গীতা ১৮/৬৬ শ্লোকের ভ্রান্তিনিবারণ - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

13 June, 2021

গীতা ১৮/৬৬ শ্লোকের ভ্রান্তিনিবারণ

গীতা ১৮/৬৬ শ্লোকের ভ্রান্তিনিবারণ 

বর্তমানে অনেকের দাবি যে, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা- অষ্টাদশ অধ্যায়ের ৬৬ নং শ্লোকটি প্রক্ষিপ্ত অথবা ত্যাজ্য। কারণ শ্লোকটিতে বলা হয়েছে -

সর্বSধর্মান্পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ৷
অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ৷৷ ---১৮/৬৬
প্রচলিত অনুবাদ : সর্ব প্রকার ধর্ম পরিত্যাগ করে কেবল আমার শরণাগত হও। আমি তোমাকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করব। তুমি শোক করো না। ---(শ্রীল প্রভুপাদ ভাষ্যম্)

সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মাম্ একম্‌ শরণম্‌ ব্রজ।
অহম্‌ ত্বাম্ সর্বপাপেভ্যঃ মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।।
গীতা-১৮।৬৬
পদ০-সর্বধর্মান্। পরিত্যজ্য। মাম্। এক। শরণম্‌। ব্রজ। অহম্। ত্বাম্। সর্বপাপেভ্যঃ। মোক্ষয়িষ্যামি। মা। শুচঃ।
পদার্থঃ হে অর্জুন! (সর্বাধর্মান্) বেদ বিরোধী সমস্ত ধর্মকে (পরিত্যজ্য) ত্যাগ করে (মাম্, একম্‌, শরণম্‌, ব্রজ) আমার এক বৈদিক ধর্মরূপী শরণকে প্রাপ্ত হও, এবূপ করার ফলে (অহম্‌) আমি (ত্বাম্) তোমাকে (সর্বপাপেভ্যঃ) সমস্ত পাপ থেকে (মোক্ষয়িষ্যামি) মুক্ত করবো (মা, শুচঃ) শোক করোনা।

ভাষ্যঃ উক্ত দুই শ্লোকের মধ্যে সম্পূর্ণ গীতার অর্থকে ব্যাসজী সংগ্রহ করে দিয়েছেন, যার তাৎপর্য পরমাত্মার অনন্য ভক্তিতে হয় , যেমন পূর্বে কোন এক স্থানে বর্ণনা করা হয়েছে যে পরমাত্মা একমাত্র অনন্য ভক্তি দ্বারা প্রাপ্ত হয় এবং একমাত্র পরমাত্মার ভক্তিকেই অনন্য ভক্তি বলা হয় অর্থাৎ যে ভক্তিতে পরমাত্মা হতে ভিন্ন বস্তুর ধ্যান হয় না যেমন 'অথ য় এতদক্ষরং গার্গীবিদিত্বাऽস্মাল্লোকা- ত্প্রৈতি স ব্রাহ্মণঃ' বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৩/৮/১১ এখানে নিরূপণ করা হয়েছে যে যিনি ওই ওম্কার [ পরমাত্মাকে] জেনে ইহ লোক হতে প্রয়াণ করেন তিনি ব্রাহ্মণ, ইত্যাদি বাক্যে একমাত্র পরমাত্মার ভক্তি বর্ণনা করা হয়েছে। এই অনন্য ভক্তিকে দৃঢ় করার জন্য কৃষ্ণজী সমস্ত ধর্মকে ত্যাগ করে একমাত্র বৈদিকধর্ম শরণের আশ্রয় নিতে বলেছে। এই শ্লোকে ধর্ম শব্দের অর্থ ধর্মাভাসের হয় যা উত্তম ধর্মের সমান প্রতিত হয় এবং বাস্তবে মিথ্যা তাকে ত্যাগ করে তুমি একমাত্র বৈদিক ধর্মের আশ্রয় লও। মায়াবাদীগণ এই দুই শ্লোকের বৃহৎ ভাষ্য করেছে, প্রথম শ্লোকের এরূপ ভাষ্য করেছে যে "'তত্ত্বমসি তথা 'অহং ব্রহ্মাস্মি" ইত্যাদি বাক্য দ্বারা যিনি জীব-ব্রহ্মের অভেদ কে বুঝে নেয় এর জন্য কৃষ্ণজী প্রতিজ্ঞা করে যে সে ব্রহ্ম হয়ে যায় এবং সে পরমেশ্বরের অত্যন্ত প্রিয় হয়, কিন্তু উক্ত ১৮/৬৫ শ্লোকের "মদ্যাজী"' আদি শব্দ মায়াবাদীদের সিদ্ধান্তের সর্বথা বিপরীত, কেননা তাদের মতানুসারে ব্রহ্মজ্ঞান দ্বারা মুক্তি হয় আর এই শ্লোকে যজ্ঞ আর নমস্কার দ্বারাও ভগবৎ প্রাপ্তি কথন করা হয়েছে। এইজন্য তাদেদের মতানুকূলে জীব ব্রহ্মের একতার অর্থ এই শ্লোক কদাপি দেয় না, এবং "সর্বধমর্মান্ পরিত্যজ্য" এই শ্লোকের ভাষ্যতে মায়াবাদীগণ এরূপ অর্থ করে যে বর্ণাশ্রমের সমস্ত ধর্মকে ত্যাগ করে একমাত্র ভগবৎ শরণের এখানে উপদেশ করেছে এবং তারা ভগবৎ শরণের তিনটি অর্থ করেছে - ১) আমি ওই পরমেশ্বরের হই,( ২) পরমেশ্বর আমার হয় ৩) সেই পরমেশ্বর আমি হই, এই অর্থ গীতার আশয় থেকে বিপরীত , কেননা "স্বকর্মণা তমভ্যর্চ্য সিদ্ধিং বিন্দতি মানবঃ" গীতা ১৮/৪৫,৪৬ শ্লোকে বলা হয়েছে যে চার বর্ণ নিজ- নিজ কর্ম দ্বারা পরমাত্মার পূজন করে সিদ্ধিকে প্রাপ্ত হয়। যখন এই শ্লোকে বর্ণের ধর্ম দ্বারা পরমাত্মার পূজনের জন্য বর্ণনা করা হয়েছে তখন এখানে এসে তা ত্যাগের বর্ণনা করার তাৎপর্য কি ? অতএব এখানে কৃষ্ণজীর তাৎপর্য বেদ বিরুদ্ধ ধর্মকে ত্যাগ করা।।
( ভাষ্যকার-পণ্ডিত আর্যমৃনি)
ধর্ম ত্যাগ এবং পাপ থেকে মুক্ত করা বিষয় নিয়েই বিভিন্ন প্রশ্ন জাগে এই শ্লোকটি নিয়ে। যেমন -
☞ শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ম্ বলেছেন -
শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ।
স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ॥ ---গীতা-৩/৩৫
অনুবাদ : উত্তমরূপে আচরিত অন্য ধর্ম থেকে গুণরহিত নিজ ধর্ম অতি উত্তম। নিজ ধর্মে মৃত্যুও কল্যাণদায়ক, কিন্তু পরধর্ম ভয়াবহ।
শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণ; পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাং।
স্বভাবনিয়তং কর্ম কুর্বন্ নাপ্নোতি কিল্বিষং॥ ---গীতা-১৮/৪৭
অনুবাদ : উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত অন্যের ধর্ম হতে গুণরহিত নিজ স্বধর্ম শ্রেষ্ঠ ; কারণ স্বভাবনির্দিষ্ট স্বধর্মরূপ কর্ম করলে মানুষের পাপ হয় না।
সহজং কর্ম কৌন্তেয় সদোষমপি ন ত্যজেৎ॥ ---গীতা-১৮/৪৮
অনুবাদ : হে কুন্তীপুত্র! দোষযুক্ত হলেও সহজ অর্থাৎ স্বাভাবিক কর্ম ত্যাগ করা উচিত নয়।
অর্জুন ছিল ক্ষত্রিয়, আর ক্ষত্রিয়ের স্বাভাবিক কর্ম তথা ধর্ম দুষ্টদের দণ্ড দেওয়া, "লোকসংরক্ষণে" অর্থাৎ প্রজাদের রক্ষা করা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা, "যুদ্ধে চাপ্যপলায়নম্" অর্থাৎ যুদ্ধ হইয়ে পলায়ন না করা। ---(গীতা-১৮/৪৩, শুক্রনীতি, মনুস্মৃতি...)
স্বকৰ্মণা তমভ্যর্চ্য সিন্ধিং বিন্দতি মানব:॥ ---(গীতা-১৮/৪৬)
অর্থাৎ মনুষ্য নিজ কর্ম দ্বারা পরমাত্মার অর্চনা করে সিদ্ধিলাভ করে।
ধর্ম্যাদ্ধি যুদ্ধাচ্ছ্রেয়োঽন্যৎ ক্ষত্রিয়স্য ন বিদ্যতে ॥ ---(গীতা-২/৩১)
অর্থাৎ ধর্মযুদ্ধ অপেক্ষা ক্ষত্রিয়ের পক্ষে শ্রেয়ঃ আর কিছু নেই।
অথ চেত্ত্বমিমং ধর্মং সংগ্রামং ন করিষ্যসি।
তত: স্বধর্মং কীর্তিং চ হিতা পাপমবাপ্স্যসি॥ ---(গীতা-২/৩৩)
অর্থাৎ যদি তুমি ধর্মযুদ্ধ না কর, তবে স্বধর্ম ও কীর্তি ত্যাগ করিয়া তুমি পাপযুক্ত হইবে।
তস্মাদ্ যুধ্যস্ব ভারত। ---(গীতা-২/১৮)
অর্থ: অতএব অর্জুন তুমি যুদ্ধ করো।
☞ শ্রীকৃষ্ণ নিজেই অর্জুনকে অর্জুনের স্বধর্ম সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন এবং স্বধর্ম ত্যাগ করলে পাপ হবে তাই যেন স্বধর্ম ত্যাগ না করে পালন করেন, তা দ্বারাই উত্তম গতিপ্রাপ্ত হবে বলেছেন। আবার নিজেই ১৮/৬৬ শ্লোকে সকল ধর্ম ত্যাগ করতে বলেছেন। এই শ্লোকটি মানলে শ্রীকৃষ্ণকে স্ববিরোধী মানতে হবে, নয়তো শ্লোকটিই ত্যাজ্য করতে হবে, এরূপ ভাবনা অনেকের মনেই জাগে।
◾ঋষি দয়ানন্দ থাকাকালীন, রামগোপাল নামক এক ব্যক্তিরও এই শ্লোকটি নিয়ে শঙ্কা হয়েছিল। তিনি গীতার অনেক টিকা অধ্যয়ণ করেছিলেন কিন্তু তাতেও তাহার শঙ্কা দূরীভূত হয়নি। তারপর তিনি ঋষি দয়ানন্দজীর নিকট গিয়ে গীতার ১৮/৬৬ শ্লোকের শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তখন ঋষি দয়ানন্দ বলেছিলেন -
"ধর্মান্" শব্দকে এখানে "অধর্মান্" বুঝা উচিত। "শকন্ধ্বাদিষু পররূপং বাচ্যম্" ব্যাকরণের নিয়মানুসারে "সর্ব" শব্দে বকারে যে অকার রয়েছে, তা "অধর্মান" এর অকারে তদ্রুপ হয়ে যায়, অর্থাৎ বকারে যে অকার রয়েছে তা ইহার সহিত যুক্ত হয়ে যায়, এই প্রকার যদ্যপি "অধর্মান্" শব্দ "ধর্মান্" শব্দরূপ গ্রহণ করে নিয়েছে, পরন্তু বাস্তবে "অধর্মান্" ই রয়েছে। এর দ্বারা রামগোপাল বৈশ্যের শঙ্কা সমাধান হয়ে যায় এবং তিনি সন্তুষ্ট হন।
মহর্ষি দয়ানন্দ জীবন চরিত
দেবেন্দ্রনাথ- ১/১৯১, লেখরাম- ১৯৮
◾মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত আর্যমুনি এই শব্দটির অর্থ লিখেছেন - (সর্বধর্মান্) বেদ বিরোধি সকল ধর্ম।
দর্শন শাস্ত্রে বলা হয়েছে - চোদনালক্ষণোহর্থো ধর্মঃ ---(মীমাংশাদর্শন-১/১/২)
অর্থাৎ যে কর্ম বেদ বিহিত তাহাই ধর্ম আর যা বেদ বিরোধী তাহাকে অধর্ম বলা হয়। নিষ্কর্ষ এটাই হয় যে, তিনিও "সর্বধর্মান্" শব্দ দ্বারা সকল অধর্মই বুঝিয়েছেন। তিনি ভাষ্য ব্যাখানেও এই বিষয়ে লিখেছেন।
উপরোক্ত শব্দার্থ অনুযায়ী পূর্ণ শ্লোকের ভাষ্যম্ -
সর্বধর্মান্পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ৷
অহং ত্বাম্ সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ৷৷
পদপাঠ : সর্বধর্মান্ । পরিত্যজ্য । মাম্ । একম্ । শরণম্ । ব্রজ । অহম্ । ত্বাম্ । সর্বপাপেভ্যঃ । মোক্ষয়িষ্যামি । মা । শুচঃ ।।
পদার্থঃ- হে অর্জুন !
সর্বধর্মান্ = বেদ বিরোধি সকল ধর্মকে
অথবা
সর্ব+অধর্মান্ = সকল অধর্মকে
পরিত্যজ্য = পরিত্যাগ করে
মাম্ একম্ শরণম্ ব্রজ= আমার এক বৈদিকধর্মরূপী শরণকে প্রাপ্ত হও, এমন করিলে
অহম্ = আমি
ত্বাম্ = তোমাকে
সর্বপাপেভ্যঃ = সর্ব পাপ হইতে
মোক্ষয়িষ্যামি = মুক্ত করিয়ে দেবো
মা শুচঃ = তুমি শোক করো না।।
সরলার্থ : হে অর্জুন ! বেদ বিরোধি সকল অধর্মকে পরিত্যাগ করে আমার এক বৈদিকধর্মরূপী শরণকে প্রাপ্ত হও, এমন করিলে আমি তোমাকে সর্ব পাপ হইতে মুক্ত করিয়ে দেবো তুমি শোক করো না।

এখন কৃষ্ণজী বৈদিকধর্মে অর্জুনের শ্রদ্ধাকে দৃঢ় করার জন্য উপসংহারে আবার নিজের বৈদিকমতের দৃঢ়তা উপদেশ করেন-
মন্মনাঃ ভব মদ্ভক্তঃ মদ্যাজী মাম্‌ নমঃ কুরু।
মাম্ এব এষ্যসি সত্যম্‌ তে প্রতিজানে প্রিয়ঃ অসি মে ।।
গীতা-১৮।৬৫
পদ০-মন্মনা!। ভব। মদ্ভক্তঃ। মদ্যাাজী। মাম্। নমঃ। কুরু। মাম্। এব। এষ্যসি। সত্যম্। তে। প্রতিজানে। প্রিয়ঃ। অসি। মে।।
পদার্থঃ হে অর্জুন! (মন্মনাঃ) তুমি আমার মতো মনযুক্ত হও (মদ্যাজী) তুমি আমার মতো যজ্ঞ করো (মদ্ভক্তঃ) আমার ভক্ত হও (মাম্‌, নমঃ, কুরু) আমাকে নমস্কার করো (সত্যম্‌, তে, প্রতিজানে) আমি তোমার নিকট এই প্রতিজ্ঞা করছি যে এরূপ করার পর (মাম্, এব, এষ্যসি) তুমি আমাকেই প্রাপ্ত হবে (প্রিয়ঃ, অসি, মে) তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয়।
ভাষ্যঃ এই শ্লোকে 'মামেবৈষ্যসি' এই বাক্যে 'মাম্‌' শব্দের অর্থ বৈদিক ধর্ম হয় অর্থাৎ এরূপ করার ফলে তুমি বৈদিক ধর্মকে প্রাপ্ত হবে, যেমন গীতা ১৬/২০ শ্লোকেও 'মাম্' শব্দ বৈদিকধর্মের জন্য এসেছে,ওই প্রকার এখানেও সেই একই ভাব হয়।
উপস্থাপকঃ প্রিয়রত্ন বিদ্যার্থী

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

ঋগ্বেদ ৭/৪/৭

  পরিষদ্যম্ হ্যরণস্য রেক্ণো নিত্যস্য রায়ঃ পতয়ঃ স্যাম। ন শেষো অগ্নে অন‍্যজাতম্ অস্ত্যচেতনস্য মা পথম্ বিদুক্ষঃ॥ ঋগ্বেদ ভাষ্য (স্বামী দयानন্দ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ