সত্যার্থপ্রকাশে বিদ্যমান ত্রুটির জন্য দায়ী কে? - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

02 December, 2025

সত্যার্থপ্রকাশে বিদ্যমান ত্রুটির জন্য দায়ী কে?

সত্যার্থপ্রকাশে বিদ্যমান ত্রুটির জন্য দায়ী কে?

এটা এক নির্বিবাদ সত্য যে মহর্ষি দয়ানন্দ বেদ ও বৈদিক শাস্ত্রের মর্মজ্ঞ ছিলেন এবং বৈদিক ও লোকিক সংস্কৃত ভাষার অসাধারণ পণ্ডিত ছিলেন। তিনি সংস্কৃত ভাষা, শাস্ত্র, তত্ত্ব এবং নিজের অভিপ্রায় বিরোধী কোনো ভুল কখনোই করতে পারতেন না। তবুও সত্যার্থপ্রকাশ-এর দুইটি পাণ্ডুলিপি এবং দ্বিতীয় সংস্করণ (১৮৮৪)-এ অনেক ত্রুটি পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে এসব ত্রুটির জন্য দায়ী ছিলেন তাঁর বেতনভোগী লেখক অর্থাৎ লিপিকার ও প্রাথমিক সংশোধকগণ—এ তথ্য আমরা সত্যার্থপ্রকাশ-এর রচনাপ্রক্রিয়া থেকে জানতে পারি।

লিখন-কার্য সহজ করার জন্য এবং কাজের অধিকতার কারণে মহর্ষি বিভিন্ন ভাষার—যেমন সংস্কৃত, হিন্দি, ইংরেজি ও উর্দু—বেতনভুক্ত লিপিকার নিয়োগ করেছিলেন, যারা তাঁর বক্তৃতা, বক্তব্য এবং পত্রালাপ লিখে রাখত। সত্যার্থপ্রকাশ রচনার সময়ও মহর্ষি উচ্চারণ করে যেতেন এবং তখনকার নিযুক্ত লিপিকার তা লিখে নিতেন। গ্রন্থ সম্পূর্ণ হওয়ার পর তার ‘প্রেস-কপি’ও লিপিকাররাই প্রস্তুত করে।

মুখে বলা লেখা লিখতে গেলে অক্ষর, শব্দ, বাক্য—কখনো ভুল, কখনো সামনে-পিছনে লেখা—এটা স্বাভাবিক। সত্যার্থপ্রকাশ-এও লিপিকারদের এমন ত্রুটি ঘটেছে। বানান ও বাক্যগঠন-সংক্রান্ত ভুল লিপিকারদের অযোগ্যতা এবং অসাবধানতার ফল। যেহেতু লিপি লেখার দায়িত্ব তাদের ছিল—তাই লিপি-সংক্রান্ত ত্রুটিও তাদেরই। মহর্ষি প্রতিটি শব্দ একভাবেই উচ্চারণ করতেন, কিন্তু লিপিকার তাদের যোগ্যতা-অযোগ্যতা অনুযায়ী তা শুদ্ধ বা অশুদ্ধভাবে লিখত। একজন লিপিকার একটি শব্দ একভাবে লিখেছে, অন্যজন অন্যভাবে—লিপিকার সংখ্যা বেশি হওয়ায় এই বৈষম্য ঘটেছে। এমনকি একই বাক্য, অনুচ্ছেদ বা পৃষ্ঠায় শব্দ একবার শুদ্ধ লেখা হয়েছে, আবার অন্যত্র একই শব্দ ভুল—এমন বিশৃঙ্খলাও দেখা যায়।

লিখে নেওয়ার পর সংশোধনের দায়িত্ব ছিল বেতনভোগী প্রাথমিক-শোধকদের। সত্যার্থপ্রকাশের সংশোধনের দায়িত্ব ছিল পণ্ডিত জ্বালাদত্ত শর্মা এবং পণ্ডিত ভীমসেন শর্মার, কিন্তু তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করেননি। যদিও লেখার পর মহর্ষি নিজে সংশোধন ও পর্যালোচনা করতেন, তবে তিনি মূলত বিষয়বস্তু ও উদ্দেশ্যে দৃষ্টি দিতেন। ভাষাগত সম্পাদনার জন্য তিনি লিপিকার ও শোধকদের ওপরই নির্ভর করতেন।

পরবর্তীতে পাওয়া মহর্ষির চিঠিপত্র থেকে জানা যায়—তাঁর লিপিকার ও শোধক ছিলেন অযোগ্য, অসাবধান, দায়িত্বহীন, কাজে অনাগ্রহী, কুটিল এবং প্রতারণাপূর্ণ। পৌরাণিক চিন্তাধারার কারণে তাঁরা মহর্ষির সমাজসংশোধনী বিপ্লবী ভাবনার বিরোধী ছিলেন এবং অন্তরে তাঁকে অপছন্দ করতেন। যদিও মহর্ষি তাঁদের সে সময়ের মান অনুযায়ী ভালো বেতন দিতেন, তবুও তারা না আন্তরিকতা দেখিয়েছে, না নিষ্ঠা। সুযোগ পেলে তারা মহর্ষির রচনায় তাঁর অভিপ্রায়বিরোধী পরিবর্তনও করত। মনে রাখা উচিত, মহর্ষিকে প্রতারণা করা এবং বিষপ্রয়োগের চেষ্টা কারীরাও তাঁরই বেতনভোগী কর্মচারী ছিল।

তাদের কাছ থেকে কাজ করিয়ে নেওয়া ছিল মহর্ষির বাধ্যতা, কারণ তখন অধিকাংশ শিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন পৌরাণিক মানসিকতার। মহর্ষির প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে পড়ে এবং দীর্ঘদিন তাঁর সঙ্গে থেকেও পণ্ডিত ভীমসেন, তাঁর প্রয়াণের কয়েক বছর পর পুনরায় কট্টর পৌরাণিক হয়ে যায়—এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, তার পৌরাণিক প্রবৃত্তি আগেই ছিল।

মহর্ষি এসব সবকিছু ভালোভাবেই জানতেন এবং সম্ভাব্য অনিষ্ট সম্পর্কে তিনি সচেতনও ছিলেন—এ বিষয়ে পরবর্তী প্রমাণ তাঁর বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করবে। সময়ের অভাব, কাজের চাপ এবং যোগ্য লোকের অভাবে তাঁর গ্রন্থসমূহের লেখন-প্রক্রিয়া, মুদ্রণ ও সংশোধন প্রত্যাশিত মানে পৌঁছাতে পারেনি। তবে মুন্সী সমর্থদানজি ছিলেন তাঁর নিষ্ঠাবান ও তুলনামূলকভাবে যোগ্য সহযোগী, এবং যতটুকু সঠিকভাবে হতে পেরেছে, তা তাঁর সতর্কতা ও প্রচেষ্টার ফল। মহর্ষি ও মুনশীজির মধ্যে পত্র-ব্যবহার সমস্ত সত্যকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। মহর্ষি তাঁর ব্যথা ও অসন্তোষ এসব চিঠিতে খোলাখুলি প্রকাশ করেছেন।

মুদ্রণ-প্রতিতে বিদ্যমান ত্রুটিগুলো সম্পর্কে মহর্ষি সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন এবং তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে—মুন্সী সমর্থদান এগুলো সংশোধন করতে পারবেন, তাই তিনি তাঁকে এই চিঠিটি লেখেন

(ক)

“সত্যার্থপ্রকাশে কোথাও কোনো অনুচিত শব্দ থাকলে তা বাদ দিয়ে, আমাদের অভিপ্রায়-বিরোধী নয়—এমন শব্দ তার স্থানে বসাবে এবং কী বসালে তা লিখে আমাদের জানাবে।”
— ১৯ আগস্ট ১৮৮৩, মহর্ষি কর্তৃক মুন্সীজিকে লেখা পত্র (পত্র ও পত্র-ব্যবহার, খণ্ড ২, পৃ. ৭৬৪)

(খ)

উত্তরে মুন্সী সমর্থদান সত্যার্থপ্রকাশের প্রেস-কপি-র বিশৃঙ্খল অবস্থা সম্পর্কে মহর্ষিকে লিখেন—

“আপনি ভাষা পরিবর্তনের অনুমতি দিয়েছেন—এটা জানা গেল… কপিতে অনেক বিশৃঙ্খলা আছে—তাই ভুলগুলো বিবেচনা করে দেখা উচিত। আমরা এখানে সংশোধন করতে গেলে সন্দেহ তৈরি হয়।”— ২৮ আগস্ট ১৮৮৩-র পত্র

(গ)

এর মধ্যেই বেদভাষ্য-সম্পর্কে মহর্ষি তাঁকে আরও লেখেন—

“যেখানে কোনো শব্দ বাদ পড়ে—সেটা ভাষা-রচয়িতা এবং শুদ্ধ-লেখকের ভুল। আমরা প্রায়ই এটা বলেছি—এমন হলে লিখে পাঠাবে।”— ৯ সেপ্টেম্বর ১৮৮২ (খণ্ড ২, পৃ. ৬১২)

(ঘ)

আরও একটি পত্রে মহর্ষি সত্যার্থপ্রকাশ সম্পর্কে লেখেন—

“যেখানে ভাষা অসংলগ্ন হয়, বা অভিপ্রায়, অক্ষর বা মাত্রা-সংক্রান্ত ত্রুটি থাকে—তুমি নিজেই তা সংশোধন করে নেবে।”— ১৫ অক্টোবর ১৮৮৩ (খণ্ড ২, পৃ. ৬২০)

(ঙ)

সত্যার্থপ্রকাশের মুদ্রণ-প্রতিতে থাকা ভুলের প্রসঙ্গে মুন্সীজি লিখেছিলেন যে—এই ভুলগুলো সংশোধনের দায়িত্ব ছিল পণ্ডিত জ্বালাদত্তের, কিন্তু তিনি তা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছিলেন না।

“শোধন করার ক্ষেত্রে আমার দৃষ্টিও এখনো অপরিপক্ব… এই কাজ জ্বালাদত্তেরই। তিনিই সতর্কভাবে পরীক্ষা করবেন। সত্যার্থপ্রকাশ-এর শেষ ভাগ আমি একবার দেখি, সেটিও শুধু কমা ইত্যাদি চিহ্নের জন্য। তাতেও যদি কোনো ভুল চোখে পড়ে তবে বাদ দিই, কিন্তু মূল শোধনের দায়িত্ব জ্বালাদত্তেরই।”

(২৭ আগস্ট ১৮৮৩-এর পত্র)

এটি স্পষ্ট যে লেখক, এবং পন্ডিত জ্বালাদত্ত, পন্ডিত ভীমসেন ইত্যাদি শোধকেরা তাদের দায়িত্ব সততার সঙ্গে পালন করেননি, বরং খারাপ মানসিকতা এবং দায়িত্বহীনতার কারণে উল্টো ক্ষতি করেছেন। তাদের আচরণ প্রকাশ করতে গিয়ে এবং তাদের কাজের প্রতি অসন্তোষ জানিয়ে মহর্ষি বহু চিঠিতে তার বেদনা প্রকাশ করেছিলেন। তাদের সম্পর্কে মহর্ষির অভিজ্ঞ এবং লিখিত মন্তব্য পাঠক মনোযোগ দিয়ে পড়ুন—

(১) পন্ডিত ভীমসেন শর্মা সম্পর্কে:

“ব্যাকরণ ইত্যাদি শাস্ত্র পড়েছে, সেই পর্যন্তই বিদ্যা; অন্য বিষয়ে শিশুর মতো।” (পত্রব্যবহার, পৃ. ৫১৭)
“ভাষা খুব ঢিলেঢালা বানায়!” (পৃ. ৫৮৬)
“শোধন করা বইগুলোতে অনেক ভুল পাওয়া যায়!” (পৃ. ৫৭২)
“ভীমসেনকে অযোগ্যতার কারণে চিরদিনের জন্য সরিয়ে দেওয়া হয়েছে!” (পৃ. ৫৬২)
“ভীমসেন বকবৃত্তিধারী এবং বিড়াল স্বভাবের।” (পৃ. ৬৬৯)
“ভীমসেনকে আমরা না নিজেদের কাছে, না অন্য কোথাও কোনো কাজে রাখতে চাই। সে কাজে অযোগ্য এবং স্বভাবে খুবই খারাপ মানুষ।”
“সে শুধু ভণ্ড এবং মিথ্যাচারী।” (পৃ. ৬৭৩)
“সে কোনো আর্যসমাজে থাকার যোগ্য নয়।” (পৃ. ৬৭৩)

(২) পন্ডিত জ্বালাদত্ত শর্মা সম্পর্কে:

“আমরা জানতাম না শোধনে তোমার দৃষ্টি এতটাই কাঁচা… ভবিষ্যতে এমন যেন না হয়।” (পৃ. ৪৫৮)
“পন্ডিত জ্বালাদত্তের শোধনে অনেক ভুল থাকে।” (পৃ. ৪৫৮)
“…আমার ধারণা ভীমসেনের ছোট ভাই জ্বালাদত্ত। তাকে বাদ দিলে বড় কোনো ক্ষতি হবে না। কারণ সে মন দিয়ে কখনো কাজ করবে না এবং তার দৃষ্টি এতটাই কাঁচা যে সে শোধন করতে গিয়ে ভুল করে নষ্ট করবে।”
“এখন উদয়পুরে যে ভাষা সে তৈরি করেছে, শোধন করলে দেখা গেছে: কিছু জায়গায় অর্থ বাদ দিয়েছে, কিছু শব্দ বাদ দিয়েছে এবং কিছু জায়গায় শব্দ সামনে-পেছনে সরিয়ে দিয়েছে।”
(পত্র: ১৭ মার্চ ১৮৮৩)

“জ্বালাদত্ত যে ভাষা তৈরি করে, সাবধানে না হলে কোথাও ‘পোপলীলা’ ঢুকিয়ে দেবে।” (পৃ. ৭২৬)
“এবারের ভাষায় অনেক শব্দ বাদ দিয়েছে। কোথাও নিজের আঞ্চলিক ভাষাও লিখেছে।” (পৃ. ৭৬৩)
“…এই জ্বালাদত্ত একেবারে বিকারগ্রস্ত মানুষ… এখনো ভাষা ভালো বানাতে পারে না, শুধু যত্রতত্র কেটে ফেলে।” (২৩ আগস্ট ১৮৮৩-এর পত্র)

উভয়ের বিষয়ে সমালোচনামূলক মন্তব্য:

“এই দুজন (ভীমসেন ও জ্বালাদত্ত) একজন যেমন ভূতনাথ, অন্যজন তেমন প্রেতনাথ। এদের সঙ্গে বুদ্ধি করে চলবে—এরা কাজচোর।”
(২৯ আগস্ট ১৮৮২ এর পত্র)

(৩) পন্ডিত মহাদেব ও কানপুরি পন্ডিত:

“…আমার কাছে মনে হয় এ পন্ডিত অর্থলাভের জন্য কাজ করে, ধর্মের জন্য নয়… এদের প্রতি বিশ্বাস তখনই হবে যখন প্রকাশ্যে এবং অপ্রকাশ্যে একই ব্যবহার দেখা যাবে।”
(২৫ এপ্রিল ১৮৮৩ এর পত্র)

(৪) পন্ডিত দিনেশরাম:

তার মূল নাম ছিল দুলারাম—মহর্ষি নাম বদলে দিনেশরাম রাখেন।

“…সে ছিল বড় ধূর্ত— ‘বিষপূর্ণ কলস কিন্তু মুখে দুধ’। সামনে প্রশংসা করত, পিছনে নিন্দা। বলত— ‘আমি এমন বাক্য বইয়ের মধ্যে ঢুকিয়ে দেবো যে স্বামীজি প্রলয় পর্যন্তও বুঝতে পারবেন না।’ স্বামীজি তার কপটতা বুঝে তাকে সরিয়ে দেন।”
(তথ্য: মহর্ষি জীবনচরিত্র, পৃ. ৬০৫)

(৫) লিপিকর রামচন্দ্র:

“…এই চিঠি আমি অফিস থেকে আলাদা লিখেছি, কারণ অফিসের চিঠি রামচন্দ্র নকল করে এবং সে আমাদের ভাবনা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক—বরং বিপরীত…”

“…বিরোধীরা যাতে বিষয়টি না পায় তাই নম্বর দেওয়া হয়নি…”

“…ব্যবস্থাপনার সম্পদ আর্যদের অর্থে, কিন্তু কর্মচারী অনার্য—এটাই সময়ের বিদ্রূপ।”

শেষে লেখকের মন্তব্য:

মহর্ষির কর্মীরা অধিকাংশই অনার্য ছিলেন। তারা বিশ্বস্ততা নয় বরং বিরোধিতা করতেন; এমনকি বিষ প্রয়োগ করে প্রাণনাশও করেছিলেন। তাই মহর্ষির রচনাগুলো মূল্যায়ন করতে হলে সেই সময়ের বাস্তব পরিস্থিতি মাথায় রাখা জরুরি—আবেগে নয়, বিচারবুদ্ধিতে।

(১) ১৮৮৪ সালে মুদ্রিত দ্বিতীয় সংস্করণে যেসব ভুল রয়ে গিয়েছিল, তার সম্পর্কে তার মুদ্রক মুনশি সমর্তদানজি এ কথা স্বীকার করেন—

“ছাপার সময় গ্রন্থটি যাচাই করা এবং বিরামচিহ্ন বসানোর ক্ষেত্রে যথাসম্ভব যত্ন নেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাড়াহুড়োর কারণে কোথাও ভুল থেকে গিয়ে থাকলে পাঠকগণ ঠিক করে নেবেন।”
(দ্বিতীয় সংস্করণ ১৮৮৪, নিবেদন, পৃষ্ঠা ১, शोध सं. ৫)

(২) “চতুর্দশ সমুল্লাসে কোরআনের মঞ্জিল, সিপারা, সূরা এবং আয়াতগুলোর যে বিবরণ দেওয়া হয়েছে, তার বাকি সব ঠিক রয়েছে, তবে আয়াতের সংখ্যা দুই-চারটিতে হেরফের থাকা সম্ভব। সুতরাং পাঠকগণ ক্ষমা করবেন।”
(সেই বইয়েরই সূচনাপত্র, পৃষ্ঠা ২, शोध सं. ৫)

(৩) উপরোক্ত পত্র ও তথ্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে মহর্ষি এবং মুনশি সমর্তদানজি জানতেন এবং স্বীকারও করতেন যে সত্যার্থপ্রকাশ ও তার পান্ডুলিপিতে ত্রুটি রয়েছে, এবং তা লেখক, লিপিকার, সংশোধক ও প্রুফ-পরীক্ষকদের ভুল।

মহর্ষি তার পত্রে সম্ভাব্য ভুলের যে ধরনগুলো উল্লেখ করেছেন, তা হলো—

১) ভাষাগত অসংলগ্নতা।
২) মহর্ষির ভাবের বিপরীতে লেখা বা সংযোজন।
৩) অক্ষর, মাত্রা ইত্যাদিতে বানানভুল।
৪) ‘পোপলীলা’ অর্থাৎ মৌলিক মতবাদের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃত সংযোজন।
৫) শব্দ, বাক্য, পাঠ-ত্রুটি।
৬) অনুপযুক্ত শব্দ প্রয়োগ।
৭) শব্দ বা বাক্য সামনে-পেছনে লেখা বা স্থানচ্যুতি।
৮) শোধন বা প্রুফের ভুল রেখে দেওয়া।
৯) অন্য সব ধরনের মুদ্রণদোষ, সংখ্যা দোষ ও বিরামচিহ্নগত ত্রুটি।

এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর ভুল, যার উল্লেখ মহর্ষি নিজেই করেছেন, তা হলো—

“মহর্ষির মতের বিপরীতে শব্দ বা অংশ সংযোজন”,
অর্থাৎ ইচ্ছাকৃত বিকৃতি। এর বহু প্রমাণও পাওয়া গেছে।
(প্রমাণ: সত্যার্থ প্রকাশ মীমাংসা, পৃষ্ঠা ৯১–৯৯)

(৪) উপরে উল্লেখিত চিঠিগুলোর বাইরে মহর্ষি নিজেই নিজের গ্রন্থে দুটি স্থানে সম্ভাব্য ভুলের কথা স্বীকার করেছেন। দুটি উক্তি—

“যদি কোথাও ভুলক্রমে অন্যরূপ লেখা হয়ে থাকে তবে তা সংশোধন করে নিতে হবে।”
(চতুর্দশ সমুল্লাস, পৃষ্ঠা ১০৪২)

“এই গ্রন্থে (সত্যার্থপ্রকাশ) যদি কোথাও লিখতে, শোধনে বা ছাপায় ভুল থেকে যায়, তবে তা জানা গেলে এবং যাচাই হলে সত্যের সঙ্গে মিলিয়ে সংশোধন করা হবে।” (ভূমিকা, পৃষ্ঠা ৯)

মহর্ষির এই বিনয় ও স্পষ্টতার প্রসঙ্গে স্বামী শ্রদ্ধানন্দ লিখেছেন—

“কতো সরল কথা! নিজের ভুলের সম্ভাবনাও মেনে নিচ্ছেন, আর শোধন ও মুদ্রণজনিত ভুলও সংশোধনের জন্য সর্বদা প্রস্তুত।” (বেদ এবং আর্যসমাজ, পৃষ্ঠা ১৩১)

(৫) প্রথম প্রজন্মের নিষ্ঠাবান আর্য নেতৃবৃন্দ যখন সতর্কভাবে সত্যার্থপ্রকাশ পড়লেন, তাঁদেরও পরিষ্কার ধারণা হলো যে এতে বহু ভুল রয়েছে। তারা এসব ত্রুটি পরোপকারিণী সভার নজরে আনেন। প্রমাণস্বরূপ বৈদিক যন্ত্রালয়ের ব্যবস্থাপক শ্রী শিবদয়াল সিংহ পোরোপকারিণী সভার মন্ত্রী শ্রী মোহনলাল বাবুলাল পান্ড্যাজিকে একটি পত্র লিখেছিলেন, যেখানে তিনি বলেন—

পত্রের অংশ:

নং ২০৫,
বৈদিক যন্ত্রালয়, প্রয়াগ
১২–২–১৮৯০

“মহাশয়, নমস্কার। সত্যার্থপ্রকাশ মাত্র ৫৯০ কপি বাকি আছে, তাই নতুন সংস্করণ ছাপা প্রয়োজন…
শুদ্ধ সংস্করণ ছাপতে স্বামীজির প্রামাণিক গ্রন্থ লাগবে।

পাঞ্জাবের পণ্ডিত লেখরাম যে সংশোধনের কথা বলেছেন, আর অন্য পণ্ডিতরাও করেছেন— সে সব ত্রুটি সংশোধন করে এবার সত্যার্থপ্রকাশ অতি শুদ্ধভাবে ছাপা উচিত।”

আপনার দাস—
শিবদয়াল সিংহ, ব্যবস্থাপক

(৬) আমরা জানি— পরোপকারিণী সভার দ্বিতীয় সংস্করণ (পঞ্চম মুদ্রণ)-এর সংশোধন পণ্ডিত লেখরাম করেন। পরবর্তীতে অধিকাংশ প্রকাশক সেই সংস্করণ অনুসরণ করেছেন।

আর্য সমাজের অধিকাংশ জ্ঞানী ব্যক্তি শোধনের পক্ষে ছিলেন— যেমন:
পণ্ডিত লেখরাম, স্বামী শ্রদ্ধানন্দ, পণ্ডিত ভাগবদ্দত্ত, পণ্ডিত ব্রহ্মদত্ত জিজ্ঞাসু, পণ্ডিত যুধিষ্ঠির মীমাংসক, স্বামী বেদানন্দ, শ্রী জয়দেব শর্মা বিদ্যানংকার, পণ্ডিত বিশ্বনাথ বেদোপাধ্যায়, আচার্য উদয়বীর শাস্ত্রী, আচার্য ভদ্রসেন, পণ্ডিত মহেশচন্দ্র মাওলভি ‘আলিম’ প্রমুখ।

( উ-উ ) আমরা জানি যে পরোপকারিণী সভা দ্বারা প্রকাশিত সত্যার্থপ্রকাশ-এর দ্বিতীয় সংস্করণের পঞ্চম মুদ্রণটির সংশোধন পণ্ডিত লেখরামজী করেছিলেন, এবং সেটি বিস্তৃত রূপে ছিল। পরবর্তীকালে অধিকাংশ প্রকাশক সেই সংশোধন-সমূহ গ্রহণও করেছেন। অধিকাংশ প্রাজ্ঞ আর্যজন এবং বিদ্বানগণ ভুল-ত্রুটির সংশোধনের পক্ষেই ছিলেন—যেমন পণ্ডিত লেখরাম, স্বামী শ্রদ্ধানন্দ সরস্বতী, পণ্ডিত ভগবদ্দত্ত, পণ্ডিত ব্রহ্মদত্ত জিজ্ঞাসু, পণ্ডিত যুধিষ্ঠির মীমাংসক, স্বামী বেদানন্দ সরস্বতী, শ্রী জয়দেব শর্মা বিদ্যালংকার, পণ্ডিত বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আচার্য উদয়বীর শাস্ত্রী, আচার্য ভদ্রসেন, পণ্ডিত মহেশচন্দ্র মৌলভী 'আলিম ফাজিল', পণ্ডিত রামচন্দ্র দেহলভী, স্বামী স্বাধীনানন্দ সরস্বতী, শ্রী জগদেবসিংহ সিদ্ধান্তী, স্বামী বিদ্যানন্দ সরস্বতী, ডঃ ভবানীলাল ভারতীয়, স্বামী জগদীশ্বরানন্দ সরস্বতী, পণ্ডিত বিশুদ্ধানন্দ মিশ্র ও তাঁর সম্পাদক-সমিতি, আর্য সাহিত্য প্রচার ট্রাস্ট দিল্লি, আর্য সাহিত্য মণ্ডল আজমের, আর্য প্রতিনিধি সভাসমূহ, আর্য প্রতিষ্ঠানসমূহ, সার্বদেশিক আর্য প্রতিনিধি সভা দিল্লি প্রভৃতি।

প্রারম্ভিক সময়ে আর্যসমাজে কিছু রক্ষণশীল ব্যক্তিও দেখা দিয়েছিলেন, যারা বলতে লাগলেন যে সত্যার্থপ্রকাশ ইত্যাদিতে একটি অক্ষরও পরিবর্তন করা চলবে না। তাঁদের কারণেই ঋষিগ্রন্থসমূহে সংশোধন করা হবে কি হবে না—এই বিতর্ক তখন বীজরূপে জন্ম নেয়। তখন বৈদিক যন্ত্রালয়ের সভাপতি হিসেবে স্বামী শ্রদ্ধানন্দ সরস্বতী স্পষ্টভাবে মত প্রকাশ করেন যে লিপিকার ও সংশোধনকারীদের কারণে সত্যার্থপ্রকাশ-সহ অন্যান্য গ্রন্থে শুধু ভুল-ত্রুটি-ই সৃষ্টি হয়নি, বরং সুযোগ পেলে তাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু সংযোজনও করেছেন।

মুদ্রণপ্রতির দশম সমুল্লাসে "ভক্ষ্য-অভক্ষ্য" প্রসঙ্গে পাশে (হাঁশিয়ায়) লেখা মাংসভক্ষণ সমর্থনকারী এক সন্নিবেশ সম্পর্কে অনুসন্ধান করে স্বামী শ্রদ্ধানন্দ জানান যে ঐ অংশটি পণ্ডিত জ্বালাদত্ত শর্মা সংযোজন করেছেন, কারণ লেখাটি তাঁরই। তিনি সেটি মুদ্রণপ্রতি ঋষি পর্যবেক্ষণের পর, প্রেসে পাঠানোর সময় পিছন থেকে সংযুক্ত করেন, এবং তখন মুদ্রণের সময় মুন্সি সমর্থদানজির দৃষ্টি সেখানে যায় এবং তিনি সে-সম্পর্কে লেখক মহর্ষিকে অবহিত করেন। (দেখুন—‘মীমাংসা-ভাগ’, পৃষ্ঠা ২৮ এবং মূলগ্রন্থে ৫০০-তম পৃষ্ঠার মন্তব্য।)

এই পরিস্থিতিতে স্বামী শ্রদ্ধানন্দজির সত্যার্থপ্রকাশ-সম্পর্কিত বক্তব্য যা উপরে প্রদত্ত সিদ্ধান্তের সমর্থনে যথেষ্ট—

(ক)
“বেদ ঈশ্বরপ্রদত্ত জ্ঞান, তাই নির্ভ্রান্ত। সত্যার্থপ্রকাশ মানব-রচিত, তাই তাতে ভুলের সম্ভাবনা আছে। প্রথমত এটি নিশ্চিত নয় যে সত্যার্থপ্রকাশ-এ যা মুদ্রিত তা-ই সবকিছু যা ঋষি দয়ানন্দ লিখিয়েছিলেন। যেখানে প্রতিটি সংস্করণে মুদ্রণ-ত্রুটি দেখা যায় এবং বহু জায়গায় ঋষি দয়ানন্দের স্বাক্ষরসমেত সংশোধনকারীদের হস্তক্ষেপ দেখা যায়।”— বেদ এবং আর্যসমাজ, পৃ. ১৩৪

(খ)
“সারকথা—সত্যার্থপ্রকাশ-এর প্রতিটি শব্দকে সমর্থন করা হয় অজ্ঞানতাবশে, স্বার্থে এবং ভুয়া লোকলজ্জায় আটকে থেকে। তাই অত্যন্ত প্রয়োজন যে বিদ্বেষ, পক্ষপাত এবং অলৌকিক লোকলজ্জার ভয় ভুলে সত্যার্থপ্রকাশ-কে সেই মর্যাদা দেওয়া হোক (সম্প্রদায়িক স্মৃতির), যার প্রকৃতপক্ষে সেটি অধিকারী।”— একই গ্রন্থ, পৃ. ১৩৩-১৩৪

(গ)
“উপরের মুন্সি সমর্থদান-প্রদত্ত পত্রটি (যা তিনি দশম সমুল্লাসে মাংসসমর্থনকারী হাঁশিয়া-লেখ সম্পর্কে জানানোর জন্য লিখেছিলেন) পড়ে, আমি ঋষির পত্রগুলোর তারিখ-ক্রম অনুসন্ধান করি। তখন সেই হাঁশিয়ার মাংস-বিষয়ক লেখাটি নিঃসন্দেহে পণ্ডিত জ্বালাদত্তের বলে প্রতীয়মান হয়। তাঁর বেশ কিছু পত্র পাওয়া গেছে, যার সাথে সেই হাঁশিয়ার লেখার অক্ষর মিলে গেছে।”— একই গ্রন্থ, পৃ. ১৪০

(ঘ)
“উপরের দীর্ঘ উদ্ধৃতিগুলি নিঃসন্দেহে কিছুটা বিরক্তিকর মনে হতে পারে, তবে এগুলো ছাড়া জানা কঠিন ছিল যে পৌরাণিক সংস্কৃতজ্ঞরা কেমন প্রচেষ্টা করেছিলেন ঋষি দয়ানন্দের রচনাগুলো বিকৃত করতে। যদি ঋষির হাতে-লেখা মূলপত্রের সঙ্গে তাঁর মুদ্রিত গ্রন্থসমূহ মিলিয়ে দেখা হয়, তবে কে জানে কত পার্থক্য বেরিয়ে আসবে! উপরেরটি একটি কারণ—যার জন্য সত্যার্থপ্রকাশ-এর প্রতিটি অক্ষরের দায় আর্যসমাজ নিতে পারে না। তবে শুধু মুদ্রণ-ত্রুটি, লেখক এবং সংশোধক-পণ্ডিতদের অযোগ্যতা ও কুটিলতা-ই নয়, এক বিষয় আরও আছে।”— একই গ্রন্থ, পৃ. ১৪১

স্বামী শ্রদ্ধানন্দজি এবং মহর্ষি দয়ানন্দের এই উদ্ধৃতিগুলি থেকে স্পষ্ট হয় যে সত্যার্থপ্রকাশ-এ পাওয়া বহু ভুল কেবল লিপিকারদের অযোগ্যতা বা অসতর্কতার ফল নয়—বরং ইচ্ছাকৃত প্রতারণা, দায়িত্বহীনতা ও বিদ্বেষ থেকেও সৃষ্ট। এবং লিপিকার-সংশোধকদের ভুল শুধু ভাষাগত ত্রুটিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং তাঁরা ঋষির ভাব-উদ্দেশ্যের বিরোধী সংযোজনও করেছেন।

( ভয় ) ঋষি-গ্রন্থসমূহে ভুল-ত্রুটি থাকা সম্পর্কে এবং মহর্ষির লেখকদের মানসিকতা প্রসঙ্গে পণ্ডিত যুধিষ্ঠির মীমাংসকের মতও উল্লেখযোগ্য—

“এই সকল উদ্ধৃতি থেকে ভালোভাবে স্পষ্ট হয়ে যায় যে স্বামীজীর সহচর পণ্ডিতরা কতটা কুটিল স্বভাবের ছিলেন। … সহানুভূতি থাকা তো দূরের কথা, এরা নিজেদের নীচ স্বভাবের কারণে স্বামীজীর কাজ মনোযোগ-সহকারে করতেন না। … এই পণ্ডিতদের অযোগ্যতা এবং কুটিলতার কারণেই স্বামীজীর নিজের হাতে লিখিত এবং তাঁদের দ্বারা লিখিয়ে নেওয়া গ্রন্থসমূহে বহু ভুল-ত্রুটি পাওয়া যায়। স্বামীজী বহু স্থানেই এই ভুলগুলোর বিষয়ে পত্রের মাধ্যমে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।”
ঋষি দয়ানন্দের গ্রন্থসমূহের ইতিহাস, পৃষ্ঠা ৪১৬–৪১৭


( আ-আ ) এই ধরনের বহু কারণেই গ্রন্থকার মহর্ষি সত্যার্থপ্রকাশ (দ্বিতীয় সংস্করণ ১৮৮৪)-এর টাইটেল পেজ এবং মুখপৃষ্ঠায় দুটি স্থানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও দূরদর্শিতাপূর্ণ বাক্য মুদ্রিত করিয়ে ভাষাগত এবং সম্পাদনাগত ত্রুটির সমস্ত দায় ভাড়াটে সম্পাদক-শোধকদের ওপর ন্যস্ত করেছিলেন এবং নিজেকে সেখান থেকে মুক্ত করেছিলেন। সেই গুরুত্বপূর্ণ বাক্যটি হলো—

“पण्डितज्वालादत्तभीमसेनशर्म्मभ्यां संशोधितः”
(দেখুন—আরম্ভের ৪-র্থ পৃষ্ঠা)

অর্থাৎ—
সত্যার্থপ্রকাশ-এর ভাষার সংশোধন ও সম্পাদনা পণ্ডিত জ্বালাদত্ত ও পণ্ডিত ভীমসেন করেছেন।”

এই বাক্যটি বহু সংস্করণ পর্যন্ত ছাপা হয়েছে। যদি ভাষাগত দায়িত্ব লেখক নিজের বলে গ্রহণ করতেন, তবে তিনি মুখপৃষ্ঠায় দু’বার এই বাক্য মুদ্রণ করাতে দিতেন না। বেদ ভাষ্য এবং অন্যান্য বহু গ্রন্থেও আজও এই-রূপ বাক্য দেখা যায়। যারা এই বিষয়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন না এবং মহর্ষির গ্রন্থসমূহের লেখন-প্রক্রিয়া বোঝেন না—তাঁরা সন্দেহ ও পূর্বধারণার ফাঁদে পড়ে নিজেও বিভ্রান্ত হচ্ছেন এবং সত্যার্থপ্রকাশ-কেও বিভ্রান্ত করছেন।

যে পণ্ডিত বা পাঠক ঋষি-গ্রন্থসমূহে বর্তমান ত্রুটির সংশোধনে বাধা সৃষ্টি করেন—তিনি কার্যত ঋষির দেওয়া উপদেশ এবং উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধেই আচরণ করেন। মহর্ষির পত্রসমূহ তাঁদের অন্তরের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে যে তিনি তাঁর গ্রন্থসমূহকে সম্পূর্ণভাবে ত্রুটিমুক্ত দেখতে চেয়েছিলেন এবং তার জন্য যথাসম্ভব সকল প্রচেষ্টা করেছিলেন।

এক সময় অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ (যাকে অজ্ঞতাও বলা যেতে পারে), অভিমানী এবং দূরদৃষ্টিহীন চিন্তাধারার এক আর্যবিদ্বানের আবির্ভাব ঘটে পরোপকারিণী সভা, আজমেরে। তিনি আবেগে ভেসে (বা অজ্ঞানতাবশে) মুখপৃষ্ঠাটি থেকে পূর্বোক্ত গুরুত্বপূর্ণ বাক্যটি মুছে ফেলান। এর ফলে ঘটে মহাবিপর্যয়—কারণ তখন থেকে সত্যার্থপ্রকাশ-এ অবশিষ্ট সমস্ত ভুল-ত্রুটি এবং ঘাটতি মহর্ষির ওপর চাপানো হতে লাগল। অর্থাৎ—শুদ্ধ-অশুদ্ধ সব-কিছুই মহর্ষির লেখা বলে ধরে নেওয়া হলো। এই বাক্য অপসারণের ফলে শুধু এতটুকুই নয়—কিছু লোক ভবিষ্যতের সংস্করণে কোনো সংশোধন করা চলবে না—এমন অহেতুক জেদও দৃঢ় করে বসলো।

ফলে যে অবস্থান সৃষ্টি হওয়া উচিত ছিল—অর্থাৎ আর্য বিদ্বানরা মিলিতভাবে বসে একমত হয়ে সংশোধিত সত্যার্থপ্রকাশ-এর সবচেয়ে শুদ্ধ সংস্করণ প্রকাশ করবেন—তা আজ ১২৮ বছরেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও সম্ভব হলো না। সংশোধন তো প্রয়োজনীয় ছিল এবং অত্যন্ত জরুরি ছিল—তাই আর্যবিদ্বানরা তা নিজ নিজ পর্যায় থেকে আংশিকভাবে করতে লাগলেন। এর করুণ ফল হলো—সংশোধন ও পাঠভেদ হতে হতে সত্যার্থপ্রকাশ (১৮৮৪)-এর প্রতিটি সংস্করণ এক-একটির থেকে ভিন্ন হয়ে পড়ল। ফলে আর্যসমাজের সংগঠনের মতো তার ধর্মগ্রন্থও বিভেদ ও ভিন্নতার বলি হলো।

সত্যার্থপ্রকাশ-কে ধর্মগ্রন্থ বলে যারা মানেন—তাঁরা আজও নিজেদের অহংকার ও পূর্বধারণা দূর করে এটির বিষয়ে একমত হতে পারেননি। এর চেয়ে তাঁদের এবং সত্যার্থপ্রকাশ-এর দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে?

এই দুরবস্থার জন্য সংশোধন-বিরোধী মতবাদই বেশি দায়ী, কারণ সত্যার্থপ্রকাশ-সম্পর্কে তাঁদের অধ্যয়ন সীমাবদ্ধ, চিন্তা আবেগপ্রবণ ও দূরদৃষ্টিহীন, মতবাদ পূর্বাগ্রহ-নির্ভর, এবং মহর্ষির প্রকাশিত স্পষ্ট বক্তব্যের বিরোধী—যা এই গ্রন্থের সর্বাধিক অকল্যাণ সাধন করছে।

এই কথার পেছনে কিছু যুক্তিসংগত ভিত্তি রয়েছে—


১. আজ কোনো প্রকাশক—তা সে সার্বদেশিক সভা হোক, প্রাদেশিক সভা, অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান বা ট্রাস্ট, কিংবা পরোপকারিণী সভা—যাই দাবি করুক না কেন, আজ পর্যন্ত উপলব্ধ সত্যার্থপ্রকাশ-এর এমন একটি সংস্করণও নেই যা মহর্ষি মহর্ষির জীবনকালে অর্ধ-প্রকাশিত দ্বিতীয় সংস্করণ (১৮৮৪)-এর যে অবিকৃত রূপ থাকা উচিত ছিল—আজ তার অস্তিত্ব নেই। সব প্রকাশকের সংস্করণেই বহু সংশোধন রয়েছে, এবং সেই সংশোধনের সংখ্যা শতাধিক। সবচেয়ে দু:খজনক বিষয় হলো—প্রতিটি সংস্করণ একে অপরের থেকে ভিন্ন, এবং তার থেকেও বড় বিস্ময় এই যে—একই প্রকাশকের প্রকাশিত সংস্করণগুলিও পরস্পর মিলছে না।

যদি আজ কোনো সংশোধন-বিরোধী পাঠক এই মানসিকতা নিয়ে বসে থাকে যে সত্যার্থপ্রকাশ–এর “কমা, বিরামচিহ্ন পর্যন্ত পরিবর্তন করা যাবে না”, এবং সে যদি অবিকৃত দ্বিতীয় संस्करण (১৮৮৪)-এর আশা করে—তবে তাকে স্পষ্টভাবে জানা উচিত যে আজকের দিনে তার কল্পিত সেই সত্যার্থপ্রকাশ কোথাও নেই, কারণ তার চাহিদা অনুযায়ী কোনো সংস্করণ বর্তমানে ছাপাই হয় না। বাস্তবে তো অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে—যতগুলো দ্বিতীয় সংস্করণ আছে, ততগুলো নতুন সত্যার্থপ্রকাশ আছে। যদি সংশোধন করা কারও মতে দোষ হয়—তাহলে আজ সেই দোষে সকল প্রকাশক, সম্পাদক, সার্বদেশিক সভা, প্রাদেশিক সভা, প্রতিষ্ঠান এবং ট্রাস্ট সমানভাবে দায়ী—তারা যতই নিজেদের সাফাই দিতে কুটর্ক করুক না কেন।

সব সম্পাদক নিজ নিজ সংস্করণে শতাধিক সংশোধন করেছেন—এটাই প্রমাণ করে যে তাঁদের মতে সত্যার্থপ্রকাশ-এ সংশোধন অপরিহার্য ছিল, এবং এখনো আছে—এবং মহর্ষির নিজস্ব মতও এমনই ছিল। চিন্তাশীল ব্যক্তি এই সত্য অস্বীকার করতে পারবেন না। যারা সংশোধনের প্রয়োগ নিজেরাই করছেন, অথচ প্রকাশ্যে সংশোধনের প্রয়োজন অস্বীকার করছেন—তারা নিঃসন্দেহে ভণ্ডামি করছেন, কারণ সংশোধনের সূচনা তো দ্বিতীয় সংস্করণ (১৮৮৪)-এর শুদ্ধিপত্র থেকেই শুরু হয়েছিল—এবং আজও তা অব্যাহত। প্রতিদিন কেউ না কেউ ঘোষণা করছে—“নতুন সংশোধিত সংস্করণ” প্রকাশিত হবে—এবং তা প্রকাশও হচ্ছে।

যখন দ্বিতীয় সংস্করণ (১৮৮৪)-এর অবিকৃত কোনো পাঠই অস্তিত্বে নেই, এবং সেখানে শতাধিক সংশোধন ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে, তখন বোঝা যাচ্ছে না—বাকি থাকা শতাধিক সংশোধনের ক্ষেত্রে আপত্তি কোথায় ও কেন? কেন সেগুলো জেনেবুঝেই ভুল অবস্থায় রাখা হচ্ছে? বরং বলতে হয়—সংশোধন না করা মানে বর্তমান এবং ভবিষ্যতে মহর্ষি দয়ানন্দ ও সত্যার্থপ্রকাশ-এর ক্ষতিই করা। লিপিকার ও পূর্বতন সংশোধকদের ভুল মহর্ষির মাথায় চাপিয়ে দেওয়া—এটিই কি ভক্তি? আর সেই ভুলগুলোকে স্থায়ী করে রাখা—এটা কি সত্যিই সত্যার্থপ্রকাশ এবং মহর্ষির জন্য সম্মানের বিষয়?

যদি তাই হয়—তবে তারা অবিকৃত দ্বিতীয় সংস্করণ (১৮৮৪) পুনরায় ছেপে দেন—তিক্ত সত্য হলো, কেউই তা করতে পারে না।

সংশোধন-বিরোধীরাও ভুলে আছেন যে সত্যার্থপ্রকাশ–এর সংশোধনের একটি দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। বৈদিক প্রেস, আজমের থেকে দ্বিতীয় সংস্করণের ৩৬টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে—এবং প্রায় প্রতিটি সংস্করণেই পণ্ডিত-কমিটিগুলোর মাধ্যমে ধারাবাহিক সংশোধন করা হয়েছে। একই অবস্থা অন্যান্য বহু প্রকাশকও করেছেন। ফলে সব সংস্করণ এতটাই ভিন্ন হয়ে গেছে যে—আজ যেন ডজনখানেক আলাদা “দ্বিতীয় সংস্করণ” বর্তমান।

যখন সব প্রকাশক, সম্পাদক, সভা, ট্রাস্ট নিজেদের সংস্করণে কম-বেশি সংশোধন করেছেন—এবং এইভাবে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে সংশোধন অপরিহার্য—তখন প্রশ্ন ওঠে—

👉 একবারেই সকল সংশোধন করে, একটি শুদ্ধ, একক, প্রামাণিক সংস্করণ প্রকাশ করা হলো না কেন?

👉 বারবার এই দুরবস্থা কেন ঘটানো হলো?

👉 এবং আজও কেন তা অব্যাহত?

এই প্রশ্ন চিরকাল আর্যসম্পাদকদের সামনে জ্বলন্ত জিজ্ঞাসার মতো থাকবে।

দ্বিতীয় সংস্করণের ক্রমাগত সংশোধন, “শুদ্ধ সংস্করণ” নামে নতুন সংস্করণ প্রকাশ, নতুন শুদ্ধ সংস্করণের পরিকল্পনা ঘোষণা, বা শুদ্ধ সংস্করণের জন্য সভা আহ্বান—এসব থেকে তিনটি বিষয় প্রমাণিত—


১. তাঁদের মতে, দ্বিতীয় সংস্করণে এখনো ভুল রয়েছে—যেগুলো সংশোধনযোগ্য।

২. তাঁদের মতে, এ পর্যন্ত প্রকাশিত সব দ্বিতীয় সংস্করণই ত্রুটিপূর্ণ—এমনকি মহর্ষির জীবদ্দশায় অর্ধপ্রকাশিত (১৮৮৪) সংস্করণও।

৩. নতুন শুদ্ধ সংস্করণ…প্রকাশিত করার ঘোষণা করেও যে ব্যক্তি দ্বিতীয় সংস্করণে অশুদ্ধি না থাকার কথা বলে, তা তার পরস্পরবিরোধ, ভণ্ডামি এবং একগুঁয়েমি মাত্র, নাকি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সে এমন বলছে? যখন অশুদ্ধির অস্তিত্ব স্বীকারই করা হচ্ছে না, তখন তাদের দ্বারা শুদ্ধ সংস্করণ প্রকাশ করার পরিকল্পনার অর্থই বা কী থাকে? মোট কথা, এই সব কথা এই সত্যগুলোকে প্রমাণ করছে যে সকলের মতে "সত্যার্থ প্রকাশ"-এ লিপিকারাদি দ্বারা সৃষ্ট অশুদ্ধি এখনও বিদ্যমান এবং তার সংশোধন করা সকলেই অপরিহার্য বলে মনে করেন।

৪. সংশোধন-বিরোধী আর্যজনদের এটাও জেনে রাখা উচিত যে দ্বিতীয় সংস্করণ (১৮৮৪) যদি হুবহু প্রকাশ করা হয় তবে লিপিকার-শোধকদের অবহেলা এবং কাজচোরির কারণে তৈরি ত্রুটিগুলো রয়ে যাওয়ায় তা এতটাই বিকৃত প্রকাশ হবে যে বর্তমান শিক্ষিত সমাজে তা গ্রহণযোগ্য ও পাঠযোগ্য গ্রন্থই বলা যাবে না। এই কারণে তাকে আদর্শ সংস্করণ হিসেবে উদ্ধৃত করা অর্থহীন এবং সেই কারণেই এতে সংশোধনের বিরাট প্রয়োজন আছে। আর সেই সংশোধনও হওয়া উচিত সর্বাঙ্গসুন্দর, আংশিক এবং বারবার নয়।

এই অচিন্তিত ধারণাগুলোর কারণেই আমাদের প্রকাশকরা পণ্ডিত লেখরামজি, স্বামী বেদানন্দজি সরস্বতী, পণ্ডিত ভাগবদ্দত্তজি, পণ্ডিত যুধিষ্ঠিরজি মীমাংসক, স্বামী জগদীশ্বরানন্দজি সরস্বতী, ডঃ রামনাথজি বেদালঙ্কার প্রমুখ পরিশ্রম করে যে শুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য রূপ উপস্থাপন করেছিলেন, তার সুবিধা নেওয়া হয়নি এবং আজও ভাষাগত ত্রুটিযুক্ত "সত্যার্থ প্রকাশ" প্রকাশ করাকে বা অসম্পূর্ণ সংশোধন করাকেই ঋষিভক্তি ও শ্রদ্ধা বলে মনে করা হচ্ছে।

 "সত্যার্থ প্রকাশ"-এর এই ত্রুটিপূর্ণ অবস্থার ধারণা প্রথম আমার মনে জন্মেছিল যখন আমি ১৯৭০-৭১ সালে গুরুকুল কাংড়ি বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ. হিন্দি শ্রেণিতে পড়ছিলাম। তখন একদিন ‘আরম্ভিক হিন্দি ভাষা ও গদ্যে বিভিন্ন সংস্থার অবদান’ পাঠ্যবিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমাদের এক প্রফেসর বলেছিলেন — “সত্যার্থ প্রকাশের ভাষা ও সম্পাদনা সাহিত্যিক মানের নয়।” তখন আমি সেই পরোক্ষ অভিযোগের উত্তরে গুরুকুল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাপত্রিকা ‘গুরুকুল পত্রিকা’য় দুই সংখ্যায় সমাপ্ত একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখে তাতেই শান্ত হয়েছিলাম, কিন্তু সেই বাক্যবাণের যন্ত্রণা আজও আমার হৃদয়ে রয়ে গেছে। সেই ঘটনাই আমার মনে সেই ‘অস্তরীয়তা’ অনুসন্ধানের আকাঙ্ক্ষার বীজ বপন করেছিল।

বৌদ্ধিক পরিপক্বতা আসার পরেও কখনও "সত্যার্থ প্রকাশ"-কে এই দৃষ্টিতে দেখিনি যে — “এতে গণনাগত ও ভাষাগত ত্রুটি বিদ্যমান, সেগুলো কেন আছে এবং তাদের নিরসন আজও কেন হয়নি?” — ইত্যাদি। একদিন আরেকটি চমকে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটল। প্রায় পনেরো বছর আগের কথা। তখন আমি রাজকীয় মহাবিদ্যালয় ঝাঝ্জর (হরিয়ানা)-তে হিন্দি অধ্যাপক ছিলাম। ছাত্রদের শুদ্ধ উচ্চারণ ও শুদ্ধ লেখনে আমি বিশেষ গুরুত্ব দিতাম। একদিন এক ছাত্র পড়ার জন্য "সত্যার্থ প্রকাশ" চাইল। আমি তাকে একটি কপি উপহার দিলাম। কয়েকদিন পর সে আমার বাসায় এল। বিষয়বস্তুর প্রশংসা করে বলল — “স্যার! আপনি আমাদের বলেন যে অমুক-তমুক মাত্রাযুক্ত শব্দ ভুল, অথচ এতে তো সেইভাবেই লেখা আছে— তাহলে আপনি তাকে ভুল বলেন কেন? একইভাবে গণনাগত ভুলও আছে। স্যার! এমন ভুল তো সাধারণ লেখকের বইতেও থাকে না এবং এর লেখককে তো ‘মহর্ষি’ বলা হয়েছে!” আমি উল্টে-পাল্টে কয়েকটি অংশ দেখলাম এবং তাকে এই বলে সন্তুষ্ট করলাম — “মুদ্রণে এমন ভুল হয়ে যায়।” আমি জানতাম আমি ভুল উত্তর দিচ্ছি, কিন্তু এত গুরুত্ব দিয়ে কখনও এই আঘাত অনুভব করিনি যেমনটি সেই ছাত্রের সামনে করলাম। পুরোনো ক্ষতে আবার খোঁচা লাগল, কিন্তু ইংরেজি ওষুধের মতো ‘উপেক্ষা’ নামক বড়ি কিছুদিন পরে সেই যন্ত্রণাকে চেপে দিল। এরপর মনে হল— "সত্যार्थ প্রকাশ"-এ হাত দেওয়ার অধিকার কিংবা জ্ঞান আমার নেই; যার থাকবে, সে-ই করবে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে প্রশ্ন এল— “তাহলে সেই ‘বড়ো বিদ্বান’রা এই কাজ করছেন না কেন? শতাধিক বছরেও কেন কেউ এই কাজ করলেন না?” কিছুদিন পরে সেই চিন্তাও শান্ত হয়ে গেল।

সময়-সময় অভিজ্ঞতা ও বাস্তবে পাওয়া এমন নানা ক্ষুদ্র ঘটনার পাশাপাশি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এলো, যা নিস্তেজ হয়ে থাকা সেই ইচ্ছাকে আবার জাগিয়ে দিল এবং কিছু করার আকাঙ্ক্ষাকে প্রবল করে তুলল। পরোপকারিণী সভা, আজমের (রাজস্থান) মহর্ষি দয়ানন্দ থেকে শুরু হওয়া, দ্বিতীয় সংস্করণ-নির্ভর "সত্যার্থপ্রকাশ" প্রকাশের প্রায় সওয়া-শত বছরের এবং ৩৬ সংস্করণের পুরনো প্রথা ও নীতি ত্যাগ করে, ৩৭তম সংস্করণ হিসেবে মহর্ষি-উক্ত এবং সংশোধিত মূল-হস্তলিখিত (মূলপ্রতি) এবং মুদ্রণ-প্রতি ও দ্বিতীয় সংস্করণকে গৌণভাবে ভিত্তি করে, শ্রীরামজীবিরজানন্দ দেবকরনি সম্পাদিত "সত্যার্থপ্রকাশ"-এর ৩৭তম সংস্করণ বহু পরিবর্তন, সংযোজন ও সংশোধনসহ প্রকাশ করে দিল। তাকে নিয়ে কিছু লোক আর্যবিদ্বানদের মধ্যে একপ্রকার ঝড় তুলল। ঝড়ের কারণ ছিল— যেখানে একদিকে লোকেরা এ বিষয়ে অজ্ঞ ছিল, সেখানে অন্যদিকে শতবর্ষ ধরে যে "সত্যার্থপ্রকাশ" দেখা-পড়া হয়েছে, তার প্রতি তাদের সংস্কার গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। সেই অবস্থায় তাদের কাছে “মূলপ্রতি সংস্করণ” অনাবশ্যক ও অগ্রহণযোগ্য প্রকাশ বলে মনে হয়েছিল, কিন্তু এর আড়ালে বিরোধভাবও ছিল।

এ নিয়ে অনেক অযথা বিতর্ক হল, প্রবন্ধ লেখা হল, কটাক্ষপূর্ণ বিশেষণ বেছে নেয়া হল, অভিযোগ-প্রত্যাঘাত চলল, বিরোধে বইও প্রকাশিত হল, বৈঠক-গো্ষ্ঠী হল, তবু কোনও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ফলল না। দুই পক্ষই নিজের যুক্তি প্রমাণে এবং অপরকে অভিযুক্ত করতে ব্যস্ত ছিল এবং জেদ করে নিজ নিজ পছন্দের সংস্করণ প্রকাশ করতে লাগল। "সত্যার্থপ্রকাশ" আর্যসমাজের রাজনীতির মাধ্যম হয়ে উঠল।

পরোপকারিণী সভার ৩৭তম সংস্করণের প্রকাশনার প্রতিবাদে, দ্বিতীয় সংস্করণের সমর্থক বিদ্বান ও প্রকাশকদের দ্বারা ১ মার্চ ২০০৫-এ উদয়পুরের নওলখা মহলে প্রবীণ বৈদিক পণ্ডিত পণ্ডিত বিশুদ্ধানন্দজি মিশ্রের সভাপতিত্বে একটি সভার আয়োজন করা হয়, যেখানে আর্যসমাজের পঁচিশ-তিরিশ জন প্রবীণ-কনিষ্ঠ বিদ্বান উপস্থিত ছিলেন। পরোপকারিণী সভার মন্ত্রী ড. ধর্মবীরজির অনুরোধে আমি সভার পক্ষ রাখতে সেখানে উপস্থিত হই। সেখানে গিয়ে দেখি— সভার সংস্করণ নিয়ে কেবল অসন্তোষই নয়, বিরক্তিও বিরাজমান। আমি এ কথা জানতামই না। আমি স্বাভাবিক মনোভাব নিয়ে গিয়েছিলাম। কিছু নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে বাদ দিলে বাকিরা সবাই বিপক্ষে— আমার বন্ধু, কনিষ্ঠ, এমনকি প্রবীণরাও। আমি একাই আমার পক্ষের একমাত্র ব্যক্তি হয়ে রইলাম।

আলোচনা শুরু হলে একে একে বাক্য-প্রহার শুরু হল ৩৭তম সংস্করণের বিরুদ্ধে। আমি কল্পনাও করিনি যে প্রবীণ বিদ্বানদের প্রশ্নের বৃষ্টি আমাকে সহ্য করতে হবে। অডিও রেকর্ডিং হচ্ছিল, তাই প্রতিটি উত্তর সতর্কতার সাথে দিতে হচ্ছিল। পরিস্থিতি বুঝে আত্মবল জড়ো করে প্রতিউত্তরের জন্য প্রস্তুত হলাম। যেহেতু আমি উভয় সংস্করণের বিষয়ে পূর্বেই যথেষ্ট অধ্যয়ন করেছিলাম, তাই প্রশ্ন-অভিযোগ ও বাক্য-প্রহারের মধ্যেও আমি নিজ অবস্থান বিচলিত হতে দিইনি।

এখন, সত্যার্থপ্রকাশ ন্যায়াস, উদয়পুর কর্তৃক প্রকাশিত সংস্করণ দেখে আমার সেই বৈঠকে নিজের ভূমিকা নিয়ে আত্মতৃপ্তি হয়— কারণ তাতে আমার প্রায় সব পরামর্শ-যুক্তিই গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন— আমার মত ছিল যে ‘মূলপ্রতি সংস্করণ’-এ “জপ মন থেকে করা উচিত” (উদয়পুর সং. তৃতীয় সমুল পৃ. ৪১) এবং নবম সমুল পৃ. ২৪৬-এ “নির্বুদ্ধিতা তাকে কেন দেওয়া?”-র স্থলে “বুদ্ধি কেন দেওয়া?”— এ পাঠ সঠিক। উদয়পুর সংস্করণে দুটি পাঠই গ্রহণ করা হয়েছে। আমি বলেছিলাম— ‘মূলপ্রতি সংস্করণ’ বিরোধ-বিতর্ক-উপেক্ষার বিষয় নয়; বরং দ্বিতীয় সংস্করণের সংশোধনে তা কাজে লাগানো উচিত— এবং উদয়পুর সংস্করণে তার প্রায় দুই-শোর মতো পংক্তি দ্বিতীয় সংস্করণের তুলনায় অধিকতর মূল্যবান বলে গ্রহণ করা হয়েছে। এমন আরও বহু বিষয় ছিল— যা রেকর্ড রয়েছে।

এটাও সত্য যে কোন সংস্করণ নিয়ে আমার মনে কখনও বিদ্বেষ বা পক্ষপাত ছিল না; আমার ইচ্ছা ছিল— দুই সংস্করণের ভেদ মুছে একটিই সম্পূর্ণ ও শুদ্ধতম সংস্করণ প্রচলিত হোক। আমি সেই পবিত্র লক্ষ্য পূরণে সকলকে ঐকমত্যে আসার আহ্বানও জানিয়েছিলাম।

গোষ্ঠী শেষে বিদ্বানদের একটি কমিটি গঠিত হয়, যার কাজ ছিল এই পথে এগিয়ে পূর্বাগ্রহমুক্তভাবে "সত্যার্থপ্রকাশ"-এর একটি সর্বসম্মত, সর্বাধিক শুদ্ধ, প্রামাণ্য সংস্করণ প্রস্তুত করা।

দুঃখের বিষয়— কমিটির কাজ সঠিক নিরপেক্ষ পথে এগোয়নি। তা পূর্বগৃহ এবং অহংকারপূর্ণ তুচ্ছ ব্যাপারে জড়িয়ে নিষ্ফল হয়ে গেল— এবং এর সাথে "সত্যার্থপ্রকাশ"-এর "ঐক্যবদ্ধ সংস্করণ"-এর স্বপ্নও ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত "সত্যার্থপ্রকাশ"-এর দুটি ধারা প্রচলিতই রইল।

বহু বছর ধরে কোনও বিদ্বদ্‌-মণ্ডলী "সত্যার্থপ্রকাশ"-এর "একক সংস্করণ"-নির্মাণ বিষয়ে নিরপেক্ষ উদ্যোগ নিল না। যেতে দেখে, ‘সত্যধর্ম প্রকাশন’-এর পরিচালক আচার্য সত্যানন্দজি নিষ্ঠিকের বারবার অনুরোধে, আমার মনে এই কাজটি গ্রহণ করার ভাবনা তৈরি হল। সত্যার্থপ্রকাশ-সংক্রান্ত পূর্বের বিতর্ককালীন সময়ে বহুবার আমাকে বিভিন্ন সংস্করণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ হয়েছিল। যতই গভীরভাবে অধ্যয়ন এগোতে লাগল, ততই তাতে লিপিকার ও সংশোধকদের দ্বারা ছেড়ে দেওয়া “ত্রুটিপূর্ণ” অংশগুলি স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। গত কয়েক বছরের মধ্যে আমি বহু বিদ্বান, প্রকাশক ও পাঠকের সামনে বহুবার সত্যার্থপ্রকাশ-এ পাওয়া সেই “অস্তরীয়” বিষয়বস্তু এবং “প্রমাণিত ভুলগুলির” আলোচনা করে এই কথাটিই জোর দিয়ে বলেছি যে সেগুলো দূর করে একটি শুদ্ধতম সংস্করণ প্রস্তুত করা দরকার। আশ্চর্যের বিষয়— কয়েকজনকে বাদ দিলে বেশিরভাগই এই গুরুতর কাজ থেকে দূরে থাকলেন। তাঁরা এতে আগ্রহ নিলেন না, আমার উপস্থাপিত আপত্তির জবাব দিলেন না এবং এই কাজে উৎসাহও দেখালেন না। কিছুজন আবার বিরোধ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কায় নীরবতা অবলম্বন করলেন। তবে কিছু চিন্তাশীল ব্যক্তি মিলেছিলেন যাঁদের হৃদয়ে বিকৃত-অবস্থায় থাকা সত্যার্থপ্রকাশের জন্য বেদনা ছিল এবং তাঁরা এটিকে সংশোধন করা জরুরি মনে করতেন।

অতএব, সকল পক্ষের উৎসাহহীনতা ও ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর দৃষ্টিভঙ্গি দেখে আমি এই পরিকল্পনায় নিরপেক্ষ ভঙ্গিতে গবেষণাকার্য ঘোষণাপূর্বক শুরু করলাম। কিছু লোকের চরিত্রের বিস্ময়কর দিক হল— যেখানে ইতিবাচক দিকটিতে সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন ছিল, সেখানে নীরব রইলেন, অথচ নেতিবাচক অবস্থানে বিরোধ করতে সক্রিয় হয়ে উঠলেন। তাঁরা শুধু কাজের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করারই চেষ্টা করেননি, বরং অপপ্রচার ও বিদ্বেষপূর্ণ পরিকল্পনাও করেছেন। আশ্চর্যজনক বিষয়— যারা এত বিরোধ তোলেন, তারা আমার প্রশ্নের জবাবও দিতে পারেননি, তবুও বিরোধ করাকে তারা অযথা মনে করেননি। ভবিষ্যতেও এমন অসার বিরোধীদের মুখোমুখি হতে হবে, কিন্তু আমার দৃঢ় সংকল্প— সত্যার্থপ্রকাশের শুদ্ধতম সংস্করণের জন্য প্রতিটি পরিস্থিতির মুখোমুখি হব।

এখন আমি নিশ্চিত হয়েছি যে যারা অযথা বিরোধ-বিতণ্ডা করছে, তাদের কাছে না আছে সত্যার্থপ্রকাশ-সংক্রান্ত আপত্তির উত্তর, না তারা এ ধরনের গবেষণার দীর্ঘমেয়াদি প্রয়োজন ও গুরুত্ব বোঝে, না তারা সত্যার্থপ্রকাশের প্রকৃত অবস্থার ধারণা রাখে। তাদের কাছে রয়েছে কেবল গোঁড়ামি, সংকীর্ণ চিন্তাভাবনা এবং অহং-মিশ্রিত পক্ষপাত! লিপিকার, সংশোধক ও সম্পাদকদের অসতর্কতা, অযোগ্যতা ও অবহেলাজনিত ভুলগুলো মহর্ষি দয়ানন্দের নামে চাপিয়ে তাঁকে ছোট করে রাখার প্রচেষ্টা যারা করে, তারা কি একবারও ভেবে দেখে— তারা কী করছে? গত ১২৮ বছর ধরে আমাদের বিদ্বানরা প্রতিটি সংস্করণে কাটাছেঁড়া করতেই সময় নষ্ট করেছেন, তবু পাঠকদের একটি শুদ্ধ সংস্করণ দিতে পারেননি। বরং প্রতিটি সংস্করণে নতুন নতুন পাঠভেদ সৃষ্টি করে একটিকে আরেকটির থেকে আলাদা করে তার হাস্যকর ও অপ্রামাণিক অবস্থা তৈরি করেছেন।

আমাদের সরল-বিশ্বাসী পাঠকেরা ভুলবশত এই দুরবস্থাকে সুস্থ অবস্থা এবং অবক্ষয়কে উন্নতি বলে ধরে নিয়েছেন। এখন পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে— সকল সম্পাদক ও প্রকাশক নিজেদের সংস্করণকে ব্যক্তিগত অহং, জেদ ও মর্যাদার প্রশ্ন বানিয়ে ফেলেছেন। তাদের ব্যক্তিগত ভাবনার চাপে অবহেলিত সত্যার্থপ্রকাশ নিজের বিদ্রূপাদ্য ভাব দেখে নীরব অশ্রু ফেলছে, আর সকলে নিজেদের ঢোল নিজ নিজ সুরে বাজিয়ে তাতেই তৃপ্ত।


২. সংশোধন-বিরোধীদের বৈপরীত্যপূর্ণ মানসিকতা ও আচরণ

সত্যার্থপ্রকাশের সর্বাঙ্গীন সংশোধন-পরিকল্পনার অনাহুত বিরোধ ও বিতর্ক তুলতে থাকা লোকদের মধ্যে বহু পরস্পরবিরোধী এবং বিস্ময়কর মানসিকতা দেখা যায়—

১. কিছু লোকের গবেষণা বা দূরদর্শিতার সঙ্গে দূরদূরান্তের সম্পর্ক নেই। যিনি সাধারণ ভাষা-জ্ঞানও রাখেন না, সেই অযোগ্যতম মানুষও এ বিষয়ে মন্তব্য ও সিদ্ধান্ত এমনভাবে দেন যেন তিনিই এই বিষয়ে প্রধান বিশেষজ্ঞ। তিনি নিজেকে বিরাট বিদ্বান, সর্বাধিক বুদ্ধিমান ও সত্যার্থপ্রকাশের প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষী বলে মেনে নিয়ে, নিজেকে স্বয়ংঘোষিত উগ্র নেতা ও সত্যভক্ত হিসেবে তুলে ধরতে চান এবং গবেষক বিদ্বানদের পিছনের সারির মানুষ হিসেবে দেখাতে চেষ্টা করেন। তিনি ভুলে যান— গবেষক যদি তাঁর থেকে বড় না-ও হন, অন্তত তার সমমানের বিদ্বান ও আন্তরিক সত্যান্বেষী তো বটেই।

এমন লোকেরা সত্যার্থপ্রকাশকে এত…স্তরহীন গ্রন্থ মনে করে নিয়েছে যে, যেখানে যে-কেউ এলোমেলো মন্তব্য ও সিদ্ধান্ত দিতে পারে; অথচ সত্যার্থপ্রকাশ একটি গম্ভীর শাস্ত্র, যাকে বুঝতে বিদ্বানদেরও পরিশ্রম ও চিন্তন প্রয়োজন হয়। অনধিকারী ব্যক্তির দ্বারা সত্যार्थপ্রকাশ-এর উপর সিদ্ধান্ত দেওয়া মানে তার অবমূল্যায়ন করা।

আমি মনে করি, সত্যার্থপ্রকাশ নিয়ে আলোচনা করা বা জিজ্ঞাসা-সংশয় তোলার অধিকার প্রত্যেক স্বাধ্যায়ী’র আছে, কিন্তু মন্তব্য করার ও সিদ্ধান্ত দেওয়ার অধিকার কেবল সেই বিশেষজ্ঞের, যিনি দুইটি হস্তলিখিত প্রতিলিপি (মূলপ্রতি ও মুদ্রিত প্রতি) মিলিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন; যিনি বৈদিক শাস্ত্র ও তত্ত্বের জ্ঞান রাখেন; যিনি ঋষিকালীন এবং আধুনিক হিন্দি ভাষা ও গদ্য-শৈলীসহ ব্যাকরণের জ্ঞান রাখেন; যিনি বিভিন্ন সংস্করণের তুলনা করে সমালোচনামূলক পাঠপর্যালোচনা করেছেন; যার কোনো পূর্বাগ्रह নেই এবং যিনি নিজের কল্পিত অর্থহীন ব্যাখ্যা জোর করে চাপিয়ে দেন না; এবং যার অন্যান্য মতবাদ-সম্পর্কিত শাস্ত্র-জ্ঞান রয়েছে। এমন জ্ঞান না থাকলে — সে বিদ্বান হোক বা অ-বিদ্বান — সত্যার্থপ্রকাশ-এর উপর সিদ্ধান্তমূলক মন্তব্য করা উচিত নয়।

সংস্কার-বিরোধীদের দ্বিতীয় অদ্ভুত মানসিকতা হল—সংস্কারের উপকারিতা বোঝালেও তারা গ্রহণ করে না এবং সবসময় এমন আচরণ করে যেন — "চিরিও আমার, পাটিও আমার"। যখন কোনো বিদ্বান বা সম্পাদকেরা মন্তব্য ছাড়া নিঃশব্দে ভুল সংশোধন করেন, তখন তারা হায়-তোবা তোলে — “এরা গোপনে সংশোধন করে ফেলেছে!”, “হায়! সব নষ্ট করে দিল!”, “এরা তো আস্তিনের সাপ!”, ইত্যাদি। কিন্তু যখন কেউ ঘোষণা সহকারে এবং যুক্তিসহ সংশোধন করেন, তখন বলে — “এরা তো বিরোধীদের হাতে অস্ত্র দিয়ে দিল।” অথচ এই অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, কারণ আজ পর্যন্ত কোনো বিরোধী কোনো আর্য-বিদ্বানের সংশোধিত সংস্করণকে ভিত্তি করে সমালোচনা করেনি। যদি সমালোচনা হয়েছে — তবে তা কেবল কথিত নিজেদের পক্ষ থেকেই হয়েছে। তাছাড়া আমরা তো প্রমাণ করেছি যে ভুলগুলোর দায় ঋষির নয়—ঋষির লিপিকার-সহকারীদের এবং সম্পাদকদের, এবং আমরা প্রমাণ দিয়েছি যে ঋষিকে এই দায় থেকে মুক্ত রাখা উচিত। আমাদের গবেষণাকর্ম সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির — যেখানে নিষ্পক্ষ মানদণ্ডে পাঠ-নির্ধারণ ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

উভয় পক্ষের চিন্তাধারায় বিরাট পার্থক্য রয়েছে। সংশোধন-বিরোধী আবেগপ্রবণ ও দূরদর্শিতাহীন আর্যজনেরা ভুলগুলোকে চেপে রেখে সত্যার্থপ্রকাশ-এর ত্রুটিকেই সৌন্দর্য ও গৌরব মনে করে; কিন্তু আমরা মনে করি—সেই ভুলগুলোকে গবেষণা-রূপী সাবান দিয়ে ধুয়ে চিরস্থায়ীভাবে শুদ্ধ করা—সেটিই সমাধান এবং ঋষির মর্যাদা-রক্ষা। যাতে ভবিষ্যতে কোনো ব্যক্তি প্রমাণসহ আঙুল তুলতে না পারে। লুকিয়ে থাকা ভুল যেকোনো সময় প্রকাশ পেতে পারে, কিন্তু পরিশোধিত রূপ চিরকাল উজ্জ্বল থাকে। এতে সত্যার্থপ্রকাশ-এর মর্যাদা ও ঋষির গৌরবই বৃদ্ধি পাবে।

তৃতীয় অদ্ভুত দিক হল—সংস্কার-বিরোধীরা সত্যার্থপ্রকাশ-এ বিদ্যমান ভুলগুলোর কোনো যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দেয় না, না উত্তর দেয়, না নিজেরাই তা সংশোধন করার চেষ্টা করে। উত্তর দিলেও তা সত্যার্থপ্রকাশ-এর ভাষায় নয়—বরং নিজেদের কল্পিত, অযৌক্তিক, টানাটানি-ভরা ও পক্ষপাতদুষ্ট ব্যাখ্যা হয়। এই তাদের আত্মবিরোধী এবং অস্বাভাবিক মানসিকতা।

বাস্তবে — তারা সার্বিক সংশোধনের অপরিহার্যতা ও গভীর গুরুত্বই বুঝতে পারেনি। কখনও কখনও মনে হয়—শুদ্ধতার মূল্য এবং অশুদ্ধতার ভবিষ্যৎ ক্ষতি সম্পর্কে তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। যদি সেই জ্ঞান তাদের থাকত — তবে এত গুরুতর বিষয়ের উপরে তারা বিতণ্ডা সৃষ্টি করত না।

কিছু লোক তো এই বিষয়কে নিজেদের রাজনীতি করার হাতিয়ার বানিয়েছে। আবার কিছুদের চিন্তাহীন ধারণা—যে এখন পর্যন্ত যে-কিছু সংশোধন হয়েছে তা আপত্তিহীন, কিন্তু এখন যা হচ্ছে তা আপত্তিকর। অথবা যদি তাদের পছন্দের কোনো বিদ্বান বা তারা নিজেরা নীরবে বা প্রকাশ্যে সংশোধন করে থাকেন—তবে তা গ্রহণযোগ্য—আর অন্য সম্পাদক করলে তা বিরোধযোগ্য! এই চিন্তায় কোনো যুক্তি নেই, কারণ সংশোধনের ন্যায্য ভিত্তি হল অশুদ্ধি, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নয়। সংশোধন হয় ত্রুটি-নির্ভর, ব্যক্তি-নির্ভর নয়। তাদের পঞ্চম অদ্ভুত মানসিকতা হলো—আজ বিধর্মীদের বিরোধী তরফ থেকে এবং কিছু কথিত স্বধর্মীদের দিক থেকেও সত্যার্থপ্রকাশ-এর উপর বহু আঘাত আসছে। বিতণ্ডা সৃষ্টি করা এদের মধ্যে অনেকেই—না তার উত্তর দেয়, না প্রতিবাদ করে, না কষ্ট অনুভব করে। তাদের ভণ্ডামি-ভরা ব্যথা এমন—যা নিজেদের লোকের সামনে জেগে ওঠে, অথচ বিরোধীদের সামনে নিস্তেজ হয়ে যায়! তবুও তাদের দম্ভভরা দাবি—তারাই সত্যার্থপ্রকাশ-এর প্রকৃত রক্ষক, তারাই সত্যিকারের “ঋষিভক্ত”।

এ প্রসঙ্গে স্বামী শ্রদ্ধানন্দ সরস্বতীর সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে, যা তিনি একই পরিস্থিতিতে লিখেছিলেন—

“আর্য সমাজে স্বার্থান্বেষীরা নীতি-শাস্ত্র শুধু তখনই মনে করে, যখন তাদের এমন কোনো ভাইকে নিচে নামাতে হয় যার সঙ্গে কোনো কারণে তাদের বৈরিতা হয়েছে। … ঋষি দয়ানন্দ কী মানতেন এবং তার কথার অর্থ কী—এ সব বিষয় এমন লোকেরা নিজেরাই স্থির করে নেয়, আর অন্যকে ‘ননু-নচ’ করার অধিকার দেয় না।”
(বেদ এবং আর্যসমাজ, পৃষ্ঠা ১৩২–১৩৩)

নিজের ধর্মগ্রন্থকে ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত করে সর্বশুদ্ধ রূপ দেওয়ার মতো পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যকে যারা ভেবে-চিন্তে না দেখেই বিরোধিতা করে—তাদের আচরণ ঠিক এমন, যেন কারও দেহে রোগ আছে এবং বৈদ্য বা ডাক্তার সেই রোগ চিনে জানিয়ে দিল—আর রোগী তাকে উল্টো প্রশ্ন করে—“আপনি আমাকে রোগী বললেন কেন?” এর চেয়ে নির্বোধ আর কে হতে পারে? তাকে জ্ঞানীদের দলে গণ্য করবে কে? একজন বুদ্ধিমান তো বরং চিকিৎসককে ধন্যবাদ জানাবে যে—“ভালো হলো সময়মতো ধরা পড়েছে, নইলে পরে এই রোগ দুরারোগ্য হয়ে যেত।”

ঠিক একই কথা সত্যার্থপ্রকাশ-এর গবেষণা-কার্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যাঁরা চিন্তা-শক্তিহীন ও দূরদর্শিতা-শূন্য—তারাই এই গবেষণা-কার্য নিয়ে বিরোধিতা করবে; কিন্তু জ্ঞানী, বিবেচক ও দূরদর্শী মানুষ এটাকে কেবল উপকার বলেই মেনে নেবে।

আমার বক্তব্য আরও এই যে—যে ভুলগুলো প্রকাশ্যে এসেছে, সম্পাদক বা গবেষকেরা সেগুলো নিজেরা সৃষ্টি করেননি, কিংবা নতুন করে বসিয়ে দেননি। এগুলো সত্যার্থপ্রকাশ-এর জন্মকাল থেকেই—১২৮ বছরেরও বেশি সময় ধরে—বারবার ছাপা হয়েছে, প্রকাশকেরা সেগুলো ছাপিয়েই গিয়েছেন। এগুলোর সংস্করণও বিভিন্ন প্রকাশকের। তাহলে আপত্তি হওয়া উচিত—ত্রুটিপূর্ণ সংস্করণের বিরুদ্ধে, অথবা ভুলগুলোর বিরুদ্ধে, অথবা যারা ভুল করেছে—সেই লিপিকার ও প্রাথমিক সম্পাদকদের বিরুদ্ধে। পূর্ব থেকে বর্তমান থাকা ভুল চিহ্নিত করে তা জানানো এবং সংশোধনের উদ্দেশ্যে কাজ করা—এটা কোনো অপরাধ নয়। বরং প্রশংসনীয় যে—নিজ ধর্মগ্রন্থকে শুদ্ধ করে সর্বোত্তম সংস্করণ তৈরি করার প্রয়াস নেওয়া হচ্ছে।

যেমন আমি বলেছি—সত্যার্থপ্রকাশ-এর সংশোধন-প্রক্রিয়ার ইতিহাস যত দীর্ঘ, সংশোধন-বিরোধিতার ইতিহাসও প্রায় ততটাই দীর্ঘ। কিন্তু দুঃখ হয় সবচেয়ে যখন দেখি কিছু বিদ্বান বা বিরোধী—লিপিকার ও সম্পাদকদের ভুলকে মহর্ষির বক্তব্য বলে আঁকড়ে থাকে এবং ভুলকে সঠিক প্রমাণ করতে নিজেরা অসংগত ব্যাখ্যা টানাটানি করে। তারা জেদ ধরে নিজের একটা পক্ষ তৈরি করেছে।

এমন লোকেরা—না ঋষির সত্য বক্তব্য মানতে প্রস্তুত, না পান্ডুলিপিগত প্রমাণ গ্রহণ করতে চায়, না যুক্তি-প্রমাণ মানে, না অন্য পক্ষের যুক্তি শোনে। ঋষির নাম নিয়ে ভুলে অটল থাকা—ওটাই যেন তাদের কাছে ‘ঋষিভক্তি’। তারা এমন এক ভ্রমে বাস করে—“আমরাই কেবল সত্যার্থপ্রকাশের ভক্ত, আমরাই ঋষির একমাত্র হিতৈষী।” বাস্তবে তারা এতটাই পক্ষপাত ও ভ্রান্ত অহংকারে আবদ্ধ যে—ঋষিভক্তি ও ঋষির ভাবনার প্রকৃত অর্থ নিয়ে ভাববার সামান্য মনও তাদের মধ্যে নেই।

চিন্তা-মননের বহু ক্ষেত্রে আমি দেখেছি—অনেক আর্য-বিদ্বান পর্যন্ত সুস্পষ্ট ভুলের ক্ষেত্রেও জেদ ধরে ভুল দিকেই দাঁড়ায়। এমন তথাকথিত “ঋষিভক্ত” বিদ্বানদের কাছে আমি বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করব—যেন তারা ঋষির এই কথাগুলো বিবেচনা করেন…গম্ভীরভাবে মনন করুন—

“মানুষের আত্মা সত্য–অসত্যের জ্ঞানী; তথাপি নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধি, একগুঁয়েমি এবং অজ্ঞতার দোষে সত্যকে ছেড়ে অসত্যের দিকে ঝুঁকে পড়ে।” (সত্যার্থপ্রকাশ, ভূমিকাঃ পৃ. ৯)

আর্য পাঠকবৃন্দ! এখন আমাদের এ বাক্য উদ্ধৃত করা বন্ধ করা উচিত যে— “এই গ্রন্থে কোথাও ভুল-ত্রুটি যদি সংশোধন বা মুদ্রণে অজান্তে থেকে যায়, তা জানা-জনানোর পর, যেভাবে সত্য হবে সেভাবেই করে দেওয়া হবে।” (ভূমিকা পৃ. ৯) —এই বক্তব্য মহর্ষির জীবদ্দশার জন্য ছিল। মহর্ষি এখন আর নেই, এবং তিনি জানতে বা জানাতে আসবেন তাও নয়। এ কথাও গ্রহণযোগ্য বা সম্ভব নয় যে মহর্ষির সময়কার দ্বিতীয় সংস্করণ (১৮৮৪) যথাযথভাবে ছাপা হবে, কারণ তাতে বহু সহস্র ভুল রয়ে গেছে। এখন এই সংশোধনের কাজ তাদেরই করতে হবে যারা তাঁর যোগ্য এবং সক্ষম অনুসারী। এখন সময় এসেছে মহর্ষির নিম্নোক্ত বাণীর উপর মনোযোগ দিয়ে তার অনুসরণ করার—

“যদি কোথাও ভুলবশত অন্যরূপে লেখা হয়ে থাকে তাহলে তা শুদ্ধ করে নেবেন।” (সত্যার্থপ্রকাশ ১৪তম সমুল্লাসের শেষে পৃ. ১০৪২)

সংশোধন-বিরোধী মানসিকতার আর্যজনেরা এই গুরুতর কথাটিও চিন্তা করুন। সময় সর্বদা একরকম থাকে না; পরিস্থিতিও সবসময় অনুকূল থাকে না। রাজনৈতিক অবস্থাতেও পরিবর্তন আসবেই। যথাযথ জ্ঞানের অভাবে আজ কিছু মানুষ এই গবেষণাকর্মকে ভিন্নভাবে দেখতে পারেন, কিন্তু তাদের এই সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ আশঙ্কার কথাও ভাবতে হবে— ভবিষ্যতে কখনো কেউ, কোনোভাবে, এমন ব্যক্তি প্রকাশ পেতে পারে যে বিদ্যমান ত্রুটিগুলোর ভিত্তিতে সত্যার্থপ্রকাশ এবং মহর্ষির মানহানি করতে উদ্যোগী হবে। পাঠক স্মরণ রাখবেন, সত্যার্থপ্রকাশের উপর ইতিমধ্যে আটটিরও বেশি মামলা এবং নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। সুতরাং উত্তম হবে দ্রুতই অহেতুক জেদ ও অহং ত্যাগ করে লেখক–সংকলক বা অন্য যে কোনো কারণে থেকে যাওয়া ভুলগুলিকে ঋষিহিতার্থে দূর করে আমাদের ধর্মগ্রন্থকে সর্বোচ্চ শুদ্ধ রূপে প্রতিষ্ঠা করা। এখানেই বুদ্ধিমত্তা, এখানেই দূরদৃষ্টিসম্পন্নতা, এখানেই ঋষিভক্তি, এখানেই সত্যার্থপ্রকাশের মঙ্গল। সকল মত ও পরম্পরার অনুসারীরা এমনই বুদ্ধিপূর্ণ ও দূরদর্শী কার্য সম্পাদন করেছেন — ইতিহাস তার সাক্ষী।

৩. সকল মত–পদ্ধতির ‘ধর্মগ্রন্থের’ পাঠ–নির্ধারণ পরে সম্পন্ন হয়েছে—

সকল মত–পদ্ধতির বর্তমান ধর্মগ্রন্থ তাঁদের প্রবর্তক বা প্রচারক মৃত্যুর পর তাঁদের অনুসারীদের দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে। এ কাজ কখনো অস্বাভাবিক বা আপত্তিকর বলে বিবেচিত হয়নি। এ বিষয়ে কিছু ঐতিহাসিক প্রমাণ উপস্থিত করা হচ্ছে—

১. মহাত্মা বুদ্ধের ক্ষেত্রে

মহাত্মা বুদ্ধ তাঁর জীবদ্দশায় নিজে কিছু লিখেননি। তাঁর প্রদত্ত উপদেশসমূহ তাঁর শিষ্যরা সংকলন করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর উপদেশগুলিতে যে পারস্পরিক বিরোধ, পাঠভেদ বা মতভেদ প্রতীয়মান হয়েছিল তা দূর করার জন্য বৌদ্ধ ভিক্ষু–পণ্ডিতদের ছয়–সাতটি সঙ্গীতি (সম্মেলন) অনুষ্ঠিত হয়। তখন পাঠ–নির্ধারণ বা গ্রন্থ–নির্ধারণ সম্পন্ন হয়। তবু সম্পূর্ণ একমত হওয়া সম্ভব হয়নি এবং মতভেদের কারণে অনেক সম্প্রদায় গড়ে ওঠে— যেমন: দিগম্বর, শ্বেতাম্বর, হীনযান, মহাযান, মাধ্যমিক, সৌত্রান্তিক, যোগাচার, বৈভাষিক ইত্যাদি। তথাপি আজ যে পাঠ উপলব্ধ তা বুদ্ধের মৃত্যুর পরে বৌদ্ধ পণ্ডিতরা সঙ্গীতির মাধ্যমে নির্ধারণ করেছেন।

২. যিশু খ্রিষ্টের ক্ষেত্রে

যিশু খ্রিষ্টও জীবদ্দশায় কিছু লেখেননি। যা পাওয়া যায় সবই তাঁর অনুসারীদের লিখিত। “বাইবেল” ৭২টি পুস্তিকার সংকলন, যার দুই ভাগ—
১. পুরাতন ধর্মগ্রন্থ বা তৌরাত
২. নতুন ধর্মগ্রন্থ বা ইনজিল

প্রথম অংশ ইহুদিদের কাছে মান্য এবং প্রধানত হজরত মূসার প্রচারিত ধর্মগ্রন্থ; দ্বিতীয় অংশ খ্রিষ্টানদের কাছে মান্য। বিস্ময়ের বিষয় হল—একই গ্রন্থ দুই অংশে যুক্ত এবং একটি ধর্মগ্রন্থ হিসেবে পরিচিত হলেও উভয় সম্প্রদায় পরস্পরের অংশকে মানে না এবং মতভেদের কারণে ইতিহাসে ভয়াবহ যুদ্ধও সংঘটিত হয়েছে।

ইসাই সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থ বাইবেল নামটিও ইসার মৃত্যুর বহু বছর পর নির্ধারিত হয়েছে। যেমন আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, বাইবেলে মোট ৭২টি গ্রন্থের সংকলন, যার প্রথম অংশে (ওল্ড টেস্টামেন্ট) ৪৫টি এবং দ্বিতীয় অংশে (নিউ টেস্টামেন্ট) ২৭টি গ্রন্থ রয়েছে। এগুলো বিভিন্ন ব্যক্তির লিখিত। এই গ্রন্থগুলোর সংকলন হওয়ার সিদ্ধান্তও এক শতাব্দীরও বেশি সময় পরে গ্রহণ করা হয়। আজও এই গ্রন্থগুলোর সবকটিকে ঈশ্বরপ্রেরিত বলে স্বীকার করার বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। ‘ক্যাথলিক’সহ কয়েকটি খ্রিষ্টীয় সম্প্রদায় ৭২ গ্রন্থসম্বলিত বাইবেল গ্রহণ করে, কিন্তু ‘প্রোটেস্ট্যান্ট’ সম্প্রদায় সাতটি গ্রন্থ তাদের বাইবেলে সংযোজন করে না—
১. টোবিয়াস
২. জুডিথ
৩. ম্যাকাবি
৪. উইজডম
৫. সিরাহ
৬. দানিয়েল
৭. এসথারের কিছু অংশ।

এইভাবে খ্রিষ্টানদের মধ্যে দুটি বাইবেল প্রচলিত।

বাইবেলের অনুবাদ হাজারেরও বেশি ভাষায় হয়েছে এবং অনুবাদে বৈচিত্র্যের পরিমাণ অপরিমেয়। বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা সময়ে সময়ে প্রয়োজনে ভাষা ও অনুবাদে সংশোধন সাধন করে। এতে যেমন আপত্তিকর অংশগুলো সংশোধিত বা নমনীয় করা হয়, তেমনি বাইবেলকে আরও শুদ্ধ করার চেষ্টাও করা হয়। এটি তাদের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ।

৩. কোরআন সম্পর্কে

মুসলমানদের বিশ্বাস—কোরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর হৃদয়ে অবতীর্ণ হয়েছিল। হজরত মুহাম্মদ (সা.) শিক্ষিত ছিলেন না। যখনই তাঁর কাছে কোনো আয়াত অবতীর্ণ হতো, তিনি তা উচ্চারণ করতেন এবং তাঁর সঙ্গে থাকা শিক্ষিত সঙ্গীরা তা লিখে রাখতেন—কখনো কাঠে, কখনো পাথরে, কখনো হাড়ে, কখনো পাতায়। এগুলো সংগ্রহ করেই কোরআনের রূপ সম্পন্ন হয়।

ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়—হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর মৃত্যুর পর কোরআনের একাধিক পাঠভেদ প্রচলিত ছিল। ৬৫১ খ্রিষ্টাব্দে হজরত উসমান খলিফা হন। তিনি চারজন বিদ্বানকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন এবং নির্দেশ দেন যে, কোরআনের সব প্রচলিত সংস্করণ সংগ্রহ করে একটি নির্ভুল পাঠ নির্ধারণ করতে। সেই সঙ্গে সংগ্রহ করা হয় হজরত মুহাম্মদের স্ত্রী বিবি হাফসার সংরক্ষিত কপি।

কমিটিতে ছিলেন—
১. আবদুল্লাহ বিন জুবাইর
২. সাঈদ বিন আস
৩. আবদুর রহমান বিন হারিস
৪. যায়েদ বিন সাবিত

বর্তমান প্রচলিত কোরআনের পাঠ এ কমিটির নির্ধারিত। যেহেতু হজরত উসমান শাসক ছিলেন, তিনি নির্দেশ দেন—সমস্ত মুসলমান কেবল এই সংস্করণ ব্যবহার করবে এবং বাকি সব পাঠ ধ্বংস করতে হবে। মদিনার শাসক মারওয়ান, অনুরোধক্রমে বিবি হাফসার কপিটিও নষ্ট করে। এরপর থেকে কেবল একটিই কোরআনের পাঠ প্রচলিত। এই কোরআনে রয়েছে ৩০ পারা, ১১৪ সুরা ও ৬৬৬৬ আয়াত। পাঠভেদ না থাকলেও তাফসিরে পার্থক্য প্রকট—কেউ এক অর্থ ব্যাখ্যা করেন, কেউ অন্য।

সত্যার্থপ্রকাশে মহর্ষি যেসব আয়াতের অর্থ দিয়েছেন, সেগুলো প্রচলিত আলেমদের ব্যাখ্যার উপর ভিত্তি করে। আরবি–ফারসি ভাষার আর্য পণ্ডিত পণ্ডিত রামচন্দ্র দেহলভীর মতে, এসব অর্থ শাহ রফিউদ্দিন দেহলভীর উর্দু অনুবাদ থেকে নেওয়া। এর মধ্যে যদি ভুল বা আপত্তিকর অর্থ থাকে, তবে দায় ভাষ্যকারদের, মহর্ষির নয়।


যখন উল্লেখিত ধর্মসমূহ তাদের ধর্মগ্রন্থ সংশোধন, পাঠনির্ধারণ এবং পরিমার্জন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করেছে, তখন যারা নিজেদের বুদ্ধিজীবী মনে করেন সেই আর্যরা কেন পারবেন না? যতদিন রক্ষণশীলতার আবেগে সত্যার্থপ্রকাশ নিয়ে অনর্থক বিতর্ক চলবে—ততদিন ক্ষতি হবে সত্যার্থপ্রকাশের, ক্ষতি হবে ঋষির, ক্ষতি হবে আর্য সমাজের।

বিলম্ব–বিসম্বাদ ছাড়াই একদিন এ কাজ করতেই হবে। নিজের অহংভঙ্গ করে এই সত্য যত দ্রুত উপলব্ধি ও গ্রহণ করা যাবে—ততই মঙ্গল সত্যার্থপ্রকাশের, গ্রন্থকার ঋষির এবং আর্যসমাজের।

“नान्यः पन्था विद्यतेऽयनाय” (এই লক্ষ্য—এই গন্তব্যে পৌঁছানোর আর কোনো পথ নেই)।

 সুরেন্দ্র কুমার জীর লেখা হতে 

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

সত্য়ার্থ প্রকাশ দ্বিতীয় সংস্করণের রচনা ও রচনাকাল

সত্যার্থ প্রকাশ (প্রথম সংস্করণ) শেষ হয়ে আসছিল। তাতে সংশোধন করা খুবই জরুরি ছিল এবং অনেক নতুন সমাগ্রীও তাতে সংযোজন করা প্রয়োজন ছিল। তাই মহর্...

Post Top Ad

ধন্যবাদ