ভূমিকা
ইসলামী সমাজে কাম বা যৌনতা (সেক্স) বিষয়টি একেবারেই অপ্রকাশিত। সাধারণ মুসলিম সমাজে যৌনতা শব্দটি কদাচিৎ উচ্চারিত হয়ে থাকে। হলেও হয় গোপনে, ভয়ে ভয়ে। দৈব-দুর্বিপাকে কোনো সমস্যা দেখা দিলে কিংবা কাফেরদের দেশে নারীসম্ভোগের জন্যে গমন করা ছাড়া অন্য সময়ে যৌনবিষয়ক আলাপ আলোচনা ইসলামী সমাজে নিষিদ্ধই বলা যায়। ইসলাম ভান করে, যেন পুরুষ বা নারীর দেহে যৌনাঙ্গ বলতে কোনোকিছুর অস্তিত্ব নেই। একজন মুসলিম রমণীকে তার মাথা হতে পা পর্যন্ত ঢেকে রাখতে হয় আজীবন, তার “আওরাকে” সে এভাবেই আবরণ নিয়ে রক্ষা করে। ইসলামী পরিভাষায় আওরা বলতে নারীর সেই অঙ্গকে বোঝায়, যা দেখলে পুরুষ কামোত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং যা নারীর জন্যে লজ্জাস্বরূপ। অর্থাৎ যৌনাঙ্গ হচ্ছে নারীদেহের একটি অতিশয় লজ্জাজনক অংশ। তার সমস্ত দেহটিই একটি লজ্জাজনক বস্তু—এই অনুভূতি নিশ্চয়ই নারীদের জন্যে সম্মানের বিষয় নয়।
পুরুষের জন্যও এই ধারণা চরম অবমাননাকর। কারণ এতে এই প্রমাণ হয় যে, পুরুষজাতি রাস্তায় বিচরণরত বেওয়ারিস ষাঁড়ের চেয়ে বেশি কিছু নয়, সামনে মেয়ে দেখলেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে অপরিসীম যৌনক্ষুধা মিটিয়ে নেয়ার জন্যে সর্বক্ষণ মুখিয়ে আছে সে। একেবারেই অর্থহীন বাজে একটি ধারণা এটি। আমি কাফেরদের দেশে যুগের পর যুগ বাস করছি। নানা বর্ণের, নানা বয়সের লাখ লাখ মেয়ে এখানে অহোরাত্র প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে দিনে এবং রাতে। তাদের কারও বেশভূষা শালীন, কারও বেশভুষা প্রচলিত ভাষায় যাকে বলে চরম উত্তেজনাকর বা ‘সেক্সি’, কিন্তু কখনও দেখিনি যে, কোনো পুরুষ কামতাড়িত হয়ে এমনকি চরম যৌনাবেদনময়ী বা সেক্সি মেয়েটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং যৌনক্ষুধা মিটিয়ে নিল।
ইসলামী আইনসমূহে অগণিত ছিদ্র রয়েছে। এত ছিদ্র আছে যে, ইচ্ছে করলে যে কোনো মুসলমান পুরুষ, তা সে বিবাহিত বা অবিবাহিত যা‑ই হোক না কেন, আইনের কানাগলির সুযোগ নিয়ে অপরিমিত যৌনসম্ভোগ করতে পারে। তাকে যা করতে হবে, তা হলো - খেলাটি ভালভাবে রপ্ত করা। না জেনে খেলতে গেলে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা। রতিলীলা করার জন্য ইসলামে এত গুপ্ত উপায়, না-বলা এতসব আইনকানুন আছে যে, মোল্লারা সে সম্পর্কে মুখ খুলবে না।
পাঠক, শীতকালে গরম লেপের উষ্ণতা কতোই না আরামদায়ক। তাই না? শেক্সপিয়ারের সনেট, রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গান, অজন্তার গুহাচিত্র কিংবা প্রাচীন গ্রিসের ভাস্কর্য—সর্বযুগের সংস্কৃতিপ্রেমী মানবসন্তানের মনে সন্তোষের জন্ম দেয়। কিন্তু আপনি কি ভেবে দেখেছেন যে, কিছু বিরল উপাদান আছে, যার মাঝে মানুষ তার শারীরিক ও মানসিক তৃপ্তি একসাথে খুঁজে পায়? তা হচ্ছে যৌনতৃপ্তি। হ্যাঁ, সেক্স [বা যৌনক্রিয়া] হচ্ছে সেই বিরল উপাদানগুলির মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী উপাদান যা মানবজাতির (নারী পুরুষ উভয়ের) চালিকা শক্তি (ড্রাইভিং ফোর্স) হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। এই শক্তিশালী উপাদানটিকে কোন সমাজ কীভাবে দেখাশোনা করে, তার ওপরেই সে সমাজের প্রসারতা কিংবা পরিপক্কতার পরিচয় নির্ভর করে।
এই নিরিখে ইসলাম কীভাবে যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, তার পর্যালোচনা করা যাক। ইসলাম মানব‑প্রজাতির যৌনাচারকে স্ত্রীজাতির মর্যাদার সাথে গুলিয়ে ফেলেছে। অথচ মানুষের স্বাভাবিক যৌন ক্রিয়াকলাপ আর নারীর মর্যাদা সম্পূর্ণ আলাদা দু’টি বিষয়। পৃথিবীতে প্রচলিত আর সব ধর্ম বা সামাজিক প্রক্রিয়াগুলির সাথে তুলনা করলে দেখা যায় যে, ইসলাম যৌনতার পবিত্রতার উপর অতিমাত্রায় গুরুত্ব আরোপ করে, অথচ এর মাঝে এত বেশি স্ববিরোধিতা রয়েছে, যা দেখে মনে হয় নর-নারীর স্বাভাবিক সম্পর্কে ইসলাম বড় বেশি স্পর্শকাতর, বড় বেশি উৎকণ্ঠিত। সেক্সুয়ালিটি বা যৌনাচার সম্পর্কে ইসলামের কপটতা, দ্বিমুখী ও পক্ষপাতদুষ্ট নীতি এবং উদ্ভট ও অযৌক্তিক বিধিনিষেধের স্বরূপ উন্মোচন করাই বক্ষ্যমান প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য। সেই সাথে এটাও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানো যে, যৌথ সম্মতির ভিত্তিতে নরনারীর যৌনতৃপ্তি মেটানোর প্রাকৃতিক অধিকারের ওপর কিছু অন্যায় ও অযৌক্তিক বাধানিষেধ আরোপ করে মানুষের ওপর অপরিসীম নির্যাতন চালানোর বিধান দেয়া হয়েছে ইসলামে। নর-নারীর যৌনসম্পর্ক মানবজীবনের পরম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ধরাপৃষ্ঠে জীবকুলের বিকাশ যৌনপ্রক্রিয়ারই অবধারিত ফসল। এটি ছাড়া ডারউইনের বিবর্তন বহু আগেই বন্ধ হয়ে যেতো।
যে সমাজে নারীর ওপরে যত কম অত্যাচার হয়, সে সমাজ তত সভ্য। সে হিসেবে এখনো পৃথিবীতে মা-বোনের সামনে আমাদের লজ্জা রাখার জায়গা নেই। সৃষ্টির শুরু থেকে পুরুষ যত রকমে সম্ভব নারীর ওপরে অত্যাচার করেছে। এবং সেজন্য রাষ্ট্র, সাহিত্য, আঞ্চলিক সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক কাঠামো এমনকি ধর্ম পর্যন্ত কাজে লাগিয়েছে। নারীর ওপরে অত্যাচারকে হালাল করার ব্যাপারে ধর্মের ব্যবহারটা খুবই মোক্ষম। ইসলামের অবস্থাও তাই। সে অত্যাচার ঠেকাবে কি, ওটাকে অত্যাচার বলে মনে করতেই সাহস পায় না কেউ। ইমান নষ্ট হবে তাহলে। এ ব্যাপারে লেখালেখি হয়েছে বিস্তর। ভক্ত মুসলমানরা আর মওলানারা লক্ষ লক্ষ কেতাবে, প্রবন্ধ‑নিবন্ধে, মিলাদ‑মজলিসে, আর বক্তৃতায় কোরআন-হাদিসের নানারকম উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়েছেন, ইসলামে নারীর জায়গা বড়ই চমৎকার। ইসলাম মেয়েদের একেবারে দুধে-মধুতে রেখেছে। কথাটা যে একবারে মিথ্যে; তা কিন্তু নয়। মেয়েদের ব্যাপারে মিষ্টি-মধুর অনেক কথাই আছে ইসলামে। আছে মনোহরণ বর্ণনা, আছে চমৎকার উপদেশ, উপরোধ আর অনুরোধ। সেটা হল মুদ্রার একটা দিক। চাঁদের যেমন একটা দিকই পৃথিবীর দিকে সব সময় মুখ করা থাকে, তেমনি মেয়েদের ব্যাপারে ইসলমের ওই মিষ্টি সুন্দর মুখটাই মওলানারা সব জায়গায় দেখিয়ে বেড়ান। অন্য কুৎসিত দিকটা তাঁরা জানেন নিশ্চয়ই, কিন্তু ভুলেও দেখান না। কিংবা, বোধহয়, ইমানের কঠিন দেয়াল ভেঙে মানবতাটা মাথায় ঢুকতেই পারে না। যদি ইসলাম মেয়েদের এতই মাথায় তুলে রাখবে, তাহলে মুসলমান সমাজের ইতিহাসে আর বর্তমানে মেয়েদের এত আর্তনাদ, এত গোঙানির অন্য কারণগুলোর সাথে সাথে ইসলামী আইনের নিষ্ঠুরতাটা লুকিয়ে রাখেন বিলকুল। ইসলামকে যদি ঠিকমত জানতে হয়, তবে দু’টো দিকই দেখতে হবে আমাদের।
দলিল থেকে নারীর প্রতি ইসলামের আদর দেখিয়েছেন লক্ষ লক্ষ মওলানা। আর নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছেন মুষ্টিমেয় মাত্র কিছু পণ্ডিত। দু’একটা বইও আছে ইংরেজিতে এর ওপর। তবে এ বিষয়ে সবচেয়ে বিস্তারিত বলেছেন আবুল কাশেম। ইন্টারনেটের অনেক সাইট তাঁর পুরো গবেষণা ধরে রেখেছে, বিশেষ করে মুক্তমনা। এ বইয়ের অন্য জায়গায় মুক্তমনার ঠিকানা দেয়া আছে। কোরআন-হাদিস আর ইসলামের আদি কেতাবগুলো থেকে তিনি একের পর এক অজস্র দলিল এভাবে তুলে ধরেছেন যে, তা থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ হয়, মুসলমান মেয়েদের প্রতি যত অত্যাচার হয়েছে, তার একটা বড় অংশের জন্য দায়ী ইসলাম নিজেই। বাংলায় এতবড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একটি বইও নেই, এটাই প্রথম। আপনাদের সামনে দেবার আগে বছরের পর বছর ধরে এর প্রতিটি বক্তব্যের সত্যতা সম্বন্ধে সমুদ্র-মন্থন করা হয়েছে কোরআন-হাদিস এবং ইসলামের আদি ইতিহাস থেকে। কারণ আমরা হাড়ে হাড়ে জানি মওলানারা কি চীজ। একটা ভুল পেলেই চিৎকার করে আকাশপাতাল একাকার করে ফেলবেন। ভুল না পেলেও মুরতাদ-টুরতাদ বলে টাকা-পয়সার ঘোষণা দিয়ে তাঁরা আমার মাথাকাটার চেষ্টা করবেন। যাহোক, কোনো মওলানা যদি এর মূল উদ্ধৃতিতে ভুল দেখাতে পারেন, তা হলে প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে এ বই আমি বাজার থেকে উঠিয়ে নেব, এ ওয়াদা থাকল।
এবারে কাজে নামা যাক। আমাদের মা, বোন, স্ত্রী, কন্যাকে ইসলাম কী চোখে দেখছে, মুখের কথায় কী বলছে, আর কাজে কী করছে? আমি আবুল কাশেমের গবেষণা থেকে আলোচনা করব, আমার সিদ্ধান্ত আপনাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেব না। মাথার মধ্যে মগজ সবারই আছে। সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব আপনাদের। পাঠক! অবাক এবং ক্রুদ্ধ হবার জন্য প্রস্তুত থাকুন।
ধন্যবাদ।
একজন পাঠক
২৫শে সেপ্টেম্বর, ২০০২ খ্রিষ্টাব্দ।
লেখকের সামান্য কথা
প্রায় এক যুগ ধরে ‘উইমেন ইন ইসলাম’ এবং সেটার বাংলা অনুবাদ বিভিন্ন ওয়েব সাইট এবং ই-বুক হিসেবে পাঠকেরা পড়ে আসছেন। বহু সংখ্যক পাঠক আরও জানার জন্য আমাকে অনেক দিন ধরেই তাগিদ দিচ্ছেন। তাঁদের অনুরোধে এই দ্বিতীয় সংস্করণ তৈরি করা হলো। এখানে অনেক নতুন তথ্য দেওয়া হয়েছে এবং কলেবর বৃদ্ধি হয়েছে। তবুও এই সংস্করণের ভিত্তি হচ্ছে প্রথম সংস্করণের বাংলা অনুবাদ। সেই অনুবাদকের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
জানুয়ারি ১২, ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দ
সূচিপত্র
সূচনা
অধ্যায় ১: প্রথম পাঠ
অধ্যায় ২: নারীরা হচ্ছে নিকৃষ্টতম প্রাণী
অধ্যায় ৩: ইসলামে বহুগামিতা
অধ্যায় ৪: ইসলামী দেনমোহর
অধ্যায় ৫: ইসলামী নারীদের জীবিকা
অধ্যায় ৬: ইসলামী তালাক
অধ্যায় ৭: হিলা এবং মুসলিম নারীদের অধিকার
অধ্যায় ৮: খৎনা এবং জিহাদ করা
অধ্যায় ৯: ইসলামের নারী শিকার
উপসংহার
সূচনা
সব বাংলাদেশীর মত আমিও ইসলামকে খুবই শান্তির ধর্ম মনে করতাম, সবার মতই আসল ইসলাম সম্বন্ধে জানতাম অল্পই। ইরানে ইসলামী হুকুমত কায়েমে দুনিয়া তার দিকে ফিরে তাকাল। পরে আমিও কৌতূহলী হয়ে ঢুকে পড়লাম অন্তর্জালে। ইউরোপ-আমেরিকার শত শত ইসলামী মনীষীর অসংখ্য লেখা পড়ে মনটা খুব খুশি হয়ে গেল। সব সৎ পাঠকের মত আমিও তাদের প্রতিটি কথাই বিশ্বাস করলাম। ইসলামে আমাদের মা-বোনদের জন্য এত ভালো ভালো কথা আছে যে, তা দেখে মনটা আমার বড়ই মোহিত হয়ে গেল।
কিন্তু তারপর পৃথিবীর মুসলিম দেশগুলোর দিকে তাকিয়ে কেমন যেন সন্দেহ হল। ইসলামী মনীষীরা এত জোর দিয়ে যা কিছু বলছেন, তার দেখি কিছুই মিলছে না। উল্টো বরং মেয়েদের আর্তনাদে সেখানে কান পাতা দায়। পাকিস্তানে, নাইজিরিয়াতে, আফগানিস্তানে তো মোটামুটি ইসলামী আইন (শরিয়া) চালু আছে, কিন্তু তাহলে সে সব দেশে মেয়েদের অবস্থা এত করুণ কেন? আফগানিস্তানের রাস্তায় পুলিশ লাঠি দিয়ে মেয়েদের পেটাচ্ছে, নাইজিরিয়ায় ধর্ষিতা মেয়ে পুলিশের কাছে নালিশ জানাতে এসে শরিয়া কোর্টে মৃত্যুদণ্ড পেল, দুবাই কোর্ট স্বামীদেরকে বৌ-পেটানোর অধিকার দিল, পত্রিকায় এই সব দেখে মাথায় যেন বজ্রাঘাত হল, আতংকে ত্রাসে শিরশির করে উঠল বুকের ভেতর। সর্বনাশ! অন্য কেতাবে যা-ই লেখা থাকুক, শরিয়ার কেতাবে তো এগুলোই আছে। বাংলাদেশেও শরিয়া চালু করার চেষ্টা চলছে, এমন ঘটলে আমাদের যে কী সর্বনাশ হয়ে যাবে, তা ভেবে ভয়ে হিম হয়ে গেল বুক। তারপর বাধ্য হয়েই ঢুকে পড়লাম ইসলামের ভেতর। ওখানে কী আছে, দেখতে হবে, শেকড় খুঁজে বের করতে হবে নারীর ওপর ইসলামী অন্যায়-অত্যাচারের। অত্যাচারগুলো আসলে কি কেতাবেই আছে, না কি পুরুষরা আইনগুলোকে বিকৃত করেছে?
যা দেখলাম, তাতে দম বন্ধ হয়ে গেল। অবিশ্বাস্য, এ যে অবিশ্বাস্য! এ কী চেহারা আসল ইসলামের? এ যে প্রকাণ্ড এক দানব ছাড়া আর কিছু নয়! আবার সব কিছু দেখলাম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। না, কোনো ভুল নেই, মানুষকে হাজার বছর ধরে নির্লজ্জ মিথ্যে কথায় কঠিন প্রতারণা করেছেন মওলানারা। আমি উচ্চ বিদ্যায়তনে ছাত্র পড়াই, জীবনে অনেক পরীক্ষাই দিয়েছি ও পাশ করেছি। এবার যেন জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে, এ কথা মনে রেখে আবার পড়া শুরু করলাম ইসলামের মূল বইগুলো, যেখান থেকে উঠে এসেছে ইসলামের আইন কানুন। খাটাতে শুরু করলাম নিজের বিবেক-বুদ্ধি আর কল্যাণ-বোধ। তখন ধীরে ধীরে ইসলামের এই লুকিয়ে রাখা না-বলা দানবীয় দিকটা স্পষ্ট হয়ে এল চোখের সামনে। না, কোনো ভুল নেই। নারীর প্রতি ইসলামের আদর-সম্মান শুধু লোক-দেখানো, মন-ভোলানো। ওগুলো শুধু গজদন্তের মত হাতির বাইরের সুন্দর দাঁতটা। আসলে ইসলামের মুখের ভেতরে লুকোনো আছে মেয়েদের চিবিয়ে খাওয়ার জন্য আরও এক পাটি শক্তিশালী বিষাক্ত দাঁত। তারই নাম শরিয়া বা শারিয়া।
কিন্তু এটা আমি একা দেখলে তো চলবে না। অবশ্যই এ লুকোনো দলিল দেখতে হবে পৃথিবীর সব মানুষকে। যত অবিশ্বাস্যই হোক, যত বেদনাদায়কই হোক, সবাইকে জানতেই হবে ইসলামী শরিয়া আইন কী শকুনের চোখে তাদের দেখে। খাল কেটে এ রক্তপিপাসু কুমিরকে ডেকে আনবার আগে অবশ্যই সমস্ত শান্তিপ্রিয় মুসলমানকে দেখতে হবে ইসলামের এই ভয়াবহ লুকোনো চেহারা।
তাই হাতে তুলে নিয়েছি কলম, খুব আস্তে-ধীরে ইসলামের আসল চেহারাটা ফুটিয়ে তুলব আপনাদের সামনে। আপনারা পড়ুন, খুঁটিয়ে দেখুন, এবং চিন্তা করুন। এবং দেখান মওলানাদের। তাঁদের কী বলার আছে, জানান আমাকে। যদিও জানি, তাঁরা টুঁ শব্দটি করবেন না। কারণ তাঁদের ভালোই জানা আছে যে, লড়াইটা তাঁদের করতে হবে আমার বিরুদ্ধে নয়, বরং তাঁদের নিজেদের কেতাবের বিরুদ্ধেই। এটাও তাঁরা ভালোই জানেন যে, এ ব্যাপারে বেশি নাড়াচাড়া করলে তাঁরা মধ্যপ্রাচ্যের চোরাবালির গর্তে ঢুকে মারা পড়বেন।
ধন্যবাদ।
আবুল কাশেম।
অধ্যায়-১ : প্রথম পাঠ
প্রথমে কোরআন দিয়েই শুরু করা যাক, সৌদি আরব থেকে প্রকাশিত মওলানা মুহিউদ্দিন খানের অনুবাদ। কোরআনের যে-কথাগুলো পুরুষের মন-মানসিকতায় ব্রহ্মাস্ত্র হিসেবে গেঁথে রয়েছে, সেগুলো একটু দেখে নেয়া যাক, তারপরে বিস্তারিত তথ্যে যাব আমরা।
আল্লাহ্র পছন্দ হচ্ছে পুরুষ—তা কি বলার দরকার রাখে?
কী আছে সুরা নাহল- আয়াত ৪৩ (১৬:৪৩), সুরা হজ্ব আয়াত ৭৫ (২২:৭৫) এ?
নারীকে কোনোদিন নবী-রসুল করা হবে না।
সুরা ইউসুফ, আয়াত ১০৯-(১২:১০৯) তেও একই কথা:
আপনার পূর্বে আমি যতজনকে রসুল করে পাঠিয়েছি, তারা সবাই পুরুষই ছিল জনপদবাসীদের মধ্য থেকে, আমি তাঁদের কাছে ওহী প্রেরণ করতাম।
এবং সিদ্ধান্ত দিয়েছে সুরা আল্ আনাম আয়াত ৯ (৬:৯):
যদি আমি কোনো ফেরেশতাকে রসুল করে পাঠাতাম, তবে সে মানুষের আকারেই হত। এতেও ঐ সন্দেহই করত, যা এখন করছে।
কোনো কোনো অনুবাদে দেখবেন আরবির ‘পুরুষের আকারে’ শব্দটাকে অনুবাদে ‘মানুষের আকারে’ বলে সমস্যাটাকে ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করেছেন চালাক মওলানারা।
আরবিতে মানুষ হল ইনসান আর পুরুষ হল রাজাল। মওলানাদের জিজ্ঞাসা করুন তো, কোরানে কোন শব্দটা আছে?
এবারে একটু হাদিস ঘেঁটে দেখা যাক। হাদিস হল নবী (সঃ)-এর কথাবার্তা, আচার-বিচার, ধ্যান-ধারণা, ব্যবহার-ব্যক্তিত্ব, মতামত-সিদ্ধান্ত, এ সবের বিস্তারিত প্রতিবেদন বা বিবরণী, যা তাঁর সহচরেরা দিয়ে গেছেন। হাদিস ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, কোরানের পরেই এর স্থান। হাদিস বাদ দিলে ইসলামের সাংঘাতিক অঙ্গহানী হয়ে যায়। বিখ্যাত মওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম তাঁর বিখ্যাত ‘‘হাদিস সংকলনের ইতিহাস’’ বইয়ের ৯৪ পৃষ্ঠায় বিভিন্ন বুলন্দ ইমামের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘হাদিস অমান্যকারী কাফির।’
ছয়টি হাদিসের বই সর্বকালে সর্ব দেশে সুন্নী মুসলমানেরা ‘‘সহি’’ বা ‘‘সত্য’’ বলে গণনা করেন, সেগুলো হল সহি বুখারি, সহি মুসলিম, সহি নাসাঈ, সহি তিরমিযী, সহি আবু দাউদ এবং সহি ইবনে মাজাহ। অনেকে মালিকের মুয়াত্তাকেও অন্তর্ভুক্ত করে থাকেন। আমরা মোটামুটি সেগুলো থেকেই উদ্ধৃতি দেব।
দুনিয়ার একশো বিশ কোটি মুসলমানের মধ্যে সুন্নীরাই একশো কোটি। হাদিসে মেয়েদের সম্মন্ধে অনেক ভালো কথাও আছে। কিন্তু তার পাশাপাশি যা আছে, তাতে লজ্জায় মুসলমান পুরুষদের স্রেফ আত্মহত্যা করা ছাড়া অথবা ওই শত শত দলিলগুলোকে খুন করা ছাড়া উপায় নেই। বাড়িয়ে বলছি না একটুও, সবই দেখাব একটা একটা করে।
সহি মুসলিম; বই ৩১, হাদিস নম্বর ৫৯৬৬:
আবু মূসার বর্ণনা মতে নবী (সা) বলেছেন: “পুরুষদের মধ্যে অনেকেই ত্রুটিমুক্ত কিন্তু নারীদের মধ্যে কেউ-ই ত্রুটিমুক্ত নয়, কেবল ইমরানের কন্যা মেরী এবং ফারাওয়ের স্ত্রী আয়েশা ছাড়া।” (সূত্র ৩)
হল? একেবারে সাফ কথা। এ কথার পর কি আর কিছু বলার থাকতে পারে, না বলা উচিত? এর পরেও আবার যদি গোদের ওপর বিষফোঁড়া গজায়, ইসলাম যদি পতিদেবতাকে ওপরে তুলতে তুলতে একেবারে আসমানি পাতি-দেবতা করে তোলে, তবে নারী তো পুরুষের পায়ের তলায় পিষে যাবেই, তার জন্মগত মানবাধিকার তো লেজ তুলে পালাবেই।
প্রমাণ দেখাচ্ছি সুনান আবু দাউদ হাদিস থেকে; বই ১১ হাদিস নম্বর ২১৩৫:
কায়েস ইবনে সা’দ বলছেন, ‘‘নবী (সা) বললেন: “আমি যদি কাউকে কারো সামনে সেজদা করতে বলতাম, তবে মেয়েদের বলতাম তাদের স্বামীদের সেজদা করতে। কারণ আল্লাহ স্বামীদের বিশেষ অধিকার দিয়েছেন তাদের স্ত্রীদের ওপরে।” (সূত্র ৪)
গ্রাম-গঞ্জের কোটি কোটি অশিক্ষিত মুসলিম পুরুষ আর কিছু না বুঝুক, আল্লার দেয়া এই ‘‘বিশেষ অধিকার’’ ঠিকই বুঝেছে, আর তার ঠ্যালায় মেয়েদের যে কী অপমান আর নৃশংস অত্যাচার সইতে হয়েছে শতাব্দী ধরে, তা ঠিকমত উপলব্ধি করলে অশ্রু সামলানো যায় না।
এ ঘটনাটা ঘটেছিল হিন্দুধর্মের বইতেও। হিন্দুরা তো তাদের মহাপুরুষদের অক্লান্ত চেষ্টায় সে নরক থেকে বেরিয়ে এসেছে, শুধু আমরা মুসলমানরাই এখনো চোখে সর্ষে ফুল দেখে দেখে ভিরমি আর খাবি খেয়ে চলেছি এ অন্ধকূপের ভেতর। মেয়েদের আর্তনাদ শুনছি আর সাম্যের বক্তৃতা শুনছি। অবশ্যই, অবশ্যই!
সে কথাগুলো হল: পুরুষ নারীর ওপরে কর্তা, উত্তরাধিকারে পুরুষ নারীর দ্বিগুণ পাবে, আর্থিক লেনদেনে নারীর সাক্ষ্য পুরুষের অর্ধেক, ইত্যাদি ইত্যাদি।
নারীরা হল ভূমি এবং ক্রীতদাসী সদৃশ - এ-ও কি বলে দিতে হবে?
দেখুন কোরআন শরীফ
সুরা বাকারা, আয়াত ২২৩ (২:২২৩):
তোমাদের স্ত্রীরা হলো তোমাদের জন্য শষ্যক্ষেত্র। তোমরা যেভাবে ইচ্ছা তাদেরকে ব্যবহার কর।
এ কথার মানে কি? ‘শষ্যক্ষেত্র’ কথাটার মানেই হল, মেয়েদের বিছানায় টেনে নিয়ে যাও, আর ‘চাষ কর’, ‘শষ্য’ অর্থাৎ বাচ্চা পয়দা করার জন্য। ছিঃ! কোনো ধর্মগ্রন্থ যে নারীদের নিয়ে এমন অবমাননাকর শব্দ উচ্চারণ করতে পারে, তা কল্পনাই করা যায় না। আর ‘ব্যবহার কর’ কথাটার মানেই বা কী? মেয়েরা কাপড়, না জুতো যে ব্যবহার করতে হবে? এর পরেও কোরানে পুরুষের জন্য মেয়েদের ‘উপভোগ কর’, ‘সম্ভোগ কর’ এ ধরণের কামুক কথাবার্তা প্রচুর আছে। আর বেহেশতের তো কথাই নেই। [এই আয়াত নিয়ে দীর্ঘ লেখা আছে ‘ইসলামে যৌনতা’ পর্বে পড়ে নিন।]
সুরা আল-ওয়াক্বিয়াতে (সূরা ৫৬: ৩৫-৩৭) মেয়েদের নানারকম উত্তেজক বর্ণনার পর বলা হল:
আমি জান্নাতী রমণীগণকে বিশেষরূপে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর তাদেরকে করেছি চিরকুমারী, কামিণী, সমবয়স্কা।
এদিকে বেচারা অনুবাদকের হয়ে গেল মহা মুশকিল। রমণীর সাথে রমণের লোভটাই সবচেয়ে আকর্ষনীয়, কিন্তু একবার রমণ হয়ে গেলে রমণীর পক্ষে চিরকুমারী থাকাটাও অসম্ভব। কী করা যায়! অনেক ভেবে-চিন্তে মাথা চুলকে তিনি ব্যাখ্যার অংশে লিখলেন: জান্নাতের নারীদের এমনভাবে সৃষ্টি করা হবে যে, প্রত্যেক সঙ্গম-সহবাসের পর তারা আবার কুমারী হয়ে যাবে (পৃ-১৩২৭, কোরানের বাংলা অনুবাদ মওলানা মুহিউদ্দীইন খান)। শুধু তাই নয়, ঐ একই পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে: এছাড়া শয্যা, বিছানা ইত্যাদি ভোগবিলাসের বস্তু উল্লেখ করায় নারীও তার অন্তর্ভুক্ত আছে বলা যায়। অর্থাৎ নারী শুধু শয্যা ও লাঙ্গল চালানোর ভূমি মাত্র।
শাব্বাশ!
এইসব কথা বলার পরে প্রচুর মিষ্টি মিষ্টি কথা কিংবা ‘আর নিজেদের জন্য আগামী দিনের ব্যবস্থা কর এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাক’ এসব বলে কোনোই লাভ হয়নি, মুসলমান মেয়েরা চিরকাল পিষ্ট হয়েছে পুরুষের পায়ের নিচে।
এগুলোই হল প্রথম পাঠ। এবার আসা যাক দীর্ঘ আলোচনায়।
অধ্যায়-২ : নারীরা হচ্ছে নিকৃষ্টতম প্রাণী
নারীরা যে একেবারেই নিকৃষ্ট, তা কি বলার অপেক্ষা রাখে?
এবার শুরু করা যাক বিস্তারিত আলোচনা।
সুরা বাকারা, আয়াত ২২৮ (২:২২৮):
আর পুরুষদের যেমন স্ত্রীদের ওপর অধিকার রয়েছে, তেমনিভাবে স্ত্রীদেরও অধিকার রয়েছে পুরুষদের ওপর, নিয়ম অনুযায়ী। আর নারীদের ওপর পুরুষদের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে।
এই হল শুরু। পরস্পরের ওপর এই ‘অধিকারটা’ যে কত প্রকার ও কী কী, তা পরিষ্কার করে পুরো কোরানের কোথাও কিচ্ছু বলা হল না বটে, কিন্তু শ্রেষ্ঠত্বটা ঠিকই খামচে ধরল পুরুষ, একেবারে চিরকালের জন্য। যাহোক, মেয়েদের যে অধিকার বলে একটা কিছু আছে, তার স্বীকৃতি একটুখানি হলেও পাওয়া গেল এখানে। পয়গম্বর হয়ত চেষ্টা করেছিলেন মেয়েদের কিছুটা হলেও অধিকার দিতে, কিন্তু সম্ভবত, সেই বেদুঈন পুরুষদের শত শত বছরের প্রতিষ্ঠিত একচেটিয়া ক্ষমতার সমাজে উল্টো প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনায় তিনি এ ব্যাপারে ধুমধাড়াক্কার কোনো বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নিতে চাননি।
এবারে সুরা নিসা, আয়াত ৩৪ (৪:৩৪):
পুরুষরা নারীর উপর কর্তৃত্বশীল। এ জন্য যে আল্লাহ একের উপর অন্যের বৈশিষ্ট্য দান করেছেন এবং এ জন্য যে, তারা তাদের অর্থ ব্যয় করে। সে মতে নেককার স্ত্রীলোকগণ হয় অনুগতা এবং আল্লাহ যা হেফাজতযোগ্য করে দিয়েছেন লোকচক্ষুর অন্তরালেও তার হেফাজত করে। আর যাদের মধ্যে অবাধ্যতার আশংকা কর তাদের সদুপদেশ দাও, তাদের শয্যা ত্যাগ কর এবং প্রহার কর। যদি তাতে তারা বাধ্য হয়ে যায়, তবে আর তাদের জন্য অন্য কোন পথ অনুসন্ধান করো না।
না, আর কোন রাখা-ঢাকা নেই, পুরুষের কর্তৃত্বশীলতা বলেই দেয়া হল এখানে। যে কর্তৃত্ব করে, আর যার ওপরে কর্তৃত্ব করা হয়, এ দু’জন কখনো সমান হয় না, হতে পারে না। পুরুষকে কোরআন এ-কর্তৃত্ব দিল স্পষ্টভাষায়, সম্ভবত, টাকা-পয়সার এবং শারীরিক শক্তির কারণেই। কিন্তু শারীরিক শক্তি কোনো যুক্তিই হতে পারে না। তাহলে আফ্রিকার জঙ্গলের গরিলাই হত মহান আশরাফুল মাখলুকাত, সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। কিংবা হাতি বা তিমি মাছ। টাকা-পয়সার ব্যাপারটা তখনকার সমাজে হয়ত ঠিকই ছিল, কিন্তু আজকে?
আজকের পৃথিবীতে বহু মেয়েই উপার্জনক্ষম, বহু মেয়ের উপার্জনেই সংসারে বাপ-ভাইয়ের মুখে অন্ন জুটছে, বহু স্ত্রীর উপার্জন স্বামীর চেয়ে বেশি, পিতৃহারা বহু সন্তানই মানুষ হচ্ছে শুধুমাত্র মায়ের উপার্জনেই। তা ছাড়া ‘‘প্রহার করা’’ তো সাংঘাতিক একটা মানসিক অপমানও বটে। যে-অধিকার একটা ভালো লোককেও রাগের মুহূর্তে পশু বানিয়ে দিতে পারে, কোনো বেহেশতি ধর্ম তেমন একটা বিপদজ্জনক অধিকার কাউকে কেন দেবে? বউ বেচারাদের টাকা-পয়সা উপার্জনের সুযোগই দেয়া হয়নি, তাদের খাওয়া-পরার জন্য স্বামীর ওপরে চিরকাল নির্ভরশীল করে রাখা হয়েছে, সেজন্য? তাহলে যেসব স্বামী বউয়ের উপার্জনে খায়, তারা কি বউয়ের হাতে মার খাবে? এ অন্যায়টা কিন্তু কোনো কোনো মওলানার মাথায় ঠিকই ঢুকেছে। তাই কোরানের কোনো কোনো অনুবাদে আপনি দেখবেন ‘‘প্রহার কর’’ কথাটার সাথে ব্র্যাকেটের ভেতর ‘‘আস্তে করে’’ কথাটা ঢোকানো আছে। মানেটা কী? ‘আস্তে করে প্রহার কর’ – কথাটার মানেটাই বা কী? এ কি সেই ছোটবেলার পাঠশালার পণ্ডিতমশাইয়ের ধমক: অ্যাই! বেশি জোরে গণ্ডগোল করবি না! গণ্ডগোলের আবার আস্তে-জোরে কী?
আসলে ওটা হল অনুবাদকের কথা, কোরানের নয়। প্রায় সবগুলো অনুবাদেই আল্লাহর কথার সাথে সুপ্রচুর ব্র্যাকেটের মধ্যে অনুবাদকের অবারিত লম্বা নাকটা ঢুকে আছে। এদিকে প্রত্যেকটি অনুবাদ বইতেই কিন্তু মস্ত একটা তফসির অর্থাৎ ব্যাখ্যার অংশ আছে। তোমার যা বলার, সেটা ব্যাখ্যার অংশে বল না কেন, বাপু! অনুবাদের মধ্যে নিজের কথা ঢোকানোর অধিকার তোমাকে কে দিল? তা নয়, ভাবখানা এই যে, “আস্তে করে” কথাটা যেন কোরানেরই কথা। কিন্তু মানুষ কি গাধা? আস্তে করে ‘ছোট্ট কলমি শাক দিয়ে প্রহার কর’ বলে বিরাট কুমীরটা কি ঢাকা যায়? যায় না। এ প্রহার সকাল-বিকাল দিন-রাত চললেও কোনো অসুবিধে নেই, কারণ সে ব্যাপারে কিছুই বলা হয়নি। আর বউকে পিটিয়ে স্বামী যাতে মনে মনে অপরাধবোধে না ভোগে, তার ব্যবস্থাও স্পষ্টভাবে দেয়া আছে হাদিসে।
সুনান আবু দাউদ, বই ১১ হাদিস নম্বর ২১৪২:
উমর বিন খাত্তাব বলেছেন: নবী (সা) বলেছেন, “কোনো স্বামীকে (পরকালে) প্রশ্ন করা হবে না, কেন সে বউকে পিটিয়েছিল”।
আরও দেখুন, ইসলামের শ্রেষ্ঠ খলিফা হযরত উমর কেমন করে তাঁর স্ত্রীদেরকে পেটাতেন।
বাংলা মুসনাদে আহমদ; খণ্ড ২, পৃ ১৪৮, হাদিস নম্বর ১০৫৫
আশ’আছ্ ইব্ন কায়স (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি অতিথি হিসেবে উমর (রা)-এর নিকট উপস্থিত হই। তখন তিনি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে প্রহার করলেন, তারপর বললেন, হে আশ’আছ, তুমি আমার নিকট থেকে তিনটি জিনিস সংরক্ষণ কর, যেগুলো আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট থেকে সংরক্ষণ করেছি। (প্রথম) কোনো ব্যক্তিকে তার স্ত্রীর প্রহার করার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করবে না। (দ্বিতীয়ত) বিতর না পড়ে ঘুমাবে না।
[আবু দাউদ তায়ালিসী তার মুসনাদে। এর সনদে দাউদ আওদী নামক এক দুর্বল রাবী আছেন।] (সূত্র ২৪)
আচ্ছা, আমদের প্রিয় নবী (সা) কি কোনো মেয়েকে শারীরিক আঘাত করেছেন? এ কথা মুখ আনাও যে পাপ! অনেকে বলে থাকেন নবী (সা) কখনই কোনো বেগানা নারীকে স্পর্শ করেননি। এমনকি নবী তাঁর কোনো স্ত্রীর গায়ে মৃদুভাবে হলেও হাত দেননি।
দেখুন, এই সব হাদিসে কী লেখা আছে।
দ্রষ্টব্য: এই হাদিসটি অনেক লম্বা। তাই এখানে সারাংশ দেয়া হ’ল। অনুরাগী পাঠকেরা পূর্ণ হাদিসটা পড়ে নিতে পারেন। (সূত্র ৩)
সহি মুসলিম; বই ৪, হাদিস নম্বর ২১২৭: মুহাম্মদ বিন কায়স বর্ণিত:
Anchorএকবার নবী (সা) এবং আয়েশা একই বিছানায় শায়িত ছিলেন। অনেক রাত্রিতে নবী (সা) উঠে পড়লেন এবং চলতে শুরু করলেন। নবী (সা) ভেবেছিলেন আয়েশা ঘুমন্ত। কিন্তু নবী (সা) শয়ন ঘর হতে বের হবার অল্পক্ষণ পরেই আয়েশা বিছানা থেকে উঠে চুপিসারে নবীকে (সা) অনুসরণ করতে থাকেন। নবী ‘বাকি’ নামক কবরস্থানে গিয়ে বেশ কিছু সময় কাটালেন এবং মৃতদের উদ্দেশে অনেক কিছু বললেন। এরপর নবী (সা) ঘুরে দাঁড়ালেন এবং হাঁটতে শুরু করলেন। বিবি আয়েশা খুব দ্রুতপদে শয়ন ঘরে চলে আসলেন এবং ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকলেন। কিন্তু তিনি (আয়েশা) হাঁপচ্ছিলেন এবং ঘন ঘন নিশ্বাস নিতে থাকলেন। এই ভাবে বিবি আয়েশা ধরা পড়ে গেলেন। তখন নবী আয়েশার বুকে এমন জোরে আঘাত করেলেন যে আয়েশা নিজেই বলছেন, “তিনি আমার বুকে এমন জোরে আঘাত করলেন যে, আমি প্রচুর ব্যথা পেলাম।” (সূত্র ৩)
বাংলা বুখারী শরীফ; খণ্ড ৯, হাদিস নম্বর ৪৮৭৮:
আবু নুয়ায়ম (র)…আবু উসায়দ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: আমরা নবী (সা)‑এর সঙ্গে বের হয়ে শাওত নামক বাগানের নিকট দিয়ে চলতে চলতে দু’টি বাগান পর্যন্ত পৌঁছলাম এবং দু’টির মাঝখানে বসে পড়লাম। তখন নবী (সা) বললেন: তোমরা এখানে বসে থাক। তিনি (ভেতরে) প্রবেশ করলেন। তখন নু’মান ইব্ন শারাহীলের কন্য জুয়াইনাকে উমাইমার খেজুর বাগানস্থিত ঘরে পৌঁছান হয়। আর তাঁর সাথে তাঁর সেবার জন্য ধাত্রীও ছিল। নবী (সা) যখন তার কাছে গিয়ে বললেন, তুমি নিজেকে আমার কাছে সমর্পণ কর, তখন সে বলল: কোনো রাজকুমারী কি কোনো বাজারি (নীচ) ব্যক্তির কাছে নিজেকে সমর্পণ করে? রাবী বলেন: এরপর তিনি তাঁর হাত প্রসারিত করলেন তার শরীরে রাখার জন্য, যাতে সে শান্ত হয়। সে বলল: আমি তোমার থেকে আল্লাহর নিকট পানাহ্ চাই। তিনি বললেন: তুমি উপযুক্ত সত্তারই আশ্রয় নিয়েছ। এরপর তিনি আমাদের নিকট বেরিয়ে আসলেন এবং বললেন: হে আবু উসমান! তাকে দু’খানা কাতান কাপড় পরিয়ে দাও এবং তাকে তার পরিবারের নিকট পৌঁছিয়ে দাও।
হুসাইন ইব্ন ওয়ালীদ নিশাপুরী (র)…সাহল ইবন সা’দ ও আবু উসায়দ (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তাঁরা বলেন যে, নবী (সা) উমাইমা বিন্ত শারাহীলকে বিবাহ করেন। পরে তাকে তার কাছে আনা হলে তিনি তার দিকে হাত বাড়ালেন। সে এটি অপছন্দ করল। এরপর তিনি আবু উসায়দকে নির্দেশ দিলেন, তার জিনিস গুটিয়ে এবং দু’খানা কাতান বস্ত্র পরিয়ে তাকে তার পরিবারে পৌঁছে দিতে। (সূত্র ১৭)
(লক্ষণীয়, ইংরেজি অনুবাদে আছে যে, নবী (স) জুয়াইনার পিঠ চাপড়ে দিলেন)
কী সাংঘাতিক ধর্মীয় সমর্থন, কল্পনা করা যায়? এ-ই হল সেই নির্লজ্জ সমর্থন, যা শুধু বইয়ের লেখাতে সীমাবদ্ধ থাকে না, কেয়ামতের মত যা নারীর মাথায় ভেঙে পড়ে। এরই শক্তিতে এই ২০০২ সালে দুবাই আদালত বিধান দিয়েছে, স্বামীরা বউকে পেটাতে পারবে। এই সভ্য যুগে পৃথিবীর কোনো দেশের আদালত এই বিধান দিতে পারে, কল্পনা করা যায়? উদ্ধৃতি দিচ্ছি:
দুবাই, ১লা এপ্রিল। দুবাইয়ের একটি আদালত রবিবার এক রায়ে স্বামীদের বৌ পেটানোর অধিকার দিয়েছে। দুবাই কোর্ট অফ ক্যাসেশনের রায়ে বলা হয়, ‘‘স্ত্রীদের নিয়ন্ত্রন’’ (নিয়ন্ত্রনে?) রাখতে স্বামীরা তাদের মারধর করতে পারবে। তবে মারধরের মাধ্যমে স্ত্রীদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন বা ক্ষত সৃষ্টি করা যাবে না’’। সূত্র: দুবাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক গাল্ফ নিউজের বরাতে টরন্টো থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক দেশে বিদেশে, ৪ এপ্রিল, ২০০২। টরন্টোর “নমস্তে ক্যানাডা” পত্রিকাতেও এ খবর ছাপা হয়েছে।
এখন বলুন, ইসলামে নারীর এ কেমন মর্যাদা? এর পরে আপনি বউ পেটালে আপনাকে ঠেকিয়ে রাখার মত বাপের ব্যাটা দুনিয়ায় পয়দা হয়নি, হবেও না। সাধারণ মুসলমানেরা বউ পেটায় না, সে শুধু মানুষের স্বাভাবিক মানবতা। কিন্তু তাহলে মেয়েদের বানানোই বা হল কেন? ‘‘শষ্যক্ষেত্রে’’ শুধু ‘‘চাষ করে শষ্য ফলানো” ছাড়াও এ ব্যাপারে হাদিস কেতাবে কী বলছে তা পরীক্ষা করার আগে খোদ কোরআন শরীফ কী বলছে, তা দেখা যাক।
সুরা আল্‑আরাফ আয়াত ১৮৯ (৭:১৮৯), এবং সুরা আর রূম আয়াত ২১ (৩০:২১):
যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন একটি মাত্র সত্তা থেকে। আর তার থেকেই তৈরি করেছেন তার জোড়া, যাতে তার কাছে স্বস্তি পেতে পারে। ‘‘তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক।
হাওয়ার আগে যে আদম সৃষ্টি হয়েছে, তা সবাই জানে। ওপরের আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা গেল কে কার জন্য সৃষ্টি হয়েছে এবং কী জন্য সৃষ্টি হয়েছে। পুরুষের শরীরের সাথে ‘ম্যাচ’ করেই যে নারীর শরীর বানানো হয়েছে, সেটাও কোনো কোনো পুরুষপন্থী ইসলামী চিন্তাবিদ বলতে ছাড়েন না। জব্বর বিশ্লেষণ বটে! এ বিশ্লেষণে নারী এ জীবনে শুধু বিছানার যৌবন আর বেহেশতে অতি অপূর্ব বাহাত্তর হুরীর শরীরের উত্তপ্ত প্রলোভন। সেখানে নারী মমতার সাগর মা নয়, স্নেহময়ী বোন নয়, প্রেমময়ী স্ত্রী নয়, জ্ঞানী শিক্ষয়িত্রী নয়, সক্ষম নেত্রী নয়, সে শুধু যৌবনের কামুক উন্মাদনা ছাড়া আর কোনো কিছুই নয়।
সাধারণ মেয়েরা স্বামীর ইসলামী-পিট্টি খাবে, তা না হয় হল। কিন্তু অসাধারণ নারীরা?
এক নির্ভুল সত্য: শরিয়া হয়েছে পুরুষদের স্বার্থে—
ইসলামে শরিয়া (বা শারিয়া) বলে একটা কথা আছে, যা কিনা হল ইসলামী আইন। এ আইন মেয়েদের আর অমুসলমানের জন্য এতই বে-আইন যে, তা দু-এক কথায় বলে শেষ করা যাবে না। অমুসলমান খুন করলে মুসলমানের মৃত্যুদণ্ড হবে না। সাত-সাতটা বিষয়ে মেয়েদের চোখের সামনে ঘটনা ঘটলেও তাদের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। যারা নিজের চোখে ধর্ষণ দেখেছে, এমন চার জন বয়স্ক মুসলমান পুরুষের সাক্ষ্য আদালতে পেশ না করতে পারলে ধর্ষিতার কপালে জুটবে পাথরের আঘাতে মৃত্যুদণ্ড (বিবাহিতা হলে) অথবা চাবুকের আঘাত (অবিবাহিতা হলে)। এইসব হলো শারিয়ার আইন‑কানুন, যা এতই উদ্ভট যে, বিশ্বাস করাই মুশকিল। এ বইয়ের অন্য জায়গায় বিস্তারিত বলা আছে এ ব্যাপারে, প্রমাণসহ।
এমনিতে কলমা-নামাজ-রোজা-হজ্ব-জাকাত, ইসলামের এই হল পাঁচটা স্তম্ভ, নবীজির দিয়ে যাওয়া। এর পরেও শরিয়া কী করে যেন ইসলামের অঘোষিত ছয় নম্বর স্তম্ভ হয়ে, ইসলামের অংশ হয়ে বসে আছে!
উত্তরাধিকারে মেয়েরা তো পুরুষের অর্ধেক বটেই, টাকা-পয়সার লেনদেনেও শরিয়াতে মেয়েদের সাক্ষী হল পুরুষের অর্ধেক। সাক্ষীতে কেন অর্ধেক? কারণ তারা ভুলে যেতে পারে। আর পুরুষ? না, পুরুষ হল যেন কম্পিউটার, কোনোদিন কোনোই ভুল সে করতেই পারে না!
চলুন দেখি এবার কোরআন শরীফ, সুরা বাকারা, আয়াত ২৮২ (২:২৮২):
যখন তোমরা কোন নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে ঋণের আদান প্রদান কর, তখন তা লিপিবদ্ধ
করে নাও এবং তোমাদের মধ্যে কোন লেখক ন্যায়সঙ্গত ভাবে তা লিখে দেবে;
..... দু’জন সাক্ষী কর, তোমাদের পুরুষদের মধ্য থেকে। যদি দু’জন পুরুষ না হয়, তবে একজন পুরুষ ও দু’জন মহিলা। ঐ সাক্ষীদের মধ্য থেকে যাদেরকে তোমরা পছন্দ কর - যাতে একজন যদি ভুলে যায়, তবে একজন অন্যজনকে স্মরণ
করিয়ে দেয়।
ব্যস, হয়ে গেল। উত্তরাধিকারে বোন ভাইয়ের অর্ধেক পাবে, এটা তো আছেই, তার ওপরে দু’জন নারীকে সাক্ষী হবার ব্যাপারে এই যে এক পুরুষের সমান করা হল, এটা হাদিসে আইনে পড়ে বাড়তে বাড়তে একেবারে এমন স্বর্গে পৌঁছে গেল যে, এখন ইউনিভার্সিটি-কলেজের পছন্দসই কোনো আসরার (একজন পাকিস্তানি ধর্ষিতা মহিলা) সর্বনাশ করে আসতে পারেন, এবং কোর্টকে কাঁচকলা দেখিয়ে হাসতে হাসতে বেরিয়ে যেতে পারেন।
কারণ? কারণ ইসলামী আইন অনুযায়ী চারজন মুসলমান পুরুষের চাক্ষুষ সাক্ষী পাওয়া যাবে না। আর, মেয়েদের সাক্ষী তো নৈব নৈব চ’, তা তিনি ইন্দিরা-হাসিনা-খালেদা হলেও। কী সাংঘাতিক কথা! মেয়েদের কী সাংঘাতিক অপমান, তাই না? বিশ্বাস হচ্ছে না তো? জানি। দেখতে চান দলিল? এ বইয়েরই ‘ইসলামী আইন’ অধ্যায়ে দেখানো আছে সব, দলিলের আতাপাতাও দেয়া আছে। বটতলার মোল্লা-মুন্সীর নয়, একেবারে বাঘের ঘরের ইসলামী দলিল, পোকায় খেয়ে যাবে, তার বাপের সাধ্যি নেই। তার পরেও যদি কোনো কাঠমোল্লা তেড়ে আসে, শুধু জিজ্ঞাসা করবেন, পাকিস্তানের জাফরান বিবি, নাইজিরিয়ার আমিনা লাওয়াল কুরামীর কেইস্টা কী, বলুন তো? এগুলো তো মধ্যযুগের নয়, এসব এই ২০০১ সালের ইসলামী কোর্টের ঘটনা। দেখবেন, জোঁকের মুখে নুন আর হুঁকোর পানি দু’টোই একসাথে পড়েছে, কাঠমোল্লা বাবাজী প্রচণ্ড গোস্সায় দ্বিগুণ বেগে তসবিহ্ ঘোরাতে ঘোরাতে অতিবিলম্বে সবেগে উল্টোপথে হাঁটা ধরেছেন।
দেখুন, বিখ্যাত কোরআন ব্যাখ্যাকারী (তাফসীরকারী) ইবনে কাসীর ওপরের আয়াত প্রসঙ্গে কী লিখেছেন:
অতঃপর বলা হচ্ছে যে, লেখার সাথে সাথে সাক্ষ্যও হতে হবে, যেন এই আদান-প্রদানের ব্যাপারটি খুবই শক্ত ও পরিষ্কার হয়ে যায়। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন: ‘তোমরা দু’জন পুরুষ লোককে সাক্ষী করবে। যদি দু’জন পুরুষ পাওয়া না যায়, তবে একজন পুরুষ ও দু’জন স্ত্রী হলেও চলবে। এই নির্দেশ ধন-সম্পদের উদ্দেশ্যের ব্যাপারে রয়েছে। স্ত্রীলোকের জ্ঞানের স্বল্পতার কারণেই দু’জন স্ত্রীলোককে একজন পুরুষের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। (সূত্র ৩১, খণ্ড ১, ২, ৩, পৃ ৭৬৫)
আরেক বিখ্যাত কোরআন ব্যাখ্যাকারী তাফসীরে মাযহারী গ্রন্থে আয়াত ২৩:৫, ৬ সম্পর্কে কী লেখা আছে, দেখা যাক:
স্বল্পজ্ঞানের কারণে নারীজাতিকে সাধারণত বিবেকহীন সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত মনে করা হয়। অর্থাৎ তাদেরকে গণ্য করা হয় স্ত্রীলিঙ্গবাচক প্রাণীকুলের সঙ্গে। (সূত্র ৩৫, খণ্ড ৮, পৃ ২০১)
জ্বী, হাঁ স্ত্রীলোক, মানে আমাদের মা, বোন, প্রেয়সী, স্ত্রী, উচ্চ আদালতের নারী বিচারক, উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা… ইত্যদি সবারই জ্ঞানগরিমার অভাব—স্বয়ং আল্লাহই তাই বলে দিয়েছেন। শুধু তাই‑ই নয়, সমস্ত স্ত্রী-প্রজাতি হচ্ছে স্ত্রী-পশুদের সমতুল্য।
একটু মস্করাই হয়তো করছি, কিন্তু বড় দুঃখেই করছি। হাজার হলেও ধর্মটা আমারই, এর মধ্যে এত অন্যায়ের, এত নিষ্ঠুরতার লজ্জা আমি রাখব কোথায়? নবী করীমের হাদিসেই দেখুন:
সহি বুখারি; খণ্ড ৭, হাদিস নম্বর ৩০:
আবদুল্লা বিন উমর বলেছেন, আল্লাহর নবী বলেছেন যে, তিন জিনিসের মধ্যে অশুভ আছে - নারী, বাড়ি আর ঘোড়া। (সূত্র ২)
সহি বুখারি খণ্ড ৭, হাদিস নম্বর ৩৩:
উসামা বিন যায়েদ বলেছেন, নবী বলেছেন যে, আমার পর পুরুষের জন্য নারীর চেয়ে বেশি ক্ষতিকর আর কিছু রইল না। (সূত্র ২)
দেখলেন? আরও দেখাচ্ছি। এক সহি হাদিসই যথেষ্ট, তবু এ হাদিস আছে সহি মুসলিম বই ১, হাদিস ১৪২ নম্বরেও। বর্ণনা দিচ্ছি:
সহি বুখারি; খণ্ড ১, হাদিস নম্বর ৩০১:
আবু সাঈদ আল খুদরী বলেছেন:- একদিন নবী (সা) ঈদের নামাজের জন্য মাসাল্লাতে গিয়েছিলেন। সেখানে কিছু নারীর সামনে দিয়ে যাবার সময় তিনি বললেন, “তোমরা সদকা দাও, কেননা আমি দোজখের আগুনে বেশির ভাগ নারীকেই পুড়তে দেখেছি”। তারা বলল: “এর কারণ কী, ইয়া রসুলুল্লাহ?” তিনি বললেন: “তোমরা অভিশাপ দাও এবং তোমাদের স্বামীদের প্রতি তোমরা অকৃতজ্ঞ। ধর্মে আর বুদ্ধিতে তোমাদের চেয়ে খাটো আমি আর কাউকে দেখিনি। একজন বুদ্ধিমান সংযমী পুরুষকে তোমাদের কেউ কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারে।” তারা বলল: “ইয়া রসুল্লুল্লাহ! ধর্মে আর বুদ্ধিতে আমরা খাটো কেন?” তিনি বললেন: “দু’জন নারীর সাক্ষ্য কি একজন পুরুষের সমান নয়?” তারা হ্যাঁ-বাচক জবাব দিল। তিনি বললেন: “এটাই হল বুদ্ধির ঘাটতি। এটা কি সত্যি নয় যে, মাসিক-এর সময় নারীরা নামাজ এবং রোজা করতে পারে না?” তারা হ্যাঁ-বাচক জবাব দিল। তিনি বললেন: “এটাই হল ধর্মে ঘাটতি”। (সূত্র ২)
অবাক হচ্ছেন, পাঠক? এ তো সবে শুরু। নারী আর উটের মধ্যে তফাতটাই বা কী?
দেখা যাক, এ ব্যাপারে সুনান আবু দাউদ কী বলছে।
সুনান আবু দাউদ; বই ১১, হাদিস নম্বর ২১৫৫:
আবদুল্লাহ, বিন আম’র বিন আ’স বলছেন: ‘নবী (সা) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ দাস-দাসী কিনলে বা বিয়ে করলে তাকে বলতে হবে, ও আল্লাহ! আমি এর স্বভাব-চরিত্রে ভালো কিছুর জন্য তোমার কাছে প্রার্থনা করি। আর এর চরিত্রের মন্দ থেকে তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করি। কেউ উট কিনলেও তাকে উটের কুজঁ ধরে এ কথা বলতে হবে”’।’ (সূত্র ৪)
মাতৃত্ব হল মানবজীবনের সর্বপ্রধান সম্পদ। এর চেয়ে বড় আশীর্বাদ মানুষ কল্পনাই করতে পারে না। এই মাতৃত্বের জন্যই স্বাভাবিকভাবে মাসিকের আয়োজন করেছে প্রকৃতি। অথচ এই একান্ত স্বাভাবিক ব্যাপারটাকে সমস্ত পুরুষতন্ত্র চিরটা কাল এত নিষ্ঠুরভাবে মেয়েদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে যে, ভাবলে অবাক হতে হয়।
হিন্দু (সনাতন) ধর্মে তো কথাই নেই, ইসলামেও মাসিককে ‘রোগ’ বা ‘নোংরামি’ হিসেবে দেখিয়ে মেয়েদের একেবারে অপবিত্র এবং খুঁতযুক্ত বানিয়ে ফেলা হয়েছে। ওই সময়টায় তারা যে ‘নোংরা’, তা বিশ্বাস করতে বাধ্য করা হয়েছে। কোরানের সুরা বাকারা, আয়াত ২২২ (২:২২২) এবং সহি বুখারি খণ্ড ৩, হাদিস নম্বর ১৭২-এ কথা স্পষ্ট লেখা আছে। তাই মুসলমান মেয়েদের ওই অবস্থায় ইসলাম নামাজ-রোজা করতে বা কোরআন পড়তে দেয় না। মাতৃত্বের জন্য মেয়েদের কেন এ রকম কঠিন মূল্য দিতে হবে? মাসিকের অবস্থায় কী এমন তাদের মানসিক ঘাটতি হবে যে, তারা বিরাট জটিল ব্যবসা চালাতে পারবে, বিচারক হয়ে কয়েদীদের জেল দিতে পারবে, খুনীকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারবে, কিন্তু উপাসনা-আরাধনা করতে পারবে না? মেয়েদের বিরুদ্ধে এটা একটা হীন চক্রান্ত ছাড়া আর কী?
এহেন নারীকে ইসলাম কি কোনো দেশের রাষ্ট্রপতি অথবা প্রধানমন্ত্রী হতে দেবে?
পাগল আর কী! তাই কি হয়?
সহি বুখারি; খণ্ড ৫, হাদিস নম্বর ৭০৯
সাহাবী আবু বাক্রা বলছেন, নবী (সা) বলেছেন যে, যে-জাতি নারীর ওপরে নেতৃত্ব দেবে, সে-জাতি কখনো সফলকাম হবে না। (সূত্র ২)
মাঝে মাঝে মনে হয়, মেয়েরা কি এমন অন্যায়-অপরাধ করেছে যে, জীবনের প্রতি পদে তাদের এত অপমান, অবজ্ঞা আর অত্যাচার সহ্য করতে হবে? পৃথিবীর যত দার্শনিক-বৈজ্ঞানিক-মহাপুরুষ এমনকি নবী-রসুলকে পেটে ধরেনি তারা? মৃত্যুযন্ত্রণা সহ্য করে জন্ম দেয়নি তারা? পৃথিবীর যত খুন-জখম দাঙ্গা-হাঙ্গামা সব তো পুরুষই করেছে। আশ্চর্য! যত শিক্ষিতাই হোক, যত আলোকিত উদারমনাই হোক, যত মেধাবী-বুদ্ধিমতীই হোক, জ্ঞান-বিজ্ঞানে যত প্রাজ্ঞই হোক, মেয়ে হলেই তার আর রক্ষা নেই, সর্বগ্রাসী পুরুষতন্ত্র ইসলামের অন্ধকার কারাগারে তাকে আবদ্ধ করে রাখবেই। আর তার মাথাটা এমন মোহনভাবে ধোলাই করে দেবে যে, সে মেয়ে নিজেই সেই কারাগারে বসে বেহেশতের স্বপ্ন দেখবে, বেরোতেই চাইবে না সেখান থেকে, যেখানে তাদের অপমান করতে করতে একেবারে শয়তান বলা হয়েছে।
অসহ্য! দেখুন:
সহি মুসলিম; বই ৮, হাদিস নম্বর ৩২৪০:
জাবির বলেছেন: আল্লাহ’র নবী (সা) একদিন এক স