ভগবদ্গীতা একটি ৭০-শ্লোকের গ্রন্থ। এটি প্রাচীন সংস্কৃত মহাকাব্য মহাভারত-এর একটি অংশ।
মুলত ভিষ্মপর্বে মাত্র ৭০ টি শ্লোকে লিপিবদ্ধ ছিল (অনুমান) এই গীতা। ৭০ শ্লোকে লিপিবদ্ধ বলেই একে শপ্তপপ্তি বলা হয়। গীতা যজুর্বেদের কিছু মন্ত্রে ব্যখ্যা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রায় ২৫০০ বছর পরে ৭০০ শ্লোকে গীতা সংকলন হয়। পন্ডিতগণমনে করেন যে অষ্টমশতাব্দীতে শ্রীশঙ্করাচার্য প্রথম এইঅধ্যায়গুলিকে মহাভারত থেকে আলাদা করেন এবং গীতা হিসাবে এর একটি ভাষ্য লেখেন। গীতা-র বিষয়বস্তু শ্রীকৃষ্ণ ও পাণ্ডব রাজকুমার অর্জুনের কথোপকথন।
গীতা সনাতন ধর্মতত্ত্বের একটি সংক্ষিপ্ত পাঠ, এবং সনাতনদের জীবনচর্যার একটি ব্যবহারিক পথনির্দেশিকা। শ্রীমদ্ভাগবত গীতা এর অর্থঃ শ্রীমদ্ অর্থ পবিত্র গ্রন্থ;
(ভগবদ্ অর্থ ঈশ্বর; / গীতা অর্থ গান;)
ভগবদ্গীতার অর্থ হল ঈশ্বরের গান এবং শ্রীমদ্ হল এর বিশেষণ। ভগবান শ্রীপরাশসুত কৃষ্ণদ্বৈয়পায়ন বেদব্যাস বিরচিত অষ্টাদশপর্ব সমন্বিত শান্তরস পরিপ্লুত মাহাভারতের ভীষ্মপর্বের ২৫-৪২ পর্যন্ত অষ্টাদশ অধ্যায় সংকলিত অংশ শ্রীমদ্ভগবৎগীতা নামে পরিচিত।
এখন প্রশ্ন হতে পারে ভগবদ্গীতা শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন, তবে একে গান বলা হয় কেন?
কারণ, গীতার মিত্রাক্ষর ছন্দ যখন সঠিক ভাবে উচ্চারণ করা হয় তখন তা খুবই সুন্দর সুরেলা সঙ্গীত এর সৃষ্টি করে। গীতার এই ছন্দকে অনুষ্টুপ্ বলা হয় এবং এর প্রতিটি শ্লোক ৩২। অক্ষর সমণ্বিত।
বেদ অখিলোধর্মমূলম (মনুঃ২/৬)- সমগ্র বেদ ধর্মের মূল
অর্থকামেষবসক্তানাং ধর্মজ্ঞানং বিধীয়তে।
ধর্মং জিজ্ঞাসমানানাং প্রমাণং পরমং শ্রুতিঃ
মনুস্মৃতি 2/13
অর্থ-যাঁরা অর্থ ও কামে আসক্ত নন,ধর্মের প্রকৃত জ্ঞান তাঁদেরই হয়।আর, ধর্মজিজ্ঞাসু ব্যক্তিগনের কাছে বেদই সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ।(যেখানে শ্রুতি বা বেদ ও স্মৃতির মধ্যে বিরোধ উপস্থিত হবে, সেখানে শ্রুতি বা বেদের মতই গ্ৰাহ্য।এই কারণে,শ্রুতি বা বেদকে, সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ বলা হয়েছে)
সুতরাং,ধর্ম জানার একমাত্র উপায় হল বেদ। গীতা, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, এগুলো কোন ধর্ম গ্ৰন্থ নয় আর ধর্ম জানার উপায় নয়।
গীতা হল শ্রীকৃষ্ণের বানী। যা কিনা,পরবর্তী সময়ে অনেক বৈষ্ণব দ্বারা প্রক্ষিপ্ত হয়েছে।গীতা কোন ঈশ্বরের বাণী নয়। ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণের মাধ্যমে কোন বাণী দেননি। ঈশ্বরের বাণী (জ্ঞান) হলে বেদ।
" শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞানং তত্পরঃ সংযতেন্দ্রিয়ঃ৷৪/৩৯ "
একমাত্র শ্রদ্ধাশীল ও সংযত ইন্দ্রিয় ব্যক্তি জ্ঞান লাভের যোগ্য। গুরু/ গাইড/ শিক্ষক / পথ প্রদর্শক এর প্রতি যে ব্যক্তি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে, সেই ব্যক্তি জ্ঞান ও কর্মদক্ষতা লাভের যোগ্য। গুরু সেই শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তিকে প্রতিদান দিবেন। আর শিষ্য বা শিক্ষার্থীর দেহ, মন ও ইন্দ্রিয় সংযত - নিয়ন্ত্রণ এর যোগ্যতা থাকতে হবে।
অর্জুন যখন কর্তব্য বিমুখ হয়ে সন্যাসী ও বৈরাগীর মতো আচরণ করে যুদ্ধ ত্যাগ করতে উদগ্রীব হয়ে পড়েন, তখন তাঁকে গীতার জ্ঞান দেন কৃষ্ণ।
গীতা এমন একটি গ্রন্থ, যার অনুবাদ, ব্যাখ্যা, টিপ্পণী, গবেষণাপত্র নানান ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। আদি শঙ্করাচার্য, রামানুজ, রামানুজাচার্য, মধ্বাচার্য, নিম্বার্ক, ভাস্কর, বল্লভ, শ্রীধর স্বামী, আনন্দ গিরি, মধুসূদন সরস্বতি, সন্ত জ্ঞানেশ্বর, বালগঙ্গাধর তিলক, পরমহংস যোগানন্দ, মহাত্মা গান্ধী, মহর্ষি অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখ ব্যক্তি গীতার ওপর প্রবচন দিয়েছেন।
অবজানন্তি মাং মূঢ়া মানুষীং তনুমাশ্রিতম্।
পরং ভাবমজানন্তো মম ভূতমহেশ্বরম্।।
গীতা-নবম-অধ্যায়-রাজগুহ্য-যোগ শ্লোক-11
অনুবাদ- আমি যখন মনুষ্যরূপে অবতীর্ণ হই, তখন মূর্খেরা আমাকে অবজ্ঞা করে।তারা আমার পরম ভাব সম্বন্ধে অবগত নয় এবং তারা আমাকে সর্বভূতের মহেশ্বর বা পরম ঈশ্বর বলে জানে না।
এখন,গীতার এই শ্লোকটি দুই ভাবে,বিশ্লেষণ করবো-1. শ্রীকৃষ্ণকে স্বয়ং ঈশ্বর ধরে। 2.শ্রীকৃষ্ণকে যোগী ধরে অর্থাৎ তিনি যোগযুক্ত অবস্থায় ঈশ্বরের বাণী বলেছেন।
1.শ্রীকৃষ্ণকে স্বয়ং ঈশ্বর ভেবে বিচার-----
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হল যে,অধিকাংশ মানুষের বেদ নিয়ে সঠিক ধারণা নেই।এইজন্য,কিছু বেদ বিরোধী সম্প্রদায় ও প্রতারক গুরুদেবগণ,ঈশ্বরের অবতার হয় বা ঈশ্বর মানুষরূপে জন্মগ্রহণ করেন,এই বেদ বিরোধী মিথ্যা ধারণা,বিশ্বাস করেন ও প্রচার করেন।
এইবার বেদের সিদ্ধান্ত দেখুন------
স পর্য্যগাচ্ছুক্রমকাযমব্রণমস্নাবিরং শুদ্ধমপাপ বিদ্ধম।
কবির্মনীষী পরিভুঃ স্বযম্ভূর্যাথাতথ্যতো হর্থান্ ব্যদধাচ্ছাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ।।
ঈশোপনিষদ:শ্লোক:8
যর্জুবেদ০অধ্যায় ৪০ মন্ত্র ৮
ব্যাখ্যা:(অন্বয়)- সঃ(সেই পরমাত্নাই), পর্যগাৎ ( সর্বত্র গিয়েছেন অর্থাৎ সর্বব্যাপী), [সঃ] (তিনিই), শুক্রম্ (জ্যোর্তিময়), অকায়ম্(শরীরহীন), অব্রণম্ (ক্ষতহীন), অস্নাবিরং (স্নায়ু বা শিরাবিহীন), শুদ্ধম্(পবিত্র), অপাপবিদ্ধম (পাপ দ্বারা অবিদ্ধ বা ধর্ম অধর্মাদি রহিত), কবিঃ(ক্রান্তদর্শী), মনীষী(সর্বজ্ঞ),পরিভূঃ (সর্বোপরি বিদ্যমান),স্বয়ম্ভূঃ (নিজেই নিজের কারণ),[সঃ] (তিনি), শাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ (নিত্যকাল ধরে), [সংবৎসরাখ্য প্রজাপতিদের জন্য], অর্থান্( বিষয় সমূহ বা কর্তব্য পদার্থসমূহ), যাথা-তথ্যতঃ(লোকের যথাযথ কর্মফল ও সাধনা অনুসারে), ব্যদধাৎ(বিধান করেছেন)।
ভাবার্থঃ-"স পর্যগাৎ" সেই পরমাত্মা আকাশবৎ সর্বত্র পরিপূর্ণ ভাবে (ব্যাপক) বিদ্যমান। "শুক্রম্" তিনিই অখিল বিশ্বের রচিতা। "অকাযম্" এবং তিনি কখনও শরীর (অবতার) ধারণ করেন না। কেননা তিনি অখন্ড, অনন্ত ও নির্বিকার। এই কারণ তিনি শরীর ধারণ করেন না। তদপেক্ষা অধিক এই সলসারে আর কিছুই নাই। এই কারণে ঈশ্বরের শরীর ধারণ কখনও সম্ভব নয়। "অব্রণম্" তিনি এক অখন্ড সত্তা, অচ্ছেদ্য, অভেদ্য, নিস্কম্প ও অচল। এই জন্য তাহাতে অলশা অংশী ভাব নাই, কেননা তাহাতে কোনও প্রকার ছিদ্র থাকিতে পারে না। "অস্নাবিরম্" নাড়ী প্রভৃতির প্রতিবন্ধও (নিরোধ) তাহাতে থাকা সম্ভব নয়। অতিসূক্ষ বলিয়া ঈশ্বরের কোন আবরণ নাই। "শুদ্ধম" সেই পরমাত্মা সদাসর্বদা নির্মল অবিদ্যাদি জন্ম মরণ হর্ষ শোক ক্ষুধা তৃষ্ণাদি দোষ অপরাধমুক্ত। "অপাপ বিদ্ধম্" পরমাত্মা কখনও অন্যায় করেন না, কেননা তিনি সদৈব ন্যায়কারী। "কবি" ত্রৈকালঙ্গ (সর্ববিৎ) মহাবিদ্বান্ যাহার বিদ্যার শেষ কেন নিবারণ করিতে পারে না। "মনীষী" সমস্ত জীবের মন (বিজ্ঞান) অধিকৃত সাক্ষী ! সকলের মন দমনকারী। "পরিভুঃ" সর্ব দিকে ও সর্ব স্থানে পরিপূর্ণ রূপে বিদ্যমান, এবং সকলের উপর বিরাজমান। "স্বযংভূঃ" যাঁহার আদিকারণ মাতা-পিতা উৎপাদক কেহ নাই কিন্তু তিনি সকলের আদি করাণ। "যথাতথ্যতোহর্থান্ ব্যদধাচ্ছাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ" সেই ঈশ্বর আপন প্রজাবর্গকে যথাবৎ সত্য বিদ্যা, যাহা চার বেদ সমগ্র মানব সমাজের জন্য পরম হিতার্থে উপদেশ দিয়াছেন, তিনি আমাদের দয়াময় পিতা-পরমেশ্বর ! তিনি অতিশয় করুণা করিয়া অবিদ্যান্ধকার নাশক বেদ বিদ্যারূপ সূর্য প্রকাশিত করিয়াছেন। ঈশ্বর যেরূপ ন্যায়কারী ও পূর্ণ বিদ্যান্ তদ্রূপ বেদও; বেদ ঈশ্বরীয় জ্ঞান, বেদ তুল্য বা বেদ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ অন্য কোন পুস্তক নাই।
শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং যে ঈশ্বর না,এই বেদের বাণী দিয়ে তা প্রমাণিত হয়।তাছাড়া, শ্রীকৃষ্ণ বেদজ্ঞ ছিলেন।এই ধরনের বেদ বিরোধী বক্তব্য তাঁর পক্ষে বলা সম্ভব নয়।এই শ্লোকদ্বয় পরবর্তী সময়ে তাঁর মুখে, কোন প্রতারক অবতারবাদী বসিয়েছেন।
2.শ্রীকৃষ্ণকে যোগী ভেবে বিচার--------
অনেকে বলেন,শ্রীকৃষ্ণ যোগযুক্ত অবস্থায় ঈশ্বরের বাণী বলেছেন।এই বিষয়ে, মহাভারতের প্রমাণ দেখুন-
ন চ শক্যং পুনর্বক্তুমশেষেণ ধনজ্ঞয়।
স হি ধর্মঃ সুপর্য্যাপ্তো ব্রহ্মণঃ পদবেদনে।
ন শক্যং তন্মষা ভূয়স্তথা বক্তুমশেষতঃ।
পরং হি ব্রহ্মা কথিতং যোগযুক্তেন তন্ময়া
ইতিহাসন্তু বক্ষ্যামি তস্মিন্নর্থে পুরাতনম।।
মহাভারত- অশ্বমেধিক পর্ব-অধ্যায়-17, শ্লোক-11,12,13
অর্থ-(শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন)হে, ধনজ্ঞয়(অর্জুন),সেই সমস্ত কথা(গীতার বাণী) আমার পক্ষে বলা আর সম্ভব নয়।সেই ধর্মটি পরমাত্নার স্বরূপ জানবার জন্য যথেষ্ঠ ছিল।আমি এখন সেই সমস্ত কথা,পুনরায় বলতে পারব না।সেই সময় আমি যোগযুক্ত হয়ে,পরব্রহ্মের বিষয় বলেছিলাম।এখন সেই বিষয়ে প্রাচীন বৃত্তান্ত বলছি।
এখানে, শ্রীকৃষ্ণ পরিস্কার ভাষায় বলছেন,তিনি যোগযুক্ত অবস্থায় ঈশ্বরের বিষয়ে বলেছেন।শ্রীকৃষ্ণ একবারও বলেননি যে,ঈশ্বর তাঁর(শ্রীকৃষ্ণের) মাধ্যমে,বাণী দিয়েছেন।
সুতরাং,গীতার এই শ্লোক প্রক্ষিপ্ত।
বেদ হল,ঈশ্বরীয় বাণী।তাই বেদের বাণীকে মন্ত্র বলে।গীতা হল,মানুষের বাণী।তাই গীতার বাণীকে শ্লোক বলে।
একাদশ-অধ্যায়-বিশ্বরূপ-দর্শন ২২ নং শ্লোকঃ
রুদ্রাদিত্যা বসবো যে চ সাধ্যা
বিশ্বেহশ্বিনৌ মরুতশ্চোষ্মপাশ্চ।
গন্ধর্বযক্ষাসুরসিদ্ধসঙ্ঘা
বীক্ষন্তে ত্বাং বিস্মিতাশ্চৈব সর্বে।।২২।।
অনুবাদঃ রুদ্রগণ, আদিত্যগণ, সাধ্য নামক দেবতারা, বসুগণ, বিশ্বদেবগণ, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, মরুতগণ, পিতৃগণ, গন্ধর্বগণ, যক্ষগণ, অসুরগণ ও সিদ্ধগণ সকলেই বিস্মৃত হয়ে তোমাকে দর্শন করছে। ৮ বসু তো জড় পদার্থ। সেই সূর্য,চন্দ্র আদি বসু গুলো কিভাবে শ্রীকৃষ্ণ কে দেখবে ?
গীতার মানবতাবিরোধী ও বেদ বিরোধী শ্লোকমাং হি পার্থ ব্যপাশ্রিত্য যেহপি স্যুঃ পাপযোনয়ঃ।
স্ত্রিয়ো বৈশ্যাস্তথা শূদ্রাস্তেহপি যান্তি প্রাং গতিম্।।
গীতা_রাজযোগ/রাজগুহ্য যোগ_শ্লোক-32
অনুবাদঃ পুণ্যবান ব্রাহ্মণ, ভক্ত ও রাজর্ষিদের আর কি কথা? তাঁরা আমাকে আশ্রয় করলে নিশ্চয়ই পরাগতি লাভ করবেন। অতএব, তুমি এই অনিত্য দুঃখময় মর্ত্যলোক লাভ করে আমাকে ভজনা কর।
[শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ]
অর্থ-হে পার্থ!!পাপ-যোনীতে জন্মানো, বৈশ্য, শূদ্র ও নারীরা, আমার (শ্রীকৃষ্ণের) শরণ নিলে পরমাগতি লাভ করে। তার,মানে এই শ্লোক অনুযায়ী,পৃথিবীর সব মেয়ে ও মায়েরা পাপ যোনীতে জন্ম গ্ৰহণ করেছেন!!!
দারুণ সম্মান তো মেয়েদের প্রতি!! এইজন্যই, অনেক গুরুদেব বলেন,নারী হল নরকের দ্বার। কিন্তু পরম আশ্চর্যের বিষয় হল এই যে,সেই গুরুরা তো নরকের দ্বার দিয়েই বেড়িয়ে,পৃথিবীর আলো দেখেছেন!!
বিঃদ্রঃ আর্টিকেলের নীচে গীতার অন্য ভাষ্যকারের ভাষ্য দেখুন
এবার দেখুন বেদ কি বলে~
যথেমাং বাচং কল্যাণীমাবদানি জনেভ্যঃ।
ব্রহ্মরাজন্যাভ্যা শূদ্রায চার্য্যা চ স্বায চারণাযচ।।-যজুর্বেদ-26/2
অর্থ-(ঈশ্বর বলছেন) আমি সব মানুষের সুখের জন্য এই কল্যাণদায়ক চার বেদের বাণী উপদেশ করছি।অর্থাৎ,ঈশ্বরের দৃষ্টিতে,নারী ও পুরুষের বিভেদ নেই।উচ্চ-নীচ বিভেদ নেই।
অন্ততঃ,27জন নারী ঋষি বেদের মন্ত্র দ্রষ্টা।তাহলে এঁরাও পাপ যোনীতে জন্ম গ্ৰহণ করেছেন নাকি?
এই প্রক্ষিপ্ত শ্লোকটি কোন, নারী বিদ্বেষী মানুষের লেখা যে কিনা নিজের মাকে অস্বীকার করেন!
বি.দ্র.আমেরিকার বিল গেটস পাপযোনীতে জন্ম গ্ৰহণ করে,পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি।আর নামধারী ব্রাহ্মণরা,যাঁরা কিনা উচ্চকুলে জাত বলে, অহংকার করেন,তাঁরা ঈশ্বরের নামে ভিক্ষা করে!
বি.দ্র.যে সমস্ত বৈষ্ণব ধর্মগুরু বলেন নারী নরকের দ্বার,তাঁরা কি আকাশ থেকে উৎপন্ন হয়েছেন নাকি?!!এই নরকের দ্বার দিয়েই তো বেড়িয়েছেন!! বৈষ্ণব হল নিজের মাকে বিদ্বেষ করা সম্প্রদায়!!!এই নর্দমার কীট বৈষ্ণবদের থেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন।
গীতা কার বাণী?
অতিজ্ঞানী বৈষ্ণব নরদেহধারী স্বয়ং ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণের বানী।
বৈদিক গীতা কোন ঈশ্বরের বাণী নয়। শ্রীকৃষ্ণের বানী যা কিনা কালের নিয়মে আর শুদ্ধ অবস্থায় নেই কারণ গীতায় অনেক প্রক্ষিপ্ত বা বেদ বিরোধী এবং পরস্পর বিরোধী শ্লোক আছে।
গীতা ঈশ্বরের বাণী হলে,প্রমাণ হয়,ঈশ্বর সত্যযুগের প্রারম্ভে বেদের বাণী প্রেরণ করার সময় ভুল করেছিলেন। সেই ভুল বুঝতে ঈশ্বরের সময় লাগলো# 1728000 (সত্যযুগ)+1296000 (ত্রেতাযুগ)+864000 (দ্বাপর যুগ)=3888000 বছর!!!
ইহা অতি হাস্যকর ব্যাপার।
(বি.দ্র.যুগের কালগণনার জন্য,মনু স্মৃতি#প্রথম অধ্যায়_শ্লোক_68-73 দেখুন।)
বেদের বাণীকে মন্ত্র বলে কারণ তা ঈশ্বরীয় বলে। গীতার বাণীকে শ্লোক বলে,কারণ তা মানুষের দ্বারা রচিত বলে।
ঈশ্বর বেদে বলেছেন,তিনি,সূক্ষ,স্থুল ও কারণ শরীর ধারণ করেন না (যর্জুবেদ_40/8)। সুতরাং, শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর বা ঈশ্বরের অবতার নন।
এইবার গীতা ও বেদের বিরোধের উদাহরণ দেখুন-
মুক্তি বিষয়ে গীতা ও বেদের বিরোধ
মুক্তি বিষয়ে,গীতা ও বেদের বিরোধ বর্তমান।এই বিরোধ প্রমাণ করে যে,গীতা ঈশ্বরের বাণী নয়। যদি গীতা ঈশ্বরের বাণী হয় তাহলে ঈশ্বর মিথ্যাবাদীতে রূপান্তরিত হন!! ঈশ্বর কি মিথ্যাবাদী?!!! এবং এটাও প্রমাণ হয় যে শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর নন একজন মরণশীল সাধারণ মানুষ মাত্র। শ্রীকৃষ্ণ যদি ঈশ্বর হতেন তাহলে গীতা ও বেদে পরস্পর বিরুদ্ধ কথা বলতেন না।এইবার প্রমাণ দেখুন-
যদ্ গত্বা ন নির্বত্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম।-গীতা-15/6
এই শ্লোক থেকে জানা যায়,মানুষ বা জীব একবার মুক্তি পেলে পুনরায় কখনো সংসারে আগমন করে না বা চিরকালের মতো মুক্তির আনন্দ উপভোগ করে।
এইবার মুক্তি বিষয়ে বেদের প্রমাণ দেখুন।বেদ মন্ত্র অনুযায়ী গীতার বচন, কিভাবে,মিথ্যা প্রমাণিত হয়,প্রমাণ দেখুন-
কস্য নূনং কতমস্যামৃতানাং মনামহে চারু দেবস্য নাম।
কোনো মহ্যা অদিতযে পুনর্দাৎ পিতরং চ দৃশেযং মাতরং চ।।1।।
অগ্নের্বযং প্রথমস্যামৃতানাং মনামহে চারু দেবস্য নাম।
স নো মহ্যা অদিতযে পুনর্দা্ৎ পিতরং চ দৃশেযং মাতরং চ।।2।।
ঋগ্বেদ-1/24/1-2
অর্থ- আমরা কার নাম পবিত্র বলে জানব? অবিনাশী পদার্থ সমূহের মধ্যে বিদ্যমান, চির প্রকাশ রূপ কোন্ দেব আমাদের সকলকে মুক্তি সুখ ভোগ করিয়ে পুনরায় এই সংসারে জন্মদান করান এবং পিতা-মাতা'কে দর্শন করান?।।1।।
আমরা এই স্বপ্রকাশরূপ, অনাদি এবং সদামুক্ত পরমাত্মার নাম পবিত্র বলে জানব।পরমাত্না আমাদের মুক্তিতে আনন্দ ভোগ করিয়ে পুনরায় মাতা-পিতার সংযোগে জন্মদান করিয়ে তাঁহাদের দর্শন করান।। 2।।
গীতা "কর্মসন্ন্যাসযােগ" পঞ্চম অধ্যায় (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ)
ভোক্তারং যজ্ঞতপসাং সর্বলোকমহেশ্বরম্।
সুহৃদং সর্বভূতানাং জ্ঞাত্বা মাং শান্তিমৃচ্ছতি।।২৯।।
অনুবাদঃ আমাকে সমস্ত যজ্ঞ ও তপস্যার পরম ভোক্তা, সর্বলোকের মহেশ্বর এবং সমস্ত জীবের সুহৃদরূপে জেনে যোগীরা জড় জগতের দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্ত হয়ে শান্তি লাভ করেন।
অর্থ- আমাকে যজ্ঞ ও তপস্যার ভােক্তা, সর্বলােকের মহেশ্বর, সকল প্রাণীর দয়ালু প্রেমী জেনে শান্তি লাভ করেন।-(২৯)
একানেও প্রশ্ন উদয় হয় শ্রীকৃষ্ণ কি ঈশ্বর !!??
গীতা-অষ্টাদশ অধ্যায়-মোক্ষযোগ (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ)
সর্বকর্মাণ্যপি সদা কুর্বাণো মদব্যপাশ্রয়ঃ।
মৎপ্রসাদাদবাপ্নোতি শাশ্বতং পদমব্যয়ম্।।৫৬।।
অনুবাদঃ আমার শুদ্ধ ভক্ত সর্বদা সমস্ত কর্ম করেও আমার প্রসাদে নিত্য অব্যয় ধাম লাভ করেন।
চেতসা সর্বকর্মাণি ময়ি সংন্যস্য মৎপরঃ।
বুদ্ধিযোগমুপাশ্রিত্য মচ্চিত্তঃ সততং ভব।।৫৭।।
অনুবাদঃ তুমি বুদ্ধির দ্বারা সমস্ত কর্ম আমাতে অর্পণ করে, মৎপরায়ণ হয়ে, বুদ্ধযোগের আশ্রয় গ্রহণপূর্বক সর্বদাই মদগতচিত্ত হও। গীতার ১৮/৫১-৫৭ নং শ্লোক হল গুহজ্ঞান। আর তা হল নির্বিশেষ প্রকাশ
ব্রহ্ম বিষয়ক জ্ঞান। অথচ এখানে কোথাও নির্বিশেষ শব্দটাই নেই ! কেও নির্বিশেষ বলতে যদি
নিরাকার বুঝিয়ে থাকেন, তাহলে এই শ্লোকগুলো পরবর্তী মন্তব্যগুলোকেই
খন্ডন করে দেয়। কারণ পুরো বিশ্বসংসার এবং কল্পনাতীত যে ফাঁকা জায়গা (অসীম)
তার পুরোটাই ওনার(নিরাকারের) ধাম। বরংচ আপনার সাকারের ধাম যদি কোন গন্ডির
মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে তাহলে সেখানে অপার আনন্দ অনুভুত হবে না, কারণ জেলখানায় যেমন সুখ নেই, ঠিক তেমনি সাকার ঈশ্বরের সাকার ধামেও অনন্ত সুখ নেই। আপনার কথা অনুসারে তিনি যেহেতু সাকার সেহেতু ওনার ধামও সীমাবদ্ধ বা সাকার।
ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জুন তিষ্ঠতি।
ভ্রাময়ন্ সর্বভূতানি যন্ত্রারূঢ়ানি মায়য়া।।৬১।।
অনুবাদঃ হে অর্জুন! পরমেশ্বর ভগবান সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থান করছেন এবং সমস্ত জীবকে দেহরূপ যন্ত্রে আরোহণ করিয়ে মায়ার দ্বারা ভ্রমণ করান।[ অভয়চরণারবিন্দ ]
বেদে ঈশ্বর সর্বব্যাপক বলা হয়েছে
গীতায় আমি বলতে মূলত ২টি সত্ত্বাকে বুঝায়, একটা মুক্ত
জীবাত্মা কৃষ্ণজী ও অপর সত্ত্বাটা
পরমেশ্বরকেই বুঝিয়েছেন। প্রমাণ
স্বরূপ কৃষ্ণজী বলছেন যে-
ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জুন তিষ্ঠতি।
ভ্রাময়ন্ সর্বভূতানি যন্ত্রারূঢ়ানি মায়য়া।।১৮/৬১।।
অনুবাদঃ হে অর্জুন! পরমেশ্বর ভগবান সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থান করছেন এবং সমস্ত জীবকে দেহরূপ যন্ত্রে আরোহণ করিয়ে মায়ার দ্বারা ভ্রমণ করান।
"হে অর্জুন, ঈশ্বর. সর্ব জীবের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত থাকিয়া মায়াদ্বারা যন্ত্রারূঢ় পুত্তলিকার মত তাহাদিগকে ভ্রমণ করাইতেছেন।"-গীতা ১৮।৬১.
"হে ভারত, সর্বতোভাবে তাঁহার (ঈশ্বরের) শরণ
লও, তাঁহার অনুগ্রহে পরম শান্তি ও চিরন্তন স্থান প্রাপ্ত হইবে।"-গীতা১৮।৬২.
তমেব শরণং গচ্ছ সর্বভাবেন ভারত।
তৎপ্রসাদাৎ পরাং শান্তিং স্থানং প্রাপ্স্যসি শাশ্বতম্।।৬২।।
অনুবাদঃ হে ভারত! সর্বতোভাবে তাঁর শরণাগত হও। তাঁর প্রসাদে তুমি পরা শান্তি এবং নিত্য ধাম প্রাপ্ত হবে।
ইতি তে জ্ঞানমাখ্যাতং গুহ্যাদ্ গুহ্যতরং ময়া।
বিমৃশ্যৈতদশেষেণ যথেচ্ছসি তথা কুরু।।৬৩।।
অনুবাদঃ এভাবেই আমি তোমাকে গুহ্য থেকে গুহ্যতর জ্ঞান বর্ণনা করলাম। তুমি তা সম্পূর্ণরূপে বিচার করে যা ইচ্ছা হয় তাই কর।
"আমি তোমার নিকট এই গুহ্য হতেও গুহ তত্ত্বকথা ব্যাখ্যা করিলাম, তুমি ইহা বিশেষভাবে পর্যালোচনা
করিয়া যাহা ইচ্ছা হয় তাহাই কর।"
গীতা ১৮।৬৩.
.
উপরের এই ৩টি শ্লোক থেকে পরিষ্কার এই সময় কৃষ্ণ স্বাভাবিক মানুষদের মতই তথা জীবের মতই
কথা বলছেন। যোগযুক্ত অবস্থায় কথা বলছেন না। কারণ এই স্থলে কৃষ্ণ আমার বা আমাকে শরণ লও এই কথা বলে নাই। বলেছে ঈশ্বরের শরণ নেওয়ার কথা। আর যখন দেখলেন এতেও অর্জুন
স্থির হতে পারেন নাই তখনই কৃষ্ণ যোগযুক্ত হলেন এবং তখন যোগযুক্ত কৃষ্ণজীর আত্মায় পরমাত্মা বা ঈশ্বর প্রকটিত হয়ে বলিলেন-
সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।
অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।।৬৬।।
অনুবাদঃ সর্ব প্রকার ধর্ম পরিত্যাগ করে কেবল আমার শরণাগত হও। আমি তোমাকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করব। তুমি শোক করো না।
"সকল ধর্ম পরিত্যাগ করিয়া তুমি একমাত্র আমারই (পরমেশ্বরের) শরণ লও, আমি (পরমেশ্বর)
তোমাকে সকল পাপ থেকে রক্ষা করিব, শোক করিও না।"
গীতা১৮।৬৬.
মুক্ত জীবাত্মারা বিষয়ে উপনিষদের বচনঃ
"ভাবং জৈমিনিঃ, বিকল্পামননাৎ"
বেদান্তসূত্র ৪।৪।১১.
অর্থাৎ মুক্ত আত্মার দেহ ও ইন্দ্রিয়াদি থাকে, ইহা জৈমিনি মুনিরর মত। কারণ শাস্ত্রে বলা আছে যে, তারা নানা রূপ দেহধারণ করার ক্ষমতা আছে।
.
"...তিনি(মুক্ত জীবাত্মা) এক প্রকার থাকেন, তিন প্রকার হন, পঞ্চ প্রকার, সপ্ত প্রকার এবং নব প্রকার হন...।"
ছান্দোগ্যোপনিষদ্৭।২৬।২.
.
এছাড়াও তিনি যে যা ইচ্চা তাই পেয়ে থাকেন তথা করতে পারেন তার প্রমাণ আরো দেখুন-
"তিনি যদি পিতৃলোক কামনা করেন, তবে তাহার সঙ্কল্পমাত্রই পিতৃগণ তাঁহা সহিত মিলিত হন...। মাতৃলোক
কামনা করলে মাতৃগনের সহিত মিলিত হন... ভাতৃলোক কামনা করলে তাদের সহিতও মিলিত হতে পারেন... ।
ভগিনীলোক কামনা করলে, বন্ধুলোক কামনা কললে তাদের সহিতও মিলিত হন। এক কথায় যাহা
চান তাহাই প্রাপ্ত হন।"-ছান্দোগ্য_উপনিষদ ৮।২।১-১০.
গীতার পরস্পর বিরোধী শ্লোক
চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।
তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম্।।১৩।।
গীতা-৪র্থ অধ্যায়-জ্ঞান যোগ ১৩ নং শ্লোক
অনুবাদঃ প্রকৃতির তিনটি গুণ ও কর্ম অনুসারে আমি মানব-সমাজে চারটি বর্ণবিভাগ সৃষ্টি করেছি। আমি এই প্রথার স্রষ্টা হলেও আমাকে অকর্তা এবং অব্যয় বলে জানবে।[ অভয়চরণারবিন্দ ]
অর্থ-"গুণ(সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ) ও কর্মের বিভাগ অনুসারে বাহ্মণ, ক্ষত্রিয়,বৈশ্য ও শূদ্র এই চার বর্ণের সৃষ্টি করেছি।"
এই শ্লোকটা থেকে বোঝা যায়,বংশানুসারে নয়,গুনানুসারেই বর্ণের বিভাগ।অর্থাৎ,ব্রাহ্মণের পুত্রের মধ্যে যদি তমোগুণের আধিক্য ঘটে তাহলে সে শূদ্র এবং শূদ্রের পুত্রের মধ্যে যদি সত্ত্বগুণের আধিক্য ঘটে তাহলে সে শূদ্র বংশে জন্মেও ব্রাহ্মণ হবে।(এই বিষয়ে, মহাভারত ও মনুস্মৃতির প্রমাণ আছে)
উপরের শ্লোকের বিরোধী শ্লোক দেখুন-
শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ।
স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ।।৩৫।।
গীতা-৩য় অধ্যায়-কর্মযোগ-৩৫ নং শ্লোক
অনুবাদঃ স্বধর্মের অনুষ্ঠান দোষযুক্ত হলেও উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত পরধর্ম থেকে উৎকৃষ্ট। স্বধর্ম সাধনে যদি মৃত্যু হয়, তাও মঙ্গলজনক, কিন্তু অন্যের ধর্মের অনুষ্ঠান করা বিপজ্জনক।[অভয়চরণারবিন্দ]
অর্থ বিশ্লেষণ- ধরা যাক, শূদ্রকে উদ্দেশ্য করে এই শ্লোকটি বলা হয়েছে। তাহলে এই শ্লোকটির অর্থ হবে,হে শূদ্র,তোমার কর্ম হলো ব্রাহ্মণদের সেবা করা।এটাই তোমার স্বধর্ম। এতে যদি তোমার মৃত্যু হয় তাহলে তুমি স্বর্গলোকে যাবে।কিন্তু ব্রাহ্মণের কর্ম গ্রহণ করলে,তোমার পরধর্ম গ্রহন করা হবে। পরধর্ম ভয়ংকর,কেননা, উহা নরকে যাবার কারণ।
মহাভারতে আছে দ্রোণ, তাঁর শ্যালক কৃপাচার্য এবং তার পুত্র অশ্বথামা এরা সকলেই ব্রাহ্মণ কিন্তু এরা তো ক্ষত্রিয়ের ধর্ম পালন করতেন তাছাড়া পরশুরাম ছিলেন ব্রাহ্মণ,অথচ তিনি ক্ষত্রিয় ধর্ম পালন করতেন।তাহলে এঁরা কি পরধর্ম আচরণ করে,ভয়ংকর অশাস্ত্রীয় আচরণ করেছেন? বিশেষতঃ,পরশুরাম তো আবার হিন্দুদের অবতার!!!অবতার হয়ে, পরশুরাম গীতার এই শ্লোক অনুযায়ী,নরকগামী হবেন!!ঋষি বিশ্বামিত্র ছিলেন বেদ মন্ত্রের দ্রষ্টা। তিনি ছিলেন ক্ষত্রিয়, তাহলে গীতার বচন অনুযায়ী,তিনিও নরকগামী হবেন!!! (প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো,গীতায় স্বর্গ ও নরকের উল্লেখ আছে তাই এই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। স্বর্গ ও নরক বলতে বিশেষ কোন স্থান নেই!)
ধর্ম বলতে,তখন কর্মকেও বোঝাতো।যেমন,ক্ষত্রিয়ের ধর্ম হল,যুদ্ধ করা।গীতাতেও, তাই বলা আছে।(গীতা~2/33 দেখুন।)
ধর্ম জিজ্ঞাসু#কিছু পন্ডিত বলেন, গীতা হল যোগযুক্ত অবস্থায় বলা ঈশ্বরের বাণী!
বৈদিক# মহাভারতের এই প্রমাণটি দেখুন-
ন চ শক্যং পুনর্বক্তুমশেষেণ ধনজ্ঞয়।
স হি ধর্মঃ সুপর্য্যাপ্তো ব্রহ্মণঃ পদবেদনে।
ন শক্যং তন্মষা ভূয়স্তথা বক্তুমশেষতঃ।
পরং হি ব্রহ্মা কথিতং যোগযুক্তেন তন্ময়া
ইতিহাসন্তু বক্ষ্যামি তস্মিন্নর্থে পুরাতনম।।
মহাভারত- অশ্বমেধিক পর্ব-অধ্যায়-17, শ্লোক-11,12,13
অর্থ-(শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন)হে, ধনজ্ঞয়(অর্জুন),সেই সমস্ত কথা(গীতার বাণী) আমার পক্ষে বলা আর সম্ভব নয়।সেই ধর্মটি পরমাত্নার স্বরূপ জানবার জন্য যথেষ্ঠ ছিল।আমি এখন সেই সমস্ত কথা,পুনরায় বলতে পারব না।সেই সময় আমি যোগযুক্ত হয়ে,পরব্রহ্মের বিষয় বলেছিলাম।এখন সেই বিষয়ে প্রাচীন বৃত্তান্ত বলছি।
এখানে, শ্রীকৃষ্ণ পরিস্কার ভাষায় বলছেন,তিনি যোগযুক্ত অবস্থায় ঈশ্বরের বিষয়ে বলেছেন।শ্রীকৃষ্ণ একবারও বলেননি যে,ঈশ্বর তাঁর(শ্রীকৃষ্ণের) মাধ্যমে,বাণী দিয়েছেন।
সুতরাং,গীতা কোন ঈশ্বরীয় বাণী নয়।ইহা শ্রীকৃষ্ণ নামক মরণশীল মানুষের নিজস্ব বানী এবং গীতার অনেক শ্লোক বেদ বিরোধী ও পরস্পর বিরোধী, কারণ কিছু স্বার্থপর মানুষ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য,গীতায় অনেক প্রক্ষিপ্ত শ্লোক ঢুকিয়েছেন।
বৈষ্ণব মতের সমীক্ষা
ওমিত্যেকাক্ষরং ব্রহ্ম ব্যাহরন্ মামনুস্মরণ্।
যঃ প্রয়াতি ত্যজন্ দেহং স যাতি পরমাং গতিম্
গীতা_অক্ষরব্রহ্মযোগঃ_শ্লোক সংখ্যা_13
অর্থ-(শ্রীকৃষ্ণ বলছেন) যিনি,"ওম্"এই ব্রহ্মস্বরূপ একাক্ষর নামটি মনে মনে উচ্চারণ করে দেহত্যাগ করেন,তিনি পরমগতি প্রাপ্ত হন।
বৈষ্ণবরা যদি সত্যিই শ্রীকৃষ্ণের বানী মানতো,তাহলে 'ওম্' নাম জপ করতো!!কিন্তু বৈষ্ণবদের মতে,হরেকৃষ্ণ নাকি মহামন্ত্র।
প্রথমতঃ,বেদের বাণীকে মন্ত্র বলে।হরেকৃষ্ণ বলে, বেদে কোন মন্ত্র নেই। সুতরাং,হরেকৃষ্ণ কোন মন্ত্র নয়।
দ্বিতীয়তঃ,মহামন্ত্র বলা হয়, বেদের বাণী গায়ত্রী মন্ত্রকে।
তৃতীয়তঃ,অনেক অতিজ্ঞানী বৈষ্ণব যুক্তি দেখায় যে,কলিযুগের জন্য,শ্রীকৃষ্ণ,চৈতন্য মহাপ্রভুর রূপ ধারণ করে এই হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জীবকে উপদেশ করেছেন।
কিন্তু,বৈষ্ণবরা,শ্রীকৃষ্ণকে স্বয়ং ঈশ্বর বলে বিশ্বাস করেন।তাহলে,ঈশ্বর দ্বাপরে ভুল করলেন।সেই ভুল সংশোধন করার জন্য পুনরায় কলিতে জন্ম নিলেন!!ঈশ্বর মানুষের মতো ভুল করেন!!বাঃ বাঃ।ইহাতে তো,শ্রীকৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব খন্ডন হয়ে যায়।
এইবার,বৈষ্ণবদের অবতার ও ঈশ্বরের কিছু হাস্যকর লীলা দেখুন~
বৈষ্ণব ঈশ্বরের জন্তু অবতার#শুয়োর,কচ্ছপ, মাছ।
পশু বা এলিয়েন অবতার#নৃসিংহদেব।
বেঁটে অবতার#বামনাবতার
ঈশ্বরে অবিশ্বাসী ঈশ্বরের অবতার#বুদ্ধদেব।
এইবার,বৈষ্ণবরা যাঁকে ঈশ্বর বলে,বিশ্বাস করেন সেই নরদেহধারী স্বয়ং ঈশ্বর,শ্রীকৃষ্ণের সংক্ষিপ্ত জীবনী দেখুন~
বিবেচনা করুন,এইরকম ঈশ্বরের স্বরূপ হওয়া সম্ভব কিনা?!
ঈশ্বরকে সাধারণ মরণশীল মানুষের পর্যায়ে নামিয়ে এনে,বেদ বিরোধী মতবাদ প্রচারকারীদের নাম হল বৈষ্ণব।শ্রীকৃষ্ণের মতো শুদ্ধ চরিত্রের মানুষের চরিত্র কালিমালিপ্ত করে,তাঁকে যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী মানুষদের কাছে তাচ্ছিল্যের পাত্র করে তুলেছেন এই বৈষ্ণব সম্প্রদায়।
আপনারা এই যুক্তি বুদ্ধির শত্রু,ধর্মের মোড়কে ব্যাভিচার,ধর্ষণ ও অসুস্থ যৌনতা সমর্থনকারী এই বৈষ্ণবরূপী ভেড়াদের পরিত্যাগ করুন।
বি.দ্র.খ্রীষ্টান ও মুসলিম ধর্মগুরু হতে গেলে,তাঁকে বাইবেল ও কোরান শরীফ জানতেই হয়।কিন্তু, হিন্দুদের ক্ষেত্রে,বেদ না জেনে এবং বেদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করে,যে কেউ নিজেকে অবতার ও ধর্মগুরু বলে দাবি করতে পারেন।তা সে, প্রভুপাদ বা সদগুরু,রামপাল যেই হোন না কেন!!!
শ্রীকৃষ্ণ কি মূর্তি পূজায় বিশ্বাস করতেন•সমীক্ষা•
বৈষ্ণব সম্প্রদায়রা তো অন্য প্রমাণ মানতেই চান না,তাই বৈষ্ণবদের অতিপ্রিয় ভাগবত পুরাণ থেকে প্রমাণ দেখাবো-----
মূর্তি পূজার বিরুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত বচন শুনুন-
যস্যাত্নবুদ্ধি কুনপে ত্রিধাতুকে।
স্বধীঃ কলত্রাদিষু ভৌম ইজ্যধীঃ।।
যত্তীর্থ বুদ্ধিঃ সলিলে ন কর্হিচিজ্জনেষবভিজ্ঞেসু স এব গোখরঃ।।
ভাগবত পুরাণ_10/84/13
(শ্রীকৃষ্ণ বলছেন),
যার, ত্রিধাতুযুক্ত (কফ-বায়ু-পিত্ত) দেহে আত্নবুদ্ধি,কলত্রাদিতে আত্নীয়বুদ্ধি,ভূবিকারে অর্থাৎ মৃন্ময়,পাষাণ মূর্তিতে দেবতাবুদ্ধি বা জলে তীর্থবুদ্ধি আছে, কিন্তু সাধুদের যে ব্যক্তি সেরূপ অর্থাৎ দেবতাজ্ঞান করে না,সে ব্যক্তি গরুর ঘাস বহনকারী গাধার মত।
অর্থাৎ,গাধা তেমন নিজে পশু হয়েও,অন্য পশু গরুর জন্য ঘাস বয়ে মরে অথচ নিজের জন্য ঘাস জোটে না,সেই রকম যে লোক ভগবানের প্রত্যক্ষ জীবন্ত স্বরূপ সাধু মহাপুরুষকে অবজ্ঞা করে জড়মূর্তির পূজার জন্য মন্দিরে এবং জলময় স্থানগুলোকে তীর্থ মনে করে দৌড়ে বেড়ায় সেই লোক ঠিক ওই গাধার মত কেবল পন্ডশ্রম করে মরে!!!
এইবার গীতার প্রমাণ দেখুন--------
যত্তু কৃৎস্নবদেকস্মিন্ কার্যে সক্তমহৈতুকম্।
অতত্ত্বার্থবদল্পং চ তত্তামসমুদাহৃতম্।।
গীতা_18/22
এই শ্লোকটির উপর প্রসিদ্ধ বৈষ্ণব আচার্য ও চৈতন্য মহাপ্রভুর অতি প্রিয়,শ্রীধর স্বামীর টীকা দেখুন-------
"একস্মিন্ কার্যে দেহে বা প্রতিমাদৌ বা কৃৎস্নবৎ পরিপূর্ণবৎ সক্তম্ এতাবানেবাত্না ঈশ্বরো বেত্যাভিনিবেশ যুক্তম্।অহৈতুকম্ নিরুপপত্তিকম্।
অতত্ত্বার্থবৎ পরমার্থাবলম্বনশূন্যম্।
অতএবাল্পম্ তুচ্ছম্।অল্পবিষয়াত্বাৎ।অল্পফলত্বাচ্চ।যদেবম্ভূতম্ জ্ঞানম্ তত্তামসমুদাহৃতম্।।"
অর্থাৎ, যে জ্ঞানে একমাত্র দেহে বা প্রতিমাদিতে পরিপূর্ণ ঈশ্বর অবস্থিত আছেন,এইরূপ অভিনিবেশ জন্মে,এক পরিছিন্ন মূর্তি পরিপূর্ণবৎ প্রতীয়মান হয়,সেই জ্ঞানে কোন পরমার্থ লাভ হয় না।অতএব,অযথার্থ, যুক্তিহীন ও তুচ্ছ জ্ঞানকে তামসিক জ্ঞান বলা হয়।
অর্থাৎ,যে জ্ঞানে মনে হয়,ঈশ্বর শরীর ধারণ করেন,মূর্তির মধ্যে ঈশ্বর আছেন বা মূর্তিই ঈশ্বর,সেই জ্ঞান হল খুব নিম্নমানের,তামসিক জ্ঞান।
বৈষ্ণবরা তো শ্রীকৃষ্ণকে স্বয়ং ঈশ্বর বলেন।স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ মূর্তি পূজকদের গাধা বলেছেন।
আপনাদের চৈতন্য মহাপ্রভুর অতি প্রিয় বৈষ্ণব আচার্য,শ্রীধর স্বামী মূর্তিকে ঈশ্বর ভেবে পূজা করাকে তামসিক জ্ঞান বলেছেন!!!
আর্য সমাজ মূর্তি পূজার বিরোধিতা করে বলে তারা যদি কাঠ মোল্লা হয়,তাহলে মূর্তি পূজার বিরোধিতা করা, স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীধর স্বামী এখানে কোন স্তরের মোল্লা?!!
ভগবান গীতায় বলিয়াছেনঃ —
লোকেহস্মিন দ্বিবিধা নিষ্ঠা পুরা প্রোক্তা ময়ানঘ ।
জ্ঞানযোগেন সাংখ্যানাং কর্মযোগেন যোগিণাম্ ।। (৩/৩)
অর্থ — এই পৃথিবীতে নিষ্ঠা (নিঃশেষরূপে স্থিতিলাভ, ব্রাহ্মীস্থিতি) লাভের জন্য আমি (ভগবান) সৃষ্টির পূর্ব হইতেই পথের কথা বলিয়াছি (নিয়ম করিয়া দিয়াছি) । এই দুইটি পথের মধ্যে যাহারা জ্ঞাননিষ্ঠ, তাঁহাদের জ্ঞানের দ্বারা এবং যোগিগণের কর্মযোগের দ্বারা মুক্তি হইবে ।
ভগবান এখানে ভক্তির কোন কথা উল্লেখ করেন নাই । কারণ জ্ঞান ও কর্ম এই দুইটি মৌলিক পদার্থ । ভক্তি কোন মৌলিক পদার্থ নহে—ভক্তি একটি যৌগিক পদার্থ । যেমন অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন দুইটি মৌলিক বায়বীয় বস্তু । এই দুইটি গ্যাসের একত্র মিলন হইলে জলের সৃষ্টি হয় । এই জল একটি যৌগিক বস্তু । তাই জলকে উত্তপ্ত করিলে উহা পুনরায় স্বকারণ অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন নামক গ্ল্যাসদ্বয়ে বিলীন হইয়া যায়— জলের কোন চিহ্নও থাকে না । এইরূপ ভক্তিও একটি যৌগিক বস্তু । জ্ঞান ও কর্মের সমুচ্চয় অবস্থার নাম ভক্তি অর্থাৎ জ্ঞানের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে ব্রহ্মত্ব লাভ হয় এবং কর্মগুলি যদি জ্ঞানমিশ্রিত নাহয়, তবে সেই কর্মে বন্ধন সৃষ্টি করে ; আর কর্মগুলি যদি জ্ঞানমিশ্রিত হয়, তবে চিত্ত শুদ্ধ হইয়া কর্মী ব্রহ্মজ্ঞান লাভের অধিকার অর্জন করে জ্ঞানমিশ্রিত কর্মানুশীলনের ফলে যে অনুভূতি লাভ হয়, সেই অনুভূতিরই নাম ভক্তি । তাই ভক্তি জ্ঞানেরই প্রকার ভেদ —ভক্তির নিজস্ব কোন সত্তা নাই —ইহা জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল ।
ভগবান গীতাতে দুই প্রকার ভক্তির কথা বলিয়াছেন—
(১) অনন্যা ভক্তি, ও
(২) অব্যভিচারিণী ভক্তি।
যেখানে দুই থাকে না, দুইটি মিলিয়া এক হইয়া যায় ( ন+অন্য =অনন্য), যেমন জীবাত্মার পরমাত্মার মধ্যে লীন হইয়া যাওয়া, নদীর সাগরের মধ্যে বিলীন হইয়া যাওয়া —এই সকলই অনন্যা ভক্তির দৃষ্টান্ত । যেখানে ভক্ত ও ভগবানের দুইটি পৃথক বস্তুর অস্তিত্ব থাকে না, তাহাই অনন্যা ভক্তি ।
‘অব্যভিচারিণী’ ভক্তির অর্থ হইতেছে, যে ভক্তিতে ব্যভিচার (দুই) থাকে না, তাহাই অব্যভিচারিণী ভক্তি । ভক্তি— ভজ্ ধাতু ক্ত প্রত্যয়যোগে ভক্ত শব্দ নিষ্পন্ন হইয়াছে । ভজ্ ধাতু সেবায়াং —ভজ্ ধাতুর অর্থ সেবা এবং ক্ত পদের অর্থ প্রবেশ করা —সেবা দ্বারা একের অপরের মধ্যে (জীব ব্রহ্মের মধ্যে) প্রবেশ করিয়া দুইটি বস্তু এক হইয়া যাওয়ার নাম ভক্তি।
গীতার ভক্তিযোগে (দ্বাদশ অধ্যায়ে) ভগবৎ ভক্তের যেসব লক্ষণ দেওয়া হইয়াছে, সেগুলি সবই ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের লক্ষণ —সাধারণ মানবের ঐসব লক্ষণ হয় না । এইজন্য ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষই ভগবানের প্রিয় ভক্ত । নিন্মে ভগবৎ ভক্তের কয়েকটি লক্ষণ দেওয়া হইলঃ—
“অদ্ব্যেষ্টা সর্বভূতানাম্” (গীতা ১২/১৩)- সকল ভূতের সঙ্গে যিনি দ্বেষ করেন না, তিনিই ভগবানের প্রিয় ভক্ত ।
“নির্মমঃ নিরহঙ্কারঃ”— যাহার মোহ নাই এবং দেহেতে যাহার আত্মবুদ্ধি নাই অর্থাৎ ‘এই স্থূল দেহটি আমি’ এইরূপ যাহার বোধ নাই, তিনিই ভগবানের প্রিয় ভক্ত ।
“যতাত্মা দৃঢ়নিশ্চয়” —যাহার ইন্দ্রিয়গণ সংযত হইয়াছে এবং ‘আমি ব্রহ্মই, জীব নহি’ এইরূপ যাহার বুদ্ধি নিশ্চয় করিয়াছে, তিনিই ভগবানের প্রিয় ভক্ত ।
“হর্ষামর্ষভয়োদ্বেগৈঃ মুক্তঃ” যিনি হর্ষ-বিষাদ, মৃত্যুভয়, মানসিক চাঞ্চল্য হইতে মুক্ত হইয়াছেন —এরূপ ব্যক্তিই ভগবানের প্রিয় ভক্ত ।
বর্তমান সমাজে যে রাধাকৃষ্ণে ভক্তি, কালী-দূর্গা-শিবে ভক্তি ইত্যাদি ভক্তির নামে মনগড়া সাধন-ভজন চলিতেছে —এইই সকলই শাস্ত্রবহির্ভূত অজ্ঞানকৃত ভক্তি । দ্বাপর যুগের পূর্বে যখন কৃষ্ণের জন্ম হয় নাই, তখন মানব কাহার উপাসনা করিয়া শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করিয়াছিলেন? তাহারা কি কালী,দূর্গা,শিব প্রভৃতি দেবতাগণের উপাসনা করিয়া ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করিয়াছিলেন ? বেদে আকারবান কোন মূর্তি উপাসনা বিহিত হয় নাই । তাই এই সকল অবৈদিক উপাসনা ।
গীতা বলেন,—
যঃ শাস্ত্রবিধিমুৎসৃজ্য বর্ততে কামকারতঃ। ন স সিদ্ধিমবাপ্নোতি ন সুখং ন পরাং গতিম্।। (১৬/২৩)
অর্থ— যাহারা শাস্ত্রীয় নির্দেশ অমান্য করিয়া নিজেদের খেয়াল খুশিমত সাধন-ভজন করে, তাহারা সিদ্ধিলাভ করিতে পারে না, তাহাদের জীবনে সুখ বা মোক্ষলাভও হয় না ।
বেদে একেশ্বরবাদ ঘোষণা করিয়াছেন। গীতা বলেন,—
স তয়া শ্রদ্ধয়াযুক্তস্তস্যরাধন মিহতে।
লভতে চ ততঃ কামান্ ময়ৈব বিহিতান্ হি তান্ ।। (৭/২২)
অন্তবৎ তু ফলং তেষাং তদ্ভবৎ অল্প মেধাসাং ।
দেবান্ দেবযজো যান্তি মদ্ভক্তাঃ যান্তি মামপি ।। (৭/২৩)
অর্থ — শ্রদ্ধাযুক্ত হইয়া দেবতার উপাসনা করিয়া যাহারা কামনা অনুরূপ ফল লাভ করেন, তাহাদের সেই ফলও দেবতা হইতে আসে না —সেই ফলও আমিই (ভগবানই) বিধান করিয়া থাকি।। “ অন্তবৎ তু ফলং তেষাং” —
কিন্তু তাহাদের সেই ফল নাশশীল, আর যাহারা ফলপ্রার্থী হইয়া দেবতাদের উপাসনা করে, তাহাদের মেধা (বুদ্ধি) অল্পই বলিতে হইবে । কেননা দেবতা উপাসনার দ্বারা দেবতাকেই পাওয়া যায় —আমাকে (ভগবানকে) পাওয়া যায় না । যাহারা আমার উপাসনা করে, তাহারাই আমাকে প্রাপ্ত হয় । সুতরাং দেবতাগণের উপাসনা এবং ভগবানের উপাসনা এক বস্তু নহে ।
দেবতার উপাসনার ফল নাশশীল অর্থাৎ অল্পকাল স্থায়ী এবং ইহাতে অর্থব্যয় ও শ্রমের প্রয়োজন হয় । কিন্তু আত্মার উপাসনায় অর্থের প্রয়োজন হয় না, শারীরিক কোন শ্রমেরও প্রয়োজন নাই অথচ এই উপাসনার ফল হয় চিরস্থায়ী ।
মনের কল্পনা ব্যতীত দেবগণের বাস্তব অস্তিত্ব কেহ কোনদিন দেখে নাই । পণ্ডিতগণ মনেরই এক একটি ভাবকে এক একটি দেবতারূপে কল্পনা করিয়াছেন ।
“সাধকানাং হিতার্থায় ব্রহ্মণঃ রূপ কল্পনা”— সাধকগণের হিতের জন্য ব্রহ্মের রূপের কল্পনা করা হইয়াছে ।
যজন্তে সাত্ত্বিকা দেবান্ যক্ষ রক্ষাংসি রাজসাঃ । প্রেতান্ ভূতগণাংশ্চান্যে যজন্তে তামাসা জনাঃ।। (গীতা ১৭/৫ )
অর্থ— সাত্ত্বিক ব্যক্তিগণ ইন্দ্রিয়গণের প্রকাশ-ভাবের উপাসনা করেন। দেবান্ —
দিব্ ধাতু হইতে ‘দেব’ শব্দ নিস্পন্ন হইয়াছে ।
দিব্ ধাতুর অর্থ দ্যুতি বা প্রকাশ । চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক—এই পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়ের মধ্যে দিয়া যে দর্শন, শ্রবণ, আঘ্রাণ্ আস্বাদন ও শারীরিক স্পর্শানুভব অনুভুত হইতেছে এই সকল একই আত্মশক্তি হইতে আসিতেছে—ইহা জানিয়া সাত্ত্বিকগণ সকল জ্ঞানেন্দ্রিয়ের মধ্যে এক প্রকাশময় আত্মারই উপাসনা করেন । গীতা বলেন,—
সর্বদ্বারেষু দেহেঅস্মিন্ প্রকাশ উপজায়তে । জ্ঞানং যদা তদা বিদ্যাদ্ বিবৃদ্ধং সত্তমিত্যুতঃ ।। (১৪/১১)
অর্থ— যখন এই দেহের চক্ষু- কর্ণাদি সমস্ত ইন্দ্রিয়দ্বারের জ্ঞানময় প্রকাশ অনুভুত হয়, তখন জানিবে যে, সত্ত্বগুণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়াছে ।
যাহারা রাজসিক শ্রদ্ধাবান তাহারা যক্ষ ও রক্ষের উপাসনা করে। ‘যক্ষ’ অর্থ যাহারা ধন সঞ্চিত করিয়া রাখে, ব্যয় করিতে কুন্ঠিত হয়—কৃপণ। ‘রক্ষ’ অর্থ যাহারা ব্যবসায়-বানিজ্য ও কৃষিকর্মের দ্বারা অর্থোপার্জনে রত থাকে । আর যাহারা তামসিক শ্রদ্ধাবান তাহারা ‘প্রতান্’ পরলোকগত (মৃত) ব্যক্তির এবং ‘ভূতগণাং’ যেসব ভূতগণ (প্রাণীগণ) বাঁচিয়া রহিয়াছে তাঁহাদের উপাসনা করে । অর্থাৎ যাহারা তামসিক ব্যক্তি তাহারাই স্থূল দেহের (মৃত বা জীবিত) দেহের উপাসনা করে । স্থূলদেহ প্রকৃতির অন্তর্গত। প্রকৃতি জড়া বলিয়া তাঁহার উপাসনার দ্বারা জড়ত্বই লাভ হয়—সাধনার যে লক্ষ্য চৈতন্য লাভ তাহা হয় না ।
যজ্ঞরূপ নিঃস্বার্থভভাবে জনগণের কল্যাণমূলক কর্মের অনুশীলনের দ্বারা মানবের চিত্ত শুদ্ধ হয় । চিত্তশুদ্ধ হইলে দেবত্ব অর্জিত হয় এবং পরে সাধক সকল দেহের মধ্যে যে চৈতন্যশক্তি বিরাজমান রহিয়াছেন, সেই চৈতন্যের স্মরণ-মনন করিয়া আত্মজ্ঞান লাভ করেন । এই আত্মজ্ঞানই সকল সাধনার চরম ফল । আত্মজ্ঞান লাভই সকল মনুষ্য সম্প্রদায়ের লক্ষ্য । ইহাই গীতার শিক্ষা ।
গীতার ভাষ্যকারের অভাব নাই। কিন্তু ভাষ্যের মধ্যে প্রায় সকলেরই কিছু-না-কিছু ভূল-ত্রুটি রহিয়া গিয়াছে ।
এইগুলি সংশোধন হওয়া বিশেষ প্রয়োজন নচেৎ ঐ সকল ভাষ্য -পাঠকগণের ভূল ধারণা থাকিয়াই যাইবে। সঠিক বা সত্য ধারণা না হইলে সংশয় নিরসন হয় না ।
“সংশয়াত্মা বিনশ্যতি” (গীতা-৪/৪০) —সংশয়াক্রান্ত ব্যক্তি বিনষ্ট হয় ।
পাঠকগণের সুবিধার্তে নিন্মে মাত্র কয়েকটি শ্লোকের ব্যাখ্যা দেওয়া হইলঃ —
১ অধ্যায়, শ্লোক ৪২—
বর্ণসঙ্করঃ কুলনাশকদিগকে নরকে লইয়া যায় ; পিণ্ড ও তর্পনাদি বিলুপ্ত হওয়ায় ইহাদিগের পিতৃগণ নিশ্চয়ই পতিত হন। (মধুসুধন স্বরস্বতী)।
‘বর্ণসঙ্কর’ অর্থ এক জাতীয় পুরুষের সহিত অন্য জাতীয় স্ত্রীলোকের বিবাহ হইতে যেসব পুত্রকন্যা জন্মগ্রহণ করে, তাহারাই বর্ণসঙ্কর প্রাপ্ত ।
যদি এইরূপ ব্যাখ্যাই যুক্তিসম্মত হইয়া থাকে, তবে যিনি গীতাগ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন, সেই ব্যাসদেব কি বর্ণসঙ্কর হইতে জাত হয় নাই ? প্রবাদ আছে, পরাশর মুনির ঔরষে ও ধীবর কন্যার গর্ভে ব্যাসদেবের জন্ম হইয়াছিল । কিন্তু এই বর্ণসঙ্করের দরুন দেশ উচ্ছন্নে যায় নাই । ভারতে যদি ব্যাসদেব জন্মগ্রহণ না করিতেন, তবে এই দেশ ঘোর অজ্ঞানান্ধকারে ডুবিয়া থাকিত। কৌরব ও পাণ্ডবগণও বর্ণসঙ্কর হইতে জাত ।
লুপ্ত পিণ্ডোদকক্রিয়াঃ — পিণ্ড ও উদকক্রিয়ার লোপ হওয়াতে পিতৃপুরুষগণ পিণ্ড ও জল না পাইয়া নরকগামী হন । পিতৃ পুরুষের উদ্যেশ্যে পিণ্ডদান পিণ্ড নহে । ‘পিণ্ডঃ কুণ্ডলিনী শক্তিঃ’ ( গুরুগীতা) —কুণ্ডলিনী শক্তির নাম পিণ্ড । মনের উর্ধগামী শক্তির নাম কুণ্ডলিনী শক্তি ।
‘উদক্’ অর্থ জল বা রস । মনোবৃত্তিগুলি উর্দ্ধগামী হইলে ভগবৎ রসের যে সঞ্চার হয়, তাহাই উদক্ । একটি উর্দ্ধগামী শক্তি, অপরটি ভগবৎ তত্ত্বের অনুভব ।
‘উদক্’ অর্থে ভাষ্যকারগণ পিতৃপুরুষের তর্পণের সময় তাঁহাদের উদ্দেশ্যে যে জল দেওয়া হয়, সেই জলের নাম উদক্ বলিয়াছেন, । তর্পণ শব্দটি কিন্তু মূল শ্লোকে নাই । হিন্দুগণ তর্পণ ক্রিয়ার দ্বারা পিতৃগণকে মুক্ত করিয়া থাকেন । তর্পণ না করিলে তাহারা নরকগামী হয় । যাহারা তর্পণ করে না সেই খৃষ্টান ও মুসলমানগণ মনে হয়, এই ব্যাখ্যা অনুসারে কেহই মুক্ত হইতে পারেন না । এইরূপ সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যা ত্যাগ করাই সঙ্গত ।
বস্তুতঃ বর্ণসঙ্কর মনের অবস্থা —জাতির অবস্থা নহে । স্বামী-স্ত্রী যদি একই প্রকারের সত্ত্ব, রজঃ বা তমঃ গুণের অধিকারী হয়, তবে কোন সন্তানই বর্ণসঙ্কর প্রাপ্ত হয় না । গুণ বৈষম্যেই বর্ণসঙ্কর প্রাপ্ত হয় ।
গীতা বেদরই নির্যাস। বেদের জ্ঞানভাগের নাম উপনিষদ্ । মহামতি ব্যাসদেব উপনিষদ্ হইতে সারভাগ সংগ্রহ করিয়া লোক কল্যাণের নিমিত্তে একখানি ধর্মগ্রন্থ রচনা করিয়া তাহা নিজ রচিত মহাভারতে সন্নিবিষ্ট করিয়া দেন । ইহারই নাম গীতা । সুতরাং গীতার তত্ত্ব সবই উপনিষদ্ হইতে লওয়া হইয়াছে । যেহেতু উপনিষদ্ যুগে বৈদিকযুগে রচিত সেইহেতু গীতাও উপনিষদিক যুগেরই ধর্মগ্রন্থ । বৈদিকযুগে ভারতে জাতিগত বর্ণবিভাগ ছিল না । তখন গুণ ও কর্ম হইতে ব্রাহ্মণাদি বর্ণাশ্রম প্রচলিত ছিল । ‘ চতুর্বণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্ম বিভাগশঃ’ (গীতা ৪/১৩) —আমি গুণ কর্মের দ্বারা চারিবর্ণ সৃষ্টি করিয়াছি । গুণ মনের ধর্ম । মন না থাকিলে কর্মও হয় না । তাই কর্মও মনের ব্যাপার—জাতির ব্যাপার নহে ।
যাহাদের পুত্র জন্মে নাই অথবা যাহারা বিবাহ করেন নাই তাহারা পিণ্ড না পাওয়ার দরুন কি মু্ক্ত হইতে পারিবে না ? যেসব মহাপুরুষগণ বিবাহ করেন নাই, তাহারা কি মুক্ত হইতে পারেন নাই ?
জাতিগত বর্ণাশ্রম জাত্যাভিমানী ব্রাহ্মণগণের তৈরী —ভগবৎ সৃষ্ট নহে । অতএব গীতার ভাষ্যকারগণ যে জাতিগত বর্ণাশ্রম ধরিয়া সেইভাবে বর্ণসঙ্কর ব্যাখ্যা করিয়াছেন তাহা যুক্তিযুক্ত হইয়াছে কিনা পাঠকগণ চিন্তা করিয়া দেখিবেন ।
৯ অধ্যায়, ১১ শ্লোক
অবজানন্তি মাং মূঢ়া মানুষীং তনুমাশ্রিতম্ । পরং ভাবমজানন্তো মম ভতমহেশ্বরম্ ।।
অর্থ — অবিবেকী ব্যক্তিগণ সর্বভূত মহেশ্বর স্বরূপ আমার পরম ভাব না জানিয়া মনুষ্য-দেহধারী বলিয়া আমায় অবজ্ঞা করিয়া থাকে । (জগদীশ ঘোষের গীতা ভাষ্য)।
ভগবান কি শুধু মনুষ্যদেহই ধারণ করিয়াছিলেন ? পশু-পক্ষী, কীট -পতঙ্গ, বৃক্ষ -লতা প্রভৃতি স্থাবর -জঙ্গমাত্মক দেহ কে ধারণ করিয়াছিল ? মূল শ্লোকে মনুষ্যদেহ বলিয়া কোন শব্দ আছে ? মূল শ্লোকে আছে — ‘মানুষীং তনু’ । মানুষ পুংলিঙ্গ —পুরুষ ; আর মানুষের স্ত্রীলিঙ্গে মানুষী— প্রকৃতি। সুতরাং ‘মানুষী তনু’ অর্থ প্রকৃতির দেহ । মনুষ্য, পশু, পক্ষী প্রভৃতি সকলেই প্রাকৃতিক দেহের অন্তর্গত । মনুষ্যদেহ বলিলে এই শ্লোকের অর্থ শুধু মনুষ্য সম্প্রদায়ে আবদ্ধ থাকে । সুতরাং ইহা সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যা । গীতা কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্য রচিত হয় নাই । ভগবানের বাণী বিশ্বের সকল মানবের জন্যই । সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যার দ্বারা গীতাকে অবমাননা করা হয় ।
১০ অধ্যায়, ৬ শ্লোক —
মহর্ষয়ঃ সপ্ত পূর্বে চত্বারো মনবস্তথা ।
মদ্ভাবা মানসা জাতা যেষাং লোকঃ ইমাঃ প্রজা ।।
অর্থ — ভৃগু প্রভৃতি সপ্ত মহর্ষি, তাহাদের পূর্ববর্তী চারিজন মহর্ষি এবং স্বায়ম্ভূবাদি মনুগণ, —ইহারা সকলেই আমার মানস-জাত এবং আমার জ্ঞানেশ্বৈর্য শক্তিসম্পন্ন ; জগতের সকল প্রজা তাহাদিগ হইতে সৃষ্টি হইয়াছে । (জগদীশ ঘোষের গীতাভাষ্য) ।
সপ্তমহর্ষি—মরিচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলহ, পুলস্ত, ত্রুত ও বশিষ্ঠ । ইহাদের পূর্বে যে চারিজন মহর্ষি জন্মলাভ করিয়াছিলেন, তাহারা হইতেছেন —সনক, সনন্দন, সনাতন ও সনৎকুমার । এই চারিজন মহর্ষি বিবাহই করেন নাই । সুতরাং তাহাদের হইতে প্রজাগণ কিরূপে সৃষ্টি হইল ? তারপরে স্বায়ম্ভূয়াদি যে ১৪ জন মনুর কথা বলা হইল তাহাদের নাম কি মূলশ্লোকে আছে ? বস্তুতঃ স্ত্রী ব্যতীত শুধু পুরুষের দ্বারা কোন সৃষ্টি হইতে পারে না ।
ভাব প্রকাশ— সৃষ্টিক্রম অনুসারে দেখা যায় যে, নির্গুণ আত্মা হইতে সত্ত্বগুণের সংযোগে প্রাণের সৃষ্টি হয় । প্রাণের সহিত তিনটি গুণ ও পঞ্চতন্মাত্রার যোগে মনের জন্ম হয় । মন হইতে বা পঞ্চতন্মাত্রা হইতে পঞ্চমহাভূত এবং মহাভূত হইতে জীবগণের সৃষ্টি হইয়াছে ।
সপ্তমহর্ষি — স্পর্শ-তন্মাত্রা (বায়ু), রূপ (অগ্নি), রস (জল) ও গন্ধ (মৃত্তিকা) এই চারটি তন্মাত্রা এবং সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিনটি গুণ —এই সাতটিকে সপ্তমহর্ষি বলা হইয়াছে । সৃষ্টিকার্যে আকাশের প্রয়োজনীয়তা নাই বলিয়া বৃহদারণ্যক উপনিষদে আকাশের উল্লেখ হয় নাই ।
‘ঋষি’ অর্থ সত্যদ্রষ্টা — সত্যকে যাহারা দেখিতে পায় । চারটি তন্মাত্রা ও তিনটি গুণ যখন শুদ্ধ অবস্থায় থাকে, তখন তাহারাই ঋষি পদবাচ্য ।
চারটি মনু— মন, বুদ্ধি, চিত্ত ও অহংকার, মনের এই চারটি অবস্থার নাম মনু । মনন বা সৃষ্টি করিতে ইচ্ছুক বলিয়া ইহাদের মনু বলা হইয়াছে ।
৭ জন মহর্ষি,— তৎপূর্বে ৪ জন মহর্ষি এবং স্বায়ম্ভূয়াদি ১৪ জন মনু হইতে জগৎ সৃষ্টি হইয়াছে ইহা হিন্দুগণ স্বীকার করিলেও কোন খৃষ্টান বা মুসলমান “ঋষিগণ হইতে জগৎ সৃষ্টি হইয়াছে” বলিয়া স্বীকার করে না । এক্ষেত্রেও গীতার ব্যাখ্যা সাম্প্রদায়িকতাতে পর্যবসিত হয় ।
১০ অধ্যায়, ২৮ ও ২৯ শ্লোক —
“সর্পাণাং অস্মি বাসুকিঃ” —
আমি সর্পগণের মধ্যে বাসুকি সাপ ।( মধুসুধন সরস্বতী ভাষ্য)।
“অনন্তশ্চাস্মি নাগাণাং”—
নাগগণের মধ্যে আমি অনন্ত নাগ। (মধুসুধন সরস্বতী ভাষ্য)।
ভাবপ্রকাশ— বিভুতি যোগে সর্বত্রই একটিকে সর্বাপেক্ষা বড় বলিয়া দেখানো হইয়াছে । যেমন— নরগণের মধ্যে আমি রাজা ; বৃক্ষের মধ্যে আমি অশ্বত্থ বৃক্ষ ; ইত্যাদি । কিন্তু উপরের শ্লোক দুইটিতে সর্পের মধ্যে দুইটি সাপকে বড় কিরূপে দেখানো যাইতে পারে ? সর্বাপেক্ষা বড় একটিই হয়—দুইটি সর্প একই সমান বড় হইতে পারে না । সর্প ও নাগ একই জাতীয় প্রাণী । শ্লোকের ব্যাখ্যা হওয়া উচিৎঃ — ‘নাগাণাং’ অর্থ নাগগণের মধ্যে । ন+গ = নাগ —যাহা একস্থান হইতে অন্যস্থানে গমন করে না অর্থাৎ অনন্ত আকাশ । ঘটাকাশ, মঠাকাশ, গৃহাকাশ প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আকাশের মধ্যে আমি মহাকাশ ।
অখণ্ড আকাশের নাম অনন্ত নাগ।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-৯/৩২ শ্লোকঃ
মাং হি পার্থ ব্যপাশ্রিত্য যেপি স্যুঃ পাপযোনয়ঃ৷
স্ত্রিয়ো বৈশ্যাস্তথা শূদ্রাস্তেপি যান্তি পরাং গতিম্৷৷
পদার্থঃ- হে পার্থ ! (হি) নিশ্চয় (মাম্ ) আমাকে (ব্যপাশ্রিত্য) আশ্রয় করে (যে) যারা (স্যুঃ, স্ত্রিয়ঃ, অপি বৈশ্যাঃ, তথা শূদ্রাঃ) তারা স্ত্রী হোক ও বৈশ্য হোক অথবা শূদ্র হোক তথা (পাপযোনয়ঃ) পাপের ফলে প্রাপ্ত জন্মগ্রহণকারী [হোক] (তে অপি) তারাও (পরাম্, গতিম্, যান্তি) পরম গতি প্রাপ্ত হয়। (মধুসুধন সরস্বতী ভাষ্য)
অনুবাদঃ- হে পৃথানন্দন ! যারা আমাকে আশ্রয় করে, তারা স্ত্রী হোক ও বৈশ্য হোক অথবা শূদ্র হোক তথা পাপের ফলে প্রাপ্ত জন্মগ্রহণকারী হোক তারাও পরম গতি প্রাপ্ত হয়।
ভাষ্যঃ- উক্ত শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যে, পূর্ব প্রারম্ভ কর্ম দ্বারা প্রাপ্ত জন্মগ্রহণকারী হোক বা স্ত্রী হোক, বা বৈশ্য কিংবা শূদ্র হোক সেও পরমাত্মপরায়ণ হওয়ার দ্বারা শুদ্ধ হয়ে যায় এবং পরম গতি প্রাপ্ত হয়।
এই শ্লোকে প্রায় টিকাকার - স্ত্রী, বৈশ্য, শূদ্রকে জন্ম দ্বারাই দুষ্ট মেনেছেন, কিন্তু উক্ত শ্লোকের ভাব এমন নয়।
তজাত্যাব্রাহ্মণশ্রাত্রক্ষত্রিয়োবৈশ্যএবন।
নশূদ্রোনর্চবম্লেচ্ছোভেদিতাগুণকর্মভিঃ। (শুক্রনীতি - ১/৪/৩৮)
অনুবাদঃ- এই জগতে জন্মদ্বারা ব্রাহ্মণ - ক্ষত্রিয় - বৈশ্য - শূদ্র - ম্লেচ্ছ হয় না, কিন্তু গুণ এবং কর্মভেদে হয়।
গীতা-৪/১৩
চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।
তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম্।।১৩।।
গীতা ১৮/৪১
ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়বিশাং শূদ্রাণাং চ পরন্তপ।
কর্মাণি প্রবিভক্তানি স্বভাবপ্রভবৈর্গুণৈ।।৪১।।
শ্লোকেই বলা হয়েছে যে কর্মানুযায়ী বৈশ্য, শূদ্র বর্ণ নির্ধারণ হয়েছে।
১১ অধ্যায়, ১৫ শ্লোক —
পশ্যমি দেবাংস্তবদেবদেহে সর্বাংস্তথা ভুতবিশেষসঙ্ঘান্। ব্রহ্মাণমীশং কমলাসনস্থং ঋষিংশ্চ সর্বানুরগাংশ্চ দিব্যান্।।
অনুবাদঃ — হে দেব, তোমার দেহে আমি সমস্ত দেবগণ, স্থাবর জঙ্গমাত্মক বিবিধ সৃষ্ট পদার্থ, সৃষ্টিকর্তা কমলাসনস্থ ব্রহ্মা নারদ সনকাদি দিব্য ঋষিগণ এবং অনন্ত-তক্ষকাদি সর্পগণকে দেখিতেছি । (জগদীশ ঘোষের গাতাভাষ্য)
অর্জুন ভগবানের দেহার মধ্যে তেত্রিশ কোটি দেবগণকে দেখিতে পাইতেছিলেন । দেবগণকে অর্জুন পূর্বেই যেন দেখিয়াছিলেন। তাই দাখিয়াই চিনিতে পারিলেন যে, ইহাঁরাই দেবতা । তেত্রিশকোটি বা তাহারাও অধিক দেবগণকে একস্থানে সমাবেশ অর্জুনের চক্ষে সর্ষপের চেয়েও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রূপে দৃষ্টিগোচর হইতেছিল মনে হয় । কারণ মানবিক মূর্তিতে ভগবান অর্জুনের সম্মুখে দণ্ডায়মান থাকিলে তাঁহার দেহের মধ্যেই অর্জুন দেবগণকে, পৃথিবীস্থ সকল জীবজন্তু, বৃক্ষলতাদি সকলকেই দেখিতে পাইতেছিলেন । বিশ্বের যেকোন স্থানে, যেকোন জীবজন্তু বা বৃক্ষলতা আছে সকলই অর্জুনের পূর্ব হইতে জানা ছিল! তাই তাহাদিগকে দেখিয়াই চিনিতে পারিলেন । দেহধারী শ্রীকৃষ্ণরূপ ভগবানের দেহে অর্জুন আরও যাহাদিগকে দেখিতে পাইয়াছিলেন তাহারা হইতেছেন —সকলের সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, নারদ-সনকাদি ঋষিগণ এবং অনন্তনাগ, তক্ষক প্রভৃতি সর্পগণ বলিতে তাহাদের সন্তানসন্ততিও বুঝিতে হইবে । অর্জুনের যেন সকলেই পূর্ব -পরিচিত, তাই তাহাদের দেখিবামাত্রই চিনিতে পারিয়াছিলেন.।
ভাবপ্রকাশ — ভগবানের কখনও মানবিক দেহ হয় না। তিনি সচ্চিদানন্দ। তাঁহার জ্ঞানময় দেহ বা বোধের মধ্যেই স্থাবর জঙ্গমাত্মক বিশ্ব সৃষ্ট হইতেছে, বাঁচিয়া আছে, আবার সমস্ত কর্মের অবসানে লীন প্রাপ্ত হইতেছে । তাই অর্জুন ভগবানকে ‘দেবদেহ’ বলিয়া সম্বোধন করিলেন । দেব অর্থ দ্যুতিশীল বা প্রকাশময় । ভগবান স্বপ্রকাশ বলিয়া তাঁহার প্রকাশের মধ্যেই এবং প্রকাশের দ্বারাই সবকিছু দৃষ্টিগোচর হইতেছে । এ যেন গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজা । বিশেষ বিশেষ ভূতগন ভগবানের দিব্যদেহেই মনের দ্বারা প্রকাশ পাইতেছে । ইহারা সকলেই বিশ্বের স্থূল রূপ । অর্জুন এই স্থূল রূপের মধ্যেই মনোনেত্রে দেখিতে পাইতেছেন —
“ব্রহ্মাণমীশং” — রজোগুণরূপী সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, যাহাদ্বারা স্থূল রূপের দর্শন হইতেছে এবং তমোগুণ যাহাদ্বারা ধ্বংস হইতেছে । বিশ্বের সর্বত্রই রজঃ ও তমোগুণের খেলা ।
ঈশ অর্থ সংহার কর্তা বা তমোগুণ ।
“কমলাসনস্থং”— হৃদ্কমলে (হৃদয়ে) অবস্থিত। অর্জুন বোধহয় সকল জীবের মধ্যেই রজঃ ও তমঃ —এই গুণদ্বয়কে দেখিতে পাইলেন । সত্ত্বগুণে সৃষ্টি ও সংহার থাকে না বলিয়া এখানে সত্ত্বগুণের উল্লেখ হয় নাই ।
“ঋষিংশ্চ সর্বান্”— সকল ঋষিগণকে । যাহারা সত্যদ্রষ্টা তাহাদিগকে ঋষি বলে । পঞ্চ মহাভূত, পঞ্চ তন্মাত্রা এবং সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ নামক তিনটি গুণ —ইহারা যখন কাহারও সহিত মিশ্রিত না হইয়া স্ব -স্ব ভাবে অবস্থান করে, তখন তাহারা ভগবানের নিকটে অবস্থান করিয়া ঋষি আখ্যায় ভূষিত হয় । “প্রকৃতি পুরুষঞ্চৈব বিদ্যানাদী উভাবপি” (গীতা -১৩/১৯) - প্রকৃতি ও পুরুষকে অনাদি বলিয়া জানিও । জগৎসৃষ্টির যাহারা উপাদান কারণ, সকলেই প্রকৃতি ।
“উরগাংশ্চ দিব্যান্”— দিব্য উরগগণকে । উরগ অর্থ সর্পও বুঝায় । কিন্তু এখানে “বক্ষসি বিচরিত ইতি উরগঃ”— যাহারা বক্ষে বিচরণ করে অর্থাৎ শিরা-উপশিরা যাহার সর্পের মত বক্রগতি বিশিষ্ট, সকলেই উরগ । ইহারা উরগের স্থূল রূপ । মনের কামনা-বাসনা উরগের সূক্ষ্ম রূপ । ইহারা সকলেই দিব্য —প্রকাশময় । মন হইতে উত্থিত কোন বাসনাই অপ্রকাশ থাকে না । অপরের নিকট প্রকাশিত না হইলেও নিজের নিকট গুপ্ত থাকে না ।
১১ অধ্যায়, ২৫ শ্লোক—
দ্রষ্টা করলানি চ তে মুখানি দৃষ্টেব কালানলসন্নিভানি । দিশো ন জানে ন লভে চ শর্ম প্রসীদ দেবেশ জগন্নিবাস ।।
অনুবাদঃ — বৃহৎ দণ্ডসমূহের দ্বারা ভয়ানক দর্শন, প্রলয়াগ্নি সদৃশ তোমার মুখসকল দর্শন করিয়া আমার দৃষ্টিভ্রম ঘটিতেছে (আমি দিশেহারা হইয়াছি), আমি অসস্তিতে পাইতেছি না । হে দেবেশ, হে জগন্নিবাস, প্রসন্ন হও (আমার ভয় দূর কর) ।
(জগদীশ ঘোষের গীতাভাষ্য।)
বিশ্লেষণ— ভগবানের দাঁতগুলি কি লাঙ্গলের মত বিশালাকায় ছিল ? তাঁহার মুখের মধ্যদিয়া কি প্রলয়াগ্নি নির্গত হইতেছিল ? ভগবানের রূপ দেখিবার জন্য বিশ্বের সকলেই লালায়ীত ; মুনিঋষিগণ সমস্ত প্রকারের দুঃখকষ্ট সহ্য করিয়াও যেই রূপ দেখিবার জন্য উৎকন্ঠিত হইয়া থাকেন, অর্জুনের সেই রূপ দেখিয়া ভয় পাইবার কারণ কি ? তবে কি ভগবান যাদুবিদ্যা প্রভাবে অর্জুনকে ভয় দেখাইয়াছিলেন ? সকল প্রাণীরই একটি মাত্র মুখ থাকে ; ভগবানের অনেক মুখের মধ্য হইতে অগ্নি নির্গত হইতে দেখা যাইতেছিল কেন ? তবে কি ভগবানের সর্বশরীরে মুখ ছিল ?
ভাবপ্রকাশ— ভগবান অশরীরী অবস্থায় সমস্ত বিশ্বে ব্যাপ্ত হইয়া রহিয়াছেন, তাই তিনি সর্বব্যপী । তাঁহার এই নিরাকার ও বোধময় শরীরের অধিষ্ঠানেই মহামারী, মহাপ্লাবন, দূর্ভিক্ষ, যক্ষ্মা, হাঁপানী প্রভৃতি দুরারোগ্য ব্যাধিরূপ প্রাকৃতিক ক্রিয়া সকল সংঘটিত হইতেছে । ভগবান অর্জুনকে জ্ঞানের দ্বারা প্রবোধিত করিলে অর্জুন স্বীয় জ্ঞাননেত্র একে একে বিশ্বের স্থূল-সূক্ষ্ম যাবতীয় বিভাবই দেখিতে পাইলেন বা বুঝিতে পারিলেন । অর্জুন বুঝিলেন — সকল জীব যেমন এইসব দৈব দুর্বিপাকের মধ্যে পড়িয়া মেঘের মত ছিন্নভিন্ন হইয়া যায়, তাহার যে এরূপ হইবে না তাহাতে আর আশ্চর্য কি ? তাই অর্জুন ভগবানের নিকট প্রার্থনা জানাইতেছেন, —হে ভগবান, তুমি আমার নিকট হইতে প্রকৃতির রূপ সরাইয়া লও ; আমার দেহগত ও মনোগত ভাব দূর করিয়া তোমার চিন্ময়তত্ত্বে আমাকে স্থিতিলাভ করাও । তবেই আমি পরম শান্তি লাভ করিতে পারিব। এই জগৎ “দুঃখং দুঃখং কষ্টং কষ্টং”।
(বুদ্ধদেবের বাণী)
১১ অধ্যায়, ২৯ শ্লোক —
বক্ত্রাণি তে ত্বরমানা বিশ্বন্তি দ্রংষ্টা করালানি ভয়নকানি ।
কেদিদ্বিলগ্না দশনান্তরেষু সংদৃশ্যন্তে চুর্নিতৈরুত্তমাঙ্গৈঃ ।।
অনুবাদঃ — কেহ কেহ বিচুর্ণমস্তক হইয়া তোমার বিশাল দন্তের সন্ধিস্থলে সংলগ্ন হইয়া রহিয়াছে দেখিতেছি ।
(মধুসুদন সরস্বতী গীতাভাষ্য)
বিশ্লেষণ— ভগবান কি যাদুবিদ্যা প্রভাবে রাক্ষসের রূপ ধরিয়া অজগর সর্পের মত বিশাল মুখ ব্যাদান করিয়া রহিয়াছেন ? তাই অর্জুন দেখিতে পাইতেছেন, সমস্ত জীব তাঁহার ভয়ঙ্কর ও বিরাট মুখ গহবরে প্রবেশ করিতেছে মৃত্যুর জন্য । কেহ কেহ মুখ গহ্বরে প্রবেশ করিতে যাহয়া ভগবানের বিশাল দন্তের ফাঁকের মধ্যে আটকাইয়া গিয়াছে । তাহাদের শরীরের অর্দ্ধেক ভগবানের মুখের ভিতরে এবং অপরার্দ্ধ বাহিরে দৃষ্টিগোচর হইতেছে ।
ভাবপ্রকাশ — নিরাকার সচ্চিদানন্দ ভগবানের মুখগহ্বরে বিরাট বিরাট দাঁত থাকা সম্ভব নহে । অখণ্ড ভগবানের চিন্ময় দেহের মধ্যেই জীবগণের মৃত্যু হইতেছে —তাহারা কালের গ্রাসে পতিত হইতেছে । কতজীব দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হইয়া মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করিতেছে । মনে হইতেছে যেন তাহাদের জীবনের অর্দ্ধেক এখনও কোনও প্রকারে বাঁচিয়া আছে । দৈবদুর্বিপাক এবং দুরারোগ্য রোগশোক সমূহকেই ভগবানের দাঁতরূপে কবি কল্পনা করিয়াছেন ।
১৫ অধ্যায়, ১৩ শ্লোক —
গাম্ আবিশ্য চ ভূতানি ধারয়াম্যহমোজসা ।
পুষ্ণামি চৌষধিঃ সর্বাঃ সোমোভূত্বা রসাত্মকঃ ।।
অনুবাদঃ — আমি পৃথিবীতে অনুপ্রবিষ্ট হইয়া স্বকীয় বলের দ্বারা ভূতগণকে ধারণ করিয়া আছি। আমি অমৃত রসযুক্ত চন্দ্ররূপ ধারণ করিয়া ব্রীহি যবাদি ঔষধিগণকে পরিপুষ্ট করিয়া থাকি ।
(জগদীশ ঘোষের গীতাভাষ্য)
ভাবপ্রকাশ — ‘গাম’ অর্থ সূর্যকে এবং পৃথিবীকে দুই হয় । গো ধাতুর ২য়ার একবচন গাং । যেহেতু পূর্বের শ্লোকে সূর্য, চন্দ্র ও অগ্নির কথা বলা হইয়াছে, সুতরাং এখনে গাং অর্থে ‘সূর্যকে’ হওয়াই বাঞ্জনীয় । কারণ সূর্য ব্যতীত পৃথিবীদ্বারা কোন প্রাণী বাঁচিতে পারে না । একটি অঙ্কুরকে যদি ঢাকিয়া সূর্যালোক প্রবেশ বন্ধ করিয়া দেওয়া হয় তবে অচিরেই সেই নবজাত অঙ্কুরটি মরিয়া যায়। একটি লতাকে ছায়ার মধ্যে রাখিলে সে সূর্যালোকের দিকেই মস্তক বাড়াইয়া দিতে চায়।
এইসব দিক বিচার করিয়া গীতার ব্যখ্যা যাহাতে যথাযথ হয়, যাহাতে পাঠকগণ ভুলপথে পরিচালিত না হয়, সেইদিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখিয়া গীতার ব্যাখ্যা করা উচিৎ.। একটি লোককে ভুলপথের নির্দেশ দেওয়া মানে তাহার জীবনটিকে নষ্ট করিয়া দেওয়া ।
কৃষ্ণের গুরু ছিলেন সন্দিপন মুনি ও ঘোর অঙ্গিরস। যুদ্ধের ৩৫ বছর পর দেহত্যাগ করেন কৃষ্ণ। তখন থেকেই কলিযুগের সূচনা মনে করা হয়। মৃত্যুকালে কৃষ্ণের বয়স ছিল ১১৯ বছর। আর্যভট্টের গণনা অনুযায়ী ৫১৫৪ বছর আগে অর্জুনকে জ্ঞান দিয়েছিলেন কৃষ্ণ। হরিয়ানার কুরুক্ষেত্রে যখন এই জ্ঞান দেওয়া হয়েছিল, তখন একাদশী তিথি ছিল। দিনটি ছিল সম্ভবত রবিবার। আনুমানিক ১৫ মিনিট পর্যন্ত এই জ্ঞান দিয়েছিলেন তিনি। ইসকনের মত অনুযায়ী গীতায় কৃষ্ণ ৫৭৪, অর্জুন ৮৫, সঞ্জয় ৪০ ও ধৃতরাষ্ট্র ১টি শ্লোক বলেছিলেন।
কলি যুগের ধর্মই "হরে কৃষ্ণ..." #মহামন্ত্র জপ সমীক্ষা।।
হরে কৃষ্ণ নামক কোন কিছুই গীতা, উপনিষদ, মনুসংহিতা, বেদান্ত, বেদ ইত্যাদি কোন বৈদিক সনাতন শাস্ত্রেই নেই। সকলের মনে রাখা উচিত-
"ধর্ম অধর্ম তথা কর্তব্য কর্ম নির্ধারণে শাস্ত্রই তোমার একমাত্র প্রমাণ। তাই এই সংসারে শাস্ত্র বিধান উক্ত কর্ম করা উচিত।" গীতা ১৬।২৪
.
গীতাতে বলা আছে-
"যজ্ঞ, দান ও তপস্যারূপ কর্ম ত্যাগ করা উচিত নয়-এই সকল করাই উচিত। যজ্ঞ, দান, তপঃ কর্ম মনীষীদের চিত্তশুদ্ধিকর।" গীতা ১৮।৫.
"নিত্য কর্মের ত্যাগ যুক্তিযুক্ত নয়, মোহবশত নিত্যকর্মের ত্যাগকে তামস ত্যাগ বলে।" গীতা ১৮।৭.
.
অর্থাৎ সকল যুগেই ঐ সকল কর্ম করা উচিত। আর যারা তা ত্যাগ করে তাদেরকে তামসিক বলে। এরপরও যারা কুতর্ক করবেন তারা দয়া করে মহর্ষি মনু মহারাজ রচিত মনুসংহিতাটা একটু খুলে দেখুন, মিলিয়ে নিন কষ্ট করে। দেখুন মহর্ষি মনু কলি যুগের প্রধান ধর্ম কি বলেছেন-
.
"তপঃ পরং কৃতযুগে ত্রেতায়াং জ্ঞানমুচ্যতে।
দ্বাপরে যজ্ঞমেবাহুর্দানমেকং কলৌ যুগে।।"
মনুসংহিতা ১।৮৬.
অনুবাদ~ সত্যযুগে তপস্যাই মানুষের শ্রেষ্ঠ ধর্ম, ত্রেতাযুগে জ্ঞানই শ্রেষ্ঠ, দ্বাপর যুগে যজ্ঞ এবং কলিতে একমাত্র দানই শ্রেষ্ঠ।
.
এখন প্রশ্ন হতে পার এই দান কি? এর উত্তরও পরিষ্কার, দান অনেক প্রকারের হয়। তবে সকল দানের মধ্যে একটা দান আছে যা সর্বশ্রেষ্ঠ। দেখুন মনুসংহিতা থেকেই-
"জল, অন্ন, গরু, ভূমি, বস্ত্র, তিল, সোনা এবং ঘি-এই সব দানের তুলনায় ব্রহ্মদান অর্থাৎ বেদের অধ্যাপনা ও তার ব্যাখ্যা সর্বোৎকৃষ্ট ফলপ্রদ এবং সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।।"
মনুসংহিতা৪।২৩৩.
.
এখন দেখলেন তো কলি যুগেরও যে প্রধান ধর্ম বেদ জ্ঞান দান? কারণ এক মাত্র বেদ জ্ঞান দানের মাধ্যমেই জগতে প্রকৃত সুখ শান্তি বিস্তার লাভ করতে পারে, আবার মুক্তি লাভ তথা ঈশ্বর প্রাপ্তিও সম্ভব। কারণ বেদেই জীবের জন্য সম্পূর্ণ জীবন বিধান দেওয়া আছে।
এখন প্রশ্ন হতে পারে এগুলো কি বেদ থেকেই আগত?
উত্তরও খুব পরিষ্কার, এগুলো বেদ থেকেই আগত এবং তা মহর্ষি মনু মহারাজই বলেছেন। দেখুন তার প্রমাণ-
"চাতুর্বর্ণ্যং ত্রয়ো লোকাশ্চত্বারশ্চশ্রমঃ পৃথক্।
ভূতংভবদ্ভবিষ্যঞ্চ সর্বং বেদাৎ প্রসিদ্ধ্যতি।।"
মনুসংহিতা ১২/৯৭.
অনুবাদ- চারটি বর্ণ, তিন লোক, পৃথক পৃথক চারটি আশ্রম এবং ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান-এগুলো একমাত্র বেদ থেকেই প্রচারিত হয়।
.
আর এই সব তথাকথিত "হরে কৃষ্ণ..." মহামন্ত্র কালের গর্বে হারিয়ে যাবে কারণ এগুলো বেদ থেকে প্রচারিত হয়নি। তাইতো মনু বলেছেন-
"এই বেদ ছাড়া আর যত শাস্ত্র আছে(ভাগবত, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান, চৈতন্যচরিতামৃত ইত্যাদি) সেগুলো কালক্রমে উৎপন্ন হয় এবং বিনাশও প্রাপ্ত হয়। সেগুলো সব অর্বাচীনকালীন, এজন্য সেগুলো সব নিষ্ফল ও মিথ্যা।"
মনুসংহিতা ১২/৯৬.
.
তারপরও যারা বলবেন যে কলি যুগে এক মাত্র মহামন্ত্র হরে কৃষ্ণ, তারা প্রকৃত পক্ষে সনাতন ধর্ম অবলম্বিই নয়। কারণ তারা তো গীতাটাই মানে না, বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ তো পরের কথা! তাছাড়া বেদে ব্যতীত অন্য যে কোন গ্রন্থের বাণীগুলোকে শ্লোক বলে, শুধুমাত্র বেদের ক্ষেত্রেই মন্ত্র বলা হয়। দেখুন গীতাতেই মহামন্ত্র কাকে বলেছে-
"গায়ত্রী ছন্দসামহম্ অর্থাৎ ছন্দ (মন্ত্র) সমূহের মধ্যে আমিই (পরমাত্মা) গায়ত্রী।" গীতা ১০।৩৫.
অর্থাৎ গায়ত্রী মন্ত্রই একমাত্র মহামন্ত্র।
.
অনেকে বলে কলি যুগে নাকি সত্য যুগের মত মানুষের আয়ু নেই, সত্য যুগে নাকি হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ বছর বেশী বাঁচতো মানুষ। তাই কলি শুধু নাম জপ করলেই নাকি মানুষ মুক্তি লাভ করবে?
.
যে আপনাকে এই ধরণের কথা বলেছে তার বেদ বাণী সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই। কারণ, বেদ বলছে অন্য কথা! দেখুন বেদে কি বলা আছে-
.
"ওম্ তচ্চক্ষুর্দেবহিতমং পরস্তাচ্ছুক্রুমুচ্চরৎ।
পশ্যেম শরদঃ শতং জীবেম শরদ শতং শৃণুয়াম শরদঃ শতং প্র ব্রবাম শরদঃ শতমদীনাঃ স্যাম শরদঃ শতং ভুয়শ্চ শরদঃ শতাৎ।।
যজুর্বেদ ৩৬/২৪.
ভাবার্থ- সেই পরমাত্মা সর্বদ্রষ্টা, উপাসকদের হিতকারী ও পবিত্র। সৃষ্টির পূর্ব হতেই তিনি সর্বব্যাপকরূপে বর্তমান আছেন। শতবর্ষ কাল তার কৃপায় আমরা দেখিব। শতবর্ষ কাল আমরা জীবিত থাকিব, শতবর্ষ কাল আমরা শ্রবণ করিব, শতবর্ষ কাল আমরা বলিব। শতবর্ষ কাল স্বাধীন থাকিব এবং শতবর্ষরেরও অধিক কাল এইরূপ থাকিব।
" ত্র্যায়ুষং জমদগ্নেঃ কশ্যপস্য ত্র্যায়ুষম্।
য়দ্দেবেষু ত্র্যায়ুষং তন্নো অস্তু ত্র্যায়ুষম্।।"
যজুর্বেদ ৩/৬২.
ভাবার্থ- হে পরমেশ্বর! আপনার অনুগ্রহে যেন আমার প্রাণাদি অন্তঃকরণ ও চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয় সকল তিন শত বর্ষ পর্যন্ত সুস্থ ও বলবান থাকে। যেরূপ বিদ্বান মনুষ্যদিগের মধ্যে বিদ্যাদি শুভগুন ও আনন্দ বর্তমান থাকে ও ত্রিগুণ আয়ুর বৃদ্ধি হয়, তদরূপ আমাদিগের মধ্যেও হোক। পুনরায় (ত্র্যায়ুষং জমদগ্নেঃ) এই উপদেশ দ্বারা এটাও বুঝা যায় যে, মনুষ্য ব্রহ্মচর্যাদি শুভ নিয়ম প্রতিপালন করলে আয়ুকে ত্রিগুণ ও চর্তুরগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করিতে সমর্থ হন।
যেখানে বেদে বলা আছে ব্রহ্মচার্য নিয়ম পালন করলেও সকল যুগেই সর্বোচ্চ ৩-৪শত বছর বাঁচতে পারে, যেখানে সত্য যুগে হাজার হাজার ও লক্ষ লক্ষ বছর বাঁচার কথা অবান্তর।
নাম যজ্ঞ করা কি ঠিক?
নাম যজ্ঞ করা কি ঠিক? হোম যজ্ঞের কথা শাস্ত্রের সর্বত্রই আছে জানি, কিন্তু বর্তমানে নামযজ্ঞ নিয়ে অনেক কথা কাটাকাটি হচ্ছে, প্রকৃত পক্ষে সত্যিটা কি?
উত্তর- দুটোই ঠিক, কোনটাই ভুল নয়। তবে সমস্যা হল এটাই যে অনেকে শাস্ত্র মেনে করে না এগুলো। এখানেই যত গন্ডোগোল! প্রথমে যজ্ঞ কি তা একটু শাস্ত্র থেকে বলি-
"যজ্ঞেন_যজ্ঞময়জন্ত_দেবাস্তানি_ধর্মাণি_প্রথমান্যসন্।
তে_হ_নাকং_মহিমানঃ_সচন্ত_য়ত্র_পূর্বে_সাধ্যাঃ_সন্তিদেবাঃ।।
ঋগবেদ ১০/৯০/১৬.
অর্থাৎ সত্য নিষ্ঠ বিদ্বানেরা যজ্ঞের দ্বারাই পরমেশ্বরের পূজা করেন। যজ্ঞে সব শ্রেষ্ঠ ধর্মের সমাবেশ হয়। মহান ব্যক্তিরা যজ্ঞ দ্বারা ভগবানের পূজা করে দুঃখরহিত হয়ে মোক্ষ লাভ করেন। সাধন সাধন সম্পন্ন ও জ্ঞান সম্পন্ন বিদ্বানেরা যেখানে পূর্ব হতেই বাস করছেন।
এই সবই উপরোক্ত মন্ত্রের উল্লেখ যোগ্য বিষয়। এখানে বুঝতে হবে যে 'যজ্ঞ' শব্দ 'যজ্' ধাতু থেকে তৈরি হয়েছে। যার তিনটি অর্থ ধাতু পাঠে বর্ণিত আছে- ১.দেবপূজা, ২.সংগতিকরণ ৩.দান। এর মধ্যেই আমাদের সকল কর্তব্য নিহিত আছে। এই জন্য শতপথ_ব্রাহ্মণ ১/৭/৩/৫. এ বলা আছে- "যজ্ঞো_বৈ_শ্রেষ্ঠতমং_কর্ম।" আবার তৈত্তিরীয়_সংহিতা ৩/২/১/৪. নং এ আছে- "যজ্ঞো_হি_শ্রেষ্ঠতমং_কর্ম। এই সব ক্ষেত্রে যজ্ঞকে শ্রেষ্ঠতম কর্ম বলে অভিহিত করা হয়েছে, গীতাতেও এরূপই বলা আছে। আর যারা যজ্ঞ করে না তাদের কি দুর্গতি ও অধপতন হয় তা দেখুন-
"ন_য়ে_শেকুর্য়াজ্ঞিয়াং_নাবমারুহম্_ইর্মেব তে_ন্যবিশন্ত_কেপয়ঃ।"
ঋগবেদ ১০/৪৪/৬. অথর্ববেদ ২০/৯৪/৬.
অর্থাৎ যে ব্যক্তিরা যজ্ঞময়ি নৌকায় আরোহন করতে সক্ষম হয় না, তারা কুৎসিৎ অপবিত্র আচরণকারী হয়ে এই লোকেই ক্রমশঃ অধপতিত হতে থাকে।
যজ্ঞ আবার ৫ প্রকার, মহর্ষি মনু মহারাজ মনুসংহিতা ২/২৮ নং শ্লোকে বলেছেন-
"মহায়জ্ঞৈশ্চ য়জ্ঞৈশ্চ ব্রাহ্মীয়ং ক্রিয়তে তনুঃ।
অর্থাৎ পঞ্চমহাযজ্ঞ ও সোমযজ্ঞের অনুষ্ঠানে দ্বারা মানুষ ব্রহ্ম প্রাপ্তির যোগ্য হয়ে যায়।
এই পঞ্চমহা যজ্ঞ হল- ব্রহ্মযজ্ঞ দেবযজ্ঞ পিতৃযজ্ঞ অতিথিযজ্ঞ বলিবৈশ্যদেবযজ্ঞ। যেহেতু প্রশ্নের আলোচ্য বিষয় হল নাম যজ্ঞ, তাই আলোচনা অন্যদিকে না নিয়ে শুধু নাম যজ্ঞ নিয়েই করছি। প্রকৃত পক্ষে নাম_যজ্ঞ ব্রহ্মযজ্ঞ এর অন্তর্গত, প্রশ্ন হতে পারে এটা আবার কিরূপ? তাই এই ব্যাপারে একটু বিস্তারি লিখা দরকার বলে মনে করি।
ব্রহ্মযজ্ঞের দুইটি ভাগ- ১.সন্ধ্যা-উপাসনা, প্রাতকালীন ও সায়ংকালীন ঈশ্বর_স্তুতি, প্রার্থনা ও উপাসনা করা। ২.স্বাধ্যায় করা। প্রথম ভাগে বর্ণিত ঈশ্বর স্তুতির মধ্যেই মূলত সেই নামযজ্ঞ বিদ্যমান! হোম যজ্ঞের ব্যাপারে বেদ উপনিষদ গীতা ইত্যাদি সকল শাস্ত্রেই বলা আছে স্পষ্ট ভাবে, তা আপনিও জানেন। নাম যজ্ঞের ব্যাপারে খুব স্পষ্ট ভাবে বলা নেই, তাই এই ব্যাপারটাই তুলে ধরছি এখানে।
প্রশ্ন হল ঈশ্বরের স্তুতি বা নাম স্মরণ করলে কি হয়? উত্তরও খুব পরিষ্কার, ঈশ্বরের স্তুতি বা নামের স্মরণ দ্বারা ঈশ্বরের প্রতি প্রীতি জম্মে। ওনার গুণ, কর্ম ও স্বভাব দ্বারা নিজের গুণ, কর্ম ও স্বভাবের সংশোধন হয়। যেমন কিনা বলা চলে পরমেশ্বরের একটা নাম তৈজস। কেহ যদি ইচ্চা করে ওনাকে এই নামে স্মরণ করতে পারে এবং নিজের মধ্যে তেজ স্থাপন করতে পারে। একটু বেদ মন্ত্রের মাধ্যমে ওনার স্তুতি করছি-
"তেজোহসি তেজো ময়ি দেহি অর্থাৎ হে তেজস্বী! আমাতে তেজ স্থাপন করুন।" যজুর্বেদ ১৯/৯.
এইরূপ পরমেশ্বরের অনন্ত নাম যথা- ব্রহ্ম, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, রুদ্র, গণেশ, দেব, দেবী, বুদ্ধ, শ্রী, লক্ষী, সরস্বতী, দয়াল, অদ্বৈত, যম, শংকর, মহাদেব, বিশ্বকর্মা, অগ্নি, মনু, প্রজাপতি, প্রাণ, ইন্দ্র, ঈশ্বর, পরমাত্মা, সত্য, মিত্র... ইত্যাদি স্মরণ হতে পরে, আর একেই নাম যজ্ঞ বলে। তবে পরমেশ্বরের অনন্ত নামের মধ্যেও একটি নাম আছে যার স্মরণের কথা সর্ব শাস্ত্রেই বর্ণিত আছে। আর তা হল "ওম্", বেদ মন্ত্র থেকেই দেখি-
"ওমিত্যেতদক্ষরমুদ্গীথমুপাসতি।
ছান্দোগ্যোপনিষদ্ ১/১/১.
অর্থাৎ "ওম্" এই অক্ষরকে (যিনি কখনো বিনষ্ট হন না) উপাসনা করিবে, কারণ "ওম্" এই শব্দ হতে আরম্ভ করে উদগীথ গান করেন।
"ওম্ বায়ুরনিলমমৃতমথেদং ভস্মান্তং শরীরম্।
ওম্ ক্রতো স্মর কৃতং স্মর ক্রতো স্মর কৃতং স্মর।।" যজুর্বেদ ৪০/১৫
ভাবার্থ- হে কর্মশীল জীব! শরীর পৃথক হওয়ার সময় তুমি "ওম্" এর স্মরণ কর, নিজ সামথ্যের জন্য ওম্ স্মরণ কর, কৃত কর্মকে স্মরণ কর, ধনঞ্জয়াদি বায়ু নিজ কারণরূপে পরিণত হতেই এই শরীর ভস্ম হয়ে যায়।
আপনি যেহেতু প্রশ্ন করেছেন গীতার উপর, তাই সেখান থেকেই এখন নাম স্মরণের ব্যাপারে তুলে ধরছি। প্রশ্ন থেকে যায় যে- 'আমরা কি নাম স্মরণ করবো?' পূর্বে বলেছি পরমেশ্বরের গুণ, কর্ম ও স্বভাব যেহেতু অনন্ত, সেহেতু ওনার নামও অনন্ত। যদিও পূর্বে বেদ থেকে দেখিয়েছি, তারপরও একটা কথা থেকে যায় যে, গীতা এই ব্যাপারে কি বলে? তাও একটু দেখে নেওয়া যাক! আমরা সকলেই জানি অর্জুন ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের সখা, বন্ধু তথা সবচেয়ে প্রিয়পাত্র। আর সেই অর্জুনই কিন্তু নাম স্মরণের ব্যাপারে মূল প্রশ্নটা তুলে দিয়েছেন গীতাতে! দেখে নেওয়া যাক সেটি কি-
"আপনার এরূপ মহিমা না জেনে প্রমাদবশত, কখনো বা ভালোবেসে সখা মনে করে আপনাকে হে_কৃষ্ণ, ওহে যাদব, সখা বলে অবিনয়ে সম্বোধন করে যা বলেছি। বিহার শয্যা উপবেশন ও ভোজনকালে একাকী আপনার সাক্ষাতে বা অসাক্ষাতে বা বহুজন সমক্ষে পরিহাসচ্ছলে আপনাকে যে অসম্মান বা অমর্যাদা করেছি, আপনার কাছে তার জন্য আমি ক্ষমা চাইছি। পিতা যেমন পুত্রের, সখা যেমন সখার, প্রিয় যেমন প্রিয়ার অপরাধ ক্ষমা করে, আপনিও সেরূপ আমার অপরাধ ক্ষমা করুন।"
গীতা ১১/৪১,৪২,৪৪.
এর থেকে বুঝা যায় যে যেন তেন নাম স্মরণ (হরে কৃষ্ণ এর মত) করলেই নাম যজ্ঞ হয়ে যাবে না, কারণ প্রত্যকটা ব্যাপারেরই একটা বিধি নিষেধ আছে। তাই তো শ্রীভগবান গীতায় বলেছেন-
"কর্তব্য অকর্তব্য নির্ধারণে শাস্ত্রই তোমার একমাত্র প্রমাণ। তাই এই সংসারে শাস্ত্র বিধান উক্ত কর্ম করা উচিত।" গীতা ১৬/২৪.
ক্ষর পুরুষ জন্ম গ্রহণ করে, তার বৃদ্ধি ঘটে এবং একটি সময়ান্তে তার মৃত্যু ঘটে বা বিনাশপ্রাপ্ত হয়। অপরপক্ষে অক্ষর পুরুষ অজ, নিত্য ও শ্বাশত। ইহা জন্ম-মৃত্যুর অতীত, অব্যয়, অদৃশ্যমান, ব্রহ্ম সনাতন।
তাই আমাদের দেখতে হবে যে নাম যজ্ঞের ব্যাপারে শাস্ত্র/গীতা উক্ত বিধান কি। গীতায় শ্রীভগবান এই ব্যাপারে বলেছেন-
"ওম্_এই_এক_অক্ষর_ব্রহ্ম_উচ্চারণ_করে আমাকে অনুস্মরণ করে যিনি দেহ ত্যাগ করেন, তিনি পরম গতি লাভ করেন।" গীতা ৮/১৩.
"যা অব্যক্ত অক্ষর বলে কথিত হয়, তাঁকেই পরম গতি বলে। গীতা ৮/২১.
"আমি এই জগতের পিতা, মাতা, ধাতা, পিতামহ এবং একমাত্র জ্ঞেয়, পবিত্র_ওঙ্কার, আমি ঋক্ সাম যজুর্বেদ।" গীতা ৯/১৭.
"শব্দসমূহের_মধ্যে_আমিই_এক_অক্ষর, যজ্ঞসমূহের_মধ্যে_আমি_জপযজ্ঞ...।" গীতা১০/২৫.
"সামমন্ত্র_সমূহের_মধ্যে_আমি_বৃহৎসাম, গায়ত্রী_ছন্দসামহম্ অর্থাৎ #মন্ত্রের_মধ্যে_আমি_গায়ত্রী।" গীতা ১০/৩৫.
ওঁ_তৎ_সৎ এই নির্দেশ নাম তিনটি ব্রহ্মের, এরূপ বলা আছে। এই নাম দিয়ে পুরাকালে যজ্ঞের কর্তা ব্রাহ্মণ, যজ্ঞের কারণ বেদ ও যজ্ঞররূপ ক্রিয়া নির্মিত হয়েছে। গীতা ১৭/২৩.
.
গীতা থেকে মোট সাতবার দেখা যায় যে, নাম স্মরণের ব্যাপারে শ্রীভগবান "ওম্" জপ করার জন্য বলেছেন, অর্থাৎ আজকাল কিছু কিছু সম্প্রদায় যে নাম যজ্ঞ করে তা তামসিক নাম যজ্ঞ। কারণ সেখানে শাস্ত্রের নির্দেশনা অনুসারে নাম যজ্ঞ হচ্ছে না। বরংচ নিজেদের তৈরি বিধান অনুসারে তথাকথিত নাম যজ্ঞ হচ্ছে, যেখানে অর্জুনও যেন তেন নামে ডাকার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন, যেখানে এরা এই রকম সাহস দেখায় কি করে? তারা বলে ভগবান হল ভক্তির কাঙ্গাল, তাই ভক্ত যে নামেই ডাকুক না কেন কোন সমস্যা নেই। এখন তাদের প্রতি আমার প্রশ্ন-বুঝলাম ভগবান হল ভক্তের কাঙ্গাল। তাই বলে আপনি এক জন ভক্ত হয়ে কেন আপনার প্রিয় ভগবানকে ওনার প্রকৃত নামে ডাকবেন না? যেখানে উনি নিজেই বলেছেন ওনার প্রকৃত নাম কি। ধরুন আপনি আপনার বাবাকে খুব ভালোবাসেন, বাবা আপনাকে শিক্ষা দিয়ে বলছেন যে- খোকা আমাকে তুমি "বাবা" বলে ডেকো। আপনি "বাবা" বলে না ডেকে ওনাকে হাবা, বোবা, গাধা ইত্যাদি নামে ডাকলে কি উনি খুশি হবে? নাকি মনে কষ্ট পাবেন? যদি বলেন যে-'আমরা তো জানি না ভগবানের প্রকৃত নাম কি!' তাদের উদ্দ্যেশে এটাই বলতে চাই-'এখন তো জেনেছেন প্রকৃত নাম কি?' তাহলে এখন থেকেই প্রকৃত নামে ডাকুন। কেন অযথা নিত্য নতুন সম্প্রদায় তৈরির লক্ষে ভগবানকে নিত্য নতুন নিজেদের সৃষ্ট নামে ডাকছেন? এগুলো তো ভালো লক্ষণ নয়, তাইতো গীতায় ভগবান বলেছেন-
.
"শাস্ত্র_বিধান_না_মেনে, অন্ন ও দান না করে, যথাযথ_মন্ত্র_উচ্চারণ_না_করে, দক্ষিনা না দিয়ে, শ্রদ্ধাহীন ভাবে যে যজ্ঞ করা হয় তাকে #তামস_যজ্ঞ বলা হয়।" গীতা ১৭/১৩.
"যজ্ঞ করাই কর্তব্য এই ভাবে মন স্থির করে ফলাকাঙ্ক্ষা না করে #শাস্ত্রের_নির্দেশনা_অনুসারে যে যজ্ঞ করা হয় তাই সাত্ত্বিক_যজ্ঞ।" গীতা ১৭/১১.
.
মনে রাখা উচিত-
"বেদমুখে এরূপ বহুবিধ যজ্ঞ বিহিত হয়েছে। সে সকলই কর্ম জাত বলে জানবে, এরূপ যেনে মুক্তি লাভ করবে। দ্রব্য যজ্ঞ অপেক্ষা জ্ঞানরূপ যজ্ঞ প্রশস্ততর। সকল কর্ম নির্বিশেষে জ্ঞানে গিয়েই শেষ হয়।" গীতা ৪/৩২,৩৩.
"সকল পাপী অপেক্ষাও যদি তুমি অধিক পাপী হও, তা হলেও জ্ঞনরূপ ভেলার দ্বারা তুমি পাপ সমূদ্র অতিক্রম করতে পারবে। এই জগতে জ্ঞানের সদৃশ পবিত্র আর কিছুই নেই। নিজের চেষ্টাকৃত যোগ বলে দীর্ঘ কাল পর নিজের আত্মাতেই সেই জ্ন লাভ করে থাকেন।"
গীতা ৪/৩৬,৩৮.
.
পরিশেষে এটাই বলতে চাই যে, যারা বলে 'নাম যজ্ঞ ঠিক নয়' এই কথাটা যেমন অজ্ঞনতা। ঠিক তেমনি যারা শাস্ত্র অমান্য করে নাম যজ্ঞ করে তদের নাম যজ্ঞও সাত্ত্বিক নাম যজ্ঞ নয়, শাস্ত্র উক্ত নাম যজ্ঞ নয়, তা তামসিক নাম যজ্ঞ। কারণ তাদের সেই তথাকথিত নাম যজ্ঞের জপ করার অক্ষর ও মন্ত্র এর কোনটাই বেদ, উপনিষদ, বেদান্ত সূত্র, গীতা ইত্যাদি বৈদিক শাস্ত্র উক্ত নয়।
বিশ্বরূপই ঈশ্বরের বিরাটরূপ
গীতা বিশ্লেষনঃ -
অর্জুন বলছ - গীতা ১১/৩ শ্লোক
পদার্থ - হে পরমেশ্বর ! (এবম্) উক্ত প্রকার ( যথা) যেভাবে ( আত্মানং , ত্বম , আস্থ ) তুমি আপনা আপনাকে বলছ (ঐশ্বরম্) ঈশ্বর ম্যায় হোনে বালা (তে , এতত্ , রূপম্) এই তোমার রূপই পুরুষোত্তম ! ( অহং , দ্রষ্টুম্ ইচ্ছামি) আমি দেখিবার ইচ্ছা করছি ।
ভাষ্য - এই শ্লোকে অর্জুন ওই রূপকে দেখিবার ইচ্ছা প্রকট করেছে যে রূপ যোগেশ্বর কৃষ্ণ আত্মত্বোপাসনার অভিপ্রায়ে বিভূতি যোগে বলেছিল , কৃষ্ণের সেই রূপ নিজের নয় কিন্তু 'ঐশ্বরম্' এই কথা দ্বারা স্পষ্ট পাওয়া যায় যে , সেই রূপ ঈশ্বরের বিশ্বরূপ = বিরাট রূপ , পরমেশ্বর এবং পুরুষোত্তম এই দুই সম্বোধন এই অভিপ্রায়ে দিয়েছে যে , পরমেশ্বর কহিতে কৃষ্ণকে পরমেশ্বর হওয়া অজ্ঞানিগনের সন্দেহ উৎপন্ন হয়েছিল এ জন্য পুরুষোত্তম বলেছে ।
পুরুষোত্তমেরর অর্থ - যে পুরুষ সব পুরুষ থেকে উত্তম ।
উপনিষদে ও বিরাটরূপ তথা বিশ্বরূপের বর্ননা আছে। বৃহদারণ্যকউপনিষদে ১/১/১ শ্লোকে বিরাট পুরুষের রূপকে বর্ননা করেছে । এবং এটি সম্পূর্ন রূপকের মাধ্যমে ।
গীতায় ও এরকম রূপের বর্না করেছেন মাত্র ।
গীতা ১০।২৩ বিশ্লেষণ॥
গীতা ১০।২৩ বলা আছে "রুদ্রাণাং শঙ্করশ্চাস্মি" অর্থাৎ রূদ্রদের মধ্যে আমি শঙ্কর।
হরিবংশ ১/৩/৫১,৫২. এর মতে একাদশ রূদ্র হল-
"হর, বহুরূপ, ত্র্যম্বক, অপরাজিত, বৃষাকপি, শম্ভু (শঙ্কর), কপর্দী, রেবত, মৃগব্যাধ, শর্ব ও কপালী।"
এতে করে বুঝা যায় প্রভুপাদ হরিবংশ থেকেই কথাটা বলেছেন! অথচ গীতার যিনি মাতা অর্থাৎ উপনিষদে. একাদশ রূদ্রের অন্য একটা তালিকা দেওয়া আছে! সেখানে হরিবংশ ও মহাভারতে উল্লেখি একাদশ রূদ্রের নাম গন্ধও নেই! দেখুন-
.
"বিদগ্ধ শাকল্যের প্রশ্নের উত্তরে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য বলিলেন- কতমে রুদ্রা ইতি দশমে পুরুষে প্রাণা আত্মৈকাদশস্তে য়দাহস্মাচ্ছরীরান্মর্ত্যাদুৎক্রামন্ত্যথ রোদয়ন্তি তস্মাদ্ রুদ্রা ইতি।
বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৩।৯।৪.
অর্থাৎ কাঁহারা রূদ্রগণ? মানব দেহে এই যে দশটি ইন্দ্রিয় (পঞ্চ কর্ম ইন্দ্রিয় ও পঞ্চ জ্ঞান ইন্দ্রিয়) এবং জীবাত্মা তাঁহাদের একাদশ। তাঁহারা যখন এই মর্ত্য দেহ থেকে উৎক্রান্ত হন, তখন (আত্মীয়গণকে) রোদন করাইয়া থাকেন। যেহেতু তারা উক্ত সময়ে রোদন করান, অতএব তাঁরা রুদ্র।"
.
প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান, সমান, নাগ, কূর্ম, কৃকল, দেবদত্ত ,ধনঞ্জয় ও জীবাত্মা। এই ১১টি দেহান্তকালে রোদন করে বলিয়া ইহাদিগকে রুদ্র বলে। অর্থাৎ উপনিষদে শঙ্কর নামক কোন রূদ্র নেই!
গীতায় বহু জায়গায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন আমিই সব, এক মাত্র আমারই সরণ লও, ... ইত্যাদি আমি, আমার, আমাকে যুক্ত অনেক কথাই বলেছেন, যেমন গীতা ১৮।৬৬. তাহলে কেন শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর ভগবান নন?
। দেখুন না ছান্দোগ্য উপনিষদে ঠিক ঐ রকমই আমি, আমার, আমাকে ... ইত্যাদি যুক্ত কথা আছে।
.
ছান্দোগ্য উপনিষদে সনৎকুমার তাহার শিষ্য নারদকে বলেছেন-
"....অহমেবাধস্তাদহমুপরিষ্টাদহং পশ্চাদহং পুরস্তাদহং
দক্ষিণতোহহমুত্তরতোহহমেবেদং সর্বমিতি।।"
ছান্দোগ্যোপনিষদ ৭।২৫।১.
অনুবাদ- আমিই অধো ভাগে, আমি উর্ধ্বে, আমি পশ্চাতে, আমি সম্মূখে, আমি দক্ষিণে, আমি উত্তরে-আমিই এই সমস্ত।
.
তাহলে কি আমাকে বলতে হবে সনৎকুমারই পরমেশ্বর ভগবান? যদি আমরা তৈত্তিরীয়োপনিষদ্ এ ভৃগু নামে প্রসিদ্ধ বরুণপুত্র পিতা বরুনেকেই ভগবান সম্বোধন করে ব্রহ্মোউপদেশ করতে বলেছেন। বরুন ঋষিও অনেক ক্ষণ ব্রহ্মোপদেশ দেওয়ার পর বলেছেন-
.
"আমি অন্ন, আমি অন্ন, আমি অন্ন। আমি অন্ন ভোক্তা, আমি অন্ন ভোক্তা, আমি অন্নভোক্তা। আমি অন্ন ও অন্নভোক্তার মিলন ঘটক তথা চেতনাবান কর্তা, আমি চেতনাবান কর্তা, আমি চেতনাবান কর্তা। আমি প্রথমজ- আমি মূর্তামূর্ত জগতের এবং দেবগণেরও পূর্ববর্তী। আমাতে অমৃতত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত। যিনি অন্নারর্থীর নিকট অন্নরূপী আমায় দান করেন, তিনি এই প্রকারেই আমায় রক্ষা করেন। যিনি অন্নদান না করেন তাকে অন্নরূপী আমিই ভক্ষণ করি। আমি পরমেশ্বররূপে সমস্ত জগৎকে শাসন করি। আমার জ্যোতিসমূহ আদিত্যেরই ন্যায় নিত্য প্রকাশমান।"--ইহাই। পরম আত্ম জ্ঞান। যিনি এইরূপ জানেন তাঁহার এইরূপ ফল হয়।"
তৈত্তিরীয়_উপনিষদ ৩/১০/৬.
.
এখানেও কি বলতে হবে যে বরুন ঋষিই স্বয়ং ভগবান? না তা নহে, শ্রীকৃষ্ণ, সনৎকুমার বা বরুন ঋষি এরা কেহই পরমেশ্বর ভগবান নয়, মূল কথা হল যোগ যুক্ত অবস্থায়
যোগীরা আমি, আমার, আমাকে ইত্যাদি যুক্ত কথা বলেন। কৃষ্ণ, সনৎকুমার, বরুন ঋষি ওনারা প্রত্যেকেই
যোগযুক্ত অবস্থায় ছিলেন বলেই মুলত অংকার সূচক এই ধরণের বাক্য বলেছেন।
.
আবার গীতাতেই শ্রীকৃষ্ণই বলেছেন যে পরমেশ্বরের সরণ নিতে, ওনার কথা বলেননি। এর প্রমাণ গীতা ১৮। ৬১ও ৬২ নং শ্লোকে দেখুন-
"সর্বোতভাবে তাহারই(ঈশ্বরের) সরণ লও..." গীতা ১৮।৬২.
আবার সেই ছান্দগ্য উপনিষদে সনৎকুমারই বলেছেন যে- "তিনিই (ঈশ্বরই) নিম্নে, তিনি উর্ধ্বে, তিনি পশ্চাতে ..
তিনিই এই সমস্ত।.." ছান্দোগ্য ৭।২৫।১.
স পর্যগাচ্ছুক্রেমকায়মব্রণমস্নাবিরꣳ শুদ্ধমপাপবিদ্ধম্।
কবির্মনীষী পরিভূঃ স্বয়ম্ভূর্যাথাতথ্যতোऽর্থান্ ব্যদৃধাচ্ছাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ।।
-যজুর্বেদ ৪০।৮।।
-হে মনুষ্য ! পরমেশ্বর অনন্ত শক্তিযুক্ত, অজন্মা, নিরন্তর, সর্বদা মুক্ত, ন্যায়কারী, নির্মল, সর্বজ্ঞ, সমস্ত কিছুর সাক্ষী, নিয়ন্তা, সমস্ত জগতের রচয়িতা, অনাদিস্বরূপ। পরমপিতা পরমেশ্বর কল্পের আরম্ভে জীবকে বেদ সম্বন্ধে জ্ঞান প্রদান করায় বিদ্যা প্রাপ্ত হয়েই বিদ্যান হন, ধর্ম্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষের ফল ভোগে সমর্থ হবেন- তাই ব্রহ্মেরই সর্বদা উপাসনা করো
কবির্মনীষী পরিভূঃ স্বয়ম্ভূর্যাথাতথ্যতোऽর্থান্ ব্যদৃধাচ্ছাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ।।
-যজুর্বেদ ৪০।৮।।
-হে মনুষ্য ! পরমেশ্বর অনন্ত শক্তিযুক্ত, অজন্মা, নিরন্তর, সর্বদা মুক্ত, ন্যায়কারী, নির্মল, সর্বজ্ঞ, সমস্ত কিছুর সাক্ষী, নিয়ন্তা, সমস্ত জগতের রচয়িতা, অনাদিস্বরূপ। পরমপিতা পরমেশ্বর কল্পের আরম্ভে জীবকে বেদ সম্বন্ধে জ্ঞান প্রদান করায় বিদ্যা প্রাপ্ত হয়েই বিদ্যান হন, ধর্ম্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষের ফল ভোগে সমর্থ হবেন- তাই ব্রহ্মেরই সর্বদা উপাসনা করো
ঈশ্বর নিরাকার, সর্বব্যপী, অদৃশ্য, অগ্রাহ্য, নিত্য এবং সর্বভূতের কারন
---- মুন্ডক উপনিষদ ১।১।৬
"যত্তদদ্রেশ্যমগ্রাহ্মমগোত্রমবর্ ণমচক্ষুঃশ্রোত্রং তদপাণিপদাম্।
নিত্য়ং বিভূং সর্বগতং সূসুক্ষ্মং তদব্যয়ং যদ্ভূতয়োনিং পরিপশ্যন্তি ধীরাঃ।।"
---- মুন্ডক উপনিষদ ১।১।৬
"যত্তদদ্রেশ্যমগ্রাহ্মমগোত্রমবর্ ণমচক্ষুঃশ্রোত্রং তদপাণিপদাম্।
নিত্য়ং বিভূং সর্বগতং সূসুক্ষ্মং তদব্যয়ং যদ্ভূতয়োনিং পরিপশ্যন্তি ধীরাঃ।।"
"ন দ্বিতীয়ো ন তৃতীয় শ্চতুর্থো নাপ্যুচ্যতে।
ন পঞ্চমো ন ষষ্ঠঃ সপ্তমো নাপ্যুচ্যতে।
নাষ্টমো ন নবমো দশমো নাপ্যুচ্যতে।
য এতং দেবমেক বৃতং বেদ।।"
অথর্ববেদ ১৩/৪/২. (১৬/১৭/১৮).
.
ভাবার্থ- পরমাত্মা এক, তিনি ছাড়া কেহই দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম, বা দশম ঈশ্বর বলিয়া অভিহিত হন না। যিনি তাহাকে শুধু এক বলিয়া জানেন তিনিই তাঁহাকে প্রাপ্ত হন।
.
"ইন্দ্রং মিত্রং বরুণমগ্নিমাহু, রথো দিব্যঃ স সুপর্ণো গরুত্মান। একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্ত্যগ্নিং যমং মাতরিশ্বানমাহুঃ।।" ঋগবেদ ১/১৬৪/৪৬.
ভাবার্থ- এক সত্তা পরম ব্রহ্মকে জ্ঞানীরা ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ, অগ্নি, দিব্য, সুপর্ণ, গরুৎমান, যম, মাতারিশ্বা আদি বহু নামে অভিহিত করেন।
.
"এতমেকে বদন্ত্যগ্নি মনুমন্যে প্রজাপতিম্।
ইন্দ্রমমেকে পরে প্রাণমপরে ব্রহ্ম শাশ্বতম্।।"
মনুসংহিতা ১২/১২৩.
ভাবার্থ- এই পরম পুরুষকেই কেউ কেউ অগ্নি বলে জানেন, কেই একে মনু বলেন, কেউ প্রজাপতি, কেউ ইন্দ্র, কেউ প্রাণ এবং কেউ আবার সনাতন ব্রহ্ম বলে থাকেন।
গীতায় অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে ভগবান বলে ডেকেছেন, ভগবান একটা সন্মান সূচক বাক্যঃ
_উপনিষদ্ ১।১ এ ভরদ্বাজ তনয় সুকেশা, শিবি প্রুত্র সত্যকাম, গর্গ গোত্রীয় সৌর্যায়ণি, অশ্বল তনয় কৌসল্য, ভৃঙ্গুবংশীয় বৈদর্ভি ও কত্য তনয় কবন্ধী, এরা সকলেই গুরু পিপ্পলাদকে ভগবান বলে ডেকেছেন।
.
এছাড়াও প্রশ্ন উপনিষদ ২।১, ৩।১, ৪।১, ৫।১ ও ৬।১ নং শ্লোকের মধ্যেও গুরুকে ভগবান বলে ডেকেছেন। মুণ্ডক_উপনিষদ্ ১।১।৩ নং শ্লোকে গৃহস্থাগ্রণী শৌনক ঋষি অঙ্গিরাকে ভগবান বলে ডেকেছেন। তৈত্তিরীয়_উপনিষদ্ ৩।১-৫ নং শ্লোকের প্রতিটাতেই ভৃগু নামে প্রসিদ্ধ বরুণপুত্র পিতা বরুণের সামনে উপস্থিত হয়ে তার পিতাকে ভগবান বলে ডেকেছেন এবং বলেছেন যে- "হে ভগবান, আমায় ব্রহ্মোপদেশ
করুন।"
.
ছান্দোগ্য_উপনিষদ্ ও বৃহদারণ্যক_উপনিষদ্ এর দিকে তাকলে তো ভগবানের হিড়িক খুজে
পাওয়া যায়! ছান্দোগ্য উপনিষদ থেকে কিছু নমুনা তুলে ধরলাম- ছান্দোগ্য উপনিষদ ১।১১।৩,৪,৬ও৮, ১।১২।২, ৪।১।৮, ৪।২।২, ৪।৪।৩, ৪।৫।১ও২, ৪।৬।২ও৩, ৪।৭। ২ও৩, ৪।৮।২ও৩, ৪।৯।১ও৩, ৪।১৪।২, ৬।২।১, ৬।৫।৪, ৬।৮।৭, ৬।৯।৪, ৬।১০।৩, ৬।১১।৩, ৬।১২।১ও৩, এবং ৭।১।১ থেকে ৭।২৬।২ নং পর্যন্ত সকল শ্লোকেই শিষ্যরা
তাদের গুরুদেবকে ভগবান বলেছেন। আর গুরুদেবরাও তার প্রেক্ষিতে উত্তর দিয়েছেন।
ভগবান্-"ভজ সেবায়াম্" এই ধাতু থেকে 'ভগ' সিদ্ধ হয়, ইহার সাথে "মতুপ্" প্রত্যয় যোগে 'ভগবান' শব্দ সিদ্ধ হয়।
"ভগঃ সকলৈশ্বর্য়ং সেবনং বা বিদ্যতে য়স্য স ভগবান্"
অর্থাৎ যিনি ঐশ্বর্যযুক্ত এবং ভজনের যোগ্য। এই জন্য সেই পরমেশ্বরের নাম "ভগবান্"।
.
গুরুদেবরাও ঐশ্বর্যযুক্ত ও ভজনের যোগ্য তথা ওনার গুণকীর্তন মানে গুণগান গাওয়ার যোগ্যতা ছিল বলেই গুরুদেরকে ভগবান ডাকতেন ওনাদের শিষ্যরা। আর ঈশ্বর তো সকল ভগবানেরও ভগবান। তাই স্বয়ং ভগবানের তো গুণগান মানে ভজনা করতেই হয়। বিষ্ণপুরাণ মতে যার ৬টি গুণ আছে তাকেই ভগবান বলা যায় যথা- ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য যার আছে তাকেই ভগবান বলে।
.
এখন অনেকে বলবেন যে, আপনারা বৈদিকরা তো বর্তমানে প্রচলিত ৩৬টা পুরাণ মানেন না, তাহলে পুরাণের রেফারেন্স দিচ্ছেন কেন? তাদের জন্য বলতে চাই যে ঐ পুরাণ ছাড়াও পরাশর সংহিতায়ও পরাশর মুনিও একই কথাই বলেছেন। অর্থাৎ ৬টা গুণের কথা বলেছেন। আর ঐ গুরুদেরও ঐ ৬টা গুণ ছিল বলেই ওনাদেরকে ওনাদের শিষ্যরা ভগবান ডেকেছে, কৃষ্ণজীরও ছিল বলে ওনাকে অর্জুন ভগবান ডেকেছেন। আর পরমেশ্বরের তো গুণের অন্ত নেই অথাৎ অসীম তার গুণ, ৬টা গুণ দিয়ে কি আর ঈশ্বরকে বেঁধে রাখা সম্ভব?
.
এখন শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম ও মিশন, দিনাজপুর, বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত শ্রীমদ্ভগবদগীতায় শ্রীকৃষ্ণজীকে কি স্বয়ং ভগবান বলে মেনেছেন কিনা তা একটু যাচাই করে দেখুন সকলে। স্বামী_অমৃতত্বানন্দজী কর্তৃক অনুবাদীত ও ব্যাখ্যাকৃত রামকৃষ্ণ মিশনের গীতা ২।২নং শ্লোকের ব্যাখ্যায় তিনি তথা রামকৃষ্ণ মিশনই বলছে যে-
[গীতা প্রবক্তা কৃষ্ণ নয়-সাক্ষাৎ ভগবান্। একথা তিনি নিজ মুখেও স্বীকার করেছেন, অনুগীতায় বলেছেন- এক্ষণে পুনরায় আমি তা সমগ্ররূপে কীর্তন করতে পারব না, তৎকালে আমি যোগযুক্ত হয়েই সেই পরব্রহ্ম প্রাপক বিষয়(গীতা) কীর্তন করেছিলাম' (মহাভারত অনুগীতা ১৬অধ্যায়)। এতে শ্রীকৃষ্ণ মাহাত্ম্য কিছু কমে যায় না।]
রামকৃষ্ণ মিশন গীতা ২।২নং শ্লোক, পৃষ্ঠা নং ২৯।
জগতে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা যা আচরণ ও প্রমাণ করে সাধারণ লোক সেরূপই আচরণ করে এবং প্রমাণিক
"য়দ্ য়দ্ আচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ।
স য়ৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ততে।।"-গীতা ৩/২১.
অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা যা যা আচরণ করেন, সাধারণেরা সেরূপই আচরণ করে। তিনি যা প্রমাণিক করেন, লোকেরা তারই অনুবর্তন করে।
গীতায় ভগবান ঘোষণা করেছেন-
.
"তাই কর্তব্য ও অকর্তব্য নির্ধারণে শাস্ত্রই(বেদই) তোমার একমাত্র প্রমাণ। তাই সংসারে শাস্ত্র বিধান উক্ত কর্ম করা উচিত।" গীতা ১৬/২৪.
যঃ শাস্ত্রবিধিমুৎসৃজ্য বর্ততে কামকারতঃ।
ন স সিদ্ধিমবাপ্নোতি ন সুখং ন পরাং গতিম্।।১৬/২৩।।
অনুবাদঃ যে শাস্ত্রবিধি পরিত্যাগ করে কামাচারে বর্তমান থাকে, সে সিদ্ধি, সুখ অথবা পরাগতি লাভ করতে পারে না।
তস্মাচ্ছস্ত্রং প্রমাণং তে কার্যাকার্যব্যবস্থিতৌ।
জ্ঞাত্বা শাস্ত্রবিধানোক্তং কর্ম কর্তুমিহার্হসি।।২৪।।
অনুবাদঃ অতএব, কর্তব্য ও অকর্তব্য নির্ধারণে শাস্ত্রই তোমার প্রমাণ। অতএব শাস্ত্রীয় বিধানে কথিত হয়েছে যে কর্ম, তা জেনে তুমি সেই কর্ম করতে যোগ্য হও।
গীতা-দ্বাদশ অধ্যায়-ভক্তিযোগ বিশ্লেষণঃ
অর্জুন উবাচ
এবং সততযুক্তা যে ভক্তাস্ত্বাং পর্যুপাসতে।
যে চাপ্যক্ষরমব্যক্তং তেষাং কে যোগবিত্তমাঃ।।১।।
অনুবাদঃ অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন-এভাবেই নিরন্তর ভক্তিযুক্ত হয়ে যে সমস্ত ভক্তেরা যথাযথভাবে তোমার আরাধনা করেন এবং যাঁরা ইন্দ্রিয়াতীত অব্যক্ত ব্রহ্মের উপাসনা করেন, তাঁদের মধ্যে কারা শ্রেষ্ঠ যোগী।[শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ]
শ্রীভগবানুবাচ
ময্যাবেশ্য মনো যে মাং নিত্যযুুক্তা উপাসতে।
শ্রদ্ধয়া পরয়োপেতাস্তে মে যুক্ততমা মতাঃ।।২।।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান বললেন-যাঁরা তাঁদের মনকে আমার সবিশেষ রূপে নিবিষ্ট করনে এবং অপ্রাকৃত শ্রদ্ধা সহকারে নিরন্তর আমার উপাসনা করেন, আমার মতে তাঁরাই সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী।[শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ]
গীতার ঐ অধ্যায়ে এমন কিছু বলা নেই! এখানে বলা আছে অব্যক্ত অক্ষর ও ব্যক্ত এই দুটি শব্দ এবং বলা হয়েছে অব্যক্ত থেকে ব্যক্ত উপাসনা সহজ। তাছাড়া নির্গুণ মানে নিরাকার নয় এবং সগুণ মানে সাকার নয়। প্রথমে দেখুন নিরাকার, সাকার, সগুণ ও নির্গুণ বলতে কি বুঝায়া, তারপর অব্যক্ত ও ব্যক্ত শব্দ দুটো নিয়ে আলোচনা করবো-
.
নিরাকার:- (নির্ ও আঙ) পূর্বক ডুকৃঞ্ করণে
এই ধাতু হতে নিরাকার শব্দ সিদ্ধ হয়। 'নির্গত আকারাৎ স নিরাকারঃ', যাহার কোন আকার নেই, যিনি কখনো শরীর ধারণ করেন না সেই কারণে পরমেশ্বরের নাম নিরাকার।
.
নিরাকার উপাসনা কিরূপ তা একটু দেখুন(এই মন্ত্রগুলো উপাসনা বিধির মনসা পরিক্রমা এর অন্তর্গত ৬টি মন্ত্র, একটি দেওয়া হল)-
"ওম্ প্রাচী দিগগ্নিরধিপতিরসিতো রক্ষিতা দিত্যা ইষবঃ।
তেভ্যো নমো ধিপতিভ্যো নমো রক্ষিতৃভ্যো নম ইষুভ্যো নম এভ্যো অস্তু। য়ো৩স্মান্দ্বেষ্টি য়ং বয়ং দ্বিষ্মস্তং বো জম্ভে দধমঃ।। অথর্ববেদ ৩/২৭/১.
ভাবার্থ- পূর্বে প্রভু অগ্নি নামে তুমিই রক্ষক।
সূর্যরশ্মি বাণ তব তমোবিনাশক।।
তোমারে প্রণাম করি, জগতের পতি।
রক্ষক তুমিই প্রভু, তোমারে প্রণতি।।
রক্ষার কৌশল তব অতি চমৎকার।
তোমারে প্রণাম প্রভু করি বারংবার।।
আমাসবাকারে দ্বেষ যাহারা করিবে,
আমাদের দ্বেষভাব যাহার প্রতি রবে,
সবাকার দ্বেষভাব ন্যায় দন্ড তলে
রাখিনু, বিনাশো তাহা সব শক্তি বলে।।
.
সাকার- সাকার অর্থ যার সুনির্দিষ্ট আকার আছে। এখন আমার প্রশ্ন হল ঈশ্বর কী সুনির্দিষ্ট আকারের মধ্যে আবদ্ধ? তাহলে ঐ সুনির্দিষ্ট আকারের বাহিরে কে আছে? তিনি কে? এক কথায় সাকার নামক কোন শব্দ
ঈশ্বরের ক্ষেত্রে প্রযোয্য নয়।
.
সগুণ:- 'য়ো গুণৈঃ সহঃ বর্ত্ততে স সগুণ' পরমেশ্বর সর্বজ্ঞান, সর্বসুখ, পবিত্রতা এবং অনন্ত বলাদি গুণযুক্ত বলিয়া সেই পরমেশ্বরের নাম 'সগুণ'।
.
সগুণ ব্রহ্মের উপাসনা উপস্থাপনা মন্ত্রের মাধ্যমেও হয়, আমি ভিন্ন একটি বেদ মন্ত্রের মাধ্যমে দেখাচ্ছি-
"ওম্ তেজোহসি তেজো ময়ি ধেহি,
বীর্য্যমসি বির্য্যং ময়ি ধেহি।
বল মসি বলং ময়ি ধেহি,
ওজোহস্যো জোময়ি ধেহি।
মনু্যরসি মন্যুং ময়ি ধেহি,
সহোহসি সহোময়ি ধেহি।
যজুর্বেদ ১৯/৯.
আনুবাদ- হে প্রভু! তুমি তেজোময়, আমাতে তেজ স্থাপন কর। তুমি বীর্যময় আমাতে বীর্য স্থাপন কর। তুমি বলবান, আমাতে বল স্থাপন কর। তুমি ওজসি, আমাতে ওজ স্থপন কর। তুমি অধর্মের দন্ড দাতা, আমাতে অধর্ম দমনের শক্তি স্থাপন কর। তুমি সহনশীল, আমাকে সহনশক্তি দাও।
.
নির্গুণ:- 'গণ্যন্তে য়ে তে গুণা বা য়ৈর্গণয়ন্তি তে গুণাঃ য়ো গুণেভ্যো নির্গতঃ স নির্গুণ ঈশ্বরঃ।' জড়ের
সত্ত্ব রজ তম রূপ রস স্পর্শ ও গন্ধাদি যত গুণ
আছে এবং জীবের অবিদ্যা অল্পজ্ঞতা রাগ দ্বেষ ও
অবিদ্যাদি ক্লেশ এইরূপ যতগুণ আছে, সে সব হতে
তিনি পৃথক। এই বিষয়ে 'অশব্দমস্পর্শমর
ূপমব্যয়ম্' ইত্যাদি উপনিষদের
প্রমাণ আছে। তিনি শব্দ স্পর্শ এবং রূপাদি গুণ রহিত,
এই কারণে সেই পরমেশ্বরের নাম 'নির্গুণ' ।
.
যেমন পৃথিবী গন্ধাদি গুণ যুক্ত বলে সগুণ ও ইচ্ছাদি
গুণ নেই বলে নির্গুণ। সেইরূপ জগৎ তথা জীবের গুণ হইতে পৃথক পরমেশ্বর নির্গুণ এবং সর্বজ্ঞতাদি গুণ যুক্ত বলিয়া সগুণ। অর্থাৎ এমন কোন পদার্থ নাই যাহা সগুণতা ও নির্গুণতা হইতে পৃথক। চেতন গুণ রহিত বলে জড় পদার্থ যেরূপ নিগুণ এবং স্ব-গুণযুক্ত বলে সগুণ ।
সেরূপ জড় গুণ হতে পৃথক বলে জীব নির্গুণ, আবার ইচ্ছাদি নিজ গুণযুক্ত বলিয়া সগুণ। পরমেশ্বরের ক্ষত্রেও এইরূপ বুঝতে হবে।
.
এখন আসুন অব্যক্ত ও ব্যক্ত শব্দ দুটিতে-
বাংলা ভাষায় প্রাপ্ত প্রায় সব গীতাতেই আলাদা আলাদা করে সংস্কৃত শাব্দের অর্থ লিখার সময় অব্যক্ত
অর্থ অপ্রাকাশিত ও ব্যক্ত অর্থ প্রকাশিত লিখেছেন, যা কিনা ঠিক। অথচ পুরো শ্লোকের অনুবাদ করার
সময় তারা অপ্রকাশিত এর বদলে নির্গুণ অথবা নিরাকার ও প্রকাশিত বলতে সগুণ অথবা সাকার লিখেছে, যা কিনা বলা চলে ভুল। এখন প্রশ্ন হল অব্যক্ত অর্থ যে অপ্রাশিত এবং ব্যক্ত অর্থ প্রকাশিত তার প্রমাণ কি এবং এই অপ্রকাশিত ও প্রকাশিত বলতে কি
বুঝায়, তা জানানোর জন্য আপনাদের গীতা, উপনিষদ ও মনুসংহিত এর দিকে নজর দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি। প্রথমে দেখি গীতা কি বলছে-
.
"অব্যক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত।
অব্যক্তনিধানিধনান্যেব তত্র কা পরিদেবনা।।"
গীতা ২/২৮.
ভাবার্থ- হে ভারত! প্রাণিগণ বা সমস্ত জীব আাদিতে অব্যক্ত বা অপ্রকাশিত ছিল, মধ্যে বা স্থিতীকালে ব্যক্ত বা প্রকাশিত হয়, নিধনে বা বিনাশের পর আবার অব্যক্ত বা অপ্রকাশিত হয়ে যায়। সুতরাং এর জন্য শোক কেন?
.
দেখুন মনু কিবলেছেন-
"তারপর অব্যক্ত বা অপ্রকাশিত (যোগলব্দ) ভগবান স্বয়ম্ভু প্রলয় অবস্থায় ধ্বংসক,মতান্তরে প্রকৃতিপ্রেরক হয়ে এই স্থুল আকাশাদি মহাভূত-যা পূর্বে অপ্রকাশ ছিল-সেই বিশ্বসংসারকে ক্রমে ক্রমে প্রকটিত করে
প্রকাশিত হলেন।" মনুসংহিতা ১।৬.
"যিনি মনোমাত্রাগ্রাহ্য,সূক্ষতম, অব্যক্ত বা অপ্রকাশক, চিরস্থায়ী, সর্বভূতে বিরাজমান এবং যিনি চিন্তার বহির্ভূত সেই অচিন্ত্য পুরুষ স্বয়ংই প্রথমে ব্যক্ত বা প্রকাশিত
হয়েছিলেন।" মনুঃ১।৭.
.
উপরের শ্লোকগুলো থেকেই প্রমাণ হয় যে অব্যক্ত অর্থ ঈশ্বরের জগৎ সৃষ্টির পূর্বের অবস্থা,আর ব্যক্ত অর্থ ঈশ্বরের জগৎ সৃষ্টির পরের অবস্থা। এবং জীবের ক্ষেত্র জম্মের পূর্বের ও পরের অবস্থা। আবার আসুন গীতার বাণীতে-
"দেহ ধারী ব্যক্তিদের পক্ষে ঈশ্বরের ঐ অবক্ত অবস্থাকে
উপলব্দি করা দেহধারীদের পক্ষে কষ্ট কর, তবে যোগীদের দ্বারা সম্ভব।" গীতা১২।৫.
কেননা জগৎ সৃষ্টির পূর্বে ঈশ্বর কেমন ছিলেন তা আমরা দেহধারী সাধারণ মানুষরা শুধু মুখে বলতে পারি, কিন্তু খুব সহজে উপলব্দি করতে পারিনা। আর ব্যক্ত উপাসনা দেহধারীদের পক্ষে সহজ (গীতা১২।৬)। কেননা তখন আমরা দেহধারীরা ঈশ্বরের গুণ ও কর্মগুলোকে চিন্তা করে উপাসনা করতে পারি। ছান্দোগ্য উপনিষদ ৩।১৯।১ এ অব্যক্ত ও ব্যক্তকে যথাক্রমে অসৎ ও সৎ এই দুটো শব্দ দ্বারা মনুসংহিতার ঐ কথাগুলোই বলা
হয়েছে অর্থাৎ ঈশ্বরের অপ্রকাশিত অবস্থা ও প্রকাশিত অবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে।
.
এখন ব্যক্ত উপাসনা কি ভাবে করে তা একটু দেখাচ্ছি (এই মন্ত্র ৩টি উপাসনা বিধির অঘমর্ষণ এর অন্তর্গত, একটি দিলাম)-
"ওম্ ঋতং চ সত্যং চ ভীদ্ধাত্তপসোহধ্যজায়ত।
ততো রাত্র্যজায়ত ততঃ সমুদ্রো অর্ণবঃ।।
ঋগবেদ ১০/১৯০/১.
অনুবাদ- নিত্যজ্ঞানময় বেদ এবং কারণ প্রকৃতি তোমার জ্ঞানময় সামর্থ্য হতে প্রকাশিত হয়েছে এবং সেই সামর্থ্য হতেই জলপূর্ণ আকাশ উৎপন্ন হয়েছে।
.
পরিশেষে একটা কথাই বলতে চাই, ঈশ্বর অব্যক্ত, ব্যক্ত, নির্গুণ, সগুণ ও নিরাকার। কিন্তু কোন ক্রমেই সাকার নয় অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট গঠনের মধ্যে আবদ্ধ নয়।
শ্রীকৃষ্ণ পরমাত্মা না জীবাত্মা বিশ্লেষণঃ
.
দ্বাপর যুগের কৃষ্ণের কোন বর্ণনা বেদে নেই, কারণ কারো ইতিহাস তার জম্মের পরেই লিখা হয় পূর্বে না। তবে উপনিষদে একবার কৃষ্ণের বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে সেখানে কৃষ্ণকে ঈশ্বর মানা হয় নাই, উপনিষদে দেখা যায়
তিনি এক গুরুর নিকট থেকে শিক্ষা নিচ্ছেন!!! তবে সেই কৃষ্ণ দ্বাপর যুগের কিনা এটা নিয়ে যথেষ্ট মতবিরোধ আছে।
.
তবে বেদে এই ধরণের কোন কিছু নেই। দ্বাপর যুগে যে দেহ
ধারী কৃষ্ণকে আমরা দেখতে পাই তিনি ঈশ্বর নয় বা পরমাত্মা নয়। তিনি হলেন জীবাত্মা, আমরা
যেমন প্রত্যেকেই জীবাত্মা তিনিও জীবাত্মাই ছিলেন, পরমাত্মা নয়। তবে পূর্ণ আত্মা, মুক্ত আত্মা ছিলে। বেদে স্পষ্টই বলা আছে পরমাত্মার দেহ বা শরীর নেই, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের শরীর ছিল। এখন প্রশ্ন হল এই কথা গুলোর
ভিত্তি কি???
চলুন প্রমাণ দেখি-
গীতা ৪।৫. কৃষ্ণ বলেছে ওনার ও অর্জুনের বহু জম্ম অতীত হয়েছে, আর সেই সব জম্মের
কথা কৃষ্ণ মনে করতে পারেন, কিন্তু অর্জুন তার সবগুলো মনে রাখতে পারেন না।
.
এই শ্লোক থেকে প্রমাণিত পূর্বে কৃষ্ণের জম্ম হয়েছে এবং তিনি পূর্ব জম্মের কথা মনে
রাখতে পারেন। যেমন কিনা কৌরব মাতা গান্ধারীও কিছু জম্মের কথা মনে রাখতে পারে।
.
অবতারবাদের কথাই বলেছে। কিন্তু আমি
বলবো এই শ্লোকটা অবতারবাদের কথা বলেনি, যেখানে বলেছে সেখানেই অবতারের কথা
আলোচনা করঅনেকই বলে যে এই শ্লোকে মূলত ঈশ্বরেরবো। তাই আরো কিছু প্রমাণ দেখানো হল
পূর্ব জম্ম নিয়ে-
.
হরির অংশে পৃথিবীতে কৃষ্ণ ও বলরামের শোভা বর্ধন-
পুরা গ্রামেস্বাগ্রয়েণৈরৈন্দ্রিয়ৈশ্চ মহোৎসবৈ।
বভৌ ভূঃ পক্কশস্যাঢ্যা কলাভ্যাং নিতরাং হরে।। ভাগবতঃ ১০।২০।৪৮.
ভাবার্থ- নগর গ্রাম বৎসরের নতুন শস্যের অগ্রভাগে ইন্দ্র দেবের উদ্যেশে নিবেদন এবং মহোৎসব হচ্ছিলো। পরিপক্ক শস্য সমৃদ্ধা পৃথিবী হরির বিশেষ অংশ উভয়ে (কৃষ্ণ ও বলরাম) দ্বারা শোভা পাচ্ছিলো।
.
বিষ্ণুর অংশে কৃষ্ণ ও বলরামের অবতার -
যদোশ্চ ধর্মশীলস্য নিতরাং মুনিসত্তম।
তত্রাংশেনাবতীর্স্য বিষ্ণোবীর্যাণি শংস নঃ।।
ভাগবত ১০।১।২.
ভাবার্থ- হে মহান মুনিবর! আপনি আমাদের প্রসংশার সহিত বর্ণনা করুন ধর্মানুরাগী উচ্চ যোগ্যতা সম্পন্ন যদুবংশের। সেই বংশে বিষ্ণুর অংশে অত্যন্ত বীর্যের সহিত (কৃষ্ণ ও বলরাম) অবতীর্ণ হয়েছে।
.
এখানে বৈষ্ণবদের প্রিয় শ্রী জীব কষ্ট কল্পনা করিয়া অর্থ দাড় করিয়েছেন-
অংশের অর্থাৎ শ্রী বলরামের সংগে অবতীর্ণ কৃষ্ণ। সর্ব্বব্যপকতা দ্বারা পরিপূর্নতার পর্যবসান শ্রীকৃষ্ণে আছে। এই জন্য বিষ্ণু এ স্থলে শ্রীকৃষ্ণকে নির্দেশ করা হয়েছে।
কিন্তু পরিচ্ছিন্ন দেহধারী শ্রীকৃষ্ণ যে সর্বত্র বেপে থাকতেন সে কথা ব্যাসদেব মহাভারতের কোথাও বলেন নি। মহাভারত থেকে জানা যায়, কপট দ্যুতক্রিড়ায় সর্বস্ব হারিয়ে পান্ডব যখন বনে ছিলেন। তখন একদিন কৃষ্ণ সেখানে এসে বললেন-
.
নৈতৎ কৃচ্ছমনুপ্রাপ্তো ভবান স্যাদ বসুধাধিপ।
যদ্যহং দ্বারকায়ং স্যাং রাজন সন্নিহিত পুরা।।
অর্থাৎ আমি যদি তখন দ্বারকাতে থাকতাম তাহলে হে রাজন যুধিষ্ঠির তোমাদের এত কষ্ট ভোগ হতো না।
এখান থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে তিনি সর্বত্র ছিলেন না।
.
হরির অংশে দেবকীর গর্ভে কৃষ্ণের জন্ম-
দিষ্ট্যাম্ব তে কুক্ষিগতঃ পরঃ পুমান
অংশেন সাক্ষাৎ ভগবান ভাবয় নঃ।
ভাগবত ১০।০২।৪১.
ভাবার্থ -হে মাতঃ! সৌভাগ্যক্রমে আমাদের কল্যাণের জন্য সাক্ষাৎ পরম পুরুষ ভগবান অংশে (হরির অংশে) আপনার গর্ভে আগমন করেছেন।
এখানে কৃষ্ণ যে অংশ পূর্ণ নন তা স্পষ্ট বলা হলো।
.
এতৌ ভগবতঃ সাক্ষাদ্ধরের্ণারায়ন্য হি।
অবতীর্ণ বিহাংশেন বসুদেবস্য বেশ্মনি।।
ভাগবতঃ ১০।৪৩।২৩.
ভাবার্থ -অবশ্যই এরা দুজন সাক্ষাৎ ভগবান নারায়ন হরির অংশে এই লোকে বসুদেবের গৃহে অবতীর্ণ হয়েছে।
.
পৃথিবীর ভার হরনের জন্য হরির অংশে কৃষ্ণ ও অর্জুনের পৃথিবীতে আবির্ভাব-
তাবিমৌ বৈ ভগবতো হরেরংশাবিহাগতৌ।
ভারব্যয়য়া চবভূব কৃষ্ণৌ যদুকুরুদ্বহৌ।।
ভাগবতঃ ৪।১।৫৯.
ভাবার্থ- এই উভয়ে অবশ্যই হরির অংশ কৃষ্ণ ও অর্জুন এখানে পৃথিবীর ভার হরনের জন্য যথাক্রমে যদু ও কুরু বংশে আবির্ভূত হয়েছেন।
.
কৃষ্ণ যে পরমাত্বার একটি কেশের অংশ মাত্র। মহাভারতের আদিপর্বেও তার বর্ণনা আছে।
"দেবগন কর্তৃক প্রার্থিত হয়ে শ্রী হরি কেশদ্বয় উৎপাটন করলেন। তার একটি শুক্ল অপরটি কৃষ্ণবর্ণ। সেই কেশদ্বয় যদুকুল মহিলা রোহিনী এবং দেবকীতে আবিষ্ট হইয়াছিলো। শ্বেতবর্ণ কেশ বলভদ্র এবং কৃষ্ণবর্ণ কেশ কৃষ্ণরূপে উক্ত হন"
মহাভারত, আদিপর্ব ১৯৬।৩২-৩৩.
.
কৃষ্ণ ও অর্জুন নর ও নারায়ন ঋষি ছিলেন এবং ভূমাপুরুষের নিজের অংশ বলে দাবী করেছেন তাও একবার দেখুন-
.
কলাবতীর্ণব্বনের্ভারাসুরান্
হত্বেহ ভূয়স্তরয়োতমস্তি মে।।
ভাগবত ১০।৮৯।৫৮.
ভাবার্থ- ভূমাপুরুষ বলছে, তোমরা আমার অংশে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছো। ভারস্বরূপ অসূরদের বধ করে পূনরায় আমার নিকট ফিরে।
.
পূর্ণকামাবপি যুবাং নরনারায়রনাবৃষৌ।
ধর্মমাচরতাং স্থিত্যৈ ঋষভৌ লোকসংগ্রহম্।।
ভাগবত ১০।৮৯।৫৯.
ভাবার্থ- তোমারা দুজনে পূর্ণকাম সর্বশ্রেষ্ঠ নর এবং নারায়ন ঋষি। তথাপি (জগতের) স্থিতি এবং লোকরক্ষার জন্য ধর্মাচরন আবশ্যক।
.
এই ভূমাপুরুষের উপাখ্যানে জানা যায় যে, এক বাহ্মণের মৃত পুত্রকে ফিরিয়ে আনবার জন্য অর্জুনকে নিয়ে অনন্তদেব ভূমাপুরুষের ধাম মহাকালপুরে প্রবেশ করলেন। তখন ভূমাপুরুষের অঙ্গজ্যোতি দর্শনে অক্ষম হয়ে অর্জুন চক্ষু মুদিত করলেন। তারপর কৃষ্ণার্জুন উভয়েই সেই ভূমাপুরুষকে প্রণাম করলে তিনি বলেন-
তোমরা আমার অংশ। পৃথিবীর ভারস্বরূপ অসুর বধের জন্যই অবতীর্ণ হয়েছো। তা সম্পন্ন করে আমার কাছে আগমন করো।
.
অর্থাৎ পূর্ব জম্মের অনেক ত্যাগ তীতিক্ষার ফলে আমরা দ্বাপর যুগের মোক্ষলাভ
করা আত্মা বা মুক্ত আত্মা কৃষ্ণকে
পাই।
.
গীতার ৪।৭ও৮ নং শ্লোক হল
আপনাদের সেই
অবতারবাদ তত্ত্ব। আপনাদের কথা
মত কৃষ্ণ এখানে বলেছেন তিনি
অবতরণ করেন। এই প্রসঙ্গে আমি এটাই বলতে চাই যে মুক্ত
আত্মারা তা পারেন।
.
এই অবতরণ পরমাত্মার নয়, ইহা
মোক্ষ লাভ করা আত্মারই হয়।
কারণ আত্মারা যখনই দেহ ধারণ
করে তখনই সেটাকে আমরা বলি
জম্ম, যেমন আমাদের ক্ষেত্রে এটা
জম্ম। আর মোক্ষলাভ করা আত্মা
বা মুক্তি পাওয়া আত্মারা তাদের
নিজের ইচ্চায় যখন দেহ ধারণ করে
তখন সেটাকে বলে অবতরণ। আর ঐ
দেহধারী আত্মাকে বলে অবতার।
.
পরমাত্মা যেহেতু সর্বত্র
আছেন সেহেতু ওনার জম্ম বা
অবতরণের প্রশ্নই আসে না। আর
তিনি যে শরীর ধারণ করেন না এটা
পবিত্র বেদে স্পষ্ট করেই বলা
আছে। পরমাত্মা তথা ঈশ্বর সম্পর্কে
পবিত্র বেদের বাণী-
.
"পরমাত্মা সর্বব্যাপক,
সর্বশক্তিমান,
শরীররহিত, ছিদ্ররহিত, স্নায়ু আদির
বন্ধন রহিত,
রোগরহিত, জম্মরহিত, শুদ্ধ,
নিষ্পাপ. সর্বজ্ঞ,
অন্তর্যামী, দুষ্টের দমন কর্তা ও
অনাদি। তিনি
তাঁহার শাশ্বত প্রজা জীবের জন্য
যথাযথ ফলের
বিধান করেন।"
যজুর্বেদ ৪০।৮.
.
উপরের বেদ মন্ত্র থেকে এটা
নিশ্চিত পরমাত্মা শরীর ধারণ করে না। অর্থাৎ দ্বাপর যুগের কৃষ্ণ পরমাত্মা তথা ঈশ্বর নয়, জীবাবতার।
সহায়কঃ-সাগর বেদবাদী, রাজন আর্য
মহাভারত
1.(রাজশেখর বসু)-https://drive.google.com/open…
2-সম্পূর্ণ মহাভারত-কালীপ্রসন্ন সিংহ https://drive.google.com/open...
বিভিন্ন গীতার সরাসরি ডাউনলোড লিংক দেওয়া হলো।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (জগদীশচন্দ্র ঘোষ) (বড়) - https://bit.ly/2l6pxfL
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (জগদীশচন্দ্র ঘোষ) (ছোট) - https://bit.ly/2mos3hi
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (শ্রীচৈতন্য সারস্বত মঠ) - https://bit.ly/2kJXORB
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (যথার্ত গীতা) (অড়গড়ানন্দ) - https://bit.ly/2lgjtkA
শিব গীতা - https://bit.ly/2mLvGOF
অবধূত গীতা - https://bit.ly/2kKnUnA
অষ্টাবক্র গীতা - https://bit.ly/2mipBsS
অনুগীতা - https://bit.ly/2mirHJg
দেবী গীতা - https://bit.ly/2lgqIZO
ব্যাধ গীতা - https://bit.ly/2lg4qr6
শান্তি গীতা - https://bit.ly/2mfADix
রাম গীতা - https://bit.ly/2mk0ENP
পাণ্ডব গীতা - https://bit.ly/2mGbduy
অর্জুন গীতা - https://bit.ly/2kO386E
গৌড়ীয় গীতা - https://bit.ly/2lg9RGD
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (গীতা যথাযথ) (প্রভুপাদ) - https://bit.ly/2mOCTh3
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (শক্তিবাদ ভাষ্য) - https://bit.ly/2lgzOWB
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (অধরচন্দ্র চক্রবর্তী) - https://bit.ly/2mJ5Iv7
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (আশুতোষ দাস) -https://bit.ly/2mNiclE
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (কালীপ্রসন্ন সিংহ) - https://bit.ly/2mfMddv
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (কৃষ্ণানন্দ) - https://bit.ly/2mpB5dZ
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (কেদারনাথ দত্ত) - https://bit.ly/2mOmYPO
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (কৈলাসচন্দ্র) (শঙ্কর-আনন্দগিরি-শ্রীধর টিকা সহ) - https://bit.ly/2lgKJzq
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (গান্ধী ভাষ্য) - https://bit.ly/2kL2BCt
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (দেবেন্দ্র) - https://bit.ly/2mNqlGK
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (ধ্রুবানন্দ) - https://bit.ly/2mhtUVt
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (নবীনচন্দ্র সেন) - https://bit.ly/2mJODkM
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (নারায়ণ দাস) - https://bit.ly/2mkjww9
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (প্রমথনাথ তর্কভূষণ) - https://cutt.ly/kw13H97
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (প্রশন্নকুমার শাস্ত্রী) - https://cutt.ly/9w135zL
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (মথুরানাথ তর্করত্ন) - https://cutt.ly/mw18uZQ
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (লক্ষ্মণ শাস্ত্রী) - https://cutt.ly/5w18zN9
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (শশীধর তর্কচূড়ামনি) - https://cutt.ly/Rw18T9q
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (সতেন্দ্রনাথ ঠাকুর) - https://cutt.ly/Uw18NH7
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (কৃষ্ণাপ্রসন্ন সেন) - http://tiny.cc/0qsadz
বাংলা গীতা ও অনুগীতা (বিপনবিহারী) - http://tiny.cc/jvsadz
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (প্রচীন গীতা, ৭০ শ্লোক) - http://tiny.cc/dxsadz
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (শঙ্করাচার্য) (ইংরেজী) - http://tiny.cc/mzsadz
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা - (বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়) - http://tiny.cc/lysadz
২৫ টি ভিন্ন ভিন্ন গীতা একত্রে - http://tiny.cc/b0sadz



No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ