ঋগ্বেদ ১০/২৮/৩ - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

03 November, 2025

ঋগ্বেদ ১০/২৮/৩

ঋগ্বেদ ১০/২৮/৩
ঋগ্বেদ ১০.২৮.৩-এর সঠিক অর্থ ও গোমাংস ব্যাখ্যার খণ্ডন


🌼 ভুল ব্যাখ্যার সারসংক্ষেপ

কিছু আধুনিক লেখক, বিশেষত পশ্চিমা দার্শনিক ও কিছু “বেদবিরোধী” অনুবাদক, ঋগ্বেদের ১০.২৮.৩ মন্ত্রে “বৃষভা পচন্তি” অংশটি দেখে দাবি করেছেন— “তাহারা ষাঁড় রান্না করে এবং ইন্দ্রকে তা ভক্ষণ করতে বলা হয়েছে।” এই ব্যাখ্যা ভাষাতাত্ত্বিকভাবে ও বেদীয় ব্যাকরণ অনুসারে সম্পূর্ণ ভুল।


🕉️ অপ্রামাণিক সংস্কৃত পাঠ

পচস্তি তে বৃষভা অৎসি তেষাম

এটি আসলে ঋগ্বেদ ১০.২৮.৩ মন্ত্রেরই একটি মাত্র অংশ মূল মন্ত্রটি নীম্নে দেওয়া হলঃ

প্রামাণিক পাঠ (ঋগ্বেদ ১০।২৮।৩)

অদৃণা তে মন্দিন ইন্দ্র তূযান্ত্‌সুন্বন্তি সোমান্‌ পিবসি ত্বমেষাম্‌।
পচন্তি তে বৃষভাঁ অত্সি তেষাং পৃক্ষেণ যন্মঘবন্ন্‌ হূযমানঃ॥

“বৃষভ” শব্দের ভাবার্থ পরিপক্বতা বা সম্পূর্ণ বিকাশ বোঝায়।

 বৈদিক সংস্কৃতির আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে একটি বিশ্লেষণ

পদার্থঃ (ইন্দ্র) হে আত্মা! অথবা হে রাজন! (তে) তোমার জন্যে, (অদৃণা) প্রশংসাকারী বৈদ্য বা পুরোহিত দ্বারা প্রেরিত, (মন্দিনঃ) তোমাকে আনন্দিত করা পারিবারিক জন বা রাজকর্মচারী, (তূয়াৎ সোমান্ সুন্বন্তি) রসময় সোমপদার্থ (অর্থাৎ শক্তিদায়ক রস) প্রস্তুত করে,(তেষাম্ ত্বং পিবসি)  তুমি তা পান করো, এবং (তে) তোমার জন্যে, (বৃষভান্ পচন্তি) সুখবর্ষণকারী ভোগ্য বস্তুকে প্রস্তুত করে, (মঘবন্ পৃক্ষেণ হূয়মানঃ) হে আত্মা! অথবা হে রাজন! স্নেহপূর্ণ সম্পর্ক দ্বারা আহ্বানিত হয়ে, (তেষাম্ অত্সি)  তুমি তাদের ভোগ করো। ॥৩॥

ভাবার্থঃ যখন আত্মা শরীরে অবতীর্ণ হয়, তখন তাকে অনুমোদনকারী বৈদ্য এবং আনন্দদানকারী পারিবারিক জনেরা নানা রকমের রস ও ভোগ্যবস্তু তার জন্য প্রস্তুত করে, এবং স্নেহসহকারে তাকে খাওয়ায়–পান করায়, যাতে দেহ ক্রমে পুষ্ট হতে থাকে। একইভাবে, যখন রাজা রাজপদে অধিষ্ঠিত হন, তখন তার প্রশংসাকারী পুরোহিত ও সন্তুষ্টিদায়ক রাজকর্মচারীরা সোমাদির মতো ঔষধি রস এবং নানান ভোগ্য বস্তু তার জন্য প্রস্তুত করে। রাজা, স্নেহভরে ও সম্মানসহ যাদের দ্বারা আহ্বানিত হন, তিনি সেই সকল প্রস্তুত ভোগ্যবস্তুর আস্বাদ গ্রহণ করেন। ॥৩॥

(ব্রহ্মমুনি পরিব্রাজক কর্তৃক হিন্দি পদার্থ ও ভাবার্থের বাংলা অনুবাদ)

अद्रि॑णा ते म॒न्दिन॑ इन्द्र॒ तूया॑न्त्सु॒न्वन्ति॒ सोमा॒न्पिब॑सि॒ त्वमे॑षाम् । 

पच॑न्ति ते वृष॒भाँ अत्सि॒ तेषां॑ पृ॒क्षेण॒ यन्म॑घवन्हू॒यमा॑नः ॥

পদার্থঃ [১] পূর্ববর্তী মন্ত্রে প্রভু জীবকে "সুত সোম" (অর্থাৎ পরিশুদ্ধ শক্তিময়) হতে বলেছিলেন। তার উত্তর দিতে গিয়ে সে বলে—হে (ইন্দ্র) = সোমপানকারী প্রভু! (তে মন্দিনঃ) = তোমার স্তোতা ভক্তগণ, (অদৃণা) = [অদ্রিঃ = বজ্রঃ] ক্রিয়াশীলতার দ্বারা, অথবা [না দীর্যতে] ধর্মমার্গ থেকে বিচ্যুত না হয়ে, (তূয়ান্) = বিলম্ব না করে, অর্থাৎ দ্রুত কর্মসম্পাদনের শক্তি প্রদানকারী, (সোমান্) = সোমরূপ শক্তিকণসমূহকে (সুন্বন্তি) = উৎপন্ন করে। (ঐষাম্) = এই সোমকণগুলির (ত্বম্) = আপনিই (পিবসি) = পান করেন অর্থাৎ এই সোমকণসমূহ আমার শরীরে আপনার কৃপায় সংরক্ষিত থাকে। আপনার স্মরণ আমাকে কামনা বাসনা থেকে উপরে তুলে আনে, এবং কামনা থেকে উর্ধ্বে উঠার ফলে আমি সোমকে (অর্থাৎ আত্মশক্তিকে) রক্ষা করতে সক্ষম হই।

[২] এইভাবে, (তে) = তোমার এই ভক্তগণ (বৃষভান্ পচন্তি) = অর্থাৎ পরিপক্ব ও শক্তিশালী পুরুষে রূপান্তরিত হয়, শক্তিশালী হয়ে তারা অপরের উপর সুখের বর্ষণ ঘটায়।

[৩] হে প্রভু! আপনি (তেষাম্) = তাদের পথের অন্তরায়রূপ বাধাসমূহের (অত্সি) = বিনাশ করেন [‘অদ্’ = ধ্বংস করা]। কিন্তু এই বাধা-বিঘ্নের বিনাশ আপনি কখন করেন? (যৎ) = যখন (পৃক্ষেণ) = [পৃচি = সংস্পর্শ] আপনার সঙ্গে সংযোগের মাধ্যমে, হে (মঘবন্) = ঐশ্বর্যশালী প্রভু! আপনি (হূয়মানঃ) = আহ্বান করা হন। এই ভক্তগণ প্রাতে ও সায়ং আপনার সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক স্থাপন করে, এবং শক্তিশালী হয়ে, সমস্ত বাধা দূর করে, অগ্রসর হয়।

ভাবার্থঃ ক্রিয়াশীলতার মাধ্যমে আমরা কামনা-বাসনা থেকে নিজেকে রক্ষা করব। সোম (অর্থাৎ আত্মশক্তি ও সত্ত্বগুণ) সংরক্ষণের দ্বারা নিজেদের শক্তিশালী করে তুলব। প্রভুর সংস্পর্শে এসে, শক্তিসঞ্চয় করে, বাধা-বিঘ্ন দূর করে আমরা দৃঢ়ভাবে অগ্রসর হব।

(হরিশরণ সিদ্ধান্তলঙ্কারজীর হিন্দি পদার্থ ও ভাবার্থের বাংলা অনুবাদ)

📘 পদার্থ বিশ্লেষণ

শব্দ ধাতু / উৎস নিরুক্ত / সূত্র প্রামাণিক অর্থ রূপক ভাব
পচন্তি (pachanti) √पच্ (ধাতু) নিরুক্ত ১.১.১.১২  “সিদ্ধ করা”, “পরিপক্ব করা” সিদ্ধ করে / পরিপক্ব করে আধ্যাত্মিক বিকাশ সাধন
বৃষভাঃ (vṛṣabhāḥ) √वृष্ ধাতু নিরুক্ত ৯.২৩.১  “বলবান”, “শক্তিশালী ব্যক্তি” বলবান মানুষ সাধক, পরিপক্ব কর্মযোগী
অদ্রিণা (adriṇā) अद्रि (পাথর / দৃঢ়তা) নিরুক্ত ৫.৫.১  “দৃঢ় কর্মশক্তি” দৃঢ়তার দ্বারা অধ্যবসায় ও সাধনার প্রতীক
তে মন্দিনঃ (te mandinaḥ) মন্দিন = স্তোতা নিরুক্ত ৭.৩.১ তোমার ভক্তগণ উপাসকরা
অৎসি (atsi) √अद্ ধাতু নিরুক্ত ৬.৩.৪ “খাওয়া” বা “ধ্বংস করা” তুমি ধ্বংস করো এখানে “বাধা বিনাশ করা” অর্থে
মঘবন (maghavan) নামরূপ ইন্দ্রের নিরুক্ত ৪.১৯.৮ ঐশ্বর্যশালী / দাতা ঈশ্বররূপ প্রভু
হুয়ামাহ্ (hūyamānaḥ) √हु ধাতু নিরুক্ত ১.৫.৫  “আহ্বান করা” আহ্বানিত যজ্ঞে আহ্বান প্রাপ্ত হওয়া

🪔 সংস্কৃত থেকে সঠিক বাংলা অনুবাদঃ 

(ইন্দ্র) হে আত্মন! অথবা রাজন! (তে) তোমার জন্য (অদ্রিণা) স্তোত্রকার কবি, চিকিৎসক বা পুরোহিতের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে “অদ্রিরসি শ্লোককৃত্” [কাঠক সংহিতা ১।৫] (মন্দিনঃ) তোমাকে আনন্দিতকারীরা, তোমার পারিবারিক সদস্যগণ বা রাজকর্মচারিগণ (তূয়ান্ সোমান্ সুন্বন্তি) জলে পরিপূর্ণ, রসে পরিপূর্ণ “তূয়ম্ উদকনাম” [নিঘন্টু ১।৯]এমন সোমরস প্রস্তুত করে; (তেষাম্ ত্বং পিবসি)তুমি সেগুলি পান করো “লিঙ্গার্থে লেট্” [অষ্টাধ্যায়ী ৩।৪।৭]; আবার (তে) তোমার জন্য (বৃষভান্ পচন্তি)সুখ ও রসের বর্ষণকারী বস্তুসমূহ প্রস্তুত করে “বৃষভঃ যঃ বর্ষতি সুখানি সঃ” [ঋগ্বেদ ১।৩১।৫ দয়ানন্দ], “বৃষভঃ বর্ষিতা আপাম্” [নিরুক্ত ৪।৮]; (মঘবন্) হে ঐশ্বর্যবান প্রভু! (পৃক্ষেণ) স্নেহ-সম্পর্ক দ্বারা (হূয়মানঃ) আহ্বানিত বা নিমন্ত্রিত হয়ে (তেষাম্ অত্সি)তুমি তাদের ভোগ করো বা উপভোগ করো ॥


🚫 ভুল অনুবাদের খণ্ডন

ভুল দাবি সঠিক ব্যাখ্যা
“বৃষভা” মানে ষাঁড় “বৃষভ” মানে শক্তিমান ব্যক্তি, ঈশ্বর বা জ্ঞানবান
“পচন্তি” মানে রান্না করা “পচন্তি” মানে পরিপক্ব করা, উন্নত করা, সিদ্ধ করা
“অৎসি” মানে খাওয়া “অৎসি” মানে ধ্বংস করা / রক্ষা করা
“গোমাংস ভক্ষণ” প্রসঙ্গ কোথাও নেই  মন্ত্রটি শক্তি, ভক্তি ও সাধনার রূপক প্রকাশ

📜 পাণিনি ও নিরুক্ত সূত্র প্রমাণ

১. পাণিনি অষ্টাধ্যায়ী ৭.১.৫১: “वृषस्यति गोः”-  এখানে “বৃষ” শব্দে “গো” অর্থে নয়, বরং বলবান রূপে ব্যবহৃত।
২. নিরুক্ত (৯.২৩.১): “वृषो बलवां नरः” - বৃষ মানে বলবান মানুষ।
৩. নিরুক্ত (১.১.১.১২): “पच् = सिध्यति” - সিদ্ধ করা, উন্নত করা।


🌸 উপসংহার

ঋগ্বেদ ১০.২৮.৩ মন্ত্রটি গোমাংস ভক্ষণ বা পশুবলি নির্দেশ করে না।
বরং এটি বলে—মানুষকে দৃঢ় কর্ম, সাধনা ও ঈশ্বরস্মরণের দ্বারা শক্তিমান হতে হবে,
তখন প্রভু তার সমস্ত প্রতিবন্ধকতা দূর করে পথ প্রসারিত করেন।

অতএব, “ষাঁড় রান্না” বা “গোমাংস ভক্ষণ” ব্যাখ্যা কেবল ভাষাতাত্ত্বিক অজ্ঞতা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিকৃতি।
এই মন্ত্র আসলে কর্মশক্তি, বোধ ও ঈশ্বরযোগের প্রতীকী স্তব।

📚 ৫. সায়ণাচার্যের ভাষ্য অনুযায়ীঃ

“वृषभान् पचन्ति इति बलीयान् पुरुषान् परिपच्य भवन्ति।”
(Rigveda with Sāyaṇa Bhāṣya, Nirnaya Sagar Edition, Vol. 4, p. 532)

অর্থাৎ, “বৃষভান্ পচন্তি” মানে— ভক্তরা নিজেদের পরিপক্ব বা শক্তিশালী করে তোলে, এটা না যে তারা পশু রান্না করে।


No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

ঋগ্বেদ ১০/২৮/৩

ঋগ্বেদ ১০.২৮.৩-এর সঠিক অর্থ ও গোমাংস ব্যাখ্যার খণ্ডন 🌼 ভুল ব্যাখ্যার সারসংক্ষেপ কিছু আধুনিক লেখক, বিশেষত পশ্চিমা দার্শনিক ও কিছু “বেদবির...

Post Top Ad

ধন্যবাদ