বেদ শব্দ এবং তার অর্থ - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

29 December, 2025

বেদ শব্দ এবং তার অর্থ

বেদ শব্দ এবং তার অর্থ
স্বর-ভেদে বেদ শব্দের দুই প্রকার—স্বর-ভেদের কারণে প্রাচীন গ্রন্থসমূহে বেদ শব্দের দুই প্রকার দেখা যায়। আদ্যোদাত্ত বেদ শব্দ প্রথমা একবচনে একবার পাওয়া যায়। আবার অন্তোদাত্ত বেদ শব্দও পাওয়া যায়। একটি আদ্যোদাত্ত এবং অন্যটি অন্তোদাত্ত। ঋগ্বেদে এটি পনেরোবার ব্যবহৃত হয়েছে, এবং তৃতীয়া একবচনে ঋগ্বেদে পাওয়া যায় না। যজুর্বেদ ও অথর্ববেদে অন্তোদাত্ত ‘বেদ’ শব্দ পাওয়া যায়।

বেদ শব্দের এই দুই প্রকারকে লক্ষ্য করেই পাণিনি উঞ্ছাদি ৬।১।১৬০।। এবং বুধাদি ৬।১।২০৩।।—এই দুই গণে বেদ শব্দ দু’বার পাঠ করেছেন। দयानন্দ সরস্বতী তাঁর সৌবর গ্রন্থে উঞ্ছাদি সূত্রের ব্যাখ্যায় লেখেন—করণ কারকে প্রত্যয় হলে ঘঞন্ত বেগ, বেদ, বেষ্ট, বন্ধ—এই চারটি শব্দ অন্তোদাত্ত। … ‘ভেত্তি যেন স বেদঃ’ … এবং ভাব বা অধিকরণে প্রত্যয় হলে আদ্যোদাত্তই বুঝতে হবে।

বেদ শব্দের ব্যুৎপত্তি

১. সংহিতা ও ব্রাহ্মণ অনুসারে কাথক, মৈত্রায়ণী ও তৈত্তিরীয় সংহিতায় বেদ শব্দের ব্যুৎপত্তি নিম্নরূপে পাওয়া যায়—

“বেদেন বৈ দেবা অসুরাণাং বিত্তং বেদ্যমবিন্দন্ত তদ্বেবস্য বেদত্বম্।”
তৈ. সং. ১।১৪।২০॥

তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে এইরূপ বাক্য পাওয়া যায়—

“বেদিদং দেবভ্যো নিলায়ত। তাং বেদেনান্ববিন্দন্।”

“বেদেন বেদি বিবিদুঃ পৃথিবীম্।”
তৈ. ব্রা. ৩।৩।৬।৬৬॥

উপরিউক্ত প্রমাণসমূহে—অন্ববিন্দন্, অবিন্দন্, অবিন্দন্ত এবং বিবিদুঃ—এই সমস্ত প্রয়োগ পাণিনীয় মতানুসারে ‘বিবিদ্’ ধাতু থেকে ব্যুৎপন্ন।

ভট্ট ভাস্কর তৈত্তিরীয় সংহিতার উক্ত প্রমাণের অর্থে লেখেন—

“বিদ্যতে = লভ্যতেऽনেনে ইতি করণে ঘন্। উঞ্ছাদিত্বাদন্তোদাত্তম্।”

১. বেদঃ—ঋগ্বেদ ১।১৭।১৫।। ৩।৫৩।১৪।। প্রভৃতি।

২. বেদেন = স্বাধ্যায়েন—ইতি বেঙ্কটমাধবঃ। তদ্রূপ—বেদেন বেদাধ্যয়নেন ব্রহ্মযজ্ঞে ন—ইতি সায়ণঃ (৮।১৬।৫।)।

৩. বেদঃ—যজুর্বেদ ২।২১।। অথর্ববেদ ৭।২৬।১।।
তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণের উক্ত প্রমাণের অর্থে তিনি লেখেন—বিবিদুঃ = লব্ধবন্তঃ

তৈত্তিরীয় সংহিতার ভাষ্যে ভট্ট ভাস্কর লেখেন—

পুরুষার্থানাং বেদয়িতা বেদ উচ্যতে। ৩।৩।৪।৭।।

২. আনন্দতীর্থ তাঁর বিষ্ণুতত্ত্বনির্ণয় গ্রন্থে বেদ শব্দের ব্যুৎপত্তি প্রদর্শনের জন্য পিপ্পলাদ শাখা-সম্পর্কিত কোনো নবীন উপনিষদ অথবা খিল থেকে এইরূপ প্রমাণ প্রদান করেছেন—

নেন্দ্রিয়াণি নানুমানং বেদা হো বেনং বেদয়ন্তি। তস্মাদাহুর্বেদা ইতি পিপ্পলাদশ্রুতিঃ।

৩. সুশ্রুত সংহিতা-তে লেখা আছে—

আয়ুরস্মিন্ বিদ্যতেऽনেনে বা আয়ুর্বিন্বতীতিযায়ুর্বেদঃ। সূত্রস্থান ১।১৪।।

এই বাক্যের ব্যাখ্যায় ডল্হণ লেখেন—

আয়ুঃ অস্মিন্নায়ুর্বেদে বিদ্যতে অস্তি… বিদ্যতে জ্ঞায়তেऽনেনে… বিদ্যতে বিচার্যতেऽনেনে বা…
আয়ুরনেনে বিন্দতি প্রাপ্নোতি ইতি বা আয়ুর্বেদঃ।

সুশ্রুতের উক্তি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সুশ্রুতকার করণ ও অধিকরণ—উভয় অর্থেই প্রত্যয় মান্য করেছেন। তাঁর টীকাকার ডল্হণ মনে করেন—বিদ্ সত্তায়াম্, বিদ্ জ্ঞানে, বিদ্ বিচারণে এবং বিদ্ (লাভে)—এই সকল ধাতু থেকেই সুশ্রুতকার বেদ শব্দের সিদ্ধি অভিপ্রেত করেছেন।

৪. চরক সংহিতা-তে লেখা আছে—

তন্ত্রায় বেদ ব্যতীতায় বেদঃ। সূত্রস্থান ৩০।২০।।

চরকের টীকাকার চক্রপাণি এ বিষয়ে লেখেন—বেদয়তি বোধয়তি—অর্থাৎ বিদ্ জ্ঞানে ধাতু থেকে কর্তৃ অর্থে প্রত্যয় মেনে বেদ শব্দ গঠিত হয়েছে।

৫. নাট্যশাস্ত্র—নাট্যশাস্ত্র ১।১।। এর বিবৃতিতে অভিনবগুপ্ত লেখেন—

নাট্যস্য বেদনং সত্তা লাভো বিচারশ্চ যত্র তন্নাট্যার্থ দশত্বেন… উচ্যতে।

এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, অভিনবগুপ্ত ভাবার্থেও প্রত্যয় মেনে সত্তা, লাভ ও বিচার অর্থবাহী বিদ্ ধাতু থেকে বেদ শব্দের সিদ্ধি করেছেন।

৬. শব্দকোষ ও তাদের টীকা
অমরকোষ ১।৫।৩।। এর টীকায় ক্ষীরস্বামী লেখেন—

বিবন্ত্যনেনে ধর্মবোধঃ।

সর্বানন্দ তাঁর টীকায় লেখেন—

বিবন্তি ধর্মাবিকমনেনে ইতি বেদঃ।

জৈনাচার্য হেমচন্দ্র তাঁর অভিধান চিন্তামণি (পৃ. ১০৬)-এ লেখেন—

বিন্দত্যনেনে ধর্মবোধঃ।

এই সকল লেখন থেকে জানা যায় যে, ক্ষীরস্বামী, সর্বানন্দ ও হেমচন্দ্র—তিনজনেই করণার্থে প্রত্যয় মেনেছেন; তবে প্রথম দুই পণ্ডিত জ্ঞানার্থক বিদ্ ধাতু থেকে বেদ শব্দের ব্যুৎপত্তি মানেন, আর তৃতীয়জন বিদ্ (লাভার্থক) ধাতু থেকে মানেন।

৭. মানবধর্মশাস্ত্র-ভাষ্য—মানবধর্মশাস্ত্র ২।৬।। এর ভাষ্যে মেধাতিথি লেখেন—

ব্যুৎপাদ্যতে চ বেদশব্দঃ। বিদন্ত্যনন্যপ্রমাণবেদ্য ধর্মলক্ষণমচং তস্মাদিতি বেদঃ। তচ্চ
বেদনমেককস্মাদ্ বাক্যাদ্ ভবতি।

—প্রথম পরিচ্ছেদের আরম্ভ।

৮. আপস্তম্ব-পরিভাষা-ভাষ্য—আপস্তম্ব সূত্র ১।৩৩।। এর ভাষ্যে কপর্দীস্বামী লেখেন—

নিঃশ্রেয়স্করাণি কর্মাণ্যাবেদয়ন্তি বেদাঃ।

সূত্র ১।৩।। এর বৃত্তিতে হরদত্ত লেখেন—

বেদয়তীতি বেদঃ।

এতে লেখা আছে—
১. ঋগ্বেদাদিভাষ্য ভূমিকা—দयानন্দ সরস্বতী স্বামী তাঁর ঋগ্বেদাদিভাষ্য ভূমিকা-গ্রন্থে লেখেন—

বিদন্তি জানন্তি, বিদ্যন্তে ভবন্তি, বিন্দন্তি অথবা বিন্বন্তে লভন্তে, বিন্বন্তি বিচারয়ন্তি—সর্বে মনুষ্যাঃ সর্বাঃ সত্যবিদ্যার্থেষু বা বিদ্বাংসশ্চ ভবন্তি তে বেদাঃ।

এইভাবে প্রতীয়মান হয় যে, কাথকাদি সংহিতার কাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত
১. বিদ্ জ্ঞানে,
২. বিদ্ সত্তায়াম্,
৩. বিদ্ (লাভে),
৪. বিদ্ বিচারণে
এই চার ধাতুর যে কোনো একটিতে বা চারটিতেই করণ অথবা অধিকরণে প্রত্যয় মেনে পণ্ডিতগণ বেদ শব্দের সিদ্ধি করে এসেছেন। এবং বহু গ্রন্থকার ভাবার্থে প্রত্যয় মেনেও বেদ শব্দের সিদ্ধি করেন।

বেদ ও ঋষি পরস্পর পর‍্যায়বাচী শব্দ।

স্বামী হরিপ্রসাদ তাঁর বেদ সর্বস্ব গ্রন্থের উপোদ্ঘাতে অধিকরণার্থে প্রত্যয় মানা এবং সত্তা, লাভ ও বিচারার্থক বিদ্ ধাতু থেকে ব্যুৎপত্তি মানাকে অসম্ভব বা নিরর্থক মনে করেন। উপরিউক্ত প্রমাণসমূহের আলোকে এই মত যুক্তিহীন বলেই প্রতীয়মান হয়।

যে বেদ শব্দের ব্যুৎপত্তির প্রকার পূর্বে বলা হয়েছে, সেই বেদ শব্দ বেদ-সংহিতার অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। কোথাও কোথাও ভাষ্যকারগণ তা থেকে দরভমুষ্টি প্রভৃতি অর্থও গ্রহণ করেছেন, কিন্তু এই অর্থবাচক বেদ শব্দ আমাদের এখানে প্রয়োজনীয় নয়।

বেদ-সংহিতা অর্থবাচক বেদ শব্দকে ভাষ্যকারগণ অন্তোদাত্ত বলে গ্রহণ করেন। বেদ শব্দ দ্বারা এখানে আমাদের অভিপ্রায় মন্ত্র-সংহিতাসমূহ। বহু বিদ্বান মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ—উভয়কেই বেদ বলে মানেন। তাঁদের পরম্পরাও যথেষ্ট প্রাচীন। তাঁদের মতের বিস্তৃত সমালোচনা এই গ্রন্থের ব্রাহ্মণ অংশে রয়েছে।

হিরণ্যকেশীয় শ্রৌতসূত্র ২৭।৭।১৪৪।। এবং আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ২।৪।৮।১২।।-এ লেখা আছে—

শব্দার্থ-মারম্ভণানাং তু কর্মখাণ্ডসমাম্নায়সমাপ্তৌ বেদশব্দঃ।

অর্থাৎ—যে কর্মসমূহ প্রত্যক্ষ প্রভৃতি দ্বারা সিদ্ধ নয়, কিন্তু শব্দপ্রমাণ দ্বারা বিধেয়, সেই কর্মগুলির উপদেশ যেখানে সমাপ্ত হয়, সেই সকল গ্রন্থের জন্য বেদ শব্দ ব্যবহৃত হয়।

এর অভিপ্রায় ব্যাজয়ন্তীকার মহাদেব এইরূপে ব্যাখ্যা করেন যে—মন্ত্র, ব্রাহ্মণ ও কল্প—এই তিনটিই বেদ শব্দ দ্বারা অভিপ্রেত। এই লক্ষণ অত্যন্ত ব্যাপক ও আনুষ্ঠানিক।

অতএব এখানে আমরা সাধারণভাবে বেদ শব্দের সিদ্ধির প্রকার প্রদর্শন করেছি। বেদ শব্দের যে সিদ্ধি ও যে অর্থ স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী নির্দেশ করেছেন, তাতেই সমগ্র অভিপ্রায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।

১।১০।৭—বৈদিক বাঙ্ময়ের ইতিহাস, দ্বিতীয় ভাগ, বেদদের ভাষ্যকার, পৃ. ১৬৭৬।

আগে কী বেদ একটিই ছিল

আর্যাবর্তীয় মধ্যযুগীয় বহু পণ্ডিত এই মত পোষণ করতেন যে আদিতে বেদ একটিই ছিল। দ্বাপর পর্যন্ত তাই চলে এসেছে এবং দ্বাপরের শেষে ভগবান ব্যাস ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদ—এই চার ভাগে তা বিভক্ত করেন।

পূর্বপক্ষ—দেখা যাক মধ্যযুগীয় গ্রন্থকারেরা কী লেখেন—

১. মহীধর তাঁর যজুর্বেদ-ভাষ্যের আরম্ভে লেখেন—

তত্রাবীব্রহ্মপরম্পরয়া প্রাপ্তং বেদং বেদব্যাসো মন্দমতীন্মনুষ্যান্ বিচিন্ত্য তৎকৃপয়া চতুর্ধা ব্যস্য ঋগ্যজুঃ সামাথর্বাল্যাংশ্চতুরো বেদান্ পৈলবৈশম্পায়নজৈমিনিসুমন্তুভ্যঃ ক্রমাদুপদিদেশ।

অর্থাৎ—ব্রহ্মার পরম্পরা থেকে প্রাপ্ত বেদ ভগবান বেদব্যাস মন্দবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কথা বিবেচনা করে কৃপাবশত চার ভাগে বিভক্ত করে ঋগ্‌, যজুঃ, সাম ও অথর্ব—এই চার বেদ পৈল, বৈশম্পায়ন, জৈমিনি ও সুমন্তুকে ক্রমানুসারে উপদেশ দেন।

২. মহীধরের পূর্ববর্তী ভট্টভাস্কর তাঁর তৈত্তিরীয় সংহিতা-ভাষ্যের আরম্ভে লেখেন—

পূর্বং ভগবতা ব্যাসেন জগদুপকারার্থমেকীভূয়স্থিতা বেদা ব্যস্তাঃ শাখাশ্চ পরিছিন্নাঃ।

অর্থাৎ—পূর্বে ভগবান ব্যাস জগতের উপকারার্থে একত্র অবস্থানকারী বেদসমূহকে বিভক্ত করে শাখাগুলি নির্দিষ্ট করেন।

৩. ভট্টভাস্করেরও অনেক পূর্বে আচার্য দুর্গ নিরুক্তের বৃত্তিতে লেখেন—

বেদং তাবদেকং সন্তমতিমহত্ত্বাদ্ দুরধ্যেয়মনেকশাখাভেদেন সমাম্নাসিষুঃ। সুখগ্রহণায় ব্যাসেন সমাম্নাতবন্তঃ। ১।১।২০॥

অর্থাৎ—বেদ প্রথমে একটিই ছিল, অতিশয় বৃহৎ হওয়ায় অধ্যয়নে দুষ্কর ছিল; তাই পরে বহু শাখার ভেদে সমাম্নাত করা হয়। সহজ গ্রহণের জন্য ব্যাস কর্তৃক এর বিভাজন করা হয়।

এই মতের অল্প ভিত্তি পুরাণেও পাওয়া যায়। সেখানে লেখা আছে—

জাতুকর্ণোऽভবন্মত্তঃ কৃষ্ণ পায়নস্ততঃ।
অষ্টাবিংশতিরিত্যেতে বেদব্যাসাঃ পুরাতনাঃ।
একো বেদশ্চতুর্থা তু যৈঃ কৃতো দ্বাপরাবিষু।
৩।৩।১৬।২০॥ বিষ্ণু পুরাণ।

এবং—

বেদশ্চৈকশ্চতুর্ধা তু ব্যস্যতে দ্বাপরাবিষু॥ ১৪৪।১১॥ মৎস্য পুরাণ।

অর্থাৎ—প্রত্যেক দ্বাপরের শেষে একটিমাত্র চতুষ্পাদ বেদ চার ভাগে বিভক্ত করা হয়। এই বিভাজন এখন পর্যন্ত আটাশ বার হয়েছে। যিনি এই বিভাজন করেন তাঁর নামই ব্যাস।

উত্তরপক্ষ—দয়ানন্দ সরস্বতী স্বামী এই মতের খণ্ডন করেন। সত্যার্থপ্রকাশ একাদশ সমুল্লাসে লেখা আছে—

যাঁরা বলেন যে বেদসমূহ ব্যাসজি একত্র করেছিলেন, এই কথা মিথ্যা। কারণ ব্যাসের পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ—পরাশর, শক্তি, বশিষ্ঠ এবং ব্রহ্মা প্রভৃতিরাও চারটি বেদই অধ্যয়ন করেছিলেন।

এই দুই পক্ষের মধ্যে কোনটি প্রাচীন ও সত্য—তা পরবর্তী আলোচনায় স্পষ্ট হবে।

(ক) মন্ত্র-প্রমাণ
১. সমস্ত বৈদিক এই বিষয়ে একমত যে মন্ত্র অনাদি। মন্ত্রগত শিক্ষা সর্বকালের জন্য। অতএব যদি মন্ত্রে বহুবচনান্ত বেদাঃ পদ পাওয়া যায়, তবে নিশ্চিতভাবে বুঝতে হবে যে আদিকাল থেকেই বেদ বহু ছিল। এখন দেখা যাক মন্ত্র কী বলে—

যস্মিন্ বেদা নিহিতা বিশ্বরূপাঃ।
৪।৩৫।৬।। অথর্ববেদ।

অর্থাৎ—যে পরব্রহ্মে সমগ্র বিদ্যার ভাণ্ডারস্বরূপ বেদসমূহ স্থিত আছে।

২. পুনরায়—

ব্রহ্ম প্রজাপতির্ধাতা লোকা বেদাঃ সপ্ত ঋষয়োऽগ্নয়ঃ।
তৈমে কৃতং স্বস্ত্যয়নমিন্দ্রো মে শর্ম যচ্ছতু॥

১৬।৬।১২।। অথর্ববেদ।

এখানেও বেদাঃ বহুবচনান্ত পদ এসেছে। এই মন্ত্রের ভাষ্য করতে গিয়ে আচার্য সায়ণ লেখেন—বেদাঃ সাঙ্গাশ্চত্বারঃ। অর্থাৎ এই মন্ত্রে বহুবচনান্ত ‘বেদ’ পদ দ্বারা চারটি বেদকেই বোঝানো হয়েছে।

৩. আবার তৈত্তিরীয় সংহিতায় একটি মন্ত্র আছে—

বেদেভ্যঃ স্বাহা। ৭।৭।৫।১১।২।।

৪. এই পূর্বোক্ত মন্ত্র কাথক সংহিতা ৫।২।।-এও পাওয়া যায়।

এই সকল প্রমাণ থেকে জানা যায় যে প্রাচীনতম কাল থেকেই বেদ বহু সংখ্যায় প্রচলিত ছিল।

(খ) ব্রাহ্মণ গ্রন্থ-প্রমাণ—এই বিষয়ে ব্রাহ্মণ গ্রন্থসমূহের মতও একই। শুধু তাই নয়, সেখানে তো এটাও লেখা আছে যে চারটি বেদ আদিকাল থেকেই প্রচলিত। মাধ্যন্দিন শতপথ ব্রাহ্মণের একাদশ কাণ্ডের স্বাধ্যায়-প্রশংসা ব্রাহ্মণে আদিকাল থেকেই বহু বেদের অস্তিত্বের কথা বলা হয়েছে। ঐতরেয় প্রভৃতি অন্যান্য ব্রাহ্মণ গ্রন্থেও একই কথা পাওয়া যায়।

১. কভঠ ব্রাহ্মণে লেখা আছে—

চত্বারি শৃঙ্গা ইতি বেদা বা এতদুক্তা।

অর্থাৎ—“চত্বারি শৃঙ্গাঃ” এই প্রসিদ্ধ মন্ত্রে চারটি বেদেরই উল্লেখ রয়েছে।

২. পুনরায় কাথক শতাধ্যায়ন ব্রাহ্মণের আরম্ভে ব্রহ্মৌদন প্রकरणে অথর্ববেদের প্রাধান্যের বর্ণনা করতে গিয়ে কেবল চারটি বেদেরই উল্লেখ করা হয়েছে—

আয়র্বণো বৈ ব্রহ্মণঃ সমানঃ... চত্বারো হোমে বেদাস্তানেব ভাগিনঃ করোতি, মূলং বৈ ব্রাহ্মণো বেদাঃ, বেদানামেতন্মূলং, যজ্বৃত্বিজঃ প্রাশ্নন্তি তদ্ ব্রহ্মৌদনস্য ব্রহ্মাদনত্যম্।

অর্থাৎ—চারটিই বেদ। তাদের মধ্যে অথর্ববেদ প্রধান—ইত্যাদি।

১। পৃ. ২৬৬, ব্রাহ্মণ ও আরণ্যক, বৈদিক বাঙ্ময়ের ইতিহাস, ১৬২৭।

৩. গোপথ ব্রাহ্মণ—পূর্ব ভাগে লেখা আছে—

ব্রহ্ম হ বৈ ব্রাহ্মণং পুষ্করে সসৃজে। স… সর্বাংশ্চ বেদান্ ……। ১।১৬।॥

অর্থাৎ—পরমাত্মা ব্রহ্মাকে পৃথিবী-কমলের উপর উৎপন্ন করেন। তাঁর মনে চিন্তা হয়—কোন এক অক্ষরের দ্বারা আমি সমস্ত বেদকে উপলব্ধি করব।

(গ) উপনিষদ্-প্রমাণ—উপনিষদের যেসব অংশে অলংকার, গাথা বা ঐতিহাসিক কাহিনি রয়েছে সেগুলি বাদ দিলে, অবশিষ্ট যে অংশ মন্ত্রময়, তা নিঃসন্দেহে প্রাচীনতম কালের। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদকে মন্ত্রোপনিষদ বলা হয়। তার একটি মন্ত্র বিদ্বৎসমাজে বহু কাল ধরে প্রসিদ্ধ। এই মন্ত্র থেকে কেবল ব্যাসের পূর্বেই বেদ একাধিক ছিল তাই নয়, সৃষ্টির আরম্ভেই বেদ একাধিক ছিল—এ কথাও সুস্পষ্টভাবে নির্ণীত হয়। সেই প্রসিদ্ধ মন্ত্রটি হল—

यो ब्रह्माणं विदधाति पूर्वं यो वै वेदान्श्च प्रहिणोति तस्मै। ৬।১৮।।

অর্থাৎ—যিনি আদিতে ব্রহ্মাকে সৃষ্টি করেন এবং তাঁর জন্য বেদসমূহ প্রদান করেন।

আমাদের পক্ষের পক্ষে এই প্রমাণ এতই শক্তিশালী যে, এর অর্থ সর্বদিক থেকে বিচার করা আবশ্যক।

(ঘ) শঙ্করাচার্যের প্রমাণ—বেদান্তসূত্র ভাষ্য ১।৩।৩০।। এবং ১।৪।১।।-এ স্বামী শঙ্করাচার্য লেখেন—

ঈশ্বরাণাং হিরণ্যগর্ভাদীনাং বর্তমানকল্পাদৌ প্রাদুর্ভবতাং পরমেশ্বরানুগৃহীতানাং সুপ্তপ্রবুদ্ধবৎ কল্পান্তরব্যবহারানুসন্ধানোপপত্তিঃ। তথা চ শ্রুতিঃ—যো ব্রহ্মাণং… ইতি।

শঙ্করাচার্য এখানে ব্রহ্মা বলতে হিরণ্যগর্ভকেই বোঝান। এই হিরণ্যগর্ভই তাঁর মতে ঈশ্বর। তিনি মানবের ঊর্ধ্বতন। সেই দেব ব্রহ্মার বুদ্ধিতে কল্পের আরম্ভে পরমেশ্বরের কৃপায় বেদসমূহ প্রকাশিত হয়। বাচস্পতি মিশ্র ‘ঈশ্বর’ শব্দের অর্থ করেন—ধর্ম, জ্ঞান, বৈরাগ্য ও ঐশ্বর্যের অতিশয়সম্পন্ন ব্যক্তি।

বৈদিক দেবতাবাদে এইরূপ স্থানে ‘দেব’ শব্দের অর্থ বহু সময় বিদ্বান মানুষও হয়ে থাকে। অতএব সর্বত্র প্রথমে অধিষ্ঠাতৃ দেবতার কল্পনা করে পরে বৈদিক গ্রন্থসমূহের সঙ্গে তার সামঞ্জস্য স্থাপন করা কেবল কষ্টসাধ্য কল্পনামাত্র। অতএব এই ক্লিষ্ট কল্পনার অবকাশ নেই।

প্রমাণ আছে যে ব্রহ্মা আদিসৃষ্টির এক বিদ্বান মানুষ—এই অর্থে মুণ্ডকোপনিষদের প্রথম মন্ত্র—

ব্রহ্মা দেবানাং প্রথমঃ সম্বভূব বিশ্বস্য কর্তা ভুবনস্য গোপ্তা।
স ব্রহ্মবিদ্যাং সর্ববিদ্যাপ্রতিষ্ঠামথর্বায় জ্যেষ্ঠপুত্রায় প্রাহ।

এখানেও শঙ্কর অথবা তাঁর পদাঙ্ক অনুসারীরা ‘বেদানাম্’ পদ উপস্থিত থাকায় ব্রহ্মাকে মানবাতীত মনে করেন। কিন্তু পরবর্তী ‘জ্যেষ্ঠপুত্রায়’ পদটি তাঁদের জন্য আপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ অধিষ্ঠাতা ব্রহ্মের তো পুত্রই নেই, সেখানে জ্যেষ্ঠ পুত্র কেমন করে হবে?

যদিও জড় পদার্থের ক্ষেত্রেও কারণ-কার্য সম্পর্কের ভিত্তিতে পুত্র প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার দেখা যায়, কিন্তু এখানে অথর্বা কোনো জড় পদার্থ নয়।

অতএব পূর্বোক্ত প্রমাণে ব্রহ্মাকে মনুষ্যেতর মানা যুক্তিযুক্ত নয়। এই ব্রহ্মাই আদিসৃষ্টিতে অগ্নি প্রভৃতির মাধ্যমে চারটি বেদ প্রাপ্ত হয়েছিলেন।

(২) শ্রী গোবিন্দের ব্যাখ্যা—বেদান্তসূত্র ১।৩।৩০।।-এর শাঙ্করভাষ্যের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শ্রী গোবিন্দ লেখেন—

পূর্বকল্পাদৌ সৃজতি তস্মৈ ব্রহ্মণে প্রহিণোতি গময়তি তস্য বুদ্ধৌ বেদানাবির্ভাবয়তি।

এখানেও যদিও তাঁর অভিপ্রায় অধিষ্ঠাতৃ দেবতাকেই বোঝানো হতে পারে, তথাপি তিনি বেদসমূহের আদিকাল থেকেই বহুবিধ অস্তিত্ব স্বীকার করেন।

(৩) আনন্দগিরীয় ব্যাখ্যা—এই সূত্রের ভাষ্যের উপর লিখতে গিয়ে আনন্দগিরিও ব্রহ্মাকেই বেদসমূহ প্রাপ্ত হওয়ার কথা মানেন—

বিপূর্বী দধাতি করোত্যর্থঃ। পূর্বকল্পাদৌ প্রহিণোতি দদাতি।

অন্য স্থানে শঙ্কর প্রভৃতিরা যে প্রমাণ উদ্ধৃত করেছেন, সেখানেও আমাদের প্রদর্শিত অভিপ্রায়ের সঙ্গে কোনো বিরোধ পড়ে না। এই ব্রহ্মাই আদিব্রহ্মা, যাকে মহাভারতে ধর্ম, অর্থ ও কামশাস্ত্র—এই বৃহৎ ত্রিবর্গশাস্ত্রের উপদেষ্টা বলা হয়েছে।

চার বেদ জানলেই ব্রহ্মা হওয়া যায়। এমন ব্রহ্মা আদিসৃষ্টি থেকে বহুবার হয়ে আসছেন। ব্যাসের প্রপিতামহের পিতাও ব্রহ্মাই ছিলেন। এদের সকলের মধ্যে প্রথম বা আদিসৃষ্টির ব্রহ্মার উল্লেখ মুণ্ডকোপনিষদের প্রথম মন্ত্রে আছে। সেই উপনিষদেই তাঁর বংশপরম্পরা এইভাবে বলা হয়েছে—ব্রহ্মা, অথর্বা, অঙ্গিরঃ, ভারদ্বাজ সত্যবাহ, অঙ্গিরস্‌, শৌনক।

এই শৌনক, বৃহদ্দেবতা প্রভৃতি গ্রন্থের কর্তা, আশ্বলায়নের গুরু শৌনকের থেকেও অনেক পূর্ববর্তী হবেন। অতএব তিনি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাসেরও বহু পূর্ববর্তী। এই শৌনককে উপদেশ দিতে গিয়ে ভগবান অঙ্গিরস্‌ বলেন—ঋগ্বেদঃ, যজুর্বেদঃ, সামবেদঃ, অথর্ববেদঃ।

যখন এত প্রাচীন কালে চারটি বেদ বিদ্যমান ছিল, তখন এই কথা বলা যে প্রত্যেক দ্বাপরের শেষে কোনো ব্যাস এক বেদকে চার বেদে ভাগ করেন, অথবা মন্ত্রসমূহ একত্র করে চার বেদ রচনা করেন—এটি যুক্তিসঙ্গত নয়।

(ঙ) প্রাচীন ইতিহাস—পূর্বে প্রদত্ত প্রমাণগুলি ইতিহাসবহির্ভূত গ্রন্থসমূহ থেকে নেওয়া। এখন ইতিহাস এ বিষয়ে কী বলে তা দেখা প্রয়োজন। আমাদের ইতিহাস রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি গ্রন্থে পাওয়া যায়। এদের মধ্যেই আরও প্রাচীন কালের বহু উপাখ্যান সংরক্ষিত রয়েছে। আমাদের এই ইতিহাসগ্রন্থগুলিকে প্রমাণের মর্যাদা থেকে বিচ্যুত করার জন্য বহু পক্ষপাতদুষ্ট বিদেশি পণ্ডিত চেষ্টা করেছেন। কিছু ভারতীয় পণ্ডিতকেও তাঁদের অনুকরণ করতে দেখা যায়। স্বীকার করা যায় যে এই গ্রন্থগুলিতে কিছু প্রক্ষেপ হয়েছে, কিছু অংশ নষ্ট হয়েছে, কিছু অসংগতিও আছে, এবং কিছু আধুনিক সভ্যতার অনুকূল বলে মনে হয় না; কিন্তু এই সব কারণ দেখিয়ে সমগ্র ইতিহাসের উপর অবিশ্বাস করা কেবল একরকম জেদ মাত্র।

কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি গ্রন্থসমূহ সংকলন করেছিলেন। তিনিই মহাভারত রচনা করেন। তাঁরই পিতা, তাঁরই শিষ্য-প্রশিষ্যদের মধ্যে ব্রাহ্মণাদি, পিতামহ পরাশর, শক্তি প্রভৃতি ছিলেন।

১। পৃ. ১৬, বার্হস্পত্য সূত্র, ভগবদ্দত্তকৃত।

তিনি আর্যজ্ঞানের এক অতুলনীয় পণ্ডিত ছিলেন। তাঁকে কল্পিত বলা বিদেশি পণ্ডিতদেরই দুঃসাহস। এইরূপ দুরাগ্রহ জগতের ক্ষতি করে এবং সাধারণ মানুষকে ভ্রান্তিতে ফেলে।

আমরা পরবর্তী প্রমাণ মহাভারত থেকেই প্রদান করব। আমাদের দৃষ্টিতে এই গ্রন্থ বিশ্বের অন্যান্য ঐতিহাসিক গ্রন্থের মতোই প্রামাণিক। এই ইতিহাস ঋষিপ্রণীত। হ্যাঁ, এর কিছু সাম্প্রদায়িক অংশ নবীন।

(১) মহাভারতের শল্যপর্ব, অধ্যায় ৪১-এ কৃতযুগের একটি কাহিনি বর্ণনা করতে গিয়ে মুনি বৈশম্পায়ন মহারাজ জনমেজয়কে বলেন—

পুরা কৃতযুগে রাজন্নাষ্টিষেণো দ্বিজোত্তমঃ।
বসন্ গুরুকুলে নিত্যং নিত্যমধ্যয়নে রতঃ।।৩।।
তস্য রাজন্ গুরুকুলে বসতো নিত্যমেব চ।
সমাপ্তিং নাগমদ্ বিদ্যা নাপি বেদা বিশাম্পতে।।৪।।

অর্থাৎ—প্রাচীন কালে কৃতযুগে আষ্টিষেণ নামক এক শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ গুরুকুলে বাস করে সর্বদা অধ্যয়নে রত থাকতেন। কিন্তু হে রাজন্, তিনি বিদ্যারও সমাপ্তি করতে পারেননি, বেদগুলিরও নয়।

(২) দশরথনন্দন রামের রাজ্যের বর্ণনা করতে গিয়ে মহাভারতের দ্রোণপর্ব, অধ্যায় ৫১-এ লেখা হয়েছে—

চতুর্ভির্বেদৈঃ সুপ্রীতাঃ প্রাপ্নুবন্তি বিবৌকসঃ।
হব্যং কব্যং চ বিবিধং নিষ্পূর্তং হুতমেব চ।।২২।।

অর্থাৎ—রামের রাজ্যে চারটি বেদ অধ্যয়নকারী বিদ্বানরা তৃপ্ত ছিলেন।

(৩) আদিপর্ব ৭৬।১৩।।-এ যযাতি দেবযানীকে বলেন যে তিনি সম্পূর্ণ বেদ অধ্যয়ন করেছেন—

ব্রহ্মচর্যেণ কৃত্স্নো মে বেদঃ শ্রুতিপথং গতঃ।।

(৪) শান্তিপর্ব ৭৩।৫।। থেকে ভীষ্মজি উশনার প্রাচীন শ্লোক উদ্ধৃত করে শোনাচ্ছেন। উশনা বলেন—

রাজ্ঞশ্চাচর্যং বেদেন সর্বকর্মাণি কারয়েত্।।৭।।

অর্থাৎ—অথর্ববেদের দ্বারা রাজাকে পুরোহিত সমস্ত কর্ম সম্পাদন করাবে।

(৫) মহাভারতের বনপর্ব, অধ্যায় ২১-এ দ্রৌপদীকে উপদেশ দিতে গিয়ে মহারাজ যুধিষ্ঠির কাশ্যপ-গীত নামে একটি প্রাচীন গাথা শোনান—

অত্রাপ্যুদাহরন্তীমা গাথা নিত্যং ক্ষমাবতাম্।
গীতাঃ ক্ষমাবর্তা কৃষ্ণে কাশ্যপেন মহাত্মনা।।৩৮।।
ক্ষমা শ্রুতম্। ক্ষমন্তুমर्हতি।।৩৬।।
ক্ষমা ধর্মঃ ক্ষমা যজ্ঞঃ ক্ষমা বেদাঃ যস্তামেব বিজানাতি স সর্ব…

অর্থাৎ—এটি মহাত্মা কাশ্যপের গীত গাথা, যেখানে বলা হয়েছে—ক্ষমাই বেদ।

মহাভারতের আদিপর্বে শকুন্তল উপাখ্যান প্রসিদ্ধ। সেখানে সুরম্য আশ্রমে প্রবেশের সময়কার দৃশ্য ভগবান বর্ণনা করেছেন। রাজর্ষি দুষ্যন্তের সেই দৃশ্য কাশ্যপ কণ্বের আশ্রমে দ্বৈপায়ন অতি সুন্দরভাবে চিত্রিত করেছেন। অধ্যায় ৬৪-এ বলা হয়েছে—

ঋচো যজুঃ চ মুখ্যৈশ্চ প্রর্যমাণাঃ পদক্রমৈঃ।
শুশ্রাব মনুজব্যাঘ্রো বিততেষ্বিহ কর্মসু।।৩১।।
অথর্বাণং চ প্রবরাḥ পূয়যাজ্ঞিকসংমতাঃ।
সংহিতামীরয়ন্তি স্ম পদক্রমযুতাং তু তে।।৩৩।।

অর্থাৎ—সেখানে প্রধান ঋক্‌ ও যজুঃ মন্ত্র পদক্রমে পাঠ করা হচ্ছিল, যা মনুষ্যব্যাঘ্র দুষ্যন্ত শুনলেন। তদ্রূপ অথর্ববেদের শ্রেষ্ঠ ঋত্বিজগণ যজ্ঞোপযোগী বলে সম্মত সংহিতা পদক্রমসহ উচ্চারণ করছিলেন।ঋগ্বেদীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা পদ ও ক্রমপাঠ অনুসারে ঋচা পাঠ করছিলেন, এবং অথর্ববেদে পারদর্শী বিদ্বানগণ পদ ও ক্রমযুক্ত সংহিতা পাঠ করছিলেন।

এটি কী স্পষ্ট প্রমাণ! এতে পরিষ্কারভাবে লেখা আছে যে ব্যাসজীর সহস্র সহস্র বছর পূর্বে মহারাজ দুষ্যন্তের কালে পর্যন্তও অথর্ববেদের সংহিতা পদ ও ক্রমসহ পাঠ করা হতো। এটি সেই সময়ের বর্ণনা, যখন বেদের স্বতন্ত্র শাখাসমূহ এখনো গঠিত হয়নি, কিন্তু মন্ত্রের ব্যাখ্যারূপ পাঠান্তর আর্যাবর্তের বহু গুরুগৃহে প্রসিদ্ধ ছিল, এবং ব্রাহ্মণাদি গ্রন্থের বিষয়বস্তুও বহু আচার্য-পরম্পরায় একত্রিত হয়ে গিয়েছিল।

এই বেদগুলিরই পাঠান্তর ও ব্যাখ্যার ফলে পরে বহু শাখার সৃষ্টি হয়। তখন এই বেদগুলি কোনো নির্দিষ্ট প্রবক্তা ঋষির নামে প্রসিদ্ধ ছিল না। এই বেদই সনাতন কাল থেকে চলে এসেছে। ব্যাসজী বহু ঋষি-মুনির সহায়তায় সেই পাঠান্তরগুলিকে একত্র করে বেদশাখা নির্মাণ করেন, এবং ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলির বিষয়বস্তুকেও ক্রমানুসারে সংশ্লিষ্ট শাখার উপযোগী করে সংকলন করেন। কিছু আচার্য ব্রাহ্মণাদিকেও বেদ বলতেন, তাই তারা বলতে শুরু করেন যে ব্যাসজীই বেদের বিভাগ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে বেদব্যাসজী ব্রাহ্মণাদি গ্রন্থেরই বিভাগ করেছিলেন। বেদ তো চিরকাল থেকেই চলে এসেছে। বাস্তবে পুরাণসমূহেও এর বিপরীত কিছু বলা হয়নি। সেখানেও এটিই লেখা আছে যে বেদ আদিকাল থেকেই চতুষ্পাদ ছিল, অর্থাৎ এক বেদের চারটি সংহিতাই ছিল।

*

১. পূনা সংস্করণ, আরণ্যকপর্ব, ৩০।৩৫-৩৬।

২. পুণে সংস্করণে এই পাঠটি নেই।

তথ্যঃ

1 (a) In other words, there was no one author of the great Epic, though with a not uncommon confusion of editor with author, an author was recognized, called Vyāsa. Modern scholarship calls him, The Unknown Vyāsa, for convenience. p. 58, The Great Epic of India, W. Hopkins.

(b) But this Vyāsa is a very shadowy person. In fact his name probably covers a guild of rivisors and retellers of the tale. W. Hopkins, p. 69, India Old and New.

(c) Badarāyaņa is very loosely identified with the legendry person named Vyāsa. Monier Williams, p. 111, footnote 2.

(d) Tradition invented as the name of its author the designation Vyāsa, (arranger). A. A. Macdonell, p. 88, India's Past.

(e) To Ramanuja the legendry Vyasa was the seer. India's Past, A. A. Macdonell, p. 149.

(f) Vyāsa Pārāśarya is the name of a mythical sage. p. 339, Vedic India, A. A.

Macdonell and A. B. Keith, এই বিষয় নিয়ে ইউরোপীয় লেখকদের অতিরিক্ত প্রলাপ আমাদের ‘ভারতবর্ষের বৃহৎ ইতিহাস’ প্রথম ভাগ, পৃষ্ঠা ২৮৪-এ দেখা যেতে পারে।

প্রাচীন বৈদিক আচার্য

প্রজাপতি ব্রহ্মা – সর্বদিকমুখী প্রজাপতি ব্রহ্মা প্রাচীন বৈদিক আচার্য ছিলেন। সমগ্র বৈদিক সাহিত্য এবং সংস্কৃত গ্রন্থসমূহে সমস্ত বিদ্যার প্রবর্তক—ব্রহ্মাই ছিলেন। ব্রহ্মা আগ্নি, বায়ু এবং অন্যান্য প্রাচীন ঋষিদের থেকে চারটি বেদের জ্ঞান প্রাপ্ত হন। সেই ভিত্তিতেই তিনি লোককল্যাণমুখী সমস্ত বিদ্যার প্রবর্তন করেন। এ কারণে ভারতীয় সাহিত্যসভায় তিনি আদি বৈদিক আচার্য হিসেবে পরিচিত। বেদের অর্থ ও শাস্ত্রের ধারাবাহিকতা ক্রমবর্ধমানভাবে বিকাশিত হয়েছে।

আপান্তরতমা = প্রাচীনগর্ভ

(ক) আচার্য শঙ্কর তাঁর বেদান্তসূত্রভাষ্যে লিখেছেন—
তথা হি-আপান্তরতমা নাম বেদাচার্যঃ পুরারণাশঃ বিষ্ণুনিয়োগাত্ কলিদ্বাপরযোঃ সংঘৌ কৃষ্ণ-দ্বৈপায়নঃ संबভূভুতি স্মরন্তি।

অর্থাৎ, আপান্তরতমা নামে বেদাচার্য এবং প্রাচীন ঋষি ছিলেন, যিনি কলি-দ্বাপর যুগের সংধিতে বিষ্ণুর আদেশে কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন রূপে জন্মগ্রহণ করেন।

(খ) এই প্রসঙ্গে অহির্বুধন্যসংহিতা উল্লেখ করে—
অথ কালবিপর্যায়সাদ যুগমেদসমুদ্র্ভবে ॥৫০॥
ত্রেতাদাউ সত্ত্বসংকোচাব্রজসি প্রবিজুম্ভতে।
আপান্তরতমা নাম মুনির্বাক সম্ভব হরেঃ ॥৫৩॥
কপিলশ্চ পুরাবিরাদিবেভসমুদ্র্ভবঃ।
হিরণ্যগর্ভো লোকাদিরহং পশুপতিঃ শিবঃ ॥৫৪॥
উদভূত্তত্র ধীরূপমৃগ্যজুঃ সামসংকুলम् ॥৫৮॥
বিষ্ণুসংকল্পসংভূতমেতদ্ বাচ্যায়নেরিতম্।

অর্থাৎ, বাচের পুত্র বাচ্যায়ন, যার অপর নাম আপান্তরতমা। (কালক্রমের বিপর্যয়ের কারণে) ত্রেতা যুগের প্রারম্ভে বিষ্ণুর আদেশে আপান্তরতমা, কপিল ও হিরণ্যগর্ভ প্রাচীন আচার্যরা যথাক্রমে ঋগ্বেদ, সামবেদ, সাংখ্য শাস্ত্র ও যোগ ইত্যাদির বিভাগ করেন। অহির্বুধন্যসংহিতা শঙ্করের চেয়ে অনেক প্রাচীন।

(গ) আরও অনেক আগেই মহাভারতে বৈশাম্পায়ন রাজা জনমেজয়কে বলা হয়েছে—
আপান্তরতমা নাম সুতো বক্সম্ভবো বিভোহঃ।
ভূতভব্যভবিষ্যশঃ সত্যবাদি বৃদ্ধব্রতঃ ॥৩৮॥

উল্লেখিত সূত্রসমূহ:
১. ৩।৩।৩২।। পৃঃ ৩৩৫, ব্রহ্মসূত্র শঙ্করভাষ্য, মতি লাল বনারসি দাস, ১৬৬৪
২. অধ্যায় ১১, পৃঃ ১০০, ১০১, সম্পাদক রামানুজাচার্য, অদধার ১৬৬৬
৩. অধ্যায় ৩৩৭, মহাভারত, ভঃ ওঃ রিঃ ঈঃ, পুনে

তমুভাচ নতং মূর্জা দেবানামাদিরঅব্যয়ঃ। 

বেদাণ্যানে শ্রুতিঃ কার্যাঃ ত্বয়ঃ মতিমতাং বরঃ॥৪০॥ 

তস্মাত্ করু যথাজ্ঞপ্তং মর্যতদ্বচনং মুনে। 

তেন বিভ্নাস্তদা বেদা মনঃ স্বায়ম্ভুভে'ন্তরে॥৪১॥ 

শ্রপান্তরতমাশ্চৈব বেদাচার্যঃ স উচ্যতে। 

প্রাচীনগর্ভ তমৃষি প্রবদন্তীহ কেচন॥৬১॥

এই শ্লোকগুলি এবং মহাভারতের এই অধ্যায়ের অন্যান্য শ্লোকগুলির অর্থ একই— আপান্তরতামা ঋষি বেদাচার্য অথবা প্রাচীনগর্ভ নামে পরিচিত। তিনি একবার প্রাচীনকালে বেদগুলির শাখা-বিভাগ করেছেন।

আপান্তরতামার একটি নিজস্ব সিধান্তগ্রন্থও ছিল। যোগিয়াজ্ঞল্ক্য গ্রন্থে তাঁর উল্লেখ পাওয়া যায়।

মহাভারতে বর্ণিত বেদাচার্য:
শান্তি পর্বে সাতটি প্রধান বেদাচার্যের নাম স্মরণ করা হয়েছে—
মরিচি, অঙ্গিরি, রাশ্চাত্রি, পুলস্ত্য, পুলহ, ঋতু, বশিষ্ঠ।
এরা সাতজন প্রধান বেদবিদ্যাজ্ঞানী বেদাচার্য হিসেবে বিবেচিত। এদের কার্যকলাপ ও ধর্মকর্ম প্রজাপতি দ্বারা নির্ধারিত হয়।

অনুশাসন পর্বেও এ বেদাচার্যদের স্মরণ করা হয়েছে—
পিতামহঃ পুলস্ত্যশ্চ বশিষ্ঠঃ পুলহস্তথা। অঙ্গিরাশ্চ ক্রতুঃচৈব কশ্যপশ্চ মহান্বিঃ।
এরা কুরু কুলের শ্রেষ্ঠ মহাযোগেশ্বর হিসেবে স্মৃত। এবং পিতৃদের মতই এদেরও শ্রাদ্ধবিধি পালন করা হয়।

সূত্রসমূহ:
১. যাজ্ঞবাল্ক্য স্মৃতি, অপরার্ক টীকা; ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ, পদ ২, অধ্যায় ৩৫, শ্লোক ১২৪–১২৬, ভেঙ্কটেশ্বর প্রেস, ১৬৬২, বম্বে। এখানে ৩২ জন ব্যাসের নাম উল্লেখ রয়েছে এবং শেষে বলা হয়েছে, এরা ৩৮ জন ব্যাস হয়ে গেছেন।
২. মহাভারত, অধ্যায় ৩২৭, ভা. ও. ২ি. ৩০, পুনা।
৩. মহাভারত, অধ্যায় ৬২, শ্লোক ২০–২১।

পুনরায় একই পর্বে লেখা হয়েছে—

অথ সপ্তমহাভাগা ঋষয় লোকবিশ্রুতাঃ।
বশিষ্ঠপ্রमुखাঃ সর্বে ব্রমাণং পদ্মসম্ভবম্। প্রদক্ষিণমভিক্রম্য সর্বে প্রাঞ্জলয়ঃ স্থিতা। উবাচ বচনং তেষাং বশিষ্ঠো ব্রমভিত্তমঃ॥

এখানে বর্ণিত হয়েছে— মহাভারতের শান্তি পর্বে আরেক স্থানে দশজন প্রধান বেদাচার্যের নাম উল্লেখ আছে—

ভূগুমরিচিরাত্রিশ্চ হ্যঙ্গিরাঃ পুলহঃ ক্রতুঃ। মনুর্বক্ষো বশিষ্ঠশ্চ পুলস্ত্যশ্চেতি তে দশঃ॥৬৬॥
ব্রাহ্মণো মানসা হা তে উদ্ভূতাঃ স্বয়মীশ্বরাঃ। পরত্বেনষংয়ো যসমাত্-স্মৃতাস্তস্মান্ মহর্ষয়ঃ॥১৭॥

অর্থাৎ— ভুগু, মরিচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলহঃ, ঋতু, মনু, দক্ষ, বশিষ্ঠ, পুলস্ত্য এই দশজন প্রধান ঋষি। এরা নিজেই ঈশ্বর এবং ব্রহ্মার মানসপুত্র।

বেদব্যাস-সাহিত্য অনুযায়ী— ব্যাসের চিহ্ন হলো “বেদান্ বিন্যাস যসমাত্স বেদব্যাস ইতি স্মৃতঃ।” এই অনুযায়ী, ২৮ ঋষি বিভিন্ন সময়ে শাখা ও বেদপ্রবচনের কাজ করেছেন। এদের মধ্যে বাল্মীকি প্রভৃতি কয়েকজন ব্যাস দ্বারা শাখা-নিয়ম বিশেষ শাখায় সংরক্ষিত।

মহাভারত শান্তি পর্বে লেখা আছে—
বেদার্থবেত্তুভ্র্যাসস্য। অর্থাৎ বেদার্থবেত্তা ব্যাস।

মহাভারত এবং বেদপ্রবচনের মধ্যে— শান্তি পর্বে ভীষ্ম, ব্যাস এবং শুক্রের সংলাপ উল্লেখ আছে। সেখানে শ্লোকটি হলো—

ত্রেতায় সংহতা বেদা যজ্ঞা বর্ণাস্তথৈব চ।
সংরোধাদায়ুষস্ত্বেতে ব্যস্যন্তে দ্বাপরে যুগে॥৬৫॥

অর্থাৎ— ত্রেতায় বেদসমূহ সংহত বা পৃথকভাবে একত্রিত হয়েছিল; যজ্ঞ ও বর্ণও তেমনই। দ্বাপরে আয়ু সংরোধের হ্রাসের কারণে শাখা আকারে প্রচারিত হয়েছে।

পুরাণে উল্লেখিত ২৮ বেদাচার্য—
অট্ঠাইস ব্যাস পুরাণে ভৈবস্বত মনু থেকে শুরু করে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন পর্যন্ত প্রতি দ্বাপরের জন্য ২৮ ব্যাসকে গণনা করা হয়েছে। ভৈবস্বত মনু ত্রেতা যুগের শুরুতে ছিলেন এবং বেদ-প্রবচন দ্বাপরে সম্পন্ন হয়েছে। ধরা হয়েছে...

সূত্রসমূহ—
১. অনুশাসন পর্ব পরিশিষ্ট ১, সংখ্যা ১৪, শ্লোক ২৫৬–২৬০, মহাভারত।
২. ১২২।৪৪।। তুলনা করুন শান্তি পর্ব ২০৭।৩–৫০ এবং ৩৪৬। ৬৭–৬৮।
৩. ৩৩৭।৬।। মহাভারত।
৪. অধ্যায় ২২৪, মহাভারত, ভা. ও. রি. ই., পুনা।
৫. বায়ুপুরাণ অংক ২৩, শ্লোক ১১৪-এর পর।

অতএব, ত্রেতা যুগীয় বৈবস্বত মনু থেকে বেদ-প্রবচন কিভাবে আরম্ভ হয়েছিল, তা পরস্পর বিরোধী মনে হয়। পুরাণের এই প্রসঙ্গে “দ্বিতীয়েদ্বাপরে, তৃতীয়দ্বাপরে” ইত্যাদি বলে “পরিবতেঃ পুনঃ ষষ্ঠ” এবং “পর্যায়শ্চ চতুর্বশ” ইত্যাদির মাধ্যমে গণনা করা হয়েছে। এর থেকে বোঝা যায়, বেদ-প্রবচন বিষয়ক গণনার উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। সুতরাং, ত্রেতার শুরু থেকে দ্বাপরের শেষ পর্যন্ত ২৮ বার বেদ-প্রবচন ধরা হয়েছে।

যদি ধরা হয় যে এখানে প্রতিটি চতুর্যুগের দ্বাপর গোনা হয়েছে, তা সঠিক নয়।

কারণ—
১. বৈবস্বত মনু প্রথম চতুর্যুগের দ্বাপরে ছিলেন না, তিনি ত্রেতার শুরুতে ছিলেন।
২. ঋক্ষ অর্থাৎ ভাল্মীকি ২৪তম পরিবতের ব্যাস ধরা হয়েছে। তিনি দাশরথী রামের সমকালিক। রাম থেকে ভারতযুদ্ধ পর্যন্ত কেবল ৩৫ প্রজন্ম গণ্য করা যায়, অধিক নয়। এগুলো প্রধান প্রজন্ম নয়, সম্পূর্ণ প্রজন্ম। অতএব ঋক্ষকে ২৪তম চতুর্যুগ ধরা ইতিহাসের বিপরীতে।
৩. ২৬তম পরিবতের ব্যাস পারাশর এবং ২৭তম পরিবতের ধ্যস জাতুকর্ণ্য যথাক্রমে কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের পিতা ও চাচা ছিলেন। এরা পূর্ব চতুর্যুগের নয়।

এই ২৮ বেদ-প্রবচনে আপান্তরতামার নাম কোথাও দেখা যায় না। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, তিনি বৈবস্বত মনুর পূর্বে স্বয়ম্ভুব-অন্তরে বেদ-প্রবচন করেছেন।

বিশিষ্ট ব্যাস

বেদ-প্রবচনকারীদের মধ্যে নিম্নলিখিত ব্যাসদের বিশেষ উল্লেখ আছে। তাদের দ্বারা প্রচারিত অনেক শাখা ক্রমানুসারে কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের বেদ-প্রবচনের গণনায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

১. ভার্গব উষ্ণ কাব্য— তৃতীয় দ্বাপরের বেদ-প্রবচক উষ্ণ কাব্য ছিলেন। অসুরাচার্য উষ্ণ কবি ভূগুর সন্তান হওয়ায় তিনি ভার্গব ছিলেন। আথর্ববেদকে ভূগু-অঙ্গিরোবেদও বলা হয়। অনেক আথর্বণ সুক্ত উষ্ণ দ্বারা প্রদর্শিত। উষ্ণ মহান ভিষক ছিলেন। আথর্বসংহিতায় এক মন্ত্রে “ভিষক্” শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। মন্ত্রায়ণী সংহিতায় একই স্থানে “কবি” শব্দ পাঠিত হয়েছে। এই অনুযায়ী উষ্ণও কবি ছিলেন। প্রাচীন প্রয়োগ অনুযায়ী আজও বৈদ্য বা ভিষক কবিরাজ বলা হয়।

২. সারস্বত— নবম পরিবতের ব্যাস। তাঁর চার শিষ্য: পারাশর, গার্গ্য, ভার্গব এবং অঙ্গিরা। অন্যান্য ব্যাসদেরও চারজন শিষ্য বা সন্তান গোনা হয়েছে। শিষ্যকে সন্তান বলা হয়েছে। যেমন শীশু সারস্বত অঙ্গিরা বৃদ্ধ ঋষিদের সন্তান বলেছেন।

সারস্বতের বেদ-প্রবচন নিম্নলিখিতভাবে প্রমাণিত—
(ক) সংস্কাররত্নমালাতে কৃষ্ণ যজুর সম্পর্কিত সারস্বত পাঠের বর্ণনা।
(খ) অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিত ও সৌন্দরনন্দ কাব্যে বেদ-প্রবচনের উল্লেখ।
(গ) তাণ্ডধ ব্রাহ্মণে নিম্নলিখিত পাঠ—
শিশুর্বা শ্রাঙ্গিরসো মন্ত্রকৃতাং মন্ত্রকৃতাসীত্। ১৩।৩।২৪।।
অর্থাৎ অঙ্গিরা গোত্রোৎপন্ন শীশু সারস্বত কবি চরণ-প্রবচনকারীদের মধ্যে অত্যন্ত শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা ছিলেন। এখানে “মন্ত্রকৃত্” অর্থ মন্ত্র রচয়িতা নয়, বরং মন্ত্রপ্রবচনকারী। বিশেষ আলোচনা ‘ঋগ্বেদে ব্যাখ্যান’ অংশে পাওয়া যাবে।

সারস্বত পাঠ— সারস্বত দ্বারা প্রবর্তিত বেদপাঠ তৈত্তিরীয় সংহিতা ইত্যাদিতে যথেষ্টভাবে সংরক্ষিত।

শৈশব সাম— শীশু সারস্বত দ্বারা প্রদর্শিত শৈশব সাম প্রসিদ্ধ। উপরোক্ত তাণ্ড্য বচনও শৈশব সামের প্রশংসায় লেখা।

৩. ভারদ্বাজ – ভারদ্বাজ ছিলেন ষোড়শ পরিবতের ব্যাস। তাঁর সন্তান ছিলেন হিরণ্যনাভ, কৌশল্য, কুচুমি ইত্যাদি। এই বারহস্পত্য ভারদ্বাজই আয়ুর্বেদ ও বহু শাস্ত্রের প্রবক্তা ছিলেন। এজন্য ঐতরেয় আরণ্যকে মাহীদাস লিখেছেন, তিনি ঋষীদের মধ্যে অত্যন্ত নত এবং দীর্ঘজীবী ছিলেন। যেমন—

भरद्वाजो ह वा ऋवीरणामनूचानतमो दीर्घजीवितमस्तपस्वितम आस। ১।२।२॥

“অনূচান” হওয়ার লক্ষণ ছিল—

वेदवेदाङ्गतत्त्वज्ञः शुद्धात्मा पापजितः। दशेषं श्रोत्रियवत् प्राप्तः सोऽनूचान इति स्मृतः॥२

ভারদ্বাজ শিক্ষা ভারদ্বাজ শ্রোত্রিয় ও গৃহ্য সংক্রান্ত সম্ভবত তাঁরই প্রবর্তিত চরণ।

৪. ঋক্ষ অর্থাৎ ভাল্মীকি – তিনি চব্বিশতম পরিবতের ব্যাস ছিলেন। তাঁর সন্তান ছিলেন শালিহোত্র, অগ্নিবেশ্য, যুবনাশ্ব এবং শরদ্বসু। এই দীর্ঘজীবী অগ্নিবেশ্য দ্রোণের গুরু ছিলেন এবং পূর্বে পুনর্বসু আত্রেয়ের আয়ুর্বেদোপদেশকে তন্ত্রবদ্ধ করেছিলেন। ভাল্মীকি-এর বেদ-প্রবচন, তাঁর চরণের সংধি এবং উচ্চারণ সংক্রান্ত তিনটি নিয়ম তৈত্তিরী প্রাতিশাখ্য-তে বর্ণিত আছে। বেদ-প্রবচনের কারণে ভাল্মীকি ঋষি হিসেবে স্বীকৃত হন। তাই তাঁর কাব্যময় ইতিহাস রামায়ণ-এ বহু স্থানে আর্ষ কাব্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রমাণসমূহ—
(ক) সারস্বতশ্চাপি জগাদ নষ্টং ওয়েভং পুনয়ং … (বুদ্ধচরিত, লাহোর, ১৬৩৬)
(খ) সারস্বতো যত্র সুতোऽস্য জজ্ঞে নষ্টস্য বেদস্য পুনঃ প্রবক্তা … (সৌন্দরনন্দ, লাহোর, ১৬২৮)

অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সূত্র—

  • পৃষ্ঠা ২৮৪ ও ৪৪২, যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি, অপরার্ক টীকা, আনন্দাশ্রম, পুনা, ১৬০৩।

  • ৫।৩৬।০; ১১৪; ১৮/৬॥, মাদ্রাস, ১৬৩০।

  • ৪।৪০।।; ৫।৪।।, বালকাণ্ড, পশ্চিমোত্তর শাখা, লাহোর, ১৬৩১।

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

ব্রাহ্মণ গ্রন্থ কী

বৈদিক বাঙ্গময়ের ইতিহাস – প্রথম অধ্যায়:  ১. গ্রন্থবাচী ব্রাহ্মণ শব্দ ও এর অর্থ বৈদিক এবং সংস্কৃত সাহিত্যের গ্রন্থকার, ভাষ্যকার, বাতিককার ও ট...

Post Top Ad

ধন্যবাদ