচিত করিয়া রাখে, তেমনি যিনি রূপরসাদি ইন্দ্রিয়ের বিষয় হইতে ইন্দ্রিয়সকল সংহরণ করিয়া লন, তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ । ৫৮
ইন্দ্রিয়দ্বারা বিষয়গ্রহণে অপ্রবৃত্ত ব্যক্তির বিষয়োপভোগ নিবৃত্ত হয় বটে, কিন্তু বিষয়-তৃষ্ণা নিবৃত্ত হয় না । কিন্তু সেই পরম পুরুষকে দেখিয়া স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির বিষয়-বাসনাও নিবৃত্ত হয় । ৫৯
হে কৌন্তেয়, প্রমাথী ইন্দ্রিয়গণ সংযমে যত্নশীল, বিবেকী পুরুষেরও চিত্তকে বলপূর্বক হরণ করে (বিষয়াসক্ত করে) । ৬০
যিনি আমার অনন্যভক্ত তিনি সেই সকল ইন্দ্রিয়কে সংযত করিয়া আমাকে চিত্ত সমাহিত করিয়া অবস্থান করেন । তাদৃশ সমাহিতচিত্ত ব্যক্তিরই ইন্দ্রিয়-সকল বশীভূত হয়, তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ । ৬১
বিষয়-চিন্তা করিতে করিতে মনুষ্যের তাহাতে আসক্তি জন্মে, আসক্তি হইতে কামনা অর্থাৎ সেই বিষয় লাভের অভিলাষ জন্মে, সেই কামনা কোন কারণে প্রতিহত বা বাধা প্রাপ্ত হইলে প্রতিবোধকের প্রতি ক্রোধ জন্মে, ক্রোধ হইতে মোহ, মোহ হইতে স্মৃতিভ্রংশ, স্মৃতিভ্রংশ হইতে বুদ্ধিনাশ, বুদ্ধিনাশ হইতে বিনাশ ঘটে । ৬২-৬৩
কিন্তু যিনি বিধেয়াত্মা অর্থাৎ যাহার মন নিজের বশবর্তী, তিনি অনুরাগ ও বিদ্বেষ হইতে বিমুক্ত, আত্মবশীভূত ইন্দ্রিয়গণদ্বারা বিষয় উপভোগ করিয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করেন । ৬৪
চিত্তপ্রসাদ জন্মিলে এই পুরুষের সমস্ত দুঃখের নিবৃত্তি হয়, যেহেতু প্রসন্নচিত্ত ব্যক্তির বুদ্ধি শীঘ্র উপাস্য বস্তুতে স্থিতি লাভ করে । ৬৫
যিনি অযুক্ত অর্থাৎ যাঁহার চিত্ত অসমাহিত ও ইন্দ্রিয় অবশীকৃত, তাঁহার আত্ম-বিষয়া বুদ্ধিও হয় না, চিন্তাও হয় না । (যাঁহার আত্ম-বিষয়া) চিন্তা নাই, তাঁহার শান্তি নাই, যাঁহার শান্তি নাই, তাঁহার সুখ কোথায় ? ৬৬
মন বিষয়ে প্রবর্তমান ইন্দ্রিয়গণের যেটিকে অনুবর্তন করে, সেই একটি ইন্দ্রিয়ই, যেমন বায়ু জলের উপরিস্থিত নৌকাকে বিচলিত করে, তদ্রূপ উহার প্রজ্ঞা হরণ করে । ৬৭
হে মহাবাহু ! (যখন ইন্দ্রয়াধীন মন এবং মনের অধীন প্রজ্ঞা) সেই হেতু, যাহার ইন্দ্রিয় সর্বপ্রকারে বিষয় হইতে নিবৃত্ত হইয়াছে, তাহারই প্রজ্ঞা স্থির হইয়াছে । ৬৮
সাধারণ প্রাণিগণের পক্ষে যাহা (আত্মনিষ্ঠা) নিশাস্বরূপ, তাহাতে (আত্মনিষ্ঠাতে) সংযমী ব্যক্তি জাগ্রত থাকেন; যাহাতে (বিষয়নিষ্ঠাতে) অজ্ঞ প্রাণিসাধারণ জাগরিত থাকে, আত্মদর্শী মুনিদিগের তাহা (বিষয়নিষ্ঠা) রাত্রিস্বরূপ । ৬৯
যেমন নদ-নদীর জলে পরিপূরিত প্রশান্ত সমুদ্রে অপর জলরাশি আসিয়া প্রবেশ করিয়া বিলীন হইয়া যায়, সেইরূপ যে মহাত্মাতে বিষয় সকল প্রবেশ করিয়াও কোনরূপ চিত্তবিক্ষেপ উৎপন্ন করে না, তিনি শান্তিলাভ করেন; যিনি ভোগ কামনা করেন, তিনি শান্তি পান না । ৭০
যে ব্যক্তি সমস্ত কামনা ত্যাগ করিয়া নিস্পৃহ হইয়া বিচরণ করেন, যিনি মমতাশূন্য ও অহঙ্কারশূন্য, তিনিই শান্তিপ্রাপ্ত হন । ৭১
হে পার্থ, ইহাই ব্রাহ্মীস্থিতি (ব্রহ্মজ্ঞানে অবস্থান) । এই অবস্থা প্রাপ্ত হইলে জীবের আর মোহ হয় না । মৃত্যুকালে এই অবস্থায় থাকিয়া তিনি ব্রহ্মনির্বাণ বা ব্রহ্মে মিলনরূপ মোক্ষ লাভ করেন । ৭২
১৩) জন্মান্তরবাদ : খ্রীষ্টীয় বনাম হিন্দু মত
অদ্বয় জ্ঞান তত্ত্ব কৃষ্ণের স্বরূপ । ব্রহ্ম, আত্মা, ভগবান তিন তাঁর রূপ ।।
জ্ঞান, যোগ, ভক্তি তিন সাধনার বশে । ব্রহ্ম, আত্মা, ভগবান ত্রিবিধ প্রকাশে ।। [শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত]
বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ : ব্রহ্ম ও জীব স্বতন্ত্র বস্তু । জগৎ মিথ্যা নহে, উহা ব্রহ্মের মায়াশক্তি-প্রসূত । জগৎ ব্রহ্মেরই শরীর । ব্রহ্ম সগুণ, তিনি জগতের কর্তা ও উপাদান । এই মতকে অনেকে দ্বৈতবাদও বলেন ।
শুদ্ধদ্বৈতবাদ : ব্রহ্ম, জীব ও জগৎ তিনই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও পৃথক তত্ত্ব ।
ষড়দর্শনের মধ্যে মীমাংসা-দর্শন (পূর্ব-মীমাংসা) কর্মবাদী, অন্যান্যগুলি জ্ঞানবাদী । মীমাংসা-মতে যজ্ঞাদিই ধর্ম এবং স্বর্গই পরম পুরুষার্থ, তদ্ভিন্ন ঈশ্বরতত্ত্ব বা ব্রহ্মতত্ত্ব বলিয়া কিছু আছে বলিয়া ইঁহারা স্বীকার করেন না । এই শ্লোকে এই কর্মবাদী মীমাংসকদিগকেই লক্ষ্য করা হইয়াছে ।
নির্দ্বন্দ্ব = শীতোষ্ণ, সুখ-দুঃখাদি পরস্পর-বিরোধী ভাবদ্বয়কে যিনি তুল্য জ্ঞান করেন ।
নিত্যসত্ত্বস্থঃ = নিতসত্ত্বগুণাশ্রিত অথবা নিত্যধৈর্যশীল । তমঃ ও রজোগুণকে দমন করিয়া শুদ্ধ সত্ত্বগুণের উৎকর্ষ দ্বারাই ত্রিগুণাতীতের অবস্থা লাভ হয় । এই অবস্থাই সিদ্ধাবস্থা, ইহার পর আর সাধনার প্রয়োজন হয় না ।
নির্যোগক্ষেম = যোগ-ক্ষেম-রহিত; যোগ = অলব্ধ বস্তুর উপার্জন; ক্ষেম = লব্ধ বস্তুর রক্ষণ । অর্থ এই - তুমি উপার্জন ও রক্ষা এই উভয় বিষয়েই চিন্তা ত্যাগ কর ।
৪৯) সমত্ববুদ্ধির যোগ/বুদ্ধিযোগ : সিদ্ধি ও অসিদ্ধিতে যে-সমত্ববুদ্ধি তাহাই যোগ । এই সমত্ববুদ্ধি-রূপ যোগ বা সমত্ববুদ্ধির যোগকেই এখানে বুদ্ধিযোগ বলা হইয়াছে ।
কর্মাকর্মের নৈতিক বিচারে বুদ্ধিই শ্রেষ্ঠ কষ্টিপাথর অর্থাৎ ভাল/মন্দ কর্ম বা শ্রেষ্ঠ/নিকৃষ্ট কর্ম বিচার করিবার সময় কর্মের বাহ্য ফলের দিকে দৃষ্টি না করিয়া, কর্তা কি উদ্দেশে, কিরূপ বুদ্ধিতে কার্য করেন, তাহাই দেখিতে হইবে । 'The moral worth of an action cannot be anywhere but in the principle of the will, without regard in the ends which can be attained by action.' -[Kant's Theory of Ethics quoted by Lokamanya Tilak].
'এক্ষণে বুঝা গেল, বুদ্ধিযোগ বলিতে কি বুঝায়, অভ্রান্ত বুদ্ধির সহিত এবং সেই জন্য অভ্রান্ত ইচ্ছার সহিত, অনন্যচিত্ত হইয়া সর্বভূতে এক আত্মা জানিয়া, আত্মার শান্ত সমতা হইতে কার্য কর, অনন্ত কামনার বশে ইতস্তত ছুটাছুটি না করা, হাই 'বুদ্ধিযোগ' । - [শ্রী অরবিন্দের গীতা, অনিলবরণ]
৫১) স্বর্গ ও মোক্ষ : কর্মমাত্রই বন্ধনের কারণ, সে সুকৃতই হউক আর দুষ্কৃতই হউক, - যেমন স্বর্ণ-শৃঙ্খল আর লৌহ-শৃঙ্খল । পুণ্যফলে স্বর্গাদি-প্রাপ্তি মোক্ষ নহে, উহাও অস্থায়ী ভোগের বিষয়মাত্র । স্বর্গ হইতে পতন অনিবার্য । কিন্তু নিষ্কাম কর্মী মোক্ষপদ প্রাপ্ত হন ।
৫৫) আত্মারাম = 'আপনাতেই আপনি তুষ্ট' - পরমানন্দস্বরূপ আত্মাতেই স্বয়ং পরিতুষ্ট । যিনি সর্ববিধ কামনা বর্জন করিয়াছেন, সুতরাং বাসনা-জনিত চিত্তবিক্ষেপ বিদূরিত হওয়াতে যিনি বিশুদ্ধ আত্মানন্দ উপভোগ করিতেছেন ।
৫৬) রাগ = বিষয়ানুরাগ
ভয় = বিষয়-বিনাশের আশঙ্কা
ক্রোধ = বিষয়-বাসনা প্রতিহত হইলে প্রতিকারোন্মুখ জ্বলনাত্মক চিত্ত-বিকার
বিষয়-বাসনার পূরণে সুখ, অপূরণে দুঃখ । সুতরাং সুখ, দুঃখ, রাগ, ভয়, ক্রোধ - সকলেরই মূল কামনা; কামনা-ত্যাগীই স্তিথধী ।
প্রশ্নঃ কামনার পূরণে অর্থাৎ ভোগেই সুখ । কামনা বর্জন করিয়া ভোগ-সুখ ত্যাগ করিয়া কি তবে জড়পিণ্ডবৎ হইতে হইবে ? এ কি অস্বাভাবিক ধর্ম নয় ? পাশ্চাত্যেরা যাহাকে Ascetism বলে, এ কি তাই নয় ?
উত্তরঃ না, তা নয় । 'ভোগ-দ্বিবিধ, শুদ্ধ ও অশুদ্ধ । শুদ্ধ ভোগে সুখদুঃখ নাই, পুরুষের চিরন্তন স্বভাবসিদ্ধ ধর্ম আনন্দই আছে । অশুদ্ধ ভোগে সুখ ও দুঃখ আছে; হর্ষশোকাদি-দ্বন্দ্ব অশুদ্ধ ভোগীকে বিচলিত ও বিক্ষুব্ধ করে । কামনা অশুদ্ধতার কারণ । কামীমাত্রেই অশুদ্ধ, যে নিষ্কাম সে শুদ্ধ ।' - [শ্রীঅরবিন্দ]
গীতায় এই শুদ্ধ ভোগই বিহিত, অশুদ্ধ ভোগ নিষিদ্ধ । ইন্দ্রিয়-সংযমই বিহিত ইন্দ্রিয়ের ধ্বংস বিহিত নয়, বরং নিষিদ্ধ [২|১৫,৬৪; ৩|৭,৩৩,৩৪; ১৭|৬] ।
৬৪) নির্লিপ্ত সংসারী :
'বিষয়াসক্ত জীব মুখে নাম জপ করে, কিন্তু মনে বিষয়-চিন্তা করে । উহা উল্টাইয়া লও ।' - রামদয়াল মজুমদার ।
Online Source:
http://geetabangla.blogspot.com/2011/08/blog-post_24.html
*Hard Copy Source:
হে জনার্দন, যদি তোমার মতে কর্ম হইতে বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ, তবে হে কেশব, আমাকে হিংসাত্মক কর্মে কেন নিযুক্ত করিতেছ ? বিমিশ্র বাক্যদ্বারা কেন আমার মনকে মোহিত করিতেছ; যাহাদ্বারা আমি শ্রেয় লাভ করিতে পারি সেই একটি (পথ) আমাকে নিশ্চিত করিয়া বল । ১,২
শ্রীভগবান কহিলেন -
হে অনঘ, ইহলোকে দ্বিবিধ নিষ্ঠা আছে, ইহা পূর্বে বলিয়াছি । সাংখ্যদিগের জন্য জ্ঞানযোগ এবং কর্মীদিগের জন্য কর্মযোগ । ৩
কর্মচেষ্টা না করিলেই পুরুষ নৈষ্কর্ম্যলাভ করিতে পারে না, আর (কামনা ত্যাগ ব্যতীত) কর্মত্যাগ করিলেই সিদ্ধিলাভ হয় না । ৪
কেহই কখনো ক্ষণকাল কর্ম না করিয়া থাকিতে পারে না, কেননা, প্রকৃতির গুণে অবশ হইয়া সকলেই কর্ম করিতে বাধ্য হয় । ৫
যে ভ্রান্তমতি হস্তপদাদি কর্মেন্দ্রিয় সকল সংযত করিয়া অবস্থিতি করে, অথচ মনে মনে ইন্দ্রিয়-বিষয়সকল স্মরণ করে, সে মিথ্যাচারী । ৬
কিন্তু যিনি মনের দ্বারা জ্ঞানেন্দ্রিয়সকল সংযত করিয়া অনাসক্ত হইয়া কর্মেন্দ্রিয়ের দ্বারা কর্মযোগের আরম্ভ করেন, তিনিই শ্রেষ্ঠ । ৭
তুমি নিয়ত কর্ম কর; কর্মশূন্যতা অপেক্ষা কর্ম শ্রেষ্ঠ, কর্ম না করিয়া তোমার দেহযাত্রাও নির্বাহ হইতে পারে না । ৮
যজ্ঞার্থ যে কর্ম তদ্ভিন্ন অন্য কর্ম মনুষ্যের বন্ধনের কারণ । হে কৌন্তেয় তুমি সেই উদ্দেশ্যে (যজ্ঞার্থ) অনাসক্ত হইয়া কর্ম কর । ৯
সৃষ্টির প্রারম্ভে প্রজাপতি যজ্ঞের সহিত প্রজা সৃষ্টি করিয়া বলিয়াছিলেন - তোমরা এই যজ্ঞদ্বারা উত্তরোত্তর বর্ধিত হও; এই যজ্ঞ তোমাদের অভীষ্টপ্রদ হউক । ১০
এই যজ্ঞদ্বারা তোমরা দেবগণকে (ঘৃতাহুতি প্রদানে) সংবর্দ্ধনা কর, সেই দেবগণও (বৃষ্ট্যাদি দ্বারা) তোমাদিগকে সংবর্ধিত করুন; এইরূপে পরস্পরের সংবর্ধনা দ্বারা পরম মঙ্গল লাভ করিবে । ১১
যেহেতু, দেবগণ যজ্ঞাদিদ্বারা সংবর্ধিত হইয়া তোমাদিগকে অভীষ্ট ভোগ্যবস্তু প্রদান করেন, সুতরাং তাঁহাদিগের প্রদত্ত অন্নপানাদি যজ্ঞাদি-দ্বারা তাহাদিগকে প্রদান না করিয়া যে ভোগ করে সে নিশ্চয়ই চোর (দেবস্বাপহারী) । ১২
যে সজ্জনগণ যজ্ঞাবশেষ অন্ন ভোজন করেন অর্থাৎ দেবতা, অতিথি প্রভৃতিকে অন্নাদি প্রদান করিয়া অবশিষ্ট ভোজন করেন তাঁহারা সর্বপাপ হইতে মুক্ত হন । যে পাপাত্মারা কেবল আপন উদরপূরণার্থ অন্ন পাক করে, তাহারা পাপরাশিই ভোজন করে । ১৩
প্রাণিসকল অন্ন হইতে উৎপন্ন হয়, মেঘ হইতে অন্ন জন্মে, যজ্ঞ হইতে মেঘ জন্মে, কর্ম হইতে যজ্ঞের উৎপত্তি, কর্ম বেদ হইতে উৎপন্ন জানিও এবং বেদ পরব্রহ্ম হইতে সমুদ্ভূত; সেই হেতু সর্বব্যাপী পরব্রহ্ম সদা যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত আছেন । এইরূপে প্রবর্তিত জগচ্চক্রের যে অনুবর্তন না করে (অর্থাৎ যে যজ্ঞাদি কর্মদ্বারা এই সংসার-চক্র পরিচালনের সহায়তা না করে) সে ইন্দ্রিয়সুখাসক্ত ও পাপজীবন; হে পার্থ, সে বৃথা জীবন ধারণ করে । ১৪,১৫,১৬
কিন্তু যিনি কেবল আত্মাতেই প্রীত, যিনি আত্মাতেই তৃপ্ত, যিনি কেবল আত্মাতেই সন্তুষ্ট থাকেন, তাঁহার নিজের কোন প্রকার কর্তব্য নাই । ১৭
যিনি আত্মারাম তাঁহার কর্মানুষ্ঠানে কোন প্রয়োজন নাই, কর্ম হইতে বিরত থাকারও কোন প্রয়োজন নাই । সর্বভূতের মধ্যে কাহারও আশ্রয়ে তাঁহার প্রয়োজন নাই (তিনি কাহারও আশ্রয়ে সিদ্ধকাম হইবার আবশ্যকতা রাখেন না) । ১৮
অতএব তুমি আসক্তিশূন্য হইয়া সর্বদা কর্তব্য কর্ম সম্পাদন কর, কারণ অনাসক্ত হইয়া কর্মানুষ্ঠান করিলে পুরুষ পরমপদ (মোক্ষ) প্রাপ্ত হন । ১৯
জনকাদি মহাত্মারা কর্ম দ্বারাই সিদ্ধিলাভ করিয়াছেন । লোকরক্ষার দিকে দৃষ্টি রাখিয়াও তোমার কর্ম করাই কর্তব্য । ২০
শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যাহা যাহা আচরণ করেন, অপর সাধারণেও তাহাই করে । তিনি যাহা প্রামাণ্য বলিয়া বা কর্তব্য বলিয়া গ্রহণ করেন, সাধারণ লোকে তাহারই অনুবর্তন করে । ২১
হে পার্থ, ত্রিলোক মধ্যে আমার করণীয় কিছু নাই, অপ্রাপ্ত বা প্রাপ্তব্য কিছু নাই, তথাপি আমি কর্মানুষ্ঠানেই ব্যাপৃত আছি । ২২
হে পার্থ, যদি অনলস হইয়া কর্মানুষ্ঠান না করি, তবে মানবগণ সর্বপ্রকারে আমারই পথের অনুবর্তী হইবে । (কেহই কর্ম করিবে না) । ২৩
उत्सीदेयुरिमे लोका न कुर्यां कर्म चेदहम् ।
संकरस्य च कर्ता स्यामुपहन्यामिमाः प्रजाः ॥3.24॥
যদি আমি কর্ম না করি তাহা হইলে এই লোক সকল উৎসন্ন যাইবে । আমি বর্ণ*-সঙ্করাদি সামাজিক বিশৃঙ্খলার হেতু হইব এবং ধর্মলোপহেতু প্রজাগণের বিনাশের কারণ হইব । ২৪
হে ভারত, অজ্ঞ ব্যক্তিরা কর্মে আসক্তিবিশিষ্ট হইয়া যেরূপ কর্ম করিয়া থাকে, জ্ঞানী ব্যক্তিরা অনাসক্ত চিত্তে লোকরক্ষার্থে সেইরূপ কর্ম করিবেন । ২৫
জ্ঞানীরা কর্মে আসক্ত অজ্ঞানদিগের বুদ্ধিভেদ জন্মাইবেন না । আপনারা অবহিত হইয়া সকল কর্ম অনুষ্ঠান করিয়া তাহাদিগকে কর্মে নিযুক্ত রাখিবেন । ২৬
প্রকৃতির গুণসমূহদ্বারা সর্বতোভাবে কর্মসকল সম্পন্ন হয় । যে অহঙ্কারে মুগ্ধচিত্ত সে মনে করে আমিই কর্তা । ২৭
কিন্তু হে মহাবাহো ! যিনি সত্ত্বরজস্তমোগুণ ও মন, বুদ্ধি ইন্দ্রিয়াদির বিভাগ ও উহাদের পৃথক্ পৃথক্ কর্ম-বিভাগ তত্ত্ব জানিয়াছেন, তিনি ইন্দ্রিয়াদি ইন্দ্রিয়বিষয়ে প্রবৃত্ত আছে ইহা জানিয়া কর্মে আসক্ত হন না, কর্তৃত্বাভিমান করেন না । ২৮
যাহারা প্রকৃতির গুণে মোহিত তাহারা দেহেন্দ্রিয়াদি কর্মে আসক্তিযুক্ত হয়; সেই সকল অল্পবুদ্ধি মন্দমতিদিগকে জ্ঞানিগণ কর্ম হইতে বিচালিত করিবেন না । ২৯
কর্তা ঈশ্বর, তাঁহারই উদ্দেশ্যে ভৃত্যবৎ কর্ম করিতেছি, এইরূপ বিবেকবুদ্ধি সহকারে সমস্ত কর্ম আমাতে সমর্পণ করিয়া কামনাশূন্য ও মমতাশূন্য হইয়া শোকত্যাগপূর্বক তুমি যুদ্ধ কর । ৩০
যে মানবগণ শ্রদ্ধাবান ও অসূয়াশূন্য হইয়া আমার এই মতের অনুষ্ঠান করে, তাহারাও কর্মবন্ধন হইতে মুক্ত হয় । ৩১
যাহারা অসূয়াপরবশ হইয়া আমার এই মতের অনুষ্ঠান করে না, সেই বিবেকহীন ব্যক্তিগণকে সর্বজ্ঞান-বিমূঢ় ও বিনষ্ট বলিয়া জানিও । ৩২
জ্ঞানবান্ ব্যক্তিও নিজ প্রকৃতির অনুরূপ কর্মই করিয়া থাকেন । প্রাণিগণ প্রকৃতিরই অনুসরণ করে; ইন্দ্রিয়-নিগ্রহে কি করিবে ? ৩৩
সকল ইন্দ্রিয়েরই স্ব স্ব বিষয়ে রাগদ্বেষ অবশ্যম্ভাবী । ঐ রাগদ্বেষের বশীভূত হইও না; উহারা জীবের শত্রু (অথবা, শ্রেয়োমার্গের বিঘ্নকারক) । ৩৪
স্বধর্ম কিঞ্চিদ্দোষবিশিষ্ট হইলেও উহা উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত পরধর্মাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ । স্বধর্মে নিধনও কল্যাণকর, কিন্তু পরধর্ম গ্রহণ করা বিপজ্জনক । ৩৫
অর্জুন কহিলেন -
হে কৃষ্ণ, লোকে কাহাদ্বারা প্রযুক্ত হইয়া অনিচ্ছা-সত্ত্বেও যেন বলপুর্বক নিয়োজিত হইয়াই পাপাচরণ করে । ৩৬
শ্রীভগবান বলিলেন -
ইহা কাম, ইহাই ক্রোধ । ইহা রজোগুণোৎপন্ন, ইহা দুষ্পূরণীয় এবং অতিশয় উগ্র । ইহাকে সংসারে শত্রু বলিয়া জানিবে । ৩৭
যেমন ধূমদ্বারা বহ্নি আবৃত থাকে, মলদ্বারা দর্পণ আবৃত হয়, জরায়ূদ্বারা গর্ভ আবৃত থাকে, সেইরূপ কামের দ্বারা জ্ঞান আবৃত থাকে । ৩৮
হে কৌন্তেয়, জ্ঞানীদিগের নিত্যশত্রু এই দুষ্পূরণীয় অগ্নিতুল্য কামদ্বারা জ্ঞান আচ্ছন্ন থাকে । ৩৯
ইন্দ্রিয়সকল, মন ও বুদ্ধি - ইহারা কামের অধিষ্ঠান বা আশ্রয়স্থান বলিয়া কথিত হয় । কাম ইহাদিগকে অবলম্বন করিয়া জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করিয়া জীবকে মুগ্ধ করে । ৪০
কাম, প্রবল শত্রু । ইন্দ্রিয়াদি উহার অবলম্বন বা আশ্রয়স্বরূপ । তুমি প্রথমে কামের অবলম্বন স্বরূপ ইন্দ্রিয়দিগকে জয় কর, তবেই কাম জয় করিতে পারিবে । ৪১
ইন্দ্রিয়সকল শ্রেষ্ঠ বলিয়া কথিত হয়; ইন্দ্রিয়গণ অপেক্ষা মন শ্রেষ্ঠ; মন অপেক্ষা বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ; বুদ্ধি হইতে যিনি শ্রেষ্ঠ তিনিই আত্মা । ৪২
হে মহাবাহো, এইরূপে বুদ্ধির সাহায্যে বুদ্ধিরও উপরে অবস্থিত পরমাত্মা সম্বন্ধে সচেতন হইয়া, আত্মাকে আত্মশক্তির প্রয়োগেই ধীর ও নিশ্চল কর এবং দুর্ণিবার শত্রু কামকে বিনাশ কর [শ্রীঅরবিন্দ] । অথবা, নিজেই নিজেকে সংযত করিয়া কামরূপ দুর্জয় শত্রুকে মারিয়া ফেল [লোকমান্য তিলক]; অথবা, নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধিদ্বারা মনকে নিশ্চল করিয়া কামরূপ দুর্জয় শত্রু (কামকে) বিনাশ কর [শ্রীধরস্বামি] । ৪৩
কেবলং শাস্ত্রমাশ্রিত্য ন কর্তব্যো বিনির্ণয়ঃ ।যুক্তিহীনবিচারেণ ধর্মহানিঃ প্রজায়তে ।। - বৃহস্পতি
অন্যং তৃণমিব ত্যাজ্যমপ্যুক্তং পদ্মজন্মনা - বশিষ্ঠ
১৩) পঞ্চমহাযজ্ঞ : মানুষ জীবনরক্ষার্থ অনিচ্ছাসত্ত্বেও প্রাণিহিংসা করিতে বাধ হয় । শাস্ত্রকারগণ গৃহস্তের পাঁচ প্রকার 'সূনা' অর্থাৎ জীবহিংসা-স্থানের উল্লেখ করেন । যথা - (i)উদূখল, (ii)জাঁতা, (iii)চুল্লী, (iv)জলকুম্ভ ও (v)ঝাঁটা । এগুলি গৃহস্তের নিত্য-ব্যবহার্য, অথচ এগুলি দ্বারা কীটপতঙ্গাদি প্রাণিবধও অনিবার্য, সুতরাং তাহাতে পাপও অবশ্যম্ভাবী । এই পাপমোচনার্থ পঞ্চমহাযজ্ঞের ব্যবস্থা । যথা - (i)অধ্যাপনা (এবং সন্ধ্যোপাসনাদি) ব্রহ্মযজ্ঞ/ঋষিযজ্ঞ, (ii)তর্পণাদি পিতৃযজ্ঞ, (iii)হোমাদি দৈবযজ্ঞ, (iv)কাকাদি-জীবজন্তুকে খাদ্যপ্রদান ভৃতযজ্ঞ ও (v)অতিথি-সৎকার নৃযজ্ঞ । সকলের প্রতিই মানুষের কর্তব্য আছে, এই কর্তব্যকেই শাস্ত্রে 'ঋণ' বলে । ত্যাগমূলক পঞ্চযজ্ঞদ্বারা পিতৃঋণ, দেবঋণ ইত্যাদি পরিশোধ করিতে হয় ।
রহস্য - যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞাদি
১৭-১৯) জ্ঞানীর কর্ম : 'উচ্চতর সত্যের অভিমুখ হইলেই কর্ম ত্যাগ করিতে হইবে না - সেই সত্য লাভ করিবার পূর্বে ও পরে নিষ্কাম কর্মসাধনই গূঢ় রহস্য । মুক্ত পুরুষের কর্মের দ্বারা লাভ করিবার কিছুই নাই, তবে কর্ম হইতে বিরত থাকিয়াও তাঁহার কোনো লাভ নাই এবং কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য তাঁহাকে কর্ম করিতে বা কর্ম ত্যাগ করিতে হয় না, অতএব যে কর্ম করিতে হইবে (জগতের জন্য, লোক-সংগ্রহার্থে [৩|২০]) সর্বদা অনাসক্ত হইয়া তাহা কর ।' - শ্রীঅরবিন্দের গীতা
'প্রায়ই দেখা যায়, মুনিরা নির্জনে মৌনাবলম্বন করিয়া তপস্যা করেন, তাঁহারা তো লোকের দিকে দৃষ্টি করেন না । তাঁহারা তো পরার্থনিষ্ঠ নন, তাঁহারা নিজের মুক্তির জন্যই ব্যস্ত, সুতরাং স্বার্থপর ।'
প্রশ্নঃ জ্ঞানীও কর্ম করেন, অজ্ঞানও কর্ম করেন, তবে জ্ঞানী ও অজ্ঞানে পার্থক্য কি ?
উত্তরঃ অজ্ঞান ব্যক্তি মনে করেন, কর্ম করি আমি, জ্ঞানী মনে করেন, কর্ম করেন প্রকৃতি । অজ্ঞান 'আমি'টাকে কর্মের সহিত যোগ করিয়া দেন বলিয়াই ফলাসক্ত হন । সুতরাং অজ্ঞানের কর্ম ভোগ, জ্ঞানীর কর্ম যোগ । কর্মী হইলেই কর্মযোগী হয় না । কর্তৃত্বাভিমান ও ফলাকাঙ্খা বর্জন ব্যতীত কর্ম যোগে পরিণত হয় না ।
'কাঁচা আমি' ও 'পাকা আমি' : "মানুষের ভিতর 'কাঁচা আমি' ও 'পাকা আমি', এই দুই রকম 'আমি' আছে । অহঙ্কারী আমি কাঁচা আমি । এ-আমি মহাশত্রু । ইহাকে সংহার করা চাই । মুক্তি হবে কবে, অহং যাবে যবে । সমাধি হলে তাঁর সঙ্গে এক হওয়া যায়, আর অহং থাকে না । জ্ঞান হবার পর যদি অহং থাকে তবে জেনো সে বিদ্যার আমি, ভক্তির আমি, দাস আমি, সে অবিদ্যার আমি নয় । সে পাকা আমি । প্রহ্লাদ, নারদ, হনুমান, এঁরা সমাধির পর ভক্তি রেখেছিলেন; শঙ্করাচার্য, রামানুজ, এঁরা বিদ্যার আমি রেখেছিলেন ।" - শ্রীরামকৃষ্ণ ।
৩৩) স্বভাব কাহাকে বলে ?
জীবমাত্রেই একটি বিশেষ প্রকৃতি লইয়া জন্মগ্রহণ করে এবং প্রকৃতির অনুগামী হইয়া সে কর্ম করে । এই প্রকৃতি কি ? শাস্ত্রকারগণ বলেন, পূর্বজন্মার্জিত ধর্মাধর্ম-জ্ঞানেচ্ছাদিজনিত যে-সংস্কার তাহা বর্তমান জন্মে অভিব্যক্ত হয়; এই সংস্কারের নামই প্রকৃতি । পূর্বে বলা হইয়াছে যে, ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতির প্রেরণায়ই জীব কর্ম করে [৩|২৭-২৯] । বস্তুত, এই প্রাক্তন সংস্কারের মূলেও সেই ত্রিগুণ । পূর্বজন্মের ধর্মাধর্ম কর্মফলে গুণবিশেষের প্রাবল্য বা হ্রাস হইয়া স্বভাবের যে অবস্থা দাঁড়ায়, তাহাই প্রাচীন সংস্কার বা অভ্যাস । কাহারো মধ্যে সত্ত্বগুণের, কাহাতে রজোগুণের, কাহাতে তমোগুণের প্রাবল্য । আবার গুণত্রয়ের সংযোগে নানাবিধ মিশ্রগুণেরও উৎপত্তি হয়; যথা - সত্ত্ব-রজঃ, রজ-স্তমঃ ইত্যাদি । যখন যাহার মধ্যে যে গুণ প্রবল হয়, তখন তাহার মধ্যে সেই গুণের কার্য হইয়া থাকে । ইহাকেই স্বভাবজ কর্ম বলে । এ-স্থলে বলা হইতেছে, জীবের প্রবৃত্তি স্বভাবেরই অনুবর্তন করে, স্বভাবই বলবান, ইন্দ্রিয়ের নিগ্রহে বা শাস্ত্রাদির শাসনে কোন ফল হয় না ।
৩৪) তবে কি জীবের স্বাতন্ত্র্য নাই, তাহার আত্মোন্নতির উপায় নাই ?
আছে । ইন্দ্রিয়সমূহকে নিগ্রহ বা পীড়ন না করিয়া তাহাদিগকে বশীভূত করিতে হইবে । স্ব-স্ব বিষয়ে রাগদ্বেষ ইন্দ্রিয়ের স্বাভাবিক, কিন্তু জীবের রাগদ্বেষের বশে যাওয়া উচিত নয় । যিনি রাগদ্বেষ হইতে বিমুক্ত, তিনি ইন্দ্রিয়ের অধীন নন, ইন্দ্রিয়সমূহই তাঁহার অধীন হয় । এইরূপ আত্মবশীভূত ইন্দ্রিয়দ্বারা স্বকর্ম করিতে হইবে, স্বধর্ম পালন করিতে হইবে [২|৬৪] ।
- কাম = যে-কোন রূপ ভোগবাসনা ।
- ক্রোধ = বাসনা প্রতিহত হইলেই ক্রোধের উদ্রেক হয় ।
- লোভ = মিষ্টরসাদি বা ধনাদির দিকে অতিমাত্রায় আকৃষ্ট হওয়া ।
- মোহ = বিষয়-বাসনারূপ অজ্ঞান বা মায়া যা আত্মজ্ঞান আচ্ছন্ন করিয়া রাখে, উহার অতীত নিত্যবস্তুকে দেখিতে দেয় না ।
- মদ = এই অজ্ঞানতার ফলে 'আমি ধনী', 'আমি জ্ঞানী' এইরূপ অহমিকা ।
- মাৎসর্য = পরশ্রীকাতরতা; পরের উন্নতি-দর্শনে নিজের অহমিকার খণ্ডনের ফলে উপস্থিত চিত্তক্ষোভ ।
৩৮) বিষয়-বাসনা থাকিতে আত্মজ্ঞানের উদয় হয় না । যেমন ধূম অপসারিত হইলে অগ্নি প্রকাশিত হয়, ধূলিমল অপসারিত হইলে দর্পণের স্বচ্ছতা প্রতিভাত হয়, প্রসবের দ্বারা জরায়ূ প্রসারিত হইলে ভ্রুণের প্রকাশ হয়, সেইরূপ বিষয়-বাসনা বিদূরিত হলে তত্ত্বজ্ঞানের উদয় হয় (সংসারের ক্ষয় হয়) ।
এই অব্যয় যোগ আমি সূর্যকে বলিয়াছিলাম । সূর্য (স্বপুত্র) মনুকে এবং মনু (স্বপুত্র) ইক্ষ্বাকুকে ইহা বলিয়াছিলেন । ১
এইরূপে পুরুষপরম্পরা প্রাপ্ত এই যোগ রাজর্ষিগণ বিদিত ছিলেন । হে পরন্তপ, ইহলোকে সেই যোগ দীর্ঘকালবশে নষ্ট হইয়াছে । ২
তুমি আমার ভক্ত ও সখা, এই জন্য এই সেই পুরাতন যোগ অদ্য তোমাকে বলিলাম; কারণ, ইহা উত্তম গুহ্য তত্ত্ব । ৩
অর্জুন বলিলেন -
আপনার জন্ম পরে, বিবস্বানের জন্ম পূর্বে; সুতরাং আপনি যে পূর্বে ইহা বলিয়াছিলেন, তাহা কিরূপে বুঝিব ? ৪
শ্রীভগবান্ বলিলেন -
হে অর্জুন ! আমার এবং তোমার বহু জন্ম অতীত হইয়াছে । আমি সে সকল জানি; হে পরন্তপ ! তুমি জান না । ৫
আমি জন্মরহিত, অবিনশ্বর এবং সর্বভূতের ঈশ্বর হইয়াও স্বীয় প্রকৃতিতে অনুষ্ঠান করিয়া আত্মমায়ায় আবির্ভূত হই । ৬
হে ভারত ! যখনই যখনই ধর্মের গ্লানি এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, আমি সেই সেই সময়ে নিজেকে সৃষ্টি করি (দেহ ধারণপূর্বক অবতীর্ণ হই) । ৭
সাধুগণের পরিত্রাণ, দুষ্টদিগের বিনাশ এবং ধর্মসংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই । ৮
হে অর্জুন, আমার এই দিব্য জন্ম ও কর্ম যিনি তত্ত্বতঃ জানেন, তিনি দেহত্যাগ করিয়া পুনর্বার আর জন্মপ্রাপ্ত হন না - তিনি আমাকেই প্রাপ্ত হন । ৯
বিষয়ানুরাগ, ভয় ও ক্রোধ বর্জন করিয়া, আমাতে একাগ্রচিত্ত ও আমার শরণাপন্ন হইয়া, আমার জন্মকর্মের তত্ত্বালোচনা রূপ জ্ঞানময় তপস্যাদ্বারা পবিত্র হইয়া অনেকে আমার পরমানন্দভাবে চিরস্থিতি লাভ করিয়াছেন । ১০
হে পার্থ ! যে আমাকে যে-ভাবে উপাসনা করে, আমি তাহাকে সেই ভাবেই তুষ্ট করি । মনুষ্যগণ সর্বপ্রকারে আমার পথেরই অনুসরণ করে অর্থাৎ মনুষ্যগণ যে পথই অনুসরণ করুক না কেন, সকল পথেই আমাতে পৌঁছিতে পারে । ১১
ইহলোকে যাহারা কর্মসিদ্ধি কামনা করে তাহারা দেবতা পূজা করে, কেননা মনুষ্যলোকে কর্মজনিত ফললাভ শীঘ্রই পাওয়া যায় । ১২
বর্ণচতুষ্টয় গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে আমি সৃষ্টি করিয়াছি বটে, কিন্তু আমি উহার সৃষ্টিকর্তা হইলেও আমাকে অকর্তা ও বিকাররহিত বলিয়াই জানিও । ১৩
কর্মসকল আমাকে লিপ্ত করিতে পারে না, কর্মফলে আমার স্পৃহাও নাই, এইরূপে যিনি আমাকে জানেন, তিনি কর্মদ্বারা আবদ্ধ হন না । ১৪
এইরূপ জানিয়া (অর্থাৎ আত্মাকে অকর্তা, অভোক্তা মনে করিয়া) পূর্ববর্তী মোক্ষাভিলাষিগণ অর্থাৎ পূর্ববর্তী জনকাদি রাজর্ষিগণ কর্তৃত্বাভিমান বর্জনপূর্বক নির্লিপ্তভাবে স্বীয় কর্তব্য কর্ম সম্পাদন করিয়া গিয়াছেন, তুমিও সেইরূপ নিষ্কামভাবে স্বীয় কর্তব্য পালন কর । ১৫
কর্ম কি, কর্মশূন্যতাই বা কি, এ বিষয়ে পণ্ডিতেরাও মোহ প্রাপ্ত হন অর্থাৎ ইহার প্রকৃত তত্ত্ব বুঝিতে পারেন না, অতএব কর্ম কি, (এবং অকর্ম কি) তাহা তোমাকে বলিতেছি, তাহা জানিলে অশুভ হইতে (সংসারবন্ধন হইতে) মুক্ত হইবে । ১৬
বিহিত কর্মের বুঝিবার বিষয় আছে, বিকর্ম বা অবিহিত কর্মের বুঝিবার বিষয় আছে, অকর্ম বা কর্মত্যাগ সন্বন্ধেও বুঝিবার বিষয় আছে; কেননা কর্মের গতি (তত্ত্ব) দুর্জ্ঞেয় । ১৭
যিনি কর্মে অকর্ম এবং অকর্মে কর্ম দেখেন মনুষ্যের মধ্যে তিনিই বুদ্ধিমান্; তিনি যোগী, তিনি সর্বকর্মকারী । ১৮
যাঁহার সমস্ত কর্মচেষ্টা, ফলতৃষ্ণা ও কর্ত্তৃত্বাভিমানবর্জিত, সুতরাং যাঁহার কর্ম জ্ঞানরূপ অগ্নিদ্বারা দগ্ধ হইয়াছে, সেইরূপ ব্যক্তিকেই জ্ঞানিগণ পণ্ডিত বলিয়া থাকেন । ১৯
যিনি কর্মে ও কর্মফলে আসক্তি পরিত্যাগ করিয়াছেন, যিনি সদা আপনাতেই পরিতৃপ্ত, যিনি কোন প্রয়োজনে কাহারও আশ্রয় গ্রহণ করেন না, তিনি কর্মে প্রবৃত্ত হইলেও কিছুই করেন না (অর্থাৎ তাঁহার কর্ম অকর্মে পরিণত হয়) । ২০
যিনি কামনা ত্যাগ করিয়াছে, যাঁহার চিত্ত ও ইন্দ্রিয় সংযত, যিনি সর্বপ্রকার দান-উপহারাদি গ্রহণ বর্জন করিয়াছেন, তাদৃশ ব্যক্তি কেবল শরীরদ্বারা কর্মানুষ্ঠান করিয়াও পাপভোগী হন না (কর্মবন্ধনে আবদ্ধ হন না) । ২১
যিনি প্রার্থনা ও বিশেষ চেষ্টা না করিয়া যাহা প্রাপ্ত হওয়া যায় তাহাতেই সন্তুষ্ট থাকেন, যিনি দ্বন্দ্বসহিষ্ণু, মাৎসর্য্যশূন্য সুতরাং বৈরবিহীন, যিনি সিদ্ধি ও অসিদ্ধি তুল্য জ্ঞান করেন, তিনি কর্ম করিয়াও কর্মফলে আবদ্ধ হয়েন না । ২২
যিনি ফলাকাঙ্ক্ষাবর্জিত, রাগদ্বেষাদিমুক্ত, যাঁহার চিত্ত আত্মবিষয়ক জ্ঞানে নিবিষ্ট বা জ্ঞানস্বরূপ ব্রহ্মে অবস্থিতি, যিনি যজ্ঞার্থ (অর্থাৎ ঈশ্বর-প্রীত্যর্থ যজ্ঞস্বরূপ) কর্ম করেন, তাঁহার কর্মসকল ফলসহ বিনষ্ট হইয়া যায়, ঐ কর্মের কোন সংস্কার থাকে না (অর্থাৎ তাহার কর্ম বন্ধনের কারণ হয় না) । ২৩
অর্পণ (স্রুবাদি-যজ্ঞপাত্র) ব্রহ্ম, ঘৃতাদি ব্রহ্ম, অগ্নি ব্রহ্ম, যিনি হোম করেন তিনিও ব্রহ্ম, এইরূপ জ্ঞানে ব্রহ্মরূপ কর্মে একাগ্রচিত্ত পুরুষ ব্রহ্মই প্রাপ্ত হন । ২৪
অন্য কোন কোন যোগিগণ দৈবযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন, অপর কেহ কেহ ব্রহ্মরূপ অগ্নিতে (পূর্বোক্ত ব্রহ্মার্পণ রূপ) যজ্ঞদ্বারাই যজ্ঞার্পণ করেন (অর্থাৎ সর্বকর্ম ব্রহ্মে অর্পণ করেন) । ২৫
অন্যে সংযমরূপ অগ্নিতে চক্ষুকর্ণাদি ইন্দ্রিয়সমূহকে হোম করেন অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গুলিকে রূপরসাদি বিষয় হইতে প্রত্যাহার করিয়া সংযতেন্দ্রিয় হইয়া অবস্থান করেন, ইহার নাম সংযম-যজ্ঞ বা ব্রহ্মচর্য; অন্যে ইন্দ্রিয়রূপ অগ্নিতে শব্দাদি বিষয়সমূহকে আহুতি দেন - অর্থাৎ ইন্দ্রিয়সমূহ শব্দাদি বিষয় গ্রহণ করিতেছে, কিন্তু তিনি রাগদ্বেষশূন্যচিত্তে অনাসক্তভাবে থাকেন । মুমুক্ষু নির্লিপ্ত সংসারীরা এই যজ্ঞ করেন; ইহাকে বলা যায় ইন্দ্রিয়-যজ্ঞ । ২৬
অন্য কেহ (ধ্যানযোগিগণ) সমস্ত ইন্দ্রিয়-কর্ম ও সমস্ত প্রাণকর্ম ব্রহ্মজ্ঞানে প্রদীপিত আত্মসংযম বা সমাধিরূপ যোগাগ্নিতে হোম করেন অর্থাৎ পঞ্চ জ্ঞানেদ্রিয়, পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় ও পঞ্চ প্রাণ - ইহাদের সমস্ত কর্ম নিরোধ করিয়া আত্মানন্দসুখে মগ্ন থাকেন । ইহার নাম আত্মসংযম বা সমাধি যজ্ঞ । ২৭
কেহ কেহ দ্রব্যদানরূপ যজ্ঞ করেন, কেহ কেহ তপোরূপ যজ্ঞ করেন, কেহ কেহ যোগরূপ যজ্ঞ করেন, কোন কোন দৃঢ়ব্রত যতিগণ বেদাভ্যাসরূপ যজ্ঞ করেন, কেহ কেহ বেদার্থপরিজ্ঞানরূপ যজ্ঞ সম্পাদন করেন । ২৮
আবার অন্য যোগিগণ অপান বায়ুতে প্রাণবায়ু এবং প্রাণবায়ুতে অপান বায়ু আহুতি দিয়া প্রাণ ও অপান বায়ুর গতি রোধ করিয়া প্রাণায়াম-পরায়ণ হইয়া থাকেন । ২৯
অপর কোনো-কোনো যোগী মিতাহারী হইয়া (আহার-সংযম-পূর্বক) ইন্দ্রিয়সমূহ প্রাণবায়ুতে আহুতি দেন । এই সকল যজ্ঞবিদ্গণ যজ্ঞদ্বারা পাপমুক্ত হন । ৩০
যাঁহারা অমৃত-স্বরূপ যজ্ঞাবশিষ্ট অন্ন ভোজন করেন, তাঁহারা সনাতন ব্রহ্মপদ লাভ করেন । হে কুরুশ্রেষ্ঠ! যে কোনরূপ যজ্ঞই করে না, তাহার ইহলোকই নাই, পরলোক তো দূরের কথা (অর্থাৎ ইহলোকেই তাহার কোন সুখ হয় না, পরলোকে আর কি হইবে ?) । ৩১
এইরূপ বহুবিধ যজ্ঞ ব্রহ্মের মুখে বিস্তৃত (বিহিত) আছে, এ সকলই কর্মজ অর্থাৎ কায়িক, বাচিক বা মানসিক এই ত্রিবিধ কর্ম হইতে সমুদ্ভূত বলিয়া জানিও; এইরূপ জানিলে মুক্তিলাভ করিবে । ৩২
হে পরস্তপ, দ্রব্যসাধ্য দৈব্যযজ্ঞাদি হইতে জ্ঞানযজ্ঞ শ্রেষ্ঠ; কেননা, ফল-সহিত সমস্ত কর্ম নিঃশেষে জ্ঞানে পরিসমাপ্ত হয় । ৩৩
গুরুচরণে দণ্ডবৎ প্রণামদ্বারা, নানা বিষয় প্রশ্নদ্বারা এবং গুরুসেবা দ্বারা সেই জ্ঞান লাভ কর । জ্ঞানী, তত্ত্বদর্শী গুরু তোমাকে সেই জ্ঞান উপদেশ করিবেন । ৩৪
হে পাণ্ডব, যাহা জানিলে পুনরায় এরূপ (শোকাদি জনিত) মোহ প্রাপ্ত হইবে না, যে জ্ঞানদ্বারা সমস্ত ভূতগ্রাম স্বীয় আত্মাতে এবং অনন্তর আমাতে দেখিতে পাইবে । ৩৫
যদি তুমি সমুদয় পাপী হইতেও অধিক পাপাচারী হও, তথাপি জ্ঞানরূপ তরণী দ্বারা সমুদয় পাপসমুদ্র ঊত্তীর্ণ হইতে পারিবে । ৩৬
হে অর্জুন, যেমন প্রজ্জ্বলিত অগ্নি কাষ্ঠরাশিকে ভস্মীভূত করে, তেমন জ্ঞানরূপ অগ্নি কর্মরাশিকে ভস্মসাৎ করে । ৩৭
ইহলোকে জ্ঞানের ন্যায় পবিত্র আর কিছু নাই । কর্ম-যোগে সিদ্ধ-পুরুষ সেই জ্ঞান কালসহকারে আপনিই অন্তরে লাভ করে । ৩৮
যিনি শ্রদ্ধাবান্, একনিষ্ঠ সাধন-তৎপর এবং জিতেন্দ্রিয়, তিনিই জ্ঞানলাভ করেন । আত্মজ্ঞান লাভ করিয়া অচিরাৎ পরম শান্তি লাভ করেন । ৩৯
অজ্ঞ, শ্রদ্ধাহীন, সংশয়াকুল, ব্যক্তি বিনষ্ট হয়, সংশয়াত্মার ইহলোকও নাই, পরলোকই নাই, সুখও নাই । ৪০
নিষ্কাম কর্মযোগের দ্বারা যাঁহার কর্ম ঈশ্বরে সমর্পিত হইয়াছে, আত্মদর্শনরূপ জ্ঞানের দ্বারা যাঁহার সকল সংশয় ছিন্ন হইয়াছে, এইরূপ অপ্রমাদী আত্মবিদ্ পুরুষকে কর্মসকল আবদ্ধ করিতে পারে না অর্থাৎ তিনি কর্ম করিলেও কর্মফলে আবদ্ধ হন না । ৪১
অতএব হে, ভারত, অজ্ঞাতজাত হৃদয়স্থ এই তোমার সংশয়রাশিকে আত্মজ্ঞানরূপ খড়্গদ্বারা ছেদন করিয়া নিষ্কাম কর্মযোগ অবলম্বন কর, উঠ, যুদ্ধ কর । ৪২
৯-১০) লীলা-তত্ত্বের অনুধ্যানই শ্রেষ্ঠ সাধনা
শ্রেষ্ঠ অধ্যাত্মতত্ত্ব : শ্রীভগবান অজ, অব্যয়, অব্যক্ত হইয়াও কিরূপে আত্মমায়ার দ্বারা অবতীর্ণ হন ।
দিব্য কর্মতত্ত্ব : তিনি নিষ্ক্রিয়, অকর্তা হইয়াও নির্লিপ্তভাবে কিরূপে কর্ম করেন ।
ভক্তি-তত্ত্ব : তিনি নির্গুণ হইয়াও সগুণ, অশেষকল্যাণগুণোপেত, অহেতুক কৃপাসিন্ধু; লোকসংগ্রার্থ, লোকশিক্ষার্থ বা ভক্তবাঞ্ছাপূরণার্থ তাঁহার এই লীলা - এই তত্ত্ব ।
'অবতারের আগমনের নিগূঢ় ফল তাহারা ল্ভ করে, যাহারা ইহা হইতে দিব্য জম্ন ও দিব্য কর্মের প্রকৃত মর্ম বুঝিতে পারে, যাহাদের চিত্ত তাঁহার চিন্তাতেই পূর্ণ হয়, যাহারা সর্বতোভাবে তাঁহার আশ্রয় গ্রহণ করে, যাহারা জ্ঞানের দ্বারা শুদ্ধ হইয়া এবং নিম্ন প্রকৃতি হইতে মুক্ত হইয়া দিব্য সত্তা ও দিব্য প্রকৃতি লাভ করে ।' [শ্রীঅরবিন্দের গীতা]
চতুর্বর্ণের উৎপত্তি
যিনি যজ্ঞ করিতে বসিয়া স্রুবাদি (হবিঃ-অর্পণ করিবার জন্য হাতা) কিছু দেখিতে পান না, সর্বত্রই ব্রহ্ম দর্শন করেন, ব্রহ্ম ব্যতীত আর-কিছু ভাবনা করিতে পারেন না, ব্রহ্মে একাগ্রচিত্ত সেই যোগী পুরুষ ব্রহ্মই প্রাপ্ত হন । এই স্থলে 'যজ্ঞ'-শব্দ রূপার্থক; বস্তুত জ্ঞানীর কর্মকেই এখানে যজ্ঞরূপে কল্পনা করা হইয়াছে । ইহাই কর্মযোগের শেষ কথা, এই অবস্থায় কর্ম জ্ঞানে পরিসমাপ্ত হয় । এই জন্যই বলা হইয়াছে, 'সাংখ্যগণ যে স্থান লাভ করেন, কর্মযোগীও তাহাই প্রাপ্ত হন' [৫|৫] । যাঁহারা 'সাংখ্যযোগ ও কর্মযোগকে পৃথক বলেন তাঁহারা অজ্ঞ' [৫|৪] । 'সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম' (এ-সমস্তই ব্রহ্ম), 'অহং ব্রহ্মাস্মি' (আমি ব্রহ্ম), ইত্যাদি শ্রুতিবাক্য এই জ্ঞানই প্রচার করিয়াছেন । জীবের অহংবুদ্ধি যখন সম্পূর্ণ বিদূরিত হয়, তখনই এই পূর্ণ একত্বের জ্ঞান আবির্ভূত হয় । তখন জ্ঞাতা-জ্ঞেয়, উপাস্য-উপাসক, কর্তা-কর্ম-করণ এইসকল ভেদবুদ্ধি থাকে না; সর্বত্রই এক তত্ত্ব, এক শক্তিই আবির্ভূত হয় । এইরূপ জ্ঞানে যিনি কর্ম করিতে পারেন, জীবনযাপন করিতে পারেন, তাঁহার কর্ম-বন্ধন কি ? তিনি তো মুক্ত পুরুষ ।
কর্ম, ভক্তি, জ্ঞান - এই তিন মার্গেরই শেষ ফল অদ্বয় তত্ত্বোপলব্ধি, পার্থক্য প্রারম্ভে ও সাধনাবস্থায় ।
- কর্মীর আরম্ভ লোকরক্ষার্থ বা ঈশ্বরপ্রীত্যর্থ নিষ্কাম কর্মে;
- ভক্তের আরম্ভ নিষ্কাম উপাসনায়;
- জ্ঞানমার্গী সাধকগণ প্রারম্ভ হইতেই অদ্বৈতভাবে চিন্তা করেন ।
প্রকৃত পক্ষে জ্ঞানমার্গী সাধকগণদের কোনো উপাসনা নাই, কেননা সকলই যখন ব্রহ্ম, তখন কে কাহার উপাসনা করিবে ? কেবল ব্রহ্মচিন্তাই তাঁহাদের উপাসনা, তাই এই উপাসনার নাম 'বিশিষ্ট চিন্তা' । ইহা ত্রিবিধ -
- অঙ্গাববিদ্ধ উপাসনা = যজ্ঞের অঙ্গবিশেষকে ব্রহ্ম ভাবনা করা ।
- প্রতীক উপাসনা = যাহা ব্রহ্ম নয়, তাহাকে ব্রহ্ম-ভাবনা, যেমন মনকে ব্রহ্ম ভাবিয়া উপাসনা করা ।
- অহংগ্রহ = আত্মা ব্রহ্ম হইতে অভিন্ন, আমিই ব্রহ্ম ('অহং ব্রহ্মাস্মি') - এইরূপ ভাব-সাধনা ।
- দৈবযজ্ঞ : ইন্দ্র-বরুণাদি দেবতার উদ্দেশে
- ব্রহ্মার্পণ যজ্ঞ বা জ্ঞানযজ্ঞ : ব্রহ্মাগ্নিতে জীবাত্মার আহুতি
- সংযমযজ্ঞ : ব্রহ্মচর্য অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গুলিকে রূপরসাদি-বিষয় হইতে প্রত্যাহার
- ইন্দ্রিয়যজ্ঞ : ইন্দ্রিয়রূপ অগ্নিতে শব্দাদি-বিষয়সমূহের আহূতি (নির্লিপ্ত সংসারী)
- আত্মসংযম বা সমাধি-যজ্ঞ : আত্মাতে চিত্তকে একাগ্র করা (ধ্যানযোগিগণ)
- প্রাণবায়ুর কর্ম : বহির্নয়ন
- অপান বায়ু্র কর্ম : অধোনয়ন
- ব্যান বায়ু্র কর্ম : আকুঞ্চন ও প্রসারণ
- উদান বায়ু্র কর্ম : ঊর্দ্ধনয়ন
- সমান বায়ুর কর্ম : ভুক্তপদার্থের পরিপাক-করণ
- দ্রব্যযজ্ঞ : দ্রব্যত্যাগরূপ যজ্ঞ । পূর্বের দৈবযজ্ঞ ও ব্রহ্মার্পণ যজ্ঞও দ্রব্যযজ্ঞ । উহা শ্রৌত কর্ম, আর বাপী-কূপাদি খনন, দেবমন্দির প্রতিষ্ঠা, অন্নসত্র দান ইত্যাদি স্মার্ত-কর্ম । এ-সকল এবং পুষ্পপত্র-নৈবেদ্যাদি দ্বারা পূজার্চনা সমস্তই দ্রব্যযজ্ঞ ।
- তপোযজ্ঞ : কৃচ্ছ্র-চান্দ্রায়ণাদি উপবাস ব্রত
- যোগযজ্ঞ : অষ্টাঙ্গ যোগ বা রাজযোগ - যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি ।
- স্বাধ্যায়-যজ্ঞ : ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করিয়া শ্রদ্ধাপূর্বক যথাবিধি বেদাভ্যাস
- বেদজ্ঞান-যজ্ঞ : যুক্তিদ্বারা বেদার্থ নিশ্চয় করা
হে কৃষ্ণ ! তুমি কর্মত্যাগ ও কর্মযোগ উভয়ই বলিতেছ, এই উভয়ের মধ্যে যাহা শ্রেয়স্কর সেই একটি আমাকে নিশ্চয় করিয়া বল । ১
শ্রীভগবান্ কহিলেন -
সন্ন্যাস ও কর্মযোগ উভয়েই মোক্ষপ্রদ, কিন্তু উভয়ের মধ্যে কর্মসন্ন্যাস অপেক্ষা কর্মযোগই শ্রেষ্ঠ । ২
হে মহাবাহো, যিনি কিছু আকাঙ্ক্ষা করেন না, রাগ-দ্বেষও করেন না, তাঁহাকে নিত্যসন্ন্যাসী জানিও; তাদৃশ রাগ-দ্বেষাদি-দ্বন্দ্বশূন্য শুদ্ধচিত্ত পুরুষ অনায়াসে সংসারবন্ধন হইতে মুক্তি লাভ করেন । ৩
অজ্ঞ ব্যক্তিগণই সন্ন্যাস ও কর্মযোগকে পৃথক্ বলিয়া থাকেন, পণ্ডিতগণ এরূপ বলেন না । ইহার একটি সম্যক্ অনুষ্ঠিত হইলে উভয়ের ফল (মোক্ষ) লাভ হয় । ৪
সাংখ্যগণ যে স্থান লাভ করেন কর্মযোগিগণও সেই স্থান প্রাপ্ত হন । যিনি সন্ন্যাস ও কর্মযোগকে একরূপ দেখেন তিনিই যথার্থদর্শী । ৫
হে মহাবাহো, কর্মযোগ বিনা সন্ন্যাস কেবল দুঃখের কারণ হয় । কিন্তু কর্মযোগযুক্ত সাধক অচিরেই ব্রহ্ম সাক্ষাৎকার লাভ করেন । ৬
যিনি কর্মযোগে যুক্ত, বিশুদ্ধচিত্ত, সংযতদেহ, জিতেন্দ্রিয় এবং সর্বভূতের আত্মাই যাহার আত্মস্বরূপ, এরূপ সম্যগ্দর্শী পুরুষ কর্ম করিয়াও কর্মে আবদ্ধ হন না । ৭
কর্মযোগে যুক্ত তত্ত্বদর্শী পুরুষ দর্শন, শ্রবণ, স্পর্শ, ঘ্রাণ, ভোজন, গমন, নিদ্রা, নিঃশ্বাস গ্রহণ, কথন, ত্যাগ, গ্রহণ, উন্মেষ ও নিমেষ প্রভৃতি কার্য করিয়াও মনে করেন, - ইন্দ্রিয়সকলই ইন্দ্রিয়বিষয়ে প্রবৃত্ত হইতেছে, আমি কিছুই করিনা (ইন্দ্রিয়দ্বারা কর্ম করিলেও কর্তৃত্বাভিমান-বর্জনহেতু তাঁহার কর্মবন্ধন হয় না) । ৮,৯
যিনি ব্রহ্মে সমুদয় কর্ম স্থাপনপূর্বক ফলাসক্তি ও কর্তৃত্বাভিমান ত্যাগ করিয়া কর্ম করেন, তিনি পাপে লিপ্ত হন না, যেমন পদ্মপত্র জলসংসৃষ্ট থাকিয়াও জলদ্বারা লিপ্ত হয় না । ১০
কর্মযোগিগণ ফলকামনা ও কর্তৃত্বাভিনিবেশ পরিত্যাগ করিয়া চিত্তশুদ্ধির নিমিত্ত কেবল শরীর, মন, বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয়াদি দ্বারা কর্ম করিয়া থাকেন । ১১
নিষ্কাম কর্মযোগিগণ কর্মফল ত্যাগ করিয়া সর্বদুঃখ-নিবৃত্তিরূপ স্থিরা শান্তি লাভ করেন । সকাম বহির্মুখ ব্যক্তিগণ কামনাবশতঃ ফলে আসক্ত হইয়া বন্ধনদশা প্রাপ্ত হন । ১২
জিতেন্দ্রিয় পুরুষ (কর্মযোগী) মনে মনে সমস্ত কর্ম ত্যাগ করিয়া নবদ্বারমুক্ত দেহে সুখে বাস করেন, তিনি কিছু করেন না, অন্যকেও কিছু করান না । ১৩
প্রভু (আত্মা) লোকের কর্তৃত্ব করেন না, কর্ম সৃষ্টি করেন না, সুখদুঃখরূপ কর্মফলসন্বন্ধও রচনা করেন না, কিন্তু প্রকৃতিই কর্মে প্রবৃত্ত হয় । ১৪
সর্বব্যাপী আত্মা কাহারও পাপ বা পুণ্য গ্রহণ করেন না; অজ্ঞান কর্তৃক জ্ঞান আচ্ছন্ন থাকে বলিয়া জীব মোহপ্রাপ্ত হয় । ১৫
কিন্তু যাহাদের আত্ম-বিষয়ক জ্ঞানদ্বারা সেই অজ্ঞান বিনষ্ট হয় তাহাদিগের সেই আত্মজ্ঞান সূর্যবৎ পরম তত্ত্বকে প্রকাশ করিয়া দেয়, অর্থাৎ সূর্য যেরূপ তমোনাশ করিয়া সমস্ত বস্তু প্রকাশিত করেন, সেইরূপ আত্মজ্ঞান জীবের সমস্ত মোহ দূর করিয়া পরম পুরুষকে প্রকাশ করিয়া দেয় । ১৬
যাঁহাদের নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি সেই পরম পুরুষেই নিবিষ্ট হইয়াছে, তাহাতেই যাঁহাদের আত্মভার, তাহাতেই যাঁহাদের নিষ্ঠা, তিনিই যাঁহাদের পরমগতি এবং অনুরক্তির বিষয়, তাঁহাদের আর পুনরায় দেহধারণ করিতে হয় না, কারণ জ্ঞানের দ্বারা তাঁহাদের সংসার-কারণ অজ্ঞান দূরীভূত হইয়াছে । ১৭
বিদ্যাবিনয়যুক্ত ব্রাহ্মণে, চণ্ডালে, গো, হস্তী ও কুক্কুরে আত্মবিৎ পণ্ডিতগণ সমদর্শী । ১৮
যাহাদিগের মন সাম্যে অবস্থিত অর্থাৎ সর্ববিষয়ে বৈষম্য-রহিত, তাহারা ইহলোকে থাকিয়াই এই জনন-মরণ-রূপ সংসার অতিক্রম করেন; যেহেতু, ব্রহ্ম সম ও নির্দোষ, সুতরাং সেই সমদর্শী পুরুষগণ ব্রহ্মেই অবস্থিতি করেন অর্থাৎ ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হন । ১৯
ঈদৃশ ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তি স্থিরবুদ্ধি, সর্বপ্রকার মোহ-বর্জিত এবং ব্রহ্মেই অবস্থিত অর্থাৎ ব্রহ্মভাবে ভাবিত; সুতরাং তিনি প্রিয়বস্তু লাভেও হৃষ্ট হন না, অপ্রিয় সমাগমেও উদ্বিগ্ন হন না (তিনি শুভাশুভ, প্রিয়াপ্রিয় ইত্যাদি দ্বন্দ্ববর্জিত) । ২০
বাহ্যবিষয়ে অনাসক্ত, ব্রহ্মে সমাহিতচিত্ত পুরুষ আত্মায় যে আনন্দ আছে তাহা লাভ করেন, তিনি অক্ষয় আনন্দ উপভোগ করেন । ২১
বিষয়ভোগজনিত যে সকল সুখ সে সকল নিশ্চয়ই দুঃখের হেতু এবং আদি ও অন্তবিশিষ্ট (ক্ষণস্থায়ী, অনিত্য), বিবেকী ব্যক্তি উহাতে রত হন না । ২২
যিনি দেহত্যাগ করিবার পূর্বে এই সংসারে থাকিয়াই কামক্রোধজাত বেগ প্রতিরোধ করিতে পারেন, তিনিই যোগী, তিনিই সুখী পুরুষ । ২৩
যাঁহার অন্তরে (আত্মাতেই) সুখ, যাঁহার অন্তরে (আত্মাতেই) আরাম ও শান্তি, যাঁহার অন্তরেই আলোক, সেই যোগী ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হন । ২৪
যাঁহারা নিষ্পাপ, সংশয়শূন্য, সংযতচিত্ত, সর্বভূতহিতে রত, সেইরূপ ঋষিগণ ব্রহ্মনির্বাণ প্রাপ্ত হন । ২৫
কামক্রোধবিমুক্ত, সংযতচিত্ত আত্মদর্শী যতিগণের ব্রহ্মনির্বাণ নিকটেই, চারিদিকেই বর্তমান অর্থাৎ তাঁহারা ব্রহ্মনির্বাণের মধ্যেই বাস করেন । ২৬
বাহ্যবিষয়সমূহ মন হইতে বহিষ্কৃত করিয়া; - চক্ষুর্দ্বয়কে ভ্রূমধ্যে স্থাপন করিয়া, প্রাণ ও অপান বায়ুর ঊর্ধ্ব ও অধো গতি সমান করিয়া, উহাদিগকে নাসামধ্যে রাখিয়া যিনি ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধিকে সংযত করিযাছেন এবং যিনি মোক্ষপরায়ণ, ইচ্ছাভয়ক্রোধবর্জিত ও আত্মমননশীল - তিনি সর্বদাই মুক্ত । ২৭,২৮
মুক্ত যোগিপুরুষ আমাকে যজ্ঞ ও তপস্যাসমূহের ভোক্তা, সর্বলোকের মহেশ্বর এবং সর্বলোকের সুহৃদ্ জানিয়া পরম শান্তি লাভ করেন । ২৯
এই অধ্যায়ের ১৩-১৪-১৫ শ্লোকে বর্ণিত তত্ত্বগুলি মূলত সাংখ্যশাস্ত্রের । সাংখ্যদর্শন নিরীশ্বর; উহার মূলে দুইটি তত্ত্ব - নিষ্ক্রিয় পুরুষ আর ক্রিয়াশীল প্রকৃতি । বেদান্তদর্শনের পরিভাষায় সাংখ্যের নিষ্ক্রিয় পুরুষ বা আত্মাই নির্গুণ ব্রহ্ম, আর প্রকৃতি হইতেছেন মায়া বা অজ্ঞান । মায়াতত্ত্ব অনুযায়ী এক ব্রহ্মই সত্য । বেদান্তে ব্রহ্মের নির্গুণ-সগুণ দুই বিভাবেরই বর্ণনা আছে এবং গীতাও তাহাই অনুসরণ করিয়াছেন । শ্রীগীতা অনুযায়ী অজ্ঞান অর্থ জ্ঞানের অভাব বা ভ্রান্ত জ্ঞান । ঈশ্বরই পরতত্ত্ব, পরমাত্মা, পুরুষোত্তম । সাংখ্যের পুরুষ ও প্রকৃতি তাঁরই পরা ও অপরা প্রকৃতি, শক্তি বা বিভাব ।
১৮) আপাততঃ বিষম বস্তুতে সমদর্শন হয় কখন ? যখন আত্মস্বরূপ বা ব্রহ্মস্বরূপ দর্শন হয় । আত্মজ্ঞানের ফলই সমত্ব । আত্মদর্শী পণ্ডিতগণ জগৎকে ব্রহ্ম-দৃষ্টিতে দেখেন । এই ব্রহ্মই নারায়ণ পদবাচ্য । তাঁহাদের দৃষ্টিতে ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল, পাপী, পুণ্যবান, গাভী, হস্তী, কুক্কুর সকলই নারায়ণ ।
কর্মফলে আকাঙ্ক্ষা না করিয়া যিনি কর্তব্য-কর্ম করেন, তিনিই সন্ন্যাসী, তিনিই যোগী । যিনি যজ্ঞাদি শ্রৌতকর্ম ত্যাগ করিয়াছেন অথবা সর্ববিধ শারীরকর্ম ত্যাগ করিয়াছেন, তিনি নহেন । ১
হে পাণ্ডব, যাহাকে সন্ন্যাস বলে, তাহাই যোগ বলিয়া জানিও, কেননা, সঙ্কল্পত্যাগ না করিলে কেহই যোগী হইতে পারে না । ২
যোগে আরোহণেচ্ছু মুনির পক্ষে নিষ্কামকর্মই যোগ-সিদ্ধির কারণ, যোগারূঢ় হইলে চিত্তের সমতাই ব্রাহ্মীস্থিতিতে নিশ্চল থাকিবার কারণ । ৩
যখন সাধক সর্বসঙ্কল্প ত্যাগ করায় রূপরসাদি ইন্দ্রিয় ভোগ্যবিষয়ে এবং কর্মে আসক্ত হন না, তখন তিনি যোগারূঢ় বলিয়া উক্ত হন । ৪
আত্মার দ্বারাই আত্মাকে বিষয়কূপ হইতে উদ্ধার করিবে, আত্মাকে অবসর করিবে না (নিম্নদিকে যাইতে দিবে না) । কেননা, আত্মাই আত্মার বন্ধু এবং আত্মাই আত্মার শত্রু । ৫
যে আত্মাদ্বারা আত্মা বশীভূত হইয়াছে, সেই আত্মাই আত্মার বন্ধু । অজিতাত্মার আত্মা শত্রুবৎ অপকারে প্রবৃত্ত হয় । ৬
জিতেন্দ্রিয়, প্রশান্ত অর্থাৎ রাগদ্বেষাদিশূন্য ব্যক্তির পরমাত্মা শীত-গ্রীষ্ম, সুখ-দুঃখ, অথবা মান-অপমান প্রাপ্ত হইলেও সমাহিত থাকে (অর্থাৎ অবিচলিতভাবে আপন সম-শান্ত-স্বরূপে অবস্থান করে) । ৭
যাঁহার চিত্ত শাস্ত্রাদির উপদেশজাত জ্ঞান ও উপদিষ্ট তত্ত্বের প্রত্যক্ষ অনুভূতির দ্বারা পরিতৃপ্ত, যিনি বিষয়-সন্নিধানেও নির্বিকার ও জিতেন্দ্রিয়, মৃৎপিণ্ড পাষাণ ও সুবর্ণখণ্ডে যাঁহারা সমদৃষ্ট, ঈদৃশ যোগীকে যুক্ত (যোগসিদ্ধ) বলে । ৮
সুহৃৎ, মিত্র, শত্রু, উদাসীন, মধ্যস্থ, দ্বেষ্য, বন্ধু, সাধু ও অসাধু - এই সকলের প্রতি যাঁহার সমান বুদ্ধি, তিনিই প্রশংসনীয় অর্থাৎ তিনি সর্ববিষয়ে সকলের প্রতি রাগদ্বেষশূন্য, তিনিই শ্রেষ্ঠ । ৯
যোগী একাকী নির্জন স্থানে থাকিয়া সংযতচিত্ত, সংযতদেহ, আকাঙ্ক্ষাশূন্য ও পরিগ্রহশূন্য হইয়া চিত্তকে সতত সমাধি অভ্যাস করাইবেন । ১০
পবিত্র স্থানে নিজ আসন স্থাপন করিবে; আসন যেন অতি উচ্চ অথবা অতি নিম্ন না হয় । কুশের উপরে ব্যাঘ্রাদির চর্ম এবং তাহার উপর বস্ত্র পাতিয়া আসন প্রস্তুত করিতে হয়; সেই আসনে উপবেশন করিয়া চিত্ত ও ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়া সংযমপূর্বক মনকে একাগ্র করিয়া আত্মশুদ্ধির জন্য যোগ অভ্যাস করিবে । ১১,১২
শরীর (মেরুদণ্ড), মস্তক ও গ্রীবা সরলভাবে ও নিশ্চলভাবে রাখিয়া সুস্থির হইয়া আপনার নাসাগ্রবর্তী আকাশে দৃষ্টি রাখিবে, এদিক্ ওদিক্ তাকাইবে না; (এইরূপে উপবেশন করিয়া) প্রশান্ত-চিত্ত, ভয়বর্জিত, ব্রহ্মচর্যশীল হইয়া মনঃসংযমপূর্বক মৎপরায়ণ মদ্গতচিত্ত হইয়া সমাধিস্থ হইবে । ১৩,১৪
পূর্বোক্ত প্রকারে নিরন্তর মনঃসমাধান করিতে করিতে মন একাগ্র হইয়া নিশ্চল হয় । এইরূপ স্থিরচিত্ত যোগী নির্বাণরূপ পরম শান্তি লাভ করেন । এই শান্তি আমাতেই স্থিতির ফল । ১৫
হে অর্জুন, কিন্তু যিনি অত্যধিক আহার করেন অথবা যিনি একান্ত অনাহারী, তাঁহার যোগ হয় না; অতিশয় নিদ্রালু বা অতিজাগরণশীলের যোগসমাধি হয় না । ১৬
যিনি পরিমিতরূপ আহার-বিহার করেন, পরিমিতরূপ কর্মচেষ্টা করেন, পরিমিতরূপে নিদ্রিত ও জাগ্রত থাকেন, তাঁহার যোগ দুঃখনিবর্তক হয় । ১৭
যখন চিত্ত বিশেষরূপে নিরুদ্ধ হইয়া আত্মাতেই অবস্থিতি করে, তখন যোগী সর্বকামনাশূন্য হয় । ঈদৃশ যোগী পুরুষই যোগসিদ্ধ বলিয়া কথিত হন । ১৮
নির্বাত-প্রদেশে স্থিত দীপশিখা যেমন চঞ্চল হয় না, আত্মবিষয়ক যোগাভ্যাসকারী সংযতচিত্ত যোগীর অচঞ্চল চিত্তের উহাই দৃষ্টান্ত । ১৯
যে অবস্থায় যোগাভ্যাসদ্বারা নিরুদ্ধ চিত্ত উপরত (সর্ববৃত্তিশূন্য, নিষ্ক্রিয়) হয় এবং যে অবস্থায় আত্মাদ্বারা আত্মাতেই আত্মাকে দেখিয়া পরিতোষ লাভ হয় (তাহাই যোগ শব্দ বাচ্য জানিও) । ২০
যে অবস্থায় ইন্দ্রিয়ের অগোচর, কেবল শুদ্ধ বুদ্ধিগ্রাহ্য যে নিরতিশয় সুখ (আত্মানন্দ) যোগী তাহাই অনুভব করেন এবং যে অবস্থায় স্থিতি লাভ করিয়া আত্মস্বরূপ হইতে বিচলিত হন না, তাহাই যোগশব্দবাচ্য জানিবে । ২১
যে অবস্থা লাভ করিলে যোগী অন্য কোন লাভ ইহার অপেক্ষা অধিক সুখ-কর বলিয়া বোধ করেন না এবং যে অবস্থায় স্থিতি লাভ করিলে মহাদুঃখেও বিচলিত হন না (তাহাই যোগশব্দবাচ্য জানিবে) । ২২
এইরূপ অবস্থায় (চিত্তবৃত্তিনিরোধে) দুঃখসংযোগের বিয়োগ হয়, এই দুঃখ-বিয়োগই যোগশব্দবাচ্য । এই যোগ নির্বেদশূন্য চিত্তে অধ্যবসায় সহকারে অভ্যাস করা কর্তব্য । ২৩
সংকল্পজাত কামনাসমূহকে বিশেষরূপে ত্যাগ করিয়া, মনের দ্বারা (চক্ষুরাদি) ইন্দ্রিয়সমূহকে বিষয় ব্যাপার হইতে নিবৃত্ত করিয়া, ধৈর্য্যযুক্ত বুদ্ধিদ্বারা মন ধীরে ধীরে নিরুদ্ধ করিবে এবং এইরূপ নিরুদ্ধ মনকে আত্মাতে নিহিত করিয়া (আত্মাকারবিশিষ্ট করিয়া) কিছুই ভাবনা করিবে না । ২৪,২৫
মন স্বভাবতঃ চঞ্চল, অতএব অস্থির হইয়া উহা যে যে বিষয়ে ধাবিত হয়, সেই সেই বিষয় হইতে উহাকে প্রত্যাহার করিয়া আত্মাতেই স্থির করিয়া রাখিবে । ২৬
এইরূপ যোগসিদ্ধ পুরুষ চিত্তবিক্ষেপক রজোগুণবিহীন এবং চিত্তলয়ের কারণ তমোগুণ বর্জিত হইয়া ব্রহ্মভাব লাভ করেন, ঈদৃশ প্রশান্তচিত্ত যোগীকে নির্মল সমাধি-সুখ আশ্রয় করে । ২৭
এই রূপে সদা মনকে সমাহিত করিয়া নিষ্পাপ হওয়ায় যোগী ব্রহ্মানুভবরূপ নিরতিশয় সুখ লাভ করেন । ২৮
এইরূপ যোগযুক্ত পুরুষ সর্বত্র সমদর্শী হইয়া আত্মাকে সর্বভূতে এবং সর্বভূতকে আত্মাতে দর্শন করিয়া থাকেন । ২৯
যিনি আমাকে সর্বভূতে অবস্থিত দেখেন এবং আমাতে সর্বভূত অবস্থিত দেখেন, আমি তাহার অদৃশ্য হই না, তিনিও আমার অদৃশ্য হন না । ৩০
যে যোগী সমত্ববুদ্ধি অবলম্বনপূর্বক সর্বভূতে ভেদজ্ঞান পরিত্যাগ করিয়া সর্বভূতস্থিত আমাকে ভজনা করেন, তিনি যে অবস্থায়ই থাকুন না কেন, আমাতেই অবস্থান করেন । ৩১
হে অর্জুন, সুখই হউক, আর দুঃখই হউক, যে ব্যক্তি আত্মসাদৃশ্যে সর্বত্র সমদর্শী সেই যোগী সর্বশ্রেষ্ঠ ইহাই আমার অভিমত । ৩২
অর্জুন বলিলেন -
হে মধুসূদন, তুমি এই যে সমত্বরূপ যোগতত্ত্ব ব্যাখ্যা করিলে, মন যেরূপ চঞ্চল তাহাতে এই সমত্বভাব স্থায়ী হয় বলিয়া আমার বোধ হয় না । ৩৩
হে কৃষ্ণ, মন স্বভাবতঃই চঞ্চল, ইন্দ্রিয়াদির বিক্ষেপজনক মহাশক্তিশালী (বিচারবুদ্ধি বা কোনরূপ মন্ত্রৌষধিরও অজেয়), দৃঢ় (লৌহবৎ কঠিন, অনমনীয়); এই হেতু আমি মনে করি বায়ুকে আবদ্ধ করিয়া রাখা যেরূপ দুঃসাধ্য, মনকে নিরোধ করাও সেইরূপ সুদুষ্কর । ৩৪
শ্রীভবগান্ বলিলেন -
হে মহাবাহো ! মন স্বভাবতঃ চঞ্চল, উহাকে নিরোধ করা দুষ্কর, তাহাতে সংশয় নাই । কিন্তু হে কৌন্তেয়, অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা উহাকে বশীভূত করা যায় । ৩৫
অভ্যাস ও বৈরাগ্য দ্বারা যাহার চিত্ত সংযত হয় নাই তাহার পক্ষে যোগ দুষ্প্রাপ্য, ইহা আমারও মত; কিন্তু বিহিত উপায় অবলম্বন করিয়া সতত যত্ন করিলে চিত্ত বশীভূত হয় এবং যোগলাভ হইতে পারে । ৩৬
অর্জুন কহিলেন -
হে কৃষ্ণ, যিনি প্রথমে শ্রদ্ধাসহকারে যোগাভ্যাসে প্রবৃত্ত হন, কিন্তু যত্নের শিথিলতাবশতঃ যোগ হইতে ভ্রষ্টচিত্ত হওয়ায় যোগসিদ্ধি লাভে অসমর্থ হন, তিনি কি প্রকার গতি প্রাপ্ত হন ? ৩৭
হে মহাবাহো, তিনি ব্রহ্মপ্রাপ্তির উপায়ভূত যোগমার্গে অকৃতকার্য হওয়াতে মোক্ষ হইতে বঞ্চিত হন, এবং কাম্য কর্মের ত্যাগহেতু স্বর্গাদি হইতেও বঞ্চিত হন, সুতরাং ভোগ মোক্ষরূপ পুরুষার্থদ্বয় ভ্রষ্ট হইয়া, ছিন্ন মেঘখণ্ডের ন্যায় (মেঘখণ্ড যেমন মূল মেঘরাশি হইতে ছিন্ন হইয়া অপর মেঘরাশি প্রাপ্ত না হইলে মধ্যস্থলে বিলীন হইয়া যায় তদ্রুপ) নষ্ট হন না কি ? ৩৮
হে কৃষ্ণ, তুমি আমার সংশয় নিঃশেষরূপে ছেদন করিয়া দাও, কেননা, তুমি ভিন্ন আমার এই সংশয়ের অপনেতা আর কেহ নাই । ৩৯
শ্রীভগবান্ বলিলেন -
হে পার্থ, যোগভ্রষ্ট ব্যক্তির ইহলোকে কি পরলোকে কুত্রাপি বিনাশ নাই । কারণ, হে বৎস, শুভকর্মকারী পুরুষ কখনও দুর্গতি প্রাপ্ত হন না । ৪০
যোগভ্রষ্ট পুরুষ পুণ্যকর্মকারীদিগের প্রাপ্য স্বর্গলোকাদি প্রাপ্ত হইয়া তথায় বহু বৎসর বাস করিয়া পরে সদাচার সম্পন্ন ধনীর গৃহে জন্মগ্রহণ করেন । ৪১
পক্ষান্তরে, যোগভ্রষ্ট পুরুষ জ্ঞানবান্ যোগীদিগের কুলে জন্মগ্রহণ করেন । জগতে ঈদৃশ জন্ম অতি দুর্লভ (যেমন ব্যাসতনয় শুকদেবের) । ৪২
হে কুরুনন্দন, যোগভ্রষ্ট পুরুষ সেই জন্মে পূর্বজন্মের অভ্যস্ত মোক্ষবিষয়ক বুদ্ধি লাভ করেন এবং মুক্তিলাভের জন্য পুনর্বার যত্ন করেন । ৪৩
তিনি অবশ হইয়াই পূর্বজন্মের যোগাভ্যাসজনিত শুভ সংস্কারবশতঃ যোগমার্গে আকৃষ্ট হন । যিনি কেবল যোগের স্বরূপ-জিজ্ঞাসু, তিনিই বেদোক্ত কাম্যকর্মাদির ফল অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ফল লাভ করেন (যিনি যোগের স্বরূপ জানিয়া যোগাভ্যাস-পরায়ণ তাঁহার আর কথা কি ?) । ৪৪
সেই যোগী পূর্বাপেক্ষাও অধিকতর যত্ন করেন, ক্রমে যোগাভ্যাসদ্বারা নিষ্পাপ হইয়া বহু জন্মের চেষ্টায় সিদ্ধিলাভ করিয়া পরম গতি লাভ করেন । ৪৫
যোগী তপস্বিগণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, জ্ঞানিগণ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ, কর্মিগণ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ, ইহাই আমার মত; অতএব হে অর্জুন, তুমি যোগী হয় । ৪৬
যিনি শ্রদ্ধাবান্ হইয়া মদ্গতচিত্তে আমার ভজনা করেন, সকল যোগীর মধ্যে তিনিই আমার সহিত যোগে সর্বাপেক্ষা অধিক যুক্ত, ইহাই আমার অভিমত অর্থাৎ ভগবানে ঐকান্তিক ভক্তিপরায়ণ যোগীই শ্রেষ্ঠ সাধক । ৪৭
আত্মশক্তি ও কৃপাবাদ : আমাদের শাস্ত্রে দুই-রকম ধর্মোপদেশ পাওয়া যায় - (i)মায়ামুক্ত না হইলে তাঁহাকে পাওয়া যাইবে না, আবার (ii)তাঁহাকে না পাইলে মায়াও ঘুচিবে না । উভয় কথাই সত্য, উভয়ই গ্রাহ্য কারণ ইহার আগে-পরে নাই । মায়া-মুক্তি ও ঈশ্বর-প্রাপ্তি একই অবস্থা এবং ঠিক একই সময়েই হয় । এই দুই-রকম উপদেশ প্রকৃতপক্ষে দুইটি বিভিন্ন মার্গ বা সাধন-পথের সঙ্কেত ।
- জ্ঞানমার্গের (আত্মস্বাতন্ত্র্য ও আত্মশক্তি) উপদেশ : মায়া বা অজ্ঞান দূর না হইলে সেই পরতত্ত্ব উপলব্ধ হয় না । আত্মার দ্বারা আত্মার উদ্ধার । সাধনদ্বারা প্রকৃতির রজস্তমোগুণকে দমন করিয়া শুদ্ধ সত্ত্বগুণের উদ্রেক করিয়া প্রকৃতির অতীত হওয়াই নিজেই নিজেকে উদ্ধার করিতে পারা ।
- ভক্তিমার্গের (আত্মসমর্পণ ও কৃপাবাদ) উপদেশ : সর্বতোভাবে তাঁহার শরণ না লইলে, তাঁহার কৃপা না হইলে, মায়া দূর হইবে না । ঈশ্বরই জীবকে যন্ত্রারূঢ় পুত্তলিকার ন্যায় মায়াদ্বারা চালাইতেছেন, জীব সর্বতোভাবে তাঁহার শরণ লইলে, অনন্যভক্তিযোগে তাঁহার ভজনা করিলে ঈশ্বরই তাহাকে এমন বুদ্ধিযোগ দেন, যাহাদ্বারা সে মায়ামুক্ত হইয়া ভগবানকে পাইতে পারে ।
নির্বেদ : এত কাল যোগাভ্যাস করিলাম, সিদ্ধিলাভ হইল না, আত কত কাল কষ্ট করিব - এইরূপ হতাশভাব (মধুসূদন) ।
ধৃতিগৃহীতয়া বুদ্ধ্যা = ধৈর্যযুক্ত বুদ্ধিদ্বারা [শঙ্কর]
উপরমেৎ = উপরতি অভ্যাস করিবেন, মনের নিরোধ করিবেন - 'cease from mental action'.
সমাধি অভ্যাস :
- কামনা ত্যাগ - সর্বপ্রকার কামনা নিঃশেষে ত্যাগ করিতে হয় ।
- মনের দ্বারা ইন্দ্রিয়সংযম - মনের দ্বারা ইন্দ্রিয়সমূহকে বিষয় হইতে প্রত্যাহরণ করিতে হইবে । চক্ষু দর্শন করিতেছে, কিন্তু মন তাহাতে যোগ দিতেছে না, সুতরাং দেখিয়াও দেখা হইল না । চক্ষু নষ্ট হইলে বা মুদ্রিত করিয়া থাকিলেই ইন্দ্রিয়সংযম হয় না ।
- চিত্তবৃত্তি নিরোধ - সাত্ত্বিকী-বুদ্ধি ভাল-মন্দ নিশ্চয় করিয়া, নিত্যানিত্য বিচার করিয়া মনকে সৎপথে চালিত করে । সাত্ত্বিকী ধৃতিশক্তি মনকে বহির্মুখী হইতে না দিয়া ভিতরে ধারণ করিয়া রাখে । এই ধৃতিসংযুক্ত বুদ্ধিদ্বারা মনকেও অন্তর্মুখী করিয়া ক্রমে-ক্রমে চিত্তবৃত্তি নিরোধ করিতে হইবে । সহসা চিত্তবৃত্তি নিরোধের চেষ্টা করিলে মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যহানির সম্ভাবনা ।
- আত্মাতে বিলীন - মন নির্মল হইয়া যখন আত্মাকার প্রাপ্ত হইবে, তখনই আত্মস্বরূপ প্রতিভাত হইবে । এই অবস্থায় কোন চিন্তাই থাকিবে না, আত্মচিন্তাও নয় । কারণ চিন্তা থাকিলে মনের অতীত হওয়া যায় না । এ-অবস্থায় ধ্যাতা, ধ্যান, ধ্যেয় - জ্ঞাতা, জ্ঞান, জ্ঞেয় - সবই এক হইয়া যায় । এক আত্মস্বরূপই থাকে, চিন্তা করিবে কে ? কার ? তাই ভগবান শঙ্করাচার্য বলিয়াছেন - 'চিন্তাশূন্যতাই শ্রেষ্ঠ ধ্যান' ।
অষ্টাঙ্গ যোগ ও গীতোক্ত যোগ :
ধারণার পরিপক্ক অবস্থা ধ্যান, ধ্যানের পরিপক্ক অবস্থা সমাধি; ধ্যান, ধারণা, সমাধি - এই তিনটি ক্রমে এক বস্তু সম্বন্ধে প্রযুক্ত হইলে তাহাকে 'সংযম' বলে [যো.সূ.|৩|৪] । এই তিনটিই যোগের অন্তরঙ্গ-সাধন, অপরগুলিই বহিরঙ্গ-সাধন [যো.সূ.|৩|৭] । যম ও নিয়ম চিত্তশুদ্ধির উপায়, উহা সকল সাধনার ভিত্তিস্বরূপ । আসন, প্রাণায়াম, মনঃ-সংযমের সহায়ক শারীরিক-প্রক্রিয়া । এই সকলই গীতাতে সাধারণভাবে স্থানে-স্থানে উল্লিখিত হইয়াছে । প্রকৃতপক্ষে, ধ্যান ও সমাধিই যোগের মূল কথা - গীতায় উহাই বিশেষরূপে উপদিষ্ট হইয়াছে । কিন্তু গীতার পূর্ণাঙ্গ যোগে কর্ম, ধ্যান, জ্ঞান, ভক্তি এই চারিটিরই সমন্বয় ।
পূর্বোক্ত যম-নিয়মের অভ্যাস নৈতিক চরিত্র-গঠনের শ্রেষ্ঠ উপায় এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির ভিত্তিস্বরূপ । মহাত্মা গান্ধীর প্রতিষ্ঠিত সত্যাগ্রহাশ্রমে বিদ্যার্থীদের এগুলি অভ্যাস করিতে হইত । সত্য-অহিংসাদির অভ্যাসে সম্যক সিদ্ধ হইলে যে যোগবল বা আত্মশক্তি লাভ হয় তাহা দ্বারাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইতে পারে । যেমন যোগশাস্ত্রে আছে 'যিনি অহিংসা সাধনে চরম সিদ্ধিলাভ করিয়াছেন, তাঁহার সম্মুখে সকল প্রাণীই বৈরভাব ত্যাগ করে' [যো.সূ.|২|৩৫] । মহাত্মা গান্ধী তাই বিশ্বাস করতেন অহিংসার প্রভাবে হিংস্র বন্যপশুও যখন হিংসা ত্যাগ করে, তখন অত্যাচারী নরপশু হইলেও অহিংসা ও ত্যাগের প্রভাবে তাহার ভাবান্তর (change of hearts) অনিবার্য । তাই তাঁর আন্দোলনের মূল কথা ছিল আত্মত্যাগ ও আত্মশুদ্ধি (self-sacrifice and self-purification).
২৭) যোগসিদ্ধির ফল নির্মল ব্রহ্মানন্দ ও সর্বত্র সমত্ববুদ্ধি ।
শ্রীভগবান বলিতেছেন - আমার ভক্ত কখনো আমাকে হারান না, আমিও ভক্তকে কখনো হারাই না । আমার ভক্ত সর্বত্র আমাকেই দেখেন এবং আমাতেই সমস্ত দেখেন । তিনি জগতের দিকে তাকাইলে জগৎময় আমার মূর্তিই অনুভব করেন । আবার আমার দিকে তাকাইলে তিনি দেখেন আমিই সব, আমাতেই সব । অপার সমুদ্রে যেমন তরঙ্গমালা, সেইরূপ বিধি, বিষ্ণু, শিব, শক্তি, রবি, চন্দ্র, বরুণ, যমাদি সকলই আমাতে ভাসিতেছে ।
'আমাকে ভজনা করা' এবং 'সর্বভূতস্থ আমাকে ভজনা করা' - এই দুই-কথার মধ্যে কি পার্থক্য তাহা প্রণিধানযোগ্য । এই কথাটি শ্রীমদ্ভাগবতে নির্গুণভক্তিতত্ত্ব-বর্ণনা প্রসঙ্গে অতি স্পষ্টরূপে উল্লেখ করা হইয়াছে -
'আমি সর্বভূতে ভূতাত্মস্বরূপে অবস্থিত আছি । অথচ সেই আমাকে অবজ্ঞা করিয়া মনুষ্য প্রতিমাদিতে পূজারূপ বিড়ম্বনা করিয়া থাকে । সর্বভূতে অবস্থিত আত্মা ও ঈশ্বর আমাকে উপেক্ষা করিয়া যে প্রতিমাদি ভজনা করে সে ভস্মে ঘৃতাহুতি দেয় । যে প্রাণীগণের অবজ্ঞাকারী, সে বিবিধ দ্রব্য ও বিবিধ ক্রিয়াদ্বারা আমার প্রতিমাতে আমার পূজা করিলেও আমি তাহার প্রতি সন্তুষ্ট হই না । সুতরাং মানুষের কর্তব্য হইল, আমি সর্বভূতে আছি ইহা জানিয়া সকলের প্রতি সমদৃষ্টি, সকলের সহিত মিত্রতা ও দান-মানাদির দ্বারা সকলকে অর্চনা করে ।' - [ভা|৩|২৯|২১-২২, ২৪, ২৭]সর্বজীবের সেবাই ঈশ্বরের অর্চনা । বিশ্বপ্রেমই ঈশ্বরে ভক্তি । অবশ্য ইষ্টবস্তুর উপাসনা আবশ্যক নয়, নিষিদ্ধও নয় । 'পুরুষ যে-পর্যন্ত সর্বভূতস্থিত আমাকে আপনার হৃদয়ের মধ্যে জানিতে না পারে, সে-পর্যন্ত প্রতিমা-প্রভৃতিতে আমার অর্চনা করিবে [ভা|৩|২৯|২৫] । সুতরাং সর্বদা মনে রাখিতে হইবে প্রতিমাতে কাহার অর্চনা হইতেছে এবং সে-অর্চনার উদ্দেশ্য কি । উহা বিস্মৃত হইয়া যদি প্রতীককেই ঈশ্বর করিয়া তুলি, তবে উহা জড়োপাসনায় পরিণত হয় ।
'হে দৈত্যগণ, এই বিশজগৎ বিষ্ণুর বিস্তারমাত্র । তোমরা সকলকে আপনার সঙ্গে অভেদ দেখিও । এইরূপ সমত্বদর্শনই ঈশ্বর-আরাধনা ।' [প্রহ্লাদ, বিষ্ণু পুরাণ |১|১৭|৮৪|৯০]
'Whoever loves God in all and whose soul is founded upon the divine oneness, however he lives and acts, lives and acts in God - that may almost be said to sum up the whole final result of the Gita's teaching.' - Sri Aurobindo.
দয়া ও মায়া :
প্রশ্নঃ আত্মজ্ঞ যোগী দ্বন্দ্ববর্জিত পুরুষ । তিনি সুখদুঃখের অতীত । তিনি জীবের সুখদুঃখে অভিভূত হইবেন কিরূপে ? সে তো তাঁহার অধঃপতন, আধ্যাত্মিক অপমৃত্যু । আর জগতের দুঃখের পসরা নিজের মাথায় লইয়া তাঁহার স্বস্তি কোথায় ? সমদর্শনের কি এই ফল ? কেবল দুঃখের মাত্রা বৃদ্ধি ?
উত্তরঃ কথাটা ধরেছ ভাল, কিন্তু তা হলে ঈশ্বরের মতো দুঃখী বোধ হয় আর কেহ নাই । তাঁহাকে 'দয়াময়' বলা হয়, জীবের দুঃখে দুঃখিত না হইলে তিনি দয়াময় হন কিরূপে ? স্মরণ রাখিতে হইবে, এ-স্থলে বদ্ধ জীবের কথা হইতেছে না, এ হইতেছে জীবন্মুক্ত যোগীর কথা যিনি প্রকৃতির মধ্যে থাকিয়াও, সুখদুঃখের মধ্যে থাকিয়াও সেই পরম পুরুষেই অবস্থান করেন । তাঁহার আর পতনের সম্ভাবনা কোথায় ? তাঁহার সংসারে থাকার একমাত্র উদ্দেশ্য জীবের যাহাতে দুঃখমোচন হয়, জীব যাহাতে সুখী হয়, তাহাই করা । তিনি নির্লিপ্তভাবে, নিষ্কামভাবে সেই কর্মই করেন - সময়-সময় সুখদুঃখের অভিনয়ও করেন - কিন্তু সে অভিনয় মাত্র, তিনি অভিভূত হন না । তাঁহার দয়া আছে, তিনি জড়পিণ্ড নহেন, কিন্তু তাঁহার মায়া নাই, অর্থাৎ সুখদুঃখাদি যে প্রকৃতির ধর্ম, তাহাতে তিনি বদ্ধ হন না । অবতারগণ, মহাপুরুষগণ, জনকাদি রাজর্ষিগণ - ইঁহারা সকলেই এইরূপেই জীবের সঙ্গে হাসিয়া-কাঁদিয়া লীলাখেলা করিয়াছেন, জীবের দুঃখমোচনের চেষ্টা করিয়াছেন । নরেন্দ্রাদি অন্তরঙ্গ ভক্তের জন্য শ্রীরামকৃষ্ণের এত ব্যাকুলতা কেন ? সে দয়া, মায়া নহে । জীবের দুঃখে গৌতম গৃহত্যাগী, শ্রীচৈতন্য সন্ন্যাসী । সে-ও দয়া, মায়া নহে ।
অভ্যাসে দুঃসাধ্য কার্যও সুসাধ্য হয় । স্বভাব অভ্যাসেরই ফল । শারীরিক অভ্যাস অপেক্ষা মানসিক অভ্যাসের ফল আরও অদ্ভুত । আমাদের মনে যে কোনো চিন্তা-প্রবাহ উদিত হয়, তাহাই একটি সংস্কার রাখিয়া যায় । এই সংস্কারগুলির সমষ্টিই আমাদের স্বভাব । আমাদের বর্তমান স্বভাব পূর্ববর্তী অভ্যাসের ফল । আমাদের পরবর্তী স্বভাব হইবে বর্তমান অভ্যাসের ফল । সুতরাং সৎস্বভাব গঠন করিতে হইলে সর্বদা সৎচিন্তা ও সৎকর্মের অভ্যাস কর্তব্য । যোগ কতকগুলি সদভ্যাসের অনুশীলন মাত্র, এই জন্য ইহাকে অভ্যাসযোগ বলে । কিসের অভ্যাস ? প্রধানত বহির্মুখী চঞ্চল মনকে অন্তর্মুখী করিয়া আত্মসংস্থ করিবার অভ্যাস ।
৪০) যোগাভ্যাসের যে কোনরূপ চেষ্টামাত্রই শুভকর্ম । সম্পূর্ণ সিদ্ধি লাভ না হওয়াতে তাহার পুনর্জন্ম নির্ধারিত হয় না বটে, কিন্তু শুভকর্মজনিত অন্যরূপ শুভফল তিনি প্রাপ্ত হন, তাহার সদ্গতিই লাভ হয় ।
কর্মী = যাঁহারা স্বর্গাদি-ফলকামনায় যাগযজ্ঞাদি কাম্য-কর্ম করেন ।
পরোক্ষ জ্ঞানী = যাঁহার কেবল শাস্ত্রজ্ঞান আছে, আত্মা, জীব, জগৎ এ-সব কি তাহা শাস্ত্রানুশীলনে বুঝিয়াছেন, কিন্তু আত্মানুভব হয় নাই ।
অপরোক্ষ জ্ঞানী = যাঁহার প্রত্যক্ষ আত্মদর্শন হইয়াছে ।
এ-স্থলে জ্ঞানী অপেক্ষা যোগী শ্রেষ্ঠ বলায় শাস্ত্রজ্ঞানী বা পরোক্ষ জ্ঞানীকেই লক্ষ্য করা হইয়াছে ।
এ-স্থলে 'যোগী' = কর্মযোগী, 'জ্ঞানী' = সাংখ্যজ্ঞানী সন্ন্যাসী [গীতারহস্য, লোকমান্য তিলক]
উঃ অক্ষর ব্রহ্ম সম, শান্ত, নিষ্ক্রিয়, নির্বিকার - তিনি কর্মে লিপ্ত নন, কর্ম করে প্রকৃতি, উহাই মায়া বা অজ্ঞান; সুতরাং কর্ম অজ্ঞান-প্রসূত, উহার সহিত জ্ঞানের সমুচ্চয় হয় না এবং অচিন্ত্য, অব্যক্ত, নির্গুণ ব্রহ্মে ভক্তিও সম্ভব না । গীতা পুরুষোত্তম-তত্ত্ব দ্বারা জ্ঞানবাদিগণের এ-আপত্তি খণ্ডন করিয়াছেন । গীতায় শ্রীভগবান বলিতেছেন - প্রকৃতি কর্ম করে তা ঠিক, কিন্তু প্রকৃতি আমারই প্রকৃতি - আমারই শক্তি । ক্ষর ও অক্ষর দুই-ই আমার বিভাব - আমি পুরুষোত্তম [১৫|১৬-১৮] । অহংশূন্য জীবন্মুক্তের কর্মের সহিত জ্ঞানের বিরোধ নাই, কারণ সে কর্ম তাঁহার নয়, আমারই কর্ম । আর এ-জ্ঞানের সহিত ভক্তিরও কোনো বিরোধ নাই; কেননা এ-জ্ঞান কেবল অচিন্ত্য, অব্যক্ত, অক্ষর ব্রহ্মের জ্ঞান নহে, ইহা অব্যক্ত-ব্যক্ত, নির্গুণ-গুণী 'সমগ্র' পুরুষোত্তমের জ্ঞান । তাই শ্রীভগবান বলিয়াছেন, জ্ঞানীই আমার শ্রেষ্ঠ ভক্ত, 'আমার আত্মস্বরূপ' [৭|১৭-১৮], আমাতে অব্যভিচারিণী ভক্তিই জ্ঞান [১৩|১০-১১] ।
এইরূপে গীতা কর্ম, জ্ঞান, ভক্তির সমন্বয়ে সুন্দর সম্পূর্ণ সাধনতত্ত্ব প্রচার করিয়াছেন । ইহাই গীতার পূর্ণাঙ্গযোগ । গীতোক্ত যোগী একাধারে জ্ঞানী, কর্মী ও ভক্ত । এ-যোগী নিত্যসমাহিত, নিত্যমুক্ত, - যুদ্ধ-কোলাহলে তাঁহার চিত্তবিক্ষেপের ভয় কি ? এ সমাধির অর্থ ভগবৎ-সত্তায় আপন সত্তা মিলাইয়া দেওয়া, তাঁহারই প্রেমানন্দে সর্বকামনা ভুলিয়া তাঁহারই কর্ম বাহিরে দেহেন্দ্রিয়াদি দ্বারা সম্পন্ন করা, আর অন্তরে সতত সর্বাবস্থায় তাঁহাতেই অবস্থান করা ।
এই অধ্যায়ে প্রধানতঃ ধানযোগ বা সমাধি-যোগের প্রক্রিয়া ও ধ্যানযোগীর লক্ষণ বর্ণিত হইয়াছে । এই হেতু ইহাকে ধ্যানযোগ বা অভ্যাসযোগ বলে ।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : অষ্টম অধ্যায় – অক্ষরব্রহ্মযোগ
হে পুরুষোত্তম, ব্রহ্ম কি, অধ্যাত্ম কি, কর্ম কি, অধিভূত এবং অধিদৈবই বা কাহাকে বলে ? ১
অক্ষরকে নিরতিশয় পরব্রহ্ম বলে। স্বভাবকে অর্থাৎ প্রতি দেহে সেই পরব্রহ্মের প্রত্যগাত্মভাবে অবস্থিতিকে অধ্যাত্ম বলে । ভূতবস্তুর উৎপত্তিকর দেবোদ্দেশে দ্রব্যাদি ত্যাগরূপ যজ্ঞকে কর্ম বলে । ৩
ওঁকার-সহায়ে পরব্রহ্মের ধ্যানকারিগণ ক্রমমুক্তিলাভ করেন । - [ব্রঃসূঃ, ১|৩|১৩]
১৬) সপ্তলোক = ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ, মহঃ, জন, তপঃ ও সত্যলোক বা ব্রহ্মলোক
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : নবম অধ্যায় - রাজবিদ্যা-রাজগুহ্য-যোগ
জ্ঞানং বিজ্ঞানসহিতং যজ্ জ্ঞাত্বা মোক্ষ্যসেহশুভাৎ।।১
প্রত্যক্ষাবগনং ধর্ম্ম্যং সুসুখং কর্ত্তুমব্যয়ম্।।২
ইহা রাজবিদ্যা, রাজগুহ্য অর্থাৎ সকল বিদ্যা ও গুহ্য বিষয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ; ইহা সর্বোৎকৃষ্ট, পবিত্র, সর্বধর্মের ফলস্বরূপ, প্রত্যক্ষ বোধগম্য, সুখসাধ্য এবং অক্ষয় ফলপ্রদ । ২
অপ্রাপ্য মাং নিবর্ত্তন্তে মৃত্যুসংসারবর্ত্মনি।।৩
হে পরন্তপ, এই ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাহীন ব্যক্তিগণ আমাকে পায় না; তাহারা মৃত্যুময় সংসার-পথে পরিভ্রমণ করিয়া থাকে । ৩
মৎস্থানি সর্ব্বভুতানি ন চাহং তেষ্ববস্থিতঃ।।৪
আমি অব্যক্ত স্বরূপে এই সমস্ত জগৎ ব্যাপিয়া আছি । সমস্ত ভূত আমাতে অবস্থিত, আমি কিন্তু তৎসমুদয়ে অবস্থিত নহি । ৪
ভূতভৃন্ন চ ভূতস্থো মমাত্মা ভূতভাবনঃ।।৫
তুমি আমার ঐশ্বরিক যোগদর্শন কর । এই ভূতসকলও আমাতে স্থিতি করিতেছে না; আমি ভূতধারক ও ভূতপালক, কিন্তু ভূতগণে অবস্থিত নহি । ৫
তথা সর্ব্বাণি ভূতানি মৎস্থানীত্যুপধারয়।।৬
যেমন সর্বত্র গমনশীল মহান্ বায়ু আকাশে অবস্থিত, সেইরূপ সমস্ত ভূত আমাতে অবস্থিত ইহা জানিও । ৬
কল্পক্ষয়ে পুনস্তানি কল্পাদৌ বিসৃজাম্যহম্।।৭
হে কৌন্তেয়, কল্পের শেষে (প্রলয়ে) সকল ভূত আমার ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতিতে আসিয়া বিলীন হয় এবং কল্পের আরম্ভে ঐ সকল পুনরায় আমি সৃষ্টি করি । ৭
ভুতগ্রামমিমং কৃৎস্নমবশং প্রকৃতের্বশাৎ।।৮
আমি স্বীয় প্রকৃতিকে আত্মবশে রাখিয়া স্বীয় স্বীয় প্রাক্তন-কর্ম নিমিত্ত স্বভাববশে জন্মমৃত্যুপরবশ ভূতগণকে পুনঃ পুনঃ সৃষ্ট করি । ৮
উদাসীনবদাসীনমসক্তং তেষু কর্ম্মসু।।৯
হেতুনানেন কৌন্তেয় জগত্ বিপরিবর্ত্ততে।।১০
হে কৌন্তেয়, আমার অধিষ্ঠানবশতঃই প্রকৃতি এই চরাচর জগৎ প্রসব করে, এই হেতুই জগৎ (নানারূপে) বারংবার উৎপন্ন হইয়া থাকে । ১০
অবজানন্তি মাং মুঢ়া মানুষীং তনুমাশ্রিতম্।
পরং ভাবমজানন্তো মম ভুতমহেশ্বরম্।।১১
এই সকল বিবেকহীন ব্যক্তি, বুদ্ধিভ্রংশকারী তামসী ও রাজসী প্রকৃতির বশে, আমাকে অবজ্ঞা করিয়া থাকে । উহাদের আশা ব্যর্থ, কর্ম নিষ্ফল, জ্ঞান নিরর্থক এবং চিত্ত বিক্ষিপ্ত । ১২
কিন্তু হে পার্থ, সাত্ত্বিকী প্রকৃতি-প্রাপ্ত মহাত্মগণ অনন্যচিত্ত হইয়া আমাকে সর্বভূতের কারণ এবং অব্যয়স্বরূপ জানিয়া ভজনা করেন । ১৩
তাঁহারা যত্নশীল ও দৃঢ়ব্রত হইয়া ভক্তিপূর্বক সর্বদা আমার কীর্তন এবং বন্দনা করিয়া নিত্য সমাহিত চিত্তে আমার উপাসনা করেন । ১৪
কেহ জ্ঞানরূপ যজ্ঞদ্বারা আমার আরাধনা করেন । কেহ কেহ অভেদ ভাবে (অর্থাৎ উপাস্য-উপাসকের অভেদ/একত্ব চিন্তাদ্বারা), কেহ কেহ পৃথক্ ভাবে অর্থাৎ (দাস্যাদি ভাবে), কেহ কেহ সর্বময়, সর্বাত্মা আমাকে নানা ভাবে (অর্থাৎ ব্রহ্মা, রুদ্রাদি নানা দেবতারূপে) উপাসনা করেন । ১৫
আমি ক্রতু, আমি যজ্ঞ, আমি স্বধা, আমি ঔষধ, আমি মন্ত্র, আমিই হোমাদি-সাধন ঘৃত, আমি অগ্নি, আমিই হোম । ১৬
আমি এই জগতের পিতা, মাতা, বিধাতা, পিতামহ; যাহা কিছু জ্ঞেয় এবং পবিত্র বস্তু তাহা আমিই । আমি ব্রহ্মবাচক ওঙ্কার, আমি ঋক্, সাম ও যজুর্বেদ স্বরূপ । ১৭
আমি গতি, আমি ভর্তা, আমি প্রভু, আমি শুভাশুভ দ্রষ্টা, আমি স্থিতি-স্থান, আমি রক্ষক, আমি সুহৃৎ, আমি স্রষ্টা, আমি সংহর্তা, আমি আধার, আমি লয়স্থান এবং আমিই অবিনাশী বীজস্বরূপ । ১৮
হে অর্জুন, আমি (আদিত্যরূপে) উত্তাপ দান করি, আমি ভূমি হইতে জল আকর্ষণ করি, আমি পুনর্বার জল বর্ষণ করি; আমি জীবের জীবন, আমিই জীবের মৃত্যু; আমি সৎ (অবিনাশী অব্যক্ত আত্মা), আমিই অসৎ (নশ্বর ব্যক্ত জগৎ) । ১৯
ত্রিবেদোক্ত যজ্ঞাদিকর্মপরায়ণ ব্যক্তিগণ যজ্ঞাদি দ্বারা আমার পূজা করিয়া যজ্ঞশেষে সোমরস পানে নিষ্পাপ হন এবং স্বর্গলাভ কামনা করেন, তাঁহারা পবিত্র স্বর্গলোক প্রাপ্ত হইয়া দিব্য দেবভোগসমূহ ভোগ করিয়া থাকেন । ২০
তাঁহারা তাঁহাদের প্রার্থিত বিপুল স্বর্গসুখ উপভোগ করিয়া পুণ্যক্ষয় হইলে পুনরায় মর্ত্যলোকে প্রবেশ করেন । এইরূপে কামনাভোগ-পরবশ এই ব্যক্তিগণ যাগযজ্ঞাদি বেদোক্ত ধর্ম অনুষ্ঠান করিয়া পুনঃ পুনঃ সংসারে যাতায়াত করিয়া থাকেন । ২১
অনন্যচিত্ত হইয়া আমার চিন্তা করিতে করিতে যে ভক্তগণ আমার উপাসনা করেন, আমাতে নিত্যুযুক্ত সেই সমস্ত ভক্তের যোগ ও ক্ষেম আমি বহন করিয়া থাকি (অর্থাৎ তাহাদের প্রয়োজনীয় অলব্ধ বস্তুর সংস্থান এবং লব্ধ বস্তুর রক্ষণ আমি করিয়া থাকি) । ২২
হে কৌন্তেয়, যাহারা অন্য দেবতায় ভক্তিমান্ হইয়া শ্রদ্ধাযুক্তচিত্তে তাঁহাদের পূজা করে তাহারাও আমাকেই পূজা করে, কিন্তু অবিধিপূর্বক (অর্থাৎ যাহাতে সংসার নিবর্তক মোক্ষ বা ঈশ্বরপ্রাপ্তি ঘটে তাহা না করিয়া) । ২৩
আমিই সর্ব যজ্ঞের ভোক্তা ও ফলদাতা । কিন্তু তাহারা আমাকে যথার্থরূপে জানে না বলিয়া সংসারে পতিত হয় । ২৪
ইন্দ্রাদি দেবগণের পূজকেরা দেবলোক প্রাপ্ত হন, শ্রাদ্ধাদি দ্বারা যাঁহারা পিতৃগণের পূজা করেন তাঁহারা পিতৃলোক প্রাপ্ত হন, যাঁহারা যক্ষ-রক্ষাদি ভূতগণের পূজা করেন তাঁহারা ভূতলোক প্রাপ্ত হন, এবং যাঁহারা আমাকে পূজা করেন তাঁহারা আমাকেই প্রাপ্ত হন । ২৫
যিনি আমাকে পত্র, পুস্প, ফল, জল, যাহা কিছু ভক্তিপূর্বক দান করেন, আমি সেই শুদ্ধচিত্ত ভক্তের ভক্তিপূর্বক প্রদত্ত উপহার গ্রহণ করিয়া থাকি । ২৬
হে কৌন্তেয়, তুমি যাহা কিছু কর, যাহা কিছু ভোজন কর, যাহা কিছু হোম কর, যাহা কিছু দান কর, যাহা কিছু তপস্যা কর, তৎ সমস্তই আমাকে অর্পণ করিও । ২৭
এইরূপ সর্ব কর্ম আমাতে সমর্পণ করিলে শুভাশুভ কর্ম-বন্ধন হইতে মুক্ত হইবে । আমাতে সর্বকর্ম সমর্পণরূপ যোগে যুক্ত হইয়া কর্মবন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া আমাকেই প্রাপ্ত হইবে । ২৮
আমি সর্বভূতের পক্ষেই সমান । আমার দ্বেষ নাই, প্রিয়ও নাই । কিন্তু যাহারা ভক্তিপূর্বক আমার ভজনা করেন, তাঁহারা আমাতে অবস্থান করেন এবং আমিও সে সকল ভক্তেই অবস্থান করি । ২৯
অতি দুরাচার ব্যক্তি যদি অনন্যচিত্ত (অনন্য ভজনশীল) হইয়া আমার ভজনা করে, তাহাকে সাধু বলিয়া মন করিবে । যেহেতু তাহার অধ্যবসায় উত্তম । ৩০
ঈদৃশ দুরাচার ব্যক্তি শীঘ্র ধর্মাত্মা হয় এবং নিত্য শান্তি লাভ করে; হে কৌন্তেয়, তুমি সর্বসমক্ষে নিশ্চিত প্রতিজ্ঞা করিয়া বলিতে পার যে, আমার ভক্ত কখনই বিনষ্ট হয় না । ৩১
হে পার্থ, স্ত্রীলোক, বৈশ্য ও শূদ্র, অথবা যাহারা পাপযোনিসম্ভূত অন্ত্যজ জাতি তাহারাও আমার আশ্রয় লইলে নিশ্চয়ই পরমগতি প্রাপ্ত হন । ৩২
পুণ্যশীল ব্রাহ্মণ ও রাজর্ষিগণ যে পরম গতি লাভ করিবেন তাহাতে আর কথা কি আছে ? অতএব তুমি (এই রাজর্ষি-দেহ লাভ করিয়া) আমার আরাধনা কর । কারণ এই মর্ত্যলোক অনিত্য এবং সুখশূন্য । ৩৩
তুমি সর্বদা মনকে আমার চিন্তায় নিযুক্ত কর, আমাতে ভক্তিমান্ হও, আমার পূজা কর, আমাকেই নমস্কার কর । এইরূপে মৎপরায়ণ হইয়া আমাতে মন সমাহিত করিতে পারিলে আমাকেই প্রাপ্ত হইবে । ৩৪
পরমেশ্বর বিশ্বতোমুখ, এই হেতুই তাঁহার উপাসনা-প্রণালীও বিভিন্ন হয় । জ্ঞান-যজ্ঞের অর্থ পরমেশ্বরের স্বরূপ-জ্ঞানের দ্বারাই বিচার করিয়া উহার দ্বারা সিদ্ধিলাভ করা । কিন্তু পরমেশ্বরের এই জ্ঞানও দ্বৈত-অদ্বৈত প্রভৃতি ভেদে অনেক প্রকারের হইতে পারে । এই কারণে জ্ঞান-যজ্ঞও বিভিন্ন প্রকারের হইতে পারে । ' 'একত্ব', 'পৃথকত্ব' প্রভৃতি পদের দ্বারা বুঝা যায় যে, অদ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত প্রভৃতি সম্প্রদায় যদিও আধুনিক, তথাপি কল্পনাসকল প্রাচীন ।' - [গীতারহস্য|লোকমান্য তিলক]
১৬) ক্রতু, যজ্ঞ - এই দুইটি সদৃশার্থক হইলেও একার্থক নহে । 'যজ্ঞ' শব্দ 'ক্রতু' শব্দ অপেক্ষা অধিক ব্যাপক । শ্রৌত যজ্ঞকে ক্রতু বলে । এস্থলে দুইটি শব্দই ব্যবহৃত হইয়াছে বলিয়া ক্রতু অর্থে অগ্নিষ্টোমাদি শ্রৌত যজ্ঞ এবং যজ্ঞ অর্থে স্মার্ত যজ্ঞাদি বুঝিতে হবে ।
১৯) সৎ ও অসৎ : এই শব্দদ্বয় গীতা এবং বেদান্তাদি-শাস্ত্রে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে ।
- সৎ = অক্ষর অবিনাশী অব্যক্ত ব্রহ্মবস্তু; অসৎ = নশ্বর ব্যক্ত জগৎ ।
- সৎ = অব্যক্ত প্রকৃতি; অসৎ = ব্যক্ত জগৎ ।
- সৎ = অস্তি, আছে; অসৎ = নাস্তি, নাই । যে-বস্তুর সৃষ্টি হয় এবং যাহার নাশ হইয়া থাকে সেই বস্তুই সৎ বা অসৎ । যাহা সৃষ্টির পূর্বেও ছিল এবং পরেও থাকিবে, তৎসম্বন্ধে 'আছে' বা 'নাই' এরূপ কিছুই বলা যায় না । তাই ব্রহ্মতত্ত্বের বর্ণনায় কখনো 'ন সৎ ন অসৎ' বলা হয় । কেননা, সেই অতীন্দ্রিয় ব্রহ্মবস্তু সত-অসৎ, আলোক-অন্ধকার, জ্ঞান-অজ্ঞান ইত্যাদি পরস্পর সতত-সাপেক্ষ দ্বৈত-বুদ্ধির অতীত অর্থাৎ সম্পূর্ণ অজ্ঞেয় ।
- প্রাচীন উপনিষদাদিতে অনেক স্থলে বিপরীতার্থে এই শব্দদ্বয় ব্যবহার করা হইয়াছে । অর্থাৎ 'সৎ' = দৃশ্য ব্যক্ত জগৎ; 'তৎ' বা 'অসৎ' = অব্যক্ত ব্রহ্মবস্তু ।
৩৪) ঐকান্তিক ধর্ম - ভগবৎ-শরণাগতি :
একান্ত ভাবে ভগবানের শরণ লইয়া নিত্যযুক্ত হইয়া তাঁহার ভজনা করা এবং স্বধর্মরূপে ভৃত্যবৎ তাঁহারই কর্ম সম্পাদন করা ।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : দশম অধ্যায় - বিভূতি-যোগ
হে মহাবাহো, তুমি আমার বাক্য শ্রবণে প্রীতি লাভ করিয়াছ, আমি তোমার হিতার্থ পুনরায় উৎকৃষ্ট কথা বলিতেছি, তাহা শ্রবণ কর । ১
কি দেবগণ, কি মহর্ষিগণ কেহই আমার প্রভাব বা উৎপত্তির বিষয় জ্ঞাত নহেন । কেননা আমি দেব ও মনুষ্যগণের সর্বপ্রকারেই আদিকারণ । ২
যিনি জানেন যে আমার আদি নাই, জন্ম নাই, আমি সর্বলোকের মহেশ্বর, মনুষ্য মধ্যে তিনি মোহশূন্য হইয়া সর্বপাপ হইতে মুক্ত হন । ৩
বুদ্ধি, জ্ঞান, কর্তব্য বিষয়ে অব্যাকুলতা, ক্ষমা, সত্য, দম, শম, সুখ, দুঃখ, জন্ম, মৃত্যু, ভয়, অভয়, অহিংসা, রাগদ্বেষাদি বিষয়ে সমচিত্ততা, সন্তোষ, তপঃ, দান এবং যশ ও অযশ - প্রাণিগণের এই সমস্ত ভিন্ন ভিন্ন ভাব (অবস্থা) আমা হইতেই উৎপন্ন হইয়া থাকে । ৪,৫
ভৃগু প্রভৃতি সপ্তমহর্ষি, তাঁহাদের পূর্ববর্তী চারি জন মহর্ষি (অথবা সংকর্ষণাদি চতুর্ব্যুহ) এবং স্বায়ম্ভূবাদি মনুগণ,- ইহারা সকলেই আমার মানসজাত এবং আমার জ্ঞানৈশ্বর্য-শক্তিসম্পন্ন; জগতের সকল প্রজা তাহাদিগ হইতে উৎপন্ন হইয়াছে । ৬
যিনি আমার এই বিভূতি (ভৃগু, মন্বাদি) এবং যোগৈশ্বর্য যথার্থরূপে জানেন, তিনি মৎভক্তিলক্ষণ স্থির যোগ লাভ করেন এবং আমাতেই সমাহিতচিত্ত হন, তাহাতে সংশয় নাই । ৭
আমি সমস্ত জগতের উৎপত্তির কারণ । আমা হইতে সমস্ত প্রবর্তিত হয়; বুদ্ধিমান্গণ ইহা জানিয়া প্রেমাবিষ্ট হইয়া আমার ভজনা করেন । ৮
যাহাদিগের চিত্তই আমাতেই অর্পিত, যাঁহারদের প্রাণ মদ্গত (আমাকে ভিন্ন যাঁহারা প্রাণ ধারণে অসমর্থ), এইরূপ ভক্তগণ পরস্পরকে আমার কথা বুঝাইয়া এবং সর্বদা আমার কথা কীর্তন করিয়া পরম সন্তোষ লাভ করেন । তাঁহাদের আর কোন অভাব থাকে না, সুতরাং তাহারা পরম প্রেমানন্দ উপভোগ করিয়া থাকেন । ৯
যাঁহারা সতত আমাতে চিত্তার্পণ করিয়া প্রীতিপূর্বক আমার ভজনা করেন সেই সকল ভক্তকে আমি ঈদৃশ বুদ্ধিযোগ প্রদান করি, যদ্দারা তাঁহারা আমাকে লাভ করিয়া থাকেন । ১০
আমার সেই ভক্তগণের প্রতি অনুগ্রহার্থই তাঁহাদের অন্তঃকরণে অবস্থিত হইয়া উজ্জ্বল জ্ঞানরূপ দীপদ্বারা তাহাদের অজ্ঞানান্ধকার বিনষ্ট করি । ১১
অর্জুন বলিলেন -
আপনি পরব্রহ্ম, পরম ধাম, পরম পবিত্র, ভৃগু প্রভৃতি ঋষিগণ, দেবর্ষি নারদ ও অসিত, দেবল এবং ব্যাস প্রভৃতি আপনাকে নিত্য-পুরুষ, স্বয়ংপ্রকাশ, আদিদেব, জন্মরহিত ও সর্বব্যাপী বিভু বলেন । আপনি স্বয়ং আমাকে তাহাই বলিলেন । (১২,১৩)
হে কেশব ! তুমি যাহা আমাকে বলিতেছ সে সকলই সত্য বলিয়া মানি; কারণ, হে ভগবন্ ! কি দেব কি দানব, কেহই তোমার প্রভাব (বা আবির্ভাবতত্ত্ব) জানেন না (আমি ক্ষুদ্র মনুষ্য, উহা কি বুঝিব ?) ১৪
হে পুরুষত্তম, হে ভূতভাবন, দেবদেব, হে জগৎপতে, তুমি আপনি আপন জ্ঞানে আপন স্বরূপ জান । (তোমার স্বরূপ আর কেহ জানে না) । ১৫
তুমি যে যে বিভূতি দ্বারা সর্বলোক ব্যাপিয়া রহিয়াছ তাহা তুমিই বলিতে সমর্থ । সে সকল বিস্তৃতরূপে আমাকে কৃপাপূর্বক বল । ১৬
হে যোগিন্, কি প্রকারে সতত চিন্তা করিলে আমি তোমাকে জানিতে পারি ? হে ভগবন্, আমি তোমাকে কোন্ কোন্ পদার্থে কি ভাবে চিন্তা করিব, তাহা বল । ১৭
হে জনার্দন ! তুমি পুনরায় তোমার যোগৈশ্বর্য ও বিভূতি-সকল আমাকে বিস্তৃতরূপে বল । যেহেতু তোমার অমৃতোপম বচন শ্রবণ করিয়া আমার তৃপ্তি হইতেছে না । ১৮
শ্রীভগবান্ কহিলেন -
আচ্ছা, আমার প্রধান প্রধান দিব্য বিভূতিসকল তোমাকে বলিতেছি । কারণ আমার বিভূতি-বাহুল্যের অন্ত নাই । (সুতরাং সংক্ষেপে বলিতেছি ।) ১৯
হে অর্জুন, সর্বভূতের হৃদয়স্থিত আত্মা (প্রত্যক্ চৈতন্য) আমিই । আমিই সর্বভূতের উৎপত্তি, স্থিতি ও সংহার স্বরূপ (অর্থাৎ সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়কর্তা) । ২০
দ্বাদশ আদিত্যের মধ্যে আমি বিষ্ণু নামক আদিত্য । জ্যোতিষ্কগণের মধ্যে আমি কিরণমালী সূর্য । মরুৎগণের মধ্যে আমি মরীচি এবং নক্ষত্রগণের মধ্যে চন্দ্র । ২১
বেদসমূহের মধ্যে আমি সামবেদ, দেবগণের মধ্যে আমি ইন্দ্র, ইন্দ্রিয়গণের মধ্যে আমি মন এবং ভূতগণের আমি চেতনা (জ্ঞানশক্তি) । ২২
একাদশ রুদ্রের মধ্যে আমি শঙ্কর, যক্ষরক্ষোগণের মধ্যে আমি কুবের, অষ্ট বসুর মধ্যে আমি অগ্নি এবং পর্বতগণের মধ্যে আমি সুমেরু । ২৩
হে পার্থ ! আমাকে পুরোহিতগণের প্রধান বৃহস্পতি জানিও, আমি সেনানায়কগণের মধ্যে দেব সেনাপতি কার্তিকেয় এবং জলাশয় সমূহের মধ্যে আমি সাগর । ২৪
মহর্ষিগণের মধ্যে আমি ভৃগু, শব্দসকলের মধ্যে আমি একাক্ষর ওঁকার, যজ্ঞসকলের মধ্যে আমি জপযজ্ঞ এবং স্থাবর পদার্থের মধ্যে আমি হিমালয় । ২৫
আমি বৃক্ষসকলের মধ্যে অশ্বত্থ, দেবর্ষিগণের মধ্যে নারদ, গন্ধর্বগণের মধ্যে চিত্ররথ এবং সিদ্ধপুরুষগণের মধ্যে কপিলমুনি । ২৬
অশ্বগণের মধ্যে অমৃতার্থ সমুদ্র মন্থনকালে উদ্ভূত উচ্চৈঃশ্রবাঃ বলিয়া আমাকে জানিও; এবং হস্তিগণের মধ্যে ঐরাবত এবং মনুষ্যগণের মধ্যে রাজা বলিয়া আমাকে জানিও । ২৭
আমি অস্ত্রসমুহের মধ্যে বজ্র, ধেনুগণের মধ্যে কামধেনু, আমি প্রাণিগণের উৎপত্তি হেতু কন্দর্প; এবং আমি সর্পগণের মধ্যে বাসুকি । ২৮
নাগগণের মধ্যে আমি অনন্ত, জলচরগণের মধ্যে আমি জলদেবতা বরুণ, পিতৃগণের মধ্যে আমি অর্যমা, এবং ধর্মাধর্ম ফলদানের নিয়ন্তৃগণ মধ্যে আমি যম । ২৯
দৈত্যগণের মধ্যে আমি প্রহ্লাদ, গ্রাসকারীদিগের মধ্যে আমি কাল, পশুগণের মধ্যে আমি সিংহ, পক্ষিগণের মধ্যে আমি গরুড় । ৩০
বেগবান্দিগের মধ্যে আমি বায়ু, শস্ত্রধারিগণের মধ্যে আমি দাশরথি রাম, মৎস্যগণের মধ্যে আমি মকর এবং নদীসমুহের মধ্যে আমি গঙ্গা । ৩১
হে অর্জুন, সৃষ্ট পদার্থ মাত্রেই আদি, মধ্য ও অন্ত (উৎপত্তি, স্থিতি ও বিনাশকর্তা) আমি, বিদ্যাসমূহের মধ্যে আমি আত্মবিদ্যা বা ব্রহ্মবিদ্যা; তার্কিকগণের বাদ, জল্প ও বিতণ্ডা নামক তর্কসমূহের মধ্যে আমি বাদ (তত্ত্বনির্ণয়ার্থ বিচার) । ৩২
অক্ষরসমূহের মধ্যে আমি অকার, সমাসসমূহের মধ্যে আমি দ্বন্দ্ব, আমিই অক্ষয় কালস্বরূপ, এবং আমিই সমুদয় কর্মফলের বিধান-কর্তা । ৩৩
সংহর্তাদিগের মধ্যে আমি সর্বসংহারক মৃত্যু, ভবিষ্য প্রাণিগণেরও আমি উদ্ভব স্বরূপ; নারীগণের মধ্যে আমি কীর্তি, শ্রী, বাক্, স্মৃতি, মেধা, ধৃতি, ক্ষমা - এই সকল দেবতাস্বরূপ, অর্থাৎ ঐ সকল আমারই বিভূতি । ৩৪
আমি সামবেদোক্ত মন্ত্রসকলের মধ্যে বৃহৎ সাম, ছন্দোবিশিষ্ট মন্ত্রের মধ্যে গায়ত্রী; আমি বৈশাখাদি দ্বাদশ মাসের মধ্যে অগ্রহায়ণ মাস, এবং ঋতুসকলের মধ্যে বসন্ত ঋতু । ৩৫
আমি বঞ্চনাকারিগণের দ্যূতক্রীড়া (Gambling), আমি তেজস্বিগণের তেজঃ । বিজয়ী পুরুষের জয়, উদ্যোগী পুরুষের উদ্যম এবং সাত্ত্বিক পুরুষের সত্ত্বগুণ । ৩৬
আমি বৃষ্ণি-বংশীয়দিগের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণ, পাণ্ডবগণের মধ্যে ধনঞ্জয়, মুনিগণের মধ্যে ব্যাস, কবিগণের মধ্যে শুক্রাচার্য । ৩৭
আমি শাসনকর্তৃগণের দণ্ড, জয়েচ্ছু ব্যক্তিগণের সামাদি-নীতি, গুহ্য বিষয়ের মধ্যে মৌন, এবং জ্ঞানিগণের জ্ঞান । ৩৮
হে অর্জুন, সর্বভূতের যাহা বীজস্বরূপ তাহাই আমি, আমা ব্যতীত উদ্ভূত হইতে পারে চরাচরে এমন পদার্থ নাই । ৩৯
হে পরন্তপ, আমার দিব্য বিভূতিসমূহের অন্ত নাই । আমি এই যাহা কিছু বিভূতি বিস্তার বলিলাম, তাহা আমার বিভূতিসকলের সংক্ষেপে বা দিগ্দর্শন মাত্র । ৪০
যাহা যাহা কিছু ঐশ্বর্যযুক্ত, শ্রীসম্পন্ন অথবা অতিশয় শক্তিসম্পন্ন তাহাই আমার শক্তির অংশসম্ভূত বলিয়া জানিবে । ৪১
অথবা হে অর্জুন, তোমার এত বহু বিভূতিবিস্তার জানিয়া প্রয়োজন কি? (এক কথায় বলিতেছি) আমি এই সমস্ত জগৎ আমার একাংশ মাত্র দ্বারা ধারণ করিয়া অবস্থিত আছি । ৪২
বিশ্বানুগ - বিশ্বাতিগ :
শ্রীভগবান বলিতেছেন, - 'আমি একাংশে এই চরাচর বিশ্ব ব্যাপিয়া আছি, আমি বিশ্বরূপ ।' তবে অপরাংশ কিরূপ, কোথায় ? মানব-বুদ্ধি বিশ্বরূপের ধারণাতেই বিহ্বল হইয়া যায়, বিশ্বের অতীত, নাম-রূপের অতীত যে বস্তু, তাহা সে ধারণাই করিতে পারে না । তাহা অনন্ত, অব্যক্ত, অজ্ঞেয় । তিনি মায়া স্বীকার করিয়া সোপাধিক হইলেও সসীম হন না । তিনি বিশ্বানুগ (Immanent) হইয়াও বিশ্বাতিগ (Transcendental), প্রপঞ্চাভিমানী হইয়াও প্রপঞ্চাতীত । তাঁহার এই প্রপঞ্চাতীত বিশ্বাতিগ নির্গুণ স্বরূপ ধারণার অতীত ।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : একাদশ অধ্যায়
- বিশ্বরূপ-দর্শন-যোগ
তুমি আমার প্রতি অনুগ্রহ করিয়া যে পরম গুহ্য অধ্যাত্ম-তত্ত্ব বর্ণন করিলে তাহাতে আমার এই মোহ বিদূরিত হইল । ১
হে কমললোচন, ভূতগণের উৎপত্তি ও লয় এবং তোমার অক্ষয় মাহাত্ম্য - এ সকলই তোমার নিকট হইতে সবিস্তারে আমি শুনিলাম । ২
হে পরমেশ্বর, তুমি আপনার বিষয় যাহা বলিলে তাহা এইরূপ বটে; হে পুরুষোত্তম, আমি তোমার সেই ঐশ্বরিক রূপ দেখিতে ইচ্ছা করি । ৩
হে প্রভো ! যদি তুমি মনে কর যে, আমি সেই রূপ দর্শনের যোগ্য, তাহা হইলে হে যোগেশ্বর, আমাকে তোমার সেই অক্ষয় আত্মরূপ প্রদর্শন কর । ৪
শ্রীভগবান্ বলিলেন -
হে পার্থ, নানা বর্ণ ও নানা আকৃতিবিশিষ্ট শত শত সহস্র সহস্র বিভিন্ন অবয়ববিশিষ্ট আমার এই অদ্ভূত রূপ দর্শন কর । ৫
হে ভারত (অর্জুন), এই আমার দেহে দ্বাদশ আদিত্য, অষ্ট বসু, একাদশ রুদ্র, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, এবং ঊনপঞ্চাশৎ মরুদ্গণ দর্শন কর; পূর্বে যাহা কখনও দেখ নাই, তেমন বহুবিধ আশ্চর্য বস্তু দর্শন কর । ৬
হে নিদ্রাজয়ী অর্জুন, আমার এই দেহে একত্র অবস্থিত চরাচর সমগ্র জগৎ দর্শন কর এবং অপর যাহা কিছু তুমি দেখিতে ইচ্ছা কর, তাহাও এখন দেখিয়া লও । ৭
হে অর্জুন, তুমি তোমার এই চর্মচক্ষুদ্বারা আমার এই রূপ দর্শনে সমর্থ হইবে না । এজন্য তোমাকে দিব্যচক্ষু দিতেছি, তদ্দারা আমার এই ঐশ্বরিক যোগসামর্থ্য দেখ । ৮
সঞ্জয় কহিলেন -
হে রাজন্ মহাযোগেশ্বর হরি এইরূপ বলিয়া তৎপর পার্থকে পরম ঐশ্বরিক রূপ দেখাইলেন । ৯
সেই ঐশ্বরিক রূপে অসংখ্য মুখ, অসংখ্য নেত্র, অসংখ্য অদ্ভুত অদ্ভুত দর্শনীয় বস্তু, অসংখ্য দিব্য আভরণ এবং অসংখ্য উদ্যত দিব্যাস্ত্রসকল বিদ্যমান (ছিল) । ১০
সেই বিশ্বরূপ দিব্য মাল্য ও দিব্য বস্ত্রে সুশোভিত, দিব্যগন্ধদ্রব্যে অনুলিপ্ত, সর্বাশ্চর্যময়, দ্যুতিমান্ অনন্ত ও সর্বতোমুখ (সর্বত্র মুখবিশিষ্ট) (ছিল) । ১১
আকাশে যদি যুগপৎ সহস্র সূর্যের প্রভা উত্থিত হয়, তাহা হইলে সেই সহস্র সূর্যের প্রভা মহাত্মা বিশ্বরূপের প্রভাব তুল্য হইতে পারে । ১২
তখন অর্জুন সেই দেবদেবের দেহে নানা ভাবে বিভক্ত তদীয় অঙ্গপ্রত্যঙ্গ স্বরূপ একত্রস্থিত সমগ্র জগৎ দেখিয়াছিলেন । ১৩
সেই বিশ্বরূপ দর্শন করিয়া ধনঞ্জয় বিস্ময়ে আপ্লুত হইলেন । তাঁহার সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল । তিনি অবনতমস্তকে সেই দেবদেবকে প্রণাম করিয়া করজোরে বলিতে লাগিলেন । ১৪
অর্জুন বলিলেন -
হে দেব, তোমার দেহে আমি সমস্ত দেবগণ, স্থাবর জঙ্গমাত্মক বিবিধ সৃষ্ট পদার্থ, সৃষ্টিকর্তা কমলাসনস্থ ব্রহ্মা, নারদ-সনকাদি দিব্য কবিগণ এবং অনন্ত্য-তক্ষকাদি সর্পগণকে দেখিতেছি । ১৫
অসংখ্য বাহু, উদর, বদন ও নেত্রবিশিষ্ট অনন্তরূপ তোমাকে সকল দিকেই আমি দেখিতেছি । কিন্তু হে বিশ্বেশ্বর, হে বিশ্বরূপ, আমি তোমার আদি, অন্ত, মধ্য, কোথাও কিছু দেখিতেছি না । ১৬
কিরীট, গদা ও চক্রধারী, সর্বত্র দীপ্তিশালী, তেজঃপুঞ্জস্বরূপ, প্রদীপ্ত অগ্নি ও সূর্যের ন্যায় প্রভাসম্পন্ন, দুর্নিরীক্ষ্য, অপরিমেয় তোমার অদ্ভূত মুর্তি সর্বদিকে সর্বস্থানে আমি দেখিতেছি । ১৭
তুমি অক্ষর পরব্রহ্ম, তুমি একমাত্র জ্ঞাতব্য তত্ত্ব, তুমিই এই বিশ্বের পরম আশ্রয়, তুমিই সনাতন ধর্মের প্রতিপালক, তুমি অব্যয় সনাতন পুরুষ, ইহাতে আমার সংশয় নাই । ১৮
আমি দেখিতেছি, তোমার আদি নাই, মধ্য নাই, অন্ত নাই, তোমার বলৈশ্বর্যের অবধি নাই, অসংখ্য তোমার বাহু, চন্দ্র সূর্য তোমার নেত্রস্বরূপ, তোমার মুখমণ্ডলে প্রদীপ্ত হুতাশন জ্বলিতেছে; তুমি স্বীয় তেজে নিখিল বিশ্বকে সন্তাপিত করিতেছ । ১৯
হে মহাত্মন্, একমাত্র তুমিই স্বর্গ ও পৃথিবীর মধ্যস্থল এই অন্তরীক্ষ এবং দিক্সকলও ব্যাপিয়া রহিয়াছ । তোমার এই অদ্ভূত উগ্রমূর্তি দর্শন করিয়া ত্রিলোক ব্যথিত হইতেছে । ২০
ঐ দেবতাগণ তোমাতেই প্রবেশ করিতেছেন । কেহ কেহ ভীত হইয়া (জয় জয়, রক্ষ রক্ষ ইত্যাদি বাক্যে) কৃতাঞ্জলিপুটে রক্ষা প্রার্থনা করিতেছেন, মহর্ষি ও সিদ্ধগণ স্বস্তি স্বস্তি বলিয়া উত্তম সারগর্ভ স্তোত্রসমূহদ্বারা তোমার স্তব করিতেছেন । ২১
একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য, অষ্ট বসু, সাধ্যনামক দেবগণ, বিশ্বদেবগণ, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, ঊনপঞ্চাশ মরুৎ, উষ্মপা (পিতৃগণ), গন্ধর্ব, যক্ষ, অসুর ও সিদ্ধগণ সকলেই বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া তোমাকে দর্শন করিতেছেন । ২২
হে মহাবাহো, বহু বহু মুখ, নেত্র, বাহু, ঊরু, পাদ ও উদর বিশিষ্ট এবং বহু বৃহদাকার দন্ত দ্বারা ভয়ঙ্করদর্শন তোমার এই সুবিশাল মূর্তি দেখিয়া লোকসকল ভীত হইয়াছে এবং আমিও ভীত হইয়াছি । ২৩
হে বিষ্ণো, নভঃস্পর্শী, তেজোময়, বিচিত্রবর্ণ, বিস্ফারিতবদন, অত্যুজ্জল বিশালনেত্র-বিশিষ্ট তোমার রূপ দেখিয়া আমার অন্তরাত্মা ব্যথিত হইতেছে, আমার দেহেন্দ্রিয় বিকল হইতেছে, আমি মনকে শান্ত করিতে পারিতেছি না । ২৪
বৃহৎ দন্তসমূহের দ্বারা ভয়ানকদর্শন, প্রলয়াগ্নি সদৃশ তোমার মুখসকল দর্শন করিয়া আমার দৃষ্টিভ্রম ঘটিতেছে (আমি দিশেহারা হইয়াছি), আমি স্বস্তি পাইতেছি না । হে দেবেশ, হে জগন্নিবাস, প্রসন্ন হও (আমার ভয় দূর কর) । ২৫
(জয়দ্রথাদি) রাজন্যবর্গসহ ঐ সকল ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণ এবং ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ এবং আমাদের প্রধান প্রধান যোদ্ধৃগণ তোমার দংষ্ট্রাকরাল ভয়ঙ্করদর্শন মুখগহ্বরে ধাবিত হইয়া প্রবেশ করিতেছে । কাহারো কাহারো মস্তক চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া গিয়াছে এবং উহা তোমার দন্তসন্ধিতে সংলগ্ন হইয়া রহিয়াছে দেখা যাইতেছে । ২৬,২৭
যেমন নদীসমূহের বিপুল জলপ্রবাহ সমুদ্রাভিমুখ হইয়া সমুদ্রে গিয়া প্রবেশ করে, সেইরূপ এই মনুষ্য লোকের বীরগণ তোমার সর্বতোব্যাপ্ত জ্বলন্ত মুখগহ্বরে প্রবেশ করিতেছে । ২৮
যেমন পতঙ্গগণ অতি বেগে ধাবমান হইয়া মরণের জন্য জ্বলন্ত অগ্নিতে প্রবেশ করে, সেইরূপ এই লোকসকল মরণের নিমিত্তই অতি বেগে তোমার মুখগহ্বরে প্রবেশ করিতেছে । ২৯
তুমি জ্বলন্ত মুখসমূহের দ্বারা লোকসমূহকে গ্রাস করিয়া বারংবার স্বাদগ্রহণ করিতেছ । সমগ্র জগৎ তোমার তীব্র তেজোরাশি-ব্যাপ্ত হইয়া প্রতপ্ত হইয়া উঠিয়াছে । ৩০
উগ্রমূর্তি আপনি কে, আমাকে বলুন । হে দেববর, আপনাকে প্রণাম করি, প্রসন্ন হউন । আদি পুরুষ আপনাকে আমি জানিতে ইচ্ছা করি । আপনি কে, কি কার্যে প্রবৃত্ত, বুঝিতেছি না । ৩১
শ্রীভগবান্ কহিলেন -
আমি লোকক্ষয়কারী অতি ভীষণ কাল; এক্ষণে এই লোকদিগকে সংহার করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি; তুমি যুদ্ধ না করিলেও প্রতিপক্ষ সৈন্যদলে যে সকল যোদ্ধা অবস্থান করিতেছে তাহারা কেহই থাকিবে না । ৩২
অতএব, তুমি যুদ্ধার্থ উত্থিত হও; শত্রু জয় করিয়া যশঃ লাভ কর, নিষ্কন্টক রাজ্য ভোগ কর । হে অর্জুন, আমি ইহাদিগকে পূর্বেই নিহত করিয়াছি; তুমি এখন নিমিত্ত-মাত্র হও । ৩৩
দ্রোণ, ভীষ্ম, জয়দ্রথ, কর্ণ এবং অন্যান্য যুদ্ধবীরগণকে আমি পূর্বেই নিহত করিয়া রাখিয়াছি, তুমি সেই হতগণকে নিহত কর; ভয় করিও না । রণে শত্রুগণকে নিশ্চয় নিহত করিতে পারিবে, যুদ্ধ কর । ৩৪
সঞ্জয় বলিলেন -
শ্রীকৃষ্ণের এই বাক্য শ্রবণ করিয়া অর্জুন কম্পিত কলেবরে কৃতাঞ্জলিপুটে কৃষ্ণকে নমস্কার করিলে; আবার অত্যন্ত ভীত হইয়া প্রণামপূর্বক গদ্গদ স্বরে বলিতে লাগিলেন । ৩৫
অর্জুন কহিলেন -
হে হৃষীকেশ, তোমার মাহাত্ম্য-কীর্তনে সমস্ত জগৎ যে হৃষ্ট হয় এবং তোমার প্রতি অনুরক্ত হয়, ইহা যুক্তিযুক্ত; রাক্ষসেরা যে তোমার ভয়ে ভীত হইয়া চতুর্দিকে পলায়ন করে, এবং সিদ্ধগণ যে তোমাকে নমস্কার করেন, তাহাও আশ্চর্য নহে । ৩৬
হে মহাত্মন্, হে দেবেশ, হে জগন্নিবাস, তুমি ব্রহ্মারও গুরু এবং আদি কর্তা; অতএব সমস্ত জগৎ কেন তোমাকে নমস্কার না করিবে । তুমি সৎ (ব্যক্ত জগৎ), তুমি অসৎ (অব্যক্ত প্রকৃতি) এবং সদসতে অতীত যে অক্ষর ব্রহ্ম তাহাও তুমি । ৩৭
হে অনন্তরূপ, তুমি আদিদেব, তুমি অনাদি পুরুষ, তুমি এই বিশ্বের একমাত্র লয়স্থান, তুমি জ্ঞাতা, তুমিই জ্ঞাতব্য, তুমিই পরমধাম ! তুমি এই বিশ্ব ব্যাপিয়া অবস্থান করিতেছ । ৩৮
বায়ু, যম, অগ্নি, বরুণ, চন্দ্র তুমিই; পিতামহ ব্রহ্মাও তুমি এবং ব্রহ্মার জনকও (প্রপিতামহ) তুমি । তোমাকে সহস্রবার নমস্কার করি, আবার পুনঃ পুনঃ তোমাকে নমস্কার করি । ৩৯
তোমাকে সম্মুখে নমস্কার করি, তোমাকে পশ্চাতে নমস্কার করি; হে সর্বস্বরূপ, সর্বত্রই তুমি - তোমাকে সকল দিকেই নমস্কার করি; অনন্ত তোমার বলবীর্য, অসীম তোমার পরাক্রম । তুমি সমস্ত ব্যাপিয়া রহিয়াছ, সুতরাং তুমিই সমস্ত । ৪০
তোমার এই বিশ্বরূপ এবং ঐশ্বর্যমহিমা না জানিয়া, তোমাকে সখা ভাবিয়া অজ্ঞানবশতঃ বা প্রণয়বশতঃ, হে কৃষ্ণ, হে মাধব, হে সখা, এইরূপ তোমায় বলিয়াছি; হে অচ্যুত, আহার, বিহার, শয়ন ও উপবেশনকালে একা অথবা বন্ধুজন সমক্ষে পরিহাসচ্ছলে তোমার কত অমর্যাদা করিয়াছি, অচিন্ত্যপ্রভাব তুমি, তোমার নিকট তজ্জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি । ৪১,৪২
হে অমিতপ্রভাব, তুমি এই চরাচর সমস্ত লোকের পিতা; তুমি পূজ্য, গুরু ও গুরু হইতে গুরুতর; ত্রিজগতে তোমার তুল্য কেহই নাই, তোমা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ থাকিবে কি প্রকারে ? ৪৩
হে দেব, পূর্বোক্ত রূপে আমি অপরাধী, সেই হেতু দণ্ডবৎ প্রণামপূর্বক তোমার প্রসাদ প্রার্থনা করিতেছি । সকলের বন্দনীয় ঈশ্বর তুমি; পিতা যেমন পুত্রের, সখা যেমন সখার, প্রিয় যেমন প্রিয়ার অপরাধ ক্ষমা করেন, তুমিও তদ্রুপ আমার অপরাধ ক্ষমা কর । ৪৪
হে দেব, পূর্বে যাহা কখনও দেখি নাই, সেই রূপ দেখিয়া আমার হর্ষ হইয়াছে বটে, কিন্তু ভয়ে মন ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছে; অতএব, তোমার সেই (চির পরিচিত) পূর্বরূপটা আমাকে দেখাও; হে দেবেশ, হে জগন্নিবাস, আমার প্রতি প্রসন্ন হও । ৪৫
কিরীটধারী এবং গদা ও চক্রহস্ত তোমার সেই পূর্বরূপই আমি দেখিতে ইচ্ছা করি । হে সহস্রবাহো, বিশ্বমূর্তে, তুমি চতুর্ভূজ মূর্তি ধারণ কর । ৪৬
শ্রীভগবান্ বলিলেন -
আমি প্রসন্ন হইয়া স্বকীয় যোগ প্রভাবেই এই তেজোময়, অনন্ত, আদ্য, বিশ্বাত্মক পরমরূপ তোমাকে দেখাইলাম; আমার এই রূপ তুমি ভিন্ন পূর্বে কেহ দেখে নাই । ৪৭
হে কুরুপ্রবীর, না বেদাধ্যয়ন দ্বারা, না যজ্ঞবিদ্যার অনুশীলন দ্বারা, না দানাদি ক্রিয়াদ্বারা, না উগ্র তপস্যা দ্বারা - মনুষ্যলোকে তুমি ভিন্ন আর কেহ আমার ঈদৃশ রূপ দেখিতে সক্ষম হয় নাই । ৪৮
তুমি আমার এই ঘোর রূপ দেখিয়া ব্যথিত হইও না, বিমূঢ় হইও না, ভয় ত্যাগ করিয়া প্রীত মনে পুনরায় তুমি আমার পূর্বরূপ দর্শন কর । ৪৯
সঞ্জয় বলিলেন -
বাসুদেব অর্জুনকে এই বলিয়া পুনরায় সেই স্বীয় মূর্তি দেখাইলেন; মহাত্মা পুনরায় প্রসন্ন মূর্তি ধারণ করিয়া ভীত অর্জুনকে আশ্বস্ত করিলেন । ৫০
অর্জুন বলিলেন -
হে জনার্দন, তোমার এই সৌম্য মানুষ রূপ দর্শন করিয়া আমি এখন প্রসন্নচিত্ত ও প্রকৃতিস্থ হইলাম । ৫১
শ্রীভগবান্ বলিলেন -
তুমি আমার যে রূপ দেখিলে উহার দর্শন লাভ একান্ত কঠিন; দেবগণও সর্বদা এই রূপের দর্শনাকাঙ্ক্ষী । ৫২
আমাকে যেরূপ দেখিলে এই রূপ বেদাধ্যয়ন, তপস্যা, ধ্যান, যজ্ঞ, কোন কিছু দ্বারাই দর্শন করা যায় না । ৫৩
হে পরন্তপ, হে অর্জুন, কেবল অনন্যা ভক্তি দ্বারাই ঈদৃশ আমাকে স্বরূপতা জানিতে পারা যায়, সাক্ষাৎ দেখিতে পারা যায়, এবং আমাতে প্রবেশ করিতে পারা যায় । ৫৪
হে পাণ্ডব, যে ব্যক্তি আমারই কর্মবোধে সমুদয় কর্ম করেন, আমিই যাঁহার একমাত্র গতি, যিনি সর্বপ্রকারে আমাকে ভজনা করেন, যিনি সমস্ত বিষয়ে আসক্তিশূন্য, যাহার কাহারও উপর শত্রুভাব নাই (সর্বভূতে বৈরভাবশূন্য), তিনিই আমাকে প্রাপ্ত হন । ৫৫
একাদশ অধ্যায়ে বিশ্বরূপের বর্ণনা, ইহা অদ্ভুতরসের বর্ণনা - ইহাতে ভয়, বিস্ময়, বিহ্বলতা আনয়ন করে - ইহাতে মাধুর্য, শান্তি ও প্রীতির ভাব নাই । তাই সৌন্দর্য-রস-পিপাসু ভক্তগণ সেই অনন্তস্বরূপের অনন্ত ঐশ্বর্যের চিন্তা করেন না - তাঁহার শান্ত সৌম্য লীলাবিগ্রহই ধ্যান করেন - উহার অপার সৌন্দর্য উপভোগ করেন । ঐশ্বর্য ও মাধুর্যে এই প্রভেদ । কথাটি রসতত্ত্ব-বিচারে পাশ্চাত্য দার্শনিকগণও বেশ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করিয়াছেন । যেমন -
"The beautiful calms and pacifies us; the sublime brings disorders into our faculties." [Weber's History of Philosophy]
"The sublime is incompatible with charms; and as the mind is not merely attracted by the object but continually in turn repelled, satisfaction in the sublime does not so much contain positive pleasure as admiration and respect." [Kant]
"The beautiful is the infinite represented in the finite form". [Schelling]
৪৭) শ্রীকৃষ্ণের চতুর্ভুজ ও দ্বিভুজ রূপ : এ-স্থলে অর্জুন ভগবানের চতুর্ভুজ বিষ্ণুমূর্তি দেখিতে চাহিতেছেন । কৃষ্ণলীলায় ভগবান দ্বিভুজ; কিন্তু বাসুদেবগৃহে তিনি শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী চতুর্ভুজ-রূপেই আবির্ভূত হইয়াছিলেন । পরে কংসভয়ে ভীত বসুদেবের প্রার্থনায় দুই বাহু সংবরণ করেন । কিন্তু সময়-সময় চতুর্ভুজ মূর্তিও ধারণ করিয়াছেন । [ভাগবত |১০|৮৩|২৮]
৫৫) অহিংস-নীতি ও ধর্ম্যযুদ্ধ :
ব্যবহারিক ধর্মতত্ত্ব বড় সূক্ষ্ম ও জটিল । অহিংসনীতি ও অত্যাচারীর সংহার, সত্যকথন ও দস্যুতাড়িত পলায়নপর আশ্রিতের রক্ষা, ইত্যাদি স্থলে যখন পরস্পর বিরোধ উপস্থিত হয়, তখন কোনটি ধর্ম, কোনটি অধর্ম - তাহা নির্ণয় করা বড় সহজ নহে । এই হেতু মহাভারতে পুনঃপুনঃ বলা হইয়াছে, 'সূক্ষ্মা গতির্হি ধর্মস্য' ।
বিশ্বরূপ ও ভূমাবাদ :
দুইটি শ্রুতিবাক্যকে সনাতন ধর্মের ভিত্তি বলা যায় :-
- 'একমেবাদ্বিতীয়ং ব্রহ্ম' - ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়
- 'সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম' - এই সমস্তই ব্রহ্ম
কিন্তু এই বাক্য দুইটির ব্যাখ্যায় বৈদান্তিকগণের মধ্যে মর্মান্তিক মতভেদ আছে । এক পক্ষ বলেন, - একমাত্র ব্রহ্মই আছেন, তিনি অখণ্ড অদ্বৈত-তত্ত্ব, তাহার মধ্যে নানাত্ব নাই - তিনি ভূমা । ভ্রমবশত সেই ব্রহ্ম-বস্তুতেই জগতের অধ্যাস হয় - যেমন রজ্জুতে সর্পভ্রম হয়, মরীচিকায় জলভ্রম হয় । এই ভ্রমের কারণ মায়া বা অজ্ঞান; অজ্ঞান বিদূরিত হইলেই ব্রহ্ম উদ্ভাসিত হন ।
অপরপক্ষ বলেন - ব্রহ্ম অদ্বিতীয় তাহা ঠিক, ব্রহ্মই এই সমস্ত হইয়াছেন । তিনিই জগতের নিমিত্ত কারণ ও উপাদান কারণ । তিনি আপনাকে জগৎরূপে পরিণত করিয়াছেন । জগৎ ব্রহ্মের শরীর, বিশ্ব তাঁহার রূপ বা দেহ, এইজন্য তিনি বিশ্বরূপ । তিনিই ভূমা । ইহা ভূমাবাদের অন্য দিক ।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : দ্বাদশ অধ্যায় - ভক্তিযোগ
সতত ত্বদ্গতচিত্ত হইয়া যে সকল ভক্ত তোমার উপাসনা করেন এবং যাঁহারা অব্যক্ত অক্ষরের উপাসনা করেন, এই উভয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সাধক কে ? ১
শ্রীভগবান্ কহিলেন -
যাঁহারা আমাতে মন নিবিষ্ট করিয়া নিত্যযুক্ত হইয়া পরম শ্রদ্ধা সহকারে আমার উপাসনা করেন, তাঁহারাই আমার মতে যুক্ততম অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ সাধক । ২
কিন্তু যাহারা সর্বত্র সমবুদ্ধিযুক্ত এবং সর্বপ্রাণীর হিতপরায়ণ হইয়া ইন্দ্রিয়সমূহকে বিষয় হইতে প্রত্যাহৃত করিয়া সেই অনির্দেশ্য, অব্যক্ত, সর্বব্যাপী, অচিন্ত্য, কূটস্থ, অচল, ধ্রুব, অক্ষর ব্রহ্মের উপাসনা করেন, তাহারাও আমাকেই প্রাপ্ত হন । ৩,৪
অব্যক্ত নির্গুণব্রহ্মে আসক্তচিত্ত সেই সাধকগণের সিদ্ধি লাভে অধিকতর ক্লেশ হয়; কারণ, দেহধারিগণ অতি কষ্টে নির্গুণ ব্রহ্মবিষয়ক নিষ্ঠা লাভ করিয়া থাকেন । ৫
কিন্তু যাহারা সমস্ত কর্ম আমাতে অর্পণ করিয়া, একমাত্র আমাতেই চিত্ত একাগ্র করিয়া, ধ্যাননিরত হইয়া আমার উপাসনা করেন, হে পার্থ, আমাতে সমর্পিতচিত্ত সেই ভক্তগণকে আমি অচিরাৎ সংসারসাগর হইতে উদ্ধার করিয়া থাকি । ৬,৭
আমাতেই মন স্থাপন কর, আমাতে বুদ্ধি নিবিষ্ট কর, তাহা হইলে দেহান্তে আমাতেই স্থিতি করিবে, ইহাতে সন্দেহ নাই । ৮
হে ধনঞ্জয়, যদি আমাতে চিত্ত স্থির রাখিতে না পার, তাহা হইলে পুনঃপুনঃ অভ্যাসদ্বারা চিত্তকে সমাহিত করিয়া আমাকে পাইতে চেষ্টা কর । ৯
যদি অভ্যাসেও অসমর্থ হও, তবে মৎকর্মপরায়ণ হও (অর্থাৎ শ্রবণ, কীর্তন, পূজাপাঠ ইত্যাদি কর্মের অনুষ্ঠান কর); আমার প্রীতি সাধনার্থ কর্মের অনুষ্ঠান করিলেও তুমি সিদ্ধি লাভ করিবে । ১০
যদি ইহাতেও অশক্ত হও, তাহা হইলে মদ্যোগ অর্থাৎ আমাতে কর্মার্পণরূপ যোগ আশ্রয় করিয়া সংযতাত্মা হইয়া সমস্ত কর্মের ফল ত্যাগ কর । ১১
অভ্যাস অপেক্ষা জ্ঞান শ্রেষ্ঠ, জ্ঞান অপেক্ষা ধ্যান শ্রেষ্ঠ । ধ্যান অপেক্ষা কর্মফলত্যাগ শ্রেষ্ঠ । এইরূপ ত্যাগের পরই শান্তি লাভ হইয়া থাকে । ১২
যিনি কাহাকেও দ্বেষ করেন না; যিনি সকলের প্রতি মিত্রভাবাপন্ন ও দয়াবান্; যিনি সমত্ববুদ্ধি ও অহঙ্কারবর্জিত, যিনি সুখে দুঃখে সমভাবাপন্ন, সদা সন্তুষ্ট, সমাহিতচিত্ত, সংযত-স্বভাব, দৃঢ়বিশ্বাসী, যাহার মন বুদ্ধি আমাতে অর্পিত, ঈদৃশ মদ্ভক্ত আমার প্রিয় । ১৩,১৪
যাহা হইতে কোন প্রাণী উদ্বেগ প্রাপ্ত হয় না এবং যিনি স্বয়ংও কোন প্রাণি-কর্তৃক উত্যক্ত হন না এবং যিনি হর্ষ, অমর্ষ, ভয় ও উদ্বেগ হইতে মুক্ত, তিনি আমার প্রিয় । ১৫
যিনি সর্ব বিষয়ে নিঃস্পৃহ, শৌচসম্পন্ন, কর্তব্য-কর্মে অনলস, পক্ষপাতশূন্য, যাহাকে কিছুতেই মনঃপীড়া দিতে পারে না এবং ফল কামনা করিয়া যিনি কোন কর্ম আরম্ভ করেন না, এতাদৃশ ভক্ত আমার প্রিয় । ১৬
যিনি ইষ্টলাভে হৃষ্ট হন না, অপ্রাপ্য বস্তুলাভে আকাঙ্ক্ষা করেন না, যিনি কর্মের শুভাশুভ ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করিয়াছেন, ঈদৃশ ভক্তিমান্ সাধক আমার প্রিয় । ১৭
যিনি শত্রু-মিত্রে, মান-অপমানে, শীত-উষ্ণে, সুখ-দুঃখে সমত্ববুদ্ধি-সম্পন্ন, যিনি সর্ববিষয়ে আসক্তিবর্জিত, স্তুতি বা নিন্দাতে যাঁহার তুল্য জ্ঞান, যিনি সংযতবাক্, যদ্দৃচ্ছালাভে সন্তুষ্ট, গৃহাদিতে মমত্ববুদ্ধি-বর্জিত, এবং স্থিরচিত্ত, ঈদৃশ ভক্তিমান্ ব্যক্তি আমার প্রিয় । ১৮,১৯
যাঁহারা শ্রদ্ধাবান্ ও মৎপরায়ণ হইয়া পূর্বোক্ত অমৃততুল্য ধর্মের অনুষ্ঠান করেন, সেই সকল ভক্তিমান্ আমার অতীব প্রিয় । ২০
৮) ব্যক্ত ও অব্যক্তের উপাসনা - ভক্তিমার্গের শ্রেষ্ঠতা
পরমেশ্বরের দুই বিভাব - ব্যক্ত ও অব্যক্ত । যিনি সগুণ, সাকার, স্বরূপে লীলাবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, তিনিই আবার বিশ্বাত্মা, অব্যক্ত নির্গুণ-স্বরূপে তিনি অচিন্ত্য, অনির্দেশ্য, নির্বিশেষ পরব্রহ্ম । শ্রীভগবান বলিয়াছেন, ভগবদ্ভক্তই শ্রেষ্ঠ সাধক কিন্তু যাঁহারা কেবল আত্মস্বাতন্ত্র্যবলে মায়া-নির্মুক্ত হইয়া ব্রহ্মসাক্ষাৎকারে যত্ন করেন, তাঁহারাও তাঁহাকেই প্রাপ্ত হন । কিন্তু দেহাভিমানী জীবের পক্ষে দেহাত্মবোধ বিদূরিত করিয়া ব্রহ্মচিন্তা করা অধিকতর ক্লেশকর । ইহাদ্বারা ভক্তিমার্গ অধিকতর সুলভ ও সুখসাধ্য বলিয়া কথিত হইল ।
১০) ভগবৎকর্মপরায়ণ : যিনি নিম্নে উল্লিখিত ভক্তিশাস্ত্রের নববিধ ভক্তির সাধন করেন :-
- শ্রবণ
- কীর্তন
- স্মরণ
- পদসেবা
- অর্চনা
- বন্দনা
- দাস্য
- সখ্য
- আত্মনিবেদন
নিষ্কাম কর্মযোগের শ্রেষ্ঠতা :
গীতার মতে কর্মযোগই সর্বাপেক্ষা সহজসাধ্য কারণ ইহা সর্বাঙ্গ সুন্দররূপে সম্পন্ন করিতে না পারিলেও একেবারে নিষ্ফল হয় না । আর সুসাধ্য হইলেই যে নিম্নস্তরের হইবে, এ-কথার কোনো যুক্তি নাই । দ্বিতীয়ত, ইহাতে বিধি-নিষেধের কঠোর গণ্ডীর মধ্যে থাকিতে হয় না, সুতরাং পদে-পদে বাধা-বিঘ্নের আশঙ্কা থাকে না । তৃতীয়ত, ইহাতে ভগবানের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করিতে হয় । সুতরাং সাধকের লাভালাভ, সিদ্ধি-অসিদ্ধি বিষয়ে আর-কোনো ভাবনা-চিন্তা করিতে হয় না, কেননা তাঁহার অভয়বাণীই আছে, একান্তে আমার শরণ লও; সব আমিই করিয়া দিব, ভয় নাই । অন্যান্য সকল সাধনায়ই আত্মস্বাতন্ত্র্যের উপর নির্ভর করিতে হয়, পদস্খলন হইলেই বিপদ । এ-ক্ষেত্রে কিন্তু তিনি সর্বদাই হাত ধরিয়া আছেন, পতনের ভয় কি ?
১৭) শুভাশুভপরিত্যাগী : যিনি স্বর্গাদি-কামনায় অথবা নরকাদির ভয়ে কোনো কর্ম করেন না, যিনি ফলাকাঙ্ক্ষাবর্জিত, সমত্ববুদ্ধিযুক্ত, সুখদুঃখ, পাপপুণ্যাদি দ্বন্দ্ববর্জিত ।
ভক্তের লক্ষণ [১২|৬-৭, ১৩-২০] = স্থিতপ্রজ্ঞের লক্ষণ [২|৫৫-৭৫] = জ্ঞানীর লক্ষণ [১৩|৭-১১]বস্তুত পরাভক্তি ও পরমজ্ঞানে কোনো পার্থক্য নাই । কামনাত্যাগ উভয়েরই মূলকথা এবং ত্যাগজনিত শান্তি ও সমত্ববুদ্ধি উহার সুধাময় ফল ।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : ত্রয়োদশ অধ্যায় - ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞ বিভাগযোগ
হে কেশব, প্রকৃতি ও পুরুষ, ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞ এবং জ্ঞান ও জ্ঞেয় এইগুলি জানিতে আমি ইচ্ছা করি । (প্রক্ষিপ্ত ? শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য ও শ্রীধরস্বামী এই শ্লোকটি গ্রহণ করেন নাই ।)
শ্রীভগবান্ কহিলেন -
হে কৌন্তেয়, এই দেহকে ক্ষেত্র বলা হয় এবং যিনি এই ক্ষেত্রকে জানেন (অর্থাৎ ‘আমি’ ‘আমার’ এইরূপ মনে করেন) তিনিই ক্ষেত্রজ্ঞ (জীবাত্মা); ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞবেত্তা পণ্ডিতগণ এইরূপ বলিয়া থাকেন । ১
হে ভারত, সমুদয় ক্ষেত্রে আমাকেই ক্ষেত্রজ্ঞ বলিয়া জানিও; ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের যে জ্ঞান তাহাই প্রকৃত জ্ঞান, ইহাই আমার মত । অথবা ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞের যে জ্ঞান তাহাই আমার (পরমেশ্বরের) জ্ঞান, ইহাই সর্বসম্মত । ২
সেই ক্ষেত্র কি, উহা কি প্রকার, উহা কি প্রকার বিকার-বিশিষ্ট, ইহার মধ্যেও কি হইতে কি হয়, এবং সেই ক্ষেত্রজ্ঞ কে এবং তাহার প্রভাব কিরূপ, এইসকল তত্ত্ব সংক্ষেপে আমার নিকট শ্রবণ কর । ৩
ঋষিগণ কর্তৃক নানা ছন্দে পৃথক্ পৃথক্ নানা প্রকারে এই ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞ-তত্ত্ব ব্যাখ্যাত হইয়াছে । ব্রহ্মসূত্র-পদসমূহেও যুক্তিযুক্ত বিচারসহ নিঃসন্দিগ্ধরূপে এই বিষয় ব্যাখ্যাত হইয়াছে । ৪
ক্ষিতি আদি পঞ্চমহাভূত, অহঙ্কার, বুদ্ধি (মহত্তত্ত্ব), মূল প্রকৃতি, দশ ইন্দ্রিয়, মন এবং রূপরসাদি পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের বিষয় (পঞ্চতন্মাত্র) এবং ইচ্ছা, দ্বেষ, সুখ, দুঃখ, সংঘাত, চেতনা ও ধৃতি এই সমুদয়কে সবিকার ক্ষেত্র বলে । ৫,৬
শ্লাঘা-রাহিত্য, দম্ভ-রাহিত্য, অহিংসা, ক্ষমা, সরলতা, গুরুসেবা, শৌচ, সৎকার্যে একনিষ্ঠা, আত্মসংযম, বিষয়-বৈরাগ্য, নিরহঙ্কারিতা, জন্ম-মৃত্যু-জরাব্যাধিতে দুঃখ দর্শন, বিষয়ে বা কর্মে অনাসক্তি, স্ত্রীপুত্রগৃহাদিতে মমত্ববোধের অভাব, ইষ্টানিষ্টলাভে সমচিত্ততা, আমাতে (ভগবান্ বাসুদেবে) অনন্যচিত্তে ঐকান্তিক ভক্তি, পবিত্র নির্জন স্থানে বাস, প্রাকৃত জনসমাজে বিরক্তি, সর্বতা অধ্যাত্মজ্ঞানের অনুশীলন (নিত্য আত্মজ্ঞাননিষ্ঠা), তত্ত্বজ্ঞানের প্রয়োজন আলোচনা - এই সকলকে জ্ঞান বলা হয়; ইহার বিপরীত যাহা তাহা অজ্ঞান । ৭-১১
যাহা জ্ঞাতব্য বস্তু, যাহা জ্ঞাত হইলে অমৃত অর্থাৎ মোক্ষ লাভ করা যায়, তাহা বলিতেছি; তাহা আদ্যন্তহীন, আমার নির্বিশেষ স্বরূপ-ব্রহ্ম; তৎসন্বন্ধে বলা হয় যে, তিনি সৎও নহেন, অসৎও নহেন । ১২
সর্বদিকে তাঁহার হস্তপদ, সর্বদিকে তাঁহার চক্ষু, মস্তক ও মুখ, সর্বদিকে তাহার কর্ণঃ এইরূপে এই লোকে সমস্ত পদার্থ ব্যাপিয়া তিনি অবস্থিত আছেন । ১৩
তিনি চক্ষুরাদি সমুদয় ইন্দ্রিয় বৃত্তিতে প্রকাশমান অথচ সর্বেন্দ্রিয়বিবর্জিত, নিঃসঙ্গ অর্থাৎ সর্বসঙ্গশূন্য অথচ সকলের আধারস্বরূপ, নির্গুণ অথচ সত্ত্বাদি-গুণের ভোক্তা বা পালক । ১৪
সর্বভূতের অন্তরে এবং বাহিরেও তিনি; চল এবং অচলও তিনি; সূক্ষ্মতাবশতঃ তিনি অবিজ্ঞেয়; এবং তিনি দূরে থাকিয়াও নিকটে স্থিত । ১৫
তিনি (তত্ত্বতঃ বা স্বরূপতঃ) অপরিচ্ছিন্ন হইলেও সর্বভূতে ভিন্ন-ভিন্ন বলিয়া প্রতীত হন । তাঁহাকে ভূতসকলের পালনকর্তা, সংহর্তা ও সৃষ্টিকর্তা বলিয়া জানিবে । ১৬
তিনি জ্যোতিসকলেরও (সূর্যাদিরও) জ্যোতিঃ; তিনি তমের অর্থাৎ অবিদ্যারূপ অন্ধকারের অতীত, তিনি বুদ্ধিবৃত্তিতে প্রকাশমান জ্ঞান, তিনি জ্ঞেয় তত্ত্ব, তিনি জ্ঞানের দ্বারা লভ্য, তিনি সর্বভূতের হৃদয়ে অবস্থিত আছেন । ১৭
এই প্রকারে ক্ষেত্র, জ্ঞান এবং জ্ঞেয় কাহাকে বলে সংক্ষেপে কথিত হইল । আমার ভক্ত ইহা জানিয়া আমার ভাব বা স্বরূপ বুঝিতে পারেন, বা আমার দিব্য প্রকৃতি প্রাপ্ত হন । ১৮
প্রকৃতি ও পুরুষ, উভয়কেই অনাদি বলিয়া জানিও । দেহেন্দ্রিয়াদি বিকারসমূহ এবং সুখ, দুঃখ, মোহাদি গুণসমূহ প্রকৃতি হইতেই উৎপন্ন হইয়াছে জানিবে । ১৯
শরীর ও ইন্দ্রিয়গণের কর্তৃত্ব বিষয়ে প্রকৃতিই কারণ, এবং সুখ, দুঃখ ভোগ বিষয়ে পুরুষই (ক্ষেত্রজ্ঞ) কারণ বলিয়া উক্ত হন । ২০
পুরুষ প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিত হইয়া প্রকৃতির গুণসমূহ ভোগ করেন এবং গুণসমূহের সংসর্গই পুরুষের সৎ ও অসৎ যোনিতে জন্মগ্রহণের কারণ হয় । ২১
এই দেহে যে পরম পুরুষ আছেন, তিনি উপদ্রষ্টা, অনুমন্তা, ভর্তা, ভোক্তা, মহেশ্বর ও পরমাত্মা বলিয়া উক্ত হন । ২২
যিনি এই প্রকার পুরুষতত্ত্ব এবং বিকারাদি গুণ সহিত প্রকৃতিতত্ত্ব অবগত হন, তিনি যে অবস্থায় থাকুন না কেন, পুনরায় জন্মলাভ করেন না অর্থাৎ মুক্ত হন । ২৩
কেহ কেহ (স্বয়ং) আপনি আপনাতেই ধ্যানের দ্বারা আত্ম দর্শন করেন । কেহ-কেহ সাংখ্যযোগ দ্বারা এবং অন্য কেহ-কেহ কর্মযোগের দ্বারা আত্মাকে দর্শন করেন । ২৪
আবার অন্য কেহ-কেহ এইরূপ আপনা আপনি আত্মাকে না জানিয়া অন্যের নিকট শুনিয়া উপাসনা করেন । শ্রদ্ধাপূর্বক উপদেশ শ্রবণ করিয়া উপাসনা করতঃ তাঁহারাও মৃত্যুকে অতিক্রম করেন । ২৫
হে ভরতর্ষভ, স্থাবর, জঙ্গম যত কিছু পদার্থ উৎপন্ন হয়, তাহা সমস্তই ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের সংযোগ হইতে হইয়া থাকে জানিবে । ২৬
যিনি সর্বভূতে সমভাবে অবস্থিত এবং সমস্ত বিনষ্ট হইলেও যিনি বিনষ্ট হন না, সেই পরমেশ্বরকে যিনি সম্যক দর্শন করিয়াছেন, তিনিই যথার্থদর্শী । ২৭
যিনি সর্বভূতে সমান ও সমভাবে অবস্থিত ঈশরকে দর্শন করেন, তিনি আত্মাদ্বারা আত্মাকে হনন করেন না এবং সেই হেতু তিনি পরম গতি প্রাপ্ত হন । ২৮
প্রকৃতিই সমস্ত প্রকারে সমস্ত কর্ম করেন এবং আত্মা অকর্তা, ইহা যিনি দর্শন করেন তিনিই যথার্থদর্শী । ২৯
যখন তত্ত্বদর্শী সাধক ভূতসমূহের পৃথক্ পৃথক্ ভাব বা নানাত্ব একস্থ অর্থাৎ এক ব্রহ্মবস্তুতেই অবস্থিত এবং সেই ব্রহ্ম হইতেই এই নানাত্বের বিস্তার দর্শন করেন, তখন তিনি ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হন । ৩০
হে কৌন্তেয়, অনাদি ও নির্গুণ বলিয়া এই পরমাত্মা অবিকারী; অতএব দেহে থাকিয়াও তিনি কিছুই করেন না এবং কর্মফলে লিপ্ত হন না । ৩১
যেমন আকাশ সর্ববস্তুতে অবস্থিত থাকিলেও অতি সূক্ষ্মতা হেতু কোন বস্তুতে লিপ্ত হয় না, সেরূপ আত্মা সর্বদেহে অবস্থিত থাকিলেও কিছুতেই লিপ্ত হন না । ৩২
হে ভারত, যেমন এক সূর্য সমস্ত জগৎকে প্রকাশিত করেন, সেরূপ এক ক্ষেত্রজ্ঞ (আত্মা) সমস্ত ক্ষেত্র বা দেহকে প্রকাশিত করেন । ৩৩
যাহারা জ্ঞানচক্ষুদ্বারা ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের প্রভেদ এবং ভূতপ্রকৃতি অর্থাৎ অবিদ্যা হইতে মোক্ষ কি প্রকার তাহা দর্শন করেন (জানিতে পারেন) তাহারা পরমপদ প্রাপ্ত হন । ৩৪
২৩) প্রকৃতি-পুরুষ বিবেক :
এই জ্ঞেয় বস্তুই ক্ষেত্রজ্ঞ, পরমাত্মা বা পরব্রহ্ম এবং প্রকৃতি-সম্ভূত দেহেন্দ্রিয়াদিই ক্ষেত্র । বেদান্তে যাহা ক্ষেত্র বা ক্ষেত্রজ্ঞ, সাংখ্য-শাস্ত্রের পরিভাষায় তাহাই প্রকৃতি ও পুরুষ এবং ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞ-জ্ঞানই সাংখ্যের পুরুষ-প্রকৃতি-বিবেক । এই প্রকৃতি-পুরুষের বিবেকজ্ঞান অর্থাৎ পার্থক্য-জ্ঞানেই কৈবল্য মুক্তি - যাঁহার এই জ্ঞান হইয়াছে, তাঁহার পক্ষে ধর্ম-কর্ম, বিধি-নিষেধ কিছু নাই; অনাসক্তভাবে কর্ম করিলেও তাঁহার কর্মবন্ধন নাই, কেননা তিনি ত্রিগুণাতীত মুক্তপুরুষ । প্রকৃতিই মায়া, উহাই সংসারের কারণ; সুতরাং তিনি মায়ামুক্ত, তাঁহার সংসারের ক্ষয় হইয়াছে ।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : চতুর্দশ অধ্যায় - গুণত্রয়-বিভাগযোগ
আমি পুনরায় জ্ঞানসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম জ্ঞান বলিতেছি, যাহা জানিয়া মুনিগণ এই দেহবন্ধন হইতে মোক্ষলাভ করিয়াছেন । ১
এই জ্ঞান আশ্রয় করিয়া যাঁহারা আমার সাধর্ম্য লাভ করেন অর্থাৎ ত্রিগুণাতীত অবস্থা প্রাপ্ত হন, তাঁহারা সৃষ্টিকালেও জন্মগ্রহণ করেন না, প্রলয়কালেও ব্যথিত হন না (অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যু অতিক্রম করেন) । ২
হে ভারত, প্রকৃতিই আমার গর্ভাধান-স্থান । আমি তাহাতে গর্ভাধান করি, তাহা হইতেই সর্বভূতের উৎপত্তি হয় । ৩
হে কৌন্তেয়, দেব-মনুষ্যাদি বিভিন্ন যোনিতে যে সকল শরীর উৎপন্ন হয়, প্রকৃতি তাহাদের মাতৃস্থানীয়া এবং আমিই গর্ভাধানকর্তা পিতা । ৪
হে মহাবাহো, সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ প্রকৃতিজাত এই তিন গুণ দেহমধ্যে অব্যয় আত্মাকে বন্ধন করিয়া রাখে । ৫
হে অনঘ, এই তিন গুণের মধ্যে সত্ত্বগুণ নির্মল বলিয়া প্রকাশক এবং নির্দোষ; এই সত্ত্বগুণ সুখসঙ্গ ও জ্ঞানসঙ্গদ্বারা আত্মাকে বন্ধন করিয়া রাখে । ৬
হে অর্জুন, রজোগুণ রাগাত্মক, তৃষ্ণা ও আসক্তি উহা হইতে উৎপন্ন হয় । উহা কর্মাসক্তিদ্বারা দেহীকে বন্ধন করে । ৭
হে ভারত, তমোগুণ অজ্ঞানজাত এবং দেহিগণের ভ্রান্তিজনক । ইহা প্রমাদ (অনবধানতা), আলস্য ও নিদ্রা (চিত্তের অবসাদ) দ্বারা জীবকে আবদ্ধ করে । ৮
হে ভারত, সত্ত্বগুণ সুখে এবং রজোগুণ কর্মে জীবকে আসক্ত করে । কিন্তু তমোগুণ জ্ঞানকে আবৃত করিয়া প্রমাদ (কর্তব্যমূঢ়তা বা অনবধানতা) উৎপন্ন করে । ৯
হে ভারত, সত্ত্বগুণ রজঃ ও তমোগুণকে অভিভূত করিয়া প্রবল হয়, রজোগুণ তমঃ ও সত্ত্বগুণকে অভিভূত করিয়া প্রবল হয় এব তমোগুণ রজঃ ও সত্ত্বগুণকে অভিভূত করিয়া প্রবল হয় । ১০
যখনই এই দেহে শ্রোত্রাদি সর্ব ইন্দ্রিয়দ্বারে জ্ঞানাত্মক প্রকাশ অর্থাৎ নির্মল জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তখন জানিবে যে, সত্ত্বগুণ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইয়াছে । ১১
হে ভরতশ্রেষ্ঠ, লোভ, সর্বদা কর্মে প্রবৃত্তি এবং সর্ব কর্মে উদ্যম (সর্বদা ইহা করিব উহা করিব - এইরূপ অস্থিরতা), শান্তি ও তৃপ্তির অভাব, বিষয়স্পৃহা - এইসকল লক্ষণ রজোগুণ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইলে উৎপন্ন হয় । ১২
হে কুরুনন্দন, তমোগুণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইলে বিবেকভ্রংশ, নিরুদ্যমতা, কর্তব্যের বিস্মরণ এবং মোহ বা বুদ্ধি-বিপর্যয় - এইসকল লক্ষণ উৎপন্ন হয় । ১৩
সত্ত্বগুণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইলে যদি জীবের মৃত্যু হয়, তবে তিনি উত্তম তত্ত্ববিদ্গণের প্রাপ্য প্রকাশময় দিব্য লোকসকল প্রাপ্ত হন । ১৪
রজোগুণের বৃদ্ধিকালে মৃত্যু হইলে কর্মাসক্ত মনুষ্য-যোনিতে জন্ম হয় এবং তমোগুণের বৃদ্ধিকালে মৃত্যু হইলে পশ্বাদি মূঢ়-যোনিতে জন্ম হয় । ১৫
সাত্ত্বিক পুণ্য কর্মের ফল নির্মল সুখ, রাজসিক কর্মের ফল দুঃখ এবং তামসিক কর্মের ফল অজ্ঞান, তত্ত্বদর্শিগণ এইরূপ বলিয়া থাকেন । ১৬
সত্ত্বগুণ হইতে জ্ঞান উৎপন্ন হয়; রজোগুণ হইতে লোভ এবং তমোগুণ হইতে অজ্ঞান, প্রমাদ ও মোহ উৎপন্ন হইয়া থাকে । ১৭
সত্ত্বগুণপ্রধান ব্যক্তি ঊর্ধ্বলোকে অর্থাৎ স্বর্গাদি লোকে গমন করেন; রজঃপ্রধান ব্যক্তিগণ মধ্যলোকে অর্থাৎ ভূলোকে অবস্থান করেন; এবং প্রমাদ-মোহাদি নিকৃষ্টগুণসম্পন্ন তমঃপ্রধান ব্যক্তিগণ অধোগামী হয় (তমিস্রাদি নরক বা পশ্বাদি যোনি প্রাপ্ত হয়) । ১৮
যখন দ্রষ্টা জীব গুণ ভিন্ন অন্য কাহাকেও কর্তা না দেখেন (অর্থাৎ প্রকৃতিই কর্ম করে, আমি করি না, ইহা বুঝিতে পারেন) এবং তিন গুণের অতীত পরম বস্তুকে অর্থাৎ আত্মাকে জ্ঞাত হন, তখন তিনি আমার ভাব অর্থাৎ ব্রহ্মভাব বা ত্রিগুণাতীত প্রাপ্ত হন । ১৯
জীব দেহোৎপত্তির কারণভূত এই তিন গুণ অতিক্রম করিয়া জন্মমৃত্যু জরাদুঃখ হইতে বিমুক্ত হইয়া অমৃতত্ত্ব অর্থাৎ মোক্ষ লাভ করেন । ২০
অর্জুন কহিলেন -
হে প্রভো, কোন্ লক্ষণের দ্বারা জানা যায় যে জীব ত্রিগুণ অতিক্রম করিয়াছেন ? তাঁহার আচার কিরূপ ? এবং কি প্রকারে তিনি ত্রিগুণ অতিক্রম করেন ? ২১
শ্রীভগবান্ বলিলেন -
হে পাণ্ডব, সত্ত্বগুণের কার্য প্রকাশ বা জ্ঞান, রজোগুণের ধর্ম কর্ম-প্রবৃত্তি এবং তমোগুণের ধর্ম মোহ, এই সকল গুণধর্ম প্রবৃত্ত হইলেও যিনি সুখবুদ্ধিতে উহা আকাঙ্ক্ষা করেন না, তিনিই গুণাতীত বলিয়া উক্ত হন । ২২
যিনি উদাসীনের ন্যায় সাক্ষিরূপে অবস্থান করেন, সত্ত্বাদিগুণ-কার্য সুখদুঃখাদি কর্তৃক বিচালিত হন না, গুণসকল স্ব স্ব কার্যে বর্তমান আছে, আমার সহিত ইহার কোন সম্পর্ক নাই, ইহা মনে করিয়া যিনি চঞ্চল হন না, তিনি গুণাতীত বলিয়া কথিত হন । ২৩
যাঁহার নিকট সুখদুঃখ সমান, যিনি স্বস্থ অর্থাৎ আত্মরূপেই স্থিত, মৃত্তিকা, প্রস্তর ও সুবর্ণ যাঁহার নিকট সমান, যিনি প্রিয় ও অপ্রিয় এবং আপনার নিন্দা ও প্রশংসা তুল্য মনে করেন, যিনি ধীমান্ বা ধৈর্যযুক্ত, তিনিই গুণাতীত বলিয়া অভিহিত হন । ২৪
মানে ও অপমানে, শত্রুপক্ষ ও মিত্রপক্ষে যাঁহার তুল্যজ্ঞান এবং ফলাকাঙ্ক্ষা করিয়া যিনি কর্মোদ্যম করেন না (সর্বারম্ভপরিত্যাগী), এরূপ ব্যক্তি গুণাতীত বলিয়া কথিত হন । ২৫
যিনি ঐকান্তিক ভক্তিযোগ সহকারে আমার সেবা করেন, তিনি এই তিন গুণ অতিক্রম করিয়া ব্রহ্মভাব লাভে সমর্থ হন । ২৬
যেহেতু আমি ব্রহ্মের নিত্য অমৃতের অর্থাৎ মোক্ষের, সনাতন ধর্মের এবং ঐকান্তিক সুখের প্রতিষ্ঠা (অথবা আমি অমৃত ও অব্যয় ব্রহ্মের, শাশ্বত ধর্মের এবং ঐকান্তিক সুখের প্রতিষ্ঠা) । ২৭
(৩,৪) মহদ্ব্রহ্ম = প্রকৃতি; 'গর্ভাধান করি' = সর্বভূতের জন্মকারণ স্বরূপ বীজ প্রকৃতিরূপ যোনিতে আধান করি । ভূতগণকে তাহাদের স্বীয় প্রাক্তন কর্মানুসারে ক্ষেত্রের সহিত সংযোজিত করি । অথবা প্রকৃতিতে আমার সঙ্কল্পিত বীজ আধান করি অর্থাৎ আমার সঙ্কল্পানুসারেই প্রকৃতি সৃষ্টি করে । ঈশ্বরের সৃষ্টি-সঙ্কল্পই গর্ভাধানস্বরূপ - প্রকৃতির স্বতন্ত্র সৃষ্টি-সামর্থ্য নাই । বেদান্তে ইহাকেই 'ঈক্ষণ' বলে (জ্ঞান-বিজ্ঞান-যোগে 'সাংখ্যের সৃষ্টিতত্ত্ব - প্রকৃতি ও পুরুষ' দ্রষ্টব্য) ।
সত্ত্বগুণ জলের ন্যায় নির্মল হইলেও অপর দুইটির সহিত মিশ্রিত থাকায় উহা বন্ধনের কারণ হয় । "সত্ত্বগুণের খুব প্রাধান্য হইলেও তাহা প্রকৃত স্বাধীনতার অবস্থা নহে কারণ অন্যান্য গুণের ন্যায়ই বাসনা (মহত্তর) ও অহঙ্কারের (শুদ্ধতর) দ্বারাই বন্ধন করে । সাত্ত্বিক অহঙ্কারের উদাহরণ - আমি সাধু, আমি জ্ঞানী । প্রকৃত স্বাধীনতা, চরম স্বরাজ্য তখনই আরম্ভ হইবে যখন প্রাকৃত আত্মার উপরে আমরা পরমাত্মাকে দেখিতে পাইব, ধরিতে পারিব । আমাদের ক্ষুদ্র 'আমি' - আমাদের অহঙ্কার এই পরমাত্মাকে দেখিতে দেয় না । ইহার জন্য আমাদিগকে গুণত্রয়ের বহু ঊর্ধ্বে উঠিতে হইবে, ত্রিগুণাতীত হইতে হইবে, কারণ পরমাত্মা সত্ত্বগুণেরও উপরে ।" ...[abridged from শ্রীঅরবিন্দের গীতা (অনিলবরণ)] ।
(২২,২৩) দেহে প্রকৃতির কার্য চলিতেছে চলুক । আমি উহাতে লিপ্ত নই । আমি অকর্তা, উদাসীন্, সাক্ষিস্বরূপ । এই জ্ঞান যাঁহার হইয়াছে তিনিই ত্রিগুণাতীত ।
(২৫) আরম্ভ = ঐহিক বা পারত্রিক ফল কামনা করিয়া কর্মের উদ্যোগ । সর্বারম্ভপরিত্যাগী = এইরূপ আরম্ভ যিনি করেন না । উদাহরণ ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির ।
(২৭) আমিই ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা - ভগবৎ-তত্ত্ব ও ব্রহ্মতত্ত্ব
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : পঞ্চদশ অধ্যায় - পুরুষোত্তমযোগ
(বেদবিদ্গণ) বলিয়া থাকেন যে, (সংসাররূপ) অশ্বত্থের মূল ঊর্দ্ধদিকে এবং শাখাসমূহ অধোগামী; উহা অবিনাশী; বেদসমূহ উহার পত্রস্বরূপ; যিনি এই অশ্বত্থকে জানেন তিনিই বেদবিৎ । ১
সত্ত্বাদিগুণের দ্বারা বিশেষরূপে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত, বিষয়রূপ তরুণপল্লব-বিশিষ্ট উহার শাখাসকল অধোভাগে ও ঊর্ধ্বভাগে বিস্তৃত; উহার (বাসনারূপ) মূলসহ মনুষ্যলোকে অধোভাগে বিস্তৃত রহিয়াছে । ঐ মূলসমূহ ধর্মাধর্মরূপ কর্মের কারণ বা প্রসূতি । ২
এ সংসারে স্থিত জীবগণ সংসার-বৃক্ষের পূর্বোক্ত ঊর্দ্ধমূলাদি রূপ উপলব্ধি করিতে পারে না । সেইরূপ আদি, অন্ত এবং স্থিতিও উপলব্ধি করিতে পারে না । এই সুদৃঢ়মূল অশ্বত্থবৃক্ষকে তীব্র বৈরাগ্যরূপ শস্ত্রদ্বারা ছেদন করিয়া তৎপর যাঁহাকে প্রাপ্ত হইলে আর পুনর্জন্ম হয় না, যাঁহা হইতে এই সংসার-প্রবৃত্তির বিস্তার হইয়াছে, 'আমি সেই আদি পুরুষের শরণ লইতেছি' এই বলিয়া তাঁহার অন্বেষণ করিতে হইবে । ৩,৪
যাঁহাদের অভিমান ও মোহ নাই, যাঁহারা সংসার-আসক্তি জয় করিয়াছেন, যাঁহারা আত্মতত্ত্বে নিষ্ঠাবান্, যাঁহাদের কামনা নিবৃত্ত হইয়াছে, যাঁহারা সুখদুঃখ-সংজ্ঞক দ্বন্দ্ব হইতে মুক্ত, তাদৃশ বিবেকী পুরুষগণ সেই অব্যয় পদ প্রাপ্ত হন । ৫
যে পদ প্রাপ্ত হইলে সাধক আর সংসারে প্রত্যাবর্তন করেন না, যে পদ সূর্য, চন্দ্র বা অগ্নি প্রকাশ করিতে পারে না, তাহাই আমার পরম স্বরূপ । ৬
আমারই সনাতন অংশ জীব হইয়া প্রকৃতিতে অবস্থিত মন ও পাঁচ ইন্দ্রিয়কে সংসারে অর্থাৎ কর্মভূমিতে আকর্ষণ করিয়া থাকেন । ৭
যেমন বায়ু, পুষ্পাদি হইতে গন্ধবিশিষ্ট সূক্ষ কণাসমূহ লইয়া যায় তদ্রূপ যখন জীব এক দেহ পরিত্যাগ করিয়া অন্য দেহে প্রবেশ করেন, তখন এই সকলকে (এই পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও মনকে) সঙ্গে করিয়া লইয়া যান । ৮
জীবাত্মা কর্ণ, চক্ষু, ত্বক্, রসনা, নাসিকা এবং মনকে আশ্রয় করিয়া শব্দাদি বিষয়সকল ভোগ করিয়া থাকেন । ৯
জীব কিরূপে সত্ত্বাদি গুণসংযুক্ত হইয়া দেহে অবস্থিত থাকিয়া বিষয়সমূহ ভোগ করেন, অথবা কিরূপে দেহ হইতে উৎক্রান্ত হন, তাহা অজ্ঞ ব্যক্তিগণ দেখিতে পান না, কিন্তু জ্ঞানিগণ জ্ঞাননেত্রে দর্শন করিয়া থাকেন । ১০
সাধনে যত্নশীল যোগিগণ আপনাতে অবস্থিত এই আত্মাকে দর্শন করিয়া থাকেন, কিন্তু যাহারা অজিতেন্দ্রিয় ও অবিবেকী তাহারা যত্ন করিলেও ইঁহাকে দেখিতে পায় না । ১১
যে তেজ সূর্যে থাকিয়া সমস্ত জগৎ উদ্ভাসিত করে এবং যে তেজ চন্দ্রমা ও অগ্নিতে আছে, তাহা আমারই তেজ জানিবে । ১২
আমি পৃথিবীতে অনুপ্রবিষ্ট হইয়া স্বকীয় বলের দ্বারা ভূতগণকে ধারণ করিয়া আছি । আমি অমৃতরসযুক্ত চন্দ্ররূপ ধারণ করিয়া ব্রীহি যবাদি ওষধিগণকে পরিপুষ্ট করিয়া থাকি । ১৩
আমি বৈশ্বানর (জঠরাগ্নি) রূপে প্রাণিগণের দেহে অবস্থান করি এবং প্রাণ ও অপান বায়ুর সহিত মিলিয়া চর্ব্য চূষ্যাদি চতুর্বিধ খাদ্য পরিপাক করি । ১৪
আমি অন্তর্যামিরূপে সকল প্রাণীর হৃদয়ে অধিষ্ঠিত আছি, আমা হইতেই প্রাণিগণের স্মৃতি ও জ্ঞান উৎপন্ন হইয়া থাকে এবং আমা হইতেই স্মৃতি ও জ্ঞানের বিলোপও সাধিত হয়; আমিই বেদসমূহের একমাত্র জ্ঞাতব্য, আমিই আচার্যরূপে বেদান্তের অর্থ-প্রকাশক এবং আমিই বুদ্ধিতে অধিষ্ঠিত থাকিয়া বেদার্থ পরিজ্ঞাত হই । ১৫
ক্ষর ও অক্ষর দুই পুরুষ ইহলোকে প্রসিদ্ধ আছে । তন্মধ্যে সর্বভূত ক্ষর পুরুষ এবং কূটস্থ অক্ষর পুরুষ বলিয়া কথিত হন । ১৬
অন্য এক উত্তম পুরুষ পরমাত্মা বলিয়া কথিত হন । তিনি লোকত্রয়ে প্রবিষ্ট হইয়া সকলকে পালন করিতেছেন, তিনি অব্যয়, তিনি ঈশ্বর । ১৭
যেহেতু আমি ক্ষরের অতীত এবং অক্ষর হইতেও উত্তম, সেই হেতু আমি লোক-ব্যবহারে এবং বেদে পুরুষোত্তম বলিয়া খ্যাত । ১৮
হে ভারত, যিনি মোহমুক্ত হইয়া এই ভাবে আমাকে পুরুষোত্তম বলিয়া জানিতে পারেন, তিনি সর্বজ্ঞ হন এবং সর্বতোভাবে আমাকে ভজনা করেন । ১৯
হে নিষ্পাপ, আমি এই অতি গুহ্যকথা তোমাকে কহিলাম । যে কেহ ইহা জানিলে জ্ঞানী ও কৃতকৃত্য হয় । (অতএব তুমিও যে কৃতার্থ হইবে তাহাতে সন্দেহ কি ?) ২০
কিন্তু শ্রীভগবান্ এও বলিতেছেন - "জীব আমার সনাতন অংশ" [১৫|৭] । এ অংশ কিরূপ ? অদ্বৈতবাদী বলেন - ব্রহ্ম অখণ্ড, অপরিচ্ছিন্ন, নিরবয়ব, অদ্বয় বস্তু, উহার খণ্ডিত অংশ কল্পনা করা যায় না । এ স্থলে 'অংশ' বলিতে মহাকাশের অংশ ঘটাকাশ (ঘটের মধ্যে যে আকাশ আছে) বুঝিতে হইবে । ঘট ভাঙ্গিলে এক অপরিচ্ছিন্ন আকাশই থাকে । জীবেরও দেহোপাধিপশতঃ ব্রহ্ম হইতে পার্থক্য, দেহোপাধিনাশে এক অপরিচ্ছিন্ন ব্রহ্মসত্তাই অবশিষ্ট থাকে ('ব্রহ্মাদ্বয়ং শিষ্যতে') ।
(৮-১০) জন্মান্তর-রহস্য - জীবের উৎক্রান্তি - সূক্ষ শরীর
এস্থলে পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও মনকেই সূক্ষ শরীর বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে [১৫|৯] । দ্রষ্টব্য এই, 'ইন্দ্রিয়' বলিতে চক্ষু-কর্ণাদি স্থূল ইন্দ্রিয়যন্ত্র বুঝায় না, উহা স্থূল দেহের অন্তর্গত - প্রকৃত ইন্দ্রিয় বা ইন্দ্রিয়-শক্তিই সূক্ষ তত্ত্ব । বেদান্তমতে পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চ প্রাণ এবং বুদ্ধি ও মন (মোট ১৭টি অবয়বে) সূক্ষ শরীর গঠিত । সাংখ্যমতে পঞ্চ প্রাণ একাদশ ইন্দ্রিয়েরই অন্তর্ভূক্ত ।
(১৩) শাস্ত্রে এইরূপ বর্ণনা আছে যে, চন্দ্র জলময় ও সর্বরসের আধার এবং চন্দ্রের এই রসাত্মক গুণেই বনস্পতিগণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় ।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : ষোড়শ অধ্যায় - দৈবাসুর-সম্পদ্-বিভাগযোগ
নির্ভীকতা, চিত্তসূদ্ধি, আত্মজ্ঞাননিষ্ঠা ও কর্মযোগে তৎপরতা, দান, বাহ্যেন্দ্রিয় সংযম, যজ্ঞ, শাস্ত্র-অধ্যয়ন, তপঃ, সরলতা, অহিংসা, সত্য, অক্রোধ, ত্যাগ, শান্তি, পরনিন্দাবরজন, জীবে দয়া, লোভহীনতা, মৃদুতা (অক্রৌর্য), কু-কর্মে লজ্জা, অচাঞ্চল্য, তেজস্বিতা, ক্ষমা, ধৃতি, শৌচ, দ্রোহ বা হিংসা না করা, অনভিমান, - হে ভারত, এই সকল গুণ দৈবী সম্পদ্ অভিমুখে জাত পুরুষের হইয়া থাকে । ১,২,৩ (অর্থাৎ যাঁহারা পূর্বজন্মের কর্মফলে দৈবী সম্পদ্ ভোগার্থ জন্মগ্রহণ করেন তাঁহাদেরই এই সকল সাত্ত্বিক গুণ জন্মিয়া থাকে) ।
হে পার্থ, দম্ভ, দর্প, অভিমান, ক্রোধ, নিষ্ঠুরতা এবং অজ্ঞান আসুরী সম্পদ্-অভিমুখে জাত ব্যক্তি প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ এই সকল রাজসিক এবং তামসিক প্রকৃতির লোকের ধর্ম । ৪
দৈবী সম্পদ্ মোক্ষের হেতু এবং আসুরী সম্পদ্ সংসার-বন্ধনের কারণ হয় । হে পাণ্ডব, শোক করিও না; কারণ তুমি দৈবী সম্পদ্ অভিমুখে জন্মিয়াছ । ৫
হে পার্থ, এ জগতে দৈব ও আসুর এই দুই প্রকার প্রাণীর সৃষ্টি হয় । দৈবী প্রকৃতির বর্ণনা সবিস্তার করিয়াছি, এক্ষণে আসুরী প্রকৃতির কথা আমার নিকট শ্রবণ কর । ৬
আসুরভাবাপন্ন ব্যক্তিগণ জানে না যে, ধর্মে প্রবৃত্তিই বা কি আর অধর্ম হইতে নিবৃত্তিই বা কি, অর্থাৎ তাহাদের ধর্মাধর্ম, কর্তব্যাকর্তব্য জ্ঞান নাই । অতএব তাহাদের মধ্যে শৌচ, সদাচার বা সত্য কিছুই নাই । ৭
এই আসুর প্রকৃতির লোকেরা বলিয়া থাকে যে, এই জগতে সত্য বলিয়া কোন পদার্থ নাই, সকলই অসত্য; জগতে ধর্মাধর্মেরও কোন ব্যবস্থা নাই এবং ধর্মাধর্মের ব্যবস্থাপক ঈশ্বর বলিয়াও কোন বস্তু নাই । ইহা কেবল স্ত্রী-পুরুষের অন্যোন্যসংযোগে জাত (কামসম্ভূত) । স্ত্রী-পুরুষের কামই ইহার একমাত্র কারণ, ইহার অন্য কারণ নাই । ৮
পূর্বোক্ত দৃষ্টি (নিরীশ্বরবাদীদিগের মত) অবলম্বন করিয়া বিকৃতমতি, অল্পবুদ্ধি ক্রূরকর্মা ব্যক্তিগণ অহিতাচরণে প্রবৃত্ত হয়; তাহারা জগতের বিনাশের জন্যই জন্মগ্রহণ করিয়া থাকে । ৯
যাহা কখনও পূর্ণ হইবার নহে, এইরূপ কামনার বশীভূত হইয়া দম্ভ, অভিমান ও গর্বে মত্ত হইয়া, তন্ত্রমন্ত্রাদি দ্বারা স্ত্রী-রত্নাদি প্রাপ্ত হইব, অবিবেকবশতঃ এইরূপ দুরাশার বশবর্তী হইয়া অশুচিব্রত অবলম্বন করতঃ তাহারা কর্মে (ক্ষুদ্র দেবতাদির উপাসনায়) প্রবৃত্ত হইয়া থাকে । ১০
মৃত্যুকাল পর্যন্ত অপরিমেয় বিষয়-চিন্তা আশ্রয় করিয়া (যাবজ্জীবন নিরন্তর বিষয়চিন্তাপরায়ণ হইয়া) বিষয়ভোগনিরত এই সকল ব্যক্তি নিশ্চয় করে যে, কামোপভোগই পরম পুরুষার্থ, এতদ্ব্যতীত জীবনের অন্য লক্ষ্য নাই, সুতরাং ইহারা শত শত আশাপাশে বদ্ধ এবং কামক্রোধপরায়ণ হইয়া অসৎ মার্গ অবলম্বনপূর্বক অর্থ-সংগ্রহে সচেষ্ট হয় । ১১,১২
অদ্য আমার এই লাভ হইল, পরে এই ইষ্টবস্তু পাইব, এই ধন আমার আছে, এই ধন আমার পরে হইবে, এই শত্রুকে আমি পরাজিত করিয়াছি, অন্যান্যকেও হত করিব; আমি সকলের প্রভু, আমিই সকল ভোগের অধিকারী, আমি কৃতকৃত্য, আমি বলবান্, আমি সুখী, আমি ধনবান্, আমি কুলীন, আমার তুল্য আর কে আছে ? আমি যজ্ঞ করিব, দান করিব, মজা করিব - এই প্রকার অজ্ঞানে বিমূঢ়, বিবিধ বিষয়-চিন্তায় বিভ্রান্তচিত্ত, মোহজালে জড়িত, বিষয়ভোগে আসক্ত ব্যক্তিগণ অপবিত্র নরকে পতিত হয় । ১৩-১৬
আত্মশ্লাঘাযুক্ত, অবিনয়ী, ধনমানের গর্বে বিমূঢ় সেই আসুর প্রকৃতির ব্যক্তিগণ দম্ভ প্রকাশ করিয়া অবিধিপূর্বক নামমাত্র যজ্ঞ করে । ১৭
সাধুগণের অসূয়াকারী সেই সকল ব্যক্তি অহঙ্কার, বল, দর্প, কাম ও ক্রোধের বশীভূত হইয়া স্বদেহে ও পরদেহে অবস্থিত আত্মরূপী আমাকে দ্বেষ করিয়া থাকে । ১৮
এইরূপ দ্বেষপরবশ, ক্রুরমতি, নরাধম, আসুরপুরুষগণকে আমি সংসারে (ব্যাঘ্র-সর্পাদি) আসুরী যোনিতে পুনঃ পুনঃ নিক্ষেপ করিয়া থাকি । ১৯
হে কৌন্তেয়, এই সকল মূঢ় ব্যক্তি জন্মে জন্মে আসুরী যোনি প্রাপ্ত হয় এবং আমাকে না পাইয়া শেষে আরও অধোগতি (কৃমিকীটাদি যোনি) প্রাপ্ত হয় । ২০
কাম, ক্রোধ এবং লোভ - এই তিনটি নরকের দ্বারস্বরূপ, ইহারা আত্মার বিনাশের মূল (জীবের অধোগতির কারণ) । সুতরাং এই তিনটিকে ত্যাগ করিবে । ২১
হে কৌন্তেয়, নরকের দ্বারস্বরূপ এই তিনটি হইতে মুক্ত হইলে মানুষ আপনার কল্যাণ সাধনপূর্বক পরমগতি প্রাপ্ত হয় । ২২
যে ব্যক্তি শাস্ত্রবিধি ত্যাগ করিয়া স্বেচ্ছাচারী হইয়া কর্মে প্রবৃত্ত হয়, সে সিদ্ধি লাভ করিতে পারে না, তাহার শান্তি-সুখও হয় না, মোক্ষলাভও হয় না । ২৩
অতএব কর্তব্য-অকর্তব্য নির্ধারণে শাস্ত্রই তোমার প্রমাণ, সুতরাং তুমি শাস্ত্রোক্ত ব্যবস্থা জানিয়া (ইহায়) যথাধিকার কর্ম করিতে প্রবৃত্ত হও । ২৪
___________________________
(১-৩) আসুরিক প্রকৃতির লোক তাঁহাকে চিনে না, সুতরাং অবজ্ঞা করে; দৈবী বা সাত্ত্বিক প্রকৃতির লোক তাঁহাকে ভক্তি করে [৯|১১-১৩] । এই উভয় প্রকৃতির বিস্তারিত বর্ণনা এই অধ্যায়ে করা হইতেছে এবং আসুরী প্রকৃতির কিরূপে সংশোধন হয় তাহাও উপদেশ দেওয়া হইয়াছে ।
(৮) অথবা মতান্তরে, জগতের শাস্ত্রোক্ত কোন সৃষ্টি-পরম্পরা নাই । জগতের সকল পদার্থই মনুষ্যের কামনা-বাসনা তৃপ্ত করিবার জন্য । তাহাদের অন্য কোনও উপযোগ নাই ।
(১৭) এই সকল বিবেকহীন ব্যক্তি, বুদ্ধিভ্রংশকারী তামসী ও রাজসী প্রকৃতির বশে, আমাকে অবজ্ঞা করিয়া থাকে । উহাদের আশা ব্যর্থ, কর্ম নিষ্ফল, জ্ঞান নিরর্থক এবং চিত্ত বিক্ষিপ্ত । [৯|১২]
(১৮) আমি অন্তর্যামিরূপে সকলের মধ্যেই আছি, কিন্তু দম্ভবশে আমার অন্তর্যামিত্ব অস্বীকার করিয়া স্বদেহস্থিত আমাকে দ্বেষ করে এবং প্রাণি-হিংসাদি দ্বারা অন্য দেহেও আমাকে দ্বেষ করিয়া থাকে ।
(২৩) সিদ্ধি = পুরুষার্থ প্রাপ্তির যোগ্যতা (শঙ্কর); তত্ত্বজ্ঞান (শ্রীধর) ।
(২৪) শাস্ত্র = শ্রুতি-স্মৃতি-পুরাণাদি । ধর্মশাস্ত্র = কর্তব্যাকর্তব্য নির্ণায়ক শাস্ত্র; আধুনিকগণ ইহাকে নীতিশাস্ত্র বলেন । কিন্তু সংস্কৃত সাহিত্যে নীতিশাস্ত্র বলিতে কেবল রাজনীতিই বুঝায় । উহা ধর্মশাস্ত্রেরই অন্তর্গত ।
(২৪) ইহ = কর্মাধিকারে বর্তমান থাকিয়া (শ্রীধর); এই লোকে (তিলক); এই কর্মাধিকার-ভূমিতে অর্থাৎ ভারতবর্ষে (শঙ্কর) । ভারতবর্ষ কর্মভূমি, মোক্ষ সাধনার শ্রেষ্ঠ স্থান, দেবগণও এস্থানে জন্মগ্রহণ বাঞ্ছা করেন [বৃহন্নারদীয় পুরাণ ৩|৪৯-৫৬, ৬৯-৭৯; অপিচ, ভাগবত ৫|১৯-২৭] ।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : সপ্তদশ অধ্যায় - শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগযোগ
হে কৃষ্ণ, যাঁহারা শাস্ত্রবিধি ত্যাগ করিয়া (অথচ) শ্রদ্ধাযুক্ত হইয়া যাগযজ্ঞ পূজাদি করিয়া থাকেন, তাঁহাদিগের নিষ্ঠা কিরূপ ? সাত্ত্বিকী, না রাজসী, না তামসী ? ১
শ্রীভগবান্ কহিলেন -
দেহীদিগের সাত্ত্বিকী, রাজসী ও তামসী, এই তিন প্রকারের শ্রদ্ধা আছে, উহা স্বভাবজাত অর্থাৎ পূর্বজন্মের সংস্কার-প্রসূত; তাহা বিস্তারিত বলিতেছি, শ্রবণ কর । ২
হে ভারত, সকলেরই শ্রদ্ধা নিজ নিজ অন্তঃকরণ-প্রবৃত্তি বা স্বভাবের অনুরূপ হইয়া থাকে । মনুষ্য শ্রদ্ধাময়; যে যেইরূপ শ্রদ্ধাযুক্ত, সে সেইরূপই হয় । ৩
সাত্ত্বিক ব্যক্তিগণ দেবগণের পূজা করেন, রাজসিক প্রকৃতির ব্যক্তিগণ যক্ষরক্ষদিগের পূজা করেন এবং তামসিক ব্যক্তিগণ ভূত-প্রেতের পূজা করিয়া থাকে । ৪
দম্ভ, অহঙ্কার, কামনা ও আসক্তিযুক্ত এবং বলগর্বিত হইয়া যে সকল অবিবেকী ব্যক্তি শরীরস্থ ভূতগণকে এবং অন্তর্যামিরূপে দেহমধ্যস্থ আমাকে কৃশ করিয়া (কষ্ট দিয়া) শাস্ত্রবিধিবিরুদ্ধ অত্যুগ্র তপস্যাদি করিয়া থাকে, তাহাদিগকে আসুরবুদ্ধিবিশিষ্ট বলিয়া জানিবে । ৫,৬
(প্রকৃতিভেদে) সকলেরই প্রিয় আহারও ত্রিবিধ হইয়া থাকে; সেইরূপ যজ্ঞ, তপস্যা এবং দানও ত্রিবিধ; উহাদের মধ্যে যেরূপ প্রভেদ তাহা শ্রবণ কর । ৭
যাহা আয়ু, উৎসাহ, বল, আরোগ্য, চিত্ত-প্রসন্নতা ও রুচি - এ সকলের বর্ধনকারী এবং সরস, স্নেহযুক্ত, সারবান্ এবং প্রীতিকর - এইরূপ (সাত্ত্বিক) আহার সাত্ত্বিক ব্যক্তিগণের প্রিয় । ৮
অতি কটু, অতি অম্ল, অতি লবণাক্ত, অতি উষ্ণ, তীক্ষ্ণ, বিদাহী এবং দুঃখ, শোক ও রোগ উৎপাদক (রাজসিক) আহার রাজস ব্যক্তিগণের প্রিয় । ৯
যে খাদ্য বহু পূর্বে পক্ক, যাহার রস শুষ্ক হইয়া গিয়াছে, যাহা দুর্গন্ধ, পর্যুষিত (বাসি), উচ্ছিষ্ট ও অপবিত্র, তাহা তামস ব্যক্তিগণের প্রিয় । ১০
ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করিয়া 'যজ্ঞ করিতে হয় তাই করি' এইরূপ অবশ্য-কর্তব্য বোধে শাস্ত্রবিধি অনুসারে শান্তচিত্তে যে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়, তাহা সাত্ত্বিক যজ্ঞ । ১১
কিন্তু হে ভরতশ্রেষ্ঠ, ফল লাভের উদ্দেশ্যে এবং দম্ভার্থে (নিজ ঐশ্বর্য, মহত্ত্ব বা ধার্মিকতা প্রকাশার্থ) যে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয় তাহাকে রাজস-যজ্ঞ বলিয়া জানিবে । ১২
শাস্ত্রোক্ত বিধিশূন্য, অন্নদানহীন, শাস্ত্রোক্ত মন্ত্রহীন, দক্ষিণাহীন, শ্রদ্ধাশূন্য যজ্ঞকে তামস-যজ্ঞ বলে । ১৩
দেব, দ্বিজ, গুরু, বিদ্বান্ ব্যক্তির পূজা, শৌচ, সরলতা, ব্রহ্মচর্য, অহিংসা, এই সকলকে শারীর তপস্যা বলে । ১৪
যাহা কাহারও উদ্বেগকর হয় না, যাহা সত্য, প্রিয় ও হিতকর এইরূপ বাক্য এবং যথাবিধি শাস্ত্রাভ্যাস - এই সকলকে বাঙ্ময় বা বাচিক তপস্যা বলা হয় । ১৫
চিত্তের প্রসন্নতা, অক্রুরতা, বাক্-সংযম, আত্মসংযম বা মনসংযম এবং অন্যের সহিত ব্যবহারে কপটতারাহিত্য, এই সকলকে মানসিক তপস্যা বলে । ১৬
পূর্বোক্ত ত্রিবিধ তপস্যা যদি ফলাকাঙ্ক্ষাশূন্য, ঈশ্বরে একাগ্রচিত্ত ব্যক্তিগণ কর্তৃক পরম শ্রদ্ধা সহকারে অনুষ্ঠিত হয়, তবে তাহাকে সাত্ত্বিক তপস্যা বলে । ১৭
সৎকার, মান ও পূজা লাভ করিবার জন্য দম্ভ সহকারে যে তপস্যা অনুষ্ঠিত হয় এবং ইহলোকে যাহার ফল অনিত্য এবং অনিশ্চিত, তাহাকে রাজসিক তপস্যা বলে । ১৮
মোহাচ্ছন্নবুদ্ধিবশে নিজের শরীরাদিকেও পীড়া দিয়া অথবা জারণ, মারণাদি অভিচার দ্বারা পরের বিনাশার্থ যে তপস্যা অনুষ্ঠিত হয়, তাহাকে তামস তপস্যা বলে । ১৯
"দান করা উচিত, তাই দান করি" এইরূপ কর্তব্য-বুদ্ধিতে উপযুক্ত দেশ, কাল ও পাত্র বিবেচনা করিয়া অনুপকারী ব্যক্তিকে (অর্থাৎ প্রত্যুপকারের আশা না রাখিয়া) যে দান করা হয়, তাহাকে সাত্ত্বিক দান বলে । ২০
পরন্তু প্রত্যুপকারের আশায় অথবা স্বর্গাদি ফল কামনায় অতি কষ্টের সহিত যে দান করা হয়, তাহাকে রাজস দান বলে । ২১
অনুপযুক্ত দেশে, অনুপযুক্ত কালে এবং অনুপযুক্ত পাত্রে যে দান এবং (উপযুক্ত দেশকালপাত্রে প্রদত্ত হইলেও) সৎকারশূন্য এবং অবজ্ঞাসহকারে কৃত যে দান, তাহাকে তামস দান বলে । ২২
(শাস্ত্রে) 'ওঁ তৎ সৎ' এই তিন প্রকারে পরব্রহ্মের নাম নির্দেশ করা হইয়াছে; এই নির্দেশ হইতেই পূর্বকালে বেদবিদ্ ব্রাহ্মণ, বেদ ও যজ্ঞ সৃষ্ট হইয়াছে । ২৩
এই হেতু ব্রহ্মবাদিগণের যজ্ঞ, দান ও তপস্যাদি শাস্ত্রোক্ত কর্ম সর্বদা 'ওঁ" উচ্চারণ করিয়া অনুষ্ঠিত হয় । ২৪
যাঁহারা মোক্ষ কামনা করেন, তাঁহারা ফল কামনা ত্যাগ করিয়া 'তৎ' এই শব্দ উচ্চারণপূর্বক বিবিধ যজ্ঞ তপস্যা এবং দানক্রিয়ার অনুষ্ঠান করেন । ২৫
হে পার্থ, সদ্ভাব ও সাধুভাব অর্থাৎ কোন বস্তুর অস্তিত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব নির্দেশার্থ সৎ শব্দ প্রযুক্ত হয়; এবং (বিবাহাদি) মঙ্গল কর্মেও সৎ শব্দ ব্যবহৃত হয় । ২৬
যজ্ঞ, তপস্যা ও দানে স্থিতি অর্থাৎ নিষ্ঠা বা তৎপর হইয়া থাকাকেও সৎ বলে এবং এই সকলের জন্য যে কিছু কর্ম করিতে হয় তাহাও সৎ বলিয়া কথিত হয় । ২৭
হে পার্থ, হোম, দান, তপস্যা বা অন্য কিছু যাহা অশ্রদ্ধাপূর্বক অনুষ্ঠিত হয়, সে সমুদয় অসৎ বলিয়া কথিত হয় । সে সকল না ইহলোকে না পরলোকে ফলদায়ক হয় । ২৮
___________________________
(৩) পুরুষঃ = সংসারী জীবঃ (শঙ্কর)
(৪) কিন্তু সকাম দেবোপসনা মিশ্রসাত্ত্বিক । উহাতে কাম্যবস্তু বা দেব-লোকাদি প্রাপ্তি হয়, ভগবৎ-প্রাপ্তি হয় না । নিষ্কামভাবে একমাত্র ভগবানের আরাধনাই শুদ্ধ সাত্ত্বিকী শ্রদ্ধা, ভাগবতে ইহাকেই নির্গুণা শ্রদ্ধা বলা হইয়াছে [ভাগবত ১১|২৫|২৬] ।
ত্রিবিধ শ্রদ্ধা :
শ্রদ্ধাই উপাসনার প্রাণ; যজ্ঞ, দান, ব্রত-নিয়মাদিরও মুখ্য কথা শ্রদ্ধা । প্রেমভক্তি-পথের প্রথম কথাই শ্রদ্ধা, শ্রদ্ধা হইতে ক্রমে রুচি, রাগ, ভাব ও নির্মল প্রেমের বিকাশ । - [ভক্তিরসামৃতসিন্ধু|১|৪|১১, চৈ.চ. মধ্য|২৩|৯|১০]
শ্রদ্ধা মনের ধর্ম, মন স্বভাবতই অন্ধ, শ্রদ্ধাও অন্ধ; বুদ্ধিদ্বারা চালিত না হইলে উহা অযোগ্য বস্তুতেই শ্রদ্ধা জন্মাইয়া জীবকে অধঃপাতিত করে । পক্ষান্তরে, মনে যদি শ্রদ্ধা না থাকে, লোকে যদি কেবল বুদ্ধিদ্বারাই চালিত হয়, তবে কেবল শুষ্ক পাণ্ডিত্য, বিতর্ক ও নাস্তিকতা আনয়ন করে ।
বুদ্ধিও সাত্ত্বিকাদি-ভেদে ত্রিবিধ এবং শ্রদ্ধা এই বুদ্ধিকর্তৃক চালিত হয় বলিয়া উহাও ত্রিবিধ হয় । তামসিকবুদ্ধি-প্রসূত তামসিক শ্রদ্ধা - দস্যুগণের নরবলি দিয়া কালীপূজা করা । রাজসিকবুদ্ধি-প্রসূত রাজসিক শ্রদ্ধা - ছাগমহিষাদি বলিদান করা । সাত্ত্বিকবুদ্ধি-প্রসূত সাত্ত্বিক শ্রদ্ধা - ছাগমহিষাদিকে কামক্রোধাদি পাশব বৃত্তির প্রতীকমাত্র বুঝিয়া ঐ সকল রিপুকে বলিদান করাই মায়ের শ্রেষ্ঠ অর্চনা বলিয়া মনে করা ।
(১০) সাত্ত্বিকাদি-ভেদে তিন প্রকার আহার :-
- সাত্ত্বিক আহার : যাহা আয়ু, উৎসাহ, বল, আরোগ্য, চিত্ত-প্রসন্নতা ও রুচি বর্ধনকারী এবং সরস, স্নেহযুক্ত, সারবান এবং প্রীতিকর ।
- রাজস আহার : অতি কটু, অতি অম্ল, অতি লবণাক্ত, অতি উষ্ণ, তীক্ষ্ণ, বিদাহী এবং দুঃখ, শোক ও রোগ-উৎপাদক ।
- তামস আহার : যে খাদ্য বহু পূর্বে পক্ক, যাহার রস শুষ্ক হইয়া গিয়াছে, যা হা দুর্গন্ধ, পর্যুষিত (বাসি) উচ্ছিষ্ট ও অপবিত্র ।
আহার-শুদ্ধি
সর্বপ্রকার সাধনপক্ষেই, বিশেষতঃ ভক্তিমার্গে, আহারশুদ্ধির বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হয় । 'আহার শুদ্ধ হইলে চিত্ত শুদ্ধ হয়, চিত্ত শুদ্ধ হইলে সেই শুদ্ধ চিত্তে সর্বদা ঈশ্বরের স্মৃতি অব্যাহত থাকে' [ছান্দোগ্য ৭|২৬] ।
(1) শ্রীমৎ রামানুজাচার্যের মতে আহার = খাদ্য (food) । তাঁহার মতে খাদ্যের ত্রিবিধ দোষ পরিহার করা কর্তব্য । (i) জাতিদোষ অর্থাৎ খাদ্যের প্রকৃতিগত দোষ - যেমন মদ্য, মাংস, রশুন, পেঁয়াজ ইত্যাদি উত্তেজক খাদ্য; (ii) আশ্রয় দোষ - অর্থাৎ যে ব্যক্তির নিকট হইতে খাদ্য গ্রহণ করা যায়, তাহার দোষে খাদ্যে যে দোষ জন্মে - যেমন অশুচি, অতিকৃপণ, আসুর-স্বভাব, কুৎসিত-রোগাক্রান্ত খাদ্যবিক্রেতা, দাতা, পাচক বা পরিবেশনকারী প্রভৃতি; (iii) নিমিত্ত দোষ - অর্থাৎ খাদ্যে ধুলি, ময়লা, কেশ, মুখের লালা ইত্যাদি অপবিত্র দ্রব্যের সংস্পর্শ ।
(2) শ্রীমৎ শঙ্করাচার্যের মতে আহার = ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়জ্ঞান অর্থাৎ যাহা গ্রহণ করা যায় তাহাই আহার । তাঁহার মতে আহারশুদ্ধি অর্থ রাগ, দ্বেষ, মোহ এই ত্রিবিধ দোষবর্জিত হইয়া ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বিষয়গ্রহণ ।
(3) স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন - "এই দুইটি ব্যাখ্যা আপাতবিরোধী বলিয়া বোধ হইলেও উভয়টিই সত্য ও প্রয়োজনীয় । সূক্ষ শরীর বা মনের সংযম, মাংস-পিণ্ডময় স্থূল শরীরের সংযম হইতে উচ্চতর কার্য বটে, কিন্তু সূক্ষের সংযম করিতে হইলে অগ্রে স্থূলের সংযম করা বিশেষ আবশ্যক । সুতরাং ইহা যুক্তিসিদ্ধ বোধ হইতেছে যে, খাদ্যাখাদ্যের বিচার মনের স্থিরতারূপ উচ্চাবস্থা লাভের জন্য বিশেষ আবশ্যক । নতুবা সহজে এই স্থিরিতা লাভ করা যায় না । কিন্তু আজকাল আমাদের অনেক সম্প্রদায়ে এই আহারাদির বিচারের এত বাড়াবাড়ি, এত অর্থহীন নিয়মের বাঁধাবাধি, এই বিষয়ে এত গোঁড়ামি যে, তাঁহারা যেন ধর্মটিকে রান্নাঘরের ভিতর পুরিয়াছেন । এইরূপ ধর্ম এক বিশেষ প্রকার খাঁটি জড়বাদ মাত্র । উহা জ্ঞান নহে, ভক্তিও নহে, কর্মও নহে ।" [ভক্তির সাধন, ভক্তিযোগ, স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, চতুর্থ খণ্ড, পৃঃ ৪০-৪১]
(১১) ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে শ্রীকৃষ্ণ এইরূপ সাত্ত্বিক যজ্ঞ করিতেই উপদেশ দিয়াছিলেন এবং তিনিও কর্তব্যানুরোধে নিষ্কামভাবে উহা সম্পন্ন করিয়াছিলেন । যুধিষ্ঠির বলিয়াছিলেন - "রাজপুত্রি, আমি কর্মফলান্বেষী হইয়া কোন কর্ম করি না; দান করিতে হয় তাই দান করি, যজ্ঞ করিতে হয় তাই যজ্ঞ করি; ধর্মাচরণের বিনিময়ে যে ফল চাহে, সে ধর্মবণিক, ধর্মকে সে পণ্যদ্রব্য করিয়াছে । সে হীন, জঘন্য ।" [মভাঃ বনপর্ব ৩১|২৫]
(১৫) অপ্রিয় সত্য বলা অনুচিত - মনু ৪|১৩৮ । অপ্রিয় সত্য ও হিত্যবাক্য বলার ও শোনার লোক অতি বিরল - মহাভারতে বিদুরবাক্য ।
(১৮) সৎকার = সাধুকার অর্থাৎ এই ব্যক্তি বড় সাধু, তপস্বী - এইরূপ প্রশংসা-বাক্যাদি । মান = মানন অর্থাৎ প্রত্যুত্থান (আসিতে দেখিয়া উঠিয়া দাঁড়ান), অভিবাদন প্রভৃতি দ্বারা সম্মান প্রদর্শন । পূজা = পাদ প্রক্ষালন, আসনাদি দান, ভোজন করান ইত্যাদি ।
(১৮) এইরূপ তপস্যায় আত্মোন্নতি বা পারলৌকিক কোন স্থায়ী ফল হয় না, কেবল ইহলোকে ক্ষণস্থায়ী প্রতিষ্ঠা লাভ হইতে পারে । কিন্তু সেইরূপ প্রতিষ্ঠা লাভও যে হইবে তাহারও নিশ্চয়তা নাই । এই জন্য ইহাকে অনিত্য ও অধ্রুব বলা হইয়াছে ।
(২০) সাত্ত্বিক দান
সাত্ত্বিক দানের তিনটি লক্ষণ - (1) ফলাকাঙ্ক্ষা না করিয়া নিষ্কাম কর্তব্য-বুদ্ধিতে দান, (2) অনুপকারী ব্যক্তিকে দান (যে পূর্বে উপকার করেনি অথবা পরেও প্রত্যুপকার করিবে না তাহাকে দান নচেৎ উহা আদান-প্রদান হইয়া যায়), (3) উপযুক্ত দেশ, কাল ও পাত্র বিবেচনা করিয়া দান ।
(3a) উপযুক্ত দেশের উদাহরণ - যে গ্রামে বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব, তথায়ই পুষ্করিণী প্রতিষ্ঠায় জলদানের ফল হয়, বড় শহরে উহার কোন প্রয়োজন নাই । প্রাচীন টীকাকারগণদের সঙ্কীর্ণ মতে কুরুক্ষেত্রাদি পুণ্যক্ষেত্র ।
(3b) উপযুক্ত কালের উদাহরণ - কলেরার প্রাদুর্ভাবমাত্রেই ঔষধ দানের ব্যবস্থা করা বিধেয়, পূর্বে বা পরে উহাতে অর্থব্যয় করা নিষ্ফল । প্রাচীন টীকাকারগণদের সঙ্কীর্ণ মতে সংক্রান্তি গ্রহণাদি পুণ্যকাল ।
(3c) উপযুক্ত পাত্রের উদাহরণ - অভাবগ্রস্থ বিপন্ন ব্যক্তিকেই দান করিতে হয়, অর্থশালীকে দান করা নিষ্ফল । প্রাচীন টীকাকারগণদের সঙ্কীর্ণ মতে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ (শঙ্কর) ।
কিন্তু আধুনিকগণ এইরূপ সঙ্কীর্ণ অর্থ অনুমোদন করেন না । যেমন মনস্বী বঙ্কিমচন্দ্র লিখিয়াছেন - "সর্বনাশ ! আমি যদি স্বদেশে বসিয়া (অর্থাৎ পুণ্যক্ষেত্রাদিতে নয়) ১লা হইতে ২৯শে তারিখের মধ্যে (অর্থাৎ সংক্রান্তিতে নয়) কোন দিনে অতি দীনদুঃখী, পীড়ায় কাতর একজন মুচি বা ডোমকে (অর্থাৎ ব্রাহ্মণকে নয়) কিছু দান করি, তবে সে দান ভগবদভিপ্রেত দান হইল না ! এইরূপে কখন কখন ভাষ্যকারদিগের বিচারে অতি উন্নত, উদার ও সার্বভৈমিক যে ধর্ম তাহা অতি সঙ্কীর্ণ এবং অনুদার উপধর্মে পরিণত হইয়াছে । ইহারা যাহা বলেন তাহা ভগবদ্বাক্যে নাই, স্মৃতিশাস্ত্রে আছে । কিন্তু বিনা বিচারে ঋষিদিগের বাক্যসকল মস্তকের উপর এতকাল বহন করিয়া এই বিশৃঙ্খলা, অধর্ম ও দুর্দশায় আসিয়া পড়িয়াছি । এখন আর বিনা বিচারে বহন কর্তব্য নহে ।" [ধর্ম্মতত্ত্ব (অনুশীলন), বঙ্কিম রচনাসমগ্র]
প্রকৃত পক্ষে এ বিষয়ে ঋষিশাস্ত্রের কোনরূপ অনুদারতা নাই । শাস্ত্রের মর্ম বুঝিবার বা বুঝাইবার ত্রুটিতে আমাদের দুর্দশা । শাস্ত্রে দীনদুঃখী, আর্ত, পীড়িত, অভ্যাগত (visitor), এমন কি পশুপক্ষী, বৃক্ষলতাদির পর্যন্ত ধারণ-পোষণের ব্যবস্থা আছে । সর্বভূতের রক্ষাই গার্হস্থ্য ধর্ম, ইহাই শাস্ত্রের অনুশাসন । তবে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণকে দান সর্বশ্রেষ্ঠ দান বলিয়া উল্লিখিত কারণ তাঁহারা হিন্দু-সমাজের প্রতিষ্ঠা ও বর্ণাশ্রম ধর্মাদির ব্যবস্থা করিয়াও অর্থাগমের যাবতীয় কর্মেই (যেমন রাজত্ব, প্রভুত্ব, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্যাদি) অন্য জাতির অধিকার দিয়াছেন । নিজেরা উঞ্ছবৃত্তি বা অযাচিত দানের (প্রতিগ্রহ) উপর নির্ভর করিয়া সামান্য গ্রাসাচ্ছাদনে সন্তুষ্ট থাকিয়া সমাজে ধর্ম (যজন-যাজন) ও জ্ঞান (অধ্যয়ন, অধ্যাপনা) বিস্তারের ভার লইয়াছেন । ঈদৃশ পরার্থপর ত্যাগী ব্রাহ্মণজাতির রক্ষাকল্পে শাস্ত্রের যে সকল ব্যবস্থা তাহা সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত ও সমাজরক্ষার অনুকূল । আবার, বেদজ্ঞানহীন নিরগ্নি (অর্থাৎ স্বধর্ম পালনে পরাঙ্মুখ) দ্বিজবন্ধুদিগকে দান করিলে নিরয়গামী (condemned to hell) হইতে হয়, শাস্ত্রে এমন কঠোর অনুশাসনও রহিয়াছে । সুতরাং ঋষিশাস্ত্রের অনুদারতা বা পক্ষপাতিতা কোথাও নাই ।
গ্রহণাদি সময়ে বা পুণ্যক্ষেত্রাদিতে লোকের সাত্ত্বিক ভাব বৃদ্ধি হওয়ারই সম্ভাবনা থাকে, এই হেতু সেই কাল বা স্থান-দানাদি কর্মে প্রশস্ত বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকিবে, কেননা দানাদি কর্ম সাত্ত্বিক শ্রদ্ধার সহিত নিষ্পন্ন না হইলে নিষ্ফল হয় [গীতা ১৭|২৮] । কিন্তু কাল পরিবর্তনে ব্রাহ্মণজাতির ব্রাহ্মণত্ব বা তীর্থক্ষেত্রাদির মাহাত্ম্য যদি লোপ পায় এবং তদ্দরুণ লোকের ভক্তিশ্রদ্ধার যদি ব্যত্যয় ঘটে, তবে এই সকল বিধি-ব্যবস্থার কোন মূল্য থাকে না, তাহা বলাই বাহুল্য । সে স্থলে শাস্ত্রের প্রকৃত মর্ম ও উদ্দেশ্য বুঝিইয়া তদনুসারে কর্তব্যাকর্তব্য নির্ণয় করাই শ্রেয়কল্প; সংস্কারবশতঃ প্রাণহীন অনুষ্ঠান লইয়া বসিয়া থাকিলে ক্রমশঃ অধোগতি সুনিশ্চিত ।
(২৬) সদ্ভাব = থাকার ভাব বা অস্ত্যর্থে ।
(২৭) ওঁ তৎ সৎ (স্ফোট) - এই তিনটি ব্রহ্মবাচক । তিনটির পৃথক্ও ব্যবহার হয়, এক সঙ্গেও ব্রহ্ম নির্দেশার্থ ব্যবহৃত হয় । ওঁ (অ-উ-ম্) বা প্রণব বা শব্দব্রহ্ম বা স্ফোটরূপী ওঙ্কার হইতেই জগতের সৃষ্টি । " 'ওঁ' - গূঢ়াক্ষররূপী বৈদিক মন্ত্র; 'তৎ' - তাহা অর্থাৎ দৃশ্য জগতের অতীত দূরবর্তী অনির্বাচ্য তত্ত্ব; 'সৎ' - চক্ষুর সম্মুখস্থ দৃশ্য জগৎ । এই তিন মিলিয়া সমস্তই ব্রহ্ম, ইহাই এই সঙ্কল্পের অর্থ ।" - লোকমান্য তিলক । এ স্থলে বলা হইতেছে যে - 'ওঁ তৎ সৎ' এই ব্রহ্মনির্দেশ হইতে ব্রাহ্মণাদি কর্তা, করণরূপ বেদ এবং কর্মরূপ যজ্ঞ সৃষ্টি হইয়াছে । ইহারই নাম শব্দব্রহ্মবাদ । এই ওঙ্কারই জগতের অভিব্যক্তির আদি কারণ শব্দব্রহ্ম । ইহার নাম স্ফোট । স্ফোট হইতে কিরূপে জগতের সৃষ্টি হইল তাহা শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণিত আছে [ভা | ১২|৬|৩৩-৩৭] :-
১) সমাধিমগ্ন ব্রহ্মার হৃদাকাশ হইতে প্রথমত নাদ উৎপন্ন হইল;
২) নাদ হইতে ত্রিমাত্রা ওঙ্কার উৎপন্ন হইল যাহা সমস্ত বৈদিক মন্ত্রোপনিষদের বীজস্বরূপ;
৩) অব্যক্ত ওঙ্কারের অকার, উকার, মকার এই তিন বর্ণ প্রকাশ পাইল;
৪) এই তিন বর্ণ হইতে ক্রমশ সত্ত্বাদি গুণ, ঋগাদি বেদ, ভূর্ভুবাদি লোক অর্থাৎ জগৎপ্রপঞ্চ সৃষ্ট হইল ।
কর্মে ব্রহ্মনির্দেশ :
পূর্বে বলা হইয়াছে, ব্রহ্মবাচক স্ফোটরূপী ওঙ্কার হইতেই জগতের সৃষ্টি । জগতের ধারণ-পোষণের জন্য যজ্ঞসৃষ্টি । যজ্ঞ-শব্দে ব্যাপক অর্থে চাতুর্বর্ণ্যের আচরণীয় সমস্ত কর্ম বুঝায় । এই যজ্ঞ-কর্মের ব্যবস্থাই বেদে আছে এবং যজ্ঞরক্ষার ভার প্রধানত ব্রাহ্মণের উপর । ব্রাহ্মণ, বেদ ও যজ্ঞ পরব্রহ্ম হইতেই উৎপন্ন হইয়াছে; সুতরাং ব্রহ্মবাচক 'ওঁ তৎ সৎ' এই সঙ্কল্পই সমগ্র সৃষ্টির মূল । যজ্ঞ বা কর্মদ্বারাই সৃষ্টিরক্ষা হয়, সুতরাং 'ওঁ তৎ সৎ' এই সঙ্কল্পদ্বারাই সমস্ত কর্ম করিতে হয় । ইহার স্থূল মর্ম এই যে, সর্বকর্মই পরমাত্মাকে স্মরণ করিয়া ঈশ্বরার্পণ-বুদ্ধিতে করিবে অর্থাৎ কর্মকে ব্রহ্মকর্মে পরিণত করিবে, তাহা ত্যাগ করিবে না ।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : অষ্টাদশ অধ্যায় - মোক্ষযোগ
হে মহাবাহো, হে হৃষিকেষ, হে কেশিনিসূদন, সন্ন্যাস ও ত্যাগের তত্ত্ব কি, তাহা পৃথক্ ভাবে জানিতে ইচ্ছা করি । ১
শ্রীভগবান্ বলিলেন -
কাম্য কর্মের ত্যাগকেই পণ্ডিতগণ সন্ন্যাস বলিয়া জানেন; এবং সমস্ত কর্মের ফল-ত্যাগকেই সূক্ষ্মদর্শিগণ ত্যাগ বলিয়া থাকেন । ২
কোন কোন (সাংখ্য) পণ্ডিতগণ বলেন যে, কর্মমাত্রই দোষযুক্ত, অতএব ত্যাজ্য; অন্য কেহ কেহ (মীমাংসকগণ) বলেন যে, যজ্ঞ, দান ও তপঃকর্ম ত্যাজ্য নহে । ৩
হে ভরতশ্রেষ্ঠ, ত্যাগ বিষয়ে আমার সিদ্ধান্ত শ্রবণ কর; হে পুরুষশ্রেষ্ঠ, ত্যাগ ত্রিবিধ বলিয়া কথিত হইয়াছে । ৪
যজ্ঞ, দান ও তপস্যারূপ কর্ম ত্যাজ্য নহে, উহা করাই কর্তব্য । যজ্ঞ, দান ও তপস্যা বিদ্বান্গণেরও চিত্তশুদ্ধিকর । ৫
হে পার্থ, এই সকল কর্মও কর্তৃত্বাভিমান ও ফল কামনা ত্যাগ করিয়া করা কর্তব্য । ইহাই আমার নিশ্চিত মত এবং ইহাই উত্তম মত । ৬
স্বধর্ম বলিয়া যাহার যে কর্ম নির্দিষ্ট আছে, সেই কর্ম ত্যাগ করা কর্তব্য নহে । মোহবশতঃ সেই কর্ম ত্যাগ করাকে তামসত্যাগ বলে । ৭
কর্মানুষ্ঠান দুঃখকর মনে করিয়া কায়িক ক্লেশের ভয়ে যে কর্মত্যাগ করা হয়, তাহা রাজসত্যাগ । যিনি এই ভাবে কর্মত্যাগ করেন, তিনি প্রকৃত ত্যাগের ফল লাভ করেন না । ৮
হে অর্জুন, কর্তৃত্বাভিমান ও ফলকামনা ত্যাগ করিয়া, কেবল কর্তব্য বলিয়া যে বিহিত কর্ম করা হয়, তাহাই সাত্ত্বিক ত্যাগ বলিয়া কথিত হয় । ৯ (অর্থাৎ কর্তৃত্বাভিমান ও ফলকামনা ত্যাগই সাত্ত্বিক ত্যাগ, কর্মত্যাগ নহে) ।
সত্ত্বগুণবিশিষ্ট, স্থিরবুদ্ধি, সংশয়শূন্য পূর্বোক্ত সাত্ত্বিক ত্যাগী পুরুষ দুঃখকর কর্মেও দ্বেষ করেন না এবং সুখকর কর্মেও আসক্ত হন না । ১০ (অর্থাৎ রাগদ্বেষ হইতে বিমুক্ত থাকিয়া কেবল কর্তব্যবোধে কর্ম করিয়া থাকেন) ।
যে দেহ ধারণ করে তাহার পক্ষে কর্ম সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করা সম্ভবপর নয়; অতএব যিনি (কর্ম করিয়াও) কর্মফল ত্যাগ করেন, তিনিই প্রকৃত ত্যাগী বলিয়া কথিত হন । ১১
যাঁহারা ফল-কামনা ত্যাগ করেন না সেই অত্যাগী পুরুষগণের মৃত্যুর পরে অনিষ্ট, ইষ্ট ও ইষ্টানিষ্ট-মিশ্র, তাঁহাদের কর্মানুসারে এই তিন প্রকার ফল লাভ হয় । কিন্তু সন্ন্যাসীদের অর্থাৎ যাঁহারা কর্মফল ত্যাগ করিয়া কর্ম করেন, তাঁহাদের কখনও ফল লাভ হয় না । ১২ (অর্থাৎ তাঁহারা কর্ম করিলেও কর্মে আবদ্ধ হন না) ।
হে মহাবাহো, যে কোন কর্ম সম্পাদনের পক্ষে পাঁচটি কারণ সাংখ্য-সিদ্ধান্তে বর্ণিত আছে, তাহা আমার নিকট শ্রবণ কর । ১৩
অধিষ্ঠান (স্থান), কর্তা, বিবিধ করণ বা সাধন (যন্ত্র), কর্তার অনেক প্রকার চেষ্টা বা ব্যাপার এবং পঞ্চম কারণ দৈব । ১৪
মনুষ্য শরীর, মন ও বাক্যদ্বারা ন্যায্য বা অন্যায্য যে কোন কর্ম করে, পূর্বোক্ত পাঁচটি তাহার কারণ । ১৫
বাস্তবিক অবস্থা এইরূপ হইলেও (অর্থাৎ পূর্বোক্ত পাঁচটি কর্মের কারণ হইলেও) নিঃসঙ্গ আত্মাকে যে কর্তা বলিয়া মনে করে, তাহার বুদ্ধি শাস্ত্রাদি জ্ঞানের দ্বারা পরিমার্জিত না হওয়ায় সে প্রকৃত তত্ত্ব দেখিতে পায় না । ১৬
যাঁহার 'আমি কর্তা' এই ভাব নাই, যাঁহার বুদ্ধি কর্মের ফলাফলে আসক্ত হয় না, তিনি সমস্ত লোক হনন করিলেও কিছুই হনন করেন না এবং তাহার ফলে আবদ্ধও হন না । ১৭
জ্ঞান, জ্ঞেয় ও পরিজ্ঞাতা, এই তিনটি কর্মচোদনা অর্থাৎ কর্মপ্রবর্তক বা কর্মপ্রবৃত্তির হেতু । করণ, কর্ম, কর্তা, এই তিনটি কর্মসংগ্রহ বা ক্রিয়ার আশ্রয় । ১৮
কাপিল সাংখ্যশাস্ত্রে জ্ঞান, কর্ম ও কর্তা সত্ত্বাদি গুণভেদে তিন প্রকার কথিত হইয়াছে, সে সকল যথাবৎ কহিতেছি, শ্রবণ কর । ১৯
যে জ্ঞানদ্বারা পরস্পর বিভক্তভাবে প্রতীয়মান সর্বভূতে এক অদ্বয় অব্যয় বস্তু (পরমাত্মতত্ত্ব) পরিদৃষ্ট হয়, সেই জ্ঞান সাত্ত্বিক জানিবে । ২০
যে জ্ঞানের দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন ভূতসমূহে পৃথক্ পৃথক্ ভাবের অনুভূতি হয় তাহা রাজস জ্ঞান । ২১
যাহা প্রকৃত তত্ত্ব তাহা না বুঝিয়া, ইহাই যাহা কিছু সমস্ত, এইরূপ বুদ্ধিতে কোন একমাত্র বিষয়ে আসক্ত থাকে সেই যুক্তিবিরুদ্ধ, অযথার্থ, তুচ্ছ জ্ঞানকে তামস জ্ঞান কহে । ২২
কর্মকর্তা ফলকামনা পরিত্যাগপূর্বক রাগদ্বেষ-বর্জিত হইয়া অনাসক্তভাবে অবশ্যকর্তব্যরূপে বিহিত যে কর্ম করেন, তাহাকে সাত্ত্বিক কর্ম বলা হয় । ২৩
আর, ফলাকাঙ্ক্ষা করিয়া অথবা অহঙ্কার সহকারে বহু আয়াস স্বীকার করিয়া যে কর্ম অনুষ্ঠিত হয়, তাহা রাজস কর্ম বলিয়া কথিত হয় । ২৪
ভাবিফল কি হইবে, নিজের সামর্থ্য কতটুকু, প্রাণিহিংসাদি হইবে কিনা, পরিণামে কিরূপ হানি হওয়ার সম্ভাবনা - এইসকল বিচার না করিয়া মোহবশতঃ যে কর্ম আরম্ভ করা হয়, তাহা তামস কর্ম বলিয়া কথিত হয় । ২৫
যিনি আসক্তিবর্জিত, যিনি 'আমি', 'আমার' বলেন না অর্থাৎ কর্তৃত্বাভিমান ও মমত্ববর্জিত, যিনি সিদ্ধি ও অসিদ্ধিতে হর্ষবিষাদশূন্য হইয়া নির্বিকার চিত্তে ধৈর্য ও উৎসাহ সহকারে কর্ম করেন, তাঁহাকে সাত্ত্বিক কর্তা বলে । ২৬
বিষয়াসক্ত, কর্মফলাকাঙ্ক্ষী, লোভী, হিংসাপরায়ণ, শৌচাচারহীন, সিদ্ধিলাভে হর্ষান্বিত ও অসিদ্ধিতে শোকান্বিত - এরূপ কর্তাকে রাজস কর্তা বলে । ২৭
যে অস্থিরমতি, অভদ্র, অনম্র, শঠ, পরবৃত্তিনাশক, অলস, সদা অবসন্নচিত্ত ও দীর্ঘসূত্রী, তাহাকে তামস কর্তা বলে । ২৮
হে ধনঞ্জয়, বুদ্ধির ও ধৃতিরও যে গুণানুসারে তিনপ্রকার ভেদ হয় তাহা পৃথক্ পৃথক্ সুস্পষ্টরূপে বলিতেছি, শ্রবণ কর । ২৯
হে পার্থ, কর্ম করা অথবা কর্ম হইতে নিবৃত্ত থাকা (অর্থাৎ কর্মমার্গ বা সন্ন্যাস), কর্তব্য কি, অকর্তব্য কি, কিসে ভয়, কিসে অভয়, কিসে বন্ধ, কিসে মোক্ষ, এই সকল যে বুদ্ধিদ্বারা যথাযথরূপে বুঝা যায়, তাহাই সাত্ত্বিকী বুদ্ধি । ৩০
হে পার্থ, যে বুদ্ধিদ্বারা ধর্ম ও অধর্ম, কার্য ও অকার্য যথার্থরূপে বুঝা যায় না, তাহা রাজসী বুদ্ধি । ৩১
হে পার্থ, যে বুদ্ধি মোহাচ্ছন্ন থাকাতে অধর্মকে ধর্ম মনে করে এবং সকল বিষয়ই বিপরীত বুঝে, তাহা তামসী বুদ্ধি । ৩২
যে অবিচলিত ধৃতিদ্বারা মন, প্রাণ ও ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়া সমাধি বা সমদর্শনরূপ যোগবলে নিয়মিত হয়, তাহা সাত্ত্বিকী ধৃতি । ৩৩
হে পার্থ, হে অর্জুন, যে ধৃতিদ্বারা মনুষ্য ধর্ম, অর্থ ও কামোপভোগেই লাগিয়া থাকে এবং সেই সেই প্রসঙ্গে ফলাকাঙ্ক্ষী হয়, তাহা রাজসী ধৃতি । ৩৪
হে পার্থ, যে ধৃতিদ্বারা দুর্বুদ্ধি ব্যক্তি নিদ্রা, ভয়, শোক, বিষাদ এবং মদ ছাড়িতে পারে না অর্থাৎ যাহাতে মনুষ্যকে এই সকল বিষয়ে আবদ্ধ করিয়া রাখে, তাহা তামসী ধৃতি । ৩৫
হে ভরতর্ষভ, এক্ষণে আমার নিকট ত্রিবিধ সুখের বিষয় শ্রবণ কর । ৩৬
যে সুখে ক্রমে ক্রমে অভ্যাসবশতঃ আনন্দ লাভ হয় (হঠাৎ নহে), যাহা লাভ হইলে দুঃখের অন্ত হয়, যাহা অগ্রে বিষের ন্যায়, পরিণামে অমৃততুল্য, যাহা আত্মনিষ্ঠ বুদ্ধির প্রসন্নতা হইতে জন্মে, তাহাই সাত্ত্বিক সুখ । ৩৭
রূপরসাদি বিষয়ে ইন্দ্রিয়ের সংযোগবশতঃ যে সুখ উৎপন্ন হয় এবং যাহা অগ্রে অমৃতের ন্যায় কিন্তু পরিণামে বিষতুল্য হয়, সেই সুখকে রাজস সুখ কহে । ৩৮ (ইহারই নাম বৈষয়িক বা আধিভৌতিক সুখ) ।
যে সুখ প্রথমে এবং পরিণামেও আত্মার বা বুদ্ধির মোহজনক এবং যাহা নিদ্রা, আলস্য ও কর্তব্যবিস্মৃতি হইতে উৎপন্ন হয়, তাহাকে তামস সুখ বলে । ৩৯
পৃথিবীতে, স্বর্গে অথবা দেবগণের মধ্যেও এমন প্রাণী বা বস্তু নাই যাহা প্রকৃতিজাত সত্ত্বাদি গুণ হইতে মুক্ত । ৪০
হে পরন্তপ, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদিগের কর্মসকল ভাবজাত গুণানুসারে পৃথক্ পৃথক্ বিভক্ত হইয়াছে । ৪১
শম, দম, তপঃ, শৌচ, ক্ষমা, সরলতা, জ্ঞান, বিজ্ঞান ও সাত্ত্বিকী শ্রদ্ধা - এই সমস্ত ব্রাহ্মণের স্বভাবজাত কর্ম (লক্ষণ) । ৪২
পরাক্রম, তেজ, ধৈর্য, কার্যকুশলতা, যুদ্ধে অপরাঙ্মুখতা, দানে মুক্তহস্ততা, শাসন-ক্ষমতা, এইগুলি ক্ষত্রিয়ের স্বভাবজাত কর্ম (লক্ষণ) । ৪৩
কৃষি, গোরক্ষা ও বাণিজ্য বৈশ্যদিগের এবং সেবাত্মক কর্ম শূদ্রদিগের স্বভাবজাত । ৪৪
নিজ নিজ কর্মে নিষ্ঠাবান্ ব্যক্তি সিদ্ধি লাভ করে; স্বকর্মে তৎপর থাকিলে কিরূপে মনুষ্য সিদ্ধিলাভ করে তাহা শুন । ৪৫
যাঁহা হইতে ভূতসমূহের উৎপত্তি বা জীবের কর্মচেষ্টা, যিনি এই চরাচর ব্রহ্মাণ্ড ব্যাপিয়া আছেন, মানব নিজ কর্মদ্বারা তাঁহার অর্চনা করিয়া সিদ্ধিলাভ করিয়া থাকে । ৪৬
স্বধর্ম দোষ-বিশিষ্ট হইলেও সম্যক্ অনুষ্ঠিত পরধর্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ । স্বভাব-নির্দিষ্ট কর্ম করিয়া লোকে পাপভাগী হয় না । ৪৭
হে কৌন্তেয়, স্বভাবজ কর্ম দোষযুক্ত হইলেও তাহা ত্যাগ করিতে নাই । অগ্নি যেমন ধূমদ্বারা আবৃত থাকে, তদ্রূপ কর্মমাত্রই দোষযুক্ত । ৪৮
যিনি সর্ববিষয়ে অনাসক্ত, জিতেন্দ্রিয় ও নিস্পৃহ, তিনি কর্মফল ত্যাগের দ্বারা নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি লাভ করেন অর্থাৎ কর্মবন্ধন হইতে মুক্ত হন । ৪৯
হে কৌন্তেয়, এইরূপে নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি-প্রাপ্ত ব্যক্তি যে প্রকারে ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হন তাহা আমার নিকট শ্রবণ কর; উহাই জ্ঞানের চরম অবস্থা । ৫০
বিশুদ্ধ সাত্ত্বিক বুদ্ধিযুক্ত হইয়া, ধৈর্যসহ আত্মসংযমন করিয়া, শব্দাদি বিষয়সমূহ ত্যাগ করিয়া, রাগদ্বেষ বর্জন করিয়া, নির্জন স্থানে অবস্থিত ও মিতভোজী হইয়া, বাক্য, শরীর ও মনকে সংযত করিয়া, বৈরাগ্য অবলম্বন করিয়া, সর্বদা ধ্যানে নিরত থাকিয়া, অহঙ্কার, বল (পাশবিক শক্তির ব্যবহার), দর্প, কাম, ক্রোধ এবং বাহ্য ভোগ-সাধনার্থ প্রাপ্ত দ্রব্যাদি বর্জন করতঃ মমত্ববুদ্ধিহীন প্রশান্তচিত্ত সাধক ব্রহ্মভাব লাভে সমর্থ হন । ৫১,৫২,৫৩
ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হইলে পর তিনি প্রসন্নচিত্ত হইয়া (নষ্ট বস্তুর জন্য) শোক করেন না, বা (অপ্রাপ্ত বস্তুর জন্য) আকাঙ্ক্ষাও করেন না । তিনি সর্বভূতে সমদর্শী হন এবং আমাতে পরা ভক্তি লাভ করেন । ৫৪
(যিনি) এইরূপ পরাভক্তিদ্বারা আমাকে স্বরূপতঃ জানিতে পারেন, (তিনিই) বুঝিতে পারেন - আমি কে, আমার কত বিভাব, আমার সমগ্র স্বরূপ কি; এবং এইরূপে আমাকে স্বরূপতঃ জানিয়া তদনন্তর (তিনি) আমাতে প্রবেশ করেন । ৫৫
আমাকে আশ্রয় করিয়া সর্বদা সর্বকর্ম করিতে থাকিলেও আমার প্রসাদে শাশ্বত অব্যয় পদ প্রাপ্ত হন । ৫৬
মনে মনে সমস্ত কর্ম আমাতে সমর্পণ করিয়া, মৎপরায়ণ হইয়া, সাম্য-বুদ্ধিরূপ যোগ অবলম্বন করিয়া, সর্বদা আমাতে চিত্ত রাখ (এবং যথাধিকার স্বকর্ম করিতে থাক) । ৫৭
আমাতে চিত্ত রাখিলে তুমি আমার অনুগ্রহে সমস্ত সঙ্কট অর্থাৎ কর্মের শুভাশুভ ফল অতিক্রম করিবে । আর যদি আমার কথা না শুন, তবে বিনাশ-প্রাপ্ত হইবে । ৫৮
তুমি অহঙ্কারবশতঃ এই মনে করিতেছ আমি যুদ্ধ করিব না, তোমার এই সঙ্কল্প মিথ্যা; প্রকৃতিই (তোমার ক্ষত্রিয় স্বভাব) তোমাকে (যুদ্ধকর্মে) প্রবর্তিত করিবে । ৫৯ (৩|২৭ শ্লোক দ্রষ্টব্য)
হে কৌন্তেয়, মোহবশতঃ তুমি যাহা করিতে ইচ্ছা করিতেছ না, স্বভাবজ স্বীয় কর্মে আবদ্ধ থাকায় তোমাকে অবশ হইয়া তাহা করিতে হইবে । ৬০
হে অর্জুন, ঈশ্বর সর্ব জীবের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত থাকিয়া মায়াদ্বারা যন্ত্রারূঢ় পুত্তলিকার ন্যায় তাহাদিগকে ভ্রমণ করাইতেছেন । ৬১
হে ভারত, সর্বতোভাবে তাঁহারই শরণ লও; তাঁহার প্রসাদে পরম শান্তি ও চিরন্তন স্থান প্রাপ্ত হইবে । ৬২
আমি তোমার নিকট এই গুহ্য হইতেও গুহ্য তত্ত্বকথা ব্যাখ্যা করিলাম, তুমি ইহা বিশেষভাবে পর্যালোচনা করিয়া যাহা ইচ্ছা হয় তাহা কর । ৬৩
এখন সর্বাপেক্ষা গুহ্যতম পরমশ্রেয়ঃসাধন আমার কথা শ্রবণ কর; তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয়, এই হেতু তোমাকে এই কল্যাণকর কথা বলিতেছি । ৬৪
তুমি একমাত্র আমাতেই চিত্ত রাখ, আমাকে ভক্তি কর, আমাকে পূজা কর, আমাকে নমস্কার কর । আমি সত্য প্রতিজ্ঞাপূর্বক বলিতেছি, তুমি আমাকেই পাইবে, কেননা তুমি আমার প্রিয় । ৬৫
সকল ধর্ম পরিত্যাগ করিয়া তুমি একমাত্র আমারই শরণ লও; আমি তোমাকে সকল পাপ হইতে মুক্ত করিব, শোক করিও না । ৬৬
যে তপস্যা করে না বা স্বধর্মানুষ্ঠান করে না, যে অভক্ত, যে শুনিবার ইচ্ছা রাখে না এবং যে আমাকে নিন্দা করে, এরূপ ব্যক্তিকে তুমি গীতাশাস্ত্র বলিবে না । ৬৭
যিনি এই পরম গুহ্যশাস্ত্র আমার ভক্তগণের নিকট ব্যাখ্যা করিবেন, তিনি আমাকে পরাভক্তি করায় (অর্থাৎ এই কার্যে আমি ভগবানেরই উপাসনা করিতেছি এইরূপ মনে করায়) আমাকেই প্রাপ্ত হইবেন, ইহাতে সন্দেহ নাই । ৬৮
মনুষ্যমধ্যে গীতা-ব্যাখ্যাতা অপেক্ষা আমার অধিক প্রিয়কারী আর কেহ নাই এবং পৃথিবীতে তাহা অপেক্ষা আমার অধিক প্রিয় আর কেহ হইবেও না । ৬৯
আর যিনি আমাদের এই ধর্মসংবাদ (গীতাশাস্ত্র) অধ্যয়ন করিবেন, তিনি জ্ঞানযজ্ঞদ্বারা আমার অর্চনা করিলেন, ইহাই আমি মনে করিব । ৭০
যিনি শ্রদ্ধাবান্ ও অসূয়াশূন্য হইয়া শ্রবণ করেন, তিনিও পাপ হইতে বিমুক্ত হইয়া পুণ্যবান্গণের প্রাপ্য শুভ লোকসকল প্রাপ্ত হন । ৭১
হে পার্থ, তুমি একাগ্রমনে ইহা শুনিয়াছ ত ? হে ধনঞ্জয়, তোমার অজ্ঞানজনিত মোহ দূর হইয়াছে ত ? ৭২
অর্জুন বলিলেন -
হে অচ্যুত, তোমার প্রসাদে আমার মোহ নষ্ট হইয়াছে, আমার কর্তব্যাকর্তব্য-জ্ঞান লাভ হইল, আমি স্থির হইয়াছি, আমার আর সংশয় নাই, আমি তোমার উপদেশ মত কার্য (যুদ্ধ) করিব । ৭৩
সঞ্জয় বলিলেন -
এইরূপে মহাত্মা বাসুদেব এবং অর্জুনের এই অদ্ভুত লোমহর্ষকর সংবাদ আমি শ্রবণ করিয়াছি । ৭৪
ব্যাসদেবের প্রসাদে সাক্ষাৎ যোগেশ্বর স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের মুখ হইতেই আমি এই যোগশাস্ত্র শ্রবণ করিয়াছি । ৭৫
হে রাজন্, কেশব ও অর্জুনের এই পবিত্র অদ্ভুত সংবাদ বারংবার স্মরণ করিয়া মুহুর্মুহুঃ হর্ষ হইতেছে । ৭৬
হে রাজন্, হরির সেই অতি অদ্ভুত বিশ্বরূপ স্মরণ করিয়া আমার অতিশয় বিস্ময় জন্মিতেছে এবং বার বার হর্ষ হইতেছে । ৭৭
যে পক্ষে যোগেশ্বর কৃষ্ণ এবং যেখানে ধনুর্ধর পার্থ, সেখানেই লক্ষী, বিজয়, উত্তরোত্তর ঐশ্বর্যবৃদ্ধি ও অখণ্ডিত রাজনীতি আছে, ইহাই আমার মত । ৭৮ [অতএব আপনি পুত্রগণের জয়লাভের আশা ত্যাগ করুন, পাণ্ডবগণের সঙ্গে সন্ধি করুন ।]
১৮) কর্মচোদনা ও কর্মসংগ্রহ - কোন কর্ম আরম্ভ করিবার পূর্বে একটি প্রেরণা চাই, এই প্রেরণার জন্য জ্ঞান, জ্ঞেয় ও জ্ঞাতা, এই তিনটির প্রয়োজন । স্থুল কথা কর্মচোদনা = কর্মবিষয়ক মানসিক প্রেরণা, কর্মসংগ্রহ = সেই প্রেরণার বাহ্য প্রকাশ ।
২০) সাত্ত্বিক-জ্ঞান - জগতের নানাত্বের মধ্যে যে একত্ব দর্শন তাহাই প্রকৃত জ্ঞান । একমাত্র অদ্বয় অব্যয় সদ্বস্তুই আছেন, যাহা কিছু ছিল, আছে বা থাকিতে পারে, সমস্তই তাঁহাতেই আছে, তিনি 'সব', সমস্তই বাসুদেব; ইহাই অদ্বৈত জ্ঞান । এই জ্ঞান লাভ জীবের পরম নিঃশ্রেয়স্, উহাই মুক্তি । আত্মজ্ঞান, ব্রহ্মজ্ঞান, ব্রহ্মাত্ম্যৈক্যজ্ঞান, সর্বত্র সমদর্শন ইত্যাদি নানা কথায় এই জ্ঞানের বর্ণনা পূর্বে করা হইয়াছে । এই সাত্ত্বিক জ্ঞানলাভ করিয়া সাত্ত্বিক কর্তা বা কর্মযোগী সাত্ত্বিক (নিষ্কাম) কর্ম করেন ।
২১) রাজস জ্ঞান - সর্বভূতে ভেদবুদ্ধি, একত্বের মধ্যে নানাত্ব দর্শন, ইহাই বদ্ধ জীবের জ্ঞান বা অজ্ঞান । ইহাতেই বদ্ধ হইয়া জীব জন্মমৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হয় । এই রাজস জ্ঞান বা ভেদজ্ঞান হইতেই সংসার, ইহা হইতেই রাগদ্বেষ দম্ভদর্পাদি সর্ববিধ রাজস প্রবৃত্তি অ কাম্য কর্মের উৎপত্তি ।
২৫) ত্রিবিধ কর্ম - নিষ্কাম কর্ম = সাত্ত্বিক কর্ম, সকাম কর্ম = রাজসিক ও তামসিক কর্ম, নিষিদ্ধ কর্ম = সকাম কর্মের কতকগুলিকে শাস্ত্রে নিষিদ্ধ কর্ম বলা হইয়া থাকে । বিশেষ দ্রষ্টব্য - কর্মের এই শ্রেণী-বিভাগ কর্মেরই বাহ্য প্রকৃতি বা পরিণাম বিচার করিয়া করা হয় নাই, কর্তার বুদ্ধি অনুসারেই করা হইয়াছে । গীতার মতে কর্মের কর্তব্যাকর্তব্য-বিচারে কর্মের ফলাফল না দেখিয়া কর্তার বাসনাত্মিকা বুদ্ধিরই বিচার করা হয় । এইরূপ বিচারে হিংসাত্মক যুদ্ধাদি কর্মও সাত্ত্বিক হইতে পারে, আবার অবস্থা-বিশেষে লোকহিতকর দানাদি কর্মও রাজসিক বা তামসিক হইতে পারে । আবার একই কর্ম এক জনের পক্ষে সাত্ত্বিক হইতে পারে, অপরের পক্ষে রাজসিক বা তামসিক হইতে পারে । যেমন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকর্ম - ইহা অর্জুনের পক্ষে সাত্ত্বিক, কেননা তিনি স্বধর্ম বলিয়া নিষ্কামভাবে উহা অনুষ্ঠান করিয়াছেন । কর্ণাদি যোদ্ধৃগণের পক্ষে ইহা রাজসিক, কেননা তাঁহারা ধনমানাদির আশায় উহাতে যোগদান করিয়াছিলেন; দুর্যোধনের পক্ষে উহা তামসিক, কেননা তিনি নিজের সামর্থ্য, শক্তিক্ষয়, ভাবিফল ইত্যাদি বিবেচনা না করিয়া মোহবশতঃ উহাতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন ।
২৮) দীর্ঘসূত্রী = আজ না, কাল করিব এইরূপ ভাবে যে কাল-বিলম্ব করে ।
৩০) সাত্ত্বিকী বুদ্ধি ও সদসদ্বিবেক (Conscience) :
পাশ্চাত্য নীতিশাস্ত্র অনুযায়ী সদসদ্বিবেক (Conscience) হল মানুষের এক স্বাভাবিক স্বতন্ত্র শক্তি যাহাদ্বারা সে বিনা বিচারে (intuitionally) ভাল-মন্দ নির্ণয় করিতে পারে । কিন্তু চোর বা সাধুর conscience পৃথক হয় কেন, তাহার কোন সন্তোষজনক উত্তর পাশ্চাত্য শাস্ত্রের কাছে নাই । ভারতীয় দর্শনে এরূপ কোনো স্বতন্ত্র শক্তির অস্তিত্ব স্বীকৃত হয় নাই । হিন্দু-দর্শনমতে ভাল-মন্দ বা যাহা-কিছু বিচারের শক্তি একমাত্র বুদ্ধির । বুদ্ধি যখন আত্মনিষ্ঠ হইয়া শুদ্ধ হয় তখনই তাহার বিচার যথার্থরূপ হয়, কেননা তখন উহা আত্মার প্রেরণা বা স্বাধর্ম্য লাভ করে, ইহাই সাত্ত্বিকী বুদ্ধি । সাত্ত্বিকী বুদ্ধিই সন্দেহস্থলে প্রমাণস্বরূপ, কিন্তু রাজসী ও তামসী বুদ্ধি লোককে বিপথে চালিত করে । এই হেতুই পাশ্চাত্যগণ যাহাকে conscience বলেন, তাহা সকলের সমান হয় না । কেননা প্রকৃতির গুণভেদে বুদ্ধি বিভিন্ন হয় ।
২৯,৩৩,৩৫) ত্রিবিধ ধৃতি - সেই মানসিক শক্তি যাহাতে মনুষ্য কোন কর্মে দৃঢ়ভাবে লাগিয়া থাকিতে পারে ।
সাত্ত্বিকী ধৃতি = যাহা দ্বারা সাত্ত্বিক বা নিষ্কাম কর্মে লাগিয়া থাকা যায়;
রাজসী ধৃতি= যাহাতে অর্থকামাদি রাজসিক বিষয়ে লাগিয়া থাকে;
তামসী ধৃতি = যাহা দ্বারা শোক, ভয় ইত্যাদি তামসিক ভাবে লাগিয়া থাকে ।
৩৯) প্রমাদ = কর্তব্যের ভ্রম বা বিস্মৃতি । অনবধানতা ।
কর্মতত্ত্ব বিশ্লেষণ :
যে কোনো কর্ম সম্পাদনের পক্ষে অধিষ্ঠান, কর্তা, করণ, নানাবিধ চেষ্টা এবং দৈব - এই সকল কারণ বিদ্যমান থাকে । সুতরাং যে মনে করে, কেবল 'আমিই' কর্ম করি, সে দুর্মতি প্রকৃত তত্ত্ব বোঝে না । যাহার 'আমি কর্তা' এই ভাব নাই, তিনি কর্মের শুভাশুভ ফলে আবদ্ধ হন না । কর্মপ্রবৃত্তির হেতু = (i)জ্ঞান, (ii)জ্ঞেয়, (iii)জ্ঞাতা । ক্রিয়ার আশ্রয় = (i)কর্তা, (ii)কর্ম, (iii)করণ । তন্মধ্যে জ্ঞান, কর্তা ও কর্ম গুণভেদে ত্রিবিধ হয় । আবার কর্তার বুদ্ধি, ধৃতি এবং যে-সুখলাভার্থ কর্ম করা হয় সেই সুখও গুণভেদে ত্রিবিধ । এইরূপ গুণভেদবশতই বিভিন্ন কর্তার, বিভিন্ন কর্মের বিভিন্ন ফল হয় । যেমন সাত্ত্বিক জ্ঞান (সর্বত্র সমদর্শন) হইতে সাত্ত্বিক কর্তা (কর্মযোগী) সাত্ত্বিক কর্ম (নিষ্কাম কর্ম) করেন, তাঁহার সাত্ত্বিকী বুদ্ধি (বন্ধমোক্ষ-নির্ণয়-সমর্থা) এই কর্ম নিশ্চয় করিয়া দেয় । সাত্ত্বিকী ধৃতি তাঁহাকে এই কর্মে স্থির রাখে এবং তিনি এই সাত্ত্বিক কর্মের যে-ফল সাত্ত্বিক সুখ, নির্মল আত্মপ্রসাদ (আত্মানন্দ), তাহা লাভ করেন । রাজসিক ও তামসিক কর্তার কর্ম এবং তাহার ফলও এইরূপ গুণভেদে বিভিন্ন হয় ।
৫৪-৫৬) নিষ্কাম কর্ম -> নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি -> সাত্ত্বিকী বুদ্ধি -> ব্রহ্মভূত (ব্রহ্মভাব প্রাপ্তি) -> পরাভক্তি -> মোক্ষ (ভগবৎ-প্রাপ্তি)
৫৭) বুদ্ধিযোগ : গীতায় শ্রীভগবান যে যোগ বলিতেছেন, তাহাকে কখনো বুদ্ধিযোগ, কখনো বা কেবল যোগ শব্দদ্বারাই প্রকাশ করিয়াছেন । এ-স্থলে বুদ্ধি অর্থ শুদ্ধ সাম্য-বুদ্ধি, উহাই কর্মযোগের মূল, কর্ম করিবার সময় বুদ্ধিকে স্থির, পবিত্র সম ও শুদ্ধ রাখাই সেই যোগ, 'যুক্তি' বা কৌশল যাহাতে কর্মের বন্ধন হয় না, সে কর্ম যাহাই হউক-না-কেন । এই হেতুই 'কর্ম হইতে বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ' [২|৪৮-৫১] ।
৫৯-৬৩) প্রকৃতি-পারতন্ত্র ও আত্মস্বাতন্ত্র্য - এস্থলে শ্রীভগবান্ বলিতেছেন - তুমি ইচ্ছা না করিলেও প্রকৃতি তোমাকে স্বাভাবিক কর্মে প্রবর্তিত করিবে, তোমাকে অবশভাবেই সে কর্ম করিতে হইবে । প্রকৃতির প্রেরণায় কর্ম, কর্মফলে সদসৎ যোনিতে জন্ম, জন্মিয়া আবার কর্ম, কর্মফলে আবার জন্ম । সুতরাং দেখা যায়, জীবকে অবিরত জন্ম-কর্মের ভবচক্রেই ঘুরিতে হয় । এই প্রকৃতি-পারতন্ত্র বা কর্মবিপাক হইতে মুক্তিলাভের উপায় কি ? জ্ঞানলাভার্থ, মোক্ষার্থ জীবের কি কোন স্বাতন্ত্র্য নাই ? অধ্যাত্মশাস্ত্র বলেন, আছে । পরমাত্মা শুদ্ধবুদ্ধমুক্তস্বভাব এবং তিনিই বা তাঁহারই সনাতন অংশ জীবাত্মারূপে দেহে আছেন; তিনি কখনও প্রকৃতির পরতন্ত্র হইতে পারেন না । দেহেন্দ্রিয়াদির বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ায় তাঁহাকে বদ্ধ অ পরাধীনের ন্যায় বোধ হয়; তিনি মায়াধীন হন । কিন্তু তাহা হইলেও স্বতঃই তাঁহার মুক্ত হইবার প্রেরণা আসে । গুরুপদেশ, সাধুসং প্রভৃতি অনুকূল অবস্থায় সেই প্রেরণা মন এবং বুদ্ধির উপর কার্য করে, তাহাতেই মনুষ্যের মনে আত্মোন্নতি বা মোক্ষানুকূল কর্ম করিবার প্রবৃত্তি জন্মে ।
ইচ্ছা-স্বাতন্ত্র্য (Freedom of the Will) - পাশ্চাত্য দার্শনিকগণ ইহা সম্বন্ধে অনেক গবেষণা করিয়াছেন, কিন্তু কোন স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারিয়াছেন বলিয়া বোধ হয় না । আর্য ঋষিগণ সাংখ্য-বেদান্তাদি শাস্ত্রে মনস্তত্ত্ব ও আত্মতত্ত্বের যে সূক্ষানুসূক্ষ বিশ্লেষণ করিয়াছেন তাহা পর্যালোচনা করিলে দেখা যায় যে, 'ইচ্ছা-স্বাতন্ত্র্য' শব্দটিই একরূপ অর্থহীন । কারণ, ইচ্ছা মনের ধর্ম; মন বুদ্ধির দ্বারা চালিত হয়, মনবুদ্ধি প্রকৃতিরই পরিণাম এবং প্রকৃতির গুণানুসারেই বিভিন্ন হয়, সুতরাং ইচ্ছাও সর্বদাই প্রকৃতির অধীন - উহার স্বাতন্ত্র্য নাই । উহার স্বাতন্ত্র্য তখনই হয়, যখন জীব ত্রিগুণাতীত বা নিত্যসত্ত্বস্থ হয়, অর্থাৎ জীবের স্বাতন্ত্র্য-ইচ্ছা থাকে না, যখন জীবের ইচ্ছা এবং ঈশ্বরেচ্ছা এক হইয়া যায় - প্রকৃতপক্ষে উহা আত্ম-স্বাতন্ত্র্য, 'ইচ্ছা-স্বাতন্ত্র্য' নহে । এই হেতুই গীতায় মিশ্র-সাত্ত্বিক বুদ্ধিকেও বন্ধনের কারণ বলা হইয়াছে ।
৬৪,৬৬) সর্বধর্মত্যাগ করিয়া আমার শরণ লও (শরণাগতি)
৬৭) শুশ্রূষা শব্দের দুই অর্থ - (i) শ্রবণের ইচ্ছা, (ii) পরিচর্যা, সেবা । এস্থলে যে কোন অর্থ গ্রহণ করা যায় ।
৭৮) এস্থলে "যোগেশ্বর ও ধনুর্ধর" এই বিশেষণের সার্থকতা লক্ষ করিবার বিষয় । যুক্তি ও শক্তি মিলিত হইলেই কার্য-সফলতা সম্ভবপর, নচেৎ কেবল বলে বা কেবল বুদ্ধিদ্বারা কৃতকার্য হওয়া যায় না, উদাহরণ জরাসন্ধ-বধ ।
শ্রীশ্রীগীতামাহাত্ম্যম্
যে ব্যক্তি এই পবিত্র গীতাশাস্ত্র পাঠ করেন, তিনি ভয় ও শোকাদি শূন্য হয়ে বিষ্ণুধাম প্রাপ্ত হন । ১
আমার সীমিত সামর্থ্যে অনুসন্ধান করে এ পর্যন্ত ৬টি গীতামাহাত্ম্যের খোঁজ পেয়েছি :-
- বৈষ্ণবীয় তন্ত্রসারে উক্ত গীতামাহাত্ম্য (84-85 শ্লোকসংখ্যা) 1, 2, 3
- বরাহপুরাণে উক্ত গীতামাহাত্ম্য (23 শ্লোকসংখ্যা) 1, 2
- শ্রী আদি শংকরাচার্য্য'এর লেখা গীতামাহাত্ম্য (7 শ্লোকসংখ্যা) 1, 2
- পদ্মপুরাণ, উত্তরাখণ্ডে উক্ত গীতামাহাত্ম্য 1, 2, 3, 4, 5, 6 (English); 7, 8 (Bengali)
- স্কন্দপুরাণ, অবন্তীখণ্ডে উক্ত গীতামাহাত্ম্য (15 শ্লোকসংখ্যা) 1, 2
- মহাভারতে উক্ত গীতামাহাত্ম্য (4 শ্লোকসংখ্যা) 1

No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ