প্রত্যর্ধির্ যজ্ঞানামশ্বহযো রথানাম্।
ঋষিঃ স যো মনুর্হিতো বিপ্রস্য যাবযত্যখঃ ॥ ঋ০১০।২৬।৫
পদার্থঃ (ঋষিঃ সঃ) ঋষি সেই, (যঃ) যিনি, (যজ্ঞানাং প্রতি অধিঃ) যজ্ঞসমূহের প্রতিপাদক, যিনি যজ্ঞের মতোই শুদ্ধ, পবিত্র ও পাপমুক্ত, (রথানাম্ অশ্ব-হযঃ) যিনি রথগুলির অর্থাৎ জীবনরথের দ্রুত প্রেরক, ত্বরিত চালক, শুভকর্মের প্রাণ, (মনুঃ হিতঃ) যিনি সকল মানুষের মঙ্গল ও কল্যাণ কামনাকারী, (বিপ্রস্য সখঃ) যিনি জ্ঞানী, বুদ্ধিমান ও ধর্মপরায়ণ ব্যক্তিদের বন্ধু, (যাবয়ৎ) যিনি সকল দুঃখ দূর করেন।
ভাবার্থঃ ঋষি কে? বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে ‘ঋষি’ শব্দের নানা রকম ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। কিন্তু বেদে ‘ঋষি’-র যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তা একেবারেই অনন্য, আশ্চর্য ও অতুলনীয়। বেদ ঋষির লক্ষণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেনঃ
১. ঋষি সেই, যিনি যজ্ঞসমূহের তথা শ্রেষ্ঠ কর্মের সম্পাদনাকারী। তিনি নিজেও যজ্ঞের মতোই পবিত্র, নির্মল ও নির্দোষ, এবং সর্বদা শুভ কর্মই সম্পাদন করেন।
২. ঋষি সেই, যিনি জীবনের রথকে দ্রুত এগিয়ে দেন; অর্থাৎ জীবনের গতি, প্রেরণা ও কর্মশক্তির উৎস। এমনকি কুটিল, দুষ্কর্মী, অসচ্চরিত্র বা ভ্রষ্ট মানুষকেও তিনি নিজের শুভ প্রেরণায় সৎপথে পরিচালিত করেন।
৩. ঋষি সেই, যিনি কোনো প্রকার ভেদাভেদ বা পক্ষপাত না রেখে, নিরপেক্ষভাবে সমস্ত মানবজাতির মঙ্গল ও কল্যাণ কামনা করেন।
৪. ঋষি সেই, যিনি জ্ঞানী, বুদ্ধিমান এবং ধর্মপরায়ণ ব্যক্তিদের বন্ধু—তাঁদের সহচর, তাঁদের পথপ্রদর্শক।
৫. ঋষি সেই, যিনি শুধু মানুষের কল্যাণে সীমাবদ্ধ নন; তিনি সমস্ত জীবজগতের দুঃখ ও কষ্ট দূর করার জন্য কাজ করেন, প্রানীমাত্রের কল্যাণে নিজেকে নিবেদন করেন।
অর্থাৎ, বেদের মতে ঋষি হলেন সেই মহাপুরুষ**, যিনি অন্তরে শুদ্ধ, কর্মে পবিত্র, জ্ঞানে তত্ত্বদ্রষ্টা, যাঁর হৃদয়ে সকল প্রাণীর প্রতি সমান মমতা ও কল্যাণবোধ বিদ্যমান। (স্বামী জগদীশ্বরানন্দজীকৃত ভাষ্য)
🌿 নিরুক্ত শাস্ত্রে বেদের আগম-প্রকার (উৎপত্তি পদ্ধতি)
যাস্কাচার্য বলেন— (নিরুক্ত ১।২০)
“সাক্ষাত্কৃতধর্মাণ ঋষয়ো বভূবুঃ। তে অবরেব্যঃ অসাক্ষাত্কৃতধর্মভ্য উপদেশেন মন্ত্রান্ সম্প্রাদুঃ। উপদেশায় গ্লায়ন্তঃ অবরে বিল্মগ্রহণায় ইমং গ্রন্থং সমাম্নাসিষুঃ। বেদং চ বেদাঙ্গানি চ।”
অর্থাৎ, যারা ধর্মকে প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করেছিলেন, তাঁরাই ছিলেন ঋষি। তাঁরা যাঁরা তাঁদের অপেক্ষা ছোট এবং ধর্মের সত্য স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারেননি, তাঁদেরকে উপদেশের মাধ্যমে মন্ত্রসমূহের পাঠ ও অর্থ শিক্ষা দিয়েছিলেন।
🔸 ঋষিগণের অবদান
ভারতবর্ষের সমস্ত প্রাচীন জ্ঞান অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত সত্য-ধর্মানুগ জ্ঞানের উৎস এই ঋষিরাই। বেদ, ধর্মশাস্ত্র, আয়ুর্বেদ, ধনুর্বেদ, অর্থশাস্ত্র, গান্ধর্ববেদ, জ্যোতিষশাস্ত্র ইত্যাদি সমস্ত বিদ্যা তাঁদের থেকেই উদ্ভূত।
এই ঋষিগণই ছিলেন —
ব্রহ্মা, অত্রি, বসিষ্ঠ, স্বায়ম্ভুব মনু, মাৰ্কণ্ডেয় প্রভৃতি।
যাদের দ্বারা সরাসরি ধর্ম উপলব্ধি সম্ভব হয়েছিল, তাঁরাই ছিলেন “সাক্ষাৎকৃতধর্মা ঋষিগণ।”নিরুক্ত ১।২০।২- দুর্গাচার্যের ব্যাখ্যা
অর্থাৎ যাঁরা তপস্যার মাধ্যমে ধর্মকে নিজের চোখে উপলব্ধি করেছিলেন, তাঁরাই সত্য ঋষি নামে অভিহিত হয়েছেন।
“বৎকাম ঋষিঃ” অর্থাৎ “ঋষি মানে সেই ব্যক্তি বা মন্ত্র, যে কোনো কামনা পূরণের উদ্দেশ্যে কোনো দেবতার স্তব করে।” অর্থাৎ, ঋষি (বা মন্ত্র) কোনো ইচ্ছিত বস্তুর অধিপতি হিসেবে যে দেবতার বন্দনা করে, সেই দেবতাই সেই মন্ত্রের দেবতা হন॥

No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ