গোপথ ব্রাহ্মণ ২৯ - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

19 December, 2025

গোপথ ব্রাহ্মণ ২৯

গোপথ ব্রাহ্মণ
= কণ্ডিকা ২৯ =
[চারটি বেদের দেবতা এবং তাতে ছন্দের প্রধান্য]

কিং দেবতমিত্যুচামগ্নির্দেবতন্তদেব জ্যোতির্গায়ত্রীং ছন্দঃ পৃথিবী স্থানম্। অগ্নিমীড়ে পুরোহিতং যজ্ঞস্য দেবমৃত্‌বিগোপথ ব্জম্। হোতারং রত্নধাতমমিত্যেবমাদিং কৃত্বা ঋগ্বেদমধীয়তে। যজুষাং বায়ুর্দেবতং তদেব জ্যোতিঃ ত্রৈষ্টুভং ছন্দোऽন্তরিক্ষং স্থানম্। ইষে ত্বোর্জে ত্বা বায়ব স্থ দেবো বঃ সবিতা প্রার্পয়তু শ্রেষ্ঠতমায় কর্মণ ইত্যেবমাদিং কৃত্বা যজুর্বেদমধীয়তে। সাম্নামাদিত্যো দেবতং তদেব জ্যোতির্জাগতম্ ছন্দো দ্যৌঃ স্থানম্। অগ্ন আয়াহি বীতয়ে গৃণানো হব্যদাতয়ে। নি হোতা সত্সি বর্হিষীত্যেবমাদিং কৃত্বা সামবেদমধীয়তে।অথর্বণাং চন্দ্রমা দেবতং তদেব জ্যোতিঃ সর্বাণি ছন্দাংস্যাপঃ স্থানম্। শন্নো দেবীরভিষ্টয় ইত্যেবমাদিং কৃত্বা অথর্ববেদমধীয়তে। অদ্ভ্যঃ স্থাবরজঙ্গমো ভূতগ্রামঃ সম্ভবতি, তস্মাৎ সর্বমাপোময়ং ভূতং সর্বং ভৃগ্বঙ্গিরোময়ম্। অন্তরৈতে ত্রয়ো বেদা ভৃগূনঙ্গিরসঃ শ্রিতা ইত্যবিতি প্রকৃতিরপামোঙ্কারেণ চৈতস্মাদ্ ব্যাসঃ পুরোবাচ ভৃগ্বঙ্গিরোবিদা সংস্কৃতোऽন্যান্ বেদানধীয়ীত নান্যত্র সংস্কৃতো ভৃগ্বঙ্গিরসোऽধীয়ীত। অথ সামবেদে খিলশ্রুতিঃ ব্রহ্মচর্যেণ চৈতস্মাদথর্বাঙ্গিরসো হ যো বেদ স বেদ সর্বমিতি ব্রাহ্মণম্ ॥ ২৯ ॥

ভাষ্য— (কিম্, দেবতম্, ইতি, ঋচাম্, অগ্নিঃ, দেবতম্, তৎ, এব, জ্যোতিঃ, গায়ত্রীম্, ছন্দঃ, পৃথিবী, স্থানম্) চারটি বেদের বিষয়ে ক্রমানুসারে সংক্ষেপে আলোচনা করতে গিয়ে লেখক প্রথমে প্রশ্ন উত্থাপন করেন ঋগ্বেদের দেবতা কে? একই সঙ্গে তার জ্যোতি, ছন্দ ও স্থান কী? যদিও প্রশ্নে এসব বিষয় সরাসরি বলা হয়নি, তবুও উত্তরের মধ্য দিয়েই এই প্রশ্নগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ পায়। এই প্রশ্নগুলোর উত্তরে বলা হয়েছে যে, ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলির দেবতা হলেন অগ্নি; জ্যোতিও অগ্নি; ছন্দ গায়ত্রী এবং স্থান পৃথিবী। যদিও ঋগ্বেদে অন্যান্য দেবতাসূচক মন্ত্রও বিদ্যমান, তবুও এখানে প্রধানতার ভিত্তিতে অগ্নিকেই দেবতা বলা হয়েছে। এর অর্থ হলো—ঋগ্বেদে অগ্নিদেবতাসংক্রান্ত মন্ত্রের সংখ্যা অন্যান্য দেবতাসংক্রান্ত মন্ত্রের তুলনায় অধিক। এই কারণেই অগ্নিকেই এখানে ঋগ্বৈদিক মন্ত্রসমূহের জ্যোতি বলা হয়েছে। অগ্নিদেবতা সংক্রান্ত মন্ত্রের প্রাধান্য থাকার ফলে অগ্নির জ্যোতিকে ঋগ্বৈদিক মন্ত্রের জ্যোতি বলা সম্পূর্ণ যুক্তিসংগত।

ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলিতে গায়ত্রী ছন্দের প্রাধান্য থাকার জন্য এর ছন্দ হিসেবে গায়ত্রীকে উল্লেখ করা হয়েছে। গায়ত্রী ছন্দের সঙ্গে অগ্নির সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে ঋষিদের বক্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে—
“অগ্নির্গায়ত্রঃ” (শতপথ ব্রাহ্মণ ৬.১.১.১৫),
“গায়ত্রচ্ছন্দা অগ্নিঃ” (তাণ্ড্য ব্রাহ্মণ ১৬.৫.১৯)।

এই মন্ত্রগুলির স্থান হিসেবে পৃথিবীকে বলা হয়েছে। মহর্ষি যাস্কও অগ্নিকে পৃথিবীতে অধিষ্ঠিত দেবতা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অন্যদিকে, গায়ত্রী ছন্দের সঙ্গে পৃথিবীর সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে মহর্ষি মৈত্রেয় বলেছেন— “ইয়ং (পৃথিবী) বৈ গায়ত্রী” (মৈত্রেয়ী সংহিতা ১.৫.১০)।

এখান থেকে আরও একটি ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, পার্থিব পদার্থসমূহে ঋগ্বৈদিক মন্ত্রের বিশেষত গায়ত্রী ছন্দের রশ্মিসমূহের প্রাধান্য বিদ্যমান।

(অগ্নিমীড়ে পুরোহিতং যজ্ঞস্য দেবমৃত্‌বিজম্। হোতারং রত্নধাতমম্ ইতি, এবম্, আদিম্, কৃত্বা, ঋগ্বেদম্, অধীয়তে) ঋগ্বেদের দেবতা, জ্যোতি, ছন্দ ও স্থান নির্ধারণ করার পর গ্রন্থকার লিখেছেন যে ঋগ্বৈদিক মন্ত্রসমূহ সর্বপ্রথম “অগ্নিমীড়ে পুরোহিতম্…” এই মন্ত্র উচ্চারণ করে অধ্যয়ন করা হয়। এখানে গ্রন্থকার এই মন্ত্রের অর্থ বা ব্যাখ্যা কিছুই করেননি; তাঁর উদ্দেশ্য কেবল এটুকুই জানানো যে এটি ঋগ্বেদের প্রথম মন্ত্র। সেই কারণে আমরাও এখানে এই মন্ত্রের পৃথক ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন মনে করি না।

(যজুষাম্, বায়ুঃ, দেবতম্, তৎ, এব, জ্যোতিঃ, ত্রৈষ্টুভম্, ছন্দঃ, অন্তরিক্ষম্, স্থানম্) যজুর্বৈদিক মন্ত্রসমূহের দেবতা হিসেবে বায়ুকে বলা হয়েছে। যদিও যজুর্বেদেও বহু দেবতাসূচক মন্ত্র রয়েছে, তবুও এখানেও বায়ুকে দেবতা বলা হয়েছে প্রধানতার ভিত্তিতেই—এ কথা বোঝা উচিত। পণ্ডিত ক্ষেমকরণদাস ত্রিবেদী এই প্রসঙ্গে ঋগ্বেদ ও যজুর্বেদের প্রথম মন্ত্রের দেবতাকেই গ্রহণ করেছেন; অর্থাৎ তাঁর মতে গ্রন্থকার প্রথম মন্ত্রের দেবতার ভিত্তিতেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু এই মত সামবেদ ও অথর্ববেদের প্রসঙ্গে টেকে না। সুতরাং দেবতা নির্ধারণে প্রধানতার ভিত্তিই অধিক যুক্তিসংগত বলে প্রতীয়মান হয়।

দেবতার পর গ্রন্থকার বলেছেন যে যজুর্বৈদিক মন্ত্রগুলির জ্যোতিও বায়ু। প্রকৃতপক্ষে ‘দেবতা’ বলতে সেই তত্ত্ব বা পদার্থকেই বোঝায়, যা কোনো মন্ত্রের প্রভাবে সর্বাধিকভাবে প্রভাবিত হয়। অতএব, যে পদার্থ দেবতা হিসেবে বিবেচিত, তার জ্যোতিকেই সেই মন্ত্র বা ছন্দের জ্যোতি বলা হয়। জ্যোতির অর্থ আলোক বা দীপ্তি—এ কথা সর্বজনবিদিত। সেই হিসেবে বায়ুর রশ্মিসমূহের সূক্ষ্ম দীপ্তিকেই যজুর্বৈদিক মন্ত্রগুলির দীপ্তি হিসেবে বুঝতে হবে। একইভাবে অন্যান্য বেদের মন্ত্রগুলির ক্ষেত্রেও এ নীতি প্রযোজ্য।

এই বেদে ত্রিষ্টুপ্ ছন্দের প্রাধান্য রয়েছে, যদিও অন্যান্য ছন্দও এতে বিদ্যমান। যজুর্বৈদিক মন্ত্রগুলির স্থান হিসেবে অন্তরিক্ষ বা আকাশকে বলা হয়েছে। এর অর্থ—আকাশতত্ত্বে এই মন্ত্রগুলিরই প্রাধান্য। আমাদের মতে, আকাশতত্ত্বে যজুর্বেদের বৃহৎ ছন্দের চেয়ে যাজুষী ছন্দের রশ্মিসমূহের প্রাধান্যই বেশি।

যাজুষী ছন্দের রশ্মি ও ত্রিষ্টুপ্ ছন্দের সঙ্গে অন্তরিক্ষের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে ঋষিগণ বলেছেন—
“অন্তরিক্ষং বৈ যজুষামায়তনম্” (গোপথ ব্রাহ্মণ ২.২৪),
অর্থাৎ আকাশতত্ত্ব যাজুষী রশ্মিরই বিস্তার।

আবার বলা হয়েছে—
“অন্তরিক্ষলোকো যজুর্বেদঃ” (ষড়বিংশ ব্রাহ্মণ ১.৫),
অর্থাৎ অন্তরিক্ষলোক যজুর্বৈদিক মন্ত্র দ্বারা নির্মিত।

এবং—
“ত্রৈষ্টুভমন্তরিক্ষম্” (শতপথ ব্রাহ্মণ ৮.৩.৪.১১),
অর্থাৎ আকাশতত্ত্বের ভিত্তি হল যাজুষী ত্রিষ্টুপ্ ছন্দের রশ্মিসমূহ।

যদিও আকাশতত্ত্বে অন্যান্য রশ্মিও বিদ্যমান, তবুও প্রধানতা যাজুষী ছন্দের রশ্মিসমূহেরই।

(ইষে ত্বোর্জে ত্বা বায়ব স্থ দেবো বঃ সবিতা প্রার্পয়তু শ্রেষ্ঠতমায় কর্মণে—ইতি, এবম্, আদিম্, কৃত্বা, যজুর্বেদম্, অধীয়তে) যজুর্বৈদিক মন্ত্রসমূহের পাঠ “ইষে ত্বোর্জে ত্বা…” এই মন্ত্রের মাধ্যমে শুরু করা হয়। অর্থাৎ, এই মন্ত্রটিই যজুর্বেদের প্রথম মন্ত্র—এ কথাই এখানে জানানো হয়েছে।

(সাম্নাম্, আদিত্যঃ, দেবতম্, তৎ, এব, জ্যোতিঃ, জাগতম্, ছন্দঃ, দ্যৌঃ, স্থানম্) সামবেদের মন্ত্রসমূহে আদিত্য দেবতার প্রাধান্য রয়েছে এবং আদিত্যের জ্যোতিকেই সামবৈদিক মন্ত্রসমূহের জ্যোতি হিসেবে গণ্য করা হয়। আদিত্য ও সাম-রশ্মির পারস্পরিক সম্পর্ক নির্দেশ করতে মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন—

“অর্চিঃ (আদিত্যস্য) সামানি” (শতপথ ব্রাহ্মণ ১০.৫.১.৫)।

এখানে বলা হয়েছে যে সামবৈদিক মন্ত্রগুলিতে জগতি ছন্দের প্রাধান্য রয়েছে। এর স্থান হিসেবে দ্যৌ বা স্বর্গলোক নির্ধারিত হয়েছে। মহর্ষি যাস্কও নিরুক্ত গ্রন্থে আদিত্যকে দ্যুস্থানি দেবতা বলেছেন। এখানে আদিত্যের সঙ্গে সাম-রশ্মির সম্পর্ক স্পষ্ট হওয়ায়, সামবৈদিক মন্ত্রসমূহের দ্যুস্থানি হওয়াও স্বতঃসিদ্ধ হয়ে যায়।

এই বিষয়টি অন্যত্রও বলা হয়েছে— “ঋগ্বা অয়ং (পৃথিবী) লোকঃ, সামাসৌ (দ্যৌঃ)” (জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ ৩.১৪৫), এবং “সাম বা অসৌ (দ্যৌ) লোকঃ” (তাণ্ড্য ব্রাহ্মণ ৪.৩.৫)। এই সব প্রমাণের মাধ্যমে সামবৈদিক মন্ত্রসমূহের দ্যুস্থানি স্বভাব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।

(অগ্ন আয়াহি বীতয়ে গৃণানো হব্যদাতয়ে। নি হোতা সত্সি বর্হিষি—ইতি, এবম্, আদিম্, কৃত্বা, সামবেদম্, অধীয়তে) সামবৈদিক মন্ত্রসমূহের পাঠ “অগ্ন আয়াহি বীতয়ে…” এই মন্ত্রের মাধ্যমে শুরু করা হয়। অর্থাৎ, এটিই সামবেদের প্রথম মন্ত্র।

(অথর্বণাম্, চন্দ্রমাঃ, দেবতম্, তৎ, এব, জ্যোতিঃ, সর্বাণি, ছন্দাংসি, আপঃ, স্থানম্) অথর্ববৈদিক মন্ত্রসমূহে চন্দ্রমা দেবতার প্রাধান্য রয়েছে। সেই কারণে অথর্ববৈদিক মন্ত্রগুলির জ্যোতি চন্দ্রমার জ্যোতির ন্যায় বলে গণ্য করা হয়। অথর্ববেদে কোনো একটি নির্দিষ্ট ছন্দের প্রাধান্য নেই; বরং এতে সকল প্রকার ছন্দই বিদ্যমান। এই মন্ত্রগুলির স্থান হিসেবে ‘আপঃ’ অর্থাৎ জলতত্ত্বকে বলা হয়েছে। এর দ্বারা বোঝা যায় যে, মহাভূতরূপে আপঃ-তত্ত্বে অথর্ববৈদিক মন্ত্রগুলির বিশেষ প্রাধান্য রয়েছে।

(শন্নো দেবীরভিষ্টয়ে, ইতি, এবম্, আদিম্, কৃত্বা, অথর্ববেদম্, অধীয়তে) এখানে গ্রন্থকার উল্লেখ করেছেন যে অথর্ববৈদিক মন্ত্রসমূহের পাঠ “শন্নো দেবীরভিষ্টয়ে…” এই মন্ত্রের মাধ্যমে শুরু করা হয়। অর্থাৎ, এটিই অথর্ববেদের প্রথম মন্ত্র

বিশেষ জ্ঞাতব্য

এই সমগ্র প্রকরণটি সম্পর্কে আমরা আমাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে পুনরায় বিচার করি। দেবতা-প্রসঙ্গে যদি আমরা গভীরভাবে চিন্তা করি, তবে দেখা যাবে যে ঋগ্বৈদিক মন্ত্রসমূহে অগ্নিদেবতাসংক্রান্ত মন্ত্রের প্রাধান্য থাকতে পারে; কিন্তু যজুর্বৈদিক মন্ত্রসমূহে বায়ুদেবতাসংক্রান্ত এবং সামবৈদিক মন্ত্রসমূহে আদিত্যদেবতাসংক্রান্ত মন্ত্রের তেমন স্পষ্ট প্রাধান্য আমাদের চোখে পড়ে না। অপরদিকে, অথর্ববৈদিক মন্ত্রসমূহে চন্দ্রমা দেবতাসংক্রান্ত মন্ত্রের প্রাধান্য তো নিশ্চিতভাবেই প্রতীয়মান হয় না। তাহলে কি আমরা ধরে নেব যে গ্রন্থকারের বক্তব্য ভ্রান্ত? আমাদের দৃষ্টিতে এমনটি মানা কোনোভাবেই যুক্তিসংগত নয়, কারণ ঋষিগণ মন্ত্রদ্রষ্টা।

আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়—বেদসংহিতাগুলিতে মন্ত্রগুলির উপরে যে দেবতার নাম নির্দেশ করা হয়েছে, সেই প্রথা কবে এবং কীভাবে প্রচলিত হয়েছে, সে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত কিছু বলতে পারি না। সর্বপ্রথম কে এই দেবতা-নির্দেশের প্রথা চালু করেছিলেন, তাও আমাদের অজানা। তবে গোপথ ব্রাহ্মণের রচয়িতা যে বেদের এক মহৎ ঋষি-ব্যাখ্যাতা, এতে কোনো সন্দেহ নেই। অতএব তাঁর বক্তব্যের প্রামাণিকতা নিঃসন্দেহ।

ঐতরেয় ব্রাহ্মণের বৈজ্ঞানিক ভাষ্য রচনার সময় আমরা লক্ষ্য করেছি যে মহর্ষি ঐতরেয় মহীদাস কিছু বেদমন্ত্রের দেবতা সংহিতায় উল্লিখিত দেবতার থেকে ভিন্ন বলে গ্রহণ করেছিলেন। সেই ক্ষেত্রে ভাষ্য রচনার সময় আমরা সংহিতার পরিবর্তে ঐতরেয় মহীদাস কর্তৃক নির্দেশিত দেবতাকেই গ্রহণ করেছি। ঠিক সেইভাবেই এখানে আমাদের সুদৃঢ় মত হলো—বেদের এই মন্ত্রসমষ্টিগুলির যে সামগ্রিক বা ফলিত দৈব প্রভাব সৃষ্টি হয়, তা এই দেবতাগুলির ভিত্তিতেই কার্যকর হয়।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়ঋগ্বেদের সমস্ত মন্ত্রের সম্মিলিত প্রভাবে অগ্নিতত্ত্বই সর্বাধিক প্রভাবিত হবে। যজুর্বৈদিক মন্ত্রসমূহের দ্বারা বায়ুতত্ত্বই সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হবে। একইভাবে সামবেদের সকল মন্ত্রের সামগ্রিক প্রভাবে আদিত্যলোক বা আদিত্যরশ্মিসমূহ এবং অথর্ববেদের মন্ত্রসমূহের সমষ্টিগত প্রভাবে চন্দ্রমা ও সোমরশ্মিসমূহ অধিকমাত্রায় প্রভাবিত হবে

ছন্দ-বিষয়ে আলোচনা

এখন আমরা ছন্দ বিষয়টি নিয়ে বিচার করি। এই প্রসঙ্গে একথা বলা কঠিন যে ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলিতে গায়ত্রী ছন্দের, যজুর্বেদের মন্ত্রগুলিতে ত্রিষ্টুপ্ ছন্দের এবং সামবেদের মন্ত্রগুলিতে জগতি ছন্দের প্রাধান্য রয়েছে। বিশেষত সামবেদের ক্ষেত্রে তো আমরা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি যে বাস্তবে এমনটি দেখা যায় না। তবে এখানে যে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, তা আर्ष (ঋষিপ্রণীত) হওয়ায়, এ বিষয়ে আমরা এতটুকুই বলতে পারি যে—ঋগ্বৈদিক মন্ত্রসমূহের সামগ্রিক বা সমষ্টিগত প্রভাব গায়ত্রী ছন্দসুলভ হবে, যজুর্বৈদিক মন্ত্রসমূহের সামগ্রিক প্রভাব ত্রিষ্টুপ্ ছন্দসুলভ হবে এবং সামবৈদিক মন্ত্রসমূহের সামগ্রিক প্রভাব জগতি ছন্দসুলভ হবে, মন্ত্রগুলি প্রকৃতপক্ষে যে কোনো ছন্দেরই হোক না কেন।

আমরা জানি যে মোট সাতটি ছন্দ দেবী থেকে ব্রাহ্মী পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে মোট আট প্রকারে বিভক্ত। বেদসংহিতাগুলিতে যে ছন্দগুলি উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আর্ষী শ্রেণির ছন্দ; অন্যান্য ছন্দ খুব কমই সেখানে নির্দেশিত হয়েছে। সুতরাং এই গ্রন্থে যে ছন্দগুলির উল্লেখ আছে, সেগুলি আর্ষী ছন্দ ছাড়াও অন্য ছন্দ হতে পারে, অথবা তাদের ফলিত বা পরিণামগত প্রভাব এখানে বর্ণিত ছন্দগুলির আর্ষী স্বরূপের অনুরূপও হতে পারে। অথর্ববৈদিক মন্ত্রগুলির ক্ষেত্রে অবশ্য কোনো অসুবিধা নেই, কারণ সেখানে সব ধরনের ছন্দই বিদ্যমান।

এখানে গ্রন্থকার “শন্নো দেবীরভিষ্টয়ে…” মন্ত্রটিকে অথর্ববেদের প্রথম মন্ত্র বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বর্তমানে প্রচলিত সংহিতায় এই মন্ত্রটি অথর্ববেদের প্রথম কাণ্ডের ষষ্ঠ সূক্তের প্রথম মন্ত্র হিসেবে পাওয়া যায়। তাহলে গ্রন্থকার কেন এটিকে অথর্ববেদের প্রথম মন্ত্র বলছেন—এ বিষয়টি চিন্তনীয়।

এই প্রসঙ্গে ড. প্রজ্ঞাদেবী এবং আচার্যা মেধাদেবী, পণ্ডিত ত্রিবেদী-কৃত গোপথ ব্রাহ্মণের ভাষ্যের সম্পাদকীয় অংশে লিখেছেন—

“গোপথ ব্রাহ্মণ অথর্ববেদের পৈপ্পলাদ শাখার ব্রাহ্মণ, কারণ এই শাখার সূচনা ‘শন্নো দেবীরভিষ্টয়ে…’ মন্ত্র দ্বারা হয়।”

(অদ্ভ্যঃ, স্থাবরজঙ্গমঃ, ভূতগ্রামঃ, সম্ভবতি, তস্মাৎ, সর্বম্, আপোময়ম্, সর্বম্, ভূতম্, ভৃগ্বঙ্গিরোময়ম্) সমস্ত স্থাবর ও জঙ্গম প্রাণীর সমষ্টি ‘আপঃ’ অর্থাৎ প্রাণ-রশ্মি থেকেই উৎপন্ন হয়। সেই কারণেই এই সমগ্র চরাচর জগৎ প্রাণতত্ত্বে পরিপূর্ণ। এইভাবে সমস্ত জড় জগৎ এবং চেতন প্রাণীদের সমষ্টি—সবকিছুই প্রাণ-রশ্মি দ্বারা নির্মিত ও পরিব্যাপ্ত। অন্য কথায়, স্থূল ও সূক্ষ্ম সমস্ত সত্তাই প্রাণশক্তির প্রকাশমাত্র।

(এতে, ত্রয়ঃ, বেদাঃ, ভৃগূন্, অঙ্গিরসঃ, অন্তরা, শ্রিতাঃ, ইতি, অপ্, ইতি, অপাম্, প্রকৃতিঃ, ওঙ্কারেণ, চ) এই তিন বেদ—ঋক্, যজুঃ ও সাম—তাদের নিজ নিজ ছন্দ-রশ্মিসহ প্রাণ-রশ্মির পরিপক্ব অবস্থাতেই আশ্রিত থাকে। ‘আপঃ’ অর্থাৎ প্রাণ-রশ্মি আসলে কী—তা স্পষ্ট করতে বলা হয়েছে যে, প্রকৃতিরূপী মূল উপাদানই প্রাণতত্ত্বের উপাদান কারণ। যখন এই প্রকৃতি ওঙ্কার-রশ্মির সঙ্গে সংযুক্ত হয়, তখনই প্রাণ-রশ্মির উৎপত্তি ঘটে।

এখানে প্রাণের কারণরূপ উপাদান হিসেবে মনস্তত্ত্বকেও গ্রহণ করা যায়। মহর্ষি ঐতরেয় মহীদাস এ বিষয়ে বলেছেন— “মনসা সৃষ্টা আপশ্চ বরুণশ্চাপো হাস্মৈ শ্রদ্ধাং সংনমন্তে” (ঐতরেয় আরণ্যক ২.১.৭)। অর্থাৎ মন থেকেই আপঃ (প্রাণতত্ত্ব) এবং বরুণের সৃষ্টি হয়েছে, এবং সেই আপঃ মনকেই আশ্রয় করে থাকে।

যখন মনস্তত্ত্বকে প্রাণ-রশ্মির উপাদান কারণ হিসেবে গ্রহণ করা হয়, তখন এখানে উল্লিখিত ওঙ্কার-রশ্মির অর্থ হবে পশ্যন্তী ওঙ্কার-রশ্মি—অর্থাৎ শব্দের সূক্ষ্মতম, অন্তর্লীন শক্তির স্তর। অর্থাৎ সেখানে ওঙ্কার-রশ্মি বলতে পশ্যন্তী ওম্ রশ্মি-কেই বুঝতে হবে।

(এতস্মাৎ, ব্যাসঃ, পুরা, উবাচ, ভৃগ্বঙ্গিরোবিদা, সংস্কৃতঃ, অন্যান্য্, বেদান্, অধীয়ীত, অন্যত্র, সংস্কৃতঃ, ভৃগ্বঙ্গিরসঃ, ন, অধীয়ীত) এই কারণেই পূর্বকালে মহর্ষি ব্যাস বলেছেন—

ভৃগু ও অঙ্গিরার তত্ত্বে পারদর্শী, অর্থাৎ প্রাণতত্ত্ব ও তার সম্পূর্ণ বিজ্ঞান যিনি জানেন—এমন আচার্যের দ্বারা সংস্কারপ্রাপ্ত ছাত্রই অন্যান্য শাস্ত্র, অর্থাৎ বেদ বা ছন্দের বিজ্ঞান অধ্যয়ন করবে। এর অর্থ হল, প্রাণতত্ত্বকে না বুঝলে বেদ তথা ছন্দের বিজ্ঞান বা সৃষ্টির বিজ্ঞান যথার্থভাবে বোঝা যায় না।

আবার তিনি বলেছেন—যে ছাত্র অন্য কোনো বিষয়ে পারদর্শী আচার্যের নিকট সংস্কার গ্রহণ করেছে, সে যেন না প্রাণবিজ্ঞান অধ্যয়ন করে, না বেদ অধ্যয়ন করে; কারণ অন্যান্য বিষয়ে পরিশ্রমরত ব্যক্তি এই গভীর ও সূক্ষ্ম বিষয়গুলি অনুধাবন করতে সক্ষম হয় না। তবে এটি কোনো কঠোর বিধান নয়, বরং ঋষির উপদেশমাত্র। কারণ বহু স্থানে এর ব্যতিক্রমও দেখা যায়। কোনো কোনো প্রতিভাশালী ব্যক্তি কারো নিকট অধ্যয়ন না করেও এই বিদ্যাগুলি গ্রহণ করতে সক্ষম হন, তবে তা ব্যতিক্রম হিসেবেই গণ্য।

(অথ, সামবেদে, খিলশ্রুতিঃ, ব্রহ্মচর্যেণ, চ, এতস্মাৎ, অথর্বাঙ্গিরসঃ, হ, যঃ, বেদ, সঃ, বেদ, সর্বম্, ইতি, ব্রাহ্মণম্) এই প্রসঙ্গে সামবেদে একটি খিল-শ্রুতি পাওয়া যায়। সেই মন্ত্রটি এইরূপ—

“ব্রহ্মচর্যেণ চৈতস্মাদথর্বাঙ্গিরসো হ যো বেদ স বেদ সর্বম্”

বর্তমানে প্রচলিত সামবেদ-সংহিতায় আমরা কোনো খিল মন্ত্র পাই না। সম্ভবত গ্রন্থকারের সময়ে সামবেদে কিছু খিল মন্ত্র বিদ্যমান ছিল, যা পরবর্তীকালে লুপ্ত হয়ে গেছে। এখানে বলা হয়েছে—উপরিউক্ত কারণগুলির ফলে যে অনুসন্ধিৎসু ব্রহ্মচর্য পালনের মাধ্যমে বিদ্যার সাধনা করে অথর্ববেদকে জানতে সক্ষম হয়, সে সমগ্র বেদের জ্ঞান লাভ করে।

আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে অথর্ববেদে সব প্রকার ছন্দ বিদ্যমান এবং ঋক্, যজুঃ ও সাম—এই তিন শৈলীর মন্ত্রও সেখানে অন্তর্ভুক্ত। সেই কারণে অথর্ববেদের জ্ঞান লাভ করলে অন্যান্য বেদের বিষয়েও যথেষ্ট ও সামগ্রিক জ্ঞান অর্জিত হয়।

ভাবার্থঋগ্ববেদীয় মন্ত্রসমূহে অগ্নিদেবতার প্রাধান্য রয়েছে। এর অর্থ হল—ঋগ্বেদে অগ্নিদেবতাসংক্রান্ত মন্ত্রের সংখ্যাই সর্বাধিক। ছন্দের দিক থেকে দেখলেও ঋগ্বেদে গায়ত্রী ছন্দযুক্ত মন্ত্রের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। সেই কারণেই অগ্নিকে ঋগ্বৈদিক মন্ত্রসমূহের জ্যোতি বলা হয়েছে। অপ্রকাশিত বা স্থূলরূপে অনাবিষ্কৃত পদার্থসমূহে ঋগ্বৈদিক ছন্দ-রশ্মির প্রাধান্য থাকে। এই বেদের প্রথম মন্ত্র হল— “অগ্নিমীळेপুরোহিতম্…”

যজুর্বেদীয় মন্ত্রসমূহে বায়ুদেবতাসংক্রান্ত মন্ত্রের প্রাধান্য রয়েছে। সেই কারণেই বায়ুকে যজুর্বেদের জ্যোতি বলা হয়েছে। অর্থাৎ বায়ু-রশ্মির সূক্ষ্ম দীপ্তিকেই যজুর্বেদের দীপ্তি হিসেবে বুঝতে হবে। এই বেদে ত্রিষ্টুপ্ ছন্দযুক্ত মন্ত্রের আধিক্য রয়েছে। আকাশতত্ত্বে যজুর্বৈদিক মন্ত্রগুলির প্রাধান্য বিদ্যমান। আমাদের মতে, যজুর্বেদের ক্ষেত্রে মন্ত্রের স্থানের পরিবর্তে যাজুষী ছন্দ-রশ্মিকেই গ্রহণ করা অধিক যুক্তিসংগত। যাজুষী ত্রিষ্টুপ্ ছন্দ-রশ্মিগুলি আকাশতত্ত্বের ভিত্তিস্বরূপ এবং এগুলির অপেক্ষাকৃত বৃহৎ ছন্দ-রশ্মি বায়ুতত্ত্বের রূপ ধারণ করে অথবা বায়ুতত্ত্ব গঠনে সহায়ক হয়। “ইষে ত্বোর্জে ত্বা বায়বস্থ…”—এই মন্ত্রটি যজুর্বেদের প্রথম মন্ত্র।

সামবেদে আদিত্যদেবতাসংক্রান্ত মন্ত্রের প্রাধান্য রয়েছে। সেই কারণে আদিত্যকে সামবেদের জ্যোতি বলা হয়েছে। এই বেদে জগতি ছন্দযুক্ত মন্ত্রের আধিক্য দেখা যায়। সূর্য ও অন্যান্য নক্ষত্র এবং তাদের কিরণসমূহে সামবৈদিক মন্ত্রের প্রাধান্য বিদ্যমান। “অগ্ন আ যাহি…” সামবেদের প্রথম মন্ত্র।

অথর্ববেদীয় মন্ত্রসমূহে চন্দ্রমাদেবতাসংক্রান্ত মন্ত্রের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। সেই কারণে অথর্ববৈদিক মন্ত্রসমূহের জ্যোতি চন্দ্রজ্যোতির ন্যায় বলে বিবেচিত। এই বেদে কোনো একটি নির্দিষ্ট ছন্দের প্রাধান্য নেই; বরং সকল প্রকার ছন্দই মিশ্ররূপে বিদ্যমান। এই বেদের মন্ত্রপাঠ “শন্নো দেবীরভিষ্টয়ে…” মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে শুরু করা উচিত।

আমাদের দৃষ্টিতে এই সমস্ত আলোচনার মূল তাৎপর্য হল—ঋগ্বৈদিক মন্ত্রসমূহের সমষ্টিগত বা ফলিত দৈব প্রভাব অগ্নিদেবতার প্রভাবের সদৃশ। যজুর্বৈদিক মন্ত্রসমূহের ফলিত দৈব প্রভাব বায়ুদেবতার ন্যায়। অনুরূপভাবে সামবৈদিক ও অথর্ববৈদিক মন্ত্রসমূহের দৈব প্রভাব যথাক্রমে আদিত্য ও চন্দ্রমাদেবতার প্রভাবের সঙ্গে তুলনীয়।

একইভাবে ঋগ্বৈদিক মন্ত্রসমূহের ফলিত ছান্দস প্রভাব গায়ত্রী ছন্দের সদৃশ, যজুর্বৈদিক মন্ত্রসমূহের ফলিত ছান্দস প্রভাব ত্রিষ্টুপ্ ছন্দের ন্যায় এবং সামবৈদিক মন্ত্রসমূহের ফলিত ছান্দস প্রভাব জগতি ছন্দের অনুরূপ। এই সমস্ত ছন্দ-রশ্মি পরিপক্ব প্রাণ-রশ্মিতে আশ্রিত থাকে এবং প্রাণ-রশ্মি পরিপক্ব পশ্যন্তী ওঁ রশ্মি ও মনস্তত্ত্বে আশ্রিত। অতএব প্রাণবিদ্যার পূর্ণ জ্ঞান ব্যতীত বেদের বিজ্ঞান সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।


No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

গোপথ ব্রাহ্মণ ২৯

= কণ্ডিকা ২৯ = [চারটি বেদের দেবতা এবং তাতে ছন্দের প্রধান্য] কিং দেবতমিত্যুচামগ্নির্দেবতন্তদেব জ্যোতির্গায়ত্রীং ছন্দঃ পৃথিবী স্থানম্। অগ্নিম...

Post Top Ad

ধন্যবাদ