মূর্তি একটি প্রতীক আমরা কোনো প্রতিমা, ছবি, কারুকার্জ বা মূর্তির বিরুদ্ধে নই কারণ প্রতিমা আমাদের ধরোহর... ঐতিহ্য। সেই সব ভাস্কর, কারিগর এবং শিল্পীদের প্রতি আমাদের অনেক শ্রদ্ধা রয়েছে যারা শিল্পকর্মের মাধ্যমে তাদের কল্পনা প্রকাশ করার চেষ্টা করেন এবং বিভিন্ন ধরনের ভাস্কর্য তৈরি করেন। মূর্তিগুলি নিছক প্রতীক, যার প্রদর্শনের দ্বারা অকথ্য রহস্যগুলি সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। এটি মানুষের জ্ঞান বৃদ্ধির একটি অনন্য উপায়। আমাদের শিশুরা যাতে সংস্কৃতিবান হয়, শিল্পের দৃষ্টিকোণ থেকে ঘরে মূর্তি রাখা উচিত, কিন্তু যে মূর্তির কারণে নিজ বাড়িতে বা সমাজে যে কোনো ধরনের অন্ধবিশ্বাস, অন্ধশ্রদ্ধা ,কুসংস্কার বা ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়, সেই ধরনের প্রতিমা, ছবি ও আলংকারিক জিনিসপত্র অবিলম্বে সেখান থেকে অপসারণ করা উচিত এতে সবার পরিবারে সুখ, সমৃদ্ধি, ভালোবাসা ও শান্তি বজায় থাকবে।
এর ফলে আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি অবশ্যই নিরাপদ থাকবে। অশ্লীল বা আপত্তিকর মূর্তি প্রদর্শন যদি কোনো জাতি, মত-মতান্তর, দেশ বা তার সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে অসম্মান করে, তাহলে কোনো বুদ্ধিজীবী তাকে সমর্থন করতে পারে না, তাই এর বিরোধিতা করতে দরকার। চেতনে জড় এবং জড়ে চেতনতার অনুভব করা অজ্ঞানতা বা মিথ্যাজ্ঞান বলা হয়।
অজ্ঞতাই সকল প্রকার দুঃখ-দুর্দশার মূল কারণ [পাতঞ্জলসূত্র-২/৪]। যে বস্তু যা নয়, তাকে সেইরূপে জানাই হলো অবিদ্যা।‘অবিদ্যা ক্ষেত্রমুক্তরেষাং প্রসুপ্ততনুবিচ্ছিন্নোদারানাম্’।-[পাতঞ্জলসূত্র-২/৪]। আমরা কখনই মূর্তির বিরোধিতা করি না এবং এটাও সত্য যে আমরা যদি বস্তুটিকে বারবার দেখি, তবে জ্ঞাতসারে বা অজান্তে আমাদের অনুভূতিও তার সাথে যুক্ত হয়। কিছু স্বার্থপর মানুষ সাধারন মানুষের আবেগ..ভাবনা নিয়ে খেলা করেছে, যেমন মূর্তি নিজেই ভগবান / ঈশ্বর..অর্থাৎ মূর্তি পূজায় ঈশ্বর সন্তুষ্ট হন, মূর্তিরা জীবন্ত মানুষের মতো খায় এবং পান করে। মূর্তিকে স্নান করানো, তাদের নিবেদন করা ইত্যাদি – এটা দেখে ও শুনে অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরা মূর্তিপূজারীদের নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে এবং তাদের অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রতিমাদের অপমান ও অবমাননা করতে থাকে, যার কারণে সমাজে তাদের বদনাম হয়। সমাজে মানুষের মধ্যে মারামারি, অশান্তি, কলহ, অশান্তি লেগেই থাকে।
প্রকৃত সনাতন বৈদিক ধর্মের অনুসারীরা, শুধুমাত্র নিরাকার ঈশ্বরের উপাসনা করে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা মূর্তিকে অপমান করি বা অসম্মান করি। কেউ যদি মূর্তিকে অপমান করে, তবে প্রথমে আমরা তাকে উপযুক্ত জবাব দিই। মূর্তিগুলি হল ভারতীয় সংস্কৃতি এবং সভ্যতার অমূল্য ঐতিহ্য কারণ মূর্তিগুলি আমাদের অনেক কিছু শেখায়, শিক্ষা প্রদান করে, আমাদের গাইড করে, তাই তাদের পর্যবেক্ষণ, সুরক্ষিত এবং সুরক্ষিত করা উচিত। আমাদের দেশের সংবিধানও বলে যে কারও সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ক্ষতি করা অপরাধ। ভারতীয় ইতিহাসে, কাল্পনিক মূর্তিগুলির মধ্যে যে মূর্তিটি (মূর্তি) সবচেয়ে সম্মানিত তা হল 'গণপতি', কিন্তু সেই 'গণপতি'-এর মূর্তিকে আমাদের আপন জনগণই এত অপমান করেছে যা অন্য কারোর কমই হয়েছে।
রাশিচক্রের নামে গণপতি, বিভিন্ন রূপে ও বর্ণের গণপতি, বিভিন্ন ভঙ্গিতে গণপতি, গণপতি খেলাধুলা করে এবং না জানি গণপতি কী কী করেন !!? অনেক সময় দেখানো হয় যে গণপতি ক্রিকেট খেলছেন (ব্যাটিং, বোলিং এবং ফিল্ডিং), ফুটবল খেলছেন, হোলির রঙে রাঙাচ্ছেন, দৌড়াচ্ছেন, লাফ দিচ্ছেন এবং আরও কয়েকটি শিশুদের বিনোদনের নাম দিয়ে 'বাল গণপতি'-তে অনেক অ্যানিমেশন চলন্ত ছবি বানানো. 'গণপতির মূর্তি' উপহাস এবং হাস্যরসের বিষয় নয়, তবে এটি সবচেয়ে গবেষণার বিষয়।
তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের খেলনা তৈরি করা হয় 'গণপতি' যাকে সারা বিশ্ব পূজা করে। আপনি কি কখনও অন্য কোন সম্প্রদায়ের (মুসলিম, খ্রিস্টান, শিখ ইত্যাদি) অনুসারীদের তাদের কোন দেবতা বা গুরুর মূর্তির এমন হাস্যকর দুর্দশা দেখেছেন !!? একেবারেই না! বা আমরা কখনই এটি দেখতে পাব না কারণ অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের দেবতাদের অথবা মহাপুরুষদের এত সম্মান করে যে তারা এমন জঘন্য কাজ করার সাহস করতে পারে না !!! কেন আমরা ঐতিহাসিক পুরুষদের (ভগবান শিব, শ্রী রামচন্দ্র, শ্রী কৃষ্ণ মহারাজ, ইন্দ্র, গনেশ জী প্রভৃতি) যাদের আমরা আমাদের ভগবান এবং পৌরানিকেরা কুলদেবতা বলে মনে করে তাদের সাথে এত খেলা করি !!? মনে হচ্ছে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের সংস্কৃতি ও সভ্যতা ভুলে গেছি বা মানব ধর্ম সম্পর্কে কিছু জানতে চাই না বা ভাবি এসব দিয়ে কি করা যায়...?
উৎসবের নামে গণপতিকে এক না এক রূপে দেখানো হয়। আজকাল আর একটা নতুন ভণ্ডামি শুরু হয়েছে যে দীপাবলি উপলক্ষ্যে আপনার রাশি অনুযায়ী বাড়িতে গণপতির মূর্তি রাখলেই আপনার মনস্কামনা পূরণ হবে। লালচের (লোভ) জন্য আমরা কী কী কাজ করি, এমনকি নিজেদের দেবতাদের (দেবী) নিয়েও ঠাট্টা করি। চলন্ত ছবির [animation] মাধ্যমে 'স্বর্গ ও নরক' নিয়ে মজা করা হয়। এরকম অনেক দৃশ্য ও কাল্পনিক কাহিনী দেখিয়ে আমরা আমাদের নিজেদের হিন্দু সংস্কৃতিকে উপহাস করি, তাতেই আমরা আনন্দ পাই।
মূর্তির মধ্যে ঈশ্বর আছেন..তিনি সর্বব্যাপক, কিন্তু মূর্তি কখনো ঈশ্বর নন। প্রতিমা নির্মাতারাই সাধারণত প্রতিমা ভাঙেন। বিদ্যানেরা মূর্তি ভাঙে না, রক্ষা করেন। যারা ঈর্ষা, বিদ্বেষ ও অপমানের অনুভূতি নিয়ে কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা ঐতিহাসিক মূর্তিকে অসম্মান করে বা ভাঙে, তাঁরা শেষ শ্রেণীর মানসিক রোগী।
এমনকি অমানবিকতার শ্রেণীও সে সকল ব্যক্তি অতিক্রম করে। যারা আর্থিকভাবে আচ্ছন্ন, ধর্ম ভক্ষক, ভণ্ড তারাই মন্দির থেকে ঈশ্বরের মূর্তি চুরি করে বা করিয়ে নেয়। এটা কি ঈশ্বর চুরি করা হয়েছে মানে..? না মানবেন..? ঈশ্বরকে কি বিক্রি করে কেনা যায়..? না কি ঈশ্বরের মূর্তি বানানো সম্ভব !! মূর্তি শুধুমাত্র সৌন্দর্য এবং সংস্কৃতির প্রতীক এবং যারা সংস্কৃতিকে আক্রমণ করে তাদের কখনই ক্ষমা করা উচিত নয়। আমরা মূর্তি পূজার বিরুদ্ধে, মূর্তি বিরোধী নয়, কারণ আমরা জানি কীভাবে জিনিসকে সম্মান করতে হয় এবং রক্ষা করতে হয়। ইতিহাস সাক্ষী যে যখনই সাংস্কৃতিক মূর্তি আক্রমণ করা হয়েছে, শুধুমাত্র বৈদিক ধার্মিকরাই [আর্য় সমাজ] তাদের রক্ষা করেছেন।..
ঈশ্বর সর্বব্যাপী, তাঁর জ্যোতি আত্মা ও প্রকৃতির সমস্ত অনু পরমানুতেও তিনি বিরাজমান, মহাবিশ্বের প্রত্যেক কোনায় তিনি, পৃথিবীতে, জলে, আগুনে, বায়ুতে, আকাশেও বিরাজমান। তিনিও চেতন এবং জড়েও। ধরা যাক মাটির মূর্তির মধ্যেও আছে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা মূর্তি পূজা করব। একেবারেই না! আমরা সচেতন, তাই কি আমরা ভগবানের সাক্ষাৎকারের নিমিত্ত মূর্তির ভিতরে প্রবেশ করতে পারি..? না! তাহলে কখন, কোথায়, কিভাবে তার সাথে দেখা হবে..? সেই একমাত্র স্থান হতে পারে যেখানে আমরাও আছি এবং আমাদের ঈশ্বরও আছেন। উভয়কেই একই স্থানে মুখোমুখি উপস্থিত থাকতে হবে। সেই একমাত্র স্থান হল অন্তঃকরণ (মন); যেখানে আত্মার সাথে পরমাত্মাও বিরাজমান। সবকিছুতেই তিনি বিদ্যমান কারণ ঈশ্বর সর্বব্যাপক [যজুর্বেদ ৪০৷৮]। ঈশ্বরের কোন রূপ, বর্ণ, আকৃতি বা ধরন নেই [न तस्य॑ प्रति॒माऽअस्ति॒ यस्य॒ नाम॑ म॒हद्यशः॑-শুক্লযজুর্বেদ ৩২৷৩]।
মানুষের আত্মা সত্যাসত্যের সন্ধানী। আমরা সত্যকে ছেড়ে অসত্যের দিকে ধাবিত হচ্ছি। ঈশ্বর মানুষকে 'সত্য ও অসত্য জানার একটি হাতিয়ার' দিয়েছেন, যাকে আমরা বলি 'বুদ্ধি' বা 'বিচক্ষণতা'। পরমাত্মার দেওয়া এই অমূল্য হাতিয়ার যদি আমরা ব্যবহার না করি, তাহলে আমরা শুধু নিজেরই ক্ষতি না, অন্যেরও ক্ষতি করবো এবং এই কারণেই অধিকাংশ মানুষ মানুষ হওয়া সত্ত্বেও পশুর মতো বাঁচে এবং মরে।
নিজেকে প্রশ্ন করুন আমরা কি মানুষ? বিবেক থাকা সত্ত্বেও আমরা কি বিচক্ষণতার সাথে কাজ করি? আপনি কি ঈশ্বর প্রদত্ত বেদ (জ্ঞান-বিজ্ঞান) জানার চেষ্টা করেন..? সবকিছুকে বিচক্ষণতার মাপকাঠিতে পরীক্ষা করে!! সত্য সত্যের সিদ্ধান্ত নেয়? আপনি কি নিয়মিত বেদ ও অর্ষ গ্রন্থের স্বাধ্যায় করেন? যদি হ্যাঁ! তাহলে কি আমরা আমাদের ভেতরের কণ্ঠস্বর শুনি..? সত্য জেনেও আমরা কেন অসত্যকে বিশ্বাস করি...? সর্বোপরি, আমরা আর কতকাল বিভ্রান্তির ঘুমে ঘুমিয়ে থাকব..!!?
আমাদের অজ্ঞতার ঘুম কখন শেষ হবে..? কেন আমরা সত্য বলতে ভয় পাই..? আমরা কি জন্য ভীত..? আমাদের কি আমাদের পরম পিতা পরমাত্মার প্রতি বিশ্বাস নেই..? আমরা কি ঈশ্বরের বিধানে সন্দেহ করি? আর কতদিন আমরা বাজারের বাবুদের মাঝে পড়ে জন্ম-মৃত্যুর চক্রে বিভ্রান্ত হতে থাকব..? আর কতদিন আসল ছেড়ে নকলের পিছনে ছুটবে..? আর কতদিন নিজেকে ফাঁকি দিতে থাকবে..? সত্য জেনেও আর কতদিন পাথরের সামনে হাত গুটিয়ে বসে থাকব..? গণপতির আসল রূপ আমরা কবে বুঝব..? আমরাও কি পাথরের পূজা করতে গিয়ে পাথর হয়ে গেছি ?!!!
গণের অধিপতি 'গণপতি'-এর প্রকৃত স্বরূপ বুঝুন। গণপতি কোন খেলনা বা হৃদয় বিদারক জিনিস নয়। আমাদের পূজনীয় দেবতা, ভগবান, মহাত্মাদের সম্মান করতে শিখুন। সঠিক পূজা অর্চনা শিখুন। সাংস্কৃতিক এবং সার্বজনিক সঠিক স্বরূপকে জানার প্রয়াস করুন..তখন দেখি কার সাহস সকলের হৃদয়ে সর্বদা ব্যাপক, সকলের প্রিয় গণপতির কে নিরাদর করতে পারে।
আমার প্রিয় বন্ধু ও অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের কাছে বিনীত অনুরোধ যে, কেউ অপরের কথাশুনে এবং পরীক্ষা ছাড়া কোনো কিছু গ্রহণ করবেন না বা রাজি করবেন না। আগে সত্য জানুন, তারপর বিশ্বাস করুন। বেদান্তিক পদ্ধতিতে আচরণ করুন। এতেই নিহিত রয়েছে সকলের মঙ্গল। উর্দুতে একটা কথা আছে "हिम्मते मर्दा मददे खुदा"[হিমতে মারদা মাদ্দে খুদা]- বিনা কারণে ঈশ্বর কাউকে সাহায্য করেন না! নিজ সহায়তা সয়ং করতে হয়.."যে মানুষ নিজেকে সাহায্য করে ও অপরকে সাহায্যের পূর্ণ প্রচেষ্টা করে, পরমপিতা তাকে সাহায্য করেন, তিনি তাকে কখনও পিছু ছাড়েন না। ঈশ্বর গণপতি সবাইকে বুদ্ধি দান করুন।"
ग॒णानां॑ त्वा ग॒णप॑तिꣳहवामहे प्रि॒याणां॑ त्वा प्रि॒यप॑तिꣳहवामहे निधी॒नां त्वा॑ निधि॒पति॑ꣳ हवामहे वसो मम। आहम॑जानि गर्भ॒धमा त्वम॑जासि गर्भ॒धम् ॥-यजुर्वेद
-গণপতি যিনি সমস্ত জগৎকে রক্ষা করেন, কাঙ্খিত আনন্দ প্রদান করেন, ঐশ্বর্য দান করেন, প্রকৃতির রক্ষণাবেক্ষণ করেন এবং সমস্ত বীজের ব্যবস্থা করেন, তিনিই গণের পতি।
তং য়ে ভজন্তি মনুজা বিতথপ্রপত্তাঃ৷
জানন্তি তে ন সকলার্থফলপ্রদাত্তীম,
ত্বাং দেবীং বিশ্বজননী সুখসেবনীয়াম্||
(দেবীভাগবত- ৫-২৯-২০)
অর্থাৎ যারা গণেশের পূজা করে তারা মূর্খ,তাদের সমস্ত কার্যাদি বৃথা হয়
......চলবে >>
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ