বেদের ঋষি - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

29 December, 2025

বেদের ঋষি

বেদের ঋষি
বৈদিক শাখাগুলির বিবরণ ইতিমধ্যেই দেওয়া হয়েছে। শাখা-প্রবচন কালের বিষয়টিও নির্ণীত হয়েছে। এখন প্রশ্ন ওঠে— বেদের কাল কীভাবে নির্ধারণ করা যায়। বেদের কাল জানার জন্য পাশ্চাত্য লেখকেরা নানা ধরনের কল্পনা করেছেন। সেগুলি সবই ভিত্তিহীন কল্পনা। সেগুলির দ্বারা কোনো বাস্তব তথ্য জানা যায় না; তবে সাধারণ মানুষ সেগুলি পড়ে বিভ্রান্ত হতে পারে।

ঋষি-ইতিহাসের প্রয়োজন
বেদের কাল নির্ণয়ের জন্য বেদের ঋষিদের ইতিহাস জানা অত্যন্ত সহায়ক। আমরা জানি যে বেদমন্ত্রগুলির সঙ্গে যেসব ঋষির নাম লিখিত আছে, অথবা মন্ত্রসম্বন্ধে অনুক্রমণীতে যেসব ঋষির নাম দেওয়া হয়েছে, তারা সকলেই সেই মন্ত্রগুলির আদিদ্রষ্টা নন। বহু মন্ত্র তাদের অনেক আগেই বিদ্যমান ছিল। তথাপি সেই ঋষিদের ইতিবৃত্ত জানলে অন্তত এতটুকু বলা যায় যে অমুক অমুক মন্ত্র শাখা-প্রবচন কালের এতটা আগে অবশ্যই বিদ্যমান ছিল। সেই মন্ত্রগুলি ওই কালের পরবর্তী হতে পারে না।

পুরাণসমূহে ঐসব ঋষিদের বিষয়ে ভালো তথ্য সংরক্ষিত আছে। বায়ুপুরাণ ৫৬.৫৬, ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ ২.৩২.৬২ এবং মৎস্যপুরাণ ১৪৫.৫৮— এই তিনটি পুরাণে এই বিবরণ আরম্ভ হয়েছে। এই তিন পুরাণের পাঠ বর্তমানে অত্যন্ত অশুদ্ধ হয়ে গেছে; তথাপি নীচে দেওয়া শ্লোকগুলি কিছুটা সংশোধন করে লেখা হচ্ছে। এগুলির সংশোধনে আমরা সম্পূর্ণ সফল না হলেও আংশিক সাফল্য অবশ্যই পেয়েছি। শ্লোকগুলির সংখ্যা ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ অনুসারে দেওয়া হয়েছে—

ঋষীণাং তপ্যতামুদ্র
তপঃ পরমবুষ্করम् ॥৬৭॥

মন্ত্রাঃ প্রাদুর্বভূবুর্বাহ পূর্বমন্বন্তরেষ্বিহ ।

অসন্তোষাদ্ ময়াদ্ দুঃখাত্
সুলাত্ শোকাচ্চ পঞ্চধা ॥৬৮॥

ঋষীণাং তপঃ কাত্স্যেন
দর্শনেন যদৃচ্ছয়া ।

এই শ্লোকগুলির যথার্থ অভিপ্রায় এই যে— তপস্যা প্রভৃতি আটটি প্রভাবের দ্বারা ঋষিদের নিকট মন্ত্রগুলির সাক্ষাৎকার হয়েছিল। সেই তপ নানা কারণবশত করা হয়েছিল। এই ভাবই নিরুক্ত এবং তৈত্তিরীয় আরণ্যক (?) গ্রন্থেও পাওয়া যায়।

পাঁচ প্রকারের ঋষি
যেসব ঋষিদের নিকট মন্ত্র প্রাদুর্ভূত হয়েছিল, তারা পাঁচ প্রকারের। তাদের বলা হয়— মহর্ষি, ঋষি, ঋষীক, ঋষিপুত্রক এবং শ্রুষি। চরকতন্ত্র সূত্রস্থান ১.৭-এর ভাষ্যে ভট্টার হরিচন্দ্র চার প্রকার মুনির কথা বলেছেন—
মুনিনাং চতুর্বিধো ভেদঃ— ঋষয়ঃ, ঋষিকাঃ, ঋষিপুত্রাঃ, মহর্ষয়শ্চ।

১. মৎস্য-মোহাচ্

হরিচন্দ্র শ্রুতঋষিদের গণনা করেন না। এই পাঁচ প্রকার ঋষির মধ্যে বর্তমানে পুরাণসমূহে কেবল তিন প্রকার ঋষিরই বিবরণ অবশিষ্ট আছে। বাকি দুই প্রকার ঋষি-সম্পর্কিত পাঠ নষ্ট হয়ে গেছে। এই ঋষিদের বিষয়ে পুরাণস্থিত পাঠ নিচে দেওয়া হল—

অতীতানাগতানাং চ পঞ্চধা হ্যার্ষকং স্মৃতম্ ।
অতস্ত্বৃষীণাং বক্ষ্যামি তত্র হ্যার্ষসমুদ্ভবম্ ॥৭০॥

ইত্যেতা ঋষিজাতীস্তা নামভিঃ পঞ্চ বৈ শৃণু ॥১৫॥

অর্থাৎ— এখন পাঁচ প্রকার ঋষির বিবরণ করা হচ্ছে।

১. মহর্ষি ঈশ্বর
ভৃগুর্মরীচিরত্রিশ্চ হ্যঙ্গিরাঃ পুলহঃ ক্রতুঃ ।
মনুর্বক্ষো বসিষ্ঠশ্চ পুলস্ত্যশ্চৈতি তে দশ ॥৬৬॥

ব্রহ্মণো মানসা হ্যেতে উদ্ভূতাঃ স্বয়মীশ্বরাঃ ।
পরত্বেনর্ষয়ো যস্মাত্ স্মৃতাস্তস্মান্মহর্ষয়ঃ ॥৬৭॥

ঋষিকোটিতে প্রথম এই দশজন মহর্ষি। তুলনা করুন— শান্তিপর্ব ২০৭.৩–৫ এবং ৩৪৬.৬৭–৬৮। তাঁরা স্বয়ং ঈশ্বর এবং ব্রহ্মার মানসপুত্র।

২. ঋষি
এই দশ ভৃগু প্রভৃতি মহর্ষিদের পুত্রদের বিবরণ পরবর্তীতে দেওয়া হয়েছে। তাঁদের ঋষি বলা হয়—

ঈশ্বরাণাং সুতা হ্যেতে ঋষয়স্তান্নিবোধত ।
কাব্যো বৃহস্পতিশ্চৈব কশ্যপশ্চ্যবনস্তথা ॥৬৮॥

উতথ্যো বামদেবশ্চ অগস্ত্যশ্চৌশিজস্তথা ।
কর্দমো বিশ্রবাঃ শক্তির্বালখিল্যাস্তথার্বতঃ ॥৬৯॥

ইত্যেতে ঋষয়ঃ প্রোক্তাস্তপসা চষিতাং গতাঃ ।

অর্থাৎ— উশনা কাব্য, বৃহস্পতি, কশ্যপ, চ্যবন, উতথ্য, বামদেব, অগস্ত্য, উশিক্, কর্দম, বিশ্রবা, শক্তি, বালখিল্য ও অর্বত— এঁরা ব্রহ্মর্ষিদের পুত্র ঋষি, যাঁরা তপস্যার দ্বারা এই পদ লাভ করেছেন।

৩. ঋষিপুত্র (ঋষীক)
ঋষিপুত্রানৃষীকাংস্তু গর্ভোত্পন্নান্নিবোধত ॥১০০॥

বৎসরো নগ্নহূশ্চৈব ভরদ্বাজস্তথৈব চ ।
ঋষিদীর্ঘতমাশ্চৈব বৃহদ্যুক্তঃ শরদ্বতঃ ॥১০১॥

বাজশ্রবাঃ সুবিত্তশ্চ বশ্যাশ্বশ্চ পরাশরঃ ।
দধীচঃ শংশপাশ্চৈব রাজা বৈশ্রবণস্তথা ॥১০২॥

ইত্যেতে ঋষিকাঃ প্রোক্তাস্তে সত্যাবৃষিতাং গতাঃ ।

ঋষিপুত্র ও ঋষীক সমার্থক। (তুলনা করুন— শান্তিপর্ব ১২.৪৮)। ‘শরদ্বত’ পাঠটি বিচার্য। শংশপের পুত্র শাংশপায়ন পুরাণপ্রবক্তা ছিলেন।

উনিশটি ভৃগুপুরাণে ভৃগুকুলের উনিশজন মন্ত্রকর্তা ঋষির উল্লেখ আছে। তাঁদের নাম নিম্নলিখিত শ্লোকগুলিতে দেওয়া হয়েছে—

এতে মন্ত্রকৃতঃ সর্বে কৃত্স্নশস্তান্নিবোধত ।
ভৃগুঃ কাব্যঃ প্রচেতাশ্চ দধীচো হ্যাপন্বানপি ॥১০৪॥

ঔর্বোऽথ জমদগ্নিশ্চ বিদঃ সারস্বতস্তথা ।
আষ্টিষেণশ্চ্যবনশ্চ বীতহব্যঃ সুমেধসঃ ॥১০৫॥

বৈন্যঃ পৃথুদিবোদাসো বাঘ্রঘশ্বো গৃত্সশৌণকঃ ।
একোনবিংশতিহ্যতে ভৃগবো মন্ত্রবাদিনঃ ॥১০৬॥

১. বায়ু— অয়োজ্যশ্চৌশি। ব্রহ্মাণ্ড— অপাস্যশ্চোশি। মৎস্য— অগস্ত্যঃ কৌশিকস্তথা।
২. বায়ু— প্রোক্তা জ্ঞানয়ো ঋষিতাম্।
৩. শ্যা বা শ্বশ্চ ?

১. ভৃগু ২. কাব্য (উশনা–শুক্র) ৩. প্রচেতা ৪. দধ্যঙ্‌ (আথর্বণ) ৫. আপন্বান্ ৬. ঔর্ব (ঋচীক) ৭. জমদগ্নি ৮. বিদ ৯. সারস্বত ১০. আষ্টিষেণ ১১. চ্যবন ১২. বীতহব্য ১৩. সুমেধাঃ ১৪. বৈন্য পৃথু ১৫. দিবোদাস ১৬. বাঘ্রযশ্ব ১৭. গৃত্স (মদ) ১৮. শৌণক।

এগুলি আঠারোজন ঋষির নাম। পুরাণসমূহে মোট সংখ্যা উনিশ বলা হয়েছে এবং সেখানে বৈন্য ও পৃথুকে দুই ব্যক্তি হিসেবে গণনা করা হয়েছে। বৈদিক সাহিত্যে বৈন্য পৃথু একই ব্যক্তি, অতএব আমরা এটিকে একটিমাত্র নাম হিসেবে গ্রহণ করেছি। এইভাবে উনিশতম নামটি অন্য কোথাও অনুসন্ধান করতে হবে। এদের মধ্যে বহু ঋষিকেই ভৃগু বলা হয়েছে। তাঁদের মূল ভৃগু থেকে সর্বদা পৃথক্‌ করে জানা উচিত। এই কুলের শ্রেষ্ঠ বৃত্তান্ত মহাভারতের আদিপর্ব ৬০.৪০ থেকে আরম্ভ হয়েছে। সেই অনুসারে ভৃগুর পুত্র ছিলেন কবি। কবির পুত্র ছিলেন শুক্র, যিনি যোগাচার্য ও দৈত্যদের গুরু ছিলেন। ভৃগুর আর এক পুত্র ছিলেন চ্যবন। এই চ্যবনের পুত্র ছিলেন ঔর্ব। ঔর্বের পুত্র ছিলেন ঋচীক এবং ঋচীকের পুত্র ছিলেন জমদগ্নি। মহাভারতে এরপর অন্যান্য বংশের বিবরণ চলতে থাকে। পুরাণ অনুযায়ী চ্যবন ও সুকন্যার দুই পুত্র ছিলেন— একজন আপন্বান্ এবং অপরজন দধীচ বা দধ্যঙ্। আপন্বানের পুত্র ছিলেন ঔর্ব। ঔর্বদের অবস্থান ছিল মধ্যদেশে। এখানেই এই ভৃগুবংশীয়দের কার্তবীর্য অর্জুনের সঙ্গে বিরোধের সূচনা হয়। এখানেই অর্জুনের পুত্রেরা জমদগ্নিকে বধ করেছিল। বীতহব্য প্রথমে ক্ষত্রিয় ছিলেন। এক ভৃগু ঋষির বচনে তিনি ব্রাহ্মণ হন। তাঁরই কুলে গৃত্সমদ ও শৌণকের জন্ম হয়েছিল। গৃত্সমদ দাশরথি রামের সমসাময়িক ছিলেন।

ভৃগুকুল এবং অথর্ববেদ— পৃষ্ঠা ২৫৬-এ আমরা পূর্বে লিখেছি যে, অথর্ববেদের একটি নাম ছিল ‘ভৃগ্বঙ্গিরোবেদ’। এর অর্থ এই যে, ভৃগু ও অঙ্গিরা— এই দুই কুলের সঙ্গে এই বেদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ভৃগুকুলের ঋষিদের নাম উপরে দেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ভৃগু, দধ্যঙ্ এবং শৌণক স্পষ্টতই আথর্বণ। সম্ভবত এই শৌণকই আথর্বণ শৌণক শাখার প্রবর্তক। ভৃগু, গৃত্সমদ ও শুক্র বহু আথর্বণ সূক্তের দ্রষ্টা। এদের মধ্যে শুক্রের সূক্ত সংখ্যা সর্বাধিক। ভৃগ্বঙ্গিরাদেরও বহু সূক্ত আছে। অতএব অথর্ববেদের ‘ভৃগ্বঙ্গিরোবেদ’ নামটি সম্পূর্ণ সঙ্গত।

অথর্ববেদ ও দৈত্যদেশ— উশনা শুক্র যে দৈত্যদের গুরু ছিলেন, তা সুপ্রসিদ্ধ। পারস্য, কালদিয়া, ব্যাবিলোনিয়া প্রভৃতি দেশই ছিল দৈত্যদেশ। শুক্র নিশ্চয়ই এই সব দেশে তাঁর পিতৃসূত্রে প্রাপ্ত আথর্বণ শ্রুতির প্রচার করেছিলেন। এই কারণেই এই দেশগুলির ভাষায় বহু আথর্বণ শব্দ প্রচলিত হয়ে যায়। উপরে উল্লিখিত ‘আলিঙ্গী’ প্রভৃতি শব্দ সেইগুলির অন্তর্গত। অতএব বাল গঙ্গাধর তিলকের এই মত যে, এই শব্দগুলি কালদিয়ার ভাষা থেকে অথর্ববেদে প্রবেশ করেছে— তা যুক্তিসঙ্গত নয়। এই শব্দগুলি বরং শুক্রের মাধ্যমে অথর্ববেদ থেকে কালদিয়ার ভাষায় গিয়েছে।

ইউরোপ দৈত্যদের বংশধরদের দ্বারা বসতিস্থাপিত হয়েছিল— এর বিশদ আলোচনা এই গ্রন্থের পূর্ববর্তী পৃষ্ঠা ৫১–৬১ এবং ভাষার ইতিহাস পৃষ্ঠা ১০৮–১০৬-এ দ্রষ্টব্য।

১. দেখুন পূর্ববর্তী পৃষ্ঠা ৫১–৬৩

অঙ্গিরা কুলের তেত্রিশ ঋষি— অঙ্গিরা কুলের নিম্নলিখিত তেত্রিশ ঋষির নাম পুরাণে লিখিত আছে—

১. অঙ্গিরা ২. ত্রিত ৩. ভারদ্বাজ বাস্কল ৪. ঋতবাক ৫. গর্গ ৬. শিনি ৭. সংকৃতি ৮. গুরুবীত ৯. মান্ধাতা ১০. অম্বরীষ ১১. যুবনাশ্ব ১২. পুরুকুৎস ১৩. ত্রসদস্যু ১৪. সদস্যুমান ১৫. আহার্য ১৬. অজমীঢ় ১৭. ঋষভ ১৮. কপি ১৯. পৃষদশ্ব ২০. বিরূপ ২১. কণ্ব ২২. মুদ্গল ২৩. উতথ্য ২৪. শরদ্বান্ ২৫. বাজশ্রবা ২৬. অয়াস্য ২৭. সুবিত্তি ২৮. বামদেব ২৯. অসিজ ৩০. বৃহদুক্ত ৩১. দীর্ঘতমা ৩২. কক্ষীবান্।

এই কুলে আরও ছয়জন ব্রহ্মবাদী কাশ্যপ রয়েছেন। তেত্রিশতম নামটি অশুদ্ধ পাঠের কারণে লুপ্ত হয়ে গেছে। এই বত্রিশটি নামের মধ্যেও অনেকগুলির শুদ্ধ রূপ আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। এই অঙ্গিরা গোত্রে পরে বহু শাখা গড়ে ওঠে, যেমন— কণ্ব, মুদ্গল, কপি ইত্যাদি। এই কুলের মূল পুরুষ অঙ্গিরা ছিলেন অত্যন্ত প্রাচীন ব্যক্তি। অঙ্গিরা কুলের এই মন্ত্রদ্রষ্টাদের মধ্যে মান্ধাতা, অম্বরীষ ও যুবনাশ্ব প্রভৃতি ক্ষত্রিয় কুলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। রাজা অম্বরীষও এক অতি প্রাচীন ব্যক্তি ছিলেন। মহাভারত প্রভৃতি গ্রন্থে নাভাগ অম্বরীষ নামে তাঁর উল্লেখ বহুবার পাওয়া যায়। অঙ্গিরারও অথর্ববেদের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। স্বতন্ত্রভাবে এবং ভৃগুর সঙ্গে মিলিত হয়ে তাঁর বহু সূক্ত অথর্ববেদে রয়েছে।

কাশ্যপ কুলের ছয় ঋষি

১. কাশ্যপ
২. বৎসার
৩. নৈধ্রুব
৪. রেভ্য
৫. অসিত
৬. দেবল

কাশ্যপ কুলে এই ছয়জন ঋষি হয়েছেন। এদের মধ্যে অসিত ও দেবলের সঙ্গে মহাভারতকালের একই নামধারী ব্যক্তিদের সম্পর্ক আছে বলে জানা উচিত। সম্ভবত উভয়েই পিতা-পুত্র ছিলেন এবং অত্যন্ত দীর্ঘজীবী ছিলেন।

ছয় আত্রেয় ঋষি

১. অত্রি
২. অর্চনানা
৩. শ্যাবাশ্ব
৪. গবিষ্ঠির
৫. আবিহোত্র
৬. পূর্বাতিথি

পঞ্চম নামটির বহু পাঠান্তর রয়েছে। সম্ভবত এই নামটি ‘অন্ধিগু’। অন্ধিগু গবিষ্ঠিরের পুত্র এবং ঋগ্বেদ ৬.১০১-এর ঋষি।

সাত বাসিষ্ঠ ঋষি

১. বসিষ্ঠ
২. প্রাক্তি
৩. পরাশর
৪. ইন্দ্রপ্রমতি
৫. ভরদ্বসু
৬. মৈত্রাবারুণি
৭. কুণ্ডিন

বসিষ্ঠ কুলে এই সাতজন ব্রহ্মবাদী ছিলেন। এদের মধ্যেই একজন পরাশর, যিনি কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের পিতা। কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন মহাভারত ও বেদান্তসূত্রে মন্ত্রকে নিত্য বলেছেন। কৃষ্ণের মতো সত্যবক্তা ঋষি যখন তাঁর পিতার দৃষ্ট মন্ত্রগুলিকে নিত্য বলেন, তখন এই নিত্য-সিদ্ধান্তের গভীর বিচার করা উচিত। বহু আধুনিক ব্যক্তি এখনও বেদের নিত্য-সিদ্ধান্ত সম্যকভাবে বুঝতে অক্ষম।

তেরো ব্রহ্মিষ্ঠ কৌশিক ঋষি

১. বিশ্বামিত্র
২. দেবরাত
৩. উদ্দাল (বল)
৪. মধুচ্ছন্দা
৫. অঘমর্ষণ
৬. কীল
৭. লোহিত
৮. কত
৯. অষ্টক
১০. দেবশ্রবা
১১. রেণু
১২. পূরণ
১৩. ধনঞ্জয়

মৎস্য পুরাণে আরও দুইটি নাম যোগ করা হয়েছে। সেগুলি হল— শিশির এবং শালঙ্কায়ন। বসিষ্ঠদের বর্ণনার পর বায়ু পুরাণের পাঠ ত্রুটিপূর্ণ হয়ে গেছে। বায়ু পুরাণ ৬১।৬৩ অনুসারে দেবরাতের কৃত্রিম পিতা বিশ্বামিত্রের প্রকৃত নাম ছিল বিশ্বরথ। বিশ্বরথের পিতার নাম ছিল গাধি। গাধির পর বিশ্বরথ রাজ্য শাসন করেন। কিছুদিন রাজ্য শাসনের পর বিশ্বরথ রাজ্য ত্যাগ করে বারো বছর কঠোর তপস্যা করেন। এই বিশ্বরথের সঙ্গে বসিষ্ঠের বৈরিতা সৃষ্টি হয়। সত্যব্রত ত্রিশঙ্কু নামে অযোধ্যার এক রাজকুমার ছিল। বিশ্বরথ তাকে বিশেষ সহায়তা করেছিলেন। তারই পুত্র ছিলেন হরিশ্চন্দ্র এবং পৌত্র ছিলেন রোহিত। তপস্যার ফলে এই বিশ্বরথ ক্ষত্রিয় থেকে ব্রাহ্মণ হননি, বরং ঋষি হয়েছিলেন। ঋষি হওয়ার পর তাঁর নাম হয় বিশ্বামিত্র। যজ্ঞে তিনি শুনঃশেপ দেবরাতকে নিজের কৃত্রিম পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। এই কাহিনি প্রসিদ্ধ। মধুচ্ছন্দা ও অঘমর্ষণ ধর্মের সুবিদ্বান ছিলেন।

তিন আগস্ত্য ঋষি

১. অগস্ত্য
২. দৃঢ়দ্যম্ন (দৃঢ়ায়ু)
৩. ইন্দ্রবাহু (বিধ্মবাহ)

এই তিনজন অগস্ত্য কুলের ঋষি ছিলেন।

দুই ক্ষত্রিয় মন্ত্রবাদী

বৈবস্বত মনু এবং ঐল রাজা পুরুরবা— এই দুইজন ক্ষত্রিয় ঋষি ছিলেন।

তিন বৈশ্য ঋষি

১. ভলন্দন
২. বৎস
৩. সংকীল

এই তিনজন বৈশ্যদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। বৈবস্বত মনু মূলত ব্রাহ্মণ ছিলেন, পরে তিনি ক্ষত্রিয় হন। তাঁর পুত্র ছিলেন নাভানেদিষ্ঠ। নাভানেদিষ্ঠ ক্ষত্রিয় হননি, তিনি বৈশ্য হয়েছিলেন এবং সেই কুলেই এই তিন ঋষির জন্ম হয়।

এইভাবে মোট ঋষির সংখ্যা ছিল ৬২। তাদের বিবরণ নিম্নরূপ—

ভৃগু — ১৬
আঙ্গিরস — ৩৩
কাশ্যপ — ৬
আত্রেয় — ৬
বাসিষ্ঠ — ৭
কৌশিক — ১৩
আগস্ত্য — ৩
ক্ষত্রিয় — ২
বৈশ্য — ৩

মোট — ৬২

ব্রহ্মাণ্ডে মোট সংখ্যা ১০ লিলী, কিন্তু মালয় অনুযায়ী সংখ্যা ৬২ মাত্র। ব্রহ্মাণ্ডের পাঠ অসম্পূর্ণ মনে হয়। এর পরেও ব্রহ্মাণ্ডে এই বিষয়ের কিছু পাঠ আরও পাওয়া যায়। বায়ুর পাঠ ইতিমধ্যেই ভেঙে গেছে এবং মত্যের পাঠ এই সংখ্যাকে গণনা করে ভেঙে যায়। ব্রহ্মাণ্ডে ঋষিপুত্রক এবং অতষীদের বৃত্তান্তও লেখা আছে। ব্রাহ্মণদের প্রবচনকারীরা শেষ প্রকারের ঋষিরাই। তাদের নাম ব্রাহ্মণ অংশে লেখা হবে।

বদ মন্ত্র, মন্ত্র-দ্রষ্টা ঋষিদের থেকে প্রাপ্ত মন্ত্র বিদ্যমান

আমরা পৃঃ ২৬৫-এ লিখেছি যে, যে ঋষিদের নাম এখন মন্ত্রগুলির সাথে অনুক্রমণিতে স্মরণ করা হয়; তারা প্রায়শই মন্ত্রগুলির শেষ ঋষি। মন্ত্রগুলি তাদের পূর্বেই বিদ্যমান ছিল। এই বিষয়টি প্রমাণ করার জন্য আমরা আমাদের ঋগ্বেদে বক্তৃতায় দুটি প্রমাণ দিয়েছি। সেই দুটি প্রমাণ এবং কিছু নতুন প্রমাণ নিচে দেওয়া হলো—

১. তাইত্তিরীয় সংহিতা ৩.১, ৬.৩০, মৈত্রায়ণী সংহিতা ১.৫৮ এবং ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৫.১৪-এ একটি কাহিনী পাওয়া যায়। এতে বলা হয়েছে যে মনুর অনেক পুত্র পিতার আজ্ঞা অনুযায়ী পিতার সম্পত্তি ভাগ করেছেন। তাদের কনিষ্ঠ ভ্রাতা নাভানেদিষ্ঠ তখনও ব্রহ্মচর্য বাস করছে। গুরুকুল থেকে ফিরে নাভানেদিষ্ঠ পিতার কাছে নিজের অংশ চায়। অন্যান্য দ্রব্য না থাকায় পিতা তাকে দুইটি সূক্ত এবং একটি ব্রাহ্মণ দিয়ে বলেন যে আঙ্গিরস ঋষি স্বর্গের কামনা নিয়ে যজ্ঞ করছেন। যজ্ঞের মধ্যে তারা ভুল করে বসেন। তুমি এই সূক্তগুলি দিয়ে সেই ভুল দূর করো। যারা দক্ষিণা দেব, সেটি তুমি নিজের অংশ মনে করো। এই সূক্তগুলি ঋগ্বেদ দশম মণ্ডলের সুপরিচিত ৬১, ৬২ সূক্ত। ব্রাহ্মণের একটি পাঠ তাইত্তিরীয় সংহিতার ভাষ্যে ভট্ট ভাস্কর মিশ্র দিয়েছেন। অনুক্রমণী অনুযায়ী এই সূক্তগুলির ঋষি নাভানেদিষ্ঠ। নাভানেদিষ্ঠের নামও ৬১.১৮-এ পাওয়া যায়। এই কাহিনীর অর্থ হলো যে এই সূক্তগুলি নাভানেদিষ্ঠের যুগের আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল, তবে এই সূক্তগুলির ঋষি সেই নাভানেদিষ্ঠই।

২. ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৬.১৬ এবং গোপথ ব্রাহ্মণ ৬.১-এ লেখা আছে যে ঋগ্বেদ ৪.১৬ ইত্যাদি সমপাৎ ঋচাগুলি বিশ্বামিত্র প্রথম (প্রথমং) দেখেছিলেন। এর পর বিশ্বামিত্র থেকে দেখা সেই সমপাৎ ঋচাগুলি বামদেব সাধারণ মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। কাত্যায়ন সর্বানুক্রমণী অনুযায়ী এই ঋচাগুলির ঋষি বামদেব, বিশ্বামিত্র নয়। এই ঋচাগুলি বামদেব ঋষির আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল।

৩. কাউষীতকি ব্রাহ্মণ ১২.২ থেকে কভস ঋষির উল্লেখ শুরু হয়। সেখানে লেখা আছে যে কভস ১৫ ঋচা বিশিষ্ট ঋগ্বেদ ১০.৩০ সূক্ত দেখেছেন। এর পর তিনি এটি যজ্ঞে ব্যবহার করেছিলেন। কাউষীতকি ব্রাহ্মণ ১২.৩-এ পুনরায় লেখা হয়েছে— কভসवंষ মহিমা সূক্তस्य চানুভেদিতা

অর্থাৎ, কভসের এই মহিমা হলো, তিনি ১০.৩০ সূক্তের উত্তরবর্তী জানার ব্যক্তি।

এর থেকে জানা যায় যে কভসের আগে এই সূক্ত জানেন এমন ঋষিরা ইতিমধ্যেই ছিলেন। অনেক স্থানে বিদ্ ইত্যাদি ধাতুর সঙ্গে অনু অর্থক্রমক্রমে বা অনুক্রম অনুযায়ী হয়। তবে একই স্থানে অনু অর্থ পরেও হতে পারে। অতএব কাউষীতকি বচনের যে অর্থ আমরা নিয়েছি, তা এই বচনের সরাসরি অর্থ।

১. উপরে পৃঃ ১৩০-১৫৫ দেখুন (পুস্তকে)। 

মিত্রবর শ্রী পণ্ডিত ব্রহ্মদত্ত জীর শিষ্য ব্রহ্মচারী পণ্ডিত যুধিষ্ঠির মীমাংশক-এর একটি প্রবন্ধ আর্য-সিদ্ধান্ত বিতর্কে প্রকাশিত হয়েছে। শিরোনাম—ঋষি কী বৈদিক মন্ত্র রচয়িতা ছিলেন? সেখানে তিনি চারটি প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন যা আমাদের পূর্বোক্ত পক্ষকেই শক্তিশালী করে। সেই প্রবন্ধ থেকে দুটি প্রমাণ সংক্ষিপ্তভাবে এখানে দেওয়া হলো। বাকি দুই প্রমাণের বিষয়ে আমরা আলোচনা করছি—

১. সর্বানুক্রমণী অনুযায়ী কস্য নুনং… ঋগ্বেদ ১.২৪-এর ঋষি আজীরগাত, অজীগর্ত-এর পুত্র দেবরাত। এই দেবরাতই বিশ্বামিত্রের কৃত্রিম পুত্র হয়ে শুনঃশেপ নামে পরিচিত হন। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৩৩.৩,৪-এও বলা হয়েছে যে শুনঃশেপ কস্য নুনং ঋক্ দ্বারা প্রজাপতির স্তুতি করেছেন। বররুচি-কৃত নৃপুক্ত সমুচ্ছয়-এও এই সূক্তের বিষয়ে একটি আখ্যান রয়েছে। তার অনুযায়ী এই সূক্তের দর্শক অজীগর্ত নিজেই। যদি নৃপুক্ত সমুচ্ছয়-এর পাঠ ভ্রান্ত না হয়ে যেত, তবে শুনঃশেপের আগে ফস্য নুনং ইত্যাদি মন্ত্র বিদ্যমান ছিল।

২. তাইত্তিরীয় সংহিতা ৫.২.৩ এবং কাঠক সংহিতা ২০.১০-এ ঋগ্বেদ ৩.২২ সূক্ত বিশ্বামিত্র দ্বারা দর্শিত হয়েছে। সর্বানুক্রমণী অনুযায়ী এই সূক্ত গাথী-গাধী-এর। এটি নির্দেশ করে যে বিশ্বামিত্রের আগে এই সূক্ত গাধীর কাছে ছিল।

অনেক প্রমাণ থেকে আমরা দেখিয়েছি যে মন্ত্রদর্শক ঋষি মন্ত্র রচয়িতা ছিলেন না। তারা ছিলেন মন্ত্রার্থ-প্রকাশক বা মন্ত্র বিনিয়োজক। পূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে ভৃগু, অঙ্গিরা ইত্যাদি ঋষি মন্ত্রদর্শক ছিলেন। এই ভৃগু, অঙ্গিরা ইত্যাদির যুগ মহাভারত যুগের বহু আগে। মহাভারত যুদ্ধের সময় বিক্রম থেকে প্রায় ৩০৪০ বছর পূর্বে। তাই চিন্তা করা উচিত, যখন বৈদিক মন্ত্র ভৃগু, অঙ্গিরা ইত্যাদির যুগের বহু আগে, অর্থাৎ বিক্রম থেকে প্রায় ৪০০০ বছর আগে বিদ্যমান ছিল, তখন বলা যে ঋগ্বেদের কাল খ্রীষ্টপূর্ব ২৫০০–২০০০ বছর আগে, এটি কেবল বিভ্রান্তি।

যে আধুনিক গবেষকরা ভাষাতত্ত্ব (Philology)-এ অধিক গুরুত্ব দিয়ে বৈদিক মন্ত্রের কাল খ্রীষ্টপূর্ব ২০০০–১৫০০ বছর নির্ধারণ করেন, তাদের উচিত ভৃগু, অঙ্গিরা ইত্যাদির মন্ত্রের ভাষা পরাশরের মন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করা। পরাশর ভারতযুদ্ধ যুগের, কিন্তু ভৃগু, অঙ্গিরা বহু আগে। তখন তারা বুঝতে পারবে যে তাদের ভাষাগত কৌশল বৈদিক মন্ত্রের কাল নির্ধারণে সহায়ক নয়। বৈদিক মন্ত্রের কাল কেবল ঐতিহাসিক ক্রম অনুসারে নির্ধারণযোগ্য, এবং সেই অনুযায়ী বৈদিক মন্ত্র যুগ-কাল থেকে চলে আসছে। ঋষিদের ইতিহাসই আমাদের এই ফলাফলে পৌঁছে দিয়েছে।

মন্ত্রের পুনরাবৃত্তি প্রাদুর্ভাব

উপরোক্ত প্রমাণ থেকে এটি নিশ্চিত হয় যে মন্ত্রের প্রাদুর্ভাব বারবার হয়েছে। এজন্য একাধিকবার একই সূক্তের অনেক ঋষি হয়েছে। গণনা প্রায় শত পর্যন্ত পৌঁছায়। এটি প্রমাণ করে যে ঋষি মন্ত্র রচয়িতা ছিলেন না, বরং তারা মন্ত্রদর্শক। এই বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনা পূর্বে দেখানো হয়েছে।

১. এর দুটি সংস্করণ ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে।
২. পৃঃ ১৩০ থেকে আগের অংশ।

মন্ত্রার্থ দর্শক ঋষি

মন্ত্রের বারবার প্রাদুর্ভাবের একটি আরও গভীর অর্থ রয়েছে। আমরা জানি, বিভিন্ন ব্রাহ্মণ গ্রন্থে একই মন্ত্রের বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। একই মন্ত্রের ব্যবহারও বিভিন্নভাবে দেখানো হয়েছে। মন্ত্রার্থের এই ভিন্নতা থেকেই এক মন্ত্র বিভিন্ন সময়ে অনেক ঋষির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এ কারণে প্রাচীন আচার্যরা লিখেছেন যে ঋষি মন্ত্রার্থ দর্শকও ছিলেন। এর জন্য নিম্নলিখিত প্রমাণ বিবেচনীয়—

১. নিরুক্ত ২.৮-এ লেখা আছে যে শাকপূণি সিদ্ধান্ত নিল যে আমি সব দেবতাকে জানব। তার জন্য দুটি লিঙ্গযুক্ত দেবতা প্রাদুর্ভূত হলো। তিনি তাকে জানতে পারলেন না। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন। সেই দেবতা ঋ০ ১.১৬৪.২৬ সূক্তের নির্দেশ দিল। এটাই “মুজ দেবতা বালা মন্ত্র”। এই প্রমাণ থেকে বোঝা যায় যে দেবতা শাকপূণিকে সূক্তও জানাল এবং ঋগ্বেদসংক্রান্ত অর্থও দেখাল। তখনই শাকপূণি মন্ত্রার্থ জ্ঞান লাভ করলেন এবং দেবতাকে চিনলেন। এই মন্ত্র শাকপূণির আগে থেকেই পরিচিত ছিল। মন্ত্রটি বৈদিকের অংশ ছিল এবং ব্যাস প্রমুখরা আগে থেকেই এটি পাঠ করেছেন। শাকপূণি নিজেও এই মন্ত্রটি পড়েছিলেন। তবুও তার জন্য এই মন্ত্রের নির্দেশ হলো এবং তিনি মন্ত্রে উদ্ভূত লিঙ্গ দেবতা দেখলেন।

২. নিরুক্ত ১৩.১২-এ লেখা আছে—“না হ্যেষু প্রতক্ষমস্ত্যনৃষের তপসো বা”। অর্থাৎ এই মন্ত্রগুলিতে অনুষি এবং তপশূন্যতার সরাসরি প্রকাশ নেই। যারা সংস্কৃত ভাষার মর্ম বোঝেন, তারা এই বাক্য পড়ে বুঝবেন যে এই বাক্যর অর্থ হলো মন্ত্র বহুধা বিদ্যমান থাকে এবং সেই মন্ত্রগুলিতেই ঋষিদের দর্শন ঘটে। যেমন পৃথিবীতে গোলাপের ফুল বহুদিন ধরে আছে, তবুও তার বৈশিষ্ট্যে বৈদ্যের দৃষ্টি মাঝে মাঝে যায়। যখনই দৃষ্টি খোলে, তখনই সেই ফুলের একটি নতুন ব্যবহার উদ্ভাবিত হয়।

এরপর নিরুক্তকার লিখেছেন—

“মনুষ্য বা ঋষিষূত্রক্রমত্সু দেবানন্ বন্ত। কে ন ঋষিঃ ভবিধ্যতি। তেবা এতং তর্কমুধি প্রায়চ্ছন। মন্ত্রার্থচিন্তামিউহমভ্যূলহম। তসমাদ্যদেব কিচানূচানোভ্যূহত্যার্থং তদ্ভবতি।”

এই পুরো বাক্যের অর্থ হলো ঋষিরা প্রায়ই মন্ত্রার্থই বুঝতেন। বেণ্কটমাধব তার ঋগ্ভধ্যের অষ্টম অষ্টকে সপ্তম অধ্যায়ের অনুক্রমণীতে লিখেছেন যে নিরুক্তের এই পাঠ কোনো প্রাচীন ব্রাহ্মণ গ্রন্থের পাঠ। তিনি প্রকৃতপক্ষে এটি ব্রাহ্মণের নামে উদ্ধৃত করেছেন। এটি নির্দেশ করে যে ব্রাহ্মণ গ্রন্থেও ঋষিকে প্রায়ই মন্ত্রার্থ দর্শক হিসেবে ধরা হয়েছে। যাস্কের এষু প্রতক্ষম্ পদ থেকে নিরুক্ত ৭.৩-এ এসেছে যে ঋষীণাং মন্ত্রদৃষ্টয়ঃ-এর সপ্তমি পার্ক অর্থও একই নির্দেশ দেয়। এতে বোঝা যায় যে বিদ্যমান মন্ত্রেও ঋষিদের দর্শন ছিল।

৩. নিরুক্ত ১০.১০-এ লেখা আছে—“না ঋষৃ বর্ষার্থস্য প্রীতি ভবতি আখ্যান সংযুক্তা।” এখানে ‘দৃষ্টার্থ’ শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থ হতে পারে মন্ত্র বা মন্ত্রার্থ। মন্ত্রার্থের অর্থ থেকেই এখানে আমাদের প্রাপ্ত অভিপ্রায় নিশ্চিত হয়।

৪. ন্যায়সূত্র ৪.৬.৬২-এ ভাষ্য করতে গিয়ে কোনো ব্রাহ্মণ গ্রন্থের প্রমাণ দিয়ে वात্স্যায়ন মুনি লিখেছেন—

“য় এং মন্ত্রব্রাহ্মণের দর্শক এবং প্রবর্তক, তারা ইতিহাস, পুরাণ এবং ধর্মশাস্ত্রেরই।”

পুনঃ সূত্র ২.২.৬২-এর ভাষ্যে বাৎস্যায়ন লিখেছেন—

“য এৱাপ্তা বেদার্থানাং দর্শ্তারঃ প্রবর্তারশ্চ ত এবাযুর্বেদপ্রণৃতীনামিতি।”

এই উক্তি এবং পূর্বের উক্তিগুলো থেকে স্পষ্ট হয় যে, ঋষিরা, যাঁরা প্রাপ্তসাক্ষাৎধর্মের অধিকারী ছিলেন, তাঁরা বেদার্থের দর্শকও ছিলেন। এই বেদার্থ ব্রাহ্মণ গ্রন্থে বিদ্যমান, তাই বলা যায় ঋষিরা বেদার্থরূপী ব্রাহ্মণের দর্শক ছিলেন। এর অর্থ হলো, সময়ে সময়ে একই মন্ত্র বিভিন্ন ঋষির কাছে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহার প্রদর্শিত হয়েছে।

৫. যজুর্বেদ’এর সপ্তম অধ্যায়ে ৪৬তম মন্ত্র—

“ব্রাহ্মণমদ্য বিদেয়ং পিতুমন্তং পৈত্র্যমুষি- মার্ষেয়ম্।”

এখানে ঋষি পদ নিয়ে ব্যাখ্যায় উওট লিখেছেন— ঋষিঃ মন্ত্রাণাং ব্যাখ্যাতা। অর্থাৎ ঋষি মন্ত্রের ব্যাখ্যাতা।

৬. বৌধায়ন ধর্মসূত্র ২.৬.৩৬-এ ঋষি পদ পাওয়া যায়। এর ব্যাখ্যায় গোবিন্দ স্বামী লিখেছেন— ঋষিঃ মন্ত্রার্থজ্ঞঃ। অর্থাৎ ঋষি মন্ত্রার্থের জ্ঞানী।

কাশিকার জ্ঞানের সমালোচনা—
সংস্কৃত ভাষা-জ্ঞান: আয়ুর্বেদ ইতিহাস’এর প্রথম ভাগের সমালোচনায় পূণায় কাশিকার জি লিখেছেন যে, वातস্যায়নের উক্তি এটি প্রকাশ করে না যে আয়ুর্বেদ, ইতিহাস, পুরাণ এবং ধর্মশাস্ত্রের রচয়ীতারাই ব্রাহ্মণ গ্রন্থের প্রবর্তক ছিলেন।

এই প্রবন্ধ থেকে বোঝা যায়, অসত্য ইউরোপীয় পক্ষের পক্ষপাত এবং হঠের কারণে কাশিকার জি এমন একটি ভিত্তিহীন বক্তব্য দিয়েছেন, যা ন্যায়শাস্ত্রের শিক্ষিতরাও স্বপ্নেও জানতেন না। ন্যায়শাস্ত্রের এই উক্তির প্রাসঙ্গিক অর্থ কোনো শিক্ষিত ব্যক্তি থেকে পড়ে বোঝা যায়। ইউরোপীয় কল্পিত-পক্ষের গবেষকরা এটি কেবল উপহাসের বিষয়।

৭. ভৃগু-প্রোক্ত মনুস্মৃতি’র প্রথম অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকান্তর্গত ‘মহর্ষয়ঃ’ পদে মেধা-তিথি লিখেছেন—

“শ্রঋষিবন্দঃ। তদধ্যয়ন-বিজ্ঞান-তদর্থানুষ্ঠানাতিশয়যোগাত পুরুষে অপিউষিশব্দঃ।”

অর্থাৎ বেদের অধ্যয়ন, বিজ্ঞান, অর্থানুষ্ঠান ইত্যাদির কারণে ‘পুরুষ’ ও ক্ষেত্রে ঋষি শব্দ ব্যবহার হয়।

এভাবে অনেক প্রমাণ থেকে জানা যায়, মন্ত্রার্থদর্শক ঋষির জন্যও ‘ঋষি’ শব্দের ব্যবহার প্রাচীন সাহিত্যেই চলিত হয়েছে।

মন্ত্র থেকে নেওয়া বহু ঋষির নাম
আমরা পৃঃ ২৬৬-এ লিখেছি, বিশ্বরথ নামের রাজা তীব্র তপস্যা করেছিলেন। এই তপস্যার প্রভাবে তিনি ঋষি হন। ঋষি হওয়ার পর তার নাম হয়ে যায় বিশ্বামিত্র। এটি নির্দেশ করে যে ঋষি হওয়ার পর অনেকেই নিজেদের নাম পরিবর্তন করে বেদের কোনো শব্দ নিজের নামে ব্যবহার করেছেন। শিবসংকল্প ঋষিও যজুঃ ৩৪.১ থেকে শিবসংকল্প শব্দ নিয়ে নাম নিয়েছেন।

এই বিষয়ের সুন্দর বিশ্লেষণ করেছেন পরলোকগত মিত্রবর শ্রী শিবশঙ্কর জী কাব্যতীর্থ তাদের বৈদিক ইতিহাসে।

সূত্র: বুলেটিন অব দ্য ভাণ্ডারকর অরিয়েন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ১৯৫৪।

সার্থ নির্নয় পৃঃ ২৪–২৯ পর্যন্ত এ বলা হয়েছে। ঐতরেয়ারণ্যক-এর প্রমাণের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে যে, বিশ্বামিত্র, গৃত্সমদ প্রভৃতি নাম প্রাণবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। একইভাবে, ওমদেব, অত্রি এবং ভারত্বাজ নামও সাধারণ অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে।

শতপয় ব্রাহ্মণ-এর প্রমাণ অনুযায়ী, বাসিষ্ঠ প্রভৃতি নাম ইন্দ্রিয়দের নির্দেশ করে। ঋগ্বেদ ১০.১৫১-এর বালে শ্রদ্ধাসূক্ত-এর ঋষিকা হলো শ্রদ্ধা কামায়নী। এই কন্যা নিশ্চয়ই তার নাম পরিবর্তন করেছে। এই ধরনের বহু প্রমাণ সংক্ষেপে উক্ত গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে। বিচক্ষণ পাঠক সেই সূত্র থেকে এগুলো অধ্যয়ন করবেন। ইতিহাসবিজ্ঞানের ভিত্তিতে, যারা বেদপাঠ করেন, তাদের হৃদয়ে স্বতঃসিদ্ধভাবে প্রকাশ পাবে যে, বেদ মন্ত্রের আশ্রয়ে বহু ব্যক্তি বহু নাম নিয়েছেন বা পরিবর্তন করেছেন। এজন্যই ভগবান মনু ভৃগু-প্রোক্ত শাস্ত্রে ১.২১-এ বলেছেন—

“সর্বেষাং তু স নামানী কর্মাণী চ পৃথক্ পৃথক্। বেদশব্দেব্য এবাদৌ পৃথক্ সংস্হাশ্চ নির্মমে।”

অর্থাৎ বেদের শব্দ থেকেই আদিতে বহু পদার্থের নাম স্থাপন করা হয়েছে।

আর্য ধর্মের জীবনদাতা ঋষি

আর্য ধর্মের জীবনদাতা এই ঋষিরা ছিলেন। এদের উপদেশ থেকেই আর্য সংস্কৃতি ও সভ্যতার ভিত্তি গড়ে উঠেছে। এই ঋষিদের মান্যতা আর্য সম্রাটগণ তাদের সর্বোচ্চ কর্তব্য মনে করতেন। বিশাল সাম্রাজ্যশালী সম্রাটগণও তাদের কন্যাদের এই ঋষিদের বিবাহে দিতেন এবং এটিকেই গৌরব মনে করতেন। উদাহরণস্বরূপ, জানশ্রুতি তার কন্যা রক্কাকে দিয়েছে, লোপামুদ্রা রাজকন্যা ছিলেন, এবং সুকন্যা সম্রাট শর্যতীর কন্যা ছিলেন।

এই ধরনের বহু উদাহরণ মহাভারত প্রভৃতি গ্রন্থে বিদ্যমান। যখন ঋষিরা আর্য রাজাদের সভায় যেতেন, তখন রাজারা রত্ন, ধন, ধান্য দিয়ে তাদের মান্যতা দিতেন। ঋষিদের চেয়ে আর্য জনদের মধ্যে আর কারো স্থান ছিল না। তাদের কথা প্রমাণস্বরূপ ছিল। তারা সরাসরি ধর্মের ধারক ছিলেন, পরম সত্যবাদী এবং সত্যনিষ্ঠ। তাদের রচিত ধর্মসূত্রগুলোতে নানা প্রক্ষেপ থাকলেও প্রাচীন আর্য ধর্মের একটি উজ্জ্বল রূপ প্রতীয়মান।

বর্তমান দুঃখগ্রস্ত পৃথিবীর জন্য এটি শান্তির একটি মহান উৎস হতে পারে। ধর্ম ও অ-ধর্মের ন্যায্য সিদ্ধান্ত কেবল এই ঋষিদের বাক্য দ্বারা সম্ভব। যাদব কৃষ্ণ সদৃশ তেজস্বী যোগীরা এই ঋষিদের কতটা শ্রদ্ধা করতেন, তা মহাভারত-এ দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, যখন ভগবান মধুসূদন দূতকার্যের জন্য যুধিষ্ঠীরের সঙ্গে বিদায় নেন, পথে ঋষিদের সাথে সাক্ষাৎ হয়। তাঁরা বলেন “হে কেশব, সভায় তোমার বক্তব্য শোনার জন্য আসব।”

এরপর শ্রীকৃষ্ণ হস্তিনাপুরে পৌঁছান। রাতে বিদুরের গৃহে অবস্থান করেন। প্রাতঃকালে সমস্ত কার্যক্রম থেকে অবকাশ নিয়ে রাজ-সভায় প্রবেশ করেন। সাত্যকী তাদের সঙ্গে ছিলেন। সেই সভায়, রাজাদের মধ্যে অবস্থানরত দাশার্হ আকাশস্থ ঋষিদের দেখেন। তখন, বাসুদেব শন্তনুর পুত্র ভীষ্মজীকে ধীরে ধীরে বললেন—

পাঠিভী সমিতি দর্শন করুক ঋষিসমূহ, রাজা।

নিমন্ত্রণ করা হোক, আসন ও সম্মানসহ শ্রদ্ধা প্রদর্শন কর।
যাদের কাছে বসা যায় না, তাদের উদ্দেশ্যবিহীনভাবে বসানো সম্ভব নয়।

(উদ্যোগপর্ব, অধ্যায় ৬৪, শ্লোক ৫৪–৫৫)

১. ৪.১.১০৪ সূত্রে মহাভাষ্য অনুসারে বলা হয়েছে, বিশ্বামিত্র তপস্যা করলেন, “আমি অনুধি না হই।” তিনি ঋষি হলেন। পুনরায় তপস্যা করলেন, “আমি অষি-এর পুত্র না হই।” তখন গাধি ঋষি হলেন। তিনি পুনরায় তপস্যা করলেন, “আমি অনুষি-এর নাতি না হই।” তখন কুশিক ঋষি হলেন। পিতা এবং পিতামহের পরে ঋষি হলেন।

২. এই বচন সম্পর্কে প্রভাতচন্দ্রের বক্তব্যের সংক্ষিপ্ত উল্লেখ পূর্ব পৃঃ ৫০, ২৬-এ দেখুন। অর্থাৎ—
“হে রাজা! পৃথিবীতে অনুষ্ঠিত এই সভা দেখার জন্য ঋষিগণ পর্বত থেকে এখানে অবতীর্ণ হয়েছেন। তাদের বহুবিধ সম্মান ও আসন দিয়ে আদর কর। যতক্ষণ তারা বসেনি, অন্য কেউ বসতে পারবে না। ঋষিদের পূজা সম্পন্ন হলে তারা বসলেন।”

তাদের উপবিষ্ট হলে ভারত গ্রহন করল।
নিষসাদাসনে কৃশ্ণও রাজাসহ যথাসম্মান নিজের আসনে বসলেন।

অর্থাৎ ঋষিদের বসার পর কৃশ্ণজী তাদের আসনে অধিষ্ঠিত হলেন, এবং অন্যান্য রাজারা নিজেদের আসনে বসলেন।

নিজের জ্ঞানদাতাদের, ধর্মসংরক্ষকদের, ধর্মপ্রচারকদের এবং দ্যিভ জ্ঞানসঞ্চয়কারীদের প্রতি কত শ্রদ্ধা রয়েছে। এই ভূমিতে অন্য কোন জাতি কি এমন দৃশ্য স্থাপন করেছে? কোথায় বড় বড় সম্রাটগণ এমন ধনহীন ব্যক্তিদের সামনে নত হয়েছেন? সত্যিই আর্য সংস্কৃতি মহান এবং অনন্য। এই শ্রদ্ধাতেই এই সংস্কৃতির জীবন এবং প্রাণ নিহিত ছিল।

বেদের সমার্থক ঋষি শব্দ

অনেক প্রাচীন ভাষ্যকার বহু প্রসঙ্গে ঋষি শব্দকে বেদের সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এই প্রবণতা কখন থেকে শুরু হয়েছে, তা ইতিহাসগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ, সেজন্য নিচে প্রদর্শন করা হলো—

১. ভোজরাজ কৃত উণাদিসূত্র ২.১.১৫৬-এর ব্যাখ্যায় দণ্ডনাথ নারায়ণ লিখেছেন—
“ঋষিঃ বেদঃ।” অর্থাৎ ঋষি বেদকে বোঝায়।

২. হদত্তমিশ্র পাণিনীয় সূত্র ১.১.১৮-এর পদমঞ্জরী ব্যাখ্যায় লিখেছেন—
“ঋষি-বন্দঃ। তদুক্তমৃষিণা ইত্যাদৌ দর্শন।”

অর্থাৎ— ব্রাহ্মণ গ্রন্থের তদুক্তমুষিণ পাঠের অনুরোধে ঋষি শব্দের অর্থ বেদ।

৩. বৈজয়ন্তিকোষে যাদবপ্রকাশ লিখেছেন— “ঋষি-ত্বেবে-বে।” অর্থাৎ ঋষি শব্দ বেদের অর্থে ব্যবহৃত হয়।

৪. মনু ভাধ্যকার মেধাতিথির “ঋষিঃ বেদঃ” প্রমাণ পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।

৫. অষ্টম শতাব্দীর আগে শাশ্বত কোষ শ্লোক ৭১৬-এ লেখা— “বিবেণ দে।” এইসব প্রমাণ থেকে বোঝা যায়, সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত ঋষি শব্দের বেদ অর্থ সুপরিচিত ছিল। কতকাল আগে এই অর্থ প্রচলিত হয়েছে, তা বিবেচনা করার বিষয়।

বেদ এবং ঋষিদের বিষয়ে তৎগত বুদ্ধের সম্মতি

শান্তরক্ষিত তাঁর তত্ত্বসংগ্রহে লিখেছেন—
“যয়োক্তং ভগবতা ইত্যেতে আনন্দ পौरাণ মহর্ষয়ো বেদানং কর্তাগে মন্ত্রাণাং প্রবর্তয়িতারঃ।” (১০ ১৪)

অর্থাৎ— “ভগবান বুদ্ধ বলেছেন— হে আনন্দ! এরা প্রাচীন মহর্ষি ছিলেন, যারা বেদ রচনা করেছেন এবং মন্ত্র প্রচলন করেছেন।”

মন্ত্র প্রচলনের মাধ্যমে বুদ্ধের উদ্দেশ্য কী, তা বিবেচ্য। বুদ্ধের কৃতবেদদের দ্বারা বোধহয় সেই শাখার প্রবক্তাদের বোঝানো হয়েছে। বুদ্ধ যদি বেদের প্রতি কোনো শ্রদ্ধা দেখাতেন, তাও তাঁর অনুচরদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি।

মজ্জিমনিকায় ২.৫.৫-এ বুদ্ধ বলেছেন— ব্রাহ্মণদের পূর্বপুরুষ ঋষি: অট্টক, যামক…

পুনরায় মজ্জিমনিকায় ২.৫.৬-এ বুদ্ধ বিহারের ধাওস্তী উল্লেখ করেন। শ্রাবস্তীর জেত-বনে বুদ্ধ বলেন—
“মাণব, যে তারা বেদের রচয়িতা, মন্ত্রের প্রবক্তা এবং ব্রাহ্মণদের পূর্বপুরুষ ঋষি ছিলেন, যাদের গীতি, সঙ্গীত এবং প্রাচীন মন্ত্র আজও ব্রাহ্মণরা সেই অনুযায়ী পাঠ করে।”

(সেখানে পূর্বপুরুষ ঋষি যেমন— অট্টক-অষ্টক, বামক-বামদেব, বিশ্বামিত্র, জামদাগ্নি, অঙ্গিরা, ভারদ্বাজ, বাসিষ্ঠ, কাশ্যপ, ভৃগু)।

এই বচনে “বামক” সম্ভবত বামদেবকে বোঝায় এবং বাকী আট ঋষি প্রযোজ্য। পালি ভাষায় তারা “অট্টক” নামে পরিচিত। মজ্জিমনিকায় এই বচন থেকে বোঝা যায় যে শান্তরক্ষিতের পাঠে “প্রবর্তয়িতারঃ” এর স্থলে “প্রবক্তারঃ” পাঠ থাকা উচিত।

তত্ত্বার্য শ্লোকবার্তিকের রচয়িতা বিদ্যানন্দ স্বামী সূত্র ১.২০-এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন—

“তত্কারণং হি কাণাদাঃ স্মরন্তি চতুরাননম্। জৈনাঃ কালাসুরং বৌদ্ধাঃ স্বষ্টকাত্সকালাঃ সদা।” (৩৬)

অর্থাৎ— বৈশেষিক দর্শনের ব্রহ্মা থেকে বেদ উৎপত্তি মানা হয়, জৈনরা কালাসুর থেকে এবং সকল বৌদ্ধ সম্প্রদায় স্বষ্টক থেকে বেদ উৎপত্তি মানে।

জৈনরা কিভাবে কালাসুর থেকে বেদ উৎপত্তি মানে, তা জৈন ইতিহাসেই লেখা আছে। বিদ্যানন্দ স্বামী এখানে বৌদ্ধদের যে মতটি উল্লেখ করেছেন, তার মূল পূর্বে প্রদর্শিত মজ্জিমনিকায় প্রমাণে পাওয়া যায়। “স্বষ্টক” পদটি সু-অট্টক থেকে উদ্ভূত।

বেদ অনাদি কাল থেকে প্রচলিত। যখনই বেদের ক্ষয় হয় বা প্রচার কম হয়, তখনই ঋষিরা সেই বেদ প্রচার করেন, অর্থ প্রকাশ করেন। প্রাচীন বৈদিক ঋষিদের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।

ঋষি কাল কতদূর পর্যন্ত চলল

সাধারণভাবে বলতে গেলে ঋষি কাল কখনো শেষ হয়নি। তপস্যা, যোগ, জ্ঞান বা বেদাভ্যাস দ্বারা যে কেউ ঋষি হতে পারে, তবে এটি অসাধারণ ঘটনা। বর্তমানে বেদমন্ত্র বা মন্ত্রার্থের দর্শন কেবল বিরল ব্যক্তির ভাগ্য হয়। অতীত যুগে যেমন শত শত ঋষির সংখ্যা দেখা গেছে, তা ভারত যুদ্ধের কিছু সময়ের আগ পর্যন্ত দেখা যায়। এটি বায়ু ইত্যাদি পুরাণে উল্লেখ আছে।

যুধিষ্ঠিরের পর, পরিবৃত্ত হস্তিনাপুরের রাজগদী গ্রহণ করেন। পরিবৃত্তের পুত্র জন্মেজয় এবং জন্মেজয়ের পুত্র শাতানীক। শাতানীকের পুত্র ছিলেন অশ্বমেধদত্ত।

বায়ুপুরাণ ৬৬ অধ্যায়ে অশ্বমেধদত্তের পুত্র সম্পর্কে লেখা আছে—

“পুত্রোঃ অশ্বমেধদলাইজাতঃ পরপুরঞ্জয়ঃ” (২৫৭)
“অধিসোমকৃষ্ণো ধর্মাত্মা সাংপ্রতোয়ঁ মহাযশাঃ। যস্মিন প্রচাসতি মহীং ইউষ্মাভিরিদমাহৃতম্। দুরাপং দীর্ঘসত্রং শ্রীণি বর্ষাণি বুশ্চরম্। বর্শদ্বয়ং কুরুক্ষেত্রে বৃষদ্বত্যা দ্বিজোত্তমাঃ।” (২৫৬–২৫৮)

অর্থাৎ— অশ্বমেধদত্তের পুত্র ছিল অধিসোমকৃষ্ণ। তার রাজ্যে ঋষিরা দীর্ঘ সত্র সম্পন্ন করেছিলেন।

এই প্রসঙ্গে বায়ুপুরাণের প্রারম্ভে লেখা আছে—

শাতানীক সম্ভবত কোনো অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন। এর পর এই পুত্রের জন্ম হয়, এ কারণেই তার এমন নামকরণ করা হয়েছে।

অসোমকৃষ্ণের রাজ্যে ঋষিরা কুরুক্ষেত্রে দৃষদ্বতীর তটে দীর্ঘ সত্র সম্পন্ন করেছিলেন—

“অসোমকৃষ্ণে বিক্রান্তে রাজন্যে অনুপমত্ভিষি। প্রশাসতীমাং ধর্মেণ ভূমি ভূমিসত্তমে।” (১২)
“ঋষযঃ সংশিতাত্মানঃ সত্যব্রতপরায়ণাঃ। ঋজবো নষ্টরজঃ শান্তা দান্তা জিতেন্দ্রিয়াঃ।” (১৩)
“ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে দীর্ঘসত্র তু ঈজিগরে। নদ্যাস্তীরে বৃষদ্বত্যাঃ পুণ্যায়াঃ শুচিরোধসঃ।” (১৪)

অর্থাৎ— অসোমকৃষ্ণের রাজ্যে ঋষিরা কুরুক্ষেত্রে দৃষদ্বতীর তটে একটি দীর্ঘসত্র সম্পন্ন করেছিলেন।

যুধিষ্ঠিরের রাজত্যাগের সময় কালিয়ুগ শুরু হয়। এরপর বংশক্রম অনুযায়ী—

  • পরিবৃত্তের রাজ্যকাল: ৬০ বছর

  • জন্মেজয়: ৮৪ বছর

  • শাতানীক ও অশ্বমেধদত্ত: ৮২ বছর

মোট প্রায় ২২৬ বছর। অসোমকৃষ্ণ এদের পরবর্তী রাজা, যারও রাজ্যকাল দীর্ঘ ছিল। অনুমান অনুযায়ী, তার রাজ্যের ১৫তম বছরে হয়তো দীর্ঘসত্র শুরু হয়। অর্থাৎ কালি সংবত ২৪০-এ এই দীর্ঘযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হচ্ছিল, যেখানে ঋষিরা উপস্থিত ছিলেন। এই যজ্ঞের ২০০ বছর পরও কিছু ঋষি ছিলেন, কারণ এই যজ্ঞের পরে প্রাচীন গ্রন্থে তাদের উপস্থিতির আর কোনও উল্লেখ নেই। ফলে বলা যায়, কালি সংবত প্রায় ৪৪০–৪৫০ পর্যন্ত ঋষিরা সক্রিয় ছিলেন।

গৌতম বুদ্ধের সময় ভারতভূমিতে কোনো ঋষি ছিল না। বৌদ্ধ সাহিত্যেও এমন কোনো প্রমাণ নেই যা দেখায় যে বুদ্ধের সময় ঋষি উপস্থিত ছিলেন। বুদ্ধের সময়ের অনেক আগে থেকেই আধ্যাত্মিক ও আচার্য যুগ শুরু হয়ে গিয়েছিল। বুদ্ধ নিজে তার সময়ের ব্রাহ্মণদের বলেন, তাদের পূর্বপুরুষরা ঋষি ছিলেন—অর্থাৎ তার সময়ে নতুন ঋষি ছিলেন না।

আর্ষ সাহিত্যকাল

যখন ঋষিদের সময়সীমা প্রায় চিহ্নিত হয়ে গেছে, তখন বলা যায় যে সমস্ত আর্ষ সাহিত্য কালি সংবত ৪৫০-এর আগে রচিত। এতে অন্তর্ভুক্ত—

  • ধর্মশাস্ত্র: মনু, বৌধায়ন, আপস্তম্ভ

  • আয়ুর্বেদ: চরক, সুশ্রুত, হরিত, জাটুকণ

  • অর্থশাস্ত্র: ভ্রদ্বাজ, পিশুন, উশনা, বৃশপতি

  • নিরুক্ত: শাকপূণি, ঔর্ণব, ঔপমান্যব

  • দর্শন: বেদান্ত, মীমাংসা, কপিল

  • ব্রাহ্মণ গ্রন্থ এবং অন্যান্য সহস্রাধিক আর্ষ শাস্ত্র

যে বিদেশী গ্রন্থকারেরা এই সাহিত্যকে খ্রিস্টপূর্বের মাত্র এক বা দেড় সহস্র বছর পূর্ববর্তী বা খ্রিস্টাব্দের করে দেখিয়েছেন, তারা পক্ষপাতিত্বের কারণে আর্ষ সাহিত্যকে গুরুতর অবমাননা করেছেন।

এই অন্যায় ও বিভ্রান্তি দূর করার জন্যই এই ইতিহাস লিখার প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে। যত তথ্য আমরা পাচ্ছি, তা আমাদের দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করাচ্ছে যে ভারত-যুদ্ধ যুগ এবং আর্ষ যুগের নির্ণয় প্রাচীন সাহিত্যকের সময়কাল নির্ধারণ করবে। গ্রন্থের অন্যান্য অংশ থেকে এই বিষয়টি আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে।

मूल लेखक द्वारा रचित तथा सम्पादित पुस्तकें

१. ऋग्वेद पर व्याख्यान

२. बार्हस्पत्य सूत्र की भूमिका

३. वैदिक कोष की भूमिका

४. वैदिक वाङ्मय का इतिहास

प्रथम भाग वेदों की शाखाएं

द्वितीय भाग- ब्राह्मण और आरण्यक

तृतीय भाग- वेदों के भाष्यकार

५. भारतवर्ष का बृहद् इतिहास - प्रथम भाग

६. भारतवर्ष का बृहद् इतिहास - द्वितीय भाग

७. भारतवर्ष का इतिहास- गुप्त साम्राज्य के अन्त तक

८. भाषा का इतिहास

e. Western Indologists

१०. वेद-विद्या-निदर्शन

११. Story of Creation as seen by Seers

सम्पादित

१. वाल्मीकीय रामायण (पश्चिमोत्तर पाठ) बाल काण्ड तथा अरण्य काण्ड का कुछ भाग

२. आथर्वण ज्योतिष

३. माण्डूकी शिक्षा

४. अथर्ववेद पञ्चपटलिका

५. उद्‌गीथाचार्य कृत ऋग्वेद भाष्य, दशम मण्डल का कुछ भाग

६. ऋषि दयानन्द सरस्वती का स्वरचित जन्म चरित

७. ऋग्-मन्त्र व्याख्या

८. ऋषि दयानन्द सरस्वती के पत्र और विज्ञापन

१. गुरुदत्त लेखावली- भाषा-अनुवाद


सम्पादक द्वारा लिखित तथा सम्पादित पुस्तकें

१. Sakas in India

२. Irrigation in India

३. प्राचीन भारत में सिचाई

४. वैदिक वाङ्मय का इतिहास - ब्राह्मण तथा आरण्यक ग्रन्थ

नोट: उपलब्ध पुस्तकें प्रणव प्रकाशन से प्राप्य हैं।

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

ব্রাহ্মণ গ্রন্থ কী

বৈদিক বাঙ্গময়ের ইতিহাস – প্রথম অধ্যায়:  ১. গ্রন্থবাচী ব্রাহ্মণ শব্দ ও এর অর্থ বৈদিক এবং সংস্কৃত সাহিত্যের গ্রন্থকার, ভাষ্যকার, বাতিককার ও ট...

Post Top Ad

ধন্যবাদ