![]() |
কঠ উপনিষদ |
কঠ উপনিষদ (কঠোপনিষদ / কঠোপনিষত্) বা কঠক হল অন্যতম মুখ্য উপনিষদ্। আদি শঙ্কর এই উপনিষদের ভাষ্য রচনা করেছিলেন। এটি কৃষ্ণ যজুর্বেদের চারক-কঠ শাখার অন্তর্গত এবং বৈদিক সংস্কৃত ভাষার ইতিহাসে সূত্রসাহিত্যের যুগে রচিত। এটিতে বৌদ্ধ চিন্তাধারার কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। তাই মনে হয়, এটি সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের পরে লেখা। মুক্তিকা উপনিষদে ১০৮টি উপনিষদের যে তালিকা পাওয়া যায়, তাতে এই উপনিষদের স্থান তৃতীয়। কঠ উপনিষদ্ দুটি “অধ্যায়াস” বা অধ্যায়ে বিভক্ত। অধ্যায়গুলি আবার তিনটি করে “বল্লী” বা উপপর্বে বিভক্ত। প্রতিটি বল্লীতে ১৫ থেকে ২৯টি করে শ্লোক আছে। এই উপনিষদের কয়েকটি পংক্তি ভগবদ্গীতা-র সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। আধুনিক গবেষকদের মতে, এই উপনিষদে দ্বৈতবাদী দর্শনের পরিচয় পাওয়া যায়।
প্রামাণিক ঋষিকৃত উপনিষদ গুলি হলো –১. ঈশ, ২. কেন, ৩. কঠ, ৪. প্রশ্ন, ৫. মুণ্ডক, ৬. মাণ্ডুক্য, ৭. ঐতরেয়, ৮. তৈতরীয়, ৯. ছান্দোগ্য, ১০. বৃহদারণ্যক, ১১. শ্বেতাশ্বতর।
প্রামাণিক ঋষিকৃত উপনিষদ গুলি হলো –১. ঈশ, ২. কেন, ৩. কঠ, ৪. প্রশ্ন, ৫. মুণ্ডক, ৬. মাণ্ডুক্য, ৭. ঐতরেয়, ৮. তৈতরীয়, ৯. ছান্দোগ্য, ১০. বৃহদারণ্যক, ১১. শ্বেতাশ্বতর।
কঠ উপনিষদ – প্রথম অধ্যায় – প্রথম বল্লী – শ্লোক ১-৪
১:১:১-৪ রাজস্রবস্ উদ্দালক নামক মুনির ‘বিশ্বজিৎ’ নামক যজ্ঞের অনুষ্ঠান; তৎকর্ত্তৃক গো-দক্ষিণা দানকালে তৎপুত্র নচিকেতার পিত্র-সমীপে আত্ম-সম্প্রদানের প্রার্থণা এবং ক্রুদ্ধ উদ্দালক-কর্ত্তৃক নচিকেতাকে –
শ্লোক ১-৪
উশন্ হ বৈ বাজশ্রবসঃ সর্ববেদসং দদৌ।
তস্য হ নচিকেতা নাম পুত্র আস।।১।।
তস্য হ নচিকেতা নাম পুত্র আস।।১।।
[বক্ষমাণ ব্রহ্মবিদ্যার শ্রোতার শ্রদ্ধা সমুৎপাদনার্থ বেদ নিজেই একটি আখ্যায়িকার অবতারণা করিয়াছেন]—বাজ অর্থ—অন্ন, সেই অন্নদান করিয়া যিনি যশস্বী হইয়াছিলেন, তিনি ‘বাজশ্রবাঃ’; তাঁহার পৌত্র প্রভৃতি সন্তানকে ‘বাজশ্রবস’ বলা যায়। উদ্দালক-পুত্র সেই বাজশ্রবস মুনি ‘বিশ্বজিৎ’ নামক যজ্ঞ করিয়াছিলেন; তিনি তাহাকে স্বর্গলোক লাভের ইচ্ছায় সমস্ত সম্পত্তি দান করিয়াছিলেন। ‘নচিকেতস্’ নামে তাঁহার একটি পুত্র ছিল।
শঙ্কর ভাষ্যানুবাদ।–এই উপনিষদে ব্রহ্মবিদ্যার স্তুতি বা প্রশংসার্থ আখ্যায়িকা (অল্প) প্রদত্ত হইয়াছে। ‘উশন্’ অর্থ—ফলকামী, ‘হ’ ও ‘বৈ’ কথা দুইটি নিপাত শব্দ (ব্যাকরণের কোন নিয়মানুযায়ী পদ নহে)। অতীত ঘটনা স্মরণ করান ঐ দুইটি পদের অর্থ। ‘বাজ’ অর্থ—অন্ন; অন্নদানে যাঁহার যশ আছে, তাঁহার নাম ‘বাজশ্রবস্’। অথবা, উহা অর্থহীন নাম মাত্র। বাজশ্রবার পুত্র—‘বাজশ্রবস’ নামক ঋষি যজ্ঞের যথোক্ত ফল পাইবার নিমিত্ত সর্ব্বমেধ (যাহাতে সমস্ত সম্পত্তি দান করিতে হয়; সেই) ‘বিশ্বজিৎ নামক যজ্ঞ করিয়াছিলেন। তিনি এই যজ্ঞে (নিজের) সমস্ত সম্পত্তি দান করিয়াছিলেন। সেই যজমানের (যিনি যজ্ঞ করেন) নচিকেতা নামে এক পুত্র ছিল।।১।।
তঁ হ কুমারঁ সন্তং দক্ষিণাসু
নীযমানাসু শ্রদ্ধাবিবেশ সোঽমন্যত।।২।।
নীযমানাসু শ্রদ্ধাবিবেশ সোঽমন্যত।।২।।
পিতা যজ্ঞ-দক্ষিণা স্বরূপ জরা জার্ণ গোসকল ব্রাহ্মণকে দান করিতেছেন, এস্মন সময় সেই বালক নচিকেতার হৃদয়ে শ্রদ্ধার উদ্রেক হইল; তিনি মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন।।২।।
শঙ্কর ভাষ্যানুবাদ।–সেই নচিকেতা কুমার—প্রথমবয়সে স্থিত। অর্থাৎ তখনও সন্তানোৎপাদন শক্তি লাভ করে নাই, এরূপ বালক হইলেও পিতার হিতাকাঙ্খা বশতঃ তাহাতে (তাহার হৃদয়ে) শ্রদ্ধা অর্থাৎ আস্তিক্যবুদ্ধি (শাস্ত্রের ও ঋষিবাক্যের সভ্যতায় দৃঢ় বিশ্বাস) প্রবিষ্ট হইয়াছিল। কোন্ সময়? তাই বলিতেছেন,–পিতা যখন ঋত্বিক্গণ ও সদস্যগণের উদ্দেশে দক্ষিণা লইয়া যাইতেছেন,–অর্থাৎ যজ্ঞের ব্রতী ও ক্রিয়ার দোষগুণ পরীক্ষক সদস্যগণের দক্ষিণার্থ যখন পৃথক পৃথক ভাবে গোসকল উপস্থাপিত করিতেছেন*, সেই সময়—নচিকেতা শ্রদ্ধাযুক্ত হইয়া মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলেন–।।২।।
পীতোদকা জগ্ধতৃণা দুগ্ধদোহা নিরিন্দ্রিযাঃ।
অনন্দা নাম তে লোকাস্তান্ স গচ্ছতি তা দদত্।।৩।।
অনন্দা নাম তে লোকাস্তান্ স গচ্ছতি তা দদত্।।৩।।
সে সকল গো [জন্মের মত জল পান করিয়াছে, তৃণ ভক্ষণ করিয়াছে, দুগ্ধ দান করিয়াছে, এবং ইন্দ্রিয়রহিত হইয়াছে। যে লোক সেই সকল গো দান করে, সে লোক আনন্দ অর্থাৎ দুঃখ-বহুলরূপে প্রসিদ্ধ লোকে গমন করে।।৩।।
শঙ্কর ভাষ্যানুবাদ।–কিরূপ ভাবনা করিয়াছিলেন? “পীতোদকাঃ” ইত্যাদি বাক্যে তাহা কথিত হইতেছে; দক্ষিণার্থে প্রদেয় গোসকলের বিশেষণ প্রদত্ত হইতে;–যে সকল গো পীতোদক—যাহারা শেষ উদক (জল) পান করিয়াছে, (আর পান করিবে না) জগ্ধতৃণ—যাহারা [জন্মের মত] তৃণ ভক্ষণ করিয়াছে, (আর ভক্ষণ করিবে না), দুগ্ধদোহ যাহাদের শেষ ক্ষীর দোহন করা হইয়াছে (আর দোহন করিতে হইবে না), এবং নিরিন্দ্রিয়—আর সন্তানোৎপাদনে অসমর্থ,–অর্থাৎ জরাজীর্ণ ও নিষ্ফল। যে যজমান (যজ্ঞকর্ত্তা) এবংভূত গোসকলকে দক্ষিণাবুদ্ধিতে প্রদান করে, সেই যজমান তাদৃশ দানের ফলে সেই যে, প্রসিদ্ধ আনন্দরহিত—অসুখময় লোক, তাহাতে গমন করে।।৩।।
স হোবাচ পিতরং তত কস্মৈ মাং দাস্যসীত।
দ্বিতীযং তৃতীযং তঁ হোবাচ মৃত্যবে ত্বা দদামীতি।।৪।।
দ্বিতীযং তৃতীযং তঁ হোবাচ মৃত্যবে ত্বা দদামীতি।।৪।।
নচিকেতার চিন্তা প্রণালী উপসঙ্ঘার করতঃ এখন উক্তির প্রণালী নির্দ্দেশ করিতেছেন,–সেই নচিকেতা পিতাকে বলিলেন, পিতঃ! আপনি আমাকে কোন ঋত্বিকের উদ্দেশ্যে দান করিবেন? অভিপ্রায় এই যে, যদি আমাকে দান করিয়াও যজ্ঞের কথঞ্চিত উপকার হইতে পারে, তাহা করা উচিত। নচিকেতা এইরূপে দুইবার, তিনবার পিতাকে বলিলেন; [অনন্তর, পিতা ক্রুদ্ধ হইয়া] পুত্রকে বলিলেন যে, তোমাকে যমের উদ্দেশ্যে দান করিলাম।।৪।।
শঙ্কর ভাষ্যানুবাদ।–নচিকেতা ভাবিতে লাগিলেন—এইরূপে যজ্ঞের অপূর্ণতা বা অঙ্ঘীনতা-নিবন্ধন পিতার যে অনিষ্ট ফল হইতেছে, আমি তাঁহার পুত্র; আমার পক্ষে প্রাণ দিয়াও যজ্ঞের পূর্ণতা সম্পাদনপূর্ব্বক সেই অনুষ্ট নিবারণ করা আবশ্যক। নচিকেতা এইরূপ মনে করিয়া পিতার সমীপে উপস্থিত হইলেন এবং পিতাকে বলিতে লাগিলেন,–তত! (পিতঃ!) আমাকে দক্ষিণাস্বরূপ কোন ঋত্বিকের উদ্দেশে প্রদান করিবে? নচিকেতা এইরূপ বলিলেও পিতা প্রথমতঃ তাহা উপেক্ষা করিলেন। কিন্তু নচিকেতা উদ্দেশে দান করিবেন,–আমাকে কাহার উদ্দেশে দান করিবেন? নচিকেতা দুই তিনবার এইরূপ বলিলেন পর, পিতা বুঝিলেন যে, ইহার স্বভাব ত বালকের মত নহে [নিতান্ত ধৃষ্টতাপূর্ণ], তখন ক্রোধ সহকারে পুত্রকে বলিলেন,–বৈবস্বত (সূর্য্য-পুত্র) মৃত্যুর উদ্দেশে তোমাকে দান করিতেছি।।৪।।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ