গীতার আমি রহস্য উন্মোচন - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

12 August, 2018

গীতার আমি রহস্য উন্মোচন

অহং ব্রহ্মাস্মি

ঈশ্বরের অবতরণ, অবতার ভ্রান্ত ধারণা
রেফারেন্সঃ-[ঋগ্বেদ০ ৪।১।১, ৮।৭২।৩, যজু০ ৩২।২, ৪০।৮]
শ্রীমদ্ভগবত গীতার "আমি" রহস্য উন্মোচন
★★শ্রীমদ্ভগবদ গীতার এই শ্লোকটি খেয়াল করুন,
মনুষ্যাণাং সহস্রেষু কশ্চিৎ যততি সিদ্ধয়ে।
যততামপি সিদ্ধানাং কশ্চিন্মাং বেত্তি তত্ত্বতঃ।।
গীতা = ৭/৩
অনুবাদঃ হাজার হাজার মানুষের মধ্যে কোনো একজন আমাকে লাভ করবার জন্য যত্ন করেন, এবং সেই যত্নকারীদের মধ্যে হয়তো কেউ আমাকে তত্ত্বতঃ জানতে পারেন।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, সেই আমি টা কে? আমি টা কি শ্রীকৃষ্ণ নাকি অন্যকেউ? অন্যকেউ বলতে সেই পরমসত্ত্বা পরব্রহ্ম... আর এই আমাকে জেনে লোকের কি অবস্থা হয়?
একটু পিছনে ফিরে আমরা উপনিষদে যাই,
★★যথা নদ্যঃ স্যন্দমানাঃ সমুদ্রে অস্তম্ গচ্ছন্তি নামরূপে বিহায়। তথা বিদ্বান্ নামরূপাদ্ বিমুক্তঃ পরাৎপরং পুরুষমুপৈতি দিব্যম্।। মুণ্ডক উপনিষদ, ৩/২/৮।।
★অনুবাদঃ যেরূপ প্রবহমান নদীগুলো নামরূপ ত্যাগ করে সমুদ্রে বিলীন হয়ে যায়, সেইরূপ জ্ঞানী মহাত্মাও নাম রূপ থেকে মুক্ত হয়ে উত্তম থেকে উত্তম দিব্য পরমপুরুষ পরমাত্মাকে প্রাপ্ত হন।
আর এই পরমাত্মাকে লাভ করার পর কি অবস্থা হয়, এর পরের মন্ত্রে আমরা দেখে নেই...
★★ স যো হ বৈ তৎপরমং ব্রহ্ম বেদ ব্রহ্মৈব ভবতি।।মুণ্ডকোপনিষদ, ৩/২/৯।।
★অনুবাদঃ নিশ্চয়ই যে কেহ ঐ পরব্রহ্ম পরমাত্মাকে জানেন সে ব্রহ্মই হয় অর্থাৎ ব্রহ্মস্বরূপতা লাভ করে ব্রহ্মের মতই আচরণ করেন।
ঠিক যেভাবে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ গীতায় আচরণ করেছিলেন, তেমনি কিছু আচরণ আমরা দেখে নেই...
প্রথমেই
প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদ থেকেই দেখে নেই বেদ কি বলে,
★★প্র তদ্ বোচেদ্ অমৃতস্য বিদ্বান্ গন্ধর্বো ধাম পরমং গুহ্য যৎ। ব্রীণি পদানি নিহিতা গুহাস্য যস্তানি বেদ স পিত্বষ্পিতাসৎ।। অথর্ববেদ = ২/১/১/২।।
★অনুবাদঃ অমৃত(অবিনাশী) ব্রহ্মের স্বরূপ জেনে, আদিত্য উপাসকদের কাছে সে ব্রহ্মতত্ত্ব বলুক। সে ব্রহ্মের আবৃত্তি রহিত পরমস্থান, হৃদয়রূপ গুহায় স্থিত। এই পরমাত্মার তিনটি পদ গুহায় নিহিত আছে। গুহানিহিত পদার্থের মত অজ্ঞাত অপরিচ্ছন্ন ব্রহ্ম কেবল উপদেশের দ্বারা জ্ঞাত হয়। এ পরব্রহ্মের তিন পদ (অংশস্বরূপ) বিরাট, হিরন্যগর্ভ ও ঈশ্বর মুমুক্ষগন লাভ করেন। শম-দমাদি সম্পন্ন অধিকারী গুরুর উপদেশ দ্বারা জীব ও ঈশ্বরের উপাধি ত্যাগ করে সে নিষ্কল ব্রহ্মের সাক্ষাৎ লাভ করে থাকে। যে তাকে জানে, সে নিজ জনকেরও কারণভূত (পিতা) হয় অর্থাৎ সর্ব্বজগতের অধিষ্ঠানরূপ ব্রহ্মের সাথে নিজেরও সর্বজগৎ-কারণত্ব উপলব্ধি করে।
এখন বেদের আলোকেই তার প্রমাণ দেখে নেই, অথর্ববেদে_অম্ভৃণ মহর্ষির দুহিতা বাক্ নাম্নী ব্রহ্মবাদিনী বলছেন...
অহং রুদ্রেভির্বসুভিশ্চরাম্যহমাদিত্যৈরুত বিশ্বদেবৈঃ।
অহং মিত্রাবরুণোভা বিভর্ম্যহমিন্দ্রাগ্নী অহমশ্বিন্যেভা।।
অথর্ববেদ, ৪র্থ কাণ্ড/৬ষ্ট অনুবাক/৫ম সূক্ত/১নং মন্ত্র।
অনুবাদঃ আমি একাদশ রুদ্র ও অষ্ট বসুগণের সাথে অভিন্নরূপে বিচরণ করি। সেরূপ আদিত্যগণ ও বিশ্বদেবগণের সাথে অভিন্নরূপে আমি বর্তমান। আমিই পরব্রহ্মাত্মিকা মিত্র ও বরুণদেবকে ধারণ করি, ইন্দ্র ও অগ্নিকে আমিই ধারণ করি এবং উভয় অশ্বিনীকুমারদ্বয়কেও আমিই ধারণ করি।
এখানে "আমি" শব্দ দ্বারা মন্ত্রের বক্তাকে ঈশ্বর মানলে ঋষিকন্যা বাক্ কেও তো ঈশ্বর হিসেবে মানতে হয়। ব্যাপারটা কি তাই নয়?
আবার ঋগ্বেদে ৪র্থ মণ্ডলে ২৬ নং সূক্তের ১ম পংক্তিতে ঋষি বামদেব বলছেন,
★অহং মনুরভবং, সূর্যশ্চাহং কক্ষীবী ঋষিরস্মি বিপ্রঃ।
অহং কুৎসমার্জুনেয়ং ন্যৃংজে অহং কবিরুশনা পশ্যতা মা।।
অর্থাৎ আমি মনু, আমি সূর্য, আমি মেধাবী কক্ষীবান ঋষি, আমি অর্জুনীর পুত্র কুৎস ঋষিকে অলংকৃত করেছি। আমি কবি উশন। আমাকে দর্শন কর।
তাহলে এখানে কি ঋষি বামদেব কেও ঈশ্বর মানা উচিত নয়?
★★ছান্দোগ্য উপনিষদেও সনৎকুমার তাঁর শিষ্য নারদকে বলেছেন-
"★স এবাধস্তাৎ স উপরিষ্টাৎ স পশ্চাৎ স পুরস্তাৎ স দক্ষিণতঃ স উত্তরতঃ স এবেদং সর্বমিতাথাতঃ
অহঙ্কারাদেশ ___
এব অহমেবাধস্তাদহমুপরিষ্টাদহং পশ্চাদহং পুরস্তাদহং
দক্ষিণতঃ অহমুত্তরতঃ অহমেবেদং সর্বমিতি।।"
ছান্দোগ্যোপনিষদ ৭।২৫।১.
★অনুবাদঃ তিনিই নিম্নে, তিনিই উর্ধ্বে, তিনি পশ্চাতে, তিনি সম্মুখে, তিনি দক্ষিণে, তিনি উত্তরে,--তিনিই এই সমস্ত।
আমিই অধো ভাগে, আমিই উর্ধ্বে, আমিই পশ্চাতে, আমিই সম্মূখে, আমিই দক্ষিণে, আমিই উত্তরে-আমিই এই সমস্ত।
এখানে সনৎকুমার, গীতার শ্রীকৃষ্ণের মতন দু'রকম কথা বলেছে, তাহলে শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর মানলে, সনৎকুমারকেও ঈশ্বর হিসেবে মানতে হবে। তাই নয় কি? বিচার করুন...
আবার তৈত্তিরীয় উপনিষদে বলা হয়েছে –
★★অহং বৃক্ষস্য রেরিবা। কীর্তিঃ পৃষ্ঠং গিরেরিব। উর্ধ্বপবিত্রো বাজিনীব স্বমৃতমস্মি। দ্রবিণং সবর্চসম্। সুমেধা অমৃতোক্ষিতঃ। ইতি ত্রিশঙ্কোর্বেদানুবচনম্।।
তৈত্তিরীয় উপনিষদ– শীক্ষাবল্লী ১০ম অনুবাক।
★অনুবাদঃ আমি সংসাররূপ বৃক্ষের উচ্ছেদক, আমার কীর্তি পর্বতের শিখরের মতো উন্নত। অন্নোৎপাদক শক্তিযুক্ত সূর্য উত্তম অমৃতের মতো, সেইরূপ আমিও অতিশয় পবিত্র অমৃত স্বরূপ তথা আমি প্রকাশযুক্ত ধনের ভাণ্ডার, পরমানন্দময় অমৃত দ্বারা অভিসিঞ্চিত তথা শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিসম্পন্ন– এরূপ এই ত্রিশঙ্কুর ঋষির অনুভূত বৈদিক প্রবচন।
তাহলে এখানে ত্রিশঙ্কুর ঋষিকেও ঈশ্বর বলে মান্য করতে হয়, তাই ত? ।
★★তৈত্তিরীয় উপনিষদে আরও বলা হয়েছে...
★★হা৩বু হা৩বু হা৩বু।
অহমন্নমহমন্নমহমন্নম্। অহমন্নাদো৩হহমন্নাদো৩হহমন্নাদঃ। অহং শ্লোককৃদহং শ্লোককৃদহং শ্লোককৃহং শ্লোককৃৎ। অহমস্মি প্রথমজা ঋতা৩স্য। পূর্বং দেবেভ্যোহমৃতস্য না৩ভায়ি। যো মা দদাতি স ইদেব মা৩বাঃ। অহমন্নমন্নমদন্তমা৩দ্মি। অহং বিশ্বং ভুবনমভ্যভবা৩ম্।। সুবর্ণ জ্যোতীঃ য এবং বেদ। ইত্যুপনিষৎ।।
তৈত্তিরীয়_উপনিষদ–ভৃগুবল্লী ১০ম অনুবাক।
অনুবাদঃ আশ্চর্য! আশ্চর্য! আশ্চর্য! আমি অন্ন, আমি অন্ন, আমি অন্ন। আমিই অন্ন ভোক্তা, আমি অন্ন ভোক্তা, আমিই অন্ন ভোক্তা। আমি সংযোগকারী, আমি সংযোগকারী, আমি সংযোগকারী। আমি সত্যের অর্থাৎ প্রতক্ষ্য জগত অপেক্ষা সর্ব প্রধান ও সর্ব প্রথম উৎপন্ন এবং দেবতাগণ হতেও পূর্বে বিদ্যমান অমৃতের কেন্দ্র হচ্ছি আমি। যে কেউ আমাকে অন্ন দেয় সে কার্য দ্বারা আমার রক্ষা করে। আমিই অন্নস্বরূপ হয়ে অন্ন ভক্ষণকর্তাকে ভক্ষণ করি। আমি সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডকে অভিভূত করি। আমার প্রকাশের এক ঝলক সূর্যের ন্যায়। যে এরূপ জানে সেও স্থিতি লাভ করে। এরূপ এই উপনিষদ সমাপ্ত।
তাহলে এই আমি বলতে কি বুঝায় তার সমাধান কি?
বেদাঙ্গের অন্যতম "নিরুক্ত" তে ঋষি যাস্ক বলেছেন,
★★সাক্ষাত্কৃতধর্মোণ ঋষয়ো বভূবুস্তেহবরেভ্যোহসাক্ষাত্ কৃতধর্মস্য উপদেশেন মন্ত্রানসম্প্রাদু।
নিরুক্ত ১।১৯
অনুবাদঃ তপের বল দ্বারা যারা ধর্মের সাক্ষাৎ করেছেন তারাই (ধর্মের সাক্ষাৎ দ্রষ্টা ঋষি) এবং তাহারাই যারা ধর্মের সাক্ষাৎ করেন নি তাদের উপদেশ দিয়েছেন।
★ শ্রীকৃষ্ণ একজন যোগী ছিলেন তার প্রমাণ স্বয়ং গীতাতেই দেওয়া হয়েছে। গীতার ১৮/৭৮ এ শ্রীকৃষ্ণকে যোগী এবং ১৮/৭৫ এ তাঁকে যোগেশ্বর অর্থাৎ যোগে সিদ্ধ পুরুষ বলা হয়েছে।
মহাভারতের অশ্বমেধিক পর্বের ১৬-তম অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণর নিজেই বলেছেন,
★যুদ্ধের পরে অর্জুন যখন সেই গীতার উপদেশ পুনরায় শুনতে চেয়েছিলেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন -
★বিদিতং মে মহাবাহো সংগ্রামে সমুপস্থিতে।
মহাত্ম্যং দেব দেবকীমাতস্তশ্চতে রূপমৈশ্বরম্।। ১৬/৫।।
অনুবাদঃ মহাবাহো! দেবকীনন্দন! যখন সংগ্রামের সময় উপস্থিত ছিলো, সেই সময় আমার মহাত্মার জ্ঞান এবং ঈশ্বরীয় স্বরূপের দর্শন হয়েছিলো।
★★যত্ তত্ ভগবতা প্রোক্তং পুরা কেশব সৌহৃদাত্। তত্ সর্বৈ পুরুষব্যাগ্র নষ্টং মে ভ্রষ্টচেতসঃ।।১৬/৬।।
অনুবাদঃ কিন্তু কেশব! নিজ সৌহার্দ্যবশতঃ প্রথমে আমাকে যে জ্ঞানের উপদেশ দিয়েছিলেন, আমার সেসব জ্ঞান ওই সময় বিচলিতচিত্ত হওয়ার কারণে নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
★★মম কৌতুহলং ত্বস্তি তেষ্বর্থেষু পুনঃ পুনঃ। ভবাংস্তু দ্বারকাং গন্তা নচরাদিব মাধব।।১৬/৭।।
অনুবাদঃ মাধব! সেই বিষয় শোনার জন্য আমার মন বারংবার উৎকন্ঠিত হচ্ছে। আপনি শীঘ্রই দ্বারকা গমন করবেন, অতঃ সেই বিষয় আমাকে শুনিয়ে দিন।
এ কথা শুনে শ্রীকৃষ্ণ অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে অর্জুনকে বললেন -
★★শ্রাবিতস্ত্বং ময়া গুহ্যংজ্ঞাপিতশ্চ সনাতনম্।
ধর্মৈ স্বরূপিণে পার্থ সর্বলোকাংশ্চ শাশ্বতান্।।১৬/৯।।
অবুদ্ধয়া নাগ্রহীর্যস্ত্বং তন্মে সুমহদপ্রিয়ম্।
ন চ সাদ্য পুনর্ভূয়ঃ স্মৃতির্মে সম্ভবিষ্যতি।।১৬/১০।।
অনুবাদঃ হে অর্জুন! সেই সময় তোমাকে অত্যন্ত গোপনীয় জ্ঞানের শ্রবন করিয়েছিলাম। নিজ স্বরুপভূত ধর্ম সনাতন পুরুষোত্তমত্বের পরিচয় দিয়েছিলাম এবং (শুক্ল কৃষ্ণ গতির নিরুপন করে) সম্পূর্ণ নিত্য লোকেরও বর্ণনা করেছিলাম। কিন্তু তুমি যে নিজে না বোঝার কারণে সেই উপদেশের স্মরণ করতে পারছো না, ইহা আমার অত্যন্ত অপ্রিত। সেই কথার এখন পুরোপুরি স্মরণ সম্ভব
নয়।
★★নূনমশ্রধানোহসি দুর্সেধা হ্যসি পান্ডব।
ন চ শক্য পূনর্বক্তুমশেষেণ ধনন্জয়।।১১।।
অনুবাদঃ পান্ডুনন্দন! নিশ্চয়ই তুমি বড় শ্রদ্ধাহীন, তোমার বুদ্ধি অত্যন্ত মন্দ। ধনন্জয়! এখন আমি সেই উপদেশের বর্ণনা করতে পারবো না।
★★ স হি ধর্মঃ সুপর্যাপ্তো ব্রহ্মণঃ পদবেদনে।
ন শক্যং তন্ময়া ভূয়স্তথা বক্তুমশেষতঃ।।১২।।
অনুবাদঃসেই ধর্ম ব্রহ্ম পদের প্রাপ্তি করানোর জন্য পর্যাপ্ত ছিলো। তাহার সারের ধর্ম সেই রূপে পূনরায় প্রদান করা এখন আমার বশের কথাও নয়।
★★ উপরোক্ত শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ, অর্জুনকে বললেন যে, সেই জ্ঞানের উপদেশ পূনরায় তিনি করতে পারবেন না। কেননা সেই জ্ঞানের উপদেশ করার মতো অবস্থা এখন তাহার বশে নেই। শ্রীকৃষ্ণ কেন সেই উপদেশ পূনরায় দিতে পারেননি সেই কথা স্পষ্ট করে, তিনি বলেছেন -
★★পরম হি ব্রহ্ম কথিতং যোগযুক্তেন তন্ময়া।
ইতিহাসং তু বক্ষ্যামি তস্মবন্নথৈ পুরাতনম্।। ১৬/১৩।।
অনুবাদঃ শ্রীকৃষ্ণ বললেন! সেই সময় আমি যোগযুক্ত হয়ে পরমাত্মতত্ত্বের বর্ণনা করেছিলাম। এখন সেই বিষয় এর জ্ঞান করানোর জন্য আমি এক প্রাচীন ইতিহাসের বর্ণনা করছি।
★★পরিশেষে, অর্থাৎ গীতাতে শ্রীকৃষ্ণ অষ্টাদশ অধ্যায়ে কি বলেছেন, আসুন দেখে নেই..
★★ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জুন তিষ্ঠতি ।
ভ্রাময়ন্ সর্বভূতানি যন্ত্রারূঢ়ানি মায়য়া ॥১৮/৬১॥
অনুবাদঃ- হে অর্জুন ! পরমেশ্বর ভগবান সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থান করছেন এবং সমস্ত জীবকে দেহরূপ যন্ত্রে আরোহণ করিয়ে মায়ার দ্বারা পরিভ্রমণ করান।
★★তমেব শরণং গচ্ছ সর্বভাবেন ভারত ।
তৎপ্রসাদাৎ পরাং শান্তিং স্থানং প্রাপ্স্যসি শাশ্বতম্ ॥১৮/৬২॥
অনুবাদঃ হে ভারত ! সর্বতোভাবে তাঁর শরণাগত হও। তাঁর প্রসাদে তুমি পরা শান্তি এবং নিত্য ধাম প্রাপ্ত হবে।
এখানে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ যদি ঈশ্বর হন, তবে আবার কোন ঈশ্বরের স্মরণ নিতে বললেন? বলবেন কি? তাহলে বোঝা যায়, এই গীতার বাণীগুলো অচিন্ত্যস্বরূপ পরমাত্মার বাণী। আর এখানে "আমি" তাই সেই চিন্তার অতীত ইন্দ্রিয়াতীত পরমাত্মাই।

দেহাত্মানিনাং দৃষ্টির্দেহেহহং 'মম' শব্দতঃ,
কবুদ্ধয়োনে জানন্ডি,মম ভাবমনাময়ম্।[শান্তিগীতা ৪৭]

গীতাতে 'আমি আমার' এরূপ শব্দ প্রয়োগ করাতে দেহাত্ম বুদ্ধি লোকেরা আমার দেহেতে দৃষ্টি করে আমাকে দেহরূপ জ্ঞান করে। মূঢ়েরা আমার নিত্যশুদ্ধ পরমভাব জানে না। স্বরূপবোধের পরিবর্ত্তে নরাকৃতি পরব্রহ্ম জ্ঞানে জড়মূর্ত্তি পূজা মূঢ়তা !
শান্তি গীতা পিডিফ
অহং ব্রহ্মাস্মি
মুনি ঋষিরা যোগযুক্ত অবস্থায় কেউ কেউ বলেছেন 'অহং ব্রহ্মাস্মি', আবার কেউ কেউ বলেছেন অয়মাত্মাব্রহ্ম,তার অর্থ এই নয় যে তাঁরা সকলে সর্ব্বশক্তিমান ঈশ্বর হয়ে গেছেন। উপনিষদের এই বচনগুলির বৈদিক ব্যাকরণ অনুযায়ী সঠিক অর্থ না করে অনেকে ইহার অনর্থই করেছেন। আর এই উক্তিগুলির ভিত্তি করেই
শিষ্যের দল তাদের গুরুদের অবতার বানিয়ে ছেড়েছে। এবং এই সব গুরুরা নিজেরা এক একজন স্বঘোষিত ভগবান্ হয়ে মঠমন্দির তৈরী করে শিষ্য বাড়িয়ে মানুষকে ঠকিয়ে ব্যবসা করে খাচ্ছে। উপরিক্ত উপনিষদের বচনগুলি সমাধি প্রাপ্ত যোগী বা মুক্তাত্মা সম্বন্ধে বলা হয়েছে বুঝতে হবে।
জীবাত্মা নির্গুণ বলে পরমাত্মার সহিত পূর্ণ ভাবে সম্বন্ধ উৎপন্ন করে,তাহাতে যোগী সমাধি প্রাপ্ত হয়ে তদাকার হয়ে ব্রহ্মভাব ধারণ করে,যা য়োগীরাজ শ্রীকৃষ্ণের হয়েছিল। মুনি ঋষিরা তাঁদের ওই অবস্থার ব্যাখ্যার জন্য "অহংব্রজ্মাস্মি,অয়মাত্মা ব্রহ্ম,তত্ত্বমসি" ইত্যাদি বচন সমূহের ব্যবহার করেছেন। কাউকে ভ্রমে পতিত করার জন্য নহে।
লৌকিক সংস্কৃত দ্বারা এই সমস্ত বচনের অর্থ করা যায় না, বৈদিক ব্যাকরণ ও অভিধান পাঠ করা প্রয়োজন। মহর্ষি পাণিনীর ব্যাকরণ অষ্টাধ্যায়ীতে একটি সূত্র আছে-'তাতৎস্তোপাধি' তৎসহচরিত উপাধি। ঐস্থলে 'স্থ' শব্দ উহ্য আছে জানতে হবে। অহং ব্রহ্মাস্মি শব্দের অর্থ 'অহং ব্রহ্মস্থ অস্মি'। অর্থাৎ আমি সর্ব্বব্যাপক ব্রহ্মেই অবস্থিত আছি
এইরূপ বুঝিতে হইবে। অয়মাত্মা ব্রহ্ম শব্দে বুঝতে হবে অয়মাত্মা ব্রহ্মস্থ অর্থাৎ আমার আত্মা ব্রহ্মের আধারে অবস্থিত। তত্ত্বমসি এ ছান্দোগ্য উপনিষদের বচন। শ্বেতকেতুকে তাঁর পিতা বলেছেন তুমি সেই অন্তর্যামী পরমাত্মাকেই যুক্ত আছো।
গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন- ময়া ততমিদং সর্বং জগদব্যক্ত মূর্ত্তিনা।
মৎস্থানি সর্ব্বাভূতানি ন চাহং তেস্বাস্থিতঃ।।-গীতা।।৯।৪
অর্থাৎঃ আমি অব্যক্তরূপে এই সমস্ত জগৎ ব্যাপিয়া আছি।সমস্ত ভূত আমাতে অবস্থিত,আমি কিন্তু তৎ সমুদেয়ে অবস্থিত নই। এখানে এই "আমি"কথার অর্থ বৈষ্ণবরা বা অনেকেই শ্রী কৃষ্ণকেই প্রতিপন্ন করতে চান। কিন্তু এখানে 'আমি' অর্থে পরমাত্মার কথাই বেলছেন। কারন গীতার ৯।৫ শ্লোকে বলেছেন-
ন চ মৎস্থানি ভূতানি পশ্য মে য়োতমৈশ্বরম্।। অর্থাৎঃ তিনি অর্জুনকে যত উপদেশ দিয়েছেন, তা তিনি যোগযুক্ত অবস্থায় বলেছেন। এ কারণে তিনি গীতার বহু জায়গায় একাধিকবার পশ্য মে য়োগমৈশ্বম্ কথাটি অর্জুনের প্রতি ব্যবহার করেছেন।
আত্মজ্ঞ মহাপুরুষ যখন ভূমি থেকে ভূমার ক্ষেত্রে উঠেন, তখন দ্বৈত-ভ্রান্তি দূরে যায়, জ্ঞাতা-জ্ঞেয়-জ্ঞান, দ্রষ্টা-দৃশ্য-দর্শন, এই ত্রিপুটির লয় হয়; ব্যুত্থানের পরেও যে চিত্তবৃত্তি মানিষকে দেশকালপাত্র দেহাত্মবুদ্ধির মধ্যে পরিচ্ছিন সীমিত করে রাখে, সেই চিত্তবৃত্তির নিরোধের জন্য স্বরূপোলব্ধি হওযায়, সর্বত্রই দেখেন, সেই একই আত্মা জ্ঞাতা জ্ঞেয় জ্ঞান, দ্রষ্টা দৃশ্য দর্শনরূপে Subjectively & Objectively অভিব্যক্ত !

তরঙ্গ যদি বলে আমি জল, স্বর্ণময় অলঙ্কার যদি নামরূপ উপাধির পরিবর্ত্তে বলে আমি সোনা, তাতে যেমন ভুল হয় না তেমনি নামরূপ উপাধি বিনির্ন্মক্ত স্বরূপপলব্ধির পর, সর্ব্বত্র অভেদ-দর্শনের জন্য আত্মজ্ঞ পুরুষেরা "আত্মাদেশ" বাক্য ব্যবহার না করে পারেন না। "ব্রহ্মবিদ্ ব্রহ্মৈব ভবতি"। আত্মতত্ত্ববিদ্ মহাযোগৈশ্বর্য্যশালী মহাপুরুষ যখন শিষ্যকে উপদেশ দেন, তখন আত্মাতে সমাহিত হয়েই উপদেশ দেন। দেহাত্মবোধ থাকে না বলে, পরমাত্মার সঙ্গে একাত্ববোধের জন্য, তাঁদের সেই সময়কার উপদেশগুলি পরমাত্মারই বাণীরূপে স্ফুরিত হয়। আত্মজ্ঞ পুরুষরা এই ভূমাবোধে প্রতিষ্ঠিত হয়েই মম, মায়, মাম্ ইত্যাদি কথা ব্যবহার করেন। কপিলদেব তাঁর পিতাকে উপদেশ দিয়েছেন
"গচ্ছাকামঃ ময়া পৃষ্টো মায়সন্ন্যস্ত কর্ম্মনা, জিত্মা সুদুর্জ্জয়ং সৃত্যুম মৃত্যম মৃতত্বায় মাং ভজ"[ভাগঃ৩,২৪,৩৮]----অর্থাৎ মৃত্যুজয় এবং অমৃতত্ত্ব লাভের জন্য আমার ভজনা ক'রো। আবার ভাগবত ৫,৫,১১ তে ঋষভদেব "আমার প্রীতির জন্য কর্ম্ম করা, আমার কথা বলা, আমার ভক্তগণের সঙ্গ, আমার গুনকীর্ত্তন".. এই রকম "আমি আমার" সূচক উপদেশ দিয়েছেন। দশম স্কন্ধের উননব্বই অধ্যায়ে ভূমাপুরুষও উপদেশ কালে "মম,মাম,ময়ি শব্দ ব্যবহার করেছেন। গীতাতে যেখানে শ্রীকৃষ্ণ "মম ময়ি মাম্" ব্যবহার করেছেন, সেই সমস্তই তিনি কপিল, ঋষভ অথবা শঙ্করাচার্য্যে ইত্যাদির মত আত্মাকে লক্ষ্য করে আত্মাতে সমাহিত হয়েই বলেছেন।
ভাগবতকার কেবল শ্রীকৃষ্ণের বেলাতেই "মম,ময়ি,মাম" শব্দ ব্যবহারের কারনে, ওনাকে "স্বয়ং পরমাত্মা" বানিয়ে দিয়েছেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে ঈশ্বর বা ঈশ্বরের অবতার ছিলেন না তা মহাভারত,আশ্বমেধিক অনুগীতাপর্ব্বের ১৬ অধ্যায়ে দেখতে পায়, সেখানে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন "তৎসর্ব্বং পুরুষব্যাঘ্র ! নষ্টং মে ভ্রষ্ট চেতসঃ", আরো প্রমান গীতা ১১।৪৭-৪৮ ও মহাভারত, উদ্দোগপর্ব্ব,১৩১ অঃ পড়লে বুঝতে পারি। আরো প্রমান মহাভারত আশ্বমেধিক, অনুগীতাপর্ব্বের ১১,১২,১৩ যেখানে অর্জ্জুন পুনঃ শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ শোনার আগ্রহ করায়, শ্রীকৃষ্ণ অর্জ্জুন কে বলছেন "তুমি নির্ব্বোধ; যথাযথ শ্রদ্ধা তোমার নেই। আমার সে স্মৃতিও নেই। যোগযুক্ত অবস্থায় পরব্রহ্ম বিষয়ে তখন যা বলেছিলাম তা এখন অশেষ ভাবে আমি বলতে অক্ষম।
"গীতা ২।২৭ [জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুর্ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ। তস্মাদপরিহার্যেহর্থে ন ত্বং শোচিতুমর্হসি।।] এখানে বলা আছে জন্মগ্রহনকারীর মৃত্যু নিশ্চিত এবং তার পুনরায় জন্মও নিশ্চিত। যদি ঈশ্বরের জন্ম স্বীকার করা হয় তবে ঈশ্বর জন্ম মৃত্যুরড় চক্রে আবদ্ধ হয়ে পড়বে।

মহাত্মা বীর-শ্রেষ্ঠ, আপ্ত-পুরুষ, যোগীরাজ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের গৌরবকে কলঙ্কিত করার জন্য তাঁকে বৈষ্ণব ও ইসকনেরা ঈশ্বর বানিয়ে ভারতবর্ষের মেরুদন্ড কে পঙ্গু করছে....মেঘাস্থিনিসের বিবরণ থেকে জানা যায়, তিনি যখন গ্রীক রাজদূতরূপে চন্দ্রগুপ্তের রাজসভায় এসেছিলেন তখন অর্থাৎ খৃঃপূঃ তৃতীয় শতাব্দী পর্যন্ত্য শ্রীকৃষ্ণকে মহামানবরূপেই মানতেন, মানতেন রাজনীতি সমাজনীতি লোকনীতি সববিষয়েই একজন ভূয়োদর্শীরূপে, পরে পরে বেদব্যাসের নাম দিয়ে ভাগবত রচনা করে সবকিছু বিকৃত করেছেন বৈষ্ণব পাদদের মত কিছু সত্যান্বেষী.. ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বরের উপাসনা করতেন [শ্রীমদ্ভাগবত ১০।৭০]

" মুক্তাত্মা" সম্পর্কে অনান্য শাস্ত্রের প্রমান
জিতেন্দ্রিয় পুরুষ মোক্ষ প্রাপ্ত হন। আর মোক্ষ লাভের পর জগতের কল্যাণের জন্য শরীর ধারণ পূর্বক জগতে বিচরণ করেন।
अपश्यं गोपामैनपद्यमानमा च परा च पृथिभिश्चर॑न्तम् ।
स सध्रीचीः स विषूचीर्वसान आ वरीवर्ति भुवनेष्वन्तः [ অথর্ববেদ - ৯/১০/১১ ]
১.(গোপাম্) যারা ইন্দ্রিয়ের রক্ষা করে (অনিপদ্যমানম্) বার বার বিবিধ যোনীতে অবতরণ করতে (অপশয়ম্) আমি দেখেছি। জিতেন্দ্রিয়তা দ্বারা মুক্ত হওয়া ওই পুরুষকে ( আ চ পরা চ) নিকটে এবং দূরে - আমাদের নিকট আসে আবার আমাদের ছেড়ে দূরে চলে যায় (মার্গং সে চরন্তম্) বিচরণ করতে আমি দেখেছি। যেখামে আমরা আছি সেখানেও আসে আবার অন্য লোক-লোকান্তরেও চলে যায়।
২.(সঃ)ওই মুক্তাত্মা মানবকল্যাণ/লোকহিতের জন্য (সঘ্রীচী) যে শরীরের সাথে আমাদের ওঠা-বসা সেই শরীর ধারণ করে। এই শরীরের মাধ্যমেই আমাদের উপদেশ দেন এবং নিজের জন্মের উদ্দ্যেশ্য পূরণ করে। (সঃ বিষূচী) সেই মুক্তাত্মা বিভিন্ন লোকে শরীর ধারণ করে এবং ( ভূবনেষু অন্ত ) এই ভূবনে বিচরণ করে । লোকহিতের জন্য এই পুরুষকে " অতিমানব " বা মহাপুরুষ বলা হয়।
ভাবার্থ : জিতেন্দ্রিয় পুরুষ মুক্তাত্মা হয়ে যায়। সে সময় - সময় লোকহিতের জন্য শরীর ধারণ করে এই ভূবনে বিচরণ করেন। -[ আধ্যাত্মিক ভাষ্যঃ পন্ডিত হরিশরণ সিধান্তালংকার ]

স স্মা কৃণোতি কেতুমা নংক্ত চিদ্ দূর আ সতে।
পাবকো যদ্বনস্পতীন্প্র স্মা মিনাত্যজরঃ।।ঋগ্বেদ (৫/৭/৪)
পদার্থঃ (সঃ) সেই (পাবকঃ) প্রভু আমাদের জীবনকে পবিত্রকারী (নংক্ত চিত্) রাত্রিতেও, অত্যন্ত অন্ধকারেও এমনকি (দূরে আসতে) সর্বদা দূরে স্থিত পুরুষের জন্যেও (কেতুম্) [ জ্ঞানের আলোকে ] প্রকাশিত (আকৃণোতি স্ম) করেন প্রভু। বস্তুত প্রভুর কৃপাতেই আমরা [ জ্ঞানের ] আলোকে প্রাপ্ত হই। এই আলোকে তখন প্রাপ্ত করি (যদ্) যখন (অজরঃ) কখনো জীর্ণ হয় না সেই প্রভু (বনস্পতীন্) জ্ঞান রশ্মির [ প্রাপ্তকারী ] স্বামীদের, জ্ঞানী পুরুষদের, মুক্তাত্মা পুরুষদের (প্র আ মিনাতি স্ম) একবার পুনরায় পৃথিবীতে স্থাপন করেন। প্রভুর প্রেরণাতেই এই মুক্তাত্মা জন্ম-মৃত্যুর কষ্টকে স্বীকার করে এই পৃথিবীতে আসেন আর লোকজনকে প্রভুর সন্দেশ শুনান।
ভাবার্থঃ প্রভুর থেকে দূরে স্থিত অন্ধকারে মগ্ন পুরুষকে প্রভু স্বেচ্ছায় জন্ম নেওয়া মুক্তাত্মাদের দ্বারা, জ্ঞানের সন্দেশ শুনান , আর এইভাবে তাদের অজ্ঞানতার অন্ধকারকে দূর করেন।।
[ আধ্যাত্মিক ভাষ্যঃ পন্ডিত হরিশরণ সিধান্তালংকার ]
মােক্ষ প্রাপ্ত জীবাত্মা - কেই মুক্তাত্মা বলা হয়ে থাকে । মুক্তাত্মা কি করতে পারে এই সম্পর্কে প্রমাণ দেখুন
শতপথ ব্রহ্মণ গ্রন্থ থেকে দেখুন-
"শৃণ্বন্ শ্রোত্রং ভবতি, স্পর্শয়ন্ ত্বগ্ভবতি, পশ্যন চক্ষুর্ভবতি,রসয়ন্ রসনা ভবতি, জিঘ্রন্ ঘ্রাণং ভবতি, মন্বানো মনো ভবতি, বোধয়ন্ বুদ্ধির্ভবতি, চেতয়ঁশ্চিত্তম্ভবত্যহঙকুর্বাণো হঙ্কারো ভবতি।।"
(শতপথ ব্রাহ্মণ কাং ১৪)
অর্থাৎ মুক্তি অবস্থায় জীবাত্মা শুনিতে ইচ্ছা করিলে স্বশক্তি দ্বারাই শ্রোত্র, স্পর্শ করিতে ইচ্ছা করিলে ত্বক, দেখিবার সংকল্প হইলে চক্ষু, স্বাদ গ্রহণের জন্য ঘ্রাণ, সংকল্প বিকল্প করিবার জন্য মন, নিশ্চয় করিবার জন্য বুদ্ধি, স্মরণ করিবার জন্য চিত্ত, অহংবুদ্ধির জন্য যেমন ইন্দ্রিয়গোলকের দ্বারা স্বকার্য সিদ্ধ করে সেইরূপ মুক্তি অবস্থায় স্বশক্তি দ্বারা সমস্ত আনন্দ ভোগ করে।"এর থেকে একেবারে নিশ্চত ভাবে যানা যায় যে মুক্ত আত্মারা চাইলে অবতরণ করতে পারেন। কৃষ্ণজীও মুক্ত আত্মা ছিলেন, যার ফলে তিনি ইচ্ছা করেছিলেন যে যখনই ধর্মের গ্লাণি হয় অধর্ম বেড়ে যায় তখন সাধুদের রক্ষার জন্য তিনি অবতরণ করে। এই অবতরণ মুক্ত বা মোক্ষ প্রাপ্ত জীবাত্মার হয়,ঈশ্বর বা পরমাত্মার বা পরমেশ্বরের বা পরমব্রহ্মের নয়।
মুক্ত আত্মারা যে দেহধারণ করে তার আরো কিছু প্রমাণ দেখুন, ছান্দগ্যোপনিষদ ও বেদান্ত সূত্রেও বলা আছে যে মুক্ত জীবাত্মারা তা পারেন।
প্রমাণ দেখুন-
দেখুন, ছান্দগ্যোপনিষদ বলা আছে যে মুক্ত জীবাত্মারা তা পারেন প্রমাণ দেখুন -
(ছান্দোগ্যোপনিষদ ৭।২৬।২)
এছাড়াও তিনি যে যা ইচ্ছা তাই পেয়ে থাকেন তথা করতে পারেন তার প্রমাণ আরো দেখুন-
"তিনি যদি পিতৃলোক কামনা করেন, তবে তাহার
সঙ্কল্পমাত্রই পিতৃগণ তাঁহা সহিত মিলিত হন...।
মাতৃলোক কামনা করলে মাতৃগনের সহিত মিলিত হন... ভাতৃলোক কামনা করলে তাদের সহিতও মিলিত হতে
পারেন... । ভগিনীলোক কামনা করলে, বন্ধুলোক কামনা করলে তাদের সহিতও মিলিত হন। এক কথায় যাহা চান তাহাই প্রাপ্ত হন।"
(ছান্দোগ্য_উপনিষদ ৮।২।১-১০)
বেদান্ত সূত্র হতে প্রমাণ
"ভাবং জৈমিনিঃ, বিকল্পামননাৎ" (বেদান্তসূত্র ৪।৪।১১)
অর্থাৎ মুক্ত আত্মার দেহ ও ইন্দ্রিয়াদি থাকে, ইহা জৈমিনি মুনির মত। কারণ শাস্ত্রে বলা আছে যে, তারা নানা রূপ দেহধারণ করার ক্ষমতা আছে। তিনি(মুক্ত জীবাত্মা) এক প্রকার থাকেন, তিন প্রকার হন, পঞ্চ প্রকার, সপ্ত প্রকার এবং নব প্রকার হন...।"
“সংকল্পাদেব তু তচ্ছ্রুতেঃ
(বেদান্ত সূত্র ৪।৪।৮)
অর্থাৎ ইচ্ছামাত্র মুক্ত আত্মারা তাদের সঙ্কল্প সিদ্ধ করতে পারেন।”
গীতা ৪।৬নং শ্লোকে তিনি নিজেকে জীবসমূহের ঈশ্বর বলেছেন। ইহারও একটা কারণ আছে, বেদান্ত সূত্র থেকে দেখুন-
.
“অত এব চানন্যাধিপতিঃ
(বেদান্ত সূত্র ৪।৪।৯)
অর্থাৎ সেই স্থানে মুক্ত আত্মার কোন অধিপতি নাই। কারণ তখন তিনি স্বাধীন ও সতন্ত্র থাকেন।”
সংসার জগতে যেমন প্রধান অপ্রধান থাকে, মুক্তিতে সেইরূপ থাকে না বলেই তিনি নিজেকে সংসারে আবদ্ধ সকল জীবের ঈশ্বর বলেছেন। কারণ ঐ সময় তিনি সংসারে আবদ্ধ সকল জীবের চেয়ে উন্নত ছিলেন, কারণ তিনি মুক্ত ছিলেন। তবে এটাও জেনে রাখা উচিত মুক্ত জীবাত্মা সর্বশক্তির অধীশ্বর নয়, বেদান্ত সূত্রে ইহা স্পষ্ট বলা আছে। প্রমাণ দেখুন-
.
“ভোগমাত্রসাম্যলিঙ্গাচ্চ।।
(বেদান্ত সূত্র ৪।৪।২১)
অর্থাৎ শুধুমাত্র ভোগ্য ব্যাপারে পরমেশ্বর ও মুক্ত জীবাত্মার মধ্য সাম্যভাব আছে। সর্বশক্তিমত্তা বিষয়ে নয়।”
আরো জেনে রাখা উচিত যে ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত মুক্ত আত্মা সৃষ্ট্যাদি ব্যাপার ব্যতীত অপর সর্ববিধ শক্তির অধিকারী হন। প্রমাণ দেখুন-
.
“জগদ্ব্যাপারবর্জম্ প্রকরণাৎ অসন্নিহিতত্বাচ্চ।।
(বেদান্ত সূত্র ৪।৪।১৭)
অর্থাৎ মুক্ত আত্মা সৃষ্ট্যাদি শক্তি ব্যাপার ব্যতীত অন্য ক্ষমতার অধিকারী হন।”

বিদিতবন্ধকারণস্য দৃষ্ট্যাহতদ্রুপ।।সাংখ্য ১/১৫৫
পদঃ - বিদিতবন্ধকারণস্য । দৃষ্টা । অতদ্রুপম্ ।।
সরলার্থ — যখন যােগী নির্বীজ সমাধি লাভ করিয়া পরমাত্মার স্বরূপে মগ্ন হয় তখন নিজ স্বরূপ ভুলিয়া পরমাত্মার স্বরূপ ধারণ করে । জীবাত্মা স্বরূপতঃ নির্গুণ বলিয়া যখন যাহার সহিত পুর্ণভাবে সম্বন্ধে উৎপন্ন করে তখন তাহার সদৃশ ভাব ধারণ করিয়া থাকে । যােগজ সামর্থ্যের দ্বারা একনিষ্ঠ হইয়া পরমাত্মায় মগ্ন হইলে তাঁহাকেই প্রত্যক্ষ করিয়া থাকে ।
সাক্ষাত্কৃতধর্মোণ ঋষয়ো বভূবুস্তেহবরেভ্যোহসাক্ষাত্ কৃতধর্মস্য উপদেশেন মন্ত্রানসম্প্রাদু।
নিরুক্ত ১।১৯
অনুবাদঃ তপের বল দ্বারা যারা ধর্মের সাক্ষাৎ করেছেন তারাই (ধর্মের সাক্ষাৎ দ্রষ্টা ঋষি) এবং তাহারাই যারা ধর্মের সাক্ষাৎ করেন নি তাদের উপদেশ দিয়েছেন।
মুনি ঋষিরা যোগযুক্ত অবস্থায় কেউ কেউ বলেছেন 'অহং ব্রহ্মাস্মি', আবার কেউ কেউ বলেছেন অয়মাত্মাব্রহ্ম,তার অর্থ এই নয় যে তাঁরা সকলে সর্ব্বশক্তিমান ঈশ্বর হয়ে গেছেন। উপনিষদের এই বচনগুলির বৈদিক ব্যাকরণ অনুযায়ী সঠিক অর্থ না করে অনেকে ইহার অনর্থই করেছেন। আর এই উক্তিগুলির ভিত্তি করেই
শিষ্যের দল তাদের গুরুদের অবতার বানিয়ে ছেড়েছে। এবং এই সব গুরুরা নিজেরা এক একজন স্বঘোষিত ভগবান্ হয়ে মঠমন্দির তৈরী করে শিষ্য বাড়িয়ে মানুষকে ঠকিয়ে ব্যবসা করে খাচ্ছে। উপরিক্ত উপনিষদের বচনগুলি সমাধি প্রাপ্ত যোগী বা মুক্তাত্মা সম্বন্ধে বলা হয়েছে বুঝতে হবে।
জীবাত্মা নির্গুণ বলে পরমাত্মার সহিত পূর্ণ ভাবে সম্বন্ধ উৎপন্ন করে,তাহাতে যোগী সমাধি প্রাপ্ত হয়ে তদাকার হয়ে ব্রহ্মভাব ধারণ করে,যা য়োগীরাজ শ্রীকৃষ্ণের হয়েছিল। মুনি ঋষিরা তাঁদের ওই অবস্থার ব্যাখ্যার জন্য "অহংব্রজ্মাস্মি,অয়মাত্মা ব্রহ্ম,তত্ত্বমসি" ইত্যাদি বচন সমূহের ব্যবহার করেছেন। কাউকে ভ্রমে পতিত করার জন্য নহে।
লৌকিক সংস্কৃত দ্বারা এই সমস্ত বচনের অর্থ করা যায় না, বৈদিক ব্যাকরণ ও অভিধান পাঠ করা প্রয়োজন। মহর্ষি পাণিনীর ব্যাকরণ অষ্টাধ্যায়ীতে একটি সূত্র আছে-'তাতৎস্তোপাধি' তৎসহচরিত উপাধি। ঐস্থলে 'স্থ' শব্দ উহ্য আছে জানতে হবে। অহং ব্রহ্মাস্মি শব্দের অর্থ 'অহং ব্রহ্মস্থ অস্মি'। অর্থাৎ আমি সর্ব্বব্যাপক ব্রহ্মেই অবস্থিত আছি
এইরূপ বুঝিতে হইবে। অয়মাত্মা ব্রহ্ম শব্দে বুঝতে হবে অয়মাত্মা ব্রহ্মস্থ অর্থাৎ আমার আত্মা ব্রহ্মের আধারে অবস্থিত। তত্ত্বমসি এ ছান্দোগ্য উপনিষদের বচন। শ্বেতকেতুকে তাঁর পিতা বলেছেন তুমি সেই অন্তর্যামী পরমাত্মাকেই যুক্ত আছো।
গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন- ময়া ততমিদং সর্বং জগদব্যক্ত মূর্ত্তিনা।
মৎস্থানি সর্ব্বাভূতানি ন চাহং তেস্বাস্থিতঃ।।-গীতা।।৯।৪
অর্থাৎঃ আমি অব্যক্তরূপে এই সমস্ত জগৎ ব্যাপিয়া আছি।সমস্ত ভূত আমাতে অবস্থিত,আমি কিন্তু তৎ সমুদেয়ে অবস্থিত নই। এখানে এই "আমি"কথার অর্থ বৈষ্ণবরা বা অনেকেই শ্রী কৃষ্ণকেই প্রতিপন্ন করতে চান। কিন্তু এখানে 'আমি' অর্থে পরমাত্মার কথাই বেলছেন।
কারন গীতার ৯।৫ শ্লোকে বলেছেন-
ন চ মৎস্থানি ভূতানি পশ্য মে য়োতমৈশ্বরম্।।
অর্থাৎঃ তিনি অর্জুনকে যত উপদেশ দিয়েছেন, তা তিনি যোগযুক্ত অবস্থায় বলেছেন। এ কারণে তিনি গীতার বহু জায়গায় একাধিকবার পশ্য মে য়োগমৈশ্বম্ কথাটি অর্জুনের প্রতি ব্যবহার করেছেন।
সেই সমস্তই তিনি ঋষি কপিল,ঋষভ ও শঙ্করাচার্য্যের মত আত্মাকে লক্ষ্য করে আত্মাতে সমাহিত হয়েই বলেছেন। উদঃ কপিলদেব তাঁর পিতাকে উপদেশ দিচ্ছেন-
"গচ্ছাকামং ময়া পৃষ্টো মায়সন্ন্যস্ত কর্ম্মনা
জিত্বা সুদুর্জ্জয়ং মৃতত্বায় মাং ভজ"[ভাগ ৩।২৮।৩৮]
এখন যথা ইচ্ছা গমন কর, আমাতে সমস্ত কর্ম্ম সমর্পণ করে, দুর্জ্জয় মৃত্যুজয় এবং অমৃতত্ত্ব লাভের জন্য আমায় ভজনা ক'রো। ঋষভদেবও," আমার প্রীতির জন্য কর্ম্ম করা, আমার কথা বলা, আমার ভক্তগণের সঙ্গ, আমার গুনকীর্ত্তন- মৎকর্ম্মভির্মৎকথয়া চ নিত্যং মদ্দেবসঙ্গাদ্গুণকীর্ত্তনাম্মে' [৫।৫।১১] এই রকমের 'আমি আমার' সূচক উপদেশ দিয়ে পুত্রগণকে বলছেন, "স্থাবর জঙ্গম যা কিছু আছে সেই সকল পদার্থেই আমার অধিষ্ঠান জেনে পবিত্র দৃষ্টিতে সতত তাদের সস্মান করো তাহাই আমার পূজা [ভাগঃ৫।৫।২৬]। দশম স্কন্ধের উননব্বই অধ্যায়ে ভূমাপুরুষও উপদেশ কালে 'মম,মাম্,ময়ি' কথা ব্যবহার করেছেন।।আত্মজ্ঞ পুরুষেরা এই ভূমাবোধে প্রতিষ্ঠিত হয়েই মম,মায়,মাম্ ইত্যাদি কথা ব্যবহার করেন; তাঁদের সার্দ্ধত্রিহস্ত পরিমিত দেহ বা নিজের ব্যক্তিগত সত্ত্বা লক্ষ্য করে তাঁরা ওরকম কথা বলেন না।।
পরোক্ষ এবং অপরোক্ষজ্ঞানের তারতম্যে, উপলব্ধ ভূমির তারতম্যানুযায়ী ঐ সর্বব্যাপক ব্রহ্মচৈতন্যের বিষয় বেদে বা শ্রুতিতে তিন উপায়ে উপদিষ্টা হয়েছে কোথাও 'তদাদেশ' বাক্য কোথাও "আত্মাদেশ" এবং কোথাও বা "অহংকারাদেশ" বাক্য; আর 'অহং ব্রহ্মাহস্মি"- এটি 'অহংকারাদেশ' বাক্য।
তিনিই উর্দ্ধে, অধে,পশ্চাতে, সন্মুখে,দক্ষিনে,উত্তরে,আত্মাই এই সকল- 'আত্মা এব ইদং সর্ব্বমিতি-এটি আত্মাদেশ' বাক্য; আর আমি অধে, উদ্ধে, পশ্চাতে, সন্মুখে,দক্ষিণে,উত্তরে, আমিই এই সকল-'অহমেব অধঃস্তাৎ অহম্ উপরিষ্টাৎ, অহং পশ্চাৎ অহং পুরস্তাৎ..... অহমেব ইদং সর্ব্বমিতি'- এই হ'ল 'অহংকাদাদেশ' বাক্য।।

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

अथर्ववेद 6/137/1

  एक वरिष्ठ वैदिक विद्वान् ने मुझे अथर्ववेद के निम्नलिखित मन्त्र का आधिदैविक और आध्यात्मिक भाष्य करने की चुनौती दी। इस चुनौती के उत्तर में म...

Post Top Ad

ধন্যবাদ