শিবলিঙ্গ কি - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

15 July, 2021

শিবলিঙ্গ কি

শিব লিঙ্গের গোপন রহস্য
লিঙ্গ শব্দের অর্থ সংস্কৃতে ‘চিহ্ন বা প্রতীক’। "লয়ং যাতি ইতি লিঙ্গম্"- অর্থাৎ যাঁর মধ্যে সমস্ত কিছু লয় প্রাপ্ত হয়, তাই লিঙ্গ। লিঙ্গ শব্দটির উৎপত্তি সৎস্কৃত লিঙ্গম্ শব্দ থেকে যার অর্থ প্রতীক বা চিহ্ন। ব্যাকরণ বইয়ে নিশ্চয় সবাই লিঙ্গ বিষয়টা পড়েছ যা স্ত্রী বা পুরুষ বুঝায়। কিন্তু তোমরা লিঙ্গ দিয়ে যে জননাঙ্গ বুঝাও তা যদি বলি তাহলে স্ত্রীলিঙ্গ শব্দটা কোথা থেকে আসলো? তাহলে কি স্ত্রীরও কি লিঙ্গ আছে?
“না, নেই।” তাই না? তাহলে বাংলা বা হিন্দিতে যে ব্যাকরণগুলো লেখা হয়েছে তাতে লিঙ্গ শব্দটা কেন এই বিষয়ে প্রয়োগ হয়েছে?
ব্যবহার হওয়ার কারণ এই যে, এগুলো এখন পর্যন্ত সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরনের উপর নির্ভরশীল। সংস্কৃতে প্রত্যেক শব্দ সুগঠিত। এতে প্রত্যেক শব্দের মূল শব্দ বা ধাতু, প্রত্যয় এবং বিভক্তিআদিতে ভাগ করা যায়। এতে লিঙ্গ শব্দ বলতে বুঝানো হয়েছে সেই সব চিহ্নকে অর্থাৎ প্রত্যয়কে বা প্রত্যয়যুক্ত শব্দকে যা স্ত্রী বা পুরুষ চিহ্নিত করে। "যঃ কৌতি শব্দয়তি সর্ব্বা বিদ্যাঃ স কবিরীশ্বরঃ"-ঈশ্বর বেদদ্বারা সর্ব্ববিদ্যার উপদেশক এবং জ্ঞাতা বলিয়া তাঁহার নাম "কবি" হইয়াছে। "শিবু কল্যানে"- এই ধাতু হইতে 'শিব" শব্দ সিদ্ধ হয়।"বহুল-মেতন্নিদর্শনম্" এই প্রমাণ হইতে "শিবু" ধাতু মানা যায়। যিনি কল্যাণস্বরূপ এবং কল্যাণকর্ত্তা এরূপ পরমেশ্বরের নাম "শিব" হইয়াছে। শিব শব্দের অপর একটি অর্থ হল যাঁর মধ্যে প্রলয়ের পর বিশ্ব নিদ্রিত থাকে; এবং লিঙ্গ শব্দটির অর্থও একই – যেখানে বিশ্বধ্বংসের পর যেখানে সকল সৃষ্ট বস্তু বিলীন হয়ে যায়। 
বিঃদ্রঃ- বেদের রূঢ় অর্থের কারনে নানা মত,পন্থের সৃষ্টি
শিবলিঙ্গ ধারণাটি এসেছে বৈদিক যূপস্তম্ভ বা স্কম্ভ ধারণা থেকে। অথর্ববেদে (১০।৭ সূক্ত) একটি স্তম্ভের স্তব করা হয়েছে। এটিই সম্ভবত লিঙ্গপূজার উৎস।-N.K. Singh, Encyclopaedia of Hinduism p.1567
ন চেশিতা নৈব তস্য লিঙ্গম
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ-6/9
অর্থাৎ এমন কোন লিঙ্গ বা চিহ্ন নেই,যা অবলম্বন করে,ঈশ্বরের সমন্ধে অনুমান করা চলে।
শিবলিঙ্গ শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো শিবের মাথা। তবে অজ্ঞতাবশত লিঙ্গ শব্দটি তার অর্থ পরিবর্তন করে বাংলায় পুরুষ জননেন্দ্রিয় অর্থ লাভ করেছে যা বিকৃত এবং অশালীন;এক্ষেত্রে এটি বাংলায় শিশ্ন শব্দকে প্রতিস্থাপিত করেছে।শিব লিঙ্গের উপরে ৩টি সাদা দাগ থাকে যা শিবের কপালে থাকে, যাকে ত্রিপুণ্ড্র বলা হয়। শিবলিঙ্গ যদি কোন জনেন্দ্রিয় বুঝাত তাহলে শিবলিঙ্গের উপরে ঐ ৩টি সাদা তিলক রেখা থাকত না।শিবলিঙ্গ ৩টি অংশ নিয়ে গঠিত, সবার নিচের অংশকে বলা হয় ব্রহ্ম পিঠ, মাঝখানের অংশ বিষ্ণুপিঠ এবং সবার উপরের অংশ শিব পিঠ । একটি সাধারণ তত্ত্ব অনুযায়ী, শিবলিঙ্গ শিবের আদি-অন্তহীন সত্ত্বার প্রতীক এক আদি ও অন্তহীন স্তম্ভের রূপবিশেষ।
এই থেকে তো এইটুকু প্রমাণিত হলো যে লিঙ্গ শব্দটা কোন জননাঙ্গকে বুঝায় না। তাহলে লিঙ্গটা কি? কেনই বা এর পূজা করা হয়?
লিঙ্গের কাহিনীটি পাওয়া যায় শিব পুরাণের কোটিরুদ্রসংহিতার ১২ অধ্যায়ের ৫ থেকে ৪৮ শ্লোকে মধ্যে।
শিব পুরাণ, কোটিরুদ্রসংহিতা, ১২ অধ্যায়ের ৫ থেকে ৪৮ শ্লোক
সুত জি বললেন পূর্ব সময়ে দারু বনে ব্রাহ্মণ দের সাথে যে বৃত্তান্ত হয়েছিল তা ধ্যান পূর্বক শুনুন আমি বলছি, দারু বনে ঋষিপুরুষ গণ নিজের পত্নীদের সাথে বাস করতেন , তারা সবাই শিব ভক্ত ছিল ,একসময় ঋষিগণ জঙ্গলে গেছিলেন কাঠ ইত্যাদি আনতে তখন তাদের স্ত্রীরা একা একা ছিল তখন। এই সময়েই সাক্ষাৎ মহাদেব জী বিকৃত রূপে পরীক্ষা করাই জন্য চলে আসেন , একেবারে উলঙ্গ শরীর , অত্যন্ত তেজস্বী শরীরে ভস্মিত মহাদেব জী তার লিঙ্গ হাতে নিয়ে কুকর্ম করার চেষ্টা করতে থাকে , তা দেখে ঋষিদের স্ত্রী রা অত্যন্ত ভীত হয়ে যায় তারপর তারা ব্যাকুল হয়ে কাছে মহাদেব জীর কাছে চলে আসে । ঋষিদের সেই স্ত্রী রা মহাদেব জীকে বুকের জড়িয়ে ধরেন , বহু স্ত্রী রা তার হাত ধরেন , নিজেদের মধ্যে এই সমস্ত কর্মে মস্ত হয়ে জান । ঠিক এই সময় ঋষিগণ জঙ্গল থেকে চলে আসেন , তারা এই সমস্ত অসভ্যতা দেখে দুঃখী আর ক্রুদ্ধ হন । আর এই তারা দুঃখী হয়ে বলেন - ইনি কে হন ইনি কে ? শিবের মায়া তে মোহিত হিয় ঋষিরা কোলাহল শুরু করেন , তখন ঋষিগণ উলঙ্গ ভয়ঙ্কর এই ব্যক্তি অর্থাৎ শিব জী কে বলেন ।কেন তুমি বেদ বিরুদ্ধ , ধর্মের বিনাশকারী, অসভ্য কর্ম করছে , এমন বলে তারা অভিশাপ দেন যে - " তোমার যে লিঙ্গ তা কেটে গিয়ে ভূমিতে পরবে " , তখন ঋষিদের এমন বলার পর ওই অদ্ভুত রূপধারী শিবের লিঙ্গ ক্ষনিকের মধ্যে ভূমিতে কেটে পরে । সেই লিঙ্গ টি অগ্নির মতো জ্বলতে শুরু করে , যেখানে যেখানে সে লিঙ্গ যাচ্ছে সেখানে সেখানে সব কিছু জ্বালিয়ে দিচ্ছিলো , সেই লিঙ্গ পাতাল , স্বর্গ আর পৃথিবীতে দৌড়তে শুরু করে , পরন্তু কোনো ভাবেই সেই লিঙ্গ স্থির হতে চাইছিল না , সম্পূর্ণ সংসার ব্যাকুল হয়ে যায় তখন দুঃখী হয়ে দেবতাদের সাথে ঋষিগণ ব্রহ্মার কাছে জান পরামর্শ নেবার জন্য , এবং তাকে প্রণাম করে সমস্ত বৃত্তান্ত বলেন ,তাদের কথা শুনে ব্রহ্মা জী বলেন তোমরা ভুল করে ফেলেছো মহাদেবের মতো অতিথির সৎকার না করে । যতক্ষণ পর্যন্ত এই লিঙ্গ স্থাপিত না হচ্ছে ততক্ষণ ত্রিলোকে শান্তি স্থাপিত হবে না , তারপর ব্রহ্মাজী লিঙ্গ কে স্থাপিত করার উপায় বের করলেন। তখন ব্রহ্মা বললেন হে দেবতাগণ! তোমরা পার্বতী কে প্রসন্ন করে শিবের প্রার্থনা করো , যদি পার্বতী জি যোনি রূপ ধারণ করে তাহলেই একমাত্র এই লিঙ্গ স্থির হবে। এই কথা শুনে ব্রাহ্মণ ও দেবতাগণ ব্রহ্মা কে প্রণাম করে সারা বিশ্ব সংসারের সুখের যিনি শিবের শরণে আসেন, তখন পরম ভক্তি, প্রার্থনার দ্বারা পূজিত মহাদেব জী প্রসন্ন হয়ে বললেন - হে দেবতাগণ! হে ঋষিগণ! তোমরা আমার কথা শোনো, যদি আমার লিঙ্গ যোনিতে স্থাপিত হয় তাহলেই একমাত্র ত্রিলোকে সুখ হয়ে পারে। পার্বতীর ছাড়া আর কোনো স্ত্রী আমার লিঙ্গ কে ধারণ করতে পারবে না । তাতে যদি আমার লিঙ্গ ধারণ করা হয় তাহলে খুবই তাড়াতাড়ি শান্তি কে প্রাপ্ত হবে । এই কথা শুনে ঋষি, দেবতাগণ প্রসন্ন হয়ে ব্রহ্মাকে সাথে নিয়ে পার্বতীর প্রার্থনা শুরু করেন, পার্বতী কে প্রসন্ন করে মহাদেব কেও প্রসন্ন করেন তারপর সেই লিঙ্গ স্থাপিত হয়।
শিবলিঙ্গ কি


হিন্দুদের ইতিহাস লেখা এমন অনেকগুলো বই আছে যেগুলো ‘পুরাণ’ নামে প্রসিদ্ধ। তার মধ্যে ১৮টি পুরাণ অতি প্রাচীন। ওই অষ্টাদশ মহাপুরাণের মধ্যে অন্যতম ‘লিঙ্গপুরাণ’, যাতে লেখা আছে লিঙ্গের রহস্য ও এর তথ্যাবলি।
ওই পুরাণের তৃতীয় অধ্যায়ের একেবারে প্রথমেই এই লিঙ্গের বর্ণনা আছে এইভাবে-
“জ্ঞানীগণ নির্গুণ ব্রহ্মকেই লিঙ্গ বলে। মহাদেব সেই নির্গুণ ব্রহ্ম, তার থেকেই অব্যক্ত আবির্ভূত হয়েছে। শ্রেষ্ঠ লিঙ্গ প্রধান ও প্রকৃতি নামে প্রসিদ্ধ। রূপ রস গন্ধ স্পর্শ শব্দ বর্জিত পরমেশ্বর শিবই অলিঙ্গ(চিহ্নহীন)। আবার তিনি নিজেই পঞ্চভূত(জল-তরলের প্রতীক, বায়ু-বায়বীয় পদার্থের প্রতীক, পৃথিবী-কঠিন পদার্থের প্রতীক,অগ্নি-শক্তির প্রতীক, আকাশ- অন্তরীক্ষ, শূন্য ও স্থানের প্রতীক ), পঞ্চতন্মাত্র(রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ ও শব্দ) সকল গুণ ভূষিত লিঙ্গ রূপ উৎপন্ন হয়েছেন। এবং তার থেকেই সৃষ্টির কারণ শিবস্বরূপ প্রধান দেবত্রয়(সৃষ্টিকর্তা-ব্রহ্মা, পালনকর্তা-বিষ্ণু ও সংহারকর্তা-শিব) আবির্ভূত হয়েছেন।”
খুব স্পষ্ট করে দেখলে শিবলিঙ্গের উপরে স্থাপিত এই শিবভাগের আকৃতি কিন্তু পুরুষের জননাঙ্গের মত নয়, এটা মহাবিশ্বের আকৃতির ন্যায় উপবৃত্তাকার।
শিবলিঙ্গের তিনটা অংশের একদম নিচে ব্রহ্মা, মাঝখানে বিষ্ণু ও একদম উপরে অর্ধ-উপবৃত্তাকার আকৃতিতে শিব। সম্পূর্ণ লিঙ্গের আকৃতি উপবৃত্তাকার। উপবৃত্তাকার আকৃত অনন্ত মহাবিশ্বকে প্রকাশ করে। এই উপবৃত্তাকার আকৃতির লিঙ্গ একাধারে সৃষ্টি ও ধ্বংসকে নির্দেশ করে।
আধুনিক কসমোলজিতে শিবলিঙ্গের স্বরুপঃ
শিবলিঙ্গ কি
শিব চরিত্র পড়ুন

শিবলিঙ্গের দিকে তাকালে দেখা যাবে এর লম্বাকৃতি অংশটিতে পরপর তিনটি খাঁজ কাটা রয়েছে। বিজ্ঞানী নিলস বোরের পরমাণু মডেলের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করলে এই তিনটি খাঁজ আসলে পরমাণুর তিনটি উাপাদান— প্রোটন, নিউট্রন ও ইলেকট্রনের প্রতীক হিসেবে চিত্রায়িত করা যায়। এই তিনটি উপাদান দিয়েই তৈরি হয়েছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। অর্থাৎ ব্রহ্মাণ্ডের গঠনের প্রতীক হল শিবলিঙ্গ।

[কোয়ান্টাম ফিজিক্স নিয়ে কাজ করার সময় এরভিন শ্রোডিঙ্গার ও নীলস বোর দুজনেই বেদান্ত নিয়ে উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন। এর মধ্যে নীলস বোর বলেছিলেন, " আমি উপনিষদ পড়ি উত্তর খোজার জন্য"]
 শিব হলো সাব-এটমিক বস্তুর (ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন) চেয়েও ক্ষুদ্রতর আবার মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় বস্তুর চেয়েও বৃহত্তর। এছাড়াও ভাগবত পূরাণের ৩/১১/১-৫ নং শ্লোকে পরমাণুর গঠন ও মহাবিশ্বের সৃষ্টিতে পরমাণুর ধারণা ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
শিবলিঙ্গ হচ্ছে একটা পরমাণু। বিষ্ণু হচ্ছে পজিটিভ চার্যযুক্ত প্রোটন, ব্রহ্মা নেগেটিভ চার্যযুক্ত ইলেকট্রন এবং শিব নিরপেক্ষ (চার্যবিহীন) নিউট্রন। যেহেতু শিব চার্যবিহীন নিউট্রন তাই তিনি শান্ত ও ধ্যানাবস্থায় থাকেন। তিনি শান্ত থাকা বলতে পরমানুর স্ট্যাবিলিটি বুঝায়। লিঙ্গের চারপাশে গোলাকার চাকতির মত অংশকে শক্তিস্তর বলে। এই শক্তিস্তরকে রেনুকা (রেনু) ও রুদ্রাণী বলে। রেনুকা শিবের ভাব ও রুদ্রাণী হলো রুদ্রের ভাব। এই শক্তিস্তর হচ্ছে মহাবিশ্বের প্রকৃতি।

 শিবের সাথে সমশক্তি নিয়ে অবস্থান করেন বিষ্ণু। লিঙ্গের চারপাশে ঘূর্ণায়মান শক্তিস্তরে (প্রকৃতি) ঋণাত্মক চার্জ নিয়ে অবস্থান করে ব্রহ্মা। শ্রীবিষ্ণুর নাভীমূল থেকে বের হওয়া পদ্মে অবস্থান করে ব্রহ্মা এটা দিয়ে বুঝানো হয়েছে বিষ্ণুর চারপাশে সমচার্য (সমশক্তি) সম্পন্ন অসংখ্য ব্রহ্মা (ইলেকট্রন) তথা ব্রহ্মাণ্ড। অর্থাৎ মহাবিশ্বে যত ব্রহ্মাণ্ড আছে বিষ্ণুর পজিটিভ চার্জও তত। আমরা জানি অনু গঠনে প্রধান ভুমিকা রাখে ইলেকট্রন তাই ব্রহ্মাকে বলা হয়ে সৃষ্টিকর্তা। বিষ্ণু পজিটিভ চার্জ নিয়ে পরমাণুর ব্যালেন্স করে তাই তিনি স্থিতিকর্তা।

 শিবের চারপাশে রেনুকার স্থলে যখন রুদ্রাণী অবস্থান করে তখন শিবের রুদ্ররুপের প্রকাশ ঘটে অর্থাৎ নিউট্রন ভেঙে মহাবিনাশী নিউক্লিয়ার ফিশন শুরু হয়। রুদ্রাণী হলো ধ্বংসাত্মক প্রকৃতি তথা শিবের রুদ্ররুপের কারণ। এজন্যই শিবের রুদ্ররূপকে বলা হয় সংহারকর্তা।

অর্থাৎ শিবলিঙ্গ হচ্ছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডেরই প্রতিকীরূপ তথা পরমেশ্বরের পূর্ণপ্রতীক। একটা শিবলিঙ্গ দ্বারাই মহাবিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি ও বিনাশকে সঙ্গায়িত করা যায়।
এবার দেখা যাক বেদ কি বলে-
“সর্বপ্রথম কিছুই ছিল না, একেবারে কিছুই না। একমাত্র পরমেশ্বর ছিলেন আত্মারূপে, চিহ্ন বর্জিত। তার মধ্যে ইচ্ছার(সংস্কৃতে কাম/কামনা) সৃষ্টি এবং তা হতে সকল কিছুর সৃষ্টি।“
(ঋগ্বেদ মণ্ডল-১০, সুক্ত-১২৯ - নাসদীয় সুক্তম্)
অর্থাৎ প্রথমে সবকিছু একস্থানে ঘনীভূত ছিল যা হতে সব উৎপন্ন হয়েছে। এবং এই জিনিসটিকেই ঈশ্বরের প্রথম চিহ্ন ধরা হয় যাকে লিঙ্গ বলে, যা স্বয়ং ‘স্রষ্টা ও সৃষ্টি’।
(যোগশিখা উপনিষদ)
বেদের একই সুক্তে বলা হয়েছে, "এবার সেই কারণ সলিল নির্মিত পিণ্ড উপরে ও নিচে উঠতে লাগলো। আর মধ্যেও তার বিস্তার হতে থাকে। এই স্তম্ভকেই বলে লিঙ্গ।"
বেদে শিব লিঙ্গ
কেবল সেখানেই নয়, লিঙ্গপুরাণের লিঙ্গোদ্ভব অধ্যায়েও তাই বলা হয়েছে।
লিঙ্গের আকৃতি দেখলে আসা করি শুধু একটা উপবৃত্তাকার-স্থম্ভ দেখবে না! তার সঙ্গে নিচে বেদী আকৃতির একটি অংশ ও দেখবে। এটি আবার কি? মনে নিশ্চয় প্রশ্ন জাগবে। তাহলে সেই উত্তরের সমাধান নিশ্চয়ই আছে। আর এর উত্তর সর্বদা লিঙ্গের পাশে বিদ্যমান থাকে।
সমগ্র শিবলিঙ্গের আকৃতির তিন ভাগ আছে। যদি শিবলিঙ্গ দেখে থাকো তাহলে নিশ্চয়ই দেখবে তার পাশে ত্রিশূল বসানো। তার তিনটি শূল তিন গুণের প্রতীক, যথা-
১। সত্ত্ব,
২। রজ,
৩। তম
এই তিন গুণ সৃষ্টির তিন কারণকে (সৃষ্টিকর্তা- ব্রহ্মা, পালনকর্তা- বিষ্ণু ও সংহারকর্তা- শিব) বুঝায়। আর এই তিন প্রধান দেবতা নিচ থেকে সম্পূর্ণ লিঙ্গটা সৃষ্টি করে এই ভাবে-
১। সবার নিচের অংশ বা ভুমি ভাগ-
এই ভাগ সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার অংশ। এটি আমাদের বুঝায় সব কিছুর মুলেই সৃষ্টিকর্তা বিদ্যমান। আর সবকিছুর সাত্ত্বিক গুণসম্পন্ন শান্তিময় স্থান এটি। অর্থাৎ ঈশ্বরের ছত্রতলেই জগতের সব শান্তি।
২। পীঠ বা মধ্য ভাগ-
এটা সেই অংশ যাতে পালনকর্তা বিষ্ণু অবস্থান করে। এই অংশ বুঝায় বিষ্ণু নিজে আমাদের ধারণ করেছেন তার মধ্যে এবং সুরক্ষা দিচ্ছেন। এইটি রজগুণকে বুঝায় যা সত্ত্ব আর তমের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। আবার এই অংশ বিষ্ণুর বৈশিষ্ট্যকেও বোঝায়। বিষ্ণু মোক্ষ দানে সহায়তা করে, যা শিব লিঙ্গে ঢালা জলের মধ্যে প্রকাশ পায়। জল যা জীবনের প্রতীক তা জগতে ঈশ্বরের মধ্যে দিয়ে প্রকৃতিতে এসে আবার বিলীন হয়ে যায়।
এই দুই ভাগকে মিলে আবার প্রকৃতি ভাগও বলে, যা পুরুষ বা পরমাত্মাকে ধারণ করে। জগতমাতা দুর্গা এই প্রকৃতি। বিশেষ উল্লেখ্য এই যে শিব বেদে রুদ্র বলে বর্ণিত যে সর্বদা শান্ত থাকে শম্ভু রূপে যা শক্তি অর্থাৎ দেবী দুর্গার কারণে। লিঙ্গের এই অংশ তাই তিনি বিরাজ করেন। আর শিবের যে বিগ্রহগুলো থাকে তার বেশিরভাগই রুদ্র মূর্তি যা সংহারের ইঙ্গিত করে। তাই যুদ্ধ ছাড়া বেশিরভাগ সময়ই শিবকে লিঙ্গে পূজা করা হয়।
৩। সর্বোপরি রুদ্র ভাগ-
এই অংশ মূল লিঙ্গকে বলে। একে পূজা ভাগও বলে। এতে পুরুষ(বেদে বর্ণিত পরমাত্মা, বা ঈশ্বর) বা শিব অবস্থান করে। যা সর্বশক্তির উৎস ও কেন্দ্র। লিঙ্গপুরাণের পূর্বভাগের অধ্যায়-১৭ তে এর বর্ণনা দেওয়া আছে এইভাবে যে শিব নিজে এই ভাগে ধ্যান অবস্থায় আছেন। যা হতে তিনি প্রথম আবির্ভূত হয়েছেন। অথর্ববেদের দশম কাণ্ডে তো সুস্পষ্ট ভাবে স্তম্ভের মধ্যে পরমেশ্বরের আরাধনার কথা লেখা আছে।
শিবলিঙ্গের গায়ে যে সাপটি থাকে তা আসলে সুপ্ত চেতনার প্রতীক:
শিবলিঙ্গের গায়ে অনেক সময়ে যে সাপটি প্যাঁচালো অবস্থায় দেখা যায়, সেটি আসলে কুলকুণ্ডলিনীর প্রতীক। এই শক্তির জাগরণকে চিহ্নিত করে শিবলিঙ্গ। 
শিবলিঙ্গ কি
এই লিঙ্গ যে শুধু সৃষ্টি স্থিতি আর লয় বা পুরুষ ও প্রকৃতির কিম্বা পরমেশ্বরের কথা বলে তাই না। এটি আমাদের আত্মাকে ও জ্ঞানকে জাগ্রত করে। কিভাবে?
এভাবে- ইরা, পিঙ্গলা আর সুষুম্না। যদি কেউ যোগশাস্ত্র(অনেকে যাকে ইয়োগা বলে চিনো সেই বিষয়টা) পড়ে থাকো তাহলে এই তিনটা শব্দ নিশ্চয়ই শুনে থাকবে। ইরা আর পিঙ্গলাকে নদী বলে যা প্রাণীর দেহে প্রবাহিত হয়। মূলত এগুলো দেহের স্নায়ু তন্ত্রের দুইভাগকে বুঝায়, যা দুটি সাপ দিয়ে দেখানো হয়। আর সুষুম্না হলো মেরুদণ্ডে অবস্থিত মধ্য সুষুম্না। যোগশাস্ত্র মতে, এই সুষুম্নার মধ্যে সাতটি চক্র আছে, যা আমাদের জীবনের সঞ্চালক শক্তি। এগুলো যদি সম্পূর্ণ রূপে সক্রিয় হয় তাহলে মানুষ আধাত্মিক ও আত্মিক ভাবে জাগ্রত হবে, শান্তি এবং আনন্দ অনুভব করবে, বুদ্ধি বৃদ্ধি এবং আধ্যাত্মিক ভাবে সংযোগ বৃদ্ধিসহ আরও অনেক লাভ পাবে। আর শিবলিঙ্গ এর সম্পূর্ণ জাগ্রত প্রতীক। কিভাবে?
মূল লিঙ্গের ভেতরে সক্রিয় সাতটি চক্র বিদ্যমান এবং শিবলিঙ্গে সাপ দেখবে যা কুণ্ডলিনী চক্রের মতো সাড়ে তিন প্যাঁচ দিয়ে উপরে উঠে। এবং এই শক্তি আমাদের মন স্থির করতে সাহায্য করে, তাই এটি আমাদের আধ্যাত্মিক ভাবে জাগ্রত এবং মানসিক ভাবে শান্ত করে। বিশ্বাস হচ্ছে না?
এটার প্রমান আমি দিবো না, তুমি নিজেই একটা নিস্তব্ধ শিব মন্দিরের গর্ভগৃহের(মন্দিরের সেই ঘর যাতে দেবতা থাকে) সামনে যাও, কোন কিছু করতে হবে না, না তাকে নমস্কার করতে হবে, না পূজা করতে হবে, শুধু চুপ করে একবার শান্ত হয়ে লিঙ্গটির দিকে দেখ আর চোখ বন্ধ করে আশেপাশের অবস্থা বুঝার চেষ্টা করো। নিজেই বুঝতে পারবে এর তাৎপর্য।
বাঘের ত্বক
হিন্দু ধর্মে বাঘ শক্তি ও বাহিনীর দেবী শক্তি বাহনের প্রতিনিধিত্ব করে । বাঘের চামড়া পরা শিব তাঁর শক্তির প্রতিনিধিত্ব করেন এবং তিনি যে শক্তির কর্তা যা অন্য কোনও শক্তির বাইরে। বাঘও কামের প্রতিনিধিত্ব করে, এবং শিবের উপর বসে এটি দেখায় যে তিনি অভিলাষকে জয় করেছেন। তদুপরি, বাঘও শক্তির প্রতীক, এবং এই ক্ষেত্রে, এটি শিবকে সমস্ত মহাবিশ্ব জুড়ে প্রাসঙ্গিক শক্তির উত্স হিসাবে প্রতিনিধিত্ব করে, এবং শিব তাঁর নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি দিয়ে মহাবিশ্বকে অন্তহীন চক্রে প্রবর্তনের জন্য শক্তি সক্রিয় করেন।
রুদ্রাক্ষের মালা
শিব পরেন তাঁর নিজের অশ্রু থেকে তৈরি 108 টি পুঁতি নিয়ে রুদ্রাক্ষের মালা পরিয়েছেন । পুঁতির অর্থ পৃথিবীর উপাদান, এবং তার পরা মানে রুদ্রাক্ষ বিশ্বজগতের নিয়ম সম্পর্কে । এমনকি তিনি মহাজাগতিক আইন অনুসরণ করেন।
দামারু, ড্রাম
উত্স - স্বরূপ্রয়
এটি মহাজাগতিক শব্দকে উপস্থাপন করে। ডমরু শব্দ বলা হয় ব্রাহ্ম" বা ওম এবং প্রতিনিধিত্ব করে। এটি থেকেই ব্যাকরণ এবং সংগীত প্রকাশিত হয়েছিল। যখন ডমরু ভাইব্রেটেড হয়, তখন এটি ভিন্নধর্মী শব্দ উত্পন্ন করে যা একটি শব্দ তৈরি করতে অনুরণন দ্বারা একসাথে মিশে যায়। এইভাবে উত্পন্ন শব্দটি নাদের প্রতীকী, এইউএমের মহাজাগতিক শব্দ, যা গভীর ধ্যানের সময় শোনা যায়। শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে শিব মোড সৃষ্টির সময় তাঁর ডামরু 14 বার কম্পন করে। এই 14 টি মূল সূত্রে সংস্করণের সমস্ত বর্ণমালা বিভিন্ন ব্যাকরণগত প্রক্রিয়াগুলি সহজতর করার জন্য সাজানো হয়েছে। সুতরাং, দামারু বর্ণমালা, ব্যাকরণ এবং ভাষা নিজেই উপস্থাপন করে।
প্রস্তাবিত - ভগবান শিব এবং তাঁর চিত্রকর্ম সম্পর্কে 5 টি গল্প
ত্রিশূল
শিবের বর্শায় তিনটি ছড়িয়ে রয়েছে এবং তারা শিবের মৌলিক শক্তির তিনটি প্রতিনিধিত্ব করে: উইল (আইচচ্যা), কর্ম (ক্রিয়া) এবং জ্ঞান (জ্ঞান)। এটি প্রতিনিধিত্ব করে যে সে মন্দ ও অজ্ঞতা ধ্বংস করতে পারে। এটি আরও উপস্থাপন করে যে অপরাধীরা প্রভুকে তিনটি প্লেনে শাস্তি দেয়: আধ্যাত্মিক, সূক্ষ্ম এবং শারীরিক।
শিবলিঙ্গ কি
চার মাথা-বিশিষ্ট পাথরের শিবলিঙ্গ, দশম শতাব্দী, নেপাল

Kamandalu
কমন্ডলু শিবের আর একটি আনুষঙ্গিক জিনিস। এটি শুকনো কুমড়ো থেকে তৈরি একটি জলের পাত্র এবং এতে অমৃত রয়েছে। এটি প্রভুর যোগী পক্ষকে উপস্থাপন করে তবে এর গভীর অর্থ রয়েছে। ঠিক যেমন কীভাবে কুমড়ো গাছ থেকে কেটে ফেলা হয় এবং এর ফলটি মুছে ফেলা হয় এবং খোলটি শুদ্ধ অমৃত বহন করার জন্য পরিষ্কার করা হয়, একজন ব্যক্তিকে অবশ্যই জগতের ত্যাগ করতে হবে এবং অহংকারের আত্মাকে সরিয়ে ফেলতে হবে এবং কেবল তখনই তিনি খাঁটি আধ্যাত্মিক সন্ধান করতে পারবেন গঠন করে।
কুন্ডল
তারা দুটি কানের দুল উল্লেখ করে: অলক্ষ্যা যার অর্থ কোনও চিহ্ন দ্বারা দেখা যায় না এবং নিরঞ্জন, যা নশ্বর চোখ দ্বারা দেখা যায় না। এর অর্থ শিবের দুর্ভেদ্য প্রকৃতিকে বোঝায়। বাম দিকটি মহিলাদের দ্বারা পরিহিত হয় এবং ডানটি পুরুষরা ব্যবহার করে। কুণ্ডলগুলি শিব ও শক্তির দ্বৈত প্রকৃতির প্রতিনিধিত্ব করেন, পুরুষ ও স্ত্রী, সৃষ্টির মূলনীতি।
কৈলাশ পর্বত
কৈলাশ পর্বত দেবতা শিবের বাসিন্দা, এবং হিন্দু ধর্ম অনুসারে, এই পর্বতটিকে মহাবিশ্বের কেন্দ্রস্থল বলা হয়। এর অর্থ শিব হলেন শান্তির দাতা কৈলাস।
নন্দী, ষাঁড়
পশুপতিনাথ মন্দিরে সোনার নন্দী
পশুপতিনাথ মন্দিরে সোনার নন্দী
নন্দী শিবের বাহন এবং এটি শক্তি এবং অজ্ঞতা উভয়েরই প্রতীক। ষাঁড়টিকে সংস্কৃত ভাষায় "বৃষ্টি" বলা হয় এবং এর অর্থ "ধার্মিকতা"। শিবের সাথে নন্দী, শিবকে ধার্মিকতার সঙ্গী হিসাবে প্রতীক হিসাবে দেখান।
 ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়, কারণ জগতপালক শ্রীবিষ্ণু নিজেই একবার মানবকূল রক্ষা করতে একটা স্থম্ভ হতে আবির্ভূত হয়েছিলেন দেব নৃসিংহ রূপে। যা বিষ্ণু আর শিবকে দুইজন হয়েও এক করে দেয়।
(নৃসিংহ পুরাণ)
শিব পুরাণ, কোটিরুদ্রসংহিতা, ১২ অধ্যায়ের ৫ থেকে ৪৮ শ্লোক
সুত জি বললেন পূর্ব সময়ে দারু বনে ব্রাহ্মণ দের সাথে যে বৃত্তান্ত হয়েছিল তা ধ্যান পূর্বক শুনুন আমি বলছি, দারু বনে ঋষিপুরুষ গণ নিজের পত্নীদের সাথে বাস করতেন , তারা সবাই শিব ভক্ত ছিল ,একসময় ঋষিগণ জঙ্গলে গেছিলেন কাঠ ইত্যাদি আনতে তখন তাদের স্ত্রীরা একা একা ছিল তখন। এই সময়েই সাক্ষাৎ মহাদেব জী বিকৃত রূপে পরীক্ষা করাই জন্য চলে আসেন , একেবারে উলঙ্গ শরীর , অত্যন্ত তেজস্বী শরীরে ভস্মিত মহাদেব জী তার লিঙ্গ হাতে নিয়ে কুকর্ম করার চেষ্টা করতে থাকে , তা দেখে ঋষিদের স্ত্রী রা অত্যন্ত ভীত হয়ে যায় তারপর তারা ব্যাকুল হয়ে কাছে মহাদেব জীর কাছে চলে আসে । ঋষিদের সেই স্ত্রী রা মহাদেব জীকে বুকের জড়িয়ে ধরেন , বহু স্ত্রী রা তার হাত ধরেন , নিজেদের মধ্যে এই সমস্ত কর্মে মস্ত হয়ে জান । ঠিক এই সময় ঋষিগণ জঙ্গল থেকে চলে আসেন , তারা এই সমস্ত অসভ্যতা দেখে দুঃখী আর ক্রুদ্ধ হন । আর এই তারা দুঃখী হয়ে বলেন - ইনি কে হন ইনি কে ? শিবের মায়া তে মোহিত হিয় ঋষিরা কোলাহল শুরু করেন , তখন ঋষিগণ উলঙ্গ ভয়ঙ্কর এই ব্যক্তি অর্থাৎ শিব জী কে বলেন ।
কেন তুমি বেদ বিরুদ্ধ , ধর্মের বিনাশকারী, অসভ্য কর্ম করছে , এমন বলে তারা অভিশাপ দেন যে - " তোমার যে লিঙ্গ তা কেটে গিয়ে ভূমিতে পরবে " , তখন ঋষিদের এমন বলার পর ওই অদ্ভুত রূপধারী শিবের লিঙ্গ ক্ষনিকের মধ্যে ভূমিতে কেটে পরে । সেই লিঙ্গ টি অগ্নির মতো জ্বলতে শুরু করে , যেখানে যেখানে সে লিঙ্গ যাচ্ছে সেখানে সেখানে সব কিছু জ্বালিয়ে দিচ্ছিলো , সেই লিঙ্গ পাতাল , স্বর্গ আর পৃথিবীতে দৌড়তে শুরু করে , পরন্তু কোনো ভাবেই সেই লিঙ্গ স্থির হতে চাইছিল না , সম্পূর্ণ সংসার ব্যাকুল হয়ে যায় তখন দুঃখী হয়ে দেবতাদের সাথে ঋষিগণ ব্রহ্মার কাছে জান পরামর্শ নেবার জন্য , এবং তাকে প্রণাম করে সমস্ত বৃত্তান্ত বলেন ,তাদের কথা শুনে ব্রহ্মা জী বলেন তোমরা ভুল করে ফেলেছো মহাদেবের মতো অতিথির সৎকার না করে । যতক্ষণ পর্যন্ত এই লিঙ্গ স্থাপিত না হচ্ছে ততক্ষণ ত্রিলোকে শান্তি স্থাপিত হবে না , তারপর ব্রহ্মাজী লিঙ্গ কে স্থাপিত করার উপায় বের করলেন। তখন ব্রহ্মা বললেন হে দেবতাগণ! তোমরা পার্বতী কে প্রসন্ন করে শিবের প্রার্থনা করো , যদি পার্বতী জি যোনি রূপ ধারণ করে তাহলেই একমাত্র এই লিঙ্গ স্থির হবে। এই কথা শুনে ব্রাহ্মণ ও দেবতাগণ ব্রহ্মা কে প্রণাম করে সারা বিশ্ব সংসারের সুখের যিনি শিবের শরণে আসেন, তখন পরম ভক্তি, প্রার্থনার দ্বারা পূজিত মহাদেব জী প্রসন্ন হয়ে বললেন - হে দেবতাগণ! হে ঋষিগণ! তোমরা আমার কথা শোনো, যদি আমার লিঙ্গ যোনিতে স্থাপিত হয় তাহলেই একমাত্র ত্রিলোকে সুখ হয়ে পারে। পার্বতীর ছাড়া আর কোনো স্ত্রী আমার লিঙ্গ কে ধারণ করতে পারবে না । তাতে যদি আমার লিঙ্গ ধারণ করা হয় তাহলে খুবই তাড়াতাড়ি শান্তি কে প্রাপ্ত হবে । এই কথা শুনে ঋষি, দেবতাগণ প্রসন্ন হয়ে ব্রহ্মাকে সাথে নিয়ে পার্বতীর প্রার্থনা শুরু করেন, পার্বতী কে প্রসন্ন করে মহাদেব কেও প্রসন্ন করেন তারপর সেই লিঙ্গ স্থাপিত হয়।
শিবপুরাণ অনুসারে ভগবান শিবই একমাত্র ব্রহ্মরূপ হওয়ায় তাঁকে ‘নিষ্কল’ (নিরাকার) বলা হয়।
সাকার হয়েও নিরাকার এই শিবলিঙ্গ আবার নিরাকার হয়েও সাকার।” কারণ-
শিব সাকার কিন্তু লিঙ্গের মধ্যে তার আকার নেই, কিন্তু পরমেশ্বর নিরাকার কিন্তু লিঙ্গে তিনি লিঙ্গ আকৃতিতে অবস্থিত। এবং এই জন্যই সকল প্রকার আরাধনাই এই শিবলিঙ্গে সম্ভব, যা একই সঙ্গে সাকার ও নিরাকার এবং সমগ্র জগতের প্রাণ কেন্দ্র।
আবার এর আশেপাশে থাকা সবকিছুই জ্ঞানের প্রতীক। ত্রিশূল যেমন আমাদের সৃষ্টির তিন কারণ যা এক পরমেশ্বর বুঝায়, তেমনি তার প্রক্রিয়াও বুঝায়। যা তার তিন শূল থেকে ঝুলতে থাকা ডমরু হিসাবে থাকে। এইভাবে- তিন ঈশ্বর এক হয় যখন তখন এক মহাজাগতিক কম্পন বা নাদ সৃষ্টি করে যা হতে সবকিছুর সৃষ্টি। এর গায়ে আঁকা হয় মঙ্গল-তিলক যা ত্রিপুণ্ড্র নামে পরিচিত তা ঈশ্বরের সৃষ্টির তিন লোক(স্বর্গ মর্ত আর পাতাল) বুঝায়।
শিবলিঙ্গ শিবপুরাণে
দারুবনে ঋষিরা বাস করতেন। একদিন শিব ঋষিদের কোনোরূপ পরীক্ষা করার জন্য গায়ে ছাই-ভস্ম মেখে নগ্ন হয়ে,বনের মধ্যে প্রবেশ করেন ,বিকৃত মনোবৃত্তি নিয়ে হাতে নিজ লিঙ্গ ধরে ঋষিপত্নীদের মোহিত করতে থাকেন। কোনো কোনো ঋষিপত্নী ব্যাকুল হয়ে শিবের সামনে উপস্থিত হন। কেউ কেউ শিবের হাত ধরে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। ঋষিরা এসব দেখে অত্যন্ত রেগে যান। তারা শিবকে তার এমন আচরণের কারণ জিজ্ঞাসা করেন। তারা শিবকে অভিশাপ দেন- “তোমার লিঙ্গ ভূতলে পতিত হউক।” অভিশাপ মাত্রই শিবের লিঙ্গ মাটিতে খসে পড়ে যায়। ওই লিঙ্গ সামনে যা কিছু পেল তাই দগ্ধ করে। স্বর্গ, মর্ত, পাতালে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে দেয় মহাদেবের লিঙ্গ।

এই পরিস্থিতিতে লোকেরা ও ঋষিরা দুঃখিত হন। নিরূপায় হয়ে তারা ব্রহ্মার শরণ নেন। ব্রহ্মা বলেন, “যে পর্যন্ত লিঙ্গ স্থিরভাবে অবলম্বন না করিতেছে, সে পর্যন্ত ত্রিজগতের কোথাও শুভ হইবে না, ইহা সত্য কহিতেছি।” এরপর ব্রহ্মা দেবতা- ঋষিগণকে উপদেশ দেন, ” মঙ্গলদায়িনী গিরিজাদেবীর আরাধনা কর, তিনি যদি প্রসন্না হইয়া যোনিরূপ ধারণ করেন, তাহা হইলে নিয়ম এই প্রকার করিবে।” এরপর ব্রহ্মা বলেন কিভাবে যোনিতে লিঙ্গ স্থাপন করে কোন কোন উপাচারের মাধ্যমে তার আরধনা করতে হবে, “…হে দেবেশ! প্রসন্ন হও, হে জগদলাদায়ক… শান্ত হও। এই প্রকারে করিলে নিশ্চয় স্বাস্থ্য হইবে।”

তারপর শিবের শরণাপন্ন হয়ে দেবতা, ঋষিরা তার আরাধনা করতে থাকেন। আরাধনায় শিব সন্তুষ্ট হন। পার্বতী ছাড়া অন্য কেউ শিবের লিঙ্গ ধারণে সমর্থ হবে না ভেবে দেবতা-ঋষিরা পার্বতীকে সন্তুষ্ট করেন। পার্বতী লিঙ্গ ধারণ করেন। লিঙ্গ স্থাপিত হলে জগতে সুখ হয়।
(শিবপুরাণ/জ্ঞানসংহিতা/অধ্যায় ৪২|অনুবাদক- শ্রী পঞ্চানন তর্করত্ন)
বামনপুরাণে
দক্ষযজ্ঞে সতীর মৃত্যু হলে শিব অস্থির চিত্তে এদিক ওদিক হাটতে থাকেন। তাকে স্ত্রী শোকে কাতর দেখে কামদেব তার পুষ্পশর নিয়ে শিবকে তাড়া করলে শিব দারুবনে প্রবেশ করেন। সেখানে মুনিরা তাদের পত্নীদের সাথে বসবাস করতেন।  তাদের দেখে শিব তাদের কাছে ভিক্ষা চান। মুনিরা শিবের কথার উত্তর না দিলে শিব তাদের আশ্রমে মলত্যাগ করতে থাকেন। যাইহোক, মহাদেবকে আশ্রমে দেখতে পেয়ে ভার্গব ও আত্রেয়ের পত্নীরা ( সতী অরুন্ধতী ও অনুসূয়া বাদে) অত্যন্ত কামার্ত হয়ে পড়েন। তারা মহাদেবের পিছু পিছু যেতে লাগলেন। স্ত্রী হাতি যেমন পুরুষ হাতিকে অনুসরণ করে তারাও ঠিক তেমনিভাবে ঘরের কাজ ফেলে শিবের পিছু পিছু যাচ্ছিলেন। এই দৃশ্য দেখে ভার্গব ও আঙ্গিরস মুনি শিবকে অভিশাপ দেন যার ফলে তার লিঙ্গ মাটিতে পড়ে যায়। শিবের লিঙ্গ পতিত হলে  তা ত্রিভুবনে উৎপাত  করতে থাকে, সব ধ্বংস করতে থাকে। তা দেখে ব্রহ্মা শঙ্কিত হয়ে বিষ্ণুর কাছে উপস্থিত হন। এরপর ব্রহ্মা ও বিষ্ণু একসাথে লিঙ্গ যে স্থানে পড়েছিল সে স্থানে উপস্থিত হন। বিষ্ণু গরুড়ে চড়ে এবং ব্রহ্মা তার পদ্মযানে চড়ে লিঙ্গের শেষ খোঁজার চেষ্টা করতে থাকেন কিন্তু কেউই খুঁজে পান না। নিরুপায় হয়ে তারা স্তব স্তুতি করে শিবকে সন্তুষ্ট করেন। স্তব শেষ হলে শিব উপস্থিত হন। শিবকে দেখে তারা শিবকে তার লিঙ্গ ফিরিয়ে নিতে বলেন। কিন্তু শিব বলেন, এক শর্তে তিনি তার লিঙ্গ ফিরিয়ে নিতে পারেন, যদি তার লিঙ্গের পূজা করা হয়! বামন পুরাণ অনুসারে, এর পর থেকে শিবলিঙ্গের পূজা শুরু হয়।
(বামন পুরাণ/৬ষ্ঠ অধ্যায়)

পদ্মপুরাণে
পদ্মপুরাণের উত্তরখণ্ডে,রাজা দিলিপ ঋষি বশিষ্টকে জিজ্ঞাসা করেন, “কোন কারণে শিব ও পার্বতীর নিন্দনীয় রূপ দেখা যায়? সেই প্রসিদ্ধ রূপটিতে (শিবলিঙ্গে)  কেন লিঙ্গ ও যোনি দেখা যায়?  শিবের এই নিন্দনীয় রূপের কারণ কি?”
বশিষ্ট বলেন,

পূর্বে স্বায়ম্ভূব মনু মন্দার নামক শ্রেষ্ঠ পর্বতে ঋষিদের সাথে নিয়ে এক দীর্ঘ চমৎকার যজ্ঞ করেছিলেন। কোন দেবতা ব্রাহ্মণের পূজনীয় এটা নিয়ে তর্ক বেধেছিল। কোনো কোনো ঋষি বললেন শিব শ্রেষ্ঠ। কেউ বললেন ব্রহ্মা একাই পূজনীয়। কেউ আবার বিষ্ণুর কথা বললেন। ঋষিরা ভৃগু ঋষিকে বললেন, ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরকে দেখে  আসতে। এদের মধ্যে যার মধ্যে শুদ্ধ সত্ত্ব গুণ বিরাজ করে তিনিই পূজনীয় হবেন।…

ঋষিদের কথামত ভৃগু, বামদেবের সাথে দেবতাদের দর্শন করতে যান। প্রথমে তারা শিবের আবাসস্থল কৈলাসে গিয়ে উপস্থিত হন। শিবের বাড়ির দরজার কাছে গিয়ে প্রহরারত নন্দীকে দেখে ভৃগু বলেন-

“আমি শ্রেষ্ঠ দেব শিবের সাথে দেখা করতে এসেছি। তাকে খবর দাও।“

ভৃগুর কথা শুনে নন্দী রুষ্ট কণ্ঠে বলে ওঠে, “ প্রভু এখন ব্যস্ত আছেন। তিনি পার্বতীর সাথে সম্ভোগ করছেন। হে মুনি, প্রাণের মায়া থাকলে, এখান থেকে চলে যাও।“

ভৃগু বহুদিন অপেক্ষা করেও শিবের দেখা পান না। অবশেষে রেগে গিয়ে তিনি শিবকে অভিশাপ দেন-

“ স্ত্রী সংসর্গে মত্ত হয়ে মহাদেব আমাকে অবজ্ঞা করছে। অতএব তাদের উভয়ের শরীর লিঙ্গ ও যোনিরূপ হবে। আমি ব্রাহ্মণ, শিব পাপাচ্ছন্ন হয়ে আমাকে জানতে পারল না। অতএব সে অব্রাহ্মণ হয়ে দ্বিজদের অপূজ্য হবে। আর যারা শিবভক্ত হয়ে অস্থিভস্ম, লিঙ্গমূর্তি ধারণ করবে তারা পাষণ্ড হয়ে বৈদিক ধর্ম হতে বহিষ্কৃত হবে।“

(পদ্মপুরাণ/উত্তরখণ্ড/২৫৫/১-৩৪ | publishers:- MOTILAL BANARSIDASS PUBLISHERS PRIVATE LIMITED)

স্কন্দ পুরাণে
একদিন শিব নগ্ন হয়ে ভিক্ষা করার জন্য দারুবনে গমন করেন।দারুবনের ঋষিরা স্নান করার জন্য অন্য জায়গায় গিয়েছিলেন,কেবলমাত্র ঋষি পত্নীরাই সেইসময়ে আশ্রমে ছিলেন, এমন সময় শিব দারুবনের আশ্রমের দিকে নগ্নভাবে অগ্রসর হন। মহাদেবকে দেখে মুনিপত্নীরা বলেন,” কে এই অপূর্ব দর্শন ভিক্ষুক এখানে আগমণ করিলেন? যাহা হউক আমরা সখীগণ সমভিব্যহারে ইহাকে ভিক্ষা প্রদান করিব।” তারপর তারা শিবকে মনমত ভিক্ষা দেন। এরপর মুনিপত্নীদের শিব জানান ,”আমি ঈশ্বর।”। তখন মুনিপত্নীরা অনুমান করেন, তিনি নিশ্চয় মহাদেবই হবেন। তারপর ঋষি পত্নীরা শিবের কাছে তার  ভিক্ষা করার কারণ জানতে চান। তখন শিব জানান,” পত্নী দাক্ষায়ণীর সহিত আমার বিচ্ছেদ ঘটিয়াছে,তাই আমি দিগম্বর হইয়া বিচরণ করি।” শিব আরো বলেন, তার সতী ভিন্ন অপর কোনো নারীতে তার রুচি নেই।

শিব ভিক্ষা গ্রহণ করে চলে যেতে থাকলে, ঋষিদের পত্নীরাও কামপরবশ হয়ে তাকে অনুসরণ করতে থাকেন। তারা ঘরের সকল কাজ ছেড়ে শিবের পেছন পেছন চলতে শুরু করেন।
এদিকে ঋষিরা আশ্রমে এসে দেখেন তাদের স্ত্রীরা সেখানে নেই। তখন তারা আশঙ্কা করে বলেন, “আমাদের পত্নীসকল কোথায় গেল, কিছুই জানিতেছি না। কোনো নষ্ট লোক কি তাহাদের সকলকে হরণ করিল?” ঋষিরা আশ্রমের চারদিকে তাদের স্ত্রীদের খুজতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর তারা দেখতে পেলেন, তাদের স্ত্রীরা শিবের পেছন পেছন চলে যাচ্ছেন। তা দেখে তারা সকলেই খুব রেগে যান এবং শিবের কাছে গিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, মহাদেব কেন তাদের পত্নীদের চুরি করে নিয়ে যাচ্ছেন। ঋষিদের কথা শুনেও শিব কিছু না বলে কৈলাশের দিকে চলতে থাকেন। শিবের এমন আচরণ দেখে ঋষিরা অত্যন্ত রেগে যান, তারা শিবকে অভিশাপ দেন ,

“যেহেতু তুমি অব্যয় মহাদেব হইয়াও আমাদের কলত্রাপহরত্তা (স্ত্রী অপহরণকারী) , এইজন্য সত্ত্বর তোমাকে ক্লীব হইতে হইবে।”

মুনিদের অভিশাপের সাথে সাথে শিবের লিঙ্গ মাটিতে পড়ে যায়। ঐ লিঙ্গ মাটিতে পরে বাড়তেই থাকে, স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল সবই লিঙ্গ দ্বারা আবৃত হয়।শিবের লিঙ্গে সকল কিছুই লীন হয়ে যায়। যেহেতু শিবের লিংগে সব কিছু লীন হয়ে যায়, তাই তার নাম হয় লিঙ্গ। ব্রহ্মা ও বিষ্ণু এই লিঙ্গের আদি ও অন্ত জানার জন্য পাতাল ও স্বর্গাভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু কেউই তার আদি ও অন্ত দেখতে পান না।

ঋষি-দেবতাগন সকলেই ভয় বিহ্বল হয়ে শিবলিঙ্গের স্তুতি করতে থাকেন। বীরভদ্র, দেব ঋষিগণ শিবলিঙ্গের পূজা করে তাকে শান্ত করেন।

(স্কন্দ পুরাণ/মাহেশ্বরখণ্ডে-কেদারখণ্ডম/৬-৭ অধ্যায়)

কূর্ম পুরাণে
“পূর্বকালে দেবদারু বনে হাজার হাজার মুনি স্ত্রী পুত্রদের নিয়ে তপস্যা করেছিলেন। ঐ মহর্ষিরা নানা প্রকার কাম্য কর্ম করতে প্রবৃত্ত হয়ে বিবিধ যজ্ঞ  আর তপস্যা করতে লাগলেন। তখন কামনাসক্ত চিত্ত মুনিদের দোষ দেখিয়ে দেবার জন্য ভগবান মহাদেব দেবদারু বনে উপস্থিত হলেন।” মহাদেব বিষ্ণুকে সাথে করে দেবদারু বনে গিয়েছিলেন। মহাদেব ২০ বছর বয়সী অত্যন্ত সুঠাম, সুদর্শন পুরুষের রূপ ধারণ করলেন। আর বিষ্ণুও এক সুন্দরী নারীর মূর্তি ধারণ করলেন।নগ্ন মহাদেব ও স্ত্রীবেশধারী বিষ্ণু সবাইকে মোহিত করতে করতে জঙ্গলে বিচরণ করতে লাগলেন। ঋষিদের পতিব্রতা স্ত্রীরাও মহাদেবকে দেখে কামার্ত হয়ে পড়লেন। “তাদের বস্ত্র ও আভরণ খুলে পড়ে যেতে লাগল। এইভাবে বারাঙ্গনার মত নির্লজ্জ হয়ে তারা শিবের সঙ্গে সঙ্গে ভ্রমণ করতে লাগলেন। ঋষিদের তরুণ পুত্রেরা জিতেন্দ্রিয় ছিলেন কিন্তু এখন কামার্ত হয়ে স্ত্রী বেশধারী হৃষীকেশের (বিষ্ণুর) পেছনে পেছনে যেতে লাগলেন। বিলাসিনী নারীরা পত্নীর সঙ্গে অদ্বিতীয় মহাদেবকে অতি সুন্দর ও অদ্বিতীয় নায়করূপে দেখে নাচতে গাইতে শুরু করলেন আর মাঝে মাঝে ইচ্ছার বশে আলিঙ্গনও করতে লাগলেন… রুদ্র নারীদের আর কেশব (বিষ্ণু) পুত্রদের মোহিত করছেন দেখে মুনিরা ক্রুদ্ধ হলেন।“ অসন্তুষ্ট মুনিদের সাথে এক পর্যায়ে শিবের ঝগড়া বেধে গেল। “ঋষিরাও আবার তাকে দণ্ড, যষ্টি ও মুষ্টির দ্বারা  তাড়না করতে লাগলেন। তারপর শিবকে উলঙ্গ ও বিকৃত চিত্তযুক্ত হয়ে ভ্রমণ করতে দেখে ঋষিরা বললেন, রে দুর্মতি, তুই এই লিঙ্গ উপড়ে ফেল। মহাযোগী শঙ্কর তাদের বললেন, যদি আমার এই লিঙ্গের উপর তোমাদের এতই রাগ , তবে না হয় উপড়েই ফেলছি। এই বলে ভগদেবতার নেত্র উৎপাটনকারী ভগবান লিঙ্গ উপড়ে ফেললেন।“ তারপর শিব ও বিষ্ণু অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এরপরেই নানা প্রকার দুর্যোগ দেখা দিতে শুরু করে। পৃথিবী কাঁপতে থাকে,সমুদ্র ফুলে উঠতে থাকে। এর পরে ঋষিরা ব্রহ্মার কাছে গিয়ে সব খুলে বলে তার কাছ থেকে পরামর্শ নিলেন-

ব্রহ্মা বললেন, “তার (শিবের) যে লিঙ্গকে তোমরা ভূমিতে পড়ে যেতে দেখেছিলে , সেই লিঙ্গের মত দেখতে আরেকটি লিঙ্গ নির্মাণ কর, তারপর স্ত্রী পুত্রের সঙ্গে ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে সযত্নে নানা প্রকার বৈদিক নিয়মে পূজা কর। তোমরা বন্ধু আর পুত্রদের সঙ্গে মিলে শতরুদ্রিয় পাঠ আর পরম তপস্যা অবলম্বন করে ঋক,যজুঃ, সামবেদস্থিত শাঙ্কর মন্ত্রে প্রতিষ্ঠা করে সমাহিতভাবে পূজা কর এবং সকলেই কৃতাঞ্জলিপুটে ভগবান শূলপানির শরণাপন্ন হও। তাহলেই অসংস্কৃতাত্ম পুরুষেরা যাকে সহজে দেখতে পায় না সেই দেবাধিপতি মহাদেবকে দেখতে পাবে।”

(কূর্ম পুরাণ /উত্তরভাগ/ ৩৭ অধ্যায় । নবপত্র প্রকাশন)  ( Kurma Purana/uttar-bhaga/ 38-39 chapter)

মহাভারতে
” দেবগণ সেই মহেশ্বরের লিঙ্গ ব্যতিরেকে আর কাহারও লিঙ্গ পূজা করেন নাই ও করিতেছেন না। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, আপনি ও অন্যান্য দেবগণ আপনারা সকলেই সেই দেবাদিদেবের লিঙ্গ পূজা করিয়া থাকেন, সুতরাং তিনিই সকল দেবতার অগ্রগণ্য। ব্রহ্মার চিহ্ন পদ্ম, বিষ্ণুর চিহ্ন চক্র ও আপনার চিহ্ন বজ্র বিদ্যমান রহিয়াছে। কিন্তু প্রজারা আপনাদিগের কাহারই চিহ্নে চিহ্নিত নহে। তাহারা হরপার্বতীর চিহ্নানুসারে লিঙ্গ ও যোনি চিহ্ন ধারণ করিয়াছে । সুতরাং উহারা যে শিব ও শিবা হইতে উদ্ভূত, তাহার আর সন্দেহ নাই। স্ত্রীজাতি পার্বতীর অংশে সম্ভূত হইয়াছে বলিয়া যোনিচিহ্নে চিহ্নিত আর পুরুষেরা মহাদেবের অংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছে বলিয়া লিঙ্গচিহ্নিত হইয়াছে; যাহারা উহাদের উভয়ের চিহ্নেই চিহ্নিত তাহারা ক্লীবপদবাচ্য হইয়া জনসমাজ হইতে বহিষ্কৃত হয় এই জীবলোকে পুংলিঙ্গধারীরে শিবের ও স্ত্রীলিঙ্গধারীরে পার্বতীর অংশ বলিয়া অবগত হইবে। এই চরাচর বিশ্ব হরপার্বতী দ্বারাই ব্যাপ্ত রহিয়াছে। ”(কালিপ্রসন্নের মহাভারত/ অনুশাসন পর্ব/ চতুর্দশ অধ্যায়)
হিন্দু সভ্যতায় বহুদেবতাবাদ প্রচলিত থাকলেও হিন্দু সমাজ মূলত পঞ্চদেবতার উপাসক। এই পঞ্চোপাসক সম্প্রদায় হলো– শৈব, শাক্ত, সৌর, গাণপত্য ও বৈষ্ণব। আবার সম্প্রদায়গতভাবে ভগবান শ্রীবিষ্ণু ও শিব ঠাকুরের পূজা মূর্ত ও অমূর্ত বা বিমূর্তরূপে শালগ্রাম শিলায় ও শিবলিঙ্গে বহুল প্রচলিত। এর মধ্যে শিবলিঙ্গ পূজা সমাজ জীবনে এতটাই জনপ্রিয় যে, জনমানসে তাঁর মূর্তিরূপই ক্রমবিলীয়মান। এ প্রসঙ্গে মহাশায় অক্ষয় কুমার দত্ত বলেন–
‘শিবের সহিত অন্য অন্য দেবতার একটি বিষয়ে বিশেষ বিভিন্নতা দেখিতে পাওয়া যায়। তাঁহার সর্বাবয়বের প্রতিমূর্তি অতীব বিরল; ভারতবর্ষের সকল অংশেই তদীয় লিঙ্গ-মূর্তিতেই তাঁহার পূজা হইয়া থাকে। উহা সর্বত্র এরূপ প্রচলিত যে, শিবের উপাসনা বলিলে শিবের লিঙ্গ-মূর্তির উপাসনাই বুঝিতে হয়। শিবালয় ও শিব-মন্দির সমুদায় কেবল ঐ মূর্তিরই আলয়। শৈবতীর্থে কেবল ঐ মূর্তিরই মহিমা প্রকাশিত আছে। স্বতন্ত্র একখানি বৃহৎ পুরাণ ঐ মূর্তিরই গুণ-কীর্তন উদ্দেশে বিরচিত হইয়াছে।’– (ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় : দ্বিতীয় ভাগ, পৃষ্ঠা-৮৯)
উল্লিখিত ঐ স্বতন্ত্র পুরাণটি হলো লিঙ্গপুরাণ। এই লিঙ্গপুরাণে দুই প্রকার শিবের বিষয় লিখিত আছে– অলিঙ্গ ও লিঙ্গ। যেমন–
জগদ্যোনি মহাভূতং স্থূলং সূক্ষ্মমজং বিভূম্ ।
বিগ্রহং জগতাং লিঙ্গং অলিঙ্গাদভবত্ স্বয়ম্ ।। (লিঙ্গপুরাণ তৃতীয় অধ্যায়)
অর্থাৎ : স্থূল, সূক্ষ্ম, জন্ম-রহিত ও সর্ব-ব্যাপী মহাভূত-স্বরূপ লিঙ্গ শিব জগতের কারণ ও বিশ্ব-রূপ। তিনি অলিঙ্গ-শিব হইতে উৎপন্ন হইয়াছেন।
অন্যদিকে বিদ্যেশ্বর সংহিতার মতে–
শিব একো ব্রহ্মরূপত্বান্নিষ্কলঃ পরিকীর্তিতঃ।
রূপিত্বাৎ সকল স্তদ্বৎ তস্মাৎ সকল নিষ্কলঃ।।
নিষ্কলত্বান্নিরাকারং লিঙ্গং তস্য সমাগতম্ ।
সকলত্বাৎ তথা রেবং সাকারং তস্য সঙ্গতম্ ।। (বিদ্যেশ্বর-সংহিতা)
অর্থাৎ : ব্রহ্ম যেমন নির্গুণ ও সগুণ দুই প্রকারই হন, তেমনি নিষ্কল শিব নিরাকার লিঙ্গরূপী এবং সগুণ শিব সাকার রূপধারী।
             উপরের এই উদ্ধৃতিতে স্পষ্টতই ব্রহ্মবাদী বেদান্ত ধারণারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হয়, তবু প্রজননমূলক বিশ্বাসাশ্রিত লিঙ্গ ধারণা যে বেদান্তের চেয়ে বহু বহু প্রাচীন ও প্রাগৈতিহাসিক সময়কালে নিহিত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু প্রাচীন জনমানসে এই লিঙ্গের সাথে কখন কিভাবে কোথায় শিব নামক বেদবাহ্য এক বিপুল পূজ্য দেবতার ধারণার একাত্মতা ঘটেছে এবং কালে কালে দেবতামূর্তি ছাপিয়ে তাঁর প্রতীকী লিঙ্গমূর্তি রূপটাই এতো জনপ্রিয় ও বহুল পূজ্য হয়ে ওঠেছে সেটা নিশ্চয়ই গভীর অনুসন্ধানের বিষয়। কেননা ঐ লিঙ্গপুরাণের সপ্তদশ অধ্যায়ে সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে, মহাদেবের সৃজন-শক্তিই লিঙ্গ। যেমন–
প্রধানং লিঙ্গমাখ্যাতং লিঙ্গী চ পরমেশ্বরঃ। (লিঙ্গপুরাণ সপ্তদশ অধ্যায়)
অর্থাৎ : মহেশ্বর লিঙ্গী এবং তাঁহার প্রকৃতি অর্থাৎ সৃজন-শক্তি লিঙ্গ বলিয়া খ্যাত।
শিব ও লিঙ্গ 
লিঙ্গকে মহাপ্রতীক মেনে যাঁরা দেবতা শিবকে পরমেশ্বরজ্ঞানে উপাসনা করেন তাঁদেরকে বলা হয় শৈব। এই শৈবদের মধ্যেও তত্ত্বগত দৃষ্টিভঙ্গি ও সাধনাচারের পার্থক্যপ্রসূত বিভিন্ন সম্প্রদায়ভেদ রয়েছে। রয়েছে ধ্যান-ধারণাগত পার্থক্য ও আচার-বিচারে বৈচিত্র্য। লিঙ্গায়েৎ শৈব সম্প্রদায়ের মতে লিঙ্গ নিষ্কল ব্রহ্মের প্রতীক। কোন কোন পন্ডিতের মতে, মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েই তাঁরা নাকি এরূপ লিঙ্গার্চনা শুরু করেন। তবে শৈব সম্প্রদায়গুলোর নিজেদের মধ্যকার তত্ত্বীয় অভিন্নতা হলো, এরা পরমেশ্বর শিবকেই সৃষ্টির আদিদেবতা বলে স্বীকার করেন এবং লিঙ্গকে তাঁরই সূক্ষ্ম প্রতীক হিসেবে গণ্য করেন। ‘লী’ ধাতুর অর্থ লয় পাওয়া এবং ‘গম’ ধাতুর অর্থ বহির্গত হওয়া। কৌলজ্ঞাননির্ণয়ে তাই বলা হয়েছে–
যস্যেচ্ছয়া ভবেৎ সৃষ্টির্লয়স্তত্রৈব গচ্ছতি।
তেন লিঙ্গন্তু বিখ্যাতং যত্র লীনং চরাচরম্ ।।’ (কৌলজ্ঞাননির্ণয়-৩/১০)
অর্থাৎ : যে পরম সত্তার থেকে জগতের উৎপত্তি হয় এবং যাঁর মধ্যে জগৎ লীন হয় সেই পরম কারণই লিঙ্গ।
স্কন্দপুরাণেও প্রায় একইরূপ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়–
আকাশং লিঙ্গমিত্যাহুঃ পৃথিবী তস্য পীঠিকা।
আলয়ঃ সর্বদেবানাং লয়নাল্লিঙ্গমুচ্যতে।।
শিবপুরাণের বায়বীয় সংহিতার মতে–
লিঙ্গঞ্চ শিবয়োর্দেহস্তাভ্যাং যস্মাদধিষ্টিতং। (বা. স. উত্তরভাগ- ২৭/১২)
অর্থাৎ : শিবশক্তি লিঙ্গেতে নিত্য অধিষ্ঠান করেন।
            লিঙ্গপুরাণ, শিবপুরাণ ও স্কন্দপুরাণেই শিব ও শিবলিঙ্গ সম্পর্কে বিস্তারিত অবগত হওয়া যায়। পুরাণের স্বাভাবিক ধারা অনুসারে লিঙ্গপুরাণে বিভিন্ন প্রকার শিবমূর্তির বর্ণনা এলেও এবং সেই সব মূর্তির পূজাদির কথা বলা হলেও লিঙ্গার্চনার উপরেই জোর দেওয়া হয়েছে বেশি। শিবের লিঙ্গমূর্তির পূজা না করার জন্যই যে তারকাসুরের ধ্বংস হয়েছিল সেকথা জানিয়ে পিতামহ ব্রহ্মা অতঃপর বলছেন–
পূজনীয়ঃ শিবো নিত্যং শ্রদ্ধয়া দেবপুঙ্গবৈঃ।
সর্বলিঙ্গময়ো লোকঃ সর্বং লিঙ্গে প্রতিষ্ঠিতম্ ।।
তস্মাত্সম্পূজয়েল্লিঙ্গং যইচ্ছেৎ সিদ্ধিমাত্মনঃ।
সর্বে লিঙ্গার্চনাদেব দেবাদৈত্যাশ্চদানবাঃ।।
যক্ষা বিদ্যাধরাঃ সিদ্ধা রাক্ষসাঃ পিশিতাশনাঃ।
পিতরো মুনয়শ্চাপি পিশাচাঃ কিন্নরাদয়ঃ।।
অর্চয়িত্বালিঙ্গমূর্তিং সংসিদ্ধানাত্র সংশয়ঃ।
তস্মাল্লিঙ্গং যজেন্নিত্যং যেনকেনাপিবা সুরাঃ।। (লিঙ্গপুরাণ-১/৭৩/৬-৯)
অর্থাৎ : যে নিজের অভিষ্ট সিদ্ধি করতে চায়, সে লিঙ্গ পূজা করবে। কারণ সমস্ত জগৎ লিঙ্গাধীন এবং লিঙ্গে সমগ্র জগৎ অধিষ্ঠিত। দেব, দৈত্য, দানব, যক্ষ, বিদ্যাধর, সিদ্ধ, রাক্ষস, পিতৃপুরুষগণ, মুনি, কিন্নর সকলেই লিঙ্গমূর্তি মহাদেবকে পূজো করে সিদ্ধ হবে। এই বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।
         লিঙ্গপুরাণে বিভিন্ন দেবতার বিভিন্ন প্রকার লিঙ্গার্চনের বিবরণ আছে। বলা হচ্ছে,– ব্রহ্মার আদেশে বিশ্বকর্মা স্বাধিকারানুসারে লিঙ্গ প্রস্তুত করে দেবতাদের দেন। বিষ্ণু ইন্দ্রনীলমণি নির্মিত লিঙ্গ পূজা করতে লাগলেন। ইন্দ্র পদ্মরাগের লিঙ্গ, কুবের সোনার লিঙ্গ, বিশ্বদেবগণ রজতলিঙ্গ, অষ্টবসু চন্দ্রকান্তমণির লিঙ্গ, বায়ু পিতলের, অশ্বিনীকুমার যুগল মাটির, বরুণ স্ফটিকের, দ্বাদশাদিত্য তামার, চন্দ্র মুক্তার, অনন্তাদি নাগেরা প্রবালের, দৈত্য ও রাক্ষসেরা লোহার, গুহ্যকেরা ত্রৈলোহিক, প্রমথেরা লোহার, চামুণ্ডাদি মাতৃগণ বালির, নিরুতি কাঠের, যম পান্নার, রুদ্রগণ ভস্মের, পিশাচেরা সীসার, লক্ষ্মী বৃক্ষের, কার্ত্তিক গোময়ের, শ্রেষ্ঠ মুনিরা কুশাগ্র নির্মিত, বামারা পুষ্পলিঙ্গ, মনোন্মনী গন্ধদ্রব্য নির্মিত লিঙ্গ, বাগদেবী রত্নময় লিঙ্গ, দুর্গা বেদিসমেত স্বর্ণলিঙ্গ পূজা করেন।
লিঙ্গপুরাণের মতোই শিবপুরাণের জ্ঞানসংহিতার পঞ্চবিংশ অধ্যায়ে প্রায় একই প্রকার কথা পাওয়া যায়, যেমন–
প্রস্তুতঞ্চৈব দৃষ্টঞ্চ সর্বং দৃষ্টান্তমদ্ভূতম্ ।
সন্ত্যজ্য দেবদেবেশং লিঙ্গমূর্তিং মহশ্বেরম্ ।।
তারপুত্রাস্তথৈতে বৈ নষ্টাস্তে চৈব বান্ধবাঃ।
ময়া চ বিমোহিতাস্তে বৈ মায়য়া দূরতঃ কৃতাঃ।।
সর্বে বিনষ্টাঃ প্রধ্বস্তাঃ শিবেন রহিতা যদা।
তস্মাৎ সদা পূজনীয়া লিঙ্গমূর্তিধরো হরঃ।।
যদি সুখং সুরেশাশ্চ বৈরন্তর্যং ভবেদিহ।
(পূজনীয়ঃ শিবো নিত্যং শ্রদ্ধয়া দেবপূঙ্গবৈঃ।।
সর্বলিঙ্গময়েঅদেবঃ সর্বলিঙ্গে প্রতিষ্ঠিতঃ।
তস্মাৎ সম্পূজয়েন্নিত্যং যদীচ্ছেৎ সিদ্ধিমাত্মনঃ।।
সর্বে লিঙ্গার্চনাদেব দেবা দৈত্যাশ্চ দানবাঃ।
বয়ষ্ণৈব তথা ব্রহ্মন্ কিমথং বিস্তৃতং ত্বয়া।।
অর্চয় ত্বং লিঙ্গমূর্তিং সংসিদ্ধেৎ নাত্র সংশয়ঃ।
তস্মাল্লিঙ্গেহর্চয়েন্নিত্যং যেন কেনাপি বৈ সুরাঃ।।)- (শিবপুরাণ/জ্ঞানসংহিতা-২৫ অ/২২-২৮)
অর্থাৎ : হে দেবগণ! সর্বদুঃখ নাশের জন্য শঙ্কর যে সেবনীয় তা তোমরা পূর্বে দেখেছো এবং এখনও দেখছো, তাহলে কেন আবার সেই কথা জিজ্ঞাসা করছো? এই বিষয়ে দেবেশ্বর মহাদেব আমার ও ব্রহ্মার কাছে বিশেষ রূপে বলেছেন। তোমরা দেখেছো যে তারক পুত্রগণ লিঙ্গমূর্তি মহাদেবকে অনাদর করে সবান্ধবে বিনষ্ট হয়েছে। আমি প্রথমতঃ তাদের মায়ায় মোহিত করে দূর করে দিলাম এবং পরে যখন তারা শিবকে অবজ্ঞা করতে লাগলো তখন সকলে বিনষ্ট হলো। অতএব হে সুরেশ্বরগণ! যদি সর্বদা সুখবাসনা থাকে, তাহলে সব সময় লিঙ্গমূর্তিধর মহাদেবকে পূজা করা উচিত। দুঃখ দূর করার জন্য দেবতাদেরও সর্বলিঙ্গে অন্তর্যামিরূপে প্রতিষ্ঠিত শিবকে পূজা করা উচিত। (বন্ধনীযুক্ত বাকি শ্লোকগুলির অর্থ পূর্বোক্ত লিঙ্গপুরাণ-১/৭৩/৬-৯ শ্লোকের অনুরূপ।)
এই শিবপুরাণেও লিঙ্গপুরাণ-১/৭৪/১ অংশের শ্লোকের অনুরূপ বক্তব্যে বলা হয়েছে যে–
লিঙ্গানি কল্পয়িত্বৈবঞ্চাধিকারানুরূপতঃ।
বিশ্বকর্মা দদৌ তেভ্যো নিয়োগাদ্ ব্রহ্মণঃ প্রভোঃ।। (জ্ঞানসংহিতা-২৫/৩৮)
অর্থাৎ : ব্রহ্মার আদেশে বিশ্বকর্মা স্বাধিকারানুসারে বিভিন্ন প্রকার লিঙ্গ নির্মাণ করেন ও দেবতাদের প্রদান করেন।
এই বিভিন্ন প্রকার লিঙ্গ প্রসঙ্গে লিঙ্গপুরাণের চুয়াত্তর অধ্যায়ে বিশদভাবে বর্ণিত আছে। যেমন–
ষট্-বিধং লিঙ্গমিত্যাহুর্দ্রব্যাণাঞ্চপ্রভেদতঃ।
তেষাং ভেদাশ্চতুর্যুক্তশ্চত্বারিংশদিতি স্মৃতাঃ।।
শৈলজং প্রথমং প্রোক্তং তদ্ধি সাক্ষাচ্চতুর্বিধম্ ।
দ্বিতীয়ং রত্নজং তচ্চ সপ্তধা মুনিসওমাঃ।।
তৃতীয়ং ধাতুজং লিঙ্গমষ্টধা পরমেষ্ঠিনঃ।
তুরীয়ং দারুজং লিঙ্গং তত্তু ষোড়শধোচ্যতে।।
মৃন্ময়ং পঞ্চমং লিঙ্গং দ্বিধা ভিন্নং দ্বিজোত্তমাঃ।
ষষ্ঠন্তু ক্ষণিকং লিঙ্গং সপ্তধা পরিকীর্ত্তিতম্ ।। (লিঙ্গপুরাণ-১/৭৪/১৩-১৬)
অর্থাৎ : দ্রব্য উপাদানভেদে লিঙ্গকে প্রথমত ছয় ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে এবং তাদের আবার চতুঃচত্বারিংশ বা চুয়াল্লিশ ভাগে বিভাগ করা হয়েছে। প্রথমে শৈলজালিঙ্গ বা প্রস্তরনির্মিত লিঙ্গ চার প্রকার, দ্বিতীয় রত্নজ লিঙ্গ সাত প্রকার, তৃতীয় ধাতুজ লিঙ্গ আট প্রকার, তারপর দারুজ বা কাষ্ঠনির্মিত লিঙ্গ ষোড়শ প্রকার, পঞ্চমে মৃন্ময় বা মৃত্তিকানির্মিত লিঙ্গ দুই প্রকার এবং ষষ্ঠত রঙ্গ বা রাং নির্মিত রিঙ্গ সাত প্রকার।
        বিভিন্ন প্রকার লিঙ্গের বিবরণ শাস্ত্রে শ্রুত হলেও এটাও বলা আছে যে সমস্ত প্রকার লিঙ্গের পূজনে একই ফল লাভ হয় না। যেমন–
শ্রীপ্রদাং রত্নজং লিঙ্গং শৈলজং সর্বসিদ্ধিদম্ ।
ধাতুজং ধনদং সাক্ষাদ্দারুজং ভোগসিদ্ধিদম্ ।।
মৃন্ময়ঞ্চৈব বিপ্রেন্দ্রাঃ সর্বসিদ্ধিকরং শুভম্ ।
শৈলজং চোত্তমং প্রোক্তং মধ্যমঞ্চৈব ধাতুজম্ ।। (লিঙ্গপুরাণ-১/৭৪/১৭-১৮)
অর্থাৎ : রত্ন নির্মিত লিঙ্গ পূজার দ্বারা শ্রীলাভ হয়, শৈলজ (প্রস্তর নির্মিত) লিঙ্গ সর্বসিদ্ধি দায়ক, ধাতুর দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ সাক্ষাৎ ধনদ, কাঠের দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ ভোগ ও সিদ্ধি দান করে, মৃন্ময় লিঙ্গ সর্বসিদ্ধিদায়ক ও শুভ। প্রস্তর দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ অতি উত্তম এবং ধাতুর দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ মধ্যম প্রকৃতির।
কেবল যে দ্রব্যের প্রকারগত ভিন্নতার কারণে লিঙ্গপূজা ভিন্ন ফলদায়ক হয় তাই নয়, লিঙ্গের আকৃতিগত ভিন্নতার কারণেও ফলভিন্নতা হতে পারে। যেমন লিঙ্গপুরাণ মতে–
বহুধা লিঙ্গভেদাশ্চ নব চৈব সমাসতঃ।
মূলে ব্রহ্মা তথা মধ্যে বিষ্ণুস্ত্রিভুবনেশ্বরঃ।।
রুদ্রোপরি মহাদেবঃ প্রণবাখ্যঃ সদা শিবঃ।
লিঙ্গবেদী মহাদেবী ত্রিগুণাত্রিময়াত্মিকা।।
তথা চ পূজয়েদ্যস্তু দেবী দেবশ্চ পূজিতৌ। (লিঙ্গপুরাণ-১/৭৪/১৯-২১)
অর্থাৎ : লিঙ্গের বিভিন্ন ভাগ রয়েছে। লিঙ্গের মূলে বাস করেন ব্রহ্মা, মধ্যে বিষ্ণু ও উপরে ওঙ্কাররূপী মহাদেব রুদ্র। ত্রিগুণাত্মিকা মহাদেবী হলেন লিঙ্গবেদি। যে ব্যক্তি বেদি সমেত লিঙ্গ পূজা করে, তার সর্ব দেবদেবীর পূজা ফল লাভ হয়।
             উল্লেখ্য, বর্তমানে গৌরীপট্ট সংবলিত যে কৃত্রিম শিবলিঙ্গ দৃশ্যমান হয়, বেদবিহিত পৌরাণিক ব্যাখ্যায়– লিঙ্গের তিন ভাগের মধ্যে– শিবলিঙ্গে গৌরীপট্টের উপরের অংশকে রুদ্রভাগ বলে, মাঝের অংশ অর্থাৎ গৌরীপট্টের অঞ্চলকে বিষ্ণুভাগ এবং গৌরীপট্টের নিচের অংশকে ব্রহ্মভাগ বলে। কিন্তু সকল লিঙ্গে– বিশেষ করে প্রাকৃতিক উপায়ে সৃষ্ট লিঙ্গে– এই গৌরীপট্ট দেখা যায় না।
শিবলিঙ্গ সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই গৌরীপীঠ বা গৌরীপট্টের কথা এসে যায়। শাক্তচিন্তা প্রসূত বেদবাহ্য ব্যাখ্যায় এই গৌরীপট্টকে যোনিও বলা হয়। যোনিমুদ্রার আকৃতিও গৌরীপট্টের মতো। লিঙ্গোপাসনাকে যাঁরা যৌন উপাসনা বলেন তাঁরা স্ত্রী ও পুং জননেন্দ্রিয়ের প্রতীক হিসেবেই যোনি ও লিঙ্গকে দেখাতে চান। প্রাণতোষিনী তন্ত্রের একটি বচনে বলা হয়েছে– লিঙ্গ ব্রহ্মস্বরূপ সাক্ষাৎ মহেশ্বর এবং যোনি জগন্ময়ী মহামায়া। নিরুত্তর তন্ত্রেও প্রায় একই কথা পাওয়া যায়–
লিঙ্গরূপো মহাকালো যোনিরূপা চ কালিকা।
অর্থাৎ : লিঙ্গরূপে স্বয়ং মহাকাল এবং যোনিরূপে দেবী কালিকা অধিষ্ঠিত।
এভাবে শিব ও শক্তির অভেদের কল্পনা করেই নারদ-পঞ্চরাত্রের একটি বচনে তাই দেখা যায়–
যত্র লিঙ্গস্তত্র যোনিযত্র যোনিস্ততঃ শিবঃ।
অর্থাৎ : যেখানে লিঙ্গ (শিব) সেখানেই যোনি (শক্তি), যেখানে যোনি সেখানেই শিব।
             লিঙ্গ যেহেতু পিতৃত্বের এবং যোনি মাতৃত্বের প্রতীক, তাই (গৌরীপট্ট সমন্বিত) লিঙ্গ একই সঙ্গে পিতামাতার প্রতীক। লিঙ্গপুরাণের উত্তরভাগেও (১১/৩১) আমরা এধরনের মতবাদের প্রতিধ্বনি শুনতে পাই–
পীঠাকৃতিরুমাদেবী লিঙ্গরূপশ্চ শঙ্করঃ।
প্রতিষ্ঠাপ্য প্রযত্নেন পূজয়ন্তি সুরাসুরাঃ।।
অর্থাৎ : উমাদেবীকে লিঙ্গপীঠ রূপে এবং মহাদেব শঙ্করকে লিঙ্গরূপে প্রতিষ্ঠা করে সমস্ত সুর ও অসুরেরা তার পূজা করে থাকেন।
              বেদপন্থীরা যে যোনিরূপ গৌরীপট্টের ব্যাখ্যা অন্যভাবে দিয়ে থাকেন, তা ইতঃপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। ঋগ্বেদের একটি মন্ত্রের ব্যাখ্যায় (ঋক-১/১০৪/১) সায়ণাচার্য্য যোনিকে যজ্ঞবেদী হিসেবে অর্থবাদ করেছেন। যেমন–
যোনিষ্ট ইন্দ্র নিষদে অকারি তমা নি ষীদ স্বানো নার্বা।
বিমুচ্যা বয়োহবসায়াশ্বান্দোষা বস্তোর্বহীয়সঃ প্রপিত্বে।। (ঋগ্বেদ-সংহিতা-১/১০৪/১)
অর্থাৎ : হে ইন্দ্র! তোমার বসবার (অবস্থানের) জন্য যে বেদি (যোনি) প্রস্তুত হয়েছে শব্দায়মান অশ্বের ন্যায় তথায় উপবেশন কর। অশ্ববন্ধন রশ্মিবিমোচন করে অশ্বদের মুক্ত করে দাও, সে অশ্ব যজ্ঞকাল সমাগত হলে দিন রাত তোমাকে বহন করে।
           পরবর্তী চিন্তায় সেই বেদীকে দক্ষতনয়া উমা গৌরীর সঙ্গে এক করে দেখা হয়েছে। এই যোনি বা বেদির উপর প্রজ্বলিত অগ্নি হলেন লিঙ্গ। মহাভারতকারও যে সমস্ত পুরুষের প্রতীক হিসাবে লিঙ্গকে এবং সমস্ত নারীর প্রতীক হিসেবে যোনিপীঠকে বিবেচনা করতেন, তা উপমন্যু কথিত শিবলিঙ্গ কথা থেকে বোঝা যায়। সেখানে বলা হয়েছে–
পুংলিঙ্গং সর্বমীশানং স্ত্রীলিঙ্গং বিদ্ধিচাপ্যুমাম্ ।
দ্বাভ্যাং তনুভ্যাং ব্যাপ্তং হি চরাচরমিদং জগৎ।। (মহাভারত-১৩/১৪/২৫৩)
অর্থাৎ : সমস্ত পুরুষ ঈশান এবং সমস্ত স্ত্রীমূর্তিই উমা। শিবশক্তির পুরুষ এবং স্ত্রী এই দুই তনুর দ্বারা জগৎ ব্যাপ্ত।
একই কথা শিবপুরাণের বায়বীয় সংহিতার পঞ্চম অধ্যায়ে পাওয়া যায়। সেখানে ৫৫ শ্লোকে বলা হয়েছে–
শঙ্কর পুরুষাঃ সর্বে স্ত্রিয়ঃ সর্বা মহেশ্বরী।
সর্বে স্ত্রী-পুরুষাস্তস্মাৎ তয়োরেব বিভূতয়ঃ।।
অর্থাৎ : পুরুষ মাত্রেই সেই দেব-দেব শঙ্কর এবং স্ত্রীমাত্রেই দেবী শঙ্করী। সমস্ত স্ত্রী-পুরুষ সেই ভব-ভবানীর বিভূতি।
           শিব-শক্তির সম্পর্ক দেখাতে গিয়ে এখানে যেসব কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে যে তন্ত্রের বীজ রয়েছে তা বোধকরি বলার অপেক্ষা রাখে না, এবং হয়তো পঞ্চম-মকারের কথাও এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে ভগবতীর যোনিরূপ ধারণের কারণ সম্পর্কে পুরাণের আখ্যায়িকাটি বিশেষভাবে স্মরণীয়। দেবী ভাগবতে এই আখ্যানের কথা যেমন আছে তেমনি শিবতত্ত্বপ্রদীপিকায় ‘শৈবে’ বলে উদ্ধৃত অংশে বিস্তৃতভাবে সেই আখ্যান পাওয়া যায়। ঐ আখ্যানে বলা হয়েছে (ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বর্ণনায়)–
‘দারুকবনে শিবভক্ত ঋষিরা যখন ত্রিসন্ধ্যা শিবপূজা ও শিব আরাধনায় রত তখন তাদের ভক্তি পরীক্ষার জন্য শিব দিগম্বর মূর্তিতে নিজের লিঙ্গটি (পুং জননেন্দ্রিয়) ধারণ করে ঋষিপত্নীদের কাছে উপস্থিত হয়ে নানা রকম ভাবভঙ্গী দেখাতে লাগলেন। বিপ্র নারীরাও তাঁর সঙ্গে আনন্দ উপভোগ করতে লাগলেন। এমন সময় ঋষিরা সমিধ আহরণের জন্য সেই বনে উপস্থিত হয়ে স্ত্রীদের এরূপ কাণ্ড দেখে উলঙ্গ পুরুষটির কাছে বার বার তার পরিচয় জানতে চাইলেন। পুরুষটি আত্ম-পরিচয় না দেওয়ায় ক্রোধোন্মত্ত হয়ে তাঁরা অভিশাপ দিলেন যে ‘তোমার লিঙ্গ ধরাতলে নিপতিত হোক’। অগ্নিতুল্য শিবলিঙ্গ ধরাতলে পতিত হয়ে সব ধ্বংস করল এবং তা স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল সর্বত্র ঘুরতে লাগল ও সবকিছু ধ্বংস করতে লাগল। তখন দেবতা ও ঋষিরা ভয় পেয়ে ব্রহ্মার কাছে গেলেন এবং সব ঘটনা জানালেন। ব্রহ্মা তখন দেবতাদের কাছ থেকে সব ঘটনা জানলেন এবং বললেন– যতক্ষণ না ঐ লিঙ্গ স্থির হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত ত্রিজগতের মঙ্গল হবে না। এরপর তিনি ঋষিদের উপদেশ দিলেন গিরিজা দেবীর আরাধনার জন্য। যদি গিরিজা দেবী যোনিরূপ ধারণ করে ঐ লিঙ্গ ধারণ করেন তাহলেই কেবলমাত্র ঐ লিঙ্গ স্থির হবে। অষ্টদশ পদ্মের মণ্ডলে কিভাবে দেবীর আরাধনা করতে হবে তাও ব্রহ্মা উপদেশ দিলেন। পার্বতী যোনিরূপ ধারণের পর শিবলিঙ্গ তাতে আধারিত হল এবং জগৎ শান্তি পেল।’
            শিব সংক্রান্ত বিভিন্ন আখ্যানাদি বিভিন্ন পুরাণে ছড়িয়ে আছে। শৈব পুরাণগুলি শিবকেই প্রাধান্য দিতে চায় বলে ব্রহ্মা, বিষ্ণু প্রভৃতির মুখে শিবমাহাত্ম্য স্তুতি স্থাপন বসানো হয়েছে। আর সেখানে শিব মানেই শিবলিঙ্গের মাধ্যমে তার অবস্থিতিই প্রধান। তাছাড়া পঞ্চোপাসক সমস্ত সম্প্রদায়ের মধ্যেই লিঙ্গপূজাকে জনপ্রিয় করার বিভিন্ন কায়দা শাস্ত্রকারেরা নিয়েছেন। এজন্য অর্থবাদের দ্বারা বলা হয়েছে যে–
লিঙ্গপূজাং বিনা দেবি! অন্য পূজাং করোতি যঃ।
বিফলা তস্য পূজাস্যাদন্তে নরকমাপ্নুয়াৎ।। (লিঙ্গার্চনতন্ত্র)
অর্থাৎ : লিঙ্গপূজা না করে অন্য দেবতার পূজা করলে সেই পূজা বিফল হবে এবং সেই পূজক অন্তে নরকে যাবে।
           সেই কারণেই ঐ তন্ত্রে শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব প্রভৃতি সকল সম্প্রদায়কেই বিল্বপত্রের দ্বারা লিঙ্গপূজা করে, তারপর অন্যপূজায় ব্রতী হতে বলা হয়েছে। কিন্তু লিঙ্গপূজা করতে বললেই পূজা হবে না, কেননা লিঙ্গের বহু প্রকারভেদ, পূজার মাহাত্ম্য ও প্রয়োজনীয় বিধি-নিষেধও রয়েছে। সেগুলো জানার প্রয়োজনও রয়েছে।
আমরা দেখতে পাই, পৌরাণিক যুগে পরম শিব ও পরব্রহ্মতত্ত্ব প্রচারের পর থেকে লিঙ্গপূজার ব্যাপক প্রসার ঘটে। পণ্ডিতদের মতে এই সময়টা গুপ্ত যুগ। কারণ পরবর্তী কালের মন্দিরগুলিতে মূলতঃ লিঙ্গমূর্তিই প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে, যদিও কয়েকটি ক্ষেত্রে মানবাকার মূর্তিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বিষয়গত ধারণার লক্ষ্যে অধ্যায়ের শুরুতেই শিব ও লিঙ্গ বিষয়ে এ দুয়ের অদ্বয়ত্ব, গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনুধাবনের জন্য শৈব মতানুসারী পুরাণগুলিতে উপস্থাপিত লিঙ্গের পূজা ও তার বৈচিত্র্য ও প্রকারভেদ প্রসঙ্গে আলোচনা হয়েছে বিধায় এখানে সেগুলোর পুনরুক্তির দরকার নেই। তবে এটা জানা যায় যে,–
‘কেবল ভারতবর্ষেই নয়, ভারতের সীমা ছাড়িয়ে কম্বোজ, চম্পা প্রভৃতি রাজ্যেও লিঙ্গ পূজার প্রচলন ঘটেছিল। নীলকণ্ঠ শাস্ত্রী তাঁর ‘South Indian Influences in the Far East’ গ্রন্থে কম্বোজ ও চম্পায় লিঙ্গরূপী শিবের উপাসনার কথা বলেছেন। ঐতিহাসিক ইলিয়টের মতে প্রায় ৫৫০ খৃষ্টাব্দের প্রথমার্ধে কম্বোডিয়ায় লিঙ্গপূজার প্রচলন ছিল। কম্বোডিয়া অউথিয়া, লোপচুরি প্রভৃতি অঞ্চল থেকে বৌদ্ধ দেবতাদের সঙ্গে সঙ্গে রাম, বিষ্ণু, শিব, গণেশ, স্কন্দ, উমা, লক্ষ্মী প্রভৃতি ব্রাহ্মণ্য দেবতার মূর্তিও আবিষ্কৃত হয়েছে। থাইল্যান্ড অঞ্চলে প্রাপ্ত শিবের ত্রিশূল, ঐ অঞ্চলে শৈব ধর্মের প্রসারের কথাই বলে।’– (ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়/ ভূমিকা, লিঙ্গ পুরাণ, পৃষ্ঠা-১১)
             ইতঃপূর্বে আমরা দেখেছি যে, শৈব তন্ত্র ও পুরাণের অনুযায়ী লিঙ্গার্চক সম্প্রদায়ের বিশ্বাস হলো, শিবশক্তি লিঙ্গেতে নিত্য অধিষ্ঠান করেন এবং যে পরম সত্তার থেকে জগতের উৎপত্তি হয় এবং যাঁর মধ্যে জগৎ লীন হয় সেই পরম কারণই লিঙ্গ।
লিঙ্গের আবির্ভাব সম্পর্কে লিঙ্গপুরাণের সপ্তদশ অধ্যায়ে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের বিবাদাত্মক একটি আখ্যান কথিত হয়েছে। সেই কাহিনীতে বলা হয়েছে– শ্রেষ্ঠত্বের অধিকার নিয়ে ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর মধ্যে বিরোধ থেকে ক্রমশঃ ভয়ঙ্কর যুদ্ধ বাধলো। তখন তাঁদের মোহ দূর করার জন্য শিব অনল স্তম্ভ রূপে তাঁদের দুজনের মাঝখানে আবির্ভূত হলেন–
প্রলয়ার্ণবমধ্যে তু রজসা বদ্ধবৈরয়োঃ।
এতস্মিন্নন্তরে লিঙ্গমভবচ্চাবয়োঃ সুরাঃ।।
বিবাদশমনার্থঞ্চ প্রবোধার্থঞ্চ ভাস্বরম্ ।
জ্বালামালাসহস্রাভং কালনলশৎপোমম্ ।। (লিঙ্গপুরাণ সপ্তদশ অধ্যায়)
অর্থাৎ : প্রলয়-সমুদ্রের মধ্যে রজোগুণ-প্রভাবে আমাতে (অর্থাৎ ব্রহ্মাতে) ও বিষ্ণুতে বিরোধ হইতেছিল, এমন সময়ে সেই বিরোধ-ভঞ্জন ও প্রবোধ-প্রদান জন্য শত-সংখ্যক কালাগ্নি স্বরূপ ও সহস্র অগ্নিশিখা তুল্য দীপ্তিমান্ লিঙ্গ উৎপন্ন হইল।
প্রজাপতি ব্রহ্মার বয়ানে লিঙ্গপুরাণের বাকি উদ্ধতাংশটি এরকম–
‘আমরা দুজনেই তখন রজোগুণে আবিষ্ট হবার ফলে প্রলয় সমুদ্রের মধ্যে লোমহর্ষক এক মহাযুদ্ধ আমরা আরম্ভ করলাম। আমাদের পারস্পরিক বিবাদ বন্ধ করে প্রবোধের জন্য সেই সময় উভয়ের সম্মুখে আবির্ভূত হল ভাস্বর লিঙ্গ। এই লিঙ্গের আভা সহস্র শিখায় সমুজ্জ্বল অগ্নির মতই ছিল ভয়ঙ্কর। আদি মধ্য ও অন্তহীন, ক্ষয় ও বৃদ্ধিশূন্য, অনির্দেশ্য, অব্যক্ত ও বিশ্ববীজস্বরূপ সেই লিঙ্গের উজ্জ্বল সহস্র শিখা দেখে মোহিত হয়ে ভগবান বিষ্ণু আমাকে বললেন– এই অগ্নির কিভাবে উৎপত্তি হল তা আমাদের পরীক্ষা করা দরকার। আমি এই অগ্নি স্তম্ভের নীচের দিকে যাচ্ছি, তুমি ওপরের দিকে যাও। সেই সময়েই ভগবান হরি তাঁর বরাহরূপ প্রকাশ করেছিলেন। আমিও আকাশে উড়ে যাবার জন্য তখন হংসরূপ গ্রহণ করলাম।… লিঙ্গের স্বরূপ জানার জন্য শুভ্রবর্ণ হংসরূপ ধরে আগুনের মত রক্তচক্ষু ও সুন্দর পাখা যুক্ত হয়ে আমি বায়ুর মত বেগে ওপরে উড়তে লাগলাম। নারায়ণও দশযোজন বিস্তৃত শতযোজন আয়ত মেরুপর্বতের মত নীল কাজলের মত বিশাল বরাহ মূর্তি ধারণ করেছিলেন। তখন তাঁর তীক্ষ্ণ ধারাল দাঁতগুলো সূর্য্যরে মত চক্চক্ করছিল, নাসিকা ঘোর গর্জন করছিল এবং হাত-পা গুলি বিচিত্র অঙ্গভঙ্গী করছিল। এইভাবে তিনি পাতালে প্রবেশ করলেন। তৎসত্ত্বেও শূকর রূপ ধারণকারী বিষ্ণু লিঙ্গের মূল কোথায় তা সামান্য পরিমাণেও বুঝতে পারলেন না। এদিকে আমিও অনন্ত আকাশে উড়তে উড়তে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম, অথচ লিঙ্গের অন্ত কোথায় তা বুঝতে পারলাম না। অবশেষে অহঙ্কার-বশতঃ নীচের দিকে নেমে এলাম। দেবতাদের উৎপত্তির বীজস্বরূপ বিষ্ণুও পরিশ্রান্ত হয়ে ভয়-কম্পিতনেত্রে শীঘ্রই মাটির তলা থেকে উপরে উঠে এলেন। মায়ার দ্বারা মুগ্ধ বিষ্ণু আমার সঙ্গে মিলিত হবার পর আমরা উদ্বিগ্ন মনে ভগবান শম্ভুর কাছে গিয়ে উপস্থিত হলাম এবং তাঁকে প্রণাম করলাম।’– (লিঙ্গ পুরাণ পূর্বভাগ, সপ্তদর্শ অধ্যায়, পৃষ্ঠা-৩১-২)
             শিবপুরাণের বিদ্যেশ্বর সংহিতা (৩/২৭-৬১, ৫/১১, ৭/১৯-২০ ইত্যাদি) অংশের কাহিনীতে এবং লিঙ্গপুরাণ ইত্যাদির কাহিনীতেও শিবের স্তম্ভমূর্তির কথা আছে। তাই অনেক পণ্ডিত এই স্তম্ভ মূর্তিকেই শিবের আদিরূপ বলে মনে করেন। তাছাড়া আখ্যানগুলির মৌলিক ঐক্য থাকলেও ক্ষেত্র বিশেষে বিন্যাসগত পার্থক্য আছে। তবে কোনও আখ্যানেই কিন্তু লিঙ্গকে জননেন্দ্রিয়ের সঙ্গে একীভূত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয় না। অতএব সাধারণ ভাবে পৌরাণিক ধারায় লিঙ্গোপাসনার অন্য একটা দিক আছে।
পুরাণ আখ্যান অনুযায়ী আদ্যান্তহীন সেই স্তম্ভের শেষ ব্রহ্মা বিষ্ণু খুঁজে পেলেন না। শিবপুরাণে শিব তাই ব্রহ্মা ও বিষ্ণুকে বলেছেন–
অনাদ্যন্তমিদং স্তম্ভমণুমাত্রং ভবিষ্যতি।
দর্শনার্থং হি জগতাং পূজনার্থং হি পুত্রকৌ।।
ভোগাবহমিদং লিঙ্গং ভুক্তিমুক্ত্যেকসাধনম্ ।
দর্শনস্পর্শনধ্যানাজ্জন্তূনাং জন্মমোচনম্ ।। (শিবপুরাণ)
অর্থাৎ : জগৎবাসীর দর্শন ও পূজনের জন্য এই আদি ও অন্তহীন স্তম্ভ ক্ষুদ্ররূপ ধারণ করবে। ভোগাবহ এই লিঙ্গ একাধারে ভুক্ত ও মুক্তির সাধন। এই লিঙ্গের দর্শন, স্পর্শন ও ধ্যানের দ্বারা জীবের জন্ম বন্ধ ঘুচে যায়।
            এ কারণে– ‘বৈদিক যূপ উপাসনা থেকেই শিবলিঙ্গের উৎপত্তির কথা অনেকে বলতে চেয়েছেন। শূলগব যজ্ঞের স্মারক হিসাবে যূপের পাশে উৎকীর্ণ বৃষমূর্তি যৌধেয়দের মুদ্রায় আবিষ্কৃত হয়েছে। আনন্দকামারস্বামী স্তম্ভপূজন থেকেই শিবলিঙ্গের উৎপত্তির কথা বলেছেন। কুষাণযুগের শেষ দিককার একটি চতুর্ভুজ দণ্ডায়মান শিবমূর্ত্তির গায়ে স্তম্ভের মত প্রতীক দেখা যায়।’
‘খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতকের মুদ্রার থেকে একথা যেমন একদল প্রমাণ করতে চান, তেমনি ভারতীয় ও বিদেশী শাসকদের মুদ্রার থেকে শিবপূজার আদি উৎসকে একদল আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। কারো কারো মুদ্রায় বৃষ ও যূপ অঙ্কিত দেখে তাদেরই শিব ও শিবলাঞ্ছন হিসাবে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন অনেকে।’
‘বৌদ্ধদের মধ্যে প্রচলিত স্তূপ পূজা থেকে লিঙ্গ পূজার উদ্ভব ঘটেছে বলে একদল পণ্ডিত মনে করেন। আপাত ভাবে বৌদ্ধস্তূপের সঙ্গে শিবলিঙ্গের আকারগত সাদৃশ্য অস্বীকার করা যায় না। বৌদ্ধ যুগেই সাচীস্তূপ প্রভৃতির এবং পরবর্তী কালের সারনাথ, বুদ্ধগয়া প্রভৃতি স্থানে স্তূপ পূজার প্রচলন ছিল এবং এখনও আছে। লিঙ্গকে যেভাবে অক্ষত, চন্দন, পুষ্প, ধূপ, দীপ প্রভৃতি দ্বারা অর্চনা করা হয় বোধিসত্ত্বাবদানকল্পলতাতেও সেই ভাবেই স্তূপ অর্চনার বিধান পরিলক্ষিত হয়। সাচীস্তূপ অবশ্য বুদ্ধকায়স্বরূপ বৌদ্ধ স্মৃতি মন্দিরেরই নিদর্শন। মনে রাখতে হবে যে শিবলিঙ্গও কিন্তু সেই অর্থে শিবপ্রতীক। সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের মধ্যে প্রাপ্ত ফলকগুলি যদি সত্য সত্যই শিবলিঙ্গ হয়ে থাকে, তাহলে কিন্তু বৌদ্ধস্তূপ অর্চনা থেকে লিঙ্গ পূজার প্রচলন ঘটেছিল– একথা বলা যাবে না, কারণ বৌদ্ধপর্বের বহু পূর্ব থেকেই সেক্ষেত্রে লিঙ্গপূজার অস্তিত্ব স্বীকার করতে হবে।’- (ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়)
          এবং লিঙ্গপূজার উৎপত্তি যে বৌদ্ধপর্বের বহু পূর্বেই ঘটেছে ইতঃপূর্বের আলোচনা থেকে আমরা এই ধারণা ইতোমধ্যেই পেয়েছি। আর পুরাণের রচনাকাল মূলত গুপ্তযুগেই এবং লিঙ্গ পুরাণের রচনাকাল মোটামুটি ৭০০ খ্রিস্টাব্দ বলে ধরা হয়। তবুও ভারতীয় পরম্পরা অনুসারে পুরাণগুলি বেদেরই প্রবর্ধিত রূপ। ড. উদয়চন্দ্রের মতে,– ‘তাই অনেক ক্ষেত্রেই বলা হয়েছে যে– ‘পুরাণম্ বেদসম্মতম্’। পুরাণগুলি দুভাবে বৈদিক তথ্যকে ব্যবহার করেছে– (১) কোন বৈদিক আখ্যানকে বিস্তৃততর রূপ দিয়ে নিজের মত করে সাজিয়ে নিজের বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, যেমন উমা হৈমবতীর কেনোপনিষদযুক্ত আখ্যান লিঙ্গ পুরাণে ১/৫৩/৫৫-তে আমরা পেয়েছি। (২) আবার বৈদিক মন্ত্রগুলিকে বিভিন্ন পূজা পদ্ধতির সঙ্গে পুরাণগুলি যুক্ত করেছে। লিঙ্গপুরাণে উল্লিখিত মন্ত্রগুলি আমরা নিম্নলিখিত বৈদিক গ্রন্থে পেয়ে থাকি– ঋগ্বেদের মূল অংশ, ঋগ্বেদের খিল অংশ, সামবেদ, অথর্ববেদ, মাধ্যন্দিন বাজসনেয়ী সংহিতা, বাজসনেয়ীসংহিতা, তৈত্তিরীয়সংহিতা, মৈত্রায়নী সংহিতা, কাঠক সংহিতা, তৈত্তিরীয় আরণ্যক, মহানারায়ণ উপনিষদ্, নৃসিংহপূর্বতাপনী উপনিষদ্, শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্, আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র, হিরণ্যকেশী গৃহ্যসূত্র ইত্যাদি। মন্ত্রগুলিকে কোথাও কোথাও বিশেষ সংজ্ঞার দ্বারা বিধান করা হয়েছে, কখনো আদি অংশ উদ্ধৃত করে বিধান দেওয়া হয়েছে আবার কখনো বা মন্ত্রমধ্যস্থ অংশ তুলে হয়তো পর পর কয়েকটি মন্ত্র প্রয়োগ করতে হয়েছে। এখানে যজুর্বেদের তথা কৃষ্ণযজুর প্রভাব বেশী বলেই মনে হয়েছে।’
‘বিভিন্ন সময়েই লিঙ্গপুরাণে রুদ্রাধ্যায়ের মন্ত্র উদ্ধৃত হয়েছে এবং শতরুদ্রীয় ইত্যাদির কথাও প্রায়ই বলা হয়েছে। ‘ত্র্যম্বকম্ যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবর্ধনম্ । উর্বারুকমিব বন্ধনাত্ মৃত্যোর্মুক্ষীয় মামৃতাত্ ।’ ইত্যাদি বৈদিক মন্ত্রকে মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র বলা হয়ে থাকে এবং (লিঙ্গপুরাণের) উত্তর ভাগের ৫৪ অধ্যায়ে একেই মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র বলা হয়েছে। তন্ত্রের যামল ধারায় কিন্তু এই মন্ত্রকে মৃত্যুঞ্জয় বলা হয়নি। তাদের মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র আরো ছোট এবং মন্ত্রটি তান্ত্রিকমন্ত্র। বর্তমানে অনেক পুরোহিতকে (বিশেষতঃ বাংলার বাইরেকার) লিঙ্গপুরাণোক্ত মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রের সঙ্গে তন্ত্রোক্ত মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জুড়ে নিয়ে জপ করতে দেখেছি। হয়তো তন্ত্র ও বেদের মিশ্রণের ফলেই এরূপ ঘটেছে। লিঙ্গ পুরাণেও অনেক ক্ষেত্রে বৈদিক মন্ত্রটির আগে তন্ত্রোক্ত মন্ত্র পুটিত করে পাঠের বিধান পরিলক্ষিত হয়। যেমন উত্তর ভাগের ৫১ অধ্যায়ে শত্রুজয়ের জন্য ব্যবহৃত গায়ত্রী মন্ত্রের পূর্বে ‘ওঁ ফট্ জহি হুং ফট্ হিন্দি ভিন্দি জহি হন হন স্বাহা’ ইত্যাদি যুক্ত করতে বলা হয়েছে। মন্ত্রের অবয়ব শাক্তদের বগলামুখী মন্ত্রের কথাই মনে করায়। এভাবেই প্রত্যেকটি মন্ত্রের আলোচনা হলে একটা নতুন দিকের আভাস পাওয়া যাবে বলেই মনে হয়। বৈদিক এবং ধর্মশাস্ত্রধৃত মন্ত্রগুলি সাধারণ ভাবে লিঙ্গপুরাণের পূর্বভাগে এসেছে এবং তন্ত্রোক্ত মন্ত্রের প্রাধান্য উত্তর ভাগে এসেছে। পাশুপতাদি শৈবধারাকে কেউ কেউ বৈদিক ধারা বলেছেন আবার কেউ কেউ অবৈদিক ধারা বলেছেন। সমন্বয়ধর্মী ব্রাহ্মণ্য রচনা পুরাণে যখন এসব ধারা বিধৃত হয়েছে, তখন তার উপর বৈদিক শান্তিবারির প্রলেপ অবশ্যই পড়বে এটাই স্বাভাবিক। তাই লিঙ্গপুরাণে খাঁটি অবৈদিক শৈব ধারার পূর্ণ পরিচয় অবিকৃত ভাবে বোধ হয় পাওয়া যাবে না।’– (ভূমিকা, লিঙ্গ পুরাণ)
         কিন্তু এখানে বলা বোধ করি বাহুল্য হবে না যে, কোন বৈদিক আখ্যানকে বিস্তৃততর রূপ দিয়ে নিজের মত করে সাজানোর যে প্রয়াস পুরাণ সাহিত্যের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে তা কোন্ প্রেক্ষিতে কিংবা কেন এমনটা হতে হলো সে বিষয়ে কিছুটা প্রাক্-ধারণা না থাকলে পুরাণ সাহিত্যের উৎস বা পুরাণ রচনার কার্যকারণ ও গুরুত্ব যথাযথ অনুধাবন করা যাবে না। তাই অতি সংক্ষেপে বিষয়টার কিঞ্চিৎ বিবৃতি দেয়া যেতে পারে।
          এখন পর্যন্ত যেটুকু জানা যায় সেই মতে, বৈদিক আর্যরা ভারতবর্ষের পশ্চিমদিক থেকে ক্রমশ পূর্বদিকে সরে এসে তাদের আর্যাবর্তের সীমারেখাকে ক্রমপ্রসারিত করেছে। কিন্তু শুরুতে তারা একই সাথে উত্তর-পশ্চিম, পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিকেও প্রসারিত হতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তখন তো সেই দেশ একেবারে জনশূন্য ছিল না, ফলে সেখানকার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রবল প্রতিরোধের সামনে আর্যদের পরাজয় স্বীকার করতে হয়। সে যাত্রায় তাদের দাক্ষিণাত্য ও কাশ্মীর উপত্যকা অভিযান ব্যর্থ হয়। আর এই পরাজয়ের প্রত্যাঘাতে আর্য-সমাজজীবনে নিশ্চয়ই গভীর সংকটের সৃষ্টি হয়। আমরা প্রাচীন ঋগ্বেদ-সংহিতায় দেখি বলা হচ্ছে-
বি জানীহ্যার্য্যান্যে চ দস্যবো বর্হিষ্মতে রন্ধয়া শাসদব্রতান্ ।
শাকী ভব যজমানস্য চোদিতা বিশ্বেত্তাতে সধমাদেষু চাকন।।- (ঋগ্বেদ-১/৫১/৮)
অর্থাৎ : হে ইন্দ্র! তুমি কারা আর্য এবং কারা দস্যু তা বিশেষরূপে অবগত হও। ঐ ব্রত বা যজ্ঞবিরোধীদের নিগ্রহ করে যজ্ঞানুষ্ঠাতা যজমানের অধীন কর। তুমি শক্তিশালী, অতএব যজ্ঞ-সম্পাদকদের সহায় হও। আমি তোমার হর্ষজনক যজ্ঞে তোমার সেই কর্ম প্রশংসা করতে ইচ্ছা করি।
উল্লেখ্য, মনুসংহিতার রচনাকালে আর্যাবর্তের যে সীমানা চিহ্নিত করা হয় তা হলো–
আসমুদ্রাত্তু বৈ পূর্ব্বদাসমুদ্রাত্তু পশ্চিমাৎ।
তয়োরেবান্তরং গির্য্যােরার্য্যাবর্ত্তং বিদুর্বুধাঃ।।- (মনুসংহিতা-২/২২)
অর্থাৎ : উত্তরে হিমালয় ও দক্ষিণে বিন্ধ্যাচল এবং পূর্বে পূর্বসমুদ্র ও পশ্চিমে পশ্চিমসমুদ্র, এই চতুঃসীমাবদ্ধ ভূভাগের নাম পণ্ডিতেরা আর্যাবর্ত বলিয়া জানেন।
            অমরকোষেও লিখিত আছে যে, বিন্ধ্য ও হিমালয় পর্বতের মধ্যগত দেশ আর্য্যাবর্ত্ত অর্থাৎ আর্য্যদিগের স্থান ছিল।’– আর্য্যাবর্ত্তঃ পুণ্যভূমির্মধ্যং বিন্ধ্যহিমাগয়োঃ।- (অমরকোষ)
আর এই আর্যাবর্তে কারা বসবাস করবে, তাও মনুসংহিতায় বলে দেয়া হয়েছে এভাবে–
এতান্ দ্বিজাতয়ো দেশান্ সংশ্রয়েরন্ প্রযত্নতঃ।
শূদ্রস্তু যস্মিন্ কস্মিন্ বা নিবসেৎ বৃত্তিকর্ষিতঃ।।- (মনুসংহিতা-২/২৪)
অর্থাৎ : দ্বিজাতি অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যেরা এই সকল দেশে বসতি করিবেন, শূদ্রেরা ব্যবসায় অনুরোধে যথা তথা বাস করিতে পারে।
           তার মানে কি এই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যেরাই আর্যাবর্তের অধিবাসী আর্য? আর শূদ্রেরা অনার্য? অন্তত মনুবচন রচনাকালে যে তা-ই ছিল এটা অস্বীকারের উপায় নেই। কেননা, অথর্ববেদ-সংহিতায় সমগ্র লোককে দুইভাবে ভাগ করার নির্দেশনাই দেয়া আছে এভাবে–
তয়াহং সর্ব্বং পশ্যামি যশ্চ শূদ্র উতার্য্যঃ।- (অথর্ববেদ-৪/১২০/৪)
অর্থাৎ : সমগ্র লোক শূদ্র ও আর্য এই দুইভাগে বিভক্ত।
শতপথ ব্রাহ্মণে ও কাত্যায়ন-প্রণীত শ্রৌতসূত্রেও এই বক্তব্যে প্রতিধ্বনি করে বলা হয়েছে–
শূদ্রার্য্যৗে চর্ম্মণি পরিমণ্ডলে ব্যযচ্ছেতে।- (কাত্যায়ন-শ্রৌতসূত্র-১০/৩/৭)
এবং এই কাত্যায়নকৃত সূত্রের অর্থে ভাষ্যকার বলেন–
শূদ্রশ্চতুর্থো বর্ণঃ আর্য্যস্ত্রৈবর্ণিকঃ।
অর্থাৎ : আর্য্য শব্দের অর্থ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এই তিন বর্ণ; চতুর্থ বর্ণের নাম শূদ্র।
         মহাশয় অক্ষয় কুমার দত্তের মতে,– ‘বোধ হয়, শূদ্রবর্ণ আর্য্যবংশীয় নহে; আর্য্যরো ভারতবর্ষে আসিয়া শূদ্রনামক অনার্য্য-জাতি-বিশেষকে আপনাদের সমাজ-ভুক্ত করিয়া লন।’
আর এজন্যেই বোধকরি বর্ণবাদী পিতৃতান্ত্রিক সমাজাধিকারী মনুসংহিতায় আর্য ও অনার্য এই উভয় কুলের পরস্পর বিভিন্নতা সুস্পষ্ট করে বিধান দেয়া হয়েছে–
জাতো নার্য্যামনার্য্যারামার্য্যাদার্য্যাে ভবেৎগুণৈঃ।
জাতোহপ্যনার্য্যাদার্য্যায়ামনার্য্য ইতি নিশ্চয়ঃ।।- (মনুসংহিতা-১০/৬৭)
অর্থাৎ : আর্য্য পুরুষের ঔরসে ও অনার্য্যা নারীর গর্ভে যে সন্তান জন্মে, সে সন্তান শাস্ত্রোক্ত-গুণযুক্ত হইলে আর্য্যত্ব প্রাপ্ত হয়। আর অনার্য্য পুরুষের ঔরসে আর্য্যা স্ত্রীর গর্ভে যে পুত্র জন্মে, সে নিশ্চয়ই অনার্য্য।

             আর্য-সমাজজীবনে গভীর সংকটের অন্যান্য উপাদান হিসেবে আমরা আরও জানতে পারি যে, এই আর্যাবর্তে প্রথম থেকেই আর্যদের মধ্যেও সকলেই কিন্তু বৈদিক সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী ছিল না। এ ছাড়া আরও ছিল বিভিন্ন সময়ে বৈদিক আর্যসমাজ থেকে বহিষ্কৃত কিছু মানুষ, যাদের ‘বাহীক’ বলা হতো। এইসব দলছুটেরা সমাজে ভবঘুরের মতো জীবনযাপন করতো এবং নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির প্রয়োজনে সর্বস্তরের মানুষের সাথে যথেচ্ছভাবে মেলামেশা করে এক অবৈদিক জনগোষ্ঠীর সূচনা করে। এইসব বেদবহির্ভূত জনগোষ্ঠীতে আর্য-অনার্য সকলেরই স্থান ছিল। এদেরকে সমগ্রভাবে বলা হতো– ‘ব্রাত্যজন’। সংহিতা ও ব্রাহ্মণের নৈষ্ঠিক ক্রিয়াকলাপকে প্রথমেই তারা অস্বীকার করে উপনিষদের ব্রহ্মতত্ত্বের জ্ঞানকাণ্ডকে নিজেদের মতো ব্যাখ্যা করে জনমানসে এক অদ্ভূত মোহের সৃষ্টি করেছিল। ফলে বহু সাধারণ মানুষ এদের প্রতি আকৃষ্ট হয়– যা এক সময়ে বৈদিক সমাজের এক সংকট হয়ে দাঁড়ায়।
এ ছাড়াও বৈদিক যাগযজ্ঞ ও ক্রিয়াকর্মগুলি ক্রমশ বহু বিস্তৃত হয়ে অনুষ্ঠান উপলক্ষে প্রচুর বলিদানের প্রথাও প্রচলিত ছিল। কিন্তু কৃষিভিত্তিক সমাজজীবনে চাষাবাদের উৎকর্ষের সাথে সাথে কৃষির জন্য প্রয়োজন হলো প্রচুর গো-ধনের। ফলে যাগযজ্ঞের নামে বিপুল গোধনের অপচয়ের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগোষ্ঠী প্রতিবাদী হতে শুরু করলে বৈদিক সমাজ সংগঠকদের কাছে এটাও এক নতুন সামাজিক সংকটের সৃষ্টি করে।
আবার পাপপুণ্য, কর্মফল ও জন্মান্তরবাদ ইত্যাদি বিষয় নিয়েও মানুষের মনে প্রশ্ন জাগতে শুরু করে। কারণ এ সময়ে লোকায়ত চার্বাক দর্শনের চমৎকারিত্বে বহু লোক আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। এ ছাড়াও ছিলেন জাবালি ও অন্যান্যরা। তাঁদের দর্শনের কথা ও যুক্তিগুলোর চমৎকারিত্বে রয়েছে তাৎক্ষণিক প্রভাব ও মোহগ্রস্ততা। সমাজের কিছু ব্যবস্থার বিরুদ্ধে উত্থাপিত তাঁদের যুক্তি ও তীক্ষ্ণ সমালোচনায় বৈদিক জনমানসে সৃষ্ট বিভ্রান্তি সামাজিক সংকট ও অস্থিরতা বৃদ্ধির সহায়ক হয়ে ওঠে।
এর সাথে যুক্ত হলো বহুত্ববাদী ও নিরীশ্বরবাদী কপিলের সাংখ্য দর্শনের সুস্পষ্ট বক্তব্য– প্রমাণের অভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার করা গেল না এবং তাবৎ স্থাবর ও জঙ্গম (জীব ও জড় জগৎ) পঞ্চভূতের থেকে সৃষ্ট হয়ে আবার পঞ্চভূতেই লীন হয়ে যায়। তা হলে আত্মা কী? আর তার অবস্থানই বা কোথায়? আর এই তত্ত্বের নিরীখে পুনর্জন্মবাদ টেকে কী করে? কপিলের এই লোকায়তমুখী সাংখ্যদর্শন তখন জনসমাজে বিপুলভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ফলে বৈদিক সমাজের বাঁধনও আলগা হয়ে যায়। এই গভীর সংকট কাটিয়ে সাধারণ মানুষকে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টায় সমাজ সংগঠকদের বহু পরিশ্রম করে বহু দার্শনিকতার অবতারণা করতে হয়। এতে করে বৈদিক সাহিত্য ও সংস্কৃতিও নতুন নতুন সংকটের মোকাবিলায় ক্রমসমৃদ্ধ হতে থাকে।
           এমনিতেই সাধারণ মানুষ দ্বন্দ্বদীর্ণ শ্রেণিভিত্তিক সমাজে খুব একটা সুখে-শান্তিতে ছিল না। তার উপর প্রায়ই যুদ্ধ বিগ্রহ ও নানা অশান্তি লেগেই থাকতো। সে তুলনায় অপরদিকে অনার্য জীবনযাত্রা ছিল গোষ্ঠীবদ্ধ সরল ও অনাড়ম্বর। ফলে বহু মানুষ এই সরল অনাড়ম্বর গোষ্ঠীবদ্ধ সুখী জীবনযাত্রার দিকে আকৃষ্ট হতে থাকলো। এতেও সমাজে আরেকধরনের সংকটের সৃষ্টি হতে থাকে। এইসব সামাজিক সংকটকে কাটিয়ে ওঠবার উপায়ও ভেবেচিন্তে বের করতে হয়।
এদিকে গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাবকালীন সময় থেকে সনাতনী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দেখা দেয় প্রবল প্রতিবাদী আন্দোলন। সে যুগে অনেকগুলি প্রতিবাদী সংগঠন সনাতন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ায়। এদের মধ্যে জৈন, বৌদ্ধ ও আজীবিকেরাই প্রধান। এদের সঙ্গে ছিল বেদ-বহির্ভূত আর্যরা। তারাও সংখ্যায় নিতান্ত কম ছিল না। এইসব আঘাতের মুখে সনাতনী ব্যবস্থা অত্যন্ত সংকটের মুখে পড়ে গেলো। দলে দলে লোক ওইসব ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সনাতন ধর্ম ত্যাগ করছে। এই অবস্থাকে সামাল দেওয়ার জন্যে তখন সনাতন ধর্মে যেসব বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হলো, জানা যায়, তার মধ্যে একটা হলো– ব্রাত্যস্তোম বা শুদ্ধি যজ্ঞ। এই যজ্ঞে সকল ব্রাত্যজন হবিপ্রদান করে, সনাতন ধর্মে দীক্ষিত হয়ে, সকলের সাথে সমাসনের অধিকার পায়।
           আমরা আগেই দেখেছি যে, আর্য সমাজে প্রায় গোড়া থেকেই অনার্য রক্তের সংমিশ্রণ হয়েছিল। তখন থেকেই তাঁরা প্রাগার্য সমাজের অনুকরণে শ্রেণিবিভাগ, গোত্রবিভাগ ইত্যাদি করে বলে মনে করা হয়। তবে তখনও তাঁদের মধ্যে জাতিভেদ প্রথা বিশেষভাবে প্রচলিত ছিল না। আর তাও যেটুকুও বা ছিল তাতে লোকে সচ্ছন্দে এক বর্ণ থেকে অন্য বর্ণে উন্নীত হতে পারতো। তাই দেখা যায় জাবালি, সত্যকাম, মহীদাস ঐতরেয়-কে নিজেদের গোষ্ঠীভুক্ত করে নেওয়া হয় তাঁদের গুণ কর্মের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে।–
‘এই সময়ে সমাজে একজন শূদ্রও ব্রাহ্মণ হতে পারত (কপিল স্মৃতি ৮৯৬ ও ৮৯৭ শ্লোক দ্রষ্টব্য)। ব্রাহ্মণের সর্বশ্রেষ্ঠ গায়ত্রী মন্ত্রের রচয়িতা ক্ষত্রিয় কুলজাত বিশ্বামিত্র ব্রাহ্মণ্যত্ব লাভ করেছিলেন। অর্থাৎ সে যুগে ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণ্যত্ব একান্তই জন্মার্জিত বা রক্তের বিশুদ্ধতার উপর নির্ভরশীল ছিল না। যথাযথ সংস্কারের উপরেই তা একান্ত ভাবে নির্ভরশীল ছিল। এ থেকে বোঝা যায় যে, সে যুগে আর্য সমাজজীবনে সামাজিক সচলতা বা সোশ্যাল মোবিলিটি ছিল।’
‘এ ছাড়াও অনার্যদের প্রধান দেবতা ছিলেন ‘আদি শিব’, যা পরবর্তীকালে সমগ্র ব্রাত্যজনের গণদেবতা। ঋগ্বেদ সংহিতাতে তিনি বৈদিক রুদ্রের সমীকরণ হয়ে খুবই অপ্রধান দেবতারূপে স্তুত ছিলেন। সেই দেবতাকে সনাতনী ধর্মে প্রাধান্য দিয়ে সামনের সারিতে নিয়ে আসা হল– আমজনতাকে আকৃষ্ট করবার একমাত্র আকুল অবলম্বন হিসাবে।— বৈদিক সংস্কৃতির মহিমা মণ্ডিত হয়ে রুদ্রদেব সনাতনী ধর্মকে রক্ষা করবার একমাত্র উপায় হিসাবে যজুর্বেদের দুই শাখাতেই বিপুলভাবে স্তুত হয়ে দার্শনিকতার চরমোৎকর্ষতা লাভ করে পরমাত্মায় পর্যবসিত হলেন। তাই রুদ্রাধ্যায়ের প্রতিটা মন্ত্রেই যে কবিত্ব শক্তি ও দার্শনিকতার পরাকাষ্ঠা দেখা যায় তা আজও বৈদিক সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।’
‘কিন্তু এত করেও শেষরক্ষা করা গেল না। যে অতুলনীয় কবিত্বশক্তি ও অসাধারণ দার্শনিকতা দিয়ে ‘গণদেবতাকে’ বন্দনা করা হল, তা সাধারণ মানুষের বোধ-বুদ্ধির জগতের অনেক অনেক ঊর্ধ্বের কথা। ফলে সাধারণ মানুষ এতে আকৃষ্ট হল না। তারা চায় তাদের প্রাণের ঠাকুরকে প্রাণের ভক্তি আর উষ্ণতা দিয়ে বাঁধতে। পেতে চায় আরও আরও নিবিড় করে। ফলে প্রচেষ্টা যতই মহৎ ও মহাকালের সম্পদ হোক না কেন, তা দিয়ে তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মিটল না।’- (অশোক রায়, বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-১৯৪)
            এই তাৎক্ষণিক প্রয়োজন না-মেটার প্রেক্ষিতে তখন অন্য উপায়ের কথা ভাবা হতে লাগলো, যা দিয়ে সমাজকে আবার নতুনভাবে সংগঠিত করে তোলা যায়। প্রাচীনকাল থেকেই এদেশে রাজ অনুগৃহীত কিছু মানুষ ছিল, যাদের কাজ ছিল– দেশে দেশে গিয়ে প্রাচীন কালের কথা, রাজা-রাজড়াদের বীরত্বের কথা, প্রাচীন রাজবংশাবলির কথা বিভিন্ন আখ্যানের মাধ্যমে একত্রিত করে জনগণের মধ্যে প্রচার করা। এদেরকে বলা হতো সূত বা মাগধ– ইতঃপূর্বে যাদের কথা আলোচিত হয়েছে– এরাই ছিলেন সেকালের রাজা-রাজড়াদের রাজ-ইতিহাসবক্তা। এরাই পুরনো দিনের কথা, গাথা, প্রশস্তি ও আখ্যানগুলোকে পরম্পরাগতভাবে উত্তরকালের কাছে পৌঁছে দিতো। সমাজে এদের বেশ মান্যতাও ছিল। এটাই ছিল আমাদের দেশের ইতিহাস রক্ষার প্রাচীন ব্যবস্থা। যদিও এই ব্যবস্থায় শ্রোতা ও বক্তার কল্পনার দৌড়ে অনেক সময়ই বাস্তবতার সীমারেখা হারিয়ে যেত। অশোক রায়ের ভাষ্যে– ‘আজ আমরা যাকে (ক্রিটিক্যাল) বৈচারিক ইতিহাস (‘ইতিহ-আস’ হল ইতিহাস) বলি সে যুগে এ রকম কোনও নৈষ্ঠিক ব্যবস্থা চালু ছিল না।’
‘বুদ্ধদেবের আবির্ভাবের পর এই সমস্ত আখ্যান ও উপকথাগুলো ‘জাতক’ কাহিনির রূপ ধারণ করে। জাতক কাহিনিগুলো প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৌদ্ধধর্ম মহা সম্মেলনে (তৃতীয় মহাসম্মেলন সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে ২৬৯-২৩২ খ্রি. পূ.) সংকলিত হয়ে যায়। এরপর সম্রাট অশোক থেকে প্রাক্-গুপ্ত যুগ অবধি, এই পাঁচ-ছয়শো বছর ধরে দেশে বৌদ্ধ ধর্মের বিপুল প্রাবল্য দেখা দেয়। দলে দলে সাধারণ ও নিম্নকোটির মানুষেরা ধর্মান্তরিত হতে থাকে। সনাতন ধর্মের উপর বৌদ্ধ ধর্মের এই আঘাতকে সামাল দেওয়ার জন্যেই পৌরাণিক ধর্মের উদ্ভব। আর্য-অনার্য-ব্রাত্য ধর্মের চূড়ান্ত সংশ্লেষণের মধ্যে দিয়েই পৌরাণিক ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ। তখন আর্য ও অনার্য জাতির ঐতিহ্য, দেবতাবাদে, পূজা-পার্বণ সূত বা মাগধদের মুখে মুখে চলে আসা রাজকাহিনি ও শক্তিধর পুরুষদের কাহিনি ও সমস্ত কিছুকেই একত্রিত করে পুরাণের উদ্ভব ও প্রতিষ্ঠা। তাই বলা হয়– পুরাভরম্ ইতি পুরাণম্ । অর্থাৎ যা পুরনো দিনের কথা– তাই পুরাণ। তবে এই সমস্ত গাথা কথা যেহেতু আর্য প্রতিভায়, আর্য ভাষায় গ্রথিত হল, তাই এতে আর্য প্রাধান্য ও প্রভাব আছে বিস্তর। এই পুরাণগুলো নব-সংস্কৃতি ও নব-সভ্যতার ধারক ও বাহক। যা পরবর্তীকালের হিন্দুধর্ম, হিন্দু সভ্যতা ও হিন্দু সংস্কৃতি।’- (বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-১৯৫)
            বলা বাহুল্য, বর্তমানে হিন্দুধর্মে যে প্রতিমাপূজা ভারতবর্ষের সর্বত্র দেখা যায়, বেদে তার কোনও উল্লেখ নেই। সেখানে দেবতারা মন্ত্রময়ী ও অপুরুষবিৎ। প্রাগার্য বা অনার্যরাই মূর্তি পূজা করতো। অথচ তাদের দেব-দেবীরাই পৌরাণিক যুগে আর্য প্রজ্ঞায় মহিমান্বিত হয়ে এক-একটা গুণকে আশ্রয় করে, এক এক দেবদেবীর মূর্তি কল্পনা করা হয়েছে। যেহেতু মাটি বা ধাতুর প্রতিমায় দেবতার আবির্ভাব, তাই তাঁর পাদ্য-অর্ঘ্য, ধূপ-দীপ, পুষ্প-পত্র ও নৈবেদ্য দিয়ে অর্চনা করা হয়েছে। দেবতার তৃপ্তির জন্য বাদ্য, গীত ও নৃত্য ইত্যাদি আড়ম্বরের আয়োজন করা হয়েছে। ফলে বৈদিক দেবতারা বৈদিক উপাসনা-পদ্ধতির মতোই ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেছে। প্রসঙ্গত, যদিও পৌরাণিক দেবতারা একেবারে বেদ-বহির্ভূত সম্পূর্ণ নতুন দেবতা হয়তো নন, কিন্তু আমরা জানি যে, ঋগ্বেদের দেবসভায় তাঁদের স্থান ছিল নিতান্ত অপ্রধান ও নগন্য। তাহলেও প্রশ্ন আসে– মন্ত্রদ্রষ্টা আর্য ঋষি ও ব্রহ্মজ্ঞানীর প্রজ্ঞা কেন এই অধমাধম মূর্তি পূজাকে সাদরে গ্রহণ করলো ! অশোক রায়ের ভাষ্যেই এর উত্তর খোঁজা যেতে পারে,–
‘খুব সম্ভবত প্রতিমা শব্দটার মধ্যেই তাঁদের চিন্তার মূল সূত্র পাওয়া যায়। প্রতিমার অর্থই– প্রতিমূর্তি, কল্পিত শরীর বা Image যা আসল বা স্বরূপ নয়; কিন্তু আসলের ছায়ায় তারই গুণাবলম্বনে রূপ-কল্পনা মাত্র। কবিরা যেমন প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষকে স্পষ্ট করে বোঝাবার জন্যে উপমার আশ্রয় নেন। মুনিরাও তেমনি অপ্রত্যক্ষ, অরূপ কিন্তু গুণময়কে বোঝানোর জন্যে গুণাশ্রয়ে রূপের কল্পনা করে থাকেন। শাস্ত্রে আছে– ব্রহ্ম যদিও চিন্ময়, অপ্রমেয়, তবু সাধকের হিতের জন্যে তাঁরও রূপ কল্পনা করা হয়। নির্গুণ ও অশরীরী, ব্রহ্মসদ্ভাব উত্তম, ধ্যানভাব মধ্যম, স্তুতি ও জপ অধম, বাহ্য পূজা অধমেরও অধম। কিন্তু এতে ব্রহ্ম সান্নিধ্য আসে; তাই নিষ্ক্রিয়তা, নাস্তিকতা বা ব্রহ্মবিমুখতা থেকে সহস্রগুণ বরণীয়। মহানির্বাণ তন্ত্রে আছে– ধ্যান, ধারণা বা স্তুতিরূপ অন্তপূজা; প্রতিমা পূজা বাহ্যপূজা, তা যে অধম তাতে কোনও সন্দেহ নেই। রূপ, চিহ্ন বা প্রতীক অথবা শব্দ-আশ্রয় না করে অশব্দ, অস্পর্শ, অলিঙ্গ, অরূপ, অব্যয়ের ধারণা ও আরাধনা করতে পারেন কয়জন। সাধারণ মানুষের পক্ষে ইন্দ্রিয়ের সাহায্য না নিয়ে অতিরিন্দ্রিয়কে অনুভব করা সম্ভব কী?’- (বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-১৯৭)
           রূপ দর্শনেন্দ্রিয়ের গ্রাহ্য বিষয়, অবশ্যই তা অনেক স্থূল। কিন্তু পুরাণকারেরা হয়তো মনে করলেন– প্রথম অবস্থায় সগুণ-সাকার ঈশ্বরের গুণাবলিকে রূপ-প্রতীকের মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারলে সাধারণ লোকের পক্ষে রূপাশ্রয়ে গুণের উপলব্ধি করা সহজ হবে। তাই সাধকেরা রূপাবলম্বনে উপাসনা করতে করতে অরূপ-জ্যোতি ও পরে স্বরূপ-সত্তার উপলব্ধি করেন। চঞ্চলচিত্ত মানুষ দেবতা বা ইষ্টের শ্রীমূর্তি ধ্যানের পথ ছেড়ে বাহ্য বিষয়ে বা বাহ্য রূপের নেশায় ধাবিত হয়। এই অবস্থায় অভ্যাসযোগ অবলম্বনীয়। ক্রমাগত অভ্যাস যোগের দ্বারা চিত্তের বিক্ষেপ হয় প্রশমিত। বাহ্য রূপের প্রতি সংসারী জীবের যে স্বাভাবিক প্রবণতা তখন তা মুছে যেতে থাকে। ক্রমে ইষ্টমূর্তিতে চিত্ত লয়প্রাপ্ত হয়। অধ্যায়ান্তরে তন্ত্রের আলোচনায় এই মূর্তি কল্পনার বিষয়ে প্রয়োজনীয় আলোচনা করা হয়েছে। তবে ভাব কিভাবে রূপ পরিগ্রহ করে তার দৃষ্টান্ত দেখাতে গিয়ে অশোক রায়ের বর্ণনায়–
‘ভাব কীভাবে রূপ পরিগ্রহ করে সরস্বতীর মূর্তি লক্ষ করলেই তা সহজেই বোঝা যায়। প্রাথমিক অবস্থায় তিনি আর্য ঋষি প্রজ্ঞায় ছিলেন– অম্বিতমে দেবী তমে বা নদীরূপী দেবীরূপী চ। কিন্তু পরবর্তীকালে ইনিই জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। বিদ্যার আলোকে সমস্ত অবিদ্যার অন্ধকার দূরীভূত করেন। তাই তিনি সর্বশুক্লা– এক অখণ্ড জ্যোতিস্বরূপা। তাঁর বর্ণ শুক্ল, বসন শুক্ল, আসনের হংস ও পদ্মও শুক্ল; তিনি শুদ্ধ সত্ত্বগুণময়ী– তাই জ্যোতির্ময়ী। তাঁর এক হাতে পুস্তক, যা যাবতীয় বিদ্যার প্রতীক, অপর হাতে বীণা, যা মহানাদ বা প্রণব; অথবা গীতবাদ্য ইত্যাদি, যা সুকুমার কলার প্রতীক। যোগীগণের প্রস্ফুটিত মানস-শতদলে শুদ্ধ বিদ্যার অধিষ্ঠঅন। নীর ত্যাগ করে ক্ষীর গ্রহণ করতে পারে যে মরাল, সেই তাঁর বাহন।’- (বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-১৯৯)
          এভাবে পরমেশ্বরের একেকটা গুণকে আশ্রয় করে একেকটা দেবদেবীর রূপ কল্পনা হতে হতে পৌরাণিক যুগে দেবদেবীর সংখ্যা অগণিত পর্যায়ে এসে দাঁড়ায়। তবে দেবদেবীর সংখ্যা যাই হোক, শাস্ত্রকারেরা দেবতার একত্ব ও অদ্বিতীয়ত্বকে কখনোই বিস্মৃত হননি। তাই ইষ্ট দেবতা শিব, বিষ্ণু অথবা শক্তি যিনিই হোন না কেন, আরাধনার সময় প্রত্যেক দেবতাই সৃষ্টি-স্থিতি ও লয়কারী– সর্বশক্তিমান, সর্বগুণাধার পরমেশ্বর রূপেই অর্চিত হয়ে থাকেন। ভক্তের রুচিভেদ ও প্রকৃতিভেদের জন্যই এক অদ্বিতীয় পরমেশ্বরের বহুরূপের উপাসনা দেখা যায়।
তবে পৌরাণিক যুগে দেব-পরিকল্পনার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হলো– ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর– এই ত্রিমূর্তি বা ত্রয়ী। আবার এই ত্রিমূর্তিই এক দেহে লীন হয়ে– পরমাত্মা পরমেশ্বর। যিনি সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহারের নিয়ন্তা। এ দেবতা নতুন, এঁর রূপকল্পনাও নতুন, এমনকি পূজাবিধিও নতুন। এখানে বৈদিক যাগ-যজ্ঞ বা উপনিষদের অরূপের ধ্যান-ধারণা আর নেই। এই পৌরাণিক কল্পনায় আমরা দেখি–
‘ধ্যান-স্তিমিত-লোচন, চতুরানন ব্রহ্মা রক্তপদ্মে উন্নত উজ্জ্বল দেহ, বাম করে কমণ্ডলু, দক্ষিণ করে যজ্ঞের স্রুব বা হাতা, অপর দুই হাতে জপমালা ও অভয় মুদ্রা। তাঁর বামে সাবিত্রী দেবী, দক্ষিণে সরস্বতী, সম্মুখে বেদরাশি, পুরাভাগে ঋষিগণ বেদধ্বনি করছেন। ইনি দেবতা ও অসুরদের পিতামহ, ইনি প্রজাপতি, ইনি কখনও হংসপৃষ্ঠে আরোহণ করে থাকেন। ইনি সৃষ্টিকর্তা, অনাদি অনন্ত কাল ধরে নিরন্তর অসংখ্য জগৎ ও জীবসৃষ্টি করে চলেছেন।
বৈদিক বিষ্ণু এখন পৌরাণিক বিষ্ণু-নারায়ণ। জ্যোতির্ময় সবিতৃ মণ্ডলের মধ্যে পদ্মাসনে উপবিষ্ট, তাঁর হিরন্ময় অঙ্গে কেয়ূর, কিরীট, কুণ্ডল ও হার। ইনি চতুর্ভুজ; তাঁর চার হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম। ইনি সর্বদা জগৎপালক।’- (বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-২০০)
                আর দেবাদিদেব মহেশ্বর শিব? ইতঃপূর্বেই আলোচনা হয়েছে যে, প্রাগৈতিহাসিক যুগের ‘সমাধি প্রস্তর’ এক সময়ে বিবর্তিত হয়– আত্মা প্রস্তরে, যা আজও আদিবাসী সমাজে ‘বীরকাঁড়’ বলে পরিচিত। তারপর ভূমিকর্ষণের প্রয়োজনীয়তায় সৃজন শক্তির প্রতীক রূপে ‘লিঙ্গযষ্টিতে’। তারপর সিন্ধু সভ্যতায় আমরা আদি শিবকে দেখতে পাই– পশুপতি রূপে। এখানে তিনি কেবল একাই নন, একই সাথে পূজিত হতে দেখি আদি মাতাকেও। সেখানে তাঁরা যে সৃজন শক্তি ও উর্বরা শক্তির প্রতীক লিঙ্গ ও যোনি রূপে আলাদা আলাদাভাবে পূজিত হতেন, এ-বিষয়ে বিদ্বান মহলে সকলেই প্রায় নিঃসন্দেহ।
এরপর বৈদিক যুগে ঋগ্বেদের কালে তিনি শিশ্নদেব রূপে নিন্দিত হলেও, পরবর্তীকালে বৈদিক দেবমণ্ডলীতে একজন অত্যন্ত অপ্রধান ধ্বংসের দেবতা রুদ্ররূপে স্তুত। এ সময় শিব কথাটা ছিল রুদ্রের বিশেষণ। এরপর উপনিষদে– বিশেষ করে শ্বেতাশ্বতরে– কিছু কিছু জায়গায় তিনি একটু একটু করে মঙ্গলময় রূপ পরিগ্রহ করতে থাকেন। কিন্তু যজুর্বেদের দুই শাখাতেই তিনি বিপুলভাবে স্তুত হয়ে পরমাত্মায় পর্যবসিত হন। এই সময়েই তাঁর মঙ্গলময় রূপে দার্শনিক প্রকাশ চরমোৎকর্ষ লাভ করে। ইতঃপূর্বে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। তবে ঋগ্বেদের যুগে শিব কথাটা ছিল রুদ্রের বিশেষণ, আর এখন রুদ্র শব্দটা হয়ে দাঁড়ালো শিবের বিশেষণ। ফলে যজুর্বেদের রুদ্রাধ্যায়ে তিনি বন্দিত হলেন–
নমঃ শম্ভবায় চ ময়োভবায় চ।
নমঃ শঙ্করায় চ ময়ষ্করায় চ।
নমঃ শিবায় চ শিবতরায় চ।।
অর্থাৎ : শম্ভুকে নমস্কার, সুখভবকে নমস্কার। শঙ্করকে নমস্কার, সুখকরকে নমস্কার। শিবকে নমস্কার, শিবতরকে নমস্কার।
           এখানে শম্ভব, ময়োভব, শঙ্কর, ময়ষ্কর ও শিব– প্রতিটা শব্দের একই অর্থ– কল্যাণ সুন্দর মঙ্গলময় রূপ। এ শুধু শিবই নয়। ‘শিবতর’ অর্থাৎ অধিকতার মঙ্গলদায়ক ও কল্যাণজনক।
            অশোক রায়ের ভাষ্যে, এই সময় তিনি বৈদিক অগ্নিদেবতারও কয়েকটা বৈশিষ্ট্য নিয়ে শিবরূপে লীন হন। তাই বলা হয়– শিব বা মহেশ্বর রজতগিরির ন্যায় শুভ্র। এঁর পঞ্চমুখ ও ত্রিনয়ন, ললাটে চারুচন্দ্র, পরিধানে ব্যাঘ্রচর্ম। পদ্মাসীন এই দেবতা সতত অমর-গণ কর্তৃক বন্দিত হয়ে বরাভয় হস্তে নিখিলের ভয় হরণ করছেন। মহাপ্রলয়ের তাণ্ডবে মত্ত হয়ে ইনিই রূদ্ররূপে বিশ্বসংহার করে থাকেন।
শিবের বাহ্যরূপ বিচার করলে অনার্যভাবেরই পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু আর্য প্রতিভা তাঁর সমগ্র তত্ত্ব-বিচার করে তাঁদের প্রজ্ঞায় এঁকে সংস্কৃত করেছেন, শুদ্ধ করেছেন। রূপকাশ্রয়ে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা দিয়ে মোহনীয় ও বরণীয় করেছেন; আর সত্যম্-শিবম্-সুন্দরম্-এর প্রকাশে সম্পূর্ণ করার প্রয়াস নিয়েছে। কারণ–
‘আর্যপ্রজ্ঞা অনুভব করেছিল, অগণিত অনার্য ও ব্রাত্য নরনারীর নিত্য-পূজিত এই শ্মশাসচারী উন্মত্ত গণদেবতাই ধর্ম সংকটের কালে একমাত্র ত্রাতা। যখন সাধারণ মানুষ বৈদিক যাগ-যজ্ঞ, ক্রিয়াকর্ম, আচার-অনুষ্ঠানের বিপুল ব্যায়বাহুল্যতা ও ক্রিয়াসর্বস্বতায় বীতশ্রদ্ধ, তখন মানুষের কাছে ইনিই এই সবের (যাগ-যজ্ঞ, ক্রিয়া-কর্মের) ঊর্ধ্বের একমাত্র গণদেবতা। যাঁর পূজায় নারী-পুরুষ, ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল, পণ্ডিত-মূর্খ সকলেরই সমান অধিকার। ভক্তি ছাড়া এঁর পূজায় আর অন্য কোনও উপচারই লাগে না। শুধু একটা বেলপাতা, শুধু একটু জল, তাতেই আশুতোষের পরম তুষ্টি। তাই আর্য ঋষিপ্রজ্ঞা এঁকে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হলেন। বৈদিক রুদ্র দেবতার অঙ্গীভূত করে শিব দেবতাকে তাঁরা নতুন ভাবে প্রকাশ করলেন। এর আগেও তাঁরা একবার প্রকাশ করেছিলেন– যজুর্বেদে। কিন্তু বর্তমান রূপই হল শিবঠাকুরের পৌরাণিক রূপ। তাঁর প্রত্যেকটা ভূষণ ও আচারকে অপূর্ব দার্শনিক রূপকাশ্রয়ে আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা দিয়ে এমনভাবে মহিমান্বিত করলেন যা সকলের কাছে গ্রহণীয়, আদরণীয় ও বরণীয় হয়ে সমগ্র হিন্দু জনমানসে পরমাত্মার রূপ পরিগ্রহ করল।’- (বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-২০১)
           তাঁর যে অনার্য রূপের পরিচয় ছিল, তিনি কখনও ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিত, আবার কখনও বা উলঙ্গ; কণ্ঠে সর্পমালা, বৃষভ তাঁর বাহন, পর্বতে তার বাস, ভূতপ্রেত নিয়ে শ্মশানে-মশানে তাঁর বিচরণ; আর চিতাভস্ম গায়ে মেখে তিনি বিষ, সিদ্ধি বা ধুস্তুর সেবন করেন– এই কথাগুলোকেই দার্শনিকতায় মহিমামণ্ডিত করে বলা হলো–
‘চতুষ্পদ ধর্মরূপী বৃষই হল বৃষভ দেবতার বাহন। তিনি উলঙ্গ নন, দিগম্বর– দিক ব্যাপিয়া অম্বর যাঁর। তিনি বিশ্বব্যাপী ভূমা। তাঁর আবার বসন হবে কী করে? প্রপঞ্চ– পরাঙ্মুখ মহাযোগী। তিনি বাঘাম্বর ও বাঘাম্বরেই ধ্যানাসীন। পৃথিবীর যত ভয়স্থান, যত দুঃখ, যত ব্যাধি, যত বিপদ ও যত অমঙ্গল, এমনকী বিষধর সর্প এই সমস্ত কিছুকেই নিজ অঙ্গে অঙ্গভূষণ করে, জটায় কিরীট-ভূষণ করে, পরম মঙ্গলময় শিব যেন নির্বিকার। তাঁর অগণিত রত্ন-ভাণ্ডার তিনি স্পর্শও করেন না। সেবক কুবের তা ভোগ-রক্ষা করে চলেছেন। শ্মশানের চিতা বিভূতি অঙ্গে মেখে সংহারের দেবতা সৃষ্টির ক্ষণভঙ্গুরত্ব ও সংসারের নশ্বরত্বই যে এই জগতের চরম পরিণাম, একান্ত বৈরাগ্যভরে তা ঘোষণা করছেন। দেবাসুরের (সংসার?) সমুদ্র মন্থনে যখন অমৃত উঠল তখন কেউই শিবকে স্মরণ করল না। তারপর যখন বাসুকী নাগের উদ্গীর্ণ কালকূট, হলাহল বা গরলে বিশ্ব-বিনাশ হয় হয়; তখনই একমাত্র তিনিই সেই হলাহলকে পান করে বিশ্বকে আসন্ন ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন। পরম মঙ্গলময় দেবতা তিনি, তাই জগতের সমস্ত অমঙ্গল বিষকে নিজ কণ্ঠে ধারণ করে– নীলকণ্ঠ বা নীললোহিত।’
‘তাঁর তৃতীয় নেত্র হল– প্রজ্ঞানেত্র। যোগীরাজের যোগসিদ্ধিজাত এই জ্ঞাননেত্র। তাই এই নেত্রজাত জ্ঞানবহ্নি দ্বারাই তিনি রতি-সহায় মদনকে ভস্মীভূত করে উমার পরিণয়-প্রসঙ্গে কামের দৌত্যকে অস্বীকার করলেন। এই জ্ঞাননেত্রের কেবল উপরিভাগই ভক্তের প্রতি অমৃত-বর্ষী স্নিগ্ধ চন্দ্রকলায় দীপ্যমান। তারই জটিল শীর্ষ অবলম্বন করেই ভূলোকে গঙ্গাবতরণ হয়। হিমালয়ের গভীর অরণ্যানী তাঁরই জটাজালের আভাস। সেই জটারণ্যের জালে ঘুরে ঘুরে সুরধুনি মন্দাকিনীর মর্ত্যে অবতরণ। বুদ্ধদেবের ধ্যান-প্রশান্ত রূপের মহিমাই তাঁকে সংসার-বিরাগী যোগীরাজরূপে পরিচিত করেছে। তিনিই তন্ত্রের মহাভৈরব, বেদের মহারুদ্র। আবার তিনিই নটরাজ রূপে বিশ্ব-সৃষ্টি লীলায় ও প্রলয়-তাণ্ডবে উন্মত্ত। বামে উমাকে সঙ্গিনী করে তিনিই সাংখ্যের প্রকৃতি ও পুরুষরূপে প্রকাশিত। তিনিই আদর্শ গৃহী। দশদিকে দশভূজ বিস্তার করে সিংহবাহিনী অসুরমর্দ্দিনী মহাশক্তি দুর্গা তাঁর গৃহিণী। ঋদ্ধি ও বিদ্যা স্বরূপা লক্ষ্মী ও সরস্বতী তাঁর দুই কন্যা। বল ও সিদ্ধিরূপী কার্তিক ও গণেশ এই দুই পুত্রকে নিয়ে মহাগৃহী শংকর।’
‘তাঁর হস্ত-ধৃত ত্রিশূল জীবের ত্রিতাপ বিনাশকারী, ইনি জ্ঞানেশ্বর, সাক্ষাৎ পরমজ্ঞানী। শিবশক্তির ভেদ ঘুচিয়ে ইনিই বেদান্তের অদ্বৈত ব্রহ্ম; রজতগিরিনিভকান্তি পরম জ্যোতি স্বরূপে প্রকাশমান। এই পুরুষ থেকেই মঙ্গলজাত বলে ইনি– শিব ও শম্ভু; মঙ্গলময় বলে– শংকর। ইনি আশুতোষ, মৃত্যুঞ্জয়; ভূজগভূষণ, নীলকণ্ঠ; ইনিই স্মরহর, চন্দ্রশেখর; আবার ইনিই গঙ্গাধর, পরমেশ্বর, ইনিই পরমব্রহ্ম।’
‘তাঁর কত নাম, কত রূপ; কত কাহিনি তাঁকে আশ্রয় করে পর্বতে, নদীতটে, অরণ্যে, নগরে ও গ্রামে। কত শত কুৎসিত কাহিনি প্রেত-পিশাচের মতো তাঁকে অবলম্বন করে বেঁচে আছে তার ইয়ত্তা নেই। সত্যিই ইনি দেবাদিদেব মহাদেব। সর্বভাব, সর্বধর্ম ও সর্বজ্ঞতা এঁতেই এসে মিশেছে, যেন মানুষের কল্পনার চূড়ান্ত পরিস্ফূর্তি এখানেই। তাই শৈব সাধকেরা উদার মন্ত্রে বলেন– যত্র জীব তত্র শিব।’- (বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-২০২)
              পৌরাণিক কল্পনায় এই পুরো বিষয়টা আর্য প্রজ্ঞায় ও সংস্কৃতিতে রচিত হয়েছিল বলেই ব্রাহ্মণ্যবাদের মূর্ত প্রতীক ভগবান শ্রীবিষ্ণুকে স্থান দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ স্বর্গ– বৈকুণ্ঠে, এবং সেখানে তিনি বিষ্ণুপ্রিয়া মা লক্ষ্মীর সাথে অধিষ্ঠিত। আর শিব ঠাকুরের স্থান হলো মর্ত্যরে মেরুপর্বত– কৈলাসে। সেখানে তাঁর সাথে অধিষ্ঠিতা হলেন– শিবজায়া মা দুর্গা।
বলা হয়, পৌরাণিক যুগের আরেক শ্রেষ্ঠ অবদান হলো মার্কণ্ডেয় পুরাণের শ্রীশ্রীচণ্ডী। এ-বিষয়ে অধ্যায়ান্তরে শক্তি-সাধনা প্রসঙ্গে বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে। তবু বর্তমান আলোচনায় খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে, বাংলাদেশে শরৎকালে ঘরে ঘরে যে মহাপূজা অনুষ্ঠিত হয়, আজ তা বাঙালি হিন্দুর জাতীয় উৎসব দুর্গাপূজা। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার মতো শ্রীশ্রীচণ্ডীও হিন্দু-সম্প্রদায়ের নিত্য পাঠ্য গ্রন্থ। তবে এর মাহাত্ম্য অন্যরকম। অশোক রায়ের ভাষ্য অনুযায়ী, এখানে মহাদেবীর তিনটি চরিত্র দেখা যায়। প্রথম চরিতে মধু-কৈটভ-বধ; মধ্যম চরিতে মহিষাসুর-বধ; আর উত্তর চরিতে শুম্ভনিশুম্ভ-বধ।
‘মধ্যম চরিতে– মহিষাসুর স্বর্গভূমি অধিকার করলে, ক্রুদ্ধ দেবতাদের দেহসম্ভূত তেজরাশি পুঞ্জীভূত হয়ে এক জ্বলন্ত পর্বতের রূপ ধারণ করে। সেই মিলিত মহাতেজ থেকেই নারীরূপে মহাশক্তির আবির্ভাব। আর এই মহাশক্তিই দেবগণ দ্বারা পূজিতা হয়ে, মহিষাসুর বিনাশ ও স্বর্গভূমি উদ্ধার করেন। তিন চরিতে দেবীর চারটে স্তব আছে, যার মহিমা অতুলনীয়। চৈতন্যই শক্তি, আর শক্তির বহুবিধ প্রকাশই হল– সৃষ্টি। এই শক্তিই মায়া; যার প্রভাব কেউই অতিক্রম করতে পারে না। তাই জগতের সমস্ত প্রাণী ও মানুষ মহামায়ার প্রভাবে মোহিত হয়ে নিজ নিজ কার্য করে চলেছে। কিন্তু কে এই দেবী? মুনি বলেন– তিনিই সৃষ্টিকারিণী, স্থিতি ও সংহারকারিণী শক্তি; মহাবিদ্যা, মহামায়া ও মহাসুরী তিনিই; তিনি কালরাত্রি ও মোহরাত্রি; তিনি শ্রী, লজ্জা, পুষ্টি, তুষ্টি, শান্তি ও ক্ষান্তি; তিনি সৌম্যা, সৌমরতা থেকেও অতীব সুন্দরী; সৎ, অসৎ যাবতীয় বস্তুর তিনিই একমাত্র শক্তি– দেবী পরমেশ্বরী।’
‘পুণ্যবানের ঘরে তিনি– লক্ষ্মীস্বরূপা; পাপাত্মার ঘরে– অলক্ষ্মীস্বরূপা। বুদ্ধিমানের হৃদয়ে– বুদ্ধি, সাধুর অন্তরে– শ্রদ্ধাস্বরূপা। তিনি সর্বভূতে মাতৃরূপে ও সর্ববিধ শক্তিরূপে অবস্থিতা। তিনিই বিশ্বের বীজ, পরমা মায়া। সমস্ত বিদ্যা ও সমস্ত নারী তারই রূপভেদ। সমগ্র জগৎ তাঁরই প্রভাবে সম্মোহিত। একমাত্র তিনি প্রসন্না হলেই মানুষের মোহমুক্তি সম্ভব। তাই কথাতেই বলা আছে– একৈবাহহং জগত্যত্র দ্বিতীয় কা মমাপরা– এ জগতে আমি একাই বর্তমান, আমার আবার দ্বিতীয় কে? বহুরূপে দেবী একাই জগৎ-খেলা খেলিতেছেন।’- (
বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-২০৩)
             সে যাক্, আমরা যদি শিব প্রসঙ্গে আসি তাহলে এ পর্যায়ে এসে বোঝা যাচ্ছে যে, আজকের দিনের শিবঠাকুর ভারতীয় সংস্কৃতিতে প্রকৃতই যেন– দেবাদিদেব। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই তিনি বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন মানুষের কাছে আশ্রয়-ভরসার প্রতীক স্বরূপ। তাই তিনি সেই সময় থেকেই সর্বপূজিত ও সর্বপ্রণম্য। তারপর মানব বিবর্তনের ধারা বেয়ে তাঁরও রূপবিবর্তন ঘটতে থাকে। এই মহাকালের পথ পরিক্রমার বিভিন্ন নিদর্শনগুলোই ক্রমে তাঁর বাহন, অঙ্গভূষণ ও পূজা প্রকারণ রূপে দেবাংশী হয়েছে বলে পণ্ডিতদের অভিমত। আদিতে তিনি ছিলেন অমূর্ত বা বিমূর্ত। এরপরে সিন্ধু সভ্যতায় তিনি হলেন মূর্ত ও অমূর্ত। সমগ্র আর্য সভ্যতায় ঋগ্বেদ সংহিতার যুগ থেকে অথর্ববেদ সংহিতার যুগ পর্যন্ত তিনি আবার অমূর্ত, কারণ, আর্যরা মূর্তিপূজার ঘোর বিরোধী ছিলেন। এরপরে পৌরাণিক যুগে এসে আর্য-অনার্য এই দুই সভ্যতার চূড়ান্ত ধারা সংশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে আবার তিনি মূর্তিরূপ পরিগ্রহ করলেন; আবার একই সাথে তিনি লিঙ্গ প্রতীকেও পূজিত হতে থাকলেন। সবশেষে আজ তিনি তাঁর লিঙ্গ প্রতীকে এতোটাই জনপ্রিয় যে, তার ফলে তাঁর কায়ারূপ জনমানস থেকে ক্রম-অপস্রিয়মাণ।
বর্তমানে শিবঠাকুরের যে মূর্তিরূপ দেখি, তার উৎপত্তি সম্ভবত পৌরাণিক যুগেই সূচিত হয়েছে। সেখানে সিন্ধু সভ্যতার আদি শিবের মূর্তি বহু পরবর্তী অনার্য সভ্যতার মধ্যে ফল্গুধারার মতো প্রাগার্য সভ্যতা থেকে অনুপ্রবেশ করেছিল কিনা তা অবশ্যই গবেষণার বিষয়। কিন্তু বর্তমানে আমরা তাঁর যে গৌরীপট্ট সমন্বিত লিঙ্গ প্রতীকরূপ দেখি তা মোটেও বেশি প্রাচীন কালের কথা নয়। কারণ প্রাগৈতিহাসিক আত্মা প্রস্তর থেকে শুরু করে পৌরাণিক কাল পর্যন্ত লিঙ্গ প্রতীক বহুবার বহু-সংস্কৃত হলেও আদি পিতার সাথে আদি মাতার সমন্বয় মূর্তি রচনা কখনোই সম্ভব হয়নি। সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শনগুলো থেকেও অনুমান করা যায় যে তখনো লিঙ্গ ও মাতৃদেবী (আদি পিতা ও আদি মাতা) আলাদা আলাদা ভাবেই পূজিত হতেন। পৌরাণিক যুগে এসেও লিঙ্গমূর্তিতে গৌরীপট্ট সংযোজন করা সম্ভব হয়নি। বরং, পণ্ডিতজনদের মতে, এই সময়ে বোধহয় কোনও সামাজিক অবক্ষয়ের ফলে লিঙ্গমূর্তি ক্রমে ক্রমে একান্ত বাস্তবানুগ রূপ নেয়, আবার একই সাথে ক্রমশ তা আকারেও বড় হতে থাকে। এরকম বহু নিদর্শনের মধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশের গুড্ডিমল্লম গ্রামের মনুষ্যপ্রমাণ (খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর) লিঙ্গমূর্তিটি আজও সাড়ম্বরে পূজিত হওয়ার কথা ইতঃপূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে।
‘এই সময়কার লিঙ্গমূর্তিগুলো সরাসরি মাটির উপরে খাড়াভাবে প্রোথিত অবস্থায় থাকত। যা ক্রমশ শ্লীলতার সীমারেখা অতিক্রম করতে থাকে। তারপর এই বাস্তবানুগ রূপ খুব সম্ভবত জনরোষেই ধীরে ধীরে পরিশীলিত হয়। যার ফলে পরবর্তীকালের নিদর্শনগুলো বাস্তবানুগতা ছেড়ে বিভিন্ন মাপের নানা ধরনের (লম্বা, ডিম্বাকৃতি, উপবৃত্তাকার, গোলাকার ইত্যাদি) হতে থাকে। আর তা সরাসরি মাটির উপরে খাড়া ভাবে প্রোথিত থাকত।’
‘এইরকম শিবলিঙ্গ আজও বহু জায়গায় (প্রাচীন মন্দিরগুলোতে) পূজিত হচ্ছে। একটু ভালভাবে লক্ষ করলেই দেখা যাবে যে, সেইসব লিঙ্গমূর্তিতে গৌরীপট্ট পরবর্তীকালে বিভিন্ন কায়দায় সংযোজন করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়– কাশীর বিশ্বনাথ, কেদারনাথ, মহাকাল, ওংকারেশ্বর, লিঙ্গরাজ, তারকেশ্বর ইত্যাদি। এই উদাহরণগুলো দেখে অনেক প্রাজ্ঞ মানুষ আপত্তি করতে পারেন যে, ওইসব মন্দিরগুলো তো আরও অনেক প্রাচীন কালের নিদর্শন। তা হলে তাঁদেরকে কি এই যুক্তিতে আনা যায়? কথাটা ঠিকই বিশ্বনাথ, মহাকাল, ওংকারেশ্বর ইত্যাদি মন্দিরগুলো অতি প্রাচীন। কিন্তু ইতিহাস বলে ওই মন্দিরগুলো বহুবার বহুভাবে বিনষ্ট ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে; আবার নতুন করে তৈরি হয়েছে।’- (বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-২০৫)
            ঐতিহাসিকেরা যদিও গুপ্তযুগকে পৌরাণিক ও হিন্দু সভ্যতার স্বর্ণযুগ বলেন, কিন্তু এই সময়েও লিঙ্গমূর্তিতে আদিপিতার সাথে আদিমাতার সমন্বয় সাধন করা সম্ভব হয়নি। তা সম্ভব হয়েছে গুপ্তোত্তর কালে এসে (খ্রি. ষষ্ঠ শতাব্দী) কোন এক মাহেন্দ্রক্ষণে। আবিষ্কৃত হলো ‘সনালিকা গৌরীপট্ট সমন্বিতম্’ শিবলিঙ্গ। জানা যায়, এর ঠিক কিছুকাল আগে পাঞ্জাবের উদম্বর জনগোষ্ঠী বহুভাবে লিঙ্গমূর্তির রূপ সংস্কারের বহু প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, যার নিদর্শন আজও পাওয়া যায় বলে গবেষকদের অভিমত।
‘তৈরি হল মানুষের দার্শনিকতার সাথে মেলবন্ধন করে যুগোপযোগী ও রুচিসম্মত শিবলিঙ্গ মূর্তি। যাতে বাস্তবানুগতার চেয়ে দার্শনিকতাই বেশি প্রাধান্য লাভ করেছে। আর তাই এই মূর্তি আসমুদ্রহিমাচলে সর্বত্র আদৃত, পূজিত ও প্রণম্য হল– আদি পিতা ও আদি মাতার– শিবশক্তির– বিশ্বাদ্যং বিশ্ববীজং-এর দার্শনিক বিমূর্ত প্রকাশরূপে।’- (বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-২০৬)
আর এই দার্শনিকতার সাহিত্য নিদর্শনও আমরা দেখতে পাই পরবর্তীকালের শৈব তন্ত্র ও পুরাণ সাহিত্য নিদশনগুলিতে। যেমন, বায়বীয় সংহিতায় বলা হয়েছে–
লিঙ্গবেদী মহাদেবী লিঙ্গং সাক্ষান্মহেশ্বরঃ। (বায়বীয় সংহিতা উত্তরভাগ-২৭/১৩)
অর্থাৎ : লিঙ্গের বেদীতে মহাদেবীর এবং লিঙ্গেতে মহেশ্বরের অধিষ্ঠান।
প্রাণতোষিণী-ধৃত লিঙ্গপুরাণ বচনেও বলা হয়েছে–
লিঙ্গবেদো মহাদেবী লিঙ্গং সাক্ষান্মহেশ্বরঃ।
ত্রয়োঃ সংপূজনান্নিত্যং দেবী দেবশ্চ পূজিতৌ।। (প্রাণতোষিণী-ধৃত লিঙ্গপুরাণ বচন)
অর্থাৎ : লিঙ্গ-বেদী মহাদেবী ভগবতী-স্বরূপ। আর লিঙ্গ সাক্ষাৎ মহাদেব স্বরূপ। এই লিঙ্গ ও বেদীর পূজাতে শিব ও শক্তি উভয়ের পূজা হয়।
পরবর্তীকালের তান্ত্রিক দৃষ্টিতেও একই তত্ত্ব পাওয়া যায়। যেমন, নিরুত্তর তন্ত্রের ভাষায়–
লিঙ্গরুপো মহাকালো যোনিরূপা চ কালিকা। (নিরুত্তরতন্ত্র-১৪পটল)
অর্থাৎ : লিঙ্গরূপে মহাকাল এবং যোনিরূপে কালিকা দেবী অবস্থান করেন।
নারদপঞ্চরাত্রেও লিঙ্গযোনির নিত্যসম্বন্ধের কথা পাওয়া যায়, যেমন–
যত্র লিঙ্গস্তত্র যোনির্যত্র, যোনিস্ততঃ শিবঃ। (নারদপঞ্চরাত্র)
অর্থাৎ : যেখানে লিঙ্গ সেখানেই যোনি এবং যেখানে যোনি সেখানেই শিবের অবস্থান।
একইভাবে–
শক্তিং বিনা মহেশানি প্রেতত্বং তস্য নিশ্চিতম্ ।
শক্তিসংযোগমাত্রেণ কর্মকর্তা সদ্যশিবঃ।
অতএব মহেশানি পূজয়েচ্ছিবলিঙ্গবম্ ।।
অর্থাৎ : মহেশানি ! শক্তি-সংযুক্ত না থাকিলে শিব নিশ্চিত শব-স্বরূপ হন, এবং শক্তি-যুক্ত হইলেই কর্ম-ক্ষম হইয়া উঠেন। অতএব শক্তির সহিত শিব-লিঙ্গের পূজা করিবে।
লিঙ্গ যেহেতু পিতৃত্বের এবং যোনি মাতৃত্বের প্রতীক, হয়তো এর থেকেই জগৎ পিতা-মাতার কল্পনা শাস্ত্রকারদের বুদ্ধিতে উদিত হয়েছিল। সে কারণেই নিরুত্তরতন্ত্রে বলা হয়েছে–
যোনিশ্চ জনিকা মাতা লিঙ্গশ্চ জনকঃ পিতা।
মাতৃভাবং পিতৃভাবমুভয়োরপি চিন্তয়েৎ।।
অর্থাৎ : যোনিতে মাতা এবং লিঙ্গে পিতা, এভাবে উভয়কে মাতৃ-পিতৃজ্ঞানে চিন্তা করবে।
তাই হয়তো পরবর্তীকালে শঙ্করাচার্য্যরে অন্নপূর্ণাস্তোত্রে বলা হয়েছে–
মাতা মে পার্বতী দেবী পিতা দেবো মহেশ্বরঃ।
বান্ধবাঃ শিবভক্তাশ্চ স্বদেশো ভুবনত্রয়ম্ ।। (অন্নপূর্ণাস্তোত্র)
অর্থাৎ : দেবী পার্বতী আমার মা, পিতা মহেশ্বর; শিবভক্তরা বান্ধব তাই ত্রিভুবনই স্বদেশ।
শিবলিঙ্গের প্রকারভেদ ও মাহাত্ম্য
প্রাথমিকভাবে শিবলিঙ্গ দুই প্রকার– কৃত্রিম ও অকৃত্রিম। এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রকার দ্রব্যের দ্বারা যেমন কৃত্রিম ও অকৃত্রিম শিবলিঙ্গ নির্মিত হয়েছে, তেমনি তাদের আকৃতিও বিভিন্ন প্রকার হয়েছে। এইসব আকৃতি অনুসারে বিভিন্ন প্রকার লিঙ্গের বিভিন্ন নামকরণ হয়েছে। ফলে শালগ্রাম শিলা চেনার জন্য যেরূপ বিভিন্ন প্রকার চক্রজ্ঞানের প্রয়োজন হয়, তেমনি শিবলিঙ্গ পরিজ্ঞানের জন্যও গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এই সব গ্রন্থ পর্যালোচনা করলে শিবলিঙ্গের অসংখ্য নাম ও আকৃতির বিবরণ পাওয়া যায়।
শাস্ত্র অনুযায়ী শিবলিঙ্গ দুই প্রকার– কৃত্রিম ও অকৃত্রিম। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে সৃষ্ট স্বয়ম্ভুলিঙ্গ, বাণলিঙ্গ ইত্যাদিকে অকৃত্রিম লিঙ্গ বলে। প্রাণতোষিণী তন্ত্রে বলা হয়েছে–
লিঙ্গং হি দ্বিবিধমকৃত্রিমং কৃত্রিমঞ্চ।
অকৃত্রিমং স্বয়ম্ভূতং স্বয়ম্ভূবাণলিঙ্গাদি।। (প্রাণতোষিণী)
অর্থাৎ : লিঙ্গ দুই প্রকার, অকৃত্রিম ও কৃত্রিম; স্বয়ম্ভূ ও বাণ-লিঙ্গ প্রভৃতি যে সকল লিঙ্গ মনুষ্য দ্বারা নির্মিত হয় নাই, তাহার নাম অকৃত্রিম লিঙ্গ।
              আর ধাতু, পাথর ইত্যাদি দিয়ে মানুষের তৈরি শিবলিঙ্গকে কৃত্রিম লিঙ্গ বলে। এই কৃত্রিম ও অকৃত্রিম উভয় ধরনের লিঙ্গই আবার দুই প্রকার– চল ও অচল। যে লিঙ্গকে প্রয়োজনে স্থানান্তরিত করা যায় তাকে চল বা সচল লিঙ্গ এবং যে লিঙ্গকে প্রয়োজনে স্থানান্তরিত করা যায় না তকে অচল লিঙ্গ বলে। সাধারণত কৃত্রিম লিঙ্গের মধ্যে মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গকে অচল লিঙ্গ বলে।
অকৃত্রিম শিবলিঙ্গ পাঁচ প্রকার– স্বয়ম্ভূলিঙ্গ, দৈবলিঙ্গ, গোললিঙ্গ, আর্যলিঙ্গ ও মানসলিঙ্গ। লিঙ্গশাস্ত্র অনুযায়ী–
তল্লিঙ্গং দ্বিবিধং জ্ঞেয়মচলঞ্চ চলং তথা।
প্রাসাদে স্থাপিতং লিঙ্গসচলং তচ্ছিলাদিজম্ ।।
পঞ্চধা তৎ স্থিতং লিঙ্গং স্বয়ম্ভূদৈব-গোলজম্ ।
আর্যঞ্চ মানসং লিঙ্গং তেষাং লক্ষণমুচ্যতে।।
অর্থাৎ : কৃত্রিম হোক আর অকৃত্রিমই হোক সমস্ত শিবলিঙ্গই চল ও অচল ভেদে দ্বিবিধ। যে লিঙ্গকে স্থানান্তরিত করা যায় না তা অচল লিঙ্গ আর যাকে স্থানান্তরিত করা যায় তা চল লিঙ্গ। অকৃত্রিম শিবলিঙ্গকে আবার পাঁচ ভাগে বিভক্ত করা যায়, যথা– স্বয়ম্ভূলিঙ্গ, দৈবলিঙ্গ, গোললিঙ্গ, আর্যলিঙ্গ ও মানসলিঙ্গ।
          শাস্ত্র অনুযায়ী দশদিক্পালের থেকে উৎপত্তি হয়েছে দশ প্রকার স্বয়ম্ভূলিঙ্গের। এইসব অকৃত্রিম স্বয়ম্ভূলিঙ্গের লক্ষণ বর্ণনায় বলা হয়েছে–
নানাছিদ্রসমাযুক্তং নানাবর্ণসমন্বিতম্ ।
অদৃষ্টমূলং যল্লিঙ্গং কর্কশং ভূবি দৃশ্যতে।।
তল্লিঙ্গন্তু স্বয়ম্ভূতমপরং লক্ষণচ্যুতম্ ।
স্বয়ম্ভূলিঙ্গমিত্যুক্তং তচ্চ নানাবিধংমতম্ ।।
শঙ্খাভমস্তকং লিঙ্গং বৈষ্ণং তদুদাহৃতম্ ।
পদ্মাভমস্তকং ব্রাহ্মং ছত্রাভং শাক্রমুচ্যতে।।
শিরোযুগ্মং তথাগ্নেয়ং ত্রিপদং যাম্যমীরিতম্ ।
খড়্গাভং নৈঋতং লিঙ্গং বারুণং কলসাকৃতি।।
বায়ব্যং ধ্বজবল্লিঙ্গং কৌবেরন্তু গদান্বিতম্ ।
ঈশানস্য ত্রিশূলাভং লোকপালাদিনিঃসৃতম্ ।।
স্বয়ম্ভূলিঙ্গমাখ্যাতম্ সর্বশাস্ত্রবিশারদৈঃ।।
অর্থাৎ : যে প্রাকৃতিক বা অকৃত্রিম লিঙ্গ বহুছিদ্রযুক্ত নানা বর্ণযুক্ত এবং ভূগর্বে যার তল খুঁজে পাওয়া যায় না তারাই স্বয়ম্ভূলিঙ্গ। এইসব লক্ষণ যদি স্বয়ম্ভূলিঙ্গে না থাকে, তাহলে তা লক্ষণচ্যুত বলে বুঝতে হবে। যে সব স্বয়ম্ভূলিঙ্গের মস্তক শঙ্খের মত আবৃতি বিশিষ্ট তাদের বলে বৈষ্ণবলিঙ্গ। যে লিঙ্গের মস্তক পদ্মের মত আকৃতিবিশিষ্ট তার নাম ব্রাহ্মলিঙ্গ। যার মস্তকভাগ ছত্রের মত তাকে বলে ঐন্দ্রলিঙ্গ। শিবলিঙ্গের দুটি মস্তক থাকলে সেই লিঙ্গকে বলে আগ্নেয় লিঙ্গ। তিনটি পদচিহ্ন থাকলে তাকে বলে যাম্যলিঙ্গ। খড়্গরে মত আকৃতিযুক্ত লিঙ্গকে বলে নৈর্ঋতলিঙ্গ। কলসের মত আকৃতিযুক্ত লিঙ্গকে বলে বারুণলিঙ্গ। ধ্বজচিহ্ন যুক্ত হলে (ঢেউখেলানো) সেই লিঙ্গের নাম বায়বীয় লিঙ্গ। যে লিঙ্গের মধ্যে গদাচিহ্ন অঙ্কিত দেখা যায় তার নাম কৌবের লিঙ্গ। যদি ত্রিশূল চিহ্ন অঙ্কিত থাকে তাহলে সেই লিঙ্গকে বলে ঈশানলিঙ্গ। এইভাবে দশদিকপাল থেকে দশরকম স্বয়ম্ভূলিঙ্গ প্রকাশিত হয়েছে।
            এছাড়াও বিভিন্ন দেবতার চিহ্নযুক্ত বহু ধরনের স্বয়ম্ভূলিঙ্গ আছে। তবে এখানে উল্লেখ করা বাহুল্য হবে না যে, প্রাকৃতিক ঘটনায় সৃষ্ট বস্তুপুঞ্জে ভক্তিবাদীর দৃষ্টিতে যতই অপ্রাকৃত ধারণা সঞ্জাত আধ্যাত্মিক ভাবনা থাকুক না কেন, গবেষকের দৃষ্টিভঙ্গিতে এর পেছনের যে বিজ্ঞানাশ্রিত ভক্তি-নিরপেক্ষ পুরাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণও থাকতে পারে এটি আমাদের ভুলে যাওয়া চলে না। তাই এক্ষেত্রে অশোক রায়ের মন্তব্যটি প্রাসঙ্গিক,– ‘সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক কারণে যে-কোনও ধরনের শিলাতে যদি সুলক্ষণ যুক্ত ও লিঙ্গাকৃতি দেখা যায়, তবে সেই শিলাকেই স্বয়ম্ভূলিঙ্গ বলে। বিভিন্ন ধরনের শিলার বর্ণও তাই বিভিন্ন। প্রকৃতির প্রকোপে (Weathering effect-এর ফলে) শিলাগাত্র মসৃণ না হওয়ারই কথা। তারপর তা নিত্যদিনের পূজা-অর্চনা ও অঙ্গমার্জনার ফলে ধীরে ধীরে মসৃণ হয়ে যায়। অনেক সময় আবার লিঙ্গের যে অংশে ভক্তের হাত বেশি পড়ে সেই অংশ অতি মসৃণ হয়ে যায়, বাকি অংশ থাকে অমসৃণ কর্কশ; ফলে লিঙ্গে একই সাথে রুদ্র ও শিবরূপ অনুভূত হয়। এ ছাড়াও প্রাকৃতিক শিলা সুনিপুণ লিঙ্গাকৃতি না হওয়াই স্বাভাবিক, ফলে তাতে নানা ধরনের চিহ্ন (আকৃতি অনুযায়ী) অনুভূত হয় এবং সেই লক্ষণ চিহ্ন অনুযায়ী স্বয়ম্ভূলিঙ্গের নামকরণ হয়ে থাকে। তাই ভক্তের চোখে ভগবান বিভিন্ন নামরূপে ধরা দেন।’- (বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-৩০৩)
স্বয়ম্ভূলিঙ্গের পর দ্বিতীয় প্রকার প্রাকৃতিক বা অকৃত্রিম লিঙ্গ দৈবলিঙ্গের লক্ষণ বর্ণনায় শাস্ত্রকার বলছেন–
করসংপুটসংস্পর্শং শূলটঙ্কেন্দুভূষিতম্ ।
রেখাকোটরসংযুক্তং নিম্নোন্নতসমন্বিতম্ ।।
দীর্ঘাকারঞ্চ যল্লিঙ্গং ব্রহ্মভাগাদিবর্জিতম্ ।
লিঙ্গং দৈবমিতি প্রোক্তং গোলকং প্রোচ্যতেহধুনা।।
অর্থাৎ : যে প্রাকৃতিক বা অকৃত্রিম লিঙ্গে করসংপুটের চিহ্ন (হাতের ছাপ-এর মতো দাগ) দেখা যায়, যাতে শূল টঙ্গনামক খড়্গ, চন্দ্রকলা চিহ্ন ও রেখাচিহ্ন থাকে এবং যা ছিদ্রবিশিষ্ট ও উন্নতান্নত (অমসৃণ) দীর্ঘাকৃতি এবং যদি লিঙ্গে গৌরীপট্ট না থাকে অর্থাৎ লিঙ্গে ব্রহ্মভাগ, বিষ্ণুভাগ ও রুদ্রভাগের পৃথক লক্ষণ দেখা না যায়, তাকে দৈবলিঙ্গ বলে।

              এখানে উল্লেখ্য, লিঙ্গের গৌরীপট্টের ওপরের দিককে বলে রুদ্রভাগ, এখানে রুদ্রের অবস্থান। গৌরীপট্ট অংশের নাম বিষ্ণুভাগ, এখানে বিষ্ণুর অবস্থান এবং গৌরীপট্টের নিচের অংশ হলো ব্রহ্মভাগ। যদি গৌরীপট্ট না থাকে, তাহলে এরূপ তিন অংশের বিভাগ সম্ভবপর হয় না। সুতরাং এই তিন ভাগ বিবর্জিত লক্ষণাক্রান্ত লিঙ্গকে দেবলিঙ্গ বলে। আর যেহেতু এটিও অকৃত্রিম প্রাকৃতিক লিঙ্গ, তাই পুরাতত্ত্বের দৃষ্টিতে ভাবলে, পাললিক শিলায় স্তরায়ণ চিহ্ন প্রায়শই প্রকটভাবে দেখা যায়। বিশেষত, যদি পলি অধঃক্ষেপণ মোটাদানার হয়। এই স্তরায়ণ চিহ্নই আসলে উপরে বর্ণিত লিঙ্গের রেখা চিহ্ন। এছাড়া মোটা দানার পলি অধঃক্ষেপের ফলে সৃষ্ট শিলা সর্বদাই অমসৃণ ও ছিদ্রযুক্তই হয়ে থাকে।
           এরপর শাস্ত্রকারের ভাষায় তৃতীয় প্রকার প্রাকৃতিক বা অকৃত্রিম গোললিঙ্গ বা গোলকলিঙ্গের লক্ষণ হিসেবে বলা হয়েছে–
কুষ্মাণ্ডস্য ফলাকারং নাগরঙ্গফলোপমম্ ।
কাকডিম্বফলাকারং গোললিঙ্গমিতীরিতম্ ।।
অর্থাৎ : যে প্রাকৃতিক বা অকৃত্রিম লিঙ্গের আকৃতি চালকুমড়ার মতো, অথবা নাগরঙ্গ (কমলালেবু) ফলের মতো কিংবা কাকের ডিমের মতো যার মাথার দিকটা (ফলক) তার নাম গোল লিঙ্গ।
             বেনারসের বিখ্যাত ‘তিল ভাণ্ডেশ্বর’ শিবলিঙ্গকে গোলকলিঙ্গের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর চতুর্থ প্রকার প্রাকৃতিক বা অকৃত্রিম আর্যলিঙ্গের লক্ষণে শাস্ত্রকার বলছেন–
নারিকেলফলাকারং ব্রহ্মসূত্রবিবর্ত্তনম্ ।
মূলে স্থূলশ্চ যল্লিঙ্গং কপিত্থফলসন্নিভম্ ।।
তালস্য বা ফলাকারং মধ্যে স্থূলঞ্চ যদ্ভবেৎ।
মধ্যে স্থূলং বরং লিঙ্গং ঋষিবাণমুদাহৃতম।।
অর্থাৎ : যে প্রাকৃতিক বা অকৃত্রিম লিঙ্গে ব্রহ্মসূত্র চিহ্ন বা যজ্ঞোপবীত লক্ষণ দেখা যায়, যার মূল ভাগ স্থূলকায় অর্থাৎ লিঙ্গের আকৃতি নারকেল-এর মতো, অথবা যার মধ্যভাগ স্থূল অথচ লিঙ্গটি কদবেল বা তালের মতো দেখতে তাকে বলে আর্যলিঙ্গ। এরূপ লিঙ্গ ঋষিবাণলিঙ্গ নামেও পরিচিত। এরমধ্যে মধ্যভাগ স্থূল লিঙ্গই শ্রেষ্ঠ।
            প্রসঙ্গক্রমে এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে,– ‘বিজারক পরিবেশে পলি অধঃক্ষেপণ হলে অক্সিজেনের অভাবে কোনও অক্সাইড যৌগ তৈরি করতে পারে না। তার বদলে তৈরি হয় সালফাইড যৌগ। সাধারণত এই ধরনের শিলার বর্ণ হয় কালো বা ধূম্রবর্ণ। কালো রং-এর কাদা পাথরে বা তা থেকে সৃষ্ট শেল পাথরে সাদা কোয়ার্টজ-এর স্তর প্রায়শই দেখা যায়। পাললিক শিলায় এই স্তরায়ণকে ‘কোয়ার্টজ ভেন’ বলে। এই কোয়ার্টজ ভেনই শিব লিঙ্গে সাদৃশ্যতাবশত হয়েছে যজ্ঞোপবীত বা ব্রহ্মসূত্র চিহ্ন।’– (অশোক রায়)
            পঞ্চম প্রকার প্রাকৃতিক বা অকৃত্রিম লিঙ্গ হলো মানসলিঙ্গ। মানসলিঙ্গকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়– রৌদ্রলিঙ্গ, শিবনাভিলিঙ্গ এবং বাণলিঙ্গ।
রৌদ্রলিঙ্গ প্রসঙ্গে ‘বীরমিত্রোদয়’ নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে–
নদীসমুদ্ভবং রৌদ্রমন্যোন্যস্য বিঘর্ষণাৎ।
নদীবেগাৎ সমং স্নিগ্ধং সজ্ঞাতং রৌদ্রমুচ্যতে।।
অর্থাৎ : নদীর গতিবেগে গড়িয়ে চলা নুড়িগুলো পরস্পর ঘষা খেতে খেতে পাথর যদি সমতল ও মসৃণ হয়ে লিঙ্গরূপ ধারণ করে তাহলে সেই লিঙ্গকেই রৌদ্রলিঙ্গ বলে।
এ প্রসঙ্গে শাস্ত্রকার বলেন–
সরিৎপ্রবাহসংস্থানং বাণলিঙ্গসমাকৃতি।
তদন্যদপি বোদ্ধব্যং রৌদ্রলিঙ্গং সুখাবহম্ ।।
নদীসারনর্মদায়াং বাণলিঙ্গসমাকৃতি।
তদন্যদপি বোদ্ধব্যং লিঙ্গং রৌদ্রং ভবিষ্যতি।।
রৌদ্রলিঙ্গং তথা খ্যাতং বাণলিঙ্গসমাকৃতি।
শ্বেতং রক্তং তথা পীতং কৃষ্ণং বিপ্রাদিপূজিতম্ ।।
স্বভাবাৎ কৃষ্ণবর্ণং বা সর্বজাতিষু সিদ্ধিদম্ ।
নর্মদাসম্ভবং রৌদ্রং বাণলিঙ্গবদীরিতম্ ।।
অর্থাৎ : নদীপ্রবাহ থেকে যে লিঙ্গের উদ্ভব, যা বাণলিঙ্গাকৃতি তাকেই বলে রৌদ্রলিঙ্গ। নর্মদা নদীর স্রোত থেকে উৎপন্ন অথচ বাণলিঙ্গের মতো আকৃতি বিশিষ্ট লিঙ্গকেও রৌদ্রলিঙ্গ বলে। রৌদ্রলিঙ্গ চার প্রকার হয়ে থাকে– শ্বেত, রক্ত, পীত এবং কৃষ্ণ। ব্রাহ্মণেরা শ্বেতবর্ণ, ক্ষত্রিয়েরা রক্তবর্ণ, বৈশ্যেরা পীতবর্ণ এবং শূদ্রেরা কৃষ্ণবর্ণ লিঙ্গের পূজা করলে সর্বসিদ্ধি লাভ হয়। কৃষ্ণবর্ণের লিঙ্গে সব জাতির পক্ষেই পূজিত ও শুভ। নর্মদা নদীতে জাত রৌদ্রলিঙ্গ বাণলিঙ্গের মতোই ফলদায়ক।
          বীরমিত্রোদয় অনুসারে যে প্রাকৃতিক বা অকৃত্রিম লিঙ্গে রমণীয় বেদিকা দেখা যায়, মহর্ষিগণ তাকে শিবনাভিলিঙ্গ বলেন। এ প্রসঙ্গে শাস্ত্রকার বলেন–
উত্তমং মধ্যমধমং ত্রিবিধং লিঙ্গমীরিতম্ ।
চতুরঙ্গুলমুৎসেধে রম্যবেদিকমুত্তমম্ ।
উত্তমং লিঙ্গমাখ্যাতং মুনিভিঃ শাস্ত্রকোবিদৈঃ।।
তদর্দ্ধং মধ্যমং প্রোক্তং তদর্ধমধমং স্মৃতম্ ।
শিবনাভিময়ং লিঙ্গং প্রতিপূজ্য মহর্ষিভিঃ।
শ্রেষ্ঠং সর্বলিঙ্গেভ্যস্তস্মাৎ পূজ্যং বিধানতঃ।।
অর্থাৎ : শিবনাভিলিঙ্গ উত্তম, মধ্যম ও অধম ভেদে তিন প্রকার। চার আঙুল উচ্চতাযুক্ত এবং সুন্দর বেদি সমন্বিত লিঙ্গ হলো উত্তম শিবনাভিলিঙ্গ। তার অর্ধেক অর্থাৎ দু-আঙুল উচ্চতাযুক্ত এরূপ লিঙ্গ মধ্যম প্রকৃতির এবং এর অর্ধেক পরিমাণ অর্থাৎ এক আঙুল উচ্চতাযুক্ত লিঙ্গ হলো অধম প্রকৃতির শিবনাভিলিঙ্গ। অপরাপর অন্যান্য লিঙ্গ অপেক্ষা শিবনাভিলিঙ্গ শ্রেষ্ঠ বলে মহর্ষিরা মনে করেন। সকলেরই যথাবিধানে এই লিঙ্গে পূজা করা কর্তব্য।

              অন্যান্য লিঙ্গের তুলনায় শাস্ত্রে বাণলিঙ্গের প্রশংসাই অধিক পাওয়া যায়। মেরুতন্ত্র-এ নর্মদা নদীর স্রোতমধ্যস্থিত সচল স্বয়ম্ভূলিঙ্গকে বাণলিঙ্গ বলা হয়েছে। এই বাণলিঙ্গে সর্বদা সদাশিবের অধিষ্ঠান। অন্ন-জল বা যে-কোনও বস্তু বাণলিঙ্গে অর্পিত হলে তা-ই প্রসাদরূপে গ্রহণ করা যায়। বলা হয় যে, রুদ্রাক্ষ ও শিবলিঙ্গ যত স্থূল হয় ততই প্রশস্ত, কিন্তু শালগ্রাম শিলা ও বাণলিঙ্গ যত সূক্ষ্ম হবে ততই উৎকৃষ্ট। বাণলিঙ্গের নামকরণ সম্পর্কে শাস্ত্রে দুই রকম মতবাদ পাওয়া যায়–
বাণার্চ্চার্থং কৃতং লিঙ্গং বাণলিঙ্গমতঃ স্মৃতম্ ।
বাণো বা শিব ইত্যুক্তস্তৎকৃতং বাণমুচ্যতে।।
অর্থাৎ : বাণাসুর শিবপূজার জন্য যে লিঙ্গসমূহ নির্মাণ করেছিলেন সেগুলির নাম হয়েছিল বাণলিঙ্গ। এই মতানুসারে বাণাসুরের দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ হলো বাণলিঙ্গ। আরেকটি মতে বলা হয়েছে যে, বাণ শব্দের অর্থ হলো শিব। এই শিব বা বাণের দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ হলো বাণলিঙ্গ।
      একইভাবে বীরমিত্রোদয়-এও বলা হয়েছে–
বাণঃ সদাশিবো দেবো বাণো বাণান্তরোহপি চ।
তেন যস্মাৎ কৃতং তস্মাদ্বানলিঙ্গমুদাহৃতম্ ।। (বীরমিত্রোদয়)
অর্থাৎ : স্বয়ং সদাশিবের নাম বাণ। বাণ শব্দে বাণ রাজাও বুঝায়। সেই বাণ রাজা কর্তৃক স্থাপিত হওয়াতে, বাণ-লিঙ্গ বলিয়া খ্যাতি হইয়াছে।
             বাণলিঙ্গের উৎপত্তি সম্পর্কে শাস্ত্রে একটি আখ্যায়িকা পাওয়া যায়। লিঙ্গপুরাণ গ্রন্থের ভূমিকায় কৃত ড.উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বর্ণনা অনুসারে– পুরাকালে সর্বপ্রকার ক্রোধ জয়কারী ও শিবপূজায় রত মহাদেবের এক প্রিয় ভক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত নিপুণ এক শিল্পী। প্রত্যেকদিন স্বহস্তে তিনি শিবলিঙ্গ প্রস্তুত করে ও পূজা করে তা প্রতিষ্ঠা করতেন। এইভাবে প্রত্যহ শিবপ্রতিষ্ঠার দ্বারা দিব্য শত বৎসর কেটে গেল। তার একান্ত ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান শঙ্কর তাঁর কাছে আবির্ভূত হয়ে বললেনঃ ‘হে বাণ! তোমার ওপর আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছি। তুমি কী বর প্রার্থনা কর তা জানাও। আমি এক্ষুনি তোমাকে সেই বর দেব’। বাণ শিবের কথায় তুষ্ট হয়ে তাঁকে প্রণাম করে বল্লেন– ‘হে ভগবান্! শাস্ত্রমতে শুভ লক্ষণযুক্ত শিবলিঙ্গ নির্মাণ করতে আমার প্রত্যেকদিন খুব কষ্ট হয়। অতএব আপনি সন্তুষ্ট হয়ে শুভলক্ষণ যুক্ত কিছু লিঙ্গ আমাকে দিন। ঐসব লিঙ্গের অর্চনার দ্বারা যেন আমার সমস্ত অভিলাষ পূর্ণ হয় এবং আমি কৃতার্থ হই।’ জগৎকারণস্বরূপ মহাদেব বাণের এরূপ প্রার্থনা শ্রবণের পর কৈলাশ পর্বতের শিখরে গিয়ে চোদ্দ কোটি শিবলিঙ্গ প্রস্তুত করলেন। এই প্রত্যেকটি লিঙ্গই সিদ্ধলিঙ্গ এবং এদের পূজা করলে প্রতিটি মানুষেরই উন্নতি লাভ হয়। তারপর মহাদেব সেই লিঙ্গগুলি এনে বাণকে দান করলেন। বাণ তখন থেকে আর লিঙ্গ প্রস্তুত করতেন না। শিবপ্রদ ঐ লিঙ্গগুলির থেকেই প্রত্যেকদিন এক একটি লিঙ্গকে প্রতিষ্ঠা করতেন এবং পূজা করতেন। নিজের রাজধানীতে এই বিশালসংখ্যক লিঙ্গকে নিয়ে গিয়ে চিন্তা করলেন যে মানবদের সিদ্ধির জন্য মহাবেগযুক্ত নদীর মধ্যে এই লিঙ্গগুলিকে রক্ষা করা উচিত। এরূপ চিন্তা করে বিভিন্ন পবিত্রস্থানে তিনি লিঙ্গগুলিকে রেখে এলেন। শিবপ্রদত্ত এই বাণলিঙ্গগুলি যেখানে যেখানে রেখে আসা হয়েছিল সেই সেই স্থলেই বাণলিঙ্গ পাওয়া যায়। বাণ কোন্ কোন্ স্থানে কত পরিমাণ লিঙ্গ স্থাপন করেছিলেন তার একটি বিবরণ শাস্ত্রকারেরা লিপিবদ্ধ করেছেন–
লিঙ্গানাং কালিকাগর্তে সঞ্চিতাস্তু ত্রিকোটিকঃ।
শ্রী শৈলে কোটয়স্তিস্রঃ কোটোকো কন্যকাশ্রমে।।
মাহেশ্বরে চ কোট্যস্তু কন্যাতীর্থে তু কোটিকা।
মহেন্দ্রে চৈব নেপালে একৈকা কোটিরেব চ।।
অর্থাৎ : তিন কোটি লিঙ্গ কালিকাগর্তে, তিন কোটি শ্রীশৈলে, এক কোটি কন্যকাশ্রমে, এক কোটি মাহেশ্বরক্ষেত্রে, এক কোটি কন্যাতীর্থে, এক কোটি মহেন্দ্রাচলে, এক কোটি নেপালে এবং অন্যান্য স্থানে অবশিষ্ট গুলিকে রক্ষা করলেন। নদীর স্রোতে ভেসে আসা বা পর্বতে কুড়িয়ে পাওয়া এইসব লিঙ্গকেই বাণলিঙ্গ জ্ঞানে সাধকেরা পূজা করে থাকেন।

              কেবলমাত্র প্রস্তর নির্মিত লিঙ্গেই যে শিবপূজা হয় তা নয়, মাটির দ্বারা শিবলিঙ্গ নির্মাণ করে তার উপরেও শিব পূজার বিধান শাস্ত্রে পরিলক্ষিত হয়। মাটির দ্বারা নির্মিত লিঙ্গকে বলে পার্থিব লিঙ্গ। বিভিন্ন কামনায় বিভিন্ন প্রকার পার্থিব লিঙ্গের পূজা বিধি আছে। এই প্রকার লিঙ্গ নির্মাণ, তার পরিমাপ, লিঙ্গ গঠনকালে মাথার উপর বজ্রস্থাপন এবং পূজার সময় বজ্রমোচন ইত্যাদির বিধিবিধান ও মন্ত্র বাংলাদেশের পঞ্চোপাসক ব্রাহ্মণগণ বিশেষভাবে অবহিত। পার্থিব শিবলিঙ্গ পূজা করলেও তাকে বাণলিঙ্গ রূপেই পূজা করা হয়ে থাকে।
বলা হয়, কোমল বস্তু দিয়ে নির্মিত লিঙ্গের মধ্যে পার্থিব লিঙ্গই শ্রেষ্ঠ। আর কঠিন বস্তু দিয়ে নির্মিত লিঙ্গের মধ্যে পাষাণ-নির্মিত লিঙ্গই শ্রেষ্ঠ। অন্যান্য দামী প্রস্তর বা ধাতুর দ্বারাও লিঙ্গ নির্মিত হতো। এদের মধ্যে ক্রমিক উৎকর্ষের কথা আলোচনা করতে গিয়ে মেরুতন্ত্রে এরূপ ক্রমোৎকর্ষের যে তালিকা পাওয়া যায়, সেখানে বস্তুত বাণলিঙ্গের মাহাত্ম্যই বর্ণিত হয়েছে। যেমন, বলা হয়েছে–
কোমলেষু তু লিঙ্গেষু পার্থিবং শ্রেষ্ঠমুচ্যতে।
কঠিনেষু তু পাষাণং পাষাণাৎ স্ফটিকং পরম্ ।।
স্ফাটিকাৎ পুষ্পরাগোত্মমিন্দ্রনীলোদ্ভবং ততঃ।
ইন্দ্রনীলাচ্চ গোমেদং গোমেদাৎবিদ্রুমোদ্ভবম্ ।।
বিদ্রুমান্মৌক্তিকং শ্রেষ্ঠং হৈরণ্যাদ্ধীরকং বরম্ ।
হীরকাৎ পারদং শ্রেষ্ঠং বাণলিঙ্গং ততঃ পরম্ ।।
সংস্থাপ্য বাণলিঙ্গং রত্নকোটিগুণং ভবেৎ।
রসলিঙ্গে ততঃ বাণাৎ ফলং কোটিগুণং স্মৃতম্ ।।
অর্থাৎ : কোমল পদার্থের দ্বারা যত লিঙ্গ প্রস্তুত করা হয় তার মধ্যে পার্থিব লিঙ্গই সর্বশ্রেষ্ঠ, আর কঠিন বস্তু দিয়ে নির্মিত লিঙ্গের মধ্যে প্রস্তর নির্মিত লিঙ্গ শ্রেষ্ঠ। প্রস্তর নির্মিত লিঙ্গের থেকেও স্ফটিক নির্মিত লিঙ্গ শ্রেষ্ঠ, আবার স্ফটিকলিঙ্গের থেকেও শ্রেষ্ঠ হলো পদ্মরাগমণি নির্মিত লিঙ্গ। পদ্মরাগনির্মিত লিঙ্গের চেয়েও কাশ্মীর লিঙ্গ, তার থেকেও পুষ্পরাগনির্মিত লিঙ্গ, তার চেয়ে ইন্দ্রনীলমণি গঠিত লিঙ্গ, তার চেয়ে গোমেদ নির্মিত লিঙ্গ, তার চেয়ে হীরক লিঙ্গ, তার চেয়ে স্বর্ণনির্মিত লিঙ্গ, তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ পারদনির্মিত লিঙ্গ এবং পারদ লিঙ্গের (শাস্ত্রে পারদকে রুদ্রের বীর্য বলে) থেকেও বাণলিঙ্গ সর্বশ্রেষ্ঠ। এককোটি রত্নলিঙ্গ পূজা করলে যে ফল পাওয়া যায় একটিমাত্র বাণলিঙ্গ পূজার দ্বারা সেই ফল পাওয়া যায়। কোটি বাণলিঙ্গ পূজার ফল একটি পারদ লিঙ্গের পূজাতে লাভ হয়।

             উল্লেখ্য, এই শ্লোকে একবার বাণলিঙ্গ পারদলিঙ্গের থেকে শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে, আবার পরক্ষণেই বলা হয়েছে একটি পারদলিঙ্গ পূজার দ্বারা কোটি বাণলিঙ্গের পূজার ফল লাভ হয়। পণ্ডিতেরা বলেন, এতে কোন বিরোধ নেই। কেননা তাদের মতে, এখানে বলতে চাওয়া হয়েছে যে কৃত্রিম পারদলিঙ্গের তুলনায় অকৃত্রিম বাণলিঙ্গ শ্রেষ্ঠ। আবার পারদ যেহেতু শিববীর্য তাই পারদলিঙ্গ কৃত্রিম বাণলিঙ্গের থেকেও শ্রেষ্ঠ একথা বলতে চাওয়া হয়েছে।
বাণলিঙ্গের মাহাত্ম্য এখানেই শেষ নয়। বীরমিত্রোদয়ধৃত-কালোত্তর অনুযায়ী– ‘বাণলিঙ্গের লক্ষণ বিষয়ে প্রাচীন স্মৃতিগ্রন্থে আছে যে, নর্মদা, গঙ্গা, যমুনা ও অন্যান্য পুণ্যৎ নদীর উৎপত্তিস্থলে বাণলিঙ্গ স্থাপিত আছে। সর্বার্থদায়ক সদাশিব সর্বদা সেইসব বাণলিঙ্গে অধিষ্ঠান করেন। ইন্দ্রাদি দেবগণ যে যে বাণলিঙ্গের পূজা করেছেন, সেই সেই লিঙ্গে সেই সেই দেবতার চিহ্ন সমুদয় প্রকটিত আছে। কথিত আছে যে, বাণলিঙ্গ পূজা করলে ভোগ ও মোক্ষ লাভ হয়। বাণলিঙ্গে গৌরীপট্ট যোগ করলেও চলে, আবার না করলেও চলে কারণ, বাণলিঙ্গে শিবের সাথে শক্তির নিরন্তর অবস্থান। স্বভাবতই গৌরীপট্ট বাণলিঙ্গে অন্তর্নিবিষ্ট আছেন। আবার বাণলিঙ্গের অভিষেক সংস্কার, আবাহন, প্রতিষ্ঠা ও বিসর্জন নেই কারণ, বাণাসুর বা অন্যান্য দেবগণ নিজ নিজ পূজিত বাণলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেই রেখেছেন। আবার তারা যে সমস্ত বাণলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাতে কোনওরকম স্পর্শ দোষও হয় না।’ (অশোক রায়)
            বাণাসুর ও অন্যান্য দেবতারা যে যে লিঙ্গ অর্চনা করেছেন, সেই সেই লিঙ্গ তাঁদের নিজ নিজ লাঞ্ছন চিহ্নে চিহ্নান্বিত হয়ে নামরূপলক্ষণে বাণলিঙ্গের বিভিন্ন প্রকারভেদ স্বরূপ মানুষের কাছে পূজ্য হয়েছে। এগুলি বস্তুত অস্বয়ম্ভূলিঙ্গ। শাস্ত্রকারের ভাষায় সেই সেই লিঙ্গ পূজনের বিশেষ ফলশ্রুতির কথাও বলা হয়েছে। যেমন–
বজ্রাদিচিহ্নতং লিঙ্গং ইন্দ্রলিঙ্গং প্রকীর্ত্তিতম্ ।
সাম্রাজ্যদায়কং তদ্ধি মনোহভীষ্টপ্রদায়কম্ ।। ১
বারুণং বর্ত্তুলাকারং পাশাঙ্কং চালিবর্চসম্ ।
বৃদ্ধিঃ সুখাদের্বৈ সত্ত্বসৌভাগ্যাদিস্তু লভ্যতে।। ২
শালগ্রামাদিসংস্থন্তু শশাঙ্কং শ্রীবিবর্দ্ধনম্ ।
পদ্মাঙ্কং স্বস্তিকাঙ্কং বা শ্রীবৎসাঙ্কং বিভূতয়ে।। ৩
বৈষ্ণবং শঙ্গচক্রাঙ্গগদাজাদিবিভূষিতম্ ।
শ্রীবৎসকৌস্তুভাঙ্কঞ্চ সর্বসিংহাসনাঙ্কিতম্ ।।
বৈনতেয়সমাঙ্কং বা তথা বিষ্ণুপদাঙ্কিতম্ ।
বৈষ্ণবং নাম তৎ প্রোক্তং সর্বৈশ্বর্য্যফলপ্রদম্ ।। ৪
আরুণং হিত্যকীলালমুষ্ণস্পর্শং করোত্যলম্ ।। ৫
আগ্নেয়ং তচ্ছক্তিনিভমথবা শক্তিলাঞ্ছিতম্ ।
ইদং লিঙ্গবরং স্থাপ্য তেজসোহধিপতির্ভবেৎ।। ৬
কৃষ্ণং ধূমং ন বা রুচ্যং ধ্বজাভং ধ্বজমুষলম্ ।
মস্তকে স্থাপিতং যস্য বায়ুলিঙ্গং প্রকীর্ত্তিতম্ ।। ৭
তূণপাশগদাকারং গুহ্য কেশস্য মধ্যগম্ ।
অস্থিশূলাঙ্কিতং রৌদ্রং হিমমন্ডলবর্চসম্ ।। ৮
অর্থাৎ : বজ্রাদি চিহ্নে চিহ্নিত বাণলিঙ্গকে ইন্দ্রলিঙ্গ বলে এবং এই লিঙ্গ পূজনে সাধক সাম্রাজ্য লাভ করে এবং তার মনোবাসনা সিদ্ধ হয়। ১।। যে বাণলিঙ্গ গোলাকৃতি পাশচিহ্নযুক্ত এবং ভ্রমরের মতো কালো তাকে বারুণলিঙ্গ বলে এবং এই লিঙ্গ পূজনে সত্ত্বগুণ ও সুখসৌভাগ্যাদি বৃদ্ধি হয়। ২।। শালগ্রামশিলাতে যেরূপ চক্রচিহ্ন থাকে সেরূপ চিহ্ন এবং শশাঙ্ক চিহ্ন থাকলে সেই লিঙ্গকে বলে বৈষ্ণব লিঙ্গ। এরূপ লিঙ্গ পূজার দ্বারা শ্রীবৃদ্ধি হয়। বৈষ্ণবলিঙ্গে যদি পদ্ম, স্বস্তিক ইত্যাদি চিহ্ন অঙ্কিত থাকে তাহলে তার পূজার দ্বারা বিভূতি লাভ হয়। ৩।। বাণলিঙ্গে যদি শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম, শ্রীবৎস, কৌস্তুভ, সিংহাসন, গরুড়, বিষ্ণুপদ ইত্যাদি চিহ্ন থাকে, তাহলে সেই লিঙ্গকেও বৈষ্ণবলিঙ্গ বলে এবং এরূপ লিঙ্গ পূজার দ্বারা সাধক সর্বপ্রকার ঐশ্বর্য্য প্রাপ্ত হন। ৪।। জলের মতো স্বচ্ছ এবং উষ্ণস্পর্শ হলে সেই লিঙ্গকে আরুণলিঙ্গ নামে অভিহিত করা হয়। আরুণলিঙ্গও সাধকের মঙ্গল সাধন করে। ৫।। শক্তি চিহ্ন লিঙ্গের মধ্যে বিদ্যমান থাকলে এবং আগুনের মতো তেজসম্পন্ন হলে সেই লিঙ্গকে বলে আগ্নেয়লিঙ্গ। এরূপ শিবলিঙ্গের পূজার দ্বারা তেজের অধীশ্বর হওয়া যায়। ৬।। যে লিঙ্গ কৃষ্ণ বা ধূম্রবর্ণ, নির্মল নয় বরং ধ্বজাসদৃশ (ঢেউ খেলানো) এবং যার মস্তকে ধ্বজ ও মুষলচিহ্ন থাকে সেরূপ অসমতল লিঙ্গ বায়ুলিঙ্গ নামে খ্যাত। ৭।। যে লিঙ্গের মাঝখানে তূণ, পাশ বা গদার চিহ্ন থাকে তাকে বলে কুবেরলিঙ্গ। যদি লিঙ্গগাত্রে অস্থি বা শূলচিহ্ন বর্তমান থাকে এবং লিঙ্গের বর্ণ হিমমণ্ডলের (সাদা বরফের) মতো হয়, তাহলে সেই লিঙ্গকে রৌদ্রলিঙ্গ বলে। ৮।।
             এছাড়াও হেমাদ্রিধৃত লক্ষণ কাণ্ডে– দেবর্ষি নারদ পূজিত একাদশ রুদ্র বাণলিঙ্গের প্রধান প্রধান লক্ষণ-চিহ্নের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। তার মধ্যে নয় প্রকার চিহ্ন-লক্ষণের বর্ণনা নিম্নরূপ, যেমন–
মধুপিঙ্গলবর্ণাভং কৃষ্ণকুন্ডলিকাযুতম্ ।
স্বয়ংভূলিঙ্গমাখ্যাতং সর্বসিদ্ধৈর্নিষেবিতম্ ।। ১
নানা বর্ণ সমাকীণং জটাশূলসমন্বিতম্ ।
মৃত্যুঞ্জয়াহ্বয়ং লিঙ্গং সুরাসুরনমস্কৃতম্ ।। ২
দীর্ঘাকারং শুভ্রবর্ণং কৃষ্ণবিন্দুসমন্বিতম্ ।
নীলকণ্ঠং সমাখ্যাতং লিঙ্গং পূজ্যং সুরাসুরৈঃ।। ৩
শুক্লাভং শুক্লকেশঞ্চ নেত্রত্রয়সমন্বিতম্ ।
ত্রিলোচনং মহাদেবং সর্বপাপপ্রণোদনম্ ।। ৪
জ্বলল্লিঙ্গং জটাজুটং কৃষ্ণাভং স্থূলবিগ্রহম্ ।
কালাগ্নিরুদ্রমাখ্যাতং সর্বসর্বত্ত্বৈর্নিষেবিতম্ ।। ৫
মধুপিঙ্গলবর্ণাভং শ্বেতযজ্ঞোপবীতকম্ ।
শ্বেতপদ্মসমাসীনং চন্দ্ররেখাবিভূষিতম্ ।
প্রলয়াস্ত্রসমাযুক্তং ত্রিপুরারিসমাহ্বয়ম্ ।। ৬
শুভ্রাভং পিঙ্গলজটং মুণ্ডমালাধরং পরম্ ।
ত্রিশূলধরমীশানং লিঙ্গং সর্বার্থসাধনম্ ।। ৭
ত্রিশূলডমরুধরং শুভ্ররক্তার্দ্ধভাগতঃ।
অর্দ্ধনারীশ্বরাহ্বানং সর্বদেবৈরভীষ্টদম্ ।। ৮
ঈষদ্রক্তময়ং কান্তং স্থূলং দীর্ঘং সমুজ্জ্বলম্ ।
মহাকালং সমাখ্যাতং ধর্মকামার্থমোক্ষদম্ ।। ৯
এতত্তু কথিতং তুভ্যং লিঙ্গচিহ্নং মহেশি তু।
একেনৈব কৃতার্থঃ স্যাৎ বহুভিঃ কিমু সুব্রতে।। ১০
অর্থাৎ : নারদের মতে– যে বাণলিঙ্গ মধুর মতো পিঙ্গলবর্ণ এবং যাতে কৃষ্ণবর্ণ কুণ্ডলিনী বিদ্যমান তাকে বলে স্বয়ম্ভূলিঙ্গ। সিদ্ধযোগীরা এই প্রকার লিঙ্গের পূজা করে থাকেন। ১।। নানা বর্ণযুক্ত যে লিঙ্গে জটা ও শূলচিহ্ন বর্তমান থাকে, তাকে বলে মৃত্যুঞ্জয়লিঙ্গ। সমস্ত সুরাসুরই এই লিঙ্গকে নমস্কার করে। ২।। কৃষ্ণবিন্দু যুক্ত দীর্ঘাকৃতি ও শুভ্রবর্ণ বাণলিঙ্গকে নীলকণ্ঠলিঙ্গ বলে। এই লিঙ্গ সুর ও অসুর সকলেরই পূজ্য। ৩।। ত্রিনেত্রচিহ্ন শোভিত শুক্লবর্ণ, শুক্লাভাযুক্ত ও শুক্ল কেশরচিহ্ন সমন্বিত বাণলিঙ্গকে বলে ত্রিলোচনলিঙ্গ। এর পূজা করলে সর্বপাপ বিনষ্ট হয়। ৪।। স্থূল, অগ্নির মতো উজ্জ্বল অথচ কৃষ্ণবর্ণ আভাযুক্ত এবং জটাজুটচিহ্ন বর্তমান থাকলে, সেই লিঙ্গকে বলে কালাগ্নিরুদ্রলিঙ্গ। এরূপ লিঙ্গ সর্বজীবের পূজ্য। ৫।। যে বাণলিঙ্গ মধুর মতো পিঙ্গল আভাযুক্ত, শ্বেত যজ্ঞোপবীত চিহ্ন শোভিত এবং শ্বেতপদ্মের উপর অধিষ্ঠিত চিহ্নযুক্ত ছাড়াও শোভন চন্দ্ররেখা ও প্রলয়ান্ত্র চিহ্ন দৃষ্ট হলে, সে লিঙ্গকে ত্রিপুরারিলিঙ্গ বলে। ৬।। যে বাণলিঙ্গ শুভ্রবর্ণ পিঙ্গল জটাজুট যুক্ত এবং ত্রিশূল ও মুণ্ডমালা চিহ্ন শোভিত, তাকে বলে ঈশানলিঙ্গ। এই লিঙ্গ পূজনে সমস্ত অভিপ্রায় সিদ্ধ হয়। ৭।। ত্রিশূল ও ডমরুচিহ্ন শোভিত যে বাণলিঙ্গের অর্ধাংশ শুভ্রবর্ণ ও অর্ধাংশ রক্তবর্ণ, তাকে অর্ধনারীশ্বরলিঙ্গ বলে। এরূপ বাণলিঙ্গ সর্বদেবপূজ্য এবং ঈপ্সিতফলপ্রদ। ৮।। ঈষৎ লোহিতবর্ণ, স্থূল, দীর্ঘ, সুদৃশ্য ও উজ্জ্বল হলে সেই বাণলিঙ্গকে বলে মহাকাললিঙ্গ। এই লিঙ্গের পূজার দ্বারা ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ এই পুরুষার্থ চতুষ্টয় লাভ হয়। ৯।। বাণলিঙ্গের যেসব চিহ্নের কথা বলা হলো তার সবগুলোই একটি লিঙ্গে থাকবে এমন কথা নেই, তবে এসব চিহ্নের একটি মাত্র চিহ্ন থাকলেও তা বাঞ্ছিতসিদ্ধি দান করে। ১০।।

            নর্মদা নদীর জলে প্রাপ্ত যে সমস্ত বাণলিঙ্গ দেখা যায় সেই সব অকৃত্রিম বাণলিঙ্গ বিভিন্ন প্রকার রঙের হয়ে থাকে। তবে প্রত্যেক প্রকার লিঙ্গ প্রত্যেকের পূজ্য নয়। শাস্ত্রানুসারে বিশেষ বর্ণের লিঙ্গ বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির পূজ্য। যেমন–
অর্থদং কপিলং লিঙ্গং ঘনাভং মোক্ষকাক্সিক্ষণাম্ ।
লঘু বা কপিলং স্থূলং গৃহী নৈবার্চয়েৎ ক্বচিৎ।
পূজিতব্যং গৃহস্থেন বর্ণেন ভ্রমরোপমম্ ।।
অর্থাৎ : কপিলবর্ণের বাণলিঙ্গ পূজা করলে অর্থ লাভ হয়। তবে মোক্ষার্থীরা মেঘের মত বর্ণের লিঙ্গ পূজা করবেন। কিন্তু যে লিঙ্গ অতি লঘু বা অতি স্থূল অথচ কপিল বর্ণ (হলদে বা মেটে হলদে) তার পূজা গৃহীর পক্ষে কর্তব্য নয়। ভ্রমরের মতো কৃষ্ণবর্ণ লিঙ্গ (অতি লঘু বা অতি স্থূল হলেও) গৃহস্থের পূজা করা কর্তব্য।
           অকৃত্রিম বাণলিঙ্গগুলি যদিও একই নর্মদা নদীর জলে একইভাবে সৃষ্ট, তবুও শাস্ত্রে কিছু লক্ষণযুক্ত বিশেষ বিশেষ আকৃতির বাণলিঙ্গকে পূজা করতে নিষেধ করা হয়েছে। এইসব অপূজ্য এক এক ধরনের লিঙ্গ পূজার দ্বারা এক এক প্রকারের অমঙ্গল লাভ ঘটে। এইসব অনিষ্টকর লক্ষণযুক্ত অপূজ্য বাণলিঙ্গকে অনিষ্টকর লিঙ্গ বা ত্যাজ্য বাণলিঙ্গ বলে। কিরূপ লিঙ্গের পূজায় কিরূপ অমঙ্গল ঘটে তা শাস্ত্রকারেরা একত্র নিবন্ধ করেছেন। যেমন–
কর্কশে বাণলিঙ্গে চু পুত্রদারক্ষয়ো ভবেৎ।
চিপিটে পূজিতে তস্মিন্ গৃহভঙ্গো ভবেৎধ্রুবম্ ।।
একপার্শ্বস্থিতে ধেনুপুত্রদারধনক্ষয়ঃ।
শিরসি স্ফুটিতে বাণে ব্যাধিমরণমেব চ।।
ছিদ্রলিঙ্গেহর্চ্চিতে বাণে বিদেশগমনং ভবেৎ।
লিঙ্গে চ কর্ণিকাং দৃষ্ট্বা ব্যাধিমান্ জায়তে পুমান্ ।
অত্যুন্নতি বিলাগ্রে তু গোধনানাং ক্ষয়ো ভবেৎ।।
তীক্ষ্ণাগ্রং বক্রশীর্ষঞ্চ ত্র্যস্রলিঙ্গং বিবর্জয়েৎ।
অতিস্থূলং চাতিকৃশং স্বল্পং বা ভূষণান্বিতম্ ।
গৃহী বিবর্জয়েত্তাদৃক্ তদ্ধি মোক্ষার্থিনো হিতম্ ।।
অর্থাৎ : কর্কশ বাণলিঙ্গের পূজা করলে স্ত্রীপুত্র ক্ষয় হয় এবং চিপিট (চ্যাপ্টা) লিঙ্গের পূজার দ্বারা গৃহভঙ্গ হয়। একপাশমাত্র আছে (একপার্শ্বাস্থিত) এরূপ লিঙ্গের পূজা করলে সেই পূজকের স্ত্রী, পুত্র, গাভী, ধন ইত্যাদি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। মাথাভাঙা (শিরসি স্ফুটিত) বাণলিঙ্গের পূজা করলে ব্যাধি ও মৃত্যুলাভ ঘটে। ছিদ্রযুক্ত লিঙ্গের পূজা করলে বিদেশ গমন ঘটে। যে লিঙ্গের মস্তকে পদ্মকোষের মতো কর্ণিকা থাকে তার পূজা করলে পীড়া হয়। যে লিঙ্গের ছিদ্রের পাশটা অত্যন্ত উঁচু তার অর্চনা করলে গোধন ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। যে বাণলিঙ্গের অগ্রভাগ তীক্ষ্ণ অথবা বক্র বা যে লিঙ্গ ত্রিকোণাকৃতি তার পূজা করতে নেই। যে বাণলিঙ্গ অত্যন্ত স্থূল, অত্যন্ত কৃশ বা অতি খর্ব তা সুলক্ষণ চিহ্নান্বিত হলেও গৃহীর পক্ষে সেরূপ লিঙ্গ পূজ্য নয়। তবে ওইসব লিঙ্গ পূজা মোক্ষকামীর পক্ষেই হিতকর।
এছাড়াও শাস্ত্রকারের ভাষায়–
দণ্ডাকারং ভবেদ্যাম্যমথবা রসনাকৃতি।
নিশ্চিতং নিধনস্তেন ক্রিয়তে স্থাপিতেন তু।। ১
রাক্ষসং খড়্গসদৃশং জ্ঞানযোগফলপ্রদম্ ।
কর্করাদিপ্রলিপ্তস্তু কুণ্ঠকুক্ষিযুতং তথা।
রাক্ষসং; নৈর্ঋতের্লিঙ্গং গার্হস্থে ন সুখপ্রদম্ ।। ২
অর্থাৎ : শিবলিঙ্গ যদি লাঠির মতো লম্বা হয় বা জিহ্বার মতো লম্বা হয় তাকে বলে যাম্যলিঙ্গ। এরূপ লিঙ্গকে পূজা করতে নেই। এধরনের লিঙ্গ স্থাপন করলে বা পূজা করলে সাধকের নিশ্চিত মৃত্যু হয়। ১।। খড়গের মতো আকৃতি বিশিষ্ট লিঙ্গকে বলে রাক্ষস লিঙ্গ। এরূপ লিঙ্গের পূজা করলে মোক্ষলাভ হয়। তবে রাক্ষস লিঙ্গের গা যদি কাঁকরের মতো কর্কশ হয় এবং মাঝখানটা চ্যাপা থাকে, তাহলে সেই লিঙ্গকে নৈর্ঋতলিঙ্গ বলে। এই লিঙ্গের পূজোর দ্বারা অলক্ষ্মী লাভ হয়। সেই কারণে গৃহস্থের পক্ষে এরূপ লিঙ্গ পূজা করা উচিত নয়। ২।।

            এতক্ষণ আমরা অকৃত্রিম বা প্রাকৃতিক লিঙ্গের লক্ষণ ও পূজা-মাহাত্ম্য দেখলাম। এবার কৃত্রিম লিঙ্গ সম্পর্কে সামান্য আলোচনা করা যেতে পারে।
কৃত্রিম লিঙ্গ শব্দের অর্থ ব্যক্তি বিশেষের দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ। কৃত্রিম লিঙ্গ শিলা, ধাতু, মাটি ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করা হয়ে থাকে, তাই পৃথিবীতে কৃত্রিম লিঙ্গের সংখ্যা অসংখ্য। ইতঃপূর্বে শৈলজ ও ধাতুনির্মিত লিঙ্গের উল্লেখ করা হয়েছে। এখন বিশেষ বিশেষ কিছু জিনিস দিয়ে তৈরি কৃত্রিম লিঙ্গের আরও কিছু শাস্ত্র-নির্দেশনা দেখতে পারি, যেমন গরুড় পুরাণে বলা হয়েছে–
কার্য্যং পুষ্পময়ং লিঙ্গং হয়গন্ধসমন্বিতম্ ।
নবখণ্ডাং ধরাং ভুক্ত্বা গণেশাধিপতির্ভবেৎ।।
রজোভিনির্মিতং লিঙ্গং যঃ পূজয়তি ভক্তিতঃ।
বিদ্যাধরপদং প্রাপ্য পশ্চাচ্ছিবসমো ভবেৎ।।
শ্রীকামো গোশকৃল্লিঙ্গং কৃত্বা ভক্ত্যা প্রপূজয়েৎ।
স্বচ্ছেন কপিলেনৈব গোময়েন প্রকল্পয়েৎ।।
কার্য্যং যথাক্রমং লিঙ্গং যবগোধূমশালিজম্ ।
শ্রীকামঃ পুষ্টিকামশ্চ পুত্রকামস্তদর্চয়েৎ।।
সিতাখণ্ডময়ং লিঙ্গং কার্য্যমারোগ্যবর্দ্ধনম্ ।
বশ্যে লবণজং লিঙ্গং তালত্রিকটুকান্বিতম্ ।।
গব্যঘৃতময়ং লিঙ্গং সংপূজ্য বুদ্ধিবর্দ্ধনম্ ।
লবণেন চ সৌভাগ্যং পার্থিবং সর্বকামদম্ ।।
কামদং তিলপিষ্টোত্মং তুষোত্থং মারণে স্মৃতম্ ।।
ভস্মোত্থং সর্বফলদং গুড়োত্মং প্রীতিবর্দ্ধনম্ ।
গন্ধোত্মং গুণদং ভুরি শর্করোত্মং সুখপ্রদম্ ।।
বংশাঙ্কুরোত্মং বংশকরং গোময়ং সর্বরোগদম্ ।
কেশাস্থিসম্ভবং লিঙ্গং সর্বশত্রুবিনাশনম্ ।।
ক্ষোভণে মারণে পিষ্টসম্ভবং লিঙ্গমুত্তমম্ ।
দারিদ্র্যদং দ্রুমোদ্ভূতং পিষ্টং সারস্বতপ্রদম্ ।।
দধিদুগ্ধোদ্ভবং লিঙ্গং কীর্ত্তিলক্ষ্মীসুখপ্রদম্ ।
ধান্যদং ধান্যজং লিঙ্গং ফলোত্মং ফলদং ভবেৎ।।
পুষ্পোত্মং দিব্যভোগায়ুর্মুক্ত্যৈ ধাত্রীফলোদ্ভবম্ ।
নবনীতোদ্ভবং লিঙ্গং কীর্তিসৌভাগ্যবর্দ্ধনম্ ।।
দুর্বাকাণ্ডসমুদ্ভূতম্ অপমৃত্যুনিবারণম্ ।
কর্পূরসম্ভবং লিঙ্গং তথা বৈ ভুক্তিমুক্তিদম্ ।
অয়োস্কান্তং চতুর্ধা তু জ্ঞেয়ং সামান্যসিদ্ধিষু।।
অর্থাৎ : অশ্বগন্ধাযুক্ত কুসুম দ্বারা লিঙ্গ প্রস্তুত করে তার অর্চনা করলে নবখণ্ডা পৃথিবীর সমস্ত ঐশ্বর্য্য ভোগের পর গণাধিপত্য লাভ করা যায়। যে ব্যক্তি যথাযথ ভক্তির দ্বারা ধুলিনির্মিত শিবলিঙ্গ প্রস্তুত করে পূজা করে সে বিদ্যাধরপদ প্রাপ্ত হয় এবং শিবতুল্য হয়ে থাকে। কপিলা ধেনুর গোময় ভূপতিত হবার পূর্বেই তা আহরণ করে তার দ্বারা শিবলিঙ্গ প্রস্তুত করে পূজা করলে শ্রীলাভ করা যায়। অতএব শ্রীকামী এভাবে লিঙ্গ প্রস্তুত করে তার অর্চনা করবেন। শ্রীকামী ব্যক্তি যবের দ্বারা লিঙ্গ প্রস্তুত করে তার অর্চনা করবেন, পুষ্টিকামী ব্যক্তি গোধূম দ্বারা লিঙ্গ প্রস্তুত করে তার অর্চনা করবেন এবং পুত্রকামী ব্যক্তি শালিধান্য দ্বারা লিঙ্গ প্রস্তুত করে তার অর্চনা করবেন। মধু জমে চিনির মতো শক্ত হলে, তার দ্বারা লিঙ্গ প্রস্তুত করে যে পূজা করে, তার আরোগ্য লাভ হয়। লবণ, হরিতাল এবং ত্রিকূট দ্বারা লিঙ্গ প্রস্তুত করে তার পূজা করলে বশীকরণ সিদ্ধ হয়। গব্যঘৃত দ্বারা লিঙ্গ প্রস্তুত করে তার পূজা করলে বুদ্ধিবৃদ্ধি ঘটে। লবণ নির্মিত লিঙ্গ পূজার দ্বারা সৌভাগ্য লাভ হয়। মৃত্তিকা নির্মিত লিঙ্গ পূজার দ্বারা সর্বকামনা পূর্ণ হয়। তিল বেটে তার দ্বারা লিঙ্গ প্রস্তুত করে পূজা করলে অভীষ্টসিদ্ধি হয় এবং তুষ দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ পূজা করলে মারণকার্য্য সিদ্ধ হয়ে থাকে। ভস্ম নির্মিত লিঙ্গ পূজা করলে সর্বপ্রকার অভীষ্ট লাভ হয়। গুড় দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ পূজা করলে প্রীতি বৃদ্ধি পায়। চন্দন প্রভৃতি গন্ধ দ্রব্যের দ্বারা লিঙ্গ নির্মাণ করে পূজা করলে বহু গুণের অধিকারী হতে পারা যায়। শর্করা বা চিনির দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ পূজা করলে সুখ লাভ হয়। বাঁশ গাছের অঙ্কুরের দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ পূজার দ্বারা বংশ বৃদ্ধি ঘটে থাকে। গোময় বা গোবর দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ পূজা করলে সর্বপ্রকার রোগ তকে আক্রমণ করে। কেশ, অস্থি ইত্যাদি নির্মিত লিঙ্গ পূজা করলে যাবতীয় শত্রু বিনষ্ট হয়। পিষ্ঠনির্মিত লিঙ্গ ক্ষোভন ও মারণকার্য্যে প্রশস্ত। কাষ্ঠ নির্মিত লিঙ্গ পূজার দ্বারা দারিদ্র হয়। পিষ্ঠসম্ভব লিঙ্গ বিদ্যাদান করে। দধি, বা দুগ্ধ দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ পূজা করলে কীর্তি, শ্রী ও সুখলাভ হয়। ধান্য নির্মিত লিঙ্গ পূজা করলে ধান্য লাভ এবং ফল নির্মিত লিঙ্গ পূজা করলে ফল লাভ ঘটে। পুষ্পজ লিঙ্গ পূজা করলে দিব্য ভোগ লাভ করা যায়। ধাত্রীফল নির্মিত লিঙ্গ পূজার দ্বারা মুক্তিলাভ হয় এবং ননী (নবনীত) দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ পূজার দ্বারা কীর্তি ও সৌভাগ্যবৃদ্ধি ঘটে। দুর্বাকাণ্ডের দ্বারা লিঙ্গ নির্মাণ করে পূজা করলে অপমৃত্যু নিবারিত হয়। কর্পূর নির্মিত লিঙ্গে পূজা করলে ভুক্তিমুক্তি প্রাপ্তি ঘটে। চারপ্রকার অয়স্কান্ত নির্মিত লিঙ্গে পূজা করলে সিদ্ধি পাওয়া যায়।

              এতক্ষণের আলোচনায় বিভিন্ন পর্যায়ের সাধক ও পূজকদের পূজ্য নানা প্রকারের কৃত্রিম ও অকৃত্রিম শিবলিঙ্গের প্রসঙ্গ আলোচিত হলেও যেসব বিখ্যাত ‘অচল’ শিবলিঙ্গ গোটা ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে প্রাচীনকাল থেকে অগণিত মন্দির, তীর্থ ও লক্ষকোটি ভক্ত জনগোষ্ঠীর নিত্য কোলাহল-সমাকীর্ণ অনড় শিবক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ও প্রকাশিত হয়ে আছে, সেসবের উল্লেখ না হলে বস্তুত সাধন-পরম্পরায় প্রাধান্য অর্জনকারী এই শৈব সাধনা তথা লিঙ্গ পূজার মূল স্পন্দনটাকে উপলব্ধি করা যাবে না। কিন্তু আমাদের বর্তমান আলোচনায় এগুলোর বিশাল বিস্তৃত বিবরণ দেয়া সম্ভব নয় বা উদ্দেশ্যও তা নয়। কেননা, শিবপুরাণের জ্ঞানেশ্বর-সংহিতার আটত্রিশ অধ্যায়ে ঋষিরা সূতের কাছে লিঙ্গের বিষয়ে যখন জানতে চেয়েছেন তখন তিনি বলেছেন–
যৎ পৃষ্টং হি ঋষিশ্রেষ্ঠ লিঙ্গানি কথ্যতেহধুনা।
সর্বের্ষাঞ্চৈব লিঙ্গানাং সংখ্যানং বিদ্যতে কুতঃ।।
সর্বা লিঙ্গময়ী ভূমিঃ সর্বং লিঙ্গময়ং জগৎ।
লিঙ্গময়ানি তীর্থানি সর্বং লিঙ্গে প্রতিষ্ঠিতম্ ।।
সংখ্যা ন বিদ্যতে তেষাম্ কিঞ্চৈব তৎ ব্রবীমিহ।
যৎ কিঞ্চিৎদ্দৃশ্যতে দৃশ্যং বর্ণ্যতে স্মর্য্যতে চ যৎ।
তৎ সর্বং শিবরূপঞ্চ নান্যদস্তীতি কিঞ্চন।।
তথাপি শ্রূয়তাং হ্যেতং কথায়ামি যথাশ্রুতম্ ।
লিঙ্গানি চ ঋষিশ্রেষ্ঠঃ পৃথিব্যাং যানি তানিহ।। (শিবপুরাণ-জ্ঞানসংহিতা-৩৮/১৬-২২)
অর্থাৎ : এই পৃথিবীতে লিঙ্গের সংখ্যা পরিমাপ করা যায় না। সমগ্র জগৎ যেমন লিঙ্গময় তেমন সমগ্র পৃথিবীও লিঙ্গময়। যা কিছু দেখা যায়, বর্ণনা করা যায়, স্মরণ করা যায় সবই শিবস্বরূপ, শিব ছাড়া আর কিছুই নেই। লোকেদের উপকারের জন্য ভগবান শম্ভু বিভিন্ন স্থানে লিঙ্গরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। মানুষের পক্ষে সেই সমস্ত লিঙ্গের সংখ্যা নিরূপণ কিভাবে সম্ভব।
           এর পরেই এখানে কয়েকটি জ্যোতিলিঙ্গের বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। স্থাপিত লিঙ্গের সংখ্যা অসংখ্য হলেও প্রচলিত মতে জ্যোতিলিঙ্গের সংখ্যা বারোটি অর্থাৎ– দ্বাদশ জ্যোতিলিঙ্গ। শিবপুরাণে বলা হয়েছে–
সৌরাষ্ট্রে সোমনাথঞ্চ শ্রীশৈলে মল্লিকার্জনম্ ।
উর্জুয়িনাং মহাকালমোঙ্কারং পরমেশ্বরম্ ।।
কেদারং হিমবৎপৃষ্ঠে ডাকিন্যাং ভীমশঙ্করম্ ।
বারাণস্যাং বিশ্বেশরং ত্র্যম্বকম্ গৌতমীতটে।।
বৈদ্যনাথং চিতাভূমৌ নাগেশং দারুকাননে।
সেতুবন্ধে চ রামেশং ঘুশ্মেকঞ্চ শিবালয়ে।। (জ্ঞানেশ্বর-সংহিতা-৩৮/১৭-১৯)
অর্থাৎ : দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ হলো– সৌরাষ্ট্রে শ্রীসোমনাথ, শ্রীশৈলে শ্রীমল্লিকার্জুন, উজ্জয়িনীতে শ্রীমহাকাল, পরমেশ্বরে শ্রীওঙ্কারেশ্বর, হিমালয়পৃষ্ঠে শ্রীকেদারনাথ, শ্রীভীমাশঙ্কর, বারাণসিতে শ্রীবিশ্বেশ্বর, গৌতমীতটে শ্রীত্র্যম্বকেশ্বর, চিতাভূমে শ্রীবৈদ্যনাথ, দারুকাননে শ্রীনাগেশ্বর, সেতুবন্ধে শ্রীরামেশ্বর এবং শিবালয়ে শ্রীঘুশ্নেশ্বর।

             প্রাচীনকালে সারা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে তিরাশি/চুরাশিটা মন্দিরে দেবাদিদেব মহাদেবের পূজার জন্যে বিখ্যাত ছিল বলে জানা যায়। স্কন্দ পুরাণের আবন্ত্যখণ্ডে বিভিন্ন তীর্থে অবস্থিত চুরাশি প্রকার লিঙ্গের বিবরণ পাওয়া যায়। সেখানে উমা শিবকে জিজ্ঞাসা করেছেন–
চতুরশীতিলিঙ্গানি ত্বয়োক্তানীহ যানি তু।
তানি বিস্তরতো ব্রূহি সর্বপাপহরাণিতু।। (স্কন্দপুরাণ-আবন্ত্যখণ্ড-১/১৯)
অর্থাৎ : আপনি যে চতুরশীতি লিঙ্গের কথা বলেছেন তা বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করুন, আমি সর্বপাপ হর ঐ সকল লিঙ্গের কথা শুনতে চাই।
             মহাদেব তখন বিস্তৃতভাবে সেই সব লিঙ্গের বিবরণ ও তার পূজা ফলের কথা বলেছেন। বিভিন্ন তীর্থের বর্ণনা প্রসঙ্গে শিবের কথাও এখানে এসেছে। এর মধ্যে কিছু মন্দির সেসময় নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হলেও বেশিরভাগই প্রাচীন, অতি প্রাচীন ও মহা প্রাচীন। যেমন স্বয়ং কাশী বিশ্বনাথই স্মরণাতীত কাল থেকে অনাদি লিঙ্গ বা অবিমুক্তেশ্বররূপে পূজিত হয়ে আসছিলেন, পরে জ্যোতির্লিঙ্গরূপে হলেন– বিশ্বেশ্বর বা বিশ্বনাথ। এরপরে হয়তো আরো হাজার বছর কেটে গেছে। সপ্তম শতাব্দীতে হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠ সংগঠক বলে কথিত শঙ্করাচার্য ওই সুপ্রাচীন মন্দিরগুলোর মধ্যে বারোটা মন্দিরকে জ্যোতির্লিঙ্গ বলে আখ্যা দিলেন। শিবপুরাণ ও নন্দীপুরাণে কথিত আছে– ‘আমি সর্বত্র বিরাজমান হলেও এই বারোটি স্থানে (সোমনাথ, মল্লিকার্জুন, মহাকালেশ্বর, ওংকারেশ্বর ও অমলেশ্বর, কেদারনাথ, ভীমাশংকর, ত্রম্বকেশ্বর, বৈদ্যনাথ বা বৈজনাথ, নাগেশ্বর, রামেশ্বর, বিশ্বেশ্বর বা বিশ্বনাথ, বিমলেশ্বর ও ঘৃশ্লেশ্বর) জ্যোতির্লিঙ্গরূপে বাস করি।’
           জ্যোতির্লিঙ্গ শব্দটার প্রচলন সর্বপ্রথম শুরু হয়েছিল কৈলাস শৃঙ্গ-কে শিবলিঙ্গরূপে অভিষেক করার সময় থেকে। তারপর সেই ধারা বেয়ে সমতলের প্রথম জ্যোতির্লিঙ্গ হলেন– কাশী বিশ্বনাথ। তারপর ছড়িয়ে পড়লো সারা ভারতের তিরাশিটা স্থানে। এর মধ্যে বারোটাকে শঙ্করাচার্য মান্যতা জ্ঞাপন করলেন। ভক্তের টানে দেবাদিদেব মহাদেব ওইসব স্থানে আবির্ভূত হয়ে জ্যোতির্লিঙ্গরূপে অবস্থান করছেন বলেই বিশ্বাস। কিন্তু ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে দেখলে যুক্তিসংগত কারণেই এই শিবপুরাণ ও নন্দীপুরাণ সপ্তম শতাব্দীর পরেই রচিত বলে মনে হয়। তবে সারা ভারতের প্রতিটা কোণায় কোণায় ছড়িয়ে থাকা শত শত শিবলিঙ্গের মধ্যে কেন ওই বারোটা শিবলিঙ্গই জ্যোতির্লিঙ্গের মান্যতা পেলো, সে সম্পর্কে আচার্য শঙ্করের কোনও ব্যাখ্যা আছে বলে জানা নেই। স্বল্পায়ু জীবনে তিনি সনাতন হিন্দু ধর্মকে সংগঠিত করে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত সারা ভারতের বিভিন্ন হিন্দু তীর্থস্থানগুলোতে বৈদিক মতে পূজা পদ্ধতির প্রচলন করেন। এছাড়াও পুনঃপ্রতিষ্ঠিত তীর্থস্থানগুলোকে দেখভাল করার জন্যে ভারতবর্ষের চারকোণায় চার-চারটে মঠও প্রতিষ্ঠা করেন। অশোক রায়ের মতে, শঙ্করাচার্য সম্ভবত এই দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ সারা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা আর্য ও অনার্য প্রভাবিত ও পূজিত তীর্থস্থানগুলোর (তিরাশিটা) মধ্যে থেকে সেই যুগে জনপ্রিয়তার নিরিখে মান্যতা জ্ঞাপন করেছিলেন। নইলে অনার্য প্রভাবিত তীর্থস্থানগুলো (বৈদ্যনাথ/বৈজনাথ, ভীমাশংকর, নাগনাথ ও ঘৃশ্লেশ্বর ইত্যাদি) একই সাথে দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের শিরোপা কিভাবে পেলো তার আপাত ব্যাখ্যা মেলে না।
             তবে জ্যোতির্লিঙ্গের সৃষ্টির ধারণার বিকাশ কিভাবে ঘটতে পারে বা ঘটেছে, অশোক রায় যেভাবে তার বিজ্ঞানসম্মত সম্ভাব্য কারণ ব্যাখ্যা করেছেন তাকে যুক্তিসঙ্গত বলে মেনে নিতে বাধা দেখি না। কেননা–
‘মহাকাশে পৃথিবীর কক্ষপথে বা তার আশপাশে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাপহীন, আলোহীন (প্রধানত লোহা, নিকেল ও সিলিকেট-এর বিভিন্ন যৌগের) অসংখ্য ধূলিকণা। এদের প্রধান উৎস হল ধূমকেতু। যদিও কিছু ধূলিকণা সৌরজগতের সৃষ্টির সময়কাল থেকে পড়ে থাকা পদার্থ। আবার কখনও কখনও গ্রহাণুর সংঘর্ষজাত টুকরো। এরা পৃথিবীর কক্ষপথের উপরে বা তার আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। পৃথিবী নিজের কক্ষপথের সেই বিশেষ জায়গায় এলেই এরা (পৃথিবীর আকর্ষণে) সেকেন্ডে ৫০-৭০ কিলোমিটার গতিবেগ নিয়ে পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০০-১৫০ কিমি উপর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পৃথিবীর উপরে আছড়ে পড়ে। এই বিপুল গতিবেগে বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে উদ্ভূত প্রচণ্ড তাপে যখন তারা জ্বলে ওঠে তখনই তাদের আমরা দেখতে পাই। এদের বলে উল্কা (Meteor)। এই উল্কাপিণ্ডের (Meteoroid) বেশিরভাগই জ্বলতে জ্বলতে নেমে আসার পথেই নিঃশেষ হয়ে যায় (পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫০ কিমি উপরে)। চলতি কথায় এর নাম ‘তারা খসা’ (Shooting Star)। জ্বলে ওঠা উল্কাপিন্ড তার আশপাশের বাতাসকে উত্তপ্ত ও আয়নিত করে, ফলে কখনও কখনও উল্কা নিঃশেষ হয়ে গেলেও আকাশে থেকে যায় তার আভা (Meteor trail), কোনও উল্কা মিলিয়ে যায় অতি দ্রুত, আবার কেউ কেউ বিস্ফারিত হয়ে তৈরি করে অগ্নি গোলক (Fire ball বা bolides)। রাতের আকাশের যে অংশ থেকে উল্কাগুলো ছুটে আসে বলে মনে হয় সেই অংশকে বলে ‘দীপ্তিকেন্দ্র’; আর যে নক্ষত্রমন্ডলীতে এই দীপ্তিকেন্দ্রের অবস্থান তারই নামে রাখা হয় উল্কাবৃষ্টির নাম।’
‘এই মহাজাগতিক পদার্থগুলো সমস্ত গ্রহেই চিরকালই পড়ে আসছে। পৃথিবীর উপরে বাতাসের এক পরিমণ্ডল থাকায় তার সাথে সংঘর্ষের ফলে বেশিরভাগ উল্কাই নেমে আসার পথেই জ্বলতে জ্বলতে নিঃশেষ হয়ে যায়। কদাচিৎ দু’-একটা ওই বিপুল বেগ নিয়ে আছড়ে পড়ে পৃথিবীর বুকে। তখন সেখানে ঘটে এক– প্রলয় কাণ্ড (একই সাথে ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ড ও প্রবল বিস্ফোরণ)। ভারতবর্ষের ‘লোনার হ্রদ’ এইরকমই এক বিশাল উল্কাপাতের ফলে সৃষ্ট। সেখানে উল্কা মাটির এত গভীরে চলে গেছে যে তার হদিশ আজও মেলেনি। সাইবেরিয়াতেও এইরকমই এক উল্কাপাতের কথা জানা যায়। সম্প্রতি নজরে এল নাসার বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন গত ৭ নভেম্বর ২০০৫-এ চন্দ্রপৃষ্ঠে আছড়ে পড়েছে এক ১২ সেমি চওড়া উল্কা। তার গতিবেগ ছিল ২৭ কিমি প্রতি সেকেন্ডে। এই বিপুল বেগে চাঁদের বুকে উল্কাটি আছড়ে পড়ায় যে বিস্ফোরণ ঘটে তার শক্তি ছিল ৭০ কেজি T.N.T-এর সমান।’
‘এই ধরনের বড়সড় উল্কাপাতের ঘটনা পৃথিবীতে কদাচিৎ ঘটে। জ্বলতে জ্বলতে প্রায় নিঃশেষিত কিছু টুকরো অনেক সময়ই পড়ে। যদিও তার ফলে সেই অঞ্চলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হয় যথেষ্ট।’
‘যাই হোক যে কথা বলার জন্য উল্কাপাতের ঘটনার প্রস্তাবনা তা হল– আদিমকাল থেকেই প্রাগৈতিহাসিক মানুষেরা প্রত্যক্ষ করেছে এই অতি প্রাকৃত ঘটনাকে। ফলে ভয়ে, বিস্ময়ে, আত্মরক্ষার প্রয়োজনে, দূর থেকে স্তব-স্তুতি করে শান্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে এই জ্যোতির্ময় অগ্নিগোলককে। ক্রমে ঠাণ্ডা হয়ে এলেও সাহস হয়নি কাছে যাওয়ার। ফলে বারংবার প্রণতি জানিয়েছে দূর থেকে। তারপর একসময় কাছে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করে স্তুব-স্তুতি-প্রণতি জানিয়ে ও সবশেষে ওই মহাশক্তিধরের উপরে জল ঢেলে তাকে শান্ত করার প্রয়াসও চালিয়েছে।’
‘সাধারণত এই উল্কাপিণ্ডগুলো দেখতে হয় কালো মসৃণ ও ডিম্বাকৃতি। এতে প্রধানত লোহা ও নিকেল ছাড়া বিভিন্ন সিলিকেট যৌগও থাকে। তাই এর ওজনও হয় অন্য সাধারণ পাথরের থেকে বেশি। ফলে দেবদত্ত ও দৈবগুণসম্পন্ন বলে প্রতিষ্ঠা পেতে দেরি হয় না। কালক্রমে তা দেবত্বের মান্যতাও লাভ করে– ভয়ে ও ভক্তিতে। শুরু হয়ে যায় তন্ত্র-মন্ত্র, ঝাড়ফুঁক ও চিকিৎসার কাজে এই অতি দুর্লভ জিনিসের ব্যবহার। কালস্রোতে তা শিবত্বের সাথে লীন হয়ে যায়। অতি প্রাচীন শৈব সম্প্রদায়ের ভ্রাম্যমাণ তীর্থিকেরা এই অতি দুর্লভ বস্তুকে সযত্নে সংগ্রহ করে বিভিন্ন শৈব তীর্থস্থানে শিবলিঙ্গের মণি বেদিকায় তা প্রোথিত করে দেয়। তাদের মধ্যে সেই সময়ে যেসব শৈবতীর্থের শিবলিঙ্গ জনমানসে প্রসিদ্ধি লাভ করে সম্ভবত তাদের মধ্যে থেকেই আচার্য শঙ্কর বারোটা স্থানকে দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের মান্যতা জ্ঞাপন করেন।’– (বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-১৬৩-৬৫)
            এই সম্ভাব্য কারণের মধ্যে কতটুকু সত্য নিহিত থাকতে পারে তার বিচার হয়তো একদিন সময়ই করবে। তবে শিবলিঙ্গের আর এক শাস্ত্রিয় বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় স্কন্দপুরাণের কাশীখণ্ডে। স্কন্দপুরাণের মাহেশ্বর খণ্ড থেকেও শিবলিঙ্গ সম্পর্কে অনেক বিবরণ পাওয়া যায়। বিভিন্ন শিবতীর্থের দীর্ঘ তালিকা ও বিবরণ থেকে বোঝা যায় যে এইসব তীর্থ সমগ্র ভারতবর্ষব্যাপী বিস্তৃত ছিল। সে বিবরণ এখানে বাহুল্য। বাস্তবতা হলো, লিঙ্গ পূজা যে উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-মধ্য-পশ্চিম সমগ্র ভারতেই বিস্তৃত ছিল তা এইসব তীর্থ তালিকা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়। বর্তমান ভারতবর্ষেও এমনকি এই বাংলাদেশেও তুলনামূলক বিচারে শিবক্ষেত্রেরই প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়।
কিন্তু কোন্ সময় থেকে এই লিঙ্গপূজার উদ্ভব এবং সেই সঙ্গে শিবলিঙ্গের এই অমূর্ত বা বিমূর্ত রূপের পেছনে কোন্ প্রাচীন বিশ্বাস বা দৃষ্টিভঙ্গি লুকিয়ে আছে, গবেষকের ভক্তিনিরপেক্ষ কৌতুহলী দৃষ্টিতে তা অনুসন্ধান করা আবশ্যক বৈকি।
শিব পুরাণ, কোটিরুদ্রসংহিতা, ১২ অধ্যায়ের ৫ থেকে ৪৮ শ্লোক এর মতো নানা শ্লোকে শিবলিঙ্গ নিয়ে নানা নোংরা কাহিনি বিদ্যমান।
শম্ভোঃ পপাত ভুবি লিঙ্গমিদং প্রসিদ্ধং
শাপেন তেন চ ভৃগোর্বিপিনে গতস্য।
তং যে নরা ভুবি ভজন্তি কপালিনন্তু
তেষাং সুখং কথমিহাপি পরত্র মাতঃ!।। (দেবীভাগবত-৫/১৯/১৯)
অনুবাদঃ- মাতঃ!সতীর বিয়োগবশত মহাদেব, অরণ্যমধ্যস্থ ঋষিগণের আশ্রমে গমন করিলে ভৃগুমুনির শাপে তাঁহার লিঙ্গ ভূতলে পতিত হয়, ইহা ত সর্ব্বত্রই প্রসিদ্ধ আছে ;অতএব যিনি স্বীয় লিঙ্গ রক্ষা করিতেও সমর্থ নন,বিশেষত যিনি অস্পৃশ্য নরকপাল প্রভৃতি ধারণ করেন,সেই শম্ভুকে যে মানবেরা ভজনা করে তাদের ইহকালে ও পরকালে কিরূপে সুখ লাভ হইবে?
শিব পুরাণ, কোটিরুদ্রসংহিতা, ১২ অধ্যায়ের ৫ থেকে ৪৮ শ্লোক
সূতমুনি বললেন,পূর্ব সময়ে দারু বনে,ঋষিদের সাথে যে ঘটনা ঘটেছিল তা আমি বর্ণনা করছি, মনোযোগ দিয়ে শুনুন। দারু বনে,ঋষিরা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে বাস করতেন,তাঁরা সবাই শিব ভক্ত ছিলেন।একদিন ঋষিরা,স্ত্রীদের রেখে,জঙ্গলে গেছিলেন কাঠ ইত্যাদি আনতে।তখন সেই সময়েই স্বয়ং মহাদেব,
বিকৃতরূপ ধারণ করে, পরীক্ষা করার মানসে
চলে আসেন।অত্যন্ত তেজস্বী ও উলঙ্গ দেহধারী মহাদেব,তাঁর লিঙ্গ হাতে নিয়ে কুকর্ম করার চেষ্টা করতে থাকেন।তা দেখে ঋষিদের স্ত্রীরা প্রথমে অত্যন্ত ভীত হয়ে যান। তারপর তাঁরা অত্যন্ত কামার্ত হয়ে মহাদেবের কাছে চলে আসেন।ঋষিদের স্ত্রীরা,কেউ মহাদেবকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেন, কেউ তাঁর হাত ধরেন। এইভাবে,নিজেদের মধ্যে এই সমস্ত,কামক্রিয়ায় অত্যন্ত মত্ত হয়ে যান।ঠিক এই সময়ে,ঋষিরা জঙ্গল থেকে চলে আসেন,তাঁরা এই সমস্ত অসভ্যতা দেখে অত্যন্ত দুঃখী আর ক্রুদ্ধ হন।আর তাঁরা,দুঃখী হয়ে বললেন,- ইনি কে হন!!ইনি কে ? শিবের মায়া দ্বারা মোহিত ঋষিরা,কোলাহল শুরু করেন। তারপর,ঋষিরা,সেই উলঙ্গ শিবকে বলেন,কেন তুমি বেদ বিরুদ্ধ ,ধর্মের বিনাশকারী, অসভ্য কর্ম করছো?এই বলে তাঁরা অভিশাপ দেন যে - তোমার,লিঙ্গ ছিন্ন হয়ে মাটিতে পড়বে।এই অভিশাপের ফলে,ওই অদ্ভুত রূপধারী শিবের লিঙ্গ,ছিন্ন হয়ে মূহূর্তের মধ্যে মাটিতে পড়ে।তারপর,শিবের সেই ছিন্ন লিঙ্গটি আগুনের মতো জ্বলতে শুরু করে।ওই জ্বলন্ত লিঙ্গ,তার গতিপথের সমস্ত স্থান জ্বালাতে জ্বালাতে স্বর্গ,মর্ত্য,পাতালে দৌড়তে শুরু করে।কোনো ভাবেই সেই লিঙ্গ শান্ত হতে চাইছিল না।এই জগৎ সংসার,যখন ভয়ে ব্যাকুল হয়ে যায় তখন দুঃখী হয়ে দেবতাদের সাথে ঋষিরা, ব্রহ্মার কাছে যান পরামর্শ করার জন্য।ব্রহ্মাকে, প্রণাম করে তাঁরা সমস্ত বৃত্তান্ত বলেন।তাঁদের কথা শুনে ব্রহ্মা বলেন, মহাদেবের মতো অতিথির সৎকার না করে,তোমরা খুব ভুল করে ফেলেছ। যতক্ষণ পর্যন্ত না এই লিঙ্গ স্থাপিত হচ্ছে ততক্ষণ ত্রিলোকে শান্তি স্থাপিত হবে না।তারপর ব্রহ্মা,লিঙ্গ কে স্থাপিত করার উপায় বের করলেন।তখন ব্রহ্মা বললেন হে দেবতাগণ! তোমরা পার্বতী কে প্রসন্ন করে শিবের প্রার্থনা করো , যদি পার্বতী যোনীরূপ ধারণ করে তাহলেই একমাত্র এই লিঙ্গ স্থির হবে।এই কথা শুনে ঋষি ও দেবতারা ব্রহ্মা কে প্রণাম করে,সারা বিশ্ব সংসারের সুখের যিনি কারণ,সেই শিবের শরণ গ্ৰহণ করেন। তখন পরম ভক্তি ও প্রার্থনার দ্বারা পূজিত মহাদেব,প্রসন্ন হয়ে বললেন - হে দেবতাগণ! হে ঋষিগণ!তোমরা আমার কথা শোন!যদি আমার এই লিঙ্গ যোনিতে স্থাপিত হয় তাহলেই একমাত্র ত্রিলোকে সুখ হতে পারে।পার্বতী ছাড়া আর কোনো স্ত্রী আমার লিঙ্গ কে ধারণ করতে পারবে না।পার্বতীর যোনীতে যদি আমার লিঙ্গ ধারণ করানো হয় তাহলে খুব তাড়াতাড়ি,সবাই শান্তি প্রাপ্ত হবেন।এই কথা শুনে ঋষি ও দেবতাগণ প্রসন্ন হয়ে ব্রহ্মাকে সাথে নিয়ে পার্বতীর প্রার্থনা শুরু করলেন।পার্বতী কে প্রসন্ন করে,মহাদেব কেও প্রসন্ন করলেন তারপর সেই লিঙ্গ, যোনীতে স্থাপিত হয়।

শিবের গলা নীল বর্ণের কেন:
পুরাণের কল্যাণে আমরা সবাই সমুদ্র মন্থনের হাস্যকর গল্পটা জানি। সমুদ্র মন্থন থেকে নাকি বিষ উত্থিত হয়েছিল, এবং সমগ্ৰ জগৎকে সেই বিষ থেকে রক্ষা করার জন্য,শিব সেই বিষ পান করেছিলেন ও বিষের প্রভাবে তাঁর গলার রং নাকি নীল রং ধারণ করেছিল,ইত্যাদি ইত্যাদি।
পুরাণের এই হাস্যকর গল্পের উদ্ভব হয়েছে,পুরাণ লেখকদের মূর্খতার কারণে।
যেমন,বেদে,বলা হয়েছে সূর্য সপ্তাশ্ব বিশিষ্ট। মূর্খ পুরাণ লেখক,আষাঢ়ে গল্প ফাঁদলেন যে, সূর্যের সাতটি ঘোড়া আছে!!!
অথচ,অশ্ব মানে রশ্মিও হয়। সূর্যের সাত বর্ণের রশ্মি আছে যা কিনা বিজ্ঞান সম্মত,তাই পুরাণ রচয়িতার হাতে পড়ে সাত ঘোড়া বিশিষ্ট সূর্যের রথের আষাঢ়ে গল্পে পরিণত হয়েছে!!
যর্জুবেদের ষোড়শ অধ্যায় রুদ্রাধ্যায় নামে বিখ্যাত।এখানে বলা হয়েছে,রুদ্র হলেন "নীলগ্ৰীবায়" বা "নীলগ্ৰীবো" অর্থাৎ গ্ৰীবা বা গলা যাঁর নীল বর্ণের।
প্রসঙ্গতঃ রুদ্র শব্দের বহু অর্থ হয়।যথা-- ক্ষত্রিয় সেনাপতি, পরমাত্মা,বৈদ্য, সূর্য,অগ্নি,বায়ু,আকাশ ইত্যাদি।
পুরাণপ্রিয় মানুষদের অতিপ্রিয় বেদ ভাষ্যকার হলেন মহীধর।

নম॑স্তে রুদ্র ম॒ন্যব॑ऽউ॒তো ত॒ऽইষ॑বে॒ নমঃ॑ ।
বা॒হুভ্যা॑মু॒ত তে॒ নমঃ॑ ॥ যজুর্বেদ ১৬।১

পদার্থঃ–হে (রুদ্র) দুষ্ট শত্রুদিগকে রোদনকারী রাজন্ । (তে) তোমার (মন্যবে) ক্রোধযুক্ত বীর পুরুষদিগের জন্য (নমঃ) বজ্র প্রাপ্ত হউক, (উতো) এবং (ইষবে) শত্রুদিগের বধকারী (তে) তোমার জন্য (নমঃ) অন্ন প্রাপ্ত হউক (উত) এবং (তে) তোমার (বাহুভ্যাম্) বাহুগুলির দ্বারা (নমঃ) বজ্র শত্রুগুলিকে প্রাপ্ত হউক ।

য়া তে॑ রুদ্র শি॒বা ত॒নূরঘো॒রাऽপা॑পকাশিনী ।
তয়া॑ নস্ত॒ন্বা᳕ শন্ত॑ময়া॒ গিরি॑শন্তা॒ভি চা॑কশীহি ॥  যজুর্বেদ ১৬।২

পদার্থঃ–হে (গিরিশন্ত) মেঘ বা সত্য উপদেশ দ্বারা সুখ উপস্থিতকারী (রুদ্র) দুষ্টদিগকে ভয় এবং শ্রেষ্ঠদিগের জন্য সুখকারী শিক্ষক বিদ্বান্! (য়া) যে (তে) আপনার (অঘোরা) ঘোর উপদ্রব রহিত (অপাপকাশিনী) সত্য ধর্ম্মের প্রকাশক (শিবা) কল্যাণকারিণী (তনুঃ) দেহ বা বিস্তৃত উপদেশ রূপ নীতি, (তয়া) সেই (শন্তময়া) অত্যন্ত সুখ প্রাপ্তকারিণী