‘যজুর্বেদ’ শব্দটি সংস্কৃত ‘যজুস্’ ও ‘বেদ’ শব্দদুটি থেকে এসেছে। মনিয়ার-উইলিয়ামসের মতে, ‘যজুস্’ শব্দের অর্থ “ধর্মানুশীলন, শ্রদ্ধানিবেদন, পূজা, যজ্ঞ, যজ্ঞে উচ্চারিত প্রার্থনা, পদ্ধতি, যজ্ঞের সময় অদ্ভুতভাবে উচ্চারিত নির্দিষ্ট মন্ত্র।” ‘বেদ’ শব্দের অর্থ “জ্ঞান”। জনসনের মতে, ‘যজুস্’ শব্দের অর্থ “যজুর্বেদে সংকলিত (প্রধানত) গদ্যে রচিত পদ্ধতি বা মন্ত্র, যেগুলি গোপনে উক্ত হয়।”
| শাখার নাম | অধ্যায় | অনুবাক | শ্লোকসংখ্যা | সংশ্লিষ্ট অঞ্চল | তথ্যসূত্র |
| মধ্যণ্ডিন | ৪০ | ৩০৩ | ১৯৭৫ | বিহার, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত, উত্তর ভারত | |
| কান্ব | ৪০ | ৩২৮ | ২০৮৬ | মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, তেলঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু |
| শাখার নাম | উপশাখার সংখ্যা[২১] | কাণ্ড | প্রপাঠক | মন্ত্রসংখ্যা | সংশ্লিষ্ট অঞ্চল | তথ্যসূত্র |
| তৈত্তিরীয় | ২ | ৭ | ৪২ | দক্ষিণ ভারত | ||
| মৈত্রয়ানী | ৬ | ৪ | ৫৪ | পশ্চিম ভারত | ||
| কঠক (চরক) | ১২ | ৫ | ৪০ | ৩০৯৩ | কাশ্মীম, উত্তর ভারত, পূর্ব ভারত | |
| কপিস্থল | ৫ | ৬ | ৪৮ | হরিয়ানা, রাজস্থান |
—ভাগবত শাস্ত্রী শ্রীবিজনবিহারী গোস্বামী
যজুর্বেদ-সংহিতা দুটি স্পষ্ট শাখায় বিভক্ত—শুক্ল ও কৃষ্ণ। অনুষ্ঠান পরিচালনার সময় যজুর্বেদের পুরোহিত যে সমস্ত মন্ত্র উচ্চারণ করতেন, শুক্ল যজুর্বেদে শুধু সেইগুলিই পাওয়া যায়। তাই শুক্ল যজুর্বেদের ‘ব্রাহ্মণ’সমূহ স্বতন্ত্র রচনারূপে প্রতিষ্ঠিত হলেও কৃষ্ণ যজুর্বেদের ‘ব্রাহ্মণগুলি প্রকৃতপক্ষে পরবর্তীকালে প্রথিত, গদ্যে রচিত নির্দেশমালা ও ব্যাখ্যাসমূহের ধারাবাহিক সংযোজন। কৃষ্ণ-যজুর্বেদে অনুষ্ঠানের বর্ণনা ও তার বিধিবদ্ধ ব্যাখ্যার সঙ্গে যজ্ঞানুষ্ঠানের সূত্রগুলিও রয়েছে। মন্ত্র-বহির্ভূত অন্যান্য অংশে গদ্যে রচিত এবং ব্রাহ্মণ-গ্ৰন্থসমূহের পূর্বগামী।
শুক্ল যজুর্বেদের একমাত্ৰ সাহিত্যকর্ম বাজসনেয়ী-সংহিতাটি দুটি শাখায় ঈষৎ ভিন্ন পাঠে পাওয়া যায়–কাণ্ব ও মাধ্যন্দিন ; এই বিভাজন ‘ব্রাহ্মণ’-গ্ৰন্থগুলির মধ্যেও রয়েছে। অবশ্য শুক্ল যজুর্বেদ প্রতিশাখ্য এই দুটি ভাগকেই একসঙ্গে উল্লেখ করেছে। আলোচ্য শাখা দুটির মধ্যে কাণ্বই প্রাচীনতর। দুটি শাখার মধ্যে পাঠগত ভিন্নতার মূল কারণ ভৌগোলিক ; যখন এক প্ৰজন্ম থেকে অন্য প্রজন্ম এই শ্রুতি-সাহিত্য মৌখিকভাবে সঞ্চারিত হত, স্থানগত ভিন্নতায় স্বাভাবিকভাবেই পাঠও ভিন্ন হয়ে পড়ছিল। মাধ্যন্দিন শাখায় বাজসনেয়ী সংহিতা মোট ৪০টি অধ্যায়, ৩০৮ অনুবাক্ ও ১৯৭৫ কণ্ডিকায় বিভক্ত। প্ৰথম ২৫টি অধ্যায়ে সাধারণভাবে প্ৰচলিত যে সব যজ্ঞের অনুষ্ঠানবিধি সূত্রবদ্ধ হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছে—দর্শপুর্ণমাস (১-২), অগ্নিহােত্র অর্থাৎ প্ৰাতঃকালীন ও সায়ংকালীন সংক্ষিপ্ত যজ্ঞানুষ্ঠান (৩), সাধারণ সোমযাগ (৪-৭), সোমযাগের দুটি বিশেষ ধনন (৯-১০), যজ্ঞবেদী নির্মাণ ও যজ্ঞাগ্নিসমূহের আধান (১১-১৮), সৌত্ৰিমণী যাগ, ইন্দ্রের প্রতি নিবেদিত বিশেষ কিছু কিছু অনুষ্ঠান ও প্ৰায়শ্চিত্তের নানা যাজ্ঞিক অনুষ্ঠানবিধির বিবরণ (১৯-২১) এবং অশ্বমেধ যজ্ঞের আনুষ্ঠানিক বিবৃতি (২২-২৫)। এদের মধ্যে প্রথম আঠাশটি অধ্যায় পরবর্তী সাতটি অধ্যায়ের তুলনায় প্রাচীনতর। সংহিতার দ্বিতীয় অংশ অর্থাৎ ২৬–৩৫তম অধ্যায়। পরবর্তীকালে সংযোজিত ; তাই ভাষ্যকার মহীধর এই অংশকে ‘খিল’ বলে অভিহিত করেছেন। শেষ পাঁচটি অধ্যায় অর্থাৎ ৩৬-৪০ অধ্যায়সমূহে পুরুষমেধ, সর্বমেধ, পিতৃমেধ ও পরবর্তীকালে আবিষ্কৃত প্ৰবর্গ্য যজ্ঞের বিধি সূত্রবদ্ধ হয়েছে। এই সমস্ত অধ্যায়ের কোনো কোনো অংশ স্পষ্টতই দার্শনিক ব্যঞ্জনাগর্ভ ; যেমন শতরুদ্রীয় নামক রুদ্রদেবের প্রতি নিবেদিত বিখ্যাত সূক্তটি (১৬শ অধ্যায়) ঋগ্বেদীয় পুরুষসূক্ত (৩১তম অধ্যায়) এবং ‘তদেব’ সূক্ত (৩২তম অধ্যায়)। এছাড়া ৩৪তম অধ্যায়ে ‘শিবসংকল্প’ নামক সুপরিচিত সূক্তটিতে নতুন এক ধরনের দেববাদী ভাবনার উন্মেষ ঘটেছে। সংহিতার শেষ অধ্যায়টিই (৪০) ঈশোপনিষদ।
শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক প্রয়োজনে যজ্ঞবিধি সম্পর্কিত রচনারূপে কৃষ্ণ-যজুৰ্বেদ সংকলিত হওয়ার ফলে তাতে বহু শাখার বিকাশ ঘটেছে ; কখনও অঞ্চল এবং কখনও পরিবারভেদে এই সংহিতায় পাঠগত ভিন্নতা দেখা দিয়েছে। এদের মধ্যে অন্তত পাঁচটি বা ছয়টি শাখার স্পষ্ট নিদর্শন রয়েছে– তৈত্তিরীয়, কাঠক, আত্ৰেয়, হরিদ্রাবিক, মানব এবং মৈত্রায়ণীয়। এদের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূৰ্ণ তৈত্তিরীয় শাখা আপস্তম্ব ও বৌধায়নের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত ; মধ্যদেশে তার উৎপত্তি হয়েছিল।
এখানে উল্লেখ্য যে, বাজসনেয়ী শাখা উত্তর পূর্বকাশ্মীরে এবং কাঠক ও কপিষ্ঠল পাঞ্জাবে, মৈত্রায়ণীয় গুজরাট, বিন্ধ্য পর্বত ও নর্মদা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে এবং মানবশাখা ভারতের পশ্চিম অঞ্চলে উদ্ভূত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়।
কাঠক ও কপিষ্ঠল সংহিতা চারায়ণীয় (সাধারণভাবে চরকের সঙ্গে সম্পর্কিত) শাখার অন্তর্ভুক্ত। এই পাঠ বিশ্লেষণ করে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, এটি কৃষ্ণ ও শুক্ল যজুর্বেদের মধ্যে কিছুটা সমন্বয় করতে চেয়েছে। স্বভাবত স্বতন্ত্র এই পাঠ মোট পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত ; প্রথম তিনটি অধ্যায় আবার চল্লিশটি স্থানক বা উপবিভাগে বিভক্ত। চতুর্থ অধ্যায়টি বিভিন্ন ধরনের যে সমস্ত সম্পদের বিবরণ দিয়েছে, সে সব মূলত তাৎপৰ্যহীন। পঞ্চম বা শেষ অধ্যায়টি অশ্বমেধ যজ্ঞের বিবরণ দিয়েছে।
আত্ৰেয়-সংহিতা মোটামুটিভাবে তৈত্তিরীয় শাখারই ভিন্ন পাঠ ; এতে কয়েকটি কাণ্ড রয়েছে–প্ৰত্যেকটি কাণ্ড কয়েকটি ‘প্রশ্নে’ এবং প্রত্যেকটি ‘প্রশ্ন’ কয়েকটি অনুবাকে বিন্যস্ত। মৈত্রায়ণীয় বা কলাপ শাখার পাঠ হরিদ্রাবিক বলে অভিহিত। যাঙ্কাচাৰ্য যজুর্বেদের ব্রাহ্মণরূপে একমাত্র মৈত্ৰায়ণীয় শাখারই উল্লেখ করেছিলেন, এতে মনে হয় তিনিই যজুর্বেদের সংহিতা ও ব্রাহ্মাণগুলিকে সুবিন্যস্ত করে চূড়ান্ত রূপ দিয়েছিলেন।

No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ